গিলিয়াতের বিস্মিত চোখের সামনে চট করে ওর পাশে বসে পড়ল লোকটা। মেয়েটি এক পলক তাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিল, মনে হলো আবার নিজের ভাবনায় ডুবে গেছে। তবে স্পষ্ট বোঝা গেল লোকটি ওর অচেনা কেউ নয়। আর তার এই নিশি অভিসারও ওর কাছে একেবারে অপ্রত্যাশিত নয়।
মানুষটাকে চেনার চেষ্টা করল ও, কিন্তু গাছের ছায়ার জন্যে পারল না। তাছাড়া নতুন করে একটু একটু মেঘও জমতে শুরু করেছে আকাশে, বারবার চাঁদের সামনে আড়াল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। খণ্ড খণ্ড মেঘ।
একটু পর আগন্তুকের গলা শুনতে পেল গিলিয়াত। আবেগ মাখা গলায় বলল লোকটা, দেরুশেত, সারা স্যামসনে এখন তোমার-আমার বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। লোকে বলে, আগে নাকি কখনও এই সময় তুমি একা একা বাগানে বসে থাকতে না। আমি এতদিন ধরে রোজ তোমার কাছে আসছি, কিন্তু আমার মনের কথা খুলে বলার মত সাহস পাইনি কোনদিন।
কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই বোঝ সেটা কি। কাল সকালে আমি লন্ডনে চলে যাচ্ছি। দুই-একদিনের জন্যে হলেও যেতেই হবে। তাই আজ বিশেষ করে তোমার কাছে এসেছি।
একটু থামল লোকটা। তারপর আবার বলতে শুরু করল, এতদিন আমি গরীব ছিলাম, তাই নিজেকে তোমার উপযুক্ত ভাবতে পারিনি।
কিন্তু আজ আর গরীব নই আমি, মামা মারা যাওয়ায় তার একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে অনেক টাকা-পয়সার মালিক হয়ে গেছি।. অনেক ধনী আজ আমি। তাই যাওয়ার আগে আরেকবার বলতে এসেছি, আমি তোমাকে ভালবাসি, দেরুশেত।
আমি জানতে চাই, তুমিও আমাকে ভালবাসো কিনা? তুমি ছাড়া আর কোন মেয়েকে নিজের স্ত্রী হিসেবে ভাবতে পারি না আমি। তুমি আমার জীবন-মরণ, তুমিই আমার সব। বলল, দেরুশেত, যে তোমাকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালবাসে, তুমি তাকে ভালবাসো কিনা?
মাথা নিচু করে বসে ছিল দেরুশেত, তেমনিই থাকল। মৃদু স্বরে কেবল বলল, কিন্তু আমি যে মনে মনে নিজেকে তার পায়ে সঁপে দিয়েছি।
কথা কটা এতই মৃদু স্বরে বলল ও যে পাশে বসা প্রেম নিবেদনকারীটি পর্যন্ত শুনতে পেল না। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, কয়েক হাত দূরে থেকেও গিলিয়াত প্রতিটা শব্দ একদম স্পষ্ট শুনতে পেল।
চুপ করে রইলে যে, দেরুশেত? পুরুষটি বলল। আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে না?
কি উত্তর দেব, বলো? তেমনি মৃদু গলায় বলল ও।
আমি তোমার পরিষ্কার জবাব চাই, দেরুশেত!
ঈশ্বর শুনেছেন আমার উত্তর, দেরুশেত বলল। আমাকে আর জিজ্ঞেস কোরো না।
একটু পর মেঘ সরে যেতে বাগানের রাস্তার ওপর দুটো ছায়া পরস্পরকে আলিঙ্গন করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল গিলিয়াত, বোকার মত অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল সেদিকে। তারপর একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। মাথা ঘুরছে ওর, পা টলছে। কষ্ট হচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকতে।
এমন সময় দূর থেকে লেতিয়ারিকে চিৎকার করে উঠতে শুনল ও, কে কোথায় আছ! পরক্ষণে ঢং! ঢং! ঢং ঢং করে জেটির ঘণ্টী বাজতে শুরু করল। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আবার কিছু সময় বাগানের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল গিলিয়াত। তারপর রিক্ত, পরাজিতের মত মাথা নিচু করে পায়ে পায়ে বন্দরের দিকে ফিরে চলল।
একটু পর ঘন্টা বাজানো থামিয়ে জেটি থেকে নেমে এল লেতিয়ারি, সামনে তাকিয়ে দেখল কে যেন তার দিকে আসছে। একটু কাছে আসতে চিনল তাকে বৃদ্ধ, ওটা গিলিয়াত। ছড়ি, লণ্ঠন ফেলে পাগলের মত ছুটে গেল লেতিয়ারি। ওকে দুহাতে বুকে জাপটে ধরল। অন্তরের সমস্ত কৃতজ্ঞতা উজাড় করে অনেক কিছুই বলতে চাইল বৃদ্ধ, কিন্তু প্রচণ্ড আবেগে গলা বুজে গেল, কিছুই বলা হলো না।
গিলিয়াতের মুখের দিকে চেয়ে থাকল কেবল। একটুপর হুঁশ হতে টানতে টানতে ওকে বাড়ির দিকে নিয়ে চলল। বৈঠকখানায় ওকে জোর করে সোফায় বসিয়ে নিজে বসল একটা চেয়ারে! এতক্ষণে যেন ভাষা খুঁজে পেল বৃদ্ধ।
কান্নাভেজা আবেগ মাখা কণ্ঠ বলতে লাগল, গিলিয়াত! গিলিয়াত!! জানো, বাবা! আমার মন বলত এ কাজ যদি কাউকে দিয়ে কোনদিন সম্ভব হয়, তাহলে কেবল তোমাকে দিয়েই হবে। আর কাউকে দিয়ে না, বাবা। তুমি ডোভার চলে যাওয়ার পর সবাই বলাবলি করত, গিলিয়াত একটা ছন্নছাড়া, ভবঘুরে। কাজ নেই কাম নেই সারাদিন বাঁশি বাজিয়ে আর টো টো করে ঘুরে বেড়ায়, ওই ছোকরা যাবে দুরান্দের এনজিন উদ্ধার করতে? তাহলে আর চিন্তা ছিল কি?
কিন্তু আমি জানতাম, বাবা। আমি জানতাম। আমার মন বলত তুমি পারবে, কিন্তু, তারপরও মাঝেমধ্যে বিশ্বাস হতে চাইত না। ওই ছোট নৌকাটা নিয়ে যেদিন তুমি ডোভার যাবে বলে চলে গেলে, আর সবার মত আমারও বিশ্বাস করতে মন চাইছিল না তুমি সত্যিই সেখানে যাচ্ছ। লোকে বলত, লক্ষ্মীছাড়া ভঘুরে ডোভার গেছে! দেখোগে আর কোথাও হাওয়া খেতে গেছে। কথায় পেয়েছে যেন বৃদ্ধকে, একনাগাড়ে বলেই চলেছে সে। তারপর এক মাসের মত হয়ে গেল তোমার খবর পাইনি। তাই আমিও আশা-ভরসা ছেড়েই দিয়েছিলাম, বাবা।
প্রচণ্ড আবেগে গলা বুজে এল তার। একটু পর সামলে নিয়ে আবার শুরু করল, গিলিয়াত! গিলিয়াত!! সত্যিই তুমি। ডোভারে গিয়েছিলে, বাবা? এতবড় এক দুঃসাধ্য কাজ একা কিভাবে সম্ভব করলে তুমি? এতক্ষণ জেটিতে এনজিনটা পরীক্ষা করছিলাম আমি, কিছুই হয়নি ওটার। একদম আগের মত আছে। একটা স্কুও নষ্ট হয়নি। সেই বয়লার, সেই চিমনি, সেই এনজিন, সবকিছু অবিকল আগের মতই আছে।