তাঙরুলের দিকে তাকাল সে। সহজ, স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, যাও তাঙরুল, মনে কোন দুঃখ রেখো না। আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। একটু থেমে গলা চড়িয়ে বলল, আমি আদেশ করছি, নৌকা ছেড়ে দাও। তীরের দিকে যাত্রা করো এখনই। বিদায়, বন্ধুরা! বিদায়!
ক্যাপ্টেনের নামে ঘন ঘন জয়ধ্বনি করতে লাগল আরোহীরা। ক্যাপ্টেন ক্লুবিন, দীর্ঘজীবী হোন! অন্ধকার ইংলিশ চ্যানেলের বুক কেঁপে উঠল তাদের চিৎকারে।
বড় বড় ঢেউয়ের মাথায় দোল খেতে খেতে জাহাজের গা থেকে সরে গেল লাইফবোট, ঘুরে উপকূল লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতে লাগল ধীর গতিতে। দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল ওটা কুয়াশা আর অন্ধকারের মধ্যে।
দুরান্দের ডেকে সম্পূর্ণ একা দাঁড়িয়ে আছে ক্লুবিন, সাগরের গভীর থেকে ফুলেফেঁপে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা ঢেউয়ের ভয়াবহ রূপ দেখছে অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে। মনে হচ্ছে চারদিকে একটু পরপর হাজারটা কামান একযোগে হুঙ্কার ছাড়ছে যেন।
ভয়াবহ ক্রুদ্ধ গর্জনের সাথে অসীম দিগন্তের পাণে ছুটে চলছে সাগর।
আট
হঠাৎ করে আরও ঘন হয়ে উঠল কুয়াশা, ক্লুবিনের চোখের সামনে কে যেন আচমকা একটা পুরু পর্দা ঝুলিয়ে দিল। কিছু দেখতে পাচ্ছে না। পেলে কলজের পানি শুকিয়ে জমাট বেঁধে যেত তার।
পাহাড় সনাক্তকারী যাত্রীর মত তারও দৃঢ় বিশ্বাস ছিল দূরান্দ সত্যি সত্যি হ্যাঁনওয়ের কোন জুবো পাহাড়েই ধাক্কা খেয়েছে। হ্যাঁনওয়ের সাথে খুব ভাল পরিচয় ছিল ক্লুবিনের।
পাহাড় থেকে উপকূলের দূরত্ব মাত্র এক মাইল, জানে সে। এইটুকু পথ সঁতরে পাড়ি দেয়া তার জন্যে কোন ব্যাপারই নয়। সব সময় কোমরে একটা চওড়া চামড়ার বেল্ট পরে থাকত ক্লুবিন, শার্টের নিচে ঢেকে রাখত। সেটার বাকলে তার নাম খোদাই করা আছে।
টাকা-পয়সা রাখার কয়েকটা বিশেষ খোপও আছে তাতে, নিজের যাবতীয় সঞ্চয় সব সময় তার একটার মধ্যে রাখে সে। রাতাগের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া পঁচাত্তর হাজার ফ্ৰাসহ তার লোহার মানিব্যাগটাও আছে ওটার অন্য এক খোপে।
সেইন্ট ম্যালোর নির্জন সৈকতে যেদিন জুয়েলা-রাতাগকে শলা পরামর্শ করতে দেখল ক্লুবিন, সেদিনের সেই মুহূর্তেই আজকের এই অদ্ভুত জাহাজডুবী নাটকের পরিকল্পনা তার মনের মধ্যে গেড়ে বসে।
মনে মনে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দেয় সে। শেষ পর্যন্ত সফলও হয়েছে, একটা নয়, এক ঢিলে চার-চারটা পাখি মেরেছে ক্লুবিন।
এক, কায়দা করে একদম উপযুক্ত জায়গায় জাহাজডুবী ঘটিয়েছে, দুই, আত্মাহুতি দিয়ে নিজের ক্যাপ্টেনের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছে, তিন, সবার অলক্ষে দুরান্দ থেকে কেটে পড়া এখন কিছু সময়ের ব্যাপার মাত্র, এবং চার, রাতাগের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া পঁচাত্তর হাজার ফ্রাঁর সদগতি-সেটাও হতে কোন বাধা নেই এখন।
কিছুক্ষণ পর জোয়ার হলো সাগরে। পানির সাথে বাতাসের তেজও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। দেখতে দেখতে প্রচণ্ড ঝড়ও শুরু হয়ে গেল। বাতাস আর পানির চাপে ঘন ঘন আড়মোড়া ভাঙতে শুরু কবল দুরান্দ। সেই সাথে গোঙাচ্ছে অনবরত।
কিছু সময় এভাবেই চলল, তারপর আগের অবস্থান ছেড়ে একটু একটু করে সরে এল ওটা। খানিকটা দূরের অন্য দুই পাহাড় চূড়ার মধ্যে নতুন করে আটকালো। বেশ ভালভাবেই আটকেছে এবার। তাই দেখে খুশি হলো ক্লুবিন। এখন আর সহজে ডুবছে না জাহাজ, কাজেই তারও তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। নৌকাটা আরও দূরে সরে যাক।
তারপর ধীরেসুস্থে আর যাবেই বা কতদূর ওটা? ভাবল ক্লুবিন। যে ভীষণ ঝড় শুরু হয়েছে, তাতে ওইটুকু নৌকা ডুবে যেতে বেশি সময় লাগবে না। তাই যাক, তারপর নিশ্চিন্তে যাত্রা করতে পারবে তাহলে ক্লুবিন। এই সামান্য পথ পাড়ি দিতে কতক্ষণই বা লাগবে তার! বড়জোর এক ঘন্টা।
ঠিক করা আছে, প্রথমে সঁতরে তীরে গিয়ে প্লইমো গ্রামে উঠবে সে, সেই পোড়োবাড়িতে আশ্রয় নেবে। তাতে কোন সমস্যা হবে না। কারণ একে ঝড়ো আবহাওয়া, তারওপর সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত গম্ভীর হয়ে যাবে, অন্ধকারে কারও চোখে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকবে না।
প্রাইমোয় পৌঁছে শুকনো কাপড়চোপড় পরে কিছু খেয়ে নেবে সে, তারপর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে বসবে। তবে প্রয়োজনের বেশি এক মুহূর্তও প্রাইমোতে থাকার ইচ্ছে নেই ক্লুবিনের। কারণ ওই পোড়াবাড়িটা হলো চোরাচালানীদের আড্ডাখানা। তাদের মধ্যে পরিচিত কেউ ওখানে থাকলে সমস্যা, ক্লুবিনকে চিনে ফেলতে পারে।
তাহলে তার এত যত্নের প্ল্যান মাঠে মারা যাওয়ার আশঙ্কা আছে। বরবাদ হয়ে যেতে পারে সব। কিন্তু ক্লুবিন তা কিছুতেই হতে দিতে পারে না।
কয়েকদিনের মধ্যে একদল স্প্যানিশ নাবিক জাহাজে করে চোরাই মালপত্র নিয়ে প্রাইমোয় আসবে বলে খবর পেয়েছে সে। এদিকের কাজ সেরে দক্ষিণ আমেরিকায় যাওয়ার কথা তাদের। টাকা পেলে তাকেও নিশ্চয়ই নিয়ে যাবে।
একবার যেতে পারলে হয়, তারপর আর কে পায় তাকে? নতুন একটা নাম, নতুন একটা পরিচয় নিয়ে নতুন কোন দেশে আবার জীবন শুরু করবে ক্লুবিন। টাকা তো আছেই সাথে, আর চিন্তা কি? ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠল সে। মনটা আনন্দে নাচছে তার থেকে থেকে।
ভাগ্যের চাকা এমন অপ্রত্যাশিতভাবে ঘুরে যাবে, কদিন আগেও কি কল্পনা করতে পেরেছিল ক্লুবিন?
স্বপ্নের ঘোর ভাঙতে সচকিত হলো সে। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, নৌকাটা নিশ্চয়ই অনেক দূরে চলে গেছে এরমধ্যে। অথবা কে জানে, ডুবেই গেছে হয়তো!