প্রকৃতিজগতের সব বস্তুই পবিত্র এবং শাশ্বত। কিন্তু মানুষ পাপকর্মে লিপ্ত হয়ে কলুষিত হয়ে পড়ায় পচনশীল দূষিত খাদ্যের মতোই প্রকৃতি তাকে প্রত্যাখ্যান করবে। মানুষ থাকলে তার কলুষিত সংসর্গে প্রকৃতির উপাদানগুলিও দূষিত হয়ে পড়বে। মানুষ সৃষ্টি করার সময় পরম অনন্তসুখ আর অমরত্ব এই দুটি দানে ভূষিত করি আমি তাকে। এই দুটি দান হারিয়ে ফেলায় তারা মৃত্যু আর অন্তহীন দুঃখের অধিকারী হয়েছে। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত দুঃখভোগ করে যেতে হবে তাদের। একমাত্র মৃত্যুতেই তাদের সকল দুঃখের শেষ।
কঠোর দুঃখকষ্টের মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঈশ্বরবিশ্বাস, ন্যায় ও ধর্মলাভ প্রভৃতি সৎকর্ম করে সারাজীবন যাপন করলে তাদের মধ্যে সত্যোপলব্ধি জাগবে এবং মৃত্যুর পর তারা দ্বিতীয় জীবন লাভ করবে। তখন তারা স্বর্গগমন করবে। পৃথিবী নূতন হয়ে উঠবে।
এখন স্বর্গে এক সভা আহ্বান করো। আমি আমার বিচারের কথা সকলকে বলব। এখন দেবদূতরা গিয়ে দেখবে তারা কি করছে এবং কি অবস্থায় আছে। তাই দেখে আমি মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করব।
এই বলে ঈশ্বর চুপ করতেই ঈশ্বরপুত্র ভেরী বাজিয়ে সংকেত দান করলেন। তখন দেবদূতেরা এসে সমবেত হলো। তারা এসে জীবননদীর ধারে ছায়াচ্ছন্ন স্থানগুলিতে উপবেশন করলে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তাঁর সিংহাসন হতে বলতে শুরু করলেন, হে আমার পুত্রগণ, মানুষ সেই নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করার পর থেকে আমাদের মতোই ভাল-মন্দের জ্ঞান লাভ করেছে। কিন্তু শুধু ‘ভাল’র জ্ঞানের বড়াই করতে গিয়ে সে জ্ঞান হারিয়ে শুধু মন্দের জ্ঞান লাভ করেছে। সব কিছুর মধ্যে তাই শুধু মন্দ দেখছে। কিন্তু ভালর জ্ঞান লাভ করলে তারা সুখী হত।
এখন তারা কৃতকর্মের জন্য দুঃখবোধ করছে। অনুশোচনা করছে, অনুতপ্ত চিত্তে আমার প্রার্থনা করছে। এইভাবে বিভিন্ন রকমে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি মানুষের অন্তরের অবস্থা ও প্রকৃতির কথা জানি। তাদের অন্তর-প্রকৃতি বড়ই পরিবর্তনশীল, বড়ই ক্ষণভঙ্গুর। তাদের স্বাধীন ইচ্ছার দ্বারা তা নিয়ন্ত্রিত হয়। আমি ভাবছি জ্ঞানবৃক্ষের ফল ভক্ষণ করার পর পাছে তাদের সাহস বেড়ে যায় এবং তারা তাদের দুঃসাহসী হস্ত প্রসারিত করে জীবনবৃক্ষের ফল ভক্ষণ করে চিরজীবি হয়ে ওঠে অথবা চিরকাল বাঁচার স্বপ্ন দেখে তার জন্য সেখান থেকে তাদের অপসারিত করার বিধান দিচ্ছি। স্বর্গোদ্যান ইডেন থেকে তাদের সরিয়ে নিয়ে গিয়ে সেই জায়গায় নিয়ে যাও যেখানে তারা ভূমি কর্ষণ করে জীবিকা অর্জন করবে। সেটাই হবে তাদের বসবাসের উপযুক্ত জায়গা।
মাইকেল, তোমাকেই এ কাজের ভার নিতে হবে। তুমি চেরাবিম জাতীয় দেবদূতদের মধ্য হতে তোমার পছন্দমত দেবসেনাদের নিয়ে যাও। কারণ শয়তান আবার মানবজাতির পক্ষ হয়ে খালি জায়গা দেখে সেই স্থান দখল করতে এলে গোলমাল বাধাতে পারে।
সুতরাং তাড়াতাড়ি চলে যাও। ঈশ্বরনির্মিত সেই স্বর্গোদ্যান হতে দ্বিধাহীনভাবে সেই পাপিষ্ঠ দম্পতিকে বিতাড়িত করো। সেই পবিত্র স্থানে তাদের মত অপবিত্র চরিত্রের লোকের আর স্থান হবে না। মানবজাতি ও তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরগণ চিরতরে সেই স্বর্গোদ্যান হতে নির্বাসিত হলো একথা ঘোষণা করবে তুমি। যেহেতু এখন তারা অনবরত চোখের জল ফেলে অনুতাপ করছে তাদের কৃতকর্মের জন্য, তাই তারা যাতে এই দুঃখজনক দণ্ডাজ্ঞা শুনে মূৰ্ছিত না হয়ে পড়ে দুঃখে তাই মুখে কোন রাগ বা ভয়ের ভাব দেখাবে না।
যদি ধীরে ও শান্তভাবে তারা তোমার আদেশ মেনে নেয় তাহলে দুঃখ দেবে তাদের মনে। আমি যেভাবে বলতে বলব তুমি সেইভাবে আদমের ভবিষ্যৎ জীবনে কি কি ঘটবে তা তাকে বলে দেবে। আমার নিষেধাজ্ঞা বা বিধান ঈভের গর্ভজাত সন্তানদের উপরেও বর্তাবে।
এইভাবে বুঝিয়ে তাদের পাঠিয়ে দেবে। তাদের মনে দুঃখ থাকলেও তারা যেন শান্তিতে যায়। ইডেনের পূর্বদিকে যেখানে উদ্যানের মধ্যে প্রবেশ করা সবচেয়ে সহজ সেখানে চেরাবজাতীয় দেবদূতেরা প্রহরায় নিযুক্ত থাকবে। তারা জ্বলন্ত তরবারি ঘুরিয়ে দূরের অবৈধ প্রবেশকারীদের সন্ত্রস্ত করে তুলবে। জীবনবৃক্ষের কাছে যাবার পথে পাহারা থাকবে যাতে কোন দুষ্ট আত্মা উদ্যানে প্রবেশ করে আমার সব গাছগুলিকে তাদের শিকারের বস্তু করে তুলতে না পারে। মানুষ যেন আবার নিষিদ্ধ ফল চুরি করে খেয়ে ভ্রান্ত না হয়।
তার সব কথা বলে থামলেন ঈশ্বর। তখন প্রধান দেবদূত চেরাবজাতীয় প্রহরী দেবদূত সেনাদের নিয়ে স্বর্গ হতে মর্ত্যে অবতরণের জন্য প্রস্তুত হলো। সেই সব প্রহরী দেবদূতদের প্রত্যেকের চারটি ঋতুস্বরূপ চারটি মুখবিশিষ্ট রোমক দেবতা জেনাসের মত চারটি করে মুখ ছিল। তাদের দেহের মধ্যে আইওর উপর প্রহরায় নিযুক্ত শতচক্ষুবিশিষ্ট আর্গাসের মত অসংখ্য উজ্জ্বল চক্ষু ছিল।
এদিকে শিশিরসিক্ত শান্ত স্নিগ্ধ মর্ত্যভূমিতে প্রভাতকালে জেগে উঠে প্রথমে তাদের প্রার্থনা সারল আদম। ঊর্ধ্বলোক হতে এক শক্তি নেমে এসে সঞ্চারিত হলো তাদের মনে। গম্ভীর হতাশা থেকে এক অভিনব আশা ও আনন্দ উদ্ভুত হলো। তবু তাদের মন থেকে এক অজানিত আশঙ্কা বিদূরিত হলো।
আদম তখন ঈভকে সম্বোধন করে বলল, ঈভ, আমার বিশ্বাস ঈশ্বরের অনুগ্রহে মর্ত্যলোকের যে সব শুভ বস্তু উপভোগ করি তা সব নেমে আসছে আমাদের জন্য। কিন্তু সেই ভোগ্যবস্তুর জন্য আমাদের পক্ষ থেকে উপযুক্ত কৃতজ্ঞতা ও ভক্তি ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা উচিত যাতে ঈশ্বরের আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা আমরা লাভ করতে পারি। শুধু ভক্তি ও কৃতজ্ঞতা নয়, এর জন্য আমাদের দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে আমাদের ভক্তিবিনম্র প্রার্থনা তার উদ্দেশ্যে যথাযথভাবে উচ্চারিত হওয়া উচিত।