ড্রাগন

০১. ডেনিংস ডেমনস

ড্রাগন – মূল : ক্লাইভ কাসলার
অনুবাদ : মখদুম আহমেদ

উৎসর্গ

এনায়েত নগর

আমি যেতে চাই সবুজ সুন্দরে; যেখানে বহুকাল আগে গিয়েছিলাম আমি।
আমি স্বপ্নহীন, নিরাবেগ, অক্লান্ত, ক্লিব ওই তালগাছটাকে আবারো দেখতে চাই;
দেখতে চাই তার পরিচর্যা-না-করা-ময়লা-সবুজ পাতারা কেমন গাঢ় দেখায়
অন্ধকার রাতে।
আমার জানালা ছুঁয়ে হাত বাড়িয়ে রেখেছিলো সেই পাতারা, যেনো
কবাটের শিক গলে ঢুকতে চাইছিলো ভেতরে।
আশ্রয়ের জন্যে নয়; আমি জানি, এ হীন আশ্রয় তাকে টানে না।
সম্ভবত আমাকে একটু পবিত্র করে দিতে চাইছিলো সে
তার দীর্ঘ পাতার ছোঁয়ায়।
আমি দেখতে চাই সেই চাঁদ; রূপালি-ঘোলাটে চাঁদ,
প্রেমহীন-কামহীন-নিপ্রভ
অথচ
কী সুতীব্র আলোয় আলোয়
আলোয় আলোয় স্নান করে যখন ঘুমন্ত চরাচর,
কেবল আমি জাগবো সেখানে।
দিনের আলোর স্পর্শ বাঁচিয়ে আমি জাগবো মধ্যরাতে,
গাঢ় ছায়ারা যখন খেলা শুরু করে ধনাগোদা নদীর বুকে।

.

.

ডেনিংস ডেমনস্

৬ আগস্ট, ১৯৪৫।
শেমাইয়া আইল্যান্ড, আলাস্কা।

ডেনিংস ডেমনস্
শয়তান তার বাম হাতে একটা বোমা আঁকড়ে ধরে আছে, মুখে বোকা বোকা হাসি। চোখ দুটো আধখানা চাঁদ আকৃতির, ঘন ভুরু, চেহারায় ভাড়সুলভ একটা ভাব এনে দিয়েছে। চিরাচরিত লাল স্যুট পরে আছে শয়তান, ডগার দিকে দ্বিধাবিভক্ত লম্বা লেজ, মাথায় বাঁকা শিং। পা দুটো থাবার মত, একটা সোনালি দাঁড়-এ দাঁড়িয়ে আছে সে, থাবার নখগুলো পেঁচিয়ে ধরেছে দাঁড়টাকে। দাঁড়ের গায়ে লেখা রয়েছে 24K.

ছবিটা একটা বৃত্তের ভেতর, বি-টোয়েনটিনাইন বোমারুর ফিউজিলাজে আঁকা। বৃত্তের ওপর ও নিচে লেখা রয়েছে ডেনিংস ডেমনস।

ভৌতিক একটা নিঃসঙ্গ কাঠামোর মত বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্লেনটা। ওটার নাম রাখা হয়েছে কমান্ডারের নাম অনুসারে এবং তার ক্রুদের কথা মনে রেখে। পোর্টেবল কয়েকটা ফ্লাডলাইটের আলোয় পেটের নিচটা আলোকিত, চকচকে অ্যালুমিনিয়াম কাঠামোর চারপাশে কিম্ভুতকিমাকার ছায়া ফেলছে গ্রাউন্ড ক্রুরা। বৃষ্টি, বেরিং সী থেকে ছুটে আসা জোরাল বাতাস, তার সঙ্গে ঘন ঘন বজ্রপাত পরিবেশটাকে আরও ভৌতিক করে তুলেছে।

স্টারবোর্ড ল্যান্ডিং গিয়ার-এর জোড়া টায়ারের একটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেজর চার্লস ডেনিংস, হাত দুটো লেদার ফ্লাইট জ্যাকেটের পকেটে ঢোকানো, শান্ত ও নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে নিজের চারপাশের কর্মচাঞ্চল্য লক্ষ্য করছে। গোটা এলাকায় সশস্ত্র এমপি ও কে-নাইন সেন্ট্রিদের কড়া পাহারা। ক্যামেরা ক্রুদের ছোট একটা দল রেকর্ড করছে ঘটনাটা। অস্বাভাবিক মোটা বোমাটা দেখে ভয়ে শিরশির করে উঠল তার শরীর, উইঞ্চের সাহায্যে বি-টোয়েনটিনাইনের সংস্কার করা বম্ববেতে ভোলা হচ্ছে ওটা। বোমারুর নিচে ফাঁকা জায়গা বেশি নয়, তার তুলনায় বোমাটা অনেক বড়, সেজন্যে একটা গভীর গর্ত থেকে তোলা হচ্ছে ওটাকে।

ইউরোপে দুবছর বোমারু পাইলট হিসেবে কাজ করেছে ডেনিংস, হামলায় অংশ নিয়েছে চল্লিশবার, কিন্তু এ ধরনের ভয়ঙ্কর জিনিস জীবনে কখনও দেখেনি সে। বোমাটাকে প্রকাণ্ড ফুটবলের মত লাগল তার, এক ধারে বাক্স আকৃতির খোপের ভেতর কয়েকটা ফিন ওটার কাঠামোটাকে আরও যেন বিদঘুটে করে তুলেছে। গোলাকার ব্যালিস্টিক কেসিং হালকা ধূসর রঙ করা, ওটাকে ধরে রাখার জন্যে মাঝখানে ব্যবহার করা হয়েছে কয়েকটা ক্ল্যাম্প, দেখে মনে হবে বিশাল একটা যিপার।

ওটাকে তার তিন হাজার মাইল বয়ে নিয়ে যেতে হবে, ভাবতেই শিউরে উঠল ডেনিংস। লস আলামোসের বিজ্ঞানীরা বোমাটাকে বেঁধেছেদে প্লেনে তোলার কাজ যারা তদারক করছেন, কাল বিকেলে ডেনিংস ও তার ক্রুদের ব্রিফ করেছেন। ট্রিনিটি টেস্ট এক্সপ্লোসন-এর সচল ছবি দেখানো হয়েছে তরুণ ক্রুদের। অবিশ্বাসে দম বন্ধ করে রেখেছিল সবাই। একটা মাত্র বোমার বিস্ফোরণ এমন ব্যাপক ধ্বংসকাণ্ড ঘটায় কিভাবে। একটা পুরো শহর নিশ্চিহ্ন করে দিতে একটা বোমাই যথেষ্ট হয় কি করে।

আরও আধ ঘণ্টা পর বম্ব-বের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আর্মড অর্থাৎ বিস্কোরনের জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছে অ্যাটম বোমাটা, ব্যবস্থা করা হয়েছে নিরাপদে রাখার; ফুয়েল ভরা হয়েছে প্লেনে, টেকঅফ করার জন্যে সম্পূর্ণ তৈরি।

নিজের প্লেনকে দারুন ভালোবাসে ডেনিংস। বাতাসে একবার ডানা মেলতে পারলে এই বিমান আর তার শরীর যেনো এক হয়ে যায়। এ এমন একটা মিলন যা তারপক্ষে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। প্রতিবার মিলিত হবার মুহূর্তে রোমাঞ্চ অনুভব করে সে, অথচ আজ তার ভয় করছে, অজানা আশঙ্কায় কাঁপছে বুকটা।

মন থেকে অশুভ চিন্তা ঝেড়ে ফেলে একটা ঘরের দিকে ছুটল ডেনিংস, ক্রুদের শেষবারের মত ব্রিফ করবে। ভেতরে ঢুকে ক্যাপটেন বম্বারডিয়ার হার্ব স্ট্যানটনের পাশে বসল। গোলগাল আকৃতির হাসিখুশি লোক স্ট্যানটন, দেখার মত চওড়া গোঁফ আছে মুখে।

স্ট্যানটনের আরেক পাশে বসে আছে ক্যাপটেন মর্ট স্টম্প, ডেনিংসের কো পাইলট। হালকা-পাতলা গড়ন তার, একটু চঞ্চল টাইপের। ঠিক তার পিছনে বসে আছে লেফটেন্যান্ট জোসেফ আর্নল্ড, নেভিগেটর। তার পাশে বসেছে নেভী কমান্ডার হ্যাঁঙ্ক বায়ারনেস, উইপনস এঞ্জিনিয়ার। প্লেন চলার সময় বোমার ওপর নজর রাখবে সে, দায়িত্ব পালন করবে মনিটরিং-এর।

ডিসপ্লে বোর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন ইন্টেলিজেন্স অফিসার, বোর্ডে দেখানো হয়েছে টার্গেটের এরিয়াল ফটোগ্রাফ। ওসাকার শিল্পাঞ্চল প্রধান টার্গেট। আকাশে ভারী মেঘ থাকলে টার্গেট বদলে যাবে, বোমাটা তখন ফেলতে হবে ঐতিহাসিক নগরী কাইয়োটায়। দুটো পথই ম্যাপে দেখিয়ে দেয়া হলো। শান্তভাবে নোট নিল ডেনিংস।

আবহাওয়া দফতরের একজন কর্মকর্তা ওয়েদার চার্ট সটলেন বোর্ডে। উল্টোদিক থেকে হালকা বাতাস থাকবে, থাকবে ছড়ানো-ছিটানো মেঘ। উত্তর জাপানের দিকে বাতাসের তীব্রতা সম্পর্কে ডেনিংসকে সতর্ক করে দিলেন তিনি। সাবধানের মার নেই ভেবে একজোড়া বি-টোয়েনটিনাইনকে এক ঘণ্টা আগেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, ফ্লাইট ফুটের ওপরে আবহাওয়ার অবস্থা ও টার্গেট পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, ফ্লাইট রুটের ওপরে আবহাওয়ার অবস্থা ও টার্গেট দুটোর ওপর মেঘের অবস্থা দেখে রিপোর্ট করবে তারা।

পোলারাইজড ওয়েল্ডার গগলস দেয়া হলো সবাইকে। তারপর ক্রুদের সামনে দাঁড়াল ডেনিংস। গা-গরম করা বক্তৃতা আমার আসে না, বলল সে, লক্ষ করল স্বস্তিসূচক নিঃশব্দ হাসি ফুটল তার ক্রুদের মুখে। এক বছরের ট্রেনিং মাত্র এক মাসে সারতে হয়েছে আমাদের, তবে আমি জানি যে এই মিশনে সফল হবার যোগ্যতা আমরা রাখি। কোন রকম গর্ব না করেও বলতে পারি যে এয়ার ফোর্সে তোমরাই সেরা ফ্লাইট ক্রু। আমরা যদি যে যার কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে পারি, এই অভিশপ্ত যুদ্ধটা থামতে পারে। কথা শেষ করে ধর্মযাজকের দিকে তাকাল সে। মিশনের নিরাপত্তা ও সাফল্যের জন্যে প্রার্থনা করেন তিনি।

প্লেনের উদ্দেশে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ক্রুরা, ডেনিংসের সামনে এসে দাঁড়ালেন জেনারেল হারল্ড মরিসন। পাইলটের চোখের চারধারে ক্লান্তির ছাপ, তবে চোখ দুটো উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন জেনারেল। গুড লাক, মেজর।

“থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার। কাজটা আমরা ভালভাবে শেষ করব।

মুহূর্তের জন্যেও সন্দেহ করি না, মরিসন বললেন, চেহারায় জোর করে ফুটিয়ে তুললেন দৃঢ় আত্মবিশ্বাস। পাইলট কিছু বলবে, সেই আশায় অপেক্ষা করে থাকলেন তিনি। কিন্তু ডেনিংস চুপ করে থাকল।

অস্বস্তিকর কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেল। তারপর নিস্তব্ধতা ভাঙল ডেনিংস। আমরা কেন, জেনারেল?”

মরিসনের মুখে হাসি দেখা গেল কি গেল না। তুমি পিছু হটতে চাও, মেজর?

না। কাজটা আমরা করব। কিন্তু দায়িত্বটা আমরা কেন পেলাম? দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করল ডেনিংস। কথাটা বলার জন্যে ক্ষমা করবেন, জেনারেল, তবে এ বিশ্বাস করা কঠিন যে গোটা এয়ার ফোর্সে শুধু আমরাই এ কাজের জন্যে যোগ্য ও বিশ্বস্ত বিবেচিত হয়েছি। প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে আরও অনেক পাইলট প্লেন নিয়ে যাওয়া-আসা করছে, একটা অ্যাটম বোমা বয়ে নিয়ে যাওয়ার মত লোক তাদের মধ্যে নেই? বোমাটা ফেলতে হবে জাপানের মাঝখানে, তারপর ল্যান্ড করতে হবে ওকিনাওয়া-য়, এ-ও তেমন কঠিন কোন কাজ নয়, যদিও ল্যান্ড করার সময় ফুয়েল ট্যাংকে খানিকটা ফেনা ছাড়া আর কিছু থাকার কথা নয়।

এত কথার উত্তরে জেনারেল মরিসন শুধু বললেন, যতটুকু তোমরা জানো তার বেশি না জানাই তোমাদের জন্যে ভাল।

যাতে আমরা ধরা পড়লে টপ সিক্রেট ইনফরমেন ফাঁস করতে না পারি?

গম্ভীর হলেন জেনারেল মরিসন। তুমি ও তোমার ক্রুরা অশুভ পরিণতি সম্পর্কে জানো। তোমাদের প্রত্যেককে একটা করে সায়ানাইড ক্যাপসুল দেয়া হয়েছে। তবে আমি জানি তোমাদের মিশনের শুভ সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে।

বলা হয়েছে, শত্রু এলাকায় প্লেন ক্যাশ করার পর কেউ বেঁচে থাকলে ক্যাপসুলটা গিলে ফেলতে হবে, বলল ডেনিংস। আচ্ছা, বোমাটা সাগরে ফেলে দিলে অসুবিধে কোথায়? তাতে অন্তত নৌ-বাহিনী আমাদেরকে উদ্ধার করার একটা সুযোগ পাবে।

চেহারায় গাম্ভীর্য ও বিষণ্ণতা, মাথা নাড়লেন জেনারেল। অস্ত্রটা শত্রুদের হাতে পড়ার সামান্য সম্ভাবনার কথাও আমরা ভাবতে পারি না।

আচ্ছা, বিড়বিড় করল ডেনিংস। সে জন্যেই আমাদের বিকল্প হলো, জাপানের মেইনল্যান্ডের ওপর আকাশে থাকার সময় আমরা যদি গুলি খাই, যতটা সম্ভব নিচে নেমে বোমাটা ফাটিয়ে দিতে হবে।

মরিসন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। এটা সুইসাইডাল মিশন নয়। তোমার ও তোমার ক্রুদের নিরাপত্তার জন্যে সম্ভাব্য সমস্ত দিক বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আমার ওপর বিশ্বাস রাখো। ওসাকায় “মায়ের নিঃশ্বাস” ফেলা আসলে পানির মত সহজ একটা কাজ।

মুহূর্তের জন্যে হলেও, জেনারেলের কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো ডেনিংসের। কিন্তু তাঁর চোখে বিষণ্ণতার ছায়া দেখে নিজের ভুলটা বুঝতে পারল সে। মায়ের নিশ্বাস, ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল, বেসুরো গলায়, যেন কল্পনাতীত কোন আতঙ্ক তাকে গ্রাস করতে যাচ্ছে। কে সে, বোমাটার এ ধরনের একটা কোড নেম কার মাথা থেকে বেরুল?

সামান্য কাঁধ ঝাঁকিয়ে জেনারেল বললেন, সম্ভবত প্রেসিডেন্টের মাথা থেকে।

.

সাতাশ মিনিট পর উইন্ডস্ক্রীনের সচল ওয়াইপারের দিকে তাকাল ডেনিংস। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে, আবছা ও ভেজা অন্ধকারে মাত্র দুশো গজ সামনে পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে সে। এঞ্জিনগুলোকে দুহাজার দুশো আরপিএম পর্যন্ত তুলল, দুটো পা-ই চেপে রেখেছে ব্রেকের ওপর। ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ার সার্জেন্ট মোসলে রিপোর্ট করল, চার নম্বর আউটবোর্ড এঞ্জিন পঞ্চাশ আরপিএম কম গতিতে কমে থাকার জন্যে, সন্দেহ নেই, ভেজা বাতাসই দায়ী। এটল টেনে এঞ্জিনগুলোকে শান্ত করল সে, তবে সচল রাখল।

কো-পাইলট জানাল, টাওয়ার থেকে টেকঅফের ক্লিয়ার্যান্স পাওয়া গেছে। থ্রাপস নিচু করল সে। ফ্ল্যাপ সেটিং ঠিক আছে, রিপোর্ট করল দুজন ক্রু। হাত বাড়িয়ে ইন্টারকমের সুইচ অন করল ডেনিংস। ওকে, বন্ধুরা, আমরা রওনা হলাম।

থ্রটলটা আবার ধীরে ধীরে সামনে বাড়াল সে। তারপর ব্রেক রিলিজ করল।

প্লেনটার ধারণ ক্ষমতা আটষট্টি টন। সাত হাজার গ্যালন ফুয়েল থাকায় ট্যাংকগুলো কানায় কানায় ভরে আছে। প্লেনের ফরওয়াড়র্প বম্ব-বেতে রয়েছে ছয় টন ওজনের বোমাটা। সব মিলিয়ে ক্রুর সংখ্যা বারো। প্লেন এগোতে শুরু করল। প্রায় সতেরো হাজার পাউন্ড অতিরিক্ত বোঝা বহন করছে।

চারটে রাইট সাইক্লোন এঞ্জিন, প্রতিটি তিন হাজার তিনশো পঞ্চাশ কিউবিক ইঞ্চি। ১৬.৫ ফুট প্রপেলারগুলোকে ঘোরাচ্ছে আট হাজার আটশো বর্স পাওয়ার। বিশাল বোমারুটা সগর্জনে অন্ধকারের ভেতর ছুটল।

আতঙ্ককর অলস একটা ভঙ্গিতে গতি বাড়ছে ওটার। সামনে লম্বা হয়ে আছে রানওয়ে, পাথর কেটে তৈরি করা, শেষ মাথায় কিছু নেই, পাহাড়ের খাড়া গা ঝাঁপ করে নেমে গেছে আশি ফুট নিচের সাগরে। ডান দিক থেকে বাম দিকে ছুটন্ত বিদ্যুতের একটা চোখ ধাঁধানো চমক উজ্জ্বল নীল আলোয় ভাসিয়ে দিল রানওয়ের দুপাশে ফাঁক ফাঁক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ফায়ার ট্রাক ও অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে। প্লেনের গতি এখন আশি নট, হুইলটা শক্ত করে চেপে ধরল ডেনিংস, প্লেনটাকে আকাশে তোলার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

পাইলটদের সামনে, বাইরের দিকে বেরিয়ে থাকা নাকের অংশে বম্বারডিয়ার হার্ব স্ট্যানটন দেখতে পাচ্ছে দ্রুত ছোট হয়ে আসছে রানওয়ে। ছটফটে মর্ট স্টম্প সিট ছেড়ে প্রায় দাঁড়িয়ে পড়ল, অন্ধকার ভেদ করে রানওয়ের কিনারাটা দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করছে সে।

চার ভাগের তিন ভাগ রানওয়ে পিছনে ফেলে এসেছে ওরা। এখনও মাটি কামড়ে রয়েছে প্লেন। সময় যেন আঙুলের ফাঁকগলে বেরিয়ে যাচ্ছে। একই অনুভূতি হলো সবার, ওরা যেন অতল শূন্য গহ্বরে ঢুকে পড়ছে। তারপর রানওয়ের শেষ মাথার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জফগুলোর আলো বৃষ্টির পর্দা ভেদ করে অকসাৎ ঝলসে উঠল।

গড অলমাইটি! গুঙিয়ে উঠল স্ট্রম্প।প্লেনটাকে তোলো!

আরও তিন সেকেন্ড অপেক্ষা করল ডেনিংস, তারপর শান্তভাবে হুইলটাকে নিজের বুকের দিকে টেনে আনল। বি-টোয়েনটিনাইনের চাকা মাটি ছাড়ল। পিছিয়ে পড়ল রানওয়ের কিনারা, মাত্র ত্রিশ ফুট ওপরে উঠে এসেছে প্লেন।

.

রাডার ঘর থেকে বেরিয়ে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন জেনারেল মরিসন, তাঁর। পিছনে স্টাফরাও দাঁড়িয়ে। ডেনিংস ডেমনসের টেকঅফ যতটা না চোখ দিয়ে দেখলেন তিনি তার চেয়ে বেশি দেখলেন কল্পনায় সাহায্যে।

হাত দিয়ে কান ঢেকে এঞ্জিনের আওয়াজ শুনলেন মরিসন, অন্ধকারের ভেতর দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। শব্দে একটা ছন্দপতন ঘটছে, তবে তা খুবই অস্পষ্ট। অভিজ্ঞ ফ্লাইট মেকানিক বা একজন এয়ারক্রাফট এঞ্জিনিয়ার ছাড়া আর কেউ ধরতে পারবে না। সামরিক জীবনের শুরুতে এই দুই পেশাতেই দক্ষতা অর্জন করেছেন জেনারেল।

একটা এঞ্জিন সামান্য বেসুরো আওয়াজ করছে। আঠারোটার মধ্যে এক বা একাধিক সিলিন্ডার ঠিকমত কাজ করছে না। মনে আতঙ্ক, কান পেতে থাকলেন। জেনারেল, এমন একটা লক্ষণ পেতে চাইছেন যা থেকে বোঝা যাবে প্লেনটা টেকআপ করবে না। টেকআপ করার সময় ডেনিংস ডেমনস বিধ্বস্ত হলে দ্বীপটার সমস্ত কিছু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ছারখার হয়ে যাবে।

তারপর রাডার ঘরের দরজা থেকে অপারেটর চিৎকার করে বলল, আকাশে উঠে গেছে।

নিঃশ্বাস ফেলার সময় থরথর করে কেঁপে উঠল জেনারেলের শরীর। ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি, ফিরে যাচ্ছেন ঘরে। এখন আর তার কিছু করার নেই, ওয়াশিংটনে জেনারেল গ্রোভসকে শুধু একটা মেসেজ পাঠাতে হবে, জানাতে হবে যে মায়ের নিঃশ্বাস জাপানের পথে রওনা হয়ে গেছে। সবাইকে এখন অপেক্ষা করতে হবে। থাকতে হবে ভয় মেশানো আশা নিয়ে।

জেনারেল মরিসন ঘরের ভেতর পায়চারি শুরু করলেন। ডেনিংসকে তিনি চেনেন। জেদি লোক, একটা এঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দিলে ফিরবে না সে। পিঠে করে বয়ে নিয়ে যেতে হলেও ডেমনসকে ওসাকায় নিয়ে যাবে।

ঈশ্বর সাহায্য কর, বিড়বিড় করলেন জেনারেল, যদিও জানে যে এই অপারেশনে তার যে ভূমিকা, ঈশ্বর তাঁর প্রার্থনা কবুল করবেন না।

গিয়ার আপ, নির্দেশ দিল মেজর ডেনিংস।

শব্দগুলো শুনে আগে কখনও এত আনন্দ লাগেনি, বলে লিভারটা সরাল স্ট্রম্প। গিয়ার মটর গুঞ্জন তুলল, তিন সেট চাকা ঢুকে পড়ল নাক আর ডানার নিচে খোপের ভেতর। গিয়ার আপ অ্যান্ড লক।

এয়ারস্পীড বাড়ল, ফুয়েল বাঁচানোর জন্যে থ্রটল সেটিং নামিয়ে আনল ডেনিংস। এয়ারস্পীড দুশো নটে পৌঁছল, এবার ধীরে ধীরে আকসামের আরও ওপরে তুলল প্লেনটাকে। স্টারবোর্ডের দিকে রয়েছে অ্যালুসিয়ান দ্বীপমালা, যদিও দেখা যাচ্ছে না। আড়াই হাজার মাইলের মধ্যে আর কোন মাটিই ওরা দেখতে পাবে না। চার নম্বর এঞ্জিনের খবর কি? জানতে চাইল সে।

নিজের দায়িত্ব ঠিকমতই পালন করছে, তবে একটু বেশি গরম বলে মনে হচ্ছে, জবাব দিল মোসলে।

পাঁচ হাজার ফুটে উঠি, ওটার কিছু আরপিএম কমিয়ে আনব।

ক্ষতি নেই, মেজর, মন্তব্য করল এঞ্জিনিয়ার মোসলে।

ডেনিংসকে একটা কোর্স জানাল আরনল্ড, নেভিগেটর। এই কোর্স ধরে আগামী সাড়ে দশ ঘণ্টা ছুটবে প্লেনটা। চার হাজার নয়শো ফুটে উঠে কো-পাইলটের হাতে কন্ট্রোল ছেড়ে দিল ডেনিংস। সীটে হেলান দিয়ে পেশী শিথিল করল সে, কালো আকাশের দিকে তাকাল। কোথাও একটা তারা নেই। ঘন মেঘের ভেতর দিয়ে ছুটছে ওরা। প্লেন ঝাঁকি খাচ্ছে দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে বাতাসের দাপট ক্রমশ বাড়ছে।

ঝড়ের প্রবল মারমুখী অংশটা থেকে বেরিয়ে এল প্লেন, এতক্ষণে সেফটি বেল্ট খুলে সিট থেকে উঠল ডেনিংস। শরীরটা মুচড়ে ঘুরল সে, পোর্টসাইডের একটা জানালা দিয়ে প্লেনের কোমর ও লেজের দিকটা দেখতে পেল। রিলিজ মেকানিজমে ঝুলন্ত বোমাটার অংশবিশেষ চোখে পড়ে গেল তার।

টানেলে ঢুকে বম্ব-বেকে পাশ কাটাল ডেনিংস, অপরদিকে পৌঁছে লাফ দিয়ে নিচে নামল। ছোট্ট, এয়ারটাইট দরজা খুলে ঢুকে পড়ল ভেতরে। লেগ পকেট থেকে টর্চলাইট বের করে জ্বালল, ক্যাটওয়াক ধরে হাঁটছে। দুটো বম্ববে জোড়া লাগিয়ে এক করা হয়েছে, ক্যাটওয়াকটা তারই ওপর। দাঁড়াল সে, এক সেকেন্ড ইতস্তত করে বোমাটায় হাত রাখল। আঙুলের ডগায় ইস্পাতের গা বরফের মত ঠাণ্ডা। মাত্র এক সেকেন্ডের মধ্যে লাখ লাখ মানুষকে ছাই করতে পারে এই বোমা? বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো তার। শুধু তাই নয়, পরবর্তী সেকেন্ডগুলোয় মারা পড়বে আরও লাখ লাখ মানুষ হয় পুড়ে, নয়তো রেডিওশেনে আক্রান্ত হয়ে। সাদা-কালো মুভি ফিল্মে ট্রিনিটি টেস্ট দেখলেও, শক ওয়েভের থার্মোনিউক্লিয়ার টেমপারেচার অনুভব করা সম্ভব নয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডেনিংস ভাবল, আমি কোন অপরাধ করছি না কারণ আমি চাই যুদ্ধটা বন্ধ হোক, চাই নিজের দেশের লাখ লাখ মানুষকে বাঁচাতে।

ককপিটে ফিরে এসে বায়ারনেসের সঙ্গে গল্প শুরু করল সে। বোমার ডিটোনেশন সার্কিট দেখছে বায়ারনেস, হাতে একটা ছক কাটা নকশা। মাঝে মধ্যেই সামনে রাখা ঘোট কনসোল-এর দিকে মুখ তুলে তাকাচ্ছে অর্ডন্যান্স এক্সপার্ট।

ওখানে পৌঁছানোর আগেই ফেটে যেতে পারে, এমন কোন সম্ভাবনা আছে নাকি? জানতে চাইল ডেনিংস।

বাজ পড়লে ফাটতে পারে, জবাব দিল বায়ারনেস।

আঁতকে ওঠে তার দিকে তাকাল ডেনিংস। কথাটা অনেক দেরি করে বলছ, নয় কি? সেই মাঝ রাত থেকে একটা বিদ্যুৎ বহুল ঝড়ের ভেতর রয়েছি আমরা।

মুখ তুলে নিঃশব্দে হাসল বায়ারনেস। বাজ তো আঘাত করতে পারত আমরা যখন মাটিতে ছিলাম তখনও। কি আসে যায়, আমরা তো প্রায় পৌঁছে গেছি, তাই না?

সবার চেয়ে ভালভাবে জানেন। তিনি তো অ্যাটমিক বম্ব প্রজেক্টে শুরু থেকেই জড়িত।

শিউরে উঠল ডেনিংস, ঘুরে দাঁড়াল। এ স্রেফ পাগলামি, ভাবল সে। গোটা অপারেশনটাই আসলে পাগলামি। এই পাগলামির কথা বলার জন্যে ওরা যদি কেউ বেঁচে থাকে, সেটা হবে নেহাতই মিরাকল।

.

ইতোমধ্যে চাচ ঘণ্টা উড়ে ২০০০ হাজার গ্যালন ফুয়েল খরচ করেছে প্লেনটা। বি টোয়েনটিনাইনকে ১০০০০ ফুটে সিধে করল ডেনিংস। পুবের আকাশে ভোরে ম্লান আলো ফুটতে ক্রুরা একটু নড়েচড়ে বসল। ঝড়টা ওদের অনেক পিছনে রয়েছে, ছড়ানো-ছিটানো সাদা মেঘের নিচে উত্তাল সাগর দেখতে পাচ্ছে ওরা।

অলস ভঙ্গিতে, ২২০ নটে, দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে যাচ্ছে ডেনিংস ডেমনস। লেজে হালকা একটু বাতাস পাচ্ছে ওরা, সেজন্যে খুশি সবাই। দিনের আলো ফোঁটার পর উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল শূন্যতা দেখতে পেল ওরা। মনে হলো গোটা পৃথিবীতে, সাগর আকাশের মাঝখানে, একা শুধু তারাই আছে।

জাপানের প্রধান দ্বীপ, হনশু থেকে তিনশো মাইল দূরে এসে ধীরভঙ্গিতে আকাশের আরও ওপরে উঠতে শুরু করল ডেনিংস। ৩২০০০ ফুটে উঠে যাবে সে। ওসাকায় পৌঁছে এই উচ্চতা থেকেই বোমাটা ফেলবে হার্ব স্ট্যানটন। নেভিগেটর আরনল্ড জানাল, নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে বিশ মিনিট এগিয়ে আছে তারা। বর্তমান গতিবেগের হিসেবে এখন থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর ওকিনাওয়ায় ল্যান্ড করবে প্লেন।

ফুয়েল গজের দিকে তাকাল ডেনিংস। হঠাৎ খুশি হয়ে উঠল মনটা। বাতাস অনুকূল থাকায় চারশো গ্যালন ফুয়েল অবশিষ্ট থাকতেই গন্তব্যে পৌঁছে যাবে ওরা।

সবাই তার মত খুশি নয়। এঞ্জিনিয়ারের প্যানেলের সামনে বসে চার নম্বর এঞ্জিনের টেমপারেচার গজ পরীক্ষা করছে মোসলে। প্রতি মুহূর্তে আরো গম্ভীর হয়ে উঠছে তার চেহারা। নিয়মিত টোকা দিয়ে যাচ্ছে সে।

লার ঘরে পৌঁছে থরথর করে কাঁপছে কাঁটাটা। টানেল দিয়ে ক্রল করে সামনে এগোল মোসলে, একটা পোর্ট দিয়ে এঞ্জিনের তলায় তাকাল। এঞ্জিনের বহিরাবরণ তেলে ভিজে আছে, ধোঁয়া বেরুচ্ছে এগজস্ট থেকে। ককপিটে ফিরে এসে পাইলট ও কো-পাইলটের মাঝখানে হাঁটু গেড়ে উঁচু হলো সে। খবর খারাপ, মেজর, বলল সে। চার নম্বর এঞ্জিন বন্ধ করতে হবে।

আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা ওটাকে চালু রাখা যায় না? জানতে চাইল ডেনিংস।

না, স্যার একটা ভালব গিলে ফেলতে পারে, যে-কোন মুহূর্তে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে।

আমিও বলি, কিছুক্ষণ বন্ধ রেখে চার নম্বরকে ঠান্ডা করা হোক, বলল কো পাইলট স্ট্রম্প।

দ্রুত একটা হিসাব করল ডেনিংস। এই মুহূর্তে ১২০০০ ফুটে রয়েছে ওরা। ওভারহিটিং হবার আশঙ্কা আছে, কাজেই তিনটে সচল এঞ্জিন নিয়ে আরও ওপরে ওঠা উচিত হবে না। চার নম্বর ঠাণ্ডা হোক, আবার ওটা চালু করা হবে ৩২০০০ ফুটে ওঠার সময়। গ্যাবনের দৃষ্টি আকর্ষণ করল সে। নেভিগেটর আরনল্ড বোর্ডের দিকে ঝুঁকে ফ্লাইট পাথ ট্রেস করছে। ডেনিংস জানতে চাইল, জাপান আর কত দূরে?

গতি সামান্য কমেছে, সেঁটা টুকে নিয়ে দ্রুত একটা হিসাব করল আরনল্ড, জানাল, মেইনল্যান্ডে পৌঁছতে লাগবে এক ঘণ্টা একশ মিনিট।

মাথা ঝাঁকাল ডেনিংস। ঠিক আছে, আপাতত আমরা চার নম্বর বন্ধ করে দেব।

পাইলটের কথা শেষ হয়নি, তার আগেই এটল বন্ধ করে ইগনিশন সুইচ অফ করে দিল স্ট্রম্প, তারপর এনগেজ করল অটোমেটিক পাইলট।

পরবর্তী আধঘণ্টা সবাই সতর্ক একটা চোখ রাখল চার নম্বরের ওপর। টেমপারেচার কমছে, একটু পরপরই ওদেরকে জানাল মোসলে।

মাটি দেখতে পাচ্ছি, এক সময় বলল আরনল্ড। নাক বরাবর বিশ মাইল সামনে একটা দ্বীপ।

চোখে দূরবীন তুলে তাকাল স্ট্রম্প। যেন সাগর ফুড়ে বেরিয়ে আছে একটা স্যান্ডউইচ।

আরনল্ড বলল, খাড়া পাথুরে পাঁচিল। কোথাও সৈকত দেখা যাচ্ছে না।

কি নাম দ্বীপটার? জানতে চাইল ডেনিংস।

ম্যাপে ওটা নেই।

প্রাণের কোন চিহ্ন দেখতে পাচ্ছ? জাপানিরা হয়তো অফ-শোর ওয়ার্নিং স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করছে।

উঁহু, দেখে মনে হচ্ছে একদম ফাঁকা ও নির্জন।

আপাতত নিরাপদ বোধ করল ডেনিংস। এখন পর্যন্ত শত্রুপক্ষের কোন জাহাজ চোখে পরেনি। জাপানি তীর থেকে অনেক দূরে রয়েছে ওরা, শত্রুদের কোন ফাইটার এতটা দূরে বাধা দিতে আসবে না। নিজের সীটে বসে সাগরের দিকে তাকিয়ে থাকল সে।

কফি আর স্যান্ডউটচ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল সবাই। খুদে একটা বিন্দুর অস্তিত্ব। সম্পর্কে কেউই সচেতন নয়। ওদের পোর্টউইং-এর ডগা থেকে সাত হাজার ফুট ওপরে ওটা। দশ মাইল দূরে।

ডেনিংস ডেমনরা জানে না, আর মাত্র কয়েক মিনিট বেঁচে আছে ওরা।

.

লেফটেন্যান্ট জুনিয়র গ্রেড সাতো ওকিনাগা তার অনেক নিচে মুহূর্তের জন্যে কি যেন একটা ঝিক করে উঠতে দেখেছে। আকাশে কিছু ঝিক করে উঠতে পারে শুধু রোদ লাগলে, কাজেই আরও কাছ থেকে দেখা দরকার জিনিসটা কি। ডাইভ দিল সে। সন্দেহ নেই, ওটা একটা প্লেন। সম্ভবত অন্য কোন পেট্রল-এর প্লেন। রেডিও অন করার জন্যে হাত বাহিরেও থেকে গেল সে। আর কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে দেখলে ক্ষতি নেই। রেডিও অন করার আগে প্লেনটা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া দরকার।

তরুণ ও অনভিজ্ঞ পাইলট হলেও, সাতো ওকিনাগা ভাগ্যবান বটে। তাদের ব্যাচে বাইশজন ছাত্র ছিল, ট্রেনিং শেষ করার পর তিনজন বাদে বাকি সবাইকে পাঠানো হয়েছে সুইসাইড স্কোয়াড্রনে। ওদের তিনজনকে উপকূল পাহারা দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

এ ধরনের প্রায় ঝুঁকিবিহীন দায়িত্ব পেয়ে দারুণ হতাশ হয়েছে ওকিনাগা। সম্রাটের জন্যে প্রাণ বিসর্জন দেয়ার একটা ব্যাকুলতা ছিল তার মধ্যে। কিন্তু হুকুম হুকুমই, তার ওপর কথা চলে না। আপাতত এই একঘেয়েমিতে ভরা দায়িত্ব পালন করলেও, তার আশা কিছুদিনের মধ্যে আরও বড় কোন কাজের জন্যে ডাকা হবে তাকে।

নিঃসঙ্গ প্লেনটা ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে আকারে, সেই সঙ্গে অবিশ্বাসে বড় হচ্ছে ওকিনাগার চোখ দুটো। ভুল দেখছে নাকি? চোখ রগড়াল সে। একটু পরই পালিশ করা ৯০ ফুট অ্যালুমিনিয়াম ফিউজিলাজ, বিশাল ১৪১ ফুট ডানা, তিনতলা বিশিষ্ট খাড়া স্ট্যাবিলাইজার চিনতে পারল সে। ওটা একটা আমেরিকান বি টোয়েনটিনাইন, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল সে। উত্তর পূর্বে দিকের খালি একটা সাগর থেকে উড়ে আসছে প্লেনটা, কমব্যাট সিলিঙের ২০০০ ফুট নিচ দিয়ে। উত্তরবিহীন প্রশ্নগুলো ভিড় করল তার মনে। কোত্থেকে এল ওটা? একটা এঞ্জিন বন্ধ রেখে কেন ওটা মধ্য জাপানের দিকে যাচ্ছে? ওটার মিশন কি হতে পারে?

অযথা সময় নষ্ট করা উচিত হবে না তার। বিশাল ডানাসহ বোমারুটা সামনে ঝুলে রয়েছে। মিতসুবিশি এসিক্স এম, জিরো প্লেনটার থ্রটল বিরতিগুলোয় না থামিয়ে টানল সে, বৃত্ত রচনার সঙ্গে সঙ্গে ডাইভ দিল নিচের দিকে।

ফাইটারটাকে দেরিতে দেখতে পেল গানার, যদিও দেখার সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার করল সে। দেরি করল না ওকিনাগাও, জিরোর দুটো মেশিনগান ও একজোড়া টোয়েনটি মিলিমিটার কামান গর্জে উঠল।

ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ও মানুষের মাংস দলা পাকিয়ে একাকার হয়ে গেল। জিরোর ট্রেসারগুলো ডানা ভেঙে ভেতরে ঢুকল, বি-টোয়েনটিনাইনের তিন নম্বর এঞ্জিনটাকে আঘাত করল। একাধিক গর্ত থেকে হড়হড় করে বেরিয়ে এল ফুয়েল। তারপরই আগুন ধরে গেল এঞ্জিনটায়। মুহূর্তের জন্যে শূন্যে ইতস্তত করল বোমারু, তারপর চিৎ হয়ে গেল, ডিগবাজি খেতে খেতে নামতে শুরু করল সাগরে। লেফটেন্যান্ট ওকিনাগা একটা ডানার ওপর খাড়া করল জিরোকে। আহত বি টোয়েনটিনাইনকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে। কালো ধোয়া আর কলা শিখা মোচড় থেকে খেতে উঠে আসছে আকাশে। প্লেনটাকে সাগরে পড়তে দেখল সে, লাফ দিয়ে উঠল সাদা পানি।

আরও কিছুক্ষণ চক্কর দিল সে, কেউ বেঁচে আছে কিনা জানতে চায়। আবর্জনা ছাড়া কিছুই তার চোখে পড়ল ন। উল্লাসে অধীর হয়ে আছে ওকিনাগা, ফাইটার পাইলট হিসেবে এটাই তার প্রথম সাফল্য। ধোয়ার দিকে শেষ একবার তাকিয়ে নিজের এয়ারপোর্টের দিকে ফিরে চলল সে। রিপোর্ট করতে হবে।

.

ডেনিংসের বিধ্বস্ত প্লেন যখন এক হাজার ফুট পানির নিচে সাগরের তলায় স্থির। হচ্ছে, অপর একটা বি-টোয়েনটিনাইন অন্য এক টাইম জোন-এ ছয়শো মাইল দক্ষিণ পূর্বে; একই ধরনের একটা বোমা নিয়ে চুটে চলেছে কর্নেল পল টিবেটস রয়েছে কন্ট্রোলে, তার এনোপলা গে জাপানি শহর হিরোশিমার ওপর পোঁছে গেছে।

ডেনিংস ও টিবেটস, দুজন কমান্ডার কেউই পরস্পরের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন নয়। দুজনেরই ধারণা, শুধু তার প্লেন ও তার ক্রুরাই যুদ্ধ থামানোর জন্যে দুনিয়ার বুকে প্রথম অ্যাটম বোমা ফেলতে যাচ্ছে।

ডেনিংস ডেমনস তার গন্তব্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলো। সাগরের তলায় এক সময় স্থির হয়ে গেল বিধ্বস্ত প্লেনটা। ঘটনাটার কথা দুনিয়ার লোককে জানানো হলো না। গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে সমস্ত তথ্য চেপে যাওয়া হলো।

.

প্রথম পর্ব

বিগ জন্

৩ অক্টোবর, ১৯৯১,
পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর।

০১.

প্রচণ্ড টাইফুন থেমে গেছে। সাগরের সেই উন্মত্ততা এখন আর নেই, তবে ঢেউগুলো এখনও জাহাজের বো-র নাগাল পেতে চাইছে, মাঝে মধ্যেই লাফ দিয়ে উঠে পড়ছে ডেকে, পিছনে রেখে যাচ্ছে একরাশ সাদা ফেনা। ঘন কালো মেঘে ভাঙন ধরল, বাতাসের তেজ কমে দাঁড়াল ত্রিশ নটে। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে একটা সুড়ঙ্গের মত খাড়া হয়ে নিচে নামল রোদ, ফুলে-ফেঁপে থাকা ঢেউগুলোর ওপর এঁকে দিল নীল একটা বৃত্ত।

নরওয়ের রিনডাল লাইনস্ প্যাসেঞ্জার-কার্গো লাইনার নারভিকের ডেকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ক্যাপটেন আর্নি কোরভোল্ড, চোখে দূরবীন, ঢেউ ও সাদা ফেনার মাথায় নৃত্যরত বিশাল একটা জাহাজের ওপর চোখ বুলাচ্ছেন। চেহারা দেখে মনে হলো, ওটা একটা জাপানি অটো ক্যারিয়ার ব্রিজ আর আপার ডেকে ক্রুদের কোয়ার্টার ছাড়া আর কোথাও কোন পোর্ট বা জানালা নেই।

জাহাজটা দশ ডিগ্রির মত কাত হয়ে আছে, ঢেউয়ের ধাক্কায় সেটার মাত্র দাঁড়াচ্ছে বিশ ডিগ্রি। চিমনি থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে, জীবনের চিহ্ন বলতে ওইটুকুই। একটা লাইফবোটও দেখা যাচ্ছে না, তার মানে নামানো হয়েছে ওগুলো। গম্ভীর হয়ে উঠল ক্যাপটেন কোরভোন্ডের চেহারা। অশান্ত সাগরের কোথাও কোন লাইফবোটের চিহ্নমাত্র নেই। দূরবীন ঘুরিয়ে জাহাজটার নাম আরেকবার পড়লেন তিনি। জাপানিরা সাধারণত ইংলিশ নাম রাখে তাদের জাহাজের, এটাও তার ব্যতিক্রম নয়।

জাহাজটার নাম ডিভাইন স্টার।

বাতাস ও পানির ঝাপটা থেকে সেন্টাল ব্রিজে ফিরে এলেন কোরভোল্ড, কমিউনিকেশন রূমে উঁকি দিয়ে জানতে চাইলেন, এখনও কোন সাড়া নেই?

মাথা নাড়ল রেডিও অপারেটর। না, স্যার। আমরা ওটাকে দেখার পর থেকে ওরা কোন শব্দই করছে না। ওটার রেডিও নিশ্চয়ই বন্ধ করে রাখা হয়েছে। কোন সাহায্য না চেয়ে জাহাজ খালি করে চলে গেছে সবাই, এ অবিশ্বাস্য।

ব্রিজের জানালা দিয়ে নিঃশব্দে জাপানি জাহাজটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন ক্যাপটেন কোরভোল্ড, নারভিকের স্টারবোর্ড রেইল থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে ওটা। নরওয়েতে জন্ম, ক্যাপটেন কোরভোন্ড অত্যন্ত ধীরস্থির প্রকৃতির মানুষ, তাড়াহুড়া করে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া তার স্বভাব নয়। ছাব্বিশ বছর সাগরে আছেন তিনি, প্যাসেঞ্জার ও ক্রুরা তাকে সম্মান করে। কাঁচা-পাকা ছোট দাড়িতে হাত বুলালেন তিনি, চিন্তা করছেন। কোরিয়া থেকে সান ফ্রান্সিসকোয় যাচ্ছে নারভিক, ঝড়ের মধ্যে পড়ে শিডিউল থেকে পিছিয়ে পড়েছে দুদিন। গত আটচল্লিশ ঘণ্টা ব্রিজ থেকে নড়েননি ক্যাপটেন, প্রচণ্ড ক্লান্তি অনুভব করছেন। পরিবেশ একটু ভাল হয়ে আসার পর ভাবছিলেন এবার একটু বিশ্রাম নেয়া যেতে পারে, ঠিক এই সময় ডিভাইন স্টারকে দেখতে পেয়েছেন তারা।

ডিভাইন স্টারের লাইফবোটগুলোকে এখন খুঁজতে হবে। এটা আসলে মানবিক একটা দায়িত্ব, এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। আবার, নিজের প্যাসেঞ্জারদের কথাও ভাবতে হবে তাঁকে সবাই তারা সী সিকনেসে ভুগছে। কোন উদ্ধার অপারেশনে তারা উৎসাহি হবে বলে মনে হয় না।

ওটায় এটা বোর্ডিং পার্টি পাঠাবার অনুমতি দেবেন, ক্যাপটেন?

চীফ অফিসার অসকার স্টিন-এর দিকে তাকালেন ক্যাপটেন। হালকা-পাতলা গড়ন চীফ অফিসারের, নীল চোখে বৃদ্ধির দীপ্তি। সঙ্গে সঙ্গে জবাব না দিয়ে ব্রিজের একটা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন কোরভোন্ড, দুই জাহাজের মাঝখানে ঢেউগুলোর দিকে তাকালেন। একেকটা ঢেউ তিন থেকে চার মিটার উঁচু। আমি কোন ঝুঁকি নিতে চাইনি, অসকার। এসো, বরং আরও খানিকটা অপেক্ষা করি, সাগর আগে শান্ত হোক।

এর চেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে বোট নিয়ে পানিতে নেমেছি আমরা, ক্যাপটেন, মনে করিয়ে দিলেন চীফ অফিসার।

তাড়াহুড়োর কি আছে। ওটা তো একটা মরা জাহাজ, মর্গে পড়ে থাকা লাশের মত। দেখে মনে হচ্ছে ওটার কার্গো কাত হয়ে পড়ছে, পানিও ঢুকছে। ওটাকে বাদ দিয়ে আমাদের উচিত লাইফবোটগুলোর খোঁজ করা।

ওখানে আহত মানুষ থাকতে পারে, যুক্তি দেখালেন চীফ অফিসার।

মাথা নাড়লেন কোরভোল্ট। জাহাজ খালি করার সময় কোন ক্যাপটেন তার আহত ক্রুদের ফেলে যাবে না।

হ্যাঁ, যদি তার মাথার ঠিক থাকে। কিন্তু ভেবে দেখুন, ঘণ্টায় পঁয়ষট্টি নট ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে কোন ডিসট্রেস সিগন্যাল না দিয়ে অক্ষত একটা জাহাজ থেকে বোটে করে যাকে পালাতে হয়, তার কি মাথা ঠিক থাকার কথা?

হ্যাঁ, একটা রহস্য বটে একমত হলেন কোরভোল্ড।

ওটার কার্গোর কথাও বিবেচনা করতে হবে, বললেন চীফ অফিসার অসকার স্টিন। ওয়াটার লাইন বলে দিচ্ছে, জাহাজটা পুরোপুরি লোড করা। দেখে মনে হচ্ছে সাত জাহাজের বেশি বইতে পারে ওটা।

চোখ কুঁজকে চীফ অফিসারের দিকে তাকালেন ক্যাপটেন। তুমি স্যালভেজ এর কথা ভাবছ, অসকার?

জ্বী, স্যার, ভাবছি। আমরা যদি কার্গোসহ জাহাজটাকে কোন বন্দরে নিয়ে যেতে পারি, ওটার দামের অর্ধেক হবে আমাদের স্যালভেজ ক্লেইম। কোম্পানি ও কুরা ভাগ করে নিতে পারে ছয়শো মিলিয়ন ক্রোনার।

কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলেন ক্যাপটেন কোরভোল্ড। লোভ ও অজানা একটা ভয়, দুটোর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলো। জিতল লোভই। ঠিক আছে, বোর্ডিং ক্রু বেছে নাও, সাথে যেন অ্যাসিস্ট্যান্ট এঞ্জিনিয়ার থাকে। ফানেলে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে, তার মানে ওটার মেশিনারি কাজ করছে বলেই মনে হয়। একটু বিরতি নিয়ে বললেন, তবে পানি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই ভাল বলে মনে করি আমি।

অত সময় আমরা পাব না, চীফ অফিসার বললেন। আর একটু বেশি কাত হলে ডুবে যাবে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ক্যাপটেন কোরভোন্ড। শুভবুদ্ধির বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি, তবে এ-কথাও তাঁর মনে হলো যে ডিভাইন স্টারের অবস্থা একবার প্রচার হলে হাজার মাইলের মধ্যে প্রতিটি স্যালভেজ টাগ ফুলস্পীড়ে ছুটে আসবে। অবশেষে কাঁধ ঝাঁকালেন তিনি। গিয়ে যদি দেখো যে জাহাজে কেউ নেই, এবং ওটাকে চালানো যাবে, সাথে সাথে রিপোর্ট করবে আমাকে, লাইফবোটগুলোর খোঁজে সার্চ শুরু করব আমি।

ক্যাপটেন তার কথা শেষ করেননি, তার আগেই ব্রিজ থেকে বেরিয়ে গেলেন চীফ অফিসার অসকার স্টিন। দশ মিনিটের মধ্যে বোটে লোক নামালেন তিনি। বোর্ডিং পার্টিতে নিজে তো থাকলেই চারজন সীম্যানকেও নেয়া হলো, আরও থাকল অ্যাসিস্ট্যান্ট চীফ এঞ্জিনিয়ার ওলাফ এন্ডারসন; কমিউনিকেশন অপারেটর ডেভিড সাকাগাওয়া, নারভিকয় একমাত্র সেই জাপানি ভাষা বলতে পারে। সীম্যান চারজন জাহাজটায় তল্লাশি চালাবে, ওলাফ এন্ডারসন পরীক্ষা করতে এঞ্জিনরুম। চীফ অফিসার অসকার আনুষ্ঠানিকভাবে অটো ক্রারিয়ারে দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন, যদি ওটা খালি অবস্থায় পাওয়া যায়।

হেলমে থাকলেন অসকার নিজে, লঞ্চটা অশান্ত পানি কেটে এগিয়ে চলল। প্রতিবার ঢেউয়ের মাথা থেকে নামার সময় মনে হলো, এবার বুঝি তলিয়ে যাবে লঞ্জ, যদিও পরবর্তী ঢেউ এসে আবার সেটাকে তুলে নিল মাথার ওপর।

ডিভাইন স্টার থেকে একশো মিটার দূরে এসে জানতে পারল, আশপাশে ওরা একা নয়। কাত হয়ে পড়া জাহাজটাকে ঘিরে একদল হাঙর চক্কর মারছে। হিংস্র প্রাণীগুলো কিভাবে যেন বুঝতে পেরেছে জাহাজাটা ডুবে যাবে, আর ডুবে গেলে মুখরোচক কিছু খাদ্য পাওয়া গেলেও যেতে পারে।

ডিভাইন স্টারের বো একবার উঁচু, একবার নিচু হচ্ছে। অনেক কষ্টে অ্যালুমিনিয়াম এ্যাপলিং হুকসহ একটা লাইলন বোডিং ল্যাডার বোর একপাশে, রেইলিঙে আটকানো গেল, তিনবার চেষ্টা করার পর। রশির মই বেয়ে প্রথমে উঠে গেলেন চীফ অফিসার অসকার। তার পিছু নিল এন্ডারসন ও বাকি সবাই। প্রকাণ্ড অ্যাঙ্কল উইঞ্চ-এর সামনে জড়ো হল সবাই, ওদেরকে নিয়ে একটা সিঁড়ির দিকে এগোলেন অসকার, সিঁড়িটা দেখতে অনেকটা আয়ার এস্কেপ-এর মত জানালাবিহীন ফরওয়ার্ড বাঙ্কহেডের গায়ে লেগে আছে। পাঁচ ডেক ওপরে ওঠার পর বিরাট একটা ব্রিজে এসে ডুকলেন অসকার, পনেরো বছর সাগরে থাকা সত্ত্বেও এত বড় ব্রিজ আগে কখনও দেখেননি তিনি। মাঝখানে, ছোট একটা জায়গায়, এক গাদা অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক ইকুইপমেন্ট সাজানো রয়েছে।

ভেতরে কোন মানুষ নেই, তবে চার্ট, সেক্সট্যান্ট, অন্যান্য নেভিগেশনাল ইকুইপমেন্ট চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। বুঝতে অসুবিধে হয় না, খোলা কেবিনেট-এর ভেতর থেকে বের করা হয়েছে ওগুলো। একটা কাউন্টারে দুটো খোলা ব্রীফকেস পড়ে রয়েছে, ওগুলোর মালিক যেন কিছুক্ষণের জন্যে বাইরে গেছে, যে-কোন মুহূর্তে ফিরে আসবে। সবাই যে খুব আতঙ্কিত অবস্থায় পালিয়েছে, বোঝ যায়।

মেইন কনসোলটা পরীক্ষা করলেন অসকার। জাহাজটা পুরোপুরি অটোমেটেড, এন্ডারসনকে বললেন তিনি।

এঞ্জিনিয়ারের চোখে মুগ্ধ দৃষ্টি। ওয়ান্ডারফুল। ভয়েস অপারেটেড কন্ট্রোল। কোন লিবার ধরে টানা-হেঁচড়া করতে হয় না, হেলমসম্যানকে দিতে হয় না কোর্স ইট্রাকশন।

অসকার পাশে দাঁড়ানো সাকাগাওয়ার দিকে তাকালেন। এটাকে তুমি অন করতে পারবে? দেখো তো, কথা বলতে পারো কিনা।

কমপিউটরাইজড কনসোলের দিকে ঝুঁকে কয়েক সেকেন্ড নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল সাকাগাওয়া। তারপর দ্রুত হাতে দুটো বোতামে চাপ দিল। কনসোল আলোকিত হয়ে উঠল, শোনা গেল মৃদু যান্ত্রিক গুঞ্জন। ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি নিয়ে ভেনসমের দিকে তাকাল সে। আমার জাপানি মরচে ধরা, তবে এটার সাহায্যে কমিউনিকেট করতে পারব বলে মনে হয়।

জাহাজের স্ট্যাটাস রিপোর্ট করতে বলো।

ছোট একটা রিসিভারের দিকে মুখ নামিয়ে কথা বলল সাকাগাওয়া, তারপর প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষায় থাকল। কয়েক মুহূর্ত পর একটা পুরুষ কণ্ঠ, স্টষ্টভাবে সাড়া দিল। জবাব শেষ হতে চীফ অফিসারের দিকে তাকাল সাকাগাওয়া, চেহারায় হতভম্ব ভাব। কমপিউটর বলছে সী ককগুলো খোলা, এঞ্জিনরূপে ফ্লাড লেভেন দুমিটার ছুঁই ছুঁই করছে।

বন্ধ করার নির্দেশ দাও! কঠিন সুরে বললেন অসকার স্টিন।

অল্প কিছুক্ষণ বাক্য বিনিময়ের পর মাথা নাড়ল সাকাগাওয়া। কমপিউটর বলছে, সী কক আটকে গেছে, ইলেকট্রনিক কমান্ডের সাহায্যে ওগুলো বন্ধ করা যাবে না।

এন্ডারসন বলল, আমি বরং নিচে নেমে গিয়ে দেখি ওগুলো বন্ধ করা যায় কিনা। ব্যাটা বোরটকে বলল, পানি সেচতে শুরু করুক। দুজন সীম্যানকে নিয়ে কম্পানিয়নওয়ে ধরে ছুটল সে, এঞ্জিন রামের দিকে যাচ্ছে।

বাকি সীম্যানের একজন অসকার স্টিনের কাছে এসে দাঁড়াল, অবিশ্বাস ও বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে আছে চোখ দুটো, মুখের রঙ কাগজের মত সাদা। স্যার… আমি একটা লাশ পেয়েছে। সম্ভবত রেডিওম্যান…।

দ্রুত কমিউনিকেশন রুমে চলে এলেন অসকার। রেডিও ট্রান্সমিটার প্যানেলের দিকে ঝুঁকে চেয়ারে সময় হয়তো মানুষই ছিল সে, কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে মানুষ বলার কোন উপায় নেই। শরীরের কোথাও কোন চুল নেই। যেখানে ঠোঁট ছিল সেখানে সবগুলো বেরিয়ে থাকা দাঁত না থাকলে অসকার বলতে পারতেন না আকৃতিটা সামনে তাকিয়ে আছে নাকি পিছনে। বীভৎস একা দৃশ্য, দেখে মনে হলো, ফোঁসকা পড়ার পর গায়ের সমস্ত চামড়া গলে গেছে, নিচের মাংসও খানিকটা পুড়ে ও খানিকটা গলে গেছে।

অথচ আশপাশে কোথাও সামান্যতম উত্তাপ বা আগুনের চিহ্নমাত্র নেই। লোকটার গায়ের কাপড় এত পরিস্কার ও এত সুন্দর ভাঁজ করা, যেন এইমাত্র ইস্ত্রি করার পর পরেছে।

লোকটা যেন তার শরীরের ভেতরকার উত্তাপে পুড়ে গেছে।

.

০২.

উৎকট দুর্গন্ধে বমি পেল চীফ অফিসারের। নিজেকে সামলাতে পুরো এক মিনিট সময় নিলেন তিনি। তারপর চেয়ারসহ লাশটাকে একপাশে সরিয়ে ঝুঁকে পড়লেন রেডিওর দিকে। কয়েকবার ভুল করার পর নির্দিষ্ট সুইচটা খুঁজে পেলেন, যোগাযোগ করলেন নারভিকের ক্যাপটেন কার্নি কোরভোল্ডের সাথে।

কোরভোন্ড জানতে চাইলেন, কি দেখলে বলল, অসকার।

এখানে মারাত্মক কিছু একটা ঘটে গেছে, ক্যাপটেন। শুধু একটা লাশ ছাড়া এখনও আর কাউকে দেখিনি আমরা। জাহাজটা পরিত্যক্ত। লাশটা রেডিওম্যানের। পোড়া, চেনা যায় না।

তার মানে কি আগুন ধরেছিল?

আগুনের কোন চিহ্ন পর্যন্ত নেই। কমপিউটারাইজড অটোমেটেড কন্ট্রোল সিস্টেমের স্ক্রীনে, ফায়ার ওয়ার্নিং লেখাটার নিচে সবুজ আলো জ্বলছে।

এমন কোন লক্ষণ দেখছ যাতে বোঝা যায় কি কারণে লাইফবোট নিয়ে চলে গেছে ক্রুরা? কোরভোন্ড জানতে চাইলেন।

সেরকম কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু বোঝা যায়, তাড়াহুড়ো করে পালাবার সময় জাহাজটা ডুবিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে গেছে।

ফোন ধরা হাতের গিটগুলো সাদা হয়ে গেল, গম্ভীর হলেন ক্যাপটেন কোরভোন্ড। আবার বলো।

সী ককগুলো খোলার পর এমনভাবে আটকানো হয়েছে যে কমপিউটার ওগুলো বন্ধ করতে পারছে না। বন্ধ করা যায় কিনা হাত দিয়ে চেষ্টা করে দেখছে। এন্ডারসন।

কয়েক হাজার গাড়ি বহন করছে। এটা একটা অক্ষত জাহাজ, কেন ওটাকে ডুবিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হবে? বেসুরো গলায় জিজ্ঞেস করলেন কোরভোন্ড।

কিছুই বুঝতে পারছি না, স্যার। এখানে অস্বাভাবিক কিছু একটা আছে। রেডিও অপারেটরের লাশটা বীভৎস। তাকে যেন আগুনে ঝলসানো হয়েছে।

তুমি চাও আমাদের ডাক্তারকে পাঠাব?

পোস্টমর্টেম ছাড়া এখানে তার কিছু করার নেই, স্যার।

বুঝলাম। স্টেশনে আরও ত্রিশ মিনিট আছি, তারপর নিখোঁজ বোটগুলো সার্জ করতে বেরুব।

কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করেছেন, স্যার?

ক্রুদের কেউ বেঁচে থাকলে আমাদের স্যালভেজ ক্লেইম চ্যালেঞ্জ করতে পারে, এ কথা ভেবে অপেক্ষা করছি। তল্লাশি চালিয়ে দেখো, সত্যিই যদি জাহাজটা পরিত্যক্ত হয়, আমাদের কোম্পানির ডিরেক্টরকে মেসেজ পাঠিয়ে জানিয়ে দেব যে ডিভাইন স্টারের দখল নিতে যাচ্ছি আমরা।

এঞ্জিনিয়ার এন্ডারসন সী কক বন্ধ করছে, পাম্প করে পানিও বের করে দেয়া হচ্ছে। পাওয়ার সাপ্লাই ঠিক আছে, কাজেই কিছুক্ষণের মধ্যে রওনা হতে পারব আমরা।

যত তাড়াতাড়ি করতে পারো ততই ভাল, কোরোল্ড বললেন। তোমরা একটা ব্রিটিশ ওশেনোগ্রাফিক সার্ভে ভেসেল-এর দিকে ভেসে যাচ্ছে। ওরা স্থির একটা পজিশনে রয়েছে।

কতদূরে?

প্রায় বারো কিলোমিটার।

তাহলে ওরা নিরাপদ দূরত্বেই আছে।

বলার মত আর কিছু খুঁজে পেলেন না ক্যাপটেন কোরভোন্ড। অবশেষে শুধু বললেন, গুড লাক, অসকার। আমি চাই বন্দরে নিরাপদে পৌঁছুবে তোমরা। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

রেডিও থেকে মুখ তুললেন চীফ অফিসার অসকার, চেয়ারে বসে থাকা গলা লাশটার দিকে তাকালেন না। ভয়ে একা ঠাণ্ডা স্পর্শ অনুভব করলেন তিনি, শিরশির করে উঠল গা। পরিত্যক্ত জাহাজের মত ভৌতিক আর কিছু হয় না, ভাবলেন তিনি। সাকাগাওয়াকে নির্দেশ দিলেন, জাহাজের লগ খুঁজে বের করো, দেখো অনুবাদ করতে পারো কিনা। অবশিষ্ট দুজন সীম্যানকে অটো ডেক সার্চ করতে পাঠালেন, নিজে রওনা হলেন ক্রুদের কোয়ার্টার পরীক্ষা করতে। তাঁর মনে হলো, তিনি যেন একটা পোড়াবাড়ির ভেতর হাঁটছেন।

কিছু কাপড়চোপড় এলোমেলোভাবে পড়ে আছে, সেগুলো ছাড়া বাকি সবকিছু দেখে মনে হলো ক্রুরা যে-কোন মুহূর্তে ফিরে আসতে পারে। কোথাও কোন অসঙ্গতি চোখে পড়ল না, যেখানে যা থাকার সবই ঠিকমত আছে। ক্যাপটেনের কোয়ার্টারে একটা ট্রের ওপর দুটো চায়ের কাপ রয়েছে, কিভাবে যেন ঝড়ের মধ্যে ছিটকে পড়েনি। বিছানার পড়ে রয়েছে একটা ইউনিফর্ম। কার্পেটে মোড়া ডেকে পাশাপাশি রাখা হয়েছে পালিশ করা দুপাটি জুতো। পরিচ্ছন্ন ডেস্কের উপর পড়ে রয়েছে একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি নাবালক তিনটে বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক মহিলা।

ডেস্কের নিচে কিছু একটা পড়ে ছিল, পায়ে লাগল। পিছিয়ে এসে ঝুঁকলেন অসকার, জিনিসটা তুলে নিলেন। একটা নাইন-মিলিমিটার, পিস্তল। ট্রাউজারের ওয়েস্ট ব্যান্ডে ঢুকিয়ে রাখলেন তিনি।

সার্চ শেষ করে ব্রিজে ফিরে এলেন অসকার। চার্টরুমে বসে রয়েছে সাকাগাওয়া, পা দুটো ছোট একটা কেবিনেটে তুলে দিয়ে জাহাজের লগ পড়ছে। পেরেছ তাহলে? জানতে চাইলেন তিনি।

খোলা একটা ব্রীফকেসে, লগের প্রথম দিক থেকে পড়তে শুরু করল। সাকাগাওয়া। ডিভাইন স্টার, সাতশো ফুট, ১৬ মার্চ ১৯৮৮-তে ডেলিভারি। সুশিমো স্টীমশিপ কোম্পানি লিমিটেড-এর জাহাজ, হেড অফিস কোবে। চলতি ভয়েজে আমরা সাত হাজার দুশো অষ্টাশিটা মূরমোটো অটোমোবাইল বহন করে সান ফ্রান্সিসকোয় নিয়ে যাচ্ছি।

ক্রুরা জাহাজ ছেড়ে চলে গেল কেন, কোন সূত্র পেয়েছ? জানতে চাইলেন অসকার।

মাথা নাড়ল সাকাগাওয়া। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মহামারী, বিদ্রোহ কিছুই বলা হয়নি। ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে কোন রিপোর্ট নেই। শেষ এন্ট্রিটা একটু অদ্ভুত।

পড়ো।

নিজে আরেকবার পড়ে নিল সাকাগাওয়া, অনুবাদে যাতে ভুল না হয়। তারপর বলল, আমি যতটুকু অর্থ করতে পারছি আবহাওয়ার অবস্থা খারাপের দিকে। ঢেউয়ের উচ্চতা বাটুছে। ক্রুরা অজ্ঞাত রোগে ভুগছে। ক্যাপটেনসহ সবাই অসুস্থ। সন্দেহ করা হচ্ছে ফুড পয়জনিং। আমাদের প্যাসেঞ্জার, মি. সুমা, কোম্পানি ডিরেক্টরদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, উন্মাদের মত আচরণ করছেন। তার বক্তব্য, জাহাজ ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত আমাদের, জাহাজটা ডুবিয়ে দেয়া দরকার। ক্যাপটেন বলছেন, মি. সুমা নার্ভাস ব্রেকডাউনে ভুগছেন; নির্দেশ দিয়েছেন তাকে যেন তার কোয়ার্টারে আটকে রাখা হয়। এ থেকে আমি তো কিছুই বুঝলাম না, স্যার।

ভাবলেশহীন চেহারা, অসকার জানতে চাইলেন, ব্যাস, আর কিছু নেই?

না, স্যার, আর কিছু নেই।

তারিখ?

পয়লা অক্টোবর।

তার মানে দুদিন আগের ঘটনা।

মাথা ঝাঁকাল সাকাগাওয়া, অন্যমনস্ক। এরপরই বোধহয় জাহাজ ছেড়ে চলে যায় ওরা। আশ্চর্য লগটাও ওরা সাথে করে নিয়ে যায়নি।

শান্ত পায়ে কমিউনিকেশন রুমের দিকে এগোলেন অসকার, গভীরভাবে চিন্তা করছেন। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি, নিজেকে স্থির রাখার জন্যে হাত বাড়িয়ে দরজার চৌকাঠটা ধরে ফেললেন। পুরো ঘরটা তার চোখের সামনে মনে হলো যেন। দুলছে। বমি বমি একটা ভাবও অনুভব করলেন।

গলা বেয়ে তরল পদার্থ উঠে আসছে, বুঝতে পেরে ঢোক গিলে নিচে পাঠিয়ে দিলেন সেটাকে। হামলাটা হঠাৎ যেমন শুরু হয়েছিল, তেমনি হঠাৎ করেই থেমে গেল।

এলোমেলো পা ফেলে রেডিওর সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি, নারভিকের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। দিস ইজ ফাস্ট অফিসার অসকার কলিং ক্যাপটেন কোরভোল্ড। ওভার।

বলো, অসকার, জবাব দিলেন ক্যাপটেন কোরভোল্ড। কি খবর?

সার্চ করার দরকার নেই, তাতে শুধু সময় নষ্ট হবে। ডিভাইন স্টারের লগে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় পুরোপুরি শুরু হবার আগেই জাহাজ ছেড়ে চলে গেছে ক্রুরা। চলে গেছে দুদিন আগে। ইতোমধ্যে বাতাস তাদেরকে দুশো কিলোমিটার দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে।

যদি তারা বেঁচে থাকে?

সম্ভাবনা কম।

ঠিক আছে, অসকার। তোমার সাথে আমি একমত, আমরা সার্চ করলে কোন লাভ নেই। আমাদের যতটুকু করার করেছি আমরা। ইতোমধ্যে আমি মিডওয়ে আর হাওয়াই-এর আমেরিকান সী রেসকিউ ইউনিটগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছি, আশপাশে যারা আছে তাদেরকেও। তোমরা সচল হলে আমরাও সান ফ্রান্সিমকোর কোর্স ধরব।

ঠিক আছে, অসকার বললেন। অ্যান্ডারসন কতটুকু কি করতে পারল দেখার জন্যে আমি এখন এঞ্জিন রুমে যাচ্ছি।

যোগাযোগ কেটে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে যাবেন তিনি, জাহাজের একটা ফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলে অসকার বললেন, ব্রিজ।

মি, অসকার, দুর্বল একটা গলা ভেসে এল।

হ্যাঁ, কি হয়েছে?

সীম্যান আর্নি মিডগার্ড, স্যার। আপনি এখুনি একবার সি কার্গো ডেকে আসতে পারবেন? এখানে আমি একটা জিনিস পেয়েছি…।

হঠাৎ ঠেকে গেল মিডগার্ডের গলা। সে বমি করছে, শুনতে পেলেন অসকার। আর্নি, তুমি অসুস্থ?

প্লীজ, তাড়াতাড়ি করুন, স্যার! তারপরই যোগাযোগ কেটে গেল। সাকাগাওয়ার দিকে ফিরে চিৎকার করলেন অসকার, এঞ্জিন রূমের সাথে যোগাযোগ করতে হলে কোন বোতামটায় চাপ দেব?

সাকাগাওয়া কথা বলল না। চাৰ্টরমে ফিরে এলেন অসকার। আগের মতই চেয়ারে বসে রয়েছে সাকাগাওয়া, তার মুখ মরার মত ফ্যাকাসে, ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। মুখ তুলে তাকাল সে, কথাও বলল, প্রতিবার দম নেয়ার সময় বাতাসের অভাবে হাঁসফাস করছে। চার নম্বর বোতামটা… এঞ্জিন রুমে…।

কি হয়েছে তোমার? ব্যাকুলকণ্ঠে জানতে চাইলেন অসকার।

জানি না… আমি… আমার খারাপ লাগছে… ভয়ানক অসুস্থ বোধ করছি… বমি করেছি দুবার…।

শান্ত হও, ধমক দিলেন অসকার। সবাইকে ডাকছি আমি। এটা একটা ডেথ শিপ, নেমে যাব আমরা। ছো দিয়ে ফোন তুলে যোগাযোগ করলেন এঞ্জিন রুমের সাথে। কিন্তু এঞ্জিন রূম থেকে কেউ সাড়া দিল না। ভয়ে কুঁকড়ে গেল তার মন। অজানা একটা ভয়, তাদের ওপর হামলা করছে। তার মনে হলো গোটা জাহাজে ভেসে বেড়াচ্ছে মৃত্যুর একটা তীব্র গন্ধ।

নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করলেন অসকার। রাণকহেডে বসানো একটা ডেক ডায়াগ্রাম-এর উপর চোখ বুলালেন। পরমুহূর্তে ক্যানিয়নওয়ে ধরে নিচে নামতে শুরু করলেন, প্রতিবারে ছয়টা করে ধাপ টপকে। প্রকাণ্ড হোল্ডগুলোর দিকে ছুটতে চাইছেন তিনি, যেখানে গাড়িগুলো আছে, কিন্তু বমির একটা ভাব তার পেটের পেশীগুলোকে কঠিন করে তুলল। প্যাসেজে দাঁড়িয়ে টলতে শুরু করলেন তিনি, দেয়ালে বাড়ি খেতে খেতে এগোচ্ছেন, যেন একটা বন্ধ মাতাল।

অবশেষে হোঁচট খেতে খেতে সিকার্গো ডেকের দোরগোড়ায় পৌঁছালেন তিনি। বহুরঙা অটোমোবাইলের একটা সাগর যেন সামনে ও পিছন দিকে একশো মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। বিস্ময়করই বলতে হবে, এত বড় একটা ঝড়ের মধ্যে পড়েও গাড়িগুলো স্থানচ্যুত হয়নি।

মিডগার্ড-এর নাম ধরে চিৎকার করলেন স্টিন, ইস্পাতের বাল্কহেডে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল তার কণ্ঠস্বর। কোন জবাব পেলেন না। তারপর ব্যাপারটা দেখতে পেলেন তিনি।

একটা গাড়ির হুড তোলা।

দীর্ঘ সারির মঝখান দিয়ে টলতে টলতে এগোলেন অসকার। দুপাশের গাড়ির দরজায় ও ফেন্ডারে ধাক্কা খাচ্ছেন, বেরিয়ে থাকা বাম্পারে লেগে ছিঁড়ে য চামড়া,। হুড খোলা গাড়িটার কাছাকাছি এসে চিৎকার করলেন আবার, এখানে কেউ আছ?

এবার তিনি অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেলেন। তাড়াতাড়ি এগোলেন তিনি, পৌঁছে গেলেন গাড়িটার কাছে। একটা টায়ারের পাশে মিডগার্ডকে পড়ে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন থমকে।

ভেজা ঘামে ভরে গেছে মিডগার্ডের মুখ। রক্ত মেশানো ফেরা বেরুচ্ছে মুখের ভেতর থেকে। চোখ দুটো ভোলা, কিন্তু দৃষ্টি নেই। চামড়ার নিচে রক্তক্ষরন হচ্ছে, ফলে হাত দুটো হয়ে উঠেছে লাল। দেশে মনে হলো চীফ অফিসারের চোখের সামনে গলে যাচ্ছে সে।

গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে স্থির হবার চেষ্টা করলেন অসকার, আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছেন তিনি। অসহায় বোধ করছেন, হতাশায় মাথাটা দুহাতে চেপে ধরলেন। হাত দুটো যখন শরীরের দুপাশে নামিয়ে আনছেন, দেখলেন আঙুলে উঠে জানতে চাইলেন। ফিসফিস করে। মিডগার্ডের চেহারায় নিজের মৃত্যু দেখতে পেলেন তিনি। কিসে মারা যাচ্ছি আমরা?

.

০৩.

ইনভিনসিবল ব্রিটিশদের একটা ওশেনোগ্রাফিক জলযান। ওটার বিরাট ক্রেন থেকে ঝুলছে ডীপ-সী সাবমারসিবল ওল্ড গার্ট। সাগর এখন অনেকটাই শান্ত হয়ে এসেছে, কাজেই পাঁচ হাজার দুশো মিটার পানির নিচে, সাগরের তলায় বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চালাবার জন্যে সাবমারসিবলকে এবার নামানো যেতে পারে।

সাবমারসিবলটা নতুন। অত্যাধুনিক ডিজাইন, তৈরি করেছে একটা ব্রিটিশ অ্যারোস্পেস কোম্পানি। মেনডোসিনো ফ্র্যাকচার জোন সার্ভে করার জন্যে এই প্রথম ওটাকে সাগরের তলায় পাঠানো হচ্ছে। প্রশান্ত মহাসাগরের মেঝেতে বিশাল একটা ফাটল আছে, নর্থ ক্যারোলিন উপকূল থেকে জাপানের দিকে অর্ধেক পথ পর্যন্ত বিস্তৃত, এই ফাটলটারই নাম মেনডোসিনো।

অন্যান্য অ্যারোডাইনামিক সাবমারসিবলের ভেতরে চুরুট আকৃতির খোল থাকে, নিচে জোড়া লাগানো থাকে পেট ফোলা পড়, কিন্তু ওল্ড গার্টে রয়েছে ট্রান্সপারেন্ট টাইটেনিয়াম ও পলিমার দিয়ে তৈরি চারটে গম্বুজ, পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে গোলাকৃতি টানেল। একটা গম্বুজ জটিল ক্যামেরা ইকুইপমেন্টে ঠাসা, আরেকটায় রয়েছে এয়ার ব্যালাস্ট ট্রাঙ্ক ও ব্যাটারি। তৃতীয় গম্বুজে ভরা হয়েছে অক্সিজেন ইকুইপমেন্ট ও ইলেকট্রিক মোটর। চার নম্বর গম্বুজটা সবচেয়ে বড়, বাকি তিনটের উপরে বসে আছে, ক্রুরা সবাই এটাতেই থাকে। এই চার নম্বর থেকেই পরিচালিত হয় ওল্ড গার্ট।

দুনিয়ার গভীরতম সাগরতলে পানির চাপ অত্যন্ত বেশি, সে চাপ সহ্য করার মত করেই তৈরি করা হয়েছে ওল্ড গার্টকে। ওটার সাপোর্ট সিস্টেমের সাহায্য নিয়ে একজন ক্রু আটচল্লিশ ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারবে। অন্ধকার ও ভেজা অতল পাতালে আট নট গতিতে ছুটতে পারে ওটা।

ক্রেইগ প্লাঙ্কেট ওল্ড গার্ট-এর চীফ এঞ্জিনিয়ার ও পাইলট। সব কিছু চেক করে দেখার পর ফর্মে সই করলেন তিনি। পঞ্চাশ বছর বয়েস, টাক ঢাকার জন্যে কাঁচা পাকা চুলগুলো আড়াআড়িভাবে আচড়ানো। লালচে মুখ, প্রায় খয়েরি চোখ। ওল্ড গার্ট-এর ডিজাইন তৈরিতে সাহায্য করেছেন, ওটাকে এখন ব্যক্তিগত ইয়ট হিসেবে দেখেন তিনি। সাগরের তলায় খুব ঠাণ্ডা লাগবে, ভারী একটা উলেন সোয়েটার পরে নিলেন, পায়ে গলালেন একজোড়া নরম ফার দিয়ে কিনারা মোড়া মোকাসিন। বোর্ডিং টানেল থেকে নিচে নেমে বন্ধ করে দিলেন হ্যাঁচটা। এরপর চলে এলেন কন্ট্রোল গম্বুজে, বোতাম টিপে চালু করলেন। কমপিউটরাইজড লাইফ-সাপোর্ট সিস্টেম।

জিওলজিস্ট ড. রাউল স্যালাজার এরই মধ্যে নিজের সীটে বসে একটা বটম সোনার পেনিট্রেটিং ইউনিট অ্যাডজাস্ট করছেন। রেডি হোয়েন ইউ আর, প্লাঙ্কেটকে বললেন তিনি।

গম্বুজের ডানে খালি সীটের দিকে তাকালেন প্লাঙ্কেট। আমি ভেবেছিলাম স্টেসি চলে এসেছে।

এসেছে, বললেন রাউল স্যালাজার। ক্যামেরা রুমে, ভিডিও সিস্টেম চেক করে দেখছে।

ঝুঁকে টানেলের ভেতর তাকালেন প্লাঙ্কেট, ভেতরের গম্বুজে মোজা পরা একজোড়া মেয়েলি পা দেখতে পেলেন শুধু। বললেন, স্টেসি, আমরা তৈরি।

মিষ্টি একটা নারীকণ্ঠ ভেসে এল, আর এক সেকেন্ড, আমার হয়ে এসেছে।

নিজের কন্ট্রোল প্যানেলের নিচে পা দুটো লম্বা করে দিলেন প্লাঙ্কেট, এই সময় কন্ট্রোল গম্বুজে ফিরে এল স্টেসি ফক্স। মেঝের দিকে মাথা ঝুলিয়ে অনেকক্ষণ কাজ করেছে সে, ফর্সা মুখটা লালচে হয়ে আছে। তার রূপকে আগুন বলা যাবে না, তবে সুন্দরী বটে। সরল একরাশ সোনালি চুল মুখের চারপাশে ফুলে আছে, বারবার মাথা ঝাঁকিয়ে সরাতে হয়। রোগা-পাতলা গড়ন, মেয়ে অনুপাতে কাঁধ দুটো একটু বেশি চওড়া। ক্রুরা তার নিতম্ব ও স্তন সম্পর্কে শুধু কল্পনা করতে পারে, কারণ ওগুলোর আকার-আকৃতি সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নেই ভোলা সোয়েটার ও ঢোলা স্কার্ট পরে স্টেসি, নিজের শারীরিক সম্পদ আড়াল করে রাখার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক সে। তবে, মাঝে মধ্যে যখন সে হাই তোলে বা আড়মোড়া ভাঙে, বুকটা নিরেট ও ভরাট কিছু একটার আভাস দেয়।

বয়স চৌত্রিশ, যদিও দেখে আরও অনেক কম মনে হয়। এক সময় ক্যালিফোর্নিয়া সৈকতে সোনালি মেয়ে বলে খ্যাতি অর্জন করেছিল সে, মডেল হিসেবে তার সাফল্য রীতিমত ঈর্ষা করার মতো। তখনই সৌখিন ফটোগ্রাফারদের দলে নাম লেখায়। লেখাপড়া শেষ করার পর একদল মেরিন ফটোগ্রাফারের সঙ্গে ওয়ার্ল্ড ট্যুরে বেরুল, পানির তলায় এমন সব জায়গার ছবি তুলবে যেখানে আগে কখনও কোন ক্যামেরা পৌঁছায়নি। ফটোগ্রাফার হিসেবে ওল্ড গার্টে তার উপস্থিতি আসলে একটা কাভার।

গম্বুজের ডানদিকের সিটটায় বসল সে, সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়ে একটা বোতামে চাপ দিলেন প্লাঙ্কেট। ক্রেন অপারেটর ধীরে ধীরে পানিতে নামিয়ে দিল সাবমারসিবলকে।

ঢেউগুলো এখন এক কি দেড় মিটার উঁচু। একটা ঢেউয়ের মাথায় নেমে নিচের দিকে কাত হয়ে পড়ল ওল্ড গার্ট। লিফট কেবল ইলেকট্রনিক সঙ্কেতের সাহায্যে রিলিজ করা হল। শেষবারের মতো বাইরে থেকে সাবমারসিবলকে চেক করল কয়েকজন ড্রাইভার।

পাঁচ মিনিট পর জিমি নক্স, সারফেস কন্ট্রোলার, পাঙ্কেটকে রিপোর্ট করলেন, পানি নিচে এখন নেমে যেতে পারে ওল্ড গার্ট। ভরা হলো ব্যালাস্ট ট্রাঙ্ক, পানির ওপর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল সাবমারসিবল। শুরু হলো অভিযান।

অত্যাধুনিক হলেও, পুরানো ও প্রচলিত পদ্ধতিতেই নিচে নামতে হয় ওল্ড গার্টকে ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক পানিতে ভরে। ওঠার সময় বিভিন্ন আকারের ভারী লোহা পানিতে ফেলে দেয়া হয়। অস্বাভাবিক গভীরতায় পানির চাপ এত বেশি যে চলতি পাম্প টেকনলজি কোন কাজে আসবে না।

তরল জগতে দীর্ঘ পতন, সম্মোহন তুল্য একটা ঘোরের ভাব এনে দেয় স্টেসির মনে। সারফেসে ছড়িয়ে থাকা আলোয় প্রথম দিকে সব কয়টা রঙই দেখতে পাওয়া যায়, তারপর এক এক করে বিদায় নেয়, ওগুলো, থাকে শুধু নিখাদ কালো।

গম্বুজের সামনে প্রত্যেকের আলাদা কন্ট্রোল কনসোল ছাড়াও, গম্বুজের বাইরের দৃশ্য একশো আশি ডিগ্রি পর্যন্ত দেখার জন্যে স্বচ্ছ পলিমার ও টাইটেনিয়াম মোড়া একটা জানালা রয়েছে। কালো পানিতে মাঝে মধ্যে দুএকটা আলোকিত মাছ দেখা যাচ্ছে, যদিও সেদিকে কোন খেয়াল নেই ড. স্যালাজারের। সাগরের তলায় কি দেখতে পারবেন, সেটাই তার একমাত্র চিন্তা। প্লাঙ্কেট গভীরতা ও লাইফ-সাপোর্ট ইন্সটুমেন। মনিটর করছেন। চাপ প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে, সেই সঙ্গে কমে যাচ্ছে তাপমাত্রা।

জরুরি অবস্থার জন্যে ইনভিনসিবল-এ দ্বিতীয় কোন সাবমারসিবল নেই। সাগরের তলায় অনেক রকম বিপদ ঘটতে পারে। ওল্ড গার্ট পাথরের ফাটলে আটকা পড়তে পারে, যন্ত্রপাতিতে ত্রুটি দেখা দিতে পারে, সেক্ষেত্রে পানির ওপর উঠে আসতে পারবে না ওরা। এরকম কোন বিপদে পড়লে বাঁচার একমাত্র উপায় কন্ট্রোল গম্বুজটাকে ছাড়িয়ে আলাদা করে নেয়া, বিরাট একটা বুদ্বুদের মত ওপরে ভেসে উঠবে সেটা। তবে পদ্ধতিটা জটিল, হাইপ্রেশার কন্ডিশনে কখনও পরীক্ষা করে দেখা হয়নি। পদ্ধতিটা যদি কোন কারণে ব্যর্থ হয়, উদ্ধার পাবার কোনই আশা নেই, অক্সিজেনের অভাবে মারা যাবে সবাই।

ঈলের মতো লম্বা একটা আলোকিত মাছ দেখে ভিডিও ক্যামেরা চালু করল স্টেসি। ভাবতে পারেন, বিশ ফুট লম্বা ওটা! খানিক পর বোতাম টিপে বাইরের আলো জ্বালাল সে, পালিয়ে গেল কালো অন্ধকার, তার জায়গায় সবুজ একটা আভা ছড়িয়ে পড়ল পানিতে। ওল্ড গার্ট-এর বাইরে গভীর সাগর সম্পূর্ণ খালি, প্রাণের কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। ব্যাটারির শক্তি বাঁচানোর জন্যে আলোটা নিভিয়ে দিল স্টেসি।

গুম্বজের ভেতর ঠাণ্ডা লাগছে ওদের। হাতের রোম খাড়া হচ্ছে, দেখতে পেল স্টেসি। দুহাতে কাঁধ আঁকড়ে ধরে শীতে কেঁপে ওঠার একটা ভঙ্গি করল সে। সংকেতটা বুঝতে পেরে ছোট একটা হিটিং সিস্টেম চালু করলেন প্লাঙ্কেট, যদিও তীব্র শীত তাড়াবার জন্যে যথেষ্ট নয় ওটা।

সাগরের তলায় পৌঁছাতে দুঘণ্টা লাগবে ওদের। যে যার কাজে ব্যস্ত না থাকলে সময়টা কাটানো কঠিন হত। সোনার মনিটর ও ইকো সাইন্ডারের দিকে তাকিয়ে আছেন, প্লাঙ্কেট, একটা চোখ রেখেছেন ইলেকট্রিক্রাল ও অক্সিজেন লেভেল গজ-এর ওপর। তলায় পৌঁছাবার পর কিভাবে অনুসন্ধান চালাবেন, তার একটা নকশা তৈরি করছেন ড. রাউল স্যালাজার। স্টেসি নিজের ক্যামেরা ইকুইপমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত।

ইনভিনসিবল থেকে জিমি নক্স, সারফেস কন্ট্রোলারের গলা ভেসে এল আন্ডার ওয়াটার আকুটিকস টেলিফোনে, ভৌতিক লাগল ওদের কানে। দশ মিনিটের মধ্যে তলায় পৌঁছে যাবেন আপনারা, বললেন তিনি।

হ্যাঁ, জবাব দিলেন প্লাঙ্কেট। সোনার তা বলছে।

কাজ থেকে মুখ তুলে সোনার স্ক্রীনে তাকাল স্টেসি, তাকালেন স্যালাজারও। স্ত্রীন থেকে পানির দিকে, তারপর আবার স্ক্রীনের দিকে চোখ ফেরালেন প্লাঙ্কেট। সোনার ও কমপিউটারের ওপর বিশ্বাস আছে তার, তবে নিজের চোখের চেয়ে বেশি নয়।

সাবধান হোন, সর্তক করে দিলেন জিমি নক্স। এটা ক্যানিয়ন ওয়াল-এর পাশে নামছেন আপনারা।

দেখতে পেয়েছি, জানালেন প্লাঙ্কেট। পাঁচিলটা চওড়া একটা উপত্যকার দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে। হাত বাড়িয়ে একটা বোতামে চাপ দিলেন, খালি হয়ে গেল একটা ব্যালাস্ট, ওদের নামার গতি খানিকটা কমল। তলা থেকে ত্রিশ মিটার উপরে রয়েছে, আরেকটা ব্যালাস্ট খালি করা হলো। প্রায় স্থির হয়ে গেল সাবমারসিবল।

সাগরের তলা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো চোখের সামনে। ভাঙাচোরা, এবড়োথেবড়ো পাকটা ঢাল। যতদূর দৃষ্টি চলে ভাঁজ করা, মোচড় খাওয়া অদ্ভুত আকৃতির পাথর আর পাথর। আমরা একটা লাভা প্রবাহের পাশে নামছি, বললেন প্লাঙ্কেট। কিনারাটা প্রায় মাইল খানেক সামনে। তারপর তিনশো ফুট নেমে গেছে পাঁচিলের গা, নিচে উপত্যকার মেঝে।

আই কপি, জবাব দিলেন জিমি নক্স।

পোকার মত দেখতে, ওই পাথরগুলো কি? জানতে চাইল স্টেসি।

পিলো লাভা, জবাব দিলেন ড. স্যালাজার। গুলো তৈরি হয়েছে জ্বলন্ত লাভা যখন ঠাণ্ডা সাগরে বেরিয়ে আসে। আউটার সেল ঠাণ্ডা হয়ে যায়, আকৃতি পায় টিউবের মতো, ভেতরে সচল থাকে তরল লাভা।

অলটিচুড পজিশনিং সিস্টেম চালু করলেন, প্লাঙ্কেট, ফলে চালের মেঝে থেকে চার মিটার ওপরে থাকবে সাবমারসিবল। উঁচু-নিচু মালভূমির উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে ওরা।

গেট রেডি, বললেন প্লাঙ্কেট। আমরা নিচে নামছি।

কয়েক সেকেন্ড পর সাগরের তলা অদৃশ্য হলো, আবার সামনে দেখা গেল কালো অন্ধকার, নিচের দিকে নাক নামিয়ে আবার শুরু হলো ওল্ড গার্টের পতন, গিরিখাদের খাড়া পাঁচিল থেকে চার মিটার দূরত্ব বজায় রেখে।

আন্ডারওয়াটার ফোন থেকে জিমি নক্সের গলা ভেসে এল। আপনাদেরকে আমি পাঁচ-তিন-ছয়-শূন্য মিটারে পাচ্ছি।

ঠিক আছে, আমার লেখাও তাই বলছে, জবাব দিলেন প্লাঙ্কেট।

আপনারা যেখানে নামছেন, এই উপত্যকার মেঝেতেই রয়েছে ফ্র্যাকচার জোন, জানালেন জিমি নক্স।

বোধহয়, বিড়বিড় করলেন প্লাঙ্কেট, কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। ওল্ড গার্ট-এর নিচটা স্ত্রীনে দেখতে পাচ্ছেন তিনি। •

বারো মিনিট পর সামনে সমতল একটা মেঝে দেখা গেল। এতক্ষণে সিধে হলো সব। গম্বুজের চারদিকে গভীর তলদেশের পদার্থ ঘুরপাক খাচ্ছে, হালকা স্রোতে তুষার কণার মতো দেখতে লাগল। আলো একটা গোলাকার বৃত্ত সৃষ্টি করেছে, ছোট ঢেউ খেলানো বালি দেখা গেল সামনে। বালির বিস্তৃতিটুকু কালি নয়; হাজার হাজার গোল জিনিস, কামানের গোলার মতো, সাগরের তলায় ছড়িয়ে রয়েছে।

ম্যাঙ্গানিজ নডিউল, ব্যাখ্যা করলেন ড. স্যালাজার, যেন ছাত্রকে পড়াচ্ছেন। কিভাবে ওগুলো তৈরি হলো কেউ তা সঠিকভাবে বলতে পারে না, তবে সন্দেহ করা হয় যে হাঙরের দাঁত ও তিমির কানের হাড়ই নাকি দায়ী।

ওগুলোর কোন দাম আছে? জানতে চাইল স্টেসি, ক্যামেরা চালু করল।

ম্যাঙ্গানিজ ছাড়াও ওগুলোতে কিছুটা করে কোবাল্ট, কপার, নিকেল আর জিঙ্ক আছে। আমার ধারণা, ফ্র্যাকচার জোনের কয়েকশো মাইল জুড়ে পড়ে আছে ওগুলো। এক বর্গ কিলোমিটারে যতগুলো আছে, আমার হিসেবে তার দাম হবে আট মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

নডিউল ছড়ানো বালির ওপর দিয়ে নিঃশব্দে এগোচ্ছে ওল্ড গার্ট, কোন দিকে যেতে হবে সে ব্যাপারে প্লাঙ্কেটকে পরামর্শ দিচ্ছেন ড. স্যালাজার। হঠাৎ ওদের পোর্টসাইডে কি যেন একটা চকচক করে উঠল। জিনিসটার দিকে তাড়াতাড়ি সাবমাসিবলকে কাত করলেন প্লাঙ্কেট।

কি দেখছেন? জানতে চাইলেন ড. স্যালাজার, নিজের ইন্সট্রুমেন্ট থেকে মুখ তুলে।

নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ল স্টেসি। এটা বল। তার গলায় অবিশ্বাস ও বিস্ময় প্রকাণ্ড একটা মেটাল বল, সাথে অদ্ভুত টাইপের গোঁজ রয়েছে। আমার ধারণা, দশ ফুট ডায়ামিটারের কম হবে না!

প্লাঙ্কেট মন্তব্য করলেন, নিশ্চয়ই কোন জাহাজ থেকে পড়েছে।

খুব বেশিদিন আগেও নয়, কারণ কোথাও মরচে ধরেনি এখনও বললেন ড. স্যালাজার।

তারপর হঠাৎ করেই সাদা বালির চওড়া একটা বিস্তৃতি দেখতে পেলেন ওঁরা, কোথাও একটা নডিউল নেই। দেখে মনে হলো যেন বিরাট একটা ভ্যাকুম ক্লিনার মাঠের মাঝখানটা পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে।

সোজা ও সরল একটা কিনারা! বিস্ময় প্রকাশ করলেন ড. স্যালাজার। সাগরের তলায় এত লম্বা সোজা ও সরল কিনারা থাকতেই পারে না!

স্টেসির চোখেও পলক পড়ছে না। এত নিখুঁত, এত পরিচ্ছন্ন, এ মানুষের তৈরি না হয়েই যায় না।

মাথা নাড়লেন প্লাঙ্কেট। অসম্ভব, এই গভীরতায় সম্ভয় নয়। দুনিয়ার কোন এঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি সাগরের তলায় মাইনিং অপারেশন চালাবার ক্ষমতা রাখে না।

এমন কোন জিওলজিক্যাল ডিসটার্বান্স-এর কথাও কখনও শুনিনি যার ফলে সীবেড়ে এরকম একটা চমৎকার রাস্তা তৈরি সম্ভব, দৃঢ়কণ্ঠে বললেন ড. স্যালাজার।

প্লাঙ্কেট জানতে চাইলেন, কি ধরনের ইকুইপমেন্ট সাগরের তলা ঝাড় দিতে পারে?

দানব আকৃতির একটা হাইড্রলিক ড্রেজ, পাইপের মধ্যে টেনে নিয়ে সারফেসে ভেসে থাকা একটা বার্জে খালি করবে নডিউলগুলো, বললেন ড. স্যালাজার। কয়েক বছর আগেই ধারণাটা বাতিল হয়ে গেছে।

যেমন মঙ্গলগ্রহে মানুষ পাঠানোর ব্যাপারটাও বাতিল হয়ে গেছে, ওখানে পাঠানোর মতো রকেট এখনও তৈরি করা সম্ভব হয়নি। দানব আকৃতির কোন ড্রেজও আমরা তৈরি করতে পারিনি।

ড. প্লাঙ্কেটের দিকে তাকাল স্টেসি। কোন ধারণা দিতে পারেন, ব্যাপারটা কবে ঘটেছে?

কাঁধ ঝাঁকালেন ড. স্যালাজার। হয়তো গতকাল, হয়তো কয়েক বছর আগে।

কিন্তু কে তাহলে? বিড়বিড় করে জানতে চাইল স্টেসি। এ ধরনের একটা টেকনলজি আবিষ্কার হয়ে থাকলে, কেউ কৃতিত্ব দাবি করেনি কেন?

সাথে সাথে ওঁরা কেউ কিছু বললেন না। আবিষ্কারটা ওদের প্রচলিত বিশ্বাসের ওপর প্রচণ্ড এক আঘাত হেনেছে। চওড়া, পরিচ্ছন্ন বালির বিস্তৃতির দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলেন, অজানা একটা ভয়ে শিরশির করেছে গা।

অবশেষে কথা বলে উঠলেন, প্লাঙ্কেট, মনে হলো তাঁর কণ্ঠস্বর অনেক দূর থেকে ভেসে এল। তারা যে-ই হোক, এ দুনিয়ার কেউ নয়। অন্তত মানুষ নয়।

.

০৪.

চেহারায় নগ্ন আতঙ্ক, নিজের হাত দুটোয় ফোঁসকা পড়তে দেখছেন অসকার স্টিন। প্রচণ্ড মানসিক আঘাত ও আকস্মিক পেট-ব্যথায় আধ পাগলা হয়ে উঠলেন তিনি, শরীরের কাঁপুনি থামাতে পারছেন না। সামনের দিকে ঝুঁকে বমি করলেন হাপরের মত হাঁপাচ্ছেন। চারদিক থেকে আক্রমণ শুরু হয়েছে। তাঁর হার্টবিট হঠাৎ করে ছন্দ হারিয়ে ফেলেছে। সারা শরীর পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে।

সাংঘাতিক দুর্বল লাগছে, কমিউনিকেশন রুমে গিয়ে ক্যাপটেন কার্নি কোরভোল্ডকে সাবধান করা সম্ভব নয়। কোরভোল্ড সিগন্যাল পাঠিয়ে কোন সাড়া না পেলে কি ঘটেছে দেখার জন্যে আরও একটা বোর্ডিং পার্টি পাঠাবেন ডিভাইন স্টারে। অহেতুক আরও কিছু লোক মারা যাবে।

ইতোমধ্যে ঘামে ভিজে গেছেন অসকার স্টিন। হুড তোলা গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি, অদ্ভুত এক ঘৃণায় চকচক করছে তার চোখ দুটো। অসাড় একটা ভাব গ্রাস করে ফেলেছে তাকে, তার বিপর্যস্ত মন ইস্পাত, লেদার চামড়ার ভেতর অবর্ণনীয় একটা অশুভ কিছু দেখতে গেল।

যেন আত্মরক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে, নিষ্প্রাণ গাড়িটার ওপর হিংস্র হয়ে উঠলেন অসকার, ক্যাপটেনের কোয়ার্টার থেকে পাওয়া পিস্তলটা ওয়েস্টব্রান্ড থেকে বের করে গাড়ির সামনের দিকটায় একের পর এক গুলি করলেন তিনি।

দুকিলোমিটার পূর্ব দিকে রয়েছে নারভিক, ব্রিজে দাঁড়িয়ে ডিভাইন স্টারের দিকে তাকিয়ে আছেন ক্যাপটেন কার্নি কোরভোল্ড, চোখে দূরবীন, এই সময় বিস্ফোরণের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্ব হারালো জাপানি জাহাজটা। চোখের পলক পড়ল না, গোটা জাহাজটা যেন বাষ্প হয়ে উড়ে গেল।

দানবীর আকৃতির একটা আগুনে বল লাফ দিয়ে উঠল, সেটার নীল উজ্জ্বলতা সূর্যের চেয়েও গাঢ়। এক পলকেই চার কিলোমিটার জুড়ে বিস্ফোরিত হলো উত্তপ্ত সাদা গ্রাস। আকাশে জন্ম নিল একটা হেমিস্ফোরিক কনডেনসেশন ক্লাউড, ছড়িয়ে পড়ল বিশাল ছাতার আকৃতি নিয়ে।

সাগরের গা তিনশো মিটার জুড়ে ডেবে গেল গভীর একটা গামলার মতো। তারপর কয়েক মিলিয়ন টন পানিসহ আকাশের দিকে খাড়া হলো একটা থাম, থামের গা থেকে কয়েক হাজার পানির মোটা ধারা বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে এল, একেকটা এসটাডা লোভার চেয়েও বড় আকারে।

আগুনে বলটা থেকে ছুটল শক ওয়েভ, শনিকে ঘিরে থাকা রিঙের মত, দ্রুত বড় হচ্ছে আকারে, প্রতি সেকেন্ডে পাঁচ কিলোমিটার গতিতে। নারভিকের আঘাত করল শক ওয়েভ থেতলে, মুচড়ে দলা পাকিয়ে আকৃতিহীন করে দিল জাহাজটাকে।

ক্যাপটেন কার্নি কোরভোল্ট খোলা ব্রিজ উইং-এর দাঁড়িয়ে ছিলেন, ধ্বংসকাণ্ডটা দেখেননি। তাঁর চোখ ও মস্তিষ্ক ঘটনাটা রেকর্ড করার সময় পায়নি। থারমল রেডিয়েশনে এক মাইক্রো সেকেন্ডের মধ্যে কার্বনে পরিণত হয়েছে তিনি। তার গোটা জাহাজ পানি থেকে লাফ দিয়ে শূন্যে উঠল, ছিটকে পড়ল একধারে। প্রাইড অব ম্যানের ইস্পাত ও ধুলো তরল বৃষ্টিরমত ঝরে পড়ল নারভিকের বিধ্বস্ত ডেকে। ফাটল ধরা খোল থেকে বেরিয়ে এল আগুনের লেলিহান শিখা, গ্রাস করে ফেলল ভাঙাচোরা জাহাজটাকে। তারপর ভেতর দিকে বিস্ফোরণ ঘটল। কার্গো ডেকের কন্টেইনারগুলো চারদিকে ছুটে গেল ঝড়ের মুখে পড়া গাছের পাতার মত।

যন্ত্রণাকাতর, কর্কশ চিৎকার দেয়ার সময়টুকুও পাওয়া গেল না। যারা ডেকে ছিল, দেশলাইয়ের কাঠির মত জ্বলে উঠল দপ করে, চড়চড় আওয়াজ তুলে পুড়ে ছাই হয়ে গেল হাড়, পরমুহূর্তে উবে গেল কর্পূরের মতো। দুশো পঞ্চাশ জন প্যাসেঞ্জার ও ক্রু চোখের পলকে নেই হয়ে গেল।

ডিভাইন স্টার বাস্প হয়ে উড়ে যাবার প্রায় সাথে সাথে থেমে গেল ব্যাপারটা। আগুনে বলের ওপর ফুলকপি আকৃতির যে মেঘটা জমেছিল, ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল সেটা, সাধারণ মেঘের সাথে মিশে যাওয়ায় আলাদাভাবে চেনা গেল না। ধীরে ধীরে শান্ত হলো আলোড়িত পানি, ঢেউ বাদ দিলে সাগরের উপরটা এখন আগের মতই মসৃণ। বারো মাইল দূরে এখনও ভেসে রয়েছে ইনভিনসিবল। সার্ভেশিপে যখন আঘাত হানল, শক ওয়েভের অবিশ্বাস্য চাপ তখনও শক্তি হারাতে শুরু করেনি। ইনভিনসিবল-এর সুপারস্ট্রাকচার উপড়ে নিল ওটা, বাইরে থেকে ভেতরের বাল্কহেডগুলো দেখা যাচ্ছে। উপড়ে পানিতে পড়ল চিমনি, ফুটন্ত পানির সাথে ঘুরছে সেটা। চোখের পলক পড়ল না, অদৃশ্য হলো ব্রিজ, সাগরে ছড়িয়ে পড়ল ইস্পাত ও মাংস কণা।

ইনভিনসিবল-এর মাস্তুল কাত হয়ে ভেঙে গেছে। ভেঙে গেছে বড় ক্রেনটা, যেটার সাহায্যে ওল্ড গার্টকে পানির উপর ভোলা হয়। খোলের প্লেটগুলো ভেঙে ঢুকে পড়েছে জাহাজের ফ্রেম ও লংগিচ্যুড়াইনাল বীমাগুলোর মাঝখানে। নারভিকের মতই, বুবার্ডকে চেনা যায় না, আকৃতি হারিয়ে ফেলেছে। কালো, তেলতেলে ধোয়া বেরিয়ে আসছে বিধ্বস্ত পোর্ট সাইড থেকে। যারা খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল, উত্তাপে পুড়ে গেছে সবাই। ডেকের নিচে এমন কেউ নেই যে আহত হয়নি।

প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে একটা বাল্কহেডের গায়ে ছিটকে পড়লেন জিমি নক্স, বাল্কহেড থেকে ফুটবলের মত ড্রপ খেয়ে ফিরে এলেন মেঝেতে। বাতাসের তীব্র অভাবে দম আটকে মারা যাচ্ছেন তিনি। হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছেন, হা করে তাকিয়ে আছেন সিলিঙে সদ্য তৈরি একটা গর্তের দিকে।

গর্তের ভেতর দিয়ে ব্রিজ আর চার্টরুম দেখতে পেলেন তিনি। ভেতরে কেউ নেই, কিছু নেই, ছাল-চামড়া পর্যন্ত গায়েব হয়ে গেছে। হুইলহাউস পরিণত হয়েছে পোড়া আর হাড়ি ভাঙা মানুষের একটা পে, গর্তের কিনার থেকে নিচের কমপার্টমেন্টে ঝর ঝর করে নেমে আসছে তাদের রক্ত।

কাত হবার চেষ্টা করলেন জিমি নক্স, সাথে সাথে গুঙিয়ে উঠলেন তীব্র ব্যথায়? তিনটে ছাড় ভেঙেছে পাঁজরের, একটা পায়ের গোড়ালি মচকে গেছে, শরীরের অসংখ্য জায়গায় ছিঁড়ে গেছে চামড়া। কাটিয়ে উঠতেই ওল্ড গার্টে কথা মনে পড়ল তার। ক্রল করে ডেক পেরুলেন তিনি, থামলেন আন্ডারওয়াটার টেলিফোনের কাছে। ওল্ড গার্ট? ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলেন। ডু ইউ রিড?

কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলেন জিমি নক্স, কিন্তু কোন সাড়া পেলেন না। ড্যাম ইউ প্লাঙ্কেট। কথা বলুন।

তারপরও কোন সাড়া পাওয়া গেল না। ইনভিনসিবল-এর সাথে ওল্ড গার্টে সমস্ত যোগাযোগ নষ্ট হয়ে গেছে। তিনি যা ভয় করেছিলেন, তাই ঘটেছে। সার্ভেশিপ ভেঙে চুরে তুবড়ে যাবার পিছনে কারণ যা-ই হোক, সেই একই কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে পানির তলায় ওল্ড গার্টও। মারা গেছে ওরা, বিড়বিড় করলেন। ছাতু হয়ে গেছে সবাই।

তারপর হঠাৎ সহকারী ও ক্রুদের কথা ভাবলেন তিনি। নাম ধরে চিৎকার শুরু করলেন। শুধু মানুষের গোঙানি আর মৃত্যুপথযাত্রী জাহাজের ধাতব কাতর ধ্বনি শুনতে পেলেন। খোলা দরজা দিয়ে তাকাতে দেখতে পেলেন, এলোমেলোভাবে পাঁচটা দেহ পড়ে রয়েছে, একটাও নড়ছে না।

শোকে বিহ্বল, বিস্ময়ে দিশেহারা, নড়ার শক্তি পেলেন না জিমি নক্স। অনুভব করলেন, জাহাজের খিচুনি উঠে গেছে। ইনভিনসিব-এর পিছন দিকটা পাক খাচ্ছে, নেমে যাচ্ছে ঢেউয়ের ভেতর, যেন একটা ঘূর্ণিজলে ধরা পড়েছে জাহাজ। বুঝতে অসুবিধে হলো না, পানির নিচে তলিয়ে যাবে জাহাজটা।

জাহাজের পিছন দিকটা ডুবে যাচ্ছে, উঁচু হচ্ছে বো। কয়েক মুহূর্ত ওভাবে থাকার পর ডুবে গেল জাহাজের পিছনটা পানির নিচে। তারপর পুরো জাহাজটাই।

ইনভিনসিবল-এর ক্রুরা কেউ বাচল কিনা দেখার জন্যে চারদিকে তাকালেন জিমি। কোথাও কোন লাইফবোট নেই। পানিতেও কেউ সাঁতার কাটছে না। ব্যাখ্যাহীন বিয়োগান্তক ঘটনাটার তিনিই যেন একমাত্র সাক্ষী হয়ে বেঁচে রয়েছেন।

.

০৫.

পানির নিচে বৃত্তাকার শক ওয়েভের গতি ঘণ্টার কমবেশি সাড়ে ছয়হাজার মাইল, সেটার পথে পথে সমস্ত সামুদ্রিক প্রাণী ধ্বংস হয়ে গেল। গিরিখাদের আড়াল পাওয়ার ওল্ড গার্ট সাথে সাথে বিধ্বস্ত হলো না, তবে অবিশ্বাস্যা দ্রুতবেগে বারবার ডিগবাজি খেতে শুরু করল সেটা। একটা পড়-এ মেইন ব্যাটারি আর প্রোপালশন সিস্টেম রয়েছে, পাথরের শক্ত নডিউলের সাথে বাড়ি খেল সেটা, ভেঙে ডেবে গেল ভেতর দিকে। ভাগ্য ভাল যে সংযুক্ত টিউবের দুপাশের হ্যাঁচ কভার ভাঙল না, ভাঙলে কন্ট্রোল গম্বুজের তেলে পানি ঢুকে রক্তাক্ত ছাতু বানিয়ে ফেলত ওদের।

বজ্রপাতের মতো বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে এল আন্ডারওয়াটার টেলিফোনে, প্রায় একই সাথে শোনা গেল শক ওয়েভের আওয়াজ, যেন সগর্জনে ছুটে আসছে একটা এক্সপ্রেস ট্রেন। তারপর নেমে এল ভৌতিক নিস্তব্ধতা। নিস্তব্ধতা আবার ভাঙল, শোনা গেল ইস্পাতের যন্ত্রণাকাতর কর্কশ আওয়াজ, অশান্ত পানির ওপর জাহাজটা টুকরো টুকরো হয়ে নেমে আসছে সাগরের তলায়।

কি ঘটছে? চিৎকার করল স্টেসি, পড়ে যাওয়ার ভয়ে চেয়ারটা দুহাতে আঁকড়ে ধরে আছে।

আতঙ্কেই হোক, কিংবা দায়িত্বের প্রতি শর্তহীন নিষ্ঠা, নিজের কনসোল থেকে চোখ তুললেন না ড. রাউল স্যালাজার। ভূমিকম্প নয়। কমপিউটার বলছে। সারফেস ডিসটাৰ্যান্স।

ওল্ড গার্ট-এর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন ক্রেইগ প্লাঙ্কেট। নডিউল ভর্তি মাঠে অনবরত বাড়ি খাচ্ছে সাবমারসিবল, অসহায়ভাবে দেখা ছাড়া তার কিছু করার নেই। সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা ভুলে আন্ডারওয়াটার টেলিফোনে চিৎকার করছেন তিনি। সারাফেস কন্ট্রোলার, এখানে আমরা প্রচণ্ড একটা আলোড়নের মধ্যে পড়েছি। কারণটা বুঝতে পারছি না। থ্রাস্ট পথ হারিয়েছি। প্লীজ সাড়া দিন!

জিমি নক্সের কথা শুনতে পাবার কথা নয়। বেঁচে থাকার জন্যে পানির সাথে যুদ্ধ করছেন তিনি।

তখনও টেলিফোনে চিৎকার করছেন প্লাঙ্কেট, ডিগবাজি খাওয়া বন্ধ হলো ওল্ড গার্ট-এর। সাগরের তলায় ধাক্কা খেয়ে স্থির হলো সাবমারসিবল, ইলেকট্রিক্যাল ও অক্সিজেন ইকুইপমেন্ট ভরা গম্বুজটার উপর ভর দিয়ে।

সব শেষ, বিড়বিড় করলেন ড. স্যালাজার, ঠিক কি বলতে চাইছেন নিজেও জানেন না, বিস্ময় ও আতঙ্কে মাথাটা ঠিকমত কাজ করছে না।

কিসের শেষ! কর্কশ স্বরে বললেন প্লাঙ্কেট। ব্যালাস্ট ফেলে দিয়ে এখনও আমরা উপরে ভেসে উঠতে পারব। যদিও জানেন, পড়ে যে পানি ঢুকেছে তার চেয়ে আয়রন ব্যালাস্টের ওজন কমই হবে। তবু সুইচ অন করলেন তিনি, সাবমারসিবলের পেট থেকে কয়েকশো পাউন্ড বোঝা খসে পড়ল।

কয়েক মুহূর্ত কিছুই ঘটল না, তারপর এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে সাগরের মেঝে থেকে ওপর দিকে উঠতে শুরু করল ওল্ড গার্ট।

দশ ফুট ওপরে উঠেছি, ত্রিশ সেকেন্ড পর ঘোষণা করলেন প্লাঙ্কেট, যদিও মনে হলো সুইচ টেপার পর এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে।

ধীরে ধীরে সিধে হলো সাবমারসিবল, এতক্ষণে আবার নিঃশ্বাস ফেললেন ওরা। জিমি নক্সের সাথে আবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন প্লাঙ্কেট।

ডেপথ মিটারের দিকে এমন কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্টেসি তার মনে হলো ডায়ালের ওপর কাঁচটা ফেটে যাবে। গো…গো…, বিড়বিড় করে আবেদন জানাচ্ছে সে।

দুঃস্বপ্নটা গ্রাস করল ওদেরকে বিনা নোটিশে। ইলেকট্রিক্যাল ও অক্সিজেন ইকুইপমেন্ট ভরা গম্বুজটা সাগরের মেঝেতে ধাক্কা খেয়ে তুবড়ে গিয়েছিল, পানির নির্দয় চাপে ডিমের মত ভেঙে পড়ল সেটা।

ব্রাডি হেল! খসে পড়ল সাবমারসিবল, সাগরের মেঝেতে লেগে ঝাঁকি খেল। তারপরই একবার ইতস্তত করে নিভে গেল আলোটা। নিশ্চিদ্র অন্ধকার কি রকম আতঙ্ক সৃষ্টি করে তা একমাত্র অন্ধজনই বলতে পারে; প্রাঙ্কেটের মনে হলো, অন্ধকার জ্যান্ত একটা প্রাণী, চারপাশ থেকে তাকে পেঁচিয়ে ধরেছে।

নিস্তব্ধতা ভাঙলেন ড. সালাজার, মাদার অভ জেসাস, আমাদের সত্যি কোন আশা নেই।

কে বলেছে? ধমকের সুরে কথা বললেন প্লাঙ্কেট। কন্ট্রোল গম্বুজ আলাদা করে নিয়ে এখনও আমরা উপরে উঠে যেতে পারি। কনসোলে হাত বুলালেন তিনি, নির্দিষ্ট সুইচটা খুঁজে নিলেন। ক্লিক করে শব্দের সাথে ইমার্জেন্সি লাইট জ্বলে উঠল।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে স্টেসি বলল, থ্যাঙ্ক হেভেন। আমরা অন্তত দেখতে পাচ্ছি। সামান্য একটু ঢিল পড়ল তার পেশীতে।

জরুরি অবস্থা, উঠে যেতে হবে ওপরে, সেভাবে নির্দেশ দিয়ে কমপিউটারের প্রোগ্রাম সেট করলেন চীফ এঞ্জিনিয়ার প্লাঙ্কেট। রিলিজ মেকানিজম সেট করে স্টেসি ও ড. সালাজারের দিকে তাকালেন। শক্ত হয়ে বসতে হবে। উঠতে শুরু করলে কি ঘটে বলা যায় না।

আমি তৈরি, ভয়ে ভয়ে বলল স্টেসি।

রিলিজ হ্যান্ডেল থেকে সেফটি পেগ সরিয়ে নিলেন প্লাঙ্কেট, তারপর শক্ত হাতে ধরে টান দিলেন।

কিছুই ঘটল না।

নিয়ম ধরে তিনবার চেষ্টা করলেন প্লাঙ্কেট, কিন্তু সাবমারসিবলের মেইন সেকশন থেকে কন্ট্রোল গম্বুজ গোঁয়ারের মতো আলাদা হতে অস্বীকার করল। মরিয়া হয়ে উঠে কমপিউটরকে জিজ্ঞেস করলেন, কোথাও কোন যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা। দিয়েছে কিনা। চোখের পলকে উত্তর পাওয়া গেল স্ক্রীনে। সাগরের তলার সাথে ধাক্কা খাওয়ার সময় রিলিজ মেকানিজমস মুচড়ে বাঁকা হয়ে গেছে, মেরামতের অযোগ্য।

আমি দুঃখিত, হতাশায় মুষড়ে পড়ে বললেন প্লাঙ্কেট। কেউ এসে উদ্ধার না করা পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে আমাদের।

সম্ভাবনা কম, বিড়বিড় করলেন ড. স্যালাজার, স্কি জ্যাকেটের হাতা দিয়ে। মুখের ঘাম মুছলেন।

অক্সিজেনের অবস্থা কি? জানতে চাইল স্টেসি।

মেইন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেছে। তবে কন্ট্রোল গম্বুজে ইমার্জেন্সি সাপ্লাই থেকে যা পাওয়া যাবে তাতে দশ থেকে বারো ঘণ্টা টিকে থাকতে পারবে ওরা।

প্লাঙ্কেটের জবাব শুনে মাথা নাড়লেন ড. স্যালাজার। দুনিয়ার সমস্ত গির্জা, মসজিদ ও মন্দিরে আমাদের জন্যে প্রার্থনা করা হলেও সময়মত আমরা উদ্ধার পাব না। সাইটে আরেকটা সাবমারসিবল নিয়ে আসতে সময় লাগবে বাহাত্তর ঘণ্টা। ওটা আনার পরও সন্দেহ আছে, ওরা আমাদেরকে সারফেসে তুলতে পারবে কিনা।

আশাব্যঞ্জক কিছু শোনাবেন, এই আশায় প্লাঙ্কেটের দিকে তাকাল স্টেসি, কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। তার নির্লিপ্ত চেহারা দেখে মনে হলো, অন্য কোন জগতে চলে গেছেন। তারপর, স্টেসির দৃষ্টি অনুভব করে, চোখ মিটিমিট করলেন, ফিরে এলেন বাস্তবে। বললেন, ড. স্যালাজার ঠিকই বলছেন। বলতে ঘৃণাবোধ করছি, তবে কথাটা সত্যি, মিরাকুলার কিছু একটা না ঘটলে কোনদিন আমরা আর বোদ দেখতে পাব না।

কি বলছেন! ইনভিনসিবল আমাদের সন্ধানে সাগর তোলপাড় করে ফেলবে না! প্রতিবাদ জানাল স্টেসি।

মাথা নাড়লেন প্লাঙ্কেট। সারফেসে নিদারুণ কিছু একটা ঘটেছে। শেষ যে শব্দটা আমরা শুনেছি, ওটা ছিল জাহাজ ভাঙার।

কিন্তু আমরা যখন পানিতে নামি, আশপাশে আরও দুটো জাহাজ ছিল, বলল স্টেসি। কোনটা ভেঙেছে কে জানে।

একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে চুপ করে থাকলেন প্লাঙ্কেট। গম্বুজের পরিবেশ হতাশায় ভারী হয়ে উঠল। জীবিত উদ্ধার পাবার যে-কোন আশা ফ্যান্টাসি ছাড়া কিছু নয়। শুধু ধরে নেয়া যায়, পরে হয়তো ওল্ড গার্ট এবং ওদের লাশগুলো উদ্ধার করা হবে।

.

০৬.

ডেইল নিকোলাস, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী, পাইপে ঘন ঘন টান দিয়ে গলগল করে ধোয়া ছাড়ছেন, রেইমন্ড জর্ডানকে অফিসে ঢুকতে দেখে চশমার ওপর দিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকালেন তিনি।

তামাকেরও গন্ধ ও ধোঁয়া অপছন্দ করেন রেইমন্ড জর্ডান, নাক কুঁচকে হাসলেন তিনি, বললেন, গুড আফটারনুন, ডেইল।

এখনও বৃষ্টি হচ্ছে? জানতে চাইলেন ডেইল নিকোলাস।

ঝিরঝির করে। রেইমন্ড জর্ডান লক্ষ করলেন, ডেইল নিকোলাস উত্তেজনায় টানটান হয়ে আছেন। তাঁর কফিরঙা চুল এলোমেলো, কপালে চিন্তার রেখা।

প্রেসিডেন্ট ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট অপেক্ষা করছেন, তাড়াতাড়ি বললেন ডেইল নিকোলাস। প্যাসিফিক ব্লাস্ট সম্পর্কে সর্বশেষ খবর জানার জন্যে অস্থির হয়ে আছেন তাঁরা।

লেটেস্ট রিপোর্ট আমি নিয়ে এসেছি, শান্ত গলায় আশ্বাস দিলেন রেইমন্ড জর্ডান। অফিশিয়াল ওয়াশিংটনে যে পাঁচ ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাধর উনি তাঁদের অন্যতম হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ তাকে চেনে না। চেনেন না বেশিরভাগ বুরোক্র্যাট বা পলিটিশিয়ানরাও। জাতীয় নিরাপত্তা কমিশনের ডিরেক্টর হিসেবে ন্যাশনাল সিকিউরিট সার্ভিসেরও প্রধান তিনি, রিপোর্ট করেন সরাসরি প্রেসিডেন্টের কাছে।

রেইমন্ড জর্ডানকে দেখে মনে হবে না যে তিনি প্রখর বুদ্ধির বা ফটোগ্রাফিক মেমোরির অধিকারী, সেই সাথে সাতটা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন। আর দশজন সাধারণ মানুষের মতই চেহারা তার। মাঝারি আকৃতি, বয়স ষাটের কাছাকাছি, মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, নিরেট গড়ন, সামান্য একটা ভুঁড়ি আছে, চোখ দুটো শান্ত ও কোমল। বিয়ে করার পর সাঁইত্রিশ বছর ধরে স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত, তার দুই মেয়েই কলেজে মেরিন বায়োলজি পড়ে।

ডেইল নিকোলাস যখন পথ দেখিয়ে ওভাল অফিসে নিয়ে এলেন রেইমন্ডকে, প্রেসিডেন্ট ও ভাইস-প্রেসিডেন্ট তখন নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে আলাপ করছেন। পায়ের আওয়াজ পেয়ে সাথে সাথে তাকালেন তারা। রেইমন্ড জর্ডান লক্ষ করলেন, দুজনেই তারা ডেইল নিকোলাসের মতো উত্তেজিত হয়ে আছেন।

এসেছ বলে ধন্যবাদ, রেই, বললেন প্রেসিডেন্ট। হাত বাড়িয়ে একটা সোফা দেখালেন, সোফার উপরে অ্যানড্র জ্যাকসন-এর পোর্টেট।

কি ঘটছে?

যে-কোন সঙ্কটে উদ্বিগ্ন রাজনীতিকদের সাথে কথা বলার সময় কৌতুক বোধ করেন রেই জর্ডান। তিনি যে বিপুল ক্ষমতার অধিকারী, এ কথা তারা জানা সত্ত্বেও স্বীকার করতে চান না। বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের ধারণাও সীমিত, অন্তত তাঁর কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে ছোট করে মাথা ঝাঁকিয়ে বসলেন তিনি, কোলের উপর ব্রীফকেসটা রেখে অসসভঙ্গিতে খুললেন। রেফারেন্স হিসেবে কাজে লাগতে পারে, তাই একটা ফাইল বের করে হাতে রাখলেন।

আমরা কি একটা পরিস্থিতির মুখে পড়েছি? ধৈর্য হারিয়ে জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট, এখানে পরিস্থিতি একটা সাঙ্কেতিক শব্দ, বেসামরিক জনসাধারণ ভয়ঙ্কর কোন হুমকির মুখে পড়লে ব্যবহার করা হয় যেমন, পারমাণবিক আক্রমণ।

ইয়েস, স্যার, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি আমরা একটা পরিস্থিতির মুখে পড়েছি।

কি দেখতে পাচ্ছি আমরা?

ফাইলের দিকে তাকলেন না রেইমন্ড জর্ডান, রিপোর্টটা মুখস্ত হয়ে গেছে তার, পুরো ত্রিশটা পাতা। ঠিক এগারোটা চুয়ান্নতে মহাশক্তিশালী একটা বিস্ফোরণ ঘটেছে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে, মিডওয়ে দ্বীপ থেকে প্রায় নয়শো কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে। আমাদের একটা পিরামিড স্পাই স্যাটেলাইট ফ্ল্যাশ ও অ্যাটমস্কেরিক ডিসটার্ন্যান্স-এর ছবি তুলেছে, আর শক ওয়েভ রেকর্ড করেছে গোপন হাইড্রোফোনি বয়ার সাহায্যে। সমস্ত ডাটা সরাসরি ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সিতে পাঠানো হয়েছে বিশ্লেষণ করার জন্যে। আরও পাঠানো হয়েছে সিসমোগ্রাফিক রিডিং। ল্যাংলিতেও রিপোর্ট করা হয়েছে।

উপসংহার?

বিস্ফোরণটা যে পারমাণবিক, এ ব্যাপারে সবাই একমত, শান্তভাবে বললেন রেইমন্ড জর্ডান।

আমরা কি ডেফকম অ্যালার্ট-এ রয়েছি? প্রশ্ন করলেন প্রেসিডেন্ট, অর্থাৎ জানতে চাইছেন পারমাণবিক আক্রমণ ঠেকাবার প্রস্তুতিতে কোন পর্যায়ে রয়েছেন তারা।

মাথা ঝাঁকালেন রেইমন্ড জর্ডান। নিজের কাঁধে দায়িত্ব দিয়ে নোরাডকে নির্দেশ দিয়েছি, ডেফকম অ্যালার্ট থ্রী ঘোষণা করতে হবে, তৈরি থাকতে হবে ডেফকম অ্যালার্ট-টুর জন্যে নির্ভর করে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়ার ওপর।

ডেইল নিকোলাস স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন জর্ডানের দিকে। আমরা কি আকাশে?

নিশ্চিত হবার জন্যে, আরও তথ্য সংগ্রহের জন্যেও, বিশ মিনিট আগে এডওয়ার্ড এয়ার ফোর্স বেস থেকে একটা ক্যাপার এস আর-নাইনটি রেকন এয়ারক্রাফট টেক অফ করেছে।

শক ওয়েভের জন্যে নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশনই দায়ী, এটা কি নিশ্চিতভাবে জানা গেছে? জানতে চাইলেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট। পঞ্চাশ বছর বয়েস, মোটাসোটা ভদ্রলোক, ছয়বছর কংগ্রেসে ছিলেন। পানির নিচে ভূমিকম্প থেকেও সৃষ্টি হতে পারে, কিংবা আগ্নেয়গিরির…।

মাথা নাড়লেন রেইমন্ড জর্ডান। তারপর তিনি ফাইল খুলে বিভিন্ন সায়েন্টেফিক রিপোর্টগুলো পড়ে শোনালেন। বললেন, আরও তথ্য পাবার পর বলা সম্ভব হবে কতটা শক্তিশালী ছিল বিস্ফোরণটা।

অনুমান?

দশ থেকে বিশ কিলোটন।

শিকাগোকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট, মন্তব্য করলেন ডেইল। নিকোলাস।

কে, কারা, কেন? কঠিন সুরে জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট। আমাদের নিজেদের কোন নিউক্লিয়ার সাবমেরিন হতে পারে, কোন কারণে বিস্ফোরিত হয়েছে?

চীফ অব ন্যাভাল অপারেশনস আমাকে জানিয়েছেন, বিস্ফোরণের চারদিকে পাঁচশো কিলোমিটারের মধ্যে আমাদের কোন সাবমেরিন নেই।

রাশিয়ান সাবমেরিন?

না, রেইমন্ড জর্ডান বললেন। আমার রুশ প্রতিপক্ষ নিকোলাই গোলানভের সাথে কথা হয়েছে। তিনি বলছেন, তাঁদের সমস্ত নিউক্লিয়ার জলযান নিরাপদে আছে। স্বভাবতই বিস্ফোরণের জন্যে আমাদেরকে দায়ী করছেন তিনি। আমার ধারণা, আমাদের মতো তারাও অন্ধকারে রয়েছেন।

নিকোলাই গোলানভ সত্যি কথা না-ও বলতে পারেন, সন্দেহ প্রকাশ করলেন ডেইল নিকোলাস।

তাঁর দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন রেইমন্ড জর্ডান। নিকোলাইয়ের সাথে ছাব্বিশ বছরের সম্পর্ক আমার। পরস্পরকে ঘিরে আমরা প্রচুর নাচানাচি করলেও কেউ কখনও মিথ্যে কথা বলিনি।

আমরা দায়ী নই, রাশিয়া দায়ী নয়, তাহলে কে? প্রেসিডেন্টের গলা আশ্চর্য নরম।

আরও অন্তত দশটা দেশের হাতে অ্যাটম বোমা রয়েছে, বললেন ডেইল নিকোলাস। তারা কেউ টেস্ট করার জন্যে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।

সম্ভাবনা কম, বললেন রেইমন্ড জর্ডান। গ্লোবাল ব্লক ও ওয়েস্টার্ন ইন্টেলিজেন্সকে লুবিকে প্রস্তুতি শেষ করার কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আমার ধারণা, শেষ পর্যন্ত জানা যাবে, এটা একটা দুর্ঘটনা। একটা নিউক্লিয়ার ডিভাইস, বিস্ফোরিত হবার কথা নয়, কিন্তু হয়েছে।

কয়েক সেকেন্ড পর প্রেসিডেন্ট জানতে চাইলেন, এলাকায় যেসব জাহাজ ছিল, সেগুলোর পরিচয় জানা গেছে?

সমস্ত তথ্য এখনও আসেনি, তবে জানা গেছে আশপাশে তিনটে জাহাজ ছিল। নরওয়ে একটা প্যাসেঞ্জার-কার্গো লাইনার, একটা জাপানি অটো-ক্যারিয়ার, একটা ব্রিটিশ ওশেনোগ্রাফিক শিপ গভীর সাগরে সার্ভে পরিচালনা করছিল ওরা।

তার মানে অনেক মানুষ হতাহত হয়েছে।

ঘটনার আগে ও পরের স্যাটেলাইট ছবি থেকে জানা গেছে, তিনটে জাহাজেই ডুবে গেছে বিস্ফোরণের সময় বা বিস্ফেরেণের পরপরই। কোন মানুষ বেঁচেছে বলে মনে হয় না। ফায়ার বল আর শক ওয়েভে যদি মারা নাও যায়, রেডিয়েশনে মারা গেছে।

ধরে নিচ্ছি রেসকিউ মিশন পাঠানো হচ্ছে? ভাইস-প্রেসিডেন্ট বললেন।

গুয়াম আর মিডওয়ের ন্যাভ্যাল ইউনিটকে অনুস্থলে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

একদৃষ্টে কার্পেটের দিকে তাকিয়ে আছেন প্রেসিডেন্ট। ব্রিটিশরা আমাদেরকে কিছু না জানিয়ে বোমা টেস্ট করবে, এ আমি বিশ্বাস করতে পারি না।

এ কথা নরওয়ে সম্পর্কেও বলা যায়, মন্তব্য করলেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট।

কিংবা জাপান সম্পর্কে, বিড়বিড় করলেন প্রেসিডেন্ট। ওরা নিউক্লিয়ার বোমা বানাবার চেষ্টা করছে, এ ধরনের কোন রিপোর্ট আমরা পাইনি।

ডিভাইসটা চুরি করাও হয়ে থাকতে পারে, বললেন ডেইল নিকোলাস। হয়তো গোপনে নরওয়ে বা জাপানের জাহাজে করে পাচার করা হচ্ছিল।

কাঁধ ঝাঁকালেন রেইমন্ড জর্ডান। ওটা চুরি করা বলে মনে হয় না আমার। আমার ধারণা, নির্দিষ্ট একটা গন্তব্যে নিয়ে আসা হচ্ছিল ওটাকে তদন্তে সেটাই প্রমাণিত হবে।

নির্দিষ্ট গন্তব্যে?

ক্যালফোর্নিয়ার দুটো বন্দরের যে-কোন একটায়।

ঠাণ্ডা, গভীর দৃষ্টিতে রেই ট্যাবলটের দিকে তাকালেন সবাই। গোটা ব্যাপারটার বিশালত্ব এতক্ষণে যেন উপলব্ধির মধ্যে ধরা দিতে যাচ্ছে।

ডিভাইন স্টার সাত হাজার মুরমটো অটোমোবাইল নিয়ে কবে থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসে আসছিল, বললেন রেইমন্ড জর্ডান। নারভিক আসছিল কোরিয়ায়ৎর পুসান থেকে, বহন করছিল কোরিয়ান জুতো, কমপিউটার, কিচেন সরঞ্জাম ও একশো ত্রিশ জন প্যাসেঞ্জার। গন্তব্য ছিল সান ফ্রান্সিসকো।

গুড গড! বিড়বিড় করলেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট। ভীতিকর একটা চিন্তা! বিদেশী এক জাহাজ যুক্তরাষ্ট্রে নিউক্লিয়ার বোমা নিয়ে আসছে।

তোমার পরামর্শ, রেই? জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট।

এখুনি ফিল্ড টিম পাঠাতে হবে। নেভীর ডীপ-সী স্যালভেজ ভেসেল হলে ভাল হয়, তলিয়ে যাওয়া জাহাজগুলো সার্ভে করে জানতে চেষ্টা করবে কোন জাহাজে বোমাটা ছিল।

প্রেসিডেন্ট ও ডেইল নিকোলাস দৃষ্টি বিনিময় করলেন, তারপর প্রেসিডেন্ট বললেন, ডীপ-ওয়াটার অপারেশনের জন্যে নুমার অ্যাডমিরাল স্যানডেকার আর তার কর্মীরা সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে করি আমি। তাকে ব্রিফ করার দায়িত্ব আমি তোমাকে দিতে চাই, রেই।

মি. প্রেসিডেন্ট, এ ব্যাপারে আপনার প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই দ্বিমত পোষণ করি আমি, চেহারা গম্ভীর করে বললেন রেইমন্ড জর্ডান। এ ধরনের একটা অপারেশনে আমরা শুধু নেভীকে বিশ্বাস করতে পারি…।

ক্ষীণ হাসি ফুটল প্রেসিডেন্টের ঠোঁটে। তোমার উদ্বেগ আমি বুঝতে পারি, রেই। কিন্তু আমার ওপর বিশ্বাস রাখো। কোন রকম নিউজ লিক ছাড়াই কাজটা করতে পারবে নুমা, আমি জানি।

সোফা ছাড়লেন রেইমন্ড জর্ডান, অস্বস্তিবোধ করছেন, কারণ বুঝতে পেরেছেন যে নুমা সম্পর্কে এমন কিছু জানেন প্রেসিডেন্ট যা তিনি জানেন না। ডেইল যদি অ্যাডমিরালকে জানিয়ে রাখেন, তার অফিসের উদ্দেশ্যে এখুনি আমি বেরিয়ে পড়তে চাই।

ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন প্রেসিডেন্ট। ধন্যবাদ, রেই। তুমি আর তোমার লোকজন অল্প সময়ের ভেতর অনেক কাজ করেছ।

ওভাল অফিস থেকে জর্ডানকে বিদায় দেয়ার সময় আশাপাশে কেউ নেই দেখে ডেইল নিকোলাস নিচু গলায় জানতে চাইলেন, তোমার কি ধারণা, বোমাটা কারা পাচার করছিল?

এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন রেইমন্ড জর্ডান। আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাব। যে প্রশ্নটা আমাকে আতঙ্কিত করে তুলছে, সেটা হচ্ছে কি উদ্দেশ্যে পাঠানো হচ্ছিল বোমাটা?

.

০৭.

সাবম রসিবলের ভেতর পরিবেশ স্যাতসেতে ও ভ্যাপসা হয়ে উঠল। গম্বুজের দেয়াল ঘামছে, ঝরে পড়ছে ফোঁটায় ফোঁটায়। কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বিপজ্জনক হারে বাড়ছে। অক্সিজেন বাঁচাবার জন্যে কেউ নড়ছে না, কথা বলছে খুব কম। সাড়ে এগারো ঘণ্টা পর ওদের লাইফ-প্রিজারভিং অক্সিজেন সাপ্লাই প্রায় শেষ হয়ে গেল।

ভয় ও আতঙ্কের জায়গা দখল করল হতাশা, হাল ছেড়ে দিয়েছে ওরা। ড. স্যালাজার পাথুরে মূর্তির মতো বসে আছেন নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে। মনে মনে নিয়তিকে মেনে নিয়েছেন তিনি, অপেক্ষা করছেন মৃত্যুর।

ছেলেবেলায় ফিরে গেছে স্টেসি, কল্পনা করছে অন্য কোন জায়গায় অন্য কোন সময়ে রয়েছে সে। ভাইদের সাথে বাড়ির সামনে রাস্তায় ক্রিকেট খেলছে, ক্রিসমাসে উপহার পাওয়া সাইকেল চালাচ্ছে। এক সময় মাথাটা একদিক কাত করে কিছু শোনার চেষ্টা করল সে। প্রথমে সন্দেহ হলো, তার বোধহয় মাথা ঠিক নেই। তা না হলে কোরাস শুনতে পাবে কেন। চোখ মেলল সে। গম্বুজের ভেতর অন্ধকার, কাউকে দেখতে পেল না। গান গায় কে? ফিসফিস করে জানতে চাইল।

আলো জ্বাললেন প্লাঙ্কেট। কি ব্যাপার? ওটা কিসের শব্দ?

চোখ মেললেন ড. স্যালাজার, বিড়িবিড় করে বললেন, স্টেসি ভুল শুনছে।

ভুল শুনছি মানে? তবে গাওয়া হচ্ছে ভুল একটা গান, আসলে গান ধরা উচিত ছিল উই মে সেবার পাস দিস ওয়ে এগেইন।

স্টেসির দিকে তাকালেন প্লাঙ্কেট। হ্যাঁ, আমিও শুনতে পাচ্ছি…।

তাহলে বলব, দুজনেই হ্যালুসিনেশনের শিকার, হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন ড. স্যালাজার। অক্সিজেনের অভাবে কষ্ট পাচ্ছেন তিনি। হঠাৎ প্লাঙ্কেটের একটা হাত চেপে ধরে বললেন, ফর গডস সেক, ম্যান! সিস্টেমটা বন্ধ করে ঝামেলা চুকিয়ে ফেলুন। দেখতে পাচ্ছেন না, স্টেসি কষ্ট পাচ্ছে। আমরা সবাই কষ্ট পাচ্ছি।

বাতাসের অভাবে প্রাঙ্কেটের বুকটাও ব্যাখ্যা করছে। বাঁচার সম্ভাবনা একবোরেই নেই, তিনিও জানেন। কিন্তু তাই বলে মৃত্যুকে এগিয়ে আনার পক্ষপাতি তিনি নন। শেষ পর্যন্ত দেখব আমরা, ভারী গলায় বললেন। এমন হতে পারে, প্লেনে করে আরেকটা সাবমারবিসবল আনা হয়েছে ইনভিনসিবল-এ।

আপনি একটা পাগল! সাত হাজার কিলোমিটারের মধ্যে দ্বিতীয় কোন ডীপ ওয়াটার সাবসারবিসবল নেই। তবু যদি একটা আনা হয়, আর ইনভিনসিবল যদি ভেসে থাকে, এখানে নামাতে আরও আট ঘণ্টা সময় লাগবে ওদের।

আপনার সাথে তর্ক করব না। তবে আশা ছাড়তে রাজি নই আমি।

আশ্চর্য, আপনি শুনতে পাচ্ছেন না? ড. স্যালাজারকে জিজ্ঞেস করল স্টেসি। শব্দটা আগের চেয়ে কাছে চলে এসেছে।

চুপ! ধমক দিলেন প্লাঙ্কেট। আরও কি যেন শুনতে পাচ্ছি।

গম্বুজের ওপর দিকে, অন্ধকারে তাকিয়ে থাকল স্টেসি, প্রাঙ্কেটের দেখাদেখি। ওল্ড গার্ট-এর ভেতরের আলোয় বাইরের খানিকটা দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুত আকৃতির একটা জীব দেখতে পেল সে। ওটার কোন চোখ নেই, তবে গম্বুজটাকে ঘিরে চক্কর দিচ্ছে বলে মনে হলো, সারাক্ষণ দুই সেন্টিমিটার দূরত্ব বজায় রেখে।

হঠাৎ করে পানিতে কি যেন একটা চকচক করে উঠল। দূরে কি যেন একটা নড়াচড়া করছে, আভাস পাওয়া গেল দানবীর একটা আকৃতির। কালো অন্ধকার নীলচে হয়ে উঠল, সেই সাথে আরও স্পষ্ট ভাবে ভেসে এল গানের আওয়াজ।

আতঙ্কিত বোধ করলেন প্লাঙ্কেট। অক্সিজেনের অভাবে উল্টোপাল্টা কাজ শুরু করেছে ব্রেন, অবাস্তব দৈত্যের জন্ম দিচ্ছে। ওদের দিকে কিছু একটা এগিয়ে আসছে বলে মনে হলো, তা সত্যি হতে পারে না। মনে মনে ঠিক করলেন, আরও কাছে আসুক, তারপর বাইরের আলোটা জ্বালবেন শুধু শুধু ব্যাটারি খরচ করার কোন মানে হয় না।

ক্রল করে সামনে এগোল স্টেসি, গম্বুজের দেয়ালে ঠেকে গেল তার নাক। কানে ঢুকল অনেকগুলো গলা। কি, বলিনি? ফিসফিস করল সে। আমার কথাই ঠিক! শুনুন এবার, গান শুনুন!

অনেক দূরে ও অস্পষ্ট তবু গানের কথাগুলো এবার শুনতে পেলেন প্লাঙ্কেট। মনে হলো, তিনি বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছেন। অক্সিজেনের অভাব ঘটলে মানুষ চোখে ভুল দেখতে পারে, কানেও ভুল শুনতে পারে। তবে নীল আলোটা আরও উজ্জ্বল হচ্ছে, গানটাও তিনি চিনতে পারছেন।

ওহ হোয়াট এ টাইম আই হ্যাড উইথ মিনি দ্য মারমেইড।

ডাউন অ্যাট দ্য বটম অভ দ্য সী।

আই ফরগট মাই ট্রাবলস দেয়ার অ্যামাং দ্য বাবলস।

জী; বাট শি ওয়াজ অফুলি গুড টু মি।

বোতাম টিপে বাইরের আলোটা জ্বাললেন তিনি। এক মুহূর্ত স্থির হয়ে থাকলেন। সমস্ত শক্তি হারিয়ে নিঃশেষ হয়ে গেছেন তিনি, পৌঁছে গেছেন ক্লান্তির চরম সীমায়। কালো অন্ধকার থেকে যে জিনিসটা তার চোখের সামনে বেরিয়ে এল, সেটাকে বাস্তব বলে মেনে নিতে পারলেন না। জ্ঞান হারালেন সাথে সাথে।

বিস্ময়ের আঘাতে অসাড় হয়ে গেল স্টেসি, গম্বুজের দিকে এগিয়ে আসা জিনিসটার ওপর থেকে চোখ দুটো সরাতে পারল না। দানবই বটে, তবে যান্ত্রিক দানব। নিচের দিকটা ট্র্যাক্টর-এর মত, গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে আসছে, মূল কাঠামো থেকে বেরিয়ে আছে আলাদা দুটো বাহু, সেগুলোও আকারে বিশাল। ওল্ড গার্টের আলোয় এসে থামল অদ্ভুত আকৃতির কাঠামোটা। ঝাপসা, মনুষ্য আকৃতির দিক যেন একটা বসে আছে বিদঘুটে মেশিনটার স্বচ্ছ নাকে, গম্বুজ থেকে মাত্র দুমিটার দূরে। চোখ বন্ধ করে আবার খুলল স্টেসি।

ঝাপসা আকৃতিটা এবার পুরোপুরি মানুষের আকৃতি পেল। আসমানি রঙের জাম্পস্যুট পরে আছে লোকটা, সামনের দিকে আংশিক খোলা। মুখের গড়ন অত্যন্ত পুরুষালী, সুদর্শন; অসাধারণ সবুজ চোখ জোড়ার সঙ্গে ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠা হাসিটা দারুণ মানিয়েছে।

স্টেসির দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা, দৃষ্টিতে কৌতুক। পিছন দিকে হাত লম্বা করে একটা ক্লিপবোর্ড টেনে আনল কোলের ওপর, একটা প্যাডে কি যেন লিখল। তারপর কাগজটা ছিঁড়ে উল্টো করে সেটে ধরল নিজের ভিউ উইন্ডোয়।

শব্দগুলো পড়ার জন্যে চোখ কুঁচকে তাকাল স্টেসি। লেখা রয়েছে, সগি একর-এ স্বাগতম। অক্সিজেন লাইন জোড়া লাগাচ্ছি, ততক্ষণ টিকে থাকুন।

কোত্থেকে এল লোকটা? মৃত্যুর সময় এরকমই হয় বুঝি, অবাস্তব সব দৃশ্য ভেসে ওঠে চোখের সামনে? স্টেসি অনেককে বলতে শুনেছে, মারা যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে নিকটাত্মীয়দের দেখতে পায় মানুষ। কিন্তু এ লোকটা তো সম্পূর্ণ অচেনা তার।

ধাঁধার কোন উত্তর পেল না স্টেসি, জ্ঞান হারাল।

.

০৮.

বড় একটা বুদবুদ আকৃতির ঘরের মাঝখানে একা দাঁড়িয়ে রয়েছে ডার্ক পিট, হাত দুটো নুমার জাম্পস্যুটের পকেটে ঢোকানো, তাকিয়ে আছে ওল্ড গার্টের দিকে। মসৃণ ও কালো লাভা মোড়া মেঝেতে ভাঙা একটা খেলনার মতো পড়ে রয়েছে সাবমারসিবলটা। নির্লিপ্ত চেহারা, হ্যাঁচ বেয়ে ওপরে উঠে পাইলটের চেয়ারে বসল ও, কনসোলে সাজানো ইস্ট্রমেন্টগুলো পরীক্ষা করল।

পিট লম্বা মানুষ; চওড়া কাঁধের শক্তিশালী শরীর ওর; সব সময় সতর্ক, নড়াচড়ায় চিতার ক্ষিপ্রতার আভাস। এমনকি একজন আগন্তুক পর্যন্ত প্রথম পরিচয়ে ওর মধ্যকার ধারালো ভাবটুকু টের পাবে, সরকারের কোনো মহলেই কোনোদিন। বন্ধুর অভাব হয় নি ওর। তার সততা এবং বুদ্ধিমত্তার জন্যে নাম কিনেছে পিট। মেয়েমহলে তার জনপ্রিয়তা তুলনাহীন, কিন্তু নারী নয় পিটের প্রথম প্রেম হলো সমুদ্র।

নুমার বিশেষ প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে বেশিরভাগ সময়ই পানির উপর না হয়ে নিচে কাটে পিটের। প্রথমত, তার দায়িত্ব হলো ডাইভিং; জীবনে খুব কমই জিমে গিয়েছে ডার্ক। বহু বছর আগেই ধূমপান ছেড়েছে, অল্প সল্প পান করে, পরিমিত খাওয়া দাওয়া করে। কাজের কারণে দিনে পাঁচ মাইলেরও বেশি হাঁটতে হয় তাকে। পেশাগত চাকরির বাইরে সময় পেলে পানির নিচে ডুব দিয়ে পুরোনো জাহাজের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করা তার শখ।

সাবমারসিবলের বাইরে, বৃত্তাকার দেয়াল ও ধনুক আকৃতির ছাদের নিচে মসৃণ মেঝে থেকে প্রতিধ্বনি তুলল পায়ের আওয়াজ। চেয়ারে ঘুরে বসল পিট, তাকাল নুমায় ওর পুরানো বন্ধু ও সহকর্মী অ্যাল জিওর্দিনোর দিকে। পিটের কাঁধ পর্যন্ত লম্বা সে, বলিষ্ঠ গড়ন, হাসিখুশি চেহারা। কি রকম দেখছ এটাকে? পিটকে জিজ্ঞেস করল সে। ব্রিটিশরা ভাল একটা জিনিস বানিয়েছে, প্রশংসার সুরে জবাব দিল। পিট, হ্যাঁচটা বন্ধ করে দিল অ্যাল জিওর্দিনো।

বিধ্বস্ত গম্বজটার চারদিকে চোখ বুলাল অ্যাল, মাথা নাড়ল। ওরা ভাগ্যবান বটে। আর পাঁচ মিনিট দেরি হলে আমরা ওদের লাশ দেখতে পেতাম।

কেমন আছে সবাই?

দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছে, বলল অ্যাল। গ্যালিতে বসে আমাদের খাবার সাবাড়। করছে, বলছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সারফেসে ওদের জাহাজে পৌঁছে দিতে হবে। জানতে চাইছে, আমরা কারা, কোত্থেকে এলাম, সাগরের এত গভীরে বিলাসবহুল জীবনযাপনের এত সব সুবিধে কিভাবে পাচ্ছি ইত্যাদি।

ওল্ড গার্টে চারদিকে আরেকবার তাকাল পিট, বলল, আমাদের এত বছরের গোপনীয়তা সব ভেস্তে গেল।

সেজন্যে তুমি দায়ী নও।

প্রজেক্ট গোপন রাখার স্বার্থে আমার বরং উচিত ছিল ওদেরকে মরতে দেয়া।

আরে শালা, কাকে বোকা বানাবার চেষ্টা হচ্ছে? অ্যাল জিওর্দিনাকে? গলা ছেড়ে হেসে উঠল সে। তোমাকে আমি আহত কুকুরকে রাস্তা থেকে তুলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে দেখেছি। এমন কি ডাক্তারের বিল পর্যন্ত দিতে দেখেছি, যদিও কুকুরটাকে তুমি গাড়ি চাপা দাওনি। ইউ আর আর বিগ সফটি, মাই ফ্রেন্ড। কিসের গোপন অপারেশন! কুষ্ঠ বা এইডস থাকলেও ওদেরকে তুমি উদ্ধার করতে।

ব্যাপারটা কি এতই পরিষ্কার?

অ্যালের চেহারা থেকে বিদ্রুপাত্মক ভাবটুকু মুছে গেল। তোমাকে ছোট্ট বেলা থেকে চিনি আমি, ডার্ক। কেউ একবার মারলে তুমি তিনবার মেরে প্রতিশোধ নাও। ভেবেছ তোমাকে চিনতে ভুল করব আমি। বাইরে তোমাকে পাষাণ বলে মনে হতে পারে, ভেতরটা আসলে কাদা।

তা হবে। তোমার জন্যে দুঃসংবাদ, একটা সাঙ্কেতিক মেসেজ এসেছে কমিউনিকেশন রুমে। ওয়াশিংটন থেকে আসছেন অ্যাডমিরাল, দুঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবে তাঁর প্লেন। একটা সাবকে নির্দেশ দিয়েছি, সারফেসে উঠে গিয়ে তাঁকে যেন নিয়ে আসে।

ভুরু কুঁচকে তাকিলে থাকল পিট।

আমার ধারণা, তাঁর আকস্মিক আগমনের কারণ হলো ওই বিদঘুটে ডিস্টাব্যান্স।

ওল্ড গার্ট থেকে বেরিয়ে এসে গোলাকৃতি দরজাটার দিকে এগোল পিট, সাথে অ্যাল। কার্বন ও সিরামিক রিএনফোর্সড প্লাস্টিক দেয়ালগুলো সাগরের পাঁচ হাজার চারশো মাটির নিচেও সম্পূর্ণ নিরাপদ। সমতল মেঝেতে ওল্ড গার্ট ছাড়ও ট্রাক্টর এর মতো দেখতে বিশাল একটা ভেহিকেল রয়েছে, কাঠামোর উপর দিকটা চুরুট আকৃতির। পাশাপাশি রয়েছে আরও দুটো সাবমারবিসল, কয়েকজন লোক ওগুলো। সার্ভিসিং করছে।

গোল একটা সরু টানেল দিয়ে বেরিয়ে এল পিট, গম্বুজ আকৃতির দ্বিতীয় চেম্বার। এটাকে ডাইনিং কমপার্টমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। লম্বা একটা টেবিল, কয়েকটা চেয়ার, সবই অ্যালুমিনয়ামের। অতিথিদের ওপর নজর রাখছে। নুমার দুজন কু, কিচেন ও টানেলের দরজা থেকে।

টেবিলের এক ধারের তিনটে চেয়ারে বসে নিজেদের মধ্যে চাপাস্তরে আলোচনা করছেন ড. স্যালাজার, প্লাঙ্কেট ও স্টেসি ফক্স। ওদেরকে দেখে চুপ করে গেলেন সবাই।

উল্টোদিকের একটা চেয়ারে বসে একে একে সবার দিকে তাকাল পিট। সবিনয়ে জানতে চাইল, হাউ ডু ইউ ডু। আমি ডার্ক। একটা প্রজেক্ট অপারেশন চলছিল, আপনাদের আমরা দেখতে পাই। প্রজেক্টটার আমিই হেড।

থ্যাঙ্ক গড! কথা বলার মতো একজনকে পাওয়া গেল! স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন প্লাঙ্কেট।

ভাষাটাও ইংরেজি! হাঁফ ছাড়লেনও ড. স্যালাজার।

ইঙ্গিতে অ্যালকে দেখাল পিট। মি, অ্যাল জিওর্দিনো, চীফ অ্যাসিস্ট্যাট। ওই আপনাদের সব ঘুরিয়ে দেখাবে, কোয়ার্টার বরাদ্দ করবে, যা যা লাগে সব সাপ্লাই দেবে।

পরিচয়, করমর্দন ইত্যাদি শেষ হলো। সবাইকে কফি দিতে বলল অ্যাল। ধীরে ধীরে শিথিল হলো তিন আগন্তুকের পেশী।

সবার পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ, বললেন প্লাঙ্কেট। আমাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে।

আমি আর অ্যাল খুশি, সময়মত আপনাদের দেখতে পাওয়ায়।

আপনার উচ্চারণ শুনে মনে হচ্ছে আমেরিকান, স্টেসি বললো।

সরাসরি মেয়েটার চোখে তাকালো ডার্ক। হ্যাঁ, এখানে আমরা সবাই আমেরিকান।

হাবভাব দেকে মনে হলো, পিটকে যেন ভয় পাচ্ছে স্টেসি, একটা হরিণ যেমন পাহাড়ী সিংহকে ভয় পায়। অথচ প্রবল একটা আকর্ষণও বোধ করছে। জ্ঞান হারাবার আগে অদ্ভুত একটা সাবমারসিবলে আপনাকেই আমি দেখেছিলাম।

ওটা ছিল ডিএসএমভি, ডীপ সী মাইনিং ভেসেল। আমরা ওটাকে বিগ জন বলি। সাগর থেকে জিওলজিক্যাল নমুনা সংগ্রহ করাই ওটার কাজ।

এটা একটা আমেরিকান মাইনিং উদ্যোগ? গলায় অবিশ্বাস, জানতে চাইলেন প্লাঙ্কেট।

হাসল পিট। অত্যন্ত গোপনীয় একটা উদ্যোগ–সাগরতলে মাইনিং এবং সার্ভে প্রজেক্ট, টাকা দিচ্ছে মার্কিন সরকার। প্রায় আট বছর হতে চললো প্রকল্পটার বয়স।

নাম কি এই প্রকল্পের?

আমরা বলি, সগি একর।

এধরনের একটা প্রজেক্ট গোপন বা ক্লাসিফায়েড হয় কি করে? জানতে চাইলেন ড. স্যালাজার। সারফেসে নিশ্চয়ই আপনাদের সাপোর্ট ভেহিকের আছে স্যাটেলাইট বা আশপাশের জাহাজ থেকে ওটাকে দেখা যাবে।

সাগরের তলায় সচল এই আবাসটি আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ, বলল পিট। হাই টেক লাইফ সাপোর্ট সিটে আমাদেরকে সাগরের পানি থেকে অক্সিজেন সাপ্লাই দিচ্ছে। ডিস্যালিনেশন ইউনিট যোগান দিচ্ছে সুপেয় পানি। হাইড্রোথারম্যাল ডেন্টস থেকে পাচ্ছি উত্তাপ। খাবার যোগান দিচ্ছে শামুক, চিংড়ি আর কাঁকড়া। আলট্রাভায়োলেট লাইটে গোসল করি, নিজেদের ধুয়ে নিই অ্যান্টিসেপটিক শাওয়ারে, ফলে জীবাণুমুক্ত থাকা কোন সমস্যা নয়। কোন সাপ্লাই বা ইকুইপমেন্ট আমরা নিজেরা যদি যোগাড় করতে না পারি, আকাশ থেকে সাগরে ফেলা হয় সেটা, সাগরের তলা থেকে সংগ্রহ করে নিই আমরা। সদস্যদের কাউকে যদি ফেরত পাঠাবার দরকার হয়, আমাদের একটা সাবমারসিবল সারফেসে উঠে যায়, সেখানে দেখা হয় জেট-পাওয়ারড ফ্লাইং বোটের সাথে।

বিস্মিত হলেও, ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকালেন প্লাঙ্কেট। স্বপ্ন দেখতে ভালবাসেন তিনি, তাঁর জানার কথা এ-ধরনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়া অসম্ভব নয়।

বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ রাখার জন্যে নিশ্চয়ই চমৎকার একটা পদ্ধতি আছে আপনাদের? জানতে চাইলেন ড. স্যালাজার।

তার জড়ানো একটা সারফেস রিলে বয়া সাহায্য করে। আমরা ট্রান্সটি ও রিসিভ করি ভাষা স্যাটেলাইট।

পানির নিচে কতদিন আছেন আপনারা?

দুমাসের উপর হলো আমরা কেউ সূর্য দেখিনি।

এত গভীরে রিসার্চ স্টেশন চালু করার মতো টেকনলজি আছে আমেরিকানদের, আমার ধারণা ছিল না। একদৃষ্টে কফির কাপে তাকিয়ে আছেন প্লাঙ্কেট।

কাঁধ ঝাঁকাল পিট, কোন মন্তব্য করল না।

সব মিলিয়ে কতজন ক্রু আপনার?

উত্তর দেয়ার আগে কাপে চুমুক দিল পিট। বেশি নয়, বারোজন পুরুষ, দুজন মেয়ে।

দেখতে পাচ্ছি এখানেও মেয়েদেরকে তাদের সেই পুরানো কাজই করতে হয়, কণ্ঠে সামান্য ব্যঙ্গ, গ্যালির দিকে তাকিয়ে বলল স্টেসি, ওদিকে একটি স্বর্ণকেশী মেয়ে তরকারি কাটাবাছা করছে।

ক্রুরা সবাই ভলান্টিয়ার হিসেবে এসেছে, সারাও, বলল পিট। কমপিউটার সায়েন্সে মাস্টার ডিগ্রি আছে ওর, কমপিউটর সেকশনের দায়িত্বও পালন করে। আমরা সবাই একই সাথে দুটো করে দায়িত্ব পালন করি।

অপর মেয়েটি বোধহয় চাকরানী ও ইকুইপমেন্ট মেকানিক?

ক্ষীণ হাসল পিট। প্রায় ঠিক ধরেছেন। জিল আমাদের মেরিন ইকুইপমেন্ট এঞ্জিনিয়ার, আবার আমাদের রেসিডেন্ট বায়োলজিস্টও আর, আপনার জায়গায় আমি হলে, নারী স্বাধীনতা সম্পর্কে ওকে কোন উপদেশ দিতাম না। মিস কলোরাডো বডি-বিল্ডিং কমপিটিশনে প্রথম হয়েছে ও।

একটা জিনিস ব্যাখ্যা করা হলে খুশি হব আমি, বললেন প্লাঙ্কেট। আপনারা জানলেন কিভাবে যে আমরা বিপদে পড়েছি বা কোথায় আমাদের পাওয়া যাবে?

বিগ জন্ থেকে গোল্ড-ডিটেকশন সেনসর পড়ে গিয়েছিল কোথাও, সেটা খোঁজার জন্যে ফিরে আসছিলাম আমি আর অ্যাল, এই সময় আপনাদের আন্ডারওয়াটার ফোনের রেঞ্জে চলে আসি।

অস্পষ্ট হলেও আপনাদের ডিসট্রেস কল শুনতে পাই আমরা, বলল অ্যাল।

প্রথমে আপনাদেরকে অক্সিজেন সাপ্লাই দেই, বলল পিট, তারপর বিগ জনের ম্যানিপুলেটর আর্মস আপনাদের সাবমারসিবলের লিপট হুকে আটকাই, ওটাকে তুলে আনি আমাদের ইকুইপমেন্ট চেম্বারে, প্রেশার এয়ারলকের ভেতর দিয়ে।

আপনারা আমাদের ওল্ড গার্টকে রক্ষা করেছেন? হঠাৎ বলে প্লাঙ্কেট।

চেম্বারে গেলেই দেখতে পাবেন।

বলুন তো, কত তাড়াতাড়ি আমাদেরকে সাপোর্ট শিপে পৌঁছে দেয়া যাবে? ঠিক প্রশ্ন নয়, যেন দাবি জানালেন ড. স্যালাজার।

দুঃখিত, দেরি হবে, বলল পিট।

আমাদের সাপোর্ট শিপকে জানানো দরকার যে আমরা বেঁচে আছি, বলল স্টেসি, প্রতিবাদের সুরে। নিশ্চয়ই আপনারা ওটার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন?

অ্যালের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল পিট। আপনাদেরকে উদ্ধার করতে আসার পথে একটা বিধ্বস্ত জাহাজকে পাশ কাটিয়ে এসেছি আমরা, সম্প্রতি নেমে এসেছে সাগরে তলায়।

না, ওটা ইনভিনসিবল হতে পারে না!

অ্যাল বলল, দেখে মনে হলো, প্রচণ্ড কোন বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হয়েছে। কেউ বেঁচেছে বলে মনে হয় না।

আমরা যখন নিচে নামি, আশপাশে আরও দুটো জাহাজ ছিল, বললেন প্লাঙ্কেট। আপনারা সম্ভত ওই দুটোর একটাকে দেখেছেন।

বলা কঠিন। পিটকে চিন্তিত দেখাল। ওপরে কিছু একটা ঘটেছে। গোটা মহাসাগর লাফিয়ে উঠেছিল। তদন্ত করার সময় পাইনি আমরা।

শক ওয়েভটা আপনারাও নিশ্চয়ই অনুভব করেছেন? জানতে চাইলেন প্লাঙ্কেট। আপনাদের কাছ থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে, গিরিখাদের আড়ালে ছিলাম আমরা। শক ওয়েভের যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, আমাদের উপর দিয়ে চলে যায়। সামান্য স্রোত ও আলোড়ন ছাড়া আর কিছু আমরা অনুভব করিনি।

পিটের দিকে কটমট করে তাকাল স্টেসি। আপনাদের ইচ্ছেটা কি, আমাদেরকে বন্দী করে রাখবেন?

বন্দী শব্দটায় আপত্তি আছে আমার। তবে প্রজেক্টটা ক্লাসিফায়েড তো, আপনারা কটা দিন আমাদের অতিথি হিসেবে থাকলে খুশি হব আমরা।

কয়টা দিন বলতে কি বোঝাতে চান? সতর্ক সুরে জানতে চাইলেন ড. স্যালাজার।

আরও দুমাস ওপরে ওঠার কোন প্রান নেই আমাদের, বলল পিট।

স্তব্ধ হয়ে গেল পরিবেশ। ড. স্যালাজার, স্টেসি, তারপর পিটের দিকে তাকালেন প্লাঙ্কেট। ব্লাডি হেল! তিক্ত কণ্ঠে বললেন তিনি। দুমাস আপনি আমাদেরকে আটকে রাখতে পারেন।

আমার স্ত্রী…, ঢোক গিলে বললেন ড. স্যালাজার, ভাববেন আমি মারা গেছি।

আমার একটা মেয়ে আছে, কথাটা শেষ না করে পিটের দিকে তাকিয়ে থাকল স্টেসি।

এত হতাশ হবার কিছু নেই, বলল পিট। আগে আমাকে জানতে হবে, উপরে কি ঘটেছে। তারপর আমাকে কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে হবে। একটা না একটা উপায় হবেই। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো পিট, দোরগোড়ায় কিথ হ্যারিসকে দেখে চুপ করে গেল। কিথ হ্যারিস ওদের সিসমোলজিস্ট, ইঙ্গিতে পিটকে ডাকছে।

ক্ষমা চেয়ে নিয়ে দরজার দিকে এগোল পিট, লক্ষ করল হ্যারিসের চেহারায় উত্তেজনা। সমস্যা? কঠিন সুরে জানতে চাইল ও।

ডিসটার্ব্যান্সটা সাগরের তলায় অনেকগুলো কাঁপন সৃষ্টি করেছে। এখন পর্যন্ত সেগুলো ছোট আর মৃদু, আমরা আসলে প্রায় অনুভবই করিনি। কিন্তু ওগুলোর শক্তি ও ব্যাপকতা বাড়ছে।

রিডিং কি বলছে?

আমরা এমন একটা পাথুরে স্তরে রয়েছি, প্রায় নড়বড়েই বলা যায়, বলল কিথ হ্যারিস। এলাকাটা ভলকানিকও বটে। ক্রাস্টাল স্ট্রেইন এনার্জি যে হারে রিলিজ হচ্ছে, সাঙ্গাতিক ভয় পাচ্ছি আমি। আমার ধারণা, একটা ভূমিকম্প হতে যাচ্ছে। সিক্স-পয়েন্ট-ফাইভ।

আঁতকে উঠল পিট। তার মানে বাঁচার কোন উপায় থাকবে না। গম্বুজের মাথায় একটা পাথর ছিটকে এসে লাগলে পানির চাপে চিড়ে-চেপটা হয়ে যাবে সবাই।

কতক্ষণ সময় পাব আমরা? জানতে চাইল ও।

নিশ্চিত করে কিছু বলার উপায় নেই। তবে আমার আন্দাজ, বারো ঘণ্টা।

সরে যাবার জন্যে যথেষ্ট সময়।

আমার হিসেব ভুলও হতে পারে, বলল কিথ হ্যারিস, চেহারায় ইতস্তত একটা ভাব। প্রথমে সামান্য যে আলোড়ন আমরা অনুভব করব, সেটা আসল ভূমিকম্পের আগমন বার্তাও হতে পারে সেক্ষেত্রে মাত্র কয়েক মিনিট সময় পাব আমরা। আবার, আলোড়নটা থেকেও যেতে পারে।

পিট কিছু বলার আগেই পায়ের নিচে মৃদু কাঁপুনি অনুভব করল ওরা, পিরিচের ওপর টুংটাং আওয়াজ তুলে নাচতে শুরু করল কাপগুলো।

পিটের দিকে চোখ তুলে তিক্ত হাসল কিথ হ্যারিস। দেখা যাচ্ছে সময় আমাদের অনুকূলে নয়, ডার্ক।

.

০৯.

কাঁপনটা এত দ্রুত বাড়ছে যে আতঙ্ক বোধ করল ওরা। গুরুগম্ভীর একটা আওয়াজ আসছে দূর থেকে। তারপর ভেসে এল হুড়মুড় করে পাথর ধসের শব্দ গিরিখাদের ঢাল বেয়ে নামছে। সবাই ওরা মুখ তুলে তাকিয়ে আছে ইকুইপমেন্ট চেম্বারের ছাদের দিকে, পাথর ধসের আঘাতে যে-কোন মুহূর্তে ছাদ বা দেয়াল চুরমার হয়ে যেতে পারে। ছোট্ট একটা ফুটো হলেই যথেষ্ট, এক হাজার কামানের গর্জন তুলে ভেতরে ঢুকবে পানি।

আতঙ্কিত হলেও, বাইরে তার প্রকাশ নেই। প্রজেক্টের কমপিউটার রেকর্ড ছাড়া কেউ কিছু বহন করছে না। ইকুইপেমন্ট চেম্বারে জড়ো হয়ে ডীপ-সী ভেহিকেলে উঠতে আট মিনিট সময় নিল ক্রুরা।

পিট জানে, সবাইকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। দুটো সাবমারসিবলে খুব বেশি হয়ে চোদ্দজন লোককে জায়গা দেয়া যাবে। ওর দলের ওই চৌদ্দজনই রয়েছে। সমস্যা সৃষ্টি করবে ইনভিনসিবল-এর ক্রুরা।

কাঁপনগুলো আগের চেয়ে শক্তিশালী, আসছেও আগের চেয়ে ঘন ঘন। সারফেসে পৌঁছে লোকজনকে নামিয়ে আবার ফিরে আসবে সাবমারসিবল, তা সম্ভব নয়, অত সময় পাওয়া যাবে না। যেতে-আসতে সময় লাগবে চার ঘণ্টা, অথচ খুব বেশি হলে সময় পাওয়া যাবে কয়েক মিনিট।

ডার্কের থমথমে চেহারা দেখে অ্যাল বলল, এক ট্রিপে সম্ভব নয়, দুই ট্রিপ লাগবে। আমি বরং দ্বিতীয় ট্রিপের জন্যে অপেক্ষা করি…।

দুঃখিত, দোস্ত, তাকে থামিয়ে দিল পিট। প্রথম সাবটা তুমি চালাচ্ছ, দ্বিতীয়টা নিয়ে তোমাকে অনুসরণ করব আমি। সারফেসে উঠে যাও, ইনফ্লেটেবল র‍্যাফটে প্যাসেঞ্জারদের নামাও, তারপর দ্রুত ফিরে এসে এখানে যারা রয়ে যাবে তাদের নিয়ে যাও।

ফিরে আসার সময় পাব না।

বেশ, এরচেয়ে ভাল একটা প্ল্যান দাও।

পরাজয় স্বীকার করে মাথা নাড়ল অ্যাল। এখানে থাকবে কারা?

ব্রিটিশ সার্ভে টিমের সদস্যরা।

আড়ষ্ট হয়ে গেল অ্যাল। কাউকে সিন্ধান্ত নেয়ারও সুযোগ দেবে না? কেউ যদি ভলেন্টিয়ার হতে চায়? তুমি একটা মেয়েকে রেখে যেতে চাইছ, এ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

প্রথমে আমি নিজের দলের লোকদের বাঁচাতে চাইব, ঠাণ্ডা সুরে বলল পিট।

কাঁধ ঝাঁকাল অ্যাল, চেহারায় অসন্তোষ। এত কষ্ট করে বাঁচালাম ওদের, অথচ মৃত্যুর মুখে রেখে যাচ্ছি।

আবার শুরু হলো কাঁপন, এবার অনেকক্ষণ স্থায়ী হলো, প্রায় দশ সেকেন্ড। সেই সাথে গুরুগম্ভীর একটা আওয়াজ ভেসে এল। তারপর আবার সব থেমে গেল, নিস্তব্ধ হয়ে গেল পরিবেশ।

বন্ধুর চোখের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল অ্যাল। ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই সেখানে। পিটকে আশ্চর্য নির্লিপ্ত দেখল সে। তার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে পিট মিথ্যে কথা বলছে। দ্বিতীয় সাবের পাইলট হবার কোন ইচ্ছেই ওর নেই। ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সবাইকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে থেকে যাবে।

কিন্তু এখন আর তর্ক করার সময় নেই। অ্যালকে ধরল পিট, প্রায় ধাক্কা দিয়ে প্রথম সাবমারসিবলের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। অ্যাডমিরালকে আমার শ্রদ্ধা জানিও, বলল ও।

পিটের কথা শুনতে পেল না অ্যাল, পাথর ধসের শব্দে চাপা পড়ে গেল। হ্যাঁচটা বন্ধ করে দিল পিট।

সাবের ভেতর সাতজন মানুষ গাদাদাদি করে বসেছে। কেউ কথা বলল না, কেউ কারও দিকে তাকাল না। সবার কাঁধ ও ঘাড়ের ওপর দিয়ে সামনে এগোল অ্যালি, বসল পাইলটের সীটে। ইলেকট্রিক মটন স্টার্ট দিল সে, রেইল টপকে এয়ারলকে চলে এল সাব।

রওনা হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে অ্যাল, ওদিকে দ্বিতীয় সাবে লোকজনকে তুলে দিচ্ছে পিট। ওর নির্দেশে নুমার মহিলা সদস্যরা প্রথমে ভেতরে ঢুকল। তারপর স্টেসির দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল ও।

হ্যাচের সামনে পৌঁছে ইতস্তত করছে স্টেসি, প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল পিটের দিকে। আপনি মারা যাবেন, আমি আপনার জায়গা দখল করায়? নরম সুরে জিজ্ঞেস করল সে।

হনলুলুর হেইলকালানি হোটেলে একটা টেবিল রিজার্ভ করে রাখবেন, সন্ধ্যের দিকে।

উত্তরে কিছু বলতে যাচ্ছিল স্টেসি, কিন্তু পিছনে দাঁড়ানো লোকটা তাকে ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দিল ভেতরে। ঘুরল পিট, প্রজেক্টের চীফ ভেহিকেল এঞ্জিনিয়ার ডেভলওডেন সামনে দাঁড়াল।

চশমাটা নাকে ভাল মত বসিয়ে নিয়ে পিটের দিকে ঝুঁকল। আপনি আমাকে কো-পাইলট হিসেবে দেখতে চাইছেন, ডার্ক?

না, তুমি একাই ওটাকে নিয়ে যাবে, বলল পিট। অ্যাল ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করব আমি।

চোখ থেকে বিষণ্ণ ভাবটা গোপন করতে পারল না ডেভ। আপনি কেন, আপনার বদলে আমিই বরং অপেক্ষা করি।

তোমার সুন্দরী একটা বউ ও তিনটে বাচ্চা আছে। আমি একা। তাড়াতাড়ি ওঠো! তার দিকে পিছন ফিরে সামনে এগোল পিট, দাঁড়াল প্লাঙ্কেট আর ড. স্যালাজারের সামনে।

প্লাঙ্কেটের চেহারাতেও ভয়ের লেশমাত্র নেই।

মি, প্লাঙ্কেট, আপনি কি বিবাহিত? জানতে চাইল পিট।

আমি? দূর, কনফার্মড ব্যাচেলর!

নার্ভাস ভঙ্গিতে হাত দুটো কচলাচ্ছেন ড. স্যালাজার, চোখে ভয়ের ছায়া। মৃত্যু যে অবধারিত, এ ব্যাপারে তার মনে কোন সন্দেহ নেই।

তখন বলছিলেন, আপনার বউ আছে, তাকে বলল পিট।

একটা বাচ্চাও আছে, ঢোক গিলে জানালেন ড. স্যালাজার।

আর একজনের জায়গা আছে। লাফ দিয়ে উঠে পড়ুন।

আমাকে নিয়ে আটজন হবে, বললেন ড. স্যালাজার। কিন্তু আপনার সাবমারসিবলে জায়গা হবে সাতজনের।

প্রথমটায় আমি মোটাসোটা লোকগুলোকে পাঠিয়ে দিয়েছি, বলল পিট। এটায় তুলেছি রোগা-পাতলা লোকদের ও তিনটে মেয়েকে। আপনার মতো ছোটখাট একজন মানুষ এখনও উঠতে পারবে।

একটা ধন্যবাদও দিলেন না, তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন ড. স্যালাজার। হ্যাঁচটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল পিট।

আপনি অত্যন্ত সাহসী মানুষ, ডার্ক। ঈশ্বরের ভূমিকায় এত ভাল অভিনয় করা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।

দুঃখিত, আপনার জন্যে কোন ব্যবস্থা করতে পারলাম না।

নো ম্যাটার। ভাল একজন মানুষের সাথে মরতে গর্ববোধ করব আমি।

সামান্য বিস্মিত হয়ে প্রাঙ্কেটের দিকে তাকাল পিট। মৃত্যু সম্পর্কে কে কি বলল আপনাকে?

আমাকে মিথ্যে অভয় দেবেন না, প্লীজ। সাগরকে আমি চিনি।

মি. প্লাঙ্কেট, পাথর ধসের আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠল পিটের কণ্ঠস্বর, আমার ওপর আস্থা রাখুন?

পিটের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন প্লাঙ্কেট। এমন কিছু আছে যা আপনি জানেন, আমি জানি না?

শুধু জেনে রাখুন, সগি একর থেকে সবার শেষে রওনা হচ্ছি আমরা।

বারো মিনিট পর। বিরতিহীন হয়ে উঠল শক ওয়েভ। গিরিখাদের ঢাল থেকে টন টন পাথর নেমে এল, গোলাকার কাঠামোটাকে আঘাত করল নির্দয়ভাবে। অবশেষে মানুষের তৈরি সাগরতলের আশ্রয়টাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে ফেলল কয়েক বিলিয়ন লিটার হিমশীতল কালো পানি।

১০. দুই ঢেউয়ের মাঝখানে

১০.

দুই ঢেউয়ের মাঝখানে, পানি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল প্রথম সাবমারসিবল। আকাশ স্বচ্ছ নীল, সাগর প্রায় শান্ত। ঢেউগুলো খুব বেশি হলে এক মিটারের মত উঁচু। হ্যাঁচ খুলে গোলকার টাওয়ারের উঠল অ্যাল। ভেবেছিল খালি সাগর দেখতে পাবে কিন্তু চারদিকে তাকাতে গিয়ে বিস্ময় ও আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে গেল তার চোখ।

চল্লিশ মিটার দূরে একটা জাহাজ, সরাসরি ভাসমান সাবমারসিবলের দিকে এগিয়ে আসছে। বো-র ওপর চারকোণা ডেক, পিছনটা গোল মতো ও উঁচু, দেখেই বোঝা যায় ওটা একটা চাইনিজ জাহাজ। বো-তে একটা চোখ আঁকা, অ্যালের দিকে নিস্পলকে তাকিয়ে আছে।

টাওয়ারের উপর থেকে নিচের দিকে তাকাল অ্যাল, চিৎকার করল, এভরিবডি আউট! জলদি, জলদি।

ঢেউয়ের মাথায় উঠল খুদে সাবমারসিবল, জাহাজের দুজন ক্রু দেখতে পেল ওটাকে। চিৎকার জুড়ে দিল তারা, হেলমসম্যানকে স্টারবোর্ডের দিকে গুঁড়িয়ে নিতে বলছে জাহাজ। কিন্তু মাঝখানের ব্যবধান কমে গেছে। চকচকে খোল সদ্য পানিতে লাফিয়ে পড়া প্যাসেঞ্জারদের ওপর চড়াও হলো। জাহাজের ক্রুরা রেইলিঙে দাঁড়িয়ে আছে, যেন পাথরের মূর্তি। কারও মনে কোন সন্দেহ নেই, জাহাজের বো ধাক্কা দিয়ে সাবমারসিবলটাকে ডুবিয়ে দেবে এখুনি।

শেষ লোকটা লাফ দিয়ে পানিতে পড়ল, এবার অ্যালের পালা। ঢেউয়ের মাথায় চড়ে জাহাজের বো ওপরে উঠল, তারপর নেমে এল সরাসরি সাবের গায়ে। সংঘর্ষের ফলে যে প্রচণ্ড কোন আওয়াজ হলো, তা নয়। প্রায় কোন শব্দই হলো না। সাবটা এই ছিল, এখন নেই। দেরিতে হলেও, জাহাজের হেলমসম্যান ক্রুদের চিৎকার শুনতে পেয়েছে। সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব নয়, বুঝতে পেরে জাহাজ থামাবার চেষ্টা করছে সে। ক্রুরাও বসে নেই, পালগুলো নামিয়ে ফেলছে তারা। আবার চালু হলো জাহাজের এঞ্জিন, রেইলিং থেকে পানিতে ফেলা হলো লাইফ রিঙ।

অল্পের জন্যে রক্ষা পেল অ্যাল, ছিটকে দূরে না পড়লে জাহাজের খোলে বাড়ি খেত। নাক দিয়ে নোনা পানি ঢুকল, খক খক করে কাশছে সে। কয়েকটা মাথা ঢেউয়ের মাথায় ডুবছে আর ভাসছে। গুণে দেখল, ছয়টা। আশ্চর্য, জাহাজ চড়াও হলেও, কেউ তেমন মারাত্মকভাবে আহত হয়নি। সবাই লাইফ রিঙ ধরার জন্যে সাঁতার দিচ্ছে।

পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে চাইনিজ জাহাজ। নামটা পড়ল অ্যাল, সাংহাই শেলি। ভাগ্যকে ধিক্কার দিল সে বন্ধুকে ফিরিয়ে আনার কোন সুযোগই আর থাকল না।

না, একটা উপায় আছে। দ্বিতীয় সাবটা নিয়ে নামতে হবে তাকে।

তবে আগের কাজ আগে। চারদিকে তাকাল সে, চিৎকার করল, কেউ আহত হলে হাত তোলো!

তরুণ এক জিওলজিস্ট একা হাত তুলল। আমার একটা গোড়ালি মচকে গেছে।

ধীর ধীরে ঘুরে ফিরে এল জাহাজ, স্থির হলো ওদের দশ মিটার দূরে। রেইলিং থেকে নিচের দিকে ঝুঁকে পড়লেন পৌঢ় এক ভদ্রলোক।

কেউ আহত হয়েছেন? চিৎকার করলেন। আমরা কি বোট নামাব?

গ্যাংওয়ে নামান, নির্দেশ দিল অ্যাল। আপনাদের জাহাজে চড়ব আমরা। তারপর বলল, চারদিকে নজর রাখুন। নিচে থেকে আমাদের আরও একটা সাব উঠে আসছে।

শুনতে পেয়েছি।

পাঁচ মিনিট পর, একজন বাদে প্রথম সাবের সব কয়জন ক্রু সাংহাই শেলির ডেকে দাঁড়িয়ে আছে, একা শুধু তরুণ জিওলজিস্টকে জালে আটকে জাহাজে তোলার পর সিক-বেতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পৌঢ় লোকটা এগিয়ে এসে অ্যালের সামনে দাঁড়ারেন। গড, সত্যি আমরা দুঃখিত। একেবারে শেষ মুহূর্তে আপনাদের আমরা দেখতে পাই।

আপনাদের দোষ নয়। আমরা আপনাদের খোলের নিচে পড়ে গিয়েছিলাম।

কেউ নিখোঁজ হয়েছে?

ভাগ্যকে ধন্যবাদ, না।

ঈশ্বর মহান। তবে আজকের দিনটাই বিদঘুটে। এখান থেকে আঠারো-বিশ কিলোমিটার দূরে আরেক ভদ্রলোককে জাহাজে তুলেছি আমরা। তাঁর অবস্থা ভাল নয়। নাম বলছেন জিমি নক্স। উনি আপনাদের কেউ?

না, বলল অ্যাল। আপনাদের বাকি সবাই দ্বিতীয় একটা সাবমারসিবলে রয়েছে।

ক্রুদের নির্দেশ দিয়েছি, তারা যেন চোখ মেলে থাকে। খোলা সাগরের উপর চোখ বুলালেন পৌঢ়। আপনারা এলেন কোত্থেকে?

পরে ব্যাখ্যা করব। আপনাদের রেডিওটা কি ব্যবহার করতে পারি?

অবশ্যই। ভাল কথা, আমি ওয়েন মারফি।

অ্যাল জিওর্দিনো।

কোয়ার্টার ডেকের একটা বড় কেবিন দেখিয়ে পৌঢ় বললেন, ওদিকে চলে যান মি. জিওর্দিনো। আপনি রেডিওতে কথা বলুন, ইতোমধ্যে আপনার লোকদের শুকনো কাপড়ের ব্যবস্থা করি আমি।

অসংখ্য ধন্যবাদ, তাড়াতাড়ি কেবিনটার দিকে এগোল অ্যাল। সাগরের তলায় আটকা পড়ে আছে পিট ও মি, প্লাঙ্কেট, দৃশ্যটা কল্পনা করে শিউরে উঠল সে।

নুমার দ্বিতীয় সাবমারসিবল সাংহাই শেলির আধ কিলোমিটার দূরে ভেসে উঠল। পানিতে না ভিজে জাহাজে উঠতে পারল ক্রুরা।

পরিস্থিতি সম্পর্কে অ্যাডমিরাল স্যানডেকারকে একটা ধারণা দিয়ে আগেই ডেকে বেরিয়ে এসেছে অ্যাল, ফ্লাইং বোটে চড়ে রওনা হয়ে গেল সাবমারসিবলের উদ্দেশ্যে। সাব থেকে অর্ধেকটা বেরিয়ে আছে ডেভ, তার উদ্দেশ্যে চিৎকার করল অ্যাল, স্ট্যান্ড বাই! ওটাকে আমি নিচে নিয়ে যেতে চাই।

মাথা নাড়ল ডেভ। সম্ভব নয়। ব্যাটারি কেসিং-এর লিক দেখা দিয়েছে। চারটে ব্যাটারি শেষ। আরেকটা ডাইভ দেয়ার মত শক্তি নেই।

হতাশায় মুষড়ে পড়ল অ্যাল, রেইলিং ঘুসি মারল সে। নুমার বিজ্ঞানী ও এঞ্জিনিয়ার, স্টেসি ও ড. স্যালাজার, এমন কি সাংহাই শেলির ক্রুরাও বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল তার দিকে।

নট ফেয়ার, বিড়বিড় করছে অ্যাল। নট ফেয়ার।

অনেকক্ষণ ওখানেই, একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকল অ্যাল, তাকিয়ে আছে সাগরের দিকে, যেন পানির তলায় কি ঘটছে দেখার চেষ্টা করছে। আকাশে অ্যাডমিরাল স্যানডেকারের এয়ারক্রাফট উদয় হলো, চক্কর দিচ্ছে সাংহাই শেলিকে ঘিরে, তখনও রেইলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে অ্যাল।

.

কোন রকম জ্ঞান আছে জিমি নক্সে, কেবিনে ঢুকল ড. স্যালাজার ও স্টেসি। বেডের পাশে এক ভদ্রলোক বসে আছেন চেয়ারে, ওদেরকে দেখে দাঁড়ালেন তিনি। হ্যালো, আমি হ্যারি ডিয়ারফিল্ড। আপনারা কি মি. জিমি নক্সেকে চেনেন?

আমরা বন্ধু, একই ব্রিটিশ সার্ভে শিপের সহকর্মী, জবাব দিলেন ড. স্যালাজার। কেমন আছেন উনি?

সুস্থ হতে সময় নেবেন, বললেন হ্যারি ডিয়ারফিল্ড। এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন।

আপনি কি ডাক্তার।

পিডিঅ্যাট্রিকস, আসলে। ছয় সপ্তার ছুটি নিয়ে ওয়েনকে সাহায্য করছি এই ভয়েজে। জিমি নক্সের দিকে ফিরলেন তিনি। মি. নক্স, আপনার বন্ধুরা আপনাকে দেখতে এসেছেন।

চোখ না খুলে একটা হাত তুলে একবার আঙুল নাড়লেন জিমি নক্স। তার মুখ ফুলে আছে, কয়েক জায়গায় আঁচড়ের দাগ। ধীরে ধীরে চোখ মেললেন তিনি। ড. স্যালাজার ও স্টেসিকে চিনতে পেরে উজ্জ্বল হয়ে উঠল চোখ দুটো। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আপনারা নিরাপদে আছেন। ভাবিনি আবার আপনাদের দেখতে পাব। সেই উন্মাদ ভদ্রলোক…মি. প্লাঙ্কেট কোথায়?

তিনি একটু পরই আসছেন, বলল স্টেসি, ড. স্যালাজারকে চুপ থাকার ইঙ্গিত করল। কি ঘটেছিল, জিমি? আমাদের ইনভিনসিবল কোথায়?

দুর্বল ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন জিমি নক্স। জানি না। কোন এক ধরনের বিস্ফোরণ ঘটেছিল। আপনাদের সাথে আন্ডারওয়াটার ফোনে কথা বলছিলাম, হঠাৎ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল গোটা জাহাজ, আগুন ধরে গেল চারদিকে। কোন রকমে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি, চোখের সামনে ডুবে গেল জাহাজ…।

ডুবে গেল? বিড়বিড় করল স্টেসি, মেনে নিতে পারছে না। ইনভিনসিবল ডুবে গেছে, আমাদের ক্রুরা সবাই মারা গেছে?

কতক্ষণ ভেসে ছিলাম বলতে পারব না, ওয়েন মারফির ক্রুরা আমাকে দেখতে পেয়ে তুলে আনে। আশপাশে সার্চ করে ওরা, কিন্তু আর কাউকে পায়নি।

কিন্তু আমরা যখন ডাইভ দেই, কাছাকাছি আরও দুটো জাহাজ ছিল! বলল স্টেসি। সেগুলো গেল কোথায়?

কোথাও দেখিনি। বোধহয় ওগুলোও তলিয়ে গেছে, ফিসফিস করে বললেন জিমি নক্স, মনে হলো যে-কোন মুহূর্তে আবার জ্ঞান হারাবেন। ইচ্ছাশক্তি আছে, কিন্তু শরীরে বল নেই। চোখ বন্ধ করলেন তিনি, মাথাটা এদিকে কাত হয়ে পড়ল।

ডাক্তার হ্যারি ডিয়ারফিল্ড ইঙ্গিতে দরজাটা দেখিয়ে দিলেন ওদেরকে। আপনারা পরে কথা বলবেন, ওঁর এখন বিশ্রাম দরকার।

ওর সমস্যাটা কি? জানতে চাইলেন ড. স্যালাজার।

এক্স-রে ছাড়াই বলছি, পাঁজরের দুতিনটে হাড় ভেঙেছে। এ ধরনের আঘাতের চিকিৎসা আমার জানা আছে। কিন্তু…,

কিন্তু?

কিন্তু বাকি সব লক্ষণগুলো অদ্ভুত, জাহাজডুবি থেকে বাঁচা কোন মানুষের মধ্যে দেখা যায় না।

কি বলছেন, কিছুই তো বুঝতে পারছি না! তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললেন ড. স্যালাজার।

জ্বর, লো ব্লাড প্রেশার, ইরাইথেমা, স্টমাক ক্র্যাম্প, অদ্ভুত ধরনের ফোঁসকা।

কারণ?

কাঁধ ঝাঁকালেন ডাক্তার হ্যারি ডিয়ারফিল্ড। আমার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বাইরে। এ বিষয়ে মেডিকেল জার্নালে দু একটা আর্টিকেল পড়েছি শুধু। তবে একথা বললে ভুল হবে না যে মি. জিমি নক্সের সিরিয়াস লক্ষণগুলোর কারণ হলো রেডিয়েশন।

এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল স্টেসি, তারপর জানতে চাইল, নিউক্লিয়ার রেডিয়েশন?

মাথা ঝাঁকালেন ডাক্তার হ্যারি ডিয়ারফিল্ড। আমার তাই বিশ্বাস।

তাহলে ওঁকে বাঁচার উপায়?

এখানে চিকিৎসার সুবিধে নেই বললেই চলে। আমি এসেছি ডেক হ্যান্ড হিসেবে। আমার ব্যাগে শুধু ট্যাবলেট, অ্যান্টিসেপটিক ও ব্যান্ডেজ আছে। একটু থেমে আবার বললেন, আমরা তীরের আরও কাছাকাছি না পৌঁছলে ওঁকে হেলিকপ্টারে ভোলাও সম্ভব নয়। তারপরও আমার সন্দেহ আছে, থেরাপিউটিক ট্রিটমেন্টের সাহায্যে ওঁকে বাঁচানো যাবে কিনা।

শালাদের ফাঁসি দাও! হঠাৎ গর্জে উঠলেন জিমি নক্স, চমকে উঠে সবাই তাঁর দিকে তাকাল। ভদ্রলোকের চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে আছে, সামনে দাঁড়ানো লোকজনকে ভেদ করে দৃষ্টি চলে গেছে বাঙ্কহেড ফুড়ে দূরে কোথাও। শালাদের ফাঁসিতে ঝোলাও।

তাঁকে অমন করতে দেখে ভয় পেল স্টেসি। নিজের জায়গা ছেড়ে নড়তে পারল না। বিছানার দিকে ছুটে এলেন ড. স্যালাজার ও হ্যারি ডিয়ারফিল্ড। বিছানার উপর ছটফট করছেন জিমি নক্স, ব্যর্থ চেষ্টা করছেন উঠে বসার।

বেজন্মা কুত্তাগুলোকে খতম করো! হিংস্র আক্রোশে বারবার গর্জন করছেন। তিনি, কাদের যেন অভিশাপ দিচ্ছেন। আবার ওরা খুন করবে! শালাদের ফাঁসি দাও।

একটা ইঞ্জেকশন দেয়ার চেষ্টা করলেন হ্যারি ডিয়ারফিল্ড, কিন্তু তার আগেই জিমি নক্সের শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেল। মুহূর্তের জন্যে চকচকে হয়ে উঠল চোখ দুটো, তারপর কুয়াশার মত মিহি একটা পর্দা পড়ল। বিছানার উপর নেতিয়ে পড়লেন তিনি। অসাড় হয়ে গেল শরীর।

বুকে চাপ দিয়ে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের সাহায্যে জিমি নষ্মে দম ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হলো। কিন্তু কোন লাভ হলো না। এক সময় ঘর্মাক্ত হ্যারি ডিয়ারফিল্ড জানালেন, ভদ্রলোক মারা গেছেন।

যেন সম্মোহিত, কেবিন থেকে বেরিয়ে এল ওরা। স্টেসি নিঃশব্দে কাঁদছে, ড. স্যালাজার গম্ভীর ও বিষণ্ণ।

কিছু সময় পর, চোখ মুছে স্টেসি বললো, উনি কিছু একটা দেখেছিলেন।

তার দিকে তাকায় স্যালাজার। কি দেখেছিলেন?

কোনো এক অসাধারণ উপায়ে তিনি জানতেন, খোলা দরোজা দিয়ে নিথর দেহটার দিকে তাকিয়ে থাকে স্টেসি। মৃত্যুর কিছুসময় আগে জিমি বুঝতে পেরেছিলো এই ধ্বংসলীলা আর মৃত্যুর জন্যে কারা দায়ী।

.

১১.

লাল চুল খুলি কামড়ে আছে, তার ওপর পানামা স্ট্র, হ্যাঁ। নীল গলফ শার্ট, তার সাথে ম্যাচ করা প্যান্ট পরেছেন ভদ্রলোক। একহারা গড়ন, তলোয়ারের মত খাড়া ও ঋজু। বয়েস হয়েছে, বৃদ্ধই বলা যায়, তবে আসলে তিনি চির তরুণ। সাংহাই শেলির গ্যাংওয়ের ওপর দিয়ে একটা দমকা বাতাসের মত উঠে এলেন, মুখের চুরুটটা থেকে আগুনের ফুলকি ছুটছে চারদিকে। নাটকীয় উদয় বা আবির্ভাবের জন্যে অস্কার দেয়ার প্রচলন থাকলে, কোন সন্দেহ নেই, ন্যাশনাল আন্ডারওয়াটার অ্যান্ড মেরিন এজেন্সির ডিরেক্টর অ্যাডমিরাল স্যানডেকার প্রথম পুরস্কারটি ঠিকই ছিনিয়ে নিতেন। প্লেনে থাকতেই অ্যালের কাছ থেকে দুঃসংবাদটা পেয়েছেন তিনি, কাজেই থমথম করছে তার চেহারা। সাংহাই শেলির ডেকে পা দিয়েই ফ্লাইং বোট এর পাইলটের উদ্দেশ্যে একটা হাত তুললেন, পাইলটও সাড়া দিয়ে হাত নাড়ল। বাতাসের দিকে ঘুরে ছুটল এয়ারক্রাফট, ঢেউয়ের মাথায় বাড়ি খেল বার কয়েক, তারপর শূন্যে উঠে পড়ল। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে হাওয়াইয়ান দ্বীপগুলোর দিকে চলে যাচ্ছে।

অ্যাল সামনে বাড়ল, সাথে ওয়েন মারফি অর্থাৎ সাংহাই শেলির মালিকও। রয়েছেন। মালিকের দিকেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন অ্যাডমিরাল। হ্যালো, ওয়েন। ভাবিনি এখানে তোমার সাথে দেখা হবে আমার।

ঠোঁটে মৃদু হাসি, অ্যাডমিরালের সাথে করমর্দন করলেন ওয়েন মারফি। আমারও তো সেই কথা, জেমস। তোমাকে দেখে ভারি খুশি লাগছে আমার। ইঙ্গিতে নুমার টিমটাকে দেখালেন তিনি, ওদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সবাই, এবার হয়তো কেউ আমাকে জানাবে কাল আলো ও বজ্রপাতের যে প্রদর্শনীটা দেখলাম, আসলে সেটা কি ছিল কারাই বা দায়ী। আরও জানতে পারব, এরা সবাই সাগরের মাঝখানে হাবুডুবু খাচ্ছিল কেন।

সরাসরি জবাব দিলেন না, অ্যাডমিরাল। ডেকের চারদিকে তাক আনা পালগুলো দেখলেন। এটা আসলে কি দেখছি আমরা?

এটা একটা চাইনিজ জাংক, শখ করে বানিয়েছি। হংকং থেকে হনলুলু যাচ্ছি আমরা, ওখান থেকে যাব সান ডিয়াগো।

পরস্পরকে আপনারা চেনেন? অবশেষে জানতে চাইল অ্যাল।

মাথা ঝাঁকালেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার। নেভিতে একই সাথে নাম লেখাই আমরা, কিন্তু পরে রিজাইন করে ও। ইলেকট্রনিকস্-এর ব্যবসা করে প্রচুর কামিয়েছে, ইউএস ট্রেজারিতে যত টাকা আছে, তারচেয়ে বেশি আছে ওয়েন মারফির কাছে।

বাড়িয়ে বলার দোষটা তোমার এখনও তাহলে আছে! লাজুক হাসি দেখা গেল ওয়েন মারফির ঠোঁটে।

হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠলেন অ্যাডমিরাল। বেস-এর শেষ খবর কি, অ্যাল?

ওটা বোধহয় হারিয়েছি আমরা, শান্তস্বরে জবাব দিল অ্যাল। আমাদের অবশিষ্ট সাব থেকে আন্ডারওয়াটার টেলিফোনে সাড়া পাবার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিছু শোনা যায়নি। হ্যারিসের ধারণা, বেস থেকে আমরা বেরিয়ে আসার একটু পরই প্রচণ্ড শক ওয়েভ আঘাত করেছিল। আপনাকে আমি আগেই জানিয়েছি, সাব দুটোয় আমাদের সবার জায়গা হয়নি। পিট ও ব্রিটিশ মেরিন সায়েন্টিস্ট ভদ্রলোক স্বেচ্ছায় নিচে থাকার সিদ্ধান্ত নেন।

ওদেরকে বাঁচানোর জন্যে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?

মাথা নিচু করল অ্যাল। দুঃখিত, অ্যাডমিরাল করার মত কিছু নেই আমাদের।

কে আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে? অ্যাল? অ্যাল জিওর্দিনো? ডার্ক পিটের ঘনিষ্ঠ বন্ধু? প্রচন্ড গর্জে উঠলেন অ্যাডমিরাল, অ্যাল? সে-ই তুমি ওকে সাগরের সাড়ে পাঁচ হাজার মিটার নিচে রেখে এসে বলছ, ওকে উদ্ধার করার জন্যে কিছুই তোমার করার নেই? কেন, তুমি না বললে ব্যাকআপ সাবমারসিবল নিয়ে ফিরে যাবে?

বলেছিলাম ডেভ বাতিল ব্যাটারি নিয়ে উঠে আসার আগে। প্রথমটা ডুবে গেছে, দ্বিতীয়টা অচল, এখন আপনিই বলুন কি করার আছে আমাদের।

অ্যাডমিরাল চেহারা নরম হলো। মাথা থেকে পানামা স্ট্র হ্যাঁ নামিয়ে পায়চারি শুরু করলেন তিনি। পিটকে তিনি আপন সন্তানের মত ভালবাসেন। অ্যালের সামনে দাঁড়ালেন একবার। ব্যাটারি মেরামত করা যায় না?

ইঙ্গিতে সাবমারসিবলটা দেখার অ্যাল, বিশ মিটার দূরে ঢেউয়ের মাথায় দুলছে।চেষ্টার কোন ত্রুটি করছে না ডেভ, তবে আশা না করাই ভাল।

কেউ যদি দায়ী হয় তো আমি, মন খারাপ করে বললেন ওয়েন মারফি।

অ্যাাল বলল, আমার ধারণা, এখনও বেঁচে আছে পিট। সহজে মরার লোক নয় সে।

তার দিকে কটমট করে তাকালেন অ্যাডমিরাল, মাথার চুলে আঙুল চালাচ্ছেন।

অ্যাল বলল, এখানে যদি আমরা আরেকটা সাব আনতে পারি…।

ডীপ কোয়েস্ট দশ হাজার মিটার নিচে নামতে পারে, বললেন অ্যাডমিরাল, রেইলিঙের সামনে চলে এলেন। লস অ্যাঞ্জেলস হারবারে আমাদের ডকে রয়েছে ওটা। হাতঘড়ির ওপর চোখ বুলালেন। নিয়ে আসতে আট ঘণ্টার মত লাগবে।

কিভাবে আনবে? জানতে চাইলেন ওয়েন মারফি।

এয়ার ফোর্স সি-ফাইভে করে।

তুমি বলছ, একটা বারো টন সাবমারসিবলকে এরোপ্লেন বা হেলিকপ্টার থেকে পানিতে নামাবে?

তাছাড়া উপায় কি! বোটে করে আনতে এক সপ্তাহ লেগে যাবে।

তবু তোমাদের একটা সাপোর্ট শিপ লাগবে বলে মনে হয়, বললেন ওয়েন। তুমি চাইলে আমাদের সাংহাই শেলিকে কাজে লাগাতে পারো।

বন্ধুর কাঁধে একটা হাত রাখলেন অ্যাডমিরাল। তোমার জাহাজটাকে যদি ফ্লিট কমান্ড শিপ হিসেবে কাজে লাগানো যায়, ভারি উপকার হবে। নুমার তরফ থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ, ওয়েন।

ফ্লিট? তার মানে?

কেন, জানো না ইউএস নেভির অর্ধেক জাহাজ চারদিক থেকে ছুটে আসছে এদিকে? জানতে চাইলেন অ্যাডমিরাল, যেন ধরেই নিয়েছেন, রেইমন্ড জর্ডান গোপনে তাঁকে যে ব্রিফ করেছেন সে কথা কারও অজানা নেই। এই মুহূর্তে যদি এখানে ওদের একটা নিউক্লিয়ার সাবমেরিন মাথা তোলে, একটুও অবাক হব না। বিশ কিলোমিটার দূরে রয়েছে অ্যাটাক সাবমেরিন টাকসন। পানির চারশো মিটার নিচে দিয়ে ছুটে আসছে সাংহাই শেলির দিকে। সাবমেরিনের কমান্ডার, বিউ মরটন পার্ল হারবারে থাকার সময় নির্দেশ পেয়েছেন, বিস্ফোরণ এলাকায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছতে হবে তাকে। ওখানে পৌঁছে আন্ডারওয়াটার রেডিওলজিক্যাল কনটামিনেশন সম্পর্কে পরীক্ষা চালাতে হবে, ভাসমান কোন আবর্জনা থাকলে নিরাপদে তুলে নিতে হবে সাবমেরিনে। একটা বাল্কহেডের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বিউ মরটন, এক হাতে খালি একটা কাপ, তাকিয়ে আছেন ন্যাভাল রেডিওলজিক্যাল ডিফেন্স ল্যাবরেটরির কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার স্যাম হাউজারের দিকে। নেভির বিজ্ঞানী ভদ্রলোকে বিউ মরটনের উপস্থিত সম্পর্কে সচেতন বলে মনে হল না। নিজের কাজে মগ্ন তিনি। সাবমেরিনের পিছনে লেজের মত লম্বা হয়ে আছে যন্ত্রপাতি ঠাসা একাধিক প্রোব, রেডিও-কেমিক্যাল ইনস্ট্রমেন্ট ও কমপিউটারের সাহায্যে ছবিটা ও গামা-র মাত্রা ও ঘনত্ব মনিটর করছেন তিনি।

আমরা কি এখনও অন্ধকারে? জানতে চাইলেন বিউ মরটন।

রেডিওঅ্যাকটিভিটি কোথাও বেশি, কোথাও কম ডিসট্রিবিউট করা হয়েছে, বললেন স্যাম হাউজার। তবে ম্যাক্সিমাম পারমিসিবল এক্সপোজার এর যথেষ্ট নিচে। হেভিয়েস্ট কনসেনট্রেশন উপর দিকে।

সারফেস ডিটোনেশন?

হ্যাঁ-জাহাজ, সাবমেরিন নয়। বাতাসই বেশিরভাগ দূষিত হয়েছে।

আমাদের উত্তরে যে চীনা জাহাজটা রয়েছে, ওটার কোন ক্ষতি হবে না তো?

মাথা নাড়লেন স্যাম হাউজার। অনেকটা দূরে রয়েছে ওরা, বাতাসের উল্টোদিকে। সামান্য একটু ছোঁয়া পাবে মাত্র।

কিন্তু এই মুহূর্তে বিস্ফোরণ এলাকার দিকে ভেসে আসছে যে?

বিস্ফোরণের আগে ও পরে প্রবল বাতাস ছিল, সাগরও ছিল অশান্ত, বললেন হাউজার। বেশিরভাগ রেডিয়েশন পূর্ব দিকে আকাশে উঠে গেছে। কমপার্টমেন্টের ফোনটা পিপ-পিপ করে উঠল। রিসিভার তুলে কানে ঠেকালেন তিনি। ইয়েস?

ক্যাপটেন কি ওখানে আছেন, স্যার?

রিসিভারটা বিউ মরটনের হাতে ধরিয়ে দিলেন হাউজার।

দিস ইজ দ্যা ক্যাপটেন।

স্যার, সোনারম্যান কাইজার। অদ্ভুত একটা কনট্যাক্ট, স্যার। আপনার শোনা উচিত।

এখুনি আসছি, বলে রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন বিউ মরটন।

সোনারম্যানকে পাওয়া গেল তার কনসোলের কাছে, কানে এয়ারফোন আটকে কি যেন শুনছে, কুঁচকে আছে ভুরু জোড়া। বিউ মরটনের এক্সিকিউটিভ অফিসার, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার তার দিকে একজোড়া স্পেয়ার ফোন বাড়িয়ে ধরলেন। তাড়াতাড়ি সেটা কানে আটকালেন তিনি। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করলেন, কিন্তু কিছুই শুনতে পেলেন না। কোথায় কন্ট্রাক্ট?

সাথে সাথে জবাব না দিয়ে আরও কয়েক সেকেন্ড শোনার চেষ্টা করল সোনারম্যান কাইজার, তারপর বাম কান থেকে এয়ারফোন নামিয়ে বলল, আশ্চর্য ব্যাপার।

আশ্চর্য? কি আশ্চর্য?

দাঁড়ান, স্যার প্লীজ! স্পিকারটা অন করি।

অদ্ভুত যোগাযোগের কথা এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে সাবমেরিনের সবখানে, সোনার এনক্লোজারের ভেতর অফিসারদের ভিড় কমে গেল। স্পিকার অন করা হতেই শোনা গেল আওয়াজটা। অস্পষ্ট, তবে দুর্বোধ নয়। কারা যেন কোরাস গাইছে।

অ্যান্ড এভরি নাইট হোয়েন দ্য স্টারফিশ কেইম আউট,
আই উড হাগ অ্যান্ড কিস হার সো।
ওহ, হোয়াট আ টাইম আই হ্যাড উইথ মিনি দ্য মারমেইড
ডাউন ইন হার সীমী বাংলো।

নিশ্চয় সাংহাই শেলি থেকে আসছে। বললেন বিউ মরটন।

না, স্যার। কোন জাহাজ বা কোন সারফেস ভেসেল থেকে আসছে না।

আরেকটা সাবমেরিন থেকে? রাশিয়ান নাকি?

মাথা নাড়লেন ফাৎসিও। না। এদিকে রাশিয়ানদের কোন সাবমেরিন নেই।

রেঞ্জ? বিয়ারিং? জানতে চাইলেন বিউ মরটন।

ইতস্তত করছে সোনারম্যান কাইজার। যেন বাচ্চা একটা ছেলে বিপদে পড়েছে, ভয় পাচ্ছে সত্যি কথা বলতে। হরাইজেন্টাল কমপাস বিয়ারিং নেই, স্যার। কোরাসটা ভেসে আসছে সাগরের তলা থেকে, সোজা পাঁচ হাজার মিটার নিচ থেকে।

.

১২.

গিরিখাদের তলায়, যেখানে একসময় নুমার মাইনিং স্টেশন ছিল, পলি ও পাথর ধসে ঢাকা পড়ে গেছে। এবড়োখেড়ড়া, উঁচু-নিচু একটা প্রান্তরে পরিণত হয়েছে। জায়গাটা, বোল্ডার স্তূপগুলোকে ঘিরে ভেসে বেড়াচ্ছে মিহি পলির মেঘ। ভূমিকম্পের কাঁপন ও গর্জন থেকে যাবার পর মৃত্যুপুরীর নিস্তব্ধতা নেমে আসার কথা, কিন্তু তা নামেনি, সাগরের অতল গহবরে ভেসে বেড়াচ্ছে একটা গানের আওয়াজ।

শব্দের উৎস সন্ধানে কেউ যদি জঞ্জাল ভর্তি প্রান্তরের ওপর দিয়ে এই মুহূর্তে হাঁটে, নিঃসঙ্গ একটি অ্যান্টেনা শ্রাফট দেখতে পারে বসে বাঁকা ও মোচড়ানো, মাথাচাড়া দিয়ে আছে কাদার ওপর। একটা লালচে-খয়েরি র‍্যাটফিশ দুএক মুহূর্তের জন্যে পরীক্ষা করল অ্যান্টেনাটা, তারপর উৎসাহ হারিয়ে চোখা লেজ নেড়ে দূরে সরে গেল।

একটু পর অ্যান্টেনা থেকে কয়েক মিটার দূরে নড়ে উঠল পলিমাটির স্তূপ, শুরু হলো একটা ঘূর্ণি, ক্রমশ আকারে বড় হচ্ছে, ভেতর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে একা আলো। আলোর ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল একটা যান্ত্রিক হাত, চ্যাপ্টা কোদাল আকৃতির, হাতলের কাছটা গিটসর্বস্ব। যান্ত্রিক হাতটা শিকারী কুকুরের মত সিধে হলো, তারপর যেন শিকারের সন্ধানে বাতাস শুঁকতে শুঁকতে চারদিকে তাকাল।

তারপর কোদালটা বাঁকা হয়ে নিচের দিকে ঝুঁকল, গভীর একটা ট্রেঞ্চ কুঁড়ছে। ট্রেঞ্চের গা ঢালু হয়ে নেমে গেছে নিচের দিকে। খোঁড়ার কাজ তখনও শেষ হয়নি, বড় একটা বোল্ডার বাধা হয়ে দাঁড়াল কোদালের তুলনায় বোল্ডারটা বড়। কোদালের পাশে চলে এল বিশাল একটা ধাতব থাবা। থাবার আঙ্কটাগুলো মোন পাখির বাঁকা নখের মত, চারদিক থেকে আঁকড়ে ধরল বোল্ডারটাকে, কাদা থেকে তুলে ফেলল টান দিয়ে, ফেলে দিল ট্রেঞ্চের বাইরে অনেকটা দূরে। আবার নিজের জায়গায় সরে গেল থাবা, নিজের কাজ শুরু করল কোদাল।

নাইস ওঅর্ক, ডার্ক, চীফ এঞ্জিনিয়ার প্লাঙ্কেট বললেন, পরম স্তস্তিতে নিঃশব্দে হাসছেন। লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে বিকেলের চা খাওয়ার আগেই বাড়িতে পৌঁছে যাব।

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রযেছে পিট, গভীর মনোযোগের সাথে তাকিয়ে আছে টিভি মনিটরের দিকে।এখনও আমরা রাস্তায় পড়িনি।

আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কার কতিত্ব? ভাগ্যের, নাকি প্রতিভার? আমি বলব, প্রতিভার। ভূমিকম্পের মূল ধাক্কাটা লাগার আগেই আমরা আপনার একটা ডীপ সী মাইনিং ভেসেলে ঢুকে পড়ি, তারপর টুকি এয়ার প্রেশার লকে। মাত্র কয়েক সেকেন্ড দেরি করলে এ যাত্রা আর বাঁচতে হত না।

ভাগ্যের কৃতিত্ব হচ্ছে, এয়ার-লকের দেয়াল টিকে গেছে, ভেঙে পড়েনি, বিড়বিড় করে বলল পিট, ভেহিকেলের কমপিউটারকে নির্দেশ দিচ্ছে কোদালটাকে আরও একটু বাঁকা করতে।

ডিএসএমভি-র চারদিকে তাকালেন প্লাঙ্কেট। সত্যি, অদ্ভুত একটা মেশিন। এর শক্তির উৎসটা কি?

ছোট একটা নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর।

নিউক্লিয়ার? মাই গড! আমার ধারণা, সাগরের তলা দিয়ে ইচ্ছে করলে আমরা এটা নিয়ে ওয়াইকিকি সৈকতে পৌঁছে যেতে পারি, কি বলেন?

বিগ জনের রিয়্যাক্টর ও লাইফ-সাপোর্ট সিস্টেম সাহায্য করবে আমাদের, তবে এটার গতি খুব কম, ঘণ্টায় মাত্র পাঁচ মাইল। পৌঁছবার আগে না খেতে পেয়ে মারা যাব আমরা।

এখানে কোন খাবার নেই, বলতে চাইছেন?

একটা আপেলও না।

না খেয়ে মরি, তাতে আফসোস নেই, বললেন প্লাঙ্কেট। মরার সময় গান শুনতে পারব, এটাই বা কম কিসে!

টেলিফোন হাউজিং চুরমার হয়ে গেছে, কাজেই সারফেসের সাথে যোগাযোগ করার একমাত্র মাধ্যম জলো অ্যাকুসটিক রেডিও ট্রান্সমিটার। আলাপ করার জন্যে রেঞ্জ অবশ্য যথেষ্ট নয়, তবে এটা ছাড়া আর কিছু নেই আমাদের। কোরাসটা কেউ যদি শুনতে পায়, বুঝতে পারবে এখানে কেউ বেঁচে আছে।

তাতে যে কতটুকু উপকার হবে, বলা মুশকিল, ম্লান কণ্ঠে বললেন প্লাঙ্কেট। ধরুন, একটা রেসকিউ মিশন পাঠানো হলো, কিন্তু প্রেশার-লক না থাকায় এই ভেহিকেল থেকে একটা সাবমারসিবলে আমরা ঢুকব কিভাবে? পকেট থেকে একটা ফাস্ক বের করে পিটের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন তিনি। নিন, আর চার পাঁচ ঢোক অবশিষ্ট আছে।

ডিগিং অপারেশন শুরু করার পর পাঁচ ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। এতক্ষণে টিভির পর্দার সরু তবে প্রায় পরিচ্ছন্ন একটা করিডর দেখতে পেল পিট, ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠে গেছে মেঝেটা। কমপিউটারকে দায়িত্ব থেকে আপাতত অব্যাহতি দিয়ে ম্যানুয়াল কন্ট্রোল চালু করল ও।

থ্রটল কন্ট্রোল ধীরে ধীরে সামনের দিকে ঠেলল পিট। বিগ জনের দুধারের চওড়া ট্র্যাক ঘুরতে শুরু করল। গতি ধীরে ধীরে বাড়াল পিট। এ ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে এগাল বিগ জন। তারপর কাদায় আটকে গেল একটা চাকা।

কাদা সরাতে হবে, বলল পিট।

তারপর আবার ওই কাদাতেই আটকা পড়বে, মন্তব্য করলেন প্লাঙ্কেট, হতাশা চেপে রাখতে পারছে না।

আমাদের গোটা প্রজেক্ট ভেস্তে গেছে, গম্ভীর সুরে বলল পিট। আপনারা আপনাদের সাবমারসিবল, সাপোর্ট শিপ ও ক্রুদের হারিয়েছেন। এ-সবের জন্যে কেউ না কেউ দায়ী।

বেশ, দায়ী! তো কি হলো?

কি হল মানে? যদি বাঁচি তো দেখতে পাবেন! ব্যাটাদের ঠিকই আমি খুঁজে বের করব! অদ্ভুতদর্শন যান্ত্রিক হাতটার সাহায্যে কাদা সরাবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল পিট। ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন ব্রিটিশ সার্ভে টিমের চীফ এঞ্জিনিয়ার প্লাঙ্কেট।

.

০৮.

হাজার কিলোমিটার দূরে, ম্যানিলা বে-র মুখের কাছে একটা পাথুরে দ্বীপ। পাহাড়ের ঢালে পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে খাড়া একটা সুড়ঙ্গ, বাঁকা হয়ে নেমে গেছে নিচে। বিশজন শ্রমিক নিচে দাঁড়িয়ে পাথর ও মাটি কেটে একটা গর্ত তৈরি করছে, দুজন ভদ্রলোককে এগিয়ে আসতে দেখে সরে দাঁড়াল তারা। ফ্লাডলাইটের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে আছে সুড়ঙ্গের ভেতরটা। খানিক সামনে একটা টানেল দেখা গেল, ভেতরে একটা পুরানো ও মরচে ধরা ট্রাক দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাহাড়ের গভীর গহরে নামার জন্যে এক সময় আঁকাবাঁকা টানেল ব্যবহার করা হত, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ দিকে ডিনামাইট ফাটিয়ে টানেলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

ইয়ামাশিটার গুপ্তধন-এর সন্ধানে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে এখানে। ১৯৪৪ সালের অক্টোবরের পর জাপানি সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন জেনারেল ইয়ামাশিটা। যুদ্ধের সময় চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটা দেশ, ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ ও ডেইলপইন থেকে বিপুল সোনা, মূল্যবান পাথর, অলঙ্কার, রূপো, প্রাচীন মূর্তি ইত্যাদি লুট করা হয়। শুধু সোনাই লুট করা হয় কয়েক হাজার মেট্রিক টন। ম্যানিলা ছিল কালেকশন পয়েন্ট, ওখানে সংগ্রহ করে রাখার পর জাপানে সরিয়ে নিয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে আমেরিকান সাবমেরিনগুলো আক্রমণ শুরু করায় শতকরা বিশ ভাগের বেশি টোকিয়োতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কাজেই জাপানি তস্কররা লুজান দ্বীপের চারদিকে অন্তত একশো জায়গায় ওগুলো লুকিয়ে রাখার প্ল্যান করে, আশা ছিল পরে এক সময় ফিরে এসে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে।

কয়েক বছর গবেষণা করে সেই গুপ্তধন কোথায় আছে জানতে পেরেছেন ওঁরা। চলতি বাজারে ওগুলোর দাম আন্দাজ করা হয়েছে, সাড়ে চারশো থেকে পাঁচশো বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

আজ চার মাস ধরে চলছে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। সিআইন এ হেডকোয়ার্টার ল্যাংলিতে পুরানো যে ও এস এস ম্যাপগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলোর সাহায্য নিয়ে গুপ্তধনের সন্ধান করছে মার্কিন ও ডেইলাইন ইন্টেলিজেন্স-এর এজেন্টরা। ম্যাপে জাপানের একটা আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, প্রচুর সময় ও ধৈর্য লেগেছে অনুবাদ করতে। পাহাড়ের নিচে সরাসরি পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ডিনামাইট ফাটিয়ে ধসিয়ে দেয়া হয়েছে টানেলগুলো। প্রথমে পাথর কেটে একটা খাড়া শ্যাফট তৈরি করতে হয়েছে, নিচে টানেল পাবার পর কাটতে হয়েছে মাটি, পাথর ও কংক্রিটের পাঁচিল। অবশেষে গভীর একটা গর্তের ভেতর চওড়া একটু টানেলের মুখ দেখা গেল। টানেলের মুখ থেকে ভেতর দিকে ছড়িয়ে রয়েছে নিচু ঝোঁপ। সেদিকে আলো ফেলার পর দুই ভদ্রলোকের একজন, যিনি একটু বেশি লম্বা, ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, হঠাৎ আঁতকে উঠলেন। নিচু ঝোঁপগুলো আসলে কি, বুঝতে পেরেছেন তিনি।

তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন রিকো একোস্টা, ডেইলাইন সিকিউরিটি ফোর্স-রে একজন মাইনিং এঞ্জিনিয়ার। মাইনিং দেখছ, ফ্রাঙ্ক? জানতে চাইলেন তিনি।

হাড়, ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো বললেন ফিসফিস করে। কঙ্কাল। গড, কম করেও কয়েকশো হবে! পিছিয়ে এসে জায়গা করে দিলেন রিকো একোস্টাকে।

ছোটখাট ভদ্রলোক শ্রমিকদের নির্দেশ দিলেন, গর্তটা আরও চড়া করো।

গর্ত বড় করার পর নিচে মানুষ নামার সুযোগ হলো। টানেলের গা সস্তা সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, দেখে মনে হলো যে-কোন মুহূর্তে ভেঙে পড়বে। টানেলের মুখের কাছে থামলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, পকেট থেকে পাইপ বের করে তামাক ভরলেন।

কলোরাডো স্কুল অভ মাইনস থেকে গ্রাজুয়েট ডিগ্রি অর্জন করার পর কর্মজীবনের শুরুতে দীর্ঘ কয়েক বছর মূল্যবান পাথরের খোঁজে দুনিয়ার প্রায় সমস্ত এলাকার খনিতে কাজ করেছেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। অস্ট্রেলিয়ায় ওপাল, কলম্বিয়ায় এমারেল্ড, তাঞ্জানিয়ায় রুবি আবিষ্কার করেছেন। সিআইএ তাঁকে বিশেষ একটা এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করে ফিলিপাইনে পাঠায় ইয়ামাশিটা গুপ্তধনের সন্ধান! অত্যন্ত কড়া গোপনীয়তার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, গুপ্তধন পাওয়া গেলে ফিলিপাইনের বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে তা ব্যবহার করা হবে।

গল্পটা তাহলে সত্যি! তার পাশ থেকে বিড়বিড় করে বললেন রিকো একোস্টা।

মুখ তুলে তাকালেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। গল্প?

মিত্র বাহিনীর বন্দী সদস্যদেরকে দিয়ে তৈরি করানো হয় এই টানেলগুলো, টালে তৈরি হবার পর তাদের সবাইকে মেরে ফেলে জাপানিরা, কেউ যাতে এগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে না পারে।

সেরকমই মনে হচ্ছে। ভেতরে ঢোকার পর নিশ্চিত হতে পারব।

আমার কাছে আশ্চর্য লাগছে, জাপানিরা আবার ফিরে আসেনি কেন? গুপ্তধন উদ্ধার করার জন্যে?

চেষ্টা করেনি, একথা বলা যাবে না, জবাব দিলেন ম্যানকিউসো। যুদ্ধের পর নির্মাণ কাজে সহায়তার নাম করে অনেক জাপানি ঠিকাদারি কোম্পানি ফিলিপাইনে ঢুকতে চেয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল, একবার ঢুকতে পারলে গোপনে সব সরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু মার্কোস গুপ্তধনের কথা জানার পর জাপানিদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেন, নিজেই খুঁজতে শুরু করেন।

মার্কোস সব না হলেও অংশবিশেষ উদ্ধার করেন। উৎখাত হবার আগে কয়েক দফায় যে ত্রিশ বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে পাচার করেন তিনি, বলা হয় তার বেশিরভাগটাই গুপ্তধন বেচা টাকা। ঘৃণায় মুখ কুঁচকে থুথু ফেললেন রিকো একোস্টা। মার্কোস আর তাঁর স্ত্রীর লোভ আমাদের যে ক্ষতি করেছে, তা পূরণ করতে একশো বছর লাগবে আমাদের।

নাকে-মুখে কাপড় বড়িয়ে নিয়ে সামনে বাড়লেন ওঁরা, তা না হলে দুর্গন্ধে জ্ঞান হারাবেন। টানেলের ভেতর কোথাও কোথা পানি জমে রয়েছে। একবার দাঁড়ালেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, লক্ষ করলেন সিলিং থেকে পানির ধারা গড়িয়ে নিচে নামছে। হাতের টর্চটা জ্বাললেন, আলো ফেললেন নিচের দিকে।

একটা কঙ্কাল পড়ে রয়েছে সামনে, কঙ্কালের একটা হাতের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি। কঙ্কাল, তবে পরনের ইউনিফর্মটা চেনা গেল। গলায় একটা চেইন, চকচক করছে টর্চের আলোয়। লকেটের ওপর আলো ফেললেন ম্যানকিউসো, তারপর ঝুঁকে ভাল করে তাকালেন। লুকেটে নাম লেখা রয়েছে, উইলিয়াম মিলার। নামের নিচে লেখা রয়েছে আর্মি সিরিয়াল নম্বর। সিধে হলেন ম্যানকিউসো, আলোটা চারদিকে ঘোরালেন। টানেলের চারদিকে শুধু কঙ্কাল আর কঙ্কাল। কোথাও কোথাও অনেকগুলো কঙ্কাল স্তূপ হয়ে আছে।

মিত্র বাহিনীর সদ্য ছিল এরা সবাই, বিড়বিড় করলেন রিকো একোস্টা। আমেরিকান, ফিলিপিনো, ব্রিটিশ, অস্ট্রেলিয়ান। দেখে মনে হচ্ছে অন্যান্য যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকেও বন্দীদের ধরে এনেছিল জাপানিরা কাজ করানোর জন্যে। কিন্তু একসাথে এতগুলো মানুষকে খুন করা হলো কিভাবে?

বুলেটের কোন চিহ্ন নেই। টানেল বিধ্বস্ত হওয়ায় ওরা বোধহয় দম বন্ধ হয়ে মারা যায়। প্রথম ট্রাকটাকে পাশ কাটিয়ে সামনে বাড়লেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। এক সারিতে অনেকগুলো ট্রাক দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রতিটি ট্রাকের চাকা বসে গেছে, পচে গেছে প্রতিটি ক্যানভাস টপ। একটা ট্রাকের ভেতর টর্চের আলো ফেললেন তিনি। ভাঙা কাঠের বাক্স ছাড়া আর কিছু নেই। এভাবে কয়েকটা ট্রাক পরীক্ষা করা হলো। সবগুলোই খালি।

দুশো মিটার এগিয়ে বাধা পেলেন ওঁরা। দেখেই বোঝা যায়, বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ধসিয়ে দেয়া হয়েছ টানেল। বাধার সামনে ছোট একটা অটো হাউজ টেইলার দেখা গেল, অ্যালুমিনিয়ামের গা এখনও চকচক করছে। ১৯৪০ সালে এধরনের অটো ট্রেইলার ছিল না। গাড়িটার পাশে কোন মার্কা নেই, তবে টায়ারের গায়ে লেখাগুলো পড়া গেল।

ধাতব ধাপ বেয়ে ওপরে উঠলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ভেতরে টর্চের আলো ফেললেন। ভেতরটা দেখে অফিস বলে মনে হলো। ঠিকাদাররা এধরনের সচল অফিস ব্যবহার করে।

চারজন লোককে নিয়ে গাড়িটার কাছে এসে দাঁড়ালেন রিকো একোস্টা। ফ্লাডলাইটের তার বহন করছে লোকগুলো উজ্জ্বল আলোয় ভেসে গেল চারদিক। এটা আবার এল কোত্থেকে! বিস্ময়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন তিনি।

আলোটা ভেতরে আনতে বলো, নির্দেশ দিলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো।

আলো ফেলার পর দেখা গেল ট্রেইলারের ভেতরে কিছুই নেই। ডেস্ক থেকে সমস্ত কাগজপত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। দেরাজগুলো খালি, খালি ওয়েস্টপেপার বাস্কেট। কোথাও কোন ছাইদানী নেই। দেয়ালে হুকের সঙ্গে ঝুলছে শুধু একটা হ্যাঁ। আরেক দিকের দেয়ালে একটা ব্যাকবোর্ড দেখা গেল। আরবিতে লেখা কয়েকটা সংখ্যা দেখলেন ওঁরা, শিপটম লেখার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে কাতাকানা সঙ্কেত।

কি ওগুলো?

গুপ্তধনের তালিকা বলে মনে হচ্ছে।

ডেস্কের পিছনে, একটা চেয়ারের ওপর ধপ করে বসে পড়লেন রিকো একোস্টা। কিছুই নেই, সব নিয়ে চলে গেছে।

প্রায় পঁচিশ বছর আগে, বোর্ডে লেখা তারিখ দেখে অন্তত তাই মনে হচ্ছে।

মার্কোস? জানতে চাইলেন একোস্টা।

না, মার্কোস নন, বললেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। জাপানিরা। ওরা ফিরে এসেছিল। আমাদের জন্যে শুধু হাড়গুলো রেখে গেছে।

.

১৪.

ওয়াশিংটনের ফোর্ডস থিয়েটারে বসে অনুষ্ঠান দেখছেন রেইমন্ড জর্ডান, পাশে স্ত্রী। হঠাৎ তার হাতঘড়ির অ্যালার্ম পিপ পিপ করে উঠল। স্ত্রীকে বললেন, আসছি। থিয়েটার থেকে শান্তভাবে বেরিয়ে এলেন তিনি। লবিতে পৌঁছে দেখলেন কার্টিস মিকার একা তার জন্যে অপেক্ষা করছেন।

কার্টিস মিকার হলেন অ্যাডভান্সড টেকনিক্যাল অপারেশনস-এর ডেপুটি ডিরেক্টর। নিজের অফিস ছেড়ে বড় একটা বেরোন না তিনি, ওখানে বসেই সারাদিন স্যাটেলাইট ইন্টেলিজেন্স ফটো পরীক্ষা করেন।

কি খরব? কোন ভূমিকা না করেই জানতে চাইলেন রেইমন্ড জর্ডান।

কোন জাহাজে বোমাটা ছিল, আমরা জানি, কার্টিস মিকার জবাব দিলেন।

কিন্তু এখানে তো কথা বলা সম্ভব নয়।

ম্যানেজারের সাথে আলাপ করেছি, তার অফিসটা ব্যবহার করতে পারি আমরা।

কামরাটা চেনেন রেইমন্ড জর্ডান। ভেতরে ঢুকে ম্যানেজারের চেয়ারে বসলেন তিনি। তুমি নিশ্চিত? কোন ভুল হচ্ছে না?

শান্তভাবে মাথা নাড়লেন কার্টিস মিকার। একটা আবহাওয়া পাখি থেকে তোলা ফটোতে দেখা যাচ্ছে এলাকায় তিনটে জাহাজ ছিল। বিস্ফোরণের পর ওই এলাকার উপর দিয়ে যাবার সময় আমরা আমাদের পুরানো স্কাই কিং ইন্টেলিজেন্স স্যাটেলাইট অ্যাকটিভেট করি। ওটা থেকে পাওয়া ফটোতে আমরা দুটো জাহাজ দেখত পাচ্ছি।

কিভাবে?

রাডার-সোনার সিস্টেমের কার্যকারিতা কমপিউটারের সাহায্যে অনেক বাড়িয়ে নেওয়ার ফলে পানির নিচেটা আমরা পরিষ্কার দেখতে পাই, দেখে মনে হয় স্বচ্ছ কাঁচ।

তুমি তোমার লোকদের ব্রিফ করেছিলে?

হ্যাঁ।

কার্টিসের চোখে চোখে রাখলেন রেই জর্ডান। তুমি সন্তুষ্ট? কোথাও কোন খুঁত নেই?

কোন খুঁত নেই, দৃঢ়কণ্ঠে বললেন কার্টিস মিকার।

হ্যাঁ।

জানো তো যে ভুল করলে তোমাকেও দায়ী হতে হবে?

তোমাকে রিপোর্ট করার পর বাড়িতে ফিরে নাক ডেকে ঘুমাব আমি।

বেশ, এবার বলো।

পকেট থেকে একটা ফোল্ডার বের করে টেবিলের ওপর রাখলেন কার্টিস মিকার।

রেইমন্ড জর্ডান হাসলেন। তুমি দেখছি ব্রিফকেসের ভক্ত নও।

হাত দুটো মুক্ত রাখতে চাই, বলে ফোল্ডারটা খুললেন কার্টিস মিকার। ভেতর থেকে পাঁচটা ফটোগ্রাফ বেরুলো। প্রথম তিনটেতে জাহাজগুলোকে পানির ওপর অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। এখানে তুমি দেখতে পাচ্ছ জাপানি অটো ক্যারিয়ারটাকে ঘিরে চক্কর মারছে নরওয়জিয়ান প্যাসেঞ্জার কার্গো লাইনার-স্রোতে ভেসে যাচ্ছে অটো ক্যারিয়ার বারো কিলোমিটার দূরে, পানিতে একটা সাবমারসিবল নামাচ্ছে ব্রিটিশ সার্ভে শিপ।

বিস্ফোরণ ঘটার আগের পরিস্থিতি, মন্তব্য করলেন রেইমন্ড জর্ডান।

মাথা ঝাঁকালেন কার্টিস মিকার। পরের ছবি দুটো বিস্ফোরিণের পর স্কাই কিং থেকে তোলা, সাগরের তলায় ভাঙাচোরা দুটো খোল দেখা যাচ্ছে। তৃতীয় জাহাজটা গায়েব হয়ে গেছে। সাগরের মেঝেতে ওটার এঞ্জিনের কিছু টুকরো-টাকরা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না।

তিনটের মধ্যে কোনটি সেটা? ধীরে ধীরে জানতে চাইলেন রেইমন্ড জর্ডান।

যে দুটো ডুবে গেছে ওগুলোর পরিচয় পেয়েছি আমরা। বোমাটা ছিল জাপানি অটো ক্যারিয়ারে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিলেন রেইমন্ড জর্ডান। জাপানের কাছে অ্যাটম বোমা আছে, খবরটা আমার জন্যে বড় কোন বিস্ময় নয়। কারণ বহু বছর ধরেই বোমা বানাবার টেকনলজি ওদের হাতে রয়েছে।

প্রথম আভাস পাওয়া যায় ওরা যখন একটা নিকুইড মেটাল ফাস্ট-ব্রীডার রিয়্যাক্টর বানায়। ফিশনিং উইথ ফাস্ট নিউট্রনস, দ্য ব্রীডার ক্রিয়েটস মোর পুটোনিয়াম ফুয়েল দ্যাট ইট বার্নস। পারমাণবিক অস্ত্র বানাবার প্রথম পদক্ষেপ।

এবার মরীচিৎকার পিছনে ছোটো-কুঁজে বার করো কোথায় আছে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কারখানা! তিক্তকণ্ঠে বললেন রেইমন্ড জর্ডান।

জাপানিরা আমাদেরকে বোকা বানিয়েছে, মন্তব্য করলেন কার্টিস মিকার।

আমার কেন যেন মনে হয় জাপানের সরকারি নেতারাও এ ব্যাপারে কিছু জানেন না।

ওদের প্রোডাকশন ফ্যাসিলিটি মাটির ওপর হলে আমাদের নতুন স্যাটেলাইট ডিটেকশন ইকুইপমেন্ট ওগুলোর খবর ঠিকই পেয়ে যেত।

অদ্ভুত ব্যাপার, ওদের কোন এলাকাতেই অস্বাভাবিক রেডিও অ্যাকটিভিটি ধরা পড়েনি।

আমরা শুধু ওদের ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার রিয়্যাক্টরগুলোর কথা জানি, আর জানি একটা নিউক্লিয়ার ওয়েস্ট ডাম্প সম্পর্কে উপকূল শহর রোকোটার কাছে।

রিপোর্টগুলো আমি দেখেছি, বললেন রেইমন্ড জর্ডান। পারমাণবিক বর্জ্য ফেলার জন্যে চার হাজার মিটার গভীর একটা শ্যাফট বানিয়েছে ওরা। এমন হতে পারে, কিছু একটা দেখার কথা ছিল, কিন্তু দেখতে পাইন আমরা?

চুপ কর থাকলেন কার্টিস মিকার।

কি সর্বনাশ! হঠাৎ বিস্ফোরিত হলেন রেইমন্ড জর্ডান। জাপান বিনা বাধায় জাহাজে করে আমেরিকায় অ্যাটম বোমা পাঠাচ্ছে অথচ আমরা কিছুই জানি না। বোমা কোথায় পেল ওরা, কিভাবে বানাল, কেন পাঠাচ্ছে, ঠিক কোথায় পাঠাচ্ছে…ওহ গড, আমরা তো কিছুই জানি না।

তুমি বলছ বোমাগুলো? বহুবচন? জিজ্ঞেস করলেন কার্টিস মিকার।

কলোরাডোর সিসমোগ্রাফিক সেন্টার-এর রিডিং অনুযায়ী প্রথম বিস্ফোরণের এক মিলিসেকেন্ড পর দ্বিতীয় একটা বিস্ফোরণ ঘটেছে।

এক সেকেন্ড চুপ করে থাকলেন কার্টিস মিকার, তারপর বললেন, খুবই খারাপ। কথা, দশ বছর আগেই সতর্ক হওনি তোমরা।

কিসের ভিত্তিতে দশ বছর আগে সতর্ক হব? রাজনীতিকরা তো শুধু রাশিয়া আর মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল। প্রতি বছর ইন্ট্রেলিজেন্স বাজেটও কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাছাড়া জাপান হলো আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। ওখানে আমরা শুধু অবসরপ্রাপ্ত দুজন এজেন্টকে ভাড়ায় রেখেছি। একই কথা ইসরায়েল সম্পর্কে। আমরা জানি যে-কোন দিন অ্যাটম বোমা বানিয়ে ফেলবে ওরা, কিন্তু যেহেতু ওরা আমাদের বন্ধু, তেমন গুরুত্ব দিই না।

গাফলতির খেসারত দিতে হবে এখন, মন্তব্য করলেন কার্টিস মিকার। দেখো, প্রেসিডেন্ট কি বলেন। ফোল্ডার থেকে আরেকটা ছবি বের করলেন তিনি। দেখো তো, কি এটা?

ফটোর দিতে ঝুঁকে তাকালেন রেইমন্ড জর্ডান। দেশে মনে হচ্ছে বড় একটা ফার্ম ট্র্যাক্টর।

ওটা অচেনা একটা ডীপ সী মাইনিয়ং ভেসেল। পানির পাঁচ হাজার মিটার নিচে রয়েছে। বিস্ফোরণ এলাকা থেকে খুব বেশি হলে বিশ কিলোমিটার দূরে। তুমি জানো, কাদের এটা? বা ওই সময় ওখানে কি করছিল ওরা?

হ্যা… ধীরে ধীরে বললেন রেইমন্ড জর্ডান। আগে জানতাম না, এখন জানি। ধন্যবাদ, কার্টিস।

ফটোগুলো পকেটে ভরে কামরা থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি, পিছন থেকে তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন কার্টিস মিকার।

.

১৫.

কাদা সরিয়ে, ঢাল বেয়ে ট্রেঞ্চের ওপর উঠে এল বিগ জন্।

চীফ এঞ্জিনিয়ার প্লাঙ্কেট জানতে চাইলেন, ল্যান্ডস্লাইড থেকে তো রক্ষা পেলাম, এবার আপনার প্ল্যানটা কি, ডার্ক? চায়ের কাপে চুমুক দিলেন তিনি।

প্ল্যান হলো ওপরে ওঠা। হাত তুলে বিগ জনের ছাদটা দেখিয়ে দিল পিট।

আপনার বিগ জন ভাসতে পারে না, আর আমাদের মাথার ওপর রয়েছে পাঁচ কিলোমিটার সাগর, ওপরে ওঠার মত অসম্ভব একটা কাজ কিভাবে আপনি করতে চান?

নিঃশব্দে হাসল পিট। তারপর বলল, স্রেফ বসে থাকুন, উপভোগ করুন চারদিকের দৃশ্য। আপনাকে আমি পাহাড়ের মাথায় তুলে নিয়ে যাব।

.

ওয়েলকাম আবোর্ড, অ্যাডমিরাল! অ্যাটাক সাবমেরিন সাইন্ডারের কমান্ডার বিউ মরটন বললেন, তাকিয়ে আছেন অ্যাডমিরাল জেমস স্যানডেকারের দিকে। মুখে হাসি ধরে রাখলেও, মনে মনে খুশি নন তিনি। এধরনের ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। আমরা একটা অভিযানে রয়েছি, হঠাৎ নির্দেশ এল সারফেসে উঠে একজন ভিজিটরকে তুলে নিতে হবে। আপনাকে জানাতে আপত্তি নেই, ব্যাপারটা আমার পছন্দ হয়নি।

সাংহাই শেলির লঞ্চ থেকে সাউন্ডারের আংশিক ভাসমান সেইল টাওয়ারে পা দিলেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার, বিউ মরটনের বাড়িয়ে দেয়া হাতটা ধরে এমনভাবে ঝাঁকালেন যেন কতদিন ধরে চেনেন আঁকে, চেহারায় হাসিখুশি ভাব। আপনার সাবমেরিনে চা খেতে আসার জন্যে আমি কোন কলকাঠি নাড়িনি, কমান্ডার। আমাকে আসতে হয়েছে সরাসরি প্রেসিডেনশিয়াল নির্দেশে। আপনার যদি অসুবিধে হয় বলুন, এখুনি আমি চাইনিজ জাঙ্কে ফিরে যাই।

চেহারায় আহত একটা ভাব ফুটিয়ে বিউ মরটন বললেন, নো অফেন্স, অ্যাডমিরাল। কিন্তু রুশ স্যাটেলাইট…।

আমাদের ছবি তুলবে, এই তো? তুলবে, সে ব্যাপারে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। টাওয়ারে উঠে এল অ্যাল, তার দিকে তাকালেন স্যানডেকার। অ্যাল জিওর্দিনো, আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রজেক্ট ডিরেক্টর।

কুশলাদি বিনিময়ের পর পথ দেখিয়ে ওদেরকে সাবমেরিনের কন্ট্রোল সেন্টারে নিয়ে এলেন বিউ মরটন। কমান্ডারের পিছু পিছু ট্রান্সপারেন্ট প্লটিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন অ্যাডমিরাল। ডিসপ্লেতে সাগরের নিচেটা দেখা যাচ্ছে। থ্রী ডাইমেনশন্যাল সোনার ভিউ।

লেফটেন্যান্ট ডেভিড ডিলুসা, সাউন্ডারের নেভিগেশন অফিসার, টেবিলের ওপর ঝকে রয়েছেন। পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় উষ্ণ হাসি ছড়িয়ে পড়ল মুখে।

অ্যাডমিরাল স্যানডেকার, দিস ইজ অ্যান অনার। অ্যাকাডেমিতে আপনার একটা লেকচারও আমি মিস করতাম না!

ঠোঁট টিপে হাসলেন অ্যাডমিরাল। যদি বলেন আমার লেকচার শুনে আপনার ঘুম পেত, ভারি লজ্জা পাব।

কি যে বলেন, স্যার! নুমা প্রজেক্ট সম্পর্কে আপনার লেকচার শুনে মুগ্ধ হয়ে গেছি আমি।

ডিলুসার দিকে চট করে একবার তাকিয়ে টেবিলের দিকে ইঙ্গিত করলেন বিউ মরটন। তোমার আবিষ্কার সম্পর্কে অ্যাডমিরাল জানতে চান, ডেভিড ডিলুসা।

ডিলুসার কাঁধে একটা হাত রাখলেন স্যানডেকার। কি আবিষ্কার করেছেন, মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড?

ভাবাবেগে সামান্য কেঁপে গেল ডি লুসার গলা, সাগরের তলা থেকে অদ্ভুত একটা মিউজিকের আওয়াজ পাচ্ছি আমরা…।

মিনি দ্য মারমেইড? জানতে চাইল অ্যাল।

হ্যাঁ…।

আপনারা জানলেন কিভাবে? তীক্ষ্ণকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন বিউ মরটন।

পিট, জোর গলায় বলল বি। এখনও বেঁচে আছে ও।

অ্যাডমিরাল স্যানডেকার, তাকালেন ডিলুসার দিকে। এখনও কি শুনতে পাচ্ছেন কোরাসটা?

ইয়েস, স্যার। একটা ফিক্স পাবার পর উৎসটারও সন্ধান পেয়েছি।

সচল?

সাগরের তলায়, ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার।

পিট আর মি. প্লাঙ্কেট ভূমিকম্পের ধাক্কা সামলে নিয়েছে, আশ্রয় নিয়েছে বিগ জন্-এ, বলল অ্যাল।

যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন? বিউ মরটনকে জিজ্ঞেস করল অ্যাডমিরাল।

চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু এক হাজার মিটারের চেয়ে বেশি গভীরে ট্রান্সমিট করা আমাদের সিস্টেমের পক্ষে সম্ভব নয়।

শুনতে পাবেন কি, ওরা যদি কোন সারফেস ভেসেলের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে?

ওদের কোরাস যদি শুনতে পাই, ভয়েস ট্রান্সমিশনও শুনতে পারব।

সে ধরনের কোন শব্দ রিসিভ করেছেন?

তার মানে ওদের ফোন সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে, মন্তব্য করলেন স্যানডেকার।

কিন্তু তাহলে মিউজিক ট্রান্সমিট করছেন কিভাবে ওঁরা?

বিগ জন-এ একটা ইমার্জেন্সি অ্যামপ্লিফাইং সিস্টেম আছে, জবাব দিল জিওর্দিনো। সেটার শব্দ পেয়ে রেসকিউ ভেহিকেল যাতে পৌঁছাতে পারে। তবে ওটা ভয়েস ট্রান্সমিট বা রিসিভ করতে পারে না।

বিউ মরটন তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইলেন, আপনাদের বিগ জন্-এ ওঁরা কারা, জানতে পারি? প্রশান্ত মহাসাগরে তলায় কি করছেন ওরা?

সবিনয়ে হাসলেন অ্যাডমিরাল। দুঃখিত, কমান্ডার! এটা আমাদের একটা টপ সিক্রেট প্রজেক্ট। ডিলুসার দিকে ফিরলেন তিনি। আপনি বলছিলেন, ওটা সচল।

ইয়েস, স্যার! কয়েকটা বোতামে চাপ দিলেন ডিলুসা। টেবিলের ডিসপ্লেতে থ্রী-ডাইমেনশন্যাল হলোগ্রাফ ফুঠে উঠল।

লেটেস্ট আন্ডারওয়াটার ভিজুয়াল টেকনলজি, বললেন বিউ মরটন, গলায় গর্বের সুর। আমাদের সাবমেরিনেই প্রথম ফিট করা হয়েছে।

লাল হয়ে উঠল বিউ মরটনের চেহারা। চাপাস্বরে তিনি বললেন, অ্যাডমিরালকে দেখাও তার খেলনা কি রকম কাজ করে।

লাঠি আকৃতির একটা প্রোব হাতে নিয়ে ডিসপ্লের মেঝেতে একটা লাইট ছোট গিরিখাদ থেকে এখানটায় উঠে আসে, মেইন ফ্র্যাকচার জোন থেকে খানিকটা দূরে। এই মুহূর্তে আঁকাবাঁকা একটা পথ ধরে ঢাল বেয়ে উঠছে ওটা। কিছু বলতে হল না, ডিসপ্লেটা আকারে বড় করে তুলল সে। খাড়া ঢালের গায়ে বিগ জনকে দেখা গেল।

এর চেয়ে বেশি পরিষ্কারভাবে দেখানো সম্ভব নয়।

স্রেফ একটা বিন্দু, তার বেশি কিছু না। বিশ্বাস করা কঠিন যে ওই বিন্দুটার ভেতর দুজন মানুষ বাঁচার জন্যে প্রাণপণ সংগ্রাম করছে।

মরটন জানতে চাইলেন, আপনাদের সাবমারসিবলের সাহায্যে ভদ্রলোকদের বাঁচাতে পারেন না?

ডিসপ্লে টেবিলের রেইল শক্ত করে চেপে ধরে আছে অ্যাল, আঙুলের গিটগুলো সাদা হয়ে গেছে। কাছে যেতে পারি, কিন্তু দুটো ভেহিকেলের কোনটাতেই এয়ার লক নেই, ফলে ওদেরকে ট্রান্সফার করা সম্ভব নয়।

কেবল দিয়ে আটকে তুলে আনা যায় না?

ছয় কিলোমিটার কেবল কোন জাহাজে থাকে বলে তো শুনিনি। ভুলে গেলে চলবে না যে যথেষ্ট মোটা হতে হবে কেবলটাকে।

কাঁধ ঝাঁকালেন বিউ মরটন। আমরা কিছু করতে পারছি না বলে সত্যি দুঃখিত।

ধন্যবাদ, কমান্ডার।

প্রায় এক মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন ওঁরা, তাকিয়ে আছেন ডিসপ্লের দিকে।

আচ্ছা, ওঁরা যাচ্ছেন কোথায়? অবশেষে নিস্তব্ধতা ভাঙলেন ডিলুসা।

কি বললেন? হঠাৎ যেন ঘুম থেকে জাগলেন অ্যাডমিরাল।

ওটার ওপর যখন থেকে নজর রাখছি আমি, বললেন ডেভিড ডিলুসা, মনে হচ্ছে নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছে। বাধা পেলে এদিক ওদিক ঘোরে, তারপর আবার আগের কোর্সে ফিরে আসে।

পিট উঁচু জায়গায় উঠে আসছে, মাই গড!

কোর্স দেখে সম্ভাব্য একটা গন্তব্য ডিলুসা, বললেন বিউ মরটন। হিসেবে করে বের করো।

নেভিগেশন্যাল কমপিউটারের বোতামে চাপ দিলেন ডেভিড ডিলুসা। তারপর মনিটরের দিকে তাকালেন, অপেক্ষা করছেন কমপাস প্রজেকশনের জন্যে। প্রায় সাথে সাথে সংখ্যাগুলো ফুটে উঠল মনিটরের স্ক্রীনে। আপনার লোক, অ্যাডমিরাল, থ্রী থ্রী, ফোর ধরে এগোচ্ছে।

থ্রী-থ্রী-ফোর, বিড়বিড় করলেন বিউ মরটন। তার মানে সামনে কিছুই নেই!

ওটার সামনের জায়গা এনলার্জ করুন, প্লীজ, ডেভিড ডিলুসাকে অনুরোধ করল অ্যাল।

করা হলো এনলার্জ। দেখা যাচ্ছে কয়েকটা পাহাড়ের মাথা ছাড়া আর কিছু নেই।

পিট কনরো গাইঅট-এর দিকে যাচ্ছে, বলল অ্যাল।

গাইঅট? ডেভিড ডিলুসা জানতে চাইলেন।

সমতল চূড়াসহ একটা সী মাউন্ট, ব্যাখ্যা করলেন স্যানডেকার।

চূড়ার ডেপথ কত? ডিলুসাকে প্রশ্ন করল অ্যাল।

টেবিলের নিচের কেবিনেট থেকে একটা চার্ট বের করে ভাঁজ খুললেন ডেভিড ডিলুসা। ডেপথ তিনশো দশ মিটার।

বিগ জন্ থেকে কত দূরে? প্রশ্নটা এল মরটনের তরফ থেকে।

মাপজোক করে ডেভিড ডিলুসা বললেন, প্রায় ছিয়ানব্বই কিলোমিটার।

প্রতি ঘণ্টা আট কিলোমিটার, হিসেব করল অ্যাল, পথে বাধা পাওয়ায় দূরত্বটাকে দ্বিগুণ ধরতে হবে ভাগ্য ভাল হলে কাল এই সময় চূড়ান্ত পৌঁছাবে ওঁরা।

চূড়ায় উঠতে পারলে সারফেসের খানিকটা কাছে আসবেন ওঁরা, তা ঠিক। কিন্তু তারপরও তিনশো মিটার বা প্রায় এক হাজার ফুট নিচে থাকবেন সারফেস থেকে। আপনাদের এই লোক কিভাবে…?

ওর নাম ডার্ক পিট, বলল অ্যাল।

বেশ, ডার্ক পিট। তো উনি কিভাবে পানির ওপর আসতে চান, সাঁতার দিয়ে?

অন্তত ওই গভীরতা থেকে সম্ভব নয় সেটা।

তাহলে এই পিট কি করতে চাইছে?

কেউ কোন কথা বলল না। বিউ মরটনের প্রশ্নের উত্তর ওদের কারও জানা নেই।

.

১৬.

আমরা দুহাজার মিটার পেরিয়ে এসেছি, রিপোর্ট করল পিট।

ভেরি গুড, মন্তব্য করলেন ক্লোভার প্লাঙ্কেট। চূড়া আর বেশি দূরে নয়।

এখুনি হবার কোন কারণ নেই, বলল পিট। ঢালটা ক্রমশ আরও খাড়া হচ্ছে। আর যদি পাঁচ ডিগ্রি বেশি খাড়া হয়, আমাদের ট্র্যাক মাটি কামড়াতে পারবে না।

ব্যর্থতার কথা এখন আর চিন্তা করছেন না প্লাঙ্কেট। পিটের ওপর তার আস্থা প্রায় সীমাহীন হয়ে উঠেছে। তবে ঢালের মেঝে তো দেখছি সমতল উঠে যেতে অসুবিধে হবে বলে মনে হয় না।

দেখা যাক, বলে চোখ বুজল পিট, দেখে মনে হলো ঘুমিয়ে পড়েছে।

.

দুঘণ্টা পর গুলির মত একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল ওর। চোখ মেলে কনসোলের দিকে তাকাল ও। লাল একটা আলো জ্বলছে আর নিভছে।

যান্ত্রিক কোন ত্রুটি? জিজ্ঞেস করল ও।

একটা লিক দেখা দিয়েছে, বললেন প্লাঙ্কেট। আওয়াটার সাথে সাথে ওয়ার্নিং লাইট জ্বলে উঠল।

ড্যামেজ ও লোকশান সম্পর্কে কমপিউটার কি বলছে?

দুঃখিত, আপনি আমাকে প্রোগ্রাম ক্যাকটিভেট করার জন্যে কোড় শোনেননি।

কীবোর্ডের নির্দিষ্ট একটা বোতামে চাপ দিল পিট। ডিসপ্লে মনিটরে ফুটে উঠল রিডআউট। আমরা ভাগ্যবান, বলল ও। লাইফ সাপোর্ট ও ইলেকট্রনিক ইকুইপমেন্ট চেম্বার অক্ষতই আছে। লিকটা নিচে কোথাও, এঞ্জিনের পাশপাশে বা জেনারেটর কমপার্টমেন্টে।

তারপরও বলছেন আমরা ভাগ্যবান?

ওদিকে নড়াচড়া করার জায়গা আছে। চেয়ার থেকে নেমে ক্রল করে কন্ট্রোল কেবিনের দিকে এগোল পিট, একটা ট্র্যাপ ডোর খুলে ভেতরে ঢুকল। আলো জ্বেলে এনি কম্পার্টমেন্টের চারদিকে তাকাল ও। হিসহিস আওয়াজ হচ্ছে, কিন্তু উ+সটা দেখা গেল না। এরইমধ্যে খানিকটা পানি জমেছে ভেতরে।

লিকটা পেলেন? চিৎকার করে জানতে চাইলেন প্লাঙ্কেট।

না।

বিগ জনকে থামাব!

না, চূড়ার দিকে উঠতে থাকুন। দ্রুত চিন্তা করছে পিট। ঘন ঘন বাড়ি খেয়ে বিগ জনের বাইরের দেয়াল তুবড়ে গেছে। হিসহিস আওয়াজ শুনে ও পানি দেখে বোঝা যাচ্ছে, সূচের মত সরু একটা ফুটো তৈরি হয়েছে কোথাও। সরু একটা ফুটো দিয়ে ধীরে ধীরে পানি ঢুকলে এঞ্জিন কমপার্টমেন্ট ভরতে দুঘন্টা লাগবে। কিন্তু যদি ফুটোটা বড় হয়, কামানের মত বিস্ফোরিত হবে পানি, ভেতরের দেয়াল এক পলকে চুরমার হয়ে যাবে। প্রশ্ন হলো, সরু ফুটোটা কি এরই মধ্যে গুরুত্ত্বপূর্ণ কোন ইকুইপমেন্টের ক্ষতি করেছে? ফুটোটা কি এত বড় যে বন্ধ করা সম্ভব নয়? ক্রল করে আরও একটু এগোল পিট। আওয়াজটা কাছাকাছি কোথাও থেকে আসছে। ভেতরে মিহি পানির কণা ভাসছে, কুয়াশার মতো, ঝাপসা লাগছে সব কিছু। কুয়াশার ভেতর দিয়ে আরও একটু এগাল পিট। তারপর মাথায় একটা বুদ্ধি এল। পায়ের এক পাটি জুতো খুলে মুখের সামনে নাড়ল ও, একজন অন্ধ যেভাবে তার ছড়ি নাড়ে। এক মুহূর্ত পর প্রায় ছো দিয়ে জুতোটা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা হল। এতক্ষণে ফুটোটা দেখতে পেল ও। ওর সামনে, ডান দিকে, উজ্জ্বল একটা চকচকে ভাব।

সুচের মত সরু একটা ফুটো, কমপ্যাক্ট স্টীম টারবাইনের গায়ে। পিছিয়ে এসে স্পেয়ার পার্টস কেবিনেটটা খুলল পিট। ভেতর থেকে বের করল এক প্রস্থ হাই প্রেশার রিপ্লেসমেন্ট পাইপ ও একটা ভারী জে-টাইপ হ্যাঁমার।

ইতোমধ্যে মেঝেতে আধ মিটার পানি জমে গেছে। টেপ বা অন্য কিছু দিয়ে ফুটোটা বন্ধ করা সম্ভব নয়। একটাই উপায় আছে, সেটা যদি ব্যর্থ হয়, নির্ঘাৎ ডুবে মরতে হবে ওদের। পাইপের একটা প্রান্ত ফুটোর ওপর ঠেকাল ও, অপর প্রান্তটা মোটা বাল্কহেড শীল্ডের ঢালু গায়ে চেপে ধরল। হাতুড়ি দিয়ে পাইপের নিচের দিকটায় ঘা মারল ও, ফুটো আর বাল্কহে শীল্ডের গায়ে শক্তভাবে আটকে গেল সেটা।

পানি ঢোকা বন্ধ হলো, তবে পুরোপুরি নয়। কোনমতেই এটাকে স্থায়ী সমাধান বলা যাবে না। ধীরে ধীরে বড় হবে ফুটোটা, ছিটকে পড়বে পাইপ। পানিতে বসে থাকল পিট। এক মিনিট পর ভাবল, ব্যাপারটা অদ্ভুত নয়? বরফের মতো ঠাণ্ডা পানিতে বসে ঘামছি?

কনরো গাইওটে উঠে এল বিগ জন্। ডিজিটাল ডেপথ রিডিং-এর দিকে তাকাল পিট। তিনশো বাইশ মিটার ওপরে সারেফস।

আপনার লোকদের কাউকে দেখতে পাচ্ছেন? জানতে চাইলেন প্লাঙ্কেট।

সোনার-রাডার প্রোবে হাত ছোঁয়াল পিট। ডিসপ্লেতে দশ বর্গ কিলোমিটার চুড়া সম্পূর্ণ খালি দেখা গেল। পিট আশা করেছিল, একটা রেসকিউ ভেহিকেল আসবে। কিন্তু আসেনি। না।

উপর থেকে ওরা আমাদের মিউজিক শুনতে পায়নি, এ স্রেফ বিশ্বাস করা যায় না।

রেসকিউ অপারেশন শুরু করতে প্রস্তুতির জন্যে সময় লাগে, বিড়বিড় করল পিট। ও জানে, অ্যাডমিরাল স্যানডেকার ও অ্যাল ওদের খোঁজে স্বর্গ-মর্ত্য তোলপাড় করে ফেলবেন। ওর প্ল্যানটা ওরা বুঝতে পারেনি, এটা মেনে নিতে মন চাইছে না। নিঃশব্দে চেয়ার ছাড়ল ও, এঞ্জিন কমপার্টমেন্টের দরজা তুলে ভেতরে তাকাল। ফুটোটা বড় হয়েছে, মেঝেতে পানি এখন এক মিটারের মতো। আর চল্লিশ মিনিটের মধ্যে টারবাইন ডুবে যাবে। টারবাইন ডুবলে জেনারেটরও ডুববে। লাইফ-সাপোর্ট সিস্টেম কাজ না করলে ওরাও বাঁচবে না।

ওরা আসবে, বিড়বিড় করল পিট। আমি জানি, আসবে ওঁরা।

.

১৭.

দশ মিনিট পেরিয়ে গেল। তারপর বিশ মিনিট। ভীতিকর একটা নিঃসঙ্গতা ঘিরে। ধরল ওদেরকে।

এখন কি হবে? জানতে চাইলেন প্লাঙ্কেট। ওরা তো আসছে না।

আমরা উদ্ধার পাব কি পাব না, নির্ভর করে অ্যালের ওপর, বলল পিট। সে যদি ধরতে পারে আমি কি ভাবছি, তাহলে একটা সাবমারসিবল নিয়ে নিচে নামবে সে, ইকুইপমেন্ট থাকবে…

কিন্তু আপনার বন্ধু ইতোমধ্যে আপনাকে একবার হতাশ করেছেন।

নিশ্চয়ই কোন বিপদে পড়ে আসতে পারেনি সে। নিজের চেয়ারে ফিরে এসে বসল পিট। বিগ জনের আলো পড়েছে বাইরে, আলোয় আকৃষ্ট হয়ে এক ঝাক মাছ কাছাকাছি চলে এসেছে। সেদিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকাল ও।

কি ব্যাপার?

যেন মনে হলো একটা শব্দ শুনলাম!

মনের ভুল, বললেন প্লাঙ্কেট। ধীরে ধীরে মরার চেয়ে হঠাৎ প্রাণ হারানোই ভাল বলে মনে করি, ডার্ক। কেবিনটা পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে, আসুন, ঝামেলা সেরে ফেলি।

হঠাৎ নিঃশব্দে হাসল পিট। চেয়ারে নড়ে বসল, তাকাল আপার ভিউইং উইন্ডোয়। বিগ জনের পিছনে, সামান্য ওপরে, ভাসছে নুমার একটা সাবমারসিবল? ভেতরে বসে রয়েছে অ্যাল, বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসছে সে। বড়, গোল পোর্টে অ্যাডমিরাল স্যানডেকারকেও দেখা গেল।

পিটকে প্রচণ্ড শক্তিতে আলিঙ্গন করলেন প্লাঙ্কেট, দম আটকে মারা যাবার অবস্থা হলো পিটের। নিজেকে ছাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে ও, প্লাঙ্কেট ওকে চুমো খেলেন।

আপনি আমার আপন ভাই!

ছাড়া পেয়ে দম নিচ্ছে পিট, স্পীকারের ভেতর থেকে বেরিয়ে অ্যালের গলা ভেসে এল, আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

কানে মধু বর্ষণ করছে হে!

দেরি করার জন্যে দুঃখিত, পিট। প্রথম সাবটা সারফেসে ওঠার পর ডুবে গেছে। এটার ব্যাটারি শেষ হয়ে গিয়েছিল, মেরামত করতে দেরি হয়ে গেল।

তোমার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। গুড টু সী ইউ, অ্যাডমিরাল।

ড্রাগন তোমার স্ট্যাটাস জানাও, নির্দেশ দিলেন অ্যাডমিরাল।

একটা ফুটো তৈরি হয়েছে, আর কয়েক মিনিটের মধ্যে পাওয়ার সোর্স বন্ধ। করে দেবে। কাবি সব ঠিক আছে।

তাহলে আর কোন কথা নয়, আমরা কাজ শুরু করছি।

অ্যাটাক সাবমেরিন টাকসন থেকে অক্সিজেন ক্যাটিং ইকুইপমেন্ট নিয়ে এসেছে অ্যাল, সাবমারসিবলের যান্ত্রিক বাহুতে জোড়া লাগানো হয়েছে সেটা। সেই কাটিং ইকুইপমেন্টের সাহায্যে বিগ জনের সমস্ত মাউন্ট, ড্রাইভ শ্রাফট ইত্যাদি কেটে আলাদা করা হবে, উদ্দেশ্য মেইন ফ্রেমও ট্র্যাক মেকানিজম থেকে কন্ট্রোল হাউজিং বিচ্ছিন্ন করা।

পঁয়ত্রিশ মিনিট পর বিগ জনের শুধু কন্ট্রোল হাউজিংটা হুক দিয়ে আটকে পানির ওপর তোলা হল। পানিতে ভেসে অবাক হয়ে বিশাল সাবমেরিনের লেজের দিকে চেয়ে থাকে পিট। প্লাঙ্কেটকে ওদিকে টেনে তোলা হলো সাবমেরিনের উপরে। ইউএস নেভীর লোকেরা ঘিরে রেখেছে ব্রিটিশ ভদ্রলোককে।

নুমা সাবমারসিবল থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো অ্যাল। দুই কান বিস্তৃত হাসি হাসছে।

দেখলে তো, তোমার জন্যে এত্তো ঝামেলা! চারপাশের ব্যস্ততার দিকে ইঙ্গিত করলো সে। এর জন্যে বহু টাকা গচ্চা যাচ্ছে হে!

কিন্তু বেঁচে থাকার আনন্দ নয়, পিটের চেহারায় নির্দয় হিংস্রতা। টানটান, অস্বাভাবিক স্বরে সে বলে উঠলো, যেই দায়ী থাকুক এর জন্যে, চরম মূল্যই দিতে হবে তাকে।

.

দ্বিতীয় পর্ব

দ্য কেইটেন মিনেস

৬ অক্টোবর, ১৯৯৩, টোকিও, জাপান।

১৮.

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সুইসাইড স্কোয়াডের- জাপানি পাইলটরা প্লেনে ওঠার আগের মুহূর্তে পরস্পরকে বিদায় জানাবার সময় বলতে, আবার দেখা হবে ইয়াসুকুনিতে।

ইয়াসুকুনি হলো পবিত্র তীর্থ মন্দির। সেই ১৮৬৮ সাল থেকে সম্রাটের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে যারা মারা গেছে তাদের পবিত্র স্মৃতিতে উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয় মন্দিরটা। একটা ঢালের মাথায় বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে তীর্থভূমি, টোকিওর মাঝখানে। ঢালটার নাম কুড়ান হিল। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আচার অনুষ্ঠানের জন্যে মূল হলটা তৈরি করা হয়েছে শিন্টো স্থাপত্য রীতি অনুসারে। ওখানে কোন রকম ফার্নিচার রাখা হয়নি।

প্রাচীন ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা শিন্টো আসলে জাপানিদের একটা সাংস্কৃতিক ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি, খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। শিন্টো আজ বহু শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত, দল-উপদলের সংখ্যা-সীমা নেই। অবশেষে শিন্টো বলতে মানুষ বোঝে, বিভিন্ন দেবতা বা ঈশ্বরের মাধ্যমে ঐশ্বরিক ক্ষমতা অর্জনের উপায় বিশেষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেখা গেল, শিন্টো হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় পূজা পদ্ধতি বা রাষ্ট্রীয় ধর্মবিশ্বাস ও নৈতিক দর্শন; প্রচলিত অন্যান্য ধর্মের সাথে কোন মিলই নেই। আমেরিকানদের দখলে থাকার সময় শিন্টো তীর্থভূমি ও মন্দিরগুলো সরকারি সমর্থন হারায়, তবে পরে ওগুলোকে জাতীয় জাদুঘর, ধনভাণ্ডার ও পবিত্র সাংস্কৃতিক স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়।

সমস্ত শিন্টো মন্দিরের ভেতরে, মূল উপসানালয়ে, প্রধান পুরোহিত ছাড়া আর কারও প্রবেশ নিষেধ। প্রতিটি উপাসনালয়ের ভেতরে একটা বস্তু থাকে, ঐশ্বরিক আত্মা বা ক্ষমতার প্রতীক বলে মনে করা হয় সেটাকে যা কিনা মহা-পবিত্র হিসেবে মর্যাদা পায়-ইয়াসুকুনিতে মহা-পবিত্র ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রতীক চিহ্ন হলো একটা আয়না।

ব্রোঞ্জের তৈরি বিশাল তোরণ পেরিয়ে যুদ্ধে নিহত বীরদের সমাধি-মন্দিরে কোন বিদেশী ঢুকতে পারে না। বীর যোদ্ধারা যেখানেই মারা গিয়ে থাকুক, মনে করা হয় তাদের সবার আত্মা এই মন্দিরে অবস্থান করছে। সংখ্যায় তারা আড়াই লাখের কম নয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইয়াসুকুনি স্রেফ সামরিক স্মৃতিমন্দির থাকল না। রক্ষণশীল ডানপন্থী রাজনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের গোপন মিটিং বসতে শুরু করল এখানে। এখনও তারা স্বপ্ন দেখেন, গুণে মানে শ্রেষ্ঠ জাপানি কালচার পৃথিবীর বুকে বিশংশাল এক সাম্রাজ্যের জন্ম দিতে পারে, সে সাম্রাজ্যে শুধু জাপানিরাই কর্তত্ব করবে। প্রতি বছর একবার অন্তত জাপানের প্রধানমন্ত্রি তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্য ও পার্টি নেতাদের নিয়ে ইয়াসুকুনিতে আসেন, ১৯৪৫ সালে জাপানের পরাজয় বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে। তাঁর এই আগমন টিভি ও রেডিওতে ফলাও করে প্রচার করা হয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত তীব্র প্রতিবাদ জানায়, তাদের সাথে যোগ দেয় বামপন্থী ও মধ্যপন্থী রাজনীতির সমর্থকরা, শিন্টো-বিরোধী ধর্মীয় দল-উপদল এবং প্রতিবেশী দেশগুলো, যুদ্ধের সময় জাপানিদের দ্বারা যারা নির্যাতিত হয়েছে।

সমালোচনা এড়াতে উগ্র মৌলবাদী ও ডানপন্থী রাজনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তারা ইয়াসুকুনিতে আসেন রাতের অন্ধকারে, সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে। ভূত বা চোরের মত আসা-যাওয়া করেন তারা, যদিও কেউই তারা সমাজের সাধারণ মানুষ নন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন জাপানের শিল্পপতি, ব্যাংকার, ক্ষমতাধর রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মকর্তা।

এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হলো হিদেকি সুমা।

.

ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে, ব্রোঞ্জ তোরণ পেরিয়ে ইয়াসুকুনি উপাসনালয়ের দিকে ধীরে পায়ে হাঁটছে হিদেকি সুমা। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই, চারদিকে অন্ধকার, শুধু টোকিওর উজ্জ্বল আলো মেঘে প্রতিফলিত হয়ে স্নানআভা ছড়িয়ে রেখেছে কুড়ান হিলের ওপর। অবশ্য অন্ধকারেও ইয়াসুকুনির পথ চিনতে হিদেকি সুমার কোন অসুবিধে হয় না, পবিত্র মন্দিরের প্রতিটি ইঞ্চি তার চেনা। বড় একটা গাছের নিচে দাঁড়াল সে, উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বিশাল উঠানের চারদিকে চোখ বুলাল। কোথাও কিছু নড়ছে না।

কেউ লক্ষ করছে না, বুঝতে পেরে স্বস্তিবোধ করল সুমা। আরও খানিক এগোল সে, একটা পাথুরে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে রীতি অনুসারে হাত ধুলো, তারপর কাঠের হাতা দিয়ে পানি তুলে মুখে পুরল, কুলকুল শব্দ করে মুখের ভেতরটাও ধুলো। মন্দিরের ভেতর ঢুকে থামল না সে, করিডর ধরে হনহন করে এগোল। প্রধান পুরোহিত অপেক্ষা করছেন তার জন্যে। উপাসনালয়ে পৌঁছে পুরোহিতের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল সে। দুজনের মধ্যে কোন বাক্যবিনিময় হলো না, মাথা নত করে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করল হিদেকি সুমা, রেনকোটের পকেট থেকে টিস্যু পেপারে মোড়া এক তোড়া নোট বের করে পুরোহিতের হাতে ধরিয়ে দিল। প্যাকেটটা বেদির ওপর রাখলেন পুরোহিত।

মন্দিরের ভেতর ঢং ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠল, হিদেকি সুমার নির্দিষ্ট ঈশ্বরকে আহ্বান করা হচ্ছে। এরপর দুইজোড়া হাত এক হলো। সুমার নিজের আত্মশুদ্ধির জন্যে পুরোহিত সুমার সাফল্যের জন্যে প্রার্থনা করলেন।

প্রার্থনা শেষে পুরোহিতের সাথে এক মিনিট আলাপ করল সুমা, নিচুস্বরে। টিস্যু পেপাটা পুরোহিতের হাত থেকে নিয়ে পকেটে ভরল, তারপর বেরিয়ে এল মন্দির থেকে।

গত তিনদিনের মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেল হিদেকি সুমা। প্রার্থনা শেষ হতেই নতুন শক্তি ও অনুপ্রেরণা লাভ করেছে সে। তার ঈশ্বর তাকে ঐশ্বরিক ক্ষমতা দান করেছেন, অন্তরে জ্বেলে দিয়েছেন আশার আলো। হিদেকি সুমার গোটা জীবনটাই একটা ধর্মযুদ্ধে নিবেদিত। দুটো যুদ্ধক্ষেত্রে লড়ছে সে। পশ্চিমা বিষাক্ত প্রভাব থেকে জাপানি সংস্কৃতিকে মুক্ত করতে হবে। এবং জাপান যে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে, সেটাকে গোটা দুনিয়ার বুকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে হবে। হিদেকি সুমা বিশ্বাস করে, এই যুদ্ধে তাকে সাহায্য করছে ঐশ্বরিক একটা ক্ষমতা।

ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে এখন যদি কেউ দেখে ফেলে হিদেকি সুমাকে, কোন গুরুত্ব দেবে বলে মনে হয় না। পরনে শ্রমিকদের ওভারাল, রঙচটা সস্তাদরের নেরকোট, মাথায় কোট হ্যাট নেই, দেখে মনে হবে নিতান্তই সাধারণ একজন লোক। খুবই লম্বা তার চুল, খুলির পিছনে ইচ্ছে করলে একটা খোঁপা বাধা যায়। ঊনপঞ্চশ বছর বয়েস, তবে কালো চুলের জন্যে আরও অনেক কম বয়েসী বলে মনে হয় তাকে। জাপানিদের তুলনায় একটু বেশি লম্বা সে, একশো সত্তর সেন্টিমিটার।

শুধু তার চোখের দিকে তাকালে বোঝা যায়, এই লোক সাধারণ কেউ নয়। নীল চোখ জোড়ায় অদ্ভুত এক সম্মোহনী শক্তি, যেন একবার তাকালেই বশ্যতা স্বীকার না করে উপায় নেই। চিরকালই রোগা-পাতলা সে, তবে পনেরো বছর বয়েস থেকে ওয়েট লিফটিং চর্চা করছে। অমানুষিক পরিশ্রম ও দৃঢ় প্রত্যয়ে সে তার শরীরটাকে পরিণত করেছে পেশীসর্বস্ত একটা কঠিন পাথুরে মূর্তিতে।

মাথা নত করে শ্রদ্ধা জানাবার পর হিদেকির দেহরক্ষী তথা শোফার তোরণের গেটটা বন্ধ করে দিল। মুরো কামাতোরি, সুমার পুরানো বন্ধু ও প্রধান সহকারী, তোশি কুদো, সুমার সেক্রেটারি, তোরণের দিকে পিছন ফেরা একটা কালো মুরমটো লিমুজিনে বসে আছে। গাড়িটাকে চালায় বারো সিলিন্ডারের, ছয়শো ঘোড়ার একটা এঞ্জিন। ধীর পায়ে হেঁটে এসে পিছনের সীটে বসল হিদেকি সুমা।

সাধারণ জাপানি মেয়েদের চেয়ে অন্তত দুইঞ্চি বেশি লম্বা তোশি কুদো। দীর্ঘ, সুগঠিত পা; ঘন কালো লম্বা চুল, কোমর পর্যন্ত বিস্তৃত, ত্রুটিহীন হালকা হলুদ রঙা ত্বক, চোখ যেন দুফোঁটা কফি, দেখে মনে হবে জেমস বন্ড সিনেমার একজন নায়িকা। শুধু দেখতেই সুন্দরী বা সেক্সি নয়, তোশির বুদ্ধিও খুব ধারাল। তার আইকিউ একশো পঁয়ষট্টি।

হিদেকি সুমা গাড়িতে উঠল, কিন্তু তার দিকে তাকাল না তোশি কুদো। তার মন ও চোখ আটকে আছে কোলের ওপর রাখা একটা কমপ্যাক্ট কমপিউটারের স্ক্রীনে।

মুরো কামাতোরি একটা টেলিফোনে কথা বলছে। তার বুদ্ধি তোশি কুদোর সমতুল্য না হতে পারে, তবে সুমার গোপন পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত করার জন্যে যে নিষ্ঠুরতা, শয়তানি ও নোংরা চাতুর্য দরকার তা তার মধ্যে প্রচুর পরিমাণেই আছে। সমস্ত দুনম্বর কাজ তাকে দিয়েই করায় সুমা।

লালমুখো, রাগী বাঁদরের মত চেহারা মুরো কামাতোরির। তার ভুরু অত্যন্ত ঘন ও কালো, নিচে প্রাণহীন একজোড়া চোখ, চোখে মোটা লেন্সের বিমলেস চশমা। ঠোঁট দুটো পরস্পরের সাথে শক্তভাবে সেঁটে থাকে, মুরো কামাতোরিকে কেউ কখনও হাসতে দেখেনি। দয়া বা ভাবাবেগ বলে কিছু নেই তার ভেতর। একটা বিশেষ খেলার ভক্ত সে, খেলেও খুব ভাল, এ ব্যাপারে তাকে একটা প্রতিভাই বলা যায়। খেলাটার নাম, মানুষ শিকার।

দুনিয়ায় এক শুধু হিদেকি সুমার প্রতি অনুগত মুরো কামাতোরি। কেউ যদি হিদেকি সুমার কাছে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তা সে যতই ধনী ব্যবসায়ী বা প্রভাবশালী সরকারি কর্মকর্তা হোক, যে কোন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাতে হবে তাকে, দোষ চাপবে ব্যক্তিগত কোন শত্রু অথবা বিরুদ্ধ রাজনৈতিক দলের ওপর।

খুনী মুরো কামাতোরির একটা বৈশিষ্ট্য হলো, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিশদ বিবরণ একটা খাতায় লিখে রাখে সে। গত পঁচিশ বছরে দুশো সাঁইত্রিশটা খুনের বিবরণ লিখেছে।

টেলিফোনে কথা শেষ করে রিসিভারটা আর্মরেস্ট ক্রেডলে রেখে দিল সে, তাকাল সুমার দিকে। অ্যাডমিরাল ইতাকুরা কথা বললেন। অ্যাডমিরাল ইতাকুরা ওয়াশিংটনে রয়েছেন, জাপানি দূতাবাসে। তিনি তার সূত্র থেকে জানতে পেরেছেন, হোয়াইট হাউস নিশ্চিত যে বিস্ফোরণটা নিউক্লিয়ার এবং দায়ী হলো ডিভাইন স্টার।

মৃদু কাঁধ ঝাঁকাল হিদেকি সুমা। ওদের প্রেসিডেন্ট কি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোন আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছে।

মার্কিন সরকার অদ্ভুত আচরণ করছে, বলল মুরো কামাতোরি। প্রতিবাদ তো দূরের কথা, টু-শব্দটিও করছে না। তবে নরওয়ে আর ব্রিটেন খুব চেঁচামেচি করছে, জাহাজ হারিয়েছে বলে।

মার্কিন নিউজ মিডিয়া?

অস্পষ্ট রিপোর্ট ছাপছে কাগজগুলো। টিভি নেটওঅর্কও পরিষ্কার কিছু বলছে না।

সামনের দিকে ঝুঁকল সুমা, তোশি কুদোর নাইলন ঢাকা হাঁটুতে টোকা দিল। এক্সপ্লোসন সাইটের ছবিটা দেখাও তো, প্লীজ।

সমীহের সাথে মাথা ঝাঁকাল তোশি, চাপ দিল কমপিউটারের বোম। ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে ডিভাইডার ওয়াল-এর ফিট করা ফ্যাক্স মেশিন থেকে রঙিন একটা ফটো বেরিয়ে এল। ডিভাইডার ওয়ালটা ড্রাইভার ও প্যাসেঞ্জার কমপার্টমেন্টের মাঝখানে। ফটোটা সুমার হাতে ধরিয়ে দিল তোশি, সুমা ভেতরের একটা আলো জ্বালাল, তারপর মুরো কামাতোরির বাড়িয়ে দেয়া হাত থেকে ম্যাগরিফাইং গ্লাসটা নিল।

ইনফ্রারেড ফটোটা দেড় ঘণ্টা আগে আমাদের আগাগি স্পাই স্যাটেলাইট থেকে, চোখে প্রশ্ন। একটা নিউক্লিয়ার হান্টার কিলার অ্যাটাক সাবমেরিন, আর একটা চাইনিজ জাংক? আমি যেমন আশা করেছিলাম, আমেরিকা তো সেরকম আচরণ করছে না। অদ্ভুত, ওরা ওদের প্যাসিফিক ফ্লিটের অন্তত অর্ধেকটা তো পাঠাবে।

এক্সপ্লোসন এরিয়ার দিকে কয়েকটা ন্যাভাল শিপ যাচ্ছে, বলল মুরো কামাতোরি। ওদিকে একটা ওশেন সার্ভে বেসেলও আছে, নুমার।

হোয়াই অ্যাবাউট স্পেস সার্ভেইল্যান্স?

মাকিনীরা তাদের পিরামিড়ার স্পাই স্যাটেলাইট ও এস আর-নাইনটি এয়ার ক্রাফটের সাহায্যে এই মধ্যে যথেষ্ট ডাটা সংগ্রহ করেছে।

ফটোয় গায়ে ছোট একটা বিন্দুর ওপর আঙুলের টোকা দিল সুমা। দুটো ভেসেলের মাঝখানে একটা সাবমারসিবল ভাসছে। কোত্থেকে এল ওটা?

ফটোর দিকে ঝুঁকে পড়ল মুরো কামাতোরি। জাংক থেকে অবশ্যই আসেনি। নিশ্চয়ই সাবমেরিনটা থেকে এসেছে।

যত চেষ্টাই করুক, ডিভাইন স্টারের কিছুই ওরা খুঁজে পাবে না, বিড় বিড় করে বলল হিদেকি সুমা। বিস্ফোরণে নিশ্চয়ই ওটা অণুতে পরিণত হয়েছে। ফটোটা তোশির দিকে ছুঁড়ে দিল সে। আরেকটা রিড আউট, প্লীজ যেসব ক্যারিয়ার আমাদের তৈরি গাড়ি বহন করছে, ওগুলোর বর্তমান স্ট্যাটাস ও গন্তব্য।

মুখ তুলে তার দিকে তাকাল তোশি, সমস্ত তথ্য আমার কাছে আছে, মি. সুমা।

ইয়েস?

কাল রাতে বোস্টনে অটো কার্গো খালাস করেছে ডিভাইন মুন, রিপোর্ট করল তোশি, ডিসপ্লে স্ক্রীনের জাপানি লেখাগুলোর ওপর চোখ। ডিভাইন ওয়াটার…আট ঘন্টা আগে লস অ্যাঞ্জেলেস পোর্টে ভিড়েছে ওটা, এই মুহূর্তে কার্গো খালাস করছে।

বাকিগুলো?

আর দুটো। ডিভাইন স্কাই নিউ অরলিয়নস-এর ভিড়বে আঠারো ঘণ্টার মধ্যে। লস অ্যাঞ্জেলেসে ডিভাইন লেক পৌঁছাবে পাঁচ দিন পর।

আমাদের বোধহয় জাহাজগুলোকে জরুরি নির্দেশ পাঠানো উচিত, বলল মুরো কামাতোরি। আমেরিকার দিকে না গিয়ে অন্য কোন দিকে চলে যাক। মার্কিন কাস্টমসকে হয়তো সতর্ক করে দেয়া হয়েছে, রেডিয়েশন আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখবে ওরা।

লস অ্যাঞ্জেলেসে আমাদের আন্ডারকভার এজেন্ট কে? জানতে চাইল হিদেকি সুমা।

দক্ষিণ-পশ্চিম রাজ্যগুলোর আমাদের গোপন ব্যাপারগুলো দেখাশোনা করেন জর্জ ফুরোকাওয়া।

সীটে হেলান, দিল সুমা। ফুরোকাওয়া অত্যন্ত যোগ্য মানুষ। মার্কিন কাস্টমস কড়াকড়ি করলে আগাম খবর পাবে সে। কামাতোরির দিকে তাকাল, দেখল টেলিফোনে কথা বলছে তার সহকারী। আরও তথ্য না পাওয়ার আগে ডিভাইন স্কাইকে জ্যামাইকার দিকে ঘুরে যেতে বললো। তবে ডিভাইন লেক লস অ্যাঞ্জেলেসে যেমন যাচ্ছে যাক।

ফোনে কথা শেষ করে মাথা আঁকাল কামাতোরি, তারপর আবার ডায়াল করল।

আমরা কি ধরা পড়ার ঝুঁকি নিচ্ছি না, মি. সুমা? নরম সুরে জিজ্ঞেস করল তোশি।

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মাথা নাড়ল সুমা। মার্কিন ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস জাহাজগুলো সার্চ করবে, করুক। বোমাগুলো কোনদিন খুঁজে পাবে না ওরা। আমাদের টেকনলজির কাছে হার মানতে হবে ওদের।

ডিভাইন স্টারে বিস্ফোরণটা হলো খারাপ একটা সময়ে, বলল তোশি। ভাবছি কারণটা কোনদিন আমরা জানতে পারব কিনা।

ও-সব নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না, ঠাণ্ডা সুরে বলল সুমা। অ্যাকসিডেন্টটা দুর্ভাগ্যজনক, তবে সেটা আমাদের কেইটেন প্রজেক্ট শেষ করতে কোন বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। তার চেহারায় হিংস্র একটা ভাব ফুটে উঠল। আমাদের নতুন। সাম্রাজ্যের জন্যে হুমকি হয়ে দাঁড়ালে যেকোন রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেয়ার মত খুঁটি ইতোমধ্যেই সাজিয়ে ফেলেছি আমরা।

.

১৯.

নামকরা প্রতিষ্ঠান স্যামুয়েল জে, ভিনসেন্ট ল্যাবরেটরিজ-এর অফিসে বসে ভাইস প্রেসিডেন্ট জর্জ ফুরোকাওয়া টেলিফোনে তার স্ত্রীর সাথে কথা বলছে। দাঁতের ডাক্তারের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, একথা মনে করিয়ে দেয়ায় স্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাল সে, দুএকটা ভালবাসার কথা বলল, তারপর রেখে দিল রিসিভার।

অপরপ্রান্তের মহিলাটি তার স্ত্রী নয়, হিদেকি সুমার একজন এজেন্ট, মিসেস ফুরোকাওয়ার গলা হুবহু নকল করতে পারে। ডেন্টাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট আসলে একটা সঙ্কেত, এর আগে পাঁচবার পেয়েছে সে। এর অর্থ হলো, মুরমটো গাড়ি দিয়ে একটা জাহাজ ভিড়েছে বন্দরে, কার্গো খালাসের প্রস্তুতি চলছে।

বিকেলের বাকি সময়টা দাঁতের ডাক্তারের কাছে থাকতে হবে, একথা সেক্রেটারিকে বলে এলিভেটরে চড়ল জর্জ ফুরোকাওয়া, নেমে এল আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যারেজে। কয়েক পা হেঁটে একটা মুরমটো স্পোর্টস কারে উঠে বসল সে।

সীটের তলাটা হাতড়াল জর্জ ফুরোকাওয়া। হ্যাঁ, একটা এনভেলাপ রয়েছে। প্রতিবারের মত এবারও এটা রেখে গেছে সুমার কোন লোক। ডক এরিয়া থেকে তিনটে গাড়ি ছাড়াবার জন্যে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট যা লাগবে, সবই রয়েছে এনভেলাপের ভেতর। পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হলো সে, কাগজগুলোয় কোন খুঁত নেই।

গাড়িতে স্টার্ট দিল ফুরোকাওয়া। ইস্পাতের উঁচু গেটের কাছে এসে দাঁড়াল গাড়ি। গেটহাউস থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে এল গার্ড।

আজ আপনি এত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছেন, মি. ফুরোকাওয়া?

আমার একটা ডেন্টাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

আপনার দাঁতের চিকিৎসা করে ডাক্তার নিশ্চয়ই একটা ইয়ট কিনে ফেলেছে।

শুধু ইয়ট, ফ্রান্সে একটা ভিলাও নয় কেন? পাল্টা কৌতুক করল জর্জ ফুরোকাওয়া।

হেসে উঠল গার্ড, তারপর রুটিন প্রশ্ন করল, আজ রাতের জন্যে কোন ক্লাসিফায়েড কাজ বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন?

না। অ্যাটাচী কেসটা অফিসে ফেলে এসেছি।

দেয়ালের দিকে পিছু হটল গার্ড, একটা বোতামে চাপ দিতেই ইস্পাতের গেট ধীরে ধীরে খুলে গেল, গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে এল জর্জ ফুরোকাওয়া।

লম্বা একটা কাঁচ মোড়া বিল্ডিঙের দুটো ফ্লোর নিয়ে ভিনসেন্ট ল্যাব, পাঁচিলের ভেতর সার সার ইউক্যালিপটাস থাকায় রাস্তা থেকে ভাল দেখা যায় না। ভিনসেন্ট ল্যাব একটা মিলিটারি রিসার্চ ও ডিজাইন সেন্টার, মালিক হলো একাধিক স্পেস ও অ্যাভিয়েশন কোম্পানির একটা কনসোটিংয়াম। এখানের কাজগুলো অত্যন্ত গোপনীয়, ফলাফল কড়া পাহারায় রাখা হয়। কাজগুলো বেশিরভাগই আসে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে, এখানের আবিষ্কারগুলো একা শুধু সামরিক বাহিনী ব্যবহার করতে পারে।

এসপিওনাজ জগতে যাদেরকে স্লীপার বলা হয়, জর্জ ফুরোকাওয়া তাদেরই একজন। তার মা-বাবা যুদ্ধের পরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসে, হাজার হাজার জাপানিদের সাথে। ফুরোকাওয়া দম্পতি আমেরিকায় আসে ঠিকই, কিন্তু আমেরিকাকে ভালবেসে নয়। চিরকালই তারা শুধু জাপানের প্রতি অনুগত ছিল, আমেরিকাকে জাপানের প্রধান শত্রু বলে মনে করেছে।

ফুরোকাওয়া দম্পতি তাদের একমাত্র সন্তানকে মার্কিন ব্যবসা জগতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে সম্ভাব্য সবকিছু করেছে। আমেরিকার সবচেয়ে নামী-দামী স্কুলে পড়িয়েছে ছেলেকে। টাকা তাদের জন্যে কোন সমস্যা হয়নি, জাপানি ব্যাঙ্ক থেকে টাকা এসেছে পারিবারিক অ্যাকাউন্টে। অবশেষে অ্যারোডাইনামিক ফিজিক্সে পিএইচডি করল জর্জ ফুরোকাওয়া, অর্জন করল ভিনসেন্ট ল্যাবে সম্মানজনক ও উঁচু মানের পদ। অ্যাভিয়েশন ডিজাইনারদের চোখে অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র, জর্জ ফুরোকাওয়া এখন আমেরিকার সর্বশেষ অ্যারোস্পেস টেকনলজি সংক্রান্ত মহামূল্য ও টপ সিক্রেট তথ্যাদি গোপনে পাচার করছে জাপানে, সরাসরি সুমার কাছে।

জাপানে কখনও যায়নি ফুরোকাওয়া, তবে তার পাঠানো ইনফরমেশন পাওয়ায় কয়েক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেঁচে গেছে জাপানের, গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে প্রায় কিছুই ব্যয় করতে হয়নি। আমেরিকার সাথে তার বিশ্বাসঘাতকতার ফলে পাঁচ বছর এগিয়ে এসেছে জাপান, অ্যারোস্পেস মার্কেটে দখল করেছে শীর্ষ স্থান।

হাওয়াই-এ হিদেকি সুমার সাথে একবারই মাত্র দেখা হয় তার। তখনই তাকে কেইটেন প্রজেক্টে রিট করা হয়। জাপানের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা পবিত্র একটি দায়িত্ব দিয়ে সম্মানিত করে তাকে। তার কাজ হলো, বিশেষ একটা রঙের গাড়ি ডক থেকে গোপনে সংগ্রহ করে অজানা গন্তব্যে পাঠিয়ে দেয়া। ফুরোকাওয়া কোন প্রশ্ন করে না। অপারেশনের সবটুকু তাকে জানানো হবে না, একথা শুনে সে বরং খুশিই হয়। এসব ব্যাপারে যত কম জানা যায় ততই ভাল। গভীরভাবে জড়িয়ে পড়লে মার্কিন টেকনলজি চুরির কাজটায় বরং বিঘ্ন সৃষ্টি হবে।

সান্তা মোনিকা বুলেবার্ডে চলে এল গাড়ি। এদিকটায় যানবাহনের সংখ্যা কমই। আরও কয়েক কিলোমিটার এগিয়ে দক্ষিণ দিকে বাঁক নিল সে উঠে এল সান। ডিয়াগো ফ্রিওয়েতে। আরেকবার ডান দিকে বাঁক ঘুরল সে, চলে এল হারবার ফ্রিওয়েতে। দশ মিনিট পর পৌঁছে গেল শিপিং টার্মিনাল এরিয়ায়। গাড়ি নিয়ে একটা গলির ভেতর ঢুকল ফুরোকাওয়া। খালি একটা ওয়ারহাউসের পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিরাট একটা ট্রাক ও একটা সেমিস্ট্রেইলার। ট্রাক ও ট্রেইলারের গায়ে নামকরা একটা স্টোরেজ কোম্পানির লোগো আঁকা রয়েছে। গাড়ি দুটোকে পাশ কাটিয়ে এসে থামল সে, হর্ন বাজাল দুবার। ট্রেইলারের ড্রাইভার সাড়া দিল তিন বার হর্ন বাজিয়ে, এগিয়ে এসে থামল স্পোর্টস কারের পিছনে।

দশ মিনিট পর লোর্ডি ডক-এর সামনে দেখা গেল ফুরোকাওয়াকে। অসংখ্য ট্রাক ঢুকছে ও বেরিয়ে আসছে, কোনরকমে গা বাঁচিয়ে একটা পাঁচিল ঘেরা উঠানের গেটে এসে থামল সে। বিদেশ থেকে আমদানি করা গাড়িগুলো রাখা হয় এখানে। এনভেলাপ থেকে বের করে ডকুমেন্টগুলো গার্ডের হাতে ধরিয়ে দিল ফুরোকাওয়া, তাকিয়ে দেখল ডিভাইন ওয়াটার থেকে আনলোড করা গাড়িতে ভরে গেছে বিশাল উঠানটা। আশপাশের প্রতিটি উঠানের একই অবস্থা কোনটায় আছে টয়োটা, কোনটায় হোন্ডা বা মাজদা। ফুরোকাওয়ার সামনের উঠানে আরেকটা গেট দিয়ে এখনও ভেতরে ঢুকছে গাড়ি, প্রতি মিনিটে আঠারোটা করে।

কাগজগুলো ফিরিয়ে দিল গার্ড, বলল, সব ঠিক আছে, স্যার। তিনটে এসপি ফাইভ হানড্রেড স্পোর্ট সেডান। প্লীজ, রাস্তার ওপারে চলে যান, কাগজগুলো ডেসপ্যাচারকে দেখালে সেই সব ব্যবস্থা করবে।

ধূমপানরত ডেসপ্যার ফুরোকাওয়াকে চিনতে পারল। আবার সেই পচা ব্রাউন রঙের গাড়িগুলো দিতে এসেছেন, স্যার? সকৌতুকে জানতে চাইল সে।

কাঁধ ঝাঁকাল ফুরোকাওয়া। আমার এক মক্কেল এগুলো তার সেলস ফ্লিট-এর জন্যে কেনে। বিশ্বাস করো বা না করো, ব্রাউন ছাড়া আর কোন রঙ পছন্দ নয় তার।

কি বেচে লোকটা, কুমীরের লেজ?

না, বিদেশী কফি।

নামটা জানতে চাই না, আমার কোন আগ্রহ নেই।

ডেসপাচারের হাতে একশো ডলারের একটা নোট গুঁজে দিল ফুরোকাওয়া। কত তাড়াতাড়ি আমি ডেলিভারি পেতে পারি? জানতে চাইল সে।

নিঃশব্দ হাসল ডেসপাচার। কার্গো হোল্ডে আপনার গাড়ি খুঁজে পাওয়া পানির মত সহজ। বিশ মিনিটের মধ্যে হাজির করছি আপনার সামনে।

এক ঘণ্টার মধ্যে সেমিট্রেইলারে ভোলা হলো গাড়ি তিনটে। উঠান থেকে রওনা হয়ে গেল ট্রেইলার। ড্রাইভারের সাথে একবারও কথা বলেনি ফুরোকাওয়া। এমনকি দুজন ভুলেও একবার পরস্পরের দিকে তাকায়নি।

গেটের বাইরে বেরিয়ে এসে রাস্তার পাশে গাড়ি থামাল ফুরোকাওয়া, ধীরে সুস্থে একটা সিগারেট ধরাল। তাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল সেমি ট্রেইলার, বাঁক নিয়ে চলে যাচ্ছে হারবার ফ্রিওয়ের দিকে। ট্রেইলারের নাম্বার প্লেটে ক্যালিফোর্নিয়া লেখা রয়েছে, তবে রাস্তায় কোথাও বদলে ফেলা হবে ওটা।

কৌতূহলটা তীব্র নয়, তবু ফুরোকাওয়া একবার ভাবল, ব্রাউন গাড়িগুলোর রহস্যটা কি? কি আছে ওগুলোয়? এগুলোর গন্তব্য এভাবে গোপন রাখা হয় কেন?

২০. সাফবোর্ডে দাঁড়িয়ে

২০.

প্রথমে আমরা সাফবোর্ডে দাঁড়িয়ে ম্যাকাপু পয়েন্টে সূর্যোদয় দেখব, বলল পিট, স্টেসির একটা হাত ধরে আছে। পরে, হানাউমা বে-তে চড়ব ডলফিনের পিঠে। তারপর সৈকতে শুয়ে গায়ে রোদ মাখব, যতক্ষণ না আপনার চামড়া থেকে সানট্যান তেল শুকায়। দুপুরে আমরা ছাতার নিচে বসে লাঞ্চ খাব, বিকেলটা গাছের নিচে শুয়ে। আর রাতে… রাতে, ছোট্ট একটা নির্জন রেস্তোরাঁয় নিয়ে যাব আপনাকে, ম্যানোয়া ভ্যালিতে ওটা…।

ভারি মজা পাচ্ছে স্টেসি, কথাবলার সময় কৌতুকে চিকচিক করে উঠল চোখ দুটো। একটা এসকর্ট সার্ভিস খোলার কথা ভেবেছেন কখনও?

মেয়েদের কাছ থেকে কিছু খসাবার প্রবণতা আমার ভেতর একেবারেই নেই, বলল পিট। সেজন্যেই পকেট সব সময় খালি থাকে।

এয়ার ফোর্স হেলিকপ্টারের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল পিট। বাইরে অন্ধকার, দূরে অস্পষ্ট একটা আলো দেখা গেল।

পিট ও প্লাঙ্কেটকে উদ্ধার করা হয় সন্ধ্যার দিকে, তার একটা পরই সবাইকে তুলে দেয়া হয় এই হেলিকপ্টারে। সবাই মানে সগি একর-এর মাইনিং টিম, ওল্ড গার্ট-এর ত্রু। সাংহাই শেলি ত্যাগ করার আগে ওয়েন মারফি ও তাঁর ক্রুদের অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়েছে ওরা। হেলিকপ্টারে সবার শেষে ভোলা হয় জিমি নষ্পে লাশ, ক্যানভাসে মুড়ে। চাইনিজ জাংক ও মার্কিন অ্যাটাক সাবমেরিনকে ওখানে রেখে হেলিকপ্টার রওনা হয়ে গেল হাওয়াই-এর উদ্দেশে।

অ্যাডমিরাল স্যানডেকার সীটে বসে ঘুমাচ্ছেন। তার পাশের সীটে অ্যালও। সম্ভবত বাকি সবাইও জেগে নেই। স্টেসিও ঘুমিয়ে পড়ত, শুধু পিটের সঙ্গ দারুন। ভাল লাগছে বলে জেগে আছে সে।

কিছু দেখতে পেলেন? জানতে চাইল স্টেসি।

দিগন্তের কাছে একটা দ্বীপ, নাম জানি না, বলল পিট। তবে বোধহয় পনেরো মিনিটের মধ্যে হনলুলুকে পাশ কাটাব।

চোখে ক্ষীণ বিদ্রূপ, স্টেসি বলল, আপনি বরং আগামীকাল সম্পর্কে আরও কিছু বলুন। ইতোমধ্যে বুঝে ফেলেছি, আপনি মানুষকে ভাল ভাল স্বপ্ন দেখাতে পারেন।

আগামীকাল সম্পর্কে আপনি ঠিক কি জনতে চান বলুন তো?

বিশেষ করে ডিনার পরবর্তী প্রোগ্রাম সম্পর্কে বলুন।

কিন্তু আমি তো ডিনার সম্পর্কে এখনও কিছু বলিনি আপনাকে।

বলেননি, এখন বলুন।

ঠিক আছে। ওখানে, মানে সাদা বালির ওপর, সরি সরি অনেকগুলো নারকেল ও সুপারি গাছ আছে…।

আনন্দে চিকচিক করে উঠল স্টেসির চোখ দুটো। নারকেল ও সুপারি গাছ? বাহ্ দারুণ! তারপর?

গাছগুলোর মাঝখানে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর আছে, গাছের পাতা দিয়ে তৈরি। ঘরটা এত ছোট যে কোনরকমে দুজনের জায়গা হতে পারে।

.

হিকাম ফিল্ডের একধারে ল্যান্ড করল হেলিকপ্টার। অন্ধকারে দেখা যায় না, তবে চারদিকে পাহারা দিচ্ছে আর্মির একটা বিশেষ কমব্যাট প্ল্যাটুন। একটা বাস ছুটে এল, পিছনে একটা কালো ফোর্ড সিডান ও আর্মি অ্যাম্বুলেন্স। কার থেকে নামল সাদা পোশাক পরা চারজন লোক, হেলিকপ্টারের দরজার দুপাশে দাঁড়াল তারা। পোস্টমর্টেম করার জন্যে জিমি নক্সের লাশ সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে।

নুমার লোকজনকে বাসে উঠতে বলা হলো। হেলিকপ্টার থেকে সবার শেষে নামল পিট ও স্টেসি বাসের দিকে এগোচ্ছে, ওদের পথরোধ করে দাঁড়াল একজন গার্ড, ইঙ্গিতে আরেক দিকে যেতে বলছে সে, যেখানে অ্যাডমিরাল স্যানডেকার দাঁড়িয়ে আছেন, পাশে অ্যাল। গার্ডের লম্বা করা হাতটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল পিট, এগিয়ে এসে দাঁড়াল বাসের পাশে। গুডবাই, প্লাঙ্কেটকে বলল ও। পা দুটো শুকনো রাখার চেষ্টা করবেন।

পিটের হাতটা মুচড়ে দিলেন প্লাঙ্কেট। আপনার জন্যে লাইফ পেয়েছি, সেজন্যে ধন্যবাদ, ডার্ক। আবার দেখা হলে বোতলের খরচ আমি দেব।

মনে থাকবে আমার। আপনার জন্যে শ্যাম্পেন, আমার জন্যে বিয়ার।

গড ব্লেস।

কালো গাড়িটার দিকে হেঁটে আসছে পিট, দেখল দুজন লোক তাদের সোনালি আইডি কার্ড অ্যাডমিরালের মুখের সামনে ধরে আছে, নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে ফেডারেল গভর্মেন্টের এজেন্ট বলে। তাদের একজন বলল, আমি প্রেসিডেনশিয়াল নির্দেশে কাজ করছি, অ্যাডমিরাল। আমার ওপর নির্দেশ আছে আপনাদের চারজনকে সরাসরি ওয়াশিংটনে নিয়ে যেতে হবে। আপনি, মি. ডার্ক পিট, মি. অ্যাল জিওর্দিনো ও মিস স্টেসি ফক্স।

বুঝলাম না, বললেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার, চেহারায় অস্বস্তি। এত তাড়া কিসের?

তা আমার জানা নেই, স্যার।

কিন্তু আমার নুমার অফিসাররা দুমাসের ওপর পানির নিচে কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, ওদের বিশ্রাম দরকার, প্রতিবাদের সুরে বললেন অ্যাডমিরাল।

নিউজ ব্ল্যাকআউট, প্রেসিডেন্টের নির্দেশ, স্যার। আপনার নুমার লোকজন, প্লাঙ্কেট ও ড. স্যালাজার সহ, দ্বীপের নিরাপদ একা কম্পাউন্ডে থাকবেন, যতদিন না নিউজ ব্ল্যাকআউট তুলে নেয়া হয়। তারপর সরকারি খরচে ওরা যে যেখানে যেতে চান পৌঁছে দেয়া হবে।

যতদিন মানে?

তিন কি চার দিন, স্যার।

অন্যান্যদের সাথে মিস স্টেসিও যেতে পারবেন না?

না, স্যার। আমার ওপর নির্দেশ আছে, তাকেও আপনার সাথে থাকতে হবে।

স্টেসির দিকে তাকাল পিট, ঠোঁট বাঁকা করে বলল, কি যেন গোপন করে গেছেন আপনি, লেডি!

অদ্ভুত রহস্যময় এক টুকরো হাসি ফুটল স্টেসির ঠোঁটে। হাওয়াই-এর আমাদের আগামীকালটা ভেস্তে গেল!

কেন বলতে পারব না, আমার তা মনে হচ্ছে না।

স্টেসির চোখ দুটো সামান্য একটু বড় হলো। অন্য এক সময় পুষিয়ে নেয়া যাবে, সম্ভবত ওয়াশিংটনে।

আপনি আমাকে বোকা বানিয়েছেন। এখন সন্দেহ হচ্ছে ওল্ড গার্টে যে সাহায্য চেয়েছিলেন, সেটাও আপনার ছিল কিনা।

মুখ তুলে তাকাল স্টেসি, চেহারায় রাগ ও অভিমানের অদ্ভুত সংমিশ্রণ। সময়মত আপনারা না পৌঁছালে সবাই আমরা মারা যেতাম।

তাছাড়া, রহস্যময় বিস্ফোরণটা? ওটা কি আপনাদেরই কীর্তি?

কে দায়ী সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই, আন্তরিক সুরে বলল স্টেসি। আমাকে ব্রিফ করা হয়নি।

ব্রিফ, মৃদুকণ্ঠে পুনরাবৃত্তি করল পিট। একজন ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার এ ধরনের একটা শব্দ ব্যবহার করবে কেন? আসলে কাদের হয়ে কাজ করছেন আপনি?

হঠাৎ যেন কঠিন হয়ে উঠল স্টেসির সুর। শিগগিরই জানতে পারবেন। পিটের দিকে পিছন ফিরল সে, গাড়িতে উঠে পড়ল।

.

ওয়াশিংটনে যাবার পথে, প্লেনে মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমাল পিট। গালফস্ট্রীম সরকারি জেটের পিছন দিকে, সবার কাছ থেকে দূরে একা বসে আছে ও, কোলের ওপর পড়ে রয়েছে ইউএসএ টুডে। কাগজটার দিকে তাকিয়ে আছে, তবে পড়ছে না।

রেগে আছে পিট। রাগ হচ্ছে একাধিক কারণে। বিস্ফোরণের কারণে যে ভূমিকম্প হলো, সে-ব্যাপারে একের পর এক অনেক প্রশ্ন করেছে ও, কিন্তু ওর প্রতিটি প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার। বুঝতে অসুবিধে হয়নি, মুখ খুলতে রাজি নন তিনি। রাগ স্টেসির ওপরও, কারণ এখন ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে ব্রিটিশদের ডীপ-ওয়াটার অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল নুমার সগি একর প্রজেক্টের ওপর নজর রাখা। একই লোকেশনে ওল্ড গার্টের ডাইভ দেয়াটা কাকতালীয় ব্যাপার হতে পারে না। ফটোগ্রাফার না ঘোড়ার ডিম, ওটা আসলে স্টেসির কাভার। মেয়েটা আসলে স্পাই, কোন সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হলো, কোন এজেন্সির প্রতিনিধিত্ব করছে সে?

চিন্তার মগ্ন পিট, প্লেনের পিছন দিকে চলে এসে পিটের পাশে বসল অ্যাল। তোমাকে পরাস্ত বলে মনে হচ্ছে, দোস্ত।

আড়মোড়া ভাঙল পিট। ভাবছি, বাড়ি ফিরতে পারলে ভালো হতো।

অ্যান্টিক ও ক্লাসিক গাড়ির একটা বিরাট সংগ্রহ আছে পিটের, অ্যাল তা জানে।

নতুন কোন গাড়ির ওপর কাজ করবে? জানতে চাইল সে।

কোনটা?

জিওর্দিনো মাথা ঝাঁকায়। প্যাকার্ড না মারমন?

কোনোটাই না, পিট বলে। প্যাসিফিকে যাওয়ার আগে স্টাজে লাগানোর জন্যে একটা এঞ্জিন তৈরি করেছি নতুন করে।

সেই যে, ১৯৩২ সালের সবুজ গাড়িটা?

হ্যাঁ।

.

ক্লাসিক গাড়ির রেস হবে রিচমন্ডে, থাকতে চাও ওখানে?

রেস তো আর মাত্র দুদিন পর, চিন্তিত ভাবে বলল পিট। এত তাড়াতাড়ি গাড়িটা খাড়া করাতে পারব না।

দুজন মিলে চেষ্টা করলে পারব, উৎসাহ দিয়ে বলল অ্যাল। অন্তত চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি?

বোধহয় সুযোগ পাব না, অ্যাল, বলল পিট। শুধু নিউজ ব্ল্যাকআউট নয়। ব্যাপারটা আরো সিরিয়াস তে পারে। অ্যাডমিরালের হাবভাব আমার ভাল ঠেকছে না।

আমি তার মুখ খোলাবার কম চেষ্টা করিনি, হতাশ কণ্ঠে বলল অ্যাল।

কিন্তু?

তার চেয়ে একটা লাইটপোস্টের সাথে কথা বললেও হয়তো কিছু আদায় করা যেত।

মাত্র একটা তথ্য আদায় করতে পেরেছি আমি, বলল পিট। ল্যান্ড করার পর সরাসরি আমাদেরকে ফেডারেল হেডকোয়ার্টার বিল্ডিঙে নিয়ে যাওয়া হবে।

হতভম্ব দেখায় অ্যালকে। ওয়াশিংটনে কোন ফেডারেল হেডকোয়ার্টার বিল্ডিং আছে বলে তো কখনও শুনিনি।

আমিও, বলল পিট।সেজন্যেই মনে হচ্ছে, আমাদের আটকে রাখা হয়েছে।

.

২১.

ভ্যানটায় কোন চিহ্ন নেই, পাশে কোন জানালাও নেই। এ এয়ারফোর্স বেস থেকে বেরিয়ে কনস্টিটিউশন অ্যাভিনিউ ধরে ছুটল সেটা। বেশ কিছুক্ষণ পর নির্জন একটা গলির ভেতর ঢুকল। থামল পার্কিং লটের পিছনে, একটা পুরানো ছতলা ভবনের সিঁড়ির গোড়ায়। ভবনের গায়ে প্লাস্টার প্রায় নেই বললেই চলে, দেখে মনে হলো যেকোন মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে। বাইরের দিকের সবগুলো জানালা ভেতর থেকে বন্ধ, সম্ভবত বছরের পর বছর খোলা হয় না। কয়েকটা ঝুল-বারান্দার রেইল ভেঙে গেছে, পরে আর মেরামত করা হয়নি। যেন পরিত্যক্ত একটা ভবন।

ওদের সাথে দুজন ফেডারেল এজেন্ট রয়েছে, তারাই পথ দেখাল। কয়েকটা ধাপ টপকে লবিতে ঢুকল ওরা। লবিতে ফার্নিচার বলতে তেমন কিছু নেই, যা-ও বা আছে, সব ভাঙাচোরা ও মান্ধাতা আমলের। মেঝেতে বসে আছে ছেঁড়া কম্বল জড়ানো এক প্রৌঢ়, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, দেখে মনে হলো আশ্রয়হীন। তার দিকে চোখ পড়তে দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নিলেন অ্যাডমিরাল। লোকটার গায়ে নির্ঘাত ছারপোকা আর উৎকট দুর্গন্ধ আছে, যেকোন মেয়ের মনে ঘৃণার উদ্রেক করবে, কিন্তু লোকটার দিকে চোখ পড়তে সামান্য হাসল স্টেসি।

কৌতূহল বোধ করল পিট, দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, রোদ পোহাবার জন্যে দিনটা ভাল।

প্রৌঢ় লোকটা নিগ্রো, জট করে মুখ তুলে তাকাল। আপনি অন্ধ নাকি, মিস্টার? রোদ আমার কি উপকারে আসবে?

লোকটার চোখে প্রফেশন্যাল অবজারভার-এর দৃষ্টি, লক্ষ করল পিট। ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল সে। এ চোখ আশ্রয়হীন কোন দুর্ভাগার হতে পারে না।

কি জানি, প্রতিবেশীসুলভ সৌহার্দ্য প্রকাশ পেল ওর গলার সুরে। তবে পেনশন পাবার পর আপনি যখন বারমুডায় সময় কাটাতে যাবেন, রোদে তো আপনাকে বেরুতেই হবে, তাই না?

সর্বহারা লোকটি হাসল, মুক্তার মত ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে। হ্যাভ আ সেফ স্টে, মাই ম্যান, বলল সে।

চেষ্টা করব, বলল পিট। অদ্ভুত উত্তর শুনে কৌতুক বোধ করল। সামনে এই প্রথম এক সারিতে কয়েকজন সশস্ত্র সেন্ট্রিকে দেখতে পেল ও। তাদেরকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়ল মেইন হলরুমে।

প্রথমেই ডিজাইনফেকট্যান্ট-এর গন্ধ ঢুকল নাকে। হলরুমের মেঝেতে চাল বলে কিছু নেই, কোথাও গর্তও সৃষ্ট হয়েছে। দেয়ালে অনেক কাল আগে রঙিন কাগজ সাঁটা হয়েছিল, বেশিরভাগ ছিঁড়ে গেছে। একপাশে একটা অ্যান্টিক পোস্টবক্স দেখল ও, গায়ে লেখা রয়েছে ইউএস মেইল।

নিঃশব্দে খুলে গেল একটা এলিভেটরের দরজা। ভেতরটা চকচকে ক্রোম, দেখে অবাক হয়ে গেল সবাই। সদ্য ভাজ খোলা ইউনিফর্ম পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইউএস মেরিন-এর একজন সদস্য, সেই অপারেটর। কোন রকম জড়তা নেই, সরাসরি এলিভেটরে উঠে পড়ল স্টেসি। পিটের মনে হলে, এখানে সম্ভবত আগেও এসেছে সে।

ওপরে নয়, এলিভেটর নামতে শুরু করল নিচের দিকে। এক সময় থামল সেটা। বাইরে বেরিয়ে এসে পিট দেখল, করিডরের মোজাইক করা মেঝে ঝকঝক করছে, দেয়ালগুলো এত সাদা যেন গতকালই চুনকাম করা হয়েছে। ফেডারেল এজেন্টরা ওদেরকে একটা দরজার সামনে এসে দাঁড় করাল। দেখেই বোঝা গেল, দরজাটা সাউন্ডপ্রুফ। সবার সাথে ভেতরে ঢুকল পিট।

এটা একটা কনফারেন্স রুম। নিচু সিলিং, সিলিঙের আড়ালে আলো। কামরার মাঝখানে বিরাট একটা লাইব্রেরি টেবিল, টেবিলটা প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট হোয়াইট হাউসের জন্যে কিনেছিলেন। টেবিলের ওপর একটা বেতের ঝুড়িতে এক গাদা আপেল রয়েছে, পাশেই একটা কনসোল। নিচে রক্তলাল পারশিয়ান কার্পেট।

টেবিলের উল্টোদিকে গিয়ে দাঁড়াল স্টেসি। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে তার মুখের পাশে আলতোভাবে চুমো খেলেন এক ভদ্রলোক, অভ্যর্থনা জানালেন নিচু স্বরে, উচ্চারণ ভঙ্গিতে টেক্সাসের সুর স্পষ্ট। দেখে মনে হলো, স্টেসির সাথে আগে থেকেই পরিচয় আছে তার। যদিও স্টেসি ওদের কারও সাথে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিল না। হাওয়াই-এ প্লেনে চড়ার পর থেকে পিট ও স্টেসি পরস্পরের সাথে কথা বলেনি। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ভান করার চেষ্টা করছে স্টেসি, দিকে পিছন ফিরে থাকছে সে।

স্টেসির পরিচিতি ভদ্রলোকের দুপাশে আরও দুজন বসে রয়েছেন, চেহারাই বলে দেয় এশিয়ান, তাদেরকেও পিট চেনে না। নিজেদের মধ্যে চাপাস্বরে কথা বলছেন সবাই, পিট ও অ্যাল ঘরে ঢুকতেও মুখ তুলে তাকালেন না। টেবিলের মাথার কাছে একটা চেয়ার রয়েছে, সেটার পাশের একটা চেয়ারে বসলেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার, শান্তভাবে একটা হাভানা চুরুট ধরালেন। টেবিলে আরও এক ভদ্রলোক বসে আছেন, একটা ফাইল খুলে কি যেন পড়ছেন তিনি।

রোগা-পাতলা, স্যুটপরা এক ভদ্রলোক, চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এলেন, হাতে একটা পাইপ। জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের মধ্যে ডার্ক পিট কে?

আমি, বলল পিট।

ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, ভদ্রলোক বললেন, পিটের দিকে বাড়িয়ে দিলেন ডান হাতটা। আমাকে বলা হয়েছে, আমরা একসাথে কাজ করব।

কাজটা কি না জেনে উৎসাহ বোধ করছি না, করমর্দন করে বলল পিট। আমার বন্ধু, অ্যাল জিওর্দিনো ও আমি, দুজনেই আমরা অন্ধকারে।

আমরা সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়েছি একটা এমএআইটি তৈরি করব বলে।

এম এআইটি মানে?

মাল্টি এজেন্সি ইনভেস্টিগেটিভ টিম।

ও আচ্ছা, গম্ভীর সুরে বলল পিট। বেশ ভাল, খুশির খবর। টিম গঠন করুন, আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। শুধু যদি ক্ষমা করেন, এই মুহূর্তে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে চাই আমি। আমার ঘুম পেয়েছে।

পিটেরও কথা শেষ হলো, রেইমন্ড জর্ডানও দুই ভদ্রলোককে নিয়ে কনফারেন্স রুমে ঢুকলেন। তিনজনের চেহারাই থমথম করছে। রেইমন্ড জর্ডান সরাসরি জেমস স্যানডেকারের দিকে এগিয়ে এলেন। তোমাকে দেখে খুশি লাগছে, জেমস, বললেন তিনি। এই বিপদে তোমার সহযোগিতা পেয়ে সত্যি মুগ্ধ হয়েছি আমি। জানি প্রজেক্টটা নষ্ট হওয়ার তোমাদের কারও মনই ভাল নেই।

নুমা আরেকটা প্রজেক্ট তৈরি করবে, গমগম করে উঠল অ্যাডমিরালের গলা।

টেবিলের মাথায় বসলেন রেইমন্ড জর্ডান। সহকারীরা পাশেই থাকলেন, কয়েকটা ফাইল রাখলেন তার সামনে। বসার পরও শিথিল হলো না তার পেশী। ভঙ্গিটা আড়ষ্ট, শিরদাঁড়া চেয়ারের পিছনটাকে স্পর্শ করছে না। একে একে সবার দিকে তাকালেন তিনি, দৃষ্টি দেখে বোঝা যায় মনের কথা পড়ার চেষ্টা করছেন। তারপর তিনি তিনজনকে উদ্দেশ্য করে আলাপ শুধু করছেন। ওরা তিনজন এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে পিট, অ্যাল ও ম্যানকিউসো। আপনারা বসবেন, প্লীজ?

বসল ওরা। সামনের ফাইলগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন রেইমন্ড জর্ডান। পরিবেশ উত্তেজনা ও উদ্বেগে ভারী হয়ে আছে।

চুপচাপ বসে আছে পিট, নির্লিপ্ত। লেকচার বা ভাষণ শোনার মত মন নেই ওর। গত দুদিন সাঙ্ঘাতিক ধকল গেছে ওর ওপর দিয়ে, ক্লান্তি বোধ করছে। ইচ্ছে গোসল করে আট ঘণ্টা ঘুমাবে। কারও বাধা মানত না, শুধু অ্যাডমিরালের প্রতি শ্রদ্ধাবশত এখনও এখানে নিজেকে ধরে রেখেছে।

আপনাদের কারও যদি কোন অসুবিধে করে থাকি, সেজন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থী, শুরু করলেন রেইমন্ড জর্ডান। তবে এ-ও সত্যি যে আমরা একটা মহাসঙ্কটে পড়ে দিশেহারা বোধ করছি। সঙ্কট বা বিপদ যে শুধু আমেরিকার, তা নয়। আমাদের ধারণা, গোটা বিশ্বই মারাত্মক একটা সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে। সেজন্যেই এখানে আজ বসে আমরা যে ইনভেস্টিগেটিভ টিম তৈরি করব তাতে আমেরিকান ছাড়াও জাতিসংঘ ও অন্যান্য দেশের প্রতিনিধি থাকবেন। থামলেন তিনি, একটা ফাইলে চোখ বুলালেন। আপনাদের সম্পর্কে জানি আমি।

এতটা নিশ্চিত না হওয়াই ভাল, মন্তব্য করল অ্যাল, অ্যাডমিরাল কঠিন দৃষ্টি এড়িয়ে গেল।

দুঃখিত, বললেন জর্ডান। আমার নাম রেইমন্ড জর্ডান। জাতীয় ও আন্ত র্জাতিক নিরাপত্তার স্বার্থে প্রেসিডেন্ট আমাকে ইনভেস্টিগেটিভ টিম গঠন করার অনুমতি ও নির্দেশ দিয়েছেন। পরিস্থিতি এবং আপনাদের উপস্থিতি ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব আমি ছেড়ে দিচ্ছি আমার ডেপুটি ডিরেক্টর অপারেশনস, মি. ডোনাল্ড কার্নকে।

ডোনাল্ড কার্ন হাড়সর্বস্ব ব্যক্তি, ঠাণ্ডা নীল চোখ দিয়ে সবার অন্তর পর্যন্ত দেখে নিচ্ছেন। সবার, শুধু পিটের বাদে। দুজনকে দেখে মনে হলো, মাঝপথে দুটো বুলেট এক হয়েছে, কেউ কাউকে পথ ছাড়বে না।

প্রথমে, শুরু করলেন ডোনাল্ড কার্ন, এখনও পিটের মন বোঝার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন, টিমের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করব আমি। প্রতিটি টীমে দুজন করে সদস্য থাকবেন। নেতৃত্ব দেবেন একজন। টিম লীডার যদি চান, সদস্য সংখ্যা বাড়াতে পারবেন। তবে তাদের তালিকা আগেই পৌঁছে দিতে হবে আমার কাছে। প্রতিটি টিমের কমান্ড সেন্টার ওয়াশিংটন, এই টিমের কমান্ড সেন্টার ওয়াশিংটন, এই ফেডারেল হেডকোয়ার্টার বিল্ডিং। শাখা অফিস থাকবে প্রশান্ত মহাসাগরের একটা দ্বীপে, পালাও রিপাবলিকের কাছাকাছি। ওটা হবে আমাদের ইনফরমেশন গ্যাদারিং ও কালেকশন পয়েন্ট। আমাদের ডিরেক্টর অভ ফিল্ড অপারেশনস নিয়োগ করা হয়েছে মি. মেল পেনারকে। পেনারের দিকে তাকলেন তিনি, তাঁর ও জর্ডানের সাথেই কনফারেন্স রুমে ঢুকেছেন ভদ্রলোক।

অলসভঙ্গিতে একটা হাত তুললেন পেনার। কারও দিকে তাকালেন না, হাসলেনও না।

আমাদের টিমগুলোর কোডের ভেতরে থাকবে, বললেন ডোনাল্ড কার্ন। সেন্ট্রাল কমান্ডকে বলা হবে টিম লিঙ্কন। মেল পেনার হলেন টিম ক্রাইসলার। মি. মার্ভিন শওয়াল্টার, ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের আসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর অভ সিকিউরিটি, টোকিওর ইউএস দূতাবাসে দায়িত্ব পালন করবেন। তার টিম কোড হলো ক্যাডিলাক।

মার্ভিন শওয়াল্টার দাঁড়ালেন, মাথা নত করে সবিনয়ে জানালেন, আপনাদের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে আমি ধন্য মনে করছি।

ডোনাল্ড কার্ন এরপর ফিরলেন স্টেসি ও তার পাশে বসা দাড়িঅলা ভদ্রলোকের দিকে। মিস স্টেসি ও মি. টিমোথি ওয়েদারহিল, আপনারা দুজন দেশের ভেতর তদন্ত চালাবেন। আপনাদের কাভার, ডেনভার ট্রিউবুন-এর জার্নালিস্ট ও ফটোগ্রাফার। টিমের কোডনেম, টিম বুইক। এরপর তিনি এশিয়ান ভদ্রলোকের। দিকে তাকালেন। টিম হোন্ডা হলো মি. রয় ওরশিয়া ও জেমস হানামুরা। আপনারাই সবচেয়ে বিপজ্জনক অ্যাসাইনমেন্ট পেয়েছেন জাপানে।

মি. ডোনাল্ড ব্রিফ শেষ করার আগে কারও কোন প্রশ্ন আছে? জানতে চাইলেন রেইমন্ড জর্ডান।

আমরা যোগাযোগ করব কিভাবে? জানতে চাইলেন ওয়েদারহিল।

জবাব দিলেন ডোনাল্ড কান, ফোনে। টেবিলের ওপর একটা কনসোল রয়েছে, অনেকগুলো বোতামের একটায় চাপ দিলেন তিনি, তাকালেন দেয়ালের দিকে দেয়ালে সাঁটা একটা কালো স্ক্রীন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আরও কয়েকটা বোতামে চাপ দিলেন তিনি, কয়েকটা সংখ্যা ফুটে উঠল স্ক্রীনে। টেলিফোন নম্বরটা মুখস্থ করে নিন সবাই। এই নম্বরে চব্বিশ ঘণ্টা একজন অপারেটর থাকবে, নিরাপদ লাইন, তার জানা থাকবে কে কোথায় আছি আমরা।

খুক করে কেশে রেইমন্ড জর্ডান বললেন, প্রতি বাহাত্তর ঘণ্টায় একবার যোগাযোগ করবেন টিম লীডার। যদি না করেন, আপনাদের খোঁজে এখান থেকে কাউকে আমরা পাঠাব।

নিজের চেয়ারের পিছনের পায়া দুটোর ওপর ভর চাপিয়ে দোল খাচ্ছে পিট, দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে একটা হাত তুলল। আমার একটা প্রশ্ন আছে।

ইয়েস, ডার্ক?

কৃতজ্ঞবোধ করব, দয়া করে কেউ যদি বলে দেন এখানে ঠিক কি ঘটছে।

অস্বস্তিতে ভরপুর নিস্তব্ধতা নামল কনফারেন্স রুমে। অ্যাল ছাড়া সবাই ভুরু কুঁচকে তাকাল পিটের দিকে, দৃষ্টিতে অসন্তোষ।

জেমস স্যানডেকারের দিকে তাকালেন রেইমন্ড জর্ডান, অ্যাডমিরাল মাথা নেড়ে বললেন, তুমি যেমন অনুরোধ করেছিলে, পিট বা অ্যালকে আমি পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুই জানাইনি।

মাথা ঝাঁকালেন রেইমন্ড জর্ডান। দ্রমহোদয়গণ, আপনাদেরকে ব্রিফ করা হয়নি, এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যর্থতা। আপনাদের ওপর দিয়ে যে ধরনের ধকল গেছে, তারপর যদি অমর্যাদাকর আচরণ করা হয়ে থাকে, সেজন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

জর্ডানের দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে আছে পিট। নুমার মাইনিং অপারেশনে অবৈধভাবে নজর রাখার জন্যে একটা ষড়যন্ত্র করা হয়। আমি জানতে চাই, ষড়যন্ত্রের পিছনের ব্যক্তিটি কি আপনি?

এক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন রেইমন্ড জর্ডান, তারপর বললেন, আমরা কখনও অবৈধভাবে নজর রাখি না, ডার্ক। আমরা পর্যবেক্ষণ করি। হ্যাঁ, নির্দেশটা আমিই দেই। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে একটা ব্রিটিশ সার্ভে টিম আগে থেকেই কাজ করছিল, আপনাদের এলাকায় সরে গিয়ে তারা আমার সাথে সহযোগিতা করে।

আর পানির ওপর যে বিস্ফোরণটা হলো, যে বিস্ফোরণে ডুবে গেল ক্রু সহ ব্রিটিশ জাহাজটা, ভূমিকম্পের কারণ সৃষ্টি করল, আট বছরে গবেষণা ও পরিশ্রম ব্যর্থ হয়ে গেল নুমার, সেটাও কি আপনার নির্দেশে?

না, ওটা ছিল একটা আকস্মিক ট্রাজেডি। কেউ জানত না এধরনের কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।

ভাবতে আশ্চর্য লাগছে আমার, নুমার পিছনে আপনি স্পাই লাগালেন!

পিটের দিকে নয়, তাকালেন জেমস স্যানডেকারের দিকে, বললেন, তোমার ফ্যাসিলিটি, যেটাকে তোমরা সগি একর বলছ, এমন কড়া গোপনীয়তার মধ্যে তৈরি করা হয় যে আমাদের কোন ইন্টেলিজেন্স এজিন্সি জানেই না তোমরা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কাজ করছ কিনা।

কাজেই প্রজেক্টের কথা জানতে পারার সাথে সাথে গলাবার জন্যে লম্বা হয়ে গেল আপনার নাকটা? জিজ্ঞেস করল পিট।

রেইমন্ড জর্ডান এত বড় পদের অধিকারী, এত বেশি তার দক্ষতা, কেইউ কখনও তাঁকে ব্যঙ্গ করার স্পর্ধা দেখায়নি। তাঁর আচরণে কখনোই আত্মরক্ষার ভঙ্গি থাকে না। অথচ পিটের চোখের দিকে তাকালেন না তিনি। যা হবার হয়ে গেছে, বললেন তিনি। এতগুলো মানুষ মারা যাওয়ায় সত্যি আমি দুঃখিত। কিন্তু ভুল একটা সময়ে দুর্ভাগ্যজনক একটা পজিশনে অপারেটরদের পাঠানোর জন্যে পুরোপুরি আমাদেরকে দায়ী করা যায় না। কেউ আমাদেরকে জানায়নি যে একটা জাপানি অটো ক্যারিয়ার সাগরের ওপর দিয়ে অ্যাটম বোমা বয়ে আনছে। ওগুলো। যে দুর্ঘটনাবশত প্রায় আপনাদের মাথার ওপর ফেটে যেতে পারে, তা-ও আমরা জানতাম না।

মুহূর্তের জন্যে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে তাকল পিট। প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেয়েছে সত্যি, তবে ধাক্কাটা দুসেকেন্ডেই সামলে নিল ও। ধাঁধার উত্তরগুলো ধীরে ধীরে মিলে যাচ্ছে। কথা বলার সময় তাকিয়ে থাকল জেমস স্যানডেকারের দিকে, অনুভব করল আহত বোধ করছে। আপনি জানতেন, অ্যাডমিরাল, অথচ কিছুই আমাকে বলেননি। আপনি ওয়াশিংটন ত্যাগ করার আগেই জানতেন। অ্যাটাক সাবমেরিন টাকসন মি. প্লাঙ্কেট ও আমাকে উদ্ধার করতে আসেনি, এসেছিল রেডিওঅ্যাকটিভিটি রেকর্ড ও আবর্জনার সন্ধানে।

কেউ জ্বালাতন করায় এই প্রথম লাল হয়ে উঠল অ্যাডমিরালের চেহারা। প্রেসিডেন্ট আমাকে দিয়ে কথা আদায় করিয়ে নেন, আমি গোপনীয়তা রক্ষা করব, ধীরে ধীরে বললেন তিনি। এর আগে কখনও তোমাকে আমি মিথ্যে কথা বলিনি, পিট। কিন্তু এক্ষেত্রে যোবা না থেকে আমার উপায় ছিল না।

মনে মনে অ্যাডমিরালকে ক্ষমা করে দিল পিট, তবে জর্ডানের ওপর রাগটা এখনও আছে। জানতে চাইল, বলুন, মি. জর্ডান, আমরা এখানে কেন?

প্রতিটি টিমের সদস্যকে প্রেসিডেন্ট স্বয়ং বাছাই করেছেন, বললেন জর্ডান। আপনাদের সবার ব্যাকগ্রাউন্ড, রেকর্ড, ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি তিনি জানেন। আপনারা সবাই যে বিশ্বস্ত, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হবার পরই তৈরি করা হয়েছে তালিকাটা।

আবার শুরু করলেন রেইমন্ড জর্ডান, অ্যাডমিরাল এবং মি. জিওর্দিনো দুজন মিলে একটা টিম। কোডনেম মার্সিডিজ। ওঁরা সাগরের নিচে কাজ করবেন।

আমার প্রশ্নের মাত্র অর্ধেকটার উত্তর দিচ্ছেন আপনি, মি. জর্ডান, মনে করিয়ে দিল পিট।

বাকি অর্ধেককটাও বলতে যাচ্ছি, জানালেন রেইমন্ড জর্ডান। আপনি এবং মি. ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, আপনারা দুজন একটা সাপোর্ট টিম হিসেবে কাজ করবেন।

কিসের সাপোর্ট?

প্রতিটি টিমকে সহযোগিতা দেবেন আপনারা। এটা একটা বিশাল অপারেশন, কাজেই সাপোর্ট টিমের দায়িত্বই সবচেয়ে বেশি। কোন টিম বিপদে পড়লে, তাদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার দায়িত্ব আপনাদের।

আমাদের কোডনেম?

ডোনাল্ডের দিকে তাকালেন রেইমন্ড জর্ডান, ভদ্রলোক বলেন, সাপোর্ট টিমের কোডনেম…টিম স্টাজ।

বেশ, বলল পিট। নামকরণ যখন হয়ে গেল, এখানে আমার আর থাকার দরকার আছে বলে মনে হয় না। হাতঘড়ির ওপর চোখ বুলাল ও। এখানে আমাকে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে টেনে আনা হয়েছে। গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমিয়েছি আমি, খেয়েছি মাত্র একবার। আমাকে একবার বাথরুমেও যেতে হবে। অথচ এখনও আমাকে জানানো হয়নি আসলে ঠিক কি ঘটছে। আপনাদের সেন্ট্রিরা বা মেরিনরা আমাকে বাধা দিতে পারে, জানি। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমি আহত হব, আর আহত হলে সাপোর্ট টিমে থাকতে পারব না।

এক সাথেই বেরোই, বলে পিটের আগে চেয়ার ছাড়ল অ্যাল। পিটের মত আমাকেও জিজ্ঞেস করা হয়নি, টীমে থাকতে আমি রাজি আছি কিনা।

অসম্ভব! গম্ভীর সুরে বললেন ডোনাল্ড কার্ন। এভাবে আপনারা চলে যেতে পারেন না। ইউ আর আন্ডার কন্ট্রাক্ট টু দ্য গভর্নমেন্ট।

সিক্রেট এজেন্টের ভূমিকায় কাজ করার জন্যে কারও সাথে আমার কোন চুক্তি হয়নি, শান্ত গলায় বলল পিট। সাগরের তলা থেকে আমরা ফিরে আসার পর যদি আমেরিকায় সামরিক অভ্যুত্থান না ঘটে থাকে, এদেশে কারও স্বাধীন ইচ্ছায় হস্তক্ষেপ করার অধিকার কেউ আপনারা রাখেন না।

রেগেমেগে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন ডোনাল্ড কার্ন, তাঁকে থামিয়ে দিয়ে কথা বললেন রেইমন্ড জর্ডান। ডার্ক, আপনার অসন্তুষ্ট হবার কারণ আমি বুঝতে পারছ। আপনি যদি দয়া করে আর একটু ধৈর্য ধরেন, তাহলে সব কথা আপনাকে জানাবার একটা সুযোগ পাই আমরা। প্রথমেই বলে রাখছি, কিছু কিছু ব্যাপার ক্লাসিফায়েড থাকবে। পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা আপনাদের কারও না থাকাই ভাল বলে মনে করি আমি। সেটা আপনাদের নিরাপত্তার স্বার্থেই। বুঝতে পারছেন তো?

আমি শুনছি, বলল পিট।

জাপানের কাছে অ্যাটম বোমা আছে, তথ্যটা ফাঁস করলেন জাতীয় নিরাপত্তা কমিশন চীফ। কতদিন থেকে আছে বা কতগুলো আছে তা এখনও আমরা জানি না। অ্যাডভান্স নিউক্লিয়ার টেকনলজিতে জাপানের যে উন্নতি, ওঅরহেড তৈরি করার ক্ষমতা দশ বছর আগেই অর্জন করেছে ওরা। পরমাণু অস্ত্র-বিরোধী চুক্তিতে সই করলেও, ওদের ক্ষমতা-বলয়ের মধ্যে কেউ বা কোন একটি গ্রুপ সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রয়োজনে অন্তত ব্যাকমেইল করার জন্যে অমোঘ একটা অস্ত্র তাদের দরকার।

খুব সামান্যই জানি আমরা, তা-ও জেনেছি বিস্ফোরণের পর। জাপানের একটা অটো ক্যারিয়ার মুরমটো অটোমোবাইল বহন করছিল, প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে এক কি দুটো বোমা বিস্ফোরিত হয় ওটার সাথে ধ্বংস হয়ে যায় নরওয়ের একটা প্যাসেঞ্জার-কাগো লাইনার ও একটা ব্রিটিশ সার্ভে শিপ, ক্রু সহ। জাপানের একটা জাহাজে অ্যাটম বোমা কেন? ওরা ওগুলো গোপনে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরে আনছিল। শুধুই কি যুক্তরাষ্ট্রের পাঠাচ্ছে ওরা? বোধহয় না। ওদের উদ্দেশ্যটা কি? সম্ভবত নিউক্লিয়ার হুমকি সৃষ্টি।

জাপানের কাছে নিউক্লিয়ার বোমা থাকতে পারে, কিন্তু ওটা ফেলার জন্যে দূর পাল্লার যে মিসাইল বা বহুবার দরকার তা ওদের নেই। ওরা কি ভাবছে, আমরা আন্দাজ করে নিতে পারি। জাপান একটা অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে, দুনিয়ায় এমন কোন লোক নেই যে জাপানি পণ্য ব্যবহার করছে না। এই সাম্রাজ্যটাকে রক্ষার জন্যে, আকারে আরও বড় করার জন্যে, পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে গোপনে অ্যাটম বোমা পাঠাচ্ছে ওরা, লুকিয়ে রাখছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়, প্রয়োজন হলে যাতে অল্প সময়ের নোটিশে ব্যবহার করতে পারে। কখন প্রয়োজন হবে?

ধরুন, জাপানের ব্যবসায়িক নীতি আমেরিকার পছন্দ হলো না। কিংবা ধরুন, কোন কারণে জাপানের ওপর আমেরিকা খুব রেগে গেল। আপনারা জানেন, জাপানি ব্যাংকগুলো আমেরিকারকে কয়েকশো বিলিয়ন মার্কিন ডলার ধার দিয়েছে। রেগে গিয়ে আমেরিকা জানিয়ে দিল, ধারের টাকা জাপানকে তারা ফেরত দেবে না। আরও জানাল, জাপানি পণ্য বয়কট করা হবে। এই মুহূর্তে, আপনাদের সাথে আমি যখন কথা বলছি, প্রেসিডেন্টের কাছে ঠিক এই প্রস্তাবই তুলছেন সিনেটর মাইক ডিয়াজ ও কংগ্রেস সদস্য লরেন স্মিথ। শুধু তাই নয়, এমন হতে পারে প্রেসিডেন্ট হয়তো সুপিরিয়র মিলিটারি ফোর্সকে নির্দেশ দেবেন, জাপানকে যেন অবরোধ করা হয়, আমাদের তেল ও কোন কাঁচামাল তারা যেন না পায়। আপনি শুনছেন তো, ডার্ক?

শুনেছি।

আমরা জাপানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারি, এ সম্ভাবনা নিয়ে কথাবার্তা অনেক দিন ধরেই চলছে। কাজেই ওরাও সতর্ক হয়েছে। তার নমুনা, এই বোমা। কাজেই আমরা ধরে নিতে পারি, আমেরিকা বা আর কারও ভয়ে জাপানিরা ভীত নয় আমরা বেশি বাড়াবাড়ি করলে বোতাম টিপে ওগুলো ফাটিয়ে দেবে তারা, বা ফাটিয়ে দেয়ার হুমকি দেবে। পরবর্তী প্রশ্ন, আমরা এখানে কেন? বোমাগুলো কোন দেশে কোথায় আছে, জানতে হবে আমাদের। জাপানিদের ঠেকানোর এটাই একমাত্র উপায়। বোমাগুলো খুঁজে বের করতে হবে, আমরা কাজ শুরু করেছি এ কথা ওরা জানতে পারার আগেই। এখানেই টিম বুইকের প্রসঙ্গ এসে পড়ে। স্টেসি ফক্স আসলে ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির একজন অপারেটর। টিমোথি ওয়েদারহিল একজন নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট, রেডিও অ্যাকটিভিটি ডিটেকশনে বিশেষজ্ঞ। টিম হোন্ডা, জিম হানামুরা ও রয় ওরশিয়া, সিআইএ এজেন্ট। ওদের কাজ, বোমার উৎস, কমান্ড সেন্টার, কন্ট্রোল ও ডিটোনেশন সম্পর্কে অনুসন্ধান ও তথ্য সংগ্রহ। আমরা কি একটা দুঃস্বপ্নের ভেতর রয়েছি? নিঃসন্দেহে। আমার ধারণা, একটা হিংস্র ড্রাগন গোটা পৃথিবীকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে, আগামী দুএক হপ্তার ভেতর ওটাকে বাধা দেয়া না গেলে কেউ আমরা বাঁচব না। বিশ্বাস করুন বা না করুন, ডার্ক, এমএআইটি অপারেশন হলো দুনিয়াটাকে বাঁচানোর শেষ উপায়। ছবিটা পরিষ্কার হয়েছে?

হ্যা…, ধীরে ধীরে বলল পিট। ধন্যবাদ, মি. জর্ডান। ছবিটা পরিষ্কার।

এবার অফিশিয়ালি আমাদের সাথে যোগ দিতে আপনার আপত্তি নেই তো?

চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল পিট, অ্যাল ও অ্যাডমিরালকে ছাড়া বাকি সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলল, প্রস্তাবটা বিবেচনা করে দেখব আমি।

কথা শেষ করে কনফারেন্স রুম থেকে বেরিয়ে এল ও।

.

২২.

পিটের কার মিউজিয়াম ওয়াশিংটন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের একেবারে গা ঘেষে, একটা পুরানো এয়ারক্রাফট হ্যাঙ্গারের ভেতর। তবে ফেডারেল হেডকোয়ার্টার বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে সেদিকে গেল না ও। প্রথমে অ্যালকে কয়েকটা নির্দেশ দিয়ে একটা ট্যাক্সিতে তুলে দিল, তারপর কনস্টিটিউশন অ্যাভিনিউ ধরে হাঁটতে লাগল যতক্ষণ না একটা জাপানি রেস্তোরাঁ পায়।

হেড ওয়েটারকে ডেকে এক কোণার একটা বুঁদ চাইল পিট। বসার পর অর্ডার দিল, সবই জাপানি খাবার। স্বচ্ছ চিংড়ি সুপ আর চুনো মাছের খিচুড়ি খেয়ে টেবিল ত্যাগ করল, ঢুকল রেস্ট রুমের পাশে একটা ফোন বুদে।

মানি ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা অ্যাড্রেস বুক বের করে পাতা ওল্টাল পিট। ফোন নম্বরটা পেয়ে ডায়াল করল। ভদ্রলোকের নাম ড. পার্সিভাল ন্যাশ। মেরিল্যান্ডে থাকেন। ডার্কের মায়ের দিকের চাচা হন স্থানীয় পার্সিভাল ন্যাশ। পিটকে অত্যন্ত হে করেন। পরপর ছয়বার রিং হলো তবু কেউ রিসিভার তুলছে না। যোগাযোগ কেটে দিতে যাচ্ছে পিট, এই সময় অপরপ্রান্ত থেকে সাড়া পাওয়া গেল।

ড. ন্যাশ বলছি, তারুণ্যে ভরপুর একটা কণ্ঠস্বর, যদিও ভদ্রলোক চলতি বছর বিরাশিতে পড়েছেন।

কাকা, আমি পিট।

ও মাই গুডনেস, ডার্ক! বুড়ো কাকাকে মনে পড়ল? সানন্দে হাসলেন পার্সিভাল ন্যাশ। পাঁচ মাস হয়ে গেল একবারও ফোন করোনি।

চার মাস, শুধরে দিল পিট। সাগরমন্থন করছিলাম কিনা।

আমার বোনের খবর কী? আর যে নোংরা বুড়ো পলিটেশিয়ানটাকে বিয়ে করেছে। তারই বা কী খবর?।

এখনো বাড়ি যাইনি আমি, বলল পিট। তবে মা আর সিনেটর ভাল আছেন বলেই জানি।

তারপর বলো। তুমি ভাল আছ তো?

আছি ভালই, তবে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। আপনার সাহায্য দরকার।

বাকি দিনগুলো তো স্রেফ অবসর, বলল না কি কাজ।

ফোনে বলা যাবে না, কাকা। যদি সম্ভব হয় নুমা বিল্ডিঙে চলে আসুন।

কি আশ্চর্য, কাজটা সম্পর্কে একটা ধারণা তো দেবে! শুনলে হয়তো বলতে পারব, তোমার কোন উপকারে আসব কিনা।

বলছি। ধরুন, রেস কারে নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর লাগাতে চাই আমি।

পার্সিভাল ন্যাশ সাথে সাথে বুঝতে পারলেন, টেলিফোনে আলাপ করতে রাজি নয় পিট। জানতে চাইলেন, কখন?

যত তাড়াতাড়ি আপনার পক্ষে সম্ভব, কাকা।

এক ঘণ্টা পর?

ঠিক আছে, বলল পিট।

তুমি এখন কোথায় ডার্ক?

জাপানি ডিনার খাচ্ছি।

সুস্বাদু, তবে দেখতে ভাল না, বলে যোগাযোগ কেটে দিলেন ভদ্রলোক।

টেবিলে ফিরে এসে কফি খেল পিট, একটা সিগারেট ধরাল। রেস্তোরাঁয় ঢোকার পর থেকেই কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছিল, এতক্ষণে কারণটা বুঝতে পারল। ভয় হচ্ছে রেস্তোরাঁয় ভেতর কোথাও পাচার করা কোন বোমা আছে কিনা। তাড়াতাড়ি ওখান থেকে বেরিয়ে এল ও।

একটা ট্যাক্সি নিয়ে দশতলা নুমা বিল্ডিঙে চলে এল পিট। পান্না-সবুজ সোলার গ্লাসে গোটা বিল্ডিংটা মোড়া, মাথার অংশটা পিরামিড আকৃতির গম্বুজ। লবিতে রয়েছে অসংখ্য জলপ্রপাত ও অ্যাকুয়ারিয়াম, সামুদ্রিক মাছ ও উদ্ভিদে সাজানো। সবুজ মার্বেল পাথরের মেঝেতে, মাঝখানে, প্রকাণ্ড একটা গ্লোব। পৃথিবীর প্রতিটি পাহাড়, সাগর, বড় লেক ও প্রধান নদীগুলো দেখানো হয়েছে তাতে। এলিভেটরে চড়ে ১০ লেখা বোতামে চাপ দিল পিট। পাঁচতলার অফিস এগিয়ে ওপরতলার কমিউনিকেশন ও ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক-এ উঠে এল ও। এখানেই রয়েছে নুমার মস্তিষ্ক। সমুদ্র সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য এখানে জমা আছে, তা সে বৈজ্ঞানিক হোক বা ঐতিহাসিক, ফিকশন হোক বা নন-ফিকশন। নুমার বাজেটের বেশিরভাগ টাকাই এখানে ব্যয় করেন স্যানডেকার।

নুমার এই ডাটা সুপার মার্কেটের অধিপতি হলো হিরাম ইয়েজার। ঝোড়ো কাকের মতো চেহারা, কমপিউটার জগতে জাদুকর হিসেবে নাম কিনেছে। কমপিউটার ডিজাইনে লেগে থাকলে এতদিনে নিজেই একটা বিশাল কোম্পানির মালিক হতে পারত সে, কিন্তু নিজে থেকে কিছু করার উৎসাহ তার কোনকালেই ছিল না, আজও নেই। একটু ঘর-কুনো টাইপের লোক, অফিস আর বাড়ি ছাড়া কিছু চেনে না। পিটের অত্যন্ত ঘনিষ্ট বন্ধু সে।

ডেস্কেই পাওয়া গেল তাকে। ডেস্কটা একটা উঁচু মঞ্চের ওপর, বিশাল কামরার মাঝখানে। মঞ্চটা গোল, চারদিক ঘোরে। বিলিয়ন ডলার মূল্যের রাজত্বের প্রতিটি কোণায় চোখ রাখতে চায়, সেজন্যে নিজেই অর্ডার দিয়ে মঞ্চটা বানিয়েছে হিরাম ইয়েজার। পিটকে দেখে চওড়া হাসি ফুটল তার মুখে। আরে, ডার্ক! তুমি ফিরে এসেছ?

কয়েকটা ধাপ টপকে মঞ্চে উঠল পিট, বন্ধুর সাথে হ্যান্ডশেক করল। কেমন আছ, হিরাম?

সগি একর ভেস্তে গেছে শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল, বলল হিরাম। তবে এখনও জীবিতদের মধ্যে তুমি আছ দেখে সত্যি ভাল লাগছে। দোস্ত, তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বসো, আরাম করো।

তোমার মত বন্ধু হারালে বাঁচার আনন্দটাই মাটি হয়ে যাবে। কিন্তু দোস্ত, শুধু আমার পিৎসা খাবার জন্যে আমার কাছে আসো নি তুমি। কি চাও, বলে ফেলো।

আমার আত্মীয় এক ভদ্রলোককে আশা করছি আমি, বলল পিট। ড. পার্সিভাল ন্যাশ, কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যাবেন। কাজ করেছেন অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনে, এখন অবসর জীবনযাপন করছেন। তোমার আছে সুপারকমপিউটার ইন্টেলিজেন্স, আর পার্সিভাল ন্যাশর আছে নিউক্লিয়ার অস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান। আমি চাই তোমরা দুজন মিলে একটা সিনারিও তৈরি করবে।

কিসের দৃশ্যপট?

একটা স্মাগলিং অপারেশন-এর।

কি স্মাগল করব আমরা?

পার্সিভাল ন্যাশ আসুন, তখন বলব।

হিরাম ইয়েজার হাসল। নিরেট কোন বস্তু? এই ধরো, একটা নিউক্লিয়ার ও অরহেউ?

বন্ধুর দিকে তাকাল পিট। হতে পারে।

ভদ্রলোকের জন্যে অপেক্ষা করো তুমি, ইতোমধ্যে আমি আমার সিএডি/ সিএএম গরম করি, বলে চেয়ার ছাড়ল হিরাম ইয়েজার। পিট কিছু বলার আগেই মঞ্চ থেকে নেমে গেল সে।

.

২৩.

ধবধবে সাদা দাড়ি, নেকটাই ছাড়িয়ে নিচে নেমে এসেছে। মোটাসোটা মানুষ, নাভির নিচে পরা ট্রাউজারটা বেল্ট দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। বিরাশি পেরোলেও, পার্সিভাল ন্যাশর চেহারায় হাসিখুশি ভাব ও লাবণ্য আজও অম্লান। নীল স্যুট পরেছেন তিনি, লাল টাই। পায়ে গলিয়েছেন সারার্ড-স্কীন কাউবয় বুট। চিরকুমার তিনি, তবে এই বয়েসেও তার মেয়ে-বন্ধুর তালিকাটা ছোট নয়। তাঁর চরিত্রের গুরুতর বৈশিষ্ট্য একটাই, সেটা হলো পারমাণবিক মারণাস্ত্র সম্পর্কে বিপুল জ্ঞান। তৃতীয় বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রনায়ক তাঁদের সারা জীবনের সঞ্চয় তার মেধার বিনিময়ে হাতবদল করতে রাজি আছেন। পার্সিভাল ন্যাশ সম্পর্কে বলা হয়, উনি ওঁর গ্যারেজে বসেও অ্যাটম বোমা বানাতে পারেন, দাম পড়বে একটা রিকন্ডিশন গাড়ির চেয়ে বেশি নয়।

ডার্ক, মাই বয়, পিটকে দেখে উদ্ভাসিত হলো তার চেহারা। তোমাকে এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন!

আপনাকে দেখে এখন আর ক্লান্তি বোধ করছি না, পরস্পরকে আলিঙ্গন করার সময় বলল পিট।

মোটর ভেহিকেল ডিপার্টমেন্ট আমার মটরসাইকেলের লাইসেন্সটা কেড়ে নিয়েছে, জানো! তবে জাগুয়ার জেডকে ওয়ান-টোয়েনটিটা এখনও আমি চালাতে পারি। ট্যাক্সি ভাড়া নয়, পেট্রলের খরচটা দিতে হবে তোমাকে।

আপনি আমাকে সময় দিচ্ছেন বলে আমি কৃতজ্ঞ, কাকা, বলল পিট।

চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা আমার বেঁচে থাকার প্রধান উপকরণ, বলে হাসলেন বৃদ্ধ।

হিরাম ইয়েজারের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিল পিট। পরিচয় পর্বের পর একটা কমপিউটার স্ক্রীনের সামনে দুটো অতিরিক্ত চেয়ার টেনে আনল হিরাম ইয়েজার। যে-কোন ডেস্ক মেডেলের চেয়ে তিনগুণ বড় স্ক্রীনটা। পিট ও পার্সিভাল ন্যাশ বসার পর হাত নেড়ে শুরু করল সে।

কমপিউটার শিল্পের সর্বশেষ আবিষ্কার হলো সিএডি/সিএএম-কমপিউটর এইডেড ডিজাইন/কমপিউটর-এইডেড ম্যানুফাঁকচারিং। আসলে এগুলো কমপিউটার গ্রাফিক সিস্টেম, তবে সেই সাথে সুপার-সফিসটিকেটেড ডিজুয়াল মেশিনও বটে, যার সাহায্যে ড্রাফটসম্যান ও এঞ্জিনিয়াররা কল্পনাযোগ্য যে-কোন বস্তুর অপূর্ব সুন্দর বিশদ ড্রইং তৈরি করতে পারে। কোন ভিভাইডার, কমপাস বা টি স্কয়ার লাগছে ন। প্রোগ্রাম সেট করে আপনি শুধু স্ক্রীনে ইলেকট্রনিক পেন দিয়ে রাফ একটা আউটলাইন আঁকবেন, ব্যস। এরপর কমপিউটার নিজেই ওটাকে নিখ নিরেট করে তুলবে, কিংবা থ্রী ডাইমেনশন-এর প্রদর্শন করবে।

বিস্ময়কর, বিড়বিড় করলেন পার্সিভাল ন্যাশ। ড্রইং-এর বিভিন্ন অংশ কি আলাদাভাবে দেখানো সম্ভব, কিংবা আকারে বড় করা?

হ্যাঁ, অনায়াসে সম্ভব। আপনি রং লাগাতে পারেন, আকৃতি বদলাতে পারেন, পরিবর্তন এডিট করতে পারেন, তারপর ফলাফলটা মেমোরিতে জমাও রাখতে পারেন, ঠিক একটা ওয়ার্ড প্রসেসর-এর মত।

নিজের চেয়ারটায় উল্টো করে বসেছে পিট, ব্যাকরেস্টে চিবুক ঠেকাল। দেখা যাক, আমাদের সমস্যার কোন সুরাহা করতে পারে কিনা।

এবার বল, কি খুঁজছ তুমি, ডার্ক? জানতে চাইলেন পার্সিভাল ন্যাশ।

খুঁজছি একটা নিউক্লিয়ার বোমা, বলল পিট।

কোথায়?

একটা গাড়িতে।

গাড়িটা কি সীমান্তে দিয়ে পাচার করা হবে? জানতে চাইলেন বৃদ্ধ বিজ্ঞানী।

ধরে নিন তাই।

সীমান্তটা কি? সাগর, নাকি মাটি?

সাগর।

দুদিন আগে প্রশান্ত মহাসাগরে যে বিস্ফোরণ ঘটল, তার সাথে কোন সম্পর্ক। আছে নাকি?

বলতে পারব না।

আরে ডার্ক, কার কাছে তুমি লুকাচ্ছ? এদেশের প্রেসিডেন্ট বাদে, আমারই রয়েছে হাইয়েস্ট সিকিউরিটি ক্লিয়ারান্স, তা জানো?

আপনি যেন আমাকে কিছু বলতে চাইছেন, কাকা?

জাতিসংঘের পারমাণবিক অনুসন্ধান কমিটিতে আছি আমি, কাজেই আমার সাথেই প্রথম প্যাসিফিক ডিটোনেশন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন রেইমন্ড জর্ডান।

চুপসে গেল পিট। তাহলে তো আপনি আমার চেয়ে বেশি জানেন।

অন্তত একটুকু জানি যে জাপান আমেরিকায় গাড়ি-বোমা লুকিয়ে রাখছে। তবে বুড়ো মানুষ বলে জর্ডান আমাকে তার টিমে জায়গা দেয়নি।

ধরে নিন আপনাকে আমার টিমে জায়গা দেয়া হয়েছে, বলল পিট। এইমাত্র আমার টিম, স্টাজ-এ আপনি যোগ দিলেন। তুমিও, হিরাম।

মি. জর্ডান জানতে পারলে খেপে যাবে তোমার ওপর, সাবধান করলেন পার্সিভাল ন্যাশ।

আপনাদের দুজনের নাম জানিয়ে দেব ওদের, বলল পিট। টিমের সদস্য বারাবার অনুমতি আছে।

গাড়িতে জাপানি বোমা, ব্যাপারটা কি? প্রশ্ন করল হিরাম ইয়েজার, গলায় অবিশ্বাস।

তার কাঁধে একটা হাত রাখলেন ডক্টর ন্যাশ। এখানে যে কাজটা করব আমরা, হিরাম, যেকোন মূল্যে গোপন রাখতে হবে।

হিরামের বিটা-কিউ ক্লিয়ারান্স রয়েছে, বলল পিট।

তাহলে আর দেরি কিসের, আমরা কাজ শুরু করছি না কেন?

শুরু করার আগে ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেতে চাই আমি, বৃদ্ধের চোখে চোখ রেখে বলল ল্যারি কিং।

অ্যাটমিক এক্সপার্ট বৃদ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলেন, তারপর শুরু করলেন, ত্রিশের দশকে জাপান যুদ্ধ শুরু করেছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলার মানসে। আজ, পঞ্চাশ বছর পর, আবার একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা, এবার সাম্রাজ্যটাকে রক্ষা করার জন্যে। কেউ কিছু সন্দেহ করার আগে, অত্যন্ত কড়া গোপনীয়তার মধ্যে, নিজেদের নিউক্লিয়ার অস্ত্র বানিয়ে ফেলেছে তারা। সিভিলিয়ান নিউক্লিয়ার ফ্যাসিলিটি থেকে উইপনস-গ্রেড প্রটোনিয়াম ও ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করা হয়েছে। ওদের কাছে বোমা থাকতে পারে, এটা আরও একটা কারণে সন্দেহ করা হয় নি কারণটা হলো, ওদের ডেলিভারি সিস্টেম নেই। ডেলিভারি সিস্টেম মানে লং রেঞ্জ মিসাইল, বহুবার বা মিসাইল-বহনযোগ্য সাবমেরিন।

কিন্তু আমি তো জানি পারমাণবিক নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে সই করেছে জাপান, বলল হিরাম ইয়েজার।

করেছে, সত্যি। এ-ও সত্যি যে বেশিরভাগ জাপানি পারমাণবিক মারণাস্ত্রের ঘোরতর বিরোধী। কিন্তু ওদের বুরোক্র্যাসীর মূলধারার গভীরে একটা গ্রুপ আছে যারা অত্যন্ত প্রভাবশালী, তারা দেখতে চায় জাপান অ্যাটম বোমার অধিকারী হয়েছে। এসব মারণাস্ত্র ঠিক সামরিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে তৈরি করা হয় নি, তৈরি করা হয়েছে অর্থনৈতিক হুমকি প্রতিরোধ করার জন্যে। জাপানের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী মহলে একটা আতঙ্ক আছে, ইউরোপ ও আমেরিকায় তাদের পণ্য বয়কট করা হতে পারে। যদি হয়, তখন এই মারণাস্ত্র ব্যবহার করার হুমকি দিয়ে পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে আনার চেষ্টা করবে তারা।

শুধু যে অস্বস্তিবোধ করছে হিরাম ইয়েজার, তা নয়। তার ভয়ও লাগছে। আপনি বলতে চাইছেন, এমন হতে পারে এই মুহূর্তে আমরা একটা নিউক্লিয়ার বোমার ওপর বসে আছি?

জবাব দিল পিট, বোমাটা হয়তো পাঁচ-সাতশো গজের ভেতর কোথাও আছে।

এ অচিন্তনীয়! রাগে কেঁপে উঠল হিরাম ইয়েজারের নিচু গলা। কটা বোমা পাঠিয়েছে ওরা?

এখনও আমরা জানি না, বলল পিট। একশো হতে পারে, দুশো হওয়াও বিচিত্র নয়। আর শুধু আমেরিকায় পাঠিয়েছে কি না, তা-ও আমরা জানি না। সম্ভবত দুনিয়ার আরও অনেক দেশে পাঠিয়েছে।

পরিস্থিতি কতটা খারাপ, কল্পনা করতে ভয় লাগে, বললেন পার্সিভাল ন্যাশ। বোমাগুলো সত্যি যদি বিভিন্ন দেশের বড় বড় সবগুলো শহরে পাঠিয়ে থাকে ওরা, পৃথিবীটাকে নিশ্চিতভাবে ধ্বংস করার মারাক্কা ক্ষমতা পেয়ে গেছে জাপান। ইটস অ্যান এফিশিয়েন্ট সেট-আপ। বোমাগুলো একবার জায়গামত পৌঁছবার পর, ওগুলোর বিরুদ্ধে কারও কিছু করার থাকবে না। দেয়ার ইজ নো ডিফেন্স এগেইনস্ট দেম, নো টাইম টু রিয়্যাক্ট, নো অ্যালার্ট, নো সেকেণ্ড স্ট্রাইক। ওরা শুধু বোম টিপবে, পরমুহূর্তে শুরু হয়ে যাবে ধ্বংসযজ্ঞ।

গুড গড! আমরা তাহলে করবটা কি?

খুঁজে বার করব ওগুলো, বলল পিট। ধারণা করা হচ্ছে, অটো শিপ ক্যারিয়ারে করে বোমাগুলো আনা হয়েছে। আমার সন্দেহ, লুকানো আছে আমদানি করা গাড়িতে। কম্পিউটারের সাহায্যে জানতে হবে গাড়ির কোন জায়গায় লুকানো আছে ওগুলো।

গাড়ি করে আনা হলে, হিরাম ইয়েজার বলল, কাস্টমস অফিসাররা দেখতে পাবে, কারণ তারা ড্রাগস আছে কিনা সার্চ করে দেখবে।

মাথা নাড়ল পিট। এটা একটা সফিসটিকেটেড অপারেশন, হাই-টেক প্রফেশন্যালদের দ্বারা পরিচালিত। তারা তাদের কাজ বোঝে। বোমাটার ডিজাইন এমনভাবেই করবে তারা, যাতে মনে হয় গাড়িরই একটা অংশ ওটা, ফলে সার্চ করলেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কাস্টমস অফিসাররা সার্চ করবে টায়ার, গ্যাস ট্যাংক, সিট যেখানে ফাঁকা জায়গা আছে। কাজেই এমন জায়গায় বোমাটা লুকাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে, বুদ্ধিমান কোন কাস্টমস অফিসারও যাতে খুঁজে না পায়।

হুম! গম্ভীর আওয়াজ করল হিরাম ইয়েজার।

মেঝের দিকে চিন্তিতভাবে তাকিয়ে রয়েছেন পার্সিভাল ন্যাশ, বললেন, ঠিক আছে, এবার আকার-আকৃতি নিয়ে আলোচনা করা যাক।

ওটা আপনার ডিপার্টমেন্ট, কাকা, বলল পিট।

আমাকে কিছু তথ্য দাও, ডার্ক। অন্তত গাড়ির মডেলটা আমাকে জানতে হবে, আমি আবার জাপানি মেশিনারি সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না।

ওটা যদি একটা মুরমটো হয়, স্পোর্ট সিডান হওয়ারই বেশি সম্ভাবনা।

পার্সিভাল ন্যাশর হাসিখুশি চেহারা থমথমে হয়ে উঠল। তার মানে আমরা একটা কমপ্যাক্ট নিউক্লিয়ার ডিভাইস খুঁজছি, দশ কিলোগ্রাম-এর কাছাকাছি যেটা কিনা মাঝারি সাইজের একটা সিডানে আছে, অথচ খুঁজে পাওয়া সহজ নয়।

ডিভাইসটা যথেষ্ট দূর থেকে ফাটিয়ে দেয়া যায়, যোগ করল পিট।

বলাই বাহুল্য, ড্রাইভার যদি আত্মহত্যা করতে না চায়।

বোমার আকৃতি কি হবে বলে ভাবছি আমরা? জানতে চাইল হিরাম ইয়েজার।

তেলের একটা ব্যারেল ও একটা বেসবল, এ-দুটোর মাঝখানে যে-কোন সাইজের হতে পারে, জবাব দিলেন পার্সিভাল ন্যাশ।

বেসবল, বিড়বিড় করল হিরাম ইয়েজার, যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। কিন্তু অত ছোট একটা জিনিস কি যথেষ্ট ক্ষতি করতে পারবে?

সিলিংয়ের দিকে তাকালেন বৃদ্ধ বিজ্ঞানী, যেন ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করছেন। ওঅরহেডটার মান যদি তিন কিলোটন-এর কাছাকাছি হয় তাহলে ডেনভার, কলোরাডোর মাঝখানটা মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারে, আর বিস্ফোরণের ফলে যে আগুন ধরবে তাতে শহরের আশপাশ বলে কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।

শিউরে উঠল হিরাম ইয়েজার।

ব্যবচ্ছেদ করার জন্যে একটা মডেল দরকার আমাদের। কি ব্যবহার করছি আমরা?

আমাদের পারিবারিক ফোর্ড টরাস, বলল হিরাম ইয়েজার। এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে আমি ওটার সমস্ত পার্টস ম্যানুয়াল কম্পিউটারে ঢুকিয়ে দিয়েছি। গোটা কাঠামোটা বা প্রতিটি পার্ট আলাদাভাবে দেখাতে পারব। কীবোর্ডের ওপর কয়েক সেকেন্ড প্রজাপতির মত লাফালাফি করল তার আঙুলগুলো, তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে হাত দুটো কোলের ওপর ফিরিয়ে আনল। একটা ছবি ফুটে উঠল স্ক্রীনে, বহুরঙা, থ্রী ডাইমেনশনাল। আবার একটা বোতামে চাপ দিল সে। লাল ফোর্ড, চার দরজা, স্ক্রীনে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ঘুরতে মুখ করল, ওটা যেন একটা সফল মঞ্চের ওপর রয়েছে।

তুমি কি আমাদেরকে গাড়িটার ভেতর নিয়ে যেতে পারো? জানতে চাইল পিট।

ঢুকছি, বলল হিরাম ইয়েজার। বোতামে চাপ দেয়ামাত্র মনে হলো, নিরেট ধাতব পার্টস-এর ভেতর নিয়ে উড়ে যাচ্ছে ওরা, আশপাশে দেখতে পাচ্ছে চেসিস ও বডির অভ্যন্তর-ভাগ। ভূতের মত, যেন দেয়াল ফুড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ওরা। গাড়ির প্রতিটি নাট-বল্ট পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। অবশেষে ওদেরকে নিয়ে এঞ্জিনের ভেতর ঢুকে পড়ল হিরাম ইয়েজার।

ইন্টারেস্টিং কিছু দেখতে পাচ্ছেন, কাকা? জানতে চাইল পিট।

সাদা দাড়িতে হাত বুলালেন পার্সিভাল ন্যাশ। ট্রান্সমিশন কেসিং ভাল একটা কন্টেইনার হতে পারে।

নো গুড। এঞ্জিন বা ড্রাইভট্রেনেরও কিছু থাকতে পারে না। স্বাভাবিকভাবে চলার সুবিধে থাকতে হবে গাড়িটায়।

বাদ পড়ছে ব্যাটারি কেসিং রেডিয়েটরও, বলল হিরাম ইয়েজার। শক অ্যাবজরবার?

মাথা নাড়লেন ডক্টর ন্যাশ। প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ পাইপ-বোমার জায়গা হতে পারে, নিউক্লিয়ার ডিভাইসের জন্যে বড় সরু হয়ে যায়।

স্ক্রীনের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকল ওরা, হিরাম ইয়েজার ওদেরকে অ্যাক্সেল ও বিয়ারিং অ্যাসেম্বল, ব্রেক সিস্টেম, স্টার্টার মটর ও অলটার-নেটর-এর ভেতর দিয়ে নিয়ে গেল। প্রতিটি খুঁটিয়ে পরীক্ষা করার পর বাতিলও করে দেয়া হলো।

হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙল পিট। উৎসাহ ও উত্তেজনা বোধ করলেও, ঘুমে জড়িয়ে আসছে ওর চোখ। হিটিং ইউনিটে থাকতে পারে?

নকশার সাথে মেলে না, বললেন পার্সিভাল ন্যাশ। উইশীল্ড বা ওয়াশার বটল?

মাথা নাড়ল হিরাম ইয়েজার। সহজেই চোখে পড়ে যাবে।

হঠাৎ প্রায় একটা ঝাঁকি খেয়ে, আড়ষ্ট হয়ে গেল পিটের পেশী। এয়ার কন্ডিশনার! শব্দ দুটো বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে এল গলা থেকে। এয়ার কন্ডিশনারের ভেতর কমপ্রেসার!

বোতাম টিপে স্ক্রীনে ভেতরের দৃশ্য ফুটিয়ে তুলল হিরাম। এয়ার কন্ডিশনারের সাথে গাড়ি চলার বা না চলার কোন সম্পর্ক নেই। কমপ্রেসার ঠাণ্ডা বাতাস ছাড়ছে না কেন, জানার জন্যে দুঘণ্টা ব্যয় করে ওটা খুলতে যাবে না কোন কাস্টমস অফিসার।

কমপ্রেসারের ভেতরের সবকিছু বের করে নাও, বোমা রাখার একটা জায়গা পেয়ে যাবে তুমি, বলল পিট, তাকিয়ে আছে কমপিউটার ইমেজ-এর দিকে।

আপনি কি বলেন, কাকা?

কনডেনসর কয়েলকে ডিটোনেট-এর রিসিভিং ইউনিটে রূপান্তর করা যেতে পারে, বললেন পার্সিভাল ন্যাশ। বেশ অনেকটা জায়গা পাওয়া যাবে। নাইস ওঅর্ক, জেন্টলমেন! আমার ধারণা, রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে।

খালি একটা ডেস্কের দিকে এগোল পিট, তুলে নিল ফোনের রিসিভার। ডোনাল্ডের দেয়া নম্বরে ডায়াল করল। অপরপ্রান্ত থেকে সাড়া দিল এক লোক। ও বলল, দিস ইজ স্টাজ। টিম লিঙ্কনকে বলুন তার গাড়ির এয়ার কন্ডিশনারের ত্রুটি রয়েছে। গুড বাই।

ডিসপ্লে স্ক্রীনে কমপ্রেসার-এর ভেতর দিকটা আকারে বড় করেছে হিরাম ইয়েজার, সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে সে বলল, চায়ের কাপে আমি একটা মাছ দেখতে পাচ্ছি।

মানে? দাড়িতে হাত বুলাচ্ছিলেন পার্সিভাল ন্যাশ, হাতটা স্থির হয়ে গেল। কি বলছেন?

জাপানের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো, ফলে জাপান আমাদের জীবন-প্রদীপ নিভিয়ে দিল, এরকম একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে,– তাই না? কিন্তু ওরা আমাদের সমস্ত ডিফেন্স ধ্বংস করে দিতে পারবে না, বিশেষ করে আমাদের নিউক্লিয়ার সাবমেরিনগুলো অক্ষতই থাকবে। আমাদের রিট্যালিয়েশেন ফোর্সদের গোটা আইল্যান্ড চেইন ছিন্নভিন্ন করে দেবে। আমার দৃষ্টিতে গোটা ব্যাপারটাই অসম্ভব ও সুইসাইডাল। বিরাট একটা ব্লাফ।

আপনার ধারণার মধ্যে ছোট্ট একটা ত্রুটি আছে, বললেন পার্সিভাল ন্যাশ, হাসছেন। দুনিয়ার সেরা ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসগুলোকে বোকা বানিয়েছে জাপান, দুনিয়ার মুরুব্বিরা অপ্রস্তুত অবস্থায় ধরা খেয়েছে। তাদের দৃষ্টিতে পরিণতি অতটা ধ্বংসাত্মক হতে যাচ্ছে না। জাপান আমেরিকাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিল, আমেরিকা তা গ্রহণ করে নি। ইনকামিং মিসাইল ও অরহেড ধ্বংস করার জন্যে স্ট্রাটেজিক ডিফেন্স সিস্টেম গড়ে তুলতে গোপনে একটা কাজ শুরু করে জাপান। আমাদের নেতারা অত্যন্ত খরচবহুল ও অকার্ডকর বলে বাতিল করে দেয় গবেষণা। আমার ধারণা, জাপান একটা সিস্টেম খাড়া করেছে, আমাদেরকে ঠেকাতে পারবে।

তার মানে কি জাপান অজেয় হয়ে উঠেছে? জিজ্ঞেস করল হিরাম ইয়েজার, চোখ দুটো কুঁচকে আছে।

মাথা নাড়লেন পার্সিভাল ন্যাশ। এখনও নয়। কিন্তু আরও দুবছর সময় দিন ওদেরকে, ওদের হাতে থাকবে স্বয়ংসম্পূর্ণ স্টার ওঅরস সিস্টেম। কিন্তু আমাদের বা আর কারও হাতে থাকবে না।

.

২৪.

ক্যাপিটল বিল্ডিং-এর একটি রুদ্ধদ্বার কক্ষে মিটিং বসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর জাপানের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব তদন্ত ও মূল্যায়ন করাই মিটিংয়ের উদ্দেশ্য। কংগ্রেসের কয়েকজন সদস্য রাগে কাঁপছেন, কারণ তাঁদের ধারণা জাপানের পুঁজি ও ব্যবসায়িক নীতির কাছে এমন মার খাচ্ছে আমেরিকা, বলা যায় ওদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন তারা।

ইচিরো সুবোই, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সিকিউরিটি কোম্পানি কানোইয়া সিকিউরিটিজ-এর চীফ ডিরেক্টর, একটা টেবিলে বসে আছে। তার সামনে কাউন্টার আকৃতির একটা ডেস্কে বসেছেন কংগ্রেশন্যাল সাব-কমিটির সদস্যরা। ইচিরো সুবোইর দুদিকে রয়েছে চারজন উপদেষ্টা। ইচিরো প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে নিজেদের মধ্যে চাপাস্বরে কিচিরমিচির করছে তারা, ফলে কমিটির সদস্যরা ভারী অস্বস্তিবোধ করছেন।

ইচিরো সুবোইকে দেখে মনে হবে না যে সে একজন ধনকুবের। আমেরিকার প্রথম সারির পাঁচজন ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসায় যে পরিমাণ পুঁজি খাটান, সে তার কানোইয়া সিকিউরিটিজ-এর একটি তারচেয়ে অনেক বেশি পুঁজি ঢেলেছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, প্রথম সারির অন্তত দশজন ব্যবসায়ীর বিভিন্ন কোম্পানিতে তারও মোটা শেয়ার আছে। বেঁটেখাট, রোগা মানুষ। সব সময় হাসিখুশি থাকে।

তার হাসিখুশি ভাবটা আসলে কৃত্রিম আবরণ। ভদ্রবেশী এই টাকার কুমীর যেমন হিংস্র তেমনি প্রতিশোধপরায়ণ। জাপানে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাকে যমের মত ভয় ও ঘৃণা করে, অতীত অভিজ্ঞতার কারণে। অন্যান্য জাপানি ব্যবসায়ীদের সাথে ইচিরো সুবোইর পার্থক্য হলো, আমেরিকা ও ইউরোপ সম্পর্কে তার রাগ ও বিদ্বেষ সে গোপন করে না।

সিলেক্ট সাব-কমিটির সামনে বসে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে সে, সারাক্ষণ সবিনয়ে হাসছে, হাবভাবে উত্তেজনার লেশমাত্র নেই।

কংগ্রেস যে প্রস্তাব করতে যাচ্ছে তার সারমর্ম হলো, যে-সব জাপানি কোম্পানি আমেরিকায় ব্যবসা করছে তাদেরকে বেশিরভাগ শেয়ার সংশ্লিষ্ট আমেরিকান কোম্পানিগুলোকে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দিতে হবে। এ সেফ জাতীয়করণ ছাড়া কিছু নয়। আমেরিকার ব্যবসা-নীতি বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে, কোন সন্দেহ নেই। ইন্টারন্যাশনাল কারেন্সির সাথে ব্যাংকিং সিস্টেম ধসে পড়বে। শিল্প-সমৃদ্ধ দেশগুলো দেউলিয়া হয়ে যাবে। কিন্তু কেন এই সর্বনাশা আঘাত? আমি সবিনয় বলতে চাই, আমেরিকানদের জীবনে ভাল যা কিছু ঘটেছে সেগুলোর মধ্যে সেরা হলো জাপানি পুঁজিপতিদের এ-দেশে আগমন।

আপনি যে আইনের কথা বললেন, কংগ্রেস সে-ধরনের কোন আইন এখুনি প্রয়োগ করতে বলছে না, কঠিন স্বরে জানালেন সিনেটর মাইক ডিয়াজ। আমি শুধু বলেছি, আমেরিকার মাটিতে আপনাদের যে কোম্পানিগুলো ব্যবসা করে প্রফিট করছে, সে-সব কোম্পানির জন্যেও আমাদের শুল্ক ও ইনকাম ট্যাক্স নীতি প্রযোজ্য হবে। আপনাদের দেশে আমেরিকানরা রিয়েল এস্টেট কিনতে পারে না, পারে না ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের একচ্ছত্র মালিক হতে, অথচ আমাদের দেশে ব্যবসা করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নিয়ে কেটে পড়ছেন আপনারা, মি. ইচিরো সুবোই…।

অন্তত একজন মানুষ ইচিরো সুবোইকে চিনতে ভুল করেন নি, তিনি হলেন সাব-কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর মাইক ডিয়াজ। জাপানিদের ব্যবসায়িক নীতির সবচেয়ে কড়া সমালোচক তিনি, পারলে আজই আইন করে জাপানি পন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

মি. চেয়ারম্যান? সাব-কমিটির মহিলা সদস্য মাত্র একজন, কথা বলার জন্যে হাত তুলল সে। ইয়েস, মিস স্মিথ, বলুন।

মি. ইচিরো, শুরু করল লরেন, এর আগে আপনি উল্লেখ করেছেন, ডলারকে সরে গিয়ে জায়গা করে দিতে হবে ইয়েনকে। আপনার মনে হয় না, এখানে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন আপনি?

আমার তা মনে হয় না। আপনারও তা মনে হবে না, যদি স্মরণ রাখেন যে আপনাদের বাজেট ঘাটতির শতকরা পঞ্চাশ ভাগ যোগান দিচ্ছে জাপানি পুঁজিপতিরা, উদার ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল ইচিরো সুবোই। আপনাদের কারেন্সির জায়গা দখল করবে আমাদের কারেন্সি, এটা তো স্রেফ সময়ের ব্যাপার মাত্র।

আপনি বোধহয় বলতে চাইছেন, মি. ইচিরো, আমেরিকা ও জাপান আরও ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তুললে ডলারের জায়গা এমনিতেই দখল করে নেবে ইয়েন। কিন্তু আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কিভাবে হতে পারে, বলবেন কি? আমেরিকায় জাপানের যে-সব শাখা ব্যাংক কাজ করছে, সমস্ত আমেরিকান ব্যাংকের সর্বমোট অ্যাসেট-এর চেয়ে ওগুলোর অ্যাসেট অনেক বেশি। এ-দেশে জাপানি মালিকদের অধীনে এক মিলিয়ন আমেরিকান চাকরি করছে। আপনাদের লবিস্টরা পারলে আমাদের সরকারকে কিনে ফেলেন। জাপানিরা চল্লিশ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ইউএস রিয়েল এস্টেটের মালিক হয়েছে। এরপর আরও ঘনিষ্ঠ কিভাবে আমরা হতে পারি, বলবেন কি, মি. ইচিরো?

অমায়িক হাসি ফুটল ইচিরো সুবোইর মুখে। আপনাদের প্রেসিডেন্ট ও কংগ্রেস আমাদেরকে আশ্বাস দিয়ে আরও ঘনিষ্ঠ হবার পথ খুলে দিতে পারেন–কথা দিতে পারেন, আমাদের পুঁজি ও পণ্য আপনাদের বাজারে কখনোই নিষিদ্ধ করা হবে না। আমরা আরও একটা ব্যাপারে নিশ্চয়তা চাই, বিনা ভিসায় জাপানিদেরকে আমেরিকায় ঢুকতে দিতে হবে।

কিন্তু যদি এ-ধরনের চিন্তাকে আমরা প্রশ্রয় না দিই?

কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিষ্ঠুর হাসি হাসল ইচিরো সুবোই। আমরা পাওনাদার জাতি। আপনারা দেনাদার, গোটা দুনিয়ায় আপনারাই সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছেন জাপানের কাছ থেকে। কাজেই, তখন বাধ্য হয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে আমাদেরকে। আমার ভয় হচ্ছে, সেটা আপনাদের জন্যে প্রীতিকর হবে না।

তার মানে আমেরিকা জাপানিদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে, আপনি বলতে চাইছেন?

এ-পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাবার রাস্তা আপনাদের জন্যে আমরা ভোলা রেখেছি, বলল ইচিরো সুবোই। আপনাদের এখন পতনের সময়। আর জাপানের সময় উত্থানের। কাজেই বাঁচতে হলে নিজেদের মেথড পরিহার করে আমাদের মেথড গ্রহণ করুন। আপনাদের নাগরিকদের উচিত আমাদের সংস্কৃতি আরও ভালভাবে বোঝার চেষ্টা করা। তাহলে কিছু একটা শিখতেও পারে তারা।

সেজন্যেই কি নিজের দেশের বাইরেও জাপানি কোম্পানিগুলো শুধু জাপানিদের চাকরি দিচ্ছে?

টপ পজিশনে নয়। শুধু নিস্তরের ম্যানেজার, সেক্রেটারি, ক্লার্ক আর পিয়নদের চাকরি দেন। তা-ও শুধু পুরুষদের, মহিলারা বাদ পড়ে যাচ্ছে। আরেকটা কথা বলা দরকার, জাপানি কোম্পানিগুলো শ্রমিক ইউনিয়নকে কোন পাত্তাই দিতে চায় না।

উত্তর দেয়ার আগে উপদেষ্টাদের সাথে পরামর্শ করল ইচিরো সুবোই। অবশেষে বলল, আপনাকে বুঝতে হবে যে আমরা সংস্কারকে প্রশ্রয় দিই না। পশ্চিমারা আমাদের পদ্ধতির ভক্ত নয়, কাজেই তাদেরকে টপ পজিশনে বসিয়ে নিজেদের ব্যবসায়িক ক্ষতি করতে রাজি নই আমরা। এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে পশ্চিমারা আমাদের কালচারকে ভাল চোখে দেখে না। আপনিই বলুন, আমাদের কালচারের ওপর যাদের ভক্তি নেই, তাদেরকে আমরা কিভাবে টপ পজিশনে বসাই?

আমাদের দেশে বসে ব্যবসা করতে এসে আমাদেরকেই আপনারা অবজার্ভ করবেন, এমন আচরণ করবেন যেন আমরাই বিদেশী, এটা কি মেনে নেয়ার মত একটা ব্যাপার, মি. ইচিরো?

এটা দুর্ভাগ্যজনক, মিস লরেন। আমরা আপনাদের অবজ্ঞা করি, এটা ঠিক নয়। আমরা ব্যবসায়ী, বোকার মত কোন ঝুঁকি না নিয়ে লাভ করতে ভালবাসি।

হ্যাঁ, জাপানি ব্যবসায়ীদের স্বার্থপরতা সম্পর্কে আমরা সচেতন। ব্যবসা করার নামে আপনারা সাপের গালেও চুমো খান, ব্যাঙের গালেও। পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ান ব্লকে আপনারা স্ট্রাটেজিক মিলিটারি কমপিউটার টেকনলজি বিক্রি করছেন। আপনার মত করপোটে এক্সিকিউটিভের কাছে রাশিয়া, জার্মানি, কিউবা, ইরান, লিবিয়া, স্রেফ খদ্দের।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা মতাদর্শ আমাদের মাথাব্যথা নয়। ব্যবসায়িক স্বার্থেই ও-সব আমরা তুচ্ছ জ্ঞান করি।

আর একটা প্রশ্ন, বলল লরেন স্মিথ। এ-কথা কি সত্যি, আপনাদের সরকার গোটা হাওয়াই রাজ্য কিনে নেয়ার প্রস্তাব দিতে চাইছেন, জাপানের সাথে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি ব্যালান্স করার জন্যে?

উপদেষ্টাদের সাথে পরামর্শ না করে সাথে সাথে জবাব দিলেন ইচিরো সুবোই, হ্যাঁ, সরকারকে প্রস্তাবটা বিবেচনা করার প্রস্তাব দিয়েছি আমি। হাওয়াই-এ জাপানিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ওখানে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার শতকরা বাষট্টি ভাগ আমরা নিয়ন্ত্রণ করছি। আমি আরও প্রস্তাব দিয়েছি, ক্যালিফোর্নিয়াকে আমাদের দুদেশের কম্বাইন্ড ইকোনমিক কমিউনিটিতে পরিণত করা হোক। আমরা জাপানি লোকদের ওখানে পাঠাব, সবাই তারা দক্ষ। কয়েকশো ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানী গড়ে তোলার মত পুঁজি দেব আমরা।

আপনার প্রস্তাব অত্যন্ত তিক্ত লাগছে আমার, বলল লরেন স্মিথ। জাপানি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দ্বারা ক্যালিফোর্নিয়াকে রেপ করার দুরাশা কোনদিনই সফল হবে না। এ সত্যি দুর্ভাগ্যজনক যে হাওয়াই-এর কোন কোন এলাকা শুধু জাপানিদের জন্যে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। শুনতে পাই, অনেক ক্লাব ও-রেস্তোরাঁয় শুধু জাপানিরা ঢুকতে পারে, আমেরিকানদের ঢোকা নিষেধ করা হয়েছে। জাপানিদের এই আচরণ কোন আমেরিকান মেনে নিতে পারে না। অন্তত আমি মেনে নিতে পারি না। দরকার হলে আমি একাই লড়ে যাব, যাতে…।

সাব-কমিটির সদস্যরা প্রশংসা-মুখর হয়ে উঠলেন। ডেস্কের ওপর হা সবাইকে থামতে বললেন সিনেটর মাইক ডিয়াজ।

ভবিষ্যতে কি ঘটতে যাচ্ছে কে বলবে, নরম হাসি দেখা গেল ইচিরো সুবোইর ঠোঁটে। আপনাদের সরকারকে উৎখাত করার কোন গোপন প্ল্যান আমাদের নেই। তবে এ-কথা ঠিক যে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় আপনারা হেরে গেছেন। আর কে না জানে যে হারু পার্টিকে অনেক নিষ্ঠুর শর্তও মেনে নিতে হয়।

আমরা যদি হেরে থাকি, হেরেছি জাপানি ব্যবসায়ীদের অন্যায় ব্যবসায়িক নীতির কাছে, কঠিন সুরে বলল লরেন স্মিথ।

আপনারা, আমেরিকানরা, বাস্তবতা মেনে নিন। আমরা যদি আমেরিকাকে কিনিনি, কিনছি শুধু আপনারা বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে।

সাব-কমিটির সদস্য ছাড়াও কনফারেন্স রুমে রয়েছেন তাদের উপদেষ্টা ও বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের অসংখ্য পর্যবেক্ষক। ইচিরো সুবোইর প্রচ্ছন্ন হুমকি সবাইকে যেমন বিস্মিত করল তেমনি খেপিয়েও তুলল। জাপানি বিলিওনিয়ার সবার মনে। একটা ভয় ধরিয়ে দিয়েছে।

ডেস্কের ওপর ঝুঁকে পড়লেন সিনেটর মাইক ডিয়াজ, তাঁর চোখে কঠিন দৃষ্টি। পরিবেশটাকে আপনারা তিক্ত করে তুলেছেন, কোন সন্দেহ নেই, বললেন তিনি। তবু অন্তত দুটো সুবিধে পাচ্ছি আমরা।

এই প্রথম ইচিরো সুবোইকে খানিকটা বিচলিত হতে দেখা গেল। কি ধরনের সুবিধের কথা বলছেন আপনি, সিনেটর?

এক, আপনারা যদি বেশি বাড়াবাড়ি করেন, আপনাদের পাওনা টাকার হিসেব মুছে ফেলতে পারব আমরা। কিভাবে শুনবেন? টাকা তো আপনারা কাগজে পত্রে পাবেন, তাই না? হিসাবটা আছে কাগজে আর কমপিউটার মনিটরে। ওগুলো মুছে ফেলতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড লাগবে আমাদের। দুই, আজ আর আগলি আমেরিকান-এর কোন অস্তিত্ব নেই। তার জায়গা দখল করেছে আগলি জাপানিজ।

.

২৫.

কি করতে হবে বলে দিল পিট, ফেডারেল হেডকোয়ার্টার বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে ডিপার্টমেন্ট অভ কমার্স-এর চলে এল অ্যাল। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ব্যবসার উপ-পরিচালক ভদ্রলোক তার আত্মীয়, মুরমটো মোটর গাড়ি আমদানি সম্পর্কিত ফাইলটা তার কাছ থেকে চেয়ে নিল। এরপর ট্যাক্সি নিয়ে আলেকজান্দ্রিয়া, ভার্জিনিয়ায় চলে এল সে। একটু খুঁজতেই পাওয়া গেল বিল্ডিংটা, মুরমটো, মোটর করপোরেশন এখান থেকে পাঁচটা রাজ্যে তাদের আমদানি করা গাড়ি বিলিবণ্টন করে।

ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে বিল্ডিংয়ের সামনে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল অ্যাল। লাল ইটের আধুনিক ভবন, জানালাগুলো কাঁচ আর ব্রোঞ্চ দিয়ে মোড়া। পার্কিং লটে অনেক গাড়ি রয়েছে, সবগুলোই মুরমটো কোন আমেরিকান বা ইউরোপিয়ান গাড়ি চোখে পড়ল না। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল অ্যাল, এক জাপানি রিসেপশনিস্টের সামনে দাঁড়াল।

বলুন, আপনার জন্যে কি করতে পারি? জানতে চাইল মেয়েটা।

অ্যাল জিওর্দিনো, কমার্স ডিপার্টমেন্ট। নতুন গাড়ি আমদানি সম্পর্কে কার সাথে কথা বলব?

এক সেকেন্ড চিন্তা করল মেয়েটা, তারপর একটা নোটবুক খুলে কর্মকর্তাদের নামগুলোর ওপর চোখ বুলাল। আমাদের ট্রান্সপোর্টেশন ডিরেক্টর ডেনিশ সুহাকার সাথে। আমি তাঁকে জানাচ্ছি, মি. অ্যাল জিওর্দিনো দেখা করতে এসেছেন।

অ্যাল জিওর্দিনো।

সরি। অ্যাল জিওর্দিনো।

খানিক পর এক জাপানি সেক্রেটারি ডেনিশ সুহাকার অফিসে নিয়ে এল অ্যালকে। হলওয়েতে দামী কার্পেট, দুপাশের দরজায় লেখাগুলো দেখে কৌতুক বোধ করল সে। কেউ এখানে ম্যানেজার, সুপারিনটেনডেন্ট বা ভাইস-প্রেসিডেন্ট নয়, সবাই ডিরেক্টর।

ডেনিশ সুহাকা, গোলগাল আকৃতির হাসিখুশি মানুষ। ডেস্কের পিছন থেকে উঠে এসে অ্যালের সাথে করমর্দন করলেন। ডেনিশ সুহাকা, মি. জিওর্দিনো। বলুন কমার্স ডিপার্টমেন্টের জন্যে কি করতে পারি আমি।

স্বস্তিবোধ করল অ্যাল, ডেনিশ সুহাকা ওর বিধ্বস্ত ও দাড়ি-না-কামানো চেহারা দেখে কোন প্রশ্ন তোলেন নি বা পরিচয়পত্রও দেখতে চান নি। তেমন জরুরি কোন ব্যাপার না। রেকর্ড ঠিকঠাক রাখার জন্যে স্বাভাবিক আমলাতান্ত্রিক ছুটোছুটি।

সুপারভাইজার বললেন, বাড়ি ফেরার পথে আমি যেন একবার এখান থেকে তথ্যটা সংগ্রহ করি।

কি তথ্য, মি. অ্যাল জিওর্দিনো?

আপনারা যে-কটা গাড়ি আমাদনি করে ডিলারদের কাছে পাঠিয়েছেন, তার সংখ্যাটা আমাকে জানতে হবে। আপনাদের টোকিও হেডকোয়ার্টার থেকে একটা সংখ্যা আমরা পেয়েছি, ওটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখব।

কতদিনের হিসেব চান আপনি? আমরা তো প্রচুর গাড়ি আনাই।

গত নব্বই দিনের হিসেব পেলেই বলবে।

কোন সমস্যা নয়, বললেন ডেনিশ সুহাকা। আমাদের শিপমেন্ট লিস্ট পুরোটাই কমপিউটারাইজড, দশ মিনিটের মধ্যে পেয়ে যাবেন। সংখ্যাগুলো মিলবে। টোকিও প্রায় কোন ভুল করে না বললেই চলে। অপেক্ষা করার সময়টা আপনি এক কাপ কফি খান, প্লীজ?

সাজানো ছোট্ট একটা অফিসে নিয়ে আসা হল অ্যালকে, সুন্দরী সেক্রেটারি কফি পরিবেশন করল। কাপে চুমুক দিচ্ছে অ্যাল, একগাদা কাগজ-পত্র দিয়ে গেল মেয়েটা।

যে জিনিসের খোঁজে পাঠিয়েছে পিট, আধ ঘণ্টার মধ্যে পেয়ে গেল অ্যাল। চেয়ারে হেলান নিয়ে চোখ বুজল সে, একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছে। ঠিক পাঁচটার সময় কামরায় ঢুকলেন ডেনিশ সহাকা। স্টাফরা বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, তবে আমি আরও বেশ কিছুক্ষণ আছি। আপনার আর কিছু লাগবে?

না, বলল অ্যাল, কাগজগুলো ফাইলে ভরে ফেলল। আমিও বাড়ি ফিরতে চাই, সাত ঘণ্টার বেশি ডিউটি করতে রাজি নই। সহযোগিতা করার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। আপনাদের ইমপোর্ট ইউনিট ফিগারস সরকারী কমপিউটারে প্রোগ্রামের জন্যে ঢোকানো হবে। কি উদ্দেশ্যে? বেসমেন্ট অফিসে এক হতাশ কেরানি ছাড়া আর বোধহয় কেউ জানে না। কমার্স ডিপার্টমেন্টের ফাইলটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল সে। দরজার কাছে পৌঁছে ঘুরল সে, হঠাৎ যেন কিছু মনে পড়ে গেছে। একটা কথা।

বলুন?

ছোট্ট একটা খুঁত, উল্লেখ করার মত নয় অবশ্য।

ইয়েস?

আপনাদের ইনকামিং ইনভেনটরি লিস্টে ছটা গাড়ি দেখলাম, দুটো আলাদা জাহাজ থেকে বাল্টিমোর-এর খালাস করা হয়েছে, কিন্তু ওগুলো আপনাদের টোকিওর এক্সপোর্ট লিস্টে নেই।

বিস্মিত হলেন ডেনিশ সুহাকা, তার বিস্ময় নির্ভেজাল বলেই মনে হল। কই, আমার চোখে তো পড়ে নি। আপনার তালিকার সাথে মিলিয়ে দেখতে পারি?

ডিপার্টমেন্ট অভ কমার্স থেকে ধার করে আনা অ্যাকাউন্টিং শীটটা টেবিলের ওপর মেলে ধরল অ্যাল, পাশেই রয়েছে সুহাকার সেক্রেটারির দিয়ে যাওয়া তালিকাটা। তার নিজের তালিকায় ছটা গাড়ির নামের নিচে দাগ দিল অ্যাল, দেখা গেল টোকিও থেকে পাঠানো তালিকায় নেই ওগুলো। ছটাই এসপি-৫০০ স্পোর্ট সেডান।

অফিশিয়াল নিয়মের কথা যদি বলেন, এ-ধরনের গরমিল আমাদের কোন মাথাব্যথা নয়, বলল অ্যাল। এ-দেশে ওগুলো আমদানি করা সংক্রান্ত তথ্য আপনারা খাতায় লিখে রাখলে সরকারের সাথে আপনাদের কোম্পানির কোন ঝামেলা হবার কথা নয়। আমার ধারণা, এটা আপনাদের টোকিও অ্যাকাউন্টিং ডিপার্টমেন্টের গাফলতি ছাড়া কিছু নয়।

নিজেকে আমার অপরাধী মনে হচ্ছে। এ-ধরনের অক্ষমনীয় অবহেলা আমার দ্বারা কি করে যে হলো। ডেনিশ সুহাকাকে দেখে অ্যালের মনে হলো, নর্দমায় রাজমুকুট ফেলে দিয়ে হতভম্ব হয়ে পড়েছেন ভদ্রলোক। হোম অফিসের ওপর খুব বেশি ভরসা করেছিলাম। আমার চোখে না হয় পড়ল না, আমার স্টাফদের কারও চোখেও পড়ল না।

স্রেফ কৌতূহল, ওই গাড়িগুলো কারা রিসিভ করেছেন? মানে ডিলারদের নাম কি?

এক মিনিট, বলে অ্যালকে নিয়ে নিজের অফিসে চলে এলেন ডেনিশ সুহাকা। ডেস্কের পিছনে বসে কমপিউটারের চাবি টিপলেন। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে অপেক্ষায় থাকলেন। একটু পরই স্ক্রীনে ছড়িয়ে পড়ল এক গাদা তথ্য। ধীরে ধীরে তার মুখের হাসি নিভে গেল। ছটা গাড়িই ছয়জন ডিলারের কাছে পাঠানো হয়েছে। কে কোথায় রয়েছে, খুঁজে বের করতে হলে কয়েক ঘণ্টা লেগে যাবে। দয়া করে কাল যদি একবার যোগাযোগ করেন আমার সাথে, ডিলারদের নামগুলো আপনাকে আমি জানাতে পারব।

কোন প্রয়োজন নেই, ভুলে যান। আপনিও ব্যস্ত মানুষ, আর আমারও কাল বিবাহ-বার্ষিকী।

কংগ্রাচুলেয়শন্স, বললেন ডেনিশ সুহাকা, চেহারায় স্বস্তি ফুটে উঠল।

সহযোগিতা করার জন্যে ধন্যবাদ।

মুখের হাসি ফিরে পেলেন ডেনিশ সুহাকা। অলওয়েজ গ্ল্যাড টু হেলপ! গুড বাই।

বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এসে দুশো গজ হাঁটল অ্যাল, একটা গ্যাস স্টেশন থেকে ফোন করল। শুধু হ্যালো বলে সাড়া দিল একটি পুরুষ কণ্ঠ।

আমি আপনার কার সেলসম্যান বন্ধু। নতুন একটা মডেল এসেছে হাতে, আপনার পছন্দ হতে পারে।

আপনি আসলে নিজের এলাকার বাইরে ব্যবসা করার চেষ্টা করছেন, স্যার। আপনার উচিত পানির কিনারায় খদ্দের ধরার চেষ্টা করা। আরও ভাল হয় যদি প্রশান্ত মহাসাগরে ডুব দেন।

ভাল একটা জার্মান গাড়ি যদি খুব বেশি দামী মনে হয়, মুরমটো কিনতে পারেন। আমার কাছে ছটা এসপি-৫০০ স্পোর্ট সেডান-এর খবর আছে, যেগুলোর কোন হিসেব নেই।

এক মিনিট।

এরপর অপরপ্রান্ত থেকে অন্য একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ডেপুটি ডিরেক্টর অভ অপারেশন, ডোনাল্ডের গলা, চিনতে পারল অ্যাল। বেশ, বেশ। সস্তায় গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে, এরচেয়ে সুখবর আর কিছু হতে পারে না। বলুন, হিসেবের বাইরে আপনার গাড়িগুলো কোথায় পেতে পারি।

সে তথ্য আপনাকে উদ্ধার করতে হবে মুরমটো ডিসট্রিবিউটর-এর কাছ থেকে। ওটা আলেকজান্দ্রিয়ায়। ওদের কমপিউটার রেকর্ড বলছে, ছটা গাড়ি এ দেশে এসেছে, কিন্তু কারখানা থেকে বের হয় নি। কথাটা জানাজানি হয়ে যাবার আগেই ওখানে আপনার পৌঁছানো উচিত। তিনটে গাড়ি বাল্টিমোর-এ খালাস করা হয়েছে, চার তারিখ অগাস্টের। বাকি তিনটে এসেছে সেপ্টেম্বরের দশ তারিখে।

হোল্ড অন, নির্দেশ দিলেন ডোনাল্ড কার্ন, কথা বললেন তাঁর সহকারীর সাথে। এখুনি হাত লাগাও কাজে। মুরমটো কমপিউটার সিস্টেমে নাক গলাও, তাড়াতাড়ি বের করে আনো ওদের শিপিং রেকর্ড। দেরি করলে সমস্ত ডাটা মুছে ফেলবে ওরা। আবার অ্যালের সাথে কথা বললেন তিনি। নাইস ওঅর্ক। আপনার সমস্ত বাড়াবাড়ি ক্ষমা করা হলো। ভাল কথা, এ-ধরনের একটা ব্যবসা আপনি হঠাৎ পেলেন কিভাবে?

আইডিয়াটা আমার বন্ধুর। ওর কোন খবর পেয়েছেন?

পেয়েছি, আধ ঘণ্টা আগে ফোন করেছিলেন, বললেন ডোনাল্ড। সমস্যার উৎসটা তিনি আবিষ্কার করেছেন।

আমি জানতাম, রহস্যের সমাধান ওর দ্বারাই সম্ভব, বলল অ্যাল। ওর সাফল্যে আমি গর্ব বোধ করছি।

.

২৬.

ওয়াশিংটনের ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের এক কোণে পুরানো ও পরিত্যক্ত একটা হ্যাঁঙ্গার আছে, উনিশশো ছত্রিশ সালে তৈরি। পুরানো গাড়ি সংগ্রহ করা ওর একটা হবি, হ্যাঁঙ্গারটাকে ওর ব্যক্তিগত কার মিউজিয়াম বলা যেতে পারে। ওর বন্ধু হিরাম ইয়েজার, সন্ধ্যের পর পৌঁছে দিল ওকে। ভেতরে একটা চক্কর দিয়ে সে বলল, তোমার কার কালেকশন আরেকদিন ভাল করে দেখে যাব, আজ আমাকে বিদায় দাও। কাজ আছে, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে।

হিরাম ইয়েজারের গাড়ি হ্যাঙ্গারের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, হেডলাইটের আলো পড়েছে ওদের গায়ে। পটোম্যাক নদীর ওপার থেকে আলোকিত শহরের আভাও এসে পড়েছে এ দিকটায়। আর মাত্র একটি আলোর উৎস চোখে পড়ে দুশো মিটার উত্তরে জ্বলছে নিঃসঙ্গ একটি রোড ল্যাম্প। আশপাশে লোকবসতি নেই, রাস্ত টাও নির্জন।

লিফট দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ, বলল পিট। ধন্যবাদ সমস্যা সমাধানে সাহায্য করার জন্যে। সেই কবে শেষবার ঘুমিয়েছি মনে করতে পারছি না, আমাকেও বিছানায় উঠতে হবে।

গাড়িতে চড়ে হিরাম ইয়েজার বলল, তুমি কোন সমস্যা নিয়ে এলে তবেই আমার মাথা খোলে। যদি কোনদিন বিশ্ব সৃষ্টির রহস্য ভেদ করতে চাও, আমার কাছে চলে এসো। জানালা দিয়ে হাত বের করে নাড়ল সে, গাড়ি ছেড়ে দিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

হিরাম ইয়েজার চলে যাবার পর পকেট থেকে একটা স্পেয়ার ট্রান্সমিটার বের করল পিট। এটা নুমা অফিসে রাখে ও। কয়েকটা বোতামে চাপ দিয়ে হ্যাঙ্গারের সিকিউরিটি সিস্টেম বন্ধ করে দিল, তারপর ভেতরের আলো জ্বালাল। পাশের একটা দরজা খুলে হ্যাঙ্গারে ঢুকল, ঘুমে বুজে আসছে চোখ। ভেতরে মেঝেটা চকচক করছে, একটু ময়লা নেই কোথাও। কার মিউজিয়াম না বলে, এটাকে আসলে বলা উচিত ট্র্যান্সপোর্ট মিউজিয়াম। এক কোণে মান্ধাতা আমলের একটা রেলরোড পুলম্যান কার-এর পাশে দেখা যাচ্ছে। পুরানো ফোর্ড ট্রাইমোটর এরোপ্লেন। বাকি দশ হাজার বর্গ মিটার দখল করে রেখেছে পঞ্চাশটার ওপর মোটর গাড়ি। ব্রিটিশ গাড়ির মধ্যে রয়েছে দুর্লভ একটা হিসপানো-সুইজা। একটা মার্সিডিজ-বেঞ্জ রয়েছে ফিফটিফোর ওকে, আর একটা জর্ডান-লাগো। ওগুলোর পাশেই জায়গা করে নিয়েছে কয়েকটা আমেরিকান ক্লাসিক কার-একটা কর্ড এল টোয়েটিনাইন, একটা পীয়ার্স-অ্যারো ও পান্না সবুজ স্টাজ টাউন কার। পরিবেশের সাথে একেবারেই বেমানান এমন জিনিস একটাই দেখা গেল হ্যাঙ্গারে, তা হলো ঢালাই করা লোহার একটা বাথটাব, ব্যাকরেস্টে জোড়া লাগানো রয়েছে আউটবোর্ড মোটর।

প্যাঁচানো লোহার সিঁড়ি বেয়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে উঠে এল পিট, এখান থেকে ওর কালেকশনগুলো পরিষ্কার দেখা যায়। এককালে যেটা অফিস ছিল, নতুন করে সাজিয়ে সেটাকেই আরামদায়ক এক রূপের অ্যাপার্টমেন্টে বানিয়ে নিয়েছে ও, সাথে আছে বড় একটা লিভিং রুম সেটাকে স্টাডি হিসেবেও ব্যবহার করা চলে। শেলফে প্রচুর বই আছে, আর আছে জাহাজের অনেকগুলো মডেল।

কিচেন থেকে সুন্দর একটা গন্ধ ভেসে আসছে, জিভে পানি বেরিয়ে এল পিটের। ডাইনিং টেবিলের ওপর একটা ফুলদানিতে একগাদা গোলাপ রয়েছে, মাঝখানে একটা কাগজ। ভাজ খুলে লেখাটা পড়ার সময় আপন মনে হাসল পিট।

শুনলাম শহরে তোমার শুভাগমন ঘটেছে। রেফ্রিজারেটরে কয়েক মাস আগে রাখা সমস্ত তরিতরকারি পচে গিয়েছিল, কাজেই সব ফেলে দিলাম। ভাবলাম তোমার খিদে পাবে, তাই এক প্লেট সালাড বানিয়ে রেখে গেলাম। স্টোভে গরম হচ্ছে কচি বাছুরের নরম কাঁধ। তোমাকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্যে থাকতে পারছি না বলে দুঃখিত, হোয়াইট হাউসের ডিনারে উপস্থিত না থাকলেই নয়।
লাভ,
এল।

ওখানে দাঁড়িয়ে ঘুমে আচ্ছন্ন মনটাকে একটা সিদ্ধান্তে আসার তাগাদা দিচ্ছে ডার্ক। আগে খাবে, তারপর শাওয়ার সারবে কিনা? নাকি প্রথমে ভিজবে? সিদ্ধান্ত নিল, পেটখালি রাখতে নেই। ঢোলা একটা আলখেল্লা পরল ও, তারপর টেবিলে বসে সালাদ ও ভরপেট মাংস খেল। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে প্লেটগুলো ধুচ্ছে, এই সময় ফোন এল।

হ্যালো? ^

মি. ডার্ক পিট?

হ্যাঁ, মি. রেইমন্ড জর্ডান, ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের ডিরেক্টর-এর গলাটা চিনতে পেরে বলল পিট। আপনার জন্যে কি করতে পারি আমি?

আশা করি আপনার ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছি না।

আর দশ মিনিট পর শুতে যাব।

মি. অ্যাল জিওর্দিনের সাথে আপনার কথা হয়েছে কিনা জানার জন্যে ফোন করছি আমি।

হ্যাঁ, আপনার সাথে কথা হবার পরই ফোন করে সে আমাকে।

আমার অনুমতি ছাড়াই অন্যান্য লোকদের সাহায্য নিয়েছেন আপনি, তবু আবিষ্কারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনার ওপর আমি অসন্তুষ্ট নই, বললেন রেইমন্ড জর্ডান। অন্যান্য লোক বলতে নুমার কমপিউটার বিজ্ঞানী হিরাম ইয়েজার ও পরমাণু বিজ্ঞানী ডক্টর ন্যাশের কথা বলছেন তিনি। ওদের দুজনেরই এ-প্লাস সিকিউরিটি ক্লিয়ার্যান্স আছে। একটা গাড়ির ঠিক কোথায় অ্যাটম বোমা লুকিয়ে রাখা যেতে পারে, জানার জন্যে ওদের সাহায্য নিয়েছে পিট।

আমাকে একটা দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, সেটা আমি নিজস্ব পদ্ধতিতে পালন করব। আপনি অসন্তুষ্ট হলেও আমার কিছু করার ছিল না, বলল পিট।

হ্যাঁ, বুঝতে পারছি একা কাজ করতে পছন্দ করেন আপনি।

আর কি জানতে চান, মি. রেইমন্ড জর্ডান? বিছানায় ওঠার জন্যে অস্থির হয়ে আছে পিট।

ভাবলাম আপনি জেনে খুশি হবেন যে বম্ব ক্যারিয়ারগুলো পেয়েছি আমরা।

ছটা গাড়িই? জিজ্ঞেস করল পিট, অবাক হয়ে গেছে। এত তাড়াতাড়ি?

হ্যাঁ। ওয়াশিংটনে, একটা জাপানি ব্যাংক বিল্ডিংয়ে লুকানো রয়েছে। আন্ডারগ্রাউন্ড বেসমেন্টে সীল করে রাখা হয়েছে। প্রয়োজনের সময় ধুলো ঝেড়ে নির্দিষ্ট টার্গেটে নিয়ে যাওয়া হবে, তারপর ডিটোনেট করা হবে।

খুব দেখিয়েছেন।

নিজস্ব পদ্ধতি আমাদেরও আছে, মি. ডার্ক পিট। মৃদু শব্দে হাসলেন রেইমন্ড জর্ডান।

ওগুলোর ওপর নজর রাখা হচ্ছে তো? জানতে চাইল পিট।

তা তো হচ্ছেই। তবে খুব সাবধানে নড়াচড়া করছি আমরা। আমরা যে জানি, এটা শত্রুদেরকে বুঝতে দিচ্ছি না। এই আতঙ্ক সৃষ্টির জন্যে যারা দায়ী, প্রথমে তাদেরকে খুঁজে বের করব আমরা। ওদের কমান্ড সেন্টারটাও ধ্বংস করতে হবে। মি, অ্যাল জিওর্দিনো নিজের অজান্তেই একটা বিপদ ডেকে এনেছিলেন, আপনি কি তা জানেন?

কি রকম?

মুরমটো ডিসট্রিবিউটরস-এর কেউ একজন ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওদের ইমপোটেড শিপিং ডাটা কমপিউটার থেকে মুছে ফেলতে যাবে, এই সময় নাক গলাই আমরা। আর দশ মিনিট দেরি করলে সর্বনাশ হয়ে যেত।

ওই ডাটাই আপনাদেরকে গাড়িগুলো খুঁজে বের করতে সাহায্য করে? জানতে চাইল পিট।

আমরা একটা ফ্রেইট কোম্পানীর সন্ধান পাই, মালিক জাপানি। ওই কোম্পানীর ট্রাকেই গাড়িগুলো বহন করা হয়। ওদের রেকর্ডে গন্তব্য সম্পর্কে কোন তথ্য নেই, তবে ড্রাইভারের ডেলিভারি লগ ধার করি আমরা। ডকইয়ার্ড থেকে রওনা হবার পর কত কিলোমিটার ছুটেছে ট্রাক, লেখা আছে তাতে। এরপর নিরেট তদন্ত ও সামান্য কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছে।

মানুষ অ্যাটম বোমার ওপর বসে আছে, খবরটা ফাঁস হয়ে গেলে আপনাদের গোটা দৈশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে, বলল পিট। বোমাগুলো জাপানি, জানাজানি হয়ে গেলে ব্যাপক দাঙ্গাও বেধে যেতে পারে। আমেরিকায় জাপানিদের সংখ্যা কম নয়।

হ্যাঁ, পরিস্থিতি ভাল নয়। সাধারণ আমেরিকানরা পাল্টা ব্যবস্থা অর্থাৎ প্রতিশোধ নেয়ার দাবি জানাবে। তাতে ভয় পেয়ে জাপানিরা গাড়িগুলোকে স্ট্র্যাটেজিক পজিশনে নিয়ে গিয়ে ফায়ার বাটনে চাপ দিতে পারে, আমরা ওগুলো খুঁজে বের করি অকেজো করার আগেই।

সবগুলো বোমা খুঁজে বের করতে হলে গোটা দেশে তল্লাশি চালাতে হবে, বলল পিট। তাতে সময় লাগবে, আমার ধারণা, বিশ বছর।

আমার তা মনে হয় না, বললেন রেইমন্ড জর্ডান। আমরা জানি কিভাবে কি করে ওরা। কি খুঁজছে আমরা তা-ও জানি, মি. অ্যাল জিওর্দিনো ও আপনাকে সেজন্যে ধন্যবাদ। এসপিওনাজ জগতে আমরা যতটা দক্ষ, জাপানিরা তার অর্ধেকও নয়। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, বোমাসহ প্রতিটি মুরমটো এক মাসের মধ্যে খুঁজে বের করে ফেলব আমরা।

আমি নিজেও একজন আশাবাদী, তবে বাস্তব সমস্যার কথা ভুলে থাকতে পারি না, বলল পিট। ভাল কথা, আপনাদের বন্ধুও রাশিয়ার কথা কিছু ভাবছেন? জাপানিরা ওদের ঘরেও বোমা লুকিয়ে রাখতে পারে। আপনাদের প্রেসিডেন্ট কি ওদেরকে সতর্ক করে দেবেন?

এখনই নয়। এ-ধরনের মারাত্মক একটা গোপন তথ্য ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোকেও এখুনি আমরা জানাতে চাইছি না। বিশ্বাস করা যায় না, কোন ফুটো দিয়ে বেরিয়ে যায়। তবে কোন কোন দেশকে ইচ্ছে করলে জানাতেও পারেন প্রেসিডেন্ট, কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও মজবুত করার জন্যে।

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর রেইমন্ড জর্ডান বললেন, কাজটা আপনি ভাল করেন নি, মি. ডার্ক পিট। ইনফরমেশনটা লিক হয়ে গেলে গোটা দুনিয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে।

আরেকটা হুমকির কথা আপনি ভেবেছেন কি?

আরেকটা হুমকি?

ধরুন যুক্তরাষ্ট্রে বা রাশিয়ায় দুএকটা গাড়ি-বোমা ফাটিয়ে দিল জাপান। দুপক্ষই ভাববে, হামলার জন্যে প্রতিপক্ষ দায়ী। আপনারা, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া, পরস্পরের সাথে যুদ্ধ বাধিয়ে দিলেন।

এ-ধরনের দুশ্চিন্তা নিয়ে বিছানায় যাওয়ার কোন মানে হয় না, ঘুম আসবে না, বললেন রেইমন্ড জর্ডান, অস্বস্তিবোধ করছেন। যখন যা ঘটে তাই নিয়ে চিন্তা করুন। আমাদের অপারেশন যদি সফল হয়, তারপর গোটা ব্যাপারটা চলে যাবে রাজনীতিকদের হাতে।

আপনার এ-কথা শোনার পর ঘুমাতে পারব বলে মনে হয় না, বলল পিট।

.

ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যাচ্ছে পিট, হঠাৎ সিকিউরিটি অ্যালার্ম বেজে উঠল। কেউ একজন হ্যাঙ্গারে ঢোকার চেষ্টা করছে।

বিছানা থেকে নেমে স্টাডিতে বেরিয়ে এল পিট, বোতাম টিপে ছোট একটা টিভি মনিটরিং সিস্টেম চালু করল। হ্যাঙ্গারের সাইড ডোর-এর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্টেসি ফক্স, মুখ তুলে সিকিউরিটি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

একটা বোতামে চাপ দিল পিট, সাইড ডোর খুলে গেল। স্টাডি থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির মাথায়, ঝুল-বারান্দায় এসে দাঁড়াল ও। খোলা দরজা দিয়ে হ্যাঁঙ্গার ঢুকল কেটা সেক্স বম্ব। কলারবিহীন নীল জ্যাকেট পরে আছে স্টেসি, সঙ্গে ম্যাচ করা স্কার্ট ও জুয়েলনেক সাদা ব্লাউজ। মুগ্ধ বিস্ময়ে গাড়িগুলোর ভেতর দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে এল সে। মেটালিক বু জর্ডান-লাগো গ্রান্ড স্পোর্ট-এর পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল, আলতোভাবে আঙুল ছোঁয়াল ফেন্ডারে।

স্টেসিই প্রথম নয়। পিটের এই অদ্ভুত বাসস্থানে আরও অনেক মেয়েই এসেছে, তাদের প্রায় সবইকে আকৃষ্ট করেছে জর্ডান। গাড়িটাকে মেকানিক্যাল আর্ট-এর উৎকৃষ্ট একটা নমুনা বলে মনে করে পিট, তবে মেয়েরা ওটার দিকে তাকালে পুলক ও শিহরণ অনুভব করে। গাড়িটার চকচকে পিচ্ছিল গা, আকৃতির মধ্যে বিড়ালসুলভ ছন্দ, শক্তিশালী এঞ্জিনের উপস্থিতি, ভেতরে দামী চামড়ার গন্ধ প্রায় এক ধরনের যৌনবেদনা সৃষ্টি করে।

আপনি আমাকে খুঁজে পেলেন কিভাবে? জানতে চাইল পিট, বিশাল হ্যাঙ্গারের ভেতর প্রতিধ্বনি তুলল আওয়াজটা।

মুখ তুলে তাকাল স্টেসি। ইনভিনসিবলে চড়ার আছে, আমি আপনার ফাইলে চোখ বুলিয়ে নিই।

ইন্টারেস্টিং কিছু পেলেন?

আপনি তো সাহেব ভয়াবহ রকম সফল একজন মানুষ।

ফ্ল্যাটারি ইনডীড।

আপনার গাড়ির সংগ্রহ বিস্ময়কর।

তার মানে সত্যিকার ভাল কালেকশন আপনি দেখেন নি।

জর্ডান লাগোর দিকে আবার তাকাল স্টেসি। আই লাভ দিস ওয়ান।

আমার পছন্দ ওটার পাশের সবুজ টাউন কার।

ঘাড় ফিরিয়ে স্টাজ-এর দিকে তাকাল স্টেসি। মাথা নাড়ল সে। সুন্দর, তবে বিশাল ও গম্ভীর দর্শন; বড় বেশি পুরুষালি ভাব, প্রায় কর্কশই বলা যায়। মুখ তুলে তাকাল সে। আমরা কথা বলতে পারি? জানতে চাইল হঠাৎ।

যদি জেগে থাকতে পারি। উঠে আসুন।

প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল স্টেসি, অ্যাপার্টমেন্টটা তাকে ঘুরিয়ে দেখাল পিট। তারপর জিজ্ঞেস করল, কফি চলবে?

না, ধন্যবাদ, পিটের দিকে তাকিয়ে আছে স্টেসি, ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে গেল চেহারা। আমার আসা উচিত হয় নি। দেখে মনে হচ্ছে যে-কোন মুহূর্তে জ্ঞান হারাবেন আপনি।

এক রাত ঘুমাতে দিন, দেখে মনে হবে আবার আমি সমুদ্র মন্থন করতে পারব।

ডলাই-মলাই পছন্দ করেন না? হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে জানতে চাইল স্টেসি। ঘুমের জন্যেও ওটা একটা মহৌষধ।

আমি ভেবেছিলাম আপনি কথা বলতে এসেছেন। একটা ঢোক গিলল পিট।

আমি একই সময়ে একাধিক কাজ করতে পারি, বলল স্টেসি। ম্যাসেজও করলাম, আবার কথাও বললাম। কোনটা আপনার পছন্দ-সুইডিস নাকি শিয়াৎসু?

হোয়াট দ্য হেল, ডু বোথ।

হেসে উঠল স্টেসি। ঠিক আছে। পিটের হাত ধরল সে, বেডরুমে নিয়ে এল, মৃদু ধাক্কা দিয়ে শুইয়ে দিল ওকে বিছানায়, উপুড় করে।

আলখেল্লাটা খুলে ফেলুন, প্লীজ।

পর্দা হিসেবে গায়ে একটা চাদর রাখতে পারি?

আমি দেখি নি, এমন কিছু আছে আপনার? আলখেল্লাটা পিটের গা থেকে খুলে নিল স্টেসি।

হেসে উঠল পিট। আমাকে চিৎ হতে বলবেন না।

আসলে টিমোথি আর আমি ওয়েস্ট কোস্টে চলে যাচ্ছি, যাবার আগে ক্ষমা চাইতে এসেছি, গম্ভীর সুরে বলল স্টেসি।

টিমোথি?

ড. টিমোথি ওয়েদারহিল।

আপনারা আগেও একসাথে কাজ করেছেন, ধরে নিতে পারি?

হ্যাঁ।

আবার আপনার সাথে আমার দেখা হবে?

বলতে পারছি না। আমাদের মিশন দুজনকে দুদিকে নিয়ে যেতে পারে। এক সেকেন্ড ইতস্তত করল স্টেসি। আপনাকে আমি জানাতে চাই, আমার দ্বারা যে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল সেজন্যে সত্যি আমি দুঃখিত। আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন, সে-কথা কোন দিন আমি ভুলব না।

শরীরটা ভাল করে ডলে নিতে পারলে দেনা-পাওনা শোধবোধ হয়ে যাবে। ক্লান্ত, আড়ষ্ট হাসি পিটের মুখে।

পিটের লম্বা শরীরের ওপর চোখ বুলাল স্টেসি। পানির নিচে এত দিন ছিলেন, কিন্তু গায়ের রঙটা এমন রোদে পোড়া সোনালি থাকল কিভাবে?

জিপসি রক্ত, ঘুমজড়ানো গলায় বিড়বিড় করল পিট।

শিয়াৎসু পদ্ধতি অনুসারে পিটের নগ্ন পায়ের স্পর্শকাতর জায়গায় আঙুলের ছাপ দিল স্টেসি।

দারুণ লাগছে, বিড়বিড় করল পিট। রেইমন্ড জর্ডান আপনাকে জানিয়েছেন, ওঅরহেড সম্পর্কে কি জানত পেরেছি আমরা?

হ্যাঁ, বলেছেন। তার সাথে ঝগড়া করে ফেডারেল হেডকোয়ার্টার বিল্ডিং থেকে যেভাবে বেরিয়ে গেলেন আপনি, উনি ধরে নিয়েছিলেন, আপনি বোধহয় টীমে থাকবেন না। আমি আর টিমোথি এখন জানি কোথায় তদন্ত হবে, গাড়ি-বোমাগুলো খুঁজে বের করা অনেক সহজ হয়ে গেল।

তার মানে ওয়েস্ট কোস্ট থেকে তদন্ত শুরু করেছেন আপনারা?

সীয়াটল, সানফ্রান্সিকো আর লস অ্যাঞ্জেলস পোর্টগুলোতেই মুরমটো ক্যারিয়ার নোঙর ফেলে।

পিটের হাত, পিঠ ও ঘাড় ডলে দিচ্ছে স্টেসি। তারপর কোমরে একটা চাপড় মেরে চিৎ হতে বলল সে, কিন্তু কোন সাড়া পেল না। ঘুমিয়ে পড়েছে পিট।

ভোরের দিকে কোন এক সময় ঘুম ভাঙল পিটের, অনুভব করল স্টেসির নরম শরীরের সাথে ওর শরীরটা বিদঘুটে ভঙ্গিতে জড়িয়ে আছে। পরবর্তী নড়াচড়া, তৃপ্তিকর অনুভূতি, স্টেসির অস্ফুট একটা-দুটো শব্দ, সবই যেন স্বপ্নের ভেতর ঘটল। তারপর আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল পিট।

কুম্ভকর্ণ, জাগো! কংগ্রস সদস্য লরেন স্মিথ পিটের উদোম পিঠে একটা চাদর বিছিয়ে দিল। চাদরটা বুকের কাছে খামচে ধরল পিট, ধড়মড় করে উঠে বসল বিছানায়, ঘাড় কাত করে নিজের পাশে তাকাল। বিছানার একটা পাশ খালি পড়ে আছে, কিনারায় বসে রয়েছে লরেন স্মিথ। স্টেসি ফক্স চলে গেছে দেখে বিরাট একটা স্বস্তিবোধ করল ও। মুখে আড়ষ্ট হাসি, তাকাল কংগ্রেস সদস্যের দিকে। ফুল আর পাতা বহুল ছিট কাপড়ের শার্ট পরে আছে সে, প্রিন্টের কাপড়টা মনে হলো। ক্যানভাস, পকেট আর বোম গিজগিজ করছে। তোমার না কংগ্রেসে বসে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যে গরম বক্তৃতা দেয়ার কথা?

অধিবেশন মূলতবী ঘোষণা করা হয়েছে। কফির কাপটা বাড়াল লরেন, তারপরও সেটা পিটের নাগালের বাইরে থাকল, ওকে প্ররোচিত করতে চাইছে।

কাপটা পেতে হলে কি করতে হবে আমাকে?

একটা চুমো, ব্যস।

বেশ দামী জিনিস, কিন্তু পাবে।

আর একটা সত্যি কথা।

আমি কখনও মিথ্যে বলি না, অন্তত তোমাকে।

রাতটা তুমি কার সাথে কাটালে?

আমি একটা মেয়ের সাথে রাত কাটিয়েছি? পিটের চেহারা নির্লিপ্ত।

কাল রাতে এই বিছানায় তুমি একা শোওনি। আরেকজনকে নিয়ে শুয়েছিলে।

এখানে তুমি কোন মেয়েকে দেখেছ নাকি?

দেখার দরকার নেই, বলল লরেন। আমি তার গন্ধ পেয়েছি।

বললে বিশ্বাস করবে, সে আমার ম্যাসাঞ্জার ছিল?

কফির কাপটা পিটের নাগালের মধ্যে বাড়িয়ে ধরল লরেন। মন্দ নয়। তোমার উদ্ভাবনী শক্তি এ-প্লস।

আমাকে ঠকানো হয়েছে, অভিযোগ করল পিট। কাপটা মাত্র অর্ধেক ভর্তি।

নিশ্চয় তুমি চাওনি গোটা চাদরে ছলকে পড়ক কফি? হেসে উঠল লরেন। চাদরটা কোমরে জড়িয়ে যাও, বাথরুমে গিয়ে ঢোকো, গোসল করে গা থেকে ধয়ে ফেলো সমস্ত পারফিউম। গন্ধটা খারাপ নয়, স্বীকার করছি। বেশ দামী। ইতোমধ্যে আমি ব্রেকফাস্ট তৈরি করে ফেলি।

আট ঘণ্টায় দ্বিতীয়বার শাওয়ার সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে পিট দেখল, রুটিতে মাখন লাগাচ্ছে লরেন। কোমরে মুদু তোয়ালে, তাড়াতাড়ি বেডরুমে ঢুকে কাপড় পরে নিল ও। কিচেন থেকে ডাক দিল লরেন, এত দেরি করছ কেন?

অনেকদিন পর দেখা হলো, কিচেনে ঢুকে লরেনের মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসল পিট। কেমন আছ তুমি, লরেন?

ভাল। অ্যাডমিরাল স্যানডেকার আমাকে বললেন, তোমার একটা প্রজেক্ট নাকি ভেস্তে গেছে। মারাই যেতে, একটুর জন্যে বেঁচে গেছ।

ব্যাপারটা গোপন থাকার কথা, বলল পিট।

গোপন তথ্য জানার বিশেষ অধিকার আছে কংগ্রেস সদস্যদের। মুখে এক টুকরো আপেল ফেলল লরেন। প্রজেক্টটা নষ্ট হওয়ায় সত্যি আমি দুঃখিত। তোমাকে হারাতে হয়নি, তাতেই আমি খুশি।

প্রজেক্ট নষ্ট হলেও, সবগুলো টেস্টের রেজাল্ট রক্ষা করা গেছে।

লরেনের নিয়ে আসা দৈনিক পত্রিকাটা তুলে নিয়ে চোখ বুলাল পিট। এক মিনিট পর বলল, জাপানি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আবার দেখছি বিবৃতি দিচ্ছে তুমি। মুখ তুলে হাসল ও।

কফির কাপে চুমুক দিল লরেন। আমাদের ব্যবসার মালিকানা এক তৃতীয়াংশ চলে গেছে টোকিয়োতে। তারই সাথে চলে গেছে জাতির গর্ব, সমৃদ্ধি ও স্বাধীনতা। আমেরিকা এখন আর আমেরিকানদের নেই। আমরা এখন জাপানের অর্থনৈতিক উপনিবেশ।

সত্যি এতটা খারাপ?

কতটা খারাপ সাধারণ মানুষের ধারণা নেই, বলল লরেন, পিটের জন্যে কফি ঢালল কাপে। বাজেটে বিপুল ঘাটতি আমাদের অর্থনীতিতে প্রকাণ্ড একটা গর্তের সৃষ্টি করেছে, সেটা দিয়ে হু হু করে ঢুকে পড়েছে জাপানি টাকা।

কফির কাপটা তুলে নিয়ে পিট বলল, সেজন্যে আমরাই দায়ী। আমরা বেশি ভোগ করি, ওরা কম ভোগ করে, ফলে দিনে দিনে ঋণের পরিমাণ বাড়ছে তোমাদের। টেকনলজির যে-সব শাখায় আমরা এগিয়ে আছি, ফমূলাগুলো হয় চুরি যায়, না হয় আমরা ওদের কাছে বিক্রি করে দিই।

কী ব্যাপার? এতো বড় ভাষণ? সিনেটে যোগ দেবে নাকি?

দুদিন গাড়িগুলোর একটা যত্ন নেব, বলল পিট। স্টাজটাকে ঘষেমেজে ঠিক করে নিতে পারলে ক্লাসিক কার রেসে অংশগ্রহণও করতে পারি।

গায়ে-হাতে গ্রীজ লাগানোর চেয়ে অনেক ভালো একটা কাজ আমার জানা আছে, আচমকা খসখসে গলায় বলে লরেন।

দারুণ একটা আকর্ষণ বোধ করছে পিট। ধীরে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো উঠে দাঁড়ায় সে। এগিয়ে যায় লরেনের দিকে।

বিছানায় নয়, রুদ্ধস্বরে লরেন বলে। অন্তত, চাদরটা না পাল্টালে নয়!

.

২৭.

মুরমটো টিল্ট-রোটর এক্সিকিউটিভ জোন থেকে নেমে এল হিদেকি সুমা, তার ঠিক পিছনেই হয়েছে মুরো কামাতেরি। প্লাস্টিকের প্রকাণ্ড একটা গম্বুজের পাশে হেলিপোর্টে ল্যান্ড করল প্লেন। ঘন গাছপালায় ঢাকা পার্কের মাঝখানে পঞ্চাশ মিটার। উঁচু গম্বুজটা আসলে মাটির নিচে এড়ো সিটি-তে নামার একটা প্রবেশ পথ।

এডো সিটিকে জাপানের নতুন আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্রন্টিয়ার বিবেচনা করা হয়, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও যুদ্ধ পরিচালনার মূল ঘাঁটি হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। এডো সিটির ধারণা হিদেকি সুমার মাথা থেকে বেরোয়, নকশা ও নির্মাণও তার নির্দেশে সম্পন্ন হয়েছে। প্রায় ষাট হাজার লোক কাজ করছে এখানে। মাটির নিচে প্রকাণ্ড সিলিন্ডার আকৃতির, বিশতলা বিল্ডিংটায় বিজ্ঞানীরা সপরিবারে বাস করেন। এক হাজার সদস্যের একটা সিকিউরিটি ফোর্সও আছে শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে।

মাটির নিচে একই আকৃতির আরও কয়েকটা সিলিন্ডার আছে, প্রধান সিলিন্ডারের সাথে সেগুলোর যোগাযোগ রক্ষা করা হয় টানেলের মাধ্যমে। কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্ট, হিটিং ও কুলিং সিস্টেম, টেমপারেচার ও তিউমিডিটি নিয়ন্ত্রণ, ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং ওয়েস্ট প্রসেসিং মেশিনারির জন্যে আলাদা আলাদা বিল্ডিং। গোটা এভো সিটি সিরামিক কংক্রিট দিয়ে তৈরি, মাটির নিচে একশো পঞ্চাশ মিটার পর্যন্ত গভীর।

সরকারী কোন সাহায্য ছাড়াই প্রজেক্টের কাজ শেষ করেছে হিদেকি সুমা। আইনগত বাধা বা অন্যান্য ঝামেলার কারণে নির্মাণ কাজে যে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয় নি তা নয়, তবে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক প্রভাব খাঁটিয়ে সে সব সমস্যা দূর করেছে সে। টোকিওর কুখ্যাত ক্রিমিন্যালরা তাকে গুরু হিসেবে মান্য করে। স্মাগলার ও হেরোইন ব্যবসায়ীদের পুঁজি সরবরাহ করে সে। ঘুষখোর সরকারী কর্মকর্তারা তার ভক্ত। দুর্নীতিপরায়ণ অসৎ রাজনীতিকরা তার কাছ থেকে সাহায্য ও নিরাপত্তা পেয়ে অভ্যস্ত। তাছাড়া, জাপানি কালচারের প্রতি অন্ধ ভক্ত ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ফ্যানাটিকরা তো আছেই। হিদেকি সুমা নিজেই একটা সরকার, তার কাজে বাধা দেয় এমন শক্তি জাপানে নেই।

মুরো কামাতোরিকে নিয়ে গোপন একটা এলিভেটরে চড়ল সে, নেমে এল মূল সিলিন্ডারের পাঁচতলায়। পাঁচতলার পুরোটা জুড়ে তার করপোরেট অফিস। প্রাইভেট অফিস ও অ্যাপার্টমেন্টের সামনে সশস্ত্র প্রহরীরা সারাক্ষণ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। দরজা খুলে গেল, ভেতরে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার সেক্রেটারি তোশি কুদো।

কামরাগুলোর জানালা-দরজা ও দেয়াল ঢাকা হয়েছে ব্রোকেড, সাটিন ও ক্রেপ দিয়ে। দেয়ালের ওপরের অংশে অনেকগুলো পেইন্টিং, বেশিরভাগই প্রাকৃতিক দৃশ্য। তবে ড্রাগন চিতা, হরিণ ও ঈগলও আছে।

মি. আশিকাগা ইনশু অপেক্ষা করছেন, সবিনয়ে জানাল মুশি ততশি।

নামটা তো আমার মনে পড়ছে না।

মি. ইনশু একজন ইনভেস্টিগেটর। দুর্লভ শিল্প খুঁজে বের করা ভদ্রলোকের পেশা, এ-ব্যাপারে তাকে একজন বিশেষজ্ঞ বলা যেতে পারে। শুধু খুঁজে বের করাই নয়, নিজের ক্লায়েন্টকে কিনে দেয়ার জন্যে মধ্যস্থতাও করেন, ব্যাখ্যা করল তোশি কুদো। আমাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, এমন একটা পেইন্টিং আবিষ্কার করেছেন তিনি, যেটা আপনার কালেকশনে নতুন একটা মাত্রা যোগ করবে। আপনার সাথে আলোচনা না করেই একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করেছি আমি, ভদ্রলোক যাতে পেইন্টিংটা আপনাকে দেখানে পারেন।

কিন্তু আমার হাতে সময় খুব কম, বলে হাতঘড়ি দেখল হিদেকি সুমা।

কাঁধ ঝাঁকাল মুরো কামাতোরি। কি এনেছে দেখই না একবার, সুমা। এমন হতে পারে তুমি হয়তো এই পেইন্টিংটাই খুঁজছ।

ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও যাবতীয় অপকর্মের সহযোগীর দিকে একবার তাকাল সুমা, তারপর সেক্রেটারিকে বলল, ঠিক আছে, ডেকে পাঠাও তাকে।

আর্টডিলার কামরায় ঢুকতে তার উদ্দেশ্যে মাথা নত করে বাউ করল সুমা। মি. ইনশু, শুনলাম আপনি নাকি আমার জন্যে দুর্লভ একটা জিনিস যোগাড় করেছেন?

জী, আমার তাই ধারণা। আপনার জন্যে কি যোগাড় করেছি, দেখলে আমার ওপর ভারি খুশি হবেন আপনি। আশিকাগা ইনশুর মাথায় রূপালি কেশর, তার গোঁফ জোড়া অস্বাভাবিক চওড়া, ঘন ভুরু। সুমার চোখে চোখ রেখে হাসছে সে।

আলোয়, স্ট্যান্ডে রাখুন এটা, প্লীজ, বলল সুমা, হাত তুলে বড় একটা জানালার সামনে ইজেলটা দেখিয়ে দিল।

জানালার পর্দা আরেকটু তুলে দিতে পারি?

প্লীজ ডু সো।

জানালার পর্দা সামান্য সরিয়ে ইজেলে পেইন্টিংটা চড়াল আশিকাগা ইনশু, তবে সিল্কের আবরণটা সরাল না। ষোড়শ শতাব্দীর একটা মাসাকি শিমজু।

শ্রদ্ধেয় সীস্কেপ আর্টিস্ট, বলল কামাতোরি, গলার স্বরে চাপা উত্তেজনা। তোমার প্রিয় আর্টিস্টদের একজন, সুমা।

আপনি জানেন আমি শিমজুর একজন ভক্ত? আশিকাগ ইনশুকে জিজ্ঞেস করল সুমা।

আপনি যে তার কাজ সংগ্রহ করেন, শিল্প জগতের সবাই তা জানে। বিশেষ করে আমাদের চারপাশের দ্বীপগুলোর যে ছবি তিনি এঁকেছেন।

তোশি কুদোর দিকে ফিরল সুমা। তার ছবি কটা যেন আছে আমার কালেকশনে?

তার আকা দ্বীপের ছবি মোট তেরোটা, তার মধ্যে এগারোটা আছে আমাদের সংগ্রহে। আরও আছে হাইড়া পাহাড়ের ওপর করা চারটে ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টি।

আর একটা যোগ হলে দ্বীপের ছবি হবে মোট বারোটা?

জী।

শিমজুর আঁকা কোন দ্বীপের ছবি এনেছেন আপনি আমার জন্যে, মি. ইনশু? জিজ্ঞেস করল সুমা, আগ্রহে চকচক করছে তার চোখ জোড়া। আজিমা?

না, কেচি।

হতাশায় মগ্ন হয়ে গেল সুমার চেহারা। আমি আশা করেছিলাম ওটা আজিমা হবে।

সত্যি আমি দুঃখিত, বলল আশিকাগা ইনশু, আজিমা সংগ্রহ করতে না পারাটা যেন তার ব্যক্তিগত পরাজয়। সভ্যতার দুর্ভাগ্য, জার্মানির পতনের সময় আজিমা হারিয়ে গেছে। ওটাকে শেষবার দেখা গেছে আমাদের বার্লিন দূতাবাসে, অ্যামব্যাসাডরের অফিসের দেয়ালে, উনিশশো পঁয়তাল্লিশ সালের মে মাসে।

আপনি খোঁজ করতে রাজি হলে সমস্ত খরচ আমি বহন করব।

ধন্যবাদ, বলল আশিকাগা ইনশু, সুমার উদ্দেশ্যে মাথা নত করল। ইউরোপ ও আমেরিকায় আমার লোকজন অনেক আগে থেকেই ওটা খুঁজছে।

গুড। এবার কেচি আইল্যান্ড দেখান আমাদের।

নাটকীয় ভঙ্গিতে সিল্ক আবরণটা সরাল আশিকাগা ইনশু পাখির চোখ দিয়ে দেখা একটা দ্বীপের ছবি, উজ্জ্বল রঙের বিপুল সমাহার চোখ ধাঁধিয়ে দিল।

শ্বাসরুদ্ধকর, বিড় বিড় করল তোশি কুদো, মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে।

একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল ইনশু। শিমজুর এত ভাল কাজ আমি আর দেখি নি।

তোমার কি মনে হয়, সুমা? জানতে চাইল কামাতোরি।

হা মাস্টারওয়ার্ক, বলল সুমা, শিল্পীর প্রতিভা প্রায় বিহ্বল করে তুলেছে তাকে। এ স্রেফ অবিশ্বাস্য! ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে আকাশের অত ওপর থেকে দেখা এ রকম একটা দৃশ্য তিনি আঁকলেন কিভাবে। ছবির প্রতিটি বিবরণ কি নিখুঁত, লক্ষ করেছ? যেন মনে হয় একটা বেলুনে ভাসমান অবস্থায় এঁকেছেন।

কিংবদন্তী আছে, উনি নাকি একটা ঘুড়ির ওপর বসে এটা এঁকেছিলেন, বলল মুশি তোশি।

ঘুড়িতে বসে সম্ভবত স্কেচ করেছিলেন, শুধরে দেয়ার সুরে বলল আশিকাগা ইনশু। দৃশ্যটা আসলে আঁকা হয়েছে মাটিতে দাঁড়িয়েই।

অবাক হবার কিছু নেই। মুহূর্তের জন্যেও পেইন্টিং থেকে নড়ছে না সুমার চোখ। বিশাল আকৃতির ঘুড়ি তৈরি করার হাজার বছরের ঐতিহ্য রয়েছে আমাদের। অবশেষে ঘাড় ফিরিয়ে আশিকাগা ইনশুর দিকে তাকাল সে। সত্যি একটা কাজের কাজ করছেন আপনি, মি. ইনশু। এটা আপনি পেলেন কোথায়?

হংকং-এ, এক ব্যাংকারের বাড়িতে, জবাব দিল ইনশু। চীনারা দখলে যাবার আগে ভদ্রলোক তার সম্পদ বেঁচে দিয়ে মালয়েশিয়ায় সরে যাচ্ছেন। বছরখানেক সময় লাগলেও, শেষ পর্যন্ত তাকে আমি বেঁচতে রাজি করিয়ে ফেলি টেলিফোনে। দেরি না করে সাথে সাথে হংকং-এ চলে যাই, দর দাম করে জিনিসটা নিয়ে ফিরে আমি। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি আপনার অফিসে চলে এসেছি।

কত?

একশো পঁয়তাল্লিশ মিলিয়ন ইয়েন।

সন্তুষ্টচিত্তে দুহাতের তালু এক করে ঘষল সুমা। ভাল দামই বলব আমি। ধরে নিন, কিনলাম।

ধন্যবাদ, মি. সুমা। আপনি সত্যি উদার। শুধু আপনার কথা ভেবে আজিমার খোঁজে আরও লোক লাগাব আমি। পরস্পরকে বাউ করল ওরা, তারপর তোশি কুদোর পিছু পিছু কামরা থেকে বেরিয়ে গেল আশিকাগা ইনশু।

পেইন্টিংয়ের ওপর ফিরে এল সুমার দৃষ্টি। সৈকতে কালো পাথর ছড়িয়ে রয়েছে, জেলেদের ছোট একটা গ্রামও দেখা যাচ্ছে, একধারে কয়েকটা মাছ ধরার বোট। প্রতিটি জিনিসের আকার-আকৃতি দেখে মনে হয় যেন আকাশ থেকে ভোলা একটা ফটো। কি আশ্চর্য শান্ত গলায় বলল সে। দ্বীপের যে ছবিটা আমি সবচেয়ে ভালবাসি শুধু সেটাই আমার কাছে নেই।

আজও যদি ওটার অস্তিত্ব থাকে, ইনশু ঠিকই খুঁজে বের করে ফেলবে, বন্ধুকে সান্ত্বনা দিল কামাতোরি। লোকটাকে দেখে নাছোড়বান্দা বলে মনে হলো আমার।

আজিমার জন্যে কেচির চেয়ে দশ গুণ বেশি দাম দেব আমি।

একটা চেয়ারে বসে পা দুটো লম্বা করল কামাতোরি। আজিমা আঁকার সময় শিমজুর কোন ধারণা ছিল না, দ্বীপটা কিসের প্রতীক হতে যাচ্ছে।

কামরায় ফিরে এসে তোশি কুদো সুমাকে মনে করিয়ে দিল, দশ মিনিট পর আপনার সাথে মি. ইয়োশিশুর মিটিং।

প্রাচীন কাণ্ড চোর এবং গোল্ড ড্রাগনস-এর লীডার, বলল কামাতোরি, ঠোঁটে ব্যঙ্গাত্মক হাসি। তোমার অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যে নিজের শেয়ার হিসেব নিতে এসেছেন।

ধনুক আকৃতির বিশাল জানালা দিয়ে পার্কের দিকে তাকাল সুমা। যুদ্ধের সময় ও পরে কোরোরি ইয়োশিশু আর আমার বাবা সে সংগঠনটা গড়ে তোলেন, তারই নিরেট ফল হলো আজকের এই প্রজেক্ট।

আগামী শতাব্দীর নিপ্পন-এর গোল্ড ড্রাগনস বা অন্যান্য গুপ্ত সংগঠনগুলোর কোন ভূমিকা থাকবে না, বলল কামাতোরি। নিপ্পন একটি প্রাচীন শব্দ, অর্থ হলো সূর্যের উৎস।

আমাদের আধুনিক টেকনলজির পাশে ওদেরকে বেমানান লাগে, স্বীকার করল হিদেকি সুমা, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে এখনও ওরা আমাদের কালচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ওদের সাথে আমার অনেক বছরের সম্পর্ক, তা থেকে আমি লাভবানই হয়েছি।

এ-সব ফ্যানাটিক্যাল গুপ্ত সংগঠন বা আন্ডারওয়ার্ল্ড ক্রাইম সিন্ডিকেটগুলোর সাহায্য না নিলেও চলে তোমার, ব্যাকুলস্বরে বলল কামাতোরি। মন্ত্রিসভায় তোমার পুতুলের সংখ্যা কম নয়, তোমার হুকুম পালন, করার জন্যে এক পায়ে খাড়া হয়ে আছে সবাই। তারপরও কেন যে তুমি…, কথা শেষ না করে কাঁধ ঝকাল সে, বলল, যদি কোন দিন ফাঁস হয়ে যায় যে তুমি দুনম্বর ড্রাগন, বড় ধরনের খেসারত দিতে হবে তোমাকে।

কারও কাছে আমি বাঁধা পড়ি নি, শান্তভাবে ব্যাখ্যা করল সুমা। আইন যেটাকে ক্রিমিন্যাল অ্যাকটিভিটি বলে, তার সাথে আমার পরিবার দুই শতাব্দী ধরে জড়িয়ে আছে। পূর্ব-পুরুষদের পায়ের ছাপ ধরে এগোচ্ছি আমি, তাদের রেখে যাওয়া ভিতের ওপর গড়ে তুলছি একটা সংগঠন। আমি গর্বিত, কারণ এ-ধরনের শক্তিশালী সংগঠন দুনিয়ার খুব কম দেশেই আছে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের বন্ধুদের জন্যেও আমি গর্বিত, লজ্জিত নই।

আমি আরও খুশি হতাম তুমি যদি সম্রাটের প্রতি সম্মান দেখাতে, গুরুত্ব দিতে পুরানো নৈতিক মূল্যবোধকে।

দুঃখিত, কামাতোরি। তীর্থ মন্দিরে গিয়ে বাবার জন্যে প্রার্থনা করি বটে, তবে পৌরাণিক কাহিনীর ঈশ্বরতুল্য সম্রাটের ওপর আমার কোন শ্রদ্ধা নেই। চা পান অনুষ্ঠানে গিয়ে গেইসাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, কাবুকি খেলায় অংশগ্রহণ করা, কানোইয়া কুস্তি দেখা, কিংবা জাতীয় কালচারকে শ্রেষ্ঠ বলে গর্ব বোধ করা, কোনটাই আমার দ্বারা সম্ভব নয়। নতুন যে থিওরিটা আজকাল শোনা যাচ্ছে ঐতিহ্য, ইন্টেলিজেন্স, আবেগ, ভাসা, ইত্যাদি ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের তুলনায় আমরা শ্রেষ্ঠ, এর সঙ্গেও আমি একমত নই। এই সব আইডিয়া বা মতবাদ আমি সমর্থন করি নিজের স্বার্থের কথা ভেবে, কিন্তু এ সবে আমার বিশ্বাস নেই। সত্যি কথা বলতে কি, আমি আমার প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছোট করে দেখতে রাজি নই। আমিই আমার ঈশ্বর, বিশ্বাস করি টাকা আর ক্ষমতায়। তুমি কি রেগে যাচ্ছ, মুরো?

কোলের ওপর পড়ে থাকা হাত দুটোর দিকে তাকাল কামাতোরি। চুপচাপ বসে থাকল সে, চোখে বিষাদের ছায়া। অবশেষে সে বলল, না, মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি সম্রাটকে শ্রদ্ধা করি, ভালবাসি আমাদের ঐতিহ্যবাহী কালচারকে। তার পরিবারের উৎস বা রুটস যে পবিত্র স্বর্গ, এ আমি বিশ্বাস করি, বিশ্বাস করি আমাদের এই দ্বীপগুলোর ওপর ঈশ্বরের বিশেষ দৃষ্টি ও ভালবাসা আছে। আমাদের রক্তে কোন ভেজাল নেই, আমাদের গোটা জাতির আত্মা এক সুতোয় গাঁথা। তবে আমি তোমাকেও অনুসরণ করি, হিদেকি। কারণ আমরা পুরোনো বন্ধু। কারণ, তোমারে আন্ডারগ্রাউন্ড কানেকশন আমার পছন্দ না হলেও, জাপানকে দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দেশে পরিণত করার জন্যে বিরাট অবদান রয়েছে তোমার।

তোমাকে আমি ভালবাসি, কারণ তুমি আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু, মুরো, সত্যি কথাই বলল সুমা। সামুরাই বংশের লোক তুমি, জন্মসূত্রেই যোদ্ধা, হাতে কাতানা থাকলে একাই তুমি একশো।

কাতানা শুধুই একটা তলোয়ার নয়, তারচেয়ে বেশি কিছু সামুরাইদের সতেজ আত্মা, বলল কামাতোরি, গলার সুরে প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। কাতানায় দক্ষ হওয়া মানে স্বর্গীয় পবিত্রতা অর্জন করা। সম্রাটের মর্যাদা ও নিরাপত্তার জন্যে কাতানা ব্যবহার করতে পারলে আমার আত্মা শান্তিময় আশ্রয় পাবে পবিত্র তীর্থ মন্দিরে।

অথচ আমি বললে আমার জন্যেও হাতে কাতানা তুলে নেবে তুমি।

বন্ধুর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মুরো কামাতোরি। তোমার নির্দেশে যে কোন লোককে আমি খুন করব, কারণ তুমি স্বজাতির জন্যে অনেক কিছু করেছ।

ভাড়াটে খুনীর নিষ্প্রাণ চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকল সুমা। প্রাচীন সামন্ত প্রভুদের নির্দেশে হত্যাকাণ্ড ঘটানো ছিল সামুরাই যোদ্ধাদের পেশা, বিনিময়ে সামান্য কিছু সুবিধে ও নিরাপত্তা পেলেই খুশি থাকত। সুমা জানে, রাতারাতি আনুগত্য প্রত্যাহার করে নেয়াও সামুরাইদের একটা বৈশিষ্ট্য। কথা বলার সময় অস্বাভাবিক শান্ত শোনাল তার গলা, কিছু লোক শিকার করে তীর-ধনুক দিয়ে, বেশিরভাগই ব্যবহার করে আগ্নেয়াস্ত্র। একা শুধু তোমাকে আমি চিনি, মুরো, মানুষ শিকার করার খেলায় তুমি তলোয়ার ব্যবহার করো।

.

আপনাকে সুস্থ ও সতেজ দেখাচ্ছে, প্রাচীন বন্ধু, বলল সুমা, তোশি কুদোর পিছু পিছু কোরোরি ইয়োশিশুকে কামরায় ঢুকতে দেখেই। কোরারি ইয়োশিশুর সাথে ইচিরো সুবোইও রয়েছে, কংগ্রেশন্যাল সিলেক্ট সাব-কমিটির সাথে বিতর্কে অংশগ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এসেছে সে।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক মৃদু হাসলেন। বাইরে থেকে সুস্থ ও সতেজ বলে মনে হলেও, আরও বুড়ো হয়ে গেছি আমি। আর খুব বেশি নতুন চাঁদ দেখার সুযোগ পাব না। শ্রদ্ধেয় পূর্ব-পুরুষদের সাথে মিলিত হবার একটা আকুলতাও অনুভব করছি।

কিন্তু আমরা জানি আরও একশো নতুন চাঁদ দেখার সুযোগ আপনি পাবেন।

দাঁতহীন মাড়ি বের করে হাসলেন কোরোরি ইয়োশিশু। কামরা থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিল তোশি কুদো। ইচিরো সুবোইর সামনে দাঁড়িয়ে মাথা নত করল সুমা। তোমাকে দেখে আনন্দ লাগছে আমার, ইচিরো। শুনলাম আমেরিকানদের তুমি নাকি বিষম একটা ধাক্কা দিয়েছ।

তেমন নাটকীয় কিছু নয়, বলল ইচিরো সুবোই। তবে ওদের ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ে দুএকটা ফাইল বোধহয় ধরাতে পেরেছি।

খুব কম লোকই জানে যে মাত্র চোদ্দ বছর বয়েসে গোল্ড ড্রাগন-এর সদস্য হয় ইচিরো সুবোই। কিশোর বালকটির ওপর নজর পড়ে কোরোরি ইয়োশিশুর, গুপ্ত সংগঠনের নীতিমালা মেনে চলার ব্যাপারে তার নিষ্ঠা ও আগ্রহ দেখে মুগ্ধ হন তিনি। ইয়োশিশু নিজে তাকে অর্থনীতি ও ব্যবসা শেখান। আজ কানোইয়া সিকিউরিটিজ-এর চীফ ডিরেক্টর হিসেবে ইচিরো সুবোই, সুমাও ইয়োশিশুর ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য পাহারা দেয়, পরামর্শ দেয় গোপন লেনদেন সম্পর্কে।

আমার বিশ্বস্ত বন্ধু, মুরো কামাতোরি, আশা করি নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দরকার নেই, বলল সুমা।

যুবা বয়েসে আমি যেমন নাম করেছিলাম, তলোয়ার যুদ্ধে সে-ও তেমনি নাম করেছে, আমি জানি, বললেন কোরোরি ইয়োশিশু।

মাথা নত করার সময় কামাতোরির কোমর ভাঁজ হয়ে গেল। আমি জানি, কাতানায় আজও আপনি আমার চেয়ে ভাল।

তোমার বাবাকে আমি চিনতাম, ভার্সিটিতে উনি তখন ফেনসিং মাস্টার ছিলেন, বললেন ইয়োশিশু। আমি ছিলাম তার সবচেয়ে বাজে ছাত্র। আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, একটা কামান কিনে আমি যেন জঙ্গলে হাতি মারতে যাই।

বৃদ্ধ ইয়োশিশুর একটা হাত ধরল সুমা, চেয়ারগুলোর দিকে এগোল দুজন। জাপানের সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যক্তি ধীরপায়ে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে হাঁটছেন, তবে তাঁর মুখে স্থির হয়ে আছে পাথুরে হাসি, আর চোখ দুটোকে কিছুই ফাঁকি দিতে পারছে না।

পিঠ উঁচু একটা চেয়ারে বসলেন তিনি, মুখ তুলে সুমার দিকে তাকালেন, কোন ভূমিকায় না গিয়ে সরাসরি প্রসঙ্গে চলে এলেন। কেইটেন প্রজেক্টের কি অবস্থা?

খোলা সাগরে আঠারোটা বম্ব ভেহিকেল রয়েছে আমাদের। ওগুলোই শেষ। চারটের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। পাঁচটা যাবে রাশিয়ায়। বাকিগুলো ইউরোপ আর প্যাসিফিক রাষ্ট্রগুলোয়।

টার্গেটের কাছাকাছি কোন সময় পৌঁছুবে ওগুলো?

কমবেশি তিন হপ্তার মধ্যে। ইতোমধ্যে আমাদের কমান্ড সেন্টারের কমপিউটারের সাথে ডিফেন্স-ডিটেকশন ও ডিটোনেশন সিস্টেম সংযুক্ত করার কাজ শেষ হয়ে যাবে।

সুমার দিকে অবাক হয়ে তাকালেন ইয়োশিশু। ডিভাইন স্টারে সময়ের আগে বিস্ফোরণ ঘটায় প্রজেক্টের কোন ক্ষতি হয় নি? প্রজেক্টটা পিছিয়েও যায় নি?

ভাগ্য ভাল যে ঝড়ে, সংঘর্ষে বা অন্য কোন দুর্ঘটনায় একটা জাহাজ হারাতে হতে পারে, এ আমি ধরেই রেখেছিলাম। ছটা অতিরিক্ত ওয়ারহেড সরানো ছিল। বিস্ফোরণে যে তিনটে হারিয়েছি সেগুলো আবার জায়গা মত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। গাড়িতে করে মেক্সিকোয় পাঠিয়ে দিয়েছি। ওখান থেকে টেক্সাস সীমান্ত পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকবে, পৌঁছে যাবে টার্গেট এরিয়ায়।

বাকি তিনটে নিরাপদে রাখা হয়েছে, ধরে নিতে পারি?

একটা সারপ্লাস ট্যাংকারে। হোক্কাইডোর এক নির্জন সৈকত থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে নোঙর ফেলে আছে ওটা।

আমরা কি জানি, কি কারণে ডিভাইনস্টারে বিস্ফোরণ ঘটল?

সময়ের আগে এই বিস্ফোরণ কেন ঘটল, ব্যাখ্যা দেয়া সত্যি কঠিন, বলল সুমা। প্রতিটি ক্ষেত্রে সেফগার্ড-এর ব্যবস্থা ছিল। আমরা জানি, ঝড়ের মুখে পড়েছিল জাহাজটা। নিশ্চয়ই একটা গাড়ি প্রচণ্ড ঝাঁকি খায়, ফলে ক্ষতি হয় ওঅরহেড কন্টেইনারের। রেডিয়েশন লিক করে, ছড়িয়ে পড়ে কার্গো ডেকে। ক্রুরা আতঙ্কিত হয়ে জাহাজ ছেড়ে পালায়। পরিত্যক্ত ডিভাইন স্টারকে দেখতে পায় নরওয়ের একটা জাহাজ, তারা একটা বোর্ডিং পার্টি পাঠায়। এর কিছু পর ডিভাইন স্টার বিস্ফোরিত হয়।

আর ক্রুরা? জানতে চাইলেন ইয়োশিশু। ডিভাইন স্টার ছেড়ে যারা পালাল?

তাদের কোন হদিস পাওয়া যায় নি। ঝড়ের মধ্যে গায়েব হয়ে গেছে।

গোটা সিস্টেমে গাড়ির সংখ্যা মোট কত? বৃদ্ধ জানতে চাইলেন।

ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়াল সুমা। হাতে ধরা ছোট একটা কন্ট্রোল বক্স-এর বোতামে চাপ দিল। কামরার একদিকের দেয়াল সিলিংয়ের দিকে উঠে গেল, বেরিয়ে পড়ল বড় একটা ট্রান্সপারেন্ট স্ক্রীন। বক্সের আরেকটা বোতামে চাপ দিল সে, গোল পৃথিবীর হলোগ্রাফিক ইমেজ ফুটে উঠল, নিওনের মত রঙিন আলো মিটমিট করছে গায়ে। এরপর ডিটোনেশন সাইটগুলো দেখাবার জন্যে আরেকটা বোতাম টিপল সে, প্রায় বিশটা দেশের গায়ে সোনালি আলো জ্বলে উঠল। এরপর কোরোরি ইয়োশিশুর প্রশ্নের জবাব দিল সুমা। পনেরোটা দেশে একশো ত্রিশটা গাড়ি বোমা।

কোরোরি ইয়োশিশু কুদে আলোগুলোর দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে থাকলেন। গ্লোবটা ঘুরছে, তার সাথে ঘুরছে আলোগুলো। অন্য যে-কোন দেশের চেয়ে আলোর সংখ্যা রাশিয়ায় বেশি। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র জাপানের ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী, কিন্তু রাশিয়াকে ওরা জাপানের পরম শত্রু বলে মনে করে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, কোন সামরিক স্থাপনা বা বড় কোন শহরকে টার্গেট করা হয় নি। আলো দেখা যাচ্ছে শুধু ফাঁকা ও কম জনবহুল এলাকাগুলোয়।

তোমার বাবার আত্মা তোমাকে নিয়ে গর্ব অনুভব করছেন, বললেন কোরোরি ইয়োশিশু, আবেগে কেঁপে গেল তাঁর গলা। তোমার প্রতিভাকে নমস্কার, দুনিয়ার বুকে অন্যতম সুপার পাওয়ার হতে যাচ্ছে জাপান। একবিংশ শতাব্দীতে দুনিয়া শাসন করবে নিপ্পন। আমেরিকা ও রাশিয়ার দিন শেষ।

সুমা খুশি। আপনার সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া কোনদিনই কেইটেন প্রজেক্ট সফল হত না, প্রিয় প্রাচীন বন্ধু। টাকা বানানোর কারিগর বা জাদুকর ইচিরো সুবোইর অবদানও কম নয়।

গোপন নিউক্লিয়ার অস্ত্র বানাবার জন্যে ফান্ড সংগ্রহ করা, সত্যি বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়, বলল ইচিরো সুবোই। তবে যার কাছে গেছি সে-ই আমাকে সাহায্য করেছে।

রুশ ও ওয়েস্টার্ন ইন্টেলিজেন্স জানে যে অ্যাটম বোমা বানাবার ক্যাপাসিটি আমাদের আছে, বলল মুরো কামাতোরি, আলোচনায় বাস্তবতার ছোঁয়া আনতে চাইছে সে।

বিস্ফোরণের আগে যদি না-ও জানত, বলল সুমা, এখন তারা জানে। আমেরিকানরা তো কয়েক বছর ধরেই সন্দেহ করছে আমাদের। তবে আমাদের সিকিউরিটি রিঙ পেনিট্রেট করতে পারে নি ওরা, আমাদের ফ্যাসিলিটির সঠিক অবস্থান খুঁজে পায় নি।

তবে আমাদের ভুলে থাকা উচিত নয় যে রাশিয়া বা আমেরিকার চোখে এক সময় আমরা ঠিকই ধরা পড়ে যাব, গম্ভীর সুরে বললেন কোরোরি ইয়োশিশু।

আমাদের একজন এজেন্ট আমাকে জানিয়েছে, বলল কামাতোরি, ডিভাইন স্টারে বিস্ফোরণ ঘটার পর আমরা জড়িত কিনা জানার জন্যে গোপন তদন্ত শুরু করেছে আমেরিকানরা। গন্ধ শুঁকে এরই মধ্যে মুরমটো অটো ডিসট্রিবিউটরস-এ গিয়েছিল ওরা।

কোবোরি ইয়োশিশুর কপালের বলিরেখাগুলো কুঁচকে উঠল। আমেরিকান ইন্টেলিজেন্সকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। আমার ভয় হচ্ছে কেইটেন প্রজেক্ট না বানচাল হয়ে যায়।

আজকালকের মধ্যেই খবর পাব আমরা, কতটা কি জানে ওরা, বলল কামাতোরি। আমাদের এজেন্ট ওয়াশিংটন থেকে ফিরে এসেছে, তার সঙ্গে আমার দেখা হবে। সে দাবি করছে, তার কাছে লেটেস্ট ইনফরমেশন আছে।

ইয়োশিশুর কপালে দুশ্চিন্তার রেখাগুলো আরও গম্ভীর হলো। কমান্ড সেন্টার স্বংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠার আগে প্রজেক্টটা যদি কোন বিপদের মধ্যে পড়ে, আমাদের নতুন সাম্রাজ্যের স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাবে।

আমি একমত, বলল ইচিরো সুবোই। আগামী তিন হপ্তা অরক্ষিত অবস্থায় থাকব আমরা। ওঅরহেডগুলো কোন কাজে আসবে না। কিছু যদি ফাঁস হয়ে যায়, পশ্চিমা দেশগুলো একযোগে চারদিক থেকে হামলা শুরু করবে অর্থনৈতিক, সামরিক, দুধরনেরই।

অত চিন্তার কিছু নেই, আশ্বাস দিল সুমা। ওদের এজেন্ট আমাদের নিউক্লিয়ার উইপনস্ ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট যদি খুঁজে বের করেও ফেলে, কেইটেন প্রজেক্টের ব্রেন সেন্টার কোনদিনই খুঁজে পাবে না। একশো বছরেও নয়, তিন হপ্তার মধ্যে তো প্রশ্নই ওঠে না।

তাছাড়া, ওদের ভাগ্য যদি সুপ্রসন্নও হয়, বলল কামাতেরি, সময়মত ওটাকে নিউট্রালাইজ করা সম্ভব হবে না। ভেতরে ঢোকার পথ তো একটাই, সেটাকে স্টীল ব্যারিয়ার দিয়ে দুর্ভেদ্য দুর্গ বানিয়ে রাখা হয়েছে, পাহারায় আছে দক্ষ একদল সশস্ত্র সিকিউরিটি গার্ড। ওটাকে আমরা এমনভাবেই তৈরি করেছি, অ্যাটম বোমা আঘাত করলেও চালু রাখতে পারব।

সুমার ঠোঁটে টান টান হাসি ফুটল। সব কিছুই আমাদের অনুকূলে রয়েছে। সামান্য একটু বিপদের আঁচ পেয়ে বা যদি বুঝি যে শত্রুপক্ষ হামলা করতে যাচ্ছে, দুএটা গাড়ি-বোমা ফাটিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া যাবে।

ইচিরো সুবোই সন্তুষ্ট হতে পারল না। মিথ্যে হুমকি দিয়ে কি লাভ?

সুমার কথায় যুক্তি আছে, বলল কামাতোরি। শুধু আমরা এই কজন আর কমান্ড সেন্টারের এঞ্জিনিয়াররা জানি যে আমাদের সিস্টেমটা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে তিন হপ্তা সময় লাগবে। পশ্চিমা নেতৃত্বকে সহজেই ধোঁকা দেয়া যাবে, ওরা জানবে সিস্টেমটা পুরাপুরি কাজ করছে।

কোরোরি ইয়োশিশু সন্তুষ্টচিত্তে মাথা ঝাঁকালেন। তাহলে ভয় পাবার কিছু নেই। আমাদের।

প্রায় এক মিনিট আর কেউ কিছু বলল না। তারপর ডেস্কের ইন্টারঅফিস ফোনটা বেজে উঠল। রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল সুমা। কথা না বলে শুনল শুধু, তারপর ক্রেডলে নামিয়ে রাখল রিসিভার। সেক্রেটারি জানাল, আমার প্রাইভেট ডাইনিংরুমে ডিনার দেয়া হচ্ছে। নিজেকে আমি অত্যন্ত সম্মানিত মনে করব, শ্রদ্ধেয় অতিথিরা যদি আমার সাথে খেতে বসেন।

ধীরে ধীরে দাঁড়ালেন কোরোরি ইয়োশিশু। আমি আনন্দের সাথে তোমার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম। তোমার শেফকে আমি চিনি, জাপানের সেরা শেফদের একজন। আমি আশা করছিলাম, তুমি আমাকে খেতে বলবে।

আলোচনা শেষ করার আগে, বলল ইচিরো সুবোই, আমি একটা সমস্যার কথা বলতে চাই।

মাথা ঝাঁকাল সুমা। তোমাকে ফ্লোর দেয়া হলো, ইচিরো।

এ তো জানা কথা যে বৈরী কোন সরকার আমাদের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক বাধা সৃষ্টি করলে বা আমদানি শুল্ক বাড়ালে প্রতিশোধ হিসেবে প্রতিবার আমরা অ্যাটম বোমা ফাটাবার হুমকি দিতে পারব না। আরও হালকা কোন বিকল্প আমাদের থাকা উচিত বলে মনে করি আমি।

কামাতোরি ও সুমা দৃষ্টি বিনিময় করল। এ-ব্যাপারে যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করেছি আমরা, বলল সুমা, সমস্যার চমৎকার সমাধান হলো, কিডন্যাপিং। শত্রুদের কাউকে অপহরণ।

সন্ত্রাস আমাদের কালচারের একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়, প্রতিবাদের সুরে বলল ইচিরো সুবোই।

ব্লাড রেড ব্রাদারহুডকে কি বলো তুমি, বৎস? জানতে চাইলেন কোরোরি ইয়োশিশু।

উন্মাদ ফ্যানাটিকাল কসাই। ওরা নিরীহ মেয়ে মানুষ ও বাচ্চাদের কোন কারণ ছাড়াই খুন করে। যে আদর্শের কথা বলে, সাধারণ লোকের কাছে তার কোন অর্থ। নেই।

কিন্তু তারা জাপানি।

অল্প কিছু বেশিরভাগই জার্মানির লোক, কেজিবি ট্রেনিং দিয়েছে।

ওদেরকে ব্যবহার করা যেতে পারে, বলল সুমা, উৎসাহে চকচক করছে চোখ দুটো।

আমি সাবধান করে দিচ্ছি, ওদের সাথে কোন রকম সম্পর্ক রাখা উচিত হবে না। ওদের সাথে সম্পর্ক আছে, এটা যদি কেউ সন্দেহও করে, বাইরে থেকে এমন সব নাজুক জায়গায় হামলা আসবে যে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হবে আমাদের।

সুমা খুন-খারাবির কথা বলছে না, ব্যাখ্যা করল কামাতোরি। ওর প্রস্তাব হলো, অপহরণের পর জিম্মিকে আমরা অক্ষত ও সুস্থাবস্থায় রাখব, তবে অপহরণের জন্যে দায়ী করব ব্লড রেড ব্রাদারহুডকে।

এতক্ষণে ব্যাপারটার তাৎপর্য ধরা পড়ল, হেসে উঠে বললেন বৃদ্ধ ইয়োশিশু। তোমরা আসলে সিল্কেন প্রিজন এর কথা বলছ।

মাথা নাড়ল ইচিরো সুবোই। জীবনে কখনও শুনি নি।

এটা আসলে আমাদের কালচারের পুরানো একটা ঐতিহ্য, বললেন ইয়োশিশু। যখন একজন শোগুন তার কোন শত্রুকে খুন করতে চাইছে না, তখন সে কি করে? শত্রুকে অপহরণ করে সে, গোপনে বন্দী করে রাখে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে দেয় শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে। তারপর অপহরণের জন্যে দায়ী করে বন্দীর ঈর্ষাকাতর কোন প্রতিদ্বন্দ্বীকে।

ঠিক তাই, বলল সুমা। আজিমা দ্বীপে এ-ধরনের ফ্যাসিলিটি তৈরি করেছি আমি। ছোট, তবে আধুনিক একটা এস্টেট।

এর মধ্যে সামান্য ঝুঁকি রয়েছে না? জানতে চাইল সবুই ইচিরো।

দ্য অবভিয়াস ইজ নেভার সাসপেক্টেড।

হাসিমুখে ইচিরোর দিকে তাকার কামাতোরি। কাকে বা কাদেরকে অপরহণ করা যেতে পারে, তুমি শুধু তাদের নামগুলো আমাকে জানালেই চলবে।

মাথা নিচু করে চিন্তা করল সবুই ইচিরো। তারপর মাথা উঁচু করে তাকাল সে। যুক্তরাষ্ট্রে দুজন মানুষ বড় বেশি বিরক্ত করছে আমাদের। কিন্তু অত্যন্ত সাবধানে কাজ করতে হবে তোমাকে। দুজনেই তারা কংগ্রেসের সদস্য। ওদেরকে কিডন্যাপ করা হলে মার্কিন মুলুকে বিরাট আলোড়ন উঠবে।

দায়ী করা হবে ব্ল্যাড রেড ব্রাদারহুডকে। মোটা টাকা মুক্তিপণও চাইবে ওরা, বলল সুমা, যেন আবহাওয়ার সংবাদ দিচ্ছে।

আপনি ঠিক কাদের কথা বলছেন, ইচিরো সুবোই? জানতে চাইল কামাতোরি।

কংগ্রেস সদস্য লরেন স্মিথ আর সিনেটর মাইকেল ডিয়াজ।

মাথা ঝাঁকালেন কোরোরি ইয়োশিশু। ও, হ্যাঁ, ওরাই তো জাপানের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক অবরোধ সৃষ্টির সুপারিশ করছে।

আমাদের লবি যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও, সিনেট ও কংগ্রেসে আইন পাস করাবার মত ভোট ওরা পেয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। ওদের দুজনকে সরিয়ে আনতে পারলে এই উদ্যোগে ভাটা পড়বে।

যুক্তরাষ্ট্র সরকার খেপে যাবে, সাবধান করল সুমা। হিতে বিপরীত হবে না তো?

কংগ্রেসে আমাদের লবির প্রভাব আছে, টেরোরিস্টদের ষড়যন্ত্র বলে সরকারের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো কঠিন হবে না। সিলেক্ট সাব-কমিটি যে আচরণ করেছে তার সাথে, সে-কথা ভুলেনি ইচিরো সুবোই। মার্কিন রাজনীতিকদের দ্বারা কম অপমানিত হই নি আমরা। এবার এই শিক্ষাটা দেয়া উচিত যে নিজেদের শক্তি ওদেরকে রক্ষা করার জন্যে যথেষ্ট নয়।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন কোরোরি ইয়োশিশু, কিন্তু কিছু দেখছেন বলে মনে হলো না। এক সময় মাথা নাড়লেন তিনি। করুণা হয়।

তার দিকে তাকাল সুমা। কার ওপর করুণা হয়, প্রাচীন বন্ধু?

ইউনাইটেড স্টেটস অভ আমেরিকার ওপর, নরম গলায় বললেন ইয়োশিশু। দেশটা সুন্দরী রমণীর মত, যে মারা যাচ্ছে ক্যান্সারে।

.

২৮.

মার্ভিন শওয়াল্টার নিজেদের দূতাবাস থেকে ট্রেনে চড়ে বাড়ি ফিরছেন। রোজকার মত আজও দুজন জাপানি এজেন্ট নজর রাখছে তার ওপর। সিট ছেড়ে দরজার দিকে এগোলেন তিনি, তারপর দরজা খোলার অপেক্ষায় আরোহীদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকলেন।

দরজা খুলে গেল, আরোহীদের স্রোতটা নেমে এল প্ল্যাটফর্মে। নিচে নেমে দাঁড়িয়ে থাকলেন মার্ভিন শওয়াল্টার, এক দুই করে গুনতে শুরু করেছেন মনে মনে। পাশের একটা কমপার্টমেন্ট থেকে এজেন্ট দুজনও নেমেছে, ভিড়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসছে তারা। পঁচিশ পর্যন্ত গুনে হঠাৎ চরকির মত আধপাক ঘুরেই লাফ দিয়ে আবার ট্রেনে চড়লেন তিনি। দুসেকেন্ড পর বন্ধ হয়ে গেল দরজা, সেই সাথে চলতে শুরু করল ট্রেন। দেরি হয়ে গেছে, এজেন্ট দুজন আবার ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করেও সফল হলো না। গতি বাড়ল ট্রেনের, ঢুকে পড়ল টানেলে।

পরবর্তী স্টেশনে ট্রেন বদল করলেন মার্ভিন শওয়াল্টার। এরপর নামলেন টোকিওর উত্তরপুর এলাকায়। জায়গাটার নাম শিটামাচি। শিটামাচি পুরানো টোকিওর অংশ, প্রাচীন অনেক নিদর্শন এখনও এদিকটায় দেখতে পাওয়া যায়।

প্যাটফর্ম থেকে কাঁপাবাসি স্ট্রীটে বেরিয়ে এলেন মার্ভিন। ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলেন শহরের মাঝখানে, নামলেন একটা জাপানি সরাইখানার সামনে। সরাইখানার নাম রায়ওকন।

বাইরে থেকে দেখে স্নান ও বিধ্বস্ত মনে হলেও, সরাইখানার ভেতরটা পরিচ্ছন্ন ও ছিমছাম। দোরগোড়াতেই একজন স্টাফের সঙ্গে দেখা হলো, মাথা নত করে বলল সে, রিজ-এর স্বাগত, পেশীবহুল দৈত্যই বলা যায় নোকটাকে।

আমার ধারণা ছিল এটা একটা গেইস্ট হাউস।

কথা না বলে পথ ছেড়ে দিল ডোরম্যান, রিসেপশনে ঢুকলেন মার্ভিন। ওক। কাঠের পালিশ করা মেঝে। দেয়াল ঘেঁষে সৌখিন বেতের চেয়ার। জুতো খুলে প্লাস্টিকের স্লিপার পরার অনুরোধ করা হলো তাকে। জাপানিদের পা ছোট, তাদের স্লিপারও ছোট, তবে এগুলো এমারসনের বড় আকারের পায়ে ঠিকমতই ফিট করল। তার ধারণা হলো, স্লিপারগুলো আমেরিকা থেকে আমদানি করা হয়েছে। তিনি জানেন, রায়ওকন-এর মালিক আসলে একটা মার্কিন ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি। এদের কাজ হলো, এজেন্টরা অন্যায় কিছু করে ধরা পড়তে যাচ্ছে দেখলে গোপনে ও নিরাপদে জাপান থেকে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে দেয়া।

সরাইখানার ভেতরের একটা কামরায় নিয়ে আসা হলো মার্ভিনকে। ঘরের সাথে বারান্দা আছে, বারান্দার নিচে বাগান। কোন চেয়ার বা ফার্নিচার নেই, কার্পেটের ওপর আছে শুধু কুশন। একটা বিছানাও আছে একপাশে, বালিশবহুল। কামরার মাঝখানে একটা গর্তের ভেতর আগুন জ্বলছে, টকটকে লাল হয়ে আছে কয়লাগুলো। কাপড়চোপড় খুলে খাটো একটা আলখেল্লা পরলেন মার্ভিন। এরপর কিমানো পরা এক পরিচালিকা এসে সরাইখানার বারোয়ারি গোসলখানায় নিয়ে গেল তাকে। আলখেল্লা ও হাতঘড়ি খুলে একটা বেতের ঝুড়িতে রাখলেন মার্ভিন, কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে ঢুকে পড়লেন ঘেরা গোসলখানায়। প্রথমে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজলেন কিছুক্ষণ, তারপর ধূমায়িত বাথটাবে নামলেন। বাথটাব তো নয়, ছোটখাট একটা সুইমিং পুল বললেই চলে।

একটা ছায়ামূর্তিকে আগেই দেখেছেন তিনি, বুক সমান পানিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মার্ভিনই প্রথম কথা বললেন, টিম হোন্ডা, ধরে নিচ্ছি।

মাত্র অর্ধেকটা, জবাব দিল রয় ওরশিয়া। জিম হানামুরা যে-কোন মুহূর্তে এসে পড়বে বলে আশা করছি। সাকি চলবে?

অপারেশনে রয়েছি, তবে ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি। দিন।

পুলের কিনারা থেকে বোতলটা তুলে নিয়ে গ্লাসে সাকি ঢালল রয় ওরশিয়া। দূতাবাসের খবর কি?

ঠিকই আছে সব। গ্লাসটা নিয়ে চুমুক দিলেন মার্ভিন। ইনভেস্টিগেশন কেমন চলছে? টিম লিঙ্কনের কাছ থেকে যে সূত্র পাওয়া গিয়েছিল, সেটা কোন কাজে লাগল?

মুরমটো কোম্পানি ম্যানেজমেন্ট চেক করেছি আমি। করপরেট এক্সিকিউটিভ অফিসারদের সাথে ও অরহেডের সরাসরি কোন যোগাযোগ আছে বলে মনে হয় না। আমার ধারণা, ওরা কিছু জানে না।

কেউ না কেউ নিশ্চয়ই জানে।

নিঃশব্দে হাসল রয় ওরশিয়া। অ্যাসেম্বলি লাইন ওয়ার্কারদের মধ্যে মাত্র দুজনের জানার কথা।

মাত্র দুজন কেন?

অ্যাসেম্বলি লাইন ওয়ার্কারদের মধ্যে একজন গাড়িতে এয়ারকন্ডিশনার বসানোর কাজ তদারক করে। তার যা পজিশন, ওয়ারহেড বসানোর জন্যে নির্দিষ্ট একটা গাড়ি বাছাই করার সুযোগ একমাত্র তারই আছে। দ্বিতীয় লোকটা হল ইন্সপেক্টর, যার কাজ ডিলারের কাছে গাড়িগুলো পাঠানোর আগে চেক করে দেখা ইউনিটটা ঠিকমত কাজ করছে কিনা। এয়ারকন্ডিশনার কাজ করছে না জানা সত্ত্বেও রিপোর্ট দেয়, সব ঠিক আছে।

তৃতীয় একজনও থাকার কথা, বললেন মার্ভিন শওয়াল্টার। কারখানার কমপিউটারাইজড শিপিং ডিপার্টমেন্টে। সে গাড়ি-বোমার সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলে। শুধু বিল অভ লেডিং ছাড়া, কারণ বিদেশী কাস্টমস অফিসারদের ওটা দেখাতে হবে।

সুতোটা ধরে এগোতে পেরেছেন কারখানা থেকে এয়ারকন্ডিশনার সাপ্লায়ার্স, ওখান থেকে বোমা তৈরির প্ল্যান্ট পর্যন্ত?

সাপ্লয়ার্স পর্যন্ত এগোতে পেরেছি, তারপর সব চিহ্ন মুছে গেছে। তবে আশা করছি দুএকদিনের মধ্যে নতুন একটা সূত্র পাব।

কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল ওরশিয়া, ড্রেসিং রুম থেকে এক লোককে বেরিয়ে আসতে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল সে। লোকটা মাঝারি আকৃতির, মাথায় রূপালি চুল, কোমরে শুধু একটা তোয়ালে।

হু দ্য হেল আর ইউ? জিজ্ঞেস করলেন মার্ভিন, ভয়ে নীল হয়ে গেছে চেহারা। তার ধারণা, রায়ওকনের সিকিউরিটি ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েছে আগন্তুক।

আমার নাম আশিকাগা ইনশু।

কে?

কথা না বলে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকল লোকটা। দিশেহারা বোধ করলেন মার্ভিন, উদভ্রান্তের মত এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন, ভাবছেন আশপাশে সেন্ট্রিরা নেই কেন।

তারপর হাসতে শুরু করল ওরশিয়া। অদ্ভুত ছদ্মবেশ, জিম। দুজনকেই বোকা বানিয়েছ তুমি।

মাথা থেকে রূপালি উইগ নামাল জিম হানামুরা, নকল গোঁফটাও খুলে ফেলল। শুধু তোমাদেরকেই নয়, হিদেকি সুমা আর তার সেক্রেটারিকেও বোকা বানিয়েছি।

বড় করে শ্বাস নিয়ে গলা পর্যন্ত পানির তলায় নেমে গেলেন মার্ভিন। জেসাস, যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন না।

সাকির গন্ধটা দারুণ। আমার জন্যে খানিকটা আছে নাকি?

একটা গ্লাসে খানিকটা সাকি ঢালল ওরশিয়া। কিচেনে পুরো এক বাক্স আছে। পরমুহূর্তে তার চেহারায় বিস্ময় ফুটে উঠল। কি যেন বললেন, এই মাত্র?

কই?

হিদেকি সুমা।

মুরমটো অটোমোটিভ, মুরমটো এয়ারক্রাফট করপোরেশন ইত্যাদি অনেকগুলো কোম্পানির আসল মালিক কে, আমি জানতে পেরেছি। সবই ধনকুবের হিদেকি সুমার। এ-সব কোম্পানির এক বালতি পানিতে কয়েকটা ফোঁটা মাত্র। গোটা ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্য, নেভাড়া ও আরিজোনা বিক্রি করলে যে টাকা পাওয়া যাবে তারচেয়ে অনেক বেশি টাকার মালিক এই লোক।

তার মানে কি ডিভাইন স্টার, যে জাহাজটা বিস্ফোরিত হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরে, ওটার মালিক সুমা?

অবশ্যই।

সুমা অত্যন্ত প্রভাবশালী লোক, বললেন মার্ভিন। বলা হয়, সে যদি জাপানের প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রিসভার কোন সদস্যকে বাহুতে ডানা লাগিয়ে বিশতলা বিল্ডিংয়ের মাথা থেকে লাফ দিতে বলে, কে কার আগে লাফ দেবে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।

তুমি সত্যি সুমার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে? হানামুরাককে প্রশ্ন করল ওরশিয়া।

কোন সমস্যাই হয় নি। অফিস আর তার সেক্রেটারি, দুটোই ভারি সুন্দর।

ছদ্মবেশ কেন?

টিম লিঙ্কনের আইডিয়া। ষোড়শ শতাব্দীর এক জাপানি আর্টিস্ট, নাম মাসাকি শিমজু, তাঁর পেইন্টিং সংগ্রহ করে সুমা। হোয়াইট হাউসের রেইমন্ড জর্ডান এক ওস্ত দি জালিয়াতকে ভাড়া করেন, নির্দেশ দেন শিমজুর অনাবিস্কৃত একটা পেইন্টিং আঁকতে, যেটা সুমার কালেকশনে নেই। আশিকাগা ইনশু হলেন দুর্লভ ও হারানো শিল্প খুঁজে বের করায় অভিজ্ঞ এক লোক। তাঁর ছদ্মবেশ নিয়ে যাই আমি, সুমার কাছে বিক্রি করি ছবিটা।

মাথা ঝাঁকালেন মার্ভিন। দারুণ। সত্যি দারুণ। জাপানি আর্ট সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনাকে পড়াশোনা করতে হয়েছে?

সংক্ষিপ্ত। হেসে উঠল হানামুরা। সুমা আমাকে ব্যাখ্যা করল, শিমজু কিভাবে বেলুনে চড়ে দ্বীপের ছবি আঁকলেন। যদি জানত যে স্যাটেলাইট ফটো দেখে আমার ছবিটা আঁকা হয়েছে, নিশ্চয়ই পানিতে চুবিয়ে মারত আমাকে।

কিন্তু লাভটা কি হলো? জিজ্ঞেস করল ওরশিয়া, টান টান হয়ে আছে মুখের চামড়া।

তার অফিসে এখন ছারপোকা আছে।

কিন্তু এ-সব আমি কেন জানি না?

একজন কি করছে অপরজন তা জানতে পারবে না, এটা আমার সিদ্ধান্ত, বললেন শাভিন। ফলে কেউ ধরা পড়লে খুব বেশি তথ্য ফাস করতে পারবে না।

ছারপোকা কোথায় রেখে এসেছ? হানামুরাকে জিজ্ঞেস করল ওরশিয়া।

পেইন্টিংয়ের ফ্রেমে দুটো। জানালার সামনে দাঁড় করানো ইজেলে একটা। আরেকটা পর্দার হাতলে। শেষ দুটো একটা রিলে ট্রান্সমিটারের সাথে সম্পর্ক রাখবে, গম্বুজের বাইরে একটা গাছের ডালে বেঁধে রেখে এসেছি ওটাকে।

কিন্তু যদি ছারপাকা ধরার গোপন যন্ত্র থাকে সুমার?

তার ফ্লোরের ইলেকট্রিক্যাল ব্লুপ্রিন্ট জোড়াড় করেছি আমি। ডিটেকশন ইকুইপমেন্টগুলো প্রথম শ্রেণীর, তবু আমাদের ছারপোকার অস্তিত্ব খুঁজে বের করতে পারবে না।

কেন পারবে না?

আমাদের মিনিয়েচার রিসিভিং ও সেণ্ডিং ইউনিট দেখতে খুদে ইলেকট্রনিক বস্তুর মত নয়, ওগুলো জ্যান্ত পিঁপড়ের মত দেখতে। চোখে পড়লে হয় অগ্রাহ্য করা হবে, নয়তো পিষে মেরে ফেলা হবে।

মাথা ঝাঁকালেন মার্ভিন। বাহ।

রিলে ট্রান্সমিটারটা গলফ বল আকৃতির। সমস্ত আলোচনা রিলে করবে ওটা। টেলিফোন বা ইন্টারকমে যা বলা হবে, তা-ও আমরা শুনতে পাব, আমাদের একা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। স্যাটেলাইট থেকে আওয়াজগুলো সরাসরি চলে যাবে মেল পেনারের কাছে অর্থাৎ টিম ক্রাইসলারের কাছে। ওরা পালাউ-এ আছে।

আমরা নিশ্চিতভাবে জানি, সুমার কথাবার্তা ওরা শুনতে পাচ্ছে কিনা? পানির ওপর চোখ রেখে জানতে চাইল ওরশিয়া।

সিস্টেমটা চমৎকার কাজ করছে, মার্ভিন আশ্বাস দিয়ে বললেন। এখানে আমার আগে মেল পেনারের সাথে কথা হয়েছে আমার। পরিষ্কার সিগন্যাল পাচ্ছেন তিনি। পাচ্ছি আমরাও আমার টিমের এক লোক ছারপোকার দিকে কান পেতে আছে।

কোন তথ্য যদি আমাদের তদন্তে কাজে লাগে, জানাতে দেরি করবেন না।

অবশ্যই দেরি করব না, বললেন মার্ভিন। দুঃখের বিষয় হলো, সুমা আর কোরোরি ইয়োশিশুর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটা আলোচনা হচ্ছিল, এই সময় দূতাবাস থেকে বেরিয়ে আমি আমি। মাত্র দুমিনিট শোনার সুযোগ হয়েছে আমার।

ইয়োশিশু, কোরোরি ইয়োশিশু, বিড়বিড় করল রয় ওরশিয়া। গুড গড, বুড়ো শয়তানটা আজও তাহলে বেঁচে আছে।

.

ভোর হতে আর ঘণ্টাখানেক বাকি, একটা মুরমটো লিমোজিন এসে থামল গাঢ় ছায়ার ভেতর। আসাকুসার সরু রাস্তা ধরে ধীরগতিতে আবার এগোল গাড়িটা।

মি. সুমার অফিসে আড়িপাতা যন্ত্র ফিট করা হয়েছে, বলল রয় ওরশিয়া। আমাদের একজন এজেন্ট আর্ট ডিলারের ছদ্মবেশে ভেতরে ঢুকেছিল। একটা পেইন্টিংয়ের ফ্রেমে, ইজেলে আর পর্দার হাতলে আছে ওগুলো।

তুমি ঠিক জানো? জানতে চাইল মুরো কামাতোরি, হতভম্ব হয়ে গেছে সে। ডিলার লোকটা আসল একটা শিমজু নিয়ে এসেছিল।

আসল নয়। স্যাটেলাইট ফটো দেখে নকল করা হয়েছে।

হিস হিস করে উঠল কামাতোরি, আমাকে আরও আগে জানানো উচিত ছিল তোমার।

আমি নিজেই জানতে পেরেছি মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে।

কথা না বলে আধো ছায়া আধো অন্ধকারে রয় ওরশিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল কামাতোরি, যেন তার ওপর বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।

রয় ওরশিয়া একজন ইন্টেলিজেন্স স্লিপার, জাপানি মা-বাবার ঘরে আমেরিকায় জন্ম, সিআইএ-তে চাকরি পাবার জন্যে ছোটবেলা থেকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। তাকে।

অবশেষে কামাতোরি বলল, আজ বিকেলে অনেক কথাই আলোচনা হয়েছে, সে-সব জানাজানি হয়ে গেলে মি. সুমার বিরাট ক্ষতি হবে। তুমি নিশ্চিত, কোথাও কোন ভুল হচ্ছে না?

আর্ট ডিলার কি নাম বলল তার? আশিকাগা ইনশু?

শিউরে উঠল কামাতোরি, নিজেকে অপরাধী মনে হলো তার। সুমার অর্গানাইজেশনে কেউ যাতে নাক গলাতে না পারে সেটা সেটাই তার কাজ। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে সে। হ্যাঁ, ইনশু।

তার আসল নাম জিম হানামুরা। আমার টিমের দ্বিতীয় লোক সে। তার কাজ নিউক্লিয়ার গাড়িবোমার উৎস খুঁজে বের করা।

গাড়ির সাথে ও অরহেডের সম্পর্ক আছে, এই রহস্য ভেদ করল কে?

ডার্ক পিট নামের এক অ্যামেচার। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল আন্ডারওয়াটার অ্যান্ড মেরিন এজেন্সির লোক সে।

সে কি আমাদের জন্যে বিপজ্জনক?

আমি নিশ্চিত নই। সে এখনো অফিশিয়ালি আমাদের পিছনে নেই। কিন্তু উদ্ভট প্রচুর জিনিস আবিষ্কার করেছে সে।

সীটে হেলান দিল কামাতোরি, জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। কিছুক্ষণ পর ওরশিয়ারের দিকে ফিরল সে। তুমি যে-সব এজেন্টদের সাথে কাজ করছ তাদের নামের একটা তালিকা দিতে পারো আমাকে? কে কি করছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ সহ?

মাথা ঝাঁকাল ওরশিয়া। নামগুলো দেয়া যাবে। তৎপরতা, সম্ভব নয়। সবাই আমরা আলাদাভাবে কাজ করছি। কেউ কারও সম্পর্কে কিছু জানি না।

ঠিক আছে, যখন যতটা পারো জানিয়ে আমাকে।

পিটের ব্যাপারে কি করবে বলে ভাবছ?

ওরশিয়ার দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকাল কামাতোরি। প্রথম সুযোগেই মেরে ফেলতে হবে।

.

২৯.

সবগুলোই ক্লাসিক অ্যান্টিকস কার, কোনটার বয়সই ষাট-সত্তরের কম নয়। লক্ষ্য করার মত বিষয় হলো, গাড়িগুলোর মালিকরাও প্রায় সবাই পৌঢ় বা বৃদ্ধ, যুবকদের সংখ্যা খুবই কম। পুরানো গাড়ি সংগ্রহ খরচবহুল হবি, এ ধরনের শখ মেটাবার সামর্থ্য যুবক বয়সে খুব কম লোকেরই হয়। সব মিলিয়ে প্রায় একশোর মতো গাড়ি এসেছে মাঠে, দর্শকের সংখ্যা কয়েক হাজার। পিটের স্টাজকে দাঁড় করানো হয়েছে উনিশশো ছাব্বিশ সালে ফ্রান্সে তৈরি একটা হিসপানো-সুইজার পাশে। প্রতিবার দুটো করে গাড়ি প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। বিচার করে পরীক্ষা করে ঠিক করবেন কোন দুটো গাড়ি পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করবে।

পিটের দুপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে লরেন স্মিথ ও অ্যাল জিওর্দিনো। মাথা চুলকে অ্যাল বলল, রেস শুরু হতে মনে হচ্ছে দেরি আছে, কিন্তু আমার যে খিদে পেয়েছে।

হেসে উঠে স্টাজের ব্যাক সিট থেকে পিকনিক বাস্কেটটা নামাল লরেন।

ঘাসের ওপরই বসে পড়ল তিনজন। ওরা খাচ্ছে, দুজন বিচারক এসে পিটের স্টাজ ও পাশের গাড়িটা পরীক্ষা করলেন। স্টাজের সিগারেট লাইটার ঠিকমত কাজ করছে না, এগজস্ট সিস্টেম মূল ডিজাইনের সাথে মিলছে না, এসব কারণে তিন পয়েন্ট কাটা গেল। পয়েন্ট কাটা যাবার অর্থ হলো, প্রতিযোগিতায় জিতলেও টাকা কিছু কম পাবে বিজয়ী। হিসপানো-সুইজার সাথেই প্রতিযোগিতা করতে হবে স্টাজকে, সিদ্ধান্ত দিলেন বিচারকরা।

জিতবে তো? জানতে চাইল অ্যাল।

বলা কঠিন, জবাব দিল পিট। ওটার চেয়ে আমার গাড়ির বয়স ছয় বছর কম, তবে হিসপানোর এঞ্জিনটা বড়, শরীরটা হালকা। কি হয় বলা যায় না।

আপনিই জিতবেন, ওদের কাছে এসে দাঁড়ালেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো।

মাইনিং এঞ্জিনিয়ারের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল পিট। হঠাৎ কোত্থেকে উদয় হলেন আপনি? জানতে চাইল ও।

কানে এল, এখানে আপনাকে পাওয়া যাবে, সহাস্যে বললেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। ভাবলাম আপনার গাড়িটাও দেখা হবে, মি. অ্যাল জিওর্দিনোর সাথে কথাও বলা যাবে, তাই চলে এলাম?

কোথাও ডাক পড়েছে নাকি? জানতে চাইল পিট।

এখুনি নয়।

লরেন স্মিথের সাথে ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসোর পরিচয় করিয়ে দিল পিট। হাসিমুখে ম্যানকিউসোর হাতে এক গ্লাস বিয়ার ধরিয়ে দিল লরেন। ইতোমধ্যে খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়েছে ওদের, লরেনের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে মাঠের ওপর হাঁটতে শুরু করল তিনজন। কি ঘটছে? ধৈর্য হারিয়ে জিজ্ঞেস করল অ্যাল।

অ্যাডমিরাল স্যানডেকার সম্ভবত আপনাদেরকে জানাবেন। টিম মার্সিডিজকে কে আপাতত কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গাড়ি-বোমা বহন করছিল যে জাহাজটা, সেটার অবশিষ্ট কিছু পাওয়া যায় কিনা খোঁজ করার কাজটা ও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

কারণ?

প্রেসিডেন্ট ভাবছেন, আপাতত ব্যাপারটা বেশি নাড়াচাড়া না করাই ভাল। চারদিকে নানান সমস্যা। রুশ রাজনীতিকরা এরই মধ্যে অভিযোগ করছেন, বিস্ফোরণের জন্যে আমেরিকাই দায়ী। আন্ডার কবার স্যালভেজ অপারেশন চালু রাখা হলে, রাশিয়াকে একটা ব্যাখ্যা দিতে হবে, প্রেসিডেন্ট সে ধরনের ঝামেলায় যেতে চাইছেন না। তাছাড়া, প্রশান্ত মহাসাগরের তলায় নুমা কি করছিল, এটা তিনি গোপন রাখতে চান। সাগরের মেঝেতে মাইনিং অপারেশন পরিচালনা করা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।

হুম। ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসোর দিকে তাকাল পিট। ওয়ারহেডসহ কয়টা গাড়ি পাওয়া গেছে?

এখন পর্যন্ত শুধু আপনার ছয়টা। ওয়েস্ট কোস্টে স্টেসি ফক্স ও ড. টিমোথি ওয়েদারহিল কতদূর কি করতে পেরেছেন এখনও কোন রিপোর্ট আসেনি।

জাপানিরা নিশ্চয়ই গোটা আমেরিকার সবখানে ছড়িয়ে রেখেছে ওগুলো, বলল পিট। সবগুলো খুঁজে বের করতে হলে রেই হবে।

লোকবল কোন সমস্যা নয়। সমস্যা হলো, জাপানিদের কোণঠাসা না করে কাজটা সারতে হবে। তারা যদি দেখে তাদের নিউক্লিয়ার প্রজেক্ট হুমকির মুখে পড়ছে, অস্থির হয়ে দুএকটা ম্যানুয়ালি ফাটিয়ে দিতে পারে।

খুব ভাল হত যদি চীম টিম হোন্ডা লোকেশন-এর একটা ম্যাপ যোগাড় করতে পারত, শান্ত গলায় বলল অ্যাল।

সে চেষ্টাই করছে ওরা, জানালেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো।

আপাতত আমরা তাহলে কানে আঙুল ঢুকিয়ে বসে থাকব? পিট গম্ভীর।

এত হতাশ হবার কিছু নেই, ডার্ক। সবগুলো টিম মিলে গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় যা করেছে, আপনারা প্রথম চার ঘণ্টায় তার চেয়ে অনেক বেশি করেছেন। সময় হলে আপনাদের ডাকা হবে।

কিছু ঘটার অপেক্ষায় অন্ধকারে বসে থাকতে আমার ভাল লাগে না, বলল পিট।

ভিড়ের মধ্যে চারজনের দলটাকে সম্পূর্ণ বেমানান লাগল। ক্লাসিক গাড়ির মালিক বা দর্শকরা সাধারণ শাট ট্রাউজার পরে এসেছে, তাদের মধ্যে গাঢ় রঙের স্যুট পরা একদল বেঁটেখাটো শক্ত-সমর্থ জাপানিকে হাতে অ্যাটাচি কেস নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখলে অবাক হবারই কথা। লোকের গাড়িগুলো খুঁটিয়ে দেখছে, খসখস করে নিজেদের ভাষায় কি যেন লিখছে নোটবুকে, ভাবটা যেন টোকিওর গাড়ি সংগ্রাহকদের প্রতিনিধি তারা। যতটা না বিস্মিত হচ্ছে লোকজন, তারচেয়ে বেশি কৌতুক বোধ করছে। ওরা যে আসলে ভাড়াটে টেরোরিস্ট, বুঝতে পারছে না কেউ। চারটে অ্যাটাচি কেসে ঠাসা রয়েছে গ্যাস গ্রেনেড ও অ্যাসল্ট উইপনস। ক্লাসিক গাড়ির রেস দেখতে নয়, তারা এসেছে লরেন স্মিথকে অপহরণ করতে।

সশস্ত্র সিকিউরিটি গার্ডরা কে কোথায় আছে, ভাল করে দেখে নিল ওদের লীডার। আগেই লক্ষ্য করেছে, পিটের স্টাজ মাঠের প্রায় মাঝখানে দাঁড়িয়ে। ভিড়ের মধ্যে থেকে লরেন স্মিথকে কিডন্যাপ করা সম্ভব নয়, ধরা পড়ে যেতে হবে। কাজেই অনুকূল পরিবেশের জন্যে অপেক্ষায় থাকতে হবে ওদেরকে। রাস্তার কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ওদের লিমুসিন, তিনজনকে গাড়িতে ফিরে যেতে বলল লীডার। ভিড়ের মধ্যে একা থাকল সে, লরেনের ওপর নজর রাখছে। দূর থেকে পিট, অ্যাল ও ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসোর দিকেও নজর রাখছে সে। তার মনে হলো, তিনজনের একজনের কাছেও কোন আগ্নেয়াস্ত্র নেই।

একজন রেস স্টুয়ার্ড এসে জানাল, স্টাজ নিয়ে স্টাটিং লাইনে দাঁড়াতে হবে পিটকে। দল বেঁধে, হৈ-চৈ করতে করতে এগোল ওদের পুরো দলটা। গাড়ির হুড তুলে শেষবারের মত এঞ্জিনটা চেক করে নিল অ্যাল, পাশে দাঁড়িয়ে ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো সাহায্য করলেন তাকে। পিটকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে শুভ কামনার চিহ্নস্বরূপ চুমো খেল লরেন, তারপর ছুটে চলে এল ট্র্যাক-এর পাশে, নিচু একটা পাঁচিলের উপর বসল পা ঝুলিয়ে। ইতোমধ্যে হিসপানো-সুইজার মালিক ক্লাইভ কিউমন্ট-এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে পিটের। করমর্দন করে যে যার গাড়িতে উঠে বসল ওরা।

স্টিয়ারিং হুইলের পিছনে বসে ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেল ও ড্যাশবোর্ডের ওপর চোখ বুলাল পিট, তারপর মুখ তুলে তাকাল অফিশিয়াল স্টার্টার-এর দিকে। লোকটা ধীরে ধীরে সবুজ পতাকাটার ভাঁজ খুলছে। কংক্রিটের সেফটি ওয়াল-এর কাছাকাছি, লরেনের ঠিক সামনে, একটা নিমুসিন এসে দাঁড়িয়েছে, দেখতে পেল না ও। দেখতে পেল না এক লোক গাড়িটা থেকে নেমে এগিয়ে এল, কথা বলছে লরেনের সাথে।

এখনও স্টাজ-এর এঞ্জিন পরীক্ষা করছে অ্যাল। একা শুধু ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো দেখলেন, জাপানি লোকটার উদ্দেশ্যে ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল লরেন, পাঁচিল থেকে নেমে তার সাথে হেঁটে গেল লিমুসিনের দিকে, উঠে বসল গাড়িতে।

হুডটা নামাল অ্যাল, পিটের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল, নো অয়েল অর ওয়াটার রিকস। তবে খুব বেশি খাঁটিও না বেচারিকে। এঞ্জিনকে আমরা নতুন করে তৈরি করলেও, বুড়ির বয়েস ষাট বছরের ওপর।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, বলল পিট, হঠাৎ খেয়াল করল আশপাশে কোথাও লরেনকে দেখা যাচ্ছে না। লরেন কোথায়? জানতে চাইল ও।

দরজার দিকে ঝুঁকে ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো হাত তুলে সাদা লিংকনটাকে দেখালেন। ওই লিমোর এক জাপানি ভদ্রলোক তার সাথে কথা বলছেন। সম্ভবত কোন লবিষ্ট হবেন।

রেস বাদ দিয়ে কথা বলতে চলে গেল?

আমি তার ওপর নজর রাখছি, বললেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো।

স্টার্টার দুই গাড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে পতাকাটা মাথার উপর তুলল। অ্যাল আর ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো সরে এলেন তাড়াতাড়ি। পতাকা নেমে এল, সেই সাথে ছুটল গাড়ি দুটো।

প্রথমেই হিসপানো-সুইজাকে পিছনে ফেলে দিল স্টাজ। রাস্তাটা সোজা প্রায় এক হাজার গজ লম্বা, তারপর বাঁক নিয়ে চলে গেছে উত্তর দিকে। গাছপালা বা বাড়িঘর নেই, মাঠ থেকে উত্তর দিকের দুমাইল রাস্তা পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আবার বাঁক নিয়ে তির্যকভাবে স্টার্টিং পয়েন্টে ফিরে এসেছে রাস্তাটা। পুরোটা রাস্তার দুপাশে হালকা ভিড়, হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে ড্রাইভারদের। উত্তরের রাস্তায় একবার সামনে থাকল স্টাজ, একবার হিসপানো। রাস্তাটার শেষ অংশে দুটো গাড়ি একই সাথে, পাশাপাশি ছুটল। তির্যক রাস্তায় ওঠার পর, মাঝামাঝি জায়গায়, স্টাজকে ছাড়িয়ে কয়েক হাত সামনে চলে এল হিসপানো। স্টাটিং পয়েন্ট আর মাত্র কয়েক শো গজ দূরে, এখনও এগিয়ে আছেন ক্লাইভ বিউমন্ট। বোঝাই যাচ্ছে ফলাফল কি হবে। স্টাজের চেয়ে এক কি দেড় সেকেন্ড আগে ফিনিশিং লাইন স্পর্শ করবে হিসপানো।

আর মাত্র পঞ্চাশ গজ বাকি, এই সময় একটা ঝাঁকি খেয়ে বেড়ে গেল স্টাজের গতি। হিসপানো ছুটছে ফুল স্পীডে, স্পীড আর বাড়ানোর কোন সুযোগ নেই। শেষ মুহূর্তের জন্যে এঞ্জিনের খানিকটা শক্তি রিজার্ভ রেখেছিল পিট, এবার সেটা কজে লাগাচ্ছে। ঘণ্টায় আশি মাইল স্পীডে ছুটছিল ওর গাড়ি, সেটা বেড়ে নব্বইয়ে উঠে গেল।

ফিনিশিং লাইন স্পর্শ করল দুটো গাড়ি, মনে হলো একসাথে। কিন্তু না, আধ হাত এগিয়ে ছিল স্টাজ, টিভির বিরাট স্ক্রীনে তাই দেখা গেল। নিয়ম হলো, বিজয়ী ড্রাইভার মাঠটাকে এক চক্কর ঘুরে স্টার্টিং লাইনে ফিরে, কিন্তু অ্যাল আর ম্যানকিউসো পিটকে সে সুযোগ দিল না। স্টাজের সামনে দাঁড়িয়ে উন্মাদের মত হাত নাড়ছে তারা, অগত্যা বাধ্য হয়ে ব্রেক কষতে হলো পিটকে। ও লক্ষ্য করছে, হাত বাড়িয়ে সাদা লিমুসিনটাকে দেখাচ্ছেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো।

গাড়ি থামিয়ে জানালা দিয়ে মাথা বের করল পিট। লরেন?

স্টাজও চলছে, লাফ দিয়ে রানিং বোর্ডে উঠে পড়ল অ্যাল। হা! আমার ধারণা, লিমুসিনের জাপানিরা তাকে কিডন্যাপ করেছে।

ছুটে এলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, হাঁপাচ্ছেন। গাড়ি নিয়ে চলে গেল ওরা, বুঝতে পারিনি মিস লরেন ওটায় আছেন।

আপনার কাছে অস্ত্র আছে? জানতে চাইল পিট।

হোলস্টারে একটা কোল্ট অটো আছে, পঁচিশ ক্যালিবারের।

উঠে পড়ুন। নির্দেশ দিল পিট, তাকাল অ্যালের দিকে। তুমি একজন গার্ডের রেডিও চেয়ে নিয়ে পুলিশে খবর দাও। আমরা ধাওয়া করছি।

মাথা ঝাঁকিয়ে গার্ডের খোঁজে ছুটল অ্যাল। স্পীড বাড়িয়ে মাঠ থেকে পূর্ব দিকের রাস্তায় উঠে এল পিট। মান্ধাতা আমলের একটা গাড়ি নিয়ে আধুনিক মডেলের একটা লিমুসিনকে ধাওয়া করে কোন লাভ নেই, জানে ও। তবু চেষ্টা করে দেখতে হবে ওকে।

৩০. পার্কিং লটে কয়েকশো গাড়ি

৩০.

পার্কিং লটে কয়েকশো গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে, মাঝখানের ফাঁক দিয়ে ছুটছে পিটের স্টাজ। স্পীড ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল, সাদা লিমুসিন থেকে বিশ সেকেন্ড পিছিয়ে রয়েছে ওরা।

হর্নের বোমাটা টিপে রেখেছে পিট। তবে বেশিরভাগ দর্শক রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিযোগিতা দেখছে, পার্কিং লট প্রায় নির্জনই বলা যায়। কোন বিপদ ঘটল না, রাস্তায় নেমে এল স্টাজ।

রাগে উন্মাদ হয়ে আছে পিট। সাদা লিমুসিনকে দাঁড় করিয়ে লরেনকে উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভবই বলা যায়। বড় আকারের ডি-এইচ এঞ্জিন থাকায় স্টাজের চেয়ে দ্বিগুণ হর্সপাওয়ার রয়েছে লিমুসিনের। ও জানে, এটা ঠিক ক্রিমিন্যাল কিডন্যাপিং নয়, তারচেয়ে মারাত্মক কিছু। কিডন্যাপাররা লরেনকে মেরে ফেলবে বলে ভয় পাচ্ছে ও।

হাইওয়েতে উঠে এল ওদের গাড়ি।

ওরা আমাদের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে আছে, ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো হতাশ গলায় বললেন।

দেখা যাক ধরতে পারি কিনা, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ একটা ভাব ফুটে রয়েছে পিটের চেহারায়। সাইড রোড থেকে একটা গাড়ি উঠে এল হাইওয়েতে, দ্রুত হুইল ঘুরিয়ে সংঘর্ষ এড়াল ও ওরা জানে না আমরা ধাওয়া করছি, কাজেই টহল পুলিশের ভয়ে স্পীড লিমিটের বাইরে যাবে না। স্টেট, পুলিশ বাধা না দেয়া পর্যন্ত ওটাকে আমি শুধু দৃষ্টি সীমার মধ্যে রাখতে চাই।

পিটের গাড়িটার সাথে কথা বলছে পিট, অনুরোধ করছে আরও জোরে ছোটার। ওর মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। যেন ওর অনুরোধে সাড়া দিয়েই স্পীড বেড়ে গেল স্টাজের। ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো দেখলেন স্পীড মিটারের কাটা নব্লুইয়ের ঘর ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নতুন অবস্থায়ও গাড়িটা এত জোরে ছোটেনি। একের পর এক কার, ট্রাক, ট্রেইলারকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে পিট। বাঁক নেয়ার সময়ও গতি কমাল না। গাড়িটা রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ছে না দেখে বিস্মিত হলেন। ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। এঞ্জিনের আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠল অন্য একটা শব্দ, জানালা দিয়ে বাইরে মাথা বের করে আকাশের দিকে তাকালেন তিনি। হেলিকপ্টার।

পুলিশ?

কোন ছাপ নেই। দেখে যেন হচ্ছে কমার্শিয়াল।

রেডিও না থাকলে কত যে অসুবিধে।

লিমুসিনের দুশো মিটার পিছনে চলে এসেছে ওরা, এই সময় সামনের গাড়ির লোকজন স্টাজের অস্তিত্ব টের পেয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে গেল স্পীড, দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে।

সমস্যা সৃষ্টি করল বড় একটা ডজ পিকআপ ট্রাক। ক্লাসিক কারটাকে দেখে খুব মজা পেল ড্রাইভার, কৌতুক করার লোভ সামলাতে পারল না। যতবার পাশ কাটাবার চেষ্টা করছে পিট, ডজের ড্রাইভার যতবার বাধা দিচ্ছে, বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসছে সে। জানালা দিয়ে মাথা বের করে ভেঙাচ্ছে পিটকে।

হোলস্টার থেকে খুদে অটোমেটিকটা বের করলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। দেব নাকি ব্যাটার ক্যাপটা উড়িয়ে?

আমি একটু চেষ্টা করে দেখি, বলল পিট। ডজে ডান দিকে সরে ও, পরমুহূর্তে বাম দিকে একবার ডানে, তারপরই বামে, বারবার। বাধা দেয়ার জন্যে ডজের ড্রাইবারও দ্রুত ডানে বামে সরে যাচ্ছে। পিট কোন দিকে আছে দেখার জন্যে জানালা দিয়ে ঘন ঘন পিছন দিকে তাকাচ্ছে লোকটা। জানে না, কাজটা ওকে পিটই করাচ্ছে।

সামনে বাঁক, কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই লোকটার। রাস্তার ধারে নিচু পাঁচিল, বাঁক নিতে দেরি করায় ধাক্কা খেল ডজ, পাঁচিল ভেঙে ঢালের কিনারায় চলে গেল। ঢাল বেয়ে নেমে যাচ্ছে, ভাগ্য ভাল উল্টে পড়ল না ট্রাকটা। পাশ কাটাবার সময় লোকটার উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল পিট। হাসছে ও।

বাঁক ঘুরতেই নিভে গেল মুখের হাসি। পরবর্তী বাঁকের মুখে একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে রয়েছে, তেলের তিনটে ড্রাম পড়ে রয়েছে রাস্তার উপর, তার মধ্যে একটা গড়াগড়ি খাচ্ছে। শেষ ড্রামটা ফেটে গেছে, হড়হড় করে বেরিয়ে আসছে চকচকে তেল। সাদা লিমুসিন। কোন রকমে সংঘর্ষ এড়াল, তবে তেলের মধ্যে পড়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। কোন বিরতি ছাড়াই তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরে বৃত্ত রচনা করল দুবার। অলৌকিক ক্ষমতায় ড্রাইভার আবার সিধে করে নিল গাড়ি, ছুটে গেল সামনের দিকে।

গতি কমাবার সময় পাওয়া গেল না, ব্রেক করলে উল্টে যাবে গাড়ি, প্রায় আত্মহত্যার ঝুঁকি নিয়ে পিটও ঝাঁপ দিল তেলের মধ্যে। এই সময় পিছু হটতে শুরু করল ট্রাক। সংঘর্ষ অনিবার্য, দুহাতে সিট আঁকড়ে ধরে তৈরি হলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। একেবারে শেষ মুহূর্তে গাড়িটাকে কাত করে ফেলল পিট, এক দিকের দুটো চাকা প্রায় শূন্যে উঠে পড়ল, অপর দিকের চাকা দুটো পিছলাতে শুরু করেছে। তেলের মধ্যে পড়ল গাড়ি ব্রেক করেনি পিট, শুধু ক্লাচ ঠেলে দিল, তেলের উপর দিয়ে নিজের খুশি মত ছুটতে দিল গাড়িটাকে। তারপর ঘাস মোড়া রাস্তার কিনারায় চলে এল ও, যতক্ষণ চাকায় তেল থাকল ততক্ষণ আর রাস্তায় উঠল না।

দুটো গাড়ির মাঝখানে দূরত্ব এখন খুব সামান্যই। হেলিকপ্টার? জানতে চাইল পিট।

জানালা দিয়ে মাথা বের করলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। আছে। লিমুসিনের ওপর, ডান দিকে।

আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, দুটো একই দলের।

ফড়িংটার গায়ে কোন ছাপ না থাকাটা সন্দেহজনক, একমত হলেন ম্যানকিউসো।

ওদের কাছে অস্ত্র থাকলে আমরা গেছি।

আকাশ থেকে অটোমেটিক অ্যাসল্ট উইপন ব্যবহার করা হলে আমার খুদে কোল্ট কোন কাজে আসবে না।

কিন্তু কয়েক মাইল আগেই গুলি করে আমাদেরকে অচল করে দিতে পারত। দেয়নি কেন?

পানি নেই, রেডিয়েটরের দিকে আঙুল তাক করলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো।

ফিলার ক্যাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে।

লিমুসিনের পিছনের সীটে, কল্পনার চোখে দেখতে পেল পিট, হাত-মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে রয়েছে লরেন। ভয় ও দুচিন্তায় হিম বাতাসের মত ঝাপটা মারল ওর মনে। কিডন্যাপাররা এরই মধ্যে তাকে মেরে ফেলেছে কিনা কে জানে। চিন্তাটা মাথা থেকে বের করে দিয়ে ভাবল, লরেনকে জিম্মি রেখে মুক্তিপণ চাওয়ার সুযোগটা ওরা হাতছাড়া করবে না। তবে লরেনের যদি কোন ক্ষতি করে, ওদের সব কটাকে মরতে হবে, যেন মনে প্রতিজ্ঞা করল ও।

ভূতে পাওয়া মানুষের মত, যেন একটা ঘোরের মধ্যে ধাওয়া করছে পিট। যেভাবেই হোক লরেনকে মুক্ত করতে হবে। ঘোয়ারের মত লিঙ্কনটাকে ধাওয়া করে যাচ্ছে।

স্পীড বাড়িয়ে পালাতে পারছে না ওরা, ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো এক সময় বললেন।

ওরা আমাদের সাথে খেলছে, বলল পিট, তাকিয়ে আছে পঞ্চাশ মিটার দূরের সাদা লিমুসিনের দিকে। ইচ্ছে করলেই আমাদেরকে পেছনে রেখে চলে যেতে পারে ওরা।

হতে পারে ওদের এঞ্জিনে সমস্যা দেখা দিয়েছে।

আমার তা মনে হয় না। ড্রাইভার লোকটা প্রফেশন্যাল। তেলের উপর দিয়ে আসার পর একই গতিতে ছুটছে সে।

রাস্তার পাশের গাছপালার ফাঁক দিয়ে রোদ এসে চোখে লাগছে। হাতঘড়ি দেখলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো।স্টেট পুলিশ আসছে না কেন?

আশপাশের সমস্ত রাস্তা চষে ফেলছে। কোথায় রয়েছি আমরা,অ্যাল তা জানে না।

এই গতি খুব বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারবেন না আপনি।

অ্যাল ঠিকই আমাদেরকে খুঁজে নেবে, দৃঢ়কণ্ঠে বলল পিট, পুরানো বন্ধুর ওপর ওর আস্থার কোন অভাব নেই।

নতুন আরেকটা শব্দ ঢুকল কানে, মাথাটা জানালা দিয়ে আবার বের করলেন ম্যানকিউসো। তারপর শরীরের প্রায় অর্ধেকটাই বের করে আনলেন। হাত দুটো উন্মাদের মত নাড়ছেন।

কি ব্যাপার? জানতে চাইল পিট, তীক্ষ্ণ একটা বাঁক ঘুরে দেখল সামনে ছোট একটা ব্রিজ, নিচে সরু খাল।

আরেকটা হেলিকপ্টার, রুদ্ধশ্বাসে বললেন ম্যানকিউসো।

কোন ছাপ আছে?

ব্রিজ পেরিয়ে এল গাড়ি, রাস্তার দুপাশে এখন আর কোন গাছ নেই। যতদূর দৃষ্টি যায় খেত, মাঠ, খাল আর প্রকাণ্ড আকারের কংক্রিটের সাইলো।

দ্বিতীয় হেলিকপ্টারটা একদিকে কাত হলো, ফলে গায়ের লেখাগুলো পরিষ্কার পড়তে পারলেন ম্যানকিউসো। হেনরিকো কাউন্টি শেরিক ডিপার্টমেন্ট। রোটর ব্লেডের শব্দকে ছাপিয়ে উঠল তার চিৎকার। পরমুহূর্তে অ্যাল জিওর্দিনোকে চিনতে পারলেন তিনি, হেলিকপ্টারের খোলা দরজা থেকে হাত নাড়ছে। সময়মতই। পৌঁছেছে সে, বুড়ি স্টাজের দশ প্রায় ফুরিয়ে এসেছে।

দ্বিতীয় হেলিকপ্টারকে বেধে ফেলেছে প্রথমটার পাইলট। হঠাৎ করে দিক বদলাল সে, অনেকটা নিচে নেমে দ্রুতবেগে ছুটল উত্তরপূর্ব দিকে। ফসল ঢাকা একটা মাঠের শেষ মাথায় সারি সারি গাছ দাঁড়িয়ে আছে, আড়াল পাবার জন্যে পালাচ্ছে সেদিকে।

ধীরে ধীরে রাস্তার একপাশে সরে গেল সাদা লিংকন। আঁতকে উঠল পিট, দেখল রাস্তার কিনারা থেকে নিচের দিকে খসে পড়তে যাচ্ছে গাড়িটা। ছোট একটা গতে পড়ল সাদা লিমুসিন,তারপর ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল খেতের দিকে, যেন হেলিকপ্টারের পিছু নিতে চায়।

দ্রুত চোখ বুলিয়ে চারপাশটা একবার দেখে নিল পিট, হুইল ঘুরিয়ে অনুসরণ করল লিমুসিনকে। শুকলো ও ভঙ্গুর আঘাত করল উইন্ডস্ক্রীনে, তাড়াতাড়ি মাথাটা গাড়ির ভেতর টেনে নিলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো।

সাদা গাড়িটাকে ধাওয়া করছে স্টাজ। সামনে ধুলোর পাহাড়। প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছে না পিট, তবু গণি একটু কমাল না।

কাঁটাতারের একটা বেড়া ফুঁড়ে বেরিয়ে এল ওরা। বুঝতে পারেনি পিট, যাচ্ছে। তীর বেগে ছুটে এসে সরাসরি কংক্রিটের একটা সাইলোর সাথে ধাক্কা খেল লিঙ্কন।

ওহ গড! আঁতকে উঠলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, বুঝতে পাচ্ছে সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব নয়।

সংঘর্ষ এড়াবার জন্যে মরিয়া হয়ে ডান দিকে হুইল ঘোরাল পিট, সাইলোর কোণ ঘেষে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা। স্টাজ ঘুরতে শুরু করল, পিছনটা বাড়ি খেল বিধ্বস্ত লিংকনের সাথে। খানিক দূরে এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল ওদের গাড়ি।

গাড়ি দাঁড়াবার আগেই নেমে পড়েছে পিট, লিমুসিনের দিকে ছুটছে। বাঁক ঘুরতেই ছ্যাৎ করে উঠল বুক, দুমড়ে মুচড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে লিংকন। এ ধরনের সংঘর্ষের পর কারও পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। ফ্রন্ট-সিট ভেঙে বেরিয়ে এসেছে এঞ্জিন, ছাদে ঠেকে রয়েছে স্টিয়ারিং হুইল। ড্রাইভারকে কোথাও না দেখে পিট ধরে নিল, গাড়ির অপর দিকে ছিটকে পড়েছে লোকটা।

প্যাসেঞ্জার সিট বলতে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই, ছাদের সাথে জোড়া লেগে গেছে। দরজাগুলো তুবড়ে ডেবে গেছে ভেতর দিকে। জানালার কাঁচ যেটুকু অবশিষ্ট আছে, লাথি মেরে ভেঙে ফেলল পিট, ভেতরে মাথা গলালো।

ভেতরে কেউ নেই।

সমস্ত অনুভূতি ভোতা হয়ে গেছে পিটের, বিধ্বস্ত গাড়িটার চারদিকে ঘুরছে। কিন্তু কোথাও কোন লাশ পড়ে নেই। কিছুই পেল না ও, একটু রক্ত বা এক টুকরো ছেঁড়া কাপড়ও নয়। তারপর ডেবে যাওয়া ড্যাশবোর্ডের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো ভৌতিক গাড়িটায় কেন কেউ নেই। ইলেকট্রিক্যাল কানেক্টর থেকে ছোট্ট একটা ইন্সট্রুমেন্টে খুলে নিয়ে পরীক্ষা করল ও, রাগে লালচে হয়ে উঠল চেহারা।

তখনও বিধ্বস্ত গাড়িটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে পিট, নেমে আসা হেলিকপ্টার থেকে ছুটে এল অ্যাল। স্টাজ থেকে নেমে তার সাথে এলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসোও।

লরেন? ব্যাকুল কণ্ঠে জানতে চাইল অ্যাল।

মাথা নেড়ে হাতের ইন্সট্রুমেন্টটা অ্যালের দিকে ছুঁড়ে দিল পিট। আমাদেরকে বোকা বানানো হয়েছে, বলল ও। গাড়িটা ছিল টোপ। অপারেট করেছে একটা ইলেকট্রনিক রোবট ইউনিট, ঢালানো হয়েছে হেলিকপ্টার থেকে, রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে।

উদভ্রান্তের মত লিমুসিনের চারদিকে তাকালেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। আমি… আমি নিজের চোখে মিস লরেনকে চড়তে দেখেছি ওটায়।

আমিও দেখেছি, তাকে সমর্থন করল অ্যাল।

সেটা অন্য গাড়ি, শান্ত গলায় বলল পিট।

কিন্তু এটা তো একবারও আমাদের চোখের আড়ালে যায়নি।

গেছে। চিন্তা করে দেখুন। আমারা ধাওয়া করি বিশ সেকেন্ড পর। পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে আসারও বেশ খানিক পর এটাকে আমরা দেখতে পাই। গাড়ি বদলের ঘটনা ঘটেছে পার্কিং লটে।

কয়েক মুহূর্তে কথা বলল না কেউ। তারপর নিস্তব্ধতা ভাঙল অ্যাল। লরেন ওদের হাতে, যেন ব্যথায় কাতরে উঠল সে। ছাই হয়ে গেছে মুখের চেহারা। গড হেলপ আস, লরেন ওদের হাতে।

লিমুসিনের দিকে তাকিয়ে আছে পিট, হাত দুটো মুঠো করা, কিছুই দেখছে না। লরেনকে আমি উদ্ধার করব, বলল ও, গলার স্বর বরফের মত ঠাণ্ডা। ওর কোন ক্ষতি হলে ওদেরকে আমি ছাড়ব না।

.

তৃতীয় পর্ব

আজিমা দ্বীপ

অক্টোবর ১২, ১৯৯৩, বিলফিল্ড, পশ্চিম জার্মানি।

৩১.

কাঠের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে খেতের উপর নিয়ে ঢাল ও বনভূমির দিকে তাকাল অগাস্ট ক্লওসেন। গোটা উপত্যকা জুড়ে তার ফার্ম, উপত্যকটাকে ঘিরে রেখেছে আঁকাবাঁকা একটা পাহাড়ী নদী। কিছুদিন হলো নদীতে একটা বাঁধ দিয়েছে সে। কোটের বোতামগুলো লাগিয়ে গোলাবাড়ির দিকে এগোল, আজ তাকে ট্রাক্টর নিয়ে কাজে যেতে হবে।

শক্ত-সমর্থ ক্লওসেনের বয়স চুয়াত্তর হলেও ভোর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত একটানা পরিশ্রম করে সে। তার পরিবার পাঁচ পুরুষ ধরেই এই ফার্মের মালিক। দুই মেয়ে আছে তার, কোন ছেলে নেই, মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাবার পর স্বামী-স্ত্রী একা হয়ে গেছে। ফসল কাটার সময় কাজের লোক রাখতে হয়, বছরের বাকি সময়টা নিজেরা খাটে। গোলাবাড়ি থেকে ট্রাক্টর নিয়ে বেরিয়ে এল সে, মেঠো পথ ধরে এগোল দূর প্রান্তের একটা খেতের দিকে। খেতের ফসল কাটা হয়ে গেছে, এক কোণে ছোট একটা গর্ত আজ তাকে মাটি ফেলে ভরতে হবে। কাল বিকেলে ট্রাক্টরের সামনের অংশে একটা যান্ত্রিক কোদাল অর্থাৎ স্কুপ লাগিয়ে রেখেছে সে, ওটার সাহায্যে মাটি বয়ে এনে গর্তের ভেতর ফেলবে। যুদ্ধের সময়কার একটা কংক্রিট ব্যাংকারের পাশে উঁচু ঢিবি আছে, কাজেই মাটি পাওয়া কোন সমস্যা নয়।

ক্লওসেনের জমির একটা অংশ লুফটভাফ ফাইটার স্কোয়াড্রন-এর এয়ারফিল্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে যুদ্ধের সময়। যুদ্ধের সময় জার্মানি ছেড়ে পালিয়েছিল সে, ফিরে এসে দেখে তার খেতগুলোর ছড়িয়ে আছে পোড়া ও ভাঙাচোরা প্লেন, মোটরগাড়ি, জীপ ইত্যাদি। বেশিরভাগই বাতিল লোহা-লক্কড় হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছে সে।

মেঠো পথ ধরে দ্রুত এগোচ্ছে ট্রাক্টর। দুহপ্তা বৃষ্টি হয়নি, খটখট করছে মাটি। গর্তটার কাছে এসে ট্র্যাক্টর থামাল সে, নেমে এসে কিনারায় দাঁড়াল। কৌতুক বোধ করল রয়টার, কাল যেমন দেখেছিল আজ যেন তার চেয়ে একটু বেশি গভীর দেখাচ্ছে গর্তটাকে গর্তের নিচে, মাটির তলায় পানি থাকতে পারে, ভাবল সে। যদিও মাটিতে ভেজা কোন ভাব নেই।

ট্রাক্টরে আবার চডল কওসেন, কংক্রিট বাংকারের পাশে মাটির ঢিবির কাছে চলে এল। জায়গাটা গাছপালা দিয়ে ঢাকা, আশপাশের খেতে কেউ থাকলেও তাকে দেখতে পাচ্ছে না। স্কুপে মাটি ভরে গর্তের কিনারায় চলে এল সে। স্কুপের মাটি গর্তের মধ্যে ফেলতে যাবে, হঠাৎ লক্ষ করল ট্রাক্টরের সামনের অংশ নিচের দিকে ডেবে যাচ্ছে। প্রথম অবাক হলো কওসেন, তারপর আতঙ্কিত। ট্রাক্টরের সামনের চাকা মাটির তলায় সেঁধিয়ে যাচ্ছে।

কিনারা থেকে তলা পর্যন্ত ফাঁক হয়ে যাচ্ছে গর্তটা, সদ্য তৈরি বিশাল একটা হাঁ-র ভেতর ডাইভ দিচ্ছে ট্রাক্টর। আতঙ্কে, অবিশ্বাসে স্থির পাথর হয়ে গেল কওসেন। তাকে নিয়ে নিচের অন্ধকারে তলিয়ে গেল ট্রাক্টর। হুইলটা দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ধাতব মেঝেতে বসে পড়ল কওসেন। প্রায় বারো মিটার খসে পড়ল ট্রাক্টর,ছলাৎ করে আওয়াজ হলো। পাতালে জমে থাকা পানির মধ্যে পড়েছে সে। শুধু ট্রাক্টর নয়, তার সাথে ধুলোর মেঘ নেমে এল পানিতে, ঝাপসা হয়ে গেল চারদিক। পানিতে পড়েও খানিকদূর এগোল ট্রাক্টর, থামার পর দেখা গেল পিছনের উঁচু চাকাগুলো প্রায় পুরোটাই ডুবে গেছে পানিতে।

পতনের ঝাঁকি খেয়ে দম ফুরিয়ে গেছে মার্কের। পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করল সে। শিরদাঁড়ার হাড় ভেঙ্গে গেছে বলে সন্দেহ হলো তার। দুটো পাঁজরের দাঁড়াও ভেঙেছে, স্টিয়ারিং হুইলটা বুকের সাথে ধাক্কা খাওয়ায়। ধড়ফড় করছে বুক, ব্যথায় গোঁড়াচ্ছে। বুকের কাছে পানি উঠে আসছে দেখে আতঙ্কে কান্না পেল তার।

তবু ভাগ্য ভাল যে ট্রাক্টরটা উল্টে যায়নি বা কাত হয়ে পড়েনি। সেক্ষেত্রে চিড়ে-চেপটা হয়ে মারা যেত সে। মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল কওসেন, খাদের কিনারা এত খাড়া আর উঁচু যে একার চেষ্টায় ওপরে উঠার কোন প্রশ্নই উঠে না। চারপাশে চোখ বুলাল সে।

ট্রাক্টরটা লাইমস্টোন-এর প্রকাণ্ড এক গুহার ভেতর পড়েছে। গুহার একটা দিকে পানি আছে, অপর দিকটা ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠে গেছে চওড়া এক সুড়ঙ্গে। গুহার অপর দিকেও একটা সুড়ঙ্গ রয়েছে, তবে মুখের কাছটা পানিতে ডোবা। দুটো সুড়ঙ্গই ছয় মিটারের মত উঁচু। মসৃণ ও সমতল সিলিঙ দেখে বোঝা যায়। লাইমস্টোন কেটে টানেলগুলো তৈরি করা হয়েছে ভারী ইকুইপমেন্টের সাহায্যে।

দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করছে কওসেন, হামাগুড়ি দিয়ে ও সাঁতার কেটে ঢাল বেয়ে উঠে এল শুকনো সুড়ঙ্গের মুখে। টানেলের ভেতর আলো খুব কম, সব কিছু ঝাপসা লাগল চোখে, তবু পরিচিত আকৃতিগুলো দেখেই চিনতে পারল সে। টানেলের ভেতরটা চওড়া হয়ে গেছে, চারদিকে সারি সারি দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেকগুলো প্লেন। দুচারটে নয়, ডজন ডজন! চিনতে পারল কওসেন, লুফটভাফ এর প্রথম টার্বোজেট এয়ারক্রাফট এগুলো। প্রায় পঞ্চাশ বছর কোন যত্ন নেয়া হয়নি, অথচ দেখে মনে হচ্ছে সবগুলো উড়তে পারবে। চ্যাপ্টা হয়ে আছে টায়ারগুলো, অ্যালুমিনিয়ামে সামান্য মরচে ধরেছে, বোঝা যায় অনেকদিন কারও হাত পড়েনি। মিত্র বাহিনী পৌঁছানোর আগেই সম্ভবত এই গোপন এয়ার বাস খালি করা হয়, সীল করে দেয়া হয় প্রবেশপথগুলো। তারপর এটার অস্তিত্ব ভুলে যাওয়া হয়।

এতই বিস্মিত ও উত্তেজিত হয়ে পড়েছে কওসেন, প্রায় কোন ব্যথাই অনুভব করছে না। প্লেনগুলোর মাঝখান দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছে সে। ইতোমধ্যে চোখে সয়ে গেছে অন্ধকার। ফ্লাইট কোয়ার্টার ও মেইন্টেন্যান্স রিপেয়ার শেড-এ চলে এল সে। প্রতিটি জিনিস সাজানো অবস্থায় ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছে, দ্রুত পলায়নের কোন লক্ষণ চোখে পড়ে না।

এসব রয়েছে তার জমিনের নিচে, সেই এগুলোর মালিক। চিন্তাটা আরও উত্তেজিত করে তুলল কওসেনকে। সংগ্রাহকদের কাছে এসব প্লেন বেঁচতে পারলে কোটি কোটি টাকা পাওয়া যাবে।

ধীর পায়ে গুহার কিনারায় ফিরে এল কওসেন। শুধু ট্রাক্টরের স্টিয়ারিং হুইল আর ওপরের টায়ারগুলো ভেসে আছে পানির ওপর। মুখ তুলে আবার আকাশের দিকে তাকালো সে। না, একা তার পক্ষে ওঠা সম্ভব নয়।

ভয়টা দূর হয়ে গেছে, কারণ কওসেন জানে তার ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখলে বউ তাকে খুঁজতে আসবে। প্রতিবেশীদের সাহায্যে এই গুহা থেকে তাকে উদ্ধার করবে সে।

টানেলের ভেতর নিশ্চয়ই কোথাও একটা জেনারেটর আছে, ভাবল কওসেন। খুঁজে দেখতে হয়। ভাগ্য ভাল হলে ছোট একটা উনন জ্বালতে পারবে সে, তাতে করে আলোও পাওয়া যাবে। হাতঘড়ি দেখল কওসেন। ঘণ্টা চারেকের মধ্যে তাকে খুঁজে বের করে ফেলবে তার স্ত্রী, ধারণা করল সে। গুহার উল্টোদিকে তাকাল, ভাবল ওদিকের টানেলে কি আছে কে জানে।

.

৩২.

পাবলিক যদি জানত সরকার কত কি গোপন রাখে, ওয়াশিংটনে আগুন ধরিয়ে দিত। তারা, বললেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার। ভার্জিনিয়ার শহরতলি দিয়ে ছুটছে বাস, জানালা-দরজার কাঁচগুলো রঙিন ও বুলেটপ্রুফ। বিখ্যাত একটা বাস সার্ভিসের গাড়িতে রয়েছে ওরা, এটাকে নুমার মোবাইল কমান্ড সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

সন্দেহ নেই আমরা একটা কঠিন যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি, বললেন ডোনাল্ড কার্ন, টিমগুলোর ডেপুটি ডিরেক্টর অভ অপারেশনস।

এক ধরনের যুদ্ধ, সমর্থনের সুরে বলল পিট। লরেন ও সিনেটর ডিয়াজকে একই দিনে কিডন্যাপ করা হয়েছে, এর চেয়ে অবিশ্বাস্য ব্যাপার আর কি হতে পারে। তথ্যটা নির্ভুল তো, মি. ডোনাল্ড?

সিনেটর তার ফিশিং লজ থেকে আজ সকালে বোটে চড়েন। লেকের মাঝখানে আক্রান্ত হন তিনি। আশপাশে দুজন জেলে ছিল, তারা সব দেখেছে। একটা লঞ্চ এসে সিনেটরকে জোর করে তুলে নেয়। লোকগুলো জাপানি। দুঘন্টা পর এফবিআই একটা টেলিফোন পায়। কিডন্যাপিঙের কৃতিত্ব দাবি করেছ ব্লাড রেড ব্রাদারহুড।

কুখ্যাত টেরোরিস্ট অর্গানাইজেন, মন্তব্য করল পিট, তারপর জানতে চাইল, লিমুসিনকে যে হেলিকপ্টারটা নিয়ন্ত্রণ করছি, সেটার কোন খবর জানেন?

হাম্পটন বোড পর্যন্ত দেখা গেছে ওটাকে, তারপর আকাশেই বিস্ফোরিত হয়ে পড়ে গেছে পানিতে। এই মুহূর্তে নেভীর একটা স্যালভেজ টিম ডাইভ দিচ্ছে…

কোন লাশ পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। দ্বিতীয় গাড়িটা পাওয়া গেছে, যেটায় লরেন ছিল?

মাথা নাড়লেন ডোনাল্ড কার্ন। কংগ্রেস সদস্য মিস লরেনকে সম্ভবত তৃতীয় কোন গাড়িতে তুলে নেয় ওরা, দ্বিতীয় গাড়িটাকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে।

তল্লাশি করছে কারা?

এফবিআই।

আপনার ধারণা, গাড়ি-বোমার সাথে এই কিডন্যাপিঙের সম্পর্ক আছে? জানতে চাইল অ্যাল। অনুস্থর থেকে পিট, ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো ও অ্যালকে বাসে তুলে নিয়েছেন ওঁরা।

এমন হতে পারে, ওরা আমাদেরকে আগে না বাড়ার জন্যে সাবধান করে দিতে চাইছে, বললেন ডোনাল্ড কার্ন। কিংবা হয়তো চাইছে সিনেট সাব-কমিটি বাতিল হয়ে যাক। সাব-কমিটি তদন্ত করে দেখছে যুক্তরাষ্ট্রে জাপানি পুঁজি বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করা উচিত কিনা। মিস লরেন ও মি. ডিয়াজ, দুজনেই নিষিদ্ধ করার পক্ষে।

প্রেসিডেন্ট পড়েছেন উভয় সঙ্কটে, বললেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার। ওদের কিডন্যাপিং সম্পর্কে নিউজ মিডিয়াকে কিছু জানাতে নিষেধ করেছেন তিনি, তার ধারণা সবাই জেনে ফেললে কিডন্যাপাররা ওদেরকে মেরে ফেলতে পারে। আবার ভয় পাচ্ছেন, কংগ্রেস ও পাবলিক জেনে ফেললে কি কান্ডই না বেধে যায়।

আমার ধারণা, ব্লাড রেড ব্রাদারহুডের কাজ নয় এটা, বলল পিট। ওদের সংগঠন অতটা শক্তিশালী নয়।

তাহলে? জানতে চাইল অ্যাল।

ডোনাল্ড কার্ন বললেন, আমরা যতদূর জানি, জাপানের প্রধানমন্ত্রী বা তার মন্ত্রিসভার কোন সদস্য জড়িত নন। তাঁদের অগোচরে কি ঘটছে, তাঁরা বোধহয় কোন খবরই রাখেন না। এ ধরনের ঘটনা জাপানি রাজনীতিতে দুর্লভ নয়। আমরা একটা অত্যন্ত গোপন সংগঠনকে সন্দেহ করছি। একদল উগ্র জাতীয়বাদী শিল্পপতি ও আন্ডারওয়ার্ল্ড লিডার, জাপানের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। টিম হোন্ড যে তথ্য পাঠিয়েছে, তা থেকে মনে হয় হিদেকি সুমা নামে এক বাস্টার্ড এই গোপন সংগঠনের নেতা। গাড়ি-বোমার পিছনে যে সুমা আছে, এ ব্যাপারে মার্ভিন শওয়াল্টার নিশ্চিত।

হিদেকি সুমা, বললেন অ্যাডমিরাল। গত তিন দশক ধরে আড়াল থেকে জাপানের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে।

তার আগে নিয়ন্ত্রণ করত সুমার বাবা, বললেন ডোনাল্ড, তাকালেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসোর দিকে। মি. ম্যানকিউসো সুমার ব্যাপারে একজন এক্সপার্ট। হিদেকি পরিবারের একটা ফাইল তৈরি করেছেন তিনি।

একটা সিগারেট ধরিয়ে ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসে জিজ্ঞেস করলেন, ঠিক কি জানতে চান আপনারা?

সংগঠনটার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, বললেন কাঁপারফিল্ড।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি সৈন্যরা প্রথমে মাঞ্চুরিয়া ও কোরিয়ায় লুটপাট চালায়, তারপর একে একে চীন, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, মালয়, সিঙ্গাপুর, ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ ও ডেইলাইন থেকে সোনা, পাথর, মূর্তি ইত্যাদি সরিয়ে আনে। সব মিলিয়ে চলতি বাজারে ওগুলোর দাম হবে দুশো বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

মাথা নাড়লেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার। তা কি করে হয়।

শুধু সোনাই ওরা লুট করেছে সাত হাজার টনের ওপর।

সব তারা জাপানে নিয়ে যায়? জানতে চাইল অ্যাল।

উনিশশো তেতাল্লিশ সাল পর্যন্ত। তারপর ওদের জাহাজগুলোকে আমাদের সাবমেরিন বাধা দিলে স্রোতটা মন্থর হয়ে আসে। রেকর্ড দেখে অনুমান করা হয়, লুটের অর্ধেক মাল ফিলিপাইনে পাঠানো হয়, পরে টোকিওতে নিয়ে যাবার জন্যে। তবে যুদ্ধের শেষদিকে বিভিন্ন দ্বীপে গোপনে পুঁতে ফেলা হয়।

এসবের সাথে হিদেকি পরিবারের সম্পর্ক কি? জানতে চাইল পিট।

বলছি, সিগারেটে টান দিলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। চলতি শতাব্দীর প্রথম দিকে জাপানের আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করত ব্ল্যাক স্কাই নামে একটা ক্রিমিন্যাল অর্গানাইজেশন। পরে ব্ল্যাক স্কাই-এর দুজন এজেন্ট গ্রুপ থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজেদের সংগঠন গড়ে তোলে, নাম দেয় গোল্ড ড্রাগন। দুজনের একজন হলো কোরোরি ইয়োশিশু, অপরজন হিদেকি সুমার বাবা।

কোরোরি ইয়োশিশুর বাবা ছিল কাঠমিস্ত্রী। দশ বছর বয়েসে তার বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। ব্ল্যাক স্কাই-এর যোগ দেয় সে। অল্পদিনে নামও করে। উনিশশো সাতাশ সালে,তার বয়েস যখন আঠারো ব্ল্যাক স্কাই-এর লীডাররা তাকে আর্মিতে পাঠায়। রাজকীয় সেনাবাহিনী মারিয়া দখল করল, ইয়োশিশু ইতোমধ্যে ক্যাপটেন হয়েছে। মাঞ্চুরিয়ায় গোপনে হিরোইন ব্যবসা শুরু করল সে, তার এই অপারেশন থেকে ব্ল্যাক স্কাই কয়েক মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে।

এক মিনিট, বলল অ্যাল। আপনি বলতে চাইছেন জাপানি সেনাবাহিনী ড্রাগ বিজনেসের সাথে জড়িত ছিল?

ছিল না মানে! যুদ্ধের সময় যেখানে গেছে ওরা সেখানেই আফিম আর হিরোইনের ব্যবসা করেছে। শুধু তাই নয়, ওদের দখল করা প্রতিটি দেশে কালোবাজারীদের হাট বসে যেত। গুন্ডাপাণ্ডাদের ডেকে লটারির আয়োজন আর জুয়ার আসর বসাতে বলেছে…।

মাই গড।

হিদেকি সুমার বাবা আর কোরোরি ইয়োশিশু এক বয়েসী। প্রথমে রাজকীয় নৌ-বাহিনীতে ভর্তি হলেও, পালিয়ে গিয়ে নাম লেখায় ব্ল্যাক স্কাই-এর। গ্যাঙ লিডাররা তার রেকর্ড-পত্র মুছে ফেলার ব্যবস্থা করে, আবার নৌ-বাহিনীতে ভর্তি করে দেয় তাকে, এবার অফিসার হিসেবে। দুজনে একই সংগঠনের সদস্য, কাজেই একসাথে কাজ শুরু করল ওরা। একজন ড্রাগ ব্যবসা ধরল, অপরজন দায়িত্ব নিল লুট করা সোনা রাজকীয় জাহাজে তুলে দেয়ার।

লুট করা সোনার কত ভাগ জাপানে পৌঁছায়? জানতে চাইল পিট। চেয়ার, থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙল ও, বাসের সিলিঙে ঠেকে গেল আঙুলগুলো।

জাপানের ইমপেরিয়াল ওঅর ট্রেজারিতে খুব সামান্যই জমা পড়ে। বেশিরভাগই সাবমেরিনে করে টোকিওতে পাঠিয়ে দেয় ওরা, বিশেষ করে মূল্যবান পাথর ও প্রাটিনিয়াম। গ্রামের দিকে, এক বনভূমিতে, মাটির তলায় লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। আর সোনার বেশিরভাগটাই রয়ে যায় পুজোর-এর মূল দ্বীপে। কয়েকশো মিটার লম্বা টানেলে রাখা হয় ওগুলো। টানেলগুলো কাটানো হয় মিত্রবাহিনীর বন্দী সৈনিকদের দিয়ে। কাজ শেষ হলে, মেরে ফেলা হয় সবাইকে। আমি কোরিগিদর-এ একটা টানেল আবিষ্কার করি, লাশ পাই তিনশো বন্দীর। ওদেরকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলা হয়েছিল।

এসব ঘটনার কথা প্রকাশ করা হয়নি কেন? জানতে চাইল পিট।

কাঁধ ঝাঁকালেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। তা বলতে পারব না। শুধু জানি, চল্লিশ বছর পর দুএকটা বইতে কিছু কিছু আভাস দেয়া হয়েছে মাত্র।

নাৎসী অপরাধীদের এখনও ধরে ধরে বিচার করা হচ্ছে, বলল পিট। কিন্তু জাপানি আর ক্রিমিন্যালরা বেঁচে গেল কেন?

সে সময় যারা বিশ্বকে নেতৃত্বে দিয়েছেন, তারা দায়ী, বললেন অ্যাডমিয়াল। নাৎসীদের নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে ওঠে সবাই যে জাপানিদের কথা কারও মনেই পড়েনি।

গম্ভীর স্বরে অ্যাল জানতে চাইল, যুদ্ধের পর জাপান কি ও-সব উদ্ধার করেছে?

কিছু উদ্ধার করে জাপানি ঠিকাদার কোম্পানিগুলো। ডেইলাইনকে শিল্পসমৃদ্ধ দেখে পরিণত করবে, এই আশ্বাস দিয়ে আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে দেশটার ভেতর ঢোকার সুযোগ করে নেয়। কিছু উদ্ধার করেন ফার্দিনান্দ মার্কোস। কিছু মানে কয়েকশো টন। সবই তিনি দেশের বাইরে পাচার করেন। বিশ বছর পর বাকিটুকু উদ্ধার করে কোরোরি ইয়োশিশু আর হিদেকি পরিবার। তারপরও লুট করা সম্পদের প্রায় অর্ধেক রয়ে গেছে মাটির তলায়, তা আর কোনদিন খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

যুদ্ধের পর কি হলো ওদের? জানতে চাইল পিট।

ভারি চালাক, উনিশশো তেতাল্লিশ সালেই বুঝে ফেলে যুদ্ধে জাপান জিততে পারবে না। যুদ্ধে প্রাণ হারানোর বা জাপানি স্টাইলে দলবেঁধে আত্মহত্যার করার কোন ইচ্ছে ওদের ছিল না। একটা সাবমেরিন নিয়ে চিলিতে পালিয়ে যায় ওরা, সাথে ছিল বিপুল ধন-সম্পদ। ওখানে পাঁচ বছর কাটিয়ে ফিরে আসে জাপানে, গড়ে তোলে নিজেদের সংগঠন। পরবর্তী দশ বছরের আন্ডারগ্রাউন্ডে ও ব্যবসা-বাণিজ্যে অজেয় শক্তিতে পরিণত হয়।

হিদেকি সুমার বাবা লাঙ ক্যান্সারে মারা যায় উনিশশো তিয়াত্তর সালে। কোরোরি ইয়োশিশু আর হিদেকি সুমা বিশাল সংগঠনের দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেয়। ইয়োশিশু নিয়ন্ত্রণ করে জাপানের আন্ডারওয়ার্ল্ড, শিল্প ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে সুমা।

টিম হোভার রিপোর্ট অনুসারে, ওদেরকে জানালেন ডোনাল্ড কার্ন, ইয়োশিশু আর সুমা নিউক্লিয়ার উইপনস প্ল্যান্ট ও কেইটেন প্রজেক্ট সফল করার জন্যে নিজেদের সমস্ত শক্তি এক করেছে।

কেইটেন প্রজেক্ট? পুনরাবৃত্তি করল পিট।

গাড়ি-বোমা অপারেশন-এর কোড নেম।

কিন্তু জাপান সরকার পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তারের বিপক্ষে, বলল পিট। সরকারের সাহায্য ছাড়া ওরা নিউক্লিয়ার উইপনস ফ্যাসিলিটি তৈরি করেছে, এ কি বিশ্বাস করার মত একটা কথা?

রাজনীতিকরা জাপানকে চালায় না। আমলাদের পিছনে বসে প্রভাবশালী মহল সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। জাপান একটা লিকুইড মেটাল ফাস্ট রিডার রিয়্যাক্টর তৈরি করল, আমরা সবাই তা জানি। তবে খুব কম লোকই জানে যে, রিয়্যাক্টরটা পুটোনিয়ামও তৈরি করে, লিথিয়ামকে রূপান্তরিত করে ট্রিটিয়াম-এ। দুটো থার্মোনিউক্লিয়ারের জন্যে জরুরি উপাদান। আমার ধারণা, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ব্যাপারে জাপানকে প্রস্তুত অবস্থায় দেখতে পেলে খুশিই হবেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। তবে কেইটেন প্রজেক্ট সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না বলেই আমার ধারণা।

টিম হোন্ডা উইপনস প্ল্যান্ট-এর সন্ধান করতে পেরেছে? জানতে চাইল পিট।

পাতাল শহর এডোর ষাট বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে কোথাও, ওদের ধারণা।

কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না?

জিম হানামুরার ধারণা, এডো সিটির সাথে ফ্যাসিলিটির টানেল যোগাযোগ আছে। দারুণ একটা কাভার। সন্দেহ করার মত মাটির উপর কোন বিল্ডিং বা রোড নেই। এভোয় কয়েক হাজার লোক বসবাস করে, তাদের জন্যে নিয়মিত সাপ্লাই যাচ্ছে, বেরিয়ে আসছে আবর্জনা। নিউক্লিয়ার ইকুইপমেন্ট বা মেটেরিয়াল গোপনে আনা-নেয়া করা সম্ভব।

ডিটোনেশন কমান্ড সম্পর্কে কোন তথ্য? জিজ্ঞেস করল অ্যাল।

ড্রাগন সেন্টার?

ওরা ওটার ওই নাম দিয়েছে?

হ্যাঁ। হাসলেন ডোনাল্ড কার্ন। না, নিরেট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। রয় ওরশিয়ার শেষ রিপোর্টে বলা হয়েছে, সে একটা সূত্র পেয়েছে। একটা পেইন্টিং।

পেইন্টিং মানে? বিরক্ত মনে হলো অ্যালকে।

বাসের পিছনের একটা দরজা খুলে গেল, কমিউনিকেশন কমপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে এক লোক ডোনাল্ডের হাতে কয়েকটা কাগজ ধরিয়ে দিল।

মেসেজটা পড়ছেন, চেহারা কঠিন হয়ে উঠল ডোনাল্ডের। শেষ পাতাটা পড়ার সময় চেয়ারের হাতল ধরা হাতটা কাঁপতে শুরু করল। ওহ মাই গড।

তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়লেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার। কি ব্যাপার?

পালাউ থেকে মেল পেনারের স্ট্যাটাস রিপোর্ট। মার্ভিন শওয়াল্টারকে কিডন্যাপ করা হয়েছে, দূতাবাসের কাছাকাছি একটা রাস্তা থেকে।

বলে যান।

রয় ওরশিয়া মেল পেনারকে রিপোর্ট করেছে, সে নিশ্চিতভাবে জেনেছে মাটির দেড়শো মিটার নিচে রয়েছে ওদের উইপনস প্ল্যান্ট। মেইন অ্যাসেম্বলি এরিয়া এড়ো সিটির সাথে সংযুক্ত, চার কিলোমিটার উত্তরে। সংযোগ রক্ষা করছে একটা ইলেকট্রিক রেলওয়ে। অনেকগুলো টানেলের ভেতর দিয়ে ওই একই রেললাইন চলে গেছে অস্ত্রাগার, ওয়েস্ট ডিসপোজাল পিট ও এঞ্জিনিয়ারিং অফিসে।

আর কিছু? জানতে চাইলেন অ্যাডমিরাল।

জিম হানামুরা জানিয়েছে, একটা সূত্র ধরে ড্রাগন সেন্টারে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে সে। এইটুকুই।

রয় ওরশিয়া সম্পর্কে কোন খবর নেই? জানতে চাইল পিট।

একবার শুধু তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

তার মানে সে-ও গায়েব নাকি?

না, মেল পেনার সেরকম কিছু বলেনি। শুধু জানিয়েছে, ওরশিয়া চাইছে অনুকূল পরিবেশের জন্যে অপেক্ষা করতে।

আমরা পিছিয়ে পড়ছি, বলল পিট, অনেকটা আপনমনে। তিনজন কিডন্যাপ হয়ে গেল, উদ্ধারের কোন ব্যবস্থা করতে পারছি না। প্রতিপক্ষ আমাদের পরিচয় জানে, জানে আমরা কি খুঁজছি।

মি. রেইমন্ড জর্ডানকে খবর দিচ্ছি আমি, বললেন ডোনাল্ড কার্ন। তিনি প্রেসিডেন্টকে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাবেন।

জেয়ারে হেলান দিয়ে পিট বলল।হোয়াই ব্রাদার?

বুঝলাম না।

ভয় পাবার কোন কারণ দেখছি না।

কি বলছেন! গোটা দুনিয়া নিউক্লিয়ার ব্ল্যাকমেইলিঙের শিকার হতে যাচ্ছে। আশঙ্কা করছি মিস লরেন ও মি. গ্রাফটনের জন্যে মুক্তিপণ চাওয়া হবে। আপনি বুঝতে পারছে না, হিদেকি সুমা যে-কোন মুহূর্তে মাথায় হাতুড়ির বাড়ি মারবে?

না, মারবে না। অন্তত এখুনি নয়।

আপনি কিভাবে জানলেন? কঠিন সুরে প্রশ্ন করলেন ডোনাল্ড কার্ন।

কিছু একটা ঠেকিয়ে রেখেছে সুমাকে। বহু দেশে অসংখ্য গাড়ি-বোমা লুকিয়ে রেখেছে সে, ইচ্ছে করলেই দুএকটা ফাটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তা না ফাটিয়ে কি করছে সে? নোংরা কিডন্যাপের ভূমিকায় নেমেছে। তার মানে কি? সুমা এখনও প্রস্তুত নয়। তার আরও সময় দরকার।

মি. পিটের কথায় যুক্তি আছে, বললেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। এমন হতে পারে, ডিটোনেশন কমান্ড সম্পূর্ণ তৈরি হবার আগেই সুমার এজেন্টরা গাড়ি বোমাগুলোকে পজিশনে পাঠিয়ে দিয়েছে।

হতে পারে, বললেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার। ওটাকে অচল করার জন্যে নতুন একটা টিম পাঠানোর সময় হয়তো এখনও আমাদের হাতে আছে।

এই মুহূর্তে সব কিছু নির্ভর করছে হানামুরার ওপর, ইতস্তত করে বললেন ডোনাল্ড। ড্রাগন সেন্টারে পৌঁছাতে গিয়ে সে যদি সুমার সিকিউরিটি ফোর্সের হাতে ধরা পড়ে যায়, তাহলে সব ভেস্তে যাবে।

অ্যাডমিরাল বললেন, হানামুরা একা কতটুকু কি করতে পারবে জানি না। দ্বিতীয় একটা টিমের কথা সিরিয়াসলি ভাবছি আমি।

.

৩৩.

জিম হানামুরা আত্মহত্যা করল, নাকি খুন হলো, বলা কঠিন। সম্ভবত দুটোই সত্যি।

তার প্ল্যানটা ভালই ছিল। সুমার এক স্ট্রাকচারাল এঞ্জিনিয়ার, মারু নাগাওয়াকির সিকিউরিটি ক্লিয়ারান্স পাস জাল করে সে। শারীরিক কাঠামো ও চেহারা দুজনের প্রায় একই রকম। এদা সিটিতে ঢুকতে কোন অসুবিধে হয়নি, চেকপয়েন্টগুলো পেরিয়ে ডিজাইন ও কনস্ট্রাকশন ডিপার্টমেন্টে চলে আসে সে। গার্ডরা জানে, অফিস টাইমের পরও স্টাফরা কাজ করে রাত দুপুর পর্যন্ত। ইলেকট্রনিক আইডেনটিটি কমপিউটারে পাসটা ঢোকাল হানামুরা, সঙ্গে সঙ্গে বেল বেজে উঠল, সন্তুষ্ট হয়ে পথ ছেড়ে দিল গার্ডরা।

দেড় ঘণ্টার মধ্যে তিনটে অফিসে তল্লাসি চালাল হানামুরা। অবশেষে এক ড্রাফটসম্যান-এর দেরাজে খুঁজে পেল একটা গোপন স্থাপনার খসড়া স্কেচ। স্কেচগুলো নষ্ট করে ফেলা উচিত ছিল, সম্ভবত ড্রাফটসম্যান গুরুত্ব দেয়নি। মেশিনে ঢুকিয়ে কপি করল ওগুলো, আসলগুলো রেখে দিল আগের জায়গায়, কপিগুলো এনভেলাপে ভরে টেপ দিয়ে আটকালো হাঁটুর পিছনে।

পাৰ্গদের পিছনে রেখে বেরিয়ে এল হানামুরা, আনন্দে আত্মহারা। বিশাল এক কংক্রিটের মাঠে অপেক্ষা করছে সে, এলিভেটরে চড়ে পার্কিং লেভেলে উঠবে, ওখানে সে তার মুরমটো গাড়িটা রেখে এসেছে। এলিভেটরে চড়ল সে, তার সাথে চড়ল আরও প্রায় বিশজন। তার দুর্ভাগ্য, সামনের সারিতে দাঁড়িয়েছিল সে। এলিভেটর থামতেই বেরিয়ে এল, বেরিয়েই পড়ে গেল এক লোকের সামনে। লোকটা আর কেউ নয়, এঞ্জিনিয়ার মারু নাগাওয়াকি, তারই সিকিউরিটি ক্লিয়ারান্স পাস জাল করে ভেতরে ঢুকছিল সে। দুই ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে পাশের এলিভেচন থেকে বেরিয়ে এসেছে লোকটা। হানামুরার বুকে নিজের পাস আটকে আছে দেখে প্রথমে অবাক হয়ে গেল সে, তারপর চিৎকার করে গার্ডকে ডাকল। তাকে প্রচণ্ড এক ঘুসি মেরে গাড়ির দিকে ছুটল হানামুরা।

সশস্ত্র গার্ডরা টানেলের মুখে বাধা দিল তাকে। ব্যারিয়ার ভেঙে টানেলে ঢুকল হানামুরা, ক্ষতি হলেও চালু থাকল গাড়ি, তবে তিনটে গুলি খেল সে বাম হাত ও বাম কাঁধে। টানেলেই এক আমেরিকানের সাথে দেখা হয়ে গেল সে তার। এঞ্জিনে কিছু হয়েছে, নিজেই চেষ্টা করছে সারাবার। গাড়ি থামিয়ে এনভেলাপটায় কিছু লিখল হানামুরা, অনুরোধ করল মার্কিন দূতাবাসে পৌঁছে দিতে। লোকটাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আবার ছেড়ে দিল গাড়ি।

টানেল থেকে বেরিয়ে জঙ্গলের দিকে ছুটল হানামুরার গাড়ি। শহরের রাস্তায় থাকলে পুলিশের হাতে ধরা পড়তে হবে, জানে সে। মাইল দশেক এগোবার পর জ্ঞান হারাল সে, গাড়িটা ধাক্কা খেল এক বাড়ির পাচিলে। ঝাঁকি খেয়ে জ্ঞান ফিরল তার। গাড়ি থেকে নেমে বাড়িটার পিছনের উঠানে ঢুকল, এই সময় শুনতে পেল আশপাশের বাড়ি লোজন চারদিক থেকে ছুটে আসছে। কোনরকমে পাঁচিল টপকে পালাল হানামুরা। দশ মিনিট পর একটা নর্দমার শেষ মাথায়, মাঝারি একটা গর্তের ভেতর পড়ে গেল সে। প্রায় আধ ঘণ্টার মত কাদা-পানিতে ডুবে থাকল, ইতোমধ্যে বার তিনেক সামনের রাস্তা দিয়ে পুলিশের গাড়িগুলোকে ছুটোছুটি করতে দেখেছে। খানিক পর আবার এল ওরা, এবার গর্তের কিনারায় থামল। একটা গাড়ি থেকে নেমে এল এক লোক, হাতে চকচক করছে খাপমুক্ত তলোয়ার। হেডলাইটের আলোয় রয় ওরশিয়াকে দেখে হাসল সে। আরে, এ যে দেখছি আমাদের বিখ্যাত আর্ট ডিলার আশিকাগা ইনশু!

কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে জিম হানামুরা, রাগে থরথর করে কাঁপছে।

এডো সিটিতে কি পেলে তুমি? জানতে চাইল মুরো কামাতোরি।

জবাব না দিয়ে জিভের ধাক্কায় নকল দাঁতটা মাড়ি থেকে ছাড়াল হানামুরা। গো টু হেল, বলে পিলটা ভেঙে ফেলল সে। মুখের ভেতর তরল বিষ ছড়িয়ে পড়ল। টিস্যুর মাধ্যমে শরীরের ভেতর ঢুকে যাবে বিষ, ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে মারা যাবে সে। কি ঘটছে আন্দাজ করতে পারল কামাতোরি, তলোয়ারটা উঁচু করে নামিয়ে আনল হানামুরায় গলায়।

উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল মুরো কামাতোরি, শালা আমাকে ফাঁকি দিতে পারেনি।

তলোয়ারের নিখুঁত কোপে ধড় থেকে আলাদা হয়ে গেছে হানামুরার মুণ্ডু।

.

৩৪.

সেমি-ট্রেইলরে সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে চারটে ব্রাউন রঙের মুরমটো। জর্জ ফুরোকাওয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে ভাবল, এটাই শেষ চালান। বরাবরের মত সে তার স্পোর্টস কারের ফ্রন্ট সীটের তলায় রিলিজ ডকুমেন্টগুলো পেয়েছে, সাথে একটা চিরকুট, তাতে লেখা, প্রজেক্টে তার ভূমিকা এখানেই শেষ হলো। চিরকুটে একটা নির্দেশও দেয়া হয়েছে, গাড়িগুলোতে হোমিং ডিভাইস আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। ফেডারেল ইনভেস্টিগেটররা কোন কারণে গাড়িগুলোকে সন্দেহ করছে হয়তো। চিন্তাটা তার মনে ভয় ধরিয়ে দিল। হাতে একটা ইলেকট্রনিক ইউনিট, রেডিও সিগন্যাল ডিটেক্ট করতে পারে। ব্যস্তভাবে চারটি গাড়িই চেক করল সে, চোখ থাকল ডিজিটাল রিড়আউট-এর ওপর। কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই, কাজেই ড্রাইভার আর তার হেলপারকে ট্রেইলরের গাড়িগুলো তোলার নির্দেশ দিল সে, তারপর এগোল নিজের স্পোর্টস কারের দিকে।

কোন বিপদ ছাড়াই তার অ্যাসাইনমেন্ট শেষ হয়েছে, সেজন্যে খুশি জর্জ ফুরোকাওয়া। ভিনসেন্ট ল্যাবরেটরিজ-এর তার ভাইস-প্রেসিডেন্ট-এর পদটা কোন হুমকির মুখে পড়েনি। হিদেকি সুমা এই কাজের জন্যে তাকে যে মোটা টাকা দিয়েছে সেটা আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত এক জাপানি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করবে সে। গেটের কাছে এসে গাড়ি থামাল একবার, রিলিজ ডকুমেন্টগুলো গার্ডের হাতে ধরিয়ে দিল। একবারও পিছন ফিরে তাকাল না, রওনা হলো নিজের অফিসের উদ্দেশ্যে। গাড়িগুলোর গোপন গন্তব্য সম্পর্কে যে আগ্রহ ছিল মনে, সেটা মরে গেছে।

হেলিকপ্টারের সাইড ডোর সরিয়ে ফেলা হয়েছে, সমুদ্রের ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছে কন্ট্রোল কেবিনে। ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখলেও স্টেসি ফক্সের মুখের সামনে চুলগুলো উড়ছে। তার কোলের ওপর একটা ভিডিও ক্যামেরা সেটা তুলে টেলিফটো লেন্স অ্যাডজাস্ট করল। ডক ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে মুরমটো স্পোর্টস কারটা।

লাইসেন্স নম্বর দেখতে পেয়েছেন? জানতে চাইল সোনালিচুলো পাইলট।

হ্যাঁ, দারুণ হয়েছে ছবিটা। ধন্যবাদ।

আপনি বললে আরও একটু কাছাকাছি যেতে পারি আমি।

না, যথেষ্ট দূরে থাকুন! নির্দেশ দিল স্টেসি, ওরা কথা বলছে হেডসেট মাইক্রোফোনে। ওদের মনে সন্দেহ হয়েছে, তা না হলে হোমিং ডিভাইসের জন্যে গাড়িগুলো চেক করত না।

ভাগ্য ভাল যে ড. টিমোথি ওয়েদারহিল সে-সময় ট্রান্সমিট করছিলেন না।

বিল ম্যাককারির দিকে তাকালেই কৌতুক বোধ না করে উপায় নেই স্টেসির। কিনারা ভেঁড়া স্ট্রম্প শর্টস পরেছে সে, গায়ের টি-শার্টে মেক্সিকান বিয়ারের বিজ্ঞাপন, পায়ে জুতোর বদলে স্যান্ডেল। এই আজব চিড়িয়াটাকে আজই প্রথম দেখে স্টেসি, দেখে বিশ্বাস করতে পারেনি ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির একজন দক্ষ অপারেটর হতে পারে ছোকরা।

বাঁক নিয়ে হারবার ফ্রিওয়েতে উঠে যাচ্ছে ট্রেইলার, বলল স্টেসি। পিছিয়ে পড়ুন, তা না হলে ড্রাইভার দেখে ফেলবে আমাদের হেলিকপ্টার। আমরা ওয়েদারহিলের বীম অনুসরণ করব।

নির্দেশ পালন করল বিল ম্যাককারি।

এই সময় ড. টিমোথি ওয়েদারহিলের গলা ভেসে এল এয়ারফোনে। আকাশে আছ তো, টিম বুইক?

আপনার কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি, মি. ওয়েদারহিল, বলল বিল।

ট্রান্সমিট করা নিরাপদ?

মন্দ লোকেরা হোমিং ডিভাইস আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখেছে, বলল স্টেসি। তবে এখন ট্রান্সমিট করতে কোন অসুবিধে নেই।

ফলস প্যানেল সরিয়ে ব্যাক সিট ও পিছনের জানালার মাঝখানে, লাগেজ রাখার ঘেরা জায়গাটায় উঠে এলেন ড. টিমোথি ওয়েদারহিল। কাস্টমস এজেন্টদের একটা বিশেষ টিম মুরমটো গাড়িটার ভেতর তাঁকে লুকিয়ে পড়তে সাহায্য করে, ট্রেইলার নিয়ে জর্জ ফুরোকাওয়া পৌঁছানোর চার ঘণ্টা আগে। ফলস প্যানেলের নিচে কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়েছিলেন তিনি, ব্যথায় টন টন করছে সারা শরীর, দরদর করে ঘামছেন। ট্রেইলারের ভেতরটা অন্ধকার, দশ মিনিট বিশ্রাম নেয়ার পর পরনের ইউনিফর্ম থেকে একটা টর্চ বের করে জ্বাললেন। তিন নম্বর। মুরমটো থেকে নেমে প্রথমটার কাছে চলে এসে হুড খুললেন, পাউচ থেকে বের করলেন ছোট একটা রেডিয়েশন অ্যানালাইজার। গাড়ির এয়ারকন্ডিশনিং কমপ্রেসর-এর চারদিকে ঘোরালেন ওটা, রিডআউটে চোখ। হাতের উল্টোপিঠে রিডিং লিখলেন। তারপর ফেন্ডারের ওপর সাজিয়ে রাখলেন কমপ্যাক্ট-এর চারদিকে ঘোরালেন ওটা, রিডআউটে চোখ। হাতের উল্টোপিঠে রিডিং লিখলেন। তারপর ফেন্ডারের উপর সাজিয়ে রাখলেন কমপ্যাক্ট টুল-এর একটা সেট। কথা বললেন রেডিওতে। হ্যালো, বুইক টিম।

কাম ইন, সাড়া দিল স্টেসি।

অপারেশন শুরু করছি।

স্ট্যাডিং বাই।

পনেরো মিনিটের মধ্যে কমপ্ৰেসর কেস খুলে। বোমাটাকে অকেজো করলেন টিমোথি ওয়েদারহিল। এখনও আছ, টিম বুইক?

আছি, সাড়া দিল স্টেসি।

আমি কোথায়?

ওয়েস্ট কোভিনায়। পূর্ব দিকে যাচ্ছে ট্রেইলার।

একটার কাজ শেষ, বাকি আছে তিনটে।

গুড লাক।

এক ঘন্টা পর চার নম্বর অর্থাৎ শেষ গাড়িটার হুড বন্ধ করলেন টিমোথি ওয়েদারহিল। স্বস্তিতে নেতিয়ে পড়ল তার শরীর। সব কয়টা বোমা অকেজো করে দিয়েছেন তিনি। জাপান থেকে যতই সিগন্যাল পাঠানো হোক, কোনটাই ফাটবে না। রেডিওর সাহায্যে স্টেসির সাথে আবার যোগাযোগ করলেন তিনি। স্টেসি পরামর্শ দিল, ট্রেইলার থেকে নামার জন্যে পঁয়তাল্লিশ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে তাকে।

করার কিছু নেই, টিমোথি ওয়েদারহিলকে একঘেয়েমিতে পেয়ে বসল। গ্লাভ কমপার্টমেন্ট খুলে গাড়ির ওয়ারেন্টি পেপার ও মালিকের ম্যানুয়াল বের করলেন তিনি। ভেতরের আলো জ্বেলে ম্যানুয়ালের পাতা ওল্টালেন অলস ভঙ্গিতে। তার বিষয় মিউক্লিয়ারফিজিক্স হলেও, ইলেকট্রনিক্স-এও তার আগ্রহ আছে। মুরমটোর ইলেকট্রিক্যাল ডায়াগ্রাম দেখার ইচ্ছে হলো, কিভাবে ওয়্যারিং করা হয়েছে দেখবেন। কিন্তু ম্যানুয়ালের পাতায় ইলেকট্রনিক্যাল ওয়্যারিয়ের চিহ্ন মাত্র নেই। আছে ম্যাপ, আর কিছু নির্দেশ_নির্দিষ্ট পজিশনে কিভাবে নিয়ে যেতে হবে গাড়িটাকে, তারপর কিভাবে ডিটোনেশন করতে হবে।

ড. টিমোথি ওয়েদারহিল আতঙ্ক বোধ করলেন। জাপানের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যকে রক্ষা করার জন্যে গাড়ি-বোমাগুলোকে হুমকি হিসেবে ব্যবহার করা হবে, ব্যাপারটা শুধু তা-ই নয়। আসলেও ব্যবহার করা হবে ওগুলো।

.

৩৫.

শেষবার কবে এভাবে অনধিকার অনুপ্রবেশ করেছেন, মনে করতে পারলেন না ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির ডিরেক্টর রেইমন্ড জর্ডান। দশ বছর আগে ফিল্ড এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন, মনে থাকার কথাও নয়। হঠাৎ খেয়াল চেপেছে, আগের সেই দক্ষতা আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখবেন।

হ্যাঙ্গারের সিকিউরিটি অ্যালার্ম সিস্টেমের তারে ছোট্ট একটা কমপিউটার পোব ঢোকালেন তিনি, বোতাম টিপতেই কমবিনেশন নাম্বার চলে এল পোবে। কোডটা চিনতে পারল অ্যালার্ম বক্স, পরিবেশন করল একটা এলইডি ডিসপ্লেতে। এরপর বোতাম টিপে অ্যালার্ম সিস্টেম অফ করা পানির মত সহজ হয়ে গেল। দরজার তালা খুলে হ্যাঙ্গারের ভেতর ঢুকে পড়লেন তিনি।

হ্যাঙ্গারের এক প্রান্তে, স্টাজ-এর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে পিট, তার দিকে পিছন ফিরে। একটা হেডলাইট মেরামত করছে ও।

স্থির দাঁড়িয়ে থেকে ক্ল্যাসিক গাড়িগুলোর উপর চোখ বুলালেন রেইমন্ড জর্ডান। বিস্মিত ও মুগ্ধ হলেন তিনি। অ্যাডমিরাল স্যানডেকারের মুখে পিটের কালেকশন সম্পর্কে শুনেছেন বটে, তবে আশা করেননি এত সব দুর্লভ গাড়ি দেখতে পাবেন এখানে। নিঃশব্দ পায়ে প্রথম সারির গাড়িগুলোর পিছনে চলে এলেন তিনি, এগোলেন অ্যাপার্টমেন্টের দিক থেকে। এটা একটা পরীক্ষাই দেখা যাক দুহাত দুর থেকে হঠাৎ একজন আগন্তুককে দেখে কি প্রতিক্রিয়া হয় পিটের।

পিটের পিছনে, দুহাত দূরে দাঁড়িয়ে পড়লেন রেইমন্ড জর্ডান। স্টাজের গায়ে অনেক আঁচড়ের দাগ দেখা যাচ্ছে। ফেটে গেছে উইন্ডস্ক্রীনের কাঁচ, বাম দিকের হেডলাইট তারের মাথায় ঝুলছে।

সাধারণ একটা ট্রাউজার ও হাতে বোনা সোয়েটার পরে আছে পিট। ব্যাকব্রাশ করা চুল, তবে এলোমেলো হয়ে আছে। একটা ক্রোম রিমে হেডলাইটের লেন্স ক্রু দিয়ে আটকাচ্ছে ও।

কথা বলতে যাবে রেইমন্ড জর্ডান, তার আগে পিটই মুখ খুলল, আগের মতই পিছন ফিরে রয়েছে। গুড ইভনিং, মি. জর্ডান। আপনি আসায় আমি খুশি হয়েছি।

হতভম্ব হয়ে গেলেন রেইমন্ড জর্ডান। আগের মতই নির্লিপ্ত ও ব্যস্ত পিট, এখনও আগন্তুকের দিকে তাকায়নি।

আমার নক করা উচিত ছিল, বললেন রেইমন্ড জর্ডান।

কি দরকার। আপনি যে এসেছেন, আমি জানতাম।

অতীন্দ্রিয় কোন ব্যাপার, নাকি মাথার পিছনে দুটো চোখ আছে?

জানতে চাইলেন রেইমন্ড জর্ডান, সাবধানে পিটের দৃষ্টিপথে চলে আসছেন।

মুখ তুলে নিঃশব্দে হাসল পিট। পুরানো হেডলাইটের রিফ্লেক্টরটা তুলে সামান্য নাড়ল ও, রূপালি গায়ে জর্ডানের ছবি ফুটে উঠল।

হ্যাঙ্গারের ভেতর আপনার বেড়ানোটা দেখে ফেলেছি আমি। ঢোকার কৌশলটাও ছিল প্রফেশনালদের মত।

তার মানে ব্যাক-আপ ক্যামেরাটা আমার চোখে পড়েনি।

রাস্তার ওপারে। টেলিফোন পোলের মাথায় ছোট একটা বাক্স। ইনফ্রারেড। দরজার কাছে কেউ এলেই অস্পষ্ট অ্যালার্ম বাজে।

আপনার কালেকশন অদ্ভুত, কত বছর লেগেছে?

গত দশ বছরে গাড়ির সংখ্যা দ্বিগুণ করেছি আমি। হাতের কাজ শেষ করে সিধে হলো পিট। বলুন, কফি না অন্য কিছু?

কিছুই নয়। আপনাকে আমি ডিসটার্ব করলাম না তো?

উপরে আসুন, প্লীজ, বলে সিঁড়ির দিকে এগোল পিট। ডেপুটি ডিরেক্টরকে না পাঠিয়ে হেডম্যান স্বয়ং চলে এসেছেন দেখে নিজেকে আমি সম্মানিত মনে করছি।

পিটের পিছু পিছু সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় রেইমন্ড জর্ডান বললেন, মনে হলো কথাটা আমার নিজেরই আপনাকে জানানো উচিত। মিস লরেন ও মি. ডিয়াজকে দেশ থেকে বের করে নিয়ে গেছে ওরা।

ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল পিট, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল, হঠাৎ স্বস্তি ফুটে উঠল চেহারায়। লরেন বেঁচে আছে!

ওরা উন্মাদ একদল টেরেরিস্ট নয়, বললেন রেইমন্ড জর্ডান। অপহরণের জন্যে যে বিরাট আয়োজন করা হয়েছিল, তা থেকেই আমি বুঝে নিয়েছি ওদেরকে অত্যন্ত যত্ন করে রাখা হবে।

এত বাধা পেরিয়ে ওরা বেরিয়ে গেল কিভাবে?

নিউপোর্ট নিউজ, ভার্জিনিয়া এয়ারপোর্ট থেকে একটা প্রাইভেট জেটে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওদেরকে। জেটটার মালিক সুমার একটা আমেরিকান করপোরেশন। এক হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকার সবগুলো এয়ারপোর্টে খোঁজ নিতে হয় আমাদের, প্রতিটি প্লেনের রেজিস্ট্রেশন চেক করে দেখতে হয়। সুমার একটা প্লেন পাওয়া গেল বটে, স্যাটেলাইটের সাহায্যে আমরা সেটার ফ্লাইট পথ-ও আবিষ্কার করলাম, কিন্তু ততক্ষণে সেটা জাপানের উদ্দেশ্যে বেরিং সী-তে রয়েছে।

আপনাদের কোন একটা বিমান ঘাঁটি থেকে সামরিক প্লেন পাঠিয়ে বাধা দেয়া গেল না?

জাপানের এয়ার সেলফ-ডিফেন্স ফোর্স-এর এক স্কোয়াড্রন এফ এস এক্স ফাইটার জেট ওটাকে এসকর্ট করে নিয়ে যায়।

তারপর? সিঁড়ির মাথায় উঠে এসে জানতে চাইল পিট।

ওদেরকে আমরা হারিয়ে ফেললাম।

প্লেন ল্যান্ড করার পর?

হ্যাঁ, টোকিও ইন্টারন্যাশনালে। পিটের পিছু পিছু স্টাডিতে ঢুকে ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন রেইমন্ড জর্ডান।

কেন, জাপানে আপনাদের লোকজন কি করছিল? ভদ্রলোকের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে পিট।

মার্ভিন শওয়াল্টার ও জিম খুন হওয়ার পর…।

দুজনেই ওরা মারা গেছে?

টোকিও পুলিশ রয় জিমের লাশ পেয়েছে একটা নর্দমায়, গলা কাটা অবস্থায়। মার্ভিনের মাথা পাওয়া গেছে দূতাবাসের কাঁটাতারে আটকানো অবস্থায়, ধড়ের কোন চিহ্ন নেই। কয়েক ঘণ্টা আগে। আরও খারাপ খবর হলো, রয় ওরশিয়াকে স্লিপার বলে সন্দেহ করছিল। প্রথম থেকেই আমাদের সব তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছিল সে। ঈশ্বরই বলতে পারবে সুমা কতটুকু কি জানে। ক্ষতির পরিমাণ কোনদিনই হয়তো জানা যাবে না।

মার্ভিন শওয়াল্টার আর জিম হানামুরাকে এভাবে কেন খুন করা হলো? কে দায়ী?

প্রাচীন জাপানে এভাবে খুন করা হত। পুলিশের প্যাথলজিস্ট বলছে, ওদের মাথা কাটা হয়েছে সামুরাই তলোয়ার দিয়ে। সুমার ডান হাত ও প্রধান খুনী প্রাচীন মার্শাল আর্টের ভক্ত বলে শোনা যায়, কিন্তু প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে সে-ই ওদেরকে মেরেছে।

ধীরে ধীরে একটা চেয়ারে বসল পিট। জাপানে তাহলে কাজ করার মত কেউ থাকল না।

খুন হবার আগে মস্ত একটা উপকার করে গেছে হানামুরা। একটা সূত্র দিয়ে গেছে সে, ওটা ধরে ডিটোনেশন সেন্টারে হয়তো পৌঁছানো যাবে।

শিরদাঁড়া খাড়া হয়ে গেল পিটের। ডিটোনেশন সেন্টারের লোকেশন জানা গেছে? | সুমার কনস্ট্রাকশন ডিজাইনারের অফিসে ঢুকে পড়ে হানামুরা, একটা ইলেকট্রনিক কন্ট্রোল সেন্টারের খসড়া স্কেচ বের করে আনে। দেখে মনে হয় ওটা পাতালে, যেতে হয় টানেলের ভেতর দিয়ে।

কোথায়?

এক আমেরিকান টুরিস্টকে স্কেচ ভরা খামটা দেয় সে, দূতাবাসে পৌঁছে দিতে বলে। তাড়াহুড়ো করে খামের উপর যা লিখেছে, অর্থ উদ্ধার করা কঠিন।

কি লিখেছে?

লিখেছে, আজিমা দ্বীপে খোঁজ করুন।

সামান্য কাঁধ ঝাঁকাল পিট। তাহলে সমস্যাটা কি?

আজিমা বলে কোন দ্বীপের অস্তিত্ব নেই, হতাশ সুরে বললেন রেই ট্যাবট। চোখ ফিরিয়ে ট্রফি ভর্তি কাঁচের শো-কেসটার দিকে তাকালেন। আমেরিকান ফেনসিং ক্লাব-এর দুটো ট্রফি দেখে বিস্মিত হলেন তিনি।

আপনি ফেনসার নাকি?

সময় পেলে একটু চর্চা করি, বলল পিট। অস্তিত্ব নেই, এমন একটা দ্বীপের কথা কেন বলবে হানামুরা? জিজ্ঞেস করল ও। কন্ট্রোল সেন্টারটা ওখানেই, সম্ভবত এ-কথাই বলতে চেয়েছে সে।

প্রাচীন পেইন্টিং সম্পর্কে তার আগ্রহ ছিল। জাপানি আর্ট সম্পর্কে তার জ্ঞান আছে দেখেই সুমার অফিসে মাইক্রোফোন রেখে আসার প্ল্যানটা করা হয়। মাসাকি শিমজুর পেইন্টিং সংগ্রহ করে সুমা, এ আমি জানতাম। সেজন্যেই শিমজুর একটা পেইন্টিং নকল করে জিমকে দিয়ে পাঠানো হয়। দ্বীপের উপর আঁকা শিমজুর সব পেইন্টিংই সুমার কাছে আছে, নেই শুধু আজিমা। শুধু এই একটাই যোগাযোগ দেখতে পাচ্ছি আমি।

তাহলে আজিমার অস্তিত্ব না থেকে পারে না।

আমারও তাই বিশ্বাস, কিন্তু আজিমা নামে কোন দ্বীপ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রাচীন ও আধুনিক কোন চার্টেই নেই ওটা। এমন হতে পারে, নামটা আসলে আর্টিস্টের দেয়া, মাসাকি শিমজুর। ওই নামটাই ক্যাটালগে রাখা হয়েছে।

হানামুরার ছারপোকা থেকে কিছু পাওয়া গেল?

সুমা, তার কসাই মুরো কামাতেরি, বুড়ো কোরোরি ইয়োশিশু আর ধনকুবের ইচিরো সুবোই একসাথে বসে আলোচনা করছিল, অনেক তথ্য পাওয়া গেছে।

ইচিরো সুবোই, সিকিউরিটি ও এসপিওনাজ জগতের কিং বলা হয় তাকে, সেও হাত মিলিয়েছে সুমার সাথে? জানতে চাইল পিট।

গলায় গলায় ভাব দুজনের, বললেন রেইমন্ড জর্ডান। জাপানি রাজনীতিকদের গোপন করে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির জন্যে কিভাবে ফান্ড সংগ্রহ করা হয়েছে, আলোচনার সময় ব্যাখ্যা করছিল সে। সাংকেতিক নাম কেইটেন প্রজেক্ট সম্পর্কেও এই প্রথম জানতে পারলাম আমরা।

চেয়ারে নড়েচড়ে বসল পিট। আপনি আমাকে শুধু কয়েকটা তথ্য দিতে এসেছেন, মি. জর্ডান? বিশ্বাস হয় না।

আমি আমার অসহায়ত্বের কথা জানাতে এসেছি আপনাকে, মি. ডার্ক পিট। মিস লরেন ও মি. ডিয়াজকে উদ্ধার করব, আবার একই সাথে কেইটেন প্রজেক্ট ধ্বংস করব, এত লোকবল আমার নেই।

কোনটাকে ফার্স্ট প্রায়োরিটি দিচ্ছেন? জানতে চাইল পিট।

প্রেসিডেন্ট প্রথমে চান, কেইটেন প্রজেক্ট ধ্বংস করা হোক। তারপর ওদেরকে উদ্ধার করা যাবে।

তার মানে আবার রহস্যময় আজিমা দ্বীপে ফিরে আসছি আমরা, কর্কশ স্বরে বলল পিট। শিল্পীর শুধু এই ছবিটাই সুমার কাছে নেই, বলছেন?

হ্যাঁ, ওটার জন্যে সে পাগল।

কোন সূত্র আছে, কোথায় ওটা পাওয়া যেতে পারে?

আজিমা পেইন্টিং শেষবার দেখা গেছে বার্লিনের জাপানি দূতাবাসে, জার্মানির। পতনের ঠিক আগে। পুরানো ওএসএস রেকর্ড দেখা যায়, ইটালি থেকে যে-সব শিল্প লুট করেছিল নাৎসীরা, আজিমাকে সেগুলোর সাথে রাখা হয়, তারপর ট্রেনে করে পাঠিয়ে দেয়া হয় জার্মানির উত্তর-পশ্চিমে, রাশিয়ানদের ভয়ে। তারপর ওটা ইতিহাস থেকে গায়েব হয়ে গেছে।

আজিমা দ্বীপ পাওয়া যাচ্ছে না, ছবিটাও নিখোঁজ, বলল পিট। কাজেই সূত্রই কোন কাজে আসছে না। তবে আপনাদের স্পাই প্লেন আর স্যাটেলাইটের সাহায্যে সুমার গোপন আস্তানার খোঁজ পাওয়া সম্ভব। একটা নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট ছোটখাট কোন ব্যাপার নয়।

প্রধান দ্বীপ জাপানের চারটে হোনস, কাউউশু, হোক্কাইডু আর শিকোক। সবগুলোকে ঘিরে আছে প্রায় এক হাজার ছোটখাট দ্বীপ। নির্দিষ্ট দ্বীপটা খুঁজে বের করা সহজ কাজ নয়।

তীর থেকে দশ মাইল বা আরও বেশি দূরে, এ-ধরনের দ্বীপগুলোকে প্রথমেই বাদ দিয়ে বাকিগুলোর ওপর নজর রাখা হয়েছে। কিন্তু কোন সন্দেহজনক তৎপরতা বা কাঠামো চোখে পড়েনি। স্বাভাবিক, কারণ আমাদের ধারণা গোটা স্থাপনাই মাটির তলায়। আরও একটা কথা প্রায় সব কয়টা দ্বীপই ভলকানিক ব্লক-এ তৈরি, আমাদের সেনসর পেনিট্রেট করতে পারে না। আমি কি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছি?

পিট বলল, মাটি ও পাথর না তুলে টানেল তৈরি করা সম্ভব নয়।

জাপানিদের দ্বারা সম্ভব হয়েছে বলে মনে হয়। স্যাটেলাইট ফটো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, টানেল তৈরির জন্যে কোথাও মাটি বা পাথর কাটা হয়নি, এমন একটা রাস্তার চিহ্নও পাওয়া যায়নি যেটা কোন প্রবেশ পথের দিকে গেছে। এক সেকেন্ড চুপ করে থেকে খুক করে কাশলেন রেইমন্ড জর্ডান। কাজেই, চারদিকে অন্ধকার দেখছি আমি।

আপনি আমার কাছ থেকে খানিকটা আলো পাবার আশা নিয়ে এসেছেন? জানতে চাইল পিট।

রেইমন্ড জর্ডান হাসলেন না। শুধু বললেন, আপনি বুদ্ধিমান মানুষ।

আপনি চান জাপানে যাই আমি, দ্বীপগুলোয় ঘুরঘুর করি?

না, বললেন রেইমন্ড জর্ডান। আপনাকে আমি জার্মানিতে যাবার অনুরোধ করছি। একটা লুফটফ বাংকারে ডাইভ দেয়ার জন্যে।

.

৩৬.

ডাইভ দেয়ার পর স্রেফ গায়েব হয়ে গেছে ওরা।

মাটিতে একটা হাঁটুগেড়ে পুকুরের কালো পানির দিকে তাকাল পিট।

আধ ডোবা ট্রাক্টরটা ছাড়া আর কিছু দেখতে পেল না।

ওদেসেফটি লাইন ছিঁড়ে গেছে, আবার বলল অফিসার। জার্মান ন্যাভাল ডাইভ টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছে সে, একটা নাইলন লাইন উঁচু করে দেখাল পিটকে। দেখে মনে হলো, ধারালো ক্ষুর দিয়ে কাটা হয়েছে ওটা। কিভাবে ছিঁড়ল? আমরা জানি না!

কমিউনিকেশন লাইনও? জানতে চাইল পিট। ছোট একটা নুড়ি পাথর কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিল ও, ছলকে ওঠা পানি ও খুদে ঢেউগুলো দেখছে।

লিড ডাইভারের সাথে ফোন ছিল, সেটাও ছিঁড়ে গেছে। প্রথমে দুজন লোকের একটা টিম পুকুরটায় নামে। একটু পরই একটা আন্ডারওয়াটার টানেল পায় ওরা, পশ্চিম দিকে চলে গেছে। সাঁতরে নব্বই মিটারের মত এগোয় তারা, তারপর রিপোর্ট করে ছোট একটা চেম্বারের সামনে শেষ হয়েছে টানেল, দরজাটা স্টীলের। এর খানিক পর ফোন লাইন আর সেফটি লাইন ঢিলে হয়ে গেল। কি হয়েছে দেখার জন্যে আরেকটা টিম পাঠালাম আমি। প্রথমটার মত এটাও গায়েব হয়ে গেল।

মাথা ঘুরিয়ে জার্মান নেভির ডাইভ টিমের দিকে তাকাল পিট। বন্ধুদের হারিয়ে শোকে কাতর সবাই। পোর্টেবল কমান্ড পোস্ট-এর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। ফোল্ডিং চেয়ারে বসে রয়েছে পুলিশ বিভাগের আন্ডারওয়াটার রেসকিউ ডাইভাররা। ইউনিফর্ম ছাড়াও তিনজন লোককে দেখা গেল, ওরা সরকারী অফিসার, ওদের সাথেই এখানে পৌঁছেছে পিট ও নেভির দল। শেষ লোকটা কখন নেমেছে? জানতে চাইল ও।

আপানারা পৌঁছানোর চার ঘণ্টা আগে, ন্যাভাল টিমের লীডার জবাব দিল। লেফটেন্যান্ট হেলমুট রেইনহার্ট বলে নিজের পরিচয় দিয়েছে সে। আমার বাকি লোকেরা নিচে নামার জন্যে অস্থির হয়ে আছে, অনেক কষ্টে ঠেকিয়ে রেখেছি ওদের। কি ঘটছে ওখানে না জেনে আর কাউকে পাঠাতে পারি না। কিন্তু ওই ব্যাটা হাঁদারাম পুলিশের লোকগুলো নিজেদেরকে অমর বলে মনে করে। আমার কথা শুনবে না, নিজেদের একটা টিম পাঠাবার প্ল্যান করছে।

কোন কোন লোক জন্মই নেয় আত্মহত্যার করার জন্যে, বলল অ্যাল। এই যেমন আমি।

জ্বী? হাঁ করে তাকিয়ে থাকল লেফটেন্যান্ট।

ওর কথায় কান দেবেন না, বলল পিট। মাঝে মধ্যে মতিভ্রম ঘটে ওর। পুকুরের কিনারা থেকে সরে এল পিট, ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, বুবি-ট্র্যাপ।

মাথা ঝাঁকালেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। আমার তাই ধারণা। ফিলিপাইনের ট্রেজার টানেলের মুখে বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল, মাটি খুঁড়তে শুরু করলেই ফেটে যাবে। পার্থক্য হলো, আবার ফিরে গিয়ে গুপ্তধন উদ্ধার করার প্ল্যান ছিল জাপানিদের, আর নাৎসীদের বুবি-স্ট্র্যাপ মানে হলো সার্চ টিমের সাথে গুপ্তধন ধ্বংস করা।

আমার লোকজন যেভাবেই মারা যাক, অন্তত বোমায় মারা যায়নি, বলল লেফটেন্যান্ট রেইনহার্ট।

কি করা যায় ফ্রেডি ম্যানকিউসের সাথে পরামর্শ করছে পিট, দুটো দলের মধ্যে তর্কযুদ্ধ বেধে গেল। পুলিশের ডাইভাররা পুকুরে নামবে, নেভির লোকেরা বাধা দিচ্ছে।

ইতোমধ্যে দুপক্ষই জেনেছে, জার্মানির শিল্প ও সংস্কৃতি মন্ত্রীর ব্যক্তিগত আমন্ত্রণে ডার্ক পিটের নেতৃত্বে নুমার এই বিশেষ দলটির আগমন ঘটেছে। ওদের আগমনের কারণটাও ব্যাখ্যা করা হয়েছে সবিস্তারে।

যুদ্ধের পরপর বহু নাৎসী অফিসারকে ইন্টারোগেট করা হয়, তার রেকর্ড বার্লিন আর্কাইভ ও যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অভ কংগ্রেসে সংরক্ষিত আছে। সে-সব রেকর্ড থেকে জানা যায়, পাতালের একটা গোপন এয়ারফিল্ডে আঠারো হাজার মূল্যবান শিল্পকর্ম লুকানো আছে। আলোচ্য পুকুরটি সেই গোপন এয়ারফিল্ডের প্রবেশপথ হলেও হতে পারে, পানির তলায় গোপন টানেল থাকা সম্ভব।

দুপক্ষের ঝগড়া থামাবার জন্যে একটা আপোস প্রস্তাব দিল পিট। লেফটেন্যান্ট হেলমুট বলল, শুনতে আপত্তি নেই।

সাতজনের একটা টিম গঠন করব আমরা, বলল পিট। আমরা থাকব তিনজন। কারণ, মি, ম্যানকিউসো একজন মাইনিং এঞ্জিনিয়ার, টানেল কনস্ট্রাকশন–এর এক্সপার্ট। আমি আর মি. অ্যাল আন্ডারওয়াটার স্যালভেজ-এর অভিজ্ঞ। দুজন থাকবেন লেফটেন্যান্ট রেইনহার্ট-এর লোক, বোমা বা বিস্ফোরক অকেজো করার অভিজ্ঞতা আছে তাদের। বাকি দুজন থাকবেন পুলিশের লোক, রেসকিউ ডাইভার ও মেডিকেল ব্যাকআপ হিসেবে।

সঙ্গত প্রস্তাব, কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। লেফটেন্যান্ট রেইনহার্ট ইতস্তত না করে রাজি হয়ে গেল। পরিষদের একজন অফিসার জানতে চাইল, কে আগে নামবে?

আমি, ইতস্তত না করে বলল পিট।

উপস্থিত সবাই শ্রদ্ধা মেশানো নতুন দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে।

এয়ার ট্যাঙ্কের সাথে জোড়া লাগানো মাইক্রোইলেকট্রনিক কমপিউটারে সময় বেঁধে নিল পিট, তারপর শেষ বারের মত চেক করল রেগুলেটর ও বয়অ্যানসি কমপেনসেটর। কৃষক কওসেনের খেত থেকে মই বেয়ে নিচে নামার পর এবার নিয়ে চারবার কালো পানির দিকে তাকাল ও। না, পানিতে নামতে ভয় পাচ্ছে না। ভাবছে, অর্ধেক দুনিয়া পাড়ি দিয়ে এসে, এত ঝুঁকি নিয়ে শেষ পর্যন্ত কোন লাভ হবে কিনা। আঠারা হাজার শিল্পকর্ম, তার মধ্যে মাসাকি শিমজুর আঁকা আজিমা দ্বীপ সত্যি কি আছে?

আপনার কি মনে হয়, পানির তলায় কি ঘটছে? জিজ্ঞেস করলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো।

ধাঁধার অর্ধেক সমাধান করতে পেরেছি বলে মনে হয়, বলল পিট। কিন্তু লাইন কাটছে কিভাবে? এটা একটা রহস্যই বটে।

আত্মহত্যা যখন করতেই হবে, দেরি কিসের? জানতে চাইল অ্যাল।

লেফটেন্যান্ট রেইনহার্টের দিকে তাকাল পিট। রেডি, জেন্টেলমেন? সবাই যে যার সামনের লোকের দুমিটারের মধ্যে থাকতে চেষ্টা করবেন, প্লীজ। আমার টিম আপনাদের সাথে আকুসটিকস স্পীকারের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখবে।

পিটের বক্তব্য জার্মান ভাষায় অনুবাদ করল লেফটেন্যান্ট, তারপর সামরিক কায়দার স্যালুট করল পিটকে, বলল, আফটার ইউ, স্যার।

আমি মাঝখানে থাকব, বলল পিট। মি. ম্যানকিউসো দুমিটার পিছনে, আমার বাম দিকে। অ্যাল, আমার ডান দিকে। পাঁচিল থেকে অস্বাভাবিক কোন মেকানিজম বেরিয়ে এসেছে কিনা, নজর রাখবে।

ডাইভ লাইট অন করল পিট, সেফটি লাইন ঠিকমত আটকানো আছে কিনা দেখে নিল টান দিয়ে, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে।

ঠাণ্ডা পানি। কমপিউটারের ডিজিটাল রিডআউট-এর দিকে তাকাল পিট। পানির তাপমাত্রা ১৪ সেলসিয়াস বা ৫৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট। কংক্রিটের মেঝেতে কাদা জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে। সতর্ক থাকল পিট, জমে থাকা কাদায় যেন ফিনের বারি না লাগে। পানি ঘোলা হয়ে গেলে পিছনের লোকজন সামনের দৃশ্য দেখতে পাবে না।

ডাইভ লাইট উপর দিকে তাক করল পিট, বাংকারের সিলিঙের দিকে তাকাল। নিচের দিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে ওটা, ক্রমশ পুরোপুরি ডুবে গেছে, সরু হতে হতে পরিণত হয়েছে একটা টানেলে। সাবধান হওয়া সত্ত্বেও ঘোলা হয়ে গেল পানি, তিন মিটারের ওদিকে দৃষ্টি চলে। দাঁড়াল পিট, সঙ্গীদের আরও কাছাকাছি থাকতে বলল। তারপর আবার এগোল।

আরও বিশ মিটার এগিয়ে আবার থামল পিট, শরীর মুচড়ে ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো আর অ্যালের খোঁজে পিছন দিকে তাকাল। ম্লান আভার মত দেখা গেল ওদের লাইট। কমপিউটার চেক করল ও। প্রেমার রিডআউট-এ দেখা গেল মাত্র ছয়মিটার গভীরে রয়েছে ও।

আরও খানিক এগোবার পর আন্ডারওয়াটার টানেল সরু হতে শুরু করল, একই সাথে উঁচু হয়ে যাচ্ছে মেঝেটা। সাবধানে এগোল পিট, ঘোলা পানিতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকায় টান পড়ছে চোখের চারপাশের শ্রেণীতে। খালি হাতটা মাথার ওপর লম্বা করল, পানির ওপর উঠে যাওয়ায় বাতাস লাগল আঙুলে। চিৎ হলো ও আলোটা তাক করল উপর দিকে। পাতালের আজব এক প্রাণীর মত পানি উপর ছোট একটা চেম্বারে উঠে মাস্ক ও রেগুলেটারসহ রাবার হেলমেট পরা পিটের মাথাটা। ফিন পরা পা দুটো হালকাভাবে নাড়ল পিট, মৃদু ধাক্কা খেল কংক্রিটের একটা সিঁড়িতে। হামাগুড়ি দিয়ে সমতল একটা মেঝেতে উঠে এল।

যা দেখবে বলে ভয় করেছিল, অন্তত এখুনি সেরকম কিছু চোখে পড়ল না। জার্মান নেভি টিমের লাশগুলো কোথাও নেই। কংক্রিটের মেঝেতে শ্যাওলা জমেছে, শ্যাওলার ওপর তাদের ফিনের দাগ দেখা গেল। কিন্তু লোকগুলোর কোন চিহ্ন নেই।

চেম্বারের দেয়ালগুলো সাবধানে পরীক্ষা করল পিট। বিপজ্জনক কিছু পেল না। দূর প্রান্তে, ডাইভ লাইটের আলোয় দেখা গেল একটা মরচে রঙা ধাতব দরজা। ফিন পরে থাকায় আড়ষ্ট ভঙ্গিতে হাঁটছে। দরজার গায়ে হেলান দিল। কব্জাগুলো সহজেই সচল হলো, ভেতর দিকে খুলে যাচ্ছে কবাট দুটো। কাধ সরিয়ে নিতেই আবার দ্রুত বন্ধ হয়ে গেল, প্রীঙের চাপে।

হ্যালো, কি পেলাম এখানে আমরা? আকুসটিকস স্পীকার থেকে ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসোর কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

দরজার ওদিকে কি আছে বলতে পারলে তিন দিনের বেতন পুরস্কার পাবেন, বলল অ্যাল।

পায়ের ফিন খুলে দরজাটা আবার খানিকটা খুলল পিট, নিচের চৌকাঠ পরীক্ষা করল। ধাতব চৌকাঠ ধারাল ছুরির মত, মরচে ধরে গেছে। ফোন আর সেফটি লাইন কেন ছিঁড়েছে, তার ব্যাখ্যা পাওয়া গেল।

মাথা ঝাঁকাল অ্যাল। ডাইভাররা ভেতরে ঢোকার পর স্ত্রীঙের টানে আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যায় দরজা, ধারাল চৌকাঠ ও কবাটের মধ্যে পড়ে ছিঁড়ে গেছে।

পিটের দিকে তাকালেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। আপনি তখন বলছিলেন, ধাঁধার অর্ধেক সমাধান করে ফেলেছেন।

হ্যাঁ, বলছিল। জবাব দাও, সবজান্তা। নেভির ডাইভাররা মরল কিভাবে? নাকি তারা মরেনি?

গ্যাস, বলল পিট। পয়জন গ্যাস, দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢোকার সঙ্গে, সঙ্গে আক্রান্ত হয় ওরা।

পানি থেকে উঠে এল টিমের বাকি সদস্যরাও।

মি. ম্যানকিউসো, বলল পিট, আপনার কাজ, কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেবেন না। শুধু আমি আর অ্যাল ঢুকব। যাই ঘটুক, লক্ষ রাখবেন সবাই যেন শুধু ট্যাংকের বাতাসে শ্বাস নেয়। কোন অবস্থাতেই রেগুলেটর ভোলা চলবে না।

মাথা ঝাঁকিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো।

পিটের মত অ্যালও তার পায়ের ফিন খুলে ফেলল। কোন কথা হলো না। দরজাটা ঠেলে অর্ধেকটার মত খুলল পিট, এমন হালকা পায়ে ভেতরে ঢুকল যেন রশির উপর দিয়ে হাঁটছে। চেম্বারের বাতাস শুকনো, হিউমিডিটি নেই বললেই চলে। ভেতরে ঢুকে থামল পিট, আলো ফেলল চারদিকে, সাবধানে খুঁজছে কিছু। সরু তার থাকতে পারে, পায়ে বাধলে হোঁচট খেতে হবে। থাকতে পারে কেবল, চলে গেছে এক্সপ্লোসিভ ডিটোনেটারে বা পয়ঃজন গ্যাস কন্টেইনারে। ওর প্রায় পায়ের সামনেই পড়ে রয়েছে ধূসর রঙের একটা সরু ফিশ লাইন, ছিঁড়ে দুটুকরো হয়ে গেছে। অস্পষ্ট আলোয় কোন রকমে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

এক প্রস্থ লাইনকে অনুসরণ করল আলোটা। ওটার গায়ে লেখা রয়েছে ফসজীন। ভাগ্যকে মনে মনে ধন্যবাদ দিল পিট। ফসজীন বিপজ্জনক, তবে শুধু ফুসফুসে প্রবেশ করলে।

তোমার কথাই ঠিক, বলল অ্যাল। গ্যাসই।

আমাদের মত সাবধান হলে নেভির লোকগুলো মরত না।

আরও চারটে পয়ঃজন গ্যাস বুবি ট্র্যাপে পেল পিট, দুটো ক্যানিস্টারের মুখ খোলা। ঠিকমতই কাজ করেছে গ্যাস। কয়েক ফুট ব্যবধানে পড়ে রয়েছে কুণ্ডলী পাকানো নেভি ডাইভারদের লাশগুলো। সবাই তারা যার যার এয়ার টাংক ও ব্রিদিং রেগুলেটর খুলে ফেলেছিল। কারও পালস দেখতে গিয়ে সময় নষ্ট করল না পিট, মুখের নীলচে রঙ আর দৃষ্টিহীন বিস্ফারিত চোখই বলে দিচ্ছে মারা গেছে তারা।

লম্বা একটা গ্যালারিতে আলো ফেলল পিট, পরমুহূর্তে স্থির হয়ে গেল। ওর চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক উদ্ভিন্ন যৌবনা তরুণী, মাথাটা একদিকে সামান্য কাত করে তাকিয়ে আছে, দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা শ্বাসরুদ্ধকর। তুলনাহীন সৌন্দর্যের আধার ওই মুখ, ঠোঁটে মিষ্টি হাসি লেগে রয়েছে।

মেয়েটি একা নয়। তার পাশে ও পিছনে আরও কয়েকটি নারীদের দেখা গেল, তাদের নিস্পলক দৃষ্টি যেন সরাসরি পিটের ওপরই নিবদ্ধ। সবাই ওরা নগ্ন, আবরণ বলতে শুধু প্রায় হাঁটু পর্যন্ত লম্বা বেণী করা চুল।

মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে, ঘোষণা করল অ্যাল। সুন্দরীদের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।

উত্তেজিত হয়ো না, সাবধান করল পিট। রঙ করা মূর্তি ওগুলো। প্রমাণ আকৃতির নারীমূর্তিগুলোর মাঝখানে হাঁটাহাঁটি করছে ও। তারপর মাথার ওপর ভাইভ আলোটা তাক করল। সোনার চকচকে একটা সাগর দেখতে পেল ও। গিলটি করা ছবির ফ্রেম ওগুলো। যতদূর আলো পৌচেছে, তারপর আরও অনেক দূর পর্যন্ত, সারির পর সারি শুধু র‍্যাক আর র‍্যাক, প্রতিটি র‍্যাকে অসংখ্য দামী পেইন্টিং, মূর্তি, ভাস্কর্য শিল্প, ধর্মীয় নিদর্শন, দুপ্রাপ্য বই, প্রাচীন ফার্নিচার, অ্যার্কিওলজিক্যাল আন্টিকস ইত্যাদি।

আমার মনে হয়, বিড়বিড় করল পিট। এইমাত্র জাদুর কাঠি আবিষ্কার করেছি আমরা।

.

৩৭.

দক্ষতা জার্মানদের চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্য। চার ঘণ্টার মধ্যে ডিকনটামিনেশন এক্সপার্টরা পৌঁছে গেল, দূষিত বাতাস পাম্প করে ভরে ফেলল একটা কেমিক্যাল ট্যাংক ট্রাকে। সাফ-সুতরোর কাজ চলছে, রেইনহার্টের লোকজন ফসজিন রিলিজ মেকানিজম ডিঅ্যাকটিভেট করে ক্যানিস্টারগুলো ডিকনটামিনেশন ক্রুদের হাতে তুলে দিল। সবশেষে লাশগুলো তোলা হলো অ্যাম্বুলেন্সে।

পাতালের পানিও পাম্প করে কাছাকাছি একটা নদীতে ফেলার কাজ শুরু হয়ে গেছে। শ্রমিকরা মাটি কাটছে, বাংকারে নামার আসল পথটা উন্মুক্ত করার জন্যে, যুদ্ধের পরপরই ওটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। পুরো সময়টা কৃষক কওসেনের বাড়িতে ঘুমিয়ে কাটাল অ্যাল। মিসেস কওসেন নুমার পুরো টিমটাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে ভাল করে খাইয়ে দিল।

বিখ্যাত কয়েকজন রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তার একটা দল, নামকরা শিল্পী বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক ও টিভি ক্রুরা। মন্ত্রী মহোদয় নির্দেশ দিলেন, সব কিছু ভাল করে সার্ভে না হওয়া পর্যন্ত নিউজ মিডিয়াকে কোন তথ্য দেয়া যাবে না।

ধাতব দরজার কাছ থেকে শুরু, তারপর গ্যালারিটা লম্বা প্রায় এক কিলোমিটার। টানেলে পানি থাকলেও, দরজাটা ছিল এয়ার টাইট, গ্যালারির ভেতর জলীয় বাষ্প ঢোকেনি, ফলে প্রতিটি শিল্পকর্ম অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে। জার্মান বিশেষজ্ঞরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একটা ল্যাবরেটরি ও একটা ওয়ার্কশপ খাড়া করে ফেলল। রেকর্ড করার জন্যে ফেলা হলো আলাদা তাঁবু।

জার্মান অফিশিয়ালের সঙ্গে আলাপ করল পিট। বার্লিনের জাপানি দূতাবাস থেকে যে শিল্পকর্ম সরানো হয়েছিল, আমরা শুধু সেগুলোর ব্যাপারে আগ্রহী, তাঁকে জানাল ও।

আপনার ধারণা ওগুলো এখানে আছে?

জাপানে পাঠানোর সময় ছিল না, ব্যাখ্যা করলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। রাশিয়ানরা শহরটাকে ঘিরে রেখেছিল। অ্যামব্যাসডর বাড়িটায় তালা দিয়ে স্টাফদের নিয়ে কোনরকমে জান বাঁচিয়ে পালান সুইজারল্যান্ডে। রেকর্ড বলছে, দূতাবাসের সমস্ত শিল্পকর্ম নাৎসীদের হাতে তুলে দেয়া হয় নিরাপদে সংরক্ষণ করার জন্যে। তারা সেগুলোর একটা এয়ারফিল্ডে লুকিয়ে রাখে।

কিন্তু আমেরিকান সরকার জাপানি শিল্প সম্পর্কে এত আগ্রহী কেন?

দুঃখিত, বলল পিট। এই কারণটা বলা যাবে না। তবে এটুকু আশ্বাস দিতে পারি, জার্মান সরকারের কোন ক্ষতি আমরা করব না।

আমি জাপানিদের কথা ভাবছি। ওরা তাদের জিনিস ফেরত চাইবে।

আমরা কোন জিনিস নিচ্ছি না, শুধু কয়েকটার ফটো তুলব। তবে যদি দুএকটা খুব বেশি পছন্দ হয়ে যায়, আপনার কাছ থেকে চাইলে আপনি কি আর

এক সেকেন্ড চিন্তা করলেন অফিসার। চ্যান্সেলর স্বয়ং নির্দেশ দেওয়ায় নুমার দলটাকে ব্যক্তিগতভাবে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনিয়েছেন তিনি। আগেই তার সন্দেহ হয়েছে, নির্দিষ্ট কিছু একটা খুঁজছে ওরা, সেটা পেলে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাইবে। কাঁধ ঝাঁকালেন তিনি, বললেন, ঠিক আছে, সে দেখা যাবে।

.

নারীমূর্তিগুলোর পঞ্চাশ মিটার পিছনে জাপানি দূতাবাসের কনটেইনারগুলো পাওয়া গেল। বাক্সগুলো চিনতে পারা গেল সহজেই, জাপানি হরফ দেখে। কি লেখা রয়েছে? ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসোকে জিজ্ঞেস করল পিট।

চার নম্বর বাক্স, অনুবাদ করলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। জাপান সম্রাটের সম্পত্তি।

সাবধান খোলা হলো বাক্সটা। ঢাকনি তোলার পর দেখা গেল ভাঁজ করা একটা পর্দা, কয়েকটা পাহাড়চূড়ার আশপাশ দিয়ে পাখিরা উড়ে যাচ্ছে। অবশ্যই দ্বীপ নয়, কাঁধ ঝাঁকাল পিট।

আরও দুটো বাক্স খোলা হলো। ভেতর থেকে অনেক পেইন্টিংই বেরল, কিন্তু কোনটাই ষোড়শ শতাব্দীর নয়, আরও প্রাচীন যুগের। বাকি বাক্সগুলোয় অন্যান্য শিল্পকর্ম রয়েছে, কোন পেইন্টিং নেই। অবশেষে বাকি থাকল শুধু একটা বাক্স, আকার দেখে মনে হলো ভেতরে কোন পেইন্টিং থাকলেও থাকতে পারে।

ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসোর চেহারায় উত্তেজনার ছাপ। কপালে চকচক করছে ঘাম। শেষ বাক্সটাও খুলল পিট। পানি দেখতে পাচ্ছি, বলল ও। সম্ভবত সাগরের দৃশ্য। আরে, সত্যি সত্যি একটা দ্বীপ দেখছি।

থ্যাঙ্ক গড। বের করুন, বের করুন।

সাবধানে পেইন্টিংটা বের করা হলো। পকেট থেকে ছোট একটা ক্যাটালগ বের করলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। মাসাকি শিমজুর শিল্পকর্মের কালার প্লেট রয়েছে। ওটায়। ক্যাটালগের পাতা ওল্টাচ্ছেন তিনি। আমি এক্সপার্ট না, তবে দেখে মনে হচ্ছে স্টাইলটা শিমজুরই।

ছবিটা উল্টো করল পিট। এদিকে কি যেন লেখা রয়েছে।

ঝুঁকে লেখাটা পড়ার চেষ্টা করলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। আজিমা আইল্যানড, বাই মাসাকি শিমজু। উত্তেজনায়, উল্লাসে তার গলা কেঁপে গেল, পেয়ে গেছি, সুমার কমান্ড স্টোরের হদিস পেয়ে গেছি। এখন শুধু স্যাটেলাইট ফটোর সাথে তীরের রেখাগুলো মেলাতে হবে।

সাড়ে চারশো বছর আগে আঁকা আজিমা নামে দ্বীপটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে পিট। দ্বীপটা কোনদিনই টুরিস্টদের আকৃষ্ট করবে না। সফেন সাগর থেকে খাড়া আকাশের দিকে উঠে এসেছে পাহাড়ের পাথুরে প্রাচীর। সৈকতের কোন চিহ্নমাত্র নেই কোথও, গাছপালাও নেই বললে চলে। গোটা দ্বীপটা গম্ভীর দর্শন, পরিত্যক্ত ও নির্জন। কারও চোখে ধরা না পড়ে আকাশ বা সাগর থেকে দ্বীপটায় পৌঁছানোর কোন উপায় নেই। বলা যায়, প্রকৃতির তৈরি একটা দুর্গ। ঘাঁটি হিসেবে ভাল জায়গাই বেছে নিয়েছে হিদেকি সুমা।

ওই পাথরের রাজ্যে ঢোকা অসম্ভব একটা ব্যাপার, চিন্তিত স্বরে বলল পিট। কেউ চেষ্টা করলে স্রেফ মারা পড়বে।

চেহারা থেকে উল্লাসের ভাবটুকু মুছে গেল, পিটের দিকে ঝট করে তাকালেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। ও কথা মুখেও আনবেন না, বিড়বিড় করলেন তিনি। এমনকি চিন্তাও করবেন না।

মাইনিং এঞ্জিনিয়ারের চোখের দিকে তাকাল পিট। কেন? ওখানে তো আর আমাদেরকে যেতে হচ্ছে না।

আপনার ভুল হচ্ছে, হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। বুইক ও টিম হোন্ডা অকেজো হয়ে যাবার পর মি, রেইমন্ড জর্ডান আমাদেরকে ছাড়া আর কাদের পাঠাবেন? চিন্তা করে দেখুন।

কথাটা ঠিক, ভাবল পিট। হঠাৎ করে জর্ডানের উদ্দেশ্যটাও পরিষ্কার হয়ে গেল। ওদের তিনজনকে গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ না দিয়ে বসিয়ে রেখেছেন তিনি, প্রয়োজনের সময় সুমার নিউক্লিয়ার বা ডিটোনেশন সেন্টারে পাঠাবেন বলে।

.

৩৮.

ডেস্কের ওপর খোলা ফাইলটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন প্রেসিডেন্ট। তারপর মুখ তুলে যখন তাকালেন, চেহারা সম্পূর্ণ ভাবশূন্য। আসলেই ওরা ওগুলো ফাটিয়ে দেবে? ব্যাপারটা কোন রকম ধোকা নয়?

না, ওরা ধোকা দিচ্ছে না, রেইমন্ড জর্ডান মাথা নাড়লেন।

এ কল্পনার অতীত একটা ব্যাপার। কিন্তু কেন? এমন তো নয় যে আমাদের যুদ্ধজাহাজ ওদের দ্বীপগুলোকে ঘিরে রেখেছে।

কাল্পনিক আতঙ্ক থেকে এ এক ধরনের আত্মরক্ষার চেষ্টা, ডোনাল্ড কার্ন বললেন। চীন ও রাশিয়ায় গণতন্ত্র আসতে যাচ্ছে, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো স্বাধীনতা পাচ্ছে, কালোদের দাবি মেনে নেয়া হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকায়, শান্তি আসছে মধ্যপ্রাচ্যে, কাজেই দুনিয়ার দৃষ্টি এখন শিল্প সমৃদ্ধ জাপানের ওপর। ওদের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য ও বাণিজ্য নীতিই সবার একমাত্র আলোচ্য বিষয়। ওদের আচরণে অনেকেই অসন্তুষ্ট, অনেকেরই চোখ টাটাচ্ছে। আবার এ-ও সত্যি, একের পর এক যতই মার্কেট দখল করছে জাপানিরা, ততই গোঁয়ার হয়ে উঠছে।

ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওরা কোন নীতি মেনে চলে না, বললেন রেইমন্ড জর্ডান। লাভটাই আসল কথা। এ কথা শুধু জাপানিদের বেলায় সত্যি নয়, আমেরিকান ব্যবসায়ীদের বেলায়ও সত্যি। তবে জাপানিদের কাছে আমেরিকানরা। মার খাচ্ছে, ওদের মত বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে পারছে না। জাপানিদের সঙ্গে কেউই পারছে না। ফলে সবাই মিলে জাপানি পণ্য বর্জন করার জন্যে চাপ দিচ্ছে সরকারগুলোকে। ট্রেড এমবারগো আরোপ করার জন্যে কংগ্রেস সুপারিশ করতে যাচ্ছে, প্রস্তাব তোলা হবে জাপানি করপোরেশনগুলো জাতীয়করণ করার। টোকিও আপোষে রাজি হবে বলে মনে হয়, কিন্তু হিদেকি সুমা ও জাপানের বেশিরভাগ শিল্পপতি পাল্টা আঘাত হানতে চাইবে।

কিন্তু তাই বলে নিউক্লিয়ার গ্রেট…।

ওরা আসলে সময় পাবার জন্যে খেলছে, ব্যাখ্যা করলেন রেইমন্ড জর্ডান। ওদের মূল প্ল্যানটা বিশাল, অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলাটা সেই প্ল্যানের অংশবিশেষ। জাপানের সবগুলো দ্বীপের ডাঙা বা মাটি এক করলে আকারে সেটা আমাদের ক্যালিফোর্নিয়ার সমান হবে, তা-ও বেশিরভাগটা পাহাড়ী এলাকা। ওইটুকু জায়গায় বাস করে সাড়ে বারো কোটি মানুষ। ওদের আসল উদ্দেশ্য হলো, নিজেদের সুশিক্ষিত লোকজনকে অন্যান্য দেশে পাঠিয়ে কলোনি গড়ে তোলা, যারা জাপানের প্রতি অনুগত থাকবে। ব্রাজিলের দিকে তাকান, এরই মধ্যে একাধিক

কলোনি তৈরি করেছে তারা। তাকান ক্যালিফোর্নিয়া ও হাওয়াই-এর দিকে, একই অবস্থা। অস্তিত্ব রক্ষাটাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় জাপানিরা, আর ওদের বৈশিষ্ট্য হলো ভবিষ্যতের প্ল্যান করে কয়েক দশক আগে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সাহায্যে গোটা দুনিয়ায় নিজেদের একটা সমাজ গড়ে তুলতে চেষ্টা করছ ওরা, যে সমাজ শুধু জাপানি শিল্প ও সংস্কৃতির চর্চা করবে। বেশিরভাগ জাপানি যেটা বোঝে না তা হলো, দুনিয়াজোড়া সেই জাপানি সমাজের অধিপতি হতে চায় সুমা।

খোলা ফাইলের ওপর আবার একবার চোখ বুলালেন প্রেসিডেন্ট। অন্যান্য দেশে অ্যাটম বোমা পাঠিয়ে তা কি সম্ভব? জাপানিরা বোকা নাকি!

জাপানের সরকার বা সাধারণ জাপানিদের দোষ দিতে পারি না, বললেন রেইমন্ড জর্ডান। আমি প্রায় নিশ্চিত, ওদের প্রধানমন্ত্রীকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে। অসৎ ও উচ্চাভিলাষী শিল্পপতি, বিবেকবর্জিত ফাইন্যান্সার আর আন্ডারওয়ার্ল্ডের। লীডাররা যে গোপনে অ্যাটম বোমা বানিয়ে ফেলেছে, এ-খবর তার জানা নেই।

তাহলে প্রধানমন্ত্রীর সাথে মিটিঙে বসতে হয় আমাকে, বললেন প্রেসিডেন্ট। আমরা কি জানতে পেরেছি, তাকে বলি।

মাথা নাড়লেন রেইমন্ড জর্ডান। এখনি সে ধরনের কোন পরামর্শ আমি দেব না, স্যার। তার আগে কেইটেন প্রজেক্টটা ধ্বংস করতে চাই আমরা।

শেষবার যখন কথা হলো, ওদের কমান্ড সেন্টারের লোকেশন আমরা জানতাম না।

নতুন তথ্য পেয়েছি আমরা, কমান্ড সেন্টারের অস্তিত্ব খুঁজে নেব।

জানা গেছে, ডিটোনেশনের জন্যে গাড়ি-বোমাগুলো কোথায় পাঠানো হবে?

ইয়েস, স্যার, জবাব দিলেন ডোনাল্ড কার্ন। আমাদের একটা টিম গাড়ির একটা চালান অনুসরণ করে জানতে পেরেছে।

নিশ্চয়ই ওগুলো জনবহুল এলাকায় পাঠানো হবে?

জী-না, স্যার। পাঠানো হবে এমন সব জায়গায়, বিস্ফোরণে যাতে খুব কম লোক মারা যায়।

মানে?

যুক্তরাষ্ট্র ও শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলোর, ব্যাখ্যা করলেন ডোনাল্ড, এমন সব এলাকায় ফাটানো হবে ওগুলো, যেখানে লোকবসতি নেই বললেই চলে। ফাটানো হবে সবগুলো প্রায় একসাথে। ফলে মাটিতে একটা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পালনস সেট অভ করবে, যেটা উঠে যাবে অ্যাটমসফেয়ার-এর। এতে সৃষ্টি হবে ছাতা আকৃতির চেইন রিয়্যাকশন, ফলে দুনিয়া জোড়া স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন সিস্টেম অচল হয়ে পড়বে।

সমস্ত রেডিও, টেলিভিশন ও ফোন নেটওঅর্ক স্রেফ অস্তিত্ব হারাবে, যোগ করলেন রেইমন্ড জর্ডান। ফেডারেল ও লোকাল গভর্নমেন্ট, মিলিটারি কমান্ড, পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, ফায়ার ডিপার্টমেন্ট, অ্যাম্বুলেন্স, পরিবহন, সবই অচল হয়ে পড়বে, কারণ কানে কিছু না শুনতে পেলে কাজ করা সম্ভব নয়।

যোগাযোগবিহীন বিশ্ব, বললেন প্রেসিডেন্ট। কল্পনা করা যায় না।

পরিস্থিতি আরও খারাপ, মি. প্রেসিডেন্ট বললেন ডোনাল্ড কার্ন। আপনি জানেন, স্যার, কমপিউটার ডিস্কের সামনে একটা ম্যাগনেট ধরলে কি হয়?

সব মুছে যায়।

মাথা ঝাঁকালেন ডোনাল্ড কার্ন। পারমাণবিক বিস্ফোরণ থেকে যে ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক পালস সৃষ্টি হবে সেটাও তাই করবে। প্রতিটি বিস্ফোরণের চারদিকে কয়েকশো মাইল পর্যন্ত প্রতিটি কমপিউটারের মেমোরি সম্পূর্ণ মুছে যাবে।

চোখে অবিশ্বাস, ডোনান্ডের দিকে তাকিয়ে থাকলেন প্রেসিডেন্ট। মাই গড।

জ্বী, স্যার, গোটা দেশ অচল হয়ে যাবে। কমপিউটার ব্যবহার করছে এমন প্রতিটি ব্যাংক, বীমা কোম্পানি, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, সুপারমার্কেট, ডিপার্টমেন্ট স্টোর-তালিকাটা অসম্ভব লম্বা_ সব বন্ধ হয়ে যাবে।

প্রতিটি ডিস্ক, প্রতিটি টেপ?

সমস্ত বাড়ি ও অফিসে, বললেন রেইমন্ড জর্ডান। আধুনিক মোটরগাড়িতে কমপিউটার ব্যবহার করা হচ্ছে, ব্যবহার করা হচ্ছে ট্রেনে ও প্লেনে। বিশেষ করে প্লেনগুলো হঠাৎ বিপদে পড়তে পারে। ক্রুরা ম্যানুয়াল কমান্ড গ্রহণ করার আগেই মাটিতে খসে পড়বে। অচল হয়ে পড়বে মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ভিডিও ক্যাসেট রেকর্ডার, যে-কোন সিকিউরিটি সিস্টেম। আমরা কমপিউটার চিপস-এ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি, কিন্তু কখনও ভেবে দেখিনি যে ওগুলো কি অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।

হাতের কলমটা ডেস্কের উপর বার কয়েক ঠুকলেন প্রেসিডেন্ট। তারপর বললেন, সেক্ষেত্রে সিরিয়াস না হয়ে উপায় নেই আমার। ওদের পরমাণবিক অস্ত্রের গুদাম ও কমান্ড সেন্টারে আঘাত হানব আমরা নিউক্লিয়ার, ইফ নেসেসারি।

আমি আগেই বলেছি, মি. প্রেসিডেন্ট, শান্তকণ্ঠে বললেন রেইমন্ড জর্ডান, সে পরামর্শ আপনাকে আমি দেব না। তবে যদি দেখি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন অবশ্য আলাদা কথা।

প্রেসিডেন্ট জানতে চাইলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে, কি করে বুঝব?

আরও এক হপ্তা সুমার কমান্ড সেন্টার কাজ শুরু করতে পারবে না। আমাদের একটা পেনিট্রেমন প্ল্যান রয়েছে, ভেতরে ঢুকে সব গুঁড়িয়ে দেয়া সম্ভব। অপারেশনটা সফল হলে, আন্তর্জাতিক নিন্দা এড়াতে পারব আমরা। জাপানে আমরা একবার অ্যাটম বোমা ফেলেছি, দুনিয়ার লোক সে-কথা আজও ভুলতে পারেনি। যে কারণেই হোক, আবার যদি ফেলি, মানুষ কি ভাববে সহজেই তা অনুমান করা যায়। তাছাড়া, জাপান এখন আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র, ভুলে গেলে চলবে না।

আরও ত্রিশ মিনিট আলোচনার পর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন প্রেসিডেন্ট। চারদিন। আপনাদের আমি ছিয়ানব্বই ঘণ্টা সময় দিলাম।

দুজনের মুখই গম্ভীর হাসি, ডোনাল্ড কার্ন ও রেইমন্ড জর্ডান পরস্পরের দিকে তাকালেন। ওঁরা ওভাল অফিসে আসার আগেই সুমার ওপর হামলার পরিকল্পনা করে এসেছেন। শুধু একটা ফোন করলেই অপারেশনের কাজ শুরু হয়ে যাবে।

.

৩৯.

উডমটর, মেরিল্যান্ড। ভোর চারটে, গভর্নমেন্ট রিজার্ভেশন-এর কাছে ছোট একটা ল্যান্ডিং স্ট্রিপ, দেখে মনে হয় পরিত্যক্ত। ভোরের নিস্তব্ধতাকে চুরমার করে দিয়ে একটা জেট ট্রান্সপোর্টার প্লেন এসে নামল। তিন মিনিটের মধ্যে প্যাসেঞ্জার ডোর খুলে বেরিয়ে এল দুজন আরাহী, প্রত্যেকের হাতে একটা করে সুটকেস। রানওয়ের শেষ মাথা পর্যন্ত হেঁটে এল তারা। ওখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার। পিট ও অ্যালের সাথে হ্যান্ডশেক করলেন তিনি।

কংগ্রাচুলেশন্স, বললেন তিনি। অত্যন্ত সফল একটা অপারেশনের জন্যে।

রেজাল্ট কি এখনও তা আমরা জানি না, বলল পিট। ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো পেইিটিং-এর যে ছবি ট্র্যান্সমিট করে পাঠালেন, তার সাথে কোন দ্বীপের মিল পাওয়া গেছে?

যায়নি মানে! দ্বীপটাকে আজিমা বলতে স্থানীয় জেলেরা, অনেক কাল আগে। কিন্তু চার্টে ওটা আছে সোসেকি আইল্যান্ড হিসেবে। আজিমা নামটা লোকে ভুলেই গেছে।

কোথায় সেটা? জানতে চাইল অ্যাল। অ্যাডমিরালের পিছু পিছু হেঁটে এসে একটা সেশন ওয়াগনে উঠল ওরা। ড্রাইভিং সীটে বসল পিট, ওর পাশে অ্যাডমিরাল। অ্যাল বসল ব্যাকসীটে।

এডো সিটির পূর্ব দিকে, তীর থেকে প্রায় ষাট কিলোমিটার দূরে।

হঠাৎ পিটের চেহারায় উদ্বেগের ছায়া পড়ল। লরেনের কোন খবর, অ্যাডমিরাল?

মাথা নাড়লেন অ্যাডমিরাল। আমরা শুধু জানি মিস লরেন ও মি. ডিয়াজ বেঁচে আছেন, ওঁদেরকে গোপন একটা আস্তানায় আটকে রাখা হয়েছে?

উদ্ধার করার কোন চেষ্টা হচ্ছে না? বাঁক নিয়ে ওয়াশিংটনের রাস্তাটি ধরল পিট।

গাড়ি-বোমার হুমকি যতক্ষণ থাকবে, প্রেসিডেন্টের হাত বাঁধা।

ঘুমাব, মুখের সামনে হাত তুলে হাই তুলল অ্যাল, আসলে প্রসঙ্গ বদলে পিটকে শান্ত করতে চাইছে সে। আমার সাঙ্তিক ঘুম পেয়েছে।

ম্যানকিউসো জার্মানিতে রয়ে গেলেন কেন? জানতে চাইলেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার।

জাপানি দূতাবাসের পেইন্টিংগুলো টোকিওতে পৌঁছে দেবেন উনি, বলল পিট। ডোনাল্ড কার্ন ফোনে তাঁকে সে নির্দেশ দিয়েছেন।

মুচকি হাসলেন স্যানডেকার। জার্মানদের তাই বোঝানো হয়েছে। আসলে ম্যানকিউসো ওগুলো ওয়াশিংটনে নিয়ে আসছেন। সময় ও সুযোগ মত প্রেসিডেন্ট ওগুলো শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে জাপানিদের উপহার দেবেন।

কোথায় যাচ্ছি আমরা, জানতে চাইল পিট।

চুপ করে থাকলেন অ্যাডমিরাল, কি যেন ভাবছেন। ডার্কের মনে হলো, শুনতে না পাবার ভান করছেন ভদ্রলোক। প্রশ্নটা আবার করল ও। কোথায় যাচ্ছ? শুনে খুশি হবে বলে মনে হয় না। আবার প্লেনে চড়তে হবে তোমাদের।

মানে? কোথায়?

প্রথমে লস এঞ্জেলসে। তারপর প্যাসিফিকে।

লস এঞ্জেলসে কেন? প্যাসিফিকের ঠিক কোথায়?

লস এঞ্জেলসে স্টেসি ফক্স তোমার পার্টনার। তারপর পালাউ-এ যাচ্ছ। মেল পেনারের সাথে দেখা করতে।

কখন প্লেনে চড়ব আমরা?

হাতঘড়ি দেখলেন অ্যাডমিরাল। এক ঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিট পর তোমাদের ফ্লাইট। ডালেস থেকে একটা কমার্শিয়াল এয়ারলাইনের প্লেনে…।

তাহলে তো ওখানেই ল্যান্ড করলে পারতাম আমরা, বললল পিট। গাড়িতে উঠতে হত না।

সিকিউরিটির কথা ভেবে এই ব্যবস্থা, বললেন অ্যাডমিরাল ডোনাল্ড কার্ন চাইছেন আর সব সাধারণ প্যাসেঞ্জারের মত টিকেট কেটে প্লেনে চড়ো তোমরা।

কিন্তু আমাদের কাপড়চোপড় দরকার…।

এয়ারপোর্টে এতক্ষণে পৌঁছে গেছে দুটো সুইকেস।

অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে রিভার ভিউ মিররে তাকাল পিট। বেল্টওয়েতে উঠে আসার পর থেকে একজোড়া হেডলাইট অনুসরণ করছে ওদেরকে। শেষ কয়েক কিলোমিটার একই দূরত্ব বজায় রাখছে আলো দুটো। গতি সামান্য বাড়ালো ও। পিছিয়ে পড়ল জোড়া হেডলাইট, তারপর আবার এগিয়ে এল।

কি ব্যাপার, পিট? জানতে চাইলেন অ্যাডমিরাল।

ফেউ।

ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে তাকাল অ্যাল। একাধিক গাড়ি। তিনটে ভ্যানের একটা কনভয় দেখতে পাচ্ছি আমি।

পিট চিন্তিত, তাকিয়ে আছে মিররে। যারাই পিছনে লাগুক, কোন ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। গোটা একটা প্লাটুন পাঠিয়েছে।

ছোঁ দিয়ে কার ফোনের রিসিভার তুলে নিলেন অ্যাডমিরাল স্যানডেকার, লাইনটা নিরাপদ। সঙ্কেতের ধার ধরলেন না, রিসিভারে বললেন, দিস ইজ অ্যাডমিরাল স্যানডেকার। আমরা বেল্টওয়েতে রয়েছি, যাচ্ছি দক্ষিণে, মর্নিং সাইড এর দিকে। আমাদের পিছনে ফেউ লেগেছে…।

বলুন ধাওয়া করছে, বাধা দিল পিট। দ্রুত চলে আসছে ওরা।

অকস্মাৎ এক পশলা বুলেট এসে লাগল গাড়ির ছাদে। কারেকশন, অদ্ভুত শান্ত গলায় বলল অ্যাল জিওর্দিনো। ধাওয়ার বদলে বলুন হামলা।

সিট থেকে মেঝেতে নেমে গেলেন অ্যাডমিরাল, দ্রুত কথা বলছেন মাউথপীসে। অ্যাকসিলারেটরে পা চেপে ধরেছে পিট। বেল্টওয়ে ধরে ঘণ্টায় একশো পঞ্চাশ কিলোমিটার গতিতে ছুটল স্টেশন ওয়াগন।

ডিউটিতে রয়েছে একজন এজেন্ট, অ্যাডমিরাল জানলেন। হাইওয়ে পেট্রলকে মেসেজ পাঠাচ্ছে সে।

তাড়াতাড়ি করতে বলুন, আবেদন জানায় পিট, শত্রুপক্ষের লক্ষ্য ব্যর্থ করার জন্যে হাইওয়েরে তিনটে লেনের একটা থেকে আরেকটায় চলে যাচ্ছে দ্রুত।

আরও এক পশলা গুলি হলো। সিটগুলোর মাঝখানে আগেই বসে পড়েছে অ্যাল। পিছনের জানালার কাঁচ ভেঙে গেল, বুলেটগুলো ছুটল তার মাথার উপর দিয়ে, ভেঙে ফেলল সামনের উইন্ডস্ক্রীনের অর্ধেকটা। এটাকে ঠিক ফেয়ার প্লে বলা যায় না। ওদের কাছে অস্ত্র আছে, আমাদের কাছে নেই, অ্যালের সুরে অভিযোগ।

চট করে ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকাল পিট। বসে না থেকে আন্তর্জাতিক আদালতে চিঠি লেখো।

সামনে বাক, সতর্ক করলেন অ্যাডমিরাল।

রিয়ার ভিউ মিররে তাকাল পিট। ভ্যানগুলো অ্যাম্বুলেন্সের মত রঙ করা। লাল ও নীল আলোও জ্বলছে-নিভছে। তবে সাইরেন বাজছে না। কালো পোশাক পরা লোকগুলোকে দেখতে পেল ও, জানালা দিয়ে অটোমেটিক উইপন বের করে রেখেছে। প্রতিটি ভ্যানে সম্ভবত চারজন করে লোক। সব মিলিয়ে বারো জন।

সামনের বাঁকটা এখনও দুশো মিটার দূরে। ওখানে পৌঁছানোর আগেই কিছু একটা করা দরকার, কারণ পরবর্তী বুলেটের ঝাঁকগুলো রাস্তা থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করবে ওদেরকে। শত্রুপক্ষকে কিছু বুঝতে না দিয়ে অকস্মাৎ দ্রুত হুইল ঘোরাল পিট, দুটো রাস্তা পেরিয়ে উঠে এল গ্লাস মোড়া কিনারায়। সময়ের হিসেবটা নিখুঁত হয়েছে। এক ঝাঁক বুলেট ছুটে এল, কিন্তু একটাও লাগল না। রাস্তার কিনারা থেকে ঢাল বেয়ে নেমে এল স্টেশন ওয়াগন, অগভীর একটা গর্তে পড়ল ওরা, গর্তের ভেতরে পানি। দুতিনবার পিছনে গেল চাকা, তারপর গর্তের আরেক প্রান্ত দিয়ে উঠে এল বেল্টওয়ের সমান্তরাল অপর একটা রোডে।

ঘটনা দ্রুত মোড় নেয়ায় শত্রুপক্ষ হতভম্ব হয়ে পড়ল, গাড়ি থামাতে বাধ্য হলো তারা, ফলে সময় নষ্ট হলো। আবার এক হয়ে ধাওয়া শুরু করল তারা, তবে ইতোমধ্যে দশ-বারো সেকেন্ড এগিয়ে গেছে পিট।

লম্বা একটা এভিনিউ পেরিয়ে এসে আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ল স্টেশন ওয়াগন। তীক্ষ্ণ কয়েকটা বাঁক ঘুরল পিট, ভাঙা উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে ভোরের ঠাণ্ডা বাতাস এসে আঘাত করছে মুখে। দুবার বাম দিকে, তারপর ডান দিকে ঘুরল ও। আবাসিক এলাকা, কাজেই ভ্যান থেকে গুলি হচ্ছে না। আবার বাক নেয়ার সময় পিছনে তাকিয়ে পিট দেখল, ভ্যানগুলোকে দেখা যাচ্ছে না। বাঁক ঘুরেই হেডলাইট অভ করে দিল ও, গাড়ি চালাচ্ছে অন্ধকারে। জানা সমস্ত কৌশল কাজে লাগাবার চেষ্টা করছে। মাঝে মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে মাত্র, কিন্তু খসাতে পারছে না।

আরেকটা বাঁক ঘরে শহরের প্রধান এভিনিউয়ের দিকে ফিরে যাচ্ছে পিট। দ্রুত পিছিয়ে গেল একটা গ্যাস স্টেশন, থিয়েটার, কয়েকটা মুদি দোকান। হার্ডওয়্যার স্টোর খুঁজছি আমরা, দেখতে পেলে বললেন, বাতাস আর টায়ারের শব্দকে ছাপিয়ে উঠল ওর কণ্ঠস্বর।

কি খুঁজছি? অ্যাডমিরালের গলায় অবিশ্বাস।

হার্ডওয়্যারের দোকান। এটা শহর, না থেকে পারে না।

অসকার ব্রাউনস্ হার্ডওয়্যার এমপোরিয়াম, ঘোষণা করল অ্যাল। বেল্টওয়ে থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসার সময় সাইনবোর্ডটা দেখেছি আমি।

যে প্ল্যানই করে থাকো, থমথমে গলায় বললেন অ্যাডমিরাল, জলদি ম্যানেজ করো। গ্যাস গজের লাল আলো জ্বলতে দেখলাম এইমাত্র।

ড্যাশ ইন্সট্রুমেন্টের দিকে তাকাল পিট। এমটি লেখা ঘরে কাঁপছে কাঁটা। তার মানে ফুয়েল ট্যাঙ্ক সেলাই করেছে ওরা।

রাস্তার ডান দিকে ব্রাউন এমপোরিয়াম এগিয়ে আসছে, বলল অ্যাল, খোলা উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে হাত লম্বা করে দেখাল।

আপনার কাছে টর্চ আছে? অ্যাডমিরালকে জিজ্ঞেস করল পিট।

গ্লাভ কমপার্টমেন্ট।

বের করুন।

ভিউ মিররে তাকাল পিট। দুই ব্লক পিছনে বাঁক ঘুরছে প্রথম ভ্যানটা। রাস্তার বাম দিকে নর্দমার ঢাকনির উপর গাড়ি তুলল ও, তারপর ভন ভন করে ডান দিকে হুইল ঘোরাল।

আড়ষ্ট হয়ে গেলেন অ্যাডমিরাল।

কর্কশ আওয়াজ বেরুল অ্যালের গলা থেকে, ওহ, নো!

একপাশে কাত হলো স্টেশন ওয়াগন, পরমুহূর্তে ফুটপাথের উপর দিয়ে ছুটল, প্লেন গ্লাস ভেঙে ঢুকে পড়ল হার্ডওয়্যার স্টোরে। প্রথমে বিধ্বস্ত হলো সামনের কাউন্টার, দেরাজ থেকে অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়ল খুচরো পয়সা আর টাকা। দাতাল রেদা ভর্তি একটা র‍্যাক ধরাশায়ী হলো। একটা প্যাসেজে ঢুকে পড়ল গাড়ি, দুপাশের র‍্যাক থেকে বুলেটের মত ছুটল নাট-বল্টু, পেরেক, স্ক্রু আর গজাল।

প্যাসেজে চলে এল ও, কি যেন খুঁজছে। একটা তার ছিঁড়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে কর্কশ শব্দে বেজে উঠল সিকিউরিটি অ্যালার্ম।

সামনে একটা ডিসপ্লে কেস দেখে ব্রেক করল পিট, পরমুহূর্তে সামনের কাঁচ চুরমার হয়ে গেল। গাড়ির একটা মাত্র হেডলাইট মিটিমিট করে জ্বলছে, তার আলোয় দেখা গেল বিধ্বস্ত ডিসপ্লেতে বিশ কি ত্রিশটা হ্যান্ডগান ছড়িয়ে রয়েছে, পাশের বড় একটা কেবিনেটে দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি সারি রাইফেল ও শটগান।

৪০. যে যার অস্ত্র বেছে নিন

৪০.

যে যার অস্ত্র বেছে নিন, অ্যালার্মের কর্কশ আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠল পিটের চিৎকার, লাথি মেরে খুলে ফেলল গাড়ির দরজা।

দ্বিতীয়বার বলতে হলো না অ্যাডমিরালকে, বগলে টর্চ জে অ্যামুনিশন কেবিনেট হাতড়াতে শুরু করলেন। তোমাদের কি পছন্দ বলছ না যে? পিটের মত তিনিও চিৎকার করলেন।

ছোঁ দিয়ে এক জোড়া কোল্ট কমব্যাট কমান্ডার অটোমেটিক পিস্তল তুলে নিল পিট। ফরটিফাইড অটোমেটিক! ক্লিপ ইজেক্ট করল ও।

সঠিক ক্যালিবার খুঁজে পেতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিলেন অ্যাডমিরাল। পিটের দিকে দুটো বাক্স ঠেলে দিলেন তিনি। উইনচেস্টার সিলভার টিপস। ঘুরলেন অ্যালের দিকে। তোমার কি দরকার?

তিনটি রেমিং-১১০০ শটগান নামিয়েছে অ্যাল র‍্যাক থেকে। টুয়েলভ গজ, ডাবল-অটো লোড।

সরি, কঠিন সুরে বললেন অ্যাডমিরাল। অল্প সময়ের নোটিসে আমি শুধু নাম্বার-ফোর ম্যাগনাম বাকশট ম্যানেজ করতে পেরেছি। শটগান কেসিঙের কয়েকটা বাক্স ঠেলে দিলেন অ্যালের দিকে। নিচু হয়ে ছুটলেন তিনি, ঢুকে পড়লেন পেইন্ট সেকশনে।

তাড়াতাড়ি করুন, টর্চটা নেভান, তাঁকে সাবধান করল পিট, বেল্টের বাঁট দিয়ে অবশিষ্ট হেডলাইটটাও ভেঙে ফেলল।

ভ্যানগুলো কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে, দোকানের ভেতর থেকে লোকগুলোকে দেখতে পাচ্ছে না ওরা। আততায়ীরা নিজেদের গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে ছড়িয়ে পড়ল। হার্ডওয়্যারের দোকানের দিকে ছুটে এল না, দাঁড়িয়ে পড়ল।

স্টেশন ওয়াগনে গুলি চালিয়ে আরোহীদের ছাতু বানাবার প্ল্যানটা ভেস্তে গেছে। পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় রণকৌশল বদলাতে হবে ওদেরকে। তাড়াহুড়ো করল না, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করছে।

অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ওদের বুদ্ধি ঘোলা করে দিল। পালাবার সময় স্টেশন ওয়াগন থেকে কোন গুলি করা হয়নি, ওরা ধরে নিল প্রতিপক্ষ নিরস্ত্র, কাজেই সিদ্ধান্ত নিল দোকানের দিকে একযোগে ছুটে এসে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলবে।

তবে ওদের টিম লীডার সতর্ক হবার মত বুদ্ধি রাখে। রাস্তার উল্টো দিকের একটা দোরগোড়া থেকে বিধ্বস্ত দোকানটার দিকে তাকিয়ে থাকল সে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। রাস্তার আলো দোকানের ভেতরে খুব কমই ঢুকেছে। স্টেশন ওয়াগনটা ছায়ার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে। কর্কশ অ্যালার্ম বাজছে, ফলে কোন শব্দও শুনতে পেল না সে।

পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখছে, এই সময় দোকানের উপর কয়েকট অ্যাপার্টমেন্টের জানালা আলোকিত হয়ে উঠল। এখুনি কিছু একটা করার তাগাদা অনুভব করল সে। বাড়ি-ঘর থেকে লোকজন বেরিয়ে এলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। যে-কোন মুহূর্তে পুলিশ পৌঁছে যেতে পারে। আরও একটা ভুল করল সে, স্টেশন ওয়াগনের অন্তত দুএকজন লোক আহত হয়েছে। তার ধারণা হলো, মৃত্যুভয়ে দোকানের ভেতর লুকিয়েছে তারা। দোকানের পিছনে লোক পাঠানো দরকার, এই বুদ্ধিটা তার মাথায় এল না।

দোকানের ভেতর ঢুকে ওদেরকে