প্যাকেটটা খুলে দেখেছে বারবারা। মেরিয়ানার পুরনো পরিচারিকা হিসেবে এ অধিকার তার আছে। দেখেছে তাতে আছে মসলিনের কাপড়, ক্যালিকোর ছিট আর কিছু ভালো নূতন ধরনের ফিতে আর কিছু টাকা। নবার্গকে নিয়ে চিন্তার অন্ত নেই বারবারার। কি করে মেরিয়ানার চোখে নৰ্বার্গকে ভালো লাগানো যায়, কি করে তার মনে নৰ্বার্গের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ জাগানো যায় এই চিন্তায় সব সময় কাতর সে।
খ্রিস্টোৎসবের উপহারের মতো নৰ্বার্গের সব উপহার টেবিলের উপর থরে থরে সাজিয়ে রাখল বারবারা। তারপর উৎকর্ণ হয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগল মেরিয়ানার পদধ্বনির। কিন্তু যার জন্য এত কাণ্ড সে একবার ফিরেও তাকাল না এই সব উপহারের পানে। মেরিয়ানা ঘরে ঢুকে আপনার মনে চঞ্চলভাবে পায়চারি করতে লাগল ঘরময়। কোনও দিকে তাকাল না। বারবাবার দিকেও না। বারবারা একবার জিজ্ঞাসা করল, কি বাছা, তোমার শরীর খারাপ করেনি তো? একবার চেয়ে দেখো, নৰ্বাৰ্গ কি পাঠিয়েছে। এতে তোমার ভালো নাইটগাউন হবে।
মেরিয়ানা বলল, নৰ্বার্গ যখন আসবে তখন তোমরা যা বলবে করব। কিন্তু এখন আমাকে জ্বালিও না। এখন আমি শুধু একমাত্র তাকে ভালোবাসি, সে আমাকে ভালোবাসে।
প্রতিবাদে ফেটে পড়তে চাইছিল বারবারা। কিন্তু মেরিয়ানা আদরের ভঙ্গিতে তার বুকটা জড়িয়ে ধরতেই হেসে ফেলল ফোকলা দাঁতে। বলল, এখন পুরুষের পোশাকটা ছেড়ে ফেলো তো বাছা। ও পোশাকে তোমাকে মোটেই মানায় না।
এই বলে বারবারা মেরিয়ানার পায়ে হাত রাখতেই হাতটা সরিয়ে দিল মেরিয়ানা। বলল, এখন নয়, এখন আমি একজনের জন্য অপেক্ষা করছি।
বারবারা বলল, কেউ আসবে? ছোকরা মেস্তার? সেই ব্যবসায়ীর বকাটে নিঃস্ব ছেলেটা? উদারতার একটা আবেগ পেয়ে বসেছে তোমায়। যত সব নিঃস্ব অপদার্থ ছোঁড়াদের সঙ্গে তোমার কারবার বেশি। অবশ্য পরের উপকার করে নাম কেনার মধ্যে একটা মোহ আছে।
সে কথায় কান না দিয়ে মেরিয়ানা বলল, আমি তাকে ভালোবাসি। দারুণ ভালোবাসি। আমি যদি তার গলাটা এই মুহূর্তে জড়িয়ে ধরতে পারতাম।! আমি যদি তাকে সারাজীবন ধরে রেখে দিতে পারতাম।
বারবারা শান্তভাবে বলল, সংযত করো নিজেকে। একপক্ষ কালের মধ্যে নবার্গ এসে পড়বে। তার আগে আজ একটা প্যাকেট পাঠিয়েছে সে।
একপক্ষ কাল অনেক দেরি। তার আগে অনেক কিছু ঘটতে পারে।
এমন সময় উইলেম মেস্তার মেরিয়ানার ঘরে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে বারবারা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে অন্তরে চাপা বিক্ষোভ নিয়ে।
পরের দিন সকালে মার সঙ্গে দেখা হতে উইলেমকে তার মা বলল, তার এত ঘন ঘন থিয়েটারে যাওয়ার জন্য তার বাবা অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছেন তার উপর। অবশ্য আমি নিজেও মাঝে মাঝে যাই। তবু আমি থিয়েটারের ব্যাপারটাকে ঘৃণা করি। এতে আমাদের গৃহকোণের শান্তি অনেকখানি নষ্ট হচ্ছে।
উইলেম বলল, বাবা আমাকে একথা অনেক আগেই বলেছেন। কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখো মা, যে কাজ সঙ্গে সঙ্গে টাকা-পয়সা এনে দেয় সে কাজ ছাড়া জীবনে কি কিছু করার নেই আমাদের? অপ্রয়োজনীয় কোনও বস্তুতে যদি কোনও আনন্দ না থাকে তাহলে বাবা কেন এই নতুন বাড়িটা করে ঘরগুলো এমন করে সাজিয়েছেন? আমাদের পুরনো বাড়িটাতে তো বেশ চলে যাচ্ছিল। প্রতি বছর বাবা কি তাঁর ঘরগুলো অলঙ্করণের জন্য প্রচুর টাকা খরচ করেন না? এসবও থিয়েটারে যাওয়ার মতো অপ্রয়োজনীয়। তার থেকে থিয়েটারে দেখবে একই সঙ্গে আনন্দ ও শিক্ষার উপকরণ অনেক পাওয়া যায়।
মা বললেন, থিয়েটারে যাও ক্ষতি নেই, তবে বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তোমার বাবা মনে করেন, এতে তোমার মনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আর তার জন্য দোষ পেতে হচ্ছে আমাকে। আজ হতে বারো বছর আগে একবার আমি তোমাকে পুতুলনাচ দেখাই তখন তার জন্য আমাকে অনেক কথা শুনতে হয়।
উইলেম তাড়াতাড়ি বলল, বেচারা পুতুলগুলোকে দোষ দিও না মা। ফাঁকা ফাঁকা বাড়িটার মধ্যে সেই পুতুলনাচ দেখে তখন প্রচুর আনন্দ পাই। গোলিয়াথ নামে একটা বিরাট রাক্ষস সারা রাজ্যটাকে জ্বালিয়ে খাচ্ছিল। তখন ডেভিড এসে রাজাকে বলল, সে যুদ্ধ করে হারাবে রাক্ষসকে। এর পরেই যবনিকা পতন হলো। আমাদের কৌতূহল আর ধরে না। পরে যখন এই ডেভিড রাক্ষসটাকে মেরে তার মাথাটা রাজার কাছে পাঠিয়ে দিল আর তার মাংসগুলো মাঠে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠি আমরা। তার বীরত্বের পুরস্কারস্বরূপ সুন্দরী রাজকন্যাকে লাভ করে ডেভিড।
তবে তার চেহারাটা খুবই বেঁটে দেখে একটু হতাশ হয়েছিলাম আমি।
মা বললেন, আমি জানি, এটা তোমার মনে একেবারে গেঁথে গিয়েছিল পরে তুমি কতবার মোম দিয়ে ডেভিড আর গোলিয়াথের মূর্তি বানিয়ে আলপিন ফুটিয়ে গোলিয়াথকে মারতে। তবে তার জন্য আমাকে অশান্তি ভোগ করতে হয়।
উইলেম বলল, এর জন্য অনুশোচনা করো না মা। এই পুতুলনাচের কথা ভাবতেও আমার ভালো লাগে। এই কথা বলেই চাবি এনে আলমারি খুলে কাপড়ের পুতুলগুলোকে বার করল উইলেম। তার মনটা সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল সেই সূদুর শৈশবে, অনাবিল সুখশান্তি আর সৌন্দর্যে ভরা এক কল্পলোকে।
স্বভাবত বড় কল্পনাপ্রবণ উইলেম। কোনও বস্তুকে তার ভালো লাগলেই কল্পনার রং-রস দিয়ে তাকে আরও বেশি সুন্দর করে তুলত মনে মনে। প্রথম আলাপেই ভালোবেসে ফেলে সে থিয়েটারের পেশাদার অভিনেত্রী মেরিয়ানাকে। তার স্বাভাবিক নাট্যপ্রীতি নৈশ রঙ্গশালার উজ্জ্বলতা ও ঐশ্বর্যের সঙ্গে মিলে মিশে এই ভালোবাসাকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। অবশ্য এর সঙ্গে তার প্রতি মেরিয়ানার আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ ও আগ্রহের নিবিড়তাও একটা মিষ্টি গভীরতা এনে দেয় তার ভালোবাসার মধ্যে। মেরিয়ানা সত্যিই তাকে যেন একটু বেশি খাতির ও আদরযত্ন করত। উইলেমের ভালোবাসার প্রতিদান একটু বেশি করেই দিত মেরিয়ানা। তাকে কাছে পেলে ছাড়তে চাইত না, অধীর আগ্রহে, তার জন্য প্রতীক্ষা করত। তবে উইলেম হয়ত লক্ষ্য করেনি মেরিয়ানার চিন্তায় ও আচরণে একটা গভীর উদ্বেগ উঁকি মারত মাঝে মাঝে। প্রায়ই ভয় হতো মেরিয়ানার তার প্রকৃত অবস্থার কথাটা হয়ত একদিন জেনে ফেলবে উইলেম।