লোকটা দুরান্দের এনজিনম্যান। ক্লুবিনের সামনে এসে বেদম হাঁপাতে লাগল সে। ক্যাপ্টেন, ক্যাপ্টেন! সর্বনাশ হয়ে গেছে, ক্যাপ্টেন!
কি হয়েছে? ধমক মেরে উঠল ক্লুবিন।
জাহাজের তলা জাহাজের তলা ফেটে গেছে, ক্যাপ্টেন! অনেকখানি। এনজিনরুমে স্রোতের মত পানি ঢুকছে। আগুন নিভে যাবে যে কোন মুহূর্তে।
কারও বুঝতে বাকি রইল না দুরান্দের ভাগ্যে কি ঘটেছে ডুবো পাহাড়ের চূড়ায় বেকায়দারকম ধাক্কা খেয়ে তলা ফেটে গেছে ওটার। সেই ফাটল দিয়ে হুড়মুড় করে পানি ঢুকছে ভেতরে।
এদিকে চারদিক আঁধার করে রাতও ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে, তারওপর ঘন কুয়াশা। কোনদিকে নজর চলে না। এই অবস্থায় কপালে কি আছে, কাউকে তা বলে দেয়ার দরকার পড়ে না।
মাঝসাগরে ডুবন্ত জাহাজের ডেকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেল সবাই। বোধবুদ্ধি পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে।
ওদিকে জাহাজ ধাক্কা খেতে তাঙরুলের নেশা কেটে গেছে। পরিস্থিতি বুঝে নিতে বেশি দেরি হলো না তার। সামলে নিয়ে কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক তাকাল সে ফ্যালফ্যাল করে, তারপর পায়ে পায়ে এনজিনরুমের দিকে এগিয়ে গেল।
একটু পর উদ্বিগ্ন চেহারায় ফিরে এসে মিনমিনে গলায় বলল, খোলের ভেতরে খুব বেগে পানি ঢুকছে, ক্যাপ্টেন। মনে হয় দশ মিনিটের মধ্যে ডেকে উঠে আসবে।
এ কথা শুনে নাবিক-যাত্রী প্রত্যেকে ভয়ে বেদিশা হয়ে উঠল, পাগলের মত অর্ধহীন ছোটাছুটি শুরু করে দিল দুরান্দের এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত। যখন হুশ ফিরছে; বুঝতে পারছে এভাবে পালিয়ে বাঁচা যাবে না, তখন কিছুক্ষণের জন্যে থেমে এদিক-ওদিক তাকায়।
তারপর আবার সেই চিৎকার-চেঁচামেচি, দৌড়-ঝাঁপ। অবস্থা বেগতিক বুঝে লোকগুলোকে আশ্বস্ত করার জন্যে এক জায়গায় জড়ো করল ক্লুবিন। সবাই এসে তাকে ঘিরে দাঁড়াতে নিগ্রো লোকটাকে জিজ্ঞেস করল সে, এনজিন আর কতক্ষণ চালু রাখা যাবে?
বড়জোর পাঁচ-ছয় মিনিট, ক্যাপ্টেন জবাব দিল লোকটা। তার বেশি না।
গেরানসির সেই যাত্রীর দিকে ফিরল ক্লুবিন। লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, আমি তো হাল ধরা অবস্থায় ছিলাম, ঠিকমত দেখতে পাইনি। আপনি পাহাড়টা দেখেছিলেন, না?
হ্যাঁ, ক্যাপ্টেন, মাথা ঝাঁকাল লোকটা। একদম স্পষ্ট দেখেছি। সেই জন্যেই তো আপনাকে তখন বারবার সতর্ক করেছিলাম, কিন্তু আপনি আমার কথায় কান দেননি। আমার কথা যদি শুনতেন …।
এ অভিযোগের কোন উত্তর দিল না ক্লুবিন। একটু সময় ভাবল, তারপর মৃদু গলায় বলল, এখান থেকে উপকূল কতদূর হবে মনে হয়?
মাইলখানেকের মত।
দুরান্দের খোলর ভেতরে ছিল এক পাল গরু-ছাগল, হঠাৎ করে সেগুলো ভীত সন্ত্রস্ত গলায় চেঁচামেচি শুরু করে দিতে ওপরেও ব্যস্ত হয়ে উঠল সবাই। নিশ্চয়ই পানি ঢুকে পড়েছে ওগুলোর প্রকোষ্ঠে।
তাকে ঘিরে থাকা আতঙ্কিত মুখগুলোর দিকে অনিশ্চিত দৃষ্টিতে তাকাল ক্লুবিন। কিছুসময় ভাবল কি যেন। তারপর চড়া গলায় নির্দেশ দিল, তাড়াতাড়ি পানিতে নামাও লাইফবোট! আর দেরি করা যায় না।
নির্দেশ পাওয়ামাত্র ব্যস্ত হয়ে উঠল প্রতিটা নাবিক-যাত্রী, হুড়োহুড়ি করে বোটটা নামানো হলো পানিতে। ঠিক তখনই থেমে গেল এনজিনের শব্দ, আগুন নিভে গেছে। অর্থাৎ আর বেশি দেরি নেই জাহাজ ডুবতে।
দ্বিতীয়বার নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে তাড়াতাড়ি লাইফবোটে নেমে গেল দুরারে সাধারণ দুই যাত্রী, তারপর নামল নাবিকেরা। এরমধ্যে নিজের কেবিন থেকে জাহাজের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজপত্র ও কম্পাসসহ অন্যান্য দামী যন্ত্রপাতি একটা থলেতে বেঁধে নিয়ে এসেছে ক্লুবিন। থলেটা নিগ্রো মেশিনম্যানের হাতে তুলে দিল সে।
এটা নিয়ে যাও সাথে করে। লেতিয়ারিকে দিয়ো। যাও, তাড়াতাড়ি বোট ছেড়ে দাও।
ক্যাপ্টেনের কথা শুনে ভীষণ অবাক হলো সবাই, একযোগে চেঁচামেচি শুরু করে দিল। কি বলছেন? আপনি আমাদের সাথে যাচ্ছেন না?
মুখ খোলার আগে রেলিঙের ওপর দিয়ে ঝুঁকে নিচে তাকাল ক্লুবিন, দেখল পাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে জাহাজের একদিকের খোল একেবারেই চুরমার হয়ে গেছে। তবে এখনই ডুববে না দুরান্দ, জুবো চুড়ায় আটকে গেছে বলে সময় লাগবে।
আবহাওয়ার যে অবস্থা, তাতে ঝড় উঠবে যে কোন সময়ে, আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে সাগর, পাহাড় সমান একেকটা ঢেউ উঠতে শুরু করবে।
তখন কি ঘটবে জানা কথা। ঢেউয়ের আঘাতে অনবরত পাহাড়ে আছাড় খেতে খেতে গোটা জাহাজ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
না, শান্ত কণ্ঠে বলল সে। আপনারা চলে যান।
সে কি! কেন? কেউ একজন বলল।
আমি কোথাও যাচ্ছি না। জাহাজেই থাকছি।
সবাই ভাবল বোটে এতজন মানুষ ধরবে না বলেই হয়তো এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্যাপ্টেন, তাই একযোগে চেঁচামেচি শুরু করে দিল তারা। সমস্বরে বলতে লাগল, না, না, ক্যাপ্টেন! তা কেন করতে যাবেন আপনি? চলে আসুন। বোটে আরেকজনের জায়গা ঠিকই হয়ে যাবে।
তাঙরুল বলল, আপনার কি দোষ, ক্যাপ্টেন? আপনি জাহাজে থেকে কেন আত্মাহুতি দিতে চাইছেন? দোষ যদি কারও হয়ে থাকে, হয়েছে আমার। সে জন্যে শাস্তি তো আমারই হওয়া উচিত। আমাকে যা খুশি শান্তি দিন, তবু আপনি চলে যান।
না, তা হয় না, তাঙরুল ক্লুবিন দৃঢ় কণ্ঠে বলল। এই অবস্থায় ক্যাপ্টেন হয়ে আমি নিজের জাহাজ ছেড়ে যাই কি করে? জাহাজের ভাগ্যে যা ঘটে, ক্যাপ্টেনের ভাগ্যেও তাই ঘটা উচিত। তাছাড়া দুরান্দের ক্যাপ্টেন তার দায়িত্ব ঠিকমত পালন করেনি, এমন কথা বলার সুযোগ আমি কাউকে দেব না। তোমরা চলে যাও।