বাড়িটার ছাদ থেকে তাকালে উপকূল থেকে সাগরের এক মাইল ভেতরের হ্যাঁনওয়ে পাহাড় স্পষ্ট দেখা যায়। গোটা অঞ্চলে ভীষণ কুখ্যাতি আছে হ্যাঁনওয়ের। শোনা যায়, এমন কোন কুকর্ম নাকি নেই যা ওখানে ঘটে না।
অনেক গুহা আছে হ্যাঁনওয়েতে-জোয়ারের সময় পানির নিচে তলিয়ে যায়, ভাটার সময় আবার জেগে ওঠে। স্থানীয়দের বিশ্বাস, ভাল করে খুঁজে দেখলে ওইসব গুহায় মানুষের প্রচুর কঙ্কাল পাওয়া যাবে।
চ্যানেলের মাঝখানে ছোট ছোট তিনটা পাহাড় নিয়ে হ্যাঁনওয়ে। কত জাহাজ যে ওগুলোর সাথে ধাক্কা খেয়ে তলিয়ে গেছে চ্যানেলের অতল গভীরে, তার কোন লেখাজোখা নেই। হ্যানওয়ে থেকে চ্যানেল সাঁতরে তীরে পৌঁছানো একেবারে অসাধ্য না হলেও খুবই যে দুঃসাধ্য, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ক্লুবিনের কাছে সেটা কোন সমস্যাই নয়।
যে সমস্ত পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে পাশ করার মধ্যে দিয়ে ক্লুবিন লেতিয়ারির মন জয় করতে পেরেছিল, হ্যাঁনওয়ে থেকে সাঁতরে তীরে পৌঁছানো ছিল তার একটি।
পরের মঙ্গলবার যথারীতি সেইন্ট ম্যালোয় পৌঁছল দুরান্দ। জাহাজ ভিড়িয়ে হোটেলে চলে এল ক্লুবিন, হোটেল মালিককে তামোলিপা সম্পর্কে এটা-সেটা প্রশ্ন করতে লাগল।
সে রাতে রীতিমত একটা অঘটন ঘটিয়ে বসল ক্যাপ্টেন ক্লুবিন, ডিনারের পর দেখা গেল অফিসে নেই সে। হোটেলেও নেই। কোথায় গেছে, কেউ জানে না। কাউকে বলে যায়নি। এমন তো কখনও ঘটে না।
বন্দরের যে সব জায়গায় সে যায় বা যেতে পারে, সে সব জায়গা ভাল করে খুঁজে দেখা হলো, কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না তাকে। নেই তো নেই-ই লোকটা। তার জন্যে জাহাজের মালপত্র খালাসের আগে ট্যাক্স ইত্যাদি পরিশোধ করাসহ আর যে সব নিয়ম পালন করা জরুরি, সেসবের কোনটাই সেদিন ঠিকমত পালিত হলো না।
সবাই বলাবলি করতে লাগল, ক্লুবিনের মত দায়িত্বশীল একজন ক্যাপ্টেনের এতবড় গাফিলতি চিন্তাই করা যায় না। অবশ্য রাতেই হোটেলে ফিরে এল সে।
কিন্তু অনুপস্থিতির সময়টায় কোথায় ছিল ক্লুবিন, সে ব্যাপারে কাউকেই কিছু বলল না লোকটা। সম্পূর্ণ চেপে গেল। পরদিন জানা গেল, আগের রাতে সেইন্ট ম্যালোর এমন এক প্রতিষ্ঠানে তাকে দেখা গেছে, যারা বিভিন্ন দেশের টাকা-পয়সা অদল বদলের ব্যবসা করে। বন্দরের একমাত্র আগ্নেয়াস্ত্রের দোকানেও নাকি গিয়েছিল সে।
***
তামোলিপার বন্দর ছাড়ার দিনকার ঘটনা।
জেটির কিছুটা দূর দিয়ে ছোট ছোট পাহাড়ের মত দেখতে এক সারি পাথরের টিলা সোজাসুজি সাগরের অনেকটা ভেতর পর্যন্ত চলে গেছে, দূর থেকে ওগুলোকে দেখতে লাগে ঠিক একটা বর্শার মত।
সঙ্কীর্ণ একটা পাথর খণ্ড এই বর্শার সাথে তীরের সংযোগ রক্ষার কাজ করছে। বর্শার মাথা আর সব পাহাড়ের চেয়ে বেশ খানিকটা উঁচু এবং চওড়া।
সেখান থেকে আরেকটা পাথর বের হয়ে অনেকটা বাড়িয়ে দেয়া হাতের মত আড়াআড়িভাবে চলে গেছে একদিকে। সব মিলিয়ে চমৎকার, মনোরম একটা পরিবেশ। কিন্তু সাগরের বেশ খানিকটা ভেতরে এবং খুব নির্জন বলে এখানে কেউ তেমন একটা আসে না।
তবে সেদিন বিকেল চারটার দিকে একজনকে দেখা গেল সেখানে। একা। বর্শার মাথায় দাঁড়িয়ে দূরবীন চোখে লাগিয়ে একভাবে সাগরের দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা। দেখলে বুঝতে অসুবিধে হয় না কিছু একটা ঘটার প্রতীক্ষায় আছে।
পরনে সৈনিকের পোশাক। এবং সে যে সশস্ত্র, তা-ও বুঝতে অসুবিধে হয় না। লোকটা একজন উপকূল রক্ষী। বিশেষ এক গোপন খবর পেয়ে এখানে এসেছে। এক সময় তার প্রতীক্ষার অবসান হলো। অনেক দূরে, আকাশ যেখানে সাগরের সাথে মিশেছে, সেখানে বিশাল নীল চাদরের ওপর কালো ফোঁটার মত একটা বিন্দুর দেখা পেল লোকটা। বিরক্তিকর লম্বা সময় নিয়ে একটু একটু করে বড় হচ্ছে সেটা। সেইন্ট ম্যালোর দিকেই আসছে।
একটা জাহাজ! দম বন্ধ করে একভাবে ওটার দিকে তাকিয়ে থাকল রক্ষী লোকটা। দুনিয়ার আর কোনদিকে খেয়াল নেই।
পিছন থেকে কতবড় বিপদ ঘনিয়ে আসছে, ঘুণাক্ষরেও টের পেল না লোকটা। জানতেও পারল না পাহাড়ের গা বেয়ে খুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে সাক্ষাৎ মৃত্যু। একভাবে সামনে তাকিয়েই থাকল। বেশ খানিকক্ষণ পর যখন বুঝল বিটা সত্যিই বড় হচ্ছে, হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে উঠল সে।
এর কারণ আছে, তার গোপন সংবাদ ফলতে শুরু করেছে। ওটা তামোলিপা। বন্দর ছেড়ে গন্তব্যের পথে যাত্রা করেছিল ঘণ্টা দুয়েক আগে, এখন আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠল গার্ড।
ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে শুরু করেছে বিন্দুটা, এখন জাহাজটাকে বেশ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে রক্ষী। গতি কমে আসতে শুরু করেছে ওটার। কমতে কমতে এক সময় থেমেই পড়ল তামোলিপা।
এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ঢেউয়ের দোলায় দুলতে লাগল। একটা ছোট নৌকা সাগরে নামানো হলে সেটা থেকে, কয়েকজন যাত্রী নিয়ে এদিকে এগিয়ে আসতে লাগল। ওটার যাত্রীদের চেহারা-সুরত, আচরণ খুবই সন্দেহজনক।
একটু পর জাহাজ থেকে আলাদা হয়ে এদিকেই আসতে শুরু করল ওটা। উত্তেজনায় অধীর হয়ে উঠল উপকূল রক্ষী লোকটা, বারবার পা বদল করতে লাগল। চোখ থেকে দূরবীন না সরিয়েই এক পা এক পা করে বর্শার একেবারে কিনারায় এসে দাঁড়াল সে। মাত্র এক হাত সামনেই যে খাড়া তীর, নিচে উন্মত্ত সাগর, সে কথা ভুলেই গেছে বোধহয়।