কোর্স ছেড়ে অতদূর সরে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না দুরান্দের। এই দুর্ঘটনার জন্যে সম্পূর্ণ দায়ী নাবিক তাঙরুল, ব্যাটা ইদ্দ মাতাল অবস্থায় জাহাজ চালাচ্ছিল।
দুর্ঘটনার ব্যাপারে ক্যাপ্টেনের কোন দোষ ছিল না। সে বরং যথার্থ ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পালন করে গেছে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। জাহাজ বাঁচানোর কোন উপায় দেখে নাবিক-যাত্রীদের সময় থাকতে লাইফবোট নিয়ে চলে আসতে বাধ্য করেছে।
ঝড়ের মধ্যে সাগরে চলার উপযুক্ত লাইফবোট একটাই ছিল দুরান্দে, উপায় নেই দেখে সেটায় করে চলে আসে তারা। বারবার অনুরোধ করার পরও ক্যাপ্টেন আসেনি তাদের সঙ্গে। প্রতিজ্ঞা করেছে, সে জাহাজেই থাকবে।
জাহাজ ছেড়ে আসার একটু পরই প্রবল ঝড়ে পড়ে লাইফবোট। বিশাল একেকটা ঢেউয়ের মধ্যে পড়ে খাবি খেতে খেতে প্রায় ডুবেই যাচ্ছিল, জীবনের আশা ছেড়েই দিয়েছিল সবাই, এমন সময় কাশমির নামে একটা জাহাজ এসে পড়ায় অল্পের জন্যে প্রাণে রক্ষা পায় লোকগুলো।
জাহাজটা তাদেরকে সেইন্ট পিটার বন্দরে পৌঁছে দিয়েছে। তাঙরুলকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেখানে। লেতিয়ারির সামনের এক টেবিলে ক্লুবিনের পাঠিয়ে দেয়া দুরান্দের কম্পাস জরুরি কাগজপত্র রয়েছে।
মৃত্যুকে বরণ করে নেয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্তও লোকটা যে তার ওপর অর্পণ করা দায়িত্ব একান্ত আন্তরিকতার সাথে পালন করে গেছে, ওগুলো তার সাক্ষী।
ক্লুবিন যে বিশ্বস্ত ও মহত্বদয় মানুষ, সব শোনার পর সে ব্যাপারে কারও মনে কোন সন্দেহ রইল না। তবে লোকটা যে মরেনি, এখনও বেঁচে আছে, সে ব্যাপারেও তাদরকে একমত হতে হলো। কেন, এবার আসছে সেই কাহিনী। ভিড়ের মধ্যে শিনটিন নামে এক জাহাজের ক্যাপ্টেনও ছিল, তার জানা আছে দুরান্দের সর্বশেষ পরিণতির খবর।
লোকটা তার কাহিনী বলতে শুরু করল, সেটা এরকম দুরা যখন দুর্ঘটনায় পড়ে, শিনটিন নিয়ে তখন ওই এলাকার কাছাকাছিই ছিল সে। কুয়াশা পরিষ্কার হলে যাত্রা করবে বলে সাগরের মাঝে নোঙর ফেলে অপেক্ষা করছিল।
অনেকক্ষণ পর ঝড়ের বেগ কিছুটা কমে আসতে কুয়াশাও হালকা হয়ে গেছে দেখে ফের যাত্রা শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল শিনটিন, এমনসময় হঠাৎ দূর থেকে গরু-বাছুরের ভয়ার্ত চেঁচামেচি শুনে চমকে ওঠে ক্যাপ্টেন।
যেদিক থেকে শব্দ আসছিল, নোঙর তুলে সেদিকে এগিয়ে যায় তাড়াতাড়ি। কিছুদূর যেতে দূর থেকে ডোভার পাহাড়ের এক ডুবো চূড়ায় দুরান্দকে আটকে থাকতে দেখতে পায় সে। বেহাল অবস্থা তখন সেটার।
উদ্ধারের কোন আশাই নেই। ওটা যেখানে, জাহাজ নিয়ে তার বেশি কাছে যাওয়ারও উপায় ছিল না। তাই কিছুটা দূরে নিজের জাহাজ থামিয়ে ওটায় মানুষজন আছে কি না বোঝার চেষ্টা করল ক্যাপ্টেন।
নানারকম শব্দ ও সঙ্কেতের মাধ্যমে দুরান্দের আরোহীদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালিয়েছে সে অনেকক্ষণ ধরে। কোন লাভ হয়নি। সাড়া দেয়নি কেউ।
এক সময় ক্যাপ্টেনের সন্দেহ হলো, ওটায় বোধহয় মানুষজন নেই। গরু-বাছুরই আছে কেবল। তবু ভালমত নিশ্চিত হওয়ার জন্যে সেখানেই রাত কাটায় শিনটিন। পরদিন, অর্থাৎ আজ ভোরবেলা আরেকবার দুরান্দের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালানো হয় অনেকভাবে। কেউ সাড়া দেয়নি। নিশ্চিত হয়ে ফিরে আসার আয়োজন করছে সে, এমন সময় আবার ঝড় ছাড়ল।
সে কি ভীষণ ঝড়! বাতাসের প্রচণ্ড ধাক্কায় অল্প সময়ের মধ্যে ডুবো পাহাড় থেকে দুই ডোভারের মাঝখানে গিয়ে আটকে গেল দুরান্দ।
এখন সেখানেই ঝুলন্ত অবস্থায় আছে জাহাজটা খোল বরবাদ হয়ে গেলেও কাঠামোটা আরও কিছুদিন ভেসে থাকবে, খুব শীঘিই ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে নিত্য ঝড় আর পানির আঘাত সহ্য করে কতদিন ভেসে থাকতে পারবে, সে কথা বলা মুশকিল।
কাহিনীর শেষ পর্যায়ে এত হতাশার মধ্যেও একটা আশার বাণী শোনাল লোকটা। তা হলো, দুরান্দের কাঠামো অকেজো হয়ে গেলেও দামী এনজিনটার কোনরকম ক্ষতি হয়নি। ঠিকই আছে ওটা। চেষ্টা করলে হয়তোবা ওটাকে উদ্ধার করা সম্ভব হতেও পারে।
এই কথাটা যেন নতুন করে প্রাণের সঞ্চার করল লেতিয়ারির দেহে। নড়েচড়ে বসল সে। ভাবতে লাগল, শুধু ওই এনজিনটা নির্মাণের পিছনেই প্রায় চল্লিশ হাজার ফ্রা খরচ হয়েছিল এত টাকা দিয়ে ওরকম আরেকটা তৈরি করানো তার পক্ষে আর সম্ভব নয়। তাছাড়া ফ্রান্সের যে এনজিনিয়ার ওটা তৈরি করেছিল, সে-ও আর বেঁচে নেই।
কাজেই ওই চিন্তা বাদ দিতে হবে। এখন একটাই উপায় আছে, কোনমতে ওটাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা, যদি সম্ভব হয়। তাহলেও দুরান্দ হারানোর ক্ষতি কিছুটা পূরণ হয়। কিন্তু কে করবে কাজটা
এমন অসম্ভব একটা কাজ করার মত বুকের পাটা কার আছে স্যামসনে? এতবড় দুঃসাহসী কে আছে যে ডোভারের মত গজব পড়া জায়গায় গিয়ে তার এই উপকারটা করে দেবে?
কে না জানে ডোভার কত ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক জায়গা? এনজিন উদ্ধার করা তো পরের কথা, আগে তো ডোভারের ধারেকাছে পৌঁছতে হবে! এ অঞ্চলে এমন নাবিক কে আছে যে সেখানকার বিপদ সম্পর্কে জানে না?
একদিকে লেতিয়ারি এইসব ভাবছে, অন্যদিকে জিনিসটা উদ্ধারের নানান সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করছে উপস্থিত সবাই। কিন্তু শুধু সময় গড়াচ্ছে তাতে, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
কেউ সফল হওয়ার মত কোন পথ কেউ দেখাতে পারছে না। যে ওটা উদ্ধার করে আনতে পারবে, তাকে প্রচুর নগদ টাকা-পয়সা পুরস্কার দেয়া হবে বলে ঘোষণা করার পরও কেউ রাজি হচ্ছে না দেখে শিনটিনের ক্যাপ্টেন নিজেই এক সময় সম্ভাবনাটা বাতিল করে দিল।