নতুন করে পানি ওঠা শুরু হতে ফের একই বিরক্তিকর কাজে হাত লাগাতে হলো ওকে। সঙ্গে যত কাপড়চোপড় ছিল, এবার তার সবই কাজে লাগাল গিলিয়াত। প্রচণ্ড ক্লান্তি সত্ত্বেও সে রাতে অনেক সাধ্য-সাধনা করেও ঘুমাতে পারল না গিলিয়াত, নানান উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় এলই না ঘুম।
পরদিন ভোর হতে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিল, তারপর প্রস্তুত হলো তিন সপ্তাহের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল নিয়ে স্যামসনে ফিরে যাওয়ার জন্যে। তখন আর চেনার জো নেই গিলিয়াতকে। অনাহার, অনিদ্রা আর অমানুষিক পরিশ্রমের ফলে শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে, পাঁজরের হাড় সব ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। চোখ বসে গেছে কোটরে।
তবে এতকিছুর পরও সাফল্যের আনন্দে ঝলমল করছে ওর চোখমুখ। চোখের সামনে দেরুশেতের মোহনীয় মুখটা ভেসে উঠছে একটু পর পর। ওর সেদিনের উচ্চারিত প্রতিজ্ঞার প্রতিটা শব্দ কানে বাজছে।
বহুদিন পর নিজের প্রিয় গানটা গুন্ গুন্ করে গেয়ে উঠল গিলিয়াত। ডোভার পাহাড়ের আশেপাশে সে সময় যদি কেউ থাকত, ওর সেই হৃদয় কাড়া কোমল, মিষ্টি সুর নিশ্চয়ই তার অন্তর ছুঁয়ে যেত।
***
স্যামসনে বেশ সাড়া পড়ে গেছে। কারণ, সেইন্ট পিটার গির্জায় কড্রে নামে যে নতুন রেভারেন্ড এসেছে কিছুদিন আগে, সে নাকি হঠাৎ করে অনেক টাকা-পয়সার মালিক হয়ে গেছে বলে শোনা যাচ্ছে।
লন্ডনে তার এক মামা ছিল, মস্ত বড়লোক। কড্রে ছাড়া আপনজন বলতে কেউ ছিল না তার। সেই মামা মারা গেছে, এবং তার একমাত্র উত্তরাধিকারী হিসেবে সে এখন তার যাবতীয় টাকা-পয়সা, জমিজমা ইত্যাদির একমাত্র মালিক। আজই কড্রের মামার মৃত্যুর খবর এসেছে স্যামসনে।
লন্ডন থেকে আসা কাশমির নামের এক জাহাজে এ খবর এসেছে, সেই সাথে কড্রেকে অনতিবিলম্বে লন্ডনে যাওয়ার অনুরোধও। মামার শেষকৃত্যে যোগ দেয়া এবং তার সবকিছু বুঝে নিতে তার যাওয়া খুব জরুরি। দেরি করার উপায় নেই, তাই প্রস্তুতি নিতে লাগল রেভারেন্ড।
এর কয়েকদিন আগের ঘটনা। বুড়ো লেতিয়ারির নামে সীলগালা করা একটা চিঠি এল। খামের ওপর পর্তুগালের রাজধানী লিসবনের ছাপ। বেশ কৌতূহল নিয়ে খামটা খুলল সে। বেশি বড় নয় চিঠিটা-ডেটলাইন লেখা রয়েছে ১০ মার্চ। চিঠিটার বক্তব্য এরকম?
মঁশিয়ে লেতিয়ারি,
এত বছর পর আমার চিঠি পেয়ে আপনি নিশ্চয়ই খুব অবাক হবেন। বিশেষ একটা খবর আপনাক জানানো জরুরি ছিল বলে চিঠি না লিখে উপায় ছিল না। এ মুহূর্তে তামোলিপা নামের এক জাহাজে লিসবনের পথে রয়েছি আমি।
গেরানসির একজন নাবিক আছে, সে দেশে ফিরে আপনাকে একদিন আমার এ চিঠি পৌঁছে দেবে, সেই ভরসায় লিখতে বসেছি। কথাটা হলো আমি আপনার সমস্ত টাকা ফেরত দিয়েছি। কয়েক বছর আগে বিশেষ পরিস্থিতিতে পড়ে আপনার পঞ্চাশ হাজার ফ্রাঁ আমি ধার হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলাম। মাসখানেক আগে সেইন্ট ম্যালো বন্দরে আপনার বিশ্বস্ত কর্মচারী ক্লুবিনের সাথে দেখা হয় আমার, তখন সেই পঞ্চাশ হাজার এবং তার সূদ হিসেবে আরও পঁচিশ হাজার, মোট পঁচাত্তর হাজার ফ্ৰা তার হাতে তুলে দিয়েছি আমি। পনেরো হাজার জঁর পাঁচটা নোটে। আপনার প্রতিনিধি হিসেবে টাকাটা বুঝে নিয়েছে ক্লুবিন। কাজেই আমি এখন দায়মুক্ত।
খবরটা আপনার জানা দরকার বলে এ চিঠি লিখলাম। আর একটা কথা, টাকাটা নেয়ার ব্যাপারে ক্লুবিনকে অতিরিক্ত উৎসাহী মনে হয়েছে আমার। সে সময় তার হাতে গুলি ভরা পিস্তলও ছিল, তাই টাকা প্রাপ্তির রসিদ চাইতে সাহস হয়নি আমার।
– আপনার বিশস্ত রাতাগ।
চিঠি পড়া শেষ হতে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকল লেতিয়ারি, প্রায় বিস্মৃত বিশ্বাসঘাতকটার কথা ভাবছে। ক্লুবিন সম্পর্কেও একটা বিচ্ছিরি সন্দেহ ক্রমেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। গত কিছুদিন থেকে গ্রামের লোকজন তাকে নিয়ে নানান সন্দেহজনক কথাবার্তা বলাবলি করছে।
সবই কানে এসেছে সেভিয়ারিয়। তাদের ধারণা, ক্লুবিন নাকি ইচ্ছে করেই দুরান্দকে দুর্ঘটনায় ফেলেছে। অথচ সবাইকে বোঝতে চেয়েছে এ ব্যাপারে তার কোন হাত ছিল না। আসলে সে-ই সম্পূর্ণ দায়ী এ জন্যে। ওটাকে ডুবিয়ে দিয়ে লোকজন সবাইকে সাইফবোট করে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেকে একজন কর্তব্যনিষ্ঠ ক্যাপ্টেন হিসেবে প্রমাণ করতে চেয়েছে বদমাশটা।
কিন্তু আসলে পরে কোন একসময় পালিয়ে গেছে হ্যাঁনওয়ে থেকে। এই চিঠির বক্তব্য তাদের ধারণাকেই সমর্থন করছে বলে সন্দেহ আরও হাজারগুন বাড়ল বৃদ্ধের। টাকাগুলো নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মতলবেই তার এতবড় একটা সর্বনাশ ঘটাতেও পিছপা হয়নি ক্লুবিন লোকটা।
চিঠিটা পাওয়ার পর থেকেই হঠাৎ করে খুব গম্ভীর হয়ে উঠল লেতিয়ারি। কারও সাথেই কথাবার্তা তেমন একটা বলে না। একা একা থাকে সারাক্ষণ, কি যেন চিন্তা করে। যেদিন কড্রের মামার মারা যাওয়ার খবর এল, সেদিন আগের চেয়ে অনেক বেশি গম্ভীর দেখা গেল তাকে।
রাতে পূর্ণ চাঁদের আলোয় গোটা স্যামসন ঝলমল করছে দেখে দেরুশেতকে নিয়ে বাগানে হাঁটাহাঁটি করতে এল লেতিয়ারি। কিন্তু একটু পরই ধৈর্য হারিয়ে ফেলল সে, ঘুম পেয়েছে বলে ভাইঝির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভেতরে চলে গেল।
দেরুশেত তার এই অদ্ভুত আচরণে বিস্মিত হলেও কিছু বলল না। ও লক্ষ করেছে, গত কিছুদিন থেকেই বাবা যেন কেমন হয়ে উঠেছে, অন্য কারও সাথে তো নয়ই, এমনকি ওর সাথেও পর্যন্ত ঠিকমত কথা বলে না।