পড়ে যায় সে দেবদেহে, আর, চতুর্থ ব্যক্তি–এ হলো স্বয়ং সর্দার-খানসামা এর জামার দুই পকেটে দুটো সোনার ঘড়ি বাজে টিটি করে–যেন তারা বলছে–টিক্ টিক্, ঠিক ঠিক, এইভাবেই চলছে চিরদিন, এইভাবেই চলবে ঠিক! ঠিক্ ঠি! টিক্ টিক্!
হ্যাঁ, কী বলছিলাম, এই ডবল সোনার-ঘড়িওয়ালা সর্দার-খানসামা চকোলেট ঢেলে দেবে সোনার পেয়ালায়, তবে তা প্রভুর পানযোগ্য হবে! কারণ ইনি প্রভু, প্রভুদেরও প্রভু! এঁর উপরেও আর-এক প্রভু আছেন বটে, তিনি স্বয়ং রাজা। কিন্তু রাজার সঙ্গে সরাসরি ধরা-ছোঁয়ার ভিতর কম লোকই আসে। রাজশক্তির উত্তাপ নিজেদের অঙ্গে ধারণ করে এই প্রভুর দলই জনসাধারণকে পুড়িয়ে মারেন। সূর্যের তেজে গরম হয়ে ওঠে মরুভূমির বালুকা। রৌদ্রের চেয়ে সেই তপ্ত বালুকাই বেশি অসহ্য লাগে মরুপথের পথিকের কাছে।
চকোলেট পানপর্ব অবশেষে সাঙ্গ হল। রুদ্ধদ্বার খুলে গেল। প্রভুর উদয় হল তাদের সমুখে, যারা দলে দলে বাইরে বসে আছে একটিবার তাঁর দর্শন পাবার জন্য। ডাইনে-বাঁয়ে মাথা সব নুয়ে পড়তে লাগলো কর্তিত শস্যের মত। কাউকে একটি কথা, কারুর উপর একটুখানি হাসি, কারুর পানে চোখের কোণের এতটুকুন দৃষ্টি বর্ষণ করতে-করতে প্রভু চলেছেন কক্ষের পর কক্ষ অতিক্রম করে। শেষপ্রান্তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন এক ব্যক্তি, ইনিও প্রভুজাতীয়। গৃহস্বামী-প্রভুর মত অতবড় প্রভু না হলেও ইনিও বড় কম যান না। দেয়ালে কোন ইতালীয়ান ওস্তাদ শিল্পীর আঁকা ম্যাডোনা চিত্র। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে হয়তো তিনি সেই মাতৃমূর্তির সৌন্দর্যই দেখছিলেন, যদিও নিজের জীবনে মায়েদের সম্মান কমই রক্ষা করা অভ্যাস তার। মাতৃজাতি তত তার খেলার বস্তু! অর্থাৎ ওঁর একার নয়, সেই সময়কার প্রভু জাতিরই খেলার বস্তু।
গৃহস্বামীকে সামনে দেখে অন্য সবাইয়ের মত তটস্থভাব মোটেই দেখালেন না ইনি। অনেকটা সমকক্ষের মতই অভিবাদন করলেন তাঁকে। ভাবটা এই আজ তুমি রাজার কৃপালাভ করে খানিকটা উঁচুতে উঠে গেছ বটে, কিন্তু কাল পাশা উলটে যেতে পারে। তখন তোমার পদে আমি বসবো হয়তো, আর আমার বাড়িতে তুমি হাজিরা দেবে স্বার্থের খাতিরে।
আগন্তুক-প্রভুর মনের ভাব গৃহস্বামী-প্রভুর অজানা থাকবার কথা নয়, কারণ, এসব ব্যাপারে প্রভুরা পরস্পরের মনের ভাব ঠিকই বুঝতে পারেন। তিনি গম্ভীর ভাবে ঠিক সেইটুকুন সৌজন্যই দেখালেন–যা না দেখালে শিষ্টাচার বজায় থাকে না। যে চমৎকার কায়দায় আগন্তুকের নমস্কার তিনি ফিরিয়ে দিলেন, তাতে স্পষ্টই ফুটে উঠলো তার মনের কথা–অত আশা করো না বন্ধু! রাজার কৃপা তোমার বরাতে নেই, আর আমি গিয়ে তোমার বাড়িতে হাজিরা দেবো কোনদিন–এ আশা মগজে স্থান না দেওয়াই তোমার ভালো।
গৃহস্বামী পিছন ফিরলেন, দুশো লোককে খুশি করে বিদায় করার ঝামেলা মিটিয়ে দিলেন পাঁচ মিনিটের ভিতর। তিনিও নিজের খাসকামরায় গিয়ে দরজা বন্ধ করলেন, অভ্যাগত প্রভুটিও রুক্ষ মেজাজে মুখটি কালো করে ত্যাগ করলেন সে গৃহ। আসবার তার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু না এলেও সেটা অপরাধ বলে গণ্য হবার সম্ভাবনা। যতক্ষণ যার হাতে ক্ষমতা রাছে, তাকে তোয়াজ করতে হবে বইকি, তা সে যতই দাম্ভিক হোক!
অভ্যাগত প্রভুর চার ঘোড়ার গাড়ি সিঁড়ির নিচেই অপেক্ষা করে আছে। প্রভু উঠে পড়লেন, ইশারা পেয়ে বায়ুবেগে গাড়ি চালিয়ে দিলো কোচোয়ান। জনাকীর্ণ নগরীর রাজপথ; তাও যে আবার সব জায়গায় তা সমান প্রশস্ত, তা নয়। তার উপর দিয়ে এ-রকম বেগে গাড়ি চালানো নিরাপদ নয় জেনেও কোচোয়ান চাবুকের পর চাবুক মারতে লাগলো ঘোড়ার গায়ে। তেজী ঘোড়া ছুটলো ঝড়ের মত ।
এ ১ অব টু সিটীজ পথচরেরা চাপা পড়তে-পড়তে ছুটে পালাতে লাগলো। তাণে প্রাণ বাঁচানো তাদেরই। কাজ। ঘোড়ার পায়ের তলায় পড়ে মরে যদি তারা, ঘোড়ার কোন দোষ হবে না, কোচোয়ানের তো নয়ই। আরোহী? আরোহী যদি নেমে এসে মৃতের আত্মীয়দের ধরে চাবুক না মারেন, তবে তার নাম রটে যাবে দয়ালু বলে।
ঘড়-ঘড় ঝন্ঝন্ ঘটাং-ঘটাং শব্দ করে ছুটে চলেছে গাড়ি। ঝড়ের বেগে ছুটেছে, মোড়ের পর মোড় ঘুরে যাচ্ছে সেই ঝড়ের বেগে। নারীরা চিৎকার করে পালাচ্ছে পথ ছেড়ে, পুরুষেরা টানাটানি করছে শিশুদের। হৈ-হৈ ব্যাপার! রৈরৈ কাণ্ড! মাকুইসের গাড়ি! সামা!
পথের ধারে একটা ফোয়ারা। অনেক নারী ও শিশু সেখানে। নারীরা জল ভরছে, শিশুরা কাদা মাখছে। ঝড়ের বেগে এসে পড়লো মার্কুইসের গাড়ি। একটা রব উঠলোপালাও! পালাও!
একখানা চাকা ধাক্কা খেয়েছে কিসের সঙ্গে যেন। একটা আর্ত কোলাহল চারিদিকে। ঘোড়ারা পা তুলে লাফিয়ে উঠলো।
ঘোড়ারা লাফিয়ে উঠলো বলেই গাড়ি থামলো। তা নইলে থামবে কেন? গাড়ির। তলায় মানুষ চাপা পড়ে থাকে অমন, তা বলে প্রভুদের গাড়ি থেমে পড়বে রাস্তার। মাঝখানে, অমন আশা করে না গরীবেরা। কিন্তু এ-যাত্ৰা ঘোড়ারা লাফিয়ে উঠেছে, গাড়ি থামাতেই হল। মাকুইস মুখ বাড়িয়ে প্রশ্ন করলেন–হল কি?
লম্বা একটা লোক, ঘোড়ার পায়ের তলা থেকে টেনে বার করেছে একটা মাংসপিণ্ড, আর কাদার উপর সেইটেকে রেখে, তার উপরে পড়ে চিৎকার করছে হাউহাউ করে।
ছেঁড়া কাপড় পরা একটা লোক বিনীত স্বরে বললে–মহান্ মার্কুইস! ক্ষমা করুন প্রভু!–একটা বাচ্চা চাপা পড়েছে!