এদিকে আঁধারও হয়ে এসেছে, আর দেরি করা যায় না। সাগরের যে অবস্থা, তীরে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত অনেক হয়ে যাবে হয়তো।
কোমরের বেল্টটা আরেকটু কষে বেঁধে নিয়ে পানিতে নামার জন্যে প্রস্তুত হলো ক্লুবিন। তখনই জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হলো তাকে।
হঠাৎ করে সামনের কুয়াশার পর্দার মাঝে বড় একটা ফাঁক সৃষ্টি হলো। চারদিকের অনেকদূর পর্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠল চোখের সামনে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে সামনে তাকাল ক্লুবিন। পরক্ষণে চোখের সামনে অবিশ্বাস্য দৃশ্যটা দেখে ভীষণ এক ঝাঁকি খেল।
এ কি! এ কোথায় এসে পড়েছে সে? কোথায় হ্যাঁনওয়ে পাহাড়, এ যে ডোভার পাহাড়! তাইতো! ওই তো সামনেই সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে নাবিককূলের ত্রাস, ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক সেই স্কেলিটন! এত কঠিন এক বিস্ময় হজম করতে অনেক সময় লেগে গেল কবিনের, বারবার আপাদমস্তক শিউরে উঠতে লাগল। ভয়ে, আতঙ্কে মুখ শুকিয়ে গেছে তার।
সর্বনাশ! এমন কাণ্ড কি করে ঘটল? কি হবে এখন? হ্যাঁনওয়েতেই দুরান্দকে ডুবিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল ক্লুবিন, কিন্তু বেলা দুটোর পর থেকে চারদিক কুয়াশায় এমনভাবে ঢাকা পড়ে গেল যে জাহাজ কোনদিকে যাচ্ছে ঠিকমত বুঝে উঠতে পারেনি।
তাই বলে যে এমন একটা সর্বনাশা কাণ্ড ঘটে যাবে, কে ভেবেছিল? তার মত অভিজ্ঞ এক ক্যাপ্টেন থাকতে জাহাজ সঠিক কোর্স ছেড়ে জাহাজ এত দূরে সরে আসবে, এ কেমন কথা? এমনটা তো হওয়ার কথা নয়!
তারওপর যাত্রীটি যখন বারবার জোর দিয়ে বলতে লাগল হ্যাঁনওয়ে পাহাড়ই দেখেছে সে, তখন মুখে যাই বলুক, মনে মনে ঠিকই বিশ্বাস করেছিল ক্লুবিন। কারণ হিসেবে তাই হওয়ারই তো কথা ছিল!
তাছাড়া ওই লোকের কথা সে এতটাই বিশ্বাস করেছিল যে সত্যতা ভালমত যাচাই করারও প্রয়োজন মনে করেনি। হিসেবে যে ভুল হতে পারে, সে চিন্তাই মাথায় আসেনি।
হায় হায়! এখন কি হবে? ভুল শোধরাবার আর কোন উপায়ও তো নেই! বোকার মত বারবার বড় ডোভার ও হোট ডোভারের দিকে তাকাতে লাগল সে, ভয়ে কাঁপছে ঠক ঠক করে। হাত-পা অসাড় হয়ে গেছে।
কোথায় গেরানসির উপকূল থেকে এক মাইল দূরের হ্যাঁনওয়ে আর কোথায় বিশ মাইল দূরের বড় ডোভার আর ছোট ডোভার! এরকম মারাত্মক এক ভুল কেমন করে ঘটল তার মত অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেনকে দিয়ে? এভাবেই শেষ হয়ে যাবে তার এত যত্নে গড়া সপ্নসৌধ? তাহলে কি নিষ্ঠুর নিয়তি তার ভাগ্যে তীর থেকে বহুদূরের এই সর্বনাশা পাহাড়ে খিদে আর তেষ্টায় ধুকে ধুকে মরার কথাই লিখে রেখেছিল? ভাগ্যের এ কি নির্মম পরিহাস!
দুরান্দের লাইফবোটটা থাকলেও না হয় একটা আশা ছিল, এখন তো তাও নেই অন্যদেরকে প্রায় জোর করেই ওটা নিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে ক্লুবিন।
এক মাইল দূরে তীর, সেই আশায় বোট বেয়ে চলেছে লোকগুলো-খাবার পানি কিছুই নেই সঙ্গে। এক সময় আসল ব্যাপার যখন ধরতে পারবে লোকগুলো, তখন কি হবে কে জানে! নিশ্চয়ই চরম হতাশায় ভেঙে পড়বে মানুষগুলো।
খিদে তেষ্টা ঝড় আর অসহনীয় শীত, এতগুলো দুর্লজ্ঞ বাধা জয় করে বিশ মাইল উন্মত্ত সাগর ওই খুদে বোটে পাড়ি দেয়া কোনদিনও তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না, সে ব্যাপারে ক্লুবিন প্রায় নিশ্চিত।
আর যদি ওরা গেরানসিতে পৌঁছতে না-ই পারে, তাহলে দুরান্দের ক্যাপ্টেনের এখানে আটকে পড়ার খবরও বাইরের পৃখিবীর কেউ কোনদিন জানতে পারবে না। তথাৎ কেউ আসবে না তার খোঁজে।
তাহলে কি উপায় হবে ক্লুবিনের? বাইরের সাহায্য ছাড়া কি ভাবে লোকালয়ে ফিরবে সে? এখানকার চরম বিরূপ আবহাওয়ায় একজন মানুষের পক্ষে কতদিন টিকে থাকা সম্ভব?
এদিক-ওদিক তাকাল সে আশা নিয়ে। যতদূর দেখা যায় অসীম পানি আর পানি ছাড়া কিছুই নেই কোথাও। এখানে কোনরকম সাহায্যের আশা করা বৃথা বুঝতে পেরে ধপ করে দুরান্দের দোদুল্যমান ডেকের ওপর বসে পড়ল সে।
একটু পর বাতাসের বেগ আরও কিছুটা বাড়তে কুয়াশার পর্দা পুরোপুরি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল, একেবারে দিগন্তরেখা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পেল ক্লুবিন। সাথে সাথে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল নতুন এক সম্ভাবনার কথা ভেবে।
সাগরে কুয়াশার সময় দুর্ঘটনা এড়াতে সব জাহাজই নোঙর ফেলে অপেক্ষা করে, কুয়াশা কেটে গেলে আবার যাত্রা করে। কপাল ভাল থাকলে সেরকম একটা জুটে যেতেও পারে ভেবে রেলিঙের কাছে এসে দাঁড়াল ক্লুবিন, সামনে তাকিয়ে থাকল।
যা ভেবেছিল ঠিক তাই ঘটল। বেশ কিছুক্ষণ পর অনেক দূরে, দিগন্তরেখার কাছে একটা জাহাজের মাল চোখে পড়তে আনন্দে মন নেচে উঠল তার। পুর্ব থেকে পশ্চিমে, অর্থাৎ এদিকেই আসছে সেটা।
আধ ঘণ্টার মধ্যে ডোভারের কাছ দিয়ে যাবে। আনন্দে হেসে উঠল ক্লুবিন। মনে মনে বলল, এবারের মত বোধহয় বেঁচে গেলাম। পরমুহর্তে ব্যস্ত হয়ে উঠল সে। কি ভাবে জাহাজটার ক্যাপ্টেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়, তাই নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করল।
দুই ডোভারের মাঝে আটকাপড়া আধা ডুবন্ত দুরান্দ এমনিতে ওটা কারও চোখে পড়বে না, সে ব্যাপারে ক্লুবিনের কোন সন্দেহ নেই। কাজেই যাতে পড়ে, সে জন্যে কিছু একটা করতে হবে। কি করা যায়?
নিজেকে প্রশ্ন করল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত বড় ডোভারের চূড়াটাকেই সমস্যার একমাত্র সমাধান মনে হলো তার। কোনমতে যদি ওখানে একবার উঠতে পারে সে, তাহলে বিপদ কেটে যাবে।