তারপর নিচে এসে নৌকা নিয়ে আরেক চক্কর দিল ডোভারকে কেন্দ্র করে। স্কেলিটন চূড়ার নিচে, বড় ডোভারের কোলের কাছের খানিকটা জায়গা বেশ নিরাপদ মনে হলো গিলিয়াতের। নৌকাটা ওখানে রাখা যায়, ঝড় এলেও তেমন কোন সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।
ওর সামান্য ওপরে, পাহাড়ের গা থেকে লম্বালম্বিভাবে বেরিয়ে আছে একটা দীর্ঘ, খাড়া পাথর। দানবীয় একটা হাত আকাশ নির্দেশ করছে যেন। হাতটা যেখান থেকে বেরিয়েছে, সেখানে একটা গুহামত আছে। ওটার মধ্যে একজন মানুষ কোনমতে রাত কাটাতে পারবে মনে হলো গিলিয়াতের। ওতেই চলবে, এর বেশি কিছু চায়ও না সে।
নৌকাটাকে জায়গামত এনে কষে বেঁধে রেখে সাথের পোঁটলাপাটলি নিয়ে পাথরের খাড়া হাত বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল গিলিয়াত। জায়গাটা দেখে সন্তুষ্ট হলো। যা ভেবেছিল ঠিক তাই, এখানে একজন মানুষের রাত কাটাতে কোন সমস্যাই হবে না।
বরং ঝড়-বৃষ্টির হাত থেকেও বাঁচা যাবে। গুহায় নিজের সমস্ত মালপত্র গুছিয়ে রাখল ও। তারপর লম্বা একটা রশি নিয়ে সেটার একমাথা খাড়া পাথরটার সঙ্গে মজবুত করে বাঁধল, অন্য মাথাটা বাঁধল দুরান্দের সাথে, টাটা করে।
প্রয়োজনের সময় লাইনটা ধরে ঝুলে ঝুলে স্কেলিটন থেকে জাহাজ, জাহাজ থেকে স্কেলিটনে ইচ্ছেমত আসা-যাওয়া করতে পারবে গিলিয়াত। নিচে নামতে হবে না সে জন্যে।
তবে এর একটা সমস্যাও আছে, মাঝপথে কোনমতে একবার হাত ফসকে গেলেই সর্বনাশ। অনেক নিচের সাগরে গিয়ে আছড়ে পড়তে হবে। কিন্তু সে চিন্তা করছে না গিলিয়াত। এ ধরণের চিন্তার পিছনে সময় নষ্ট করার মত মানুষ ও নয়। লাইনটা টেনেটুনে দেখে সন্তুষ্ট হলো যুবক।
তারপর নির্ভীকচিত্তে ডোভারের সর্বত্র ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল। ঝড়ে দুরান্দ থেকে যে সমস্ত জিনিসপত্র উড়ে গিয়ে এখানে-সেখানে পড়ে ছিল, সব একটা একটা করে কুড়িয়ে এনে এক জায়গায় জড়ো করতে লাগল।
পরদিন থেকে শুরু হলো তার আসল কাজ। ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথে কাজে লেগে পড়ল গিলিয়াত, অন্ধকার হয়ে না আসা পর্যন্ত মুহূর্তের জন্যেও বিশ্রাম নিল না।
সারাক্ষণ একটাই চিন্তা তাড়িয়ে বেড়াল ওকে-যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দুরান্দের এনজিন উদ্ধার করে নৌকায় তুলতে হবে, দেশের পথে পাড়ি জমাতে হবে। দেরি করা চলবে না।
যেদিকেই চোখ যায়, কেবল পানি আর ঢেউ, ঢেউ আর পানি। কোথাও জনমানুষের চিহ্ন পর্যন্ত চোখে পড়ে না। মাঝেমধ্যে এক-আধটা সামুদ্রিক পাখি দেখা যায়, এছাড়া অন্য কোন প্রাণীর সাড়া নেই, এমনই এক নির্জন দ্বীপে দিনের পর দিন, ভোর থেকে সন্ধের আঁধার না নামা অব্দি ভূতের মত খেটে চলল গিলিয়াত।
সময়মত খায় না, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয় না, সারাদিন কেবল কাজ কাজ আর কাজ। যখন ঘন আঁধার গ্রাস করে ফেলে বিশ্বচরাচর, রশি ধরে ঝুলে ঝুলে নিজের গুহায় ফিরে যায় গিলিয়াত।
ক্লান্ত, শ্রান্ত দেহটা গ্যানিটের শীতল মেঝেতে এলিয়ে দেয়। তখন মনে হয়, ঘুমানোর সময় মা যেমন করে সারাদেহে তার স্নেহের কোমল হাত বুলিয়ে দিত, সাগরও যেন তেমনি ভালবাসার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে।
অন্ধকারে প্রায়ই দেরুশেতের মায়াবী মুখটা ওর মনের পর্দায় ভেসে ওঠে, বিভোর হয়ে সেটার দিকে অপলক চেয়ে থাকে গিলিয়াত। ছবি মিলিয়ে গলে হতাশ হয়ে দার্শনিঃশ্বাস ছাড়ে, পাশ ফিরে শোয়।
এভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে পুরো দশটা দিন কাটিয়ে দিল গিলিয়াত। অতিরিক্ত খাটুনি, অপর্যাপ্ত খাদ্য এবং ঘুমের অভাবে এরমধ্যে দেহ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ওর, দাড়ি-গেঁফে মুখ ভরে উঠেছে। বনমানুষের মত হয়েছে চেহারা।
জামাকাপড় সব ছিঁড়ে-ফেটে একাকার, পায়ের জুতো জোড়া কোথায় গেছে তার হদিস নেই। ওদিকে খাবার আর পানি, তাও ফুরিয়ে এসেছে অল্প কিছু বিস্কিট ছাড়া এখন তেমন কিছু আর অবশিষ্ট নেই।
দেহের বল দিন দিন কমে আসছে ওর, ভয়ঙ্কর ডোভার একটু একটু করে শুয়ে নিচ্ছে জীবনী শক্তি। অথচ এখনও বোঝা যাচ্ছে না কতদিনে কাজটা শেষ হবে! খাবার-পানি ফুরিয়ে গেলে কি অবস্থা হবে জানে না গিলিয়াত, জানতে চায়ও না। ও শুধু জানে যতদিনে হোক, যে করে হোক, দুরান্দের এনজিন তাকে উদ্ধার করতে হবে।
ওটা না নিয়ে কিছুতেই ফিরে যাবে না সে।
এগারো
অবশেষে টানা পনেরো দিনের অমানুষিক সংগ্রাম আর কঠোর অধ্যবসায় সাফল্য নিয়ে এল একদিন। এপ্রিলের শেষ অথবা মে মাসের প্রথম সপ্তাহ হবে তখন।
শেষ কাজটা শুধু বাকি এখন গিলিয়াতের। দুপুরের মধ্যে সেটাও সেরে ফেলল ও করাতের সাহায্যে দুরান্দের খোল কেটে চিমনিসহ অসম্ভব ভারী এনজিনটা আলাদা করে ফেলল। খোল থেকে মুক্তি পাওয়ামাত্র ওটার গড়িয়ে সাগরে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে, তাই আগেই জাহাজের বড় বড় শেকল দিয়ে দুই চূড়ার সাথে এটাকে খুব মজবুত করে বেঁধে নিয়েছিল গিলিয়াত। এমনভাবে বেঁধেছে, যাতে দুই চূড়ার মাঝখানে স্কুলে থাকে, ভাতে বাকি কাজ সারতে অনেক সুবিধে হবে।
জোয়ারের সময় পানি যখন বাড়তে থাকবে, তখন নৌকাটাকে এনজিনটার একদম তলায় নিয়ে যাওয়া যাবে, বাঁধন খুলে ওটাকে তখন নৌকার পাটাতনে নামিয়ে আনা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
তাই করল গিলিয়াত, নৌকা ওটার তলায় নিয়ে এসে উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় থাকল। জোয়ার হতে সাগরের পানি ফুলেফেঁপে উঠতে আরম্ভ করল, সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে নৌকাটাও একটু একটু করে ওপরে জেগে উঠছে। একসময় এনজিনটার ঠিক তলায় এসে ঠেকল নৌকা, কাজ সেরে ফেলার এখনই উপযুক্ত সময়।