সহসা কিন্তু তিনি স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ডিফার্জকে টেনে নিয়ে দেয়াল-ঘেঁষে দাঁড়ালেন সরে গিয়ে। লুসী ম্যানেট এসে চুপি-চুপি দাঁড়ালো তার হতভাগ্য কবর থেকে ফিরে পাওয়া পিতার পাশে। হাত বাড়ালে লুসীর হাত স্পর্শ করতে পারতো ম্যানেটের মাথা। তবু ম্যানেট একেবারেই জানতে পারেননি লুসীর উপস্থিতির কথা। নীরবে তিনি ঝুঁকে পড়েছেন সেলাইয়ের উপরে।
হঠাৎ বৃদ্ধের দরকার হল ছুরি। ছুরি খুঁজবার জন্য একবার ডাইনে, একবার বাঁয়ে তাকাতে লাগলেন তিনি। ও কি দেখা যায় এত কাছে? চমকে উঠলেন বৃদ্ধ। তিনি লুসীর বসনের একাংশ দেখতে পেয়েছেন!
হাতে ছুরি, চোখে পাগলের মত দৃষ্টি নিয়ে যে-ভাবে লুসীর পানে চাইতে লাগলেন বৃদ্ধ ম্যানেট, তাতে ডিফার্জ আর লরী ভয় পেয়ে ছুটে আসবার জন্য প্রস্তুত হলেন। এই বুঝি হতভাগ্য উন্মাদ দেয় ওর বুকে ছুরি বসিয়ে! ভয়ে বুঝি লুসী অজ্ঞান হয়ে যায়। কিন্তু না, লুসীর আজ আর ভয় নেই। সে মিঃ লরী আর ডিফার্জের মতলব বুঝতে পেরেছে। সে হাত নেড়ে নিবারণ করলে ওঁদের। বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে নিজের হস্ত চুম্বন করতে লাগলো সে, বারবার দুই হাত এনে বুকের উপর জড়িয়ে ধরতে লাগলো, যেন বৃদ্ধ পিতার শুষ্ক শিরই সে জড়িয়ে ধরেছে। নিজের স্নেহকোমল বুকের উপরে। তার সে করুণ দৃষ্টির অর্থ পাগলের পক্ষেও ভুল বোঝা বা না-বোঝা অসম্ভব। কোন স্নেহের সম্ভাষণ তার মুখ থেকে উচ্চারিত না হলেও তার দু’টি ওষ্ঠ যেভাবে ফুলে ফুলে উঠছিল, তাতে পাগলকেও বুঝি বিচলিত হতে হল। অনেকক্ষণ ধরে লুসীর দিকে চেয়ে থাকতে-থাকতে বৃদ্ধ বলে উঠলেন–
০-তুমি-তুমি তো কারাধ্যক্ষের মেয়ে নও!
লুসী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো–না।
–কে তুমি তবে?
লুসীর সারা দেহ আবেগে কাঁপছিল…কথা বলবার শক্তি যেন তার ছিল না। কোন উত্তর না দিয়ে ধীরে ধীরে সে বৃদ্ধের পাশে বসলো। বেঞ্চের উপরে। ভয়ে সংকোচে সরে যেতে চান বৃদ্ধ, কিন্তু লুসী বৃদ্ধের হাতের উপরে রাখলো নিজের হাত। সে-স্পর্শে হঠাৎ আশ্চর্যভাবে শিউরে উঠলো বৃদ্ধের সারা অঙ্গ, ধীরে হাতের ছুরি তিনি নামিয়ে রাখলেন পায়ের কাছে, তারপর বিস্মিত তৃষিত দৃষ্টি নিয়ে তিনি চেয়ে রইলেন এই মমতাময়ী তরুণীর দিকে।
সোনালী রঙের এলো-চুল ছড়িয়ে পড়েছিল লুসীর কাঁধের উপর। একটু-একটু করে বৃদ্ধের হাত এগিয়ে যেতে লাগলো সেই দিকে। এক-গোছা চুল হাতে তুলে নিলেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরীক্ষা করতে লাগলেন যেন!
আর থাকতে না পেরে লুসী নিজের কোমল উষ্ণ হাত দুখানি তুলে দিলো বৃদ্ধের কণ্ঠে। বৃদ্ধ সেদিকে বারবার তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখেন। তারপর নিজের গলা থেকে খুলে নিলেন–নোংরা সূতায় ঝোলানো একটা ততোধিক নোংরা ছোট্ট পুঁটুলি। খুলতে লাগলেন সেই পুঁটুলি ধীরে-ধীরে কম্পিত হস্তে।
তার ভিতর থেকে বেরুলো একগাছা লম্বা চুল, লুসীর চুলের মতই উজ্জ্বল সোনালী, লুসীর চুলের মতই মসৃণ চিকণ! হারিয়ে গেছে তার যে অতীত জীবন, তারই এক কণা অবশেষ এই একগাছি চুল। সংসার গেছে, সম্পদ গেছে, ঘর গেছে, ঘরণী গেছে, শুধু হারিয়ে-যাওয়া সেই ঘরণীর একগাছি সোনালী চুল যায়নি শুধু তাই।
একবার সেই একগাছি সোনালী চুল, আর একবার লুসীর মাথার সোনালী চুলের গোছার দিকে বৃদ্ধ বারবার আকুল দৃষ্টিতে চান। তার মনের ভেতর অকস্মাৎ জেগে ওঠে স্মৃতির ক্ষীণ আলো। চিৎকার করে ওঠেন–এ তো সেই একই চুল! কী করে হল? কেমন করে? কেমন করে? কখন? কী এসব?
বৃদ্ধ সোজা উঠে দাঁড়িয়ে লুসীর মুখটা তুলে ধরে বলেন–কে তুমি? তুমি…তুমি কি সেই?
হাঁটু গেড়ে বৃদ্ধের সমুখে বসে পড়লো লুসী। আর্তকণ্ঠে বলে উঠলো–আমি তোমার মেয়ে, তোমার মেয়ে। বাবা! বাবা! আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
বৃদ্ধের দু’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অবিরল চোখের জল।
০৩. রাজদ্রোহের মামলা
পাঁচ বৎসর পরে।
লন্ডনের ফৌজদারী আদালত-ওল্ড বেইলী।
লোকে লোকারণ্য, আজ একটা রাজদ্রোহের মামলা চলেছে। খুব সম্ভব, জুরীরা দোষীই সাব্যস্ত করবেন আসামীটাকে। জুরীরা সাধারণত তাই করে থাকেন, রাজদ্রোহের মামলা পেলে। রাজার প্রতি একটা কর্তব্য আছে তো ভদ্রলোকদের! তাছাড়া, মাঝে মাঝে ফাঁসিটা-আষ্টা নাগরিকদের দেখবার সুযোগ দেওয়াও দরকার বই কি! নইলে, তারা টেস্লো দেয় কিসের জন্য?
তার উপর, রাজদ্রোহের আসামীর যা দণ্ড, তা শুধু ফাঁসির মত নিরামিষ নয়। প্রথম অবশ্য ফাঁসিতেই ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু প্রাণটা বেরিয়ে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে নামিয়ে ফেলতে হবে তাকে। তারপর গলার দড়ি খুলে নিয়ে তা দিয়ে বাঁধতে হবে হাত-পা। সেই অবস্থায় তাকে শুইয়ে রেখে, পেট ফেড়ে নাড়িভুড়ি বার করে ফেলা হবে তার। সে নাড়িভুড়ি তার সমুখেই পোড়ানো হবে আগুন জ্বেলে। এদিকে জ্ঞান থাকতে-থাকতেই অনেক কিছু করতে হবে তাকে নিয়ে। দেরি করা চলে না। এক-একখানি হাত, এক-একখানা পা ধীরে-সুস্থে পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে কাটা হবে তরোয়াল দিয়ে। কখনও কখনও তরোয়াল ব্যবহার না করে, ঘোড়ার পেছন-পায়ের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয় হাত-পা। পরস্পরের বিপরীত-দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে দু’টো তেজী ঘোড়া। একটার পেছন-পায়ে বাঁধা হল আসামীর হাত, আর-একটার পেছন-পায়ে তার পা দুখানা। তারপর দু’টো ঘোড়াকেই মারা হলো জোরসে চাবুক। তারা ছুটলো বায়ুবেগে। অপরাধীর হাত ছিঁড়ে ছুটে চললো উত্তর দিকে, পা ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল দক্ষিণে। কী স্বর্গীয় উল্লাস দর্শকদের! এরকম মজা কি পয়সা দিয়েও সাকাসে দেখা যায়? সুসভ্য ইংরেজ গভর্নমেন্ট দেড়শো বছর আগেও নাগরিকদের আনন্দের জন্য এ-রকম সব মনোরম ব্যবস্থা রেখেছিলেন আইনে। এই অল্প কয়েক দিনেই অনেক অধঃপতন হয়েছে দেশটার, উঠে গেছে সে-সব কানুন….