ভ্রূণ অবস্থায় যারা যারা গেছে তারে ও যত সব নির্বোধের আত্মারাও আসতে লাগল। তাদের পরনে ছিল সাদা, কালো ও ধূসর রঙের পোশাক। সে সব তীর্থযাত্রীরা গলগাথায় ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মৃতদেহটিকে খুঁজতে থাকে, অথচ যীশু স্বর্গে বাস করার জন্য যাদের দেখতে পায়নি সেই সব তীর্থযাত্রীরা এখানে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়ে।
নিশ্চিত স্বর্গলাভের আশায় এ্যাঞ্জেলো পলিজিয়ানো মৃত্যুশয্যায় ডোমিনিকান সম্প্রদায়ের পোশাক পরেন এবং গিদো বৃদ্ধ বয়সে স্বৰ্গকামনায় ফ্রান্সিসকান সম্প্রদায়ভুক্ত হন। মৃত্যুর পর তাদের আত্মা পর পর সাতটি গ্রহ পার হয়ে স্বর্গদ্বারের নিকটস্থ হয়।
স্বর্গের দ্বারপাল পিটার রুদ্ধদ্বারের চাবি হাতে অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। কিন্তু এ্যাঞ্জেলো ও গিদোর আত্মার ছায়ামূর্তি স্বর্গে ওঠার শেষ সিঁড়িতে পৌঁছানোর জন্য পা তুলতেই এক প্রতিকূল ঝঞ্জাবায়ু প্রবলভাবে বইতে বইতে তাঁদের প্রায় বিশ মাইল দূরে ফেলে দেয়।
সেই প্রবল ঘূর্ণিবায়ু তাদের লিম্বো নামক এক নিম্নতর হীনতর নরকে ফেলে দেয়। সে নরকপ্রদেশকে মূর্খদের স্বর্গ বলা হয়।
এই অন্ধকার জগতের মধ্যে এই সব কিছু ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল শয়তান। অন্ধকারে এদিকে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে বেড়াল। চারিদিকে সূচীভেদ্য অন্ধকার আর অদৃশ্য ছায়ামূর্তির আনাগোনা।
অনেকক্ষণ এইভাবে কেটে যাবার পর স্বর্গ থেকে বিচ্ছুরিত এক আলোকরেখা শয়তানের প্রতিটি পদক্ষেপকে আলোকিত করে তুলল। সেই আলোর সাহায্যে ধীরে ধীরে সে স্বর্গপ্রাচীরের দিকে উঠে যেতে লাগল।
এইভাবে অনেকটা ওঠার পর শয়তানরাজ সেই প্রাচীরের উপর রাজপ্রাসাদের মত লোহার গেটওয়ালা এক প্রকাণ্ড বাড়ি দেখতে পেল। স্বর্ণ, হীরক ও নানা মণি-মুক্তাখচিত সেই প্রাসাদের মর্ত্যলোকের কোন তুলনাই হয় না। একমাত্র শুধু চিত্রে অঙ্কিত হতে পারে। সে প্রাসাদে ওঠার সিঁড়িগুলি সুন্দরভাবে সাজানো ছিল।
ইসেউ থেকে পাদান আরামে পালিয়ে যাবার সময় লজের প্রান্তরে মুক্ত আকাশের তলে রাত্রিতে নিদ্রাভিভূত অবস্থায় জ্যাকব স্বপ্নে যে সিঁড়ি দিয়ে দেবদূতদের ওঠানামা করতে দেখেছিল সেই প্রাসাদের সিঁড়িগুলি ছিল এমনি।
জ্যাকব সেদিন ঘুম থেকে জেগে উঠেই বলেছিল, এই হলো স্বর্গারোহণের সিঁড়ি।
কিন্তু সে সিঁড়ি বড় রহস্যময়, ঐন্দ্রজালিকভাবে নির্মিত। সেই সিঁড়িগুলি সব সময় প্রাসাদের সঙ্গে সংজড়িত থাকে না। মাঝে মাঝে স্বর্গের উপর সেগুলিকে তুলে নেওয়া হয়। তার অর্থ হলো এই যে, বাইরের কোন অবাঞ্ছিত বা স্বর্গসুখে অনধিকারী কোন ব্যক্তির আত্মা যেন সে সিঁড়ি দিয়ে স্বর্গে আরোহণ করতে না পারে।
সেই সিঁড়ির তলদেশে গলিত ধাতুর এক বিশাল সমুদ্র প্রবহমান। মৃত্যুর পর মর্ত্য থেকে যে পুণ্যাত্মা দেবদূতদের দ্বারা বাহিত নৌকাযোগে সেই সমুদ্র পার হয়ে আসে অথবা আগ্নেয় অস্ত্রের দ্বারা বাহিত মায়াময় রথে করে এসে স্বর্গদ্বারে এসে উপস্থিত হয়, একমাত্র তারাই এই সিঁড়ি বেয়ে স্বর্গারোহণের অধিকারী। তারা স্বর্গদ্বারে উপনীত হবার সঙ্গে সঙ্গে গুটিয়ে তুলে নেওয়া সিঁড়িগুলি আবার সাজিয়ে রাখা হয়।
শয়তান যাতে সহজে স্বর্গে আরোহণ করতে না পারে, স্বর্গদ্বার হতে যাতে সে সহজে বহিষ্কৃত হয় তার জন্য মর্ত্যভূমি হতে সুদূর স্বর্গ পর্যন্ত এক বিশাল অন্ধকার গহুর সৃষ্ট হলো শয়তানরাজের সামনে।
সে তখন স্বর্গের নিম্নতম সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে এক অন্তহীন বিহ্বলতার সঙ্গে অকস্মাৎ সৃষ্ট সেই বিশাল অনতিক্রম্য গহ্বরের দিকে তাকিয়ে রইল। সে দেখল সেই গহ্বরের অন্ধকার শূন্যতার উপর দেবদূতেরা পাখা মেলে ইতস্তত উড়ে চলেছে।
কোন এক অন্ধকার বিশাল মরুভূমিতে বিচিত্র ও বিপজ্জনক রাত্রিযাপনের পর কোন নিঃসঙ্গ সৈনিক যেমন আলোকোজ্জ্বল প্রভাতকালে একটি পাহাড়ের উচ্চ চূড়া হতে অসংখ্য প্রাসাদ ও অট্টালিকামণ্ডিত কোন সুরম্য ও সুসজ্জিত বিদেশী নগরী দেখে এক বিস্ময়বিমিশ্রিত আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়ে, শয়তানও তেমনি সেই অন্ধকার শূন্য গহ্বরের পরপারে দৃষ্টি প্রসারিত করে আশাসঞ্চারিণী কোন সুরম্য নগরী দেখার চেষ্টা করতে লাগল।
সে যখন দেখল অন্ধকার শূন্য আকাশমণ্ডলের পরপারে নক্ষত্ররাজির মাঝে মাঝে আরো কত জগৎ রয়েছে। কিন্তু সে সব জগতে কারা বাস করে তা জানার কোন ইচ্ছা হলো না তার। ছোট ছোট দ্বীপের মত সেই সব জগৎগুলিতে রয়েছে বিস্তৃত প্রান্তর ও পুষ্পিত কত উপত্যকা। হেসপীরিয়ার উদ্যানের মত কত উদ্যানও আছে সেই সব জগতে।
অন্ধকার শূন্যমণ্ডলে ভাসমান সেই সব জগতের উর্ধ্বে বিরাজিত সূর্যকিরণের মত উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত স্বর্গলোক বিমুগ্ধ করল তার দৃষ্টিকে। এই স্বর্গলোক তার উর্ধ্বায়িত দৃষ্টিপথে পতিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একই সঙ্গে বিস্ময় ও ঈর্ষায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠল তার উচ্চাভিলাষী মন।
সুদূর ঊর্ধ্বলোকে অবস্থিত সেই উজ্জ্বল আলোকমণ্ডলকে লক্ষ্য করে অন্ধকার শূন্যতার মাঝে ঝাঁপ দিল শয়তানরাজ। ঊর্ধ্ব আকাশপথে যতই উৎক্রমণ করতে লাগল ততই সে বুঝতে পারল ঐ আলোকমণ্ডলই হলো সৌরমণ্ডল। যে স্বর্গ সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে আলোকিত করে, যা দিনরাত্রি, মাস ও বৎসররূপ কালকে নির্ণীত করে, যে সূর্য সারা বিশ্বভুবনের সকল জীবের প্রাণের উৎস, সেই সূর্যমণ্ডলকে লক্ষ্য করে শূন্যে উঠে যেতে লাগল সে।