এখন আমি ওদের মুখ থেকে যা শুনেছি তা ভুললে চলবে না। এই স্বর্গলোকে বা স্বর্গোদ্যানে যা কিছু আছে তা তারা সব উপভোগ করতে পারে না। এই উদ্যানে জ্ঞানবৃক্ষ নামে একটি মারাত্মক গাছ আছে যার ফল নিষিদ্ধ তাদের কাছে। এ গাছের ফলের আস্বাদন থেকে বঞ্চিত তারা। তার মানে তাদের প্রভু ঈশ্বর এক অযৌক্তিক সংশয়ের দ্বারা আচ্ছন্ন। কিন্তু তাদের প্রভু ঈর্ষান্বিত কেন তাদের প্রতি? জ্ঞানলাভ করা কি পাপ? সে জ্ঞানলাভের পরিণাম কি মৃত্যু? তবে কি তারা অজ্ঞ রয়ে গেছে আজও? জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত হয়ে অজ্ঞতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকাটা কি সুখী অবস্থা? সেটা কি তাদের আনুগত্য আর বিশ্বাসের অভ্রান্ত প্রমাণ বা পরিচায়ক?
হ্যাঁ, এটাই হবে তাদের ধ্বংসের সৌধ নির্মাণের ভিত্তি। এই অজ্ঞতাই হবে তাদের ধ্বংসের কারণ। আমি তাদের মনে জ্ঞানের বাসনা সঞ্চারিত করে তাদের উত্তেজিত করে তুলব। আমি তাদের এমনভাবে উত্তেজিত করে তুলব যাতে তারা ঈশ্বরের ঈর্ষাজনিত আদেশ প্রত্যাখ্যান করে। তাদের আমি বুঝিয়ে দেব, ঈশ্বরের এ আদেশ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তারা যাতে চিরকাল ঈশ্বরের অধীন হয়ে থাকে, ঈশ্বরের সমান মর্যাদার আসনে কখনো উন্নীত হতে না পারে, তারই জন্য ঈশ্বর জ্ঞানবৃক্ষের ফল ভক্ষণ করতে নিষেধ করেছেন তাদের।
তারপর নিষিদ্ধ জ্ঞান লাভ করে ঈশ্বরের সমকক্ষ হবার অভিলাষে যেমন জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাবে অমনি অনিবার্য হয়ে উঠবে তাদের মৃত্যু। এর থেকে ভাল তাদের ধ্বংসের উপায় আর কি থাকতে পারে?
কিন্তু তার আগে এই উদ্যানের চারিদিক আমাকে একবার ঘুরে দেখতে হবে। এর প্রতিটা কোণ ভাল করে দেখতে হবে আমায়। ঘটনাক্রমে এই উদ্যানে কোথাও কোন গাছের তলায় অথবা কোনও ঝর্ণার ধারে কোন ভ্রাম্যমাণ দেবদূতের দেখা পেয়ে যেতে পারি। তাহলে তার কাছ থেকে জ্ঞাতব্য বিষয় জানা যাবে।
হে প্রেমিকযুগল, যতক্ষণ পর বেঁচে থাক। ক্ষণস্থায়ী আনন্দ প্রাণভরে উপভোগ করে যাও আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত। কারণ এক সুদীর্ঘকালীন দুঃখ অপেক্ষা করে আছে তোমাদের জন্য।
এই বলে ঘৃণাভরে দর্পিত পদক্ষেপে এগিয়ে চলল সে। যেতে যেতে সুচতুরভাবে নিরীক্ষণ করতে লাগল চারিদিক। ধীরে ধীরে বন, প্রান্তর, পাহাড়, উপত্যকার উপর দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল সে। যেতে যেতে দেখল একসময় চুড়ান্ত দ্রাঘিমারেখায় যেখানে আকাশ মর্ত্যের মহাসমুদ্রে মিলিত সেইখানে সূর্য অস্তাচলে গেল। স্বর্গের পূর্বদ্বারে শেষ সূর্যরশ্মিগুলি ঝরে পড়তে লাগল। সেই পূর্বদ্বারে ছিল তূপাকৃত মমরপ্রস্তরের এক অভ্রভেদী পাহাড়। মেঘলোক পর্যন্ত বিস্তৃত সেই পাহাড়ের মর্ত্যভূমি থেকে ওঠার একটিমাত্র পথ ও প্রবেশদ্বার আছে। বাকি সবটাই হচ্ছে এবড়ো-খেবড়ো পাথরে ভরা খাড়াই পাহাড় উপরে উঠে গেছে। তাতে ওঠা অসম্ভব কারো পক্ষে।
সেই পাহাড়ের উপর এক জায়গায় প্রহরাকার্যে নিযুক্ত দেবদূতদের মধ্যে প্রধান গ্যাব্রিয়েল আসন্ন রাত্রির প্রতীক্ষায় বসেছিল। স্বর্গের যুবকরা বিনা অস্ত্রে খেলা দেখাচ্ছিল তাকে। কিন্তু নিকটে ঢাল, বর্ম, শিরস্ত্রাণ, বর্শা প্রভৃতি স্বর্ণ ও হীরকখচিত অস্ত্রাদি ঝুলিয়ে রাখা ছিল।
এমন সময় গ্যাব্রিয়েলের সামনে আকাশমণ্ডলে ব্যাপ্ত ঘনায়মান সান্ধ্যছায়ার মধ্য দিয়ে সূর্যের একটি আলোকরেখার মত কক্ষচ্যুত উল্কার বেগে ইউরিয়েল এসে দাঁড়াল সহসা। শরৎকালের রাত্রিতে নক্ষত্রবিচ্ছুরিত বাম্পাগ্নি যেমন সমুদ্রনাবিকদের আসন্ন ঝড় সম্বন্ধে সতর্ক করে দেয়, ইউরিয়েল মেনি গ্যাব্রিয়েলকে সতর্ক করে দিয়ে বলল, শোন গ্যাব্রিয়েল, তোমার উপর এক নূতন কাজের ভার দেওয়া হয়েছে। সদাজাগ্রত ও সদাসতর্ক অবস্থায় কড়া নজর রাখতে হবে, কোন দুষ্ট আত্মা যেন এই চির আনন্দময় লোকে প্রবেশ করতে না পারে। আজই বেলা দ্বিপ্রহরে আমাদের এলাকায় একটি আত্মা এসেছিল। তাকে খুবই কৌতূহলী ও তৎপর দেখাচ্ছিল।
দেবদূতের মত দেখতে সেই আত্মা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সৃষ্টিকার্য সম্বন্ধে আরও অনেক কিছু জানতে চাইছিল, বিশেষ করে ঈশ্বরের সর্বশেষ প্রতিরূপ মানবজাতি সম্বন্ধে। আমি তখন মানবজাতির আদি পিতা-মাতার বাসভূমিতে যাবার পথ বলে দিই। সে সঙ্গে সঙ্গে আকাশপথে সেই দিকে উড়ে যায়। আমি তার উড়ে চলার কক্ষপথে তাকিয়ে লক্ষ্য করতে থাকি। তাকে প্রথমে দেবদুতের মত দেখালেও ইডেনের উত্তরদিকে যে পর্বত আছে তার উপর সে অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গে তার আকৃতি-প্রকৃতি ও চোখের দৃষ্টি সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়ে একেবারে স্বর্গীয় দেবদূতদের বিপরীত হয়ে যায়। তার উদ্দেশ্য কু-অভিসন্ধিমূলক আর আচরণ ও হাবভাব রহস্যময় মনে হয়।
আমি আমার দৃষ্টি দিয়ে তখনো তার অনুসরণ করতে থাকি। কিন্তু গাছের আড়ালে আমার দৃষ্টিপথের বাইরে চলে যায় সে। আমার মনে হয় সে হচ্ছে স্বর্গ হতে নির্বাসিত শয়তানদের একজন। নরকপ্রদেশ থেকে উঠে এসে স্বর্গলোকের মধ্যে প্রতিহিংসাবশত নতুন কোন বিপদ বাধাতে চায়। তোমার কাজ হবে তাকে খুঁজে বের করা এবং তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা।
একথা শুনে দেবসেনা গ্যাব্রিয়েল উত্তর করল, ইউরিয়েল, অত্যুজ্জ্বল সৌরমণ্ডলের মধ্যে বসে থেকে দৃষ্টি প্রসারিত করে তুমি যে দূরের বস্তুকে দেখতে পাবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। এই দ্বারপথে যে প্রহরা রয়েছে সে প্রহরা এড়িয়ে কেউ আসতে পারবে না। একমাত্র স্বর্গের পরিচিত কেউ ছাড়া এখানে আসে না। কিন্তু স্বর্গের দেবদূত ছাড়া বাইরের জগতের কেউ যদি পার্থিব বাধা ডিঙিয়ে স্বর্গোদ্যানের ভিতরে প্রবেশ করে, যদি সে স্বর্গের কোন দৈবশক্তি না হয় তাহলে তুমি যার কথা বললে সে এই স্বর্গলোকের মধ্যে যে রূপেই প্রবেশ করুক বা ঘুরে বেড়াক, আগামীকাল প্রত্যুষেই আমি তার বিষয়ে জানতে পারব।