থামল বৃদ্ধ, চকচকে চোখে সামনে বসা যুবকের দিকে তাকিয়ে থাকল ও কিছু বলবে ভেবে। কিন্তু গিলিয়াত কিছু বলছে না, একদম চুপ করে বসে আছে।
মাথা নাড়ল লেতিয়ারি। তারপর যেন এইমাত্র মনে পড়েছে, এমনভাবে আবার শুরু করল, ও হ্যাঁ। দুরান্দের দুর্ঘটনা যে ইচ্ছে করে ঘটানো হয়েছে, সে কথা শুনেছ তো? এর সবটাই আসলে বিশ্বাসঘাতক ক্লুবিনের ষড়যন্ত্র, বুঝলে?
যাত্রা করার আগের রাতে ক্লুবিন কায়দা করে এক নাবিককে মদ খাইয়ে পুরো মাতাল করে নিয়েছিল, জানো? পরদিন তাকেই জাহাজের হাল ধরার দায়িত্ব দেয় ও। যাকগে। সে অনেক কথা, পরে সব বলব তোমাকে।
সশব্দে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ল বৃদ্ধ। যাক, এনজিনটাই যখন ফিরে পেলাম, আর ভয় কি? এবার ডানযিগ থেকে ভাল কাঠ আনিয়ে নতুন করে আবার জাহাজ তৈরি করাব আমি। দুরান্দের চেয়ে আরও বিশ ফুট বড় হবে এবারেরটা।
তারপর আবার আমার জাহাজ সাগরে ভাসবে, তুমি হবে তার নতুন ক্যাপ্টেন। হ্যাঁ, গিলিয়াত। তুমিই হবে আমার নতুন জাহাজের ক্যাপ্টেন।
তোমাকে ছাড়া আর কাউকে চাই না আমি। আহা! আজ যদি আমার সেই পঁচাত্তর হাজার ফ্রা থাকত, এখনই কাজে লেগে পড়তাম আমি। ক্লুবিন যে ফেরার, সে কথা জানো? শয়তানটার কোন খোঁজ নেই। রাতাগ আমাকে চিঠি লিখেছে, জানো? ওর কাছ থেকে আমার নাম করে মোট পঁচাত্তর হাজার ফ্রা নিয়ে পালিয়ে গেছে হারামজাদা।
এতক্ষণ অন্য জগতে ছিল গিলিয়াত, কোন গভীর চিন্তায় ডুবে ছিল, তেতিয়ারির শেষ কথাগুলো কানে যেতে নড়ে উঠল। নীরবে পকেট থেকে ক্লুবিনের সেই বেল্টটা বের করল, লোহার মানিব্যাগ থেকে নোটগুলো বের করে বৃদ্ধের সামনের টেবিলে বিছিয়ে রাখল। টাকার পাশে ব্যাগটাও।
অনেকক্ষণ ধরে বিস্ফারিত দুচোখ মেলে ওগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকল বৃদ্ধ। চরম বিস্ময়ে ভাষা হারিয়ে ফেলেছে, চোয়াল ঝুলে পড়েছে তার। এসব কি সত্যি! এনজিন, টাকা, সবই ফেরত পেয়েছে সে?
কিছুই তাহলে খোয়া যায়নি? টাকাগুলো ধরে দেখল লেতিয়ারি। সত্যিই তো! এই তো সেই পনেরো হাজার ফ্রাঁর পাঁচটা নোট-চিঠিতে রাতাগ যেগুলোর কথা লিখেছিল! অর্থাৎ গ্রামের মানুষের ধারণা মিথ্যে ছিল না!
আমার টাকাগুলোও উদ্ধার করে এনেছ তুমি? গলা ভেঙে গেল বৃদ্ধের। কৃতজ্ঞতার পানিতে চোখ ভিজে উঠেছে। গলা কিছুতেই বাগে রাখতে পারছে না সে, কাঁপছে।
তুমি কি মানুষ, গিলিয়াত? যে ডোভারে যাওয়ার কথা মানুষ ভাবতেও ভয় পায়, সেখানে একা গিয়ে আমার দুরান্দের এতবড় এনজিনটাকে নিয়ে এসেছ! তার ওপর আবার টাকাগুলোও? বাবা, সত্তর বছরের জীবনের প্রায় ষাট বছরই সাগরে ঘুরে কেটেছে আমার, কিন্তু এমন ঘটনা আজই প্রথম দেখলাম।
পরের টাকা হাতে পড়লে তা কেউ ফেরত দেয়, সে অভিজ্ঞতাও জীবনে এই প্রথম আমার। গিলিয়াত, তোমার শরীর কি রক্ত-মাংসের না, বাবা? তুমি কি এই পৃথিবীর আলো বাতাসে বড় হওনি? টাকার লোভ বলে কিছুই কি নেই তোমার মধ্যে?
চোখ নামিয়ে ক্লুবিনের নাম লেখা বেল্ট ও মানিব্যাগটা দেখল লেতিয়ারি। মাথা দোলাল। বুঝতে পেরেছি। এর অর্থ হচ্ছে দুরান্দকে ডোবাতে গিয়ে ওই হারামজাদা নিজেও মরেছে! তাই না, গিলিয়াত?
ও আগের মতই চুপ করে বসে আছে। একটা কথাও বলেনি এ পর্যন্ত। ক্লান্ত দুচোখ স্থির, কিন্তু জাগতিক কিছু দেখছে বলে মনে হয় না। কোনও সুদূরের অজানালোকের পানে তাকিয়ে আছে যেন। লেতিয়ারির সেদিকে খেয়ালই নেই, সে আপনমনে নিজের কথাই শুধু বলে চলেছে।
দেখো, বাবা, সত্যি কথাটা স্বীকার করার এখনই উপযুক্ত সময়। স্বীকার না করলে মহাপাপ হবে আমার। তুমি যে সত্যি সত্যিই ডোভারে গিয়েছিলে, অন্যদের মত আমিও কিন্তু সে কথা বিশ্বাস করিনি।
ভেবেছিলাম তোমার ভবঘুরে স্বভাব, হয়ত কদিন কাটিয়ে আসতে আর কোথাও গিয়েছ। এক মুহূর্তের জন্যে থামল বৃদ্ধ। গিলিয়াত, তুমি আমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দাও, বাবা। এতদিনেও আমরা কেউই আসলে তোমাকে চিনতে পারিনি, একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ল সে।
এবার তুমি আমার দেরুশেতকে বিয়ে করো। জীবনের শেষ কটা দিন তোমাদের দুজনকে নিয়ে একসাথে কাটাতে চাই আমি। একটু শান্তিতে থাকতে চাই।
উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টলে উঠল গিলিয়াত, দুর্বল পা দুটো দেহের ভার সইতে পারছে না। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল ও, না, ঘঁশিয়ে, তা হয় না।
চমকে উঠল বৃদ্ধ মুখ তুলে বোকার মত তাকিয়ে থাকল ওর দিকে। কি হয় না, বাবা?
আমি দেরুশেতকে বিয়ে করতে পারবো না।
কেন, বাবা? ভীষণ অবাক হলো বৃদ্ধ। হঠাৎ এ কথা কেন? আমার দেরুশেত কি কোনদিক থেকে তোমার অযোগ্য?
না, মঁশিয়ে।
তাহলে?
আমি আমি, মানে, দেরুশেতকে ভালবাসি না, মঁশিয়ে। তাই…
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল বিস্মিত লেতিয়ারি। দুহাত প্যান্টের পকেটে ভরে কিছুক্ষণ চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকল ওর দিকে, তারপর আচমকা হা হা করে হেসে উঠল। হাসির দমকে বৃদ্ধের শীর্ণ দেহ বারবার বাঁকা হয়ে উঠতে লাগল। কি বললে? অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল বৃদ্ধ। কি বললে তুমি, গিলিয়াত? আমার দেরুশেতকে তুমি ভালবাসো না? গিলিয়াত, এতবড় একটা মিথ্যে কথা তুমি আমার সামনে বলতে পারলে?
এ কথা আমাকে বিশ্বাস করতে বলল তুমি? দীর্ঘ সত্তর বছর ধরে এই মাথার ওপর দিয়ে অনেক ঝড়-ঝাঁপটা গেছে, বাবা! জীবনে হাজারো ঘটনা দেখেছে এই দুই বুড়ো চোখ। তুমি এই চোখকে আজ ফাঁকি দিতে চাইছ?।