- বইয়ের নামঃ ট্রেজার
- লেখকের নামঃ ক্লাইভ কাসলার
- প্রকাশনাঃ রোদেলা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রহস্য, গোয়েন্দা কাহিনী
ট্রেজার
০১. আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগার
ট্রেজার – ক্লাইভ কাসলার
অনুবাদ : মখদুম আহমেদ
লেখকের বক্তব্য
আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব সত্যিই ছিল। যুদ্ধ এবং ধর্মীয় হানাহানির কারণে তা ধ্বংস না হলে প্রাচীন মিসর, গ্রিক এবং রোমান সাম্রাজ্যের বহু তথ্য আজ আমাদের জানা থাকত। শুধু তা-ই নয়, ভূমধ্যসাগরের তীর ছাড়িয়ে বহু দূরে একসময়ে প্রতিষ্ঠিত অনেক অজানা সভ্যতার কথাও জানা যেত। তিনশো একানব্বই খ্রিস্টাব্দে সম্রাট থিওড়োসিয়াস-এর নির্দেশে আলেকজান্দ্রিয়ার সমস্ত পুস্তক, শিল্পকর্ম, মহান গ্রিক দার্শনিকদের মূল্যবান বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কথিত আছে, বেশ কিছু পরিমাণ সংগ্রহ গোপনে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল তখন। কী কী উপকরণ সরিয়ে নেয়া হয়েছিল, রাখাই বা হয়েছে কোথায়; আজ ষোলোশো শতাব্দী পরেও তা এক রহস্য।
.
.
পূর্বকথা
পনেরোই জুলাই, তিনশো একানব্বই খ্রিস্টাব্দ।
অজানা কোনো স্থান।
গভীর কালো সুড়ঙ্গপথে ছোট্ট, কাঁপা কাঁপা একটা আলো ভুতুড়ে আবহ তৈরি করেছে। লোকটার পরনে আঁটো জামা, উল দিয়ে বোনা, নেমে এসেছে হাঁটু পর্যন্ত। থামল সে, হাতের কুপিটা মাথার ওপর উঁচু করে ধরল। ছোট্ট শিখার আভায় আলোকিত হয়ে উঠল মানুষের একটা দেহ, স্বর্ণ আর স্ফটিকের তৈরি একটা বাক্সের ভেতর রয়েছে ওটা। পেছনের মসৃণ দেয়ালে নৃত্য করছে কিম্ভুতকিমাকার ছায়াগুলো। আঁটো জামা পরা জুনিয়াস ভেনাটর দৃষ্টিহীন চোখজোড়ার দিকে কয়েক মুহূর্ত নীরবে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর কুপি নামিয়ে আরেক দিকে ঘুরলেন।
দীর্ঘ এক সারিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিশ্চল মূর্তিগুলো যেন মৃত্যুপুরীর নিস্তব্ধতার ভেতর; সংখ্যায় এত বেশি যে গুনে শেষ করা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ।
হাঁটতে শুরু করলেন জুনিয়াস ভেনাটর, অমসৃণ মেঝেতে তার পায়ের ফিতে বাঁধা স্যান্ডেল খসখস আওয়াজ তুলল। ক্রমে চওড়া হয়ে বিশাল এক গ্যালারিতে মিশেছে। সুড়ঙ্গপথটা। গম্বুজ আকৃতির সিলিংটাকে অবলম্বন দেয়ার জন্য খিলান তৈরি করায় প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচু গ্যালারি কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। খানিক পর পর দেয়ালের চুনাপাথর কেটে একটা করে লম্বা ও গভীর দাগ টানা হয়েছে, ওগুলো দিয়ে ছাদের পানি নেমে এসে মেঝের চওড়া নর্দমায় পড়ে। দেয়ালের গায়ে বিভিন্ন আকৃতির গর্ত প্রতিটিতে অদ্ভুতদর্শন, গোলাকৃতি পাত্র, ব্রোঞ্জের তৈরি। খোদাই করা বিশাল এই গুহার মাঝখানে একই আকৃতির বড় বড় কাঠের বাক্সগুলো না থাকলে ভীতিকর জায়গাটাকে রোমের নিচে পাতাল সমাধিক্ষেত্র বলে ভুল হতে পারত।
শেষ প্রান্তে তামার পাতে মোড়া ফিতে রয়েছে প্রতিটি বাক্সের সাথে, পাতগুলোয় বাক্সের নম্বর লেখা। প্যাপিরাস খুলে কাছাকাছি একটা টেবিলে সমান করলেন ভেনাটর, তাতে লেখা নম্বর তামার পাতে লেখা নম্বরের সাথে মেলালেন। বাতাস শুকনো আর ভারী, ঘামের সাথে ধুলো মিশে কাদার মতো জমছে গায়ে। দুঘন্টা পর সম্রষ্ট বোধ করলেন তিনি, প্রতিটি জিনিসের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। প্যাপিরাসটা গুটালেন, কোমরে জড়ানো কাপড়ের ভাঁজে ঢুকিয়ে রাখলেন সেটা।
ঘুরে ঘুরে গ্যালারির চারদিকে সাজানো সংগ্রহগুলোর দিকে আরেকবার তাকালেন ভেনাটর, অতৃপ্তির একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার বুকের ভেতর থেকে। জানেন, এসব আর কোনো দিন তার দেখা বা ছোঁয়ার সুযোগ হবে না। ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘুরলেন তিনি, হাতের কুপিটা বাড়িয়ে ধরে এগোলেন ফিরতি পথে।
বয়স হয়েছে ভেনাটরের, কিছুদিনের মধ্যে সাতষট্টিতে পড়বেন। মুখের অনেক ভাঁজ আর রেখা ফুটেছে, ক্লান্ত চরণে আগের সেই ক্ষিপ্রতা নেই, বেঁচে থাকার আনন্দ এখন আর তিনি তেমন উপভোগ করেন না। তবে অনেক দিন পর আজ তার সত্যি ভারি আনন্দ হচ্ছে, তৃপ্তি আর সন্তুষ্টির একটা অনুভূতি প্রাণশক্তির নতুন জোয়ার বইয়ে দিয়েছে তাঁর শরীরে। বিশাল একটা কর্মসূচি সাফল্যের সাথে শেষ করেছেন তিনি। কাঁধ থেকে নেমে গেছে গুরুদায়িত্ব। বাকি আছে শুধু দীর্ঘ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে রোমে ফিরে যাওয়া। কে জানে কী আছে ভাগ্যে, সমুদ্রযাত্রা নিরাপদ হবে কি না, তা শুধু নিয়তিই বলতে পারে।
আরও চারটে সুড়ঙ্গপথ ঘুরে পাহাড়ে বেরিয়ে এলেন ভেনাটর। ইতোমধ্যে একটা সুড়ঙ্গপথ পাথর ধসে বন্ধ হয়ে গেছে। ছাদ ধসে পড়ায় ওখানে বানোজন ক্রীতদাস পাথর চাপা পড়ে মারা গেছে। এখনও সেখানেই আছে তারা, চিড়েচ্যাপ্টা লাশগুলোর কবর হয়ে গেছে পাথরের তলায়। একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলেন ভেনাটর। ওদের জন্য দুঃখ করা অযৌক্তিক মনে হলো তার। এখান থেকে ফিরে আবার তো সেই সম্রাটের খনিতেই কাজ করতে হতো ওদেরকে। আধপেটা খেয়ে, রোগ-শোকে ভুগে ধুকে ধুকে মরার চেয়ে এ বরং ভালোই হয়েছে। বেঁচে থাকাই ছিল ওদের জন্য অভিশাপ।
সুড়ঙ্গমুখটা এমনভাবে পাথর কেটে তৈরি যে বড় বাক্সগুলো ভেতরে ঢোকাতে কোনো অসুবিধা হয়নি। পাহাড়ে বেরিয়ে আসছেন ভেনাটর, এই সময় দূর থেকে একটা লোমহর্ষক আর্তচিৎকার ভেসে এল। কপালে উদ্বেগের রেখা নিয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন তিনি, আলোয় বেরিয়ে এসে চোখ কোঁচকালেন। থমকে দাঁড়িয়ে ক্যাম্পের দিকে তাকালেন তিনি, ঢালু একটা প্রান্তর জুড়ে সেটার বিস্মৃতি। অসভ্য কয়েকটা যুবতী মেয়েকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে একদল রোমান সৈনিক। সম্পূর্ণ বিবস্ত্র একটা মেয়ে আবার চিৎকার করে উঠে ধস্তাধস্তি শুরু করে দিল। সৈনিকদের পাঁচিল ভেঙে প্রায় বেরিয়ে এল সে, কিন্তু সৈনিকদের একজন তার লম্বা কালো চুল ধরে হ্যাঁচকা টান দিল, ধুলোর ওপর ছিটকে পড়ল মেয়েটা।