মানবজাতির মধ্যে কিছু লোককে আমার বিশেষ অনুগ্রহলাভের যোগ্য হিসাবে নির্বাচিত করেছি। তাদের স্থান হবে অ্ন্য সকলের ঊর্ধ্বে। আমার নির্বাচিত এই সব অনুগৃহীত ব্যক্তিরা ছাড়া বাকি সকলে আমার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সতর্ক হয়ে তাদের পাপ সম্বন্ধে সচেতন হবে। তাদেরও আমি আমার অনুগ্রহ দান করব এবং তাদের মনের সব অন্ধকার ও অজ্ঞানতা দূর করব। ফলে তাদের প্রস্তরকঠিন অন্তর মেদুরতা প্রাপ্ত হয়ে আবার আমার অনুগত হয়ে উঠবে তারা। তারা তখন অনুতপ্ত হৃদয়ে আমার প্রার্থনা করে সমস্ত পাপ স্খালন করবে।
সদিচ্ছার সঙ্গে তারা পুনরুত্থানের জন্য নিষ্ঠার সঙ্গে চেষ্টা করলেও তাদের সব কথা শোনার জন্য আমার কর্ণকুহর সজাগ থাকবে সতত এবং তাদের সবকিছু দেখার জন্য আমার চোখও খোলা থাকবে। আর পরিচালক হিসাবে আমি বিবেককে স্থাপন করব তাদের অন্তরে। যদি তারা সেই বিবেকের বিবেকের নির্দেশ মেনে চলে তাহলে অন্ধকারের মধ্যে আলোর সন্ধান পাবে তারা এবং অবশেষে নিরাপদ হয়ে উঠবে তাদের জীবন। কিন্তু বিবেকবুদ্ধিকে অবহেলা ও ঘৃণার চোখে দেখলে তারা বঞ্চিত হবে আমার অনুগ্রহলাভে। তারা মুক্তির আস্বাদ লাভ করতে পারবে না। তাদের কঠিন অন্তর কঠিনতর হবে এবং তাদের অন্ধ দৃষ্টি আরও অন্ধ হবে। ফলে পতনের গভীরতর স্তরে নেমে যাবে তারা এবং আমার করুণা হতে বঞ্চিত হবে।
কিন্তু সেটাই সব নয়। মানুষ যদি বিধির বিধানকে অমান্য করে স্বর্গের পরমেশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে পাশে নিমজ্জিত হয় তাহলে তাকে সব হারাতে হবে। তাতে সমগ্র মানবজাতির ধ্বংস অনিবার্য। তাদের সকলকেই মরতে হবে যদি তাদের মধ্যে কোন যোগ্য ব্যক্তি স্বেচ্ছায় তাদের সকলের সম্মান ও মুক্তির জন্য মৃত্যুবরণ করে ঈশ্বরকে তুষ্ট না করে। হে দেবদূতগণ বল, এমন আত্যাগ ও ঈরশ্রেয় আমি কোথায় পাব? বল, কে তোমাদের মানবজাতিকে পাপ হতে উদ্ধার করার জন্য স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসবে এ কাজে? মরণশীল মানুষের জন্য এভাবে আত্মোৎসর্গ করে স্বর্গবাসীদের মধ্যে কে এমন বিরল মহানবতার পরিচয় দেবে?
ঈশ্বরের এই প্রশ্নে সমস্ত দেবদূতগণ এক নির্বাক নীরবতায় স্তব্ধ হয়ে রইল। মানবজাতির প্রতি অনুরাগের বশবর্তী হয়ে কেউ এগিয়ে এসে মৃত্যুবরণ করতে চাইল না। কেউ তাদের মুক্তির জন্য এই ভয়ঙ্কর আত্মোৎসর্গে সম্মত হলো না। ফলে। মুক্তিহীন মানবজাতির ধ্বংস, মৃত্যু ও নরকভোগ অনিবার্য হয়ে উঠল।
এমন সময় পরিপূর্ণ স্বর্গীয় প্রেমের মূর্ত প্রতীক ঈশ্বরপুত্র স্বয়ং বলতে লাগলেন : হে পরমপিতা, তোমার যা কিছু বলার তা শেষ হয়েছে। মানুষ তোমার অনুগ্রহ ও করুণালাভে ধন্য হবে ঠিক, কিন্তু কি উপায়ে এই করুণা তারা লাভ করবে তা জানে না। তোমার দ্রুতগতিসম্পন্ন পক্ষবিশিষ্ট যে সব দেবদূত সকল প্রাণীর কাছে অবাধে গিয়ে সাহায্য করে বেড়ায় তারা এখন নীরব। কিন্তু মানবজাতি যদি একবার ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে তারা দেবদূতদের কাছ থেকে কিভাবে সাহায্য চাইবে? এই মানবজাতির পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য জীবনদান করার কেউ নেই।
কিন্তু কেউ না এলেও আমি আছি। আমি সমগ্র মানবজাতির উদ্ধারের জন্য জীবনদান করতে প্রস্তুত আছি। আমাকে মানুষ মনে করে তোমার সমস্ত ক্রোধের আবেগ উজার করে ঢেলে দাও আমার উপর। আমি সেই মানবজাতির মুক্তির জন্য তোমার বক্ষস্থল ও আমার গৌরবের আসন ত্যাগ করে মৃত্যুবরণ করব। মৃত্যুর সমস্ত রোষ হাসিমুখে সহ্য করব আমি।
কিন্তু মৃত্যুবরণ করলেও মৃত্যর অন্ধকার কারাগারে তার কঠিন শক্তির অধীনে শর্ঘকাল আবদ্ধ থাকতে হবে না আমায়। কারণ তুমি আমায় অনন্ত জীবন দান করেছ। তোমার দ্বারাই বেঁচে আছি।
মানবজাতির ঋণ পরিশোধের জন্য আমি যদিও মৃত্যুবরণ করি তথাপি তুমি নিশ্চয় ঘৃণ্য কবরের মধ্যে মৃত্যুর শিকাররূপে বেশিদিন ফেলে রাখবে না আমাকে। আমার নিষ্কলুষ নিষ্কলঙ্ক আত্মাকে পাপে নিমজ্জিত হয়ে সেই অন্ধকার সমাধিগহ্বরের মধ্যে বেশি দিন বাস করতে হবে না নিশ্চয়।
আমি সে গহ্বর হতে অবশ্য বিজয়ী শত্রু মৃত্যুকে পরাভূত করে বেরিয়ে আসব শীঘ্র। তার সংশয়জনিত ক্ষতের দ্বারা নিজেই আহত হয়ে বীর্যহীন ও অগৌরবের গ্লানির দ্বারা জর্জরিত হয়ে পড়বে মৃত্যু। আমি মৃত্যুকে জয় করে বিজয়ী বীরের মত সমাধিগহ্বরের অন্ধকার হতে বেরিয়ে আসব প্রভূত আলো-বাতাসের রাজ্যে। আসার। সময়ে নরক বা মৃত্যুপুরীকেই বন্দী করে নিয়ে আসব।
হে পিতা, আমার সে কৃতিত্ব দেখে সন্তুষ্ট হবে তুমি। স্বর্গের সিংহাসন থেকে সে দৃশ্য অবলোকন করে আনন্দে হাসবে। তোমার সাহায্য ও অনুগ্রহে আমি সমাধিগহ্বর থেকে উত্থিত হয়ে আমার সমস্ত শত্রুদের ধ্বংস করব। মৃত্যুকে ধ্বংস করব সব শেষে। তার মৃতদেহ দিয়ে আমি চিরতরে বন্ধ করে দেব কবরের মুখ। তারপর মুক্ত মানবজাতিকে নিয়ে আমি আবার ফিরে আসব স্বর্গলোকে। হে পিতা, তখন তোমার মুখে কোন ক্ৰোধাবেগের মেঘ থাকবে না, সে মুখমণ্ডলে তখন বিরাজ করতে থাকবে শান্তি আর পুনর্মিলনের পরিপূর্ণ আনন্দ। তখন থেকে মানবজাতির উপর আর কোন ক্রোধের ধ্রুকুটি থাকবে না তোমার চোখে-মুখে।
ঈশ্বরপুত্রের কথা এইখানেই শেষ হলো। কিন্তু তাঁর নীরব মুখ হতে মরণশীল মানবজাতির প্রতি অমর নিরুচ্চার প্রেমের কত বাণী অশ্রুতভাবে ধ্বনিত হচ্ছিল যেন। সেই প্রেমের সঙ্গে তার মুখে দ্যোতিত হয়ে উঠছিল তাঁর পরমপিতার প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্যের ভাব। আনুগত্যের আনন্দের দীপ্তিতে ভাস্বর হয়ে উঠছিল তাঁর সমগ্র দেহাবয়ব। তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল স্বর্গলোকের অধিবাসীবৃন্দ। ঈশ্বরপুত্রের এই মহানুভবতায় আশ্চর্য হয়ে গেল তারা সকলে।