যাকগে সে সব। দশ বছর আগের এক রাতের কথা ভুলে যাওনি নিশ্চই? যে রাতে তুমি লেতিয়ারির সিন্দুক খালি করে সমস্ত টাকা-পয়সা নিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিলে! মনে পড়ে?
তোমার নিজেরও কিছু টাকা ওর মধ্যে ছিল ঠিকই, কিন্তু লেতিয়ারির ছিল পুরো পঞ্চাশ হাজার ফ্রা। দশ বছরে সেই পঞ্চাশ হাজারের সুদ আসে আরও পঁচিশ হাজার, তার মানে সব মিলিয়ে টাকাটা দাঁড়াল পঁচাত্তর হাজারে।
কাল রাতে তুমি যখন বন্দরের টাকা বদলকারীর অফিসে গিয়েছিলে, তখন সেখানে তোমার চেনা এক লোকও ছিল। তাড়াহুড়োয় খেয়াল করোনি তুমি। যা হোক, যখন তুমি ওই অফিস থেকে টাকা বদল করে বেরিয়ে এলে, তখন তোমার ব্যাগে পনেরো হাজারের পাঁচটা নোটে পঁচাত্তর হাজারসহ আরও কিছু খুচরো ঐ ছিল। কাল বোধহয় খুব বেশি তাড়া ছিল তোমার, তাই না, রাতাগ?
তাই কেউ একজন যে অন্ধকারে তোমাকে সারাক্ষণ অনুসরণ করেছে, খেয়ালই করোনি। অবশ্য তোমার তাড়া থাকারই কথা।
তামোলিপার বন্দর ছেড়ে যাওয়ার সবকিছু ঠিকঠাক, তোমাকে সেটায় যে করে তোক উঠতেই হবে। কাজেই আমি অন্তত এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখি না।
একটু থামল ক্লুবিন, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল রাতাগের দিকে। মনে মনে ওজন করছে লোকটাকে। রাতাগও দেখছে। তাকে। চেহারায় পরাজয়ের লক্ষণ সুস্পষ্ট।
কয়েকদিন আগে সী-বীচে ক্যাপ্টেন জুয়েলার সাথে আলাপ করছিলে তুমি, আবার বলতে শুরু করল ক্লুবিন। নিশ্চই পালাবার ফন্দি-ফিকির পাকা করছিলে? দেখো, সে খবরও কিছু অজানা নেই আমার। তার সাথে তোমার যে একটা গোপন চুক্তি হয়েছে, তাও জানা আছে। কি বলো, অবাক হলে?
সাগরের দিক নির্দেশ করল ক্লুবিন। ওই তো তোমার সাধের তামোলিপা দাঁড়িয়ে আছে, মাস্তুল দেখা যাচ্ছে ওটার। তোমার জিনিসপত্র তো আগেই ভোলা হয়ে গেছে ওটায়, তাই না? চুক্তি অনুযায়ী নৌকা নিয়ে জুয়েলার লোকজনও তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছে।
মাথা নাড়ল সে। কিন্তু তোমার দুর্ভাগ্য যে তুমি যেতে পারছ না। যতক্ষণ না আমি তোমাকে যেতে দিচ্ছি। এতক্ষণে তা নিশ্চই বুঝে ফেলেছ! কি বলল, পারছ না?
হাসল ক্লুবিন। মনে তো হয় পারছ। তা তোমাকে ছেড়ে দিতে আমার কোন আপত্তি নেই, রাতাগ। কিন্তু যদি যেতে চাও, তাহলে যা বলি তাই করতে হবে তোমাকে। লেতিয়ারির খোয়া যাওয়া টাকার খোঁজ এত বছর যখন পেলামই, তখন তার কর্মচারী হিসেবে ওগুলো উদ্ধার করা আমার দায়িত্ব।
দাও, দিয়ে দাও টাকাটা। মানিব্যাগ পকেট থেকে বের করে ছুঁড়ে দাও এদিকে। কিন্তু খবরদার! কোনরকম চালাকি করতে যেয়ো না যেন। চালাকি করে আমার হাত থেকে রেহাই পাবে তুমি।
যুবকের নির্দেশ পালন করা ছাড়া কিছু করার উপায় নেই দেখে কিছুক্ষণ অসহায় রাগে ফুঁসল রাতাগ। ভারী মানিব্যাগটা বের করে হতাশ চেহারায় উল্টে-পাল্টে দেখল কিছু সময়, তারপর ছুঁড়ে দিল সেটা।
ক্লুবিনের পায়ের কাছে এসে পড়ল মানিব্যাগ। পিস্তল ধরা হাত এবং নজর লক্ষ্যে স্থির রেখে একটু ঝুঁকে অন্য হাতে ওটা তুলে নিয়ে মৃদু হাসল।
ধন্যবাদ। আরেকটু কষ্ট করো, পিছন ফিরে দাঁড়াও। টাকা হারানোর শোকে কাতর হলেও দেরি না করে সুবোধ বালকের মত তার নির্দেশটা পালন করল রাতাগ, গ্রচণ্ড ক্ষোভে চোখমুখ বিকৃত ঘুরে দাঁড়াল। এই ফাঁকে প্রিঙে চাপ দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি ব্যাগটা খুলল ক্লুবিন, ভেতরে চোখ বুলিয়ে সম্ভষ্ট হয়ে মাথা দোলাল। আছে টাকাগুলো।
লেতিয়ারির পঁচাত্তর হাজার তো আছেই, বরং আরও কিছু বেশিই আছে। প্রতিটা পনেরো হাজার মূল্যমানের মোট পাঁচটা নোট রেখে বাকি টাকাগুলো ব্যাগ থেকে বের করল ক্লুবিন, বন্ধ করল ওটা।
ঠিক আছে, রাতাগ। এবার এদিকে ফিরে দাঁড়াতে পারো। লোকটা ঘুরে দাঁড়াতে আবার বলল, তোমাকে আগেই বলেছি আমি কেবল লেতিয়ারির প্রাপ্য পঁচাত্তর হাজার স্ট্রা চাই। তার এক পয়সাও বেশি চাই না। এই নাও বাকিটা।
পায়ের কাছে পড়ে থাকা এক খণ্ড পাতলা টিন দিয়ে নোটগুলো মুড়ে রাতাগের দিকে ছুঁড়ে মারল সে। গড়িয়ে গড়িয়ে তার পায়ের কাছে গিয়ে থামল দলাটা। নিরাসক্ত চোখে সেদিকে একপলক তাকাল বৃদ্ধ, তারপর এক লাথিতে সাগরে ফেলে দিল সব টাকা।
যাক, তোমার টাকা-পয়সার বিশেষ প্রয়োজন নেই দেখে খুশি হলাম, ক্লুবিন বলল। বোঝা যাচ্ছে নিজের অবস্থার বেশ উন্নতি ঘটিয়েছ তুমি এই কবছরে, কি বলল? তবে আমি কিন্তু আমার কথা রেখেছি।
তোমার ভাগ থেকে এক ফ্রা-ও নিইনি আমি। এবার যাও তাহলে, রাতাগ। তামোলিপার ক্রুদের কথা শোনা যাচ্ছে, ওরা তোমার দেরি দেখে অস্থির হয়ে পড়েছে মনে হয়। যাও, রাতাগ। বিদায়।
শেষবারের মত কিছুক্ষণ আগুনঝরা চোখে ক্লুবিনের দিকে তাকিয়ে থাকল লোকটা, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে পাথরের বাড়ানো হাত ধরে শ্লথ গতিতে হাঁটতে লাগল। আর একবারও পিছন ফিরে তাকাল না।
এক সময় চোখের আড়ালে চলে গেল সে, আরও খানিক পর পানিতে বেশ কয়েকটা বৈঠার ঝপাঝপ শব্দ শুনতে পেল ক্লুবিন। নিহত গার্ডের দূরবীনটা কাছেই পড়ে থাকতে দেখে কাছে গিয়ে সেটা তুলে নিল।
ওটা চোখে লাগিয়ে নৌকাটার দিকে তাকাল। ঢেউয়ের মাথায় চড়ে নাচতে নাচতে বেশ দ্রুত গভীর সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চলেছে ওটা। একটু পর চ্যানেলের গর্জন ছাপিয়ে একটা কণ্ঠস্বর কানে এল তার।