- বইয়ের নামঃ ১৯৮৪ (নাইন্টিন এইটি-ফোর)
- লেখকের নামঃ জর্জ অরওয়েল
- প্রকাশনাঃ ঐতিহ্য
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, উপন্যাস
১৯৮৪ (নাইন্টিন এইটি-ফোর)
১ম খণ্ড – এপ্রিলের উজ্জ্বল ঠাণ্ডা দিন
প্রথম খণ্ড
প্রথম অধ্যায়
এপ্রিলের উজ্জ্বল ঠাণ্ডা দিন। ঘড়িগুলো একটার কাঁটায় ঘণ্টা পেটাচ্ছে। থুতুনি বুকে ঠেসে হিম হাওয়ার কবল থেকে মুখমণ্ডলটা বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে ভিক্টরি ম্যানশন্সের কাঁচের দরোজা ঠেলে নিজেকে ভিতরে গলিয়ে দিলো উইনস্টন স্মিথ। সুযোগ মতো গাদাখানেক ধুলিও ঘূর্ণি খেয়ে ঢুকলো। চট করে ঢুকে পড়েও ওদের আটকাতে পারলো না উইনস্টন।
হলওয়েতে পা ফেলতেই নাক ভরে গেলো সিদ্ধ বাঁধাকপি আর ছাতরাপড়া পুরনো মাদুরের গন্ধে। একদিকের দেয়ালে বেঢপ একটা রঙিন পোস্টার সাঁটা। তাতে এক মিটারের বেশি চওড়া আরও বেঢপ আকৃতির এক মানব মুখ। ৪৫ বছর বয়স হতে পারে এমন এক পুরুষের প্রতিকৃতি। বড় কালো গোঁফ জোড়ায় বেজায় দশাসই লাগে।
লিফটের চেষ্টা বৃথা, তাই সিঁড়ির দিকেই পা বাড়ালো উইনস্টন। খুব প্রয়োজনেও কদাচই কাজ করে এই লিফট। আর এখনতো দিনের আলোয় বিদ্যুতের লাইন কাটা। মূলত ‘ঘৃণা সপ্তাহ’র অর্থনৈতিক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে চলছে বিদ্যুত সাশ্রয়। সাত তলার ফ্ল্যাট। ঊনচল্লিশের শরীর আর ডান গোঁড়ালির উপরে কুষ্ঠের ঘা নিয়ে একটু ধীরে ধীরেই সিঁড়ি ভাঙতে হচ্ছে উইনস্টনকে। একটু পর পর জিরিয়েও নিচ্ছে। প্রতি তলায় লিফটের উল্টোদিকের দেয়াল থেকে সেই একই বেঢপ পোস্টার থেকে একই বেঢপ প্রতিকৃতি চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে। মনে হবে প্রতিটি তলায় বসে আপনি কোথায় যাচ্ছেন, কি করছেন তার ওপর নজর রাখছে। মনে কেন হবে? লিখেই দেওয়া আছে ছবির ক্যাপশানে- ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ’।
সাত তলায় ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে ভিতর থেকে কানে এলো একটি ভরাট কণ্ঠ । সে কণ্ঠ আউড়ে চলেছে কতগুলোর নাম। ওগুলো লোহা উৎপাদনকারীদের নাম। লম্বাটে ধাতব পাতের মতো দেখতে ম্যাটমেটে একটা কাঁচের ভেতর থেকে ওই কণ্ঠধ্বনি বের হচ্ছে। বস্তুটি ডান দিকের দেয়ালে লটকানো । উইনস্টন সুইচ ঘোরালে কণ্ঠটা একটু দমে এসে সামান্য কানসওয়া হলো। বস্তুটির (বলা হয় টেলিস্ক্রিন) পর্দা আরও ঝাপসা হলো বটে, তবে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলো না। জানালার দিকে এগোলো সে। ছোট, শীর্ণকায় দেহখানি নীলরঙা ওভারঅলে বাড়তি কোনো ভাব প্রকাশ করে না। ওটি দলের ইউনিফর্ম। চুলগুলো ধূসর, চেহারায় কাঠিন্যের একটা ছাপ আছে বটে, তবে নিম্নমানের সাবান, ভোতা রেজরব্লেডের ব্যবহার আর সদ্যসমাপ্ত শীতের প্রকোপে মুখের ত্বক ভীষণ খসখসে।
ঝাপসা কাচের জানালার মধ্য দিয়ে যতটুকু আঁচ করা যায়, তাতে মনে হয় বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। নিচের রাস্তায় ছোট ছোট ঘুর্ণি বাতাসে ধুলো আর ছেঁড়া কাগজগুলো ঘুরে ঘুরে উড়ছে। কড়া রোদ আর নীল আকাশও কোনও কিছুকে রঙিন করে তুলতে পারেনি। কেবল এখানে ওখানে সেঁটে রাখা পোস্টারগুলোই তার প্রকট রঙ ছড়িয়ে চলেছে।
কালো গোঁফওয়ালা চেহারাটি কোনায় কোনায় তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। ঠিক উল্টোদিকের বাড়ির সামনেও একটি পোস্টার সাঁটা। ক্যাপশানে বলা আছে- ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ’। আর তার কালো চোখ দুটো যেনো পাকিয়ে পাকিয়ে ঢুকছে উইনস্টনের চোখের গভীরে।
সড়কের একদিকে কোনার দিকটা ছিঁড়ে ঝুলে থাকা আরেকটি পোস্টার দৃষ্টিতে আটকালো তার। ছেঁড়া অংশটুকু বাতাসের ঝাপটায় নড়ছে। এতে পোস্টারের ‘ইংসক’ শব্দটি একবার ঢাকা পড়ছিলো আবার দেখা যাচ্ছিলো। বেশ খানিকটা দূরে একটি হেলিকপ্টার দুই ছাদের মাঝখান দিয়ে নিচের দিকে নেমে এলো। এরপর একটি বাঁক নিয়ে আবার উড়ে গেলো। ওটি পুলিশের টহল হেলিকপ্টার। মানুষের বাড়িতে বাড়িতে জানালাপথে চোখ ফেলে নজরদারি চালাচ্ছে। এমন টহল এখন আর কোনও বিষয়ই নয়, তবে ‘থট পুলিশ’আদতেই একটা বিষয়।
উইনস্টনের পেছনটাতে টেলিস্ক্রিন তখনও লোহা উৎপাদন আর সরকারের নবম ত্রি-বার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে বকবক করে যাচ্ছে। এই টেলিস্ক্রিন একইসঙ্গে শব্দ ধারণ ও সম্প্রচার দুইই করে। খুব আস্তে ফিসফিসে আওয়াজ ছাড়া সামান্য জোরে শব্দ করলেই ওই যন্ত্র তা ধারণ করে নেবে, আর ধাতব পাতের মতো দেখতে যন্ত্রটির নির্ধারিত দৃষ্টিসীমার মধ্যে পড়ে গেলে ধারণ করা হয়ে যাবে চেহারা। সামান্য শব্দ করলে তা শোনা যাবে। তবে এটা বোঝার উপায় মাত্রও নেই ঠিক কোন মূহূর্তে আপনি সে দৃষ্টিসীমায় পড়বেন। কতবার কোন পদ্ধতিতে ‘থট পুলিশ’ ঢুকে পড়বে আপনার চৌহদ্দিতে তা আন্দাজ করা কঠিন।
ওরা আপনাকে সারাক্ষণ নজরদারিতে রাখছে-সেটুকুও হয়তো মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু যখন তখন চাইলেই যে ওরা আপনার ওয়্যার সিস্টেমে ঢুকে পড়ছে! আপনাকে এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে বাস করতে হচ্ছে যেখানে টু-শব্দটি করলেও তা অন্য কেউ শুনে ফেলছে আর ঘন ঘুটঘুটে অন্ধকার না হলে আপনার প্রতিটি নড়াচড়াও ওরা দেখে ফেলছে।
টেলিস্ক্রিনের দিকে পীঠ রেখে দাঁড়ালো উইনস্টন। এটাই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। যদিও সে ভালো করেই জানে পেছনের দিক থেকে তাকে চিনে ফেলা কঠিন কিছু নয়।
সত্য মন্ত্রণালয় (মিনিস্ট্রি অব ট্রুথ) এখান থেকে এক কিলোমিটার দূরে। ওখানেই কাজ করে উইনস্টন। বিধ্বস্ত দৃশ্যপটে একটা সাদা রঙের উঁচু ভবন। এটাই! বিস্বাদ লাগার মতো একটি অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে উইনস্টনের চোখে মুখে, আর মনে মনে বলে, এটাই লন্ডন, প্রধান নগর এয়ারস্ট্রিপ ওয়ানের। যেটি আবার ওশেনিয়ার তৃতীয়-বৃহত্তম জনবহুল প্রদেশও বটে। ছেলেবেলার কিছু স্মৃতি হাতড়ে উইনস্টন বোঝার চেষ্টা করলো লন্ডন কি আগেও ঠিক এমনটাই ছিলো? এই যে উনবিংশ-শতাব্দীর পচাগলা বাড়িগুলো, কাঠের বেড়া, কার্ডবোডে ঘেরা জানালা, ঢেউটিনের ছাদ আর বাগানের অবিন্যস্ত দেয়াল- আগেও কি এমনটাই ছিলো? আর বোমা পড়া স্থানগুলো! যেখানে পলেস্তারার ধুলোগুলো বাতাসের সাথে মিশে উড়ছে সারাক্ষণ, আর উইলো গাছের অঙ্কুরগুলো, পাথরের স্তুপের মাঝ থেকে উঁকি দেওয়ার অক্লান্ত কসরত করে যাচ্ছে, সেসব স্থানে বোমা পড়ে বড় বড় গর্ত হয়ে আছে, আর ঠিক মুরগীর খাঁচার মতো ছোট ছোট কাঠের নোংরা কলোনিগুলোতে গড়ে উঠেছে আবাসন? এসব ভেবে খুব একটা ফায়দা হলো না তার। উইনস্টন কিছুই মনে করতে পারলো না। পেছনে দৃশ্যপটহীন, অর্থহীন স্রেফ কিছু উজ্জ্বল আলোকিত আলোকচিত্র ছাড়া শিশুবেলার আর কিছুই মনে পড়ে না তার।
মিনিস্ট্রি অব ট্রুথ। নিউস্পিকে যার সংক্ষিপ্ত রূপ মিনিট্রু (নিউস্পিক ওশেনিয়ার দাপ্তরিক ভাষা)। আশেপাশে চোখে পড়ে এমন অন্য যে কোনো বস্তুর চেয়ে ভিন্ন গড়নের। ঝকঝকে সাদা কংক্রিটে পিরামিড কাঠামোয় তৈরি ৩০০ ফুট উঁচু ভবনটি। উইনস্টন এখন ঠিক যেখানটাতে দাঁড়িয়ে সেখান থেকেও ওই ভবনের সামনে জ্বলজ্বলে অক্ষরে লেখা তিনটি স্লোগান স্পষ্ট পড়ে নেওয়া যাচ্ছে-
যুদ্ধই শান্তি
স্বাধীনতা দাসত্ব
অজ্ঞতাই শক্তি
সত্য মন্ত্রণালয়ের নীচ তলার ওপরের অংশে তিন হাজার কক্ষ, এমনটাই বলা হয়। আর নিচেও তার কক্ষ সমান সংখ্যক । গোটা লন্ডনে একই গঠন ও আকৃতি আরও তিনটি ভবন রয়েছে। ভিক্টরি ম্যানশন্সের ছাদ থেকে তাকালে আশেপাশের স্থাপনাগুলোকে ক্ষুদ্রাকায় করে দিয়ে ওই চারটি ভবনই একসঙ্গে চোখে পড়ে। চার ভবনে চারটি মন্ত্রণালয়। আর পুরো সরকারও এই প্রধান চারটি ভাগে বিভক্ত। সত্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে সংবাদ, বিনোদন, শিক্ষা ও চারুকলা। মিনিস্ট্রি অব পিস বা শান্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কেবলই যুদ্ধ। মিনিস্ট্রি অব লাভ বা ভালোবাসা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আইন-শৃংখলা। আর মিনিস্ট্রি অব প্লেন্টি বা প্রাচুর্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে অর্থ সম্পর্কিত বিষয়। নিউস্পিকের ভাষায় এগুলো সংক্ষিপ্ত রূপ নিয়ে পরিচিতি পেয়েছে- মিনিট্রু, মিনিপিস, মিনিলাভ ও মিনিপ্লেন্টি নামে।
ভালোবাসা মন্ত্রণালয় সাক্ষাৎ এক ভীতির নাম। এই মন্ত্রণালয়ের ভবনে একটি জানালাও নেই। উইনস্টন এই মন্ত্রণালয়ে কখনোই ঢোকেনি, এমনকি এর চৌদিকে আধা কিলোমিটারের মধ্যেও যায়নি। দাপ্তরিক কাজ ছাড়া এখানে অবশ্য ঢোকাও যায় না। আর যদি যেতেই হয় তো কাঁটাতারে ঘেরা সরু পথ বেয়ে ইস্পাতের দরজা পথে লুকোনো মেশিন গানের নলের সামনে দিয়ে ঢুকতে হবে। এমনকি যে সড়ক দিয়ে এতসব বাধার মুখে গিয়ে পড়তে হবে তাতেও দেখা যাবে গরিলামুখো পাহারাদাররা কালো পোশাকে অস্ত্র আর মোটা বেত হাতে টহল দিচ্ছে।
হঠাৎই উল্টো ঘুরলো উইনস্টন। ততক্ষণে মুখমণ্ডলে আশাবাদীতার একটি অভিব্যক্তি সে মেখে নিয়েছে। টেলিস্ক্রিনের সামনে দাঁড়ানোর বেলায় উপদেশ এমনটাই। কক্ষ ছেড়ে সোজা ঢুকে পড়লো ছোট্ট রান্নাঘরে। দিনের এই সময়টাতে মন্ত্রণালয় থেকে বাইরে থাকায় ক্যান্টিনে তার জন্য বরাদ্দ দুপুরের খাবার নষ্ট হলো। সে ভালো করেই জানতো রান্নাঘরে বড় এক টুকরো কালচে রুটি ছাড়া আর কিছুই নেই। আর সে রুটিও পরের দিনের নাস্তার জন্য বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। তাক থেকে বর্ণহীন পানীয়র একটি বোতল নামিয়ে আনলো। সাদা লেবেলে লেখা ‘ভিক্টরি জিন’। একটা অস্বস্তিকর, তেলচিটচিটে গন্ধ নাকে লাগলো- চীনাদের চাল থেকে স্প্রিটের যে গন্ধটি বের হয় ঠিক তেমন। এককাপ পরিমান পানীয় গলায় ঢেলে, একটি ঝাঁকি সহ্য করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়ে, ঢক করে পেটে চালান করে দিলো উইনস্টন।
সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ লালচে হয়ে উঠলো, চোখ দিয়ে পানি ছুটলো। জিনিষটি মনে হলো নাইট্রিক এসিড বা তার চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু। এটি পেটে গেলে মনে হবে মাথার পেছনের দিকটাতে কেউ রাবারের লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। পরের মূহূর্তেই পাকস্থলীর আগুন কিছুটা স্তিমিত হয়ে এলে পৃথিবীকে আবার ছন্দ-আনন্দময় মনে হতে থাকবে। এবার ভিক্টরি সিগারেট লেখা কুঁচকে যাওয়া একটি প্যাকেট থেকে একটি শলাকা বের করলো উইনস্টন। কিন্তু অসচেতনতায় এর উপরের দিকটা উল্টো করে ধরায় তামাকগুলো নিমিষেই মেঝেতে পড়ে গেলো। পরের সিগারেটটি বের করে সতর্কভাবে হাতে নিয়ে লিভিং রুমে ফিরলো। টেলিস্ক্রিনের বাম দিকে পেতে রাখা ছোট্ট টেবিলটির ওপর বসলো। ড্রয়ার টেনে প্রথমেই বের করলো একটি কলমদানি। এরপর বের করে আনলো কালির দোয়াত আর মোটা কোয়ার্টো সাইজের নোটবুকটি। এর পেছনটা লাল আর কভারটি মারবেল রঙের।
লিভিং রুমে টেলিস্ক্রিন বসানো জায়গাটি কিছুটা অস্বাভাবিক। শেষ দেয়ালে বসালে গোটা রুমই এর আওতায় আসতো, কিন্তু এটি বসানো হয়েছে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ দেয়ালটির ওপর, ঠিক জানালার উল্টোদিকে। এতে একদিকে স্ক্রিনের চোখ এড়িয়ে একটি চোরকুঠুরি তৈরি হয়েছে, আর ঠিক সেখানটিতেই এখন বসে আছে উইনস্টন। হতে পারে ফ্ল্যাটগুলো বানানোর সময় এই অংশটিকে বুক শেল্ফের জন্য ভাবা হয়েছিলো। চোরকুঠুরিতে বসে উইনস্টন তখন টেলিস্ক্রিনের চোখের বাইরে। কোনো শব্দ করলে তা শোনা যাবে কিন্তু যতক্ষণ এখানে বসে থাকবে তাকে দেখা যাবে না। এমনই একটি অবস্থায় ঠিক যে কাজটি করতে সে যাচ্ছে সেটি করার জন্য অংশত কক্ষের ওই ভৌগলিক আকার-প্রকৃতিই তাকে উৎসাহিত করেছে।
অথবা হতে পারে ড্রয়ার টেনে এইমাত্র যে নোটবুকটি বের করে আনলো সেটিই এর কারণ। নোটবুকটি অদ্ভুত রকমের সুন্দর। এর পাতাগুলো মসৃণ ক্রিমের মতো। অনেক দিনের পুরোনো বলে কিছুটা হলদেটে। আর এরকম কাগজতো গত চল্লিশ বছর ধরে তৈরিই হচ্ছে না। উইনস্টন অনুমান করতে পারে, নোটবুকটি চল্লিশ বছরেরও বেশি পুরোনো হবে। শহরের বস্তির মতো একটি এলাকায় পুঁতিগন্ধময় ভাঙারির দোকানের জানালা পথে প্রথম তার চোখে পড়ে নোটবুকটি। দেখেই ওটি পাবার ভীষণ ইচ্ছা হয় উইনস্টনের। দলের সদস্যদের সাধারণ দোকানে যাওয়ায় বারণ আছে। তবে সে যে খুব কড়াকড়িভাবে মানা হয়, তা নয়। বেশ কিছু দ্রব্য-সামগ্রী রয়েছে, যেমন জুতোর ফিতে, রেজর ব্লেড এগুলো ওসব দোকানেই মেলে। রাস্তায় এদিক-ওদিক, মাথাটি ঘুরিয়ে খুব দ্রুত দেখে নিলো উইনস্টন। সুযোগ বুঝে আলগোছে ঢুকে পড়লো দোকানের ভেতরে আর আড়াই ডলার দিয়ে চট করে নোটবুকটি কিনেও ফেললো। ওই সময় উইনস্টনের মাথায় এটি কেনার পেছনে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য কাজ করেনি। অনেকটা অপরাধীর মতোই নোটবুকটি ব্রিফকেসে ঢুকিয়ে বাড়িতে ফেরে সে। এরপর একটি আঁচড়ও এতে কাটা হয়নি। এ যেনো তার অনেক আপস করে পাওয়া এক সম্পত্তি।
এখন উইনস্টন ঠিক যে কাজটি করতে যাচ্ছে তা হচ্ছে- ডায়রি লেখা শুরু করা। কাজটি অবৈধ নয়। (আসলে কোনও কাজই অবৈধ না কারণ আইনই নেই।) তবে এটা সত্য একবার ধরা পড়ে গেলে সাজাটা বেজায় বড়- হয় মৃত্যুদণ্ড, নয়তো শ্রমদাসদের ক্যাম্পে কম করে হলেও ২৫ বছরের বাস। উইনস্টন কলমদানিতে একটি নিব বসিয়ে তাতে চুষুনি টিপে কালি তুলে নিলো। কালির কলম এখন সেকেলে। এর ব্যবহার বলতে গেলে উঠেই গেছে। সই দিতেও এখন কলমের ব্যবহার কদাচই দেখা যায়। উইনস্টন কিন্তু এরই মধ্যে স্রেফ ওই নোটবুকটিতে লেখার জন্যই একটি কলম কিনে ফেলেছে। তার মন বলছিলো, অমন সুন্দর ক্রিমের মতো মসৃণ পাতাগুলোতে আঁচড় কাঁটতে একটি সত্যিকারের নিবের কলমই যথার্থ। ইঙ্ক-পেন্সিল দিয়ে দিয়ে এই অমূল্য পাতায় ঘষাঘষি করার ইচ্ছা তার মোটেই ছিলো না।
হাতে লেখায় অভ্যস্ত ছিলো না উইনস্টন। দুই-একটি ছোটখাটো নোট লেখা ছাড়া আজকাল স্পিক-রাইট পদ্ধতিরই ব্যবহার চলে। তবে ঠিক এই মূহূর্তে সে প্রক্রিয়া কোনো কাজে দেবে না। কলমটি কালির দোয়াতে চুবিয়ে এক সেকেন্ডের জন্য দমে গেলো সে। গোটা শরীরের ভেতরটা একটা ঝাঁকুনি খেলো। কাগজের ওপর দাগ কাঁটা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বটে। আর এক্ষণে সেই কাজটাই করলো। ছোট ছোট প্যাচের অক্ষরে সে লিখলো-
৪ঠা এপ্রিল ১৯৮৪।
পীঠে হেলান দিয়ে বসলো উইনস্টন। পুরোপুরি অসহায়ত্বের অনুভব ভর করলো তার ওপর। শুরুতো হলো, কিন্তু মোটে নিশ্চিতই হতে পারছিলো না- এটা ১৯৮৪ সাল তো! স্পষ্ট করেই জানে তার বয়স এখন ঊনচল্লিশ। ১৯৪৪ অথবা ১৯৪৫ এর কোনো একটি দিনে তার জন্ম। কিন্তু গত এক বা দুই বছরে একটি বারের জন্যও কোথাও, কখনো কোনও তারিখ তাকে লিখতে হয়নি। এতে যেনো সালটাই ভুলে বসে আছে সে।
এবার নতুন আরেকটি ভাবনা ভর করলো- কার জন্য এই ডায়রি লিখছে সে? ভবিষ্যতের জন্য, অনাগত প্রজন্মের জন্য। নোটবুকের পাতার ওপর লেখা অনিশ্চিত তারিখটির চারিদিকে দৃষ্টি ঘুরপাক খেতে থাকে, আর মাথায় আসে নিউস্পিকের একটি শব্দ ‘ডাবলথিঙ্ক’ (দ্বৈতচিন্তা)। এই প্রথমবারের মতো তার মনে হলো যা সে করতে যাচ্ছে, তা সে বুঝতে পারছে না। ভবিষ্যতের সঙ্গে আপনি কিভাবে যোগাযোগ করবেন? এটি প্রকৃতিগতভাবেই অসম্ভব। ভবিষ্যততো বর্তমানেরই সন্নিবেশ; তা যদি হয়, তাকে কথা শোনানো দায়; আর হতে পারে ভবিষ্যত বর্তমানের চেয়ে ভিন্ন কিছু; তাহলে এই যোগাযোগের প্রচেষ্টাই বৃথা।
কিছুটা সময় কাগজের দিকে বোকার মতো চোখ ফেলে বসে থাকলো। টেলিস্ক্রিনে ততক্ষণে উচ্চস্বরে সামরিক সঙ্গীত বাজতে শুরু করেছে। উইনস্টন বুঝতে পারছিলো না, সে কি নিজেকে ব্যক্ত করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, নাকি যা কিছু সে লিখতে চেয়েছিলো তা সব ভুলে গেছে। গত কটি সপ্তাহ ধরে ঠিক এই মূহূর্তটির জন্য সে নিজেকে প্রস্তুত করছিলো। আর তার মন থেকে এই কথাটি একবারের মতোও আলাদা হয়নি যে, এজন্য তার আর কিছুই না, কেবল সাহসের প্রয়োজন। মূল লেখার কাজটি খুব যে কঠিন হবে তা নয়। তাকে একটি কাজই করতে হবে- বছরের পর বছর ধরে সারাক্ষণ মাথার ভিতর যা কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে, সেসবই কলমের নিব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কাগজে চালান করে দিতে। কিন্তু এই মুহূর্তে যেনো সবকিছুই উবে গেছে। উপরন্তু পায়ের গোড়ালির উপরের ঘাঁয়ের জায়গাটিতে একটু বাড়াবাড়ি রকমের অসহনীয় চুলকানি অনুভূত হচ্ছে। তবে চুলকানোর সাহস করলো না সে। কারণ যখনই চুলকায় তখনই জায়গাটি ভীষণ জ্বলতে থাকে। টিক টিক করে একেকটি সেকেন্ড বয়ে যাচ্ছে। এ মূহূর্তে সামনে কাগজের শূন্য পাতা ছাড়া যেনো আর কিছুই তার অনুভূতিতে নেই। এমনকি গোড়ালির ওপরের ঘাঁ, টেলিস্ক্রিনের বাজনা আর জিনের মদিরায় সামান্য বুঁদ হয়ে থাকার ভাবটুকুও যেনো হারিয়ে গেছে।
ভীষণ আতঙ্ক নিয়ে, যা কিছু মনোস্থির করছিলো সেগুলো সম্পর্কে ভুল সচেতনতায় এবার আচমকা লেখা শুরু করলো সে। তার ছোট ছোট, অথচ শিশুসুলভ হাতের লেখাগুলো নোটবুকের পাতায় উপর-নিচ করে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। তাতে বাক্যের শুরুতে ক্যাপিটাল লেটার কিংবা বাক্যের শেষে ফুলস্টপ ব্যবহারের বালাই থাকলো না।
৪ঠা এপ্রিল, ১৯৮৪। গত রাতটি ছিলো সিনেমার। সবই যেনো যুদ্ধের ছায়াছবি। সবচেয়ে সেরা ছিলো ভূমধ্যসাগরের কোনো এক স্থানে উদ্বাস্তুবোঝাই একটি জাহাজে বোমা ফেলার দৃশ্যটি। আর দর্শকরা নিশ্চয়ই সবচেয়ে বেশি মজা পেয়েছে ওই দৃশ্যে, যাতে মোটাসোটা একটি লোক অসীম সাগরেই সাঁতরে হয়েছিলো পলায়নপর আর তার পিছু নিয়েছিলো একটি হেলিকপ্টার। প্রথম দেখা গেলো লোকটি শুশুকের মতো ডুবছে আর ভেসে উঠছে। এরপর তাকে দেখা গেলো হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া গুলির ঝাঁকের ঠিক মাঝখানে। তার চারিদিকের পানিতে আছড়ে পড়া গুলির তোড়ে তৈরি গর্তগুলো স্পষ্ট চোখে পড়ছিলো। পরক্ষণেই চারিদিকে পানি গোলাপি হয়ে উঠলো আর তখনই লোকটি ডুবেও গেলো। এতই দ্রুত যে তখনও গুলির তোড়ে সৃষ্ট গর্তগুলো পানিতে ভরে উঠতে পারেনি। আর যখন লোকটি ডুবে যাচ্ছিলো তখন দর্শকরা ছোটাচ্ছিলো হাসির ফল্গুধারা। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিলো কেউ কেউ। একটু পর সবাই দেখলো বোঝাই করা নারী আর শিশু নিয়ে ভাসছে একটি লাইফবোট। বোটের উপর দিয়ে একটি হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে। ওদের মধ্যে, ইহুদিই হবেন, এক মধ্যবয়সী নারীকে দেখা গেলো অনেকটা ঝুঁকে বসে আছেন। কোলে বছর তিনেকের একটি ছেলে। ছোট্ট শিশুটি ভয়ে চিৎকার করছে আর নারীটির বুকের মধ্যে মাথা লুকোচ্ছে। মনে হচ্ছিলো ও যেনো ওখান দিয়েই ভেতরে ঢুকে যেতে চায়। শিশুটিকে জাপটে ধরে ওকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন নারীটি। যদিও তিনি নিজেও তখন ভয়ে নীল হয়ে আছেন। তারপরেও ছেলেটিকে এমনভাবে আগলে ধরেছিলেন যেনো তার বাহুই ওকে বোমার আঘাত থেকে বাঁচাবে। আর ঠিক তখনই হেলিকপ্টার থেকে ২০ কিলো সাইজের একটি বোমা পড়লো ওদের ঠিক মাঝখানে। এক ভয়াবহ ঝলকানি দিয়ে সেটি বিষ্ফোরিত হলো। নৌকাটি চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে দেয়াশলাইয়ের কাঠির মতো ছিটকে গেলো চারিদিকে। সবার চোখে পড়লো এক অসাধারণ দৃশ্য! একটি শিশুর হাত ছিটকে উপর থেকে আরও উপরে উঠছে আর হেলিকপ্টারের নাকে লাগানো ক্যামেরায় তা ধরা পড়েছে। দলের বিভিন্ন আসন থেকে দর্শকরা হাসির হল্লা ছুটালো কেবল এক জন নারী ছিলেন ব্যাতিক্রম। ওই কক্ষে প্রোলদের (ওসেনিয়ার কর্মজীবী শ্রেণি) অংশের প্রতিনিধি তিনি। ক্রোধে উত্তেজনায় পা ছুঁড়তে লাগলেন নারীটি। আর চিৎকার করে বলতে লাগলেন, শিশুদের সামনে এগুলো কীসব দেখানো হচ্ছে, শিশুদের সামনে এগুলো দেখানোর অধিকার কারো নেই। পুলিশ ছুটে এসে নারীটিকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে গেলো। অন্যদের অভিব্যক্তিতে মনে হলো না কিছু একটা ঘটেছে। কেউই আসলে একজন প্রোল কি বললো না বললো, তার কি হলো, না হলো তাতে পাত্তা দেয় না। এটা প্রোলদের গতানুগতিক প্রতিক্রিয়া। ওরা কখনোই…
উইনস্টন লেখা থামালো। অংশত এই কারণে যে, ব্যাথায় তার পা টনটন করেছে। বুঝতে পারছে না ঠিক কী তাকে এই আবর্জনার স্রোতে টেনে এনে ফেলেছে।
তবে কৌতুক আর কৌতুহলের বিষয় হলো- সম্পূর্ণ একটা ভিন্ন স্মৃতি তার মনের কোণে স্পষ্ট হয়ে ওঠার কারণেই কাজটিতে সে হাত দিয়েছে। ভাবনাটি তার মনকে ঠেলে ঠেলে এমন একটি স্থানে নিয়ে ঠেকিয়েছে যে সে মনে করছে এগুলো লিখে ফেলা জরুরি। কিন্তু একথা ভাবতে ভাবতেই তার মস্তিষ্ক বলতে লাগলো অন্য কথা। মস্তিষ্ক এখন বলছে- সেই স্মৃতি নয়, বস্তুত অপর একটি ঘটনা এই লিখতে বসার কারণ। যে ঘটনাটি তাকে এই ভর দুপুরে ঘরে ঠেলে পাঠিয়েছে; আর আজই ডায়রি লেখা শুরু করতেও বাধ্য করেছে।
এমন একটি অতি অস্পষ্ট বিষয়কে যদি আদৌ কোনো ঘটনা কিংবা বিষয় বলা চলে তাহলে তা ঘটেছে ওইদিন সকালেই, মন্ত্রণালয়ে।
তখন বেলা এগারোটার কাছাকাছি। সবাই বেশ ব্যস্ত। উইনস্টন যেখানটায় কাজ করে সেই রেকর্ডস ডিপার্টমেন্টে সবাই মিলে বিভিন্ন কক্ষ থেকে চেয়ারগুলো টেনে টেনে হলরুমে বড় টেলিস্ক্রিনের সামনে সারি বেঁধে বসাচ্ছিলো। ‘দুই মিনিটের ঘৃণা’ কর্মসূচির প্রস্তুতি চলছিলো। উইনস্টন মাঝের সারিতে একটি চেয়ারে কেবল বসবে- ঠিক এমনই সময়ে সে কক্ষে দুই জন মানুষের অপ্রত্যাশিত আগমন। এদের উইনস্টন চেনে, আগে দেখেছে, কিন্তু কখনও কথা হয়নি। দুই জনের মধ্যে একজন একটি মেয়ে, যাকে বারান্দায় বিভিন্ন সময় দেখেছে। সে মেয়েটির নাম জানতো না। তবে এটা জানতো, ফিকশন ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। মাঝে মধ্যে তার তেলমাখা হাতে নাট-বল্টু লাগানোর যন্ত্র দেখে ধারণা করেছে মেয়েটি কোনো একটি উপন্যাস লেখার মেশিনের কারিগর হতে পারে। মেয়েটির চেহারায় কাঠিন্য স্পষ্ট, বয়স সাতাশ হবে, মোটা ঘন চুল, মেচতা পড়া গাল আর চালচলনে খেলোয়াড়সুলভ ভঙ্গি। ওভারঅলের উপর দিয়ে কোমড়ের কাছে জুনিয়র অ্যান্টি-সেক্স লিগের প্রতীক চিকন লাল পরিকর বারকয়েক পেঁচিয়ে বাধা। একটু শক্ত করেই বেঁধে নেওয়া ফলে ওভারঅলের উপর দিয়েও নিতম্বদেশ বেশ সুডৌল হয়ে ফুটে উঠেছে। ঠিক যে মূহূর্তে উইনস্টন মেয়েটিকে দেখলো তখন থেকেই সে তাকে ঠিক নিতে পারছিলো না। কারণটা অজানা নয়। মেয়েটির আগমনের ভঙ্গিমাটি এমন যেনো এটি কোনো হকি খেলার মাঠ, নয়তো ঠাণ্ডা স্নান ঘর, নয়তো কমিউনিটিকে চাঙ্গা করে তোলার কোনো কর্মসূচি, আর সে যেনো এক সুন্দর মননশীলতার ধ্বজাধারী। বস্তুত প্রায় সকল নারীকেই অপছন্দ উইনস্টনের। বিশেষ করে যারা একটু সুন্দরী তাদেরতো বটেই। তার মতে, সবসময়ই নারীরা, বিশেষ করে যুবতীরা পার্টির সবচেয়ে সংকীর্ণমনা সমর্থক, এরা স্লোগান সর্বস্ব, সুখের মাছি আর অকারণে অযাচিতভাবে যে কোনো ইস্যুতে নাক গলায়। আর এই মেয়েটিকে তার কাছে এদের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক মনে হয়। করিডোরে যেদিন প্রথম অতিক্রমণ ঘটে একে অপরের, সেদিন মেয়েটি তার দিকে আড়চোখে তীব্র দৃষ্টি হানে। উইনস্টনের মনে হয়, চাহুনি দিয়েই মেয়েটি তার ভেতরটা দেখে নিয়েছে, আর এতে অন্তর্গত একটা কালো আতঙ্ক বয়ে যায় তার শরীরময়। ভাবনায় এও এলো যে, মেয়েটি ‘থট পুলিশের’ কারিন্দা হতে পারে। এমনটা সত্য হওয়া খুব অসম্ভব। তারপরেও তার ভেতরে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি কাজ করতে থাকে। আতঙ্কের সাথে এক ধরনের শত্রুতার মনোভাব মিশ্রিত হয়। এরপর থেকে যখনই মেয়েটি তার কাছাকাছি আসে তখনই তার ভেতরে একই মনোভাব কাজ করতে থাকে।
অন্য লোকটির নাম ও’ব্রায়েন। ইনার পার্টির একজন সদস্য এবং কিছু পদেও আছেন। তবে সেসব পদের গুরুত্ব এমনই যে উইনস্টন সে সম্পর্কে সামান্যই ধারণা রাখে। পার্টির একজন সদস্য কালো ওভারঅল পরে এসেছে এমন দৃশ্যে মূহূর্তেই চারিদিকে একটা ফিসফিসানির শব্দ বয়ে যায়। ও’ব্রায়েনের দশাসই পেটানো শরীর, মোটা গর্দান, কর্কশ, কৌতুকতা আর বর্বরতার মিশেল চাহুনি। ভয়ঙ্কর দেখতে হলেও তার আচরণে এক ধরনের খুশির ভাব লেপ্টে থাকে। নাকের ওপর চশমাটি ঠিক করার সময় সে এমন একটা কিছু করে যা কৌতুহল সৃষ্টি করে, মজাও দেয়। এর কোনো সংজ্ঞা নেই বটে, তবে তারপরেও কিছুটা সভ্য বলেই তাকে মনে হয়। ভাবভঙ্গিমায়, কেউ তাকে অষ্টাদশ শতাব্দীর আদর্শবানব্যক্তিদের কারো সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেও, দেখতে পারে।
অনেক বছর ধরে অন্তত ডজন খানেকবার ও’ব্রায়েনকে দেখেছে উইনস্টন। লোকটি তার ভাবনায় ভালো করেই স্থান করে নিতো। তার বিশালাকায় লড়াকু বপু আর ভদ্রোচিত আচরণের মধ্যে যে বৈসাদৃশ্য তাতে তাকে নিয়ে এক ধরণের সিদ্ধান্তহীনতা কাজ করে উইনস্টনের মনে। তবে সেটাই যে একমাত্র কারণ তা নয়। তার চেয়েও বড় কারণ হচ্ছে- তার মধ্যে এক ধরনের বিশ্বাস- অথবা সম্ভবত বিশ্বাস নয় এক ধরনের ভাবনা কাজ কাজ করে যে ও’ব্রায়েন যে রাজনৈতিক মতাদর্শে রয়েছেন তা সঠিক নয়। ওর চেহারায় কিছু একটা আকর্ষণ আছে। এও হতে পারে তার চেহারায় যে ভদ্রোচিত ভাবটি লেখা আছে তার জন্য নয়, ওই আকর্ষণ স্রেফ তার বুদ্ধিমত্তার জন্যই। তবে যাই হোক না কেনো সে এমন একটা লোক যাকে একা পাওয়া গেলে এবং টেলিস্ক্রিনকে ফাঁকি দেওয়া গেলে তার সঙ্গে কিছু বাতচিৎ হতেই পারে। উইনস্টন অবশ্য এই অনুমানকে যাচাই করে দেখার সামান্য চেষ্টাও করেনি। যদিও সে চেষ্টা করার সুযোগও খুব ছিলো তা নয়। ঠিক এই মূহূর্তে ও’ব্রায়েন তার হাতঘড়িটির দিকে তাকিয়ে। দেখে নিলেন তখন প্রায় এগারোটা বাজে। হাবভাবে বোঝা গেলো দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচি শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি রেকর্ডস ডিপার্টমেন্টেই থাকছেন।
উইনস্টন যে সারিতে বসে ঠিক সেই সারিতেই কয়েকটি চেয়ার দূরে বসলেন ও’ব্রায়েন। ধূসরকেশী যে মেয়েটি উইনস্টনের পাশের কক্ষ থেকে চেয়ার টেনে সাজাচ্ছিলো সে বসেছে তাদের দু’জনের মাঝখানের একটি চেয়ায়ে আর আর সেই কালোকেশী বসেছে ঠিক তার পেছনে। পরক্ষণেই দৈত্যাকায় মেশিন থেকে হলের শেষ মাথায় বসানো বিশাল টেলিস্ক্রিনের মধ্য দিয়ে একটি কর্কশ ভাঙা কণ্ঠ বাজতে শুরু করলো। একে স্রেফ চ্যাঁচামেচি ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না। এতে মেজাজ খিঁচড়ে আপনার দাঁতকপাটি লেগে যাবে আর তা ঘাড়ের কাছের চুলগুলো পর্যন্ত খাড়া হয়ে উঠবে। তবে ঘৃণা কর্মসূচির শুরুটা এরকমই হলো।
অবধারিতভাবেই জনগণের শত্রু ইমানুয়েল গোল্ডস্টেইনের মুখ স্ক্রিনে ভেসে উঠলো। দর্শকদের মধ্যে এখানে সেখানে তখন কেবলই কানাঘুষার শব্দ। ধূসর চুলের মেয়েটি ভয় আর বিরক্তি মিশ্রণে একটি অদ্ভুত অভিব্যক্তি দিলো। পার্টির বিদ্রোহী আর পশ্চাদপসরণকারী হিসেবে পরিচিত এই গোল্ডস্টেইন। আগে দলের প্রধানসারির নেতাই তিনি ছিলেন, অনেকটা বিগ ব্রাদারের সমমাপের, সম পর্যায়ের। পরে প্রতিবিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন, তার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানাও জারি হয়। কিন্তু রহস্যজনকভাবে কিভাবেই যেনো বেঁচে যান, আর নিরুদ্দেশ হয়ে যান। দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচি একেক দিন একেকরকম। কিন্তু এমন একটিদিনও পাওয়া যাবে না যেদিন এর প্রধান লক্ষ্যবস্তু গোল্ডস্টেইন নন। তিনি ছিলেন প্রথম ও প্রধান বিদ্রোহী। দলের পবিত্রতার প্রথম বিনষ্টকারী। ধরে নেওয়া হয়, পরবর্তীতে পার্টিতে যত অপরাধ, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা, নাশকতা, বিচ্যুতি যা কিছুই হয়েছে তার সবকিছুই এই গোল্ডস্টেইনের শিক্ষাপ্রসূত। কোথাও কোন অজ্ঞাতস্থানে বসে এখনো তিনি তার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। হতে পারে সমুদ্রের ওপার থেকে, নয়তো বিদেশি কোনও চক্রের ছত্রছায়ায়, এমনকি হতে পারে, ঠিক যে গুজব প্রায়শঃই কানে আসে, এই ওসেনিয়ার ভেতরেই কোনো একটি গুপ্ত আস্তানা থেকে। উইনস্টনের মধ্যচ্ছদা শুকিয়ে আসছিলো। গোল্ডস্টেইনের চেহারাটা যখনই সে দেখে একটা ব্যাথাভরা অনুভূতি বয়ে যায়। কৃশকায় ইহুদি মুখ, মাথায় ঘন সাদা চুল, ছোট ছাগলা দাড়িতে চতুর চেহারা, একটা সহজাত অবজ্ঞার ভাব মুখে মাখা, লম্বা পাতলা নাকের ডগায় বসানো চশমা জোড়ায় এক ধরনের জরাগ্রস্ত বোকাটে ভাবের প্রকাশ। সব মিলিয়ে ভেড়ার মতো দেখতে আর কণ্ঠস্বরও সেই ভেড়ারই মতোন। দলের নীতির বিরুদ্ধে গোল্ডস্টেইন আক্রমনাত্মক ভঙ্গিতে সমানে বিষোদগার করে যাচ্ছিলেন। প্রতিটি বাক্যে এমন অত্যুক্তি ও ন্যয়ভ্রষ্টতা ছিলো যে, ছোট্ট শিশুটি পর্যন্ত তা পরিষ্কার বুঝতে পারে। আর এমন একটা বিশ্বাসযোগ্য ভঙ্গিতে বলে যাচ্ছিলেন যে অপেক্ষাকৃত কম বুদ্ধিসম্পন্নরা সহজেই তার কথাগুলো মেনেও নিতে পারে। বাক্যবাণে বিগ ব্রাদারকে নাজেহাল করে যাচ্ছিলেন গোল্ডস্টেইন। দলের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় তুললেন আর দাবি তুললেন, ইউরেশিয়ার সঙ্গে যেনো এখনই একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান নিশ্চিত করা হয়। তিনি বাক-স্বাধীনতার কথা বললেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বললেন, সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতার কথা বললেন। হিংস্রভাবে চিৎকার করতে করতে তিনি বললেন, বিপ্লব প্রতারিত হয়েছে- কণ্ঠস্বরের দ্রুত ওঠানামার মধ্য দিয়ে বলে চলা এই কথাগুলো দলের বাগ্মিদের বক্তব্যের স্বভাবজাত ধরণটিরই অনুকরণ। যাতে ছিলো নিউস্পিকের শব্দের ব্যবহার। দলের সদস্যরা বাস্তব জীবনে যতটা নিউস্পিকের শব্দ ব্যবহার করেন তার চেয়েও বেশি।
গোল্ডস্টেইনের এই মিথ্যা ফালতু বয়ানের বাস্তবতা নিয়ে কেউ সন্দেহ করতে পারে এই ভাবনা থেকেই পুরো বক্তৃতার সময়জুড়ে টেলিস্ক্রিনে তার পেছনে দেখানো হচ্ছিলো ইউরেশীয় সেনাদের কুচকাওয়াজ। ভাবলেশহীন কঠিন মুখোভঙ্গির এশীয় চেহারার ওই সেনাদের সারি যেনো শেষ হচ্ছিলো না। একেকটি সারি একেরবার টেলিস্ক্রিনের সামনে চলে এসে আবার দ্রুত সরে যায়, সেখানে এসে হাজির হয় একই রকম দেখতে আরেকটি সারি, সেটিও সরে যায়, আরেকটি আসে। গোল্ডস্টেইনের ভ্যা ভ্যা চিৎকারের ব্যাকগ্রাউন্ডে ভেসে আসছিলো সৈনিকদের বুটের ভারি শব্দ।
ঘৃণার তখন ত্রিশ সেকেন্ডও পার হয়নি। এরই মধ্যে কক্ষের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অবিরাম তাদের ক্রোধের প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছেন। একটি আত্মতৃপ্ত ভেড়ামুখো চেহারা টেলিস্ক্রিনে, তার পেছনে ইউরেশীয় সেনাদের ভীতিকর শক্তির প্রদর্শন, আসলেই এক অসহনীয় দৃশ্য। এর পাশাপাশি গোল্ডস্টেইনের দৃষ্টিভঙ্গি আর চিন্তা আরও ভয় ও ক্রোধ ধরিয়ে দেয়। ইদানিং ইউরেশিয়া কিংবা ইস্ট এশিয়ার চেয়েও বড় ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠেছেন এই গোল্ডস্টেইন। সাধারণত এই দুটি শক্তির কোনো একটির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে অপরটির সঙ্গে শান্তির সম্পর্কই বজায় রাখে ওসেনিয়া। কিন্তু অদ্ভুত দিকটি হচ্ছে, যদিও গোল্ডস্টেইন সর্বত্র-সকলের কাছেই ঘৃণিত-অপমানিত, যদিও প্রতিদিন এবং দিনে সহস্রবার, মঞ্চে, টেলিস্ক্রিনে, সংবাদপত্রে, বইয়ে তার তত্ত্বের বিরোধীতা হয়, গুঁড়িয়ে-উড়িয়ে দেওয়া হয়, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ হয়, নোংরা-ফালতু বলে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা হয়- তা সত্ত্বেও তার প্রভাব কখনো কমতে দেখা যায়নি। তার হাতে অপদস্থ হওয়ার জন্য সবসময়ই নতুন বোকামি থেকেই যায়। এমন একটি দিনও পাওয়া যায়নি যেদিন থট পুলিশের হাতে গোল্ডস্টেইনের জন্য কাজ করছে এমন চর কিংবা অন্তর্ঘাতক ধরা পড়েনি। একটি বিশাল ছায়া সেনাদলের অধিনায়ক সে। একটি গোপন ষড়যন্ত্রকারী নেটওয়ার্কের প্রধান, যারা রাষ্ট্রকে বানচাল করে দিতে চায়।
নেটওয়ার্কের একটি নামও রয়েছে- ‘দ্য ব্রাদারহুড’। একটি ভয়ংকর বইয়ের কথাও শোনা যায়, যেটি আসলে উৎপথগামিতার এক সংক্ষিপ্ত সোপান। গোল্ডস্টেইনই এর রচয়িতা। আর অত্যন্ত গোপনীয়তায় সে বই সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই বইয়ের কোনো নাম নেই। কেউ বইটির কথা বলতে গেলে, বা আদৌ যদি বলে, তাহলে স্রেফ ‘দ্য বুক’ কথাটিই ব্যবহার করে। কিন্তু এগুলো কেবল গুজব থেকেই জানা। দলের সাধারণ কোনো সদস্যও বাধ্য না হলে এই ‘ব্রাদারহুড’ কিংবা ‘দ্য বুক’ শব্দের ব্যবহার করবে না।
ঘৃণার দ্বিতীয় মিনিটে গোটা হলেই ক্রোধ ছড়িয়ে পড়লো। মানুষগুলো তাদের নিজ নিজ আসন থেকে লাফিয়ে উঠছিলো আর যতজোড়ে সম্ভব চিৎকার করে যাচ্ছিলো, যেনো তারা স্ক্রিনের ভ্যা ভ্যা শব্দ ছাপিয়ে নিজেদের শব্দ উচ্চারণের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ছোট ধূসর চুলের মেয়েটি ততক্ষণে গোলাপী রং ধরেছে, দেখা গেলো তার মুখ ঠিক ডাঙায় তোলা মাছের মতো একবার খুলছে একবার বন্ধ হচ্ছে। ও’ব্রায়েনের ভারী মুখও তখন জ্বলে উঠেছে। তিনি চেয়ারে সোজা হয়ে বসেছিলেন। উঁচু বুকের ছাতি কেঁপে কেঁপে স্ফীত হয়ে উঠছিলো, যেনো তিনি সজোরে আসা ঢেউয়ের আঘাত সহ্য করে দাঁড়িয়ে আছেন। উইনস্টনের পেছনের কালোকেশী মেয়েটি ততক্ষণে ‘জঘণ্য! শুয়োর!’ গলা ফাটিয়ে এসব বলে চলেছে। আচমকা একটি ভারি নিউস্পিক অভিধান তুলে নিয়ে সেটি স্ক্রিনের দিকে ছুড়ে মারলো সে। সরাসরি ওটি গিয়ে পড়লো গোল্ডস্টেইনের নাক বরাবর। এবং পড়েই ছিটকে এলো। কিন্তু তাতে বক্তব্যে বাধা পড়লো না। এমন একটা মূহূর্তে উইনস্টন নিজেকেও আবিষ্কার করলো যে সেও অন্যদের সঙ্গে সমানতালে চিৎকার করছে আর পায়ের গোড়ালি দিয়ে নিজের চেয়ারের পাদানিতে সজোরে লাথি মারছে।
দুই মিনিটের এই ঘৃণা কর্মসূচির একটা অদ্ভুত দিক হচ্ছে- কেউ এতে উপস্থিত থাকলেও ঘৃণা ছড়াতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও কেউ কাজটি না করে পারে না। ভয় আর প্রতিহিংসার উদ্যাম উল্লাস, মেরে ফেলার কিংবা নির্যাতনের প্রগাঢ় ইচ্ছা, হাতুড়ি দিয়ে মুখমণ্ডল থেঁতলে দেওয়ার তীব্র বাসনা সবগুলো মানুষের মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহের মতো বইতে থাকে। তখন তারা এমনকি অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভয়ঙ্কর চিৎকার জুড়ে দেয়। আর প্রত্যেকেই এমন ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে যে তাতে নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আর এই আচরণ একজনের কাছ থেকে অন্যজনের মাঝে আগুনের হলকার মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
কথা এই যে, উইনস্টনের যে ঘৃনার প্রকাশ দেখা গেলো তা কিন্তু আদৌ গোল্ডস্টেইনের বিরুদ্ধে ছিলো না। বরং সে ঘৃণা ছিলো বিগ ব্রাদারের বিরুদ্ধে, দলের বিরুদ্ধে এবং থট পুলিশের বিরুদ্ধে। আর ঠিক এই মূহূর্তে তার হৃদয় একাকীত্বে ভরে গেলো, উদাসভাবে স্ক্রিনের দিকে তাকালো, আর গোল্ডস্টেইনকে মনে হলো মিথ্যার দুনিয়ায় সত্য আর বিচারবুদ্ধির একক অভিভাবক। আর চারিদিকে এত মানুষের মধ্যে সে নিজেই হচ্ছে এর দ্বিতীয় উদাহরণ। গোল্ডস্টেইন যা কিছু বলছেন তার সবটাই যেনো তার কাছে সত্যি মনে হতে লাগলো। তবে পর মূহূর্তেই আবার বিগ ব্রাদারের প্রতি তার গোপন ঘৃনা রূপ নিলো ভালোবাসায়। বিগ ব্রাদারকে তার অকুতোভয় রক্ষক, এশীয়দের বিরুদ্ধে পাথরকঠিন দৃঢ়তায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন অভিভাবক মনে হচ্ছিলো। পক্ষান্তরে গোল্ডস্টেইনকে, তার নির্বাসন, অসহায়ত্ব এবং এমনকি তার সংশয়পূর্ণ অস্তিত্বের পরেও অশুভ জাদুকর বলেই মনে ঠেকলো। মনে হলো- সে যেনো তার কণ্ঠের শক্তি দিয়েই এই সভ্যতার কাঠামোকে ভেঙ্গে দিতে চায়।
এটাও সম্ভব, মূহূর্তের মধ্যেই একজনের ওপর যে ঘৃনা; তা অন্য জনের ওপর চেপে বসে। হঠাৎ, যেভাবে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মাঝেও কেউ তার প্রচণ্ড চেষ্টায় মাথাটিকে বালিশ থেকে সরিয়ে ফেলতে পারে, ঠিক সেভাবেই উইনস্টন তার মনের সব ঘৃনা স্ক্রিনের মুখটি থেকে তার পেছনের কালোকেশী মেয়েটির ওপর ফেলতে সক্ষম হলো। একটি অদ্ভুত ভাবনা তার মনের ভেতর খেলে গেলো। তার মনে হলে একটি রাবারের মোটা লাঠি দিয়ে মেয়েটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে যদি পারে; তাকে উলঙ্গ করে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে সাধু সেবাস্টিয়ানের মতো তীরে তীরে জর্জরিত করতে যদি পারে. কিংবা ওকে প্রথমে বিমোহিত করে পরে ঠিক চরম উত্তেজনার মূহূর্তে যদি জিভটা কেটে নিতে পারে। আর অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন উইনস্টন ভালো করেই যেনো বুঝতে পারছে ঠিক কী কারণে সে মেয়েটিকে ঘৃণা করতো। সে তাকে ঘৃণা করতো কারণ সে যুবতী, সুন্দরী আর ক্লিব, কারণ সে তাকে বিছানায় নিতে চাইতো কিন্তু কখনো পারেনি, কারণ তার মিষ্টি কোমল কটিদেশ, যা বাহুদিয়ে জড়িয়ে রাখার মতো, সেখানে শোভা পাইছে ঘৃণিত ওই লাল পরিকর, যা তার কৌমার্যের উদ্ধত ঘোষণা।
রুম জুড়ে ঘৃণা ততক্ষণে চরমে রূপ নিয়েছে। গোল্ডস্টেইনের কণ্ঠকে তখন সত্যিকারেই ভেড়ার ভ্যা ভ্যা ছাড়া কিছু মনে হচ্ছিলো না।
রুম জুড়ে ঘৃণা ততক্ষণে চরমে রূপ নিয়েছে। গোল্ডস্টেইনের কণ্ঠকে তখন সত্যিকারেই ভেড়ার ভ্যা ভ্যা ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছিলো না। আর স্ক্রিনে তার মুখটি হঠাৎ ভেড়ার মুখ হয়েই ভেসে উঠলো। পরমূহূর্তেই সেই মুখ পাল্টে গেলো এক ইউরেশীয় সৈনিকের মুখাবয়বে। বিশালাকায় ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে সে অবয়ব সামনে এগিয়ে আসছে, আর তার হাতের সাব-মেশিনগান ভীষণ গর্জাচ্ছে। মনে হচ্ছিলো যেনো স্ক্রিন থেকেই লাফিয়ে বের হয়ে হামলে পড়বে সেই সৈনিক। দৃশ্যের চিত্রায়ন এতটাই ভয়াবহ ছিলো যে, সামনের সারির দিকে বসা কয়েকজন তাদের মাথা কিছুটা পেছনে হেলিয়েও দিলো। তবে মাথাগুলো ফের নিজের জায়গায় যেতে না যেতে ঠিক সেই মূহূর্তে সকলের মুখে স্বস্তির এক গভীর রেখা এঁকে দিয়ে ভয়াবহ সৈনিক মূর্তিটি উবে গেলো, আর ভেসে উঠলো বিগ ব্রাদারের মুখাবয়ব। কালো চুল, কালো গোঁফ, ক্ষমতার আধার, রহস্যময় এক শান্তির প্রতীক। আর সে ছবি এতটাই বড় যে গোটা স্ক্রিন জুড়ে ছিলো তার উপস্থিতি।
তবে বিগ ব্রাদার যা বলছিলেন তা কারো কানে ঢুকছিলো না। কি আর হবে! উৎসাহব্যাঞ্জক কিছু বক্তব্য। যুদ্ধের ডামাডোলে এধরনের কথাবার্তা খুব শোনা যায়, নেই স্পষ্ট কোনো বার্তা, কিন্তু বলার ধরনে এক ধরনের আস্থার অভিব্যক্তি আছে। এরপর একসময় বিগ ব্রাদারের মুখমণ্ডলটিও ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো। আর স্ক্রিন জুড়ে ভেসে উঠলো তিনটি স্লোগান-
যুদ্ধই শান্তি
স্বাধীনতা দাসত্ব
অজ্ঞতাই শক্তি
তবে বিগ ব্রাদারের মুখটি এরপরেও কয়েক সেকেন্ড ধরে পর্দায় ভাসছে বলেই মনে হচ্ছিলো, কারণ প্রত্যেকের চোখের মনিতে এর যে প্রভাব তা এত দ্রুত মুছে যাবার নয়। ছোট ধূসরকেশী তার সামনের চেয়ারের ওপর ঝুঁকে পড়লো বির বির করে কি যেনো বলতে বলতে। শব্দটি উইনস্টনের কানে এলোও বটে- ‘আমার ত্রাতা!’। আর এ কথা বলে মেয়েটি তার দুবাহু ছুঁড়ে মারলো স্ক্রিনের দিকে। পরক্ষণেই দুই হাতের তালু দিয়ে চোখমুখ ঢেকে নিলো। দেখে মনে হলো- নিশ্চয়ই এখন কোনো প্রার্থনায় রত হয়েছে সে।
এমনই একটা মূহূর্তে গোটা কক্ষে একধরনের গুঞ্জন শুরু হলো। চারিদিক থেকে ছন্দময় ধ্বনি আসতে লাগলো ‘বি-বি!….বি-বি!’ বার বার উচ্চারিত হতে লাগলো সে ধ্বনি। ধীরে ধীরে প্রথম ‘বি’ উচ্চারণের পর একটু থেমে দ্বিতীয় ‘বি’ উচ্চারণ। একটি ভারী গুঞ্জন। কিন্তু আপনি একটু কৌতুহলী হয়ে কান পেতে শুনলে বুঝতে পারবেন এ ধ্বনি আসলে অনেকগুলো খালি পায়ের দুমদুম শব্দ বৈ কিছু নয়। সম্ভবত টানা ত্রিশ সেকেন্ড চললো ওই ‘বি-বি!’। আপনি যখন কোনও আবেগ দ্বারা তাড়িত থাকবেন তখন এমন শব্দ আপনার কানে পৌঁছাবেই না। অংশত এটি বিগ ব্রাদারের প্রাজ্ঞতা আর রাজসিকতার স্তুতি গান, তবে তার চেয়েও বড় কথা এটি আসলে আত্মসংবেশন, ছন্দময় শোরগোলের মধ্যে থেকে সচেতনতার সলিল সমাধি। উইনস্টনের ভেতরটা যেনো আরও শীতল হয়ে আসছিলো। দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচি তার বিভ্রমগুলো কাটাতে পারেনি। তবে অমানবীয় ওই ‘বি-বি!…বি-বি!’ ধ্বনি তার ভেতরটা ভীতিতে ভরে দিলো।
এটা নয় যে সে নিজে অন্যদের সঙ্গে এই গুঞ্জনে অংশ নেয়নি; সেটা না নেওয়া সম্ভবও ছিলো না। আপনার অনভূতিকে গোপণ করা, চেহারায় অভিব্যক্তিতে নিয়ন্ত্রণ, অন্যরা যা করছে তা নিজেও করা এসবই এক সহজাত প্রতিক্রিয়া। তবে এরই মধ্যে কয়েকটি সেকেন্ড পাওয়া গিয়েছিলো যখন তার চোখের অভিব্যক্তি কল্পনায় তাকে প্রতারণা করে যায়। এবং ঠিক সেই মূহূর্তেই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে- হলফ করে বলতে পারে- নিশ্চিতভাবেই সেটা ঘটেছে।
এক মূহূর্তের জন্য ও’ব্রায়েনের চোখ ধরা পরে উইনস্টনের চোখে। ও’ব্রায়েন তখন উঠে দাঁড়িয়ে। চশমা জোড়া খুলে ফের তা স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় নাকের ডগায় বসাচ্ছিলেন। আর তখনই, ঠিক এক লহমার জন্য তাদের চোখাচোখি হয়। আর সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময়টুকুতেই উইনস্টন বুঝে ফেলে- হ্যাঁ সে ঠিক বুঝে নেয়- ও‘ব্রায়েনও তাই ভাবছেন যা রয়েছে তার নিজেরও ভাবনা জুড়ে। এক অভ্রান্ত বার্তা দেওয়া-নেওয়া হয়ে যায়। যেনো তাদের দুজনেরও দুটি মন খুলে গেছে, এবং তাদের একজনের ভাবনা চোখের চাহুনির গতিপথে অন্যজনের ভেতর ঢুকে গেছে। ও’ব্রায়েন যেনো তাকে বলে দিলেন, ‘আমি তোমার সাথে আছি। আমি স্পষ্ট করেই জানি কি রয়েছে তোমার ভাবনা জুড়ে। আমি তোমার অপছন্দের কথা জানি, তোমার ঘৃণার কথা জানি, তোমার ক্ষোভের কথা জানি। কিন্তু ভয় পেয়ো না, আমিও তোমার দিকেই আছি!’ এর পরপরই বুদ্ধিমত্তার সেই দীপ্তি নিমেষে মিইয়ে গেলো। আর ও’ব্রায়েনের চেহারা ঠিক অন্যদের চেহারার মতোই হেঁয়ালিপূর্ণ হয়ে উঠলো।
ব্যস এটুকুই। আর এরপর উইনস্টনের ভেতর আবারও অনিশ্চয়তা ভর করলো, আসলেই কি ঘটনাটি এমন ঘটেছে! এ ধরনের ঘটনা কখনোই কোনো পরিণতি পায় না। যা হয়, তা হচ্ছে- ভেতরে একটা বিশ্বাস অথবা প্রত্যাশা জাগ্রত হয় এই ভেবে যে, সে ছাড়া অন্যরা দলের শত্রু। ব্যাপক গোপণ ষড়যন্ত্রের যে গুজব, তা সত্যি হতেও পারে, হতে পারে ব্রাদারহুডেরও অস্তিত্ব রয়েছে! এত গ্রেপ্তার, এত স্বীকারোক্তি, এত মৃত্যুদণ্ডের পর ব্রাদারহুড যে কেবলই একটি জনশ্রুতি নয়, তা নিশ্চিত হওয়া কঠিন। কোনো কোনো দিন এতে তার বিশ্বাস হয়, কোনো দিন হয় না। কোনো প্রমাণ ছিলো না, কেবলই একটি পলায়নপর চোখের চাহুনি, যার কিছু অর্থ থাকতেও পারে; নাও থাকতে পারে। শুনে ফেলা কোনো কথপোকথন, টয়লেটের দেয়ালে লেখা শব্দের অষ্পষ্ট আঁকিবুকি- একদা, এমনকি, যখন দুই আগন্তুকের দেখা হয়, তখনও হাতের ছোট্ট নড়াচড়াই এক ধরনের স্বীকৃতির ইঙ্গিত বহন করে। এসব কিছুই অনুমান। সবই তার কল্পনা। ও’ব্রায়েনের দিকে আর একটি বারের মতোও না তাকিয়ে সে নিজের কক্ষে চলে গেলো। সেই এক লহমার দৃষ্টি বিনিময়ের কোনো ফলোআপ হতে পারে এমনটি তার মনেও আসেনি। মনে যদি সে কথা আসতো তাহলে তা হতো অকল্পনীয় বিপদের কারণ। এক দণ্ড, দু-দণ্ডের জন্য তারা তাদের অস্পষ্ট দৃষ্টি বিনিময় করেছে, আর সে গল্পের সেখানেই সমাপ্তি। যদিও সেটি ছিলো স্মরণযোগ্য ঘটনা, তবে তা স্রেফ রূদ্ধঘরের একাকীত্বেই স্মরণ করা যেতে পারে, আর তার মধ্য দিয়েই মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়।
উইনস্টন মাথা তুললো আর আরও সোজা হয়ে বসলো। পেটের ভিতর থেকে উঠে আসা একটি ঢেঁকুর বের করে দিলো। পাকস্থলী থেকে জিন ততক্ষণে পাক দিয়ে উপরে ঠেলে উঠতে চাইছে।
আবারও চোখ ফেললো কাগজের দিকে। সে দেখলো অসহায় চিন্তুাগ্রস্ততা নিয়ে সে যখন বসেছিলো তখনও সে আসলে লিখেই চলছিলো, যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সম্পন্ন হয়েছে সে কাজ। আর এই লেখা ঠিক আগের মতো ঘিঞ্জি, অসুন্দর হাতের লেখা নয়। তার কলম মনের সুখে মসৃণ পাতায় লিখে গেছে, বড় বড় অক্ষরে সে লেখা-
বিগ ব্রাদার নিপাত যাক
বিগ ব্রাদার নিপাত যাক
বিগ ব্রাদার নিপাত যাক
বিগ ব্রাদার নিপাত যাক
বিগ ব্রাদার নিপাত যাক…
এভাবেই বার বার, পুরো আধা পৃষ্ঠা জুড়ে একই লেখা।
আতঙ্কের বেদনায় মুষড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ রইলোনা উইনস্টনের। যদিও তা ছিলো অযৌক্তিক। কারণ ডায়রি লেখা শুরু করার যে বিপদ, এই কথাগুলো তার চেয়ে বড় বিপদের কারণ হবে; এমনটা নিশ্চয়ই নয়। তবে তারপরেও এক মূহূর্তের জন্য তার মনে হলো পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলে আর পুরো উদ্যোগটিই বাতিল করে দেয়।
কিন্তু সে তা করলো না, কারণ সে জানতো, অযথাই করা হবে সে কাজ। বিগ ব্রাদার নিপাত যাক লেখা কিংবা এই লেখা থেকে বিরত থাকা এসবের কোনো কিছুই কোনও ভিন্নতা বয়ে আনবে না। ধরা পড়লে থট পুলিশ তার সঙ্গে দুটো কাজের জন্য একই ব্যবহার করবে। আর যদি একটি বারের জন্যও সে কাগজে কলম না ছোঁয়ায়, তাতেও কিছু যায় আসে না। কারণ অপরাধ যা করার সে করে ফেলেছে। একটি বড় অপরাধের মধ্যেই লুক্কায়িত থাকে আর সব অপরাধ। ওরা একে বলে চিন্তাঅপরাধ (থটক্রাইম)। থটক্রাইম চিরদিন ঢেকে রাখা যায় না। আপনি হয়তো সফলভাবে সে অপরাধ কিছু সময়ের জন্য, এমনকি কিছু বছরের জন্য ঢেকে রাখতে পারবেন, কিন্তু আজ নয়তো কাল, এখনই নয়তো আরও পরে তা বেরিয়ে আসবেই।
কাজটি রাতেই ঘটে। গ্রেপ্তার করার জন্য রাতকেই ওরা বেছে নেয়। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ একটি ঝাঁকুনি, একটি কর্কশ হাত আপনার কাঁধে, আপনার চোখের ওপর আলো জ্বলছে, বিছানার চারিদিকে ঘিরে রয়েছে কঠিন মুখগুলো। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো বিচার-আচারের বালাই নেই, গ্রেপ্তারের কোনো খবরও নেই। মানুষগুলো ঠিক গুম হয়ে যায়, আর সব সময়ই তা রাতের বেলায়। এরপর আপনার নামটি নিবন্ধনের খাতা থেকে কেটে দেওয়া হবে। আপনি কোথায় কখন কি করেছেন তা সব মুছে ফেলা হবে। আপনি যে কখনো কেউ ছিলেন তাই অস্বীকার করা হবে, এবং এরপর ধীরে ধীরে সবাই সব ভুলে যাবে। আপনি বিলুপ্ত হয়ে যাবেন, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। সাধারনত যে শব্দটি ব্যবহার করা হয় তা হচ্ছে- ‘উবে যাওয়া’।
এক মূহূর্তের জন্য স্নায়ুবৈকল্যে পেয়ে বসলো উইনস্টনকে। সে আবার লেখা শুরু করলো এলোমেলো এবং আরও দ্রুততায়-
ওরা আমাকে গুলি করবে, আমি পরোয়া করি না। ওরা আমার ঘাড়ের পেছনে গুলি করবে, আমি পরোয়া করি না। বিগ ব্রাদার নিপাত যাক। ওরা সবসময়ই যে কাউকে ঘাড়ের পেছনে গুলি করে। কিন্তু তাতে আমি পরোয়া করিনা। বিগ ব্রাদার নিপাত যাক।
ফের চেয়ারে হেলান দিলো, আর কিছুটা লজ্জাবোধ করে আবার কলম নিয়ে ডায়রির ওপর ঝাপিয়ে পড়লো। এবার শুরু হলো আরও তীব্রতায়। ঘরের দরজায় ঠিক তখনই কড়া নাড়ার শব্দ।
এরই মধ্যে! ইঁদুরের মতো চুপ হয়ে বসে থাকলো সে এক অকারণ প্রত্যাশায়, যাই হোক সাড়া না পেয়ে একবার চেষ্টা করে চলে যেতে পারে। কিন্তু না, কড়া নাড়ার শব্দ বেড়েই চলছে। দেরি করার ফল হবে সবচেয়ে খারাপ। তার হৃদযন্ত্র ততক্ষণে দ্রিম দ্রিম দামামা বাজিয়ে চলেছে, কিন্তু চেহারাটি দীর্ঘ অভ্যাসের কারণে সম্ভবত তখনও ভাবলেশহীন। উঠে দাঁড়ালো, আর দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।
দ্বিতীয় অধ্যায়
দরজার নবে হাত দিয়েই উইনস্টনের চোখে পড়লো টেবিলের ওপর ডায়রিটা খোলা। পাতাজুড়ে লেখা আছে, ‘বিগ ব্রাদার নিপাত যাক’। সে লেখা এত বড় বড় অক্ষরে যে রুমের যে কোনো জায়গা থেকে পড়া যাবে। স্রেফ বোকামি বৈ কিছু নয়। তবে এত আতঙ্কের মাঝেও উইনস্টনের মাথায় এলো- এত সাধের নোটবুকটির ক্রিমের মতো মসৃণ পাতায় সদ্য লেখা ভেজা কালি ছেতড়ে যেতে পারে। সেটা উচিত হবে না। অতএব খোলাই থাক।
বড় একটা দম নিয়ে দরজা খুললো। আর সঙ্গে সঙ্গে স্বস্তির উষ্ণতা বয়ে গেলো শরীর জুড়ে। ফ্যাকাশে মুখে বিধ্বস্ত এক নারী উশকো-খুশকো চুলে তার দরজায় দাঁড়িয়ে।
‘ও কমরেড,’ বলার ভঙ্গিতে বিগলিত ভাব ছড়িয়ে দিলেন, রিনরিনে কণ্ঠ, ‘তুমি এসেছো টের পেলাম, একটু কি আসবে নাকি। আমার রান্নাঘরের সিঙ্কটা না বন্ধ হয়ে গেছে-’
ইনি মিসেস পারসন্স। একই তলার প্রতিবেশীর স্ত্রী। (পার্টিতে মিসেস বলার চল নেই। বরং বারণ আছে। আপনাকে বলতে হবে ‘কমরেড’। কিন্তু কতিপয় নারীকে দেখলে ওই শব্দটি ঠিক আসে না।) এই নারীর বয়স বছর ত্রিশেক, কিন্তু দেখতে আরও বয়সী মনে হয়। তাকালে মনে হবে তার মুখমণ্ডলের ভাঁজে ভাঁজে ধুলোর আস্তর জমে আছে। উইনস্টন কথা না বাড়িয়ে ওর পিছু নিলো।
এই ফালতু সারাইয়ের কাজটি এখন মোটামুটি তার নিত্য বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভিক্টরি ম্যানশন্সের ফ্ল্যাটগুলো বেশ পুরোনো। ১৯৩০ কিংবা ওই সময়েরই তৈরি। আর এখন এর ছাদ-দেয়ালের পলেস্তারাগুলো ঝরে ঝরে পড়ছে। একটু বেশি বরফ পড়লে পাইপ ফাটবেই। অর্থনীতির নীতির চাপে হিটিং সিস্টেম এখন বন্ধ। তবে যখন বন্ধ ছিলো না তখনও খুব যে ভালো কাজ করতো এমন নয়। সারাইয়ের কাজ নিজে নিজে করে নিতে পারলে ভালো তা না হলে কিছুই করার নেই। জানালার শার্সি ভাঙলেও তা সারাইয়ের দায়িত্ব যাদের তারা আসবে না। বছর দুই হয়ে গেলো এসবে নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে।
‘টম বাড়িতে নেই তাই ডাকছি,’ অষ্ফুট স্বর মিসেস পারসন্সের।
পারসন্সদের ফ্ল্যাটটি উইনস্টনের ফ্লাটের চেয়ে বড় আর একটু বেশিই নোংরা। সবকিছু যেনো ছিঁড়ে-খুঁড়ে ছড়িয়ে রয়েছে; যেনো কোনও অতিকায় হিংস্র জন্তু এইমাত্র গোটা ঘরটি দাবড়ে তছনছ করে গেছে। খেলার মালমাত্তা চারিদিকে- হকি-স্টিকস, বক্সিং গ্লাভস, ফেঁটে চুপসে যাওয়া ফুটবল, ঘামে জবজবে একটি শর্টস মেঝেতে উল্টো হয়ে পড়ে আছে। টেবিলে পড়ে আছে এঁটো থালা-বাসন আর একটা শরীরচর্চার বই। দেয়ালে ইয়ুথ লিগ ও স্পাইসের জ্বলজ্বলে ব্যানার আর বিগ ব্রাদারের প্রমাণ সাইজের একটি পোস্টার ঝুলছে। পুরো ভবন থেকেই সিদ্ধ বাঁধাকপির একটা গন্ধ সারাক্ষণই আসে। তার ওপর এই কক্ষে ছড়িয়ে আছে তীব্র ঘামের গন্ধ। প্রথম নিশ্বাসেই এই গন্ধ আপনার নাসিকা রন্দ্রে ধাক্কা দেবে। বোঝা দায়- একটি লোক যখন উপস্থিত নেই তখনও তার ঘামের তীব্র গন্ধটি কি করে গোটা কক্ষজুড়ে ছড়িয়ে থাকে। অপরকক্ষে কেউ একজন একটি চিরুনি আর একটুকরা টয়লেট পেপার হাতে টেলিস্ক্রিনের সামরিক বাজনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে।
‘বাচ্চাদের কাজ,’ দরজায় মুখটি গলিয়ে দিয়ে আধা-উদ্বেগের অভিব্যক্তি ছড়িয়ে বললেন মিসেস পারসন্স। ‘আজ ওরা বাইরে যায়নি। আর বুঝতেই পারছেন…’
মাঝপথে কথা থামিয়ে দেওয়া মিসেস পারসন্সের অভ্যাস। রান্নাঘরের সিঙ্ক কানায় কানায় ভরে আছে সবুজ রঙের ঘিনঘিনে পানিতে, তাতে সিদ্ধ বাঁধাকপির চেয়েও নিকৃষ্ট গন্ধ। উইনস্টন নিচু হয়ে পাইপের সংযোগ পয়েন্টটি দেখে নিলো। হাত দিতে গা গুলিয়ে আসছিলো। নিচু হয়ে দেখতেই ঘৃণাবোধ হচ্ছিলো তার। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণত কাশির ধমক উঠে যায়। মিসেস পারসন্স অবশ্য তখনও অসহায় মুখ করে তাকিয়ে।
‘টম বাড়িতে থাকলে চিন্তাই ছিলো না, ঠিক হাত দিয়ে পরিস্কার করে ফেলতো। এসবে হাত লাগাতে ওর একটুও খারাপ লাগে না।’
সত্য মন্ত্রণালয়ে উইনস্টনের সহকর্মী পারসন্স। মোটাসোটা, কিন্তু খাটুড়ে। হাঁদারাম গোছের, সবকিছুতেই বাড়তি আগ্রহ। কোন প্রশ্ন ছাড়াই যে দায়িত্বই দেয়া হোক কাজে লেগে পড়ে। থটপুলিশ নয়, আসলে এমন কিছু নিয়োজিত কর্মীর কারণেই পার্টি টিকে আছে।
পয়ত্রিশ বছর বয়সে ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাকে ইয়ুথ লিগ থেকে বের হয়ে আসতে হয়। ইয়ুথ লিগের আগে বয়সের বাধা সত্ত্বেও ব্যবস্থা করে বছরখানেক স্পাইসেও কাটিয়েছেন। সত্য মন্ত্রণালয়ে তার কাজ নিচের দিকের একটি পদে। এমনই কাজ যাতে বুদ্ধির প্রয়োগ নেই বললেই চলে। তবে স্পোর্টস কমিটিতে তিনি কিন্তু হোমড়া-চোমড়াদের একজন। এছাড়াও কমিউনিটি চাঙ্গা করার কর্মসূচি, তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ কর্মসূচি, সঞ্চয় ক্যাম্পেইনের মতো স্বেচ্ছাসেবী কর্মসূচি হলেও তাকে কমিটিতে রাখা হয়। তখন বেশ বুক ফুলিয়ে বিষয়টি সবাইকে জানান দিতে থাকেন পারসন্স। পাইপে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ভাব-ভঙ্গিমা দেখিয়ে ওসব বলবেন। গত চার বছরে কোনও সন্ধ্যায় কমিউনিটি সেন্টারে তাকে একটি বারের জন্য হলেও দেখা যায়নি, এমনটা ঘটেনি। আর জীবন সম্পর্কে তার উদাসীনতার প্রমাণ স্বরূপ ঘামের বিকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে থাকে তিনি যেখানে যান সেখানেই।
‘সংযোগ পয়েন্টের নাটটি মুছতে মুছতে উইনস্টন বললো, ‘আপনাদের ঘরে স্প্যানার আছে?’
‘স্প্যানার,’ বললেন মিসেস পারসন্স। পরে কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে এলো, বললেন, ‘আমি ঠিক জানি না, নিশ্চিত নই। সম্ভবত বাচ্চারা…।’
বুটের ঠক ঠক শব্দ আর চিরুনি ছুঁড়ে মারার শব্দ ভেসে এলো লিভিং রুম থেকে। মিসেস পারসন্স একটি স্প্যানার এগিয়ে দিলেন। উইনস্টন ঘৃণায় মুখ বাঁকিয়ে পাইপের সঙ্গে আটকে যাওয়া একদলা চুল ছাড়িয়ে আনলো। এরপর ট্যাপের ঠাণ্ডা পানিতেই ভালো করে আঙ্গুলগুলো সাফ করে পাশের রুমে গিয়ে দাঁড়ালো।
‘হাত তোলো’ ঝাঁঝালো একটি কণ্ঠ চিৎকার করে উঠলো।
হ্যান্ডসাম, কঠিন চেহারার নয় বছরের একটি ছেলে টেবিলের পেছন থেকে মাথা তুললো। একটি স্বয়ংক্রিয় খেলনা পিস্তল হাতে হুঙ্কার ছুড়তে ছুড়তে। অন্যদিকে তার ছোট বোনটি, বছর দুয়েকের ছোট হবে, একটি কাঠের টুকরো হাতে একই ভঙ্গিমায় চিৎকার করে যাচ্ছে। দুজনই নীল শর্টস আর ধূসর রঙের শার্ট পরা, গলায় লাল গলবন্ধ। এটা ছিলো স্পাইসের ইউনিফর্ম। উইনস্টন মাথার উপরে হাত দুটি তুলে দিলো, তবে অনেকটা অস্বস্তির সঙ্গে। ওদের কণ্ঠ ও অঙ্গভঙ্গি তার কাছে মোটেই শিশুসুলভ মনে হচ্ছিলো না। সবমিলিয়ে এটি খেলা বলে ভাবতেও মন সায় দিচ্ছিলো না তার।
‘তুমি ষড়যন্ত্রকারী!’ চিৎকার করে বললো ছেলেটি। ‘তুমি একজন থট ক্রিমিনাল (চিন্তা-অপরাধী)! তুমি ইউরেশীয় চর! আমি তোমাকে গুলি করবো। আমি তোমাকে বাষ্প করে দেবো। আমি তোমাকে লবন দ্বীপে পাঠিয়ে দেবো।’
এরপর হঠাৎই দুজনই ওর চারিদিকে ঘুরে ঘুরে লাফাতে শুরু করলো আর ‘চক্রান্তকারী!’, ‘চিন্তা-অপরাধী!’ বলে চিৎকার করতে লাগলো। ভাই যেটা বলছে, যা করছে, বোনও একই বুলি আর একই কাজ করে চলছে। বিষয়টি কিছুটা ভীতিরও ছিলো, ঠিক বাঘের ছানার তিড়িংবিড়িংয়ের মতো। শিগগিরই এগুলো বড় হবে আর মানুষখেকো হয়ে উঠবে। বালকটির চোখে এক ধরনের হিংস্রতা মাখা, যাতে মনেই হচ্ছিলো ও মনেপ্রাণে উইনস্টনকে আঘাত করতে কিংবা লাথি মারতে চাইছে। আর তা করার মতো বড়ও সে হয়ে উঠেছে। মন্দের ভালো এই যে, হাতে যে পিস্তলটি সেটি আসল নয়, খেলনা, ভাবলো উইনস্টন।
মিসেস পারসন্সের ভয়ার্ত দৃষ্টি উইনস্টনের দিক থেকে একবার বাচ্চাদের দিকে পড়লো আবার ফিরে এলো। আর লিভিং রুমের অপেক্ষাকৃত বেশি আলোয় এবার উইনস্টন সত্যিই দেখতে পেলো মিসেস পারসন্সের মুখমণ্ডলের ভাজে ভাজে ধুলোর আস্তর।
‘বাচ্চারা সাধারণত এত শোরগোল করে না!’ বললেন তিনি। ‘ফাঁসির কার্যক্রম দেখতে যেতে না পেরে ওরা মন খারাপ করে আছে। আর সে জন্যই এমন আরচণ করছে। এত ব্যস্ততা যে ওদের নিয়েই যেতে পারলাম না। আর টমতো কাজ থেকে সময় মতো ফিরবেই না।’
মোটা কর্কশ কণ্ঠে ছেলেটি চিৎকার করে উঠলো, ‘কেনো আমরা ফাঁসি দেখতে যেতে পারবো না?’
‘ফাঁসি দেখতে চাই! ফাঁসি দেখতে চাই!’ চিৎকার জুড়ে দিলো ছোট মেয়েটিও। তখনও সে ঘুরছে উইনস্টনের চারিদিক।
ইউরেশীয় কয়েকজন কারাবন্দী যুদ্ধাপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। ওই সন্ধ্যায় পার্কে ওদেরই ফাঁসি হওয়ার কথা, মনে পড়লো উইনস্টনের। প্রতি মাসেই একবার এমন ফাঁসির আয়োজন থাকে। আর এখন এই ফাঁসি খুব জনপ্রিয় একটি দৃশ্যে পরিণত হয়েছে। শিশুরা এই ফাঁসি দেখার জন্য খুব চেচামেচি করে। মিসেস পারসন্সের কাছে বিদায় নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো উইনস্টন। কিন্তু প্যাসেজ ধরে ছয় পা যেতেই কিছু একটা তার ঘাড়ের পেছনের দিকে আঘাত করলো। ভীষণ ব্যাথা অনুভব করলো সে। মনে হলো যেনো একটি লাল হয়ে যাওয়া উপ্তপ্ত শলাকা শরীরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। ঘুরে দেখলো মিসেস পারসন্স ছেলেকে টেনে হিঁচড়ে দরজার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। আর তখনই ছেলেটি তার পকেটে একটি গুলতি ঢুকিয়ে ফেললো।
দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দের আগেই তার কানে আসলো বালকটির কণ্ঠ ‘গোল্ডস্টেইন’। তবে উইনস্টনকে যা সবচেয়ে আলোড়িত করলো তা হচ্ছে নারীটির ফ্যাকাশে চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়া ভীতির অভিব্যক্তি।
ফ্ল্যাটে ফিরে একটু ত্রস্ত পায়েই টেলিস্ক্রিনের সামনেটা পার হয়ে আবারও টেবিলের ওপর বসলো সে। ঘাড়ের ব্যাথার ওপরে এক হাত দিয়ে ডলতে লাগলো। টেলিস্ক্রিনের বাজনা বন্ধ হয়েছে। পরিবর্তে একটি ফ্যাসফেসে সামরিক কণ্ঠ নৃশংসতামাখা উচ্চারণে পাঠ করে যাচ্ছিলো নতুন ভাসমান ঘাঁটির অস্ত্র-শস্ত্রের বর্ণনা। আইসল্যান্ড ও ফারো আয়ল্যান্ডের মাঝামাঝি কোনও একটি স্থানে নোঙ্গর করেছে এই ভাসমান ঘাঁটি।
বাচ্চাগুলোকে নিয়ে এই নারীর সদাসন্ত্রস্ত জীবন, ভাবলো সে। আর মোটে এক কিংবা দুটি বছর। এরা এই নারীর কোনো শাসনই আর মানবে না। আজকাল প্রায় সব শিশুরই একই ভয়ঙ্কর দশা। সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটি হচ্ছে, স্পাইসের মতো সংগঠনগুলোর মাধ্যমে এরা প্রক্রিয়াগতভাবেই ছোট ছোট বেপরোয়া নৃংশস চরিত্র হিসেবে গড়ে উঠছে। আবার এমন একটা মনোভাবও তৈরি হচ্ছে যা তাদের দলের বিরুদ্ধে কোনভাবেই বিদ্রোহী করে তুলবে না। দল ও দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত যেকোনো বিষয়ের প্রতি তাদের অগাধ বিশ্বস্ততা। দলীয় সঙ্গীত, মিছিল, ব্যানার, প্রচার, ডামি রাইফেল নিয়ে মহড়া, স্লোগান আর বিগ ব্রাদারের স্তুতিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে তারা। তাদের যত নৃংশতা সব রাষ্ট্রের শত্রুর বিরুদ্ধে, বিদেশিদের বিরুদ্ধে, যড়যন্ত্রকারী, নাশকতাকারী আর চিন্তা-অপরাধীদের বিরুদ্ধে। আর ত্রিশ বছর পার করে যেকোনো বাবা-মা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে নিজেদের সন্তানদের নিয়েই। কারণটা সঙ্গত। এমন একটি সপ্তাহও যাবে না যখন ‘দ্য টাইমস’ এই আড়িপাতা পাজিগুলোকে, ‘বীর শিশু’ তকমা দিয়ে তাদের কৃতিত্ব গাঁথা প্রকাশ করছে না। এই শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের কথা-বার্তা শুনে ফেলে আর থট পুলিশের কাছে তাদের খাটো করে।
গুলতি দিয়ে ছোড়া বুলেটের ব্যাথা কিছুটা কমেছে। ডায়রিতে লেখার জন্য আর কিই বা আছে- এমন একটি ধন্দের মধ্যে থেকে অনেকটা নিরুৎসাহী ভঙ্গিতে কলমটি তুলে নিলো উইনস্টন। আর হঠাৎ করেই ও’ব্রায়েনকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলো সে।
বছর কয়েক আগে… কত বছর হবে? নিদেন পক্ষে বছর সাতেকতো বটেই…একবার সে স্বপ্ন দেখলো একটি নিকষ-কালো অন্ধকার কক্ষের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একদিকে কেউ একজন বসে। যখন সে অতিক্রম করে যাচ্ছে ঠিক তখনই লোকটি বলে উঠলো: ‘আমাদের এমন একটি স্থানে দেখা হবে যেখানে কোনো অন্ধকার থাকবে না।’ খুব ধীর আর ভাবলেশহীন ভাবেই কথাটি বললো সে। এ যেনো স্রেফ একটি কথার কথা, কোনো নির্দেশনা নয়। স্বপ্নে লোকটি হেঁটেই চললো, থামলো না। কৌতুহলের বিষয় হচ্ছে সে সময় স্বপ্নের মাঝে কথাগুলো তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া ছড়ায়নি। কিন্তু পরে তার কাছে কথাগুলো ক্রমশই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে। এখন আর মনে নেই ওই স্বপ্নটি সে ও’ব্রায়েনের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে দেখেছিলো, নাকি পরে। তার এও মনে নেই, ঠিক কখন সে ধরতে পেরেছিলো ওই কণ্ঠটি ছিলো ও’ব্রায়েনের। এই ধরতে পারায় কোনো খুঁত নেই। সেই অন্ধকার কক্ষে তাকে কথাটি যিনি বলেছিলেন তিনি ও’ব্রায়েন বৈ আর কেউ নন।
ও’ব্রায়েন তার শত্রু নাকি মিত্র- উইনস্টন কখনোই তা নিশ্চিত হয়ে ভাবতে পারেনা- এমনকি আজ সকালে তাদের চোখাচোখিতে যে লহমামাত্র হলেও একটা ঝলকানি খেলে গেলো, তারপরেও পারেনি। কখনো বিষয়টি নিয়ে খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবেও নি সে। তবে এইটুকু বোঝে, তাদের মধ্যে পারষ্পরিক অনুধাবনের একটা যোগসাজশ আছে, যা এই ভালোলাগা বা অংশীদারীত্বের চেয়ে বেশি গুরুত্ব রাখে। ‘আমাদের দেখা হবে যেখানে কোনো অন্ধকার থাকবে না,’ এটাইতো বলেছিলেন তিনি। উইনস্টন জানতো না, কীই এর মানে। তবে খুব মনে হয়, এভাবে নয়তো অন্য কোনোভাবে একদিন কথাটি সত্যি হবে।
টেলিস্ক্রিনের শব্দটা হঠাৎই থেমে গেলো। এরপর ইথারে ভেসে এলো একটি স্পষ্ট কণ্ঠের ঘোষণা-
অ্যাটেনশন প্লিজ! আমাদের ম্যালাবার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এই মাত্র খবর এলো- দক্ষিণ ভারতে আমাদের সৈন্যরা গৌরবময় বিজয় অর্জন করেছে। আমি দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে জানাচ্ছি, যে ঘটনার কথা আমরা এখন বললাম তা থেকে বুঝে নেওয়া যায়, যুদ্ধ এখন শেষের দিকে।
তাহলে খারাপ খবর আসছে, ভাবলো উইনস্টন। সে পুরোই নিশ্চিত যে, নিহত আর কারারুদ্ধদের ভয়াবহ সংখ্যাগুলো ঘোষণার পাশাপাশি এক ইউরেশীয় সেনাকে হাপিস করে দেওয়ার যে নৃশংস বর্ণনা চলছে এর পরপরই ঠিক জানিয়ে দেওয়া হবে- আগামী সপ্তাহ থেকে চকোলেটের রেশন ত্রিশ গ্রাম থেকে কমিয়ে বিশ গ্রাম করা হলো।
আরেকবার ঢেঁকুর তুললো উইনস্টন। পাকস্থলী চিমসে করে দিয়ে বাষ্প হয়ে বের হয়ে যাচ্ছে জিন। টেলিস্ক্রিনে, হতে পারে বিজয়ের উল্লাস প্রকাশে, হতে পারে হারানো চকোলেটের স্মৃতি মুছে দিতে, হঠাৎই ঝনঝনিয়ে বেজে উঠলো ‘ওসেনিয়া টিস ফর দি’ (ওসেনিয়া এ তোমারই জন্যে)। এই গান যখন বাজবে আপনাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই হবে। তবে রক্ষা, যেখানটাতে সে বসে সেখান থেকে তাকে টেলিস্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে না।
‘ওসেনিয়া ‘টিস ফর দি’ ধীরে ধীরে হালকা বাজনা স্তিমিত হয়ে আসলো। উইনস্টন টেলিস্ক্রিনে পেছন রেখে জানালার দিকে গেলো। দিনটি যেমন ঠাণ্ডা তেমনি উজ্জ্বল। দূরে কোথাও একটি রকেট বোমা বিষ্ফোরণের ভোঁতা শব্দ ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলছে। লন্ডনে আজকাল প্রতি সপ্তাহে ওগুলোর বিশ-ত্রিশটি করে পড়ছে।
নিচে রাস্তায় বাতাসে ছেঁড়া পোস্টারের সেই কোনাটি অবিরাম ঝাপটা খাচ্ছে, আর ইংসক শব্দটি একবার দৃশ্যমান হচ্ছে, আর একবার ঢাকা পড়ছে। ইংসক। ইংসকের পূজনীয় নীতি। নিউস্পিক, ডাবলথিঙ্ক, মিলিয়ে যাওয়া অতীত। তার মনে হলো সমুদ্রের তলদেশে কোনো জঙ্গলে দিক হারিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কোনো এক দৈত্যের রাজ্যে হারিয়ে গেছে সে, আর সেখানে সে নিজেই এক দৈত্য বনে গেছে। সে একা। স্রেফ একা। অতীত মরে গেছে, ভবিষ্যত কল্পনায় আসছে না। এমন কোন নিশ্চয়তা নেই যে একজন মানব সন্তানকে আর কখনো সে তার পাশে পাবে? আর কিভাবেই বা জানবে- পার্টির এই আধিপত্য চিরদিন ধরে টিকে থাকবে কি না? এসব প্রশ্নেরই একটি উত্তর হয়ে তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সত্য মন্ত্রণালয়ের সামনের সেই তিনটি স্লোগান:
যুদ্ধই শান্তি
স্বাধীনতা দাসত্ব
অবজ্ঞাই শক্তি।
পকেট থেকে পঁচিশ সেন্টের একটি মুদ্রা বের করলো। এতেও একপীঠে খোদাই করা এই স্লোগান; অন্য পীঠে বিগ ব্রাদারের মুখ। ওই মুদ্রার মধ্যে থেকেও চোখ দুটি পাকিয়ে যেনো তাকেই দেখছে। মুদ্রায়, ডাক টিকিটে, বইয়ের মলাটে, ব্যানারে, পোস্টারে, সিগারেটের প্যাকেটে- সবখানেই। সবসময়ই চোখ দুটো আপনাকে দেখছে এবং একটি কণ্ঠস্বর আপনাকে বন্দি করছে। ঘুমিয়ে কিংবা জেগে, কাজে কিংবা ভোজনে, ঘরে কিংবা বাইরে, গোসলে কিংবা বিছানায়- কোথাও মুক্তি নেই। খুলির ভেতরে গোটা কয় ঘন সেন্টিমিটার জুড়ে আপনার যে মগজ ওইটুকু ছাড়া আপনার নিজের বলে আর কিছুই নেই।
সূর্য ততক্ষণে উল্টো আকাশে পড়েছে। সত্য মন্ত্রণালয়ের অগুনতি জানালার শার্সিতে আলো ঠিকরাচ্ছে না বলে ওগুলোকে বিশাল দুর্গের গায়ে ছোট ছোট ঘুপচির মতো লাগছে। এর অতিকায় পিরামিডীয় আকৃতি ভয় ধরিয়ে দেয়। এতই শক্ত এর গড়ন যে কিছুতেই কিছু হবে না। হাজার হাজার রকেট বোমা ফেললেও না। মনের মধ্যে আবার সেই একই ভাবনা, কার জন্য এই ডায়রি লিখছে সে। ভবিষ্যতের জন্য, অতীতের জন্য- কোনোও একটি কল্পিত সময়ের জন্য! তার সামনে যা অপেক্ষা করছে তা মৃত্যু নয়, স্রেফ ধ্বংস। ডায়েরিটাকে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হবে, আর তাকে বাষ্পে পরিণত করা হবে। অস্তিত্ব ঘুচিয়ে দেওয়ার আগে, স্মৃতি থেকে সরিয়ে ফেলার আগে সে যা লিখেছে তা কেবল থট পুলিশই পড়বে ও জানবে। তাহলে আপনার কোনও অস্তিত্বই যখন থাকছে না, এমনকি এক টুকরো কাগজে নামহীন-অর্থহীন একটি শব্দও টিকে থাকছে না, তখন ভবিষ্যতের কাছে নালিশেরই বা কী উপায়?
টেলিস্ক্রিন দুপুর ২টার ঘণ্টা বাজালো। দশ মিনিটের মধ্যেই তাকে বের হতে হবে। আড়াইটার মধ্যেই ফিরতে হবে কাজে।
তবে এই ঘণ্টাধ্বনি তার ভেতরে একটি নতুন ভাবনার জন্ম দিলো। সে এক একাকী দৈত্য, সত্য উচ্চারণ করে চলেছে যা কেউ কখনো শুনতেও পাবে না। কিন্তু যখন সে তা উচ্চারণ করছে, হতে পারে অতি মিনমিনে সে উচ্চারণ, তাতে একটা ধারাবাহিকতাতো রক্ষা হলো। কথাগুলো অন্যকে শোনানোর মধ্য দিয়ে নয়, বরং যে মানব ঐতিহ্য সে বহন করে তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার মধ্য দিয়েই এই ধারাবাহিকতা রক্ষা পাবে। টেবিলে ফিরে গেলো উইনস্টন, কালিতে কলম চুবিয়ে নিয়ে সে লিখলো:
ভবিষ্যত কিংবা অতীতেই যাই, পৌঁছুতে হবে একটি সময়ে যখন চিন্তাগুলো মুক্ত হবে, যখন মানুষগুলো একে অন্যের থেকে আলাদা হবে, কিন্তু তারা আর একা হয়ে যাবে না- উপনীত হতে হবে এমন একটি সময়ে যখন তাতে সত্য বিরাজ করবে, আর যা কিছু ঘটছে কিংবা ঘটে গেছে তাকে মুছে দেওয়া হবে না: সরে যেতে চাই এই উর্দির যুগ থেকে, একাকীত্বের যুগ থেকে, বিগ ব্রাদারের যুগ থেকে, দ্বৈত চিন্তার যুগ থেকে- শুভেচ্ছা!
ধরেই নেওয়া যায় তার মৃত্যু হয়ে গেছে, ভাবলো উইনস্টন। তার মনে হলো, এখুনি সে তার ভাবনাগুলো গুছিয়ে ভাবতে শুরু করেছে, সে একটি সিদ্ধান্তেও উপনীত হতে পেরেছে। যে কোনো কাজের পরিণতি ওই কাজের মধ্যেই নিহিত থাকে। সে লিখলো:
চিন্তাঅপরাধ মৃত্যু ডেকে আনে না: চিন্তাঅপরাধ নিজেই এখন মৃত।
নিজেকে একজন মৃত মানুষ হিসেবে মেনে নিয়ে যতক্ষণ সম্ভব বেঁচে থাকাটাই এখন তার কাছে সবচেয়ে জরুরি বলে মনে হলো। ডান হাতের দুটি আঙ্গুলে কালি লেপ্টে গেছে। এতেও আপনি ধরা পড়ে যেতে পারেন। মন্ত্রণালয়ের কিছু নাক গলানো কর্মী (কোনও নারী, হতে পারে সেই ধূসরকেশী কিংবা ফিকশন ডিপার্টমেন্টের কালোকেশী) আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে- কেনো সে মধ্যাহ্ন বিরতিতে লিখতে গেলো- কেনই সে একটি সেকেলে কলম ব্যবহার করলো, কীই বা সে লিখছিলো- এবং অতঃপর যথাযথ কর্তৃপক্ষে একটি ইঙ্গিতও ঠুকে দিয়ে আসতে পারে। বাথরুমে ঢুকে পড়লো উইনস্টন। খসখসে কালচে বাদামি রঙের সাবান, যা হাতে ঘষলে পিচ্ছিল নয়, বরং শিরিস কাগজের মতো চামড়ায় ঘসা লাগায়, তাই দিয়ে যত্নের সঙ্গে আঙুলগুলো পরিষ্কার করলো। ডায়রিটি ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখলো। এটি লুকিয়ে রাখার ভাবনা বৃথা, বরং ভাবলো ডায়রিটি এমনভাবে রেখে যেতে পারে যাতে যে কেউ দেখে ভাববে এটি এখানে অধরা পড়ে আছে অনেকদিন। পাতাগুলোর শেষ মাথায় আড়াআড়ি একটি চুল থাকতেই পারে। চিমটি দিয়ে কিছুটা সাদাটে ধুলো তুলে এনে মলাটের এক কোনায় এমনভাবে রাখলো, যাতে যে কেউ ভাবতে পারে ডায়রিটি কেউ ধরলে এই ধুলাগুলো গড়িয়ে পড়তো, এভাবে জমে থাকতো না।
তৃতীয় অধ্যায়
মাকে স্বপ্ন দেখছিলো উইনস্টন।
মা যখন চলে গেলেন তখন তার বয়স দশ-এগারো বছর। লম্বা গড়নের নিশ্চল খোদাই মূর্তির মতো নিরব এক নারী ছিলেন মা। ধীর লয়ে চলাফেরা করতেন, মাথায় উজ্জ্বল সাদা চুল। বাবাকে যতটা মনে পড়ে হালকা-পাতলা গড়নের ছিলেন। কালো পোশাকে অভ্যস্ত ছিলেন। (উইনস্টনের মনে পড়ে তার বাবার জুতোর তলি থাকতো খুবই পাতলা) চশমা পরতেন। পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে দেখা মুখদুটো আবছা মনে আসে।
স্বপ্নে উইনস্টন দেখছিলো তার মা অনেক গভীরে নীচে একটি জায়গায় বসে আছেন। কোলে তার ছোট বোনটি। বোনটিকে উইনস্টনের আর মনেই পড়ে না। ক্ষুদে দুর্বল একটি শিশু, বড় বড় চোখ করে সদাই নিরব তাকিয়ে থাকতো, এটুকুই মনে আসে। গভীর খাদ থেকে ওরা দুজনই উইনস্টনের দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা যেখানে তার যেনো কোনও তল নেই। নলকূপের গভীর তলদেশ যেমনটা হয়, অথবা গভীর কোনো কবর- এটি এমনই এক স্থান যা ওর থেকে অনেক অনেক নীচে, আর তারা আরও নীচেই নেমে যাচ্ছিলো। ওরা যেনো একটি ডুবন্ত জাহাজের সেলুনের ভেতর, আর ক্রমেই অন্ধকার হয়ে আসা পানির ভেতর থেকে ওরা উপরে তার পানে তাকিয়ে। ওরা তখনও তাকে দেখতে পাচ্ছে আর সেও ওদের দেখছে, কিন্তু ক্রমশঃই ওরা গভীর থেকে আরও গভীরে ডুবে যাচ্ছিলো। ডুবে যাচ্ছিলো সবুজ জলরাশির ভেতর, যেনো তারা একবার চোখের আড়াল হলে চিরতরে হারিয়ে যাবে। সে বাইরে, চারিদিকে আলো-বাতাস, আর ওদের মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর সে উপরে বলেই ওরা নীচে যাচ্ছে। এটা সে জানতো, ওরাও জানতো। আর ওরা যে জানে তা ওদের চেহারায় ফুটে রয়েছে। তবে এ জন্য ওদের চেহারায় কিংবা হৃদয়ের গভীরে কোনো অভিযোগ নেই। ওদের একটা বিষয় জানা, মৃত্যুই তাদের পথ আর তা এই জন্য যে, উইনস্টনকে বেঁচে থাকতে হবে। এটাই যেনো এক অমোঘ বিধান।
কি ঘটেছিলো তা আর মনে নেই, তবে স্বপ্নে সে জানতো, কোনও না কোনও পথে তার জীবনের জন্যই মা ও বোনের জীবন উৎসর্গ হয়েছে। কিছু স্বপ্ন আছে যাতে স্বপ্নের দৃশ্যপটে মনোজাগতিক জীবনের বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে আসতে থাকে এবং স্বপ্নের মাঝেই কিছু ঘটনা ও ভাবনা এসে যায় যা সম্পর্কে স্বপ্নদ্রষ্টা সতর্ক হয়ে ওঠে, যা আবার স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর জাগ্রত অবস্থায়ও মূল্যবান মনে হতে থাকে। এটিও ছিলো তেমনই এক স্বপ্ন।
এখন উইনস্টনের মনে যা খেলে যাচ্ছে, তা তার মায়ের হারিয়ে যাওয়ার স্মৃতি। বছর ত্রিশেক আগের সে ঘটনা যতটা হৃদয়ভাঙ্গা ছিলো এখন আর তেমনটা ঘটে না। বিয়োগান্তক এই বিষয়গুলো আগেই বেশি আলোড়িত করতো। সে সময় মানুষের কাছে একান্ততা, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব এগুলোর মূল্য ছিলো। পরিবারের একজনের পাশে অন্যজন দাঁড়াতো, প্রশ্নটিও করতো না। মায়ের হারিয়ে যাওয়ার স্মৃতি তার হৃদয়টাকে ভেঙ্গে দেয় কারণ তাকে ভালোবেসেই ছিলো মায়ের চলে যাওয়া। সে সময় প্রতিদানে ভালোবাসা দেওয়ার মতো বড় সে ছিলো না। আর সে মনেও করতে পারে না কিভাবে আনুগত্যের কাছে ছিলো তার আত্মোৎসর্গ, যা ছিলো একান্তই ব্যক্তিগত আর অবশ্যম্ভাবী।
অতীতে যা কিছু সে দেখেছে, আজকাল আর তা ঘটেই না। ভয়, ঘৃণা ও কষ্ট জর্জরিত একটি সময় এখন। এখানে আবেগের মর্যাদা নেই, কোনও গভীর বা যৌগিক দুঃখবোধও কাজ করে না। অথচ এর সবটাই সে যেনো দেখতে পেলো তার মা ও বোনের দুজোড়া বিষ্ফোরিত চোখে। উর্ধ্বপানে দৃষ্টি মেলে তারা তাকে দেখছিলো, সবুজ পানির ভেতর থেকে, শতশত বাঁও গভীর থেকে তারা দেখছিলো। আর তখনও তারা আরও গভীরেই ডুবে যাচ্ছিলো।
এবার দেখলো, কোনও এক গ্রীস্মের বিকেলে একটি স্প্রিংয়ের টার্ফের ওপর সে দাঁড়িয়ে। সূর্যের তীর্যক আলো ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে। এমন একটি দৃশ্যপট এই প্রথম নয়, প্রায়শঃই তার স্বপ্নে আসে, তবে উইনস্টন নিশ্চিত হতে পারে না, বাস্তবে কখনোই এমনটি সে দেখেছে কি না। তার বয়ে চলা চিন্তাধারায় নিজেই এর নাম দেয় সোনালি দেশ। একটি খরগোশের আঁচড়কাটা পুরোনো চারণভূমি, মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে পায়েচলা পথ। আর ছোট ছোট ঢিবি ছড়িয়ে এখানে সেখানে। মাঠের উল্টোদিকের শীর্ণ বেড়া ঘেঁষে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে দেবদারু গাছের পাতাগুলো মৃদুমন্দ বাতাসে ঝিরিঝিরি নড়ছে। নারীর চুল যেমন বাতাসে ওড়ে দেবদারুর পাতায়ও তেমন নাচন লেগে আছে। যদিও দৃষ্টির বাইরে, তাও বুঝা যাচ্ছে কাছেই কোথাও ধীর স্রোতে বয়ে চলছে স্বচ্ছজলের নদী, যাতে উইলো গাছের ছায়ায় মিঠা পানির মাছেরা সাঁতার কাটছে।
কালোকেশী মেয়েটি মেঠোপথ ধরে এগিয়ে আসছে। এক লহমায় তার মনে হলো মেয়েটি তার গায়ের পরিধান টেনে ছিঁড়ছে আর তাচ্ছিল্যভরে আশেপাশে ছুঁড়ে ফেলছে। তার ফর্সা, নিটোল দেহবল্লরী উইনস্টনের মধ্যে কোনও আগ্রহই তৈরি করছে না, এমনকি সেদিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না সে। বরং শরীর থেকে কাপড় ছুঁড়ে ফেলায় মেয়েটির যে তাচ্ছিল্যের প্রকাশ ছিলো, সেটিই তাকে বেশি আলোড়িত করছে। এই সাবলীল অবজ্ঞা প্রকাশের মধ্য দিয়ে একটি সংস্কৃতি বিধ্বস্ত হলো, ধ্বংস হলো চিন্তার প্রক্রিয়া। একটি অসামান্য বাহুছোঁড়ার ভঙ্গিমায় যেনো বিগ ব্রাদার, পার্টি আর থট পুলিশ অসারতায় ভেসে গেলো। এটিও ছিলো প্রাচীণ সময়েরই একটি ভঙ্গিমা। ‘শেক্সপিয়র’ শব্দটি ঠোঁটে নিয়ে ঘুম ভাঙলো উইনস্টনের।
কান ঝাঁঝানো সিটি বাজিয়ে চলছে টেলিস্ক্রিন। ত্রিশ সেকেন্ড ধরে একই স্বরে বাজলো সে শব্দ। সকাল সোয়া সাতটার সাইরেন, অফিস কর্মীদের ঘুমভাঙ্গার সময়। বিছানা ছাড়লো উইনস্টন। ন্যাংটো সে। আউটার পার্টির একজন সদস্য কাপড়ের জন্য বছরে ৩০০০ কুপন পায়, তার মধ্যে একটি পাজামায়ই খরচ হয়ে যায় ৬০০। তা পরে ঘুমিয়ে নষ্ট করার মানে হয় না। হাত বাড়িয়ে চেয়ারের উপরে রাখা ময়লা গেঞ্জি আর শর্টস তুলে নিলো। তিন মিনিটের মধ্যেই শুরু হবে শরীর চর্চা। এসময় তার উঠলো কাশির দমক। ঘুম থেকে উঠলেই এমনটা হয় উইনস্টনের। এতে তার ফুসফুস পুরোই ফাঁকা হয়ে গেলো। চিৎ হয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ হাঁপানোর পর স্বাভাবিক নিশ্বাস নিতে পারলো। কাশির দমকে তার শিরাগুলো ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম। পাশাপাশি আলসারের ব্যাথাও চাগাড় দিয়ে উঠলো।
‘ত্রিশ থেকে চল্লিশের গ্রুপ!’ কর্কশ নারী কণ্ঠ বেজে উঠলো। ‘ত্রিশ থেকে চল্লিশের গ্রুপ! অনুগ্রহ করে জায়গায় দাঁড়ান। ত্রিশের থেকে চল্লিশের!…’
টেলিস্ক্রিনের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়ালো উইনস্টন। স্ক্রিনে ততক্ষণে লিকলিকে অথচ পেশীবহুল, জোব্বা গায়ে, শরীর চর্চার জুতো পায়ে তরুণীর মতো দেখতে এক নারীর ছবি ভেসে উঠেছে।
‘হাত বাঁধো, হাত ছাড়ো!’ তারস্বরে বললো মেয়েটি। ‘আমার সঙ্গে সঙ্গে… এক, দুই, তিন চার! এক, দুই, তিন, চার! কাম অন কমরেডস, জীবনের কিছুটা সময় এখানে দাও! এক, দুই, তিন, চার! এক, দুই, তিন, চার!…’
কাশির অমন কঠিন দমকও উইনস্টনের মন থেকে স্বপ্নের জের পুরোপুরি কাটিয়ে দিতে পারেনি। এখন ব্যায়ামের নামে এই যে তালে তালে শরীরটাকে হেলাচ্ছে দোলাচ্ছে তাতে তার মন জুড়ে স্বপ্নের বিষয়গুলোই ফিরে ফিরে আসছিলো। যন্ত্রের মতো হাত দুটো সামনে পেছনে ছুঁড়তে ছুঁড়তে, আর শরীর চর্চায় স্ক্রিনের সামনে যথার্থ মনে করা হয় এমন একটি আত্মতুষ্টির ভাব মুখাবয়বে মেখে নিয়ে, ভাবনার ক্যানভাস জুড়ে ছেলেবেলার সেই অনুজ্জ্বল সময়টিকে নিয়ে আসার অনবরত কসরত চালিয়ে যাচ্ছিলো সে। অস্বাভাবিক কঠিন এক সময় ছিলো তখন। পঞ্চাশের দশকের শেষভাগটাই একটু আধটু মনে পড়ে। এর আগের সব স্মৃতিই ঝাপসা। বস্তুত এর বাইরের কোন একটি কিছুরই অস্তিত্ব এখন আর নেই যার কথা উল্লেখ করা চলে। এমনকি নিজের জীবনের বাহ্যিক রেখাগুলোও উবে গেছে। অনেক কিছুই আপনার মনে পড়বে, যা আদৌ ঘটেছে কিনা নিশ্চিত করা যাবে না, খুব সম্ভবত ঘটেই নি। আবার অনেক ঘটনার কথা আপনার মনে পড়বে বটে, কিন্তু সেগুলোর পারিপার্শ্বিকতা আবহ এগুলো ধরতে পারবেন না। দীর্ঘ একটা সময় ছিলো স্রেফ শুন্যতার। যখনকার কথা কিছুই মনে পড়ে না। বস্তুত ওই সয়মটিতে আপনি আসলে কিছু করেনও নি, কিংবা করতেও পারেননি। তখনকার সময়টি সবকিছুই ছিলো অন্যরকম। এমনকি দেশগুলোর নাম, মানচিত্রে সেগুলোর আকার, তাও ছিলো ভিন্ন। এয়ারস্ট্রিপ ওয়ানের কথাই ধরুন না। সে সময়ে এই অংশকে বলা হতো ইংল্যান্ড বা ব্রিটেন। তবে উইনস্টনের নিশ্চিত মনে পড়ে লন্ডনকে তখনো লন্ডনই বলা হতো।
তার দেশ যুদ্ধে লিপ্ত নয়, এমন কোনও একটা সময়ের কথা উইনস্টনের মনেই আসে না। তবে শৈশবে এক দীর্ঘ শান্তিবিরতির কথা খুব মনে পড়ে। শৈশবের যত স্মৃতি মনে আসে তার অন্যতম হলো বিমান হামলার এক বিভিষীকাময় দিন। সেদিন সবাইকে বিষ্মিত করে দিয়ে সে হামলা হয়েছিলো। হতে পারে কলচেস্টারে যেবার আনবিক বোমা পড়েছিলো, সেবারেরই ঘটনা। হামলার কথা তার ঠিকঠাক মনে নেই, তবে মনে আছে বাবা শক্তহাতে তার হাতটি ধরে আছেন আর ওরা সবাই মিলে দ্রুত নিচের দিকে নামে যাচ্ছিলো মাটির গভীর সুরঙ্গ পথ ধরে ঘোরানো প্যাঁচানো একটি সিঁড়ি বেয়ে। পায়ের তলার সিঁড়িতে ধপধপ শব্দ হচ্ছিলো। আর সে এতই কাহিল হয়ে পড়েছিলো যে কান্না জুড়ে দিয়েছিলো। এক পর্যায়ে তারা কিছুক্ষণ থেমে জিরিয়েও নেয়। মা তার চিরাচরিত ধীর আর স্বাপ্নিক ভঙ্গিমার হাঁটাচলায় ঠিক কুলোতে পারছিলেন না ফলে তাদের চেয়ে অনেক পিছনে পড়ে গিয়ে এগুচ্ছিলেন। তার কোলে শিশু ছোটবোনটি- অথবা হতে পারে স্রেফ একটি কম্বলের বস্তা কাঁখে করেই তিনি নামছিলেন সেই সিঁড়ি বেয়ে। তার নিশ্চিত করে মনে পড়ে না, সে সময় তার ছোট বোনটির জন্ম হয়েছিলো, নাকি হয়নি। অবশেষে তারা একটি স্থানে গিয়ে পৌঁছালো, সেখানে ভীষণ শোরগোল আর হাজারো মানুষের ভীর। তার মনে পড়ে ওটি সম্ভবত একটি টিউব স্টেশনই ছিলো।
পাথর বসানো মেঝেতে বসে ছিলো অনেকে, কয়েকজন করে ঠাসাঠাসি হয়ে কতগুলো ধাতব মঞ্চকের ওপর বসেছিলো, একজনের ওপর দিয়ে আরেকজন। উইনস্টন ও তার বাবা-মা মেঝেতেই একটি স্থান বেছে নিয়েছিলো। আর তাদের কাছেই একটি মঞ্চকে পাশাপাশি বসেছিলো এক বৃদ্ধ আর এক বৃদ্ধা।
বৃদ্ধ লোকটির অভিজাত কালো স্যুট পরা, মাথায় কালো কাপড়ের ক্যাপটি পেছনের দিকে ঠেলে দেওয়া। তাতে তার ধবধবে সাদা চুলগুলো দেখা যাচ্ছিলো। চেহারাটা ছিলো লালচে, আর চোখ দুটো নীল, অশ্রু ছলছল। জিনের গন্ধ নাকে লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো লোকটির শরীর থেকে ঘাম নয় জিনের গন্ধ ছড়ায়। আর তার চোখ থেকে যে অশ্রু বেরিয়ে আসছে তাও খাঁটি জিন ছাড়া কিছুই নয়। মদিরার প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা ঝিম ধরে থাকলেও লোকটির কষ্ট স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো, যা মোটেই সহ্য করা যাচ্ছিলো না। উইনস্টন তার শিশুমন দিয়েই তখন বুঝে নিয়েছিলো ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটে গেছে এই বৃদ্ধের জীবনে। এমন কিছু যা ক্ষমার অযোগ্য, আবার সে ক্ষতি কোনো কিছু দিয়েই পূরণ হবারও নয়। তার কাছে এও মনে হচ্ছিলো যে সে বুঝতে পেরেছে ঠিক কি হয়েছে। বস্তুত বৃদ্ধ লোকটি যাকে খুব ভালোবাসতো- হতে পারে তার ছোট্ট নাতনিটি, সে সম্ভবত মারা গেছে। কয়েক মিনিট পরপরই বৃদ্ধ লোকটি একটি কথাই বলছিলেন: ‘ওদের বিশ্বাস করা আমাদের উচিত হয়নি। আমি পই পই করে বলেছিলাম, বলো বলিনি? ওদের বিশ্বাস করেই আজ এই ফল হলো! আমি তো গোড়া থেকেই বলেছি। আমাদের এই পায়ুকামীগুলোকে বিশ্বাস করা উচিত হবে না।’
ওদের ঠিক কোন পায়ুকামীদের বিশ্বাস করা উচিত হয়নি উইনস্টন এখন তা আর মনে করতে পারে না।
আক্ষরিক অর্থে অনেকটা সেই সময় থেকেই যুদ্ধটা চলছে। তবে সত্যি বটে, যুদ্ধটা সবসময় একই রকম ছিলো না। তার ছেলেবেলায় মাসের পর মাস লন্ডনের রাস্তায় রাস্তায় যখনতখন সংঘর্ষ বেঁধে যেতো, এর কোনো কোনোটির কথা স্পষ্ট মনে পড়ে উইনস্টনের। তবে পুরো সময়ের ইতিহাস ঘেঁটে, কে ঠিক কখন কার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলো তা বলা অসম্ভব। কারণ কোনো লিখিত দলিল নেই, নেই কোনো বলে রাখা কথাও। ঠিক এখন যে যুদ্ধ চলছে তার বাইরে আর কোনও কিছুর কথাই কখনো উচ্চারিত হয় না। এই সময়ে, এই ১৯৮৪ সালে (যদি এটা ১৯৮৪ সাল হয়ে থাকে) ওশেনিয়া ইউরেশিয়ার বিরু্দ্ধে যুদ্ধে রত আর ইস্টেশিয়ার সঙ্গে তার মিত্রতা। কোনও সরকারি কিংবা ব্যক্তিগত উচ্চারণে কখনো কি স্বীকার করা হবে যে একদা এই তিন শক্তির সম্পর্কটি ছিলো ভিন্ন ধারায়। উইনস্টন ভালো করেই জানে, মাত্র চার বছর আগে ওশেনিয়ার যুদ্ধ ছিলো ইস্টেশিয়ার বিরুদ্ধে আর ইউরেশিয়া ছিলো মিত্রশক্তি। তবে এ নিতান্তই এক গোপন জ্ঞান, যা সে ঘটনাক্রমে ধারন করছে, কারণ তার স্মৃতি সন্তোষজনকভাবে নিয়ন্ত্রিত নয়। অংশীদারীত্বের এই পরিবর্তন কখনোই আনুষ্ঠানিকভাবে হয়নি। ওশেনিয়া ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে; মানেই হচ্ছে ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ সবসময়ের। এখন যার সঙ্গে তার শত্রুতা, সেই শত্রুতাই শেষ কথা। তার সঙ্গে সন্ধি না ভবিষ্যতে সম্ভব হবে, না অতীতে সম্ভব ছিলো।
কাঁধ দুটি ব্যাথাতুর করে তুলে পিছনের দিকে ঠেলে দিলো উইনস্টন (পশ্চাৎদেশের ওপর দুই হাত চেপে ধরে কোমড়ের উপরের অংশের গোটা শরীর মোচড়ানোর এক ধরনের ব্যায়াম পীঠের পেশিগুলোর জন্য উত্তম) আর তখন সম্ভবত দশ সহস্রতমবারের মতো তার মনে হলো, আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, এ সব সত্য হতে পারে কিন্তু পার্টি যদি তার হাত অতীত পর্যন্ত বিস্তৃত করে, আর বলে দেয়, এমনটা কখনোই ঘটেনি- তাহলে নিশ্চিতভাবেই তা হবে এই সামান্য নির্যাতন বা মৃত্যু চেয়েও ভয়াবহ।
পার্টি বলছে ওশেনিয়া কখনোই ইউরেশিয়ার সঙ্গে জোট বাঁধেনি। আর সে, উইনস্টন স্মিথ, ভালো করেই জানে, ওশেনিয়া মাত্র চার বছর আগেই ইউরেশিয়ার মিত্র ছিলো। কিন্তু সে জানার অস্তিত্ব কোথায়? তা কেবলই তার সচেতনতায়, যা যেভাবেই হোক যথাশীঘ্র ধ্বংস করে দেওয়া হবে। আর যদি অন্য সবাই দলের চাপিয়ে দেওয়া মিথ্যা মেনে নেয়- যদি সকল নথিপত্র একই গল্প বলে- তাহলে এই মিথ্যাই ইতিহাসে পর্যবসিত হবে আর তা সত্য বনে যাবে। দলের স্লোগান বলে, ‘অতীত যার নিয়ন্ত্রণে…ভবিষ্যতেও তার নিয়ন্ত্রণ’, ‘বর্তমান যার নিয়ন্ত্রণে, অতীতেও নিয়ন্ত্রণ তারই’। তবে অতীত কখনোই পাল্টায় না। আজ যা সত্য তা চিরদিনের জন্যই সত্য। খুবই সহজ এ সত্য প্রতিষ্ঠা। যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে অব্যাহতভাবে আপনার নিজের স্মৃতিকে জয় করে চলা। ‘বাস্তবতাকে নিয়ন্ত্রণ’ যাকে নিউস্পিকে ওরা বলে ‘দ্বৈতচিন্তা’।
সোজা হও!, ব্যায়াম শিক্ষয়ত্রীর চিৎকার, তবে কিছুটা মোলায়েম স্বরে।
উইনস্টন তার হাত দুটি দুপাশে ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে ফুসফুসটা ভরে নিলো। তার মন চট করে ঢুকে পড়লো দ্বৈতচিন্তার জটিল জগতে। জানতে হবে আবার জানাও যাবে না, সতর্কভাবে যে মিথ্যার গড়ন তার কথনে পূর্ণ সত্যতার সতর্কতা নিশ্চিত করতে হবে, একই সঙ্গে দুটি মত পোষণ করতে হবে, যার দুটিই বাতিল হয়ে যাবে, দুটি মতই পরস্পরবিরোধী জেনেও দুটিতেই বিশ্বাস করতে হবে, যুক্তির বিরুদ্ধে যুক্তি দ্বার করাতে হবে, যখন নৈতিকতার কথা আসবে তখন তা অস্বীকার করতে হবে, বিশ্বাস রাখতে হবে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব আর দলই কেবল গণতন্ত্রের অভিভাবক, যা কিছু ভুলে যাওয়া প্রয়োজন তা ভুলে যেতে হবে, আর যখন প্রয়োজন হয়ে পড়বে তখনই তা আবার মনে করতে হবে, এবং এর পরপরই আবার তা ভুলে যেতে হবে, আর সর্বোপরি, প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকেই ওই প্রক্রিয়ার প্রয়োগ ঘটাতে হবে। এটাই সুক্ষ্মদর্শীতা: সচেতনভাবে অসচেতনতার প্রয়োগ, এবং অতঃপর আবারো এই মাত্র যে অসচেতনতার কাণ্ডটি ঘটে গেলো তা নিয়েও অসচেতন হয়ে যেতে হবে। বুঝতে হবে, ‘দ্বৈতচিন্তা’ শব্দের মধ্যেই রয়েছে দ্বৈতচিন্তার প্রয়োগ।
ব্যায়াম শিক্ষয়ত্রী ফের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। ‘এখন আমরা দেখবো আমাদের মধ্যে কে কে নিজেদের পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল ছুঁতে পারি,’ বেশ খানিকটা উৎসাহের সঙ্গেই বললেন তিনি। ‘ঠিক নিতম্বের ওপর দিকটা ভাজ করে, আসুন কমরেডরা, আসুন এক-দুই! এক-দুই!’
ব্যায়ামটাকে স্রেফ ঘৃণা করে উইনস্টন। এতে তার পায়ের গোড়ালি থেকে নিতম্ব পর্যন্ত ব্যাথায় টন টন করতে থাকে। আর প্রায়শই আরেক দমক কাশি ধরিয়ে ছাড়ে। এত ভাবনার মাঝে মুখে মাখা আধাসন্তুষ্টির অভিব্যক্তিটি উবে গেছে। ফের ভাবনা শুরু, অতীতকে পাল্টে দেওয়া হয়নি, আসলে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। যখন সবচেয়ে ধ্রুব সত্যটিরও অস্তিত্ব আপনি আপনার নিজের স্মৃতির বাইরে আর কোথাও খুঁজে পাবেন না, তখন তা কিভাবেই বা প্রতিষ্ঠিত করবেন? ঠিক কোন বছর বিগ ব্রাদারের কথা তার প্রথম কানে এসেছিলো, সে কথাটি মনে করার চেষ্টা করলো, মনে হলো ষাটের দশকের কোনও একটি সময়েই হবে, তবে ঠিক নিশ্চিত করা অসম্ভব। দলের ইতিহাসে দেখানো হচ্ছে বিগ ব্রাদার বিপ্লবের একেবারে গোড়ার দিনগুলো থেকেই এর নেতা আর অভিভাবক হয়ে আছেন। তার বীরত্বগাঁথা ধীরে ধীরে পেছন থেকে আরও পেছনের সময় পর্যন্ত বিস্তৃত করা হচ্ছে যা এরই মধ্যে চল্লিশের দশক ছাড়িয়ে ত্রিশের দশকের অনুপম বিশ্বের সময় অবধি পৌঁছে গেছে, যখন পুঁজিপতিরা অদ্ভুত সিলিন্ডার আকৃতির হ্যাট চাপিয়ে চকচকে মোটরগাড়ি হাঁকিয়ে কিংবা কাঁচ বসানো ঘোড়ার-শকটে চেপে লন্ডনের রাস্তায় দাবড়ে বেড়াতেন। তার জানা নেই এইসব লৌকিক উপাখ্যানের কতটা সত্য আর কতটা বানোয়াট। উইনস্টনের এও মনে পড়ে না কোন তারিখে এই পার্টিরই জন্ম হলো। ১৯৬০ এর আগে ইংসক শব্দটি একটি বারের জন্যও শুনেছে বলে সে বিশ্বাসই করে না। তবে হতে পারে ওল্ডস্পিকে ফর্মটি ছিলো ‘ইংলিশ সোশ্যালিজম’, সেদিক থেকে বলা যায় অতীতেও এর অস্তিত্ব ছিলো। সবকিছুই ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন। কখনো একটি সুনির্দিষ্ট মিথ্যার ওপর আপনি অঙ্গুলি নির্দেশ করতে পারবেন না। ধরুন, পার্টির ইতিহাস বইগুলোতে দাবি করা হয়েছে, পার্টি বিমানের আবিষ্কারক। কিন্তু এটা অসত্য, এমন কোন তথ্যপ্রমাণই নেই। সারা জীবনে কেবল একটি বার তার হাতে পড়েছিলো ঐতিহাসিক সত্যকে মিথ্যায়নের নির্ভুল প্রমাণ্য দলিল। আর সে ঘটনায়-
‘স্মিথ!’ টেলিস্ক্রিন থেকে কর্কশ চিৎকার ভেসে এলো। ‘৬০৭৯। স্মিথ ডব্লিউ.! হ্যাঁ, তুমি, নিচে ঝোঁকো! তুমি এর চেয়ে ভালো পারো। তুমি চেষ্টা করছো না। আরও নিচে, প্লিজ! এবার ভালো হচ্ছে, কমরেড। এবার সবাই আরামে দাঁড়াও, আর আমাকে দ্যাখো।’
হঠাৎ উইনস্টনের সারা শরীর দিয়ে গরম ঘাম ছুটলো। চেহারাটি সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য হয়েই থাকলো কিছুটাক্ষণ। হতাশার অভিব্যক্তি নেই। নেই ক্ষোভেরও প্রকাশ। চোখের পলকে অভিব্যক্তি পাল্টে গেলো। সোজা দাঁড়িয়ে ব্যায়াম শিক্ষিকার মাথার ওপর তুলে ধরা বাহুদুটিতে নজর তার। আহ! সুন্দর!, হাতের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এমনটা হয়তো কেউই বলবে না, তবে একটা স্বাস্থ্যসম্মতা ও দক্ষতার প্রকাশ রয়েছে- নীচু হলেন ব্যায়াম শিক্ষিকা এবং বৃদ্ধাঙ্গুলী দুটির নিচের প্রথম ভাঁজ পর্যন্ত মাটিতে ছুঁয়ে দিলেন।
‘ওয়ান-টু-থ্রি, কমরেডস! আমি চাই ঠিক এভাবেই করে দেখাও তোমরা সবাই। আমাকেই দেখো। আমার এখন ঊনচল্লিশ। চার সন্তানের মা।’ এরপর আবারও নিচু হলেন ব্যায়াম শিক্ষিকা। ‘তোমরা দেখতে পাচ্ছো আমার হাঁটু একটুও ভাঁজ হয়নি।’ ‘তোমরা সবাই চাইলেই এটা করতে পারো,’ আবার সোজা হতে হতে বললেন তিনি।
‘পঁয়তাল্লিশের নীচে যে কেউ সহজেই নীচু হয়ে তাদের পা ছুঁয়ে দিতে পারবে। আমাদের সবার যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে লড়াই করার সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা অন্তত আমাদের নিজেদের ফিট রাখতে পারি। মনে রেখো আমাদের ছেলেরা মালাবার যুদ্ধক্ষেত্রে লড়ছে! নাবিকেরা রয়েছে ভাসমান দূর্গে! একবার চিন্তা করো ওদের কত ঝুঁকিই না নিতে হচ্ছে। এখন আবার চেষ্টা করো কমরেডরা, এবার অনেক ভালো হচ্ছে,’ বলছিলেন ব্যায়াম শিক্ষিকা। আর ঠিক তখনই উইনস্টন প্রাণপন চেষ্টায় তার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল ছুঁয়ে দিলো। গত ক’বছরে এই প্রথম সে কাজটি করতে পারলো।
চতুর্থ অধ্যায়
টেলিস্ক্রিনটা পাশেই, কিন্তু তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই উইনস্টনের। গজরাতে গজরাতে স্পিকরাইট যন্ত্রটি টেনে নিলো, ফুঁ দিয়ে মাউথপিসের ধুলো সরালো, চশমা পরলো। এভাবেই শুরু হলো দিনের কাজ। ডেস্কের ডান দিকে রাখা নিউমেটিক টিউব থেকে চারটি কাগজের সিলিন্ডার বের করে একটা একটা করে প্যাঁচ খুলে খুলে ক্লিপে লটকালো।
খুপড়ির দেয়ালে তিনটি প্রকোষ্ঠ। স্পিকরাইট যন্ত্রের ডানে একটিতে ছোট নিউমেটিক টিউব। যার ভেতরে লিখিত বার্তাগুলো আসে। বাঁয়ের খোপটি অপেক্ষাকৃত বড়, সংবাদপত্রের জন্য বরাদ্দ। আর পাশ দেয়ালে, উইনস্টনের হাতের নাগালের মধ্যে অপর প্রকোষ্ঠের আয়তকার মুখ ইস্পাতের গরাদ দিয়ে শক্ত করে আটকানো। এটি মূলত একটি গহ্বর। অকেজো, নষ্ট কাগজের গন্তব্যস্থল। গোটা ভবনে এমন হাজার হাজার অথবা লাখ, লাখ গহ্বর রয়েছে। কেবল যে কামরা গুলোতে তাই নয়, বারান্দায়ও একটু পরপরই এমন গহ্ববরের মুখ দেখা যায়। কি কারণেই যেনো এগুলোর নাম হয়ে গেছে ‘স্মৃতি গহ্বর’। যে যখনই জানবে কোনও একটি নথি ধ্বংস করতে হবে, অথবা যখনই কোনও একটি কাগজের টুকরো পড়ে থাকতে দেখবে তখন স্বয়ংক্রিয় কাজটিই হবে সেটি তুলে নেওয়া আর কাছের স্মৃতি গহ্বরে ফেলে দেওয়া। সেখানে ওটি গিয়ে পড়বে প্রবাহমান তপ্ত বাতাসে, যা উড়িয়ে নিয়ে ফেলবে মস্ত এক হাপরের ভেতর। এই মস্ত ভবনের কোনও এক গোপন স্থানে হা করে আছে সেই হাপর। যে চারটি কাগজ উইনস্টন খুললো সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো সে। প্রতিটিতেই এক কিংবা দুই লাইনের একটি করে বার্তা লেখা, সংক্ষেপিত সাংকেতিক ভাষায়। এগুলো নিউস্পিকের ভাষা নয়, তবে নিউস্পিকের শব্দের ব্যবহার রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ কাজে এই ভাষার ব্যবহার চলে। যেমন লেখা আছে:
টাইমস ১৭.০৩.৮৪ বিবি স্পিচ ম্যালরিপোর্টেড আফ্রিকা রেক্টিফাই
টাইমস ১৯.১২.৮৩ ফোরকাস্টস ৩ ওয়াইপি ফোর্থ কোয়ার্টার ৮৩ মিসপ্রিন্টস ভেরিফাই কারেন্ট ইস্যু।
টাইমস ১৪.২.৮৪ মিনিপ্লেন্টি ম্যালকোটেড চকোলেট রেক্টিফাই
টাইমস ৩.১২.৮৩ রিপোর্টিং বিবি ডেঅর্ডার ডাবলপ্লাসানগুড রেফস আনপারসনস রিরাইট ফুলওয়াইজ আপসাব অ্যান্টেফিলিং।
ভালোলাগার একটা হালকা আবেশে চতুর্থ বার্তাটি পাশে সরিয়ে রাখলো উইনস্টন। শেষের এই বার্তাটি জটিল এবং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। বাকিগুলো নিয়মমাফিক, গতানুগতিক কিছু বিষয়। তবে দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে কতগুলো পরিসংখ্যানের তালিকা নিয়ে ফালতু খাটুনি আছে।
টেলিস্ক্রিনে পেছনের নম্বরগুলো ঘুরিয়ে ‘দ্য টাইমস’ এর পুরোনো পত্রিকাগুলো বের করে নিলো উইনস্টন। মিনিক কয়েক সময়, এর মধ্যে কাজ না সেরে ফেললে ওগুলো দ্রুতই স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিউমেটিক টিউবে ঢুকে পড়বে। যে বার্তাগুলো এখন তার কাছে আছে এগুলোর ভিত্তিতে সংবাদপত্রটির পুরোনো সংখ্যার সংশ্লিষ্ট খবর বা নিবন্ধে পরিবর্তন আনতে হবে। ওরা বলে শুদ্ধিকরণ। যেমন ধরুন, টাইমসের ১৭ মার্চের সংখ্যায় ছাপা হয়েছে, বিগ ব্রাদার তার আগের দিনের বক্তব্যে ধারনা ব্যক্ত করেছিলেন, দক্ষিণ ভারত যুদ্ধক্ষেত্র শান্ত থাকবে আর ইউরেশীয়রা হামলা চালাবে উত্তর আফ্রিকায়। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটলো তা হচ্ছে ইউরেশীয় হায়ার কমান্ড দক্ষিণ ভারতে হামলা চালালো আর উত্তর আফ্রিকায় কিছুই ঘটলো না। এতে টাইমসের রিপোর্টের ওই অনুচ্ছেদে সংশোধনী প্রয়োজন হয়ে পড়লো। এমনভাবে সংশোধন হলো যেনো বিগ ব্রাদার যা ভেবেছিলেন ঠিক তেমনটিই ঘটেছে যুদ্ধক্ষেত্রে। অথবা ধরুন ১৯ ডিসেম্বরের টাইমস সংখ্যায় প্রকাশিত ১৯৮৩ সালের শেষ তিন মাসের ভোক্তা সামগ্রীর শ্রেণিবিণ্যাস করে পূর্বাভাস প্রতিবেদনের ওপর তৈরি রিপোর্টের কথা। এটি ছিলো একই সাথে নবম ত্রি-বার্ষিক পরিকল্পনার ষষ্ঠ কোয়ার্টারও। আজকের সংখ্যায় রয়েছে ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশের খবর, তাতে দেখা যাচ্ছে পূর্বাভাসে যা কিছু বলা হয়েছিলো তার অনেককিছুতেই বড় বড় ভুল হয়ে গেছে। এখন উইনস্টনের কাজ হচ্ছে আনকোরা রিপোর্টের তালিকা আর পরিসংখ্যান ধরে পুরোনো রিপোর্টের ভুলগুলো শুধরে দেওয়া। তৃতীয় বার্তাটিতে ছোট্ট একটি ভুল যা শুধরে দেওয়া মিনিট কয়েকের কাজ। মাত্র গত ফেব্রুয়ারিতে প্রাচুর্য মন্ত্রণালয় থেকে একটা অঙ্গীকারনামা প্রকাশিত হয় (দাপ্তরিক ভাষায় নিঃশর্ত অঙ্গীকারনামা) যাতে বলা হয় ১৯৮৪ সালে চকোলেট রেশনিং কমানো হবে না। উইনস্টন নিশ্চিত করেই জানে এ সপ্তাহের শেষদিকে চকোলেট রেশনিং কমিয়ে ত্রিশ গ্রাম থেকে বিশ গ্রাম করার ঘোষণা আসছে। তাকে কেবল একটি কাজই করতে হবে তা হচ্ছে, ওই অঙ্গীকারনামার পরিবর্তে একটি সতর্কবানী লিখতে হবে এই ভাষায় যে, এপ্রিলের কোন এক সময় রেশন কমিয়ে দেওয়া প্রয়োজন হতে পারে।
একেকটি বার্তা নিয়ে উইনস্টন যখন কাজ করে তখন সে স্পিকরিটেন সংশোধনীগুলো দ্য টাইমসের মূল কপির সঙ্গে গেঁথে দ্রুত নিউমেটিক টিউবে ঢুকিয়ে দেয়। কাজটি শেষ হতে না হতেই চরম অবচেতনার মাঝেও বার্তার মূল কপিটিসহ সে নিজে যদি কোনো নোট নিয়ে থাকে সেগুলো সব দলামোচা করে দ্রুত স্মৃতি গহ্বরে ফেলে দেয় আগুন-বাষ্পের খাদ্য হিসেবে।
যে অদৃশ্য কুঠুরির ভেতর এই নিউমেটিক টিউব চলে যাচ্ছে সেখানে ঠিক কি হয় তা পুঙ্খানুপুঙ্খু জানেনা উইনস্টন। তবে এ সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারনা সে রাখে। দ্য টাইমসের কোনও একটি সংখ্যায় প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হয়ে গেলে সাথে সাথেই তা সংগ্রহ করে নেওয়া হয়। এরপর দ্রুত ওই বিশেষ সংখ্যাটি পুনঃমুদ্রণ করে ফেলা হয় আর মূল সংখ্যার সকল কপি ধ্বংস করা হয়। আর্কাইভের ফাইলে পুরোনো কপির বদলে স্থান করে নেয় নতুন কপি।
বদলে ফেলার এই চর্চার প্রয়োগ যে কেবলই সংবাদপত্রের সংখ্যায়, তা নয়, পুস্তক, সাময়িকী, প্রচারপত্র, প্যাম্ফেলেট, পোস্টার, লিফলেট, চলচ্চিত্র, শব্দবার্তা, কার্টুন, ছবি থেকে শুরু করে যে কোনো সাহিত্যকর্ম বা প্রামাণ্য দলিল পর্যন্ত যা কিছু রাজনৈতিক বা আদর্শিকভাবে গুরুত্ববহন করে তার সব কিছুই এর অন্তর্ভূক্ত। এভাবেই দিনের পর দিন বলা যায়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা, মিনিটের পর মিনিটেই অতীতকে করে তোলা হচ্ছে পাকাপোক্তভাবে নির্ভুল। এভাবেই পার্টির প্রতিটি অনুমান দালিলিক প্রমাণসহ হয়ে উঠছে ভ্রান্তিহীন। তা হোক কোনও সংবাদ, অথবা কোনও মতের প্রকাশ, সময়ের প্রয়োজনের সঙ্গে যার মিল নেই তার নথিটি থাকারও অবকাশ নেই। সকল ইতিহাসই আদতে একটি পাণ্ডুলিপি যা ঘষে পরিষ্কার করা হয়েছে, নয়তো ঠিক যখনই প্রয়োজন হয়েছে লিখে ফেলা হয়েছে নতুন করে। কাজ যখন শেষ তখন তার মধ্যে কোনও ভ্রান্তি ছিলো এমনটা প্রমাণের এতটুকু সুযোগ রাখা হয়নি। রেকর্ডস বিভাগের সবচেয়ে বড় অংশটি উইনস্টন যে অংশে কাজ করে তার চেয়ে অনেক অনেক গুন বড়। সেখানে কেবল তাদেরই গতায়ত যারা এই ভুল ধরার কাজে আর বাতিল করা হয়েছে এবং ধ্বংস করা হবে এমন বই, খবরের কাগজ এবং অন্যান্য নথি সংগ্রহের কাজে ন্যস্ত। দ্য টাইমসের যে সব সংখ্যায় রাজনীতির নতুন মেরুকরণ কিংবা বিগ ব্রাদারের ভুল ভবিষ্যবচনে বারবার পুনর্লেখন হয়েছে সেগুলো তার পুরোনো তারিখ নিয়েই নথিভুক্ত হয়ে আছে। এই কপির বাইরে ওই সংখ্যার আর একটি কপিরও অস্তিত্ব রাখা হয়নি, যা এই অসামঞ্জস্যতার প্রমাণ হিসেবে খাড়া হতে পারে। বইগুলোও বার বার জব্দ করা হয়েছে, নতুন করে লেখা হয়েছে এবং অকপটে তা ফের বাজারে ছাড়া হয়েছে। একটিবারের জন্যও কোথাও স্বীকার করে নেওয়া হয়নি, বলা হয়নি যে এতে কিছু পরিবর্তন আনা হলো। এমনকি লিখিত যেসব নির্দেশনা উইনস্টনের হাতে আসে, কাজ শেষ হওয়া মাত্র যেগুলোর অস্তিত্ব সে নিজেই বিলীন করে দেয়, তাতেও কোনও দিন বলা হয়নি যে ওটি ছিলো নিজেদের ভুল, বরং বলা হয়েছে যা লেখা হয়েছে তা ভুল, মুদ্রণপ্রমাদ কিংবা ভ্রান্ত উদ্ধৃতি যা শুদ্ধতার খাতিরেই নতুন করে লেখা প্রয়োজন।
বস্তুতঃ প্রাচুর্য মন্ত্রণালয়ের নথিতে যখন পরিসংখ্যানগুলো পাল্টে দিচ্ছিলো তখন উইনস্টনের কাছেও বিষয়টি প্রতারণা বলে মনে হচ্ছিলো না। একটি ফালতু জিনিষ দিয়ে আরেকটি ফালতু জিনিষের প্রতিস্থাপন ছাড়া এটি আর কিছুই নয়। যা কিছুই হচ্ছে তার অধিকাংশেরই সঙ্গে বাস্তব জগতের কোনো কিছুর সম্পর্ক নেই। সবকিছুই যেন কেবলই মিথ্যা, কেবলই জালিয়াতি। পরিসংখ্যানগুলো তার মূল সংখ্যায় যেমন তামাশা, শুদ্ধিকরণের পরও একই তামাশা। চাইলেই এগুলো মাথা থেকে সরানো যাবে না। যেমন ধরুন প্রাচুর্য মন্ত্রণালয় তার পূর্ব ধারনা দিলো সিকি বছরে ১৪৫ মিলিয়ন জোড়া জুতো তৈরি হবে। কিন্তু বাস্তবে তা গিয়ে দাঁড়ালো ৬২ মিলিয়ন জোড়ায়। এখন উইনস্টন পূর্ব ধারনার সংশোধনীতে লিখে দিলো ৫৭ মিলিয়ন জোড়া। যাতে দাবি করা যায়, কোটা যা ছিলো তার চেয়ে বেশিই তৈরি হয়েছে। যাই বলুন না কেন, ৬২ মিলিয়নের হিসাবটি না ১৪৫ মিলিয়ন হিসাবের ধারে কাছের, না ৫৭ মিলিয়নের। আর এটা ভাবলেও অবাস্তব ভাবা হবে না যে, আদৌ কোনও জুতোই প্রস্তুত হয়নি। তবে অতীব বাস্তব কথা এই যে, কেউ কখনোই জানবে না, সত্যিকারে কতগুলো জুতো প্রস্তুত হয়েছে, আর কেউ তা জানতে চাইবেও না। সবাই কেবল এটাই জানবে অতি বৃহৎ সংখ্যায় জুতো প্রস্তুত হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত চিত্র হতে পারে ওসেনিয়ার অর্ধেক লোকই নগ্নপায়ে পথ চলছে। নথিভুক্ত সকল তথ্যেরই একই দশা, হোক সে ছোট কিংবা বড়। সবকিছুই মিলিয়ে যাচ্ছে এক ছায়া-পৃথিবীর দিকে, আর তাতে শেষাবধি বছরের তারিখটা পর্যন্ত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
হলের চারিদিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিলো উইনস্টন। উল্টোদিকের একই আকৃতির আরেকটি খুপড়িতে ছোট সুক্ষ্ম চেহারার কালো থুতনিওলায়া লোকটি, নাম টিলোটসন, অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। হাঁটুর ওপর ভাঁজ করা একটি সংবাদপত্র আর মুখটা স্পিকরাইটের মাউথপিসের সঙ্গে লাগোয়া। টেলিস্ক্রিনের সঙ্গে তার গোপন কথা চলছে এমন একটা আবহ তৈরি করে নিয়েছে চারিদিকে। এরই মাঝে চশমার ভেতর দিয়ে উইনস্টনের দিক একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হানলো সে।
টিলোটসনকে ভালো করে চেনে না উইনস্টন। সে কি কাজ করে তাও তার জানা নেই। রেকর্ডস ডিপার্টমেন্টের লোকেরা তাদের কাজ নিয়ে অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে চায় না। লম্বা জানালাবিহীন হলে, দুই সারিতে ছোট ছোট কামরা থেকে অবিরাম কাগজের খসখসানি আর স্পিকরাইটে টানা কথা বলার ঝিমধরা গুনগুনানি ভেসে আসে। এই হলের ভেতর ডজন খানেক লোকতো হবেই যাদের এমনকি নাম অব্দি জানা নেই উইনস্টনের। তবে প্রায় প্রতিদিনই বারান্দা ধরে তাদের হন্তদন্ত ছোটাছুটি দেখে, আর দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচিতে তাদের দেখা মেলে চিৎকার চেচামেচিতে সামিল। পাশের কামরার ধুসরকেশীর কথা সে জানে, দিনের পর দিন মেয়েটি হাপিস করে দেওয়া হয়েছে এমন মানুষদের নাম-ঠিকুজি খুঁজে বের করে চিরতরে মুছে দেওয়ার কাজেই ন্যস্ত। কাজটি তার মতো আর কে-ই পারবে! কারণ বছর কয়েক আগে তার স্বামীকেই তো এমনভাবে বাষ্পায়িত করে দেওয়া হয়েছিলো। কয়েকটা খুপড়ির পরের খুপড়িতে শান্ত, বুদ্ধিদীপ্ত, স্বাপ্নিক চেহারার মানুষটির কথাও বলা যায়। নাম অ্যাম্পলফোর্থ। কান ভর্তি চুল, বিষ্ময়কর গানের গলা। আর কাজটি হচ্ছে যে কোনও কিছুর বিকৃত রূপ দেওয়া। কবিতার পংক্তিমালা যদি আদর্শবিরোধী হয়, আর তা যদি কোনও কারণে সংকলনে রেখেই দিতে হয় তাহলে সেগুলো বিকৃতরুপ পায় অ্যাম্পলফোর্থের হাতে। এই হলে, জনা পঞ্চাশেক, বা তার কমবেশি লোক কাজ করে যা মূলত বিশাল জটিলতা ভরা রেকর্ডস বিভাগের একটি উপ-বিভাগ মাত্র। পেছনে, উপরে, নীচে আরও ঝাঁকে-ঝাঁকে কর্মী কল্পনাতীত লাখো কাজে ন্যস্ত। রয়েছে বিপুল সংখ্যক মুদ্রণ-দোকান, তাদের সহ-সম্পাদকের দল, দক্ষ মুদ্রাক্ষরিক, আর ভুয়া ছবি তোলার জন্য যন্ত্রপাতি সজ্জিত বিশাল স্টুডিও। এখানে একটি টেলি-প্রোগাম বিভাগ রয়েছে। তাতে রয়েছেন প্রকৌশলী, প্রযোজক আর অভিনেতা-অভিনেত্রীর দল, যাদের বাছাই করা হয় কণ্ঠ নকল করার দক্ষতার মাপকাঠিতে। রয়েছে একদল অভিসম্বদ্ধ করনিক যাদের কাজ হচ্ছে স্রেফ যেসব বই আর সাময়িকি পাল্টে দিতে হবে সেগুলো তালিকা বানানো। বড় বড় গুদামঘর রয়েছে যাতে মজুদ হয় সংশোধিত নথিপত্র, আর রয়েছে লুক্কায়িত চুল্লি যাতে মূল কপিগুলো পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। এবং কোথাও বা অন্যখানে রয়েছে একেবারেই অজ্ঞাতনামা মস্তিষ্কধারীরা, যারা পুরো কাজটির সমন্বয় করছেন, আর নীতি রেখা তৈরি করে দিচ্ছেন যার ভিত্তিতে অতীতের কিছু কিছু বিষয় সংরক্ষিত হচ্ছে, কিছু করা হচ্ছে মিথ্যায়নে সিদ্ধ আর অন্যসব কিছুর অস্তিত্বই ঘষে ঘষে বিলীন করে দেওয়া হচ্ছে।
রেকর্ডস ডিপার্টমেন্ট, যা সত্যমন্ত্রণালয়ের একটি শাখামাত্র, তার প্রাথমিক কাজ এই অতীতকে পুনর্গঠন করা নয় বরং ওসেনিয়ার নাগরিকদের জন্য সংবাদপত্র প্রকাশ, চলচ্চিত্র নির্মাণ, পাঠ্যবই ছাপানো, টেলিস্ক্রিনের কর্মসূচি সম্প্রচার, নাটক, উপন্যাস তৈরি ইত্যাদি- যাতে সন্নিবেশিত থাকবে মেনে নেওয়ার মতো সকল তথ্য, নির্দেশনা আর বিনোদন। ভাস্কর্য নির্মাণ থেকে স্লোগান বানানো, কবিতার পঙক্তি রচনা থেকে জৈব গবেষণা-বিশ্লেষণ, শিশুশিক্ষার বর্ণমালা পুস্তক থেকে নিউস্পিকের অভিধান রচনা পর্যন্ত সবই তাদের দায়িত্ব। আর মন্ত্রণালয় যে কেবল দলের বহুমাত্রিক প্রয়োজন মেটাতে কাজ করে যাচ্ছে তাই নয়, নিচু শ্রেণির মানুষগুলোর জন্য উপকারী, উপযোগী ও উপভোগ্য প্রায়োগিক সকল কর্মযজ্ঞের ভারও তাদের হাতে। এই শ্রেণির জন্য সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক আর বিনোদন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেও ভিন্ন ভিন্ন বিভাগ রয়েছে। এখানে ফালতু নিম্নমানের সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় যাতে খেলা, অপরাধ আর রাশিফল ছাড়া কিছুই থাকে না। সস্তা দরের যৌন উত্তেজক উপন্যাস, যৌনতায় ভরা চলচ্চিত্র, আর সস্তা আবেগস্পর্শী গীত রচিত হয় স্রেফ যান্ত্রিক পদ্ধতিতে, লিখনযন্ত্র বলে পরিচিত এক বিশেষ ধরনের ক্যালিডোস্কোপের ব্যবহারে। আরও একটি পূর্ণাঙ্গ উপ-বিভাগ রয়েছে, নিউস্পিকে যাকে বলে পর্নোসেক, যা সবচেয়ে নিচু দরের পর্নোগ্রাফি তৈরি করছে, সেগুলো আবার সিলকরা প্যাকেটে বাইরে যাচ্ছে। পার্টির যারা এর নির্মাণ কাজে সম্পৃক্ত তারা ছাড়া আর সকল সদস্যের জন্যই এসব নিষিদ্ধ পণ্য।
উইনস্টন যখন কাজ করে যাচ্ছিলো সেই সময়ের মধ্যেও নিউমেটিক টিউব থেকে আরও তিনটি বার্তা বের হয়, ওগুলো স্বাভাবিক কিছু বিষয়ের ওপর, নিত্য রুটিনে দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচির শুরুর আগেই ওগুলো সেরেও ফেলে সে। আর ঘৃণা কর্মসূচি শেষ করে কামরায় ফিরে তাক থেকে নিউস্পিক অভিধান নামিয়ে নেয়, স্পিকরাইটটি একদিকে সরিয়ে রেখে, চশমার কাচ পরিষ্কার করে সকালের কাজে মনোনিবেশ করে।
কাজই উইনস্টনের জীবনের পরম আনন্দ। বেশিরভাগই গৎবাঁধা বিরক্তিকর একঘেঁয়ে কাজ, তারপরেও কিছু কিছু থাকে ভীষণ কঠিন আর জটিল। আপনি চাইলে নিজেকে ওই কাজের মধ্যে হারিয়ে ফেলতে পারবেন ঠিক যেমন জটিল গণিতের অংক মেলাতে কেউ কেউ নিজেকে তার মধ্যে ডুবিয়ে দেয়। প্রতারণামূলক বার্তাগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে আপনি ইংসকের নীতিসম্পর্কিত জ্ঞান আর দল কি বলতে চায় তা নিয়ে অনুমান করার বাইরে নিজেকে পরিচালনা করার মতো নির্দেশিকা আর কিছুমাত্র পাবেন না। এই কাজটা উইনস্টন ভালোই করে। মাঝে মধ্যে তাকে বিশ্বাস করে সম্পূর্ণ নিউস্পিকে লেখা ‘দ্য টাইমস’ এর প্রধান প্রধান নিবন্ধগুলো শুদ্ধিকরণের দায়িত্বও দেওয়া হয়। পাশে সরিয়ে রাখা বার্তার কাগজটির প্যাঁচ খুলে নিলো উইনস্টন। এতে লেখা আছে-
টাইমস ৩.১২.৮৩ রিপোর্টিং বিবি ডেঅর্ডার ডাবলপ্লাসআনগুড রেফস আনপারসনস রিরাইট ফুলওয়াইজ আবসাব অ্যান্টেফিলিং।
ওল্ডস্পিকে (অথবা প্রমিত ইংরেজিতে) এর মানে দাঁড়ায়:
১৯৮৩ সালের ৩ ডিসেম্বরের দ্য টাইমস সংখ্যায় বিগ ব্রাদারের ‘দিনের নির্দেশ’ নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনটি ভীষণভাবে অসন্তুষ্টিজনক এবং এতে অস্তিত্বহীন মানুষের রেফারেন্স রয়েছে। এটি পুরোপুরি পুনর্লেখন করো এবং ফাইলবদ্ধ করার আগে খসড়া উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দাও।
অসন্তুষ্টির কারণ হওয়া ওই গোটা নিবন্ধটি পড়ে ফেললো উইনস্টন। বিগ ব্রাদারের ‘দিনের নির্দেশে’ এফএফসিসি নামে পরিচিত একটি সংস্থার কাজের প্রশংসাই প্রাধান্য পেয়েছে। সংস্থাটি ভাসমান ঘাঁটিগুলো সৈনিকদের সিগারেট আর অন্যান্য আরামসামগ্রী সরবরার করে। কমরেড উইদারস নামে ইনারপার্টির একজন প্রধানসারির সদস্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাকে অর্ডার অব কনস্পিশাস মেরিট, সেকেন্ড ক্লাস তকমা দেওয়া হয়েছে।
মাস তিনেক পরে এই এফএফসিসি কোনও কারণ না দেখিয়েই হঠাৎ বিলুপ্ত করে দেওয়া হলো। যে কেহই বুঝবে, উইদারস ও তার সঙ্গীরা ক্ষেপে আছে, কিন্তু সে নিয়ে সংবাদপত্র বা টেলিস্ক্রিনে একটা খবরও নেই। এমনটাই প্রত্যাশিত। কারণ, রাজনৈতিক অপরাধীদের বিচার কিংবা এমনকি জনসম্মখে নাজেহাল করা হয়েছে এমন নজির নেই। এই যে হাজার হাজার মানুষকে সম্পৃক্ত করে গণ আদালতে বিশ্বাসঘাতক আর চিন্তা-অপরাধীদের বিচার হয়, যে বিচারে অপরাধ স্বীকার করে নেওয়ার পর তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয় তা লোক দেখানো মাত্র। বছর কয়েকে এক-আধবার এমনটা ঘটে বৈতো নয়! কিন্তু খুব সাধারণত যা হয়, তা হচ্ছে, দলের নাখোশের কারণ হলে ঠিক হাপিশ হয়ে যাবে, তার কথা আর কোনও দিন উচ্চারিতও হবে না। কারো কাছে কখনোই কি ঘটেছে তার ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র চিহ্নটিও থাকবে না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এমনকি তাদের মৃত্যু নাও হতে পারে। নিজের বাবা-মাকে ছাড়াও উইনস্টন ব্যক্তিগতভাবেই আরও অন্তত ত্রিশ জনের কথা জানে যারা এভাবেই গুম হয়ে গেছে।
একটি পেপার ক্লিপ দিয়ে ধীরে ধীরে নাক চুলকাচ্ছিলো উইনস্টন। উল্টোদিকের খুপড়িতে কমরেড টিলোটসন তখনও স্পিকরাইট নিয়ে গোপনীয়তার আবহ ছড়িয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। এক মুহূর্তের জন্য মাথাটি তুললেন, এতে চশমার আলোয় তীব্র একট ঝিলিক চোখে লাগলো। উইনস্টনের ধন্ধ জাগলো, কমরেড টিলোটসনও কি একই কাজে ন্যস্ত ঠিক যে কাজটি সে এখন করছে। এটা অসম্ভব কিছু না। এমন একটি জটিল কাজের জন্য মাত্র একজনের ওপর কখনোই ভরসা করা হয় না। অন্যদিকে, এটি যখন কোনও কমিটির কাছে জমা পড়বে তখন জাল করার বিষয়টি প্রকাশ্য হয়ে যাবে। এটা খুবই সম্ভব, ওই দিন বিগ ব্রাদার সত্যিই যা বলেছিলেন তা তুলে রাখতে বিরোধী পক্ষ অন্তত ডজন খানেক লোক লাগিয়ে রেখেছিলো। আর এখন ইনার পার্টির কোনও এক বিশাল মস্তিষ্ক এটি অথবা অন্য ভার্সনটি নির্বাচন করবেন, তার ওপর সম্পাদনার কলম চালাবেন, প্রয়োজন মাফিক ক্রস চেক করে নেবেন এবং অবশেষে কোনও একটি মিথ্যাকে পছন্দ করে নেবেন যা স্থায়ীভাবে নথিভুক্ত হয়ে যাবে এবং সেটাই সত্যে পরিণত হবে।
উইনস্টন জানে না উইদারসকে কেনো শাস্তি পেতে হলো। হতে পারে দুর্নীতির জন্য নয়তো অযোগ্যতার জন্য। অথবা হতে পারে অতি-জনপ্রিয় কোনো অধস্তনকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন বিগ ব্রাদার। হতে পারে উইদারস কিংবা তার ঘনিষ্ঠ কেউ সন্দেহভাজন ঐতিহ্যানুগ ছিলেন। অথবা হতে পারে- যার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি- এই যে উবিয়ে দেওয়া বা বাষ্পায়িত করা সরকারযন্ত্রের এক অতি প্রয়োজনীয় কাজ আর সে কারণেই এমনটা ঘটেছে। একমাত্র বাস্তব ক্লু থেকে যায় ‘রেফ আনপারসন্স’ শব্দটির মধ্যে, যা এই নির্দেশ করে যে, উইদারস এখন আর কেউ নন। তবে কেউ যখন গ্রেফতার হয় তখনই ভেবে বসলে চলবে না যে, পরিনতি এমনটাই হতে যাচ্ছে। কখনো কখনো তাদের ছেড়ে দেওয়া হয় আর এক বা দুই বছর চলে তাদের স্বাধীন ঘোরাঘুরি, অতঃপর একদিন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়ে যায়। খুব কম, কিন্তু এও হয়, সবাই জানে কোনও এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে কিন্তু অনেক পরে হঠাৎ একদিন ভুতের মতো তার দেখা মিলবে কোনও এক গণ বিচারের দিনে, সেখানে নিজেই নিজের মুখে আরও শত শত মানুষের মতো অপরাধ স্বীকার করে নেবে আর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়ে যাবে। উইদারস, এরই মধ্যে যাকে ‘আনপারসন’ বলে দেওয়া হয়েছে, তার কোন অস্তিত্ব নেই, আর কোনও কালেই ছিলো না। উইনস্টন ঠিক করলো বিগ ব্রাদারের বক্তব্যের ধরন পাল্টে দেওয়াই যথেষ্ট হবে না, বরং মূল বিষয়ের সঙ্গে আদৌ সম্পর্কিত নয় এমন একটা কিছু এখানে বসিয়ে দিলেই তা হবে যথার্থ।
সে খুব সহজেই বক্তব্যটিকে বিশ্বাসঘাতক আর চিন্তা-অপরাধীদের নিন্দাবাদ দিয়ে পাল্টে দিতে পারতো কিন্তু তা খুব সাধারণ কিছু হয়ে যাবে। আর কোনও একটি যুদ্ধক্ষেত্রে জয়ের খবর কিংবা নবম ত্রি-বার্ষিক পরিকল্পনার বড় ধরনের কোনও অর্জনের কথা থাকলে তা আরও জটিল করে তুলবে। আসলে যা দরকার সেটি হচ্ছে খাঁটি মজাদার কিছু একটা বসিয়ে দেওয়া। হঠাৎ করেই তার মনের মধ্যে খেলে গেলো এক দারুণ চিন্তা। রেডিমেড, খাটুনি নেই, স্রেফ একটি ছবি বসিয়ে দেওয়া যেতে পারে। আর সে ছবিটি হবে নিঃসন্দেহে কমরেড অগিলভির, দিন কয়েক আগে যুদ্ধক্ষেত্রে তার বীরের মৃত্যু হয়েছে। কোনও কোনও দিন বিগ ব্রাদার তার দিনের নির্দেশে দলের কোনও এক অনুগত, উচ্চপদস্থ সদস্যের কথা স্মরণ করেন যার জীবন কিংবা মৃত্যুর ঘটনাকে তিনি অনুসরণীয় বলে তুলে ধরেন। আর ওই দিনটিতে তিনি কমরেড অগিলভিকে স্মরণ করেছেন সেতো হতেই পারে। এটা সত্য কমরেড অগিলভি নামে কেউ কখনো ছিলো না, তবে ছাপার অক্ষরে কয়েকটি লাইন আর মিথ্যা ছবিতে তার অস্তিত্ব নিশ্চয়ই ফুটে উঠবে।
উইনস্টন এক মূহূর্ত চিন্তা করে নিলো, নিজের দিকে স্পিকরাইট যন্ত্রটি টেনে নিয়ে বিগ ব্রাদারের পরিচিত ভঙ্গিমায় উচ্চারণ করতে লাগলো; যে উচ্চারণ একই সঙ্গে সামরিক ও পদধারীর মিশ্রিত রুপ। নিজেই প্রশ্ন করা আবার নিজেই তার উত্তর দেওয়া (তাহলে কমরেডরা এই ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নিলাম? আমরা শিখলাম- যা আসলে ইংসকের মৌলিক নীতিরও একটি- আর তা হচ্ছে.. ইত্যাদি, ইত্যাদি) যা নকল করা খুব সহজ।
কমরেড অগিলভির বয়স যখন তিন তখন একটি সাব-মেশিনগান, একটি মডেল হেলিকপ্টার আর ড্রাম ছাড়া সব খেলনাই ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ছয় বছরে, রীতি শিথীল করে নির্ধারিত বয়সের এক সন আগেই তাকে নেওয়া হয় গুপ্তচরবৃত্তিতে। আর নয় বছরে তাকে একটি গুপ্তচরদলের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১১ বছর বয়সে নিজের চাচাকে, কিছু কথাবার্তা শুনে ফেলে অপরাধী প্রবৃত্তির বলে মনে হওয়ায়, থট পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়। ১৭ বছরে জুনিয়র অ্যান্টি-সেক্স লিগের জেলা সংগঠক হয় অগিলভি। ১৯ বছরে সে একটি হাত গ্রেনেড বানায় যা শান্তি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পায়, আর প্রথম পরীক্ষামূলক ব্যবহারে ওই গ্রেনেডের এক বিষ্ফোরণেই ইউরেশীয় কারাবন্দিদের একত্রিশ জন নিহত হয়। ২৩ বছরে কর্মরত অবস্থায় তার জীবনাবসান ঘটে। গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সংবাদ নিয়ে ভারত সাগরের ওপর দিয়ে যখন উড়ে যাচ্ছিলেন তখন শত্রুপক্ষের জেট বিমান তার পিছু নেয়, শরীরে মেশিনগানের ওজন বেঁধে হেলিকপ্টার থেকে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদগুলো নিয়েই ঝাপিয়ে পড়ে গভীর পানিতে তলিয়ে যান। সঙ্গে ডুবে যায় গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের নথিপত্রসহ সব কিছু- আর সেখানেই সব শেষ- বলেন বিগ ব্রাদার। ইর্ষণীয় এক আত্মত্যাগ- বলেন তিনি। সঙ্গে বিগ ব্রাদার আরও কিছু মন্তব্য যোগ করেন যাতে ফুটে ওঠে কমরেড অগিলভির জীবনের খাঁটি ও দৃঢ়তার দিকগুলো। তিনি ছিলেন পুরোপুরি মদ্যপানপরিহারকারী ও অধুমপায়ী ব্যক্তি, দিনে একবার ঘণ্টাখানের ব্যায়ামাগারে কাটানোর বাইরে তার বিনোদন বলতে আর কিছু ছিলো না, কৌমার্যের প্রতি তার ছিলো অগাধ আনুগত্য, বিয়েতে বিশ্বাস আর পরিবারের সঙ্গে ভালোবাসার বন্ধনে থেকে কাজের প্রতি দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টার আত্মনিয়োজন সম্ভব নয়। তার কথাবার্তায় ইংসকের নীতি ব্যতিরীকে আরও কোনও বিষয় থাকতো না, ইউরেশীয় শত্রুদের দমন করা ছাড়া আর তাদের গুপ্তচরদের, বিশ্বাসঘাতকদের, চিন্তা-অপরাধীদের আর যড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করা ছাড়া জীবনের আর কোনও লক্ষ্যও ছিলো না।
কমরেড অগিলভিকে অর্ডার অব কন্সপিশাস মেরিট পদকে ভূষিত করা হবে কি না সে নিয়ে নিজের সঙ্গে নিজেই বিতর্ক করে নিলো উইনস্টন। আর শেষে না করারই সিদ্ধান্ত নিলো কারণ ওতে খামোখা কিছু বাড়তি তথ্য ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে।
উল্টোদিকের কুঠুরিতে বসা প্রতিপক্ষের দিকে আরও একবার দৃষ্টি হানলো উইনস্টন। কিছু একটা কারণে তার মনে হচ্ছে- টিলোটসনও একই কাজে ন্যস্ত যা সে নিজেও করছে। কোনও পথই নেই কার কাজটি শেষ পর্যন্ত গৃহীত হবে তা জানা। তবে একটা দৃঢ় আস্থাবোধ তার মধ্যে কাজ করছে যে, তার লেখাটিই নেওয়া হবে। কমরেড অগিলভি, ঘণ্টাখানেক আগে যা কল্পনায়ও ছিলো না, তা এখন এক বাস্তবতা। তার কৌতুহলে আঘাত হানলো আরেক ভাবনা, জীবিত একটি মানুষ সৃষ্টি অসম্ভব হলেও আপনি চাইলে একটি মৃত মানুষ সৃষ্টি করতে পারবেন। কমরেড অগিলভি, যার অস্তিত্বের কোনও বর্তমান কোনও কালে ছিলো না, এখন অতীতে তার অস্তিত্ব আছে। আর যখন এই জাল নথির সব কিছু সবাই ভুলে যাবে, তখন তার অস্তিত্ব এই প্রমাণের ভিত্তিতেই কার্লোস ম্যাগনাস বা জুলিয়াস সিজারের মতোই বাস্তব হয়ে উঠবে।
পঞ্চম অধ্যায়
গভীর পাতালঘরে অনুচ্চ ছাদের ক্যান্টিনে দুপুরের খাবার নেওয়ার লম্বা লাইনটি শম্বুকগতিতে এগুচ্ছে। ঘরটিতে মানুষ গিজগিজ করছে, শোরগোলে কান ঝালাপালা। কাউন্টারের লোহার বেড়ার ওপার থেকে ধাতব লবনের গন্ধমাখা স্ট্যুর ধোঁয়া এসে নাকে লাগছে, আর তা ছাপিয়ে ভিক্টরি জিনের কড়া গন্ধ। কামরার শেষের দিকে ছোট্ট বার সেখান থেকে দেয়ালের ছোট গলুই গলিয়ে আসছে জিন, ১০ সেন্টে মিলে যাবে বড় এক ঢোক।
‘ঠিক যাকে খুঁজছিলাম,’ পেছন থেকে কেউ একজনের গলা শুনতে পেলো উইনস্টন।
ঘুরে দেখে বন্ধু সাইম। গবেষণা বিভাগে কাজ করে। ‘বন্ধু’ শব্দটি সম্ভবত সঠিক নয়। আজকাল বন্ধু বলে কেউ নেই, সবাই কমরেড। তবে কিছু কমরেড আছেন যারা অন্যদের চেয়ে একটু ঘনিষ্ঠ। সাইম ভাষাতত্ত্ববিদ। নিউস্পিক বিশেষজ্ঞ। নিউস্পিক অভিধানের ১১তম সংস্করণ তৈরিতে যে বড় একটা কর্মীবাহিনী কাজ করছে তাদের একজন। ছোটখাটো গড়ন, উইনস্টনের চেয়েও ছোট। কালো লম্বাটে চুল, প্রস্ফীত চোখে মেখে থাকে শোকগ্রস্ত, ভীত চাহুনি। আপনি যখন ওর সঙ্গে কথা বলবেন, মনে হবে ও আপনার মুখমণ্ডলে কিছু একটা খুঁজছে।
‘তুমি রেজর ব্লেড পেয়েছো নাকি?,’ প্রশ্ন সাইমের।
‘নারে.. একটাও না, অপরাধীর গলা উইনস্টনের। বিভিন্ন জায়গায় চেষ্টা করেছি। মনে হয় আর পাওয়া যাবে না।’
সবাই কেবল রেজর ব্লেডের কথাই জানতে চায়। তার কাছে অবশ্য দুটো ছিলো, অব্যহৃত। আগেই তুলে রেখেছিলো। মাস কয়েক আগে যখন রেজর ব্লেডের মঙ্গা দেখা দিলো তখন। যে কোনও সময়ই বিশেষ কোনও প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহে পার্টির দোকানগুলো অপারগতা ঘোষণা করে দেয়। কখনো বোতাম, কখনো রিফুর উল, কখনো জুতোর ফিতে। এখন রেজর ব্লেড। পেতে পারেন, অতি সংগোপনে, ওদের চোখ ফাঁকি দিয়ে যদি ‘ফ্রি’ মার্কেটগুলোতে আপনি টুক করে ঢুকে পড়তে পারেন তাহলে। তবে তাতেও যে মিলেই যাবে তার নিশ্চয়তা নেই।
‘আমি ছয় সপ্তাহ ধরে একই ব্লেড ব্যবহার করছি,’ মিথ্যা করেই বললো উইনস্টন।
খাবারের জন্য লাইনটি আরেক ধাক্কা এগিয়ে ফের থমকালো। উইনস্টন ঘুরলো সাইমের দিকে। কাউন্টারের শেষ মাথা থেকে তেলতেলে দুটো ধাতব ট্রে তুলে নিলো দুজন।
‘গতকাল কারাবন্দিদের ফাঁসি দেখতে গিয়েছিলে নাকি?’ প্রশ্ন সাইমের।
‘কাজ ছিলো’ উত্তর উইনস্টনের। ‘ভিডিওচিত্রে দেখে নিতে পারবো, আশা করি।’
‘বিকল্প হিসেবে এটাকে ভালো কিছু বলবো না’ গম্ভীর কণ্ঠ সাইমের।
উইনস্টনের মুখের ওপর ঘুরছে তার বিদ্রুপাত্মক চাহুনি। ‘আমি তোমাকে চিনি,’ চোখ জোড়া যেনো সে কথাই বলতে চাইছে। ‘আমি তোমার ভেতরটা দেখতে পাই, আমি জানি কেনো তুমি কারাবন্দিদের ফাঁসি দেখতে যাওনি।’ বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে সাইম বিষাক্ত গোঁড়া কিসিমের। শত্রুপক্ষের গ্রামে যখন হেলিকপ্টার হামলা চালায়, চিন্তা-অপরাধীরা যখন স্বীকারোক্তি দেয় কিংবা বিচারের মুখোমুখি দাঁড়ায়, ভালোবাসা মন্ত্রণালয়ের কারাবন্দিদের যখন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় আর সেসব নিয়ে ও যখন কথা বলে তখন কণ্ঠে সন্তুষ্টি ঝড়ে ঝড়ে পড়ে অবিশ্বাস্য সংকীর্ণতায়। ওর সঙ্গে কথা বলার সময় এসব বিষয় এড়িয়ে বরং সম্ভব হলে নিউস্পিকের খুঁটিনাটি দিকগুলো টেনে আনা ভালো। ওতে তার দখল যেমন আছে, মজাও পাওয়া যায়। বড় কালো দুটি চোখের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি এড়াতে উইনস্টন মাথাটি ইষৎ ঘুরিয়ে নিলো।
‘দারুণ ফাঁসি হয়েছে’- শুনিয়ে দিতে চাওয়ার ভঙ্গিমা সাইমের কণ্ঠে। ‘অবশ্য ওদের প্রত্যেক দুই পা এক সাথে বেঁধে ঝোলানোর বিষয়টি ফালতু মনে হয়েছে। মৃত্যুযন্ত্রণায় ওরা পা গুলো ছোঁড়াছুড়ি করছে এমনটা দেখতেই ভালো লাগতো। তবে দারুণ লেগেছে যখন ওদের জিহ্বাগুলো মুখ থেকে বেরিয়ে এলো আর কড়া নীল হয়ে গেলো সেই দৃশ্যটা দেখতে। এই বিষয়টি আমার মধ্যে একটা আবেদন তৈরি করে।’
‘নেক্স’ প্লিজ! হাতা হাতে চিৎকার পাড়লো সাদা অ্যাপ্রোন পরা প্রোলদের একজন।
উইনস্টন ও সাইম গ্রিলের নীচ দিয়ে দুজনের ট্রে দু’টি ঠেলে দিলো। তাতে দ্রুতই ভরে দেওয়া হলো দুপুরের বরাদ্দ খাবার- ছোট ধাতব পেয়ালায় ধূসর-গোলাপি স্ট্যু, এক খামচা রুটি, এক টুকরো পনির, দুধহীন এক মগ ভিক্টরি কফি আর একটি স্যাকারিন ট্যাবলেট।
‘চলো টেলিস্ক্রিনের নিচে একটি টেবিল ফাঁকা আছে,’ বললো সাইম। ‘যাওয়ার পথে জিন নিয়ে নেই।’
হাতলবিহীন চীনা পাত্রে ওদের জিন এলো। ভিড় ঠেলে গিয়ে খাবার নিয়ে বসলো ধাতব পাতের পাটাতনের টেবিলে, যার এক কোনায় কারো ফেলে যাওয়া থকথকে স্ট্যু পড়ে আছে, দেখে মনে হবে কেউ বমি করে রেখেছে। জিনের পাত্রটাই প্রথম তুলে নিলো উইনস্টন। একটু দম টেনে শরীরটাকে শক্ত করে নিলো, আর তেল-স্বাদের তরলটুকু ঢেলে দিলে গলদেশের গভীরে। চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসা পানি মুছতে মুছতে তার মনে হলো ভীষণ ক্ষুধার্ত সে। চামচ ডুবিয়ে স্ট্যু তুলে গলায় ঢালতে লাগলো। তরল স্যুপের মধ্যে গোলাপী মতো দেখতে যে ছোট ছোট পিচ্ছিল টুকরোগুলো দেখা যাচ্ছে ওগুলো মাংসে তৈরি। স্ট্যুর পেয়ালা পুরোটা শেষ করার আগে দু‘জনের মুখে রা’ শব্দটিও উচ্চারিত হলো না। উইনস্টনের বায়ে একটু পেছনের দিকের একটি টেবিলে একজন টানা বকবক করে যাচ্ছিলো। হাঁসের প্যাক-প্যাক শব্দের মতে ছিলো সে উচ্চারণ। গোটা কক্ষে যে হৈচৈ চলছে তা ছাপিয়েও কানে লাগছিলো সে শব্দ।
‘অভিধানের কাজ কেমন এগুচ্ছে? শোরগোলের মাঝে একটু উঁচুকণ্ঠেই জিজ্ঞেস করলো উইনস্টন।
‘ধীরে ধীরে,’ বললো সাইম। ‘বিশেষণ নিয়ে কাজ করছি, ভালোই লাগছে।’
নিউস্পিকের প্রসঙ্গে খুব দ্রুতই উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ওর মুখ। স্ট্যুর পেয়ালাটা একদিকে ঠেলে রেখে এক হাতে রুটি আর হাতে পনিরের টুকরোটি তুলে নিয়ে টেবিলের ওপর অনেকখানি ঝুঁকে গেলো যাতে না চিল্লিয়ে কথা বলা যায়।
‘একাদশ সংস্করণটিই চূড়ান্ত’ বললো সে। ‘আমরা ভাষাটির একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ পাচ্ছি- এমন একটা রূপ যে এর বাইরে মানুষের কথ্য আর কিছু থাকবে না। আমরা কাজ শেষ করলে তোমাদের মতো লোকেদের এর গোটাটাই ভালো করে শিখতে হবে। সবাই জানে, আমাদের প্রধান কাজ নতুন নতুন শব্দ তৈরি। কিন্তু আসলে যা হচ্ছে, আমরা প্রতিদিন শব্দ ধ্বংস করছি- ঝাঁকে-ঝাঁকে শব্দ, শত শত শব্দ। আমরা ভাষাটির হাড্ডি ছেঁটে ছোট করে দিচ্ছি। আমি বলতে চাই, এগারোতম সংস্করণে এমন একটি শব্দও থাকবে না যা ২০৫০ সালের আগে বিলীন বা অকেজো হবে।
ক্ষুধার্তের মতো বড় গ্রাসে রুটিতে কামড় বসালো, আর গিললো সাইম। আর কথা চলতে থাকলো পণ্ডিতি ধাচে। চিমসানো কালো চেহারাটা যেনো অঙ্কিত ছবির রূপ নিলো আর চোখের সেই সারাক্ষণের খুঁজে বেড়ানোর ভাবটা কেটে স্বপ্নময় হয়ে উঠলো। ‘শব্দ ধ্বংস অসাধারণ একটা কাজ! ক্রিয়া আর বিশেষণগুলোর বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে এটা ঠিক, কিন্তু শত শত বিশেষ্য থেকে মুক্তি মিলছে। সমার্থক শব্দগুলোই কেবল নয়, বাদ যাচ্ছে বিপরীতার্থকগুলোও। অন্য একটা শব্দের বিপরীত, এইতো, এর এমনকি প্রয়োজন বলো। প্রতিটি শব্দই তার বিপরীতার্থ ধারন করে। যেমন ধরো “গুড”, এর জন্য “ব্যাড” শব্দের প্রয়োজন কি? “আনগুড” য়েই চলে যায়। আর কেবল চলবেই কেনো, আমি বলি এটাই অপেক্ষাকৃত সঠিক, কারণ এতে বৈপরীত্বটা স্পষ্ট হয় যা “ব্যাড” শব্দে হয় না। আবার তুমি যদি “গুড”র আরও শক্ত কোনও ব্যঞ্জনা চাও, তখন “এক্সিলেন্ট”, “স্প্লেন্ডিড” এমন আরও কিছু ফালতু শব্দের প্রয়োজন দেখি না। বলে দাও “প্লাসগুড” ওতেই অর্থ পরিষ্কার অথবা যদি কিনা আরও জোর দিয়ে ভালোত্বের প্রকাশ ঘটাতে চাও “ডাবলপ্লাসগুড” বলো। এরই মধ্যে আমরা এগুলোর ব্যবহার শুরু করেছি, তবে নিউস্পিকের যে চূড়ান্ত সংস্করণ হচ্ছে এর বাইরে আর কিছুই থাকবে না। আর শেষমেষ ভালোত্ব আর মন্দত্বের সকল ধারনাই মাত্র ছয়টি শব্দের মাঝে সন্নিবেশিত হবে- প্রকৃতপক্ষে একটি শব্দে। ভাষার এই সৌন্দর্যটা তোমার চোখে পড়ছে না, উইনস্টন? আর অতি অবশ্যই, প্রধানত এটা বি.বি.’র অভিপ্রায়,’ যেন অনুগতচিন্তার অনিবার্য প্রকাশের অংশ হিসেবেই যোগ করলো সে।
বিগ ব্রাদারের নাম উঠতেই চেহারায় মেকি একটা আগ্রহের ছাপ মেখে নিলো উইনস্টন। হলে কি হবে, সাইম দ্রুতই ধরে ফেললো তার মধ্যে উচ্ছ্বাসের খামতি আছে।
‘নিউস্পিক নিয়ে তোমার ভিতরে কোনও আগ্রহ দেখি না, উইনস্টন,’ করুণ ব্যাথিত সুরে বললো সে। ‘এমনকি যখন লেখো তখনও তোমার মধ্যে পুরোনো ভাষাই ভর করে থাকে। “দ্য টাইমসে” তোমার কিছু কিছু লেখা মাঝে মধ্যে পড়ি। ভালোই লেখো কিন্তু ওগুলো স্রেফ অনুবাদ ছাড়া আর কিছু হয় না। তোমার হৃদয়ের গহীনে পুরোনো ভাষারীতির সব ফালতু আর অপ্রয়োজনীয় অর্থগুলো ধরে রাখার ইচ্ছাটাই প্রবল দেখি। তুমি কি জানো এই নিউস্পিক হতে যাচ্ছে বিশ্বের একমাত্র ভাষা যার শব্দভাণ্ডার হরবছর হ্রাস পাচ্ছে।
উইনস্টন বিষয়টি ভালোই জানে। সে হাসলো, অনুকম্পার হাসি, তবে মনে হলো না তার কথা বলার দরকার আছে। সাইম কালচে রুটিতে আরো একটা কামড় বসালো, কিছুটা চিবিয়ে নিয়ে ফের শুরু করলো:
‘তুমি দেখছো না, নিউস্পিকের লক্ষই হচ্ছে চিন্তার পরিধিটি ছোট করে আনা। আর এর মধ্য দিয়ে শেষমেষ আমরা চিন্তা অপরাধ সংঘটন আক্ষরিক অর্থে অসম্ভব করে তুলবো। কারণ, বস্তুত তখন বিষয়টি প্রকাশের জন্য কোনও শব্দই থাকবে না। প্রয়োজন হতে পারে এমন প্রতিটি ধারনাই একটি মাত্র শব্দে ব্যক্ত হবে যার অর্থও কঠোরভাবে সংজ্ঞায়িত থাকবে আর এর সম্পূরক অর্থগুলো মুছে ফেলা হবে, ভুলে যাওয়া হবে। ‘হবে নয়’, বলতে পারো ‘হয়ে গেছে’। একাদশ সংস্করণে আমরা এর থেকে আর খুব দূরে নই। তবে প্রক্রিয়া চলবে আরও দীর্ঘ সময় ধরে, তোমার আমার মৃত্যুরও অনেক পরে পর্যন্ত। এটা স্রেফ আত্ম-শৃঙ্খলাবদ্ধতার প্রশ্ন, বাস্তবতা নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন। তবে শেষ পর্যন্ত এর আদৌ কোনও প্রয়োজনও আর হবে না। ভাষা সঠিক হয়ে উঠলেই বিপ্লব সুসম্পন্ন হবে। নিউস্পিকই ইংসক আর ইংসকই নিউস্পিক,’ এক ধরনের রহস্যাবৃত্ত সন্তুষ্টির উচ্চারণে কথাগুলো বলে গেলো সে। ‘তুমি কি কখনো ভেবে দেখেছো, উইনস্টন, ২০৫০ সালের পর একটি মানুষও জীবিত থাকবে না যে আজ তুমি আমি যেই ভাষায় কথা বলছি তা বুঝতেও পারবে।’
‘কেবল মাত্র…’ সন্দেহমাখা কণ্ঠে কথাটা বলতে শুরু করেই থেমে গেলো উইনস্টন।
তার ঠোঁটের আগায় যে কথাটি এসে জমেছিলো তা হচ্ছে ‘কেবলমাত্র প্রোলরা ছাড়া,’ কিন্তু সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো, এই ভেবে তার এই মন্তব্য নিশ্চিতভাবেই প্রথাসিদ্ধ হবে না। তবে সে ঠিক কি বলতে যাচ্ছিলো তা দিব্য আর ধী-শক্তিতে ঠিক বুঝে নিলো সাইম।
‘প্রোলরা মনুষ্য জাত নয়’ অবজ্ঞামাখা উচ্চারণ তার। ‘২০৫০ সালের মধ্যে- হতে পারে তার আগেই, এই পুরোনো ভাষার সকল বাস্তব জ্ঞানের সমাপ্তি ঘটবে। পুরোনো সময়ের সকল সাহিত্য ধ্বংস করে দেওয়া হবে। চসার, শেক্সপিয়র, মিল্টন, বায়রন- এরা সবাই নিউস্পিক ভার্সনে টিকে থাকবেন, তবে তা কেবল ভিন্ন কিছুতে পরিবর্তীত হয়ে নয়, বরং বিতর্কিত কিছু বিষয়ের মধ্য দিয়ে, যাতে তারা অভ্যস্তও। এমনকি পার্টির সাহিত্য-কর্মও পাল্টে যাবে, স্লোগান পাল্টে যাবে। “স্বাধীনতা দাসত্ব” এমন একটি স্লোগান তুমি কিভাবে ধরে রাখবে যখন স্বাধীনতার ধারনাটিই আর থাকবে না? চিন্তুার পুরো আবহটিই পাল্টে যাবে। বস্তুত, যতটুকু বুঝতে পারি, চিন্তা বলেই আর কিছু থাকবে না। প্রথা মানেই চিন্তাহীনতা- চিন্তার অপ্রয়োজনীয়তা। প্রথা মানেই অসচেতনতা।’
হঠাৎই গভীর নিশ্চয়তায় উইনস্টনের মনে হলো, এই সময়েরই কোনও এক দিন সাইমকে বাষ্পায়িত করা হবে। সে অত্যন্ত ধী-শক্তি সম্পন্ন। সে সবকিছুই একটু বেশিই আগে দেখে ফেলছে, সোজাসাপ্টা তা বলেও দিচ্ছে। পার্টি এ ধরনের মানুষ খুব একটা পছন্দ করে না। একদিন সে গুম হয়ে যাবে। তার চোখে মুখে সেটাই লেখা রয়েছে।
রুটি আর পনির গেলা শেষ করলো উইনস্টন। চেয়ারে একদিকে একটু বেঁকে গিয়ে কফির মগে চুমুক দিলো। বামদিকে পেছনের টেবিলের লোকটি তখনও কর্কশ স্বরে তার অবিরাম অবিন্যস্ত কথা চালিয়ে যাচ্ছেন। এক তরুণী, হতে পারে তার সেক্রেটারি, উইনস্টনের সঙ্গে পীঠাপীঠি করে বসা, ভদ্রলোকের সব কথায় আগ্রহভরে অবিরাম সায় দিয়ে চলেছে। রিনরিনে নারী কণ্ঠের সে উচ্চারণের দু’একটা উইনস্টনের কর্ণকুহরে পশেছে- ‘আমি মনে করি আপনিই ঠিক, আমি আপনার সাথে একমত’ ধরনের বাক্য। আর উল্টোদিকের বক্তা বকে যাচ্ছেন অবিরাম। মেয়েটি যখন কিছু বলছে তখনও থামছেন না। চোখের দেখায় লোকটিকে চেনে উইনস্টন, ফিকশন বিভাগে কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন, এটুকুর বাইরে কিছুই জানা নেই তার। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি, মোটা গ্রীবা, বড় হা। মাথাটি ইষৎ হেলিয়ে রাখায় তার চশমা জোড়ায় যে আলো পড়েছে তাতে উইনস্টনের চোখে তার চোখ নয়, ধরা পড়ে আছে দুটো ব্ল্যাঙ্ক ডিস্ক। তবে কিছুটা ভয়ের বিষয় হচ্ছে, তার মুখ থেকে যে কথার ফল্গুধারা ছুটছিলো তার মধ্য থেকে একটি শব্দও আলাদা করে বুঝতে পারা ছিলো প্রায় অসম্ভব। মাত্র একটি বারের মতো উইনস্টন ধরে ফেলেছিলো তার কথা- ‘গোল্ডেস্টেইনীয় তত্ত্বের পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত অবসান’- আর সে কথা দ্রুতই আবার হারিয়ে গেলো অন্যান্য অবোধ্য উচ্চারণে। অন্যদের জন্য এই বকবকানি শোরগোল বা হাঁসের মতোই প্যাঁকপ্যাঁক বই আর কিছুই নয়। আর আপনি যখন শুনতেই পাবেন না লোকটি কি বলছে তখন সেই কথা নিয়ে আপনার মনে সন্দেহও দানা বাঁধবে না। হতে পারে সে গোল্ডস্টেইনের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করছে, আর চিন্তা অপরাধী ও নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোরতর শাস্তির দাবি তুলছে, হতে পারে সে ইউরেশীয় সেনাদের নৃশংসতার বিরুদ্ধে ফোঁসফাঁস করছে, নতুবা হতে পারে সে বিগ ব্রাদারের কিংবা মালাবার যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিকদের প্রশংসা করছে- এর কোনও কিছুতেই কিছু আসে যায় না। যাই থাক-না থাক এই বকবকানিতে, মূল সূর একটাই তা হচ্ছে- খাঁটি গোঁড়ামি আর খাঁটি ইংসক। একটি চোখহীন মুখমণ্ডলের চোয়ালটি যখন অবিরত উপর-নিচ করে যাচ্ছিলো, তা দেখে উইনস্টনের মধ্যে একটি কৌতুহলের অনুভূতি কাজ করলো, তার মনে হলো লোকটি আসলে রক্ত-মাংসের মানুষ তো! নাকি স্রেফ একটা কুশপুতুল! লোকটির মস্তিষ্ক থেকে এই কথা বেরিয়ে আসছে না, আসছে তার বাগযন্ত্র থেকে। তার ভেতর থেকে যা কিছু বেরিয়ে আসছে তা বাস্তবিক অর্থে কোনও কথা নয়, কেবলই শব্দের সমাহার; অসচেতনতায় উচ্চারিত হৈচৈ ধ্বনি, ঠিক যেনো হাঁসের প্যাঁকপ্যাঁক।
এক মুহূর্তের জন্য থামলো সাইম, চামচের হাতল ধরে স্ট্যুর মধ্যে নাড়ানাড়ি করছে অবিরাম। অন্য টেবিল থেকে প্যাঁকপ্যাকানি চলছেই, যা চারিদিকের শোরগোলের মধ্যেও সহজেই কানে এসে বাড়ি মারছে।
‘নিউস্পিকে একটা শব্দ আছে,’ বললো সাইম, ‘তুমি জানো কিনা জানিনা, ডাকস্পিক, মানে হাঁসের মতো প্যাঁক-প্যাঁকানো। এটি সেইসব মজার শব্দের একটি যা একই সঙ্গে দুটি পরস্পর বিরোধী অর্থ দেয়। তুমি তোমার প্রতিপক্ষের কারো সম্পর্কে কথাটি বললে তাকে হেয় করা হবে আর যদি তুমি তুষ্ট এমন কারো প্রসঙ্গে বলো, তাহলে সেটা হবে প্রশংসা।’
প্রশ্নাতীতভাবেই সাইমকে বাষ্পায়িত করে দেওয়া হচ্ছে, আরও একবার ভাবলো উইনস্টন। তার এই ভাবনার মধ্যে একধরনের দুঃখবোধও কাজ করছিলো। যদিও সে ভালো করেই জানতো সাইম তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, কিছুটা অপছন্দ করে আর যদি একটি বারও তার কাছে মনে হয় সে চিন্তা অপরাধী তাহলে তাকে ফাঁসিয়ে দিতে এতটুকু পিছপা হবে না। বোকার মতো কিছু একটা ভুল সাইম করে ফেলেছে। কিছু একটা অভাব ওর মধ্যে দেখা যাচ্ছে: অসাবধানতা, উদাসীনতা, বা নির্বোধের মতো কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলেছে। ওকে তো ব্যত্যয়কারীদের কেউ একজন বলা যাবে না। ইংসকের নীতিতে বিশ্বাসী, বিগ ব্রাদারের প্রতি বিশ্বস্ত, যে কোনো জয়ে আনন্দের সীমা থাকে না, উৎপথগামীদের ঘৃণা করে, আর তা যে কেবল অত্যন্ত আন্তরিকতায় করে তাই নয়, সীমাহীন উদ্দীপনার সাথেই করে। পার্টির সব তাজা খবরই সে রাখে, যেসব খবর অন্য অনেক সদস্য গায়ে মাখে না তা নিয়েও সে থাকে সমান উদ্দীপ্ত। তারপরেও মৃদু একটা অশোভনতা ওকে যেনো ঘিরে থাকে। ও এমন কিছু বলে, যা না বললেই বরং ভালো হতো, অনেক বই পড়ে, চিত্রকর আর গায়কদের দেখতে চেস্টনাট ট্রি ক্যাফেতেও তার নিয়মিত গতায়ত। চেস্টনাট ট্রি ক্যাফেতে যাওয়া যাবে না এমন কোনও আইন নেই। নেই কোনও অলিখিত বিধান। তারপরেও স্থানটিকে কেন জানি অশুভ বলেই জ্ঞান করা হয়। দলের পুরোনো, অসম্মানিত নেতারা শেষ ধোলাই হওয়ার আগে এখানেই আড্ডা জমাতো। বলা হয়, দশক কয়েক আগে গোল্ডস্টেইনকেও বার কয়েক ওখানে দেখা গেছে। এই থেকে সাইমের কপাললিখন পড়ে ফেলা খুব কঠিন কিছু নয়। একথা ধ্রুব সত্য, সাইম যদি তিন সেকেন্ডের তরেও উইনস্টনের গোপন এই ধারনার কথা জানতে পারে, তার বিরুদ্ধে থট পুলিশকে নালিশ করে দিতে সে একদণ্ড সময়ও নেবে না। অন্য যে কেউই তাই করবে: কিন্তু সাইম এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে থাকবে। উদ্দীপনা দেখালেই তা যথেষ্ট নয়। গোঁড়ামি অবচেতনতারই নামান্তর।
মাথা তুললো সাইম। ‘এই ঢুকলো পারসন্স,’ বললো সে।
গলার স্বরে এমন একটা ভঙ্গি ছিলো যেনো সে বলতে চেয়েছিলো, ‘ফালতু নির্বোধটা এলো’। ভিক্টরি ম্যানসন্সে উইনস্টনের প্রতিবেশী পারসন্স, ততক্ষণে রুমের ওপ্রান্তে যাওয়ার যুদ্ধে রত। মাঝারি উচ্চতার মোটাসোটা লোকটার মাথায় সাদা চুল, ব্যাঙমুখো চেহারা। পয়ত্রিশেই তার ঘাড়ে-গর্দানে আর ভুরিতে দলা দলা চর্বি জমেছে। তবে তার হাঁটাচলায় একটা বালকসুলভ ভঙ্গিমা আছে। তার পুরো অবয়বে মনে হয়, ছোট একটা বালক, গায়ে-গতরে একটু বেশি বেড়ে গেছে। নীতি মেনে কাপড় পরেও এই ভাব সে কাটাতে পারে না। স্পাইজের নীল শর্টস, ধূসর শার্ট আর লাল গলবন্ধ ছাড়া পারসন্সকে দেখা যাবে, এমনটা ভাবাও অসম্ভব। তাকে চোখে পড়া মাত্রই দেখা যাবে তার শর্টসের হাঁটুর অংশ আর শার্টের আস্তিন কুঁচকে উপরে উঠে হাত ও পায়ের থলথলে চর্বি তুলে ধরছে। তবে দলের যখন কোনো কর্মসূচি থাকে তখন এই পোশাক ছেড়ে অন্যকিছু পরতেও পারসন্সকে দেখা যায়। ‘হালো, হালো!’ বলে দুজনকেই শুভেচ্ছা জানিয়ে তাদের টেবিলেই বসে পড়লো। আর সাথে সাথে নাকে এসে লাগলো ঘামের গাঢ় গন্ধ। গোলাপি মুখমণ্ডলটা ভেজা ভেজা। তার ঘামের গন্ধের শক্তি অনন্যসাধারণ। কমিউনিটি সেন্টারে যে কেউ টেবিল টেনিস ব্যাটের হাতল ধরে বলে দিতে পারবে পারসন্স খেলে গেছে। সাইম এক পাতা কাগজ তুলে তার মধ্যে লেখা দীর্ঘ একটি কলাম গভীর মনোযোগে পড়তে শুরু করলো। হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে একটি কালির কলম চেপে ধরে সেটি টেনে টেনে পড়ছিলো।
‘দ্যাখো ব্যাটাকে, লাঞ্চের সময়েও কাজ করছে,’ উইনস্টনের গায়ে একটা ধাক্কা দিয়ে বললো পারসন্স। ‘কি মনোযোগ, আহা! ওর মধ্যে তুমি এমন কি পাচ্ছো, বুড়ো বালক? আশা করবো, আমার জন্য জ্ঞানের কিছু একটা হবে। স্মিথ, বুড়ো বালক, আরে শোনো, তোমাকেই খুঁজছি। আমাকে চাঁদা দেওয়ার কথা ভুলে গেছো বুঝি!’
‘কিসের চাঁদা?’, টাকার ওপর দরদ থেকেই বললো উইনস্টন। প্রত্যেকের বেতনের চারভাগের একভাগই এই স্বেচ্ছাসেবীদের চাঁদার খাতে চলে যায়। আর এরা সংখ্যায় এত বেশি যে আপনি চাইলেও ওদের হিসাব কষে রাখতে পারবেন না।
‘ঘৃণা সপ্তাহের জন্য- তুমি জানো- ঘরে ঘরে আদায় হচ্ছে এই তহবিল। আমাদের ব্লকে আমিই কোষাধ্যক্ষ। উঠেপড়ে লেগেছি- একটা দারুণ কিছু দেখাতে চাই। আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি, ভিক্টরি ম্যানসন্সের বাইরের ফ্ল্যাগগুলো হবে গোটা সড়কের মধ্যে সবচেয়ে বড়, টাকার অভাবে না পারলে পরে আমাকে দুষবে না, বলে দিচ্ছি। দুই ডলার দেবে বলে কথা দিয়েছিলো তুমি।’
পকেট হাতড়ে কোচকানো, নোংরা দুটি নোট বের করে এগিয়ে দিলো উইনস্টন। পারসন্স ওদুটো ছোট নোটবুকের পাতার ভাজে ঢুকিয়ে দিয়ে তাতে অশিক্ষিত সাবধানি হস্তাক্ষরে টুকে রাখলো।
‘ওহ শোনো, বুড়ো বালক,’ বললো সে। ‘শুনলাম আমার ছোট পাঁজিটা তোমার গায়ে গতকাল গুলতি ছুঁড়েছে। ব্যাটাকে কঠিন করে বকে দিয়েছি। আর বলেছি ফের যদি এমনটি করে আমি ওর গুলতিটাই কেড়ে নেবো।’
‘ফাঁসি দেখতে যেতে না পেরে ও মনে হয় একটু বিচলিত ছিলো,’ বললো উইনস্টন।
‘সেটা ভালো- আসলে আমি বলতে চাইছি এমটাইতো হওয়ার কথা, কি বলো? দুটোই পাঁজি ছোট বেয়াদব, কিন্তু ওদের অনুরাগের কথা ভাবো! ওদের চিন্তা জুড়েই আছে স্পাইজ, যুদ্ধ- এগুলো। তুমি কি জানো, গত শনিবার বার্কহ্যামেস্টেডে প্রচার অভিযানের সময় আমার ওই ছোট্ট মেয়েটি কি করেছে? আরও দুটি মেয়ে জুটিয়ে নিয়ে কর্মসূচি থেকে আস্তে করে সটকে পড়ে, আর গোটা বিকেল ওরা এক আগন্তুকের পিছু নিতে থাকে। টানা দুই ঘণ্টা লেজে লেজে কাটিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যখন আমার্শ্যামে পৌঁছায় তখন টহলদারদের হাতে ব্যাটাকে ধরিয়ে দেয়।’
‘ওরা কি জন্য এটা করলো?’ একটু উদ্বেগের স্বরেই বললো উইনস্টন। আর পারসন্স তার খুশির গদগদ ভাবটা ধরে রেখেই বলে চললো: ‘মেয়ে আমার বুঝে ফেলেছিলো লোকটি শক্রপক্ষের চর- ধরে নাও প্যারাসুটে চেপে এসেই নেমেছে। কিন্তু এখানেই কথা, হে বুড়ো বালক। কি বলোতো- মেয়েটিকে নিশ্চয়ই তোমায় সবার সেরা বলতে হবে। সে কি করছে, লক্ষ করেছে ব্যাটার জুতোয়। এক অদ্ভুদ ধরনের জুতো পরেছিলো সে- বললো এমন জুতো আর কাউকে কখনোই পরতে দেখেনি। সুতরাং ধরেই নেওয়া যায় সে বিদেশি। সাত বছরের এক দুধের শিশুর জন্য ভীষণ স্মার্ট একটা কাজ, কি বলো?’
‘লোকটির কি হলো?’ প্রশ্ন উইনস্টনের।
‘আরে, সেটা জানি না। তবে এ কথা শুনলে মোটেই বিস্মিত হবো না যদি… পারসন্স বন্দুক তাক করার একটি ভঙ্গি করলো আর মুখে ‘ফটাস’ শব্দ করলো।
‘দারুণ,’ অন্যমনষ্ক ভঙ্গিমাতেই উচ্চারণ সাইমের, তবে তার সেই কাগজের লেখা থেকে চোখ তুললো না।
‘অবশ্যই কোনো সুযোগ দেওয়ারই সুযোগ নেই আমাদের’ দায়িত্বের অংশ হিসেবে সম্মতি জ্ঞাপন করলো উইনস্টন।
‘আসলে আমিও তাই বলতে চাই, ঠিক যখন একটি যুদ্ধ চলছে,’ বললো পারসন্স।
যেনো সে কথারই নিশ্চয়তা দিতে ঠিক তখনই ওদের মাথার ওপর বসানো টেলিস্ক্রিনে বেজে উঠলো তুর্যনাদ। সেটা অবশ্য কোনো সামরিক য্দ্ধু জয়ের ঘোষণা দিতে নয়, স্রেফ প্রাচুর্য মন্ত্রণালয়ের একটি এলান তুলে ধরতে।
‘কমরেডস!’ একটা উত্তেজিত যৌবনদ্দীপ্ত কণ্ঠ বেজে উঠলো। ‘অ্যাটেনশন, কমরেডস! তোমাদের জন্য আমাদের কাছে দারুণ খবর আছে। আমরা উৎপাদন যুদ্ধে জয়ী হয়েছি। উৎপাদিত সকল ভোগ্যপণ্যের অবিক্রিত অংশের হিসাব বলছে মানুষের জীবনমান যা বেড়েছে তা গেলো বছরের তুলনায় ২০ শতাংশের কম হবে না। গোটা ওশেনিয়া জুড়ে আজ সকালে ফ্যাক্টরি শ্রমিক আর অফিস কর্মীরা মিছিল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে, তাদের হাতে ব্যানার, মুখে স্লোগান। তাতে বিগ ব্রাদারের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতারই প্রকাশ। তারা বলেছে, বিগ ব্রাদারের বুদ্ধিমত্তার নেতৃত্বই তাদের নতুন সুখী জীবন এনে দিয়েছে। এখানে কতগুলো পরিসংখ্যান তুলে ধরছি। খাদ্য সামগ্রী….।’
‘আমাদের নতুন সুখী জীবন’ কথাটি কয়েকবার করে বাজলো। প্রাচুর্য মন্ত্রণালয়ের ঘোষণায় এর ব্যবহার খুব শোনা যায়। সেই যে তুর্যধ্বনি পারসন্সনের মনোযোগ কেড়ে নিলো, এরপর গভীর নিরবতায়, গাম্ভীর্য নিয়ে পুরো ঘোষণাটি শুনলো। পরিসংখ্যানগুলো তার ধরতে পারার কথা নয়; কিন্তু এটা বুঝেছিলো ওগুলো সন্তোষজনক কিছু হবে। বড় সাইজের নোংরা একটি পাইপ বের করে আনলো সে, যার আধাটা পোড়া তামাকে ভরা। যখন তামাকের রেশন সপ্তায় ১০০ গ্রাম, তখন গোটা পাইপ পুরে তামাক টানা কারো পক্ষে কদাচই সম্ভব। অতি সাবধানে আড়াআড়ি করে ধরে রেখে একটি ভিক্টরি সিগারেট ফুঁকছিলো উইনস্টন। আগামীকালের আগে নতুন রেশন মিলছে না, আর তার কাছে মাত্র চারটি সিগারেট মজুদ আছে। বাইরের শোরগোল বাঁচিয়ে টেলিস্ক্রিনের কথাগুলোই শোনার চেষ্টা করছিলো উইনস্টন। বলা হচ্ছে- চকোলেটের রেশন বাড়িয়ে সপ্তাহে ২০ গ্রাম করায় কোথায় যেনো বিগ্র ব্রাদারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মিছিল হয়েছে। মাত্র গতকালই সে চকোলেটের রেশন সপ্তাহে ২০ গ্রামে নামিয়ে আনার পূর্ব ঘোষণাটি ঘঁসে ঠিক করে রেখেছিলো। এও কি সম্ভব মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে মানুষ এই নতুন কথা মেনে নেবে! কিন্তু হ্যাঁ, তারা তো মেনেই নিয়েছে। যেমন পারসন্স খুব সহজেই মেনে নিয়েছে, নির্বোধ পশুর মতোই মেনে নিয়েছে। অন্য টেবিলের চক্ষুহীন জন্তুটিও আরও অতিমাত্রার গোঁড়ামি আর গদগদ ভাব নিয়েই মেনে নিয়েছে। আর কেবল মেনেই নেয়নি, গেলো সপ্তাহেও চকোলেটের রেশন ত্রিশ গ্রাম ছিলো এমন কথা যারা ঘুণাক্ষরে মনে আনবে তাদের খুঁজে বের করে নিন্দাবাদ জানিয়ে, বাস্পায়িত করে দেওয়ার উগ্র মনোভাবও পোষণ করছে। সাইম, সেও- তবে আরেকটু জটিল উপায়ে, দ্বৈতচিন্তার প্রয়োগ ঘটিয়ে সেও এই কথা মেনে নিয়েছে। তাহলে সেই কি একা এক ব্যক্তি যে সেই সত্যিকারের স্মৃতির ধারক?
অসাধারণ সব পরিসংখ্যানে ভরে উঠছে টেলিস্ক্রিন। গেলো বছরের সঙ্গে একটা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে বলা হচ্ছে- খাদ্য, বস্ত্র বেশি উৎপাদন হয়েছে, তৈরি হয়েছে অধিকতর বাসস্থান, আসবাবপত্র, বেশি রান্নার পাত্র, জ্বালানি, আরও বেশি জাহাজ, বেশি সংখ্যক হেলিকপ্টার, বেশি পুস্তক, আর বেশি বেশি শিশুও… রোগবালাই, অপরাধ আর মস্তিষ্কবিকৃতি ছাড়া সবকিছুই বেশি বেশি। বছর-বছর আর মিনিটে মিনিটে সবকিছুই তরতর করে বেড়ে উঠছে উপরের দিকে। একটু আগে সাইম যেমনটা করছিলো ঠিক তেমনি হাতের চামচটি দিয়ে টেবিলের ওপর লম্বা লাইন হয়ে ছড়িয়ে পড়া ম্যারম্যারে রঙের থকথকে বস্তুগুলোর ওপর আঁকিবুকি শুরু করলো উইনস্টন। বড় তিক্ত মনে এই বাহ্যিক জীবনবিন্যাস নিয়ে ভাবতে বসলো সে। সবসময়ই কি জীবনটা এমনই ছিলো? ক্যান্টিনময় চোখ ঘুরিয়ে নিলো, দেখলো একটি অনুচ্চ ছাদের কক্ষে মানুষ গিজগিজ করছে। অসংখ্য শরীরের গন্ধে ঘৃণ্য পরিবেশ, ভাঙ্গাচোরা ধাতব চেয়ার-টেবিল এত ঠাসাঠাসি করে বসানো যে বসলেই কনুই লেগে যায়, বাঁকানো চামচ, বেঁকে যাওয়া ট্রে, মোটা সাদা মগ; যার উপরটা তেলতেলে, প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে ময়লার আস্তর, আর ফালতু জিন ও কফির মিলিত টক-টক গন্ধ, ধাতবরঙা স্ট্যু আর ময়লা কাপড়। এসবের মাঝে আপনার পাকস্থলী আর ত্বক সদাই যেনো প্রতিবাদী হয়ে বলতে থাকে এই কথা, তোমার যা অধিকার তা থেকে তুমি প্রতারিত হচ্ছো। এটা সত্য যে খুব একটা পার্থক্য টানা যাবে এমন কোনও স্মৃতিও তার নেই। ভালোভাবেই মনে করতে পারে একটি সময়ও ছিলো না যখন পর্যাপ্ত খাদ্য ছিলো, ছেঁড়া মোজা বা ছেঁড়া গেঞ্জি-জাঙিয়া পরতে হয়নি, আসবাবপত্র সবসময় দেখেছে ভাঙাচোরা, নড়বড়ে, অনুষ্ণ ঘর, টিউব ট্রেনে ঠেলাঠেলি, বাড়িগুলোতে আস্তর খসে খসে পড়ছে, কালচে রুটি, চায়ের আক্রা, বিস্বাদময় কফি, অপর্যাপ্ত সিগারেগ- সিনথেটিক জিন ছাড়া কোনও কিছুই সস্তা নয়, প্রাচুর্য নেই। কারো শরীর যখন বুড়িয়ে যায় তখন এগুলো আরও মন্দ আকার নেয়। যখন অস্বস্তি, আবর্জনা আর অভাবগ্রস্ততায় কারো হৃদয় আক্রান্ত হয়, দীর্ঘ শীতে কাবু থাকে, একটাই মোজা পরতে হয় দিনের পর দিন, লিফট যখন কখনোই কাজ করেনা, পানি ঠাণ্ডা হয়ে থাকে, খসখসে হয় সাবানের টুকরো, সিগারেট যখন ভেঙ্গে ভেঙ্গে খেতে হয়, আর খাদ্যের হয় এমন অগ্রাহ্য স্বাদ, তখন ওই বুড়িয়ে যাওয়াকে প্রাকৃতিক নিয়ম বলা চলে কি? আর কেনই এগুলো অসহনীয় ঠেকবে যখন অতীতের কোনও স্মৃতিই এর চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিলো না?
আরও একবার গোটা ক্যান্টিনে চোখ ঘুরিয়ে নিলো উইনস্টন। প্রায় প্রত্যেকেরই চেহারা কুৎসিত, নীল ওভারঅল ছাড়া অন্য কিছু পরলেও এদের এমন কুৎসিতই দেখাতো। কক্ষের দূরের দিকটাতে একটি টেবিলে একা বসে দুঁদে মাছির মতো দেখতে একজন কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন আর সন্দেহভরা চোখ দু’টি এদিক ওদিক ঘোরাচ্ছেন। পার্টি তার কর্মীদে জন্য যে শারীরিক গঠন নির্ধারন করে দিয়েছে- লম্বা, পেশিবহুল যুবক, গভীর-বক্ষা, উজ্জ্বল চুলের নারী, রোদে পোড়া, বেপরোয়া ভাব- নিজের দিকে না তাকালে বিষয়টি এমনই এবং ভালো করেই তা বর্তমান বলে বিশ্বাস হয় উইনস্টনের কাছে। কিন্তু বাস্তবিক হচ্ছে, যতটা তার বিচারবুদ্ধি বলে, এয়ারস্ট্রিপ ওয়ানের অধিকাংশ মানুষই এখন বেটেখাটো, কালো আর অবহেলিত। কৌতুহলের বিষয় এই মাছি-আকৃতির মানুষটি মন্ত্রণালয়ের কাজে কিভাবে ঢুকে পড়লো? বেটে মোটা মানুষগুলো, জীবনের গোড়ার দিকেই গায়ে মেদ জমিয়ে ফেলে, খাটো খাটো পায়ে দ্রুত-হন্তদন্ত হাঁটে, আর তাদের ভোমা-দুর্বোধ্য মুখমণ্ডলে কুঁতকুঁতে চোখ। দলের প্রতিপত্তির মতো করে এই ধরনের মানুষগুলোর সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে।
আরেকবার তুর্যধ্বনি বাজিয়ে প্রাচুর্য মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা শেষ হলো আর শুরু হলো ধাতব সুরের সঙ্গীত। পরিসংখ্যানের ধামাকায় এতক্ষণ হতভম্ব হয়ে থাকার পর এবার মুখ থেকে পাইপটি বের করে আনলো পারসন্স।
‘প্রাচুর্য মন্ত্রণালয় এবার নিঃসন্দেহে ভালো কাজ করেছে,’ যেনো খুব বুঝতে পেরেছে এমন ভঙ্গিমায় মাথাটি নাড়াতে নাড়াতে বললো সে। ‘আরে শোনো স্মিথ, বুড়ো খোকা, আমার ধারনা তোমার কাছে আমাকে দেওয়ার মতো একটাও রেজর ব্লেড নেই!’
‘একটিও না,’ বললো উইনস্টন। ‘গেলো ছয় সপ্তাহ ধরে আমি একটাই ব্লেড ব্যবহার করছি’
‘ঠিক আছে- ঠিক আছে- ভাবলাম তোমাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখি, বুড়ো খোকা।’
‘দুঃখিত,’ বললো উইনস্টন।
মন্ত্রণালয়ের ঘোষণার সময় সাময়িক বন্ধ থাকা প্যাঁকপ্যাঁক কন্ঠস্বরটি ফের চালু হয়েছে, আগের মতোন সমান সশব্দে। কি কারণেই যেনো উইনস্টনের ভাবনায় এলো মিসেস পারসন্সের কথা। তার ফাঁপা চুল আর মুখের ভাজে ভাজে জমে থাকা ময়লার আস্তর চোখে ভেসে উঠলো। দুই বছরের মধ্যে তার সন্তানেরা তাকে থট পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেবে আর মিসেস পারসন্স বাষ্পায়িত হয়ে যাবে। অন্যদিকে, পারসন্স কখোনোই বাষ্পায়িত হবে না। সাইমকে বাষ্পায়িত করা হবে। উইনস্টনকে বাষ্পায়িত করা হবে। ও’ব্রায়েনকে বাষ্পায়িত করা হবে, কিন্তু পক্ষান্তরে পারসন্সকে কখনোই বাষ্পায়িত করা হবে না। এই চক্ষুহীন, হংসকণ্ঠের জন্তুটি কখনোই বাষ্পায়িত হবে না। দুঁদে মাছির মতো দেখতে মানুষগুলো, যারা মন্ত্রণালয়ের গোলকধাঁধার মতো বারান্দাগুলোতে ভন ভন করে ঘুরছে, ওদেরও কখনোই বাষ্পায়িত করা হবে না। আর কালো চুলের মেয়েটি, ফিকশন ডিপার্টমেন্টের মেয়েটি- ওদেরও কখনোই বাষ্পায়িত করা হবে না। তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে কে টিকে থাকবে আর কে অন্তিম পথের যাত্রী হবে: যদিও টিকে থাকার কারণটি কি তা নিশ্চিত করে বলা সহজ নয়। মস্তিষ্কে প্রকাণ্ড একটা ঝাঁকুনি বোধ করে দিবাস্বপ্ন থেকে বাস্তবে ফিরলো সে। পাশের টেবিলের মেয়েটি ইষৎ ঘুরে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এই সেই কালোকেশী। একপাশ থেকে কৌণিক দৃষ্টি ফেলে সে তাকিয়ে উইনস্টনের দিকে, গভীর কৌতুহলভরা সে চাহুনি। চোখাচোখি হতেই মেয়েটি দ্রুত দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো।
উইনস্টনের মেরুদণ্ড বেয়ে ঘাম নেমে গেলো। ভীষণ এক ভীতি বয়ে গেলো তার শরীরের ভেতর দিয়ে। খুব দ্রুত তা চলেও গেলো বটে তবে মনে এক ধরনের অস্বস্তির অনুভূতি রেখে গেলো। মেয়েটি কেনো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো তাকে? কেনো সে সারাক্ষণই তাকে অনুসরণ করছে? দুর্ভাগ্যজনক যে, সে যখন পৌঁছায় তখন মেয়েটি এই টেবিলে বসেছিলো, না কি পরে এসে বসেছে তা উইনস্টন স্মরণ করতে পারছে না। কিন্তু গতকালও দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচির সময় মেয়েটি তার ঠিক পেছনে বসে পড়ে, যার আসলে কোনোও প্রয়োজন ছিলো না। বোঝাই যায় তার আসল উদ্দেশ্য ওর কথা শোনা এবং পর্যাপ্ত জোরে সে চিৎকার করছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া।
পুরোনো চিন্তা আবার ফিরে আসে উইনস্টনের মন জুড়ে: মেয়েটি থট পুলিশের সদস্য হবে বলে তার মনে হয় না, তাহলে হতে পারে সে শখের গুপ্তচর, সবার জন্যই যে বড় বিপদের কারণ। তার জানা নেই, কতক্ষণ ধরে মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে ছিলো, হতে পারে পাঁচ মিনিট ধরেই, আর এও সম্ভব পুরো সময়ই নিজের সকল অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিলো উইস্টন। জনসমক্ষে কিংবা টেলিস্ক্রিনের আওতার মধ্যে থেকে চিন্তাজগতকে উদ্দেশ্যহীন পথে হাঁটতে দেওয়ার বিপদ ভয়ঙ্কর। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোনও বিষয়ই আপনাকে বিপদে ফেলে দেবে। একটা সামান্য স্নায়ুবিক খিচুনি, একটি অবচেতন উদ্বেগের দৃষ্টি, স্বগোতোক্তির অভ্যাস- যে কোনোটা অস্বাভাবিক কিছু একটা নির্দেশ করে, ধরেই নেওয়া হবে, আপনি কিছু লুকোতে চাইছেন। একটি বেঠিক মুখোভঙ্গির (যেমন ধরুন কোনও যুদ্ধ জয়ের ঘোষণার সময় আপনাকে নিস্পৃহ দেখাচ্ছে) প্রকাশ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এনিয়ে নিউস্পিকে একটি শব্দও রয়েছে, যাকে বলে ফেইসক্রাইম।
মেয়েটি তার দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসলো। হতে পারে মেয়েটি আদতে তাকে অনুসরণ করছেই না। হতে পারে পরপর দুই দিন তার কাছাকাছি মেয়েটির বসা স্রেফ ঘটনাক্রমেই ঘটে যাওয়া। উইনস্টনের সিগারেট নিভে গেছে। অতি সতর্কতায় সেটি টেবিলের এক কোনায় রাখলো। ভেতরের তামাকগুলো ধরে রাখতে পারলে কাজের শেষে ওটি আবার ধরাবে। হতেই পারে পাশের টেবিলের মেয়েটি থট পুলিশের চর, আর এও হতে পারে তিন দিনের মধ্যেই তার স্থান হবে ভালোবাসা মন্ত্রণালয়ের গরাদের ভেতর। কিন্তু তাই বলে একটি সিগারেটের গোড়া নষ্ট করার কোনও মানে থাকতে পারে না। সাইম তার হাতের কাগজটি ভাজ করে পকেটে ঢুকিয়ে ফেললো। পারসন্স ফের বকবক শুরু করেছে।
‘তোমাকে বলেছি নাকি, বুড়ো খোকা,’ পাইপের গোড়া চেপে ধরে ঘুরাতে ঘুরাতে বললো সে, ‘আমার পাজি দুটো পুরান বাজারের এক মহিলার স্কার্টে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো। ওরা দেখতে পেলো মহিলাটি বি.বি’র একটি পোস্টার ছিঁড়ে সসেস পেঁচিয়ে নিচ্ছে। সন্তর্পণে ওর ঠিক পেছনে গিয়ে দেয়াশলাই ঠুকে দিলো আগুন ধরিয়ে। আমার ধারনা, ভালোই পুড়েছে। ছোট দুই পাঁজি! তবে বেশ চটপটে। স্পাইজে আজকাল ওরা প্রথম পর্যায়ের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে- ভালোই আমাদের সময় এমন প্রশিক্ষণ পাইনি। তুমি কি জানো, ওদের কাছে কি আছে? চাবির ছিদ্র দিয়ে কথা শুনার এক ধরনের শ্রবনযন্ত্র পার্টি ওদের দিয়েছে। এক রাতে আমার কন্যা ওগুলোর একটি বাড়িতেও নিয়ে এসেছিলো- আমাদের বসার ঘরের দরজা থেকে পরীক্ষা করে দেখেছে, বললো খালি কানে যতটুকু শুনতে পায় এর শব্দ তার দ্বিগুন। অবশ্যই এটি খেলনা বৈতো নয়, তারপরেও এতেই কাজ দিচ্ছে, ওরা ঠিক ঠিক ধরে ফেলতে পারছে।
ঠিক এই সময়ে টেলিস্ক্রিনে কানফাটা সিটি বেজে উঠলো। কাজে ফিরে যাওয়ার সংকেত। টেবিলের তিনজনই চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলো, লিফটের কাছে পৌঁছানোর লড়াইয়ে সামিল হতে। আর অমনি উইনস্টনের সিগারেটের শেষাংশের তামাকগুলো ঝুরঝুর করে নিচে পড়ে গেলো।
ষষ্ঠ অধ্যায়
ডায়রি লিখছিলো উইনস্টন।
তিন বছর আগের কথা। কোনও এক সন্ধ্যার অন্ধকারে, বড় রেলওয়ে স্টেশনের কাছাকাছি একটি সরু গলির ভেতর দেয়াল ঘেঁষে দরজাপথের পাশেই সড়কবাতির নিচে দাঁড়িয়েছিলো মেয়েটি। এই গলির সড়কবাতিগুলো কদাচই আলো দিতো। তরুণী-মুখ, গাঢ় রং মাখা। এই রংটির সত্যিই একটা আবেদন আমার কাছে ছিলো, এর সাদাটেরূপ, ঠিক মুখোশের মতো, আর লাল-উজ্জ্বল ঠোঁট। পার্টির মেয়েরা তাদের মুখে রঙ মাখায় না। সেই সন্ধ্যার সড়কে আর কেউই ছিলো না, কোন টেলিস্ক্রিন ছিলো না। মেয়েটি বললো.. দুই ডলার। আমি–
ওই মূহূর্তে লেখা চালিয়ে যাওয়া ভীষণ কঠিন মনে হলো। চোখ দুটি বন্ধ করে আঙ্গুল চেপে ধরলো সে। দৃশ্যটি ভাবনা থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করলো, কিন্তু সেটাই ঘুরে ঘুরে আসছে। তার মনে হচ্ছিলো নোংরা ভাষায় গালি-গালাজ করে, দেয়ালের সঙ্গে মাথা ঠোকে নয়তো কালির দোয়াতটা জানালা দিয়ে সজোরে বাইরে ছুড়ে দেয়- সহিংস কিংবা বেদনাদায়ক কিছু একটা করে, হৈচৈ হট্টগোল বাঁধিয়ে দেয় যাতে স্মৃতি থেকে সরে যায় সবকিছু।
স্নায়ুতন্ত্রটিই আসলে সবচেয়ে বড় শত্রু। যে কোনো ক্ষণেই আপনার ভেতরের দুশ্চিন্তাটা কিছু একটা বাহ্যিক লক্ষণ হয়ে আপনার ওপর ক্রিয়া করতে থাকবে। এবার তার মাথায় এলো সপ্তাহ কয়েক আগের এক স্মৃতি। রাস্তায় উল্টো দিক থেকে আসছিলো একজন। অতিসাধারণ দেখতে, দলেরই সদস্য। বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ, লম্বাটে-পাতলা গড়নের, হাতে ব্রিফকেস। দুজনের মধ্যে যখন কয়েক মিটারের দূরত্ব, তখন হঠাৎই তার মনে হলো লোকটির মুখমণ্ডলের বাম দিকটা খিচে ভেঙ্গেচুড়ে যাচ্ছে। এরপর ঠিক যখন দুজন-দুজনকে অতিক্রম করে গেলো তখনও একই ব্যাপার দেখতে পেলো। ঘটনাটি এক লহমার, ঠিক যেমন বিদ্যুৎ ফড়কানো কিংবা শিহরণ জাগানোর মতো কিছু একটা। ক্যামেরার ক্লিকে শাটার পড়ার মতোই ক্ষণস্থায়ী। তখনই তার মনে হয়েছিলো এই বেচারা তো মহাবিপদে আছে। বিপদের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিপদ ঘুমের মাঝে বকা। যতটা সে বুঝতে পারে, এ থেকে মুক্তি নাই।
গভীর শ্বাস নিয়ে আবার লিখতে শুরু করলো সে:
আমি তার সঙ্গে দরজাপথ পেরিয়ে পেছনের আঙ্গিনা ধরে বেজমেন্টের একটি রান্নাঘরে ঢুকলাম। দেয়ালে লাগোয়া একটি বিছানা পাতা, টেবিলের ওপর একটি বাতি জ্বলছে মৃদু আলোতে। মেয়েটি-
দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো সে। মনে হলো থুঁতুর পিচকিরি ছিটাবে। তখনই বেজমেন্টের রান্নাঘরের সেই নারীর পাশাপাশি তার মনোজগতে এসে হানা দিলো ক্যাথরিন, তার স্ত্রী। উইনস্টন বিবাহিত ছিলো, একটা সময় পর্যন্ত বিবাহিত ছিলো, সম্ভবত এখনও সে বিবাহিত, যদ্দুর জানে, তার স্ত্রী এখনও মারা যায়নি। আবারও যেনো বেজমেন্টের রান্নাঘরে গুমোট গরম আবহাওয়ায় শ্বাস নিচ্ছে সে, ছারপোকা, নোংরা কাপড়, সস্তা সুগন্ধীর মিশ্রনে এক উদ্ভট গন্ধ, তবে সম্মোহনী, কারণ পার্টির মেয়েরা কখনোই সুগন্ধী মাখে না, এমনকি মাখার কথা কল্পনাও করতে পারে না। কেবল প্রোলরাই সুগন্ধী মাখে। তার মনে ব্যাভিচারের ভাবনার সঙ্গে ওই গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো।
মেয়েটির সঙ্গে যখন গেলো সেটি ছিলো ওই সময়ে অন্তত দুই বছরের মধ্যে তার প্রথম স্খলন। পার্টিতে পতিতাগমন নিষিদ্ধ। তবে এটিও সেইসব নীতির একটি যা মাঝেমধ্যে ভাঙ্গার সাহস করা যায়। ধরা পড়লে বিপদ আছে। কিন্তু এটি জীবন-মরণ কোনও বিষয় নয়। গণিকাসহ হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলে, যদি অন্য কোনো অপরাধে সম্পৃক্ততা না থাকে, বাধ্যতামূলক শ্রম ক্যাম্পে আপনার পাঁচ বছরের অন্তরীণ জীবন, এতটুকুই সাজা, এর বেশি নয়। আবার আইনের চোখ বাঁচিয়ে কাজটি করাও কঠিন কিছু নয়। অপেক্ষাকৃত গরীবদের কোয়ার্টারগুলোতে নারীরা নিজেদের বেচতে প্রস্তুত হয়ে থাকে। এমনকি এক বোতল জিনের বিনিময়েই ওরা আপনার ভোগের পণ্য হয়ে বিকোয়। প্রোলদের জন্য জিন নিষিদ্ধ বলেই হয়তো আরও সহজ। কৌশলে দলই পতিতাবৃত্তিকে উৎসাহিত করে। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিগুলো অবদমন করে রাখার চেয়ে সেগুলো মিটিয়ে ফেলার একটি পথ রাখতেই হয়। ছোট ছোট পাপস্খলণ বড় কিছু নয়। বিশেষ করে যখন তা গোপনে-নিরানন্দে ঘটে চলে, আর তাতে জড়িত থাকে কেবলই নিম্নস্তরের ঘৃণিত নারীরা। দলের সদস্যদের জন্য প্রকীর্ণতা ক্ষমার অযোগ্য। আর এটি এমন এক অপরাধ যে বিচারের মুখে অভিযুক্তকে তা স্বীকার করে নিতেই হয়- সুতরাং অনেকেই এমন অপরাধ সংগঠনের কথা চিন্তায়ও আনে না।
পার্টির উদ্দেশ্য কিন্তু স্রেফ নারী ও পুরুষদের এমন একটি নীতির প্রতি অনুগত করে তোলা নয়; বরং প্রকৃত এবং অঘোষিত উদ্দেশ্য হচ্ছে যৌনকর্মের যে আনন্দ তা বিলীন করে দেওয়া। ভালোবাসা নয়, এখানে যৌনকামনাই শত্রু, হোক তা বিবাহভুক্ত কিংবা বহির্ভূত। দলের সদস্যদের মধ্যে বিয়ে হতে হলে এ জন্য গঠিত কমিটির অনুমোদন লাগে। নীতির বিষয়ে কোনও স্পষ্ট ঘোষণা নেই; তবে পাত্র-পাত্রীকে শারীরিকভাবে আকৃষ্ট মনে হলে বিয়ের অনুমতি মেলে না। বিয়ের একমাত্র স্বীকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে দলের সেবায় শিশুর সংখ্যা বাড়িয়ে চলা। প্রশ্রাবদ্বারে সিরিঞ্জ দিয়ে ওষুধ ঢোকানোর মতো একটি বিরক্তিকর কাজ হিসেবেই দেখা হয় যৌনমিলনকে। কথাগুলো সরাসরি হয়তো কোথাও বলা হয় না, কিন্তু দলের সদস্যদের শিশু বয়স থেকেই যৌনতার প্রতি আগ্রহ ঘষে ঘষে মুছে দেওয়া হয়। জুনিয়র এন্টি সেক্স লিগের মতো কিছু সংগঠন রয়েছে যারা নারী-পুরুষ উভয়কেই পুরোপুরি কৌমার্যের পথে ধরে রাখতে কাজ করছে। শিশুদের জন্ম হচ্ছে কৃত্রিম পরিনিষেকে (আর্টিফিসিয়াল ইনসেমিনেশন, নিউস্পিকে যাকে বলা হয় আর্টসেম) আর বেড়ে উঠছে সরকারি প্রতিষ্ঠানে। এটাই, উইনস্টন জানে সবমিলিয়ে হয়তো ঐকান্তিকভাবে কাজটি হচ্ছে না, তবু কোনও না কোনওভাবে এটাই দলের সাধারণ আদর্শ। যৌনতায় আগ্রহকে হত্যা করতে চায় দল, অথবা, হতে পারে হত্যা নয়, এর একটা বিকৃত রূপ দিতে চায়, নোংরা করে তুলতে চায়। সে জানে না, কেন এমনটি করা হচ্ছে, তবে মনে হচ্ছে এটাই হওয়া উচিত। আর যখন বিষয়টিতে নারীরা সম্পৃক্ত, দলের এই প্রচেষ্টা যথেষ্ঠই সফল।
আবারও চিন্তাজগতে ক্যাথরিনের প্রবেশ। নয়-দশ বছর হবে, এগারোও হতে পারে, তারা আলাদা হয়ে গেছে। কৌতুহলের বিষয়, কদাচই সে তার কথা ভাবে। কখনো দিনের পর দিন সে ভুলেই বসে থাকে যে একদা তার বিয়ে হয়েছিলো। তারা একসঙ্গে ছিলো পনেরো মাসের মতো। দল তালাকের অনুমতি দেয় না, বরং বাচ্চাকাচ্চা না থাকলে আলাদা থাকার বিষয়টিকেই উৎসাহিত করে।
ক্যাথরিন লম্বা গড়ণের, সুন্দর চুলের মেয়ে, অসাধারণ দেহ সৌষ্ঠব। ঈগলসদৃশ দৃঢ়-বাঁকানো চেহারা, যা দেখলে যে কেহই বলবে ‘অনন্যা’, অন্তত যতক্ষণ না তারা বুঝবে এর ভেতরটা ফাঁপা। বিবাহিত জীবনের খুব গোড়াতেই সে বুঝে ফেলেছিলো- যদিও তুলনা করে দেখার মতো অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গেই তার খুব একটা ঘনিষ্টতা কখনোই হয়নি- তার পরেও যতজন দেখেছে তার মনে হয়েছে, সন্দেহাতীতভাবেই এই মেয়েটি তাদের মধ্যে সবচেয়ে নির্বোধ, ফালতু আর শুণ্যমনা। পার্টির স্লোগানের বাইরে তার মাথায় আর কিছু নেই। দলের কথা মনের মধ্যে ধরে রাখতে না পারার মতো এতটা নিবুর্দ্ধিতা আর কারো মধ্যে দেখা যাবে না। মনে মনে সে তার নাম দিয়েছিলো ‘মানব শব্দযন্ত্র’। তারপরেও তার সঙ্গে বসবাস চলতো যদি সহবাসের বিষয়ে তাদের বনিবনাটা হয়ে যেতো।
তাকে ছুঁলেই কুঁকড়ে শক্ত হয়ে যেতো। তাকে জড়িয়ে ধরা আর একটি কাঠের পুতুলকে জড়িয়ে ধরার মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিলো না। আরও অদ্ভুত ছিলো- যখন তাকে কাছে টানতো, তখন মনে হতো ও যেনো প্রাণপণে তাকে দূরে ঠেলছে। তার শক্ত হয়ে থাকা নির্লিপ্ত পেশিগুলো অন্তত সেই বার্তাই দিতো। না ছিলো প্রতিরোধ, না সহযোগিতা। কেবল চোখ বন্ধ করে নিজেকে সমর্পন করে শুয়ে থাকতো। বিষয়টি ছিলো অস্বাভাবিকরকম বিরক্তিকর, আর কিছুক্ষণ পর তা হয়ে উঠতো ভয়াবহ অসহনীয়। তারপরেও মেনে নিয়ে একসঙ্গে থাকা যেতো যদি তারা দুজনই কৌমার্য ধরে রাখার ব্যাপারে একমত হতে পারতো। কিন্তু বিস্ময়করভাবে ক্যাথরিনই তাতে বাঁধ সাঁধলো। সে বললো, সম্ভব হলে তারা অবশ্যই একটা বাচ্চা নেবে। সুতরাং কাজটি ওভাবেই চললো। একেবারেই অসম্ভব হয়ে না পড়লে সপ্তাহে একদিন, নিয়ম করেই চলতো। সপ্তাহের দিনটি এলেই সকালেই মনে করিয়ে দিতো সন্ধ্যার কাজটির কথা। এ জন্য দুটি কথা ব্যবহার করতো ও- একটি ছিলো ‘সন্তান পয়দার কাজ’ অন্যটি ‘দলের প্রতি দায়িত্ব’ (সত্যি এই দুটি কথাই সে বলতো)। যখনই নির্দিষ্ট দিনগুলো আসতো উইনস্টনের ভেতর একটি ইতিবাচক শঙ্কার অনুভূতি কাজ করতো, তবে ভাগ্যক্রমে সন্তান আগমনের খবর মিলতো না। আর অবশেষে দু’জনই এই প্রচেষ্টায় ক্ষান্ত দেওয়ার বিষয়ে একমত হলো। আর এর কিছু দিনের মধ্যেই তারা আলাদা হয়ে গেলো।
একটা নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস ফেললো উইনস্টন। কলম তুলে নিয়ে ফের লিখতে শুরু করলো:
আচমকা মেয়েটি নিজেকে বিছানায় ছুড়ে দিলো, কোনো ধরনের রাগমোচনের প্রস্তুতি ছাড়াই, কল্পনাতীত বিভৎসতায় সে তার স্কার্টটি উপরে তুললো। আমি-
সে দেখছে, সে যেনো বাতির মৃদু আলোয় দাঁড়িয়ে, নাসিকারন্দ্রে এসে লাগছে ছারপোকার গন্ধ, সস্তা সুগন্ধী। আর হৃদয়খানি বিদীর্ণ হচ্ছে পরাজয়ের গ্লানি ও অপরাধবোধে। এরই মাঝে ভাবনা জগতে এসে মিশলো ক্যাথরিনের ধবল দেহখানি, পার্টির সংবেশন ক্ষমতায় যা চিরতরেই বরফহীম হয়ে গেছে। সবকিছুই এমন কেনো হবে? কেনো তার জন্য নিজের একজন নারী থাকবে না। কেনো তাকে বছরের বিরতিতে এমন ঘৃণ্য নোংরা নারী সান্নিধ্যে আসতে হবে? একটি সত্যিকারের ভালোবাসার সম্পর্ক মোটামুটি অচিন্তনীয় বিষয়। পার্টির নারীগুলো সবই একই রকম। পার্টির প্রতি আনুগত্যের মতোই কৌমার্য্যরে শুদ্ধতার বিষয়টি তাদের মনের গভীরে প্রোথিত। সতর্ক বাল্যশিক্ষায়, খেলায়, শীতল স্নানে, স্কুলের পাঠে, স্পাইজে, ইউথ লিগে, বক্তৃতায়, মিছিলে, গানে, স্লোগানে, যন্ত্রগীতে সবকিছুর মধ্য দিয়েই বিষয়টি তাদের মধ্যে চালিত। এতে তাদের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক অনুভূতিগুলোই গেছে মরে। তার যুক্তিগুলো বলছে, কিছু ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু হৃদয় মোটেই তা বিশ্বাসে রাজি নয়। এরা সব অজেয়, ঠিক যেমনটি দল চায় তেমনভাবেই অলঙ্ঘনীয়। আর সে কি চায়! সে ভালোবাসা চায় না, বরং জীবনে একটি বার হলেও সে এই শুদ্ধতার দেয়ালটি ভেঙ্গে দিতে চায়। যৌনতা, সাফল্য দুইই এখানে বিদ্রোহের নামান্তর। এখানে ইচ্ছা বা প্রত্যাশার নাম চিন্তাঅপরাধ। এমনকি একবারও যদি শয্যায় সঙ্গমে সে যৌনাবেদনে জাগরুক এক ক্যাথরিনকে পেতো তা হয়ে যেতো শ্লীলতাহানি, অথচ সেতো তার স্ত্রীই ছিলো।
যাইহোক গল্পের পরের অংশ লেখা হলো ডায়রিতে। সে লিখলো:
আমি বাতির সলতেটা বাড়িয়ে দিলাম। আর তখন আমি মেয়েটিকে আরো আলোয় দেখতে পেলাম-
অন্ধকার কেটে গেলে হারিকেনের দুর্বল আলোকেই বেশ উজ্জ্বল মনে হয়। এই প্রথম সে মেয়েটিকে ঠিক মতো দেখতে পেলো। এক পা মেয়েটির দিকে এগিয়ে ফের থমকে দাঁড়ালো, তার মধ্যে তখন কামলিপ্সার সহিংস রূপ। ঠিক যে কাজটি সে করতে যাচ্ছে তা নিয়ে বেদনার্তভাবেই আবার সে সচেতনও। খুবই সম্ভব, বের হওয়ার পথেই টহলদাররা তাকে ধরে ফেলবে; হতে পারে এ জন্য তারা এরই মধ্যে বাইরে অপেক্ষমান। এখানে যে কাজে সে এসেছে তা না করেও যদি এখুনি বের হয়ে যায় তাহলেও!
একটু দ্রুতই লিখে চলেছে সে, সেই একই অবিন্যস্ত হাতের লেখায়:
আমি বাতির আলোতে দেখতে পেলাম স্রেফ একটা বুড়ি, নিদেন পক্ষে পঞ্চাশ বছরতো হবেই। কিন্তু আমি এগিয়ে গেলাম। এবং যা করার ঠিক তাই করলাম।
আবারও চোখের ওপর আঙুলগুলো চেপে ধরলো সে। অবশেষে কথাগুলো লিখে ফেলেছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। সেই যে নোংরা ভাষায় চিৎকার করে বলার তীব্র বাসনা তা তীব্রতর হলো।
সপ্তম অধ্যায়
‘আশা যদি কিছু থেকে থাকে,’ লিখলো উইনস্টন ‘তা ওই প্রোলদের মধ্যেই প্রোথিত।’
আশা যদি কিছু থেকে থাকে, অবশ্যই তা প্রোলদের মধ্যে প্রোথিত, কারণ একমাত্র মৌচাকের মৌমাছির মতো ঠাসাঠাসি করে থাকা, ওশেনিয়ার মোট জনসংখ্যার ৮৫ ভাগের ভাগীদার এই জনগোষ্ঠীই একদিন মহীরুহের মতো গড়ে ওঠা পার্টিকে ধ্বংস করে দেওয়ার শক্তি হয়ে উঠতে পারে। ভেতর থেকে পার্টির পতন সম্ভব হবে না। এর শত্রুরা, যদি আদৌ এর কোনো শত্রু থেকে থাকে, কোনোভাবেই একজোট হতে পারবে না, এমনকি একে অপরকেই চিনবে না তারা। এমনকি কিংবদন্তির ব্রাদারহুডও যদি টিকে থাকে, তেমন একটা সম্ভাবনা যেহেতু রয়েছে, এটা ভাবা অসম্ভব যে এর সদস্যরা দুইজন বা তিনজন করেই সমবেত হতে পারবে। বিদ্রোহ মানেই হচ্ছে চোখে চোখ রেখে, কণ্ঠস্বর উচিয়ে প্রতিরোধের উচ্চারণ। প্রোলরা পারবে, কিন্তু তাও যদি তারা কভু তাদের এই শক্তি সম্মন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে তবেই। এ জন্য তাদের ষড়যন্ত্রের জাল বেছাতে হবে না। কেবল জেগে উঠতে হবে। অশ্বশক্তির ঝাঁকুনি দিয়ে মৌমাছির মতো ছুটতে হবে। কাল সকালেই যদি তারা পার্টিকে খান খান করে দিতে চায়, পারবে। নিঃসন্দেহে খুব কাছাকাছি সময়ে, নয়তো অনেক দেরিতে হলেও তারাই এটা করবে। আর এখনো-!
উইনস্টনের মনে পড়ে একদিন এক ভিড়ের সড়কে হাঁটছিলো সে। এসময় শত শত নারী কণ্ঠের আওয়াজ কানে আসে। একটু সামনেই গলি সড়কের ভেতর থেকে ফেটে পড়া বিক্ষোভের শব্দ। সে ছিলো ক্রোধ আর ঘৃণার ভীষণ ভয়াল চিৎকার, তীব্র তারস্বরের উচ্চারণ ‘উহ-উ-উ-উ-উহ!’ ঘণ্টারধ্বনি যেমন অনুরুণন তুলে ইথারে ছড়ায়, ঠিক তেমনি। তার হৃদয়খানি লাফিয়ে উঠেছিলো। মনে হয়েছিলো, শুরু বুঝি তাহলে হয়েই গেলো! দাঙ্গা! প্রোলরা অবশেষে বাঁধ ভাঙছে! অকুস্থলে পৌঁছে সে দেখতে পেলো শ’ তিনেক নারী সমবেত হয়েছে সড়কপাশের মার্কেটের দোকানগুলো ঘিরে। তাদের চেহারায় বিয়োগান্তের ছাপ। যেনো তারা গভীর সমুদ্রে ডুবন্ত কোনো জাহাজের যাত্রী। সে যখন ওখানে, ততক্ষণে সমবেত ক্ষোভ ব্যক্তিগত ঝগড়াঝাটিতে রূপ নিয়েছে। জানা গেলো স্টলগুলোর একটিতে টিনের সসপ্যান বিক্রি হয়। ঠুনকো ও ফালতু মানের সসপ্যান। রান্নার পাত্রের আক্রা লেগেই থাকে। আর ওই সময়টিতে সরবরাহ ছিলো অপ্রত্যাশিত ভাবেই কম। যারা পেয়ে গেছে তাদের ওপর হামলে পড়ছে অন্যরা। যারা পেয়েছে তারা সটকে পড়তে পারলে বাঁচে, কিন্তু অন্যরা তাদের যেতে দিচ্ছে না। দোকানির বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনে হট্টগোল বাঁধিয়ে দিয়েছে। অভিযোগ, অন্য কোথাও সসপ্যান মজুদ করে রেখেছে দোকানি।
এ পর্যায়ে নতুন করে আবারও চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হলো। অতিপ্রকাণ্ড বপুর দুই নারীর একজন খোলা এলোমেলো চুলে ছুটে গিয়ে আরেকজনের হাতে ধরা সসপ্যানটিতে ছোঁ মারলো। এরপর শুরু হলো টানা-টানি আর সঙ্গে সজোরে চিৎকার। কিছুক্ষণের টানাটানিতেই হাতলটি ছুটে চলে গেলো এক জনের হাতে অন্য জনের হাতে সসপ্যান। মহাবিরক্তি নিয়ে উইনস্টন এদের কাণ্ড-কারখানা দেখছিলো। মাত্র কয়েকশ’ কণ্ঠের চিৎকারে একটু আগেই যে শক্তি সে মনে মনে দেখতে পেয়েছিলো তা নিমেষে উবে গেলো। তার মনে হলো- ঠিক এই কারণেই এরা কখনো এমন আওয়াজ তুলতে পারবে না যা গুরুত্ব রাখে।
সে লিখলো:
ওরা যতদিনে সচেতন হয়ে না উঠবে ততদিনে বিদ্রোহী হতে পারবে না, আর যতদিনে বিদ্রোহী না হবে ততদিনে সচেতন হতে পারবে না।
হ্যাঁ ঠিক একথাটিই, তার মনে হলো, পার্টির পাঠ্যবইগুলোতে ঠিক এমন একটি কথাই লেখা রয়েছে। সকল বন্ধন থেকে প্রোলদের মুক্ত করতে হবে, এটাই পার্টির দাবি। বিপ্লবের আগে ওরা পুঁজিপতিদের চরম নিষ্পেষণের শিকার হয়েছে, ওরা ভুখা থেকেছে, মার খেয়েছে, কয়লার খনিতে নারীরা জবরদস্তি শ্রম খেটেছে (বাস্তবতা হচ্ছে নারীরা এখনো কয়লার খনিতে শ্রম খাটে), শিশুরা ছয় বছর বয়সেই বিক্রি হয়েছে কারখানাগুলোর হাতে। অথচ পাশাপাশি দ্বৈতচিন্তার নীতি বাস্তবতায়, পার্টি মনে করে প্রোলরা প্রাকৃতিকভাবেই অধস্তন, গুটিকয় সাধারণ বিধির প্রয়োগে ওদের পশুর মতো অসহায়ত্বে ফেলে রাখাই বিধান। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রোলদের সম্পর্কে খুব কমই সবার জানা আছে। জানার প্রয়োজনও খুব বেশি নয়। ওরা কাজ করবে, সন্তান জন্ম দেবে, এর বাইরে ওদের কোনোও কাজেরই কোনো গুরুত্ব নেই। আর্জেন্টিনার বিশাল সমতল ভূমিতে ছাড়া গরু-বাছুরের মতোই ওরা ছাড়া থাকে, কিন্তু ওরা এমনই এক জীবনে অভ্যস্ত যাকে প্রকৃতির বিধান বলেই মেনে নিয়েছে, এর সঙ্গেই ওরা সইয়ে নিয়েছে নিজেদের জীবন।
নর্দমায় ওদের জন্ম, নর্দমায়ই বেড়ে ওঠা। বারো বছরেই ওরা শ্রমিক, আর কাজের মাঝেই কখন পার হয়ে যায় ওদের জীবনের সুন্দর হয়ে ওঠার সময়, যৌনতার অনুভূতিকে বুঝে ওঠার বয়স। বিশে ওরা বিয়ে করে, ত্রিশেই মধ্যবয়ষ্ক হয়ে ওঠে আর এদের অধিকাংশই ষাটের মধ্যেই বরণ করে নেয় মৃত্যুকে। গতর খাটা কাজ, বাচ্চাপালন, প্রতিবেশির সঙ্গে ঝগড়া, সিনেমা, ফুটবল, বিয়ার আর সর্বোপরি জুয়ায় জড়িত ওদের জীবন। আর এর মধ্যেই ঘুরপাক খায় ওদের মন ও মননশীলতা। ওদের নিয়ন্ত্রণ এতটুকু কঠিন কিছু নয়। থট পুলিশের গুটি কয় চর ওদের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়, কথায় কথায় মিথ্যা গুজব ছড়ায় আর ভয়ঙ্কর কিংবা ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে এমনদের চিহ্নিত করে গুম করে দেয়।
ওদের মধ্যে দলের আদর্শ ঢুকিয়ে দেওয়ার কোনও প্রচেষ্টাই নেই। প্রত্যাশাও নেই যে প্রোলরা রাজনৈতিক অনুভূতিতে চাঙা হবে। তাদের কাছে একটাই চাওয়া তা হচ্ছে আদিম দেশপ্রেম যা ওদের দীর্ঘ কর্মঘণ্টা আর আরও কম রেশনেও গদগদ করে রাখবে। আর এমনকি অখুশি বা অসন্তুষ্ট হয়ে উঠলেও, যা ওরা মাঝে মধ্যে হয়ও, তাদের সে অসন্তুষ্টির বোধ কোনও পরিণতি পায় না, কারণ এই অসন্তোষ সাধারণে ছড়িয়ে দেওয়া ওদের পক্ষে সম্ভব নয়, বরং ওরা কোনো একটি ক্ষোভের মাঝেই ঘুরপাক খায়, আর তারই নিরসন চায়। অপেক্ষাকৃত বড় ক্ষতিকর দিকগুলো ওদের চোখ এড়িয়ে থাকে।
প্রোলদের একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের বাড়িতে টেলিস্ক্রিনও নেই। সিভিল পুলিশ ওদের কম ঘাঁটায়। অপরাধীতায় ভরা লন্ডন। ভূ-খণ্ডের মাঝেই চোর, ডাকাত, পতিতা, মাদকব্যবসায়ী, প্রতারক, বাটপারদের এক পূর্ণাঙ্গ ভূ-খণ্ড। কিন্তু এর সবকিছুই যেহেতু প্রোলদের নিজেদের মাঝেই ঘটে তাই এ নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা নেই। নৈতিকতার সকল প্রশ্নে ওরা তাদের পুরুষানুক্রমিক ধারাই মেনে চলে। যৌনাচারের শুদ্ধিবাদ ওদের ওপর আরোপিত নয়। নির্বিচার যৌনাচারে নেই শাস্তির বিধান, বিবাহবিচ্ছেদে মানা নেই। আর এ কারণেই, প্রোলরা ধর্মীয় উপসনা করতে চাইলে তারও অনুমতি মেলে। ওদের ওপর সন্দেহের চোখ ঘোরপাক খায় না। ওদের জন্য পার্টির স্লোগানই হচ্ছে: ‘প্রোল আর পশুরা মুক্ত’।
নিচু হয়ে ঘায়ের জায়গাটি সাবধানে চুলকে নিলো উইনস্টন। এতে আবারও চুলকানি শুরু হয়েছে। বিপ্লবের আগের জীবন ঠিক কেমন ছিলো তা জানা অসম্ভব। আর সেই অসম্ভবেই বার বার ফিরে যাবেন আপনি। ড্রয়ার থেকে শিশুদের ইতিহাসের একটি পাঠ্যবই বের করে আনলো সে। বইটি মিসেস পারসন্সের কাছ থেকে ধার চেয়ে এনেছে। বই থেকে ডায়রিতে তুলতে শুরু করলো একটি অনুচ্ছেদ:
বইয়ে লেখা হয়েছে- পুরোনো দিনগুলোতে, গৌরবান্বিত বিপ্লবের আগে, আজ যে লন্ডনকে আমরা চিনি তেমন সুন্দর নগর এটি ছিলো না। সে ছিলো অন্ধকার, নোংরা, দুর্বিসহ এক লন্ডন যেখানে কেউ কদাচই পর্যাপ্ত খেতে পেতো, শত শত এবং হাজার হাজার দরিদ্র মানুষের পায়ে জুতো ছিলো না, ঘুমানোর জন্য মাথার ওপর আচ্ছাদন ছিলো না। তোমাদের মতো ছোট ছোট শিশুরা দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করতো, কাজ কম হয়ে গেলে ক্রুর মনিবরা ওদের ওপর চালাতো অত্যাচারের চাবুক, ওদের গন্ধময় শক্ত রুটির টুকরো আর পানি ছাড়া কিছুই খেতে দিতো না। এই ভয়াবহ দারিদ্রের পাশাপাশি গুটিকয় মাত্র বড় সুন্দর বাড়ি ছিলো যাতে ধনাঢ্যরা বাস করতো। যাদের দেখভাল করতেই নিয়োগ করা হতো জনা-ত্রিশেক চাকর-বাকর। এই ধনাঢ্যদের বলা হতো পুঁজিপতি। ওরা ছিলো মোটা, কুৎসিত চেহারার, ঠিক উল্টো পৃষ্ঠার ছবিটির মতো। তোমরা দেখতে পাচ্ছো- তার গায়ে লম্বা কালো কোট যাকে বলা হতো ফ্রক কোট, আর অদ্ভুত জ্বলজ্বলে হ্যাট, দেখতে ঠিক চুল্লির চোঙার মতো, ওরা বলতো টপ হ্যাট। এটাই ছিলো পুঁজিপতিদের পোশাক, তারা বৈ আর কারও এই পোশাক পরার অনুমতি ছিলো না। এই পুঁজিপতিরা গোটা বিশ্বের সবকিছুরই মালিক ছিলো, আর বিশ্বের অন্যসবাই ছিলো তাদের কৃতদাস। তাদের দখলে ছিলো সকল জমি, ঘর-বাড়ি, কারখানা আর অর্থসম্পদ। তাদের অমান্য করলেই কারাগারে নিক্ষেপ করতো, অথবা কাজ ছিনিয়ে নিয়ে ক্ষুধায় মৃত্যুবরণে বাধ্য করতো। যদি কখনো কোনও সাধারণ মানুষ কথা বলতো কোনও পুঁজিপতির সামনে, তাকে হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করেই থাকতে হতো, মাথা থেকে হ্যাট খুলে রাখতে হতো আর ‘প্রভু’ বলে সম্মোধন করতে হতো। সকল পুঁজিপতির যিনি প্রধান তাকে বলা হতো ‘রাজা’, আর-
উইনস্টন জানে আর কি কি থাকতে পারে এই বইয়ে। লম্বা আচিনের পোশাক পরিহিত বিশপদের কথা, বিচারকদের জন্য পশুর লোমে তৈরি গাউনের কথা, অপরাধীদের সাজার জন্য তৈরি কাঠের পিলোরি, গবাদির পাল, ঘানি, বহুলেজবিশিষ্ট চাবুক, লর্ড মেয়রের ভোজসভা, পোপের পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলে চুমু খাওয়ার রেওয়াজ এসবইতো। একটা প্রচলন ছিলো-বলা হতো জাস প্রাইমি নকটিস, শিশুদের পাঠ্য বইয়ে সম্ভবত তার উল্লেখ থাকবে না। এটি ছিলো এমন এক আইন যাতে প্রত্যেক পুঁজিপতি তার কারখানায় কাজ করে এমন প্রতিটি নারীকেই শয্যাসঙ্গী করতে পারতো।
আপনি কি করে জানবেন এর কতটা অসত্য? হতে পারে, বিপ্লবের আগের সময়ের চেয়ে গড়পড়তা মানুষের এখনকার জীবন ভালো কাটছে। কিন্তু এর বিপরীতে একমাত্র প্রমাণ হচ্ছে আপনার হাড়ের ভেতরে জমে থাকা সুপ্ত প্রতিবাদ, আপনার যাপিত জীবনের অসহনীয় পরিবেশ নিয়ে সহজাত অনুভূতি, যা ভিন্ন সময়ে ভিন্ন রূপ নেয়।
উইনস্টনের মনে হলো আধুনিক জীবনের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য এর নিষ্ঠুরতা ও নিরাপত্তাহীনতায় নয়, বরং এর নগ্নতা, নোংরামি আর অস্তিত্বহীনতায় নিহিত। আপনি নিজের দিকটা দেখলেও দেখবেন, টেলিস্ক্রিন থেকে যে অনবরত মিথ্যার বেসাতি চলছে তার সঙ্গেই কেবল নয়, এর মধ্য দিয়ে দল যে আদর্শ অর্জন করতে চাইছে তারও সঙ্গেও জীবনের কোনও সাজুয্য নেই। দলের একজন সদস্যের জন্যও এর সেরা দিকগুলো হচ্ছে নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক মনোভাব পোষণ, একঘেঁয়ে কাজ, টিউবে একটু স্থান করে নেওয়ার লড়াই, ছিড়ে যাওয়া মোজায় পা গলানো, স্যাকরিন ট্যাবলেটে মিষ্টি উপভোগ আর সিগারেটের গোড়া বাঁচিয়ে ধূমপানের তৃষ্ণা নিবারণ। পার্টি যে আদর্শ নির্ধারণ করেছে তা বিশাল, ভয়াবহ আর জ্বলজ্বলে- ইষ্পাত আর কংক্রিটের এক জগত, দৈত্যাকায় যন্ত্র আর ভয়াল অস্ত্র- যুদ্ধবাজ আর গোঁড়াদের এক জাতি যা এগিয়ে চলছে যথার্থ যুথবদ্ধতায়, সবাই একই ভাবনা ভাবছে, একই স্লোগান তুলছে, টানা কাজ করে যাচ্ছে, যুদ্ধ করছে, জয় করছে, যন্ত্রণা দিচ্ছে- আবার যন্ত্রণাই ভোগ করছে- তিন কোটি মানুষের একই মুখ, একই চেহারা। বাস্তবতা হচ্ছে- ক্ষয়িষ্ণু নোংরা নগরে বুভুক্ষ মানুষগুলো ছেঁড়া জুতো পায়ে এদিক ওদিক ছুটছে, উনবিংশ শতাব্দীর ক্ষয়ে ক্ষয়ে পড়া বাড়িগুলো থেকে সদাই ছুটছে সিদ্ধ বাঁধাকপি আর বিষ্ঠার উৎকট গন্ধ। তার চোখে ভেসে উঠলো লাখ লাখ ডাস্টবিনে ভরা সর্বনেশে এক লন্ডন নগরী আর তা মিশে একাকার হয়ে গেলো মিসেস পারসন্সের অবয়বে, উশকো খুশকো চুলে ছাতরা পড়া একটি মুখ, পাইপে পূতিগন্ধময় আবর্জনা আটকে যাওয়ার পর যাতে মেখে আছে অসহায়ত্বের ছাপ।
আবারও নুয়ে পড়ে গোড়ালির দিকটা চুলকে নিলো সে। দিবারাত্রি টেলিস্ক্রিনগুলো পরিসংখ্যানের তোড়ে আপনার কানে ব্যাথা ধরে যাবে। যেনো প্রমাণ করেই ছাড়বে জনগণ এখন বেশি খাদ্য পাচ্ছে, বস্ত্র পাচ্ছে, আবাসন পাচ্ছে, অধিকতর বিনোদন পাচ্ছে- পঞ্চাশ বছর আগের মানুষের চেয়ে তারা বেশি বাঁচে, কম খাটে, গায়ে-গতরে বড়, স্বাস্থ্যবান, শক্তিধর, আরও খুশি, আরও বুদ্ধিমান, আরও শিক্ষিত। এসব কথার একটি শব্দকণাও কখনো প্রমাণ করা যাবে না, আবার অপ্রমাণও করা যাবে না। ধরুন, দল দাবি করছে, বয়ষ্ক প্রোলদের ৪০ শতাংশ শিক্ষিত: বিপ্লবের আগে বলা হতো এর সংখ্যা ছিলো মাত্র ১৫ শতাংশ। দল দাবি করছে শিশু মৃত্যুর হার এখন হাজারে ১৬০, অথচ বিপ্লবের আগে এর সংখ্যা ছিলো ৩০০- এরকমই অন্য সব পরিসংখ্যান। এটা যেনো দুই অজানা তথ্যকে এক সমীকরণে মেলানো। খুব হতে পারে, এই ইতিহাসের বইয়ের প্রতিটি শব্দ, এমনকি যা কিছু প্রশ্নাতীতভাবে গৃহীত তাও খাঁটি অলিক কল্পনা বৈ কিছু নয়। এমনও হতে পারে, জাস প্রাইমি নকটিস বলে কোনও আইন ছিলো না, পুঁজিপতি বলে কোনও সৃষ্টির অস্তিুত্ব ছিলো না, ছিলো না টপ হ্যাট নামের কোনও পোশাকও।
সবকিছুই ধোয়াশায় মিশে গেছে। অতীত মুছে ফেলা হয়েছে, যার ঘঁষে ফেলা অংশটিও এখন বিস্মৃত, মিথ্যাটাই আজ সত্যে পরিণত হয়েছে। গোটা জীবনে মাত্র একটিবার- মিথ্যায়নের সুনির্দিষ্ট, অভ্রান্ত নজীর তার হাতে পড়েছিলো। মাত্র ত্রিশ সেকেন্ড ওটি আঙুলের ফাঁকে আটকে ধরেও রেখেছিলো সে। সালটা ১৯৭৩ই হবে- ততদিনে ক্যাথরিনের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তবে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তারিখটি বিচ্ছেদেরও সাত বা আট বছর আগের।
গল্পের শুরু ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে, মহাশুদ্ধিকরণের সেই দিনগুলোতে বিপ্লবের মূল হোতাদের যখন একবারে এবং চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হচ্ছিলো তখন। ১৯৭০ এর পর এদের একজনেরও অস্তিত্ব থাকলো না, বিগ ব্রাদার ছাড়া। বাদবাকিরা ততদিনে হয় উবে গেছে নয়তো ষড়যন্ত্রকারী, প্রতিবিপ্লবীর তকমা নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। গোল্ডস্টেইনও পালালো, আর কোথায় সে গা-ঢাকা দিলো তা কেউ জানে না। অন্যদের মধ্যে কেউ কেউ স্রেফ গুম হয়ে গেলো, আর অধিকাংশেরই বিস্ময়কর গণবিচারে অপরাধের স্বীকারোক্তির পর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়ে গেলো।
শেষ যারা টিকে ছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন তিনজন- জোন্স, অ্যারোনসন আর রাদারফোর্ড। ১৯৬৫ সাল নাগাদ এই তিনজনকে গ্রেফতার করা হলো। যেমনটা প্রায়শঃই ঘটে, এদের তিনজনকেই বছর খানেক বা তারও বেশি সময় ধরে লাপাত্তা করে দেওয়া হলো, যাতে কেউ বুঝতে না পারে ওরা বেঁচে আছেন, নাকি মৃত। এরপর স্বাভাবিক নিয়মে হঠাৎই একদিন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে আবারও সামনে আনা হলো তাদের। তিন জনই স্বীকার করলেন, তারা শক্রপক্ষের গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করেছেন (সে সময়ও ইউরেশিয়াই ছিলো শত্রুপক্ষ), সরকারের তহবিল তসরুপ করেছেন, দলের কয়েকজন আস্থাভাজন সদস্যকে হত্যা করেছেন, বিগ ব্রাদারের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছেন আর তা শুরু হয় বিপ্লব শুরুরও অনেক আগে, এছাড়াও তারা জড়িত ছিলেন এমন এক নাশকতায় যার ফলে মৃত্যু হয়েছে কয়েক লাখ মানুষের। এতসব কিছু স্বীকার করে নেওয়ার পরেও তাদের ক্ষমা করে দেওয়া হলো, দলে ফিরিয়ে নেওয়া হলো, পদে বসানো হলো, যেসব পদ স্রেফ অনারারি, দায়িত্বহীন। তিন জনই ‘দ্য টাইমস’এ লম্বা ফিরিস্তিমূলক ফালতু নিবন্ধ লিখলেন যাতে বর্ণিত হলো তাদের পদস্খলনের কারণ আর সংশোধিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি।
ওদের ছেড়ে দেওয়ার পর কিছুদিনের মধ্যেই একদিন এই তিনজনকে চেস্টনাট ট্রি ক্যাফেতে দেখতে পায় উইনস্টন। তার মনে পড়ে, চোখের কৌনিক দৃষ্টি ফেলে কি ভীতিকর আগ্রহ নিয়ে সে তাদের দেখেছিলো। ওরা তার চেয়ে অনেক বয়ষ্ক, যেন প্রাচীন বিশ্বের ভগ্নাবশেষ, দলের সেই গৌরবময় সাহসী দিনগুলোর টিকে থাকা শেষ ক’টি মানুষ। গোপণ সংগ্রাম আর গৃহযুদ্ধের জ্বলজ্বলে স্মৃতি এখনও তাদের চোখেমুখে হালকা হয়ে মেখে আছে। তার মনে পড়ছিলো, যদিও ততদিনে তারিখ আর ঘটনাগুলো আবছা হয়ে এসেছে, বিগ ব্রাদারের নাম জানার অনেক আগেই সে জেনেছিলো এই মানুষগুলোর নাম। কিন্তু মাত্র একটি কিংবা দুটি বছরের মধ্যেই এরা হয়ে গেলো নিষিদ্ধঘোষিত, শক্রপক্ষ, অচ্ছ্যুত, দণ্ডপ্রাপ্ত, নিশ্চিত মৃত্যুপথযাত্রী। থট পুলিশের হাতে পড়ে শেষ পর্যন্ত রেহাই পেয়েছে এমন একজনও পাওয়া যাবে না। এরা আসলেই কয়েকটি মৃতদেহ যাদের ভাগাড়ে পাঠানোর অপেক্ষা মাত্র।
ওদের কাছাকাছি টেবিলগুলোতে কেউ বসেনি। এ ধরনের মানুষের আশেপাশেও ঘেঁষাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। লবঙ্গের সুঘ্রাণ মিশ্রিত জিন এই ক্যাফের বিশেষত্ব, তারই ঘ্রাণ ছড়ানো গ্লাস সামনে নিয়ে নিঃশব্দে বসেছিলেন তারা। তিন জনের মধ্যে রাদারফোর্ডের চেহারা বেশি আকৃষ্ট করে উইনস্টনকে। একসময়ের বিখ্যাত ব্যাঙ্গচিত্র আঁকিয়ে, যার দুর্দান্ত কার্টুনগুলো বিপ্লবপূর্ব ও বিপ্লবকালীন বিষ্ফোরিত জনমত গঠনে বড় ভূমিকা রেখেছিলো। এখনও দীর্ঘ বিরতিতে তার কার্টুন দ্য টাইমসে আসে। তবে সেগুলো পুরোই ফাঁকিবাজি, স্পন্দন নেই, নেই প্রভাবিত হওয়ার মতো কিছু। পুরোনো বিষয়গুলোরই চর্বিত চর্বন- বস্তিবাসী, ক্ষুধার্ত শিশু, সড়ক সংঘর্ষ, আর চোঙা হ্যাটের পুঁজিপতি- বাধার মধ্যে থেকেই পুঁজিপতিরা এখনো তাদের চোঙা হ্যাটে পেছনের দিনে ফিরে যাওয়ার অবিরাম, অবুঝ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিপুল বপু, তেলজবজবে ধুসর কোকঁড়ানো চুল, বলিরেখা ভরা ঝুলে-পড়া চামড়ার মুখ, নিগ্রোগের মতো মোটা ঠোঁট রাদারফোর্ডের। একসময় তার শরীর যে ভীষণ শক্তি ধরতো তা বোঝা যায়, কিন্তু এখন তার সেই বড় বপুখানা ঝুঁকে-নুয়ে পড়েছে, ভেঙ্গে-ভেঙ্গে পড়ছে সবদিক থেকে। পাহাড় যেমন ধসে যায় তেমনি মানুষের চোখে ধসে পড়েছেন তিনি।
বেলা তখন তিনটা, একাকীত্বের সময় উইনস্টনের। এখন ঠিক মনে আসছে না, অমন একটি সময়ে কিভাবেই সে চেস্টনাট ট্রি ক্যাফেতে পৌঁছেছিলো। গোটা ক্যাফেই বলতে গেলে ফাঁকা। হালকা একটা সুর-সঙ্গীত টেলিস্ক্রিন থেকে ভেসে আসছিলো। তিন ব্যক্তি এক কোনায় অনেকটা মূর্তির ন্যায় বসে, মুখে রা নেই কারো। কিছু বলার আগেই আরেক প্রস্থ জিন দিয়ে গেলো ওয়েটার। টেবিলের একপাশে একটা দাবার বোর্ড, গুটি সাজানো আছে, খেলা শুরুর অপেক্ষা। টেলিস্ক্রিনের সঙ্গীত পাল্টে গেলো। শুরু হলো নতুন বাজনা- অদ্ভুত, ভাঙ্গা, কর্কশ এলোমেলো স্বর। উইনস্টন মনে মনে এর নাম দিয়েছে হলুদ স্বর। টেলিস্ক্রিন থেকে ভেসে আসা কণ্ঠ গাইছে:
ছড়িয়ে পড়া চেস্টনাট গাছের ছায়ায়
আমি তোমাকে বেচলাম, তুমি বেচলে আমায়
হেথায় শুয়ে তারা, আর আমরা এখানে
ছড়িয়ে পড়া চেস্টনাট গাছের ছায়ায়…
তিন জনের মধ্যে নড়াচড়াটুকুও নেই। উইনস্টন আরেকবার যখন রাদারফোর্ডের বিপর্যস্ত চেহারায় চোখ ফেললো, দেখতে পেলো চোখ দুটি পানিতে ভরে উঠেছে। আর প্রথমবারের মতোই তার নজরে এলো অ্যারনসন ও রাদারফোর্ড দুজনেরই নাক ভাঙা। চোখে পড়তেই মনের ভেতরটা গুমড়ে উঠলো। অবশ্য আজও সে জানেনা কেনোই তার মনের ভেতরটা গুমড়ে উঠেছিলো।
কিছুদিনের মধ্যে তিনজনকেই গ্রেপ্তার করা হলো। দেখানো হলো, মুক্তির পর থেকেই এরা তিনজন নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। দ্বিতীয় বিচারে তারা আরেকদফা পুরোনো সকল অপরাধ স্বীকার করলো, সঙ্গে নতুন অপরাধগুলোও পুরোপুরি মেনে নিলো। তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়ে গেলো, আর তাদের এই করুণ পরিণতি পার্টির ইতিহাসে নথিভুক্তও হলো পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে।
এর প্রায় পাঁচ বছর পর, ১৯৭৩ সাল, নিউমেটিক টিউব থেকে মাত্র বের করে এনে টেবিলে রাখা এক গাদা নথি থেকে একেকটির প্যাঁচ খুলে খুলে দেখছিলো উইনস্টন। তার মধ্যেই সে পেয়ে গেলো একটি কাগজ যা অন্যগুলোর মধ্যে ভুলে ঢুকে পড়েছে। খুলেই সে এর গুরুত্ব ধরে ফেললো। এটি ছিলো দ্য টাইমসের বছর দশেক আগের একটি সংখ্যার ছেঁড়া আধখানা পাতা। পাতার উপরের আধা অংশ, ফলে তারিখটিও রয়েছে স্পষ্ট। পত্রিকার সেই পাতায় পার্টির একটি প্রতিনিধি দলের নিউ ইয়র্ক সফরে গিয়ে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার খবর একটি বড় ছবিসহ। ছবির মাঝখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উপস্থাপিত তিনজন- জোন্স, অ্যারনসন আর রাদারফোর্ড। ভুল হওয়ার কোনও কারণ নেই, আর নিচে ক্যাপশনেও লেখা ছিলো তাদেরই নাম।
এখন কথা হচ্ছে, দু’দফা বিচারেই এরা তিন জন স্বীকারোক্তিতে বলেছেন, ওই দিনটিতে তারা ইউরেশিয়ায় অবস্থান করছিলেন। কানাডার একটি গোপন বিমানঘাঁটি থেকে উড়ে গিয়েছিলেন সাইবেরিয়ায়। সেখানে ইউরেশীয় জেনারেল স্টাফের সদস্যদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করে তারা তুলে দিয়েছিলেন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক গোপন তথ্য। উইনস্টনের কাছে তারিখটি ধরা পড়লো কারণ ওটি ছিলো মধ্য গ্রীস্মের একটি দিন। পুরো গল্পটি অবশ্যই আরও অসংখ্য স্থানে একইভাবে রচিত হয়ে আছে। এ থেকে বলাই যায়- এরা মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন।
অবশ্যই এটা নতুন কোনও আবিষ্কার নয়। শুদ্ধি অভিযানে বিলীন হয়ে যাওয়া মানুষগুলো যেসব অপরাধে অভিযুক্ত, সত্যিকারে সে অপরাধগুলো তারা করতো বলে উইনস্টন কল্পনায়ও মনে করতো না। কিন্তু এ ছিলো এক সুনির্দিষ্ট প্রমাণ, ছিলো মুছে ফেলা অতীতের বেঁচে যাওয়া একটি স্মৃতি, যেভাবে জীবাষ্মের কোনো হাড় ভুল স্তরে পড়ে টিকে গিয়ে ভূ-তত্ত্বের মূল তত্ত্বকেই হুমকিতে ফেলে দেয় কখনো, ঠিক তেমনি। এই একটি নথি পার্টিকে অণুতে গুঁড়িয়ে দিতে পারে, যদি কোনভাবে বিশ্বের দরবারে এটি প্রকাশ করা যায় আর এর গুরুত্ব তুলে ধরা যায়, তবেই।
সোজা কাজে মন দিলো উইনস্টন। ছবিটি দেখে এর গুরুত্ব বুঝে ফেলার পর দ্রুতই আরেকটি কাগজ দিয়ে ওটি ঢেকে ফেললো। ভাগ্য ভালো বলা চলে, কাগজটি যখন খুলছিলো তখন টেলিস্ক্রিনের চোখে ছিলো এর উল্টো দিকটা।
লেখার প্যাড হাঁটুর উপর রেখে চেয়ারটি ধাক্কা দিয়ে পেছনে সরিয়ে নিলো উইনস্টন। টেলিস্ক্রিনের চোখ থেকে নিজেকে যতটা বাঁচানো যায়। চেহারা অভিব্যক্তিশূন্য করে রাখা এমন কিছু কঠিন নয়, এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়; কিন্তু হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়; আর টেলিস্ক্রিন এতটাই সুক্ষ্ম যে ওই স্পন্দনটিও ধরে ফেলে। তার বিচারে এভাবেই কাটলো দশ মিনিট, যন্ত্রণাদায়ক একটি ভয় ভর করে থাকলো মনের ভিতর- যেনো তাকে প্রতারিত করে, আচমকা বাতাসের ঝাপটায় ডেস্ক থেকে সব উড়ে যাবে। এরপর, ঢাকা থাকা অবস্থাতেই তুলে নিয়ে আরও কিছু অকেজো কাগজের সঙ্গে ছবিটি স্মৃতি গহ্বরে ফেলে দিলো। আর সম্ভবত এক মিনিটের মধ্যেই তা ভষ্মে পরিণত হলো।
এ ঘটনা দশ-এগারো বছর আগের। এখনকার হলে, হতে পারতো, ছবিটি রেখেই দিতো উইনস্টন। তবে হাতের আঙুলে ক্ষণকাল চেপে ধরে রাখা সেই সত্য তার কাছে এখনও ভিন্ন কিছু অর্থ দেয়, যদিও সেই ছবি আর সে ছবিতে নথিভুক্ত ঘটনা দুইই আজ স্মৃতি। তার সন্দেহ জাগে, অতীতের ওপর কি তাহলে দলের দখল কম, যে দলিল আজ নেই, এক সময়তো তা অবশ্যই ছিলো।
কিন্তু আজ, ধরা যাক ছাই থেকেই ছবিটি ফের আসল চেহারা পেলো তাতেই কি একটি বড় প্রমাণ হয়ে যাবে। সে যখন এটি আবিষ্কার করে ততদিনে ওশেনিয়ার সঙ্গে ইউরেশিয়ার যুদ্ধ সাঙ্গ হয়ে গেছে, তখন পূর্ব এশিয়ার এজেন্টদের কাছে এর ব্যাখ্যা এই হতো, তিনটি মৃত ব্যক্তি তাদের দেশের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
এরপর পরিস্থিতি বার বার পাল্টেছে- দুই বার, তিন বার, সে জানেনা কতবার! হতে পারে স্বীকারোক্তি পুনর্লিখনের পর পুনর্লিখন হয়েছে, যতক্ষণ মূল ঘটনা ও তারিখ তার সামান্য গুরুত্বটুকুও হারিয়ে না ফেলেছে ততক্ষণ, ততবার লেখা হয়েছে। অতীত কেবল পাল্টেই দেওয়া হয়নি, বার বার পাল্টানো হয়েছে। মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে যা তাকে সবচেয়ে বিপর্যস্ত করে রাখে তা হচ্ছে সে কোনও দিন স্পষ্ট করে বুঝতে পারে না, কেনো ছলচাতুরির এই বিশাল যজ্ঞ। অতীত মিথ্যায়নের আপাত সুবিধা আছে, কিন্তু এর মূল অভিসন্ধী রহস্যে ভরা। ফের কলম তুলে নিলো সে, লিখলো:
আমি বুঝি কিভাবে; কিন্তু বুঝিই না কেনো।
সে নিজেই কি আসলে একটা পাগল? এই ভেবে তার ভয় হয়। অতীতেও বার বার হয়েছে। একজন পাগল স্রেফ একা। একটা সময় ছিলো, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে এমন কথায় বিশ্বাস করাই ছিলো পাগলামি; এখন অতীত পাল্টানো যায় না, সে কথায় বিশ্বাস করা পাগলামি। হতে পারে সে একাই সেই বিশ্বাস ধারণ করে, আর যদি একাই হয়, তাহলে তো সে পাগলই। তবে এই পাগল হওয়ার ভাবনা তাকে খুব একটা ঝামেলায় রাখে না, বরং তার এই ভাবনা যদি ভুল হয়ে বসে সেই ভয়টিই বড় আতঙ্কের বিষয় হয়ে ওঠে!
শিশুদের ইতিহাস বইটি তুলে নিয়ে এর মুখচিত্রে ছাপা বিগ ব্রাদারের ছবিটির দিকে তাকালো সে। সম্মোহনী চোখ দুটো তার চোখের গভীরে প্রোথিত। মনে হবে কিছু একটা কঠিন চাপ সৃষ্টি করে খুলির ভেতরে ঢুকে পড়ছে, মস্তিষ্কে আঘাত হানছে, বিশ্বাসগুলো থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছে, আর প্রায় এমন কাবু করে ফেলছে যেনো আপনি আপনার নিচের চেতনাকেও অস্বীকার করে বসেন। এরপর পার্টি একদিন ঘোষণা করে দেবে- দুই আর দুইয়ে পাঁচ হয়, আর আপনি তাই বিশ্বাস করবেন। এটা অবশ্যম্ভাবী, অতি শীঘ্র, নয়তো আরও পরে পার্টি একদিন এমন দাবিই করবে, তাদের অবস্থান থেকে এটাই হবে যৌক্তিক দাবি। অভিজ্ঞতার শক্তিই কেবল নয়, বিদ্যমান বাহ্যিক বাস্তবতাগুলোও কৌশলে তাদের দর্শণ দিয়ে অস্বীকার করা হচ্ছে। সকল নব্যতন্ত্রের সেরা তন্ত্র সাধারণ জ্ঞান। ভিন্নচিন্তার জন্য আপনাকে যে ওরা হত্যা করে সেটা ভয়ঙ্কর নয়, ভয়ঙ্কর হচ্ছে ওরা যা করে সেটাই ওরা সঠিক বলে জ্ঞান করে। তাহলে আমরা কিভাবেই জানবো, দুই আর দুইয়ে চার হয়? অথবা মধ্যাকর্ষণের শক্তি কিভাবে কাজ করে? অথবা অতীত পাল্টানো যায় না? যদি অতীত আর বাহ্যিক পৃথিবী দুইয়েরই অস্তিত্ব থাকে কেবল মনে, আর সে মনটা যদি হয় নিয়ন্ত্রিত, তাহলে কী করেই বা তা হবে?
কিন্তু না! তার সাহসিকতা হঠাৎ করেই যেনো নিজের মতো করে জোর পায়। কোন যোগসূত্র ছাড়াই তার মনে ভেসে উঠলো ও’ব্রায়েনের মুখ। অতীতের চেয়ে অনেক বেশি নিশ্চয়তায় সে জানে, ও’ব্রায়েন তার পক্ষের কেউ নন। সে এই ডায়রি লিখছে ও’ব্রায়েনের জন্য- ও’ব্রায়েনের কাছে: এ যেনো অসমাপনীয় একটি চিঠি যা কেউ পড়বে না; কিন্তু তা এক বিশেষ ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে লেখা এবং সেই সত্য থেকেই এর রং নেওয়া।
পার্টি বলে দিয়েছে যে কোনও দলিল চোখে দেখে বা কানে শুনে ভুলে যেতে হবে। এটিই তাদের চূড়ান্ত ও সবচেয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ। তার হৃদয়টি যেনো তলিয়ে যায় যখন সে ভাবে কি ভয়ানক ক্ষমতার দাপটে সে কুক্ষিগত হয়ে আছে, কত সহজে পার্টির কোনো বুদ্ধিজীবী তাকে বিতর্কের মাঝে ছুঁড়ে দিতে পারে, ধোঁয়াটে যুক্তি খাড়া করতে পারে যার উত্তর দেওয়া দূরে থাক, অর্থই সে বুঝতে পারবে না। তার পরেও সত্যেই তার অবস্থান! ওরাই ভুল, সেই সঠিক। ষ্পষ্টতই যা প্রতীয়মান, যা ফালতু, যা সত্য তা সুরক্ষিত হবে। স্বতঃসিদ্ধ সত্যগুলো সত্য হবে! মাটির পৃথিবী বিদ্যমান, এর আইন পাল্টায় না। পাথর শক্ত, পানি ভেজা, উপর থেকে ফেললে কোনো বস্তু নিচেই পড়বে। ও’ব্রায়েনকে উদ্দেশ্য করেই যেনো কথাগুলো বলছে, এবং সে যেনো কোন স্বঃতসিদ্ধ বিষয় সামনে নিয়ে আসছে এমন একটি অনুভূতি নিয়ে সে লিখলো:
স্বাধীনতা হচ্ছে, দুইয়ে দুইয়ে চার হয়, এই কথাটুকু বলতে পারা। এটুকু স্বাধীনতা যদি মেলে, বাকি সবই মিলবে।
অষ্টম অধ্যায়
পথের নিচে কোথাও থেকে কফির পোড়া গন্ধ এসে সড়কময় ছড়িয়ে পড়েছে। ভিক্টরি কফি নয়, প্রকৃতপক্ষে কফি বলতে যা বোঝায়, তা-ই! অজান্তেই থমকালো উইনস্টন। দুই সেকেন্ডের মতো হবে, এরই মধ্যে সে শৈশবের বিস্মৃতপ্রায় সেই জগতটিতে ফিরে গেলো। আর ঠিক তখুনি এখানে কাছে-ধারে কোথাও সপাটে দরজা লাগানোর একটা শব্দে কফির গন্ধটা কেটে গেলো। যেনো গন্ধটাও ছিলো ঠিক শব্দের মতো ইথারের কম্পন।
ফুটপাত দিয়ে কয়েক কিলোমিটার হেঁটেছে সে। পায়ের ঘায়ের অংশে তখন ব্যাথায় টনটন করছে। গত তিন সপ্তাহে কমিউনিটি সেন্টারে সান্ধ্যকালীন কর্মসূচিতে এটি তার দ্বিতীয় অনুপস্থিতি। স্রেফ অপরিনামদর্শীরাই এমনটা করতে পারে। কারণ হাজিরার বিষয়ে সতর্ক নজরদারি চলে। নীতিগতভাবেই পার্টির সদস্যদের জন্য বাড়তি সময় বলে কিছু নেই। বিছানায় কাটানোর সময়টুকু ছাড়া অন্য কোনও সময়ই একা হয়ে যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি। কাজ, খাওয়া আর ঘুমের বাইরে সাধারণ কিছু বিনোদনমূলক কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া চলবে। একাকীত্বের আভাস দেয় এমন কিছু করা, এমনকি একা একা হেঁটে যাওয়াও কিছুটা বিপদের। নিউস্পিকে একটা শব্দ আছে ‘ওউনলাইফ’- যার এরা মানে দিয়েছে খামখেয়ালিপনা। কিন্তু আজ বিকেলে মন্ত্রণালয় থেকে বের হয়ে এলে এপ্রিলে মৃদুমন্দ বাতাস তাকে আহ্বান জানালো। আকাশটাকে এতটা উষ্ণনীল এবছর আর একদিনও দেখা যায়নি। তার মনে এলো কমিউনিটি সেন্টারে শোরগোলে সন্ধ্যার দৃশ্য, ঘর্মাক্ত হয়ে ঘিনঘিনে পরিবেশ চলবে খেলা, বকবকানি, ভাষণ, জিনের মদিরায় তেলতেলে সৌহার্দ্যতার ক্যাচক্যাচানি, এসবই অসহ্য ঠেকে তার কাছে। ভাবাবেগে আপ্লুত সে বাস-স্টপের উল্টোপথ ধরলো, পা বাড়ালোর গোলক ধাঁধার লন্ডন নগরীর পথে। প্রথমে দক্ষিণে সেখান থেকে পূবে এরপর আবারও উত্তরে। অজানা-অচেনা সড়কগুলোতে নিজেকে হারিয়ে ফেলে, পথ কোন দিকে যাচ্ছে, কোথায় গন্তব্য তা নিয়ে এতটুকু না ভেবে স্রেফ ঘুরে বেড়ালো।
‘আশা যদি কিছু থাকে,’ ডায়রিতে লিখেছিলো সে, ‘তা ওই প্রোলদের মধ্যেই প্রোথিত’, রহস্যাবৃত সত্য আর স্পষ্ট বোধগম্য অযৌক্তিকতা নিয়ে সে কথাগুলোই বার বার তার মনের মাঝে ফিরে ফিরে আসছিলো। তখন সে উত্তর-পূর্বদিকের একটা ধূসর-রঙা বস্তিতে। এক সময় এখানেই ছিলো সেন্ট প্যানক্র্যাস স্টেশন। কুচি পাথর বিছানো একটি সড়ক ধরে হাঁটছিলো। দুপাশে সারি সারি দ্বি-তল বাড়ি, ফুটপাত লাগোয়া ভাঙাচোরা দরজাপথগুলো ইঁদুরের গর্তসদৃশ। এখানে সেখানে নোংরা ঘিনঘিনে কাদাপানি, পাথরগুলোও কাদায় জড়ানো। সবগুলো দরজাপথই অন্ধকার, নিচে সরু গলিপথ থেকেও দুই দিকে ছড়িয়ে শাখাপথ। বিষ্ময়কর সংখ্যায় মানুষের গিজগিজ- শরীরে যৌবন ফুটিয়ে তুলে গাঢ় লিপস্টিক মাখা মেয়েদের ঘোরাঘুরি, তাদের সঙ্গে তরুণ-যুবকদের ঘেঁষাঘেঁষি, রূপ আর যৌবন উপচে দিয়ে নারীরা হেলেদুলে যেনো দেখাচ্ছে- নারীতো এমনই, বুড়ো হাবড়ারা চওড়া পা ফেলে এদিক সেদিক ঘুরছে, নোংরা নগ্নগায়ের শিশুরা কাদায় খেলছে, আর তাদের মায়েদের ক্রুদ্ধ চিৎকারে শিউরে শিউরে উঠছে। বাড়িগুলোর এক-চতূর্থাংশেরই জানালা ভাঙা, তাতে বোর্ড লাগানো।
একটা অসহায়ত্বের বোধ যেনো গেড়ে বসলো উইনস্টনের মধ্যে। এই বুড়োর স্মৃতিতেতো ফালতু কিছু নোংরামি দুষ্টুমির ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নেই! গোটাদিন প্রশ্ন করলেও তার পেট থেকে প্রকৃতচিত্র কিছু কেউ বের করে আনা সম্ভব নয়। তাহলে কি পার্টির ইতিহাসবেত্তারাই সত্যি লিখেছেন। হতে পারে তারাই পুরোপুরি সত্য। এসব ভাবতে ভাবতে একটা শেষ চেষ্টা চালালো সে।
‘আমি বোধ হয় তোমাকে ঠিক বুঝাতে পারিনি,’ বললো সে। আমি বলতে চাইছি – বয়সতো তোমার ম্যালাই হলো; জীবনের অর্ধেকটা তোমার কেটেছে বিপ্লবের আগে। ১৯২৫ সালের কথাই ধরো, ততদিনে তুমিতো বেশ বড়ই হয়ে উঠেছিলে। তো যতটা স্মরণ করতে পারো তার ওপর ভর করেই বলো- ১৯২৫ সালের সেই জীবন কি এখনকার জীবনের চেয়ে ভালো কিছু ছিলো? তোমাকে যদি পছন্দ করতে বলা হয়, তুমি কোন জীবনটি বেছে নেবে, তখনের নাকি এখনের?’
বাণখেলার বোর্ডের দিকে একটা ধ্যানগ্রস্ত চাহুনি ফেলে রেখেছে বুড়োটি। এবার বিয়ারের গ্লাস তুলে এক চুমুকে পুরোটা খালি করে দিলো। তবে আগের চেয়ে একটু ধীর ধীরে। বলতে শুরু করলো। বিয়ারে নেশা তাকে ধরেছে ঠিকই, তবে কথাবলার ভঙ্গিতে দার্শনিকতার ছাপটা তখনও রয়ে গেছে।
‘আমি জানি তুমি ঠিক কি শুনতে চাইছো,’ বললো সে। ‘তুমি চাইছো আমি বলি, আমি যৌবনে ফিরে যেতে চাই। অনেক মানুষই বলে, তারা যৌবনে ফিরতে চায়। যৌবনে তোমার স্বাস্থ্য ভালো থাকে, শক্তি-সামর্থ থাকে। আমার মতো বয়স যখন হবে তখন তুমিও সুস্থ থাকবে না। আমার কথাই ধরো, এখন পায়ের ব্যথায় ভুগছি, মুত্রথলির দশা যাচ্ছেতাই। রাতে গড়ে ছয়-সাতবার বিছানা থেকে উঠতে হয়। তবে বুড়ো হওয়ার কিছু সুবিধাজনক দিকও আছে বলে রাখি। উদ্বেগের কারণগুলিই হবে ভিন্ন কিছু। নারীর সান্নিধ্য নেই, সেটাও একটা ভালো দিক। আমি তো গত প্রায় ত্রিশ বছর কোনও নারীর সঙ্গে শুইনি। আশা করি বিষয়টা তোমার ভালো লাগছে। আর এসবই তো শুনতে চাও, না- কি?’
জানালার শার্সিতে ঠেস দিয়ে বসলো উইনস্টন। আর কথা চালিয়ে যাওয়ার কোনো মানেই হয় না। তবে বিয়ারতো খাওয়াই যায়। এই ভাবনা থেকে ঠিক যখন ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনই দ্রুত গতিতে বুড়ো ছুটলো কামরার পাশের প্রশ্রাবখানার দিকে। অতিরিক্ত আধা লিটার এরই মধ্যে তার ওপর ক্রিয়া করতে শুরু করেছে। নিজের খালি গ্লাসের দিকে স্থির দৃষ্টিতে এক কিংবা দুই মিনিট তাকিয়ে থাকলো উইনস্টন, এরপর সম্বিত যখন ফিরলো তখন নিজেকে সে আবিস্কার করলো সড়কে। উইনস্টনের মনে হলো, বড়জোর বিশ বছর, এই সময়ের মধ্যে এই যে ‘এখনকার জীবন অতীতের চেয়ে ভালো কি মন্দ ছিলো?’ এমন প্রশ্নটিও উবে যাবে। এর আর উত্তরও যেমন থাকবে না, প্রশ্নটিও অস্তিত্ব হারাবে। আর এখনই কি এর উত্তর মিলছে? যেখানে অতীতের টিকে থাকা গুটিকয় মানুষ বুঝতেই পারছে না তাদের নিজেদেরই অতীত ভালো ছিলো, নাকি বর্তমানটি ভালো। তারা লাখো অপ্রয়োজনীয় ফালতু বিষয় মনে রাখে, সহকর্মীর সঙ্গে একবার যে বচসা বেঁধেছিলো সে কথা, একবার বাইসাইকেলের হাওয়া চলে গেলে কি কষ্টই না হয়েছিলো, বহু আগে মরে যাওয়া বোনটির চেহারার অভিব্যক্তি, সত্তুর বছর আগে কোনও এক সকালে ঘূর্ণিবাতাসে ধুলোদের উড়োউড়ি পর্যন্ত তাদের মনে ধরে আছে- কিন্তু প্রয়োজনীয় সব সত্যই তাদের দৃষ্টির বাইরে। এরা স্রেফ পিঁপড়ার মতো, কেবল ছোট ছোট বস্তুই দেখতে পায়, বড় বস্তু এদের চোখে পড়ে না। স্মৃতি যখন ব্যর্থ, আর নথিগুলো মিথ্যায়নে সিদ্ধ- তখন পার্টির তরফ থেকে জীবনমান উন্নয়নের সকল দাবিই ধোপে টিকে যায়, কারণ অতীতের জীবনমানের কোনো তথ্য বা মাপকাঠী কারো জানা নেই যার সঙ্গে বর্তমানের তুলনা চলে।
ঠিক এটা ভাবতে ভাবতেই উইনস্টনের ভাবনার ট্রেন হঠাৎ থামলো। সে থমকালো, আর চোখ তুলে তাকালো। তখন একটা সরু সড়ক দিয়ে যাচ্ছিলো। অন্ধকারে গোটা কয় দোকান-পাট বাসাবাড়ি গুলোর মাঝেই স্থান করে নিয়েছে। ঠিক তার মাথার উপর ঝুলছিলো তিনটে রংচটা ধাতব বল। দেখে মনে হচ্ছিলো, একসময় এগুলো চকচকেই ছিলো। স্থানটি তার চেনার কথা। অবশ্যই চেনে! সে এখন ঠিক সেই ভাঙারির দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে যেখান থেকে একদা ডায়রিটি কিনেছিলো।
একটি ভয়ার্ত বেদনা তার শরীরের ভেতর দিয়ে শিরশির করে বয়ে গেলো। নোটবুকটি কেনাই ছিলো এক মস্ত অপরাধ। তখনই শপথ করেছিলো এই পথ আর মাড়াবে না। তবে ভাবনাটাকে স্বাধীন করে দিয়ে সে বুঝতে পারলো, বস্তুত সে নয়, তার পদযুগলই তাকে টেনে এনে দাঁড় করিয়েছে এই দোকানের সামনে। ডায়রি লেখা শুরু করেও নিজেকে রক্ষা করা যাবে বলে যে আশাটুকু ছিলো, এইখানে ফের চলে আসা সেই আশাটুকু বাঁচিয়ে রাখার জন্যও যে সর্বনেশে তা তার বুঝতে বাকি নেই। সে দেখলো রাত তখন নয়টা বাজে কিন্তু এই রাতেও দোকানটি খোলা। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে ভেতরে ঢুকে পড়াই হবে কম সন্দেহের হবে এমন একটা ভাবনা থেকে দরজাপথে ভেতরে পা বাড়ালো। কেউ যদি জেরা করে, বলতে পারবে রেজর ব্লেড কেনার জন্যই আসা।
দোকান মালিক একটি ঝুলন্ত তেলের কুপি জ্বালিয়েছে মাত্র। কুপি থেকে অল্প আলো আর মোহময় একটা ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে। ষাটের কোটায় বয়স, দুর্বল, ঝুঁকে পড়া শরীর, লম্বা টিকালো নাক, মৃদু চাহুনি যা চশমার মোটা কাচে বিঘ্নিত। মাথার চুল অনেকটাই পেকে সাদা, তবে ঘন ভ্রু-যুগল এখনো কালো। চশমায়, ভদ্র-শ্লথ নড়াচড়ায়, আর পরনের কালো ভেলভেটের জ্যাকেটে এক ধরনের বুদ্ধিদীপ্তের ছাপ। মনে হবে লোকটি শিক্ষিত, অথবা শিল্পীও ভেবে বসতে পারেন। কণ্ঠ অনুচ্চ গম্ভীর, আর উচ্চারণ অধিকাংশ প্রোলদের চেয়ে আলাদা।
ফুটপাতে তোমাকে দেখেই চিনে ফেলেছি, বললো দোকানি। ‘তুমি তো সেই, সেবার শ্যুভেনির অ্যালবামটি কিনলে। কাগজগুলো খুবই সুন্দর। জানো, বলা হতো ক্রিম-লেপা কাগজ! অমন কাগজ এখন আর তৈরিই হয় না- আমিতো বলবো গত পঞ্চাশ বছরে দেখিনি।’ চশমার কাচের উপর দিয়ে চোখ তুলে উইনস্টনের দিকে তাকালো সে। ‘তোমার বিশেষ কিছু চাই? নাকি স্রেফ দেখার জন্য এলে?’
‘এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, অনিশ্চিতের স্বর উইনস্টনের কণ্ঠে। ‘মনে হলো একটু ভেতরে ঢুকি। বিশেষ কিছু চাই না।’
‘সে ভালো বটে’ বললো দোকানি। ‘আমারও মনে হয় না, তোমার ভালো লাগবে এমন কিছু আছে,’ নরম দুটি করতল ঘষে ঘষে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি তার। ‘দেখতে পাচ্ছো দোকানটার দশা। একেবারে খালি বলতে পারো। তোমাকে একটা কথা বলি, আমার মনে হয় প্রাচীন পণ্যের বাজার শেষ হতে বসেছে। ওগুলোর আর কোনও কদর নেই, চাহিদা নেই আর মজুদও নেই। আসবাব, চিনামাটির তৈজষ এসব ভাঙতে ভাঙতে শেষ, ধাতব পাত্র-পদার্থতো দিনে দিনে উবে গেছে। পিতল-দস্তা আর তামার মিশেলে যে মোমদানি হতো তা কত বছর দেখি না!’
ছোট্ট দোকানের ভেতরটা মালপত্রে ঠাসা। কোনোটিই কমদামি না। মেঝেও ফাঁকা পড়ে নেই, দেয়ালে গাদা গাদা ছবির ফ্রেম ধুলো জমিয়ে ঝুলে আছে। জানালায় পাতা ট্রেতে ছোট ছোট নাট-বোল্টু, ভাঙা বাটালি, হাচড়া-খাচড়া ধাঁরহীন কলম-ছুরি, দমহীন ঘড়ি, যা আর কখনোই সময় দেবে না; এমন আরও নানা ধরনের ভাঙাচোড়া বস্তু-সামগ্রী। এক কোনায় একটি ছোট টেবিলও ভরে আছে নানা সামগ্রীতে- কারুকাজ করা নস্যির কৌটা, আকিক পাথরখচিত কাপড়ের পিনসহ এমন সব জিনিষ যা দেখলেই পছন্দ হবে, মনে হবে দারুণ কিছু।
টেবিলের ওপর গোলাকার একটি বস্তুতে চোখ আটকে গেলো উইনস্টনের। গোল, মসৃণ, বাতির আলোয় হালকা দ্যুতি ছড়াচ্ছে। আলগোছে বস্তুটি হাতে তুলে নিলো সে। কাঁচের তৈরি স্বচ্ছ ভারি একটি বস্তু। এক পীঠ বাঁকানো অন্যদিক সমান, ফলে অনেকটা গোলার্ধের রূপ নিয়েছে। রঙ ও স্বচ্ছতায় মনে হবে বৃষ্টির বড় এক ফোঁটা স্ফটিক জল। ঠিক মাঝখানে অদ্ভুত গোলাপী একটা কিছু কুণ্ডলী পাকিয়ে বসানো। দেখলে গোলাপ কিংবা সামুদ্রিক তারাফুল মনে হবে। বাঁকানো অংশের কারণে উপর থেকে চোখে সেটি বড় হয়ে ধরা দেয়।
‘কি এটা?’ আগ্রহ ভরে জানতে চাইলো উইনস্টন।
‘ওটা কোরাল,’ বললো বুড়ো দোকানি। অবশ্যই ভারত মহাসাগর থেকে এসেছে। কাঁচের ভেতর বসানো হয়েছে সামুদ্রিক কোরাল। আমার মনে হয় না, এটির বয়স শত বছরের কম হবে, দেখে মনে হচ্ছে তারও বেশি হবে।
‘ভীষণ সুন্দর,’ বললো উইনস্টন।
‘হ্যাঁ, খুব সুন্দর,’ প্রশংসাসূচক উচ্চারণ দোকানির। ‘তবে আজকাল আর এগুলো বেশি পাওয়া যায় না।’ খানিকটা কেশে নিয়ে বুড়ো ফের বললো, ‘এখন তুমি যদি এটা কিনতে চাও, পুরো চার ডলার দাম পড়বে। আমার দিব্যি মনে আছে পুরো আট পাউন্ড দিয়ে কিনেছি। আর আট পাউন্ড মানে হচ্ছে- না ঠিক হিসাব কষতে পারবো না, কিন্তু এটা বুঝি অনেক টাকা। সত্যিকারের প্রাচীন বস্তুতে কারই বা আগ্রহ বলো? হোক না এখন এগুলো খুব কমই মেলে?’
উইনস্টনের মন ধরে গেলো বস্তুটিতে, তাই দ্রুত দোকানির হাতে চার ডলার তুলে দিয়ে বস্তুটি পকেটে পুরে নিলো। এর সৌন্দর্য তার কাছে বড় বিষয় নয় বরং আজকালের বস্তুগুলোর চেয়ে এটি ভিন্ন কিছু, যার মালিকানা পাবার তীব্র বাসনাই বড় আবেদন হয়ে ধরা দিয়েছিলো তার মনে। বৃষ্টির পানির মতো স্বচ্ছ এমন কাঁচের গোলক আর কখনোই সে দেখেনি। আপাত এই প্রয়োজনহীনতাই বস্তুটিকে তার কাছে দ্বিগুণ আকর্ষণের করে তুললো, যদিও সে জানে একদিন হয়তো সে এটি পেপারওয়েট হিসেবেই ব্যবহার করতে শুরু করবে। পকেটে খুব ওজন লাগছিলো, তবে পকেটে বস্তুটি খুব একটা ফুলে উঁচু হয়ে নেই সেটাই বাঁচোয়া। এটি অদ্ভুত একটা বস্তু, একজন পার্টি সদস্যের মালিকানায় থাকাটাও অস্বাভাবিক বলে জ্ঞান করা হয়। ফলে যা কিছু পুরোনো, আর যা কিছু সুন্দর তা-ই সন্দেহের উদ্রেক ঘটায়। পুরো চার ডলার হাতে পেয়ে বুড়োর খুশি মুখটা দেখার মতো হয়ে উঠেছিলো। উইনস্টনের মনে হলো বুড়ো আসলে তিন ডলারে এমনকি দুই ডলারেই বেচতে রাজি হয়ে যেতো।
‘উপরের তলায় আরেকটি কামরা আছে, তুমি চাইলে একবার ঘুরে দেখতে পারো,’ বললো দোকানি। ‘খুব বেশি কিছু নেই, মাত্র কয়েকটা জিনিষ। তুমি যেতে চাইলে বাতি হাতে করে যেতে হবে।’
‘আরেকটা বাতি জ্বালালো বুড়ো, আর ধনুক-বাঁকা পীঠে খাড়া, নড়বড়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে ধীরে ধীরে উপরে উঠলো। পরে সরু একটি পথ গলে তারা যে কামরায় ঢুকলো সেখান থেকে রাস্তা দেখা যায় না, তবে বাইরেটা চোখে পড়ে। পাথর বিছানো আঙিনা আর চোঙা-আকৃতির বড়বড় পাত্র রয়েছে ওদিকটায়। উইনস্টন দেখলো ঘরের ভেতরেও কিছু আসবাবপত্র সাজানো, তাতে মনে কেউ এখানে বসবাস করে। মেঝেতে এক ফালি কার্পেট, দেয়ালে ঝোলানো এক-দুটি ছবি। একটি নিচু নোংরা হাতলওয়ালা চেয়ার ফায়ার প্লেসের সামনে পাতা। পুরোনো ফ্যাশনের বারো ঘণ্টা ডায়ালের একটি কাঁচের ঘড়ি চুল্লির উপরের দেওয়াল থেকে বেরিয়ে আসা তাকের ওপর বসে টিক টিক করে সময়ের বহমানতা জানান দিচ্ছে। জানালার পাশে কামরার সিকিভাগটা জুড়ে প্রমাণ সাইজের একটা বিছানা পাতা।
‘আমার স্ত্রী যতদিন বেঁচে ছিলো ততদিন আমরা এখানেই থাকতাম,’ আবার ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিমা বুড়োর কথায়। ধীরে ধীরে আসবাবপত্রগুলো বেচে দিচ্ছি। ওই যে বড় মেহগনি কাঠের বিছানাটি দেখছো ওটাই বাকি আছে, ছারপোকা ছাড়াতে পারলে ওটাও বেচবো। তবে বলতে পারি কাজটা ঝামেলারই হবে।’
বাতিটি সামান্য উঁচু করে ধরলো বুড়ো, এতে গোটা কামরা নজরে এলো আর ঠিক তখনই উষ্ণ আলো লুটিয়ে পড়া কামরাটি যেনো তাকে আহ্বান করে বসলো। উইনস্টনের মনে হলো, সপ্তায় গোটা কয় ডলার খরচ করলে এটি ভাড়া নেওয়া যায়। এজন্য কেবল তাকে ঝুঁকি নেওয়ার সাহসটুকুই সঞ্চার করতে হবে। ভয়াবহ এক জংলি ভাবনা, যা মনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বাতিল করে দেওয়া উচিত। কিন্তু এই কামরা যে তার ভেতরে এক ধরনের নস্টালজিয়া তৈরি করেছে, পিতৃপুরুষের কোনও এক অজানা স্মৃতি তার মধ্যে জাগ্রত করেছে। তার মনে হলো ঠিক এমনই একটি কক্ষে ফায়ারপ্লেসের পাশে হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে আছে, চুল্লির ঘেরের ওপর দুটি পা তুলে রাখা, আর কেতলিতে ফুটছে গরম পানি, এমন একটি দৃশ্যকল্প তার অনুভবে ছিলো। যেখানে সে সত্যিকার অর্থেই একা, সত্যিকারেই নিরাপদ, কেউ তার ওপর নজর রাখছে না, কোনো কণ্ঠ নির্দেশ দিয়ে চলছে না, কেবল কেতলির মৃদু ফট ফট আর ঘড়ির প্রিয় টিক টিক ধ্বনি ছাড়া আর কোনও শব্দই কোথাও নেই।
‘কোনো টেলিস্ক্রিন নেই!’ বিস্ময়ের বিড়বিড় উচ্চারণে কথাটি না বলে পারলো না সে।
‘নাহ!,’ বললো বুড়ো, ‘কোন কালেই বস্তুটি আমার ছিলো না। ম্যালা দামি। আর আমার মনেও হয় না এর কোনো প্রয়োজন আছে। কোনায় ওই পা-ভাঁজ করা টেবিলটি দেখেছো। তুমি চাইলে পা ছড়িয়ে বসাতে পারো, ভাঁজ করেও রাখতে পারো।’
অন্য কোনায় একটি ছোট বইয়ের বাক্স, আর উইনস্টনও ততক্ষণে ওটি দেখে এগিয়ে যাচ্ছে। ভেতরে ময়লার দলা ছাড়া কিছুই নেই। বই খুঁজে খুঁজে তা ধ্বংস করার কাজটি অন্যত্রের মতো একইভাবে প্রোলদের কোয়ার্টারগুলোতেও হয়েছে। ১৯৬০ সালে আগে রচিত কোনও একটি বই ওশেনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তখনও বাতিটি উঁচু করে ধরে, বুড়ো দাঁড়ালো একটি গোলাপকাঠের ফ্রেমে বাঁধা ছবির সামনে। এটি বিছানার ঠিক উল্টোদিকে, ফায়ার প্লেসের অপর পাশে ঝোলানো।
‘এই পুরোনো ছাপায় যদি আদৌ তোমার কোনো আগ্রহ থাকে-’ হেয়ালিপনার উচ্চারণ বুড়োর।
উইনস্টন উল্টোদিকে এগিয়ে গেলো ছবিটি পরীক্ষা করতে। স্টিলে খোদাই করা আয়াতকার জানালা বিশিষ্ট ডিম্বাকৃতির একটি ভবন, সামনে একটি ছোট টাওয়ার। ভবনের চারিদিক রেলিং ঘেরা, আর পেছনের শেষভাগে একটি মূর্তি বসানো। কিছুক্ষণ ধরে ছবিটি দেখলো উইনস্টন। অস্পষ্টভাবে মনে হলো, এমন দৃশ্য সে আগে দেখেছে, তবে ঠিক কবে কোথায় মনে করতে পারছে না।
‘ফ্রেমটি দেয়ালে সেঁটে দেওয়া,’ বললো বুড়ো, ‘তবে বলছি, স্ক্রু খুলে ওটা আমি তোমায় দিতে পারবো না।’
‘ছবির এই ভবনটি আমার চেনা,’ অবশেষে বললো উইনস্টন। ‘এটা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এটি বিচারলয় প্রাসাদের বাইরে সড়কের ঠিক মাঝখানে ছিলো।’
‘ঠিক বলেছো। আদালত ভবনের বাইরে ছিলো। এতে বোমা মারা হয়েছিলো- কত সালে মনে পড়ছে না, তবে অনেক বছর আগে। একসময় এটি ছিলো গির্জা, নাম ছিলো সেইন্ট ক্লেমেন্ট ডেইনস। আবারও ক্ষমাপ্রার্থণার ভঙ্গি তার হাসিতে, যেনো, এমন কিছু বলার সচেতনতাই অপরাধ। তবে যোগ করলো, ‘অরেঞ্জেস অ্যান্ড লেমন্স, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট ক্লেমেন্ট’স!’
‘মানে কি?’ প্রশ্ন উইনস্টনের।
‘আরে! “অরেঞ্জেস অ্যান্ড লেমন্স, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট ক্লেমেন্ট’স” এটা ছিলো আমাদের ছেলেবেলার একটি ছড়া। কিভাবে এই ছড়া এলো বলতে পারবো না, কিন্তু আমি জানি এখন আর এই ছড়া নেই। “হিয়ার কামস অ্যা ক্যান্ডল টু লাইট ইউ টু বেড, হিয়ার কামস অ্যা চপার টু চপ অফ ইওর হেড।” এটা ছিলো নাচের গান। দুজন হাত বেঁধে উপরে তুলে রাখতো, আর অন্যজন নিচে দিয়ে যেতো। আর যখন তারা “হিয়ার কামস অ্যা চপার টু চপ অফ ইওর হেড” বলতো তখন দ্রুত হাত নামিয়ে আটকে ফেলতো।’
একটা তালিকা দেখিয়ে বললো, ‘এগুলো বিভিন্ন গির্জার নাম। লন্ডনের সব প্রধান প্রধান গির্জার নাম পাবে।’
উইনস্টন দেখছিলো গির্জাটি কোন শতাব্দীর। লন্ডনের ভবনগুলোর বয়স মাপা বরাবরই কঠিন একটা কাজ। কোনটি বড় বা সুন্দর হলে, আর তা দেখতে যদি অপেক্ষাকৃত নতুন মনে হয়, সেটা খুব সহজেই বিপ্লবের সময় নির্মিত বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর যেগুলো সন্দেহাতীত ভাবেই পুরোনো, সেগুলোকে বলে দেওয়া হবে মধ্য যুগের। কেউ স্থাপত্য থেকে ঠিক ইতিহাসটি আর জানতে পারবে না, বই থেকেই তা জানতে হবে। মূর্তি, ভাস্কর্য, স্মৃতি ফলক, সড়কের নাম- এমন যা কিছু অতীতকে নির্দেশ করতে পারে তা অতি সতর্কতায় প্রক্রিয়াকরণ হয়ে গেছে।
‘এটি যে গির্জা ছিলো তা আমার জানা ছিলো না,’ বললো উইনস্টন।
‘এর অনেকগুলো এখনও আছে, সত্যিই আছে,’ বললো বুড়ো, ‘তবে সেগুলো এখন ভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাহলেই বোঝো, ছড়া কি আর টিকে থাকবে?
“অরেঞ্জেস অ্যান্ড লেমন্স, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট ক্লেমেন্ট’স,
“ইউ ও মি থ্রি ফার্দিংস, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট মার্টিন’স-”
যদ্দুর মনে করতে পারছি, আমার মনে হয় এমনটাই ছিলো। ফার্দিং হচ্ছে ছোট দস্তার মুদ্রা, এখন যে সেন্ট দেখছো এমনই।’
‘সেইন্ট মার্টিন’স কোথায় ছিলো?’ প্রশ্ন উইনস্টনের।
‘সেইন্ট মার্টিন’স? সেতো এখনো আছে। এটিতো ভিক্টরি স্কয়ারে, পিকচার গ্যালারির পাশে। ওই যে সামনে পিলারগুলো ত্রিকোণাকৃতির, আর অনেক উঁচু একটা সিঁড়ি।’
উইনস্টন জায়গাটি ভালো করেই চেনে। বিভিন্ন ধরণের প্রচারণামূলক বিষয়ের প্রদর্শনী চলে এখানে- রকেট বোমা, ভাসমান দূর্গের মডেল, শত্রুপক্ষের নিষ্ঠুরতা তুলে ধরে তৈরি মোমের মূর্তি ইত্যাদি।
‘বলা হতো- সেইন্ট মার্টিন’স-ইন-দ্য-ফিল্ড,’ বললো বুড়ো, ‘তবে আমি ওই অংশে একটি মাঠের কথাও স্মরণ করতে পারছি না।’
ছবিটি কিনলো না উইনস্টন। কাঁচের পেপারওয়েটের চেয়ে অনেক বেশি অসংগতির বস্তু হবে এটি, আর ফ্রেম থেকে ছাড়িযে না নিলে এটি বাড়িতে বয়ে নিয়ে যাওয়াও হবে অসম্ভব। তবে সে বুড়োর সঙ্গে আরো কিছুটা সময় কাটালো। দোকানের সামনের নাম ফলক থেকে যে কেউ ধরে নেবে বুড়োর নামটি হবে উইকস- কিন্তু তার নাম মূলত চ্যারিংটন। মি. চ্যারিংটনের বয়স তেষট্টি আর এই দোকানের মধ্যেই তার গত ত্রিশ বছরের জীবন। তখন থেকেই জানালার পাশে নাম ফলকে নামটি পাল্টে নেওয়ার কথা তার মনে রয়েছে কিন্তু এপর্যন্ত আর তা করা হয়ে ওঠেনি। যতক্ষণ তাদের কথা চললো ততক্ষণই উইনস্টনের মস্তিষ্ক জুড়ে থাকলো বুড়োর সেই আধাআধি স্মরণ করতে পারা ছড়া। “অরেঞ্জেস অ্যান্ড লেমন্স, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট ক্লেমেন্ট’স”, “ইউ ও মি থ্রি ফার্দিংস, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট মার্টিন’স”। ব্যাপারটি কৌতুহলের, কিন্তু আপনি যা মনে মনে বলবেন বেলের শব্দে তো অবচেতন মনে সেটাই শুনবেন। হারিয়ে যাওয়া লন্ডনের সেই সব বেল হয়তো কোনখানে টিকে আছে, লুকিয়ে আর বিস্মৃত হয়ে। কোনও এক ভৌতিক চুড়া থেকে সে যেনো শুনতে পাচ্ছে একের পর এক বেল বেজে চলার শব্দ। তবে যতটা মনে করতে পারে, বাস্তব জীবনে সে কখনোই গির্জার বেল বাজার শব্দ শোনে নি।
চ্যারিংটনের কাছ থেকে এগিয়ে একাই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলো সে, রাস্তায় পা ফেলার আগে বুড়োটি কাছে থাকুক তা চাইছিলো না। এরই মধ্যে সে অবশ্য মনোস্থির করে ফেলেছে, সুবিধাজনক বিরতি দিয়ে, হতে পারে মাস খানেক পরে, আরও একবার এই দোকানে আসার ঝুঁকি সে নেবে। সেন্টারে এক সন্ধ্যার অনুপস্থিতির চেয়ে মনে হয় বিষয়টি বেশি বিপদের হবে না। সবচেয়ে বড় বোকামি কিন্তু ডায়রিটা কেনার পর একই স্থানে আরেকবার যাওয়া, বিশেষ করে দোকানের মালিককে বিশ্বাস করা যায় কিনা তা নিশ্চিত না হয়েই। যাইহোক-!
হ্যাঁ, তার মনে হলে ওখানে সে আবারও যাবে। আবারও সে এখানকার সুন্দর সুন্দর অপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনবে। সেইন্ট ক্লেমেন্ট ডেন্স’র ওই খোদাইকরা ছবিটি কিনে ওটি ফ্রেম থেকে ছাড়িয়ে, আলখেল্লার জ্যাকেটের নিচে ঢুকিয়ে তবেই বাসায় নিয়ে যাবে। মি. চ্যারিংটনের স্মৃতি ঘেঁটে বের করে আনবে কবিতার বাকি অংশটুকু। এমনকি উপরের তলার কামরাটি ভাড়া করার যে ক্ষণিকের ইচ্ছা জাগ্রত হয়েছিলো সে ইচ্ছাটিও তার মনে আবার চাড়া দিয়ে উঠলো। এসবের উত্তেজনা প্রায় পাঁচ সেকেন্ড ধরে তাকে বেপরোয়া করে রাখে, অতঃপর সে উদভ্রান্তের মতোই পা ফেলে ফুটপাতে। আর একটি সুর গুনগুন করতে থাকে-
অরেঞ্জেস অ্যান্ড লেমন্স, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট ক্লেমেন্ট’স,
ইউ ও মি থ্রি ফার্দিংস, সে দ্য….
ঠিক তখনই তার হৃদয়খানি বরফহিম হয়ে যায়, আর প্রসাবের প্রচণ্ড বেগ চাপে। নীল ওভারঅল পরা কেউ একজন ফুটপাতে নেমে এসেছে, দশ মিটারও ব্যবধান হবে না দুজনের মাঝখানে। এবারও সেই ফিকশন ডিপার্টমেন্টের মেয়েটি। সেই কালোকেশী। আলো অস্পষ্ট কিন্তু চিনে ফেলতে কষ্ট হয়নি। মেয়েটি সরাসরি একবার তার চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো আর ত্রস্ত পায়ে হাঁটতে শুরু করলো, যেনো সে তাকে দেখতেই পায়নি।
ক্ষণকয়েক চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলো উইনস্টন। এবার ডানে ঘুরলো আর দ্রুত পায়ে এগুতো থাকলো, একবারও মনে এলো না ভুল দিকে যাচ্ছে সে। ব্যাপারটা একেবারে পাক্কা। মেয়েটি যে তার ওপর গোয়েন্দাগিরি করছে, তাতে কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকলো না। সে অবশ্যই তাকে অনুসরণ করে এখানে এসেছে। পার্টির সদস্যরা যেখানে থাকে সেখানে থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে, এই অন্ধকার সড়কে একই সন্ধ্যায় দু’জনেরই এসে পড়ার আর কোনো বিশ্বাসযোগ্য কারণ থাকতে পারে না। এটাও একটা বড় বিষয়, মেয়েটি কি আসলে থট পুলিশের চর, নাকি নিতান্তই শখের গোয়েন্দাগিরিতে লিপ্ত। তবে সে যাইহোক, এতে কদাচই কিছু যায় আসে। সে তাকে নজরে রাখছে, এটাই যথেষ্ট। হতে পারে মেয়েটি তাকে সুঁড়িখানায়ও দেখে ফেলেছে।
একেই বলে কষ্ট করে হেঁটে চলা। কাঁচের পিণ্ডটি প্রতি পদক্ষেপে তার রানের ওপর আঘাত করছে, এতে সে প্রায় মনোস্থির করেই ফেলেছিলো ওটি ছুঁড়ে ফেলে দেবে। সবচেয়ে অসহনীয় হয়ে দেখা দিলো পেটের ব্যাথা। কয়েক মিনিট তার এও মনে হচ্ছিলো, দ্রুত একবার টয়লেটে ঢুকতে না পারলে সে মরেই যাবে। কিন্তু এই এলাকায় কোনো গণশৌচাগার নেই। পরে অবশ্য পায়খানার বেগ চলে গেছে, তবে রেখে গেছে একটা পেট কচলানো ব্যথা।
ওটি ছিলো একটা চোরা গলি। শেষ মাথায় গিয়ে উইনস্টন থামলো। কয়েক সেকেন্ড ভেবেই পাচ্ছিলো না, কি করবে। এবার উল্টো ঘুরলো আর আবারও হাঁটতে শুরু করলো। ঠিক যখন ঘুরছিলো তখনই তার মনে হলো, মোটে তিন মিনিট আগে মেয়েটি তাকে অতিক্রম করে গেছে, সে যদি একটু দৌড় লাগায় তো ওকে ধরে ফেলতে পারবে। এতে সুবিধা হবে, এই নিরব এলাকায় যতক্ষণ থাকবে সে তার গতিবিধি অনুসরণ করতে পারবে, এরপর একটা পাথর দিয়ে সে তার খুলিটি চুরমার করেও দিতে পারবে। তার পকেটে যে কাঁচের পিণ্ডটি রয়েছে ওটিও এমন একটি কাজের জন্য যথেষ্টই ভারি হবে। তবে পুরো ভাবনাটি দ্রুতই বাতিল করলো সে, কারণ এই মূহূর্তে শারিরিক পরিশ্রমের কোনো কাজ করার চিন্তা করাও তার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সে দৌড়াতেও পারবে না, আর একটি ঘুষিও ছুঁড়তে পারবে না। উপরন্তু মেয়েটি যুবতী আর গাট্টাগোট্টা, সেই বরং উল্টো তাকে ঘায়েল করে ফেলবে। তার মাথায় এই চিন্তাও এলো দ্রুত কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছে যাবে, আর বন্ধ হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত সেখানেই কাটাবে। তাতে ওই সন্ধ্যার কার্যক্রমের একটা আংশিক ব্যাখা সে দেখাতে পারবে। কিন্তু সেও ছিলো অসম্ভব। ভীষণ এক অবষন্নতা তাকে পেয়ে বসেছে। এখন তার একটাই ইচ্ছা, দ্রুত ঘরে ফিরে যাওয়া আর শান্ত হয়ে আরাম করে বসা।
ফ্ল্যাটে যখন ফিরলো ততক্ষণে রাত দশটা পার হয়ে গেছে। মূল ফটকে অবশ্য আলো বন্ধ করা হয় রাত সাড়ে এগারোটায়। ঘরে ঢুকেই দ্রুত রান্নাঘরে ছুটলো আর দেরি না করে এককাপ পরিমান ভিক্টরি জিন গলায় ঢাললো। ধকল সামলাতে সামলাতে চোরকুঠুরির টেবিলে ফিরলো, ড্রয়ার থেকে ডায়রিটা তুলে নিলো কিন্তু তখনই পাতা খুললো না। টেলিস্ক্রিন থেকে একটা কর্কশ নারী কণ্ঠ তারস্বরে গাইছে দেশপ্রেমের গান। ডায়রির মার্বেল মলাটের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলো সে, আর নারী কণ্ঠটিকে সজ্ঞানতার বাইরে ঠেলে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো।
ওরা আপনার খোঁজে রাতেই আসে। সঠিক কাজটি হচ্ছে, ওরা ধরে ফেলার আগেই আত্মহত্যা করে ফেলা। নিঃসন্দেহে কিছু মানুষ সেটাই করে। এ কারণেই বলা যায়, অনেক গুমের ঘটনা মূলতঃ আত্মহত্যা। তবে নিজেকে হত্যা করার জন্য প্রয়োজন চরম সাহস, বিশেষ করে আপনি যখন এমন বিশ্বে বাস করছেন যেখানে আগ্নেয়াস্ত্র কিংবা দ্রুত কাজ করে এমন বিষ কেনার সুযোগটিও রাখা হয়নি। ভয় ও বেদনার জৈবিক অকার্যকারিতা নিয়ে বিস্ময়চিত্তে সে ভাবলো, মানবদেহের শাসনটাই এমন যে, ঠিক অতি প্রয়োজনে শরীরটা বেঁকে বসে। একটু দ্রুত উদ্যোগী হলে সে হয়তো কালোকেশী মেয়েটিকে ধরতে পারতো: কিন্তু স্রেফ বিপদের আশঙ্কা তার শরীরকে অবশ করে দেয়। তার মনে হলো, সঙ্কটাপন্ন অবস্থায়ও মানুষকে বাইরের শত্রুর মোকাবেলা করা না লাগতে পারে, কিন্তু শরীরের ভেতরের শত্রুটির বিরুদ্ধে লড়াই চলে নিরন্তর। ঠিক এখন, জিন পেটে যাওয়ার পরেও পেটের ব্যাথাটি তার ধারাবাহিক চিন্তায় বিঘ্ন ঘটিয়ে চলেছে। বিষয়টি সবসময়ই একরকম, হোক সে বীরত্বের কিংবা বিয়োগান্তের। যুদ্ধের মাঠ, নিপীড়ণ কক্ষ, ডুবন্ত জাহাজে আপনার অব্যাহত লড়াইয়ের বিষয়গুলো মনে আসবে না কারণ তখন শরীর আপনার দখলেই থাকে না। যতক্ষণে ভয়ে অচেতন হয়ে যান নি, অথবা ব্যথায় চিৎকার জুড়ে দেননি ততক্ষণ পর্যন্ত জীবনটা প্রতি মূহূর্তের এক সংগ্রাম। সে সংগ্রাম ক্ষুধার, ঠাণ্ডার অথবা নিদ্রাহীনতার বিরুদ্ধে। অথবা পাকস্থলীর অম্বল কিংবা দাঁতের ব্যথার বিরুদ্ধে।
ডায়রি খুললো উইনস্টন। কিছু বিষয় লিখে ফেলা জরুরি। টেলিস্ক্রিনের নারী নতুন গান ধরেছে। সে গান তার মস্তিষ্কে কাচের ধারালো স্প্লিন্টারের মতো বিঁধছে। ও’ব্রায়েনকে নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করলো সে, যার জন্য, কিংবা যাকে উদ্দেশ্য করেই এই ডায়রি লেখা। কিন্তু ও’ব্রায়েন নয়, তার ভাবনা জুড়ে স্থান করে নিলো, থটপুলিশ। ওরা তাকে ধরে ফেললে কি হবে সেসব বিষয়। ওরা যদি সাথে সাথে মেরে ফেলে তো কোনও কথাই নেই। সে হত্যা হবে আপনার প্রত্যাশার পূরণের মতো কিছু। কিন্তু মৃত্যুর আগে (প্রত্যেকেই জানে কিন্তু কেউ কথা বলে না) দোষ স্বীকার সম্পর্কিত কিছু রুটিন কাজের মধ্য দিয়ে আপনাকে যেতেই হবে- মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়ে চিৎকার করতে করতে ক্ষমাভিক্ষা, প্রহারে প্রহারে হাড়গুলো ভাঙার কড়কড় শব্দ, দাঁত গুঁড়িয়ে দেওয়ার যন্ত্রণা আর মাথায় জমাট বেঁধে থাকা রক্তের উপলব্দি।
শেষ যখন ওই একই প্রাণহানিতে, তাহলে তার আগে কেনো এত কিছু? ওই কটি দিন বা সপ্তাহ জীবন থেকে কেনো বাদ দেওয়া যায় না? সন্দেহে পড়ে কেউ ধরা পড়েনি এমন হয়নি, আর কেউ অপরাধ স্বীকার করে নেয়নি এমনটাও হয়নি। একবার যদি আপনি চিন্তাঅপরাধের জালে পড়ে যান, কোনও এক দিনে সেকারণেই আপনার মৃত্যু অবধারিত। তাহলে যে ভয় কোনও কিছু পাল্টে দেয় না সে ভয় করাই কেনো, কেনই বা ভবিতব্যের কাছে মাথা ঠোকা?
চিন্তা জগতে ও’ব্রায়েনের ছবি টেনে আনতে এবার কিছুটা সফল সে। ‘এমন কোথাও আমাদের দেখা হবে যেখানে কোনও আঁধার থাকবে না,’ ও’ব্রায়েন বলেছিলো তাকে। সে জানে এর মানে কি, অথবা অন্তত তার মনে বলে, সে জানে। যেখানে কোন আঁধার নেই সে স্থানটি এক কাল্পনিক ভবিষ্যত, যা কেউ কখনোই দেখবে না, তবে দূরদৃষ্টি দিয়ে কেউ কেউ তার রহস্যময়তা উপলব্দি করতে পারবে। টেলিস্ক্রিনের কর্কশ শব্দে ভাবনার ধারাবাহিকতা বার বার কেটে যাচ্ছে। চিন্তার ট্রেন গতি হারাচ্ছে। মুখে একটি সিগারেট চেপে ধরলো সে। অর্ধেক পরিমান তামাক পড়লো জিভের ওপর। ভীষণ তেতো কিন্তু তখনই থুুতু ফেলে ওগুলো ফেলে দেওয়াও কঠিন। এমনই মূহূর্তে তার চিন্তার সমুদ্র থেকে ও’ব্রায়েনকে সরিয়ে দিয়ে সাঁতরে ঢুকে পড়লো বিগ ব্রাদার। দিন কয়েক আগে যা করেছিলো ঠিক তেমনিভাবে পকেট থেকে একটি মুদ্রা বের আনলো সে, আর তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো। মুদ্রার পীঠের মানুষটি যেনো তাকেই দেখছে, গভীর, শান্ত ও সুরক্ষার দৃষ্টিতে: কিন্তু কালো ঘন গোঁফের নিচে কিসের এক চাপা হাসি লুকিয়ে আছে? স্তিমিত হয়ে আসা ঘণ্টাধ্বনির মতো তার কানে বার বার বাজতে থাকলো:
যুদ্ধই শান্তি
স্বাধীনতা দাসত্ব
অবজ্ঞাই শক্তি।
২য় খণ্ড – উইনস্টনের দুঃসাহসিক প্রেমকাহিনী
দ্বিতীয় খণ্ড – উইনস্টনের দুঃসাহসিক প্রেমকাহিনী
অধ্যায় ১
তখন মধ্য সকাল। কামরা ছেড়ে টয়লেটের দিকে যাচ্ছিলো উইনস্টন।
উজ্জ্বল আলোকিত লম্বা বারান্দা পথের উল্টোদিক থেকে আসছিলো একজন। সেই কালোকেশী মেয়েটি। ভাঙারি দোকানের বাইরে তাদের সেই সন্ধ্যায় দেখা হয়ে যাওয়ার পর চারদিন গত হয়েছে। কাছাকাছি আসতেই দেখা গেলো তার ডানহাতটি ভাঁজ করে স্লিংয়ে ঝুলিয়ে রাখা।
স্লিংয়ের কাপড়টি ওভারঅলের রঙের হওয়ায় দূর থেকে আন্দাজ করা যাচ্ছিলো না। হতে পারে অতিকায় কেলিডোস্কোপে উপন্যাসের খসড়া তৈরির কাজের সময় মেশিনে হাত আটকে গিয়েছিলো, এমনটাই ভাবলো সে। ফিকশন ডিপার্টমেন্টে এমন দুর্ঘটনা প্রায়শঃই ঘটে।
ভাবনার চাকা ঘুরতে ঘুরতে ততক্ষণে তাদের দূরত্ব কমে চার মিটারের কাছাকাছি। আর ঠিক তখনই আচমকা হোঁচট খেয়ে মেয়েটি উপুড় হয়ে পড়লো। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো সে। আহত হাতটাই পড়েছে নিচে। উইনস্টন একটু থমকালো। মেয়েটি ততক্ষণে হাঁটুতে ভর করে শরীরটাকে তুলে নিয়েছে। তার মুখমণ্ডল দুধ-হলুদ রঙ ধরেছে, ওর মুখটা এতটা লাল হয়ে উঠতে এর আগে আর কখনোই দেখেনি সে। চোখ তুলে মেয়েটি তাকালো উইনস্টনের দিকে। আর সে চেহারার অভিব্যক্তি বলছে, ব্যথার চেয়ে যেনো ভয়টাই বেশি পেয়েছে।
হৃদয় মাঝে একটা কৌতুহলের আবেগ বয়ে গেলো উইনস্টনের। তার সামনে এক শত্রু, যাকে সে হত্যা করতে চেয়েছিলো: তার সামনে এমনও একজন, যে আসলে এক মানব সন্তান, ব্যাথাতুর। আর হতে পারে এবার তার হাড্ডিটাও ভেঙ্গেছে। অজান্তেই মেয়েটির দিকে সাহায্যের মনোভাব নিয়ে এগিয়ে গেলো সে। মেয়েটিকে তারা ভাঙা হাতটির উপর পড়ে যেতে দেখে তার যেনো মনে হচ্ছিলো সে নিজেই ব্যথাটি অনুভব করতে পারছে।
‘ব্যথা পেয়েছো?’ বললো সে।
‘ও কিছু না। হাতে চাপ পেয়েছি। ঠিক হয়ে যাবে এখুনি।’
তার কথায় মনে হচ্ছিলো তার হৃদয় কাঁপছে। আর মুখমণ্ডল তখন পুরোই ফ্যাকাশে।
‘ভেঙ্গে ফেলোনি তো?’
‘না আমি ঠিক আছি। একটু ব্যথা পেয়েছি এই যা।’
মেয়েটি তার অন্য হাতটি এগিয়ে দিলো। আর সে ওকে ধরে দাঁড়াতে সাহায্য করলো। ততক্ষণে মেয়েটি তার নিজের রঙ কিছুটা ফিরে পেয়েছে, আর তাতে তাকে একটু ভালোও দেখাচ্ছিলো।
‘ও কিছু না,’ আবারও বললো মেয়েটি। ‘কব্জির ওপর সামান্য চাপ পড়েছে। ধন্যবাদ কমরেড!’
এই কথা বলে মেয়েটি তার পথে হেঁটে এগিয়ে গেলো, এমন একটা ভঙ্গি করে যেনো কিছুই হয়নি। পুরো ঘটনাটি ঘটতে আধা মিনিটও নেয়নি। অনুভূতিকে চেহারায় ফুটিয়ে না তোলা এখন প্রত্যেকেরই অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আর, এ কথা বলা বাহুল্য ঘটনার সময় তারা দুজন টেলিস্ক্রিনের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো। তারপরেও ক্ষণিকের বিষ্ময়কে এড়িয়ে যাওয়া ছিলো ভীষণ কঠিন। মাত্র দুই কি তিন সেকেন্ড। যখন মেয়েটির হাত ধরে টেনে তুলছিলো ঠিক তখনই কিছু একটা তার হাতের মধ্যে গুঁজে দেয়। প্রশ্নাতীতভাবেই পুরো ঘটনাটিই ছিলো পরিকল্পিত। ছোট আর চ্যাপ্টা ধরনের কিছু একটা বলেই হাতের মুঠোয় বোধ হচ্ছে। টয়লেটের দরজা দিয়ে ঢুকেই বস্তুটি পকেটে চালান করে দিলো সে। উপর থেকে আঙুলের মাথা আস্তে করে বুলিয়ে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো। ধারনা করলো, ওটি চৌকা করে কয়েক ভাঁজে ভাঁজ করা এক টুকরো কাগজ।
প্রশ্রাবের প্যানে দাঁড়িয়ে আবারও আঙুল বুলিয়ে বুলিয়ে পকেটের ভেতরেই ভাঁজ করা কাগজটি অনুভব করার চেষ্টা করলো সে। ধরেই নিলো এতে নিঃসন্দেহে কোনও একটা বার্তা লেখা রয়েছে। একবার মনেও এসেছিলো কোন একটা টয়লেটের ভেতরে ঢুকে চিরকূটটি পড়ে ফেলে। কিন্তু সেটা হবে সবচেয়ে ভয়াবহতম বোকামি। টেলিস্ক্রিন যখন সারাক্ষণই চোখ পাকিয়ে রয়েছে তখন আপনি কোনও একটি স্থানকেও নিশ্চিত নিরাপদ ভাবতে পারেন না।
কামরায় ফিরলো সে। বসলো। কাগজের টুকরোটি খাপছাড়া একটা বেখেয়ালী ভঙ্গিমায় ডেস্কের অন্য কাগজগুলোর মধ্যে ছুড়ে ফেলে রাখলো। চশমা জোড়া চোখে লাগিয়ে স্পিকরাইটটি কাছে টেনে নিলো। ‘পাঁচ মিনিট,’ নিজেকেই নিজে বললো উইনস্টন, ‘অন্তত পক্ষে পাঁচটি মিনিট!’ তার হৃদযন্ত্র তখন আতঙ্ক ধরিয়ে দেওয়ার মতো করে বুকের ভেতর লাফাচ্ছে। বাঁচোয়া যে, হাতের কাজটি তখন জটিল কিছু ছিলো না। বড় একটি পরিসংখ্যানের তালিকা সংশোধনী, যার জন্য গভীর মনযোগের দরকার নেই।
কাগজের টুকরোটিতে যা কিছুই লেখা থাক, তার একটি রাজনৈতিক অর্থ থাকবেই বলে ধারনা উইনস্টনের। অন্তত দুটি বিষয় তার মনে আসছে। যার মধ্যে একটি হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এত দিনের আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করে মেয়েটি যে থট পুলিশেরই এজেন্ট তা নিশ্চিত করা হয়েছে এই কাগজে। তবে তার বোধে ধরছে না, থট পুলিশ কেনই তাদের বার্তা পৌঁছে দিতে এমন একটা পথ বেছে নেবে? হতে পারে তাদের সুনির্দিষ্ট কোনও কারণ অবশ্যই রয়েছে। কাগজটির বার্তায় একটি হুমকিও থাকতে পারে, হতে পারে কোনও তলব নোটিশ, আত্মহত্যা করার নির্দেশ অথবা কোন কিছুর ফাঁদ। তবে আরও একটি, অপেক্ষাকৃত হিংস্র সম্ভাবনা তারা মাথায় জেগে উঠছে, যদিও সর্বোতভাবেই সে চাইছে ভাবনাটি দমন করে রাখতে, আর তা হচ্ছে, এই বার্তা আদৌ থট পুলিশের তরফ থেকে আসে নি, এসেছে কোনও এক গুপ্ত সংগঠনের পক্ষ থেকে। হতে পারে ব্রাদারহুডের পক্ষ থেকে! আর এই মেয়েটি তাদের সঙ্গে রয়েছে! নিঃসন্দেহে এটি একটি ফালতু ভাবনা, তবে এই ভাবনা হাতের তালুতে কাগজের টুকরোটি অনুভূত হওয়ার মূহূর্তেই তার মনের ভেতর লাফিয়ে উঠেছিলো। আর অপর এবং সবচেয়ে সম্ভাবনার ভাবনাটি তার মনে আসে মিনিট কয়েক পরে। যে কারণে, এই বার্তায় তার মৃত্যুঘোষণা লেখা রয়েছে বলে বিবেচনা ও বিশ্বাস সত্বেও, হৃদয়ের ধুকপুকানিতে, সকল জটিলতাকে সঙ্গী করে স্পিকরাইটে পরিসংখ্যানগুলো উচ্চারণের সময় গলার কাঁপুনিতেও একটা অযৌক্তিক প্রত্যাশা তার মধ্যে জাগরুক।
হাতের কাজ শেষ করে কাগজগুলো পেঁচিয়ে নিয়ে নিউমেটিক টিউবে ঢুকিয়ে দিলো। এর মধ্যে আট মিনিট পার হয়ে গেছে। নাকের ওপর চশমাটি নেড়েচেড়ে ভালো করে বসিয়ে নিলো। বড় একটা শ্বাস টেনে পরের কাজের জন্য রাখা কাগজগুলো নিজের দিকে টানলো। আর সেই সঙ্গে কাগজগুলোর উপরে ফেলে রাখা সেই চিরকূটটিও তখন তার সামনে। আলতো করে ওটি তুলে নিলো। ভাঁজ খুললো। যাতে গোটা গোটা হরফে লেখা:
আমি তোমাকে ভালোবাসি।
কয়েক দণ্ডের জন্য সে এতটাই হতবিহ্বল হয়ে থাকলো যে এই অপরাধ সংসৃষ্ট বস্তুটি স্মৃতিগহ্বরে ছুঁড়ে ফেলতেও ভুলে গেলো। যখন সে কাজটি করলো, তার আগে, অতি আগ্রহ দেখানোর সমূহ বিপদের কথা ভালো করে জানা থাকার পরেও, কথাগুলো সত্যিই এতে লেখা রয়েছে এমনটা নিশ্চিত হতে লেখাটি আরেকবার পড়ে নেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারলো না।
সকালের বাকি সময়টা কাজে মন দেওয়া সত্যিই কষ্টকর হয়ে উঠলো। ডেস্কে জমে থাকা জটিল কাজগুলোতে মনোনিবেশের চেয়েও বড় প্রয়োজন হয়ে দেখা দিলো ভেতরের উত্তেজনাকে টেলিস্ক্রিনের চোখ এড়িয়ে রাখা। তখনই তার মনে হলো পেটের ভেতর ক্ষুধার আগুন জ্বলছে।
ভ্যাপসা গরম, ঠাসাঠাসি, চ্যাচামেচিতে আচ্ছন্ন ক্যান্টিন অসহ্য ঠেকছিলো। আশা ছিলো এক কোনে একা বসেই কাটাবে সময়টি কিন্তু বিধি বাম। হাঁদারাম পারসন্স এসে ধপ করে পাশে বসলো, তার ঘামের বোঁটকা গন্ধ স্ট্যুর তামাটে গন্ধকে হার মানিয়ে নাকে ঝাপটা মারলো, আর সঙ্গে সঙ্গে ছুটলো কথার তুবড়ি। বিষয় ঘৃণা সপ্তাহের প্রস্তুতি। কাগজের মণ্ড দিয়ে বিগ ব্রাদারের যে মূর্তি তৈরি হচ্ছে তা নিয়েই তার সবচেয়ে বেশি উৎসাহ। তার মেয়ের স্পাইজ ট্রুপে যোগ দেওয়া উপলক্ষ্যেই তৈরি হচ্ছে দুই মিটার প্রস্থ মাপে বিগ ব্রাদারের মস্তক-মূর্তি। বিরক্তির হচ্ছে, এই শোরগোলের মধ্যে পারসন্স ঠিক কি বলছে তা তার কানেই পৌঁছাচ্ছে না, যে কারণে তার বোকামিভরা মন্তব্যগুলো বার বার জিজ্ঞেস করে করে শুনে নিতে হচ্ছে। মেয়েটিকে এর মধ্যে এক নজর দেখলো সে। এক কোনার একটি টেবিলে অন্য দুটি মেয়ের সঙ্গে বসা। চেহারায় মনে হচ্ছিলো সে তাকে দেখতে পায় নি। তবে এরপর ওইমুখে আর একবার চোখ ফেললো না সে।
বিকেলটা অপেক্ষাকৃত স্বস্তির ছিলো। দুপুরের খাবারের পরপরই ডেস্কে একটা স্পর্শকাতর-জটিল কাজও এলো, যা শেষ করতে কয়েক ঘণ্টা লাগলো, এমনকি অন্যকাজ পাশে ঠেলে রেখেই তা সারতে হলো। দুই বছর আগের কিছু উৎপাদন বিষয়ক রিপোর্টকে মিথ্যায়নের কাজ। এমনভাবে করতে হবে যাতে সে সময়কার ইনারপার্টির এক বিশিষ্ট নেতার সুনামহানি হয়। এই নেতা এখন কোনঠাসাদের একজন। এই কাজে উইনস্টনের হাত পাকা। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় মেয়েটিকে সে সফলভাবে মনের বাইরে রেখে মন লাগিয়ে কাজ করলো সে। এরপর মেয়েটির মুখ ফের যখন মনে এলো তখন তার একা হওয়ার এক জ্বালাধরা অসহনীয় বাসনা হতে লাগলো। বস্তুত, যতক্ষণ না একা হতে পারছে জীবনে নতুন হয়ে আসা বিষয়টি নিয়ে ভালো করে ভাবতেও পারছে না।
আজ রাতে কমিউনিটি সেন্টারে যাওয়ার তারিখ। আরেকবার ক্যান্টিনের বিস্বাদ খাবার গিলে ছুটলো সেন্টারের দিকে, সেখানে নিপাট নির্বোধদের সমন্বয়ে গঠিত একটি আলোচনা চক্রে যোগ দিলো, দুই গেম টেবিল টেনিস খেললো, কয়েক গ্লাস জিন গিললো, আধাঘণ্টা খানেক ‘দাবা খেলায় ইংসকের সম্পর্ক’ বিষয়ক একটি বক্তৃতা শুনলো। বিরক্তিতে আত্মা পর্যন্ত তেঁতো হয়ে উঠেছে, কিন্তু আজ সন্ধ্যায় সেন্টার ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা একেবারেই ভাবছে না সে। ‘আমি তোমায় ভালোবাসি’ কথাগুলো দেখার পর থেকে বেঁচে থাকা তার কাছে বড় হয়ে উঠেছে, আর সে কারণেই ছোট ছোট ঝুঁকি নেওয়া তার কাছে বোকামি বলে মনে হতে লাগলো। রাত এগারোটার আগেই ঘরে ফিরে নিজেকে বিছানায় গলিয়ে দিলো। অন্ধকার কামরা- এখানে টেলিস্ক্রিনের চোখ বাঁচিয়ে আপনি পুরোই নিরাপদ, অন্তত যতক্ষণ নিরবতা বজায় রাখা যাবে ততক্ষণ। আর এটাই তার ভাবনার অফুরান সুযোগ।
মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ করে সরাসরি কথা বলার জন্য সময় ঠিক করে নেওয়া প্রয়োজন। তবে বাহ্যিকভাবে এটি একটি বড় সমস্যা। মেয়েটি তাকে কোনো ফাঁদে ফেলতে যাচ্ছে এমনটা সে আর মনেই করছে না। সে নিশ্চিত করে বুঝতে পারছে- তেমন কিছু নয়। হাতের ভেতর কাগজের টুকরোটি গুঁজে দেওয়ার সময় ভুল করে হলেও যে উত্তেজনাটুকু সে দেখিয়েছে তা থেকেই এটুকু নিশ্চিত হওয়া যায়। বেজায় ভয়াতুর হয়ে পড়েছিলো মেয়েটি। ওকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা তার মনের মধ্যে একবারও আসছে না। মোটেই পাঁচ রাত আগে সে তাকে পাথরের ঘায়ে মাথা গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিলো; কিন্তু সে কথা এখন ধর্তব্যের বাইরে। এখন তার চিন্তাজুড়ে মেয়েটির নগ্ন, যৌবনবতী শরীর, সেই রাতে স্বপ্নে যেমনটি দেখেছিলো। সে ভেবেছিলো মেয়েটি বাকিদের মতোই নির্বোধ, তার মস্তিষ্ক জুড়ে রয়েছে মিথ্যা আর ঘৃণা, তার পেটের ভেতরটা দুর্বুদ্ধিতে ভরা। এবার এক ধরনের জ্বরাগ্রস্ততা তাকে পেয়ে বসলো। মনে হলো মেয়েটিকে যে হারাতে চলেছে, ওর যৌবনভরা দেহখানা বুঝি আর তার হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় হয়ে যে ভয় দেখা দিলো তা হচ্ছে, খুব তাড়াতাড়ি সাড়া না দিলে মেয়েটি মন পাল্টে ফেলবে। আর এই সামনাসামনি দেখা হওয়া যে কত জটিল কাজ সেটা তার জানা। দাবার কোটে রাজা যখন চেকে পড়ে তখন একেকটি গুটির চাল যেমন কঠিন হয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি। যে দিকেই মুখ ঘোরান, টেলিস্ক্রিনে মুখ। চিরকূটের লেখাটি পড়ার পরের পাঁচ মিনিটের মধ্যেই যোগাযোগের সবগুলো সম্ভাব্য পথ নিয়ে সে ভেবে রেখেছে। এখন চিন্তার জন্য সময় পেয়ে সেগুলোই আবার একের পর এক সামনে এনে ভাবতে লাগলো। যেভাবে টেবিলের ওপর কোনো সরঞ্জাম থরে থরে সাজিয়ে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখা যায় সেভাবে।
আজ সকালে ঘটনাটি যেভাবে ঘটেছে ঠিক একইভাবে একই ঘটনা আরেকবার ঘটানো একটা অসম্ভব ভাবনা। মেয়েটি যদি রেকর্ডস ডিপার্টমেন্টে কাজ করতো তাহলে কাজটি তুলনামূলক সহজ হতো, কিন্তু এই ভবনে ফিকশন ডিপার্টমেন্টটির অবস্থান নিয়েই খুব সামান্য ধারনা রাখে সে। আর থাকলেও সেখানে যাওয়ার কোনো ওছিলাও তার হাতে নেই। যদি জানা থাকতো মেয়েটি কোথায় থাকে, আর কখন কাজ শেষ করে, তাহলে ওর বাড়ি ফেরার পথে কোথাও মুখোমুখি হওয়ার ফন্দি আঁটা যেতো। কিন্তু বাড়ির পথে ওর পিছু নেওয়া নিরাপদ হবে না, কারণ তার ব্যাখ্যা দাঁড়াবে মন্ত্রণালয়ের বাইরে ইতস্তত ঘোরাঘুরি, আর সহজেই তা নজরে পড়ে যাবে। ডাকে চিঠি পাঠানো যায়। কিন্তু সে প্রশ্নও উঠতে পারে না, কারণ মাঝ পথে সব চিঠিই খুলে পড়াই এখন নিয়ম। কেউ কেউ যে চিঠি লিখেন না তা নয়, তবে তা কেবল প্রয়োজনীয় তথ্য পাঠানোর জন্য। একটা ছাপানো পোস্টকার্ড রয়েছে তাতে বার্তাগুলো লেখা থাকে। কেউ তার অপ্রয়োজনীয় কথাগুলো কেটে দিয়ে পাঠায়। আরেকটা কথা, ঠিকানাতো দূরের কথা, সেতো মেয়েটির নামই জানে না। অবশেষে সে সিদ্ধান্তে পৌঁছালো ক্যান্টিনই হতে পারে সবচেয়ে নিরাপদ। কোনও একটি টেবিলে যদি সে তাকে একা পেয়ে যায়! রুমের ঠিক মাঝের দিকের কোনও একটি টেবিল হলে ভালো হয় যেখানটা টেলিস্ক্রিন থেকে অপেক্ষাকৃত দূরে, আর তখন চারিদিকে যদি পর্যাপ্ত মাত্রায় চিৎকার চেচামেচি চলতে থাকে- এমন একটি অবস্থায় যদি তাকে পাওয়া যায়, মোটে ত্রিশ সেকেন্ডের জন্যও যদি হয় সে সাক্ষাৎ; হতে পারে, তখন কিছু কথা বলা যাবে।
পরের সপ্তাহটি জীবনের জন্য হয়ে থাকলো কেবলই সপ্নময়। ঘটনার ঠিক পরের দিন যতটা সময় তার ক্যান্টিনে কেটেছে সে সময়ের মধ্যে কালোকেশীর টিকিটিরও দেখা পায়নি। হুইসেল বেজে উঠলে ক্যান্টিন ছাড়লো সে। মনে মনে ভাবলো, হতে পারে মেয়েটি কাজের শিফট পাল্টে ফেলেছে।
সেদিন অবশ্য একবার তারা একে অন্যের সামনে দিয়ে হেঁটে গেছে, কিন্তু কেউ কাউকে দেখতে পায়নি। ঘটনার তৃতীয় দিনে এসে নিয়ম মাফিক লাঞ্চে ক্যান্টিনে দেখা গেলো তাকে। তবে সঙ্গে আরও তিনটি মেয়ে ছিলো। আর বসেছিলো ঠিক টেলিস্ক্রিনের নিচে।
পরের তিনটি দিন গেছে আরও অসহনীয়তায়। এই তিন দিনে একটি বারের জন্যও মেয়েটিকে সে দেখতে পায়নি।
গোটা দেহ আর মন যেনো এক ধরনের অহসহনীয় সংবেদনশীলতায় আক্রান্ত হয়ে থাকলো। সব কিছুই যেনো ফাঁকা ফাঁকা। প্রতিটি চলন, প্রতিটি বলন, প্রতিটি স্পর্শ, প্রতিটি শব্দ যা তার কানে পসছে, সবই যেনো ব্যথা ধরিয়ে দিচ্ছে। ঘুমের মাঝেও মেয়েটির অবয়ব তার চোখ আর মন ছাড়া হয়নি। এই ক’দিনে ডায়রিটা ছুঁয়েও দেখেনি। স্বস্তি যদি কিছুটা পেয়ে থাকে তা ছিলো ঠিক কাজের টেবিলে। এখানেই সে কিছুটা সময় ধরে হলেও মেয়েটিকে ভুলে থাকতে পেরেছে, কাজের চাপে চাপে অন্তত দশ মিনিট মেয়েটির অবয়বমুক্ত থেকেছে তার মন। মেয়েটির যে কি হলো তা নিয়ে ভেবে কোনই কূল-কিনারা করতে পারলো না। খোঁজে নামা নিতান্তই অসম্ভব। হতে পারে, ওকে বাষ্প করে দেওয়া হয়েছে, হতে পারে ও আত্মহত্যা করেছে, হতে পারে ওকে ওশেনিয়ার সীমান্তে বদলি করা হয়েছে, আর সবচেয়ে বাজে ও সবচেয়ে সম্ভাব্য দিকটি হচ্ছে, সে মত পাল্টে ফেলেছে, আর তাকে এড়িয়ে চলছে।
পরের দিন অবশ্য তার চাঁদবদনের দেখা মিললো। বাহুখানি ততক্ষণে স্লিংমুক্ত। তবে এবার কব্জিতে প্ল্যাস্টার প্যাঁচানো। সে যাই হোক, দেখতে যে পেলো সেটাই বড় স্বস্তির। আর সেই দর্শণে সে এতটাই আপ্লুত হয়ে পড়লো যে কয়েক সেকেন্ড তার দিকে দৃষ্টি ফেলে রেখে সেই অভিব্যক্তির প্রকাশ না ঘটিয়ে পারলো না। এর পরের দিন মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ প্রায় এসেই গিয়েছিলো।ক্যান্টিনে পৌঁছে দেখে মেয়েটি টেলিস্ক্রিন থেকে যথেষ্ট দূরেরই একটি টেবিলে বসা, আর পুরোই একা। দুপুরের খাবারে ভীর তখনও পুরোদমে শুরু হয়নি। ক্যান্টিনও ভরে ওঠেনি। কিউতে দাঁড়িয়ে এগুতে এগুতে উইনস্টন যখন প্রায় কাউন্টারের কাছাকাছি, ঠিক তখনই ঝামেলাটা বাঁধলো। তার সামনের জনের অভিযোগ তিনি তার ট্রেতে স্যাকরিনের বড়ি পাননি। সে নিয়ে চিৎকার জুড়ে দিলেন। তাতে কেটে গেলো কিছুটা সময়। মেয়েটি অবশ্য তখনও একাই বসে। যাই হোক ওদের বসচা মিটে গেলে উইনস্টন নিজের ট্রেতে খাবার নিয়ে কিছুটা খাপছাড়া ভঙ্গিতে মেয়েটির টেবিলের দিকেই এগুচ্ছিলো। চোখ ঠিক ওই টেবিলে নয়, দৃষ্টির গতিপথ বলছে- যেনো পেছনের টেবিলে স্থান খুুঁজছে সে। কালোকেশীর টেবিল তখন মোটে তিন মিটার দূরে। দুই সেকেন্ডেই সামনে পৌঁছে যাবে। আর ঠিক তখনই পেছন থেকে কেউ একজন ডেকে উঠলো, ‘স্মিথ!’। প্রথমে সে এমন একটা ভাব করলো যেনো শুনতে পায়নি। ‘স্মিথ!’ আরেকটু জোরে আরেকবার ডেকে উঠলো কণ্ঠটি। এবার নিরুপায়। সে ঘুরলো। এক ঝাঁকড়া-চুলের ফালতু চেহারায় এক যুবক। নাম উইলশার, ভালো করে চেনেও না উইনস্টন, মুখে হাসি ছড়িয়ে সে-ই তাকে আহ্বান জানালো তার টেবিলের ফাঁকা চেয়ারটিতে বসার জন্য। ওকে প্রত্যাখ্যান করা নিরাপদ হবে না। একজন ডাকার পরেও তাকে উপেক্ষা করে আরেকটি মেয়ের টেবিলে বসে পড়া রীতিমতো অসমিচীন, যেখানে মেয়েটি তাকে ডাকেও নি। এমন কিছু করে ফেললে সবারই চোখে পড়ে যাবে। অগত্যা বন্ধুসুলভ হাসি ছড়িয়ে সে বসে পড়লো যুবকটির টেবিলে। ফালতু চেহারার ঝাঁকড়াচুলো তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। উইনস্টনের মনে হচ্ছিলো একটা কুড়োল দিয়ে টেবিলটির মাঝ বরাবর কোপ মেরে দুখান করে দেয়। ভাবতে ভাবতে কয়েক মিনিটেই মেয়েটির টেবিলটাও ভরে গেলো অন্যরা বসে পড়ায়।
সে নিশ্চিত, মেয়েটি বুঝতে পেরেছে যে উইনস্টন তার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলো। আর হতে পারে এর থেকে সে কিছু একটা বুঝেও নিয়েছে। পরের দিন যাতে একটু আগে আগে যেতে পারে সে বিষয়টি মাথায় ছিলো। আর আগের দিনের ভাবনা সঠিক করে দিয়ে এদিনও মেয়েটি সেই একই টেবিলে আর স্রেফ একা বসে। কিউতে তার ঠিক সামনের লোকটি বেটেখাটো আর শুধুই নড়াচড়া করছে। সেই মধুমক্ষী চেহারার লোকটি। চ্যাপ্টা মুখমণ্ডলে ছোট-কুতকুতে দুটি চোখ। উইনস্টন যখন তার ট্রেটি হাতে নিয়ে কাউন্টার থেকে ঘুরলো, সে দেখলো বাটুল ব্যাটা সোজা মেয়েটির টেবিলের দিকেই যাচ্ছে। আশার তরী তবে ডুবলো এবারও। একটু দূরে আরেকটি টেবিলে চেয়ার ফাঁকা, কিন্তু বাটুলের চেহারা দেখে পড়ে নিলো- এই ব্যাটা অপেক্ষাকৃত বেশি ফাঁকা টেবিলটিতেই আরাম করে বসবে। বরফহীম হৃদয় নিয়ে উইনস্টন এগুচ্ছে। ওকে একা টেবিলে না পেলে কোনই ফায়দা নেই। ঠিক সেই মূহূর্তে সশব্দে চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেলো বাটুল লোকটা। চার হাত পা চারদিকে ছড়িয়ে, আর তার ট্রে-খানা উল্টে স্যুপের ও কফির ধারা মেঝেতে গড়ালো। ঘৃণাভরা দৃষ্টি হেনে উইনস্টনের দিকে তাকাতে তাকাতে পরক্ষণেই উঠে দাঁড়ালো। তার সন্দেহমাখা দৃষ্টি বলছে যেনো উইনস্টন তাকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু তাতে কিছুই যায় আসে না। হৃদযন্ত্রের ধক ধক ধক ধক শব্দ নিয়ে উইনস্টন বসে পড়লো মেয়েটির টেবিলে।
মেয়েটির দিকে না তাকিয়েই ট্রের খাবারগুলো খোলায় মন দিলো সে। আর দ্রুতই খাওয়াও শুরু করলো। কেউ এসে পড়ার আগে এখুনি কথা সেরে ফেলা খুবই জরুরি, কিন্তু এক ভয়াবহ ভীতি যেনো তাকেজাপ্টে ধরলো। মেয়েটি কথাগুলো বলার পর এক সপ্তাহ পার হয়েছে। এর মধ্যে সে অবশ্যই তার মনও পাল্টে ফেলেছে! এই সম্পর্ক সফলতায় শেষ হবে এমনটা অসম্ভব; এমন ঘটনা বাস্তব জীবনে ঘটেই না। কানভরা পশমওয়ালা সেই কবি অ্যাম্পলফোর্থকে ট্রে হাতে বসার জায়গা খুঁজতে না দেখলে, এখনই কিছু বলবে না এমন একটি সিদ্ধান্ত সে প্রায় নিয়েই ফেলেছিলো। নিজের মতো করেই উইনস্টনের সঙ্গে খাতির রেখে চলে এই অ্যাম্পলফোর্থ, আর নিশ্চিতভাবেই বলা যায় তাকে দেখে ফেললে ছুটে এসে এই টেবিলেই বসবে। হাতে মোটে এক মিনিট সময়ও নেই। উইনস্টন ও মেয়েটি দুজনই ধীরে ধীরে খাবার মুখে তুলছে। যা খাচ্ছে তা ওই পাতলা স্ট্যু, মূলত শিম-বরবটির স্যুপ। অনেকটা বিরবির করার মতো করে উইনস্টন কথা পারলো। কেউই চোখ তুলে তাকালো না। ধীরে ধীরে চামচে তুলে তরল পদার্থ মুখে দিচ্ছে। আর এর মাঝেই কিছু প্রয়োজনীয় শব্দ বিনিময় হচ্ছে। খুব আস্তে অভিব্যক্তিমুক্ত সে কণ্ঠধ্বনি-
– ‘কাজ শেষ হয় কখন?’
– ‘সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায়।’
-‘কোথায় দেখা হতে পারে?’
– ‘ভিক্টরি স্কয়ার, স্মৃতিস্তম্বের কাছে।’
– ‘ওখানটা তো টেলিস্ক্রিনে ভরা।’
– ‘ভিড় থাকলে ওটা কোনও বিষয় না।’
– ‘কোনও সংকেত?’
– ‘না। আমার আশেপাশে অনেক মানুষের ভীড় না থাকলে কাছে ঘেঁষা যাবে না। আর আমার দিকে তাকানোও যাবে না। তবে আমার আশেপাশেই কোথাও থাকবে।’
– ‘কখন?’
– ‘সন্ধ্যা ৭টা’
– ‘ঠিক আছে’।
উইনস্টনকে দেখতেই পায়নি অ্যাম্পলফোর্থ। এগিয়ে গিয়ে অন্য একটি টেবিলে বসে পড়েছে সে। ওদের দুজনের মধ্যে আর কোনও কথা হলো না। আর যতক্ষণ টেবিলের দুদিকে দুজন বসে ছিলো কেউ কারো দিকে তাকালোও না। মেয়েটি একটু দ্রুত খাবার শেষ করে বেরিয়ে গেলো। উইনস্টন সিগারেট ফুঁকবে বলে আরেকটু বসলো।
নির্ধারিত সময়ের আগেই ভিক্টরি স্কয়ারে পৌঁছে গেলো উইনস্টন। খাঁজকাটা অতিকায় স্তম্ভটির চারিদিকটা একবার ঘুরে দেখলো। এই স্তম্ভের চূড়ায় দখিণমুখো করে বসানো বিগ ব্রাদারের অতিকায় মূর্তি। আকাশের পানে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছেন, ঠিক যেদিকটাতে এয়ারস্ট্রিপ ওয়ান যুদ্ধে তার হাতে পরাভূত হয়েছিলো ইউরেশীয় বিমানগুলো (বছর কয়েক আগে তা অবশ্য ছিলো পূর্ব এশীয় বিমান) সেদিকটাতে মুখ করে। সড়কের সম্মুখভাগে একটি ঘোড়ার পিঠে সওয়ার এক মানবমূর্তি। বলা হয় ওটি ওলিভার কর্মওয়েলের প্রতিরূপ। নির্ধারিত সময়ের পরেও পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেছে। ভয়াবহ সেই ভীতি আবার তাকে পেয়ে বসলো। সে আর আসছে না! মন পাল্টে ফেলেছে! ধীরে হাঁটতে হাঁটতে স্কয়ারের উত্তর দিকটাতে এগিয়ে গেলো সে। ঠিক তখনই সেন্ট মার্টিন’স চার্চটি চোখে পড়ায় একটা ফ্যাকাশে রঙের আনন্দানুভূতি বয়ে গেলো। এই সেই গির্জা, যার ঘণ্টা, যখন ঘণ্টা বলতে কিছু ছিলো, ধ্বনি তুলতো ‘ইউ ও মি থ্রি ফারদিংস।’ এরপর সে মেয়েটিকে দেখতে পেলো স্মৃতিস্তম্ভের বেদীতে দাঁড়িয়ে, স্তম্ভের সাথে ঘূর্ণায়মান একটি পোস্টার হয় পড়ছে, নয়তো পড়ার ভান করছে। কাছে ধারে আরও কিছু মানুষ জড়ো না হলে এখনই মেয়েটির কাছাকাছি যাওয়া অনিরাপদ। চারিদিকে ঝুল ছাদে বসানো রয়েছে বেশ কয়েকটি টেলিস্ক্রিন। ঠিক সেই মুহূর্তে ব্যাপক চিৎকার-চ্যাচামেচি শুরু হলো আর বাম দিক থেকে ভারি ভারি যানবাহন ছুটে আসতে লাগলো একের পর এক।
হঠাৎ সবাই স্কয়ারের চারিদিকে ছোটাছুটি শুরু করলো। মেয়েটি ক্ষীপ্রতার সাথে বেদীর সিংহমূর্তিগুলোর মাঝ থেকে ঘুরে ছুটন্ত মানুষগুলোর সঙ্গে যোগ দিলো। উইনস্টন তাকে অনুসরণ করলো। আর যখন দৌড়াচ্ছিলো তখনই অন্যদের কথা থেকে জানতে পারলো ইউরেশীয় কারাবন্দিদের একটি বহর যাবে এখান দিয়ে। ততক্ষণে স্কয়ারের দক্ষিণ দিকটা লোকে লোকারণ্য। এমন পরিস্থিতে উইনস্টন সাধারণত ভীড়ের বাইরের দিকটাতে থাকে, কিন্তু এখন সে ধাক্কাধাক্কি, ঠেলাঠেলি করে, শরীরখানা আকিয়ে-বাঁকিয়ে তবেই ভীড়ের ঠিক মাঝের দিকে ছুটছে। যখন মেয়েটির বাহুর নাগালে পৌঁছালো তখনই বাধা হয়ে দাঁড়ালো অতিকায় বপুর এক পুরুষ প্রোল, আর একই মাপের আরেক নারী প্রোল। মনে হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীই হবে। থলথলে মাংসের একটি দেয়াল হয়ে সামনে সামনে হাঁটছে এই প্রোল যুগল। একবার তার ইচ্ছা হলো দু’জনের পশ্চাৎদেশের নিচে পায়ের ফাঁক গলিয়ে সামনে চলে যায়, কিন্তু তার প্রয়োজন হলো না, দেয়াল ভেঙ্গে ঘাম ছুটিয়ে তবেই আবিষ্কার করলো তার পাশে এখন আর কেউ নয়, স্রেফ কালোকেশী। দুজনেই পাশাপাশি হাঁটছে, আর দুজনেরই দৃষ্টি সম্মুখে স্থির।
কাঠমুখো প্রহরীরা সাবমেশিনগান হাতে কোনায় কোনায় দাঁড়িয়ে। ট্রাকের একটি দীর্ঘ লাইন ধীরে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। ট্রাকগুলোতে ছোট ছোট হলদেটে চেহারার মানুষগুলো সবুজাভ ইউনিফর্মে উবু হয়ে ঠাসাঠাসি করে বসা। তাদের বিষাদময় মঙ্গোলীয় চোখগুলো আশেপাশে পড়ে আছে তাতে কৌতুহলের চিহ্নও নেই।
মাঝে মাঝে ট্রাকগুলো যখন ঝাঁকি খাচ্ছে তখন কয়েদীদের ধাতব ডান্ডাবেরিগুলো ঝন-ঝন শব্দ তুলছে। করুণ চেহারার কতগুলো মানুষে ঠাসা ট্রাকের পর ট্রাক পার হয়ে যাচ্ছে। উইনস্টন অবশ্য ওদিকটায় খুব একটা তাকালোও না। মেয়েটির কাঁধ ও কনুই কখনো কখনো তার কাঁধে ও হাতে এসে লাগছে। তার গাল এতটাই কাছে যে উষ্ণতা অনুভব করা যায়। তবে খুব দ্রুতই মেয়েটিই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিলো, ঠিক যেমনটি সে নিয়েছিলো ক্যান্টিনেও। একই অভিব্যক্তিশূন্য কণ্ঠে সে কথা শুরু করলো। ঠোঁটদুটি সামান্যই নড়ছে, বিরবির অনুচ্চ কণ্ঠ, শোরগোল আর ট্রাকের শব্দে যা সহজেই হারিয়ে যাচ্ছে।
– ‘তুমি কি আমায় শুনতে পাচ্ছো?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘রোববারের বিকেলটা ছুটি নিতে পারবে?’
– ‘পারবো।’
– ‘তাহলে মন দিয়ে শোনো। মনে রেখো। আমরা প্যাডিংটন স্টেশনের দিকে যাচ্ছি…’
সামরিক এলানের মতো বলে গেলো মেয়েটি। এতে হতবিহ্বল উইনস্টন। মেয়েটিই পথ বাতলে দিচ্ছে, তাকে স্রেফ অনুসরণ করে যেতে হবে।
-‘রেলে আধাঘণ্টা, স্টেশনের বাইরে বায়ে ঘুরলে উঠে যাওয়া একটি সুঁড়িখানার লাগোয়া দরজা, সেখানে ঢুকলেই মাঠের ভেতর দিয়ে একটি পথ বয়ে গেছে, ঘাস গজিয়ে উঠেছে সে পথে, এগুলেই জঙ্গলের মাঝ দিয়ে একটি আরেকটি হাঁটাপথ, সেখানে শ্যাওলা ধরা একটি মরা গাছ।’ বলার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছিলো পুরো মানচিত্র তার মস্তিষ্কে আাঁকা।
‘পুরোটা মনে থাকবে তো?’ জানতে চাইলো মেয়েটি।
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘প্রথমে বায়ে ঘুরবে, এরপর ডানে, এরপর ফের বায়ে। আর মনে রাখবে এখানে উপরের সুঁড়িখানাটি এখন আর নেই।’
– ‘ঠিক আছে। কখন?’
– ‘তিনটার দিকে। তোমাকে একটু অপেক্ষা করতে হতে পারে। আমি ভিন্ন পথে যাবো। তুমি কি নিশ্চিত যে সবকিছু ঠিকঠাক মনে থাকবে?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘তাহলে যত দ্রুত পারো আমার কাছ থেকে সটকে পড়ো।’
তাকে বলতে হতো না। কিন্তু তখনই ভীড়ের মধ্যে আলাদা হয়ে যাওয়াও সম্ভব ছিলো না। ট্রাকগুলো তখনও পার হচ্ছে, মানুষগুলো তখনও হা করে তা দেখছে। গোড়ার দিকে কিছুটা হিস-হাস শব্দ ছিলো, সেগুলো ভীড়ের মধ্যে যারা পার্টির সদস্য তাদের মুখ থেকেই বের হচ্ছিলো, সেটাও দ্রুতই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন যা টিকে আছে তা স্রেফ কৌতুহল। ইউরেশিয়া থেকে হোক কিংবা পূর্ব এশিয়া থেকে, বিদেশি মানেই যেনো অদ্ভুত কোনো জন্তু। এই কয়েদীর সাজ ছাড়া আর কোনো রূপে এদের কেউ কখনো দেখেনি। এমনকি কয়েদীদের দিকে একবারের বেশি দুইবার তাকায়নি। আর, যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যাদের ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে তাদের বাইরে অন্যদের কপালে কি ঘটছে তা তারা জানেও না। অন্যরা শুধুই উবে যাচ্ছে। নয়তো স্থান হচ্ছে জবরদস্তিমূলক শ্রমের ক্যাম্পে। গোলাকার চেহারাগুলো ময়লা, শশ্রুমণ্ডিত আর বিপর্যস্ত ইউরোপীয় রূপ নিয়েছে। ভাঙ্গা গালের ওপর গোলগোল বিষ্ফোরিত চোখগুলোর কোনো কোনোটির সাথে উইনস্টনের চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত গভীরতার সে চোখগুলো আবার নিমিষেই সরে যাচ্ছে। বহরটি শেষ হলো। শেষ ট্রাকটিতে তার চোখে পড়লো এক বৃদ্ধের ওপর। ধূসর চুলে তার মুখ ঢাকা, দুই কব্জি সামনের দিকে বাঁধা, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে। মনে হলো লোকটি যেনো এমন হাতবাঁধা অবস্থাতেই অভ্যস্ত। মেয়েটির কাছ থেকে উইনস্টনকে এখনই সরে যেতে হবে। কিন্তু শেষ মূহূর্তে, ভীড় তখনও তাদের ভেতরেই ঠেলছিলো আর সে বুঝতে পারলো তার হাতের ভেতর তখন মেয়েটির হাত। আস্তে আস্তে চাপ দিচ্ছে।
দশ সেকেন্ডের বেশি হবে না, কিন্তু তার মনে হলো কতনা দীর্ঘ সময় ধরেই যেনো তারা দুজন হাত ধরাধরি করে আছে। এরই মধ্যে তার হাতের প্রতিটি বিষয়ই যেনো সে জেনে নিয়েছে। লম্বা আঙুল, লম্বাটে নোখ, কাজের চাপে কিছুটা শক্ত তালু, কিণাঙ্ক, কব্জির নিচে পেলব মাংস।
অনুভূতি থেকে যতটা জেনে নিলো তা যেনো চোখে দেখে জানারই সমান। ঠিক তখনই তার মধ্যে একটা ভাবনা এলো, মেয়েটির চোখের রঙ কেমন তা তার জানা হয়নি। সম্ভবত ওগুলো বাদামী; তবে কালো চুলওয়ালাদের চোখ সাধারণত নীল হয়। মাথা ঘুরিয়ে মেয়েটির চোখ দুটি দেখে নেওয়া হবে ভীষণ বোকামি। এত মানুষের চাপাচাপিতে হাতে হাত ধরার দৃশ্য চোখে পড়বে না, কিন্তু তাকাতে গেলে ধরা পড়বে নিশ্চিত। তখনও তারা দুজনই স্থিরভাবে সামনে তাকিয়ে। তবে ততক্ষণে আর মেয়েটির চোখ নয়, উইনস্টনের মনের গভীরে ভেসে উঠলো সেই কয়েদীর মুখমণ্ডল ঢেকে থাকা চুলের ফাঁকগলিয়ে চোখে পড়া বিষাদময় দুটি চোখ।
অধ্যায় ২
গাছের শাখাতলে ফোঁটা ফোঁটা আলো আর ছায়ামাখা পথ ধরে হাঁটছে উইনস্টন। আর যেখানে শাখাগুলো দুই দিকে ছড়িয়ে সেখানে স্বর্ণসেতুতে পা ফেলে ফেলে এগুচ্ছে। বাঁয়ে বৃক্ষরাজির নিচে ধোঁয়াশা ছড়ানো মাটিতে ফুটে আছে নীলঘণ্টি (ব্লুবেলস) ফুল। মৃদুমন্দ হাওয়া চুমু খেয়ে গায়ে লেগে আছে। মে মাসের দ্বিতীয় দিন। বনের মাঝে আরও গভীর কোথাও থেকে ভেসে আসছে তিলা ঘুঘুর ডাক।
একটু আগেই এসে গেছে সে। পথে এতটুকু ঝামেলা হয়নি। মেয়েটির বর্ণনায় সবকিছু চোখে গাঁথা ছিল, ফলে স্বাভাবিক পথচলায় যেটুকু সংশয় থাকে এই পথে সে সংশয়ও সঙ্গী হয়নি। একটি নিরাপদ স্থানই বেছে নেওয়া হয়েছে সে ব্যাপারে মেয়েটির ওপরে ভরসা তার শতভাগ। লন্ডনের বাইরে গ্রামের দিকে একটু বেশি নিরাপদ, তেমনটা কেউ ভাবে না। টেলিস্ক্রিন নেই সে কথা ঠিক, কিন্তু গুপ্ত মাইক্রোফোন থেকে আপনার কথা রেকর্ড হয়ে যেতে পারে, চিনেও ফেলতে পারে, সে বিপদ পদে পদে। এছাড়াও একা একা যাবেন কিন্তু কারও নজরে পড়বেন না এমনটা হবার নয়। ১০০ কিলোমিটারের কম কোনও পথে যেতে হলে পাসপোর্ট এনডোর্স করা লাগে না, কিন্তু রেল স্টেশনগুলোতে টহলদারদের কড়া চোখ পড়ে থাকে। তারা পার্টি মেম্বারদের দেখে ফেললে আটকে দিতে পারে, ফালতু-অস্বস্তিকর প্রশ্নে জর্জরিতও করতে পারে। সে যাই হোক, উইনস্টনের পথে কোনও টহলদার বাধ সাধে নি, স্টেশন থেকে বের হওয়ার পর থেকেই পিছুপানে সতর্ক দৃষ্টি হেনে বারবারই দেখে নিয়ে নিশ্চিত হয়েছে, কেউ তার পিছুও নেয়নি।
ট্রেনে ঠাঁসাঠাঁসি করে যাচ্ছিল প্রোলরা, গ্রীষ্মের আবহাওয়ার ছোঁয়ায় তাদের মন ছিল ছুটির দিনের মত ফুরফুরে। কাঠের আসন পাতা যে বগিটিতে সে উঠেছিল, ওটি ঠাঁসাঠাঁসি হয়েছিল এক বিশাল পরিবারের সদস্যদের দিয়ে। ফোঁকলাদাঁতের প্রোপিতামহ থেকে শুরু করে এক মাসবয়সী শিশুটিও রয়েছে সে দলে। সবাই মিলে গ্রামে আত্মীয় বাড়ি যাচ্ছে বিকেলটা কাটিয়ে আসতে। আর এই ফাঁকে কালোবাজার থেকে কিছু মাখন নিয়ে আসবে সে কথাও উইনস্টন ওদের কাছ থেকেই জানতে পারে।
রাস্তাটি এখানে একটু চওড়া হয়েছে, এরপর মিনিটখানেক হাঁটতেই পায়ে চলা পথের কথা মেয়েটি বলে দিয়েছিল। দেখে মনে হলো জঙ্গল চিরে তৈরি এই পথে গবাদিরই গতায়ত চলে। তার কাছে ঘড়ি নেই, তবে এখনও তিনটা বাজেনি ধারণা করা যায়। নীলঘণ্টি ফুলেরা এখানে এতটাই ঘন হয়ে পথের মাঝে মাঝে ছড়িয়ে যে, কোনও কোনওটি পায়ের তলায় দলে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে উবু হয়ে ফুল তুলে নিচ্ছিল সে। সময়টাও কাটছে তাতে। তবে এও মনে ছিল, দেখা হলে এর একগোছা ফুল সে মেয়েটিকে দেবে। একসাথে বড় একগুচ্ছ পেয়ে গেল, নাকের কাছে টেনে মনমাতানো মৃদু গন্ধ নিচ্ছিল সে, ঠিক তখনই পেছনে একটি শব্দ পেয়ে শরীর বরফহীম হয়ে উঠল। আসলে উবু হওয়াতে নিজের পায়ের হাঁটু ভাঙার শব্দ সেটি। নীলঘণ্টি ফুল তুলতে তুলতে দুহাত ভরিয়ে ফেলল। মনে হচ্ছিল এতটা আহ্লাদভরে এমন কাজ আর কখনও করেনি। এবার মনে হলো মেয়েটিই বুঝি, অথবা হতে পারে কেউ পিছু নিয়ে পৌঁছে গেছে। মুখে বেচারা গোছের ভাব নিয়ে ঘুরে তাকাতে যাবে ঠিক তখনই কাঁধে একটি হাতের মৃদু স্পর্শ।
মুখ তুলে তাকাল সে। এবার মেয়েটি। মাথা ঝাঁকিয়ে চুপ থাকার জন্য ইশারা করল। জঙ্গল ঝোপঝাড় দুই হাতে দ্রুত দুদিকে সরিয়ে একটি সরুপথে তারা আরও ঘন জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়ছে। অবশ্যই এর আগেও এই পথে এসেছে মেয়েটি। সে কারণেই পায়ের নিচে নরম কাদামাটি এড়িয়ে অভ্যস্ত পায়ে এগুচ্ছিল। আর তার পায়ে পায়ে উইনস্টনও। দুই হাতে ধরে আছে ফুলগুলো। প্রথম অনুভূতিটি ছিল স্বস্তির, কিন্তু যখন সে দেখতে পেল একটি সরু দেহ বল্লরী তুলে সামনে সামনে চলছে, উজ্জ্বল লাল পরিকর কোমরে আঁটো করে বাঁধা থাকায় নিতম্বের ভাঁজ স্পষ্ট, তখন একটা হীনমন্যতা চেপে বসল তার ওপর। বাতাসের মিষ্টতা আর গাছের পাতার শ্যামলিমাই যেন তাকে হতোদ্যম করে দিল।
মে মাসের রৌদ্রে স্টেশন থেকে হেঁটে আসায় আগে থেকেই নিজেকে নোংরা, ঘিনঘিনে লাগছিল। সে যেন ঘরকুণো এক জন্তু, লন্ডনের নোংরা ধুলোয় যার ত্বকে ময়লার স্তর জমে আছে। তার মনে হলো এর আগে মেয়েটি তাকে দিনের প্রকাশ্য আলোয় খোলা আকাশের নিচে কখনওই দেখেনি। ভাবতে ভাবতে তখনই তারা সেই মৃত গাছটির কাছে পৌঁছাল, যেটির কথা মেয়েটি আগেই বলেছিল। গাছ ডিঙ্গিয়ে ঘন জঙ্গল সরিয়ে ঢুকে পড়ল সে, উইনস্টনও তার পিছু পিছু ঢুকল। আর আবিষ্কার করল প্রকৃতি এখানে কত সুচারুভাবে একটি ফাঁকা স্থান করে রেখেছে, যার চারিদিক ঘন জঙ্গলের বেড়া আর মাঝখানে তৃণাবৃত একটা ঢিঁবি। মেয়েটি চলা থামিয়ে ঘুরল।
‘আমরা পৌঁছে গেছি’—বলল সে।
একটু দূরত্বে থেকেই মেয়েটির দিকে তাকাল সে। তখনও কাছে ঘেঁষার সাহস কুলিয়ে উঠতে পারেনি।
‘পথে কথা বলতে চাইনি’—বলল মেয়েটি, ‘জানো তো পথে পথে গোপন মাইক পাতা থাকে। আমার মনে হয় না এখানে আছে, কিন্তু থাকতেও পারে। জঘন্য বস্তুগুলোর কোনও একটি ঠিক তোমার কণ্ঠস্বর চিনে ফেলবে। কিন্তু এখানে আমাদের কোনও সমস্যা নেই। ’
তখনও কাছে যেতে সাহস করছে না সে। ‘এখানে আমাদের কোনও সমস্যা নেই?’ বোকার মত একই উচ্চারণ তার।
‘হ্যাঁ, নেই। চেয়ে দেখ চারিদিকের গাছগুলো। ’
ছোট ছোট ধূসর বাকল আর শক্ত কাঠের অরণ্যবৃক্ষ। একদা এগুলো কেটে ফেলা হয়েছিল যা গুঁড়ি থেকে আবার গজিয়ে উঠেছে। একেকটি গাছ হাতের কব্জিসম মোটা হবে, ওগুলোই চারিদিকে ঘন খুঁটির জঙ্গল হয়ে আছে।
‘এখানে কোনও মাইক লুকিয়ে রাখার সুযোগ নেই, তাছাড়া আমি আগেও এসেছি। ’
একতরফাই কথা চালিয়ে যাচ্ছে মেয়েটি। ততক্ষণে সে তার কাছাকাছি ঘেঁষার একটু সাহস সঞ্চার করে নিয়েছে। মেয়েটি তখন তার ঠিক সামনে সটান দাঁড়িয়ে, মুখে মৃদুহাসি মেখে নিয়ে যেভাবে তাকিয়ে, তাতে তাকে কিছুটা বিস্মিতই ঠেকছিল, যেন তার জিজ্ঞাসা, এত নিস্তেজ কেন তুমি! মাটিতে মাদুর বিছিয়ে ছড়িয়ে আছে নীলঘণ্টি ফুল। ততক্ষণে ওরা আরও কাছাকাছি। মেয়েটির হাত হাতে তুলে নিল সে।
‘তুমি বিশ্বাস করবে, এ পর্যন্ত আমি তোমার চোখের রঙ কী জানতাম না’—বলল সে। নজরে এলো পিঙ্গল বর্ণের দুটি চোখ। ঠিক পিঙ্গল নয় যেন কালো পাপড়ির মাঝে পিঙ্গলের আবরণমাখা। ‘এবার তাহলে তুমি দেখলে আমি দেখতে ঠিক কেমন। কী মনে হচ্ছে আমার দিকে তাকানো যায়?’
‘হ্যাঁ, সহজেই। ’
‘আমার ৩৯। বিয়ে করেছিলাম, আলাদা থাকি কিন্তু মুক্তি মেলেনি। শরীরের ত্বকজুড়ে শিরাগুলো স্ফীত। গোটা পাঁচেক নকল দাঁত আছে। ’
‘ওতে কিছু আসে যায় না’—বলল মেয়েটি।
এইক্ষণে বলা মুসকিল কে আগে অন্যজনকে কাছে টেনে নিয়েছে, কিন্তু ততক্ষণ মেয়েটি উইনস্টনের বাহুতে। গোড়ার দিকে তার অনুভূতিতে বিস্ময় ছাড়া কিছু ছিল না। যৌবনবতী দেহখানি তার গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। ঘন কালোকেশে মুখ ঢাকা পড়েছে। আর হ্যাঁ! মেয়েটি তার মুখখানি উপরের দিকে তুলে রেখেছে, আর সে লাল ঠোঁটদুটো চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটি তার বাহুদুটি দিয়ে তার ঘাড় জড়িয়ে রেখেছে, আর কখনও প্রিয়তম, কখনও জীবনের অমূল্য পাওয়া আর ভালোবাসার পাত্র বলে সম্বোধন করে চলেছে। এবার মেয়েটি মাটিতে শুয়ে, কোনও কিছুতেই বাধা নেই তার, যা চাও নিয়ে নাও এমন অভিব্যক্তি। কিন্তু সত্য বলতে কি, কোনও শারীরিক উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে না উইনস্টনের; কেবল ওই জড়িয়ে রাখার ভালোলাগাটুকু ছাড়া। তার অনুভূতি জুড়ে সন্দেহ আর গর্ববোধের মিশ্রণ। যা কিছু ঘটে চলেছে তাতে সে আনন্দিত, কিন্তু তার শরীরের কোনও চাওয়া নেই। আর আচমকাই মেয়েটির যৌবন আর সৌন্দর্যের মাখামাখি তার ভেতরে ভয় ধরিয়ে দিল—মেয়েদের সান্নিধ্যছাড়া বসবাসেই অভ্যস্ত সে—কিন্তু ভীত হয়ে পড়ার কারণটি বুঝতে পারছে না। মেয়েটি উঠে বসল আর চুলের মধ্যে ঢুকে পড়া একটি নীলঘণ্টি ফুল টেনে বের করে আনল। মুখোমুখি বসে দুই বাহুতে কোমর জড়িয়ে ধরল।
‘কিছু মনে করো না, প্রিয়তম। তাড়াহুড়ার কিছু নেই। গোটা বিকেলটাই যে আজ এখানে কাটাব দুজন। তুমি কী বলো? লুকিয়ে থাকার জন্য অসাধারণ একটি জায়গা না? সেবার কমিউনিটি চাঙ্গা করার এক কর্মসূচিতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। তখন ঘুরতে ঘুরতে দেখা পাই এই জায়গাটির। কেউ যদি এসেও পড়ে তুমি অন্তত একশ’ মিটার দূর থেকেই শুনতে পাবে। ’
‘তোমার নাম কী?’ প্রশ্ন উইনস্টনের।
‘জুলিয়া। আমি কিন্তু তোমার নাম জানি। উইনস্টন… উইনস্টন স্মিথ। ’
‘কী করে জানলে?’
‘আমার ধারণা কোনও কিছু জেনে নিতে তোমার চেয়ে আমি একটু পটুই হব, প্রিয়তম। এবার আমায় বলো, সেদিন ছোট চিরকূটটি দেওয়ার আগে তুমি আমাকে নিয়ে কী ভাবতে?
মিথ্যা বলার কোনও চাপ অনুভব করল না সে। মনে হলো ভালোবাসার শুরুতেই ভয়াবহ কথাগুলো বলে ফেলা যায়।
‘তোমাকে দেখলেই আমার ভেতরে ঘৃণা জাগত’—বলল সে। ‘আমি চাইতাম, তোমাকে ধর্ষণ করে হত্যা করি। মাত্র দুটি সপ্তাহ আগেও আমার ইচ্ছা হচ্ছিল পাথর দিয়ে তোমার মাথাটি থেঁতলে দেই। তুমি যদি সত্যিই জানতে চাও, আমি বলতে পারি কল্পনা জুড়েই ছিল, তুমি আসলে থট পুলিশের কেউ হবে। ’
মেয়েটি হাসল, আনন্দ ছড়িয়ে ছড়িয়ে হাসল, যেন এই কথা বলার মধ্যে তার ছদ্মবেশের প্রতি এক ধরনের স্বীকৃতিই মেলে।
‘না থট পুলিশ না! তুমি আসলে সেটা ভাবতে, না?’
‘হ্যাঁ, সেটা হয়ত নয়। কিন্তু তোমার চেহারায়—বিশেষ করে তুমি যুবতী, ডাগর, আর স্বাস্থ্যবান, বুঝতেই পারো—আমি ভাবতাম সম্ভবত তুমি…’
‘তুমি ভাবতে আমি পার্টির ভালো সদস্যদের একজন। কথায় ও কাজে একদম খাঁটি। ব্যানারে, মিছিলে, স্লোগানে, খেলায়, কমিউনিটি চাঙ্গা করার কর্মসূচিতে সবখানে। আর তুমি এও ভাবতে সামান্য সুযোগ পেলেই আমি তোমাকে চিন্তা অপরাধী বলে নালিশ করে দেব, যাতে তোমাকে হত্যা করা হয়?’
‘হ্যাঁ ঠিক সেরকমই। অনেক যুবতী মেয়েই তো তেমন, তুমি ভালো করেই জানো। ’
‘যারা করে তারা হিংস্র’—বলল জুলিয়া।
আর বলতে বলতে কোমর থেকে জুনিয়র এন্টি সেক্সের লাল পরিকরটি একটি গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখল। এরপর কোমরে হাত রেখে যে মুখোভঙ্গি করল, তাতে মনে হলো কিছু একটা হঠাৎই মনে পড়ে গেছে। আলখেল্লার পকেটে জিনিসটির অস্তিত্ব টের পেল আর দ্রুতই বের করে আনল একটি চকলেট। অর্ধেক করে ভেঙ্গে এক টুকরো এগিয়ে দিল উইনস্টনের দিকে। চকলেটটি হাতে পাওয়ার আগেই এর ঘ্রাণ থেকে সে বুঝে নিল এটি সাধারণ কোনও চকলেট না। কালো চকচকে আর রুপালি কাগজে মোড়ানো। সাধারণ চকলেটগুলো ম্যাড়মেড়ে বাদামি রঙের আর মুখে দিলে ধোঁয়াটে গন্ধ আসে। কোনও এক সময় সেও এমন দারুণ স্বাদের চকলেট চেখে দেখেছে। গন্ধটা নাকে লাগার সাথে সাথেই তার স্মৃতিতে কিছু একটা নাড়া দিয়ে গেল কিন্তু সুনির্দিষ্ট করা গেল না। তবে বুঝল সেটি ছিল বড় কোনও ঘটনা আর ঝামেলারও।
‘পেলে কোথায়?’—প্রশ্ন উইনস্টনের।
‘কালোবাজারে’—উত্তর দিতে সময় নিল না সে। ‘আসলে আমি মেয়েই এমন। খেলাধূলায় ভালো। স্পাইজে আমি ট্রুপ লিডার। সপ্তাহে তিন সন্ধ্যা তুমি আমাকে জুনিয়র অ্যান্টি সেক্স লিগের স্বেচ্ছাসেবী কর্মসূচিগুলোতে পাবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি লন্ডনময় ওদের ফালতু পোস্টার সেঁটে বেড়াই। মিছিলের সামনে ব্যানারের এক কোণা ধরে তুমি আমাকেই পাবে। মুখে হাসি মেখে কোনও কিছুতেই না করি না। ভিড়ের মাঝে চিৎকার করি। আমি বলতে চাই, নিরাপদ থাকার এটাই একমাত্র পথ। ’
চকলেটের প্রথম অংশ উইনস্টনের জিভের ওপরেই গলে গেল। অসাধারণ স্বাদ। স্মৃতিটা এখনও তার চেতনার কিনারায় এসে গা ছুঁইয়ে চলে যাচ্ছে। অনুভব করছে কিন্তু কোনওভাবেই আকার দিতে পারছে না। ঠিক কোনও কিছু দৃষ্টি সীমায় পড়ে আবার যেমন হারিয়ে যায় তেমনই। মন থেকে বিষয়টি ঝেড়ে ফেলল, মাথায় রাখল এটি আসলে কোনও ঘটনার স্মৃতি যা ফিরিয়ে আনা যাবে, কিন্তু পারছে না।
‘তোমার বয়স কম’—বলল উইনস্টন। ‘আমার চেয়ে দশ-পনের বছরের ছোট হবে। আমার মত লোকের মধ্যে এমন কী দেখলে যা তোমাকের আকৃষ্ট করল। ’
‘তোমার চেহারার মধ্যে কিছু একটা আছে। আমার মনে হচ্ছিল একবার চেষ্টা করেই দেখি। যারা ওদের দলের নয় তাদের চিহ্নিত করতে ভীষণ পাকা আমি। তোমাকে প্রথম দেখেই ধরে ফেলি তুমি ওই শুয়োরগুলোর বিরুদ্ধে। ’
ওদের বলতে পার্টিকেই বোঝানো হলো, মোদ্যাকথা ইনার পার্টির সবাইকে। যাদের কথা সে খোলামনে তাকে বলে চলছে—তাতে উইনস্টন অস্বস্তিই বোধ করছে, যদিও সে জানে অন্য যে কোনও স্থানের চেয়ে এখানে তারা নিরাপদেই আছে।
মেয়েটির স্থূল কথাগুলো তাকে কিছুটা বিস্মিত করল। পার্টির সদস্যরা কটু-কাটব্য করে না, উইনস্টনের মুখ থেকেও কদাচই গালাগাল বের হয়। আর উচ্চস্বরে তো নয়ই। কিন্তু জুলিয়া যখনই পার্টির কথা বলছিল, বিশেষ করে ইনার পার্টির কথা, তখনই তার মুখ থেকে এমন সব শব্দ বের হচ্ছিল যা বস্তির গলি-ঘিঞ্জির দেয়ালেই লেখা থাকে কিংবা শোনা যায়।
উইনস্টনের বিষয়টি অপছন্দ হচ্ছে বলা যাবে না, বরং স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্যই মনে হচ্ছিল তার কাছে। পচা খড়কুটোয়ও ঘোড়ার যেমন অনাগ্রহ থাকে না ঠিক তেমনি। ওরা ফাঁকা জায়গাটি থেকে বের হয়ে এলো আগের সেই ঝোঁপঝাড় ভাঙা পথ ধরে। যেখানেই একটু প্রশস্ত পথ পাচ্ছে একে অপরের কোমরে হাত জড়িয়ে রেখে পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি করে এগুচ্ছে। উইনস্টন খেয়াল করল কী নরম কটিদেশ এই মেয়ের, লাল পরিকরটিও তখন আর বাঁধা নেই। তাদের মধ্যে যেভাবে কথা চলছে তাকে ফিসফিসানিই বলা চলে।
ফাঁকা জায়গাটির বাইরে গেলে চুপচাপ থাকাই ভালো, বলল জুলিয়া। একপর্যায়ে জঙ্গলের প্রায় কিনারার দিকে পৌঁছাল তারা। আর উইনস্টনকে থামাল সে।
‘এখনই খোলা মাঠের দিকে যেও না। কেউ নজরদারি করতে পারে। জঙ্গলের ভেতরে যতক্ষণ আছি, নিরাপদ আছি। ’
একটি ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়েছে তারা। সূর্যের আলো পত্র-পল্লবরাজি ভেদ করে চুইয়ে চুইয়ে পড়লেও তাদের গায়ে তা তপ্ত হয়েই লাগছে। উইনস্টন পেছনের খোলা মাঠটির দিকে তাকিয়ে। তার স্মৃতি মৃদু আঘাত হেনে বলছে এ জায়গাটি খুব চেনা চেনা। এবার ঠিক চিনে ফেলল। খরগোশের আঁচড়কাটা পুরোনো চারণভূমি, মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে পায়েচলা পথ। সারা মাঠ জুড়ে এখানে সেখানে ছুছুন্দরীর ছোট ছোট মাটি তোলা ঢিঁবি। মাঠের উল্টোদিকের শীর্ণ বেড়া ঘেঁষে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে দেবদারু গাছের পাতাগুলো মৃদুমন্দ বাতাসে ঝিরিঝিরি নড়ছে। নারীর চুল যেমন বাতাসে ওড়ে দেবদারুর পাতায়ও তেমন নাচন লেগে আছে।
এখান থেকে দেখা না গেলেও নিঃসন্দেহে কাছে ধারে কোথাও ধীর স্রোতে বয়ে চলা নদীর স্বচ্ছ সবুজ পানিতে মাছেরা সাঁতার কাটছে বলেই মনে হলো তার।
‘আশে পাশে কোথাও ছোট নদী বয়ে গেছে, তাই না?’ ফিসফিসিয়ে বলল উইনস্টন।
‘হ্যাঁ, একটি নদী আছে। ওই মাঠের ঠিক ওপার ঘেঁষেই। এতে অনেক মাছ, এত্ত বড় বড় ! উইলো গাছের নিচে গেলেই তুমি দেখতে পাবে মাছগুলো লেজ নেড়ে নেড়ে চলছে। ’
‘এটাই ঠিক সেই সোনালি দেশ’—বিড়বিড় করে বলল সে।
‘সোনালি দেশ?’
‘না কিছু না। প্রায়ই স্বপ্নে আমি এমন একটি ভূদৃশ্য দেখি। ’
‘ওদিকে দ্যাখো!’ ফিসফিসিয়ে উঠল জুলিয়া।
ওদের কাছেই একটি গাছের ডালে উড়ে এসে বসল একটি দোয়েল পাখি, ঠিক ওদের মুখ বরাবর। পাখিটি সম্ভবত ওদের দেখতে পায়নি। ওটির গায়ে হলদেটে রোদ পড়েছে আর ওরা ছায়ায়। একবার পাখা ঝাপটালো পাখিটি। ওরা দুজন তখন আরও নিঃশব্দ। এবার মাথা তুলে যেন সূর্যের আলোকে অভিবাদন জানালো পাখিটি আর অতঃপর মনের সুখে গান ধরল। বিকেলের নিঃশব্দে সে সুর হয়ে উঠল মোহময়। উইনস্টন আর জুলিয়া প্রবল আকর্ষণে নিজেদের আরও ঘন আলিঙ্গনে জড়িয়ে নিল। গানের সুর একটানা বেজেই চলেছে, মিনিটের পর মিনিট কেটে যাচ্ছে, আর দোয়েলটি তার গলায় ভাঁজছে একের পর এক মোহময় সুর যার একটির সঙ্গে অন্যটির মিল নেই। মনে হচ্ছিল, পাখিটি যেন আজ এই বিকেলে তার সুরের পাণ্ডিত্য ফলাচ্ছে। মাঝে মাঝে ক্ষণিকের বিরতি নিয়ে, পাখা ঝাপটিয়ে, পেলব পশমের বক্ষদেশ ফুলিয়ে শক্ত হয়ে গলায় শান দিয়ে আবার গানের সুরে ফেটে পড়ছে।
একটা অস্পষ্ট শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে পাখিটির গান গাওয়া দেখছিল উইনস্টন। কার জন্য, কেন গাইছে এই পাখি? তার কোনও সঙ্গী নেই, শত্রুও নেই যে দেখবে তার এই উদাস সুরে গাওয়া। কী কারণে এই নিঃসঙ্গ বনের কিনারে বসে অসীম শূন্যতাকে ভরে তুলছে গানে?
তার মনে এলো আশেপাশে কোথাও আদৌ কি লুকিয়ে পাতা রয়েছে কোনও মাইক্রোফোন। জুলিয়ার সঙ্গে তার কথাবার্তা চলছিল আরও মৃদুস্বরে, ফলে তাদের কথা ধরা পড়বে না, তবে দোয়েলের এই গান ঠিকই ধারণ হয়ে যাবে। হয়ত এই যন্ত্রের অন্যপাশে সারাক্ষণ কান পেতে থাকা কোনও এক বেটেখাটো মাছি-সদৃশ ব্যক্তির কানে পৌঁছে যাচ্ছে এই সুর। এই সুরের বন্যায় তার ভেতরের সকল অনুমান ভেসে যাচ্ছে। যেন এই সুর কোনও তরল বস্তুর মত তার গায়ে ঢেলে দেওয়া হচ্ছে আর তা মিশে যাচ্ছে এই পত্র-পল্লবের মাঝ থেকে চুইয়ে পড়া সূর্যালোকের সঙ্গে।
ভাবনা থামালো সে। আর অনুভব করতে লাগল, মেয়েটির যে কটিদেশ তার বাহুতে বন্দি, তা এখন আরও কোমল আরও উষ্ণ। মেয়েটিকে সে ঘুরিয়ে নিল, দুজন তখন বুকের সাথে বুক মিলিয়ে। ওর কোমল দেহটি যেন গলে গলে তার গায়ের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। যেখানেই হাত যায় কোমল পানির অনুভব। মুখ মুখে মিশে আছে তাদের, এর আগে যে কড়া চুম্বন তারা এঁকেছিল একে অপরের ঠোঁটে—এ যেন তার চেয়েও ভিন্ন কিছু। যখন ফের মুখ দুটি আলাদা হলো দুজনই যেন লজ্জা পেল। তখনই পাখিটি ডানা ঝাপটে উড়ে গেল দূরে।
উইনস্টন তার ঠোঁট ওর কানের কাছে নামালো। ‘এখন’—ফিসফিসিয়ে বলল সে।
‘এখানে না’—মেয়েটিও ফিসফিসাল। ‘চলো লুকোনোর জায়গাটিতে ফিরে যাই, ওখানটাই নিরাপদ। ’
দ্রততার সঙ্গে, জঙ্গল সরিয়ে সরিয়ে, সেই ফাঁকা স্থানে ছুটল তারা। আর সেই চারা গাছের চক্রের মধ্যে ঢুকে পড়তেই মেয়েটি ঘুরে তার মুখোমুখি দাঁড়াল। দু’জনেরই ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে, মেয়েটির মুখের কোণে সেই চেনা হাসিটি ফিরে এসেছে। তার চোখে চোখ রেখে সে দাঁড়িয়ে, তা এক লহমার জন্য। এরপর তার হাত আলখেল্লার জিপারে। আর হ্যাঁ! ঠিক এমনটাই ছিল সেই স্বপ্নে। এইক্ষণে দ্রুত যতটুকু স্মরণ করে নেওয়া যায়, মেয়েটি তার শরীর থেকে পরিধান ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলছে, আর যখন সেগুলো দুই দিকে তাচ্ছিল্যভরে ছুঁড়ে ফেলছিল তাতে গোটা সভ্যতাই যেন বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছিল। মেয়েটির নগ্ন শরীর সূর্যের আলোতে উজ্জ্বল রঙ ধরেছে। কিন্তু সেই মুহূর্তে তার চোখ শরীরে নয়; আটকে আছে মেয়েটির মুখের কোণায় লেগে থাকা হাসিতে। মেয়েটির সামনে হাঁটু গেড়ে বসল সে। ওর হাত দুটো তুলে নিল হাতে।
‘তুমি আগে কখনও করেছো?’
‘অবশ্যই। শতশত বার করেছি—না মানে, অনেকবার করেছি। ’
‘পার্টির সদস্যদের সঙ্গে?’
‘হ্যাঁ, সবসময়ই কোনও না না কোনও পার্টি-সদস্যই ছিল। ’
‘ইনার পার্টির সদস্যদের সঙ্গে?’
‘না এই শুয়োরদের সঙ্গে নয়। তবে সুযোগ দিলে এদের হিড়িক পড়ে যেত। যতটা ভাব করে ততটা পবিত্র আসলে ওরা নয়। ’
তার হৃদযন্ত্র ধক করে উঠল। অনেক অনেকবার সেও এই কাজ করেছে। তারও ইচ্ছা—শত শত কিংবা হাজার হাজারবারই হোক। দুর্নীতির আভাস মেলে এমন কিছু হলেই তার মধ্যে এই এক হিংস্র প্রত্যাশা জাগ্রত হয়। কে জানে, পার্টি হয়ত আসলে তলে তলে পচেই গেছে, এর কষ্টার্জিত প্রথা আর আত্ম অপহ্নব স্রেফ দুর্বলতা আর বদমায়েশি ঢেকে রাখার প্রতারণা মাত্র। সে যদি এদের সবাইকে বা অনেককেই কুষ্ঠ কিংবা যৌনব্যাধিতে সংক্রমণ করে দিতে পারত, তাহলে কতই না খুশি হতো। যা কিছুকে পচিয়ে দেয়া যায়, দুর্বল করে দেয়া যায়, খাটো করা যায়, করে দাও।
জুলিয়ার হাত ধরে টান দিয়ে নামালো; এখন তারা দুজনই হাঁটুভেঙ্গে মুখোমুখি।
‘শোনো যত পুরুষের সঙ্গে তুমি শুয়েছো, ততই বেশি আমি তোমায় ভালোবাসি। তুমি কি বুঝতে পারছো?’
‘হ্যাঁ, পুরোই বুঝে নিয়েছি। ’
‘আমি পবিত্রতায় ঘৃণা করি, আমি ভালোত্বে ঘৃণা করি! আমি চাই না কোন সদ্গুণ কোথাও টিকে থাক। আমি চাই সবাই হাড়ে হাড়ে বজ্জাত হয়ে উঠুক। ’
‘বেশ, তাহলে তোমার সঙ্গেই আমার মিল, প্রিয়তম। আমি এক হাড়ে হাড়ে বজ্জাত। ’
‘তুমি কি কাজটা করতে পছন্দ করো? আমি ঠিক স্রেফ আমার সঙ্গের কথা বলছি না, সার্বিকভাবে কাজটির কথা বলছি। ’
‘আগ্রহ আর ভক্তিভরেই কাজটি করি আমি। ’
ঠিক এমনটাই শুনতে চেয়েছিল সে। কারও সঙ্গে ভালোবাসার টানে নয়, পাশবিক তাড়নায়, স্রেফ অভিন্ন লালসায় কাজটি করবে, আর সেই শক্তিই পার্টিকে খান খান করে দেবে।
মেয়েটিকে চেপে ধরে ঘাসের ওপর শুইয়ে দিল সে, চারিদিকে ছড়িয়ে আছে নীলঘণ্টি ফুল। এবার আর কোনও বাধা নেই। এ পর্যায়ে তাদের বুকের ওঠানামা স্বাভাবিক গতি পেল আর দুজন আলাদা হয়ে শুয়ে পড়ল। সূর্যটা আরও তেজি হয়ে উঠেছে বলেই বোধ হচ্ছিল। ওদের দুজনেরই ঘুম ঘুম লাগছে। ছুঁড়ে ফেলা আলখেল্লাটি তুলে নিয়ে তার কিছু অংশ মেয়েটির গায়ের ওপর মেলে দিল। অনেকটা তখনই দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ল। আর প্রায় আধাঘণ্টা ধরে ঘুমোলো।
প্রথম ঘুম ভাঙল উইনস্টনের। উঠে বসল আর মেছতা পড়া মুখটির দিকে চোখ পড়ল, হাতের তালুতে বালিশ বানিয়ে তখনও শান্তির ঘুম তার। মুখের গড়নটি ছাড়া আর কোনও কিছুতেই তাকে আপনি সুন্দরী বলতে পারবেন না। একটু কাছে থেকে দেখলে চোখে পড়বে তার চোখের চারিদিকে দাগ পড়ে আছে। ছোট কালো চুলগুলো অস্বাভাবিকরকমই মোটা আর নরম। এবার মনে এলো, এখনও ওর ডাকনামটি জানা হয়নি, জানা হয়নি কোথায় থাকে সে।
ঘুমের মাঝে অসহায় যৌবনভরা এই শক্তসামর্থ শরীরখানা তার মধ্যে এক ধরনের করুণা জাগ্রত করল, যেন ওর সুরক্ষার দায়িত্ব তার। কিন্তু ঝোপের পেছনে দোয়েলের গান শুনতে শুনতে যে ভালোলাগাটুকু ছিল তা যেন আর পুরোপুরি ফিরে আসছে না।
পুরোনো দিনগুলোর কথা ভাবল সে, কোনও একটি পুরুষ একটি নারীর শরীরকে কামনার দৃষ্টি থেকেই দেখত, আর একেকটি কাহিনী কামনার তৃপ্তিতেই শেষ হতো। কিন্তু আজকাল আপনি আর নির্ভেজাল ভালোবাসা যেমন পাবেন না, নির্ভেজাল লালসাও তেমনি পাবেন না। এখন আবেগটাই খাঁটি, কারণ সবকিছুই আজ ভয় আর ঘৃণায় একাকার হয়ে গেছে। তাদের আলিঙ্গন ছিল এক যুদ্ধ, সঙ্গম ছিল সে যুদ্ধের জয়। এ ছিল পার্টির মুখে এক চরম আঘাত। আর নিঃসন্দেহে এ এক রাজনৈতিক কাজও বটে।
অধ্যায় ৩
‘আমরা এখানে আবারও আসতে পারি’—বলল জুলিয়া। ‘একেকটি গোপন স্থান দুইবার পর্যন্ত ব্যবহার চলে, তবে অবশ্যই এক-দুই মাসের মধ্যে না। ’
ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে ওর আচরণটাই কেমন পাল্টে গেল। বেশ সতর্ক মনে হচ্ছিল, আর ভাবখানা এমন যেন কাজের কথার বাইরে কোনও কথাই তার পছন্দ নয়। কাপড় গায়ে চরাল, লাল পরিকর কোমরে বেঁধে নিল, আর কথা পাড়ল কিভাবে ফেরা হবে তা নিয়ে। এ দায়িত্ব যেন ওর ওপরই বর্তানো। তার মধ্যে কিছু একটা বাস্তব বুদ্ধিতা আছে, যা উইনস্টনের নেই। আর লন্ডনের আশেপাশের সবকিছু নিয়ে তার জ্ঞানের পরিধি যে বিশাল তাও স্পষ্ট। কমিউনিটি চাঙ্গা করার অসংখ্য কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে এই অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরেছে সে।
যে পথে এসেছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত একটি ফেরার পথ বাতলে দিল তাকে, রেলস্টেশনটিও ভিন্ন। ‘যেই পথে বাইরে কোথাও যাবে সেই একই পথে কখনওই ঘরে ফিরবে না’—কথাটি এমন এক ভঙ্গিমায় বলল সে, যেন বাণী চিরন্তনীর কোনও এক গুরুত্বপূর্ণ নীতিবাক্য আওড়ালো। সে আগে যাবে, আর উইনস্টন ঘণ্টা আধেক অপেক্ষা করে বের হবে।
এই ফাঁকে কাজের শেষে অন্তত চারটি সন্ধ্যায় তাদের ঠিক কোথায় দেখা হতে পারে সেটাও জানিয়ে রাখল। গরীবদের আবাসন এলাকায় রাস্তার পাশের খোলাবাজারটি হবে তাদের পরের দেখা করার স্থান। সাধারণত লোকে লোকারণ্য হয়েই থাকে এই বাজার। বলে রাখল, ওখানে দোকানগুলোতে ঘুরে ঘুরে সে দেখতে থাকবে, যেন জুতোর ফিতে বা সুঁই-সুতো খুঁজছে। যদি তার মনে হয় পরিস্থিতি অনুকূলে, তাহলে উইনস্টন কাছে পৌঁছালেই নাকে শব্দ করবে, আর না করলে উইনস্টন থামবে না, না চেনার ভান করে তাকে অতিক্রম করে চলে যাবে। ভাগ্য সহায় হলে, ওই ভিড়-ভাট্টা আর শোরগোলের মধ্যে মিনিট পনের কথা বলে তারা পরের দেখা কোথায় হবে তা ঠিক করে নিতে পারবে।
‘এখন আমি যাই’—পুরো বিষয়টি উইনস্টন বুঝে নিতেই বলল সে। ‘আমাকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার মধ্যে পৌঁছতে হবে। জুনিয়র এন্টি-সেক্স লিগের কাজ আছে। লিফলেট বিতরণসহ আরও কিছু কাজে রাতেই ঘণ্টা দুয়েক সময় দিতে হবে। তুমি আমার চুলগুলো একটু দেখ তো কিছু আটকে আছে কিনা? নিশ্চিত বলছো? তাহলে বিদায়, প্রিয়তম, বিদায়!’
একথা বলেই উইনস্টনের বাহুতে ঝাপিয়ে পড়ল সে, সহিংস একটা চুমু বসাল তার মুখে, আর পরমুহূর্তেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চারাগাছের ভেতর দিয়ে গভীর জঙ্গলে অনেকটা নিঃশব্দে হারিয়ে গেল। এত কিছু হয়ে গেল, কিন্তু মেয়েটির ডাক নামটি জানা হলো না, জানা গেল না তার ঠিকানাও। তাতে অবশ্য কিছু আসে যায় না, কারণ তাদের কখনওই গৃহমাঝে দেখা হবে কিংবা চিঠি লিখে হবে কোনও ভাব বিনিময়—এমনটা হবার নয়।
বাস্তবে যা ঘটল, জঙ্গলের গভীরের ওই ফাঁকাস্থানে তাদের আর যাওয়া হয়নি। গোটা মে মাসে তারা আর মাত্র একবারই ভালোবাসাবাসি করার সুযোগ পেয়েছে। তা অন্য এক গোপন স্থানে, আর সেটিও ছিল জুলিয়ারই চেনা। গ্রামের দিকে অনেক নির্জন এলাকায়, বিধ্বস্ত একটি গীর্জার ঘণ্টিঘরে। বছর ত্রিশেক আগে ওই এলাকায় একটি আনবিক বোমা ফেলা হয়েছিল। গোপন স্থান হিসেবে অসাধারণ, তবে তা কেবল জায়গামত পৌঁছানোর পরেই। কিন্তু পৌঁছানোর পথটি ভয়াবহ বিপদের। এর বাইরে তাদের মাত্র দুই দফা দুটি ভিন্ন সড়কে সন্ধ্যার দিকে দেখা হয়েছে। আর, কোনও দেখাতেই আধাঘণ্টার বেশি সময় একসঙ্গে থাকা সম্ভব হয়নি। রাস্তায় কথা বলা চলে, কিন্তু মন ভরে না। যখন ওরা কোনও ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তখন খুব যে পাশাপাশি থাকা যায়, তাও নয়। আর একজন অন্যজনের দিকে তাকায়ও না।
এরই মধ্যে তাদের কথাবার্তা এগোয় যা বাতিঘরের আলোর মত এই চলে এই বন্ধ হয়ে যায়। দলের ইউনিফর্ম পরা কারও দেখা পেলে কথা বন্ধ, কাছাকাছি টেলিস্ক্রিন থাকলে তো কথাই নেই। আবার যখন কয়েক মিনিট পরে কথার সুযোগ মেলে তখন আগের বাক্য যেখানে শেষ সেখান থেকেই শুরু হয়। আর এভাবে পরের দিন যখন দেখা হয় তখন আগের দিন যেখানে শেষ হয়েছিল সেখান থেকে কথা শুরু হয়। জুলিয়াকে মনে হয় এভাবে কথা বলায় বেশ অভ্যস্ত সে। এর একটা নামও দিয়েছে—‘কিস্তিতে কথা বলা’।
মেয়েটির আরেকটি অদ্ভুত দক্ষতারও পরিচয় মিলল। ঠোঁট না নাড়িয়ে অবিরাম কথা বলতে পারে সে। এভাবেই প্রায় একমাস দেখাদেখির পর স্রেফ একবার তারা একটি চুমু বিনিময় করতে পেরেছিল। সে রাতে ওরা একটি পার্শ্ব-সড়কে নীরবে হাঁটছিল (মূলসড়কে না থাকলে জুলিয়ার মুখ থেকে একটি শব্দও কখনও বের হয় না) তখনই কানে তালা লাগানো ভীষণ গর্জন শোনা গেল। মাটি কেঁপে উঠল, চারিদিক অন্ধকার হয়ে এলো। উইনস্টনের যখন সম্বিত ফিরল দেখল মাটিতে শুয়ে, কুঁকড়ে আছে, গা-ভর্তি আঘাতের ব্যথা। নিকটেই কোথাও রকেট বোমা পড়েছে। ঠিক তখনই কয়েক সেন্টিমিটারের মধ্যেই জুলিয়ার মুখটি দেখতে পেল সে, মৃত-সাদা রঙ ধরে আছে, যেন মুখটিতে চক ঘষে দেওয়া হয়েছে। এমনকি ওর ঠোঁট দুটোও সাদা। মনে হলো, মেয়েটি কি মরেই গেল! কাছে টেনে আনলো তাকে, আর আবিষ্কার করল সে এক জীবন্ত উষ্ণ ঠোঁটেই চুমু দিচ্ছে। এতে মেয়েটির ঠোঁটেও লেগে গেল সাদা পাউডারের মত কিছু একটা। আসলে তাদের দুজনেরই চেহারা পলেস্তারার ধুলোয় ঢেকে গিয়েছিল।
অনেক সন্ধ্যা গেছে, ওদের দেখা হয়েছে, পাশাপাশি দুজন হেঁটেছে দীর্ঘসময়, কিন্তু টহলদারদের আনাগোনা কিংবা মাথার ওপর হেলিকপ্টারের চক্করের কারণে সংকেতটি পর্যন্ত বিনিময় হয়নি। বিপদ যদি একটু কমও থাকে, দেখা করার সময় মিলিয়ে নেওয়া হয়ে পড়ে ভীষণ কঠিন। উইনস্টনের সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা ষাট, জুলিয়ার আরও বেশি। আজ ওর কাজের চাপ থাকে তো অন্যদিন উইনস্টনের। খুব কমই এমন হয়, একসঙ্গে দুজনের ফুসরত মেলে। বিকেলটা পুরো ফাঁকা, এমনটা জুলিয়ার ক্ষেত্রে প্রায় হয়ই না। বক্তৃতা আর বিক্ষোভের কর্মসূচিগুলোতে বিস্ময়করভাবে বেশি সময় দেয় সে। এছাড়াও জুনিয়র এন্টি-সেক্স লিগের লিফলেট-বইপত্র বিলি, ঘৃণাসপ্তাহের ব্যানার বানানো, সঞ্চয় বিষয়ক প্রচারাভিযানের জন্য চাঁদা তোলা, এমন হাজারো কাজের কাজী সে।
এর একটা মূল্য আছে, বলে সে, বলে এটাই সেরা কপটাবেশ। ছোট ছোট নিয়মগুলো যদি তুমি খুব করে মেনে চল, বড় নিয়মগুলো তখন অনায়াসে ভাঙতে পারবে। উইনস্টনকেও সে একটি সন্ধ্যায় বাড়তি কাজে লেগে পড়তে বাধ্য করেছে। গোলাবারুদের হিসাব রাখার এই কাজ পার্টির হিংসুটে স্বেচ্ছাসেবকরাই কেবল করতে চায়। সুতরাং সপ্তাহের একটি বিকেলের চার ঘণ্টা তাকে নিতান্তই অনিচ্ছায় অকেজো বোমা আর গোলাবারুদের ভাগাড়ে সামান্য আলোর খসখসে পরিবেশে কাজ করতে হয়, যেখানে টেলিস্ক্রিনের সঙ্গীত আর হাতুড়ি পেটার ঠক ঠক শব্দ একাকার হয়ে থাকে।
বিধ্বস্ত গির্জার সেই ঘণ্টাঘরে যেদিন দেখা হলো, সেদিন তারা এই অভিব্যক্তিহীন কথপোকথনের নির্যাস থেকে বুঝে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় যেটুকু ঘাটতি থেকে গেছে তা পূরণ করে নেয়। জ্বলজ্বলে রোদের এক বিকেল ছিল সেটি। ঘণ্টিঘরের বর্গাকার খুঁপড়িতে বাতাস যেন থমকে ছিল, আর ভীষণ তপ্ত। সঙ্গে মিশে ছিল কবুতরের বিষ্ঠার তীব্র গন্ধ। ধূলিমাখা, পাখির বিষ্ঠাভরা মেঝেতে বসে ওরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে কাটিয়ে দেয়। একটু পরপর একেকবার একেক জন মাথা তুলে অ্যারোস্লিটের ছিদ্রপথে চোখ ফেলে দেখে নিচ্ছিল, কেউ এসে যায় কিনা।
জুলিয়ার এখন ২৬। আরও গোটা ত্রিশেক মেয়ের সঙ্গে একটি হোস্টেলে থাকে (সর্বদাই নারীর বোঁটকা গন্ধের মাঝে বাস! নারীকে ঘৃণা করিই কী করে! কথার মাঝে লঘুবন্ধনী দিয়ে টেনে টেনে বলল সে)। আর তার অনুমানই সত্য, ফিকশন ডিপার্টমেন্টে উপন্যাস লেখার মেশিনে কাজ করে সে। নিজের কাজ তার খুব পছন্দ, মজাও পায়। একটি বিশাল বৈদ্যুতিক যন্ত্র চালানো আর ঠিকঠাক করাই তার কাজ। যন্ত্রগুলোর সঙ্গে কাজ করার সময় হাতে কালি-ঝুলি লাগাতে সে ভালোই বোধ করে। একেকটি উপন্যাস কম্পোজ করা থেকে শুরু করে প্ল্যানিং কমিটি যে সাধারণ নির্দেশনাগুলো দেয় তা আর পুনর্লেখক দল যেভাবে তা চূড়ান্ত করে তার প্রতিটি ধাপে ধাপে কাজের ফিরিস্তি তার জানা। তবে এই নিখুঁত পণ্যে তার কোনও আকর্ষণ নেই। এগুলো পড়ার ব্যাপারেও নেই কোনও আগ্রহ। পাউরুটির জ্যাম বা জুতোর ফিতার মত একটি পণ্য ছাড়া বইকে আর কিছুই মনে করে না সে।
ষাটের দশকের গোড়ার দিককার আগের কোনও স্মৃতিই তার নেই। একটি মাত্র লোককে সে বিপ্লবের আগের দিনগুলোর কথা খুব বলতে শুনত, সে তার দাদাভাই। তার যখন আট বছর তখনই দাদু হাপিস হয়ে যান। স্কুলে হকি দলের অধিনায়ক ছিল সে আর পরপর দুবছর শরীর চর্চায় ট্রফি জিতেছিল। স্পাইজে দলনেতা ছিল আর জুনিয়র এন্টি-সেক্স লিগে যোগদানের আগে ইয়ুথ লিগে শাখা-সচিবের পদে ছিল। দক্ষ হিসেবে অত্যন্ত সুনামের কারণে তাকে একবার ফিকশন বিভাগের উপ-বিভাগ পর্নোসেকেও কাজ দেওয়া হয়েছিল। সস্তা পর্নোগ্রাফি বানিয়ে প্রোলদের মাঝে বিতরণই যার কাজ। উপ-বিভাগটিতে যারা কাজ করে ওরা এর নাম দিয়েছে গোবর-ঘর (মাক হাউজ)। ওখানে এক বছর কাজ করেছিল। ‘পাছা চাপড়ানোর গল্প’ ‘মেয়েদের স্কুলে এক রাত’ ধরনের নাম দিয়ে বুকলেট বানিয়ে সিল করা প্যাকেটে ভরে তা যুবক প্রলেতারিয়েতদের জন্য কিনে ফেলার নাগালের মধ্যে পাঠানো নিশ্চিত করাই কাজ। আর যেন অবৈধ কিছু একটা কিনছে এমন একটা মনোভাব নিয়েই তারা এগুলো হরদম কেনে।
‘বইগুলো আদতে কেমন?’—কৌতূহলের প্রশ্ন উইনস্টনের।
‘আরে ভীষণ ফালতু। সত্যিকার অর্থেই বিরক্তিকর। মোটে ছয় পাতার কিন্তু ওগুলোই ওদের বড় বাণিজ্য। আমি কেবল কেলিডোস্কোপে কাজ করতাম। পুনর্লেখকদের দলে ছিলাম না। ওসব পর্নোসাহিত্য আমার আসে না, প্রিয়তম—আর ওজন্য ঠিক আমি নই। ’
বিস্ময়ের সাথে সে আরও জানলো এই পর্নোসেকে যারা কাজ করে তাদের কর্তাব্যক্তিরা ছাড়া সবাই তরুণী। তত্ত্বটা হচ্ছে, নারীদের চেয়ে পুরুষদের যৌনাকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণক্ষমতা কম। আর সে কারণে যে ঘিনঘিনে বিষয় নিয়ে তাদের কাজ করতে হয় তাতে তাদের নিজেদের জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে।
‘ওরা এমনকি বিবাহিত নারীদেরও নিতে চায় না, বলল জুলিয়া। মেয়েদের সবসময় এতটাই খাঁটি হয়ে থাকতে হবে। তবে, এখানে অবশ্য একজন আছে যে মোটেই খাঁটি নয়। ’
ওর প্রথম প্রেম হয় ষোল বছর বয়সে। প্রেমিকটি পার্টির সদস্য ছিল, বয়স ষাট। পরে গ্রেফতার এড়াতে আত্মহত্যা করে সে। ‘ঠিক কাজটিই করেছে’—বলল জুলিয়া, ‘নয়ত ওর স্বীকারোক্তি থেকেই ওরা আমার নামটি জেনে যেত। ’ এরপর আরও বেশ কয়েকটি প্রেম হয়েছে। জীবনটাকে সে সহজ করেই দেখে।
তুমি একটি ভালো সময় কাটাতে চাও তো; ‘ওরা’—মানে পার্টি চাইবে তোমাকে থামিয়ে দিতে; সুতরাং তুমি নিয়মগুলো ভাঙ্গো, যত পার তত ভাঙ্গো। বিষয়টিকে সে স্রেফ এমন করেই ভাবতে চায়, ‘ওরা’ তোমার আনন্দ ছিনিয়ে নিতে চাইছে, অতএব তুমি যা খুশি করে যাও, তবে গ্রেফতার এড়িয়ে। দলকে সে ঘৃণা করে, আর সে ঘৃণার প্রকাশ ঘটাতে সবচেয়ে ঘৃণিত শব্দগুলোই ব্যবহার করে। তবে তার মুখে সস্তা ও সাধারণ সমালোচনাগুলো শোনা যাবে না। তার নিজের জীবনে প্রভাব না ফেললে পার্টির কোনও মতবাদেই তার আপত্তি বা আগ্রহ নেই। উইনস্টন দেখেছে, দৈনন্দিন ব্যবহারে মিশে গেছে এমন কিছু শব্দ ছাড়া নিউস্পিকের ব্যবহার নেই জুলিয়ার কথা-বার্তায়। ব্রাদারহুডের নাম সে কখনওই শোনেনি, আর এর অস্তিত্ব আদৌ আছে বলে বিশ্বাসও করতে চায় না। পার্টির বিরুদ্ধে যে কোনও বিদ্রোহই হোকনা কেন—তা ব্যর্থ হতে বাধ্য, আর তা বোকামি ছাড়া কিছুই হবে না, এমনটাই মনে করে সে। সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে, এই সব নিয়মের মধ্যে থেকেই নিয়ম ভেঙ্গে চলা।
উইনস্টনের জানতে ইচ্ছা করে, এই মেয়েটির মত আরও কতজন আছে এই তরুণ প্রজন্মে যারা বিপ্লবের বিশ্বেই বড় হয়ে উঠেছে, আর পার্টিকে বদলানো যাবে না, আকাশসম পার্টির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাও যাবে না—এমন মনোভাব পোষণ করে অথচ তারাও এর নীতিকে ধোকা দিয়ে চলেছে, ঠিক খরগোশ যেমন কুকুরকে ধোকা দেয়।
দুজনের মধ্যে বিয়ের সম্ভাবনা নিয়ে ওদের কোনও কথা হয়নি। এমন একটি বিষয় তখন ভাবনায় আনার চেয়েও অনেক দূরের। কোনও কাল্পনিক কমিটিও এমন একটি বিয়ে মেনে নেবে না, এমনকি উইনস্টনের স্ত্রী ক্যাথরিন যদি তার থেকে মুক্ত হয়েও যায়, তারপরেও না। দিবাস্বপ্নের মতই অসাড় সে ভাবনা।
‘ও দেখতে কেমন ছিল, তোমার স্ত্রী?’—বলল জুলিয়া।
‘ও ছিল—নিউস্পিকে একটা শব্দ আছে না… গুডথিংকফুল? মানে হচ্ছে প্রকৃতঅর্থেই শুদ্ধাচারী, খারাপ কিছু ভাবতেও পারে না। ’
‘না, শব্দটি আমার জানা নেই, তবে আমি এ ধরনের মানুষদের চিনি, খুব ভালো করেই চিনি। ’
জুলিয়াকে বিবাহিত জীবনের গল্প শোনাতে লাগল উইনস্টন, তবে কৌতূহল উদ্রেক করার মত করে, সেই বরং উল্টো বেশি কথা বলল, এমন সব কিছু বলল যেন আগে থেকে মূল মূল দিকগুলো তারা জানা। জুলিয়াই তাকে বর্ণনা করল, যেন সবই সে দেখেছে কিংবা অনুভব করেছে। তার ছোঁয়া পেলে ক্যাথরিনের শরীরটা কিভাবে শক্ত হয়ে যেত, কিভাবে সে সর্বশক্তি দিয়ে তাকে দূরে ঠেলত—এগুলোই বলে যাচ্ছিল, নিজের দুই বাহু দিয়ে উইনস্টনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেই এসব বলছিল। জুলিয়ার সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলতে কোনও অস্বাভাবিকতা বোধ করছিল না সে, ক্যাথরিন তার জীবনের এক ব্যথাতুর স্মৃতি, আর বিস্বাদময় এক নাম।
‘এরপরও সব মেনে নেওয়া যেত যদি একটি বিষয় সামনে না আসত’—বলল সে। সে তাকে জানালো, প্রতি সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট রাতে ক্যাথরিন যেভাবে তাকে বাধ্য করত কাজটি করতে। ‘ও কাজটি ঘৃণা করত, কিন্তু কোনভাবেই কাজটি না করার কথা মেনে নিত না। ও বলত… তুমি ধারণাও করতে পারবে না কি বলত। ’
‘পার্টির প্রতি আমাদের কর্তব্য’—দ্রুতই বলল জুলিয়া।
‘তুমি কী করে জানলে?’
‘আমিও স্কুলে পড়েছি, প্রিয়তম। ষোল বছরের বেশি বয়সীদের জন্য মাসে একদিন যৌনতা বিষয়ক আলোচনা শুনতে হতো। আর যুব আন্দোলনেও রয়েছে এ বিষয়ক আলোচনা। ওরা বছরের পর বছর ধরে তোমার ভেতরে কথাগুলো ঢুকিয়ে দেয়। আমি বলব অনেক ক্ষেত্রেই এই প্রচেষ্টা সফল হয়। তবে তুমি কখনওই বলতে পারবে না, লোকেরা এতটাই কপট। ’
বিষয়টি নিয়ে কথা টেনে বাড়ালো জুলিয়া। ধীরে ধীরে আলোচনা যৌনাচার নিয়ে তার নিজের ভাবনার দিকে মোড় নিল। আর এ প্রসঙ্গ আসতেই তার কথার ধারও বাড়লো। উইনস্টন না পারলেও, পার্টির যৌনতা বিষয়ক শুদ্ধিবাদের ভেতরের অর্থটা সে ঠিকই ধরতে পারে। যৌনাচার মানুষকে একটি ভিন্ন জগতে নিয়ে যায় যেখানে পার্টির নিয়ন্ত্রণ চলে না, আর সে কারণে যৌনতাকেই বিলুপ্ত করে দিতে হবে, বিষয়টি স্রেফ এমন নয়। এর চেয়েও বড় গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, যৌনতার অপ্রাপ্তি এক ধরনের স্নায়ুবৈকল্য সৃষ্টি করে, আর সেটাই কাম্য, কারণ এই বৈকল্যই তখন যুদ্ধ-জ্বর আর নেতৃত্বের স্তুতিতে কাজে লাগে। কথাগুলো ঠিক এভাবে বলল সে:
‘যখন তুমি ভালোবাসাবাসি করছো, তোমার শক্তি খরচ হচ্ছে, আর কাজটি করার পরে এক ধরনের খুশি খুশি বোধ করছো, তখন কোনও কিছুতেই তুমি আর বিক্ষুব্ধ হবে না। কিন্তু তোমার এমন অনুভূতি ওরা ঠিক মেনে নিতে পারে না। ওরা চায় তুমি সবসময়ই তোমার শক্তি ধরে রাখো। এইসব উপর-নিচে ছোটাছুটি, খুশিতে পতাকা ওড়ানোর মধ্য দিয়ে যৌনতা তোমার কাছে টক টক লাগুক। কিন্তু ভালোবেসে তুমি যদি নিজেই ভিতরে ভিতরে খুশি বোধ করতে থাকো তখন বিগ ব্রাদারকে নিয়ে, ত্রি-বার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে, দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচি নিয়ে এবং ওদের এমন আরও সব ফালতু বিষয় নিয়ে তোমার উত্তেজনা বোধ করার ফুসরতই থাকবে কোথায়?
কথাগুলো খুব সত্য, ভাবল সে। কৌমার্য আর রাজনৈতিক শুদ্ধিবাদের মধ্যে সরাসরি একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। কিন্তু প্রশ্ন, এই যে সদস্যদের সঠিক পথে রাখতে তাদের মধ্যে ভীতি, ঘৃণা আর নির্বোধের আনুগত্য চাওয়া হচ্ছে তা পার্টির জন্য কতটাই আর চালিকাশক্তি হয়ে থাকবে? যৌনতায় আগ্রহ দলের জন্য বিপজ্জনক, আর দল তা নিয়ন্ত্রণেও নিতে পেরেছে।
একই ধরনের কৌশল তারা নিয়েছে পিতৃ-মাতৃত্বের অভিব্যক্তিতে, মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কে। পরিবার ব্যবস্থা পুরোপুরি বিলোপ করে দেওয়া হচ্ছে না। বরং চাওয়া হচ্ছে বাবা-মা যেন তাদের সন্তানদের প্রতি স্নেহবাৎসল্যের সেকেলে মনোভাবটাই বহাল রাখেন। আর অন্যদিকে শিশুদেরকে অত্যন্ত প্রক্রিয়াগতভাবে করে তোলা হচ্ছে বাবা-মায়ের বিরোধী। মা-বাবার ওপর চরগিরি করে তাদের গোপন অসন্তোষ বা ব্যত্যয় থাকলে রিপোর্ট করে দেবে, এটাই শিক্ষা তাদের। এতে পরিবারগুলো হয়ে উঠছে থট পুলিশের বর্ধিতাংশ। এ এমন ব্যবস্থা যেখানে প্রতিটি মানুষ দিবা-রাত্রি প্রতিটি ক্ষণই চর পরিবেষ্টিত। যাদের তারা চেনে কিন্তু কিছুই বলতে পারে না।
হঠাৎই তার মনে আবার ভর করল ক্যথরিন। ক্যাথরিন যদি বোকা না হতো, তাহলে তার এসব অশুদ্ধবাদী মতগুলো ধরে ফেলত আর প্রশ্নাতীত ভাবেই তা থট পুলিশে জানিয়ে দিত। তবে এই মুহূর্তে তাকে মনে পড়ার সত্যিকারের কারণ এই বিকেলের খরতাপ, যা তার কপালে জমিয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। যে ঘটনাটি ঘটেছিল, বরং বলা যায় ঘটতে গিয়েও ঘটতে পারেনি, সেটিই এখন জুলিয়াকে বলতে শুরু করেছে সে। এগারো বছর আগে সেটিও ছিল এমনই এক ঘাম ঝড়ানো বিকেল।
বিয়ে হয়েছে তখন মোটে তিন-চার মাস হবে। কেন্টের দিকে কোনও একটি এলাকায় কমিউনিটি চাঙ্গা করার কর্মসূচিতে গিয়ে দুজনই পথ হারিয়ে ফেলে। দলের অন্যদের চেয়ে মিনিট কয়েক পিছিয়ে পড়েছিল। কিন্তু একটা ভুল বাঁক নিয়ে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দুজন। আর এক পর্যায়ে আবিষ্কার করে পুরোনো একটি চুনা পাথরের কোয়ারির পাশে দিয়ে যাচ্ছে তারা। দশ কিংবা বিশ মিটার নিচে বড় বড় পাথর দেখা যাচ্ছে। আশেপাশে কারও দেখা মিলছে না যে পথ জানতে চাইবে।
হারিয়ে গেছে এটা বুঝতে পেরে ক্যাথরিন বেশ অস্বস্তি বোধ করছিল। ভিড়-ভাট্টার বাইরে, এমনকি দলের সদস্যদের জটলার বাইরে গেলেই ওর মধ্যে একটা অপরাধ বোধ কাজ করতে থাকে। কত দ্রুত ফেরা যায় সেই ভাবনায় এদিক সেদিক পথের খোঁজ করছিল। তখনই উইনস্টনের চোখে পড়ল পাথরের ফাটল ফুঁড়ে গজিয়ে ওঠা গাছে গুচ্ছগুচ্ছ ঘাসফুল ফুটে আছে। একগুচ্ছ ফুলে আবার দুটি রঙের মিশ্রণ, কতকটা টকটকে লাল আর বাকিটা ইটরঙা যা একই মূল থেকে গজিয়ে গাছে ধরে আছে। এমনটা আর কখনওই চোখে পড়েনি তার। সে ক্যাথরিনকে ডাকল ফুলগুলো দেখার জন্য।
‘দ্যাখো ক্যাথরিন! এই ফুলগুলো দ্যাখো। ওগুলো একই মূল থেকে গজিয়ে উঠেছে। তুমি দেখতে পাচ্ছো, ফুলগুলোর যে দুটি ভিন্ন রঙ?’
ততক্ষণে ক্যাথরিন চোখ ঘুরিয়ে ফিরে যেতে ধরেও আবার ঘুরল, তবে চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ। তারপরেও সে পাথরের ফাটলটির দিকে তাকাল আর ঝুঁকে পড়ে দেখার চেষ্টা করছিল কী সে দেখাতে চাইছে। উইনস্টন ঠিক তার পেছনটাতে দাঁড়ানো। ক্যাথরিন যাতে পড়ে না যায় সে জন্য দুই হাতে তার কোমর ধরে রাখল। তখনই তার মাথায় এলো, কী দারুণ একা এখানে তারা দুজন। চারিদিকে কোনও মানবসন্তানের অস্তিত্ব নেই, একটি গাছের পাতাও নড়ছে না, এমনকি নেই কোনও পাখির ডাকও। এমন একটি স্থানে গোপন মাইক্রোফোন বসানো থাকার সম্ভাবনাও ক্ষীণ, আর যদি মাইক্রোফোন থাকেও তা শব্দই কেবল ধারণ করবে, আর কিছু নয়। প্রচণ্ডতম গরমে স্থির হয়ে থাকা এক বিকেল। তার মুখমণ্ডলেও জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আর তখনই আরেকটি ভাবনা এসে মনের গহীনে আঘাত হানলো…
ওকে ধরে একটা ধাক্কা দিলে না কেন?’—প্রশ্ন জুলিয়ার। ‘আমি হলে দিতাম। ’
‘হ্যাঁ প্রিয়তমা, তুমি হলে দিতে। আমিও দিতাম, যদি আমি ঠিক এখন যেমন তখনও তেমনটি থাকতাম। অথবা আমি হয়ত দিতামই—আমি ঠিক নিশ্চিত নই। ’
‘কাজটি না করার জন্য এখন কি তোমার দুঃখবোধ হয়?’
‘হ্যাঁ, সবমিলিয়ে আমি কাজটি না করার জন্য দুঃখবোধই করি। ’
ধূলাকীর্ণ মেঝেতে ওরা পাশাপাশি বসে। জুলিয়াকে বাহুর কাছে টেনে আনলো সে। মাথাটি কাঁধের ওপর রাখল, কবুতরের বিষ্ঠার তীব্রতাকে হার মানিয়ে চুলের দারুণ গন্ধ এসে নাকে লাগল। তরুণী এই মেয়ে, ভাবল সে, জীবন থেকে এখনও তার অনেক কিছুই জানার আছে। এই মেয়ে জানে না, ভিন্ন মতের একটি মানুষকে খাদের মধ্যে ফেলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে কিছুই সমাধান হওয়ার নয়।
‘আসলে তাতে কিছু যেয়ে আসত না’—বলল সে।
‘তাহলে কাজটি না করার জন্য এখন তোমার দুঃখবোধ কেন?’
‘একটাই কারণ, আমি নেতিবাচকতার চেয়ে ইতিবাচকতাকেই বেছে নেই। এই যে খেলা আমরা খেলছি, এতে আমরা জয়ী হব না। তারপরেও কিছু কিছু পরাজয় রয়েছে যা অন্য পরাজয়ের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো, এটুকুই, আর কিছু না। ’
ওর কাঁধের ঝাকুনিতে এই কথায় তার দ্বিমতের প্রকাশই টের পেল সে। যখনই সে এ ধরনের কিছু বলে ও তার বিরোধিতা করে। ব্যক্তির হারই প্রকৃতির বিধান, এ কথা সে মানতে চায় না। একভাবে সে বুঝতেও পারে যে, সে নিজেই ভেঙ্গে গেছে, খুব শিগগিরই, নয়ত আরও পরে একদিন থট পুলিশ তাকে ধরে ফেলবে আর হত্যা করবে। কিন্তু তার মনের অপর অংশটি দিয়ে সে প্রাণপনে বিশ্বাস করতে চায়, কোনও না কোনওভাবে একটি গোপন জগত গড়ে তোলা সম্ভব, যেখানে তুমি তোমার মন যা চায় তাই করতে পারবে। মনে করে, এ জন্য প্রয়োজন স্রেফ ভাগ্যের সহায়, চাতুর্য আর দৃঢ়তা। সে বুঝতেই পারে না, সুখ বলে আর কিছু নেই, বিজয় যদি থেকেও থাকে তা এখনও সুদূরে, আপনার-আমার মৃত্যুর অনেক অনেক পরের বিষয়। এখন পার্টির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, কল্পনায় নিজের মৃতদেহ দেখারই সামিল।
‘আমরা সবাই মৃত’—বলল সে।
‘না আমরা এখনো মরি নি’—বিরসবদনে বলল জুলিয়া।
‘শারীরিকভাবে মরিনি। ছয় মাস, এক বছর… পাঁচ বছরেও হয়ত মরব না। আমার মৃত্যুভয় আছে। তোমার বয়স কম, বোধ করি তোমার ভয়টা আমার চেয়েও বেশি। নিঃসন্দেহে আমরা যতক্ষণ সম্ভব আমাদের কসরত চালিয়ে যাব। কিন্তু তাতে পরিবর্তন খুব কমই আসবে। একটি মানব সন্তান ঠিক যতক্ষণ মানব সন্তান হয়ে থাকে, ততক্ষণ তাদের কাছে জীবন আর মৃত্যু সমান কথা। ’
‘আহ, ফালতু! তুমি কি আমার সঙ্গে শুতে চাও নাকি আমার কঙ্কালের সঙ্গে? এই যে আমরা বেঁচে আছি, একে তুমি উপভোগ করো না? এই যে আমাদের অনুভূতিগুলো, ওগুলো তোমার ভালো লাগে না। এই যে এখানে আমি, এই আমার হাত, এই আমার পা, সত্যিকারের আমি, পরিপূর্ণ আমি, এক জীবিত আমি! একি তোমার ভালো লাগে না?’
নিজেকে আরও একটু ঘন করে উইনস্টনের শরীরের সঙ্গে জড়িয়ে নিল জুলিয়া। আলখেল্লার ভেতর থেকেই তার পীনোন্নত স্তনের চাপ বুকে লাগছে। যৌবন ভরা একটি দেহ ধীরে ধীরে তার শরীরের আরও গভীরে ঢুকে পড়তে লাগল।
‘হ্যাঁ, আমার ভালো লাগে’—বলল সে।
‘তাহলে মৃত্যুর কথা আর মুখেও আনবে না। আর এখন শোনো, আমার প্রিয়তম, আমাদের পরের দেখা কোথায় হবে সেটাও তো ঠিক করতে হবে। আমরা সেই জঙ্গলে আরেকবার যেতে পারি। বড় সড় একটা বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে ঢিবিটিকে। এবার কিন্তু তোমাকে আরেকটি ভিন্ন পথে সেখানে যেতে হবে। ট্রেনে যেতে পারো—কিন্তু, আমিই তোমাকে দেখাচ্ছি কিভাবে যাবে। ’
নিজের অভ্যাসগত ভঙ্গিমায় ধুলো জড়ো করে একটি চৌকার মত স্থান বানিয়ে নিল মেঝেতে। আর কবুতরের একটি পালক দিয়ে সেখানে পথের মানচিত্র আঁকতে শুরু করল জুলিয়া।
অধ্যায় ৪
চ্যারিংটনের দোকানের দোতলার অগোছালো কামরার চারিদিকে একদফা চোখ ঘুরিয়ে নিল উইনস্টন। জানালার পাশে বিশালাকার বিছানাটি পাতা, তাতে একটি ছেঁড়া কম্বল আর কাভারবিহীন কোলবালিশ পড়ে আছে। তাকের ওপর ১২ ঘণ্টা ডায়ালের পুরানা আমলের ঘড়িটি টিক টিক করে চলেছে। অন্য কোণায়, ভাঁজ করে রাখার উপযোগী সেই গেটলেগ টেবিলটি পাতা, যার ওপরে আধো আঁধারেও হালকা ঝিলিক দিচ্ছে স্বচ্ছ কাচের পেপারওয়েট। ফেন্ডারের ভেতরে একটি ভাঙাচোরা তেলের স্টোভ, একটি সসপ্যান, দুটি কাপ। মি. চ্যারিংটন ওগুলো দিয়ে গেছেন। উইনস্টন চুল্লিটি জ্বালাল আর প্যানে করে পানি সিদ্ধ দিল। ইনভেলপ ভরে সঙ্গে করে ভিক্টরি কফি আর কিছু স্যাকারিন ট্যাবলেট নিয়ে এসেছে। ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল পাঁচটা বিশ, তবে প্রকৃত সময় সন্ধ্যা সাতটা বিশ মিনিট আর জুলিয়ার পৌঁছার কথা রাত সাড়ে নয়টায়।
স্রেফ বোকামি, তার মন বলে চলেছে, সচেতনভাবে, অকারণে, আত্মঘাতী এক বোকামির সিদ্ধান্তই সে নিয়েছে। পার্টির সদস্যরা যেসব অপরাধ করে ঢেকে রাখতে পারে তার মধ্যে এটি হবে সবচেয়ে অসম্ভবের। গেটলেগ টেবিলের পাটাতনে পেতে রাখা কাচের পেপারওয়েটের ভেতরে ভেসে ওঠা একটি দৃশ্যের প্রতিচ্ছবি চোখে পড়ার পরপরই ভাবনাটা মাথায় খেলে যায় তার। যেমনটা ভেবে রেখেছিল, কামরাটি ভাড়া দিতে একটুও ঝামেলা করেননি মি. চ্যারিংটন। এতে করে যে গোটা কয় ডলার তার পকেটে ঢুকছে তাতেই সে যারপরনাই খুশি। ভালোবাসার মেয়েটিরে নিয়ে এখানে সময় কাটাবে স্রেফ এই কারণেই উইনস্টন কামরাটি ভাড়া নিতে চায়, সে কথায়ও তার আপত্তি কিংবা বিস্ময় কোনওটাই ছিল না। বরং একটু অদূরে দৃষ্টি ফেলে এমনভাবে কথা বলে গেলেন যেন এ জগতেই নেই তিনি। মুখে শুধু বললেন, একান্ততা খুবই দামি একটা বিষয়। প্রত্যেকেই এমন একটি স্থান চায় যেখানে সে মাঝেমধ্যে একান্তে সময় কাটাতে পারে। আর যখন সে স্থানটি মিলে যাবে, তখন অন্য কেউ যদি সে কথা জেনেও থাকে তাকে—তা নিজের মধ্যেই রাখতে হয়। এমনভাবেই তিনি কথাগুলো বলছিলেন যেন তখনই তিনি অনেকটা অস্তিত্বহীন। জানালেন এই বাড়িতে ঢোকার দুটি দরজা আছে, অপরটি পেছনের আঙ্গিনার দিকে, ওদিকটা দিয়ে চলাচলের একটি পথও আছে।
জানালার নিচে বাইরে কেউ একজন গান ধরেছে। মসলিনের পর্দার পেছনে নিজেকে ভালোভাবে আড়াল করে উঁকি দিল উইনস্টন। জুনের আকাশে তখনও উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে সূর্য। আর প্রখর রোদে ভরে থাকা নিচের আঙিনায় এক দৈত্যাকায় নারী, নরম্যানের খাম্বার মতই কঠিন-শক্ত-সামর্থ্য, লালচে বাদামি হাতের ত্বক, মোটা অ্যাপ্রোনের ওপরে ফিতা দিয়ে কোমর বাঁধা। কাপড় ধোয়ার বালতি থেকে একেকবার হাত ভরে নিয়ে একটু দূরে আড়াআড়ি টানিয়ে রাখা কাপড় শুকানোর রশি পর্যন্ত যাচ্ছেন আর ক্লিপ দিয়ে ছোট ছোট বর্গাকার বস্তুগুলো রশিতে লটকিয়ে আবার বালতির কাছে ফিরছেন। উইনস্টন বুঝতে পারল ওগুলো শিশুদের ডায়াপার হবে। আর কাপড়ের ক্লিপ যখন দাঁতে চেপে রাখছেন তখন গান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আবার যখন সরিয়ে নিচ্ছেন চড়া গলায় শুরু হচ্ছে সেই গান—
নিষ্ফল এক অলীক কল্পনা ছাড়া কিছু নয়,
ফুরিয়ে গেল যেভাবে এপ্রিল ফুরোয়
কিন্তু সেই চাহনি, সেই শব্দ আর স্বপ্ন
হরণ করে নিয়ে যায় আমার হৃদয়।
এই গান গত ক’সপ্তাহ ধরে লন্ডন জুড়ে বাজছে। সঙ্গীত বিভাগের একটি উপবিভাগ প্রোলদের উপকারে যে অসংখ্য গান প্রকাশ করেছে—এটি তার একটি। এই গান রচনায় কোনও মানব সন্তানের যোগসাজশ নেই। ভার্সিফিকেটর নামের একটি যন্ত্রের সম্পূর্ণ নিজস্ব সৃষ্টি এই গান। কিন্তু এই নারী গানটিকে এমন ছন্দময় করে গাইছেন যেন ভয়াবহ ফালতু একটি বিষয় সুমধুর হয়ে ফুটেছে তার কণ্ঠে। সে এই নারীর গান শুনছে আর কানে আসছে তার জুতোর ফটফট শব্দ, রাস্তা থেকে ভেসে আসা শিশুদের চিৎকার, দূরে কোথাও রাস্তায় গাড়ি চলার গর্জন। তবে এতকিছুর পরেও তার কক্ষটি বেশ শান্ত-নীরব। টেলিস্ক্রিনের অনুপস্থিতিই ধন্যবাদার্হ।
নির্বুদ্ধিতা, নির্বুদ্ধিতা, নির্বুদ্ধিতা! আবারও ভাবল সে। এক-দুই সপ্তাহর বেশি সময় এখানে আসা-যাওয়া করবে আর ধরা পড়বে না সেটা অচিন্তনীয়। আর এমনি নাকের ডগায় একেবারে নিজেদের করে একটা গোপন আস্তানা গেড়ে নেওয়া তাদের দুজনের জন্যই ভীষণ রকমের বাড়াবাড়ি। ওই ভাঙ্গা গির্জার ঘণ্টিঘরে দেখা হওয়ার পর আরেকটি মোলাকাত সত্যিই অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। ঘৃণা সপ্তাহ ঘনিয়ে আসার কারণে দিনের কর্মঘণ্টা বেড়ে গেল। এখনও একমাসের বেশি বাকি, তাও প্রস্তুতির বিশাল আর জটিল সব কর্মযজ্ঞ চলছে, ফলে সবারই বেশি সময় ধরে কাজ করতে হছে। অবশেষে একটি বিকেলে তাদের দুজনেরই দেখা করার ফুসরত মিলল। ঠিক করল ওই জঙ্গলেই ফের যাবে। এর ঠিক আগের সন্ধ্যায় রাস্তায় তাদের সংক্ষিপ্ত একটি সাক্ষাতের সুযোগ মিলল। আগের মতই ভিড়ের মধ্যে দুজন হাঁটছে। কিন্তু উইনস্টন জুলিয়ার দিকে তাকাচ্ছে না বললেই চলে। এরই মধ্যে খুবই ছোট্ট একটি চাহনিতে তার মনে হলো মেয়েটি আরও ফ্যাকাশে আরও মলিন হয়ে গেছে।
‘সবকিছুই বাতিল’—কথা বলার প্রথম সুযোগটি পেয়েই বিড়বিড় করে বলল জুলিয়া। ‘আমি বলছি, আগামীকালের কথা। ’
‘মানে?’
‘আগামীকাল বিকেলে। আমি আসতে পারছি না। ’
‘কিন্তু কেন?’
‘কারণ স্বাভাবিক! ব্যাপারটি এবার একটু আগেভাগে শুরু হয়ে গেছে। ’
ক্ষণিকের জন্য হলেও ভীষণ রাগ হলো উইনস্টনের। সে জানে গত একমাসে জুলিয়াকে পাওয়ার ক্ষেত্রে তার চাওয়ার ধরনগুলো পাল্টে গেছে। গোড়ার দিকে একটা ভোগের সুখাশক্তি কাজ করত। ওদের প্রথম দিনের ভালোবাসাবাসি ছিল স্রেফ ইচ্ছাপূরণ। কিন্তু দ্বিতীয়বারের পর বিষয়টি কেমন যেন ভিন্ন কিছু হয়ে উঠেছে। জুলিয়ার চুলের গন্ধ, ঠোঁটের স্বাদ, ত্বকের অনুভূতি সবকিছু যেন তার ভেতরে ঢুকে পড়েছে, অথবা ওগুলোই যেন তাকে ঘিরে থাকে। ও এখন তার জন্য হয়ে উঠেছে বড় প্রয়োজন, ওকে যে সে কেবল চায়, তা-ই নয়, মনে করে ওর ওপরই যেন তার সব অধিকার। তবে ঠিক এই মুহূর্তে ভিড়ের চাপই তাদের ঠেলে কাছাকাছি করে দিল আর দৈবক্রমে তাদের হাতেরও মিলন হলো। জুলিয়া তার আঙ্গুলের ডগায় উইনস্টনের হাতের তালুতে আঁকিবুকি করে যে ছোঁয়া দিল তাতে আহ্বান ছিল কিন্তু সে আহ্বান আকাঙ্ক্ষার নয়, ভালোবাসার।
তার ভেতরে ভাবনা কাজ করছে, যখন কেউ কোনও নারীর সঙ্গে বাস করে তখন এসব হতাশা স্বাভাবিক হয়েই ধরা দেয়, নিত্য ঘটনার অংশ হয়ে ওঠে, আর এখন এক গভীর উষ্ণতার অনুভূতি কাজ করছে, যা জুলিয়াকে নিয়ে তার ভেতরে এর আগে কখনওই হয়নি। তার মনে হচ্ছে অন্তত বছর দশেক ধরেই তাদের দাম্পত্য জীবন। তার মনে হচ্ছে অনেক আগে থেকেই তারা রাস্তায় হাত ধরাধরি করে হেঁটে আসছে, এখনকার মত গোপনে না, প্রকাশ্যে তারা রাস্তায় হাঁটে, দোকানে যায়, ঘর-গৃহস্থালির টুকিটাকি জিনিসপত্র কেনে।
তার আরও মনে হলো, একটি জায়গা যদি থাকত—যেখানে তারা একসঙ্গে থাকতে পারে, যেখানে কোনও বাধা থাকবে না, সংশয় থাকবে না, যখন চাইবে একসঙ্গে কাটাতে পারবে। এসব নিয়ে যখন ভাবছিল ঠিক তখনই নয়, ওর পরের দিন তার মাথায় মি. চ্যারিংটনের দোতলার কামরাটি ভাড়া নেওয়ার আইডিয়াটি এলো। কথাটি জুলিয়ার কাছে পাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে রাজি হয়ে গেল, এতটা সহজে রাজি হবে বলে সে ভাবেও নি। তারা দুজনেই জানে এই সিদ্ধান্ত স্রেফ নির্বোধের পাগলামো। অনেকটা এমন যে, দুজনে মিলেই কবরের দিকে পা বাড়ালো। বিছানার কিনারায় পা ঝুলিয়ে বসে আজ আরও একবার সে ভালোবাসা মন্ত্রণালয়ের কয়েদখানাগুলোর কথা ভাবল। এমন অবধারিত ভীতি কী করেই কারও সচেতন মনে এমন আসা-যাওয়া করে—সে এক কৌতূহলেরই বিষয়।
এমনটাই। ভবিষ্যৎ এভাবেই নির্ধারিত। ৯৯’র পরে যেমন আসে ১০০ ঠিক তেমন নিশ্চয়তায় নির্ধারিত হয়ে আছে মৃত্যু। কারও পক্ষেই তা এড়িয়ে যাওয়ার নয়, কেউ কেউ চাইলে বড়জোর কিছুটা সময়ের জন্য স্থগিত করে রাখতে পারে। তবে কেউ যখন মৃত্যুর নিশ্চয়তা জেনেই যায় তখন আর এই বিরতিটা বাড়াতে চায় না, বরং যত তাড়াতাড়ি হয়ে যায় সেটাই কাম্য।
নিচের সিঁড়িতে দ্রুত বেয়ে ওঠা পায়ের শব্দ। আর তখনই কক্ষে জুলিয়ার সশব্দ উপস্থিতি। মোটা খাকি রঙের একটি টুলস-ব্যাগ হাতে, মন্ত্রণালয়ে মাঝে মধ্যেই ব্যাগটি ওর হাতে চোখে পড়েছে। একটু এগিয়ে গেল বাহুবন্দি করবে বলে, কিন্তু জুলিয়ার পক্ষ থেকে সমান সাড়া মিলল না, হতে পারে হাতের ব্যাগটিই তার কারণ।
‘আধা সেকেন্ড’—বলল সে। ‘আমি কী এনেছি একটু দেখাতে দাও। তুমি নিশ্চয়ই ওই ঘিনঘিনে ভিক্টরি কফি নিয়ে এসেছো। আমি ভেবেছিলাম তুমি এই কাজই করবে। ওগুলো তুমি এবার ছুঁড়ে ফেলতে পার, কারণ, আমাদের আর ওগুলোর দরকার হচ্ছে না। এগুলো দ্যাখো। ’
হাঁটু গেড়ে বসল জুলিয়া, ঝপ করে ব্যাগটি মেঝেতে রাখল, আর এর উপরের দিকে রাখা কতগুলো স্প্যানার আর স্ক্রু-ড্রাইভার তুলে আনলো। নিচে কতগুলো পরিষ্কার কাগজের প্যাকেট। প্রথম প্যাকেটটি উইনস্টনের দিকে এগিয়ে দিলে এক অদ্ভুত, অস্পষ্ট পরিচিত অনুভূতি বয়ে গেল তার ভেতর। ভেতরে ভারী বালুর মত ঝুরঝুরে কিছু একটা, যেখানেই চাপ পড়ছে, দেবে যাচ্ছে।
‘চিনি নিশ্চয়ই!’—বলল সে।
‘খাঁটি চিনি। স্যাকারিন, চিনি না। আর এখানে এক টুকরো রুটি… খাঁটি সাদা রুটি, আমাদের ওইসব ফালতু রুটি না… এই হলো ছোট এক পট জ্যাম… আর এটা হলো এক টিন দুধ… কিন্তু এটা দ্যাখো… এটা পেয়ে বেশ গর্বই বোধ করছি। বাইরে থেকে একটু পেঁচিয়ে নিতে হয়েছে, কারণ…’
কেন পেঁচিয়ে আনতে হয়েছে সে কারণটা তাকে বলার প্রয়োজন নেই। এর গন্ধ ততক্ষণে গোটা কামরা ভরিয়ে দিয়েছে। কী দারুণ গন্ধ, ছেলে বেলায় নাকে লাগা এমন গন্ধ তার জানা, কিন্তু সে স্মৃতি মাঝে মধ্যে তাকে ধরা দিয়েও হারিয়ে যায়। কোনও একটি পথ জুড়ে গন্ধ উড়ছে, কিন্তু দরজার শব্দে আবার তা উবে যাচ্ছে, অথবা কোনও এক ভিড়ের সড়কে রহস্যজনকভাবে এক লহমার জন্য চোখে পড়ে আবার দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।
‘হুমমম… কফি’—বিড়বিড়িয়ে উঠল সে—‘আসল কফি। ’
‘এটা ইনার পার্টির কফি, এখানে পুরো এক কিলো’—বলল জুলিয়া।
‘পেলে কিভাবে?’
‘এখানে সবই ইনার পার্টির মালামাল। ওই শুয়োরদের কাছে নেই—এমন কিছু নেই, কিছুই না বুঝলে। ওয়েটার আর চাকর-বাকররা চুরি চামারি করে বেচে, ওইগুলোই জোগাড় করেছি। আর দ্যাখো—ছোট এক প্যাকেট চা-ও এনেছি। ’
পায়ের গোড়ালিতে চেপে জুলিয়ার পাশে বসে পড়ল উইনস্টন। প্যাকেটটির এক কোণা আস্তে করে ছিঁড়ে ফেলল।
‘আরে এও তো দেখছি আসল চা, ওইসব জামপাতার চা নয়। ’
‘আজকাল চায়ের বেশ যোগান। ওরা ভারত না যেন কোন দেশ দখল করে নিয়েছে’—অনিশ্চয়তার উচ্চারণ তার। ‘কিন্তু শোন প্রিয়তম। আমি বলছি, এখন উল্টো ঘুরে থাকবে তুমি। তিন মিনিটেও ফিরবে না। যাও বিছানার উল্টো দিকে গিয়ে বসো। কিন্তু জানালার কাছাকাছি যাবে না। আর আমি না বলা পর্যন্ত আমার দিকেও ফিরবে না। ’
মসলিনের পর্দার ভেতর দিয়ে বাইরে ভাবলেশহীন দৃষ্টি ফেলে বসে রইল উইনস্টন। নিচে নরম্যানের খাম্বাকায় সেই নারী তখনও বালতি থেকে কাপড় তুলছে আর শুকোতে দিচ্ছে। তখনই মুখে চেপে রাখা আরও দুটি ক্লিপ বের করে দুটি ডায়াপার ঝুলিয়ে দিল। আর মুখখানা মুক্ত হতেই গানের সুর বেরিয়ে এলো—
বলেছিল ওরা ঠিক হয়ে যাবে
বলেছিল একদিন সবই ভুলে যায়
কিন্তু সেই হাসি, সেই অশ্রুজল আজও
হৃদয়খানি মোর ভেঙ্গে দিয়ে যায়…
মনে হলো পুরো গানটাই হৃদয়ঙ্গম করেছে এই নারী। গ্রীস্মের মিষ্টি হাওয়া তার গান ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে দূর থেকে আরও দূরে। দারুণ গলার সুরের সঙ্গে মিশেছে সুখের দুঃখগাথা। কেউ ভাবতেই পারে, জুনের এই বিকেলটা যদি হয়ে ওঠে অনন্ত, আর যদি কাপড়ের যোগান থাকে অফুরান, তাহলে এই নারী ডায়াপার শুকোতে দিতে দিতে আর গান করে কাটিয়ে দিতে পারবে হাজার বছর।
উইনস্টন ভাবল, সে তো কখনওই পার্টির কোনও সদস্যকে এমন একাকীত্বে উদার-উদাস গলায় গান গাইতে শোনেনি। এমনটা প্রথাবিরুদ্ধই কেবল নয় বিপদও ঘটে যেতে পারে। একা একা কথা বললে যে বিপদ—ঠিক তেমনই। হতে পারে মানুষ যখন বুভুক্ষের পর্যায়ে পৌঁছে যায় তখন তাদের কণ্ঠে গান এমন করেই আসে।
‘হ্যাঁ এবার ঘুরতে পার’—বলল জুলিয়া।
ঘুরল উইনস্টন। আর এক সেকেন্ড মোটে চিনতেই পারছিল না তাকে। তার প্রত্যাশা ছিল জুলিয়া নগ্ন হয়ে তাকে আহ্বান জানাবে, কিন্তু সে যা করেছে তা যে নগ্নতার চেয়েও বিস্ময়ের! মুখে রঙ মেখে সেজেছে সে।
নিশ্চয়ই প্রোলেতারিয়েতদের কোনও দোকানে ঢুকে সাজসজ্জার সব উপকরণ কিনে এনেছে এই মেয়ে। ঠোঁটদুটো গাঢ় লাল, গালে রুজ মাখানো, নাকে পাউডার, চোখের নিচেও কিছু একটা লাগিয়েছে—এতে তার চোখদুটো বেশ টানা টানা লাগছে। দক্ষ হাতে হয়নি কোনও কিছুই, কিন্তু উইনস্টনের চোখে তা ধরা পড়ার কথা নয় কারণ এ নিয়ে তার বোধটাও সমৃদ্ধ কিছু নয়। পার্টির কোনও মেয়ের মুখে প্রসাধনি মাখা দেখবে এমনটা এর আগে সে কল্পনাও করেনি। সাজের পর তার মুখটা দেখতে চমৎকার হয়েছে। মুখের কয়েকটি জায়গায় কয়েকটি রঙের ব্যবহার তাকে কেবল আরও সুন্দরীই করেনি, বরং, বলা যায় আরও বেশি নারীসুলভও করে তুলেছে। তার ছোট চুল, ছেলেদের মত আলখেল্লাও সে রূপে সামান্যই প্রভাব ফেলতে পেরেছে। আর যখন সে তাকে বাহুতে তুলে নিল সুগন্ধির একটি ধাক্কা এসে লাগল তার নাসিকা রন্ধ্রে। তার মনে পড়ে গেল আধো-অন্ধকারে ঢাকা সেই নিচতলার রান্নাঘরের কথা, আর প্রকাণ্ড মুখের এক নারীর চেহারা। গন্ধটা একই রকম। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই এসব নিয়ে ভাবতে বসার সময় এটা নয়।
‘সুগন্ধীও!’—বলল সে।
‘হ্যাঁ, প্রিয়তম, সুগন্ধীও। আর তুমি কি জানো, এরপর আমি কী করতে যাচ্ছি? আমি সত্যিকারের মেয়েদের একটি ফ্রক জোগাড় করব আর এই ফালতু ট্রাউজার ফেলে সেটা পরব। আমি মখমলের মোজা পরব, হাইহিল জুতো পরব। এই কামরার ভেতরে আমি সত্যিকারের একজন নারী হয়ে উঠব, পার্টির কমরেড হয়ে থাকব না। ’
দুজনেরই শরীর থেকে বসন খসে পড়ল একে একে, আর দুই নগ্ন দেহ মেহগনি কাঠের বিছানায় ঝাপিয়ে পড়ল। এই প্রথমবার জুলিয়ার সামনে পুরোপুরি নগ্ন হলো উইনস্টন। এখনও শরীরের জেগে ওঠা শিরা আর গোড়ালির ওপরের ঘা সহ ফ্যাকাশে কৃশকায় শরীরটি নিয়ে লজ্জায় থাকে সে। বিছানায় কোনও চাদর পাতা নেই, ছেঁড়া হলেও কম্বলটি মসৃণ, তার ওপরই শয্যা রচিত হলো দুজনের। বিছানাটি বড়সড়ো আর বেশ স্প্রিংয়ি। ‘আমি নিশ্চিত এই বিছানা ছারপোকায় ভরা, কিন্তু তাতে কারই পাত্তা?’—বলল জুলিয়া। প্রোলদের ঘরে ছাড়া, আজকাল ডাবল সাইজের বিছানা আর দেখাই যায় না। ছেলেবেলায় উইনস্টন মাঝেমধ্যে এমন একটি বিছানায় ঘুমিয়েছে, কিন্তু যদ্দূর মনে পড়ে জুলিয়া কখনওই এমন বিছানায় গা ছোঁয়ায়নি।
দুজনই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তবে অল্প সময়ের জন্য। উইনস্টনের যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়ির কাঁটা নয়টার কাছাকাছি। নড়ল না, কারণ জুলিয়া তখনও তার বাহুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে। ওর মুখের প্রসাধনীর অনেকটা এখন তারও মুখমণ্ডলে লেগে আছে, তবে রুজমাখা গাল দুটি দারুণ সুন্দর লাগছিল।
ডুবন্ত সূর্যের একটা হলুদ রশ্মি বিছানার পায়ের দিকটাতে পড়ে ফায়ার প্লেসের ওপর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। ওটির ওপর পেতে রাখা কড়াইয়ে তখনও পানি ফুটছে। নিচের আঙ্গিনায় সেই নারীর গান থেমেছে, কিন্তু সড়ক থেকে শিশুদের চিৎকার চেঁচামেচির হালকা শব্দ এসে কানে লাগছে। তার কৌতূহলী মনে প্রশ্ন জাগল, মুছে দেওয়া অতীতেও কি বিছানায় শুয়ে থাকার অনুভূতি এমনটাই ছিল, গ্রীষ্মের শান্ত সন্ধ্যায়, দুই নগ্ন নর-নারী তাদের ইচ্ছামত যেমন খুশি ভালোবাসাবাসি করে, মনে যা আসে তাই নিয়ে কথা বলে সময় কাটিয়ে দিচ্ছে। উঠে যাওয়ার জন্য কোনও চাপ বোধ করবে না, স্রেফ শুয়ে থাকবে আর কানে ভেসে আসবে বাইরের শান্তশব্দগুলো। নিশ্চয়ই এসব কিছু স্বাভাবিক মনে হবে—এমন একটা সময় কখনওই ছিল না। জুলিয়ার ঘুম ভাঙল, চোখ দুটি দুই হাতে ডলে নিয়ে কনুইয়ের ওপর ভর করে মাথা তুলে তেলের স্টোভের দিকে তাকাল।
‘পানির অর্ধেকটাতো সিদ্ধই হয়ে গেল’—বলল সে। ‘একটু পরেই উঠব আর কফি বানাব। আমাদের হাতে আরও এক ঘণ্টা সময় আছে। তোমার ফ্লাটে আলো বন্ধ হয় কখন?’
‘রাত সাড়ে এগারোটায়। ’
হোস্টেলে রাত এগারোটায়। কিন্তু তোমাকে তার আগেই ঢুকে পড়তে হবে, কারণ… আয়হায়! নোংরা জানোয়ার এবার ওঠো!’
হঠাৎই দ্রুত বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে, মেঝে থেকে জুতো কুড়িয়ে নিয়ে ছোট বাচ্চাদের মত তা এক কোণায় ছুড়ে মারল। দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচিতে সেবার টেলিস্ক্রিনে গোল্ডস্টেইনের মুখের উপর ঠিক যেভাবে অভিধানটি ছুড়ে মেরেছিল সেভাবেই।
‘কী হলো!’ বিস্ময় উইনস্টনের কণ্ঠে
‘ইঁদুর। ওই কাঠের দৌড়ের ভেতরে থেকে ওর হিংস্র নাক বের করেছিল। ওখানে নিশ্চয়ই একটা গর্ত আছে। তবে ব্যাটাকে বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছি। ’
‘ইঁদুর!’—বিড়বিড় করে বলল উইনস্টন ‘এই কামরায়!’
‘ওদের বিচরণ সর্বত্র’—বলল জুলিয়া। আর বলতে বলতে আবারও শুয়ে পড়ল। আমাদের হোস্টেলের রান্নাঘরেও দেখি ঘুরঘুর করে। লন্ডনের কোনও কোনও এলাকা ইঁদুরে ছেয়ে গেছে। তুমি কি জানো ওরা শিশুদের ওপর আক্রমণ করে? সত্যিই করে। এইসব সড়কগুলোতে মেয়েরা দুই মিনিটের জন্যও তাদের শিশুদের একা ফেলে রাখতে ভয় পায়। বড় ধূসরবর্ণের ইঁদুরগুলোই কাজটা বেশি করে। আর সবচেয়ে ঘৃণার কাজটি এরা যা করে তা হচ্ছে…’
‘থাক না’—বলল উইনস্টন। চোখদুটো শক্ত করে বন্ধ করে রাখা।
‘আরে প্রিয়তম! তুমি তো পুরো ফ্যাকাশে হয়ে গেছো। ঘটনা কী? ওগুলোর কথা শুনে অসুস্থ বোধ করছো নাকি?’
‘পৃথিবীতে ভয়াবহতমগুলোর একটি হচ্ছে এই ইঁদুর!’
বিছানায় উইনস্টনকে ফের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করল জুলিয়া, যেন সে তার শরীরের উষ্ণতা দিয়ে তাকে ভরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু তখনও চোখ খোলেনি সে। জীবনে বারবার আসা একটি দুঃস্বপ্নের স্মৃতির অনুভবে কয়েকটি দণ্ড নিজেকে আচ্ছন্ন করে রাখতেই মন চাইল তার। প্রায় সবগুলো স্বপ্নই একরকম। অন্ধকারের দেয়াল ঘেঁষে সে দাঁড়িয়ে। উল্টো দিকে কিছু একটা, ঠিক বোঝা যায় না, তবে ভীষণ ভয়ঙ্কর। এই স্বপ্নে বরাবরই তার এক গভীর অনুভূতি হয়, যাকে সে স্রেফ ছলনা ছাড়া কিছু মনে করে না। কারণ সত্যিই সে জানে ওই অন্ধকার দেয়ালের ওপারে কী আছে। সে জানে জোর চেষ্টা করলে, মস্তিষ্ক থেকে টেনে বের করলে, ভয়ঙ্কর বিষয়টিও প্রকাশ্য হয়ে যাবে। প্রতিবারই—কী সেই ভীতিকর বস্তু—তা প্রকাশ্য হওয়ার আগেই তার ঘুম ভাঙ্গে, আর সে জানে জুলিয়াকে যেখানে থামাল, সেখানে না আটকালে ও যা বলত তার সঙ্গে এর একটা যোগসাজশ রয়েছে।
‘দুঃখিত’—বলল সে, ‘কিছুই না। ইঁদুর আমার অসহ্য, এই যা। ’
‘উদ্বেগের কিছু নেই, প্রিয়তম, এই ঘরে ওর আর অস্তিত্ব মিলবে না। যাওয়ার আগেই আমি ওর গর্তটাকে কিছু একটা দিয়ে আটকে দেব। আর এরপর যেদিন আসব কিছু প্ল্যাস্টার নিয়ে আসব যাতে গর্তটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া যায়। ’
তাৎক্ষণিক যে ভীতি ছিল তা এখন অনেকটা কেটে গেছে। কিছুটা লজ্জাও বোধ করছিল উইনস্টন। বিছানার শিথানের দিকে উঠে বসল সে। জুলিয়া বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ল আর আলখেল্লা গায়ে চাপিয়ে কফি বানাতে লেগে গেল। সসপ্যান থেকে যে কড়া, উত্তেজক গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে তাতে তারা জানালা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলো, নইলে কারও নাকে এই ঘ্রাণ গেলে আগ্রহী হয়ে খোঁজ লাগাতে চলে আসতে পারে। এর স্বাদে যতটা, তার চেয়েও বেশি ভালো লাগল চিনি মেশানো কফির রেশমি বর্ণ।
স্যাকারিন খেতে খেতে চিনি নামের বস্তুটার কথা ভুলেই গিয়েছিল উইনস্টন। পকেটে এক হাত ঢুকিয়ে আর অন্যহাতে রুটি আর জ্যাম নিয়ে জুলিয়া কামরাটির এদিক ওদিক পায়চারি করে চলেছে, বইয়ের বাক্সটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, গেইটলেগ টেবিলটিকে কিভাবে সারাই করা যায় তা ঠিক করল, ভাঙ্গা হাতলওয়ালা চেয়ারটিতে একবার বসে দেখল কতটা আরাম তাতে আর খুটে খুটে দেখল ১২ ঘণ্টা ডায়ালের ঘড়িটি। সবকিছুই করে চলল এক ধরনের বিমোহিত ভাব নিয়ে।
কাচের পেপারওয়েটটি হাতে করে বিছানার দিকে এলো যাতে অপেক্ষাকৃত আলোতে এটি ভালো করে দেখা যায়। উইনস্টন তার হাত থেকে ওটি নিয়ে নিল আর এর ভেতরে বৃষ্টির পানির ফোঁটার মত বুদবুদগুলো আবারও মুগ্ধ হয়ে দেখল।
‘জিনিসটা কী, বলো তো?’—বলল জুলিয়া।
‘এটিকে আমার কিছুই মনে হয় না—মানে আমি বলতে চাই, কখনওই কোনও কাজে এটি লেগেছে বলে আমার বোধ হয় না। আর ঠিক সে কারণেই জিনিসটি আমার পছন্দ। এটি স্রেফ এক টুকরো ইতিহাস যা ওরা পাল্টে দিতে ভুলে গেছে। এটি শত বছর আগের একটি বার্তা, তবে সে বার্তা—স্রেফ যে পড়তে পারবে তার জন্যই। ’
‘আর ওই যে ওদিকে টানিয়ে রাখা ছবিটি’—উল্টো দিকের দেয়ালের দিকে দৃষ্টি হেনে বলল জুলিয়া। ‘ওটাও কি শত বছরের পুরোনো?’
‘তারও বেশি। আমি বলতে চাই অন্তত দুইশ’ বছরের পুরোনো। কেউ আসলে বলতেও পারবে না। এখন এই যুগে আর এর জন্ম ইতিহাস জানা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। ’
ছবিটির দিকে এগিয়ে গেল জুলিয়া। ‘এখান থেকেই ইঁদুরটা নাক বের করেছিল’ বলেই ছবিটির ঠিক নিচে গর্তের ওপর লাথি বসাতে লাগল। ‘এটা কোন জায়গা, মনে হচ্ছে আগে কখনও স্থানটি দেখেছি’—এবার ছবির দিকে তাকিয়ে বলল সে।
‘ওটা একটা গির্জা, অন্তত বলা চলে, গির্জাই হবে। নাম ছিল সেইন্ট ক্লেমেন্ট’স ডেনস। ’ মাথায় এলো মি. চ্যারিংটনে ছড়াটি। আর আধেকটা নস্টালজিক হয়ে উচ্চারণ করল:
অরেঞ্জেস অ্যান্ড লেমন্স, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট ক্লেমেন্ট’স!
আর তাকে ভীষণ বিস্মিত করে দিয়ে জুলিয়া আওড়াল:
ইউ ও মি থ্রি ফার্দিংস, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট মার্টিন’স,
হোয়েন উইল ইউ পে মি? সে দ্য বেলস অব ওল্ড বেইলি—
এই লাইনটির পরে কী ছিল মনে করতে পারছি না। তবে মনে আছে ছড়াটি শেষ হয় এভাবে, “হিয়ার কামস অ্যা ক্যান্ডল টু লাইট ইউ টু বেড, হিয়ার কামস অ্যা চপার টু চপ অফ ইওর হেড!”
এটা কোনও গোপন সংকেতের দুটি ভাগ হবে। তবে ‘দ্য বেলস অব ওল্ড বেইলি’র পরে আরেকটি পঙ্ক্তি থাকার কথা। মি. চ্যারিংটনের মগজ থেকে সেটা খুঁড়ে বের করা সম্ভব হলেও হতে পারে। তবে তার জন্য তাকে মওকা মত পেতে হবে।
‘তোমাকে কে শিখিয়েছে?’—প্রশ্ন উইনস্টনের।
‘আমার দাদাভাই। যখন ছোট্ট মেয়েটি ছিলাম দাদাভাই আমাকে এগুলো খুব শোনাতেন। আমার যখন আট বছর বয়স তখন তাকে বাষ্পায়িত করা হয়—অর্থাৎ গুম হয়ে যান। আমি জানি না, এই লেবুটা দেখতে কেমন’—টানা বলেই চলল জুলিয়া। ‘কমলা দেখেছি। হলুদ রঙের গোল এক ধরনের ফল। চামড়া মোটা। কিন্তু লেবু দেখিনি। ’
‘লেবুর কথা আমার স্মরণে আসছে’—বলল উইনস্টন। পঞ্চাশের দশকে বাজারে খুব দেখা যেত। ওগুলো খেতে টক। ঘ্রাণ নিলেও তোমার দাঁত ধরে আসবে। ’
‘আমি বাজি ধরতে পারি, ওই ছবির পেছনে ছারপোকার আখড়া হয়েছে’—বলল জুলিয়া। ‘একদিন নিচে নামিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করে দেব। আমার ধারণা এখন আমার চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তবে তার আগে মুখের রঙ ধুয়ে ফেলতে হবে। ফালতু একটা জিনিস! তোমার মুখেও লিপস্টিকের দাগ লেগে আছে। ওগুলোও মুছতে হবে। ’
আরও কয়েক মিনিট বিছানায় পড়ে থাকল উইনস্টন। কামরাটি ধীরে ধীরে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আসছে। যেদিকটা দিয়ে আলো আসছে সেদিকে ঘুরল আর শুয়ে শুয়ে তাকিয়ে থাকল কাচের পেপারওয়েটটার দিকে। ভেতরে বসানো কোরালটিতে যতটা না আকর্ষণ তার চেয়ে বেশি আকর্ষণ কাচের অংশে। বলা যায় বাতাসের মত স্বচ্ছ। মনে হবে কাচের উপরিতলটি ঠিক আকাশের মত। একটা ছোট পৃথিবী এই কাচের ভেতরে স্থান করে নিয়েছে। উইনস্টনের মনে হলো, ইস্ যদি এই কাচের ভেতরে ঢুকে পড়া যেত। আর সত্যি বলতে কী, মনে মনে সে আসলে কাচের ভেতরেই ঢুকে পড়ল। তার সঙ্গী হয়ে ভেতরে ঢুকেছে মেহগনির বিছানা, গেটলেগ টেবিল, ঘড়ি, স্টিলের খোঁদাই করা চিত্রকর্ম আর এই কাচের পেপারওয়েটি নিজেও। পেপারওয়েটটিই যেন পুরো কামরা আর সে তার ভেতরে। ওই কোরাল যেন জুলিয়ার জীবন, আর তার নিজেরও, যা স্ফটিকের কেন্দ্রস্থলে চির অবস্থান নিয়ে আছে।
পঞ্চম অধ্যায়
সাইম বাষ্পায়িত হয়ে গেছে। এক সকালে কাজে তার দেখা মিলল না। কতিপয় অবিবেচক সে অনুপস্থিতি নিয়ে কিছু মন্তব্যও করল। পরের দিন অবশ্য কারও মুখে তার নামটিরও উচ্চারণ ছিল না। তৃতীয় দিন উইনস্টন একবার রেকর্ডস ডিপার্টমেন্টের প্রবেশপথটা ঘুরে এলো। সেখানে টাঙিয়ে রাখা নোটিশ বোর্ডে দাবা কমিটির একটা ছাপানো তালিকায় সাইমের নাম ছিল। উইনস্টন দেখল পুরো একই রকম দেখতে একটি তালিকা ঝুলছে। তাতে কোনও নাম কাটা হয়নি—তবে একটি নাম কমে গেছে। ওতেই চলবে। অস্তিত্ব বিরতিতে চলে গেল সাইম; আর হতে পারে তার অস্তিত্ব কোনওকালেই ছিল না।
তাঁতানো গরম আবহাওয়া। গোলকধাঁধার মন্ত্রণালয়ের জানালাবিহীন, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষগুলোতে তাপমাত্রা স্বাভাবিক, কিন্তু বাইরের আঙ্গিনায় পা ফেলতেই ফোস্কা পড়ে যায়। আর ভিড়ের সময়ে টিউবগুলোতে ঘামের বোঁটকা গন্ধ স্রেফ বিভীষিকাময় ঠেকে। ঘৃণা সপ্তাহের প্রস্তুতি পুরোদমেই চলছে, সবগুলো মন্ত্রণালয়ের স্টাফই অতিরিক্ত সময় খাটছে। মিছিল, মিটিং, সামরিক কুচকাওয়াজ, বক্তৃতা, মোমের মূর্তি, সাজসজ্জা, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, টেলিস্ক্রিন প্রোগ্রাম সবকিছুরই আয়োজন থাকছে। খাম্বা গেড়ে কুশপুতুল টাঙানো, স্লোগান লেখা, স্লোগান বাছাই, গুজব ছড়িয়ে দেওয়া, ভুয়া ছবি তৈরি এসবও চলছে সমানে।
জুলিয়ার ফিকশন ডিপার্টমেন্ট উপন্যাস রচনা আপাতত বন্ধ রেখে সহিংসতার প্যামফ্লেট বানাতে ব্যস্ত। উইনস্টন তার নিয়মিত কাজের পাশাপাশি প্রতিদিনই দীর্ঘ সময় ধরে ‘দ্য টাইমস’র পুরোনো ফাইল ঘাঁটছে আর যেসব সংবাদ থেকে বক্তৃতায় উদ্ধৃতি থাকবে সেগুলো পাল্টে সুবিধা মত সাজিয়ে রাখছে। গভীর রাতে, যখন সড়কগুলোতে মাতাল প্রোলদের ঘোরাঘুরি চলতে থাকে, তখন শহরটাতে যেন জ্বর নেমে আসে। আগের চেয়ে একটু ঘনঘনই রকেট বোমা পড়ছে, আর কখনও কখনও দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসে ভীষণ বিস্ফোরণের শব্দ, যার ব্যাখ্যা কারও জানা নেই, তবে এ নিয়ে রয়েছে ভয়াবহ সব গুজব।
ঘৃণা সপ্তাহের প্রতিপাদ্য সঙ্গীতে সুরারোপ করা হয়েছে (নাম দেওয়া হয়েছে ঘৃণাগীত) আর তা অবিরাম বেজে চলছে টেলিস্ক্রিনে। অসভ্য ঘেউ ঘেউ ধ্বনির এই গানকে আর যাই হোক সঙ্গীত বলা চলে না। ড্রাম বাজিয়ে তাই গাওয়া হচ্ছে। সঙ্গে মিশছে কুচকাওয়াজরত শত শত পায়ের ভীতিকর শব্দ। প্রোলরা বিষয়টিকে মজা হিসেবে নিয়েছে। মধ্যরাতের সড়কগুলোতে ‘নিষ্ফল এক অলীক কল্পনা ছাড়া কিছু নয়’র সঙ্গে জনপ্রিয়তার পাল্লা লেগে গেছে এই গানের। পারসন্সের বাচ্চারা অহর্ণিশ অবিরাম অসহনীয়ভাবে তা বাজিয়ে চলেছে। চুলে চিরুণী চালাতে চালাতে কিংবা টয়লেট পেপার দিয়ে কাজ সারতে সারতে তাদের একই গান।
উইনস্টনের সন্ধ্যাগুলো আগের যেকোন সময়ের চেয়ে এখন পরিপূর্ণ হয়ে থাকে। স্বেচ্ছাসেবক দলগুলো সংগঠিত করছে পারসন্স। এদেরই দায়িত্বে ঘৃণাসপ্তাহের জন্য সড়কগুলো প্রস্তুত হচ্ছে। ব্যানার টাঙানো, পোস্টার আঁকানো, বাড়িগুলোর ছাদে পতাকার খুঁটি বসানো, রাস্তাগুলোর এপাশ থেকে ওপাশে দড়ি টাঙিয়ে কাগজের পতাকা সাজানো চলছে। পারসন্স বলেছিল ভিক্টরি ম্যানসন্সেই লেগে যাবে চারশ মিটার লম্বা পতাকার রশি। আজন্মসিদ্ধ ভাবনা আর খুশিতে গদগদ হয়ে আছে সে। গরম আর কাজের ধরনের কারণে সন্ধ্যার জমায়েতে তার কোঁচকানো শর্টস আর বোতাম খোলা শার্ট মাননসই হয়ে গেছে। হঠাৎ হঠাৎই তার উপস্থিতি, দেখা মিলবে এখানে ওখানে, কিছু ধাক্কাচ্ছে নয়ত টানছে, করাত কাটছে, নয়ত হাতুড়ি পেটাচ্ছে। এসবই করছে তার কমরেডসুলভ অভিব্যক্তি দিয়ে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে করতে। তবে একই সঙ্গে প্রতি পরতে পরতে ছড়িয়ে পড়ছে তার গা থেকে ভুরভুর করে বেরিয়ে আসা ঘামের অসহনীয় কটূগন্ধ।
হঠাৎ একটি পোস্টারে গোটা লন্ডন ছেয়ে গেছে। ক্যাপশন নেই, স্রেফ দৈত্যাকায় বপুর এক ইউরেশীয় সেনা। তিন কিংবা চার মিটার লম্বা, ভাবলেশহীন মঙ্গোলীয় মুখ সম্মুখপানে উদ্ধত। পায়ে মোটা বড় বুট। কোমড়ের নিচে ঝুলে আছে সাবমেশিনগান। যেদিক থেকেই তাকান না কেন পরিপ্রেক্ষিতের বিবর্ধনে মনে হবে, ওটি সোজা আপনার দিকেই তাক করা। প্রতিটি দেয়ালের প্রতিটি ফাঁকা স্থানে সেঁটে দেওয়া হয়েছে এই পোস্টার। ফলে তা বিগ ব্রাদারের পোস্টারকেও ছাপিয়ে গেছে। প্রোলরা যুদ্ধের ব্যাপারে সাধারণত উদাসীন থাকলেও মাঝে মধ্যে তাদের দেশপ্রেমের আতিশয্য দেখা যায়। আর মনে হচ্ছে, সাধারণের এই উচ্ছ্বাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রকেট বোমায় মৃত্যুর সংখ্যাটাও একটু বেড়েছে। একটি পড়েছে স্টেফনির এক জনাকীর্ণ ফিল্ম থিয়েটারে। তাতে ধ্বংসস্তূপের নিচে প্রাণ গেছে কয়েকশ’ জনের। পুরো এলাকার মানুষ লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিল। এতে বড় যে কাজটি হয়ে গেল তা হচ্ছে, ঘৃণা আর ক্ষোভের বিনিময়।
আরেকটি বোমা পড়েছে বর্জ্য ফেলে ফেলে গড়ে তোলা একটি মাঠের ওপর। ওখানে ডজন কয়েক শিশু খেলা করছিল। ওরা সব টুকরো টুকরো হয়ে উড়ে গেছে। এতে ক্ষোভ আর ঘৃণা প্রতিহিংসায় রূপ নিল। গোল্ডস্টেইনের কুশপুতুল পোড়ানো হলো, ইউরেশীয় সেনার ছবি সম্বলিত সেই পোস্টারের শত শত কপি ছিঁড়ে আগুনে ছুঁড়ে দেয় সহিংস জনতা, হাঙ্গামার মাঝেই বেশ কিছু দোকানপাটে লুটতরাজ চলে; আর অতঃপর গুজব ছড়িয়ে পড়ে, গুপ্তচরেরা এক ধরনের বেতার তরঙ্গ সৃষ্টি করে রকেট বোমার গতি পাল্টে দিয়েই এই বিস্ফোরণগুলো ঘটিয়েছে। সন্দেহভাজন এক বিদেশি বৃদ্ধ দম্পতি এই কাজ ঘটিয়ে নিজেরাই নিজেদের ঘরে আগুন জ্বালিয়ে শ্বাসরোধ হয়ে মারা গেছে—সে খবরও রটিয়ে পড়ে।
মি. চ্যারিংটনের দোকানের উপরের সেই কামরায় যখন যেতে পারে জুলিয়া আর উইনস্টন—কাপড় খুলে রেখে খোলা জানালাপাশের বিছানায় শুয়ে থাকে। শরীর ঠাণ্ডা রাখার জন্যই এই নগ্নতা। ইঁদুরটিকে আর দেখা যায়নি, তবে গরমে ছারপোকা বেড়েছে ভয়াবহ বহুগুনে। তাতে ওদের তোয়াক্কা নেই। নোংরা বা পরিষ্কার যাইহোক, এই কামরা তাদের কাছে স্বর্গ। এখানে পৌঁছেই সবকিছুতে কালোবাজার থেকে কেনা পিপুলের গুঁড়ো ছড়িয়ে দেয় এরপর শরীর থেকে ছুঁড়ে ফেলে সব কাপড়, ঘামজবজবে শরীর দুটো ভালোবাসাবাসির আলিঙ্গনে জড়ায়, সঙ্গম হয়, অতঃপর গভীরঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। আর ঘুম ভাঙলেই উঠে দেখে ছারপোকারা সারি বেঁধে একজোট হয়ে পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
জুন মাসে তারা মিলিত হলো—চার, পাঁচ, ছয় পার করে সাত-সাতবার। সারাক্ষণ জিন পানের যে অভ্যাস ছিল তা ছেড়েছে উইনস্টন। এমনকি মনে হয়, সে যেন এর প্রয়োজনীয়তাই আর বোধ করছে না। কিছুটা মুটিয়েও গেছে সে। পেটের ভেতরে আলসার অনেকটা কম জ্বালাতন করছে, তবে পায়ের গোড়ালির উপরের ঘায়ের স্থানটিতে বাদামি রঙের ঘা এখনও কমেনি। আরও দারুণ বিষয়, প্রতি সকালে নিয়ম করে যে কাশির তোড়ে কাহিল হয়ে যেত—সেটিও বন্ধ হয়েছে। জীবনের অসহনীয় দিকটা থেকে বের হয়ে এসেছে সে। এখন আর টেলিস্ক্রিনের মুখোমুখি হতে হয় না, অথবা চিৎকার দিয়ে ভর্ৎসনা করার তাগিদও বোধ করে না। এখন তাদের একটি নিরাপদ লুকোনোর জায়গা আছে, যা অনেকাংশেই ঘরের মতো। এখানে তাদের দেখা যে ঘন ঘন হয় না, আর দেখা হলেও ঘণ্টা কয়েকের বেশি সেখানে থাকা অসম্ভব, তারপরেও তাদের কোনও অভাববোধ নেই। একটাই ভাবনা, এই ভাঙারির দোকানের উপরের কামরাটিরই অস্তিত্ব থাকবে তো।
কামরাটি অক্ষত থাকবে কি না তা আগেভাগে জানতে পারা স্রেফ অসম্ভব। এই কামরা যেন একটি জগত, একটি অতীতের সংরক্ষিত ভূমি যেখানে বিলুপ্ত প্রাণীরা চড়ে বেড়ায়। উইনস্টন ভাবে, মি. চ্যারিংটন নিজেই যেন এক বিলুপ্ত প্রাণী। সাধারণত এখানে পৌঁছে উপরে ওঠার আগে কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে মি. চ্যারিংটনের কথাবার্তা শোনে সে। এই বৃদ্ধ কদাচই ঘরের বাইরে গেছেন কিংবা হতে পারে কখনওই যাননি। আর বুড়োর দোকানে কোনও খদ্দের থাকে না বললেই চলে। এই ছোট্ট অন্ধকার দোকান আর তার চেয়েও ছোট একটি রান্না ঘর, যেখানে নিজেই খাবার তৈরি করেন, এই দুইয়ের মাঝে আটকে আছে তার ভূতুড়ে জীবন যাপন।
রান্নাঘরে অবিশ্বাস্য পুরোনো বিশাল হর্নওয়ালা একটি গ্রামোফোন। কথা বলার কাউকে পেলে বুড়ো খুশিই হন। মূল্যহীন এইসব সংগ্রহ তার। লম্বা নাকের ওপর ভারী কাচের চশমা বসিয়ে ওগুলোই খুটে খুটে দেখে সময় কাটে। সারাক্ষণই ঝুঁকে যাওয়া কাঁধে ঝুলে থাকে মখমলের জ্যাকেট। সবমিলিয়ে বেনে নয়, একজন সংগ্রাহকই মনে হয় তাকে। এক ধরনের অস্পষ্ট আতিশয্যে তার আঙ্গুলগুলো এইসব পুরোনো অপ্রয়োজনীয় বস্তু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে—চীনা বোতলের ছিপি, নস্যির কৌটার কারুকাজ করা ঢাকনা, শংকর ধাতুর লকেট যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক আগে মৃত কোনও শিশুর ক’টি চুল। আর এগুলো উইনস্টন কিনবে কিনা সে প্রশ্ন কখনওই উচ্চারিত হয়নি বুড়োর মুখে। এমনকি এগুলো তার ভালো লাগছে কিনা তাও জানতে চায়নি। বুড়োর সঙ্গে কথা বলার মানেই হচ্ছে কেবল শুনে যাওয়া, নয়ত বলা চলে ভাঙা রেকর্ড চালিয়ে বসে থাকা। স্মৃতির কোণা কোণা ঘেঁটে ভুলে যাওয়া আরও কিছু ছড়া এনে শুনিয়েছেন উইনস্টনকে। তারই একটি এক গণ্ডা আর এক কুড়ি কালোপাখির ছড়া, আরেকটি বাঁকানো শিংয়ের গরুর ছড়া, একটি আছে বোকা মোরগ রবিনের মৃত্যুগাথা। ‘এটি আমার ভালো লাগত, তোমার আগ্রহ থাকলেও থাকতে পারে’—যখনই নতুন কিছু পেয়ে যান একটা ছোট্ট হাসি ছড়িয়ে এই কথাটিই বলেন বুড়ো। তবে কোনওটারই গুটিকয় চরণ ছাড়া বাকিটা মনে করতে পারেন না।
তারা দুজনই জানে—দুজনেরই মনের মধ্যে রয়েছে, জীবনের এই নতুন ব্যবস্থা খুব বেশি দিন টিকে থাকার নয়। একটা সময় ছিল যখন অনাগত মৃত্যুর সত্যটি তাদের কাছে শুয়ে থাকা এই বিছানাটির মতোই সত্য হয়েছিল, আর এক ধরনের হতাশার অনুভূতি নিয়েই তারা একে অন্যকে আলিঙ্গনে জড়াত, ঠিক যেমন করে একটি স্তিমিত হয়ে আসা আত্মা জীবনের শেষ ঘণ্টা বাজার আগের পাঁচটি মিনিট শেষ আনন্দটুকু ভোগ করে নিতে চায়। তবে এমনও হয়েছে, কেবল যে নিরাপদ তাই-ই নয়—এই ব্যবস্থাই তাদের জন্য স্থায়ী হয়ে থাকবে দুজনই এমন বিভ্রমে আপ্লুত হয়ে থেকেছে। যতটা সময় তারা এই কামরায় থাকে, তাদের অনুভব বলে, কোনও ক্ষতিই তাদের হবে না। এখানে পৌঁছানোটা যতটা কঠিন ততটাই বিপজ্জনক; তবে কামরাটি যেন এক অভয়ারণ্য। উইনস্টনের চোখ পেপারওয়েটের হৃদয়ভূমিতে বিচরণ করছে, আর অনুভবে সে ওই কাচের জগতটাতেই ঢুকে পড়তে চাইছে। মনে হচ্ছিল একবার ঢুকে পড়তে পারলে সময়টিকেই বেঁধে ফেলা যাবে।
রেহাই পেয়ে যাবে এমন দিবাস্বপ্নও তারা কম দেখেনি। তাদের ভাগ্য তাদের সহায় হয়ে থাকবে আর প্রাকৃতিক মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এমনই জীবন তারা যাপন করে যাবে। অথবা ক্যাথরিন মারা যাবে আর কিছুটা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে উইনস্টন ও জুলিয়া বিয়ে করে ফেলবে। অথবা তারা দুজনই একসঙ্গে আত্মহত্যা করবে। অথবা তারা একসময় নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে, আর নিজেদের এমনভাবে পাল্টে দেবে যাতে কেউ চিনতেও পারবে না। প্রোলেতারিয়েতদের মতো করে কথা বলা শিখে নেবে, কোনও কারখানায় কাজ করবে আর পেছনের কোনও গলি-ঘিঞ্জিতে আবাস গাড়বে, কেউ জানবে না তারা কারা। এসবই ফালতু ভাবনা। আর তারা দুজনই তা জানে। বাস্তবতা হচ্ছে, রেহাই মেলার কোনও সুযোগ নেই। এমনকি আত্মহত্যার সচরাচর যে চর্চা দেখা যায়—সে পথে তাদের যাওয়ার কোনও ইচ্ছা নেই। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ চেষ্টা করে একটি বর্তমানই বুনন করে চলছে তারা, এর কোনও ভবিষ্যত নেই, এ এক যুদ্ধ, যা জয় করা সম্ভব নয়, ঠিক যেমন—কারও ফুঁসফুঁস ততক্ষণই শ্বাস নিতে পারে যতক্ষণ বায়ু সঞ্চালন থাকে।
কখনও এও হয়েছে, তারা পার্টির বিরুদ্ধে সক্রিয় বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়ার কথা ভেবেছে, কিন্তু এর পয়লা পদক্ষেপটিই কী হবে সে নিয়ে কোনও ধারণা নেই। এমনকি ব্রাদারহুডের যদি আদৌ কোনও অস্তিত্ব থাকে, তার জন্যও কোন পথে এগুতে হবে সে এক কঠিন চিন্তা। এরই মধ্যে ও’ব্রায়েনের সঙ্গে তার যে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে, কিংবা রয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায় সে কথাটিও জুলিয়াকে জানিয়েছে উইনস্টন। এছাড়াও কোথাও ও’ব্রায়েনের উপস্থিতিই যে বলে দেয় সে আসলে পার্টির লোক নয়, বরং শত্রু—আর সে তার সহযোগিতা চায়, এমন ভাবনার কথাগুলোও বলেছে।
কৌতূহলের দিক হচ্ছে, এসব কোনও কিছুই তার কাছে ভয়াবহ কোনও কাজ বলে মনে হয়নি। মানুষকে সেও চেহারা দিয়ে বিচার করে, আর সে কারণেই স্রেফ চোখের একটি চাহনির ওপর ভিত্তি করে উইনস্টন যেভাবে ও’ব্রায়েনকে বিশ্বাসযোগ্য বলে ধরে নিয়েছে তা তার কাছে স্বাভাবিকই ঠেকেছে। উপরন্তু সে মনে করে, সকলেই কিংবা প্রায় সকলেই গোপনে পার্টিকে ঘৃণা করে আর যখনই নিরাপদ বোধ করে পার্টির নিয়ম ভাঙে।
তবে সংগঠিত সুবিস্তৃত কোনও বিরোধী শক্তি আছে কিংবা থাকতে পারে এমনটা সে মানতে নারাজ। গোল্ডস্টেইন ও তার গোপন সেনা দল, তার মতে, নিছকই পার্টির সৃষ্ট কিছু ফালতু প্রচারণা। পার্টি নিজের প্রয়োজনে, উদ্দেশ্য হাসিলে এগুলো সৃষ্টি করে আর তোমাকে তা বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ে। অসংখ্যবার পার্টির মিছিলে, তাৎক্ষণিক বিক্ষোভে সে তারস্বরে চিৎকার করে সেইসব মানুষের মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে যাদের নামটিও কখনও শোনেনি, আর তাদের তথাকথিত অপরাধেও তার নেই সামান্য বিশ্বাস।
গণবিচারগুলোতে ইয়ুথ লিগের চ্যালারা যখন সকাল থেকে রাত অবধি আদালত ঘিরে অবস্থান নেয় আর থেমে থেকে চিৎকার করে ‘ষড়যন্ত্রীর ফাঁসি চাই!’ তখন সেও একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচিতে অন্যদের সঙ্গে সেও গোল্ডস্টেইনের অপমানে চিৎকার করে ঠিকই কিন্তু গোল্ডস্টেইন কে আর কোন নীতিরই সে প্রতিনিধিত্ব করছে—সে বিষয়ে তার ধারণা অতীব ক্ষীণ। বিপ্লবের পরেই তার বেড়ে ওঠা আর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে যে আদর্শিক সংগ্রাম চলেছে তা মনে রাখার মতো বয়স তার ছিল না।
একটি স্বাধীন রাজনৈতিক অন্দোলনের মতো ঘটনা তার কল্পনারও অতীত; আর যেভাবেই হোক এটাই তার বদ্ধমূল ধারণা যে পার্টি অজেয়। পার্টি থাকবে, আর সদাই একইরকম থাকবে। এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের একটিই পথ তা হচ্ছে গোপন অবজ্ঞা, আর অমান্য করে যাওয়া, অথবা সর্বোচ্চ যা হতে পারে তা হচ্ছে বিচ্ছিন্ন কিছু সহিংসতা ঘটিয়ে চলা, যেমন কাউকে হত্যা করা অথবা কিছু একটা উড়িয়ে বা ধ্বংস দেওয়া।
পার্টির প্রচারণার কোনওটিতে তার অবিশ্বাস উইনস্টনের চেয়ে অনেক তীব্র আবার কোনওটি গ্রহণ করে নিতে উইনস্টনের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে। একদিন ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ে কথা হচ্ছিল, সেদিন তাকে চমকে দিয়ে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় জুলিয়া বলে ফেলল, তার বিশ্বাস যুদ্ধটা হচ্ছেই না। প্রতিদিন লন্ডনে যেসব রকেট বোমা পড়ছে, ওগুলো যথেষ্ঠই সম্ভব যে ওশেনিয়ার সরকার নিজেই ফেলছে। আর তা স্রেফ মানুষকে আতঙ্কের মধ্যে রাখার জন্যই করছে।
এমন একটি ভাবনা উইনস্টনের মধ্যে কখনওই আসে নি। এছাড়াও তাকে অনেকটা ইর্ষান্বিত করে দিয়ে জুলিয়া বলল, দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচিগুলোতে তার কাছে যা সবচেয়ে কঠিন মনে হয় তা হচ্ছে, এই চিৎকার আর হাসাহাসিতে অংশ না নিয়ে না পারাটা। তবে পার্টির এইসব শিক্ষার বিরুদ্ধে সে তখনই প্রশ্ন তোলে যখন তা তার ব্যক্তিজীবনের ওপর এসে পড়ে।
কখনও কখনও সে সরকারি মিথগুলো মেনে নিতেও রাজি থাকে, কারণ সত্য আর মিথ্যার মধ্যে যে ফারাক তার কাছে তা গুরুত্বপূর্ণ মনেই হয় না। উদাহরণস্বরূপ, স্কুল থেকেই সে জেনে এসেছে, পার্টি উড়োজাহাজ আবিষ্কার করেছে, আর তাতেই তার বিশ্বাস। (উইনস্টন স্মরণ করতে পারে, পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে তার নিজের স্কুলের দিনগুলোতে পার্টি দাবি করেছিল, তারা হেলিকপ্টার আবিষ্কার করেছে। তার কয়েক ডজন বছর পেরিয়ে, যখন জুলিয়া স্কুলে যায় তখন পার্টির দাবি উড়োজাহাজ আবিষ্কারের; হতে পারে আরেক প্রজন্ম পার করে কী জানি বাষ্প-ইঞ্জিন আবিষ্কারের কৃতিত্বও পার্টিই নিয়ে নেয় কি না। ) আবার জুলিয়াকে যখন সে জানায় তার জন্মেরও আগে, বিপ্লবের অনেক অনেক পূর্বে উড়োজাহাজ আবিষ্কৃত হয়েছে, তখন সেই সত্য তার কাছে কোনও আগ্রহই তৈরি করে না। এটা ঠিক, কে উড়োজাহাজ আবিষ্কার করেছে তাতে কী-ই যায় আসে? তবে সত্যিই একটা ঝাঁকুনি লাগে যখন জুলিয়ার কিছু মন্তব্য থেকে বুঝতে পারে, মাত্র চার বছর আগে ওশেনিয়া যে পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল আর ইউরেশিয়ার সঙ্গে ছিল শান্তির সম্পর্ক—সেকথাও সে বেমালুম ভুলে বসে আছে।
এটা সত্য, গোটা যুদ্ধটাকেই সে প্রতারণা বৈ কিছু মনে করে না, এখন মনে হচ্ছে শত্রুপক্ষ যে পাল্টে গেছে সেটার খোঁজও সে রাখে না। ‘আমি ভেবেছিলাম আমরা বরাবরই ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছি’—গুরুত্বহীনভাবেই বলল সে। এতে কিছুটা আতঙ্ক বোধ করল উইনস্টন। উড়োজাহাজ আবিষ্কারের ঘটনা তার জন্মের অনেক বছর আগের, কিন্তু যুদ্ধের বিষয়টি তো ঘটে গেছে মোটেই চার বছর আগে। তখন সে পুরোই বড় হয়ে উঠেছে। উইনস্টন এ নিয়ে তার সঙ্গে প্রায় পনের মিনিট ধরে যুক্তিতর্ক দিল। আর অবশেষে সে সফল হলো তার স্মৃতিতে জোর করে হলেও কিছু ঘটনা টেনে আনতে। আর সে হালকা করে হলেও মেনে নিল একটা ইউরেশিয়া নয়, শত্রুপক্ষ ছিল পূর্ব এশিয়া। তবে তারপরেও এই বিষয় থোরাই গুরুত্ব পেল তার কাছে। ‘কে পাত্তা দেয়?’—অধৈর্যের উচ্চারণ জুলিয়ার। ‘সব সময়ই একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, আর মানুষ জানে এসব খবরই মিথ্যা। ’
রেকর্ড ডিপার্টমেন্টে তার নির্লজ্জ প্রতারণামূলক কাজগুলো নিয়েও জুলিয়ার সঙ্গে মাঝে মধ্যে কথা হয়। এ বিষয়গুলোও তাকে আতঙ্কিত করে না। মিথ্যাগুলোর এমন সত্যায়নের যে বেসাতি চলছে তা নিয়ে তার ভাবান্তর নেই। সে তাকে জোন্স, অ্যারোনসন, আর রাদারফোর্ডের গল্পও শোনালো, তার হাতে পড়ে যাওয়া সেই এক খণ্ড কাগজের কথাও বলল। এসব কিছুতেই তার মধ্যে কোনও অভিব্যক্তি তৈরি হলো না। এমনকি প্রথম শুনে সে বিষয়টির গুরুত্বই অনুধাবন করতে পারে নি।
‘ওরা কি তোমার বন্ধু ছিল?’—বলল জুলিয়া।
‘না আমি ওদের চিনতাম না। ওরা ছিল ইনার পার্টির সদস্য। পাশাপাশি, ওরা আমার চেয়ে বয়সেও অনেক বড় ছিল। ওরা পুরনো দিনের মানুষ, বিপ্লবেরও আগের। ওদের কদাচই সামনাসামনি দেখেছি আমি। ’
‘তাইলে ওদের নিয়ে উদ্বেগের কী আছে? অহরহ মানুষ হত্যা চলছে, বলো চলছে না?’
সে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করল। ‘এটি একটি ভিন্ন বিষয়। এটি স্রেফ কেউ একজনকে হত্যা করা হলো, এমন বিষয় নয়। তুমি বুঝতে পারো, গতকাল থেকে শুরু হয়েছে যে অতীত, তা মূলত বিলুপ্ত? যদি সে অতীত কোথাও টিকে থাকে, তা স্রেফ কিছু খাঁটি বস্তুতে, তার সঙ্গে কোনও বক্তব্য জুড়ে থাকছে না, ঠিক ওই কাচের তৈরি গোলাকার বস্তুটির মতো। এরই মধ্যে বিপ্লব এবং বিপ্লবের আগেকার কথার প্রায় সবটাই আমাদের অজানা হয়ে গেছে। প্রতিটি নথিই হয় ধ্বংস করা হয়েছে নয়ত মিথ্যায়নে সিদ্ধ, প্রতিটি বই নতুন করে রচিত হয়েছে, প্রতিটি ছবি নতুন করে আঁকা হয়েছে, প্রতিটি মূর্তি, প্রতিটি সড়ক, প্রতিটি ভবন নতুন নাম পেয়েছে, প্রতিটি তারিখ বদলে দেওয়া হয়েছে। আর সে প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে দিনের পর দিন, মিনিটের পর মিনিট। ইতিহাস থেমে গেছে। একটি অসীম বর্তমান ছাড়া কোনও কিছুই আর টিকে নেই, আর সেই বর্তমানটাই এমন যেখানে পার্টিই সদা সঠিক।
আমি জানি, অবশ্যই জানি, অতীত মিথ্যা হয়ে গেছে, কিন্তু আমি কখনওই তা প্রমাণ করতে পারব না, এমনকি আমি নিজে এই মিথ্যায়নের সঙ্গে যুক্ত থেকেও না। কোনও বস্তু চলে গেলে তার প্রমাণ আর কখনওই মিলবে না। একমাত্র প্রমাণ আমার নিজের মনের ভিতর বিরাজ করবে, আর কোনও নিশ্চয়তা দিয়েই আমি জানতে পারছি না আর কোনও মানব সন্তানই আমার মতো একই স্মৃতি বহন করছে কি না। আমার গোটা জীবনে মাত্র ওই একটি ঘটনাই ছিল, যা ঘটনার অনেক অনেক বছর পর আমার হাতে তার একটি সত্যিকারের প্রমাণ হিসেবে ধরা দিয়েছিল। ’
‘তাতে হলো টা কী?’
‘কিছুই হলো না, কারণ আমি কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেটি ছুঁড়ে দিয়েছি স্মৃতি গহ্বরে। কিন্তু একই ঘটনা যদি আজ আবারও ঘটে, আমি কিন্তু তা রেখে দেব। ’
‘আমি রাখব না!’—বলল জুলিয়া। ‘আমি এমন একটি ঝুঁকি অবশ্যই নিতে রাজি, কিন্তু তখনই নেব যখন তার একটা গুরুত্ব থাকবে, মূল্য থাকবে, পুরনো সংবাদপত্রের একটি ছেঁড়া অংশের জন্য নিশ্চয়ই নেব না। ধরো কাগজের টুকরোটি যদি এখনও তোমার কাছে থাকত, তুমি কী-ই করতে পারতে?’
‘হয়ত বেশি কিছু করতে পারতাম না। কিন্তু ওটা একটা প্রমাণ হয়ে নিশ্চয়ই থাকত। যদি আমি সাহস করে কাউকে ওটা দেখাতে পারতাম, তাতে এখানে সেখানে কিছু সন্দেহের বীজ বপন করা হয়ে যেত। কল্পনায়ও ভাবি না, আমরা আমাদের জীবদ্দশায় কোনও কিছুই পাল্টে দিতে পারব। কিন্তু ছোট ছোট প্রতিবাদ এখানে সেখানে গড়ে উঠবে সে কথাটুকু ভাবনায় স্থান দেওয়া যায় বৈকি। ছোট ছোট দলে মানুষ জোটভুক্ত হচ্ছে, আর ধীরে ধীরে তা বেড়ে উঠছে, আর এমনকি কিছু কিছু ঘটনা ঘটিয়েও চলছে, যা পরের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাবে এমনটা ভাবা কিন্তু অলীক নয়। ’
‘পরের প্রজন্ম নিয়ে আমার কোনও আগ্রহ নেই প্রিয়তম। আমি স্রেফ আমাদিগেই আগ্রহী। ’
‘তোমার বিদ্রোহ স্রেফ কোমরের নিচেই সীমাবদ্ধ’—উইনস্টন বলল জুলিয়াকে। দারুণ বুদ্ধিতায় আর চতুরতায় সে এটা মেনে নিল আর তাকে দুবাহু বাড়িয়ে গভীর আনন্দ আলিঙ্গনে জড়াল।
পার্টির মতবাদের এসব শাখা-প্রশাখা নিয়ে তার সামান্যতম আগ্রহও নেই। যখনই উইনস্টন ইংসকের নীতি নিয়ে কথা বলে, দ্বৈতচিন্তা, অতীত মুছে দেওয়া, বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতার অস্বীকার, কিংবা নিউস্পিকে ব্যবহৃত শব্দ নিয়ে কথা তোলে—সে বিরক্ত হয়, তালগোল পাকিয়ে ফেলে আর বলে, এসবে তার আগ্রহ বা আকর্ষণ কোনও কালেই ছিল না। সবাই জানে এসব কিছুই ফালতু, তাহলে কেনই কেউ এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হবে? সে জানে কখন আনন্দিত হতে হবে, কখন ধুয়ো তুলতে হবে, আর কারও ঠিক সেটুকু জানলেই চলে। এরপরেও উইনস্টন যদি এসব বিষয় নিয়ে কথা চালিয়ে যেতে থাকে তখন সে আস্তে করে ঘুমিয়ে পড়ে। কিছু মানুষ আছে না, যে কোনও সময় যে কোনও স্থানে ঘুমিয়ে পড়তে পারে—সে তাদেরই একজন।
গোঁড়ামির মানেটা পর্যন্ত না জেনে নিজেকে একজন পাক্কা গোঁড়া হিসেবে সাজিয়ে রাখা যে কত সহজ তা জুলিয়ার সঙ্গে কথা বলেই প্রথম বুঝেছে উইনস্টন। কোনও না কোনওভাবে পার্টি খুব সফলতায় মানুষকে তাদের বোধে অক্ষম করে তুলতে পেরেছে। বাস্তবতার ভয়াবহ লঙ্ঘনটিও তারা মেনে নেয়, কারণ তারা কখনও জানেই না তাদের কাছে কী চাওয়া হচ্ছে, আর সরকার কোথায় কী ঘটিয়ে চলেছে তা নিয়ে তাদের আগ্রহও সামান্যই। স্রেফ নির্বুদ্ধিতার জোরেই ওরা হয়ে থাকে যৌক্তিক। তারা সবকিছু গলধঃকরণ করে, আর যা কিছুই গিলুক তাতে তাদের কোনও ক্ষতি-বৃদ্ধি হয় না, এর কোনও অবশিষ্টাংশ থাকে না। ভুট্টার একটি দানা যেমন পাখির ঠোঁট থেকে পেটে ঢুকে মলের সঙ্গে বেরিয়ে যায় ঠিক তেমন।
অধ্যায় ৬
অবশেষে ঘটনাটি ঘটল। প্রত্যাশিত বার্তাটি পৌঁছুল। গোটা জীবন ধরেই, বলা যায়, এমন কিছুর অপেক্ষা ছিল তার।
মন্ত্রণালয়ের লম্বা কোরিডোর ধরে হেঁটে যাচ্ছে। সেবার জুলিয়া যেখানে হোঁচট খেয়েছিল ঠিক তার কাছাকাছি যখন পৌঁছায় তখনই মনে হলো তার চেয়ে গায়ে-গতরে বড়সড়ো হবে এমন কেউ একজন ঠিক পিছনে। গলা খাকরির শব্দ কানে এলো। মনে হলো যিনি শব্দ করছেন তিনি কথা বলতে চান। উইনস্টন থামল আর ঘুরে তাকাল। ইনি ও’ব্রায়েন।
অবশেষে তারা মুখোমুখি, আর তার চেতনা ততক্ষণে বুঝি পুরোই উবে যাচ্ছে। হৃদযন্ত্রের ধুকপুকানি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মুখে কথা সরছে না। ও’ব্রায়েন অবশ্য যে ভঙ্গি আর গতিতে হাঁটছিলেন সেটাই বজায় রেখে এগিয়ে এলেন। উইনস্টনের বাহুতে তার একটি বন্ধুত্বের হাত এক লহমার জন্য পড়ল আবার সরে গেল। এবার দুজন পাশাপাশি হাঁটছে। তিনিই কথা বলতে শুরু করলেন যাতে মিশে আছে পুরোনো সেই অদ্ভুত সৌজন্যতা, ঠিক যা তাকে পার্টির অন্য সদস্যদের চেয়ে আলাদা করে রাখে।
‘তোমার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ খুঁজছিলাম’—বললেন তিনি। সেদিন ‘দ্য টাইমসে’ তোমার নিউস্পিক নিয়ে আর্টিকেলগুলোর একটি পড়লাম। তখন থেকেই মনে হচ্ছিল তোমার সঙ্গে কথা বলব। আমার ধারণা, নিউস্পিকের বিষয়ে তুমি কিছুটা পাণ্ডিত্যের আগ্রহ নিয়েছো।
উইনস্টন ততক্ষণে কিছুটা নিজেতে ফিরেছে। ‘পাণ্ডিত্যের কিছু নয়’—বলল সে। ‘আমি একজন নবীশ মাত্র। আর ওটি আমার বিষয়ও নয়। ভাষার সত্যিকারের কাঠামো নিয়ে আমার কখনওই কিছু করা হয়নি। ’
‘কিন্তু তুমি অত্যন্ত সুচারুভাবেই বিষয়টি লিখেছো’—বললেন ও’ব্রায়েন। ‘আর সেটা কেবল আমার একার মত না। সম্প্রতি এ নিয়ে তোমার এক বন্ধুর সঙ্গেও আমার কথা হয়, আর সে তো নিঃসন্দেহে একজন বিশেষজ্ঞ। তবে নামটা এখন ঠিক ভুলে গেছি। ’
আবারও ব্যথা ধরিয়ে লাফাতে লাগল উইনস্টনের হৃদযন্ত্র। তার মনে হলো রেফারেন্সের এই নামটি সাইম ছাড়া অন্য কারও হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সাইম তো কেবল মৃতই নয়, পুরোই বিলীন, এই নামে কখনওই কেউ ছিল না। তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনও কিছুর চিহ্নটিও এখন মৃত্যুসম ভয়াবহ। ও’ব্রায়েনের এই মন্তব্য নিঃসন্দেহে একটি সিগন্যাল বা কোড। থটক্রাইমের একটি ছোট্ট কাজের কথা তুলে ধরে তিনি মূলত দুইজনের মধ্যে যোগসাজশ টেনে দিলেন। ধীরে ধীরে তারা কোরিডোরের শেষ দিকটাতে চলে এসেছে। এবার ও’ব্রায়েন থামলেন। কৌতূহলী, চমৎকার বন্ধুত্বের চাহনি দিয়ে, স্বভাবজাত ভঙ্গিমায় চোখের চশমা জোড়া ঠিক করে নাকের ডগায় বসালেন। এবার বললেন:
‘আসলে আমি বলতে চাই, নিবন্ধে তুমি দুটি শব্দের ব্যবহার করেছো যা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে তা খুব সম্প্রতিই। তুমি কি নিউস্পিক অভিধানের দশম সংস্করণটি পড়ো নি?’
‘না’—বলল উইনস্টন। ‘আমি জানতাম না ওটি এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। রেকর্ডস ডিপার্টমেন্টে আমরা এখনও নবম সংস্করণ ব্যবহার করছি। ’
‘কয়েক মাসের মধ্যেই দশম সংস্করণ আসবে। কিছু অগ্রীম কপি বিতরণ করা হয়েছে। আমার কাছেও একটি আছে। আমার ধারণা, তুমি এটি দেখতে চাইবে?’
‘ভীষণভাবে’—অতি আগ্রহের সঙ্গে বলল উইনস্টন।
‘নতুন কিছু অগ্রগতি আছে তবে ভীষণ রকম স্বদেশীপনা তুমি এতে পাবে। ক্রিয়া পদগুলো কমিয়ে ফেলা হয়েছে—আমার ধারণা এটার একটা আবেদন তোমার কাছে থাকবে। দেখি, কেউ একজনকে দিয়ে তোমাকে একটা ডিকশনারি পাঠিয়ে দিতে পারি কি না। তবে নিঃসন্দেহে আমি ভুলে যাব। হতে পারে, সুবিধা মতো সময়ে তুমিই একদিন আমার ফ্ল্যাটে এসে ওটি নিয়ে যেতে পার। দাঁড়াও। তোমাকে ঠিকানাটা দিয়ে দিচ্ছি। ’
ওরা দুজনই টেলিস্ক্রিনের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। অন্যমনষ্কতায় ও’ব্রায়েন তার দুই পকেটের ওপর হাত বুলিয়ে অস্তিত্ব বুঝে নিয়ে এবার বের করে আনলেন চামড়ার মলাটের একটা নোটবুক আর সোনালি রঙের একটা ইঙ্ক-পেন্সিল। ঠিক টেলিস্ক্রিনের নিচে এমন একটা স্থানে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন যেখান থেকে এই নোটবুকে যা লেখা হবে তা টেলিস্ক্রিনে চোখ রাখলেই অন্যরাও দেখতে পাবে। একটি পাতায় তিনি ঠিকানাটি লিখলেন আর তা ছিঁড়ে উইনস্টনের হাতে দিলেন।
‘সন্ধ্যায় আমি সাধারণত ঘরেই থাকি’—বললেন তিনি। ‘আর না থাকলে আমার কাজের লোকটি তোমাকে ডিকশনারিটি দিয়ে দেবে। ’
তিনি চলে গেলেন, এক টুকরো কাগজ হাতে ধরে উইনস্টন তখনও দাঁড়িয়ে। এই কাগজের টুকরো লুকিয়ে রাখার কোনও দরকার নেই। বরং খুব সতর্কতার সঙ্গে ওতে যা লেখা আছে তা স্মৃতিতে ধরে নিল, আর ঘণ্টা কয়েক পরে ওটি আরও অনেক কাগজের সঙ্গে স্মৃতি গহ্বরে চালান করে দিল।
মোটে মিনিট কয়ই হবে তারা দুজন কথা বলল। তবে এই ঘটনার একটাই অর্থ দাঁড়ায়; উইনস্টনকে জানিয়ে দেওয়া হলো ও’ব্রায়েনের ঠিকানা। এর দরকার ছিল, কারণ সরাসরি খোঁজ না করলে কারও পক্ষেই জানা সম্ভব নয়, কে কোথায় থাকে। ঠিকানায় কোথা থেকে কোথায় যাবে তার কোনও উল্লেখ নেই। আসলে ও’ব্রায়েন তাকে বলে গেলেন, ‘তুমি যদি কখনও আমার সঙ্গে দেখা করতে চাও তাহলে এই হলো আমার ঠিকানা। ’ হতে পারে ডিকশনারির ভেতরেও কোথাও লুকিয়ে দেওয়া হবে কোনও বার্তা। কিন্তু সে যাই হোক, একটি বিষয় পুরোই নিশ্চিত। যে ষড়যন্ত্র সে স্বপ্নেই শুধু দেখেছে তা বাস্তবে আকার নিচ্ছে। আর সে প্রায় তার কিনারায় পৌঁছে গেছে।
সে জানে, শিগগিরই নয়ত পরে ও’ব্রায়েনের ডাকে সাড়া দেবেই। হতে পারে আগামীকালই, অথবা হতে পারে অনেকদিন পর—কোনওটাই তার কাছে নিশ্চিত নয়। যা কিছু ঘটে চলেছে তা আসলে অনেক বছর আগে শুরু হওয়া একটি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। প্রথম পদক্ষেপটি ছিল গোপন এক অনৈচ্ছিক ভাবনায়, আর দ্বিতীয়টি আকার পায় ডায়রি লিখতে শুরু করার মধ্য দিয়ে। এতে তার ভাবনা রূপ নিল শব্দে আর এখন শব্দগুলো রূপ নিচ্ছে কাজে। আর শেষ পদক্ষেপটি এমন কিছু হবে যা ঘটবে ঠিক ভালোবাসা মন্ত্রণালয়ের ভেতরেই। এটা সে মেনেই নিয়েছে। শুরুতেই নিহিত রয়েছে এর শেষ। তবে ভীতিকর দিক হচ্ছে; অথবা আরও নির্দিষ্ট করে বলা চলে, এ হচ্ছে মরার আগেই মৃত্যুর স্বাদগ্রহণ। এমনকি যখন ও’ব্রায়েনের সঙ্গে তার কথা চলছিল, তখন শব্দের অর্থগুলো তলিয়ে যাচ্ছিল, আর এক হীমশীতল কম্পন জাপটে ধরেছিল তার শরীর। তার মনে হচ্ছিল স্যাঁতস্যাঁতে কবরের মধ্যে পা ফেলেছে, আর এ যেন সেই কবর যা তার জন্যই অপেক্ষা করে ছিল।
অধ্যায় ৭
কান্নাভরা চোখে ফোঁপাতে ফোঁপাতে ঘুম ভাঙল উইনস্টনের। জুলিয়া গুটিসুটি হয়ে তার পাশে ঘুমিয়ে। ঘুমের ঘোরেই বলে উঠল, ‘কী হয়েছে?’
‘স্বপ্ন দেখেছি—’ বলতে ধরেই থেমে গেল সে। এমন জটিল স্বপ্ন শব্দে তুলে ধরা অসম্ভব। স্বপ্ন তো ছিলই, এর সঙ্গে যুক্ত হয় একটি স্মৃতি, যা ঘুমভাঙ্গার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মনের মাঝে সন্তরণ শুরু করে।
চোখ বন্ধ করে চিৎ হয়ে শুয়ে রইল সে, তখনও যেন স্বপ্নের ঘোরেই আচ্ছন্ন। একটি সুবিস্তৃত উজ্জ্বল স্বপ্ন যা তার গোটা জীবনটাকেই ধারণ করে সামনে তুলে ধরেছে। গ্রীষ্মের বিকেলে বৃষ্টির পর দৃশ্যপট যেমন স্পষ্ট হয়ে ওঠে ঠিক যেন তেমনই। পুরোটাই ঘটে গেছে কাচের পেপারওয়েটের ভেতরে, আর এর উপরিতলটি যেন হয়েছিল আকাশের ছাদ। সেই ছাদের নিচে সবকিছুই যেন স্বচ্ছ মোলায়েম আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে আর সেখানে অতিদূরের বস্তুও স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে চোখে। স্বপ্নমাঝে আরও এলো তার মায়ের ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখা বাহু, আর তার সঙ্গে মিশে গেল ত্রিশ বছর পরে খবরের ভিডিওচিত্রে দেখা সেই ইহুদি নারীর বাহুখানি যা টুকরো টুকরো হয়ে উড়ে যাওয়ার আগে বুলেটের আঘাত থেকে প্রাণপণে বাঁচাতে চেষ্টা করছিল ছোট্ট শিশুটিরে।
‘তুমি কী জানো’—বলল সে, ‘এখনও আমার মনে হয়, আমিই আমার মাকে হত্যা করেছি?’
‘কেন তুমি হত্যা করলে তোমার মাকে?’ ঘুমের ঘোরেই বলল জুলিয়া।
‘না ঠিক হত্যা নয়! শারীরিকভাবে হত্যা বলা যাবে না!’
স্বপ্নে এসেছিল মায়ের সঙ্গে তার শেষ দেখা হওয়ার দৃশ্যটিও। কিন্তু ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার কয়েক দণ্ডের মধ্যে ছোট ছোট ঘটনাকে ঘিরে সেই স্মৃতি তার মনে এসে পুরো দানা বাঁধলো। এ এমন এক স্মৃতি যা সে ইচ্ছাকৃত সচেতনতায় ঠেলে দূরে সরিয়ে রেখেছে অনেক বছর। তারিখটি ঠিক মনে নেই, তবে তখন তার বয়স দশ বছরের কম হবে না, হতে পারে বারো বছর বয়স তার তখন।
বাবা নিখোঁজ হন তারও কিছু আগে, কতটা আগে তা মনে নেই। তবে ভালো করেই মনে আছে, সে ছিল শোরগোলের এক অস্থির সময়। ভীতিকর বিমান হামলা, আর টিউব স্টেশনে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনা ক’দিন পরপরই ঘটত। এখানে সেখানে ইট-পাথরের ধ্বংসস্তূপ, সড়কের কোণায় কোণায় অবোধ্য সব ঘোষণার পোস্টার সাঁটা, একই রঙের শার্ট পরে যুবকরা বেকারিগুলোর বাইরে বিশাল লাইন ধরে দাঁড়িয়ে, থেকে থেকে দূর থেকে ভেসে আসছে মেশিনগানের গর্জন… সর্বোপরি, এটাই বড় বাস্তবতা যে, পর্যাপ্ত খাবার ছিল না কারও। তার মনে আছে, অনেক দীর্ঘ বিকেল তার কেটেছে আরও ছেলেদের সঙ্গে ডাস্টবিনের ময়লা স্তূপ ঘেঁটে ঘেঁটে বাঁধাকপির পাতা থেকে ডাঁটা আর আলুর ছোবড়া কুড়িয়ে, কখনও পেয়ে যেত এক আধ টুকরো রুটি, সতর্কে ময়লা ছড়িয়ে তা খেত আর পথ দিয়ে কখন আসে কোনও ট্রাক তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত। গবাদির খাদ্যবাহী সেসব ট্রাক সড়কের এবড়ো থেবড়ো অংশে ঝাঁকি খেলে তা থেকে পড়ত খৈলের গুঁড়ো।
যখন তার বাবা নিখোঁজ হলেন, মাকে তার এতটুকু বিস্মিত বা বিচলিত মনে হলো না, দেখালেন না কোনও সহিংস শোকেরও প্রকাশ। কিন্তু হঠাৎই যেন পাল্টে গেলেন তিনি। যেন পুরোই এক নিষ্প্রাণ মানবী। উইনস্টনের তখন মনে হতো তার মা যেন কোনও কিছুর অপেক্ষায়, আর তিনি জানতেন নিশ্চিতভাবেই তা ঘটবে।
প্রয়োজনীয় সব কাজই করতেন মা—রান্না, ধোওয়া-মোছা, সারাই, বিছানা পাতা, ঝাড়-মোছ, আগুনের চুল্লি জ্বালানো—এসবই করতেন, কিন্তু অতি ধীর লয়ে, তাতে থাকত না সামান্য প্রাণের ছাপ। যেন চিত্রপটে আঁকা কোনও মানবীর শরীর ধীরে ধীরে নিজের স্থানে থেকেই নড়াচড়া করছে। তার বড় সুডৌল তনুখানি মনে হতো যেন প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে গেছে। কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিছানায় অনড় বসে বসে তার ছোট বোনটির সেবায় কাটিয়ে দিতেন। ক্ষীণকায়, রোগাক্রান্ত অতি নীরব এক শিশু। বয়স দুই কি তিন হবে, শুকনো মুখখানি বানরের মতো দেখতে। কোনও কোনও দিন উইনস্টনকে কাছে টেনে নিতেন আর দীর্ঘ সময় ধরে তাকে বুকে চেপে ধরে রাখতেন, মুখে রা শব্দটিও থাকত না। ছোট হলেও, আর কিছুটা স্বার্থপরতার পরেও সে তখন বুঝত এই বুকে চেপে রাখার সঙ্গে ওই ঘটতে চলা ঘটনাটির সম্পর্ক রয়েছে যা তার মা তাকে মুখ ফুটে বলছেনই না।
তার মনে পড়ে যে কামরায় তারা থাকত সেটি ছিল অন্ধকার, গুমোট গন্ধময় যার অর্ধেকটা জুড়েই ছিল সাদা চাদর পাতা একটি বিছানা। ফেন্ডারের ভেতরে গ্যাসের চুলা বসানো ছিল আর খাবার তুলে রাখার তাক। বাইরের আঙ্গিনায় মাটির পাড়ের একটি কূপ, কয়েকটি পরিবার মিলে পানির ব্যবহার চলত। তার মনে পড়ে মায়ের স্থির অনড় দেহখানি গ্যাসের চুলায় কড়াই বসিয়ে দিয়ে কিছু একটা রান্নায়রত।
সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে সদাই এক ক্ষুধার্ত সে, আর খাবারের বেলা এলেই যে ঘৃণ্য লড়াইয়ে সামিল হতে হতো সে কথাও। মায়ের সঙ্গে সারাক্ষণ ঘ্যান-ঘ্যান, কেন খাবার থাকে না? মাঝে মাঝে চিৎকার-চেঁচামেচিও জুড়ে দিত, মায়ের ওপর ঝাপিয়ে পড়ত (আজ এই সময় নিজের গলার স্বরটিও তার মনে পড়ে, যা কৈশোরের একটু আগেই ভেঙ্গে কর্কশ শোনাত, আর মাঝে মাঝে তা থেকে অদ্ভুত শব্দ বের হতো) অথবা খাবারের ভাগ বেশি পাওয়ার জন্য নাকি-কান্না জুড়ে দিত।
তার মা বরাবরই ভাগে যতটুকু তার চেয়ে বেশিই দিতেন। তিনি মেনেই নিয়েছিলেন, সে ‘ছেলে’ বলে তার ভাগটা সবচেয়ে বড়; কিন্তু মা যত বেশি তাকে দিতেন সে চাইত তার চাইতেও বেশি। প্রতিবেলা খাবারের সময় মা তাকে বোঝাতেন এমন স্বার্থপরের মতো করতে নেই, ছোট্ট বোনটি অসুস্থ, ওর বেশি খাওয়া দরকার, কিন্তু কোনও কথাই গায়ে মাখত না। পাতে তার হাতাভর্তি হয়ে খাবার পড়তে থাকবে, বন্ধ হলেই চিৎকার, কখনও কখনও কড়াই ও চামচ সমেত কেড়ে নিতে চাইত। খাবলা মেরে তুলে নিত বোনের পাতের খাবার।
সে জানত তার কারণেই অন্য দুজন অভুক্ত থাকছে, কিন্তু কাজটি সে না করে পারত না; আর এমনকি তার ভাবনাও ছিল যা সে করছে সে তার অধিকার। পেটের রাক্ষুসে ক্ষুধার কারণেই এসব অসদাচরণ তার কাছে সঠিক বলে মনে হতো। আর দুই বেলা খাবারের মাঝে মা আশেপাশে না থাকলেই তাকে তুলে রাখা খাবারের ওপর হানা দিত সে।
একদিন চকলেটের রেশন জারি হলো। গত কয়েক সপ্তাহ কিংবা মাসে এই প্রথম রেশনে মিলল চকোলেট। তার খুব স্পষ্টই মনে পড়ে, কী দারুণ ছিল ছোট ছোট চকোলেটের টুকরোগুলো। এক ফালিতে দুই-আউন্স (তখনও তাদের আউন্সের হিসাব চলত)। আর তা সমান তিন খণ্ডে ভাগ করা যেত। এটাই হওয়ার কথা, তিন জন এক টুকরো করে পাবে। কিন্তু আজও উইনস্টন যেন কানে শুনতে পায়, পুরো চকোলেট একা খাবে বলে তার সে কি তারস্বরের চিৎকার। টানা ঘ্যানঘ্যান, আর মুখে মুখে কথা চালাল মায়ের সঙ্গে। আর চিৎকার-চেঁচামেচি, অনুযোগ, চোখের পানি, ওজোর-আপত্তি, প্যানপ্যানানি।
তার শীর্ণকায় বোনটি দুই হাতে মাকে আঁকড়ে ধরে আছে, ঠিক যেন বানরশিশু। আর মায়ের ঘাড়ের উপর দিয়ে তার দিকে ড্যাবড্যাবে করুণ চোখে চেয়ে আছে। অবশেষে চকোলেটের চার-ভাগের তিন ভাগ তাকে দিতে বাধ্য হলেন মা আর অপর একভাগ তার বোনকে দিলেন। ছোট্ট মেয়েটি ওটি হাতে ধরে বসে আছে আর ভ্যবলা চোখে তাকিয়ে রয়েছে, মনে হয় বুঝতেই পারছে না বস্তুটি দিয়ে কী করবে। ওই টুকরোটির ওপরও উইনস্টনের লোভী নজর পড়ল। সুযোগ বুঝে ওটি ছোঁ মেরে নিয়ে দরজা ঠেলে দৌড়ে পালাল।
‘উইনস্টন, উইনস্টন!’—পেছনে ডাক জুড়ে দিলেন মা। ‘ফিরে এসো, বোনের চকোলেট ফেরত দাও। ’ সে থামল, কিন্তু ফিরল না। তার মায়ের উদ্বিগ্ন চোখ দুটো তার চোখে স্থির হয়ে থাকল কিছুক্ষণ। আজও সে জানতে পারেনি, কী ছিল সেই ঘটনা যা ঘটতে ধরেছিল, যা নিয়ে ছিল মায়ের এত উদ্বেগ।
বোনটি, তার হাত থেকে কিছু একটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে বুঝতে পারলেও দুর্বল করুণ চাহনি ছাড়া আর কোনও অভিব্যক্তিই দেখাল না। তার মা দুই হাতে কন্যাকে আরও একটু আগলে নিয়ে মুখটি বক্ষমাঝে চেপে ধরলেন। মায়ের ভাবভঙ্গিতে মনে হলো বোনটি বুঝি তার মরেই যাচ্ছে। কিন্তু তোয়াক্কা না করে সে ঘুরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে পালাল, হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে আছে সেই চকোলেট।
এরপর মাকে আর দেখেনি সে। চকোলেট সাবাড় করে তার মধ্যে এক ধরনের লজ্জাবোধ হতে লাগল। কয়েক ঘণ্টা এই রাস্তা, সেই গলি ধরে হাঁটল, এক পর্যায়ে ক্ষুধাই তাকে আবার ঘরে টেনে নিল। যখন ফিরে আসে ততক্ষণে মা নিরুদ্দেশ। হঠাৎ গায়েব হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা তখন অহরহই ঘটছে। কামরার সব কিছুই ঠিকঠাক, কেবল নেই তার মা আর বোনটি। ওরা কোনও কাপড় নিয়ে যায়নি, মায়ের ওভারকোটটিও ঘরে পড়ে আছে।
আজ পর্যন্ত সে কোনও পথেই নিশ্চিত হতে পারেনি, তার মায়ের মৃত্যু হয়েছে। এটা খুবই সম্ভব, তাকে জবরদস্তি শ্রম শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার বোনটির কী হতে পারে? হতে পারে তাকেও উইনস্টনের মতোই বাস্তুহীন শিশুদের কলোনিগুলোর (ওরা বলে পুনরুদ্ধার কেন্দ্র) একটিতে পাঠানো হয়েছিল। এখানকার শিশুরা গৃহযুদ্ধের শিকার শিশু হিসেবেই বড় হয়। অথবা বোনটিকেও শ্রম ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে তার মায়ের সাথে। অথবা অন্য কোথাও ফেলে দেওয়া হয়েছে স্রেফ মরে যাওয়ার জন্য।
স্বপ্নের দৃশ্য মনের মধ্যে এখনও উজ্জ্বল। বিশেষ করে ভাঁজ করা হাতের আড়ালে জীবনকে আশ্রয় দেওয়ার চেষ্টায় রত থাকার সেই অভিব্যক্তি যেন পূর্ণ অর্থবহ হয়েই মনের মাঝে ধরে আছে। তার মনে এলো মাস দুয়েক আগের আরও একটি স্বপ্নের কথা। সাদা-চাদর পাতা নোংরা বিছানার সিথানে তার মা ঠিক যেভাবে বসে শিশুটিরে কোলের মধ্যে আঁকড়ে ধরে রাখতেন, সেভাবেই যেন তিনি বসেছিলেন ডুবন্ত সেই জাহাজের পাটাতনে, তার চেয়ে অনেক গভীরে, আর প্রতি মিনিটেই আরও গভীর থেকে গভীরে ডুবে যাচ্ছিলেন, আর তখনও ক্রমেই অন্ধকার ছেয়ে যাওয়া পানির তলদেশ থেকে উর্ধ্বপানে তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
মায়ের হারিয়ে যাওয়ার গল্পটি জুলিয়াকে শোনাল সে। চোখ না খুলেই জুলিয়া আরও কুঁকড়ে আরও একটু আরাম খুঁজে নিল। ‘আমার ধারণা সেসময়ে পাষণ্ড এক ছোট্ট শুকর বৈ কিছু ছিলে না তুমি’—অস্ফুট স্বরে বলল সে। ‘সবগুলো শিশুই একেকটা শুয়োর। ’
‘হ্যাঁ তা ঠিক। কিন্তু ঘটনার মূল দিকটা হচ্ছে—’
জুলিয়ার ঘন নিঃশ্বাস বলে দিচ্ছে আবারও গভীর ঘুমে ডুবেছে সে। মায়ের কথা আরও বলতে পারলে ভালো লাগত। যতটুকু, যেটুকু স্মরণ হয় তাতে তিনি অসাধারণ কোনও নারী ছিলেন বলে মনে হয় না, বুদ্ধিমতী কেউ ছিলেন এমনটাও কম মনে হয়। তারপরেও বলা যায়, তার মধ্যে এক ধরনের মহত্ব, এক ধরনের খাঁটিত্ব ছিল। যে জীবনমান তিনি মেনে চলতেন তা ছিল স্রেফ তার ব্যক্তিগত, তার নিজের মতো। তার অনুভূতিগুলো ছিল নিজের, বাইরে থেকে কোনওভাবেই তা বদলানো যেত না। অপ্রয়োজনীয় কোনও ঘটনাও তার কাছে অর্থহীন মনে হতো না। তুমি যদি কাউকে ভালোবাসো, তাকে ভালোই বাসো, যখন তাকে দেওয়ার আর কিছুই থাকবে না তখনও তুমি তাকে ভালোবাসা দাও।
চকোলেটের শেষ টুকরোটিও যখন হাতছাড়া হয়ে গেল মা বাহু দিয়েই শিশুটিরে জড়ালেন। এর কোনও মানে তো হয় না, এতে কিছুই পাল্টে যাবে না, চকোলেটও আসবে না, শিশুটির কিংবা তার নিজের জীবন রক্ষাও পাবে না, কিন্তু তিনি সেটাই করলেন। প্রকৃতিগতভাবেই তিনি এমন। নৌকোর সেই উদ্বাস্তু নারী তার বাহু দিয়ে শিশু ছেলেটিরে আগলে ধরেছিলেন, বুলেটের সামনে সে হাত ছিল কাগজের পাতার মতো ঠুনকো। পার্টি যে ভয়াবহ কাজটি নিশ্চিত করেছে তা হচ্ছে—আপনাকে এমনভাবে প্ররোচিত করেছে যাতে আপনার কাছে ইচ্ছা বা অনুভূতিগুলো স্রেফ মূল্যহীন হয়ে যায়। আর একই সাথে এই বাস্তব জগতে আপনার সকল শক্তিই ওরা ডাকাতি করে নিয়ে গেছে। একবার পার্টির আগলে পড়েছেন তো, আপনি কী ভাবলেন কিংবা ভাবলেন না, আপনি কী করলেন বা করা থেকে বিরত থাকলেন তার মধ্যে বাস্তবিক অর্থেই আর কোনও ফারাক থাকল না।
আপনাকে নিয়ে বা আপনার ওপর যা কিছু হয়েছে তা নির্মূল করা হয়ে গেছে, এখন আপনাকে কিংবা আপনার কোনও কাজের কথা কেউ আর শুনতেও পাবে না। ইতিহাসের স্রোত থেকে আপনাকে পুরোপুরি তুলে নেওয়া হয়েছে। আর মাত্র দুই প্রজন্ম আগের মানুষের কাছে এসবের কোনও গুরুত্ব ছিল বলেই মনে হয় না। কারণ তারা ইতিহাস বদলে দিতে চায়নি। তারা ব্যক্তিগত বিশ্বাসবোধেই পরিচালিত হতো, যা নিয়ে তাদের কোনও প্রশ্নও ছিল না। তাদের কাছে ব্যক্তিগত সম্পর্কের মূল্য ছিল, একটি অসহায়ত্বের অভিব্যক্তি, একটি আলিঙ্গন, একটি কান্না, মৃত্যুপথযাত্রীর অন্তিম ইচ্ছা—এ সবকিছুই ছিল মূল্যবান। হঠাৎই তার মাথায় খেলে গেল, মূলত প্রোলরা এখনও সেই অবস্থায় রয়েছে। তারা কোনও পার্টির প্রতি বিশ্বস্ত নয়, কোনও দেশের প্রতি নয়, নয় কোনও আদর্শের প্রতিও, তারা মূলত একে অন্যের প্রতি বিশ্বস্ত।
জীবনে এই প্রথমবার প্রোলদের ব্যাপারে তার ঘৃণাবোধ কাজ করল না অথবা মনে হলো না, ওরা এক সুপ্ত শক্তি যারা একদিন জীবনের টানে উত্থিত হবে, আর বিশ্বকে নতুন করে গড়বে। বরং তার মনে হলো প্রোলরা মানুষ হয়েই থেকে যাবে। তারা ভেতরে ভেতরে কঠিন হয়ে উঠবে না। তারা আদিম অনুভূতিকেই মনের ভেতর ধারণ করে রাখবে, যা তার নিজের পক্ষে স্রেফ সচেতন প্রচেষ্টায় শেখা সম্ভব। এসব ভাবতে ভাবতেই প্রসঙ্গহীনভাবেই তার মনে পড়ে গেল কিভাবে সপ্তাহ কয়েক আগে সে ফুটপাতে পড়ে থাকা রক্তাক্ত একটি বিচ্ছিন্ন হাত স্রেফ বাঁধাকপির ডাঁটার মতো জ্ঞান করে এক লাথিতে নর্দমায় ফেলে দিয়েছিল।
‘প্রোলরাই প্রকৃত মানুষ’—উচ্চৈস্বরে বলল সে। ‘আমরা মানুষই না। ’
‘কেন নই?’—বলল জুলিয়া, ফের ঘুম ভেঙ্গেছে তার।
এক দণ্ড ভাবল সে। ‘তোমার কি কখনও মনে হয়েছে’—বলল সে, ‘আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো কাজটি হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব এই ডেরা ছেড়ে দেওয়া আর দুজন দুজনার সঙ্গে আর কখনও দেখাটি পর্যন্ত না করা?’
‘হ্যাঁ প্রিয়তম বেশ ক’বারই সে কথা ভেবেছি। তবে আমি কিন্তু তা মোটেই করতে যাচ্ছি না, কারণ ওটা করা আর না করা সমান কথা। ’
‘আমরা ভাগ্যবান’—বলল সে, ‘কিন্তু এই পরিস্থিতি বেশিদিন এমন থাকবে না। তুমি তরুণী, তোমাকে সাধারণ আর নিষ্পাপ মনে হয়। আমার মতো মানুষগুলো থেকে দূরে থাকতে পারলে আরও পঞ্চাশটি বছর অনায়াসে বাঁচতে পারবে। ’
‘আরে না। পুরো বিষয়টি আমি ভেবে রেখেছি। তুমি কী করবে, আমি কী করতে যাচ্ছি, তার সবকিছু। এত হতোদ্যম হয়ো না। বেঁচে আমরা থাকবই, ভালো করেই থাকব। ’
‘ধরো আরও ছ’টি মাস আমরা এভাবে একসাথে থাকলাম—হতে পারে এক বছর—কেউ জানবে না। কিন্তু অন্তে বিচ্ছেদ আমাদের অনিবার্য। তুমি কি বুঝতে পারো তখন আমরা কতটা একা হয়ে যাব। যখন ওরা আমাদের ধরে ফেলবে, তখন আর কিছুই থাকবে না, কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। তখন আমরা একজনের জন্য অন্যজন কোনও কাজেই আসব না। আমি যদি স্বীকারোক্তি দেই, ওরা তোমাকে গুলি করবে, আর আমি যদি স্বীকারোক্তিতে অস্বীকার করি, তাতেও ওরা তোমাকে গুলিই করবে। আমি কিচ্ছুটি করতেও পারব না, বলতেও পারব না, কিংবা আমাকে বলা থেকে বিরতও রাখতে পারব না, তোমার অনিবার্য মৃত্যুকে আমি বড়জোর মিনিট পাঁচেক পিছিয়ে দিতে পারব মাত্র। আমাদের দুজনের কেউই জানতেও পারব না, অন্যজন বেঁচে আছি, নাকি মৃত। আমাদের সত্যিকার অর্থেই আর কোনও শক্তি অবশিষ্ট থাকবে না। একটি বিষয়ই শুধু এখানে গুরুত্ব পাবে তা হচ্ছে আমরা একজন অন্যজনের সঙ্গে প্রতারণা করছি কি না, অবশ্য তাতেও অতি সামান্য ভিন্নতাও নিশ্চিত হবে না।
‘তুমি যদি স্বীকারোক্তির কথা বলো’—বললো জুলিয়া, ‘আমরা সন্দেহাতীতভাবেই সেটা করব। সবাই সর্বদা স্বীকার করে নেয়। তুমিও তার বাইরে যেতে পারবে না। ওরা তোমাকে নির্যাতন করেই তা করাবে। ’
‘আমি ঠিক স্বীকারোক্তি বলতে চাইনি। স্বীকারোক্তি মানে প্রতারণা বা বিশ্বাসঘাতকতা নয়। তুমি কী বললে বা করলে তাতে কিছু যায় আসে না। এখানে অনুভূতিটিই মুখ্য। ওরা যদি আমার প্রতি তোমার ভালোবাসার অনুভূতিকে বন্ধ করে দিতে পারে—সেটাই হবে প্রকৃত প্রতারণা।
বিষয়টি জুলিয়াকেও ভাবিয়ে তুলল। ‘ওরা তা করতে পারবে না’—অবশেষে বলল সে। ‘এই একটি কাজ ওরা করতে পারে না। ওরা তোমাকে দিয়ে যা কিছু ইচ্ছা বলিয়ে নিতে পারবে, কিন্তু তা তোমাকে বিশ্বাস করাতে পারবে না। ওরা তোমার ভেতরটাতে ঢুকতে পারবে না। ’
‘না’—কিছুটা আশা জাগানিয়া কণ্ঠে বলল সে, ‘না; এটা বেশ সত্য বলেছো। ওরা তোমার ভেতরটাতে ঢুকতে পারবে না। তুমি যদি অনুভব করো মানুষ হয়ে থাকাটাই ভালো, এমনকি যখন তা কোনও ফল বয়ে আনে না তখনও, তাতে ওদের হারিয়েই দেওয়া হয়।
টেলিস্ক্রিনের সদা-সজাগ কান পেতে রাখার কথা ভাবনায় এলো তার। ওরা আপনার ওপর দিন-রাত চরগিরি করতে পারে, কিন্তু আপনার মাথাটি যদি ঠিক থাকে ওদের ফাঁকি দিতে পারবেন। ওদের সকল চাতুর্য দিয়েও অন্য একটি মানুষ কী ভাবছে তা জানার রহস্য রপ্ত করতে পারেনি। হতে পারে আপনি যখন ওদের কব্জায় চলে যাবেন তখন এগুলো অপেক্ষাকৃত কম সত্য হয়ে উঠবে। ভালোবাসা মন্ত্রণালয়ের ভেতরে কী ঘটে তা কেউ জানতে পারে না। তবে অনুমান নিশ্চয়ই করা যায়: নির্যাতন, মাদক, কিছু বিশেষ যন্ত্রপাতির ব্যবহার যা আপনার স্নায়বিক প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করবে, অনিদ্রা, একাকীত্ব আর উপর্যুপরি জিজ্ঞাসাবাদে ধীরে ধীরে আপনি কাবু হয়ে যাবেন।
তখন সত্য আর কোনও পথেই লুকিয়ে রাখা যাবে না। তারা তদন্তের মধ্য দিয়ে তা বের করে আনবে, ওরা নির্যাতনে নির্যাতনে আপনাকে কুঁকড়ে দেবে। কিন্তু আপনার উদ্দেশ্য যদি স্রেফ বেঁচে থাকা না হয়ে হয় মানুষ হয়ে থাকা, তখন এসব কিছুই কোনও ভিন্নতা এনে দেবে না। ওরা আপনার অনুভূতিকে বদলে দিতে পারবে না; সে জন্য আপনিও সেগুলো নিজে বদলে ফেলতে পারবেন না, চাইলেও না। ওরা সর্বোচ্চ আপনি যা কিছু করেছেন বা বলে ফেলেছেন তাই উন্মোচন করতে পারবে, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে যা কিছু ঘটে, যা কিছু আপনার নিজের কাছে রহস্যময়, তা অব্যক্তই থেকে যাবে।
অধ্যায় ৮
তারা কাজটা করল! অবশেষে কাজটা তারা করেই ফেলল!
যে কক্ষে তারা দাঁড়িয়ে সেটি লম্বাটে গড়নের, হালকা একটা আলো জ্বলছে। টেলিস্ক্রিনের ভলিউম এতটাই কমানো যে বিড়বিড় শব্দ হচ্ছে। মেঝের ঘন নীল রঙের গালিচায় পা ফেললে মখমলের বিছানার মতো মোলায়েম মনে হবে। কক্ষের অপর প্রান্তে একটি সবুজ ঢাকনাওয়ালা আলোর নিচে পাতা টেবিলে বসে আছেন ও’ব্রায়েন। বাড়ির চাকরটি জুলিয়া আর উইনস্টনকে পথ দেখিয়ে যখন এই ঘরে নিয়ে এলো তখন সামান্য চোখ তুলেও দেখলেন না তিনি।
উইনস্টনের হৃদযন্ত্র এতটাই লাফাচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল কথাই বলতে পারবে না। তারা কাজটা করল! অবশেষে কাজটা তারা করেই ফেলল! কেবল এ কথাই তার মন জুড়ে বিচরণ করছে। এখানে পৌঁছানোই এক গর্হিত কাজ, আর দুজন একসঙ্গে আসা নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা, যদিও দুজন দুই ভিন্নপথেই এখানে এসেছে আর ও’ব্রায়েনের দরজার গোড়াতেই তাদের দেখা। এমন একটি স্থানে ঢুকে পড়ার জন্য দরকার শক্ত স্নায়ুশক্তি। ইনার পার্টির কেউ কারও আবাসস্থলের কথা জানতে পারবে এমনটা বিরল ঘটনা, আর কারও ঘরে ঢুকে পড়া তো নিতান্তই অসম্ভব। বড় বড় ফ্ল্যাটবাড়ির ব্লকগুলো মিলিয়ে এই পুরো পরিবেশ সবকিছুর প্রাচুর্য আর প্রকাণ্ডতাই তুলে ধরে। নাকে লাগছে সুখাদ্যের সুঘ্রাণ, সেরা তামাকের গন্ধ। নীরব আর অবিশ্বাস্য দ্রুতগতির লিফটগুলো উপর নিচ করে যাচ্ছে, সাদা পোশাকে চাকরেরা ব্যস্ত-ত্রস্ত হয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে—এই সবকিছুই যেন ভীতিকর ঠেকছে। যদিও এখানে আসার একটা যুতসই অজুহাত তার হাতে আছে, তারপরেও প্রতিটি পা ফেলার সময়ই একটা ভয় কাজ করছিল, ভবনের কোনও কোণা বা ঘুপচি থেকে এই বুঝি কালো উর্দিধারী প্রহরী সামনে লাফিয়ে পড়ছে আর কাগজপত্র চাইছে, নয়ত তাকে বেরিয়ে যাওয়ার হুকুম দিচ্ছে। ও’ব্রায়েনের চাকরটি, অবশ্য, তাদের দুজনকেই কোনও বিপত্তি ছাড়াই এখানে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। সাদা জ্যাকেটে বেটে-খাটো কালো চুলের লোকটির হীরক আকৃতির অভিব্যক্তিবিহিন মুখ, হতে পারে চীনাদের মতো। যেই পথে সে ওদের এগিয়ে নিয়ে এলো সেটিও ছিল গালিচামোড়ানো। ক্রিম-রঙা কাগজে ঢাকা দেয়াল আর ধবধবে সাদা, পরিচ্ছন্ন পর্দা ঝুলছে। ওগুলোও ভয় ধরিয়ে দেওয়ার মতো। উইনস্টনের চোখে বা মনে একটি দেয়ালও ভেসে উঠল না যা মানব শরীরের ঘঁষায়-গন্ধে নোংরা নয়।
হাতের আঙুলে একটি কাগজের টুকরো ধরে রাখা ও’ব্রায়েনের। ধারণা করা যায় ওটাই মনযোগ দিয়ে পড়ছেন তিনি। তার প্রকাণ্ড মুখমণ্ডল একটু ঝোঁকা ফলে তার নাকের পার্শ্বআকৃতিটি চোখে পড়ল, সবমিলিয়ে তাকে ভয়ঙ্কর আর বুদ্ধিমান দুইই মনে হচ্ছিল। বিশ সেকেন্ডের মতো হবে তিনি কোনও ধরনের নড়াচড়া না করেই বসে থাকলেন। এরপর স্পিকরাইটটি নিজের দিকে টেনে নিলেন এবং মন্ত্রণালয়ের শংকর ভাষায় বেশ কাটাকাটা উচ্চারণে একটি বার্তা পড়লেন:
‘আইটেমস ওয়ান কমা ফাইভ কমা সেভেন অ্যাপ্রুভড ফুলওয়াইজ স্টপ সাজেশন কনটেইনড আইটেম সিক্স ডাবলপ্লাস রিডিকুলাস ভারজিং ক্রাইমথিংক ক্যান্সেল স্টপ আনপ্রসিড কনস্ট্রাকশনওয়াইজ অ্যান্টেগেটিং প্লাসফুল এস্টিমেটস মেশিনারি ওভারহেডস স্টপ এন্ড মেসেজ। ’
এবার চেয়ার ছেড়ে উঠলেন আর নিঃশব্দ গালিচায় পা ফেলে ফেলে ওদের দিকে এগুলেন। নিউস্পিকের শব্দগুলোর সাথে সাথে তার ওপর থেকে দাপ্তরিক ভাবটাও কিছুটা ঝড়ে গেল, তবে তার অভিব্যক্তি অন্যান্য সময়ের চেয়ে কিছুটা কর্কশ মনে হলো, যেন কাজের পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ায় অসন্তুষ্ট। একটা সাধারণ অস্বস্তিও ভর করল উইনস্টনের ভীতির ওপর।
তার মনে হতে লাগল স্রেফ একটা অতি নির্বোধের কাজ সে করে ফেলেছে। ও’ব্রায়েন একজন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রকারী হবেন এমন কীই প্রমাণ তার কাছে আছে? কিছুই নেই, স্রেফ চোখের দৃষ্টিতে সামান্য সেই ঝলকানিটুকু ছাড়া। আর একটি মাত্র অতি অস্পষ্ট উক্তি। এর বাইরে বাকিটা সবই তার অতি গোপন কল্পনা, আর স্বপ্নে দেখা ঘটনা। ডিকশনারি নিতেই এখানে আসা, সে যুক্তি ধোপে টিকবে না, কারণ তাতে জুলিয়ার উপস্থিতির কোনও ব্যাখ্যা নেই। ও’ব্রায়েন যখন টেলিস্ক্রিনের সামনে দিয়ে এগিয়ে গেলেন তার মনোজগতে এসব ভাবনাই খেলে যাচ্ছিল। ও’ব্রায়েন থামলেন, পাশ ঘুরে দেয়ালের ওপর একটি সুইচ টিপলেন। টেলিস্ক্রিনের শব্দ থেমে গেল।
জুলিয়ার মুখ থেকে একটা ছোট্ট শব্দ বেরিয়ে এলো, বিস্ময় প্রকাশে সে শব্দটুকুই যথেষ্ট। আর এত ভীতির মাঝেও উইনস্টন সে ঘটনায় এতটাই আলোড়িত হলো যে নিজের কণ্ঠকে বশে রাখতে পারল না।
‘আপনি এটা বন্ধ করে দিতে পারেন!’—বলল সে।
‘হ্যাঁ পারি’—বললেন ও’ব্রায়েন। ‘আমরা বন্ধ করে দিতে পারি, আমাদের এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ’
ততক্ষণে ও’ব্রায়েন তাদের সামনাসামনি দাঁড়িয়েছেন। তার দৃঢ়-কঠিন বপুখানি ওদের দুজনেরই মাথা ছাড়িয়ে, আর মুখের অভিব্যক্তি তখনও অনির্ণেয়। মনে হচ্ছিল উইনস্টনের মুখ থেকে কথা শোনার জন্য ভীষণ অপেক্ষায় তিনি, কিন্তু কী কথা তা স্পষ্ট নয়। আবার এও মনে হচ্ছে তিনি স্রেফ ব্যস্ত একটি মানুষ, কাজে ব্যাঘাত ঘটানোর কারণটিই জানতে চান। সব কটি মানুষই চুপ। টেলিস্ক্রিন বন্ধ করে দেওয়ায় গোটা কামরায় কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। প্রতিটি ক্ষণ কাটতেই যেন লেগে যাচ্ছে দীর্ঘ সময়। অনেক কষ্টে উইনস্টন তার চোখ ও’ব্রায়েনের চোখে ধরে রাখতে পারছে। আর তখনই হঠাৎ সেই মুখ ভিন্ন অভিব্যক্তি দেখাল। একটি মৃদু হাসি ফুটে উঠল ও’ব্রায়েনের মুখে। সহজাত ভঙ্গিমায় চশমা জোড়া নেড়েচেড়ে নাকের ডগায় বসিয়ে নিলেন।
‘কথাটি আমিই বলব, নাকি তুমি?’—বললেন তিনি।
‘আমিই বলব’—দ্রুততায় বলল উইনস্টন। ‘বস্তুটি কি আসলেই বন্ধ করা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ সব কিছুই বন্ধ করা হয়েছে, এখানে এখন স্রেফ আমরাই। ’
‘আমাদের এখানে আসার হেতু হচ্ছে…’
থামল সে, এই প্রথম তার মনে হলো, আসলে কী উদ্দেশ্যে আসা তা তার নিজের কাছেও স্পষ্ট নয়। আর যেহেতু সে জানেই না ঠিক কী ধরনের সাহায্য সে ও’ব্রায়েনের কাছে চায়, সেহেতু কেন এখানে আসা তা বলাও কঠিন। কিন্তু কথা শুরু করল সে, যদিও ভালো করেই জানে এখন সে যা বলবে তা হবে অতি দুর্বল আর আত্মশ্লাঘার উচ্চারণ।
‘আমাদের বিশ্বাস কোথাও কিছু একটা ষড়যন্ত্র চলছে, পার্টির বিরুদ্ধে গোপন কোনও শক্তি কাজ করছে, আর সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে আপনি জড়িত রয়েছেন। আমরা পার্টির শত্রু। আমরা ইংসকের নীতিতে বিশ্বাস করি না। আমরা চিন্তা-অপরাধী। আমরা ব্যভিচারীও। আমরা কথাগুলো আপনাকে বলছি, কারণ আমরা আপনার কাছেই নিজেদের সোপর্দ করতে চাই। এখন আপনি যদি আমাদের দোষীও সাব্যস্ত করেন, আমরা তার জন্য প্রস্তুত। ’
থামল সে, আর ও’ব্রায়েনের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল। কেউ একজন দরজা খুলে ঢুকছে। নিশ্চিত, কড়া না নেড়ে ঢুকে পড়া লোকটি বেটেখাটো হলদে মুখো চাকরটি বৈ কেউ না। উইনস্টন দেখল একটি বোতল আর ক’টি গ্লাস সাজানো ট্রে নিয়ে ঢুকছে সে।
‘মার্টিনও আমাদেরই লোক’—নির্বিকারভাবে বললেন ও’ব্রায়েন। ‘ড্রিঙ্কস নিয়ে এখানে আসো, মার্টিন। গোল টেবিলটির ওপর রাখো। পর্যাপ্ত চেয়ার হবে? তাহলে বেশ, চলো আমরা আরাম করে বসে কথা বলি। মার্টিন তোমার নিজের জন্য একটা চেয়ার নিয়ে আসো। এখন কাজের কথা হবে। এখন থেকে দশ মিনিট তুমি আর চাকর নও। ’
স্বাচ্ছন্দেই বসে পড়ল বেটেখাটো লোকটি, তবে অভিব্যক্তিতে চাকরসুলভ ভাবটি রয়ে গেল। মনিবের আস্কারা পেলে যে খুশির ভাবটা থাকে তাই যেন ছড়িয়ে আছে তার মুখে। চোখের কোণায় চেয়ে লোকটিকে একবার অভিবাদন জানিয়ে নিল উইনস্টন। তার ভাবনায় ভর করল, এই লোক গোটা জীবনই একটা খেলার অংশ। আরও মনে হলো, তার জন্য যে ব্যক্তিত্ব নির্ধারিত তা থেকে এক দণ্ডের জন্য সরে যাওয়াও বিপজ্জনক। ও’ব্রায়েন বোতলটির সরু অংশে ধরে তুলে নিলেন আর গ্লাসগুলোতে কড়া লাল রঙের পানীয় ঢাললেন। উইনস্টনের ম্লান স্মৃতিতে জেগে উঠল অনেক অনেক আগে দেখা কিছু একটা, একটি সাইনবোর্ডের ওপর বিশালাকায় একটি বোতল। ইলেক্ট্রিক আলোর খেলায় সে বোতল একবার উপরে উঠছে একবার নামছে আর তা থেকে বের হয়ে আসা তরল পানীয়তে ভরে যাচ্ছে একটি গ্লাস। উপর থেকে দেখলে এই বস্তু পুরোপুরি কালো মনে হয়, কিন্তু বোতলের ভেতরটা দেখতে রুবির রঙ। টক-মিষ্টির একটা ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল। সে দেখল জুলিয়া তার গ্লাসটি তুলে নিয়েছে আর অতি সততার কৌতূহলে তাতে চুমুক বসিয়েছে।
‘এটাকে বলে মদ’—ম্লান একটা হাসি দিয়ে বললেন ও’ব্রায়েন। ‘নিঃসন্দেহে বইয়ে তোমরা এ বিষয়ে পড়েছো। আউটার পার্টিতে এটা খুব একটা পাওয়া যায় না বলেই আমার ধারণা। ’ তার মুখমণ্ডলে আবারও একটা কঠিন ভাব ফিরে এলো, আর তিনি নিজেও নিজের গ্লাসটি তুলে নিলেন। ‘স্বাস্থ্যকর এই পানীয় পানের মধ্য দিয়েই আমাদের শুরু। আমাদের নেতার নামে: গোল্ডস্টেইনের নামে। ’
বিশেষ আগ্রহে নিজের গ্লাসটি তুলে নিল উইনস্টন। মদ এক বস্তু, যা সে কেবল বইয়েই পড়েছে আর স্বপ্নে দেখেছে। গ্লাস পেপারওয়েটটির মতো, কিংবা মি. চ্যারিংটনের আধা-বিস্মৃত কবিতার লাইনগুলোর মতো, এরও এক উবে যাওয়া রোমাঞ্চকর অতীত রয়েছে, পুরনো সময় যাকে সে স্থান দিয়েছে স্রেফ গোপন ভাবনায়। কী কারণে যেন তার ভাবনায় ছিল মদ হবে মিষ্টস্বাদের, ঠিক কালোজামের তৈরি জ্যামের মতো এবং এর একটি উন্মাদক প্রতিক্রিয়া থাকবে। কিন্তু যখন সে বস্তুটি গলায় ঢালালো, রীতিমতো হতাশ হলো। বাস্তবতা হচ্ছে, বছরের পর বছর জিন গিলতে গিলতে এখন আর এসবের স্বাদ বুঝতে পারে না সে। দ্রুতই খালি গ্লাসটি টেবিলে রাখল উইনস্টন।
‘তাহলে গোল্ডস্টেইন বলে কেউ একজন রয়েছেন?’—বলল সে।
‘হ্যাঁ এমন একজন ব্যক্তি রয়েছেন, জ্যান্ত এক মানব সন্তান। তবে কোথায়, তা আমি জানি না। ’
‘আর ষড়যন্ত্র… সংগঠন? এগুলোও কি বাস্তব? এগুলো স্রেফ থট পুলিশের আবিষ্কার নয়?’
‘না, এগুলো বাস্তব। আমরা এর নাম দিয়েছি ব্রাদারহুড। কখনওই তুমি ব্রাদারহুড সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবে না। কেবল এটুকুই জানবে যে, এর অস্তিত্ব আছে আর তুমিও তার সঙ্গে আছো। সে প্রসঙ্গে আসছি। ’—বলেই হাতঘড়িতে একবার সময় দেখে নিলেন তিনি। ‘ইনার পার্টির সদস্য হলেও আধাঘণ্টার বেশি সময় ধরে টেলিস্ক্রিন বন্ধ রাখা ঠিক না। তোমাদের দুজনের একসঙ্গে এখানে আসা উচিত হবে না। আর তোমাদের আলাদা আলাদা ভাবে যেতে হবে। তুমি, কমরেড’—জুলিয়ার দিকে মাথা ঝুকিয়ে নিলেন একবার—‘তুমি প্রথম বের হবে। আমাদের হাতে আর কুড়ি মিনিট সময় আছে। তোমাদের বুঝতে হবে, আমি গোড়াতেই কিছু প্রশ্ন করে নিতে চাই। যেমন ধরো, তোমরা কী কী কাজ করার জন্য প্রস্তুত?’
‘সম্ভব এমন যে কোনও কিছু’—বলল উইনস্টন।
চেয়ারেই নিজেকে কিছুটা ঘুরিয়ে নিয়ে বসলেন ও’ব্রায়েন যাতে ঠিক উইনস্টনের মুখোমুখি হওয়া যায়। জুলিয়াকে একরকম অবজ্ঞাই করলেন তিনি। যেন তার কথাগুলোও উইনস্টনই বলবে। হঠাৎই তার দুই চোখের পাতা পড়ল। দ্রুত তা খুলে ধীর, নির্বিকার কণ্ঠে প্রশ্নগুলো করা শুরু করলেন যেন এ এক নিয়মিত প্রশ্নোত্তর পর্ব, আর প্রশ্নগুলোর অধিকাংশেরই উত্তর তার কাছে আগে থেকে জানা।
‘তোমরা জীবন দিতে প্রস্তুত?’
‘হ্যাঁ। ’
‘তোমরা জীবন নিতে প্রস্তুত?’
‘হ্যাঁ। ’
‘তোমরা এমন নাশকতা ঘটাতে পারবে যাতে শত শত নিরাপরাধ মানুষের প্রাণহানি ঘটবে?’
‘হ্যাঁ। ’
‘বিদেশি কোনও শক্তির হয়ে তোমরা নিজের দেশের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারবে?’
‘হ্যাঁ। ’
‘তোমরা ছলচাতুরি, প্রতারণা, ধোকা, শিশুদের মনকে কলুসিত করে তোলা, মাদকাসক্ত করে তোলা, পতিতাবৃত্তিতে উৎসাহ যোগানো, যৌন রোগ সংক্রমণ বাড়ানো—এমন যে কোনও কিছু করতে প্রস্তুত যা পার্টির নৈতিকতার ভিত ভেঙে দেবে, ক্ষমতাকে খর্ব করবে?’
‘হ্যাঁ। ’
‘ধরো, উদাহরণ স্বরূপ, একটি শিশুর মুখে সালফিউরিক এসিড ছুড়ে দিলে তাতে আমাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ হবে—তোমরা কি তা করতে প্রস্তুত?’
‘হ্যাঁ। ’
‘তোমরা তোমাদের বর্তমান পরিচয় হারিয়ে স্রেফ ওয়েটার বা ডকের শ্রমিক হিসেবে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে প্রস্তুত?’
‘হ্যাঁ। ’
‘তোমরা আত্মহত্যা করতে প্রস্তুত, যদি এবং যখন আমরা নির্দেশ দেব তখনই?’
‘হ্যাঁ। ’
‘তোমরা দুজন দুজনা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হতে প্রস্তুত, আর কখনও একের সঙ্গে অপরের দেখা হবে না?’
‘না!’ চিৎকার করে উঠল জুলিয়া।
উইনস্টনের মুখে কথা সরছিল না। এক মুহূর্তে এও মনে হলো সে আসলে বাক শক্তিই হারিয়ে ফেলেছে। তার জিহ্বা মুখের ভেতর নড়ছে কিন্তু শব্দ উৎপাদন করছে না। একটি শব্দের শুরুর শব্দাংশটি তৈরিতেই জিহ্বার লেগে গেলে বেশ খানিকটা সময়। আর যতক্ষণ না শব্দটি উচ্চারিত হলো, সে জানতও না, ঠিক কোন শব্দটি সে বলতে যাচ্ছে। ‘না’—অবশেষে বলল সে।
‘আমাকে বলে দিয়ে ভালো করেছো’—বললেন ও’ব্রায়েন। ‘আমাদের জন্য সবকিছুই জেনে রাখা প্রয়োজন। ’
এবার তিনি ঘুরে জুলিয়ার মুখোমুখি হলেন এবার আরও একটু অভিব্যক্তি ঝরিয়েই কথাগুলো উচ্চারণ করলেন:
‘তুমি কি বুঝতে পারো, সে যদি টিকেও যায়, তা এক ভিন্ন মানুষ হিসেবেই টিকবে। হতে পারে আমরা তাকে একটি নতুন পরিচয় দিতে বাধ্য হব। তার চেহারা, চলাফেরা, হাতের আকার, চুলের রঙ—এমনকি তার কণ্ঠটিও পাল্টে যাবে। আর তুমি নিজেও হয়ে যেতে পারো ভিন্ন কেউ একজন। আমাদের সার্জনেরা মানুষকে এমনভাবেই পাল্টে দিতে পারেন যে চেনাই যাবে না। কোনও কোনও সময় এটা দরকার হয়ে পড়ে। কখনও কখনও এমনকি শরীরের একটি অঙ্গচ্ছেদ পর্যন্ত করে ফেলি আমরা। ’
মার্টিনের মঙ্গোলীয় চেহারাটির দিকে একবার তাকানো থেকে কোনওভাবেই নিজেকে বিরত রাখতে পারল না উইনস্টন। সেখানে কোনও ধরনের ভীতি সে দেখতে পেল না। জুলিয়ার মুখমণ্ডলে আরও ফ্যাকাশে হয়ে ওঠার ছাপ, এতে তার মেছতাগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তবে ও’ব্রায়েনকে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই মোকাবেলা করল সে। বিড়বিড় শব্দে কিছু একটা উচ্চারণ করল জুলিয়া যা থেকে বুঝে নেওয়া গেল সে বলেছে:
‘বেশ। তাহলে এটাই সাব্যস্ত। ’—টেবিলের ওপর রুপালি রঙের একটি সিগারেট-বাক্স, অনেকটা অন্যমনষ্ক ভঙ্গিমায় ও’ব্রায়েন সেটি ওদের দিকে ঠেলে দিলেন, নিজেও একটি শলাকা তুলে নিলেন। এরপর উঠে দাঁড়ালেন এবং মৃদু পায়চারি করতে লাগলেন, যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবনাটা ভালো জমে তার। সিগারেটগুলো খুব ভালো। মোটা আর সুন্দর প্যাকেটজাত। এর কাগজে এক ধরনের অপরিচিত রেশমিভাব আছে। ও’ব্রায়েন আরও একবার হাতঘড়ির দিকে তাকালেন।
‘মার্টিন, তুমি এবার খাবার ঘরে ফিরে গেলেই ভালো’—বললেন তিনি। ‘১৫ মিনিটের মধ্যে আমি ওটি ফের চালিয়ে দেব। যাওয়ার আগে এই কমরেডদের একবার ভালো করে দেখে নাও। এরপর ওদের সঙ্গে তোমারই দেখা হবে, আমার নাও হতে পারে। ’
‘তোমরা বুঝতে পেরেছো’—বললেন তিনি, ‘তোমাদের আসলে অন্ধকারে থেকে যুদ্ধ করতে হবে। তোমরা অন্ধকারের ভেতরেই থাকবে। তোমরা কেবল নির্দেশ পাবে আর সেগুলো মেনে চলবে, জানতেও পারবে না কেন। পরে আমি তোমাদের একটা বই পাঠাব যা পড়লে তোমরা জানতে পারবে আমরা ঠিক কোন সমাজে বাস করছি, আর এই সমাজকে আমরা কোন কৌশলে ধ্বংস করে দেব তাও জানা যাবে। যখন তোমরা বইটি পড়বে, তোমরা ব্রাদারহুডের পূর্ণাঙ্গ সদস্য হয়ে উঠবে। কিন্তু আমরা যে সাধারণ লক্ষ্যে লড়ছি, আর আমাদের এখুনি যে কাজগুলো করতে হবে এর মাঝে তোমরা কখনওই কিছু জানতে পারবে না। আমি তোমাদের বলতে চাই, ব্রাদারহুড আছে, কিন্তু আমি তোমাদের বলতেই পারব না এর সদস্য এক শত নাকি এক কোটি। এই সংখ্যাটি মোটে এক ডজনও হতে পারে, কিন্তু তোমাদের ব্যক্তিগত জ্ঞান থেকে তোমরা কখনওই তা বলতে পারবে না। গোটা তিন চারেক যোগাযোগের স্থান তোমাদের জানিয়ে দেওয়া হবে, কিন্তু সেগুলোও সময় সময় নবায়ন করা হবে।
আর এটি যেহেতু তোমাদের প্রথম যোগাযোগ এটি সংরক্ষিত থাকবে। যখনই তোমরা কোনও নির্দেশ পাবে, সেগুলো আমার হয়েই আসবে। আমরা যদি বোধ করি ওগুলো তোমাদের জানানো প্রয়োজন, তখন মার্টিনের মাধ্যমে জানিয়ে দেব। আর অবশেষে তোমরা যখন ধরা পড়ে যাবে, তোমরা স্বীকার করে নেবে। এর ব্যত্যয় হতে পারবে না। তবে তোমাদের নিজেদের কাজগুলোর বাইরে স্বীকার করতে হবে খুব অল্প কিছুই। তোমরা গুটিকয় অগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বেশি কাউকে প্রতারণা করতে পারবে না। সম্ভবত তোমরা আমাকেও প্রতারিত করবে না। কিন্তু ততক্ষণে আমি নিজেও মৃত হয়ে যেতে পারি, অথবা আমি হয়ে উঠতে পারি ভিন্ন কেউ একজন, এক ভিন্ন চেহারার মানুষ। ’
মোলায়েম কার্পেটের ওপর মৃদু পা ফেলে তখনও পায়চারি করে চলেছেন তিনি। মোটাসোটা বপু হওয়া সত্ত্বেও তার এই নড়াচড়ার মধ্যে এক ধরনের চমৎকারিত্ব ফুটে উঠছে। এক হাত পকেটে রেখে অন্য হাতে সিগারেট ধরে রাখায় ভঙিমাটি যেন আরও মানানসই। তার শারীরিক শক্তির চেয়ে আস্থার আর বোধগম্যতার ভাবটাই যেন বেশি ফুটে ওঠে।
আন্তরিকতার দিকগুলো তো আছেই, পাশাপাশি একজন চরমপন্থির যেসব একরোখা ভাব থাকার কথা তার কিছুই তার মধ্যে নেই। যখন তিনি হত্যা, আত্মহত্যা, যৌনব্যাধি, অঙ্গচ্ছেদ কিংবা পাল্টে দেওয়া চেহারার কথা বলেন একটা প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গাত্মক অভিব্যক্তি তার চেহারায় ফুটে ওঠে। ‘এর ব্যত্যয় হবার নয়’—এমন উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তার কণ্ঠ যেন বলতে চাইছে; ‘আসলে সাহসের সঙ্গে এটাই আমরা করব। কিন্তু জীবন যখন আবার যাপনযোগ্য হয়ে আসবে তখন আর আমাদের এগুলো করতে হবে না। ’
ও’ব্রায়েনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের, অনেকটা পূজনীয় পর্যায়ের ভালোলাগা কাজ করতে শুরু করল উইনস্টনের মধ্যে। এই মুহূর্তে সে গোল্ডস্টেইনের ছায়ামূর্তিও যেন ভুলে গেছে। আপনি যখন ও’ব্রায়েনের শক্তিশালী স্কন্ধের দিকে তাকাবেন, আর তার দৃঢ়তামাখানো চেহারার দিকে, অতি কুৎসিত আবার অতি সভ্য, তখন আপনার পক্ষে তাকে জেয় বলে ভাবাই অসম্ভব হয়ে উঠবে। এমন কোনও কৌশল নেই যার সমকক্ষ তিনি নন, এমন কোনও বিপদ নেই যা অনুধাবন করতে তিনি অক্ষম। জুলিয়াকেও বেশ নিবেশিত মনে হলো। হাতের সিগারেট নিজে নিজেই পুড়ে যাচ্ছে, আর গভীর মনোযোগে সে শুনে যাচ্ছে। ও’ব্রায়েন বলেই চললেন:
‘ব্রাদারহুডের অস্তিত্ব নিয়ে তোমাদের কানে গুজব আসতেই থাকবে। নিঃসন্দেহেই বলা যায় এরই মধ্যে ব্রাদারহুড নিয়ে তোমরা মনে মনে একটি ধারণা পোষণ করছো, নিজেদের মানসপটে এঁকেছো ছবিও। তোমাদের কল্পনায়, সম্ভবত, যড়যন্ত্রকারীদের এক অতিকায় গোপন শক্তি হিসেবেই রয়েছে এই ব্রাদারহুড, যারা কারাগারগুলোতেও গোপন বৈঠক করে, দেয়ালে দেয়ালে বার্তা লিখে রাখে, একজন আরেকজনকে কোডওয়ার্ডে কিংবা হাতের বিশেষ ভঙ্গিতে চেনে, কথা বলে। বাস্তবে আসলে এমন কিছুই নেই। ব্রাদারহুডের সদস্যদের একে অপরকে চেনার কোনওই পথ নেই, আর একজনের পক্ষে অপর গুটি কয়েক জনের বাইরে কাউকে চিহ্নিত করারও সুযোগ নেই। গোল্ডস্টেইন নিজেও যদি কখনও থট পুলিশের হাতে পড়ে যান, সদস্যদের পূর্ণাঙ্গ তালিকাটি তাদের দিতে পারবেন না।
বস্তুত এমন কোনও তালিকার অস্তিত্বও নেই। ব্রাদারহুডকে সমূলে উৎপাটনও সম্ভব নয় কারণ এটি সাধারণ বোধের কোনও সংগঠন নয়। একটি ধারণা বৈ এটি আর কিছুই নয়, আর সে ধারণা অমোচনীয়। তোমাদের টিকিয়ে রাখার জন্য একটি ধারণার বাইরে আর কিছুই তোমরা পাবে না। কমরেডের স্তুতি কিংবা উৎসাহ কোনওটাই মিলবে না। আর তোমরা যখন ধরা পড়ে যাবে, কারও কোনও সহযোগিতা পাবে না। আমরা সদস্যদের কোনও সহায়তা করি না। সর্বোচ্চ আমরা যখন মনে করি কেউ একজনকে চুপ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন তখন কারাগারে তার হাতে চোরাপথে একটি রেজর ব্লেড পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করি। তোমাদের আসলে কোনও প্রত্যাশা আর কোনও প্রাপ্তি ছাড়াই জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে। তোমরা কিছুদিন কাজ করবে, এরপর ধরা পড়ে যাবে, এরপর স্বীকারোক্তি দেবে, অতঃপর মৃত্যুকে বরণ করে নেবে। আসলে এই মৃত্যুতেই তোমাদের প্রাপ্তি মিলবে। আসলে আমাদের জীবদ্দশায় এর বাইরে আর কোনও কিছু ঘটতে পারে বলে আমরা মনেও করি না।
আসলে আমরা সবাই মৃত। আমাদের একমাত্র সত্যিকারের জীবন আসবে ভবিষ্যতে। যার সুফল পেতে আমাদের হাড়গোড়ের দেহাবশেষই কেবল টিকে থাকবে। কিন্তু সেই ভবিষ্যত কতদূরে হতে পারে, তা কারও জানা নেই। হতে পারে সহস্র বছর। এখন আসলে এই সুস্থ মানবিক বোধের পরিধি অতি স্লথ গতিতে বাড়িয়ে চলার বাইরে আর কিছুই করার নেই। আর সে কাজ যে আমরা দলবেধে একযোগে করতে পারব তাও নয়। আমরা কেবল আমাদের জ্ঞান একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারব, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বিস্তৃত করতে পারব। থট পুলিশের এই যুগে এর বাইরে আর কিছুই করার নেই। ’
থামলেন তিনি আর তৃতীয়বারের মতো হাত ঘড়ির দিকে তাকালেন।
‘কমরেড, তোমার চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে’—জুলিয়ার উদ্দেশে বললেন তিনি।
‘দাঁড়াও। বোতলের আধেকটা তো এখনও রয়ে গেছে। ’
গ্লাসগুলোতে ফের মদ ঢাললেন, আর নিজের গ্লাসটি তুলে নিলেন।
‘এবার তাহলে কার নামে?’—একই বক্রাঘাতি উচ্চারণ তার। ‘থট পুলিশের বিভ্রান্তির নামে? বিগ ব্রাদারের মৃত্যু কামনার নামে? মানবতার নামে? ভবিষ্যতের নামে?’
‘অতীতের নামে’—বলল উইনস্টন।
‘অতীতটাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ’—সম্মতি ও’ব্রায়েনের।
যে যার গ্লাস শেষ করল তারা, আর পরক্ষণেই জুলিয়া চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। ও’ব্রায়েন কেবিনেটের ওপর থেকে একটি বাক্স নামিয়ে আনলেন আর ভেতর থেকে চ্যাপ্টা সাদা রঙের ট্যাবলেট বের করে তার হাতে দিয়ে বললেন, ‘জিভের ওপর দিয়ে রাখো। এটার দরকার আছে। মদের গন্ধ মুখে নিয়ে বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। লিফটের অ্যাটেন্ডেন্টরা কড়া নজরদারি করে। ’
জুলিয়ার পেছনে দরজা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ও’ব্রায়েনের মুখের ভাবখানা এমন রূপ নিল যেন তার অস্তিত্বই ভুলে গেলেন। আরও দুবার পায়চারি করে থামলেন তিনি।
‘আরও কিছু বিষয় চূড়ান্ত করা প্রয়োজন’—বললেন ও’ব্রায়েন। ‘আমার ধারণা তোমাদের একটা গোপন স্থান আছে?’
মি. চ্যারিংটনের দোকানের উপরের কামরাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানাল উইনস্টন।
‘এই মূহূর্তে ওতেই চলবে। পরে আমি তোমাদের জন্য অন্য কিছু একটা ব্যবস্থা দেব। মাঝে মধ্যেই গোপন স্থান পাল্টে নেওয়া জরুরি। এরমধ্যে আমি তোমাদের “দ্য বুক”-এর একটি কপি পাঠিয়ে দেব’—ও’ব্রায়েন, লক্ষ্য করল উইনস্টন, বইটির নাম এমনভাবে বলেলন যেন উচ্চারণেই মনে হলো তা ইটালিক ফন্টে লেখা—‘গোল্ডস্টেইনের বইটি, আশা করি বুঝতে পারছো। যতটা দ্রুত সম্ভব পাঠিয়ে দেব। একটি কপি আমার হাতে আসতে দিন কয়েক লাগতে পারে। বুঝতেই পারো, আসলে এর কপি খুব বেশি নেই। যত দ্রুত আমরা এর কপি প্রকাশ করতে পারি তার চেয়েও দ্রুততায় থট পুলিশ সেগুলো পাকরাও করে ধ্বংস করে দেয়। অবশ্য তাতে খুব একটা যেয়ে আসে না। এই বই আসলে অবিনাশ্য। শেষ কপিটিও যদি ধ্বংস হয়ে যায়, আমরা আবারও তার প্রতিটি শব্দ প্রকাশ করতে পারব। তুমি কি কাজে যাওয়ার সময় ব্রিফকেস রাখো?’ যোগ করলেন তিনি।
‘নিয়ম বটে, তাই রাখি’
‘কেমন দেখতে ওটা?’
‘কালো, দুই চর্মবন্ধনির ভাঙাচোরা। ’
‘কালো, দুই চর্মবন্ধনির, ভাঙাচোরা—বেশ তো। খুব শিগগিরই, আমি তারিখ জানাতে পারছি না—তোমার সকালের কাজে একটি বার্তা থাকবে যাতে শব্দগুলো হবে আবছা এলোমেলো। তুমি তখন পুনরায় বার্তাটি পাঠানোর জন্য বলবে। পরের দিন, তুমি তোমার ব্রিফকেস ছাড়া কাজে যাবে, পথে কেউ একজন তোমার কাঁধ স্পর্শ করে বলবে, “আমার ধারণা আপনি আপনার ব্রিফকেস ফেলে এসেছেন। ” ওই ব্যক্তি তোমাকে যে ব্রিফকেস দেবেন তাতেই গোল্ডস্টেইনের বইটি থাকবে। তুমি পরবর্তী চৌদ্দ দিনের মধ্যে সেটি ফেরত দেবে। ’
কিছুক্ষণের জন্য দু’জনই চুপ করে থাকল।
‘কয়েক মিনিটের মধ্যেই তোমাকে চলে যেতে হবে’—বললেন ও’ব্রায়েন। ‘আমাদের আবার দেখা হবে—আমরা যদি আবার দেখা করি—’
উইনস্টন তার দিকে তাকাল। ‘এমন এক স্থানে, যেখানে কোনও অন্ধকার থাকবে না?’ ইতস্তত করে বলল সে।
বিস্ময়ের অভিব্যক্তি ছাড়াই সে কথায় সায় দিলেন উইনস্টন। ‘এমন এক স্থানে, যেখানে কোনও আঁধার থাকবে না’—বললেন তিনি, যেন তিনিও বুঝে ফেলেছেন এই কথার মানে। ‘এর মধ্যে, চলে যাওয়ার আগে কি তোমার আর কিছু বলার আছে? কোনও বার্তা? কোন প্রশ্ন?। ’
উইনস্টন ভাবল। তার মনে হলো না, জিজ্ঞাসা করার মতো আর কোনও প্রশ্ন তার আছে। অস্পষ্ট অনির্দিষ্ট কোনও শব্দ উচ্চারণের প্রয়োজন আছে বলেও মনে হলো না। বরং ও’ব্রায়েন বা ব্রাদারহুডের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনও কিছুর পরিবর্তে তার মনে এলো এক অন্ধকার শয়নকক্ষ যেখানে তার মা জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন। আর তার সঙ্গে মনে এলো মি. চ্যারিংটনের দোকানের দোতলার কামরা, এলো গ্লাসের পেপারওয়েট আর গোলাপকাঠের কাঠামোবদ্ধ ইস্পাতের খোদাই করা ছবিটি। অনেকটা দৈবচয়নের মতো বললো সে:
‘আপনি কি কখনও পুরনো একটি ছড়া শুনেছেন তার শুরুটা ছিলো “অরেঞ্জেস অ্যান্ড লেমন্স, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট ক্লেমেন্টস”?’
আবারও মাথা নাড়লেন ও’ব্রায়েন। দারুণ সৌজন্যতার অভিব্যক্তিতে তিনি স্তবকের পরের লাইনগুলো উচ্চারণ করলেন:
অরেঞ্জেস অ্যান্ড লেমন্স, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট ক্লেমেন্ট’স,
ইউ ও মি থ্রি ফার্দিংস, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট মার্টিন’স,
হোয়েন উইল ইউ পে মি? সে দ্য বেলস অব ওল্ড বেইলি,
হোয়েন আই গ্রো রিচ, সে দ্য বেলস অব শোরডিচ। ’
‘শেষের লাইনটিও আপনি জানেন!’—বলল উইনস্টন।
‘হ্যাঁ, আমি শেষের লাইনটিও জানি। তবে এখন আমার মনে হয় তোমার যাওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু একটু অপেক্ষা করো। তোমাকেও ওর একটি ট্যাবলেট দিতে হবে। ’
উইনস্টন উঠে দাঁড়াতেই ও’ব্রায়েন তার একটি হাত চেপে ধরলেন। তার শক্তিশালী পাঞ্জার চাপে উইনস্টনের তালুর হাড়গুলো যেন মুচড়ে গেল। দরজার কাছে গিয়ে উইনস্টন পিছনে ফিরে তাকাল। কিন্তু ও’ব্রায়েন ততক্ষণে তার অস্তিত্ব মন থেকে মুছে ফেলার প্রস্তুতিতে। টেলিস্ক্রিনে সুইচে হাত দিলে তিনি উইনস্টনের প্রস্থানের অপেক্ষায়। উইনস্টনের মন জুড়ে পেছনে ফেলে আসা সবুজ আলোর লেখার টেবিল, স্পিক রাইট আর কাগজ পত্রে ঠাসা কতগুলো বাক্স। এই ঘটনার এখানেই পরিসমাপ্তি। ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যেই তার মনে হতে লাগল, ও’ব্রায়েন এতক্ষণে পার্টির ব্যঘাতঘটে যাওয়া জরুরি কাজে মন দিয়েছেন।
অধ্যায় ৯
থকথকে একটা অবসাদগ্রস্ততা যেন পেয়ে বসেছে উইনস্টনকে। অবসাদগ্রস্ততা শব্দটিই সঠিক হবে। তাৎক্ষণিকভাবে এটিই তার মাথায় এলো। শরীরটা যেন জেলির মতো থকথকে আর স্বচ্ছ লাগছে। তার মনে হচ্ছিল, হাত তুলে দেখলে এ ভেতরটা দেখা যাবে। ভেতরের রক্ত আর রক্ত-পদার্থগুলো গলগল করে বের হয়ে আসবে, পড়ে থাকবে কেবলই শিরা উপশিরা, হাড় আর চামড়ার একটি কাঠামো। ইন্দ্রিয়বোধগুলোও বিবর্ধিত, কাঁধের ওপর আলখেল্লায় অস্বস্তি, মেঝেতে পায়ের তলায় খচখচ। এমনকি সামান্য নড়াচড়ায় হাতের জোড়াগুলো ফট ফট শব্দ করে ফোটে।
পাঁচ দিনে নব্বই ঘণ্টা কাজ করেছে সে। কেবল তার নয়, মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি কর্মীর একই অবস্থা। এখন অবশ্য সব শেষ। বাস্তবিক অর্থে এখন আর তার করার কিছুই নেই। বলার মতো পার্টির কোনও কাজ নেই, অন্তত আগামীকাল সকাল অবধি হাত পুরোই খালি। নির্দ্বিধায় গোপন আস্তানায় ছ’টি ঘণ্টা, আর পরের আরও ন’টি ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারে নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে। ধীরে ধীরে বিকেলের শান্ত রোদে একটা জীর্ণ সড়ক দিয়ে হেঁটে চলেছে। গন্তব্য মি. চ্যারিংটের দোকান। তবে এক চোখ পুরোই খোলা রাখা টহলদারদের গতিবিধিতে। যদিও যুক্তিহীনভাবে সে জানে আজ এই বিকেলে কোথাও কোনও বাধার মুখে পড়তে হবে না তাকে। হাতের ভারী ব্রিফকেসটি প্রতিবার পা ফেলার সাথে হাঁটুতে আঘাত দিচ্ছে। এতে তার পায়ের চামড়ায় এক ধরনের চুলকানির অনুভূতি হচ্ছে। ব্রিফকেসের ভেতরে বইটি। এখন থেকে আরও ছয়দিন ওটি তার দখলে থাকবে। তবে এখনও বইটি খোলা হয়নি, দেখাও হয়নি ওটি দেখতে কেমন।
ঘৃণা সপ্তাহের ষষ্ঠ দিনের কথা। মিছিল হয়ে গেছে, বক্তৃতার পালাও শেষ, চিৎকার চেঁচামেচিও থেমেছে। সঙ্গীত, ব্যানার, পোস্টার, সিনেমা, ভীতিকর ওয়াক্সওয়ার্ক, বাদ্য বাজনা আর কর্কশ শব্দ সম্প্রচার, ভারী বুটের কুচকাওয়াজ, ট্যাংকের সারি, উড়োজাহাজের গর্জন, গুলির ফটাস ফটাস শব্দে কেটেছে টানা ছয়টি দিন। উত্তেজনা যখন তুঙ্গে আর ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে ঘৃণার পারদ সর্বোচ্চ মাত্রায় তখন ভিড়ের মাঝে প্রতিটি মানুষেরই ভাবনা বিচারের শেষ দিনে যে ২,০০০ ইউরেশীয় যুদ্ধাপরাধী তখনও বধের অপেক্ষায় তাদের হাতের নাগালে পেলে ছিন্নভিন্ন করে দেবে—ঠিক তখনই ঘোষণা এলো ওশেনিয়ার যুদ্ধ ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে নয়। ওশেনিয়ার যুদ্ধ চলছে ইস্টেশিয়ার বিরুদ্ধে। ইউরেশিয়া মিত্রপক্ষ।
আর এই ঘোষণা এলো কোনও কিছু পরিবর্তনে সামান্য স্বীকারোক্তি ছাড়াই। সর্বত্র একযোগে একই আকস্মিকতায় সবারই জানা হয়ে গেল ইউরেশিয়া নয় ইস্টেশিয়াই শত্রু। ঘটনাটি যখন ঘটল উইনস্টনও তখন সেন্ট্রাল লন্ডনের একটি চৌরাস্তায় বিক্ষোভ কর্মসূচির মাঝে। তখন রাত নেমে গেছে। সাদা মুখগুলো আর উজ্জ্বল ব্যানারগুলো আলোর বন্যায় ভাসছিল। গোটা চৌরাস্তা জুড়ে তখন কয়েক হাজার জনতা। একটি ব্লকে স্পাইজের ইউনিফর্ম পরে হাজার খানেক শিশু-কিশোরও রয়েছে। উজ্জ্বল আলোর প্রক্ষেপণে জ্বলজ্বলে মঞ্চ থেকে ইনার পার্টির এক বক্তা, খর্বাকায়, কিন্তু খাটো বপুর তুলনায় অপেক্ষাকৃত লম্বা দুটি হাত আর গুটিকয় অবিন্যস্ত চুলে বড় টেকো মাথা নেড়ে নেড়ে জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছিলেন।
রামপেলস্টিলস্কিন (জার্মানি রূপকথার গল্পের এক খর্বাকায় চরিত্র)মার্কা বপুটি ঘৃণায় যেন বেঁকে বেঁকে যাচ্ছিল। এক হাতে মাইক্রোফোনটির গলা টিপে ধরে হাড্ডিসার লম্বা বাহুর শেষে আর হাতটি দিয়ে আক্রোশে মাথার ওপর বাতাস খামচে খামচে ধরছিলেন। তার কণ্ঠস্বর ধ্বনিবিবর্ধকে আরও ধাতব হয়ে ফুটছিল, তাতে ধ্বংসযজ্ঞ, বিতারণ, লুটতরাজ, ধর্ষণ, কয়েদী নির্যাতন, বোমাবাজি, মিথ্যাচার, রটনা, অন্যায় আগ্রাসন, সন্ধিভঙ্গের মতো অগুনতি অপরাধের তালিকা আরও নৃশংসভাবে প্রকাশ পেতে থাকে। মাতাল চিৎকারে বাস্তবিক অর্থে তখন আর তার কথা কারও কানে পৌঁছার মতো অবস্থা ছিল না।
ক্ষণে ক্ষণে জনতার রোষ আর চিৎকার স্পিকারের শব্দ ছাপিয়ে এক হিংস্র পশুর গোঙানিতে রূপ নিচ্ছিল। যা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে তুঙ্গ থেকে আরও তুঙ্গে উঠে হাজার কণ্ঠে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সবচেয়ে আদিম আর অসভ্যের চিৎকার ভেসে আসছিল স্কুল শিশুদের দিক থেকে। বক্তব্য চলছে তখন প্রায় বিশ মিনিট ধরে। ঠিক তখনই এক বার্তাবাহক হুড়মুড়িয়ে ঢুকলেন মঞ্চে আর বক্তার হাতে গুঁজে দিলেন একটি চিরকূট।
তিনি ওটি খুললেন আর বক্তব্যের গতিতে সামান্য ছেদ না টেনেই চিরকূটের লেখাটি পড়ে গেলেন। তার কণ্ঠেও এলো না সামান্য পরিবর্তন, অথবা যে কথাগুলো তিনি বলে আসছিলেন তার গতিও থেকে গেল অপরিবর্তিত। কেবল পাল্টে গেল কতিপয় নাম। কোনও শব্দ অনুচ্চারণেই জনতার দিক থেকে যে অভিব্যক্তি এলো তা যেন বলে দিল তারা বুঝে নিয়েছে। ওশেনিয়ার যুদ্ধ চলছে ইস্টেশিয়ার বিরুদ্ধে!
পরক্ষণেই ভেসে এলো আরও উচ্চস্বরের শোরগোল। এই চৌরাস্তা যেসব ব্যানার আর পোস্টার দিয়ে সাজানো তার সবই ভুল। অর্ধেকেরও বেশি পোস্টারে ভুল মানুষের মুখ। বলা হলো এটা অন্তর্ঘাতমূলক! গোল্ডস্টেইনের চরেরা এই কাজ করেছে। আর তখন দাঙ্গাময় একটি ছোট বিরতি মিলল যখন পোস্টারগুলো দেয়াল থেকে ছিঁড়ে নামিয়ে ব্যানারগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলে পায়ের নিচে দলাতে শুরু করল বিক্ষুব্ধ জনতা। স্পাইজের সদস্যরা অগ্রভাগে থেকে বাড়ির ছাদগুলো বেয়ে বেয়ে উঠে নিশান টাঙানো রশিগুলো কেটে কেটে চিমনির মধ্যে ফেলল। আর মাত্র দুই কি তিন মিনিটের মধ্যেই সব বিলিন হয়ে গেল।
বক্তা তখনও মাইক্রোফোনের গলা টিপে ধরে, সামনের দিকে কাঁধ ঝুঁকিয়ে মাথার ওপরে বাতাস খামচাতে খামচাতে কথা বলেই চলেছেন। আরও এক মিনিট ধরে ভিড়ের মধ্য থেকে চিৎকার ধ্বনি ভয়াবহ গর্জন তুলে ছড়িয়ে পড়তে থাকল। ঘৃণা ছড়াতে থাকল ঠিক আগের মতোই, কেবল পাল্টে গেল ঘৃণার লক্ষ্যস্থল। উইনস্টন ভীষণ মুগ্ধ হলো বক্তার ভোল পাল্টানোর ঢংটাতে। সামান্য থমকে না গিয়ে, এতটুকু না থেমে এমনকি বলার ভঙ্গিমাটুকুও না পাল্টে তিনি সম্পূর্ণ বিপরীত লক্ষ্যে বাক্যবাণ ছুঁড়তে লাগলেন। তবে ঠিক ওই মুহূর্তে অপর একটি বিষয় তার ভাবনা জুড়ে বিরাজ করছিল।
যখন পোস্টার আর ব্যানার ছেঁড়াছিড়ি চলছিল ঠিক সেই মুহূর্তেই সম্পূর্ণ অপরিচিত চেহারার এক ব্যক্তি তার কাঁধে হাত রাখলেন আর বললেন, ‘মাফ করবেন, আমার ধারণা আপনি আপনার ব্রিফকেসটি ফেলে এসেছেন। ’ বিনা বাক্যব্যয়ে ব্রিফকেসটি হাতে নিল সে। জানত, আগামী দিন কয়েক এটি খুলে দেখারও সুযোগ হবে না তার। বিক্ষোভ শেষ হওয়ার সাথে সাথে সে সরাসরি ছুটল সত্য মন্ত্রণালয়ের দিকে, যদিও তখন রাত প্রায় এগারোটা। মন্ত্রণালয়ের অন্য সব স্টাফও তার মতো ততক্ষণে মন্ত্রণালয়ে। টেলিস্ক্রিন থেকে এরই মধ্যে এতদসংক্রান্ত নির্দেশ এসে গেছে। অতএব তাদের ডেকে ডেকে আনার আর দরকার নেই।
ওশেনিয়ার যুদ্ধ চলছে ইস্টেশিয়ার বিরুদ্ধে: মানে হচ্ছে ওশেনিয়ার যুদ্ধ সবসমই ছিল ইস্টেশিয়ার বিরুদ্ধে। গেল পাঁচ বছরের রাজনৈতিক সাহিত্যের একটি বড় অংশ এখন পুরোই বাতিল। সব ধরনের প্রতিবেদন, নথি, সংবাদপত্র, বই, পুস্তিকা, চলচ্চিত্র, শব্দ-ট্র্যাক, ছবি—সবকিছুই তড়িৎ গতিতে শুদ্ধিকরণ করতে হবে। কোনও নির্দেশনা জারি হয়নি, তারপরেও সবারই জানা সব বিভাগের শীর্ষকর্তাদের এটাই চাওয়া, এক সপ্তাহের মধ্যে ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, কিংবা ইস্টেশিয়ার সঙ্গে মিত্রতা প্রমাণ করে এমন বক্তব্যের অনুমাত্রও থাকা চলবে না। ভারাবনত এক কর্মযজ্ঞ। প্রকৃত চেহারা আরও জটিল কারণ কাজটি যা, তা আবার বলে-কয়ে করার নয়।
রেকর্ডস ডিপার্টমেন্টের প্রত্যেকেই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আঠারো ঘণ্টা করে কাজ করছে। দিনে দুই-তিন ঘণ্টা করে ঘুমিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে বটে তাও মন্ত্রণালয়ের ভেতরেই। কারাগার থেকে তোষক এনে বারান্দায় বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে গড়াগড়ি দিয়ে নেওয়ার জন্য। খাবার মিলছে স্যান্ডউইচ আর ভিক্টরি কফি। বেয়ারারা ক্যান্টিন থেকে ট্রলি ভর্তি করে কামরায় কামরায় ঘুরে বিতরণ করছে ওগুলো। সামান্য বিরতি নিয়ে উইনস্টন বিছানায় গা এলিয়ে আবার যখন ঢুলুঢুলু চোখ ডলতে ডলতে ফিরছে, দেখতে পাচ্ছে আরেক পশলা কাগজের বৃষ্টি এসে স্তূপ হয়ে বরফের মতো ঢেকে দিয়েছে ডেস্ক।
কাগজের স্তূপে অর্ধঢাকা পড়েছে স্পিকরাইট। আর মেঝেতেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক কাগজ-পত্র। তার দায়িত্বই হচ্ছে হাতের কাজ শেষ করে ওদের আরও কাজ দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে এই কাজ পুরোপুরি যন্ত্রনির্ভর নয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে নামটি পাল্টে দিয়েই কাজ শেষ করা যাচ্ছে না। বিস্তারিত অংশে প্রয়োজন হয়ে পড়ছে বাড়তি সতর্কতা, প্রয়োগ ঘটাতে হচ্ছে কল্পনানির্ভর তথ্যের। বিশ্বের একটি অংশ থেকে যুদ্ধকে অন্য অংশের দিকে ঘুরিয়ে দিতে ভৌগলিক জ্ঞান থাকাও জরুরি হয়ে উঠছে।
তৃতীয় দিনে তার চোখে অসহ্য রকমের চুলকানি শুরু হলো, কয়েক মিনিট পরপরই চশমার কাচ পরিষ্কার করতে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল পাথর ভাঙ্গার মতো গতর খাটুনি চলছে তার। যে কাজ প্রত্যাখানের অধিকার যে কারও রয়েছে, খ্যাপাটের মতো সেই কাজই তাকে করে যেতে হচ্ছে। স্পিকরাইটে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ, কালি-পেন্সিলের খোঁচায় লেখা প্রতিটি অক্ষর-চিহ্নই যে ডাহা-মিথ্যা তা মনে করার মতো সময়ও নেই, আর তাতে কাজ বিঘ্নিত করার সুযোগও নেই। বরং ডিপার্টমেন্টের অন্য সকলের মতো সেও একইভাবে উদ্বিগ্ন ছিল এই ভেবে যে, জালিয়াতি যা কিছু চলছে তার মধ্যে যেন এতটুকু খুঁতও না থেকে যায়।
ষষ্ঠদিনে নথি-পত্রে ঠাসা সিলিন্ডার ডেস্কে আসার মাত্রা একটু কমলো। টানা আধাঘণ্টাও কিছুই এসে জমা পড়ল না টিউবে। এরপর আরেকটি সিলিন্ডার এলো। এরপর আর কিছুই এলো না। চারিদিকেই ততক্ষণে কাজ কমে আসছে। গভীর কিন্তু গোপন একটা লম্বা নিঃশ্বাস বয়ে গেল গোটা ডিপার্টমেন্টে। বিশাল একটি কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হয়ে গেল, যার কথা কখনও বলাও হবে না। কোনও মানব সন্তানের পক্ষেই আর নথিভিত্তিক প্রমাণ হাজির করা সম্ভব হবে না, যা দেখিয়ে সে বলতে পারবে কখনও কোনওকালে যুদ্ধ ছিল ইউরেশিয়ার বিরুদ্ধে।
অপ্রত্যাশিতভাবে বেলা ১২টায় ঘোষণা এলো মন্ত্রণালয়ের সকল কর্মীর আগামীকাল সকাল পর্যন্ত ছুটি। বইয়ের যে ব্রিফকেসটি হাতে নিয়ে হাঁটছে উইনস্টন, সেটি যখন কাজ করেছে তখন দুই পায়ের ফাঁকে, আর যখন ঘুমিয়েছে তখন গায়ের নিচে রেখে দিত। মন্ত্রণালয় থেকে সোজা বাসায় ফিরে সেভ করে গোসল সারতে গিয়ে বাথরুমেই তার ঘুমিয়ে পড়ার দশা। পানিটা ছিল ইষদোষ্ণর চেয়ে একটু বেশিই গরম।
হাত-পায়ের জোড়াগুলোতে পটাস পটাস শব্দ তুলেই মি. চ্যারিংটনের দোকানের দোতলার সিড়ি ভাঙল উইনস্টন। ভীষণ ক্লান্ত কিন্তু এখন আর ঘুমে কাতর নয় সে। জানালা খুলে দিয়ে ছোট নোংরা তেলের স্টোভটি জ্বালিয়ে নিয়ে কফির জন্য কড়াইয়ে পানি বসিয়ে দিল। জুলিয়া এসে পড়বে: এর মধ্যে বইটি দেখা শুরু করা যায়। ভাঙা হাতলওয়ালা চেয়ারটিতে বসে ব্রিফকেসের ফিতা-বন্ধনী খুলতে শুরু করল সে।
একটি ভারি কালো মলাটের বিশাল বই, কাচাহাতের বাঁধাই, মলাটে কোন নাম কিংবা শিরোনাম নেই। ছাপাগুলো কিছুটা অবিন্যস্তই মনে হলো। ধারের দিকে পাতাগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে গেছে, কোনও কোনওটি ছিঁড়ে ভিন্ন হয়ে গেছে। এমনটা বুঝেই নেওয়া যায় বহু হাত ঘুরেই তার হাতে পড়েছে এই বই। মলাট উল্টে প্রথম পাতায় লেখা রয়েছে
গোষ্ঠীশাসনভিত্তিক যৌথবাদের তত্ত্ব ও চর্চা
– ইমানুয়েল গোল্ডস্টেইন
পড়তে শুরু করলো উইনস্টন:
প্রথম অধ্যায়
অবজ্ঞাই শক্তি
যতদিনের কথা নথিভুক্ত রয়েছে ততদিন ধরে, অথবা বলা যায় নব্যপ্রস্তর যুগের পর থেকেই পৃথিবীতে উচ্চ, মধ্য আর নিম্ন এই তিন শ্রেণির মানুষ বাস করে আসছে। এরা আরও নানাভাবে উপ-বিভক্ত হয়ে, ভিন্ন ভিন্ন অগুনতি নাম পেয়েছে, তাদের আপেক্ষিক সংখ্যা, একের প্রতি অন্যের আচরণ যুগে যুগে পাল্টেছে, কিন্তু সমাজের অপরিহার্য কাঠামোটি থেকে গেছে অপরিবর্তিত। বড় বড় অভ্যুত্থান আর আপাতদৃষ্টিতে অপরবর্ত্য পরিবর্তনের পরেও, এই একই ব্যবস্থা নিজের মতো করেই সমাজ কাঠামোয় আবার স্থান করে নিয়েছে, মাপযন্ত্রের কাটা যেভাবে এদিক-ওদিক করে প্রতিবারই একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় ফিরে আসে ঠিক তেমনি।
এই গোষ্ঠীগুলোর লক্ষ্য পুরোপুরোই পরষ্পর পরাহত…
পড়া থামালো উইনস্টন। প্রধানত, যে কথাগুলো সে পড়ছে অতি স্বাচ্ছন্দ আর নিরাপদে তার যথার্থতার প্রশংসাটুকু করার জন্যই এই থামা। এখানে সে একা, টেলিস্ক্রিন নেই, চাবির ফুটো দিয়ে পাতা নেই কোনও কান, কাঁধের ওপর দিয়ে চেয়ে নেই কোনও সতর্ক চোখ, অথবা তার নিজের হাতেই ঢেকে রেখে পড়তে হচ্ছে না বইয়ের পাতা। গ্রিষ্মের মিষ্টি হাওয়া গালের ওপর খেলা করে যাচ্ছে। দূরে কোথাও থেকে শিশুদের চেচামেচির মিলিয়ে আসা শব্দ কানে আসছে। কক্ষের ভেতরে ঘড়ির টিক টিক ধ্বনি ছাড়া পুরোই নিস্তব্ধ পরিবেশ। হাতলওয়ালা চেয়ারে আরও একটু গেড়ে বসলো, আর পা দুটো তুলে রাখলো ফেন্ডারের উপর। এ যেনো স্বর্গ, এ যেনো অনন্ত সময়। কেউ যখন অন্য কখনো কোনও বইয়ের সবটা, প্রতিটি শব্দ পড়বে বলে ঠিক করে তখন এলোমেলোভাবে পাতা উল্টায়, ঠিক সেভাবেই একটি পাতা খুলে সে দেখলো ওটি তৃতীয় অধ্যায়ের শুরুটা। সে পড়তে শুরু করলো:
তৃতীয় অধ্যায়
যুদ্ধই শান্তি
বিশ্বকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করে ফেলার ঘটনাটি যে ঘটবে তা বিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়েই আন্দাজ করা যাচ্ছিলো। ইউরোপকে রাশিয়ার দখলে নেওয়া, আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দখল যুক্তরাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ায় বর্তমান তিন পরাশক্তির দুই শক্তি ওশেনিয়া আর ইউরেশিয়া ততক্ষণে পুরোদস্তুর কার্যকরভাবে বর্তমান। আর তৃতীয় শক্তি ইস্টেশিয়ার উত্থান আরও দশক খানেক সময়ের বিভ্রান্তিমূলক অন্তর্যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পর। তিন প্রধান শক্তির মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রগুলোর কোনও কোনওটি স্রেফ আবেগনির্ভর। যৌক্তিকতা নেই তাও যুদ্ধ। অন্যস্থানগুলোতে যুদ্ধ নির্ভর করছে যুদ্ধেরই ভাগ্যের ওপর, হলে হয়, নইলে নয়। তবে সাধারণভাবে যুদ্ধটি চলছে ভৌগলিক রেখার অনুসরণে। ইউরোপীয় ও এশিয়াটিক স্থলভাগের গোটা উত্তরাংশ জুড়েই ইউরেশিয়া। পর্তুগাল থেকে শুরু হয়ে বেরিং প্রণালী অব্দি যার বিস্তৃতি। আমেরিকাদ্বয়, ব্রিটিশ দ্বীপমালা আর অস্ট্রেলিয়াসহ আটলান্টিক দ্বীপপুঞ্জ এবং আফ্রিকার দক্ষিণাংশ ওশেনিয়াভুক্ত। পশ্চিমে সীমিত যুদ্ধক্ষেত্র নিয়ে ইস্টেশিয়া অন্য দুই ভু-খ-ের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট, চীন ও তার দক্ষিণের অন্য দেশগুলো, জাপানের দ্বীপমালা, মানচুরিয়া, মঙ্গোলীয়া আর তিব্বত মিলিয়ে বৃহৎ এক ভূ-খ- এর অংশ। তবে ইস্টেশিয়ার এই অংশটি বাড়া-কমার মধ্যেই থাকে।
এভাবে হোক কিংবা অন্যভাবে, এই তিন প্রধান-রাষ্ট্র স্থায়ীভাবেই একে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। আর এমন ধারা চলে আসছে গত পঁচিশ বছর ধরে। এখন আর যুদ্ধ ঠিক ততটা আক্রোশি নয়, বিংশ শতাব্দির গোড়ার দশকগুলোতে যতটা তীব্র আর ভয়াবহ ছিল, এখন তা অনেকটা ধরে এসেছে। যুদ্ধবাজদের মধ্যে যুদ্ধ থেকে অর্জনের দিকগুলো সীমিত হয়ে পড়ায়, একের পক্ষে অন্যকে পুরোপুরি ঘায়েল করার শক্তি না থাকায়, আর মূল আদর্শগত কোনও ভিন্নতা না থাকায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার বাস্তব কোনও কারণ আর নেই। তবে এ কথা বলা যাবে না, যুদ্ধ কিংবা যুদ্ধের প্রতি বিরাজমান এই মনোভাব তাদের রক্তপিপাসা কমিয়েছে কিংবা আরও বেশি শালীন করে তুলেছে। বরং যুদ্ধের উম্মত্ততা চলছেই, বিশ্বজনীন রূপ নিয়েই তা চলছে সব দেশে দেশে।
ধর্ষণ, লুটতরাজ, শিশু হত্যা, গোটা জাতিকে দাসত্বে ঠেলে দেওয়া, কারাবন্দিদের নিষ্পেষণ— যার ভয়াবহতা জীবন্ত সিদ্ধ করা, পুঁতে ফেলা পর্যন্ত গড়ায়, এসবই অনেকটা স্বাভাবিক বলে জ্ঞান করা হয়, আর যখন কাজগুলো কোনও শত্রুপক্ষ নয়, স্রেফ নিজেদের মধ্যেই নিজেরা করে চলে, তখন তা প্রশংসনীয়ই বটে! যুদ্ধে সরাসরি যুক্ত খুব কম সংখ্যক মানুষই, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ, আর হতাহতের সংখ্যাও অপেক্ষাকৃত কম।
সম্মুখ যুদ্ধ, যদি আদৌ কোথাও ঘটে থাকে, তা ঘটনে অজানা বানোয়াট যুদ্ধক্ষেত্রে, যার অস্তিত্ব সম্পর্কে গড় মানুষ কোনও ধারণাই করতে পারে না, অথবা যে ভাসমান দূর্গের কথা বলা হচ্ছে, যা সমুদ্রে কৌশলগত এলাকাগুলো পাহারা দিচ্ছে, তাও ঠিক কোথায় কেউ জানে না। সাধারণের মাঝে যুদ্ধ মানে ভোগ্যপণ্যের আকাল, মাঝে মধ্যে বিকট শব্দে দু-একটা রকেট বোমার বিস্ফোরণ আর তাতে কয়েক ডজন মানুষের মৃত্যু, এটুকুর বাইরে কিছু নয়। যুদ্ধ আসলে তার চরিত্রই বদলে ফেলেছে। আরও সুনির্দিষ্ট করে বলা যায়, যে কারণে যুদ্ধ সে কারণটিই এখন তার গুরুত্ব হারিয়েছে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে মহারণগুলোর ধরন-ধারণে যতটুকু স্বল্পবিস্তার টিকে আছে তাও এখন কর্তৃত্বময়তায় রূপ নিয়েছে যা সচেতনভাবেই স্বীকৃত ও অনুসৃত।
যে যুদ্ধটি এখন চলছে তার ধরন, বলা যায়— এই যে বছর কয়েক পরপরই জোট বদলায়, তারপরেও, বরাবরই অভিন্ন। গোড়াতেই যে কেউ বুঝে নেবে কোনও কিছুই চূড়ান্ত হওয়ার নয়, আর তা সম্ভবও নয়। তিনটি প্রধান রাষ্ট্রের কোনওটিকেই আর জয় করা যাবে না। তা যদি অন্য দুটি শক্তি এক জোট হয় তারপরও নয়। ভীষণ বেজোরের জোড়া তাদের, আর প্রত্যেকের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ভীষণ রকম পাকাপোক্ত। ইউরেশিয়া সুবিস্তৃত স্থলভাগ দিয়ে সুরক্ষিত, ওশেনিয়ার সুরক্ষা তার আটলান্টিক ও প্রশান্তমহাসাগরের বিশালতায়। ইস্টএশিয়া তার ভ’মির উর্বরতা আর অধিবাসীদের পরিশ্রম দিয়ে সম্মৃদ্ধ। দ্বিতীয়ত, বাস্তব জ্ঞানে এমন কিছুই আর বাকি নেই, যার জন্য যুদ্ধ করা চলে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ অর্থনীতির ধারা প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে, যেখানে উৎপাদন আর ভোগ পারষ্পরিক সংগতিপূর্ণ। এ অবস্থায় অতীতের যুদ্ধগুলোর প্রধান কারণ ছিল যে বাজার দখল, সেটিও এখন আর বর্তমান নেই। কাঁচামালের প্রতিযোগিতাও এখন আর জীবন-মরণ কোনও বিষয় নয়।
যেকোন পথেই এই তিন প্রধান-রাষ্ট্র এত বিশাল যে প্রত্যেকেই তার সীমারেখার মধ্যেই তার প্রয়োজনের প্রতিটি উপকরণ পেয়ে যাচ্ছে। আর যুদ্ধের যেহেতু সরাসরি একটি অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য থাকেই, বলা যায় এই যুদ্ধ এখন আসলে শ্রম শক্তির যুদ্ধ। প্রধান তিন রাষ্ট্রের সীমান্তের মাঝে যে অংশ তা কারোরই স্থায়ী দখলে নেই সেখানে চতুর্ভূজ আকৃতির একটি অংশ রয়েছে যার কোণায় কোণায় রয়েছে ট্যাঙ্গিয়ার, ব্রাজাভিল, ডারউইন আর হংকং, যার জনসংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ। এই ঘন-বসতির অঞ্চলগুলো আর উত্তরাঞ্চলীয় বরফাচ্ছন্ন ভূ-খণ্ডের দখল নিতেই প্রধান তিন শক্তির যত লড়াই। এই অমীমাংসিত এলাকার পুরো নিয়ন্ত্রণ কেউ কখনোই নিতে পারেনি। এর অংশ বিশেষ সারাক্ষণ হাতবদল হতে থাকে। আকস্মিক প্রতারণামূলক আক্রমণে এখন এটা, তখন সেটা করায়াত্ত্ব করার ফলে এখানকার দখলদারিত্বের সীমারেখা সীমাহীনভাবেই পাল্টাতে থাকে।
এইসব অমিমাংসিত সীমারেখায় রয়েছে মূল্যবান খনিজ, আর কোনো কোনো এলাকায় ফলে রাবারের মতো গুরুত্বপূর্ণ সবজি-পণ্য, অপেক্ষাকৃত শীতের জলবায়ুতে যার উৎপাদন ব্যয়ও অপেক্ষাকৃত বেশি। কিন্তু সর্বোপরি এসব অঞ্চলেরই রয়েছে সস্তা শ্রমের এক তলাহীন ভাণ্ডার। যে শক্তিই বিষুবমণ্ডলীয় আফ্রিকাকে কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে কিংবা দক্ষিণ ভারতকে অথবা ইন্দোনেশীয় দ্বীপমালাকে নিয়ন্ত্রণ করুক, এই অঞ্চলের কোটি কোটি মানব দেহের ওপর তার দখল জন্মায় যারা সস্তায় গায়ে খাটা শ্রমিক-মজদুর। এসব অঞ্চলের অধিবাসীদের প্রকাশ্য এক দাসত্বের জীবন, তারা এক শাসকের হাত বদলে অন্য শাসকের কব্জায় পড়ে। কয়লা বা তেলের ওপর দখলদারিত্বের মতোই এই শ্রমশক্তির ওপর দখলদারিত্ব বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলে যাতে তা থেকে যে অর্থ বেচে যায় তা দিয়ে আরো অস্ত্র কেনা যায় আর তাতেই আরও ভূখণ্ড দখল হয়, কব্জায় আসে আরো শ্রমশক্তি। এ এক সীমাহীন লালসা।
খেয়াল করলে দেখা যাবে যুদ্ধ ওইসব অমীমাংসিত সীমারেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। ইউরেশিয়ার সীমান্ত বরাবরই কঙ্গো অববাহিকা থেকে ভূমধ্যসাগরের উত্তর তীর পর্যন্ত আগু-পিছু করে। ভারত সাগর আর প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপগুলো কখনো ওশেনিয়ার আবার কখনো ইস্টেশিয়ার দখলে থাকে। ইস্টেশিয়া আর ইউরেশিয়ার বিভক্তি রেখায় যে মঙ্গোলিয়ার অবস্থান সেখানকার পরিস্থিতি কখনোই স্থিতিশীল থাকেনি। মেরুঅঞ্চলে বিশাল সীমারেখায় তিন প্রধানশক্তিই তাদের দখলদারিত্বের ঘোষণা দিতে থাকে যখন তখন, যেখানে মূলত কারও বসবাস যেমন নেই, যাওয়াও সম্ভব হয়নি কখনো।
তবে শক্তির ভারসাম্য বরাবরই কম-বেশি নিশ্চিত থাকে, আর প্রতিটি প্রধান-রাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড থেকে যায় অক্ষত। অধিকন্তু, বিশ্ব অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার জন্য বিষুবমণ্ডলীয় এই বঞ্চিত মানুষের শ্রমের বাস্তবিক অর্থে কোনো প্রয়োজন নেই। তারা বিশ্বের সম্পদে কোনো মূল্যই যোগ করে না, কারণ তারা যা কিছু উৎপাদন করে তা যুদ্ধের কাজেই ব্যয় হয়ে যায়। আর যা যুদ্ধের উদ্রেক ঘটায় তা তো ভালোভাবে জিইয়ে রাখতেই হবে যাতে আরও একটি যুদ্ধের উদ্রেক ঘটে। এই দাসশ্রেণির মানুষগুলো তাদের শ্রম দিয়ে যুদ্ধকে নতুন নতুন গতি দেয়। কিন্তু তাদের অস্তিত্ব যদি না থাকত, বিশ্ব সমাজের কাঠামো, আর সে কাঠামো ধরে রাখার প্রক্রিয়া খুব বেশি ভিন্ন কিছু হতো না।
আধুনিক যুদ্ধের মূল লক্ষ্য হচ্ছে (দ্বৈতচিন্তার নীতি অনুসারে, ইনার পার্টির মগজওয়ালাদের কাছে যা একইসঙ্গে স্বীকৃত এবং অস্বীকৃত দুইই) যন্ত্রে উৎপাদিত পণ্যের ব্যবহার বাড়বে, কিন্তু সাধারণের জীবন মান বাড়বে না। উনিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে উদ্বৃত্ত ভোগ্য পণ্য নিয়ে শিল্প সমাজগুলো একটি সুপ্ত সমস্যায় পড়ে আছে। এই সময়ে, যখন খুব কম মানুষই জীবন ধারণের মতো পর্যাপ্ত পায়, তখন এমন সমস্যা নিঃসন্দেহে জরুরি কিছু নয়। আর জরুরি হয়ে উঠবেও না। উদ্বৃত্ত পণ্য ধ্বংস করে দেওয়ার কোন কৃত্রিম পদ্ধতি কাজ না করলেও নয়।
১৯১৪ সালের আগের পরিস্থিতির তুলনায় এখনকার বিশ্ব ভুখা, নাঙ্গাদের এক বিপর্যস্ত ভূমি। আর আমরা যদি একটি কল্পিত ভবিষ্যতের দিকে তাকাই, এহেন পরিস্থিতি আরও বাড়বে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে ভবিষ্যত সমাজের স্বপ্ন ছিলো অভাবনীয় ধন, অফুরান অবসর, নিয়মতান্ত্রিক আর কার্যকর এক সমাজ– কাচ-ইস্পাত আর বরফ-সাদা কংক্রিটের এক ঝকমকে বিশ্ব। প্রায় প্রতিটি শিক্ষিত মানুষের সচেতন ভাবনাই ছিলো এমন। অভাবনীয় গতিতে এগিয়ে চলছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যাত্রা, আর ধরেই নেওয়া যায় এই গতি আরও বাড়বে। তারপরেও প্রত্যাশিত সমাজ গড়ে উঠতে পারেনি, অংশত দীর্ঘ ধারাবাহিক যুদ্ধ আর বিপ্লবের কারণে সৃষ্ট দারিদ্র এর কারণ, আর অংশত এই জন্যে, যে বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি উন্নয়ন ঘটছে তা স্রেফ চিন্তার ব্যবহারিক চর্চার ভিত্তিতে, যা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত সমাজে টিকে থাকতে পারছে না।
মোটের ওপর, বিশ্ব আজ পঞ্চাশ বছর আগের বিশ্ব থেকে একটু বেশিই আদিম। পিছিয়ে থাকা কিছু এলাকা এগিয়েছে, কিছু কল-কৌশলও তৈরি হয়েছে যা কোনও না কোনওভাবে যুদ্ধের আর পুলিশের গোয়েন্দাগিরির কাজে লাগছে, কিন্তু পরীক্ষা-নীরিক্ষা বা আবিষ্কার-উদ্ভাবন বন্ধ রয়েছে, আর ১৯৫০ এর দশকে ঘটে যাওয়া আনবিক যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট ধ্বংস আর ক্ষতি পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা কখনোই সম্ভব নয়।
এছাড়াও যন্ত্রের সঙ্গে এর অন্তঃস্থায়ী বিপদ আর ঝুঁকিতো রয়েছেই। প্রথম যখন যন্ত্র এলো তখন সমঝদার মানুষমাত্রের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো, মানুষের কায়িক শ্রমের দিন ফুরিয়েছে। আর আরও একটু বড় পরিসরে বলতে গেলে ধারনা করা হচ্ছিলো মানুষে মানুষে অসমতাও কমবে। যদি সে কারণেই যন্ত্রের ব্যবহার চলে তা আগামী কয়েক প্রজন্মের মধ্যেই ক্ষুধা, অতিরিক্ত কাজ, অশিক্ষা, রোগ-বালাই আর পুঁতিগন্ধময় জীবন দূর করবে।
তবে বাস্তবতা হলো, এমন কোনও উদ্দেশ্যে নয়, স্বয়ংক্রিয় এক প্রক্রিয়ায় এসব যন্ত্র সম্পদ উৎপাদন করতে থাকলো, যার বণ্টনও কখনো কখনো অসম্ভব হয়ে থাকলো না- আর তাতে পঞ্চাশ বছরের মধ্যে অর্থাৎ উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার ভাগে এসে গড়-পড়তা মানুষের জীবনের মান ভীষণভাবে বেড়ে গেলো।
কিন্তু এটাও স্পষ্ট, সম্পদের উপচয় সর্বত্র যে ধ্বংসের হুমকি দেয়, অন্য বিবেচনায় সে ধ্বংস আধিপত্যবাদী সমাজেরই। বিশ্বে মানুষ এখন কম খাটে, পর্যাপ্ত খায়, ঘরে থাকে- যার ভেতরেই পায়খানা-গোসলের ব্যবস্থা, ফ্রিজে খাবার তুলে রাখে, মোটরগাড়ি হাঁকায়, অথবা এমনকি উড়োজাহাজেও চেপে যেতে পারে কোথাও। তাতে বলাই যায়, বা বলাটা জরুরিও বটে যে, বৈষম্য দূর হয়েছে। বিষয়টি এখন সাধারণেও বিস্তৃত। সম্পদের বেশি-কমের ফারাকটি আর বড় হয়ে নেই।
ব্যক্তিমালিকানা আর বিলাসিতার বিবেচনায় সম্পদের সমবণ্টণ হবে, কিন্তু ক্ষমতা ছোট্ট একটি প্রাধিকারপ্রাপ্ত শ্রেণির হাতে থাকবে এমন একটা সমাজ কল্পনাও এখন অবাস্তব নয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে এমন একটি সমাজ স্থায়ী রূপ নিতে পারছে না। কাজের পর বিশ্রাম আর নিরাপত্তা যদি সকলের জন্য সমান হয়ে যায় তখন মানব গোষ্ঠীর একটা বড় অংশ, যারা দারিদ্র্যের কারণেই নির্বোধ, তারা শিক্ষিত হয়ে উঠবে, নিজেদের নিয়ে ভাবতে শিখবে। আর যখনই তারা সেটা করবে তখন খুব দ্রুত কিংবা আরও পরে তাদের কাছে ধরা পড়ে যাবে সুবিধাভোগী সংখ্যালঘুদের আসলে কোনো কাজ নেই। আর তখন তারা এদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করবে।
একটি আধিপত্যবাদী সমাজ নিশ্চিত করা কেবল তখনই সম্ভব যখন দারিদ্র্য থাকে, থাকে বঞ্চনা। অতীতের কৃষি সভ্যতায় ফিরে যাওয়া, কোনো কোনো চিন্তাবিদ বিশ শতকের গোড়ার দিকে যেমনটা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন, তাও কোনো বাস্তবসম্মত সমাধান নয়। এতে বিরোধ বাঁধে যান্ত্রিকীকরণের সঙ্গে, যা এখন মোটামুটি গোটা বিশ্বেরই প্রবণতা। তবে যেসব দেশ শিল্পে পিছিয়ে তারা সামরিক বিবেচনায় হয়ে পড়ে অসহায়। তখন এরা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে অপেক্ষাকৃত এগিয়ে থাকা শত্রু-দেশের হাতে শাসিত ও শোষিত হতে থাকে।
পণ্যের সুফল থেকে বঞ্চিত রেখে দারিদ্র্য জিইয়ে রাখার মধ্য দিয়ে কোনো সন্তোষজনক ফল পাওয়া গেল না। পুঁজিবাদের চূড়ান্ত দিনগুলোতে, মোটা দাগে ১৯২০ থেকে ১৯৪০ এর মধ্যে, ঘটনাটি ঠিক এমনই ঘটল। অনেক দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে গেল, ভূমি পড়ে থাকল অনাবাদী, মৌলিক যন্ত্রপাতি রয়ে গেল অনেকের কাছেই অধরা, বৃহৎ বৃহৎ চাক ধরে জনগোষ্ঠী বেকার হয়ে থাকল, আর হয়ে পড়ল রাষ্ট্রীয় চ্যারিটির অনুদাননির্ভর। কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হলো না, সামরিক শক্তি দুর্বল হয়ে আসলো, চেপে বসল অকারণ দারিদ্র্য আর তাতে বিরোধী শক্তির দানা বেঁধে ওঠা অনিবার্য হয়ে উঠল। শিল্পের চাকা ঘুরবে কিন্তু বিশ্বের প্রকৃত সম্পদ বাড়বে না এমন একটি পথ বের করা তখন হয়ে পড়ল সত্যিকারের সমস্যা। পণ্য তৈরি হবে কিন্তু তার বণ্টন থাকবে না সেটাই ছিল লক্ষ্য। আর সে লক্ষ্য পূরণের একটাই পথ দাঁড়াল, তা হলো যুদ্ধ জিইয়ে রাখা।
বিনাশই যুদ্ধের অনিবার্য রূপ। এমন নয়, সে বিনাশ হতে হবে কেবলই মানব জীবনের, হতে পারে তা পণ্যের বিনাশ, কিংবা মানব শ্রমেরও। মানবজীবন সহজ করে তুলতে পারত, কিংবা পরিণামে তাদের করে তুলতে পারত আরো বুদ্ধিমান, এমন সব কিছুকে খান-খান করে আকাশে-অন্তরীক্ষে ছড়িয়ে দেয়, অথবা সাগরের অতলান্তে তলিয়ে দেয় এই যুদ্ধ। এমনকি অস্ত্রে অস্ত্রে যখন সয়লাব হয়ে থাকে, ব্যবহার নেই, ধ্বংসও হচ্ছে না তখনো এর প্রস্তুতকরণে নিয়োজিত থাকে বৃহৎ শ্রমশক্তি যারা স্রেফ তাই উৎপাদন করে চলে যার কোনো ভোক্তা নেই।
একটি ভাসমান দূর্গের কথাই ধরা যাক, এই দূর্গে শ্রমিকরা শত শত কার্গো জাহাজ তৈরিতে ন্যস্ত। জানা আছে এসব জাহাজ একসময় পরিণত হবে ভাঙারির সামগ্রীতে, বাস্তবে কোনো কাজেই লাগবে না, কারো জন্য বয়ে আনবে না বস্তুগত কোনো সুবিধাও। কিন্তু তারপরেও আরেকটি অতিকায় ভাসমান দূর্গই তৈরি হবে। নীতিগতভাবে জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলো মিটিয়ে যা উদ্বৃত্ত থাকবে যুদ্ধ পরিকল্পনা হতে হয় তারই ভিত্তিতে, কিন্তু বাস্তবে জনগণের প্রয়োজনকে ঊন জ্ঞান করা হয় আর তার ফলে মানুষের জীবনের জন্য যা প্রয়োজন তার আধাই অপূর্ণ থেকে যায়। আর সেই অপূর্ণতাকেই আবার দেখা হয় বড় ধরনের সুবিধা হিসেবে।
এ এক ইচ্ছানীতি যেখানে অনুগ্রহভাজনদেরও অভাবগ্রস্ততার কিনারায় লটকে রাখা হয় যাতে আকালের দিনে ছোট্ট একটি সুবিধাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ধরা দেয়, আর এভাবেই অনুগ্রহ আর বিরাগভাজনদের মাঝে তফাৎটা বহুগুনে বিবর্ধিত হয়। বিশ শতকের গোড়ার দিকের জীবন-মান বিবেচনায় নিলে বলা যায়, তখন কিন্তু ইনার পার্টির একজন সদস্যেরও একটু বেশিই খাটুনির জীবন ছিল। তবে, গুটিকয় বিলাসিতাও তারা উপভোগ করত, সুসজ্জিত ফ্ল্যাট, মিহি কাপড়ের পোশাক, ভালো মানের খাবার, পানীয় আর তামাক মিলত। জনা দুই কিংবা তিনেক চাকর-বাকর রাখা যেত, ব্যক্তিগত মোটর কার কিংবা হেলিকপ্টার পর্যন্ত ছিল যাতে তাকে আউটার পার্টির একজন সদস্য থেকে খুব সহজেই আলাদা করা যেত। আর আউটার পার্টির সদস্যেরা আবার সাধারণ নিগৃহীত জনগোষ্ঠী, যাদের আমরা ‘প্রোল’ বলছি, তাদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি সুবিধা ভোগ করত। এ এক অবরুদ্ধ নগর সমাজ, যেখানে এক টুকরো ঘোড়ার মাংস থাকা আর না থাকা দিয়ে বিবেচিত হয় ধনী আর গরীবের ফারাক। একইভাবে যুদ্ধাবস্থা বা বিপদগ্রস্ততায় একটি ছোট্ট গোষ্ঠীর হাতে সর্বময় ক্ষমতা তুলে দেওয়াকেই টিকে থাকার স্বাভাবিক, অপরিহার্য শর্ত বলে ভাবতে শেখায়।
যুদ্ধ, যেমনটা দেখা যায়, প্রয়োজনীয় ধ্বংস সাধন করে চলে, আর তা করে মনস্তাত্ত্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য এক প্রক্রিয়ায়। নীতিগতভাবে বিশ্বের অতিরিক্ত শ্রম ধ্বংস করার সহজ পথ হচ্ছে, মঠ-পিরামিড তৈরি করা, গর্ত খুঁড়ে আবার সেই গর্তই ভরাট করা কিংবা বিপুল পণ্য উৎপাদন করে তাতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া। কিন্তু এতে আধিপত্যবাদী সমাজের অর্থনৈতিক ভিত দৃঢ় হয়, মনোবলের ভিত নয়। এখানে যে মনোবলের কথা বলা হচ্ছে তা কিন্তু মোটেই সাধারণের মনোবল নয়, সাধারণের ভাবাবেগ গুরুত্বহীন কারণ তাদের কাজই হচ্ছে কাজ করে যাওয়া, এই মনোবল হচ্ছে পার্টির নিজের। এমনকি অতি বিনয়ী পার্টি সদস্যটিকেও হতে হবে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় যোগ্য, পরিশ্রমী আর বুদ্ধিমান, কিন্তু এও প্রয়োজন যে এই সদস্যটি হবেন বিশ্বাসপ্রবণ, অজ্ঞ আর গোঁড়া প্রকৃতির যার মজ্জাগত হয়ে থাকবে ভীতি, ঘৃণা, তোষামোদিতা আর মাত্রাহীন বিজয়োল্লাস। অন্য কথায় তার এমন এক মানসিক গড়ন থাকতে হবে যা যুদ্ধাবদ্ধার সঙ্গে খাপ খায়। যুদ্ধ আদতে হচ্ছে কি হচ্ছে না, তাতে কিছু যায় আসে না, আর, যেহেতু সুনির্দিষ্ট যুদ্ধ জয় অসম্ভব, সেহেতু যুদ্ধ ভালো চলছে নাকি মন্দ সেটাও ধর্তব্যের নয়। যা জরুরি তা হচ্ছে, একটি যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, এটাই নিশ্চিত করা।
গোটা বিশ্বেই পার্টি তার সদস্যদের কাছে গোয়েন্দাগিরি প্রত্যাশা করে, আর যুদ্ধাবস্থায় তা করা অপেক্ষাকৃত সহজও, কিন্তু কোনো সদস্য দলের যত বেশি উচ্চপদে যাবে ততই বেশি চিহ্নিত হয়ে পড়বে। সুনির্দিষ্ট করেই বলা চলে ইনার পার্টির যুদ্ধ-মত্ততা আর শত্রুপক্ষের প্রতি ঘৃণা সবচেয়ে প্রবল। প্রশাসকের যোগ্যতা নিয়ে ইনার পার্টির একজন সদস্যকে প্রায়শই জানতে হবে, যুদ্ধের এই এই খবরগুলো অসত্য, অথবা তাকে কখনো কখনো এও জেনে রাখতে হবে যে গোটা যুদ্ধটিই মেকি, আর হয় তা মোটেই ঘটছে না অথবা কোনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়েই এই যুদ্ধের উস্কানি কিংবা হম্বিতম্বি। তবে এই জ্ঞান বা ধারণাকে দ্বৈতচিন্তার এক সহজ পদ্ধতিতে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে হবে। এদিকে, ইনার পার্টির কোনো সদস্য কিন্তু যুদ্ধ নিয়ে এতটুকুও দ্বিধান্বিত নন, এক রহস্যময় বদ্ধমূল বিশ্বাসে তারা মনে করেন এই যুদ্ধ সত্য, জয় দিয়েই তার অবসান ঘটবে, আর ওশেনিয়া একদিন হয়ে উঠবে গোটা বিশ্বের একচ্ছত্র প্রভু।
ইনার পার্টির সব সদস্যের বিশ্বাসের মর্মমূলে গেঁথে আছে এক অনাগত বিজয়। হতে পারে এই বিজয় সুনিশ্চিত হবে একের পর এক নতুন ভূ-খণ্ড দখল করে তার মধ্য দিয়ে এক বিপুল শক্তির অধিকারী হয়ে, অথবা নতুন কোনো অপ্রতিরোধ্য যুদ্ধাস্ত্র আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। নতুন অস্ত্রের এই সন্ধান চলে অবিরাম, নিরবচ্ছিন্ন, আর যে গুটিকয় কাজে উদ্ভাবনী কিংবা অনুধাবনীয় মন নিয়োজিত এটি তারও একটি। বিজ্ঞান বলতে যা বুঝায় ওশেনিয়ায় তা আজ অবর্তমান। নিউস্পিকে ‘বিজ্ঞান’ নামক শব্দটিই উঠে গেছে। চিন্তার প্রায়োগিক পদ্ধতি, যার ভিত্তিতেই অতীতের সব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, তা আজ ইংসকের প্রায় সকল মূলনীতি দ্বারা প্রতিহত। আর কারিগরি অগ্রগতিও কেবল তখনই দেখা যায় যখন এর পণ্য কোনো না কোনো পথে মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করায় ব্যবহৃত হয়।
বিশ্বের সকল প্রয়োজনীয় মূর্ত সুন্দরের সৃজন হয় থমকে আছে, নয়ত পেছনের দিকে যাচ্ছে। জমি চাষ হচ্ছে ঘোড়ায় টানা লাঙ্গলে অথচ বইগুলো রচিত হচ্ছে যন্ত্রে। তবে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে যেমন, অর্থ, প্রভাব, যুদ্ধ আর পুলিশি গোয়েন্দাগিরিতে প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গিকেই উৎসাহিত করা হচ্ছে, অথবা অন্তত সহ্য করে যাওয়া হচ্ছে। দলের দুটিই লক্ষ্য—গোটা পৃথিবীর উপরিতল করায়ত্ব করা আর স্বাধীন চিন্তার সকল সম্ভাবনা চিরতরে মিইয়ে দেওয়া। এই পথে দুটো বৃহৎ চাওয়া থেকে যাচ্ছে যার সমাধানের পথ বের করতে না পারায় পার্টি উদ্বিগ্ন। একটি, কিভাবে অন্য কেউ কী ভাবছে তা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই জেনে নেওয়া যায়, আর অন্যটি হচ্ছে, কী করে কয়েক কোটি মানুষকে আগেভাগে সতর্ক না করে, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মেরে ফেলা সম্ভব।
বিজ্ঞান গবেষণা যেহেতু এখনো বর্তমান, তাই এখন এর বিষয়বস্তু এই একটাই। এখনকার বিজ্ঞানী হয় মনস্তত্ত্ববিদ আর অনুসন্ধাতার মিশেল একটি রূপ, যারা চেহারার অভিব্যক্তি, অঙ্গভঙ্গি, কণ্ঠের আওয়াজ থেকে বোঝার চেষ্টা করেন আর ওষুধের ব্যবহার, ছ্যাকা, সংবেশন, শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে সত্য আদায়ের কৌশল পরীক্ষায় সময় পার করেন, নয়ত তারা স্রেফ রসায়নবিদ, পদার্থবিদ বা জৈববিদ যারা যে যার শাখার কোন পথে জীবন নেওয়া যায় সে সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে ব্যস্ত। শান্তি মন্ত্রণালয়ের বিশাল পরীক্ষাগারে, আর ব্রাজিলের জঙ্গলে লুক্কায়িত পরীক্ষণ স্টেশনে, অথবা অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে, নয়ত অ্যানটার্কটিকার হারানো দ্বীপমালায় বিশেষজ্ঞের দলগুলো অতন্দ্রিত কাজ করে যাচ্ছে।
কেউ কেউ ভবিষ্যত যুদ্ধের উপকরণ তৈরি পরিকল্পনায় ন্যস্ত; অন্যরা বড় থেকে আরো বড় রকেট বোমা, আরো বেশি বেশি শক্তিশালী বিস্ফোরক, তৈরি, আরো অভেদ্য সাজোয়া যান নির্মাণের পথ বাতলে দিতে ব্যস্ত; আর অন্যরা আরো ভয়ঙ্কর মরক সৃষ্টিকারী গ্যাসের সন্ধানে, অথবা এমন দ্রবণীয় বিষ আবিষ্কারে যা এতটা পরিমাণে উৎপাদন সম্ভব যা দিয়ে গোটা মহাদেশের গাছ-লতা-পাতা ধ্বংস করে দেওয়া যায়, অথবা সম্ভাব্য সব ধরনের শারীরিক প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অকেজো করে দিয়ে মানব শরীরে সংক্রমিত হতে পারে এমন রোগের জীবাণু প্রজনন; অন্যরা মনোনিবেশ করে আছে এমন যানবাহন আবিষ্কারে যা মাটির গভীরে প্রোথিত হতে পারবে, সাবমেরিনের মতো তলিয়ে যেতে পারবে পানির অতলে, অথবা এমন উড়োজাহাজ যা আকাশে উড়বে আবার পানিতেও ভাসবে; অন্যরা আরো দূরের সম্ভাবনাকে নিয়েও ঘাঁটাঘাঁটি করছে যাতে মহাকাশের হাজার হাজার কিলোমিটার দূরের সূর্যের রশ্নি লেন্সের সাহায্যে ধরা, অথবা পৃথিবীর কেন্দ্রে তাপ কেন্দ্রীভূত করে কৃত্রিম ভূমিকম্প আর জলোচ্ছাসের সৃষ্টি করা সম্ভব।
এসব প্রকল্পের কোনোটিই কখনো বাস্তবায়নের ধারেকাছেও পৌঁছায় না, আর তিন সুপার স্টেটের কোনোটিই একের চেয়ে অপরে বড় শক্তি হয়ে ওঠে না। আরো বেশি দেখার বিষয় হচ্ছে, তিন শক্তির প্রত্যেকেই আনবিক বোমা নামের একটি অস্ত্রের মালিক হয়ে আছে, যা মূলত এখন তারা যেসব শক্তি অর্জনের চেষ্টায় রত তার চেয়েও অনেক বেশি শক্তিধর। পার্টি অবশ্য তার স্বভাবজাতভাবেই দাবি করে চলছে তারাই এই আনবিক বোমার প্রথম আবিষ্কারক এবং তা আবিষ্কার হয় ১৯৪০’র দশকে আর তার দশ বছর পরে এর ব্যাপকভিত্তিক ব্যবহারেও তারা ছিল প্রথম।
সে সময় প্রধানত ইউরোপীয় রাশিয়া, পশ্চিম ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকার শিল্পকেন্দ্রগুলোতে এমন শত শত বোমা ফেলা হয়। এর প্রভাবে সকল দেশের শাসক শ্রেণি ধরে নিয়েছিল আর গুটি কয় আনবিক বোমার বিস্ফোরণ পুরো বিশ্বের সংগঠিত সমাজব্যবস্থায় ধস আনবে আর এমনকি তাদের নিজেদের শক্তিরও ইতি ঘটবে। এ অবস্থায় কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক চুক্তি ছাড়া, বিনা সন্ধিতেই ঠিক হয়ে যায় আর কোনো বোমা ফেলা হবে না। তিন শক্তিই তাদের আনবিক বোমা বানানোর কাজ অব্যাহত রাখল আর মজুদ করে রাখল নতুন কোনো মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো শক্তি হিসেবে, তারা মনেই করে আজ নয়ত কাল তেমন কোনো মারণাস্ত্র আসবেই। ইতোমধ্যে কেটে গেছে ত্রিশ কিংবা চল্লিশটি বছর আর সেই যুদ্ধকলা অনেকটা নিশ্চল হয়ে পড়েছে।
আগে যতটা দেখা যেত এখন তার চেয়ে বেশি হারে হেলিকপ্টারের ব্যবহার চলে, বোমারু বিমানকে টেক্কা দিয়ে স্বয়ংচালিত ক্ষেপনাস্ত্র জায়গা করে নিয়েছে, আর ঠুনকো যুদ্ধজাহাজ সরিয়ে দিয়ে তৈরি হয়েছে ভাসমান দুর্গ; এর চেয়ে বিশেষ কোনো উন্নয়ন ঘটেনি। ট্যাঙ্ক, সাবমেরিন, টর্পেডো, মেশিনগান এমনকি রাইফেল, হ্যান্ড গ্রেনেডের ব্যবহার আজও রয়েছে। সংবাদপত্রে টেলিস্ক্রিনে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের খবর আসে ঠিকই কিন্তু আগের সেসব বেপরোয়া যুদ্ধের মতো, যাতে শত শত, হাজার হাজার এমনকি লাখ লাখ মানুষ কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মারা পড়ত, তেমনটি আর ঘটে না।
তিন প্রধান রাষ্ট্রের কেউই বড় ধরনের ব্যর্থতার ঝুঁকি থাকে এমন কৌশল হাতে নেয় না। বড় কোনো অভিযান বলতে কোনো এক মিত্রপক্ষের ওপর আকস্মিক হামলা। তিন প্রধান শক্তিরই একই কৌশল, অথবা তাদের সকলের বিশ্বাসও একই রকম। যুদ্ধ, দরকষাকষি চালিয়ে যাওয়া আর মোক্ষম সময় বুঝে বিশ্বাসঘাতকতা এই তিনের সমন্বয়ে পরিকল্পনা সাজানো থাকে। উদ্দেশ্য একটাই, নিজের কিংবা শত্রুদেশকে ঘিরে থাকা ঘাঁটিগুলো দখলে আনা, আর অতঃপর শক্রর সঙ্গে সন্ধি কিংবা মিত্রতার চুক্তিতে উপনীত হয়ে শান্তির পতাকা উড়িয়ে বছরের পর বছর সন্দেহকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা। এই সময়ে আনবিক বোমায় ভরা রকেটগুলোকে কৌশলগত অবস্থানে বসানোর কাজ চলতে থাকে আর অবশেষে সেগুলো একযোগে চালিয়ে দেওয়া—যাতে তার প্রভাবে ঘটে যায় ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ আর প্রতিঘাত হয়ে ওঠে অসম্ভব।
এরপর সময় এসে যায় বিশ্বের বাকি শক্তিগুলোর সঙ্গে মিত্রতার চুক্তিতে উপনীত হওয়ার আর নতুন একটি হামলার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার। বলাই বাহুল্য, এই ভাবনা বা পরিকল্পনা স্রেফ তাদের দিবাস্বপ্ন, যার বাস্তবায়ন পুরোই অসম্ভব। উপরন্তু, বিষুবরেখাকে ঘিরে থাকা বিতর্কিত এলাকাগুলো আর মেরুঅঞ্চলের দখল ইস্যু ছাড়া আর কোনো যুদ্ধ কোনোকালেই দেখা যায়নি। শত্রুপক্ষের সীমারেখায় হামলার ঘটনা ঘটেনি কখনোই। এর মানে হচ্ছে, বড় শক্তিগুলোর মধ্যে কিছু কিছু সীমান্ত এলাকা নিয়ে বনিবনা হয়ে আছে।
ইউরেশিয়ার কথা বলা যায়, এরা চাইলেই ব্রিটিশ দ্বীপগুলো দখলে নিতে পারে, ভৌগলিকভাবেও ওগুলো ইউরোপের অংশ; অন্যদিকে ওশেনিয়ার পক্ষে তার সীমারেখা চাইলেই রাইন নদী পর্যন্ত এমনকি ভিস্টুলা পর্যন্ত ছড়িয়ে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু তা সাংস্কৃতিক অখণ্ডতার নীতি ভঙ্গ করবে, যদিও এমন নীতি কস্মিনকালেও গঠন করা হয়নি। ফ্রান্স বা জার্মানি নামে পরিচিত অঞ্চলগুলো ওশেনিয়া দখল করতে চাইলে, হয় এর বাসিন্দাদের নিঃশেষ করে দিতে হবে, যা বিশাল এক কঠিন কাজ, নয়ত মোটামুটি কোটি দশেক মানুষের দায়িত্ব নিয়ে নিতে হবে, যারা, কারিগরি উন্নয়ন যতদূর এগিয়েছে তাতে, অনেকাংশেই ওশেনিয়ার সমানে সমান।
এই সমস্যা তিন পরাশক্তির জন্যই একই রকম। তাদের প্রত্যেকের রাষ্ট্র কাঠামোয় যুদ্ধবন্দি আর কালো কৃতদাসদের ছাড়া আর কোনো বিদেশিকে স্বাগত জানানোর সুযোগ নেই। এমনকি এখন যে কাগজে কলমে মিত্রপক্ষ তাদের ওপরও থাকে সার্বক্ষণিক সন্দেহের চোখ। যুদ্ধবন্দিদের বাদ দিলে, ওশেনিয়ার নাগরিকরা ইউরেশিয়া বা ইস্টেশিয়ার কোনো একটি মানুষকেও কোনো দিন চোখেও দেখেনি। আর বিদেশি ভাষা শিক্ষাও তার জন্য বারণ। কেউ যদি কোনো বিদেশি সম্পর্কে জানতে বা যোগাযোগ করতে চায়, তাকে বলা হয় এরা ঠিক তারই মতো এক সৃষ্টি, আর এর বাইরে যা কিছু বলা হবে তার সবটাই মিথ্যা। যে মোহর এঁটে দেওয়া জগতে তার বিচরণ তা একদিন ভাঙবে, আর ভয়, ঘৃণা ও সাধুম্মন্যতার যে মনোভাব পোষণ করে চলছে তাও একদিন উবে যাবে। তাহলে সব দিক বিবেচনায় বোঝাই যাচ্ছে যতবারই পারস্য কিংবা মিসর কিংবা জাভা কিংবা শিলন তাদের হাত বদলাক, বোমা ছাড়া আর কিছুই মূল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওপারে পড়বে না।
এর আড়ালে লুক্কায়িত এক সত্য যা কখনোই উচ্চকিত কণ্ঠে উচ্চারণ হয়নি, কিন্তু নীরবে বোধগম্য আর ইঙ্গিতবহ, তা হচ্ছে তিন প্রধান শক্তিতেই জীবন একইরকম। ওশেনিয়ার বর্তমান দর্শনের নাম ইংসক, ইউরেশিয়ায় এর নাম নব্য-বলশেভিকবাদ, আর ইস্টেশিয়ায় এর রয়েছে একটি চীনা নাম যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায় মৃত্যু-পূজা, তবে সাধারণ অর্থ নিজেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। ওশেনিয়ার কোনো নাগরিকেরই অন্য দুই দর্শনের ব্যাপারে কিছু জানার বা বোঝার অনুমতি নেই, তবে সাধারণভাবে তার মাথায় যা ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তা হচ্ছে এদের ঘৃণা করতে হবে আর তা হতে হবে বর্বরোচিতভাবে।
তিন দর্শনকে কদাচই আলাদা করে নির্দেশ করা যায়, আর তারা যে সমাজ কাঠামো অনুসরণ করছে তা আলাদা করা যাবেই না। সবক্ষেত্রেই একই পিরামিডীয় কাঠামো, নেতার প্রতি একই দেবতাতুল্য পূজা, আর ঘটমান যুদ্ধাবস্থায় একই অর্থনীতি। এতে বলা যায় তিন প্রধান দেশের একের পক্ষে অন্যকে জয় করা সম্ভব নয়, আর করলেও তা থেকে কোনো সুফল আসবে না। বরং তারা সংঘাত জিইয়ে রেখে একে অন্যকে ঠেকনা দিয়ে রাখছে, ভুট্টার তিনটি ছড়া ঠিক যেভাবে থাকে। তিনটি শক্তিরই শাসকেরা যা কিছু করছে তা সম্পর্কে তারা একই সঙ্গে সতর্ক আবার অসতর্কও। তাদের জীবন বিশ্বজয়ে নিয়োজিত, কিন্তু তারা এটাও জানে এই যুদ্ধ চলতে হবে অন্তহীন-অবিরাম যার কোনো বিজয় থাকবে না। যুদ্ধজয়ের বিপদ না ঘটে যাওয়ার এই নিশ্চয়তা শাসকদের সকল বাস্তবতাকে অস্বীকার করার সুযোগ করে দেয়। আর সেটাই মূলত ইংসক বা এর শত্রুপক্ষগুলোর চিন্তা প্রক্রিয়ার বিশেষ দিক। এখানে আবারও বলতে হয়, আগেও বলা হয়েছে, টানা এক যুদ্ধাবস্থা মূলত যুদ্ধের চরিত্রটিই পাল্টে দিয়েছে।
অতীতে যুগে যুগে, কোনো যুদ্ধ, সংজ্ঞায়িতভাবেই এমন কিছু ছিল যা শিগগিরই নয়ত দেরিতে হলেও একদিন শেষ হতো, নির্ভুলভাবেই হয় জয় নয়ত পরাজয়ে ঘটত সে পরিণতি। অতীতে এও হতো, যুদ্ধই ছিল মানব সমাজকে কাঠামোগত বাস্তবতার স্পর্শে রাখার মূল হাতিয়ার। যুগে যুগে সকল শাসকই তাদের অনুসারীদের বৈশ্বিক কাঠামো নিয়ে একটি মিথ্যা ধারণা চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করে আসছে কিন্তু সামরিক দাপট নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগ রাখা হয়নি কখনোই। আর যতদিন পরাজয় মানেই ছিল পরাধীনতা অথবা অন্য কোনো অপ্রত্যাশিত পরিণতি ততদিন পরাজয় ঠেকানোর পূর্বসতর্কতাও ছিল প্রকট।
বাস্তব সত্যগুলোকে অবজ্ঞার সুযোগ নেই। দর্শন, ধর্ম, কিংবা নীতি বা রাজনীতিতে দুই আর দুইয়ে পাঁচ হলেও হতে পারে, কিন্তু যখন কেউ একটি বন্দুকের কিংবা উড়োজাহাজের নকশা বানাবে তখন তাকে দুই আর দুইয়ে চার মেলাতেই হবে। অকার্যকর জাতিগুলো বরাবরই দ্রুত কিংবা দেরিতে হলেও জয় করে নেওয়া হতো, তাদের কার্যকর হয়ে ওঠার সংগ্রাম তখন আরো প্রতিকূল হয়ে উঠত। কার্যকর রাষ্ট্র হতে হলে অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরি, কিন্তু তার জন্য অতীতে কী ঘটেছে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। সংবাদপত্র, ইতিহাসের বই—এসবই তো বরাবর থেকে গেছে পক্ষপাতমূলক, রং চড়ানো। কিন্তু আজ যেভাবে মিথ্যায়নে সিদ্ধ করা হচ্ছে তা ছিল অসম্ভব। যুদ্ধ ছিল সুবিবেচনার এক সুনিশ্চিত রক্ষাকবচ, আর শাসক শ্রেণির ক্ষেত্রে সম্ভবত তা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঢাল। যুদ্ধে যেহেতু জয়-পরাজয় দুই-ই ছিল সেহেতু কোনো শাসকশ্রেণি পুরোপুরি অবিবেচক হতে পারত না।
কিন্তু যুদ্ধ যখন আক্ষরিক অর্থেই এক অবিরাম অনন্ত রূপ নিল, তখন তা ভয়াবহতা হারাল। যুদ্ধ যখন টানা চলতে থাকে তখন সামরিক জরুরৎ বলে কোনো কথা আর থাকে না। কারিগরি অগ্রগতি থেমে যায়, আর ধ্রুব সত্যটিকেও করা হয় অস্বীকার কিংবা অবজ্ঞা। আমরা দেখছি বিজ্ঞান গবেষণা বলতে এখন যা চলছে তা স্রেফ যুদ্ধের জন্যই, কিন্তু সেগুলো অবধারিতভাবেই এক দিবাস্বপ্ন, ফলে কোনো ফল বয়ে আনতে না পারার যে ব্যর্থতা তাও গুরুত্ব হারাচ্ছে। দক্ষতা, এমনকি সামরিক দক্ষতারও আজ আর প্রয়োজন নেই। ওশেনিয়ায় থট পুলিশ ছাড়া আর কোনো কিছুই কার্যকর নয়। তিন প্রধান শক্তির প্রতিটিই যখন অজেয়, প্রতিটিই কার্যত একটি ভিন্ন ব্রহ্মাণ্ড যার অভ্যন্তরে চিন্তার যে কোনো বিচ্যুতিকে সহজেই চালিয়ে দেওয়া যায়। বাস্তবতার বাস কেবল প্রাত্যহিক জীবনের চাহিদার যে চাপ তার মাঝে—খেতে হবে, পান করতে হবে, মাথার ওপর চাই আচ্ছ্বাদন, চাই পরনের বসন, চাই না গলায় গরল ঢেলে কিংবা বহুতলের জানালা দিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে কিংবা এমন আরো নানা উপায়ের মৃত্যুবরণ।
জীবন আর মরণের মাঝে, আনন্দ আর বেদনার মাঝে এখনও একটি সুস্পষ্ট ফারাক রয়ে গেছে, কিন্তু সেটুকুই সব। বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, অতীত বিস্মৃত হয়ে ওশেনিয়ার নাগরিকেরা মহাকাশের তারকামণ্ডলের বাসিন্দা হয়ে উঠেছে, যাদের একটু জানারও সুযোগ নেই, কোন দিকে উপর আর কোন দিকে নিচ। এমন রাষ্ট্রে শাসক অসীম ক্ষমতাধর, ফারাও কিংবা সিজাররাও যতটা ক্ষমতার অধিকারী হতে পারেনি। দেশের নাগরিক দুর্ভিক্ষে যাতে বিপুল সংখ্যায় মারা না পড়ে তা নিশ্চিত করা তাদের দায়, আর সামরিক কৌশলে শত্রুদের সমতুল্যে একই নিচু স্তরে থেকে যাওয়াও তাদের কাজ, কিন্তু একবার এর ন্যুনতম অর্জন নিশ্চিত হয়ে গেলেই, সত্যকে তারা যেমন ইচ্ছা তেমন রূপ-আকার দিতে পারে।
তাহলে যুদ্ধ, পুরাতন যুদ্ধের মানে বিচার করা হলে, স্রেফ এক ছলচাতুরি। এই যুদ্ধ এক ধরনের জাবরকাটা প্রাণির মধ্যে সংগ্রামের সামিল, যার সিংগুলো এমন কৌণিকভাবে বাঁকানো যে একে অন্যকে গুঁতোটি পর্যন্ত বসাতে পারে না। তবে এ যুদ্ধ যেহেতু অবাস্তব নয়, সেহেতু তা অর্থহীনও নয়। এই যুদ্ধ ভোগ্যপণ্যের উদ্বৃত্ত খেয়ে ফেলছে, আর এক বিশেষ মানসিক ভাবনা সংরক্ষণ করে চলছে যে, আধিপাত্যবাদী সমাজের প্রয়োজন রয়েছে। যুদ্ধ, দেখা যাবে, আজ পুরোপুরিই এক অভ্যন্তরীণ বিষয়। অতীতে সকল দেশের শাসক গোষ্ঠী একে অন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করার সময় সাধারণ স্বার্থের দিকগুলোর ওপর খেয়াল রাখত আর প্রতিপক্ষের ক্ষয়ক্ষতিরও একটি মাত্রা বজায় রাখত। বিজয়ীরা সর্বদাই পরাস্তদের ওপর লুটতরাজ চালাত। আমাদের নিজেদের দিনগুলোতে তারা কিন্তু আদৌ একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে না। এখন প্রতিটি শাসকদল নিজেদের প্রজাকুলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে, আর সে লড়াইয়ের উদ্দেশ্য কোনো সীমান্ত রক্ষা বা জয় করা নয়, বরং সমাজ কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রাখাই এর উদ্দেশ্য।
‘যুদ্ধ’ নামের শব্দটি তাহলে নিজেই হয়ে পড়েছে বিভ্রান্তিকর। এটা বলা যথার্থ হতে পারে যে, টানা যুদ্ধের মানেই হচ্ছে যুদ্ধহীনতা। সেই নব্যপ্রস্তর যুগ থেকে শুরু করে বিংশ শতকের গোড়ার দিকটা পর্যন্ত যে অদ্ভুত চাপ মানব সন্তানের ওপর ফেলেছিল এই যুদ্ধ, তা আজ অতি ভিন্ন কিছু দিয়ে প্রতিস্থাপিত। তিন প্রধান রাষ্ট্র আজ যদি একে অন্যের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধ না করে তার পরিবর্তে অন্তহীন শান্তির সম্পর্কের দিকে যায়, প্রত্যেকেই যদি নিজেদের সীমারেখার ভেতরেও থাকে অলঙ্ঘিত তার প্রভাবও অনেকটা অভিন্ন হবে। তাহলেও প্রত্যেকেই হয়ে থাকবে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ শক্তির বলয়, বাহ্যিক বিপদের পরিমিত প্রভাব থেকেও থাকবে সম্পূর্ণ মুক্ত। একটি সত্যিকারের স্থায়ী শান্তি প্রক্রিয়াও হবে স্থায়ী যুদ্ধের সম। এটাই—যদিও পার্টির অধিকাংশ সদস্য কেবল ভাসা ভাসা বুঝতে পারে—তারপরেও এটাই ইনার পার্টির স্লোগান: ‘যুদ্ধই শান্তি’র প্রকৃত অর্থ।
এক দণ্ডের জন্য পড়া থামাল উইনস্টন। ঠিক তখনই অনেক দূরে কোথাও সশব্দে রকেট বোমা পড়েছে। টেলিস্ক্রিনবিহীন একটি কক্ষে নিষিদ্ধ বই হাতে একাকীত্বের এই স্বর্গীয় অনুভূতিতে তা চিড় ধরাতে পারল না। একাকীত্ব আর নিরাপত্তার বোধ তার শরীর জুড়ে, তার সঙ্গে মিশে আছে শরীরের ক্লান্তি, কেদারার আরাম, জানালা বেয়ে আসা মৃদুমন্দ বাতাসের ছোঁয়া, যা খেলে যাচ্ছে তার গালের ওপর। বইটি তার মন কেড়েছে, অথবা আরো নির্দিষ্ট করে বলা চলে, দিয়েছে দৃঢ় আশ্বাস। এক অর্থে এ থেকে সে যা জানল তা তার কাছে নতুন কিছু নয়, কিন্তু আকর্ষণ করেছে ভীষণভাবেই। এখানে তাই বলা হয়েছে যা সেও বলে আসছে, তার বিক্ষিপ্ত চিন্তাগুলো একসঙ্গে করে সাজিয়ে বলতে পারলে তা হবে এই কথাগুলোই।
এও বলা চলে, যিনি লিখেছেন তিনিও তার মতোই এক অভিন্ন মননশীলতা ধারণ করেন, কিন্তু নিঃসন্দেহে লেখকের মনটি অনেক বেশি ক্ষমতাধর, অনেক বেশি গোছানো, অনেক কম ভীত-সন্ত্রস্ত। তার মনে হলো, সেরা বইগুলোতে আসলে তাই থাকে যা আপনি আগে থেকেই জানেন। পাতা উল্টে আবারও সে প্রথম অধ্যায়ে ফিরে গেল, ঠিক তখনই সিঁড়িতে শুনতে পেল জুলিয়ার পায়ের শব্দ। আর চেয়ার থেকে উঠে তাকে দেখার উদ্দেশে এগোলো। ঘরে ঢুকেই খাকি রঙের টুলব্যাগটি মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল জুলিয়া আর নিজেকে উজিয়ে দিলে উইনস্টনের বাহুতে। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় পর যে দেখা হলো দুজনায়!
‘বইটি আমি হাতে পেয়ে গেছি’—প্রগাঢ় আলিঙ্গনে জড়াজড়ি করা অবস্থায় বলল উইনস্টন।
‘ও! পেয়ে গ্যাছো? খুব ভালো’—জুলিয়ার কণ্ঠে অনুচ্ছ্বাসের অভিব্যক্তি, আর দ্রুতই সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল তেলস্টোভে কফি বানাবে বলে।
বিছানায় তাদের আধাঘণ্টা কেটেছে এর মধ্যে আর বইয়ের বিষয়ে ফেরেনি কেউ। চাদর গায়ে জড়িয়ে শুয়ে থাকার জন্য যথেষ্টই ঠাণ্ডাময় এক সন্ধ্যা। নিচ থেকে ভেসে আসছে পরিচিত গান আর পাথুরে মেঝেতে বুটের শব্দ। সেই বাদামি রঙা লালবাহুর নারীটি যেন এই আঙিনার এক স্থায়ী চলমান মূর্তি। প্রথম যেদিন এসেছিল সেদিনই নারীটিকে দেখেছে উইনস্টন। মনে হয়, দিনের আলো যতক্ষণ থাকে ততক্ষণই কাপড় কাচার পাত্র থেকে শুকানোর রজ্জুর মাঝে চলে তার আসা-যাওয়া। কাপড় লটকানোর পেগগুলো মুখে নিলে মাঝে মাঝে থেমে যায় তার জোরালো গানের সুর।
জুলিয়া ততক্ষণে পাশ ফিরে ঘুমের প্রস্তুতিতে। মেঝেতে পড়ে থাকা বইটি হাতের নাগালে পেল উইনস্টন। সেটি তুলে নিয়ে শিথানের দিকে হেলান দিয়ে বসল সে।
‘আমাদের অবশ্যই এটা পড়া উচিত’—বলল সে। ‘তোমারও। ব্রাদারহুডের সকল সদস্যেরই এটা পড়া উচিত। ’
‘তুমি পড়ো’—বলল সে। ততক্ষণে তার দুচোখ বোজা। ‘একটু জোরে শব্দ করে পড়ো। সেটাই সবচেয়ে ভালো। পড়তে পড়তে তুমি আমাকে ব্যাখ্যা করেও বলতে পারবে। ’
ঘড়ির কাটা ছয়টার ঘরে, মানে সন্ধ্যা ছয়টা। তাদের হাতে তিন কিংবা চার ঘণ্টা সময় আছে। বইটি হাঁটুর ওপর রাখল সে আর পড়তে শুরু করল:
অধ্যায় ১
অবজ্ঞাই শক্তি
যতদিনের কথা নথিভুক্ত রয়েছে ততদিন ধরে, অথবা বলা যায় নব্যপ্রস্তর যুগের পর থেকেই পৃথিবীতে উচ্চ, মধ্য আর নিম্ন এই তিন শ্রেণির মানুষ বাস করে আসছে। এরা আরো নানাভাবে উপ-বিভক্ত হয়ে, ভিন্ন ভিন্ন অগুনতি নাম পেয়েছে, তাদের আপেক্ষিক সংখ্যা, একের প্রতি অন্যের আচরণ যুগে যুগে পাল্টেছে, কিন্তু সমাজের অপরিহার্য কাঠামোটি থেকে গেছে অপরিবর্তিত। বড় বড় অভ্যুত্থান আর আপাতদৃষ্টিতে অপরবর্ত্য পরিবর্তনের পরেও, এই একই ব্যবস্থা নিজের মতো করেই সমাজ কাঠামোয় আবার স্থান করে নিয়েছে, মাপযন্ত্রের কাটা যেভাবে এদিক-ওদিক করে প্রতিবারই একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় ফিরে আসে ঠিক তেমনি…
‘জুলিয়া জেগে আছো?’—বলল উইনস্টন।
‘হ্যাঁ, প্রিয়তম, আমি শুনছি। তুমি পড়তে থাকো। অসাধারণ এই লেখা। ’
সে পড়তে থাকল:
এই গোষ্ঠীগুলোর লক্ষ্য পুরোপুরোই পরস্পর পরাহত। উচ্চশ্রেণির লক্ষ্য হচ্ছে তারা যেমন আছে তেমনই থাকবে। মধ্য শ্রেণির লক্ষ্য উচ্চ শ্রেণিতে রূপান্তর। আর নিম্ন শ্রেণির লক্ষ্য হচ্ছে, যখন তাদের লক্ষ্য কিছু থাকে—কারণ নিম্ন শ্রেণির একটি বশ্যতার চরিত্র রয়েছে, তা দিয়ে তারা বোঝে শ্রম দিয়ে যাওয়াই তাদের কাজ ফলে নিজেদের জীবনের বাইরে কোনো কিছু আছে বলে যখন তখন ভুলে যায়—সকল ভেদাভেদ ভেঙ্গে দিয়ে এমন এক সমাজ নির্মাণ যেখানে সব মানুষই হবে সমান। এভাবেই ইতিহাসের ভাঁজে ভাঁজে একটি সংগ্রাম চলে এসেছে যার বাহ্যিক কাঠামোটি বারবার ছিল একই রকম। দীর্ঘকাল উচ্চ শ্রেণি নির্বিঘ্নভাবে ক্ষমতার একক ভাগীদার হয়ে থাক, কিন্তু খুব দ্রুত নতুবা কিছু পরে হলেও একটি সময় এসে যায় যখন এরা নিজেরাই নিজেদের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে অথবা হারিয়ে যায় তাদের শাসন পরিচালনার ক্ষমতা, অথবা উভয়ই। তখন মধ্যশ্রেণি তাদের হটিয়ে দেয়, আর নিম্নবিত্তদের পাশে টানে আর বলতে শুরু করে, তাদের সংগ্রামটিও স্বাধীনতা আর ন্যয় বিচারের জন্যে। আর মধ্যবিত্তরা যখন তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে ফেলে তখনই তারা নিম্নবিত্তকে ফের তাদের পুরনো দাসত্বের অবস্থানে ঠেলে দেয়, আর তারা নিজেরা হয়ে ওঠে উচ্চবিত্ত।
বর্তমানে অন্য দুটি গোষ্ঠীর যেকোনো একটি থেকে অথবা উভয় গোষ্ঠী থেকে ছিটকে পড়ে একটি নব্য মধ্যবিত্ত গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। তিন শ্রেণির মধ্যে কেবল নিম্নবিত্তরাই কখনো এমনকি সাময়িক সময়ের জন্যও তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। বলা বাহুল্য, গোটা ইতিহাস জুড়ে বাস্তবিক অর্থে তাদের অবস্থার কোনো অগ্রগতি হয়নি। এমনকি আজ এই অবক্ষয়ের যুগেও, কয়েক শতক আগে মানুষ যেমন ছিল তার চেয়ে গড়পড়তা ভালো আছে। কিন্তু সম্পদ বাড়েনি, মানুষের আচরণ পাল্টায়নি, কোনো সংস্কার বা বিপ্লব ঘটেনি যা থেকে মানুষের সাম্য এক মিলিমিটারও কাছাকাছি আসতে পেরেছে। নিম্নবিত্তের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আসলে তাদের প্রভুদের নামগুলো পাল্টে যাওয়া ছাড