উপযোগবাদ, কতদূর সত্য : সৌন্দর্য কেমনভাবে অর্জিত
দেহগঠনের প্রত্যেক ক্ষুদ্র অংশও তার অধিকারীর পক্ষে মঙ্গলকর–এই উপযোগবাদী তত্ত্বের বিরুদ্ধে কয়েকজন প্রকৃতিবিদের সাম্প্রতিক বক্তব্যের প্রতিবাদে কিছু বলতে পূর্ববর্তী মন্তব্যগুলি আমাকে প্রভাবিত করেছে। তারা বিশ্বাস করেন যে অনেক গঠনকৌশল মানুষ অথবা সৃষ্টিকর্তাকে আনন্দ দান করতে সৌন্দর্যের জন্য (এই শেষোক্ত বিষয়টি বৈজ্ঞানিক আলোচনার উদ্দেশ্যের বাইরে) অথবা শুধুমাত্র বৈচিত্র্যের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হয়েছে, বিষয়টি ইতিমধ্যে আলোচিত হয়েছে। এই মতবাদসমূহ, যদি সত্য হয়, আমার তত্ত্বের পক্ষে অত্যন্ত মারাত্মক হবে। আমি সম্পূর্ণরূপে স্বীকার করি যে অনেক দেহগঠন তার অধিকারীর কোন প্রত্যক্ষ ব্যবহারে লাগে না এবং তাদের পূর্বপুরুষদেরও কোন কাজে লেগে থাকতে পারে না; কিন্তু এ থেকে প্রমাণ হয় না যে এগুলি শুধুমাত্র সৌন্দর্য অথবা বৈচিত্র্যের জন্য সৃষ্টি হয়েছিল। সন্দেহ নেই যে পরিবর্তিত পরিবেশের নির্দিষ্ট ক্রিয়া প্রক্রিয়া এবং সাম্প্রতিককালে নিরূপিত রূপান্তরসমূহের বিভিন্ন কারণগুলি সকলে একটি ফলাফল সৃষ্টি করেছে, সম্ভবতঃ কোন সুফল ছাড়াই এভাবে অর্জিত একটি বিরাট পরিমাণ এটি। কিন্তু আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে প্রত্যেক জীবন্ত জীবের দেহের প্রধান অঙ্গটি বংশানুসৃতির জন্য হয়; এবং ফলস্বরূপ, যদিও প্রত্যেক জীব প্রকৃতিতে তার অবস্থানের জন্য নিশ্চিতই ভালভাবে মানানসই হয়েছে, জীবনের বর্তমান স্বভাবের সঙ্গে অনেক দেহগঠনের অতিশয় নিকট এবং প্রত্যক্ষ সম্পর্ক এখন নেই। এভাবে, আমরা কদাচিৎ বিশ্বাস করি যে উচ্চস্থানের রাজহাঁস অথবা ফ্রিগেট পাখির লিপ্তপদের বিশেষ ব্যবহার আছে; আমরা বিশ্বাস করতে পারি না যে বাঁদরের বাহুর, ঘোড়ার সামনের পায়ের, বাদুড়ের ডানার এবং সীলমাছের দাঁড়ের সদৃশ হাড়গুলির কোন বিশেষ ব্যবহার এইসব প্রাণীদের পক্ষে আছে। আমরা নিরাপদেই বলতে পারি যে এগুলি বংশানুসৃতির জন্য হয়েছে। কিন্তু সন্দেহ নেই যে উচ্চস্থানের রাজহাঁস এবং ফ্রিগেট পাখিদের পূর্বপুরুষদের পক্ষে লিপ্তপদ যতখানি উপকারী ছিল, এখনও ততখানিই উপকারী বর্তমান পক্ষীকুলের অধিকাংশ জলচর সদস্যদের ক্ষেত্রে। সুতরাং আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে সীলমাছের পূর্বপুরুষদের দাঁড় ছিল না, তবে চলন অথবা আঁকড়িয়ে ধরার জন্য পাঁচ আঙ্গুল সমেত একটি পায়ের পাতা ছিল; আমরা আরও বিশ্বাস করতে পারি যে বাঁদর, ঘোড়া এবং বাদুড়ের প্রত্যঙ্গগুলির কয়েকটি হাড় উপযোগবাদী সূত্রানুযায়ী সমগ্র শ্রেণীর কোন আদিম মাছের মতো পূর্বপুরুষের পাখনার আরও অসংখ্য হাড়ের হাসপ্রাপ্তির মাধ্যমেই প্রথমে উদ্ভূত হয়েছিল। সিদ্ধান্তে আসা মোটেই সম্ভবপর নয় যে পরিবর্তনের এইসব কারণগুলির কতখানি অনুমোদন করা উচিত, যথা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া, সুপরিচিত স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তনগুলি এবং বৃদ্ধির জটিল নিয়মসমূহ; কিন্তু এইসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রমগুলি ছাড়া, আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে প্রত্যেক জীবন্ত জীবের দেহকাঠামো তার অধিকারীর কোন প্রত্যক্ষ অথবা অপ্রত্যক্ষ ব্যবহারে এখন লাগে অথবা পূর্বে লাগত।
জীবসমূহ মানুষের আনন্দ উপভোগের জন্য সুন্দররূপে সৃষ্টি হয়েছে–এই বিশ্বাসটি আমার সমগ্র তত্ত্বের পক্ষে ক্ষতিকারক। আমি প্রথমেই বলতে পারি যে সৌন্দর্যবোধ মুগ্ধকর বস্তুর কোন প্রকৃত গুণ নিরপেক্ষভাবে স্পষ্টতঃ মনের অবস্থার ওপর নির্ভর করে; এবং কোষ্টা সুন্দর সে ধারণা সহজাত অথবা অপরিবর্তনীয় নয়। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন জাতির পুরুষদের মধ্যে আমরা দেখি যে এরা এদের স্ত্রীলোকদের সৌন্দর্যের একটি সম্পূর্ণ পৃথক মান পছন্দ করে। যদি কেবল মানুষের সন্তুষ্টির জন্য সুন্দর বস্তুগুলি সৃষ্টি হয়ে থাকত, তাহলে দেখাতে হবে যে মানুষের আবির্ভাবের পূর্বে প্রকৃতি কম সুন্দর ছিল। ইয়োসিন অধিযুগে সুন্দর কুণ্ডলাকার ও শঙ্কু-আকৃতি শম্বুকরা এবং মধ্যবর্তীযুগে সুশোভিত আকারবিশিষ্ট এ্যামোনাইটরা এই কারণে সৃষ্ট হয়েছিল কি যে পরবর্তী সময়ে মানুষরা তাদের প্রশংসা করবে? ডায়াটোমেসির ক্ষুদ্র সিলিকাযুক্ত কোষগুলির থেকে সৌন্দর্যময় বস্তু খুব কমই আছে; এগুলি কি এই কারণে সৃষ্টি হয়েছিল যে এরা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পরীক্ষিত এবং প্রশংসিত হবে? শেষোক্ত ক্ষেত্রে এবং অন্য অসংখ্য ক্ষেত্রে বৃদ্ধির সুসামঞ্জস্যের জন্যই আপাতভাবে এগুলি ঘটে থাকে। ফুল প্রকৃতির সুন্দরতম উৎপাদনসমূহের মধ্যে পড়ে; সবুজ পাতার সঙ্গে বৈসাদৃশ্যে এরা দৃষ্টিআকর্ষক হয়েছে এবং ফলস্বরূপ একই সময়ে সুন্দরও হয়েছে, যাতে পতঙ্গরা এদের সহজেই লক্ষ্য করতে পারে। এটিকে একটি অপরিবর্তনীয় নিয়ম হিসেবে গণ্য করে আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে বাতাস দ্বারা নিষিক্ত একটি ফুলের পাপড়িগুলি কখনও উজ্জ্বল। রঙের হয় না। কয়েকটি উদ্ভিদ স্বভাবগত কারণে দু’ধরনের ফুল উৎপাদন করে–একটি ধরণ হচ্ছে পতঙ্গদের আকর্ষণ করার জন্য খোলা ও রঙ্গিন, অন্য ধরনটি বন্ধ, রঙ্গিন। নয়, মধুবিহীন, যাতে কখনও পতঙ্গরা আসে না। অতএব আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে, পতঙ্গরা পৃথিবীতে সৃষ্ট না হলে আমাদের উদ্ভিদগুলি সুন্দর ফুল দ্বারা সজ্জিত হত, বরং শুধুমাত্র এমন নিষ্প্রভ ফুল উৎপাদন করত যেমনটা আমরা আমাদের ফার, ওক, নাট ও অ্যাস বৃক্ষগুলিতে, ঘাস, স্পাইন্যাক, ডক এবং নেটলদের ক্ষেত্রে দেখি, যারা সকলে বাতাসের মাধ্যমে নিষিক্ত হয়। ফলের ক্ষেত্রেও একই যুক্তি প্রযোজ্য। একটি পরিপক্ক স্ট্রবেরি বা চেরি যেমন রসনাকে তৃপ্ত করে, তেমনি চোখকেও সন্তুষ্ট করে। স্পিন-উড গাছের উজ্জ্বল রঙের ফলগুলি এবং হোলি গাছের টকটকে লালরঙের ফলগুলি যে অতি সুন্দর বস্তু, তা সকলেই স্বীকার করবে। কিন্তু এই সৌন্দর্য শুধুমাত্র পাখি ও পশুদের পথপ্রদর্শক হিসাবে ব্যবহৃত হয় যাতে এদের এরা গিলে খায় এবং ফলে পরিপক্ক বীজগুলি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। আমি সিদ্ধান্ত করি যে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমহীন নিয়মটি হচ্ছে–যে কোন প্রকার ফলের মধ্যে আবদ্ধ থাকা বীজগুলি এভাবে সর্বত্র বিস্তৃত হবে।