- বইয়ের নামঃ ১৯৮৪ (নাইন্টিন এইটি-ফোর)
- লেখকের নামঃ জর্জ অরওয়েল
- প্রকাশনাঃ ঐতিহ্য
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
১৯৮৪ (নাইন্টিন এইটি-ফোর)
১ম খণ্ড – এপ্রিলের উজ্জ্বল ঠাণ্ডা দিন
প্রথম খণ্ড
প্রথম অধ্যায়
এপ্রিলের উজ্জ্বল ঠাণ্ডা দিন। ঘড়িগুলো একটার কাঁটায় ঘণ্টা পেটাচ্ছে। থুতুনি বুকে ঠেসে হিম হাওয়ার কবল থেকে মুখমণ্ডলটা বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে ভিক্টরি ম্যানশন্সের কাঁচের দরোজা ঠেলে নিজেকে ভিতরে গলিয়ে দিলো উইনস্টন স্মিথ। সুযোগ মতো গাদাখানেক ধুলিও ঘূর্ণি খেয়ে ঢুকলো। চট করে ঢুকে পড়েও ওদের আটকাতে পারলো না উইনস্টন।
হলওয়েতে পা ফেলতেই নাক ভরে গেলো সিদ্ধ বাঁধাকপি আর ছাতরাপড়া পুরনো মাদুরের গন্ধে। একদিকের দেয়ালে বেঢপ একটা রঙিন পোস্টার সাঁটা। তাতে এক মিটারের বেশি চওড়া আরও বেঢপ আকৃতির এক মানব মুখ। ৪৫ বছর বয়স হতে পারে এমন এক পুরুষের প্রতিকৃতি। বড় কালো গোঁফ জোড়ায় বেজায় দশাসই লাগে।
লিফটের চেষ্টা বৃথা, তাই সিঁড়ির দিকেই পা বাড়ালো উইনস্টন। খুব প্রয়োজনেও কদাচই কাজ করে এই লিফট। আর এখনতো দিনের আলোয় বিদ্যুতের লাইন কাটা। মূলত ‘ঘৃণা সপ্তাহ’র অর্থনৈতিক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে চলছে বিদ্যুত সাশ্রয়। সাত তলার ফ্ল্যাট। ঊনচল্লিশের শরীর আর ডান গোঁড়ালির উপরে কুষ্ঠের ঘা নিয়ে একটু ধীরে ধীরেই সিঁড়ি ভাঙতে হচ্ছে উইনস্টনকে। একটু পর পর জিরিয়েও নিচ্ছে। প্রতি তলায় লিফটের উল্টোদিকের দেয়াল থেকে সেই একই বেঢপ পোস্টার থেকে একই বেঢপ প্রতিকৃতি চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে। মনে হবে প্রতিটি তলায় বসে আপনি কোথায় যাচ্ছেন, কি করছেন তার ওপর নজর রাখছে। মনে কেন হবে? লিখেই দেওয়া আছে ছবির ক্যাপশানে- ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ’।
সাত তলায় ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে ভিতর থেকে কানে এলো একটি ভরাট কণ্ঠ । সে কণ্ঠ আউড়ে চলেছে কতগুলোর নাম। ওগুলো লোহা উৎপাদনকারীদের নাম। লম্বাটে ধাতব পাতের মতো দেখতে ম্যাটমেটে একটা কাঁচের ভেতর থেকে ওই কণ্ঠধ্বনি বের হচ্ছে। বস্তুটি ডান দিকের দেয়ালে লটকানো । উইনস্টন সুইচ ঘোরালে কণ্ঠটা একটু দমে এসে সামান্য কানসওয়া হলো। বস্তুটির (বলা হয় টেলিস্ক্রিন) পর্দা আরও ঝাপসা হলো বটে, তবে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলো না। জানালার দিকে এগোলো সে। ছোট, শীর্ণকায় দেহখানি নীলরঙা ওভারঅলে বাড়তি কোনো ভাব প্রকাশ করে না। ওটি দলের ইউনিফর্ম। চুলগুলো ধূসর, চেহারায় কাঠিন্যের একটা ছাপ আছে বটে, তবে নিম্নমানের সাবান, ভোতা রেজরব্লেডের ব্যবহার আর সদ্যসমাপ্ত শীতের প্রকোপে মুখের ত্বক ভীষণ খসখসে।
ঝাপসা কাচের জানালার মধ্য দিয়ে যতটুকু আঁচ করা যায়, তাতে মনে হয় বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। নিচের রাস্তায় ছোট ছোট ঘুর্ণি বাতাসে ধুলো আর ছেঁড়া কাগজগুলো ঘুরে ঘুরে উড়ছে। কড়া রোদ আর নীল আকাশও কোনও কিছুকে রঙিন করে তুলতে পারেনি। কেবল এখানে ওখানে সেঁটে রাখা পোস্টারগুলোই তার প্রকট রঙ ছড়িয়ে চলেছে।
কালো গোঁফওয়ালা চেহারাটি কোনায় কোনায় তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। ঠিক উল্টোদিকের বাড়ির সামনেও একটি পোস্টার সাঁটা। ক্যাপশানে বলা আছে- ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ’। আর তার কালো চোখ দুটো যেনো পাকিয়ে পাকিয়ে ঢুকছে উইনস্টনের চোখের গভীরে।
সড়কের একদিকে কোনার দিকটা ছিঁড়ে ঝুলে থাকা আরেকটি পোস্টার দৃষ্টিতে আটকালো তার। ছেঁড়া অংশটুকু বাতাসের ঝাপটায় নড়ছে। এতে পোস্টারের ‘ইংসক’ শব্দটি একবার ঢাকা পড়ছিলো আবার দেখা যাচ্ছিলো। বেশ খানিকটা দূরে একটি হেলিকপ্টার দুই ছাদের মাঝখান দিয়ে নিচের দিকে নেমে এলো। এরপর একটি বাঁক নিয়ে আবার উড়ে গেলো। ওটি পুলিশের টহল হেলিকপ্টার। মানুষের বাড়িতে বাড়িতে জানালাপথে চোখ ফেলে নজরদারি চালাচ্ছে। এমন টহল এখন আর কোনও বিষয়ই নয়, তবে ‘থট পুলিশ’আদতেই একটা বিষয়।
উইনস্টনের পেছনটাতে টেলিস্ক্রিন তখনও লোহা উৎপাদন আর সরকারের নবম ত্রি-বার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে বকবক করে যাচ্ছে। এই টেলিস্ক্রিন একইসঙ্গে শব্দ ধারণ ও সম্প্রচার দুইই করে। খুব আস্তে ফিসফিসে আওয়াজ ছাড়া সামান্য জোরে শব্দ করলেই ওই যন্ত্র তা ধারণ করে নেবে, আর ধাতব পাতের মতো দেখতে যন্ত্রটির নির্ধারিত দৃষ্টিসীমার মধ্যে পড়ে গেলে ধারণ করা হয়ে যাবে চেহারা। সামান্য শব্দ করলে তা শোনা যাবে। তবে এটা বোঝার উপায় মাত্রও নেই ঠিক কোন মূহূর্তে আপনি সে দৃষ্টিসীমায় পড়বেন। কতবার কোন পদ্ধতিতে ‘থট পুলিশ’ ঢুকে পড়বে আপনার চৌহদ্দিতে তা আন্দাজ করা কঠিন।
ওরা আপনাকে সারাক্ষণ নজরদারিতে রাখছে-সেটুকুও হয়তো মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু যখন তখন চাইলেই যে ওরা আপনার ওয়্যার সিস্টেমে ঢুকে পড়ছে! আপনাকে এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে বাস করতে হচ্ছে যেখানে টু-শব্দটি করলেও তা অন্য কেউ শুনে ফেলছে আর ঘন ঘুটঘুটে অন্ধকার না হলে আপনার প্রতিটি নড়াচড়াও ওরা দেখে ফেলছে।
টেলিস্ক্রিনের দিকে পীঠ রেখে দাঁড়ালো উইনস্টন। এটাই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। যদিও সে ভালো করেই জানে পেছনের দিক থেকে তাকে চিনে ফেলা কঠিন কিছু নয়।