একই বিরাট বর্গের অন্য সব সদস্যদের মতো, বহু দূরবর্তী পূর্বপুরুষে অবস্থিত থাকা একটি গর্ত করা ও ক্রকচ (serrated) যন্ত্র হিসেবে আমরা যদি মৌমাছির হুলকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখব এটি প্রথমে গল (gall) সৃষ্টির মতো অন্য কোন উদ্দেশ্যের জন্যে বিষযুক্ত হয়ে পরবর্তীকালে বর্তমান উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কম নিখুঁতভাবে রূপান্তরিত হয়েছে। এ থেকে আমরা বোধহয় বুঝতে পারি কেমন করে যে হুলের ব্যবহার প্রায়শই পতঙ্গের নিজের মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে : কারণ যদি সামগ্রিকভাবে হুল-ফোঁটানোর ক্ষমতাটি সম্প্রদায়ের পক্ষে উপকারী হয়, তাহলে এটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের সমস্ত প্রয়োজন পূর্ণ করবে, যদিও এটি অল্প কিছু সদস্যের মৃত্যু ঘটাতে পারে। আমরা যদি ঘ্রাণশক্তির প্রকৃত বিস্ময়কর ক্ষমতার তারিফ করি, যার দ্বারা অনেক পতঙ্গদের পুরুষরা তাদের স্ত্রীদের খুঁজে পায়, এই একটি উদ্দেশ্যের জন্য হাজারে হাজারে পুরুষ-মৌমাছির সৃষ্টিকে কি আমরা তারিফ করতে পারি, যারা অন্য কোন উদ্দেশ্যের জন্য সম্প্রদায়ের পক্ষে সম্পূর্ণরূপে অনুপকারী এবং অবশেষে পরিশ্রমী ও বন্ধ্যা বোনেদের দ্বারা নিহত হয়। এটি কষ্টকর হতে পারে, কিন্তু রাণী-মৌমাছির বন্য সহজাত প্রবৃত্তিকে আমাদের প্রশংসা করা উচিত, যা জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে যুবতী রাণীদের অর্থাৎ নিজেদের কন্যাদের ধ্বংস করতে তাকে প্ররোচিত করে, অথবা জীবনসংগ্রামে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে তাকে প্ররোচিত করে, কারণ এটি সম্প্রদায়ের পক্ষে মঙ্গলকর; এবং মাতৃস্নেহ ও মাতৃঘৃণা, যদিও সৌভাগ্যক্রমে পরেরটি খুবই বিরল, হচ্ছে সকল প্রাকৃতিক নির্বাচনের অনমনীয় নিয়মের মতোই। যদি আমরা কয়েকটি নিখুঁত কলাকৌশলের তারিফ করি যার দ্বারা অর্কিড ও অন্যান্য উদ্ভিদরা পতঙ্গদের মাধ্যমে নিষিক্ত হয়, তাহলে আমাদের ফার গাছের পরাগরেণুর ঘনরাশির সম্প্রসারণকে সমভাবে নিখুঁত হিসেবে আমরা কি বিবেচনা করতে পারি, যাতে কতিপয় কণা হঠাৎ বায়ুতাড়িত হয়ে ডিম্বকে এসে পড়তে পারে?
সারাংশ : টাইপের একত্বের প্রাকৃতিক নির্বাচনতত্ত্ব দ্বারা অবলম্বিত বাঁচার পরিবেশের নিয়ম
এই অধ্যায়ে আমরা তত্ত্বটির বিরুদ্ধে উপস্থাপনযোগ্য প্রতিবন্ধক ও আপত্তিগুলি সম্বন্ধে আলোচনা করেছি। এদের অনেকগুলি গুরতর, কিন্তু আমি মনে করি সৃষ্টির স্বতন্ত্র কার্যকলাপের বিশ্বাস অনুযায়ী সম্পূর্ণরূপে অস্পষ্ট কয়েকটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে আলোচনায়। আমরা দেখেছি কোন একটি যুগের প্রজাতিরা অনির্দিষ্টভাবে পরিবর্তনশীল নয় এবং অসংখ্য মধ্যবর্তী ক্রমিক ধাপের দ্বারা একত্রে সংযুক্ত নয়, যার আংশিক কারণ হচ্ছে যে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া সর্বদা মন্থর হয় এবং যে কোন একটি সময়ে শুধুমাত্র কতিপয় আকারের ওপর কার্যকরী হয়; বাকি আংশিক কারণ হচ্ছে যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের যথাযথ প্রক্রিয়াটি পূর্ববর্তী ও মধ্যবর্তী ক্রমিক ধাপগুলির অনবরত স্থানচ্যুতি ও বিলুপ্তির ইঙ্গিত দেয়। একটি অবিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বর্তমানে বসবাসকারী নিকট সম্বন্ধীয় প্রজাতিরা নিশ্চয় সেই সময় সৃষ্টি হয়েছিল যখন অঞ্চলটি অবিচ্ছিন্ন ছিল না এবং যখন জীবন-পরিবেশ এক অংশ থেকে অন্য অংশে অজ্ঞাতসারে ক্রমে ক্রমে সরে যায় নি। একটি অবিচ্ছিন্ন অঞ্চলের দুটি জেলায় দুটি ভ্যারাইটি যখন সৃষ্টি হয়, তখন মধ্যবর্তী অঞ্চলের পক্ষে উপযুক্ত একটি মধ্যবর্তী ভ্যারাইটি প্রায়শই সৃষ্টি হবে, কিন্তু উল্লিখিত যুক্তিগুলি অনুসারে, মধ্যবর্তী ভ্যারাইটিটি তাকে সংযুক্তকারী দুটি আকারের তুলনায় সংখ্যায় সাধারণত কম হবে; পরিণামে রূপান্তর-প্রক্রিয়া চলাকালীন অধিক সংখ্যায় থাকা পরবর্তী দুটি, কম সংখ্যক মধ্যবর্তী ভ্যারাইটির ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে থাকবে এবং এভাবে এরা তাকে স্থানচ্যুত ও ধ্বংস করতে সমর্থ হবে।
এই অধ্যায়ে আমরা দেখিয়েছি যে এমন সিদ্ধান্ত করতে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত যে জীবনের অধিকাংশ ভিন্ন স্বভাবগুলি পরস্পরের মধ্যে ক্রমে ক্রমে চালিত হতে পারে না; যেমন, একটি বাদুড় প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা শুধুমাত্র বাতাসে ভেসে চলে এমন একটি প্রাণী থেকে সৃষ্টি হতে পারত না।
আমরা দেখিয়েছি যে নূতন জীবন-পরিবেশে কোন প্রজাতি তার স্বভাবসমূহের পরিবর্তন ঘটাতে পারে অথবা তার সবচেয়ে স্বগোত্রীয়দের তুলনায় কিছুটা অসদৃশভাবে নিজের স্বভাবসমূহকে বৈচিত্র্যমুখী করে থাকতে পারে। অতএব প্রত্যেক জীব যেখানে বাস করতে পারে সেখানেই বসবাস করার চেষ্টা করছে, এটি মনে রাখলে আমরা বুঝতে পারি কেমন করে লিপ্তপদ সমেত উচ্চভূমির রাজহাঁস, ভূমিতে বসবাসকারী কাঠঠোকরা, ডুবুরি গ্লাস পাখি এবং অক পাখিদের মতো স্বভাববিশিষ্ট পেট্রেল পাখিদের উদ্ভব ঘটেছে।
যদিও বিশ্বাস করা হয় যে চোখের মতো এত নিখুঁত একটি অঙ্গ প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা সৃষ্ট হয়ে থাকতে পারে, তবুও এটি যে কোন ব্যক্তিকে বিচলিত করার পক্ষে যথেষ্ট; তথাপি যে কোন একটি অঙ্গের ক্ষেত্রে, জটিলতার ক্রমিক ধাপগুলির একটি দীর্ঘ সারি সম্পর্কে যদি আমরা জানি যে প্রত্যেকটিই তার অধিকারীর পক্ষে কল্যাণকর, তখন, জীবনের পরিবর্তিত পরিবেশে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নিখুঁততার যে কোন কল্পনাসাধ্য মাত্রা অর্জনে যুক্তিসঙ্গত কোন অসম্ভাব্যতা নেই। যে ঘটনাগুলিতে আমরা কোন মধ্যবর্তী অথবা সংক্রমণগত অবস্থার কথা জানি না, সেখানে এই সিদ্ধান্তে আসতে আমাদের অতিশয় সতর্ক হতে হবে যে এ ধরনের কোন অবস্থা ছিলই না, কারণ অনেক অঙ্গের রূপান্তর থেকে দেখা যায় কার্যপদ্ধতিতে কী বিস্ময়কর পরিবর্তন সম্ভবপর হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, একটি পটকা আপাতভাবে বায়ুতে নিশ্বাস-প্রশ্বাসকারী ফুসফুসে রূপান্তরিত হয়েছে। একই অঙ্গের যুগপৎ অতি ভিন্ন কার্য সম্পাদন করা এবং তারপর অংশত অথবা সামগ্রিকভাবে একটি কার্যের জন্য বিশিষ্ট হওয়া, এবং দুটি স্বতন্ত্র অঙ্গের একই সময়ে একই কার্য সম্পাদন করা, অন্যের সাহায্যে নিখুঁত হওয়া, প্রায়শই অবস্থান্তর প্রাপ্তিতে বিশেষভাবে সাহায্য করে থাকবে।