ওর ধারণা, প্রিয় দুরান্দের কথা ভেবে মন খারাপ করেছে বোধহয় তেতিয়ারির। তারওপর আজ খুব ক্লান্তও দেখাচ্ছিল তাকে, তাই কিছু জিজ্ঞেস করল না ও। একাই পায়চারী করতে থাকল বাগানে।
ওদিকে গভীর রাতে কেন যেন হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল লেতিয়ারির। মাথা ঘোরালেই জানালা দিয়ে বন্দর দেখা যায়, চোখ মেলে অভ্যেসবশে আনমনে সেদিকে তাকাল সে। যতদূর চোখ যায় চাঁদের আলোয় কাঁচের মত চকচক করছে সাগর।
প্রথমে বোধহয় কিছুটা আনমনা ছিল বৃদ্ধ, একটু পর হঠাৎ অবিশ্বাস্য একটা দৃশ্য চোখে পড়তে ধড়মড় করে উঠে বসল। বন্দরের কাছে পানিতে কি ভাসছে ওটা? জাহাজের চিমনির মত মনে হচ্ছে না! ভাল করে চোখ রগড়ে আবার তাকাল লেতিয়ারি-হা, তাই তো! একটা চিমনিই তো ঠিক তার দুরান্দের চিমনির মত।
দুরান্দ ছাড়া এই অঞ্চলের আর কোন জাহাজের এরকম চিমনি নেই। তাহলে কি আর স্থির থাকতে পারল না লেতিয়ারি, এক হাতে একটা লণ্ঠন ও অন্য হাতে ছড়িটা নিয়ে পাগলের মত বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল সে।
হোঁচট খেতে খেতে বন্দরের দিকে ছুটল। ওখানে পৌঁছে যা দেখল, তাতে কেবল নড়াচড়াই ভুলে গেল না বৃদ্ধ, ভাষাও হারিয়ে ফেলল। নিজের চোখকেও সন্দেহ হতে লাগল তার।
জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি না তো আমি? ভাবল সে। কারণ শুধু চিমনি নয়, দুরান্দের গোটা এনজিনটাও রয়েছে ওখানে-জেটিতে বাঁধা ছোট একটা নৌকার ওপর। চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছে ওটার ধাতব দেহ। কয়েকবার ভাল করে চোখ রগড়ে দেখে নিয়ে নিঃসন্দেহ হলো বৃদ্ধ, না, ভুল দেখেনি সে। যা দেখছে সে, জিনিসটা আসলেই তাই।
এবার নৌকাটাকে দেখল সে। বুঝল, এরকম নৌকা একটাই আছে গেরানসিতে। এবং আর সবার মত ওটার মালিকও তার খুবই চেনা। এদিক-ওদিক তাকিয়ে গিলিয়াতকে খুঁজল সে, কিন্তু কোথাও নেই সে। বন্দর-জেটি সব খা খা করছে।
ওকে খোঁজার ধৈর্য হারিয়ে ফেলল বৃদ্ধ, বাতের ব্যথা ভুলে বাচ্চা ছেলের মত লাফাতে লাফাতে নৌকায় গিয়ে উঠল হাতের লণ্ঠন নাচাতে নাচাতে।
মহাব্যস্ত হয়ে এনজিন পরীক্ষা করতে লাগল। আনন্দে, উত্তেজনায় সারাদেহ কাঁপছে থর থর করে, ফোপাচ্ছে। ঠিকই আছে এনজিনটা, পরীক্ষা শেষ করে চেপে রাখা নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁচল লেতিয়ারি, কোন ক্ষতি হয়নি। প্রতিটা ক্রু পর্যন্ত আগের মতই আছে। তাহলে আর চিন্তা কি? অপ্রকৃতিত্নে মত হেসে উঠল লেতিয়ারি। এনজিনের যখন কিছুই হয়নি, তাহলে আর ভয় কিসের?
শুধু একটা খোল তৈরি করিয়ে নিলেই তো তার নতুন আরেকটা জাহাজ হয়ে গেল! আবার নতুন করে জাহাজ ব্যবসা শুরু করতে পারবে সে। আবার আগের মত।
ঘুমে বিভোর বন্দর কাঁপিয়ে পাগলের মত হা হা করে হেসে উঠল লেতিয়ারি। নিস্তব্ধ রাত চমকে উঠল সে শব্দে। দীর্ঘসময় ধরে বাতাসে ভেসে বেড়াল তার অট্টহাসি, তারপর ক্রমান্বয়ে দূর থেকে বহুদূরে মিলিয়ে গেল।
কে কোথায় আছ! চিৎকার করে উঠল সে, ছুটে গিয়ে জেটির ঘণ্টীর শেকল ধরে টানতে শুরু করল। বিকট ঢং! ঢং! ঢং! ঢং! শব্দে আবার কেঁপে উঠল স্যামসন। থামার নাম নেই লেতিয়ারির, ঘণ্টী বাজিয়ে চলেছে একনাগাড়ে। তার ইচ্ছে, ঘুম ভেঙে যাক গ্রামের সবার, বন্দরে ছুটে আসুক তারা।
এসে দেখুক, লেতিয়ারির মাথা খারাপ হয়ে গেছে। খুশিতে পাগল হয়ে গেছে সে।
চোদ্দ
মাঝরাতের খানিক পর বন্দরে এসে পৌঁছল গিলিয়াত। গোটা গ্রাম চাঁদের আলো মেখে হাসছে তখন। চারদিক নীরব, নিঝুম। কোথাও কেউ জেগে আছে বলে মনে হয় না। ঘুমিয়ে পড়েছে সবাই। জেটির যেখানটায় দুরান্দ বাঁধা থাকত, সেখানে নৌকাটা শেকল দিয়ে কষে বাঁধল গিলিয়াত।
তীরে নেমে এসে ভাবল, এতরাতে কাউকে ডাকাডাকি করে কাজ নেই। নৌকা থাকুক এখানে, সকালে এসে যা করার করা যাবে। গ্রামমুখী রাস্তাটা ধরে ধীরপায়ে বাড়ির দিকে হেঁটে চলল গিলিয়াত। লেতিয়ারির বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কৌতূহল বশে বাগানের দেয়ালের কাছে দাঁড়াল।
এতরাতে দেরুশেতকে বাগানে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না, তবু যদি পাওয়া যায়, এই ভেবে আইভি লতায় ছাওয়া নিজের বিশেষ জায়গাটায় এসে দাঁড়াল ও। জায়গাটা পথের বাঁকের মুখে। এবং নির্জন। তার ওপর লতায় লতায় ছাওয়া। বলে এখানে দাঁড়ালে সহজে কারও দেখে ফেলারও উপায় নেই। সেখান থেকে ভেতরে তাকাল গিলিয়াত।
কে যেন বসে আছে না বাগানের বেঞ্চটায়, একা? হ্যাঁ, তাইতো! বেঞ্চটার কাছেই বড় একটা গাছ আছে, চাঁদের আলো আড়াল করে রেখেছে বলে পরিষ্কার দেখা না গেলেও ওটা যে মানুষের কাঠামো, তা ঠিকই বোঝা যায়।
ওটা দেরুশেত না আর কেউ, তখনই বুঝে উঠতে পারল না গিলিয়াত। অবশ্য একটু পর বুঝল আর কেউ নয়, ওটা দেরুশেতই। চুপচাপ বসে আছে, ডান হাতের ওপরে গাল রেখে বিভোর হয়ে কি যেন ভাবছে। সব ভুলে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকল গিলিয়াত।
হঠাৎ কাছেই কোথাও একটা আওয়াজ উঠতে দেরুশেত ও গিলিয়াত একযোগে চমকে উঠল। নজর যোরতে একটা ছায়া চোখে পড়ল গিলিয়াতের-বাগানের মধ্যে দিয়ে দ্রুত পায়ে বেঞ্চটার দিকে এগোচ্ছে।
একজন পুরুষ মানুষ!
লেতিয়ারি নয়, দেখামাত্র বুঝে ফেলেছে গিলিয়াত, এ অন্য কেউ। কিন্তু কে? বিস্ময় উত্তরোত্তর বেড়েই চলল ওর। এত রাতে নির্জন বাগানে কে এসেছে তার দেরুশেতের সাথে দেখা করতে?