কাপড় উড়িয়ে দূরাগত জাহাজটার কারও না কারও দৃষ্টি নিশ্চয়ই আকর্ষণ করতে পারবে সে। চূড়াটার দিকে তাকিয়ে দুরান্দের সাথে ওটার দূরত্ব আন্দাজ করে নিল সে। মনে হলো দুশো হাতের বেশি হবে না।
সাগর যদিও ভীষণ অশান্ত, কিন্তু ক্লুবিন ওসব পরোয়া করে না। যত ঢেউ আর স্রোতই থাকুক না কেন, সে ঠিকই জায়গামত পৌঁছে যেতে পারবে।
পানির ওপরে সাঁতার কাটতে সমস্যা হলে ডুব সাঁতার দিয়ে এগোবে। চিন্তা কি? ডুব সাঁতারেও ক্লুবিনের কোন জুড়ি নেই। মোট কথা এই সামান্য পথ পাড়ি দেয়া কোন ব্যাপারই নয় তার জন্যে।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে, আর দেরি করা যায় না, এখনই পানিতে নামতে হবে। নইলে জায়গামত পৌঁছতে দেরি হয়ে যেতে পারে।
কাপড়চোপড় পরা অবস্থায় সাঁতার কাটতে অসুবিধে হবে বলে পরনে যা যা ছিল, সব খুলে ফেলল সে। ওসবের চিন্তা এখন না করলেও চলবে। একবার ওই জাহাজটায় উঠতে পারলে জামা-কাপড়ের অভাব হবে না।
কোমরের বেল্টটা আরও একটু কষে বেঁধে নিয়ে বড় ডোভারের দিকে তাকাল ক্লুবিন, শেষবারের মত আরেকবার ভাল করে ওটার দূরত্ব আর দিক নির্ণয় করে নিয়ে মাথা নিচু করে ডাইভ দিল। অনেক উঁচু থেকে একদম খাড়া ডাইভ দিয়ে পানিতে পড়ায় সাঁ করে বেশ অনেকখানি গভীরে চলে গেল সে। ইচ্ছে আছে ওই এক ডুবেই বড় ডোভারের গোড়ায় গিয়ে পৌঁছবে, তারপর পাথরের খাজে খাজে পা রেখে উঠে যাবে চূড়ায়। এবারের হিসেবে কোন ভুল ছিল না, এক ডুব সাঁতারে ঠিক জায়গাতেই এসে পৌঁছল সে।
পানির ওপরে মাথা তুলতে গুহার মত বড় বড় কয়েকটা গর্ত দেখতে পেল-পরিচিত গর্ত। ভাটার সময় জেগে থাকে, এই পথে আসা-যাওয়ার সময় দূর থেকে বহুবার দেখেছে।
পানি থেকে উঠে পড়তে যাচ্ছিল ক্লুবিন, এমন সময় কাছের এক গুহা থেকে নরম, গুড়ের মত দীর্ঘ একটা হাত আচমকা বেরিয়ে এসেই তার কোমর পেঁচিয়ে ধরল।
ভীষণ ঠাণ্ডা একটা হাত! পরমুহূর্তে হ্যাঁচকা টান পড়ল কোমরে, চোখের পলকে তাকে গুহার ভেতরে টেনে নিয়ে গেল ওটা। ঠিকমত কিছু বুঝে ওঠার বা আত্মরক্ষার জন্যে কিছু করার বিন্দুমাত্র সুযোগও পেল না। যুবক, শেষ মুহূর্তে কেবল একটা চিৎকার করতে পেরেছিল কোনমতে।
কিন্তু দুর্ভাগ্য ক্লুবিনের, কারও কানে গেল না তার আতঙ্কিত মরণ চিৎকার।
নয়
রেভারেন্ড কড্রেকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করে বন্দরে ফিরে এল গিলিয়াত। লোকটা নিজের পথে চলে যেতে সে-ও বাড়ির দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিল, এমন সময় দুঃসংবাদটা শুনতে পেল-লেতিয়ারির সাধের দুরান্দ সাগরে ডুবে গেছে।
একটু আগেই খবরটা পাওয়া গেছে-ঝড়ে বিধ্বস্ত দুরান্দ থেকে কোনমতে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা নাবিক-যাত্রীদের মুখ থেকে। মনটা খারাপ হয়ে গেল গিলিয়াতের। ঘটনা সম্পর্কে ভাল করে খোঁজ-খবর নেয়ার জন্যে লেতিয়ারির বাড়ির দিকে এগোল ও।
দূর থেকেই সেখানে অনেক মানুষের জটলা দেখতে পেল ও। রীতিমত ভিড় জমে গেছে বাড়িটার সামনে-ভেতরে। খবর শুনে বন্দরের চেনা-অচেনা অনেকেই এসেছে বৃদ্ধকে সহানুভূতি জানাতে, বিস্তারিত জানতে।
নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া জাহাজটির নাবিক যাত্রীরাও আছে তার মধ্যে, তাঙরুল ছাড়া অবশ। পায়ে পায়ে বাড়ির ভেতরে যাওয়ার জন্যে এগোল গিলিয়াত, ভিড় ঠেলে ঢুকে পড়ল সামনের ঘরে। প্রচুর মানুষ সেখানে, পা রাখার জায়গা নেই।
প্রথমেই দেরুশেতের ওপর চোখ পড়ল ওর। ঘরের এক মাথায় চেয়ারে বসে আছে ও পাথরের মূর্তির মত, দুগাল বেয়ে দরদর করে পানি ঝরছে। লেতিয়ারি রয়েছে ওর এক পাশে। দেয়ালে হেলান দিয়ে সামনের জটলার দিকে ফ্যা ফ্যা করে তাকিয়ে আছে সে।
হ্যাট ভুরু পর্যন্ত নামানো। তলা দিয়ে দীর্ঘ, কাঁচাপাকা কিছু চুল বেরিয়ে আছে, বাতাসে মৃদু মৃদু দুলছে। তার হাত দুটো নিজীবের মত ঝুলছে দেহের দুপাশে। দাঁড়াবার মধ্যে শিথিল, গা ছাড়া একটা ভাব। দেখে মনে হয় বোধবুদ্ধি পুরোপুরি লোপ পেয়েছে মানুষটার।
তা পাওয়ারই কথা। দুরান্দ নেই, দুরান্দের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় আর কখনও সতৃষ্ণ নয়নে সাগরের দিকে তাকিয়ে দিন গুণতে হবে না, এত বড় রূঢ় এক বাস্তব কি করে মেনে নেয়া সম্ভব লেতিয়ারির পক্ষে? জীবনের বাকি দিনগুলো তাহলে কি নিয়ে কাটাবে সে?
এই বয়সে তার পক্ষে নতুন করে আর কিছু কি করা সম্ভব? রাতাগের বিশ্বাসঘাতকতার পর শেষ সম্বল যা ছিল, তাই দিয়ে দুরা গড়েছিল লেতিয়ারি। ওটাই ছিল তার জীবন ধারণের একমাত্র অবলম্বন। দুরান্দ না থাকার অর্থ হলো লেতিয়ারির আয় রোজগার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ এখন স্রেফ পথে বসতে হবে তাকে! এই ধরনের হাজারো চিন্তা হতবা, স্থবির করে তুলেছে লেতিয়ারিকে। স্তব্ধ হয়ে নাবিক ও যাত্রীদের মুখে নিজের প্রিয় দুরান্দের ধ্বংসের বর্ণনা শুনছে সে।
সেটা মোটামুটি এরকম : আগের দিন দুপুরের পর ঘন কুয়াশায় দিক ভুল করে ডোভার পাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে দুরান্দ। প্রচণ্ড ধাক্কায় দুরান্দের খোলর
একদিক একেবারে চুরমার হয়ে গেছে।
প্রথমে অবশ্য এটাকে হ্যাঁনওয়ে ভেবেছিল সবাই। কারণ। কুয়াশা এত ঘন ছিল যে কেউ ঠিকমত চিনে উঠতে পারেনি জায়গাটা। তাছাড়া ওটা যে ডোভার হতে পারে, সে কথা কেউ ভাবেইনি। ভাবার কোন কারণও ছিল না। কেননা সেইন্ট ম্যালো-স্যামসন রুট থেকে ডোভার অনেক দূরে!