মায়ের মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যে ওর নিঃসঙ্গ জীবন একেবারে হাঁপিয়ে উঠল। ঘরে মন টেকে না, তাই সাগরের তীরে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। জোর বাতাসে চ্যানেলের পানি যখন ফুলে-ফেঁপে ওঠে, তখন মন তার কোন্ অজানার পানে ছুটে যায় কে জানে!
সদ্য মা হারা সন্তানের অবুঝ অন্তর আকুল আবেগে হাহাকার করতে থাকে তখন, নীরব বোবা কান্নায় গুমরে মরে গিলিয়াত। একসময় ছল-ছল চোখে বাড়ি ফিরে আসে, অবুঝ শিশুর মত বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
তিন
গিলিয়াত ছেলেটা দেখতে-শুনতে মোটামুটি ভালই। ছিপছিপে গড়ন, কপালটা সামান্য উঁচু। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা, ঝাঁকড়া চুল ওর। বড়বড় চোখ, রাজ্যের মায়াভরা।
উদাস, বেখেয়াল গোছের ছেলে। তার যে বয়স, সে বয়সে সবাই নিজের বেশভূষার দিকে স্বভাবতই একটু বিশেষ দৃষ্টি রাখে, কিন্তু ও সে ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন।
দেহের গঠন যেমনই হোক, তার শক্তি ছিল অসাধারণ। যে সমস্ত ভারী ভারী জিনিস এক কুড়ি মানুষে মিলেও তুলতে পারত না, সেসব গিলিয়াত একাই তুলে ফেলতে পারত। ওর সাথে লড়াই করতে এসে সে কালের অনেক নামকরা কুস্তি গীরকেও হার স্বীকার করতে হয়েছে। দুহাতে সমান দক্ষতার সাথে তীর-বন্দুক চালাতে পারত গিলিয়াত।
এছাড়া গিলিয়াতের মত দক্ষ সাঁতাঙরু আর দুঃসাহসী নাবিক ওই তল্লাটে দ্বিতীয় কেউ ছিল না। একেকসময় ওর উন্মত্ত সাগরকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার বিপজ্জনক দুঃসাহস দেখে ভয়ে-বিস্ময়ে জবান আটকে যেত গ্রামের মানুষের। এরকম অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে স্যামসনের মানুষ-ভীষণ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, ইংলিশ চ্যানেল মত্ত আক্রোশে ফুঁসছে, এমন সময় প্রায় সময়ই দেখা গেছে মাঝ সমুদ্রে একটা খুদে নৌকা উথাল-পাথাল করছে, ঢেউয়ের মাথায় চাটি মেরে এগিয়ে চলেছে মরনপণ করে।
কারও বুঝতে বাকি থাকত না ওই নৌকার মাঝিটি কে হতে পারে। একবার এক নৌকা বাইচের উৎসবে গিলিয়াত তার। অসম সাহসিকতার প্রমাণ দিয়ে উপস্থিত প্রত্যেকের তা লাগিয়ে দিল। বাইচে অংশ নিতে যার যার নৌকা নিয়ে অনেকেই এসেছিল সেবার।
তীরে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার শেষ পর্যন্ত বাইচের অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে গেল সেদিন। তার বদলে আয়োজনকারীরা একটা ছোট নৌকা নিয়ে অন্য এক ধরনের বাজি ধরল।
ঠিক হলো, যে ওই নৌকায় করে গিয়ে তিন মাইল দূরের হার্য দ্বীপ থেকে নৌকা বোঝাই পাথর নিয়ে ফিরে আসতে পারবে, তাকে নৌকাটা উপহার দেয়া হবে। অনেকেই এগিয়ে কে কতখানি পাকা নাবিক, তা প্রমাণ করার সংগ্রাম শুরু হয়ে গেল।
সাগরের মাঝে বাস করতে করতে মানুষ এমনিতেই দুঃসাহসী ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। প্রতিযোগীরাও প্রত্যেকেই তাই, কিন্তু কিছু সময় যেতে না যেতে দেখা গেল সাত-আটজন নামকরা, দক্ষ নাবিক সাগরের দুরন্তপনার কাছে হার স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছে, ঘাট ছেড়ে যাওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই একে একে তীরে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। বেয়াড়া ইংলিশ চ্যানেলের সাথে এঁটে উঠতে পারেনি তারা।
সবার শেষে এল গিলিয়াতের পালা। চ্যানেলের অবস্থা আরও খারাপ তখন, ঝড়ের মাতামাতি বেড়ে গেছে। কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ পর্যন্ত করল না যুবক, নৌকা ছেড়ে দিল। তীর থেকে দূরে সরে গেল সেটা। দেখতে দেখতে উত্তাল, এলোমেলো ঢেউয়ের মধ্যে হারিয়ে গেল।
তীরে অপেক্ষমাণ রুদ্ধশ্বাস দর্শকরা ভয়-ডরহীন হতচ্ছাড়া যুবকটির পরিণতির কথা ভেবে হায় হায় করতে লাগল। কিন্তু ঘণ্টাতিনেক পর তাদের অনুমান মিথ্যে প্রমাণ হলো।
হারয থেকে গিলিয়াত নৌকা বোঝাই পাথর নিয়ে নিরাপদেই ফিরে আসতে পেরেছে দেখে চরম বিস্ময়ে আর অবিশ্বাসে চোয়াল ঝুলে পড়ল তাদের।
বাজির শর্ত অনুযায়ী নৌকাটা গিলিয়াতকে উপহার দেয়া হলো। হোট হলেও বেশ মজবুত ছিল সেটা। সেদিন থেকে নৌকাটি হয়ে উঠল ওর প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী। যখনই ও সাগরে যায়, ওটায় চড়েই যায়।
রাতের গাঢ় আঁধার যখন ধরণীকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলত, চ্যানেলের কুদ্ধ গর্জনে কান পাতা দায় হয়ে উঠত, তখন সেই খুদে নৌকায় চড়ে প্রাণটা হাতের মুঠোয় নিয়ে কতদিন যে সাগরে মাছ ধরতে গেছে সে, কেউ তার হিসেব রাখেনি।
মাছ ধরা ছিল গিলিয়াতের প্রধান সখ। ইচ্ছেমত যখন-তখন সাগরে মাছ ধরে বেড়াত। নিজের প্রয়োজনে তার থেকে একটা-দুটো রেখে বাকি মাছ হয় ছেড়ে দিত ও, নয়তো গ্রামবাসীর মধ্যে বিলিয়ে দিত।
গ্রামের অন্য সবার মত ব্যবসা-ট্যবসার দিকে তেমন নজর ছিল না গিলিয়াতের। মা সঞ্চিত টাকা-পয়সা রেখে গিয়েছিল বলেই হয়তো সেসবের দরকার হত না। তাই বলে বুদ্ধির ঘাটতি ছিল না তার। দুএকটা চমৎকার কারিগরী কাজ নিজে থেকেই শিখে নিয়েছিল।
ছোটখাট এটা-সেটা ভালই তৈরি করতে পারত গিলিয়াত। এ জন্যে বাড়ির আঙিনার একধারে খুদে একটা কামারখানাও গড়ে নিয়েছিল। সেখানে বসে ইচ্ছেমত দা, কুড়ল, নোঙর ইত্যাদি বানাত। সেসব বাড়িতে মজুত রাখত গিলিয়াত, কারও প্রয়োজন হলে তাকে বিনা পয়সায় দিয়ে দিত।
কিছু কিছু অদ্ভুত ধরনের খেয়ালও ছিল গিলিয়াতের। তার একটা হচ্ছে বন্দি পাখি পেলেই ছেড়ে দেয়া। এ খবর গ্রামবাসীর জানা ছিল, তাই অনেকেই পাখি ধরে নিয়ে আসত ওর কাছে। আর ও সেগুলো কিনে নিয়ে ছেড়ে দিত।