পরদিন ক্লুবিনের নির্দেশে যখন হাল ধরল, তখন বলতে গেলে পুরোপুরি মাতাল তাঙরুল। মাথা ঘুরছে তার, পা টলছে, দু-তিনটা করে দেখছে সবকিছু।
আকাশ একদম পরিষ্কার সেদিন। ঝলমল করছে। এক ফোঁটা মেঘও চোখে পড়ছে না কোথাও। পানি কেটে তরভর করে এগিয়ে চলেছে জাহাজ। নির্দিষ্ট গতিপথ ধরে চললেও কিছুক্ষণ পরই জাহাজের আরোহী ও নাবিকদের কারও কারও মনে সন্দেহ দেখা দিল, দুরান্দ সঠিক কোর্সে চলছে না মনে হলো তাদের।
তবে ক্যাপ্টেন ক্লুবিনের ওপর সবার অগাধ আস্থা আছে, তারা জানে সে থাকতে চিন্তার কিছুই নেই। তাই ব্যাপারটা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাল না কেউ। কিন্তু আরও বেশ কিছু সময় পর অনেকেরই আস্থায় চিড় ধরতে শুরু করল।
সেই পুরনো সন্দেহ ফিরে এল তাদের মধ্যে। কারও কারও মনে হলো পথ ভুল করেছে দুরান্দ। গেরানসির দিকে নয়, জারসি দ্বীপের দিকে যাচ্ছে।
ব্যাপারটা কানে যেতে প্রথমে হেসেই উড়িয়ে দিল ক্যাপ্টেন। তার ধারণা, এতবড় ভুল তাঙরুলকে দিয়ে হতেই পারে না। কিন্তু নাবিকরা তো নয়ই, যাত্রীরাও তার ধারণার সাথে একমত হতে পারছে না দেখে একসময় ঘটনা তদন্ত করতে এল সে। দেখল সত্যিই তো! ভুল পথেই তো চলেছে দুরান্দ! তাঙরুলকে খানক বকাঝকা করে জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে ওটাকে গেরানসির সঠিক কোর্সে নিয়ে এল সে। এর ফলে বেশ কিছু সময় অনর্থক নষ্ট হলো। ওদিকে হুইল হাউসে তাঙরুলের নেশা কমার কোন সক্ষণ নেই।
বরং তখনও একটু একটু করে চড়ছে। পা রীতিমত টলছে তার, হাতেও মনে হলো শক্তি পাচ্ছে না সে ঠিকমত। তবে এ নিয়ে তখনই আর কোন কথা উঠল না। একটু পর পর ক্যাপ্টেন নিজে এসে খোঁজখবর নিচ্ছে, কাজেই চিন্তা কিসের?
দুপুরে খাবারের ঘণ্টী বাজতে সবাই খেয়ে নিল, খেল না কেবল ক্লুবিন। ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে তাকে, চোখেমুখে অস্বাভাবিক একটা ভাব। যেন কিছু একটা ঘটার প্রতীক্ষায় অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে মানুষটা।
খেয়েদেয়ে গল্প করছে জাহাজের নাবিক ও যাত্রীরা, এমন সময় হুইল হাউস থেকে ক্যাপ্টেনের চিৎকার ভেসে এল, বেরিয়ে যাও, মাতাল কোথাকার!
কৌতূহলী হয়ে পায়ে পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল সবাই। দেখতে পেল ভেতরে তাঙরুলের সামনে কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাপ্টেন, রাগে তার দুচোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসার জোগাড়।
ওদিকে নেশাগ্রস্ত হলেও নিজের অপরাধ সম্পর্কে তাঙরুলকে ভালই সচেতন মনে হলো তাদের। ধমক খেয়ে ক্লুবিনের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা ব্যাপার বুঝতে না পেরে সবাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। তখনই আচমকা অন্য এক ঘটনা ঘটল। দেখতে দেখতে ঘন কুয়াশায় ছেয়ে গেল আকাশ, উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে কুয়াশার বিশাল এক মেঘ দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগল দুরান্দের দিকে।
তাই দেখে ভয় পেয়ে গেল অনেকেই। কিন্তু ক্লুবিনকে মোটেও বিচলিত হতে দেখা গেল না। নাবিকদের নির্দেশ দিল সে, এনজিনে বেশি করে কয়লা ভরে স্টীম বাড়িয়ে দাও!
বেশ কিছুক্ষণ কুয়াশার মেঘটার ধার ঘেঁষে চলল দুরান্দ, তারপরই চরদিক থেকে খুব দ্রুত এগিয়ে এল মেঘ, দুরান্দকে ঘিরে ধরল চারদিক থেকে। সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলল। একটা অদ্ভুত কালো চাদর যেন মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বচরাচর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দিল ওটাকে।
কোনদিকেই কিছু দেখার উপায় রইল না। ভয়ে মুখ শুকিয়ে উঠল প্রত্যেকের। প্রথম ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই এল দ্বিতীয় ধাক্কা, হঠাৎ শীত শীত অনুভূতি হলে সবার। ব্যাপার ঠিকমত বুঝে ওঠার আগে শীতে কাঁপুনিই উঠে গেল।
অসহ্য ঠাণ্ডায় হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে গরম কাপড়ের খোঁজে যে যার আশ্রয়ের দিকে ছুটল মানুষগুলো। খানিক পর চারদিকের পরিবেশে কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এল হঠাৎ করে। সাগরের সমস্ত আলোড়ন যেন অদৃশ্য কোন হাতের ইশারায় থমকে গেছে। এনজিনের ধুক ধুক ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
ঘন কালো বিশাল মেঘের পাহাড়টার মধ্যে দিয়ে অজ্ঞাত ভয়ে অন্ধের মত পড়িমরি করে ছুটে চলেছে দুরান্দ। ভোঁশ ভোশ করে ধোয়া বেরোচ্ছে চোঙ থেকে। অকল্পনীয়, ভৌতিক একটা দৃশ্য।
স্টীম খুব বেশি খরচ হচ্ছে, ক্যাপ্টেন, নাবিকদের একজন সাহস করে বলল। তারওপর এত কুয়াশা, আমার মনে হয় এ সময় আর এখোনো ঠিক হবে না। কোথাও নোঙর ফেলে অপেক্ষা করলেই বোধহয় ভাল হতো।
তার উপায় নেই, ক্লুবিন জবাব দিল। এই মাতালটার জন্যে যে সময় নষ্ট হয়েছে তা পূরণ করতে হবে না?
আগের মত পূর্ণ গতিতেই ছুটতে থাকল দুরান্দ। ওদিকে কুয়াশায় পথ দেখা যায় না বলে গেরানসির একটা জেলে নৌকা মাঝসাগরে নোঙর ফেলে অপেক্ষা করছিল, একটু পর খুব কাছ দিয়ে ওটাকে পাশ কাটাল দুরান্দ। জেলে লোকটার সন্দেহ হলো জাহাজটার গতিপথ লক্ষ করে।
একটু যেন বেশি পশ্চিম দিকে সরে যাচ্ছে না ওটা? চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকল জেলে। পশ্চিমদিকে যাচ্ছে না? তাই তো! সঠিক কোর্সে চলছে না দুরান্দ।
তাছাড়া এই ঘন কুয়াশার মধ্যে ওটার এরকম পড়িমরি করে ছোটাও খুব অদ্ভুত মনে হলো জেলের। এভাবে অন্ধের মত এগোতে থাকলে যে কোন মুহূর্তে জাহাজ ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়তে পারে, এই সাধারন জ্ঞানটাও ক্যাপ্টেনের নেই নাকি? ভাবছে লোকটা।
বেলা দুটোর পর আরও খারাপের দিকে মোড় নিল আবহাওয়া। কুয়াশা এত ঘন হয়ে উঠল যে কয়েক হাত দূরের জিনিসও ভাল করে দেখা যায় না।