সম্মতি দিয়ে মাথা নাড়ল পুরো দল। সামনে অনেক কাজ। অর্ডারকে খুঁজে বের করতেই হবে। তাদেরকে থামাতেই হবে। আর বেশি দেরি হবার আগেই করতে হবে এ কাজ।
প্যাটারসন মাথা নাড়তেই সবাই যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল। কিন্তু বিজয়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “তুমি বসো।”
অন্যেরা বেরিয়ে যেতেই একা হয়ে পড়ল বিজয়। ওদিকে প্যাটারসনও একা। বড়সড় মানুষটা কিছুক্ষণ চোখ নামিয়ে রেখে অবশেষে বিজয়ের দিকে তাকালেন।
“এমন ভান করব না যে তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি সত্যিই অসম্ভব কষ্ট পেয়েছি। যুদ্ধক্ষেত্রে আমিও অসংখ্য বন্ধু হারিয়েছি। শৈশব থেকে যেসব ছেলেদের সাথে বেড়ে উঠেছি, খেলেছি, বিয়ার খেয়েছি গব গব করে…” মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “যুদ্ধ সম্পর্কে যদি কিছু শিখে থাকি তা হল আশা করো না। যুদ্ধ কখনো আশা বয়ে আনে না। বরঞ্চ আশাকে কেড়ে নেয়। একমাত্র শান্তিই কেবল আশা নিয়ে আসে। রাধার ব্যাপারে আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু তোমাকে থেমে থাকলে চলবে না। জানি মনে মনে ওর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চাইছ। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি চাই সেসব চিন্তা হঠিয়ে দাও। এখন আমাদের কাজ হল অর্ডারকে পরাজিত করা। যদি তা না পারি তো অরাজকতায় ছেয়ে যাবে সবকিছু। এটা একটা যুদ্ধ মাই বয়। তাই রাধা নয়। পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে। এটাই হল লক্ষ্য।”
নীরবে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল বিজয়। তারপর বলল, “বুঝতে পেরেছি।” প্যাটারসনের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “হাতে কোনো প্রমাণ নেই বলেই যে সাক্সেনা, ভ্যান ক্লক আর বাকিদেরকে ছেড়ে দিতে হবে সেটারও কোনো মানে নেই। যদি হাতে কোনো প্রমাণ না থাকে, তাহলে খুঁজে বের করতে হবে। আর অর্ডারকে খুঁজে বের করার জন্য যা যা করতে হয় আমি করব। এমন নয় যে আমি কেবল প্রতিশোধের কথা বলছি। অন্যদেরকে যাতে আর প্রিয়জন হারাতে না হয় সে কারণেও করতে হবে। যেমন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সাবজেক্ট হিসেবে ব্যবহৃত সেসব লোক। আমরা অর্ডারকে থামাবোই। ঈশ্বর জানেন কিভাবে করব; আমি একটা না একটা রাস্তা ঠিকই খুঁজে বের করব। তার জন্য আমাকে যাই করতে হোক না কেন আমি রাজি আছি।”
প্যাটারসন মাথা নাড়লেন, “ঠিক তাই। যাই করতে হোক না কেন। না জানি এরই মাঝে কত প্রাণ কেড়ে নেয়া হয়েছে? আর শেষ হবার আগে আরো কত প্রাণ ঝরবে?”
.
প্রতিশোধের চিন্তা
কনফারেন্স রুম থেকে বেরিয়ে এল বিজয়। পথের মাঝখানে ডা. শুক্লাকে দেখে তো রীতিমত অবাক হয়ে গেল। প্রৌঢ় ভাষাবিদের উজ্জ্বল চোখ দুটোতে এমন এক দৃঢ়-সংকল্প দেখা যাচ্ছে যা কিছুতেই অবহেলা করা যাবে না।
ডা. শুক্লার মুখোমুখি হয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল বিজয়। জানে উনি তার সাথে একান্তে কথা বলতে চাইছেন। অন্যরা চলে গেছে। রয়ে গেছেন কেবল তারা দু’জন।
খানিক অপেক্ষা করে ডা. শুক্লা এমনভাবে কথা শুরু করলেন যেন বহুকষ্টে নিজের আবেগ দমন করতে চাইছেন,
“আমি আমার মেয়েটার মৃতদেহও দেখিনি। প্রতিটা শব্দের উপর জোর দিয়ে অবশেষে বললেন, “তুমি জানো একজন পিতার কাছে তাঁর মেয়ে কতটা মূল্যবান?” বিজয় স্পষ্ট বুঝতে পারল যে কান্না আটকাতে গিয়ে ডা. শুক্লার গলা ধরে এল। কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতিতে ভরে গেল ছেলেটার অন্তর। “একজন পিতার জীবন নিহিত থাকে তার কন্যার মাঝে। মেয়ে কষ্ট পেলে বাবাও কষ্ট পায়। মেয়ের চোখে জল দেখলে বাবা নিজেও কেঁদে ফেলে। ক্ষমতা থাকুক বা না থাকুক মেয়ের পছন্দের সবটুকু খুশি এনে দেয়ার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে সেই পিতা।” নিজেকে সামলানোর জন্য হিমশিম খাচ্ছেন ডা. শুক্লা, “ও-ই ছিল আমার বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য। আর এখন…এখন তো সেই চলে গেছে।”
ভেঙে পড়লেন ডা. শুক্লা। গাল বেয়ে দরদর করে ঝরে পড়ল অশ্রুবিন্দু। নিজের আবেগকে আর ধরে রাখতে পারছেন না।
উথাল-পাথাল হৃদয় নিয়েও কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিজয়। ডা. শুক্লা শব্দগুলো স্মরণ করিয়ে দিল যে সে কী হারিয়েছে। বিজয় যেমন, মেয়েটা নিঃস্বার্থভাবে ঠিক সেভাবেই তাকে গ্রহণ করেছিল; ভালোবেসেছিল।
ডা. শুক্লার হাত ধরে চোখে চোখ রেখে বিজয় বলল, “আমি ওকে ফিরিয়ে আনব।” ডা. শুক্লাকে আশ্বস্ত করে জানাল, “ওকে সাহায্য করার জন্য আমি কিছুই করতে পারিনি। ওকে বাঁচাতে পারিনি।” গলা কেঁপে উঠতেই বুঝতে পারল আবেগ ওকে গ্রাস করছে; কিন্তু নিজেকে এখন আর সামলানোর কোনো ইচ্ছেই নেই। “কথা দিচ্ছি আপনি ওকে আবার দেখতে পাবেন। আমি ওকে ফিরিয়ে আনবোই। জানিনা কিভাবে কিন্তু ওদেরকে খুঁজে বের করে আমি ওকে নিয়ে আসবোই। আর যা করেছে তার জন্য ওদেরকে যথাযথ মূল্য চুকাতে বাধ্যও করব।”
সজ্ঞানে একটু আগে প্যাটারসনের সামনে উচ্চারিত প্রতিটা কথার বিরোধিতা করল বিজয়। কিন্তু সেটা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। পরোয়া করতে চায়ও না। ওতো কোনো হিরো নয়। ও দুনিয়াকে বাঁচাতে আসেনি। মহামানবের মত বলে এসেছে যে আর কাউকে যেন প্রিয়জন হারাতে না হয় তার জন্য কাজ করবে। কিন্তু ওর কী হবে? ও কেন রাধাকে হারাল? বিজয় তো আর তার ভালোবাসার মানুষটাকে ফিরে পাবে না!
কন্যার শোকে মূহ্যমান পিতাকে জড়িয়ে ধরল বিজয়।