শেকল কাটতে উঠল গিলিয়াত, তখনই হঠাৎ করে ওর হাত পা অসাড় হয়ে এল। রাজ্যের ক্লান্তি আর অবসাদ এসে হেঁকে ধরায় চোখে রীতিমত আঁধার দেখল ও।
জীবনে দুঃসাহসী কাজ কম করেনি গিলিয়াত, মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে অচিন সাগরের হাজারো বিপদ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে কত অসাধ্যই না সাধন করেছে সে। এবারেরটা ছিল সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কঠিনতম।
যে ডোভারে একা একা যাওয়ার কথা মানুষের স্বপ্নেরও অতীত, যেখানকার পরিবেশের কথা ভেবে অতি বড় দুঃসাহসীও শিউরে ওঠে, সেই ভয়ঙ্কর ডোভারে একা একটানা দুই সপ্তাহ কাটিয়ে দিল সে।
যে অসম্ভব কাজ নিয়ে এসেছিল, অমানুষিক পরিশ্রম করে তাতে সফলও হয়েছে। কল্পনার অতীত এই সাফল্যের কথা ভেবে গিলিয়াত নিজেই যার পর নাই বিস্মিত। আনন্দে উত্তেজনায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
আর তখনই, সাফল্যের একেবারে দোড়গোড়ায় পা রাখামাত্র হঠাৎ কেন যেন আপাদমস্তক শিউরে উঠল, ধপ করে নৌকার পাটাতনের ওপর বসে পড়ল গিলিয়াত। ওর অবচেতন মনে কোন অশুভ আশঙ্কা উঁকি দিয়ে গিয়েছিল কি না কে জানে!
সারাদেহ থর থর করে কাঁপতে শুরু করল গিলিয়াতের। অবশ্য মনের সঙ্গে জোর খাঁটিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সহজ-স্বাভাবিক করে তুলল সে, লোহা কাটার করাত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাকি কাজ শেষ করতে। বিশ মিনিট পর এনজিন নিরাপদেই নামিয়ে আনল ও, ছোট নৌকা অনেকখানি দেবে গেল জিনিসটার ভারে।
গিলিয়াতের ডোভার অভিযান শেষ, এবার নিশ্চিন্তে গেরানসি যাত্রা করা যায়। না, ভুল হলো। এখনও একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে ওর। দুরান্দের চিমনিটার কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। ওটাও নিতে হবে। এনজিন নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল যে চিমনির কথা ভুলেই গিয়েছিল গিলিয়াত। কিন্তু এখনই ওটাকে নৌকায় তোলার উপায়ও নেই।
এ মুহূর্তে দুই ডোভারের একটার সাথে মাথা ও অন্যটার সাথে লেজ ঠেকিয়ে বেকায়দা ভঙ্গিতে আটকে আছে জিনিসটা। পানির সাথে তাল রেখে দুলছে। এখন তোলা যাবে না। ভাটার সময় করতে হবে কাজটা।
কিন্তু আবার ভাটা আসতে আসতে তো সেই মাঝরাত। অতরাতে কাজ শেষ করে যাত্রা করা কঠিন হয়ে যাবে। তা হয় হোক, তবু কাজ অসমাপ্ত রেখে ফিরে যেতে রাজি নয় গিলিয়াত। কাজে কোনরকম খুঁত রাখা চলবে না।
একটু বিশ্রাম দরকার। পেটে কিছু দেয়াও জরুরি হয়ে পড়েছে, নইলে আর পারা যাচ্ছে না ও। খুঁজে খুঁজে কয়েকটা কাঁকড়া ধরল গিলিয়াত, তার সাথে কিছু বিস্কিট দিয়ে রাতের খাওয়া সেরে নিল। এবার একটু পানি চাই। পানির ভাণ্ডার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে ওর বাড়তি কয়েকদিন লেগে যাওয়ায়, এখন খুব সামান্যই অবশিষ্ট আছে। কিন্তু আজ যে প্রচণ্ড ধকল গেছে, তাতে অন্তত কয়েক ঢোক না খেলেই নয়। কাজেই চামড়ার ব্যাগটা উপুড় করে কোনমতে গলা ভেজাবার মত খানিকটা বেল গিলিয়াত। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে উঠবে বলে এনজিনটার পাশে শুয়ে পড়ল।
নানান উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় গত কয়েক রাত এক মুহূর্তের জন্যেও ঘুমাতে পারেনি, তাই পাটাতনে পিঠ ছোঁয়ানোমাত্র গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল ও।
কত রাতে কে জানে, হঠাৎ চোখের ওপর তীব্র আলোর ছটা এসে পড়তে গভীর ঘুমটা ভেঙে গেল, ধড়মড় করে উঠে বসল গিলিয়াত। হতবাক হয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। এ কিসের আলো!
ভাবসাব দেখে মনে হলে চ্যানেলের প্রতিটা ঢেউয়ের মাথায় আগুন ধরে গেছে বুঝি, আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে ইংলিশ চ্যানেল। ডোভারের প্রতিটা কোনা কানাচে নেচে বেড়াচ্ছে তার উজ্জ্বল ছটা।
তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে থাকল ও। বুঝে উঠতে পারছে না আলোটার উৎস কি। এমন আজব দৃশ্য জীবনে এই প্রথম দেখল। ভাগ্য ভাল ঘুমটা ভেঙেছিল, ভাবল ও। নইলে আর কিছুক্ষণ পর কি ঘটত বলা যায় না।
হুঁশ ফিরতে দেখল ভাটা শেষ হয়ে আবার জোয়ার এসেছে সাগরে! ওদিকে দুরান্দের চিমনিটা কি করে যেন আগের অবস্থান থেকে ছুটে অনেকটা নিচে এসে নতুন করে আটকে গেছে, ওর মাথার মাত্র কয়েক হাত ওপরে।
পানি বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ওর নৌকা ক্রমে ওপরে উঠছে। পানি আর এক হাত বাড়লেই এনজিনটা চিমনির সাথে ঠেকে যাবে, ঠেকে যাবে নৌকাও।
পানি বাড়বে অথচ নৌকা জাগবে না, তার ফল কি হতে পারে সহজেই অনুমান করা যায়। ব্যস্ত হয়ে উঠল গিলিয়াত, তাড়াতাড়ি নৌকা সরিয়ে না নিয়ে গেলে বিপদ। যে কাজ অন্য সময়ে দুমিনিটে করে ফেলতে পারত, ভীষণ ক্লান্ত বলে সেই কাজেই পুরো দশ মিনিট লাগল।
নৌকাটাকে বিপদমুক্ত করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল ও, একই সাথে চিমনির আশা ছেড়ে দিল। দরকার নেই ওটার। শুধু এনজিনটা নিয়ে ভালয় ভালয় জায়গামত পৌঁছতে পারলে হয়।
গেরানসি যাত্রা করার জন্যে জোয়ারই উপযুক্ত সময়। এ মুহূর্তে একে তো জোয়ার, তারওপর সাগরও বেশ শান্ত, তাই নৌকা ছেড়ে দেয়াই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কেন যেন সাহস হলো না গিলিয়াতের।
অবাক চোখে আগুন রঙের অদ্ভুত আলোটার খেলা দেখছে ও। এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে বোকার মত। কিছুক্ষণ পর আচমকা মিলিয়ে গেল আলোটা, ঘন আঁধারে ডুবে গেল ধরনী। দুর দিয়ে এক আঁক সামুদ্রিক চিল আতঙ্কিত গলায় ডাকতে ডাকতে উড়ে পালিয়ে গেল।
এ নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর ঝড়ের পূর্বাভাস!
পাখিগুলোর আতঙ্কিত চিৎকার ও পালিয়ে যাওযার পড়িমরি ভাব দেখেই বুঝে ফেলেছে গিলিয়াত। ওর সমস্যা আরও বাড়াতে নিশ্চয়ই প্রচণ্ড ঝড় আসছে! এমনিতে এই অঞ্চলে ঝড় ঝাঁপটা সারাক্ষণ লেগেই থাকে।