ডাক্তার ভদ্রলোক শহরের লোক এবং ছেলেদের মোটেই পছন্দ করতেন না। তাছাড়া লোত্তেদের বাড়ির ছেলেরা নোংরা এবং বদমায়েশ একথা তিনি প্রায় পাঁচ জায়গায় বলে বেড়াতেন। আমি সেই নোংরা বদমায়েশ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলা করছি দেখে তিনি চলে গেলেন কোনও কথা না বলে।
আমার কিন্তু ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থাকতে বা খেলা করতে খুব ভালো লাগে। লোত্তের সঙ্গে তাদের বাড়িতে দেখা করতে গেলে দেখতাম সে কোনও কাজে ব্যস্ত তখন তার ভাইবোনদের সঙ্গে খেলা শুরু করে দিতাম। পৃথিবীতে যত জীবিত প্রাণী আছে তার মধ্যে শিশুদের আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। মানুষের সব ভালো গুণ তাদের মধ্যে ছোট আকারে দেখতে পাই আমি। তাদের একগুঁয়েমির মধ্যে আমি দেখতে পাই মানুষের চারিত্রিক দৃঢ়তার ক্ষুদ্রতর রূপ। হে ঈশ্বর, তুমি স্বর্গ থেকে। তোমার সকল সন্তানদেরই দেখতে পাচ্ছ। তাদের মাঝে আছে বড় শিশু আর ছোট শিশু। তবে তোমার পরম পুত্র বলে গেছেন তুমি কাজের থেকে বেশি আনন্দ পাও। যাই হোক, আজকের মতো বিদায় উইলেম। আজ তার কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
জুলাই ১,
আমার মনের অবস্থা এখন খুবই খারাপ। রোগশয্যায় কোনও রোগীর পাশে বসে থাকা মানুষের থেকে আমার বিষাদ অনেক বেশি। ঠিক হয়েছে লোত্তে দিনকতকের জন্য শাহরে যাবে তাদের কোনও এক আত্মীয়ের সেবা করতে। ভদ্রমহিলা শেষ সময় লোত্তেকে দেখতে চেয়েছেন।
গত সপ্তায় আমি লোত্তের সঙ্গে একটা ছোট্ট গায়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। গাঁটা এখান থেকে এক ঘণ্টার পথ। লোত্তে তার সঙ্গে তার দ্বিতীয় বোনকে নিয়ে গিয়েছিল। আমরা সেখানে বেলা চারটের সময় পৌঁছলাম। আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছতেই একটি বুড়ো মানুষ বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ উঠে ছুটে আসছিল লোত্তের দিকে। মনে হলো লোত্তেকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সে নবজীবন লাভ করেছে। কিন্তু লোত্তে ছুটে গিয়ে তার। পাশে বসল। তার কোলের ছেলেটিকে আদর করল। বুড়োটির নাম প্যাস্টর। আমরা তারই বাড়ি বেড়াতে গিয়েছি। প্যাস্টর কানে কালা বলে লোত্তেকে খুব চিৎকার করে কথা বলতে হয়েছিল। প্যাস্টর বলছিল সে আর বেশিদিন বাঁচবে না। লোত্তে বলল, অনেক বলিস্ট যুবক অকালে মারা যাচ্ছে। আমি প্যাস্টরের স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করলাম।
বাড়ির বাইরে ছিল দুটো বিরাট কাজুবাদামের গাছ। তার ছায়া ভারা উঠোনটাকে ছেয়ে রেখেছিল। আমি গাছটার প্রশংসা করতেই প্যাস্টর আর ইতিহাস বলতে শুরু করল।
সে বলল, গাছটা কে বসিয়েছে তা জানি না। তবে ছোট গাছটা বসায় আমার স্ত্রীর বাবা। সে গাছের বয়স হলো আমার স্ত্রীর বয়সের সমান। তার মানে আমার শ্বশুর যেদিন সকালবেলায় এই গাছটা রোপণ করেন সেইদিন বিকালেই আমার স্ত্রীর জন্ম হয়। সে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের কথা। এ বাড়িঘর একদিন আমার শ্বশুরেরই ছিল। আমি এসেছিলাম আজ হতে সাতাশ বছর আগে। তখন আমি ছাত্র ছিলাম। আমাকে তিনি ভালোবাসতেন এবং পরে তাঁর মেয়েও আমাকে ভালোবাসতে থাকে। পরে একদিন আমিই এ বাড়ির মালিক হয়ে বসি।
লোত্তে প্যাস্টরের মেয়ের খোঁজ করতে লাগল। মেয়েটি তার সমবয়সী। প্যাস্টর বলল, তার প্রণয়ী স্কুমিদের সঙ্গে বেড়াতে গেছে মাঠ দিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্যাস্টারের মেয়ে ফ্রেদারিক ও স্কৃমিদ এসে গেল। লোত্তেকে দেখতে পেয়ে খুশি হয়ে এগিয়ে এসে হাত ধরল ফ্রেদারিক। আমরা একসঙ্গে বেড়াতে লাগলাম। কিন্তু ফ্রেদারিকের প্রণয়ী ছেলেটি আমাদের সঙ্গে আলোচনায় ভালো করে অংশগ্রহণ করল না। তাকে কেমন যেন অসামাজিক দেখাচ্ছিল। বিশেষ করে আমি যখন ফ্রেদারিকের। গাঁ ঘেষে বেড়াচ্ছিলাম তখন মুখখানা কালো হয়ে উঠেছিল তার। তা দেখে লোত্তে আমার হাতে চাপ দিয়ে তার লক্ষ্য করতে বলল।
সন্ধের সময় আমরা প্যাস্টরের বাড়িতে ফিরে এলাম সবাই। খাবার টেবিলে বসে আমরা যখন সুখ-দুঃখ সম্বন্ধে আলোচনা করছিলাম তখন আমি প্রসঙ্গক্রমে বললাম, আমরা সাধারণত আমাদের দুর্দিন বা দুঃখের দিনের জন্য অভিযোগ করি ঈশ্বরের কাছে। আমরা অভিযোগ করে বলি সুখের দিন কত কম। কিন্তু আমার যতদূর মনে হয় এ ধারণা, এ অভিযোগ ভিত্তিহীন। কারণ আমরা যখন কোনও সুখের দিন হাতের মুঠোর মধ্যে পাই তখন ভোলা মন নিয়ে যদি তা নিবিড়ভাবে উপভোগ করি, তার থেকে যে আত্মশক্তি পাব তা দিয়ে অনেক দুঃখ সহ্য করতে পারব। আসলে আমি ফ্রেদারিকের প্রণয়ীকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম। প্যাস্টরের স্ত্রী তখন বলল, কিন্তু আমাদের অনুভূতির উপর আমাদের সব সময় জোর খাটে না। কারণ এই সব অনুভূতি। দেহের উপর বেশি নির্ভরশীল। সুতরাং দেহ খারাপ থাকলে কোনও কিছুতেই আনন্দ পাই না।
আমি বললাম, তাহলে সেটা রোগ বলে ধরে নিতে হবে।
লোত্তে বলল, যদি আমার মনে কোনও দুঃখ, বিষাদ বা বিরক্তির ভাব আসে তাহলে আমি বাগানে গিয়ে একা-একাই একটা কোয়াড্রিল নাচ নাচতে থাকি। ফ্রেদারিক আমাদের কথা মনে দিয়ে শুনছিল। তার প্রণয়ীও শুনতে শুনতে একসময় প্রতিবাদের সুরে বলল, মানুষ সব সময় তার আবেগের উপর খরবদারি করতে পারে না।
আমি বললাম, অস্বস্তিকর আবেগের হাত থেকে সবাই মুক্তি পেতে চায়, এই অস্বস্তিকর আবেগের মাত্রা যদি বেড়ে যায় তাহলে সেটা রোগ বলে ধরে নিতে হবে এবং তার প্রতিকারের জন্য ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।