সাধারণ ঝড় এখানে কোন ব্যাপার নয়, কিন্তু অসন্ন ঝড়টা এইমাত্র নিজের আগমনের যে আলামত দেখিয়ে গেল, তাতে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল ও।
অজান্তেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত শিউরে উঠল গিলিয়াতের। না জানি কি ভয়ঙ্কর বিপদের বার্তা নিয়ে আসছে ঝড়টা। নৌকাটাকে তাড়াতাড়ি পাহাড়ের গোড়ার সেই নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে এসে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল ও, তারপর ভয়ে ভয়ে কি ঘটে তা দেখার অপেক্ষায় থাকল।
সকাল হলো। কিন্তু ভীষণ মুখ গোমরা সকাল। চ্যানেল এখন পর্যন্ত শান্তই আছে। সূর্য কিছুক্ষণের জন্যে দেখা দিয়ে গায়েব হয়ে গেল। বাতাস জমাট বেঁধে থাকায় ক্রমে শুমোট হয়ে উঠতে লাগল পরিবেশ। অবশেষে দুপুরের একটু আগে শুরু হলো প্রত্যাশিত ঝড়।
বাতাসের সামান্য ছোঁয়া পেতেই চেহারা বদলে গেল শান্ত ইংলিশ চ্যানেলের-রুদ্র মূর্তি ধরল চোখের পলকে। ভীষণভাবে কুঁসে উঠল। কুদ্ধ, দানবীয় সাপের মত হাজারটা ফণা তুলে প্রলয় নাচন জুড়ে দিল ডোভারকে ঘিরে।
দুনিয়া আঁধার করা বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টিও শুরু হলো একই সাথে। অন্ধকার আকাশের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত চিরে দিয়ে সাপের জিভের মত সকল চমকাতে লাগল, সেকেন্ডে সেকেন্ডে দিনের মত ঝলসে উঠতে লাগল চারদিক। বিরামহীন বাজ পড়ার বিকট, ভয়াবহ শব্দে গিলিয়াতের মত দুঃসাহসী নাবিকেরও বুক কাঁপতে লাগল।
নিশ্চিত মৃত্যুর অপেক্ষায় অসহায়ের মত নৌকায় বসে থাকল ও। টানা বিশ ঘণ্টা দুনিয়া ওলট-পালট করা ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়ে অবশেষে থামল ভয়ঙ্কর ঝড়টা। বাতাস, বৃষ্টি, একযোগে থেমে গেল। স্বস্তির দম ছেড়ে নৌকার পাটাতনে ক্লান্ত, অবসন্ন দেহ এলিয়ে দিল গিলিয়াত।
বারো
অনেক বেলা করে ঘুম ভাঙল ওর। সাগর তখন বেশ শান্ত। সময় মত গেরানসিতে পৌঁছতে হলে আরও আগেই রওনা করা উচিত ছিল ওর। তা যখন হলো না, তখন আজ আর যাত্রা করবে না ঠিক করল গিলিয়াত। তারচেয়ে বরং একটা দিন দেরিতে যাত্রা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
অসহ্য খিদেয় নাড়িভূঁড়ি সব হজম হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়েছে ওর। সারাদেহ কাঁপছে থর থর করে। ভয় হলো, এখনই কিছু খাবার জোগাড় করতে না পারলে ও বোধহয় মরেই যাবে।
গায়ের জামাটা তখনও একটু একটু ভেজা ছিল, ওটা খুলে ফেলল গিলিয়াত। পাজামাটা হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে নিয়ে নিজের আরেক সর্বক্ষণের সঙ্গী, লম্বা ফলার ধারাল ছুরিটা নিয়ে নেমে পড়ল নৌকা থেকে। খাওয়ার জন্যে কিছু একটা জোগাড় করতেই হবে ওকে।
নৌকাটা যেখানে বেঁধে রাখা হয়েছে, তার কয়েক হাত দূরে পাহাড়ের গায়ে বেশ বড়সড় একটা গর্ত। গুহামুখের ওপরে খিলানের মত পাথরের কার্নিশ, সামনের দিকে বেরিয়ে আছে অনেকখানি।
বুক সমান পানি ওখানটায়। ঝড়ের সময় প্রচুর বড় বড় কাঁকড়া আশ্রয় নিয়েছিল গুহার ভেতরে, আগেই লক্ষ করেছে গিলিয়াত। এখনও আছে সেগুলো বের হতে সাহস পায়নি আবার ঝড় আসতে পারে সেই ভয়ে।
খিলানের নিচ দিয়ে ওকে ভেতরে ঢুকতে দেখেই মস্ত বড় একটা কাঁকড়া দেয়ালের আশ্রয় ছেড়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল, পাশ ফিরে অদ্ভুত ভঙ্গিতে খিচে দৌড় লাগাল গুহামুখের দিকে। ওটাই ছিল ওর প্রধান লক্ষ্য, কাজেই পিছু ছাড়ল না।
ওটাকে ধাওয়া করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। গুহাটার আকার দেখে বেশ অবাক হলো গিলিয়াত। বাইরে থেকে কল্পনাই করা যায়নি ওটা এত বড় হতে পারে।
মস্তবড় গুহা। একজন মানুষ অনায়াসে চলাচল করতে পারে ভেতরে। একটু দাঁড়াল ও আবছা অন্ধকারে চোখ সইয়ে নেয়ার জন্যে। তারপর বড় কাকড়াটার খোঁজে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল।
এই সময় গুহার ও মাথায় বেদীর মত উঁচু, শুকনো খানিকটা জায়গা চোখে পড়ল। বাইরে থেকে সূর্যের আলো এসে পড়েছে ওখানটায়। ব্যাপার বোঝার জন্যে আরও কয়েক পা ভেতরে এগিয়ে দাঁড়াল গিলিয়াত, তখনই এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটল।
নরম গুড়ের মত একটা ঠাণ্ডা হাত পিছনে থেকে আচমকা ওর ডান হাতটা পেঁচিয়ে ধরল শক্ত করে। বরফের মত ঠাণ্ডা হাত! জনপ্রাণীবিহীন নির্জন জায়গায় হঠাৎ এমন অচিন্তনীয় আক্রমণে মুহূর্তের জন্যে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল ও।
পরমুহূর্তে ভয়ে জান উড়ে গেল হাতটা ওকে প্রচণ্ডভাবে আকর্ষণ করছে বুঝতে পেরে। প্রচণ্ড শক্তিতে টানছে বরফের মত ঠাণ্ডা হাতটা! সামলে নিয়ে এক পা গুহার দেয়ালে বাধিয়ে নিজেকে ছাড়াবার জন্যে গায়ের জোরে টানা-হঁচড়া শুরু করল গিলিয়াত।
কাজ হলো না। অজ্ঞাত আক্রমণকারীর কঠিন মুঠি এক চুলও শিথিল হলো না তাতে, বরং আরও এঁটে বসল। আরেকটা গুঁড় এসে ওর নগ্ন পেট পেঁচিয়ে ধরল। পরমুহূর্তে মনে হলো, ছোট ছোট অসংখ্য সুঁই পেটের প্রতিটা রোমকূপ দিয়ে রক্ত শুষে নিতে আরম্ভ করেছে বুঝি।
এরমধ্যে আরেকটা শুঁড় এসে বুক পেঁচিয়ে ধরেই চাপ দিতে শুরু করল। চাপের চোটে দম বন্ধ হয়ে এল গিলিয়াতের, ভয় হলো বুকের খাঁচা এখনই খুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে বুঝি। খানিক পরই নতুন আরও দুটো শুড় এসে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল ওকে, নড়াচড়ার উপায় রাখল না তেমন।
দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল ওর, অবশ হয়ে আসতে শুরু করেছে সারাদেহ। এত কিছু ঘটে গেল মাত্র দুই থেকে তিন সেকেন্ডের মধ্যে। আত্ৰমণকারীকে তখনও পর্যন্ত দেখতে পায়নি গিলিয়াত।