ভণ্ড ক্লুবিন! তুমি যে কত ভাল মানুষ, তা আমার জানা আছে। ওই টাকা তুমি লেতিয়ারিকে কেমন ফেরত দেবে, তাও বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি তোমাকে এত সহজে রেহাই দেবো না, ক্লুবিন! লেতিয়ারিকে সব জানিয়ে চিঠি দিচ্ছি আমি। এই নৌকায় গেরানসির একজন নাবিক আছে, সে সাক্ষী দেবে, আমি তার সমস্ত টাকা সুদে-আসলে তোমাকে বুঝিয়ে দিয়েছি। ওই টাকা তুমি কোনদিনও হজম করতে পারবে না।
কণ্ঠস্বরটা কার, বুঝতে বাকি রইল না ক্লুবিনের।
***
সেদিন অনেক রাতে হোটেলে ফেরার পথে কি মনে করে বাজার থেকে নামী কোম্পানির তৈরি বেশ দামী এক বোতল ব্র্যান্ডি কিনে নিয়ে এল ক্লুবিন। কেউ যাতে দেখে না ফেলে, সে জন্যে বোতলটাকে কোটের নিচে ভরে বেশ সতর্কতার সাথে হোটেলে ঢুকল।
অবশ্য রাত তখন বেশ গভীর বলে দেখার মত তেমন কেউ ছিলও না। ফিরেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে।
পরদিন গেরানসির পথে যাত্রা করবে দুরান্দ, সে জন্যে সমস্ত প্রতি রাতেই নিয়ে রাখতে হবে তাকে।
সাত
গেরানসির দক্ষিণে ছোট একজোড়া পাহাড় আছে, চ্যানেলের মাঝামাঝি জায়গায়, নাম ডোভার পাহাড়। উপকূল থেকে মাইল বিশেক দূরে। পানি থেকে খাড়া আকাশের দিকে উঠে গেছে পাশাপাশি দুই পাহাড়। একটার চূড়া অন্যটার তুলনায় বেশ খানিকটা লম্বা।
সেটার নাম বড় ডোভার, অন্যটার নাম ছোট ডোভার। এই দুই পাহাড়কে ঘিরে রাত-দিন চব্বিশ ঘন্টাই প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাসের মাতামাতি চলে, তার সাথে তাল মিলিয়ে সাগরও সারাক্ষণ উন্মত্ত আচরণ করে এখানে।
পানি আর বাতাসের ভয়াবহ ক্রুদ্ধ গর্জনে কান পাতা দায় ডোভারে। মনে হয় যেন একসাথে হাজারটা কামান থেকে অনবরত গোলা ছোঁড়া হচ্ছে।
সার্বক্ষণিক ঢেউয়ের আঘাতে পাহাড় দুটোর গা ক্ষয়ে ক্ষয়ে সিঁড়ির মত খাজ কাটা ধাপের সৃষ্টি হয়েছে, ক্রমে চূড়ার দিকে উঠে গেছে ধাপগুলো। গোড়ার দিকে বড় বড় গুহাও আছে বেশ কয়েকটা।
গোটা ইংলিশ চ্যানেলে ডোভারের মত বিপজ্জনক জায়গা আর নেই। নাবিকেরা যমের মত ভয় করে ডোভারকে, ওই এলাকার ধারেকাছে ঘেঁষার কথা স্বপ্নেও ভাবে না তারা। একমাত্র সামুদ্রিক পাখি ছাড়া অন্য কোন প্রাণী দেখা যায় না, ডোভারে।
এই দুই পাহাড়ের দুই চূড়াকে দূর থেকে দেখতে লাগে একজোড়া খাড়া গম্বুজের মত। দুই গম্বুজের মাঝখানে খানিকটা ফাঁকা জায়গা আছে। চ্যানেল এমনিতেই সারাক্ষণ ভীষণ বিক্ষুব্ধ থাকে এদিকটায়, দুই ডোভারের মাঝখানে থাকে আরও অনেক অনেক বেশি।
দুটোর মধ্যে দিয়ে সারাক্ষণ প্রচণ্ড ঘূর্ণি, জলোচ্ছ্বাস আর তীব্র স্রোত থাকে, সব মিলিয়ে সাঘাতিক আবহাওয়া ডোভারের। আর স্রোত? সে এক অবিশ্বস্য ব্যাপার-দিশেহারার মত ভয়ঙ্কর গতিতে এদিক-সেদিক ছোটে।
নাবিকেরা জানে ওই ঘূর্ণি আর স্রোতের মধ্যে একবার পড়লে আর রেহাই নেই, পানির আঘাতে ডোভারে আছড়ে পড়ে ছাতু হয়ে যাবে জাহাজ। তাই অনেক পথ ঘুরে ওই এলাকাকে সযতে পাশ কাটিয়ে চলাচল করে তারা। ডোভার পাহাড়ের কাছে আরেকটা পাহাড় আছে, সেটার নাম স্কেলিটন।
শোনা যায়, অনেক বছর আগে এই পাহাড়ের কাছে কোথাও একটা জাহাজডুবী হয়েছিল। সেটার এক নাবিক ভাগ্যক্রমে ভাসতে ভাসতে এই পাহাড়ে এসে ওঠে। কাঁকড়া ইত্যাদি খেয়ে সপ্তাখানেক বেঁচে ছিল হতভাগ্য লোকটা। তারপর যা দটা তাই ঘটল।
এর অনেকদিন পর এক দুঃসাহসী জেলে এদিকে মাছ ধরতে এসে দূর থেকে পাহাড়টার ওপর একটা কঙ্কাল দেখতে পায়। সেই থেকে ওটার নাম স্কেলিটন। সেটাকে ঘিরেও পানি আর বাস একই আচরণ করে।
* * *
শুক্রবার সকাল নটায় সাতজন নাবিক ও দুজন যাত্রী নিয়ে সেইন্ট ম্যালো বন্দর ত্যাগ করল দুরান্দ। খোলা সাগরে পৌঁছে তাঙরুল নামের এক পুরানো, অভিজ্ঞ নাবিকের ওপর জাহাজের হাল ধরার দায়িত্ব দিল ক্লুবিন। নাবিক হিসেবে খুব দক্ষ ছিল লোকটা, কিন্তু মস্ত একটা দোষও ছিল তার।
প্রায় সময়ই মদ খেয়ে বেহেড মাতাল থাকত। তাছাড়া মদ নিয়ে বসলে একেবারে গলা পর্যন্ত না গিলে উঠত না লোকটা। এটা তার বহুদিনের অভ্যাস।
রাতের প্রথমভাগে প্রায়ই ডিউটি অফ থাকত তাঙরুলের। ওই সময়টা ঘুমিয়ে কাটাত সে, তারপর মাঝরাতে উঠে মদের বোতল নিয়ে বসত। এটা ছিল তার নিয়মিত রুটিন। ব্যাপারটা ক্লুবিনের জানা ছিল।
এ-ও ভালই জানত যে সকালের দিকে নেশা বেশ তুঙ্গেই থাকে তাঙরুলের, তবু তার ওপরেই প্রথমদিন দুরান্দের হাল ধরার দায়িত্ব দিল সে। নেশাখোরদের প্রত্যেকেরই নেশা করার নির্দিষ্ট গোপন একটা জায়গা থাকে।
তাঙরুলেরও এরকম একটা জায়গা আছে দুরান্দে। ক্লুবিনের সে খবর জানা ছিল। এবং এই জ্ঞানটাও ভালমতই কাজে লাগিয়েছিল সে।
জাহাজ যাত্রার জন্যে পুরোপুরি প্রস্তুত আছে কিনা, বাপারটা চেক করে দেখতে আগেরদিন অনেক রাতে দুরালে এসেছিল ক্লুবিন। তাঙরুল সে সময় নিজের কেবিনে প্রবল বেগে নাক ডাকাচ্ছে। পরে ঘুম ভাঙতে পান করার নির্দিষ্ট জায়গায় চলে এল সে।
ঘুম ঘুম চোখে সেখানে বড় একটা বোতল দেখে অবাক হলো লোকটা। ব্র্যান্ডি! লেবেল দেখলেই বোঝা যায় ভাল কোম্পানির তৈরি দামী জিনিস। আশ্চর্য, এই জিনিস কি ভাবে এল এখানে? কে আনল? সে তো কখনও ব্র্যান্ডি খায় না!
তার এখানে বাইরের কেউ আসেও না, তাহলে কে আনল এটা? ভাবনা-চিন্তার পিছনে সময় নষ্ট না করে বোতলটার ছিপি খুলে ফেলল সে। ভাল জিনিস গেলার এমন একটা সুযোগ যখন পাওয়াই গেল, সেটা ছাড়া চরম বোকামী হবে। বোতলের আসল মালিক যে কোন সময় হুট করে এসে পড়তে পারে, এই ভয়ে ঢক ঢক করে গিলতে শুরু করে দিল সে। বলতে গেলে এক চুমুকেই সবটা সাবাড় করে নিশ্চিন্ত হলো, বোতল সাগরে ফেলে দিল।