তবে সেটা যে কি হতে পারে, তা বুঝে নিতে কষ্ট হলো না। সাগরে এমন প্রাণী একটাই আছে, তার নাম অক্টোপাস-যার খপ্পরে পড়ার অর্থ হচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যু।
তবে ভরসার কথা যে ওর ছোরা ধরা বাঁ হাত আর ঘাড় এখনও মুক্ত আছে। এ পর্যন্ত পাঁচটা গঁড় কাজে লাগিয়েছে অক্টোপাসটা, আরও তিনটে কাজে লাগাতে বাকি। তার আগেই রুখে দাঁড়ানো না গেলে নির্ঘাৎ মৃত্যু। ওটা কোথায় আছে দেখার জন্যে ঘুরে তাকাল ও।
গুহায় ঢুকতেই বাঁ দিকে একটা ছোট গর্ত আছে; কাঁকড়ার দিকে নজর থাকায় আগে খেয়াল করেনি গিলিয়াত, সেটার মধ্যে বসে আছে অক্টোপাসটা-নাগালের মধ্যেই। ড্যাবৃড্যা করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সে কী ভয়ঙ্কর চাউনি।
দুচোখ জ্বল জ্বল করছে সাক্ষাৎ শয়তানটার, খুব সম্ভব শিকার ধরার আনন্দে। বিশাল ধড়, এতবড় অক্টোপাস আগে কখনও দেখেনি গিলিয়াত। পাঁচটা গঁড় স্থির ওটার, ওকে ধরে রেখেছে বলে টাটা হয়ে আছে। বাকি তিনটা কিলবিল করছে শূন্যে, যে কোন মুহূর্তে কাজে লেগে পড়বে ওগুলোও।
পাকড়াও কর্ম সম্পন্ন হলে ধড়টা ওর দিকে এগিয়ে নিয়ে আসবে ড্যাডেবে শয়তানটা, বুকের ওপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে একসঙ্গে আটটা ঔড় দিয়ে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করবে যাতে দম বন্ধ হয়ে আসে গিলিয়াতের। তারপর মৃত্যু মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার।
লক্ষ্য স্থির করে নিয়ে বাঁ হাতে ধরা ছোরাটা বিদাৎ গতিতে শয়তানটার দুই চোখের মাঝখান দিয়ে চালিয়ে দিল গিলিয়াত, একেবারে মগজে ঢুকিয়ে দিল ওটার দীর্ঘ ফলা। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড এক ঝাঁকি খেল অক্টোপাস, শুড়ের বাঁধনগুলো শিথিল হয়ে গেল দেখতে দেখতে।
আরেকবার আঘাত করার জন্যে ছুরি খসাতে হাত টান দিল গিলিয়াত, কিন্তু তার আর দরকার হলো না। টান খেয়ে গর্তের মুখের দিকে খানিকটা এগিয়ে এল সাগর-দানবটা, তারপর প্রাণহীন জড়পিণ্ডের মত ধীর গতিতে পানিতে গড়িয়ে পড়ল। শুড়গুলো কুঁকড়ে আছে যন্ত্রনায়। ওই অবস্থায়ই ধোয়ার মত রক্ত ছাড়তে ছাড়তে তলিয়ে গেল ওটা। অদৃশ্য হয়ে গেল।
নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছে বুঝতে পেরে কিছুক্ষণ বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকল গিলিয়াত। প্রচণ্ড উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছে। গুড় দিয়ে ওর হাত, বুকসহ যেখানে যেখানে ধরেছিল অক্টোপাসটা, সে সব জায়গা লাল হয়ে ফুলে উঠেছে, খুব জ্বালা করছে।
সমুদ্রের লবণ পানি দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে জায়গাগুলো ডলে ডলে ধুয়ে নিল ও। জ্বালা-যন্ত্রণা কিছুটা কমে আসতে সামনে নজর দিল। সুড়ঙ্গের ভেতরে বেদীর মত যে শুকনো জায়গাটা দেখতে পেয়েছিল, পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে।
জায়গাটা বেশ উঁচুতে, তাকের মত-বেশ খানিকটা লম্বা এবং শুকনো। দেখে মনে হলো মাত্রাছাড়া জোয়ার না এলে ওই পর্যন্ত পৌঁছায় না পানি। কাঁকড়াটা নিশ্চয়ই ওখানে আছে ভেবে এগোল গিলিয়াত।
পাহাড়ের ফাঁক-ফোকর দিয়ে আসা সূর্যের আলোয় মোটামুটি দেখা যাচ্ছে তাকটা। খানিকটা এগোতেই হঠাৎ ওটার ওপরে অস্বাভাবিক কিছু একটা দেখতে পেয়ে থমকে গেল ও।
গা ছমছম করে উঠল। চোখ কুঁচকে তাকাল। কি ওটা!
মনে হলো একজন মানুষ যেন শুয়ে আছে তাকটার ওপরে, দু’ পাটি ধপধপে সাদা দাঁত বের করে বিকট হাসি হাসছে। একটু থেমে থেকে সাহসে ভর করে আবার এগোল ও।
এবার পরিষ্কার দেখতে পেল জিনিসটাকে। মানুষই বটে, তবে জীবীত নয়-মৃত। একটা নরকঙ্কাল। ওটার চারপাশে স্তূপ হয়ে আছে অজস্র মৃত কাঁকড়ার খোসা, নরকঙ্কালটাকে প্রায় ঢেকে রেখেছে ওগুলো। বিস্ময় মাত্রা ছাড়িয়ে গেল গিলিয়াতের। কিছু সময় হাঁ করে ওটার দিকে তাকিয়ে থাকল। এখানে নরকঙ্কাল আসে কি করে? ভাবল ও। সময় নষ্ট না করে তাকটার দিকে এগিয়ে গেল।
দুহাতে কঁকড়ার খোসা সরিয়ে কঙ্কালটাকে দেখল ভাল করে। কোন এককালে ওটা কোন মানুষেরই ছিল, এই সত্যটা ছাড়া আর কিছু আবিষ্কার করতে পারল না ও। তবে কঙ্কালটার কোমরে ঢামড়ার চওড়া একটা বেল্ট দেখতে পেল।
লোহার বাকলে জং ধরা ছাড়া অন্য কোন ক্ষতি হয়নি বেল্টটার। টাকা-পয়সাসহ ছোটখাট জিনিসপত্র রাখার জন্যে ওটায় কয়েকটা খোপ আছে। তার মধ্যে একটা বেশ ফুলে আছে দেখে খুলল ও, ভেতর থেকে বের হলো একটা লোহার তৈরি মানিব্যাগ।
একটা নাম খোদাই করা আছে ওটায় : ক্লুবিন।
ওটাতেও মরচে ধরে গেছে, তবে প্রিঙের কল-কব্জা কাজ করছে ঠিকমতই। ব্যাগটা খুলল গিলিয়াত, খুলেই অবাক হয়ে গেল ভেতরে পনেরো হাজার স্ট্রার পাঁচটা নোট দেখতে পেয়ে।
এখনও ভাল আছে টাকাগুলো নষ্ট হয়নি। কয়েকটা স্বর্ণমুদ্রাও পাওয়া গেল ব্যাগে। গুনে দেখল ও, মোট একুশ গিনি। বেল্টটা কঙ্কালের কোমর থেকে খুলে নিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে এল গিলিয়াত। চিন্তিত।
তেরো
নৌকায় উঠেই মাথা ঘুরে গেল গিলিয়াতের। কখন কি ভাবে ওটার তলা ফুটো হয়ে গেছে, কে জানে! হড়হড় করে পানি উঠছে। এর মধ্যেই এক হাঁটু পানি জমে গেছে খোলর ভেতরে। এখনই ফুটো বন্ধ করতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। গিলিয়াতের এতদিনের অমানুষিক পরিশ্রম বরবাদ হয়ে যাবে।
দিনের বাকি সময়টা ওই ফুটো বন্ধ করতেই কেটে গেল ওর। তাও তেমন সন্তোষজনক হলো না কাজটা। পুরো এক বেলা পরিশ্রম করে কাপড়চোপড়ের তালি মেরে একবার ওটা প্রায় মেরামত করে এনেছিল, এমন সময় আবার ছুটে গেল।