- বইয়ের নামঃ কুয়াশা
- লেখকের নামঃ কাজী আনোয়ার হোসেন
- সিরিজঃ কুয়াশা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী বই
- বিভাগসমূহঃ কল্পকাহিনী, রহস্যময় গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প, অ্যাডভেঞ্চার, গোয়েন্দা কাহিনী, অ্যাকশন
কুয়াশা
কুয়াশা ১ (ভলিউম ১)
প্ৰচন্ড শীত। মাঘের প্রথম। রাত দেড়টা। সেগুনবাগান।
সমস্ত এলাকাটা ঘুমে অচেতন। জন প্রাণীর সাড়াশব্দ নেই। কেবল টহলদার নাইট গার্ড টহল দিয়ে ফিরছে। মাঝে মাঝে হুইল বাজাচ্ছে, সাথে সাথেই দূর থেকে ক্ষীণ প্রত্যুত্তর আসছে ভেসে।
খট খট খট। টহলদারের লাঠির শব্দে রাত্রি আরও নিঝুম হয়ে আসে। রাস্তার পাশে সারি সারি লাইটপোস্টের আলোর চারধারে অনেকগুলো পোকা অনবরত ঘোরে।
এমনি সময় দেখা গেল একখানি কালো শেভ্রোলে গাড়ি সামনের বহুদূর পর্যন্ত আলোকিত করে দ্রুত এগিয়ে আসছে। গাড়িটা কাছে এলে নাম্বার প্লেটের দিকে নজর যেতেই টহলদারের শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল। সশব্দে জুতো ঠুকে স্যালুট করলো সে। সিটি এস. পি.-র গাড়ি। ভিতরটা অন্ধকার। কেউ মাথা নাড়লো কিনা বোঝা গেল না। গাড়ি সমান গতিতে এগিয়ে গোল সামনে।
গাড়িটা এসে থামলো একটা একতলা বাড়ির সামনে। এদিকটা অন্ধকার। মৃদু গর্জন করে এঞ্জিনটা বন্ধ হয়ে গেল। একজন ওভারকোট পরা লোক নামলো গাড়ি থেকে। নিঃশব্দে আগন্তুক এগিয়ে গেল বাড়িটার দিকে। হাতে তার ছোটো একটা বাক্স।
লোকালয় থেকে কিছু দূরে বাড়িটা। অনেকদিনের পুরোনো বাড়ি, কিন্তু এখনও বেশ মজবুত আছে। বাড়ির সামনে খানিকটা বাগান। এলোমেলো করে অনেক ফুলগাছ লাগানো। মাঝে মাঝে পেয়ারা, জামরুল আর আম-কাঠালের গাছ। সবটা মিলে জঙ্গল বলে বোধ হয়। তারকাটা দিয়ে ঘেরা বাগানটা। ছোট একটা লোহার গেট আছে বাড়িতে ঢুকবার জন্যে।
কোনও শব্দ না করে গেট খুললো লোকটা। একবার চারদিকে চাইলো, তারপর ঢুকে পড়লো বাগানের ভিতর। সোজা এগিয়ে গেল সে বাড়িটার দিকে। সব কটা দরজাই বন্ধ ভিতর থেকে। কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবলো আগন্তুক, তারপর একটা জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। মোটা শিক দেয়া জানালা। বেডরুম। সমস্ত ঘরটার মধ্যে কেবল এই জানালাই খোলা। হাতের বাক্স খুলে ফেললো লোকটা। ওটা কিসের যেন একটা যন্ত্র। ক্যামেরার মতো দেখতে। খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে রেগুলেট করে নিয়ে যন্ত্রটার মুখ শিকের নিচের দিকে ধরে একটা বোতাম টিপতেই মুহুর্তে আশ্চর্যজনক ভাবে গলে তেল লোহার গরাদ। এইভাবে সব কটা গরাদই গলিয়ে ফেললো আগন্তুক। তারপর অবলীলাক্রমে একটা একটা করে সব শিক বাঁকিয়ে উপর দিকে তুলে দিলো।
এবার নিঃশব্দে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়লো লোকটা। দুজন মানুষ ঘুমিয়ে আছে মস্ত একটা খাটের উপর লেপ মুড়ি দিয়ে। স্বামী-স্ত্রী বলেই মনে হয়। খাটের তলে একটা হ্যারিকেন রাখা, আলো খুব কমানো। খাটের কাছে একটা দামী আয়রন সেফ। চাবি ঢোকাবার জায়গায় বোতাম টিপে যন্ত্রটা ধরতেই নাম করা কোম্পানীর আয়রন সেফ আলগা হয়ে গেল। কয়েক তোড়া নোট এবং গোটাকতক গিনি পকেটে পুরলো আগন্তুক। আরেকটা দেরাজে কয়েকটা দামী গহনা। হীরে সেট করা বহুমূল্য নেকলেসটা পকেটে ফেললো সে।
এবারে বারান্দার দিকের দরজা খুলে দিলো লোকটা। তারপর যন্ত্রটা খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে নিয়ে থাটের পাশে এসে দাঁড়ালো। পুরুষ লোকটার গায়ের উপর থেকে লেপ খানিকটা সরিয়ে দিয়ে তার বুকের কাছে যন্ত্রটা নিয়ে বোতাম টিপে দিলো। ঘুমন্ত লোকটা আচমকা চোখ খুলে তাকালো। তারপর খোলা অবস্থাতেই স্থির হয়ে গেল।
নির্বিকারভাবে যন্ত্রটা বাক্সে পুরলো লোকটা। সন্তৰ্পণে মৃত ব্যক্তির শরীরের উপর থেকে সবটা লেপ সরিয়ে দিলো। তারপর পাঁজাকোলা করে ভারি মৃতদেহটা অনায়াসে তুলে নিলো বিছানা থেকে। খাটটা খচ মচ আওয়াজ করে উঠলো। স্ত্রী লোকটি পাশ। ফিরে লেপটা আরও টেনে নিয়ে শুলো। আততায়ী একটু চমকে উঠেছিল। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। গেটের কাছে এসে একবার তীর দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো, তারপর লাশটা পিছনের সিটে শুইয়ে দিয়ে স্টার্ট দিলো।
সেগুন বাগানের লম্বা রাস্তাটা দিয়ে কালো গাড়িটা জন্ত বেগে বেরিয়ে গেল। কেউ জানলো না এর মধ্যে কী কান্ড হয়ে গেল। ভোর পাঁচটা অবধি তেমনি হইসল বেজে চললো। পোকাগুলো লাইটপোস্টের চারধারে অনবরত ঘুরতেই থাকলো।
২.
প্ৰাইভেট ডিটেকটিভ শহীদ খানের ছোট্ট একতলা বাড়ির ড্রইংরুম। দামী পুরু কার্পেট বিছানো মেঝেতে। সোফা সেটটি অত্যন্ত রুচিসম্মত ভাবে সাজানো। দরজা দিয়ে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়ে দেয়ালে টাঙানো রবীন্দ্রনাথের বড় অয়েল পেইন্টিংটা। এক নজরে বোঝা যায় বাড়ির কর্তাটি অগাধ সম্পত্তির মালিক।
সকালবেলা স্নান সেরে একটা দামী কাশ্মীরী শাল গায়ে জড়িয়ে ড্রইংরুমে এসে বসেছে শহীদ। খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছে আর বার বার বাইরের দিকে তাকাচ্ছে। আজ ভোরে কামালের আসবার কথা। দু বন্ধু শিকারে যাবে সাত-গম্বুজের কাছে মাছরাঙা বিলে। আজকাল নাকি বেশ পাখি পড়ছে এ বিলে।
শহীদ ফিজিক্সে ফাস্টক্লাস পেয়ে পাস করেছে গেল বছর। কামাল এবার ইকনমিক্সে পাস করলো।
শহীদ কামাল দুজনেই অল্পবয়সে বাবাকে হারায়। ওদের বাবা দু জন ছিলেন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুজনেই ছিলেন অসীম সাহসী। তাঁরা আফ্রিকায় গিয়েছিলেন লিম্পোপো নদীর কুমীর শিকার করতে। সেখানেই দু জনের মৃত্যু হয়। বিস্তারিত ভাবে কিছুই জানা যায়নি, কেবল মৃত্যু সংবাদ এসে পৌঁছেছে ঢাকায়। সেদিন বাড়িতে যে কী কান্নার রোল উঠেছিল এখনও অস্পষ্ট ভাবে মনে পড়ে শহীদের। আজ পাঁচ বছর হয় মা-ও মারা গেছেন তার।