দ্য ফারাও’স সিক্রেট

০১. নীল নদের মোহনা

NUMA ফাইলস/কার্ট অস্টিন অ্যাডভেঞ্চার – দ্য ফারাও’স সিক্রেট / মূল : ক্লাইভ কাসলার ও গ্রাহাম ব্রাউন / অনুবাদ : অসীম পিয়াস / প্রথম প্রকাশ আগস্ট ২০১৬

পূর্বকথা – মৃতদের শহর

অ্যাবাইডোস, মিসর
খ্রিস্টপূর্ব ১৩৫৩
ফারাও আখেন আতেন-এর রাজত্বের সপ্ত
দশ বর্ষ

পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় মিসরের বালুকণা সব এক নীলাভ দ্যুতিতে ঝিকিমিক করছে। দেখে মনে হয় কেউ যেন বালির ওপর রঙ লেপে দিয়েছে। দূরের পাথুরে মন্দিরগুলোও মার্বেল পাথরে তৈরি বলে ভ্রম হয়। চাঁদের আলোর বিপরীতে সেগুলোর লম্বা ছায়া পড়েছে। এই আলো-আঁধারির ফাঁক দিয়েই একদল লোক চুপিসারে অনুপ্রবেশ করল মৃতদের শহরে’।

মোটমাট তিরিশজন পুরুষ এবং মহিলা। সবার চেহারা চাদরে ঢাকা, তবে দৃষ্টি আটকে আছে সামনের রাস্তায়। কেমন একটা ক্লান্ত, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হাঁটছে সবাই। ইতোমধ্যেই তারা পেরিয়ে এসেছে প্রথম রাজবংশের ফারাওদের সমাধিক্ষেত্র আর দ্বিতীয় যুগের দেবতাদের সম্মানে তৈরি বিভিন্ন মন্দির আর সৌধ।

কিছুদূর এগুতেই দেখা গেল পাথুরে রাস্তাটার ওপর বালু জমে তূপ হয়ে আছে। অভিসারী দলটা নীরবে দাঁড়িয়ে পড়ল সেখানে। তাদের দলনেতা মানু-হটেপ অন্ধকারে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল ওপাশে কিছু আছে কি-না। তারপর মাথা বাঁকিয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করল, আত্ম রক্ষায় বর্শায় চেপে বসেছে আঙুল।

এক মহিলা এগিয়ে এলো ওর দিকে, “কিছু শুনতে পেলে?” মহিলাটি মানু-হটেপ-এর স্ত্রী। আর পিছনে যারা দাঁড়ানো, তারা কয়েকটা পরিবারের সদস্য। সাথে আছে ডজন খানেক চাকর-বাকর, তাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে খাঁটিয়া। আর খাঁটিয়াতে একটা করে শিশুর লাশ প্রত্যেকটা শিশুই একই রকম অদ্ভুত এক রোগে মারা গেছে।

“একটা ফিসফিসানি শুনলাম মনে হলো, মানু-হপেট জবাব দিল।

“কিন্তু এই শহরে তো কেউ থাকে না। এসব সমাধি ক্ষেত্রে প্রবেশ তো একেবারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমরা নিজেরাই এসেছি মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে।” মহিলা বলল।

“সে কথা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না,” বলতে বলতে লোকটা তার মাথার ওপর থেকে কাপড়টা নামালো। মাথায় চুল নেই। কামানো, গলায় একটা স্বর্ণের নেকলেস। আখেন আতেন-এর পরিষদের সদস্যরাই এরকম নেকলেস পরিধান করে।

শত শত বছর ধরেই এই অ্যাবাইডোস বা মৃতদের শহর ‘ওসাইরিস’ এর পুরোহিত পূজারি আর ভক্তদের জন্য পুণ্যভূমি হিসেবে বিবেচ্য। ওসাইরিস’ হলো পরলোকের শাসক আর উর্বরতার দেবতা। প্রথম দিকের রাজবংশের সকল ফারাওকেই এখানেই সমাহিত করা হয়েছে। ইদানীংকালের ফারাওদের অবশ্য অন্যত্র কবর দেয়া হয়। তবে এখনও এখানে ওসাইরিস-এর সম্মানে মন্দির বা সৌধ নির্মাণ করেন সবাই।

তবে আখেন আতেন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ফারাও হবার কিছুদিন পরেই আখেন আতেন ঘোষণা দেন যে তিনি আর পুরাতন দেবতাদের পূজা করবেন না। যুগ যুগ ধরে চলা আসা সমস্ত দেবতাদের ওপর ডিক্রি জারি করেন এবং নির্দেশ দেন এখন থেকে শুধু একজন দেবতার-ই পূজা করবে সবাই। সেটা হলো সূর্য দেবতা-আতেন।

এরপর থেকেই অ্যাবাইভোস শহর তার শৌর্য হারানো শুরু করে। ভক্ত পুরোহিত সবাই চলে যায় শহর ছেড়ে। এখন এটা পুরোপুরি পরিত্যক্ত। এর সীমানার ভেতরে কাউকে পাওয়া গেলে তার মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। আর মানু হটেপ-এর মতো খোদ ফারাও-এর পরিষদের কোনো সদস্য যদি ধরা পড়ে। তবে তার শাস্তি হবে আরো ভয়ংকর। মারার আগে তার ওপর এমন অত্যাচার চালানো হবে যে তার চেয়ে মৃত্যুও শ্রেয়।

মানু-হটেপ কিছু বলার জন্যে মুখ খুললো, কিন্তু তার আগেই একটা নড়াচড়া টের পেয়ে থেমে গেল। তিনজনের একটা দল অন্ধকার কুঁড়ে ওদের দিকেই দৌড়ে আসছে। হাতে উদ্যত অস্ত্র। মানু-হটেপ তার স্ত্রীকে পিছনে ঠেলে দিয়ে বর্শা বাগিয়ে সামনে এগুলো। সবার সামনের লোকটা জায়গায় গেঁথে গেল এফোঁড় ওফোঁড়। আর নড়লো না। কিন্তু লাশটার বুক থেকে বর্শা বের করার আগেই দ্বিতীয় লোকটা পৌঁছে গেল সেখানে। বিন্দুমাত্র দেরি না করে আততায়ী তার তরবারি চালালো।

আঘাত এড়াতে গিয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে গেল মানু-হটেপ। তবে ততোক্ষণে মুক্ত হয়েছে তার বর্শা। দ্বিতীয় আততায়ী আবার আঘাত করার আগেই তার দিকে ছুঁড়ে দিল বর্শা। দ্বিতীয় আততায়ী শুয়ে থাকায় নিশানা ঠিক মতো হয়নি, লাগল না। আততায়ী এবার নিরস্ত্র মানু-হটেপের দিকে এগুতে চাইলো। কিন্তু পিছন থেকে একটা বর্শা তার পেট ভেদ করে বেরিয়ে গেল। মানু-হটেপের এক চাকর ছুঁড়েছে সেটা। দ্বিতীয় আততায়ী হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল, হাসফাস করছে বাতাসের জন্য। এ দিকে তৃতীয় আততায়ী আর দাঁড়ালো না। উল্টো দিকে ঘুরেই দিল ভো দৌড়।

মানু-হটেপও সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে বর্শা ছুড়লো সেদিকে। এক ইঞ্চির জন্য লক্ষ্য ভ্রষ্ট হলো সেটা। রাতের আঁধারে ছুটন্ত পদশব্দ মিলিয়ে গেল কিছুক্ষণ পরেই।

“লাশ চোর নাকি?” কেউ জিজ্ঞেস করল।

“গোয়েন্দাও হতে পারে”। মানু-হটেপ জবাব দিল। “আর গত কয়েকদিন ধরেই মনে হচ্ছে কেউ আমাদের চোখে চোখে রাখছে। দ্রুত পা চালাও সবাই। লোকটা ফারাওয়ের কানে কথাটা লাগালে কাল সকালে সূর্যের মুখ আর দেখা লাগবে না।”

“আমার মনে হয় আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত। কেন যেন মনে হচ্ছে ভুল করছি আমরা।” মানু-হটেপের স্ত্রী বলল।

“আখেন আতেনের সব কথা মেনে নেয়াটা ছিল ভুল।” মানু-হটেপ জবাব দিল। “ফারাও একজন ধর্মদ্রোহী। আর তার সাথে তাল মিলানোর কারণেই আজ ওসাইরিস আমাদের শাস্তি দিচ্ছেন। শুধু আমাদের আমরা যারা আখেন আতেনকে সমর্থন দিয়েছি তাদের প্রত্যেকের সন্তান মারা পড়ছে, আমাদের গবাদি পশু সব মরে সাফ হয়ে যাচ্ছে। আমাদেরকে ওসাইরিসের কাছে মাফ চাইতে হবে। আজই। এক্ষুনি। আর দেরি করা যাবে না।”

কথাগুলো বলতে বলতে মানু-হটেপের সংকল্প আরো দৃঢ় হলো। এতদিন আখেন আতেনের বিরুদ্ধে কেউ বলতে গেলেই তাকে জোর করে থামিয়ে দেয়া হয়েছে, চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে তাদের কণ্ঠ। কিন্তু দেবতারাও ক্ষেপে গেছে। ফলে দেশ জুড়ে এখন নিষ্ঠুর গজব চলছে। এর মধ্যে যারা আখেন আতেনের সহযোগী ছিল তারা ভুগছে সবচে বেশি।

“এদিক দিয়ে।” বলে মানু-হটেপ পা বাড়ালো।

কিছুক্ষণ পরেই দলটা শহরের আরো ভেতরে সবচেয়ে বড় দালানটার সামনে এসে পৌঁছুলো। এটাই ওসাইরিসের মন্দির।

মন্দিরের ছাদটা বিশাল, অবশ্য কোনো গম্বুজ নেই, সমতল। বিশাল বিশাল গ্রানাইটের পাথর থেকে লম্বা লম্বা থাম উঠে গেছে ওপরে। তার মাঝ দিয়ে চওড়া একটা সিঁড়ি। একটা নকশা কাটা পাথরে গিয়ে সেটা থেমেছে। পাথরটায় ইথিওপিয়ার লাল মার্বেল, আর ইরানের নীলকান্তমণি বসিয়ে পাথরটায় নকশা করা হয়েছে। তার পরেই ব্রোঞ্জের তৈরি দৈত্যাকৃতির দুটো দরজা।

মানু-হটেপ দরজার কাছে পৌঁছে ঠেলে খুলে ফেলল। কেমন শান্তি-শান্তি লাগছে তার। তবে দরজা খোলামাত্র একটা পুঁতি গন্ধ এসে নাকে লাগতেই শান্তি উবে গেল। মানু-হটেপ আরা অবাক হলো যখন দেখলো মন্দিরের বেদি আর দেয়াল জুড়ে মশাল জ্বলছে। মশালের মিটিমিটি আলোয় চোখে পড়ল মন্দিরের মাঝে অর্ধবৃত্তাকারে কিছু বেঞ্চ জড়ো করে রাখা। তার ওপর মৃত লাশ রাখা। পুরুষ, মহিলা আর শিশুর লাশ, সবই আছে। আর তার চারপাশে মৃতদের পরিবারের লোকেরা দাঁড়ানো। থেমে থেমে ফেঁপাচ্ছে আর বিড় বিড় করে প্রার্থনা করছে।

“তার মানে শুধু আমরাই আখেন আতেনের ফরমান ভঙ্গ করে এখানে আসিনি।” মানু-হটেপ বলল।

মন্দিরের ভেতরের মানুষগুলো ওর দিকে তাকাল, কিন্তু কারো মধ্যে কোনো ভাবান্তর লক্ষ করা গেল না।

“তাড়াতাড়ি করো” হটেপ ভৃত্যদের আদেশ দিল।

একে একে সব ভৃত্য লাশগুলো সারি করে সাজিয়ে রাখলো। আর মানু হটেপ ওসাইরিসের প্রকাণ্ড বেদিটার সামনে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। তারপর মাথা নিচু করে শুরু করল প্রার্থনা। চাদরের ভেতর থেকে দুটো উটপাখির পালক বের করল মানু-হটেপ। তারপর ফিসফিস করে বলল, “হে মৃতদের প্রভু! হে মহানুভব, আমরা বড় বিপদে পড়ে আপনার দ্বারস্থ হয়েছি। আমাদের পরিবারের সদস্য সকলে জরাগ্রস্ত হয়ে গিয়েছে, আমাদের ঘরবাড়িগুলো অভিশপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে, আমাদের ফসলের জমিগুলো বিরান হয়ে গিয়েছে। আজ শুধু একটাই প্রার্থনা, আমাদের মধ্যে যারা মৃত, তাদের আত্মাকে আপনি গ্রহণ করুন, তাদের পরকালকে আপনার আশীর্বাদে ধন্য করুন। আপনিই জীবন মৃত্যুর নিয়ন্ত্রক, আপনার আদেশেই মৃত বীজ থেকে আবার জীবন উৎসরিত হয়। আমরা আপনার কাছে কড়জোরে মিনতি করছি, আমাদের মাঠকে আবার ফসলে ভরিয়ে দিন, আমাদের বাড়িগুলোকে অভিশাপ মুক্ত করুন।”

তারপর বিনম্রভাবে পালক দুটোকে নামিয়ে রাখলো আর তার চারপাশে স্বর্ণমিশ্রিত বালু ছড়িয়ে দিয়ে বেদি থেকে নেমে এলো।

হঠাৎ দমকা বাতাস বয়ে গেল মন্দিরের ভেতর। মশালের আগুন তাতে একদিকে কাত হয়ে গেল। সাথে সাথেই বুম করে একটা শব্দ মন্দিরের দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে ছড়িয়ে পড়ল।

মানু-হটেপ সাথে সাথেই পিছনে ঘুরলো। দূরে দেখা যাচ্ছে প্রকাণ্ড দরজা দুটো বন্ধ হয়ে গেছে। তাতেই শব্দটা হয়েছে। ও নার্ভাস ভঙ্গিতে চারপাশে একবার তাকাল। মশালের আলো একদমই কমে এসেছে। যে কোনো সময় নিভে যাবে। তবে সেই আলো চোখে সয়ে আসতেই মানু-হটেপ খেয়াল করল বেদির ঠিক পিছনেই বেশ কয়েকটা অবয়ব দেখা যাচ্ছে। মুহূর্ত আগেও সেখানে কেউ ছিল না।

চারজনের পরনে স্বর্ণখচিত কালো পোশাক–ওসাইরিসের কাল্টের পুরোহিত এরা। পঞ্চমজনের পোশাক সম্পূর্ণ আলাদা। ভাবগাম্ভীর্যে মনে হচ্ছে, সে-ই বুঝি পরকালের দেবতা স্বয়ং। পা আর কবজির চারপাশে মমি করার কাপড় দিয়ে মোড়া গলা আর হাত ভর্তি স্বর্ণের অলঙ্কার আর মাথায় উটপাখির পালক খচিত একটা মুকুট।

অবয়বটার ডান হাতে একটা ভেড়া তাড়ানোর ছড়ি অপর হাতে একটা স্বর্ণের কস্তনি। যে এখুনি সেটা দিয়ে ধান মাড়াই আরম্ভ করবে। “আমি ওসাইরিসের দূত। পরকালের মহান প্রভুর অবতার।” পুরোহিতটা বলল অবশেষে।

গমগমে কণ্ঠস্বরটা শুনলেই বোঝা যায় যে সেটা পার্থিব দুনিয়ার কারো না। মন্দিরের ভেতরকার সবাই মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান জানালো। তারপর পুরোহিতবৃন্দ একসাথে সামনে এগুলো। মৃতদের পাশে এসে তারা পাতা, ফুলের পাপড়ি আর কি একটা ছিটাতে লাগল। শেষ জিনিসটা মানু-হটেপের কাছে মনে হলো কোনো ধরনের সরীসৃপ বা উভচরের শুকনো চামড়ার ফালি।

“তুমি ওসাইরিসের কাছে আশ্রয় চেয়েছ?” অবতার বলল।

“আমার সব সন্তান মারা গেছে। আমি পরকালে তাদের জন্যে ওসাইরিসের আশীর্বাদ চাই।” মানু-হটেপ জবাব দিল।

“কিন্তু তুমি ঐ বিশ্বাসঘাতকদের হয়ে কাজ করো। তুমি ওসাইরিসের আশীর্বাদের যোগ্য নও।” জবাব দিল অবতার। মানু-হটেপ মাথা না তুলেই বলল, “আমার কৃতকর্মের সমস্ত দায় আমার। আখেন আতেনের কথা আমি মেনেছি। তার জন্য আমাকে যা খুশি শাস্তি দিন। কিন্তু যারা মারা গেছে তারা সম্পূর্ণ নির্দোষ। দয়া করে তাদেরকে মুক্তি দিন। আখেন আতেনের অনাচার শুরু হওয়ার আগে এমনটাই করার কথা ছিল।”

বেশ কিছুক্ষণ নীরবেই কাটলো চারপাশ। মানু-হটেপ সাহস সঞ্চয় করে মাথা তুলে তাকাতেই দেখে অবতার তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার কালো চোখে পলক পড়ছে না।

‘না। ওসাইরিস তোমার মুখের কথায় আর গলবেন না। তোমাকে প্রমাণ করতে হবে যে তুমি আসলেই অনুতপ্ত।” শেষমেশ বলল অবতার।

তারপর হাড্ডিসার আঙুল তুলে বেদির ওপর থাকা একটা মাটির পাত্র দেখিয়ে বলল, “ঐ পাত্রে আছে মারাত্মক এক বিষ। কিন্তু এর কোনো স্বাদ নেই। ওটা নিয়ে আখেন আতেনের পানীয়ের সাথে মিশিয়ে দেবে। বিষের প্রভাবে সে অন্ধ হয়ে যাবে। আর কোনোদিন সে চোখ তুলে তার পরম পূজনীয় সূর্যদেবের দিকে তাকাতে পারবে না, ফলে ওর রাজত্বও ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।”

“আমার সন্তানদের কী হবে? আমি এই কাজ করলে কী পরকালে ওদেরকে মুক্তি দেয়া হবে?” মানু-হটেপ জিজ্ঞসে করল।

“না” অবতার জবাব দিল।

“কিন্তু কেন? আমিতো ভাবলাম-”

“তুমি যদি এই কাজ করো তাহলে ওসাইরিস আবার তোমার সন্তানদের জীবন ফিরিয়ে দেবেন। তিনি নীল নদকে আবার পুনরুজ্জীবিত করবেন আর তোমাদের ফসলের মাঠ আবার শস্যে ভরে যাবে। বলল, তুমি কী এই প্রস্তাবে রাজি?”

মানু-হটেপ ইতস্তত করতে লাগল। ফারাওয়ের অবাধ্যতা এক জিনিস কিন্তু তাকে হত্যা করা…

ওর দোদুল্যমান অবস্থা দেখে অবতারটা ক্ষেপে গিয়ে হাতের কস্তনিটা বেদির পাশের আগুনে ঠেসে ধরলো। মুহূর্তে অস্ত্রটার চামড়ার ফিতেয় আগুন ধরে গেল। যেন আগে থেকেই তেল মাখানো ছিল ওতে। আগুনটা ভালো মতো ধরতেই হাতের এক মোচড়ে সেটাকে আশে পাশে ছড়িয়ে থাকা শুকনো ভুসি আর পাতার দিকে ছুঁড়ে দিল। সাথে সাথেই সেগুলোয় আগুন ধরে গেল আর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরেই ঘরের জীবিত বা মৃত প্রতিটা মানুষের চারপাশে দেখা গেল আগুন।

তাপের হলকায় মানু-হটেপ পিছু হটলো। ধোঁয়া আর গন্ধে তার চোখে পানি চলে এলো। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে ওর। বহু কষ্টে যখন চোখ খুলল ততোক্ষণে চারপাশে আগুনের উচ্চতা আরো বেড়েছে। আর আগুনের ওপাশেই পুরোহিতবৃন্দ মন্দির ত্যাগ করছে।

“এ তুমি কী করলে?” মানু-হটেপের স্ত্রী বিলাপ করে উঠল।

পুরোহিতরা বেদির অপর পাশের একটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছেন। আগুনের উচ্চতা এখন প্রায় বুক সমান। আর জীবিত বা মৃত সবাইকে ঘিরেই আগুনের শিখা লক লক করছে।

“আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমার ভয় লাগছিল।” বিড়বিড় করে বলল মানু-হটেপ।

ওসাইরিস তাদেরকে একটা সুযোগ দিয়েছিল আর সে কি-না সেটাকে এভাবে পায়ে ঠেললো। প্রচণ্ড মানসিক কষ্ট নিয়ে মানু-হটেপ বেদির ওপরের বিষের পাত্রটার দিকে তাকাল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই চারপাশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। ফলে পাত্রটাও চোখের সামনে থেকে আড়াল হয়ে গেল।

চোখে আলো এসে পড়তেই মানু-হটেপের ঘুম ভেঙে গেল। ছাদের ফুটো দিয়ে আলোটা আসছে। আগুন নিভে গেছে তবে চারপাশে গোল হয়ে পড়ে আছে পোড়া ছাই। বাতাসে ধোয়ার গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। মেঝের অন্যান্য জায়গাতেও ছাইয়ের পাতলা স্তর দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। কিছুক্ষণ।

কোনোমতে উঠে বসলো ও। মাথাটা টলছে। বহু কষ্টে চারপাশে তাকাল মাথা ঘুরিয়ে। মন্দিরের দরজা খোলা। সকালের মৃদুমন্দ ঠাণ্ডা বাতাস আসছে সেদিক দিয়ে। পুরোহিতরা ওদেরকে হত্যা করেনি, কিন্তু কেন?

কারণটা ভাবতে ভাবতেই ছোট ছোট আঙুল ওয়ালা একটা ছোট্ট হাত তার পাশে কাঁপতে দেখা গেল। মাথা ঘুরাতেই দেখলো ওর মেয়ে। ডাঙ্গায় ভোলা মাছের মতো তড়পাচ্ছে। সাথে মুখ একবার খুলছে আর বন্ধ করছে যেন বাতাস ওর ফুসফুসে প্রবেশ করছে না, সেই সাথে হচ্ছে খিচুনি।

মানু-হটেপ ওকে ধরার জন্যে হাত বাড়ালো। অবাক করা ব্যাপার হলো মেয়েটার শরীর আর ঠাণ্ডা নেই, উষ্ণ। শরীরটাও আর শক্ত হয়ে নেই। নরম হয়ে গেছে, সেই সাথে হাত-পা ছুড়ছে। মানু-হটেপের ব্যাপারটা বিশ্বাস হতে চাইলো না। পাশে তাকিয়ে দেখে ওর ছেলেটাও নাড়াচাড়া করছে। যেন স্বপ্নের ভেতর খেলাধুলা করছে।

মানু-হটেপ চেপে ধরে ওর বাচ্চাদের ঝাঁকুনি থামাতে চাইলো কিন্তু কাজ হলো না। ওদের নাম ধরে ডাকলো কিন্তু ওরা সাড়া দিল না।

ওদের আশে পাশের বাচ্চারাও একই দশা নিয়ে জেগে উঠতে লাগল।

“সবার হলোটা কি?” ওর স্ত্রী জিজ্ঞেস করল।

“সম্ভবত ওরা এখন জীবন আর মৃত্যুর মাঝামাঝি আটকা পড়েছে। কে জানে কতটা কষ্ট হচ্ছে ওদের।” মানু-হটেপ অনুমান করল।

“কী করবো এখন আমরা?”

মানু-হটেপের মাঝে আর কোনো দোটানা নেই, নেই কোনো ইতস্ততবোধ। “আমরা এখন ওসাইরিসের নির্দেশ পালন করবো। ফারাওকে অন্ধ করে দেবো আমরা।”

মানু-হটেপ উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় দৌড়ে গিয়ে বেদিটার কাছে পৌঁছুলো। লাল রঙের বিষের পাত্রটা এখনও আছে। যদিও ওটার রঙ এখন কালো হয়ে গেছে। ও হাত বাড়িয়ে ওটা তুলে ধরলো। এটাই এখন ওর বিশ্বাস আর প্রত্যয়ের একমাত্র অবলম্বন। সমস্ত আশার একমাত্র আধার।

ওরা সবাই মন্দির ত্যাগ করল। বাচ্চাগুলোর তখনও খিচুনি চলছে। কবে থামবে কে জানে। হয়তো কয়েক সপ্তাহ। এরপর হয়তো আরো কয়েক মাস লেগে যাবে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার ধকল সামলাতে। তবে তততদিনে আখেন আতেনের চোখের জ্যোতি কমতে থাকবে আর ধর্মদ্রোহী ফারাওয়ের রাজত্বও প্রায় শেষ হয়ে যাবে।

.

০১.

আবুকির উপসাগর, নীল নদের মোহনা
১ আগস্ট ১৯৭৮, সন্ধ্যার ঠিক আগে

কামানের গোলার আওয়াজ গমগম করে আবুকির উপসাগরের বিশাল বিস্তৃতি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। আলোর ঝলকানিতে গোধূলি লগ্নটাও আরেকবার আলোকিত হয়ে উঠল। কিন্তু গোলার একটাও জায়গা মতো লাগল না। গরম পানির একটা ঝাঁপটা তুলে তলিয়ে গেল পানিতে। তবে আক্রমণকারী জাহাজগুলো এগিয়ে আসছে দ্রুত পরেরবারের গোলগুলো জলে যাবে না নিশ্চিত। আক্রমণের লক্ষ্য একটা নোঙ্গর ফেলা জাহাজ।

নৌবহরের কিছু সামনেই একটা সাম্পান। ছয়জন সুঠামদেহী ফরাসি নাবিক দাঁড় বাইছে সেটার। যুদ্ধের ঠিক মাঝখানের জাহাজটা লক্ষ করছে ছুটছে সাম্পানটা। অবস্থা দৃষ্টে এটাকে ‘সুইসাইডাল মিশন’ বললেও ভুল হবে না।

“দেরি হয়ে গেছে।“ একজন মাল্লা চেঁচিয়ে বলল।

“বাইতে থাকো। পুরো বহরটাই ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধ শুরু করার আগেই আমাদেরকে লরিয়েন্ট-এ পৌঁছাতে হবে। নাইলে সর্বনাশের বাকি থাকবে না।” দলটার মধ্যে একমাত্র অফিসার আদেশ দিল।

যে নৌবহরটার কথা আলোচনা হচ্ছে সেটা হলো নেপোলিয়নের প্রকাণ্ড ভূমধ্যসাগরীয় নৌ-বহর। সতেরোটা জাহাজ আছে বহরে। এর মধ্যে তেরটাই যুদ্ধ জাহাজ। ইংলিশদের গোলাবর্ষণের বিপরীতে ওরাও জবাব দেয়া শুরু করল। ফলে সূর্য ডোবার আগেই চারপাশ গোলাগুলির ধোঁয়ায় ভরে গেল।

সাম্পানের ঠিক মাঝখানে এক ফরাসি সামরিক ব্যক্তি, নাম এমিল দ্য শ্যাম্পেন। এই মুহূর্তে তাকে হেঁকে ধরেছে মৃত্যু ভয়। লোকটা একজন নামকরা আঁকিয়ে।

যে কোনো মুহূর্তে মারা পড়ার আশংকা না থাকলে দ্য শ্যাম্পেন বর্তমান পরিস্থিতির আনকোরা সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হতো নিশ্চিত। তার মতো দক্ষ শিল্পীই পারতে বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে নিশ্চল ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে। কীভাবে সামান্য স্কুলিংগ থেকে যুদ্ধের আগুন লাগতে পারে তার পরিপূর্ণ চিত্রায়ণ তার পক্ষেই সম্ভব। কামানের গোলার ভীতিকর আওয়াজ বাতাস কেটে ছুটে যাচ্ছে লক্ষ্য পানে। লম্বা লম্বা মাস্তুলগুলো সেগুলোর আঘাতে কাটা গাছের মতো হেলে পড়ছে। সাদা পানির ধারা কালো আকাশের সাথে গিয়ে মিশেছে। সেখানে হালকা গোলাপি আর নীল রঙের আভা। এই জায়গাটুকু আঁকতে বিশেষ যত্নের দরকার হবে। কিন্তু দ্য শ্যাম্পেন এই মুহূর্তে মাথা থেকে পা পর্যন্ত থরথর করে কাঁপছে। নৌকার একটা পাশ ধরে কোনো মতে কাঁপুনি থামানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।

হঠাৎই একটা গোলা তাদের ঠিক একশো গজ দূরে এসে পড়ল। দ্য চ্যাম্পিয়ন আর চুপ থাকতে পারলো না, “আমাদের দিকে কেন বোমা মারছে?”

“আমাদের দিকে মারছে না।” অফিসার জবাব দিল।

“তাহলে আমাদের এতো কাছে বোমা পড়ছে কেন?”

“ইংরেজ গোলন্দাজ। পশ্চিমে বোমা মারলে পূর্বে গিয়ে পড়ে। এদের নিশানা এতোই খারাপ।”

নাবিকেরা হেসে উঠল। দ্য চ্যাম্পিয়নের অবশ্য হাসি পেল না। নাবিকেরাও ভয় পাচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরেই ওরা ব্রিটিশদের সাথে লুকোচুরি খেলছে। মাস্টার মাত্র এক সপ্তাহ আগু-পিছুর কারণে ধরা পড়েনি, আর আলেকজান্দ্রিয়ার তো মাত্র ২৪ ঘণ্টার জন্যে বেঁচেছে। আর এখন নেপোলিয়নের সৈন্য বাহিনীকে ডাঙ্গায় নামিয়ে দিয়ে যেই বহরটা নীল নদের মোহনায় নোঙ্গর ফেলেছে, তখুনি ইংরেজরা আর তাদের আস্থাভাজন হোরাশিও নেলসন শেষমেশ ওদের সন্ধান পেয়ে গেছে।

“আমার ভাগ্যে যে এরকম শনি আছে, কে জানতো?” দ্য শ্যাম্পেন নিজেকেই নিজে শোনালো। তারপর বাকিদের উদ্দেশ্যে বলল, “আমার মনে হয় আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত।”

অফিসার মাথা নাড়লো, “আমাকে আপনাকে আর এই ট্রাংকগুলোকে লরিয়েন্টের অ্যাডমিরাল ক্ৰয়েস-এর কাছে পৌঁছে দেয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে।

“আমি জানি আপনাকে কী আদেশ করা হয়েছে। নেপোলিয়ন আদেশটা দেয়ার সময় আমিও সেখানেই ছিলাম।” দ্য শ্যাম্পেন বলল। “কিন্তু এই ভয়ানক গোলাগুলির মাঝে দাঁড় বেয়ে লরিয়েন্টে পৌঁছার বহু আগেই মারা পড়বো সবাই। আমাদের এক্ষুনি ফিরে যাওয়া উচিত। হয় তীরের দিকে না হয় অন্য কোনো জাহাজে।”

অফিসার মাথা ঘুরিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে তাকাল। লরিয়েন্ট বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর শক্তিশালী যুদ্ধ জাহাজ। এটাকে জলদুর্গ বললেও অত্যুক্তি হবে না। প্রায় একশো তিরিশটা কামান আছে এর পাটাতনে। ওজন প্রায় ৫ হাজার টন। হাজার খানেক মানুষ অনায়াসে থাকতে পারে এতে। এটার দুই পাশে সবসময় আরো দুটো ফরাসি যুদ্ধ জাহাজ থাকে। অ্যাডমিরাল ক্ৰয়েসের মতে এই নিরাপত্তা ব্যুহ ভাঙা অসম্ভব। কিন্তু ব্রিটিশরা সম্ভবত এ খবর জানে না। ওরা ছোট ছোট কয়েকটা যুদ্ধ জাহাজ নিয়েই পূর্ণোদ্যমে বোমা মেরেই যাচ্ছে।

লরিয়েন্ট আর একটা ব্রিটিশ জাহাজ বেলেরফোন একেবারে কাছাকাছি এসে গোলাবর্ষণ করল কিছুক্ষণ। ছোট ব্রিটিশ জাহাজটা প্রায় ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। স্টারবোর্ডের রেলিং ভেঙে ঝুলে পড়েছে একপাশে। তিনটা মাস্তুলের মধ্যে দুটোই উপরে পড়েছে। কোনো মতে দক্ষিণে পালিয়ে বাঁচলো সেটা, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আরেকটা জাহাজ এসে বেলেরফোনের শূন্যস্থান পূরণ করে ফেলল। এর মধ্যেই ব্রিটিশদের ছোট ছোট কয়েকটা রণতরী কম পানির দিকে এগিয়ে গিয়ে (ফরাসি নৌ-বহরের ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগল।

দ্য চ্যাম্পিয়নের কাছে মনে হলো দাঁড় বেয়ে এই দোযখের মধ্যে গিয়ে পড়া আর পাগলামি একই কথা। তার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি এসেছে, “আচ্ছা ব্রিটিশ জাহাজগুলোকে তো অ্যাডমিরাল ক্ৰয়েস ভাগিয়ে দেবেন-ই। তখনই শুধু এই ট্রাংকগুলো তাকে পৌঁছে দিলে হবে না?”

এই প্রস্তাবে অফিসার মাথা ঝাঁকালো। তারপর নিজের লোকদের দিকে ফিরে বলল, “দেখলে তো? এজন্যেই জেনারেল এনাকে পণ্ডিত বলে ডাকেন।”

অফিসার বহরের পিছনের একটা জাহাজের দিকে ইঙ্গিত করল। এই জাহাজটা এখনো যুদ্ধ শুরু করেনি। “গুইলাম টেল-এর দিকে যাও। রিয়ার অ্যাডমিরাল ভিয়েনেভ আছেন ওখানে। কি করা উচিত উনিই ভালো বলতে পারবেন।”

নৌকা বাওয়ায় আবার পূর্ণোদ্যম ফিরে পেল সবাই। যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে সাম্পানটা সরে গেল বেশ দ্রুতই। চারপাশে অন্ধকার আর ধোঁয়ায় ভরা থাকলেও নিরাপদেই মাল্লারা সাম্পানটা নৌ-বহরের পিছনের দিকে নিয়ে এলো। চারটা জাহাজ দাঁড়ানো সেখানে। সামনে স্থলস্তুল যুদ্ধ চলছে আর এগুলো এখানে পড়ে আছে। ব্যাপারটা আশ্চর্যজনকই বটে।

সাম্পানটা গুইলাম-টেল’-এর গায়ে ভিড়তেই দড়ির মই নেমে এলো নিচে। দ্রুততার সাথে মানুষ আর মালপত্র সবই তুলে নেয়া হলো জাহাজে।

দ্য শ্যাম্পেন ডেকে পৌঁছে দেখলেন যুদ্ধের অবস্থা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তার কল্পনাতেই কখনো এমন কোনো দৃশ্য ছিল না। ব্রিটিশগুলো সংখ্যায় কমে গেলেও কৌশলগত দিক দিয়ে ওরাই এগিয়ে আছে এখন। ফরাসি জাহাজগুলোর সাথে মুখোমুখি আক্রমণ বন্ধ করে দিয়েছে। পিছনের জাহাজগুলোকেও আর আক্রমণ করছে না, তার বদলে একযোগে সামনের সারির জাহাজগুলোর দিকে গোলা বর্ষণ করছে। ফলে প্রতিটা ফরাসি জাহাজকে এখন দুপাশে দুটো করে ব্রিটিশ জাহাজের সাথে লড়তে হচ্ছে। ফলাফলও অনুমেয়। অজেয় ফরাসি নৌ-বহর আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

“অ্যাডমিরাল ভিয়েনেভ আপনার সাথে দেখা করতে চান।“ একজন স্টাফ অফিসার বলল দ্য শ্যাম্পেনকে। তারপর রাস্তা দেখিয়ে রিয়ার অ্যাডমিরালের কাছে নিয়ে গেল। অ্যাডমিরালের মাথা ভরা সাদা চুল, কেমন চ্যাপটা মুখ, লম্বা কপাল আর নাকটা রোমানদের মতো লম্বা। নিখুঁত একটা ইউনিফর্ম পরনে তার। গাঢ় নীল শার্ট, সেটার এখানে সেখানে সোনালি সুতোর কারুকাজ। বুকে একটা লাল রঙের স্যাশ। দ্য চ্যাম্পিয়নের কাছে মনে হলো যুদ্ধ না, বরং প্যারেড় করতে বেরিয়েছেন অ্যাডমিরাল।

ভিয়েনেভ কিছুক্ষণ ট্রাঙ্কের তালাটা নিয়ে তোণ্ডতি করল। তারপর দ্য শ্যাম্পেনকে বলল, “আপনি সম্ভবত নেপোলিয়নের পণ্ডিতদের একজন।”

পণ্ডিত শব্দটা নেপোলিয়ন ব্যবহার করেন। দ্য শ্যাম্পেন এবং আরো কয়েকজনকে এটা বলে ক্ষেপিয়ে মজা পান তিনি। তারা প্রত্যেকেই বিজ্ঞানী এবং বিদ্বান ব্যক্তি। নেপোলিয়নই তাদের জড়ো করে মিসরে নিয়ে এসেছেন। উদ্দেশ্য এমন কোনো গুপ্তধন খুঁজে বের করা, যা দেহ ও মন দুটোকেই প্রশান্ত করবে।

দ্য শ্যাম্পেন প্রাচীন ভাষার পাঠোদ্ধারের ব্যাপারে একজন উঠতি বিশেষজ্ঞ। আর প্রাচীন ভাষার ব্যাপারে পিরামিড আর স্ফিংস এর দেশের তুলনা আর কোনটা আছে?

আর দ্য শ্যাম্পেন শুধু একজন পণ্ডিত-ই না। নেপোলিয়ন ব্যক্তিগতভাবে তাকে এই অভিযানের জন্যে বাছাই করেছেন। এখানকার সব পৌরাণিক কাহিনীর পিছনের আসল সত্যটা তিনি জানতে চান। বিনিময়ে মোটা পুরস্কারের ওয়াদা করেছিলেন। এতো টাকা দেয়ার কথা ছিল যা দ্য শ্যাম্পেন দশ জনমেও আয় করতে পারতো না। সাথে জমি-জমার প্রতিশ্রুতি তো ছিলই। ধন, দৌলত, সম্মান সবই দ্য শ্যাম্পেন পাবে, তবে তার জন্যে শর্ত একটাই। তাকে খুঁজে বের করতে হবে মৃত্যু থেকে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার উপায়। আর সেই কৌশল ফারাওদের দেশেই পাওয়া সম্ভব।

গত মাস খানেক ধরে দ্য’ শ্যাম্পেন আর ওর ছোট্ট দলটা “মৃতদের শহর” নামে জায়গাটা চষে ফেলছে। এর মাঝে যা কিছু দরকারি মনে হয়েছে সংগ্রহ করেছে-প্যাপিরাসের ওপর লেখা, পাথরে খোদাই বা লিপি যা পেয়েছে সব। যেগুলো সংগ্রহ করতে পারেনি সেগুলো খাতায় এঁকে নিয়েছে।

“আমি বিজ্ঞান ও কলা পরিষদের একজন সদস্য,” দ্য শ্যাম্পেন জবাব দিল। এই পদবীটাই তার পছন্দ।

ভিয়েনেভের তাতে কোনো ভাবান্তর হলো না, “তা আপনি এটা সাথে করে কী নিয়ে এসেছেন, কমিশনার?”

দ্য শ্যাম্পেন নিজেকে সামলালো, “বলা যাবে না, অ্যাডমিরাল। নেপোলিয়নের নির্দেশ ছাড়া এটা ভোলা নিষেধ। ভেতরে কী আছে সেটা নিয়েও আলোচনা করা যাবে না।”

ভিয়েনেভের এবারও কোনো ভাবান্তর নেই। “চাইলেই আবার এগুলো সিল করা যাবে। ঝপপট চাবিটা দিন।”

“অ্যাডমিরাল, জেনারেল কিন্তু ক্ষেপে যাবেন।” সতর্ক করল দ্য শ্যাম্পেন।

“জেনারেল এখানে নেই।” মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল ভিয়েনেভ। নেপোলিয়ন ঐ সময়টাতে খুবই ক্ষমতাধর লোক কিন্তু তখনো সম্রাটের আসনে বসেননি। পাঁচ জনের যে দলটা বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিল, তারাই তখন দেশ চালাচ্ছিল। আর বাকিরা ক্ষমতার লোভে ছোঁক ছোঁক করে বেড়াচ্ছিলো চারপাশে।

কিন্তু তারপরও দ্য শ্যাম্পেন ভিয়েননেভের এমন আচরণের মানে খুঁজে। পেল না। নেপোলিয়ন বা অ্যাডমিরাল ক্ৰয়েস কেউই হেলাফেলার লোক না। ব্রুয়েস ভিয়েনেভের সরাসরি ওপরওয়ালা বলা যায়। মাত্র আধা মাইল দূরেই তিনি জীবনবাজি রেখে লড়ছেন। আর ভিয়েনেভ এমন নাজুক পরিস্থিতিতে যুদ্ধে যোগ দেয়ার পরিবর্তে এই সামান্য ব্যাপারে কেন মাথা ঘামাচ্ছে?

“চাবিটা!” ভিয়েনেভ আবার হাত বাড়ালো।

দ্য শ্যাম্পেন আর কি করে। কথা না বাড়িয়ে গলা থেকে চাবিটা খুলে ভিয়েনেভের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “ট্রাংকের সব দায় দায়িত্ব এখন থেকে আপনার অ্যাডমিরাল।”

“সেটাই ভালো। আপনি এখন যেতে পারেন।” ভিয়েনেভ বলল।

দ্য শ্যাম্পেন ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হয়েও আবার ফিরে তাকাল। সাহস করে প্রশ্নটা করেই ফেলল, “আমরা কি যুদ্ধে যোগ দিচ্ছি?”

অ্যাডমিরালের ভ্রূ একটু উঁচু হলো। যেন অবাস্তব কোনো প্রশ্ন করেছে দ্য শ্যাম্পেন।

“এখনো সে রকম কোনো নির্দেশ আসেনি।”

“নির্দেশ?”

“অ্যাডমিরাল ক্ৰয়েস বা লরিয়েন্টের কোনো পাত্তা নেই অনেকক্ষণ।”

“অ্যাডমিরাল! ইংলিশরা দুপাশ থেকে আক্রমণ করছে। নির্দেশের জন্যে বসে থাকলে তো সব শেষ হয়ে যাবে।” দ্য শ্যাম্পেন বলল।

ভিয়েনেভ চকিত উঠে দাঁড়িয়ে একটা ক্ষ্যাপা ষাড়ের মতো দ্য শ্যাম্পেনকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “তোর এতো বড় সাহস আমাকে কথা শোনাস?”

“না, অ্যাডমিরাল, আমি শুধু–”।

“বাতাস বইছে উল্টো দিকে। ওখানে পৌঁছুতে চাইলে পুরো উপসাগর ঘুরে তারপর যাওয়া লাগবে। এরচেয়ে অ্যাডমিরাল ক্ৰয়েস পিছু হটে আমাদের কাছাকাছি চলে আসলেই আমরা তার সাথে যোগ দিতে পারতাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তার সে রকম কোনো ইচ্ছা-ই নেই।”

“তাই বলে এখানে চুপচাপ বসে থাকবো?”

ভিয়েনেভ তার ডেস্কের ওপর থেকে একটা ছুরি তুলে নিয়ে বলল, “জায়গায় খুন করে ফেলবো, আর যদি একবার আমার সাথে এভাবে কথা বলিস। পণ্ডিত মশাই! যুদ্ধ বা জাহাজ সম্পর্কে কি জানিস তুই, অ্যাঁ?”

দ্য শ্যাম্পেন বুঝলো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে! “মাফ করবেন অ্যাডমিরাল। আজ দিনটাই আসলে খারাপ।”

“ভাগ এখান থেকে। আর ভাগ্যকে ধন্যবাদ দে যে আমাদের এখনো যুদ্ধে যেতে হচ্ছে না। যদি হয় তাহলে তোকে জাহাজের মাস্তুলে গলায় বেল বেঁধে ঝুলিয়ে রাখবো। যাতে ব্রিটিশরা প্রথমেই তোকে নিশানা করতে পারে।”

দ্য শ্যাম্পেন এক কদম পিছিয়ে মাথাটা হালকা ঝুঁকিয়েই উল্টো দিকে হাঁটা দিল। ওখান থেকে বেরিয়ে ওপরে উঠে এলো ও। জাহাজের সামনের দিকে গিয়ে দূরের ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে লাগল।

এত দূর থেকেও যুদ্ধের ভয়াবহতা ওকে কাঁপিয়ে দিল। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিলো। দূরে দেখা যাচ্ছে দুটো জাহাজ গা ঘেষাঘেষি করে গোলা বর্ষণ করছে। মাস্তুল থেকে মাস্তুল, গলুই থেকে গলুই কিংবা ডেকের ওপর যে যেখান থেকে পারছে উন্মত্তের মতো গুলি করে যাচ্ছে।

“কী সাহস!” দ্য শ্যাম্পেন তন্ময় হয়ে ভাবতে লাগল।

কিন্তু শুধু সাহস থাকলেই হয় না। এই মুহূর্তে ফরাসি বাহিনীর একটা গুলির বিপরীতে প্রায় তিন থেকে চারগুণ বেশি গুলি করছে ব্রিটিশ বাহিনী। আর ভিয়েনেভের অনীহার কারণেই তাদের যুদ্ধরত জাহাজের সংখ্যা এখন বেশি।

যুদ্ধ ক্ষেত্রের ঠিক মাঝে নেলসনের তিনটা জাহাজ মিলে লরিয়েন্টকে আক্রমণ চালাচ্ছে। চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে এখন ওটাকে আর চেনাই যায় না। সুন্দর চকচকে কাঠামো বা বিশাল মাস্তুল বহু আগেই ভেঙে পড়েছে। পুরু কাঠামোর পুরোটাই এখানে সেখানে খাবলা খাবলা উঠে গেছে। কোথাও কোথাও ভেঙে গেছে। যদিও তখনো কয়েকটা কামান অবশিষ্ট আছে, কিন্তু দ্য শ্যাম্পেন, বিশেষজ্ঞ না হয়েও বলতে পারে লরিয়েন্টের সময় শেষ।

হঠাৎ জাহাজটায় আগুন ধরে গেল। দাবানলের মতোই সেটা মেইন ডেকে ছড়িয়ে পড়ল। এখানে সেখানে দেখা গেল ঘন ধোয়ার কুণ্ডলি। দুরন্ত গতিতে আগুনটা সব পালে আর ভাঙা মাস্তুলে ছড়িয়ে পড়ল। তারপর খোলা হ্যাঁচ বেয়ে নিচের খোলেও ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তেই।

হঠাৎ প্রচণ্ড আলোর ঝলকানি। দ্য শ্যাম্পেন সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করেছে কিন্তু তারপরও অন্ধ হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্যে। পরমুহূর্তেই শোনা গেল বিকট আওয়াজ। দ্য শ্যাম্পেন জীবনেও এতো জোরালো কোনো শব্দ শোনেনি। শক ওয়েভের প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে পড়ল ও। মাথার চুল পুড়ে গেছে, একটুর জন্যে মুখে লাগেনি।

ও কোনোমতে চিৎ থেকে কাত হলো। বাতাসের জন্যে হাসফাস করছে। কয়েকবার গড়াগড়ি করে কোটের আগুন নেভালো। বহু কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে আবার যুদ্ধের দিকে তাকাতেই বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেল ওর।

লরিয়েন্ট নেই।

পানির মধ্যে বিশাল একটা এলাকা জুড়ে আগুন জ্বলছে। বিস্ফোরণের ধাক্কায় আশেপাশের ছয়টা জাহাজেও আগুন ধরে গেছে। তিনটা ব্রিটিশ আর তিনটা ফরাসি জাহাজ। যুদ্ধ আপাতত থেমে গেছে। সবাই নিজ নিজ জাহাজের আগুন নেভাতে ব্যস্ত। লরিয়েন্টের পরিণতি কেউ চায় না।

“আগুন নিশ্চয়ই ওটার গোলা রাখার ঘরটায় ঢুকে পড়েছিল।” পাশ থেকে একজন ফরাসি নাবিক বলল দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে।

প্রতিটা জাহাজের খোলেই শত শত ব্যারেল গান পাউডার রাখা। আগুনের একটা স্ফুলিঙ্গও সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে।

ফরাসি লোকটার গাল বেয়ে অশ্রুর ধারা নামল। কিন্তু দ্য চ্যাম্পিয়নের গা গোলাচ্ছে। এসব আবেগ অনুভূতি ওকে আর স্পর্শ করল না।

লরিয়েন্ট যখন আবুকির বন্দরে পৌঁছায় তখন এতে প্রায় হাজারখানেক মানুষ ছিল। দ্য শ্যাম্পেন নিজেও জাহাজটায় চড়েছে। অ্যাডমিরাল ক্ৰয়েসের সাথে খাবার খেয়েছে। এই অভিযাত্রায় ও যতজনকে চিনতে তাদের সবাই ছিল ঐ জাহাজটাতে। এমনি অফিসারদের বৌ-বাচ্চারাও ছিল ওতে। তাদের মধ্যের কেউ-ই যে আর বেঁচে নেই, কেউ না বলে দিলেও দ্য শ্যাম্পেন সেটা জানে।

সেই সাথে শেষ হয়ে গেল গত একমাসে ওদের এতো পরিশ্রম। সাথে হাত ছাড়া হয়ে গেল জীবনের শ্রেষ্ঠতম সুযোগ। শুধু ভিয়েনেভের দখল নেয়া ট্রাঙ্কটাই সম্বল এখন।

দ্য চ্যাম্পিয়ন ধপ করে ডেকের ওপর বসে পড়ল, “মিসরীয়রা আমাকে আগেই বলেছিল।” বলল ও।

“আগেই বলেছিল?” জিজ্ঞেস করল নাৰিক।

মৃতদের শহর থেকে কিছু নিতে নিষেধ করেছিল। তাহলে নাকি অভিশাপ লাগবে। বার বার একটা অভিশাপের কথা বলছিল….কুসংস্কার ভেবে তখন হেসেই উড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন,…”

দ্য শ্যাম্পেন উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু আবার পড়ে গেল। নাবিকটা এসে ওকে ধরে নিচে নিয়ে গেল। তারপর সেখানে বসে বসে ইংরেজদের আগমনের অপেক্ষা করতে লাগল।

আক্রমণটা এলো ভোরের দিকে। ব্রিটিশরা আবার জড়ো হয়ে বাকি ফরাসি জাহাজগুলো ঘায়েল করতে বেরিয়েছে। কিন্তু মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি বা গোলার আঘাতে কাঠের মড়মড় শব্দের পরিবর্তে দ্য শ্যাম্পেন বাতাসের শব্দ শুনতে পেল। তার মানে শুইলাম টেল চলতে আরম্ভ করেছে।

দ্য শ্যাম্পেন ওপরে উঠে এসে দেখে জাহাজ পূর্ণ গতিতে উত্তর-পূর্ব দিকে ছুটছে। ব্রিটিশরাও ধাওয়া করছে কিন্তু ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। দূর থেকেই আলোর ঝলকানি দেখে বোঝা গেল গোলা ছুড়ছে। কিন্তু কোনোটা ধারে কাছেও এলো না। কিছুক্ষণ পর ওদের জাহাজগুলোর পালও হারিয়ে গেল দিগন্তের ওপারে।

দ্য’ শ্যাম্পেন ভিয়েনেভের সাহসের ব্যাপারে সন্দিহান, তবে লোকটা যে ধূর্ত সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। আজও বেঁচে থাকার জন্যে ভিয়েনেভের কাছে ঋণী।

সকাল পড়ে আসতেই শুইলাম টেল আর ভিয়েনরে অধীনে থাকা বাকি তিনটা জাহাজও নেলসন আর ওর সাঙ্গপাঙ্গদের বহুদূর ফেলে এগিয়ে গেল। সেখান থেকে তারা মাল্টায় পৌঁছায়। দ্য শ্যাম্পেন তার বাকিটা জীবন সেখানেই অতিবাহিত করে। গবেষণা নিয়েই ব্যস্ত ছিল বেশির ভাগ সময়। ভিয়েনেভ আর নেপোলিয়নের সাথে চিঠি চালাচালিও হয়েছে কয়েকবার। তবে কী রহস্য সে মিসর থেকে উদ্ধার করে এনেছিল সেটার হদিস বের করতে না পারার আক্ষেপ তার আমৃত্যু ছিল।

.

০২.

এমভি. তোরিনোমাল্টার পশ্চিমে সত্তর মাইল দূরে
 বর্তমান সময়

এম. ভি. তেরিনো একটা তিনশ ফুটি মালবাহী জাহাজ। পুরো কাঠামোটাই স্টিলের তৈরি। ১৯৭৩ সালে প্রথম পানিতে ভাসানো হয় জাহাজটা। কালের থাবায় আগের জৌলুস আর নেই জাহাজটার। স্পিডও তুলতে পারে না বেশি, তাই এখন আর বেশি দূরত্বে যায় না। ভূমধ্যসাগরের হোট ছোট কিছু দ্বীপ বা কালেভদ্রে লিবিয়া, সিসিলি, মাল্টা আর গ্রিসেই এটার যাত্রা এখন সীমাবদ্ধ।

ভোর হতে আর এক ঘণ্টা বাকি। মাল্টা থেকে সত্তর মাইল দূরে এখন জাহাজটা। যাচ্ছে পশ্চিমে ছোট্ট একটা ইতালি নিয়ন্ত্রিত দ্বীপ ল্যাম্পেডুসাতে।

এই শেষ রাতেও জাহাজের ওপর বেশ কয়েকজন মানুষের ভিড়। প্রত্যেকেই খুব নার্ভাস। অবশ্য সেটা হওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। গত এক ঘণ্টা ধরে একটা নামহীন জাহাজ ছায়ার মতো ওদের জাহাজকে অনুসরণ করছে। জাহাজটার বাতি নিভানো। ধীরে ধীরে দূরত্ব কমছে।

“ওটা কী আরো কাছে চলে এসেছে নাকি?”

চিৎকার করে জাহাজের মাস্টার প্রশ্নটা করল, নাম কনস্ট্যানটিন ব্রাকো। গাট্টাগোট্টা গড়ন, পাকানো পেশি, মাথায় লাল-সাদা চুলে ভরা। তিনদিন দাড়ি না কামানোয় মুখটা দেখাচ্ছে সিরিষ কাগজের মতো।

এই মুহূর্তে জাহাজের হুইল ধরে আছে সে। জবাব না পেয়ে আবার হাক ছাড়লো, “কি হলো?”

“জাহাজটা এখনো দেখা যাচ্ছে। আমাদের দিকেই ঘুরছে। গতিও বাড়ছে বোঝা যাচ্ছে।” ফাস্ট মেট জবাব দিল।

“সব লাইট নিভিয়ে দাও।” ব্রাকো নির্দেশ দিল।

একজন ক্রু মাস্টার সুইচ টিপে দিতেই পুরো তোরিনো আঁধারে ডুবে গেল। সেই সুযোগে ব্রাকো আবারো জাহাজের মুখ আরেকদিকে ঘুরিয়ে দিল।

“ওদের কাছে রাডার বা নাইট ভিশন গগলস থাকলে কিন্তু এসব করে কোনো লাভ হবে না।” ফাস্ট মেট বলল আবার।

“কিছুটা সময় তো অন্তত পাওয়া যাবে।” ব্রাকো জবাব দিল।

“এরা বোধহয় কাস্টমসের লোক বা ইতালিয়ান কোস্ট গার্ডং” আরেকজন ক্রু জিজ্ঞেস করল।

ব্রাকো মাথা নাড়লো, “তা হলে তো ভালোই হয়। বেঁচে যাবে।”

ফার্স্ট মেট ইঙ্গিতটা ধরতে পারলো, “মাফিয়া?”

ব্রাকো মাথা ঝাঁকালো, “আমাদের আগেই বখরা দিয়ে আসা উচিত ছিল। ওদের এলাকায় চোরাচালান করছি। ভাগ তো চাইবেই।”

ব্রাকো ভেবেছিল অন্ধকারে হয়তো ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবে, কিন্তু একটু পরেই বুঝলো যে চালে ভুল হয়ে গেছে।

“অস্ত্রপাতি বের করো। লড়াই করা ছাড়া উপায় নেই।” আদেশ করল সে।

“কিন্তু কনস্ট্যানটাইন, গোলাগুলি হলে কিন্তু গোলাগুলির সময় কন্টেইনারগুলোতে গুলি লাগলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”

তেরিনোর ডেক ভরা অনেক ভিন্ন মালবাহী কন্টেইনার। কিন্তু এগুলোর বেশিরভাগের ভেতর-ই তরল পোপেনের একেকটা ট্যাঙ্ক লুকানো। একেকটা ট্যাংক প্রায় একেকটা বাসের সমান বড়। আরো কিছু চোরাচালান সামগ্রীও এর সাথে আছে। মিসরের এক লোক বিশটা ব্যারেল ভরে অজানা এক জিনিস তুলে দিয়েছে। তবে ইউরোপ জুড়ে মাত্রাতিরিক্ত ট্যাক্সের কারণে প্রোপেন চোরাচালানে ব্যাপক লাভ হচ্ছে বর্তমানে।

“শালার চোরাকারবারীদের আজকাল ট্যাক্স দেয়া লাগে,” ব্রাকো নিজেই নিজেকে শোনালো। নিরাপত্তার জন্য টাকা দাও, কারো এলাকা দিয়ে যেতে হলে টাকা দাও, কোথাও জাহাজ ভিড়ালে টাকা দাও। এই সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো সরকারের চেয়ে কোনো অংশে কম না।

“এখন দ্বিগুণ খেসারত দিতে হবে। টাকাও যাবে, মালপত্রও যাবে। আবার যদি আমাদেরকে মেরে অন্যদেরকে শিক্ষা দিতে চায় তাহলে তো হয়েছেই।”

ফার্স্ট মেট মাথা ঝাঁকালো, আরেকজনের তেল বাঁচাতে নিজের জান খোয়াতে মোটেও রাজি নয় সে। “আমি বন্দুক বের করছি।” বলল সে।

ব্রাকো তার দিকে একটা চাবি ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা। হয় মারো নয় মরো পরিস্থিতি এখন।”

ফার্স্ট মেট অস্ত্রাগারের দিকে ছুটলো। তার আগে নিচের ডেকের সবাইকে ঘুম থেকে তুলবে। সে বের হতেই হুইল হাউজে আরেকজনকে দেখা গেল। একজন যাত্রী। অদ্ভুত নাম তার আম্মন তা। ব্রাকো আর ওর লোকেরা মিসরী বলে ডাকে।

লিকলিকে গড়ন লোকটার। চোখ জোড়া গভীর, মাথা কামানো। গায়ের রং গাঢ় বাদামি। চেহারায় উল্লেখযোগ্য কোনো বৈশিষ্ট্য লোকটার নেই। ব্রাকো ভেবে পায় না কোন দুঃখে লোকটা মাত্র কয়েক ব্যারেল হাশিস/(ভভাংগাঁজার শরতে) বা অন্য কোনো সস্তা মাদক নিয়ে এই ভয়ানক রাস্তায় ভ্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

“জাহাজের বাতি সব নিভানো যে? আর আমরা আরেক দিকে যাচ্ছি কেন?” কোনো ভনিতা না করেই আম্মান তা জিজ্ঞেস করল।

“সেটাও কী বুঝিয়ে বলতে হবে?”

কিছুক্ষণ চিন্তা করেই মিরীয় দুয়ে দুয়ে চার মিলাতে পারলো। তারপর কোমর থেকে একটা নাইন মি. মি. পিস্তল বের করে হাতে ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেল। জাহাজের কিনারে গলা লম্বা করে অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করতে লাগল।

“এদিকে না, পিছন দিকে,” ব্রাকো বলল।

বলামাত্রই ব্রাকো বুঝলল ওর ধারণা ভুল। কারণ সামনে থেকে দুটো লাইট এসে পড়েছে তেরিনোর ওপর। একটার ঝলকে ব্রিজে দাঁড়ানো সবার চোখ ধাধিয়ে গেল, অপরটা জাহাজের রেলিং ধরে ঘুরতে লাগল।

দুটো রাবারের ডিঙ্গিও দেখা গেল পানিতে। ব্রাকো সাথে সাথে জাহাজের মুখ সেদিকে ঘুরিয়ে দিল। কিন্তু কাজ হলো না। তারা দূরে সরে গিয়ে আবার জাহাজের পিছু নিলো। ধরে ফেলবে সহসাই। ডিঙ্গি থেকে হুক বাঁধা দড়ি ছুঁড়ে মারলো কেউ। জাহাজের রেলিং-এ সেটা আটকাতেই কয়েক সেকেন্ড পরই দুই দল অস্ত্রধারী লোক উঠে এলো তোরিনোর ডেকে।

“মাথা নামান,” ব্রাকো চিৎকার করে উঠল।

সাথে সাথে শুরু হলো গুলি। ব্রিজের জানালা আর দেয়াল ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেলো মুহূর্তেই। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো মিসরীয় লোকটা একচুলও নড়েনি। এমনকি কোনো কিছুর আড়ালও নেয়নি। গুলি থামতেই সে হুইল হাউজের আড়ালে সরে গেল, তারপর হাতের পিস্তল তুলে পরপর কয়েকটা গুলি করল।

ব্রাকো অবাক হয়ে দেখে একটাও মিস হয়নি। ঢেউয়ের তালে জাহাজ দুলছে, তারপরও আম্মন তা দুরূহ কোণ থেকে গুলি করে দুজন লোকের একেবারে ঘিলু বের করে দিল। তৃতীয় গুলিতে ওদের দিকে তাক করা একটা স্পটলাইট ভেঙে চুর চুর হয়ে গেল।

গুলি করেই মিসরীয়টা পিছনে সরে দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল। পরমুহূর্তেই সেদিকে অটোমেটিক পিস্তল গর্জে উঠল।

ব্রাকো তখনও মেঝের ওপরেই পড়ে আছে। কারণ গুলি হুইল হাউজের দিকেও করা হচ্ছে। একটা বুলেট ওর বাহু ছুঁয়ে চলে গেল। আরেকটা মামবুকার একটা বোতল গড়িয়ে দিল। সৌভাগ্যের জন্য ব্রাকো রেখে দিয়েছিল ওটা। কিন্তু ভাঙ্গা বোতল থেকে তরল গড়িয়ে পড়তেই ব্রাকো বুঝলো আজ ভাগ্য বেশি সুবিধার না। বোতলে তিনটা কফি বীজ ছিল। একটা হলো উন্নতি, একটা স্বাস্থ্য আরেকটা শান্তির বাহক হিসেবে। কিন্তু তিনটার কোনোটাই এখন চোখে পড়ল না।

রেগেমেগে ব্রাকো ওর পিস্তল বের করল। একবার মিসরীয়টার দিকে তাকাল। এখনও বহাল তরিয়তে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার সাহস আছে বটে। আর নিশানাও মারাত্মক। লোকটার সম্পর্কে ধারণা আমূল পাল্টে গেছে ব্রাকোর। লোকটা যে কে তা ব্রাকো জানে না, তবে মিসরীয় লোকটা-ই যে এই জাহাজের সবচেয়ে মারাত্মক লোক, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ভাগ্য ভালো। লোকটা আমাদের দলেই আছে। মনে মনে ভাবলো ব্রাকো।

“ফাটাফাটি শুটিং। আপনি যে এই জিনিস, আগে বুঝিনি।”

“আমি বুঝতে দেইনি তাই,” মিসরীয় বলল।

আবার ভেসে এলো গুলির শব্দ। এবার জাহাজের পিছন দিক থেকে। জবাবে ব্রাকোও সেদিকে গুলি ছুড়লো এক পশলা।

“খামাখা গুলি নষ্ট করছেন, মিসরীয় বলল।

“হোক, কিছুটা সময় তো অতিরিক্ত পাবো,” ব্রাকো জবাব দিল।

“সময় সব ওদের হাতে। ওদের কমপক্ষে এক ডজন লোক আছে এখন জাহাজে। আরো একটা রাবারে ভিঙ্গি এদিকেই আসছে।” মিসরীয় জানালো।

পিছন দিকে আরো এক পশলা গুলি বিনিময়ের শব্দে বোঝা গেল যে মিসরীয়র কথা মিথ্যা নয়।

“ঝামেলা হয়ে গেল দেখছি। পিস্তল-টিস্তল তো সব পিছন দিকেই রাখা। আমার লোকেরা যদি ওগুলো আনতে না পারে তাহলে তো খেলা এখানেই শেষ।” ব্রাকো বলল।

মিসরীয় হুইল হাউজের দরজার দিকে এগিয়ে বাইরে তাকাল। তারপর ঘুরে বলল, “আপনার আশংকাই সত্যি।”

বাইরে ভারি পদশব্দ শোনা গেল। ব্রাকো পিস্তল হতে গুলি করার জন্যে রেডি হয়ে গেল। কিন্তু মিসরীয় দরজা খুলতেই কাঁপতে কাঁপতে এক আহত ক্রু মুখ থুবড়ে পড়ল ঘরটায়।

“ওরা নিচের ডেকের দখল নিয়ে নিয়েছে। কোনো মতে উঠে বসে বলল সে।

“রাইফেলগুলো কই?”

ক্রু মাথা নাড়লো, “ওগুলোর কাছেও যেতে পারিনি।”

লোকটা পেট চেপে ধরে আছে। বুলেটে ফুটো হয়ে গেছে জায়গাটা। রক্ত পড়ছে চুঁইয়ে চুঁইয়ে। কাত হয়ে পড়ে গেল একদিকে, নড়ছে না।

এদিকে আততায়ীর দলও এগিয়ে আসছে বোঝা যাচ্ছে, সামনে যা কিছু পড়ছে, তাতেই গুলি করছে। ব্রাকো এগিয়ে ওর কুটাকে সাহায্য করার চেষ্টা করল।

ওকে ছাড়ুন। আমাদেরকে এখান থেকে সরতে হবে। মিসরীয় বলল, ব্রাকোর মোটেও সে-ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু লোকটার সময় শেষ, ও থেকেও কিছু করতে পারবে না। ভয়ানক রেগে গেছে সে, এখন কারো খুন ঝরাতে না পারলে মাথা ঠাণ্ডা হবে না। পিস্তল বাগিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো সে। সামনে যাকেই পাবে তাকেই পরপারে পাঠাবে বলে সংকল্প করেছে মনে মনে। কিন্তু মিসরীয় লোকটা ওকে টেনে ধরলো।

“আমাকে ছেড়ে দিন।” ব্রাকো আদেশ দিল।

‘খামাখা মরার ইচ্ছে হচ্ছে কেন?”

“শুয়োরের বাচ্চারা আমার লোকজনকে মারছে আর আমি আঙুল চুষবো। উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বো ওদের।”

“আপনার লোকজনের কোনো দাম নেই। ওরা যায় যাক। আমাদেরকে আমার মাল পৌঁছাতে হবে জায়গা মতো।” ঠান্ডা স্বরে বলল আম্মন তা।

ব্রাকো হতভম্ব হয়ে গেল। “আপনার মাথা কি খারাপ? আপনার কি মনে হয় আপনি জীবন নিয়ে এই জাহান্নাম থেকে পালাতে পারবেন?”

“ঐ ব্যারেলগুলোতে যা আছে তা বহুগুণে শক্তিশালী। সময় মতো পৌঁছাতে পারলে ঐ বেকুবগুলোর হাত থেকে আপনার জাহাজ বাঁচানো কোনো ব্যাপারই হবে না। এখন দেরি না করে আমাকে ওগুলোর কাছে নিয়ে চলুন।”

ব্রাকো খেয়াল করল কথাগুলো বলতে বলতে মিসরীয় লোকটার চোখ কেমন অদ্ভুত এক উজ্জ্বলতায় ভরে উঠল। সম্ভবত লোকটা মিথ্যা বলছে না। “ঠিক আছে, আসুন।”

ব্রাকো সামনে এগিয়ে ভাঙ্গা জানালাটা দিয়ে লাফিয়ে কাছের কন্টেইনারটার ওপর গিয়ে পড়ল। মিসরীয়ও এলো তার পিছু পিছু।

জানালা থেকে ডেকের উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট কিন্তু অন্ধকার থাকায় ব্রাকো তাল সামলাতে পারলো না। অদ্ভুত শব্দ করে আছড়ে পড়লো। হাঁটু ছিলে গেছে।

মিসরীয়ও ওর পাশেই লাফিয়ে নামল। তারপর হামাগুঁড়ি দিয়ে এক পাশে সরে গেল।

“আপনার মাল কন্টেইনারের প্রথম সারিগুলোর মধ্যেই আছে। এদিক দিয়ে আসুন।” ব্রাকো বলল।

দুজন প্রায় দৌড়ে কন্টেইনারগুলো পার হলো। একদম সামনের সারিতে পৌঁছে ব্রাকো কন্টেইনার বেয়ে নিচে নেমে এলো তারপর মেঝেতে শুয়ে পড়ল।

মিসরীয়ও একই কাজ করল। দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ লুকিয়ে থাকল সেখানে। থেকে থেকে বিক্ষিপ্ত গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে দূরে। যুদ্ধ প্রায় শেষ।

“এটাতেই আছে আপনার জিনিস।” ব্রাকো বলল।

“খোলেন তাড়াতাড়ি।” মিসরীয় তাড়া দিল।

ব্রাকো ওর মাস্টার কী বের করে তালা খুলে ফেলল। তারপর দরজা ধরে টান দিতেই প্রাচীন কাগুলো তীক্ষ্ণ ক্যাচ ক্যাচ শব্দে করে উঠল। ব্রাকো শিউরে উঠল তাতে।

“ভেতরে যান।” মিসরীয় আদেশ করল।

ব্রাকো ভেতরে ঢুকে একটা টর্চ জ্বাললো। প্রায় পুরো কন্টেইনার জুড়েই আছে একটা প্রোপেন ভরা সিলিন্ডার। তার পিছনেই দেখা গেল সাদা রঙের কয়েকটা ব্যারেল।

ব্রাকো আম্মন তাকে সেদিকে নিয়ে গেল।

“এখন?” ব্রাকো জিজ্ঞেস করল।

কিন্তু মিসরীয় কোনো জবাব দিল না। চুপচাপ একটা ব্যারেলের ওপরে চাপ দিয়ে খুলে ফেলল। ব্রাকো অবাক হয়ে দেখলো সাদাটে ধোয়া মতো কিছু জিনিস ব্যারেলের কিনার বেয়ে উপচে পড়ল। আশপাশটাও কেমন শীতল হয়ে গেল। “কি এর ভেতর? তরল নাইট্রোজেন?” আম্মন তা এ কথারও কোনো জবাব দিল না। হিমাঙ্কের নিচে সংরক্ষিত একটা বোতল তুলে আনলো ব্যারেলের ভেতর থেকে। একপাশে আজব একটা চিহ্ন।

চিহ্নটা কি সেটা ব্রাকো না বুঝলেও ধরন দেখে মনে হচ্ছে এটা কোনো ধরনের নার্ভ গ্যাস বা সেরকম কিছু।

“ওরা এই জিনিসটাই খুঁজছে।” হঠাৎ বুঝতে পেরে বলে উঠল ব্রাকো। “এসব প্রোপেন বা টাকার ধান্দায় ওরা আসেনি। ওদের দরকার আপনাকে আর এই জিনিসটাকে। আপনার জন্যেই শয়তানগুলো আমার লোকদের মেরে শেষ করেছে।” বলতে বলতে আম্মন তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ব্রাকো।

ঘটনার আকস্মিকতায় মিসরীয় এক মুহূর্তের জন্যে থমকে গিয়েছিল কিন্তু সামলে নিলো দ্রুত। ব্রাকোর উদ্যত হাত একপাশে ঠেলে দিল, তারপর বাহু ধরে একটা মোচড় দিয়ে আছড়ে ফেলল মাটিতে।

মাটিতে পড়ামাত্র ব্রাকোর বুকের ওপর চড়ে বসলো মিসরীয়। ব্রাকো ওর চোখের দিকে তাকাল। দয়া-মায়ার লেশমাত্র নেই সেখানে।

“আপনাকে আর কোনো দরকার নেই।” মিসরীয় বলল।

তিনকোণা ছুরিটা পেটে ঢুকতেই ব্রাকোর সারা শরীরে প্রচণ্ড একটা যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল। মিসরীয় ছুরিটা একটা মোচড় দিয়ে বের করে নিলো।

ব্যথার চোটে ব্রাকোর শরীর কুঁকড়ে এলো। পেট চেপে ধরে আছে। কিন্তু স্রোতের মতো গল গল করে রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছে না মোটেও।

ধীরে ধীরে যন্ত্রণাদায়ক এক মৃত্যু হচ্ছে ব্রাকোর। মিসরীয় পাশে দাঁড়িয়ে ধীরে সুস্থে ছুরির রক্ত মুছে আবার ঢুকিয়ে রাখলো খাপে। যেন কোনো তাড়া নেই, ব্যাপারটা উপভোগ করছে। তারপর একটা স্যাটেলাইট ফোন বের করে একটা বোতামে টিপ দিল।

“আমাদের জাহাজে কারা যেন আক্রমণ করেছে। সম্ভবত স্থানীয় সন্ত্রাসী।” লাইনের অপর প্রান্তে থাকা কাউকে বলল সে।

দীর্ঘকাল আর কোনো কথা হলো না। তারপর মিসরী নিজের মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “ওরা সংখ্যায় অনেক জন… হ্যাঁ, আমি জানি কি করতে হবে….’ডার্ক মিস্ট’ অন্য কারো হাতে পড়া চলবে না। ওসাইরিসকে আমার কথা বোলো। পরকালে তোমার সাথে দেখা হবে।”

লাইনটা কেটে প্রোপেন ট্যাঙ্কের দিকে এগুলো ও। তারপর একটা বাঁকা রেঞ্জ দিয়ে ট্রাঙ্কের ভালভ খুলে দিল। হিসস শব্দ করতে করতে বেরিয়ে এলো গ্যাস।

তারপর পকেট থেকে একটা ছোেট্ট বিস্ফোরক চার্জ বের করে টাইমার সেট করল। তারপর সেটা লাগিয়ে দিল ট্যাঙ্কটার গায়ে। তারপর কন্টেইনারের দরজা দিয়ে বেরিয়ে অন্ধকারে মিশে গেল।

নিজের রক্তের পুকুরে শুয়ে থাকলেও ব্রাকো পুরোপুরি জ্ঞান হারায়নি। কি হতে যাচ্ছে পুরোটাই বুঝেছে সে। তবে যেটাই হোক মরার হাত থেকে তার বাঁচা নেই। তবে চেষ্টা করলে বিস্ফোরণটা থামাতে পারবে সে। সেই সিদ্ধান্তই নিলো মনে মনে।

গড়িয়ে উবু হলো ব্রাকো। ব্যথায় গোঙ্গাচ্ছে। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে কীভাবে ও ট্রাঙ্কের কিনারে পৌঁছালো তা ও বলতে পারবে না। লাল গালিচার মতো লম্বা লাল রঙের দাগ হয়ে আছে পুরোটা। প্রথমে ও রেঞ্চটা দিয়ে ভালভটা লাগানোর চেষ্টা করল কিন্তু শক্তিতে কুলালো না। রেঞ্চটাই ঠিকমতো তুলতে পারছে না।

সেটা ফেলে তাই আবার ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগুনো শুরু করল। প্রতিবারই গঙ্গিয়ে উঠছে অমানুষিকভাবে। প্রোপেনের গন্ধে বমি বমি লাগছে ওর, আর পেটের মধ্যে মনে হচ্ছে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। চোখে ঝাপসা দেখছে বিস্ফোরকটা দেখতে পাচ্ছে কিন্তু টাইমারে লাগানো বোতামগুলোর একটাও পড়তে পারছে না। ও হাত বাড়িয়ে ওটা টান দিয়ে খুলে নিলো আর সেই মুহূর্তে আবার কন্টেইনারের দরজা শব্দ করে খুলে গেল।

ব্রাকো ঘুরে তাকাল। দুজন লোক দৌড়ে এলো, হাতে অস্ত্র, ওর দিকেই তাক করা। ওর কাছে পৌঁছাতেই ওর হাতের টাইমারটা নজরে এলো।

টাইমারের সব ডায়াল সেই মুহূর্তে ‘জিরো’-তে পৌঁছে গেছে।

ব্রাকোর হাতেই সেটা বিস্ফোরিত হলো আর গ্লোপেনে আগুন ধরে গেল। চোখ ধাঁধানো আলোয় কন্টেইনারটাও উড়ে গেল একপাশে।

বিস্ফোরণের ধাক্কায় সামনের সারির সব কন্টেইনার জায়গা থেকে নড়ে গেল, তারপর রেলিং ভেঙে গড়াতে গড়াতে সাগরের পানিতে পড়ে গেল।

ব্রাকো আর সেই দুজন লোক যেন বাষ্প হয়ে গেছে, কোনো অস্তিত্বই নেই। তবে ব্রাকো কিন্তু মিসরীর পরিকল্পনা ঠিকই ভেস্তে দিতে পেরেছে। সাথে লাগানো না থাকায় বিস্ফোরণ পুরু প্রোপেন সিলিন্ডারের তেমন ক্ষতি করতে পারেনি। শুধু প্রোপেনে আগুন লেগে গেছে আর হিস হিস করে প্রোপেনের সাথে আগুন বেরিয়েই যাচ্ছে।

আগুনের লকলকে শিখার সামনে যা পড়েছে তাই গলে পড়ে যাচ্ছে। এদিকে অবলম্বন না থাকায় সিলিন্ডারটা নাড়াচাড়া করতে করতে মুখটা একসময় ডেক-এর দিকে ঘুরে গেল।

প্রচণ্ড তাপে স্টিলের মেঝেও গলা আরম্ভ হলো। কয়েক মিনিট পরই সিলিন্ডারের একটা কোণা মেঝেতে দেবে গেল। আগুনের শিখা এখন আরো ভালোভাবে মেঝের দিকে ঘুরে গেল। পুরো মেঝেটাই গলে পড়া এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।

আরো বিশ মিনিট ধরে জাহাজটা জ্বলতে লাগল। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেন একটা ভাসমান আগুনের গোলা। পশ্চিমে ভাসতে ভাসতে ভোরের ঠিক আগে ওটা একটা শৈল শ্রেণিতে বাড়ি খেয়ে থামল। ল্যাম্পেডুসা থেকে মাত্র আধা মাইল দূরে সেটা।

দ্বীপের সকাল বেলার পাখিরা আগুন দেখে এগিয়ে এলো, এবং ছবি তুলতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রোপেনের ট্যাঙ্কগুলোর কাছে আগুন পৌঁছে গেল আর পনের হাজার টন ঘনীভূত জ্বালানি বিস্ফোরিত হলো সবার চোখের সামনে। দূর দিগন্তের সূর্যের চেয়েও এটার উজ্জ্বলতা বেশি।

বিস্ফোরণের দমক কমতেই দেখা গেল এম. ভি. তেরিনোর পাটাতন বলে কিছু নেই। খোলটা একটা ভোলা টিনের ক্যানের মতো পড়ে আছে। তার ওপরেই কালো ধোঁয়ার একটা আস্তরণ। বাতাসে সেটা দ্বীপের দিকে ভেসে যাচ্ছে। দেখে মনে হয় হাজার বছর ধরে বৃষ্টি জমানো কোনো মেঘ বুঝি ভেসে আসছে।

কিছুক্ষণ পরই মৃত সামুদ্রিক পাখিরা আকাশ থেকে খসে পড়তে লাগল বালিতে আর সমুদ্রের পানিতে।

যারা দেখতে এসেছিল তারা প্রাণ বাঁচাতে দৌড় দিল কিন্তু তার আগেই কুয়াশা তাদের ঘিরে ফেলল আর পাখিগুলোর মতো তারাও ধুপধাপ আছড়ে পড়তে লাগল।

বাতাসে ভেসে ভেসে সেই কুয়াশা দ্বীপকে উজাড় করে আরো পশ্চিমে চলে গেল। পেছনে পড়ে থাকল নিঃসীম শূন্যতা আর লাশ ভরা এক খণ্ড ভূমি।

.

০৩.

ভূমধ্য সাগর, ল্যাম্পেডুসা দ্বীপের তের মাইল দক্ষিণপূর্ব

একটা ঝাপসা অবয়ব আলতো করে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাগরের বুকে। বোঝাই যায় লোকটা এতে অত্যন্ত দক্ষ এবং অভ্যস্ত। নিচ থেকে দেখলে লোকটাকে মানুষ না বরং কেমন স্বর্গীয় দূত বলে ভ্রম হয়। শরীরের দুপাশে দুটো স্কুবা টাঙ্ক ঝোলানো, পিঠে পেটমোটা একটা ব্যাগ মত জিনিস, একটা প্রপালশন ইউনিটও বাধা পিঠের সাথে। তাতে এক জোড়া ছোট্ট পাখা। কাঁধে দুটো লাইট ঝোলানো। ওটার হলদেটে আলো ভৌতিক আবহ ছড়িয়ে আশেপাশের অন্ধকারকে চিরে দিছে।

প্রায় একশো ফুট নিচে সমুদ্রের তলের কাছাকাছি পৌঁছে লাইটটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিচটা দেখতে লাগল সে। কমলা রঙের পোশাক পরা কিছু ডুবুরি সেখানে কিছু একটার ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারে ব্যস্ত। জিনিসটা উদ্ধার হলে রোম আর কার্থেজদের মধ্যকার ঐতিহাসিক পিউনিক যুদ্ধের ইতিহাসের নতুন একটা দিক উন্মোচিত হবে।

লোকগুলোর থেকে প্রায় পঞ্চাশ ফুট দূরে সমুদ্র তলে নেমে দাঁড়ালো লোকটা, তারপর বাম বাহুতে ঝোলানো ইন্টারকমের সুইচ টিপে দিল।

“অস্টিন বলছি। তলায় পৌঁছে গেছি, এখন উদ্ধার কাজের দিকে এগুবো।” হেলমেটের সাথেই লাগানো মাইক্রোফোনে বলল লোকটা।

“রজার দ্যাট। জা-ভালা আর উডসন তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।” কাঁপা কাঁপা একটা কণ্ঠ জবাব দিল।

কার্ট অস্টিন প্রপালসন ইউনিটটা চালু করে দিল, তারপর পা দিয়ে মাটিতে হালকা ধাক্কা দিতেই সে এগিয়ে গেল উদ্ধার কাজটার দিকে। যদিও বেশিরভাগ ডুবুরি-ই স্টান্ডার্ড ড্রাই-স্যুট-ই পরে আছে, তবে কার্ট আর আরো দুজনের পরনে নতুন এক ধরনের হার্ড স্যুট। এটা নিয়ে অবশ্য এখনও পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। এই স্যুটগুলোর সুবিধা হলো এতে চাপের কোনো হেরফের হয় না, ফলে পানিতে ওঠানামার সময় ডিকমপ্রেশনের জন্যে থামতে হয় না।

এখন পর্যন্ত কার্টের কাছে স্যুটটা ভালোই লাগছে। শুধু একটু বড়, এই যা। উদ্ধারকর্মের কাছে পৌঁছাতেই কার্টের হাতে একটা ট্রাইপড ধরিয়ে দেয়া হলো। ওটার মাথায় একটা আন্ডারওয়াটার ফ্লাডলাইট বসানো। পুরো জায়গাটাতেই এরকম আরো অনেক লাইট বসান। একটু দূরেই একটা টারবাইনের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, সেটা দিয়েই জ্বলছে এগুলো।

স্রোতের ধাক্কায় টারবাইনের পাখাগুলো ঘোরে আর বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। ফলে আলো পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর, উদ্ধার কাজও চলছে দ্রুত গতিতে।

কার্ট প্রাচীন বিধ্বস্ত জাহাজটার পিছনের দিকে চলে এলো।

“আরে দেখো দেখো কে এসেছে!” হেলমেটের ইন্টারকমে বলে উঠল একজন।

“আমাকে তুমি চেনো। আমার কাজই হলো কাজ শেষে এসে সব ক্রেডিট নিজের করে নেয়া।” কার্ট বলল।

অন্যজন হেসে দিল। কথাটায় সত্যের লেশমাত্র নেই। কার্ট অস্টিন হলো সবার আগে এসে সবার পরে যাওয়া মানুষ। ওর মতো ঘাড় ত্যাড়া মানুষও কম-ই আছে। কোনো প্রজেক্ট আর সবাই বাতিল করে দিলেও ও লেগে থাকবেই। থাকতে থাকতে হয় সত্যিই নতুন কিছু বের করে আনে নয়তো শেষ উপায়টাও কাজে লাগিয়ে তার পরেই থামে।

“জাভালা কই?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

অন্যজন দূরে এক দিকে ইঙ্গিত করল। জায়গাটা একদমই অন্ধকার।

“কি যেন গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস দেখানোর জন্যে খুঁজছে তোমাকে। পুরনো এক বোতল জিন (মদ) খুঁজে পেয়েছে মনে হয়।”

কাট মাথা ঝাঁকিয়ে আবারো প্রপালসন চালু করল। তারপর জো জাভালা যেখানে কাজ করছে সেদিকে এগুলো। ওখানে আরো একজন আছে, নাম মিশোলি উডসন। ধ্বংসস্তূপের সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে কিছু একটা খুড়ছে ওরা।

কিছু একটা বের করে প্লাস্টিকে মুড়ে রেখেছে, যাতে করে বালি ঢুকতে না পারে।

কার্টকে দেখে জো একটু সিধে হলো তারপর ইন্টারকমে দুষ্টুমির সুরে বলল, “এই ব্যাটা হাত চালিয়ে কাজ কর, এল জেফে আমাদের দেখতে আসছেন।”

একদিক দিয়ে কথাটা সত্য, কারণ কার্ট এখন ন্যাশনাল আন্ডারওয়াটার এন্ড মেরিন এজেন্সী (NUMA)’র স্পেশাল এসাইনমেন্ট ডাইরেক্টর। NUMA হলো স্বায়ত্তশাসিত একটা সরকারি প্রতিষ্ঠান। সমুদ্রের গহীনে লুকানো রহস্য নিয়ে এদের কারবার। তবে কার্ট ঠিক অন্যান্য বসের মতো না। ওর কাছে দলগত প্রচেষ্টাটাই আসল। তবে বিপজ্জনক কোনো কিছু করার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ওর নীতি আলাদা। ওসব কাজে ও নিজেই এগিয়ে যায়। ওর মতে, এসব কাজ করা একজন দলপতির-ই দায়িত্ব।

আর জো জাভালা কার্টের অধীনস্থ হলেও দুজনের সম্পর্কটা আরও অনেক বেশি গাঢ়। বহু বছর ধরে দুজন একসাথে এসব ভাঙ্গাচোরা জিনিস নিয়ে কারবার করছে। এইতো গত বছরই ওরা ১৯০৯ সালে ডুবে যাওয়া জাহাজ এস, এস, ওয়ারাথ উদ্ধার করেছে, একসাথে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যবর্তী DMZ (দুটো দেশের মধ্যবর্তী জায়গা যেখানে সামরিক অভিযান নিষিদ্ধ) এর নিচের একটা টানেলে আটকা পড়েছে; পৃথিবীর ভয়ংকরতম টাকা জালকারী দলটাকে আটকেছে। এরা শুধু কম্পিউটার ব্যবহার করতে, ছাপাখানার ধারে কাছেও যেতো না।

এরপর দুজনেরই ছুটিতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। ভূমধ্যসাগরের নিচে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধারের খবর শুনে তাই আর দেরি করেনি।

“তোমরা দুজন নাকি এখানে ফাঁকিবাজি করছো? তোমাদের আজকের বেতন কাটা।” কার্টও রসিকতা করল।

জো হাসলো, “কাটলে কাটো, তবে বাজির টাকাটা পেলেই সব উসুল হয়ে যাবে।”

“বাজি জিতেছ? তুমি? সূর্য কি পশ্চিমে ওঠলো নাকি আজ?”

জো প্রাচীন জাহাজটার ভাঙাচোরা কাঠামোটা দেখলো, “এটার সোনার স্ক্যান দেখার পর তুমি কি বলেছিলে মনে আছে?”

“বলেছিলাম এটা কার্থেজদের জাহাজ, আর তুমি বাজি ধরেছিলে যে এটা একটা রোমান জাহাজ। আর এখন পর্যন্ত যা কিছু উদ্ধার হয়েছে, তা থেকেই বলে দেয়া যায় না যে আমার কথা-ই ঠিক।”

“কিন্তু আমার কথা যদি অর্ধেক সত্যি হয়?”

“তাহলে তো তোমার ভাগ্যটা অন্য দিনের চেয়ে ভালোই বলতে হবে আজ।”

জো আবারো হেসে মিশেলির দিকে ফিরে বলল, “ওকে জিনিসিটা দেখাও।”

মিশেলি হাত নেড়ে কার্টকে এগিয়ে আসতে ইঙ্গিত করে সদ্য উদ্ধার করা একটা অংশের দিকে লাইট তাক করে ধরলো। লম্বা-কাটার মতো একটা জিনিস দেখা গেল সেখানে। এই ধরনের কাটাগুলো আগের কালের পালতোলা জাহাজের সামনে লাগানো থাকতো অন্য জাহাজের খোল ফুটো করার কাজে লাগতো এটা। জিনিসটা একটা কাঠের মধ্যে গাঁথা। ওখানকার বালি সরিয়ে ফেলায় এখন সেখানে সম্পূর্ণ আলাদা আরেকটা জাহাজের ভাঙ্গা কাঠামো দেখা যাচ্ছে।

“জিনিসটা কি?” কার্ট জিজ্ঞেস করল। “ওটা হলো একটা বায়স, জো বলল।

বায়স মানে হলো কাক। লোহার কাটাটা প্রায় হুবহু দেখতে কাকের ঠোঁটের মতো। নামকরণও তাই এরকম।

জো আবার শুরু করল, “ইতিহাস নিশ্চয়ই ভুলে যাওনি। রোমানরা খুবই দক্ষ যোদ্ধা হলেও পানির কাছে এরা ছিল অসহায়। অপর দিকে কার্থজিনিয়ানরা ছিল এদিক দিয়ে রোমানদের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে। রোমানরা তাই বিকল্প চিন্তা করল। জাহাজের সামনের দিকে এই রকম কাটা লাগিয়ে নিলো যাতে প্রতিপক্ষের জাহাজকে ফুটো করে আটকে ফেলা যায়। আটকে গেলেই ওরা দড়ি বেয়ে বা লাফিয়ে অন্য জাহাজে চড়ে বসতো, তারপর শত্রুদেরকে কচুকাটা করতো। এই কৌশলে ওরা প্রায় প্রত্যেকটা সামুদ্রিক যুদ্ধকেই শেষ পর্যন্ত সম্মুখ যুদ্ধে পরিণত করতে সক্ষম হয়।”

“তার মানে এখানে জাহাজ দুটো?”।

জো মাথা ঝাঁকালো, “একটা রোমান যুদ্ধ জাহাজ আর একটা কার্থেজনিয়ান জাহাজ। বায়স দিয়ে এখনো গাথা। প্রায় দুহাজার বছর আগে এখানে একটা যুদ্ধ হয়েছিল। ভাবা যায়!”

কার্ট এই নতুন আবিষ্কারে চমৎকৃত হলো, “কিন্তু ডুবলো কীভাবে?”

“সংঘর্ষের আঘাতে সম্ভবত। এতো জোরে ধাক্কা লেগেছিল যে দুটোর কাঠামোতেই চিড় ধরে যায়।” জো অনুমান করল। “আর রোমানরাও বোধহয় ওদের বায়স সময়মতো খুলে নিতে পারেনি। ফলে দুই শত্রু গলাগলি করে পানিতে ডুবে মরলো, এখনো সেভাবেই আছে।”

“তার মানে আমরা দুজনেই ঠিক। তোমার একশ টাকা বেঁচে গেল।”

“একশ টাকা?” বিস্ময় ঝরে পড়ছে মিশেলির কণ্ঠে। “তোমরা দুজন প্রায় গত একমাস ধরে এই বাজির কথা বলে বলে কানের পোকা নাড়িয়ে দিয়েছ। আর সেই বাজি কি-না মাত্র একশ টাকার?”

“টাকাটাইতো সব না। কার কথা ঠিক হয় সেটাই আসল।” কার্ট বলল।

“আর ও আমার বেতন কেটে রেখেছে। সম্বল বলতে ঐ বাজির টাকাটাই ছিল,” জো বলল।

“তোমাদের দুজনেরই মাথার স্ক্রু ঢিলা,” মিশেলি বলল।

কার্ট এই কথার সমর্থনে গর্ব করে কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু তার আগেই ইন্টারকমে আরেকটা কণ্ঠ শোনা গেল।

হেলমেটের সামনের ডিসপ্লে থেকে জানা গেল কণ্ঠটা ‘সী ড্রাগন থেকেই আসছে। তবে ডিসপ্লের নিচে ছোট্ট একটা তালা আর তার পাশে নিজের আর জো-এর নাম দেখে বুঝলো ওরা দুজন বাদে কথাটা আর কেউ শুনতে পাচ্ছে না।

“কার্ট, গ্রে বলছি। তুমি আর জাভালা শুনতে পাচ্ছ?” কণ্ঠটা বলল। গ্যারি রেনল্ডস হলো সী ড্রাগনের ক্যাপ্টেন।

“পরিষ্কার। শুধু আমাদের দুজনের সাথেই কথা বলছে দেখছি। কোনো সমস্যা?”

“সম্ভবত, রেডিওতে একটা সাহায্যের আবেদন ধরা পড়ছে। কি করব বুঝতে পারছি না।”

“কেন?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

“কারণ, আবেদনটা কোনো জাহাজ থেকে আসছে না। আসছে ল্যাম্পেডুসা থেকে।”

“ঐ দ্বীপটা থেকে?”

ল্যাম্পেডুসা দ্বীপটা ছোট। মাত্র পাঁচ হাজার লোকের বাস সেখানে। যদিও এটি ইতালির অধীনে, কিন্তু লিবিয়া থেকেই বেশি কাছে। সী ড্রাগন প্রতি সপ্তাহে একবার সেখানে গিয়ে তেল আর রসদপত্র নিয়ে আসে। এখনও এখানে NUMA-র পাঁচজন লোক আছে। উদ্ধারকৃত জিনিসগুলো দেখভালের জন্য।

কার্টের মনের ভেতরের প্রশ্নটা জো-ই করল : “দ্বীপে ঝামেলা তো এই মেরিন চ্যানেলে সাহায্যের আবেদন পাঠাচ্ছে কেন?”

“জানিনা। বুদ্ধি করে রেডিও অপারেটরেরা ওটা রেকর্ড করে ফেলেছে। বেশ কয়েকবার শুনেছি আমি। কলটা ভুয়াও হতে পারে, তবে ঐ দ্বীপ থেকে যে এসেছে সেটা নিশ্চিত।”

“আমাদেরকে শোনানো যাবে?”

“সেজন্যেই তো ফোন দিলাম। দাঁড়াও।” রেনল্ডস বলল। কয়েক সেকেন্ড পরেই একটা গুনগুন শোনা গেল তারপরেই শোনা গেল একজনের কণ্ঠস্বর। প্রথম কয়েকটা কথার কিছুই বোঝা গেল না। তারপর কণ্ঠটা পরিষ্কার হলো। একজন মহিলা কথা বলছে। কণ্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে মহিলা মারাত্মক বিপদে পড়েছে কিন্তু খুব কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখেছে। প্রথম বিশ সেকেন্ড ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলল, তারপর ইংরেজিতে।

“….আবার বলছি, আমি ড. রেনাটা অ্যামব্রোসিনি….কারা যেন আক্রমণ করছে…..আমি হাসপাতালে আটকা পড়েছি…..কেউ সাহায্য করুন…আমরা বের হতে পারছি না। অক্সিজেনও কমে আসছে। প্লিজ কেউ সাড়া দিন।”

কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে আবার শুরু হলো একই কথা।

“ইমার্জেন্সি লাইনগুলো চেক করেছ? ওখানে কেউ কিছু বলছে?” জো জিজ্ঞেস করল।

“নাহ। তবে আমি ওখানকার আমাদের লোকগুলোকে ফোন করেছিলাম। কেউ ধরেনি।” রেনল্ডস বলল।

“এ রকম তো হওয়ার কথা না। আমরা সমুদ্রে যতক্ষণ থাকি ততোক্ষণতো সবসময়ই রেডিওর পাশে কারো না কারো থাকার কথা। জো বলল।

কার্টও সায় দিল তাতে। “অন্য কাউকে ফোন দাও। বন্দরের কাছেই একটা ইতালিয়ান কোস্ট গার্ডের অফিস আছে। ওদের কমান্ডারের সাথে কথা বলা যায় কি-না দেখো।”

“চেষ্টা করেছি। রেডিওগুলোতে কিছু হলো কি-না ভেবে, স্যাটেলাইট ফোনেও চেষ্টা করেছি। কাজ হয়নি। আমার কাছে ল্যাম্পেডুসার যতগুলো নাম্বার ছিল সবটাতে ফোন দিয়েছি। পুলিশ স্টেশন এমনকি পিজ্জার দোকানেও, কিন্তু কেউই ফোন ধরেনি। সামান্যতেই ঘাবড়ানোর লোক আমি না, কিন্তু তবুও কেন যেন মনে হচ্ছে পুরো দ্বীপটাই একসাথে চুপ মেরে গেছে।”

এত সহজেই উপসংহারে পৌঁছানোর লোক কার্ট না, যদিও মহিলাটা বলেছে যে তাদেরকে আক্রমণ করা হয়েছে। “পালের্মোতে ইতালিয়ান কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করো। জাহাজ থেকে আসুক না আসুক, সাহায্যের আবেদন মানে সাহায্যের আবেদন। ওদেরকে জানাও যে কি হয়েছে সেটা দেখতে আমরা ওখানে যাচ্ছি।

“আগেই ভেবেছিলাম যে তুমি যাবে। ডাইভ কেবলগুলো চেক করে দেখেছি। তুমি, জো আর মিশেলি উঠে আসতে পারো ওপরে। বাকিদের ডিপ্রেশন ট্যাংক হয়ে আসতে হবে।” রেনল্ডস বলল।

‘কার্টও সেটাই ভেবেছিল। ও খবরটা বাকি সবাইকে জানিয়ে দিল। সবাই দ্রুত লাইটগুলো নিভিয়ে, জিনিসপত্র রেখে ধীরে ধীরে পানির ওপরে উঠতে লাগল। দড়ি দিয়ে ডিপ্রেশন ট্যাংকটা নিচে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। সেটাতে করেই তাদেরকে ওপরে তুলে আনা হলো।

কার্ট, জো আর মিশেলি প্রপালসন ইউনিট ব্যবহার করে ওপরে উঠে এলো। ওপরে উঠে স্যুট খুলতে না খুলতেই রেনল্ডস আবারো খারাপ খবর দিল, ল্যাম্পেডুসার থেকে আর একটা শব্দও শোনা যায়নি। কোনো সামরিক বা কোস্টগার্ড বাহিনীর কাছ থেকেও কোনো সাড়া নেই।

“সিসিলি থেকে দুটো হেলিকপ্টার পাঠাবে বলেছে। তবে আরো আধাঘণ্টার আগে ওরা রওনা দেবে না। আর এখানে আসতে আরও ঘণ্টাখানেক লাগবে।”

“ততক্ষণে আমরা দ্বীপে পৌঁছে, নাস্তাপানি সেরে বোতল নিয়ে বসে পড়তে পারবো।” জো বলল।

“সে জন্যেই ওরা আমাদেরকেই একটু দেখতে বলছে যে কি হয়েছে। কারণ এই এলাকায় আমরাই একমাত্র সরকারি লোক। যদিও আমাদের সরকার আটলান্টিকের ঐ পাশে।” রেনল্ডস বলল।

“সেটাই ভালো। আমাদের কারো কাছে কৈফিয়ৎ দিতে হবে না। চাইলেই ভেগে যেতে পারবো।”

“আমি তাহলে জাহাজ ছেড়ে দিচ্ছি।” রেনল্ডস বলল।

কার্ট মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল।

.

০৪.

সী ড্রাগন ল্যাম্পেডুসার কাছে পৌঁছাতেই প্রথমে যে জিনিসটা নজরে পড়ল তা হলো ঘন, কালো তৈলাক্ত ধোঁয়ার একটা স্তর। দ্বীপের অনেক ওপরে স্থির হয়ে আছে। কার্ট শক্তিশালী একটা বাইনোকুলার দিয়ে সেটা দেখার চেষ্টা করল।

“কি দেখা যায়?” জো জিজ্ঞেস করল।

“জাহাজ মতো মনে হচ্ছে। তীরের কাছেই।” কার্ট বলল।

“ট্যাঙ্কার (তেলবাহী জাহাজা?)”

“বোঝা যাচ্ছে না। ধোঁয়ায় ঘিরে আছে চারপাশ। শুধু মোচড়ানো একটা ধাতব কাঠামো মতো দেখা যাচ্ছে।” কার্ট জানালো। তারপর রেনল্ডসের দিকে ফিরে বলল, “ওটার দিকেই যাও তো আগে। দেখে আসি।”

সী ড্রাগন দিক বদলে সেদিক এগুলো। যতই কাছে যাচ্ছে ধোয়ার আস্তরণ ততোই পুরু হচ্ছে।

“বাতাসে ভেসে ভেসে জাহাজের ধোয়াটা সোজা দ্বীপের দিকে উড়ে যাচ্ছে।” জো বলল।

“খোদা-ই জানে ওটায় কি আছে। বিষাক্ত কিছু হলে….রাক্যটা শেষ করল না কার্ট। তবে বাকিরা ভাবার্থ ঠিকই বুঝতে পেরেছে।

“ডাক্তার মহিলাটা বলছিল যে তারা আটকা পড়েছে আর অক্সিজেনও শেষ হয়ে আসছে। আমি ভেবেছিলাম কোনো ভূমিকম্প বা বিস্ফোরণে হয়ত হাসপাতাল ভবনটা ধসে পড়ছে, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি মহিলা সম্ভবত এই ধোয়ার হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে।” জো বলল।

কার্ট আবারো বাইনোকুলারে চোখ পাতলো। জাহাজের সামনেটা দেখে মনে হচ্ছে বিশাল কোনো আংটা দিয়ে বোধহয় টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। ভালো করে তাকাতেই বোঝা গেল যে জাহাজের অর্ধেকটাই নেই। বাকিটুকুও কালি-ঝুলিতে ঢাকা পড়েছে।

“কোনো ডুবো পাহাড়ে আটকা পড়েছে বোধহয়। নাহলে তো ডুবে যাওয়ার কথা।” কার্ট বলল। “নাম-ধামও চোখে পড়ছে না। কেউ একজন পালের্মোতে ফোন দিয়ে ব্যাপারটা জানাও। ওরা যদি জাহাজটার হদিস বের করতে পারে তাহলেই জানা যাবে এটায় কি ছিল।”

“ঠিক আছে, জানাচ্ছি।” রেনল্ডস বলল।

“আর গ্যারি।” কার্ট ডাক দিল বাতাসের উল্টোদিকে থেকো।”

রেনল্ডস মাথা ঝাঁকালো, “সেটা আর বলতে হবে না।” তারপর গতি কমিয়ে খবরটা জানাতে ফোন করল। জাহাজটা থেকে পাঁচশো গজের মতো দূরে থাকতেই সী ড্রাগনের একজন ক্রু চেঁচিয়ে উঠল, “আরে আরে দেখে যাও সবাই।”

রেনল্ডস থ্রটল ঠেলে সী ড্রাগনকে থামিয়ে দিল পুরোপুরি। কার্ট বেরিয়ে এলো ব্যাপার কি তা দেখতে। কুটা ওকে পানির দিকে আঙুল তুলে দেখালো। সেখানে আধা-ডজন অদ্ভুত আকৃতির কিছু একটা ভাসছে। জিনিসগুলো ১৫ ফুটের মতো লম্বা, দেখতে অনেকটা টর্পেডোর মতো, গায়ের রঙ কুচকুচে কালো।

“পাইলট তিমি, চারটা বড়, দুটো বাচ্চা।” –টা বলল। প্রজাতিটা চিনতে পেরেছে।

“এদিকে তো এরা আসে না, তার মানে দ্বীপে যা হয়েছে তাতে সাগরের পানিতেও তার প্রভাব পড়েছে। কার্ট বলল।

আসলেও তাই, তিমিগুলোর চারপাশে গাদা গাদা সামুদ্রিক আগাছা, মরা মাছ, স্কুইড বা প্রাণী ভাসছে। এগুলোর লোভেই ওরা এদিকে এসেছে।

“আমি নিশ্চিত ঐ জাহাজটার জন্যেই এসব হয়েছে। কেউ একজন বলল। কাটেরও সে রকই-ই ধারণা, কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করল না। ও তাকিয়ে তাকিয়ে ভাসমান মৃতদেহগুলো দেখছে। হঠাৎ শুনতে পেল জো রেডিওতে ইতালিয়ান কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলছে। ওরা কি কি দেখেছে। সেসব জানাচ্ছে। কার্ট খেয়াল করল সব স্কুইড-ই মারা যায়নি। কয়েকটাকে দেখা গেল একসাথে গুড় দিয়ে একে অন্যকে পেচিয়ে রেখেছে।

“আমাদের মনে হয় এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত।” একজন ক্রু বলে উঠল। বলতে বলতে সে পরনের গেঞ্জি টেনে তুলে নাক-মুখ ঢেকে দিলো। ভাবটা এমন যে বাতাসে যে বিষ-ই ভেসে আসুক ওর নাকে আর ঢুকতে পারবে না।

কার্ট জানে যে এখানে ওদের কোনো সমস্যা নেই। ওরা এখন বাতাসের উল্টো দিকে প্রায় সিকি মাইল দূরে। আর বাতাস একেবারেই নির্মল, এক ফোঁটা গন্ধ পর্যন্ত নেই। তারপরও সাবধানের মার নেই।

ও আবার কেবিনের ভেতরে ঢুকে বলল, “আরো মাইলখানেক পিছনে চলে যাও, আর ঐ ধোয়াটার দিকে নজর রেখো। যদি বাতাসের দিক বদল হয় তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভাগতে হবে।”

রেনল্ডস মাথা ঝাঁকালো। থ্রটল ঠেলে হুইলে হাত দিল আবার। জাহাজটা গতি পেতে পেতে রেডিওতে জো-এর কথাও শেষ হলো।

“কি খবর?”

“ওদেরকে বললাম যে আমরা কি দেখেছি। গত রাতের AIS (Autometic Identification System) ডাটা অনুসারে ওদের ধারণা এটা একটা মালবাহী জাহাজ। নাম এম. ভি. তোরিনো।”

“ছিল কি ওটায়?”

“এই যন্ত্রপাতি আর কাপড়-চোপড়-ই ছিল বেশিরভাগ। বিপজ্জনক কিছু ছিল না।”

“কাপড়-চোপড়? তোমার মাথা।” ঐ হেলিকপ্টারগুলো কদ্দূর?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

“দুঘণ্টা তো লাগবেই আরো। তিন ঘণ্টাও লাগতে পারে।”

“আধা ঘন্টার মধ্যে না রওনা দেয়ার কথা ছিল?”

রওনা দিয়েছিল কিন্তু আমাদের রিপোর্ট পেয়ে আবার ফেরত গেছে। দরকারি রসদপাতি আর মানুষজন নিয়ে ফেরত আসবে।”

“ওদের আর কি দোষ দেবো।” কার্ট মুখে বলল। কিন্তু ওর মন পড়ে রয়েছে NUMA-টীমের সদস্য আর ঐ ডাক্তার মহিলার কি হলো সেই চিন্তায়। আর ওরা কেউই আর সাড়াশব্দ করেনি। আর বাকি পাঁচ হাজার মানুষের কথা নাহয় বাদই দিল। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো কার্ট, এই মুহূর্তে ওর বিবেকে এটাই একমাত্র সমাধান মনে হচ্ছে।

“জোডিয়াকটা (রাবারের তৈরি এক ধরনের স্পিড বোর্ড। সশস্ত্র বাহিনীতে ব্যবহৃত হয়।) “রেডি করো। আমি দ্বীপে যাব কি হয়েছে দেখতে। পাশ থেকে রেনল্ডস শুনতে পেয়ে সাথে সাথে বলে উঠল, “মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে নাকি?”

“হলে হয়েছে। আমাদের লোকেরা কেউ এখনো বেঁচে আছে কি-না জানিনা। কিন্তু আরো তিন ঘণ্টা বসে থাকলে যে কেউ আর থাকবে না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। সেই ঝুঁকি আমি নিতে পারবো না। হয়তো ওরা সাহায্যের আশাতেই বসে আছে এখন।”

“আমি যাব তোমার সাথে।” জো বলল।

রেনল্ডস পরাজিত চোখে ওদের একবার দেখে বলল, “তা যে বিষে দ্বীপের সবাই মারা পড়ল সেটা থেকে বাঁচবে কীভাবে?”

“হেলমেটগুলো পরে নিলেই হবে। সাথে অক্সিজেন সিলিন্ডার তো আছেই। সমস্যা হবে না।”

“কিছু কিছু নার্ভ টক্সিন কিন্তু চামড়ার ওপরেও কাজ করে।” রেনল্ডস মনে করিয়ে দিল।

“ওয়াটার প্রুফ স্যুটগুলো পরে নিলেই হবে। চামড়াতেও কিছু লাগবে না।” কার্টও সাথে সাথে সমাধান দিয়ে দিল।

“হুম। হাতে গ্লোভস আর টেপ দিয়ে বাকি জায়গাগুলো মুড়ে দিলেই হয়ে যাবে।” জো বলল পাশ থেকে।

“টেপ? একটা টেপের ওপর তুমি তোমার জীবন বাজি ধরতে চাও?”

“এবারই প্রথম না। এর আগে একবার টেপ দিয়ে বিমানের পাখা আটানোর চেষ্টা করেছিলাম। অবশ্য সেবার জিনিসটা ঠিকমতো কাজ করেনি।” জো স্বীকার করল।

“ফাজলামো না। খামাখা তোমরা তোমাদের জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছ। ওখানে কেউ বেঁচে আছে কি-না সে কথা-ই কেউ জানে না।” বিরক্ত মুখে বলল রেনল্ডস।

“উঁহু। একটা ব্যাপার ভুলে যাচ্ছ তুমি। রেডিও কলের ব্যাপারটা। কলটা অবশ্যই ঘটনাটা ঘটার পরে করা হয়েছিল। তার মানে ঐ ডাক্তার আর আরো কয়েকজন অন্তত তখন পর্যন্ত বেঁচে ছিল। কোনো একটা হাসপাতালেই সম্ভবত। অক্সিজেন কমে আসছিল বলেছে। তার মানে কোনো বদ্ধ জায়গাতে নিজেদের আটকে রেখেছিল যাতে বিষ তাদের কাছে না পৌঁছায়। অন্যরাও হয়তো একই কাজ করেছে। আমাদের লোকেরাও হয় এভাবে কোথাও লুকিয়ে আছে। তার ওপর পানিতে দেখলাম কয়েকটা স্কুইড এখনো মরেনি। ওগুলো শুড় নাড়ছে, জড়াজড়ি করছে, হালকা হালকা নড়ছেও।” কার্ট বলল।

“যা-ই বলল, এসব সম্ভাবনা একদমই ক্ষীণ।” রেনল্ডস বলল।

কিন্তু কার্টের জন্য এতটুকু সম্ভাবনা-ই অনেক। “আমি এখানে এখন বসে থাকবো আর পরে দেখবো যে আমি সময়মতো কিছু একটা করলেই লোকগুলোকে বাঁচানো যেতো তা আমি মেনে নিতে পারবো না।”

রেনল্ডস মাথা নাড়লো। ও আগে থেকেই জানতো যে কার্টকে ফেরাতে পারবে না, “আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে। তোমরা নাহয় গেলে, আর আমরা কি করবো?”

“রেডিওতে কান পেতে বসে থাকো। আর ঐ বয়াগুলোর ওপর বসা পেলি-কানগুলোর ওপর নজর রেখো।” ইঙ্গিতে চ্যানেলের প্রবেশপথ দেখানো বয়ার ওপর বসা পাখি দেখলো। “যদি ওগুলো মরে ওখান থেকে মরে নিচে পড়ে যায় তাহলে এক মুহূর্ত দেরি না করে এখান থেকে চলে যাবে।”

.

০৫.

কয়েক মাইল দূরেই একটা ছোট জোডিয়াক নৌকায় ডিমে তা দেয়ার ভঙ্গিতে একজন বসে আছে। লোকটা আম্মন তা–জোডিয়াকটা এম, ভি. তোরিনোর। পালানোর সময় জাহাজের পিছন দিকে এটা পেয়েছে সে। একটা রেডিও আছে এটায়। তোরিনোর কু-রা জাহাজের পাশের কাঠামো পরীক্ষা করার জন্য। এটা ব্যবহার করতো। যখন বিস্ফোরণটা হয় তখন সে জাহাজটা থেকে মাত্র একশো ফুট দূরে ছিল। খুবই কাছে, বিস্ফোরণের দমকে ছাই না হলেও শক ওয়েভের ধাক্কায় মারা পড়ার কথা অন্তত। কিন্তু বিস্ফোরণের শব্দে চমকে ওঠা ছাড়া তার আর কিছুই হয়নি। ও যেভাবে চেয়েছিল সেভাবে জাহাজটা ধ্বংস হয়নি।

কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। সাথে সাথেই আবার জাহাজে উঠে দেখতে চেয়েছিল ব্যাপারটা। কিন্তু জাহাজটা তখনো পূর্ণ গতিতে চলছিল। ফলে তার এই স্বল্প গতির রাবারের নৌকায় সেটাকে ধরা সম্ভব ছিল না। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া লোকটা তাই আর কিছুই করতে পারেনি। তবে কিছুক্ষণ পরেই তার আশা পূরণ হয়। সে যেভাবে চেয়েছিল সেভাবেই জাহাজটা বিস্ফোরিত হয়।

তবে আসল ঝামেলা শুরু হয় ঠিক এর পরেই। বিস্ফোরণে ধ্বংস হওয়ার বদলে হিমাঙ্কের নিচে থাকা ঠাণ্ডা তরলটা উল্টো একটা নার্ভ গ্যাসের ধোয়া সৃষ্টি করে বসেছে। লোকটা অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখলো প্রাণঘাতী কুয়াশাটা ধীরে ধীরে পশ্চিমে এগিয়ে পুরো দ্বীপটাই ছেয়ে ফেলল। সে আর তার উচ্চপদস্থরা যে জিনিসটা গোপন রাখার এতো চেষ্টা করছিল সেটাই এখন সারা দুনিয়ায় জানাজানি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

রেডিওর সাহায্যের আবেদনটা সে-ও শুনেছে। কলটা করেছে দ্বীপের একজন ডাক্তার। সে এবং কয়েকজন রোগী একটা হাসপাতালে আটকা পড়েছে। পরিষ্কার শুনেছে মহিলা একটা গ্যাসের মেঘের কথা বলছে।

তখনই চরম সিদ্ধান্তটা সে নিয়ে নিয়েছে। ডাক্তারকে বেঁচে থাকতে দেয়া চলবে না। সেই সাথে নষ্ট করতে হবে তার উদ্ধার করা সমস্ত প্রমাণাদি।

পকেট থেকে একটা হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জ বের করল সে। ওতে আগে থেকেই ওষুধ ভরা। দাঁত দিয়ে সুঁইয়ের ক্যাপ খুললো, তারপর আঙুল দিয়ে টোকা দিয়ে নিশ্চিত হলো যে সিরিঞ্জে কোনো বুদবুদ নেই। তারপর পায়ে ইঞ্জেকশনটা ঢুকিয়ে দিল। এটা একটা প্রতিষেধক। সারা শরীরে একটা ঠাণ্ডা স্রোত ওষুধটার সাথে সাথে উঠে এলো। হাত-পা কেমন অবশ হয়ে এলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার সব স্বাভাবিক হয়ে এলো। লোকটা জোডিয়াকটার মোটর চালু করে দ্বীপের দিকে রওনা দিল। তারপর সুবিধামতো একটা জায়গায় সেটাকে আটকে রেখে নেমে এলো বালিয়াড়িতে।

কিছুক্ষণের মাঝে ও বালিয়াড়ি ছাড়িয়ে একটা পাথরের সিঁড়ির গোড়ায় এসে পৌঁছুলো। সিঁড়ির শেষ মাথা থেকে শুরু হয়েছে একটা পাকা রাস্তা।

হাসপাতাল এখান থেকে দুই মাইল দূরে। এয়ারপোর্টের কাছেই। লোকটার পরিকল্পনা হলো, সে ডাক্তার আর বাকি জীবিত লোকদের খুন করবে, তারপর এয়ারপোর্টে গিয়ে একটা ছোট বিমান চুরি করে তিউনিসিয়া বা লিবিয়া বা পারলে মিসরে পালিয়ে যাবে। কাক পক্ষীতেও ওর কথা জানতে পারবে না।

.

০৬.

“নাহ! জিনিসটা তো শান্তি দিচ্ছে না একদমই,” জো বলল।

জিনিসপত্রসহ একেবারে পুরো ডুবুরির পোশাকটাই ওর পরনে। ওপরে জ্বলছে কড়া সূর্য। ফলে গরমে ঘেমে চরম অস্বস্তিকর একটা অবস্থায় পড়ে গেছে ওরা। কেমন একটা দমবন্ধ দমবন্ধ লাগছে ওদের। বাতাস আছে। কিন্তু স্যুটের পুরু কাপড় ভেদ করে সেটা চামড়ায় পৌঁছুতে পারছে না।

“বিষাক্ত ধোয়া খেয়ে মরার চেয়ে অন্তত ভালো। কার্ট বলল।

জো মাথা ঝাঁকিয়ে আবার সামনে নজর দিল। এই মুহূর্তে ওরা ল্যাম্পেডুসা বন্দর রক্ষা বাঁধ পার হচ্ছে। কয়েক ডজন ছোট ছোট নৌকা এখানে সেখানে বাঁধা। অপরূপ নৈসর্গিক পরিবেশ চারপাশে।

“একটা নৌকাতেও কেউ নেই।” জো বলল।

কার্ট পানি ছাড়িয়ে রাস্তা আর দালানগুলোর দিকে তাকাল, “সামনের রাস্তাও জনমানব শূন্য। গাড়ি তত দূরে থাক একটা পথচারীও নেই।”

ল্যাম্পেডুসার জনসংখ্যা মাত্র পাঁচ হাজার, কিন্তু কার্ট খেয়াল করেছে এর মধ্যে অনেককেই পাওয়া যাবে মেইন রোডে। বিশেষ করে যখনই ওর কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হয়। স্কুটার আর ছোট ছোট গাড়ি ভটভট করতে করতে বিভিন্ন দিকে ছুটছে, এদের সাথে ছোট ছোট ডেলিভারি ট্রাকগুলো আবার প্রতিযোগিতায় নামে। শশা শো করে কারো তোয়াক্কা না করে পাশ কাটাচ্ছে। ভাবটা এমন যে এখানকার কমপক্ষে অর্ধেক মানুষ ফর্মুলা ওয়ানের ড্রাইভার হওয়ার যোগ্য।

এ রকম সরগরম একটা দ্বীপের এরকম নিস্তব্ধতায় ওঁর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। “ডান দিকে যাও। ঐ মাছধরা নৌকাটার পাশ দিয়ে। তাহলে শর্টকাটে যাওয়া যাবে।” কার্ট বলল।

“শর্টকাট?”

“ওদিকে একটা প্রাইভেট সিঁড়ি আছে। ওটা আমাদের বিল্ডিং-এর আরো কাছে। আমি কয়েকবার ওখানে মাছ ধরেছি। ওটা দিয়ে উঠলে অনেকখানি কম হাঁটা লাগবে।” কার্ট ব্যাখ্যা করল।

জো দিক পাল্টে কার্টের দেখানো দিকে এগুলো। মাছ ধরা নৌকাটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দুটো অবয়ব চোখে পড়ল। ডেকের ওপর দলা হয়ে পড়ে আছে। প্রথমজন পুরুষ। আছড়ে পড়ে হাত নৌকার পাশ দিয়ে বের হয়ে আছে। অপরজন মহিলা।

“একবার কি…”।

“এরা সাহায্যের বাইরে। সামনে আগাও” কার্ট বলল।

জো কিছু বলল না। তবে নৌকাও ঘোরালো না। একটুপরই কার্টের বলা কাঠের সিঁড়িটা দেখা গেল।

নৌকাটা বাঁধতে বাঁধতে জো বলল, “নৌকাটা চুরি করার মতো কেউ বোধহয় আর বেঁচে নেই।”

দ্রুত সিঁড়ি টপকে ওঠার চেষ্টা করল ওরা কিন্তু ভারী স্যুটের কারণে পারছে না। ওপরের ধাপে পৌঁছে আরো কিছু লাশ চোখে পড়ল। এক মধ্যবয়সি দম্পতি। সাথে একটা বাচ্চা আর একটা কুকুর। রাস্তার পাশের গাছগুলোর নিচে অনেক মরা পাখি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

কার্ট পাখিগুলো পেরিয়ে দম্পতির পাশে হাঁটু মুড়ে বসলো। পড়ার পরে লাগা আঘাত বাদে শরীরের আর কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই।

“দেখে মনে হচ্ছে মারা যে যাচ্ছে সেটা এরা টেরও পায়নি। একেবারে সোজা মাটিতে আছড়ে পড়েছে।”

“হুম! যা-ই এটার জন্যে দায়ী, সেটা খুব দ্রুত কাজ করে।” জো বলল। কার্ট উঠে দাঁড়িয়ে জিনিসপত্র তুলে নিয়ে পরের গলিটা দেখিয়ে বলল,

“এদিক দিয়ে।”

দুই ব্লক হাঁটার পর এরা ওদের বিল্ডিংটার কাছে পৌঁছালো। বিল্ডিংটা বেশি বড় না। আপাতত NUMA তাদের অফিস হিসেবে ব্যবহার করছিল। সামনেই একটা ছোট্ট গ্যারেজ। এখন অবশ্য সাগর থেকে ওদের উদ্ধারকৃত জিনিসপত্রগুলো রাখা হয়েছে এখানে। এর পিছনেই চারটা রুম। এগুলোই ওদের অফিস আর ঘুমানোর জায়গা।

দরজার হাতল মুচড়ে জো বলল, “তালা মারা।”

কার্ট এক কদম পিছিয়ে দাঁড়ালো তারপর সজোরে সামনে এগিয়ে লাথি চালানো কাঠের দরজায়। দরজা ভেঙে একপাশে ছুটে গেল।

জো সাথে সাথেই ভেতরে ঢুকে চেঁচালো, “লারিসা? কডি?”

কার্টও চেঁচালো। তবে এই পুরু হেলমেট ভেদ করে কতটা আওয়াজ বের হচ্ছে সন্দেহ। ওর কানেই আর ফিরে আসছে বলে মনে হচ্ছে।

“পিছনের ঘরগুলোতে চলো। যদি ওরা টের পায় যে বিপদটা আসছে এক রাসায়নিক বাষ্প থেকে, তাহলে সবচে বুদ্ধিমানের কাজ হলো সবচে ভেতরের রুমে ঢুকে দরজা জানালা বন্ধ করে লুকিয়ে থাকা।”

ওরা ত্রস্ত পায়ে পিছনের দিকে ছুটে গেল। প্রথম রুমটা খালি। জো দৌড়ে অফিস রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। কিছু একটা দেখতে পেয়ে চেঁচালো, “এখানে।”

কার্ট জো-এর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। এখানে থাকা পাঁচজনের মধ্যে চারজনকেই দেখা গেল টেবিলের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। সামনে একটা ভোলা ম্যাপ। মারা যাওয়ার আগ মুহূর্তে হয়তো এটা নিয়েই গবেষণা করছিল ওরা। একটু দূরেই কাত হয়ে পড়ে আছে কডি উইলিয়াম। যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। কড়ি ছিল রোমান পুরাকীর্তি বিশেষজ্ঞ। এই গবেষণা দলের প্রধান।

“সকালের মিটিং।” কার্ট বলল। “একবার চেক করে দেখতে বেঁচে আছে কি-না।”

“কার্ট, ওরা কেউ….”

“তাও দেখো একবার। সিওর হয়ে নাও।” গম্ভীর মুখে বলল কার্ট। জো টেবিলের কয়জনকে চেক করল আর কাট চেক করল কডিকে। তারপর চেয়ার থেকে নামিয়ে মেঝেতে শুইয়ে দিল। প্রচণ্ড ভারি লাগছে শরীরটা। কার্ট শরীরটা ধরে বহুক্ষণ ঝাঁকাঝাঁকি করল। কিন্তু কাজ হলো না কিছুই। “পালস্-টালস তো কিছুই টের পাচ্ছি না। অবশ্য এই মোটা গ্লোভস পরা থাকলে পাওয়ার কথাও না।” বলে জো গ্লোভস খুলতে গেল।

“উঁহু!” কার্ট মাথা নেড়ে নিষেধ করল।

তা দেখে জো থেমে গেল। কার্ট উঠে একটা ছুরি নিয়ে এসে ফলাটা কডির সামনে ধরলো। “নাহ! ওরা নিশ্বাস নিচ্ছে না।”

ও ছুরিটা ছুঁড়ে ফেলে দিল, “শালার জাহাজটায় ছিলটা কি?” প্রচণ্ড রাগে গজরাতে গজরাতে বলল কার্ট।.”কি এমন জিনিস যে পুরো একটা দ্বীপের প্রতিটা প্রাণীকে মেরে ফেলতে পারে। সৈন্যবাহিনীর কাছে এরকম কিছু নার্ভগ্যাস আছে বলে শুনেছি। কিন্তু এরা পাবে কোথায়?”

জোর মাথাতেও এসব চিন্তাই ঘুরছিল। “ধরলাম তুমি একজন সন্ত্রাসী আর তোমার কাছে এরকম কোনো গ্যাস আছে। কিন্তু কোন দুঃখে তুমি সেটা এই দ্বীপে ছড়াতে যাবে? সমুদ্রের মাঝের এই দ্বীপটা তো ম্যাপেও দেখা যায় না। এখানে থাকে কিছু মাঝি, ডুবুরি আর ছুটি কাটাতে আসা মানুষ।”

কার্ট আরো একবার মৃত সহকর্মীদের দিকে তাকাল, “জানিনা। তবে আমি এর পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করবোই। আর যখন করবো, এমন ছাচা দেবো শালাদের যে এই জায়গার নামও কোনোদিন মুখে আনতে চাইবে না।

জো কার্টের এই কণ্ঠটাকে খুব ভালো মতোই চেনে। এটা হলো সদাহাস্য, সদাচঞ্চল কার্টের ঠিক উল্টো রূপ। অন্যভাবে বলা যায় মুদ্রার অপর পিঠ, কার্টের অন্ধকার চরিত্র। সোজা বাংলায় যাকে বলে, ধরে নারে ধরে না, ধরলে কিন্তু ছাড়ে না।

অন্য সময় হলে জো হয়তো কার্টকে এসব জেদ থেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করতো, কিন্তু এই মুহূর্তে ওর নিজেরও ঠিক একই ইচ্ছে করছে।

“সী ড্রাগনে খবর দাও। আমি গাড়ির চাবিটা খুঁজে বের করি। হাসপাতালটায় যেতে হবে। আর হাঁটতে পারবো না।” বলে কার্ট চাবির খোঁজে বেরিয়ে গেল।

.

০৭.

জিপ গাড়ির ভি-এইট ইঞ্জিন গর্জে উঠল। নিস্তব্ধ দ্বীপে সেই শব্দটাই কানে লাগল।

কার্ট চাবি মুচড়ে বার কয়েক গাড়ি চালু বন্ধ করল। যে মায়ার প্রভাবে ওদের চারপাশের সবকিছু ঘুমিয়ে পড়েছে, সেটা যদি ভাঙ্গে সেই আশায়।

গিয়ার বদলে জিপ চালানো আরম্ভ করল কার্ট, জো একটা ম্যাপের দিকে তাকিয়ে। হাসপাতাল খুব বেশি দূর না কিন্তু রাস্তায় ডজনকে ডজন গাড়ি এলো-মেলো হয়ে থেমে আছে, কোনোটার রেডিয়েটর থেকে এখনও ধোয়া বেরুচ্ছে। স্কুটারগুলো কাত হয়ে পড়ে আছে, সেগুলোর আরোহী পড়ে আছে আরো কয়েক হাত দূরে। প্রতি রাস্তার মোড়ে গাড়িগুলো একটার ওপর অন্যটা উঠে তূপ হয়ে আছে। পথচারীরাও যেখানে ছিল সেখানেই মরে পড়ে আছে।

“দেখে মনে হচ্ছে কেয়ামত হয়ে গেছে। এতে পুরো মৃতদের শহর।” জো বলল শুকনো মুখে।

হাসপাতালের কাছেও বিশাল একটা স্তূপ দেখা গেল। পুরো রাস্তাই আটকে ফেলেছে। একটা ট্রাক উল্টে ওটার সমস্ত মালামাল রাস্তায় ছড়িয়ে পড়েছে। উপায় না দেখে কার্ট গাড়ি রাস্তার পাশের একটা বাগানে নামিয়ে দিল। তারপর ঘুরে মেইন গেটে পৌঁছালো।

“হাসপাতালটাতে ভালোই আধুনিক,” ছয়তলা দালানটার দিকে তাকিয়ে বলল জো।

“লিবিয়া আর তিউনিসিয়া থেকে আসা রিফিউজিদের জন্য এটা বড় করা হয়ছে।”

কার্ট জিপ বন্ধ করে নেমে এগুতে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়ালো। ওর কিছু একটা চোখে পড়েছে।

“কি হল?” জিজ্ঞেস করল জো।

কার্ট আবার গাড়ির কাছে ফিরে গেল, “কি যেন নড়তে দেখলাম।”

“কি সেটা?”

“জানিনা, ভাঙ্গা গাড়িগুলোর ওপরে।”

কার্ট আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, কিন্তু কিছুই দেখা গেল না।

“চলো দেখে আসি।”

কার্ট মাথা নাড়লো, “থাক। চোখের ভুল সম্ভবত। ছায়া-টায়া হবে।”

“কে জানে, জম্বিও হতে পারে।”

“তাহলে তো আর তোমার চিন্তা করার কিছু নেই। জম্বিরা শুধু ঘিলু খায়।” কার্ট বলল।

“মজা পেলুম, তবে সত্যি কথা হলো যদি কেউ সত্যিই বেঁচে থাকে আর আমাদেরকে এই অবস্থায় দেখে তাহলে সামনে আসার আগে দশবার ভাববে।” জো বলল।

“হতে পারে। তবে সম্ভবত আমার মনেরই ভুল। বাদ দাও। ভেতরে চলো,” কার্ট সামনে এগুলো।

ঢোকার দরজার কাছে পৌঁছাতেই অটোমেটিক দরজা সুউ-শ করে খুলে গেল। ওয়েটিং রুমে প্রায় ডজন খানেক লাশ পড়ে আছে। বেশির ভাগই যে চেয়ারে বসে ছিল সেখানেই কাত হয়ে আছে। ফ্রন্ট ডেস্কে একজন নার্স এলিয়ে পড়ে আছে।

“সবাইকে তো চেক করার দরকার আছে বলে মনে হচ্ছে না।” জো বলল।

“চেক করবোও না। আমার ট্যাঙ্কের অক্সিজেন তিনভাগের একভাগ কমে গেছে। তোমারটারও একই অবস্থা হওয়ার কথা। জায়গাটাও অনেক বড়। প্রতিটা রুমের সবাইকে ধরে ধরে চেক করা সম্ভব না।”

কার্ট একটা ডাইরেক্টরি খুঁজে পেল। খুলে নামগুলোর ভেতর খুঁজতে লাগল। প্রথম পাতাতেই পাওয়া গেল অ্যামব্রোসিনির নাম। তবে বাকি সব নাম টাইপ করা হলেও এই নামটা হাতে লেখা। “মহিলা সম্ভবত নতুন জয়েন করেছে। কোনো অফিস নাম্বার বা কয়তলায় বসে কিছুই লেখা নেই।”

“এটা ব্যবহার করলে কেমন হয়?” একটা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে জো বলল। জিনিসটা সম্ভবত একটা PA (Public address : মাইক) সিস্টেমের সাথে লাগানো।

“ডাক শুনলে সাড়া দিতেও পারে।”

“ভালো বুদ্ধি।”

জো সিস্টেমটা চালু করে। “অল কল’ লেখা বোতামটা টিপে দিল। সম্ভবত এটা দিলেই সারা হাসপাতালে আওয়াজ পৌঁছায়।

কার্ট মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে হেলমেটের কাঁচের সাথে চেপে ধরলো। তারপর যথাসম্ভব পরিষ্কার আওয়াজে বলার চেষ্টা করল, “ড, অ্যামব্রোসিনি অথবা জীবিত আর কেউ যদি বেঁচে থাকে তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, আমি কার্ট অস্টিন। আমরা আপনার সাহায্যের আবেদন শুনে এসেছি। যদি আপনি এই মেসেজটা শুনতে পান তাহলে ফ্রন্ট ডেস্কে ফোন করুন। আমরা আপনার খোঁজে এসেছি কিন্তু কোথায় খুঁজবো বুঝে পাচ্ছি না।”

মেসেজটা PA সিস্টেম হয়ে সারা হাসপাতালেই ছড়িয়ে পড়ল। কিছুটা কাঁপা কাঁপা তবে পরিষ্কার বোঝা যায়। কার্ট আবারো বলতে যাবে কিন্তু তার আগেই অটোমেটিক ডোরটা আবারো সুউশ করে খুলে গেল।

জো আর কার্ট চকিতে ঘুরে গেল, কিন্তু দরজা খালি কেউ নেই ওখানে। দুই সেকেন্ড পরে আবার বন্ধ হয়ে গেল সেটা।

“যত তাড়াতাড়ি পারি এখান থেকে ভাগতে চাই বাবা।” জো বলল।

“আমিও।”

ডেস্কের ফোনটা বাজতে আরম্ভ করল আর একটা সাদা বাতি জ্বলতে আর নিভতে শুরু করল।

“লাইন ওয়ানে আপনার জন্য একটা ফোন এসেছে ড. অস্টিন।” জো বলল। কার্ট স্পিকার লেখা বোতামটা টিপে দিল।

“হ্যালো, একজন মহিলার কণ্ঠস্বর,” কেউ আছেন? আমি ড, অ্যামব্রোসিনি।” কার্ট স্পিকারের একদম কাছে হেলমেট ঠেকিয়ে বলল, “আমার নাম কার্ট অস্টিন। আপনার রেডিও কল শুনে সাহায্য করতে এসেছি।”

“ওহ! থ্যাঙ্ক গড! আপনার কথা শুনে আমেরিকান মনে হচ্ছে। আপনি কি NATO-র কেউ?”

“না। আমি আর আমার বন্ধু NUMA নামের একটা প্রতিষ্ঠনে কাজ করি। পানির নিচে ডুবে যাওয়া জিনিসপাতি উদ্ধার করি আরকি।”

কিছুক্ষণ নীরবতা। “আপনাদের কিছু হয়নি কীভাবে? যারা-ই বিষটার সংস্পর্শে এসেছে তার-ই তো মারা পড়েছে। আমি নিজ চোখে দেখেছি।”

“বলতে পারেন আমরা ঠিকঠাক কাপড় পরেছি, তাই কিছু হয়নি।”

“একটু বেশিই কাপড় পরা হয়ে গেছে।” জো ফোড়ন কাটলো।

“ঠিক আছে। আমরা চার তলায় আটক পড়েছি। প্রাস্টিকের শীট আর সার্জিক্যাল টেপ দিয়ে রুমের দরজা সীল করে রেখেছি। কিন্তু আর বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না। অক্সিজেন ফুরিয়ে আসছে।”

“ইতালিয়ান সৈন্যবাহিনীর একটা ইউনিট ঝুঁকিপূর্ণ পদার্থ নিষ্ক্রিয়কারী টীম নিয়ে রওনা দিচ্ছে। আপনাদের আরো দুয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে।” কার্ট জানালো।

“সম্ভব না। এখানে আমরা উনিশজন আছি। তাজা বাতাসের দরকার সবার যত দ্রুত সম্ভব। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে।”

কার্ট সাথে করে দুটো অতিরিক্ত স্যুট আর একটা অক্সিজেন ট্যাঙ্ক নিয়ে এসেছে। পরিকল্পনা ছিল প্রথমে যাকে পাবে তাকে সী ড্রাগনে নিয়ে যাবে, তারপর বাকিদেরকে নিতে আসবে। কিন্তু এখানে প্রায় বিশজন লোক আটকা…

“কি বলছেন?” ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন।

“আমরা আপনাদেরকে বের করতে পারবো না।” কার্ট জবাব দিল।

“আমরা এখানে আর বেশিক্ষণ টিকবো না, কয়েকজন বয়স্ক রোগী এর। মধ্যেই জ্ঞান হারিয়েছে।” জবাব দিল ডাক্তার।

“হাসপাতালে কি ঝুঁকিপূর্ণ দ্রব্য নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা আছে? ওখানে খুঁজলে কিছু স্যুট পাওয়া যেতে পারে।” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

“না, এরকম কিছুতে নেই।”

“অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই। সব হাসপাতালেই তো থাকার কথা।” জো বলল পাশ থেকে।

কার্ট মাথা নাড়লো, “এই সপ্তাহে তোমার বেতন কাটা মাফ করলাম যাও।”

“এ আর নতুন কি?”

কার্ট এক হাত উঁচু করে তর্জনী নেড়ে না করল।

তা দেখে জো মারাত্মক কষ্ট পাওয়ার ভান করল আর কার্ট আবার স্পিকারের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “সাপ্লাই রুম কয় তালায়? আমরা আপনাদেরকে কিছু অক্সিজেনের বোতল এনে দিচ্ছি। আশা করি ইতালিয়ান সৈন্যবাহিনী আসার আগ পর্যন্ত থাকতে পারবেন।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাহলে চলবে। মেডিকেল সাপ্লাই তিন তলায়। প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি করুন।”

কার্ট ফোন কেটে এলিভেটরের দিকে এগুলো। দরজা খুলতেই দেখা গেল একজন ডাক্তার আর নার্স কাত হয়ে পড়ে আছে।

জো তাদেরকে তুলে বসাতে গেল কিন্তু কার্ট হাত তুলে না করল, “সময় নেই।” ৩ লেখা বোতামটা টিপতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে পিং করে আওয়াজ হতেই দরজা খুলে গেল আর কার্ট নেমে গেল। আর জো ডাক্তারটাকে টেনে অর্ধেক দরজার বাইরে এনে রেখে দিল।

“দরজায় ঠেকা দিলে?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

“আশা করি লোকটা কিছু মনে করবে না, জো জবাব দিল।

“নাহ! কি আর মনে করবে।”

শেষ মাথায় ওরা সাপ্লাই রুমটা খুঁজে পেল। দরজা ভেঙে ঢুকতেই দেখে পিছনে মেডিকেল অক্সিজেন লেখা এক খাঁচা অক্সিজেনের বোতল। কার্ট গুনে দেখলো আটটা বোতল। আশা করল এতেই কাজ হয়ে যাবে।

জো একটা ট্রলি এনে বলল, “এর ওপর উঠিয়ে দাও। তাহলে আর আমাদেরকে টানতে হবে না।”

কার্ট বোতলগুলো ট্রলিতে তুলতেই জো সেগুলো বেঁধে ফেলল যাতে গড়িয়ে না পড়ে।

তারপর ঠেলে দরজা দিয়ে বের করার চেষ্টা করল কিন্তু মাথাটা বেঁকে দেয়ালে গিয়ে ঠেকলো।

“গাড়ি চালানো শিখেছ কোত্থেকে?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

“আরে এগুলো দেখতে সহজ হলেও চালানো আসলে অনেক কঠিন।”

জো জবাব দিল।

আবার সোজা করে আবার ঠেলা দিল। এটুকুতেই একেবারে ঘাম ছুটে গেল ওদের।

কিছুদূর এগুতেই শোনে এলিভেটরের পিংশব্দ। বিঙ্কিয়ের দ্বিতীয় এলিভেটরের দরজাটা খুলে যাচ্ছে।

“আমি নিশ্চিত এই হাসপাতালে ভূতের আসর আছে।” জো বলল। “পুরা বিল্ডিংয়ে থাকলেও কারেন্টের লাইনে আছে সিওর।” কার্ট জবাব দিল।

এলিভেটরের কাছে পৌঁছাতেই, রোদে পোড়া চামড়ার একটা মানুষ দ্বিতীয় এলিভেরটা থেকে বের হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

“বাচান” হাসফাস করতে করতে বলল লোকটা, “প্লিজ…”

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কার্ট দ্রুত ট্রলিটা ছেড়ে লোকটার পাশে বসে পড়ল। লোকটার চোখ এতোক্ষণ বন্ধ ছিল। কিন্তু কার্ট তার মুখের কাছে ঝুঁকতেই লোকটার চোখ খুলে গেল তারপর অপলক তাকিয়ে থাকল কার্টের চোখের দিকে। সেই চোখে কোনো মৃত্যুভয় বা ঘোর নেই, শুধুই জিঘাংসা। সেটা প্রমাণ করতেই লোকটা ছোট্ট পিস্তলটা বের করেই গুলি করল।

.

০৮.

গুলির শব্দ ফাঁকা করিডোরে প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে গেল চারপাশে, আর কার্ট পিছন দিকে উল্টে পড়ে গেল। বেকায়দাভাবে মুচড়ে আছে শরীর। যেভাবে পড়েছে ওভাবেই পড়ে থাকল আর নড়লো না।

অবাক হলেও রিফ্লেক্সের বশেই জো সামনে ঝাঁপ দিল। অর্ধেক জীবন বক্সিংয়ের রিং-এ কাটানোর সুফল। জো-র হাতের ধাক্কায় লোকটার হাত ঘুরে গেল আরেকদিকে। ফলে পরের গুলি দুটো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গিয়ে লাগলো দেয়ালে। জো হেলমেট পরা মাথা দিয়ে লোকটার মাথায় একটা গুতো দিল, সাথে সাথে লোকটা চিৎপটাং। হাতের পিস্তলও ছিটকে পড়ল দূরে।

দুজনেই হামাগুড়ি দিয়ে পিস্তলের দিকে এগুলো। জো-ই আগে পৌঁছুলল। হাতে নিয়েই উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু ঝামেলা পাকালো হাতের গ্লোভস। কিছুতেই আঙুল ট্রিগারে ঢোকে না। এই সুযোগে আততায়ী লোকটা ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আর দুজনেই পাশের দরজাটায় আছড়ে পড়ল, দরজার ওপরে লেখা সাবধান MRI.

দুজনেই শক্ত মেঝের ওপর পতিত হলো আর ধাক্কায় একজন আরেকজনের কাছ থেকে ছুটে গেল। হেলমেট পরে থাকার কারণে জো দুইপাশে ঠিকভাবে দেখতে পারছে না, ফলে বন্দুক আর আততায়ী দুটোর হদিসই ও হারিয়ে ফেলল। আশেপাশে ঘুরে ঘুরে তাকাতে বন্দুকটা কোথাও দেখতে পেল না তবে লোকটাকে দেখলো বিশ ফুটের মতো দূরে পড়ে আছে। সম্ভবত অজ্ঞান হয়ে গেছে।

জো ওঠে দাঁড়িয়ে এক পা আগে বাড়াতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। মনে হচ্ছে কেউ যেন ওকে পিছন থেকে টেনে শুইয়ে দিতে চাচ্ছে। আরেক পা আগে দিতেই প্রায় উল্টেই পড়ে গেল। প্রথমে ভাবলো সম্ভবত বিষাক্ত গ্যাস ওর ফুসফুসে গেছে। কারণ আসলেই ও সামনে এগোতে পারছে না। মনে হচ্ছে যেন কেউ ওর কাঁধে রশি বেঁধে টানছে।

তবে খুব দ্রুতই কারণটা ধরতে পারলো। ওরা এখন আছে হাসপাতালের MRI-রুমে। ওর বিশ ফুট পেছনেই একটা ছোট গাড়ির সমান একটা মেশিন। ওটার ভেতর আছে খুবই শক্তিশালী চুম্বক। চুম্বকগুলো সব সময়ই ক্রিয়াশীল একবার কয়েকমাস হাসপাতালে কাজ করেছিল জো। ফলে MRI মেশিন সম্পর্কে ভালোই জানা আছে ওর। ওটার আশেপাশে লোহা নির্মিত কিছু আসলেই হয়। সোজা টেনে নিয়ে আটকে ফেলবে। আর জোর পিঠে স্টিলের ট্যাংক, মাথায় স্টিলের হেলমেট। ওকেতো আটকাবেই। জো তিরিশ ডিগ্রি কোণে সামনের দিকে বাঁকা হয়ে গেল। প্রাণপণ চেষ্টা করছে চুম্বকের টান উপেক্ষা করতে। ওভাবেই কয়েক পা এগুলো দেখে মনে হচ্ছে কেউ বুঝি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের বিপরীতে হাঁটছে। কিন্তু এগুতে পারছে না।

জোর প্রতিপক্ষ মাত্র দশ ফুট দূরে পড়ে আছে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি। কিন্তু এত চেষ্টা করেও জো তার কাছে পৌঁছুতে পারছে না।

জো আরো খানিকটা বাঁকা হলো, আরেক পা আগালো কিন্তু পা পড়ল মেঝের পিচ্ছিল একটা অংশে। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো। ওর পা পিছলে পিছনে সরে গেল আর সমস্ত প্রতিরোধ এক মুহূর্তে গেল হারিয়ে। ব্যস! পরের মুহূর্তেই সে বাতাসে উড়ে MRI মেশিনটার দিকে ধেয়ে গেল।

জো-র পিছন দিকটা দড়াম করে বাঁকানো মেশিনটার মুখে গিয়ে বাড়ি খেলো আর মাথা বাড়ি খেলো ওপরের অংশে।

চুম্বক ওকে সেখানেই আটকে রাখলো, ফলে ও এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঝুলে রইল সেখানে। এমনকি ওর পা-ও এটে আছে মেশিনের সাথে। পায়ের বুটে স্টিলের কাটা এজন্যে দায়ী। বাম হাতে স্টীলের ঘড়ি। সেটাও এটে আছে। কোনো মতে শুধু ডান হাতটাই মেশিনের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে। শরীরের বাকি কোনো অংশই ও নাড়াতে পারছে না।

এর মধ্যেই আততায়ী জ্ঞান ফিরে পেয়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে জো-কে দেখে এমনভাবে মাথা নাড়তে লাগল যেন খুব মজা পাচ্ছে। তারপর হাসতে হাসতে পিস্তল তুললো গুলি করার জন্যে। কিন্তু সেটা ওর হাত থেকে ছুটে উড়ে গিয়ে জো-এর পাশে গিয়ে আটকে গেল।

জো মোচড়া মুচড়ি করে বন্দুকটা হাতানোর চেষ্টা করল কিন্তু হাত পিস্তল পর্যন্ত পৌঁছালোই না।

লোকটা প্রথমে অবাক হলেও দ্রুত সামলে নিলো। ওর হাতে উঠে এলো আরেকটা অস্ত্র। একটা ছোট ত্রিকোণাকায় ছুরি। সেটাকে মুঠো করে ধরেও এগুলো জো-এর দিকে।

“আরে আরে কথা শোনেন। আপনার বোধহয় কোনো সাহায্য দরকার, তাই না? আরেকটু ভালো চিকিৎসা, আরেকটু ভালো পাগলা গারদে থাকলেই আপনি ঠিক হয়ে যাবেন।” জো বলল।

“নিজের ভাগ্যকে মেনে নাও। কষ্ট কম পাবে।” লোকটা বলল।

“নিজের চরকায় তেল দাও বাছা।”

লোকটা সামনে এগুলো আর জো হঠাৎ এক টানে ওর পা ছুটিয়ে দিল এক লাথি। মুখের একপাশে লাগল সেটা।

লাথি খেয়ে লোকটা পিছিয়ে গেল খানিকটা। মারাত্মক রেগে গেল সে। গজরাতে গজরাতে ছুরিটা ওপরে তুলে সোজা জো-র বুক বরাবর এগোতে যাবে, তখনই পিছনের দরজাটা খুলে গেল। কার্ট সেখানে দাঁড়ানো হাতে একটা স্যালাইন ঝুলানোর রড। ও ওটা ছেড়ে দিতেই ধাতব দণ্ডটা প্রচণ্ড বেগে MR মেশিনের দিকে ছুটলো। যাত্রা পথে ওটা লোকটার শরীরকে একটা বর্শার মতো ফুটো করে ওর লাশটা নিয়েই জোর পাশে মেশিনের গায়ে গিয়ে পড়ল।

জো সেদিকে তাকাতেই দেখলো লোকটার চোখের আলো নিভে যাচ্ছে। তারপর কার্টের দিকে ফিরে বলল, “সময় মতই এসেছ। আমিতো ভাবতাম তুমি বুঝি সারাদিনই মরার ভান করে উল্টে পড়ে থাকবে।”

জো খেয়াল করল কার্টের হেলমেটের ওপর দিকটা দেবে গেছে। আর সেই জায়গা থেকে চেহারা বেয়ে রক্ত পড়ছে। হেলমেটের সামনের কাঁচেও ফাটল ধরেছে।

“আসলাম ধীরে সুস্থে। জানতাম-ইতো যে এসে তোমাকে কোথাও না কোথাও ঝুলতেই দেখবো।”

জো’র চেহারায় একটা আত্মতৃপ্তির হাসি…

“যাই হোক, আর কাছে এসো না, নাহলে তোমাকে আমার পাশেই রেফ্রিজারেটর হয়ে ঝুলে থাকতে হবে।”

কার্ট দরজার ওখানেই দরজার হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। যাতে টান পড়লে আটকাতে পারে। আশেপাশে তাকাল ও। বাম দিকেই প্লোক্সি গ্লাসে ঘেরা MRI কনট্রোল রুম।

“এটা অফ করবো কীভাবে?”

“অফ করা যায় না। চুম্বকগুলো সবসময়ই ক্রিয়াশীল। আমি এল পায়ের যে হাসপাতালে কাজ করতাম সেখানে একবার একটা হুইল চেয়ার আটকে গিয়েছিল। ছয়জন লোক লেগেছিল সেটা ছাড়াতে।

কার্ট মাথা ঝাঁকিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। তবে তাকিয়ে আছে আততায়ী লোকটার দিকে।

“কিছু প্রশ্ন হলো এই ব্যাটার সমস্যা কী?”

“আমিতো বুকের মধ্যে গাথা বর্শাটা বাদে আর সমস্যা দেখছিনা।”

“ওটা বাদে।” কার্ট বলল।

“জানিনা। তবে এটাই আমাকে অবাক করছে যে এই দ্বীপের একমাত্র নড়নক্ষণ জিনিস হলো এক বদ্ধ উন্মাদ যে কি-না কোনো দৃশ্যত কারণ ছাড়াই আমাদের খুন করতে চাচ্ছিলো।” জো জানালো।

“তুমি এখনও অবাক হও। আমার তো এখন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। সবসময়ই এমনটা হয়। আমি অবাক হচ্ছি ব্যাটার পোশাক পরিচ্ছদ দেখে। বা বলতে পারো নেই দেখে। আমরা ঘেমে গোসল করে ফেলছি আর লোকটার নাকে একটা মুখোস পরারও দরকার হয়নি।”

“হয়তো বাতাস পরিষ্কার হয়ে গেছে। তার মানে আমি এখন…. জো বলল।

“ঝুঁকি নেয়ার দরকার নেই।” হাত বাড়িয়ে নিষেধ করল কার্ট।” “সিওর হওয়ার আগ পর্যন্ত এসব খোলার দরকার নেই। আমি অক্সিজেনের বোতলগুলো ড, অ্যামব্রোসিনিকে দিয়ে আসি। উনি হয়তো কিছু বলতে পারবেন।”

“আমি তোমার সাথে আসতাম। কিন্তু….”।

কার্ট হাসলো। “বুঝেছি। আমি জানি তুমি আটকা পড়েছে।”

“হুস। এর কারণ হলো আমার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব।” জো বলল। কার্ট হাসলো। তবে কিছু না বলেই ঘুরে বেরিয়ে এলো রুমটা থেকে।

.

০৯.

রেনাটা অ্যামব্রোসিনি অপারেশন রুমের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে আছে। নড়াচড়ার শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই। জীবনেও সে এরকম কোনো পরিস্থিতিতে পড়েনি আগে। যদি বেঁচে থাকে তাহলে আর পড়তেও চায় না।

খুবই ধীরে ধীরে নিশ্বাস নিচ্ছে সে। যতটা সম্ভব কম অক্সিজেন খরচ করতে চায়, অস্থির লাগছে খুব। প্রচণ্ড ইচ্ছে করছে দরজার প্লাস্টিক সিলের বাইরে বেরিয়ে বুক ভরে অক্সিজেন নিতে। মরলে মরুক আর সহ্য হচ্ছে না। মনোযোগ সরাতে চুলে হাত বুলালো, পনিটেল করা চুলের ব্যান্ড খুলে আবার রাখলো। তারপর গায়ের ল্যাব কোট প্রথমে ভাজ করে আবার সোজা করতে লাগল। আর কতক্ষণ সহ্য করতে পারবে তা জানেনা।

অক্সিজেনের প্রভাব কমে গেলে শরীর-মন দুটোর ওপরই প্রভাব পড়ে। কোনোটাই নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না, তারপরও রেনাটা সহ্য করে আছে কারণ এখানে কষ্ট হলেও বেঁচে আছে। বাইরে বেরুলেই স্রেফ মারা পড়বে।

রেনাটার বাড়ি টুসকানি-তে। তবে ইতালির অনেক জায়গাতেই ওর থাকা পড়েছে। বাবা ছিলেন ইতালির মিলিটারি পুলিশ দলের একজন বিশেষজ্ঞ। তার সাথেই সারা দেশ ঘুরেছে। এক সন্ত্রাসী হামলায় মা মারা যান। রেনাটার বয়স তখন মাত্র পাঁচ। তারপরই তার বাবা সারা দেশ ঘুরে ঘুরে সংগঠিত সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিশেষ বাহিনী তৈরির কাজে মনোযোগ দেন।

বাবার কাছ থেকে পেয়েছে সাহস আর জেদ এবং মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে সৌন্দর্য। রেনাটা বৃত্তি পেয়ে মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হয় এবং প্রথম স্থান নিয়েই পড়াশোনা শেষ করে। সাথে পার্টটাইম পেশা হিসেবে ছিল মডেলিং। তবে শেষ পর্যন্ত বিলবোর্ডের চেয়ে ইমার্জেন্সি রুমই বেশি মনে ধরে যায়। কারণ মডেল-এর জীবন হলো অন্যদের কাছ থেকে সমালোচনা পেয়ে পেয়ে বেঁচে থাকা, যেটা ওর খুব একটা পছন্দ না। আর তাছাড়া চেহারা ভালো হলেও অন্যান্য মডেলদের তুলনায় রেনাটা কিছুটা খাটো। মাত্র পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি।

অন্যরা যাতে তাকে সিরিয়াসলি নেয় তাই রেনাটা চুল সবসময় কালো রঙ করে রাখতে, বেশি একটা মেক আপ দিতো না, এমনকি মাঝে মাঝে গাম্ভীর্য আনার জন্য চোখে একটা চশমাও লাগাতো। তারপরেও এই চৌত্রিশ বছর বয়সেও জলপাই তেলের রঙের মসৃণ চামড়া আর সোফিয়া লরেনের মতো দেহ সৌষ্ঠবের কারণে তার পুরুষ সহকর্মীরা সুযোগ পেলেই আড়ালে আবডালে তার দিকে তাকিয়ে থাকতো।

সে কারণে ও সিদ্ধান্ত বদল করে ঠিক করে ডাক্তারিই করবে। এ কারণেই ল্যাম্পেডুসাতে আগমন। আর এখানেই ও আবিষ্কার করে ওর আসল সত্তা, ও আসলেই কি চায়। তবে এখন অবশ্য ও জানে না এখান থেকে বেঁচে আর ফিরতে পারবে কি-না।

“আরেকটু ধৈর্য ধরো।” নিজেকেই বলল রেনাটা।

ও আরো একবার কার্বন-ডাই-অক্সাইড দূষিত বাতাসে শ্বাস গ্রহণ করল। বুকে মনে হলো আগুন ধরে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকাল একবার। আমেরিকান লোকটার সাথে কথা হয়েছে এখনো দশ মিনিট হয়নি।

“এতক্ষণ লাগছে কেন?” রেনাটার পাশ থেকে তরুণ একজন ল্যাব সহকারী জিজ্ঞেস করল।

“এলিভেটর নষ্ট হয়ে গেছে বোধহয়।” ব্যঙ্গ করে বললে রেনাটা। তারপর বহু কষ্টে নিজেকে টেনে তুললো। অন্যদের চেক করবে।

আক্রমণটা শুরু হতেই ওরা এই রুমের কজন-ই শুধু বাঁচতে পেরেছে। এখানে আছে একজন নার্স, একজন ল্যাব-সহকারী, চারটা বাচ্চা আর বারোজন বয়স্ক রোগী। এর মধ্যে তিনজন বিদেশি। তিউনিসিয়া থেকে একটা ভাঙ্গচোরা নৌকায় করে এখানে চলে এসেছে। আসার পথে জ্বলন্ত সূর্যের তাপে গায়ে ফোস্কা পড়েছে, একটা ঝড়ের কবল থেকে বেঁচেছে। দ্বীপের কাছে পৌঁছে শেষ মুহূর্তে হাঙ্গরের আক্রমণ থেকে বাঁচতে পাঁচশো গজ সাঁতরে তীরে এসে উঠেছে। এতো মারাত্মক সব জিনিস থেকে বেঁচে এসে এখন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বিষক্রিয়ায় মারা যাচ্ছে। ভাগ্য! তাও একটা হাসপাতালের রুমে যেখানে তাদের অক্সিজেন আরো বেশি পাওয়ার কথা।

বেশ কয়েকজন রোগী-ই ইতোমধ্যে অচেতন হয়ে গেছে। সর্বশেষ অক্সিজেনের বোতলটা নিয়ে খুললো রেনাটা। কিন্তু কিছুই বেরুলো না। খালি।

বোতলটা হাত থেকে ফেলে দিল ও। প্রচণ্ড শব্দ করে সেটা একদিকে গড়িয়ে দেয়ালে গিয়ে থামল। কেউ একবার চোখ ঘুরিয়েও দেখলো না। বাকিরাও জ্ঞান হারাচ্ছে। জ্ঞান আর ফিরবে কি-না জানা নেই। আর কিছুক্ষণ। অক্সিজেন না পেলেই ব্রেইন ড্যামেজ হয়ে পুরোপুরি চিরনিদ্রায় ঢলে পড়বে সবাই। রেনাটা দরজার কাছে গিয়ে হেলান দিল। আর পারছে না। টেপ ধরে টান দিল। কিন্তু এতোটাই দুর্বল যে টেপটাও খুলতে পারলো না। “শক্ত হও রেনাটা, শক্ত হও।” নিজেকেই নিজে আদেশ দিল রেনাটা।

ঘরের ভেতর মনে হলো একটা কমলা রঙের অস্পষ্ট কিছু বোধহয় পিছনের ঘরটায় ঢুকেছে। একটা মানুষ। আজব একটা পোশাক পরনে। রেনাটার মনে হলো লোকটা নভোচারী। নাকি লোকটা এলিয়েন? নাকি পুরোটাই চোখের ভুল? হঠাৎ লোকটা চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার মানে ওটা চোখের ভুল।

আবার টেপের কোণাটা ধরলো রেনাটা। টান দেবে তখনি শোনে কেউ বলছে, “না।”

রেনাটা ছেড়ে দিল টেপ। সাথে সাথেই হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল, তারপর কাত হয়ে গেল একপাশে। শুয়ে শুয়েই দেখলো দরজার নিচের পাস্টিক ফুটো করে সরু একটা নল ঢুকে গেল। তারপর সেটা সাপের মতো হিসহিস করে উঠল। প্রথমে ভাবলো এটা বুঝি সাপ-ই কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরই ওর মাথা পরিষ্কার হয়ে এলো। অক্সিজেন-তাজা অক্সিজেন টুকছে ভেতরে।

প্রথমে ধীরে ধীরে তবে তারপরই আচমকা সব জড়তা কেটে গেল রেনাটার। মাথাটা অবশ্য টনটন করে উঠেছে, তবে ও এতেই খুশি। বুক ভরে নিশ্বাস নিলো ও। ঠাণ্ডা অক্সিজেন একেবারে শরীরের সবচে ভেতরের কোষটা পর্যন্ত পৌঁছে গেল। রক্তে আবারো বইতে শুরু করেছে অ্যাড্রেনালিন, ঠিক একজন দৌড়বিদের সমান।

আরেকটা নল ঢুকতে দেখা গেল পাশেই। রেনাটা একপাশে সরে গেল যাতে অন্যদের কাছে দ্রুত অক্সিজেন পৌঁছায়। শরীরে কিছুটা শক্তি ফিরে পেতেই রেনাটা উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে চোখ রাখলো। কমলা রঙের নভোচারীকে দেখা গেল। ইন্টারকমের দিকে যাচ্ছে। এক সেকেন্ড পরই রেনাটার ঠিক পাশেই ঝোলানো স্পিকারটা জ্যান্ত হয়ে উঠল, “সবাই ঠিক আছে তো?”

“আশা করি ঠিক থাকবে। আপনার মাথায় কি হয়েছে? রক্ত পড়ছে।”

“গুতো খেয়েছি।” কার্ট বলল।

রেনাটার মনে পড়ল ও গুলির শব্দ শুনেছিল। কিন্তু তখন ভেবেছিল কল্পনা বোধহয়।

“গুলির শব্দ শুনেছিলাম। কেউ কী আপনাদের আক্রমণ করেছিল?”

কার্টের চেহারা কঠোর হয়ে গেল, “সত্যি কথা হলো, হ্যাঁ।”

“দেখতে কেমন? একা-ই ছিল?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

কার্ট ডান-পা থেকে বাম-পায়ে দেহের ভার বদল করল। তারপর বলল, “এখন পর্যন্ত একজনকেই দেখেছি। আপনারা কী কোনো ঝামেলা আশা করেছিলেন?” কণ্ঠে বিন্দুমাত্র কোমলতা নেই এখন আর।

রেনাটা কেমন ইতস্তত করল। ইতোমধ্যেই অনেক বেশি বলে ফেলেছে ও। আর যদি বিপদ হয়ও তাহলে এই লোকটাই সম্ভবত ওদের একমাত্র ভরসা। অন্তত ইতালিয়ান বাহিনী আসার আগ পর্যন্ত একে দরকার।

“আমি আসলে…” বলতে গিয়ে থেমে গেল রেনাটা। তারপর কি মনে করে বলল, “পুরো ব্যাপারটাই আসলে খুব গোলমেলে।”

রেনাটা দেখলো লোকটা সরাসরি ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। যদিও লোকটার হেলমেটের কাঁচ ফাটা আর মাঝখানে দরজার কাঁচও আছে, কিন্তু তারপরও ও বুঝলো লোকটা ওকে আপাদমস্তক মেপে দেখছে। ঠিক যেন ওর ভেতরটা পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে। রেনাটাও চেষ্টা করল কিন্তু লোকটার মুখের ভাব ঠিক মতো বোঝা গেল না।

“ঠিক বলেছেন। খুবই গোলমেলে। একেবারে শুরু থেকেই।” অবশেষে বলল লোকটা। কণ্ঠটা শুনেই রেনাটা বুঝলো, লোকটা আসলে তার দিকেই ইঙ্গিত করছে। কিন্তু চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া ওর আর কিছুই করার নেই। লোকটা ওর জীবন বাঁচিয়েছে ঠিক। কিন্তু এখনো তার পরিচয় সে জানে না।

.

১০.

রিগ্যান ন্যাশনাল এয়ারপোর্ট, ওয়াশিংটন ডি.সি.
ভোর ৫:৩০ মিনিট

ভাইস প্রেসিডেন্ট জেমস স্যান্ডেকার নিজের রুপালি ‘জিপো’ লাইটারটা দিয়ে। ঠোঁটে ধরা সিগারেটটা জ্বাললেন। চল্লিশ বছর আগে হাওয়াই থেকে লাইটারটা কেনা। আরো বেশ কয়েকটা লাইটার আছে তার। এর মধ্যে কয়েকটা বেশ দামি। কিন্তু দীর্ঘ দিনের সঙ্গী এই মলিন হয়ে ক্ষয়ে যাওয়া লাইটারটাই তার সবচে প্রিয়। যতবারই হাতে নেন ততবারই মনে পড়ে যে কিছু কিছু টিকে থাকার জন্যেই তৈরি হয়।

বুক ভরে ধোয়া টেনে গলগল করে ছেড়ে দিলেন। সিগারের গন্ধটা বেশ ভালো। আশেপাশের সবাই তাকে আড়চোখে দেখছে। এয়ারফোর্স টু’তে (ভাইস প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমান) ধূমপান নিষেধ। কিন্তু কেউই তাকে এটা বলার সাহস পাচ্ছে না। এই মুহূর্তে তাদের যাওয়ার কথা ছিল রোমে। একটা অর্থনৈতিক সম্মেলনে যোগ দেয়ার কথা। কিন্তু তারা অলস বসে আছে রানওয়েতেই।

সত্যি কথা হলো, মাত্র দশ বা পনের মিনিট বিলম্ব হয়েছে তাদের। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটি না হলে এয়ারফোর্স ওয়ান বা টু কখনোই রওনা দিতে দেরি করে না। আর সেরকম কিছু হলে সিক্রেট সার্ভিসের লোকজন ভাইস প্রেসিডেন্টকে বিমান থেকে নামিয়ে নিয়ে যায়। তারপর ঠিক হলে আবার নিয়ে আসে বিমানে। আজ তা হয়নি।

স্যান্ডেকার মুখ থেকে সিগার নামিয়ে পাশেই তার সহকারী টেরি কারুথার্সের দিকে তাকালেন। টেরির জন্য প্রিন্সটনে। মাথায় তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। আদেশ পালনে সদা তৎপর। তাকে বলা হয়েছে কিন্তু কাজটা বাস্তবায়িত হয়নি এমন নজির নেই। এই ব্যাপারে তার কোনো জুড়ি-ই নেই। কিন্তু নিজ থেকে সে কিছুই করতে পারে না।

“টেরি,” স্যান্ডেকার ডাকলেন।

“জী, মি, ভাইস প্রেসিডেন্ট।”

“টিকিট কেটে বিমানে চড়া বাদ দেয়ার পর থেকে আর কোনোদিন আমাকে রানওয়েতে এতোক্ষণ বসে থাকতে হয়নি। শেষবার যখন এমন হয়, তখন এই বিমানবন্দর বানানোই হয়নি।”

স্যান্ডেকার কাটা কাটাভাবে বললেন। “তাই নাকি?” টেরি বলল।

“হ্যাঁ।” স্যান্ডেকারের গলার সুরেই বোঝা গেল যে তিনি যেটা বোঝাতে চেয়েছেন টেরি সেটা বোঝেনি। “আরে ব্যাটা আমাদের দেরি হচ্ছে কেন? আবহাওয়া খারাপ?”

“না, না! আবহাওয়া একদম ঠিক! আমি একটু আগেই চেক করেছি।”

কারুথার্স জবাব দিল।

“তো কি? পাইলটরা চাবি ভুলে বাসায় ফেলে এসেছে?”

“সেরকম তো মনে হয় না।”

“তাহলে…মনে হয় ওরা ইতালি যাওয়ার রাস্তা ভুলে গেছে?”

কারুথার্স হেসে ফেলল, “ওদের কাছে তো ম্যাপ আছে স্যার।”

“তাই? তাহলে বলো দেখি আমেরিকার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কেন বসে বসে রানওয়েতে হাওয়া খাচ্ছে যেখানে তার এতোক্ষণ উড়াল দেয়ার কথা?”

“এ্যা….আমি কীভাবে বলবো স্যার, আমিতো শুরু থেকে আপনার সাথেই বসে আছি।” কারুথার্স বলল।

“হুম, বসেই আছো। খুব ভালো।”

স্যান্ডেকার কি বুঝাচ্ছেন সেটা বুঝতে কারুথার্সের আরো কিছুক্ষণ লাগল। বুঝতেই লাফ মেরে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “আমি এক্ষুনি ককপিট থেকে খবর নিয়ে আসছি।”

ককপিটেই যাও। নাহয় আমি এতোটা রেগে যেতে পারি যে তোমাকে দেশের সব অভ্যন্তরীণ বিমান পরিবহন সিস্টেমের সমীক্ষা করতে পাঠিয়ে দেবো।

গুলির বেগে ছুটে গেল কারুথার্স। স্যাস্তেকার আরো একবার ধোঁয়া টেনে ছাড়লেন। ধোঁয়া সরতেই দেখেন রুমের সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্ট দুজন হাসি চাপার চেষ্টা করছে।

“এটা হলো ফার্স্ট ক্লাস পাঠদান পদ্ধতি।” স্যান্ডেকার বললেন।

কিছুক্ষণ পরেই স্যান্ডেকারের চেয়ারের হাতলে লাগানো ফোনের বাতি জ্বলা-নেভা শুরু করল।

ফোনটা ধরতেই শোনেন কারুথার্সের গলা, “মি. ভাইস প্রেসিডেন্ট। ভূ মধ্য সাগরে নাকি একটা ঝামেলা হয়েছে। ওখানকার ইতালির একটা ছোট্ট দ্বীপে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। তার জন্য নাকি এলাকায় কি একটা বিষ ছড়িয়ে পড়েছে। তাই ওখান দিয়ে বিমান চলাচল পুরো বন্ধ।”

“হুম।” স্যান্ডেকার জবাব দিলেন। এখন আর কণ্ঠে রসিকতা নেই। কারুথার্সের স্বর শুনেই বোঝা যাচ্ছে ঘটনা এখানেই শেষ নয়। “আর কিছু?”

“তেমন কিছু না তবে ঘটনাটা জানিয়েছে আপনার সাবেক প্রতিষ্ঠান NUMA”। স্যান্ডেকার NUMA-র প্রতিষ্ঠাতা। ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি-ই প্রতিষ্ঠানটা পরিচালনা করতেন। “NUMA? ওরা কীভাবে এ ব্যাপারে প্রথম জানলো?”

“আমি সবটুকু জানি না, মি. ভাইস প্রেসিডেন্ট।”

“ধন্যবাদ টেরি। তুমি চলে আসো।” স্যান্ডেকার বললেন।

কারুথার্স ফোন রাখতেই স্যান্ডেকার বিমানের কমিউনিকেশন অফিসারকে ফোন করলেন, NUMA হেড কোয়ার্টারের সাথে কথা বলবো, লাইন লাগাও।”

কয়েক সেকেন্ডেই কলটা চলে গেল NUMA’র বর্তমান সহকারী পরিচালক রুডি গান-এর কাছে।

“রুডি, স্যান্ডেকার বলছি। ভূ-মধ্যসাগরে কি নাকি হয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

“কার কাণ্ড এটা? ডার্ক?”

ডার্ক পিট NUMA’র বর্তমান পরিচালক। স্যান্ডেকার যতদিন পরিচালক ছিলেন পিট ছিল তার এক নাম্বার এজেন্ট। পরিচালক হওয়ার পরও অফিসের চাইতে সরাসরি অভিযানে নেমে পড়তেই বেশি ভালো লাগে পিটের।

“না। ডার্ক এখন সাউথ আফ্রিকায়। ঘটনা ঘটিয়েছে অস্টিন আর জাভালা।” রুডি বলল।

“জানতাম। একজন না হলে অন্যজন হবেই। খুলে বলো তো ঘটনাটা।”

রুডি যেটুকু জানে বিস্তারিত বলল। যা যা জানে না তা-ও বললো। ও ইতোমধ্যে ইতালিয়ান কোস্ট গার্ডের একজন অফিসার আর ইতালিয়ান ইন্টেলিজেন্স এজেন্সীর একজন পরিচালকের সাথেও করা বলেছে। এর বাইরে আর কিছু জানা নেই।

“কার্ট বা জো-এর সাথে সরাসরি কথা হয়নি আমার। সী ড্রাগনের ক্যাপ্টেন বলে যে ওরা না ঘণ্টা খানেক আগে তীরে উঠেছে কেউ বেঁচে আছে কি-না দেখতে। তারপর আর খোঁজ নেই।” রুডি বলল।

অন্য কেউ হলে অবাক হতো যে লোক দুটো কি পাগল নাকি যে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এরকম বিষাক্ত একটা এলাকায় গেল। কিন্তু স্যান্ডেকার অস্টিন আর জাভালার ভেতর এই গুণটা ধরতে পেরেছিলেন বলেই ওদেরকে দলে নিয়েছিলেন।

“হুম। ওরাই পারবে যদি কেউ বেঁচে থাকে তত তাদের উদ্ধার করতে।” স্যান্ডেকার বললেন।

“জ্বী। আপনি চাইলে আপনাকে নিয়মিত খবর পাঠাতে পারি।” রুডি প্রস্তাব দিল।

“তাহলে তো ভালোই হয়।” স্যান্ডেকার কথাটা বলামাত্র ইঞ্জিন গর্জে উঠল।” বিমান ছেড়ে দিচ্ছে। কার্ট আর জো-এর সাথে কথা হলে বোলো আমি ওদিকেই আসছি। পিঠে ছালা বেঁধে রাখে যেন, নইলে চামড়া আর থাকবে না।”

ব্যাপারটা নিছকই ঠাট্টা, অবশ্যই। কিন্তু অন্যকে চাঙ্গা করতে জুড়ি নেই। স্যান্ডেকার এই ব্যাপারটা খুবই ভালো পারেন।

“অবশ্যই বলবো, মি. ভাইস প্রেসিডেন্ট।” স্পষ্ট বোঝা গেল রুডি এখন আগের চেয়ে বেশ খানিকটা প্রফুল্ল।

স্যান্ডেকার ফোন রাখতেই বিমান দৌড়ানো শুরু করল। মাইল দেড়েক পরই নাক উঁচু করে এয়ারফোর্স টু উঠে এলো আকাশে। যাবে রোমে। স্যান্ডেকারের মাথায় অবশ্য নোম নেই। তিনি তখন ভাবছেন কার্ট আর জো আবার নতুন কি ঝামেলায় জড়ালো। কিন্তু কল্পনাও করেননি যে সশরীরে তার উত্তর খুঁজে পাবেন।

 ১১. রোগী পরিবাহী জাহাজ নাটাল

১১.

রোগী পরিবাহী জাহাজ নাটাল
ভূমধ্যসাগর

কার্ট, জো আর উদ্ধারকৃত বাকিরা একটা ইতালিয়ান মালবাহী জাহাজের ডেক এ বসে আছে। এটার মাস্তুলে একটা বিশাল লাল রঙের ক্রস আঁকা। ওদেরকে রাসায়নিক প্রতিরোধী সুট পরিয়ে একটা মিলিটারি হেলিকপ্টারে করে পূর্ব দিকে নিয়ে আসা হয়েছে। সবচে কষ্ট হয়েছে জো-কে MRI মেশিনটা থেকে ছোটাতে। কিন্তু ওর কাপড়ের সাথে লাগানো ধাতব অংশগুলো কেটে ফেলতেই সহজে ওকে ছুটিয়ে ফেলা যায়।

তারপর বিশেষ সাবান দিয়ে গোসল করে দূষণমুক্ত হয়ে, কয়েকটা মেডিকেল টেস্ট করার পর এখন স্বাভাবিক কাপড় পরার সুযোগ পেয়েছে। তারপর থেকেই ডেক-এ বসে আছে আর কফি খাচ্ছে। এতো ভালো এসপ্রেসো শেষ কবে খেয়েছে কার্ট মনে করতে পারে না।

দ্বিতীয় কাপ খাওয়ার পর কার্টের কেমন যেন অস্থির লাগতে লাগলো। আক্ষরিক অর্থেই বসে থাকতে পারছে না।

“তোমাকে কেমন যেন লাগছে।” জো বলল।

“মনটা কেমন খুঁতখুঁত করছে।”

“ক্যাফেইনের জন্যে এমন হচ্ছে। এত কফি খেলে তো হাতীও শুয়ে পড়বে।”

কার্ট একবার ওর হাতের খালি কাপটার দিকে নজর বুলিয়ে আবার জো এর দিকে তাকাল, “আশেপাশে ভালো করে দেখতে একবার। অন্যরকম কিছু চোখে পড়ছে?”

“আচ্ছা বলছি।” জো জবাব দিল। তারপর চারপাশে একবার মাথা ঘুরিয়ে বলল, “নীল আকাশ, ঝিকিমিকি পানি। নতুন জীবন পাওয়ায় সবাই খুশি। তবে আমি নিশ্চিত এর মধ্যেও তুমি কোনো একটা ঘাপলা ঠিকই খুঁজে পেয়েছ।”

“হুম। আমরা সবাই এখানে। ওখান থেকে বেঁচে আসা সবাই। কিন্তু একজন নেই। আমি যার সাথে সবচে বেশি কথা বলতে চাচ্ছি সেই মানুষটাই নেই : ড. আমব্রোসিনি।”

“জাহাজে ওঠার সময় দেখলাম মহিলাকে।” কফিতে চিনি ঢালতে ঢালতে বলল জো। “তার সাথে দেখা করার জন্য উতলা হওয়ায় তোমাকে দোষ দেয়া যায় না। এমন ডাক্তারের রোগী হতে কে না চায়।”

মহিলা যে দারুণ আকর্ষণীয় সে কথা কার্ট অস্বীকার করে না মোটেও, তবে ওর দেখা করতে চাওয়ার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। “বিশ্বাস করবে না জানি, তবে আমার আগ্রহ অন্য কারণে।”

জো একটা ভ্রূ সামান্য তুলে এমন ভঙ্গিতে কফিতে চুমুক দিল, যার অর্থ দাঁড়ায়, বুঝেছি! বুঝেছি!’

“সত্যি! আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দরকার,” কার্ট বলল।

“তা তো বটেই। প্রথম প্রশ্ন হলো আপনার নাম্বারটা? তারপরই জিজ্ঞেস করবে আপনার কেবিনে যাবেন নাকি আমারটায় আসবেন?” জো ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল।

কার্ট হেসে দিল। “আরে ধুর! আমি অপারেশন রুমে যাওয়ার পর উনি এমন কিছু কথা বলেছে যেগুলো খুবই গোলমেলে। যে লোকটা আমাদেরকে মারতে চেয়েছিল মহিলা তার সম্পর্কে কিছু একটা জানে। আর খেয়াল করেছে ভদ্র মহিলা একদম শুরু থেকেই এই ঘটনাটাকে আক্রমণ… আক্রমণ বলে আসছে। একদম সেই রেডিও কল থেকেই।”

জো’র চেহারা থেকে রসিকতা মুছে গেল, “কি বলতে চাচ্ছ তুমি?”

কার্ট কাঁধ ঝাঁকালো, “সমুদ্রতীরে একটা জাহাজ পুড়ছে, সেখান থেকে রহস্যময় কালো ধোঁয়ায় শহর ছেয়ে গেল, টপটপ মানুষসহ সব প্রাণী জায়গায় পড়ে মরতে লাগল। তুমি এটাকে একটা বিপদ বলতে পারো, দুর্ঘটনা বলতে পারো বা দুর্যোগও বলা চলে। কিন্তু আক্রমণ বলো কোন হিসাবে?”

“কথাটা কিন্তু মারাত্মক।” জো বলল।

“এই কফিটার মতোই মারাত্মক।” কার্ট বলল।

জো কিছুক্ষণ দূর দিগন্তে তাকিয়ে থেকে বলল, “তুমি কি বোঝাতে চাচ্ছ তা একটু একটু ধরতে পারছি। সে কথা ভাবতে ভাবতেই আরেকটা কথা মাথায় এলো। সে এত দ্রুত কীভাবে জানালো যে বাঁচতে হলে সবাইকে নিয়ে রুম সিল করে থাকতে হবে। আর কেউ তা জানে না। ডাক্তার হোক আর যা ই হোক এত দ্রুত তো এটা জানার কথা না।”

কার্ট মাথা ঝাঁকালো, “যদি কেউ আগে থেকেই জানে যে এ ধরনের বিপদ আসছে শুধু তখনই এটা সম্ভব।”

“জরুরি অবস্থা মোকাবেলা।”

“কিংবা সবসময় এভাবেই ওরা অপারেশন চালায়।”

কার্ট চারদিকে তাকাল। তিনজন ইতালিয়ান সৈন্যকে রাখা হয়েছে ওদেরকে খেয়াল করার জন্য। দায়সারা একটা কাজ। কারোর-ই তাই ওদের দিকে মনোযোগ নেই। দুজন একদম শেষ মাথায় রেলিং-এ ত্র দিয়ে ঝুঁকে গল্প করছে। তৃতীয়জন অবশ্য কাছেই। একটা ক্রেন-এর পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। “গার্ডগুলোর মনোযোগ একটু অন্যদিকে সরাতে পারবে?”

“পারবো, তবে কথা দিতে হবে যে তুমি ওদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এমন কোনো গোলমাল পাকাবে যাতে আমরা মহা বিপদে পড়ি আর ওরা আমাদেরকে জাহাজ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, জো বলল।

কার্ট শপথ করার ভঙ্গিতে হাত তুলে বলল, “তোমার নামে শপথ করলাম।”

“ঠিক আছে তাহলে। শুরু করা যাক।” কফির মগে শেষ চুমুকটা দিয়ে বলল জো।

কার্ট দেখলো জো অলস ভঙ্গিতে তৃতীয় সৈন্যটার দিকে এগিয়ে গেল। এই একজনের মনোযোগ সরাতে পারলেই হবে। বাকিরা অনেক দূরে। জো কিছু একটা নিয়ে কথা বলা শুরু করল। কিছুক্ষণ পরেই তুমুল আলোচনা জমে উঠল। জো কথা বলার সাথে সাথে প্রচুর হাত নাড়ছে। ফলে সৈন্যটার পুরো মনোযোগ জো-এর দিকে।

কার্ট উঠে দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ সামনে বাড়লো। তারপর একটা বন্ধ হ্যাঁচওয়ের পাশে বসে পড়ল। কথা বলতে বলতে জো আকাশের দিকে কিছু একটা দেখলো আর সৈন্যটা সেদিকে তাকাতে গিয়ে সূর্যের আলোর কারণে চোখের ওপর হাত দিল। এই সুযোগে কার্ট ঝট করে হ্যাঁচটা খুলে ভেতরে ঢুকে আবার নীরবে লাগিয়ে দিল।

ভাগ্য ভালো যে সামনের বারান্দাটা খালি। অবাক হলো না কার্ট। জাহাজটা ভালোই বড়। ছয়শো ফুট লম্বা কিন্তু ক্রুসহ আরোহী মাত্র দুশো জনও হবে না। তাই জাহাজের বেশিরভাগ জায়গা খালিই পড়ে থাকে। এখন ওকে রোগী রাখার জায়গাটা খুঁজে বের করতে হবে। সম্ভবত ওখানেই পাওয়া যাবে ডা. আমব্রোসিনিকে।

ও প্রথম বারান্দাটা ধরেই এগুলো। জাহাজের সামনের দিকে যাচ্ছে। ওখানেই ওদেরকে গোসল আর মেডিকেল টেস্ট করা হয়েছে। রোগী রাখার জায়গাটাও ওটার কাছেই হওয়ার কথা। যদি খুঁজে পায় তাহলে কোনো একটা অসুখের ভান করে ঢুকে পড়তে হবে। কাশি বা পেট ব্যথা কিছু একটা বলতে হবে। ক্লাস এইটে স্কুল পালানোর পর এমন অজুহাত আর কোথাও দেয়ার প্রয়োজন পড়েনি।

রাস্তার পাশেই একটা জিনিসপত্র ঠাসা বক্স পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিলো কার্ট। নৌবাহিনী আর তারপর NUMA-তে কাজ করার সুবাদে ও জানে, যদি তুমি চাও যে যাত্রাপথে তোমাকে কেউ না আটকাক, তাহলে হাঁটতে হবে দ্রুত, কারো চোখের দিকে তাকানো যাবে না আর সবচে ভালো হয় হাতে কিছু একটা নিয়ে এমনভাবে হাঁটো যে জিনিসটা যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছে দিতে হবে।

কৌশলটা এখানেও দারুণভাবে খেটে গেল। একটু পরই একদল নাবিক ওকে পাশ কাটালো কিন্তু দ্বিতীয় বার ফিরেও তাকাল না। কার্ট কিছুদর এগোতেই দেখে নিচে নামার সিঁড়ি। কি মনে করে নেমে এলো নিচে।

নিচে এসে এদিক সেদিক ঘুরে-টুরে টের পেল ও রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। মেডিকেল সেন্টারের নাম গন্ধও নেই আশে পাশে। এদিকে শুধু স্টোর রুম আর তালাবদ্ধ কেবিন।

“সাব্বাস ব্যাটা।” নিজেকেই নিজে শোনালো কার্ট। এবার কোন দিকে যাবে ভাবতে ভাবতেই ও দেখে সামনে দিয়ে ল্যাব কোট পরা দুজন নেমে আসছে। একজন পুরুষ অপরজন মহিলা। নিজেদের মধ্যে আলাপে মগ্ন।

কার্টকে পাশ কাটাতেই পিছু নিলো। “রাস্তা খুঁজে পাওয়ার ১০১টি উপায়ের প্রথম উপায় হলো : জায়গাটা চেনে এমন কারো পিছু পিছু যাওয়া।” নিজেকেই বলল আবার কার্ট।

আরো দুটো সিঁড়ি আর বেশ কিছু গলি-ঘুপচি পেরিয়ে সামনের দুজন একটা হ্যাঁচের আড়ালে অদৃশ্য হলো।

কার্টও দরজাটার পাশে দাঁড়ালো। বাইরে থেকে দেখে তো এটাকেও একটা স্টোর রুম মনে হচ্ছে ওর কাছে। ভেতরে কি আছে দেখার জন্য। দরজাটা একটু ফাঁক করতেই বুঝতে পারলো ওর ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।

সামনে গুহার মতো বিশাল একটা রুম। ওপরে সারি সারি বাতি জ্বলছে। এটা সম্ভবত জাহাজের মালপত্র রাখার জায়গা তবে এখন এখানে কোনো মালপত্র নেই। তার বদলে শত শত লাশ শুয়ে আছে মেঝেতে। খাটের ওপরও দেখা গেল কয়েক জনকে। কারো পরনে বেদিং স্যুট, যেন সমুদ্রের তীর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ওগুলো। অন্যদের পরনে সাধারণ পোশাক। কারো কারো পরনে একেবারে অফিসিয়াল পোশাক। যেন অফিসে এসে ঘুমিয়ে পড়েছে।

কার্ট দরজাটা পুরো খুলে ভেতরে পা দিল। এতো লাশ দেখে অবশ্য যতটা অবাক হওয়ার কথা ও ততটা হয়নি। কারণ লাশগুলোকে সরাতেই হতো। আর সারাদিনই দেখেছে জাহাজ থেকে হেলিকপ্টার দ্বীপটায় যাচ্ছে আর আসছে। বেশ কয়েকজনের হাতে-পায়ে দেখা গেল তার-টার হাবিজাবি লাগানো। সেগুলো আবার লাগানো একগাদা মনিটর আর অন্যান্য যন্ত্রপাতিতে। কারো কারো হাতে স্যালাইন লাগানো। কাউকে কাউকে খোঁচাখুঁচি করছে ডাক্তাররা। একজনের শরীরে কারেন্টের লাইন দিতেই কাঁপাকাপি শুরু হয়ে গেল। কিন্তু কারেন্ট থামাতেই আবার যেই কে সে-ই। নড়াচড়া নেই।

প্রথমে কেউ-ই কার্টকে খেয়াল করল না। কারণ ওর পরনে এই জাহাজের ক্রুদের মতো পোশাক আর সবাই যার যার কাজে ভীষণ ব্যস্ত। আরো সামনে এগোতেই ওর চোখে পড়ল কডি উইলিয়াম আর আরো দুজন NUMA-র লোকের লাশ। কার্ট সামনে এগিয়ে গেল। একজনকে একটা ইনজেকশন দেয়া হচ্ছে। তার মাথাতেও তার লাগানো কাউকে কারেন্টের শক দেয়া হচ্ছে।

“আরে আরে করছেন কি?” কার্ট চেঁচিয়ে উঠল।

ঘরের বেশিরভাগ চোখ ওর দিকে ঘুরে গেল। মুহূর্তেই সবাই বুঝে গেল যে ও এখানকার কেউ না। “কে আপনি?” একজন জিজ্ঞেস করল।

“তার আগে বলেন আপনারা কারা? আর লাশের ওপর এসব কি শুরু করেছেন?” আগের চেয়েও জোরে চেঁচালো কার্ট।

কার্টের চড়া আওয়াজ পুরো রুম জুড়ে প্রতিধ্বনিত হলো। হঠাৎ এর এমন রাগে বাকি সবাই হতভম্ব হয়ে গেছে। শুধু দু-একজনকে দেখা গেল ফিসফিস করে পাশের জনের সাথে কথা বলছে। কেউ মনে হলো জার্মান ভাষায় কি বলছে। হঠাৎ একজন চেঁচালো, “সিকিউরিটি?”

সাথে সাথে কয়েকজন মিলিটারি পুলিশ চলে এলো।

“আপনি যে-ই হন, এখানে থাকতে পারবেন না,” একজন ডাক্তার বলল। অদ্ভুত উচ্চারণে ইংরেজি বলছে লোকটা। তবে টানটা ইতালিয়ান না, ফ্রেঞ্চ সম্ভবত।

“ওনাকে এখান থেকে নিয়ে যান।” আরেকজন বলল। এর উচ্চারণ শুনেও অবাক হলো। মনে হচ্ছে এর বাড়ি কানসাম বা আইওয়া।

কিন্তু কার্ট এসব কথাকে পাত্তা না দিয়ে NUMA-র লোকটার দিকে এগুলো। কি করছে আসলে ওরা কাছে থেকে দেখতে চায়। কিন্তু সিকিউরিটিরা বাধ সাধলো। ওদের হাতে লাঠি। কোমরে গোজা টীজার (কারেন্টের শক দেয়ার যন্ত্র)।

“বের করে ব্যাটাকে। আর দয়া করে একটু পাহারা দেয়ার দিকে মন দাও। এরকম হতে থাকলে কাজ করবো কীভাবে?” বলল আরেকজন।

কার্ট যাওয়ার জন্যে ফিরতেই একটা মহিলা কন্ঠে বলে উঠল, “আরে করেন কি? হিরো-কে কেউ এভাবে সম্ভাষণ জানায়?”

কথাগুলো ইংরেজিতে বলা কিন্তু ইতালিয়ান টান আছে। ব্যঙ্গ করে বলা হলেও কথাটায় কর্তৃত্বের সুর স্পষ্ট। কথাগুলো বলেছে ডা. আমব্রোসিনি। সামান্য ওপরে একটা মঞ্চমত জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সে।

একজন নর্তকীর মতো মোহনীয় ভঙ্গিমায় সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো রেনাটা।

“কিন্তু ভা, আমব্রোসিনি…” বিদেশি একজন ডাক্তার বাধা দিতে গেলেন।

“কিন্তু কিছু না ডা. রবিশ্ব। লোকটা আমার জীবন বাঁচিয়েছে, আমি বাদে আরো আঠারো জনের জীবন বাঁচিয়েছে আর আমাদের তদন্তের শুরু থেকে এই সমস্যার উৎস সম্পর্কে সবচে বড় কু-ও সে-ই দিয়েছে।”

“আজকের পরিস্থিতিটা কিন্তু সম্পূর্ণ অন্যরকম।” ডা. রবিশ্ব বললেন।

“হ্যাঁ, আমি জানি।” ডা. আমব্রোসিনি জবাব দিলেন।

কার্ট ব্যাপারটায় মজা পেল। ডা. রেনাটা পুরোপুরি সিঁড়ি থেকে নামতেই দেখা গেল রুমের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে খাটো। কিন্তু সে-ই যে বস সেটাও বোঝা যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে কার্টকে দেখে আসলেই খুশি হয়েছে। তবে এই সামান্য মুচকি হাসি আর কটাক্ষে কার্টের মন গলবে না।

“এখানে আসলে হচ্ছেটা কি?” জিজ্ঞেস করল কার্ট।

“একা একা কথা বলি চলুন।” ডা. আমব্রোসিনি প্রস্তাব দিল।

“সেটাই ভালো। চলুন।”

ডা. আমব্রোসিনি কোণার একটা অফিস রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। কার্টও গেল পিছনে। রুমে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিল।

রুমটা আসলে জাহাজের কোয়ার্টার মাস্টারের জন্যে বানানো। এখন সেটা ডাক্তারদের ব্যবহার উপযোগী বানানো হয়েছে।

“প্ৰথমত, আমি আপনাকে আমার জীবন বাঁচানোর জন্যে ধন্যবাদ দিতে চাই।” ডা. আমব্রোসিনি শুরু করলেন।

“এই মাত্র আপনিও একই কাজ করেছেন।”

ডা. আমব্রোসিনি হাসলো। তারপর মুখের সামনে এসে পড়া এক গোছা অবাধ্য চুল কানের পিছনে খুঁজে বলল, “আমি আপনাকে কিছু থেকেই বাঁচাইনি। আমার ধারণা আমি ওই পুলিশগুলোকে বরং মার খেয়ে অপমান হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছি।”

“আপনি আমার সম্পর্কে বেশি উঁচু ধারণা করে ফেলছেন।” কার্ট বলল।

“আমার তা মনে হয় না।” হাত দুটো বুকে ভাজ করে সামনে ঝুঁকে বলল রেনাটা।

সত্যি হোক আর না থোক প্রশংসাটা আন্তরিক। তবে কার্ট এখানে সৌজন্য বিনিময় করতে আসেনি। “দয়া করে মূল কথায় আসুন। ঐ হাতুড়ের দল আমার বন্ধুদের লাশের ওপর কী সব করছে?”

“ঐ হাতুড়েগুলো আমার বন্ধু।” আহতস্বরে বলল ডা. আমব্রোসিনি। “ওরা অন্তত বেঁচে আছে।”

ডা. আমব্রোসিনি একটা বড় শ্বাস নিলো, সে ঠিক করছে কতটুকু বলবে। তারপর শ্বাস ছেড়ে বলল, “হ্যাঁ। আমি বুঝতে পারছি যে আপনার মন অনেক খারাপ। আপনার বন্ধুরা আর দ্বীপের সবাই মারা গেছে। কিন্তু আমাদেরকে তো খুঁজে দেখতে হবে”।

“কোন ধরনের বিষ সবাইকে মেরেছ?” বাক্যটা শেষ করল কার্ট।

“খুব ভালো প্রস্তাব। বুঝলাম সেটা। কিন্তু আমি যদূর জানি সেগুলো করা হয় রক্ত বা কোষ পরীক্ষা করে। আর সবচে বেশি দরকার হলো ঐ পোড়া জাহাজটা থেকে আসা ধোয়াটা পরীক্ষা করা। আসল ব্যাপারটা পরিষ্কার করুন। নাহয় ওসব ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো যে চিকিৎসা আপনারা দিচ্ছেন তা বন্ধ করুন।”

“ডা. ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের চিকিৎসা! আরে আমরা তো সেটাই করার চেষ্টা করছি।”

কার্ট ধরতে পারলো না কথাটা, “মানে? কেন?”

“কারণ, আমরা আবারো আপনার বন্ধুদেরকে জীবিত করে তোলার চেষ্টা করছি।” শান্তস্বরে জবাব দিল ডা. আমব্রোসিনি।

.

১২.

কার্ট এতোই অবাক হয়েছে যে কিছুক্ষণ কথা বের হলো না মুখ দিয়ে। “কি বললেন?” কোনোমতে বলল ও।

“আপনার বিস্ময় দেখে অবাক হচ্ছি না। ডা. রাবিশ্ব কি বললেন খেয়াল নেই! আজকের ব্যাপারটা একদমই আলাদা। রেনাটা বলল।

“এ তো স্রেফ পাগলামি। ওঝাদের মতো মন্ত্র পড়ে নিশ্চয়ই আপনারা আবার এতোগুলো মানুষকে জীবন দান করবেন না।” কার্ট জবাব দিল।

“আমরা পিশাচ না। ব্যাপারটা হলো এখানকার লোকগুলো এখনও মারা যায়নি। অন্তত এখনও না। তাই আমরা কোমর বেঁধে চেষ্টা করছি লোকগুলোর জ্ঞান ফেরানোর জন্য।”

কার্ট কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখলো কথাটা। তারপর বলল, “আমি নিজে কয়েজনকে পরীক্ষা করে দেখেছি।” ওরা কেউ নিশ্বাস নিচ্ছিলো না। আর ইতালিয়ান মিলিটারি আসার আগে আমি হাসপাতালের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঢু মেরেছিলাম। অনেক রোগীর গায়েই EKG মেশিন লাগানো ছিল কিন্তু কোনোটাতেই হার্ট বীট দেখাচ্ছিলো না।”

“হ্যাঁ আমি জানি। সত্যি কথা হলো তারা নিশ্বাস নিচ্ছে, তাদের হার্টও সচল। ব্যাপার হলো তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস এখন মারাত্মক রকম হালকা আর ধীর। নিশ্বাস পড়ছেও অনেকক্ষণ পরপর। দুই মিনিটে হয়তো একবার শ্বাস নিচ্ছে। হার্ট রেট কমে এসেছে এক অঙ্কের ঘরে। আর নিলয়ের সংকোচন এতোই দুর্বল যে কোনো সাধারণ মনিটরে সেটা ধরা পড়বে না।”

“সেটা কীভাবে সম্ভব?”

“এরা আসলে এক ধরনের কোমায় চলে গেছে। সমস্যা হচ্ছে এই ধরনের কোমা চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য সম্পূর্ণ নতুন। এমনিতে কোমা হলে ব্রেনের কয়েকটা অংশের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। শুধু একদম ভেতরের দরকারি অংশগুলো সক্রিয় থাকে। ধারণা করা হয় যে শরীর নিজেকে রক্ষা করতে কাজটা করে। রোগী যেহেতু সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকে, তাই শরীর বা ব্রেন যেখানেই সমস্যা থাকুক সেটা একা একাই ভালো হয়ে যায়। কিন্তু এই লোকগুলোর ব্রেন বন্ধ হয়নি। সব অংশই কাজ করছে কিন্তু কোনো ওষুধ বা উদ্দীপনা কোনো কিছুতেই সাড়া দিচ্ছে না।”

“আরেকটু সহজভাবে বলা যাবে?”

“মানে তাদের ব্রেনে কোনো ক্ষতি হয়নি, কিন্তু তারা জেগে উঠতে পারছে না। ধরেন একটা কম্পিউটারকে কেউ স্টান্ড বাই বা স্লীপ মুড-এ রেখে দিল কিন্তু আবার চালু করার জন্য যত টেপাটিপিই করুক, কম্পিউটার অন হলো না। এদের অবস্থা ঠিক সে রকম।”

কার্ট মানব শারীরতত্ত্বের খুব সামান্যই জানে। তাই নিজে নিজেই কোনো উপসংহারে পৌঁছার ঝুঁকি নিলো না। আগে ব্যাপারটা পুরোপুরি পরিষ্কার হতে চায়। “যদি ওদের হার্ট এতো আস্তেই চলে আর ঠিকমতো রক্ত সরবরাহ করতে না পারে আবার নিশ্বাসও প্রায় বন্ধই বলা যায়, তাহলে কি ওদের শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি হবে না? এতে তো ব্রেন ড্যামেজ হওয়ার কথা।”

“হতেও পারে। তবে আমাদের ধারণা ওরা আসলে জীবন আর মৃত্যুর মাঝ খানে ঝুলে আছে। শরীরের তাপমাত্রা খুবই কম, শরীরের বিপাকীয় হারও কম তার মানে তাদের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খুবই কম মাত্রায় অক্সিজেন ব্যবহার করছে। এজন্যেই এত ধীর নিশ্বাস বা দুর্বল হার্ট-বীটেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। অক্সিজেন যেটুকু আছে তাতেই চলে যাচ্ছে, ব্রেনেরও ক্ষতি হচ্ছে না। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পানিতে ডুবন্ত কোনো মানুষকে উদ্ধারের পর তাকে দেখেছেন কখনো?”

কার্ট মাথা ঝাঁকালো, “বছরখানেক আগে আমি একটা ছেলে আর ওর কুকুরকে বরফ হয়ে যাওয়া একটা লেক থেকে উদ্ধার করেছিলাম। কুকুরটা একটা কাঠবিড়ালিকে তাড়া করে বরফের ওপর উঠতেই পা আটকে যায়। ছেলেটা কুকুরটাকে উদ্ধার করতে গেলে বরফ ভেঙে দুজনেই পড়ে যায়। উদ্ধার করার পর দেখি ছেলেটার সারা শরীর নীল হয়ে গেছে। সাত মিনিটের মতো পানির নিচে ছিল সে। এতোক্ষণ পানিতে থাকলে তো বাঁচার কথা না। কুকুরটাও মারা যাওয়ার কথা। কিন্তু প্যারা মেডিকগুলো দুজনকেই সুস্থ করে ফেলেছিল। ছেলেটা পুরো সুস্থ হয়ে গিয়েছিল। ব্রেন-ট্রেন কিছুই ড্যামেজ হয়নি। এখানেও কি একই ব্যাপার নাকি?”

“আমাদের ধারণা সেরকমই। তবে পুরোপুরি ওরকম না। ছেলেটার বেলায় যা হয়েছে তা হলো ঠাণ্ডা পানি ওর শরীরে যে প্রভাব শুরু করেছিল, সাধারণ তাপমাত্রায় ফিরতেই তা আবার চলে যায়। কিন্তু এই লোকগুলোর তো আর তাপমাত্রা পরিবর্তন হয়নি, এটা হয়েছে কোনো একটা বিষের প্রভাবে। আর, এতক্ষণ পর্যন্ত গরম করা বলেন, ঠাণ্ডা করা বলেন, কারেন্ট থেকে শুরু করে এড্রেনালিন কোনো কিছুই বিষটার প্রভাব কাটাতে পারছে না।”

“বিষটা কোন ধরনের সেটা কি জানা গেছে?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

“না।”

“জিনিসটা নিশ্চয়ই ঐ জাহাজটার ঐ ধোয়া থেকে এসেছে।”

“সেরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আমরা ধোয়াটা নিয়ে পরীক্ষা করেছি। পোড়া জ্বালানি বাদে ওতে আর কিছুই নেই। সামান্য সীসা আর অ্যাসবেসটস অবশ্য আছে। কিন্তু যে কোনো জাহাজে আগুন লাগলেই এগুলো পাওয়া যায়।” রেনাটা জবাব দিল।

“তার মানে জাহাজে আগুন লাগা আর ঘন ধোয়ার আস্তরণে পুরো দ্বীপ ঢেকে যাওয়া একটা কাকতাল মাত্র? আমার বিশ্বাস হয় না। কার্ট বলল।

“আমারও না। কিন্তু ঐ মেঘটাকে দোষ দেয়ার মতো কিছু সেটার মধ্যে পাওয়া যায়নি। এটা বড়জোর চোখের জ্বলুনি, কাশি বা হাপানির সৃষ্টি করতে পারে।”

“যদি জাহাজের ধোয়া-ই না হয়, তাহলে কি?”

রেনাটা প্রথমেই জবাব দিল না। থেমে কিছুক্ষণ কার্টকে দেখলো ভালো করে। তারপর বলল, “আমাদের ধারণা এটা একটা নার্ভ টক্সিন। বিস্ফোরণটার সময় কোনোভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তবে সেটা ইচ্ছাকৃত কি-না তা বলা যাচ্ছে না। অনেক নার্ভ গ্যাসই খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ঝামেলাটা হলো আমরা মাটি, বাতাস বা রক্ত বা কোষ কোথাও বিষটার কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাইনি। তার মানে জিনিসটা যা-ই হোক সেটার আয়ু মাত্র কয়েক ঘণ্টা।”

কার্টের যুক্তিটা মনে ধরল, কিন্তু তারপরও কিছু জিনিসের ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু ল্যাম্পেডুসায় কেন?”

“কেউ জানে না, এ কারণেই ব্যাপারটাকে দুর্ঘটনা বলতেই আমরা বেশি আগ্রহী।” রেনাটা জবাব দিল।

কার্ট ভাবতে ভাবতে রুমের চারপাশে চোখ বুলালো। রেনাটার ডেস্কের পেছনেই দুটো সাদা বোড়। তাতে নানান মেডিকেলের কঠিন কঠিন শব্দ লেখা। পাশে একগাদা ওষুধের নাম। যেগুলো ইতোমধ্যে ব্যবহার করে দেখা হয়েছে সেগুলো কেটে দেয়া। পাশেই ভূমধ্যসাগরের একটা মানচিত্র। সেটার বিভিন্ন জায়গায় পিন গোঁজা। একটা পিন লিবিয়ার, একটা পিন উত্তর সুদানের একটা জায়গায়। মধ্যপ্রাচ্য আর পশ্চিম ইউরোপেও অনেক পিন দেখা গেল।

বোর্ডের দিকে ইঙ্গিত করে কার্ট বলল, “রেডিও মেসেজে আপনি একটা আক্রমণের কথা বলেছিলেন। আমার ধারণা এরকম ঘটনা আরো ঘটেছে। এবারই প্রথম না।”

রেনাটা দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো। “আপনার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা একটু বেশি-ই ভালো। উত্তর হচ্ছে~~ হ্যাঁ। ছয় মাস আগে লিবিয়ার একদল প্রগতিবাদী বিদ্রোহীরও একই অবস্থা হয়। কেউ জানে না কীভাবে হয়েছে। তারা মারা যায় আট দিন পর। ইতালির সাথে লিবিয়ার সুসম্পর্ক থাকায় ইতালি ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে রাজি হয়। তদন্ত করতে গিয়েই দেখা যায় যে লিবিয়ার আরো কিছু জায়গায় একই ঘটনা ঘটেছে। তারপর খোঁজ পাওয়া যায় যে শুধু লিবিয়া না ম্যাপের এসব জায়গাতেও একই অবস্থা। প্রতিটা ক্ষেত্রেই হয় কোনো, বিদ্রোহী দল বা কোনো শক্তিশালী ব্যক্তি এরকম আজব কোমায় চলে যায় আর মারা যায়। আমরা একটা টাস্কফোর্স গঠন করি। তারপর এই জাহাজটায় আমাদের ভাসমান ল্যাব বানিয়ে উত্তর খোঁজা শুরু করি।”

কার্ট মনে মনে ব্যাপারটার প্রশংসা না করে পারলো না। এসব কিছুতে আপনার ভূমিকা কি?”

“আমি একজন ডাক্তার।” আহতস্বরে বলল রেনাটা। “আমি একজন নিউরোবায়োলজী বিশেষজ্ঞ। কাজ করি ইতালিয়ান সরকারের হয়ে।”

“তাহলে আক্রমণটা যখন হলো তখন-ই আপনি ল্যাম্পেডুসায় ছিলেন কেন?” রেনাটা শব্দ করে শ্বাস ফেলল, “আমি ওখানে ছিলাম আমাদের একমাত্র সন্দেহভাজনকে চোখে চোখে রাখতে। ঐ হাসপাতালেরই একজন ডাক্তার।

“হুম! তাইতো বলি, আর কেউ জানে না কিন্তু আপনি কীভাবে জানেন যে কীভাবে বাঁচতে হবে।”

রেনাটা মাথা ঝাঁকালো। “আমার মতো যদি আপনিও সিরিয়া, ইরাক এসব জায়গায় ঘুরতেন আর দেখতেন কীভাবে চোখের সামনে মানুষ ঠাসঠাস করে মরে যাচ্ছে, যদি সারাক্ষণই ভয় লাগতো যে এক অদৃশ্য গ্যাস আপনাকে শেষ করার জন্য বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে তাহলে আপনিও আমার মতো অতি সতর্ক হয়েই থাকতেন সারাক্ষণ। সারাক্ষণ ভয়। প্রায় পাগলের মতো অবস্থা। তাই যখনই দেখলাম যে ঐ কালো মেঘটা যার কাছেই যাচ্ছে সে-ই জায়গায় পড়ে যাচ্ছে তখনই বুঝলাম যে কী হচ্ছে। বহুবার এসব দেখা আমার।”

কার্ট আবারো মনে মনে মহিলার সাহস ও বুদ্ধির প্রশংসা করল। “তা ঐ যে ঐ লোকটা যে আমাদেরকে মারতে চেয়েছিল, সে-ই কি আপনার সন্দেহভাজন?”

“না। আসলে আমরা জানি না কে সে। তার কোনো পরিচয়ই বের করা যায়নি। তার কোনো সনাক্তকরণ চিহ্ন আমরা পাইনি। সমস্ত ফিঙ্গার প্রিন্ট মুছে ফেলা। সম্ভবত ইচ্ছাকৃত কাজ সেটা। শুধু ক্ষত থেকে কিছু কোষ পেয়েছি। দ্বীপে আগত কোনো লোকের বর্ণনার সাথেই তার দৈহিক গঠনের মিল নেই। আপনি হয়তো ভাবছেন এটাতো হওয়ারই কথা, কিন্তু ল্যাম্পেডুসায় বেড়াতে বা থাকতে যে-ই আসুক প্রত্যেকেরই পুংখানুপুংখ বর্ণনা লিপিবদ্ধ থাকে। এয়ারপোর্ট, বন্দর বা কোনো ভাঙ্গা কাঠে করেও যদি দ্বীপে এসে ওঠেন এটা করা হবে।”

“তাহলে ঐ লোকটা সন্দেহ ভাজন না হলে কে?”

“হ্যাগেন নামের একজন ডাক্তার। লোকটা হাসপাতালে পার্ট টাইম কাজ করতো। হ্যাগেন-এর অতীত ইতিহাস বিশেষ সুবিধার না। আমাদের কাছে খবর ছিল যে আজই ওর কাছে একটা ডেলিভারি আসবে। শুধু জানতাম না কোত্থেকে এটা আসছে। কে ডেলিভারি দিচ্ছে বা কি জিনিস সেটাও ঠিকমতো জানা ছিল না। তবে এর আগেও এরকম ঘটনা ঘটেছে এরকম তিনটা জায়গাতেই তার উপস্থিতি ছিল। সে জন্যেই ধারণা করা হয় যে লোকটা ওর সাথে সম্পৃক্ত।”

কার্ট ছেঁড়া সুতোগুলো জোড়া দেয়ার চেষ্টা করল, তার মানে পিস্তল হাতে লোকটা-ই জিনিসটা নিয়ে আসছিল সম্ভবত। ডা, হ্যাগেনকে পৌঁছে দেয়ার কথা ছিল যা শেষমেশ আক্ষরিক অর্থেই তার কপালেই জুটলো।

“আমাদেরও সেরকমটাই ধারণা, রেনাটা জবাব দিল।

“হ্যাগেনের কি অবস্থা?”

ডা, রেনাটার চেহারা কঠোর হয়ে গেল, “ল্যাম্পেডুসার পাঁচ হাজার মানুষের মধ্যে শুধু হ্যাঁগেনের-ই কোনো খোঁজ নেই। ওকে আমরা সর্বক্ষণ নজরদারিতে রেখেছিলাম কিন্তু গ্যাসের প্রভাবে আমাদের দলটাও কোমায় চলে গেছে। কার্ট চেয়ারে হেলান দিয়ে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে রইল। ছাদে দুই টা রঙ করা। মাঝামাঝি একটা জায়গায় একটা রঙ অন্যটার ওপরে উঠে গেছে। ফলে সেখানে গাঢ় তৃতীয় একটা রঙের সৃষ্টি হয়েছে। তার মানে এই প্রাণঘাতী মেঘের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ মাত্র দুজন। একজন আপনাদের সন্দেহভাজন, অন্য হলো যে আমাদেরকে মারতে চেয়েছিল।”

ডা. রেনাটা মাথা ঝাঁকালো। “ঠিক। এ থেকে কি আপনি কিছু ধরতে পারছেন?”

“তাদের কাছে নিশ্চয়ই কোনো ধরনের প্রতিষেধক আছে। এমন কিছু যা এই আজব টক্সিনের কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দেয়।”

“এটাও আমাদের সাথে মিলে গেল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা হ্যাঁগেনের অফিসে কিছুই খুঁজে পাইনি। তার বাসা আর গাড়িতেও খোঁজা হয়েছে। কিছু নেই। এমনকি আমরা এই লোকটার রক্তেও কিছু পাইনি যাতে প্রতিষেধকটা বের করে ফেলবো।

“ব্যাপারটা কি অবাক করার মতো?”

“পুরোপুরি না। যেহেতু বিষটার আয়ু কম, ওটার প্রতিষেধকেরও আয়ু কমই হওয়ার কথা।”

কার্ট ব্যাপারটা ধরতে পারলো, “তার মানে প্রতিষেধক নষ্ট হয়ে গেছে। তবে যদি ডাক্তারটাকে খুঁজে পান তাহলে ব্যাটাকে ডলা দিলেই সুড়সুড় করে বলে দেবে প্রতিষেধক কোথায়।”

কান পর্যন্ত হাসি দিল ডা. রেনাটা, “আপনার মাথা আসলেই শার্প মি. অস্টিন।”

“মিস্টার বলা বন্ধ করুন প্লিজ। নিজেকে কেমন বুড়ো বুড়ো লাগে।”

“আচ্ছা কার্ট ডাকবো, আমাকেও রেনাটা বলে ডাকবেন।”

কার্টের প্রস্তাবটা পছন্দ হলো, “লোকটা কোথায় লুকাতে পারে কোনো ধারণা আছে?”

রেনাটা বাঁকা চোখে তাকাল, “কেন? সেটা জেনে আপনি কি করবেন?”

“এমনি?”

“আপনি নিশ্চয়ই লোকটাকে ধরতে যাওয়ার ধান্দা করছেন না?”

“আরে নাহ! কাজটা তো মারাত্মক বিপজ্জনক। কোন দুঃখে সেধে বিপদে পড়তে যাবো,” কার্ট জবাব দিল।

“কি জানি, মনে হলো তাই বললাম।” হালকা লজ্জা পেয়েছে রেনাটা। সেটা সামলে বলল, “আপনাকে যেটুকু দেখেছি আর NUMA-র অ্যাসিসন্ট্যান্ট ডিরেক্টরের সাথে কথা বলে আপনাকে ওরকম মনে হয়েছে তাই।”

কার্ট অবাক চোখে তাকাল, “আপনি আমার বসের সাথে কথা বলেছেন?”

“হ্যাঁ, রুডি গান। চমৎকার মানুষ। এখানে আসার আগে ওনার সাথেই কথা বলছিলাম। উনি বলেছেন যে আপনি সাহায্য করতে চাইবেন। আর যদি আমি সাহায্য না নেই তাহলে জোর করে হলেও সাহায্য করতে গিয়ে সবকিছু লেজে-গোবরে অবস্থা করে ফেলবেন।”

রেনাটার মুখে চওড়া হাসিটা ফিরে এসেছে। কথোপকথন এই প্রসঙ্গে চলে আসায় খুব খুশি। কার্ট এখন সহজেই বুঝতে পারছে যে কেন ওকে ডেকে এনে সব খুলে বলছে রেনাটা।”

“তা আমাকে বিক্রি করে কত পেল তারা?”

“বেশি না। বিনিময়ে একটা গান গেয়ে শোনাতে হয়েছে।”

“ওরে নীল দরিয়া?”

“শুধু নীল দরিয়া না। বোনাস হিসেবে মি. জাভালাকেও দিয়ে দিয়েছেন।” শুনে প্রচণ্ড আহত হয়েছে ভাব ধরলেও, মনে মনে কার্ট প্রচণ্ড খুশিই হয়েছে ব্যাপারটায়।

“তা বেতন কি ইউরোতে পাব নাকি”

“টাকা পাবেন না, মজা পাবেন। আমরা এই ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী লোকটাকে খুঁজে বের করব। আর যদি ভাগ্য ভালো হয়, তাহলে হ্যাগেন বা ঐ লোকটা যে প্রতিষেধক ব্যবহার করেছে ওটা খুঁজে বের করে এই লোকগুলোকে আবার জ্যান্ত করে তুলবো।” রেনাটা কথাটা শেষ করল।

“এরকম প্রস্তাব ফেরানো মুশকিল। কোত্থেকে শুরু করবো আমরা।” কার্ট বলল সিরিয়াস ভঙ্গিতে।

“মাল্টা। গত মাসে হ্যাগেন তিনবার সেখানে গিয়েছে।” রেনাটা জানালো। তারপর ড্রয়ার খুলে একটা ফোল্ডার বের করে সেখান থেকে কয়েকটা ছবি বের করে কার্টের হাতে দিল। ছবিগুলো দূর থেকে গোপনে তোলা।

“হ্যাগেন এই লোকটার সাথে বেশ কয়েকবার দেখা করেছে। গত সপ্তাহে একবার কথা কাটাকাটিও হয়েছে ওদের মধ্যে।” রেনাটা জানালো।

কার্ট ছবিটা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলো। ছবিটার লোকটার পরনে টুইডের জ্যাকেট, কনুইয়ের কাছে অন্য কাপড় দিয়ে তালি মেরে ডিজাইন করা। দেখে মনে হয় খুব পড়াশোনা জানা লোক। বসে আছে একটা ক্যাফেতে, আরো জনা তিনেক লোকের সাথে কথা বলছে। যেন ঐ তিনজন তাকে ঘিরে রেখেছে।

“মাঝখানের এটা হ্যাগেন। বাকি দুজন কারা আমরা জানি না। ওর সঙ্গী সাথী হবে হয়তো।” রেনাটা বলল।

“আর এই প্রফেসরের মতো দেখতে লোকটা কে?”

“মাল্টা সামুদ্রিক যাদুঘরের কিউরেটর।”

“বুঝলাম না। যাদুঘরের কিউরেটররা কখনো সন্ত্রাসীদের সাথে হাত মিলিয়ে নার্ভ গ্যাস আমদানি করছে এমনটা কখনো শুনিনি। আপনি কি ওনার ব্যাপারে নিশ্চিত?”

“আমরা কোনো ব্যাপারেই নিশ্চিত না।” রেনাটা স্বীকার করল। শুধু এটুকু জানি যে হ্যাগেন লোকটার সাথে নিয়মিত দেখা করে আসছে। আর যাদুঘর থেকে একটা পুরাকীর্তি কেনার চেষ্টা করছে। জিনিসটা দুদিন পরেই একটা গালা পার্টিতে নিলামের জন্য ভোলা হবে।”

কার্টের ব্যাপারটা যুক্তিসঙ্গত লাগছে না, “প্রত্যেকেরই শখের কিছু ব্যাপার-স্যাপার থাকে। সন্ত্রাসী হোক আর যা-ই হোক।”

“কিন্তু প্রাচীন-পুরাকীর্তি সংগ্রহ হ্যাঁগেনের বাতিক না। তাকে এর আগে কখনোই এসবের প্রতি আগ্রহী দেখা যায়নি।”

“বুঝলাম। কিন্তু লোকটা নিশ্চয়ই এতটা বোকা না যে, এই ঘটনার পর আবার মাল্টায় গিয়ে উঠবে।” কার্ট বলল।

“আমিও সেটা ভেবেছিলাম। কিন্তু খবর পাওয়া গেছে কেউ একজন সম্প্রতি হ্যাঁগেনের অ্যাকাউন্টে দুই লাখ ইউরো জমা দিয়েছে। অ্যাকাউন্টটা খোলা হয়েছিল কিউরেটর লোকটার সাথে দেখা করার পরদিন। আর টাকা জমা হয়েছে ল্যাম্পেডুসার ঘটনাটা ঘটার কয়েক ঘণ্টা পর। ইন্টার পোল টাকা জমার ব্যাপারটা নিশ্চিত করেছে।”

এবার কার্টের কাছে ব্যাপারটা গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে। ডা. হ্যাগেন বেঁচে আছে। আর ঘটনার পর সে ল্যাম্পেডুসা থেকে পালিয়ে গিয়েছে এবং মাল্টায় নিজের অ্যাকাউন্টে টাকা সরিয়ে ফেলেছে। কারণটা যা-ই হোক, পলাতক ডাক্তার যে মালটা সামুদ্রিক যাদুঘরের কিউরেটরের সাথে আরো একবার দেখা করবে সেটা নিশ্চিত।

রেনাটা ফাইলটা বন্ধ করে পায়ের ওপর পা তুলে বলল, “কথা হচ্ছে যে আপনি কি কষ্ট করে একবার মাল্টায় যাবেন ব্যাপারটা দেখতে?”

“দেখার চেয়েও বেশি কিছু করবো।” কার্ট কথা দিল।

রেনাটা খুশি হলো কথাটা শুনে। “আমি এখানকার সব রোগীর পর্যাপ্ত সেবার ব্যবস্থা করেই আপনার সাথে এসে দেখা করবো। একটা অনুরোধ, দয়া করে আমি আসার আগ পর্যন্ত কিছু করবেন না।”

কার্টের মুখেও এখন চওড়া হাসি, “শুধু দেখবো আর বলে যাবো, ওয়ান টু-র কাজ।”

ওরা দুজনেই জানে কার্ট মিথ্যে বলছে। হ্যাগেনকে পেলে কার্ট যে ছেড়ে দেবে না এটা নিশ্চিত। তাতে ঝামেলা যতই বাঁধুক না কেন।

.

১৩.

মিসরের হোয়াইট মরুভূমি, পিরামিডের সাত মাইল পশ্চিম
সকাল ১১ : ৩০ মিনিট

একটা ফ্রান্সে বানানো SA1342 গ্যাজেল হেলিকপ্টার মরুভূমির পাঁচশো ফুট ওপর দিয়ে উড়ে গেল। ওটার আওয়াজে মরুভূমির স্বাভাবিক নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে গেছে।

কপ্টারটা মরুভূমির ক্যামোফ্লেজে রঙ করা। মডেলটা অবশ্য পুরনো। এক সময় এটা মিসরীয় সেনাবাহিনীর ছিল। তাদের কাছ থেকে বর্তমান মালিক কিনে নিয়েছে।

মরুভূমির সবচে উঁচু বালিয়াড়িটা পার হতেই ওটা গতি কমিয়ে দিক পরিবর্তন করল। হঠাৎ বাক পরিবর্তনের কারণেই দূরের মরুভূমির মধ্য দিয়ে ধেয়ে আসা গাড়ির বহরটা তারিক সাকির-এর চোখে পড়ল। গাড়ি মোট সাতটা কিন্তু চলছে পাঁচটা। বাকি দুটো একটা আরেকটার সাথে বাড়ি খেয়ে ভচকে গেছে। ফলে আর চলার ক্ষমতা নেই। দুটো বালিয়াড়ির মাঝে আটকে আছে।

সাকির ওর দামি সানগ্লাসটা খুলে চোখে একটা বাইনোকুলার ধরলো। “দুটো অলরেডি গেছে। উদ্ধার করতে লোক পাঠাও। বাকিগুলো ঠিক আছে।” পাশের আরেকজনকে বলল সাকির।

বাকি গাড়িগুলো বালিয়াড়ি পেরিয়ে আসছে। পিছনে টায়ারের লম্বা দাগ পড়ে আছে। বালিতে টায়ার ঠিকমত কামড় বসাতে না পারায় ইঞ্জিন মারাত্মকভাবে গো গো করছে।

একটা গাড়িকে দেখা গেল অন্যদের চেয়ে এগিয়ে গেছে। সম্ভবত শক্ত কোনো বালির চাপড়ার খোঁজ পেয়েছে।

“চার নাম্বার। আগেই বলেছিলাম এই লোক নাছোড়বান্দা।” সাকিরের হেডফোনে কেউ বলল কথাটা।

সাকির হেলিকপ্টারের পেছনের কেবিনটার দিকে তাকাল। কালো রঙের সামরিক পোশাক পরা এক খাটো লোক বসা সেখানে। দাঁত বের করে হাসছে।

“এখনই এতো নিশ্চিত হয়ো না হাসান। শুধু গতি বেশি হলেই সবসময় রেস জেতা যায় না।” ভর্ৎসনার সুরে বলল সাকির।

তারপর রেডিওর সুইচটা টিপে বলল, “সময় হয়েছে। পিছনেরগুলোকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দাও তারপর সবটাকেই বন্ধ করে দাও। দেখি কার কত সাহস।”

কলটা রিসিভ করল গাড়িগুলোর ঠিক পেছনেই আসতে থাকা একটা গাড়ি। কথা শুনেই গাড়িতে বসা টেকনিশয়ান তার ল্যাপটপে দ্রুত কয়েকটা বোতাম টিপে ENTER চাপলো।

সাথে সাথে সবার সামনে থাকা SUv-টার ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়া বেরুনো শুরু হলো। কয়েকবার বালিতে ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেল পুরোপুরি। অন্যরা পিছন থেকে দেখে একপাশে সরে গেল তারপর ওটাকে পাশ কাটিয়ে বালিয়াড়ির অপর পাশ দিয়ে ছুটলো, এটাই শেষ বালিয়াড়ি। এটার পরেই ফিনিশিং লাইন। গত কয়েক মাস ধরে চলা কঠিন কঠিন সব পরীক্ষার এটাই শেষ ধাপ। পরীক্ষায় উত্তীর্ণরাই সাকিরের দলের উচ্চপদ লাভ করবে।

“এটা কিন্তু দুই নম্বুরী।” পিছন থেকে হাসান চেঁচালো।

“জীবনটাই একটা দুই নম্বুরী।” “আমি শুধু একটু বাটপারি করলাম। এখন দেখা যাবে কে আসলেই উপযুক্ত, কার বুকের পাটা কত চওড়া।”

বাকি গাড়িগুলোও দেখা গেল একইভাবে বন্ধ হয়ে গেল। আর কিছুক্ষণ আগেই যেখানে ইঞ্জিনের গো গো আর টায়ার বালির ঘর্ষণের শব্দে ভরা ছিল, সেটাই এখন ধুপধাপ বন্ধ দরজা, গালাগাল আর অভিসম্পাতে ভরে গেল। ড্রাইভারগুলো সবার-ই ঘামে ভিজে গোসল হয়ে গেছে; গায়ে রঙচঙে পোশাক। দেখে মনে হচ্ছে মাত্র যুদ্ধ থেকে ফিরেছে, বা নরকের দুয়ার থেকে ঘুরে এসেছে। হঠাৎ গাড়িগুলোর এহেন আচরণে সবাই হতবুদ্ধি হয়ে গেছে।

একজন গাড়ির সামনের ইঞ্জিনের হুড তুলে বোঝার চেষ্টা করল সমস্যাটা কি। আরেকজন সজোরে লাথি হাকালো নিজের গাড়ির গায়ে। দামি মার্সিডিজ SUv-এর গা ডেবে গেল খানিকটা। অন্যরাও হতাশ হয়ে একই কাজ করল। ক্লান্তি আর অবসন্নতায় তাদের বুদ্ধি লোপ পেয়েছে।

“ওরা হাল ছেড়ে দিচ্ছে।” সাকির বলল।

“সবাই না,” হাসান জবাব দিল।

একজন লোককে দেখা গেল সাকিরের মন মতো কাজ করছে। সে প্রথমে অন্যদের দিকে তাকাল তারপর সেখান থেকে বালিয়াড়ির মাথায় শেষ প্রান্তটা একবার পরখ করল তারপরই আচমকা দিল দৌড়।

লোকটা কি করতে চাচ্ছে সেটা বুঝতে বুঝতে বাকিদের কয়েক সেকেন্ড লেগে গেল। সে দৌড়ে রেস শেষ করে পুরস্কার জিততে চায়। ফিনিশিং লাইন এখান থেকে মাত্র পাঁচশো গজ আর একবার বালিয়াড়ির মাথায় উঠতে পারলেই হবে, বাকিটা ঢালু রাস্তা।

অন্যরাও ঝেড়ে দৌড় দিল পিছু পিছু। কিছুক্ষণ পরই দেখা গেল পাঁচজন লোক পড়িমড়ি করে বালিয়াড়ি ভেঙে ছুটছে।

কিন্তু বালি বেয়ে ওঠার চেয়ে নামা আরো কঠিন। বাতাসে বাতাসে ধাক্কা খেয়ে বালিয়াড়ির ধারটা একেবারে খাড়া হয়ে গেছে। দুজন লোক সেটা বেয়ে নামার চেষ্টা করতেই মুখ থুবড়ে পড়ল, তারপর গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। একজন টের পেল যে পিছলে পিছলে নামলে আরো দ্রুত নামা যাবে। সে বালিয়াড়ির ধারে পৌঁছতেই লাফ দিল সামনে তারপর বুকে পিছল খেয়ে ষাট গজ মতো এগিয়ে গেল।

“যাক, শেষ পর্যন্ত একজন বিজয়ী পাওয়া যাবে তাহলে।” সাকির হাসানকে বলল। তারপর পাইলটকে বলল, “ফিনিশিং লাইনের কাছে নিয়ে চলো।”

হেলিকপ্টার আবারো ঘুরে নিচে নামতে শুরু করল। একটা বিশাল লম্বা রেখার দিকে এগুলো। রেখাটা মরুভূমিকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। ওটার নাম “জানদ্রিয়ান পাইপ লাইন।” ওটার কাছেই একটা তেলের পাম্পকে ফিনিশিং লাইন হিসেবে ঠিক করা হয়েছে।

গ্যাজেলটা ওটার ঠিক পাশেই নামলো। মুহূর্তেই একটা ছোটখাটো ধূলি ঝড় উঠে গেল চারপাশে। সাকির ওর কান থেকে হেডসেট খুলে দরজা খুললো। তারপর মাথা নিচু করে সামনে বাড়লো। সামনেই হাসানের মতোই পোশাক পরা কয়েকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।

সাকির চাইলে অনায়াসে একজন মুভি স্টার হতে পারতো। লম্বা একহারা গড়ন। রোদে পোড়া চামড়া, ঘন বাদামি চুল আর চৌকো থুতনি। দেখে মনে হয় থুতনিতে উটের লাথি খেলেও কিছু হবে না। রোদে পোড়া মানুষদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হলে ওযে পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন মানবের খেতাব জিতবে তাতে সন্দেহ নেই। ওর চেহারা দেখেই বোঝা যায় দারুণ আত্মবিশ্বাসী ও। আর যদিও ও বাকি লোকগুলোর মতো একই পোশাক পরা, কিন্তু ওর আর ওদের মধ্যে তফাত বিস্তর। রাজা আর প্রজার মধ্যে তফাত যতটুকু ততটুকু।

বহুদিন ধরে সাকির মিসরীয় গোয়েন্দা পুলিশ বাহিনীর হয়ে কাজ করেছে। মোবারকের শাসনামলে সে ছিল এই বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড। দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে অবিরাম লড়ে গেছে আর সমস্ত ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছে একের পর এক। তারপর হোসনী মোবারক ক্ষমতাচ্যুত হলো। লোকেরা এটাকে বলে “আরব বসন্ত।” দেশ জুড়ে শুরু হলো একের পর এক পরিবর্তন, ঘটনা দুর্ঘটনা। সাকির আর ওর মতোই আরো কয়েকজন আড়ালে থেকে কলকাঠি নেড়ে গেল। ওরা এখনো শিল্পপতির ছদ্মবেশে দেশের সকল ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে।

গোয়েন্দা পুলিশে কাজ করার সময় অর্জিত দক্ষতা দিয়ে সাকির একটা সংস্থা গড়ে তুলেছে। নাম ওসাইরিস। অল্প সময়েই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে সে। কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে এটার বিন্দুমাত্র নাম গন্ধ নেই এবং সম্মান এবং সুখ্যাতির সাথে ওসাইরিস কাজ করে যাচ্ছে। সাকিরের ধারণা যদি ঠিক হয় তাহলে অচিরেই ওসাইরিস শুধু মিসর না, বরং পুরো উত্তর-আফ্রিকাই নিয়ন্ত্রণ করবে।

আপাতত ওর মনোযোগ পুরো এই রেসের দিকে। মারাত্মক কষ্টকর এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল বিশ জনকে নিয়ে। একে অপরের সাথে লড়াই করে টিকে থাকবে একজন। তাকেই সাকির নিজের দলে নেবে। ইতোমধ্যে তার কয়েক ডজন তোক উত্তর-আফ্রিকা আর ইউরোপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু সফল হওয়ার জন্যে তার আরো লোকবল দরকার। নতুন নতুন, তরুণ উদ্যোমী লোক দরকার ওর, যারা আসলেই বুঝবে ওর সংগঠনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য।

এদিকে বালিয়াড়িতে এক আর চার নাম্বার ড্রাইভারকে দেখা গেল অন্য তিনজনের চেয়ে এগিয়ে গিয়েছে। বালিয়াড়ি পেরিয়ে সমতলে আসতেই সবাই পাম্পটার দিকে ছুটলো। এক নম্বর ড্রাইভারই তখনো এগিয়ে। কিন্তু হাসানের ব্যক্তিগত পছন্দের চার নাম্বার ওকে প্রায় ধরেই ফেলেছে। মনে হচ্ছিলো শেষ পর্যন্ত হাসানের কথা-ই ঠিক হবে। কিন্তু চার নম্বর একটা মারাত্মক ভুল করে বসলো। সে আসলে এই প্রতিযোগিতার আসল ব্যাপারটা ধরতে পারেনি। এখানে জেতার জন্য সবকিছু করা জায়েজ। এমনকি অন্যকে খুনও করা যাবে।

চার নম্বর এগিয়ে গেল, কিন্তু এগিয়ে যেতেই অন্য ড্রাইভারটা পেছন থেকে ওকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিল। লোকটা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেল আর পিছনের লোকটা ওর পিঠের ওপর পাড়া দিয়ে সামনে চলে গেল।

চার নম্বর আবার উঠতে উঠতে খেলা শেষ। এক নম্বর ড্রাইভার জিতে গিয়েছে। বাকিজনও ওকে পাশ কাটিয়ে দৌড়ে চলে গেল কিন্তু সে তিক্ত মন নিয়ে সেখানেই বসে রইল।

সবাই ফিনিশিং লাইন পার হলে সাকির একটা ঘোষণা দিল,

“তোমরা সবাই বিজয়ী। এ থেকে একটা শিক্ষা কিন্তু সবাই পেয়েছে, তা হলো কখনো হাল ছাড়া যাবে না। তোমাকে যে কোনো মূল্যে জিততে হবে। এক্ষেত্রে দয়ামায়া দেখালে চলবে না।”

“বাকিদের কী হবে?” হাসান জিজ্ঞেস করল।

সাকির ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলো কিছুক্ষণ। দুজন ড্রাইভার তখনো বালিয়াড়িতে রয়ে গেছে। আছাড় খাওয়ার পর তারা আর উঠে দৌড়ায়নি। আর সেই ভচকে যাওয়া গাড়ি দুটোর ড্রাইভারেরাও বাকি আছে।

“ওদেরকে হটিয়ে সবচে কাছের চেকপয়েন্টে নিয়ে যাও।”

“হাঁটিয়ে? সবচে কাছেরটাও এখান থেকে তিরিশ মাইল।” অবাক হয়ে বলল হাসান।

“সেক্ষেত্রে তাড়াতাড়ি রওনা দিলেই ভালো হবে।”

“এখান থেকে চেক পয়েন্ট পর্যন্ত বালি বাদে আর কিছু নেই। এরাতো সবাই মারা পড়বে।” হাসান বলল।

“গেলে যাক। তবে যদি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়, তাহলে তারা একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাবে আর তখনই আমি ভেবে দেখবো ওদেরকে দলে নেয়া যায় কি-না।”

হাসান হলো সাকিরের ঘনিষ্ঠতম সহচর। সিক্রেট সার্ভিসে চাকরির সময় থেকেই দুজনের সখ্যতা। মাঝে মাঝে হঠাৎ তাই সাকির হাসানের পরামর্শ কানে তোলে কিন্তু আজ না, “যা বলেছি করো।”

হাসান রেডিও তুলে কথাটা জানিয়ে দিল। সাকিরের কালো পোশাক পরা একদল সৈন্যকে দায়িত্ব দেয়া হলো ঐ চারজনকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার। এতোক্ষণ পরে চার নম্বর ড্রাইভার তার জায়গা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ফিনিশিং লাইনের দিকে এগুলো।

হাসান ওকে পানি দিতে গেল কিন্তু সাকির বাধা দিলো, “না, ওকেও হাঁটতে হবে।”

“কিন্তু ওতো জিতেই গিয়েছিল,” হাসান আপত্তি করল।

“হ্যাঁ, আর সে ফিনিশিং লাইনের এতো কাছে থেকেও হাল ছেড়ে দিয়েছে। আমার কোনো লোকের এমন স্বভাব আমি বরদাশত করবো না। ও বাকিদের সাথে হেঁটে যাবে। আমি যদি খবর পাই যে, কেউ একে সাহায্য করেছে। তাহলে ঐ লোকের উচিত হবে আত্মহত্যা করা নাহলে আমি এমন সাজা দেবো, যা হবে মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর।”

চার নম্বর ড্রাইভার অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সাকিরের দিকে তাকিয়ে রইল। কিন্তু ওর দৃষ্টিতে ভয় নেই। কেমন অবজ্ঞা।

সাকিরও ওর দৃষ্টির রাগটাকে পছন্দ করল। একবার তো ভেবেই বসলো যে শাস্তি মওকুফ করে দেবে। পরমুহূর্তেই আবার সিদ্ধান্তে ফিরে এসে বলল,

“হাটা শুরু করো।”

চার নম্বর হাসানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সোজা এগিয়ে হাঁটা শুরু করলো। একটা কথাও বলল না বা একবার ফিরেও তাকাল না।

লোকটা হাঁটা শুরু করতেই একজন এসে সাকিরকে একটা সরকারি ঘোষণা পত্র ধরিয়ে দিল। সেটা পড়ে সাকির স্বগোক্তি করল, “খবর তো খারাপ।”

“কি হয়েছে?” হাসান জিজ্ঞেস করল।

“আম্মন তা মারা গেছে। দুজন আমেরিকান নাকি ওকে মেরেছে। ইতালিয়ান ডাক্তারের কাছে যেতেও পারেনি।”

“আমেরিকান?”

সাকির মাথা ঝাঁকালো, “NUMA” নামের একটা সংস্থার সদস্য।

“NUMA!” হাসানও নামটা একবার বলল।

দুজনেই নামটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উচ্চারণ করল। সিক্রেট সার্ভিসে থাকার সময় এই সংস্থা সম্পর্কে নানান গুজব ওরা শুনেছে। ওরা হচ্ছে সমুদ্রবিদ বা এই ধরনের কিছু একটা।

“ব্যাপারটা তো ভালো মনে হচ্ছে না, এরা তো CIA-র চেয়েও খারাপ।” হাসান-ই বলল আবার।

সাকির মাথা ঝাঁকালো, “যদূর মনে পড়ে NUMA-র একজন সদস্য-ই কয়েক বছর আগে আপ্যান বাধ ধসে পড়া আটকিয়ে মিসরের মস্ত উপকার করেছিল।

“তখন তো আমরা সবাই একই দলে ছিলাম। ওরা কি কিছু বের করতে পেরেছে?”

সাকির আত্মবিশ্বাসের সাথে মাথা নাড়লো।” জাহাজ বা আম্মন তা কোনো কিছুতেই ওরা কোনো কিছুর হদিস পাবে না দিয়ে আমাদের সন্দেহ করতে পারে।”

“হ্যাগেনের কি অবস্থা? আম্মন তার তো ওর কাছেই ব্লাক মিস্ট ডেলিভারি দেয়ার কথা ছিল। পরে ইউরোপের কিছু সরকারের সাথে ওটা দিয়ে বোঝাঁপড়া করা যেতো।”

সাকির তখনও কাগজটা পড়ছে, “হ্যাগেন পালিয়ে মাল্টা চলে গেছে। ও নিলামের আগেই আরো একবার পুরাকীর্তিটা কেনার চেষ্টা করবে। যদি না পারে তো চুরি করবে। দুদিনের মধ্যেই বিস্তারিত জানাবে বলেছে।

“একমাত্র হ্যাগেন-ই আমাদের কথা জানে। ওকে এখুনি সরিয়ে দেয়া দরকার।”

“হ্যাঁ, তবে আগে পুরাকীর্তিগুলো জোগাড় করুক। আমি ঐ শিলালিপি দুটো হয় আমার হাতের মুঠোয় চাই নাহলে ধ্বংস করে দিতে চাই যাতে আর কেউ ওটা আবার জোড়া দিতে না পারে।”

“আসলেই কি জিনিসটার গুরুত্ব আছে? আমরা তো জানিও না যে ওটায় কি আছে।” হাসান বলল।

হাসানের এতো বেশি প্রশ্নে সাকির বিরক্ত হয়ে গেল, রাগতস্বরে বলল, “আমার কথা মন দিয়ে শোনো। আমরা ইউরোপের সব নেতাদের এমনভাবে ঘুম পাড়িয়ে দেবো যে কোনো রকম প্রতিক্রিয়া ছাড়াই এই মহাদেশের সব গুরুত্ব পূর্ণ অংশ আমরা দখল করে ফেলতে পারবো। যদি কেউ ঐ শিলালিপি থেকে কোনো প্রতিষেধক বানানোর সূত্র পেয়ে যায়–যদি কেউ ব্লাক মিস্ট এর প্রভাব নষ্ট করে দেয়ার উপায় বের করে ফেলে–তাহলে আমাদের পুরো পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। এই সহজ কথাটা তোমার মাথায় ঢোকে না কীভাবে?

“তা তো বুঝেছিই। কিন্তু ঐসব পুরাকীর্তিতেই যে প্রতিষেধক বানানোর সূত্র আছে এ তথ্য আপনি কোথায় পেলেন?” হাসানও পাল্টা জবাব দিল।

“কারণ নেপোলিয়নও এই জিনিসটাই খুঁজছিল। উনি এই ব্লক মিস্টের খবর শুনেছিলেন তখন “সিটি অফ ডেড”-এ লোক পাঠান খুঁজে দেখার জন্য। তারা যা যা পেয়েছিল সব ওখান থেকে নিয়ে যায়। এটা আমাদের ভাগ্য যে যেটুকু ছিল সেটুকু দিয়েই আমরা প্রতিষেধকটা বের করে ফেলতে পেরেছি। এটার মানে হলো বেশিরভাগ শিলালিপি-ই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাদের পর দাদাদের কাছ থেকে ইউরোপিয়ানরা চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। এখন আবার আমাদের বিরুদ্ধেই সেটাকে আমি ব্যবহার করতে দেবো না। যদি ঐ শিলালিপিগুলোয় প্রতিষেধকটা বের করার সামান্যতম কোনো সূত্র থেকে থাকে তা হলেও এগুলোকে ওদের হাতে পড়ার আগেই ধ্বংস করতে হবে। আর সেটা করা হয়ে গেলে হ্যাগেনকেও সরিয়ে দেয়া হবে।

“কিন্তু ও একা তো এটা পারবে না।” হাসান বলল।

সাকিরও ব্যাপারটা ভেবে দেখলো, “ঠিক বলেছ। নতুন এজেন্টদের একটা গ্রুপ ওর কাছে পাঠিয়ে দাও। ওদেরকে বলে দিও কাজ শেষে হ্যাগেনকেও সরিয়ে দিতে।”

হাসান মাথা ঝাঁকালো। “ঠিক আছে। আমি নিজেই দেখছি ব্যাপারটা। আর এদিকে উনারা চলে এসেছেন। নিচে বাঙ্কারে বসে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে।”

সাকির শব্দ করে শ্বাস ছাড়লো। এখনও তাকে কারো কাছে কৈফিয়ৎ দিতে হয় ভাবতেই বিরক্ত লাগে। ওসাইরিস হলো একটা প্রাইভেট সামরিক দল। লক্ষ্য এমন এক সাম্রাজ্য গড়ে তোলা যারা কোনো সরকারকে কৈফিয়ৎ দেবে না, বরং সরকারগুলোকেই নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু সেটা এখনও বাস্তবায়নের পথে। আর ওসাইরিস এখনও একটা সংস্থা। সাকির একই সাথে এটার প্রেসিডেন্ট আর সিইও।

আর উনারা হলো, স্টকহোল্ডার আর বোর্ড মেম্বার। এদের প্রত্যেকেরই লক্ষ্য অনেক বড় বড়। বেহিসেবি ধন-সম্পদেও এদের মন ভরেনি। এখন তাদের চোখ পড়েছে ক্ষমতার দিকে। সবাই নিজের সাম্রাজ্য গড়তে চায় আর একমাত্র সাকির-ই তাদেরকে সেটা এনে দিতে পারবে।

.

১৪.

রোদ পড়ে পাইপগুলো ঝিকমিক করছে। পাশেই একটা লম্বা, কালো রঙের কাঠামো। সাকির সেদিকেই এগুলো। ওর অনেক পাম্পিং স্টেশনগুলোর মধ্যে এটা একটা। দুজন লোক দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। সাকিরকে দেখামাত্র দরজা খুলে ধরলো। চোখ সোজা সামনে। সাকিরের চেহারার দিকে তাকানোর দুঃসাহস ওদের নেই। ভেতরে ঢুকে সাকির সোজা ভবনের পিছন দিকে চলে গেল। একটা খনির কাজে ব্যবহৃত এলিভেটরের দরজা খুলে তাতে চড়ে বসলো। এটায় একই সাথে অনেক মানুষ আর ভারী মালামাল বহন করা যায়। সাকির নিচে নামার বোতামে চাপ দিল।

দুই মিনিট পর প্রায় চারশ ফুট নামার পর এলিভেটরের দরজা আবার খুলে গেল এবং সাকির নিচে নেমে এলো। সামনেই মাটির নিচে গুহার মতো একটা ঘর। দেয়াল আর মেঝে জুড়ে অসংখ্য লাইট লুকানো। গুহাটার অর্ধেকটা প্রাকৃতিক। বাকিটা সাকিরের মাইনিং টীম আর ইঞ্জিনিয়ারেরা বানিয়েছে।

লম্বায় প্রায় দুইশো ফুট। বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে আছে প্রকাণ্ড কয়েকটা পাম্প। ছোটখাটো একেকটা ঘরের সমান ওগুলো। সেগুলো থেকে ডজন ডজন পাইপ বের হয়ে এঁকেবেঁকে উঠে গেছে মাটির ওপরে।

সাকির সানগ্লাস খুললো। বরাবরের মতোই আবারও জিনিসটা দেখে মুগ্ধ হলো। ও এসব বিশাল যন্ত্রগুলো পার হয়ে একটা রুমে এসে ঢুকলো। এটা হলো কন্ট্রোল সেন্টার। বিশাল স্ক্রিনে মিসর আর উত্তর আফ্রিকার বেশির ভাগ অংশের মানচিত্র দেখা যাচ্ছে। সেখানে বেশ কয়েকটা সমান্তরাল দাগ টানা। সব দেশের ভেতর দিয়েই দাগটা গিয়েছে। প্রতিটা দাগের পাশে চাপ, প্রবাহমাত্রা, আয়তন সব উঠে আছে। সব লাইনের পাশেই ছোট্ট ছোট্ট সবুজ পতাকা জ্বলছে নিভছে। দেখে সন্তুষ্ট হলো সাকির।

তারপর সে ঢুকলো কনফারেন্স রুমে। রুমটা যে কোনো আকাশচুম্বী ভবনের ওপর বানানো কর্পোরেট অফিস টাওয়ারকে হারিয়ে দিতে পারবে। রুমের মাঝখানে একটা সেগুন কাঠের টেবিল। চারপাশ ঘিরে আছে মখমলে মোড়া চেয়ার। সেগুলোতে বসে আছে হোকা সাইজের কয়েকজন মানুষ। দেয়ালের স্ক্রিনে ওসাইরিসের লোগো ঝুলছে।’

সাকির টেবিলের মাথায় একটা চেয়ারে বসলো, তারপর বাকিদেরকে এক নজর দেখলো ভালো করে। পাঁচজন মিসরীয়, তিনজন লিবিয়ান, দুজন আছে আলজেরিয়ান, আর সুদান আর তিউনিসিয়ার প্রতিনিধি আছে একজন করে। মাত্র কয়েক বছরেই সাকির ওসাইরিসকে শূন্য থেকে এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ আন্ত র্জাতিক সংস্থায় রূপায়িত করেছে। সাফল্যের জন্যে কয়েকটা জিনিস লাগে : পরিশ্রম, ধূর্ততা, যোগাযোগ আর অবশ্যই টাকা। অন্য লোকের টাকা।

সাকির আর ওর সিক্রেট সার্ভিসের সাঙ্গাত্র প্রথম তিনটা জিনিসের যোগান দিয়েছে, আর শেষেরটার যোগান দিয়েছে এই লোকগুলো। এরা সবাই প্রচণ্ড ধনী এবং একসময় অনেক ক্ষমতাবানও ছিল। ছিল। কারণ আরব বসন্তে সাকির-এর চেয়েও এরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ঘটনার সূত্রপাত তিউনিসিয়ায়। সেখানে এক গরিব হকার পুলিশ কর্তৃক বছরের পর বছর নিগৃহীত হওয়ার পর একদিন সহ্য করতে না পেরে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।

কেউ হয়তো বিশ্বাসই করবে না যে এই ঘটনার এতো বড় প্রভাব পড়বে। এরকম কত জনই তো প্রতিদিন পুড়ে বা গুলি খেয়ে মরছে। কিন্তু দেখা গেল লোকটা শুধু নিজের গায়েই আগুন ধরায়নি, পুরো আরব বিশ্বের গায়েই আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। প্রায় অর্ধেক আরব জ্বালিয়ে তারপরেই থেমেছে ওটা।

প্রথমেই পতন হয় তিউনিসিয়ার। আর ওখানকার শাসকরা পালিয়ে যায় সৌদি-আরবে। এরপর শুরু হয় আলজেরিয়ায়। তারপর আগুন ছড়িয়ে পড়ে লিবিয়ায়। মুয়াম্মার গাদ্দাফি সেখানে ৪২ বছর ধরে কঠিন হাতে শাসন করে আসছিলেন। তার কাছের লোকজন সবাই তেল বেচে কোটিপতি হয়ে গিয়েছিল। গৃহযুদ্ধ বাধার পরে আর তারা জীবন বাঁচাতে পারেনি। তবে বুদ্ধি করে অনেকেই আগে আগে টাকা আর পরিবার পরিজনকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তারা বেঁচে গেছে। তবে তারপরও দেশ না ছেড়ে পারেনি। কিছুদিনের মধ্যেই তারা উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে।

এরপরে মিসর হয়ে জাগরণের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে ইয়েমেন, সিরিয়া আর বাহরাইনে। আর এই বিশাল অগ্নিকুন্ত্রে সূচনা হয়েছিল এই সামান্য স্ফুলিঙ্গ থেকে।

এখন আবার উত্তেজনা থিতিয়ে এসেছে। পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত। যারা বেঁচে গেছে তারা আবার চাইছে হারানো ক্ষমতা ফিরে পেতে।

“আশা করি রাস্তায় কারো কোনো কষ্ট হয়নি। সাকির বলল।

“এসব সৌজন্যতার সময় নেই এখন। অপারেশন শুরু হবে কখন বলুন। আমরা সবাই-ই খুব টেনশনে আছি।” কথাটা বলল একজন মিসরীয়। মাথার চুল সব সাদা হয়ে গেছে তার। পরনে ওয়েস্টার্ন স্যুট, হাতে ব্রিটলিং ঘড়ি। লোকটা মিসরীয় বিমান বাহিনীর কাছ থেকে পানির দামে বিমান কিনে সেগুলো বাইরে বেচে বেচে এত টাকা কামিয়েছে।

সাকির একজন কর্মচারীর দিকে ফিরে বলল, “পাম্পিং স্টেশনগুলো রেডি?” লোকটা মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল, তারপর সামনের কি-বোর্ডে চাপ দিতেই স্ক্রিনে কন্ট্রোল রুমে দেখা আফ্রিকার ম্যাপটা ফুটে উঠল।

“আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন, নেটওয়ার্ক গঠন পুরো শেষ,” শাকির বলল। “আমাদের কাজকর্ম কেউ টের পায়নি তো?” লিবিয়ার সাবেক একজন জেনারেল প্রশ্ন করলেন।

‘না! তেলের পাইপ বসানোর কাজ করার হুঁতো ধরার কারণে কেউ সন্দেহও করেনি যে আমরা সাহারার তলদেশের জলাধারের গভীর আর গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় হাত দিচ্ছি। এখান থেকে শুরু করে পশ্চিম আলজেরিয়ার শেষ মাথা পর্যন্ত সব মরুদ্যান আর গাছপালার জীবনের উৎস এটাই।”

“অগভীর জলাধারগুলোর কি হবে? আমাদের দেশের লোকেরা তো ওগুলোর ওপরই নির্ভরশীল।” লিবিয়ার দ্বিতীয় ব্যক্তি বলল কথাটা।

“আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে যে মিষ্টি পানির সব উৎস-ই এসব গভীর জলাধারের ওপর নির্ভরশীল। যদি আমরা ওগুলো থেকেই প্রচুর পরিমাণ পানি তুলে নেয়া শুরু করি তাহলে ওগুলোও টিকবে কি-না সন্দেহ।” সাকির বলল।

“আমি চাই ওগুলো একেবারেই শুকিয়ে যাক।” তিউনিসিয়ার প্রতিনিধি বলল।

“পুরোপুরি শুকিয়ে ফেলা অসম্ভব। তবে এটা হচ্ছে মরুভূমি। যখন হঠাৎ করেই একদিন তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া আর লিবিয়া দেখবে যে তাদের পানির সংগ্রহে টান পড়েছে তখনই তারা আমাদের হাতের মুঠোয় চলে আসবে। আশি-নব্বই ভাগ ঘাটতি হলেই হবে। পুরোটা শুকোতে হবে না। বিদ্রোহীদেরও পানির প্রয়োজন হয়। পানির সরবরাহ তখনই আবার নিশ্চিত করা হবে যখন আবার আপনারা ক্ষমতা ফিরে পাবেন। তারপর সবাই একসাথে মিলে ওসাইরিসের মাধ্যমে আমরা সমগ্র উত্তর-আফ্রিকাকে নিয়ন্ত্রণ করবো।

“আচ্ছা পানিটা তুলে রাখবেন কোথায়? আপনি দিনে দুপুরে বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালন পানি তুলবেন আর কারো চোখে পড়বে না তা-তো হয় না।” আলজেরিয়ান লোকটা বলল।

“পানি আসবে এসব পাইপের ভেতর দিয়ে।” সাকির মানচিত্রের লাইনগুলো দেখিয়ে বলল।” তারপর এসব চ্যানেল দিয়ে সোজা গিয়ে পড়বে নীল নদে। তারপর সেখান থেকে চলে যাবে সাগরে।”

রুমের সবাই একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। “দারুণ!” প্রশংসা করল একজন।

“আর যেসব ইউরোপিয়ান আর আমেরিকান আমাদের বিরোধিতা করবে?” লিবিয়ান জিজ্ঞেস করলেন।

সাকির হাসলো, “ইতালিতে আমাদের লোক সেটার ব্যবস্থা করছে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এরা কোনো সমস্যা-ই করবে না।”

“খুব ভালো। তা সেটা কখন শুরু হচ্ছে? আর আপনার কি আর কিছু লাগবে?” লিবিয়ান-ই বললেন আবার।

এদের এই প্রবল আগ্রহই শাকিবের প্রধান পুঁজি। ক্ষমতার স্বাদ একবার পাওয়ায়, এরা সেটা ফিরে পেতে এতোটাই মরিয়া যে যা খুশি করতে রাজি। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সাকির যথেষ্ট টাকা আর সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। এবার তার প্রতিদান দেয়ার পালা।

“বেশির ভাগ পাম্প-ই কয়েক মাস ধরে চলছে। পানি তোলার কাজও খুব দ্রুত শুরু হয়ে যাবে। তারপরই বাকি সবই হবে পরিকল্পনা মতো।” সাকির সবার উদ্দেশ্যে বলল। তারপর টেকিনিশিয়ানের দিকে ফিরে বলল, “অন্যান্য স্টেশনকে খবর দাও। সব পাম্প চালু করতে বলো।”

টেকনিশিয়ান কয়েকটা বোম চাপতেই পাম্পগুলো জ্যান্ত হয়ে উঠল। ঘড় ঘড় শব্দে ভরে গেল চারপাশ। কয়েক মুহূর্ত পরেই শব্দ এতো বেড়ে গেল যে মুখের কথা আর শোনা-ই যায় না। সাকির তাই দ্রুত সভার শেষ টানলো।

“মরুভূমিতে গরম বাতাসকে বলে সিরোক্কো। আজ আমরা নিজেরাই গরম বাতাসের সৃষ্টি করলাম। এই বাতাস সমগ্র আফ্রিকা জুড়ে ভেসে ভেসে আরব বসন্তের সমাপ্তি ঘটাবে। তারপরই শুরু হবে সবচেয়ে দীর্ঘ আর সবচেয়ে জ্বলন্ত গ্রীষ্ম।

.

১৫.

গাফসা, তিউনিসিয়া

পল ট্রাউট দরদর করে ঘামছে। আজ বিকেলে প্রচণ্ড গরম পড়েছে। মাথায় বিশাল একটা সময়েরা (দক্ষিণ আমেরিকার চওড়া কিনারওয়ালা টুপি), তারপরও মনে হচ্ছে মুখটা ঝলসে যাচ্ছে। সূর্য আরেকটু নিচে নামতেই এবার সূর্যের রশ্মি সরাসরি ওর মুখে পড়ে চামড়ায় কামড় বসাতে লাগল। যেন বলতে চাইছে সাদা চামড়ায় ইংলিশ লোকজনের এদিকে থাকার যোগ্যতা নেই।

পলের উচ্চতা ছয় ফুট আট। এই দলটার মধ্যে ওই সবচে লম্বা। ওরা হচ্ছে একটা হাইকারের দল। একটা পাথুরে পাহাড় বেয়ে উঠছে ওরা। পথের ধারে একটা আগাছা পর্যন্ত নেই। দলের মধ্যে ও-ই অবশ্য সবচেয়ে হ্যাংলা। কয়েক কদম সামনেই হাঁটছে ওর স্ত্রী গামায়। সে এমন দক্ষতায় পাহাড় বেয়ে উঠছে যেন কুকুর নিয়ে বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছে। তার পরনে দৌড়বিদদের পোশাক আর একটা চামড়া রঙের গোল ক্যাপ। লাল চুল পনিটেইল করে পেছনে বাধা। সেটা আবার ক্যাপের ছিদ্র দিয়ে বাইরে বের করা। গামায় সামনে বাড়লেই ওটা এপাশ ওপাশ দুলছে।

পল কাধ ঝাঁকালো। পরিবারের কাউকে তো অন্তত শক্তিশালী হতেই হবে। আর কাউকে হতে হবে বাহানা বাজ। “আমার মনে হয় আমাদের একটু রেস্ট নিলে ভালো হয়।” বলল ও।

“কাম অন পল। আর অল্প একটু আছে। আর একটা পাহাড় পার হলেই তুমি পৃথিবীর সবচে নতুন লেকের অলৌকিক পানিতে গোসল করতে পারবে আর গাফসা বীচে রেস্ট নিতে পারবে।”

রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকেই গাফসা আর এর আশপাশের এলাকাটা ভ্রমণকারীদের জন্য তীর্থ স্থান। ঝরণা, হাম্মামখানা, আর আয়ুর্বেদিক পুকুরে এলাকাটা ভর্তি। বেশির ভাগই নানান ধরনের আজব আজব চিকিৎসা পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয়। পল আর গামায়ও এখানকার প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ নিয়ে গবেষণা আর বিখ্যাত কাসাবাহ খোঁজার ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন ঝরণা আর পুকুরে রিলাক্স করেছে।

“হোটেলেও যথেষ্ট অলৌকিক পানি ছিল।” পল মজা করল।

“হ্যাঁ, তবে ওসব লেকের পানি হাজার বছর ধরে ওখানে আটকে আছে। আর এই লেকটা মাত্র ছয় মাস আগে মাটি খুঁড়ে উদয় হয়েছে। তাতেও তোমার একটু কৌতূহল হচ্ছে না?”

পল একজন ভূতত্ত্ববিদ। বড় হয়েছে ম্যাসাচুসেটস-এ। সেখানে ওর প্রচুর সময় কেটেছে পানিতে সাঁতার কেটে আর বিখ্যাত উডস হোল সমুদ্রতত্ত্ব ইনস্টিটিউট এর আশেপাশে ঘুরঘুর করে। শেষমেশ ও স্ক্রিপস সমুদ্রতত্ত্ব ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়। আর মেরিন জিওলজিতে পি. এইচ ডি, লাভ করে। ওর গবেষণার বিষয় ছিল গভীর সমুদ্র তলের গঠন। সমুদ্র তলার ভূতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করার জন্য বেশ কিছু প্রযুক্তিও আবিষ্কার করেছে ও। তাই স্বাভাবিকভাবেই হঠাৎ করে বলা নেই কওয়া নেই মাটি খুঁড়ে একটা লেক উদয় হওয়ার ঘটনা তাকে কৌতূহলী করছে বটেই। কিন্তু ঘণ্টাখানেক রাস্তা নামক খানাখন্দে গাড়ি চালানোর পর তিরিশ মিনিট এই জ্বলন্ত সূর্যের তাপেই সে কৌতূহল উবে গেছে।

“এই তো চলে এসেছি।” গামায় চিৎকার করে বলল সামনে থেকে। পল বিস্ময়ের দৃষ্টিতে ওর স্ত্রীর দিকে তাকাল। ক্লান্তি বলে যে কোনো কিছু নেই ওর। সব সময় কিছু না কিছু করছেই। এমন কি বাসায়ও ওকে কখনো স্থির দেখা যায় না। ও ডক্টরেট করেছে মেরিন বায়োলজিতে। তবে এর বাইরে ও আরো অনেক বিষয়ে ওর ডিগ্রি আছে। বহু দিনের পরিচয়ের কারণে পল জানে, কোনো কিছুতে দক্ষতা এসে গেলেই গামায় এর কাছে সেটা আর ভালো লাগে না। তাই নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জ খুঁজে বেড়ায়।

একবার পলকে চোখ টিপে বলেছিল, পলকে নাকি বহু চেষ্টা করে যাচ্ছে সোজা করার। কিন্তু পল ওকে বারবার হতাশ করেই আছে। এটাই নাকি ওদের দীর্ঘ আর সুখী দাম্পত্য জীবনের রহস্য। আর দুজনেই অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়। এ কারণেই NUMA’র অ্যাডভেঞ্চারের পাশাপাশি নিজেরাও ছুটিছাটা পেলেই বেরিয়ে পড়ে কোথাও না কোথাও।

গামায় গাইডেরও আগে চূড়ায় পৌঁছে গেল। পৌঁছে থেমে কিছুক্ষণ চারপাশ দেখলো তারপর নিতম্বে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকল।

গাইডও সেখানে পৌঁছালো এক সেকেন্ড পর। কিন্তু তার চোখে প্রশংসার বদলে কেমন যেন সন্দেহ। মাথায় হ্যাট নামিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা চুলকাতে লাগল।

পলও চুড়াটার কাছে পৌঁছাতেই কারণটা ধরতে পারলো। যা ছিল পাথরে ঘেরা বিশাল একটা লেক, সেটা এখন প্যাঁচপেচে কাদায় ভর্তি ছোট্ট একটা ডোবায় পরিণত হয়েছে। মাঝখানে মাত্র দশ ফুট ব্যাসার্ধের একটা বৃত্তাকার জায়গায় কালচে একটু পানি জমে আছে। শুধু চারপাশের পাথরের গায়ে একটা মলিন দাগ দেখে বোঝা গেল পানি ঐ পর্যন্ত ছিল।

পলের পরেই আরো কিছু পর্যটক ওখানে পৌঁছালো। ওর মতো তারাও বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। এখানে আসার আগে এই জায়গাটার দুর্দান্ত কিছু ছবি দেখেছিল সবাই। মূলত সেটা দেখেই মরুভূমি পেরিয়ে এখানে আসা। সেই জিনিসের এই দশা কেউ আশা করেনি।

“কি বিশ্রী। আমাদের এলাকায় তো কেউ এখানে মাছও ধরবে না।” এক মহিলা বলল। কণ্ঠে দক্ষিণাঞ্চলের টান।

স্থানীয় যে গাইডটা ওদের নিয়ে এসেছে তাঁকে পুরোপুরি বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। “কিছুই তো বুঝতে পারছি না। এটা কীভাবে সম্ভব? দুদিন আগেও লেকের পানি ঐ পর্যন্ত ছিল।” পাথরের দাগ দেখিয়ে বলল লোকটা।

“বাষ্প হয়ে গেছে সব পানি। যা গরম এখানে।” স্কটল্যান্ডের এক পর্যটক বলল কথাটা।

কাদার দিকে তাকাতেই পল ওর সব ব্যথা বেদনা ভুলে গেল। ও জানে যে ওরা এক রহস্যের দিকে তাকিয়ে আছে। লেক হঠাৎ গজিয়ে ওঠাকে তাও মেনে নেয়া যায় কারণ আশে পাশে প্রচুর ঝরণা আছে। ঝরণার পানির ধাক্কায় প্রায়ই দেখা যায় এখানে সেখানে মাটি সরে পানি জমে যাচ্ছে। কিন্তু এক রাতে পুরো লেকই আবার উধাও হয়ে যাওয়া…সেটা সম্পূর্ণ আরেক জিনিস।

আশে পাশে ভালো করে দেখে লেকটার আয়তন আর গভীরতা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা নিয়ে নিলো। “এতোখানি পানি দুই দিন তো দূরে থাক দুই মাসেও বাষ্প হওয়া সম্ভব না।”

“তাহলে গেল কোথায়?” দক্ষিণী মহিলাটি জিজ্ঞেস করল।

“বোধহয় কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। এই এলাকায় এখন খরা চলছে।” স্কটিশ লোকটা জবাব দিল।

লোকটার কথা সত্য। উত্তর আফ্রিকার মধ্যে তিউনিসিয়ার অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ। কিন্তু এক হাজার ট্যাংকার ট্রাক আসলেও তো এতো বড়ো লেকের পানি ফুরোনোর কথা না। পল লেকের দেয়ালে কোথাও ফাটল আছে কি-না খুঁজতে লাগল। কিন্তু সেরকম কিছুই চোখে পড়ল না।

কোত্থেকে কিছু মাছি উড়ে এসে ভো ভো করতে লাগল চারপাশে। এর বাইরে আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না আশে পাশে। শেষমেশ দক্ষিণী মহিলা আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারলেন না। গাইড লোকটার কাঁধে টোকা দিয়ে ফেরার পথে হাঁটা দিলেন। তবে তার আগে বললেন, “মনে হয় কেউ বোধহয় এটার প্লাগ খুলে দিয়েছে। তাই এই অবস্থা।”

অন্যরাও তাদের অনুসরণ করল। কাদা ভরা গর্ত দেখার কারোর-ই খুব বেশি আগ্রহ নেই। গাইড পুরো বকবক করে বোঝানোর চেষ্টা করল দুইদিন আগেও লেকটা কিরকম পানিতে টইটম্বুর ছিল। আর তাই যদিও এখন এটা আর নেই কিন্তু পয়সা ফেরত দেয়া হবে না। পল অবশ্য ফিরতে একটু দেরি করল। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে। হঠাৎ একদল বাচ্চাকে দেখা গেল কাদা মাড়িয়ে লেকের শেষ পানিটুকু সংগ্রহের জন্য।

আর থেকে লাভ নেই, তাই পা চালিয়ে ফিরতি পথ ধরলো ও। গামায় এর কাছে এসে বলল, “মহিলার কথা কিন্তু ঠিক।”

“কোন কথা?”

“ঐ যে কেউ যেন প্লাগ খুলে দিয়েছে মনে হচ্ছে সেটা। এই ধরনের ঝর্ণাগুলো প্রায়ই দেখা যায় বিভিন্ন জলাধার থেকে সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণত মাটির নিচের পাথরগুলো যখন ভেঙে সরে যায় তখন ওটার মাঝে পানি আটকা পড়ে আর একটা লেক সৃষ্টি হয়। এখানেও সম্ভবত একই ব্যাপার ঘটেছিল। কখনো কখনো পানির প্রবাহ চলতেই থাকে অবিরাম আবার কখনো একবার পানি জমেই পানি আসা বন্ধ হয়ে যায়। তবে যদি এমন হয় যে পাথর আবারো সরে গিয়ে ঝর্ণার মুখ বন্ধ হয়ে গেছে তখনও সাধারণত পানি সেখান থেকে সাথে সাথে উধাও হয় না। আস্তে আস্তে সূর্যের তাপে পানি বাষ্প হয়ে লেকটা শুকিয়ে যায়। কিন্তু সেও কয়েক মাসের ব্যাপার। যেহেতু এই লেকটা হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেছে, তার মানে পানি আসলে অন্য কোথাও সরে গিয়েছে। কিন্তু জায়গাটা একটা বাটির মতো। এটার সাথে অন্য কোনো কিছুর সংযোগ নেই।”

“তার মানে যেহেতু একটা বাষ্প হয়নি বা আশে পাশে চলে যায়নি, সেহেতু এটা আসলে মাটির ভেতর ঢুকে গেছে। এটাই আপনার মত, তাই না মি. ট্রাউট” গামায় বলল।

পল মাথা ঝাঁকালো, “যেখান থেকে এসেছিল, সেখানেই ফিরে গেছে।“ “এরকম কখনো হয় নাকি? শুনেছো কখনো?”

“না। এরকম হতে কখনো শুনিনি আমি।” পল জবাব দিল।

হঠাৎ ওদের দিকে একটা লোককে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। লোকটাকে ওরা লেকের পাড়ে দেখেছিল। তবে ওদের পাড়ে না, অন্য পাশে। ওদের মতোই ছবি তুলছিল লেকটার। লোকটা কিছুটা খাটো। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি উচ্চতা। মাথায় একটা দোমড়ানো ক্যানভাসের হ্যাট। মুখে কয়েক দিনের না কামানো দাড়ি। কাঁধে ব্যাকপ্যাক, হাতে লাঠি আর গলায় ঝোলানো বাইনোকুলার দেখেই বোঝা যাচ্ছে ইনিও হাইকার। কিন্তু হাতে একটা হলুদ কালো চিহ্ন পলের নজর এড়ালো না। চিহ্নটা জরিপকারীদের প্রতীক।

কাছে এসে ক্যাপটা একটু ওপরে ঠেলে দিয়ে বলল, “হ্যালো। আমি পাশ থেকে লেকের পানি উধাও হওয়া সম্পর্কে আপনার মন্তব্যটা শুনে ফেলেছি। সারাদিন দেখলাম লোকজন আসছে, আর হতাশ হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে ফিরে যাচ্ছে। আপনাকেই প্রথম দেখলাম যে কি-না কি হয়েছে আর পানি কোথায় গিয়েছে তা নিয়ে ভাবতে। আপনি কি ভূতাত্ত্বিক নাকি?”

“ভূতত্ত্ব নিয়ে কিছু পড়াশোনা আছে। তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, “পল ট্রাউট। এই হলো আমার স্ত্রী গামায়।”

লোকটা পল আর গামায় দুজনের সাথেই হ্যান্ডশেক করল। তারপর বলল, “আমার নাম রেজা আল-আগ্রা।”

“কেমন লাগছে এখানে?” গামায় জিজ্ঞেস করল।

“খুব বেশি ভালো না।” স্বীকার করল রেজা।

পল জরিপকারীদের প্রতীকটা দেখিয়ে বলল, “আপনি কী লেকটার মাপজোক নিতে এসেছেন নাকি?

“সেরকম কিছু না আসলে। আপনার মতো আমিও চেষ্টা করছিলাম লেকের পানি কীভাবে আর কোথায় উধাও হলো বের করতে। তাই প্রথমেই চেষ্টা করছিলাম এখানে কতটুকু পানি ছিল সেটা খুঁজে বের করার।”

“আমরা অবশ্য মনে মনেই অনুমান করেছিলাম খানিকটা।” পল বলল। কাদা নিয়ে জরিপ ওর কাছে বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে।

“হ্যাঁ,…কিন্তু আমার আসলে শুধু অনুমান করে বলার সুযোগ নেই। আমি লিবিয়া সরকারের পানি সম্পদ বিভাগের পরিচালক। আমার তাই কাটায় কাটায় আসল হিসাব দরকার।”

“কিন্তু এটা তো তিউনিসিয়া।” গামায় ভুলটা ধরিয়ে দিল।

“জানি। কিন্তু আমিও সরেজমিনে দেখতে এসেছি। আমার পেশার দিক থেকে পানি উধাও হয়ে যাওয়া খুব খারাপ লক্ষণ।” রেজা জবাব দিল।

“মরুভূমির মধ্যে এটাতো একটা ছোট্ট লেক।” গামায় বললো আবার।

“হ্যাঁ, কিন্তু এটাই উধাও হওয়া একমাত্র লেক না। আমাদের দেশে প্রায় একমাস ধরে পানির পরিমাণ শুধু কমছেই। ঝর্ণা বাহিত লেকগুলো সব শুকিয়ে গিয়েছে। নদীর ধারাও শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গিয়েছে। দেশের সব মরুদ্যান শুকিয়ে কাঠ। কার্থেজদের আমল থেকে যেসব মরুদ্যান সতেজ ছিল সেগুলোও আজ শুকিয়ে গেছে। এত দিন ধরে তাও মাটি থেকে পানি পাম্প করে চালাচ্ছিলাম, কিন্তু ইদানীং পাম্পেও বেশি পানি আর উঠছে না। প্রথমে ভেবেছিলাম এটা বুঝি শুধু আমাদেরই সমস্যা কিন্তু এই লেকটার কথা শুনলাম সেদিন, তারপর আজ দেখে বিশ্বাস হলো যে যা ভেবেছিলাম ব্যাপারটা তার চেয়েও আরো অনেক বেশি জটিল। সম্ভবত ভূগর্ভস্থ পানির স্তর মারাত্মক নিচে নেমে গিয়েছে।”

“সেটা কীভাবে সম্ভব?” গামায় জিজ্ঞেস করল।

“কেউ জানে না। কিছু মনে না করলে এব্যাপারে আপনাদের সাহায্য কী পেতে পারি?” রেজা জিজ্ঞেস করল।

পল একবার তার স্ত্রীর দিকে তাকাল। চোখে চোখে কথা হলো দুজনের। “অবশ্যই। সাহায্য করতে পারলে খুশি-ই হবে। যদি আপনি আমাদেরকে হোটেলে পৌঁছার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারেন, তাহলে আমরা ওখান . থেকে আমাদের জিনিস পত্র নিয়ে আপনার সাথে যোগ দিতে পারি।”।

“চমৎকার। এই রাস্তার মাথাতেই আমার ল্যান্ড রোভারটা আছে।” হাসি মুখে বললেন রেজা।

.

১৬.

ভ্যালেটা বন্দর, মাল্টা

ভ্যালেটা বন্দরে আসলে মনে হবে যেন ভুল করে অতীতে চলে আসা হয়েছে। যখন মাল্টা শাসন করতে বেশ কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তি। আর এটার মতো একটা ক্ষুদ্র বন্দরও আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য আর ভূমধ্যসাগর নিয়ন্ত্রণের জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সী ড্রাগন বন্দরের মুখে ঢুকতেই দেখলো এটার চেহারা এখনো সেই স্বর্ণালি অতীতের মতোই ঝলমল করছে। উনিশ শ আশি, নব্বই, এমনকি সত্তরের দশকে জন্ম নিলেও কার্টের এখানে থাকতে কোনো আপত্তিই থাকতো না। সামনে তাকাতেই কার্থেলাইট গীর্জার গম্বুজ চোখে পড়ল। ওটার পিছনেই সূর্য ডুবছে। ওটার চারপাশ জুড়ে আরো অনেক প্রাচীন ভবন আর গীর্জা দাঁড়িয়ে আছে। শুধু এই বন্দরের নিরাপত্তার জন্যেই আলাদা রক্ষীদল আর চার চারটা দুর্গ তৈরি করা হয়েছিল। এখান থেকে এখনও চোখে পড়ে সেগুলো।

ফোর্ট মানোয়েল বানানো হয়েছে লম্বা খাড়িটার একটা বাকের মুখে। আর ফোর্ট সেইন্ট এলমো উপদ্বীপটার একদম মাথায় অবস্থিত। পাঁচ হাজার বছর বয়স হয়ে গিয়েছে এগুলোর। বাইরের পাথরের দেয়াল ক্ষয়ে গেছে, দেখতে ভয়ঙ্কর লাগে। ঠিক এটার উল্টোদিকে বন্দরের ডান দিকে হলো ফোর্ট রিকাসোলি। এই দুৰ্গটা দেখতে অন্যগুলোর চেয়ে কিছুটা আলাদা। আকারেও ছোটখাটো। এটার দেয়াল একেবারে বন্দরে ঢোকার মুখ পর্যন্ত বিস্তৃত। একটা ছোট বাতিঘরও আছে দেয়ালের শেষ মাথায়। আর একেবারে বন্দরের ভেতরের দিকে আছে ফোর্ট সেইন্ট অ্যাঞ্জেলো। একদম পানির কিনার থেকে সোজা ওপরে উঠে গেছে।

শুধু দুর্গগুলোই না এখানকার বাঁধ, দালালনকোঠা, বা প্রাকৃতিকভাবেই দুকূলে সৃষ্ট খাড়া তীর সবই একই রকম তামাটে পাথরে তৈরি। এ থেকেই বোঝা যায় মাল্টা একসময় শৌর্যে বীর্যে কতটা এগিয়ে ছিল।

এজন্যেই দেখে মনে হয় পুরো দ্বীপটাই বোধহয় একই সাথে একটাই পাথর কেটে কেটে বানানো হয়েছে। সবকিছুতে এতো মিল।

চারপাশ দেখতে দেখতে জো বিস্মিত হয়ে বলল, “ভেবে পাচ্ছি না বাইরের কারো পক্ষে এই দ্বীপ দখল করা কীভাবে সম্ভব?”

“নির্বোধ লোকদেরকে বোকা বানিয়ে। আর সেজন্য লাগে বিভ্রান্ত করা আর শয়তানি চাল। নেপোলিয়ন মিসর যাওয়ার পথে রসদপত্র কেনার উদ্দেশ্যে এই দ্বীপে আসেন। স্থানীয়রা দেখলো টাকা কামানোর এই সুযোগ, তাই তাঁকে বাধা দিল না। যেই না তার জাহাজ এই দুর্গের আওতার বাইরে চলে গেল ওমনি উনি মাটিতে সৈন্যবাহিনী নামিয়ে লোকদের ঘরে ঘরে আক্রমণ শুরু করলেন।” কার্ট বলল।

“এতো দেখি ট্রয়ের ঘোড়ার মতো অবস্থা, শুধু ঘোড়ার বদলে এখানে জাহাজ।” জো মন্তব্য করল।

সী ড্রাগন ইতোমধ্যে বন্দরের ভেতরের দিকে চলে এসেছে। নোঙ্গর করার জায়গা খুঁজছে। বন্দরের এই দিকটা অবশ্য বেশ আধুনিক। ছোট ঘোট ট্যাংকার থেকে তেল নামানো হচ্ছে, পাশেই কয়েকটা প্রমোদরী আর বিশাল দুটো মালবাহী জাহাজ। সী ড্রাগনও এগুলোর পাশেই থামল।

ঘাটে পুরোপুরি লাগার আগেই কার্ট আর জো লাফ দিয়ে জাহাজ থেকে নেমে তড়িৎ নেমে পড়ল রাস্তায়।

“দুজন লোককে সব সময় পাহারায় রেখো। আশেপাশে বিপজ্জনক লোকে ভরা।” যেতে যেতে চেঁচিয়ে বলল কার্ট।

“তোমাদের মতো নাকি সবাই?” রেনল্ডসও জবাব দিল চিৎকার করে। কার্ট হাসলো।

“বেশি ঝামেলা করো না। পুলিশে ধরলে জামিন করানোর টাকা কিন্তু নেই।” রেনল্ডস আবারও বলল।

কার্ট জবাবে কিছু না বলে হাত নাড়লো। ও আর জো যাচ্ছে মাল্টা সমুদ্ৰতাত্ত্বিক যাদুঘরের কিউরেটরের সাথে দেখা করতে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।

“কিউরেটর সাহেব কি এখনও আছে বলে মনে হয়?” জো জিজ্ঞেস করল। একটা ট্যাক্সি ধরার চেষ্টা করছে।

কার্ট আকাশের দিকে তাকাল। সন্ধ্যা হতে দেরি নেই। “বলতে পারছি না। থাকতেও পারে।”

ক্যাব ড্রাইভার দেখা গেল দারুণ পটু। গিজগিজে সরু সরু গলি ধরেও সবচে কম সময়ে ওদেরকে যাদুঘরের সামনে এনে নামিয়ে দিল। গেটের পাশেই গ্রিক সমুদ্র দেবতা পসাইডনের একটা মূর্তি।

ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে কার্ট আর জো সামনে বাড়লো। একপাশে নতুন কি যেন বানানো হচ্ছে। সেদিকটা ঘেরা। ওরা সেটা পেরিয়ে যাদুঘরের মূল ভবনের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো।

মূল ভবনটা এক কথায় দুর্দান্ত। দুপাশেই পাথরের সিংহ মূর্তি। সামনেটা দেখেই কাটের নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরির কথা মনে পড়ে গেল। দরজার কাছে পৌঁছাতেই সিকিউরিটি আটকালো ওদের। কার্ট আর জো নিজেদের পরিচয় আর আসার উদ্দেশ্য বলতেই সিকিউরিটি ভেতরে ফোন করল ওদের কথা জানানোর জন্যে।

কিছুক্ষণ পরেই দুই কনুইতে ছাপ্পাওয়ালা টুইডের জ্যাকেট পরা রাশভারী একজন লোককে দেখা গেল দরজায়।

কার্ট হাত বাড়িয়ে বলল, “ড. কেনসিংটন?”

.

“উইলিয়াম বললেই খুশি হবো,” হ্যান্ডশেক করতে করতে লোকটা বলল। লোকটা জাতিতে ইংরেজ তবে এখন এখানকার-ই নাগরিক। ব্রিটিশদের দখলকৃত সব এলাকাতেই এরকম অসংখ্য মানুষ দেখা যায়। দেরি করার জন্য দুঃখিত। আসলে হঠাৎ বাতাস পড়ে যাওয়ায় দ্বীপে পৌঁছাতেই দেরি হয়ে গিয়েছিল।” কার্ট বলল।

কেনসিংটন পেঁতো হাসি হাসলেন, “বাতাস সবসময়ই পড়ে যায়। এজন্যেই সম্ভবত মোটর বোট আবিষ্কার করা হয়েছে।”

কথাটায় সবাই হেসে দিল। কথা বলতে বলতে ওরা ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ল। কেনসিংটন পিছনের দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। তবে ফেরার আগে আবারও তিনি দরজায় লাগানো ফিনিশীয় জানালার একটা পাত টেনে সরিয়ে, বাইরের দিকটা দেখতে লাগলেন। তারপর সন্তুষ্ট হয়ে ওদেরকে মেইন হলে নিয়ে আসলেন। মেইন হলটাও দারুণ। অনেক খরচ করে বানানো বোঝ যায়। আগামী পরশু নিলামের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে দেখা গেল। সেটা ছাড়িয়ে ওরা কেনসিংটনের অফিসে চলে এলো। তৃতীয় তলার শেষ মাথায় একটা ছোট চারকোণা রুমে ওনার অফিস। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বিভিন্ন পুরাকীর্তি ম্যাগাজিন হাবিজাবি গাদাগাদি হয়ে আছে। ছোট্ট একটা জানালা একপাশে। তাতে গাটু কাঁচ বসানো।

“আঠারো শতকে এটা একটা আশ্রম হিসেবে ব্যবহৃত হতো।” কেনসিংটন ব্যাখ্যা করলেন।

তিনজন বসতেই বাইরে ফ্লাডলাইট জ্বলে উঠল। সাথে শোনা গেল যন্ত্রপাতির আওয়াজ। হাতুড়ি পিটানোর শব্দ আর মানুষের চিৎকার।

“এই রাতের বেলাও কাজ চলছে?” কার্ট প্রশ্ন করল।

“আসলে দিনে পর্যটকরা আসে। তাদের যাতে সমস্যা না হয় তাই রাতেই কাজ করা হয়। পুরো চত্বরটাই সংস্কার করা হচ্ছে।”

“সংস্কারটা রাস্তায় করলে আরো ভালো হতো। আরাম করে চলাচল করতে পারতাম।” জো বলল।

কার্ট কেনসিংটনকে ওর একটা কার্ড দিল।

“NUMA” কার্ডটা পড়তে পড়তে উচ্চারণ করলেন কেনসিংটন। “আপনাদের সাথে তো আগেও কাজ করেছি। এখনও মনে পড়ে মাঝে মাঝে। এবার কীভাবে সাহায্য করতে পারি?”

“আমরা আসলে নিলামের আগে যে একটা পার্টি হবে ওটা সম্পর্কে জানতে চাই।” কেনসিংটন কার্ডটা নামিয়ে রাখলেন, “হ্যাঁ। ব্যাপারটা দারুণ মজার হবে। পরশু রাতে নিলাম অনুষ্ঠান। তার আগে ক্রেতা আকর্ষণ করার জন্যে জিনিসগুলো ঝেড়ে মুছে সবাইকে একবার দেখানো হবে। আপনাদেরকে দাওয়াত দেয়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু এটা আসলে আগে থেকেই নির্ধারিত কিছু মানুষের জন্যে।”

“এই পার্টিতে হবে টা কি?”

“এখানে আসলে অতিথিরা ঠিক করতে পারবেন তারা কোনটা কিনবেন, আর একে অন্যের সাথে পরিচিতও হতে পারবেন, তাতে জানা হয় যে কার সাথে প্রতিযোগিতা করে তাকে জিনিসটা কিনতে হবে।” বলতে বলতে দাঁত বেরিয়ে গেল কেনসিংটনের, “একবার যদি দুজনের মধ্যে অহংবোধের লড়াই বেধে যায়, তাহলে আর ভাবতে হবে না। যে কোনো পুরাকীর্তির-ই আকাশচুম্বী দাম উঠে যায়।

“বুঝতে পারছি।” কার্ট বলল।

“শোনেন, একটা জিনিস গত একশো বা হাজার বছরেও কেউ দেখেনি, সেই জিনিস এক নজর দেখার জন্যে পকেটের পয়সা খরচ করতে কারো আপত্তি নেই।”

“হুম, আর যদি সেটা বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে তো পুরো পকেট উপুড় করে দিতেও আপত্তি হবে না।”

“ঠিক। আর এটা অবৈধ কোনো কাজও না। আর এটা যাদুঘরের উন্নতির স্বার্থেই করা হচ্ছে। আমাদের যাদুঘরটা ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। শুধু টিকিট বেচা টাকায় আমাদের পোষায় না। তাই সবকিছু চালাতে টাকা লাগবেই।” কেনসিংটন বললেন।

“যা যা জিনিস বেচবেন তার কি কোনো লিস্ট আছে?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ। কিন্তু আসলে আপনাকে দেখানো যাবে না। নিয়ম নেই। আর কিছু ঝামেলাও আছে।”

“নিয়ম?”

“আর কিছু ঝামেলা।” কেনসিংটন আবার বললেন।

“বুঝলাম না।”

কেনসিংটনের কপালে ঘাম জমেছে। আপনি তো সমুদ্রের নানা জিনিস উদ্ধার করেন। আপনি বুঝবেন। কিছু একটা উদ্ধারের ঘটনা জানাজানি হলেই জিনিসটা আসলে কার তা নিয়ে টানাটানি লেগে যায়। মনে করেন একটা

স্প্যানিশ জাহাজ থেকে স্বর্ণ উদ্ধার হলো। তাহলে সেটা আসলে কার হবে? উদ্ধারকারী দল বলবে এটা তাদের। স্প্যানিশরা বলবে ওদের জাহাজ অতএব ওদের। ইনকাদের বংশধররা বলবে আমরা মাটি খুড়ে এই স্বর্ণ বের করেছিলাম, এটা আমাদের। স্বর্ণ নিয়েই এতো গ্যাঞ্জাম, আর পুরাকীর্তির কথা বাদই দিলাম। শুনেছেন নাকি যে মিসর নাকি ইংল্যান্ডের কাছ থেকে রোজেটা পাথর ফেরত নেয়ার জন্য মামলা করবে? রোমের কাছে ল্যাটেরান ও বেলিস্কটাও ফেরত চাইবে। এটা আসলে ছিল কর্ণাক-এর আমুন এর মন্দিরের বাইরে। দ্বিতীয় কনস্টানটিয়াস ওটা নিয়ে যায়। তাঁর ইচ্ছা ছিল কনস্টানটিনোপল-এ নিয়ে যাওয়া। কিন্তু শেষমেশ রোমেই থেকে যায়।”

“তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন…”।

কেনসিংটন ভনিতা বাদ দিয়ে সরাসরিই বলে দিলেন, “জিনিসগুলোর অস্তিত্ব প্রকাশিত হবার সাথে সাথে কাড়াকাড়ি শুরু হবে। দুনিয়া ব্যাপী মামলা লড়ার আগে অন্তত একটা রাত আমরা আরামে থাকতে চাই।”

গল্পটা ভালোই। অর্ধেকটা সত্যি হলেও হতে পারে। তবে কেনসিংটন কিছু লুকাচ্ছেন। “মি, কেনসিংটন,..” কার্ট বলতে গেল।

“উইলিয়াম বলবেন প্লিজ।”

“এসব করার কোনো ইচ্ছে ছিল না কিন্তু আমার আর কোনো উপায় নেই।” কার্ট বলে ডা. আমব্রোসিনির দেয়া ছবিগুলো বের করে ডেস্কের ওপর ফেলল।

“কি আছে এই ছবিতে?”

“আপনি আছেন। আপনাকে অতটা ভালো দেখাচ্ছে না, তবে এটা যে আপনি তা পুরোপুরিই বোঝা যাচ্ছে। আজকেও একই জ্যাকেটটা পরে আছেন আপনি।”

“হ্যাঁ, এটা আমি, তো?”

“ছবিতে বাকি যাদেরকে দেখা যাচ্ছে, এরা যে ধরনের মানুষ, তাতে এদের সাথে তো আসলে আপনার ঘোরাঘুরি করার কথা না। আর আমার ধারণা এই ধরনের মানুষরাই আপনার পার্টিতে আসবে।”

কেনসিংটন ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

“কাউকে কি চিনতে পারছেন?” জো জিজ্ঞেস করল।

“এনাকে।” ডা. হ্যাগেনকে দেখিয়ে বললেন কেনসিংটন। “লোকটা নাকি সংগ্রাহক। বেশি বড় না, ছোট খাটো। যতদূর মনে পড়ে পেশায় ডাক্তার। আর এই দুজন ওনার সহকর্মী। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না এর সাথে

কার্ট কথা কেড়ে নিলো, “উনি একজন ডাক্তার সেটা ঠিক। তবে লোকটাকে গতকালের ল্যাম্পেডুসার সন্ত্রাসী হামলাটার জন্যে দায়ী হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে। বাকি দুজনও সম্ভবত এটার সাথে সম্পৃক্ত।”

কেনসিংটনের মুখ থেকে রক্ত সরে গেল। ঘটনাটা ঘণ্টায় ঘন্টায় টিভিতে দেখানো হচ্ছে। ভোপালের দুর্ঘটনার পর এটাই সবচেয়ে বড় বিপর্যয় নাকি এটা। “আমিতো সন্ত্রাসী হামলার ব্যাপারে কিছু জানিনা। আমিতো ভেবেছি যে জাহাজটা বিধ্বস্ত হয়েছে ওটার থেকে বের হওয়া কোনো রাসায়নিক পদার্থের কারণেই বোধ হয় এরকম হয়েছে।”

“বাইরের সবাইকে এ কথাই জানানো হয়েছে, তবে আসল ঘটনা সেটা না।” কার্ট বলল।

কেনসিংটন গলা খাকারি দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করলেন। ডেস্কের ওপর আঙুল বাজালেন, তারপর অযথাই একটা কলম নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। প্রচণ্ড অস্থির হয়ে গেছেন বোঝাই যাচ্ছে।

“আমি…আমি আসলে বুঝতে পারিছ না আপনারা কি জানতে চাচ্ছেন?” কথা আটকে যাচ্ছে তার। “লোকটার নামও আমার মনে নেই।”

“হ্যাগেন।” পাশ থেকে জো বলল।

“হা হা…হ্যাগেন।”

“আপনার দেখছি ভালোই ভুলো মন। এই ছবিটা যারা তুলেছে তারা আপনাকে তিনবার হ্যাঁগেনের সাথে দেখা করতে দেখেছে। লোকটা কি চায় সেটা কি অন্তত মনে আছে?”

কেনসিংটন জোরে নিশ্বাস ফেললেন তারপর এমনভাবে চারপাশে তাকাতে লাগলেন যেন সাহায্য খুঁজছেন। “লোকটা পার্টিতে আসার দাওয়াত চায়। কিন্তু আমি বলেছি পারবো না।”

“কেন?”

“বললামই তো এটা খুবই প্রাইভেট একটা বিষয়। শুধু কয়েক ডজন ধনকুবেরকে দাওয়াত দেয়া হয়। এরা সবাই যাদুঘরের পৃষ্ঠপোষক। ডা. হ্যাঁগেনের এখানে আসার যোগ্যতা নেই।”

কার্ট চেয়ারে হেলান দিল, “দুই লাখ ইউরো দিলেও না?”

কেনসিংটন অবাক হয়ে চাইলেন। মুহূর্তেই সেটা সামলে বললেন, “দশ লক্ষ হলেও না।”

কার্ট ভেবেছিল টাকাটা বোধ হয় পুরাকীর্তিটা কেনার উদ্দেশ্যেই পাঠানো কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অন্য উদ্দেশ্য আছে। “যদি লোকটা আপনাকে ঘুষ হিসেবে টাকাটা সেধে থাকে তাহলে একটা কথা মনে করিয়ে দেই, এই ধরনের লোকেরা সাধারণত শেষমেশ টাকাটা দেয় না। কাজ শেষে প্রমাণ রাখা এদের স্বভাব না। ওরা আপনাকে টাকাটা দেখাবে। হয়তো আগাম হিসেবে খানিকটা দিতেও পারে। কিন্তু যখনই তাদের কাজটা উদ্ধার হয়ে যাবে, টাকাটা খরচ করার জন্যে আপনাকে আর বাঁচিয়ে রাখবে না।”

কেনসিংটন কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলেন। যেন কার্টের কথাগুলো ভাবছেন। নীরবতা ভেঙে কার্টই কথা বলল আবার, “আর কথাটা আপনি নিজেও জানেন। এ কারণেই আপনি দরজা লাগিয়েও আবার উঁকি মেরে দেখছিলেন যে আযরাইল আশেপাশে আছে নাকি।”

“আমি…”

“আপনি আসলে ভাবছিলেন ওরা আবার আসবে। আপনি ওদেরকে ভয় পাচ্ছেন। বিশ্বাস করুন, ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।”

কেনসিংটন কৈফিয়তের সুরে বললেন, “আমি ওদেরকে কিছুই বলিনি। বলেছি চলে যেতে। কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন না, ওরা…”

কেনসিংটন চুপ মেরে গেলেন আর আবারো অস্থির হয়ে এটা ওটা করতে লাগলেন। তারপর নিচু হয়ে একটা ড্রয়ার খুলতে গেলেন।

“কি করেন?” কার্ট বলল।

“আমি বন্দুক বের করছি না।” কেনসিংটন বললেন। তারপর এন্টাসিডের একটা বোতল বের করলেন। প্রায় খালি হয়ে এসেছে সেটা।

“আমরা আপনাকে বাঁচাতে পারবো। আপনার যাতে কিছু না হয় সে ব্যবস্থাও করতে পারবো। কিন্তু সেজন্যে তো আগে আপনাকে আমাদেরকে সাহায্য করতে হবে।

কেনসিংটন বোতলটা থেকে কয়েক ঢোক ওষুধ খেয়ে নিলেন। এখন একটু সুস্থির লাগছে তাকে।

“আমাকে কিছু থেকেই বাঁচাতে হবে না। এটা কি মগের মুল্লুক নাকি? কোথাকার কোন সংগ্রাহক একটা পুরাকীর্তি কেনার জন্য আমার কাছে এসে কয়দিন ঘ্যান ঘ্যান করল আর আমি হয়ে গেলাম মস্ত বড় সন্ত্রাসী? গণ হত্যাকারী?”।

“আপনাকে কেউ সেই দোষ দিচ্ছে না। কিন্তু এই লোকগুলো এতে জড়িত। ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক আপনাকে ওদের সাথে দেখা গিয়েছে। দুই দিক দিয়েই আপনি বিপদে যাকে বলে মাইনকার চিপায়।”

কেনসিংটন কিছু না বলে কপাল ডলতে লাগলেন। বাইরে আরো একটা যন্ত্র চালু হলো। সারা ভবনে ছড়িয়ে পড়ল আওয়াজ।

কার্ট কেনসিংটনের মনের অবস্থা বুঝতে পারলো। কি করবে বুঝতে পারছে না লোকটা। এই শব্দ, এই টেনশন সবকিছু চেষ্টা করছে কপাল ঘষে তুলে ফেলতে।

“আমি আপনাকে সত্যি বলছি। আমি ঐ লোকগুলো সম্পর্কে কিছুই জানিনা। আপনাদের মতো ওরাও নিলামের কয়েকটা জিনিসের ব্যাপারে জানতে চেয়েছিল। কিন্তু এ সম্পর্কে মুখখোলা নিষেধ, তাই আমি না করে দেই। আপনি কি ভাবছেন জানিনা, তবে ওরা যেসব জিনিসের খোঁজ করছিল সেসব যে খুব আলাদা কিছু তেমন কিন্তু না। একদমই সাধারণ জিনিস।”

বাইরের যন্ত্রটা অবশেষে থামল। কেনসিংটনের হাত কাঁপছে। উনি একটা কলম চেপে ধরে তা থামানোর চেষ্টা করছেন।

কাগজে এলোমেলো দাগ দিতে দিতে বললেন, “খুব দামি কিছুও না। প্রাচীন মিসরের কিছু পুরাকীর্তি। এগুলো কি আসল না নকল তা-ও পরীক্ষা করা হয়নি।”

বাইরে এবার একটা ইঞ্জিন চালু হলো। খুব জোরে আর মারাত্মক শব্দ করছে ইঞ্জিনটা। শিরশিরানিতে কার্টের ঘাড়ের কাছের চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেল। সেগুলো নামানোর জন্যে মাথাটা বাঁকিয়ে হাত দিতেই দেখে জানালার পাশ থেকে একটা ছায়া সরে গেল।

“মাথা নামাল।” চিৎকার দিয়ে মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল কার্ট। একপাশের দেয়াল ভেঙে ভেতরে একটা ক্রেনের মাথা ঢুকে গেল। কালো আর হলুদ রঙ করা দণ্ডটা আরেকটু সামনে বাড়তেই কেনসিংটনসহ ওনার ডেস্কটা গিয়ে আটকালো পেছনের দেয়ালে। সাথে ভাঙ্গা কাঁচ আর তুলোয় ভরে গেল ঘর। দণ্ডটা কয়েক ফুট পিছনে ফিরতেই কার্ট কেনসিংটনের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে টেনে ক্রেনের সামনে থেকে সরিয়ে আনলো। পর মুহূর্তেই ক্রেনটা সেই জায়গায় পেছনের দেয়ালে একটা ফুটো করে দিল।

আরো একবার আঘাত করলো ক্রেন। মনে হলো ওপর থেকে ছাদ ভেঙে পড়বে।

“কেনসিংটন?” কার্ট ডাকলো লোকটাকে।

কেনসিংটনের চেহারা ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেছে। নাক ভেঙে গিয়েছে, ঠোঁট আর দাঁত গেছে থেতলে। দষ্টার মাথা সরাসরি লেগেছে মুখে। কার্টের ডাকে সাড়া না দিলেও শ্বাস পড়ছে বোঝা গেল।

কার্ট ওনাকে মাটিতে শুইয়ে দিতেই খেয়াল হলো হাতের মধ্যে মুচড়ে আছে একটা কাগজ। কাগজটা হাতে নিতেই শোনে জো চিৎকার দিল,

“মাথা নামাও।”

দণ্ডটা এবার পাশের দিকে আসছে। কার্ট কেনসিংটনকে আড়াল করে যতটা সম্ভব মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করল। দণ্ডটা ওদের ওপর দিয়ে গিয়ে পাশের দেয়ালটা ভেঙে ফেলল।

কিন্তু এবার দণ্ডের মাথাটা দেয়ালের একটা পাথরে আটকে গেল। কয়েকবার টানাটানি করল ছোটানোর জন্যে কিন্তু কাজ না হওয়ায় হাল ছেড়ে দিয়ে পুরো ক্রেনটাই বন্ধ হয়ে গেল।

কার্ট সাথে সাথে ভাঙ্গা দেয়াল থেকে নিচে উঁকি দিল। ক্রেনের ছোট গাড়িটায় একজন লোককে দেখা গেল ক্রেনটা আবার চালু করার চেষ্টা করছে, আর আরেকজনকে দেখা গেল সাব মেশিনগান হাতে পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। কার্টকে দেখতে পেয়ে লোকটা বন্দুক তুলে দ্রুত কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়লো। কার্টও সাথে সাথে মাথা সরিয়ে নেয়ায় বুলেটগুলো পাথরে লেগে ছিটকে গেল।

এদিকে জো ফোন করে সাহায্য চাচ্ছে। ফোন কানে থাকতেই আবারো শুনলো গুলির শব্দ।

শব্দ শুনে বোঝা গেল যে, গুলি এবার এদিকে করা হয়নি, অন্যদিকে। আবারো বাইরে তাকিয়ে দেখে আততায়ীরা পালাচ্ছে। ওপরের দিকে ফাঁকা গুলি ছুড়ছে যাতে লোকজন পথ থেকে সরে যায়।

“কেনসিংটনের খেয়াল রেখো। আমি দেখি ঐ ব্যাটাদের ধরা যায় কি না।” বলেই কার্ট ভাঙ্গা জানালাটা টপকে ক্রেনের দণ্ড বেয়ে নিচে নামতে লাগল। জো বাধা দেয়ার জন্যে কিছু বলতে গেলো কিন্তু তার আগেই কার্ট নেমে গেছে অনেকখানি।

.

১৭.

ক্রেনের দণ্ডটায় যে গোল গোল ছিদ্রগুলো ছিল ওগুলো ধরে ধরে কার্ট নেমে এলো নিচে। তিনজন লোক তখনও দৌড়াচ্ছে। হাতে বন্দুক। রাস্তার শেষ মাথায় একটা মাইক্রো ভ্যান দেখা যাচ্ছে। ওটাতেই উঠবে সম্ভবত। লাফ দিয়ে মাটিতে নামতেই বেশ কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে পড়ে আছে। সম্ভবত এরাই ক্রেনের আসল কর্মচারী।

এদিকে লোকগুলো ভ্যানে উঠে পড়েছে।

কার্ট এদিক ওদিক তাকাল পিছু নেয়ার মতো কিছু পাওয়ার আশায়। কাছেই একটা সিট্রোয়েন কোম্পানির মাটি টানা ট্রাক দেখা গেল। ট্রাকটার শরীর বেশ সরু কিন্তু লম্বায় বড়। আমেরিকায় হয়তো গাড়িটা অদ্ভুত লাগবে কিন্তু এখানকার চিকন চিকন রাস্তার জন্যে এটাই মানানসই।

দৌড়ে গাড়িটায় উঠল ও। ভাগ্য ভালো যে চাবি ওখানেই লাগানো আছে। ইঞ্জিন চালু হতেই বিন্দুমাত্র দেরি না করে গিয়ার তুলে ওটাকে নামিয়ে আনলে রাস্তায়। উদ্দেশ্য ভ্যানটার সামনে গিয়ে রাস্তা আটকাবে।

কিন্তু ছোট্ট গাড়িটাকে আটকানো গেল না কোনো মতেই। ওটা কার্টের ট্রাকটাকে পাশ কাটিয়ে ফুটপাতে ওঠে গেল তারপর আবার একশ ফুটের মতো গিয়ে রাস্তায় মেনে এলো।

কার্ট দ্রুত গাড়ি রিভার্স গিয়ারে দিয়ে উল্টোদিকে সরিয়ে নিলো। তারপর দ্রুত ঘুরিয়ে ভ্যানটার পিছু নিতে যেতেই দেখে যাদুঘরের গেটে জো।

“উঠে পড়ো!” চেঁচালো কার্ট।

জো উঠতেই কার্ট গ্যাস পেডাল একেবারে ফ্লোর বোর্ডের সাথে চেপে ধরলো। “আরও ছোট কিছু ভাড়া পাওনি?” জো জিজ্ঞেস করল।

“পেয়েছিলাম কিন্তু ওরা বোনাস হিসেবে এটাই দিল। বহুত পুরনো মেম্বার তো, ভালোই সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায়।”

“তা পুলিশ ধরলে কি সুযোগ সুবিধাগুলো কাজে লাগাবে?”

“সেটা নির্ভর করছে একটা জিনিসের ওপর।” কার্ট বলল।

“কোন জিনিসের ওপর?”

“আমরা ঐ শয়তানগুলোকে ধরতে পারবো কি পারবো না তার ওপর।” যত গর্জে ততত বর্ষে না’ প্রবাদটা প্রমাণ করতেই যেন, ট্রাকটা শব্দ করছে ভীষণ কিন্তু সেই তুলনায় বেশি একটা আগাচ্ছে না। মাইক্রো ভ্যানটার গতিও এমন আহামরি কিছু না কিন্তু জিনিসটা খুব সহজে রাস্তার এপাশ ওপাশ করতে পারছে। দূরতু তাই ক্রমশ বাড়ছেই। এই সামান্য গতির তুলনাতেই ট্রাকটাকে গদাই লশকর মনে হচ্ছে।

হঠাৎ রাস্তায় জটলা লেগে যাওয়ায় কার্টের ট্রাক ভ্যানটার প্রায় কাছেই চলে এলো কিন্তু ছোট ভ্যানটা কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাঁক-ফোকর গলে বেরিয়ে গেল। কার্ট আর কি করে। গাড়ির সব বাতি জ্বেলে হর্ণ চেপে ধরেই রইল যতক্ষণ পারে।

ওর অস্থির হর্ণ শুনে চলমান গাড়িগুলো রাস্তা ছেড়ে দিল, কিন্তু রাস্তার পাশে দাঁড় করানো গাড়িগুলোই বাধালো ঝামেলা। কার্ট প্রায় সবটাতেই ঢুশ মেরে মেরে এগুতে লাগল। একটারও আয়না আস্ত থাকল না।

টানা পাঁচটা আয়না ভাঙ্গার পর জো বলল, “আরে শেষেরটা তো মিস করলে।”

“ফেরার পথে ভাঙ্গবো ওটা।”

ফাঁকা রাস্তা পেয়ে আবারও গতি বাড়ালো কার্ট। তারপর জোকে জিজ্ঞেস করল, “তোমাকে না কেনসিংটনের সাথে থাকতে বললাম?”

“ওর সাথেই তো ছিলাম,” জো জবাব দিল।

“আমি বলেছিলাম সাহায্য আসার আগ পর্যন্ত থাকতে।”

“পরের বার তাহলে স্পষ্ট করে বলবে।”

আবারও ভ্যানটার কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা। সামনের রাস্তাটা একেবারে সমুদ্রের কিনারে গিয়ে থেমেছে। তারপর বেঁকে বন্দরের ধার ঘেষে ঘাটের দিকে চলে গিয়েছে। ভ্যানের একজনকে দেখা গেল গুলি করে ভ্যানের পেছনের কাঁচ ভেঙে ফেলল, তারপর ভাঙ্গা জানালা দিয়ে ট্রাকের দিকে গুলি করতে লাগল।

কার্ট বন্দুকের নল দেখা মাত্র মাথা নিচু করে ফেলেছে। পর মুহূর্তেই সামনের কাঁচ চুরচুর হয়ে ছিটকে পড়ল চারপাশে। গুলি থেকে বাঁচতে ও রাস্তার পাশের একটা গলিতে ঢুকে পড়ল। গলিটা আবার মূল শহরের দিকে ফিরে গিয়েছে।

“আমরা কিন্তু উল্টো দিকে যাচ্ছি।” জো মনে করিয়ে দিল। কার্ট সে কথা পাত্তা না দিয়ে গাড়ির স্পিড় আরো বাড়িয়ে দিল।

“এখন আমরা আরো দ্রুত উল্টো দিকে যাচ্ছি।” জো বলল আবার।

“শর্টকাট মারছি। এখানকার সমুদ্র তীরটা একেবারে হাতের পাঞ্জার মতো। এই শালারা যাচ্ছে আঙুলের ধার ঘেষে। আর আমরা এতো ঝামেলায় না গিয়ে সরাসরি তালু বরাবর যাবো।” কার্ট ব্যাখ্যা করল।

“অথবা হারিয়ে যাবো। তোমার কাছে কোনো ম্যাপ নেই।”

“ম্যাপ লাগবে না। বন্দরটা বামে রাখতে হবে শুধু।” কার্ট জানালো।

“হুম। ব্যাটারা এখন উল্টোদিকে না ঘুরলে হয়।”

বন্দরের আশেপাশের সব দুর্গ বা গুরুত্বপূর্ণ ভবনের ছাদেই ফ্লাডলাইট লাগানো। ফলে বন্দরটা নজরে রাখতে কোনো সমস্যাই হয় না, আর আলোর কারণে নিচের রাস্তাগুলো ভালোই দেখা যায়।

.

“ঐ যে।” একদিকে আঙুল তুলে দেখালো জো।

কার্টও দেখেছে। মাইক্রো ভ্যানটা তখনও ছুটছে। এখন আরও দ্রুত গতিতে। ড্রাইভারের ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই নেই।

ঢালু রাস্তা বেয়ে নামা শুরু করতেই ট্রাকটা ভয়ানক বেগে ছুটতে আরম্ভ করল। সাথে শুরু হলো ঝাঁকুনি। ঝকির চোটে পিছনে লেগে থাকা সব কীটের গুঁড়ো আর ধুলোবালি সব উড়া আরম্ভ করল। সেই সাথে ইঞ্জিনের ভো ভে তো আছেই।

গাড়িটা সামনের চৌরাস্তার দিকে ছুটছে। ভ্যানটাও এই চৌরাস্তাতেই আসবে একটু পর।

“কি করতে চাচ্ছ?” জো জিজ্ঞেস করল।

“রোমানদের মতো বায়স বিদ্ধ করবো।”

জো ব্যস্ত হয়ে সিটবেল্ট খুঁজতে গিয়ে দেখে নেই সেটা।

“লাগালোও ও…।”

ট্রাকটা প্রচণ্ড বেগে সমতল রাস্তায় এসে উঠল কিন্তু ভ্যানটার গায়ে লাগল না। নামার সময় ট্রাকটার গতি বেশিই বেড়ে গিয়েছিল, ফলে কার্টের হিসেবে গরমিল হয়েছে। এখন ওরাই উল্টো ভ্যানের আগে চলে এসেছে।

“আমরা তো এখন সামনে চলে এসেছি দেখি। আমাদের তো ধাওয়া দেয়ার কথা।” জো বলল।

“তো কিছু একটা করো।”

ঐ মুহূর্তে জো এর মাথায় একমাত্র যুক্তিসঙ্গত যে চিন্তাটা আসলো, ও সেটাই করল। ট্রাকের পিছনের অংশটা আটকানোর যে হাতলটা ছিল সেটা টেনে দিল। সাথে সাথে অংশটা কাত হয়ে গেল আর পুরো কয়েক হাজার পাউণ্ড ভাঙ্গা ইটের টুকরো, মাটি, লোহালক্কর রাস্তায় গড়িয়ে পড়ল।

ভাঙ্গাচোরা জিনিসের স্রোত সরাসরি দ্রুত গতিতে ছুটে আসা ভ্যানটার গায়ে গিয়ে পড়ল আর সামনের দিকটা ছাড়িয়ে একেবারে ভ্যানের ছাদে গিয়ে উঠল। সামনের গ্রিল আর রেডিয়েটর ভেঙে গেল সাথে সাথেই। সামনের কাঁচও ভেঙে ঢুকে গেল ভেতরে। আর ভ্যানটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে একদিকে কাত হয়ে রাস্তার পাশে উল্টে গেল।

কার্ট এবার সমগ্র শক্তি দিয়ে ব্রেক চেপে ধরলো আর ট্রাকটা কয়েক ফুট পিছলে গিয়ে তারপরে থামল। কার্ট লাফিয়ে নেমেই উল্টানো গাড়িটার দিকে ছুটলো। জোও নামলো পিছু-পিছু হাতে একটা বাঁকানো লোহার দণ্ড।

গাড়িটার কাছে গিয়ে দেখে রেডিয়েটর দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। আর গাড়ির একটা অংশও আস্ত নেই। পুরোটা এবড়োখেবড়ো হয়ে গিয়েছে। বাতাসে গ্যাসোলিনের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।

একবার ভেতরে তাকাতেই বুঝলো পিছনের সিটে বসা লোকটা মারা গিয়েছে। জানালা গলে ইটের বড় একটা টুকরা মাথাটা থেতলে দিয়েছে। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো ভেতরে আর কেউ নেই।

“বাকিরা গেল কোথায়?” জোর জিজ্ঞাসা।

অনেক সময় এভাবে গাড়ি উল্টে গেলে গাড়ি থেকে শরীর ছিটকে বের হয়ে যায়। কিন্তু আশেপাশে তাকিয়েও কার্ট কাউকে দেখতে পেল না। তারপর কিছু দূরেই দেখা গেল দুটো অবয়ব ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। ফোর্ট সেইন্ট এঞ্জেলোর দিকে এগুচ্ছে।

‘কেডস পরে এসেছ তো? দৌড় কিন্তু শেষ হয়নি।” লোক দুটোর দিকে দৌড় দিয়ে জো’কে বলল কার্ট।

.

১৮.

ডা. হ্যাগেন প্রাণপণে দুর্গের দিকে ছুটছে। আতঙ্ক গ্রাস করেছে তাকে। সবকিছুই আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়েছে। কেনসিংটনের অফিসে লাগানো লুকানো মাইক্রোফোনে NUMA’র লোকটার সাথে আলাপচারিতার সবটাই শোনে ও। ভয় পেয়ে যায় যে কেনসিংটন সব ফাস করে দেবে। তাই ওসাইরিস থেকে লোকগুলোকে বলে বেশি কিছু ফাস করার আগেই কেনসিংটনকে সরিয়ে দিতে হ্যাগেন নিশ্চিত ছিল যে কাজটা হবেই। কিন্তু সেটা করতে যেতেই শুরু হলো একের পর এক ঝামেলা : ধাওয়া খেয়ে পালানো, দুর্ঘটনা, গাড়ি উল্টানোর সময় বন্দুক হাত ছাড়া হয়ে যাওয়া।

“আমাদের সাহায্য দরকার। কাউকে ফোন দাও।” চেঁচিয়ে বলল হ্যাগেন। ভাগ্য ভালো যে অন্য লোকটার কাছে এখনো একটা রেডিও রয়ে গেছে। সে ওটা কোমর থেকে খুলে দৌড়াতে দৌড়াতেই কথা বলতে লাগল।

“শ্যাডো, ট্যালন বলছি। একটা ঝামেলা হয়েছে। আমাদেরকে উদ্ধার করার জন্যে লোক পাঠাও।

“কি হয়েছে ট্যালন?” অপর প্রান্তের লোকটা বিরক্ত হয়েছে বোঝা গেল।

“কেনসিংটন আমেরিকার দুটোর সাথে দেখা করেছে। ওসব ফাস করে দিচ্ছিলো। তাই ওকে সরিয়ে দিয়েছি। এখন আমেরিকান দুটো আমাদের ধাওয়া করছে।”

“তো ওদেরকেও সরিয়ে দাও।”

“সম্ভব না। ওদের কাছে অস্ত্র আছে।” কথাটা মিথ্যা কিন্তু এখন মিথ্যা বলা ছাড়া উপায় নেই। “আমরা আহত। একজন মারা গিয়েছে। আমাদেরকে নিতে কাউকে পাঠাও।”

ফোর্ট সেইন্ট অ্যাঞ্জেলো কাছিয়ে এসেছে। চারপাশের উজ্জ্বল স্পট লাইটগুলোর কারণে ওটার গা থেকে কেমন কমলা আভা বেরুচ্ছে। যতই ওরা দুৰ্গটার কাছে যাচ্ছে ওদের নিচের মাটির রঙ আরো বেশি উজ্জ্বল হচ্ছে। ঠিক যেন টাইমস স্কয়ারের ভেতর দিয়ে দৌড়াচ্ছে। কিন্তু ওদের এখন এসব খেয়াল করার সময় নেই। বাঁচতে হলে দ্রুত দুর্গের দেয়ালের ভেতর ঢুকতে হবে।

“কি বলল ও?” হ্যাগেন আবার চেঁচালো।

“শ্যাডো, শুনতে পাচ্ছ?”

কিছুক্ষণ বিরতির পর আবার শোনা গেল কণ্ঠস্বর। “খাড়ির মুখে নৌকা থাকবে। যারা ধাওয়া করছে ওদের ব্যবস্থা করে তারপর সাঁতরে এসে নৌকায় উঠবে। এবার যেন আর ভুল না হয়। হলে কি হবে তা খুব ভালো করেই জানো।”

হ্যাগেনও কথাটা শুনেছে। এমনটা ও আশা করেনি। তবে নাই মামার চেয়ে কানা মামা তো অন্তত ভালো। দুর্গে ঢোকার ঢালু পথটায় ওঠার পর ওর গতি কমে গেল। হাফাচ্ছে। ট্যালন সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই দৌড়ে চলে গেল। ওর স্বাস্থ্য হ্যাঁগেনের চেয়ে ভালো। আর হ্যাগেন ধরা পড়ল কি পড়ল না তাতে ওর কিছুই যায় আসে না।

.

১৯.

কার্ট আর জো-ও সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে আততায়ী দুজনকে ধরে ফেলার। কিন্তু ওরা দুজন আগেই অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। এবং দুর্গে পৌঁছেই ভেতরে উধাও হয়ে গিয়েছে।

কার্ট ঢালু পথটা পর্যন্ত ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পার হলো। পাশেই জো।

কিন্তু দুর্গের আলোর কাছে আসতেই গতি কমিয়ে দিল। কমলা আভা আর ছায়ার কারণে আশপাশটা ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার থেকে কেউ ওর ওপর ঝাঁপ দেয় এটা কার্ট চাচ্ছে না।

এই পাশ থেকেও দুর্গটাকে দারুণ জমকালো মনে হচ্ছে। পুরো দালানটা তৈরি ভ্যালেটা বন্দরের ভেতর ঢুকে পড়া এক ফালি জমিতে। দেখতে অনেকটা বিয়ের কেক-এর মতো। কিন্তু দেয়ালগুলো গোল না বরং বিভিন্ন দিকে বাঁকানো। ফলে কেউ যখন আক্রমণ করতে চাইতো তখন বুঝে পেতো না ঠিক কোথায় গুলি করবে।

কার্ট গতি আরও কমালো। ওর ডানেই দুর্গ আর বামে বন্দর। ওর একটা তালামারা দরজা চোখে পড়ল। তারপাশেই একটা সরু সিঁড়ি একটা চিকন নালার মতো করে দুর্গের ভেতর ঢুকে গিয়েছে। সিঁড়ির মুখেও গেট আছে। তবে কার্ট এক নজর দেখেই বুঝলো যে লোক দুটো এদিকেই গিয়েছে।

“তালা ভেঙে ঢুকেছে।”গেটটা খুলতে খুলতে বলল কার্ট। তারপর ওপরে এক ঝলক তাকিয়েই ওঠা শুরু করল। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে এগুচ্ছে। কিন্তু একদম শেষ মাথায় একজন ওকে আক্রমণ করে বসলো। হাতে তরবারি।

কার্ট একপাশে ঝাঁপ দিয়ে আঘাতটা এড়ালো। তারপর গড়ান দিয়ে সোজা হতেই দেখে জো চলে এসেছে। তরবারিওয়ালা এক কদম পিছিয়ে গেল তারপর একবার জো আর ওর হাতের বাঁকানো লোহাটা আরেকবার কার্টের দিকে তাকাতে লাগল।

কার্টের নজরে পড়ল দুর্গের ইতিহাসের প্রদর্শনীর অংশ হিসেবে দেয়ালের পাশেই ধাতব বর্ম আর অস্ত্রপাতি রাখা। লোহার একজোড়া দস্তানা পড়ে আছে। মাটিতে। তরবারিটা ওটার ভেতরেই ছিল।

লোকটা তরবারিটা একবার কার্ট আরেকবার জোর দিকে তাক করতে লাগল। কার্ট ওকে চিনতে পারলো।

“আরে! এ যে দেখছি ডা. হ্যাগেন। এমন বীরপুরুষ যে কি-না এক দ্বীপ ভরা লাশ ফেলে পালিয়েছে।”

“তুই আমার সম্পর্কে কিছুই জানিস না।” ঘোত ঘোত করে বলল হ্যাগেন।

“এইটুকু জানি যে তোর কাছে একটা প্রতিষেধক আছে যেটা দিলে। ল্যাম্পেডুসার লোকজন ভালে হয়ে যাবে। যদি সময় মতো বলিস তাহলে অন্তত ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচতে পারবি।”

“চোপ।” চিৎকার করে উঠল হ্যাগেন। তারপর কার্টের দিকে আক্রমণ করার ভান করে জো-এর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিশাল একটা অর্ধবৃত্ত রচনা। করে চালালো তরবারি।

বাতাসে শিষ কেটে ফলাটা জোর দিকে ধেয়ে গেল। কিন্তু জো দারুণ দক্ষতায় সেটা পাশ কাটিয়ে লোহার দণ্ডটা দিয়ে বাড়ি দিল। ঝনাৎ করে শব্দ হয়ে আশে পাশে স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল।

“এতো দেখি পুরো মধ্যযুগীয় বর্বরতা।” জো বলল।

হ্যাগেন আবারো সামনে বাড়লো। জোর দিকে তরবারি চালিয়েই যাচ্ছে যাতে ও সিঁড়ির দিকে হেলে গড়িয়ে পড়ে যায়। কিন্তু জো সব আঘাতই ফিরিয়ে দিল। শেষমেশ হ্যাঁগেনের তরবারিতে জোরে একটা বাড়ি দিয়ে ওর বুকে একটা লাথি কষালো। হ্যাগেন উল্টে পড়ে গেল কিন্তু সাথে সাথেই উঠে দাঁড়িয়ে গেল। আবার লড়াই করতে প্রস্তুত।

“তুমিতো দেখি এই জিনিস ভালোই চালাতে পারো।” কার্ট বলল, “প্রতিটি স্টার ওয়ার্সের সিনেমা কয়েকবার করে দেখা আমার।” গর্ভ ভরে বলল জো।

“তারমানে এটাকে তো তুমি একলাই সামলাতে পারবে?”

“তা আর বলতে। তুমি এর সাথেরটাকে খুঁজে বের করো। ততোক্ষণে আমি এটাকে প্যাকেট করে ডেলিভারির জন্য রেডি করে ফেলি।”

কার্ট চলে যেতেই জো এবার ওর শত্রুর মুখোমুখি মোকাবেলা করতে দাঁড়ালো। এখন আর দণ্ডটা ও তরবারির মতো এক হাতে ধরে নেই। বরং দুই হাতে ধরে রেখেছে।

হ্যাগেন আবারো তরবারি চালালো কিন্তু জো এক প্রান্ত দিয়ে সেটাকে ঠেকিয়ে অন্য প্রান্ত দিয়ে সজোরে মুখে মারলো হ্যাঁগেনের। নাক ফেটে রক্ত বেরুলো সাথে সাথে।

“ডাক্তাররা ইঞ্জেকশন দেয়ার সময় কি বলে বলোতো? বলে যে “একটুও ব্যথা লাগবে না।” জো বলল, “তবে আজকে কিন্তু সেরকম কিছু হবে না, আজকে ভালোই ব্যথা লাগবে।”

হ্যাগেন সামনে এগিয়ে পাগলের মতো তরবারি নাড়তে লাগলো। সাথে গালাগালি এমনকি থুতু মারছে জোর উদ্দেশ্যে।

এদিকে জো একদমই ঠাণ্ডা আর ধীরস্থির। একজন প্রশিক্ষিত যোদ্ধার মতোই ওর নাড়াচাড়া। প্রতিটা পদক্ষেপ মাপা আর নিখুঁত। ফলে হ্যাঁগেনের তরবারির একটা আঘাতও জো-র শরীরে লাগল না। জো শান্তভাবে প্রতি আক্রমণ করল, দণ্ডটার এক প্রান্ত দিয়ে মারার ভান করে অন্যপ্রান্ত দিয়ে মারলো।

“আমি শুধু স্টার ওয়ার্স-ই দেখি না। এরল ফ্লিন-এরও বড় ভক্ত।” সাবধান করল জো।

“এরলল ফ্লিনটা কে?” হ্যাগেন বলল।

“এরলকে চেনো না?”

হ্যাগেন জবাব দিল না তবে জো আবার আক্রমণ করল। দণ্ডের একপ্রান্ত দিয়ে ডাক্তারকে খোঁচা দিয়ে পেছনে ঠেলে তারপর অন্যপ্রান্তটা সজোরে নামিয়ে আনলো ওর কাঁধে। হাড্ডি ভাঙ্গার মট আওয়াজ পাওয়া গেল আর প্রচণ্ড ব্যথায় ডাক্তার ঝাঁকিয়ে উঠল।

“আমি নিশ্চিত এটা হিউমেরাস (বাহুর হাড়)। আর এটাও নিশ্চিত যে খুব বেশি মজা লাগেনি তোমার।”

হ্যাগেন ঘোঁত ঘোত করে উঠল, “বলদ, এটা আমার ক্লাভিকন।” ডানা ভাঙ্গা পাখির মতো একদিকে হেলে পড়েছে হ্যাগেন।

“হায় হায়! আচ্ছা আরেকবার চেষ্টা করি।” বলে আবার মারার জন্যে দণ্ডটা তুললো জো।

“না না! আমি হার মানছি। আর মেরো না।” তরবারি ফেলে দিয়ে বলল হ্যাগেন।

হ্যাগেন হাঁটু মুড়ে বসে ওর কাধ চেপে ধরে হাঁপাতে লাগল। ব্যথায় গোঙ্গাচ্ছে। কিন্তু জো সামনে আসার চেষ্টা করতেই আরেকবার শয়তানি করার চেষ্টা চালালো। পকেট থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করে জোর পায়ে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল হ্যাগেন সেটা দেখতে পেয়ে সজোরে লাথি চালালো আর সেটা উল্টো ডাক্তারেরই উরুতে গিয়ে বিধলো।

সিরিঞ্জে যা-ই থাক সেটা একদম সাথে সাথে কাজ করা আরম্ভ করল। হ্যাগেন চোখ উল্টে ওঠে ভাঙ্গা কাঁধের দিকেই ধপাস করে পড়ে গেল।

“ধুর! এখন শলাকে আবার ঘাড়ে নিতে হবে।” জো বলল নিজেকেই। পাশে বসে হাতের পালস চেক করল। আছে পালস। ও ঊরু থেকে সিরিঞ্জটা খুলে সুই ভেঙে ফেলল। তারপর পকেটে রেখে দিল। পরে পরীক্ষা করে দেখা যাবে ভেতরে কি আছে।

.

এদিকে কার্ট সতর্ক পদক্ষেপে বাকি লোকটাকে খুঁজছে। ওর ধারণা লোকটার হয় গুলি শেষ হয়ে গেছে না হয় অস্ত্রটাই হারিয়ে ফেলেছে। কারণ এতোক্ষণ হয়ে গেল একটা গুলিও করেনি। তারপর মানে এই না যে লোকটা কোথাও ওঁত পেতে নেই।

সামনে বাড়তেই আরেকটা সিঁড়ি থেকে হালকা পদশব্দ শুনতে পেল। কার্ট সাথে সাথে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে কোণা দিয়ে উঁকি দিল। কিন্তু সিঁড়িটা প্যাচানো। সিঁড়িগুলো লম্বা হলেও পাথরের দেয়ালের কারণে একবারে কয়েকটার বেশি সিঁড়ি চোখে পড়ে না।

কার্ট নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। শোনার চেষ্টা করছে। প্রথম কয়েক সেকেন্ড কিছুই শোনা গেল না। তারপর হঠাৎই কেউ হুড়মুড় করে শেষ কয়েকটা ধাপ উঠে গেল।

কার্ট ডিগবাজি দিয়ে সিঁড়ির সামনে পড়ে ওপর দিকে উঠে গেল। তিরিশটা ছোট ছোট সিডি প্যাঁচ খেয়ে ওপরে উঠে গিয়েছে। আঠারো শতকের মানুষজনের জন্য বানানো এগুলো লম্বায় আর বহরে দুদিকেই ছোট ছিল তারা। কার্ট যতটা সম্ভব দ্রুত সিঁড়িটা পার হয়ে এসে দেখে একজন লোক দুর্গের বারান্দা ধরে সোজা দৌড়ে যাচ্ছে।

লোকটা বারান্দার শেষ মাথার দিকে দৌড়াচ্ছে। যেখানে একসারি প্রাচীন আমলের কামান বসানো। মুখগুলো সব সাগরের দিকে। কার্টও সাথে সাথে পিছু ধাওয়া করল। মাঝখানে একটা ছোট দেয়াল লাফিয়ে পার হলো। তারপর বিশাল বড় একটা সভাকক্ষ। সেটা পার হতেই লোকটাকে আবার দেখা গেল। কার্ট প্রায় কাছাকাছি পৌঁছেই গিয়েছিল, কিন্তু লোকটা দেয়াল থেকে প্রায় আট ফুট নিচে লাফিয়ে পড়ল।

কার্টও দেয়ালটার কাছে পৌঁছে ওটা থেকে লাফিয়ে পড়ল। পতনের ধাক্কা সামলে উঠে দাঁড়িয়ে লোকটা ইতোমধ্যে চল্লিশ ফুটের মতো এগিয়ে গিয়েছে পরের দেয়ালটা থেকে লাফ দিচ্ছে। কার্ট দেয়ালের কাছে পৌঁছে দেখে এটার উচ্চতা প্রায় দশ ফুট।

“ধুর। শেষমেশ এই পাহাড়ি ছাগলটাই কপালে জুটলো।”

এখান থেকে লাফ দিলে একটা ঢালু জায়গায় নামতে হবে। কার্ট একপা পিছিয়ে এসে লাফ দিল। নিরাপদেই অবতরণ করে, আবার শুরু করল ধাওয়া।

লোকটাও দৌড়াচ্ছে। সামনেই আরেকটা দেয়াল। এটা একদম দুর্গের সবচেয়ে সামনের দেয়াল। এরপরই বন্দর। এখন পর্যন্ত ওরা বিয়ের কেকটার একদম চূড়া থেকে দুটো ধাপ নেমে এসেছে। এটাই শেষ ধাপ। তার মানে এই দেয়ালটার ওপাশে মাটি কমপক্ষে সতুর-আশি ফুট নিচে হবে। আর সেখানে শুধু হা করা পাথর।

লোকটাও সম্ভবত ব্যাপারটা ধরতে পারলো। তাই দেয়াল বেয়ে উঠে যাওয়ার আগ মুহূর্তে থমকে দাঁড়ালো। একমুহূর্ত কার্টকে দেখলো, তারপর কি ভেবে আবার দেয়াল বেয়ে উঠে দিল নিচে ঝাঁপ। কার্ট জীবনে প্রথম কাউকে এভাবে আত্মহত্যা করতে দেখলো।

কার্টও দ্রুত পৌঁছে গেল দেয়ালে। আশা করেছিল নিচে তাকিয়ে দেখবে যে পাথরের ওপর একটা ফেলানো লাশ পড়ে আছে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলো দেয়ালের ওপাশে পাথরের মধ্যে চৌকো একটা নালার মতো আছে। আর লোকটা শুধু যে বেঁচে আছে তাই না। এই মুহূর্তে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নের মতো দূরের একটা ট্রলারের দিকে সাঁতরে যাচ্ছে।

চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া ওর আর কিছুই করার ছিল না। লোকটা ট্রলারের কাছে পৌঁছামাত্র কয়েকজন তাকে টেনে তুললো আর সাথে সাথে ট্রলারটা রাতের আঁধারে হারিয়ে গেল।

“কি হয়েছে?” এক স্তর ওপর থেকে একটা কণ্ঠ ডাকলো ওকে। কার্ট দেখলো জো ডা. হ্যাঁগেনের ঘাড় ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

“লোকটা পালিয়ে গিয়েছে। কিছুই করার ছিল না।” কার্ট বলল।

“অন্তত এই ব্যাটাকে তো আটকানো গিয়েছে।” জো জবাব দিল। জোর কথা শেষ না হতেই তীক্ষ্ণ একটা শব্দ হলো কোথাও আর ডা. হ্যাগেন হাঁটু ভেঙে কাত হয়ে পড়ে গেল। কার্ট আর জো দুজনই লাফ দিয়ে আড়ালে সরে গেল কিন্তু আর কোনো গুলির শব্দ পাওয়া গেল না।-কার্ট আড়ালে থেকেই উঁকি মেরে বাইরে দেখার চেষ্টা করল। ও আর জো আড়াল থেকে বের না হয়েই চিৎকার করে কথা বলতে লাগল।

“জো, ঠিক আছো তুমি?”

“হ্যাঁ, কিন্তু ডা. হ্যাগেন মারা গিয়েছে।” জো’র কণ্ঠ মনমরা।

“কার্টও সেরকম-ই ভেবেছিল, “ধ্যাৎ, এতো কষ্ট বৃথা গেল।”

“গুলি কোত্থেকে করেছে দেখেছো নাকি?”

জো যেহেতু ওপরের তলায় ছিল, আর শব্দের প্রতিধ্বনিটার ধরন শুনে মনে হয় গুলিটা করা হয়েছে পানির দিক থেকে। সে হিসেবেই বলল, “বন্দরের ওপাশ থেকে সম্ভবত।”

তারপর ঝুঁকি নিয়েই মাথা উঁচিয়ে চট করে সেদিকে একবার নজর বুলালো। ট্রলারটা নেই। আর ওটার ওপর দাঁড়িয়ে এত দূর গুলি করাও যেতো না। ওপাড়ে কিছু দালানকোঠা আছে। অন্য দুৰ্গটার কামানগুলোও এ মুখো করা।

“ওপাড় তো কমপক্ষে এক হাজার ফিট।” জো বলল।

“একে অন্ধকার, তার সাথে বাতাসও কম। দারুণ নিশানা।” কার্ট বলল।

“তাও একেবারে প্রথমবারেই।” জো যোগ করল।

ব্যাপারটা এমন না যে ওরা ভয় পাচ্ছে, ওরা আসলে ওদের শত্রুর প্রকৃতিটা বের করতে চাচ্ছে।

“আর আমাদের বদলে ওদের নিজেদের লোককেই গুলিটা করেছে।” কার্ট বলল এবার।

“তুমিও কি আমার মতোই ভাবছো নাকি? এরা কী পেশাদার খুনি?” জো জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাঁ, ভাড়াটে খুনি। হ্যাগেন ছিল আস্ত একটা গাধা।

পুলিশ ইতোমধ্যে দুর্গের দিকে রওনা দিয়েছে। বন্দর থেকেও লাল নীল বাতি জ্বালিয়ে একটা পুলিশের স্পিডবোট এদিকেই আসছে।

“খেলা তো শেষ এখন এসে কী হবে। এক বদমায়েশ ভেগেছে, আরেকটা মরে পড়ে আছে।” কার্ট ভালো মনে মনে। স্নাইপার এখনো জায়গা থেকে সরেছে কি-না জানে না, তাই শুয়ে শুয়েই কার্ট কেনসিংটনের হাতের কাগজটা বের করল। কেনসিংটন কিছু একটা লিখার চেষ্টা করছিলেন। রক্তে ভিজে গেছে কাগজটা, তবে একটা পাশ পড়া যাচ্ছে। একটা নাম মনে হচ্ছে। “সোফি স…

এরকম কোনো কিছু বা কাউকে কার্ট চেনে না। তবে এই মুহূর্তে আসলে কোনো কিছুকেই আর ওর মাথায় খেলছে না। ও কাগজটা রেখে পুলিশের অপেক্ষা করতে লাগল আর ভাবতে লাগল কবে ওদের ভাগ্য খুলবে।

নদীর অপর পাড়েই ফোর্ট সেন্ট অ্যাঞ্জেলোর শতাব্দী প্রাচীন পাথুরে মেঝেতে শুয়ে শুয়ে আরেকটা অবয়ব ভাবছিল যে তার ভাগ্যটা আজ খুবই ভালো। উঠে দাঁড়িয়ে তার গুলির ফলাফল কি হলো তা দেখতে লাগল।

সে শত্রুকে দেখলো, তারপর বাতাসের সাথে সমন্বয় করে যেই গুলি করতে যাবে ওমনি ঝাপসা দেখা শুরু করল। তারপর বহু কষ্টে দুটো প্রতিবিম্বকে এক করে তারপর ট্রিগার টিপেছে। মুখের ফোস্কা আর ঘা-গুলো হওয়ার পর থেকেই চোখের সমস্যাটা শুরু। এখন অবশ্য কমছে ধীরে ধীরে।

তবে চার নাম্বারের কাছে এই দাগগুলো গর্বের। সেদিন সে ঠিকই ঐ মরণ হন্টন শেষ করে বেঁচে গিয়েছিল। তার পুরস্কারস্বরূপ ওসাইরিসের হয়ে কাজ করার জন্যে তাকে আরেকটা সুযোগ দেয়া হয়েছে। আর মাত্র একটা গুলি করেই সে নিজের যোগ্যতা বুঝিয়ে দিয়েছে।

সে ঝটপট নিজের লম্বা ব্যারেলের রাইফেলটা গুটিয়ে ফেলল। তারপর মনোযোগ দিয়ে মাত্র খুন করা লোকটার ছবি দেখতে লাগল। একবার মনে হলো ওর কি আসলে আমেরিকানগুলোকে মারা উচিত ছিল কি-না। কিন্তু কাউকে টের না পাইয়ে একটার বেশি গুলি করা সম্ভব না। আর হ্যাঁগেনের মুখ বন্ধ করাটাই সবচেয়ে জরুরি ছিল।

রাইফেল গুছিয়ে নিয়ে সাবধানে ও মুখের চারপাশে একটা স্কার্ফ জড়িয়ে নিলো কাঁধের ওপর জড়ানো অ্যান্টিবায়োটিক মিশ্রিত গজটাও তাতে ঢাকা পড়ে যায়। তারপর লম্বা পদক্ষেপে রাতের সাথে মিশে গেল।

.

২০.

“আপনাকে আমি আসার আগ পর্যন্ত কিছু করতে নিষেধ করেছিলাম।” কথাগুলো রেনাটা আমব্রোসিনির।

মাল্টার সবচে দামি হোটেলের সবার ওপরের তলার বিলাসবহুল একটা স্যুইটে বসে আছে ওরা। ওরা মানে আমব্রোসিনি, কার্ট আর জো। কার্ট ওর কপালের ফোলা জায়গাটায় একটা স্কচের বোতল চেপে ধরে রেখেছে। জো হাত-পা ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গার চেষ্টা করছে।

ওরা যে জেলে যায়নি সেটাকে ভাগ্যই বলা চলে। গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র আর ইতালিয়ান সরকারের ফোন, তার ওপর আবার ওদের বীরত্বের একটা ভিডিও প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত ওদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। মাত্র আধা-ঘন্টা আগেই যেখানে ওদের মাথার ওপর পঞ্চাশ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের খড়গ ঝুলছিল, এখন সেখানে ওদেরকে অর্ডার অফসেইন্ট জন-এর নাইটহুডের জন্য বিবেচনা করা হচ্ছে।

“বিশ্বাস করুন, সে চেষ্টাই করেছিলাম। কিন্তু চোখের সামনে যখন ওরা দেয়াল ভেঙে দিয়ে পালানো শুরু করল তখন কীভাবে চুপচাপ বসে থাকি?” কার্ট জবাব দিল। *

রেনাটা গ্লাসে নিজের জন্য পানীয় ঢেলে নিয়ে কার্টের পাশে বসলো। “তাও ভালো যে আপনাদের অন্তত কিছু হয়নি। কেনসিংটন আর হ্যাগেন দুজনেই মারা গিয়েছে।”

জো’র চেহারা কালো হয়ে গেল, “আমার ওকে আসলে শুইয়ে রাখাই উচিত ছিল। ওর চেতনা খানিকটা ফেরায় উঠিয়ে দেয়ালের পাশে বসিয়ে দিয়েছিলাম।”

“নিজেকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তুমি তো আর জানতে না যে ওরা একজন স্নাইপার বসিয়ে রেখেছে ওখানে।” কার্ট বলল।

জো মাথা ঝাঁকালো। “সিরিঞ্জে কি ছিল তা কি জানা গিয়েছে?”

“কেটামাইট। দ্রুত কার্যকরী চেতনানাশক। ল্যাম্পেডুসার ওটা না।”

“এটাই আবার প্রতিষেধকটা না তো?” কার্ট আশা ভরা চোখে জিজ্ঞেস করল।

“ডা, রবিশ্বকে পরীক্ষা করতে দিয়েছিলাম। কিন্তু নাহ! কোনো কাজ হয়নি। আমরা এখনো শূন্যেই পড়ে আছি।”

কার্ট এক চুমুক স্কচ গলায় ঢাললো, তারপর কেনসিংটনের দেয়া দোমড়ানো কাগজটা আবার দেখতে লাগলো।

“এখানে এসে কি নাম আর ফোন নাম্বার জোগার করা শুরু করেছেন নাকি?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

‘দেয়ালটা ভেঙে পড়ার আগ মূহর্তে কেনসিংটন এটা লিখছিলেন।” কার্ট বলে কাগজটা রেনাটার হাতে ধরিয়ে দিল।

“সোফি স… কখনো শুনেছি বলে মনে পড়ছে না।”

“আমরাও না। কিন্তু উনি আমাদেরকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিলেন।” কার্ট বলল।

“হয়তো কেনসিংটন চায় আমরা এই লোকটাকে খুঁজে বের করি। “হয়তো এই মহিলা আমাদেরকে সাহায্য করতে পারবে। হয়তো সোফিস-ই হলো সেই রহস্যময় পৃষ্ঠপোষক যিনি তার সব সংগ্রহ নিলামের জন্যে দান করে দিচ্ছেন।” জো বলল।

“লেখাটা শেষ করতে পারলেই সব বোঝা যেতো।” কার্ট বলল।

“লেখালেখির ঝামেলাই বা করতে গিয়েছিলেন কেন? মুখে বললেই তো হতো।” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

কার্টও সে কথাটাই ভাবছিল। “উনি যেভাবে কথা বলছিলেন আর রুমের চারপাশে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিলেন তার মনে হয় রুমে লুকানো মাইক্রোফোন ছিল। না হয় অন্তত কেনসিংটনের ধারণা ছিল যে মাইক্রোফোন আছে।”

রেনাটা গ্লাস থেকে চুমুক দিল। “তাই উনি লিখে আপনাকে তথ্য দেয়ার চেষ্টা করছিলেন, আর মুখে বলছিলেন যে কিছুই জানেন না?”

কার্ট মাথা ঝাঁকালো। “ওনার ধারণা ছিল ওরা ওনার কথা শুনলেও দেখতে পাবে না। উনি একদিকে চাইছিলেন আমাদেরকে সাহায্য করতে আবার অন্যদিকে ধরা পড়ার ভয়ও ছিল।”

“তাহলে খামাখা উনাকে মারলো কেন? উনি তো ওদের কথা মতোই চলছিলেন।” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

“হ্যাগেনকে যে কারণে মেরেছে, সেই একই কারণে। প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করতে।”

ওরা বুঝতে পেরেছিল যে কেনসিংটন একসময় না একসময় সব ফাঁস করেবন-ই। এর মধ্যে আবার আমরা এসে পড়ায় তাড়াতাড়িই কাজটা সারতে হয় ওদের।” কার্ট ব্যাখ্যা করল।

“ওরা তো চাইলে আপনাদেরকেও মারতে পারতো।” রেনাটা বলল।

“সম্ভবত।” কার্ট বলল।

কি করতে পারতো সেটা আর এখন বড় কথা না, কি করেছে সেটাই আসল ব্যাপার। আর এখন পর্যন্ত ওদের প্রতিপক্ষই ওদের চেয়ে এগিয়ে আছে। যেটুকু সূত্র হাতে পেয়েছিল তার দুটোই আবার হাত ছাড়া হয়ে গিয়েছে। অন্তত খেলা তো জমেছিল।

“এখন এই সোফিকে খুঁজে বের করতে হবে।” রেনাটার দিকে ফিরে বলল কার্ট।” “এসব নাম-ধামের ব্যাপারে আমাদের চেয়ে আপনার নাড়াচাড়া বেশি। আপনার ইন্টারপোলের বন্ধুরা কি কোনো সাহায্য করতে পারবে? হয়তো মেয়েটা কেনসিংটনের বন্ধু বা জাদুঘরের পরিষদের সদস্য বা পৃষ্ঠপোষক।”

“হয়তো ঐ পার্টিতে দাওয়াত পাওয়া একজন।” জো বলল।

রেনাটা মাথা আঁকালো, “আমি ইন্টারপোল আর AISE (ইতালির বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা)-কে অনুরোধ করবো নামটা একটু চেক করতে। ছোট একটা দ্বীপ এটা। এখান থেকে একজনকে খুঁজে বের করা কঠিন কিছু হবে না। তাও যদি না পাওয়া যায় তাহলে আরো বিস্তারিত খুঁজবো। হতে পারে এটা একটা কোর্ড নেম বা কোনো অ্যাকাউন্টের পরিচিতি বা কোনো কম্পিউটার প্রোগ্রাম যে কোনো কিছু হতে পারে।

“মহিলা ঐ স্নাইপারটাও হতে পারে। কার্ট বলল।

“হতেই পারে। আধুনিক যুগ এটা। মেয়েরাও চাইলে যা খুশি হতে পারে।” কাৰ্ট চোখ মুখ শক্ত করে মাথা নাড়লো আর গ্লাসে আরেক চুমুক দিল। লিকারের ঠাণ্ডা আগুন তার সাথে কপালের সাথে ঠাণ্ডা গ্লাস চেপে রাখার কারণে ব্যথাটা এখন মোটামুটি সয়ে এসেছে। মাথাটাও পরিষ্কার লাগছে এতোক্ষণে।

“সব সমস্যার গোড়া কিন্তু ঐ জাদুঘর। কেনসিংটন বলেছেন যে লোকগুলো কি সব মিসরীয় পুরাকীর্তি খুঁজছে। ওগুলো নাকি একদমই ফালতু। কিন্তু সত্যি কথা বলছিলেন কি-না কে জানে। একবার আমাদের দেখা দরকার। তার মানে আমি আর জো পার্টিতে যাচ্ছি।”

“সাজুগুজু করলে আমাকে ভালোই লাগে।” জো বলল।

“আস্তে। এখনি সেলুনে দৌড়াতে হবে না। আমরা খুব বেশি সেজেগুজে যাবো না। আর আজকের ঘটনার পর সরাসরি নিজেদের চেহারা আর কোথাও না দেখানোই ভালো হবে।”

“তার মানে ছদ্মবেশ?”

“তার চেয়েও ভালো। কার্ট এটুকু বলেই থেমে গেল।

“পার্টি এখনও হবে নাকি? আমিতো ভাবলাম বাদ হয়ে গিয়েছে।” রেনাটা বলল অবাক হয়ে।

কার্ট মাথা নাড়লো, “আমিও তা-ই ভেবেছিলাম। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু কিছু ব্যাপার বুমেরাং হয়ে যায়। শুনলাম এই ঘটনার কারণে নাকি সবার আগ্রহ কমা তো দূরে থাক আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গিয়েছে। বিপদের আশংকা সবাইকে আরো বেশি উত্তেজিত করে তুলছে। তাই পার্টি বাতিল না করে ওরা নিরাপত্তা তিনগুণ করেছে, সেই সাথে আরো কয়েকজনকে দাওয়াত দিয়েছে।”

“আর আমরাও নাচতে নাচতে গেলেই ঢুকতে দেবে? ঐ তিন স্তরের নিরাপত্তা রক্ষীদের যদি ব্যাপারটা পছন্দ না হয়?” জো বলল।

“শুধু পছন্দই করবে না, সেই সাথে ওরা নিজেরা আমাদেরকে পাহারা দিয়ে ভেতরে নিয়ে যাবে। রহস্যের হাসি হেসে কার্ট জবাব দিল।

২১. দক্ষিণ লিবিয়া

২১. দক্ষিণ লিবিয়া

পুরনো DC-3 বিমানের ককপিটটা থরথর করে কাঁপছে। মরুভূমির প্রায় পাঁচশো ফুট ওপর দিয়ে দুশো নট গতিতে চলাটা ওর বুড়ো হাড়ে সহ্য হচ্ছে না। পল ট্রাউট অনুমান করল হয় প্রপেলারগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই নয়তো ওগুলো সামান্য ভারসাম্যহীন। এগুলোর একটা যদি হঠাৎ করে খুলে নিচের মরুভূমিতে পড়ে যায় বা বন বন করতে করতে এই কেবিনের ভেতর-ই ঢুকে পড়ে তাহলে তাহলে যে কি হবে সেই ভাবনাতেই আতঙ্কিত হয়ে কাঠ হয়ে বসে আছে ও।

যথারীতি গামায় এসব কোনো ব্যাপারেই ভয় পাচ্ছে না। সে বসেছে পাইলটের পাশের কো-পাইলটের সিটে। বাইরের মনোরম দৃশ্য উপভোগের পাশাপাশি এত নিচু দিয়ে এত জোরে উড়ে যাওয়ার কারণে দারুণ উত্তেজনা অনুভব করছে।

ওদের নিমন্ত্রণ দাতা রেজাও পাইলটের সিটের পেছনে পলের সাথে বসা।

“মাটির এতো কাছ দিয়ে এতো জোরে যাওয়ার কোনো দরকার আছে?” পল জিজ্ঞেস করল।

“এভাবেই নিরাপদ বেশি, না হলে বিদ্রোহীরা গুলি করে এটাকে নামিয়ে ফেলবে।” রেজা জবাব দিল।

পল অবশ্য এরকম কোনো জবাব আশা করেনি, “বিদ্রোহী?”

“আমাদের দেশে এখনও হালকা-পাতলা গৃহযুদ্ধ চলছে। এখানে বেশ কিছু ভাড়াটে সৈন্যবাহিনী আছে। এরা মাঝে মাঝে আমাদের হয়ে কাজ করে, আবার মাঝে মাঝে আমাদের বিপক্ষে কাজ করে; বিদেশি গুপ্তচর দিয়ে দেশটা ভরে গেছে। মিসর, মুসলিম ব্রাদারগুড এমনকি গাদ্দাফির দলের লোকেরাও ক্ষমতার জন্য এখনও লড়েই যাচ্ছে। ইদানীং লিবিয়ায় খুব বেশি গণ্ডগোল চলছে।” রেজা ব্যাখ্যা করল।

হঠাৎ পলের মনে হলো আরো একদিন তিউনিসিয়া থেকে গিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেই ভালো হতো। এতোক্ষণে বারান্দায় বসে পাইপ টানতে টানতে রেডিও শুনতে পারতো। এভাবে জান হাতের মুঠোয় নিয়ে চলতে হতো না। “চিন্তা করবেন না। এতো পুরনো একটা বিমানে মিসাইল মারার মতো বোকামি ওরা করবে না। ওরা সাধারণত জায়গায় বসে রাইফেল দিয়ে গুলি করে। আর এখন পর্যন্ত একটা গুলিও লাগাতে পারেনি। রেজা আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল। তারপর ককপিটের পিছনের কাঠের দেয়ালে টোকা দিল। DC-3 র মতো এই জিনিসটাও অন্য আরেক যুগের জিনিস। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে লোকজন ককপিটে ঢোকা আর বের হওয়ার সময় এটায় পাড়া দিয়ে আসছে।

বিমানের কন্ট্রোলও আগের মতোই আছে। ক্ষয় হয়ে যাওয়া। বিশাল লম্বা লম্বা কয়েকটা দণ্ড ইতস্তত বেরিয়ে আছে। যুগের পর যুগ ধরে কত পাইলট-ই না এগুলো ব্যবহার করে আসছে।

পাইলটের হাতের স্টিয়ারিং মাঝখানে বাঁকা। গামায় এর সামনে যেটা আছে সেটার চেহারা অবশ্য একটু ভালো।

“আমাদের গাড়িতে করে আসাই ভালো ছিল।” পল বলল।

“ট্রাকে করে গেলে আট ঘণ্টা লাগতো আর আকাশ পথে মাত্র দেড় ঘণ্টা। আর ওপরের দিকে গরমও কম।” রেজা বলল।

পল ঘড়ি দেখতে দেখতে ভাবলো বাপরে বাপ দেড় ঘণ্টা।” তবে ঘড়ি দেখে কিছুটা স্বস্তি ফিরলো মনে। যাক প্রায় চলে এসেছে।

বাইরে বালির ভেতর প্রায়ই বিশাল বিশাল পাথর বের হয়ে আছে। দেখে মনে হয় যেনো সমুদ্র থেকে বিশাল কোনো দানব লাফ দিচ্ছে। আরো কিছু দূর দক্ষিণে যাওয়ার পর একটা লবণ ঘেরের মতো জায়গায় কয়েকটা চক্কর দিয়ে তারপর নামতে শুরু করল। জায়গাটা দেখে পলের মনে হলো কোনো তেল ক্ষেত্র। বিশাল বিশাল টাওয়ার, চিমনি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আশে পাশে। কয়েকটা ভবনও দেখা গেল।

নামতে অবশ্য কোনো সমস্যা হলো না। মাত্র একটা ঝাঁকুনি খেয়েই বিমানের গতি কমতে শুরু করল। আগেরকালের বেশিরভাগ বিমানের মতো DC-3’র লেজের দিকে ওজন বেশি। পাখা দুটোর নিচে বড় বড় দুটো চাকা আছে এটার আর একদম পিছনে ছোট্ট লেজের নিচেই ছোট্ট আর একটা চাকা।

এজন্যেই নামার সময় মনে হলো যে মাটিতে বিমান সোজা হয়েই নেমেছে তারপর আস্তে আস্তে বিমানের নাক উঁচু হচ্ছে। অথচ ঘটনা ঘটছে উল্টোটা। তবে যা-ই হোক মাটিতে নামতে পেরেই পল খুশি। মাটিতে নেমেই ও গেল গামায়কে নামতে সাহায্য করতে। দরজা খুলতেই পল হাত বাড়িয়ে দিল। গামায় সেটা ধরে ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে নেমে এলো। “দারুণ মজা লেগেছে। এবার দেশে ফিরেই বিমান চালানো শিখবো। জো-ই শিখাতে পারবে।”

“খুবই ভালো।” পল বলল। খুব চেষ্টা করছে সমর্থকের ভঙ্গিটা ধরে রাখতে। “বের বের মরুদ্যানটা দেখেছিলে?” গামায় জিজ্ঞেস করল।

“নাতো কখন দেখা গেল ওটা?” মনে করার চেষ্টা করতে করতে বলল পল।

“চক্কর মারা শুরু করার ঠিক আগে।” রেজা বলল।

“তার মানে ঐ শুকিয়ে যাওয়া এলাকাটা?”

রেজা মাথা ঝাঁকালো।” এক সপ্তাহে। এক সপ্তাহে ওটা এটা স্বর্গোদ্যান থেকে লবণের ঘেরে পরিণত হয়েছে। গাফসাতে যেভাবে হয়েছে ঠিক একই ঘটনা সমগ্র সাহারা জুড়েই ঘটছে।

“এটা কি করে সম্ভব?” পল বলল।

রোদ থেকে বাঁচতে রেজা কপালের ওপর হাত দিয়ে রেখেছে। “চলেন আগে ভেতরে যাই।” বলল ও।

ওরা মেইন বিল্ডিং-এর দিকে এগুলো। রাস্তার পাশেই সারি সারি পাম্প আর পাইপ, সেগুলো বিভিন্ন দূরত্বে ছড়িয়ে গিয়েছে। গন্তব্য বেনগাজী। মরুভূমির দাবদাহে ঝলসে আসার পর এসি রুমে ঢোকা মানে বেহেশতে প্রবেশ করা। ওদের সাথে একদল শ্রমিকের দেখা হয়ে গেল।

“কোনো কিছু হলো?” রেজা জিজ্ঞেস করলেন।

প্রধান প্রকৌশলী মাথা নাড়লেন, “পানি উত্তোলন আরো বিশ ভাগ কমে গিয়েছে। আরো তিনটা পাম্প বন্ধ করে দেয়া লেগেছে। বেশি গরম হয়ে গিয়েছিল আর এগুলো দিয়ে পানির বদলে খালি তৈলাক্ত কাদা বেরুচ্ছে।” শক্ত মুখে বলল সে।

পল ওদের কথা শুনতে শুনতে চারদিকে তাকাল। রুম ভর্তি অনেক কম্পিউটার আর ডিসপ্লে স্ক্রিন। জানালা মাত্র কয়েকটা। সেগুলোও কালো রঙে ঢাকা। রুমটা দেখতে অনেকটা বিমান বন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল রুমের মতো।

“পৃথিবীর বৃহত্তম মানব-নির্মিত নদীর সদর দপ্তরে স্বাগতম।” রেজা বলল ওকে। “পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প এটাই। এটাসহ আরো কয়েকটা জায়গা থেকে আমরা পানি সংগ্রহ করি, তারপর প্রায় পাঁচশো মাইল মরুভূমি পাড়ি দিয়ে বেনগাজী, ত্রিপোলি আর তোবরুক শহরে পৌঁছে দেই। পানিটা আসে মূলত নুবিয়ান স্যান্ডস্টোন জলাধার থেকে।”

রেজা একটা ডিসপ্লের স্ক্রীন স্পর্শ করতেই একের পর এক বিভিন্ন বিশাল বিশাল পাম্প, পানি ভরা কৃপ আর পাইপ ভরা পানির স্রোতের ছবি ভেসে আসতে লাগল।

“আপনারা কতটুকু পানি উত্তোলন করেন?” গামায় জিজ্ঞেস করেলল।

“এতোদিন তো করতাম দিনে সাতশো মিলিয়ন কিউবিক মিটার। আমেরিকান হিসেবে ধরেন প্রায় দুই বিলিয়ন গ্যালন।” রেজা জবাব দিল।

পলের নজর বোর্ডের দিকে। সেখানে হলুদ, লাল আর কমলা নির্দেশক জ্বলছে। সবুজ নেই কোথাও।

“খরায় আপনাদের ঠিক কতটা ক্ষতি হয়েছে?” পল জিজ্ঞেস করল।

“আমাদের পরিমাণ ইতোমধ্যে সত্তর ভাগ কমে গিয়েছে। দিনে দিনে আরো কমছে।” রেজা বলল।

“ইদানীং কী কোনো ভূমিকম্প হয়েছে? মাঝে মাঝে ভূমিকম্প হলে জলাধারের অবস্থান সরে যায়। ফলে তখন আর পানি উঠতে চায় না।”

“না, ওরকম কিছু হয়নি। সামান্য কাঁপা কাপিও না। ভূতাত্ত্বিকভাবে এই এলাকাটা খুবই সুস্থির। যদিও রাজনৈতিকভাবে উল্টো।”

পল পুরোপুরি হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছে। শেষমেশ একটা কথাই ওর কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হলো, “আমি জানি কেউই হয়তো বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু জলাধারগুলো কী শুকিয়ে যেতে পারে না?”

“চমৎকার প্রশ্ন।” রেজা জবাব দিল। এখানকার যে ভূনিম্নস্থ পানি সেটার অস্তিত্ব সেই বরফ যুগ থেকে বিদ্যমান। আমরা যে পানি তুলছি সেটুক আর ফেরত যাচ্ছে না। কিন্তু যেটুকু পানি আছে সেটুকুও আগামী পাঁচশো বছর নিশ্চিন্তে চলে যাওয়ার কথা। যদি খুব বেশি বেশি করেও ভোলা হয় তাতেও একশো বছরের আগে কিছু হওয়ার কথা না। আর আমরা পানি তুলছি মাত্র পঁচিশ বছর হয়েছে। তাই আসলে যে কী হচ্ছে সেটার উত্তর আপনার মতো আমারো জানা নেই। পানি কোথায় যাচ্ছে আল্লাহ মালুম।”

“আপনারা জানেন কী তাহলে?” গামায় জিজ্ঞেস করল।

রেজা একটা মানচিত্র টেনে আনলেন, “আমি শুধু জানি খরা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আস্তে আস্তে অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। খরার বিস্তার পশ্চিম দিকে বাড়ছে। প্রথম কূপ শুকায় এখানে। আর এটা হচ্ছে পূর্ব সীমানা।” রেজা মানচিত্রে টোবরুক এর দক্ষিণে লিবিয়া আর মিসরের সংযোগস্থলের একটা জায়গা দেখালো।” ঘটনাটা ঘটে নয় সপ্তাহ আগে। তার কয়েকদিন পরেই সারির, টাজেরবো এলাকার কূপগুলো শুকানো শুরু করে। আর তিরিশ দিন আগে আমাদের পশ্চিমাঞ্চলে, ত্রিপোলির দক্ষিণের কূপগুলোর পানির সংগ্রহ যে, কমে গিয়েছে তা আমরা টের পাই। কয়েকদিনেই পাম্প করা পানির পরিমাণ অর্ধেকে নেমে আসে। এজন্যেই আমি গাফসা-তে গিয়েছিলাম।

“কারণ গাফসা হচ্ছে আরো পশ্চিমে।” পল বলল।

রেজা মাথা ঝাঁকালো। “প্রভাবটা কী আরো বাড়ছে কি-না তা আমার দেখার দরকার ছিল। এবং দেখলাম বাড়ছে। আলজেরিয়াতেও একই সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু এসব দেশের কোনোটাই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর আমাদের মতো এতোটা নির্ভরশীল না। গত পঁচিশ বছরে লিবিয়ার জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। সেচ-নির্ভর কৃষির সংখ্যা বেড়েছে প্রায় পাঁচ হাজার গুণ। শিল্পক্ষেত্রে পানির প্রয়োজন বেড়েছে পাঁচশো গুণ। সবাই এই পানির ওপর নির্ভরশীল।”

পিটার মাথা ঝাঁকালো। “তার মানে সবাই ট্যাপ ছেড়ে যদি দেখে যে পানি পড়ছে না, তাহলে আপনারা খুব বিপদে পড়বেন।”

“ইতোমধ্যে পড়ে গিয়েছি।” রেজা পলকে নিশ্চিত করল।

“আপনারা বাদে আর কেউ এবিষয়ে খোঁজ-খবর করছে?” গামায় জিজ্ঞাসা করল।

রেজা কাঁধ ঝাঁকালেন, “সেভাবে না। আসলে করার মতো যোগ্য লোকই নেই। আর বুঝতেই পারছেন যে দেশে এখনো গৃহযুদ্ধ চলছে। তাই সরকার এখন এর চেয়েও বড় বড় সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছে। বা তাদের ধারণা সেরকম। ওরা শুধু জিজ্ঞেস করেছে যে এটা কী বিদ্রোহীদের কাজ কি-না? উচিত ছিল মিথ্যে করে হ্যাঁ বলা। তাহলে ওরা দেশের সমস্ত সম্পদ এদিকে দিতো সমস্যার সমাধানের জন্যে। কিন্তু আমি না বলে দিলাম। সাথে এও বললাম যে এরকম চিন্তা করাটা হাস্যকর।” ব্যাপারটা মনে পড়তেই রেজার চেহারা মলিন হয়ে গেল। একটা কথা মনে রাখবেন ভুলেও কখনো কোনো রাজনীতিকের প্রশ্নকে হাস্যকর বলবেন না। অন্তত আমার দেশের কোনো রাজনীতিককেও না।”

“কেন?”

“আমার কাছে সেটাই মনে হয়েছে।”

“না, ওটা না, বিদ্রোহীদের দ্বারা এমন কাজ সম্ভব নয় কেন?” গামায় খুলে বলল।

“বিদ্রোহীরা সবকিছু বোমা মেরে উড়িয়ে দেয় কিন্তু এই ব্যাপারটা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। সম্ভবত কোনো বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসছে। তার ওপর সবারই পানির দরকার হয়। যদি পানিই শেষ হয়ে যায় তাহলে যুদ্ধ করবে কিসের জন্যে?” রেজা ব্যাখ্যা করল।

“দেশটা তাহলে টিকে আছে কীভাবে?” পল জিজ্ঞেস করল।

“এখন পর্যন্ত বেনগাজী, সার্তে আর ত্রিপোলির বাইরের জলাধারগুলোই সবদিক সামাল দিচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেই ভাগ করে করে দেয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আশেপাশের সব পাম্প-ই কয়েকদিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। আর তা যদি হয় তাহলে আবার মানুষ বেপরোয়া হয়ে উঠবে। আবার এদেশটায় চরম অরাজকতা শুরু হবে।

“আপনাদের সরকারকে এসব প্রমাণ দেখাচ্ছেন না কেন? এগুলো দেখলে তো আপনার কথা শোনার কথা।” গামায় বুদ্ধি দিল।

“দেখিয়েছি। ওরা শুধু বলে আমাকেই সমস্যার সমাধান করতে। না হলে সব দায় আমার ঘাড়ে চাপিয়ে অব্যস্থাপনার অভিযোগে আমাকে বরখাস্ত করা হবে। আবার তাদের সাথে দেখা করার আগে আমাকে একটা সমাধান বের করতেই হবে। অন্তত কেন এরকম হচ্ছে সেটা অন্তত জানতে হবে।”

“এই নুবিয়ান স্যান্ডস্টোন জলাধারটা কত বড়?” পল জিজ্ঞেস করল। রেজা খনন কাজের একটা প্রস্থচ্ছেদের ছবি আনালেন, “বেশির ভাগ কৃপই গভীরতায় পাঁচশো থেকে ছশো মিটার।”

“আরো গভীরে খোঁড়া যায় না?”

“সবার প্রথমেই এই বুদ্ধিটা এসেছিল। আমরা পরীক্ষামূলকভাবে এক হাজার মিটার পর্যন্ত খুড়ে দেখেছি। কাজ হয়নি। এরপর দুই হাজার মিটার খুড়েছি। তাও দেখি শুকনো।”

পল নকশাটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করল। ছবি অনুযায়ী মাটির ওপরের ছোট ছোট খোপওয়ালা দালানটায় ওরা এখন অবস্থান করছে। এটার রঙ ধূসর। কূপগুলোর রঙ উজ্জ্বল সবুজ। ফলে সহজেই দেখা যাচ্ছে। কীভাবে কূপগুলো মাটি আর পাথরের বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে লাল লাল বেলে পাথরের ভেতর আটকে পড়া সেই বরফ যুগের পানিকে উত্তোলন করে। বেলে পাথরের ঠিক নিচেই কালো একটা স্তর। এটা মাটির নিচে প্রায় আরো এক হাজার মিটার পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। তার নিচের অংশটুকু ধূসর কিন্তু চিহ্নিত করা নেই।

“বেলে পাথরের নিচে এগুলো কী পাথর?” পল জিজ্ঞেস করল।

রেজা কাঁধ ঝাঁকালো, “আমরা আসলে নিশ্চিত না। দুই হাজার মিটারের নিচে কি আছে তা নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি। আমার মনে হয় পুরোটাই পাললিক শিলা।”

“আমার মনে হয় একবার পরীক্ষা করে দেখা দরকার। হয়তোবা সমস্যা। আপনার এই বেলে পাথরে না। সমস্যা এটার নিচে।” পল বলল। “তাহলে অন্তত একটা ভূকম্পনজনিত নিরীক্ষা তো চালানোই যায়।” পল প্রস্তাব দিল। রেজা বুকে দু হাত ভাজ করে দাঁড়ালেন তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, কাজটা করতে পারলে আমিও খুশি হতাম। কিন্তু এতো নিচে আর এতো পাথর ভেদ করে কম্পন পাঠানোর জন্যে খুব শক্তিশালী একটা আঘাত লাগবে। দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের সমস্ত গোলাবারুদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

“বুঝতে পারছি কেন। সরকার চায়না বিদ্রোহীদের হাতে বিস্ফোরক গুলি পড়ক।” গামায় বলল।

“আরে সরকার না, বিদ্রোহীরাই ওগুলো নিয়ে গিয়েছে। তারপর সরকার আর ওগুলোর বদলে নতুন দেয়নি। মোদ্দাকথা হলো, আমার এখানে এমন কিছু নেই যা দিয়ে এতো শব্দ বানানো সম্ভব যে ভূমি থেকে দু’হাজার ফুট নেমে আবার ফিরে আসবে এবং স্পষ্টভাবে সেটাকে ধরা যাবে।”

এক মুহূর্তের জন্যে পল দিশাহারা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎই একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়। বুদ্ধিটা পুরোপুরি পাগলামি। কিন্তু যদি কাজ করে তাহলে এটাই কাজ করবে। ও গামায় এর দিকে তাকাল, “এখন আমি জানি নতুন কোনো বুদ্ধি বের করতে পারলে কার্টের কেমন লাগে। এটা হলো একই সাথে মেধা আর পাগলামির সমন্বয়।”

গামায় চুকচুক করল, “তবে কার্টের ক্ষেত্রে এ দুটোর মধ্যে ভারসাম্য থাকে না।”

আশা করি আমার বেলায় সেটা হবে না।” তারপর রেজার দিকে ফিরে বলল, “আপনার কী শব্দ তরঙ্গ রেকর্ড করার মতো যন্ত্রপাতি আছে?”

“পৃথিবীর সেরা যন্ত্রপাতিগুলোই আছে।”

“ওগুলো রেডি করুন। আর বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না তাও বলছি, আপনার ও লক্কর-ঝক্কর বিমানটায় তেল ভরুন। ওটাকে নিয়ে একটু চক্কর মারতে যাবো।”

.

২২.

DC-3 আবারো ধুলো ভরা রানওয়ে ধরে ছুটছে। পাম্পিং স্টেশনগুলো পার হতেই নাক উঁচু করে উঠে গেল আকাশে। দুটো কার্টিস-রাইট সাইক্লোন ইঞ্জিন সর্বোচ্চ গতিবেগে গর্জন করে চলার পরও এই গরম বিকেলে ওটার দরকারি উচ্চতা অর্জন করতে ঘাম ছুটে গেল। এই ধরনের ইঞ্জিন এখন আর ব্যবহার হয় না। প্রতিটার কর্মক্ষমতা এক হাজার হর্স পাওয়ার। কিন্তু যতোই যত্ন নেয়া হোক না কেন সত্তর বছর পর ইঞ্জিন থেকে এতোটা শক্তি পাওয়ার আশা করাটা বোকামি। তারপরও কম করে হলেও বিমানটা ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে লাগল, মুখ দক্ষিণে। দশ হাজার ফুট ওপরে উঠতেই বাতাস শুষ্ক আর ঠাণ্ডা হয়ে এলো। সেখানে কিছুক্ষণ স্থির থাকার পর সেটা আবার রানওয়ের দিকে ছুটলো।

রেজার পাইলট বিমান সামলাতে ব্যস্ত। আর পল ও গামায় কেবিনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। একটা চাকাওয়ালা ঠেলাগাড়ির দু’প্রান্ত ধরে সামলানোর চেষ্টা করছে।

ধাতব ঠেলাটার চাকা চারটা। তার ওপর একটা চারধার উঁচু সমতল ডেক। আর তার দুপাশে হাতল লাগানো। এর ওপর প্রায় চারশো পাউন্ড ওজনের কষ্ক্রিটের টুকরো ফিতা দিয়ে বেঁধে রাখা। পল আর গামায় প্রাণপণ চেষ্টা করছে যাতে কীট বা ঠেলা কোনোটাই যাতে ঘুরে না যায়।

গামায় একটা ফিতা খুলতে খুলতে বলল, “সবার শেষে তো তুমিই ধরবে না?”

পল হাঁটু মুড়ে বসে শক্ত করে ঠেলাটার পা ধরে রেখেছে যাতে ওটা বিমানের লেজের দিকে চলে যেতে না পারে।

“আর দুই মিনিট আছে।” পাইলট চেঁচিয়ে জানান দিল।

“দেখা যাক কাজ করে কি-না। আস্তে, এখন।” বলল পল।

গামায় হাতলটা ধরলো আর পল ওর দিক থেকে টেনে ধরে ধরে ঠেলাটাকে বিমানের লেজের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। ওখানকার সিট, দরজা সব খুলে ফেলা হয়েছে। বিশাল ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢুকছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এই ফাঁকা জায়গা দিয়েই গামায় আর পল ঠেলাটাকে ঠেলে ফেলে দেবে। সাথে সাথে ওরাও না পড়ে গেলেই হয়।

খোলা দরজার পাঁচ ফুট পর্যন্ত ওরা নিরাপদেই গেল, তারপরই বাঁধলো ঝামেলা। ওরা বিমানের পিছনে পৌঁছাতেই বিমানের নাক উঁচু হয়ে গেল। কীটের টুকরো আর ঠেলাগাড়িটা মিলিয়ে ওরা বিমানের সামনে থেকে প্রায় সাতশো পঞ্চাশ ফুট পিছনে ঠেলে নিয়ে এসেছে। ফলে বিমানের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে। লেজ হয়ে গেছে বেশি ভারি আর নাক উঠে গিয়েছে ওপরে।

“সামনের দিকে নামান।” গামায় চিৎকার করে বলল।

“আমার ধারণা উনি এটা জানেন।” বহু কষ্টে ঠেলাটা ওল্টে পরা থেকে আটকে রেখেছে ও।

“তাহলে করছে না কেন?” গামায় জিজ্ঞেস করল।

পাইলট আসলেই বিমান সামনের দিকে নামানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু সব কাজ করছে অত্যন্ত ধীর গতিতে। সে আরো জোরে লিভারটা চেপে ধরলো। ফলে এবার ফল হলো উল্টো। নাক নেমে এলো ঠিক কিন্তু নেমেও গেল খানিকটা বেশি। ফলে এবার ঠেলাগাড়িটা গামায়কে চাপা দিয়ে ককপিটের দিকে ছুটে আসার চেষ্টা করল।

“পল।” চেঁচিয়ে ডাকলো গামায়।

কিন্তু চেষ্টা করা ছাড়া পলের আর কিছুই করার ছিল না। বহু কষ্টে ও গামায় এর ওপর পড়ার হাত থেকে টুকরোটাকে আটকালো। কিন্তু ততক্ষণে গামায় বাকি সিটগুলোর গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে দিয়েছে।

এবার ওজন আবার সামনের দিকে ফিরে আসায় প্লেনের নাক আরো নিচে নেমে গেল আর ওটা প্রচণ্ড গতিতে নিচে নামতে লাগল। গামায় এর মনে হচ্ছে ও পুরো চ্যাপ্টা হয়ে যাবে। ও সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠেলাগাড়িটা ঠেলে সামনে পাঠানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, “এটা হচ্ছে দুনিয়ার জঘন্যতম বুদ্ধি। কার্টের সব বাজে বুদ্ধিকেও হারিয়ে দিতে পারবে।” চিৎকার করে বলল গামায়।

পলও ওর সর্বশক্তি দিয়ে ঠেলাগাড়িটা টানছে যাতে গামায় এর ওপর চাপটা কমে। সব দেখে শুনে ও-ও কথাটায় সায় দিল।

“টেনে ওঠান, টেনে ওঠান। ও নিজেই এখন পাইলটকে নির্দেশ দিতে লাগল। রেজা আর ওর লোকজন মাটিতে সেন্সর পুঁতে বিমানটা ফেরার অপেক্ষা করছে। বিমানের শব্দ পেয়ে ওরা তাকিয়ে দেখে বিমানটা পিঠ বাঁকিয়ে সোজা নিচে নেমে আসছে। ইঞ্জিন প্রচণ্ড শব্দ করছে। নিচ থেকে মনে হয় যে একটা রোলার কোস্টার।

“ওরা করছে টা কী?” একজন লোক রেজাকে জিজ্ঞেস করল।

“আমেরিকানরা সবাই পাগল।” আরেকজন বলল।

.

বিমানে বসে পলও একই কথা ভাবছিল। বিমানের নাক আবারো সোজা হতেই ঠেলাটা আবার নাড়ানো গেল। আর ওরা আবার ওটা টেনে পিছনে নিয়ে গেল। এবার পাইলট আগে থেকেই রেডি ছিল। তাই খুব বেশি সমস্যা হয়নি।

পল দাঁড়িয়ে আছে খোলা দরজার কাছে। ঠেলার এক প্রান্ত ধরে আছে, আর চিন্তা করছে যে কীভাবে নিজে না পড়ে শুধু কীটসুদ্ধ ঠেলাটাকে নিচে ফেলতে পারবে।

জোরে ধাক্কা দেয়া যায়, কিন্তু তাহলে ওকে আটকাবে কে?

“চলে এসেছি প্রায়।” পাইলট চেঁচিয়ে জানালো।

পল গামায়ের দিকে তাকাল, “যখন ভেবেছিলাম তখন তো অনেক সহজ ই লেগেছিল কাজটা।”

“আমার একটা বুদ্ধি এসেছে।” গামায় বলল। তারপর পাইলটের দিকে ফিরে বলল, “বামে মোড় নিন।”

পাইলট ঘুরে তাকাল, “কী?”

গামায় হাত দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে মুখেও বলল। কিন্তু পাইলট বুঝলো বলে মনে হলো না। তবে পল ঠিকই বুঝেছে, “দারুণ বুদ্ধি। তুমি ওনাকে দেখিয়ে দিয়ে আসো।”

গামায় ট্রলিটা ছেড়ে দৌড়ে ককপিটে চলে গেল। সে কো-পাইলটের সিটে বসে পড়ল তারপর হুইল ধরে বলল, “এভাবে!” ও হুইলটা বামে ঠেলে দিল। পাইলটও ওর দেখা দেখি একই কাজ করল আর DC-3 একদিকে কাত হয়ে গেল।

পিছনে পল এক হাত দিয়ে মাল বাঁধার একটা ফিতা টেনে ধরলো আর যতটা সম্ভব দরজা থেকে সরে গেল। বিমানটা বাঁকা হতেই ও ট্রলিটা ধাক্কা দিল আর ওটা খোলা দরজা পেরিয়ে কংক্রিটসহ নেমে গেল নিচের দিকে।

তারপর বিমানটা আবার ভারসাম্যে ফিরতেই ও সতর্কতার সাথে দরজা দিয়ে উঁকি দিল। ট্রলি আর কীটের টুকরো দুটো আলাদা আলাদা বোমার মতো সোজা নিচে নেমে যাচ্ছে। ঘুরছে না বা গোত্তা খাচ্ছে না, নিশ্ৰুপে বাতাস কেটে সোজা পড়ছে নিচে।

গামায়ও দ্রুত ফিরে এসে নিচে তাকাল, “এটাই তোমার এযাবত কালের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধি।” পলের গালে একটা চুমু দিয়ে বলল গামায়। পলও মৃদু হেসে ওর বুদ্ধি কতটা কাজে দেয় তা দেখতে লাগল।

রেজা আর বাকিরাও ওগুলো পড়তে দেখেছে।

“ওগুলো পড়ছে। সবাই রেডি?” রেজা বলল।

এখানে চারটা দল আছে। কয়েক একর জায়গা ছেড়ে ওদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সবাই মাটি খুঁড়ে সেখানে সেন্সর লাগিয়েছে। যদি সব কিছু ঠিক থাকে তাহলে কীটের টুকরোটা মাটিকে আঘাত করলে যে কম্পনের সৃষ্টি হবে তা নিচের পাথরে যে প্রতি ধ্বনির সৃষ্টি করবে এই সেন্সরগুলো সেগুলোকে সনাক্ত করবে। আর তার মাধ্যমে আশা করা যায় বের করা যাবে যে বেলে পাথরের নিচে কি আছে।

‘রেডি! একদল বলল।

‘রেডি! বাকি দলগুলোও জানান দিল।

রেজার দলও রেডি। বোর্ডে সবুজ সংকেত দেখাচ্ছে। তার মানে ওর সেন্সরগুলো নিখুঁতভাবে কাজ করছে। উনি আবার শেষ বারের মতো ওপরে তাকালেন জিনিসগুলোর অবস্থান দেখার জন্যে। এবার তাকাতেই দেখে মনে হলো যে সোজা তার দিকেই আসছে জিনিসগুলো।

“চোখের ভুল।” নিজেকে বোঝালেন রেজা।

আরও এক সেকেন্ড অপেক্ষার পর তিনি ঝেড়ে দৌড় দিয়ে পাশের বালির ওপর গিয়ে পড়লেন।

মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে কীটের টুকরোটা পড়লো। কিন্তু সাথে সাথেই সংঘর্ষের প্রচণ্ড শব্দ পুরো মরুভূমি জুড়ে অনুনাদিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। মাটিতে পড়ে থাকায় রেজা শুধু তার কানেই শুনলেন না সেটা তার বুক, হাত-পা এসব দিয়েও পুরো অনুভব করতে পারলেন।

ঠিক এই জিনিসটাই চাইছিলেন তারা। তিনি ঝটপট উঠে দাঁড়ালেন, তারপর ধুলোবালির মেঘ ভেদ করে নিজের কম্পিউটার চেক করলেন দ্রুত। তখনো সবুজ বাতি জ্বলছে। তবে স্ক্রিনের গ্রাফটা তখনো ফাঁকা।

“কাম অন, কাম অন।” অনুনয় করতে লাগলেন রেজা। অবশেষে একগাদা আঁকাবাঁকা রেখা গ্রাফ জুড়ে ফুটে ওঠা শুরু হলো। প্রতি সেকেন্ডে বাড়ছেই। বিভিন্ন গভীরতা থেকে বিভিন্ন কম্পন ধরা পড়ছে।

“আমরা পেয়ে গেছি।” চিৎকার করে উঠলেন। “আমরা পেয়ে গেছি।” উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে তিনি মাথার হ্যাট খুলে ওপর দিকে ছুঁড়ে দিলেন। DC-3 তখনো নামছে। ডাটা প্রয়োজন ছিল, সেটা তারা পেয়েছেন। এখন খুঁজে বের করতে হবে এগুলোর মানেটা কি।

.

২৩.

তারিক সাকির যে ঘরটায় দাঁড়িয়ে আছেন। সেটা এক সময় শুধু ফারাও আর তাদের পুরোহিতদের জন্যেই সংরক্ষিত ছিল। এটা একটা লুকানো মন্দির। লাশ চোরেরা এটার হদিস না পাওয়ায় এখনো এটা চোখ ধাঁধানো সব অলঙ্কার আর সহায় সম্পদে রা। এখানকার জিনিসপত্র তুতেন খামেনের সমাধিতে আবিত জিনিসপত্রের চেয়েও বেশি। প্রথম দিকের রাজাদের আমলের চিত্রকলা আর হায়রোগ্নিফে দেয়াল ভরা। একটা ছোট স্ফিংসমর্তি একপাশে, সোনার তৈরি পাতা আর নীল রঙের দামি পাথরে ঢাকা। রুমটার ঠিক মাঝখানে ডজন খানেক পাথরের কফিন। প্রতিটার ভেতর একজন করে ফারাওয়ের লাশ পাওয়া যাবে। এতোদিন সবার ধারণা ছিল এগুলো চুরি করে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে আরো হাজার বছর আগেই। কফিনগুলোর চারপাশে নানান জীব জন্তুর মমি। মিসরীয়দের ধারণা ছিল পরকালেও এরা তাদের মনিবের কাজে লাগবে। ওগুলোর পাশেই একটা কাঠের নৌকার কঙ্কালটা পড়ে আছে।

পৃথিবীর খুব বেশি মানুষ এই কক্ষটার কথা জানে না। কাউকেও জানানোরও ইচ্ছে সাকিরের নেই। তবে ও প্রায়ই বিশেষজ্ঞ এনে এনে এখানকার জিনিসপত্র পরীক্ষা করিয়েছেন। আর শুধু ও আর ওর লোকেরাই এই প্রাচীন গৌরবের সৌন্দর্য একা একা উপভোগ করার বিপক্ষে কোনো যুক্তি খুঁজে পাননি।

তার ওপর উনি যদি সফল হন, তাহলে উত্তর আফ্রিকা জুড়ে তার নিজেরই সৃষ্ট নতুন এক সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন হবে।

কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি একটা ঝামেলায় পড়েছেন।

সমাধি কক্ষটা ছেড়ে তিনি কন্ট্রোল রুমের দিকে এগুলেন। সেখানে তার বিশ্বস্ত সহচর হাসান হাঁটুমুড়ে বসে আছে। কপালে তাক করা পিস্তল। সাকির-ই এটা করার নির্দেশ দিয়েছেন।

“তারিক এসব কেন করছেন? হয়েছেটা কি?” হাসান জিজ্ঞাসা করল।

সাকির এক পা সামনে বেড়ে শাসানোর ভঙ্গিতে একটা আঙুল তুললেন। হাসান তা দেখে চুপ করে গেল, “এখনই দেখতে পাবে সেটা।” বললেন সাকির।

একটা রিমোট টিপতেই দূরের দেয়ালে একটা স্ক্রিন ফুটে উঠল। ছবি আসতেই চার নাম্বারের ফোস্কা পড়া মুখটা ভেসে উঠল।

“মাল্টা থেকে রিপোর্ট এসেছে। হ্যাগেন আর তোমার বেছে নেয়া দুজনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমেরিকানগুলোকে সরিয়ে দেয়ার। একজন ওদের হাতেই মারা যায়, হ্যাগেন ধরা পড়ে আর একজন পালিয়ে যায়। আমাদের কোনো লোকই যাতে ধরা না পড়ে সেটা নিশ্চিত করা যে কতো জরুরি তা তুমি জানো।”

“জানি। আর জানিই বলেই তো”

“তুমি এমন একজনকে পাঠিয়েছ যে কি-না প্রথমবার ব্যর্থ হয়েছিল। এমন একজনকে পাঠিয়েছ যে কি-না তিনদিন আগে মরুভূমিতেই মরে পড়ে আছে বলে আমি জানতাম। প্রচণ্ড রেগে বললেন সাকির।

“ও যে মারা গিয়েছে এ কথা আমি কখনোই বলিনি।”

“বেচে যে আছে সেটাও জানাওনি। দুটোই একই কথা।” সাকির বললেন।

“না। সে বেঁচে গিয়েছিল। আপনি খোঁজ পাননি। আপনিই নির্দেশ দিয়েছিলেন যে যদি কেউ চেক পয়েন্টে বেঁচে ফিরতে পারে তাহলে তাকে আরেকটা সুযোগ দেয়া হবে। আমি শুধু সেই আদেশ পালন করেছি মাত্র।”

নিজের কথাই নিজের বিরুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে দেখে সাকিরের মুখ কালো হয়ে গেল, “হ্যাঁ, কিন্তু চেক পয়েন্ট পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে কারো বেঁচে থাকা সম্ভব না। শুধু তিরিশ মাইল-ই না। ওপরে গনগনে সূর্য, নিচে তপ্ত বালু, পানি নেই, ছায়া নেই। তার ওপর কয়েক সপ্তাহ ধরেই চলা কঠিন প্রতিযোগিতা তো আছেই।”

“আমিতো বললামই যে ও পেরেছে। আর কারো সাহায্য ছাড়াই। ওর মুখের দিকে দেখেছেন? হাতের দিকে দেখেন। মরে যাচ্ছে মনে করে ওকে বালিতে গর্ত করে পুঁতে দেয়া হয়। সেখানে ও সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। তারপর সূর্য ডুবলে গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে এসে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। হাসান বলল।

সাকিরও ক্ষতগুলো খেয়াল করেছে। মনে মনে ছেলেটার বুদ্ধির তারিফ না করে পারলো না। তো আমার লোকেরা খবর পাঠায়নি কেন?”

“ও যখন পৌঁছায় তখন চেক পয়েন্টে কেউ ছিল না। আপনার মতোই সবাই ভেবেছিল যে কেউ বেঁচে ফিরতে পারবে না। চার নম্বর তালা ভেঙে ঢুকে আমার সাথে যোগাযোগ করে। ওর শক্তি আর দৃঢ় সংকল্প দেখে বুঝতে পারি যে আমাদের লোকের ওপর ওর নজরদারির জন্যে ওর চেয়ে ভালো আর কেউ হবে না। ওকে কেউ চেনে না। ওকে আদেশ দেই যে যদি কেউ ধরা পড়ে যা আমাদের খবর ফাঁস হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা দেয়া মাত্র তাকে সরিয়ে দিতে হবে।” প্রশ্নাতীতভাবে সাকিরই ওসাইরিস এর একচ্ছত্র অধিপতি। তবে নিজের ভুল স্বীকার করতে সে দ্বিধা করে না। যদি হাসান সত্যি কথাই বলে থাকে তাহলে চার নম্বরই একটা পদ পাওয়ার একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি। তবে তার আগে ওকে একটা নাম দিতে হবে।

হাসানকে চুপ থাকতে বলে সাকির স্যাটেলাইট চার নাম্বারের সাথে কথা বলল কিছুক্ষণ। কথাগুলো হাসানের সাথে হুবহু মিলে না গেলেও কাছাকাছিই ছিল। এ কারণেই সাকির বিশ্বাস করলেন যে দুজনে মিলে গল্পটা বানায়নি, সত্য কথাই বলছে ওরা।

তারপর হাসানের পিছনে থাকা প্রহরীদের নির্দেশ দিলেন, “ওকে ছেড়ে দাও।” প্রহরীরা সরে যেতেই হাসান উঠে দাঁড়ালো। সাকির আবার চার নম্বরের দিকে মনোযোগ দিলেন।

“তোমাকে একটা গল্প বলি শোনো। আমি যখন ছোট, তখন আমার পরিবার থাকতো কায়রোর শহরতলীতে। আমার বাবা ভাঙ্গারির লোহা সংগ্রহ করে বিক্রি করতেন। দুবেলা পেটভরে খাবার জুটতো না নিয়মিত। একদিন হঠাৎ বাসায় একটা বিছে ঢুকে পড়ে। আমাকে কামড়ও দেয়। আমি রেগে ওটাকে একটা ইট দিয়ে থেতলে দিতে যাই। কিন্তু বাবা আমার হাত ধরে ফেলেন। তিনি বলেন আমাকে একটা জিনিস শেখাতে চান। তাই আমরা বিছেটাকে একটা পাত্রে রেখে সেটাকে পানি দিয়ে ভরে দিলাম। প্রথমে গরম পানি, তারপর ঠাণ্ডা পানি। তারপর ওটাকে একটা কাঁচের পাত্রের মধ্যে রেখে রোদের মধ্যে ফেলে রাখলাম কয়েকদিন। তারপর ওটার ওপর স্পিরিট ঢেলে দিলাম। ওটা সাঁতার কাটার অনেক চেষ্টা করল কিন্তু না পেরে শেষ পর্যন্ত পাত্রের নিচেই পড়ে থাকল। পরের দিন আমরা বিছেটাকে বাড়ির পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিলাম। ওটা মরে তো নি উল্টো সাথে সাথে আমাদেরকে আক্রমণ করল। কিন্তু আমার কাছে পৌঁছার আগেই বাবা ওটাকে বাড়ি দিয়ে দূরে পাঠিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, “এই বিছেরাই আমাদের ভাই। জেদি, বিষাক্ত আর সহজে মরেও না। বিছেরা উন্নত হৃদয়ের অধিকারী।”

স্ক্রিনে দেখা গেল চার নম্বর হালকা মাথা ঝোকালো।

“তুমি তোমার যোগ্যতা প্রমাণ করেছ। এখন থেকে তুমি আমাদের একজন। আমাদের ভাই। তোমার কোড নেম হবে স্করপিয়ন (বিছে)। কারণ তুমি জেদি। মারাও শক্ত সেই সাথে উন্নত হৃদয়ের অধিকারী। তুমি সেদিন নিজের প্রাণ ভিক্ষা চাও নি। একটা বার ভয়ও পাওনি। সেজন্য আমি খুবই খুশি হয়েছি।

স্ক্রিনে দেখা গেল সদ্য নাম পাওয়া লোকটা মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন গ্রহণ করেছে।

“মুখের ক্ষতগুলোকে গর্বের সাথে লালন করবে।” সাকির বললেন।

“অবশ্যই।”

“এখন কি করবো আমরা?” হাসান জিজ্ঞেস করল। কথাবার্তা বলে আবার স্বাভাবিক হতে চাইছে ও। তবে আপাতত বেঁচে থাকতে পেরেই খুশি।

“যা বলেছিলাম সেটাই। লোকজনের সামনে আসার আগেই শিলালিপিগুলো চরি করবে আর যাদুঘর থেকে ওটার অস্তিত্বের সব প্রমাণও মুছে ফেলবে। আর এবার তুমি নিজে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে সব তত্ত্ববধান করবে।” সাকির বললেন।

.

২৪.

মাল্টা
সন্ধ্যা ৭টা

একটা ডেলিভারি ট্রাক বিশাল একটা গুদাম ঘরের মালপত্র ওঠানামার জায়গাটায় ঢুকতেই একটা কর্কশ শব্দ রাত্রির নিস্তব্দতা ভেঙে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। গুদাম ঘরটার মালিক মালটা সমুদ্রতাত্ত্বিক যাদুঘর। এখানেই মূলত তাদের নতুন নতুন মালামাল এনে রাখা হয় বা পুরনো জিনিস এনে ঝড়াপোছা করা হয়। গুদাম ঘরের গেট থেকেই দুজন সিকিউরিটি গার্ড গাড়িটাকে আসতে দেখলো।

“শালার আমরা দুজনই এখানে পচে মরছি আর ডেলিভারি নিচ্ছি। বাকিরা সবাই যাদুঘরের সব সুন্দর জিনিস দেখে ফেলছে।” একজন গার্ড বলল।

রাস্তার ধারেই লিমুজিনসহ নানান দামি দামি গাড়ি কিছুক্ষণ পর পর এসে যাদুঘরের মেইন বিল্ডিং-এর সামনে দাঁড়াচ্ছে। এখানেই হবে আজকের অনুষ্ঠান। অতিথিদের কেউ কেউ নৌকাতে করেও আসছেন। দূরেই ভাসছে তাদের ইয়ট।

গাড়ি থেকে নামছেন গণ্যমান্য সব ব্যক্তি, তাদের স্ত্রী বা বান্ধবী, তার সাথে ঝলমলে পোশাক পরা লাবণ্যময়ী যুবতীদের দল তো আছেই। এ কারণেই গুদাম ঘরের গার্ডটা এতো বিরক্ত।

দ্বিতীয় গার্ডটা কাঁধ ঝাঁকালো, “চিন্তা করোনা। কিছুক্ষণ পরেই দেখবে কারো কানের দুল খুলে পড়ে গিয়েছে আর তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়েছে সেটা খুজতে, আর এদিকে আমরা আরাম করে এখানে বসে থাকবো।”

“হুম! আচ্ছা চলো দেখি ট্রাকে কি এলো।” একটা ক্লিপবোর্ড হাতে নিয়ে বলল গার্ড।

প্রথম জন মাল খালাসের জায়গায় এগুতেই পিছনের জন দরজা বন্ধ করে দিল। চারপাশের দেয়ালের মাথায় কাটা বসানো। হাত দিলে কেটে যায়। ওটাই প্রথম স্তরের নিরাপত্তা। এরপর দ্বিতীয় স্তর হলো দরজায় লাগানো সিকিউরিটি কীপ্যাড।

সেখানে কার্ড ঢুকিয়ে ভেতরে ঢুকতে হয়। তবে তারপরেও চব্বিশ ঘণ্টা এখানে পাহারা থাকে। আর কেনসিংটন খুন হওয়ার পর এখন লোকসংখ্যা তিন গুণ বাড়ানো হয়েছে।

ট্রাকটা হালকা ঝাঁকুনি খেয়ে প্লার্টফর্মে উঠে এলো। ড্রাইভার লাফ দিয়ে নেমে পিছনে এসে দরজা খুলে দিল।

“কি নিয়ে এসেছেন আপনি?” গার্ড জিজ্ঞেস করল।

“শেষ মুহূর্তের জিনিস পত্র।”

গার্ড ট্রাকের ভেতর উঁকি দিল। একটা কাঠের বক্সমতো দেখা যাচ্ছে ভেতরে। আট ফুট মতো লম্বা, চার ফুট চওড়া আর উচ্চতা পাঁচ ফুট হবে হয়তো।

“রিসিট নাম্বার?” গার্ড জিজ্ঞেস করল।

“SN-5417” নিজের ক্লিপবোর্ডের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল ড্রাইভার। কিন্তু গার্ড নিজের কাছের কাগজে এই নাম্বারের কোনো অর্ডার দেখতে পেল না। পরের পাতা উল্টে একদম শেষে পেল নাম্বারটা। যাক পেয়েছি। একেবারে শেষ মুহূর্তে যোগ করা হয়েছে দেখছি। কোথায় ছিলেন এতোক্ষণ? এটাতো আরো এক ঘণ্টা আগে পৌঁছে দেয়ার কথা।”

ড্রাইভারকে কিছুটা হতাশ দেখালে, “আমাদের বের হতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল, আর আপনাদের এই পার্টি পুরো শহরে জ্যাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আসতে যে পেরেছি এই বেশি।”

গার্ডও একমত হলো, “দেখি একবার জিনিসাটা?”

বাক্সটার ঢাকনার নিচে একটা স্কু-ড্রাইভার ঢুকিয়ে খুলে ফেলল ওটা। ভেতরে খড়ের গাদার ভেতর শুয়ে আছে একটা মানুষ মারা কামানের নল। এগুলো দিয়ে ছররা গুলি বের হতো। ডেলিভারি শিট অনুযায়ী এটা আঠারো শতকের একটা ব্রিটিশ জাহাজ থেকে পাওয়া। তার পাশেই অনেক তরবারি দেখা গেল। সেগুলো অন্ন প্রতিরোধী কাগজ দিয়ে মোড়া।

সন্তুষ্ট হয়ে ট্রলি হাতে এক কর্মচারীকে বলল, “এগুলো পিছনে নিয়ে গিয়ে একপাশে সরিয়ে রাখো। দেখো রাস্তার মাঝে ফেলে রেখো না। পার্টি শেষ হলে তারপর এগুলোর ব্যবস্থা করবো।”

ট্রলিওয়ালা মাথা ঝাঁকালো। সে অবশ্য এখানে থাকতে পেরে খুবই খুশি। রাতের ডিউটি মানেই ওভার টাইম। আর যদি কাজ মাঝরাত পার হয়ে যায় তাহলেই দ্বিগুণ টাকা পাওয়া যায়। আজতো মাঝরাত পার হবেই। সে বাক্সটা ট্রলিতে তুলে নিয়ে গুদামের দিকে চলে গেল। রাস্তা আটকাবে না এমন একটা জায়গা খুঁজে বের করে তবেই থামল।

বাক্সটা নামিয়ে রাখার সময় সামান্য ঝাঁকি লাগল। এক নজর দেখেই লোকটা বুঝলো যে সবার নিচের কাঠের তক্তাটা ফেটে গেছে নিশ্চিত। লোকটা কাঁধ ঝাঁকালো। প্রায়ই এরকম হয়।

তারপর আবার সে সামনের দিকে ফিরে গেল। আপাতত আর কোনো কাজ নেই। কিছুক্ষণ তাই টিভি দেখার সিদ্ধান্ত নিলো সে।

ট্রলিটা রেখে মাথার শক্ত ক্যাপটা খুলে দরজা খুলে ঢুকতেই চোখে পড়ল মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে লাশ। এ মধ্যে মাত্র যে দুজন গার্ড ডেলিভারি নিয়েছে তাদের লাশও আছে।

রুমের অপর পাশেই পিস্তল হাতে আরো কয়েক সিকিউরিটি গার্ডকে দেখা গেল। লোকটা ঘুরে পালাতে গেল, কিন্তু তার আগেই গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলের মৃদু শব্দ কেউ টেরও পেল না। লোকটা তখনো মরেনি। আরেকটা গুলি হলো, লোকটা এবার কাত হয়ে উল্টে আরেকটা লাশের ওপর পড়ল।

ট্রলিচালক লোকটা আরেকটু ভালো করে খেয়াল করলেই দেখতে পেতে যে এই গার্ডগুলো আসলে নতুন যাদেরকে ভাড়া করা হয়েছে তারা। আর তাদের পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে ঝলসানো মুখের একজন মানুষ। কিন্তু এসব তথ্য তার মস্তিস্কে পৌঁছানোর আগেই লোকটা মারা গিয়েছে।

.

২৫.

আবদ্ধ একটা জায়গায় আটকে আছে কার্ট। দমবন্ধ লাগছে ওর। ডাইভিং মাস্কের ভেতর দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল বাইরে। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার বাদে কিছুই নেই। কয়েকবার ধীরে ধীরে শ্বাস নিলো ও তারপর কততক্ষণ পর হয়েছে অনুমান করার চেষ্টা করল। কিন্তু ঠাহর করতে পারলো না। এরকম একটা অন্ধকার আর নিশূপ জায়গায় শুয়ে থাকা আর সেনসরি ডিপ্রাইভেশন ট্যাঙ্কের ভেতর শুয়ে থাকা একই কথা।

ও পা সোজা করার চেষ্টা করল কিন্তু পা নাড়াতে পারলো না। বহু কষ্টে পা-টা মোচড়া মুচড়ি করতে লাগল। যেন ছোট্ট কোনো প্রাণী মাটি খুঁড়ে বের হতে চাচ্ছে। তারপর পাপোষে পা মোছর মতো করে প্যাকিং-এর জিনিসপত্রের গায়ে পা ঘষতে লাগল।

“আস্তে। আমার বুকে লাথি লাগছে।” একটা কণ্ঠ শোনা গেল। কার্ট নিশ্বাসের পাইপ থেকে মুখ সরিয়ে বলল, “স্যরি। তবে মোচড়া মুচড়িতে লাভ হয়েছে কিছুটা। তবে তখনও অস্বস্তি কাটেনি। পিঠে তীক্ষ্ণ একটার খোঁচা লাগছে। আর গায়ের ওপরের খড়ের কারণে চুলকাচ্ছে শরীর। শেষমেশ আর থাকতে পারলো না।

হাতটা বাঁকিয়ে চুরিয়ে মুখের সামনে নিয়ে আসলো। ঘড়িতে জ্বলজ্বল করছে কাটা।

“দশটা ত্রিশ। পার্টি এতোক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে। কেঁচোর মতো গর্ত ছেড়ে বের হওয়ার সময় হয়ে গেছে।” কার্ট বলল।

“কেঁচো আমার একদম পছন্দ না। তবে তোমার লাথির হাত থেকে বাঁচতে, এই মুহূর্তে কেঁচো হতেও আপত্তি নেই।”

কার্ট খড় আর ফোমের জঙ্গল ভেদ করে মাথা উঁচু করল। বাইরে কোনো সাড়া-শব্দ আছে কি-না শোনার চেষ্টা করছে। কিছুই শুনতে না পেয়ে ওর মুখোশের একপাশের একটা সুইচ টিপে দিতেই মাথার ওপর একটা LED লাইট জ্বলে উঠল। তার আলোয় দেখা গেল জো-ও পাশেই মাথা তুলেছে।

“এটা তোমার এযাবত কালের সবচেয়ে জঘন্য বুদ্ধি। পল আর গামায়কে যখন বলবো যে বুদ্ধিটা কাজ করেছে তখন ওরা বিশ্বাসই করবে না”, জো বলল।

“এটাকে বলে, থিং কিং আউট অফ দ্য বক্স”, কার্ট দাবি করল।

“মজা পেলুম!” জো বলল, যদিও কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে না যে মজা পাচ্ছে।

“কতক্ষণ ধরে এই ডায়লগ ঝাড়ার জন্যে আঁকুপাঁকু করছো?”

“একঘণ্টার মতো। আরে শোনো এবার ভুলটা কোথায় হয়েছে ধরতে পেরেছি। পরের বার আরও বড় একটা বাক্সের ব্যবস্থা করবো।” কার্ট বলল।

“পরেরবার আর বক্সে ঢুকতে হবে না। নিজেই একটা বক্স সেজে নিও।” জো জবাব দিল।

অনেক চেষ্টার পরেও খড় আর কাঠের গুড়া-টুড়া ওদের সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এদিকে রাস্তায়ও জ্যাম। আর সবশেষ ডেলিভারির পর রাখার সময় ওদেরকে প্রায় তিনফুট ওপর থেকে আছাড় মেরে ফেলা হয়েছে।

“ভাগ্য ভালো যে ব্যাটারা কামানটা ভালো মতো পরীক্ষা করে দেখেনি। একপাশে মেড ইন চায়না লেখা আছে।”

“তোমার কি একটা সত্যিকার কামানের নিচে সেনোর শখ হয়েছে নাকি?”

“বেশি আরাম তো লাগার কথা না।” জো বলল।

কার্টও একমত হলো, “আমাদেরকে জায়গা মতো ডেলিভারি করলেই হয় এখন।” কার্ট ওর অন্য হাতটাও খড় থেকে ছাড়িয়ে ওর বাহুর সাথে বাঁধা একটা ভেলক্রো প্যাক খুললো। সেখান থেকে একটা সরু কালো তার বের করে প্যাঁচ খুললো। তার এক মাথা লাগানো নিজের চশমার সাথে অন্য মাথা লাগানো একটা খুবই ছোট্ট ক্যামেরার সাথে। চারপাশটা পরীক্ষা করে দেখবে একবার।

“পেরিস্কোপ।” ফিসফিস করে বলল ও।

ক্যামেরাটা চালু করে সেটাকে বাক্সের ওপরের একটা ছিদ্র দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। লেন্স ফোকাস করতেই কার্টের মাস্কের ভেতর ছবিগুলো চলে যেতে লাগল। যদিও সব ঝাপসা কারণ, গুদামের এদিকটায় বেশি আলো নেই।

“কোনো জাপানি যুদ্ধ জাহাজ দেখা যাচ্ছে?” জো জিজ্ঞেস করল।

কার্ট ক্যামেরার মুখ ঘুরালো আরেক দিকে। “না মি. জাভালা। সাগর পুরো শান্ত। আপনি চাইলেই পানির ওপর উঠতে পারেন।”

কার্ট ক্যামেরাটা আবার খুলে ওর প্যাকে রেখে দিল। আর জো ঢাকনা খোলার কাজে মনোযোগ দিল। কার্টও মাথার লাইট বন্ধ করে ওর পাশের অংশে ঠেলা শুরু করল। দুজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শেষে খুলে গেল ঢাকনা।

জো-ই প্রথম বের হলো বাক্স থেকে। কার্টও বের হলো এক সেকেন্ড পর। তারপরই দুজন বাক্সটার পিছনে লুকিয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে পুরোপুরি হাত পা-এর অনুভূতি ফিরে আসার পর ওরা উঠে বসলো।

“রাস্তা থেকে দেখে যতটা ভেবেছিলাম, এটা তো তারচেয়েও অনেক বড়।” জো বলল।

কার্ট চারপাশে চোখ বুলালোর ঘরে প্রচুর জিনিস, তবে সবই যে নির্দিষ্টভাবে ভাগ করে রাখা তা বোঝা যায়। পিছন দিকে ওরা যেখানে আছে, সেখানকার সব জিনিসই মাটিতে রাখা। তবে অন্যান্য দিকে বেশ কিছু তাক আর শেল্ফ দেখা গেল।

“এতো কম সময়ে এতকিছু চেক করা সম্ভব না।” জো বলল।

“সব দেখতে হবে না। শুধু নিলামের জন্য যেগুলো আনা সেগুলো দেখতে হবে। তার মধ্যেও যেগুলো মিসরীয় সেগুলো। ওরা যেগুলো নিলামে তুলবে সেগুলো এই হয় মাটিতে নামিয়ে রেখেছে। না হয় একেবারে আলাদা করে কোথাও রেখেছে। তাই আপাতত শেল্ফগুলোর দেখার দরকার নেই। তুমি ডান দিকে দেখো, আমি বামে দেখছি। এদিক থেকে দেখে দেখে সামনে পর্যন্ত যাবো।”

জো মাথা ঝাঁকিয়ে কানের ভেতর একটা ছোট মাইক্রোফোন খুঁজে দিল। কার্টও একই কাজ করল। এরপর দুজনের হাতেই দেখা গেল ইনফ্রারেড ক্যামেরা। অন্ধকারেও ছবি তুলতে পারে এগুলো। পরে ছবিগুলো কাজে লাগতে পারে।

“চোখ খোলা রেখো। আগের দিনের ঘটনার পর সিকিউরিটি কিন্তু খুব কড়া হবে। আর আমি নিজেও গুলি খেতে চাই না, বা ওদের কাউকেও গুলি করতে চাই না। কিছু হলেই এখানে এসে লুকিয়ে থেকো। কার্ট সাবধান করল জো-কে।

“বলতে হবে না সেটা। পিস্তল আর শর্টগানের বিপক্ষে টীজার আর পিপার স্প্রে যে কাজ করবে না তা আমি জানি।”

যেহেতু ওরা জানে যে এখানকার সিকিউরিটিরা নিতান্তই নির্দোষ মানুষ, সেজন্য প্রাণঘাতী কোনো অস্ত্র আনেনি। খুব দরকার পড়লে যাতে কাজে লাগে তাই নিরীহ পদ্ধতিই ব্যবহার করবে।

“সুতরাং পিস্তলধারী কারো হাতে ধরা পড়োনা যেন।” কার্ট বলল।

“দারুণ উপদেশ।”

কার্ট দাঁত বের করে হাসলো, তারপর তীরন্দাজদের মতো দু আঙুল দিয়ে স্যালুট করে সামনের আলো ছায়ায় ঘেরা অংশটার দিকে এগিয়ে গেল।

.

২৬.

হাসান মাল্টা পৌঁছালো পার্টি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগে। এখন থেকে ও-ই সব দেখবে। প্রথমত, ঐ শিলালিপিগুলো উদ্ধার করতে হবে, আর ওগুলোর অস্তিত্বের সব প্রমাণ গায়েব করতে হবে। ভাগ্য ভালো যে ওর লোকেরা এর মধ্যেই যাদুঘরের সিকিউরিটি সার্ভিসে ঢুকে পড়েছে। এতোক্ষণে গুদাম ঘরটার ভেতর শিলালিপিটা খোঁজাও শুরু করার কথা। এখন শুধু সিকিউরিটি সুপারভাইজারকে অন্য কাজে ব্যস্ত রাখতে পারলেই হবে। লোকটা এই মুহূর্তে বলরুমের দায়িত্বে থাকা সিকিউরিটিদের সাথে রেডিওতে কথা বলছে। আর হাসান তার পিছনেই উদ্যত পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ভাগ্যটা একটু বেশিই ভালো বলা যায়। সিকিউরিটি গার্ডদের চারভাগের তিনভাগই এখন বলরুমের আশেপাশে দায়িত্ব পালন করছে। তার মানে গুদামে মাত্র আটজন লোক। এর মধ্যে দুজন আবার ওসাইরিসের হয়ে কাজ করে।

হাসান জানে গুদামের পুরাকীর্তিগুলোর অনেক দাম। তবে ওর কাছে ওগুলো ইয়ট, বা ব্যক্তিগত বিমান চালানো এসব ধনকুবেরদের কাছে কিছুই না।

রেডিওতে একটা কল আসলো, “চার পাশটা খুঁজে দেখা শেষ। চারপাশে হীরা জহরতে ভরা। তবে সবকিছু ঠিক আছে।”

সুপার ভাইজার ইতস্তত করতে লাগল।

“জবাব দিন।” পিস্তলটা আরো একটু ঠেলে আদেশ দিল হাসান।

সুপারভাইজার নিজের মাইক্রোফোন তুললো, “খুব ভালো, তিরিশ মিনিট পর আবার খবর দিও।”

“ঠিক আছে। কয়েকজনকে একটু বাইরে পাঠিয়ে দেবো নাকি? অনেকেই দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হচ্ছে। গুদামের ওদিক থেকে ওদের বদলে আসতে বললেই হয়।”

হাসান মাথা নাড়লো। অদল-বদল করার মতো কেউই বেঁচে নেই।

“এখনই না। ভালো মতো খেয়াল রেখো সব। সুপারভাইজার বলল।

কিছুক্ষণের জন্যে আর ঝামেলা নেই। “এখন আমাকে একত্রিশ, চৌত্রিশ আর সাতচল্লিশ নম্বর মাল যেখানে আছে সেখানে নিয়ে যান।” হাসান বলল।

সুপার ভাইজার এক সেকেন্ড ভাবলো যে কি করবে। হাসান ওর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সজোরে চড় কষালো তার মুখে। সুপারভাইজার চেয়ারসুদ্ধ উল্টে মাটিতে পড়ে গেল।

“দেরি করা আমার একদম পছন্দ না।” হাসান জানালো।

একান্ত আনুগত্যের মতো হাত নেড়ে সুপার ভাইজার বলল, “চলুন নিয়ে যাচ্ছি।”

হাসান স্করপিয়নের দিকে ফিরলো, “বোমাগুলো গুদামে নিয়ে যাও। যদি উদ্ধার করা সম্ভব না হয়, তাহলে ওগুলো ধ্বংস করে দিতে হবে। তবে ওগুলো অক্ষত অবস্থায় মিসরে ফিরিয়ে নেয়াই আমি বেশি পছন্দ করবো।”

তারপর দ্বিতীয় আরেকটা লোকের দিকে ফিরে বলল, “সব কম্পিউটারে Cyan-ভাইরাস ঢুকিয়ে দাও। ঐ শিলালিপিগুলো সম্পর্কে কোনো তথ্যই যেন ওতে না থাকে।”

লোকটা মাথা ঝাঁকাতেই হাসান সন্তুষ্ট হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। সবকিছুই ঠিকঠাক মতো চলছে। কিন্তু কেউই টিভি স্ক্রিনের দিকে খেয়াল করল না। বিভিন্ন সিকিউরিটি ক্যামেরার দৃশ্য ওখানে দেখা যাচ্ছে। খেয়াল করলে ওরা দেখতে পেতো দুটো স্ক্রীনে দেখা যাচ্ছে দুটো কালো অবয়ব গুদাম ঘরে কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে।

স্বরপিয়ন একটা চারচাকার ট্রলি নিয়ে ফিরে এলো।

“চমৎকার, একত্রিশ নাম্বার দিয়েই শুরু করা যাক।” হাসান বলল প্রশংসার সুরে।

.

জো একটা শক্ত প্লাস্টিকের কেস-এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একপাশে একটা ছোট কাগজে লেখা XXXI।

“একত্রিশ,” বিড়বিড় করে বলল ও।

জো ওপরের ঢাকনাটা সরিয়ে একটা আগুনরোধী কাগজ তুলে আনলো। এটার ঠিক নিচেই একটা ভাঙ্গা শিলালিপি দেখা গেল। মিসরীয় চিত্র কর্ম তাতে।

ছবিটায় একজন লম্বা সবুজ মানুষ একটা মন্দিরের ভেতর দাঁড়িয়ে নিজের হাত একদিকে বাড়িয়ে রেখেছে। হাতের নিচেই অনেক মানুষ মেঝের ওপর শুয়ে আছে। সবুজ লোকটার হাত থেকে ঘুমন্ত বা মৃত লোকগুলোর পর্যন্ত দাগ টানা। দেখে মনে হয় যেন লোকটা শোয়া মানুষগুলোকে শূন্যে ভাসানোর চেষ্টা করছে। ওপরের কোণার দিকে একটা গোলাকার পিণ্ড আঁকা তবে সেটা আবার কালো রঙ দিয়ে ঢাকা। সম্ভবত সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ বোঝানো হচ্ছে।

জো মিসরে বেশ কিছুদিন ছিল। কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁড়াখুড়িও করেছে। প্রাচীন মিসরীয় চিহ্ন-টিহ্নও কিছুটা চেনে।

জো কানের ইয়ার পিসে লাগানো একটা তার ধরে মোচড় দিল। এখন ও কার্টের সাথে কথা বলতে পারবো। “মিসরীয় ছবি আঁকা একটা শিলালিপি পেয়েছি। সবুজ একটা মানুষ আঁকা। বিশাল সাইজ। একবার দেখে যাও।”

“তুমি কী নিশ্চিত যে ওটা দ্য ইনক্রেডিবল হাল্ক-এর প্রথম দিককার কোনো ছবি না?” কার্ট বলল শান্ত স্বরে।

“তাহলে তো ভালোই। সেই জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছি।” জো বলল ফিসফিস করে। তারপর ক্যামেরাটা নিয়ে একটা ছবি তুললো আর আবার যেমন ছিল তেমন রেখে দিল।

অন্য পাশে কার্ট অবশ্য এখনও তেমন কিছু খুঁজে পায়নি। তবে সময়ও নষ্ট করেনি একটুও। বেশির ভাগ জাদুঘরের মতোই প্রদর্শন ক্ষমতার অতিরিক্ত পুরার্কীতি দিয়ে এটা ভরা। মাঝ মাঝে হয়তো অদল-বদল করে প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেশিরভাগই গুদামে পড়ে থেকে থেকে ধুলো সঞ্চয়

আর যেহেতু এগুলো গুছিয়ে রাখার কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিও নেই, তাই ঠিকভাবে সেটা করাও সম্ভব হয় না। এখন পর্যন্ত কার্ট পেলোপনেশিয়ান বিদ্রোহ থেকে রোমান সাম্রাজ্য পর্যন্ত সব ধরনের পুরাকীর্তিই খুঁজে পেয়েছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের জিনিসপত্রও আছে। পাশেই আছে ফরাসি বিদ্রোহের সময়কার ধ্বংসাবশেষ। ওয়াটারলু যুদ্ধে বিট্রিশদের ব্যবহৃত অস্ত্র এমনকি অ্যাডমিরাল নেলসন ট্রাফালগারে আহত হওয়ার পর যে কাপড়টা দিয়ে বেঁধে রক্তপাত বন্ধ করছিলেন সেটাও আছে।

কাপড়টা যদি আসল হয় তাহলে এটা রয়্যাল নেভীর কাছে একেবারে ধর্মীয় জিনিসের মতোই মর্যাদা পাবে। তবে মাল্টায় জিনিসটা বিক্রির জন্য ভোলা হচ্ছে দেখে জিনিসটার সম্পর্কে সন্দেহ যাচ্ছে না। তবে জঙ্গলের ভেতরেও গুপ্তধন পাওয়া যায়।

এর পাশেই নেপোলিয়নের কিছু জিনিসপত্র দেখতে পেল ও। সবই নাম্বার বসানো। এর মধ্যে একটা XVI।

প্রথম যে জিনিসটা সেটা হলো একতাড়া চিঠি। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে পাঠানো আদেশ নামাও আছে। পরেরটা হলো আরো বেশি টাকা চেয়ে অনুরোধ পত্র। চিঠিটা প্যারিসে পাঠানো হয়েছিল তবে তার আগেই ব্রিটিশদের হাতে পড়ে এটা। সবশেষে একটা ছোট বই, ওপরে লেখা “নেপেলিয়নের ডায়রি।”

সময় খুবই কম। কিন্তু তারপরও কার্ট একবার ভেতরে তাকানোর লোভ সামলাতে পারলো না। এর আগে কোনোদিন নেপোলিয়নের কোনো ডায়রির কথা শোনেননি। বাক্সটা খুলে আগুনরোধী খামের ভেতর থেকে ডায়রিটা বের করল। কিন্তু ভেতরে কোনো ডায়রি নেই। তার বদলে একটা বই। হোমারের “ওডিসি”। বইটা উল্টে-পাল্টে দেখে ফ্রেঞ্চ ভাষায় বইটার এখানে সেখানে লেখা। এগুলো কী নেপোলিয়নের লেখা নাকি? সম্ভবত সেরকমই কিছু হবে। কিন্তু এটাকে কী নেপোলিয়নের ডায়রি বলে চালানো যাবে কি-না তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে।

পাতাগুলো উল্টাতেই একটা অসংগতি চোখে পড়ল। কয়েকটা পাতা নেই। আর বেশ কিছু শব্দের চারপাশে গোল করে দাগ দেয়া। দেখেই বোয়া যায় যে, পাতাগুলো টেনে ছেঁড়া হয়েছে। ডায়রির সাথের বর্ণনা লেখা কাগজটা থেকে জানা যায় যে, বইটা ফ্রান্সের সম্রাটের সাথে সেন্ট হেলেনায় তার শেষ দিনগুলো পর্যন্ত ছিল।

খুব আগ্রহ থাকার পরও কার্ট বইটা বন্ধ করে ঠিক আগের মতো করে মুড়ে রেখে দিল। জিনিসটা খুবই টানছে ওকে তবে ওকে এখন আগে মিসরীয় জিনিস খুঁজতে হবে। কারণ কেনসিংটনের খুনী সেটাই খুঁজছিল।

এরপরে কার্ট বিশাল বড় দুটো কাঁচে ঘেরা ট্যাংক দেখতে পেল। প্রথম ট্যাংকটায় পোর্সেলিনের তাকে অসংখ্য দামি দামি জিনিস রাখা। জিনিসটা দেখতে বড় একটা ডিশওয়াশের মতো লাগছে। পরেরটায় বিশাল বড় দুটো কামানের নল। ট্যাঙ্কের পাশের কাগজ থেকে জানা যায় যে ট্যাঙ্ক দুটো পাতিত পানি দিয়ে ভরা। তার মানে জিনিসগুলো সদ্য সমুদ্রতল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সমুদ্রের পানিতে থেকে যে লবণ এগুলোর গায়ে জমা হয়েছে তাকে অপসারণের জন্য এই ব্যবস্থা।

ও গ্লাসের ভেতর দিয়ে উঁকি দিল। মিসরীয় কিছু নেই ওর ভেতর। এতে পুরো বাজার করতে যাওয়ার মতো। সব সময়ই আমি উল্টো দিকে জিনিস খুঁজে হয়রান হই।” বিড়বিড় করল কার্ট।

তারপর ওই সারি বাদ দিয়ে পাশের সারি দেখতে গেল। কিন্তু সাথে সাথেই হামাওঁড়ি দিয়ে কোণের ছায়ার দিকে ঢুকে গেল। সামনের আবছায়ার মধ্যে নাড়াচাড়া দেখা যাচ্ছে। একজন লোক আর একজন মহিলা। অবাক করা ব্যাপার হলো দুজনেরই পরনে পার্টিতে আসার পোশাক। আর দুজনেরই হাতে পিস্তল।

.

২৭.

কার্ট ইয়ারফোনের সুইচ টিপে জো কে বলল, “এদিকে দুজন লোক দেখা যাচ্ছে।”

“এদিকে আমিও একা না।” জো জবাব দিল।

“ঘরের মাঝের দিকে চলে এসো। আমাদেরকে লুকাতে হবে।” কার্ট বলল। কার্ট ঘুরে আবার সেই পাতিত পানির ট্যাঙ্কের কাছে চলে এলো। জোও সেখানেই এসে হাজির হলো।

“অফিস থেকে একজন লোক এসেছে। সারা গায়ে ছোট বড় অস্ত্র ঝোলানো।” জো বলল। “গার্ডের ড্রেস পরা, কিন্তু অন্য আরেকটা লোকের পিঠে পিস্তল ঠেকিয়ে নিয়ে এসেছে। বিপজ্জনক লোক দেখলেই বোঝা যায়। ধরা খেলে জান নিয়ে ফিরতে হবে না। হয় লুকিয়ে থাকতে হবে না হয় ওদিক দিয়ে কেটে পড়াই উত্তম।” কার্ট যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে দেখালো জো।

“ওদিকে যাওয়া যাবে না, এক ব্যাটা আর বেটি পিস্তল হাতে ওদিক দিয়েই আসছে।”

“গার্ড নাকি?”

“গার্ডরা নিশ্চয়ই টাক্সিডো আর গাউন পরে না। এরা নিশ্চিত পার্টি থেকেই আসছে।”

আর কিছু বলার আগেই কঙ্কিটের মেঝেতে চাকা গড়ানোর ঘড় ঘড় আওয়াজ শুনতে পেল ওরা। একজোড়া ফ্লাশ লাইটের আলোও দেখা গেল শেল্ফগুলোতে অলসভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জো-র দেখা দলটা কাছাকাছি চলে এসেছে।

“আবারও গিয়ে বক্সটার ভেতরে ঢুকবো নাকি?” জো জিজ্ঞেস করল। কার্ট চারদিকে তাকাল। দ্বিতীয় গ্রুপটাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আর এভাবে উল্টোপাল্টা কোনো দিকে গিয়ে কোনো বন্দুকধারীর সামনে পড়তে চায় না। আর একজন দুজন তো না। সব মিলিয়ে অনেকজন এখন।

“না, লুকাতে হবে দ্রুত।” কার্ট বলল।

“কিন্তু এখানে তো খুব বেশি আড়াল নেই।”

জোর কথা ঠিক। শেগুলোতে অনেক জিনিস। ওগুলোর আড়ালে যাওয়ার উপায় নেই। উল্টো দিকে তাকিয়ে কামানের নল ভর্তি অ্যাকুরিয়ামের মতো দেখতে ট্যাঙ্কটা চোখে পড়ল। ওটাই ওদের একমাত্র ভরসা। “ভিজতে হবে চলো।”

জো ঘুরে ট্যাঙ্কটা দেখে মাথা ঝাঁকালো। ট্যাঙ্কের পাশের ছোট্ট মইটা ধরে ওঠে যতটা সম্ভব আস্তে নেমে পড়ল নিচে। বুঁদ বুদ আর ঢেউগুলো মিলিয়ে যেতেই ওরা প্রথম কামানের নলটার পিছনে চলে গেল। তারপর ওটার ওপর দিয়ে এমনভাবে মাথা ভাসিয়ে রাখলো যেন শিকারের আশায় একটা কুমির কোনো গাছের গুঁড়ির পিছনে লুকিয়ে আছে।

প্রথম গ্রুপটা ওদের পাশ দিয়ে চলে গেল। পাঁচজন লোক তিনজনের হাতে বন্দুক; একজন একটা ট্রলি ঠেলছে আর একজন সম্ভবত ওদের কয়েদী। পিঠের ওপর পিস্তল তাক করা। সবার পরনেই এখানকার সিকিউরিটিদের পোশাক। তবে ওরা একবারও ট্যাঙ্কটার দিকে তাকালও না। দ্রুত পরের সারির দিকে গিয়ে উধাও হয়ে গেল।

“ওরা এখান থেকে কিছু একটা নিতে এসেছে।” কার্ট ফিসফিস করে বলল। তারপর আর কিছু বলার আগেই জোড়াটাকে দেখা গেল। তবে ওরা আগের দলটার সাথে যোগ দেয়ার বদলে খুব সাবধানে পা টিপে টিপে এই সারিটার দিকে এগুলো। তারপর শেফের জিনিসপত্র পরীক্ষা করতে লাগল।

কার্ট ওদের ফিসফিসানি শুনতে পাচ্ছে। অ্যাকুরিয়ামের পিছনের দেয়ালটা সামনের চেয়ে উঁচু। ওটায় বাড়ি খেয়ে শব্দ ওর কানে আসছে।

“মহিলাটা তো সেই!” জো ফিসফিস করে বলল।

মহিলাটা লম্বা, একহারা। পরনে কালো গাউন। তার আবার একপাশ কাটা। তবে পায়ের হিলের বদলে ফ্লাট স্যান্ডেল। সে উবু হয়ে শেলফের জিনিস পরীক্ষা করছে।

“এই তো আরেকটা তবে কি লেখা পড়তে পারছি না। অন্ধকার বেশি।” মহিলা বলল।

টাক্সিডো পরা নোকটা চারপাশে তাকিয়ে বলল, “আপাতত কেউ নেই। ফোনের লাইট জ্বালিয়ে দেখো।”

মহিলা হাত দিয়ে ঢেকে মোবাইলের আলোতে কাগজটা পড়তে লাগল, “এটা না” হতাশ সুরে বলল সে।

লোকটা আবার আশেপাশে তাকিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি করো। আশেপাশে লোকজন অনেক বেশি। পরিস্থিতি বিচারে খুবই ভালো সিদ্ধান্ত।

সাইলেন্সর লাগানো পিস্তলটা শক্ত করে চেপে ধরে ওরা প্রস্থান করল।

“আমার মনে হয় এরা ওদের সাথে না।” কার্ট বলল।

“হায় হায়, চোরের দল তাহলে কয়টা?” জো বলল।

“অনেক। পশ্চিমা বিশ্বে এটাই সম্ভবত সবচেয়ে কম সুরক্ষিত গুদাম ঘর।” কার্ট বলল।

“আমরাই একমাত্র বেকুব যারা অস্ত্র আনিনি। জেনে শুনে বিষ পান করা আর কি।” জো জবাব দিল।

কার্টও একমত, তবে আরেকটা ব্যাপারে ওর মন খুঁত খুঁত করছে।

“টাক্সিডো পরা লোকটার কণ্ঠ খেয়াল করেছ? আমার কাছে কেমন পরিচিত পরিচিত লাগল।

“আমারো। তবে ধরতে পারছি না কার।” জো বলল।

“আমিও না। অন্ধকারে চেহারাটাও ঠিকমতো দেখতে পারিনি। তবে আমি নিশ্চিত যে এই কণ্ঠ আগেও শুনেছি।”

আপাতত আশেপাশে কেউ নেই। “দেব নাকি দৌড়?” জো জিজ্ঞেস করল।

“দরজা পর্যন্তই যেতে পারবে না। আমাদেরকে আগে সবাইকে এখান থেকে ভাগাতে হবে, তারপর কর্তৃপক্ষকে খবর দিতে হয়। আর তা করার একমাত্র উপায় হলো ফায়ার এলার্ম চালু করা। আশেপাশে কোথাও দেখেছো?” কার্ট বলল।

জো সিলিং এর দিকে আঙুল তুলে বলল, “এগুলো দিয়ে হবে না?”

কার্ট ওপরে তাকাল। অনেক পাইপ দেখা গেল সেখানে। কারেন্টের গ্রিডের মতো এক জায়গায় এসে জড়ো হয়েছে। সেগুলোর জায়গায় জায়গায় নজেল দেখা যাচ্ছে। তার পাশেই মোচাকৃতির সেন্সর। সেগুলোতে সবুজ নির্দেশক জ্বলছে। ওগুলো নিশ্চয় তাপ বা আগুন সনাক্তকারী।

“ওখানে উঠতে পারবে?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

“তুমি কি জানো তুমি এই মুহূর্তে সেন্ট ইগনাশিও জ্যাঙ্গল জিম চ্যালেঞ্জের চ্যাম্পিয়নের সাথে কথা বলছো?” জো বলল।

“জিনিসটা কি তা আমার কোনো ধারণাই নেই। তবে উত্তরটা হা ধরে নিচ্ছি।” কার্ট বলল।

“আরে শেলফের তাকগুলোয় পাড়া দিলেই উঠে যাওয়া যাবে।”

সামনের দিকে আরেকবার তাকিয়ে জো ট্যাঙ্ক থেকে বের হয়ে ওটার মইটা শেরে গায়ে ঠেকিয়ে ওঠতে লাগল। প্রথম তাকটায় উঠেই ও ওপরের তাকে হাত দিয়ে শরীরটাকে পরের তাকে টেনে তুললল। সিলিং-এর কাছে যেই পৌঁছেছে তখনই কোথাও কয়েকটা গুলির আওয়াজ পাওয়া গেল। পর মুহূর্তেই আশেপাশে নরক ভেঙে পড়ল।

.

২৮.

কার্ট সাবধানে আশেপাশে উঁকি দিল। গোডাউনের একদম ভেতর থেকে আসছে গুলির শব্দ।

‘ধেৎ!” বিড়বিড় করল কার্ট। তারপর ভালো করে দেখার জন্যে পানি থেকে উঠে এলো।

জো আড়ালে লুকালো আর কার্ট পাশের সারির শেষ মাথার দুই দলের মারামারি দেখার চেষ্টা করল। ফিটফাট পোশাক পরা দুজন আর গার্ডের পোশাক পরা দলটার মধ্যে গুলি বিনিময় হচ্ছে।

ফিটফাট দলটা দুদিক থেকেই গুলি খাচ্ছে। তবে তাতে তারা ঘাবড়ে গেছে বলে মনে হলো না। বরং দারুণভাবে সেগুলোর প্রত্যুত্তর দিয়ে দিয়ে পিছিয়ে আসছে।

হঠাৎই একজন গার্ড উন্মত্ত হয়ে সাবমেশিন গান দিয়ে গুলি করা শুরু করল আর একটা মাটির ফুলদানি ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। মাটি, ধুলো আর ফুলদানির ভাঙ্গা টুকরোয় গলিটা ভরে গেল। এর মধ্যেই এলোমেলো গুলি চলতেই থাকল। গ্লাসের ট্যাংকটাতেও লাগল কয়েকটা গোল গোল দাগ হয়ে গেল ওটার গায়ে, সাথে সূক্ষ্ম ফাটল ছড়িয়ে গেল দশদিকে।

টাক্সিডো পরা লোকটা গুলি এড়াতে একদিকে লাফ দিল। তারপর সটান উঠে দাঁড়িয়ে মহিলাটাকে টান দিয়ে একপাশে সরিয়ে পিছু হটলো। তারপর গলিটার ধার ঘেষে দাঁড়িয়ে গুলি করতে লাগল। লোকটা ফোন কানে লাগিয়ে বলল, “ম্যাকড, চেয়ারম্যান বলছি। ঝামেলা হয়ে গিয়েছে এদিকে। গুলি খেয়ে মরার দশা। এখান থেকে বের হওয়া দরকার এখুনি।”

চেয়ারম্যান…।

মহিলা আরেকদিকে গুলি করে বললো, “হুয়ান, ওরা আমাদেরকে ঘিরে ফেলছে। এখুনি সরে যেতে হবে।”

“হুয়ান? হুয়ান ক্যাব্রিলো?” কার্ট ভাবছে মনে মনে।

হুয়ান ক্যাব্রিলো, কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান। কয়েক বছর আগে NUMA’র • একটা অপারেশনে ডার্ক পিটকে সাহায্য করতে গিয়ে একটা পা হারিয়ে ছিল লোকটা। উনি ওরিগন নামের একটা জাহাজের ক্যাপ্টেন। জাহাজটা বাইরে থেকে দেখতে লক্কর ঝক্কর হলেও আসলে ভেতরে পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি আর অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সজ্জিত।

হুয়ান আর তার সঙ্গিনী এখানে কি করতে এসেছে এ সম্পর্কে কার্টের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। তবে দেখতেই পাচ্ছে বেচারারা মারাত্মক বিপদে পড়তে যাচ্ছে। একে তো এরা মাত্র দুজন, গুলিও ফুরিয়ে আসার কথা এতোক্ষণে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এদেরকে ঘিরে ফেলবে গার্ডের দল।

গোলাগুলির মাঝেই আরেকদল গার্ড ঢুকলো ওখানে। তারপর গলির মাঝখানে কার্টের ঠিক সামনে বসে ক্যাব্রিলোর দিকে মারার জন্যে একটা C-4 রেডি করতে লাগল।

কার্ট আর বসে থাকতে পারলো না। কামানের নলটার গায়ে কাঁধ ঠেকিয়ে কাঁচের দিকে ধাক্কা দিতে লাগল। তারের ওপর ভর করে দুলতে দুলতে সেটা সোজা গিয়ে আঘাত করলো সামনের কাছে। কাঁচের গায়ের ফাটলগুলো আরো একটু লম্বা হলো তবে ভাঙলো না পুরোপুরি। কামানের নলটা পিছন দিকে সরে এসে আবার সামনে ধেয়ে গেল। কার্ট পিছন থেকে আরো জোরে ধাক্কা দিল। এবার ঠিকই পাঁচশো পাউন্ড ওজনের নলটা সোজা কাঁচের দেয়াল ভেদ করে বেরিয়ে গেল। দশ হাজার গ্যালন পানি ট্যাঙ্কটা থেকে বেরিয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল। সেই সাথে বিস্ফোরক হাতে দাঁড়ানো লোকগুলোকে নিয়ে পাশের শেলফে আছড়ে ফেলল। কার্টও পানিতে ভেসে বাইরে চলে এসেছে। সোজা গিয়ে পড়ল এক গার্ডের ওপরে। ও দ্রুত পিছিয়ে এসে লোকটার চোয়াল বরাবর বিরাশি সিক্কার এক ঘুসি বসিয়ে দিল।

দ্বিতীয় আততায়ীও উঠে বসার চেষ্টা করতেই কিছু একটা এসে ওর মাথাটা থেতলে দিল। ওপরে কোথাও থেকে জালা ছুঁড়েছে জিনিসটা।

কার্ট বিস্ফোরকের টুকরাটা হাতে নিয়ে কারেন্টের তার দুটো আলগা করে দিল তারপর ক্যাব্রিলোর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, “হুয়ান এই দিকে আসুন।”

ক্যাব্রিলো গলিটার দিকে চাইলো। ইতস্তত করছে। ধোকা কি-না নিশ্চিত না। “তাড়াতাড়ি, আপনাদেরকে ঘিরে ফেলল।” কার্ট আবারো চেঁচালো। ইতস্ত ত ভাব কেটে গেল। “দৌড় দাও।” সঙ্গিনীকে বলল হুয়ান। মহিলা নির্দ্বিধায় দৌড় দিল। ক্যাব্রিলোও আরো কয়েকটা গুলি করেই পিছু নিলো। তারপর কার্টের পাশে হামাগুড়ি দিয়ে বসে পড়ল।

“কার্ট অস্টিন।” যেন বিশ্বাস হচ্ছে না এমনভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল হুয়ান।

“এই চুলোয় মরতে এসেছেন কোন দুঃখে?”

“দেখেতো মনে হচ্ছে আপনার প্রাণ রক্ষা করতেই এসেছি। আপনি?”

লম্বা কাহিনী। মোনাকোর ব্যাপারটার সাথে সম্পর্ক আছে অবশ্য।”

ব্যস্ততার মাঝেও কার্ট মোনাকো গ্রাণ্ড প্রিক্স-এর দুর্ঘটনাটার কথা শুনেছে। গত কয়েক দিন ধরে ল্যাম্পেডুসার ঘটনা আর এই ঘটনাটা চব্বিশ ঘণ্টা টিভির খবরের শিরোনাম হিসেবে প্রতিযোগিতা করছে। কার্ট ঘুসি মেরে অজ্ঞান করা লোকটার পিস্তল তুলে নিয়ে এবার নিজেও মারামারিতে অংশ নিলো।

গার্ড-সাজা লোকগুলো আড়াল নিয়েছে। হঠাৎ দুজনের জায়গায় প্রতিপক্ষ তিনজনে পরিণত হওয়ায় আর পানির তোড়ে নিজেদের লোকজন ভেসে যেতে দেখায় ওরা আগের চেয়ে সতর্ক হয়ে গিয়েছে। ফলে গুলি বর্ষণ আপাতত বন্ধ।

“হচ্ছেটা কী এখানে?” মহিলা মুখ খুললো এতোক্ষণে।

“পুরনো দোস্ত।” ক্যাব্রিলো এক কথায় ব্যাখ্যা করল সব।

কার্ট মহিলার দিকে ফিরে তাকাল। কে হতে পারে ভাবছে। “আপনার নাম কি সোফি?” প্রশ্ন করল কার্ট।

মহিলাও বিরক্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “নাওমি।”

কার্ট কাঁধ ঝাঁকালো। “কাছাকাছি হয়েছিল।”

ক্যাব্রিলো দাঁত বের করে হাসলো তারপর বলল, “আসলে এখানে কী করতে এসেছেন বলুন তো?”।

কার্ট ওদিকের লোকগুলোকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে বলল, “ল্যাম্পেডুসার ঘটনার জন্যে ঐ লোকগুলো সম্ভবত দায়ী।”

“NUMA কী ঘটনাটা তদন্ত করছে নাকি?”

“অন্য আরেক সরকারের হয়ে।”

ক্যাব্রিলো মাথা ঝাঁকালো। “তার মানে তো আমাদের কারো হাত-ই খালি নেই। কোনো সাহায্য-টাহায্য লাগবে নাকি?”

আরেক দফা গুলি করা হলো ওদিক থেকে। তিনজনই পারলে মাটির সাথে মিশে যায়। ওই অবস্থা থেকেই পাল্টা গুলি করল ওরা। আততায়ীর দল পিছু হটলো আবার।

“কি আর সাহায্য করবেন। আমি আসলে এখানে একটা মিসরীয় পুরাকীর্তি খুঁজছিলাম।”

“তাহলেই হয়েছে। এখানে কোনো জিনিস খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। আমরা বহুক্ষণ ধরে নেপোলিয়নের একটা বই খুঁজলাম। বইটা ওনার কাছে মরার আগ পর্যন্ত ছিল।”

“হোমারের ওডিসি নাকি? ফাঁকা জায়গাগুলোতে হাতে কি সব লেখা?” কার্ট জানতে চাইলো।

“হা, ওটাই। দেখেছেন নাকি আপনি?”

এতক্ষণ ধরে গোলগুলির কোনো ধারাবাহিকতা নেই। হঠাৎ মাঝে মাঝে গুলি ছোঁড়া হচ্ছে। আর যেহেতু দুই দলই আড়ালে আছে তাই মাঝখানের খালি জায়গাটা সবচে মারাত্মক।

“কিন্তু ঐ দিকে যাওয়াটা তো সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।” হুয়ান জানালো।

“আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।” কার্ট বলল। তারপর ওপরে তাকিয়ে জোর-এর উদ্দেশ্যে শিস বাজালো।

জো আবার স্মোক ডিটেক্টরের দিকে বেয়ে উঠতে লাগল। কিন্তু একদম সবার ওপরের তাকেও উঠে দেখা গেল সেন্সরের নাগাল পাচ্ছে না। সামনে থেকে একটা বক্স সরিয়ে শরীর টান টান করে দিল সামনে। কিন্তু এর ফলে ওকে ওপাশ থেকে দেখে ফেলল একজন। লোকটা গুলি করল ওর দিকে। সিলিংটা বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেল।

কার্ট সেদিকে তাকিয়ে পিস্তল তাক করল। কিন্তু ক্যাব্রিলো ওর আগে গুলি করল। এক গুলিতেই লোকটা কুপোকাত।

লোকটা পড়ে যেতেই আবার হাত বাড়িয়ে স্মোক ডিটেক্টরের পাশে ওর টীজারটা চেপে ধরলো। চারহাজার ভোল্টের বিদ্যুতের বিচ্ছুরণে যে স্ফুলিঙ্গ উৎপন্ন হলো, তাতেই সেন্সরের কাছে সেটা আগুন হিসেবে বিবেচিত হলো। সাথে সাথে কান ফাটানো শব্দে অ্যালার্ম বাজা শুরু হলো, আশেপাশের লাইটগুলো ঘনঘন জ্বলতে-নিভতে আরম্ভ করল আর গোডাউন জুড়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস বের হওয়া শুরু হলো।

এক সেকেন্ড পরই আততায়ীর দল উল্টো ঘুরে দৌড় দিল। জো সেন্সর থেকে টীজার সরাতেই কার্বন-ডাই-অক্সাইড সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গেল। তবে আশেপাশে খবর হয়ে গিয়েছে। লোকজন আসবেই দেখতে।

“এখান থেকে চল্লিশ ফুটের মতো দূরে। বামদিকের প্রথম শেলকেই পাবেন। আপনার জায়গায় আমি থাকলে যতো দ্রুত সম্ভব কাজটা সেরে পালাতাম।” কার্ট বলল।

ক্যাব্রিলো হাত বাড়িয়ে বলল, “আবার দেখা হবে।”

কার্ট হাতটায় ঝাঁকি দিয়ে বলল, “আশা করি তখন গুলির বদলে ভালো কিছু খাবো।”

লোকটা আর মহিলাটা সামনের দিকে ছুটলো। জোও নেমে এসেছে শেলফ থেকে।

“আমি যার কথা ভাবছি উনি কী সে-ই নাকি?” নামতেই বলল জো। কার্ট মাথা আঁকালো। “এতো ভালো দুজন মানুষের সাথে এই রকম মরার গোডাউনে দেখা হলো। যাই হোক, এখান থেকে ভাগা যাক চলো।”

ওরা বেরিয়ে মাল খালাস করার জায়গাটায় পৌঁছেই দেখে কয়েকটা অগ্নি নির্বাপনকারী ট্রাক আর পুলিশের গাড়ি পিছন দিয়ে ঢুকছে। অনুষ্ঠানের আসল সিকিউরিটি দলকেও দেখা গেল এদিকেই আসছে।

“পাশের দরজা।” জো বুদ্ধি দিল।

ওরা আবার গোডাউনে ঢুকে পড়ল তারপর সেটা পার হয়ে শেষ মাথার আরেকটা দরজার দিকে দৌড়ে গেল। জো দরজাটা খুলে বাইরেটা দেখে বলল, “কেউ নেই।”

ওরা দরজা গলে গলিটায় নেমে পাঁচ কদম না যেতেই ঠিক ওদের মাথার ওপর একটা স্পট লাইট জ্বলে উঠল। আর ছাদ থেকে লাল আর নীল রঙের আলো বের করা একটা গাড়ি ছুটে এলো ওদের দিকে। জায়গায় জমে গেল ওরা, হাত তুলে ফেলেছে আগেই।

“কে জানে আগের দিন যারা আমাদের গ্রেফতার করেছিল সেই পুলিশগুলোই কি-না। শালারা ভালোই খাতির করেছিল আগের দিন।” জো বলল।

“সেরকম হলে তো ভালোই হয়।” কার্ট জবাব দিল।

ওদের সামনে এসে গাড়িটা থামতেই দুজন অফিসার নেমে এলো। হাতে উদ্যত পিস্তল। কার্ট আর জো কোনো বাধা দিল না। বিদ্যুৎ গতিতে ওদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে তুলে ওখান থেকে বের করে নিয়ে আসা হলো। কার্ট অবাক হয়ে খেয়াল করল ওদেরকে শহরের দিকে না নিয়ে শহর থেকে দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারপর সেই আগের থানাতেই ফিরে এলো।

“আমাদের একটা ফোন করতে হবে তাই না?” কার্ট বলল। একটা হাসিমুখ ওদের দিকে ফিরে বলল, “ইতোমধ্যেই আপনাদের পক্ষ থেকে একটা ফোন করা হয়েছে। লোকটার কথার টানে ভূমধ্যসাগরীয় টান নেই, বরং কেমন একটা লুইজিয়ানার মানুষের মতো টেনে টেনে কথা বলছে।” চেয়ারম্যান নিজেই করেছেন ফোনটা।”

অফিসার এক গোছা চাবি ছুঁড়ে দিল কার্টের দিকে। “আমি ম্যাকড।” পরিচয় দিল লোকটা। “এ সকল পরিস্থিতিতে আমাকে বন্ধু ভাবতে পারেন।”

কার্ট দাঁত বের করে হাসলো। তারপর নিজের হাতকড়া খুলে জো’র টাও খুলে দিল। গাড়ির লাইট আর সাইরেন ততোক্ষণে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কয়েক মিনিট পরেই ওদের হোটেল থেকে কয়েক ব্লক আগে ওদেরকে নামিয়ে দেয়া হলো।

“উদ্ধার করে আনার জন্য ধন্যবাদ। হুয়ানকে বলবেন একটা খাওয়া পাওনা হয়েছে ওনার।”

ম্যাকড হাসলো, “উনি কখনোই আপনাকে টাকা দিতে দেবেন না। তবে আপনি যে খাওয়াতে চেয়েছেন সেটা আমি জানাবো ওনাকে।”

কার্ট দরজাটা লাগিয়ে দিতেই, ম্যাকড ড্রাইভারকে ইশারা করল আর গাড়িটা চলতে শুরু করল।

“এই মিশনটা কোনোভাবে হুয়ান আর ওদের লোকদের ঘাড়ে চাপানো যায় না?” জো জিজ্ঞেস করল।

“যেত, কিন্তু ওরা নিজেরাই বহুত ঝামেলায় আছে।” কার্ট জবাব দিল। তারপর হোটেলের দিকে হাঁটা শুরু করল। ওদের গা থেকে তখনো পানি ঝরছে। গুলির শব্দে লাগা কান তালা এখনো খোলেনি। তবে রাস্তায় কোনো লোক না থাকায় ওদেরকে কেউ খেয়াল করল না। কিন্তু এতো চেষ্টার পরও–এতো ঝুঁকি নেয়ার পরও যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই পড়ে রইল ওরা।

“সন্ধ্যাটা অদ্ভুতভাবে কাটলো।” কার্ট বলল।

“এটা বছরের সবচেয়ে ভুয়া কথা।” জো জবাব দিল।

হোটেলে ঢুকে ক্লান্ত দেহে পা টেনে টেনে নিজেদের রুমে ঢুকেই দেখে রেনাটা বসে আছে। চোখমুখ ঝলমল করছে খুশিতে।

“আরে আপনাদের এই দশা কীভাবে হলো?”

কার্ট তার জবাব না দিয়ে বলল, “আপনি তত ভালোই মজায় আছেন মনে হচ্ছে।” তারপর দরজা আটকে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল।

“শহরের পুলিশের গাড়ি দৌড়াতে দেখলাম। আপনাদের কাজ নিশ্চয়ই?”

“শুধু আমাদের না, আজকের পার্টিটা কেউই ভুলতে পারবে না।”

কার্ট আশা করল রেনাটার হাসির পিছনে ভালো কোনো কারণ আছে।

“সোফি সিলিনকে খুঁজে পেয়েছেন?”

“সত্যি কথা হচ্ছে, হ্যাঁ পেয়েছি। আর সে থাকেও খুবই কাছে।” জবাব দিল রেনাটা।

.

২৯.

খবরটা শুনেই কার্টের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। “দেখা করতে যাবো কখন?”

“আশা করি খুব দ্রুত তার সাথে দেখা করার সৌভাগ্য হবে না। কারণ তিনি আর ইহজগতে নেই।” রেনাটা জবাব দিল।

খারাপ খবর। কার্টের কাছে অন্তত সেটাই মনে হলো। “সেজন্যে তো আপনার মন খারাপ বলে মনে হচ্ছে না।”

“অনেকদিন হয়ে গেল তো, শোক কাটিয়ে উঠেছি। ভদ্র মহিলা মারা গিয়েছেন ১৮২২ সালে।”

কার্ট জো-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “মাথামুণ্ডু কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”

জো মাথা নাড়লো, “অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড আমার ব্রেনের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে নিশ্চয়ই, কারণ আমি উল্টাপাল্টা শুনছি।” জো বলল।

“মজা করছো জানি। কিন্তু ভেবে দেখো ব্যাপারটা। সোফি সি, কে? আর ১৮২২ সালে মারা যাওয়া একজন মহিলার সাথে ড, কেনসিংটন আর ল্যাম্পেডুসার ঘটনার কী এমন সম্পর্ক থাকতে পারে?”

“সোফি সি, মানে হলো সোফি সিলিন।”

“কাছাকাছি হয়েছিল আমারটা।” জো বলল।

কার্ট কিছু বলল না জবাবে। রেনাটাকে বলল, “কে এই মহিলা?”

“সোফি সিলিন ছিল পিয়েরে আনডিন-এর দূর সম্পর্কের মামাতো বোন আর গোপন প্রেমিকা। পিয়েরে আনডিন ছিলেন ফরাসি বিপ্লবের পর গঠিত ফ্রেঞ্চ লেজিশ্লেটিভ এসেম্বলীর সম্মানিত সদস্য। নিজেরা অন্যদের সাথে বিবাহিত হওয়ায় তাদের পক্ষে হয়তো এক হওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু ভালোবাসাও তাতে আটকে থাকেনি। আর তারই ফসল হিসেবে একটা সন্তানও জন্ম নেয়।”

“এতো দেখি কেলেঙ্কারির ব্যাপার স্যাপার।” কার্ট বলল।

“হ্যাঁ। কেলেঙ্কারি হোক আর যা-ই হোক সন্তানটার জন্ম ছিল আনডিন-এর জন্য বিশেষ কিছু। তাই ও খুশি হয়ে নিজের প্রভাব খাঁটিয়ে ফ্রেঞ্চ নৌ-বাহিনীর একটা জাহাজের নাম বাচ্চার মায়ের নামে রাখতে বাধ্য করে।

“উপহার হিসেবে?” জো জিজ্ঞেস করল।

“আমিতো জানতাম বেশিরভাগ মেয়েই গয়না পছন্দ করে।” জো বলল।

“একমত,” জানালো রেনাটা।

“তা সোফির কি হলো?” কার্ট আবার ফিরিয়ে আনলো মূল কথায়। রেনাটা পায়ের ওপর পা তুলে বলল, “মহিলা বৃদ্ধ বয়সে ঘুমের মধ্যে মারা যান। তারপর তাকে প্যারিসের বাইরের একটা ব্যক্তিগত কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।”

কার্ট আসল ব্যাপারটা বুঝলো এতোক্ষণে, “তার মানে কেসিংটন আসলে সোফি সি. দিয়ে ঐ জাহাজটাকে বোঝাতে চেয়েছেন।”

রেনাটা মাথা ঝাঁকালো। তারপর জাহাজটার ইতিহাস লেখা একতাড়া কাগজ কার্টকে ধরিয়ে দিল। “সোফি সি, ছিলো নেপোলিয়নের ভূমধ্যসাগরীয় নৌ-বহরের অন্তর্গত একটি জাহাজ। ফরাসি শাসনামলে জাহাজটা মাল্টাতেও একবার এসেছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে মাল্টা বন্দর ছাড়ার কিছুদিন পরই জাহাজটা ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়। তখন ওতে ছিল মিসর থেকে উদ্ধার করা নানা পুরাকীর্তি আর গুপ্তধন। দ্য চ্যাম্পিয়ন কমিশন এর তত্ত্বাবধানে জাহাজটা খুঁজে বের করে উদ্ধার করা হয়। এই কমিশনটা মাল্টার এক ধনাঢ্য পরিবারের অনুদানে পরিচালিত হতো। বহু বছর উদ্ধারকৃত পুরাকীর্তিগুলো নিজেদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখার পর সম্প্রতি তারা এর মধ্যে কয়েকটা বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিক্রয়ের নির্দিষ্ট অর্থ জাদুঘরও পাবে।”

“এই জিনিসগুলোই আমাদের মারমুখী বন্দুরা কোনো টাকা পয়সা না। দিয়েই নিয়ে চলে গিয়েছে। জো বলল।

“কেনসিংটন বলেছিলেন দুই লাখ ইউরো দিলেও ওরা নাকি টেবিলে বসার। মোগ্য-ই হবে না। আর ওরা এখন পুরো টেবিলটাই নিয়ে গেল।”

জো এবার আসল প্রশ্নটা করল, “কেনসিংটন যেখানে আমাদেরকে নিলামে কোন কোন জিনিস উঠবে সেটাই বলছিলেন না, তো কোন দুঃখে এই সোফি সিলিন এর কথা বলতে গেলেন?”

“যে কারণে আমরা উদয় হয়ে ওনাকে প্রশ্ন করা শুরু করার আগ পর্যন্ত লোকগুলো ওনাকে মেরে ফেলেনি। সম্ভবত ঐ ধ্বংসাবশেষে আরও কিছু আছে যেটা ওরা চায়। সম্ভবত ওটার খবর এখনো ফাস হয়নি।”

“আমি যে মিসরীয় শিলালিপিটা দেখেছিলাম ওটা ভাঙ্গা ছিল।” পুরোটা ছিল না। খণ্ড খণ্ড। ওরা সম্ভবত বাকিগুলো খুঁজছে।” জো বলল।

কার্ট রেনাটার দিকে ফিরে বলল, “জাহাজটা ডুবেছিল কোথায়?”

রেনাটা হাতের বাকি কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই হলো জাহাজটার অবস্থান। ভ্যালেট্টা থেকে তিরিশ মাইল পূর্বে।”

“আমি যদ্দুর জানি, ওটা ফ্রান্স যাওয়ার রাস্তা না।” কার্ট বলল।

“ওটার ক্যাপ্টেন ব্রিটিশ জাহাজের সামনে না পড়ার জন্যে এমনটা করেছিলেন। তাই প্রথমে পূর্ব দিকে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। তারপর উত্তরে। হয়তো ইচ্ছা ছিল সিসিলির উপকূল ঘেষে যাবেন বা সরাসরি সিসিলি আর ইতালির মাঝখান দিয়ে চলে যাবেন। শেষমেশ কোনোটা করার আগেই জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়ে। ধারণা করা হয় উনি বন্দরে ফিরে আসতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই জাহাজ ডুবে যায়।”

ঘটনা শুরুর পর এই প্রথম কার্টের মনে হলো যে ওরা চালে এগিয়ে গিয়েছে।

“তারমানে এরপর কি করতে হবে তা আমাদের জানা। আর ওরা কি করবে সেটাও এখন জানি। যখনই ওরা টের পাবে যে এসব শিলালিপি আর ছবি আসলে ভাঙ্গা টুকরো আর খণ্ড অংশ, সাথে সাথেই ওরা ধ্বংসস্তূপ থেকে বাকি টুকরোগুলো উদ্ধারের চেষ্টা করবে।”

“আমি হলেও সেটাই করতাম। তবে আমি এখনো ভেবে পাচ্ছি না এটার সাথে ল্যাম্পেডুসার দুর্ঘটনার কী সম্পর্ক? আর ঐ লোকগুলোই বা কি চায়? তবে যদি ব্যাপারটা আসলেই এতো গুরুত্বপূর্ণ না হয় তাহলে ওরা এটার পিছনে লাগবে না। তারপরও আমার মনে হয়, ওদের আগেই আমাদের জাহাজের ধ্বংসাবশেষটার খোঁজ করা উচিত।”

.

৩০.

কার্ট, জো, ডা. আমব্রোসিনি আর প্রয়োজনীয় লোকবলসহ সী ড্রাগন ভ্যালেট্টা বন্দর ত্যাগ করল। সাবধানতাস্বরূপ কার্ট বাকি সবাইকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে।

“সোজা এই বরাবর চালাও।” ক্যাপ্টেন রেনল্ডসকে বলল কার্ট।

“আই। তবে উত্তর দিকে না ঘুরলে যে আমরা ধ্বংসাবশেষের দেখা পাবো না সে কথা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো?” রেনল্ডস বলল।

“আর কারো মুখোমুখি যাতে না হতে হয় সেজন্যেই দূরে থাকতে চাইছি।” কার্ট মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের মনিটরের দিকে তাকিলে বলল, “আপনিই

রেনল্ডসকে সব বুঝিয়ে দিয়ে কার্ট জাহাজের পিছন দিকে চলে এলো। জো আর রেনাটা মিলে গ্লাইডার (ইঞ্জিন বিহীন বিমান) জোড়া লাগাচ্ছে।

“ওড়ানো যাবে এখন?”

“প্ৰায়।” রেনাটা বলল। তারপর গ্লাইডারের গিটুগুলো শক্ত হয়েছে কি-না পরীক্ষা করে ওটার নিচে বসানো ক্যামেরাটা অন করে দিল।

“রেডি।”

কার্ট জাহাজের কপিকলের হাতলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। এটা সাধারণত ফ্যাদো মিটার ওঠা-নামা করার জন্য ব্যবহার করা হয়। তবে এখন ওটার স্টিলের তার সরিয়ে সেখানে সরু প্লাস্টিকের সুতা প্যাঁচানো হয়েছে। আর এক প্রান্ত জোড়া দেয়া হয়েছে গ্লাইডারটার সাথে। জো সেটা হাতে করে জাহাজের সামনের দিকে চলে গিয়েছে।

“রেডি। রেনাটা বলল।

জো গ্লাইডারটার নিচের আড়কাঠ ধরে ওটাকে মাথার ওপর তুলে ধরলো। তারপর একটু জোরে বাতাস আসতেই ওঠা ওর হাত থেকে লাফ দিয়ে আকাশে ভেসে গেল।

গ্লাইডার আকাশে উড়তেই কার্ট হাতল ঘুরিয়ে সুতা ছাড়তে লাগল আর ওটা আরো ওপরে উঠতে লাগল। উড়তে উড়তে ওটা জাহাজের পিছনে চলে যেতেই রেনাটা হাতের রিমোটের সাহায্যে ওটা নাড়াতে লাগল।

গ্লাইডারটা পাঁচশো ফুট ওঠার পরেই ও ওটার আর ওঠা বন্ধ করে দিল। “এখানেই আটকে দিন।” কার্টকে বলল ও।

কার্ট হাতল ঘুরানো বন্ধ করে দিল আর গ্লাইডারটা উচ্চতা স্থির রেখে সী ড্রাগনের পিছনে পিছনে আসতে লাগল। ওপর থেকে কেমন লাগছে দেখতে?”

রেনাটা সুইচ টিপে গ্লাইডারের ক্যামেরা চালু করল। ওর ডান দিকে থাকা একটা মনিটরে ভিডিও দেখা গেল। শুরুতে সবকিছু ঝির ঝির করতে লাগল। রেনাটা ফোকাস ঠিক করে দিতেই সী ড্রাগনকে পরিষ্কার দেখা গেল। নীল রঙা একটা মাঠ চষে এগিয়ে চলেছে।”

“ভালোই দেখা যাচ্ছে। দেখি আমাদের বন্ধুদের দেখা যায় কি-না।” বলল রেনাটা।

ও ক্যামেরাটা উত্তর দিকে ঘোরালো। একজোড়া নৌকা চোখে পড়ল। শুরুতে মনে হচ্ছিলো সমুদ্রের বুকে এক টুকরো খড়ের মতো। ঠিক যেন একটা নীল টেবিল ক্লথের ওপর দুটো ধান পাশাপাশি পড়ে আছে। তবে ও ক্যামেরার ফোকাস ঠিক করতেই নৌকা দুটো ভালো করে দেখা গেল।

“একটা ডুবুরিদের নৌকা আর একটা বজরা নৌকা। রেনাটা বলল।

“আরো জুম করা যাবে?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

“যাবে।”

“বজরাটা আগে জুম করেন, কার্ট বলল।

রেনাটা লেন্সটা লম্বা করে ফোকাস করতেই বজরার বিস্তারিত দেখা গেল। লাল রঙের কাঠামোয় সাদা রঙে লেখা “দ্য শ্যাম্পেন কনসারভেন্সি” একদিকে একটা ছোট ক্রেন বসানো। তাতে একটা বড় Pvc পাইপ ঝোলানো। ওটার ভেতর দিয়ে পানি আর বালি, কাদা এসব বেরুচ্ছে। পাইপের পানি পাশেই একটা ধাতুর তৈরি জালের ওপড় পড়ছে। হাতের মুঠির চেয়ে বড় যে কোনো কিছুই ওটায় আটকা পড়বে। তবে এখনো কিছু আটকায়নি। শুধু নীল সাগরের বুকে দুধ সাদা ফেনা সৃষ্টি করে বেরিয়ে যাচ্ছে পিছনে।

“দেখেতো মনে হচ্ছে ওরা সাগর পরিষ্কার করছে।” জো মন্তব্য করল।

“হুম! পুরো সাগরের তলাটাই দেখি পানির ওপর উঠিয়ে ফেলছে।” কার্ট বলল।

ক্যামেরা আরেকটু নড়তেই দেখা গেল দুজন লোক নানান উদ্ধার করা জিনিস পরীক্ষা করছে। এক নজর দেখেই ওরা ওগুলো আবার পানিতে ফেলে দিল।

“পাথর আর ঝিনুকের খোল, কার্ট অনুমান করল।

“ওরা নিশ্চয়ই আরো বড় কিছু খুঁজছে! জাদুঘরে যেমন দেখেছিলাম ওরকম শিলালিপি বোধ হয়। এসব ছোটখাট গুপ্তধনে ওদের কিছু হবে না।” জো বলল।

“ওরা যদি সত্যি সত্যিই কনসারভেন্সির লোক হতো তাহলে এগুলোকেও ওরা দাম দিতো। তবে আমার ধারণা ওরা সেটা না।” কার্ট বলল।

তারপর রেনাটার দিকে ফিরে বলল, “অন্য নৌকাটার দিকে জুম করুন তো।”

রেনাটা ক্যামেরা ঘুরিয়ে ষাটফুটি ডুবুরি নৌকার দিকে তাক করল। ডুব দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নানান জিনিসে ডেকটা ঠাসা। নৌকাটার সামনের দিকে বেশ কিছু লোককে দেখা গেল। পায়ের ওপর পা তুলে রোদের মধ্যে বসে আছে।

“এরা হয় ইয়োগা করছে নয়তো…”

লোকগুলোর ঠিক পেছনেই আরেকটা লোক দাঁড়ানো। তার হাতে একটা লম্বা নলের রাইফেল।

রেনাটা আরো বেশি জুম করার চেষ্টা করল কিন্তু লোকটার চেহারা স্পষ্ট হলো না। “লোকটার চেহারা ভালো বোঝা যাচ্ছে না।” বললও।

“দরকার নেই। ওরা কারা তা আমরা জানি।” কার্ট বলল রেনাটাকে।

“মাল্টার কোস্ট গার্ডকে খবর দিলে কেমন হয়? ওরা তাহলে কি হয়েছে। দেখতে আসবে, পুরো গ্যাঙটাই ধরা পড়বে তখন।” রেনাটা প্রস্তাব দিল।

“বুদ্ধিটা ভালই। তবে সেটা করতে গেলে ঐ নির্দোষ ডুবুরিগুলো মারা পড়বে। এ লোকগুলোর কোনো বিবেকবোধ নেই। এর মধ্যেই ওরা নিজেদের লোককেও মেরে ফেলতে দ্বিধা করেননি ভুলে গিয়েছেন? ওরা কেনসিংটন, হ্যাগেন আর জাদুঘরের অর্ধেক সিকিউরিটি গার্ডকেই খুন করেছে। এমনকি বোমা মেরে গোডাউনটাও উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। মাল্টার কোস্ট গার্ডকে খবর দেয়া মাত্র ওরা ডুবুরিগুলোকে খুন করে লেজ তুলে পালাবে। আর যদি ধরাও পড়ে বা ওদেরকে ঘিরেও ফেলা হয়। তাহলে হয় কোস্ট গার্ডকে মেরে পালাবে, না হয় নিজেরাই মরবে। তাও ধরা দেবে না। তাহলে সেক্ষেত্রে লাভের গুড় পিপড়াই খাবে। খালি লাশের সংখ্যা আরো কিছু বাড়বে।”

রেনাটা বুঝলো ব্যাপারটা। মুখ কালো করে শব্দ করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “আমার কথাই ঠিক। কিন্তু আমরা একারা তো ওদের সাথে পারবো না।”

“হ্যাঁ, তবে সারপ্রাইজ কিন্তু দিতে পারবো।”

“হায় হায় আগে বলব না? আমি তো আমার অদৃশ্য হওয়ার জামাটা ওয়াশিংটন রেখে এসেছি।” জো বলল।

“আমি সরাসরি পানির ওপরে ওদের মুখোমুখি হতে বলছি না।” কার্ট বলল।

“তার মানে আমাদেরকে গভীরে যেতে হবে।” জো বলল।

“সারপ্রাইজটা দেবো হচ্ছে আমরা। আর এক্ষেত্রে কয়েকজন সাহায্যকারীও পাওয়া যাবে।”

“কোত্থেকে?”

“যদি এদের নিজস্ব ডুবুরি থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই বন্দুকের ভয় দেখানো লাগতো না। যদি যেসব ডুবুরি পানির নিচে কাজ করছে, তারা ঐ নৌকার বন্দীদের বন্ধু হয়, আর শুধু ওদেরকে বাঁচানোর জন্যেই কাজ করতে থাকে তাহলে আমার বিশ্বাস সুযোগ পেলেই ওরা ওদের বিরুদ্ধে কাজ করবে।”

“তার মানে আমরা গিয়ে তাদের সাথে দোস্তি পাতাবো, তারপর বিদ্রোহ করা শুরু করবো।” জো বলল।

“বিদ্রোহ সব সময় এভাবেই হয়।” কার্ট বলল।

বিশ মিনিট পর কার্ট আর জোকে দেখা গেল ডাইভ স্যুট পরে সমুদ্রে নামার জন্যে প্রস্তুত। সাথে নিচ্ছে একটা Rov (Romotely operated underwater Vehicle) নাম টার্টল। ওরা এখন ধ্বংসাবশেষ থেকে তিন মাইল দূরে আছে। এতদূর থেকে ওদের সন্দেহ হওয়ার কথা না। তারপরও সতকর্তাস্বরূপ ক্যাপ্টেন রেনল্ডস সী ড্রাগনকে আরো পিছিয়ে নিয়ে আসলেন। লোকগুলো যদি বাইনোকুলার বা রাডার দিয়ে ওদের দিকে লক্ষ রাখে তাহলে দেখবে যে ওরা ধীরে সুস্থে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

কার্ট আর জো একটা প্লটফর্মে কসা। সেটা আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামছে। পানির ওপর পৌঁছতেই কার্ট, জোর আর টার্টল পানিতে নেমে গেল। ওরা একবার স্যুটের জিনিসপত্র ঠিক আছে কি-না নেড়েচেড়ে দেখে পানির নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল। ধীরে ধীরে নিচে নামছে ওরা, Rov’র বিশাল নাকটার দুপাশে দুজন ধরে রেখেছে। পঞ্চাশ ফুটের মতো নামতেই ওরা Rov-টায় চড়ে বসলো। তারপর কার্ট থাম্বস আপ’ দেখাতেই জো ওটা চালু করে দিল।

এমনিতে সাধারণত টার্টল পানির ওপরে জাহাজ থেকেই পরিচালনা করা হয়। তবে যেহেতু এটা পানির নিচে ডুবুরিদের কাজের উপযোগী করে বানানো হয়েছে, তাই এটা ডাইভ স্যুটের সাথে লাগানো একটা ডিভাইস দিয়েও করা যায়। জো এখন সে কাজটাই করছে।

“আরো নিচে নামো। মাটির কাছে চলে যাও।” কার্ট বলল।

“রজার দ্যাট। জো বলল।

মাল্টার পূর্বে সমুদ্র বেশি গভীর না। জায়গাটাকে ডাকা হয় “মাল্টা মালভূমি” নামে। এখান থেকে শুরু করে দক্ষিণ সিসিলি পর্যন্ত বিস্তৃত। সোফি সেলিন প্রায় নব্বই ফুট নিচে ডুবে আছে। মোটামুটি ভালোই গভীর। তবে পেশাদার ডুবুরির জন্য কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। ঝামেলা হলো এতো নিচে সূর্যের আলো পৌঁছায় না।

“তলায় পৌঁছে গিয়েছি।” জো বলল।

জো ওর হেলমেটের ভেতরের ডিসপ্লেতে সমুদ্রের গভীরতা, কোনদিকে যাচ্ছে বা ওদের গতি সবই দেখতে পাচ্ছে।

কিছুক্ষণ পরই সমুদ্র তল চোখে পড়ল। Rov’র সামনের লাইটে আলোকিত হয়ে আছে। জো মাটিতে নামিয়ে ওদের দিক ঠিক করল। তারপর আবার চালানো শুরু করল।

“লাইট বন্ধ করে দিচ্ছি, যাতে কারো চোখে না পড়ে।” জো বলল।

“হুম! তবে কোনো কিছুতে বেধে আবার উল্টে পোড়ো না।” সাবধান করল কার্ট। লাইট বন্ধ হতেই মনে হলো ওরা একটা অন্ধকার গুহার ভেতর দিয়ে চলছে। কিছুক্ষণ পর চোখে অন্ধকার সয়ে আসতে জো বলল, “ভালোই তো দেখতে পাচ্ছি।

“সমুদ্র এখন শান্ত। তাই পানিতে বেশি কাদা বা বালি নেই।” কার্ট বলল।

“খালি চোখে সম্ভবত পঞ্চাশ ফুটের মতো দেখা যাচ্ছে।”

“তার মানে ধ্বংসাবশেষ থেকে কমপক্ষে একশো দশ ফুট আগেই থামবে।”

Rov হিসাবে টার্টল অত্যন্ত দ্রুত গতির। আর স্রোতের অনুকূলে থাকায় গতি এখন প্রায় সাত নট। তারপরও ধ্বংসাবশেষটার কাছে পৌঁছতে বিশ মিনিট মতো লেগে লেগো। দরেই দেখা যাচ্ছে হালকা আলো জ্বলছে।

“কমপক্ষে তিন বা চারটা লাইট ওখানে।” জো বলল।

কার্টও দেখছে। একটু পরই দেখা গেল আরো দুটো লাইট। বালির একটা টিবির পেছন থেকে এগিয়ে আসছে।

আলো লাইটগুলো থেকে বেরিয়ে এমনভাবে ওপরে যাচ্ছে যেন আশ পাশে প্রচুর ধুলো উড়ছে। কার্ট ইতোমধ্যে পানির নিচের ভ্যাকুয়াম ক্লীনারের অদ্ভুত ধপধপ আওয়াজটা টের পাচ্ছে।

“আরেকটু কাছে গিয়ে আমাকে নামিয়ে দাও। সবচে কাছের ডুবুরিটার সাথেই আগে কথা বলি।” কার্ট বলল।

কার্ট হাতে লাগানো একটা প্যানেল খুলতেই ওয়াটার প্রুপ স্ক্রীন দেখা গেল। এখানে ও যা-বলবে তার লিখিত রূপ দেখা যাবে। এটা দিয়ে কথা না বলে সহজেই ডুবুরিটার সাথে যোগাযোগ করা যাবে।

“আর যদি ও শয়তানদের দলের হয়?” জো জিজ্ঞেস করল।

“তার জন্যে এটা।” বলে কার্ট বক্স থেকে একটা পিকাসো টুইন-রেইল স্পিয়ার গান তুলে নিলো। পাশাপাশি দুটো বর্শা বসানো ওটায়। সামনা সামনি দুটো ট্রিগার। এই মুহূর্তে সেফটি অন করা।

“তোমার জন্যেও একটা এনেছি।” কার্ট বলল, “তবে আপাতত দূর থেকেই খেয়াল রাখো। যদি ঝামেলায় পড়ি তাহলে তো জানো-ই যে কি করতে হবে।”

ওরা এই মুহূর্তে ডুবুরিগুলো থেকে একশো ফুট দূরে। এতোদূর থেকে ওকে দেখতে পাওয়ার কথা না। ও তারপরও কোনো ঝুঁকি নিতে চাইলো না।

“এখানেই নামবো আমি।” বলে কার্ট টার্টলের পাশের দরজা খুলে নেমে গেল। তারপর নিজের প্রপালশন ইউনিট চালু করে কোণাকুণি এগুতে লাগলো। শেষবারের মতো ফিরে তাকিয়ে দেখে নির্দেশ মতো জো ওখানেই বসে আছে।

৩১. কার্ট সামনে এগুলো

৩১.

টু শব্দটিও না করে কার্ট সামনে এগুলো। ওর প্রপালসন-ইউনিটের মৃদু ঘূর্ণের শব্দ শোনা যায় না বললেই চলে। ধ্বংসাবশেষের বাম দিকেই কাজ চলছে বেশি। এদিকে কমপক্ষে পাঁচটা লাইট জ্বলছে। সাথে ভ্যাকুয়ামের কাজ করা। ডুবুরিগুলো তো আছেই। ডানদিকে মাত্র দুটো লাইট দেখে ও সেদিকেই এগুলো।

চারদিকে ঘোলা পানি দেখেই বুঝলো যে ডুবুরিরা জাহাজটার ফসিল হয়ে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ ফুটো করে কিছু একটা বের করতে চাচ্ছে। NUMA-র অভিযানগুলো বাদে অন্যসব পানির নিচের অভিযানের মতোই এরা জাহাজটাকে আক্ষরিক অর্থেই কোপাচ্ছে। ভেঙে টুকরো টুকরো করে সেগুলো পাশে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে।

“মাথায় বন্দুক ধরা থাকলে অবশ্য এতো সব সংরক্ষণ-টংরক্ষণ মাথায় থাকে না।” ভাবলো কার্ট।

এতোদূর থেকে কার্ট জোকে রেডিওতে কোনো খবর পাঠাতে পারবে না। তার মানে এখন যা করার ওকে একাই করতে হবে।

“লিখিত কথোপকথন চালু করো।” ফিস ফিস করল কার্ট।

হেলপেটের ডিসপ্লেতে একটা সবুজ বক্স আবির্ভূত হলো। এক কোণায় T অক্ষরটা জ্বলছে নিভছে।

অনেক কথাই মাথায় আসছে। কি লিখবে কি লিখবে করে শেষমেশ সবচেয়ে সহজ কথাটাই লিখলো। “আমি এসেছি তোমাদের সাহায্য করতে।”

ওর হাতের স্ক্রীনটা জ্বলে উঠতেই ও আবার সামনে বাড়লো। কাছে পৌঁছে ও সবচে কাছের ডুবুরিটার কাঁধে টোকা দিল। ভেবেছিল লোকটা ভয় পেয়ে বা অবাক হয়ে ফিরে তাকাবে। কিন্তু এদিকে ভ্রূক্ষেপ-ই না করে ও নিজের কাজই করতে লাগল।

কার্ট আরো জোরে টোকা দিল এবার। তাও কিছু হলো না। তখন কার্ট ডুবুরিটার ঘাড় ধরে জোর করে নিজের দিকে ফিরালো।

এবার ডুবুরিটার চোখে দেখা গেল নিখাদ বিস্ময়। কার্ট দেখলো লোকটার চেহারা নীল হয়ে গিয়েছে। চোখ অর্ধেক বোজা। তার মানে লোকগুলো পানির নিচে দীর্ঘক্ষণ ধরে কাজ করছে।

কার্ট নিজের হাতের স্ক্রিনটা দেখালো।

লোকটা লেখাটা পড়ে ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকালো। তারপর ওর কাছে থাকা একটা সাদা বোর্ড তুলে নিয়ে তাতে লিখলো, “যত দ্রুত সম্ভব খোঁড়ার চেষ্টা করছি।” তারপর আবার কাজে মন দিল।

“লোকটা আমাকে শয়তানগুলোর একজন ভাবছে। তার মানে ওদের কাজ কর্মে খেয়াল রাখার জন্যে এখানে কেউ আছে।” ভাবলো কার্ট। তারপর আবার লোকটাকে ধরে লিখলো, “আমি আপনাদের উদ্ধার করতে এসেছি। লোকটা চোখ পিটপিট করে দেখলো লেখাটা। চোখটা আগের চেয়ে খুললো আরো একটু। এতোক্ষণে সম্ভবত ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। লোকটা হঠাৎ এতোটা ক্ষেপে গেল যে কার্টের তাকে চেপে ধরে রাখতে হলো।

“কয়জন লোক ওদের?” কার্ট লিখলো।

লোকটা লিখলো ৯।

“সবাই কি নিচে?”

৫ …….৪।

তার মানে পাঁচ জন ওপরে আর চারজন পানির নিচে। ঝামেলা হয়ে গেল তাহলে। নিচে এতোজন থাকবে কার্ট সেটা চিন্তা করেনি।

“কে কে দেখিয়ে দিন।” কার্ট লিখলো।

কিন্তু লোকটা কার্টকে কিছু দেখানোর আগেই ওদের ওপর আলো এসে পড়ল। ডুবুরিটার চোখ দেখেই কার্ট বুঝে ফেলল লাইটটা কোন পক্ষ ফেলেছে। ও ঘুরতেই দেখে বর্শা বাগিয়ে একটা লোক ওদের দিকেই আসছে।

.

৩২.

কার্ড ডুবুরিটাকে একপাশে ঠেলে দিয়ে নিজের পিকাসো তুলে ধরলো। কিন্তু আক্রমণকারী ডুবুরিটা খুবই কাছে চলে এসেছে ততোক্ষণে তাই কেউই বর্শা ছুঁড়তে পারলো না। তার বদলে দুজন দুজনকে জাপটে ধরে একদিকে কাত হয়ে গেল।

লোকটার মাথায় পুরো মুখ ঢাকা হেলমেট। গায়ের স্যুটটাও বেশ শক্ত। নাহলে কার্ট শুধু টান দিয়ে লোকটার মুখোশ খুলে দিতে। কিন্তু তার বদলে ওরা মোচড়া-মুচড়ি করে গড়ান দিতে লাগল একজন আরেকজনের ওপর। শেষমেশ কার্ট লোকটার মাথা চেপে ধরতে পারলো। তারপরই প্রপালশন চালু করে সোফি সি এর ভাঙ্গা কাঠামোর দিকে চলা শুরু করল।

আক্রমণকারী লোকটা স্পিয়ারগান ফেলে একটা ছুরি বের করল। কিন্তু সেটা ব্যবহারের আগেই কার্ট ওকে জাহাজের কাঠামোর ওপর তুলে ওর মাথার পিছন দিকটা সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে একটা বের হওয়া অংশের গায়ে বাড়ি দিল। সাথে সাথে লোকটার হাত থেকে ছুড়ি খসে পড়ল আর দুহাত ছড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল বালির ওপর। মারা না গেলেও অজ্ঞান হয়েছে নিশ্চিত।

অন্যপাশ থেকে আরো দুজন লোককে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। প্রথম জনের মতো এদেরও মুখ ঢাকা হেলমেট পরা তবে এদের পিঠে প্রপালশসন ইউনিট লাগানো। ফলে গতি তুলনামূলক দ্রুত।

কার্টের পাশ কেটে একটা বর্শা চলে গেল। বুদবুদ ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। কার্ট একপাশে লাফ দিয়ে পড়ল, তারপর লাথি দিয়ে বালি ছড়িয়ে পানি ঘোলা করে দিল যাতে ওকে দেখা না যায়।

তারপর ও নিজের প্রপালসন ইউনিট ঠিকঠাক করে ফুল স্পিডে চালানো শুরু করল। ফলে বালির মেঘে ঢেকে গেল চারপাশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক পাইলটের কাছ থেকে শোনা একটা কথা মনে পড়ল কার্টের : “আকাশ বা পানি যেখানেই ঘোলা হোক না কেন সব সময় বামে ঘুরবে।” কেন বামে বা কেন ডানে না সে কথা ও জানে না। তবে কথাটা যদি দুপুর বেলার আকাশের ক্ষেত্রে খাটে, তাহলে সমুদ্রের নিচেও খাটবে।

ও প্রপালশনের গতি একটুও না কমিয়ে বামে ঘুরলো, পা বালিতে বাধানো যাতে বালি আরো ওড়ে। কিছুক্ষণের জন্যে কৌশলটা ভালোই কাজে দিল। কিন্তু একটু পরেই ধুলোর মাঝেও এক জনের লাইটের আলো পৌঁছে গেল লোকটা কার্টকে দেখে অস্ত্র তুললো।

কার্ট আবারো ঘুরলো। কিন্তু আরেকটা বর্শার হুশ শব্দের বদলে কেমন ভোতা একটা আওয়াজ শুনতে পেল। যেন রাইফেলের গুলি। শব্দটা অনেকটা একে-৪৭-এর মতো লাগল ওর কাছে।

ওর কাঁধে লাগানো একটা পাখা ভেঙে গুড়ো হয়ে গেল। তবে কার্ট সামনে এনো থামল না। প্রাণপণে বালিতে লাথি দিচ্ছে যাতে ওকে ঠিকমতো খেয়াল না হয়।

প্রপালসনের ধাক্কায় অল্প পরেই ও ধ্বংসাবশেষের পিছনে চলে এলো। “জো, আমার কথা কী শুনতে পাচ্ছ? যদি শুনতে পাও তাহলে শোনো আমার জরুরি সাহায্য দরকার এখুনি। ওরা তিনজন, আমি একা। আর ওরা আন্ডার ওয়াটার রাইফেল ব্যবহার করছে। ওদের প্রপালসন ইউনিটগুলো দেখলাম রাশিয়ান, তার মানে রাইফেলগুলোও সেরকমই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।”

কার্টের যতদূর মনে পড়ে রাশিয়ানরা ওদের ডুবুরি আর স্পোজ (রাশিয়ান স্পেশাল ফোর্স) কমান্ডোদের জন্য দুই ধরনের রাইফেল বানিয়েছিল। একটাকে বলা হয় APS. এগুলো বোল্ট নামের বিশেষ স্টিলে বানানো গুলি ছুঁড়তে পারে। গুলিগুলো একেকটা পাঁচ ইঞ্চি করে লম্বা। এগুলো সীসার তৈরি বুলেটের চেয়ে পানির ভেতর অনেক ভালো কাজ করতে পারে। তবে তারপরও পানির ঘনত্বের কারণে এগুলোর পাল্লা খুব বেশি না। কার্ট যে গভীরতায় আছে সেখানে সর্বোচ্চ পঞ্চাশ থেকে ষাট ফুট হবে। কিন্তু কার্টের পিঠের ব্যথাই প্রমাণ করছে নির্দিষ্ট দূরত্বের বাইরে মেরে ফেলতে না পারলেও আঘাত ভালোই করতে পারে।

“জো, শুনতে পাচ্ছ? জো?”

আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে পানির ঘনত্ব পৃথিবীর সর্বাধুনিক কমিউনিকেশন সিস্টেমকেও অকেজো করে দিতে পারে। জো ওর কাছে-পিঠে নেই। কার্ট সোফি সেলিন-এর পিছনের দিকে তাকাল। সেদিক থেকে আলো এগিয়ে আসছে। ডানে তাকিয়ে দেখে সেদিকেও একই অবস্থা।

“তিনজন আসছে আমাকে মারতে, আর আমার হাতে বর্শা মাত্র দুটো। পরের বার বস্তা ভরে স্পিয়ার গান নিয়ে আসবো।” কার্ট বিড়বিড় করল।

কার্ট স্পিয়ার গানটা দুহাতে ধরে ডান দিকে এগুলো। আবছায়ার ভেতর থেকে ডুবুরিটার আলো স্পষ্ট হলো। কার্ট সেদিকে তাক করে বর্শা ছুঁড়লো। বর্শাটা লোকটার কলার বোনের ঠিক নিচ দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

বঁড়শিতে গাঁথা টুনা মাছের মতো লোকটা মোচড়ানো শুরু করল। আশপাশটা ভরে গেল বুদবুদ আর ঘূর্ণিতে। কিন্তু মাটিতে পড়ার বদলে লোকটা ক্ষতস্থান চেপে ধরে রাইফেলটা ফেলে দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল।

কার্ট লোকটাকে যেতে দিল। ওর লক্ষ্য রাইফেলটা। কিন্তু নিচে পড়ে অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছে।

“লাইট অন করো।” কার্ট বলল।

বাম কাঁধেরটা তো আগেই ভেঙে চুরে গিয়েছিল তবে ডান কাঁধেরটা সাথে সাথেই জ্বলে উঠল। আলোতে রাইফেলটা যেমন দেখলো কার্ট, ঠিক তেমনি ওর শত্রুরাও ওর অবস্থান জেনে গেল।

কার্ট সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপ দিল সাথে সাথেই শুনলো আরেকটা রাইফেলের আওয়াজ। ওর ঠিক সামনের বালিতে বোল্ট বিধতে লাগলো। এখন হয় কার্টকে ফিরতে হবে না হয় বোল্ট খেয়ে মরতে হবে।

বাকি ডুবুরি দুজন এগিয়ে আসছে। কার্ট নিজেকে সুস্থির করে শেষ বর্শাটা ছুড়লো। লক্ষ্য যে লোকটার হাতে রাইফেল আছে সে। একেবারে সরাসরি গলা ভেদ করে চলে গেল বর্শাটা। মুহূর্তে লোকটা হাত-পা ছড়িয়ে নিজের রক্তে নিজেই ডুবতে আরম্ভ করল।

কার্ট আবার রাইফেলটা যেদিকে পড়েছে মনে হয়েছিল সেদিকে ঝাঁপ দিল। কিন্তু ও পৌঁছতেই দেখে বাকি ডুবুরিটাও সেখানে পৌঁছে গিয়েছে।

দুইজনেই রাইফেলটা চেপে ধরলো। কার্ট ধরেছে হাতলের দিকের অংশটা, আর ওর প্রতিপক্ষ ধরেছে নলের অংশটা। ফলে টানাটানিতে কাটই জিতলে শেষমেশ।

কার্ট ওটাকে টেনে এনে গুলি করার চেষ্টা করল কিন্তু অন্যজন একেবারে ওর সাথে মিশে দাঁড়িয়ে আছে। সে কার্টের হেলমেটের পিছনদিকটা হাতড়াতে লাগল। বাতাসের পাইপটা টেনে খোলার ইচ্ছা।

কার্ট হাঁটু দিয়ে লোকটার পেটে গুঁতো দিল। লোকটা ওর বাতাসের পাইপ ছেড়ে দিল কিন্তু আরো মারাত্মক একটা জিনিস বের করল হাতে। একটা বিস্ফোরকের কাঠি। এগুলো সাধারণত হাঙ্গর মারতে ব্যবহার হয়। এর গায়ে স্পর্শ লাগলেই বিস্ফোরণ ঘটে। কার্ট লোকটার হাত আটকে কবজি চেপে ধরলো যাতে কাঠিটার মাথা ওর গায়ে লাগতে না পারে। যেখানেই লাগবে সেখানেই ফুটো হয়ে যাবে। এগুলোর একবার মাত্র স্পর্শে পনের ফুট লম্বা হাঙ্গর পর্যন্ত ধরাশায়ী হয়ে যেতে দেখছে কার্ট। ওর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। এভাবে মরার–বা কোনোভাবেই মরার ইচ্ছে নেই।

দুজন দুজনকে চেপে ধরে গোত্তা খেতে লাগল শুধু। কার্টের কাঁধের আলো লোকটার মুখোশে প্রতিফলিত হচ্ছে। ফলে দুজনের কেউই চোখে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু তারপরও কেউ কাউকে ছাড়ছে না।

কার্ট এতোক্ষণে টের পেয়েছে যে লোকটা আকারে ওর চেয়ে কত বড়। কার্টের কাঁধ চেপে ধরতে পারায় লোকটা কিছুটা সুবিধা পেয়ে গেল। আর কার্টের প্রাণপণ চেষ্টার পরও ইঞ্চি ইঞ্চি করে কাঠিটা ওর পাজরের দিকে এগুতে লাগল। কার্টের মৃত্যু এখন সময়ের ব্যাপার। লোকটাও সেটা টের পেয়েছে। কার্ট লোকটার মুখে কেমন একটা অপ্রকৃতিম্ভের মতো হাসি দেখতে পেল। আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড বাকি কার্টের আয়ুর। ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ ওদেরকে আলোর বন্যায় ভাসিয়ে একটা ঝাপসা হলুদ মতো জিনিস ছুটে এলো। আর একটা প্রচণ্ড গতির বাসের মতো কার্টকে আক্রমণকারী লোকটাকে আঘাত করল।

কার্ট পাক খেয়ে সরে গেল একদিকে। ঘুরে তাকিয়ে দেখে জো টার্টলের নাকে লোকটাকে বাধিয়ে ঠিক একটা উন্মত্ত ষাড়ের মতো ছুটে যাচ্ছে।

লোকটাকে সমদ্র তলে আছড়ে ফেলে তারপর জো থামল। তারপর টার্টল দিয়ে চাপা দিয়ে বালির ভেতর অর্ধেক গেঁথে দিল।

কার্ট নিচু হয়ে রাইফেলটা তুলে নিয়ে জোর অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরেই টার্টল কার্টের পাশে এসে থামল। হেলমেটের ভেতর দিয়েই জো’র হাসিমুখ দেখা যাচ্ছে। “আচ্ছা টাৰ্টলের গায়ে একটা কঙ্কালের মাথা একে দিলে কেমন হয়?”

আমি থাকতে সেটা হবে না, এতোক্ষণ লাগলো কেন তোমার?” কার্ট বলল। জো দাঁত বের করে হাসলো, “ওখানে বসে আসলে বোঝা যাচ্ছিলো না যে তুমি আসলেই বিপদে পড়েছ নাকি মজা নিচ্ছ। তবে যখন রাইফেলের শব্দ পেলাম তখন বুঝলাম কুছ তো গাড়বাড় হ্যায়।”

মজার ব্যাপার হলো, পানির নিচে গুলি বা রেডিও তরঙ্গের চেয়ে শব্দ অনেক দ্রুত যায়।

কৃতিত্ব পুরোটাই রাশিয়ানদের। ওরা বেশ মজার মজার অস্ত্র বানায়।” কার্ট জবাব দিল।

“হুম! তোমার কালেকশনের জন্যে দারুণ হবে এটা।” জো বলল।

কার্ট বন্দুক সগ্রহ করতে পছন্দ করে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ওগুলো যোগাড় করে। ওর কাছে ভুয়েলিং পিস্তল আছে, দুপ্রাপ্য কয়েকটা অটোম্যাটিক বোয়েন রিভলভার আছে। সম্প্রতি পশ্চিম থেকে একটা সিক্স শুটার জোগাড় করেছে। সাথে একটা কোল্ট পয়েন্ট ফোর ফাইভ। এটা দিয়েই ও ওর সর্বশেষ ভিলেনকে মেরেছে।

“তা তো অবশ্যই। তবে আমার মনে হচ্ছে। শো-কেসে জায়গা পাওয়ার আগে এটার আরো কিছু কাজ বাকি আছে।”

“আমরা যে কাজটা উল্টো দিক থেকে করছি সেটা কী বুঝতে পারছো? আমরা মাটির নিচে সব সাফ করে ফেলেছি। কিন্তু ওপরে কিন্তু রয়েই গিয়েছে। যুদ্ধের কৌশল কিন্তু এরকমটা হয় না।”

“তবে ভাগ্য কিছুটা ভালো। ওরা এখনো আমাদের কথা জানে না।” কার্ট প্রপালসন ইউনিট চালু করে আবার ধ্বংসস্তৃপের দিকে এগিয়ে গেল। কর্মরত সাধারণ ডুবুরিদের দেখা গেল আরো কয়েকটা অক্সিজেন ট্যাঙ্ক বের করছে। ওদেরকে দেখেই কেমন কুকড়ে গেল ওরা।

“সাবটাইটেল দেয়া শুরু করে দাও।” জো বলল।

ডিসপ্লেটা চালু করে কার্ট লিখলো, “সব ঠিক আছে। গার্ডরা মারা গিয়েছে, আমরা আপনাদেরকে এখান থেকে নিয়ে যাবো।”

একজন আঙুল দিয়ে ওপরে দেখিয়ে হাতের বোর্ডে খুব কষ্টে কিছু আঁকিবুকি কাটলো। এমন কাকের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং লেখা কার্ট জীবনেও দেখেনি।

“আপনারা কতক্ষণ ধরে পানির নিচে?” কার্ট জিজ্ঞেস করল। চার আঙুল দেখালো একজন।

“নব্বই ফুট পানির নিচে চার ঘণ্টা।” জো বলল।

ওরা নিশ্চয়ই শুধু অক্সিজেনের বদলে নাইট্রক্স বা টাইমিক্স ব্যবহার করছে। তার পরও এতোক্ষণ পানির নিচে থাকার কারণে ওপরে ওঠার জন্যে ওদেরকে কমপক্ষে কয়েক ঘন্টা ডিকমপ্রেস করতে হবে। দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে বুঝলো যে পর্যাপ্ত ট্যাঙ্ক নেই। পর্যাপ্ত কি নেই-ই বলা চলে। তার মানে অন্য কোনো উপায় বের করতে না পারলে এরা সবাই মারা পড়বে।

কার্ট সবার সামনের ডুবুরির কাঁধে হাত রেখে মাথা নাড়লো, “আপনারা ওপরে যেতে পারবেন না।”

ডুবুরিটাও মাথা নেড়ে আবার ওপরের দিকে দেখালো।

“আপনারা তাহলে মারা পড়বেন।”

লোকটা লেখাগুলো পড়ে আবার ওপর দিকে ইঙ্গিত করল। তারপরই হাত দিয়ে অদ্ভুত একটা ভঙ্গি করল।

“আপনারা কী বলতে চাইছেন তা বুঝতে পারছি না।” কার্ট লিখলো।

ডুবুরিটাকে হতবুদ্ধি দেখালো। কার্ট ওকে শান্ত করার চেষ্টা করল। তারপর ডুবুরিটার বোর্ড দেখিয়ে বলল, “আস্তে আস্তে লেখেন।” লোকটা বোর্ডটা নিয়ে আগের সব লেখা মুছে ফেললো। তারপর এবার আরো ভালো করে লেখার চেষ্টা করতে লাগল। ঠিক যেন একটা বাচ্চা ছেলে ধৈর্য ধরে তার হাতের লেখা সুন্দর করার চেষ্টা করছে।

শেষ করে বোর্ডটা ঘুরিয়ে ধরলো সে। এবার পড়া যাচ্ছে একটা মাত্র শব্দ লেখা তাতে।

বোমা!

.

৩৩.

ডুবুরিটা আতঙ্কের সাথে অর্ধেক উদ্ধার করা ধ্বংসাবশেষটা দেখালো। তারপর আবার কিছু লিখলো বোর্ডে।

“আপনারা যখন আক্রমণ করেন–তখন ওরা বোমা পেতেছে।”

কার্ট হঠাৎ ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। লোকগুলো এই ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করতে চেয়েছিল। কিন্তু যদি ওরা নিজেরা না পায় তাহলে ওরা ওটা কাউকেই পেতে দেবে না। “দেখান তো কোথায়?”

লোকটা ইতস্তত করতে লাগল।

দেখান!”

নিতান্ত অনীহায় লোকটা সাতরানো শুরু করল সেদিকে। খুবই ধীরে এগুচ্ছে। কাছে পৌঁছাতেই লোকটা নিজের লাইট ফেলে বোমাটা দেখালো। ওরা ভ্যাকুয়ামটা দিয়ে টনকে টন বালি সরিয়েছে। তারপর জিনিসপত্র যেগুলো পেয়েছে তার মধ্যে যেগুলো মিসরীয় মনে হয়নি সেগুলো সব ফেলে দিয়েছে। তরবারি, শেওলাপড়া কামানের নল, জুতা হাবিজাবি চারপাশে ডাস্টবিনের মতো করে পড়ে আছে।

জাহাজটা দেখতে এখন কঙ্কালের মতো লাগছে। বাইরের কাঠ-তক্তা সবই খুলে ফেলা হয়েছে। শুধু তুলনামূলক সরু কাঠের তৈরি ভেতরের কাঠামোটা রয়ে গিয়েছে। ওটার ওপর ভেসে গেল কার্ট। তারপর ডুবুরির আলো ফেলার জায়গাটা দেখতে লাগল। বোমা একটা না, দুটো। কয়েক তাল C-4-কে দেখা গেল টাইমারের সাথে লাগানো। ঠিক গোডাউনটায় যে রকমটা ব্যবহার করতে চেয়েছিল সেরকম। সমস্যা হলো বোমাটা এমনভাবে জাহাজের খোলে পড়ে আছে ঠিক যেন বাঘের খাঁচার মধ্যে মাংস দেয়া হয়েছে।

কার্ট আরো একটু কাছে গেল। তারপর জাহাজের ছাতাপড়া কাঠ চেপে ধরে কাছ থেকে দেখতে লাগল। বোমার ডিজিটাল ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে ২.৫১। সেকেন্ড সেকেন্ড করে কমছে সময়টা।

কার্ট চেষ্টা করল ভাঙ্গাচোরা জিনিসগুলোর ভেতর দিয়ে বোমাটা টেনে আনতে, কিন্তু ওর হাত অতদূর গেল না। ওর হাত থেকে আরো দুয়েক ফুট দূরে বোমাটা।

“জো! একটু সাহায্য দরকার।” কার্ট বলল।

জো আর টার্টল আসতে আসতে ঘড়ির কাটা ২.০০-তে পৌঁছে গেল। Roy- টায় একটা ভাজকরা লাঠি ছিল। জো সেটা দিয়ে চেষ্টা করল। কিন্তু কাজ হলো না। এটাও ছোটো।

“আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়া দরকার। আমি এই লোকগুলোকে নিয়ে যেতে পারবো।” জো বলল।

দেরি হয়ে গিয়েছে। এখন গেলেও বেশিদূর যেতে পারবে না। আর যে পরিমাণ C-4 ব্যবহার করা হয়েছে তাতে শক ওয়েভেই চ্যাপ্টা হয়ে মরবো। অন্য বুদ্ধি বের করতে হবে।”

হঠাৎই ওর গায়ে সামান্য ঝাঁকুনি অনুভূত হওয়ায় পাশ ফিরে দেখে ডুবুরি লোকটার হাতে ভ্যাকুয়াম পাইপটা ধরা।

“দারুণ বুদ্ধি!” বলল কার্ট।

ভ্যাকুয়ামটা তখনো চালু। কার্ট সেটাকে ভাঙ্গা জাহাজের কাঠের দিকে তাক করে ভালভ খুলে দিল।

প্রথমবারেই ওটা অনেকখানি বিস্ফোরক তুলে আনলো। কিন্তু ওটা নজেলের কাছে আটকে গেল। ও ভ্যাকুয়ামটা আবার উঠিয়ে নিয়ে আসলো আর জো ওটাকে ওখান থেকে খুলে নিলো। তারপর তারগুলো খুলে ফেলতেই বোমাটা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল। তারপরও সাবধানতাস্বরূপ জো টাইমারটাও খুলে দিল।

“চল্লিশ সেকেন্ড আছে আর। তাড়াতাড়ি। বাকিটাও উঠিয়ে আনো।” থেমে যাওয়া টাইমারটা দেখে বলল জো।

কার্ট ইতোমধ্যে ভ্যাকুয়ামটা আবার আগের জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে প্রায়। দ্বিতীয় বোমাটার দিকে তাক করতেই বোমাটা উঠে এলো। কিন্তু প্রথমটার মতো আটকে যাওয়ার বদলে বেসবলের মতো বড় বোমাটা ভ্যাকুয়ামের পাইপ বেয়ে ওপরে চলে গেল।

কার্ট আর জো দুজনেই ওপরে তাকাল। পানির ওপরে টিউবের মাথাটা দেখার চেষ্টা করছে।

“জিনিসটা কোথায় গিয়ে থামবে বলে মনে হয়?” জো জিজ্ঞেস করল। কার্ট জবাব দিল না, কারণ উত্তরটা দুজনেরই জানা। তবে কথা হচ্ছে বোমাটা কি চল্লিশ সেকেন্ডে পুরো পাইপ পার করতে পারবে নাকি কোথাও আটকে যাবে? কার্ট ভ্যাকুয়াম পূর্ণ গতিতেই চালাতে লাগল। আশা করছে বোমাটা শেষ পর্যন্তই পৌঁছতে পারবে।

.

এদিকে পানির ওপরে ভ্যাকুয়ামের কমপ্রেসরটা এতোক্ষণ অলস ভঙ্গিতে আস্তে আস্তে চলছিল। হঠাৎ সেটা পূর্ণ শক্তিতে গর্জন করা শুরু করল। ফারুক নামে একটা লোক এটার দায়িত্বে ছিল। হঠাৎ এই পরিবর্তনে খুশি হলো সে। কারণ সে ভাবছিল নিচে বোধহয় কাজ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

এখন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছুই উদ্ধার করতে পারেনি। যা পেয়েছে সবই ফালতু জিনিস। এদিকে টেনশন হচ্ছে খুব। প্রতিবারই আশপাশে কোনো জাহাজ দেখা গেলেই ওর বুকটা কেঁপে উঠছে। এই বুঝি NATO বা মাল্টার কোস্ট গার্ডের পেট্রোল বোট ধেয়ে এলো। ও আবার সেই ধাতুর জালটার দিকে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই পানির ক্ষীণ ধারাটা উনাত্ত স্রোতে রূপ নিলো। অবশ্য ওটায় পানি-ই বেশি। বালি বা অন্য জিনিস খুব একটা নেই। তবে সেটা যে কোনো মুহূর্তে পাল্টে যাবে। শেষমেশ একদলা বালি নলের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো। তারপরই ওঠে এলো শক্ত একটা জিনিস। জিনিসটা জালের ওপর পড়তেই একজন ওটা কি দেখার জন্যে এগুলো।

“না।” ফারুক চিৎকার করে উঠল।

তবে ওর চিৎকার ঢাকা পড়ে গেল বিস্ফোরণের শব্দে। অন্য লোকটা আর ফারুক দুজনেই ছাতু হয়ে গেল মুহূর্তেই। জাল, কমপ্রেসর আর বজরাটার বেশির ভাগ অংশও উড়ে গেল সাথে সাথে। যেটুকু বাকি ছিল সেটুকুও টুপ করে ডুবে গেল পানিতে।

বজরা থেকে একজন মাত্র লোক বেঁচে ফিরতে পারলো। একেবারে নৌকার শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে ছিলো সে। বিস্ফোরণের পরে নৌকাটা ভোবা আরম্ভ করতেই সে লাফ দিয়ে অন্য নৌকটার দিকে সাঁতার দিলো। অন্য কারো খোঁজ নেয়ার কথা মাথাতেই নেই।

লোকটা অন্য নৌকাটার সিঁড়িতে পৌঁছাতেই একজন এসে তাকে উঠতে সাহায্য করলো কিন্তু সিঁড়িতে পা দেয়ার আগেই তীক্ষ্ণ কিছু একটা তার পা ভেদ করে ঢুকে গেলো। তারপর তাকে টেনে আবার পানিতে এনে ফেললো।

প্রথমে লোকটা ভেবেছিল হাঙ্গর বোধহয়। কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে পানিতে অস্পষ্ট হলুদ কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। পানিতে ডুবন্ত কিছু একটা। উল্টোদিকে যাচ্ছে এখন। সাথে তাকেও টেনে নিয়ে যাচ্ছে পানির নিচে।

যে মুহূর্তে মনে হলো যে লোকটা জ্ঞান হারাবে তখনই তার পায়ের বাঁধন খুলে গেল আর সে মুক্ত হয়ে গেল। হাড়ে পাঁচড়ে পানির ওপর উঠে দেখে ডুবুরি নৌকাটা থেকে প্রায় একশো গজ দূরে সরে এসেছে। এদিকে পানির ওপরে উঠামাত্র শুরু হলো কাশি। কোনোমতে সেটা সামলে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে হলুদ জিনিসটা আর নেই।

ডুবুরি নৌকায় থাকা দুজন এদিকেই অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। আশে পাশের পানিতে গুলি করার মতো কিছু খুঁজছে ওরা যে আক্রমণের শিকার এতক্ষণে তা টের পেয়েছে।

“কিছু দেখা যায়?” একজন চিৎকার করে জানতে চাইলো।

“না”

“আরেক দিকে দেখো।”

“ঐ তো ঐ যে!” নৌকায় থাকা দ্বিতীয় জন চেঁচালো।

লোকটা ভেবেছিল জিনিসটা একটা ডুবো জাহাজ। ওর বুলেটগুলো পানি ছিটকাতে ছিটকাতে চিরে দিল সমুদ্রের বুক। কিন্তু জিনিসটা উধাও হয়ে গেল আবার।

“এদিকে।” এবার প্রথম লোকটা হলুদ জিনিসটা দেখতে পেয়েছে।

জিনিসটা এবার সোজা ওদের দিকে এগুচ্ছে। পানির ঠিক নিচে। সূর্যের আলোয় ওটার চকচকে গা দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। দুজনেই সেদিকে বন্দুক তাক করে গুলি করা শুরু করল। আশে পাশে পানি ছিটকে ফোয়ারার মতো হয়ে গেল।

কিন্তু হলুদ জিনিসটা তাতে থামল না। কয়েক মুহূর্ত পরেই সেটা পানির ওপর উঠে এলো। গুলি বষ্টিতে ভরিয়ে দিল জিনিসটাকে, কিন্তু জিনিসটা এক মুহূর্ত না থেমে ওদের নৌকায় এসে ধাক্কা দিল।

ধাক্কায় নৌকা দুলে উঠল। লোক দুটো ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে বন্দুক দুটো ঘুরিয়ে নিতে হলো। আর জিনিসটা ওদের নৌকার পাশ কাটিয়ে দূরে সরে গেল।

এতক্ষণে ওরা বুঝলল যে ওটার ভেতর আসলে কেউ নেই।

হঠাৎ পিছনে শিসের শব্দে ধারণার সত্যতা প্রমাণ হলো। ঘুরতেই দেখে রূপালি চুলের, ডুবুরিদের পোশাক পরা এক লোক ওদের দিকে একটা APS তাক করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ওরা যতক্ষণ হলুদ জিনিসটা নিয়ে ব্যস্ত ছিলা তখন কার্ট নৌকার পিছন দিক দিয়ে উঠে এসেছে।

“বন্দুকগুলো পানিতে ফেলে দাও।” আদেশ দিল কার্ট।

লোকদুটো আদেশ মেনে হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

“হাত পাছার পিছনে নিয়ে, মাথা নিচু করে বসে পড়ো।”

বিনা বাক্য ব্যয়ে এটাও মেনে নিলো তারা।

ওদের দিকে বন্দুক তাক করে রেখেই ও নৌকার ক্যাপ্টেনের হাত-পায়ের বাঁধন কেটে দিল। তারপর মুখের ভেতর থেকে কাপড়টা সরাতেই ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বলে উঠল, “পানির নিচেও আমার লোক আছে।”

“চিন্তা করবেন না, ওরা ঠিক আছে।” কার্ট বলল।

ক্যাপ্টেন মাথা নাড়লল, “ঐ লোকগুলো ভোরের পর থেকে পানির নিচে। আর আমাদের ডিকমপ্রেশন ট্যাঙ্ক ঐ বজরাতে ছিল।”

“আমাদের জাহাজে একটা আছে। ওটা আনিয়ে নিচ্ছি।” বলে ও সী ড্রাগনকে রেডিওতে খবর দিল।

“দ্য চ্যাম্পিয়নদের কি হবে? ওরা এই কনসারভেন্সিটা চালায়। ক্যাপ্টেন বলল।

“ওদের কি হবে মানে?”

‘লোকগুলো ওদেরকে ধরে নিয়ে গিয়েছে।”

“আগেই বোঝা উচিত ছিল।” কার্ট বলল, তারপর পড়ে থাকা দুজনের দিকে ফিরে বলল, “রেডিও না ফোন?”

“ফোন, ব্যাকপ্যাকে আছে।” লোকটা জবাব দিল।

কার্ট লোকটাকেই আদেশ দিল ফোন বের করে নাম্বার টিপতে।

“কি খবর বলো? কাজ কতদূর এগুলো?” কর্কশ একটা কণ্ঠ শোনা গেল। কার্ট ফোনটা ওর হাত থেকে নিয়ে নিলো, “আপনারাই কি দ্য শ্যাম্পেনদের আটকে রেখেছেন?”

“কে?”

“আমার নাম অস্টিন। কার সাথে কথা বলছি জানতে পারি?”

“আপনি যদি আমার নাম না জানেন, তাহলে সেটা না জানানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।” লোকটা বলল।

“সমস্যা নেই। আপনার লোকদের একটু কড়কে দিলেই সব জানা যাবে।” লোকটা জবাব না দিয়ে হাসতে লাগল। “লোকগুলো আমার ব্যাপারে বিন্দু বিসর্গও জানেনা। যা খুশি করুন ওদেরকে নিয়ে। আপনি যা জানেন এর বেশি একটা তথ্যও ওদের কাছে নেই।”

এই মুহূর্তে কার্ট পিছিয়ে আছে। তবে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না।

“হতে পারে। তবে ওরা যে পুরাকীর্তিগুলো উদ্ধার করেছে সেগুলো থেকে অনেক কিছুই জানা যাবে আশা করি। মিসরীয় ধ্বংসাবশেষ সংগ্রহ করা দারুণ একটা শখ। বিশাল সবুজ দানবটার রহস্যটা কি তা আমার জানার খুব আগ্রহ। সম্ভবত লোকটার মানুষকে শূন্যে ভাসাবার ক্ষমতা ছিল।

আন্দাজের ওপর বাজি ধরেছিল কার্ট কিন্তু লেগে গেলো সেটা। হাসির বদলে ওপাশে এবার নীরবতা নামলো। “যাক এবার কাজ হয়েছে।” ভাবলো কার্ট। “খোঁচাটা জায়গা মতোই লেগেছে।”

“আপনার কাছে শিলালিপিটা আছে?”

“সত্যি কথা হলো আমি তিনটা শিলালিপি পেয়েছি।” মিথ্যে বলল কার্ট। “আমি আপনাকে একটা প্রস্তাব দিতে চাই।” লোকটা বলল ফোনের অপর প্রান্ত থেকে।

“শুনছি আমি।”

“ট্যাবলেটগুলো আমাকে ফেরত দিন বদলে দ্য শ্যাম্পেনদের জীবিত ছেড়ে দেবো।”

“হুম! আচ্ছা ঠিক আছে। কোথায় আসতে হবে বলুন।”

.

৩৪.

“এই লোকগুলোকে নিয়ে আসা কি বুদ্ধির কাজ হয়েছে?” বেঁধে রাখা লোকগুলোকে দেখিয়ে বলল রেনাটা। ওরা এখন পূর্ণ গতিতে ফোনের লোকগুলোর বলে দেয়া জায়গাগুলোর দিকে ছুটছে।

“ওদের সাথে আমাদের একটা ব্যবসা করার কথা। অন্তত আমাদের মালগুলো তো দেখাবো।” কার্ট বলল।

“যখন ওরা দেখবে আপনি শিলালিপির বদলে তিনটা গুণ্ডা নিয়ে এসেছেন তখন কি হবে বলে মনে হয়?” জো জিজ্ঞেস করল।

“গোলাগুলি, বিস্ফোরণ আর লোকজনের চেঁচামেছি।” কার্ট জবাব দিল।

“তার মানে…সেই আগের মতোই।” জো হতাশ হলো।

“যা করি সবসময় তা-ই।” কার্ট বলল। শুনে রেনাটা আর জো দুজনেই হাসলো তবে রেনাটার হাসিটা বিষণ্ণ দেখালো।

“আসল সমস্যা অন্য জায়গায়,” বলল রেনাটা। “আমাদের কাছে যদি শিলালিপিগুলো আসলেও থাকতো তাহলেও ওরা দ্য শ্যাম্পেনদের ছাড়তে বলে মনে হয় না। তার ওপর এরা জানে যে এই লোকগুলো কি খুঁজছে। জাদুঘরের ঐ জিনিসগুলোও দ্য ‘চ্যাম্পিয়নদের কালেকশন থেকেই আসা। কয়েক বছর আগে ওরা সোফি সি.তে উদ্দার কাজ চালায়। এর মানে হচ্ছে দ্য শ্যাম্পেনরা পুরাকীর্তিগুলোর চেয়ে কম বিপদে নেই।” কার্ট তাকিয়ে আছে সমুদ্রের দিকে। সূর্যের আলো চোখে পড়ায় চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। যততই মজা করুক যে কাজটা করতে যাচ্ছে সেটা দারুণ কঠিন। “আমাদেরকে প্রথম সুযোগেই ওদেরকে ভড়কে দিতে হবে। অস্ত্রপাতি আর লোকজন কেমন আছে আমাদের?”

জো লোকদের কাছ থেকে নেয়া বন্দুক আর ওগুলোর গোলাবারুদ দেখে টেখে বলল, “দুটো একে-৪৭ আর একটা APS রাইফেল। গুলি আছে তিনটা বন্দুক মিলায়ে নব্বই রাউন্ডের মতো। এক্সট্রা কোনো ম্যাগজিন নেই।”

“আমার একটা গুলি ভরা বেরেটা নাইন মিলিমিটার আছে। মোট আঠারোটা গুলি আছে ওটায়।” রেনাটা বলল।

“আমার কাছে খানিক C-4 আছে।” কার্ট বলল।

“অস্ত্রপাতির ব্যবস্থা তো হলো, ঘাবড়ানোর ব্যবস্থা কী হবে?”

রেনাটা ওর ফোনে এলাকাটার একটা ছবি ডাউনলোড করে বলল, “এখানে আমাদেরকে দেখা করতে বলেছে।”

জায়গাটা উপসাগরের ভেতর। অশ্রুর মতো আকৃতি আর চারপাশে চুনাপাথরের ছোট ছোট পাহাড়ে ভরা। সাগরটার মুখেই এক চিলতে বেলাভূমি। বৈকালিক সূর্যের আলোয় সামনের পরিষ্কার পানি ফিরোজা রঙে ঝলমল করছে। “এটা কী?” ছবিটার একটা কোণা দেখিয়ে কার্ট জিজ্ঞেস করল।

রেনাটা ছবিটা আরো বড় করে বলল, “দালানকোঠা।” চুনাপাথরের পাহাড়গুলোর ওপরে ওগুলো বানানো। কয়েক তলা উঁচু, বারান্দাও আছে। উপসাগরের প্রান্তে ছোট্ট একটা ব্রিজও আছে।

“পরিত্যক্ত হোটেল।” রেনাটা বলল। তারপর বিল্ডিংটা সম্পর্কে কিছু তথ্য। বের করে জানালো, “এটা হলো মূল ভবন। আর এই ব্রিজটা বানানো হয়েছিল হোটেল থেকে সরাসরি সমুদ্র তটে যাওয়ার জন্য।”

“বালি’র (ইন্দ্রোনেশিয়ার দ্বীপ) রিসোর্টগুলোর মতো? পানির ওপর ব্রিজ?” জো জিজ্ঞেস করল।

“সেরকম মনে হচ্ছে না। এগুলো অনেক উঁচু। নিচু দিয়ে নৌকা যেতে পারবে। এখানকার দেয়া তথ্যমতে জিনিসটা বানানো হয়েছিল ‘অ্যাজউর উইন্ডো’-এর মতো করে। আশেপাশেই নাকি এরকম দেখতে প্রাকৃতিক একটা ব্রিজ আছে।” রেনাটা জবাব দিল।

কয়েক বছর আগে কার্ট অ্যাজিউর উইন্ডোটা দেখেছে। দুর্দান্ত সুন্দর জিনিসটা। প্রায় একশো ষাট ফুট উঁচু হয়ে সমুদ্র থেকে বেরিয়ে এসেছে। ও যাদের সাথে ঘুরতে গিয়েছিল ওরা তো ওখান থেকে লাফ দিয়ে সমুদ্রে পড়বে বলে ঠিক করে ফেলল। কার্ট আগাম ওদের চল্লিশার দাওয়াত চেয়ে বসায় শেষমেশ ওরা নিবৃত হয়।

“ব্রিজটা ঝামেলা করবে। সাগরের পাশের ঐ পাহাড়গুলোও সমস্যা। কার্ট বলল। “স্নাইপারদের লুকানোর জন্য আদর্শ জায়গা ওগুলো। আর এর মধ্যেই ওরা একবার তাকে ব্যবহারও করেছে।”

“আমরা ওদের পিছন দিক দিয়ে আসতে পারি। আমি বলি কি এবার আর নিচে না গিয়ে মাটির আরো উঁচু দিয়েই যাওয়া যাক।” জো বলল।

রেনাটা ছবিটা ছোট করে আশেপাশের জায়গাগুলো দেখতে লাগল। হোটেলটার আশেপাশে কিছু নেই। সবচে কাছের লোকালয়টাও অনেক দূর। একটা মাটির রাস্তা চলে গিয়েছে ওখান থেকে হোটেল পর্যন্ত। আর সমুদ্র থেকে ঐ রাস্তায় পৌঁছার রাস্তা একটাই। সেটা হলো হোটেল থেকে রাস্তা পর্যন্ত একটা আঁকাবাঁকা সিঁড়ি।

“আমরা ওই ব্যাটাদেরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারি।” ঠাণ্ডা স্বরে বলল রেনাটা। “করতে পারলে খুশি-ই হতাম। কিন্তু এই লোকগুলো নিজেদের লোকদেরকেও মারতে আটকায় না। এই কাজ করলে বরং ওরা খুশি-ই হবে।”

“তাহলে তো হয় দ্বীপে নামামাত্রই গুলি খেয়ে মরতে হবে আর ভাগ্য আরো খারাপ হলে RPG দিয়ে নামা জাহাজটাই উড়িয়ে দেবে। আমরা কিছুই করবো না?”

“কিছুই করার নেই। সত্যি কথাই বলল কার্ট। “তার ওপর এই কাল্পনিক পুরাকীর্তিগুলো থাকা না থাকায় ওদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। ওদের লক্ষ্য শুধু ওগুলো যাতে কারো হাতে না পড়ে। তবে আমার মনে হচ্ছে ওরা অন্তত একবার হলেও জিনিসগুলো দেখতে চাইবে। কারণ দেখার আগেই আমাদের ডুবিয়ে দিলে ওরা নিশ্চিত হতে পারবে না যে আসলেই ওগুলো আমাদের কাছে ছিল কি-না। আমাদের শুধু রেডি থাকতে হবে যখন ওরা ব্যাপারটা টের পাবে সেই সময়টার জন্য।”

“কোনো বুদ্ধি পেয়েছ?” জো জিজ্ঞেস করল।

“তুমি হচ্ছো মেকানিক্যাল জিনিয়াস। এসব দিয়ে তুমি কী করতে পারবে বলো?” কার্ট বলল।

জো ডেকের ওপর নজর বুলালো। সেখানে স্কুবা ট্যাঙ্ক, পাইপ, নৌকার আংটা আর কিছু দড়ি পড়ে আছে। “যা আছে তা দিয়ে খুব বেশি কিছু হয়তো করা যাবে না। তবে একটা কিছুতো বের করে ফেলবই।” জবাব দিল জো।

.

৩৫.

ডুবুরির নৌকাটা নিয়েই যাচ্ছে ওরা। চালাচ্ছে কার্ট। সমুদ্রের নীল-সবুজ পানিতে লম্বা একটা সাদা দাগ পড়ে যাচ্ছে তাতে। এদিকে জো বসে বসে খালি স্কুবা ট্যাঙ্কগুলো জোড়া দিয়ে একটা বাংকার বানাচ্ছে।

“এগুলোর গায়ে গুলি লাগলে ফুটে যায় না?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

“সিনেমাতে ফোটে। তবে সাবধানের মার নেই বলে আগেই ফুটো করে নিয়েছি গায়ে। এখন এগুলো পুরু দুই স্তরবিশিষ্ট স্টীলের প্রতিরক্ষা ঢাল হিসেবে কাজ করবে। আড়ালে লুকানোর জন্যে চমৎকার কাজে দেবে।” জো জবাব দিল।

“আপনি খুব সাহসী। আপনারা দুজন-ই” রেনাটা বলল।

“এই কথাটা দয়া করে আপনার সব বান্ধবীকে বলবেন যে কীভাবে আমরা মানবতার স্বার্থে জীবন বাজি রেখে পৃথিবীকে রক্ষা করেছি।”

রেনাটা হেসে দিল।

“আমার বান্ধবী আছেই মাত্র কয়েক জন। তবে ওরা আপনার সাথে পরিচিত হতে পারলে খুশিই হবে।”

“মাত্র কয়েকজন?”

“তিন চারজন আর কি। ওরাই আপনার জন্যে মারামারি লাগিয়ে দেবে।” রেনাটা জবাব দিল।”

“ইশ। ভালোই মজা হতো তাহলে, কিন্তু বেঁচে ফিরতে পারবো কি-না কে জানে।” করুণ একটা হাসি হেসে বলল জো। তারপর কার্টের দিকে ফিরে বলল।

“আশা করি এতে কাজ হবে। এখন আর আমার মরতে একদমই ইচ্ছে করছে না।”

জো শেষ ট্যাঙ্কটা জোড়া দেয়া শেষ করতেই ওরা গোজো দ্বীপের ধারে পৌঁছে গেল।

“তোমার জিনিস রেডি। যতটা পারি করেছি। আমি নিচে যাচ্ছি।” বলল জো। কার্ট মাথা ঝাঁকিয়ে রেনাটার দিকে ফিরলো। “আপনার লুকিয়ে থাকা দরকার। ওরা এখনো আপনার কথা জানে না।”

“আপনারা আমার দেশের শত্রুর সাথে লড়বেন আর আমি পাটাতনের নিচে লুকিয়ে থাকবো?” রেনাটা প্রতিবাদ করল।

“হ্যাঁ। সেটাই করবেন। সবার পেছনের কামরাটায় একটা জানালা আছে। ওটার ছিটিকিনি খুলে যথা সময়ের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকেন।”

“পেছনের কেবিনে কেন?”

“কারণ আমাদের খুব দ্রুত পালানোর প্রয়োজন পড়তে পারে।”

মুখ দেখে বোঝা গেল রেনাটা ব্যাপারটা মানতে পারছে না, কিন্তু কিছু বললও না। “আচ্ছা ঠিক আছে, শুধু এবার-ই।”

ওরা কানে লুকানো মাইক্রোফোন লাগাল। রেনাটা নিজেরটা পরীক্ষা করে নিয়ে নিচের ডেকে নেমে গেল। তারপর পেছনের কেবিনে চলে গেল। তারপর জানালার ছিটকিনি খুললেও জানালা না খুলে হাতে বেরেটা নিয়ে বসে থাকল।

চুনাপাথরের পাহাড়গুলোর কাছে পৌঁছাতেই কার্ট নৌকাটা এক টানে পুরো ঘুরিয়ে ফেলল। তারপর পিছন ফিরে এগুতে লাগল। পাহাড়গুলো পার হতেই ও সুড়ৎ করে অক্সিজেন ট্যাঙ্কগুলোর পিছনে ঢুকে গেল। হাতে রাইফেল। চোখ সামনের পাথরগুলোর ওপর। যে কোনো মুহূর্তে গুলির জন্য প্রস্তুত।

“আমরা এখনো বেঁচে আছি,” পাথরগুলো পেরিয়ে আসতেই বলল কার্ট।

“আপাতত, “ ক্ষুব্ধ স্বরে নীচ থেকে বলল জো।

কাৰ্ট চোখে একটা দূরবীন লাগিয়ে সামনেটা দেখতে লাগল। “ব্রিজের পাশের পাকা ঘাটলাটায় তিনজনকে দেখা যাচ্ছে। হাতে বন্দুক। রাস্তার মাথায় কয়েকটা গাড়িও দেখছি। কোনো নৌকা নেই।”

“তার মানে ওরা গাড়ি চালিয়ে এসেছে।” রেনাটা বলল, “এতে কী আমাদের কোনো সুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা আছে?”

“হ্যাঁ। যদি ওরা খুব জোরে সাতরাতে না পারে, তাহলে পালানোর সময় আমাদেরকে ধরতে পারবে না।” জো বলল।

“আড়ালে থেকো সবাই। হোটেলের ছাদে সম্ভবত একজন স্নাইপার আছে। একটা প্রতিফলন দেখলাম বলে মনে হলো।” কার্ট বলল।

“একমাত্র আপনিই নৌকার ওপরে।” রেনাটা মনে করিয়ে দিল।

“আমার সামনে প্রোটেকশন আছে। কিছু হবে না। আর ওরা ওদের জিনিস পাওয়ার আগ পর্যন্ত কিছু করবে বলে মনে হয় না।”

কার্ট নৌকাটাকে আস্তে আস্তে থামিয়ে দিল। তারপর সেটা একা একাই ভাসতে ভাসতে পাকা ঘাটলাটায় গিয়ে আটকালো। সেখান থেকে একটা রাস্তা ব্রিজের সিঁড়ি পর্যন্ত চলে গিয়েছে। আরেকটা রাস্তা চলে গিয়েছে একটা ভাঙ্গা-চোরা চালা ঘরের দিকে। ওটাই সম্ভবত ব্রিজ আর ঘাটের মেরামত ঘর।

তিনজনের একজন সামনে এগিয়ে এলো, হাতে একটা দড়ি।

স্কুবা ট্যাঙ্কগুলোর পেছন থেকে চেঁচালো কার্ট। বাধতে হবে না। আমরা বেশিক্ষণ থাকবো না। তোমাদের বস কোথায়?”

চালাঘরটা থেকে একজন গাট্টাগোট্টা ছোটোখাটো গড়নের মানুষ বের হয়ে এলো। চোখে সানগ্লাস, মাথায় মিলিটারি ছাট চুল।

“এই যে আমি।” বলল লোকটা।

“আপনি নিশ্চয়ই হাসান।” কার্ট বলল।

লোকটাকে কেমন বিরক্ত দেখালো।

“আপনার লোকগুলোকে পিটিয়ে এটুকু বের করা গিয়েছে। টুকটাক আরও কিছু জানা গিয়েছে।” কার্ট বলল।

“তাতে আখেরে কোনো লাভ হবে না। তবে আপনি চাইলে আমাকে এই নামে ডাকতে পারেন। লোকটা বলল।

“জায়গাটা অনেক সুন্দর।” বলল কার্ট। এখনো স্কুবা ট্যাঙ্কগুলোর পিছনেই ঘাপটি মেরে আছে। “তবে ভিলেনদের আস্তানা হিসেবে মানাচ্ছে না।”

“আপনার এসব সস্তা রসিকতায় মোটেও হাসি পাচ্ছে না। সাহস থাকলে উঠে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি কথা বলুন।” লোকটা বলল।

“অবশ্যই। তবে তার আগে আপনার স্নাইপারকে বলুন রাইফেলটা সাগরে ফেলে দিতে।”

“কোন স্নাইপার?”

“হোটেলের ছাদে যে আছে।”

ট্যাঙ্কগুলোর ফাঁকের সরু ফাঁক দিয়েও কার্ট লোকটার চেহারা কালো হয়ে যাওয়া দেখতে পেল।

“নাও অর নেভার।” বলতে বলতে কার্ট আবার ইঞ্জিন চালু করল। চলে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে।

লোকটা ঠোঁটের সামনে রেডিও তুলে ফিসফিস করে কিছু একটা বলল। সম্ভবত ওপাশে না-বোধক উত্তর পাওয়ায় আবার জোর দিয়ে কথাটা বলল। এবার কাজ হলো। ছাদের ওপর স্নাইপারটা উঠে দাঁড়ালো তারপর ভারী রাইফেলটা তুলে নিয়ে নিচে ছুঁড়ে মারলো। পাক খেতে খেতে সেটা সাগরের পানিতে আছড়ে পড়ল।

“খুশি?” হাসান বলল।

“ব্যাটার কাছে আরো একটা রাইফেল আছে কি-না কে জানে? বা আরেকজন স্নাইপারও থাকতে পারে।” জো বলল নিচু স্বরে।

“সাহস দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ।” চিবিয়ে চিবিয়ে বলল কার্ট। তারপর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল। “দেখা যাক ভাগ্যে কি আছে।”

কার্ট APS রাইফেলটা হাতে উঠে দাঁড়ালো। তিনটা একই অস্ত্র ওর দিকেও তাক করে ধরা। হাসানের কাছেও একটা পিস্তল আছে। তবে সেটা হাতে নেই। শোল্ডার হোলস্টারে।

“দ্য শ্যাম্পেনরা কোথায়?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

“আগে শিলালিপিগুলো দেখান।” হাসান দাবি করল।

কার্ট মাথা নাড়লো, “উঁহু! সত্যি কথা হলো, ওগুলো যে কোথায় রেখেছি মনে পড়ছে না।”

বিরক্তি ভাবটা আবার ফিরে এলো হাসানের চেহারায়। হাসান শিস দিতেই ব্রিজের ওপরে নাড়াচাড়া দেখা গেল। এক জোড়া মানুষকে ধাক্কিয়ে ব্রিজের কিনারের দিকে নিয়ে আসা হয়েছে। দ্য শ্যাম্পেন দম্পতি। মোটামুটি বৃদ্ধই বলা চলে তাদেরকে। দুইজনই একসাথে বাঁধা। ব্রিজের ঠিক যেখানে রেলিং নেই সেখানে এনে দাঁড় করানো হলো তাদের। আর এক পা এগুলেই সোজা নিচে। দ্য চ্যাম্পিয়নের হাতে একটা গোলমতো জিনিস। একটা দড়ি দিয়ে ওটা তার পায়ের সাথে বাধা।

“ঝামেলা হয়ে গেল। বিড়বিড় করে বলল কার্ট।

“কেন? কি হয়েছে?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

‘বন্দী দুজন একসাথে বাধা আর তারপর একটা নোঙ্গরের সাথে পা বেঁধে রেখেছে।”

“নোঙ্গর?”

“ওরকম-ই তো লাগছে। অবশ্য অতবড় না। বিশ পাউন্ডের মতো ওজন হবে। তবে একজন নিরীহ মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। একজন নিরীহ মানুষ আর তার স্ত্রী।

হাসান অধৈর্য হয়ে উঠল, “দেখতেই পাচ্ছেন, ওরা বেঁচে আছে। তবে আপনি যদি জিনিসগুলো না দেন তাহলে বেশিক্ষণ থাকবে না। আমি আমার মাত্র দুজন লোককে দেখতে পাচ্ছি।”

“বাকিরা এতোক্ষণ হাঙ্গরের পেটে চলে গিয়েছে। কার্ট বলল। কথাটা অর্ধেক সত্য। দুজন আহত বন্দীকে সী ড্রাগনে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ওরা বন্দরে পৌঁছলেই যথাযথ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়া হবে।

“আর শিলালিপি!” হাসান চিৎকার দিল।

“দ্য শ্যাম্পেনদের বাঁধন খুলে দিন। সতোর নিদর্শন হিসেবে।” কার্ট দাবি করল।

“সততা ধুয়ে আমি পানি খাই।”

কার্টেরও অবশ্য এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। “আচ্ছা, ঠিক আছে, দেখাচ্ছি।” বলে কার্ট একটা নাইলনের রশি ধরে টান দিল। দিতেই নৌকার পিছন দিকে থাকা একটা ক্যানভাস কাপড়ের পর্দা সরে গেল। সরতেই দেখা গেল একটা বিশাল ট্যাঙ্ক। সাধারণত ডুবুরিদের যন্ত্রপাতি রাখা হয় ওটায়।

“ওটার ভেতর আছে এগুলো।” কার্ট জানালো।

হাসানকে দেখে মনে হলো কথাটা বিশ্বাস করছে না।

“আমি ওগুলো আপনার কাছে এগিয়ে দেবো না।” কার্ট আবার বলল। হাসানের কণ্ঠে নিখাদ সন্দেহ। “আপনার তরবারিওয়ালা বন্ধুটা কোথায়?” কার্ট প্রায় হেসে-ই দিয়েছিল।

“এই যে আমি, কেবিনের জানালা খুলে জো চিৎকার করে জবাব দিল।” কার্টের মতো জো’র সামনেও একটা ছোট স্কুবা ট্যাঙ্কের দেয়াল। তবে জোর সামনের দুটো ট্যাঙ্ক খনও ভরা আর একটা পাইপ দিয়ে ওপরের ট্যাঙ্কের সাথে লাগানো।

“খুব ভালো।” হাসান বলল, তারপর তার দুজন লোককে হাত নেড়ে ইশারা করল। ওরা রাইফেল হাতেই লাফ দিয়ে নৌকায় নামলো, তারপর ট্যাঙ্কটার দিকে এগুলো।

“যদি এটা কোনো চালাকি হয়” হাসান বলা শুরু করল।

কিন্তু কার্ট কথা কেড়ে নিয়ে বলল, “জানি, জানি। আপনি আমাদের দুজনকেই মেরে ফেলবেন তারপর দ্য শ্যাম্পেনদেরও ডুবিয়ে দেবেন। আগেও শুনেছি এই বক্তৃতা।”

বন্দুকধারী দুজন এমনভাবে ট্যাঙ্কটার দিকে এগোতে লাগল, যেন এটা একটা হিংস্র জন্তু, আর যে কোনো সময় ওটা গর্জন করে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। কার্ট এমনভাবে মুখ টিপে হাসতে লাগল খুব মজা পাচ্ছে ব্যাপারটায় আর অলস ভঙ্গিতে লোকগুলোর দিক থেকে রাইফেলটা ঘুরিয়ে নিলো।

ট্যাঙ্কের কাছে পৌঁছে একজন হাটু গেড়ে বসে পড়ল ওটা খুলতে। বাকিজন পাহারা দিতে পাশেই রইল দাঁড়িয়ে।

এদিকে কেবিনের ভেতর জো অক্সিজেন ট্যাঙ্কের ভালভে হাত দিল, ওটা অবশ্য আগে থেকেই সামান্য ভোলা ছিল আর একটু একটু করে ট্যাঙ্কটাতে চাপ বাড়াচ্ছিলো। তবে একজন লোক ট্যাঙ্কের দিকে ঝুঁকতেই ও ভালভ দুটো পুরো খুলে দিল।

সাথে সাথে ট্যাঙ্কের ঢাকনা দড়াম করে খুলে গিয়ে বসা লোকটার মুখে বাড়ি দিল। জো আগে থেকেই ট্যাঙ্কের ভেতর খানিকটা গ্যাসোলিন আর ট্যাঙ্কের কবজার সাথে সিগারেটের লাইটারের আগুন জ্বালানোর চকমকি পাথরটা টেপ দিয়ে আটকে রেখেছিল। অক্সিজেনের ধাক্কায় ট্যাঙ্কটা খুলতেই গ্যাসেলিনটা বাতাসে বেরিয়ে এলো আর চকমকি পাথরটাতেও ঘষা লেগে তাতে আগুন ধরে গেল। হলিউডের সিনেমাগুলোতে এরকম কৌশল ব্যবহার হয়। আগুনটা বিশাল তবে তেমন ক্ষতি করে না কোনো। এখানেও কাজ হলো, লোকটা ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল আর সবার দৃষ্টিও এদিকে ফিরে গেল। কমলা রঙের আগুনটা কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে পরিণত হয়ে উড়ে চলে গেল।

কার্ট সাথে সাথে তার রাইফেল আগের পজিশনে নিয়ে এসে ঘাটে দাঁড়ানো বাকি দুই গুণ্ডার দিক গুলি করল। দুটো গুলিই অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ করল। ফিরতি কোনো গুলি করার আগেই তোক দুটো ঢলে পড়ল মাটিতে।

কার্ট বন্দুক ডানে ঘুরিয়ে হাসানকে লক্ষ্য করে তৃতীয় গুলিটা ছুড়লো, কিন্তু সে ততোক্ষণে একদিকে ঝাঁপ দিয়ে চালা-ঘরটার দিকে দৌড় লাগিয়েছে।

কার্ট এবার বামে ঘুরলো, ব্রিজের ওপরের গুণ্ডাগুলোকে গুলি করবে। কিন্তু গুলি করার আগেই ওর চারপাশে গুলিবর্ষণ শুরু হলো। ফলে ও মাথা নিচু করে আত্মরক্ষা করতে বাধ্য হলো।

অক্সিজেনের ট্যাঙ্কতগুলোয় শব্দ করে করে বুলেট এসে বিধতে লাগল। ট্যাঙ্কগুলোতে বিশাল বিশাল টোল পড়তে লাগল। নরম ধাতুতে হাতুড়ির উল্টো পাশ দিয়ে বাড়ি দিলে যেরকম হয় সেরকম। কার্ট গড়ান দিয়ে একপাশে সরে গেল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে উপর্যপুরি গুলির আঘাত সইতে না পেরে এর সবচে কাছের ট্যাঙ্কটা ভেঙে চুরমার হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে।

“জো, আমি মাথা তুলতে পারছি না।”

“গুলি হচ্ছে হোটেলের ছাদ থেকে।” জো জবাব দিল। তারপর দালানটার ছাদের দিকে এক পশরা গুলি ছুড়লো।

ছাদ থেকে গুলি থামল কয়েক মুহূর্তের জন্য, সেই সুযোগে কার্ট দেখলো স্নাইপারটা ছাদের নিচু দেয়ালের আড়ালে শুয়ে শুয়ে গুলি করছে। হাতে সাধারণ একটা রাইফেল, কোনো বীক্ষণ যন্ত্র নেই তাতে।”

“শালার নিশানা তো মারাত্মক।” আরেকদিকে হামাগুড়ি দিতে দিতে বলল কার্ট। তারপরও ও সেদিকে গুলি ছুড়লো কয়েকটা।

এদিকে ট্যাঙ্কের বাড়ি খেয়ে যারা উল্টে পড়েছিল তারা উঠে দাঁড়িয়েছে। একজন রাইফেল তুলে জো যেদিকে লুকানো সেদিকে এগুলো। তবে গুলি করার আগেই রেনাটা জানালা খুলে দুবার গুলি করল। দুটোই লোকটার বুকে লাগল। আর লোকটা সোজা পানিতে গিয়ে পড়ল।

বাকিজন দিল দৌড়।

রেনাটা লোকটার পা লক্ষ্য করে গুলি করলো। গুলিটা লাগল হাঁটুর ঠিক পিছনে। সাথে সাথে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। মরেনি। পরে দরকার পড়বে লোকটা।

এদিকে ছাদ থেকে আবার শুরু হয়েছে গুলিবর্ষণ। আর যে গুণ্ডা দুটো। নৌকায় বাঁধা অবস্থায় ছিল তারা বোলিং পিন-এর মতো উল্টে পড়ল। কার্টের অবশ্য এক ফোঁটাও খারাপ লাগল না তাতে, এই শালারাই ডুবুরিগুলোকে তিলে তিলে মারতে গিয়েছিল।

“ধাক্কা দাও ওদের, এখনই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দাও।” হাসানের চিৎকার শোনা গেল।

ব্রিজের ওপর থেকে দ্য শ্যাম্পেনদেরকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়া হলো। তিরিশ ফুট ওপর থেকে সোজা ঝপাশ করে পানিতে পড়েই মিলিয়ে গেল নিচে।

“ওদেরকে পানিতে ফেলে দিয়েছে।” কার্ট চিৎকার করে বলল। এদিকে ওর দিকে গুলির পরিমাণ এখনো কমেনি, “আমি মাথা তুলতে পারছি না। ওদিকে যাওয়া সম্ভব না। জো, তুমি কী যেতে পারবে?”

“আমি দেখছি ব্যাপারটা। জো চিৎকার করে বলল।

জোর দায়িত্ব ছিল গাড়িগুলোর পেছন থেকে বা চালাঘরের ওদিক থেকে যদি কেউ গুলি করে তবে তাদেরকে সামলানো। ও একটা অক্সিজেনের ট্যাঙ্কের ভালভ বন্ধ করে ট্যাঙ্কের সাথে লাগানো পাইপটা কেটে দিল। তারপর ট্যাঙ্কটা হাতে করে নিয়ে কেবিনের শেষ মাথায় জানালা ভেঙে সেদিক দিয়ে পানিতে ফেলে দিল।

“জাভালা বিদায় নিচ্ছে।” চিৎকার করে বলল ও।

তারপর সামান্য দৌড়ে ভাঙ্গা জানালা গলে নিখুঁতভাবে ঝাঁপ দিল পানিতে। তবে ওর দিকে কেউ গুলি করল না।

পানিতে পড়েই জো নিচের দিকে সাঁতরে গেল অক্সিজেনের ট্যাঙ্কটা ধরতে। তারপর ভালভটা খুলে প্রথমে খানিকটা বুদবুদ বের করে দিল, তারপর পাইপটা মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। খুব ভালো উপায় না হলেও কাজ চলে যায়।

তারপর ঘুরে ও নৌকাটার নিচে দিয়ে সাঁতরে গেল অপরপাশে। ব্রিজের গোড়ার দিকে যাচ্ছে। এখানকার পানি একেবারে পুলের পানির মতোই স্বচ্ছ। ফলে সামনেই দেখা গেল দ্য শ্যাম্পেন দম্পত্তি পানির ভেতর ছটফট করছেন। ট্যাঙ্কটা বগলের নিচে চেপে ধরে বাকি হাতে সাঁতরে এগুলো সামনে জো। তবে সব সময় ডুবুরির পোশাক পরে সাতরানোর অভ্যাস থাকায়, গতি খুবই ধীর। পনের ফুট গভীরতায় ও পায়ের নিচে বালির টের পেল। তারপর তাতে পা বাঁধিয়ে নিজেকে ঠেলে দিল সামনে। প্রায় ব্রিজের কাছাকাছি পৌঁছাতেই ওর দিকেই শুরু হলো গুলিবষর্ণ। লম্বা বুদবুদের সারি তুলে ছুটে আসতে লাগল বুলেট।

নৌকার ওপর থেকে কার্টও খেয়াল করেছে ব্যাপারটা। ঝকঝকে কাঁচের মতো স্থির পানিতে জোকে দেখতে মোটেও সমস্যা হচ্ছে না ওপরের লোকগুলোর। এখন তা-ও একটু দূরে আছে, কিন্তু দ্য শ্যাম্পেনদের কাছে পৌঁছলেই একেবারে সরাসরি বন্দুকের নিচে চলে আসবে।

দ্য শ্যাম্পেনরা ডুবে মরুক এটাও চায় না কার্ট আবার বন্ধুও গুলি খেয়ে মোরাব্বা হোক সেটাও ওর কাম্য নয়। তাই এমন পরিস্থিতিতে ওর কাছে একমাত্র যুক্তিযুক্ত মনে হলো যে কাজটা সেটাই করল ও। ও আক্রমণ চালালো।

এক টুকরো c-4 তুলে নিয়ে টাইমার ৫ সেকেন্ডে ঠিক করে ENTER টিপে দিল। তারপর সেটা চালাঘরটার দিকে ছুঁড়ে দিল। ঘরের কাছাকাছিই পড়ল বোমাটা। চালের অর্ধেকটা উড়ে গেল সাথে সাথে আর ধাক্কায় বাকিটুকুও দেয়ালসুদ্ধ তাসের ঘরের মতোই লুটিয়ে পড়ল। হাসান ভেতরে ছিল না। সে তখন গাড়িগুলোর দিকে দৌড়াচ্ছে।

বিস্ফোরণের কারণে গোলাগুলিতে কিছুক্ষণের জন্যে ছেদ পড়ল। সেই সুযোগে কার্ট দ্রুত নৌকাটার ইঞ্জিন চালু করে মুখটা ব্রিজের দিকে ঘুরিয়ে দিল।

.

বিশ ফুট নিচে জো উল্টো হয়ে সাঁতার কাটছে অক্সিজেনের ট্যাঙ্কটা এখনও বুলেটগুলোর বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে।

ও মুখ থেকে পাইপটা খুলে পানিতে ধরলো, যাতে বুদবুদ বের হয়ে ওর আসল অবস্থান কিছুটা ঢেকে যায়। কিন্তু তাতেও বুলেট বৃষ্টি থামলো না। একটা বুলেট ওর বাহুতে ঘষা দিয়ে চলে গেল। সাথে সাথে রক্তাক্ত হয়ে গেল জায়গাটা। আরেকটা লাগল ট্যাঙ্কের গোড়ায় তবে ভাগ্য ভালো যে ট্যাঙ্কটা ফুটো হলো না।

সাতরে দ্য শ্যাম্পেনদের কাছে পৌঁছে গেল জো, তারপর পাইপটা দিয়ে তাদেরকেও অক্সিজেন নেয়ার সুযোগ করে দিল।

এদিকে ব্রিজের ওপরের বন্দুকধারী কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। হাসান আর বাকিরা চলে যাচ্ছে। “যাওয়ার আগে ওদেরকে শেষ করে আসবে।” হাসান আদেশ করে গিয়েছে ওকে।

সে পিছু হটে খালি ম্যাগাজিনটা খুলে নতুন একটা লাগালো। তারপর ফুল অটো টিপে ব্রিজের পাটাতনের একটা ছিদ্র দিয়ে রাইফেলটা তাক করল। বুদবুদের কারণে ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না, তবে যখনই ওর শিকার শ্বাস নেয়ার জন্যে পানির পাইপটা মুখে নিচ্ছে তখনই মোটামুটি দেখা যাচ্ছে ওদের। ও শান্তভাবে তাক করে বুদবুদ আবার পরিষ্কার হওয়ার অপেক্ষায় রইল।

হঠাই একটা লাল আর ধূসর অবয়ব ঝলসে উঠে ব্রিজের খুটির গায়ে আছড়ে পড়ল। ক্যাচকোচ শব্দ করে পুরনো ব্রিজটা কেঁপে উঠল মারাত্মকভাবে।

প্রথমে লোকটা ভেবেছিল ব্রিজটা বুঝি হেলে পড়বে। কিন্তু এটা স্থির হয়ে গেল আর ধুলোবালিও পরিষ্কার হলো দ্রুতই। সে আবার তার গুলি করার ছিদ্রটার দিকে মনোযোগ দিল।

সোনালি চুলের আমেরিকানটার হাসিমুখ দেখা গেল সেদিক দিয়ে। হাতে APS রাইফেল।

“উঁহু!” আমেরিকান বলল।

লোকটা তাও চেষ্টা করল। যতদূর সম্ভব নিজের রাইফেলের ব্যারেলটা নিচে নামাতে। কিন্তু যথেষ্ট দ্রুত হলো না সেটা। একটা অদ্ভুত শব্দ শোনা গেল নিচে। লোকটা শব্দটা চিনতে পারলো। APS রাইফেলের বোল্টের শব্দ। যদিও এটা পানিতে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু এখন বাতাসেই গুলি করা হয়েছে। তবে চিন্তাটা মুহর্তের বেশি স্থায়ী হলো পাঁচ ইঞ্চি ধাতব খণ্ডটা সেটা সেখানেই থামিয়ে দিল চিরতরে।

.

৩৬.

দক্ষিণ লিবিয়া

পলের ছুটি শেষ হয়েছে দুই দিন হয়। কিন্তু এখনই ওর দম ফেলবার ফুরসত নেই। এই ভূতাত্ত্বিক গবেষণার ফলাফল দেখছে, আবার কম্পিউটারে NUMA থেকে ডাউনলোড করা একটা সফটওয়ারে শব্দ তরঙ্গ বিশ্লেষণ করছে। আর তার সাথে কফি বানানো আর খাওয়া তো চলছেই। রেজা’র আসল যে ভূতাত্ত্বিক ছিল সে কয়েকদিন ধরে লাপাত্তা। হয় সে কিডন্যাপ হয়েছে নয়তো নিজেই পালিয়ে গিয়ে বিদ্রোহীদের দলে যোগ দিয়েছে। সেই থেকে সব হ্যাপা পল একাই সামলাচ্ছে।

“এটা দেখুন। শেষমেশ শব্দ তরঙ্গগুলোর একটা অর্থ কম্পিউটার বের করতে পেরেছে। সেটার একটা প্রিন্ট আউট বের করে ও ডাকলো সবাইকে। গামায় ফিরে তাকাল, চোখ ঝাপসা দেখাচ্ছে। “কি এটা, আরো বেশ আঁকাবাঁকা লাইন? দারুণ!”

“তোমার আগ্রহে দেখি ভাটা পড়েছে,” পল জবাব দিল।

“আমরা এসব হাবিজাবি কয়েক ঘণ্টা ধরে দেখছি।” গামায় বলল। “একের পর এক খালি আঁকাবাঁকা দাগ। তথ্য উপাত্ত যা পাচ্ছি সেগুলো ঘাটাঘাটি করে বা কম্পিউটারে চালিয়ে দেখে পৃথিবীর অন্য কোথাওকার এসব আঁকাবাঁকা দাগের সাথে মিলাচ্ছি। এখন মনে হচ্ছে তুমি আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছ। মানসিক সুস্থতার কথা বাদই দিলাম।”

“হুম! তবে পরীক্ষায় যে পাস করছে না বোঝাই যাচ্ছে, খোঁচা মেরে বলল পল।

“তাহলে আমি তোমাকে খুন করলেও দোষ হবে না। বলবো মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলাম। যাই হোক, কি দেখাতে ডাকলে?”

“এটা হলো বেলে পাথর, প্রিন্ট আউটটার এক জায়গা দেখিয়ে বলল পল। “কিন্তু এটা হলো তরল পদার্থের একটা স্তর। বেলেপাথরের ঠিক নিচেই। নিচে এখনো পানি আছে।”

“তাহলে পাম্পে পানি উঠছে না কেন?”

“কারণ পানিটা স্থির না। এটা সরে যাচ্ছে। আরো নিচে নেমে যাচ্ছে। পানির স্তর।”

“মানে?”

“যদি আমার ধারণা ঠিক হয়, তাহলে নুবিয়ান জলাধারের নিচে আরো একটা জলাধার আছে।”

“আরেকটা জলাধার?”

পল মাথা ঝাঁকালো। “মাটির সাত হাজার ফুট নিচে। এই দাগগুলোতে বোঝা যাচ্ছে যে জলাধারটা পানি দিয়ে ভরা, তবে এখানে আর এখানে বিচ্যুতি থেকে বোঝা যায় যে পানিটা স্থির না, নড়ছে।”

“মাটির নিচের নদীর মতো?”

“হতে পারে। কম্পিউটারের তথ্য অনুযায়ী ওটা পানি এটা শুধু নিশ্চিত।” পল বলল।

“তা আপনি যাচ্ছে কোথায়?” গামায় বলল। ক্লান্তি নেই চোখে মুখে আর। “জানি না।”

“তা এটা নড়ছে কেন?”

পল কাঁধ ঝাঁকালো, “এসব আঁকাবাঁকা লাইন থেকে শুধু নড়ছে যে সেটাই জানা যায়, আর কিছু না।”

হঠাৎ প্রচণ্ড একটা শব্দে ওদের কানে তালা লেগে গেল। আকস্মিকতায় দুজনই দাঁড়িয়ে পড়ল।

“মরুভূমিতে কখনো বজ্রপাত হয় না,” ঠাণ্ডা স্বরে বলল গামায়।

“মনে হয় প্লেনের শব্দ। বিমান ঘাটির কাছে যখন থাকতাম তখন প্রায়ই এরকম শুনতাম।” পল বলল।

আরো দুবার হলো শব্দটা। তারপরই শোনা গেল মানুষের চিৎকার আর বন্দুকের আওয়াজ।

পল হাতের কাগজটা নামিয়ে জানালার কাছে ছুটে গেল। মরুভূমির ভেতর আরেকটা ঝলক দেখা গেল আর আরেকটা পাম্পিং টাওয়ার কমলা আগুনে ঢাকা পড়ল। তারপর একপাশে হেলে পড়ে গেল।

“হচ্ছে কি?” গামায় জিজ্ঞেস করল।

“বিস্ফোরণ।” পল জবাব দিল।

এক সেকেন্ড পরই হন্তদন্ত হয়ে রেজা প্রবেশ করলেন ঘরে। “পালাতে হবে এক্ষুণি! বিদ্রোহীরা হামলা করেছে।”

কিন্তু পল আর গামায়ের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।

“তাড়াতাড়ি। বিমানে উঠতে হবে আমাদের।” পাশের রুমে দৌড়ে যেতে যেতে বলল রেজা।

পল আর গামায় প্রিন্ট আউটগুলো তুলে নিয়ে রেজার পিছু পিছু ছুটলো। সবাই একসাথে হতেই সিঁড়ির দিকে এগুলো সবাই। রাস্তার ওপাশেই DC-3 কে স্টার্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ওটার বুড়ো ইঞ্জিন কাশছে আর ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে চালু হলো অবশেষে।

“বিমানে সবারই জায়গা হবে, তবে আমাদেরকে যেতে হবে খুব দ্রুত।” রেজা বললেন।

সবাই দৌড়ে রাস্তাটা পার হয়ে DC-3’র মাল ওঠানোর দরজাটা দিয়ে ঢুকে পড়ল। সাথে সাথে বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনা গেল কাছে। রকেটের আঘাতে কন্ট্রোল সেন্টারটা উড়ে গিয়েছে।

“চালানো শুরু করুন।” সবার ওঠা শেষ হওয়া মাত্র পল চিৎকার করে বলল। রেজা মাথা গুনলেন। মোট একুশজন সাথে পাইলট। এর মধ্যে পল আর গামায় বাদে সবাই এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারী।

“চালাও!” আদেশ দিলেন তিনি।

পাইলট থ্রটল সামনে ঠেলে দিতেই প্লেন রানওয়ে ধরে ছুটলো। এদিকে ওদের পিছনে বোমা ফুটেই চলেছে।

পল রেজার দিকে তাকাল, “আপনি না বললেন বিদ্রোহীদেরও পানি খেতে হয়?”

“সম্ভবত আমার ধারণা ভুল।”

ইঞ্জিন ততোক্ষণে পূর্ণ শক্তিতে গর্জাতে আরম্ভ করেছে। রাতের ঠাণ্ডা বাতাসে সহজেই হর্স পাওয়ার বেড়ে যাচ্ছে। গতি বেশি থাকলেও বিমানটা এখন পুরো ভরা। আর বিমানের ওজন বেশি হলে টেক অফের জন্যেও বেশি সময় লাগা। তাই রানওয়ের শেষ মাথায় পৌঁছে পাইলটের আর কিছু করার ছিল না।

বিমানটা আকাশে উঠানোর জন্যে যতদূর সম্ভব সে থ্রটলটা টেনে উঠাল, তারপর বিমানের নাকটা নিচু করে, বিমানের চাকা ঢুকিয়ে ফেলল। পরবর্তী তিরিশ সেকেন্ড ওরা বিশ ফুট মতো ওপরে ভেসে রইল। পাইলটরা একে বলে “গ্রাউন্ড ইফেক্ট” মাটির কাছাকাছি থাকলেই মনে হয় ওড়ার সময় খানিকটা ধাক্কা দেয় মাটি। ফলে পুরো স্পিড় তোলার জন্যে বিমান কিছুটা সময় পায় আর উচ্চতা বাড়াতেও খুব কাজে লাগে জিনিসটা। কিন্তু আজকের গ্রাউন্ড ইফেক্ট ওদের বিমানকে সরাসরি মেশিনগান বসানো একগাদা পিক-আপ ট্রাকের ওপর নিয়ে এলো।

“সাবধান,” পাইলট চিৎকার করে বিমানটা ডানে ঘুরিয়ে দিল, সেই সাথে ওপরে তোলার চেষ্টা তো আছেই।

ওরা কোনো গুলির আওয়াজ পায়নি, অবশ্য প্লেনের ইঞ্জিনের যে গর্জন তাতে পাওয়ার কথাও না। কিন্তু হঠাৎ করেই কেবিনের ভেতরটা ধাতব তারা। বাতি আর জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গে ভরে গেল।

“পল।” গামায় ডাক দিল।

“আমি ঠিক আছি, তুমি?” পল জবাব দিল।

গামায় নিজেকে দেখে-টেখে বলল, “লাগেনি কোথাও।” pc.3’র গতি বাড়ছে ধীরে ধীরে। এতে ওপরে আর গুলি পৌঁছবে না। কেবিনের সবাই ভয়ে কাঁপছে, তবে একজন বাদে কারো কিছু হয়নি।

“রেজা!” কেউ চিৎকার করে উঠল।

রেজা দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন।

পল আর গামায়-ই তার কাছে প্রথম পৌঁছলো। পা আর পেট থেকে রক্ত পড়ছে।

“রক্তপাত থামাতে হবে।” পল বলল।

সবাই চিৎকার করে উঠল।

গামায় বলল, “আমাদেরকে ওনাকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। কাছে। পিঠে কোনো শহর আছে?”

সবাই মাথা নাড়লো।

বেনগাজী, বেনগাজী যেতে হবে।” বহু কষ্টে রেজা-ই বললেন।

পল মাথা ঝাঁকালো। নব্বই মিনিট লাগবে। হঠাৎ এটাকে এক অপরিমেয় সময় বলে মনে হলো পলের কাছে।

“ধৈর্য ধরুন।” গামায় রেজার হাত ধরে অনুরোধ করল, “প্লিজ আর একটু সহ্য করুন।”

.

৩৭.

গোজো দ্বীপ, মালটা

অগভীর উপসাগরটার তলায় বসে জো ওর ট্যাঙ্ক থেকে দ্য চ্যাম্পিনদের অক্সিজেন আর নানানভাবে তাদেরকে ঠাণ্ডা রাখছিল। শেষমেশ রেনাটা আর কার্ট বহু কষ্টে ওদের পানির ওপর তুলে আনলো।

ওদেরকে ডুবুরি নৌকায় তুলে আনাটাই ছিল বেশি কষ্ট, কারণ ওদের হাত পা সবই ছিল বাঁধা। তবে শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় সবাই-ই উদ্ধার হলো। কিন্তু তখনই দেখা গেল আরেকটা সমস্যা।

“নৌকা ডুবে যাচ্ছে।” জো বলল।

নৌকাটায় যথেষ্ট গুলি লেগেছে আজ। সবচে বেশি আঘাত লেগেছে কার্ট যখন এটা দিয়ে ব্রিজটায় ধাক্কা দেয় তখন।

“সামনের দিকটা পুরো পানিতে ভরে গিয়েছে।” রেনাটা জানালো।

“ভাগ্য ভালো যে আমরা তীরের খুব কাছেই।” কার্ট বলল।

তারপর তীরের উদ্দেশ্যে নৌকার মুখ ঘুরিয়ে দিল। সামান্য পরেই ফুটো নৌকাটা তীরের বালির ওপর উঠে এলো। সবাই তীরের অগভীর পানিতে নেমে বালিয়াড়িতে উঠে এলো।

“রাস্তাটা ধরে যাই চলল, গাড়ি-ঘোড়া একটা পেয়েও যেতে পারি।” কার্ট প্রস্তাব দিল।

ওরা বালি পেরিয়ে উঠে এলো। আশেপাশেই পরাজিত গুণ্ডার দল পড়ে আছে।

“সবাই মারা গিয়েছে। যেটার পায়ে গুলি করলাম সেটাও।” রেনাটা বলল।

“কেউ পিছনে পড়ে থাকবে না।” লোকগুলো এই মতবাদে বিশ্বাসী। জো বলল, “তবে কথাটার অর্থ এদের কাছে ভিন্ন।”

কার্ট পায়ে গুলি করা লোকটাকে ভালো করে দেখলো। মুখ ভরা ফেনা।

“সায়ানাইড। এরা তো দেখি একেকটা উন্মাদ। সম্ভবত আদেশ দেয়া-ই আছে যে ধরা পড়া চলবে না।”

“এরকম নির্দেশ দেয়া তো সহজ কিন্তু পালন করা তো চাট্টিখানি কথা নয়।” দ্য শ্যাম্পেন বললেন।

“সাধারণ মানুষের কাছে হয়তো কঠিন। কিন্তু এরা যে কোন ধরনের সংগঠন কে জানে?” কার্ট বলল।

“আতঙ্কবাদী?” মি, দ্য শ্যাম্পেন বললেন।

“আতঙ্ক এরা ভালোই ছড়াতে সক্ষম, তবে আমার মনে হয় শুধু আতঙ্ক ছড়ানোই এদের উদ্দেশ্য না।” রেনাটা বলল।

কার্ট লাশটা পরীক্ষা করল, পরিচয় পাওয়া যায় এমন কিছুই নেই। কোনো তাবিজ কবজ, গয়না বা ট্যাটু বা কাটা দাগ কিছুই নেই। লোকটা কে বা কার হয়ে কাজ করতো জানার কোনো উপায়ই নেই।

“মাল্টা সরকারকে একটা খবর দিন। ওরা গোয়েন্দা সংস্থা বা সেনাবাহিনী থেকে এ ব্যাপারে সাহায্য নিতে পারে। লোকে বলে “মৃত মানুষ মুখ খোলে না।” কথাটা সম্পূর্ণ ভুয়া। এদের অস্ত্র, কাপড়, আঙুলের ছাপ এসব থেকেও অনেক কথা জানা যায়। এসব লোক মাটি খুঁড়ে উদয় হয়নি। ভালো মতো খুঁজলে কোনো না কোনো পরিচয় বেরুবেই। আর যেভাবে ওরা লড়ছিল তাতে স্পষ্ট যে এরা অতীতে ধোয়া তুলসী ছিল না। কোথাও না কোথাও রেকর্ডে নাম থাকবেই।”

রেনাটা মাথা ঝাঁকালো, “সোফি সি. থেকে যে দুটোকে ধরা হয়েছে ওদের কাছ থেকেও কিছু জানা যাবে।”

“ওরাও এতক্ষণে বিষ খেয়েছে কি-না কে জানে।” কার্ট বলল।

দলটা ধীরে ধীরে রাস্তাটায় উঠে এলো, পিছনে পড়ে থাকল পরিত্যক্ত হোটেল, আর ব্রিজ।

.

কয়েক ঘণ্টা পর ওদেরকে দেখা গেল দ্য শ্যাম্পেনদের বাড়ির বসার ঘরে। সবাই গোসল-টোসল সেরে পরিষ্কার জামা পরেছে। সন্ধ্যা তখন ছুঁই ছুঁই। ঘর জুড়ে দামি আর কারু কার্যে ভরা আসবাব, দেয়ালটা চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য আর একটা লাইব্রেরি সমান বই দিয়ে ঠাসা। বামদিকে একটা ব্যালকনি। এক পাশের দেয়ালের ঠিক মাঝখানে একটা ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে।

তবে এই মুহূর্তে ঘর আর লাইব্রেরি দুটোরই তছনছ অবস্থা। দ্য শ্যাম্পেনদের ভয় দেখাতে এই কাজ করেছে আক্রমণকারীরা।

নিকোল দ্য শ্যাম্পেন এসেই এগুলো পরিষ্কার করা শুরু করলেন কিন্তু তার স্বামী বাধা দিলেন। “এখন না, ডিয়ার। আগে পুলিশ আর ইস্যুরেন্সের লোকজন আসুক, তারপর।”

“তা ঠিক, তবে অগোছালো দেখলে আমার ভালো লাগে না।” তারপর সোফায় বসে কার্ট, জো আর রেনাটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমাদেরকে উদ্ধার করার জন্যে অন্তরের অন্তস্থল থেকে কৃতজ্ঞ আমি।”

“আমিও।” তার স্বামী বললেন।

“আসলে এটা আমাদেরই দায় ছিল। আমরা এখানে আসাতেই আপনারা বিপদে পড়েছেন। কার্ট জবাব দিল।

“না, আপনারা আসার দুদিন আগেই এই লোকগুলো এসেছিল।” ইটিয়েন বললেন। তারপর একটা রূপার ট্রে থেকে একটা স্ফটিকের পাত্র তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কগন্যাক (ফরাসি মদ) চলবে?”

কার্ট না করল।

তবে জো আগ্রহ নিয়ে বলল, “হাত-পা গরম করা দরকার।”

একটা টিউলিপ আকৃতির গ্লাসে সোনালি তরলটা ঢাললেন এটিয়েন তারপর জোকে এগিয়ে দিলেন। জো তাকে ধন্যবাদ দিয়ে গ্লাসে চুমুক দিল তারপর চোখ বন্ধ করে আমেজটা উপভোগ করতে লাগলো। স্বাদ আর গন্ধ দুটোই অতুলনীয়। মুখেও সেটাই বলল ও, “অসাধারণ।”

“সেরকমই হওয়ার কথা,” পাত্রটার দিকে তাকিয়ে কার্ট বলল, “যদি ভুল না হয়, তাহলে এটা একটা ডেলামে লি ভয়াজ। এক বোতলের দাম আট হাজার ডলার।”

জো হঠাৎ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। কিন্তু ইটিয়েন সেটাকে পাত্তা দিলেন না। “যে আমার জীবন বাঁচিয়েছে তার জন্য এইটুকু আর এমন কি।”

“একদম ঠিক,” নিকোল সমর্থন দিলেন।

আসলেই একদম ঠিক। কার্ট তার বন্ধুর জন্যে গর্বিত। সামান্য পরিচয়েই জো ওর হৃদয় খুলে দিতে পারে।

ইটিয়েন নিজের গ্লাস ঢেলে নিয়ে পাত্রটা আবার ট্রেতে রেখে দিলেন। তারপর আগুনের সামনে বসে তারিয়ে তারিয়ে সেটা উপভোগ করতে লাগলেন।

“এত সুন্দর মুহূর্তটা নষ্ট করার জন্যে দুঃখিত।” কার্ট বলল। কিন্তু ঐ লোকগুলো আপনাদের কাছে চাচ্ছিলো কী? ঐ মিসরীয় পুরাকীর্তিগুলোয় কী এমন আছে যে এতোগুলো মানুষ মারতেও ওদের আটকালো না?”

দ্য শ্যাম্পেন দম্পত্তি দৃষ্টি বিনিময় করলেন, “ওরা আমার পড়ার ঘর তছনছ করে ফেলেছে, লাইব্রেরি ভেঙে চুরে খান খান করে দিয়েছে।”

কার্ট বুঝলো দ্য শ্যাম্পেনরা আসলে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছেন না। “মাফ করবেন, কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব তাতে পাইনি। জবাবটা আমাদের দরকার। আমরা আপনাদের জীবন বাঁচিয়েছি এজন্য না, দয়া করে মানবতার স্বার্থে আমাদেরকে ব্যাপারটা জানান। হাজার হাজার মানুষের জীবন মরণ নির্ভর করছে এর ওপর। হয়তো আপনারাই বাঁচাতে পারবেন তাদের। প্লিজ সত্যিটা বলুন।”

ইটিয়েনকে দেখে মনে হলো কথাটায় তিনি আহত হয়েছেন। পাথরের মতো মুখ করে বসে রইলেন। নিকোল জামার কোণা ধরে পাচাতে আর খুলতে লাগলেন।

কার্ট উঠে ফায়ারপ্লেসের পাশে একটা জায়গায় গিয়ে বসলো। বুড়োবুড়ি ভাবুক কি বলবে। আগুনের ঠিক পাশেই একটা বড় চিত্রকর্ম। ছবিতে দেখা যাচ্ছে ব্রিটিশ নৌবহর বন্দরে নোঙ্গর করা একটা ফরাসি যুদ্ধ জাহাজের ওপর আক্রমণ করছে।

কার্ট নীরবে ছবিটা দেখতে লাগল। বর্তমান পরিস্থিতি আর ইতিহাস মিলিয়ে হঠাৎ-ই বুঝে ফেলল কিসের ছবি এটা : নীলনদের যুদ্ধ।

“The boy stood on the burning deck,
whence all but he had fled;
The flame that lit the battle’s wreck
Shone round him o’er the dead.”

কার্ট ফিসফিস করেই চরণগুলো আবৃত্তি করল, কিন্তু রেনাটা শুনে ফেলল।

“কি এটা?”

“কাসাবিয়াঙ্কা” কার্ট বলল। “ইংরেজ কবি ফেলিসিয়া হেমানস-এর বিখ্যাত কবিতা। কবিতাটা ১২ বছরের এক ছেলেকে নিয়ে। সে ছিল লরিয়েন্টের কমাণ্ডারের ছেলে। যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সে নিজের জায়গা ছেড়ে একচুলও নড়েনি। শেষমেশ গানপাউডারে আগুন লেগে জাহাজটা বিধ্বস্ত হয়।”

কার্ট ইটিয়েনের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, “এটা আবু বকর বন্দর তাই না?”

“হ্যাঁ, আপনি আপনার ইতিহাস জানেন। কবিতাও।” ইটিয়েন জবাব দিলেন। “একজন ফরাসি অভিজাতের বাসায় ছবিটা ঠিক মানানসই না। আমাদের মাঝে বেশির ভাগই আমাদের পরাজয়গুলোকে স্মরণ করতে চাই না।” কার্ট বলল।

“আমার করার কারণ আছে।”

ছবিটার নিচের কোণায় আঁকিয়ের নাম স্বাক্ষর করা : এমিল দ্য শ্যাম্পেন।

“আপনার পূর্ব-পরুষ?”

“হ্যাঁ, উনি নেপোলিয়নের বিজ্ঞসভার সদস্য ছিলেন। উনিই মিসরীয় রহস্য সমাধানের আশায় নেপোলিয়নের সাথে এসেছিলেন।”

“যদি উনি এটা এঁকে থাকেন, তাহলে উনি যুদ্ধের পরও বেঁচে ছিলেন। উনি নিশ্চয়ই বেশ কিছু ভনিয়ার এনেছিলেন সাথে।” কার্ট বলল। দ্য শ্যাম্পেন দম্পতি আবার দৃষ্টি বিনিময় করলেন। শেষমেশ নিকোল মুখ খুললেন, “ওদের বলে দাও ইটিয়েন। আমাদের আর কিছু লুকানোর নেই।”

ইটিয়েন মাথা ঝাঁকালেন, তারপর হাতের গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে সেটা নামিয়ে রাখলেন। “এমিল যুদ্ধটা থেকে বেঁচে ফিরতে পেরেছিলেন আর সেটা স্মরণ করেই ছবিটা আঁকেন। কোণায় উনার স্বাক্ষরের ঠিক উল্টো পাশেই একটা ছোট সাম্পান দেখা যাচ্ছে। ওটাতেই ছিলেন উনি। যুদ্ধ শুরুর পর তারা লরিয়েন্টে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।”

“আমার ধারণা তারা শেষ পর্যন্ত লরিয়েন্টে পৌঁছতে পারেন নি।” কার্ট বলল।

“না। তারা আরেকটা জাহাজে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। এটার নাম আপনাদের ভাষায় উইলিয়াম টেল বা ফরাসি ভাষায় গুইলামো টেল।”

কার্ট তার জীবনের অর্ধেকটাই নৌ-যুদ্ধ সম্পর্কে পড়াশোনা করে কাটিয়েছে। নামটা ওর পরিচিত, “গুইলামো টেল হচ্ছে অ্যাডমিরাল ভিয়েনেভ-এর জাহাজ।”

“রিয়ার অ্যাডমিরাল পিয়েরে-চার্লস ভিয়েনেভ ছিলেন নৌ-বহরের সেকেন্ড ইন কমান্ড। সেদিন তার দায়িত্বে ছিল চারটা জাহাজ। কিন্তু যুদ্ধে তার সঙ্গীদের অবস্থা সঙ্গিন হয়ে পড়লেও তিনি যুদ্ধে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান।”

এটিয়েন সামনে এগিয়ে এসে অন্য জাহাজগুলো থেকে দূরবর্তী একটা জাহাজ দেখিয়ে বলেন, “এটা হলো ভিয়েনেভের জাহাজ। সব দেখেও চুপচাপ বসেই আছে। সকাল হতেই যুদ্ধের গতি তাদের প্রতিকূলে থাকলেও স্রোতের গতি তাদের অনুকূলেই ছিল। ভিয়েনেভ তাই নোঙ্গর তুলে জাহাজ সেদিকে ভাসিয়ে দেন। তার চারটা জাহাজ আর আমার পর-দাদার পর-দাদাকে নিয়ে পালিয়ে আসেন।”

এতটুকু বলে তিনি চিত্রকর্ম থেকে মুখ ঘুরিয়ে কার্টের দিকে তাকালেন, “সত্যি কথা হলো সব সময়ই আমার ভেতর ভিয়েনেভের কাজটার ব্যাপারে একটা দ্বন্দ্ব কাজ করে। একদিকে তার কাজটার কারণেই ফরাসিদের সাহস আর esprit de corps যেমন হাসির পাত্র হয়েছে। আবার উনি সেদিন পালিয়ে আসলে হয়তো আমি আজ পৃথিবীতে থাকতাম না।”

“অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি না নেয়াটাই সাহসের পরিচয়।” রেনাটা বলল কথাটা। “তবে আমি নিশ্চিত যে বহরের বাকিরা ব্যাপারটা এভাবে ভেবে দেখেননি।”

“না, তারা ব্যাপারটা সহজভাবে নেয়নি।” ইটিয়েন বললেন।

কার্ট মনে মনে খণ্ডগুলো জোড়া দিচ্ছে। মনের ভাবনাকেই জোরে জোরে বলল, “যুদ্ধের পর ভিয়েনেভ মাল্টা ফিরে আসেন। আর তারপর ব্রিটিশরা যখন দ্বীপটা দখল করে তখন তাদের হাতে বন্দী হন।”

“ঠিক।” ইটিয়েন বললেন।

“আমি সাধারণত এসব নৌ-বিজয় গাথা শুনতে খুবই পছন্দ করি।” জো বলল, “কিন্তু আপনার পূর্বপুরুষের কথাটা আর একটু বলা যায়? মিসরে উনি কী খুঁজতে গিয়েছিলেন?”

“অবশ্যই।” ইটিয়েন জবাব দিলেন, “তার ডায়রি থেকে যতটুকু জেনেছি তা হলো উনি মিসরের বেশ কিছু মন্দির আর স্থাপনায় অভিযান চালান। বিশেষ করে ফারওদের যেখানে সমাহিত করা হয় সেসব জায়গায়। আর উদ্ধার অভিযান মানে হলো। নেপোলিয়নের লোকজন বহনযোগ্য যা কিছু পেতো সব কিছু তুলে নিয়ে আসতো : চিত্রকর্ম, লিপি, ওবেলিস্ক খোদাই কর্ম, সব। দরকার হলে দেয়াল থেকে খুলে খুলে আনতে। তারপর সেগুলো পাঠিয়ে দিতে লরিয়েন্টে। দুর্ভাগ্যক্রমে উদ্ধার করা জিনিসের প্রায় সবই লরিয়েন্টেই ছিল। সেগুলো সহ-ই ওটা বিস্ফোরিত হয়।”

“প্রায় সব, তবে সব না।” কার্ট বলল।

“অবশ্যই ঠিক ধরেছেন,” ইটিয়েন বললেন। “শেষ চালানটা আমার দাদার সাথেই ছিল। সাম্পানের মাঝির সাথে তার এনিয়ে ঝগড়াও হয়। দাদা চাচ্ছিলেন আদেশ মতো লরিয়েন্টের কমান্ডার অ্যাডমিরাল ব্রুয়েসের কাছে সব পৌঁছে দিতে। তবে ততোক্ষণে তিনটা ব্রিটিশ জাহাজ ওটাকে ঘিরে ফেলে, তাই সেটা আর সম্ভব হয়নি।”

ইটিয়েন রেনাটার দিকে তাকালেন, “আবারো অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকি না নেয়াটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়, তাই তারা সবচেয়ে কাছের নিরাপদ জাহাজগুলোর দিকে ছুটে যান আর মিসরীয় পুরাকীর্তি ভরা শেষ ট্যাঙ্কটা ভিয়েনেভের হাতে পড়ে যায়। আর তিনি মাল্টায় পালিয়ে আসায় এগুলো তখনকার মতো ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যায়।”

“আর তারপর সেগুলো কয়েক মাস পর সোফি সি.-তে তুলে দেয়া হয়।” কার্ট বলল।

“সেরকমই ধারণা করা হয়। তবে আসল ঘটনা কেউ জানেনা। আর এসব জিনিসপত্রই আমাদের মারমুখী বন্ধুরা যে কোন মূল্যে দেখতে চাচ্ছিলো। মিসর থেকে এমিল যা যা এনেছে সব। বিশেষ করে অ্যাবাইতোস বা সিটি অফ ডেড থেকে আনা জিনিসগুলো।”

“সিটি অফ ডেড।” আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কার্ট বলল, তারপর জোর দিকে ফিরলো। ল্যাম্পেড়সাকেও জো ঠিক এই নামেই ডেকেছিল। অবশ্যই ওটা ছিল মৃতদের দ্বীপ বা প্রায় মরাদের দ্বীপ। “আচ্ছা এই পুরাকীর্তি গুলোর সাথে কী প্রাণঘাতি কোনো রহস্যময় কুয়াশার কোনো সম্পর্ক আছে?”

ইটিয়েন কেমন হতভম্ব হয়ে গেলেন সেটা শুনে। “সত্যি কথা হলো, জিনিসগুলো ব্লাক মিস্ট নামের একটা জিনিসের সাথে সম্পৃক্ত।”

কার্টও তেমনটাই ভেবেছিল।

“কিন্তু এখানেই শেষ না।” ইটিয়েন বললেন, “এমিলের অনুবাদে আরও একটা জিনিস পাওয়া যায়। ওটাকে বলে অ্যাঞ্জেলস ব্ৰেথ, নামটা অবশ্যই পশ্চিমারীতিতে করা। মিসরীয় ভাষায় এটাকে বলে মিস্ট অফ লাইফ : কুয়াশাটার উৎস এই জগৎ না, অন্য কোনো জগৎ-পরজগৎ। সেখানে দেবতা ওসাইরিস এটা যাকে ইচ্ছা আবার বাঁচিয়ে তুলতেন। আক্ষরিক অর্থে দাঁড়ায়। এই অ্যাঞ্জেল ব্রেথ মৃতদেহে আবার জীবন সঞ্চার করতে পারে।”

.

৩৮.

“মৃতদেহে জীবন সঞ্চার করতে পারে?” কার্ট আবার বলল কথাগুলো। ও সাথে সাথে বুঝে গিয়েছে পুরো ব্যাপারটা। এটাই হলো ব্লাক মিস্টের প্রতিষেধক। এটার কারণেই হ্যাগেন আর ঐ আক্রমণকারী লোকটার কোনো ক্ষতিই হয়নি। আর সবাই কোমায় চলে গেলেও।

“এটাই সেই প্রতিষেধক।” এবার মুখে বলল ও।

“প্রতিষেধক কিসের প্রতিষেধক? মরার কোনো প্রতিষেধক নেই।” ইটিয়েন বললেন।

“এক ধরনের মরার আছে।” কার্ট বলল।

“বুঝলাম না।” ইটিয়েন বললেন।

কার্ট ওনাকে ল্যাম্পেডুসার সব ঘটনা খুলে বলল। কীভাবে ওখানকার সব অধিবাসী সবাই কোমায় চলে গেছে ও মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আর কীভাবে ওরা একজনের মোকাবেলা করে যায় এতে কিছুই হয়নি।

“তার মানে ওরা এই প্রতিষেধকটা চায়?” নিকোল জিজ্ঞেস করলেন।

“না।” কার্ট বলল, “ওদের কাছে এটা আছে। ওরা চায় যাতে এটা আর কারো হাতে না ক। কারণ এতে ওদের অস্ত্র অকার্যকর হয়ে পড়বে। আর তাই এই কাজটাই আমাদেরকে করতে হবে।”

কার্ট চারদিকের ক্ষয়ক্ষতির দিকে আরেকবার তাকাল, “আপনারা যদি আমার চেয়ে বহুগুণ বেশি সাহসী না হন–আর অবশ্যই ভালো পোকার খেলোয়াড় না হন—তাহলে আমার ধারণা পুরাকীর্তিগুলো এখানে নেই।”

“জাহাজ থেকে যা পাওয়া গিয়েছিল তার কিছুই নেই”, ইটিয়েন বললেন। “আমরা উদ্ধারকৃত জিনিসের বেশিরভাগই জাদুঘরকে দিয়ে দিয়েছি। বাকি যা ছিল তা ঐ লোকগুলো নিয়ে গিয়েছে। ওরা এমিলের ডায়রিটাও নিয়ে গিয়েছে; মানে মিসরের নাম-গন্ধ পেলেই ওরা সেটা নিয়ে নিয়েছে, ছবি, নোট সব।”

“তার মানে তো সোফি সি-তে কিছুই ছিল না।” জো বলল।

“একদম ঠিক। আমি সেকথাও ওদেরকে বলেছি।” ইটিয়েন বললেন। “জাহাজটা আবিষ্কারের পর এ-মাথা থেকে ও-মাথা খুব ভালো করেই খোঁজা হয়েছে। মূল্যবান যা কিছু ছিল সবই উদ্ধার হয়ে গিয়েছে।”

“এমন কি হতে পারে যে সব পুরাকীর্তি আসলে জাহাজে ছিল না। আপনিই তো বললেন যে আসল কথা কেউ জানে না। এটার মানে কি?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

“রেকর্ড-পত্র থেকে জানা যায় যে সোফি সি, ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত মালপত্র বহন করছিল।” ইটিয়েন ব্যাখ্যা করলেন।

“কেন?”

“আসলে সেটা ছাড়া উপায়ও ছিল না। ভিয়েনেভ এখানে এসে পৌঁছতেই আবুকির এর দুর্যোগের কথা চারদিকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। প্রতিটা ফরাসি তখন নিজেকে আর নিজের সম্পদ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠল। ফলে সবার একটাই ইচ্ছা এখান থেকে ফ্রান্সে ফিরে যাবে। সেটা সম্ভব না হলেও অন্তত তাদের অস্থাবর সম্পত্তিগুলো আগে পাঠিয়ে দেবে। আশা করি বুঝতে পারছেন অবস্থাটা কেমন ছিল। ফ্রান্সের দখলে থাকার সময়েই মাল্টার বেশির ভাগ সম্পদই ফরাসিদের কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। ফলে সব জাহাজ-ই কানায় কানায় ভরে যায় মালপত্রে। একেবারে জাহাজ ছাড়ার আগ মুহূর্তেও মাল ভরা চলতো জাহাজে। কখনো কখনো জায়গা না পাওয়ায় ঘাটেই পড়ে থাকতে মাল বা অন্য কোনো জাহাজে তুলে দেয়া হতো। এসব ঝামেলার জন্যেই ধারণা করা হয়। হয়তো পুরাকীর্তিগুলো সোফি সি.-তে তোলা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু রেকর্ড করা হয়নি, আবার এটাও সম্ভব যে ওগুলো আসলে জাহাজে ভোলা-ই হয়নি। অথবা অন্য কোনো জাহাজেও তুলে দেয়া হতে পারে। রেকর্ড-পত্র অনুযায়ী ঐদিনই আরো দুটো জাহাজ বন্দর ছেড়ে যায়। একটা সোফি সি. সাথেই ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়। আরেকটা ব্রিটিশরা দখল করে নেয়।”

জো বলল, “ব্রিটিশরা পুরাকীর্তিগুলো পেলে এটা এতোদিনে রোজেটা স্টোন বা এলজিন মার্বেলগুলোর পাশে কোনো না কোনো জাদুঘরে শোভা পেতো।”

“আর যদি এগুলো জাহাজেই না ভোলা হতো বা মাল্টাতে লুকানো থাকতো, তাহলে এতোদিনে ওগুলো উদ্ধার হয়ে যেতো। আমার মনে হয় এই সম্ভাবনা দুটোকে বাদ দেয়া যায়। আমার মনে হয় সবচেয়ে বেশি যেটা হওয়ার সম্ভাবনা সেটা হলে ঐ পুরাকীর্তিগুলো ঐ ডুবে যাওয়া জাহাজ দুটোর কোনো একটাতেই ছিল। কিন্তু আপনি তো বললেনই যে সোফি সি.-তে আর কিছুই নেই।”

“আমরা অন্য জাহাজটায় খুঁজে দেখতে পারি।” রেনাটা প্রস্তাব দিল।

ইটিয়েন মাথা নাড়লেন, “আমি বহু বছর ধরে ওঠা খুঁজছি।”

“যে কোনো ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া সহজ, কিন্তু নির্দিষ্ট একটা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া সহজ না।” জো ব্যাখ্যা করল। “ভূমধ্যসাগরের তলদেশ ডোবা জাহাজ দিয়ে ভরা। সাত হাজার বছর ধরে এই সাগরটায় মানুষ চলাচল করছে। ঐ রোমান জাহাজটা খুঁজে পাওয়ার মাসখানেক আগে আমরা যখন সম্ভাব্য অবস্থান খুঁজছিলাম তখন প্রায় চল্লিশটা জায়গা পেয়েছিলাম যেগুলোকে সম্ভাব্য বলে অভিহিত করা হয়েছিল।”

“আমাদের হাতে অতসময় নেই।” রেনাটা বলল।

কার্ট ওদের কথা মন দিয়ে শুনছিল না, ওর দৃষ্টি ছবিটার দিকে। কি যেন একটা ওর কাছে অসামঞ্জস্যশীল লাগছে। ধরি ধরি করেও ধরতে পারছে না। “আবুকির-এর যুদ্ধটা হয় ১৭৯৯ সালে।” কার্ট বলল।

“ঠিক!” ইটিয়েন বললেন।

“সতেরোশো নিরানব্বই…হঠাৎ-ই ও ব্যাপারটা ধরতে পারলো। “আপনি বললেন এমিলের লেখায় আপনি এই ব্লাক মিস্টের ব্যাপারটা পেয়েছেন। কিন্তু রোজেটা স্টোন (যে পাথর থেকে প্রথম মিসরীয় লিপির পাঠোদ্ধার করা হয়) আর ঈজিলিয়ান হায়ারোগ্লিফের অর্থ আবিষ্কার তত আরো প্রায় পনের বছর পরে হয়।”

ইটিয়েন থেমে গেলেন। দেখে মনে হলো চিন্তাটা তাকে দারুণ দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে, “কি বলতে চাচ্ছেন আপনি?–এমিলের অনুবাদের ব্যাপারটা ভুয়া?”

“খোদা করুন, সেটা যেন না হয়। কিন্তু রোজেটা স্টোন আবিষ্কারের এতো দিন আগেই যদি পুরাকীর্তিগুলো ডুবে যায়, তাহলে ওতে কি লেখা ছিল সেটা জানা সম্ভব কি করে?” কার্ট বলল।

এমিলকে দেখে মনে হলো তিনি বলবেন কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেটা চেপে গেলেন, “এটা…এটা সম্ভব না। কিন্তু…আমি শুধু জানি এমনটাই হয়েছে।”

.

৩৯.

দ্য চ্যাম্পিয়নের পড়ার ঘরের দরজাটা ভেঙে একপাশে ঝুলছে। উনি সেটাকে পাত্তা না দিয়ে ঢুকে পড়লেন ভেতরে। বাকিরাও ঢুকলে পিছু পিছু।

ইটিয়েন ভেতরে ঢুকেই এক কোণায় একটা ছোট আলমিরার দিকে এগিয়ে গেলেন। কাত হয়ে পড়ে আছে সেটা।

“এখানে।” ডাকলেন সবাইকে। “হঠাৎ করেই একটা জিনিস আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। বহুদিন ধরে ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে মরেছি।”

কার্ট আর জো ওনাকে সাহায্য করল ভারি আলমিরাটা সোজা করতে। সাথে সাথেই দ্য চ্যাম্পিয়ন ওটার ভেতর ঘাটাঘাটি আরম্ভ করলেন।

“ওরা এটা থেকে তেমন কিছু নেয়নি।” সাবধানে একটা একটা কাগজ বের করতে করতে বললেন ইটিয়েন। উনি একটা একটা কাগজ বের করছেন তারপর এক নজর দেখেই পাশে রেখে দিচ্ছেন। “ওদের লক্ষ্য ছিল শুধু পুরাকীর্তিগুলো ও এমিলের মিসরে থাকাকালীন আঁকা ছবি আর নোটপত্র। বাকিগুলোর প্রতি ওদের তেমন আগ্রহ ছিলো না। কারণটা কী বলেন তো?”

বিদ্রূপের একটা হাসি হেসে বললেন ইটিয়েন, “কারণ ওরা ফ্রেঞ্চ পড়তে পারে না। বেকুবের দল!”

কার্ট আর জো পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করল। ওরাও ফ্রেঞ্চ পড়তে পারে না। তবে সেকথা মুখে বলল না।

ইটিয়েন তখনো খুঁজেই চলেছেন। তারপর একটা ফাইল মতো বের করলেন। ভেতরে এক তাড়া পুরনো কাগজপত্র।

“পেয়েছি।” উনি কাগজগুলো নিয়ে টেবিলে আসতেই কার্ট মেঝে থেকে একটা ল্যাম্প তুলে এনে জ্বেলে দিল। তারপর পুরো দলটাই হামলে পড়ল কাগজগুলোর ওপর। জিনিসটা একটা হাতে লেখা চিঠি।

ইটিয়েন সবার জন্যে অনুবাদ করে শোনালেন সেটা। “প্রিয় বন্ধু এমিল, আপনার চিঠি পেয়ে খুব ভাল লাগছে। ট্রাফালগারের সেই দুর্দশা আর ব্রিটিশদের কাছে বন্দী থাকার পর আমি আবার আমার সম্মান ফিরে পাবো ভাবিনি।”

“ট্রাফালগার?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

কার্ট ব্যাখ্যা করল, “আবুকির বন্দর ছাড়াও, ভিয়েনেভ ট্রাফালগারের যুদ্ধেও ফ্রেঞ্চ নৌ-বহরের দায়িত্বে ছিলেন। সেখানে নেলসন ফ্রান্স আর স্পেনের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করে প্রমাণ করেন ইংল্যান্ডকে দখল করার ক্ষমতা কারো নেই। এরপর নেপোলিয়নের ইংল্যান্ড আক্রমণের যেটুকু ইচ্ছা ছিল সেটুকুও চলে যায়।”

ব্যাপারটায় রেনাটা দারুণ চমৎকৃত হয়েছে বোঝা যায়। আমি যদি ভিয়েনেভ হতাম তাহলে ব্রিটিশদের সাথে বিশেষ করে নেলসনের সাথে যেকোনো যুদ্ধ আমি এড়িয়ে চলতাম।”

জো হাসলো, “লোকটা নিশ্চয়ই নেলসনকে মারাত্মক ঘৃণা করতো।”

“আসলে তিনি ইংল্যান্ডে বন্দী থাকা অবস্থায় নেলসনের শেষকৃত্যেও যোগ দিয়েছিলেন।” ইটিয়েন বললেন।

“সম্ভবত আসলেই মরেছে কি-না সেটা দেখতে গিয়েছিলেন।” রেনাটা বলল। ইটিয়েন আবার চিঠি পড়ায় মন দিলেন, “আপনি প্রায়ই বলেন যে, জাহাজ নিয়ে নীল নদ থেকে পালিয়ে আসার মাধ্যমে আমি আপনার জীবন বাঁচিয়েছি। একথা বললেও ভুল হবে না যে আপনিও একই কাজের মাধ্যমে তার প্রতিদান দিয়েছেন। এই সুযোগে আমি আরো একবার নেপোলিয়নের সাথে দেখা করবো। আমার বন্ধুরা অবশ্য বলেছে যে নেপোলিয়ন নাকি আমাকে জীবিত দেখতে চান না। কিন্তু আমি যখন এই মহা অস্ত্র-মৃত্যুর কুয়াশা–তার হাতে তুলে দেবো তখন তিনি আমার দুই গালে চুমু খেয়ে পুরস্কৃত করবেন। আর আমি পুরস্কৃত করবো আপনাকে। তবে সবচেয়ে জরুরি ব্যাপার হলো আমরা বাদে কথাটা যেন আর কেউ না জানে। তবে আমি আমার ইজ্জতের কসম খেয়ে বলছি, বিজ্ঞ হিসেবে আপনার পাওনা আপনি পাবেন এবং বিপ্লব আর সাম্রাজ্যের দুটোরই নায়ক হিসেবে প্রাপ্য সম্মানও আপনাকে দেয়া হবে। আপনার পাঠানো আসল আর সামান্য রূপান্তরিত দুটোই আমার কাছে আছে। দয়া করে দ্রুত অ্যাঞ্জেলস ব্রেথ বানানো শেষ করে আমাকে পাঠান যাতে করে আমাদের শত্রুরা এই বিষে আক্রান্ত হলেও আমরা নিরাপদ থাকি। বসন্তের দিকে সম্রাটের সাথে দেখা করবে বলে আশা রাখি। এবার পাওনা শোধ করবো। ২৯ থার্মিডোর, সাল 13, পিয়েরে চার্লস ভিয়েনেভ।”

“রূপান্তরের আরেক অর্থ কিন্তু অনুবাদও হয়।” রেনাটা বলল। “এই ঘটনাটা কখনকার?” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

রেনাটা বের করার চেষ্টা করল সালটা। নেপোলিয়নের অদ্ভুত ক্যালেণ্ডারটার পুরোটা মনে আসছে না। তার শাসনামলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডারের বদলে এই ক্যালেন্ডার ব্যবহৃত হতো। “১৩ সালের ২৯ থার্মিডর মানে হলো…”

ইটিয়েন এর আগে বের করে ফেললেন, “১৭ আগস্ট, সালটা হলো ১৮০৫।”

“সেটাও তো রোজেটা স্টোনের রহস্যভেদের এক যুগ আগে।” কার্ট বলল।

“অবিশ্বাস্য জো বলল। “আমি বোঝাতে চাচ্ছি যে, কিছু কিছু লোক শব্দটার অর্থ বোঝে হলো বিশ্বাসযোগ্য না।”

“এমিলের ডায়রিটা পাওয়া গেলেই সব প্রমাণিত হয়ে যেতো।” ইটিয়েন বললেন, ভেতরে অনেক ছবি, হায়ারোগ্লিফ আর সম্ভাব্য অনুবাদ লেখা ছিল। এমনকি একটা ছোট ডিকশনারীর মতোও বানিয়েছিলেন উনি। কিন্তু এই সময়ের আগে পরের ব্যাপারটা কখনো আমি ধরতে পারিনি।”

কার্ট জানে যে এরকমই হয়। ইতিহাস যুগে যুগে বদলে যায়। একসময় চোখ বুজে সবাই মানতো যে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু এখন স্কুলে পড়ানো হয় যে ভাইকিংসরা তার বহু আগেই কাজটা সেরে ফেলেছিল।

“তাহলে এই ব্যাপারে ওনার কোনো নাম শোনা যায় না কেন?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

“সম্ভবত ভিয়েনেভ তাকে এটা গোপন রাখতে বলছিলেন।” কার্ট অনুমান করল। “এটা নতুন একটা অস্ত্র আবিষ্কার সংক্রান্ত ব্যাপার। এসব ব্যাপার ফাস হোক তা কেউই চাইবে না।”

“তার ওপর তখন ব্রিটিশরা মিসরের নিয়ন্ত্রণে ছিল আর একজন ফ্রেঞ্চ অ্যাডমিরালের সাথে এমিলের বন্ধুত্ব নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ করতো ওরা।” ইটিয়েন বললেন। “আসল ব্যাপারটা…” উনি অন্য চিঠিগুলোও ঘাটা শুরু করলেন।

“এখানেই কোথাও আছে।”

“কি আছে এখানে?”

“এটা…” আরেকটা কাগজ তুলে বললেন ইটিয়েন, “এটা হলো ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক এমিলের বিদেশ ভ্রমণের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা। ১৮০৫ সালের শুরুর দিকে তিনি আবারো মিসর ফিরে গিয়ে গবেষণা শুরু করার অনুমতি প্রার্থনা করেন। মাল্টার প্রাদেশিক গভর্নর সেটা অনুমোদন করলেও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সেটা নাকচ করে দেয়।”

কার্ট চিঠিটা দেখলো। দেখেই বোঝা যায় অফিসিয়াল চিঠি, “আমরা এই মুহূর্তে মিসরের ভেতরে আপনার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারবো না।” পড়ল কার্ট। “উনি যেতে চাচ্ছিলেন কোথায়?”

“জানি না।” ইটিয়েন বললেন।

“ইশ! জানতে পারলে কাজে দিতো,” রেনাটা বলল।

“উনি আর কখনো চেষ্টা-চরিত্র করেননি।” কার্ট জিজ্ঞেস করল।

“না, দুঃখের বিষয় হলো সেই সুযোগই পাননি। এর কিছুদিনের মাঝেই তিনি আর ভিয়েনেভ দুজনেই মারা যান।”

“দুজনেই?” সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করল জো, “কীভাবে?”

“এমিল স্বাভাবিকভাবেই মারা যান। মাল্টাতেই। ঘুমের মাঝে মারা যান তিনি। ধারণা করা হয় তার হার্টে সমস্যা ছিল। রিয়ার অ্যাডমিরাল ভিয়েনেভ মারা যান একমাস পর ফ্রান্সে। তার মৃত্যুটা অবশ্য এরকম স্বাভাবিক ছিল না। তার বুকে সাতবার ছুরিকাঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল। সেটাকে আত্মহত্যা বলে রায় দেয়া হয়।”

‘আত্মহত্যা? সাতবার ছুরি মেরে? আমি বহু সন্দেহজনক রিপোর্ট পড়েছি কিন্তু এটা তো পুরোই হাস্যকর।” রেনাটা বলল।

ইটিয়েনও সম্মতি জানালেন, “বিশ্বাস করা শক্ত। এমনকি সেই সময়েও এটা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়। বিশেষ করে ইংল্যান্ডে।

“ভিয়েনেভের না বসন্তে সম্রাটের সাথে দেখা করার কথা ছিল?”

ইটিয়েন মাথা ঝাঁকালেন, “হ্যাঁ। আর বেশির ভাগ ইতিহাসবিদেরই ধারণা অ্যাডমিরালের মৃত্যুর পিছনে নেপোলিয়নের হাত আছে। হয় তিনি ভিয়েনেভের কথা বিশ্বাস করেননি। অথবা হয়তো তাকে শেষ পর্যন্ত ক্ষমা করতে পারেননি।”

দুটোই হতে পারে বলে কার্টের মনে হলো। তবে ওর দরকার হচ্ছে মিসরীয় লিপির সেই আনুবাদগুলো। “যদি ভিয়েনেভের কাছে তখন অনুবাদটা থেকে থাকে তাহলে তার মৃত্যুর পর সেগুলোর কী হয়? উনার সহায় সম্পত্তির কী করা হয়েছিল জানেন নাকি?”

ইটিয়েন কাধ নাচালেন। “আমি আসলে নিশ্চিত না। ফরাসি নৌবাহিনীর বেইজ্জত অ্যাডমিরালদের কোনো জাদুঘর নিশ্চয়ই নেই। আর শেষ দিকে এসে ভিয়েনেভ একেবারেই কপর্দকহীন হয়ে পড়েন। বেনের একটা বোর্ডিং-এ থাকতেন। সম্ভবত মারা যাওয়ার পর বাড়িওয়ালাই সবকিছুর দখল নিয়ে নেয়।”

“এমনও তো হতে পারে যে ভিয়েনেভ নেপোলিয়নকে অনুবাদটা দেয়ার পরই তাকে খুন করা হয়। রেনাটা বলল।

“কেন যেন আমার সেটা মনে হয় না। কার্ট বলল, “ভিয়েনেভ খুবই তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন লোক ছিল। জীবনের প্রতিটা বিপদ সে দক্ষতার সাথে কাটিয়ে এসেছে।”

“শুধু যখন ট্রাফালগারে নেলসনের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল তখন বাদে।” জো মনে করিয়ে দিল।

“হ্যাঁ, তবে সেখানেও কিন্তু তার সব পদক্ষেপ মাপা-ই ছিল।” কার্ট জবাব দিল, “যতদূর মনে পড়ে উনার কাছে খবর পৌঁছেছিল যে নেপোলিয়ন তাকে আর চাচ্ছেন না। আর সম্রাটের কাছে গেলেই তাকে গ্রেফতার, জেল এমনকি গিলেটিনে পর্যন্ত দিতে পারেন। এতকিছু বিবেচনা করেই কিন্তু ভিয়েনেভ তার শেষ চালটা চালেন। তিনি যুদ্ধ করতে গেলেন। খুব ভালোই জানতেন যদি যুদ্ধে জয় হয় তাহলে তিনি বীর হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং বাকি সবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবেন। আর যদি তিনি হারেন তাহলে হয় মারা যাবেন না হয় ব্রিটিশদের হাতে বন্দী হবেন। সেক্ষেত্রে তাকে নিরাপদে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হবে। সেটাই কিন্তু হয়েছিল।”

“সর্বস্ব দিয়ে বাজি ধরা। জিতলে সব ফেরত পাবে, হারলে সব যাবে।” জো বলল। “চালটা কিন্তু ভালোই খেলেছিলেন। ব্রিটিশরা আবার তাকে ফ্রান্স ফেরত পাঠিয়েই গোলমালটা বাধালো।” রেনাটা মন্তব্য করল।

“সব চাল তো আর জেতা যায় না। তবে লোকটার চিন্তাধারা আর প্রতি পদক্ষেপে যে ধূর্ততা উনি দেখিয়েছেন। তাতে আমার মনে হয় না যে নেপোলিয়নের সাথে দেখা করেই ওনার একমাত্র বাঁচার অবলম্বনটা তার হাতে তুলে দেবেন। বরং নেপোলিয়নকে জিনিসটার সামান্য অংশ দেখিয়ে লোভ লাগাবেন আর বাকিটা কোথাও লুকিয়ে রাখাটাই তার সাথে যায়। কারণ একমাত্র এটাই তার জীবন রক্ষা করতে পারতো।” কার্ট বলল।

“তাহলে নেপোলিয়ন ওনাকে মারলেন কেন?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

“কে জানে? হয়তো ভিয়েনেভের কথা তার বিশ্বাস হয়নি। হতো প্রতিবার অ্যাডমিরালের এসব বকোয়াজ শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। ভিযেনেভের কারণে তাকে বহুবার বেইজ্জত হতে হয়েছে। আর হয়তো সহ্য হয়নি।” কার্ট অনুমান করল।

জো পুরো ব্যাপারটা সংক্ষেপে একবার বলল, “তাই ভিয়েনেভের হাত থেকে বাঁচার জন্যে নেপোলিয়ন তাকে মেরে ফেললেন। ভিয়েনেজের প্রস্তাবটা ভেবেও দেখলেন না বা বিশ্বাস করলেন না। আর তার ফলে ঐ ভাষান্তর আর মিস্ট অফ ডেথ আর মিস্ট অফ লাইফের সব কিছু হারিয়ে গেল। তারপর আর এই শয়তানগুলো সেগুলো কোথাও থেকে বের করেছে।”

“সেরকমটাই ধারণা আমার।” কার্ট বলল।

পরের প্রশ্নটা করল রেনাটা, “তাহলে যদি ভিয়েনেভ নেপোলিয়নকে ভাষান্তরটা না-ই দিয়ে থাকে তাহলে ওটা গেল কোথায়?”

“সেটাই আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে।” বলল কার্ট। তারপর ইটিয়েনের দিকে ফিরলো। “কোথা থেকে খোঁজা শুরু করলে ভালো হয় বলতে পারেন?” ইটিয়েন চুপচাপ কিছুক্ষণ ভাবলেন, তারপর বললেন, “রেনেস?”

যদিও কথাটা প্রশ্নবোধক সুরে বলা, তবে কার্টের মাখাতেও এটার কথাই ঘুরছিল। তাই ও মাথা ঝাঁকালো। তারপর বলল, “আমাদের সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। আমাদেরকে তাই ভাগ ভাগ করে একেক জায়গায় খুঁজতে হবে। দক্ষিণ মিসরে খুঁজতে হবে এই মিস্ট অফ লাইফের কোনো হদিস পাওয়া যায় কি-না আর ফ্রান্সে খুঁজতে হবে ভিয়েনেভ এমিল দ্য চ্যাম্পিয়নের ভাষান্তরটা কোথাও লুকিয়ে রেখেছিলেন কি-না।

“আমরা ফ্রান্সে যেতে পারি।” ইটিয়েন বললেন।

“স্যরি, আমরা আর আপনাদেরকে কোনো বিপদে জড়াতে পারবো না। রেনাটা আপনি-ই এ কাজটা ভালো পারবেন।” কার্ট বলল।

রেনাটা ঐ মুহূর্তে ওর ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল। মাত্র একটা মেসেজ এসেছে সেটা পড়ছে। সেখান থেকে মুখ তুলে বলল, “মোটও না। আমি জানি আপনি শুধু আমাকে ঝামেলা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছেন। তবে আসল ব্যাপার হলো, আমার কাছে নতুন খবর আছে : AISE আর ইন্টার পোল মিলে এ সায়ানাইড খাওয়া লোকটার পরিচয় বের করেছে। লোকটা মিসরীয় গোয়েন্দা বাহিনীর এক দল ছুট রেজিমেন্টের সদস্য। এরা হচ্ছে মোবারক সরকারের সমর্থক এবং অনেক অপরাধের জন্য সন্দেহ ভাজন।”

“তার মানে মিসর-ই হচ্ছে আসল জায়গা।” কার্ট বলল।

“আরো একটা সুখবর আছে।” রেনাটা বলল, “মাল্টায় থাকার সময় লোকগুলো যে স্যাটেলাইট ফোনে কথা বলেছিল সেটার সিগনাল ট্রাক করা গিয়েছে। কলটা করা হয়েছিল ঠিক এখান থেকে। আর দুর্গে আপনারা মারামারি করার সময় করা হয়েছিল বন্দর থেকে। ফোনটা এখন আছে কায়রো। আর আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে ফোনটা যার কাছে আছে তাকে খুঁজে বের করতে।”

“কার্টের ধারণা ফোনটা থাকে হাসানের কাছে।” ঠিক আছে। “আমি যাবো আপনার সাথে।”

“তার মানে আমাকেই যেতে হচ্ছে ফ্রান্সে। জো বলল, “ব্যাপার না। ঐ দেশে ঘুরতে যাওয়ার শখ বহুদিন ধরেই। ওখানকার ওয়াইন আর পনির খেয়ে দেখতে হবে।”

“স্যরি, প্যারিসে গ্রীষ্ম যাপন পরের বারের জন্যে তুলে রাখো। তুমিও আমাদের সাথেই যাচ্ছ।” কার্ট বলল।

“তাহলে ফ্রান্স যাবে কে?”

“পল আর গামায়। ওদের ছুটি আরো দুদিন আগে শেষ হয়েছে। কাজে যোগদানের সময় এখন।”

.

৪০

বেনগাজী, লিবিয়া

সারা শহর জুড়েই চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। এদিকে পানিও কমে এসেছে। মারাত্মকভাবে। আরেকটা গৃহযুদ্ধ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ওরা যখন পৌঁছুলো তখন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে তিল ধারণের জায়গা নেই। কেউ ছুরি খেয়েছে কেউ খেয়েছে পিটুনি। আর গুলি খাওয়ারা তো আছেই।

পল আর গামায় বহুকষ্টে এক কোণে একটু জায়গা বের করে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরই লিবিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার এক লোক ওদের সাথে যোগ দিল। পরের এক ঘন্টা ওদের জেরা করা হলো। ওরা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করল যে ওরা ওখানে কি করছিল আর ওদের লক্ষ্য ছিল জলাধারের পানির কি হচ্ছে সেই রহস্য উদ্ধারে রেজাকে সাহায্য করা। শেষমেশ কেন ওরা পালিয়েছে সেই ঘটনাও বলল।

তবে লোকটা ওদের কথা বিশ্বাস করছে বলে মনে হলো না। সে শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে আর হুম হুম করে নোট নিয়েই গেল। যদিও স্টেশনের বাকি কর্মচারীরাও ওদের কথার সমর্থনই দিয়ে গেল। লোকটার মূল আগ্রহ ছিল বিদ্রোহীদের আক্রমণের ধরন আর ওদের পালানো নিয়ে।

চারপাশে অস্বস্তিকর নীরবতা। মাঝে মাঝে শুধু আরেকদল আহত লোককে যখন রাস্তা থেকে তুলে আনা হয় তখন-ই একটু হট্টগোল হচ্ছে। সরকারি লোকটা ওদের দিকে শুরু থেকেই কেমন সাবধানী চোখে তাকিয়ে আছে।

“এই সব শুরু হলো কখন?” গামায় জিজ্ঞেস করল। হাসপাতালের এই ভরপুর দশা দেখে অবাক হয়েছে খুব। হাসপাতালের এই ভরপুর দশা দেখে অবাক হয়েছে খুব।

“সরকার শহরের কয়েকটা জায়গায় পানির সাপ্লাই বন্ধ করে দিয়েছে। তারপর থেকেই শুরু হয় আন্দোলন। শুরুতে শান্তভাবে হলেও আজ বিকেলে এরা ভাঙচুর শুরু করে। ভাগ করে করে পানি বিতরণ শুরু হয় কিন্তু তাতে কি আর হয়। মানুষও তখন বেপরোয়া। আর একজন আছে যে এই সব কিছু উস্কে দিচ্ছে।”

“একজন?” পল জিজ্ঞেস করল।

“লিবিয়া এখন বাইরের লোক দিয়ে রা। আমাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ আছে যে আমাদের দেশে এখন মিসরীয় গুপ্তচর দিয়ে গিজগিজ করছে। কিন্তু কেন? তার উত্তর আমাদের জানা নেই। দিনকে দিন এটা বাড়ছেই।” এজেন্টটা জানালো।

“আচ্ছা, এজন্যই আপনি আমাদেরকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। আপনার ধারণা আমরাই রেজাকে কিছু করেছি?” গামায় বলল।

“গত মাসেও একবার তাকে মারার চেষ্টা করা হয়। তার অবশ্য কারণও আছে। পানির অবস্থা যদি কেউ আবার আগের মতো করতে পারে তো রেজা-ই পারবে। দেশের ভূতত্ত্ব আর এসব সিস্টেম সম্পর্কে ওনার চেয়ে ভালো কেউ জানেনা। উনি না থাকলে আমাদের কি হবে তা শুধু খোদাই-ই জানে।” এজেন্ট বলল।

“আমরা শুধু ওনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি।” গামায় বলল।

“দেখা যাবে সেটা।” এজেন্ট জবাব দিল। এখনো সন্দিহান সে।

ওর কথা শেষ হতেই অপারেশন রুম থেকে একজন সার্জন বের হয়ে ওদের দিকে তাকালো। তারপর মুখোশ খুলতে খুলতে ক্লান্ত পদক্ষেপে ওদের দিকে এগুলো। তার চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে টানা কাজ করেই যাচ্ছেন ডাক্তার।

“প্লিজ একটা ভালো খবর শোনান।” গামায় বলল।

“রেজার বিপদ আপাতত কেটে গিয়েছে। উনার উরুতে একটা বুলেট বিধেছিল আর একটা লিভারে আচড় কেটে বেরিয়ে গিয়েছে। ভাগ্য ভালো যে গুরুত্বপূর্ণ কোনো অঙ্গে কিছু হয়নি। সৌভাগ্য ক্রমে অথবা দুর্ভাগ্যক্রমে বলাই ভালো–আমাদের সার্জনরা এসব সামলাতে সামাতে দক্ষ হয়ে গিয়েছে। গৃহযুদ্ধে ভালো বলতে এই একটা কাজ হয়েছে।” বললেন সার্জন।

“ওনার সাথে কথা বলা যাবে কখন?” গামায় জিজ্ঞেস করল।

“মাত্রই জ্ঞান ফিরেছে। কমপক্ষে আধাঘণ্টা তো অপেক্ষা করুন।”

এজেন্ট লোকটা নিজের আইডি কার্ড বের করে বলল, “আমি এখুনি ওনার সাথে দেখা করবো।”

“ঠিক হবে না কাজটা।” ডাক্তার বললেন।

“উনার চেতনা কী পুরোপুরি আছে?

“হ্যাঁ।”

“তাহলে আমাকে নিয়ে চলুন।”

সার্জন হতাশ হয়ে একটা শ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিক আছে আসুন। তবে তার আগে একটা গাউন পরতে হবে।”

সার্জন আর এজেন্ট চলে যেতেই গামায় এর ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে নামটা দেখেই বলল, “কার্ট ফোন করেছে। ছুটি শেষ হলেও অফিসে যাইনি কেন সেই কৈফিয়তই চাইবে মনে হয়।”

পল চারদিকে একবার তাকিয়ে ব্যালকনির দিকে হাঁটা দিল, “একটু বাতাস খেয়ে আসি চলল।”

বাইরে এসেই গামায় ফোন রিসিভ করল।

“কি খবর? ছুটি কেমন কাটচ্ছে? কাৰ্ট জিজ্ঞেস করল।

রাতের বাতাস হালকা আর উষ্ণ। ভূমধ্যমাগরের সুবাস মিশে আছে তাতে। কিন্তু হেলিকপ্টর আর দূরের গোলাগুলির শব্দই পুরো পরিবেশটা নষ্ট করে দিচ্ছে।

“যতটা ভেবেছিলাম ততোটা মজা হচ্ছে না।” গামায় বলল।

“আহারে।” তা ফ্রান্সে আরেকবার হানিমুনে যাবে নাকি? টাকা-পয়সা যা লাগে NUMA দেবে।” কার্ট বলল।

“শুনতে তো ভালোই লাগে। তবে তার সাথে একটা কিছু নিশ্চিত আছে।” “একটা কিছু তো সব সময়ই থাকে।”

পল সেটা শুনে বলল, “ওকে বলল যে আমাদের ওখানে থাকা দরকার।” গামায় মাথা ঝাঁকালো, “আচ্ছা কয়েকদিন পরে গেলে হবে না? আমরা এখানে একটা কাজে জড়িয়ে পড়েছি। এই ব্যাপারটাও আর একটু ঘেটে দেখা দরকার।”

“কোন ব্যাপার?”

“উত্তর আফ্রিকার খরা।”

কার্ট এক মুহূর্ত চুপ থাকল, “সাহারাতে তো খরা-ই থাকার কথা।” “না। এটা সেটা না। বৃষ্টি হচ্ছে না বলে যে খরা হয় এটা সেরকম না। মাটির নিচের পানি শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে ধরা। এদিককার সব লেক কাদা ভরা ভোবায় পরিণত হয়েছে। যুগ যুগ ধরে যেসব পাম্প চলছিল যেসব হঠাৎ করে পানি পাচ্ছে না আর।”

“এরকম তো কখনো শুনিনি।” কার্ট বলল।

“এটার জন্যে দেশে এর মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে গিয়েছে। সামনে আরো কি হবে কে জানে। গামায় বলল।

“শুনে খারাপ লাগছে। তবে অন্য কাউকে পাঠাতে হবে ওখানে। ফ্রান্সে তোমাদেরকে দরকার। বেনগাজী থেকে রেনে পর্যন্ত একটা ফ্লাইট চাটার্ড করা হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব চলে আসো।”

“এত তাড়া কেন জানতে পারি?”

“বিমানে ওঠা মাত্র সব জানিয়ে দেয়া হবে।” কার্ট বলল।

ফোন হাত দিয়ে ঢেকে গামায় পলকে বলল, “বড় কোনো ঝামেলা বেঁধেছে বোধ হয়। কার্ট তো কখনো এতো জোরাজুরি করে না।”

পল ওদের জেরা হওয়ার জায়গাটার দিকে একবার তাকাল, “এখন আমাদেরকে শহর ছাড়ার অনুমতি দিলে হয়।”

গামায়ও সেটাই ভাবছিল। আবার ফোন কানে লাগালো, “এখানে সরাসরি লোকজনের সাথে একটু ঝামেলা হচ্ছে। লম্বা কাহিনী। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা চলে আসছি।”

“কি হয় জানিও। কারণ তোমরা আসতে না পারলে অন্য কাউকে পাঠাতে হবে।” কার্ট বলল।

কার্ট ফোন কেটে দিতে গামায় ফোনটা পকেটে রাখতে রাখতে বলল, “ঝামেলা শুরু হলে তো দেখি থামতেই চায় না। একটার পর একটা লাগতেই থাকে।”

কিছুক্ষণ পরেই গোয়েন্দা লোকটা অপারেশন রুম থেকে বেরিয়ে এলো। ওদেরকে দেখতে পেয়ে বেলকনিতেই এগিয়ে এলো সে।

“আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি। রেজা সব বলেছেন আমাকে। উনার জীবন বাঁচানোর জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।” লোকটা বলল।

“শুনে ভালো লাগল।” পল বলল।

হঠাৎ শহরের দূরের কোথাও বিশাল এক অগ্নিকুণ্ড ঝলসে উঠল কয়েক সেকেন্ড পরেই ভেসে এলো শব্দ। বোমা-টোমা ফেটেছে কোথাও।

“হ্যাঁ আপনাদের প্রতি আর কোনো অভিযোগ নেই। রেজা বেঁচে আছেন তবে ক্ষতি যা হওয়ার হয়েই গিয়েছে। আরো দুটো পাম্পিং স্টেশনে হামলা হয়েছে। আর বাকিগুলোও দরকারের তুলনায় সামান্য পানিই তুলতে পারছে। রেজাকে আরো কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হবে। আর সুস্থ হতেও লাগবে আরো কয়েক সপ্তাহ। আর ততোদিনে দেশটা আবার খণ্ড খণ্ড হয়ে যাবে। গত পাঁচ বছরে এ নিয়ে তিনবার হবে।

“আমরা হয়তো কিছু সাহায্য করতে পারবা।” পল বলল।

এজেন্ট দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। বিস্ফোরণ হল থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। তাদের আলো ঢাকা পড়ে যাচ্ছে তাতে। “আমার পরামর্শ হচ্ছে। আপনারা সময় থাকতে চলে যান। কারণ কয়েকদিন পরেই আর এদেশ থেকে কেউ বের হতে পারবে কি-না সন্দেহ। আর আমার মতো সবাই হবে না। সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত কারো হাতে পড়লে আপনাদেরই ঝামেলা হবে। শেষে বলির পাঠা হতে হবে। আশা করি বুঝতে পারছেন?”

“আচ্ছা। তবে রেজাকে একবার বিদায় বলে যাই।” গামায় বলল।

“আর তারপর এয়ারপোর্ট পৌঁছাবার একটা ব্যবস্থা করে দেবেন প্লিজ।” পল যোগ করল সাথে।

৪১. রোম

৪১. রোম

ভাইস প্রেসিডেন্ট জেমস স্যান্ডেকার ইতালিয়ান পার্লামেন্ট বিল্ডিং-এর একটা কনফারেন্স রুমে বসে আছেন। অনেক লোকজন রুমটায়। তার সাথেও বেশ কয়েকজন পরামর্শক আছেন আর টেরি কারুথার্স তত আছেই। সারা রুম জুড়েই ইউরোপের সব দেশ থেকে আসা প্রতিনিধি দল বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে।

এই মুহূর্তে নতুন একটা ব্যবসায়িক চুক্তি নিয়ে আলোচনা করার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ-ই সেটা মোড় পাল্টে লিবিয়া, তিউনিসিয়া আর আলজেরিয়ার ঘটনাগুলোর দিকে চলে গেল।

মাত্র বারো ঘন্টার ব্যবধানে তিউনিসিয়া আর আলজেরিয়ার সরকার ক্ষমতা চ্যুত হয়েছে। নতুন জোট গঠন করা হচ্ছে। ক্ষমতা সম্ভবত আবারো আরব বসন্তের আগের লোকগুলোর হাতেই ফিরে যাচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে চলে আসা দাঙ্গা আর ক্রমবর্ধমান খরার কারণে এটা যে হবে সেটা অনুমেয়ই ছিল কিন্তু আরো কয়েকদিন হয়তো টিকতো সরকারগুলো। তবে এক সাথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পদত্যাগ করায় সেটা আর হয়নি।

বিশেষ করে আলজেরিয়ার ঘটনায় সবাই অবাক হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী ওখানে পদত্যাগ করেছেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন মন্ত্রণালয় নাকি বিশ্বাস ঘাতকে ভরে গিয়েছে।

“কেউ একজন পিছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে” স্যান্ডেকার কারুথার্সকে বললেন।

“CIA’র উত্তর আফ্রিকা নিয়ে রিপোর্টটা কাল পড়েছি। এসব ঘটার কোনো ইঙ্গিতও ছিল না তাতে।” কারুথার্স জানালো।

স্যান্ডেকার বললেন, “এজেন্সীর লোকজন মাঝে মাঝে ভালোই কাজ দেখায় কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় দড়িকে সাপ ভেবে বসে আবার মাঝে মাঝে হাতিকে ভাবে সাকার্সের জিনিস।”

“আপনার কি মনে হয়? পরিস্থিতি কতটা খারাপ?” কারুথার্স জিজ্ঞেস করল।

“আলজেরিয়া আর তিউনিসিয়ারটা হয়তো সামলে যাবে তাড়াতাড়ি কিন্তু লিবিয়ায় অবস্থা খুবই খারাপ, একটা সুতোয় ঝুলছে এখন ওদের ভাগ্য।”

“এজন্যেই কি ইতালিয়ানরা লিবিয়ায় পরিবর্তন আনার জন্য এতো চেঁচামেচি করছে।” প্রশ্নটা চমৎকার। লিবিয়া এখন একটা গৃহযুদ্ধের দ্বার প্রান্তে। আর হঠাৎ-ই ইতালিয়ান একজন আইন প্রণেতা আলবার্তো পিওলা এক অদ্ভুত প্রস্ত বি দিয়েছেন। ইতালির বর্তমান সরকারের এক প্রভাবশালী নেতা উনি। আজকের সম্মেলনেরও সভাপতি উনি। কিন্তু ব্যবসায়িক আলাপ-চারিতা বাদ দিয়ে উনি লিবিয়ায় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সকলের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

“আমার মনে হয়, পতনের আগেই আমাদের উচিত লিবিয়ার সরকারকে পদত্যাগের জন্যে অনুরোধ করা।” পিওলা বললেন।

“তাতে লাভ কী?” কানাডিয়ান রাষ্ট্রদূত জিজ্ঞেস করলেন।

“আমরা তাহলে নতুন একটা শাসন ব্যবস্থা সমর্থন করতে পারবো যেটা জনগণের সমর্থনেই ক্ষমতায় আসবে।” পিওলা বললেন।

“কিন্তু তাতে পানির সমস্যা সমাধান হবে কীভাবে?” প্রশ্নটা জার্মান ভাইস চ্যান্সেলরের।

“এতে অন্তত হানাহানি তত বন্ধ হবে।” পিওলা বললেন।

“আর আলজেরিয়ায় কী হবে?” ফ্রেঞ্চ প্রতিনিধি জিজ্ঞেস করলেন।

“আলজেরিয়ায় নতুন করে নির্বাচন হবে। তিউনিসিয়াতেও। নতুন সরকারই ঠিক করবে তাদের কি করতে হবে আর তারা পানির সমস্যা কীভাবে সামলাবে। কিন্তু লিবিয়া একেবারে পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছে।”

স্যান্ডেকার মোটামুটি চুপচাপই ছিলেন পুরোটা সময়। পিওলার এই অপ্রাসঙ্গিক লিবিয়া-প্রীতি তাকে অবাক করেছে। বিশেষ করে ইতালি যখন এখনো ল্যাম্পেডুসার ব্যাপারটা সামলে উঠতে পারেনি। NUMA আর বর্তমানের দায়িত্ব তাকে শিখিয়েছে যে, একবারের জন্য একটা সংকটই বেশি, দুটো ঝামেলা ঘাড়ে নেয়ার তো কথাই আসে না।

কারুথার্স ঝুঁকে তার কানে কানে বলল, “উনি যা বলছেন সেটা তো সম্ভব না। এখানকার সবাই রাজি হয়েও তো লাভ নেই। আমাদেরকে আগে আমাদের নিজ নিজ দেশে ফিরে গিয়ে আমাদের নেতাদেরকে রাজি করাতে হবে।”

স্যাভেকার আনমনে মাথা ঝাঁকালেন, “আলবার্তো সেটা ভালোই জানে।”

“তাহলে খামাখা এসব বলে সময় নষ্ট করছেন কেন?”

স্যান্ডেকারও বসে বসে পিওলার ব্যাপারটাই ভাবছেন। তার কাছে সবচে যুক্তিসঙ্গত যা মনে হয়েছে সেটাই বললেন, “যা কখনো হবে না সেটা নিয়ে ভোট চাওয়ার মতো বোকা পিওলা না। সে আসলে ইতোমধ্যে হয়ে গিয়েছে এমন ঘটনাকে সবার সামনে তুলে এনে সেটাকে গ্রহণযোগ্য বানানোর মঞ্চ সাজাচ্ছে।

কারুথার্স পিছনে সরে এসে অবাক চোখে ভাইস প্রেসিডেন্টের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ লাগল ওর ব্যাপারটা বুঝতে, “তার মানে…”।

“লিবিয়ান সরকারের পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর ও যেভাবে আচরণ করছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে যে সে এটাই আশা করছে।” স্যান্ডেকার বললেন।

কারুথার্স আবার মাথা ঝাঁকালো। তারপর ও এমন একটা কাজ করলেন যেটায় স্যান্ডেকার খুশি হয়ে গেলেন, “আমি CIA-র সাথে যোগাযোগ করছি। দেখি ওরা এই হাতিটা সম্পর্কে আর কি জানে।”

স্যান্ডেকারের দাঁত বের হয়ে গেল, “দারুণ বুদ্ধি!”

.

৪২.

কায়রো

কার্ট একটা ভাড়া করা কালো গাড়ি চালাচ্ছে। পিছনে বসে আছে জো। পাশেই রেনাটা। হাতে একটা শটগান আর কোলের ওপর একটা আইপ্যাড। স্যাটেলাইট থেকে বিভিন্ন তথ্য আসছে ওটায়।

“ও সোজা সামনে এগুচ্ছে।” বলল রেনাটা।

“অথবা ওর ফোন এগুচ্ছে”, কার্ট জবাব দিল। একে তো রাস্তায় প্রচুর গাড়ি। সেগুলো আবার ঠিকমতো এগোয়ও না। আবার এদিকটায় রাস্তা ভরা খানাখন্দ। পুরোটাই চন্দ্র পৃষ্ঠের মতো অবস্থা।

মাল্টা থেকে যে স্যাটেলাইট ফোনটার হদিস ওরা পেয়েছিল সেটাই অনুসরণ করছে ওরা। ওদের ধারণা ওঠা হাসানের। কিন্তু চোখে দেখার আগ পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারছে না।

“আচ্ছা আমরা ওর ফোনটার সিগন্যাল ধরছি কীভাবে? আমিতো ভাবতাম স্যাটেলাইট যোগাযোগ বেশ নিরাপদ।” জো বলল।

রেনাটা ব্যাখ্যা করল, “আমরা যে স্যাটেলাইটটা অনুসরণ করছি ওটা আসলে সৌদি আর মিসরের যৌথ প্রকল্প। দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থাই এটা ব্যবহার করে। আর এটা মহাকাশে পাঠায় ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সী। উৎক্ষেপণের আগে স্যাটেলাইটটা একটা বিশেষ জায়গায় রাখা ছিল। সেখানে ওটাকে একটা রকেটের সাথে জুড়ে দেয়া হয়। আর তারও আগে ইউরোপের কোনো এক দেশের এক এজেন্ট বিনা অনুমতিতে যোগাযোগ ব্যবস্থাটায় সামান্য কারিগরি ফলায়।”

“এজন্যেই নিজেদের স্যালেটাইট নিজেদেরই উৎক্ষেপণ করা উচিত।” জো বলল।

“সবচেয়ে ভালো হয় সেই আগের মতো টিনের কৌটা আর তার ব্যবহার করলে, কার্ট বললো।

“এত হ্যাপা না করে ওকে ফোন করে থামতে বললেই তো হয়।” জো বলল।

“তাহলে লোকটা কোথায় যাচ্ছে কোনোদিন জানা হবে না। রেনাটা বলল।

“তা অবশ্য ঠিক।”

“বামে যান। ওটার গতি কমে আসছে।” রেনাটা বলল।

“কার্ট ঘুরতেই কারণটা বুঝতে পারলো। রাস্তার দুধারে লাইন ধরে দোকান আর রেস্তোরাঁ। পথচারীরা ফুটপাতে জায়গা না পেয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। গাড়ি-ঘোড়া তাই এখন শামুকের গতিতে এগুচ্ছে।

ওরাও সেভাবেই ধীরে এগুলো। ফুটপাত জুড়ে নানান রকম বিজ্ঞাপন, ফলের দোকান, গয়না, ইলেকট্রনিক্স থেকে শুরু করে বালিশ, কাথা কম্বলের দোকান পর্যন্ত আছে। রাস্তাটা পেরুতেই ওরা নীল নদের পূর্ব তীরের একটা ঘাটে এসে পৌঁছুলো।

ঘাটের একপাশে ক্রেন দিয়ে বজরা নৌকা থেকে ধান-চালের বস্তা খালাস করা হচ্ছে। পাশেই ফেরিতে গাড়ি আর লোজন উঠছে আরেকটু পরেই বেশ কয়েকটা মাছ ধরার নৌকা আর একটা প্রমোদ তরী দেখা গেল।

“নীল নদকে স্বাগতম!” কার্ট বলল, “কিন্তু ঐ ব্যাটা গেল কই?” রেনাটা আইপ্যাডের ডিসপ্লেতে স্পর্শ করে জুম করল। চলন্ত সংকেতটা তখনও ওই এলাকার মধ্যেই আছে। “দেখে তো মনে হচ্ছে নদীর দিকে যাচ্ছে।” বলল রেনাটা। তারপর নদীর দিকে নেমে যাওয়া একটা সিঁড়ির দিকে দেখালো। ওরাও নামলে সাথে সাথে। রেনাটা আইপ্যাডটা নিতে ভোলেনি। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামলো ওরা। কার্ট ঘাটলাটার এদিক ওদিক তাকিয়ে একদিকে দেখিয়ে বলল, “ঐ তো, ওটা নিশ্চিত হাসান।”

হাসান একটা গাঢ় ধূসর রঙের স্পিড বোটে চড়ে বসলো। দেখে মনে হচ্ছে দুনিয়ায় কোনো কিছুকেই সে আর পরোয়া করে না। ও বসতেই বোটটা চালু হয়ে ঘাট থেকে সরে গেল।

“আমাদেরও একটা নৌকা লাগবে।” রেনাটা বলল।

ওরাও একটা রঙচঙা পর্যটকদের নৌকার দিকে এগুলো। একপাশে লেখা “ওয়াটার ট্যাক্সি”। মাঝখানে থেকে শুরু করে পেছনের দিকটা পর্যন্ত একটা ক্যানভাস কাপড়ে ঢাকা। বোটের পাইলট পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে।

জো-ই এগুলো কথা বলার জন্যে। লোকটা ইংরেজি জানে।

“আমাদের একটা নৌকা দরকার।” বলল জো।

পাইলট ঘড়ি দেখে বলল, “সময় শেষ। বাড়ি যাবো এখন।”

কার্ট একতাড়া টাকা হাতে সামনে এগুলো, “আজ না হয় ওভার টাইম করেন।” লোকটা সাবধানে টাকাটার দিকে তাকাল। সম্ভবত ওখানে কতটাকা আছে গোনার চেষ্টা করছে। তারপর এক মুহূর্ত ভেবে সিগারেটটা পানিতে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে আসুন।”

ওরাও নৌকায় ওঠে ক্যানভাসের ছাউনির নিচে বসলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইঞ্জিন চালু হয়ে গেল।

“উজানে চালান।” কার্ট বলল।

ড্রাইভার মাথা ঝাঁকালো তারপর নৌকার মুখ ঘুরিয়ে গতি বাড়িয়ে দিল। নৌকার গতি দ্রুতই বেড়ে গেল। যদিও স্রোতের প্রতিকূলে চলছে। কার্ট, জো আর রেনাটা পুরোদস্তুর পর্যটকের অভিনয় করছে। ছবি তুলছে, নদীর দুই তীরের বিভিন্ন জিনিস একজন আরেকজনকে দেখাচ্ছে। কার্টতো একটা বাইনোকুলার পর্যন্ত চোখে লাগালো। তবে এর ফাঁকে ফাঁকেও আইপ্যাডে নজর ঠিকই রাখছে। সিগনালটাও ধীরে ধীরে নদীর উজানেই চলছে।

“কতদূর যাবেন আপনারা? লুক্সর?” মাঝি জিজ্ঞেস করল।

“যেতে থাকেন। কতদূর যাবো জানিনা। যখন মন চাবে তখন থামবো।” কার্ট জবাব দিল।

মাঝি আর কিছু বলল না। আশে পাশে প্রচুর বজরা নৌকা। একটা ফেরি দেখা গেল। বিনা কারণে হর্ণ বাজিয়েই যাচ্ছে।

নদীর দুধারে প্রাণের চিহ্ন মাত্র নেই। খালি সারি সারি দালান-কোঠা। অ্যাপার্টমেন্ট, হোটেল, অফিস দিয়ে ভরা।

একটু পরেই ওরা সিক্স অক্টোর ব্রিজ পেরিয়ে আসলো। ওপরে গাড়ি ঘোড়ার প্রচণ্ড আওয়াজ। হর্ণ বাজছে। গাড়ির ধোঁয়া ব্রীজ থেকে নিচে নেমে আসছে।

“নাহ! নৌ-বিহারটা ঠিক রোমান্টিক হলো না।” রেনাটা বলল, “আমি ভেবেছিলাম মাছ ধরার কাঠের নৌকা দেখবো, পালতোলা নৌকা দেখবো। লোকজনকে ছোট ছোট জাল দিয়ে মাছ ধরতে দেখবো।”

“একবার ম্যানহাটনের কাছে হাডসন নদীতেও সেটাই ভেবেছিলাম আমি। কায়রো শুধু মিসরের না, মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় শহর। আশি লক্ষ মানুষের বাস এখানে।

“যাই হোক, ভালো লাগল না।” রেনাটা জানালো।

“সামনে অবশ্য এতোটা আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। শুনেছি নাসের হ্রদে নাকি কুমিরও দেখা যায় আজকাল। তবে এতদূর যাওয়া লাগবে না আশা করি।” কার্ট কথা দিল।

“রোমান্স চান? তাহলে এদিকে দেখুন।” জো ডাক দিল।

একটু দূরেই শহরের কোলাহলের ওপর দিয়ে গিজার পিরামিডটা দেখা যাচ্ছে। বিকেলের আকাশে তখন কমলা রঙ ধরেছে আর পিরামিডগুলো দেখাচ্ছে চকচকে রুপালি। এই অনুজ্জ্বল আলোতেও ওটা জ্বলজ্বল করছে।

দৃশ্যটা দেখে রেনাটার দুঃখ আরো বাড়লো। “সবসময় ইচ্ছে ছিল কাছে থেকে পিরামিড দেখবো। বিল্ডিংগুলোর ওপর দিয়ে তো ঠিকমতো দেখাই যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে স্ফিংস-এর নাকের গোড়া থেকেই ওরা শহরটা বানানো শুরু করেছে।”

কার্টও অবাক হয়েছে ব্যাপারটায়, “ছোটবেলায় যখন এখানে এসেছিলাম, তখন বেয়ে বেয়ে একেবারে খুফু’ পিরামিডের মাথায় উঠে গিয়েছিলাম। তখন তো ওখান থেকে নদী পর্যন্ত কিছুই ছিল না। শুধু সারি সারি খেজুর গাছ দেখেছিলাম। আর ফসলের মাঠ।”

কার্টের মাঝে মাঝেই অবাক লাগে যে কখনো যদি এমন হয় যে পৃথিবীর প্রতি ইঞ্চি মাটি ইটের নিচে চাপা পড়ে গেল। ও বেঁচে থাকতে যেন এমনটা না হয়। প্রসঙ্গ বদলাতে জিজ্ঞেস করল, “আমাদের বন্ধুর কি অবস্থা?”

“এখনো দক্ষিণ দিকেই যাচ্ছে। তবে এখন সম্ভবত নদী পার হচ্ছে। অন্য পাড়ে যাবে।” রেনাটা নিচু স্বরে জানালো।

কার্ট শিস বাজিয়ে মাঝিকে ডাকলো তারপর আঙুল দিয়ে অপর পাড় দেখিয়ে বলল, “ঐ পাড়ে নিয়ে যান।”

মাঝি নৌকা ঘুরিয়ে সোজা অন্যপাড়ের দিকে রওনা দিল। দেখে মনে হবে ওরা সরাসরি পিরামিডের দিকে ছুটছে। পশ্চিম পাড়ের কাছাকাছি পৌঁছতেই প্রাচীন ধ্বংসাবশেষটার আড়ালে আকাশ ঢাকা পড়ে গেল। তবে আরো একটা নতুন জিনিস চোখে পড়ল। নদীর ধারেই বিশাল কিছু একটা বানানো হচ্ছে। ক্রেন, বুলডোজার, সিমেন্ট ট্রাকে এলাকাটা গিজগিজ করছে।

তীরের লম্বা একটা অংশ পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে।

কয়েকটা ভবন, পার্কিং স্পেস আর সামনে একটা পার্ক মতো এর মধ্যেই বানানো শেষ। পুরো জায়গাটা বেড়া দিয়ে ঘেরা। তাতে আরবি আর ইংরেজি দুই ভাষাতেই লেখা “ওসাইরিস কন্সট্রাকশন।”

মাটিতে যা বানানো হয়েছে সেটা অবশ্যই দারুণ সুন্দর, তবে কার্টের মনোযোগ কাড়লো নদীর একটা জিনিস।

ওরা যেখানে আছে ওখান থেকেই দেখা যাচ্ছে নদী থেকে ছোট্ট একটা খাল কাটা হয়েছে। খালটা কমপক্ষে একশো ফুট চওড়া আর আধা মাইল লম্বা। রেনাটার আইপ্যাডের স্যাটেলাইট ছবি দেখে আরো নিশ্চিত হওয়া গেল। খালটার দুপাশেই কংক্রিটের দেয়াল সেটাকে নদী থেকে আলাদা করে রেখেছে। দূর থেকেই তাতে পানির কলকল শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

“এটা আবার কী?” জো জিজ্ঞেস করল।

“দেখে তো মনটানার পানি শোধনাগারের মতো লাগছে।” কার্ট বলল।

“সঠিক উত্তরটা দিল নৌকার মাঝি। “পানি বিদ্যুৎ। ওসাইরিস পাওয়ার এন্ড লাইট বানাচ্ছে এটা।”

রেনাটা সাথে সাথেই নেটে সেটা নিয়ে ঘাটা শুরু করল। “মাঝি ঠিকই বলেছে। নেটে বলা হচ্ছে যে পানি নদী থেকে এই প্রণালিটায় জোর করে প্রবেশ করানো হয়। তার ফলে পানির নিচের টারবাইনগুলো ঘোরে আর বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। প্রতি ঘণ্টায় পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম এটা। ওদের ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে এরকম আরো ১৯টা প্রকল্প আছে ওদের। সবই নদীর তীরে। ভবিষ্যতে মিসরের বিদ্যুৎ নিয়ে আর সমস্যা হবে না।”

“বুদ্ধিটা খারাপ না। বড় বড় বাধ দিলেই আনুষঙ্গিক সব ঝামেলা কমে যায়। আর নদীর ক্ষয়ক্ষতিও তখন আর চোখে পড়ে না।” জো বলল।

কার্টও একমত। দ্রুত একবার নজর বুলাতেই ওর মনে হলো ওরা রোমান জাহাজটা উদ্ধারের সময় বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে উপায় অবলম্বন করেছিলো এটা অনেকটা সেরকম-ই। কিন্তু কিছু একটা ঘাপলা আছেই। মিনিট খানেকের মধ্যেই সেটা ধরতে পারলে ও, “কিন্তু তাহলে প্রণালির শেষে জল প্রপাতের দরকারটা কী?”

“আমি কোনো জলপ্রপাত দেখতে পাচ্ছি না।” রেনাটা বলল।

“নায়াগ্রা ফলস খুঁজলে তো পাবেন না। ভালো করে দেখুন। নদীর পানির উচ্চতা আর প্রণালি থেকে বেরিয়ে আসা পানির উচ্চতায় ফারাক আছে। কমপক্ষে কয়েক ফুট।” রেনাটা আর জো দুজনেই চোখ বড় বড় করে দেখার চেষ্টা করল ব্যাপারটা।

“তোমার কথাই ঠিক। পানি নিচে নামছে। ওই প্রণালির ভেতরে ঢোকার পর মনে হচ্ছে যে পানির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।” জো বলল।

“বাধ দিলে কী এরকম হয় নাকি?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

“আমার ধারণা এখানে কোনো বাঁধই নেই। কার্ট জবাব দিল। “প্রবাহী পদার্থের ধর্ম অনুযায়ী ঐ প্রণালি আর নদীর পানির উচ্চতা একই হওয়ার কথা। শুধু সেটাই না, প্রণালির পানির স্রোত নদীর স্রোতের চেয়ে কম হবে। কারণ প্রণালির পানিকে বিশাল বিশাল টারবাইনে বাধা পেয়ে পেয়ে তারপর আসতে হচ্ছে। এত বড় প্রকল্পে সাধারণত দেখা যায় পানি উল্টো দিকে বইছে। এরকম এতো বেশি পানি আসে না কখনো।

“হতে পারে যে ওরা হয়তো পানির গতি বাড়ানোর কোনো উপায় বের করেছে”, জো বলল।

“হতে পারে। যাই হোক সেটা আমাদের সমস্যা না।” বলে কার্ট রেনাটার দিকে ফিরলো। “আমাদের বন্ধু এখন কোথায়?”

“আমার মনে হচ্ছে এটাই আমাদের সমস্যা। ও ঠিক নির্মাণাধীন ভবনটার পাশেই নেমেছে। সম্ভবত মেইন বিল্ডিংটায় ঢুকবে।” রেনাটা ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে বলল।

কার্ট একটা ছোট্ট বাইনোকুলার চোখে তুললো। এতো দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে যে, এলাকাটার সিকিউরিটি খুব কড়া। কুকুর হাতে গার্ডরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। গেট দিয়ে ঢোকার সময় প্রতিটা গাড়ি তল্লাসী করা হচ্ছে। দেখে তো মনে হচ্ছে আর্মি ক্যাম্প।”

“হুম, যেন, একটা দুর্গ। আর আমাদের বন্ধু হাসান ওতেই আশ্রয় নিয়েছে।” জো বলল।

“এখন?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

“ওসাইরিস ইন্টারন্যাশনাল সম্পর্কে যতটা সম্ভব জানতে হবে। আর হাসান যদি শীঘ্রই ফিরে না আসে তাহলে আমাদেরকেই ভেতরে ঢোকা লাগতে পারে। কার্ট বলল।

“এটা কিন্তু মাল্টার জাদুঘরে ঢোকার মতো অতো সহজে হবে না।” সাবধান করল রেনাটা।”

“আমাদের ওখানে ঢোকার জন্যে শুধু একটা অফিসিয়াল অজুহাত দরকার। সরকারি কোনো কিছু হলে ভালো হয়। আপনার AISE-এর বন্ধুরা একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবে নাকি?” কার্ট বলল।

রেনাটা মাথা নাড়লো। “আপনাদের দেশের ইরানে যেটুকু প্রভাব আছে আমাদেরও এখানে সেরকম-ই। হবে না।”

“তাহলে আর কি। বরাবরের মতো আমরা আমরাই।”

“সম্ভবত না।” জো দাঁত বের করে বলল, “আমার পরিচিত একজন বোধহয় সাহায্য করতে পারবে। মিসরের সরকারি আমলা একজন। একবার তার বড় উপকার করেছিলাম।”

“আশা করি, বড় কিছুই করেছিলেন।” রেনাটা বলল।

“শুধু বড় না, সবচেয়ে বড়।” জো বলল।

রেনাটা কিছুই বুঝলো না কিন্তু কার্ট ধরতে পেরেছে জো-এর কথা। ও ভুলেই গিয়েছিল যে জো মিসরের একজন জাতীয় বীর। অর্ডার অফ নাইল খেতাব প্রাপ্ত গুটি কয়েক বিদেশিদের একজন। ও সম্ভবত যা চাবে তা-ই পাবে। “মেজর ইদো।” কার্ট বলল। এই লোকটাকেই জো সাহায্য করেছিল।

“ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে প্রমোশন হয়েছে তার। আমার জন্যেই।” জো বলল।

“এজন্যই কী উনি আপনাকে সাহায্য করবেন?” রেনাটা জিজ্ঞেস করল।

জবাব দিল কার্ট। “আরে উনি তো উনি। আপনি এখন যার দিকে তাকিয়ে আছেন সে আস্বান বাধকে রক্ষা করে পুরো মিসরকে ডুবে মরার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল।”

“ওমা! ওটা আপনি?” রেনাটা হতবাক। ঘটনাটা তখন সারা বিশ্বেই আলোড়ন তুলেছিল।

“একা একা তো আর পারিনি। কিছুটা সাহায্য তো লেগেছিলই। জো বলল।

রেনাটা হাসল, “কিন্তু আপনিই ছিলেন আসল।”

জো মাখা ঝাঁকালো।

“আমি আসলেই কি বলবো বুঝতে পারছি না। আশা করি এ যাত্রায় আমরা আপনার কিছুটা সাহায্য’ হতে পারবো।” রেনাটা বলল।

কার্টও সেটাই ভাবছিল। তারপর নৌকার মাথায় মাঝির কাছে গিয়ে বলল, “আমাদের ঘোরা শেষ। ফিরে চলেন।”

নৌকা ঘুরে গেল। এখন হাসান বিল্ডিংটা থেকে বের হওয়ার আগেই ওদেরকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইদোকে খুঁজে বের করতে হবে।

.

৪৩.

জো বসে আছে এক গদি-আটা নরম চেয়ারে। শহরতলীতেই একটা অফিসে এসেছে ও। আধুনিক সাজসজ্জা। ঝলমলে আলো আর হাল্কা সংগীত থেকেই বোঝা যায় অফিসের মালিক সফল একজন মানুষ। ওর মেজর ইদোর সাথে প্রথম সাক্ষাতের কথা মনে পড়ল। সেটা ছিল বেশ কয়েক বছর আগে, এক ইন্টারোগেশন রুমে। আর ভাগ্যটাও সেদিন ওর পক্ষে ছিল না।

“হুম, দেখে মনে হচ্ছে আপনি আর সেনাবাহিনীতে নেই।” জো বলল।

ইদোর চুল এখন আগের চেয়ে লম্বা। সামরিক পোশাক ছেড়ে কেতাদুরস্ত জামাকাপড় পরায় ওর ক্লার্ক গ্যাবেল-এর মতো চেহারাটা আরো খোলতাই হয়েছে।

“বিজ্ঞাপন। এখন আমি এই জগতের লোক। এটাই আরো বেশি মজার। আর আমার সৃজনশীলতা প্রকাশের এটাই সবচেয়ে বড় সুযোগ করে দিচ্ছে।” শিল্পীর তুলি চালানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল ইদো।

“সৃজনশীলতা?”–জো জিজ্ঞেস করল।

“অবাক হওয়ারই কথা। মিলিটারি লোকজনের মধ্যে এই জিনিসটা থাকে বললেই চলে।”

জো দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “যাই হোক। যা করছেন তাতেই আমি খুশি। শুধু অবাক হলাম এই যা। কিন্তু হয়েছিল কী? আপনি জেনারেল হয়েছিলেন শুনেছিলাম?”

ইটো চেয়ারে হেলান দিয়ে কাঁধ ঝাঁকালো, “পরিবর্তন, বড় সড় কয়েকটা পরিবর্তন হয়ে গেল। প্রথমে হলে আন্দোলন। তারপর মারামারি, তারপর বিপ্লব। আমাদের সরকার পতন হলো। নতুন সরকার আসলো। তারপর আবার বিক্ষোভ শুরু হলো আর এই সরকারের পতন হলো। তারপরে মিলিটারিতে শুদ্ধি অভিযান চালানো হলো। আমাকে পেনশন ছাড়াই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।”

“আর আপনি তখন বিজ্ঞাপন ব্যবসা শুরু করেছেন?”

“আমার দুলাভাই এই ব্যবসা করে ভালোই কামিয়েছেন। অবস্থা এমন সবাই-ই কিছু না কিছু বিক্রি করতে চায়।”

জো ভাবছে ইদো কি এখনও ওদেরকে সাহায্য করতে পারবে কি-না।

“আমি আরো ভাবছিলাম আপনি আমার সাথে ওসাইরিস কন্সট্রাকশনের হোমরা-চোমরা কারো সাথে দেখা করিয়ে দিতে পারবেন।”

ইদো সামনে ঝুঁকে এলো। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে গিয়েছে, “ওসাইরিস?” খুব সাবধানতার সাথে উচ্চারণ করল শব্দটা। “নতুন কী ঝামেলায় জড়িয়েছেন আপনি?”

“আসলে বলাটা মুশকিল।” জো বলল।

ইদো ড্রয়ার খুলে এক প্যাকেট সিগারেট বের করলো। তারপর সেটা ধরিয়ে হাতে রেখেই এদিক সেদিক নাড়তে লাগল কিন্তু টান দিল না। আগেও এই অভ্যাসটা ছিল তার।

“আপনার জায়গায় আমি থাকলে ওসাইরিসকে নিয়ে ঘাটাঘাটি করতাম না।” ইদো সাবধান করলেন।

“কেন? কারা ওরা?” জো বলল।

“ওরা কারা না, সেটা হচ্ছে কথা। ওরা হলো গুরুত্বপূর্ণ সবাই।” ইদো জবাব দিলেন।

“আরেকটু খোলাসা করে বললে ভালো হয়।” ভজা বলল।

“আগের বিপ্লবের সময় যাদেরকে সেনাবাহিনী থেকে ছাটাই করা হয়েছিল তারা মিলে বানিয়েছে এটা। সেই ১৯৫২ সাল থেকে সেনাবাহিনীই মিসরের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। ওরাই ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের ডান হাত। নাসের ছিল মিলিটারি, সাদাত ছিল মিলিটারি, মুবারকও মিলিটারি। তাঁরাই সব চালাচ্ছে। তবে ভেতরের কাহিনী আরো গভীর। মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স বলে একটা কথা আছে শুনেছেন তো? মিসরে সেই ব্যাপারটাকে একটা নতুন রূপ দেয়া হয়েছে। এখানকার বেশির ভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেরই মালিক ছিল মিলিটারির লোক। তারাই ঠিক করতো কাকে চাকরি দেবে। ওরাই বন্ধুদের পুরস্কার দিত। শত্রুদের সাজা দিতো। কিন্তু বিপ্লবের পর থেকে ব্যাপারগুলো অনেকটাই বদলে যায়। ফলে চাইলেও আর আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। সেখান থেকেই ওসাইরিসের জন্ম। তারেক সাকির নামের এক লোক চালায় এটা। উনি আগে গোয়েন্দা পুলিশের কর্ণেল ছিলেন। বর্তমানে দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখেন উনি। কিন্তু উনি জানেন যে ওনার অতীত সেটা হতে দেবে না। তাই অন্যদের সহায়তা নিয়ে এই বাঁকা রাস্তা ধরেছেন। ওসাইরিস মিসরের সবচেয়ে শক্তিশালী সংস্থা। সব কাজের ঠিকাদারি ওরা পায়। শুধু সরকারি না বেসরকারিগুলোও। সবাই ওদেরকে ভয় পায়। এমনকি ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরাও।”

“তার মানে সাকির রাজা বানায় কিন্তু নিজে রাজা না।” জো বলল।

ইদো মাথা ঝাঁকালো। “সে কখনোই আড়াল থেকে সামনে আসবে না কিন্তু এর মধ্যেই দেশে বা দেশের বাইরে তার ব্যাপক ক্ষমতা। লিবিয়া, তিউনিসিয়া আর আলজেরিয়াতে কি হয়েছে তা তো দেখেছেনই।”

“হ্যাঁ।” জো বলল।

“ওসব দেশের নতুন সরকারের সব লোকই সাকিরের বন্ধু। ওর সহচর।” ইদো বললেন।

“শুনেছি ওরাও নাকি বিপ্লবের আগে যার যার দেশে ক্ষমতাসীন ছিল।” জো বলল।

“হ্যাঁ। দুয়ে দুয়ে চারটা কীভাবে মিলছে বুঝছেন আশা করি।”

জো স্পষ্ট বুঝতে পারছে প্রতি পদক্ষেপে ওরা ওদের ধারণার চেয়েও গভীর কিছু একটায় ঢুকে পড়ছে। ঠিক যেন ওরা ছোট একটা মাছ বঁড়শিতে গেঁথেছে আর সেটা আবার খেয়েছে আরেকটু বড় একটা মাছ। এখন বিশাল একটা হাঙ্গর বড় মাছটাকে তাড়া করছে।

ইদো-ই কথা বললেন আবার, “ওসাইরিসের নিজস্ব সেনাবাহিনী আছে। মিসরের সেনাবাহিনী বা স্পেশাল ফোর্স বা গোয়েন্দা পুলিশের গুপ্তঘাতকদের মধ্য থেকে তাদের বাছাই করে নেয়া হয়। সরকারি মিলিটারিতে যারা ব্রাত্য হয়ে পড়ে তারা সবাই যোগ দেয় ওসাইরিসে।”

জো কপাল ঘষলো। “কিন্তু আমাদের ঐ বিল্ডিংটার ভেতরে যাওয়াটা জরুরি। আর আমন্ত্রণ পেয়ে ওটার ভেতর যাওয়ার মতো সময়ও নেই। হাজার হাজার মানুষের জীবন-মরণ নির্ভর করছে এর ওপর।”

ইদো অ্যাশট্রেতে সিগারেটের ছাই ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি শুরু করলেন। জো’র মনে হলো ইদো’র দৃষ্টিতে কেমন একটা পরিবর্তন হয়েছে। অনেক হিসেবী সে দৃষ্টি। ইদো দেয়ালে হাত রেখে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দেখে মনে হচ্ছে এই অফিসের চার দেয়ালের মধ্যে উনি আটকা পড়ে গিয়েছেন। কিন্তু তার মতো মানুষকে শুধু চার দেয়ালের মাঝে মানায় না।

দীর্ঘক্ষণ পর তিনি জোর দিকে ফিরলেন, “ওসাইরিসের শত্রুদের সাহায্য করা আর নিজের পায়ে কুড়াল মারা একই কথা। তবে আপনার কাছে আমি ঋণী। মিসর আপনার কাছে ঋণী।” তারপর সিগারেটের গোড়াটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে বললেন, “আর তাছাড়া এই ব্যবসাটা আমার পোষাচ্ছে না। দুলাভাইয়ের অধীনে কাজ করাটা যে কত ঝামেলার তা আপনাকে বলে বোঝানো যাবে না। আর্মির চেয়েও খারাপ।”

জো হাসলো, “সাহায্যের জন্যে চির কৃতজ্ঞ থাকব।”

ইদো মাথা ঝাঁকালেন, “তা কীভাবে আপনারা ওসাইরিসের বিল্ডিংয়ে ঢুকতে চাচ্ছেন? সরাসরি আক্রমণ বা হেলিকপ্টার থেকে লাফিয়ে নামা নিশ্চয়ই সম্ভব না।”

জো রিসেপশনে বসা কার্ট আর রেনাটার দিকে ইঙ্গিত করল। ওরা কম্পিউটারে ডাউনলোড করা ম্যাপ আর নকশায় চোখ বুলাচ্ছে। “আমি এখনো জানিনা, আমার বন্ধুরা নিশ্চয়ই এতোক্ষণে কিছু একটা উপায় বের করে ফেলেছে। শুনে দেখি আগে।”

ইদো হাত নেড়ে ওদেরকে ডাকলো। পরিচিতি পর্বের পরেই ওরা আসল কথায় চলে এলো।

“আমার সহকর্মীরা আমাকে ওসাইরিস প্লান্টের একটা নকশা পাঠিয়েছে।” রেনাটা বলল। তারপর সামনে এগিয়ে আইপ্যাডটা ডেস্কের ওপর রাখলো যাতে সবাই দেখতে পায় ঠিক মতো। “যদি এই নকশাগুলো ঠিক হয় তাহলে একটা পথ বোধহয় পাওয়া গিয়েছে।”

কয়েকবার স্ক্রিনে স্পর্শ করতেই একটা হাই-রেজুলুশন ছবি ফুটে উঠল। নদীসহ বিল্ডিংটার আশপাশ দেখা যাচ্ছে তাতে। “রাস্তার দিকে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় আছে। ওদিক দিয়ে ঢাকা তাই মোটামুটি অসম্ভব। তার মানে আমাদের একমাত্র উপায় হলো নদীর দিক থেকে ঢোকা। আমাদের একটা নৌকা লাগবে। সাথে তিনজনের জন্য ডুবুরির সরঞ্জাম আর একটা মধ্যম তরঙ্গের লেজার গান–সবুজ হলে সবচেয়ে ভালো হয়। তবে মিলিটারীরা টার্গেটিংয়ের জন্যে যে লেজার ব্যবহার করে সেরকম হলেই চলবে।”

ইদো মাথা ঝাঁকালো, “আমি ওগুলো ব্যবস্থা করতে পারবো। তারপর?”

কার্ট বলা শুরু করল এরপর, “আমরা নৌকায় করে এই জায়গাটায় যাব। এটা হচ্ছে বিল্ডিংটার প্রায় আধা মাইল দক্ষিণে। আমি, রেনাটা আর জো পানিতে নেমে পশ্চিম তীর ঘেষে এগুবো। তারপর প্রণালিটায় ঢুকে, প্রথম ধাপের টারবাইনগুলো পার হয়ে, দ্বিতীয় স্তরের টারবাইনগুলোর ঠিক আগে… এখানে এসে পৌঁছুবো।”

“শুনতে তো সহজ-ই লাগছে, ইদো বলল।

“আমি নিশ্চিত ঝামেলা বাধবেই।” জো বলল।

“অবশ্যই।” বলল কার্ট। তারপর রেনাটার দিকে ফিরলল, “নশাটা আর একবার বের করুন তো।”

রেনাটা আবারও ফোনে স্পর্শ করতে পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্লুপ্রিন্টটা দেখা গেল।

“এই প্রণালিটায় ঢুকতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই আমাদেরকে এই টারবাইনগুলো পার হতে হবে। যেহেতু তখন রাত। তাই ধারণা করছি যে তখন ওরা খুব বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন করবে না, তবে সেটা যে কোনো মুহূর্তেই পরিবর্তন হতে পারে। আর যদিও স্টেশনটা থামানো থাকবে, টারবাইনগুলোর ঘোরা কিন্তু থামবে না।”

“ওগুলোর গায়ে লাগা চলবে না, তাই তো?” জো বলল।

“হ্যাঁ। আর সেটা করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো ভেতরের দেয়ালের দিকে থাকা। প্রথম টারবাইনের আশেপাশে অনেক ফাঁক আছে। একবার ওগুলোকে পেরুতে পারলেই আমরা পরের টারবাইনগুলোর দিকে এগুবো। তারপরেই শুরু হবে আসল খেলা।”

নকশাটা দেখে জো দুটো জিনিস খেয়াল করেছে। দুই নম্বর টারবাইনটা প্রথমটার চাইতে বড়। আর ওটার কিনার বরাবর দেয়াল থেকে খানিকটা অংশ বের হয়ে আছে। দেশে অনেকটা পিনবল মেশিনের ফ্লিপারের মতো মনে হয়। ও ওগুলোর দিকে দেখালো।

“ডিফ্লেকটর গেট। এগুলো থাকলে টারবাইনের দিকে আরো বেশি পানি প্রবাহিত হয়। যখন বেশি বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় তখন এগুলো কাজে লাগে।” বলল কার্ট। যখন ভেতরে ঢোকানো থাকে তখন এগুলো দেয়ালের সাথে মিশে থাকে আর তখন খানিকটা পানি দেখা যায় টারবাইনের পাখায় না লেগেই চলে আসে। আর যখন ওগুলো ভোলা থাকে তখন ওগুলোর প্রান্ত একেবারে টারবাইনের মাঝ পর্যন্ত চলে আসে। এগুলো ছাড়া ঐ টারবাইনের কাছে যাওয়া সম্ভব না। তবে পাখার কাছে যাওয়ার আগেই আমরা পানি থেকে বের হয়ে আসবো।” তারপর নকশার একটা জায়গা দেখিয়ে বলল, “এখানে একটা মেইনটেন্যান্স সিঁড়ি আছে। গেটের একপাশে ঝালাই করে লাগানো। আমরা দেয়ালের ধার ঘেষে সাঁতরাবো তারপর এটা ধরে উঠে যাবে।”

“যতক্ষণ গেটটা বন্ধ থাকছে, ততোক্ষণতো কোনো ঝামেলা নেই কিন্তু যদি ওটা সামনে বেরিয়ে আসে তখন পানির স্রোতের কী হয়?” জো জিজ্ঞেস করল।

“পুরোটা খোলা থাকলে পানির স্রোত দ্বিগুণ হয়ে যায় আর আর মোট শক্তির পরিমাণ নির্ভর করে নদীতে পানির পরিমাণের ওপর। বছরের এই সময়টায় সাধারণত এটা দুই নটের মতো হয়।”

“দুই নটে সমস্যা হবে না, তবে চার নটে হবে।” জো বলল।

কার্ট মাথা ঝাঁকালো। এটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে।

জো ব্যাপারগুলো আবার চিন্তা করল। মাঝরাতে কোনো স্টেশনে পূর্ণ শক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কোনো কারণই নেই। সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা লাগে বিকেল বেলায়।

টারবাইনে কাটা পড়ে ভর্তা না হয়ে যদি পানির ওপরে উঠতে পারি, তাহলে শুরু হবে আসল সমস্যা।” কার্ট বলল।

“চারপাশে অবশ্যই ক্যামেরা থাকবে।” ইদো মনে করিয়ে দিল। রেনাটা জবাব দিল এবার, “হ্যাঁ আছে। এখানে আর ওখানে। কিন্তু এই ক্যামেরা দুটোর মুখ আরেক দিকে ঘুরানো। কেউ বিল্ডিংটার দিকে আসছে কি-না সেটা দেখার জন্য। একবার প্রথম টারবাইনগুলো পার হতে পারলেই মাত্র একটা ক্যামেরা নিয়েই চিন্তা থাকবে। এটা এখানে লাগানো।” আরেকটা জায়গা দেখালো রেনাটা। এটায় দেওয়ালের পাশের পুরো ফুটপাতটাই দেখা যায়। আর এই ফুটপাতটাই আমাদেরকে ব্যবহার করতে হবে।”

“আর এজন্যেই লেজারটা দরকার।” ইদো বললেন।

“হ্যাঁ। একটা লেসারই পারে সেন্সরগুলোকে ওভারলোড করতে। আর এটা হবে আপনার দায়িত্ব। নদীর ওপাড়েই সামান্য উজানে একটা বালিয়াড়ি আছে। ওখান থেকেই সবচে ভালো পারবেন। একবার ঠিকমতো লেজারটা তাক করতে পারলেই সেন্সরগুলো ঠিকমত সংকেত দিতে পারবে না। আর ওরা একটা খালি স্ক্রিন বাদে আর কিছু দেখবে না।” ওর কথার খেই ধরলো কার্ট। “আর একবার ক্যামেরা কাজ করা বন্ধ হলেই আমরা পানি ছেড়ে উঠে যেতে পারবো। তারপর এই ফুটপাত ধরে এই দরজা দিয়ে ঢুকবো।”

“লেজারটা কতক্ষণ ধরে রাখতে হবে?”

“দুই মিনিটেই কাজ হয়ে যাবে।” রেনাটা জবাব দিল।

“আর ভেতরের সিকিউরিটি ক্যামেরা বা অ্যালার্মের কী হবে?” ইদো জিজ্ঞেস করলেন।

“ভেতরে ঢুকলে আমি ওগুলোর ব্যবস্থা করতে পারবো।” রেনাটা বলল। “ক্যামেরা আর অ্যালার্ম দুটোই হালিফ্যাক্স নামের একটা সফটওয়্যার দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আমাদের টেকনিক্যাল সেকশনের লোকজন আমাকে ওটা হ্যাঁক করা শিখিয়ে দিয়েছে।”

রেনাটা এবার ভেতরের বিল্ডিংয়ের নকশাটা বের করল, “হাসান এই দরজাটা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছে। এই করিডোরে আসার আগ পর্যন্ত ভালোই সিগনাল পাচ্ছিলাম, তারপর সম্ভবত এই এলিভেটরে ওঠে। তারপরই সিগনাল দুর্বল হতে হতে একসময় আর পাওয়া যায়নি। এ থেকে ধারণা করছি যে সে নিচের দিকে নামে, ওপরে না। তার মানে সম্ভবত ও এখন এই পাওয়ার জেনারেশনের কন্ট্রোল রুমে আছে।”

“আপনি কী নিশ্চিত যে এটা একটা ফাঁদ না?” ইদো জিজ্ঞেস করলেন। “এখানে একবার ঢুকলে কিন্তু দুনিয়ার কারো পক্ষেই আর আপনাদের সাহায্য করা সম্ভব হবে না।”

“জানি।” বলল কার্ট। “তবে বিশ্বাস করুন আমি বহু ভেবেও বের করতে পারছি না। কেন হাসান ওখানে বসে বসে কতখানি বিদ্যুৎ উৎপাদন হলো সেটা দেখছে। কিন্তু সিগনাল আসা বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত ওখান থেকেই সর্বশেষ সিগনালটা আসে। আর যদি ওখানে ও নাও থেকে থাকে ওসাইরিসের অবশ্যই ওখানে কিছু একটা আছে। তার মানে একবার জায়গাটা ঘুরে আসলে ক্ষতি নেই।”

“বলিহারি সাহস আপনাদের! তা আপনারা ভেতরে ঢোকার পর আমি কী করবো?” ইদো জিজ্ঞেস করলেন।

“নদীর ভাটিতে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবেন। যদি আমরা হাসানকে খুঁজে পাই তাহলে তাকে ধরে আনবো, আর যদি না পাই জায়গাটা ঘুরে টুরে দেখে বাড়ি ফিরে আসবো।”

.

৪৪.

কয়েক ঘণ্টা পর আবার ওরা নীলনদে নৌকা ভাসালো। নৌকাটা ইদোর এক বন্ধুর। তিন জনের জন্য ডুবুরির সরঞ্জাম আর একটা ট্রাইপডে বসানো লেজারও জোগাড় হয়েছে।

ইতোমধ্যে চারদিকে আঁধার জেকে বসেছে ভালোভাবেই। তাই নদীর দুধারে দিনের মতো একদমই ভিড় নেই। আকাশে চাঁদ নেই তবে দুধারের উঁচু উঁচু অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের আলো পড়ে নদীর পানি ঝিকমিক করছে।

ওসাইরিস কর্পোরেশনের কাছাকাছি পৌঁছতেই কার্ট নদীর ভাটিতে তাকাল। “প্রণালির শেষ মাথায় এখন পানি আস্তে আস্তে বইছে।”

“তার মানে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে।” রেনাটা বলল।

“যাক বাচলাম।” বলল জো।

“যদি এখনো একটা ব্যাপার বুঝে আসছে না। তবে পানি শান্ত থাকায় প্রণালিতে ঢোকা আর বিল্ডিংটার ভেতরে অনুপ্রবেশ সহজ হবে। কার্ট বলল।

জো একটা নাইট ভিশন স্কোপ দিয়ে প্রণালিটা পরীক্ষা করে বলল, “সম্ভবত গেটগুলো এখন বন্ধ-ই আছে।”

ইদে নৌকাটা আরো উজানে নিয়ে আসলেন তারপর দিক বদলে পশ্চিম তীরের দিকে এগোলেন। নৌকাটা জায়গা মতো পৌঁছতেই কার্ট, জো আর রেনাটা পানিতে নামার জন্য রেডি হয়ে গেল।

আসার আগেই ওরা কাপড়ের নিচে কালো রঙের ডুবুরির পোশাক পরে নিয়েছিল। ঝটপট তাই ওপরের কাপড় খুলে প্লবতা প্রতিরোধী কমপ্রেসর। BCD (Buayancy Control Device); অক্সিজেন ট্যাঙ্ক ইত্যাদি জায়গা মতো পরে নিলো। তারপর সব চেক করে দেখলো ঠিকঠাক চলছে কি-না। অক্সিজেনের সিলিন্ডারগুলো বেশি চকচকে না, তার ওপর রঙ করা আছে। তাই ওটায় বেশি পানি প্রতিফলিত হবে না। মাছের লেজের মতো ফিন পরেছে পায়। কয়েকটা ওয়াটার প্রুফ ব্যাগও নিয়েছে আর আছে কয়েকটা লাইট। পানির নিচে কে কোথায় আছে তা দেখতে কাজে লাগবে এটা।

.

৪৫.

রাতের বেলা পানিতে ডুব দেয়া খুবই কঠিন কাজ। এমনকি সর্বোচ্চ অনুকূল পরিস্থিতিতেও। আর যদি তীব্র স্রোত, পাথর আর বালির চাকা ভরা একটা নদীর তল দিয়ে সাঁতরানো লাগে তাহলে তো কথাই নেই। তবে যতক্ষণ ওরা পশ্চিম তীরের কাছ