সাগর আকাশ সম্পূর্ণ মুছে গেছে চোখের সামনে থেকে। বাতাসেরও নাম-গন্ধ নেই। বৃষ্টি নেই, অথচ তারপরও সবার কাপড়চোপড় ভিজে উঠেছে। এ কেমন আবহাওয়া?
নাবিকদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়তে লাগল সংক্রামক অসুখের মত। মুখে না বললেও চেহারা দেখে তাদের মনের অবস্থা বুঝতে অসুবিধে হয় না-প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে সবাই। ওদিকে ক্যাপ্টেন ক্লুবিন অনেক আগেই তাঙরুলকে সরিয়ে দিয়ে নিজে হাল ধরেছে জাহাজের। রাগ পড়েনি তার, এখনও থেকে থেকে লোকটাকে গালাগাল করে চলেছে।
শয়তান কোথাকার! আমাদের সাথে চালাকি করেছ তুমি! আগে থেকেই আমাদের এই বিপদে ফেলার বুদ্ধি করে রেখেছিলে, কেমন? তোমাকে শেকল দিয়ে বেঁধে ফেলে রাখা উচিত, বদমাশ কোথাকার! যাও, দূর হয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে!
জবাব দেয়া দূরে থাক, মাথাই তুলছে না লোকটা। অপরাধীর মত নতমুখে দাঁড়িয়ে আছে।
তিনটার সময় নিচের দিকের কুয়াশা অনেকটা হালকা হয়ে আসতে দীর্ঘ সময় পর সাগরের দেখা পাওয়া গেল। চারদিকে নীল পানির বিস্তার চোখে পড়তে মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল যাত্রী-নাবিক সবাই।
এক হাতে হাল ধরা অবস্থায় অন্য হাতে দূরবীন তুলে নিল ক্লুবিন, সামনে তাকিয়ে আপনমনে বলল, মাতালটা দেখছি অনেক দূরে এনে ফেলেছে আমাদের। এখন আর এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করা চলবে না।
ওদিকে গেরানসির দুই যাত্রীর একজন জাহাজের একদম মাথায় দাঁড়িয়ে ছিল। নিজের দূরবীন চেখে লাগিয়ে সামনে তাকিয়ে জায়গাটা চেনার চেষ্টা করছিল সে। অনেকক্ষণ পর দূরে, হালকা কুয়াশার মধ্যে হঠাৎ সামান্য আলো ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল দেখে ভয় পেল লোকটা।
এক ছুটে হুইল হাউসে এসে দাঁড়াল সে, ভীত গলায় হড়বড় করে বলল, ক্যাপ্টেন! ক্যাপ্টেন!!
কি ব্যাপার।
আমরা মনে হয় ভুল করে হ্যাঁনওয়ের কাছে এসে পড়েছি।
দূর! হেসে উঠল ক্যাপ্টেন। তা হয় কি করে!
হ্যাঁ, ক্যাপ্টেন, লোকটা জোর দিয়ে বলল। ওটা হ্যাঁনওয়ে পাহাড়ই।
অসম্ভব! রেগে উঠল ক্লুবিন। নিশ্চই ভুল দেখেছেন আপনি। এখন যান এখান থেকে।
কিন্তু সে অনড়। দৃঢ় কণ্ঠে বলল, মোটেই ভুল দেখিনি আমি, ক্যাপ্টেন। হ্যাঁনওয়ের চূড়া একদম স্পষ্ট দেখেছি আমি। ভুল হতেই পারে না।
কই, কোথায় আপনার হ্যাঁনওয়ে? বলল সে। কি এক আনন্দে চোখমুখ মুহূর্তের জন্যে ঝলমল করে উঠল।
সরল মানুষ যাত্রীটি খেয়াল করল না ব্যাপারটা। হাত তুলে জায়গাটা দেখিয়ে দিল ক্যাপ্টেনকে। ওই যে!
দূর! বিরক্ত হওয়ার ভান করে সেদিকেই দুরান্দের গলুই ঘুরিয়ে দিল ক্লুবিন। কি আবোল-তাবোল বলছেন! কোথায় হ্যাঁনওয়ে পাহাড়? আমি তো ওদিকে খোলা সাগর ছাড়া আর কিছুই দেখছি না!
লোকটা কয়েক মুহূর্ত বোকার মত ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর তাড়াতাড়ি হুইল হাউস থেকে বেরিয়ে এসে দূরবীনের কাঁচ পরিষ্কার করে আবার সামনে তাকাল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এল। ভয়ে দুচোখ বিস্ফারিত। ক্যাপ্টেন! ক্যাপ্টেন–
আবার কি হলো? বাঁচতে চাইলে এখনই জাহাজের গলুই ঘুরিয়ে দিন। আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল সে। না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
কেন? নকল বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করল ক্লুবিন।
আমার দেখায় ভুল হয়নি। ওটা হ্যাঁনওয়ে পাহাড়ের চূড়া!
জোরে জোরে মাথা নাড়ল ক্যাপ্টেন। হতেই পারে না আপনি আসলে ঘন কুয়াশার তূপ দেখেছেন।
আতঙ্কে কাঁপতে লাগল লোকটা। জড়ানো গলায় হড়বড় করে বলল, যিশুর কসম করে বলছি, ক্যাপ্টেন, এটা হ্যাঁনওয়ে পাহাড়! এখনও সময় আছে, বাঁচতে চাইলে তাড়াতাড়ি জাহাজ ঘোরান, নইলে আমাদের সবাইকে আজ ধনেপ্রাণে মরতে হবে।
আচ্ছা, আচ্ছা, আপনি যান। আমি দেখছি! এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
কথা শেষ করে যেন লোকটাকে আশ্বস্ত করার জন্যেই হাল একদিকে সামান্য ঘুরিয়ে দিল ক্লুবিন, এর পরপরই কিছু একটার সাথে ভয়াবহ সংঘর্ষ ঘটল দুরান্দের, বো থেকে স্টার্ন পর্যন্ত থরথর করে কেঁপে উঠল।
সামনের দিক থেকে ওঠা কাঠ ভাঙাচোরার বিকট কড়কড় মড়মড় শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে ঝাঁকির পর ঝাঁকি আর হোঁচট খেতে খেতে অনেক কষ্টে একটু একটু করে খানিকটা এগোল ওটা। তারপর গতি পুরোপুরি হারিয়ে একেবারে থেমেই পড়ল শেষ পর্যন্ত। ওদিকে ডেকে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই প্রথম ধাক্কার চোটেই ছিটকে চলে গেছে এদিক-সেদিক।
অনেকক্ষণ পর জাহাজ মোটামুটি স্থির হলো। সাথে সাথে হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল সেই যাত্রীটি। দূরবীন ডেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দুহাত আকাশের দিকে তুলে ধরে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল।
হায়, হায়! আমি ঠিকই বলেছিলাম ঠিকই বলেছিলাম আমি! জাহাজ হ্যাঁনওয়ের ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা খেয়েছে। শেষ হয়ে গেলাম আমরা! হায়, হায়! এখন কি হবে আমাদের।
তার দেখাদেখি অন্যরাও চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছিল, কি ধমক মেরে সবাইকে থামিয়ে দিল ক্লুবিন। চুপ করুন! সবাই চুপ করুন! এত ভয় পাওয়ার মত কিছু ঘটেনি। কেউ শেষ হয়ে যায়নি এখনও।
ডেকে কারও ছুটে আসার ভারী ধুপধাপ্ পায়ের শব্দ উঠতে ঘুরে তাকাল সবাই। দেখা গেল প্রায় নগ্ন এক নিগ্রো নাবিক এনজিন রুমের দিক থেকে বেরিয়ে দৌড়ে আসছে। এমনিতেই মানুষটা কালো, সেই সঙ্গে এনজিনরুমের কালিঝুলি মেখে কিত চেহারা হয়েছে।