গিলিয়াত স্যামসনের বাসিন্দা হলেও স্থানীয় নয়, এখানকার কারও সাথে তার তেমন সম্পর্ক নেই। তাই সবার থেকে দূরে দূরে থাকে ও। স্থানীয়রা ভাবে গিলিয়াত খাপছাড়া মানুষ।
তার বাড়িও অনেকটা তেমনি-গ্রামে থেকেও গ্রামছাড়া, চ্যানেলের তীর ঘেঁষে পানির ওপর জেগে থাকা এক টিলার ওপরে। যেন মালিকের মত ওটারও একা থাকতেই পছন্দ।
সরু একটা খাড়ি টিলাটাকে চারদিক থেকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছে যে বাড়িটা বলতে গেলে গ্রাম থেকে একরকম বিচ্ছিন্নই হয়ে আছে। সরু একটা পাথুরে রাস্তা এটার সাথে গ্রামের যোগসূত্র রক্ষার কাজ করছে। বাড়ির চারপাশে বাগান করার মত ছোট্ট একটু জায়গাও আছে, তারপরই একদম খাড়া হয়ে সাগরে নেমে গেছে টিলার কিনারা। ওখানটায় সাগরের গভীরতা অনেক বেশি।
জোয়ারের সময় কখনও কখনও বাড়ির চারদিকের জমিটুকুও তলিয়ে যায়। বাড়িটা গিলিয়াতদের নিজেদের তৈরি নয়, অন্যের কাছ থেকে কিনে নেয়া। অতীতে এক সময় স্থানীয়রা ওটাকে দৈত্যপুরী নামে ডাকত।
কারণ জোয়ারের সময় পানি বাড়তে বাড়তে যখন ও বাড়ির ভিটা ছুঁই ছুঁই করত, তখন নাকি ভেতর থেকে বিকট শুম্ গুম্ আওয়াজ উঠত, মনে হত কোন অতিকায় দানব বাড়িটার ছাদে হেঁটে বেড়াচ্ছে বুঝি। সে আওয়াজ কানে এলে ভয়ে বুক কেঁপে উঠত গ্রামের মানুষের।
জায়গাটা মনোরম দেখে অনেক বছর আগে এক লোক সখ করে বাড়িটা তৈরি করিয়েছিল। কিন্তু ওটায় থাকা আর হয়ে ওঠেনি বেচারার। সেই রহস্যময়, ভীতিকর শব্দের কারণে একদিন তল্লাট ছেড়ে পালিয়ে গেল সে।
তারপর কিছুকাল পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল বাড়িটা। গ্রামের কেউ ভুলেও ওটার ত্রিসীমানার ধার ঘেঁষত না। এর বেশ কিছুদিন পর হঠাৎ কোত্থেকে যেন একদিন গিলিয়াতরা এসে ওই বাড়িতে উঠল।
গ্রামের মানুষ ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক মনে নিল না। ওটাই শেষ পর্যন্ত এই আগন্তুক পরিবারটির সাথে গ্রামবাসীর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার পথে কঠিন এক দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
সে কবেকার কথা-আজ থেকে কম করেও পঁচিশ বছর আগে স্যামসনে এসেছে গিলিয়াতরা। এতদিনেও গ্রামবাসীর সাথে তাদের সম্পর্কের বলতে গেলে কোন উন্নতিই হলো না।
একটু পিছনের পানে তাকানো যাক। প্রায় সিকি শতাব্দী আগে, ফরাসী বিপ্লবের শেষের দিকে একদিন মাঝবয়সী এক বিধবা মহিলা তার একমাত্র শিশু সন্তানকে নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে গেরানসিতে এসে নামল।
ছেলে সন্তান ছিল সেটি। সে সময় তার বয়স পাঁচ কি ছয় হবে। মাহলা ইংরেজ না ফরাসী, নাকি আর কোন জাতের, গ্রামের কেউ জানত না। জানার চেষ্টাও করেনি কখনও। তার চেহারা দেখেও ব্যাপারটা অনুমান করার উপায় ছিল না।
তার উপাধীও আরেক অজ্ঞাত ব্যাপার। সেটা কি যে ছিল, আজ আর তা নিশ্চিত জানার কোন উপায় নেই, কেননা গেরানসির স্থানীয়দের উচ্চারণ অনুযায়ী সেটা ক্রমে বদলে গিয়ে গিলিয়াত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মহিলাকে গ্রামের সবাই মিসেস গিলিয়াত বলে সম্বোধন, করত। সেই সূত্রে ছেলেটিও কালক্রমে গিলিয়াত হয়ে গেল। টাকা-পয়সা মোটামুটি মন্দ ছিল না মিসেস গিলিয়াতের, কিছুদিনের মধ্যেই দৈত্যপুরী কিনে নিল সে। তার এই দুঃসাহস দেখে গ্রামের মানুষজন শুধু যে বিস্মিত হলো তাই নয়, এমন একটা ভাব দেখাতে লাগল যে ওই বাড়িতে উঠে গ্রামের বহুদিনের পুরানো এক সংস্কারের গোড়ায় যেন কুড়াল মেরে বসেছে মহিলা।
যে বাড়িটাকে কেন্দ্র করে গেরানসির মানুষ এতদিন রাজ্যের জল্পনা-কল্পনা করে এসেছে, নানান মুখরোচক গল্প কেঁদে আত্মতৃপ্তি লাভ করেছে, সেই বাড়িতে কোথাকার কোন এক মেয়েছেলে তার শিশু সন্তান নিয়ে একাই বাস করতে শুরু করেছে, কেউ তা মেনে নিতে পারল না।
সে যা হোক, মিসেস গিলিয়াত সুরুচিসম্পন্ন মানুষ ছিল। দৈত্যপুরীতে উঠে প্রয়োজনীয় মেরামতীর কাজ সেরে ওটাকে নতুন করে রং করিয়ে নিল সে, নিজের হারিয়ে যাওয়া রূপ ফিরে পেয়ে ঝকঝকে হয়ে উঠল বাড়িটা।
তারপর গ্রাম থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন সেই বাড়িতে দুই মা ছেলের দিন বেশ ভালভাবেই কেটে যেতে লাগল। দিনে দিনে বড় হয়ে উঠতে লাগল গিলিয়াত!
মিসেস গিলিয়াত বাড়ির সামনের এক চিলতে জমিতে চমৎকার একটা ফুলের বাগান গড়ে তুলল, অল্পদিনে ফুলে ফুলে ভরে উঠল সেটা। শৈশব কাটিয়ে একসময় কৈশোরে পা দিল গিলিয়াত, তারপর তাঙরুণ্যে।
অবশেষে এল যৌবন। এই সময় বড় একটা ধাক্কা খেল সে। বেশ কয়েক বছর থেকে নানান রোগে শয্যাশায়ী ছিল মা-একদিন হঠাৎ করে নিথর হয়ে গেল।
মানুষ যেমন বহু ব্যবহারে জীর্ণ পোশাক একসময় ফেলে দেয়, মহিলার আত্মাও তেমনি করে তার দেহপিণ্ডর ফেলে রেখে কোন অজানার উদ্দেশে পাড়ি জমাল। ব্যাপারটা অপ্রত্যাশিত ছিল না, কিন্তু গিলিয়াত বেশ কঠিন ধাক্কা খেল। অবশ্য ছেলেকে পথে বসিয়ে রেখে যায়নি মিসেস গিলিয়াত, তার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করে রেখেই গেছে।
বাড়িটা তো রইলই, সেই সাথে গিলিয়াতের জীবনধারণের জন্যে কয়েক হাজার নগদ টাকাও রেখে গেছে সে। আরও কিছু রেখে গেছে নিজের শোবার ঘরের এক কোনায় রাখা মস্ত একটা বাক্সে। ওটার গায়ে তার নিজের হাতে লেখা আছে? আমার পুত্রবধূর জন্যে।
গিলিয়াত জানে না ওটার মধ্যে আসলে কি আছে। তবে শুনেছে, তার ভাবী বউয়ের জন্যে মা ওর ভেতরে অনেকগুলো মূল্যবান পোশাক ও অলঙ্কার তুলে রেখেছে যত্ন করে। ছেলের সামনে কখনও বাক্সটা খোলেনি মিসেস গিলিয়াত। তার বড় সাধ ছিল, পুত্রবধূ বাড়িতে পা রেখে নিজের হাতেই প্রথম খুলবে ওটা। কিন্তু এসবে কি মন মানে?