পিছনের লোকটা যেন এরকম এক মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। চোখ দুটো মুহূর্তের জন্যে জ্বলে উঠল তার। মুহূর্তে উঠে দাঁড়িয়েই দুজনের মাঝখানের বাকি হাত কয়েকের ব্যবধান এক লাফে পেরিয়ে এল সে, তারপর পিছন থেকে প্রচণ্ড এক ধাক্কা মারল লোকটাকে।
মরার আগে চিৎকার করারও সময় পেল না রক্ষী, খাড়া কিনারা থেকে চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল। শূন্যে হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে অনেক নিচের সাগরে পড়েই তলিয়ে গেল সে। দূরবীনটা পড়ে থাকল জায়গায়।
এদিকে সাফল্যের বীভৎস আনন্দে বিকট হাসিতে ফেটে পড়ল হত্যাকারী। কিন্তু হাসিটা পুরো করতে পারল না সে, তার আগেই পিছনে এক জোড়া পায়ের চাপা শব্দ উঠল। গম্ভীর কণ্ঠে ডেকে উঠল কে যেন, হ্যালো, রাতাগ!
চমকে উঠে ঘুরে তাকাল প্রথমজন। মাত্র কয়েক হাত পিছনে ছোটখাট এক যুবককে পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ কুঁচকে উঠল তার। এক মুহূর্ত মাত্র, তারপরই আবার হেসে উঠল সে, পিস্তলধারীকে চিনতে পেরেছে।
ক্লুবিন!
চিনতে পেরেছ তাহলে?
পারিনি আবার? তিক্ত, কিছুটা বিরক্ত কণ্ঠে বলল বয়স্ক লোকটা। খুব চিনেছি!
সাগরের দিক থেকে দ্রুত দাঁড় টানার শব্দ শোনা যাচ্ছে, তীরের মাথার কাছে এসে পড়েছে নৌকা। ওটার যাত্রীদের চড়া গলার কথাবার্তার আওয়াজও শোনা যাচ্ছে। তাদের গলা শুনেই বোধহয় কিছুটা ব্যস্ত হয়ে উঠতে দেখা গেল রাতাগকে।
আমার কাছে কি চাও তুমি, ক্লুবিন? বলল লোকটা।
কি চাই? বাঁকা হাসি ফুটল ক্লুবিনের মুখে। তেমন কিছু। দেহের ভর এক পা থেকে অন্য পায়ে চাপাল। আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল বোধহয় দশ বছর আগে, তাই না? তা আছ কেমন?
ভাল। তুমি?
আমিও ভালই আছি, কথার ফাঁকে লোকটা এক পা এগিয়ে এসেছে দেখে পিস্তল ধরা ডান হাত একটু উঁচু করল ক্লুবিন। সাবধান, রাতাগ! আমাদের মাঝের দূরত্ব যা আছে তাই থাকুক, কমাবার চেষ্টা কোরো না। সুবিধে করতে পারবে না। দেখতেই পাচ্ছে আমার পিস্তল আছে।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা। চেহারার রং বদলে যেতে শুরু করেছে, পিস্তল আর যুবকের দিকে তাকাচ্ছে ঘন ঘন। কি চাও তুমি? বলল সে। বলে ফেলো, আমার একটু তাড়া আছে।
বললাম না তেমন কিছু না! তোমার সাথে একটু গল্প করতে চাই! একটু বিরতি দিল যুবক। তুমি এইমাত্র একজন উপকূল রক্ষীকে সাগরে ফেলে দিয়েছ, রাতাগ। আমার মনে হয় এতক্ষণে মরে গেছে লোকটা।
জবাব দিল না রাতাগ। বেশ কিছু সময় নীরবে তাকিয়ে থাকল ক্লুবিনের মুখের দিকে, তারপর হেসে প্রশংসার সুরে বলতে লাগল, এত বছর পর পিছন থেকে নিজের আসল নামের ডাক শুনেই আমি বুঝেছি এ তুমি ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে না। আমাকে কি করে চিনলে তুমি? সন্তর্পণে আবারও দুপা এগোল সে কথার ফাঁকে। আমি এখানে আছি, সে কথা জানলে
রাতাগ! শীতল গলায় হুমকি দিল ক্লুবিন। যেখানে ছিলে পিছিয়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়াও, যদি বাঁচতে চাও।
দ্রুত নির্দেশটা পালন করল বৃদ্ধ। পিছিয়ে গিয়ে বোকার মত তাকিয়ে থাকল যুবকের দিকে।
শোনো, রাতাগ, দেহের ভর এক পা থেকে অন্য পায়ে নিল দুরান্দের ক্যাপ্টেন। তারপর যেন কোন তাড়া নেই, এমন ধীরস্থির, শান্ত গলায় বলল, এখান থেকে মাত্র কয়েকশো গজ দূরে, তোমার ডানদিকে আরেকজন কোস্ট গার্ড আছে। আর বন্দরের কাস্টমস কালেক্টরেটের অফিসটাও খুব বেশি দূরে নয়। ওখানে কতজন গার্ড আছে কে জানে!
আমি যদি পিস্তলের একটা ফাঁকা আওয়াজ করি, হুড়মুড় করে ছুটে আসবে সবাই। সে ক্ষেত্রে যে গার্ডটাকে এইমাত্র তুমি সাগরে ফেলে খুন করেছ, তার লাশ খুঁজে পেতে একটুও দেরি হবে না ওদের। কাজেই বুঝতেই পারছ কি কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছ তুমি!
হ্যাঁ, পারছি, শুকনো মুখে মাথা ঝাঁকাল সে। বেশ, বলল কি চাও তুমি।
বলছি, মৃদু হাসি ফুটল যুবকের মুখে। বিজয়ীর হাসি। মন দিয়ে, শোনো। তোমার পরনের পাজামাটার দুটো পকেট আছে। তার একটায় আছে তোমার প্রিয় ঘড়িটা, ওটা যত্ন করে রেখো কিন্তু।
রাখব, ধন্যবাদ। আর কি?
আবার মাথা ঝাঁকাল ক্লুবিন, হাসছে। বলছি, বলছি! এত ব্যস্ত হলে কি চলে নাকি? আর তোমার দ্বিতীয় পকেটে লোহার পাতের তৈরি একটা মানিব্যাগ আছে। প্রিঙের সাহায্যে খোলে ওটা, ঠিক?
হ্যাঁ, ঠিক। চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে উঠল বৃদ্ধের।
ওটা বের করো।
কেন? ঢোক গিলল সে।
ওটা আমার চাই, তাই। দাও, এদিকে ছুঁড়ে দাও ওটা।
দেখতে দেখতে চেহারা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল লোকটার, রেগে উঠেছে। ও! এই জন্যেই তুমি এ যে দেখছি রীতিমত ডাকাতি!
তাই বুঝি? হাসল যুবক। ডাকাতি? তা বেশ তো! কোস্ট গার্ডরা বেশি দূরে নেই, মাথা ঝাঁকিয়ে সেদিক দেখাল। তাহলে আর দেরি করছ কেন? ডাকো না তাদের! এসে তোমাকে ডাকাতের হাত থেকে বাঁচাক।
অবস্থা বেগতিক দেখে আপোষে আসার চেষ্টা করল বৃদ্ধ। সুর নরম করে বলল, ঠিক আছে, ক্লুবিন। এসো, একটা রফা করি আমরা। আমার মানিব্যাগে যত টাকা আছে, তার অর্ধেক তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি।
উহুঁ, মাথা নাড়ল যুবক। অর্ধেকে চলবে না, পুরো টাকা চাই আমার। কারণ ওই টাকাগুলো চুরির টাকা। ওগুলোর ওপর তোমার কোন অধিকার নেই।
রেগে উঠল সে। আমি চোর! আর তুমি বুঝি খুব সাধু?
দুচোখ জ্বলে উঠল যুবকের। চড়া কণ্ঠে বলে উঠল, হ্যাঁ, আমি সাধু! এ অঞ্চলের যাকে খুশি জিজ্ঞেস করে দেখো, সে-ই বলবে দুরান্দের ক্যাপ্টেন ভাল মানুষ। সৎ। আর রাতাগ একটা বিশ্বাসঘাতক।