সাগরের তলা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো চোখের সামনে। ভাঙাচোরা, এবড়োথেবড়ো পাকটা ঢাল। যতদূর দৃষ্টি চলে ভাঁজ করা, মোচড় খাওয়া অদ্ভুত আকৃতির পাথর আর পাথর। আমরা একটা লাভা প্রবাহের পাশে নামছি, বললেন প্লাঙ্কেট। কিনারাটা প্রায় মাইল খানেক সামনে। তারপর তিনশো ফুট নেমে গেছে পাঁচিলের গা, নিচে উপত্যকার মেঝে।
আই কপি, জবাব দিলেন জিমি নক্স।
পোকার মত দেখতে, ওই পাথরগুলো কি? জানতে চাইল স্টেসি।
পিলো লাভা, জবাব দিলেন ড. স্যালাজার। গুলো তৈরি হয়েছে জ্বলন্ত লাভা যখন ঠাণ্ডা সাগরে বেরিয়ে আসে। আউটার সেল ঠাণ্ডা হয়ে যায়, আকৃতি পায় টিউবের মতো, ভেতরে সচল থাকে তরল লাভা।
অলটিচুড পজিশনিং সিস্টেম চালু করলেন, প্লাঙ্কেট, ফলে চালের মেঝে থেকে চার মিটার ওপরে থাকবে সাবমারসিবল। উঁচু-নিচু মালভূমির উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে ওরা।
গেট রেডি, বললেন প্লাঙ্কেট। আমরা নিচে নামছি।
কয়েক সেকেন্ড পর সাগরের তলা অদৃশ্য হলো, আবার সামনে দেখা গেল কালো অন্ধকার, নিচের দিকে নাক নামিয়ে আবার শুরু হলো ওল্ড গার্টের পতন, গিরিখাদের খাড়া পাঁচিল থেকে চার মিটার দূরত্ব বজায় রেখে।
আন্ডারওয়াটার ফোন থেকে জিমি নক্সের গলা ভেসে এল। আপনাদেরকে আমি পাঁচ-তিন-ছয়-শূন্য মিটারে পাচ্ছি।
ঠিক আছে, আমার লেখাও তাই বলছে, জবাব দিলেন প্লাঙ্কেট।
আপনারা যেখানে নামছেন, এই উপত্যকার মেঝেতেই রয়েছে ফ্র্যাকচার জোন, জানালেন জিমি নক্স।
বোধহয়, বিড়বিড় করলেন প্লাঙ্কেট, কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। ওল্ড গার্ট-এর নিচটা স্ত্রীনে দেখতে পাচ্ছেন তিনি। •
বারো মিনিট পর সামনে সমতল একটা মেঝে দেখা গেল। এতক্ষণে সিধে হলো সব। গম্বুজের চারদিকে গভীর তলদেশের পদার্থ ঘুরপাক খাচ্ছে, হালকা স্রোতে তুষার কণার মতো দেখতে লাগল। আলো একটা গোলাকার বৃত্ত সৃষ্টি করেছে, ছোট ঢেউ খেলানো বালি দেখা গেল সামনে। বালির বিস্তৃতিটুকু কালি নয়; হাজার হাজার গোল জিনিস, কামানের গোলার মতো, সাগরের তলায় ছড়িয়ে রয়েছে।
ম্যাঙ্গানিজ নডিউল, ব্যাখ্যা করলেন ড. স্যালাজার, যেন ছাত্রকে পড়াচ্ছেন। কিভাবে ওগুলো তৈরি হলো কেউ তা সঠিকভাবে বলতে পারে না, তবে সন্দেহ করা হয় যে হাঙরের দাঁত ও তিমির কানের হাড়ই নাকি দায়ী।
ওগুলোর কোন দাম আছে? জানতে চাইল স্টেসি, ক্যামেরা চালু করল।
ম্যাঙ্গানিজ ছাড়াও ওগুলোতে কিছুটা করে কোবাল্ট, কপার, নিকেল আর জিঙ্ক আছে। আমার ধারণা, ফ্র্যাকচার জোনের কয়েকশো মাইল জুড়ে পড়ে আছে ওগুলো। এক বর্গ কিলোমিটারে যতগুলো আছে, আমার হিসেবে তার দাম হবে আট মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
নডিউল ছড়ানো বালির ওপর দিয়ে নিঃশব্দে এগোচ্ছে ওল্ড গার্ট, কোন দিকে যেতে হবে সে ব্যাপারে প্লাঙ্কেটকে পরামর্শ দিচ্ছেন ড. স্যালাজার। হঠাৎ ওদের পোর্টসাইডে কি যেন একটা চকচক করে উঠল। জিনিসটার দিকে তাড়াতাড়ি সাবমাসিবলকে কাত করলেন প্লাঙ্কেট।
কি দেখছেন? জানতে চাইলেন ড. স্যালাজার, নিজের ইন্সট্রুমেন্ট থেকে মুখ তুলে।
নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ল স্টেসি। এটা বল। তার গলায় অবিশ্বাস ও বিস্ময় প্রকাণ্ড একটা মেটাল বল, সাথে অদ্ভুত টাইপের গোঁজ রয়েছে। আমার ধারণা, দশ ফুট ডায়ামিটারের কম হবে না!
প্লাঙ্কেট মন্তব্য করলেন, নিশ্চয়ই কোন জাহাজ থেকে পড়েছে।
খুব বেশিদিন আগেও নয়, কারণ কোথাও মরচে ধরেনি এখনও বললেন ড. স্যালাজার।
তারপর হঠাৎ করেই সাদা বালির চওড়া একটা বিস্তৃতি দেখতে পেলেন ওঁরা, কোথাও একটা নডিউল নেই। দেখে মনে হলো যেন বিরাট একটা ভ্যাকুম ক্লিনার মাঠের মাঝখানটা পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে।
সোজা ও সরল একটা কিনারা! বিস্ময় প্রকাশ করলেন ড. স্যালাজার। সাগরের তলায় এত লম্বা সোজা ও সরল কিনারা থাকতেই পারে না!
স্টেসির চোখেও পলক পড়ছে না। এত নিখুঁত, এত পরিচ্ছন্ন, এ মানুষের তৈরি না হয়েই যায় না।
মাথা নাড়লেন প্লাঙ্কেট। অসম্ভব, এই গভীরতায় সম্ভয় নয়। দুনিয়ার কোন এঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি সাগরের তলায় মাইনিং অপারেশন চালাবার ক্ষমতা রাখে না।
এমন কোন জিওলজিক্যাল ডিসটার্বান্স-এর কথাও কখনও শুনিনি যার ফলে সীবেড়ে এরকম একটা চমৎকার রাস্তা তৈরি সম্ভব, দৃঢ়কণ্ঠে বললেন ড. স্যালাজার।
প্লাঙ্কেট জানতে চাইলেন, কি ধরনের ইকুইপমেন্ট সাগরের তলা ঝাড় দিতে পারে?
দানব আকৃতির একটা হাইড্রলিক ড্রেজ, পাইপের মধ্যে টেনে নিয়ে সারফেসে ভেসে থাকা একটা বার্জে খালি করবে নডিউলগুলো, বললেন ড. স্যালাজার। কয়েক বছর আগেই ধারণাটা বাতিল হয়ে গেছে।
যেমন মঙ্গলগ্রহে মানুষ পাঠানোর ব্যাপারটাও বাতিল হয়ে গেছে, ওখানে পাঠানোর মতো রকেট এখনও তৈরি করা সম্ভব হয়নি। দানব আকৃতির কোন ড্রেজও আমরা তৈরি করতে পারিনি।
ড. প্লাঙ্কেটের দিকে তাকাল স্টেসি। কোন ধারণা দিতে পারেন, ব্যাপারটা কবে ঘটেছে?
কাঁধ ঝাঁকালেন ড. স্যালাজার। হয়তো গতকাল, হয়তো কয়েক বছর আগে।
কিন্তু কে তাহলে? বিড়বিড় করে জানতে চাইল স্টেসি। এ ধরনের একটা টেকনলজি আবিষ্কার হয়ে থাকলে, কেউ কৃতিত্ব দাবি করেনি কেন?
সাথে সাথে ওঁরা কেউ কিছু বললেন না। আবিষ্কারটা ওদের প্রচলিত বিশ্বাসের ওপর প্রচণ্ড এক আঘাত হেনেছে। চওড়া, পরিচ্ছন্ন বালির বিস্তৃতির দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেন, অজানা একটা ভয়ে শিরশির করেছে গা।