না, না, এ কাজ কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, বলল সে। ওটার আশা ছেড়ে দেয়াই ভাল। ওই অঞ্চল আমি খুব ভাল করে চিনি। ওর ত্রিসীমানার কাছেই যেতে পারবে না কেউ, এনজিন উদ্ধার করা তো পরের কথা। নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকি আছে জেনেও কেউ এমন অসম্ভব দায়িত্ব নেবে, আমার তা মনে হয় না। কাজেই ব্যাপারটা নিয়ে শুধু শুধু মাথা ঘামানোর কোন অর্থ হয় না।
ক্যাপ্টেনের কথা শেষ হতে হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল দেরুশেত। পটলচেরা দুচোখের শান্ত দৃষ্টি বুলিয়ে নিল জটলার মুখগুলোর ওপর। এমন কোন দুঃসাহসী পুরুষ কি আছে, তেমনি শান্ত কণ্ঠে বলল ও, যে ডোভার থেকে দুরান্দের এনজিনটা উদ্ধার করে নিয়ে আসতে পারবে? তাহলে তাকেই বিয়ে করব আমি।
সমস্ত আলোচনা, গুঞ্জন মুহূর্তে থেমে গেল। প্রত্যেকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল মেয়েটির মুখের দিকে। কারও মুখে কথা নেই, পলক পড়ছে না। ভাষা হারিয়ে ফেলেছে যেন সবাই। নড়তে-চড়তেও ভুলে গেছে।
জটলার মধ্যে থেকে দেরুশেতের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল একজন। সে গিলিয়াত। দেরুশেত, সত্যি বলছ তাকেই বিয়ে করবে তুমি?।
দেরুশেত জবাব দেয়ার আগেই বুড়ো লেতিয়ারি ওর সামনে এসে দাঁড়াল। আশা-নিরাশার অদ্ভুত এক দোলায় দুলছে মানুষটা। হ্যাঁ, গিলিয়াত, প্রচণ্ড আবেগে গলা কেঁপে গেল তার। হ্যাঁ। আমি ঈশ্বরের শপথ করে বলছি, আমার দেরুশেত তাকেই বিয়ে করবে। আমার সবকিছুর মালিকও হবে সে।
গিলিয়াত আর কিছু বলল না।
১০. ছোট সেই নৌকাটা
দশ
সর্বক্ষণের সঙ্গী ছোট সেই নৌকাটা নিয়ে একদিন সত্যি সত্যি ভয়ঙ্কর ডোভারের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল গিলিয়াত, একা। আবহাওয়া ভাল ছিল না সেদিন। সাগরের চেহারা ঝোড়ো, মারমুখো। দেখলে যে কোন নাবিকের বুক কেঁপে উঠবে, কিন্তু ওর অতসব দেখার সময় নেই। ওর মধ্যেই নৌকা বেয়ে চলল একমনে।
মাথার মধ্যে কেবল একটাই চিন্তা, তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে ডোভারে। যে করে হোক এনজিনটা উদ্ধার করে আনতে হবে। নইলে বেশি দিন ঝুলন্ত অবস্থায় থাকলে অনবরত ঢেউয়ের আঘাতে জাহাজের খোল গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে, সে ক্ষেত্রে এনজিনটাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ডোভারের ভীষণ স্রোত।
ডোভারে পৌঁছার সোজা, কিন্তু সবচেয়ে বিপজ্জনক কোর্স ধরে চলল গিলিয়াত। সারারাত ঝড়ের সাথে একটানা যুদ্ধ করতে করতে এগোল। পুব আকাশে দিনের আলোর আভাস দেখা দেয়ামাত্র বাতাসের বেগ কমতে শুরু করল। কমতে কমতে একসময় প্রথমেই গেল।
রোদের সোনালী আলোয় হেসে উঠল ইংলিশ চ্যানেল। রাতভর বাতাসের টানা শো শো গান শুনে অভ্যস্ত হয়ে আসা যুবকের কানে হঠাৎ এই নীরবতা কেমন যেন লেগে উঠল। চারদিকে চোখ বোলল ও। যতদূর দেখা যায় তীরের কোন চিহ্ন পর্যন্ত চোখে পড়ল না, যেন অন্য কোন পৃথিবী এটা।
চার দিগন্ত পর্যন্ত কেবল নীল পানি আর সাদা ফেনার কিরীট পরা অশান্ত ঢেউ ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ছে না। সারাদিন একটান নৌকা বেয়ে চলল গিলিয়াত, তারপর সারারাত।
দু হাত অনবরত উঠছে আর নামছে, নামছে আর উঠছে। যন্ত্রচালিতের মত। নিজের কাজে এত মগ্ন, এতটাই একাগ্র, দেখে মনে হয় জীবনে এই একটা ব্রত নিয়েই বুঝি পৃথিবীতে এসেছে গিলিয়াত!
পরদিন দুপুরের দিকে ডোভারে পৌঁছল ও। সাগর বেশ শান্ত তখন। চারদিক নীরব, নিস্তব্ধ। ভাটা চলছে, পানি সরে যাওয়ায় অনেকখানি জেগে উঠেছে ডোভার।
গোড়ার দিকের গর্তগুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে গিলিয়াত। জাহাজটা দুই ডোভারের মাঝের ফাঁকে আটকে আছে, তবে উপুড় হয়ে। এ অবস্থায় এনজিন উদ্ধার করা বেশ কঠিন হবে। জেনেও আমল দিল না।
কাজটা যে সহজ হবে না, তা জেনে-বুঝেই তো এসেছে, তাহলে আর এ নিয়ে মাথা ঘামাননা কেন? তাছাড়া দু’ চারদিনে শেষ হওয়ার নয় এ কাজ, তাও জানে।
তাই কাজের জন্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, রশি ইত্যাদির সাথে জামা-কাপড়, বিস্কিট, পাউরুটি, বেসন দেয়া মাছ এবং বড় চামড়ার ব্যাগ ভরা খাবার পানিও নিয়ে এসেছে ও। অন্তত দিন দশেক চলে যাবে এতে।
দুই ডোভারের চারদিকে প্রথমে একটা চক্কর দিয়ে নিল গিলিয়াত, একটা সুবিধেজনক জায়গা বেছে নিয়ে কোনমতে নোঙর করল নৌকাটাকে। তারপর সাথে করে বয়ে আনা মানপত্রগুলো রাখার উপযুক্ত জায়গার খোঁজে ভাঙায় উঠে এদিক-সেদিক তাকাতে লাগল। খানিক পর ডোভারের চূড়ায় উঠতে শুরু করল ও।
ওখান থেকে চারদিকটা ভালমত দেখতে পাওয়া যাবে। পাহাড়ের খাঁজে খুঁজে পা রেখে এমন অনায়াস ভঙ্গিতে উঠে যেতে শুরু করল যুবক, যেন এ পথ তার বহু চেনা। নিত্যই ওঠা-নামা করে। ওপরে উঠে দুরান্দের কাছে এসে দাঁড়াল গিলিয়াত, ভাল করে চোখ বোলাল ওটার ওপর।
একেবারে দুই চূড়ার মধ্যিখানে ফেঁসে গেছে জাহাজটা। দেখলেই বোঝা যায় ব্যাপারটা ভরা জোয়ারের সময় ঘটেছে, নইলে ওটার অত উঁচুতে ওঠার কোন কারণ নেই। কোনমতে জাহাজে উঠে খোলর মধ্যে ঢুকল ও।
দেখল ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে খোলটা। তবে আসল জিনিস ঠিকই আছে। একদম নতুনের মত ঝকঝক করছে এনজিনটা ওটাকে খেল থেকে মুক্ত করা খুব কঠিন হবে, জানে। কিন্তু সে চিন্তায় সময় নষ্ট করল না গিলিয়াত। সে যখনকার কাজ, তখন দেখা যাবে
এখন অন্য কাজ আছে। প্রথম কাজ হলো নৌকাটার জন্যে একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে বের করা, তারপর নিজের জন্যেও একটা আশ্রয় চাই। উপযুক্ত জায়গার খোঁজে চারদিকট, ভাল করে দেখে নিল যুবক!