স্রষ্টার জন্য লড়াই : মৌলবাদের ইতিহাস

০. অনুবাদকের কথা / ভূমিকা

স্রষ্টার জন্যে লড়াই : মৌলবাদের ইতিহাস – ক্যারেন আর্মস্ট্রং
অনুবাদ: শওকত হোসেন
প্ৰথম প্ৰকাশ – একুশে বইমেলা ২০১১

অনুবাদকের কথা

বর্তমান বিশ্বে ধর্মীয় মৌলবাদ প্রসঙ্গটি ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ৯/১১ পরবর্তী পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মকে নির্বিচারে মৌলবাদ অ্যাখ্যা দিয়ে খোদ ধর্মের বিরুদ্ধে সকল শক্তি প্রয়োগের একটি প্রবণতা গোটা বিশ্বজুড়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোর তিনটিতেই মৌলবাদের প্রবল উপস্থিতি থাকলেও এবং খৃস্ট ও ইহুদি ধর্মের মৌলবাদের ভয়ঙ্কর চেহারা সত্ত্বেও বিশ্ব-মিডিয়ার একপেশে প্রচারণার ফলে বর্তমানে কেবল ইসলাম ধর্মই মৌলবাদ ও ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থা এমন যেন ইসলাম ছাড়া আর কোনও ধর্মের অস্তিত্ব নেই; যে কোনও ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্যে ইসলামী সন্ত্রাসবাদই দায়ী। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে যেন ধার্মিকতা, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদের আর কোনও পার্থক্য নেই।

কিন্তু আসল ব্যাপার যে তা নয়, মৌলবাদ যে ধর্মের সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অভিব্যক্তি, আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার প্রতি ধার্মিকদের বিশেষ সাড়া হিসাবে যার জন্ম, বর্তমান বিশ্বের ধর্ম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ স্বনামখ্যাত ব্রিটিশ গবেষক-লেখক ক্যারেন আর্মস্ট্রং সেটাই তুলে ধরেছেন বর্তমান গ্রন্থে। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, মৌলবাদ কোনওভাবেই নতুন ঘটনা নয় বা কেবল ইসলামই মৌলবাদের আসরে আক্রান্ত নয়। বিগত প্রায় কয়েকশো বছর ধরে, আধুনিকায়নের সূচনাকাল হতে, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের আবির্ভাবে অস্তিত্ব বিনাশের আশঙ্কায় ধর্মের টিকে থাকার সংগ্রাম থেকেই জন্ম হয়েছিল মৌলবাদের। পৃথিবীর সকল দেশের, সকল ধর্মের মানুষই, অন্তত কিছু সংখ্যক মানুষ, ধর্মের অখণ্ডতা রক্ষার নামে আধুনিকতার সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হয়েছে। আবার যুগে যুগে রাষ্ট্রও উপর হতে আধুনিকতা চাপিয়ে দিতে গিয়ে প্রতিপক্ষ নির্ধারণ করছে ধর্মকে, মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে পশ্চাদপদতার সমার্থক বিচার করে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য, ব্যতিক্রম নেই কোথাও। মৌলবাদ যেন আধুনিক মানুষেরই অপরিহার্য সঙ্গী। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে একে নির্মূল করার প্রয়াস বিজ্ঞান সম্মত নয় বলেই মনে হয়। মৌলবাদকে প্রতিহত বা নির্মূল করা নয়, প্রয়োজন একে সংশোধন করা। এর জন্যে মৌলবাদের চেহারা, তার আদিরূপ বা ইতিহাসটুকু জানা জরুরি। ইতিহাসের দীর্ঘ সময় জুড়ে মৌলবাদের উৎপত্তি হতে শুরু করে পর্যায়ক্রমে এর বিকাশ জানতে পারলে ধর্মের এই অসুস্থ অভিব্যক্তির বিরুদ্ধে সংশোধন প্রয়াস সহজতর হবে বলে মনে হয়। বাংলাদেশের পাঠকদের মৌলবাদের ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বিশ্বের মৌলবাদ সম্পর্কে আগ্রহী পাঠকদের কৌতূহল মেটাতে ক্যারেন আর্মস্ট্রংয়ের সুবিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থ ব্যাটল ফর গড: আ হিস্ট্রি অভ ফান্ডামেন্টালিজম-এর বাংলা অনুবাদ স্রষ্টার জন্যে লড়াই: মৌলবাদের ইতিহাস পাঠকদের হাতে তুলে দিতে পেরে আমি আনন্দিত।

উল্লেখ্য, মূলগ্রন্থে বহু দার্শনিক, ধর্মীয় ও কারিগরি পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। পাঠকদের সুবিধার জন্যে আমি যথাসম্ভব বাংলা পরিভাষা ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। ধর্মগ্রন্থের, বিশেষ করে পবিত্র কোরানের আয়াতের নির্ভুল অনুবাদের খাতিরে মুহম্মদ হাবীবুর রহমানের কোরান শরীফ: সরল বঙ্গানুবাদ-এর সাহায্য নিয়েছি।

মূলগ্রন্থে ব্যবহৃত না হলেও পয়গম্বর মুহাম্মদ-এর নামের শেষ (স) চিহ্ন ব্যবহার করেছি। পাঠকদের কাছে পয়গম্বর ও নবীগণের নামের শেষে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে যথাযথ বাণী ব্যবহারের অনুরোধ থাকল।

পাঠকদের একটি বিশ্বস্ত মূলানুগ ও সাবলীল অনুবাদ উপহার দেওয়ার চেষ্টা ছিল আমার। জানি না কতটুকু সফল হয়েছি। পাঠক সামান্য উপকৃত হলেও নিজের শ্রম স্বার্থক জানব। যে কোনও রকম ভুল-ত্রুটি আমাদের গোচরে আনলে পরবর্তী সংস্করণে তা সংশোধনের প্রয়াস নেওয়া হবে।

বইটি আরও আগে বের হওয়ার কথা ছিল। দেরি হবার কারণ প্রসঙ্গে পাঠকদের জ্ঞাতার্থে এখানে কিছু কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। এই বইটিসহ আমার অনূদিত আরও কিছু বই বের হওয়ার কথা ছিল আজিজ সুপার মার্কেটের সন্দেশ নামক প্রকাশনা সংস্থা থেকে। পাণ্ডুলিপিও জমা দিয়েছিলাম। এমনি এক সময় সহসা সুপ্রিয় অনুবাদক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট অনুবাদক জনাব জি.এইচ. হাবীরের কাছে জানতে পারি সন্দেশে’ স্বত্বাধিকারী লুৎফর রহমান চৌধুরীর অপকর্মের ফিরিস্তি। জনাব লুৎফর রহমান অনুবাদকদের প্রতারিত করে বিভিন্ন বিদেশী সংস্থা থেকে অনূদিত গ্রন্থের বিপরীতে অনুবাদকদের নামে বরাদ্দ ও প্রেরিত প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। এ খবর জানতে পেরে আমি নরওয়ের নরলা, কানাডিয়ান কাউন্সিল ফর ট্রান্সলেশন, ডাচ ফাউন্ডেশন ফর ট্রান্সলেশন, ইত্যাদি বিভিন্ন সংস্থার সাথে যোগাযোগ করে জনাব লুৎফর রহমানের অপকর্মের জ্বলন্ত প্রমাণ যোগাড় করি। তাতে জানা যায় এই তথাকথিত সাহিত্যসেবী আসলে একজন নিম্নশ্রেণীর তস্কর ছাড়া আর কিছুই নন। তিনি বিভিন্ন বিদেশী প্রকাশনা সংস্থা ও লেখকদের এজেন্টদের সাথে নামী-অনামী লেখকদের বাংলাদেশের পাঠকদের সাথে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার নামে খুবই সামান্য অর্থের বিনিময়ে লাইসেন্স (স্বত্ব নয়) হাতিয়ে নেন। তারপর অনুবাদকদের সাথে নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট বইটি অনুবাদ করানোর জন্যে নামকাওয়াস্তে চুক্তি সম্পাদন করেন। কিন্তু সেই চুক্তির কথা গোপন করে তিনি উল্লেখিত বিদেশী সাহিত্য সংস্থাগুলোর কাছে অনুবাদকের সত্যিমিথ্যার মিশেল জীবনবৃত্তান্ত ও জাল স্বাক্ষরসহ সম্পূর্ণ ভিন্ন মিথ্যা চুক্তিপত্রের অনুলিপি জমা দিয়ে অনূদিত গ্রন্থের বিনিময়ে অনুবাদকের নামে বরাদ্দ অর্থের জন্যে আবেদন করেন এবং অনুবাদককে কিছুই না জানিয়ে সেই অর্থ বেমালুম তছরুপ করেন। এভাবে এপর্যন্ত তিনি বহু লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই ঘৃণ্য কাজ করে আসছেন। তাঁর এমনি প্রতারণার ফাঁদ থেকে বাংলাদেশের কোনও অনুবাদক রেহাই পাননি। নদে উপন্যাসের অনুবাদক আনিস পারভেজ, সোফির জগৎ ও শত বর্ষের নিঃসঙ্গতার নন্দিত অনুবাদক জি.এইচ. হাবীব, একটি অপহরণ সংবাদ ও বাগদাদে একশ দিন- এর অনুবাদক সিলেট মেট্রপলিটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সুরেশ রঞ্জন বসাক, লাইফ অভ পাই ও টিন রঙা শাড়ীর অনুবাদক শীব্রত বর্মণ, তাশ রহস্য-এর অনুবাদক দ্বিজেন্দ্রনাথ বর্মণ, ক্যালি গ্যাংয়ের আসল ইতিহাসের অনুবাদক সালেহা চৌধুরীসহ কেউই বাদ যাননি। অথচ প্রকাশ্যে নিজেকে তিনি সাহিত্যসেবী হিসাবে পরিচয় দিয়ে থাকেন, ভান করেন সাহিত্যের সেবা করতে গিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া, ভারতীয় পূর্বপ্রকাশিত বিভিন্ন অনুবাদও তিনি তাঁর নিকটাত্মীয়দের নামে প্রকাশ করে বর্ণিত সংস্থাগুলো থেকে অনুদানের অর্থ আদায় করে নিয়েছেন। সম্পূর্ণ বিষয়টি অনুবাদকদের মাঝে জানাজানি হওয়ার পরও এবং প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও (বর্ণিত সংস্থাসমূহের ওয়েব সাইটে অনুসন্ধান করলেই এই অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ মিলবে) তিনি বিষয়টি অস্বীকার করে গেছেন। অনেক চেষ্টা করেও আমি ও অন্য অনুবাদকগণ প্রাপ্য অনুদানের টাকা তো বটেই অন্যান্য অনূদিত গ্রন্থের বিনিময়ে চুক্তিমাফিক প্রতিশ্রুত অর্থও পাইনি। তিনি চুক্তিভঙ্গ ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন বলে পূর্বপ্রকাশিত অনূদিত গ্রন্থ প্রত্যাহারের কথা লিখিতভাবে জানানো সত্ত্বেও তিনি সেগুলোর বিপনন অব্যাহত রেখেছেন এবং দাখিল করা পাণ্ডুলিপি ফেরত চাইলেও ফেরত দেননি; যে কারণে অত্যন্ত পরিশ্রম সপেক্ষ হলেও এ বইটি দ্বিতীয়বার অনুবাদ করতে হয়েছে। আমার আরও কয়েকটি অনূদিত গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি এখনও অন্যায়ভাবে আটকে রেখেছেন, বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও তাতে কান দেননি। বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখা এবং প্রতারণা থেকে দেশের অনুবাদকদের বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসবেন এটাই কাম্য। আমি আন্তরিকভাবে আশাবাদী যে, সংশ্লিষ্ট সংস্থা যথা-ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাংলাদেশের সাহিত্য জগৎকে লুৎফর রহমান চৌধুরীর মতো নিম্নশ্রেণীর তস্করের কবল থেকে উদ্ধার করে নিবেদিতপ্রাণ লেখক ও অনুবাদকদের প্রতারণার হাত থেকে রক্ষায় এগিয়ে আসবেন। পাঠক, লেখক ও অনুবাদকগণকে এই প্ৰকাশককে সামাজিকভাবে বর্জন করার আহ্বান জানাই। পাঠকদের একটি অন্যায় সম্পর্কে অবহিত করার জন্যেই এখানে এত কথা বলতে হলো। কারও ধৈর্যচ্যুতি ঘটার কারণ হলে আমি সেজন্যে ক্ষমাপ্রার্থী। প্রসঙ্গত, এই বক্তব্যের জন্যে রোদেলার প্রকাশক দায়বদ্ধ নন।

ধন্যবাদ সবাইকে

শওকত হোসেন
মালিবাগ, ঢাকা

নতুন ভূমিকা

২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর তারিখটি বিশ্বকে চিরতরে পাল্টে দেওয়া দিন হিসাবে ইতিহাসে স্থান করে নেবে। এই দিনই মুসলিম সন্ত্রাসীরা বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র ও পেন্টাগনের একটি অংশ ধ্বংস করে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছিল। স্পষ্টতই টেলিভিশনে প্রচারের উদ্দেশ্যেই পরিকল্পিত কাজ ছিল এটা। বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের জ্বলন্ত টাওয়ারজোড়া এবং পরবর্তী দর্শনীয় ধস সম্ভবত একবিংশ শতাব্দীর আইকনে পরিণত হবে। ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ কোনও বিদেশী শক্তির হাতে আক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু কোনও জাতি রাষ্ট্র নয়, বা পারমানবিক মিসাইলও নয়, বরং স্রেফ পেননাইফ আর বক্স কাটার হাঁকানো ধর্মীয় চরমপন্থীদের হাতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পরিচালিত হামলা হলেও প্রথম বিশ্বে আমাদের সবার উদ্দেশ্যেই সতর্কবাণী ছিল এটা। এক নতুন ধরনের নগ্নতা, আক্রম্যতা বোধে আক্রান্ত হয়েছি আমরা, নিষ্ঠুরতার মাত্র এক মাসের কিছু বেশি সময় পর যখন আমি লিখছি, এখনও এটা স্পষ্ট নয় যে কীভাবে এই ঘটনাটি আমাদের আচরণকে প্রভাবিত করবে। পরিবর্তিত এই বিশ্বে একটা ব্যাপার ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, কোনও কিছুই আর আগের মতো থাকবে না। সেপ্টেম্বর ১১-এর আগে যেসব অগ্রাধিকার ও উদ্বেগ আমাদের ব্যস্ত রেখেছিল সেগুলোকে এখন অপ্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। আমরা ভীতিকর অস্বস্তিকর এক পরিবর্তনের মুখে পড়েছি।

অবশ্য মৌলবাদের গতিশীলতায় পরিবর্তন আসেনি। আক্রমণের ব্যাপকতা সম্পর্কে কারও পক্ষেই পূর্বধারণা করা সম্ভব ছিল না, কারণ তা ছিল ধারণাতীত। তবে এটা ছিল মৌলবাদীদের ঈশ্বরের পক্ষে তাদের চলমান যুদ্ধে নতুনতম ও সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আক্রমণ। এই পৃষ্ঠাগুলোতে আমি যেমন তুলে ধরার প্রয়াস পাবো, প্রায় শতবছর ধরে ক্রিশ্চান, ইহুদি ও মুসলিমরা এক উগ্র ধরনের ধার্মিকতা গড়ে তোলার কাজে ব্যস্ত ছিল যার লক্ষ্য আধুনিক সেক্যুলার সংস্কৃতিতে অবনমিত ঈশ্বর ও ধর্মকে প্রান্তরেখা থেকে আবার মধ্যমঞ্চে ফিরিয়ে আনা। এইসব ‘মৌলবাদী’, যেমন তাদের আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে, ধর্মের প্রতি উৎসগতভাবে বৈরী এক বিশ্বে বিশ্বাসের পক্ষে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। সেক্যুলার আধুনিকতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তারা; এই সংগ্রামের ভেতর দিয়ে তারা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সাধারণভাবে পণ্ডিত ও ধারাভাষ্যকারগণ ধরে নিয়েছিলেন যে সেক্যুলারিজমই আগামীর আদর্শ এবং ধর্ম আর কখনওই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তিতে পরিণত হতে পারবে না। কিন্তু মৌলবাদ এই প্রবণতাকে উল্টে দিয়েছে, ক্রমশঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মুসলিম বিশ্বের উভয় ক্ষেত্রেই ধর্ম এমন এক শক্তিতে পরিণত হয়েছে যাকে প্রতিটি সরকার গুরুত্বের সাথে নিতে বাধ্য হয়েছে।

সেপ্টেম্বর ১১-এর প্রলয়কাণ্ডকে এই গ্রন্থে বর্ণিত মৌলবাদের ইতিহাসের যৌক্তিক পরিণাম হিসাবে দেখা যেতে পারে। প্রায়শঃই লোকে যেমনটা ভেবে থাকে, মৌলবাদ কোনও সচেতন পশ্চাদপদতা নয়। এটা অতীতে ফিরে যাওয়া নয়। এইসব মৌলবাদ আবিশ্যকভাবেই আধুনিক আন্দোলন এবং নিজ সময় ছাড়া অন্য কোনও কালেই শেকড় গাড়তে পারবে না। এটা ছিল সেক্যুলার আধুনিকতার বিরুদ্ধে পরিচালিত সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী অক্রমণ, এরচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ লক্ষ্য আর বেছে নিতে পারত না সন্ত্রাসীরা। সেপ্টেম্বর ১১-র চেয়ে আর কখনওই মৌলবাদীরা মিডিয়ার এমন দক্ষ সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। প্রথম বিমানের ধ্বংসে সচেতন হয়ে ওঠা লক্ষ লক্ষ মানুষ ততক্ষণে যার যার টিভি সেটের সামনে বসে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের দাক্ষিণ টাওয়ারে দ্বিতীয় প্লেনের হামলে পড়া দেখতে হাজির হয়ে গিয়েছিল। মৌলবাদীরা আধুনিক বাবেল মনে হওয়া প্রকৃতির বিরোধিতা করে গড়ে তোলা অসাধারণ ভবন ধ্বংস করার লক্ষ্যে আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়েছে। মৌলবাদীদের কাছে এই ধরনের কাঠামো ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ঠেকতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র ও পেন্টাগন ধর্মীয় অভিশাপের মুখে তাসের ঘরের মতো জমিনে লুটিয়ে পড়েছে। মারাত্মক আঘাত ছিল এটা। কেবল হাজার মানুষ প্রাণই হারায়নি, বরং আমেরিকার গর্বিত স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও আস্থা টাওয়ারগুলোর সাথে সাথে ধসে পড়েছে। মানুষ আর কোনওদিনই সেপ্টেম্বর ১০-এর মতো নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারবে না। দশকের পর দশক এয়ারপ্লেনগুলো মানুষকে এক ধরনের অতিমানবীয় মুক্তির বোধ যুগিয়েছে, তাদের মেঘের অনেক উপরে বসে থাকতে সক্ষম করে তুলেছে, প্রাচীনকালের দেবতাদের মতোই ক্ষিপ্র বেগে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে পেরেছে তারা। কিন্তু এখন তাদের অনেকেই আকাশে উড়তে ভয় পাচ্ছে। ওদের মাটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে, নিয়ে আসা হয়েছে আসল রূপে, ওদের সেক্যুলার ডানা ছেঁটে দেওয়া হয়েছে এবং ভয়ঙ্করভাবে ফুটো করে দেওয়া হয়েছে আত্মবিশ্বাস।

প্রধান সন্দেহভাজন ওসামা বিন লাদেন মৌলিক চিন্তাবিদ নন। তাঁর ধ্যানধারণা সম্পূর্ণই মিশরিয় মৌলবাদী সৈয়দ কুতবের ধারণা ভিত্তিক। এই গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায়ে তাঁর বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কুতবের পরিভাষা ব্যবহার করে বিন লাদেন ঘোষণা করেছেন যে, সেপ্টেম্বর ১১-র ঘটনাপ্রবাহ বিশ্ব দুটি শিবিরে বিভক্ত থাকার বিষয়টিই তুলে ধরেছে: একটি ঈশ্বরের পক্ষে, অন্যটি তাঁর বিপক্ষে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্ব দুটি ভিন্ন শিবিরে ভাগ হয়ে আছে, সেটা বিন লাদেনের বর্ণনা মোতাবেক না হয়ে থাকলেও। অনেক দশক ধরে আধুনিকতার সুযোগ সুবিধা উপভোগ ও সমর্থন করে আসছে যারা আর আধুনিক সমাজ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া মৌলবাদীরা পরস্পরে প্রতি চরম বিতৃষ্ণার সাথে দুর্বোধ্যতার মহাগহ্বরের উপর দিয়ে তাকিয়ে আছে। সেপ্টেম্বর ১১-র নিষ্ঠুরতা কেবল ভুল বোঝাবুঝির মাত্রাটুকু কতটা গভীর এবং ভিত্তি কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে সেটাই তুলে ধরে। এটা সভ্যতার সংঘাত নয়, মৌলবাদ সব সময়ই আন্তসমাজ বিরোধ। যেন এই বিষয়টিকে জোরাল করে তুলতেই আমেরিকান ক্রিশ্চান মৌলবাদী জেরি ফলওয়েল ও প্যাট রবার্টসন প্রায় সাথে সাথেই ঘোষণা করেছিলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্যুলার মানবতাবাদীদের পাপের জন্যে ওই ট্র্যাজিডি ছিল ঈশ্বরেরই বিচার-এমনি দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম ছিনতাইকারীদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে খুব একটা ভিন্ন কিছু নয়।

এই গ্রন্থের পরিশিষ্টে আমি তুলে ধরেছি যে মৌলবাদ বিদায় নিচ্ছে না, বরং এটা আধুনিক দৃশ্যপটেরই অংশ, এবং এমন এক বাস্তবতা যার মোকাবিলা করা আমাদের শিখতে হবে। মৌলবাদের ইতিহাস দেখায় যে, এই উগ্র ধার্মিকতা আমরা অগ্রাহ্য করলেই মিলিয়ে যায় না। মৌলবাদের হুমকির অস্তিত্ব নেই ভান করা বা মুষ্টিমেয় উন্মাদ লোকের বদ্ধমূল ধারণা হিসাবে মৌলবাদকে সেক্যুলার বিতৃষ্ণার সাথে নাকচ করে দেওয়া মোটেই ঠিক নয়। ইতিহাস আরও দেখায় যে, মৌলবাদকে দমন করার প্রয়াস স্রেফ তাকে আরও চরম রূপ দেয়। এটা পরিষ্কার, সকল ধর্মবিশ্বাসের মৌলবাদীরা কী প্রকাশ করতে চাইছে উপলব্ধি করার জন্যে আমাদের মৌলবাদী ইমেজারিসমূহকে বোধগম্য করে তুলতে হয়েছে। কারণ এইসব আন্দোলন এক ধরনের উদ্বেগ ও অসন্তোষ তুলে ধরে যা কোনও সমাজই উপেক্ষা করে থাকতে পারে না। সেপ্টেম্বর ১১-র পর থেকে বিশ্বের বহু স্থানে ক্রমেই চরম রূপ ধারণ করতে চলা মৌলবাদী আন্দোলনসমূহকে উপলব্ধি করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিশ্চান রাইটের সদস্যরা ১৯৭০ দশকের মৌলবাদের সীমা অতিক্রম করে গেছে বলে মনে হচ্ছে। এই গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ে আমি জেরি ফলওয়েল ও মরাল মেজরিটিকে অনেক পিছে ফেলে যাওয়া রিকন্সট্রাকশনিজম ও ক্রিশ্চান আইডেন্টিটি আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করেছি। এগুলো উত্তর-মৌলবাদের একটি ধরন, যা ঢের বেশি ভীতিকর, অনমনীয় ও চরম। একইভাবে ছিনতাইকারীরা যেন ইসলামি মৌলবাদের ক্ষেত্রে কোনও ধরনের ভয়ঙ্কর পরিবর্তন তুলে ধরেছে বলে মনে হয়। বিন লাদেন সৈয়দ কুতবের প্রচলিত মৌলবাদী পরিভাষায় কথা বললেও ছিনতাইকারীরা, বিন লাদেনের যাদের কুতবিয় পরিভাষায় ‘ভ্যানগার্ড’ আখ্যায়িত করেছেন, সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের মৌলবাদের আবির্ভাব ঘটাতে পারত, এমন কিছু অতীতে যা আমরা প্রত্যক্ষ করিনি। প্রথম বিমানের চালক মিশরিয় ছিনতাইকারী মুহাম্মদ আতা ছিল প্রায়-মদ্যপ ধরনের, বিমানে আরোহনের আগেও ভদকা খাচ্ছিল সে। পেনসিলভেনিয়ায় ক্র্যাশ করা বিমানের অভিযুক্ত লেবানিজ পাইলট জিয়াদ জাররাহিও মদ্যপ ছিল, হামবুর্গে নিয়মিত নাইটক্লাবে যাতায়াত করত সে। ছিনতাইকারীরা লাস ভেগাসের বিভিন্ন ক্লাব ও নারীসঙ্গও উপভোগ করত।

এইসব তথ্য বের হয়ে আসার সাথে সাথে খুব অদ্ভুত কিছু ব্যাপার ঘটছে বলে আমি সজাগ হয়ে উঠেছিলাম। মুসলিমদের পক্ষে ধর্মীয়ভাবে অ্যালকোহল পান নিষিদ্ধ। একজন মুসলিম শহীদ পেট ভর্তি ভদকা নিয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছে, এমন ধারণা ১৯৯৪ সালে হেবরনের গ্রেট মস্কে হামলা চালিয়ে উনত্রিশজন মুসলিমকে হত্যা করার আগে শূকরের মাংস ও ডিম দিয়ে নাশতা সারা বারুচ গোল্ডম্যানের মতো ইহুদি মৌলবাদীর আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার মতোই অচিন্তনীয়। কোনও ধার্মিক মুসলিম বা ইহুদিই এই ধরনের আচরণে নিজেকে জড়িত করার কথা ভাবতে পারে না। বেশির ভাগ মৌলবাদীই অর্থডক্স জীবন অনুসরণ করে, অ্যালকোহল, নাইটক্লাব আর শিথিল রমনী হচ্ছে জাহিলিয়াহর বৈশিষ্ট্য, অজ্ঞ, ঈশ্বরবিহীন বর্বরতা মুসলিম মৌলবাদীরা সৈয়দ কুতবের নির্দেশ অনুসরণ করে যাকে কেবল বর্জনেরই শপথ গ্রহণ করেনি, বরং নিশ্চিহ্ন করারও শপথ নিয়েছে। ছিনতাইকারীরা যেন কেবল ধর্মের যেসব মৌল বিধানকে রক্ষা করার শপথ নিয়েছিল সেগুলোকেই অমান্য করার পথে যায়নি, বরং প্রচলিত মৌলবাদীদের অনুপ্রাণিতকারী নীতিমালাকেও পদদলিত করেছে।

পরের পাতাগুলোয় আমি বহু উন্মলতাবাদী আন্দোলনের বর্ণনা দিয়েছি যেখানে জনগণ ইচ্ছাকৃতভাবে প্রবল উদ্বেগ ও পরিবর্তনের পর্যায়ে পবিত্রতম রীতিনীতি লঙ্ঘন করে গেছে। এখানে সপ্তদশ শতকের মেসায়াহ চরিত্র শাব্বেতাই যেভি, তাঁর শিষ্য জ্যাকব ফ্রাংক ও ‘পবিত্র পাপের’ পক্ষে বক্তব্যদানকারী সপ্তম শতকের ইংল্যান্ডের বিপ্লবী পয়গম্বরগণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। সময় এতটাই মরিয়া ছিল যে, সম্পূর্ণ নতুন কিছুর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। প্রাচীন মূল্যবোধসমূহ আর কাজে লাগছিল না; কেবল প্রাচীন রীতিনীতির পাইকারী লঙ্ঘনের ভেতর দিয়েই অর্জনযোগ্য নতুন বিধান ও নতুন স্বাধীনতা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

আমি আরও দেখিয়েছি যে, মৌলবাদের অধিকতর চরম রূপে এক ধরনের অন্তস্থঃ ধ্বংসাত্মক প্রবণতা রয়েছে। তিনটি ধর্ম বিশ্বাসের সবকটাতেই মৌলবাদীরা ধ্বংস ও নিশ্চিহ্নকরণের কল্পনা লালন করেছে। অনেক সময়, যেমন দশম অধ্যায়ে আমি দেখিয়েছি, পরিকল্পিতভাবেই স্বয়ং-ধ্বংসাত্মক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বাধ্য করা হয়ে থাকে তাদের। ১৯৭৯ সালে ডোম অভ রক উড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে জুইশ আন্ডারগ্রাউন্ডের পরিকল্পনা এর জ্বলন্ত নজীর। এই ঘটনার ফলে ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিনাশ ঘটতে পারত। এই ইহুদি মৌলবাদীরা এক পৌরাণিক বিশ্বাসে চালিত হয়েছে। এই পৃথিবীর বুকে তারা প্রলয় ঘটাতে পারলে ঈশ্বর তখন মহাকাশ থেকে নিষ্কৃতি অবতরণ করাতে ‘বাধ্য’ হবেন। আবার, মুসলিম আত্মঘাতী বোমারুদের চেয়ে ব্যাপক ধ্বংসবাদী কর্মকাণ্ড কল্পনা করা কঠিন। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক স্তরে ১৯৮০-র দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টেলিভিশন কেলেঙ্কারীর সৃষ্টিকারী জিম ও ট্যামি ফেয় বেকার এবং জিমি সোয়াগনের বিচিত্র অ্যান্টিকসমূহ জেরি ফলওয়েলের অধিকতর সুবোধ মৌলবাদের বিরুদ্ধে ঢের চরম ধ্বংসবাদী বিদ্রোহ তুলে ধরে। এটাও উত্তর-মৌলবাদের একটা রূপ ছিল যা ‘পবিত্র পাপে’র উন্মুলতার অন্বেষণ তুলে ধরে। সেপ্টেম্বর ১১-র ছিনতাইকারীরাও সম্ভবত এমন একটা অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিল যেখানেও তারাও মুসলিম উন্মুলতা- উত্তর-মৌলবাদের একটি ধরন গড়ে তুলছিল, কোনও কিছুকেই আর পবিত্র ভাবতে পারছিল না ওরা। একবার এই পর্যায়ে পৌঁছে গেলে সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও অশুভ আচরণকেও ইতিবাচক শুভ কাজ হিসাবে দেখা হতে পারে।

সে যাই হোক, সেপ্টেম্বরের ভয়ঙ্কর হামলা দেখায় যে, লোকে যখন ঘৃণা ও হত্যাকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করতে ধর্মকে ব্যবহার করতে শুরু করে, সকল মহান বিশ্ব ধর্মের সহানুভূতিময় নৈতিকতাকে বিসর্জন দেয়, তখন তারা এমন এক পথে যাত্রা করে যেখানে বিশ্বাসের পরাজয় ফুটে ওঠে। এই আগ্রাসী ধার্মিকতা এর আরও অধিকতর চরম উপাদানকে নৈতিকতার অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে যা আমাদের সবাইকেই বিপদাপন্ন করে তোলে। তিনটি ধর্ম বিশ্বাসের মৌলবাদীরা যদি আরও রেডিক্যাল ও ধ্বংসাত্মক বিশ্বাস আলিঙ্গন করতে শুরু করে থাকে, সেটা সত্যিই ভীতিকর একটা পরিবর্তন হবে। সুতরাং, এই গভীর হতাশার পেছনে কী লুকিয়ে আছে ও কোন জিনিসটা মৌলবাদীদের তাদের কর্মকাণ্ডে বাধ্য করে, সেটা বুঝতে পারাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখনও এটা ঠিক যে মৌলবাদীদের কেবল একটা সামান্য অংশই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়, বাকি সবাই তাদের চোখে বিশ্বাসের প্রতি পরিহাসময় মনে হওয়া এক পৃথিবীতে ধর্মীয় জীবন যাপন করার প্রয়াস পাচ্ছে। আমাদের অব্যাহত অজ্ঞতা ও বিতৃষ্ণা যদি আরও বিপূল সংখ্যক মৌলবাদীকে সহিংসতার পথে ঠেলে দেয়, সেটা হবে খুবই দুঃখজনক। আসুন আমরা এই ভীতিকর সম্ভাবনাকে রোধ করার জন্যে যা কিছু সম্ভব করার প্রয়াস পাই।

সূচনা

বিগত বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগের অন্যতম চমকপ্রদ পরিবর্তন ছিল প্রতিটি প্রধান ধর্মীয় ঐতিহ্যেই জনপ্রিয়ভাবে ‘মৌলবাদ’ নামে পরিচিত এক ধরনের উগ্র ধার্মিকতা। অনেক সময় এর প্রকাশ মারাত্মক হতে দেখা যায়। মৌলবাদীরা মসজিদে প্রার্থনাকারীদের গুলি করে হত্যা করেছে, অ্যাবরশন ক্লিনিকে কর্মরত ডাক্তার ও নার্সদের খুন করেছে, নিজেদের প্রেসিডেন্টদের গুলি করে মেরেছে, এমনকি শক্তিশালী সরকারেরও পতন ঘটিয়েছে। মৌলবাদীদের খুব অল্প সংখ্যার সংখ্যালঘু অংশই এইসব সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়ে থাকে, কিন্তু সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় ও নিয়মনিষ্ঠরাও যেন বিভ্রান্ত বোধ করছে, কারণ তাদের যেন আধুনিক সমাজের অধিকাংশ মূল্যবোধের সাথেই চরমভাবে বিরোধিতায় মত্ত মনে হয়। গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, শান্তিরক্ষা, বাক-স্বাধীনতা কিংবা গির্জা ও রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতার ব্যাপারে মৌলবাদীদের কোনও অবকাশ নেই। ক্রিশ্চান মৌলবাদীরা প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে জীববিজ্ঞান ও পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন আবিষ্কারকে প্রত্যাখ্যান করে, জোর দিয়ে বলে বুক অভ জেনেসিসই সবদিক থেকে বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ভুল। অনেকেই অতীতের শৃঙ্খল ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে যখন, এমন একটা সময়ে ইহুদি মৌলবাদীরা আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠোরভাবে প্রত্যাদিষ্ট বিধান পালন করে চলেছে, মুসলিম নারীরা পশ্চিমা নারীদের স্বাধীনতাকে প্রত্যাখ্যান করে বোরখা ও চাদরে নিজেদের আবৃত্ত করছে। মুসলিম ও ইহুদি মৌলবাদীরা উভয়ই প্রবলভাবে সেক্যুলারিস্ট হিসাবে সূচিত আরব-ইসরায়েল বিরোধকে চরমভাবে ধর্মীয় দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করে। তাছাড়া, মৌলবাদ কেবল মহান একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোতেই সীমাবদ্ধ নয়। বুদ্ধ, হিন্দু, ও এমনকি কনফুসীয় মৌলবাদীও রয়েছে। উদার সংস্কৃতির বহু কষ্টে আহরিত অন্তর্দৃষ্টি যাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে, যা ধর্মের নামে যুদ্ধ ও হত্যা করে এবং রাজনীতি ও জাতীয় সংগ্রামের ক্ষেত্রে পবিত্রকে টেনে আনার সংগ্রাম করে।

এই ধর্মীয় পুনর্জাগরণ বহু পর্যবেক্ষককে হতবাক করে দিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী বছরগুলোতে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, সেক্যুলারিজম অপরিবর্তনযোগ্য প্রবণতা, ধর্মবিশ্বাস আর কোনওদিনই বৈশ্বিক কর্মকাণ্ডে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে না। ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, মানবজাতি আরও যৌক্তিক হয়ে উঠবে, তাদের আর ধর্মের প্রয়োজনই হবে না বা একে জীবনের একেবারেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমিত রেখেই সন্তুষ্ট থাকবে। কিন্তু ১৯৭০ দশকের শেষের দিকে মৌলবাদীরা সেক্যুলার আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ধর্মকে প্রান্তিক অবস্থান থেকে একেবারে মধ্যমঞ্চে তুলে নিয়ে আসে। অন্ততপক্ষে এই দিক থেকে তারা লক্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। ধর্ম আবারও এমন এক শক্তিতে পরিণত হয়েছে যাকে কোনও সরকারের পক্ষেই আর নিরাপত্তার সাথে উপেক্ষা করে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। মৌলবাদ পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছে বটে, কিন্তু কোনওভাবেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়নি। এটা এখন আধুনিক দৃশ্যপটের অত্যাবশ্যক অংশে পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যতের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বলয়ে নিশ্চিতভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকাই পালন করবে। সুতরাং, এই ধরনের ধার্মিকতার মানে কী, কীভাবে এবং কোন কারণে এর বিকাশ ঘটল, আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের তা কী জানাতে পারে এবং কেমন করে সবচেয়ে ভালোভাবে এর মোকাবিলা করা যেতে পারে সেটা বোঝার চেষ্টা করা খুবই জরুরি।

কিন্তু সামনে অগ্রসর হওয়ার আগে বহুল-সমালোচিত খোদ ‘মৌলবাদ’ কথাটির দিকে আমাদের একটু সংক্ষিপ্ত নজর দেওয়া প্রয়োজন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকগুলোতে আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্টরাই সবচেয়ে প্রথম এই পরিভাষাটি ব্যবহার করে, তাদের কেউ কেউ নিজেদের অন্য অধিকতর ‘উদার’ প্রটেস্ট্যান্টদের থেকে ভিন্ন হিসাবে তুলে ধরার জন্যে ‘মৌলবাদী’ আখ্যায়িত করতে শুরু করেছিল। তাদের মতে উদারবাদীরা ক্রিশ্চান ধর্মবিশ্বাসকে বিকৃত করছিল। মৌলবাদীরা মৌলবিশ্বাসে ফিরে যেতে চেয়েছে ও ক্রিশ্চান ঐতিহ্যের ‘মৌল বিষয়’গুলোর উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। একে তারা ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক ব্যাখ্যা ও বিশেষ কিছু বিশ্বাসকে মেনে নেওয়ার সাথে একীভূত করে নিয়েছিল। ‘মৌলবাদ’ পরিভাষাটি তখন থেকেই অন্য বিশ্ব ধর্মের সংস্কারবাদী আন্দোলনসমূহকে এমনভাবে বর্ণনা করার কাজে ব্যবহার করা হয়ে আসছে যা মোটেও সন্তোষজনক নয়। এটা যেন বোঝাতে চায় মৌলবাদী এর সব ধরনের প্রকাশে সম্পূর্ণই একরৈখিক। ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। প্রতিটি ‘মৌলবাদ’ নিজেই একটি আইন এবং এর নিজস্ব গতিশীলতা রয়েছে। পরিভাষাটি এমন ধারণাও দেয় যে, মৌলবাদীরা উৎসগতভাবে রক্ষণশীল, অতীতচারী; কিন্তু তাদের ধারণাসমূহ আবিশ্যিকভাবেই আধুনিক ও দারুণভাবে উদ্ভাবনী ধরনের। আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্টরা তাদের ‘মৌলবিশ্বাসে’ ফিরে যেতে চেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সেটা তারা করেছে লক্ষণীয়ভাবে আধুনিক কায়দায়। এমনও যুক্তি দেখানো হয়েছে যে, এই ক্রিশ্চান পরিভাষাটিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অগ্রাধিকার বিশিষ্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় না। উদাহরণ স্বরূপ, মুসলিম ও ইহুদি মৌলবাদ মূলতঃ মতবাদ নিয়ে তেমন একটা সচেতন নয়, এটা আবিশ্যিকভাবেই ক্রিশ্চান সংশ্লিষ্ট বিষয়। ‘মৌলবাদে’র আক্ষরিক অনুবাদ থেকে আমরা উসুলিয়াহ শব্দ পাই, যার মানে দাঁড়ায় ইসলামি আইনের বিভিন্ন বিধান ও নীতিমালার উৎস নিয়ে গবেষণা। পশ্চিমে ‘মৌলবাদী’ হিসাবে তকমা পাওয়া বেশিরভাগ অ্যাক্টিভিস্টই ইসলামি বিদ্যাচর্চায় নিয়োজিত নয়, তাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্বেগের বিষয় রয়েছে। সুতরাং ‘মৌলবাদ’ কথাটির ব্যবহার ভ্রান্তিকর।

অন্যরা অবশ্য এই বলে যুক্তি তুলে ধরেন যে, কেউ পছন্দ করুক বা না করুক, ‘মৌলবাদ’ কথাটি টিকে থাকতেই এসেছে। আমি পরিভাষাটি যে সঠিক নয় তার সাথে একমত পোষণ করেছি, তবে আন্দোলনসমূহকে শনাক্ত করতে এটা কাজে লাগে, এবং তাদের ভেতরকার পার্থক্য সত্ত্বেও জোরাল পারিবারিক সাদৃশ্য রয়েছে। মার্টিন এ. মার্টি ও আর. স্কট অ্যাপলবী তাঁদের বিশালাকার ছয় খণ্ডের গ্রন্থ ফান্ডামেন্টালিস্ট প্রজেক্টের ভূমিকায় যুক্তি তুলে ধরেছেন যে, সকল ‘মৌলবাদ’ নির্দিষ্ট কিছু প্যাটার্ন অনুসরণ করে চলে। আধ্যাত্মিকতার যুদ্ধংদেহী ধরন এগুলো, অনুমিত সঙ্কটের প্রতি সাড়া হিসাবে এদের উদ্ভব ঘটেছে। তারা এমন শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত যাদের সেক্যুলারিস্ট বিশ্বাসসমূহ খোদ ধর্মের প্রতি বৈরী বলে বোধ হয়। মৌলবাদীরা এই যুদ্ধকে প্রচলিত রাজনৈতিক সংগ্রাম মনে করে না, বরং একে মহাজাগতিক শুভ ও অশুভ শক্তির ভেতরকার লড়াই হিসাবে কল্পনা করে। এরা নিশ্চিহ্নতার ভয়ে ভীত; তাই অতীতের নির্দিষ্ট কিছু মতবাদ ও অনুশীলনের নির্বাচিত পুনর্জাগরণের মাধ্যমে নিজেদের আসন-ছাড়া পরিচয়কে সংহত করার প্রয়াস পায়। দূষণ এড়াতে তারা প্রায়ই প্রতি-সংস্কৃতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে সমাজের মূলধারা হতে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়, কিন্তু মৌলবাদীরা বাস্তবতা বর্জিত স্বাপ্নিক নয়। তারা আধুনিকতার বাস্তবভিত্তিক যুক্তিবাদকে আত্মস্থ করে নিয়েছে, ক্যারিশম্যাটিক নেতার নির্দেশনায় তারা এইসব ‘মৌলবিশ্বাসকে’ পরিমার্জিত করে যাতে বিশ্বাসীদের কর্মপরিকল্পনার যোগান দেওয়ার মতো একটি আদর্শ নির্মাণ করা যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত পাল্টা লড়াই করে তারা, ক্রমবর্ধমান সংশয়বাদী এক বিশ্বকে আবার পবিত্র করে তোলার প্রয়াস পায়।

আধুনিক সংস্কৃতির প্রতি এই বৈশ্বিক সাড়ার নিগূঢ়ার্থ অনুসন্ধানের জন্যে তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মবিশ্বাস ইহুদিবাদ, খৃস্টধর্ম ও ইসলামে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা অল্প কয়েকটি মৌলবাদী আন্দোলনের প্রতি দৃষ্টি দিতে চাই আমি। এদের একটির থেকে অন্যটিকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা আলাদাভাবে পর্যালোচনা না করে আমি এসবের বিকাশকে সময়ানুক্রমিকভাবে পাশাপাশি অনুসন্ধান করতে চাই, যাতে এগুলো কতটা গভীরভাবে একই রকম সেটা বুঝতে পারি। আমি বিষয়টিকে আরও বেশি গভীরতায় পরীক্ষা করার আশা করি, যাতে অধিকতর সাধারণ সামগ্রিক জরিপে তুলনায় অনেক বেশি ফল মিলবে। আমি যেসব আন্দোলন বেছে নিয়েছি সেগুলো হলো, আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্ট মৌলবাদ, ইসরায়েলের ইহুদি মৌলবাদ এবং সুন্নী মুসলিম অধ্যুষিত মিশর ও শিয়া ইরানের মুসলিম মৌলবাদ। আমি এটা দাবি করছি না যে আমার আবিষ্কারসমূহ আবিশ্যিকভাবে মৌলবাদের অন্যান্য ধরনের বেলায়ও প্রযোজ্য হবে। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও প্রভাবশালী এই বিশেষ আন্দোলনগুলো কীভাবে সাধারণ ভীতি, উদ্বেগ ও আকাঙ্ক্ষায় তাড়িত হয়েছে সেটা তুলে ধরার আশা করছি, যা আধুনিক সেক্যুলার বিশ্বের অদ্ভুত কঠিন জীবনের বিশেষ কিছু সমস্যার প্রতি সাড়া হিসাবে অস্বাভাবিক মনে হয় না।

সব যুগ ও ঐতিহ্যে সব সময়ই এমন লোক থাকে যারা তাদের সময়ে আধুনিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। কিন্তু আমাদের আলোচ্য মৌলবাদ আবিশ্যিকভাবেই বিংশ শতাব্দীর আন্দোলন। পশ্চিমে প্রথম আবির্ভূত বৈজ্ঞানিক ও সেক্যুলার সংস্কৃতির বিপক্ষে এটি একটি প্রতিক্রিয়া। পাশ্চাত্য সম্পূর্ণ নজীরবিহীন ও একেবারেই ভিন্ন ধরনের সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছে, তবে তখন থেকেই তা বিশ্বের অন্যান্য এলাকায়ও শেকড় গেড়েছে। সুতরাং, এর প্রতি ধর্মের সাড়াও অনন্য ছিল। আমাদের নিজস্ব কালে বিকশিত মৌলবাদী আন্দোলনসমূহের আধুনিকতার সাথে একটি প্রতীকী সম্পর্ক রয়েছে। এগুলো পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে, কিন্তু একে বাদ দিতে পারে না। পশ্চিমা সভ্যতা জগৎ পাল্টে দিয়েছে। ধর্মসহ কোনও কিছুই আর আগের মতো হয়ে উঠতে পারবে না। সারাবিশ্ব জুড়ে মানুষ এই নতুন অবস্থার সাথে যুঝে চলেছে, সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এক সমাজের জন্যে পরিকল্পিত ধর্মীয় ঐতিহ্যকে নতুন করে মূল্যায়ন করতে বাধ্য হয়েছে তারা।

প্রাচীন বিশ্বে একই ধরনের ক্রান্তিকাল গেছে, যার মেয়াদ ছিল মোটামুটিভাবে ৭০০ থেকে ২০০ বিসিই পর্যন্ত; ইতিহাসবিদগণ একে অ্যাক্সিয়াল যুগ বলেন, কারণ মানুষের আধ্যাত্মিক বিকাশের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই সময়টি। খোদ সময় পর্বটি ছিল হাজার হাজার বছরের অর্থনৈতিক ও সেই সুবাদে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ফল ও সংশ্লেষ। বর্তমান ইরাকের সুমের ও প্রাচীন মিশরে এর সূচনা ঘটেছিল। বিসিই চতুর্থ ও তৃতীয় সহস্রাব্দের জনগণ তাদের তাৎক্ষণিক চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে ফসল ফলানোর বদলে কৃষিতে উদ্বৃত্ত ফলানোয় সক্ষম হয়ে উঠেছিল। এর সাহায্যে তারা বাণিজ্য পরিচালনা করে আরও আয় অর্জন করতে পারত। এই বিষয়টিই তাদের প্রথম সভ্যতা গড়ে তুলতে, শিল্পকলার বিকাশ ও ক্রমবর্ধমানহারে শক্তিশালী রাজনীতির বিকাশে সক্ষম করে তুলেছিল: নগর, নগর- রাষ্ট্র ও শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্য। কৃষিভিত্তিক সমাজে ক্ষমতা আর স্থানীয় রাজা বা পুরোহিতদের করায়ত্ত ছিল না; এর কেন্দ্রবিন্দু অন্তত আংশিকভাবে হলেও প্রতিটি সংস্কৃতির সম্পদের উৎস বাজার এলাকায় স্থানান্তরিত হয়েছিল। এমনি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষ শেষতক আবিষ্কার করতে শুরু করে যে তাদের পূর্বপুরুষদের দারুণভাবে উপকারে আসা প্রাচীন প্যাগান মতবাদ এখন আর তাদের অবস্থার সাথে খাপ খাচ্ছে না।

অ্যাক্সিয়াল যুগের নগর ও সাম্রাজ্যে সাধারণ জনগণ প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি ও বিস্তৃত দিগন্তের অধিকারী হয়ে উঠছিল, ফলে স্থানীয় কাল্টসমূহকে সীমিত ও সংকীর্ণ মনে হতে শুরু করেছিল। ঈশ্বরকে কিছু সংখ্যক দেবতার মাঝে সীমিত ভাববার বদলে মানুষ ক্রমবর্ধমানহারে একজন মাত্র বিশ্বজনীন দুর্ভেয় সত্তা ও পবিত্রতার উৎসের উপাসনা শুরু করেছিল। তাদের হাতে প্রচুর অবসর ছিল বলে আরও সমৃদ্ধ অন্তস্থঃ জীবন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়ে উঠেছিল; সেই অনুযায়ী তারা এমন এক আধ্যাত্মিকার আকাঙ্ক্ষা করতে শুরু করে যা কেবল বাইরের উপাদানের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল থাকবে না। সবচেয়ে সংবেদনশীলরা কৃষিভিত্তিক সমাজে প্রতীয়মান হওয়া সামাজিক অবিচারের কারণে অস্বস্তিতে ভুগছিল; সাধারণ কৃষকদের উপর নির্ভরশীল ছিল সেটা যারা উঁচু সংস্কৃতি থেকে কোনওভাবেই কোনও রকম সুবিধা পেত না। পরিণামে পয়গম্বর ও সংস্কারকদের আবির্ভাব ঘটে, এঁরা আধ্যাত্মিক জীবনে সহানুভূতির গুণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে জোর দিতে শুরু করেন: প্রতিটি মানুষের মাঝে পবিত্রতা প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা ও সমাজের অধিকতর নাজুক সদস্যদের বাস্তবভিত্তিক সেবা প্রদানের সদিচ্ছা প্রকৃত ধার্মিকতার পরীক্ষায় পরিণত হয়। এইভাবে অ্যাক্সিয়াল যুগে মানবজাতিকে পথনির্দেশনা দিয়ে চলা মহান কনফেশনাল ধর্মবিশ্বাসসমূহ সভ্য সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ভারতে বুদ্ধধর্মমত ও হিন্দুধর্ম, দূরপ্রাচ্যে কনফুসিয় মতবাদ ও তাওবাদ। এগুলোর প্রধান পার্থক্য সত্ত্বেও অ্যাক্সিয়াল যুগের এইসব ধর্মের ভেতর অনেক সাধারণ মিল ছিল: একক সর্বজনীন দুয়ে ধারণার বিকাশ ঘটাতে এগুলো সবই প্রাচীন ঐতিহ্যের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে, এক ধরনের অন্তস্থঃ আধ্যাত্মিকতার চর্চা করেছে এবং বাস্তবভিত্তিক সহানুভূতির প্রতি জোর দিয়েছে।

আজকের দিনে, যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, আমরা একই ধরনের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। আধুনিক কালের ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে এর শেকড় প্রোথিত, যখন পশ্চিম ইউরোপের মানুষ ভিন্ন ধরনের সমাজের বিবর্তন ঘটাতে শুরু করেছিল। কৃষি উদ্বৃত্তের উপর নির্ভরশীল নয়, এই সমাজ সম্পদকে সীমাহীনভাবে পুনরুৎপাদনে সক্ষম করে তোলা প্রযুক্তির নির্ভর ছিল। সত্যের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভিন্ন জ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী ধর্মীয় পরিবর্তনের ফলে এর আগের চারশত বছরের বিপুল সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের সাথে অর্থনৈতিক পরিবর্তনসমূহ অগ্রসর হয়েছে। এবং আরও একবার ধর্মীয় পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছিল। সারা বিশ্বে জনগণ জানতে পারছিল যে তাদের নাটকীয়ভাবে বদলে যাওয়া পরিবেশে বিশ্বাসের প্রাচীন ধরন আর কাজ করছে না। মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় আলোকন ও সান্ত্বনার যোগান দিতে পারছে না এগুলো। ফলে নারী- পুরুষ অ্যাক্সিয়াল যুগের সংস্কারক ও পয়গম্বরদের মতো ধার্মিক হয়ে ওঠার, অতীতের দর্শনের উপর ভিত্তি করে এমনভাবে নিজেদের গড়ে তোলার প্রয়াস পাচ্ছে যা মানবজাতিকে নিজেদের জন্যে নির্মিত এক নতুন বিশ্বে নিয়ে যাবে। এইসব আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার অন্যতম-আপাত তাকে যতই পরস্পরবিরোধী মনে হোক ন কেন—মৌলবাদ।

আমরা ধারণা করে নিতে চাই যে, অতীতের মানুষ (মোটামুটিভাবে) আমাদের মতোই ছিল; কিন্তু আসলে তাদের আধ্যাত্মিক জীবন অনেক ভিন্ন ছিল। বিশেষ করে ভাবনা, কথোপকথন ও জ্ঞান অর্জনের দ্বিমুখী ধারা গড়ে তুলেছিল তারা, পণ্ডিতরা যার নাম দিয়েছেন মিথোস ও লোগাস। দুটোই ছিল আবশ্যক: সত্যি অর্জনের ক্ষেত্রে উভয়কেই সম্পূরক মনে করা হত, দুটোরই তাদের ক্ষমতার বিশেষ অঞ্চল ছিল। মিথকে মৌল বিষয় মনে করা হত; আমাদের অস্তিত্বের ক্ষেত্রে সময়হীন ও ধ্রুব মনে করা বিষয়সমূহের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল তা। জীবনের উৎস, সংস্কৃতির ভিত্তি ও মানব মনের গভীরতর স্তরে দৃষ্টি দিত তা। বাস্তব বিষয়আশয়ের সাথে মিথের কোনও সম্পর্ক ছিল না, ছিল অর্থের সাথে। আমাদের জীবনের এক ধরনের তাৎপর্য খুঁজে না পেলে, আমরা মরণশীল নারী-পুরুষ অনায়াসে হতাশায় ডুবে মরি। সমাজের মিথোস মানুষকে এক প্রেক্ষিতের যোগান দেয় যা তাদের দৈনন্দিন জীবনের একটা অর্থ তুলে ধরে। এটা চিরন্তন ও সর্বজনীনের প্রতি তাদের মনোযোগ চালিত করে। আমরা যাকে অবচেতন মন বলব, এটা তাতেও প্রোথিত ছিল। আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা হবে বলে মনে করা হয়নি এমন সব বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী ছিল মনস্তত্ত্বের প্রাচীন ধরন। মানুষ পাতালে অবতরণ করে গোলকধাঁধায় সংগ্রামরত বা দানবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত বীরদের কাহিনী বর্ণনার সময় অবচেতন বলয়ের অস্পষ্ট এলাকাসমূহকে আলোয় তুলে নিয়ে আসত, একেবারেই যোক্তিক মনের অনুসন্ধানে যা বোধগম্য ছিল না; তবে আমাদের অভিজ্ঞতা ও আচরণের উপর যার গভীর প্রভাব ছিল। আমাদের আধুনিক সমাজে মিথের মৃত্যুর ফলে আমাদের অন্তস্থঃ জগতের মোকাবিলা করতে সাইকোঅ্যানালিসিসের বিজ্ঞানের উদ্ভাবন করতে হয়েছে।

যৌক্তিক প্রমাণ দিয়ে মিথকে তুলে ধরা সম্ভব নয়; এর আন্তর্দৃষ্টিসমূহ অধিকতর স্বজ্ঞাপ্রসূত: শিল্পকলা, সঙ্গীত, কবিতা বা ভাস্কর্যের মতো। কেবল কাল্ট, আচার ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ধারণ করা হলেই মিথ বাস্তবে পরিণত হয়, উপাসকদের উপর নান্দনিকতার ভিত্তিতে কাজ করে, তাদের ভেতর পবিত্র তাৎপর্যের বোধ জাগিয়ে তোলে ও অস্তিত্বের গভীরতর প্রবাহ উপলব্ধিতে সক্ষম করে তোলে। মিথ ও কাল্ট পরস্পরের সাথে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে কোনটার আবির্ভাব আগে ঘটেছে সেটা পণ্ডিতি বিতর্কের বিষয় হতে পারে: পৌরাণিক বিবরণ নাকি এর সাথে সংশ্লিষ্ট আচার।o মিথ আবার অতীন্দ্রিয়বাদের সাথেও সম্পর্কিত ছিল: স্বজ্ঞাপ্রসূত অন্তর্দৃষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সকল সংস্কৃতিতে বিকশিত মনোসংযোগ ও একাগ্রতার ধাপবিশিষ্ট অনুশীলনের মাধ্যমে মনের গভীরে অবতরণ। কাল্ট বা মরমী চর্চা ছাড়া ধর্মের মিথসমূহ বিমূর্ত রয়ে যায় ও অবিশ্বাস্য ঠেকে, ঠিক যেমন আমাদের বেশিরভাগের কাছেই সঙ্গীতের সুর অস্পষ্ট রয়ে যায় ও এর সৌন্দর্য উপলব্ধির জন্যে বিভিন্ন যান্ত্রিক অনুষঙ্গ দিয়ে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে।

প্রাক-আধুনিক বিশ্বে ইতিহাস সম্পর্কে মানুষের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তারা আসলে কী ঘটেছিল তা নিয়ে আমাদের চেয়ে কম আগ্রহী ছিল। তারা বরং ঘটনার নিগূঢ় অর্থের ব্যাপারেই বেশি সংশ্লিষ্ট ছিল। ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহকে সময়ের দূরবর্তী প্রান্তের অনন্য সাধারণ ব্যাপার হিসাবে দেখা হত না, বরং একে অটল, সময়হীন বাস্তবতার প্রকাশ মনে করা হত। এই কারণে ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করার প্রবণতা দেখাত, কারণ সূর্যের নিচে কোনও কিছুই নতুন ছিল না। ঐতিহাসিক বিবরণসমূহ চিরন্তন মাত্রাকে বের করে আনার প্রয়াস পেত। এভাবে প্রাচীন ইসরায়েলিরা মিশর থেকে পালিয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করার সময় আসলে কী ঘটেছিল সেটা আর আমরা জানতে পারি না। পরিকল্পিতভাবেই এই কাহিনীকে মিথ হিসাবে লেখা হয়েছে, এবং একে যাত্রার অন্যান্য কাহিনী, গভীরে প্লাবিত হওয়া ও এক নতুন বাস্তবতা সৃষ্টির জন্যে দেবতাগণের সাগর দুই ভাগ করার কাহিনীর সাথে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রতি বছর পাসওভার সেদারের আচারে ইহুদিরা এই মিথের অভিজ্ঞতা লাভ করে, এই উৎসব ওদের জীবনে কাহিনীটিকে নতুন করে ফিরিয়ে এনে একে তাদের নিজেদের কাহিনীতে পরিণত করতে সাহায্য করে। কেউ বলতে পারেন ঐতিহাসিক ঘটনাকে এইভাবে মিথে পরিণত করা না হলে, এবং অনুপ্রেরণাসৃষ্টিকারী কাল্টে রূপান্তরিত না করলে তা ধর্মীয় হতে পারবে না। ঠিক বাইবেলে যেভাবে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, মিশর থেকে এক্সোডাস সেভাবেই ঘটেছিল কিনা, এই প্রশ্ন উত্থাপন বা একে সত্যি প্রমাণ করার জন্যে বৈজ্ঞানিক বা ও ঐতিহাসিক প্রমাণ দাবি করা গল্পের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্যকে ভুলভাবে গ্রহণ করার শামিল হবে। এটা হবে মিথোস-কে লোগোসে-র সাথে গুলিয়ে ফেলার মতো।

লোগোসও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। লোগোস হচ্ছে এই বিশ্বে নারী- পুরুষকে কর্মক্ষম রাখার যৌক্তিক, বাস্তবভিত্তিক ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা। আজকের দিনে পশ্চিমে আমরা হয়তো মিথোসের বোধ হারিয়ে ফেলেছি, কিন্তু লোগোসের সাথে আমরা বেশ ভালোভাবেই পরিচিত। এটাই আমাদের সমাজের ভিত্তি। মিথের বিপরীতে লোগোস-কে অবশ্যই বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত হতে হবে ও বাইরের বাস্তবতার সাথে মিলতে হবে, যদি একে কার্যকর হতে হয়। জাগতিক বিশ্বে একে দক্ষতার সাথে ক্রিয়াশীল থাকতে হবে। আমরা যখন কোনও কিছু করতে যাই, কোনও কাজ সম্পাদন করতে চাই বা অন্য লোককে বিশেষ কোনও কাজে সম্মত করাতে চেষ্টা করি তখনই এই যৌক্তিক, আলোচনামূলক যুক্তি প্রয়োগ করে থাকি। লোগোস বাস্তবভিত্তিক। সূচনা ও ভিত্তির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপকারী মিথের বিপরীতে লোগোস দৃঢ়তার সাথে সামনে অগ্রসর হয় ও প্রাচীন দর্শনকে ব্যাখ্যা করার লক্ষ্য নতুন কিছু আবিষ্কারের চেষ্টা করে, পরিবেশের উপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ অর্জন করে, ও আনকোরা কিছু আবিষ্কার করে এবং নতুন কিছু উদ্ভাবন করে।

প্রাক আধুনিক বিশ্বে মিথোস ও লোগোস উভয়কেই অপহিার্য মনে করা হত। একটি ছাড়া অন্যটি অচল হয়ে পড়ত। কিন্তু তারপরেও এদুটো ছিল আবিশ্যিকভাবেই ভিন্ন; পৌরাণিক ও যৌক্তিক আলোচনাকে গুলিয়ে ফেলা বিপজ্জনক মনে করা হত। ভিন্ন ভিন্ন ছিল তাদের কাজ। মিথ যৌক্তিক ছিল না; এর বর্ণনা প্রায়োগিকভাবে তুলে ধরা যাবে বলে মনে হত না। এটা অর্থের একটা পরিপ্রেক্ষিত যোগাত যা আমাদের কর্মকাণ্ডকে মূল্যবান করে তুলত। মিথোসকে বাস্তবভিত্তিক কোনও নীতির ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করবেন আপনি, এমনটা ভাবা হত না। সেটা করে থাকলে ফলাফল ভয়াবহ রকম মারাত্মক হয়ে উঠতে পারত; কারণ মনের অন্তস্থঃ বিশ্বে যা চমৎকারভাবে কাজ করে সেটা চট করে বাইরের কর্মকাণ্ডে প্রয়োগ সম্ভব ছিল না। উদাহরণ স্বরূপ, পোপ দ্বিতীয় আরবান যখন ১০৯৫ সালে প্রথম ক্রুসেডের ডাক দেন, তার পরিকল্পনা ছিল লোগোসের বলয়ের। তিনি চেয়েছিলেন ইউরোপের নাইটরা যেন পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘাত বন্ধ করে ও পাশ্চাত্য ক্রিশ্চান বিশ্বের ভিত্তি বিনষ্ট না করে চলে। এবং সেই শক্তিটুকু যেন তারা মধ্যপ্রাচ্যে ব্যয় করে তাঁর চার্চের শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে। কিন্তু এই সামরিক অভিযান লোক মিথলজি, বাইবেলিয় উপকথা ও প্রলয়বাদী ফ্যান্টাসির সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে গেলে বিপর্যয়কর হয়ে দাঁড়ায় তার পরিণতি; বাস্তবক্ষেত্রে, সামরিক দিক থেকে ও নৈতিকভাবেও। দীর্ঘ ক্রুসেডিয় কর্মকাণ্ডের দীর্ঘ সময় জুড়ে ব্যাপারটা এমন ছিল যে যখনই লোগোস আধিপত্য বজায় রেখেছে তখনই ক্রুসেডাররা সাফল্যের মুখ দেখেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে চমৎকার তৎপরতা দেখিয়েছে তারা, মধ্যপ্রাচ্যে উপযোগি কলোনী প্রতিষ্ঠা করেছে এবং স্থানীয় জনগণের সাথে অনেক বেশি ইতিবাচকভাবে মিশতে শিখেছে। তবে যখনই ক্রুসেডাররা তাদের নীতির ভিত্তিতে পৌরাণিক বা নিগূঢ় দর্শন তৈরি করতে গেছে, সাধারণত তারা পরাস্ত হয়েছে ও ভয়ানক সব নিষ্ঠুরতার জন্ম দিয়েছে।

লোগোসের নিজস্ব সীমাবদ্ধতাও ছিল বৈকি। মানুষের বেদনা বা বিষাদের প্রশমন ঘটাতে পারত না এটা। যৌক্তিক যুক্তি-তর্ক ট্র্যাজিডির কোনও অর্থ করতে পারত না। লোগোস মানব জীবনের পরম মূল্য সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর যোগাতে পারেনি। একজন বিজ্ঞানী বিভিন্ন বস্তুকে আরও কার্যকরভাবে ক্রিয়াশীল করে তুলতে পারতেন, ভৌত বিশ্ব সম্পর্কে আবিষ্কার করতে পারতেন অসাধারণ সব নতুন তথ্য, কিন্তু তিনি জীবনের অর্থ ব্যাখ্যা করতে পারতেন না।” এটাই ছিল মিথ আর কাল্টের রাজত্ব।

তবে অষ্টাদশ শতাব্দী নাগাদ ইউরোপ ও আমেরিকার জনগণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এমন বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করে যে তারা ভাবতে শুরু করেছিল যে লোগোসই সত্যি জানার একমাত্র উপায়, মিথোসকে তারা মিথ্যা ও কুসংস্কার বলে নাকচ করে দিতে শুরু করে। এটাও ঠিক যে যে নতুন বিশ্ব নির্মাণ করতে যাচ্ছিল তারা সেটা প্রাচীন পৌরাণিক আধ্যাত্মিকতার গতিশীলতার সাথে বিরোধমূলক হয়ে উঠেছিল। আধুনিক বিশ্বে আমাদের ধর্মীয় অভিজ্ঞতা বদলে গেছে, ক্রমবর্ধমান হারে মানুষ বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদকেই কেবল সত্যি হিসাবে দেখতে শুরু করায় তারা তাদের ধর্মবিশ্বাসের মিথোসকে প্রায়শঃই লোগোসে পরিণত করার প্রয়াস পেয়েছে। মৌলবাদীরাও একই প্রয়াস পেয়েছে। এই বিভ্রান্তি আরও বেশি করে সমস্যার সৃষ্টি করেছে।

আমাদের বিশ্ব কীভাবে বদলে গেছে সেটা আমাদের বুঝতে হবে। সুতরাং, এই বইয়ের প্রথম অংশ পঞ্চদশ শতকের শেষে ও সপ্তম শতকের গোড়ায় ফিরে যাবে, যখন পশ্চিম ইউরোপের জনগণ তাদের নতুন বিজ্ঞানের উদ্ভাবন ঘটাতে যাচ্ছিল। ধর্মবিশ্বাসের প্রাচীন ধরনগুলো কীভাবে কাজ করত বোঝার জন্যে আমরা প্রাক আধুনিক কৃষিভিত্তিক সমাজের পৌরাণিক ধর্মানুরাগও পর্যালোচনা করব। সাহসী নতুন বিশ্বে প্রচলিত ধারায় ধার্মিক থাকা ক্রমবর্ধমানহারে কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। আধুনিকায়ন সব সময়ই একটা বেদনাদায়ক প্রক্রিয়া ছিল। সমাজের মৌলিক পবির্তন যখন বিশ্বকে অচেনা ও শনাক্তের অতীত করে তোলে মানুষ তখন বিচ্ছিন্ন ও দিশাহারা বোধ করতে শুরু করে। আমরা ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রিশ্চান, ইহুদি জনগণ ও মিশর ও ইরানের মুসলিমদের উপর আধুনিকতার প্রভাব অনুসন্ধানের চেষ্টা করব। তাহলেই আমরা উনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদে মৌলবাদীরা ধর্মবিশ্বাসের এই নতুন ধরন সৃষ্টি করতে যাওয়ার সময় তারা আসলে কী করার চেষ্টা করছিল জানার মতো একটা অবস্থানে পৌঁছাতে পারব আমরা।

মৌলবাদীরা মনে করে তারা বুঝি তাদের পবিত্রতম মূল্যবোধকে আক্রান্তকারী শক্তির বিরুদ্ধে লাড়াই করছে। যুদ্ধের সময় সংঘাতে লিপ্ত থাকে যারা তাদের পক্ষে একে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি উপলব্ধি করা দারুণ কঠিন হয়। আমরা দেখব যে, আধুনিকায়ন সমাজের মেরুকরণের দিকে চালিত করেছে, তবে অনেক সময় বিরোধের অবনতি ঠেকাতে আমাদের অবশ্যই অন্যপক্ষের বেদনা ও দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার প্রয়াস পেতে হবে। আমাদের ভেতর যারা- আমিসহ আধুনিকতার স্বাধীনতা ও সাফল্য ভোগ করে থাকি তাদের পক্ষে ধর্মীয় মৌলবাদীদের ক্ষেত্রে সেসবের কারণে সৃষ্ট দুর্গতি বোঝা কঠিন। তবু আধুনিকায়ন প্রায়শঃই মুক্তি নয় বরং আক্রমণাত্মক হামলা হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। আধুনিক বিশ্বে ইহুদি জাতির তুলনায় খুব কমসংখ্যকই ভোগান্তির স্বীকার হয়েছে; সুতরাং, পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে আধুনিকায়নবাদী পাশ্চাত্য সমাজের সাথে তাদের বেদনাদায়ক সাক্ষাতের ঘটনা দিয়ে শুরু করাই সবচেয়ে মানানসই হবে, যা কোনও কোনও ইহুদিকে পরে নতুন বিশ্বে সাধারণ বিষয়ে পরিণত হবে এমন নানা ধরনের রণকৌশল, অবস্থান ও নীতিমালার উদ্ভাবনের পথে চালিত করেছিল।

 

০১. ইহুদি : অগ্রপথিক (১৪৯২-১৭০০)

১৪৯২ সালে স্পেনে তিনটি দারুণ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। সেই সময় এই ঘটনাগুলোকে অসাধারণ মনে করা হয়েছিল, কিন্তু পেছনে তাকিয়ে আমরা বুঝতে পারি এসব ছিল পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে পশ্চিম ইউরোপে ধীরে ধীরে বেদনাদায়কভাবে জন্ম নিতে চলা এক নতুন সমাজেরই বৈশিষ্ট্য। এই বছরগুলো আমাদের আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিকাশ প্রত্যক্ষ করেছে। সুতরাং ১৪৯২ সাল আমাদের বেশ কিছু চিন্তা-ভাবনা ও দোলাচলেরও উপরও আলোকপাত করে। প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল জানুয়ারির ২ তারিখে, এই দিন ক্যাথলিক সম্রাট-সম্রাজ্ঞী রাজা ফার্দিনান্দ ও রানি ইসাবেলার সেনাবাহিনী, যাদের বিয়ে সম্প্রতি প্রাচীন ইবারিয় পেনিসুলার রাজ্য আরাগন ও ক্যাসলকে একসূত্রে বেঁধেছিল, নগর রাষ্ট্র গ্রানাদা দখল করে নেয়। গভীর আবেগের সাথে নগরবাসীরা নগর প্রাচীরে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিশ্চান পতাকা ওড়ানো প্রত্যক্ষ করে। খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে গোটা ইউরোপ জুড়ে বিজয়ের সুরে ঘণ্টা বাজতে শুরু করে, কারণ ক্রিশ্চান বিশ্বে গ্রানাদাই ছিল শেষ মুসলিম শক্তঘাঁটি। মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রুসেডসমূহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। তবে অন্তত ইউরোপ থেকে মুসলিমদের বহিষ্কার করা গেছে। ১৪৯৯ সালে স্পেনের মুসলিমদের ক্রিশ্চান ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ বা দেশত্যাগের মধ্যে যেকোনও একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়, এরপর কয়েক শতাব্দী ধরে ইউরোপ মুসলিম শূন্য হয়ে থাকবে। গুরুত্ববহ এই বছরের দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ৩১শে মার্চ, এই দিন ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা এডিক্ট অভ এক্সপালশান স্বাক্ষর করেন; স্পেনকে ইহুদি মুক্ত করাই ছিল এর লক্ষ্য। ব্যাপ্টিজম বা দেশত্যাগের ভেতর যেকোনও একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় তাদের। অনেক ইহুদিই ‘আল-আন্দালুসের’ (প্রাচীন মুসলিম রাজ্যকে এ নামেই ডাকা হত) সাথে নিজেদের এমনভাবে সম্পর্কিত মনে করত যে, ক্রিশ্চান ধর্মে দীক্ষা নিয়ে স্পেনেই থেকে যায় তারা, কিন্তু আনুমানিক ৮০,০০০ ইহুদি সীমানা পেরিয়ে পর্তুগালে পাড়ি জমায়, অন্যদিকে ৫০,০০০ ইহুদি পালিয়ে যায় নতুন মুসলিম অটোমান সাম্রাজ্যে। এখানে তাদের স্বাগত জানানো হয়। তৃতীয় ঘটনাটি ক্রিশ্চানদের গ্রানাদা অধিকার করে নেওয়ার সময় উপস্থিত এক ব্যক্তির সাথে সম্পর্কিত। আগস্ট মাসে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলার অনুগ্রহভাজন ক্রিস্টোফার কলম্বাস ভারতের সাথে নুতন বাণিজ্য-পথ আবিষ্কারের লক্ষ্যে জাহাজ ভাসান, কিন্তু তার বদলে আমেরিকা আবিষ্কার করে বসেন তিনি।

এইসব ঘটনা যুগপৎ প্রাথমিক আধুনিক কালের মাহাত্ম্য ও বিনাশ প্ৰতিফলিত করে। কলম্বাসের অভিযান যেমন জোরালভাবে দেখিয়েছে যে, ইউরোপের জনগণ এক নতুন বিশ্বের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। ওদের দিগন্ত প্রসারিত হচ্ছিল, এপর্যন্ত বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অজানা এক ভৌগলিক বলয়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছিল তারা। এই সাফল্য তাদের বিশ্বের অধিপতিতে পরিণত করবে। কিন্তু আধুনিকতার অন্ধকার দিকও ছিল। ক্রিশ্চান স্পেন ছিল ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী ও অগ্রসর রাজ্য। ক্রিশ্চান বিশ্বের অন্যান্য অংশে বিকাশমান বিভিন্ন রাষ্ট্রের মতো একটি আধুনিক কেন্দ্রিভূত রাষ্ট্র নির্মাণের পথে ছিলেন ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা। এমন একটি রাষ্ট্র মধ্যযুগকে বৈশিষ্ট্যায়িত করে তোলা গিল্ড, কর্পোরেশন বা ইহুদি সম্প্রদায়ের মতো প্রাচীন স্বায়ত্তশাসিত, স্ব-পরিচালিত প্রতিষ্ঠানসমূহকে সহ্য করতে পারে না। গ্রানাদা অধিকারের ভেতর দিয়ে স্পেনের একীভূতকরণের প্রক্রিয়ার পরপরই জাতিগত পরিশুদ্ধির একটি প্রক্রিয়া শেষ করা হয়। ইহুদি ও মুসলিমরা তাদের আবাস হারায়। কিছু কিছু মানুষের কাছে আধুনিকায়ন ছিল ক্ষমতায়ন, মুক্তিদায়ী এবং উত্তেজনাকর। অন্যরা একে নির্যাতনমূলক, আগ্রাসী ও প্রলয়ঙ্করী হিসাবে প্রত্যক্ষ করেছে এবং করে যাবে। পাশ্চাত্য আধুনিকতা পৃথিবীর অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে এই একই প্যাটার্ন অব্যাহত থাকবে। এই আধুনিকায়ন কর্মসূচি ছিল আলোকসৃষ্টিকারী, শেষ পর্যন্ত তা মানবিক মূল্যবোধসমূহকে উপরে তুলে ধরবে, কিন্তু তা আগ্রাসীও ছিল। বিংশ শতাব্দীতে প্রাথমিকভাবে আধুনিকতাকে আক্রমণ হিসাবে প্রত্যক্ষকারীরাই পরিণত হবে মৌলবাদীতে।

কিন্তু সেটা তখনও দূর ভবিষ্যতের গর্ভে। পঞ্চদশ শতকের শেষদিকে ইউরোপের জনগণের পক্ষে তাদের সূচিত পরিবর্তনের ব্যাপকতা উপলব্ধি করা সম্ভব ছিল না। পরবর্তী তিন শো বছরের পরিক্রমায় ইউরোপ কেবল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবেই সমাজসমূহের পরিবর্তন ঘটাবে না, বরং এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব সংগঠিত করবে। বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ পরিণত হবে যুগের বিধানে, ধীরে ধীরে মন ও হৃদয়ের পুরোনো আলখেল্লাকে বিতাড়িত করবে। তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা গ্রেট ওয়েস্টার্ন ট্রান্সফর্মেশন হিসাবে আখ্যায়িত এই সময়কালের উপর আলোকপাত করব। তবে এর পূর্ণাঙ্গ তাৎপর্য উপলব্ধির আগে প্রাক আধুনিক কালের মানুষ কীভাবে বিশ্বকে প্রত্যক্ষ করত সেটা দেখতে হবে। স্পেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সোৎসাহে ছাত্র ও শিক্ষকগণ ইতালিয় রেনেসাঁর নানা নতুন ধারণা নিয়ে আলোচনায় মেতে ছিলেন। ম্যাগনেটিক কম্পাস বা জ্যোতির্বিজ্ঞানের নবতর ধারণার মতো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সাহায্য ছাড়া কলম্বাসের অভিযান সম্ভব ছিল না। ১৪৯২ সাল নাগাদ পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ দর্শনীয়ভাবে কার্যকর হয়ে উঠছিল। মানুষ আগের চেয়ে ঢের বেশি পরিপূর্ণভাবে গ্রিকরা যাকে লোগোস আখ্যায়িত করেছে তার সম্ভাবনা আবিষ্কার করছিল, সব সময়ই যা একেবারে নতুন কিছুর আকাঙ্ক্ষা করছিল। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণেই ইউরোপিয়রা সম্পূর্ণ নতুন এক বিশ্ব আবিষ্কার করে, পরিবেশের উপর অভাবনীয় নিয়ন্ত্রণ লাভ করতে শুরু করে। কিন্তু তখনও তারা মিথোসকে নাকচ করে দেয়নি। বিজ্ঞানের সাথে পরিচয় ছিল কলম্বাসের, কিন্তু তখনও তিনি প্রাচীন পৌরাণিক বিশ্বেই স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। তিনি ধর্মান্তরিত এক ইহুদি পরিবারের সন্তান ছিলেন বলেই মনে হয়, ইহুদিবাদের মরমী ঐতিহ্য কাব্বালায় তাঁর আগ্রহ রয়ে গিয়েছিল; কিন্তু আবার ধর্মপ্রাণ ক্রিশ্চান ছিলেন তিনি; ক্রাইস্টের পক্ষে গোটা বিশ্বকে অধিকার করতে চেয়েছেন। ভারতে পৌছানোর পর জেরুজালেমের সামরিক অধিকার লাভের জন্যে সেখানে একটি ক্রিশ্চান ঘাঁটি স্থাপনের আশা করেছিলেন তিনি। ইউরোপের মানুষ আধুনিতার পথে যাত্রা শুরু করেছিল, কিন্তু আমাদের মতো পূর্ণাঙ্গ আধুনিক হয়ে ওঠেনি। ক্রিশ্চান ধর্মের বিভিন্ন মিথ যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক অভিযানে তখনও ওদের কাছে অর্থ যোগাচ্ছিল।

তাসত্ত্বেও ক্রিশ্চান ধর্ম বদলে যাচ্ছিল। স্পেনিয়ার্ডরাই কাউন্সিল অভ ট্রেন্ট সূচিত কাউন্টার রিফর্মেশনের (১৫৪৫-৬৩) নেতায় পরিণত হবে। এটা ছিল পুরোনো ক্যাথলিজমকে নতুন ইউরোপের সংহত দক্ষতার সাথে এক তলে আনয়নকারী একটি আধুনিকায়ন কর্মসূচি। আধুনিক রষ্ট্রের মতো চার্চ অধিকতর কেন্দ্রিভূত সংস্থায় পরিণত হয়। কাউন্সিল পোপ ও বিশপদের ক্ষমতার সংস্কার করে, প্রথমবারের মতো মতবাদগত সমরূপতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সকল বিশ্বাসীর উদ্দেশ্যে একটি ক্যাটেশিজম জারি করা হয়। যাজকদের আরও উন্নত মানের শিক্ষিত হয়ে ওঠার প্রয়োজন ছিল, যাতে তাঁরা আরও কার্যকরভাবে ধর্ম শিক্ষা দিতে পারেন। সাধারণ মানুষের লিটার্জি ও ভক্তি প্রকাশের বিভিন্ন অনুশীলনকে যৌক্তিক করা হয়; এক শতাব্দী আগেও অর্থপূর্ণ ছিল যেসব আচার সেগুলো এখন আর নতুন যুগের জীবনযাত্রায় কাজ আসছিল না বলে বাতিল করে দেওয়া হয়। স্পেনের বহু ক্যাথলিক ওলন্দাজ মানবতাবাদী দেসিদেরিয়াস ইরাসমাসের (১৪৬৬-১৫৩০) রচনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। মৌলবিষয়ে ফিরে গিয়ে ক্রিশ্চান ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। তাঁর শ্লোগান ছিল, আদ ফন্তেস: ‘ফিরে চলো ঝর্নায়!’ ইরাসমাসের বিশ্বাস ছিল প্রাথমিক চার্চের প্রকৃত ক্রিশ্চান ধর্মবিশ্বাস প্রাণহীন কিছু মধ্যযুগীয় ধর্মতত্ত্বের নিচে চাপা পড়ে গেছে। পরবর্তীকালের বিভিন্ন সংযোজন ছিন্ন করে উৎসে-বাইবেল ও ফাদার্স অভ দা চার্চ-ফেরার মাধ্যমে ক্রিশ্চানরা গস্পেলের সজীব মূল বিষয় উদ্ধার করবে ও এক নবজন্মের অভিজ্ঞতা লাভ করবে।

কাউন্টার রিফর্মেশনের প্রধান স্পেনিয় অবদান ছিল অতীন্দ্রিয়। অনেকটা মহান নাবিকদের ভৌত বিশ্বে নতুন নতুন অঞ্চল আবিষ্কার করে চলার মতো ইবারিয়ার অতীন্দ্রিয়বাদীরা আধ্যাত্মিক জগতের অভিযাত্রীতে পরিণত হয়। অতীন্দ্রিয়বাদ ছিল মিথোসের আওতাভুক্ত, যৌক্তিক অংশের কাছে দুর্গম অবচেতন জগতেই এর কর্মকাণ্ড, ভিন্ন কৌশলে প্রত্যক্ষ করতে হত একে। তাসত্ত্বেও স্পেনের অতীন্দ্রিয়বাদী সংস্কারকগণ আধ্যাত্মিকতার এই ধরনটিকে কম অগোছাল ও অন্তর্মুখী, এবং অপরিপক্ক পরামর্শকদের উপর কম নির্ভরশীল করতে চেয়েছিলেন। জন অভ দ্য ক্রস (১৫৫২-৯১) অধিকতর সন্দেহজনক ও কুসংস্কারমূলক ভক্তি উৎখাত করে অতীন্দ্রিয়বাদী প্রক্রিয়াকে অনেকটা পদ্ধতিগত রূপ দেন। নতুন কালের অতীন্দ্রিয়বাদীদের এক স্তর থেকে অন্য স্তরে অগ্রসর হওয়ার সময় কী প্রত্যাশা করতে হবে সেটা জানার প্রয়োজন ছিল, তাদের অবশ্যই অন্তস্থঃ জীবনের বিভিন্ন সংকট ও বিপদের মোকাবিলা করার কৌশল শিখতে হত ও আধ্যাত্মিক শক্তিসমূহের কার্যকর পরিমিত ব্যবহার জানতে হত।

অবশ্য আরও আধুনিক ও অত্যাসন্ন বিভিন্ন পরিবর্তনের আভাস ছিল সাবেক সৈনিক ইগনাশিয়াস অভ লায়োলা (১৪৯১-১৫৫৫) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সোসায়েটি অভ জেসাস। এই সংঘ এমন এক ধরনের দক্ষতা ও কার্যকারিতা ধারণ করত যা আধুনিক পশ্চিমের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হবে। ইগনাশিয়াস বাস্তব ক্ষেত্রে মিথোসের শক্তি পরীক্ষা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তাঁর জেস্যুইটদের জন অভ দ্য ক্রস উদ্ভাভিত দীর্ঘ ধ্যানমূলক অনুশীলনের অবকাশ ছিল না। তাঁর স্পিরিচুয়াল এক্সারসাইজ তিরিশ দিন মেয়াদী সময়-দক্ষ একটি পদ্ধতিগত নির্জনবাসের ব্যবস্থা দিয়েছিল, ফলে প্রত্যেক জেস্যুইট অতীন্দ্রিয়বাদের একটি ঝটিকা শিক্ষা লাভ করত। পরিপূর্ণভাবে যিশুতে দীক্ষা লাভের পর একজন ক্রিশ্চান তার অগ্রাধিকারসমূহ বিন্যস্ত করে নিতে পারলে, কর্মক্ষেত্রে নামতে প্রস্তুত হতে পারত। পদ্ধতি, শৃঙ্খলা ও সংগঠনের উপর এই গুরুত্বারোপ নতুন বিজ্ঞানের মতোই ছিল। ঈশ্বরকে এক গতিশীল শক্তি হিসাবে প্রত্যক্ষ করা হত, যা সারাবিশ্বের জেস্যুইটদের অনেকটা অভিযাত্রীদের মতোই পরিচালিত করত। ফ্রান্সিস হাবিয়ের (১৫০৬-৫২) জাপানকে, রবার্ট দি নোবিলি (১৫৭৭-১৬৫৬) ভারতকে, এবং মেত্তি ও রিক্কি (১৫৫২-১৬১০) চীনকে ইভাঞ্জেলাইজ করেছেন। প্রাথমিক আধুনিক স্পেনে ধর্মকে তখনও পেছনে ফেলে আসা হয়নি। নিজেকেই নিজে সংস্কারে সক্ষম ছিল তা, এবং নিজস্ব আওতা ও আদর্শকে আরও সামনের দিকে নিয়ে যেতে আধুনিকতার বিভিন্ন অন্তর্দৃষ্টি আত্মস্থ করতে পারছিল।

সুতরাং, প্রাথমিক আধুনিক স্পেন ছিল আধুনিকতার অগ্রসর প্রহরীর অংশ। তবে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলাকে এইসব শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। এ যাবত স্বাধীন ও বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন রাজ্যকে একত্র করার প্রয়াস পাচ্ছিলেন তাঁরা; পরস্পরের সাথে সংযুক্ত করতে হচ্ছিল সেগুলোকে। ১৪৮৩ সালে এই দুই রাজণ্য তাঁদের একীভূত অঞ্চলে আদর্শগত সমরূপতা নিশ্চিত করতে নিজস্ব স্প্যানিশ ইনকুইজিশনের প্রচলন করেন। একটি আধুনিক পরম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করছিলেন তাঁরা, কিন্তু তখনও তাঁদের হাতে প্রজাদের অবারিত বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা দেওয়ার মতো সম্পদ ছিল না। ইনকুইজিটররা ভিন্নমতাবলম্বীদের খুঁজে বের করে তাদের ‘হেরেসি’ (ধর্মহীনতা) ত্যাগে বাধ্য করতেন: এই শব্দটির আদি গ্রিক অর্থ ছিল ‘কারও নিজের পথে যাওয়া। স্প্যানিশ ইনকুইজিশন অতীতের বিশ্বকে ধরে রাখার প্রাচীন কোনও প্রয়াস ছিল না। আধুনিকায়নের প্রতিষ্ঠান ছিল এটা, জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজা-রানি এর পত্তন ঘটিয়েছিলেন। তাঁরা খুব ভালো করেই জানতেন, ধর্ম একটি বিস্ফোরক ও বিপ্লবী শক্তিতে পরিণত হতে পারে। ইংল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে প্রটেস্ট্যান্ট শাসকগণ একইভাবে তাঁদের ক্যাথলিক ‘ভিন্নমতাবলম্বীদের’ প্রতি খড়গহস্ত ছিলেন; তাদেরও রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ বিবেচনা করা হয়েছিল। আমরা দেখব এই ধরনের নির্যাতন ছিল আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ারই অংশ। স্পেনে ইনকুইজিশনের প্রধান শিকার ছিল ইহুদিরা; এই অধ্যায়ে আমরা আগ্রাসী আধুনিকতার প্রতি ইহুদি জনগণের সাড়াই আলোচনা করব। তাদের অভিজ্ঞতা বিশ্বের অন্যান্য অংশের মানুষ কীভাবে আধুনিকতার প্রতি সাড়া দেবে সেই সম্পর্কে বিভিন্ন উপায়ের অনেকগুলোই তুলে ধরে।

আল-আন্দালুসের পুরোনো মুসলিম এলাকার স্প্যানিশ রিকনকুইস্তা ইবারিয়ার ইহুদিদের পক্ষে ছিল রীতিমতো বিপর্যয়। ইসলামি রাষ্ট্রে ইহুদিবাদ, ক্রিশ্চানিটি ও ইসলামের মতো তিনটি ধর্ম পাঁচ শো বছরেরও বেশি কাল একসাথে সম্প্রীতির ভেতর বাস করে এসেছে। বিশেষ করে ইহুদিরা স্পেনে সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক রেনেসাঁ উপভোগ করেছে, ইউরোপের বাকি অংশে ইহুদি জনগণের নিয়তিতে পরিণত হওয়া বিভিন্ন হত্যালীলার শিকার হতে হয়নি তাদের। কিন্তু ক্রিশ্চান সেনাবাহিনী ইসলামের আরও অনেক অনেক ভূখণ্ড অধিকার করে পেনিনসুলা ধরে ক্রমে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে অ্যান্টি-সেমিটিজমকেও সাথে করে নিয়ে আসছিল তারা। ১৩৭৮ ও ১৩৯১ সালে আরাগন ও ক্যাস্তিলের ইহুদি সম্প্রদায় ক্রিশ্চানদের হাতে আক্রান্ত হয়েছিল, ইহুদিদের জোর করে দীক্ষা দানের ঝর্নার কাছে এনে মরণ যন্ত্রণা দিয়ে ক্রিশ্চান ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেছিল তারা। আরাগনে দোমেনিকান ফ্রায়ার ভিনসেন্ত ফেরারের (১৩৫০-১৪১৯) ধর্মপ্রচারণা নিয়মিতভাবেই অ্যান্টি-সেমিটিক দাঙ্গা উস্কে দিত। ফেরার র‍্যাবাই ও ক্রিশ্চানদের ভেতর বিভিন্ন বিতর্কেরও আয়োজন করতেন, ইহুদি ধর্মকে খাট করাই এর উদ্দেশ্য ছিল। কোনও কোনও ইহুদি নির্যাতন এড়াতে স্বেচ্ছায় ক্রিশ্চান ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিল। সরকারীভাবে তারা কনভার্সোর্স (কনভার্টস) নামে পরিচিত ছিল, যদিও ক্রিশ্চানরা তাদের মারিনোস (‘শুয়োর’) বলে ডাকত, গালির ভাষা হলেও ধর্মান্তরিতদের কেউ কেউ একে অহঙ্কারের তকমা হিসাবে ধারণ করেছিল। র‍্যাবাইগণ ধর্মান্তরের ব্যাপারে ইহুদিদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রথম দিকে ‘নিউ ক্রিশ্চানরা’-কনভাসোর্সদের যেনামে ডাকা হত-সম্পদশালী ও সফল হয়ে উঠেছিল। উচ্চপদস্থ যাজকে পরিণত হয়েছিলেন কেউ কেউ, অন্যরা সেরা পরিবারে বিয়ে করে, আবার অনেকেই ব্যবসাবাণিজ্যে লক্ষণীয় সাফল্য লাভ করে। ‘পুরোনো ক্রিশ্চান’রা ইহুদিবাদী ক্রিশ্চানদের সমাজের উপরের দিকে যাত্রা অসন্তোষের চোখে দেখায় এতে এক নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয়। ১৪৪৯ ও ১৪৭৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে মারানোদের বিরুদ্ধে ঘনঘন দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে, তাদের হত্যা করা হয়েছে, সম্পদের বিনাশ সাধন করা হয়েছে কিংবা শহর ছাড়া করা হয়েছে।

এই ধরনের ঘটনাপ্রবাহে সতর্ক হয়ে ওঠেন ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা। ইহুদিদের ধর্মান্তরকরণ তাদের ঐক্যবদ্ধ রাজ্যকে কাছাকাছি আনার বদলে বরং নতুন করে বিভাজনের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। ‘নতুন ক্রিশ্চানদের’ কারও কারও আবার তাদের পুরোনো ধর্মবিশ্বাসে ফিরে গোপনে ইহুদি মতে জীবনযাপন করার সংবাদে অসন্তুষ্ট বোধ করেছেন ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা। বলা হয়ে থাকে, তাঁরা অন্য কনভার্সোদের আবার পুরোনো ইহুদি বলয়ে ফিরিয়ে নিতে প্রলুব্ধ করতে একটা গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই গোপন ইহুদিদের খুঁজে বের করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ইনকুইজিটরদের, শুয়োরের মাংস খেতে অস্বীকৃতি বা শনিবারে কাজে যাবার অস্বীকৃতির মতো কর্মকাণ্ড থেকে যাদের শনাক্ত করা সম্ভব। সন্দেহভাজনরা নিজেদের অবিশ্বাস স্বীকার ও অন্যান্য গোপন ‘জুদাইযার’দের সম্পর্কে খবর না দেওয়া পর্যন্ত তাদের উপর নির্যাতন চালানো হত। এর ফলে ইনকুইজিশনের প্রথম বার বছর সময়কালে আনুমানিক ১৩,০০০ কনভার্সো নিহত হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিহত, বন্দি বা যাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল তাদের অনেকেই ছিল বিশ্বস্ত ক্যাথলিক, তাদের মোটেই কোনওরকম ইহুদি প্রবণতা ছিল না। এই অভিজ্ঞতা বহু কনভার্সোকে তাদের নতুন ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে তিক্ত ও সংশয়বাদী করে তোলে, এবং সেটা অস্বাভাবিক নয় মোটেই।

১৪৯২ সালে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা গ্রানাদা অধিকার করার সময় ওই নগর- রাষ্ট্রে একটি নতুন ও উল্লেখযোগ্য ইহুদি সম্প্রদায়কে পেয়েছিলেন তাঁরা। তাঁরা ভেবেছিলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, ইহুদি সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে এই দুই রাজণ্য এডিক্ট অভ এক্সপালশনে স্বাক্ষর দেন। স্প্যানিশ ইহুদি সম্প্রদায় ধ্বংস করে দেওয়া হয়। আনুমানিক ৭০,০০০ ইহুদি ক্রিশ্চান ধর্ম গ্রহণ করে ইনকুইজিশনে আক্রান্ত হতে রয়ে যায়; অবশিষ্ট ১৫০,০০০ ইহুদি, আমরা যেমন দেখেছি, চলে যায় নির্বাসনে। স্পেনের ইহুদি সম্প্রদায়ের বিনাশ জেরুজালেমে ৭০ সিই’র মন্দির ধ্বংসের পর জাতির উপর নেমে আসা সবচেয়ে বিরাট বিপর্যয় হিসাবে বিশ্বজুড়ে শোকের সাথে প্রত্যক্ষ করা হয়। ইহুদিরা সেই সময় তাদের দেশ হারিয়ে প্যালেস্তাইনের বাইরে সম্মিলিতভাবে ডায়াসপোরা নামে পরিচিত বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত সম্প্রদায়ে বাস করতে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়েছিল। সেই থেকে ইহুদি জীবনে নির্বাসন এক বেদনাদায়ক লাইটমোটিফ হয়ে ছিল। ১৪৯২ সালে স্পেন থেকে বিতাড়নের ঘটনা ঘটেছিল ইউরোপের বিভিন্ন অংশ থেকে একের পর এক ইহুদিদের উৎখাতের ঘটনা ঘটার এক শতাব্দীর পর। ভিয়েনা ও লিনয থেকে ১৪২১ সালে উৎখাত করা হয় তাদের, কোলন থেকে ১৪২৪ সালে; অসবার্গ থেকে ১৪৩৯ সালে, ১৪৪২ সালে বাভারিয়া থেকে ও রাজধানী শহর মোরাভিয়া থেকে ১৪৫৪ সালে। পেরুগিয়া (১৪৮৫), ভিসেনযা (১৪৮৬), পারমা (৪৮৮), মিলান ও লুক্কা (১৪৮৯) ও ১৪৯৪ সালে তাসকানির মতো প্রধান প্রধান শহর থেকে ইহুদিদের বিতাড়ন করা হয়েছিল। আস্তে আস্তে পোল্যান্ডে পা রাখার মতো একটা শক্ত জায়গা প্রতিষ্ঠা করছে ভেবে পুবে ভেসে যেতে থাকে ইহুদিরা।’ নির্বাসনকে এই সময় ইহুদি জীবনের অপরিহার্য অসুখ বলে মনে হচ্ছিল।

নিশ্চিতভাবেই উৎখাতের পর অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তরে বিভিন্ন আফ্রিকান ও বালকান প্রদেশে আশ্রয় নেওয়া স্প্যানিশ ইহুদিদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এটা। মুসলিম সমাজের সাথে চলতে অভ্যস্ত ছিল তারা, কিন্তু স্পেনের-বা সেফরাদ, ওরা যেনামে ডাকত-পরাজয় এক গভীর মনস্তাত্ত্বিক ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। এইসব সেফারদিক ইহুদিরা মনে করেছিল যে খোদ তারা ও বাকি সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। নির্বাসন যেমন আধ্যাত্মিক তেমনি ভৌত স্থানচ্যুতিও বটে। নির্বাসিতদের জগৎ সম্পূর্ণ অজানা এবং সেকারণে অর্থহীন। সমস্ত স্বাভাবিক সমর্থন ছিনিয়ে নেওয়া সহিংস উদ্বাস্তু হওয়ার ঘটনা আমাদের জগৎ ভেঙে দেয়, আমাদের পরিচয়ের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিতে সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলো থেকে আমাদের চিরকালের জন্যে ছিন্ন করে ও স্থায়ীভাবে এক অচেনা পরিবেশে ছুঁড়ে দেয়, যাতে করে আমাদের মনে এমন ধারণা সৃষ্টি করতে পারে যে খোদ অস্তিত্বই বিপদাপন্ন হয়ে পড়েছে। নির্বাসন মানুষের নিষ্ঠুরতার সাথে সম্পর্কিত হলেও একজন ন্যায়পরায়ণ ও দয়াময় ঈশ্বরের যে জগৎ নির্মাণের কথা সেখানে অশুভের সমস্যা নিয়ে নানা জরুরি প্রশ্নও উঠে আসে।

সেফারদিক ইহুদিদের অভিজ্ঞতা উৎখাত ও স্থানচ্যুতির চরম ধরন ছিল, পরবর্তীকালে মানুষ আগ্রাসী আধুনিকায়নের প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর এর স্বাদ পাবে। আমরা দেখব যে, আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা এক ভিন্ন পরিবেশে শেকড় বিস্তার করেছিল। সংস্কৃতিকে তা এমন ভীষণভাবে বদলে দিয়েছিল যে অনেক মানুষই নিজেদের বিচ্ছিন্ন ও দিশাহারা বোধ করেছে। পুরোনো পৃথিবীকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল আর নতুন বিশ্ব এতটাই অচেনা ছিল যে, লোকে তাদের একসময়ের চারপাশের পরিচিত পরিবেশও আর চিনতে পারছিল না। নিজেদের জীবনের কোনও অর্থ খুঁজে পাচ্ছিল না। সেফারদিকদের মতো অনেকের মনেই এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়ে গেঁথে গিয়েছিল যে, তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। এই বিভ্রান্তি ও বেদনার ভেতর অনেকেই কোনও কোনও স্প্যানিশ নির্বাসিতের মতোই আচরণ করেছে। ধর্মের শরণাপন্ন হয়েছে তারা। কিন্তু তাদের জীবনধারা সম্পূর্ণ পাল্টে যাওয়ায় তাদের প্রবলভাবে বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে প্রাচীন ঐতিহ্যকে ভাষা দেওয়ার জন্যে ধর্মবিশ্বাসকে নতুনভাবে বিকশিত করতে হয়েছিল।

কিন্তু এর জন্যে সময়ের প্রয়োজন হয়েছে। ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে নির্বাসিত ইহুদিরা জানতে পারে, প্রচলিত ইহুদি ধর্মমত তাদের জন্যে কিছুই করেনি। বিপর্যয়কে নজীরবিহীন মনে হয়েছে। তারা আবিষ্কার করে যে, পুরোনো ধার্মিকতা আর কাজে আসছে না। কেউ কেউ মেসিয়ানিজমের আশ্রয় নিয়েছে। শত শত বছর ধরে একজন মেসায়াহর অপেক্ষা করে আসছিল ইহুদিরা: রাজা ডেভিডের বংশে একজন মনোনীত রাজা, যিনি তাদের দীর্ঘ নির্বাসনের অবসান ঘটাবেন, আবার প্রতিশ্রুত ভূমিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন তাদের। ইহুদিদের কিছু কিছু ঐতিহ্যে মেসায়াহর আবির্ভাবের ঠিক আগের একটা পর্যায়ে উত্তাল এক পর্বের উল্লেখ ছিল। বালকানে আশ্রয় নেওয়া কোনও কোনও সেফারদিক নির্বাসিতের কাছে মনে হয়েছে যে, ওদের উপর ও ইউরোপে তাদের আরও অসংখ্য স্বজাতির উপর নেমে আসা এই ভোগান্তি ও নিপীড়ন কেবল একটা জিনিসই তুলে ধরতে পারে: এটা নিশ্চয়ই পয়গম্বর ও সাধুদের মুখে উচ্চারিত সেই বিচারের কাল, একে তারা ‘মেসায়াহর প্রসব বেদনা’ আখ্যায়িত করেছে, কারণ এই যন্ত্রণাদায়ক মুক্তির ভেতর দিয়েই আবির্ভাব ঘটবে নতুন জীবনের। অন্য যারা আধুনিকতার আগমনে তাদের জগৎ ধ্বংস হয়ে গেছে মনে করেছিল, তারাও মিলেনিয়াল আশার বিকাশ ঘটাবে। কিন্তু মেসিয়ানিজম সমস্যা-সঙ্কুল, কারণ এপর্যন্ত একজন অত্যাসন্ন ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের আশা পোষণ করা প্রতিটি মেসিয়ানিক আন্দোলনই হতাশায় পর্যবসিত হয়েছে। সেফারদিক ইহুদিরা আরও সন্তোষজনক সমাধান বের করে এই টানাপোড়েন এড়িয়ে গেছে। এক নতুন মিথোস গড়ে তোলে তারা।

সেফারদিকদের একটা দল বালকান্স থেকে প্যালেস্তাইনে পাড়ি জমিয়েছিল। এখানে গালিলির সেফেদে বসতি গড়ে তারা। কিংবদন্তী প্রচলিত ছিল যে, মেসায়াহর আবির্ভাব ঘটার সময় গালিলিতেই নিজেকে প্রকাশ করবেন তিনি। সবার আগে তাঁকে স্বাগত জানাতে সেখানে হাজির থাকতে চেয়েছিল স্পেনিয় নির্বাসিতরা।” তাদের কেউ কেউ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, একজন সাধুসুলভ শীর্ণ অ্যাশকেনাযিয় ইহুদি ইসাক লুরিয়ার (১৫৩৪-৭৩) মাঝে তাঁকে পেয়েছে। সেফেদে বসতি গেড়েছিলেন তিনি। তিনিই প্রথম নতুন এই মিথ উল্লেখ করেন। এভাবে তিনি এক নতুন ধরনের কাব্বালাহর প্রতিষ্ঠা করেন যা এখনও তাঁর নাম ধারণ করে আছে। আমরা আধুনিকরা বলব যে, খোদ লুরিয়াই এই মিথ সৃষ্টি করেছিলেন, মানুষের অবচেতনে আকাঙ্ক্ষা ও ভীতির সাথে যারপরনাই নিবিড়ভাবে অভ্যস্ত থাকায় এমন একটি কাল্পনিক কাহিনী তৈরি করতে সক্ষম হয়ে উঠেছিলেন তিনি যা কেবল সেফেদের নির্বাসিতদের মাঝেই নয় বরং গোটা পৃথিবীর ইহুদিদের মাঝে স্বস্তি ও আশার সঞ্চার করতে পেরেছিল। কিন্তু আমাদের এমন কথা বলার কারণ, মূলত আমরা যৌক্তিক ভিত্তিতে কথা বলে থাকি। ফলে প্রাক-আধুনিক পৌরাণিক বিশ্বদৃষ্টিতে প্রবেশ কঠিন আবিষ্কার করি। লুরিয়ার শিষ্যরা তিনি সৃষ্টির এই মিথ তৈরি করেছেন’ মনে করেনি, বরং তারা মনে করেছে মিথটি নিজেই তাঁর মাঝে নিজেকে প্রচার করেছে। লুরিয়ানিক কাব্বালাহর আচার ও অনুশীলনে অভ্যস্ত নয় এমন কোনও বহিরাগতের কাছে এই সৃষ্টি-কাহিনী আজগুবী ঠেকে। তার উপর এই কাহিনীর সাথে বুক অভ জেনেসিসের সৃষ্টি কাহিনীর কোনওই মিল নেই; কিন্তু একজন কাব্বালিস্ট সেফেদের কাছে-লুরিয়া নির্দেশিত আচার ও ধ্যানমূলক অনুশীলনে মগ্ন, কিন্তু তারপরও নির্বাসনের পুরো এক প্রজন্ম পরেও সেই ঘটনার ধাক্কায় দিশাহারা-মিথোস নিখুঁত অর্থ প্রকাশ করেছে। এটা এমন এক সত্যকে তুলে ধরেছে বা ‘উন্মুক্ত’ করেছে যা আগে থেকেই স্পষ্ট ছিল বটে কিন্তু প্রাক-আধুনিক কালের ইহুদিদের অবস্থার সাথে এমন জোরের সাথে সাড়া দিয়েছে যে নিমেষে কর্তৃত্ব লাভ করেছে। তাদের অন্ধকার জগৎকে আলোকিত করে তুলেছে এটা ও জীবনকে কেবল সহনীয় নয়, আনন্দময়ও করে তুলেছে। লুরিয়া সৃষ্টি মিথের মুখোমুখি হওয়ামাত্র একজন আধুনিক মানুষ জানতে চাইবে, ‘সত্যিই কি এমনটা ঘটেছিল?’ ঘটনাপ্রবাহকে এতটাই অসম্ভব মনে হয় এবং যার প্রমাণ করা যাবে না বলে একে আমরা প্রমাণের দিক থেকে মিথ্যা হিসাবে নাকচ করে দেব। কিন্তু তার কারণ আমরা কেবল সত্যির যৌক্তিক ভাষ্যকে গ্রহণ করে থাকি বলে, আরও কোনও ধরন থাকতে পারার বোধ হারিয়ে ফেলায়। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ গড়ে তুলেছি, একে আমরা অসাধারণ সব ঘটনার পর্যায়ক্রমিক সংঘটন হিসাবে দেখি। কিন্তু প্রাক-আধুনিক বিশ্বে ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাকে একক হিসাবে নয়, চিরন্তন বিধানের নজীর, সময়হীন স্থির বাস্তবতার প্রকাশ হিসাবে দেখা হত। কোনও ঐতিহাসিক ঘটনা বারবার সংঘটিত হওয়ার কথা ছিল, কেননা সকল পার্থিব ঘটনাপ্রবাহই অস্তিত্বের মৌল বিধান প্রকাশ করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, বাইবেলে একটি নদী অলৌকিকভাবে অন্তত দুটি ঘটনায় দুই ভাগ হয়ে ইসরায়েলিদের এগিয়ে যাবার সুযোগ করে দিয়েছে: ইসরায়েলের সন্তানগণ প্রায়শঃই মিশরে ‘যাতায়াত করে’ এবং তারপর প্রতিশ্রুত ভূমিতে ফিরতি যাত্রা শুরু করে। বাইবেলের অন্যতম পৌনঃপৌনিক ঘটনা নির্বাসন। স্পেনিয় বিপর্যয়ের পর যা গোটা ইহুদি অস্তিত্বকে রঞ্জিত করেছে বলে মনে হয়েছে এবং অস্তিত্বের একেবারে মূল ভিত্তিতে ভারসাম্যহীনতার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। লুরিয়ানিক কাব্বালাহ সকল মিথোলজির বেলায় অবশ্যাম্ভাবী এইসব মৌল বিধানের অন্যতম মনে হওয়া নির্বাসনকে পরখ করে এর পূর্ণ তাৎপর্য উন্মোচনের জন্যে সূচনায় প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে সমস্যার মোকাবিলা করেছে।

লুরিয়া’র মিথে এক স্বেচ্ছানির্বাসনের ভেতর দিয়ে সৃষ্টি প্রক্রিয়ার সূচনা ঘটছে। ঈশ্বর সর্বব্যাপী হলে কীভাবে বিশ্ব অস্তিত্বমান থাকতে পারে, এই জিজ্ঞাসার ভেতর দিয়ে এর শুরু। জবাব হচ্ছে যিমযুম (‘প্রত্যাহার’)-এর মতবাদ: অসীম ও দুর্ভেয় গডহেড, কাব্বালিস্টরা যাকে বলে এন সফ (‘অন্তহীন’), বিশ্বকে স্থান করে দিতে, যেমন বলা হয়েছে, নিজের মাঝে একটা এলাকা উন্মুক্ত করার জন্যে নিজের মাঝে নিজেই সঙ্কুচিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন। সুতরাং, সৃষ্টির সূচনা ঘটেছিল ঐশী একটা ঘটনার ভেতর দিয়েঃ সৃষ্টির ভেতর ও তাদের সাহায্যে নিজেকে প্রকাশ করার আবেগময় ইচ্ছা থেকে এন সফ নিজেরই একটা অংশের উপর নির্বাসন চাপিয়ে দিয়েছিলেন। জেনেসিসের প্রথম অধ্যায়ে বর্ণিত শৃঙ্খলাপূর্ণ, শান্তিময় সৃষ্টির বদলে এটা ছিল আদিম বিস্ফোরণ, বিপর্যয় ও মিথ্যা সূচনা, সেফারদিক নির্বাসিতদের কাছে যাকে তাদের যাপিত বিশ্বের অনেক বেশি সঠিক মূল্যায়ন মনে হয়েছে। লুরিয় প্রক্রিয়ার গোড়ার দিকের পর্যায়ে এন সফ যিমযুমের মাধ্যমে সৃষ্ট শূন্যতাকে ঐশী আলো দিয়ে পূরণ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন, কিন্তু আলো বয়ে নিয়ে যাবার কথা ছিল যেসব ‘পাত্র’ বা ‘নল’-এর, চাপে সেগুলো ভেঙে যায়। ঐশী আলোর স্ফুলিঙ্গসমূহ ঈশ্বর নয়, এমন সব বস্তুর মহাগহ্বরে পতিত হয়। ‘পাত্রের ভাঙনের’ পর স্ফুলিঙ্গের কিছু অংশ গডহেডের কাছে ফিরে যায়, কিন্তু অবশিষ্টগুলো অশুভ সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ ঈশ্বরহীন বলয়ে বন্দি হয়ে থাকে, এন সফ যাকে যিমযুম প্রক্রিয়ার সময় নিজের ভেতর থেকে দূর করে দিয়েছিলেন। এই বিপর্যয়ের পর সৃষ্টিকর্ম অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে, সবকিছু উল্টাপাল্টা জায়গায় পড়ে যায়। আদমকে সৃষ্টি করার সময় তিনি এই পরিস্থিতি শুধরে নিতে পারতেন, তাহলে প্রথম সাব্বাতেই ঐশী নির্বাসনের অবসান ঘটতে পারত। কিন্তু আদম পাপ করলেন, তারপর থেকেই ঐশী স্ফুলিঙ্গসমূহ বস্তুগত বিষয়ে বন্দি হয়ে পড়ে; আর পৃথিবীর বুকে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করার জন্যে আমরা যে সত্তার সবচেয়ে কাছাকাছি যেতে পারি, সেই শেকিনাহ গডহেডের সাথে মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় এক চিরস্থায়ী নির্বাসনে জগত্ময় ঘুরে বেড়াতে থাকেন।

এটা কল্পগল্প, কিন্তু সেফেদের কাব্বালিস্টদের যদি জিজ্ঞেস করা হত যে আদৌ ব্যাপারটা এভাবেই ঘটেছিল বলে তারা বিশ্বাস করে কিনা, প্রশ্নটিকেই অপর্যাপ্ত মনে করত তারা। মিথের বর্ণিত আদিম ঘটনাটি সুদূর অতীতে কোনও এক সময় ঘটে যাওয়া একটি ঘটনামাত্র নয়। অমন একটা ঘটনা বর্ণনা করার মতো কোনও ধারণা বা শব্দ আমাদের জানা নেই, কারণ আমাদের যৌক্তিক সমাজ সময়কে কঠোরভাবে পর্যায়ক্রমিক হিসাবে দেখে। প্রাচীন গ্রিসের এলিউসিসের উপাসকদের যদি জিজ্ঞেস করা হত যে, প্লেটো সত্যিই পারসেফোনকে পাতালে নিয়ে বন্দি করে রাখায় তাঁর মা দিমিতার মেয়ের শোকে দিদ্বিদিক ঘুরে বেড়িয়েছেন কিনা, তাহলে এমনি ধারার প্রশ্নে তারা সম্ভবত বিস্মিত হয়ে যেত। তারা কেমন করে নিশ্চিত হবে যে পারসেফোনের মিথে যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে সেভাবে পৃথিবীতে ফিরে গিয়েছিলেন কিনা? কারণ এই মিথোসের তুলে ধরা জীবনের মৌলিক ছন্দ আসলে ঘটছিল। জমিনের ফসল তোলা হয়েছে, ভূগর্ভস্থ পাত্রে রাখা হয়েছে ভূট্টার ভীজ ঠিক সময়ে বপন করা হয়েছে এবং শেষে শস্য বেড়ে উঠেছে।১২ মিথোস ও ফসল তোলার ঘটনা, উভয়ই বিশ্ব সম্পর্কে মৌল এবং বিশ্বজনীন একটা কিছুর দিকে ইঙ্গিত দেয়, অনেকটা ইংরেজি শব্দ ‘নৌকা’ আর ফরাসি শব্দ ‘বাতেউর মতো; দুটোই এমন এক বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করে যা উভয় পরিভাষার অতীত ও স্বাধীন। সেফারদিক ইহুদিরা সম্ভবত একই ধরনের জবাব দিত। নির্বাসন ছিল অস্তিত্বের মৌল বিধি। আপনি যেদিকে তাকাতেন, ইহুদিরা ছিল উন্মূল বিদেশি। এমনকি জেন্টাইলরাও ক্ষতি, হতাশা ও জগতে তারা ঠিক অভ্যস্ত নয়, এমন এক ধরনের অভিজ্ঞতার লাভ করেছে-প্রথম মানুষ জাতির আদিম স্বর্গ হতে নির্বাসিত হওয়ার বিশ্বজনীন মিথে যেমন প্রত্যক্ষ করা গেছে। লুরিয়ার জটিল সৃষ্টি কাহিনী এটা তুলে ধরেছে ও সম্পূর্ণ নতুনভাবে একে স্পষ্ট করে তুলেছে। শেকিনাহর নির্বাসন ও স্থানচ্যুত মানুষ হিসাবে তাদের নিজস্ব জীবন ভিন্ন দুটি বাস্তবতা ছিল না, বরং ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। যিমযুম দেখিয়েছে যে সত্তার একেবারে ভিত্তি মূলেই নির্বাসন খোদাই হয়ে আছে।

লুরিয়া লেখক ছিলেন না, জীবদ্দশায় খুব সামান্য সংখ্যক লোকের কাছেই তাঁর শিক্ষা অবহিত ছিল।[১৩] কিন্তু শিষ্যরা উত্তরপুরুষের জন্যে তাঁর রচনাবলী রক্ষা করেছেন ও অন্যরা তা ইউরোপে ছড়িয়ে দিয়েছেন। ১৬৫০ সাল নাগাদ লুরিয় কাব্বালাহ এক গণআন্দোলনে পরিণত হয়; সেই সময় এটাই ছিল ইহুদিদের মাঝে সাধারণ গ্রহণযোগ্যতা লাভকারী একমাত্র আদর্শিক ব্যবস্থা।” যৌক্তিক বা বৈজ্ঞানিকভাবে একে প্রমাণ করা সম্ভব ছিল বলে এমনটা ঘটেনি, কেননা নিশ্চিতভাবেই সেটা সম্ভব ছিল না। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই জেনেসিসের সাথে এর বিরোধ ছিল স্পষ্ট। কিন্তু আমরা যেমন দেখব, ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক পাঠ একটা আধুনিক ধারণা, পৌরাণিক সচেতনতার উপর যৌক্তিক মনের জয়লাভের ফলেই এর বিকাশ ঘটেছে। আধুনিক কালের আগের ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমরা সবাই তাদের পবিত্র টেক্সটের দারুণ রকম রূপক, প্রতীকী ও নিগূঢ় ব্যাখ্যার রসআস্বাদন করত। ঈশ্বরের বাণী অসীম হওয়ায় তার নানা রকম অর্থ নিয়ে উপস্থিত হওয়ার ক্ষমতা ছিল। সুতরাং, বাইবেলের সরলার্থ হতে লুরিয়ার সরে যাওয়া দেখে ইহুদিরা বিচলিত বোধ করেনি, যেমনটা অনেক আধুনিক ব্যক্তি করবে। তাঁর মিথ কর্তৃত্বের সাথে তাদের প্রতি সাড়া দিয়েছে, কারণ এটা তাদের জীবনকে ব্যাখ্যা করেছে, অর্থের যোগান দিয়েছে তাদের। অস্তিত্ব লাভ করতে চলা আধুনিক জগৎ হতে উৎখাত হয়ে ইহুদিদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল অস্তিত্বের মৌল বিধানের সাথে মানানসই। এমনকি খোদ ঈশ্বর নির্বাসনে কষ্ট পেয়েছেন, একেবারে সূচনা থেকেই সৃষ্টির সমস্ত কিছুই স্থানচ্যুত হয়েছিল, ঐশী স্ফুলিঙ্গ বস্তুতে বন্দি হয়েছে আর জীবনের এক সর্বব্যাপী সত্যি অশুভের সাথে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে শুভ। এছাড়া, ইহুদিরা প্রত্যাখ্যাত ও অস্পৃশ্য ছিল না, বরং নিস্তার প্রক্রিয়ায় তারাই কেন্দ্রিয় ভূমিকা পালনকারী। মোজেসের বিধান তোরাহর বিভিন্ন নির্দেশনার সযত্ন পালন ও সেফেদে বিকশিত বিভিন্ন আচার সম্পাদন এই বিশ্বজনীন নির্বাসনের অবসান ঘটাতে পারে। ইহুদিরা এভাবে গডহেডের সাথে শেকিনাহর ‘পুনঃস্থাপন’ (তিক্কুন), ইহুদি জাতিকে প্রতিশ্রুত ভূমিতে ফিরিয়ে নেওয়া ও বিশ্বের বাকি অংশকে তার নির্দিষ্ট জায়গায় স্থাপন করার কাজে সাহায্য করতে পারে।[১৫]

ইহুদিদের কাছে মিথটি গুরুত্বপূর্ণ রয়ে গিয়েছে। অনেকেই আবিষ্কার করেছিল যে, হলোকাস্টের ট্র্যাজিডির পর তারা ঈশ্বরকে কেবল যিমযুমের কষ্টসওয়া অক্ষম ঐশী সত্তা হিসাবে দেখছিল, যিনি আর সৃষ্টির নিয়ন্ত্রণে নেই।” বস্তুতে আটকা পড়া ঐশী স্ফুলিঙ্গের ইমেজারি ও তিক্কুনের পুনঃস্থাপনের মিশন এখনও আধুনিক মৌলবাদী ইহুদি আন্দোলনসমূহকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। সকল সত্যি মিথের মতো লুরিয় কাব্বালাহ ছিল এক উন্মোচন, ইহুদিদের দেখিয়ে দিয়েছিল তাদের জীবন আসলে কী, কী তার অর্থ। মিথটি এর নিজস্ব সত্যি ধারণ করে। এবং কোনও গভীর স্তরে স্বপ্রকাশিত। এটা যেমন যৌক্তিক প্রমাণ গ্রহণ করতে পারে না, তেমনি এর তার কোনও প্রয়োজনও নেই। আজকের দিনে আমাদের উচিত হবে লুরিয় কাব্বালাহকে প্রতীক বা উপমা হিসাবে আখ্যায়িত করা, কিন্তু সেটাও একে যৌক্তিকভাবে বন্দি করারই শামিল হবে। মূল গ্রিকে ‘প্রতীক’ শব্দটির মানে ছিল দুটি বস্তুকে এক করা যাতে তারা অবিচ্ছেদ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু যখনই পশ্চিমের লোকজন কোনও আচার বা আইকন ‘কেবল প্রতীকমাত্র’ বলতে শুরু করল, তখনই এমনি বিচ্ছেদের উপর গুরুত্ব আরোপকারী আধুনিক চেতনা আবির্ভূত হয়েছিল।

প্রথাগত ধর্মে মিথ কাল্ট হতে অবিচ্ছেদ্য, বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও ধ্যানমূলক অনুশীলনের ভেতর দিয়ে তা উপাসকদের ইহজাগতিক জীবনে চিরন্তন বাস্তবতাকে হাজির করে। এর প্রতীকীবাদের শক্তি সত্ত্বেও লুরিয়ানিক কাব্বালাহ নির্বাসিতের মাঝে এক ধরনের দুয়ের বোধ জাগিয়ে তোলার মতো চমৎকার আচারের মাধ্যমে প্রকাশ করা না হলে ইহুদি অবস্থার প্রতি এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারত না। সাফেদে কাব্বালিস্টরা লুরিয়ার ধর্মতত্ত্বকে নতুন করে নির্মাণ করতে বিশেষ ধরনের আচার উদ্ভাবন করেছিল। নিজেদের শেখিনাহর সাথে পরিচিত করে তুলতে তারা রাত জাগত, তাঁকে তারা বিশ্বময় দুর্গতের মতো ঘুর বেড়ানো ঐশী উৎসের আকাঙ্ক্ষাকারী নারী হিসাবে কল্পনা করত। মাঝ রাতে ঘুম থেকে জেগে পায়ের জুতো খুলে কান্নাকাটি করত ইহুদিরা, ধুলোয় মুখ ঘঁষত। এইসব আচরিক কর্মকাণ্ড নিজস্ব শোক ও পরিত্যাগের বোধ তুলে ধরার কাজে সহায়তা করেছে তাদের ও ঐশী সত্তার সহ্য করা ক্ষতির সাথে নিজেদের সম্পর্কিত করতে সাহায্য করেছে। সারারাত জেগে শুয়ে থাকত তারা, প্রেমিকের মতো ঈশ্বরকে ডাকত, যা নির্বাসিতের ভোগান্তির মূল মানুষের দুর্গতির মূলে অবস্থিত বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণায় বিলাপ করে চলত। প্রায়শ্চিত্তের অনুশীলনও—উপবাস, বেত্রাঘাত, বরফে গড়াগড়ি খাওয়া- তিরুনের অংশ হিসাবে পালন করা হত। পল্লী এলাকায় দীর্ঘ পথ হাঁটতে বের হত কাব্বালিস্টরা, শেকিনাহর মতো ঘুরে বেড়াত, নিজেদের উন্মুল বোধের অভিনয় করত। ইহুদি বিধানে জোর দেওয়া হয়েছে যে, সমবেতভাবে অন্তত দশ জন পুরুষ মিলে পালন করলে প্রার্থনা গভীরতম শক্তি ও অর্থ পেতে পারে। কিন্তু বিশ্বে তাদের বিচ্ছিন্নতা ও নাজুক দশার প্রকৃত বোধ পরিপূর্ণভাব উপলব্ধি করার জন্যে সাফেদে ইহুদিদের বিচ্ছিন্নভাবে প্রার্থনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এই একাকী প্রার্থনা ইহুদি ও সমাজের বাকি অংশের মাঝে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি করে তাকে ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতার জন্যে তৈরি করে দিয়েছে এবং ক্রমাগত ইহুদি জনগণের অস্তিত্বকে হুমকি দিয়ে চলা এক বিশ্বে বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতাকে নতুন করে উপলব্ধি করার বেলায় তাদের সাহায্য করেছে।১৭

কিন্তু লুরিয়া কোনও রকম উন্মত্ততাকে আশ্রয় না দেওয়ার ব্যাপারে অটল ছিলেন। অবশ্যই যতক্ষণ পর্যন্ত কিছু পরিমাণ আনন্দ লাভ না করতে পারছে ততক্ষণ কাব্বালিস্টদের শৃঙ্খলিত, পদ্ধতিগত উপায়ে বিষাদের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। মাঝরাতের আচার সবসময়ই ভোরে শেকিনাহ ও এন সফের চূড়ান্ত পুনর্মিলনের উপর ধ্যানের ভেতর দিয়ে শেষ হত, যার অর্থ স্বর্গের সাথে মানুষের বিচ্ছিন্নতার অবসান। কাব্বালিস্টকে তার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গই ঐশী সত্তার পার্থিব মন্দির বলে বিশ্বাস করার জন্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।১৮ সকল বিশ্বধর্মই জোর দিয়ে বলে যে বাস্তবিক সহানুভূতির বোধ না জাগালে কোনও আধ্যাত্মিকতাই বৈধ নয়। লুরিয়ার কাব্বালাহ এই দর্শনের প্রতি বিশ্বস্ত ছিল। অন্যদের আঘাত দেওয়া ভুল, যৌন হয়রানি, বিরূপ গুজব, কারও সতীর্থকে অসম্মান করা ও বাবা-মাকে অমর্যাদা করার ক্ষেত্রে কঠিন সাজার ব্যবস্থা ছিল। ১৯

সবশেষে অধিকাংশ বিশ্বধর্ম বিকশিত অতীন্দ্রিয় অনুশীলনের দীক্ষা দেওয়া হয়েছিল কাব্বালিস্টদের। দক্ষ কাব্বালিস্টকে তা মনের গভীরতর অঞ্চলে প্রবেশাধিকার লাভ ও স্বজ্ঞামূলক অন্তর্দৃষ্টি লাভে সাহায্য করেছে। সাফেদে ঈশ্বরের নাম গড়ে তোলা বিভিন্ন হরফের দক্ষ, বিস্তারিত বিনির্মাণের উপর ধ্যান কেন্দ্রিভুত ছিল। এই ‘মনোসংযোগ’ (কাওয়ানোত) কাব্বালিস্টকে নিজের ভেতর ঐশী সত্তার একটা আভাস লাভে সক্ষম করে তুলত। নেতৃস্থানীয় কাব্বালিস্টরা বিশ্বাস করতেন, সে একজন পয়গম্বরে পরিণত হবে, ঠিক লুরিয়ার মতোই এক নতুন মিথোস উচ্চারণে সক্ষম হয়ে উঠবে এবং এপর্যন্ত আলোর মুখ না দেখা সত্যির উন্মোচন ঘটাবে। এইসব কাওয়ানোত কাব্বালিস্টের জন্যে যারপরনাই আনন্দ বয়ে আনত। লুরিয়ার অন্যতম শিষ্য হাইম ভিতাল (১৫৪২-১৬২০) বলেছেন পরমানন্দের অবস্থায় আনন্দ ও বিস্ময়ের বোধ নিয়ে থরথর করে কেঁপেছেন তিনি। কাব্বালিস্টরা বিভিন্ন দৃশ্য দেখেছে ও আনন্দময় দুয়ের অনভূতি লাভ করেছে যা নিষ্ঠুর ও অচেনা মনে হওয়া একটা সময়ে বিশ্বকে বদলে দিয়েছে।

বাস্তব বলয়ে যৌক্তিক চিন্তাভাবনা বিস্ময়কর সাফল্য লাভ করেছে, কিন্তু তা আমাদের বিষাদ প্রশমিত করতে পারে না। স্পেনিয় বিপর্যয়ের পর কাব্বালিস্টরা আবিষ্কার করেছিল যে আল-আন্দালুসের ইহুদিদের ভেতর জনপ্রিয় দর্শনের যৌক্তিক অনুশীলন তাদের বেদনার প্রশমন ঘটাতে পারছে না।২১ জীবনকে মনে হয়েছে অর্থহীন; আর জীবনে অর্থ না থাকলে মানুষ হতাশায় ডুবে যেতে পারে। জীবনকে সহনীয় করে তুলতে মিথোস ও অতীন্দ্রিয়বাদের শরণাপন্ন হয়েছিল নির্বাসিতরা; এটা তাদের বেদনা, ক্ষতি ও আকাঙ্ক্ষার অবচেতন উৎসের সাথে সংযোগ স্থাপনে সক্ষম করে তোলে ও এমন এক দৃশ্যের সাথে তাদের জীবনকে বেঁধে দিয়েছিল যা তাদের জন্যে স্বস্তি বয়ে এনেছে।

অবশ্য এটা লক্ষণীয় যে, ইগনাশিয়াস অভ লায়োলার বিপরীতে লুরিয়া ও তাঁর শিষ্যগণ ইহুদিদের রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে কোনও বাস্তব পরিকল্পনা নির্মাণ করেননি। কাব্বালিস্টরা ইসরায়েলের ভূমিতে থিতু হয়েছিল, কিন্তু তারা যায়নিস্ট ছিল না। লুরিয়া ইহুদিদের পবিত্র ভূমিতে পাড়ি জমানোর মাধ্যমে নির্বাসনের ইতি টানার তাগিদ দেননি। তিনি তাঁর মিথলজি বা অতীন্দ্রিয় দর্শনকে সক্রিয় কর্মকাণ্ডের নীলনকশা সৃষ্টি করার মতো কোনও আদর্শ গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করেননি। মিথোসের কাজ ছিল না এটা, এই ধরনের সমস্ত বাস্তব পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল লোগোসের এখতিয়ার-যৌক্তিক আলোচনামূলক চিন্তাভাবনা। লুরিয়া জানতেন, তাঁর মিশন হচ্ছে ইহুদিদের অস্তিত্বমূলক ও আধ্যাত্মিক হতাশা থেকে রক্ষা করা। পরে এইসব মিথকে রাজনীতির বাস্তব বিশ্বে প্রয়োগ করা হলে তার ফল ছিল প্রলয়ঙ্করী, যেমনটা আমরা এই অধ্যায়ে দেখতে পাব।

কাল্ট বিহীন, প্রার্থনা বিহীন ও আচার বিহীন মিথ ও মতবাদের কোনও অর্থ থাকে না। কাব্বালিস্টদের কাছে মিথকে বোধগম্য করে তোলা বিশেষ অনুষ্ঠান ও আচার বিনা লুরিয়ার সৃষ্টি-কাহিনী অর্থহীন একটা গল্পই রয়ে যেত। কেবল কোনও ধরনের ধর্মীয় শাস্ত্রীয় পরিপ্রেক্ষিতেই একটি ধর্মীয় বিশ্বাস অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। মানুষ যদি এই ধরনের আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত হয়, তারা তবে বিশ্বাস হারাবে। ক্রিশ্চান ধর্মে দীক্ষা নিয়ে ইবারিয় পেনিনসুলায় থেকে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কিছু সংখ্যক ইহুদির বেলায় ঠিক তাই ঘটেছিল। ধ্যান করে না, আচার অনুষ্ঠান পালন করে না বা আনুষ্ঠানিক লিটার্জিতে অংশ নেয় না, এমনি অনেক আধুনিক মানুষের বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছে যারা পরে আবিষ্কার করেছে যে ধর্মের মিথগুলো তাদের কাছে কোনও অর্থ বহন করছে না। কনভার্সোদের অনেকেই নিজেদের ক্যাথলিসিজমের সাথে একাত্ম করে নিতে পেরেছিল। কেউ কেউ প্রকৃতপক্ষেই, যেমন সংস্কারক হুয়ান দে ভালদেস (১৫০০-৪১) ও হুয়ান লুইস ভিভে (১৪৯২- ১৫৪০)-এর মতো ব্যক্তিরা কাউন্টার রিফর্মেশনের নেতায় পরিণত হয়েছিলেন ও প্রাথমিক কালের আধুনিক সংস্কৃতিতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছেন ঠিক যেভাবে কার্ল মার্ক্স, সিগমান্ড ফ্রয়েড, এমিলি দার্কহেইম, আলবার্ট আইনস্টাইন ও লুদভিগ ভিগেইস্তাইনের মতো সেক্যুলারায়িত ইহুদিরা মূলধারার সমাজে একীভূত হওয়ার পর পরবর্তীকালের আধুনিকতায় অবদান রেখেছেন।

এই প্রভাবশালী কনভার্সোদের অন্যতম বর্ণাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন তেরেসা অভ আভিলা (১৫১৫-৮২), জন অভ দ্য ক্রসের শিক্ষক ও পরামর্শদাতা এবং ডক্টর অভ চার্চ উপাধি লাভকারী প্রথম নারী। স্পেনে আধ্যাত্মিকতার সংস্কারের ক্ষেত্রে অন্যতম অগ্রপথিক ছিলেন তিনি। তিনি বিশেষ করে ভালো শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ও প্রায়শঃই অদক্ষ আধ্যাত্মিক নির্দেশকদের হাতে অস্বাস্থ্যকর অতীন্দ্রিয় অনুশীলনের শিকার হওয়া নারীদের ধর্মীয় বিষয়ে যথাযথ শিক্ষার ব্যবস্থা করার বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, হিস্টিরিয়াসুলভ ঘোর, দিব্যদৃষ্টি ও উন্মত্ততার সাথে পবিত্রতার কোনও সম্পর্ক নেই। অতীন্দ্রিয়বাদ চরম দক্ষতা, শৃঙ্খলিত মনোসংযোগ, ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ও প্রফুল্ল, বিচক্ষণ শারীরিক অবস্থা দাবি করে এবং তাকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত ও সতর্কভাবে স্বাভাবিক জীবনে সংশ্লিষ্ট থাকতে হবে। জন অভ দ্য ক্রসের মতো তেরেসা ছিলেন আধুনিকায়নকারী ও মেধাসম্পন্ন অতীন্দ্রিয়বাদী, তবু তিনি ইহুদি ধর্মে থেকে গেলে তাঁর পক্ষে এই গুণটি গড়ে তোলা সম্ভব হত না, কারণ কেবল পুরুষদেরই কাব্বালাহ অনুশীলনের অনুমতি ছিল। তারপরেও কৌতূহলোদ্দীপকভাবে তাঁর আধ্যাত্মিকতা ইহুদিবাদীই রয়ে গিয়েছিল। দ্য ইন্টেরিয়র ক্যাসল-এ সাতটি স্বগীয় দরবারের ভেতর দিয়ে আত্মার ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর যাত্রাপথের বিবরণ দিয়েছেন তিনি। এই প্রকল্পের সাথে ইহুদি বিশ্বে একেবারে প্রথম থেকে শুরু করে দ্বাদশ শতাব্দী সিই পর্যন্ত বিকশিত থ্রোন মিস্টিসিজমের লক্ষণীয় সাদৃশ্য রয়েছে। নিবেদিতপ্রাণ ও বিশ্বস্ত ক্যাথলিক ছিলেন তেরেসো, কিন্তু তারপরেও ইহুদির কায়দায় প্রার্থনা করতেন, নানদেরও একইভাবে প্রার্থনা করার শিক্ষা দিতেন।

তেরেসার ক্ষেত্রে ইহুদিবাদ ও ক্রিশ্চানিটি সফলভাবে মিশে যেতে পেরেছিল, কিন্তু কম মেধা সম্পন্ন অন্য কনভার্সোর্রা বিরোধ মোকাবিলা করেছে। এমনি একটি ঘটনা হচ্ছে প্রথম গ্র্যান্ড ইনকুইজিটর তোমাস দে তোরকেমাদা (১৪২০-৯৮)-র। ২২ তিনি যেমন উৎসাহ নিয়ে স্পেন থেকে ইহুদিবাদের শেষ চিহ্নটুকু মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন সেটা হয়তো অবচেতনভাবে তাঁর নিজের মন থেকেই পুরোনো ধর্মবিশ্বাসকে উৎক্ষিপ্ত করার প্রয়াস হয়ে থাকবে। বেশিরভাগ মারানোই নিপীড়নের মুখে ক্রিশ্চান ধর্ম গ্রহণ করেছিল। মনে হয় তাদের অনেকেই কখনওই পুরোপুরিভাবে নতুন ধর্মবিশ্বাস মেনে নিতে পারেনি। এটা মোটেও তেমন বিস্ময়কর নয়; কেননা দীক্ষা দেওয়ার পর ইনকুইজিটরদের নিবিড় পর্যবেক্ষণের অধীনে ছিল তারা, তুচ্ছ অভিযোগে যখন তখন আটক হওয়ার ভয়ে ছিল। শুক্রবার সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালানো, কিংবা শেলফিশ খেতে অস্বীকৃতি কারাদণ্ড, নির্যাতন, মৃত্যু কিংবা আর কিছু না হোক সম্পত্তি বাজেয়াপ্তির মতো ব্যাপারে পর্যবসিত হতে পারত। ফলে অনেকেই ধর্ম থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। তাদের জীবনকে দুর্দশাগ্রস্ত করে তোলা ক্যাথলিক মতবাদের সাথে নিজেদের সম্পূর্ণভাবে মানিয়ে নিতে না পারেনি তারা। ১৪৯২ সালে স্পেন থেকে ব্যাপক উৎখাতের পর স্পেনে আর ধর্মাচারী ইহুদির কোনও অস্তিত্ব ছিল না। মারানোরা গোপনে ইহুদি ধর্ম চর্চা করতে চাইলেও ইহুদি বিধান বা অনুশীলন শিক্ষার কোনও উপায় ছিল না তাদের হাতে। এর পরিণামে কোনও ধর্মের প্রতিই সত্যিকারের আনুগত্য ছিল না তাদের। সেক্যুলারিজমের বহু আগেই নাস্তিক্যবাদ ও ধর্মের প্রতি নির্লিপ্ততা বাকি ইউরোপে মামুলি ব্যাপারে পরিণত হয়। আমরা ইবারিয় পেনিনসুলার মারানো ইহুদিদের ভেতর এইসব আবিশ্যিকভাবে আধুনিক প্রবণতার উদাহরণ দেখতে পাই।

ইসরায়েলি পণ্ডিত ইরমিয়াহু ইয়োভেলের মতে ধর্মের প্রতি সন্দিহান হয়ে ওঠাটা মারানোদের পক্ষে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল।২৩ এমনকি ১৪৯২ সালের ব্যাপক উচ্ছেদের আগেও বিখ্যাত স্প্যানিশ পরিবারের সদস্য পেদ্রো এবং ফার্নান্দো দে লা কাবেল্লেরিয়ার মতো কেউ কেউ নিজেদের স্রেফ রাজনীতি, শিল্পকলা ও সাহিত্যে জড়িয়ে নেন, ধর্মে তাদের কোনও রকম আগ্রহ না থাকার আভাস দেন তাঁরা। প্রকৃতপক্ষেই পেদ্রো প্রকাশ্যে ভুয়া ক্রিশ্চান হওয়ার ব্যাপারে গলাবাজি করতেন; তিনি দাবি করতেন ব্যাপারটা তাঁকে পবিত্র আইন ও নিয়মকানুন নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে স্বাধীনভাবে চলার সুযোগ করে দিয়েছে।২৪ ১৪৯২ সালের অল্প কিছুদিন আগে আলবারো দে মন্তালবান নামে এক লোককে লেন্টের সময় পনির ও মাংস খাওয়ার অপরাধে ইনকুইজিটরদের সামনে হাজির করা হয়; এভাবে সে কেবল ক্রিশ্চান উপবাসই ভঙ্গ করেনি, বরং ইহুদি বিধানও লঙ্ঘন করেছে, যেখানে মাংস ও দুধ জাতীয় খাবার একসাথে খাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। স্পষ্টই কোনও ধর্মের প্রতিই তার কোনও অঙ্গীকার ছিল না। এই ক্ষেত্রে আলবারো জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যায়। ক্যাথলিসিজমে ঠেলে দেওয়ায় তার আর তেমন একটা উষ্ণ বোধ হওয়ার কারণ ছিল না। গোপনে ইহুদি ধর্মাচার পালনের দায়ে ইনকুইজিশনের হাতে নিহত হয়েছিল তার বাবা-মা। ওদের লাশ কবর থেকে তুলে আনার পর হাড়গোড় পোড়ানো হয়; সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়।২৫ ইহুদি ধর্মের সাথে এমনকি ক্ষীণ সম্পর্ক রাখতে ব্যর্থ হয়ে আলবারো ধর্মীয় শূন্যতার দিকে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হয়েছিল। সত্তর বছর বয়স্ক বৃদ্ধ হিসাবে শেষ পর্যন্ত পরকালের মতবাদের ইচ্ছাকৃত ও পৌনঃপৌনিক অস্বীকৃতির অপরাধে ইনকুইজিশনের হাতে কারাবন্দি হয় সে। ‘আমাকে এখানেই আরামে থাকতে দাও,’ একাধিকবার বলেছিল সে। কারণ এর পর আর কিছু আছে কিনা আমার জানা নেই।’২৬

আলবারোর বিশ্বাস বোঝায় যে তার মেয়েজামাই ট্র্যাজিকমিক রোমান্স লা সেলেস্তিনা’র রচয়িতা ফার্নান্দো দে রোয়াসও (c. ১৪৬৫-১৫৪১) সন্দেহের আওতায় এসে পড়েছিল। ফলে সম্মানিত ক্রিশ্চানিটির একটা সযত্ন ভাব ধারণ করেছিল সে। কিন্তু ১৪৯৯ সালে প্রথম প্রকাশিত তাঁর লা সেলেস্তিনায় স্থূল বাড়াবাড়ির আড়ালে এক ধরনের ক্ষীণ সেক্যুলারিজমের আভাস দেখতে পাই আমরা। ঈশ্বর বলে কেউ নেই। ভালোবাসাই সবচেয়ে বড় মূল্যবোধ। কিন্তু ভালোবাসার মরণ ঘটলে বিরান ভুমিতে পরিণত হয় বিশ্ব। নাটকের শেষে প্লেবেরিও মেয়ের আত্মহত্যার জন্যে মাতম করছে, কেবল সেই তাকে জীবনের একটা অর্থ যোগাত। ‘হে পৃথিবী, হে পৃথিবী,’ উপসংহার টানছে সে, ‘যখন তরুণ ছিলাম, ভেবেছিলাম তোমাকে আর তোমার কর্মকাণ্ডকে পরিচালনার কোনও নিয়ম কানুন আছে।’ কিন্তু এখন

তোমাকে ভ্রান্তি, ভীতিকর মরুভূমি, বুনো জানোয়ারের আস্তানা, লোকে কেবল ঘুরে বেড়ায় এমন একটা খেলার মতো লাগছে…পাথুরে প্রান্তর, সাপে ভরা ময়দান, ফুলে ভরা কিন্তু বিরান বাগিচা, উদ্বেগের ফোয়ারা, অশ্রুজলের নদী, কষ্টের সাগর, ব্যর্থ আশা মনে হচ্ছে।২৭

পুরোনো ধর্ম পালন করতে না পেরে, ইনকুইজিশনের অত্যাচারে নতুন ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রোয়াস এমন এক হতাশায় ডুবে গিয়েছিল যে নিয়মকানুনের আর কোনও অর্থ খুঁজে পাচ্ছিল না সে, পাচ্ছিল না কোনও পরম মূল্যও।

ফান্দিনান্দ ও ইসাবেলা ইহুদিদের আর যাই হোক সংশয়বাদী অবিশ্বাসী হয়ে যাবার ব্যাপারটা চাননি মোটেই। কিন্তু আমাদের সম্পূর্ণ কাহিনী জুড়ে আমরা দেখতে পাই যে তাঁরা যে ধরনের নিপীড়ন আরোপ করেছিলেন সেটা নেতিবাচক ফল দিয়েছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে মানুষকে তৈরি হওয়ার আগেই চলমান বিশ্বাস গ্রহণ করতে বাধ্য করার প্রয়াস এমন সব ধারণা বা চর্চার পথ খুলে দেয় যা কিনা খোদ নিপীড়নকারী কর্তৃপক্ষের চোখে দারুণভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে দাঁড়ায়। ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা ছিলেন আগ্রাসী আধুনিকায়নবাদী, সব ধরনের ভিন্ন মত দমন করতে চেয়েছিলেন তাঁরা, কিন্তু তাঁদের ইনকুইজিশনাল পদ্ধতি গোপন ইহুদি দল গঠন ও প্রথমবারের মতো ইউরোপে সেক্যুলারিজম ও নাস্তিক্যবাদের ঘোষণার দিকে চালিত করেছে। পরে কিছু সংখ্যক ক্রিশ্চানও এই ধরনের ধর্মীয় স্বেচ্ছাচারে এতটাই বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছিল যে তারাও প্রত্যাদিষ্ট ধর্মে আস্থা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু সেক্যুলারিজমও সমান হিংস্র হতে পারে। বিংশ শতাব্দীতে প্রগতির নামে সেক্যুলার রীতিনীতি আরোপ উগ্র মৌলবাদের উত্থানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে কাজ করেছে, অনেক সময় সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর পক্ষে যা মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

১৪৯২ সালে খৃস্টধর্ম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানো প্রায় ৮০,০০০ ইহুদিকে পর্তুগালে আশ্রয় দিয়েছিলেন রাজা দ্বিতীয় হোয়াও। এইসব পর্তুগিজ ইহুদি এবং তাদের উত্তরপুরুষদের ভেতরই নাস্তিক্যবাদের সবচেয়ে প্রত্যক্ষ নাটকীয় নজীর দেখতে পাই। এই ইহুদিদের কেউ কেউ মরিয়াভাবে তাদের ইহুদি ধর্মকে আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করছিল, কিন্তু পর্যাপ্ত কাল্ট না থাকায় সেটা অসম্ভব বা কঠিন আবিষ্কার করেছে। ১৪৯২ সালে পর্তুগালে পালিয়ে যাওয়া ইহুদিরা স্প্যানিশ কনভার্সোদের চেয়ে কঠিন ছিল: বিশ্বাস ত্যাগ করার বদলে দেশান্তরী হওয়ার পথ বেছে নিয়েছিল তারা। ১৪৯৫ সালে প্রথম ম্যানুয়েল সিংহাসনে আসীন হলে শ্বশুর-শাশুড়ির কারণে তিনি রাজ্যের ইহুদিদের জোর করে ব্যাপ্টাইজ করার নির্দেশ দিতে বাধ্য হন, তবে এক প্রজন্মের জন্যে তাদের ইনকুইজিশন থেকে রেহাই দিয়ে আপোস করেন। এই পর্তুগিজ মারানোরা গোপন সংগঠন গড়ে তোলার জন্যে প্রায় পঞ্চাশ বছর সময় পেয়েছিল, এই সংগঠনে একটি সংখ্যালঘু অংশ গোপনে ইহুদি ধর্ম পালন করে চলে ও অন্যদেরও পুরোনো ধর্মবিশ্বাসে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস পায় ২৮

কিন্তু ইহুদি ধর্মান্তরিত এইসব মারানো বাকি ইহুদি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ক্যাথলিক শিক্ষা লাভ করেছিল তারা, ফলে তাদের কল্পনার জগৎ ক্রিশ্চান প্রতীক ও মতবাদে পরিপূর্ণ ছিল। প্রায়শঃই তারা ক্রিশ্চান পরিভাষায় ইহুদি ধর্ম নিয়ে কথা বলত। উদাহরণ স্বরূপ, তারা বিশ্বাস করত, জেসাস নয় বরং মোজেসের আইনের কারণেই তারা রক্ষা পেয়েছে, ইহুদি ধর্মে এই ধারণার তেমন কোনও মূল্য নেই। ইহুদি বিধানের অনেক কিছুই তারা বিস্মৃত হয়েছিল। বছর পেরুনোর সাথে সাথে ইহুদিবাদ সম্পর্কে তাদের উপলব্ধিও ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসে। অনেক সময় অ্যান্টি- সেমিটিক ক্রিশ্চানদের বিভিন্ন যুক্তি সম্বলিত রচনাই ছিল তাদের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ধারণা লাভের একমাত্র উৎস। শেষ পর্যন্ত তারা যার চর্চা শুরু করে সেটা হচ্ছে সঙ্কর ধর্মবিশ্বাস যা প্রকৃত ইহুদি বা ক্রিশ্চান ধর্মের কোনওটাই ছিল না।২৯ এদের এই টানাপোড়েন আজকের দিনে উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক লোকের টানাপোড়েনের চেয়ে ভিন্ন নয়, যাদের কেবল পাশ্চাত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে ভাসা ভাসা ধারণা রয়েছে, কিন্তু আধুনিকতার আগ্রাসনে তাদের জীবন যাত্রার প্রথাগত ধারা অবদমিত হওয়ার ফলে তারা আর প্রাচীন পদ্ধতির সাথেও খাপ খাওয়াতে পারছে না। একই রকম বিচ্ছিন্নতার বোধে আক্রান্ত হয়েছিল পর্তুগালের মারানো ইহুদিরা। তাদের অন্তস্থঃ সত্তার সাথে অনুরণিত হয়নি এমন এক আধুনিকায়িত সংস্কৃতিতে নিজেদের মিলিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল তারা।

ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে কিছু সংখ্যক ইহুদিকে ইবারিয় পেনিনসুলা ছেড়ে চলে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়। স্প্যানিশ কলোনীগুলোর কোনও কোনওটায় এবং সেইসাথে দক্ষিণ ফ্রান্সে ইতিমধ্যে একটা মারানো ডায়াসপোরা গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এখানকার ইহুদিদের তখনও তাদের ধর্ম পালন করতে দেওয়া হচ্ছিল না। অবশ্য সপ্তদশ শতাব্দীতে ইহুদি ধর্মপ্রচারকারী মারানোরা ভেনিস, হামবুর্গ ও-পরে-লন্ডনের মতো বিভিন্ন জায়গায় অভিবাসন করে। এইসব জায়গায় তারা প্রকাশ্যে ইহুদি ধর্মে প্রত্যাবর্তন করতে পেরেছিল। সবচেয়ে বড় কথা, ইনকুইজিশনের কবল থেকে পালিয়ে ইবারিয় শরণার্থীরা আমস্টার্ডামে হাজির হতে শুরু করেছিল, এটা তাদের নতুন জেরুজালেমে পরিণত হয়। নেদারল্যান্ডস ছিল ইউরোপের সহিষ্ণুতম দেশ। বিকাশমান বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের একটি প্রজাতন্ত্র দেশটি স্পেন থেকে স্বাধীনতা লাভের সংগ্রামের সময় ইবারিয় মূল্যবোধের বিপরীতে এক ধরনের উদার পরিচয় গড়ে তোলে। ১৬৩৭ সালে ইহুদিরা এই দেশের পূর্ণ নাগরিকত্ব লাভ করে। বেশির ভাগ ইউরোপিয় শহরের মতো এখানে তারা আর ঘেটো-বন্দি ছিল না। ওলন্দাজরা ইহুদিদের বাণিজ্যিক দক্ষতাকে কাজে লাগিয়েছে। ফলে ইহুদিরা বিশিষ্ট ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়ে জেন্টাইলদের সাথে মুক্তভাবে মেলামেশা শুরু করে। প্রাণবন্ত সামাজিক জীবন, অসাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা ও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠা প্রকাশনা শিল্প ছিল তাদের।

অনেক ইহুদিই সন্দেহাতীতভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ লাভের জন্যেই আমস্টারডামে পাড়ি জমিয়েছিল, কিন্তু একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইহুদি ইহুদিবাদের পূর্ণাঙ্গ চর্চা বজায় রাখতে উদগ্রীব ছিল। সেটা অবশ্য সহজ ছিল না। ইবারিয়া থেকে আগত ‘নব্য ইহুদিদের’ ব্যাপকভাবে অজ্ঞ হয়ে থাকা ধর্ম সম্পর্কে নতুন করে শিক্ষা নিতে হচ্ছিল। ওদের ফিরিয়ে আনার এক চ্যালেঞ্জিং কাজ পেয়েছিলেন র‍্যাবাইরা, ঐতিহ্যের সাথে আপোস না করেই বিভিন্ন বাস্তব সমস্যার জন্যে ওদের রেয়াত দিচ্ছিলেন তাঁরা। তাঁদের কল্যাণেই কিছু প্রাথমিক উদ্বেগ সত্ত্বেও বেশির ভাগ ইহুদিই ফিরে আসতে পেরেছিল। পূর্বপুরুষের ধর্মে প্রত্যাবর্তন উপভোগ করছে বলে আবিষ্কার করেছিল তারা। উল্লেখযোগ্য নজীর ছিলেন মেটাফিজিক্সের প্রফেসর ওরোবিও দে কাস্ত্রো, বছরের পর বছর স্পেনে গোপন ইহুদি ধর্ম প্রচারক রয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ইনকুইজিশনের হাতে আটক ও অত্যাচারিত হয়েছেন, তিনি বিশ্বাস প্রত্যাহার করেছেন ও ভুয়া ক্রিশ্চান হিসাবে তুলুজে চিকিৎসা বিজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। শেষে প্রতারণা ও দ্বৈত জীবন কাটাতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে ১৬৩০ সালে ইহুদিবাদের শক্তিশালী অ্যাপোলজিস্ট ও অন্য প্রত্যাবর্তনকারী মারানোদের শিক্ষক হতে আমস্টারডামে চলে আসেন তিনি।৩১

ওরোবিও অবশ্য একটা পূর্ণ জনগোষ্ঠীর বর্ণনা দিয়েছেন যারা প্রথাগত ইহুদিবাদের আইনকানুন ও রীতিনীতির সাথে মানিয়ে ওঠা কঠিন আবিষ্কার করেছে, ওদের কাছে তা অর্থহীন ও অযথা ভার মনে হয়েছে। ওরোবিওর মতোই ইবারিয়ায় যুক্তিবিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, গণিত ও ওষুধবিজ্ঞানের মতো আধুনিক বিজ্ঞান পাঠ করেছে তারা। কিন্তু, অধৈর্যভাবে জানাচ্ছেন ওরোবিও, ‘ওদের ছিল অনেক অহঙ্কার, গর্ব ও ঔদ্ধত্য, দারুণভাবে সব বিদ্যা অর্জন করার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী।’

ওরা মনে করে পবিত্র আইনে প্রকৃত শিক্ষিতদের কাছ থেকে শিখতে রাজি হলে ওরা শিক্ষিত মানুষের পরিচয় হারিয়ে ফেলবে, তাই তারা যেসব বিষয় বোঝে না সেগুলোকে অস্বীকার করে বিরাট জ্ঞানীর ভাব ধরে।৩২

দশকের পর দশক ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতায় বাসকারী এইসব ইহুদি তাদের নিজস্ব যৌক্তিক ক্ষমতার উপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়েছিল। তাদের কোনও লিটার্জি, সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় জীবন ও তোরাহর ‘পবিত্র আইন’ পালনের আচরিক অভিজ্ঞতা ছিল না। অবশেষে আমস্টারডামে পৌঁছানোর পর প্রথমবারের মতো পূর্ণাঙ্গ কার্যকর ইহুদি সম্প্রদায়ের মাঝে নিজেদের আবিষ্কার করে স্বাভাবিকভাবেই বিস্মিত বোধ করেছে। বহিরাগত কারও চোখে পেন্টাটিউকের ৬১৩টি নির্দেশনাকে খামখেয়ালি ও প্রাচীন ঠেকেছে। কোনও কোনও নির্দেশনা অচল হয়ে গিয়েছিল, কারণ সেগুলো পবিত্র ভুমির চাষাবাদ বা মন্দিরের লিটার্জির সাথে সম্পর্কিত ছিল, ডায়াসপোরায় যা আর প্রয়োগযোগ্য ছিল না। দুর্বোধ্য খাদ্য বিধি ও পবিত্রতা অর্জনের নিয়মের মতো অন্যান্য বিধিবিধানও নিশ্চয়ই আধুনিক পর্তুগিজ মারানোদের চোখে বর্বরোচিত ও অর্থহীন মনে হয়েছে; যৌক্তিকভাবে চিন্তাভাবনা করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল বলে র‍্যাবাইদের ব্যাখ্যা মেনে নেওয়া কঠিন ঠেকেছে তাদের কাছে। কমন এরার প্রথম শতাব্দীতে সংকলিত মৌখিক সাঙ্কেতিক আইন হালাখাহ আরও বেশি অযৌক্তিক ও খামখেয়ালি বলে মনে হয়েছে, তার কারণ এর এমনকি বাইবেলিয় অনুমোদন পর্যন্ত ছিল না।

কিন্তু মোজেসের আইন তোরাহর নিজস্ব একটা মিথোস ছিল। এটি ছিল লুরিয় কাব্বালাহর মতোই নির্বাসনের স্থানচ্যুতির প্রতি সাড়া। বিসিই ষষ্ঠ শতাব্দীতে মন্দির ধ্বংস করে, ওদের ধর্মীয় জীবনকে পর্যুদস্ত করে ইসারয়েলের জনগণকে বাবিলনে নির্বাসনে পাঠানো হলে আইনের টেক্সট এক নতুন ‘মন্দিরে’ পরিণত হয়েছিল। স্থানচ্যুত জনগণ এখানে ঐশী সত্তার একটা বোধকে লালন করেছে। বিশ্বকে পরিচ্ছন্ন ও নোংরা, পবিত্র ও অপবিত্র হিসাবে গ্রন্থিত করা ছিল বিধ্বস্ত জীবনকে আবার সুশৃঙ্খলিত করার কাল্পনিক পুনঃস্থাপন। নির্বাসনে থাকার সময় ইহুদিরা আবিষ্কার করেছিল যে, আইনের পাঠ তাদের এক ধরনের গভীর ধর্মীয় অভিজ্ঞতার যোগান দেয়। আধুনিক মানুষের মতো ইহুদিরা স্রেফ তথ্যের জন্যে টেক্সট পাঠ করত না: এটা ছিল পাঠের প্রক্রিয়া-প্রশ্ন-উত্তর, উত্তপ্ত বিতর্ক ও সূক্ষ্ম বিষয়ে মগ্ন হওয়া—যা তাদের ঐশী সত্তার বোধ যোগাত। তোরাহ ছিল ঈশ্বরের বাণী, এতে গভীরভাবে মগ্ন হয়ে, মোজেসের কাছে স্বয়ং ঈশ্বরের উচ্চারিত বাণী অন্তর দিয়ে স্মৃতিতে গেঁথে নিয়ে সেগুলোকে জোরে উচ্চারণ করে নিজেদের সত্তার ভেতর ঐশী সত্তাকে টেনে আনছিল ওরা, প্রবেশ করছিল পবিত্র বলয়ে। আইন একটা প্রতীকে পরিণত হয়েছিল, এখানেই ওরা শেখিনাহর দেখা পেয়েছিল। ওদের জীবনের সূক্ষ্মতম ক্ষেত্রে আইনের পালন স্বর্গীয় স্বজ্ঞা নিয়ে আসত: যখন তারা খেত, হাতমুখ ধুতো, প্রার্থনা করত বা স্রেফ সাব্বাথের সময় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিশ্রাম করত।

মারানোদের বাধ্য হয়ে জীবনভর যার উপর নির্ভর করতে হয়েছিল এর কোনওটাই হুট করে সেই যৌক্তিক চিন্তাভাবনা দিয়ে উপলব্ধি করা সম্ভব ছিল না। এই ধরনের পৌরাণিক ও কাল্টসুলভ অনুশীলন ছিল অজানা। নব্য ইহুদিদের কেউ কেউ, অভিযোগ করেছেন ওরোবিও, ‘বর্ণনার অতীত নাস্তিকে’ পরিণত হয়েছিল। ওরা, এটা নিশ্চিত যে, আমাদের বিংশ শতাব্দীর ধারণা মোতাবেক নাস্তিক ছিল না, কারণ তখনও তারা দুয়ে উপাস্যে বিশ্বাস করছিল। কিন্তু বাইবেলের ঈশ্বর ছিলেন না তিনি। মারানোরা পরবর্তীকালের আলোকন ফিলোসফদের” উদ্ভাবিত ডেইজমের মতো একটি সম্পূর্ণ যৌক্তিক বিশ্বাস গড়ে তুলেছিল। এই ঈশ্বর ছিলেন সমস্ত কিছুর প্রথম কারণ, অ্যারিস্টটল যাঁর অস্তিত্ব যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেছিলেন। সব সময়ই ইনি যৌক্তিকভাবে আচরণ করে এসেছেন। তিনি মানুষের ইতিহাসে ভ্রান্তিপূর্ণভাবে হস্তক্ষেপ করেন না, বিচিত্র অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়ে প্রকৃতির বিধিবিধানকে লঙ্ঘন করেন না বা পর্বতশীর্ষে অস্পষ্ট বিধান অবতীর্ণ করেন না। তাঁর বিশেষ ধরনের আইনি বিধান প্রকাশ করার প্রয়োজন পড়েনি, কারণ প্রকৃতির নিয়মকানুন সবারই বোধগম্য ছিল। মানুষের যুক্তি স্বাভাবিকভাবে এই ধরনের ঈশ্বরের ধারণাই কল্পনা করতে চেয়ে এসেছে। অতীতে ইহুদি ও মুসলিম দার্শনিকগণ বলতে গেলে ঠিক এমনই একজন উপাস্যকে হাজির করেছিলেন। কিন্তু সাধারণভাবে বিশ্বাসীদের কাছে তা কখনওই খুব ভালোভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। ধর্মের দিকে থেকে তা ব্যবহারযোগ্য ছিল না, কেননা প্রথম কারণ মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন কিনা তাতেই সন্দেহের অবকাশ ছিল, কারণ তাঁর পক্ষে পূর্ণাঙ্গ নয় এমন কোনও কিছুর কথা ভাবাও সম্ভব ছিল না। এমন একজন ঈশ্বরের পক্ষে মানুষের দুঃখদুর্দশার বেলায় কোনও কিছু বলার ছিল না। সেজন্যে আপনার প্রয়োজন পৌরাণিক ও কাল্টিক আধ্যাত্মিকতা, মারানোদের সেটা অজানা ছিল।

আমস্টারডামে ধর্মবিশ্বাসে ফিরে যাওয়া বেশির ভাগ মারানো কোনও কোনও মাত্রায় হালাখিয় আধ্যাত্মিকতা শিখতে সক্ষম হয়। কিন্তু কারও কারও বেলায় পরিবর্তন অসম্ভব ঠেকেছে। করুণতম ঘটনাগুলোর অন্যতম ছিল, উরিয়েল দা কোস্তার ঘটনা। কনভার্সো পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন তিনি, শিক্ষা লাভ করেছিলেন জেস্যুইটদের কাছে, কিন্তু ক্রিশ্চান ধর্মকে তিনি নির্যাতনমূলক, নিষ্ঠুর ও গস্পেলের সাথে সম্পর্ক বিবর্জিত সম্পূর্ণ মানব রচিত নিয়ম ও মতবাদে নির্মিত বলে আবিষ্কার করেছিলেন। দা কোস্তা ইহুদি ঐশীগ্রন্থের শরণাপন্ন হন ও নিজের জন্যে ইহুদি ধর্মের খুবই আদর্শগত যৌক্তিক ধারণা গড়ে তোলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আমস্টারডামে পৌঁছানোর পর সমসাময়িক ইহুদিধর্মমত ঠিক ক্যাথলিক মতবাদের মতোই মানব রচিত আবিষ্কার করে হতবাক হয়ে যান, কিংবা তাই দাবি করেছিলেন তিনি।

সম্প্রতি পণ্ডিতগণ দা কোস্তার বক্তব্যে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা যুক্তি তুলে ধরেছেন যে, প্রায় নিশ্চিতভাবেই যতটা আবছাই হোক না কেন ইহুদিবাদের হালাখিয় ধরনের সাথে আগেও তার সাক্ষাৎ ঘটেছিল, যদিও সম্ভবত হালাখাহ কতটা গভীরভাবে স্বাভাবিক ইহুদি জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করেছিল সেটা তিনি উপলব্ধি করে উঠতে পারেননি। তবে আমস্টারডামের ইহুদি জীবনধারার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে দা কোস্তার অক্ষমতার বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। পরকালের জীবন সংক্রান্ত মতবাদ ও ইহুদি বিধানের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন তিনি। এখানে তিনি ঘোষণা করেন, তিনি কেবল মানবীয় যুক্তি ও প্রকৃতিক বিধানেই বিশ্বাস করেন। অনেক বছর র‍্যাবাইরা একঘরে করে রেখেছিলেন তাঁকে। সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার আগ পর্যন্ত করুণ বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করেছিলেন দা কোস্তা, পরে তাঁকে আবার গ্রহণ করা হয়, আবার সমাজে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু আসলে দা কোস্তা তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাননি। কোনও রকম যৌক্তিক অর্থ সৃষ্টি করে না এমন সব আচার মেনে চলা অসম্ভব ঠেকেছিল তাঁর পক্ষে। আরও দুবার সমাজচ্যুত হয়েছিলেন তিনি। অবশেষে ১৬৪০ সালে হতাশায় পরাস্ত, ভগ্ন অবস্থায় নিজেই নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন।

দা কোস্তার ট্র্যাজিডি দেখায় যে, ইউরোপে তখনও পর্যন্ত ধর্মীয় জীবনের বিকল্প কোনও সেক্যুলার রীতির অস্তিত্ব ছিল না। আপনি অন্য ধর্ম গ্রহণ করতে পারতেন বটে, কিন্তু খুবই ব্যতিক্রমী মানুষ না হলে (দা কোস্তা যা ছিলেন না), ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাইরে টিকে থাকতে পারতেন না। সমাজচ্যুত থাকার বছরগুলোতে দা কোস্তা চরমভাবে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেছেন, ইহুদি ও ক্রিশ্চানরা তাঁকে সমানভাবে বর্জন করেছিল, পথেঘাটে বাচ্চারা তাঁকে টিটকারী মারত।৩৫

কিছুটা কম করুণ হলেও মোটামুটি সমান বাঙ্ময় ছিল হুয়ান দা প্রাদোর ঘটনা। ১৬৫৫ সালে আমস্টারডামে আসেন তিনি। প্রায়ই দা কোস্তার পরিণতি নিয়ে চিন্তা- ভাবনা করতেন। বিশ বছর পর্তুগালের গোপন ইহুদি সংগঠনের সদস্য ছিলেন তিনি, কিন্তু ধারণা করা হয়, ১৬৪৫ সালের দিকেই ডেইজমের মারানো ধরনের কাছে নতি স্বীকার করেছিলেন তিনি। মেধাবী বা পদ্ধতিগত চিন্তাবিদের কোনওটাই ছিলেন না প্রাদো। তবে তাঁর অভিজ্ঞতা দেখায়, কেবল যুক্তির উপর নির্ভর করে ইহুদিবাদের মতো কনফেশনাল কোনও ধর্ম মেনে চলা অসম্ভব। উপাসনার জীবন, কাল্ট ও অতীন্দ্রিয় গুরুত্ববিহীন প্রাদো কেবল এই উপসংহারে উপনীত হতে পেরেছিলেন যে, ‘ঈশ্বর’ কেবল প্রকৃতির বিধানের অনুরূপ। তারপরেও আরও দশ বছর তিনি গোপন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর কাছে ‘ইহুদিধর্ম’ যেন বন্ধুবর্গের মতো; একটা নিবিড়ভাবে গঠিত দলে তাঁর দেখা নিবিড় বন্ধনের অভিজ্ঞতা যা তাঁর জীবনের অর্থ যোগান দিয়েছে, কারণ তিনি যখন আর্মস্টারডামে পৌঁছে সেখানকার র‍্যাবাইদের প্রতি বিরূপ ধারণা লাভ করেন, তারপরেও ইহুদি সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরেই থাকতে চেয়েছিলেন। দা কোস্তার মতো প্রাদো অনেক বছর নিজের চিন্তাভাবনার স্বাধীনতা ও পছন্দমতো উপাসনা করার অধিকার টিকিয়ে রেখেছিলেন। ‘ইহুদি ধর্ম’ সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ধারণা ছিল। আসল ব্যাপারের মুখোমুখি হয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। জোরালভাবে আপত্তি তুলে ধরেছিলেন প্রাদো। ইহুদিরা কেন ভাবে যে ঈশ্বর কেবল তাদেরই বেছে নিয়েছেন? এই ঈশ্বর আসলে কী? ঈশ্বরকে বর্বরোচিত কাণ্ডজ্ঞানহীন কতগুলো আইন চাপিয়ে দেওয়া এক ব্যক্তি না ভেবে বরং প্রথম কারণ হিসাবে চিন্তা করাই কি অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত নয়? প্রাদো পরিণত হন বিব্রতকারীতে। র‍্যাবাইরা ইবারিয়া থেকে আগত নব্য ইহুদিদের শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন (অনেকের সাথেই প্রাদোর ভাবনার মিল ছিল), তাঁর ডেইজম বরদাশত করতে পারছিলেন না তাঁরা। ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ১৬৫৭ তারিখে তাঁকে সমাজচ্যুত করা হয়; কিন্তু তারপরেও সমাজ ত্যাগে অস্বীকার গেছেন তিনি।

এটা ছিল সম্পূর্ণ সমন্বয়ের অতীত দুটো দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাত। তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাদো ও র‍্যাবাইগণ, উভয়ই সঠিক ছিলেন। প্রচলিত ইহুদিবাদের কোনও অর্থ করতে পারেননি প্রাদো, মনের অতীন্দ্রিয় ছাঁচ হারিয়ে ফেলেছিলেন; কাল্ট ও আচারের মাধ্যমে ধর্মের গভীরতম অর্থ খুঁজে বের করার সুযোগ পাননি কোনওদিন। সব সময়ই তাঁকে যুক্তি ও নিজস্ব অন্তর্দৃষ্টির উপর নির্ভর করতে হয়েছে; এখন আর তা পরিত্যাগ করতে পারেননি। তবে র‍্যাবাইরাও সঠিক ছিলেন। প্রাদোর ডেইজমের সাথে তাঁদের চেনা ইহুদিবাদের কোনও ধরনের সাথেই মিল ছিল না। প্রাদো একজন ‘সেক্যুলার ইহুদি’ হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীতে এই ধরনের কোনও কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। প্রাদো বা র‍্যাবাইদের কারও পক্ষেই একে সঠিকভাবে গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না। এটা ছিল একদিকে পুরোপুরিভাবে যৌক্তিক বিশ্বদৃষ্টি ও অন্যদিকে কাল্ট ও মিথে গড়ে ওঠা ধর্মীয় মানসিকতার সংঘাতের একটি ধারার প্রথমটি।

এইসব নীতিগত সংঘাতে প্রায়শঃ যেমন হয়, কোনও পক্ষই খুব ভালো আচরণ করেনি। উদ্ধত মানুষ ছিলেন প্রাদো, র‍্যাবাইদের প্রকাশ্যে গালি দিতেন। একবার তলোয়ার নিয়ে সিনাগগে তাঁদের উপর হামলে পড়ারও হুমকি দিয়েছিলেন। র‍্যাবাইরাও কম সম্মানের সাথে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। প্রাদোর পেছনে গুপ্তচর লাগিয়েছিলেন তাঁরা। এই গুপ্তচর তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আরও রেডিক্যাল রূপ নেওয়ার খবর দিয়েছিল। সমাজচ্যুত হওয়ার পর তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ধর্ম হচ্ছে আবর্জনা; এবং তথাকথিত ‘প্রত্যাদেশ’ নয়, যুক্তিই হবে সব সময় সত্যের একক বিচারক। প্রাদো কীভাবে শেষ জীবন কাটিয়েছিলেন সেটা কেউ জানে না। তাঁকে সমাজ ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। অ্যান্টওয়ার্পে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। কেউ কেউ বলেন, তিনি এমনকি ক্যাথলিক চার্চের সাথে আপোসরফায় পৌঁছুনোর প্রয়াসও পেয়েছিলেন। তাই যদি হয়, তা ছিল মরিয়া পদক্ষেপ, যা আবারও দেখায় যে সপ্তদশ শতাব্দীতে একজন সাধারণ গঠনের মানুষের পক্ষে ধর্মের সীমানার বাইরে অবস্থান করা কতখানি অসম্ভব ছিল।৩৬

প্রাদো ও দা কোস্তা, এরা দুজনই ছিলেন আধুনিক চেতনার অগ্রদূত। তাঁদের কাহিনী দেখায়, কনফেশনাল ধর্মের মিথোস মনের অধিকতর স্বজ্ঞামূলক অংশের চর্চাকারী প্রার্থনা ও আচারের আধ্যাত্মিক অনুশীলন ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। কেবল যুক্তি দুর্বল ডেইজমের জন্ম দিতে পারে, অচিরেই যা প্রত্যাখ্যাত হয়, কারণ আমরা যখন বিষাদের মুখোমুখি হই বা বিপদে পড়ি তখন তা কোনও কাজে আসে না। প্রাদো ও দা কোস্তা বিশ্বাস হারিয়েছিলেন কারণ তাঁরা ধর্ম অনুশীলনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। কিন্তু আমস্টারডামের আরেক মারানো ইহুদি দেখিয়েছেন যে খোদ যুক্তির অনুশীলনই এতটা আকর্ষণীয় ও আনন্দদায়ক হয়ে উঠতে পারে যার ফলে মিথের প্রয়োজন কমে আসে। এই পৃথিবীই ধ্যনের একমাত্র বস্তুতে পরিণত হয়। এবং মানুষই, ঈশ্বর নন, সব বস্তুর মানদণ্ডে পরিণত হয়। কোনও ব্যতিক্রমী নারী বা পুরুষের মাঝে খোদ যুক্তি চর্চা এক ধরনের অতীন্দ্রিয় আলোকন এনে দিতে পারে। এটাও আধুনিক অভিজ্ঞতারই অংশ ছিল।

র‍্যাবাইরা প্রাদোকে সমাজচ্যুত করার সময়ই বারুচ স্পিনোযার বিরুদ্ধে বিচার কাজেরও সূচনা করেছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র তেইশ বছর। প্রাদোর বিপরীতে স্পিনোযা আমস্টারডামে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। পর্তুগালে ইহুদি ধর্মপ্রচারকের জীবন যাপন করেছিলেন তাঁর বাবা-মা। আমস্টারডামে আসার পর তাঁরা অর্থডক্স ইহুদিবাদে ধর্মান্তরিত হতে পেরেছিলেন। ফলে স্পিনোযাকে কখনওই ধাওয়া বা নির্যাতনের শিকার হতে হয়নি। সব সময়ই উদার আমস্টারডামে বাস করেছেন তিনি, জেন্টাইল বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনে যাতায়াত ছিল। বিনা বাধায় নিজ ধর্মবিশ্বাসের চর্চা করার সুযোগ ছিল। অসাধারণ কেতার তোরাহ স্কুলে প্রথাগত শিক্ষা লাভ করেন তিনি। তবে আধুনিক গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও পদার্থবিদ্যায় পড়াশোনা করেছেন। ব্যবসা বাণিজ্যের জীবন স্থির হয়েছিল স্পিনোযার, তাঁকে নিবেদিতপ্রাণ ধার্মিক বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু ১৬৫৫ সালে আমস্টাডামে প্রাদোর আগমনের অল্প পরেই আকস্মিকভাবে সিনাগগে প্রার্থনায় যাওয়া বন্ধ করে দেন তিনি, সন্দেহের কথাকে ভাষা দিতে শুরু করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে বাইবেলের তিনি টেক্সটে স্ববিরোধিতা রয়েছে, তাই ঐশী উৎসের নয়, এটা মানব রচিত বলেই প্রমাণিত হয়। তিনি প্রত্যাদেশের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে যুক্তি দেখান যে ‘ঈশ্বর’ স্রেফ খোদ প্রকৃতির সামগ্রিকতা। শেষ পর্যন্ত ২৭শে জুলাই, ১৬৫৬ তারিখে র‍্যাবাইগণ স্পিনোযার বিরুদ্ধে সমাজচ্যুতির ফরমান জারি করেন। প্রাদোর বিপরীতে স্পিনোযা সমাজে থাকার অনুরোধ জানাননি। চলে যেতে পেরে খুশি ছিলেন, ইউরোপে প্রতিষ্ঠিত ধর্মের আওতার বাইরে সফলভাবে স্বাধীনভাবে জীবনযাপনকারী প্রথম ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি।

প্রাদো বা দা কোস্তার চেয়ে স্পিনোযার পক্ষে জেন্টাইল বিশ্বে বেঁচে থাকা অনেকাংশে সহজতর ছিল। মেধাবী ছিলেন তিনি, পরিষ্কারভাবে নিজের অবস্থান তুলে ধরতে পারতেন এবং প্রকৃত স্বাধীন মানুষ হিসাবে এর সাথে সম্পর্কিত অনিবার্য নৈঃসঙ্গকে ধারণ করতে পেরেছেন। নেদারল্যান্ডসে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি, ক্ষমতাশালী পৃষ্ঠপোষকগণ তাঁকে যুক্তিসঙ্গত রেয়াত দিয়েছেন। ফলে হতদরিদ্র অবস্থায় জীবন কাটাতে হয়নি তাঁকে। প্রায়শঃ যেমন মনে করা হয়, স্পিনোযা বেঁচে থাকার তাগিদে লেন্স ঘঁষতে বাধ্য হননি, বরং অপটিক্সে নিজের কৌতূহল নিবৃত্ত করতেই একাজ করেছিলেন। তখনকার সময়ের বেশ কয়েকজন নেতৃত্বস্থানীয় জেন্টাইল বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু তারপরেও বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি রয়ে গিয়েছিলেন। ইহুদি ও জেন্টাইলরা সমানভাবে তাঁর ধর্মহীনতাকে হয় ভয়ঙ্কর বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ হিসাবে আবিষ্কার করেছে। ৩৭

কিন্তু তাসত্ত্বেও স্পিনোযার নাস্তিক্যবাদে আধ্যাত্মিকতা ছিল, কারণ জগৎকে তিনি ঐশী ভাবতেন। জাগতিক বাস্তবতায় ব্যাপ্ত ঈশ্বরের একটা ছবিই স্পিনোযাকে বিস্ময় ও শ্রদ্ধায় পূর্ণ করে রেখেছিল। শর্ট ট্রিটাইজ অন গড-এ (১৬৬১) যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, দার্শনিক গবেষণা ও চিন্তাভাবনাকে এক ধরনের প্রার্থনা মনে করতেন তিনি। এই উপাস্য জানবার মতো কোনও বস্তু নন, বরং আমাদের ভাবনার নীতি। এ থেকে অগ্রসর হয়ে বলা হয়েছে, আমরা যখন জ্ঞান অর্জন করে আনন্দ বোধ করি সেটা ঈশ্বরের প্রতি বুদ্ধিবৃত্তিক ভালোবাসা মাত্র। প্রকৃত দার্শনিক, স্পিনোযা বিশ্বাস করতেন, তিনি যাকে স্বজ্ঞামূলক জ্ঞান বলেছেন, তার চর্চা করবেন, অন্তর্দৃষ্টির একটা ঝলক আলোচনার ভেতর দিয়ে সংগ্রহ করা তার সমস্ত তথ্যকে সমন্বিত করবে, এবং এটা ছিল এমন এক অভিজ্ঞতা স্পিনোযা যাকে ঈশ্বর বলে বিশ্বাস করেছেন। এই অভিজ্ঞতাকে তিনি বলেছেন ‘স্বর্গসুখ’ (বিটিচ্যুড): এই পর্যায়ে দার্শনিক বুঝতে পারেন যে তিনি ঈশ্বর হতে অবিচ্ছেদ্য ও মানুষের মাধ্যমেই ঈশ্বর অস্তিত্ববান। এটা ছিল অতীন্দ্রিয় দর্শন, জন অভ দ্য ক্রস ও তেরেসা অভ আভিলার চর্চিত আধ্যাত্মিকতার যৌক্তিক ভাষ্য হিসাবে দেখা যেতে পারত একে। কিন্তু এই ধরনের ধর্মীয় অন্তর্দৃষ্টির কোনও ফুরসত স্পিনোযার ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন একজন দুয়ে ঈশ্বরের আকাঙ্ক্ষা করতে গিয়ে মানুষ তার নিজ প্রকৃতি হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। পরবর্তী কালের দার্শনিকগণ স্পিনোযার স্বর্গসুখের পরমানন্দের অনুসন্ধানকে বিব্রতকর আবিষ্কার করে ঈশ্বরকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করবেন। তা সত্ত্বেও এ বিশ্ব জগতের প্রতি মনোসংযোগ ও অতিপ্রাকৃতকে অস্বীকার যাওয়ার ভেতর স্পিনোযা ইউরোপের অন্যতম প্ৰথম সেক্যুলারে পরিণত হয়েছিলেন।

অনেক আধুনিক মানুষের মতো স্পিনোযা সব ধরনের আনুষ্ঠানিক ধর্মকে বিতৃষ্ণার সাথে দেখতেন। তাঁর সমাজচ্যুতির অভিজ্ঞতা বিবেচনা করলে একে তেমন একটা বিস্ময়কর বলা যাবে না। প্রত্যাদিষ্ট ধর্মবিশ্বাসসমূহকে ‘বিশ্বাসপ্রবণতা ও কুসংস্কারের স্তূপ’ ও ‘অর্থহীন রহস্যের জটলা’ হিসাবে নাকচ করে দিয়েছেন তিনি।৩৮ বাইবেলিয় টেক্সটে নিজেকে মগ্ন করে নয়, যুক্তির বাধাহীন ব্যবহারে আনন্দ লাভ করেছেন; ফলে ঐশীগ্রন্থসমূহকে তিনি সম্পূর্ণই বস্তুগত দৃষ্টিতে দেখেছেন। একে স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ হিসাবে দেখার বদলে স্পিনোযা জোরের সাথে বলেছেন যে, বাইবেলকে অন্য যেকোনও টেক্সটের মতোই পড়তে হবে। বৈজ্ঞানিকভাবে বাইবেল পাঠকারীদের ভেতর তিনি ছিলেন অন্যতম। তিনি এর ঐতিহাসিক পটভূমি পরীক্ষা করেছেন, সাহিত্যিক ঘরানা পরখ করেছেন, ও রচয়িতার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আপন রাজনৈতিক ধারণা পরখ করতেও বাইবেল ব্যবহার করেছেন। পাশ্চাত্য আধুনিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্যে পরিণত হতে চলা ইউরোপের সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আদর্শ তুলে ধরা ব্যক্তিদের ভেতর অন্যতম ছিলেন স্পিনোযা। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, প্রিস্টরা ইসরায়েলের রাজার চেয়ে বেশি ক্ষমতা হাতে পাবার পর রাষ্ট্রের আইন-কানুন শাস্তিমূলক ও প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে। আদিতে ইসরায়েল রাজ্য ধর্মতান্ত্রিক ছিল, কিন্তু স্পিনোযার দৃষ্টিভঙ্গিতে, ঈশ্বর ও সাধারণ জনগণ একই থাকায় মানুষের কণ্ঠস্বরই ছিল সার্বভৌম। পুরোহিতরা ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার পর আর ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর শোনা যায়নি৷ কিন্তু স্পিনোযা লোকানুবর্তী ছিলেন না। অধিকাংশ প্রাক আধুনিক দার্শনিকের মতোই অভিজাতবাদী ছিলেন তিনি, সাধারণ জনগণকে যৌক্তিক চিন্তাভাবনায় অক্ষম মনে করতেন। তাদের কোনও ধরনের আলোকন যোগাতে এক জাতীয় ধর্মের প্রয়োজন পড়বে, কিন্তু প্রত্যাদিষ্ট আইনের ভিত্তিতে নয়, বরং ন্যায়বিচার, ভ্রাতৃত্ববোধ ও উদারতার স্বাভাবিক নীতিমালার ভিত্তিতে এই ধর্মকে অবশ্যই সংস্কার করতে হবে। ৪১

সন্দেহাতীতভাবে স্পিনোযা ছিলেন আধুনিক চেতনার অন্যতম বাহক। পরবর্তী সময়ে সেক্যুলার ইহুদিদের এক ধরনের নায়কে পরিণত হবেন তিনি। ধর্ম থেকে নীতির ভিত্তিতে তাঁর যাত্রাকে তারা শ্রদ্ধা করেছে। কিন্তু জীবদ্দশায় স্পিনোযার কোনও ইহুদি অনুসারী ছিল না; যদিও এটা স্পষ্ট যে, বহু ইহুদিই তখন মৌলিক পরিবর্তনের জন্যে প্রস্তুত ছিল। মোটামুটি স্পিনোযার সেক্যুলার যুক্তিবাদ গড়ে তোলার সময়টিতেই এক মেসিয়ানিক উন্মাদনায় আক্রান্ত হয়েছিল ইহুদি জগৎ যুক্তিকে যা হাওয়ায় উড়িয়ে দেবে বলে মনে হয়েছে। আধুনিক কালের অন্যতম প্রথম মিলেনিয়াল আন্দোলন ছিল এটা, নারী-পুরুষকে পবিত্র অতীতের সাথে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে সম্পূর্ণ নতুন কিছুর দিকে অগ্রসর হতে ধর্মীয় উপায় যুগিয়েছিল। আমাদের কাহিনীতে প্রায়ই এটা লক্ষ করব আমরা। অল্প সংখ্যক লোকই আধুনিকতার সেক্যুলারিস্ট দর্শন উপস্থাপনকারী অভিজাত দার্শনিকদের বুঝতে সক্ষম ছিল। বেশির ভাগই ধর্মের উপর ভরসা করে নতুন বিশ্বে যাত্রা করেছিল, যা তাদের অতীতের সাথে এক ধরনের সান্ত্বনামূলক ধারাবাহিকতার বোধ দিয়েছে ও পৌরাণিক কাঠামোয় আধুনিক লোগোসকে ভিত্তি দিয়েছে।

এটা প্রতীয়মান যে, সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ অনেক ইহুদিই বিচ্ছিন্নতার একটা অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল। আমস্টারডামের মারানো সম্প্রদায়ের মতো ইউরোপের আর কোনও ইহুদিই স্বাধীনতা ভোগ করেনি। স্পিনোযা জেন্টাইলদের সাথে মিশতে পেরেছিলেন ও নতুন বিজ্ঞান পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন বলেই তাঁর রেডিক্যাল নতুন প্রস্থান সম্ভব হয়েছিল। ক্রিশ্চান জগতের অন্যান্য জায়গায় ইহুদিরা মূলধারার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ষোড়শ শতাব্দী নাগাদ কোনও ইহুদিই ‘ঘেটো’ নামে পরিচিত বিশেষ ইহুদি এলাকার বাইরে থাকতে পারত না। এর মানে ছিল ইহুদিদের অনিবার্যভাবে অন্তর্মুখী জীবন যাপন করতে হত। বিচ্ছিন্নতা অ্যান্টিসেমিটিক সংস্কার উস্কে দিয়েছিল। ইহুদিরা স্বভাবতই নিপীড়নকারী জেন্টাইল বিশ্বের বিরুদ্ধে তিক্ততা ও সন্দেহের মাধ্যমে সাড়া দিয়েছিল। ঘেটোগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ জগতে পরিণত হয়। ইহুদিদের নিজস্ব স্কুল, নিজস্ব সামাজিক ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান, নিজস্ব স্নানঘর, কবরস্থান ও কসাইখানা ছিল। ঘেটোগুলো স্বায়ত্তশাসিত ও স্বপরিচালিত ছিল। নির্বাচিত র‍্যাবাই ও প্রবীনদের কেহিলা (গোষ্ঠীগত সরকার) ইহুদি আইন মোতাবেক নিজস্ব আদালত পরিচালনা করত। কার্যত ঘেটো ছিল রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র, পৃথিবীর ভেতরে আরেক পৃথিবী। বাইরের জেন্টাইল সমাজের সাথে ইহুদিদের যোগাযোগ ছিল-প্রায়শঃ তাদের সেই ইচ্ছাও ছিল কম। কিন্তু সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় নাগাদ মনে হয় যে অনেকেই তাদের সীমাবদ্ধতায় বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। সাধারণত অস্বাস্থ্যকর, নোংরা এলাকায় ছিল ঘেটোগুলোর অবস্থান। উঁচু দেয়ালে ঘেরাও করা ছিল সেগুলো, যার মানে ছিল জনসংখ্যার আধিক্য, কিন্তু সীমানা সম্প্রসারণের কোনও সম্ভাবনা ছিল না। এমনকি রোম বা ভেনিসের অপেক্ষাকৃত বড় ঘেটোতেও বাগান করার মতোও কোনও জায়গা ছিল না। নিজেদের জন্যে জায়গা বাড়ানোর একটা উপায়ই ছিল ইহুদিদের: আগের দালানের উপর নতুন করে আরেক তলা নির্মাণ, এবং প্রায়শঃই সেটা অপর্যাপ্ত ফাউন্ডেশনের উপর, ফলে সবকিছু ধসে পড়ত। অগ্নিকাণ্ড ও রোগশোকের হুমকি ছিল সারাক্ষণ। ইহুদিদের ভিন্ন পোশাক পরতে বাধ্য করা হত। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার মোকাবিলা করতে হয়েছে তাদের। প্রায়শঃই ফেরিঅলা বা দর্জির কাজই ছিল তাদের সামনে একমাত্র উন্মুক্ত পেশা। বৃহৎ আকারের কোনও বাণিজ্যিক উদ্যোগের অনুমতি ছিল না। ফলে জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ দানের উপর নির্ভর করে থাকত। সূর্যালোক ও প্রকৃতির সাথে সম্পর্করহিত ইহুদিরা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ওরা মানসিকভাবেও বন্দি ছিল। ইউরোপের বিজ্ঞান ও শিল্পকলার সাথে তাদের কোনও যোগাযোগ ছিল না। ওদের নিজস্ব স্কুলগুলো ভালো ছিল, কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দীর পরে ক্রিশ্চান জগতের শিক্ষাকার্যক্রম আরও উদার হয়ে উঠছিল যখন, ইহুদিরা তখনও কেবল তোরাহ ও তালমুদে পাঠে মগ্ন ছিল। কেবল নিজস্ব টেক্সট ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে মগ্ন থাকায় ইহুদিদের শিক্ষায় চুলচেরা বিশ্লেষণ ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার একটা প্রবণতা ছিল। ৪২

ইসলামি বিশ্বের ইহুদিরা ক্রিশ্চান বিশ্বের ইহুদিদের মতো নিষেধাজ্ঞার অধীন ছিল না। জিম্মি’র (‘প্রতিরক্ষা প্রাপ্ত সংখ্যালঘু’) মর্যাদা পেয়েছিল তারা, যতক্ষণ ইসলামি রাষ্ট্রের আইন ও সার্বভৌমত্ব স্বীকার করছে ততক্ষণ এটা তাদের নাগরিক ও সামরিক প্রতিরক্ষা দিয়েছে। ইসলামের ইহুদিরা নির্যাতিত হয়নি; অ্যান্টি- সেমিটিজমের কোনও ঐতিহ্য ছিল না, জিম্মিরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হলেও পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল ওদের, নিজেদের আইন অনুযায়ী নিজস্ব কর্মকাণ্ড চালাতে পারত ওরা; ইউরোপের ইহুদিদের তুলনায় ঢের ভালোভাবে মূলধারার সংস্কৃতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশ নিতে পারত। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ দেখাবে, এমনকি ইসলামি বিশ্বের ইহুদিরাও অস্থির হয়ে উঠছিল, আরও বৃহত্তর মুক্তির সন্ধান করছিল তারা। ১৪৯২ সাল থেকে ইউরোপে একের পর এক বিপর্যয়ের সংবাদ পাচ্ছিল তারা, তারপর ১৬৪৮ সালে পোল্যান্ডে ইহুদিদের বিরুদ্ধে পরিচালিত নির্যাতনের খবরে রীতিমতো সম্ভ্রন্ত ওঠে। বিংশ শতাব্দীর আগে আর যার কোনও তুলনা মিলবে না।

পোল্যান্ড সম্প্রতি বর্তমানের ইউক্রেনের সিংহভাগ এলাকা অধিভুক্ত করে নিয়েছিল; এখানে নিজস্ব প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে কৃষক সমাজ অশ্বারোহী বাহিনী গড়ে তুলেছিল। এই ‘কস্যাক’রা পোলিশ ও ইহুদিদের সমানভাবে ঘৃণা করত, এরা প্রায়শঃই পোলিশ অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যস্বত্বভোগী হিসাবে জমিন দেখাশোনা করত। ১৬৪৯ সালে কস্যাক নেতা বরিস শমিয়েলনিকি পোলদের বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। পোলিশ ও ইহুদি সম্প্রদায়ের উপর সমান তালে আক্রমণ পরিচালনা করা হয় তখন। ১৬৬৭ সালে অবশেষে যুদ্ধের অবসান ঘটলে, বিবরণী আমাদের জানায়, ১,০০,০০০ ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল ও ৩০০ ইহুদি মহল্লা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। এই সংখ্যাগুলো অতিরঞ্জিত হয়ে থাকলেও শরণার্থীদের চিঠি ও কাহিনী বিশ্বের অন্যান্য এলাকার ইহুদিদের ত্রস্ত করে তোলে। এইসব চিঠি আর কাহিনীতে ইহুদিদের বিরুদ্ধে চালানো হত্যালীলার কথা বলা হয়; ইহুদিদের জবাই করা হয়েছে, গণকবরে ইহুদি নারী-শিশুকে জ্যান্ত পুঁতে মারা হয়েছে, ইহুদিদের হাতে রাইফেল ধরিয়ে দিয়ে একজনকে অন্যের উপর গুলি চালানোর হুকুম দেওয়া হয়েছে। অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, এইসব ঘটনা নিশ্চয়ই দীর্ঘ প্রতিক্ষিত সেই ‘মেসায়াহর প্রসব বেদনাই’ হবে। ফলে মেসিয়ানিক নিস্তারকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে লুরিয় কাব্বালাহর বিভিন্ন আচার ও প্রায়শ্চিত্তমূলক অনুশীলনকে মরিয়া হয়ে আঁকড়ে ধরেছিল তারা।৪৪

মিয়েলনিকি হত্যাকাণ্ডের খবর বর্তমান তুরস্কের স্মিরনায় এসে পৌঁছলে শহরের বাইরে হাঁটতে হাঁটতে ধ্যানমগ্ন এক যুবক এক স্বর্গীয় কণ্ঠস্বর শুনতে পান। কণ্ঠস্বর তাঁকে বলছিল যে, স্বয়ং তিনি ‘ইসরায়েলের ত্রাণকর্তা, মেসায়াহ, ডেভিডের ছেলে, জ্যাকবের ঈশ্বরের মনোনীতজন।৪৫ শাব্বেতাই যেভি ছিলেন তরুণ পণ্ডিত ও কাব্বালিস্ট (যদিও এই পর্যায়ে লুরিয় কাব্বালাহয় অভিজ্ঞ ছিলেন না): ছোট একটা অনুসারী গোষ্ঠীর সাথে নিজের চিন্তভাবনা নিয়ে আলোচনা করবেন তিনি। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি; কিন্তু আনুমানিক বিশ বছর বয়সে পৌঁছানোর পরপরই এমন সব লক্ষণ দেখাতে শুরু করেছিলেন বর্তমানে আমরা যাকে ম্যানিক ডিপ্রেসিভ হিসবাবে আখ্যায়িত করব। কিছুদিনের জন্যে নিখোঁজ হয়ে যেতেন তিনি, অন্ধকার ছোট কামরায় প্রবল দুঃখে ডুবে যেতেন, কিন্তু বিষণ্নতার এই পর্যায়গুলো ‘আলোকনের’ এক উন্মত্ত পর্যায়ে প্রতিস্থাপিত হত। এই সময় অস্থির হয়ে উঠতেন তিনি, ঘুমোতে পারতেন না, তাঁর মনে হত কোনও উচ্চতর শক্তির সংস্পর্শে চলে গেছেন। অনেক সময় তোরাহর বিভিন্ন নির্দেশনা অমান্য করতে বাধ্য হতেন, যেমন প্রকাশ্যে ঈশ্বরের নিষিদ্ধ নাম উচ্চারণ করতেন; বা অকোশার খাবার খেতেন। কেন এইসব ‘অদ্ভুত কাজ’ করছেন বলতে পারতেন না তিনি, তবে তাঁর মনে হত ঈশ্বর কোনও কারণে তাঁকে দিয়ে এসব করাচ্ছেন।৪৬ পরে তিনি নিশ্চিত হয়ে যান যে, এইসব নৈতিকতা বিরোধী কর্মকাণ্ড নিস্তারমূলক: ঈশ্বর ‘অচিরেই জগৎকে ঠিক করার জন্যে নতুন আইন ও নতুন নির্দেশনা দেবেন তাঁকে।’৪৭ এইসব লঙ্ঘন ছিল ‘পবিত্র পাপ’; এগুলোকে লুরিয় কাব্বালিস্টরা তিনের কর্মকাণ্ড বলে অভিহিত করত। এমন হতে পারে যে, এসব প্রথাগত ইহুদি জীবন ধারার বিরুদ্ধে এক ধরনের বিদ্রোহ তুলে ধরেছে ও সম্পূর্ণ নতুন কিছুর জন্যে অবদমিত আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছে।

শেষ পর্যন্ত শাব্বেতাইয়ের আচার-আচরণ স্মিরনার ইহুদিদের পক্ষে সহ্যের অতীত হয়ে দাঁড়ায়। ১৬৫০ সালে শহর ত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। এরপর পনের বছর মেয়াদী একটা পর্বের সূচনা করেন। পরে একে ‘অন্ধকার বছর’ আখ্যায়িত করেছিলেন। এই সময় অটোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি, এক শহর থেকে চলে গেছেন আরেক শহরে। নিজের মেসিয়ানিক বৃত্তি সম্পর্কে কাউকে কিছু বলেননি, হয়তো বা বিশেষ ব্রতের ধারণাই বিসর্জন দিয়ে থাকতে পারেন। ১৬৬৫ সালের দিকে নিজের দানোর কাছ থেকে মুক্ত হয়ে র‍্যাবাই হতে চেয়েছিলেন তিনি।৪৮ চিকিৎসক হিসাবে নিজেকে পরিচিত করে তোলা গাযার এক মেধাবী কাব্বালিস্টের কথা জানতে পেরে তাঁর সাথে দেখা করতে রওয়ানা হয়ে যান। এই র‍্যাবাই নাথান আগেই শাব্বেতাইয়ের কথা শুনেছিলেন; সম্ভবত একই সময়ে পরস্পরের কাছে অপরিচিত অবস্থায় জেরুজালেমে থাকার সময়। শাব্বেতাইয়ের ‘অদ্ভুত কাজকর্মের’ একটা কিছু নিশ্চয়ই নাথানের কল্পনায় ঠাঁই করে নিয়েছিল, কারণ অতিথির আগমনের অল্প আগে তাঁর সম্পর্কে একটা দৈববাণী পান তিনি। সম্প্রতি লুরিয় কাব্বালাহয় দীক্ষা নিয়েছিলেন তিনি, এবং পুরিমের ঠিক আগে নিজেকে বন্দি করে উপবাস পালন করে শ্লোক আবৃত্তি করার মাধ্যমে ধ্যানে বসেছিলেন। এই ধ্যানের সময় শাব্বেতাইকে দিব্যচোখে দেখতে পান তিনি ও স্বকণ্ঠে তাঁকে চিৎকার করে ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করতে শুনতে পান। ‘আর প্রভু এইরকম কহেন! তোমার ত্রাণকর্তার আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করো। শাব্বেতাই যেভি তাঁর নাম। তিনি ক্রন্দন করবেন, হ্যাঁ, গর্জন করবেন, আমার শত্রুকে পরাস্ত করবেন।৪৯ সত্যিই শাব্বেতাই যখন তাঁর বাড়ির দরজায় এসে হাজির হলেন, নাথান একে কেবল ভবিষ্যদ্বাণীসুলভ সেই দিব্যদর্শনের প্রমাণ হিসাবেই কল্পনা করতে পেরেছিলেন।

কেমন করে নাথানের মতো একজন মেধাবী মানুষ এই বিষণ্ন, বিপর্যস্ত মানুষটিকে নিজের ত্রাতা ভাবতে পেরেছিলেন? লুরিয় কাব্বালাহ মোতাবেক একেবারে সূচনাতেই মেসায়াহ যিমযুমের আদি প্রক্রিয়ার সময় সৃষ্ট ঈশ্বরহীন বলয়ে আটকা পড়ে গিয়েছিলেন। সুতরাং ‘অন্য পক্ষের’ অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে বাধ্য হয়েছিলেন মেসায়াহ। কিন্তু এখন, কাব্বালিস্টদের প্রায়শ্চিত্তমূলক অনুশীলনের কল্যাণে নাথান বিশ্বাস করেছিলেন, এই দানবীয় শক্তিগুলো মেসায়াহর উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেছে। সময়ে সময়ে তাঁর আত্মা নিজেকে মুক্ত করে শূন্যে ভেসে যায় এবং মেসিয়ানিক যুগের নতুন বিধান অবতীর্ণ করে। কিন্তু এখনও বিজয় সম্পূর্ণ হয়নি। সময়ে সময়ে মেসায়াহ আবারও অন্ধকারের শিকারে পরিণত হন। এসবই শাব্বেতাইয়ের ব্যক্তিত্ব ও অভিজ্ঞতার সাথে যেন নিখুঁতভাবে মিলে গিয়েছিল বলে মনে হয়েছে। তিনি পৌঁছানোর পর নাথান তাঁকে বললেন, সমাপ্তি আসন্ন। অচিরেই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে তাঁর বিজয় পূর্ণাঙ্গ রূপ নেবে, ইহুদি জনগণের পক্ষে মুক্তি নিয়ে আসবেন তিনি। পুরোনো আইন রদ হয়ে যাবে, এক সময়ের নিষিদ্ধ কাজ ও পাপ পবিত্র হয়ে যাবে।

প্রথমে নাথানের এই কল্পনা-বিলাসের সাথে তাল মেলাতে রাজি হননি শাব্বেতাই, কিন্তু ক্রমে তরুণ র‍্যাবাইয়ের বাগ্মীতার কাছে পরাস্ত হন তিনি, এসব অন্তত তাঁর বিচিত্র আচরণের একটা ব্যাখ্যা যুগিয়েছিল তাঁকে। ২৮শে মে, ১৬৬৫ নিজেকে মেসায়াহ ঘোষণা করেন শাব্বেতাই। আর নাথানও সাথে সাথে অচিরেই ত্রাণকর্তা অটোমান সুলতানকে পরাস্ত করবেন, ইহুদিদের নির্বাসনের অবসান ঘটাবেন ও তাদের আবার পবিত্র ভূমিতে ফিরিয়ে আনবেন, সকল জেন্টাইল জাতি তাঁর কাছে নতি স্বীকার করবে ঘোষণা দিয়ে মিশর, আলেপ্পো ও স্মিরনায় চিঠি পাঠান।৫১ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে এই খবর। ১৬৬৬ সাল নাগাদ ইউরোপের প্রায় সমস্ত বসতি, অটোমান সাম্রাজ্য ও ইরানে শেকড় গেড়ে বসে মেসিয়ানিক উন্মাদনা। উন্মত্ত সব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছিল: ইহুদিরা সহায়সম্পদ বিক্রি করে প্যালেস্তাইনে পাড়ি জমানোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ে। সময়ে সময়ে মেসায়াহ কোনও উপবাস দিনের প্রথা বাতিল করেছেন বলে শুনতে পেত তারা, তখন মিছিল করে নেমে আসত রাস্তায়, নাচত। নাথান এই বলে নির্দেশ জারি করেছিলেন যে, ইহুদিদের সাফেদের প্রায়শ্চিত্তমূলক আচার পালন করে সমাপ্তিকে ত্বরান্বিত করতে হবে। ইউরোপ, মিশর, ইরান, বালকান, ইতালি, আমস্টারডাম, পোল্যান্ড ও ফ্রান্সে ইহুদিরা উপবাস পালন করে, রাত্রি জাগরণ করে, বরফ শীতল পানিতে ডুবে থাকে, বিছুটি পাতায় গড়াগড়ি খায় এবং গরীবদের ভিক্ষা দিতে থাকে। এটা ছিল আধুনিকতার গোড়ার দিকে সূচিত অনেকগুলো মহাজাগরণের (গ্রেট অ্যাওয়াকেনিং) অন্যতম। এই সময় লোকে সহজাত প্রবৃত্তির বশেই বড় ধরনের পরিবর্তন আসার কথা জানতে পারে। খোদ শাব্বেতাই সম্পর্কে খুব অল্প লোকই বিস্তারিত জানত। আর নাথানের দুর্বোধ্য কাব্বালিস্টিক দিব্যদর্শন সম্পর্কে ওয়াকিবহালের সংখ্যা ছিল আরও কম; মেসায়াহ এসেছেন এবং দীর্ঘ প্রতীক্ষিত আশা পূরণ হতে চলেছে, এটা জানাই যথেষ্ট ছিল। এইসব আনন্দমুখর মাসে ইহুদিরা এতটাই আশা ও প্রাণশক্তিতে জেগে উঠেছিল যে ঘেটোর কর্কশ, সীমিত জীবন মিলিয়ে গেছে বলে মনে হয়েছে। সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছুর স্বাদ লাভ করেছিল তারা, অনেকের জীবনই আর কখনও আগের মতো হবে না। নতুন সম্ভাবনার আভাস পেয়েছিল ওরা, একেবারে নাগালের ভেতর মনে হয়েছে সেটা। নিজেদের মুক্ত ভেবে অনেক ইহুদিই ধরে নিয়েছিল পুরোনো জীবন চিরকালের জন্যে বিদায় নিয়েছে।৫৩

শাব্বেতাই বা নাথানের প্রত্যক্ষ প্রভাবের অধীনে আগত ইহুদিরা পরিচিত জীবনধারার পূর্ণাঙ্গ প্রত্যাখ্যান বোঝানো সত্ত্বেও তোরাহকে বাতিল করতে প্রস্তুত আছে বলে দেখিয়েছে। মেসায়াহর রাজকীয় জোব্বা গায়ে সিনাগগে গিয়ে শ্যাব্বেতাই যখন কোনও উপবাস প্রথা বাতিল করেছেন, ঈশ্বরের নিষিদ্ধ নাম উচ্চারণ করেছেন, অকোশার খাবার খেয়ছেন বা সিনাগগে ঐশীগ্রন্থ পাঠ করার জন্যে মহিলাকে আহ্বান জানিয়েছেন, লোকে পরমানন্দে মেতে উঠেছে। তবে সবাই গ্রস্ত হয়নি অবশ্যই-প্রত্যেক মহল্লাতেই র‍্যাবাই ও সাধারণ মানুষ ছিলেন যাঁরা এইসব পরিবর্তনে রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ধনী-গরীব সকল শ্রেণীর মানুষ শাব্বেতাইকে গ্রহণ করে নিয়েছিল ও তাঁর নৈতিকতা বিরোধিতাকে স্বাগত জানিয়েছে। আইন ইহুদিদের রক্ষা করতে পারেনি, এখনও তাতে অক্ষম বলেই মনে হচ্ছে। ইহুদিরা এখনও নির্যাতিত। এখনও নির্বাসিত; জাতি নতুন মুক্তির জন্যে প্রস্তুত হয়ে ছিল।৫৪

অবশ্য, খুবই বিপজ্জনক ছিল ব্যাপারটা। লুরিয় কাব্বালাহ ছিল মিথ, বাস্তব রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এইভাবে এর রূপায়নের কথা ছিল না, বরং আত্মার অন্তস্থঃ জীবন আলোকিত করে তোলার কথা ছিল। মিথোস ও লোগোস সম্পূরক কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন স্তরের উপাদান, এদের ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা ছিল। রাজনীতি ছিল যুক্তি ও যৌক্তিকতার এখতিয়ার। মিথ একে অর্থ যুগিয়েছে। কিন্তু নাথান যেভাবে ইসাক লুরিয়ার অতীন্দ্রিয়বাদী দিব্যদৃষ্টিকে তরজমা করেছেন, সেভাবে আক্ষরিকভাবে অনূদিত হবে বলে মনে করা হয়নি। ইহুদিরা নিজেদের শক্তিশালী, মুক্ত ও নিয়তির নিয়ন্তা ভেবে থাকতে পারে, কিন্তু তাদের পরিপার্শ্ব বদলায়নি। তখনও দুর্বল, নাজুক ও শাসকদের সুনামের উপর নির্ভরশীল ছিল তারা। অন্ধকারের শক্তির সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত মেসায়াহর লুরিয়ানিক ইমেজ ছিল অশুভের বিরুদ্ধে সর্বজনীন সংগ্রামের শক্তিশালী প্রতীক, কিন্তু যখন এই ইমেজকে বাস্তব, আবেগের দিক থেকে অপ্রকৃতিস্থ কোনও ব্যক্তিতে কঠিন চেহারা দেওয়ার প্রয়াস পাওয়া হয়, তার ফল কেবল বিপর্যয়করই হতে পারে।

সত্যিই তাই প্রমাণিত হয়েছিল। ১৬৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নাথানের আশীর্বাদ নিয়ে সুলতানের মুখোমুখি হতে রওয়ান হন শাব্বেতাই। বোধগম্যভাবেই বুনো ইহুদি উৎসাহের ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন সুলতান, যৌক্তিকভাবেই বিদ্রোহের আশঙ্কা করছিলেন তিনি। গ্যালিপোলির কাছে শাব্বেতাই অবতরণ করার পর তাঁকে গ্রেপ্তার করে ইস্তাম্বুলে নিয়ে যাওয়া হয়, হাজির করা হয় সুলতানের সামনে। মৃত্যুদণ্ড বা ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ভেতর যেকোনও একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় তাঁকে। সারা পৃথিবীর ইহুদিদের সন্ত্রস্ত করে ইসলাম বেছে নেন শাব্বেতাই। ধর্মদ্রোহীতে পরিণত হন মেসায়াহ।

এখানেই ব্যাপারটার সমাপ্তি ঘটা উচিত ছিল। বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ শাব্বেতাইয়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, প্রবল গ্লানি নিয়ে আবার স্বাভাবিক জীবন ও তোরাহর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণে ফিরে যায় তারা; পুরো দুঃখজনক ব্যাপারটাকে ভুলে যাওয়া প্রয়াস পায়। কিন্তু উল্লেখযোগ্য সংখ্যালঘু একটা দল মুক্তির স্বপ্ন বিসর্জন দিতে পারেনি। ওরা বিশ্বাস করতে পারেনি যে, ওই উত্তেজনাকর মাসগুলোয় ওদের মুক্তির অভিজ্ঞতা স্রেফ কুহক ছিল, এক ধর্মদ্রোহী মেসায়াহর সাথে মানিয়ে নিতে পেরেছিল তারা, ঠিক আদি ক্রিশ্চানরা যেভাবে সাধারণ অপরাধীর মতো মৃত্যুবরণকারী একজন মেসায়াহর একই রকম কেলেঙ্কারীজনক ধারণাকে মেনে নিয়েছিল।

প্রবল বিষণ্নতার একটা সময় পার করে নিজস্ব ধর্মতত্ত্বে পরিবর্তন আনেন নাথান। মুক্তির সূচনা ঘটেছে, ব্যাখ্যা করেছেন তিনি, কিন্তু একটা বিপর্যয় ঘটে গেছে। অপবিত্রতার আরও গভীর বলয়ে অবতরণে বাধ্য হয়েছেন শাব্বেতাই, স্বয়ং তিনি অশুভের রূপ ধারণ করেছেন। এটাই ছিল ‘চূড়ান্ত পবিত্র পাপ,’ তিক্কুনের শেষ কাজ।৫ শাব্বেতাইয়ের প্রতি বিশ্বস্ত রয়ে যাওয়া শাব্বেতিয়রা ভিন্ন ভিন্নভাবে এই পরিবর্তনের প্রতি সাড়া দেয়। আমস্টারডামে খুবই জনপ্রিয় ছিল নাথানের ধর্মতত্ত্বঃ এবার মেসায়াহ ইহুদিবাদের মূলকে আঁকড়ে থেকে মারানোতে পরিণত হয়েছেন, বাইরে বাইরে ইসলামের অনুসারী হওয়ার ভান করছেন।৫৬ অনেক আগে থেকেই তোরাহ নিয়ে সমস্যায় আক্রান্ত মারানোরা মুক্তি সম্পূর্ণ হওয়ামাত্র এর অবসান কামনা করেছে। অন্য ইহুদিরা বিশ্বাস করেছে যে, মোসায়াহ সম্পূর্ণ মুক্তি না আনা পর্যন্ত তাদের তোরাহ অনুসরণ করতে হবে; তবে এরপর এক নতুন আইনের প্রবর্তন করবেন তিনি, যা সবদিক থেকেই পুরোনো আইনের বিরোধিতা করবে। রেডিক্যাল শাব্বেতিয়দের একটা ছোট গোষ্ঠী আরও সামনে অগ্রসর হয়েছিল। সাময়িক ভিত্তিতেও আর পুরোনো আইনে প্রত্যাবর্তন করতে পারছিল না তারা, তাদের বিশ্বাস ছিল ইহুদিদেরও মেসায়াহকে অনুসরণ করে অশুভের বলয়ে গিয়ে ধর্মদ্রোহীতে পরিণত হতে হবে। মুলধারার ধর্ম বিশ্বাস বেছে নেয় তারা—ইউরোপে ক্রিশ্চান ধর্ম এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসলাম-কিন্তু আপন ঘরের সীমানায় ইহুদিই রয়ে গেছে।৫৭ এই রেডিক্যাল ইহুদিরা একটা আধুনিক সমাধানও দেখতে পেয়েছিল: অনেক ক্ষেত্রেই বহু ইহুদি জেন্টাইল সংস্কৃতির সাথে মিশে যাবে, কিন্তু ভিন্ন স্তরে বিচ্ছিন্ন রেখে নিজেদের বিশ্বাস ব্যক্তিকরণ করেছে।

শাব্বেতিয়রা ভেবেছিল শাব্বেতাই বুঝি মহাকষ্টে তাঁর দ্বৈত জীবন যাপন করছেন, কিন্তু আসলে মুসলিম পরিচয়ে দারুণ সন্তুষ্ট ছিলেন তিনি। ইসলামের পবিত্র আইন শরীয়াহ পাঠ করে দিন কাটাচ্ছিলেন আর সুলতানের আধ্যাত্মিক উপদেষ্টাদের ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষা দিচ্ছিলেন। অতিথিদের সাথে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল তাঁকে, দরবার বসাতেন তিনি, সারা দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ইহুদি প্রতিনিধি দলের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। শাব্বেতাইয়ের অনন্য ধার্মিকতার কথা বলত তারা। অনেক সময় শাব্বেতাইকে নিজের বাড়িতে তোরাহ স্ক্রোল হাতে হাইম গাইতে দেখা যেত; লোকে তাঁর ভক্তি ও অন্য লোকের অনুভূতিতে তাঁর সহানুভূতির সাথে প্রবেশের ক্ষমতায় বিস্ময়ে অভিভূত হত।৫৮ শাব্বেতাই গোষ্ঠীর ধারণা আর নাথান গোষ্ঠীর ধারণা একেবারেই ভিন্ন ছিল এবং জেন্টাইলদের প্রতি ঢের বেশি ইতিবাচক। শাব্বেতাই যেন সকল ধর্মবিশ্বাসকেই বৈধ বিবেচনা করেছিলেন। নিজেকে ইসলাম ও ইহুদিবাদের ভেতর সেতুবন্ধ হিসাবে কল্পনা করেছেন তিনি; আবার খৃস্টধর্ম ও জেসাসকে নিয়েও অভিভূত ছিলেন। অতিথিরা জানিয়েছেন যে, অনেক সময় তিনি মুসলিমের মতো আচরণ করতেন, অবার অনেক সময় র‍্যাবাইয়ের মতো। অটোমানরা ইহুদি উৎসব পালনের অনুমতি দিয়েছিল তাঁকে। শাব্বেতইকে প্রায়ই এক হাতে কোরান ও অন্য হাতে তোরাহ স্ক্রোল নিতে দেখা যেত।৫৯ সিনাগগে শাব্বেতাই ইহুদিদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করতেন; কেবল তাহলেই, বলতেন তিনি, পবিত্র ভূমিতে ফিরে যেতে পারবে তারা। ১৬৬৯ সালে লেখা এক চিঠিতে বাধ্য হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ব্যাপারটি জোরের সাথে অস্বীকার করেন শ্যাব্বতাই, তিনি মন্তব্য করেন, ইসলাম ধর্ম ‘প্রকৃতই সত্যি,’ তাঁকে জেন্টাইল ও ইহুদি উভয় পক্ষের জন্যে মেসায়াহ হিসাবে পাঠানো হয়েছে।

১৬৭৬ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর শাব্বেতেইয়ের মৃত্যু ছিল শাব্বেতিয়দের জন্যে এক প্রবল আঘাত, কারণ এতে মুক্তির সমস্ত আশাই তিরোহিত হয়ে গেছে বলে মনে হয়েছে। তাসত্ত্বেও গোষ্ঠীটি গোপনে অস্তিত্ব বজায় রাখে; তারা দেখিয়ে দেয় যে মেসিয়ানিক বিস্ফোরণ কোনও হুজুগে ঘটনা ছিল না; বরং ইহুদি অভিজ্ঞতার কোনও মৌলিক জায়গা স্পর্শ করেছে। অনেকের কাছে এই ধর্মীয় আন্দোলন একটা সেতুবন্ধ ছিল যা তাদের পরে যৌক্তিক আধুনিকতায় উত্তরণের কঠিন পর্ব পার হতে সাহায্য করবে। অনেকেই যেমন দ্রুততার সাথে তোরাহকে বিসর্জন দিতে প্ৰস্তুত ছিল, এবং এক নতুন বিধানের স্বপ্ন দেখার বেলায় শাব্বেতিয়দের অটলতা দেখায় যে পরিবর্তন ও সংস্কারের জন্যে তৈরি ছিল তারা।৬১ শাব্বেতাই ও শাব্বেতিয় মতবাদের উপর বেশ কয়েকটি গ্রন্থের লেখক গারশোম শোলেম যুক্তি দেখিয়েছেন যে, এই ক্ষুদ্র শাব্বেতিয় গোষ্ঠীই ইহুদি আলোকন বা সংস্কার আন্দোলনের অগ্রপথিকে পরিণত হবে। প্রাগের জোসেফ হোয়াইটের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন তিনি। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তিনিই প্রথম পূর্ব ইউরোপে আলোকনের ধারণার বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। শাব্বেতিয় ছিলেন তিনি। হাঙেরিতে সংস্কার আন্দোলন সূচিতকারী আরন শোভিনও তরুণ বয়সে শাব্বেতিয় ছিলেন।৬২ শোলেমের তত্ত্বের বিরোধিতা করা হয়েছে; একে প্রত্যক্ষভাবে সত্যি বা মিথ্যা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তবে সাধারণভাবে এটা মেনে নেওয়া হয় যে, শাব্বেতিয়বাদ প্রচলিত রাব্বিনিক কর্তৃত্বকে খাট করার বেলায় ভালো ভুমিকা রেখেছে এবং ইহুদিদের টাবু ও অসম্ভব মনে করা পরিবর্তনের কথা ভাবতে শিখিয়েছে।

শাব্বেতাইয়ের মৃত্যুর পর দুটো রেডিক্যাল শাব্বেতিয় আন্দোলন ইহুদিদের প্রধান ধর্মে গণ ধর্মান্তরের দিকে চালিত করেছিল। ১৬৮১ সালে অটোমান তুরস্কের আনুমানিক ২০০ পরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। দোনমেহদের (‘ধর্মান্তরিত’) এই গোষ্ঠীটির নিজেদের সিনাগগ ছিল, তবে মসজিদেও প্রার্থনা করত তারা। উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে তুঙ্গ সময়ে গোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ১১৫,০০০ জনে। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এটি ভেঙে যেতে শুরু করে, সদস্যরা এই সময় আধুনিক সেক্যুলার শিক্ষা লাভ করছিল ও ধর্মের প্রয়োজন আছে মনে করছিল না। কিছু সংখ্যক দোনমেহ তরুণ ১৯০৮ সালের সেক্যুলারিস্ট তরুণ তুর্কি বিদ্রোহে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনগুলোর দ্বিতীয়টি ছিল আরও ভয়ঙ্কর ও তা মিথের আক্ষরিক অনুবাদের ফলে গড়ে ওঠা নৈরাজ্যবাদের নজীর দেখিয়েছে। জ্যাকব ফ্রাংক (১৭২৬-৯১) বালকান সফরের সময় শাব্বেতিয়বাদে দীক্ষা লাভ করেন। নিজ দেশ পোল্যান্ডে ফেরার পর এক গোপন গোষ্ঠী গড়ে তোলেন তিনি যার সদস্যরা প্রকাশ্যে ইহুদি বিধান পালন করত, কিন্তু গোপনে নিষিদ্ধ যৌন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকত। ১৭৫৬ সালে তাঁকে সমাজচ্যুত করা হলে ফ্রাংক প্রথমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন (তুরস্কে এক সফরকালে) এবং সদলবলে আবার ক্যাথলিক মতবাদে দীক্ষা নেন।

ফ্রাংক স্রেফ তোরাহর নিষেধাজ্ঞা ঝেড়ে ফেলেননি, বরং ইতিবাচকভাবে অনৈতিকতাকে আলিঙ্গন করেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে তোরাহ কেবল সেকেলেই নয়, বরং বিপজ্জনক ও অর্থহীন হয়ে গেছে। কমান্ডমেন্টসমূহ মৃত্যুর আইন, সুতরাং একে অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে। পাপ ও লজ্জাহীনতাই মুক্তি লাভ ও ঈশ্বরকে পাওয়ার একমাত্র পথ। নির্মাণ করতে নয়, বরং ‘ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করতেই’৬৪ এসেছেন ফ্রাংক। তাঁর অনুসারীরা সকল ধর্মীয় বিধানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল: ‘তোমাদের বলে দিচ্ছি, যোদ্ধাদের অবশ্যই ধর্মহীন হতে হবে, যার মানে তোমাদের অবশ্যই নিজের শক্তিতে মুক্তি লাভ করতে হবে। আজকের দিনের অনেক রেডিক্যাল সেক্যুলারিস্টের মতো ফ্রাংক সকল ধর্মকেই ক্ষতিকর হিসাবে দেখেছেন। তাঁর আন্দোলন গড়ে ওঠার সাথে সাথে ফ্রাংকবাদীরা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে, এক বিরাট বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিল তারা যার ভেতর দিয়ে অতীত ভেসে যাবে, জেগে উঠবে এক নতুন পৃথিবী। ফরাসী বিপ্লবকে তারা তাদের স্বপ্নের সত্যতার আলামত ও তাদের পক্ষে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ ভেবেছে।৬৬

ইহুদিরা আধুনিক কালের বহু ভঙ্গিমারই আভাস দিয়েছে। ইউরোপের আগ্রাসীমূলক আধুনিকায়নের সমাজের সাথে বেদনাদায়ক সংঘাত তাদের সেক্যুলারিজম, সংশয়বাদ, নাস্তিক্যবাদ, যুক্তিবাদ, নৈরাজ্যবাদ, বহুত্ববাদ ও ধর্মের ব্যক্তিকরণের মতো নানা ধারণার দিকে চালিত করেছে। অধিকাংশ ইহুদির কাছে পশ্চিমে গড়ে উঠতে থাকা উন্নয়নের পথটি ধর্মের ভেতর দিয়েই অগ্রসর হয়েছে, কিন্তু এই ধর্ম বিংশ শতাব্দীতে আমরা যে ধর্মের সাথে অভ্যস্ত তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। অনেক বেশি পৌরাণিক ভিত্তিক ছিল তা; আক্ষরিকভাবে ঐশীগ্রন্থ পাঠ করত না এবং নতুন নতুন সমাধান নিয়ে এগিয়ে আসতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল, যেগুলোর কোনও কোনওটা নতুন কিছুর সন্ধানের ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর মনে হয়েছে। প্রাক আধুনিক সমাজে ধর্মের ভূমিকা বোঝার জন্যে আমাদের মুসলিম জগতের দিকে নজর দিতে হবে, আধুনিকতার গোড়ার দিককার নিজস্ব উত্থান-পতনের পর্যায় অতিক্রম করছিল এই ধর্ম এবং ভিন্ন ধরনের আধ্যাত্মিকতা গড়ে তুলছিল যা আধুনিক কালেও মুসলিমদের প্রভাবিত করে চলবে।

০২. মুসলিম: রক্ষণশীল চেতনা (১৪৯২-১৭৯৯)

১৪৯২ সালে পশ্চিমে ধীরে ধীরে আবির্ভূত হতে চলা নতুন ব্যবস্থার অন্যতম শিকার ছিল ইহুদিরা। ওই গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলোর অন্য শিকার ছিল স্পেনের মুসলিমরা, ইউরোপে ঘাঁটি হারিয়েছিল তারা। কিন্তু ইসলাম কোনও দিক থেকেই পরাস্ত শক্তি ছিল না। ষোড়শ শতাব্দীর দিকে তখনও তা বিশ্ব পরাশক্তি ছিল। যদিও সুঙ রাজবংশ (৯৬০-১২৬০) চীনকে সামাজিক জটিলতা ও শক্তির দিক থেকে ইসলামি জগতের চেয়ে অনেক উঁচু স্তরে নিয়ে গিয়েছিল ও ইতালিয় রেনেসাঁ এক সাংস্কৃতিক আলোকনের সূচনা ঘটিয়েছিল যা শেষ পর্যন্ত পাশ্চাত্যকে সামনে এগিয়ে যেতে সক্ষম করে তুলবে, তবু মুসলিমরা প্রথম দিকে অনায়াসে এইসব চ্যালেঞ্জ সামাল দিতে পেরেছে এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত অবস্থায় রয়ে গিয়েছে। মুসলিমরা গোটা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র এক তৃতীয়াংশ, কিন্তু তারা মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও আফ্রিকায় এমন বিস্তৃত ও কৌশলগতভাবে ছড়িয়ে ছিল যে এই সময় ইসলামী জগৎকে আধুনিককালের গোড়ার দিকের সভ্য জগতের অধিকাংশ এলাকার ধ্যানধারণা তুলে ধরা বিশ্ব ইতিহাসের একটি মাইক্রোকোসম হিসাবে দেখা যেতে পারে। মুসলিমদের পক্ষে এটা ছিল এক উত্তেজনাকর ও উদ্ভাবনী কাল: ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তিনটি নতুন ইসলামি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল: এশিয়া মাইনর, আনাতোলিয়া, ইরাক, সিরিয়া, ও উত্তর আফ্রিকায় অটোমান সাম্রাজ্য; ইরানে সাফাভিয় সাম্রাজ্য; ও ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্য। প্রতিটি সাম্রাজ্য ইসলামি আধ্যাত্মিকতার ভিন্ন ভিন্ন চেহারা তুলে ধরেছিল। মুঘল সাম্রাজ্য ফালসাফাহ নামে পরিচিত সহিষ্ণু বিশ্বজনীন দার্শনিক যুক্তিবাদের প্রতিনিধিত্ব করেছে; সাফাভিয় শাহগণ এপর্যন্ত অভিজাত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস শিয়া ধর্মমতকে রাষ্ট্রীয় ধর্মে পরিণত করেছিলেন; এবং সুন্নী ইসলামের প্রতি ভীষণভাবে অনুগত রয়ে যাওয়া অটোমান তুর্কিরা পবিত্র মুসলিম বিধান শরীয়াহর ভিত্তিতে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল।

এই তিনটি সাম্রাজ্য ছিল এক বিচ্যুতি। তিনটিই প্রাথমিক আধুনিক প্রতিষ্ঠান ছিল, পদ্ধতিগতভাবে আমলাতান্ত্রিক ও যৌক্তিক নির্ভুলতার সাথে এগুলো পরিচালিত হত। গোড়ার দিকের বছরগুলোতে অটোমান রাষ্ট্র ইউরোপের অন্য যেকোনও রাজ্যেও চেয়ে ঢের বেশি শক্তিশালী ছিল। সুলতান দ্য ম্যাগনিফিশেন্টের (১৫২০- ৬৬) শাসনামলে তা শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছায়। গ্রিস, বালকান্স ও হাঙেরি হয়ে পশ্চিমে রাজ্য বিস্তৃত করেন সুলাইমান। ইউরোপের অভ্যন্তরে তাঁর অগ্রযাত্রা কেবল ১৫২৯ সালে ভিয়েনা অধিকারে ব্যর্থতার কারণেই প্রতিহত হয়েছিল। সাফাভিয় ইরানে শাহগণ অনেক সড়ক ও কারাভানসরাই নির্মাণ করেন ও অর্থনীতিকে সংহত রূপ দেন। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেশকে সামনের কাতারে নিয়ে আসেন তাঁরা। সবগুলো সাম্রাজ্যই ইতালিয় রেনেসাঁর সমমানের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ উপভোগ করেছে। অটোমান স্থাপত্যকলা, সাফাভিয় শিল্পকলা ও তাজমহলের জন্যে এক মহান সময় ছিল ষোড়শ শতাব্দী।

কিন্তু তাসত্ত্বেও এসবই ছিল আধুনিকায়নের পথে চলা সমাজ, এরা কোনও রেডিক্যাল পরিবর্তন বাস্তবায়ন করেনি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য বৈশিষ্ট্যে পরিণত হওয়া বিপ্লবী রীতিনীতির অংশীদার ছিল না তারা। বরং এই সাম্রাজ্যগুলো যা প্রকাশ করেছে তাকে আমেরিকান পণ্ডিত মার্শাল জি.এস. হজসন বলেছেন ইউরোপসহ সকল প্রাক আধুনিক সমাজেরই বৈশিষ্ট্য ‘রক্ষণশীল চেতনা’। প্রকৃতপক্ষেই এই সাম্রাজ্যগুলো ছিল রক্ষণশীল মানসিকতার শেষ রাজনৈতিক প্রকাশ; প্রাক আধুনিক কালের সবচেয়ে অগ্রসর রাষ্ট্র ছিল বলে বলা যেতে পারে এগুলো তার সমগ্রকে তুলে ধরেছে। আজ রক্ষণশীল সমাজ বিপদে রয়েছে। আধুনিক পাশ্চাত্য রীতি কার্যকরভাবে অধিকার করে নিয়েছে তাকে কিংবা রক্ষণশীল থেকে আধুনিক চেতনায় উত্তরণের কঠিন পথে অগ্রসর হচ্ছে। অধিকাংশ মৌলবাদই এই বেদনাদায়ক উত্তরণের প্রতি সাড়া। সুতরাং, এই মুসলিম সাম্রাজ্যের তুঙ্গ অবস্থায় রক্ষণশীল চেতনাকে পরখ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আমরা এর আবেদন ও শক্তি এবং সেই সাথে সহজাত সীমাবদ্ধতাগুলোও উপলব্ধি করতে পারি।

পাশ্চাত্য (পুঁজি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের উপর ভিত্তি করে) সম্পূর্ণ নতুন ধরনের সভ্যতা নিয়ে আসার আগে, উনবিংশ শতাব্দীর আগে যার অস্তিত্ব সৃষ্টি হয়নি, সকল সংস্কৃতিই অর্থনৈতিকভাবে উদ্বৃত্ত কৃষি উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল ছিল। এর মানে, যেকোনও কৃষি নির্ভর সমাজের বিস্তার ও সাফল্যের একটা সীমাবদ্ধতা ছিল, কেননা শেষ পর্যন্ত তার সম্পদ ও দায়িত্ব ফুরিয়ে ফেলবে। বিনিয়োগের জন্যে প্রাপ্য পুঁজির সীমাবদ্ধতা ছিল। বিরাট পুঁজির প্রয়োজন হতে পারে এমন যেকোনও উদ্ভাবনকে নাকচ করে দেওয়া হত, কারণ লোকের সমস্ত কিছু ভেঙে ফেলে, কর্মচারীদের বহাল রেখে আবার নতুন করে শুরু করার কোনও উপায় ছিল না। পশ্চিমে আজ যাকে আমরা নিশ্চিত ধরে নিই, আমাদের সংস্কৃতির আগের কোনও সংস্কৃতিই অব্যাহত উদ্ভাবনকে সামাল দিতে পারেনি। এখন আমরা আমাদের বাবা-মায়ের প্রজন্ম থেকে বেশি জানবার প্রত্যাশা করি, আমরা আত্মবিশ্বাসী যে, আমাদের প্রজন্ম ক্রমেই আরও প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর হয়ে উঠবে। আমরা ভবিষ্যৎমুখী, আমাদের সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে আগামীর দিকে তাকাতে হয় ও আগামী প্রজন্মকে প্রভাবিত করবে এমন বিস্তারিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। এটা স্পষ্ট হবে যে, আমাদের এই সমাজ স্থিতিশীল একরোখা যুক্তিবাদী ভাবনার ফল। এটা লোগোসের সন্তান, যা সবসময়ই সামনে তাকায়, আরও জানতে চায় ও আমাদের ক্ষমতার সীমানা বাড়াতে চায়। কিন্তু কোনও যৌক্তিক ভাবনাই একটি আধুনিক অর্থনীতি ব্যতীত এই আগ্রাসীভাবে উদ্ভাবনী সমাজ গড়ে তুলতে পারত না। নতুন নতুন আবিষ্কার সম্ভব করে তোলার জন্যে পাশ্চাত্য সমাজগুলোর পক্ষে অবকাঠামো বদলে ফেলা অসম্ভব নয়, কেননা পুঁজির অবিরাম পুনর্বিনিয়োগের ভেতর দিয়ে আমরা আমাদের মৌল সম্পদ বাড়িয়ে তুলতে পারি যাতে তারা প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সাথে তাল মেলাতে পারে। কিন্তু কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে এটা সম্ভব ছিল না, এখানে লোকে ইতিমধ্যে যা কিছু অর্জিত হয়েছে তাকেই টিকিয়ে রাখতে শক্তি ব্যয় করত। একারণে প্রাক আধুনিক কালের ‘রক্ষণশীল’ প্রবণতা কোনও মৌল ভীরুতা থেকে উৎপন্ন হয়নি, বরং এই ধরনের সংস্কৃতির বাস্তবসম্মত মূল্যায়নই তুলে ধরে। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষা মূলত পালাক্রমিক জানার ব্যাপার ছিল, এখানে কোনওরকম মৌলিকত্বকে উৎসাহিত করা হত না। কারণ সমাজ সাধারণভাবে ধারণ করতে পারত না বলে ছাত্রদের কোনও রেডিক্যাল নতুন ধারণা ভাবতে উৎসাহিত করা হত না; সুতরাং, এই ধরনের ভাবনা সামাজিকভাবে বিধ্বংসী হয়ে গোটা সম্প্রদায়কে বিপদাপন্ন করে তুলতে পারত। রক্ষণশীল সমাজে সামাজিক স্থিতিশীলতাকে বাক স্বাধীনতার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হত।

আধুনিকদের মতো ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর বদলে প্রাক আধুনিক সমাজগুলো অনুপ্রেরণার জন্যে অতীতের দিকে মুখ ফেরাত। অবিরাম উন্নয়নের প্রত্যাশার বদলে ধরে নেওয়া হত যে পরবর্তী প্রজন্ম অনায়াসে অতীতে প্রত্যাবর্তন করতে পারবে। সাফল্যের নতুন চূড়ায় আরোহণের বদলে সমাজগুলো আদিম নিখুঁত অবস্থা থেকে অবনত হয়েছে বলে মনে করা হত। এই কল্পিত সোনালি যুগকে সরকার ও ব্যক্তি বিশেষের জন্যে আদর্শ মনে করা হত। অতীতের এই আদর্শের কাছাকাছি যাওয়ার ভেতর দিয়েই কেবল কোনও সমাজ তার সম্ভাবনাকে পূর্ণ করতে পারত। সভ্যতাকে সহজাতভাবে নাজুক মনে করা হত। সবাই জানত, পঞ্চম শতকে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর পশ্চিম ইউরোপের মতো যেকোনও দেশই বর্বর কালে পতিত হতে পারে। ইসলামি বিশ্বে আধুনিক কালের গোড়ার দিকে ত্রয়োদশ শতকের মঙ্গোল আগ্রাসনের স্মৃতি তখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি। গণহত্যা, আগুয়ান দস্যু দলের হাত থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষের পলায়ন, ব্যাপক দেশান্তর, একের পর এক মহান ইসলামি শহরের ধ্বংসলীলা তখনও সত্রাসে স্মরণ করা হচ্ছিল। লাইব্রেরি ও শিক্ষার বিভিন্ন কেন্দ্রও ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল।

সেই সাথে শত শত বছরের কষ্টে সংগৃহীত জ্ঞানও হারিয়ে গিয়েছিল। মুসলিমরা সামলে নিয়েছিল; সুফি অতীন্দ্রিয়বাদীরা এক আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণে নেতৃত্ব দেন, যা লুরিয় কাব্বালাহর মতোই উপশমকারী বলে প্রমণিত হয়েছে; তিনটি নতুন সাম্রাজ্য ছিল সেই পুনরুজ্জীবনেরই নিদর্শন। অটোমান ও সাফাভিয় রাজবংশগুলোর মূল নিহিত ছিল মঙ্গোল যুগের ব্যাপক স্থানচ্যুতির ভেতর, দুটোই জন্ম নিয়েছে উগ্র গাযু রাষ্ট্রে, এগুলো সর্দার যোদ্ধার হাতে পরিচলিত হত ও প্রায়শঃই কোনও সুফি ত্বরিকার সাথে সম্পর্কিত ছিল। প্রলয়ঙ্করী ঘটনার সময় যাদের আবির্ভাব ঘটেছিল। এই সাম্রাজ্যগুলোর শক্তি ও সৌন্দর্য ছিল ইসলামি মূল্যবোধের পুনরুত্থান ও মুসলিম ইতিহাসের আবার সঠিক পথে প্রত্যাবর্তনের গর্বিত উচ্চারণ। কিন্তু এমন মাত্রার বিপর্যয়ের পর প্রাক আধুনিক সমাজের স্বাভাবিক রক্ষণশীলতা আরও প্রকট হয়ে ওঠাটাই ছিল স্বাভাবিক। লোকে সম্পূর্ণ নতুন কিছুর সন্ধান করার বদলে বরং যা কিছু হারিয়ে গেছে তাকেই আবার ধীরে ধীরে কষ্টের সাথে ফিরে পাবার দিকে মনোযোগ দিয়েছিল। উদাহরণ স্বরূপ,

সুন্নি ইসলামে-ধর্মের অধিকাংশ মুসলিমের অনুসৃত ভাষ্য, অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠিত ধর্ম-এই মর্মে ঐকমত্য স্থাপিত হয় যে ‘ইজতিহাদের দুয়ার’ (‘স্বাধীন যুক্তি প্রয়োগ’) রুদ্ধ হয়ে গেছে। এতদিন পর্যন্ত মুসলিম জুরিস্টদের কোরান বা কোনও প্রতিষ্ঠিত ট্র্যাডিশনে স্পষ্ট জবাব দেওয়া হয়নি এমনসব আদর্শ ও বিধিবিধান সংক্রান্ত উত্থাপিত প্রশ্নের সমাধান বের করার লক্ষ্যে নিজস্ব বিচার বিবেচনা প্রয়োগের অনুমতি ছিল। কিন্তু আধুনিক কালের গোড়ার দিকে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঐতিহ্য রক্ষার জন্যে সুন্নি মুসলিমরা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে স্বাধীন ভাবনার আর প্রয়োজন নেই। সমস্ত উত্তর তৈরি রয়েছে, শরীয়াহই সমাজের স্থায়ী নীল নকশা; ইজতিহাদের প্রয়োজনও নেই, তা কাঙ্ক্ষিতও নয়। মুসলিমদের বরং অবশ্যম্ভাবীভাবে অতীতের অনুসরণ (তাকলিদ) করতে হবে। নতুন সমাধান সন্ধানের পরিবর্তে তাদের উচিত হবে প্রতিষ্ঠিত আইনি সারগ্রন্থে প্রাপ্য বিধির প্রতি নতি স্বীকার করা। আইন ও অনুশীলনের ক্ষেত্রে উদ্ভাবন (বিদাহ)-কে আধুনিক কালের গোড়ার দিকে সুন্নি ইসলামি জগতে ক্রিশ্চান পাশ্চাত্যের মতবাদগত বিষয়ে ধর্মদ্রোহের মতোই বিঘ্ন সৃষ্টিকারী ও বিপজ্জনক মনে করা হত।

প্রবল রকম প্রতিমাবিরোধী আধুনিক পাশ্চাত্যের সাথে এরচেয়ে বেশি বেমানান প্রবণতা কল্পনা করা কঠিন। আমাদের যুক্তি প্রয়োগের ক্ষমতার উপর ইচ্ছাকৃত বাধা আরোপ এখন ঘৃণিত। পরের অধ্যায়ে আমরা যেমন দেখব, লোকে কেবল এই ধরনের বাধা ছুঁড়ে ফেলতে প্রস্তুত হলেই আধুনিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে পারে। পাশ্চাত্য আধুনিকতা লোগোসের ফল হয়ে থাকলে মিথোস কীভাবে প্রাক আধুনিক বিশ্বের ক্ষেত্রে রক্ষণশীল চেতনার সহায়ক ছিল সেটা বোঝা সহজ। পৌরাণিক ধ্যানধারণা অতীতমুখী, সামনে তাকায় না। পবিত্র সূচনা, আদিম ঘটনা, কিংবা মানুষের জীবনের ভিত্তির দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করে। নতুন কিছুর সন্ধান করার বদলে মিথ অটল কোনও কিছুর দিকে দৃষ্টি দেয়। আমাদের জন্যে এটা কোনও ‘সংবাদ’ বয়ে আনে না, বরং সবসময় কী ছিল সেই কথা বলে; গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত কিছুই চিন্তা করা হয়ে গেছে, অর্জিত হয়েছে। আমাদের পূর্ব পুরুষদের কথার উপর, বিশেষ করে পবিত্র টেক্সটের উপর ভিত্তি করে আমরা বেঁচে থাকি, আমাদের যা কিছু জানার তার সবই তা জানিয়ে দিয়েছে। এটাই ছিল রক্ষণশীল কালের চেতনা। কাল্ট, আচরিক অনুশীলন ও পৌরাণিক বিবরণ ব্যক্তিকে কেবল তার গভীরতর অবচেতনে অনুরণন তোলা অর্থই যোগাত না, বরং কৃষি নির্ভর সমাজে টিকে থাকার জন্যে জরুরি প্রবণতা ও এর সহজাত সীমাবদ্ধতাকে শক্তিশালী করে তুলত। শাব্বেতাই যেভি কেলেঙ্কারী যেমন স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছে যে, মিথের বাস্তব পরিবর্তন ঘটানোর কথা নয়। এটা মনের একটা অবস্থা তৈরি করে যা চলমান পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয় ও সমরূপতা অর্জন করে। অনিরুদ্ধ উদ্ভাবনকে স্থান দিতে অপারগ সমাজে এটা আবশ্যক ছিল।

পরিবর্তনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানকারী পাশ্চাত্য সমাজে বসবাসকারী মানুষের পক্ষে যেমন মিথোলজির ভূমিকা বোঝা কঠিন-এমনকি অসম্ভব; তেমনি গভীর ও জোরালভাবে রক্ষণশীল আধ্যাত্মিকতায় গড়ে ওঠা মানুষের পক্ষেও আধুনিক সংস্কৃতির অগ্রসর গতিশীলতা গ্রহণ করা দারুণভাবে কঠিন—এমনকি অসম্ভবও। আবার, এখনও প্রথাগত পৌরাণিক মূল্যবোধে লালিত জাতিকে বোঝাও আধুনিকতাবাদীর পক্ষে যারপরনাই কঠিন। আমরা যেমন দেখব, বর্তমান ইসলামি বিশ্বে কোনও কোনও মুসলিম দুটো বিষয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। প্রথমত, তারা পাশ্চাত্য সমাজের ধর্মকে রাজনীতি থেকে, চার্চকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্নকারী সেক্যুলারিজমকে ঘৃণা করে; দ্বিতীয়ত, অনেক মুসলিমই তাদের সমাজ ইসলামের পবিত্র আইন শরীয়া আইন অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া দেখতে চায়। এটা আধুনিক চেতনায় গড়ে ওঠা মানুষের চোখে দারুণভাবে বিভ্রান্তিকর; তারা যুক্তিসঙ্গতভাবেই এই ভেবে ভীত যে একটা যাজকীয় প্রতিষ্ঠান তাদের চোখে স্বাস্থ্যকর সমাজের জন্যে আবিশ্যিক অবিরাম প্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করবে। এরা চার্চ ও রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নকরণের সুবিধা ভোগ করেছে, তাই ইনকুইজিশনের মতো কোনও প্রতিষ্ঠান ‘ইজতিহাদের দুয়ার বন্ধ করে দিচ্ছে’ ভেবে শিউরে ওঠে। একই ভাবে প্রত্যাদেশ মারফত পাওয়া স্বর্গীয় বিধানের ধারণাও আধুনিক রীতিনীতির সাথে বেমানান। আধুনিক সেক্যুলারিস্টরা কোনও অতিমানবীয় সত্তা কর্তৃক মানবজাতির উপর চাপিয়ে দেওয়া অপরিবর্তনীয় আইনের ধারণা বিতৃষ্ণার উদ্রেককারী মনে করে। তারা মনে করে, আইন মিথোস থেকে নয়, বরং লোগোস থেকে উদ্ভুত। এটা যৌক্তিক ও বাস্তবভিত্তিক, চলমান অবস্থার মোকাবিলা করার জন্যে একে সময়ে সময়ে পরিবর্তনযোগ্য হতে হবে। সুতরাং, এইসব মূল ইস্যুই আধুনিকতাবাদীদের মুসলিম মৌলবাদীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।

অবশ্য তুঙ্গ অবস্থায় শরীয়া আইনের ধারণা দারুণভাবে সন্তোষজনক ছিল। এটা ছিল ইসলামি আইনের প্রতি আনুগত্য থেকে বৈধতা লাভ করা অটোমান সাম্রাজ্যের সাফল্য। সুলতানকে শরীয়াহ আইনের রক্ষক হিসাবে শ্রদ্ধা করা হত। এমনকি সুলতান ও বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নরদের নিজ দিওয়ান-খাস মহল-যেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হত—থাকলেও শরীয়াহ আদালতের (অটোমানরাই প্রথম একে পদ্ধতিগতভাবে সংগঠিত করেছিল) সভাপতিত্বকারী কাজিরাই বিচারকের সীলমোহর হিসাবে বিবেচিত হতেন। কাজি, তাদের পরামর্শক মুফতি ও মাদ্রাসায় ইসলামি জুরিসপ্রুডেন্সের শিক্ষাদানকারী পণ্ডিতগণ (ফিকহ) সবাই ছিলেন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা। তাঁরা সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মতোই সরকারের পক্ষে আবশ্যক ছিলেন। সুলতানের কর্তৃত্ব ধর্মীয় পণ্ডিত উলেমাদের মাধ্যমে মধ্যস্থতা করা হত বলে বিভিন্ন আরব প্রদেশের বাসিন্দারা তুর্কিদের আধিপত্য মিনে নিতে পেরেছিল, এদের পেছনে ইসলামি আইনের পবিত্র কর্তৃত্ব ছিল। সুতরাং সেই হিসাবে ইস্তাম্বুল ও বিভিন্ন প্রদেশের ভেতর উলেমাগণ সুলতান ও প্রজাদের ভেতর সম্পর্কের একটা উপায় ছিলেন। তাঁরা ক্ষোভের কথা সুলতানের কানে তুলতে পারতেন ও এমনকি ইসলামি বিধিবিধানের লঙ্ঘন হলে তাঁকেও ঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারতেন। সুতরাং, উলেমারা অটোমান রাষ্ট্রকে নিজেদের রাষ্ট্র মনে করতে পারতেন; আর সুলতানগণ অংশীদারি তাঁদের ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটিয়েছিল বলে তাঁদের উপর যাজকদের আরোপিত বাধা মেনে নিতেন। অটোমান সাম্রাজ্যের মতো আর কখনওই শরীয়া আইন রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে এভাবে প্রধান ভুমিকা রাখতে পারেনি। ষোড়শ শতাব্দীতে অটোমান সাম্রাজ্যের সাফল্য দেখিয়েছে যে, ইসলামি আইনের প্রতি আনুগত্য সত্যিই তাঁদের সঠিক পথে নিয়ে এসেছিল। অস্তিত্বের মৌল নীতিমালার সাথে একই ছন্দে অবস্থান করছিলেন তাঁরা।

সকল রক্ষণশীল সমাজ (যেমন ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে) এক সোনালি যুগের মুখাপেক্ষী থাকে; অটোমান সাম্রাজ্যের সুন্নি মুসলিমদের জন্যে সেটা ছিল পয়গম্বর মুহাম্মদ (স) (c. ৫৭০-৬৩২সিই) ও তাঁর অব্যবহিত পরের প্রথম চার রাশিদুন (‘সঠিকপথে পরিচালিত’) খলিফা। তাঁরা ইসলামি আইন অনুযায়ী সমাজ পরিচালনা করেছিলেন। ধর্ম ও রাষ্ট্রের কোনও বিচ্ছিন্নতা ছিল না। মুহাম্মদ (স) ছিলেন একাধারে ধর্মীয় নেতা ও রাজনৈতিক প্রধান। সপ্তম শতাব্দীর আরবাসীদের জন্যে তাঁর নিয়ে আসা প্রত্যাদিষ্ট ঐশীগ্রন্থ কোরান জোর দিয়েছে যে, একজন মুসলিমের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে ন্যায়বিচার ভিত্তিক সাম্যবাদী সমাজ গঠন করা যেখানে দরিদ্র ও দুস্থ জনগণের প্রতি সম্মানের সাথে আচরণ করা হবে। এর জন্যে প্রয়োজন সকল ক্ষেত্রে জিহাদের (একটি শব্দ ‘পবিত্র যুদ্ধে’র পরিবর্তে-যেমনটা পাশ্চাত্যবাসীরা প্রায়ই ধরে নেয়-যার অনুবাদ হওয়া উচিত ‘প্রয়াস’ বা ‘সংগ্ৰাম’।): আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত, সামরিক ও অর্থনৈতিক। আল্লাহকে প্রাধান্য দিয়ে সমাজ গঠনের মাধ্যমে ও মানবজাতির জন্যে তাঁর পরিকল্পনার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করে মুসলিমরা ব্যক্তিগত ও সামাজিক সংহতি অর্জন করবে যা তাদের আল্লাহর একত্বের বোধ জাগাবে। জীবনের কোনও একটি দিককে ঝেড়ে ফেলে তাকে এই ধর্মীয় ‘প্রয়াসে’র আওতার বাইরে ঘোষণা করা হবে প্রধান ইসলামি গুণ এই একীভূতকরণের (তাওহিদ) নীতির মারাত্মক লঙ্ঘন। এটা স্বয়ং আল্লাহকেই অস্বীকার করার শামিল হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং, ধর্মপ্রাণ কোনও মুসলিমের পক্ষে রাজনীতি হচ্ছে ক্রিশ্চানরা যাকে বলবে অপসুদীক্ষা। এটা এমন এক কর্মকাণ্ড যাকে পবিত্রায়িত করতেই হবে যাতে তা আল্লাহকে পাওয়ার একটি উপায়ে পরিণত হয়।

মুসলিম সম্প্রদায় অর্থাৎ উম্মাহর বিভিন্ন উদ্বেগ শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে প্রত্যেক মুসলিমের জন্যে বাধ্যতামূলক ইসলামের পাঁচটি আবশ্যকীয় অনুশীলন স্তম্ভে’ (রুকন) স্পষ্ট করা হয়েছে। ক্রিশ্চানরা যেখানে অর্থডক্সিকে সঠিক বিশ্বাস মনে করে, মুসলিমদের সেখানে ইহুদিদের মতো অর্থপ্র্যাক্সির, ধর্মীয় অনুশীলনের সর্বজনীনতা এবং বিশ্বাসকে গৌণ বিষয় হিসাবে দেখা প্রয়োজন। পাঁচটি স্তম্ভ অনুযায়ী প্রত্যেক মুসলিমকে শাহাদাহ (আল্লাহ’র একত্বে বিশ্বাস ও মুহাম্মদের (স) পয়গম্বরত্বের পক্ষে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি) উচ্চারণ করতে হয়, দৈনিক পাঁচবার প্রার্থনা করা, সমাজে সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করার জন্যে কর প্রদান (যাকাত) করা, দরিদ্রদের উপবাসে থাকার কষ্টের স্মরণে রমযান মাসে উপবাস পালন এবং পরিস্থিতি অনুকূল হলে মক্কায় হাজ্জ তীর্থযাত্রা পালন। উম্মাহর রাজনৈতিক স্বাস্থ্য স্পষ্টত যাকাত ও রমযানের উপবাসের মূখ্য বিষয়। কিন্তু আবিশ্যিকভাবেই সাম্প্রদায়িক ঘটনা হাজ্জে এটা জোরালভাবে উপস্থিত, এই সময় উম্মাহর ঐক্যকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্যে ও ধনী ও দরিদ্রের পার্থক্য মুছে ফেলার জন্যে তীর্থযাত্রী সর্বজনীন শাদা পোশাক পরে।

আরবীয় হিজাজের কেন্দ্রে মক্কায় অবস্থিত চৌকো আকৃতির উপাসনাগৃহ কাবাহ হাজ্জের মুল মনোযোগের বিষয়। কাবাহ এমনকি মুহাম্মদের (স) আমলেও বহু প্রাচীন ছিল, সম্ভবত আদিতে আরবীয় প্যাগান দেবনিচয়ের পরম ঈশ্বর আল্লাহ’র প্রতি নিবেদিত ছিল। মুহাম্মদ (স) কাবাহয় বার্ষিক তীর্থযাত্রার আনুষ্ঠানিকতাকে ইসলামিকরণ করেছেন, একেশ্বরবাদী তাৎপর্য দান করেছেন। এখন পর্যন্ত হাজ্জ মুসলিম সমাজের এক জোরাল অভিজ্ঞতা দান করে। কাবাহর কাঠামো মনস্তাত্ত্বিক জি.সি. জাঙ (১৮৭৫-১৯৫১) কর্তৃক আবিষ্কৃত আর্কিটাইপাল তাৎপর্যমণ্ডিত জ্যামিতিক প্যাটার্নের সাথে খাপ খায়। অধিকাংশ প্রাচীন শহরের কেন্দ্ৰে উপাসনালয় পবিত্রের সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে, তাদের অস্তিত্বের পক্ষে যাকে আবশ্যক মনে করা হত। এটা মরণশীল নারী-পুরুষের নাজুক ও অরক্ষিত শহুরে সমাজে অধিকতর সক্ষম আদিম বাস্তবতাকে বয়ে আনত। পুতার্ক, ওভিদ, দিওনিসাস অভ হেলিকারনাসাসের মতো ধ্রুপদি লেখকগণ বৃত্তাকার বা চৌকো হিসাবে উপাসনাগৃহের বর্ণনা দিয়েছেন, এটা মহাবিশ্বের অত্যাবশ্যক কাঠামোকে নতুন করে গড়ে তোলে বলে বিশ্বাস করা হত। এটা সেই প্যারাডাইম যা তুমুল বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে এবং একে টেকসই করে বাস্তবতা দান করেছে। জাঙ বিশ্বাস করতেন যে, চৌকো বা বৃত্তের ভেতর যেকোনও একটিকে বেছে নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই, বাস্তবতার ভিত্তি মহাজাগতিক শৃঙ্খলাকে তুলে ধরা জ্যামিতিক চিত্র, তিনি বিশ্বাস করতেন, বৃত্তের ভেতর প্রবেশ করানো একটা চতুর্ভুজ। উপাসনাগৃহে পালিত আচারগুলো উপাসককে মহাবিশ্বের মৌল নীতিমালা ও আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করে সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে ও একে বিভ্রান্তি বা কুহকের ফাঁদে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করতে তাদের সহজাত বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় ভরা জগতে স্বর্গীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। মক্কার কাবাহ ঠিক আর্কিওটাইপের সাথে মিলে যায়। গ্রানিটের চৌকো কাঠামো ঘিরে তীর্থযাত্রীরা সাতবার আচরিক প্রদক্ষিণে দৌড়ে বেড়ায়। এর চারটে কোণ পৃথিবীর কোণের প্রতিনিধিত্ব করে, পৃথিবীকে ঘিরে সূর্যের ঘূর্ণনের ধরনকে অনুসরণ করে তারা। নারী বা পুরুষ তার সম্পূর্ণ সত্তার জীবনের মৌল ভিত্তির কাছে কেবল অস্তিত্বগত আত্মসমর্পণের ভেতর দিয়েই (ইসলাম) একজন মুসলিম (যিনি আত্মসমর্পণ করেছেন) সমাজে প্রকৃত মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকতে পারে।

তীর্থযাত্রায় গেছে এমন একজন মুসলিমের কাছে এখনও সর্বোচ্চ ধর্মীয় অভিজ্ঞতা হজ্জ এভাবে গভীরভাবে রক্ষণশীল চেতনায় পরিপূর্ণ। সকল প্রকৃত মিথোই-এর মতো পৌরাণিক আদর্শজগতের অবচেতন বিশ্বে প্রোথিত হাজ্জ মুসলিমদের সেই মৌল উপাদানের কথা মনে করিয়ে দেয় যা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে কারও পক্ষে এর বাইরে যাওয়া অসম্ভব। এটা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের চেয়ে গভীরে যেতে, বস্তুনিচয়ের আবিশ্যিকভাবে স্বাভাবিক ধর্মে আত্মসমর্পণ ও নিজেদের মতো স্বাধীনভাবে অগ্রসর না হতে সাহায্য করে। সম্প্রদায়ের সমস্ত যৌক্তিক কর্মকাণ্ড-রাজনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য বা সামাজিক সম্পর্ক-পৌরাণিক প্রেক্ষিতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে স্থাপিত ও পরে মুসলিম বিশ্বের হৃদয়ে অবস্থিত কাবাহ এইসব যৌক্তিক কর্মকাণ্ডকে অর্থ ও পরিপ্রেক্ষিত দান করেছে। কোরানও এই রক্ষণশীল মনোভাব তুলে ধরেছে। এটা বারবার জোরের সাথে বলেছে যে, মানুষের কাছে এটা কোনও নতুন সত্যি বয়ে আনছে না, বরং মানবজীবনের অত্যাবশ্যক বিধিবিধানকেই প্রকাশ করছে। এটা এরই মধ্যে জানা সত্যিরই ‘স্মারক’। মুহাম্মদ (স) মনে করেননি যে তিনি একটি নতুন ধর্ম তৈরি করছেন, বরং বিশ্বাস করেছেন যে, এই আরবীয় গোত্রের কাছে মানবজাতির আদিমতম ধর্মকেই নিয়ে আসছেন; এর আগে কখনও এদের কাছে কোনও পয়গম্বর প্রেরণ করা হয়নি, তাদের নিজস্ব ভাষায় কোনও ঐশীগ্রন্থও ছিল না। কোরানের দৃষ্টিতে প্রথম পয়গম্বর আদমের কাল থেকেই কীভাবে জীবন যাপন করতে হবে তার শিক্ষা দিতে আল্লাহ পৃথিবীর বুকে প্রত্যেক জাতির কাছে বার্তাবাহক প্রেরণ করেছেন।’ সহজাতভাবে স্বর্গীয় বিধির কাছে আত্মসমর্পণ করায় প্রকৃতিগতভাবেই মুসলিম পশু-পাখি, মাছ বা গাছের বিপরীতে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা রয়েছে, ইচ্ছে করলে সে এই বিধানকে অমান্য করতে পারে।” তারা যখন এইসব মৌল বিধানকে অমান্য করে দরিদ্রের উপর নির্যাতনকারী সুষ্ঠুভাবে সম্পদ বণ্টনে অস্বীকারকারী স্বেচ্ছাচারী সমাজ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখনই তারা তাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে। কোরান আমাদের জানাচ্ছে অতীতের মহান সব পয়গম্বর-আদম, নোয়াহ, মোজেস, জেসাস এবং আরও অনেকে—কীভাবে আল্লাহ’র সেই একই বাণী উচ্চারণ করেছেন। এখন কোরান আরবদের কাছে সেই একই স্বর্গীয় বাণী এনে দিয়েছে, তাদের সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতার চর্চা করার নির্দেশ দিচ্ছে যা তাদের অস্তিত্বের মৌল বিধির সাথে সমন্বিত করবে। মুসলিমরা যখন আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী চলে, সবকিছু যেমন হওয়া উচিত ছিল সেইভাবে বস্তুনিচয়ের ধারার সাথে চলার বোধ জাগে তাদের ভেতর। আল্লাহ’র বিধান অমান্য করাকে প্রকৃতিবিরুদ্ধ বিবেচনা করা হয়েছে: এ যেন কোনও মাছ জমিনে বাস করার প্রয়াস পাচ্ছে।

ষোড়শ শতাব্দীতে অটোমানদের বিস্ময়কর সাফল্যকে নিশ্চয়ই তাদের প্রজাদের চোখে তারা যে এই মৌল নীতিমালার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে তার জ্বলন্ত প্রমাণ হিসাবে ফুটে উঠেছিল। একারণেই তাদের সমাজ এমন দর্শনীয়ভাবে কাজ করেছে। অটোমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় শরীয়াহ আইনকে দেওয়া নজীরবিহীন প্রাধ্যান্যকেও এই রক্ষণশীল চেতনায় দেখা হয়েছিল। আধুনিকতার সূচনায় মুসলিমরা স্বর্গীয় আইনকে তাদের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্নকারী বিষয় মনে করেনি, এটা ছিল পৌরাণিক আদর্শজগতের আচরিক ও কাল্টিক বাস্তবায়ন, যা তাদের পবিত্রের সংস্পর্শে নিয়ে গেছে বলে বিশ্বাস করেছে। মুহাম্মদের (স) পরলোকগমনের পরবর্তী শতাব্দীগুলোয় ধীরে ধীরে মুসলিম আইনের বিকাশ ঘটেছে। কোরানে খুব কমই বিধানের অস্তিত্ব রয়েছে আর পয়গম্বরের পরলোকগমনের এক শো বছরের ভেতর মুসলিমরা হিমালয় থেকে পিরেনীজ পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করছিল বলে অন্য যেকোনও সমাজের মতোই এর জটিল আইনি ব্যবস্থার প্রয়োজন থাকায় এটা ছিল একটা সৃজনশীল উদ্যোগ। শেষ পর্যন্ত ইসলামি জুরিসপ্রুডেন্সের চারটি ধারা গড়ে ওঠে। সবগুলোই প্রায় একই ধরনের, এদের সমানভাবে বৈধ মনে করা হয়। পয়গম্বর মুহাম্মদের (স) ব্যক্তিত্বের উপর ভিত্তি করে এই বিধানব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ গ্রহণের সময় ইসলামের নিখুঁত ভঙ্গিমা সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। নবম শতাব্দীতে খুব সতর্কতার সাথে পয়গম্বরের শিক্ষা ও আচরণ সংক্রান্ত প্রত্যক্ষদর্শীর প্রতিবেদন (হাদিস) সংগ্রহ করা হয়, মুসলিমরা তাঁর বাণী ও ধর্মীয় অনুশীলনের (সুন্নাহ) একটা নির্ভুল রেকর্ড লাভ করে সেটা নিশ্চিত করতে যত্নের সাথে বাছাই করা হয়েছে। আইনি মতবাদগুলো মুহাম্মদীয় এই প্যারাডাইমগুলোকে তাদের আইনি ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করে যাতে সারা বিশ্বের মুসলিমরা পয়গম্বর যেভাবে কথা বলতেন, খেতেন, হাতমুখ ধুতেন, ভালোবাসতেন ও প্রার্থনা করতেন তার অনুকরণ করতে পারে। এইসব বাহ্যিক বিষয়ে পয়গম্বরের অনুকরণের ভেতর দিয়ে তারা আল্লাহর কাছে তাঁর অন্তস্থঃ আত্মসমর্পণের নাগাল পাবার আশা করেছিল।” প্রকৃত রক্ষণশীল চেতনায় মুসলিমরা অতীতের এক নিখুঁত বিষয়ের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছিল।

মুসলিম বিধানের অনুশীলন ঐতিহাসিক চরিত্র মুহাম্মদকে (স) মিথে পরিণত করে তাঁকে তিনি যে কালে বেঁচেছিলেন সেই কাল থেকে মুক্ত করে প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমের ব্যক্তি জীবনে তুলে এনেছে। একইভাবে এই কাল্টিক পুনারাবৃত্তি মুসলিম সমাজকে আল্লাহর কাছে নিখুঁত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে একজন মানুষের কেমন হওয়া উচিত তার নজীরে পরিণত হওয়া ব্যক্তি মুহাম্মদের (স) নৈকট্য লাভের ভেতর দিয়ে প্রকৃত ইসলামি করে তুলেছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মঙ্গোল আগ্রাসনের সময় নাগাদ শরীয়াহ আধ্যাত্মিকতা শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে সারা মুসলিম বিশ্বে শেকড় বিস্তার করেছিল, সেটা খলিফা ও উলেমাগণ এটা তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার কারণে নয়, বরং এটা নারী-পুরুষকে নুমিনাসের অনুভূতি দিয়েছিল ও তাদের জীবনকে অর্থ দিয়ে পরিপূর্ণ করে তুলেছিল বলে। অতীতের প্রতি এই কাল্টিক উল্লেখ অবশ্য সপ্তম শতাব্দীর জীবনধারার প্রতি প্রাচীন আনুগত্যের কাছে বন্দি করেনি। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অটোমান সাম্রাজ্য তর্কসাপেক্ষে সবচেয়ে আধুনিক রাষ্ট্র ছিল। সময়ের হিসাবে এটা অসাধারণ দক্ষ ছিল, এক নতুন ধরনের আমলাতন্ত্রের বিকাশ ঘটিয়েছে ও প্রাণবন্ত জীবনধারাকে উৎসাহিত করেছে। অটোমানরা অন্যান্য সংস্কৃতির প্রতি উদার ছিল। পাশ্চাত্য নৌচলাচল বিজ্ঞান তাদের সত্যিই উত্তেজিত করে তুলেছিল, অভিযাত্রীদের বিভিন্ন আবিষ্কারে রীতিমতো আলোড়িত হয়েছে; এবং গানপাউডার ও আগ্নেয়াস্ত্রের মতো পাশ্চাত্য সামরিক আবিষ্কার আয়ত্ত করতে তারা উদগ্রীব ছিল।” উলেমাদের দায়িত্ব ছিল এইসব উদ্ভাবনকে মুসলিম আইনে মুহাম্মদীয় প্যারাডাইমের অন্তর্ভুক্ত করার পদ্ধতির অনুসন্ধান করা। জুরিপ্রুডেন্সের গবেষণা (ফিকহ) মানে কেবল প্রাচীন টেক্সট পাঠের ব্যাপার ছিল না, বরং এর চ্যালেঞ্জিং একটা মাত্রা ছিল। এবং এই সময় পর্যন্ত ইসলাম ও পশ্চিমের ভেতর কোনও পার্থক্য ছিল না। ইউরোপও রক্ষণশীল চেতনায় ডুবে ছিল। রেনেসাঁ মানবতাবাদীরা আদ ফন্তেসে, উৎসে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। আমরা দেখেছি, সাধারণ মরণশীলের পক্ষে সম্পূর্ণভাবে ধর্ম থেকে বের হয়ে আসা কার্যত অসম্ভব। নতুন নতুন আবিষ্কার সত্ত্বেও ইউরোপিয়রা অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত রক্ষণশীল রীতিনীতিতেই শাসিত হয়েছে। পাশ্চাত্য আধুনিকতা ভবিষ্যৎমুখী যুক্তিবাদ দিয়ে জীবনের পশ্চাদমুখী পৌরাণিক ধারাকে প্রতিস্থাপিত করার পরেই কেবল কোনও কোনও মুসলিম ইউরোপকে অচেনা ভাবতে শুরু করবে।

এছাড়া, রক্ষণশীল সমাজকে সম্পূর্ণ স্থবির কল্পনা করে নেওয়াটা ভ্রান্তি হবে। গোটা মুসলিম ইতিহাস জুড়ে ইসলা (‘সংস্কার’) ও তাজদিদ (‘নবায়ন’)-এর আন্দোলন চলেছে, প্রায়শঃই এগুলো ছিল সম্পূর্ণই বিপ্লবী। উদাহরণ স্বরূপ, দামাস্কাসের আহমাদ ইবন তাঈমিয়াহর (১২৬৩-১৩২৮) মতো একজন সংস্কারক ‘ইজতিহাদের দুয়ার রুদ্ধ করার’ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। মঙ্গোল আগ্রাসনের আগে ও পরে জীবন যাপন করেছেন তিনি, মুসলিমরা এই সময় প্রবল আচ্ছন্ন দশা থেকে মুক্ত হয়ে সমাজকে নতুন করে গড়ে তোলার প্রয়াস পাচ্ছিল। সাধারণভাবে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের কালে বা ব্যাপক রাজনৈতিক বিপর্যয়ের অব্যবহিত পরপর সাংস্কৃতিক আন্দোলন সৃষ্টি হয়ে থাকে। এমন সময়ে পুরোনো সমাধান আর কাজে আসে না, সুতরাং সংস্কারকগণ ইজতিহাদের যৌক্তিক ক্ষমতা ব্যবহার করে স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে থাকেন। ইবন তাঈমিয়াহ শরীয়াকে হালনাগাদ করতে চেয়েছিলেন যাতে করে তা এই খোলনলচে বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে মুসলিমদের সত্যিকারের প্রয়োজন মেটাতে পারে। কিন্তু তাঁর কর্মসূচি আবিশ্যিকভাবে রক্ষণশীল রূপ ধারণ করেছিল। ইবন তাঈমিয়া বিশ্বাস করতেন যে, সঙ্কট উত্তরণের জন্যে মুসলিমদের অবশ্যই উৎসে, অর্থাৎ কোরান ও পয়গম্বরের সুন্নাহ্য় ফিরে যেতে হবে। পরবর্তীকালের সকল ধর্মীয় সংযোজন বাতিল করে মূলে ফিরে যেতে চেয়েছেন তিনি। অর্থাৎ, আদিম মুসলিম আদর্শরূপে ফিরে যেতে পবিত্র বিবেচিত হতে শুরু করা অনেক মধ্যযুগীয় জুরিপ্রুডেন্স (ফিকহ) ও দর্শন বাতিল করে দিয়েছিলেন। এই প্রতিমাবিরোধিতা প্রতিষ্ঠানকে ক্ষিপ্ত করে তোলে এবং ইবন তাঈমিয়া বাকি জীবন কারাগারে কাটান। বলা হয়ে থাকে যে, আটককারী তাঁকে কলম ও কাগজ না দেওয়ায় ভগ্ন হৃদয়ে মারা গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাঁকে ভালোবেসেছিল, তাঁর আইনি সংস্কার ছিল উদার ও রেডিক্যাল, তারা বুঝতে পেরেছিল যে তাদের স্বার্থই তিনি মনে-প্রাণে গ্রহণ করেছিলেন।২ তাঁর অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠান জনপ্রিয় স্বীকৃতির প্রদর্শনীতে পরিণত হয়। ইসলামি ইতিহাসে এমন আরও অনেক সংস্কারক রয়েছেন। আমরা আমাদের বর্তমান কালের কোনও কোনও মুসলিম মৌলবাদীকে ইসলাহ ও তাজদিদের এই ঐতিহ্যে কাজ করতে দেখব।

অন্য মুসলিমরা নিগূঢ় আন্দোলনের মাঝে নতুন ধর্মীয় ধারণা ও অনুশীলনের সন্ধান করতে পেরেছিল। এসব সাধারণ জনগণের কাছে গোপন রেখেছিল তারা, কেননা তাদের ধারণা ছিল এসবকে ভুল বোঝা হতে পারে। অবশ্য, তারা ধর্ম সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধারণার কোনও পার্থক্য দেখতে পায়নি। তাদের বিশ্বাস ছিল, তাদের আন্দোলনসমূহ কোরানের শিক্ষার সম্পূরক ছিল এবং সেগুলোকে নতুন প্রাসঙ্গিকতা দিয়েছে। ইসলামের তিনটি প্রধান নিগূঢ় ধরন হচ্ছে, সুফিবাদের অতীন্দ্রিয়বাদী অনুশীলন, ফালসাফাহর যুক্তিবাদ ও শিয়া ধর্মমতের কিছুটা রাজনৈতিক ধার্মিকতা। এই অধ্যায়ে আমরা তার বিস্তারিত অনুসন্ধান করব। কিন্তু ইসলামের এই নিগূঢ় ধরনগুলোকে যত উদ্ভাবনীমূলক বা মূলধারার শরীয়া ধার্মিকতা থেকে যতই বিচ্ছিন্ন মনে হোক না কেন, মরমীরা বিশ্বাস করত যে তারা আদ ফন্তেসে ফিরে যাচ্ছে। কোরানের ধর্মে গ্রিক যুক্তিবাদের নীতিমালা প্রয়োগের প্রয়াস লাভকারী ফালসাফাহর প্রচারকরা সময়হীন সত্যির আদিম সর্বজনীন ধর্মবিশ্বাসে ফিরে যেতে চেয়েছে, তাদের ধারণা ছিল ওই ধর্ম বিভিন্ন ঐতিহাসিক ধর্মের আগেও বিরাজ করত। সুফিরা বিশ্বাস করেছে যে, অতীন্দ্রিয় পরমানন্দ পয়গম্বর কোরান গ্রহণ করার সময় যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন তারই পুনরাবৃত্তি ঘটায়, তারাও মুহাম্মদের (স) আদি আদর্শের সাথে একাত্ম হচ্ছে। শিয়াদের দাবি, কেবল তারাই কোরানে উল্লিখিত সামাজিক ন্যায়বিচারের আবেগের চর্চা করে, কিন্তু দুর্নীতিবাজ মুসলিম শাসকগণ তাকে উপেক্ষা করে গেছেন। নিগূঢ়বাদীদের কেউই আমাদের ধারণা অনুযায়ী ‘মৌলিক’ হতে চায়নি, সবাইই মূলে ফিরে যাওয়ার রক্ষণশীল দিক থেকে মৌলিক, কেবল সেটাই মানুষকে পূর্ণাঙ্গতা ও পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে বিশ্বাস করা হত।[১৩]

এই গ্রন্থে আমরা যেসব দেশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব তাদের ভেতর একটি মিশর। ১৫১৭ সালে এই দেশটি অটোমান সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয়। প্রথম সেলিম সেই সময় সিরিয়ায় অভিযান পরিচালনার সময় দেশটি অধিকার করে নিয়েছিলেন। সুতরাং শরীয়া ধার্মিকতা মিশরে প্রধান ছিল। কায়রোর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় আল আযহার সুন্নি বিশ্বে ফিকহ গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে। কিন্তু অটোমান শাসনের শতাব্দীগুলোয় ইস্তাম্বুলের পেছনে পড়ে যায় মিশর, আপেক্ষিকভাবে অস্পষ্ট হয়ে ওঠে তার অস্তিত্ব। আধুনিক কালের সূচনা লগ্নে এই দেশটির অবস্থা সম্পর্কে খুব কমই জানি আমরা। ১২৫০ সাল থেকে এই অঞ্চল মামলুকদের শাসনাধীন ছিল—এরা ছিল কিশোর বয়সে বন্দি করে ইসলামে ধর্মান্তরিত কর্সিকান দাসদের নিয়ে সংগঠিত একটা ক্র্যাক সামরিক বাহিনী। একই ধরনের দাস-বাহিনী জানেসারিরা ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের সামরিক মেরুদণ্ড। তুঙ্গ সময়ে মামলুকরা মিশর ও সিরিয়ায় এক প্রাণবন্ত সমাজে নেতৃত্ব দিয়েছে। মিশর ছিল মুসলিম বিশ্বের অন্যতম অগ্রসর দেশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মামলুক সাম্রাজ্য কৃষিভিত্তিক সভ্যতার সহজাত সীমাবদ্ধতার কাছে নতি স্বীকার করে নেয়, এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এর পতন শুরু হয়। মামলুকরা অবশ্য মিশরে সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়নি। অটোমান সুলতান প্রথম সেলিম আলেপ্পোর মামলুক গভর্নর খায়ের বে’র সাথে জোট বেঁধে দেশটি দখল করে নেন। এই রফার অধীনে খায়ের বে-কে অটোমান বাহিনী প্রত্যাহৃত হওয়ার পর ভাইসরয় নিয়োগ করা হয়েছিল।

গোড়ার দিকে অটোমানরা মামলুকদের সামাল দিতে পেরেছিল, দুটি মামলুক বিদ্রোহকে দমন করেছিল তারা।[১৪] তবে ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে অটোমানরা তাদের সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে ফেলতে যাচ্ছিল। ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি প্রশাসনে পতন ডেকে আনে এবং ক্রমশঃ বেশ কয়েকটা বিদ্রোহের পর মামলুক অধিনায়করা (বে) মিশরের আসল শাসক হিসাবে আবির্ভূত হন, যদিও সরকারীভাবে ইস্তাম্বুলের অধীন ছিলেন তাঁরা। বে-গণ উচ্চ পদমর্যাদা সম্পন্ন সামরিক ক্যাডার গড়ে তুলেছিলেন, এই বাহিনী তুর্কি গভর্নরের বিরুদ্ধে অটোমান সেনাবাহিনীতে মামলুক বাহিনীর একটা বিদ্রোহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় ও তার জায়গায় নিজেদের একজনকে ক্ষমতায় বসায়। সুলতান এই নিয়োগের বৈধতা দান করেন। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিকে সংক্ষিপ্ত একটা পর্যায় বাদে মামলুকরা দেশের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পেরেছিল। ওই সময় জানেসারিদের একজন ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলেন। তবে মামলুক শাসন ছিল অস্থিতিশীল। বে-তন্ত্ৰ দুটো উপদলে বিভক্ত ছিল, ফলে সারাক্ষণ অস্থিরতা ও অন্তর্দলীয় কোন্দল লেগেই থাকত।[১৫] এই গোটা উত্তাল সময় জুড়ে প্রধান শিকার ছিল মিশরের সাধারণ জনগণ। বিদ্রোহ ও উপদলীয় সহিংসতার সময় তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, করের ভারে পঙ্গু হয়ে গেছে তারা। তুর্কি বা সারকাসিয়ান, যাই হোক না কেন, শাসকদের সাথে তারা কোনওরকম ঐক্য বোধ করতে পারেনি, এরা ছিল বিদেশী ও জনগণের কল্যাণে কোনও আগ্রহ ছিল না তাদের। জনগণ ক্রমবর্ধমানহারে উলেমাদের শরনাপন্ন হচ্ছিল: মিশরিয় ছিলেন তাঁরা, শরীয়ার পবিত্র শৃঙ্খলার প্রতিনিধিত্ব করতেন। তাঁরাই মিশরিয় জনগণের প্রকৃত নেতায় পরিণত হন। অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে বে-দের ভেতরকার বিরোধ আরও প্রকট আকার ধারণ করলে মামলুক নেতৃবৃন্দ আবিষ্কার করেন যে, জনগণকে তাদের শাসন মেনে নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্যে উলেমাদের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গতি নেই।১৬

উলেমারা ছিলেন মিশরিয় সমাজের শিক্ষক, পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবী। প্রতিটি শহরে এক থেকে সাতটি মাদ্রাসা (ইসলামি আইন ও ধর্মতত্ত্ব পাঠের বিশ্ববিদ্যালয়) ছিল, এগুলোই ছিল দেশের শিক্ষকের যোগানদার। বুদ্ধিবৃত্তির মান খুব উন্নত ছিল না। প্রথম সেলিম মিশর দখল করে নেওয়ার পর প্রচুর মূল্যবান পাণ্ডুলিপিসহ বহু নেতৃস্থানীয় উলেমাকে সাথে করে ইস্তাম্বুলে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অটোমান সাম্রাজ্যের একটা পশ্চাদপদ প্রদেশে পরিণত হয়েছিল মিশর। অটোমানরা আরব পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়নি। মিশরিয়দের বাইরের পৃথিবীর সাথে কোনও যোগাযোগ ছিল না। মামলুক শাসনের সময় সমৃদ্ধি লাভ করা মিশরিয় দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ওষুধবিজ্ঞান ও বিজ্ঞান অধঃপতিত হয়ে পড়েছিল।১৭

কিন্তু শাসক ও সাধারণ জনগণের ভেতর যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম থাকায় উলেমাগণ যাপরনাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন। এদের বেশিরভাগই এসেছিলেন ফেলাহীন কৃষক শ্রেণী থেকে, তাই পল্লী অঞ্চলে তাদের প্রভাব ছিল উল্লেখ করার মতো। কোরান স্কুল ও মাদ্রাসায় গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতেন তাঁরা; শরীয়া আদালতসমূহ বিচার ব্যবস্থার মুল কেন্দ্র থাকায় উলেমাগণ আইনি ব্যবস্থায়ও একচেটিয়া অধিকার ভোগ করতেন। এছাড়া, দিওয়ানে” গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদের অধিকারী ছিলেন তাঁরা এবং শরীয়াহর অভিভাবক হিসাবে সরকারের বিরুদ্ধে মূল বিরোধিতারও নেতৃত্ব দিতে পারতেন। বিখ্যাত মাদ্রাসা আল-আযহারের অবস্থান ছিল বাজারের পাশে, উলেমাদের সাথে বণিক শ্রেণীর শক্তিশালী সম্পর্ক ছিল। সরকারের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চাইলে তারা আযহারের মিনার থেকে বাজানো ঢাকের আওয়াজেই বাজার বন্ধ করে দিতে পারত ও লোকজনকে রাস্তায় নামিয়ে আনতে পারত। উদাহরণ স্বরূপ, ১৭৯৪ সালে আযহারের রেক্টর শেখ আল-শারকাভি এক নতুন করারোপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, একে নির্যাতনমূলক ও অনৈসলামিক ঘোষণা করেছিলেন তিনি। তিন দিন পরে বে-গণ কর প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।১৯ কিন্তু সরকার উৎখাত করে উলেমাদের সরকার গঠনের লক্ষ্যে অভ্যুত্থান পরিচালনার কোনও বাস্তব হুমকি ছিল না। বে-গণ সাধারণত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তাঁদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতেন। মব ভায়োলেন্স প্রায়শঃই মামলুক সেনাবাহিনীর পক্ষে তেমন কোনও চলমান চ্যালেঞ্জ ছিল না। তা সত্ত্বেও উলেমাদের প্রাধান্য মিশরিয় সমাজকে একটা লক্ষযোগ্য ধর্মীয় চরিত্র দান করেছিল, ইসলামই মিশরের জনগণকে একমাত্র নিরাপত্তার যোগান দিয়েছিল।২১

অষ্টম শতাব্দীর শেষ নাগাদ মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা ছিল যারপরনাই মূল্যবান। এই সময় নাগাদ অটোমান সাম্রাজ্য মারাত্মক অবনতির শিকারে পরিণত হয়। এর ষোড়শ শতকীয় সরকারের অসাধারণ দক্ষতা বিশেষ করে সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত এলাকায় অযোগ্যতার জন্ম দেয়। বিস্ময়করভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করেছিল পাশ্চাত্য জগৎ। অটোমানরা আবিষ্কার করে যে তারা এখন আর আগের মতো ইউরোপের সাথে সমান তালে লড়তে পারছে না। পাশ্চাত্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল, সেটা রাজনৈতিক দুর্বলতার কালে ঘটছিল বলে নয়, বরং ইউরোপে গড়ে উঠতে থাকা এক নতুন সমাজের কোনও পূর্ব নজীর না থাকায়।২২ সুলতানগণ মানিয়ে নেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন, কিন্তু তাঁদের প্রয়াস ছিল বাহ্যিক। উদাহরণ স্বরূপ, সুলতান তৃতীয় সেলিম (১৭৮৯-১৮০৭ সাল পর্যন্ত শাসন করেন) পাশ্চাত্য হুমকিকে কেবল সামরিক ভিত্তিতে বিবেচনা করেছেন। ১৭৩০-এর দশকে ইউরোপিয় ধাঁচে সেনাবাহিনীকে গড়ো তোলার ব্যর্থ প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ১৭৮৯ সালে সিংহাসনে আরোহণ করার পর সেলিম ফরাসী নির্দেশকসহ বেশ কয়েকটি সামরিক স্কুল খোলেন: ছাত্ররা এখানে ইউরোপিয় ভাষা ও গণিত, নৌচলাচল, ভূগোল ও ইতিহাসের বইয়ের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠে।২৩ অল্প কিছু সামরিক কৌশল শিক্ষা ও আধুনিক বিজ্ঞানের ভাসা ভাসা জ্ঞান অবশ্য পাশ্চাত্য হুমকিকে সামাল দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণিত হয়নি। কারণ ইউরোপিয়রা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের জীবন ও চিন্তা ধারার বিকাশ ঘটিয়েছিল; ফলে সম্পূর্ণ ভিন্ন কেতায় কাজ করছিল তারা। তাদের নিজস্ব কৌশলে তাদের মোকাবিলা করার লক্ষ্যে অটোমানদের প্রয়োজন ছিল সমাজের ইসলামি কাঠামো ভেঙে একেবারে নতুন ধরনের যৌক্তিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো ও অতীতের সাথে সমস্ত পবিত্র সম্পর্ক ছেদ করতে প্রস্তুত থাকা। অভিজাত গোষ্ঠীর অল্প কিছু মানুষের পক্ষে হয়তো এই পরিবর্তন অর্জন করা সম্ভব ছিল, ইউরোপিয়দের যার জন্যে প্রায় তিনশো বছর লেগেছিল; কিন্তু সাধারণ জনগণকে কীভাবে তাঁরা এমন রেডিক্যাল পরিবর্তন মেনে নিতে ও উপলব্ধি করতে সম্মত করাতেন, যাদের মনমানসিকতা রক্ষণশীল রীতিনীতিতে পরিপূর্ণ?

ইউরোপের সীমান্তে যেসব জায়গায় অটোমান পতন অনেক বেশি প্রকট ছিল, সেখানকার জনগণ বরাবরের মতোই পরিবর্তন ও অস্থিরতার প্রতি সাড়া দিয়েছিল-ধর্মীয় কায়দায়। আরবীয় পেনিনসুলায় মুহাম্মদ ইবন আব্দ আল- ওয়াহহাব (১৭০৩-৯২) ইস্তাম্বুল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মধ্য আরব ও পারসিয়ান গাল্ফ এলাকায় নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হন। আব্দ আল-ওয়াহহাব ছিলেন টিপিক্যাল ইসলামি সংস্কারক। মধ্যযুগীয় জুরেসপ্রুডেন্স, অতীন্দ্রিয়বাদ ও দর্শন প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করে কোরান ও সুন্নাহয় প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে সঙ্কট মোকাবিলার প্রয়াস পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর দৃষ্টিতে এসব যেহেতু আদি ইসলাম থেকে বিচ্যুতি, তাই আল-ওয়াহহাব অটোমান সুলতানদের ধর্মদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তাঁদের বিশ্বাসীদের আনুগত্য লাভের অযোগ্য ও মৃত্যুদণ্ডের উপযুক্ত ঘোষণা করেছিলেন। তাঁদের শরীয়া রাষ্ট্র সঠিক নয়। তার বদলে আল-ওয়াহহাব সপ্তম শতাব্দীর প্রথম মুসলিম সম্প্রদায়ের অনুশীলনের উপর ভিত্তি করে খাঁটি ধর্মের একটা ছিটমহল সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছিলেন। এটা ছিল আক্রমণাত্মক আন্দোলন, বাহুবলে জনগণের উপর চেপে বসেছিল। এইসব সহিংস ও প্রত্যাখ্যানমূলক ওয়াহহাবীয় শিক্ষা আরও ব্যাপক পরিবর্তন ও অস্থিরতার কাল বিংশ শতাব্দীর দিকে কিছু সংখ্যক মৌলবাদী ইসলামি সংস্কারকদের হাতে ব্যবহৃত হবে।২8

মরোক্কোর সুফি সংস্কারক আহমাদ ইবন ইদ্রিসের (১৭৮০-১৮৩৬) সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, আমাদের কালেও যার অনুসারী রয়েছে। অটোমান সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জীবনের বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে তাঁর সমাধান ছিল সাধারণ জনগণকে শিক্ষিত করে তোলা ও তাদের ভালো মুসলিমে পরিণত করা। উত্তর আফ্রিকা ও ইয়েমেনে প্রচুর সফর করেছেন তিনি, সাধারণ জনগণের উদ্দেশে তাদের নিজস্ব ভাষায় বক্তব্য রেখেছেন, সমবেত প্রার্থনার শিক্ষা দিয়েছেন ও অনৈতিক অনুশীলন থেকে তাদের বের করে আনতে চেয়েছেন। তৃণমূল পর্যায়ের আন্দোলন ছিল এটা। ওয়াহহাবী পদ্ধতি নিয়ে কাজ করার অবকাশ ছিল না ইবন ইদ্রিসের। তাঁর চোখে শক্তি নয়, শিক্ষাই ছিল মূল চাবকাঠি। ধর্মের নামে মানুষ হত্যা অবশ্যই ভ্রান্তি। অন্য সংস্কারকগণ একই পথে কাজ করেছেন। আলজেরিয়ায় আহমাদ আল-তিগরানি (মৃ. ১৮২৪), মদিনায় মুহাম্মদ ইবন আব্দ আল-করিম শামীম (মৃ. ১৭৭৫) এবং লিবিয়ায় মুহাম্মদ ইবন আলি আল-সানুসি (মৃ. ১৮৩২)-এদের প্রত্যেকে উলেমাদের পাশ কাটিয়ে ধর্মকে সরাসরি মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন। এটা ছিল জনমুখী সংস্কার, তাঁরা তাঁদের চোখে অভিজাতপন্থী ও ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়া ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করেছেন; আব্দ আল-ওয়াহহাবের বিপরীতে মতবাদগত পরিশুদ্ধতার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না তাঁরা। জনগণকে মূল কাল্টে ফিরিয়ে নিয়ে ও তাদের নৈতিকভাবে জীবন যাপনে অনুপ্রাণিত করে জটিল ফিকহের চেয়ে অনেক কার্যকরভাবে সমাজের অসুস্থতাকে দূর করা যাবে।

শত শত বছর ধরে সুফিগণ শিষ্যদের তাদের নিজস্ব জীবনে মুহাম্মদীয় প্যারাডাইম নতুন করে সৃষ্টি করার শিক্ষা দিয়ে এসেছেন; তারাও জোর দিয়ে বলেছেন আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথই হচ্ছে সৃজনশীল ও অতীন্দ্ৰিয় কল্পনা: মানুষের সুফিবাদের ধ্যানমূলক অনুশীলনের সাহায্যে অবশ্যই নিজের মতো থিওফ্যানি সৃষ্টি করার দায়িত্ব রয়েছে। অষ্টম শতাব্দীর শেষে ও উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এইসব সংস্কারকগণ-পণ্ডিতরা যাদের ‘নিও-সুফি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন—আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষকে তাঁরা সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব অন্তর্দৃষ্টির উপর নির্ভর করার শিক্ষা দিয়েছেন, তাদের আর পণ্ডিত ও বিদ্বান যাজকের উপর নির্ভর করা উচিত নয়। ইবন ইদ্রিস এমনকি যত মহানই হোন না কেন, পয়গম্বর বাদে সকল মুসলিম সাধুর কর্তৃত্ব পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করার মতো পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিলেন। এভাবে তিনি মুসলিমদের যা কিছু নতুন তাকে মূল্য দিতে ও শ্রদ্ধার আলখেল্লাহ ঝেড়ে ফেলার উৎসাহ দিয়েছেন। অতীন্দ্রিয় অনুসন্ধানের লক্ষ্য আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়া নয়, বরং পয়গম্বরের মানবীয় চরিত্রের সাথে গভীরভাবে একীভূত হওয়া-যিনি আল্লাহর কাছে নিজেকে এমনি নিখুঁতভাবে উন্মুক্ত করে তুলেছিলেন। প্রাথমিকভাবে এগুলো আধুনিক প্রবণতা ছিল। নিও-সুফিগণ পয়গম্বরের আদিআদর্শ ব্যক্তিত্বের মুখাপেক্ষী থাকলেও তারা যেন দুর্ভেয়মুখী নয় বরং মানবমুখী ধর্মবিশ্বাসের বিকাশ ঘটাচ্ছিলেন এবং শিষ্যদের যা কিছু নতুন ও উদ্ভাবনী শক্তির তাকে প্রাচীনের মতোই মূল্য দিতে শেখাচ্ছিলেন। পশ্চিমের সাথে ইবন ইদ্রিসের কোনও যোগাযোগ ছিল না, তিনি কখনওই তাঁর লেখায় ইউরোপের কথা উল্লেখ করেননি, পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে জ্ঞান বা তার প্রতি কোনও আগ্রহেরও প্রকাশ ঘটাননি। কিন্তু সুন্নি ইসলামের পৌরাণিক অনুশীলন তাঁকে ইউরোপিয় আলোকনের কিছু কিছু নীতিমালাকে আলিঙ্গন করতে চালিত করেছে।২৫

ইরানের ক্ষেত্রেও একই রকম ছিল ব্যাপারটা। এই দেশের এই সময়ের ইতিহাস মিশরের তুলনায় ভালোভাবে লিখিত আছে। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সাফাভিয়রা ইরান জয় করে শিয়া মতবাদকে রাষ্ট্রের সরকারী ধর্মে পরিণত করে। এর আগে পর্যন্ত শিয়া মতবাদ বুদ্ধিবৃত্তিক ও অতীন্দ্রিয় নিগূঢ় অভিজাত আন্দোলন ছিল; নীতিগতভাবে শিয়ারা রাজনৈতিক জীবনে অংশগ্রহণ হতে বিরত ছিল। ইরানে সব সময়ই কিছু প্রধান শিয়া কেন্দ্র ছিল, তবে বেশির ভাগ শিয়াই ছিল আরব, পারসি নয়। সুতরাং, ইরানে সাফাভিয় পরীক্ষা ছিল এক বিস্ময়কর উদ্ভাবন। সুন্নি ও শিয়াদের ভেতর কোনও মতবাদগত বিরোধ নেই, পার্থক্যটা স্পষ্টতই আবেগজাত। সুন্নিরা মূলত মুসলিম ইতিহাসের বেলায় আশাবাদী, অন্যদিকে শিয়াদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশি ট্র্যাজিক: পয়গম্বর মুহাম্মদের (স) বংশধরদের পরিণতি শুভ ও অশুভ, ন্যায়বিচার ও স্বৈরাচারের মাঝে মহাজাগতিক যুদ্ধের একটা প্রতীকে পরিণত হয়েছে, যেখানে দুষ্টই যেন সব সময় জয় লাভ করছে বলে মনে হয়। সুন্নিরা যেখানে মুহাম্মদের (স) জীবনকে মিথে পরিণত করেছে, শিয়ারা তাঁর বংশধরদের জীবনকে পুরাণে পরিণত করেছে। শিয়া বিশ্বাস উপলব্ধির জন্যে-যা না হলে ১৯৭৮-৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের মতো ঘটনাবলী বোধের অতীত-আমাদের অবশ্যই সংক্ষেপে শিয়া বিশ্বাসের বিকাশ বিবেচনা করতে হবে।

৬৩২ সালে পয়গম্বর মুহাম্মদ (স) পরলোকগমন করার সময় উত্তরাধিকারী মনোনয়নের জন্যে কোনও ব্যবস্থা রেখে যাননি। তাঁর বন্ধু আবু বকর উম্মাহর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মাধ্যমে খেলাফতে অধিষ্ঠিত হন। অবশ্য কেউ কেউ বিশ্বাস করত যে, মুহাম্মদ (স) হয়তো তাঁর নিকটতম পুরুষ আত্মীয় আলি ইবন আবি তালিবই তাঁর উত্তরাধিকারী হোক, এটাই চাইতেন, তিনি ছিলেন তাঁর পোষ্য, চাচাত ভাই ও মেয়ে জামাই। কিন্তু ৬৩৬ সালে চতুর্থ খলিফা হওয়ার আগ পর্যন্ত আলিকে বিভিন্ন নির্বাচনে ক্রমাগত বাদ দিয়ে যাওয়া হয়েছিল। শিয়ারা অবশ্য প্রথম তিন খলিফার শাসনকে স্বীকার করে না। আলিকেই তারা প্রথম ইমাম (‘নেতা’) আখ্যায়িত করে থাকে। আলির ধার্মিকতা ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি তাঁর অফিসারদের উদ্দেশে ন্যায়বিচার ভিত্তিক বিচারের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে চিঠি লিখেছেন। অবশ্য ৬৩৬ সালে দুঃখজনকভাবে এক মুসলিম চরমপন্থীর হাতে নিহত হন তিনি। শিয়া- সুন্নি নির্বিশেষে এই ঘটনা শোকের সাথে স্মরণ করে থাকে। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মুয়াবিয়াহ খেলাফতের সিংহাসন দখল করে নেন এবং দামাস্কাস ভিত্তিক অধিকতর ইহজাগতিক উমাঈয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। আলির বড় ছেলে হাসান, শিয়ারা যাঁকে দ্বিতীয় ইমাম বলে থাকে, রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং ৬৬৯ সালে মদিনায় পরলোকগমন করেন। কিন্তু ৬৮০ সালে খলিফা মুয়াবিয়াহ মারা গেলে ইরাকের কুফায় আলির দ্বিতীয় ছেলে হুসেইনের পক্ষে বিশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। উমাঈয়াদের পক্ষ থেকে প্রতিশোধ এড়াতে হুসেইন মক্কায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ করেন, কিন্তু নতুন উমাঈয়া খলিফা ইয়াযিদ তাঁকে হত্যা করাতে মক্কার পবিত্রতা লঙ্ঘন করে পবিত্র নগরে দূত পাঠায়। তৃতীয় শিয়া ইমাম হুসেইন এই অন্যায় ও অপবিত্র শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দায়িত্ব মনে করেন। স্ত্রী ও সন্তানসহ পঞ্চাশ জনের একটা দল নিয়ে কুফার পথে রওয়ানা হন তিনি, ভেবেছিলেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে পয়গম্বরের উত্তরাধিকারীদের এই করুণ মিছিলের দৃশ্য উম্মাহকে আবার ইসলামের সঠিক পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। কিন্তু আরব দশম মাস মুহররমের আশুরার পবিত্র উপবাসের দিনে উমাঈয়া বাহিনী কুফার বাইরে কারবালার প্রান্তরে হুসেইনের ক্ষুদ্র বাহিনীকে ঘেরাও করে সবাইকে হত্যা করে। সবার শেষে নিহত হন হুসেইন, তখন তাঁর কোলে ছিল তাঁর শিশু পুত্র।২৬

কারবালা ট্র্যাজিডি নিজস্ব কাল্ট গড়ে তুলবে এবং প্রত্যেক শিয়ার ব্যক্তিগত জীবনের এক সময়হীন ঘটনা, মিথে পরিণত হবে। ইয়াযিদ পরিণত হয়েছে স্বৈরাচার ও অন্যায়ের মূর্ত প্রতীকে। দশম শতাব্দী নাগাদ সাধারণভাবে শিয়ারা আশুরার উপবাসের দিন হুসেইনের শাহাদাৎ বরণের বার্ষিকী পালন করে থাকে, তারা কাঁদে, নিজেদের শরীরে আঘাত করে মুসলিম রাজনৈতিক জীবনের দূষণের চিরন্তন বিরোধিতা ঘোষণা করে। কবিগণ শহীদ আলি ও হুসেইনের সম্মানে মহাকাব্যিক শোকগীতি আবৃত্তি করে থাকেন। এভাবে শিয়ারা কারবালার মিথোসের উপর ভিত্তি করে প্রতিবাদের ধার্মিকতা গড়ে তুলেছে। এই কাল্ট শিয়া দৃষ্টিভঙ্গির মূল বিষয় সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি আবেগঘন আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে রেখেছে। আশুরা আচারের সময় শিয়ারা যখন ভাবগম্ভীর মিছিলে হেঁটে যায়, তখন তারা হুসেইনকে অনুসরণ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এমনকি মৃত্যু বরণ করার প্রতিজ্ঞা ঘোষণা দেয়। ২৭

এই মিথ ও কাল্ট গড়ে উঠতে কিছুদিন সময় লেগেছিল। কারবালার পরের প্রথম কয়েক বছর হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পাওয়া হুসেইনের ছেলে আলি এবং তাঁর ছেলে মুহাম্মদ (যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম ইমাম নামে পরিচিত) মদিনায় চলে যান, তাঁরা কোনও রকম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেননি। কিন্তু ইতিমধ্যে প্রথম ইমাম আলি উমাঈয়া শাসনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠা অনেকের কাছেই ন্যায়ের প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন। আব্বাসিয় উপদল যখন শেষ পর্যন্ত ৭৫০ সালে উমাঈয়া খেলাফত উৎখাত করে তাদের নিজেদের রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে (৭৫০-১২৬০), প্রথমে নিজেদের তারা শিয়া-ই আলি (আলির দল) বলে দাবি করেছিল। শিয়ারা আবার কিছু অদ্ভূত আঁচঅনুমানের সাথেও সম্পর্কিত ছিল, বেশির ভাগ মুসলিমই যাকে ‘চরম’ (গুলুউ) মনে করে। ইরাকে মুসলিমরা এক প্রাচীন ও আরও জটিল ধর্মীয় জগতের সংস্পর্শে এসেছিল এবং কেউ কেউ ক্রিশ্চান, ইহুদি বা যোরোস্ত্রিয় মিথলজিতে আকৃষ্ট হয়। কোনও কোনও শিয়া বলয়ে আলিকে জেসাসের মতো ঈশ্বরের অবতার হিসাবে দেখা হত; শিয়া বিদ্রোহীরা মনে করত তাদের নেতারা মারা যাননি বরং আত্মগোপনে (বা ‘অকাল্টেশন’) আছেন; একদিন তাঁরা ফিরে আসবেন, অনুসারীদের বিজয়ের পথে নিয়ে যাবেন। অন্যরা স্বর্গীয় আত্মার মানুষের সত্তায় অবতরণ ও তাকে স্বর্গীয় জ্ঞান দেওয়ার ধারণায় অভিভূত হয়ে গিয়েছিল।২৮ এইসব মিথ এক পরিবর্তিত রূপে শিয়া নিগূঢ় দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

হুসেইনের সম্মানে সৃষ্ট কাল্ট এক ঐতিহাসিক ট্র্যাজিডিকে শিয়া মুসলিমদের ধর্মীয় দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা মিথে পরিণত করেছে। এটা মানুষের খোদ অস্তিত্বে অব্যাহত কিন্তু অদৃশ্য শুভ ও অশুভের ভেতরকার সংগ্রামের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকে; আচার অনুষ্ঠান হুসেইনকে তাঁর সময়ের বিশেষ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করে তাঁকে এক জীবিত সত্তায় পরিণত করে; তিনি পরিণত হন গভীর সত্যের প্রতীকে। কিন্তু শিয়াবাদের পুরাণকে বাস্তব বিশ্বে বাস্তবিকভাবে প্রয়োগ করা যাবে না। এমনকি আব্বাসিয় শাসকদের মতো শিয়ারা ক্ষমতা দখল করতে পারলেও রাজনৈতিক জীবনের কর্কশ বাস্তবতা বোঝায় যে তারা ওইসব উচ্চমার্গীয় আদর্শের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করতে পারছিলেন না। আব্বাসিয় খলিফাগণ ইহজাগতিক দিক থেকে অত্যন্ত সফল ছিলেন, কিন্তু ক্ষমতায় আরোহণের পর অল্প সময়ের ভেতরই শিয়া রেডিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি বিসর্জন দিয়ে সাধারণ সুন্নিতে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁদের শাসন উমাঈয়াদের তুলনায় খুব বেশি ন্যায়সঙ্গত বলে মনে হয়নি; কিন্তু প্রকৃত শিয়াদের পক্ষে বিদ্রোহ করা ছিল অর্থহীন, কারণ প্রয়োজনের খাতিরেই যেকোনও বিদ্রোহকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হত। প্রকৃতপক্ষেই হুসেইনের মিথ যেন বোঝাতে চেয়েছে স্বৈরাচারী শাসকের বিরোধিতা করার যেকোনও প্রয়াসই ব্যর্থ হতে বাধ্য, সেটা ন্যায়বিচারের পক্ষে যত ধার্মিক ও উৎসাহী হোক না কেন।

ষষ্ঠ শিয়া ইমাম জাফর আস-সাদিক (মৃ. ৭৬৫) এটা বুঝতে পেরেছিলেন বলে আনুষ্ঠানিকভাবে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিত্যাগ করেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে পয়গম্বরের উত্তরাধিকারী হিসাবে তিনিই উম্মাহর একমাত্র বৈধ নেতা (ইমাম) হলেও কোনও অর্থহীন বিরোধে জড়ানো সত্যিকারের কাজ নয়, বরং ঐশীগ্রন্থের অতীন্দ্রিয় ব্যাখ্যায় শিয়াদের পথ নির্দেশ করাই তাঁর দায়িত্ব। আলির বংশের প্রত্যেক ইমাম, তিনি শিক্ষা দিয়েছেন, তাঁর প্রজন্মের আধ্যাত্মিক নেতা। ইমামদের প্রত্যেকে তাঁর পূবসুরী কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি তাঁকে স্বর্গীয় সত্যের গোপন জ্ঞান (‘ইলম) দিয়ে গেছেন। সুতরাং একজন ইমাম ভ্রান্তির অতীত আধ্যাত্মিক নির্দেশক ও নিখুঁত বিচারক। এভাবে শিয়ারা রাজনীতি ছেড়ে কোরানের প্রতিটি শব্দের পেছনে লুকানো গোপন (বাতিন) প্রজ্ঞা অনুভব করতে ধ্যানের কৌশল চর্চা করার মাধ্যমে অতীন্দ্রিয় গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। শিয়ারা ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক অনুবাদে সন্তুষ্ট ছিল না, নতুন দর্শনের ভিত্তি হিসাবে টেক্সটকে কাজে লাগাত তারা। তাদের ঐশী অনুপ্রাণিত ইমামের প্রতীকীবাদ পবিত্র সত্তার শিয়া অনুভূতি তুলে ধরে যা একজন অতীন্দ্রিয়বাদী এই উত্তাল বিপজ্জনক বিশ্বে সর্বব্যাপী ও সুগম হিসাবে আবিষ্কার করে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের উপযোগী মতবাদ ছিল না এটা, একে তারা আনাড়ীভাবে ব্যাখ্যা করে বসতে পারত; তো শিয়াদের অবশ্যই তাদের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে নিজের কাছে রাখতে হবে। জাফর আস-সাদিক কর্তৃক বিকশিত ইমামতির মিথলজি ছিল একটি কল্পনানির্ভর দর্শন যা ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক ও বাস্তব ভিত্তিক অর্থের অতীতে অনুসন্ধান ও ইতিহাসকে অদৃশ্যের (আল-গায়েব ) অটল, আদিম বাস্তবতা হিসাবে দেখে। দীক্ষা হীন যেখানে কেবল একজন মানুষকে দেখেছে, ধ্যানী শিয়া জাফর আস-সাদিকের মাঝে স্বর্গীয় আভাস দেখতে পেয়েছে।২৯

ইমামত দৈনন্দিন জীবনের সখুঁত ও ট্র্যাজিক পরিস্থিতিতে আল্লাহ’র ইচ্ছা বাস্তাবায়নের চরম অসুবিধাও প্রতীকায়িত করেছে। জাফর আস-সাদিক কার্যকরভাবে ধর্মকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন, ধর্মবিশ্বাসকে ব্যক্তি পর্যায়ে এনে একে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বলয়ে সীমিত করেছেন। এটা তিনি করেছেন ধর্মকে বাঁচাতে ও এমন বিশ্বে একে বেঁচে থাকতে সক্ষম করে তুলতে যাকে আবিশ্যিকভাবেই এর প্রতি বৈরী মনে হয়। এক গভীর আধ্যাত্মিক প্রেরণা থেকেই এই সেক্যুলারাইজেশন নীতির উদ্ভব ঘটেছিল। শিয়ারা জানত ধর্মের সাথে রাজনীতির মিশ্রণ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এক শতাব্দী পরে এটা করুণভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ৮৩৬ সালে আব্বাসিয় খলিফাগণ বাগদাদের আনুমানিক ষাট মাইল দক্ষিণে সামারায় রাজধানী সরিয়ে নেন। ততদিনে আব্বাসিয়দের শক্তি ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছিল, খলিফা গোটা মুসলিম বিশ্বের নামমাত্র শাসক থাকলেও সাম্রাজ্য জুড়ে মূল কর্তৃত্ব ছিল স্থানীয় আমির ও সর্দারদের হাতে। খলিফাগণ মনে করলেন এমন একটা অস্থির সময়ে তাঁদের পক্ষে পয়গম্বরের উত্তরাধিকারী ইমামদের এভাবে মুক্ত থাকতে দেওয়া সম্ভব নয়। ৮৪৮ সালে খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল দশম ইমাম আলি আল-হাদিকে মদিনা থেকে সামারায় তলব করেন। এখানে তাঁকে গৃহবন্দি করা হয়। তিনি ও তাঁর ছেলে একাদশ ইমাম হাসান আল- আশারি শিয়াদের সাথে কেবল প্রতিনিধি (ওয়াকিল)-র মারফত যোগাযোগ রাখতে পারছিলেন। বাগদাদের বাণিজ্য এলাকা আল-কার্খ-এ থেকে আব্বাসিয় কর্তৃপক্ষের মনোযোগ এড়াতে ব্যবসা করত তারা।

৮৭৪ সালে একাদশ ইমাম পরলোকগমন করেন, সম্ভবত খলিফার ইঙ্গিতে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল তাঁকে। তাঁকে এমন ভীষণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রাখা হয়েছিল যে শিয়ারা তাঁর সম্পর্কে তেমন কিছুই জানত না। তাঁর কি কোনও ছেলে ছিল? যদি না থাকে তো কে তাঁর উত্তরাধিকারী হবে? তাঁর বংশধারা কি শেষ হয়ে গেছে? যদি তাই হয়, তার মানে কি তবে শিয়ারা অতিন্দ্রীয় নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছে? প্রবল হয়ে উঠেছিল আঁচঅনুমান, তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় মতবাদ জোরের সাথে জানাল যে, হাসান আল-আশারির সত্যিই একজন ছেলে ছিল, আবু আল কাসিম মুহাম্মদ, দ্বাদশ ইমাম; জীবন বাঁচাতে আত্মগোপন করেছেন তিনি। আকর্ষণীয় সমাধান ছিল এটা, কারণ এখানে বোঝানো হয়েছে যে কিছুই বদলায়নি। শেষ দুজন ইমাম কার্যত অগম্য ছিলেন। এখন গোপন ইমাম তাঁর ওয়াকিল উসমান আল-আমরির মারফত জনগণের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে পারবেন। এই ওয়াকিল আধ্যাত্মিক পরামর্শ দিতে পারবেন, যাকাতের দান সংগ্রহ করবেন, ঐশীগ্রন্থ ব্যাখ্যা করবেন ও আইনি সিদ্ধান্ত দেবেন। কিন্তু এই সমাধানের আয়ু ছিল সীমিত। দ্বাদশ ইমামের জীবিত থাকার সময়সীমা পার হয়ে যাওয়ামাত্র শিয়ারা আবার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে শুরু করল। তারপর ৯৩৪ সালে বর্তমান প্রতিনিধি আলি ইবন মুহাম্মদ আস-সামাররি গোপন ইমামের কাছ থেকে শিয়াদের জন্যে এক বার্তা নিয়ে এলেন। তিনি পরলোকগমন করেননি। বরং আল্লাহ অলৌকিকভাবে তাঁকে আড়াল করেছেন; শেষ বিচারের আগে আগে ন্যায়বিচারের যুগের সুচনা ঘটাতে আবার ফিরে আসবেন তিনি। এখনও তিনি শিয়াদের ভুলের অতীত নির্দেশক ও উম্মাহর একমাত্র বৈধ শাসক রয়েছেন। কিন্তু বিশ্বাসীদের সাথে তিনি আর প্রতিনিধি মারফত প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বজায় রাখতে পারবেন না। শিয়াদের তাঁর দ্রুত প্রত্যাবর্তন আশা করা ঠিক হবে না। তারা তাঁকে কেবল ‘দীর্ঘ সময় পার হয়ে যাবার পর ও পৃথিবী স্বৈরাচারে পরিপূর্ণ হলেই আবার দেখতে পাবে।’৩১

গোপন ইমামের ‘অকাল্টেশনে’র মিথ যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না। কেবল অতীন্দ্রিয়বাদ ও আচরিক অনুশীলনের প্রেক্ষাপটেই এটা অর্থ প্রকাশ করে। আমরা যদি গল্পটি লোগোস হিসাবে বুঝে থাকি, বাস্তব ঘটনার মামুলি বিবরণ হিসাবে যদি আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, সবরকম প্রশ্ন উঠে আসে। ইমাম গেছেন কোথায়? তিনি পৃথিবীতেই আছেন নাকি কোনও ধরনের মধ্যবর্তী বলয়ে? সেখানে তাঁর জীবন কেমন হতে পারে? তিনি কি ক্রমেই বুড়িয়ে যাচ্ছেন? বিশ্বাসীরা তাঁকে দেখতে বা তাঁর কথা শুনতে না পেলে কেমন করে তিনি তাদের পথ দেখাবেন? যুক্তিকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে মনের অধিকতর স্বজ্ঞামূলক শক্তির উপর নির্ভরশীল বাতিন বা ঐশীগ্রন্থের গোপন অর্থের সুশৃঙ্খল অনুশীলনে সংশ্লিষ্ট এমন কোনও শিয়ার কাছে এইসব প্রশ্ন ভোঁতা মনে হবে। শিয়ারা তাদের ঐশীগ্রন্থ ও মতবাদ আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করেনি। তাদের সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিকতা অদৃশ্যের (আল-গায়েব) প্রতীকী অনুসন্ধানে পরিণত হয়েছিল যা বাইরের যাহির)  ঘটনাপ্রবাহের আড়ালে থাকে। শিয়ারা এক অদৃশ্য, দুর্বোধ্য আল্লাহর উপাসনা করে থাকে, কোরানের গুপ্ত অর্থের সন্ধান করে, এক গোপন ইমামের আকাঙ্ক্ষায় ছিল তারা, ন্যায় বিচারের জন্যে অন্তহীন কিন্তু অদৃশ্য লড়াইতে অংশ নিয়েছে এবং ইসলামের এক নিগূঢ় ভাষ্য চর্চ্চা করেছে যাকে পার্থিব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হয়েছে।২ এই ব্যাপক ধ্যানমুখী জীবনই ছিল অকাল্টেশনের মানে তুলে ধরা পটভূমি। গোপন ইমাম মিথে পরিণত হয়েছিলেন, স্বাভাবিক ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাঁকে সময় ও কালের সীমা থেকে মুক্ত করা হয়েছে; প্যারাডক্সিকালি তিনি ও অন্যান্য ইমাম মদিনা বা সামারায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করার সময় যতখানি ছিলেন তারচেয়ে ঢের বেশি উজ্জ্বল সত্তায় পরিণত হয়েছিলেন। অকাল্টেশন এমন এক মিথ যা আমাদের পবিত্রের বোধকে অধরা ও হতবুদ্ধিকরভাবে অনুপস্থিত রূপে তুলে ধরে। জগতে উপস্থিত থাকলেও এটা এর অংশ নয়; স্বর্গীয় প্রজ্ঞা মানুষ থেকে অবিচ্ছেদ্য (কারণ মানবীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা কেবল ঈশ্বরসহ কোনও কিছু সম্পর্কে ধারণা করতে পারি), কিন্তু আমাদের তা সাধারণ নারী-পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির উর্ধ্বে নিয়ে যায়। অন্য যেকোনও মিথের মতো অগোছাল যুক্তি দিয়ে অকাল্টেশন বোঝা যাবে না, যেন বা তা স্বয়ংপ্রকাশিত সত্যি বা যৌক্তিক প্রদর্শনীর উপযুক্ত। বরং তা মানুষের ধর্মীয় অভিজ্ঞতায় একটি মিথকে তুলে ধরে।

যেকোনও নিগূঢ় আধ্যাত্মিকতার মতো শিয়া মতবাদ এই পর্যায় পর্যন্ত কেবল অভিজাত গোষ্ঠীর ব্যাপার ছিল। অতীন্দ্রিয় ধ্যনের মেধা ও চাহিদা সম্পন্ন অধিকতর বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দুঃসাহসী মুসলিমরাই এতে আকৃষ্ট হচ্ছিল বেশি। কিন্তু শিয়াদের অন্য মুসলিমদের চেয়ে ভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। সুন্নি ইসলামের আচার ও অনুশীলন যেখানে সুন্নি মুসলিমদের জীবন যেমন সেভাবেই মেনে নিয়ে আদর্শ জগতের রীতিনীতি মোতাবেক চলতে সাহায্য করেছে সেখানে শিয়া অতীন্দ্রিয়বাদ স্বর্গীয় অসন্তোষ তুলে ধরেছে। অকাল্টেশনের মতবাদ প্রচারিত হওয়ার অল্প পরেই বিকাশ লাভ করা প্রথম দিকের ট্র্যাডিশনসমূহ দশম শতাব্দীতে বহু শিয়ার অনুভূত হতাশা ও অক্ষমতা তুলে ধরেছে। একে বলা হত “শিয়া শতাব্দী’, কারণ ইসলামি সাম্রাজ্যের বহু অধিনায়ক যারা কোনও এক বিশেষ এলাকায় কার্যকর ক্ষমতা ভোগ করতেন তাদের প্রায় সবারই শিয়া মতবাদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। কিন্তু সেকারণে কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। কোরানের পরিষ্কার শিক্ষা সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে জীবন তখনও ছিল অন্যায় ও সমতাহীন। প্রকৃতপক্ষেই, সকল ইমামই শিয়াদের চোখে দুর্নীতিগ্রস্ত ও অবৈধ শাসকগোষ্ঠীর হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। ট্র্যাডিশন আছে যে, উমাঈয়া ও আব্বাসিয় খলিফারা হুসেইনের পরের প্রত্যেক ইমামকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছেন। আরও ন্যায়বিচার ভিত্তিক ও উদার সামাজিক ব্যবস্থার পক্ষে তাদের আকাঙ্ক্ষা থেকে শিয়ারা শেষ যুগে গোপন ইমামের চূড়ান্ত আবির্ভাব (যুহুর)-এর উপর ভিত্তি করে পরকালতত্ত্বের বিকাশ ঘটায়, যখন তিনি ফিরে এসে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করবেন ও চূড়ান্ত বিচারের আগে ন্যায়বিচার ও শান্তির এক সোনালি যুগের প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু সমাপ্তির জন্যে এই আকাঙ্ক্ষার মানে শিয়ারা রক্ষণশীল রীতি ত্যাগ করে ভবিষ্যৎমুখী হয়ে গেছে, এমন ছিল না। তারা আদি আদর্শ জগতের প্রতি এত প্রবলভাবে সজাগ ছিল, পরিস্থিতির যেমনটা হওয়া উচিত ছিল, তাদের চোখে সাধারণ রাজনৈতিক জীবন অসহনীয় ঠেকেছে। গোপন ইমাম এই বিশ্বে নতুন কিছু নিয়ে আসবেন না, তিনি স্রেফ মানুষের ইতিহাসকে পরিশুদ্ধ করবেন যাতে মানুষের কর্মকাণ্ড অস্তিত্বের মৌলিক নীতিমালার অনুগামী হয়। একইভাবে ইমামদের ‘আবির্ভাব’ গভীরতর অর্থে সব সময় অস্তিত্ব ছিল এমন কিছুকে প্রকাশ করবে মাত্র, কারণ গোপন ইমাম শিয়ার জীবনে এক ধ্রুব অস্তিত্ব, তিনি আল্লাহর অধরা আলোকে এক অন্ধকার স্বৈরাচারী পৃথিবীতে তুলে ধরেন এবং তিনিই আশার একমাত্র উৎস।

ষষ্ঠ ইমাম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিসর্জন দিয়ে ধর্মকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার পর সূচিত অকাল্টেশন শিয়া ইতিহাসের পুরাণে রূপান্তরের কাজটি শেষ করেছিল। মিথ বাস্তবভিত্তিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পক্ষে কোনও নীল নকশার যোগান দেয় না, বরং বিশ্বাসীকে তার সমাজের দিকে চোখ ফেরাতে ও অন্তস্থঃ জীবনকে বিকাশ করতে শেখায়। অকাল্টেশনের মিথ শিয়াদের চিরকালের মতো বিরাজনীতি করে দিয়েছিল। জাগতিক শাসকদের শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অর্থহীন ঝুঁকি নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই শিয়াদের। যাকে আত্মগোপনে যেতে হয়, চলমান বিশ্বে বাস করতে অক্ষম ন্যায়বিচারক একজন ইমামের ইমেজ শিয়াদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতাই তুলে ধরে। যুগের প্রকৃত প্রভু গোপন ইমামের কর্তৃত্বকে ছিনিয়ে নিয়েছে বলে এই নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে যেকোনও সরকারকেই অবৈধ বিবেচনা করতে হয়েছে। সুতরাং, পার্থিব শাসকদের কাছ থেকে কিছুই আশা করার ছিল না, যদিও বেঁচে থাকার স্বার্থে শিয়াদের অবশ্যই ক্ষমতাসীনদের সাথে সহযোগিতা করতে হবে। আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করবে তারা, কেবল ‘দীর্ঘ সময় শেষে’ শেষ যুগেই পৃথিবীতে আসন্ন এক ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা করবে। তারা কেবল ইমামদের সাবেক ‘প্রতিনিধি’দের স্থান গ্রহণকারী শিয়া উলেমাদের একক কর্তৃত্বই মেনে নেবে। শিক্ষা, আধ্যাত্মিকতা ও স্বর্গীয় আইনে দক্ষতার কারণে উলেমাগণ গোপন ইমামের সহকারীতে পরিণত হয়েছিলেন এবং তাঁর নামে বক্তব্য রাখতেন। কিন্তু সকল সরকারই অবৈধ থাকায় উলেমাদের অবশ্যই রাজনৈতিক পদ গ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল।৩৪

এভাবে শিয়ারা নীরবে রাজনীতির পূর্ণাঙ্গ সেক্যুলারাজেইশন সমর্থন দিয়েছিল যাকে তাওহিদের গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি নীতির লঙ্ঘন মনে হতে পারে, যেখানে রাষ্ট্র ও ধর্মের এজাতীয় বিচ্ছিন্নতাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এক ধর্মীয় দর্শন থেকে এই বিচ্ছিন্নতার মিথলজির উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সকলেই গুপ্তহত্যার শিকার, কারাবন্দি, দেশান্তরী এবং সবশেষে খলিফাদের হাতে নিশ্চিহ্ন হয়েছেন এমন ইমামদের কিংবদন্তী রাজনীতি ও ধর্মের মৌল সমন্বয়হীনতা তুলে ধরে। রাজনৈতিক জীবন লোগোসের এখতিয়ার, একে অবশ্যই ভবিষ্যৎমুখী, বাস্তবভিত্তিক হতে হবে, একে আপোস করতে জানতে হবে, পরিকল্পনা করতে হবে, যৌক্তিক ভিত্তিতে সমাজকে সংগঠিত করতে হবে। একে ধর্মের চরম চাহিদা ও জমিনে জীবনের গম্ভীর বাস্তবতার ভেতর ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। প্রাক আধুনিক কৃষিভিত্তিক সমাজ একটি মৌলিক বৈষম্যের উপর ভিত্তি করে গঠিত ছিল, এটা কৃষকদের শ্রমের উপর নির্ভর করত যারা সভ্যতার ফল ভোগ করতে পারত না। অ্যাক্সিয়াল যুগের (c. ৭০০-২০০ বিসিই) মহান কনফেশনাল ধর্মগুলোর সবকটাই এই টানাপোড়েনে ব্যস্ত ছিল, একে সামাল দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছে। সম্পদের পরিমাণ যেখানে অপ্রতুল আর যেখানে প্রযুক্তি ও যোগাযোগের অভাব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা কঠিন করে তোলে, সেখানে রাজনীতি অনেক বেশি নিষ্ঠুর ও আগ্রাসীভাবে বাস্তবভিত্তিক হয়ে ওঠে। সুতরাং, যেকোনও সরকারের পক্ষে ইসলামি আদর্শ অনুযায়ী সরকার পরিচালনা বা এর ঘাটতিসমূহ দুঃখজনকভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া স্বর্গীয় প্রজ্ঞার মূর্ত প্রতীক ইমামদের অস্তিত্ব সহ্য করা ছিল অসম্ভব। ধর্মীয় নেতারা যাচ্ছেতাই অপচয়ের বিরুদ্ধে নিন্দা, সমালোচনা বা প্রতিবাদ জানাতে পারতেন, কিন্তু এক ধরনের করুণ অর্থে পবিত্রকে হয় প্রান্তিকায়িত বা সীমার ভেতর রাখতে হয়েছে, যেমন করে খলিফাগণ সামারার আসকারী দুর্গে ইমামদের আটক করে রেখেছিলেন। কিন্তু এক আদর্শের প্রতি শিয়া ভক্তিতে মাহাত্ম্য ছিল যাকে অবশ্যই টিকিয়ে রাখার দরকার ছিল, যদিও গোপন ইমামের মতো সেটা ছিল সুপ্ত এবং বর্তমানে স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত বিশ্বে কাজ করতে অক্ষম।

শিয়া মতবাদ পৌরাণিক ধর্মবিশ্বাসে পরিণত হলেও তার মানে তা অযৌক্তিক ছিল না। আসলে শিয়াবাদ সুন্নাহর চেয়ে ইসলামের অধিকতর যৌক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভাষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শিয়ারা আবিষ্কার করেছিল যে, তারা মুতাযিলি নামে পরিচিত সুন্নি ধর্মতাত্ত্বিকদের সাথে সহমত পোষণ করে। কোরানের বিভিন্ন মতবাদকে যৌক্তিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল এরা। অন্যদিকে মুতাযিলিরাও শিয়া মতবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। প্যারাডক্সিকালি অকাল্টেশনের অযৌক্তিক মতবাদ শিয়া উলেমাদের সুন্নি উলেমাদের চেয়ে কর্মকাণ্ডের বাস্তব জগতে তাদের অনেক বেশি ক্ষমতা প্রয়োগের স্বাধীনতা দিয়েছিল। গোপন ইমাম আর নাগালের মধ্যে না থাকায় বৃদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার উপর নির্ভর করতে হত তাদের। সুতরাং, শিয়া মতবাদে সুন্নাহর মতো ‘ইজতিহাদের দুয়ার’ কোনওদিনই রুদ্ধ হয়নি।৩৫ এটা ঠিক, শিয়ারা প্রথমে ইমাম অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় মানসিকভাবে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দী নাগাদ একজন বিশিষ্ট ও জ্ঞানী শিয়া যাজক ঠিক মুজতাহিদ হিসাবেই পরিচিত ছিলেন, ইজতিহাদের যৌক্তিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষমতাশালী বলে মনে করা হত তাঁকে।

অবশ্য শিয়া যুক্তিবাদ আমাদের বর্তমান পাশ্চাত্যের সেক্যুলারাইজড যুক্তিবাদ হতে ভিন্ন ছিল। শিয়ারা প্রায়শঃই সমালোচনামুলক চিন্তাবিদ ছিল। উদাহরণ স্বরূপ, একাদশ শতাব্দীর পণ্ডিত মুহাম্মদ আল-মুইদ ও মুহাম্মদ আল-তুসি পয়গম্বর ও তাঁর কয়েকজন সহচরের হাদিস প্রতিবেদনের সঠিকতা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাঁরা মনে করেছিলেন, তাঁদের মতবাদের সমর্থনে এইসব অবিশ্বস্ত ট্র্যাডিশন উদ্ধৃত করা যথেষ্ট হবে না, বরং তার বদলে যাজকদের উচিত হবে যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করা; কিন্তু তারপরেও তাঁদের তুলে ধরা যৌক্তিক বক্তব্য আধুনিক সংশয়বাদীকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না। উদাহরণ স্বরূপ, তুসি ইমামতের মতবাদ ‘প্রমাণ’ করতে গিয়ে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, যেহেতু আল্লাহ শুভ ও তিনি আমাদের মুক্তি চান, তো এটা বিশ্বাস করাই যুক্তিসঙ্গত যে তিনিই আমাদের অনির্বচনীয় পথ-নির্দেশ যোগাবেন। নারী-পুরুষ সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রয়োজনীয়তা আবিষ্কার করতে পারে, কিন্তু স্বর্গীয় বিধি এই বিষয়টিকে আরও জরুরি করে তোলে। এমনকি তুসিও অকাল্টেশনের পক্ষে যুক্তি খুঁজতে গিয়ে দিশাহারা বোধ করেছেন।৩৬ কিন্তু শিয়াদের কাছে এটা অস্বস্তিকর ছিল না। মিথোস ও লোগোস, যুক্তি ও প্রত্যাদেশ, পরস্পর বিরোধী ছিল না, বরং স্রেফ একটি অপরটি থেকে ভিন্ন এবং সম্পূরক। আধুনিক পশ্চিমে আমরা যেখানে সত্যির উৎস হিসাবে মিথোলজি ও অতীন্দ্রিয়বাদকে নাকচ করে কেবল যুক্তির উপর নির্ভর করে থাকি; তুসির মতো একজন চিন্তাবিদ চিন্তার উভয় পথকেই বৈধ ও প্রয়োজনীয় হিসাবে দেখেছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে, অতীন্দ্রিয় ধ্যানে মগ্ন থাকার সময় নিখুঁত অর্থ প্রকাশকারী মতবাদসমূহ ইসলামি প্রেক্ষিতেও যুক্তিসঙ্গত। ধ্যানের অন্তর্মুখী কৌশলসমূহ এমন অন্তর্দৃষ্টির যোগান দেয় যেগুলো তাদের নিজস্ব বলয়ে সঠিক, কিন্তু সেগুলোকে লোগোসের সৃষ্টি কোনও গাণিতিক সমীকরণের মতো যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রমাণ করা যাবে না।

পঞ্চদশ শতকের শেষ নাগাদ, আমরা যেমন দেখেছি, বেশিরভাগ শিয়াই আরব ছিল এবং শিয়াবাদ বিশেষত ইরাকে দুটি উপাসনালয়ের শহর যথাক্রমে ইমাম আলি ও ইমাম হুসেইনের প্রতি নিবেদিত নাজাফ ও কারবালায় শক্তিশালী ছিল। বেশিরভাগ ইরানিই ছিল সুন্নি, যদিও ইরানি শহর কুম সব সময়ই শিয়াদের কেন্দ্র ছিল। রাঈ, কাশা ও খোরাশানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিয়ার বাস ছিল। তো সুফিবাদের সাফাভিয় ধরনের নেতা উনিশ বছর বয়স্ক শাহ ইসমাইলকে স্বাগত জানানোর মতো ইরানি ছিল। ১৫০১ সালে তাব্রিয দখল করেন তিনি ও পরের এক দশকের মধ্যেই ইরানের বাকি অংশ অধিকার করে নেন। তিনি ঘোষণা করেন, শিয়া মতবাদই নতুন সাফাভিয় সাম্রাজ্যের রাষ্ট্র ধর্ম হবে। নিজেকে সপ্তম ইমামের বংশধর দাবি করেছিলেন ইসমাইল, যা তাঁকে অন্য মুসলিম শাসকদের যা ছিল না সেই বৈধতা দিয়েছে বলে বিশ্বাস করতেন। ৩৭

কিন্তু এটা নিশ্চিতভাবেই শিয়া ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুতি ছিল। ‘দ্বাদশবাদী’ (দ্বাদশ ইমামের প্রতি তাদের শ্রদ্ধার কারণে) অধিকাংশ শিয়া বিশ্বাস করত যে, গোপন ইমামের অনুপস্থিতিতে কোনও সরকারই বৈধ হতে পারে না।৩৮ তাহলে কেমন করে ‘রাষ্ট্রীয় শিয়াবাদ’ থাকতে পারে? এতে অবশ্য ইসমাইলের কোনও সমস্যা হয়নি। দ্বাদশবাদী অর্থডক্সি সম্পর্কে তেমন কিছু জানা ছিল না তাঁর। মঙ্গোল আগ্রাসনের অব্যবহতি পরে প্রতিষ্ঠিত অতীন্দ্রিয় ভ্রাতৃসংঘ সাফাভিয় গোষ্ঠী মূলত সুফি সংস্থা ছিল কিন্তু প্রাচীন শিয়া মতবাদের বহু ‘চরম’ (গুলুউ) ধারণা গ্রহণ করেছিল। ইসমাইল বিশ্বাস করতেন যে, ইমাম আলি স্বর্গীয় ছিলেন, এবং স্বর্ণযুগের উদ্বোধন ঘটাতে অচিরেই ফিরে আসবেন শিয়া মেসায়াহ। তিনি হয়তো শিষ্যদের এও বলে থাকতে পারেন যে, তিনিই সেই গোপন ইমাম, অড়াল ছেড়ে বের হয়ে এসেছেন। সাফাভিয় ব্যবস্থা ছিল প্রান্তিক, জনপ্রিয়তামুখী বিপ্লবী দল, শিয়া বিশেষ নিগূঢ় ধারা থেকে অনেক ভিন্ন।৩৯ শিয়া রষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইসমাইলের কোনও রকম দ্বিধা ছিল না, জাফর আস-সাদিকের আমল থেকেই শিয়ারা যেমন করে আসছিল, সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠের সাথে একটা সভ্য মোদাস ভিভেন্দি’র খোঁজ করার বদলে ধর্মান্ধভাবে সুন্নি বিরোধী ছিলেন তিনি। অটোমান ও সাফাভিয় সাম্রাজ্যে এক নতুন উপদলীয় অসহিষ্ণুতা দেখা দিয়েছিল; একই সময়ে ইউরোপে প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকদের ভেতর দেখা দেওয়া বিবাদের চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন ছিল না সেটা। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অটোমানরা তাদের এলাকায় শিয়াদের প্রান্তিকায়িত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। ইসমাইল যখন ইরানে আবির্ভূত হন, তিনিও সমানভাবে সেখানকার সুন্নাহকে নিশ্চিহ্ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠেন।

অবশ্য সাফাভিয়দের এটা আবিষ্কার করতে বেশি সময় লাগেনি যে, বিরোধী অবস্থানে থাকার সময় মেসিয়ানিক ‘চরমপন্থী’ আদর্শ কাজে এলেও এখন ক্ষমতায় আসার পর সেটা জুৎসই ঠেকছে না। প্রাচীন গুলুউ ধর্মতত্ত্ব মুছে ফেলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শাহ প্রথম আব্বাস (১৫৮৮-১৬২০) আমলাতন্ত্র থেকে চরমপন্থীদের বরখাস্ত করেন। দ্বাদশবাদী অর্থডক্সি প্রচারের জন্যে আরব থেকে শিয়া উলেমাদের আমদানি করেন তিনি। নতুন রাজধানী ইস্পাহান ও হিল্লায় তাঁদের জন্যে মাদ্রাসা নির্মাণ করেন, তাঁদের পক্ষে সম্পত্তি অর্পণ করেন (ওয়াকফ) ও উদার হাতে তাঁদের উপহার দেন। গোড়ার দিকে এই পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন ছিল, কারণ নতুন অভিবাসী হিসাবে উলেমারা শাহর উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু অনিবার্যভাবে শিয়া মতবাদের প্রকৃতি পাল্টে দিয়েছিলেন। শিয়ারা সব সময়ই সংখ্যালঘু দল ছিল। তাদের নিজস্ব মাদ্রাসা ছিল না, সব সময়ই একে অন্যের বাড়িতে পড়াশোনা করেছেন, বিতর্ক করেছেন। এখন শিয়ারা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছিল। ইস্পাহান শিয়া মতবাদের সরকারী বিদ্যাপীঠে পরিণত হয়।৪১ শিয়ারা সব সময়ই এর আগে সরকার থেকে দূরে অবস্থান করেছে, কিন্তু এখন উলেমাগণ ইরানের শিক্ষা ও আইনি ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ এবং আরও নির্দিষ্টভাবে সরকারের ধর্মীয় দায়িত্বও হাতে তুলে নিয়েছিলেন। প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র ছিল ইরানিদের সমন্বয়ে গঠিত, তখনও সুন্নাহর প্রতি অনুগত ছিল তারা, সুতরাং, তাদের আরও বেশি সেক্যুলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইরানি সরকারে সেক্যুলার ও ধর্মীয় বলয়ে একটা চলমান বিভাজন দেখা দিয়েছিল।৪২

উলেমগণ অবশ্য সাফাভিয় রাষ্ট্র সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন। তখনও তাঁরা সরকারী পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিলেন, নিজেদের প্রজা হিসাবে দেখতেই পছন্দ করতেন। সুতরাং, তাদের অবস্থান ছিল অটোমান উলেমাদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন, কিন্তু সহজাতভাবে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী। শাহদের উদারতা ও পৃষ্ঠপোষকতা উলেমাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন করে দিয়েছিল। অটোমান ও তাদের উত্তরাধিকারীরা যেখানে সব সময়ই ভর্তুকী প্রত্যাহার বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার হুমকি দিয়ে উলেমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারত, সেখানে শিয়া উলেমাদের এভাবে ভয় দেখানোর উপায় ছিল না। ইরানি জনগণের মাঝে শিয়া মতবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে তাঁরা এই বাস্তবতা থেকে লাভবান হচ্ছিলেন যে শাহগণ নন, বরং তাঁরাই গোপন ইমামের একমাত্র প্রকৃত মুখপাত্র। অবশ্য গোড়ার দিকের সাফাভিয়রা উলেমাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম ছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইরানের জনগণ পুরোপুরি শিয়া মতবাদে দীক্ষিত হওয়ার আগে যাজকগোষ্ঠী সম্পূর্ণ নিজেদের মতো হয়ে উঠতে পারেনি।

কিন্তু ক্ষমতা দুর্নীতিগ্রস্ত করে। উলেমাগণ সাফাভিয় সাম্রাজ্যে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার সাথে সাথে অনেক বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ ও এমনকি গোঁড়া হয়ে উঠতে লাগলেন। শিয়া মতবাদের কিছু অধিকতর আকর্ষণীয় গুণাবলী চাপা পড়ে যায়। এই নতুন কঠোর পন্থা মূর্ত করে তোলেন সর্বকালের অন্যতম ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী উলেমা মুহাম্মদ বাকির মজলিসি (মৃ. ১৭০০)। শত শত বছর ধরে শিয়ারা ঐশীগ্রন্থের এক ধরনের উদ্ভাবনী প্রকৃতির কৌশল অনুসরণ করে এসেছে। কিন্তু অতীন্দ্রিয় ও দার্শনিক আঁচঅনুমানের প্রবল বিরোধী ছিলেন মজলিসি। দুটোই ছিল প্রাচীন নিগূঢ়বাদী শিয়া মতবাদের মূলধারা। তিনি ইরানে অবশিষ্ট সুফিদের উপর নিরলসভাবে নির্যাতনের সূচনা করেন ও ফালসাফাহ নামে পরিচিত দার্শনিক যুক্তিবাদ ও ইস্ফাহানে অতীন্দ্রিয় দর্শন দমন করার প্রয়াস পান। এভাবে অতীন্দ্রিয়বাদ ও দর্শনের প্রতি এক গভীর অবিশ্বাসের সূচনা করেছিলেন তিনি এখনও যা বর্তমান ইরানে টিকে আছে। কোরানের নিগূঢ় পাঠে মগ্ন হওয়ার বদলে শিয়া পণ্ডিতদের ইসলামি জুরিসপ্রুডেন্স ফিকহর প্রতি মনোনিবেশে উৎসাহিত করা হয়েছে।

হুসেইনের সম্মানে আয়োজিত আচরিক মিছিলের অর্থও পাল্টে দিয়েছিলেন মজলিসি।” আরও বিস্তৃত হয়ে উঠেছিল এসব: এখন সবুজ কাপড়ে ঢাকা উটের পিঠে ইমামের পরিবারের প্রতিনিধি হিসাবে ক্রন্দনরত নারী ও শিশুরা বসে থাকে, সৈনিকরা আকাশের দিকে ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে, গভর্নর, গণ্যমান্য লোকজন ও মানুষের জটলা ইমাম ও তাঁর শাহাদৎ বরণকারী সহচরদের প্রতীক কফিন অনুসরণ করে, এরা ছুরি দিয়ে নিজেদের আঘাত হেনে আহত করে।৫ কারবালা কাহিনীর দারুণ আবেগঘন বর্ণনা-রাওদা-খানি (‘রাওদাতের আবৃত্তি’) নামে পরিচিত বিশেষ অনুষ্ঠানে ইরাকি শিয়া ওয়াইজ কাশিফট (মৃ. ১৫০৪) রচিত রাওদাহ আশ-শাহাদা রাওদা-খানি জমায়েতে আবৃত্তি করা হত, জনতা জোরে চিৎকার করে বিলাপ করত, কাঁদত। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জীবন দিয়ে লড়াই করার জনগণের ইচ্ছা তুলে ধরায় এইসব আচারের সবসময়ই এক ধরনের বিপ্লবী সম্ভাবনা ছিল। এখন অবশ্য, জনগণকে হুসেইনকে একটা নজীর হিসাবে দেখার জন্যে উৎসাহিত করার পরিবর্তে মজলিসি ও তাঁর যাজকগোষ্ঠী শিক্ষা দিতে লাগলেন যেন তাঁকে একজন পৃষ্ঠপোষক হিসাবে বিবেচনা করা হয় যিনি তাঁর মৃত্যুর জন্যে শোক প্রকাশ করার মাধ্যমে ভক্তি দেখাতে পারলে তাদের বেহেশতে গমন নিশ্চিত করতে পারবেন। এবার স্থিতাবস্থার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে আচার অনুষ্ঠানগুলো জনগণকে শক্তিমানের পক্ষে আনুকূল্য দেখিয়ে কেবল নিজেদের স্বার্থের প্রতি খেয়াল রাখার শিক্ষা দিয়েছে। ৬ এটা ছিল পুরোনো শিয়া আদর্শের নপুংসকীকরণ ও অবমূল্যায়ন; এটা রক্ষণশীল রীতিনীতিকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। জনগণকে অস্তিত্বের মৌল বিধিবিধান ও ছন্দের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করার বদলে কাল্টকে কেবল বিপুল জনগোষ্ঠীকে সামাল দিয়ে রাখার কাজে লাগানো হয়েছে। এটা এমন এক পরিবর্তন ছিল যা সম্পূর্ণ ভিন্ন উপায়ে দেখায় যে, বিধ্বংসী রাজনৈতিক ক্ষমতা ধর্মের কী ক্ষতি করতে পারে।

মজলিসির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল ইস্ফাহানে মির দামাদ (মৃ. ১৬৩১) ও শিষ্য মোল্লাহ সম্রা (মৃ. ১৬৪০) হাতে বিকশিত অতীন্দ্রিয় দর্শন। সদ্রা এমন একজন চিন্তাবিদ ছিলেন ভবিষ্যৎ ইরানি প্রজন্মের উপর যার গভীর প্রভাব সৃষ্টি হবে।৪৭ মির দামাদ ও মোল্লাহ সদ্রা উলেমাদের কারও কারও নতুন অনমনীয় মনোভাবের দারুণ বিরোধী ছিলেন। একে তাঁরা শিয়া মতবাদ, এমনকি প্রকৃতপক্ষে সকল ধর্মের সামগ্রিক বিকৃতি বলে বিবেচনা করেছেন। প্রাচীন কালে শিয়ারা ঐশীগ্রন্থের গোপন অর্থ সন্ধানের সময় নীরবে মেনে নিয়েছিল যে স্বর্গীয় সত্যি সীমানাহীন, নতুন নতুন ধারণা সব সময়ই সম্ভব; কোরানের কোনও একক ব্যাখ্যা যথেষ্ট হতে পারে না। মির দামাদ ও মোল্লা সদ্রার চোখে সত্যিকারের জ্ঞান কোনওদিনই বুদ্ধিবৃত্তিক সমরূপতার ব্যাপার ছিল না। কোনও সাধু বা ধর্মীয় কর্তৃপক্ষই, তিনি যত মহান বা বিশিষ্টই হোন না কেন, সত্যির উপর একচেটিয়া অধিকার দাবি করতে পারেন না।

তাঁরা স্পষ্টভাবে রক্ষণশীল বিশ্বাস প্রকাশ করেছেন যে মিথোলজি ও যুক্তি উভয়ই মানব জীবনের পক্ষে আবশ্যক, একটি দিয়ে সম্পূরক না হলে অপরটি হারিয়ে যায়। মির দামাদ ছিলেন স্বভাব বিজ্ঞানী এবং ধর্মতাত্ত্বিকও। মোল্লা সদ্রা উলেমাদের পৌরাণিক স্বজ্ঞার দর্শনকে খাট করার জন্যে ও যৌক্তিক চিন্তার গুরুত্বকে বিসর্জন দিতে সুফিদের সমালোচনা করেছেন। প্রকৃত দার্শনিককে অ্যারিস্টটলের মতো যুক্তিবাদী হতে হবে, কিন্তু তারপরই তাঁকে নিজেকে অতিক্রম করে সত্যের এক নিগূঢ় কল্পনা নির্ভর উপলব্ধিতে পৌঁছুতে হবে। উভয় চিন্তকই অবচেতনের ভূমিকার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন, একে তাঁরা এমন এক পর্যায় হিসাবে বর্ণনা করেছেন যা ইন্দ্রিয়জ ধারণা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিমূর্ততায় অস্তিত্ববান। অতীতে সুফি দার্শনিকগণ এই মনস্তাত্ত্বিক অঞ্চলকে আলম আল-মিথাল বা খাঁটি ইমেজের জগৎ হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন। দিব্যদৃষ্টির বলয় এটা, আমরা যাকে অবচেতন বলব সেখান থেকে আগত, স্বপ্ন ও সম্মোহনী ইমেজারিতে যা মনের চেতন স্তরে উঠে আসে, কিন্তু অতীন্দ্রিয়দের কোনও কোনও অনুশীলন ও স্বজ্ঞামূলক চর্চার মাধ্যমেও যার নাগাল পাওয়া সম্ভব। মির দামাদ ও মোল্লা সদ্রা দুজনই জোর দিয়ে বলেছেন যে, যৌক্তিক বিশ্লেষণে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেলেও এইসব দিব্য দর্শন কেবল ধারণাগত কল্পনা নয়, বরং এসবের সুনির্দিষ্ট বাস্তবতা রয়েছে। এগুলোকে ‘কাল্পনিক’ বলে অবাস্তব হিসাবে বাতিল করার বদলে-একজন আধুনিক যুক্তিবাদী যেমনটা করতে পারে-আমাদের উচিত হবে আমাদের অস্তিত্বের এই পার্থক্যের দিকে নজর দেওয়া। সচেতন নির্মাণের পক্ষে এর অবস্থান অনেক গভীরে, কিন্তু আমাদের আচরণ ও ধারণার উপর এর গভীর প্রভাব রয়েছে। আমাদের স্বপ্ন বাস্তব, এগুলো আমাদের একটা কিছু বলে; স্বপ্নে আমরা কাল্পনিক কিছুর অভিজ্ঞতা লাভ করি। মিথোলজি ছিল অবচেতনের অভিজ্ঞতাকে ইমেজারিতে সংগঠিত করার প্রয়াস, নারী-পুরুষকে যা এইসব মৌলিক অঞ্চলকে তাদের নিজস্ব সত্তার সাথে সম্পর্কিত করতে সফল করে তুলত। বর্তমানে লোকে অবচেতন মনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে একই ধরনের ধারণা পেতে সাইকোঅ্যানালিস্টের শরণাপন্ন হয়ে থাকে। দামাদ ও মোল্লা সদ্রা জোরের সাথে বলেছেন যে, কেবল যৌক্তিকভাবে, প্রকাশ্যে ও আইনসম্মভাবে ধারণা করা কিছুই একমাত্র সত্যি নয়। এর একটা অন্তস্থঃ মাত্রা রয়েছে যা আমাদের স্বাভাবিক চেতন মনের কর্মকাণ্ড দিয়ে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।

এটা অনিবার্যভাবে কোনও কোনও উলেমাকে কট্টরপন্থী শিয়াদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে দিয়েছিল। মোল্লা সদ্রাকে ইস্ফাহান থেকে বিতাড়িত করে তারা। দশ বছর কুমের কাছে এক ছোট গ্রামে বাস করতে বাধ্য হন তিনি। এই নির্জনবাসের সময় বুঝতে পারেন যে, অতীন্দ্রিয় দর্শনের প্রতি ভক্তি সত্ত্বেও ধর্মের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এখনও বড় বেশি বৃদ্ধিবৃত্তিক রয়ে গেছে। জুরিসপ্রুডেন্স (ফিকহ) বা বাহ্যিক ধর্মতত্ত্বের পাঠ কেবল ধর্ম সম্পর্কে আমাদের তথ্য যোগাতে পারে, এটা ধর্মীয় অনুসন্ধানের মূল লক্ষ্য আলোকন বা ব্যক্তিগত পরিবর্তন এনে দিতে পারে না। কেবল মনোসংযোগের অতীন্দ্রিয় অনুশীলন গুরুত্বের সাথে চর্চা শুরু ও আপন সত্তার মাঝে গভীরভাবে আলম আল-মিথালে অবতরণের পরই তাঁর হৃদয়ে ‘আগুন জ্বলে উঠেছিল’ এবং ‘স্বর্গীয় জগতের আলোক আমার সামনে জ্বলে ওঠে…আমি আগে বুঝতে পারিনি এমন সব রহস্য উদ্ধার করতে সক্ষম হয়ে উঠি,’ তাঁর মহৎ সৃষ্টি আল-আসফার আল-আরবা’হ-তে (দ্য ফোর জার্নিজ অভ সোউল) পরে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।

সদ্রার অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা মানুষের পক্ষে এই জগতেই পূর্ণাঙ্গতা লাভ করা সম্ভব বলে নিশ্চিত করেছিল তাঁকে। কিন্তু রক্ষণশীল চেতনার প্রতি বিশ্বস্ত হওয়ায় তিনি যে সম্পূর্ণতার কথা কল্পনা করেছিলেন সেটা নতুন ও উচ্চতর এক পর্যায়ে উত্তরণ নয় বরং আব্রাহাম ও অন্যান্য পয়গম্বরের আদি খাঁটি দর্শনে প্রত্যাবর্তন ছিল। সকল অস্তিত্বের উৎস আল্লাহয়ও প্রত্যাবর্তন ছিল এটা। কিন্তু তাঁর মানে এই ছিল না যে অতীন্দ্রিয়বাদী এই জগৎকে ত্যাগ করেছেন। দ্য ফোর জার্নিজ অভ দ্য সোউল-এ এক ক্যারিশম্যাটিক রাজনৈতিক নেতার অতীন্দ্রিয় অভিযাত্রার বর্ণনা করেছেন তিনি। প্রথমে তাঁকে অবশ্যই মানুষের কাছ থেকে আল্লাহ’র উদ্দেশে যাত্রা করতে হবে। এরপর স্বর্গীয় বলয়ে ভ্রমণ করবেন তিনি যতক্ষণ না আল্লাহ’র বিভিন্ন গুণাবলী নিয়ে ধ্যান করে সেগুলোর অবিচ্ছেদ্য ঐক্যের ব্যাপারে সহজাত চেতনায় পৌঁছেন। এভাবে আল্লাহ’র মুখাবয়বের দিকে চোখ রেখে তিনি বদলে যান ও একশ্বরবাদের আসল অর্থ সম্পর্কে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও ইমামদের অনুভূত বোধের অনুরূপ এক অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেন। তৃতীয় যাত্রায় নেতা আবার মানব জাতির কাছে ফিরে এসে আবিষ্কার করেন যে, এখন তিনি জগৎকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে দেখছেন। তাঁর চতুর্থ ও চূড়ান্ত অন্বেষণ হচ্ছে এই জগতে আল্লাহ’র বাণী প্রচার করা, স্বৰ্গীয় আইন প্রতিষ্ঠার নতুন পথ বের করা ও আল্লাহ’র ইচ্ছা অনুযায়ী সমাজকে নতুন করে নির্মাণ করা।৫° এটা এমন এক দর্শন যা সমাজের পূর্ণতাকে যুগপৎ আধ্যাত্মিক উন্নতির সাথে সম্পর্কিত করে। অতীন্দ্রিয় ও ধর্মীয় গুরুত্ব ছাড়া এই মর্ত্য জগতে ন্যায়বিচার ও সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। ইহজগতে সমাজকে পরিবর্তিত করতে অত্যাবশ্যক যৌক্তিক প্রয়াস একে অর্থ প্রদানকারী পৌরাণিক ও অতীন্দ্রিয় পরিপ্রেক্ষিত হতে অবিচ্ছেদ্য আবিষ্কার করে দ্বাদশবাদী শিয়ামতবাদে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া রাজনীতি ও আধ্যাত্মিকতার সংশ্লেষ ঘটিয়েছে মোল্লা সদ্রার দর্শন। মোল্লাহ সদ্রা এভাবে শিয়া নেতৃত্বের এক নতুন আদর্শের প্রস্তাব রেখেছিলেন আমাদের কালেও ইরানের রাজনীতিতে যার গভীর প্রভাব অব্যাহত থাকবে।

মোল্লা সদ্রার দর্শনের অতীন্দ্রিয় রাজনৈতিক নেতার ঐশী অন্তর্দৃষ্টি থাকতে পারে, কিন্তু তার মানে এই ছিল না যে তিনি শক্তি দিয়ে নিজের মত ও ধর্মীয় অনুশীলন অন্যের উপর চাপিয়ে দেবেন। তেমন কিছু করলে সদ্রার দৃষ্টিতে তিনি ধর্মের সত্যির মুল সত্তাকে অস্বীকার করেছেন। উলেমাদের ক্রমবর্ধমান শক্তির প্রবল বিরোধিতা করেছেন সদ্রা। সপ্তম শতাব্দীতে ইরানে ক্রমশ শেকড় ছড়াতে থাকা এক নতুন ধারণার কারণে বিশেষভাবে অস্বস্তিতে ভুগছিলেন তিনি। কিছু কিছু উলেমা এই সময় বিশ্বাস করেছিলেন যে, উলেমারাই গোপন ইমামদের একমাত্র আনুষ্ঠানিক মুখপাত্র হওয়ায় বেশির ভাগ মুসলিমই নিজে থেকে বিশ্বাসের মৌল বিষয়সমূহ (উসুল) ব্যাখ্যা করতে অক্ষম, সাধারণ জনগণকে তাই এমন একজন মুজতাহিদ নির্বাচন করতে হবে যিনি ইজতিহাদের (‘স্বাধীন যুক্তিপ্রয়োগ’) চর্চা করার ক্ষমতা রাখেন বলে প্রতীয়মান এবং তাঁর আইনি শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই নিজেদের আচরণকে গড়ে তোলা উচিত। উসুলিদের-এই মতবাদের অনুসারীদের এই নামেই ডাকা হত—এইসব দাবি শুনে ভীত হয়ে উঠেছিলেন সদ্রা। ১ তাঁর দৃষ্টিতে এমন দাসত্বমূলক অনুকরণের (তাকলিদ) উপর নির্ভরকারী যেকোনও ধর্ম সহজাতভাবে ‘দূষিত’৷৫২ সকল শিয়াই পয়গম্বর ও ইমামদের ট্র্যাডিশন (আকবার) বোঝার ক্ষমতা রাখে এবং প্রার্থনা ও আচারআচরণের ভেতর দিয়ে প্রাপ্ত আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি ও যুক্তির উপর ভিত্তি করে নিজেরাই সমাধান বের করার উপযুক্ত।

সপ্তদশ শতাব্দী গড়িয়ে যাবার সাথে সাথে উসুলি ও তাদের বিরোধীদের সংঘাত আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সাফাভিয় শক্তির তখন পতন শুরু হয়েছে, সমাজ ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। সাধারণ জনগণ শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের একমাত্র উপযুক্ত শক্তি উলেমাদের মুখাপেক্ষী হয়ে ছিল, কিন্তু আপন ক্ষমতার প্রকৃতি নিয়ে নিজেদের ভেতরই বিরোধে লিপ্ত ছিলেন তাঁরা। এই পর্যায়ে অধিকাংশ ইরানি উসুলিদের বিরোধিতা করেছে, অতীতের ঐতিহ্যের উপর নির্ভরকারী তথাকথিত আকবারিদের অনুসরণ করেছে। আকবারিরা ইজতিহাদের প্রয়োগের নিন্দা জানিয়ে কোরান ও সুন্নাহর সংকীর্ণ আক্ষরিক অর্থের পৃষ্ঠপোষকতা করত। তারা জোর দিয়ে বলেছে যে, সকল আইনি সিদ্ধান্তকে অবশ্যই কোরান, পয়গম্বর বা ইমামদের সুস্পষ্ট বিবৃতি ভিত্তিক হতে হবে। এমন কোনও ঘটনা যদি ঘটে যার বেলায় কোনও স্পষ্ট বিধি নেই, মুসলিম জুরিস্ট অবশ্যই নিজের বিচার বিবেচনার উপর নির্ভর না করে বরং বিষয়টি সেক্যুলার আদালতে পাঠাবেন।৫৩ উসুলিরা অধিকতর নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করতে চেয়েছিল। ইসলামি ট্র্যাডিশনের অনুসৃত নীতিমালার ভিত্তিতে জুরিস্টগণ নিজস্ব যুক্তির ক্ষমতা প্রয়োগ করে বৈধ সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারতেন। তাঁরা ভেবেছিলেন যে আকবারিরা এমনভাবে অতীতে জড়িয়ে পড়বে যে ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স আর নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে না। গোপন ইমামের অনুপস্থিতিতে, যুক্তি দেখিয়েছে তারা, কোনও জুরিস্টই শেষকথা বলতে পারবেন না, আর কোনও পূর্ব নজীরই বাধ্যতামূলক হবে না। প্রকৃতপক্ষেই, তাঁরা এতদূর পর্যন্ত বলেছেন যে, অতীতের সম্মানিত কর্তৃত্বকে অনুসরণ করার বদলে বিশ্বাসীদের সব সময়ই কোনও একজন জীবিত মুজতাহিদের বিধান মেনে চলা উচিত। উভয় পক্ষই সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার একটা সময়ে রক্ষণশীল চেতনায় স্থির থাকার প্রয়াস পাচ্ছিল এবং উভয়ই প্রধানত স্বর্গীয় বাণী নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। আকবারি বা উসুলিদের কেউই বুদ্ধিবৃত্তিক সমরূপতার উপর জোর দেয়নি; এটা ছিল স্রেফ আচরণ বা ধর্মীয় অনুশীলনের ক্ষেত্রে বিশ্বাসীকে কার কাছে নতি স্বীকার করতে হবে, ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক অর্থের কাছে নাকি কোনও মুজতাহিদের কাছে সেই প্রশ্ন। তবু দুই পক্ষই একটা কিছু হারিয়েছিল। আকবারিরা আইনে মূৰ্ত আদিম স্বর্গীয় আজ্ঞাকে অতীতের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের সাথে গুলিয়ে ফেলেছে, পরিণত হয়েছে অক্ষরবাদীতে; আবিশ্যিকভাবে প্রাচীন শিয়া মতবাদের প্রতীকী ধর্মের সাথে তাদের সম্পর্ক হারিয়ে গিয়েছিল। তাদের চোখে বিশ্বাস পরিণত হয়েছিল বাহ্যিক কিছু নির্দেশনার ধারায়। মানুষের যুক্তির উপর অনেক বেশি আস্থা ছিল উসুলিদের, তাদের ধর্মের মিথোসে এখনও তা প্রোথিত আছে। কিন্তু বিশ্বাসীকে তাদের রায় মেনে নিতে হবে বলে জোর দিয়ে তারা মোল্লা সদ্রার ব্যক্তির পবিত্র স্বাধীনতায় বিশ্বাস খুইয়েছিল।

সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে রাষ্ট্রের দুর্বলতা পুষিয়ে দিতে পারবে এমন একটা আইনি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছিল, নেমে আসছিল অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা এবং পরবর্তীকালের শাহদের অযোগ্যতা রাষ্ট্রকে নাজুক করে তুলেছিল। ১৭২২ সালে আফগান গোত্রগুলো ইস্ফাহানে হামলা চালায়, নেহাত অসম্মানের সাথে আত্মসমর্পণ করে শহরটি। এক গোলযোগের যুগে প্রবেশ করে ইরান। কিছুদিনের জন্যে এমনও মনে হয়েছিল যে, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে এর অস্তিত্বও বুঝি থাকবে না। উত্তর দিক থেকে আগ্রাসন চালায় রাশানরা, পশ্চিম থেকে অটোমানরা। সুলতান হুসেইন শাহর তৃতীয় ছেলে দ্বিতীয় তাহমাস্প অবশ্য ইস্ফাহানের অবরোধ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। ইরানি আফসার গোত্রের সর্দার নাদির খানের সহায়তায় আগ্রাসীদের বিতাড়নে সফল হন তিনি। ১৭৩৬ সালে নাদির খান তাহমাস্পকে উৎখাত করে নিজেকেই সম্রাট ঘোষণা করেন। ১৭৪৮ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার আগে পর্যন্ত নিষ্ঠুর কিন্তু প্রায়শঃই দক্ষতার সাথে দেশটি শাসন করেছেন তিনি। তুর্কমান কাজার গোত্রের আকা মুহাম্মদ খান নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নেওয়ার আগ পর্যন্ত এক অন্ধকার অরাজক অন্তবর্তীকালীন সময় উপস্থিত হয়েছিল। ১৭৯৪ সালে শাসন সংহত করতে সক্ষম হন তিনি।৪ বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত ক্ষমতায় অবস্থান করে নতুন কাজার রাজবংশ।

এই বিষণ্ন বছরগুলোয় আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় পরিবর্তন ঘটে। নাদির খান ইরানে আবার সুন্নাহ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ব্যর্থ হন, ফলে নেতৃস্থানীয় উলেমারা ইস্ফাহান ছেড়ে ইরাকে অটোমান সাম্রাজ্যের মাজার শহর নাজাফ ও কারবালায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। একে প্রথমে বিপর্যয় মনে হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা উলেমাদের পক্ষে উপহার প্রমাণিত হয়েছে। কারবালা ও নাজাফে আরও বড় ধরনের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারী হয়ে ওঠেন তাঁরা। তাঁরা রাজনৈতিক শাহদের নাগালের বাইরে ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন ছিলেন। ক্রমে দরবারকে চ্যালেঞ্জ করার মতো অনন্য অবস্থানে পৌঁছে বিকল্প প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন। এই সময়ের দ্বিতীয় প্রধান পরিবর্তন ছিল বিশিষ্ট পণ্ডিত ওয়াহিদ বিহবেহানি (১৭০৫-৯২)-এর কিছুটা সহিংস পদ্ধতিতে অর্জিত উসুলিদের বিজয়। ইজতিহাদের ভূমিকা অনেক স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন তিনি, জুরিস্টদের পক্ষে এর প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিলেন। উসুলি অবস্থান মেনে নিতে অস্বীকারকারী যেকোনও শিয়াকে বিধর্মী হিসাবে নিষিদ্ধ করা হত, বিরোধিতাকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছে। কারবালা ও নাজাফে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘাতে কিছু সংখ্যক আকবারি প্রাণ হারায়। ইস্ফাহানের অতীন্দ্রিয় দর্শনও বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। সুফিবাদকে এমন বর্বরভাবে দমন করা হয়েছিল যে, বিহবেহানির ছেলে আলি সুফি-ঘাতক নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু, আমরা যেমন দেখেছি, ধর্মীয় বিষয়ে জোরজবরদস্তি সাধারণত উল্টো ফল দেয়, অতীন্দ্রিয়বাদ আত্মগোপনে চলে যায় এবং স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে সংঘর্ষ চালিয়ে যাওয়া ভিন্নমতাবলম্বী ও বুদ্ধিজীবীদের ধ্যানধারণাকে আকার দিতে থাকে। বিহবেহানির বিজয় ইরানি উলেমাদের পক্ষে রাজনৈতিক বিজয় ছিল। অরাজকতার উত্তাল সময়ে উসুলি অবস্থান জনপ্রিয় ছিল, কেননা এটা কিছু পরিমাণ শৃঙ্খলা নিয়ে আসার ক্যারিশম্যাটিক কর্তৃত্বের যোগান দিয়েছিল তাদের। মুজতাহিদগণ রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসতে সক্ষম ছিলেন, জনগণের মাঝে কখনওই ক্ষমতা হারাননি। কিন্তু ইমামদের আচরণ ও আদর্শ থেকে দূরবর্তী হওয়ায় স্বৈরাচারী উপায়ে অর্জিত বিহবেহানির বিজয় এক ধরনের ধর্মীয় পরাজয় ছিল।৫৬

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ অটোমান ও ইরানি সাম্রাজ্য উভয়ই বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল। কৃষি নির্ভর সভ্যতার সম্পদ ফুরিয়ে যাওয়ার অনিবার্য নিয়তি বরণ করে নিচ্ছিল এরা। অ্যাক্সিয়াল যুগের সময় থেকেই রক্ষণশীল চেতনা নারী-পুরুষকে গভীর স্তরে এই ধরনের সভ্যতার সীমাবদ্ধতা মেনে নিতে সাহায্য করে এসেছে। এর মানে এই ছিল না যে, রক্ষণশীল সমাজগুলো স্থবির ও অদৃষ্টবাদী ছিল। এই আধ্যাত্মিকতা ইসলামি বিশ্বে ব্যাপক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সাফল্য বয়ে এনেছিল। কিন্তু এই রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও শৈল্পিক প্রয়াস এক ধরনের পৌরাণিক পরিপ্রেক্ষিতে সম্পাদিত হয়েছিল, যা ইউরোপে বিকাশ লাভ করতে থাকা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ম্যল্যবোধের কাছে অচেনা হয়ে দাঁড়াবে। আধুনিক ইউরোপের বহু আদর্শ মুসলিমদের পক্ষে অনুকূল হবে। আমরা দেখেছি, তাদের ধর্মবিশ্বাস এমন প্রবণতার বিকাশ ঘটাতে উৎসাহিত করেছিল যা আধুনিক পাশ্চাত্যের পৃষ্ঠপোষকতা লাভকারী প্রবণতার অনুরূপ: সামাজিক ন্যায় বিচার, সাম্যবাদ, ব্যক্তির স্বাধীনতা, মানবীয় ভিত্তিক আধ্যাত্মিকতা, সেক্যুলার রাজনীতি, ব্যক্তিমুখী বিশ্বাস ও যৌক্তিক ধারণার চর্চা। কিন্তু নব্য ইউরোপের অন্যান্য বৈশিষ্টগুলো রক্ষণশীল রেওয়াজে গড়ে ওঠা মানুষের পক্ষে গ্রহণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে মুসলিমরা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ইউরোপিয়দের পেছনে পড়ে গিয়েছিল, এই সময় ইসলামি সাম্রাজ্যগুলো ও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, সেগুলো ইউরোপিয় রাষ্ট্রগুলোর কাছে নাজুক হয়ে দাঁড়ায়; এসব রাষ্ট্র বিশ্ব আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে প্রয়াস চালানোর প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে ভারতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে ব্রিটিশরা; এক নতুন সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল ফ্রান্স। ১৯শে মে, ১৭৯৮, নেপোলিয়ন বোনাপার্তে প্রাচ্যে ব্রিটিশ শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার লক্ষ্যে তুলন থেকে ৩৮,০০০ লোক ও ৪০০ জাহাজ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করল ফরাসী নৌবহর। ১লা জুলাই আলেকজান্দ্রিয়ার সৈকতে ৪,৩০০ সেনা অবতরণ করালেন নেপোলিয়ন, পরদিন ভোরের অল্প পরেই দখল করে নিলেন গোটা শহর।৫৭ এভাবে মিশরে একটা ঘাঁটি পেয়ে যান তিনি। সাথে করে পণ্ডিত, আধুনিক ইউরোপিয় সাহিত্যের একটা লাইব্রেরি, একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার ও আরবী হরফঅলা একটা ছাপাখানা নিয়ে এসেছিলেন নেপোলিয়ন। পশ্চিমের নতুন বৈজ্ঞানিক, সেক্যুলারিস্ট সংস্কৃতি আক্রমণ হানল মুসলিম বিশ্বে, কোনও কিছুই আর আগের মতো থাকবে না।

২. মুসলিম: রক্ষণশীল চেতনা (১৪৯২-১৭৯৯)

১৪৯২ সালে পশ্চিমে ধীরে ধীরে আবির্ভূত হতে চলা নতুন ব্যবস্থার অন্যতম শিকার ছিল ইহুদিরা। ওই গুরুত্বপূর্ণ বছরগুলোর অন্য শিকার ছিল স্পেনের মুসলিমরা, ইউরোপে ঘাঁটি হারিয়েছিল তারা। কিন্তু ইসলাম কোনও দিক থেকেই পরাস্ত শক্তি ছিল না। ষোড়শ শতাব্দীর দিকে তখনও তা বিশ্ব পরাশক্তি ছিল। যদিও সুঙ রাজবংশ (৯৬০-১২৬০) চীনকে সামাজিক জটিলতা ও শক্তির দিক থেকে ইসলামি জগতের চেয়ে অনেক উঁচু স্তরে নিয়ে গিয়েছিল ও ইতালিয় রেনেসাঁ এক সাংস্কৃতিক আলোকনের সূচনা ঘটিয়েছিল যা শেষ পর্যন্ত পাশ্চাত্যকে সামনে এগিয়ে যেতে সক্ষম করে তুলবে, তবু মুসলিমরা প্রথম দিকে অনায়াসে এইসব চ্যালেঞ্জ সামাল দিতে পেরেছে এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত অবস্থায় রয়ে গিয়েছে। মুসলিমরা গোটা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র এক তৃতীয়াংশ, কিন্তু তারা মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও আফ্রিকায় এমন বিস্তৃত ও কৌশলগতভাবে ছড়িয়ে ছিল যে এই সময় ইসলামী জগৎকে আধুনিককালের গোড়ার দিকের সভ্য জগতের অধিকাংশ এলাকার ধ্যানধারণা তুলে ধরা বিশ্ব ইতিহাসের একটি মাইক্রোকোসম হিসাবে দেখা যেতে পারে। মুসলিমদের পক্ষে এটা ছিল এক উত্তেজনাকর ও উদ্ভাবনী কাল: ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তিনটি নতুন ইসলামি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল: এশিয়া মাইনর, আনাতোলিয়া, ইরাক, সিরিয়া, ও উত্তর আফ্রিকায় অটোমান সাম্রাজ্য; ইরানে সাফাভিয় সাম্রাজ্য; ও ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্য। প্রতিটি সাম্রাজ্য ইসলামি আধ্যাত্মিকতার ভিন্ন ভিন্ন চেহারা তুলে ধরেছিল। মুঘল সাম্রাজ্য ফালসাফাহ নামে পরিচিত সহিষ্ণু বিশ্বজনীন দার্শনিক যুক্তিবাদের প্রতিনিধিত্ব করেছে; সাফাভিয় শাহগণ এপর্যন্ত অভিজাত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস শিয়া ধর্মমতকে রাষ্ট্রীয় ধর্মে পরিণত করেছিলেন; এবং সুন্নী ইসলামের প্রতি ভীষণভাবে অনুগত রয়ে যাওয়া অটোমান তুর্কিরা পবিত্র মুসলিম বিধান শরীয়াহর ভিত্তিতে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল।

এই তিনটি সাম্রাজ্য ছিল এক বিচ্যুতি। তিনটিই প্রাথমিক আধুনিক প্রতিষ্ঠান ছিল, পদ্ধতিগতভাবে আমলাতান্ত্রিক ও যৌক্তিক নির্ভুলতার সাথে এগুলো পরিচালিত হত। গোড়ার দিকের বছরগুলোতে অটোমান রাষ্ট্র ইউরোপের অন্য যেকোনও রাজ্যেও চেয়ে ঢের বেশি শক্তিশালী ছিল। সুলতান দ্য ম্যাগনিফিশেন্টের (১৫২০- ৬৬) শাসনামলে তা শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছায়। গ্রিস, বালকান্স ও হাঙেরি হয়ে পশ্চিমে রাজ্য বিস্তৃত করেন সুলাইমান। ইউরোপের অভ্যন্তরে তাঁর অগ্রযাত্রা কেবল ১৫২৯ সালে ভিয়েনা অধিকারে ব্যর্থতার কারণেই প্রতিহত হয়েছিল। সাফাভিয় ইরানে শাহগণ অনেক সড়ক ও কারাভানসরাই নির্মাণ করেন ও অর্থনীতিকে সংহত রূপ দেন। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেশকে সামনের কাতারে নিয়ে আসেন তাঁরা। সবগুলো সাম্রাজ্যই ইতালিয় রেনেসাঁর সমমানের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ উপভোগ করেছে। অটোমান স্থাপত্যকলা, সাফাভিয় শিল্পকলা ও তাজমহলের জন্যে এক মহান সময় ছিল ষোড়শ শতাব্দী।

কিন্তু তাসত্ত্বেও এসবই ছিল আধুনিকায়নের পথে চলা সমাজ, এরা কোনও রেডিক্যাল পরিবর্তন বাস্তবায়ন করেনি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য বৈশিষ্ট্যে পরিণত হওয়া বিপ্লবী রীতিনীতির অংশীদার ছিল না তারা। বরং এই সাম্রাজ্যগুলো যা প্রকাশ করেছে তাকে আমেরিকান পণ্ডিত মার্শাল জি.এস. হজসন বলেছেন ইউরোপসহ সকল প্রাক আধুনিক সমাজেরই বৈশিষ্ট্য ‘রক্ষণশীল চেতনা’। প্রকৃতপক্ষেই এই সাম্রাজ্যগুলো ছিল রক্ষণশীল মানসিকতার শেষ রাজনৈতিক প্রকাশ; প্রাক আধুনিক কালের সবচেয়ে অগ্রসর রাষ্ট্র ছিল বলে বলা যেতে পারে এগুলো তার সমগ্রকে তুলে ধরেছে। আজ রক্ষণশীল সমাজ বিপদে রয়েছে। আধুনিক পাশ্চাত্য রীতি কার্যকরভাবে অধিকার করে নিয়েছে তাকে কিংবা রক্ষণশীল থেকে আধুনিক চেতনায় উত্তরণের কঠিন পথে অগ্রসর হচ্ছে। অধিকাংশ মৌলবাদই এই বেদনাদায়ক উত্তরণের প্রতি সাড়া। সুতরাং, এই মুসলিম সাম্রাজ্যের তুঙ্গ অবস্থায় রক্ষণশীল চেতনাকে পরখ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আমরা এর আবেদন ও শক্তি এবং সেই সাথে সহজাত সীমাবদ্ধতাগুলোও উপলব্ধি করতে পারি।

পাশ্চাত্য (পুঁজি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের উপর ভিত্তি করে) সম্পূর্ণ নতুন ধরনের সভ্যতা নিয়ে আসার আগে, উনবিংশ শতাব্দীর আগে যার অস্তিত্ব সৃষ্টি হয়নি, সকল সংস্কৃতিই অর্থনৈতিকভাবে উদ্বৃত্ত কৃষি উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল ছিল। এর মানে, যেকোনও কৃষি নির্ভর সমাজের বিস্তার ও সাফল্যের একটা সীমাবদ্ধতা ছিল, কেননা শেষ পর্যন্ত তার সম্পদ ও দায়িত্ব ফুরিয়ে ফেলবে। বিনিয়োগের জন্যে প্রাপ্য পুঁজির সীমাবদ্ধতা ছিল। বিরাট পুঁজির প্রয়োজন হতে পারে এমন যেকোনও উদ্ভাবনকে নাকচ করে দেওয়া হত, কারণ লোকের সমস্ত কিছু ভেঙে ফেলে, কর্মচারীদের বহাল রেখে আবার নতুন করে শুরু করার কোনও উপায় ছিল না। পশ্চিমে আজ যাকে আমরা নিশ্চিত ধরে নিই, আমাদের সংস্কৃতির আগের কোনও সংস্কৃতিই অব্যাহত উদ্ভাবনকে সামাল দিতে পারেনি। এখন আমরা আমাদের বাবা-মায়ের প্রজন্ম থেকে বেশি জানবার প্রত্যাশা করি, আমরা আত্মবিশ্বাসী যে, আমাদের প্রজন্ম ক্রমেই আরও প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর হয়ে উঠবে। আমরা ভবিষ্যৎমুখী, আমাদের সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে আগামীর দিকে তাকাতে হয় ও আগামী প্রজন্মকে প্রভাবিত করবে এমন বিস্তারিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। এটা স্পষ্ট হবে যে, আমাদের এই সমাজ স্থিতিশীল একরোখা যুক্তিবাদী ভাবনার ফল। এটা লোগোসের সন্তান, যা সবসময়ই সামনে তাকায়, আরও জানতে চায় ও আমাদের ক্ষমতার সীমানা বাড়াতে চায়। কিন্তু কোনও যৌক্তিক ভাবনাই একটি আধুনিক অর্থনীতি ব্যতীত এই আগ্রাসীভাবে উদ্ভাবনী সমাজ গড়ে তুলতে পারত না। নতুন নতুন আবিষ্কার সম্ভব করে তোলার জন্যে পাশ্চাত্য সমাজগুলোর পক্ষে অবকাঠামো বদলে ফেলা অসম্ভব নয়, কেননা পুঁজির অবিরাম পুনর্বিনিয়োগের ভেতর দিয়ে আমরা আমাদের মৌল সম্পদ বাড়িয়ে তুলতে পারি যাতে তারা প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সাথে তাল মেলাতে পারে। কিন্তু কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে এটা সম্ভব ছিল না, এখানে লোকে ইতিমধ্যে যা কিছু অর্জিত হয়েছে তাকেই টিকিয়ে রাখতে শক্তি ব্যয় করত। একারণে প্রাক আধুনিক কালের ‘রক্ষণশীল’ প্রবণতা কোনও মৌল ভীরুতা থেকে উৎপন্ন হয়নি, বরং এই ধরনের সংস্কৃতির বাস্তবসম্মত মূল্যায়নই তুলে ধরে। উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষা মূলত পালাক্রমিক জানার ব্যাপার ছিল, এখানে কোনওরকম মৌলিকত্বকে উৎসাহিত করা হত না। কারণ সমাজ সাধারণভাবে ধারণ করতে পারত না বলে ছাত্রদের কোনও রেডিক্যাল নতুন ধারণা ভাবতে উৎসাহিত করা হত না; সুতরাং, এই ধরনের ভাবনা সামাজিকভাবে বিধ্বংসী হয়ে গোটা সম্প্রদায়কে বিপদাপন্ন করে তুলতে পারত। রক্ষণশীল সমাজে সামাজিক স্থিতিশীলতাকে বাক স্বাধীনতার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হত।

আধুনিকদের মতো ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর বদলে প্রাক আধুনিক সমাজগুলো অনুপ্রেরণার জন্যে অতীতের দিকে মুখ ফেরাত। অবিরাম উন্নয়নের প্রত্যাশার বদলে ধরে নেওয়া হত যে পরবর্তী প্রজন্ম অনায়াসে অতীতে প্রত্যাবর্তন করতে পারবে। সাফল্যের নতুন চূড়ায় আরোহণের বদলে সমাজগুলো আদিম নিখুঁত অবস্থা থেকে অবনত হয়েছে বলে মনে করা হত। এই কল্পিত সোনালি যুগকে সরকার ও ব্যক্তি বিশেষের জন্যে আদর্শ মনে করা হত। অতীতের এই আদর্শের কাছাকাছি যাওয়ার ভেতর দিয়েই কেবল কোনও সমাজ তার সম্ভাবনাকে পূর্ণ করতে পারত। সভ্যতাকে সহজাতভাবে নাজুক মনে করা হত। সবাই জানত, পঞ্চম শতকে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর পশ্চিম ইউরোপের মতো যেকোনও দেশই বর্বর কালে পতিত হতে পারে। ইসলামি বিশ্বে আধুনিক কালের গোড়ার দিকে ত্রয়োদশ শতকের মঙ্গোল আগ্রাসনের স্মৃতি তখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি। গণহত্যা, আগুয়ান দস্যু দলের হাত থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষের পলায়ন, ব্যাপক দেশান্তর, একের পর এক মহান ইসলামি শহরের ধ্বংসলীলা তখনও সত্রাসে স্মরণ করা হচ্ছিল। লাইব্রেরি ও শিক্ষার বিভিন্ন কেন্দ্রও ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল।

সেই সাথে শত শত বছরের কষ্টে সংগৃহীত জ্ঞানও হারিয়ে গিয়েছিল। মুসলিমরা সামলে নিয়েছিল; সুফি অতীন্দ্রিয়বাদীরা এক আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণে নেতৃত্ব দেন, যা লুরিয় কাব্বালাহর মতোই উপশমকারী বলে প্রমণিত হয়েছে; তিনটি নতুন সাম্রাজ্য ছিল সেই পুনরুজ্জীবনেরই নিদর্শন। অটোমান ও সাফাভিয় রাজবংশগুলোর মূল নিহিত ছিল মঙ্গোল যুগের ব্যাপক স্থানচ্যুতির ভেতর, দুটোই জন্ম নিয়েছে উগ্র গাযু রাষ্ট্রে, এগুলো সর্দার যোদ্ধার হাতে পরিচলিত হত ও প্রায়শঃই কোনও সুফি ত্বরিকার সাথে সম্পর্কিত ছিল। প্রলয়ঙ্করী ঘটনার সময় যাদের আবির্ভাব ঘটেছিল। এই সাম্রাজ্যগুলোর শক্তি ও সৌন্দর্য ছিল ইসলামি মূল্যবোধের পুনরুত্থান ও মুসলিম ইতিহাসের আবার সঠিক পথে প্রত্যাবর্তনের গর্বিত উচ্চারণ। কিন্তু এমন মাত্রার বিপর্যয়ের পর প্রাক আধুনিক সমাজের স্বাভাবিক রক্ষণশীলতা আরও প্রকট হয়ে ওঠাটাই ছিল স্বাভাবিক। লোকে সম্পূর্ণ নতুন কিছুর সন্ধান করার বদলে বরং যা কিছু হারিয়ে গেছে তাকেই আবার ধীরে ধীরে কষ্টের সাথে ফিরে পাবার দিকে মনোযোগ দিয়েছিল। উদাহরণ স্বরূপ,

সুন্নি ইসলামে-ধর্মের অধিকাংশ মুসলিমের অনুসৃত ভাষ্য, অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠিত ধর্ম-এই মর্মে ঐকমত্য স্থাপিত হয় যে ‘ইজতিহাদের দুয়ার’ (‘স্বাধীন যুক্তি প্রয়োগ’) রুদ্ধ হয়ে গেছে। এতদিন পর্যন্ত মুসলিম জুরিস্টদের কোরান বা কোনও প্রতিষ্ঠিত ট্র্যাডিশনে স্পষ্ট জবাব দেওয়া হয়নি এমনসব আদর্শ ও বিধিবিধান সংক্রান্ত উত্থাপিত প্রশ্নের সমাধান বের করার লক্ষ্যে নিজস্ব বিচার বিবেচনা প্রয়োগের অনুমতি ছিল। কিন্তু আধুনিক কালের গোড়ার দিকে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া ঐতিহ্য রক্ষার জন্যে সুন্নি মুসলিমরা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে স্বাধীন ভাবনার আর প্রয়োজন নেই। সমস্ত উত্তর তৈরি রয়েছে, শরীয়াহই সমাজের স্থায়ী নীল নকশা; ইজতিহাদের প্রয়োজনও নেই, তা কাঙ্ক্ষিতও নয়। মুসলিমদের বরং অবশ্যম্ভাবীভাবে অতীতের অনুসরণ (তাকলিদ) করতে হবে। নতুন সমাধান সন্ধানের পরিবর্তে তাদের উচিত হবে প্রতিষ্ঠিত আইনি সারগ্রন্থে প্রাপ্য বিধির প্রতি নতি স্বীকার করা। আইন ও অনুশীলনের ক্ষেত্রে উদ্ভাবন (বিদাহ)-কে আধুনিক কালের গোড়ার দিকে সুন্নি ইসলামি জগতে ক্রিশ্চান পাশ্চাত্যের মতবাদগত বিষয়ে ধর্মদ্রোহের মতোই বিঘ্ন সৃষ্টিকারী ও বিপজ্জনক মনে করা হত।

প্রবল রকম প্রতিমাবিরোধী আধুনিক পাশ্চাত্যের সাথে এরচেয়ে বেশি বেমানান প্রবণতা কল্পনা করা কঠিন। আমাদের যুক্তি প্রয়োগের ক্ষমতার উপর ইচ্ছাকৃত বাধা আরোপ এখন ঘৃণিত। পরের অধ্যায়ে আমরা যেমন দেখব, লোকে কেবল এই ধরনের বাধা ছুঁড়ে ফেলতে প্রস্তুত হলেই আধুনিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে পারে। পাশ্চাত্য আধুনিকতা লোগোসের ফল হয়ে থাকলে মিথোস কীভাবে প্রাক আধুনিক বিশ্বের ক্ষেত্রে রক্ষণশীল চেতনার সহায়ক ছিল সেটা বোঝা সহজ। পৌরাণিক ধ্যানধারণা অতীতমুখী, সামনে তাকায় না। পবিত্র সূচনা, আদিম ঘটনা, কিংবা মানুষের জীবনের ভিত্তির দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করে। নতুন কিছুর সন্ধান করার বদলে মিথ অটল কোনও কিছুর দিকে দৃষ্টি দেয়। আমাদের জন্যে এটা কোনও ‘সংবাদ’ বয়ে আনে না, বরং সবসময় কী ছিল সেই কথা বলে; গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত কিছুই চিন্তা করা হয়ে গেছে, অর্জিত হয়েছে। আমাদের পূর্ব পুরুষদের কথার উপর, বিশেষ করে পবিত্র টেক্সটের উপর ভিত্তি করে আমরা বেঁচে থাকি, আমাদের যা কিছু জানার তার সবই তা জানিয়ে দিয়েছে। এটাই ছিল রক্ষণশীল কালের চেতনা। কাল্ট, আচরিক অনুশীলন ও পৌরাণিক বিবরণ ব্যক্তিকে কেবল তার গভীরতর অবচেতনে অনুরণন তোলা অর্থই যোগাত না, বরং কৃষি নির্ভর সমাজে টিকে থাকার জন্যে জরুরি প্রবণতা ও এর সহজাত সীমাবদ্ধতাকে শক্তিশালী করে তুলত। শাব্বেতাই যেভি কেলেঙ্কারী যেমন স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছে যে, মিথের বাস্তব পরিবর্তন ঘটানোর কথা নয়। এটা মনের একটা অবস্থা তৈরি করে যা চলমান পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয় ও সমরূপতা অর্জন করে। অনিরুদ্ধ উদ্ভাবনকে স্থান দিতে অপারগ সমাজে এটা আবশ্যক ছিল।

পরিবর্তনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানকারী পাশ্চাত্য সমাজে বসবাসকারী মানুষের পক্ষে যেমন মিথোলজির ভূমিকা বোঝা কঠিন-এমনকি অসম্ভব; তেমনি গভীর ও জোরালভাবে রক্ষণশীল আধ্যাত্মিকতায় গড়ে ওঠা মানুষের পক্ষেও আধুনিক সংস্কৃতির অগ্রসর গতিশীলতা গ্রহণ করা দারুণভাবে কঠিন—এমনকি অসম্ভবও। আবার, এখনও প্রথাগত পৌরাণিক মূল্যবোধে লালিত জাতিকে বোঝাও আধুনিকতাবাদীর পক্ষে যারপরনাই কঠিন। আমরা যেমন দেখব, বর্তমান ইসলামি বিশ্বে কোনও কোনও মুসলিম দুটো বিষয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। প্রথমত, তারা পাশ্চাত্য সমাজের ধর্মকে রাজনীতি থেকে, চার্চকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্নকারী সেক্যুলারিজমকে ঘৃণা করে; দ্বিতীয়ত, অনেক মুসলিমই তাদের সমাজ ইসলামের পবিত্র আইন শরীয়া আইন অনুযায়ী পরিচালিত হওয়া দেখতে চায়। এটা আধুনিক চেতনায় গড়ে ওঠা মানুষের চোখে দারুণভাবে বিভ্রান্তিকর; তারা যুক্তিসঙ্গতভাবেই এই ভেবে ভীত যে একটা যাজকীয় প্রতিষ্ঠান তাদের চোখে স্বাস্থ্যকর সমাজের জন্যে আবিশ্যিক অবিরাম প্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করবে। এরা চার্চ ও রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নকরণের সুবিধা ভোগ করেছে, তাই ইনকুইজিশনের মতো কোনও প্রতিষ্ঠান ‘ইজতিহাদের দুয়ার বন্ধ করে দিচ্ছে’ ভেবে শিউরে ওঠে। একই ভাবে প্রত্যাদেশ মারফত পাওয়া স্বর্গীয় বিধানের ধারণাও আধুনিক রীতিনীতির সাথে বেমানান। আধুনিক সেক্যুলারিস্টরা কোনও অতিমানবীয় সত্তা কর্তৃক মানবজাতির উপর চাপিয়ে দেওয়া অপরিবর্তনীয় আইনের ধারণা বিতৃষ্ণার উদ্রেককারী মনে করে। তারা মনে করে, আইন মিথোস থেকে নয়, বরং লোগোস থেকে উদ্ভুত। এটা যৌক্তিক ও বাস্তবভিত্তিক, চলমান অবস্থার মোকাবিলা করার জন্যে একে সময়ে সময়ে পরিবর্তনযোগ্য হতে হবে। সুতরাং, এইসব মূল ইস্যুই আধুনিকতাবাদীদের মুসলিম মৌলবাদীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।

অবশ্য তুঙ্গ অবস্থায় শরীয়া আইনের ধারণা দারুণভাবে সন্তোষজনক ছিল। এটা ছিল ইসলামি আইনের প্রতি আনুগত্য থেকে বৈধতা লাভ করা অটোমান সাম্রাজ্যের সাফল্য। সুলতানকে শরীয়াহ আইনের রক্ষক হিসাবে শ্রদ্ধা করা হত। এমনকি সুলতান ও বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নরদের নিজ দিওয়ান-খাস মহল-যেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা হত—থাকলেও শরীয়াহ আদালতের (অটোমানরাই প্রথম একে পদ্ধতিগতভাবে সংগঠিত করেছিল) সভাপতিত্বকারী কাজিরাই বিচারকের সীলমোহর হিসাবে বিবেচিত হতেন। কাজি, তাদের পরামর্শক মুফতি ও মাদ্রাসায় ইসলামি জুরিসপ্রুডেন্সের শিক্ষাদানকারী পণ্ডিতগণ (ফিকহ) সবাই ছিলেন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা। তাঁরা সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মতোই সরকারের পক্ষে আবশ্যক ছিলেন। সুলতানের কর্তৃত্ব ধর্মীয় পণ্ডিত উলেমাদের মাধ্যমে মধ্যস্থতা করা হত বলে বিভিন্ন আরব প্রদেশের বাসিন্দারা তুর্কিদের আধিপত্য মিনে নিতে পেরেছিল, এদের পেছনে ইসলামি আইনের পবিত্র কর্তৃত্ব ছিল। সুতরাং সেই হিসাবে ইস্তাম্বুল ও বিভিন্ন প্রদেশের ভেতর উলেমাগণ সুলতান ও প্রজাদের ভেতর সম্পর্কের একটা উপায় ছিলেন। তাঁরা ক্ষোভের কথা সুলতানের কানে তুলতে পারতেন ও এমনকি ইসলামি বিধিবিধানের লঙ্ঘন হলে তাঁকেও ঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারতেন। সুতরাং, উলেমারা অটোমান রাষ্ট্রকে নিজেদের রাষ্ট্র মনে করতে পারতেন; আর সুলতানগণ অংশীদারি তাঁদের ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটিয়েছিল বলে তাঁদের উপর যাজকদের আরোপিত বাধা মেনে নিতেন। অটোমান সাম্রাজ্যের মতো আর কখনওই শরীয়া আইন রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে এভাবে প্রধান ভুমিকা রাখতে পারেনি। ষোড়শ শতাব্দীতে অটোমান সাম্রাজ্যের সাফল্য দেখিয়েছে যে, ইসলামি আইনের প্রতি আনুগত্য সত্যিই তাঁদের সঠিক পথে নিয়ে এসেছিল। অস্তিত্বের মৌল নীতিমালার সাথে একই ছন্দে অবস্থান করছিলেন তাঁরা।

সকল রক্ষণশীল সমাজ (যেমন ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে) এক সোনালি যুগের মুখাপেক্ষী থাকে; অটোমান সাম্রাজ্যের সুন্নি মুসলিমদের জন্যে সেটা ছিল পয়গম্বর মুহাম্মদ (স) (c. ৫৭০-৬৩২সিই) ও তাঁর অব্যবহিত পরের প্রথম চার রাশিদুন (‘সঠিকপথে পরিচালিত’) খলিফা। তাঁরা ইসলামি আইন অনুযায়ী সমাজ পরিচালনা করেছিলেন। ধর্ম ও রাষ্ট্রের কোনও বিচ্ছিন্নতা ছিল না। মুহাম্মদ (স) ছিলেন একাধারে ধর্মীয় নেতা ও রাজনৈতিক প্রধান। সপ্তম শতাব্দীর আরবাসীদের জন্যে তাঁর নিয়ে আসা প্রত্যাদিষ্ট ঐশীগ্রন্থ কোরান জোর দিয়েছে যে, একজন মুসলিমের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে ন্যায়বিচার ভিত্তিক সাম্যবাদী সমাজ গঠন করা যেখানে দরিদ্র ও দুস্থ জনগণের প্রতি সম্মানের সাথে আচরণ করা হবে। এর জন্যে প্রয়োজন সকল ক্ষেত্রে জিহাদের (একটি শব্দ ‘পবিত্র যুদ্ধে’র পরিবর্তে-যেমনটা পাশ্চাত্যবাসীরা প্রায়ই ধরে নেয়-যার অনুবাদ হওয়া উচিত ‘প্রয়াস’ বা ‘সংগ্ৰাম’।): আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, ব্যক্তিগত, সামরিক ও অর্থনৈতিক। আল্লাহকে প্রাধান্য দিয়ে সমাজ গঠনের মাধ্যমে ও মানবজাতির জন্যে তাঁর পরিকল্পনার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করে মুসলিমরা ব্যক্তিগত ও সামাজিক সংহতি অর্জন করবে যা তাদের আল্লাহর একত্বের বোধ জাগাবে। জীবনের কোনও একটি দিককে ঝেড়ে ফেলে তাকে এই ধর্মীয় ‘প্রয়াসে’র আওতার বাইরে ঘোষণা করা হবে প্রধান ইসলামি গুণ এই একীভূতকরণের (তাওহিদ) নীতির মারাত্মক লঙ্ঘন। এটা স্বয়ং আল্লাহকেই অস্বীকার করার শামিল হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং, ধর্মপ্রাণ কোনও মুসলিমের পক্ষে রাজনীতি হচ্ছে ক্রিশ্চানরা যাকে বলবে অপসুদীক্ষা। এটা এমন এক কর্মকাণ্ড যাকে পবিত্রায়িত করতেই হবে যাতে তা আল্লাহকে পাওয়ার একটি উপায়ে পরিণত হয়।

মুসলিম সম্প্রদায় অর্থাৎ উম্মাহর বিভিন্ন উদ্বেগ শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে প্রত্যেক মুসলিমের জন্যে বাধ্যতামূলক ইসলামের পাঁচটি আবশ্যকীয় অনুশীলন স্তম্ভে’ (রুকন) স্পষ্ট করা হয়েছে। ক্রিশ্চানরা যেখানে অর্থডক্সিকে সঠিক বিশ্বাস মনে করে, মুসলিমদের সেখানে ইহুদিদের মতো অর্থপ্র্যাক্সির, ধর্মীয় অনুশীলনের সর্বজনীনতা এবং বিশ্বাসকে গৌণ বিষয় হিসাবে দেখা প্রয়োজন। পাঁচটি স্তম্ভ অনুযায়ী প্রত্যেক মুসলিমকে শাহাদাহ (আল্লাহ’র একত্বে বিশ্বাস ও মুহাম্মদের (স) পয়গম্বরত্বের পক্ষে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি) উচ্চারণ করতে হয়, দৈনিক পাঁচবার প্রার্থনা করা, সমাজে সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করার জন্যে কর প্রদান (যাকাত) করা, দরিদ্রদের উপবাসে থাকার কষ্টের স্মরণে রমযান মাসে উপবাস পালন এবং পরিস্থিতি অনুকূল হলে মক্কায় হাজ্জ তীর্থযাত্রা পালন। উম্মাহর রাজনৈতিক স্বাস্থ্য স্পষ্টত যাকাত ও রমযানের উপবাসের মূখ্য বিষয়। কিন্তু আবিশ্যিকভাবেই সাম্প্রদায়িক ঘটনা হাজ্জে এটা জোরালভাবে উপস্থিত, এই সময় উম্মাহর ঐক্যকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্যে ও ধনী ও দরিদ্রের পার্থক্য মুছে ফেলার জন্যে তীর্থযাত্রী সর্বজনীন শাদা পোশাক পরে।

আরবীয় হিজাজের কেন্দ্রে মক্কায় অবস্থিত চৌকো আকৃতির উপাসনাগৃহ কাবাহ হাজ্জের মুল মনোযোগের বিষয়। কাবাহ এমনকি মুহাম্মদের (স) আমলেও বহু প্রাচীন ছিল, সম্ভবত আদিতে আরবীয় প্যাগান দেবনিচয়ের পরম ঈশ্বর আল্লাহ’র প্রতি নিবেদিত ছিল। মুহাম্মদ (স) কাবাহয় বার্ষিক তীর্থযাত্রার আনুষ্ঠানিকতাকে ইসলামিকরণ করেছেন, একেশ্বরবাদী তাৎপর্য দান করেছেন। এখন পর্যন্ত হাজ্জ মুসলিম সমাজের এক জোরাল অভিজ্ঞতা দান করে। কাবাহর কাঠামো মনস্তাত্ত্বিক জি.সি. জাঙ (১৮৭৫-১৯৫১) কর্তৃক আবিষ্কৃত আর্কিটাইপাল তাৎপর্যমণ্ডিত জ্যামিতিক প্যাটার্নের সাথে খাপ খায়। অধিকাংশ প্রাচীন শহরের কেন্দ্ৰে উপাসনালয় পবিত্রের সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে, তাদের অস্তিত্বের পক্ষে যাকে আবশ্যক মনে করা হত। এটা মরণশীল নারী-পুরুষের নাজুক ও অরক্ষিত শহুরে সমাজে অধিকতর সক্ষম আদিম বাস্তবতাকে বয়ে আনত। পুতার্ক, ওভিদ, দিওনিসাস অভ হেলিকারনাসাসের মতো ধ্রুপদি লেখকগণ বৃত্তাকার বা চৌকো হিসাবে উপাসনাগৃহের বর্ণনা দিয়েছেন, এটা মহাবিশ্বের অত্যাবশ্যক কাঠামোকে নতুন করে গড়ে তোলে বলে বিশ্বাস করা হত। এটা সেই প্যারাডাইম যা তুমুল বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে এবং একে টেকসই করে বাস্তবতা দান করেছে। জাঙ বিশ্বাস করতেন যে, চৌকো বা বৃত্তের ভেতর যেকোনও একটিকে বেছে নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই, বাস্তবতার ভিত্তি মহাজাগতিক শৃঙ্খলাকে তুলে ধরা জ্যামিতিক চিত্র, তিনি বিশ্বাস করতেন, বৃত্তের ভেতর প্রবেশ করানো একটা চতুর্ভুজ। উপাসনাগৃহে পালিত আচারগুলো উপাসককে মহাবিশ্বের মৌল নীতিমালা ও আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করে সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে ও একে বিভ্রান্তি বা কুহকের ফাঁদে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করতে তাদের সহজাত বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় ভরা জগতে স্বর্গীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। মক্কার কাবাহ ঠিক আর্কিওটাইপের সাথে মিলে যায়। গ্রানিটের চৌকো কাঠামো ঘিরে তীর্থযাত্রীরা সাতবার আচরিক প্রদক্ষিণে দৌড়ে বেড়ায়। এর চারটে কোণ পৃথিবীর কোণের প্রতিনিধিত্ব করে, পৃথিবীকে ঘিরে সূর্যের ঘূর্ণনের ধরনকে অনুসরণ করে তারা। নারী বা পুরুষ তার সম্পূর্ণ সত্তার জীবনের মৌল ভিত্তির কাছে কেবল অস্তিত্বগত আত্মসমর্পণের ভেতর দিয়েই (ইসলাম) একজন মুসলিম (যিনি আত্মসমর্পণ করেছেন) সমাজে প্রকৃত মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকতে পারে।

তীর্থযাত্রায় গেছে এমন একজন মুসলিমের কাছে এখনও সর্বোচ্চ ধর্মীয় অভিজ্ঞতা হজ্জ এভাবে গভীরভাবে রক্ষণশীল চেতনায় পরিপূর্ণ। সকল প্রকৃত মিথোই-এর মতো পৌরাণিক আদর্শজগতের অবচেতন বিশ্বে প্রোথিত হাজ্জ মুসলিমদের সেই মৌল উপাদানের কথা মনে করিয়ে দেয় যা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে কারও পক্ষে এর বাইরে যাওয়া অসম্ভব। এটা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের চেয়ে গভীরে যেতে, বস্তুনিচয়ের আবিশ্যিকভাবে স্বাভাবিক ধর্মে আত্মসমর্পণ ও নিজেদের মতো স্বাধীনভাবে অগ্রসর না হতে সাহায্য করে। সম্প্রদায়ের সমস্ত যৌক্তিক কর্মকাণ্ড-রাজনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য বা সামাজিক সম্পর্ক-পৌরাণিক প্রেক্ষিতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে স্থাপিত ও পরে মুসলিম বিশ্বের হৃদয়ে অবস্থিত কাবাহ এইসব যৌক্তিক কর্মকাণ্ডকে অর্থ ও পরিপ্রেক্ষিত দান করেছে। কোরানও এই রক্ষণশীল মনোভাব তুলে ধরেছে। এটা বারবার জোরের সাথে বলেছে যে, মানুষের কাছে এটা কোনও নতুন সত্যি বয়ে আনছে না, বরং মানবজীবনের অত্যাবশ্যক বিধিবিধানকেই প্রকাশ করছে। এটা এরই মধ্যে জানা সত্যিরই ‘স্মারক’। মুহাম্মদ (স) মনে করেননি যে তিনি একটি নতুন ধর্ম তৈরি করছেন, বরং বিশ্বাস করেছেন যে, এই আরবীয় গোত্রের কাছে মানবজাতির আদিমতম ধর্মকেই নিয়ে আসছেন; এর আগে কখনও এদের কাছে কোনও পয়গম্বর প্রেরণ করা হয়নি, তাদের নিজস্ব ভাষায় কোনও ঐশীগ্রন্থও ছিল না। কোরানের দৃষ্টিতে প্রথম পয়গম্বর আদমের কাল থেকেই কীভাবে জীবন যাপন করতে হবে তার শিক্ষা দিতে আল্লাহ পৃথিবীর বুকে প্রত্যেক জাতির কাছে বার্তাবাহক প্রেরণ করেছেন।’ সহজাতভাবে স্বর্গীয় বিধির কাছে আত্মসমর্পণ করায় প্রকৃতিগতভাবেই মুসলিম পশু-পাখি, মাছ বা গাছের বিপরীতে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা রয়েছে, ইচ্ছে করলে সে এই বিধানকে অমান্য করতে পারে।” তারা যখন এইসব মৌল বিধানকে অমান্য করে দরিদ্রের উপর নির্যাতনকারী সুষ্ঠুভাবে সম্পদ বণ্টনে অস্বীকারকারী স্বেচ্ছাচারী সমাজ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখনই তারা তাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে। কোরান আমাদের জানাচ্ছে অতীতের মহান সব পয়গম্বর-আদম, নোয়াহ, মোজেস, জেসাস এবং আরও অনেকে—কীভাবে আল্লাহ’র সেই একই বাণী উচ্চারণ করেছেন। এখন কোরান আরবদের কাছে সেই একই স্বর্গীয় বাণী এনে দিয়েছে, তাদের সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতার চর্চা করার নির্দেশ দিচ্ছে যা তাদের অস্তিত্বের মৌল বিধির সাথে সমন্বিত করবে। মুসলিমরা যখন আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী চলে, সবকিছু যেমন হওয়া উচিত ছিল সেইভাবে বস্তুনিচয়ের ধারার সাথে চলার বোধ জাগে তাদের ভেতর। আল্লাহ’র বিধান অমান্য করাকে প্রকৃতিবিরুদ্ধ বিবেচনা করা হয়েছে: এ যেন কোনও মাছ জমিনে বাস করার প্রয়াস পাচ্ছে।

ষোড়শ শতাব্দীতে অটোমানদের বিস্ময়কর সাফল্যকে নিশ্চয়ই তাদের প্রজাদের চোখে তারা যে এই মৌল নীতিমালার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে তার জ্বলন্ত প্রমাণ হিসাবে ফুটে উঠেছিল। একারণেই তাদের সমাজ এমন দর্শনীয়ভাবে কাজ করেছে। অটোমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় শরীয়াহ আইনকে দেওয়া নজীরবিহীন প্রাধ্যান্যকেও এই রক্ষণশীল চেতনায় দেখা হয়েছিল। আধুনিকতার সূচনায় মুসলিমরা স্বর্গীয় আইনকে তাদের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্নকারী বিষয় মনে করেনি, এটা ছিল পৌরাণিক আদর্শজগতের আচরিক ও কাল্টিক বাস্তবায়ন, যা তাদের পবিত্রের সংস্পর্শে নিয়ে গেছে বলে বিশ্বাস করেছে। মুহাম্মদের (স) পরলোকগমনের পরবর্তী শতাব্দীগুলোয় ধীরে ধীরে মুসলিম আইনের বিকাশ ঘটেছে। কোরানে খুব কমই বিধানের অস্তিত্ব রয়েছে আর পয়গম্বরের পরলোকগমনের এক শো বছরের ভেতর মুসলিমরা হিমালয় থেকে পিরেনীজ পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করছিল বলে অন্য যেকোনও সমাজের মতোই এর জটিল আইনি ব্যবস্থার প্রয়োজন থাকায় এটা ছিল একটা সৃজনশীল উদ্যোগ। শেষ পর্যন্ত ইসলামি জুরিসপ্রুডেন্সের চারটি ধারা গড়ে ওঠে। সবগুলোই প্রায় একই ধরনের, এদের সমানভাবে বৈধ মনে করা হয়। পয়গম্বর মুহাম্মদের (স) ব্যক্তিত্বের উপর ভিত্তি করে এই বিধানব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ গ্রহণের সময় ইসলামের নিখুঁত ভঙ্গিমা সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। নবম শতাব্দীতে খুব সতর্কতার সাথে পয়গম্বরের শিক্ষা ও আচরণ সংক্রান্ত প্রত্যক্ষদর্শীর প্রতিবেদন (হাদিস) সংগ্রহ করা হয়, মুসলিমরা তাঁর বাণী ও ধর্মীয় অনুশীলনের (সুন্নাহ) একটা নির্ভুল রেকর্ড লাভ করে সেটা নিশ্চিত করতে যত্নের সাথে বাছাই করা হয়েছে। আইনি মতবাদগুলো মুহাম্মদীয় এই প্যারাডাইমগুলোকে তাদের আইনি ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করে যাতে সারা বিশ্বের মুসলিমরা পয়গম্বর যেভাবে কথা বলতেন, খেতেন, হাতমুখ ধুতেন, ভালোবাসতেন ও প্রার্থনা করতেন তার অনুকরণ করতে পারে। এইসব বাহ্যিক বিষয়ে পয়গম্বরের অনুকরণের ভেতর দিয়ে তারা আল্লাহর কাছে তাঁর অন্তস্থঃ আত্মসমর্পণের নাগাল পাবার আশা করেছিল।” প্রকৃত রক্ষণশীল চেতনায় মুসলিমরা অতীতের এক নিখুঁত বিষয়ের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিচ্ছিল।

মুসলিম বিধানের অনুশীলন ঐতিহাসিক চরিত্র মুহাম্মদকে (স) মিথে পরিণত করে তাঁকে তিনি যে কালে বেঁচেছিলেন সেই কাল থেকে মুক্ত করে প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমের ব্যক্তি জীবনে তুলে এনেছে। একইভাবে এই কাল্টিক পুনারাবৃত্তি মুসলিম সমাজকে আল্লাহর কাছে নিখুঁত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে একজন মানুষের কেমন হওয়া উচিত তার নজীরে পরিণত হওয়া ব্যক্তি মুহাম্মদের (স) নৈকট্য লাভের ভেতর দিয়ে প্রকৃত ইসলামি করে তুলেছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মঙ্গোল আগ্রাসনের সময় নাগাদ শরীয়াহ আধ্যাত্মিকতা শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে সারা মুসলিম বিশ্বে শেকড় বিস্তার করেছিল, সেটা খলিফা ও উলেমাগণ এটা তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার কারণে নয়, বরং এটা নারী-পুরুষকে নুমিনাসের অনুভূতি দিয়েছিল ও তাদের জীবনকে অর্থ দিয়ে পরিপূর্ণ করে তুলেছিল বলে। অতীতের প্রতি এই কাল্টিক উল্লেখ অবশ্য সপ্তম শতাব্দীর জীবনধারার প্রতি প্রাচীন আনুগত্যের কাছে বন্দি করেনি। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অটোমান সাম্রাজ্য তর্কসাপেক্ষে সবচেয়ে আধুনিক রাষ্ট্র ছিল। সময়ের হিসাবে এটা অসাধারণ দক্ষ ছিল, এক নতুন ধরনের আমলাতন্ত্রের বিকাশ ঘটিয়েছে ও প্রাণবন্ত জীবনধারাকে উৎসাহিত করেছে। অটোমানরা অন্যান্য সংস্কৃতির প্রতি উদার ছিল। পাশ্চাত্য নৌচলাচল বিজ্ঞান তাদের সত্যিই উত্তেজিত করে তুলেছিল, অভিযাত্রীদের বিভিন্ন আবিষ্কারে রীতিমতো আলোড়িত হয়েছে; এবং গানপাউডার ও আগ্নেয়াস্ত্রের মতো পাশ্চাত্য সামরিক আবিষ্কার আয়ত্ত করতে তারা উদগ্রীব ছিল।” উলেমাদের দায়িত্ব ছিল এইসব উদ্ভাবনকে মুসলিম আইনে মুহাম্মদীয় প্যারাডাইমের অন্তর্ভুক্ত করার পদ্ধতির অনুসন্ধান করা। জুরিপ্রুডেন্সের গবেষণা (ফিকহ) মানে কেবল প্রাচীন টেক্সট পাঠের ব্যাপার ছিল না, বরং এর চ্যালেঞ্জিং একটা মাত্রা ছিল। এবং এই সময় পর্যন্ত ইসলাম ও পশ্চিমের ভেতর কোনও পার্থক্য ছিল না। ইউরোপও রক্ষণশীল চেতনায় ডুবে ছিল। রেনেসাঁ মানবতাবাদীরা আদ ফন্তেসে, উৎসে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। আমরা দেখেছি, সাধারণ মরণশীলের পক্ষে সম্পূর্ণভাবে ধর্ম থেকে বের হয়ে আসা কার্যত অসম্ভব। নতুন নতুন আবিষ্কার সত্ত্বেও ইউরোপিয়রা অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত রক্ষণশীল রীতিনীতিতেই শাসিত হয়েছে। পাশ্চাত্য আধুনিকতা ভবিষ্যৎমুখী যুক্তিবাদ দিয়ে জীবনের পশ্চাদমুখী পৌরাণিক ধারাকে প্রতিস্থাপিত করার পরেই কেবল কোনও কোনও মুসলিম ইউরোপকে অচেনা ভাবতে শুরু করবে।

এছাড়া, রক্ষণশীল সমাজকে সম্পূর্ণ স্থবির কল্পনা করে নেওয়াটা ভ্রান্তি হবে। গোটা মুসলিম ইতিহাস জুড়ে ইসলা (‘সংস্কার’) ও তাজদিদ (‘নবায়ন’)-এর আন্দোলন চলেছে, প্রায়শঃই এগুলো ছিল সম্পূর্ণই বিপ্লবী। উদাহরণ স্বরূপ, দামাস্কাসের আহমাদ ইবন তাঈমিয়াহর (১২৬৩-১৩২৮) মতো একজন সংস্কারক ‘ইজতিহাদের দুয়ার রুদ্ধ করার’ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। মঙ্গোল আগ্রাসনের আগে ও পরে জীবন যাপন করেছেন তিনি, মুসলিমরা এই সময় প্রবল আচ্ছন্ন দশা থেকে মুক্ত হয়ে সমাজকে নতুন করে গড়ে তোলার প্রয়াস পাচ্ছিল। সাধারণভাবে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের কালে বা ব্যাপক রাজনৈতিক বিপর্যয়ের অব্যবহিত পরপর সাংস্কৃতিক আন্দোলন সৃষ্টি হয়ে থাকে। এমন সময়ে পুরোনো সমাধান আর কাজে আসে না, সুতরাং সংস্কারকগণ ইজতিহাদের যৌক্তিক ক্ষমতা ব্যবহার করে স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে থাকেন। ইবন তাঈমিয়াহ শরীয়াকে হালনাগাদ করতে চেয়েছিলেন যাতে করে তা এই খোলনলচে বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে মুসলিমদের সত্যিকারের প্রয়োজন মেটাতে পারে। কিন্তু তাঁর কর্মসূচি আবিশ্যিকভাবে রক্ষণশীল রূপ ধারণ করেছিল। ইবন তাঈমিয়া বিশ্বাস করতেন যে, সঙ্কট উত্তরণের জন্যে মুসলিমদের অবশ্যই উৎসে, অর্থাৎ কোরান ও পয়গম্বরের সুন্নাহ্য় ফিরে যেতে হবে। পরবর্তীকালের সকল ধর্মীয় সংযোজন বাতিল করে মূলে ফিরে যেতে চেয়েছেন তিনি। অর্থাৎ, আদিম মুসলিম আদর্শরূপে ফিরে যেতে পবিত্র বিবেচিত হতে শুরু করা অনেক মধ্যযুগীয় জুরিপ্রুডেন্স (ফিকহ) ও দর্শন বাতিল করে দিয়েছিলেন। এই প্রতিমাবিরোধিতা প্রতিষ্ঠানকে ক্ষিপ্ত করে তোলে এবং ইবন তাঈমিয়া বাকি জীবন কারাগারে কাটান। বলা হয়ে থাকে যে, আটককারী তাঁকে কলম ও কাগজ না দেওয়ায় ভগ্ন হৃদয়ে মারা গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাঁকে ভালোবেসেছিল, তাঁর আইনি সংস্কার ছিল উদার ও রেডিক্যাল, তারা বুঝতে পেরেছিল যে তাদের স্বার্থই তিনি মনে-প্রাণে গ্রহণ করেছিলেন।২ তাঁর অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠান জনপ্রিয় স্বীকৃতির প্রদর্শনীতে পরিণত হয়। ইসলামি ইতিহাসে এমন আরও অনেক সংস্কারক রয়েছেন। আমরা আমাদের বর্তমান কালের কোনও কোনও মুসলিম মৌলবাদীকে ইসলাহ ও তাজদিদের এই ঐতিহ্যে কাজ করতে দেখব।

অন্য মুসলিমরা নিগূঢ় আন্দোলনের মাঝে নতুন ধর্মীয় ধারণা ও অনুশীলনের সন্ধান করতে পেরেছিল। এসব সাধারণ জনগণের কাছে গোপন রেখেছিল তারা, কেননা তাদের ধারণা ছিল এসবকে ভুল বোঝা হতে পারে। অবশ্য, তারা ধর্ম সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধারণার কোনও পার্থক্য দেখতে পায়নি। তাদের বিশ্বাস ছিল, তাদের আন্দোলনসমূহ কোরানের শিক্ষার সম্পূরক ছিল এবং সেগুলোকে নতুন প্রাসঙ্গিকতা দিয়েছে। ইসলামের তিনটি প্রধান নিগূঢ় ধরন হচ্ছে, সুফিবাদের অতীন্দ্রিয়বাদী অনুশীলন, ফালসাফাহর যুক্তিবাদ ও শিয়া ধর্মমতের কিছুটা রাজনৈতিক ধার্মিকতা। এই অধ্যায়ে আমরা তার বিস্তারিত অনুসন্ধান করব। কিন্তু ইসলামের এই নিগূঢ় ধরনগুলোকে যত উদ্ভাবনীমূলক বা মূলধারার শরীয়া ধার্মিকতা থেকে যতই বিচ্ছিন্ন মনে হোক না কেন, মরমীরা বিশ্বাস করত যে তারা আদ ফন্তেসে ফিরে যাচ্ছে। কোরানের ধর্মে গ্রিক যুক্তিবাদের নীতিমালা প্রয়োগের প্রয়াস লাভকারী ফালসাফাহর প্রচারকরা সময়হীন সত্যির আদিম সর্বজনীন ধর্মবিশ্বাসে ফিরে যেতে চেয়েছে, তাদের ধারণা ছিল ওই ধর্ম বিভিন্ন ঐতিহাসিক ধর্মের আগেও বিরাজ করত। সুফিরা বিশ্বাস করেছে যে, অতীন্দ্রিয় পরমানন্দ পয়গম্বর কোরান গ্রহণ করার সময় যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন তারই পুনরাবৃত্তি ঘটায়, তারাও মুহাম্মদের (স) আদি আদর্শের সাথে একাত্ম হচ্ছে। শিয়াদের দাবি, কেবল তারাই কোরানে উল্লিখিত সামাজিক ন্যায়বিচারের আবেগের চর্চা করে, কিন্তু দুর্নীতিবাজ মুসলিম শাসকগণ তাকে উপেক্ষা করে গেছেন। নিগূঢ়বাদীদের কেউই আমাদের ধারণা অনুযায়ী ‘মৌলিক’ হতে চায়নি, সবাইই মূলে ফিরে যাওয়ার রক্ষণশীল দিক থেকে মৌলিক, কেবল সেটাই মানুষকে পূর্ণাঙ্গতা ও পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে বিশ্বাস করা হত।[১৩]

এই গ্রন্থে আমরা যেসব দেশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব তাদের ভেতর একটি মিশর। ১৫১৭ সালে এই দেশটি অটোমান সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয়। প্রথম সেলিম সেই সময় সিরিয়ায় অভিযান পরিচালনার সময় দেশটি অধিকার করে নিয়েছিলেন। সুতরাং শরীয়া ধার্মিকতা মিশরে প্রধান ছিল। কায়রোর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় আল আযহার সুন্নি বিশ্বে ফিকহ গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে। কিন্তু অটোমান শাসনের শতাব্দীগুলোয় ইস্তাম্বুলের পেছনে পড়ে যায় মিশর, আপেক্ষিকভাবে অস্পষ্ট হয়ে ওঠে তার অস্তিত্ব। আধুনিক কালের সূচনা লগ্নে এই দেশটির অবস্থা সম্পর্কে খুব কমই জানি আমরা। ১২৫০ সাল থেকে এই অঞ্চল মামলুকদের শাসনাধীন ছিল—এরা ছিল কিশোর বয়সে বন্দি করে ইসলামে ধর্মান্তরিত কর্সিকান দাসদের নিয়ে সংগঠিত একটা ক্র্যাক সামরিক বাহিনী। একই ধরনের দাস-বাহিনী জানেসারিরা ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের সামরিক মেরুদণ্ড। তুঙ্গ সময়ে মামলুকরা মিশর ও সিরিয়ায় এক প্রাণবন্ত সমাজে নেতৃত্ব দিয়েছে। মিশর ছিল মুসলিম বিশ্বের অন্যতম অগ্রসর দেশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মামলুক সাম্রাজ্য কৃষিভিত্তিক সভ্যতার সহজাত সীমাবদ্ধতার কাছে নতি স্বীকার করে নেয়, এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এর পতন শুরু হয়। মামলুকরা অবশ্য মিশরে সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়নি। অটোমান সুলতান প্রথম সেলিম আলেপ্পোর মামলুক গভর্নর খায়ের বে’র সাথে জোট বেঁধে দেশটি দখল করে নেন। এই রফার অধীনে খায়ের বে-কে অটোমান বাহিনী প্রত্যাহৃত হওয়ার পর ভাইসরয় নিয়োগ করা হয়েছিল।

গোড়ার দিকে অটোমানরা মামলুকদের সামাল দিতে পেরেছিল, দুটি মামলুক বিদ্রোহকে দমন করেছিল তারা।[১৪] তবে ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে অটোমানরা তাদের সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে ফেলতে যাচ্ছিল। ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি প্রশাসনে পতন ডেকে আনে এবং ক্রমশঃ বেশ কয়েকটা বিদ্রোহের পর মামলুক অধিনায়করা (বে) মিশরের আসল শাসক হিসাবে আবির্ভূত হন, যদিও সরকারীভাবে ইস্তাম্বুলের অধীন ছিলেন তাঁরা। বে-গণ উচ্চ পদমর্যাদা সম্পন্ন সামরিক ক্যাডার গড়ে তুলেছিলেন, এই বাহিনী তুর্কি গভর্নরের বিরুদ্ধে অটোমান সেনাবাহিনীতে মামলুক বাহিনীর একটা বিদ্রোহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় ও তার জায়গায় নিজেদের একজনকে ক্ষমতায় বসায়। সুলতান এই নিয়োগের বৈধতা দান করেন। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিকে সংক্ষিপ্ত একটা পর্যায় বাদে মামলুকরা দেশের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পেরেছিল। ওই সময় জানেসারিদের একজন ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলেন। তবে মামলুক শাসন ছিল অস্থিতিশীল। বে-তন্ত্ৰ দুটো উপদলে বিভক্ত ছিল, ফলে সারাক্ষণ অস্থিরতা ও অন্তর্দলীয় কোন্দল লেগেই থাকত।[১৫] এই গোটা উত্তাল সময় জুড়ে প্রধান শিকার ছিল মিশরের সাধারণ জনগণ। বিদ্রোহ ও উপদলীয় সহিংসতার সময় তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, করের ভারে পঙ্গু হয়ে গেছে তারা। তুর্কি বা সারকাসিয়ান, যাই হোক না কেন, শাসকদের সাথে তারা কোনওরকম ঐক্য বোধ করতে পারেনি, এরা ছিল বিদেশী ও জনগণের কল্যাণে কোনও আগ্রহ ছিল না তাদের। জনগণ ক্রমবর্ধমানহারে উলেমাদের শরনাপন্ন হচ্ছিল: মিশরিয় ছিলেন তাঁরা, শরীয়ার পবিত্র শৃঙ্খলার প্রতিনিধিত্ব করতেন। তাঁরাই মিশরিয় জনগণের প্রকৃত নেতায় পরিণত হন। অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে বে-দের ভেতরকার বিরোধ আরও প্রকট আকার ধারণ করলে মামলুক নেতৃবৃন্দ আবিষ্কার করেন যে, জনগণকে তাদের শাসন মেনে নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্যে উলেমাদের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গতি নেই।১৬

উলেমারা ছিলেন মিশরিয় সমাজের শিক্ষক, পণ্ডিত ও বুদ্ধিজীবী। প্রতিটি শহরে এক থেকে সাতটি মাদ্রাসা (ইসলামি আইন ও ধর্মতত্ত্ব পাঠের বিশ্ববিদ্যালয়) ছিল, এগুলোই ছিল দেশের শিক্ষকের যোগানদার। বুদ্ধিবৃত্তির মান খুব উন্নত ছিল না। প্রথম সেলিম মিশর দখল করে নেওয়ার পর প্রচুর মূল্যবান পাণ্ডুলিপিসহ বহু নেতৃস্থানীয় উলেমাকে সাথে করে ইস্তাম্বুলে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অটোমান সাম্রাজ্যের একটা পশ্চাদপদ প্রদেশে পরিণত হয়েছিল মিশর। অটোমানরা আরব পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়নি। মিশরিয়দের বাইরের পৃথিবীর সাথে কোনও যোগাযোগ ছিল না। মামলুক শাসনের সময় সমৃদ্ধি লাভ করা মিশরিয় দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ওষুধবিজ্ঞান ও বিজ্ঞান অধঃপতিত হয়ে পড়েছিল।১৭

কিন্তু শাসক ও সাধারণ জনগণের ভেতর যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম থাকায় উলেমাগণ যাপরনাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন। এদের বেশিরভাগই এসেছিলেন ফেলাহীন কৃষক শ্রেণী থেকে, তাই পল্লী অঞ্চলে তাদের প্রভাব ছিল উল্লেখ করার মতো। কোরান স্কুল ও মাদ্রাসায় গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতেন তাঁরা; শরীয়া আদালতসমূহ বিচার ব্যবস্থার মুল কেন্দ্র থাকায় উলেমাগণ আইনি ব্যবস্থায়ও একচেটিয়া অধিকার ভোগ করতেন। এছাড়া, দিওয়ানে” গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদের অধিকারী ছিলেন তাঁরা এবং শরীয়াহর অভিভাবক হিসাবে সরকারের বিরুদ্ধে মূল বিরোধিতারও নেতৃত্ব দিতে পারতেন। বিখ্যাত মাদ্রাসা আল-আযহারের অবস্থান ছিল বাজারের পাশে, উলেমাদের সাথে বণিক শ্রেণীর শক্তিশালী সম্পর্ক ছিল। সরকারের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চাইলে তারা আযহারের মিনার থেকে বাজানো ঢাকের আওয়াজেই বাজার বন্ধ করে দিতে পারত ও লোকজনকে রাস্তায় নামিয়ে আনতে পারত। উদাহরণ স্বরূপ, ১৭৯৪ সালে আযহারের রেক্টর শেখ আল-শারকাভি এক নতুন করারোপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, একে নির্যাতনমূলক ও অনৈসলামিক ঘোষণা করেছিলেন তিনি। তিন দিন পরে বে-গণ কর প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।১৯ কিন্তু সরকার উৎখাত করে উলেমাদের সরকার গঠনের লক্ষ্যে অভ্যুত্থান পরিচালনার কোনও বাস্তব হুমকি ছিল না। বে-গণ সাধারণত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তাঁদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতেন। মব ভায়োলেন্স প্রায়শঃই মামলুক সেনাবাহিনীর পক্ষে তেমন কোনও চলমান চ্যালেঞ্জ ছিল না। তা সত্ত্বেও উলেমাদের প্রাধান্য মিশরিয় সমাজকে একটা লক্ষযোগ্য ধর্মীয় চরিত্র দান করেছিল, ইসলামই মিশরের জনগণকে একমাত্র নিরাপত্তার যোগান দিয়েছিল।২১

অষ্টম শতাব্দীর শেষ নাগাদ মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা ছিল যারপরনাই মূল্যবান। এই সময় নাগাদ অটোমান সাম্রাজ্য মারাত্মক অবনতির শিকারে পরিণত হয়। এর ষোড়শ শতকীয় সরকারের অসাধারণ দক্ষতা বিশেষ করে সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত এলাকায় অযোগ্যতার জন্ম দেয়। বিস্ময়করভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করেছিল পাশ্চাত্য জগৎ। অটোমানরা আবিষ্কার করে যে তারা এখন আর আগের মতো ইউরোপের সাথে সমান তালে লড়তে পারছে না। পাশ্চাত্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল, সেটা রাজনৈতিক দুর্বলতার কালে ঘটছিল বলে নয়, বরং ইউরোপে গড়ে উঠতে থাকা এক নতুন সমাজের কোনও পূর্ব নজীর না থাকায়।২২ সুলতানগণ মানিয়ে নেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন, কিন্তু তাঁদের প্রয়াস ছিল বাহ্যিক। উদাহরণ স্বরূপ, সুলতান তৃতীয় সেলিম (১৭৮৯-১৮০৭ সাল পর্যন্ত শাসন করেন) পাশ্চাত্য হুমকিকে কেবল সামরিক ভিত্তিতে বিবেচনা করেছেন। ১৭৩০-এর দশকে ইউরোপিয় ধাঁচে সেনাবাহিনীকে গড়ো তোলার ব্যর্থ প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ১৭৮৯ সালে সিংহাসনে আরোহণ করার পর সেলিম ফরাসী নির্দেশকসহ বেশ কয়েকটি সামরিক স্কুল খোলেন: ছাত্ররা এখানে ইউরোপিয় ভাষা ও গণিত, নৌচলাচল, ভূগোল ও ইতিহাসের বইয়ের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠে।২৩ অল্প কিছু সামরিক কৌশল শিক্ষা ও আধুনিক বিজ্ঞানের ভাসা ভাসা জ্ঞান অবশ্য পাশ্চাত্য হুমকিকে সামাল দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণিত হয়নি। কারণ ইউরোপিয়রা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের জীবন ও চিন্তা ধারার বিকাশ ঘটিয়েছিল; ফলে সম্পূর্ণ ভিন্ন কেতায় কাজ করছিল তারা। তাদের নিজস্ব কৌশলে তাদের মোকাবিলা করার লক্ষ্যে অটোমানদের প্রয়োজন ছিল সমাজের ইসলামি কাঠামো ভেঙে একেবারে নতুন ধরনের যৌক্তিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটানো ও অতীতের সাথে সমস্ত পবিত্র সম্পর্ক ছেদ করতে প্রস্তুত থাকা। অভিজাত গোষ্ঠীর অল্প কিছু মানুষের পক্ষে হয়তো এই পরিবর্তন অর্জন করা সম্ভব ছিল, ইউরোপিয়দের যার জন্যে প্রায় তিনশো বছর লেগেছিল; কিন্তু সাধারণ জনগণকে কীভাবে তাঁরা এমন রেডিক্যাল পরিবর্তন মেনে নিতে ও উপলব্ধি করতে সম্মত করাতেন, যাদের মনমানসিকতা রক্ষণশীল রীতিনীতিতে পরিপূর্ণ?

ইউরোপের সীমান্তে যেসব জায়গায় অটোমান পতন অনেক বেশি প্রকট ছিল, সেখানকার জনগণ বরাবরের মতোই পরিবর্তন ও অস্থিরতার প্রতি সাড়া দিয়েছিল-ধর্মীয় কায়দায়। আরবীয় পেনিনসুলায় মুহাম্মদ ইবন আব্দ আল- ওয়াহহাব (১৭০৩-৯২) ইস্তাম্বুল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মধ্য আরব ও পারসিয়ান গাল্ফ এলাকায় নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হন। আব্দ আল-ওয়াহহাব ছিলেন টিপিক্যাল ইসলামি সংস্কারক। মধ্যযুগীয় জুরেসপ্রুডেন্স, অতীন্দ্রিয়বাদ ও দর্শন প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করে কোরান ও সুন্নাহয় প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে সঙ্কট মোকাবিলার প্রয়াস পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর দৃষ্টিতে এসব যেহেতু আদি ইসলাম থেকে বিচ্যুতি, তাই আল-ওয়াহহাব অটোমান সুলতানদের ধর্মদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তাঁদের বিশ্বাসীদের আনুগত্য লাভের অযোগ্য ও মৃত্যুদণ্ডের উপযুক্ত ঘোষণা করেছিলেন। তাঁদের শরীয়া রাষ্ট্র সঠিক নয়। তার বদলে আল-ওয়াহহাব সপ্তম শতাব্দীর প্রথম মুসলিম সম্প্রদায়ের অনুশীলনের উপর ভিত্তি করে খাঁটি ধর্মের একটা ছিটমহল সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছিলেন। এটা ছিল আক্রমণাত্মক আন্দোলন, বাহুবলে জনগণের উপর চেপে বসেছিল। এইসব সহিংস ও প্রত্যাখ্যানমূলক ওয়াহহাবীয় শিক্ষা আরও ব্যাপক পরিবর্তন ও অস্থিরতার কাল বিংশ শতাব্দীর দিকে কিছু সংখ্যক মৌলবাদী ইসলামি সংস্কারকদের হাতে ব্যবহৃত হবে।২8

মরোক্কোর সুফি সংস্কারক আহমাদ ইবন ইদ্রিসের (১৭৮০-১৮৩৬) সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, আমাদের কালেও যার অনুসারী রয়েছে। অটোমান সাম্রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জীবনের বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে তাঁর সমাধান ছিল সাধারণ জনগণকে শিক্ষিত করে তোলা ও তাদের ভালো মুসলিমে পরিণত করা। উত্তর আফ্রিকা ও ইয়েমেনে প্রচুর সফর করেছেন তিনি, সাধারণ জনগণের উদ্দেশে তাদের নিজস্ব ভাষায় বক্তব্য রেখেছেন, সমবেত প্রার্থনার শিক্ষা দিয়েছেন ও অনৈতিক অনুশীলন থেকে তাদের বের করে আনতে চেয়েছেন। তৃণমূল পর্যায়ের আন্দোলন ছিল এটা। ওয়াহহাবী পদ্ধতি নিয়ে কাজ করার অবকাশ ছিল না ইবন ইদ্রিসের। তাঁর চোখে শক্তি নয়, শিক্ষাই ছিল মূল চাবকাঠি। ধর্মের নামে মানুষ হত্যা অবশ্যই ভ্রান্তি। অন্য সংস্কারকগণ একই পথে কাজ করেছেন। আলজেরিয়ায় আহমাদ আল-তিগরানি (মৃ. ১৮২৪), মদিনায় মুহাম্মদ ইবন আব্দ আল-করিম শামীম (মৃ. ১৭৭৫) এবং লিবিয়ায় মুহাম্মদ ইবন আলি আল-সানুসি (মৃ. ১৮৩২)-এদের প্রত্যেকে উলেমাদের পাশ কাটিয়ে ধর্মকে সরাসরি মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন। এটা ছিল জনমুখী সংস্কার, তাঁরা তাঁদের চোখে অভিজাতপন্থী ও ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়া ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করেছেন; আব্দ আল-ওয়াহহাবের বিপরীতে মতবাদগত পরিশুদ্ধতার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না তাঁরা। জনগণকে মূল কাল্টে ফিরিয়ে নিয়ে ও তাদের নৈতিকভাবে জীবন যাপনে অনুপ্রাণিত করে জটিল ফিকহের চেয়ে অনেক কার্যকরভাবে সমাজের অসুস্থতাকে দূর করা যাবে।

শত শত বছর ধরে সুফিগণ শিষ্যদের তাদের নিজস্ব জীবনে মুহাম্মদীয় প্যারাডাইম নতুন করে সৃষ্টি করার শিক্ষা দিয়ে এসেছেন; তারাও জোর দিয়ে বলেছেন আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথই হচ্ছে সৃজনশীল ও অতীন্দ্ৰিয় কল্পনা: মানুষের সুফিবাদের ধ্যানমূলক অনুশীলনের সাহায্যে অবশ্যই নিজের মতো থিওফ্যানি সৃষ্টি করার দায়িত্ব রয়েছে। অষ্টম শতাব্দীর শেষে ও উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এইসব সংস্কারকগণ-পণ্ডিতরা যাদের ‘নিও-সুফি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন—আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষকে তাঁরা সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব অন্তর্দৃষ্টির উপর নির্ভর করার শিক্ষা দিয়েছেন, তাদের আর পণ্ডিত ও বিদ্বান যাজকের উপর নির্ভর করা উচিত নয়। ইবন ইদ্রিস এমনকি যত মহানই হোন না কেন, পয়গম্বর বাদে সকল মুসলিম সাধুর কর্তৃত্ব পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান করার মতো পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিলেন। এভাবে তিনি মুসলিমদের যা কিছু নতুন তাকে মূল্য দিতে ও শ্রদ্ধার আলখেল্লাহ ঝেড়ে ফেলার উৎসাহ দিয়েছেন। অতীন্দ্রিয় অনুসন্ধানের লক্ষ্য আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়া নয়, বরং পয়গম্বরের মানবীয় চরিত্রের সাথে গভীরভাবে একীভূত হওয়া-যিনি আল্লাহর কাছে নিজেকে এমনি নিখুঁতভাবে উন্মুক্ত করে তুলেছিলেন। প্রাথমিকভাবে এগুলো আধুনিক প্রবণতা ছিল। নিও-সুফিগণ পয়গম্বরের আদিআদর্শ ব্যক্তিত্বের মুখাপেক্ষী থাকলেও তারা যেন দুর্ভেয়মুখী নয় বরং মানবমুখী ধর্মবিশ্বাসের বিকাশ ঘটাচ্ছিলেন এবং শিষ্যদের যা কিছু নতুন ও উদ্ভাবনী শক্তির তাকে প্রাচীনের মতোই মূল্য দিতে শেখাচ্ছিলেন। পশ্চিমের সাথে ইবন ইদ্রিসের কোনও যোগাযোগ ছিল না, তিনি কখনওই তাঁর লেখায় ইউরোপের কথা উল্লেখ করেননি, পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে জ্ঞান বা তার প্রতি কোনও আগ্রহেরও প্রকাশ ঘটাননি। কিন্তু সুন্নি ইসলামের পৌরাণিক অনুশীলন তাঁকে ইউরোপিয় আলোকনের কিছু কিছু নীতিমালাকে আলিঙ্গন করতে চালিত করেছে।২৫

ইরানের ক্ষেত্রেও একই রকম ছিল ব্যাপারটা। এই দেশের এই সময়ের ইতিহাস মিশরের তুলনায় ভালোভাবে লিখিত আছে। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সাফাভিয়রা ইরান জয় করে শিয়া মতবাদকে রাষ্ট্রের সরকারী ধর্মে পরিণত করে। এর আগে পর্যন্ত শিয়া মতবাদ বুদ্ধিবৃত্তিক ও অতীন্দ্রিয় নিগূঢ় অভিজাত আন্দোলন ছিল; নীতিগতভাবে শিয়ারা রাজনৈতিক জীবনে অংশগ্রহণ হতে বিরত ছিল। ইরানে সব সময়ই কিছু প্রধান শিয়া কেন্দ্র ছিল, তবে বেশির ভাগ শিয়াই ছিল আরব, পারসি নয়। সুতরাং, ইরানে সাফাভিয় পরীক্ষা ছিল এক বিস্ময়কর উদ্ভাবন। সুন্নি ও শিয়াদের ভেতর কোনও মতবাদগত বিরোধ নেই, পার্থক্যটা স্পষ্টতই আবেগজাত। সুন্নিরা মূলত মুসলিম ইতিহাসের বেলায় আশাবাদী, অন্যদিকে শিয়াদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশি ট্র্যাজিক: পয়গম্বর মুহাম্মদের (স) বংশধরদের পরিণতি শুভ ও অশুভ, ন্যায়বিচার ও স্বৈরাচারের মাঝে মহাজাগতিক যুদ্ধের একটা প্রতীকে পরিণত হয়েছে, যেখানে দুষ্টই যেন সব সময় জয় লাভ করছে বলে মনে হয়। সুন্নিরা যেখানে মুহাম্মদের (স) জীবনকে মিথে পরিণত করেছে, শিয়ারা তাঁর বংশধরদের জীবনকে পুরাণে পরিণত করেছে। শিয়া বিশ্বাস উপলব্ধির জন্যে-যা না হলে ১৯৭৮-৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের মতো ঘটনাবলী বোধের অতীত-আমাদের অবশ্যই সংক্ষেপে শিয়া বিশ্বাসের বিকাশ বিবেচনা করতে হবে।

৬৩২ সালে পয়গম্বর মুহাম্মদ (স) পরলোকগমন করার সময় উত্তরাধিকারী মনোনয়নের জন্যে কোনও ব্যবস্থা রেখে যাননি। তাঁর বন্ধু আবু বকর উম্মাহর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মাধ্যমে খেলাফতে অধিষ্ঠিত হন। অবশ্য কেউ কেউ বিশ্বাস করত যে, মুহাম্মদ (স) হয়তো তাঁর নিকটতম পুরুষ আত্মীয় আলি ইবন আবি তালিবই তাঁর উত্তরাধিকারী হোক, এটাই চাইতেন, তিনি ছিলেন তাঁর পোষ্য, চাচাত ভাই ও মেয়ে জামাই। কিন্তু ৬৩৬ সালে চতুর্থ খলিফা হওয়ার আগ পর্যন্ত আলিকে বিভিন্ন নির্বাচনে ক্রমাগত বাদ দিয়ে যাওয়া হয়েছিল। শিয়ারা অবশ্য প্রথম তিন খলিফার শাসনকে স্বীকার করে না। আলিকেই তারা প্রথম ইমাম (‘নেতা’) আখ্যায়িত করে থাকে। আলির ধার্মিকতা ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি তাঁর অফিসারদের উদ্দেশে ন্যায়বিচার ভিত্তিক বিচারের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে চিঠি লিখেছেন। অবশ্য ৬৩৬ সালে দুঃখজনকভাবে এক মুসলিম চরমপন্থীর হাতে নিহত হন তিনি। শিয়া- সুন্নি নির্বিশেষে এই ঘটনা শোকের সাথে স্মরণ করে থাকে। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মুয়াবিয়াহ খেলাফতের সিংহাসন দখল করে নেন এবং দামাস্কাস ভিত্তিক অধিকতর ইহজাগতিক উমাঈয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। আলির বড় ছেলে হাসান, শিয়ারা যাঁকে দ্বিতীয় ইমাম বলে থাকে, রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং ৬৬৯ সালে মদিনায় পরলোকগমন করেন। কিন্তু ৬৮০ সালে খলিফা মুয়াবিয়াহ মারা গেলে ইরাকের কুফায় আলির দ্বিতীয় ছেলে হুসেইনের পক্ষে বিশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। উমাঈয়াদের পক্ষ থেকে প্রতিশোধ এড়াতে হুসেইন মক্কায় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ করেন, কিন্তু নতুন উমাঈয়া খলিফা ইয়াযিদ তাঁকে হত্যা করাতে মক্কার পবিত্রতা লঙ্ঘন করে পবিত্র নগরে দূত পাঠায়। তৃতীয় শিয়া ইমাম হুসেইন এই অন্যায় ও অপবিত্র শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দায়িত্ব মনে করেন। স্ত্রী ও সন্তানসহ পঞ্চাশ জনের একটা দল নিয়ে কুফার পথে রওয়ানা হন তিনি, ভেবেছিলেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে পয়গম্বরের উত্তরাধিকারীদের এই করুণ মিছিলের দৃশ্য উম্মাহকে আবার ইসলামের সঠিক পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। কিন্তু আরব দশম মাস মুহররমের আশুরার পবিত্র উপবাসের দিনে উমাঈয়া বাহিনী কুফার বাইরে কারবালার প্রান্তরে হুসেইনের ক্ষুদ্র বাহিনীকে ঘেরাও করে সবাইকে হত্যা করে। সবার শেষে নিহত হন হুসেইন, তখন তাঁর কোলে ছিল তাঁর শিশু পুত্র।২৬

কারবালা ট্র্যাজিডি নিজস্ব কাল্ট গড়ে তুলবে এবং প্রত্যেক শিয়ার ব্যক্তিগত জীবনের এক সময়হীন ঘটনা, মিথে পরিণত হবে। ইয়াযিদ পরিণত হয়েছে স্বৈরাচার ও অন্যায়ের মূর্ত প্রতীকে। দশম শতাব্দী নাগাদ সাধারণভাবে শিয়ারা আশুরার উপবাসের দিন হুসেইনের শাহাদাৎ বরণের বার্ষিকী পালন করে থাকে, তারা কাঁদে, নিজেদের শরীরে আঘাত করে মুসলিম রাজনৈতিক জীবনের দূষণের চিরন্তন বিরোধিতা ঘোষণা করে। কবিগণ শহীদ আলি ও হুসেইনের সম্মানে মহাকাব্যিক শোকগীতি আবৃত্তি করে থাকেন। এভাবে শিয়ারা কারবালার মিথোসের উপর ভিত্তি করে প্রতিবাদের ধার্মিকতা গড়ে তুলেছে। এই কাল্ট শিয়া দৃষ্টিভঙ্গির মূল বিষয় সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতি আবেগঘন আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে রেখেছে। আশুরা আচারের সময় শিয়ারা যখন ভাবগম্ভীর মিছিলে হেঁটে যায়, তখন তারা হুসেইনকে অনুসরণ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এমনকি মৃত্যু বরণ করার প্রতিজ্ঞা ঘোষণা দেয়। ২৭

এই মিথ ও কাল্ট গড়ে উঠতে কিছুদিন সময় লেগেছিল। কারবালার পরের প্রথম কয়েক বছর হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পাওয়া হুসেইনের ছেলে আলি এবং তাঁর ছেলে মুহাম্মদ (যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম ইমাম নামে পরিচিত) মদিনায় চলে যান, তাঁরা কোনও রকম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেননি। কিন্তু ইতিমধ্যে প্রথম ইমাম আলি উমাঈয়া শাসনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠা অনেকের কাছেই ন্যায়ের প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন। আব্বাসিয় উপদল যখন শেষ পর্যন্ত ৭৫০ সালে উমাঈয়া খেলাফত উৎখাত করে তাদের নিজেদের রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করে (৭৫০-১২৬০), প্রথমে নিজেদের তারা শিয়া-ই আলি (আলির দল) বলে দাবি করেছিল। শিয়ারা আবার কিছু অদ্ভূত আঁচঅনুমানের সাথেও সম্পর্কিত ছিল, বেশির ভাগ মুসলিমই যাকে ‘চরম’ (গুলুউ) মনে করে। ইরাকে মুসলিমরা এক প্রাচীন ও আরও জটিল ধর্মীয় জগতের সংস্পর্শে এসেছিল এবং কেউ কেউ ক্রিশ্চান, ইহুদি বা যোরোস্ত্রিয় মিথলজিতে আকৃষ্ট হয়। কোনও কোনও শিয়া বলয়ে আলিকে জেসাসের মতো ঈশ্বরের অবতার হিসাবে দেখা হত; শিয়া বিদ্রোহীরা মনে করত তাদের নেতারা মারা যাননি বরং আত্মগোপনে (বা ‘অকাল্টেশন’) আছেন; একদিন তাঁরা ফিরে আসবেন, অনুসারীদের বিজয়ের পথে নিয়ে যাবেন। অন্যরা স্বর্গীয় আত্মার মানুষের সত্তায় অবতরণ ও তাকে স্বর্গীয় জ্ঞান দেওয়ার ধারণায় অভিভূত হয়ে গিয়েছিল।২৮ এইসব মিথ এক পরিবর্তিত রূপে শিয়া নিগূঢ় দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

হুসেইনের সম্মানে সৃষ্ট কাল্ট এক ঐতিহাসিক ট্র্যাজিডিকে শিয়া মুসলিমদের ধর্মীয় দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা মিথে পরিণত করেছে। এটা মানুষের খোদ অস্তিত্বে অব্যাহত কিন্তু অদৃশ্য শুভ ও অশুভের ভেতরকার সংগ্রামের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকে; আচার অনুষ্ঠান হুসেইনকে তাঁর সময়ের বিশেষ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করে তাঁকে এক জীবিত সত্তায় পরিণত করে; তিনি পরিণত হন গভীর সত্যের প্রতীকে। কিন্তু শিয়াবাদের পুরাণকে বাস্তব বিশ্বে বাস্তবিকভাবে প্রয়োগ করা যাবে না। এমনকি আব্বাসিয় শাসকদের মতো শিয়ারা ক্ষমতা দখল করতে পারলেও রাজনৈতিক জীবনের কর্কশ বাস্তবতা বোঝায় যে তারা ওইসব উচ্চমার্গীয় আদর্শের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করতে পারছিলেন না। আব্বাসিয় খলিফাগণ ইহজাগতিক দিক থেকে অত্যন্ত সফল ছিলেন, কিন্তু ক্ষমতায় আরোহণের পর অল্প সময়ের ভেতরই শিয়া রেডিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি বিসর্জন দিয়ে সাধারণ সুন্নিতে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁদের শাসন উমাঈয়াদের তুলনায় খুব বেশি ন্যায়সঙ্গত বলে মনে হয়নি; কিন্তু প্রকৃত শিয়াদের পক্ষে বিদ্রোহ করা ছিল অর্থহীন, কারণ প্রয়োজনের খাতিরেই যেকোনও বিদ্রোহকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হত। প্রকৃতপক্ষেই হুসেইনের মিথ যেন বোঝাতে চেয়েছে স্বৈরাচারী শাসকের বিরোধিতা করার যেকোনও প্রয়াসই ব্যর্থ হতে বাধ্য, সেটা ন্যায়বিচারের পক্ষে যত ধার্মিক ও উৎসাহী হোক না কেন।

ষষ্ঠ শিয়া ইমাম জাফর আস-সাদিক (মৃ. ৭৬৫) এটা বুঝতে পেরেছিলেন বলে আনুষ্ঠানিকভাবে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিত্যাগ করেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে পয়গম্বরের উত্তরাধিকারী হিসাবে তিনিই উম্মাহর একমাত্র বৈধ নেতা (ইমাম) হলেও কোনও অর্থহীন বিরোধে জড়ানো সত্যিকারের কাজ নয়, বরং ঐশীগ্রন্থের অতীন্দ্রিয় ব্যাখ্যায় শিয়াদের পথ নির্দেশ করাই তাঁর দায়িত্ব। আলির বংশের প্রত্যেক ইমাম, তিনি শিক্ষা দিয়েছেন, তাঁর প্রজন্মের আধ্যাত্মিক নেতা। ইমামদের প্রত্যেকে তাঁর পূবসুরী কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি তাঁকে স্বর্গীয় সত্যের গোপন জ্ঞান (‘ইলম) দিয়ে গেছেন। সুতরাং একজন ইমাম ভ্রান্তির অতীত আধ্যাত্মিক নির্দেশক ও নিখুঁত বিচারক। এভাবে শিয়ারা রাজনীতি ছেড়ে কোরানের প্রতিটি শব্দের পেছনে লুকানো গোপন (বাতিন) প্রজ্ঞা অনুভব করতে ধ্যানের কৌশল চর্চা করার মাধ্যমে অতীন্দ্রিয় গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। শিয়ারা ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক অনুবাদে সন্তুষ্ট ছিল না, নতুন দর্শনের ভিত্তি হিসাবে টেক্সটকে কাজে লাগাত তারা। তাদের ঐশী অনুপ্রাণিত ইমামের প্রতীকীবাদ পবিত্র সত্তার শিয়া অনুভূতি তুলে ধরে যা একজন অতীন্দ্রিয়বাদী এই উত্তাল বিপজ্জনক বিশ্বে সর্বব্যাপী ও সুগম হিসাবে আবিষ্কার করে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের উপযোগী মতবাদ ছিল না এটা, একে তারা আনাড়ীভাবে ব্যাখ্যা করে বসতে পারত; তো শিয়াদের অবশ্যই তাদের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে নিজের কাছে রাখতে হবে। জাফর আস-সাদিক কর্তৃক বিকশিত ইমামতির মিথলজি ছিল একটি কল্পনানির্ভর দর্শন যা ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক ও বাস্তব ভিত্তিক অর্থের অতীতে অনুসন্ধান ও ইতিহাসকে অদৃশ্যের (আল-গায়েব ) অটল, আদিম বাস্তবতা হিসাবে দেখে। দীক্ষা হীন যেখানে কেবল একজন মানুষকে দেখেছে, ধ্যানী শিয়া জাফর আস-সাদিকের মাঝে স্বর্গীয় আভাস দেখতে পেয়েছে।২৯

ইমামত দৈনন্দিন জীবনের সখুঁত ও ট্র্যাজিক পরিস্থিতিতে আল্লাহ’র ইচ্ছা বাস্তাবায়নের চরম অসুবিধাও প্রতীকায়িত করেছে। জাফর আস-সাদিক কার্যকরভাবে ধর্মকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন, ধর্মবিশ্বাসকে ব্যক্তি পর্যায়ে এনে একে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বলয়ে সীমিত করেছেন। এটা তিনি করেছেন ধর্মকে বাঁচাতে ও এমন বিশ্বে একে বেঁচে থাকতে সক্ষম করে তুলতে যাকে আবিশ্যিকভাবেই এর প্রতি বৈরী মনে হয়। এক গভীর আধ্যাত্মিক প্রেরণা থেকেই এই সেক্যুলারাইজেশন নীতির উদ্ভব ঘটেছিল। শিয়ারা জানত ধর্মের সাথে রাজনীতির মিশ্রণ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এক শতাব্দী পরে এটা করুণভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ৮৩৬ সালে আব্বাসিয় খলিফাগণ বাগদাদের আনুমানিক ষাট মাইল দক্ষিণে সামারায় রাজধানী সরিয়ে নেন। ততদিনে আব্বাসিয়দের শক্তি ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছিল, খলিফা গোটা মুসলিম বিশ্বের নামমাত্র শাসক থাকলেও সাম্রাজ্য জুড়ে মূল কর্তৃত্ব ছিল স্থানীয় আমির ও সর্দারদের হাতে। খলিফাগণ মনে করলেন এমন একটা অস্থির সময়ে তাঁদের পক্ষে পয়গম্বরের উত্তরাধিকারী ইমামদের এভাবে মুক্ত থাকতে দেওয়া সম্ভব নয়। ৮৪৮ সালে খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল দশম ইমাম আলি আল-হাদিকে মদিনা থেকে সামারায় তলব করেন। এখানে তাঁকে গৃহবন্দি করা হয়। তিনি ও তাঁর ছেলে একাদশ ইমাম হাসান আল- আশারি শিয়াদের সাথে কেবল প্রতিনিধি (ওয়াকিল)-র মারফত যোগাযোগ রাখতে পারছিলেন। বাগদাদের বাণিজ্য এলাকা আল-কার্খ-এ থেকে আব্বাসিয় কর্তৃপক্ষের মনোযোগ এড়াতে ব্যবসা করত তারা।

৮৭৪ সালে একাদশ ইমাম পরলোকগমন করেন, সম্ভবত খলিফার ইঙ্গিতে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল তাঁকে। তাঁকে এমন ভীষণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রাখা হয়েছিল যে শিয়ারা তাঁর সম্পর্কে তেমন কিছুই জানত না। তাঁর কি কোনও ছেলে ছিল? যদি না থাকে তো কে তাঁর উত্তরাধিকারী হবে? তাঁর বংশধারা কি শেষ হয়ে গেছে? যদি তাই হয়, তার মানে কি তবে শিয়ারা অতিন্দ্রীয় নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছে? প্রবল হয়ে উঠেছিল আঁচঅনুমান, তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় মতবাদ জোরের সাথে জানাল যে, হাসান আল-আশারির সত্যিই একজন ছেলে ছিল, আবু আল কাসিম মুহাম্মদ, দ্বাদশ ইমাম; জীবন বাঁচাতে আত্মগোপন করেছেন তিনি। আকর্ষণীয় সমাধান ছিল এটা, কারণ এখানে বোঝানো হয়েছে যে কিছুই বদলায়নি। শেষ দুজন ইমাম কার্যত অগম্য ছিলেন। এখন গোপন ইমাম তাঁর ওয়াকিল উসমান আল-আমরির মারফত জনগণের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে পারবেন। এই ওয়াকিল আধ্যাত্মিক পরামর্শ দিতে পারবেন, যাকাতের দান সংগ্রহ করবেন, ঐশীগ্রন্থ ব্যাখ্যা করবেন ও আইনি সিদ্ধান্ত দেবেন। কিন্তু এই সমাধানের আয়ু ছিল সীমিত। দ্বাদশ ইমামের জীবিত থাকার সময়সীমা পার হয়ে যাওয়ামাত্র শিয়ারা আবার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে শুরু করল। তারপর ৯৩৪ সালে বর্তমান প্রতিনিধি আলি ইবন মুহাম্মদ আস-সামাররি গোপন ইমামের কাছ থেকে শিয়াদের জন্যে এক বার্তা নিয়ে এলেন। তিনি পরলোকগমন করেননি। বরং আল্লাহ অলৌকিকভাবে তাঁকে আড়াল করেছেন; শেষ বিচারের আগে আগে ন্যায়বিচারের যুগের সুচনা ঘটাতে আবার ফিরে আসবেন তিনি। এখনও তিনি শিয়াদের ভুলের অতীত নির্দেশক ও উম্মাহর একমাত্র বৈধ শাসক রয়েছেন। কিন্তু বিশ্বাসীদের সাথে তিনি আর প্রতিনিধি মারফত প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বজায় রাখতে পারবেন না। শিয়াদের তাঁর দ্রুত প্রত্যাবর্তন আশা করা ঠিক হবে না। তারা তাঁকে কেবল ‘দীর্ঘ সময় পার হয়ে যাবার পর ও পৃথিবী স্বৈরাচারে পরিপূর্ণ হলেই আবার দেখতে পাবে।’৩১

গোপন ইমামের ‘অকাল্টেশনে’র মিথ যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না। কেবল অতীন্দ্রিয়বাদ ও আচরিক অনুশীলনের প্রেক্ষাপটেই এটা অর্থ প্রকাশ করে। আমরা যদি গল্পটি লোগোস হিসাবে বুঝে থাকি, বাস্তব ঘটনার মামুলি বিবরণ হিসাবে যদি আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, সবরকম প্রশ্ন উঠে আসে। ইমাম গেছেন কোথায়? তিনি পৃথিবীতেই আছেন নাকি কোনও ধরনের মধ্যবর্তী বলয়ে? সেখানে তাঁর জীবন কেমন হতে পারে? তিনি কি ক্রমেই বুড়িয়ে যাচ্ছেন? বিশ্বাসীরা তাঁকে দেখতে বা তাঁর কথা শুনতে না পেলে কেমন করে তিনি তাদের পথ দেখাবেন? যুক্তিকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে মনের অধিকতর স্বজ্ঞামূলক শক্তির উপর নির্ভরশীল বাতিন বা ঐশীগ্রন্থের গোপন অর্থের সুশৃঙ্খল অনুশীলনে সংশ্লিষ্ট এমন কোনও শিয়ার কাছে এইসব প্রশ্ন ভোঁতা মনে হবে। শিয়ারা তাদের ঐশীগ্রন্থ ও মতবাদ আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করেনি। তাদের সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিকতা অদৃশ্যের (আল-গায়েব) প্রতীকী অনুসন্ধানে পরিণত হয়েছিল যা বাইরের যাহির)  ঘটনাপ্রবাহের আড়ালে থাকে। শিয়ারা এক অদৃশ্য, দুর্বোধ্য আল্লাহর উপাসনা করে থাকে, কোরানের গুপ্ত অর্থের সন্ধান করে, এক গোপন ইমামের আকাঙ্ক্ষায় ছিল তারা, ন্যায় বিচারের জন্যে অন্তহীন কিন্তু অদৃশ্য লড়াইতে অংশ নিয়েছে এবং ইসলামের এক নিগূঢ় ভাষ্য চর্চ্চা করেছে যাকে পার্থিব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হয়েছে।২ এই ব্যাপক ধ্যানমুখী জীবনই ছিল অকাল্টেশনের মানে তুলে ধরা পটভূমি। গোপন ইমাম মিথে পরিণত হয়েছিলেন, স্বাভাবিক ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাঁকে সময় ও কালের সীমা থেকে মুক্ত করা হয়েছে; প্যারাডক্সিকালি তিনি ও অন্যান্য ইমাম মদিনা বা সামারায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করার সময় যতখানি ছিলেন তারচেয়ে ঢের বেশি উজ্জ্বল সত্তায় পরিণত হয়েছিলেন। অকাল্টেশন এমন এক মিথ যা আমাদের পবিত্রের বোধকে অধরা ও হতবুদ্ধিকরভাবে অনুপস্থিত রূপে তুলে ধরে। জগতে উপস্থিত থাকলেও এটা এর অংশ নয়; স্বর্গীয় প্রজ্ঞা মানুষ থেকে অবিচ্ছেদ্য (কারণ মানবীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা কেবল ঈশ্বরসহ কোনও কিছু সম্পর্কে ধারণা করতে পারি), কিন্তু আমাদের তা সাধারণ নারী-পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির উর্ধ্বে নিয়ে যায়। অন্য যেকোনও মিথের মতো অগোছাল যুক্তি দিয়ে অকাল্টেশন বোঝা যাবে না, যেন বা তা স্বয়ংপ্রকাশিত সত্যি বা যৌক্তিক প্রদর্শনীর উপযুক্ত। বরং তা মানুষের ধর্মীয় অভিজ্ঞতায় একটি মিথকে তুলে ধরে।

যেকোনও নিগূঢ় আধ্যাত্মিকতার মতো শিয়া মতবাদ এই পর্যায় পর্যন্ত কেবল অভিজাত গোষ্ঠীর ব্যাপার ছিল। অতীন্দ্রিয় ধ্যনের মেধা ও চাহিদা সম্পন্ন অধিকতর বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দুঃসাহসী মুসলিমরাই এতে আকৃষ্ট হচ্ছিল বেশি। কিন্তু শিয়াদের অন্য মুসলিমদের চেয়ে ভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। সুন্নি ইসলামের আচার ও অনুশীলন যেখানে সুন্নি মুসলিমদের জীবন যেমন সেভাবেই মেনে নিয়ে আদর্শ জগতের রীতিনীতি মোতাবেক চলতে সাহায্য করেছে সেখানে শিয়া অতীন্দ্রিয়বাদ স্বর্গীয় অসন্তোষ তুলে ধরেছে। অকাল্টেশনের মতবাদ প্রচারিত হওয়ার অল্প পরেই বিকাশ লাভ করা প্রথম দিকের ট্র্যাডিশনসমূহ দশম শতাব্দীতে বহু শিয়ার অনুভূত হতাশা ও অক্ষমতা তুলে ধরেছে। একে বলা হত “শিয়া শতাব্দী’, কারণ ইসলামি সাম্রাজ্যের বহু অধিনায়ক যারা কোনও এক বিশেষ এলাকায় কার্যকর ক্ষমতা ভোগ করতেন তাদের প্রায় সবারই শিয়া মতবাদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। কিন্তু সেকারণে কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। কোরানের পরিষ্কার শিক্ষা সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে জীবন তখনও ছিল অন্যায় ও সমতাহীন। প্রকৃতপক্ষেই, সকল ইমামই শিয়াদের চোখে দুর্নীতিগ্রস্ত ও অবৈধ শাসকগোষ্ঠীর হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। ট্র্যাডিশন আছে যে, উমাঈয়া ও আব্বাসিয় খলিফারা হুসেইনের পরের প্রত্যেক ইমামকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছেন। আরও ন্যায়বিচার ভিত্তিক ও উদার সামাজিক ব্যবস্থার পক্ষে তাদের আকাঙ্ক্ষা থেকে শিয়ারা শেষ যুগে গোপন ইমামের চূড়ান্ত আবির্ভাব (যুহুর)-এর উপর ভিত্তি করে পরকালতত্ত্বের বিকাশ ঘটায়, যখন তিনি ফিরে এসে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করবেন ও চূড়ান্ত বিচারের আগে ন্যায়বিচার ও শান্তির এক সোনালি যুগের প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু সমাপ্তির জন্যে এই আকাঙ্ক্ষার মানে শিয়ারা রক্ষণশীল রীতি ত্যাগ করে ভবিষ্যৎমুখী হয়ে গেছে, এমন ছিল না। তারা আদি আদর্শ জগতের প্রতি এত প্রবলভাবে সজাগ ছিল, পরিস্থিতির যেমনটা হওয়া উচিত ছিল, তাদের চোখে সাধারণ রাজনৈতিক জীবন অসহনীয় ঠেকেছে। গোপন ইমাম এই বিশ্বে নতুন কিছু নিয়ে আসবেন না, তিনি স্রেফ মানুষের ইতিহাসকে পরিশুদ্ধ করবেন যাতে মানুষের কর্মকাণ্ড অস্তিত্বের মৌলিক নীতিমালার অনুগামী হয়। একইভাবে ইমামদের ‘আবির্ভাব’ গভীরতর অর্থে সব সময় অস্তিত্ব ছিল এমন কিছুকে প্রকাশ করবে মাত্র, কারণ গোপন ইমাম শিয়ার জীবনে এক ধ্রুব অস্তিত্ব, তিনি আল্লাহর অধরা আলোকে এক অন্ধকার স্বৈরাচারী পৃথিবীতে তুলে ধরেন এবং তিনিই আশার একমাত্র উৎস।

ষষ্ঠ ইমাম রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিসর্জন দিয়ে ধর্মকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার পর সূচিত অকাল্টেশন শিয়া ইতিহাসের পুরাণে রূপান্তরের কাজটি শেষ করেছিল। মিথ বাস্তবভিত্তিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পক্ষে কোনও নীল নকশার যোগান দেয় না, বরং বিশ্বাসীকে তার সমাজের দিকে চোখ ফেরাতে ও অন্তস্থঃ জীবনকে বিকাশ করতে শেখায়। অকাল্টেশনের মিথ শিয়াদের চিরকালের মতো বিরাজনীতি করে দিয়েছিল। জাগতিক শাসকদের শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অর্থহীন ঝুঁকি নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই শিয়াদের। যাকে আত্মগোপনে যেতে হয়, চলমান বিশ্বে বাস করতে অক্ষম ন্যায়বিচারক একজন ইমামের ইমেজ শিয়াদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতাই তুলে ধরে। যুগের প্রকৃত প্রভু গোপন ইমামের কর্তৃত্বকে ছিনিয়ে নিয়েছে বলে এই নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে যেকোনও সরকারকেই অবৈধ বিবেচনা করতে হয়েছে। সুতরাং, পার্থিব শাসকদের কাছ থেকে কিছুই আশা করার ছিল না, যদিও বেঁচে থাকার স্বার্থে শিয়াদের অবশ্যই ক্ষমতাসীনদের সাথে সহযোগিতা করতে হবে। আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করবে তারা, কেবল ‘দীর্ঘ সময় শেষে’ শেষ যুগেই পৃথিবীতে আসন্ন এক ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা করবে। তারা কেবল ইমামদের সাবেক ‘প্রতিনিধি’দের স্থান গ্রহণকারী শিয়া উলেমাদের একক কর্তৃত্বই মেনে নেবে। শিক্ষা, আধ্যাত্মিকতা ও স্বর্গীয় আইনে দক্ষতার কারণে উলেমাগণ গোপন ইমামের সহকারীতে পরিণত হয়েছিলেন এবং তাঁর নামে বক্তব্য রাখতেন। কিন্তু সকল সরকারই অবৈধ থাকায় উলেমাদের অবশ্যই রাজনৈতিক পদ গ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল।৩৪

এভাবে শিয়ারা নীরবে রাজনীতির পূর্ণাঙ্গ সেক্যুলারাজেইশন সমর্থন দিয়েছিল যাকে তাওহিদের গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি নীতির লঙ্ঘন মনে হতে পারে, যেখানে রাষ্ট্র ও ধর্মের এজাতীয় বিচ্ছিন্নতাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এক ধর্মীয় দর্শন থেকে এই বিচ্ছিন্নতার মিথলজির উদ্ভব হয়েছে। প্রায় সকলেই গুপ্তহত্যার শিকার, কারাবন্দি, দেশান্তরী এবং সবশেষে খলিফাদের হাতে নিশ্চিহ্ন হয়েছেন এমন ইমামদের কিংবদন্তী রাজনীতি ও ধর্মের মৌল সমন্বয়হীনতা তুলে ধরে। রাজনৈতিক জীবন লোগোসের এখতিয়ার, একে অবশ্যই ভবিষ্যৎমুখী, বাস্তবভিত্তিক হতে হবে, একে আপোস করতে জানতে হবে, পরিকল্পনা করতে হবে, যৌক্তিক ভিত্তিতে সমাজকে সংগঠিত করতে হবে। একে ধর্মের চরম চাহিদা ও জমিনে জীবনের গম্ভীর বাস্তবতার ভেতর ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। প্রাক আধুনিক কৃষিভিত্তিক সমাজ একটি মৌলিক বৈষম্যের উপর ভিত্তি করে গঠিত ছিল, এটা কৃষকদের শ্রমের উপর নির্ভর করত যারা সভ্যতার ফল ভোগ করতে পারত না। অ্যাক্সিয়াল যুগের (c. ৭০০-২০০ বিসিই) মহান কনফেশনাল ধর্মগুলোর সবকটাই এই টানাপোড়েনে ব্যস্ত ছিল, একে সামাল দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছে। সম্পদের পরিমাণ যেখানে অপ্রতুল আর যেখানে প্রযুক্তি ও যোগাযোগের অভাব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা কঠিন করে তোলে, সেখানে রাজনীতি অনেক বেশি নিষ্ঠুর ও আগ্রাসীভাবে বাস্তবভিত্তিক হয়ে ওঠে। সুতরাং, যেকোনও সরকারের পক্ষে ইসলামি আদর্শ অনুযায়ী সরকার পরিচালনা বা এর ঘাটতিসমূহ দুঃখজনকভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া স্বর্গীয় প্রজ্ঞার মূর্ত প্রতীক ইমামদের অস্তিত্ব সহ্য করা ছিল অসম্ভব। ধর্মীয় নেতারা যাচ্ছেতাই অপচয়ের বিরুদ্ধে নিন্দা, সমালোচনা বা প্রতিবাদ জানাতে পারতেন, কিন্তু এক ধরনের করুণ অর্থে পবিত্রকে হয় প্রান্তিকায়িত বা সীমার ভেতর রাখতে হয়েছে, যেমন করে খলিফাগণ সামারার আসকারী দুর্গে ইমামদের আটক করে রেখেছিলেন। কিন্তু এক আদর্শের প্রতি শিয়া ভক্তিতে মাহাত্ম্য ছিল যাকে অবশ্যই টিকিয়ে রাখার দরকার ছিল, যদিও গোপন ইমামের মতো সেটা ছিল সুপ্ত এবং বর্তমানে স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত বিশ্বে কাজ করতে অক্ষম।

শিয়া মতবাদ পৌরাণিক ধর্মবিশ্বাসে পরিণত হলেও তার মানে তা অযৌক্তিক ছিল না। আসলে শিয়াবাদ সুন্নাহর চেয়ে ইসলামের অধিকতর যৌক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভাষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শিয়ারা আবিষ্কার করেছিল যে, তারা মুতাযিলি নামে পরিচিত সুন্নি ধর্মতাত্ত্বিকদের সাথে সহমত পোষণ করে। কোরানের বিভিন্ন মতবাদকে যৌক্তিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল এরা। অন্যদিকে মুতাযিলিরাও শিয়া মতবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। প্যারাডক্সিকালি অকাল্টেশনের অযৌক্তিক মতবাদ শিয়া উলেমাদের সুন্নি উলেমাদের চেয়ে কর্মকাণ্ডের বাস্তব জগতে তাদের অনেক বেশি ক্ষমতা প্রয়োগের স্বাধীনতা দিয়েছিল। গোপন ইমাম আর নাগালের মধ্যে না থাকায় বৃদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার উপর নির্ভর করতে হত তাদের। সুতরাং, শিয়া মতবাদে সুন্নাহর মতো ‘ইজতিহাদের দুয়ার’ কোনওদিনই রুদ্ধ হয়নি।৩৫ এটা ঠিক, শিয়ারা প্রথমে ইমাম অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় মানসিকভাবে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ত্রয়োদশ শতাব্দী নাগাদ একজন বিশিষ্ট ও জ্ঞানী শিয়া যাজক ঠিক মুজতাহিদ হিসাবেই পরিচিত ছিলেন, ইজতিহাদের যৌক্তিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষমতাশালী বলে মনে করা হত তাঁকে।

অবশ্য শিয়া যুক্তিবাদ আমাদের বর্তমান পাশ্চাত্যের সেক্যুলারাইজড যুক্তিবাদ হতে ভিন্ন ছিল। শিয়ারা প্রায়শঃই সমালোচনামুলক চিন্তাবিদ ছিল। উদাহরণ স্বরূপ, একাদশ শতাব্দীর পণ্ডিত মুহাম্মদ আল-মুইদ ও মুহাম্মদ আল-তুসি পয়গম্বর ও তাঁর কয়েকজন সহচরের হাদিস প্রতিবেদনের সঠিকতা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাঁরা মনে করেছিলেন, তাঁদের মতবাদের সমর্থনে এইসব অবিশ্বস্ত ট্র্যাডিশন উদ্ধৃত করা যথেষ্ট হবে না, বরং তার বদলে যাজকদের উচিত হবে যুক্তি ও বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করা; কিন্তু তারপরেও তাঁদের তুলে ধরা যৌক্তিক বক্তব্য আধুনিক সংশয়বাদীকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না। উদাহরণ স্বরূপ, তুসি ইমামতের মতবাদ ‘প্রমাণ’ করতে গিয়ে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, যেহেতু আল্লাহ শুভ ও তিনি আমাদের মুক্তি চান, তো এটা বিশ্বাস করাই যুক্তিসঙ্গত যে তিনিই আমাদের অনির্বচনীয় পথ-নির্দেশ যোগাবেন। নারী-পুরুষ সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রয়োজনীয়তা আবিষ্কার করতে পারে, কিন্তু স্বর্গীয় বিধি এই বিষয়টিকে আরও জরুরি করে তোলে। এমনকি তুসিও অকাল্টেশনের পক্ষে যুক্তি খুঁজতে গিয়ে দিশাহারা বোধ করেছেন।৩৬ কিন্তু শিয়াদের কাছে এটা অস্বস্তিকর ছিল না। মিথোস ও লোগোস, যুক্তি ও প্রত্যাদেশ, পরস্পর বিরোধী ছিল না, বরং স্রেফ একটি অপরটি থেকে ভিন্ন এবং সম্পূরক। আধুনিক পশ্চিমে আমরা যেখানে সত্যির উৎস হিসাবে মিথোলজি ও অতীন্দ্রিয়বাদকে নাকচ করে কেবল যুক্তির উপর নির্ভর করে থাকি; তুসির মতো একজন চিন্তাবিদ চিন্তার উভয় পথকেই বৈধ ও প্রয়োজনীয় হিসাবে দেখেছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে, অতীন্দ্রিয় ধ্যানে মগ্ন থাকার সময় নিখুঁত অর্থ প্রকাশকারী মতবাদসমূহ ইসলামি প্রেক্ষিতেও যুক্তিসঙ্গত। ধ্যানের অন্তর্মুখী কৌশলসমূহ এমন অন্তর্দৃষ্টির যোগান দেয় যেগুলো তাদের নিজস্ব বলয়ে সঠিক, কিন্তু সেগুলোকে লোগোসের সৃষ্টি কোনও গাণিতিক সমীকরণের মতো যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রমাণ করা যাবে না।

পঞ্চদশ শতকের শেষ নাগাদ, আমরা যেমন দেখেছি, বেশিরভাগ শিয়াই আরব ছিল এবং শিয়াবাদ বিশেষত ইরাকে দুটি উপাসনালয়ের শহর যথাক্রমে ইমাম আলি ও ইমাম হুসেইনের প্রতি নিবেদিত নাজাফ ও কারবালায় শক্তিশালী ছিল। বেশিরভাগ ইরানিই ছিল সুন্নি, যদিও ইরানি শহর কুম সব সময়ই শিয়াদের কেন্দ্র ছিল। রাঈ, কাশা ও খোরাশানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিয়ার বাস ছিল। তো সুফিবাদের সাফাভিয় ধরনের নেতা উনিশ বছর বয়স্ক শাহ ইসমাইলকে স্বাগত জানানোর মতো ইরানি ছিল। ১৫০১ সালে তাব্রিয দখল করেন তিনি ও পরের এক দশকের মধ্যেই ইরানের বাকি অংশ অধিকার করে নেন। তিনি ঘোষণা করেন, শিয়া মতবাদই নতুন সাফাভিয় সাম্রাজ্যের রাষ্ট্র ধর্ম হবে। নিজেকে সপ্তম ইমামের বংশধর দাবি করেছিলেন ইসমাইল, যা তাঁকে অন্য মুসলিম শাসকদের যা ছিল না সেই বৈধতা দিয়েছে বলে বিশ্বাস করতেন। ৩৭

কিন্তু এটা নিশ্চিতভাবেই শিয়া ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুতি ছিল। ‘দ্বাদশবাদী’ (দ্বাদশ ইমামের প্রতি তাদের শ্রদ্ধার কারণে) অধিকাংশ শিয়া বিশ্বাস করত যে, গোপন ইমামের অনুপস্থিতিতে কোনও সরকারই বৈধ হতে পারে না।৩৮ তাহলে কেমন করে ‘রাষ্ট্রীয় শিয়াবাদ’ থাকতে পারে? এতে অবশ্য ইসমাইলের কোনও সমস্যা হয়নি। দ্বাদশবাদী অর্থডক্সি সম্পর্কে তেমন কিছু জানা ছিল না তাঁর। মঙ্গোল আগ্রাসনের অব্যবহতি পরে প্রতিষ্ঠিত অতীন্দ্রিয় ভ্রাতৃসংঘ সাফাভিয় গোষ্ঠী মূলত সুফি সংস্থা ছিল কিন্তু প্রাচীন শিয়া মতবাদের বহু ‘চরম’ (গুলুউ) ধারণা গ্রহণ করেছিল। ইসমাইল বিশ্বাস করতেন যে, ইমাম আলি স্বর্গীয় ছিলেন, এবং স্বর্ণযুগের উদ্বোধন ঘটাতে অচিরেই ফিরে আসবেন শিয়া মেসায়াহ। তিনি হয়তো শিষ্যদের এও বলে থাকতে পারেন যে, তিনিই সেই গোপন ইমাম, অড়াল ছেড়ে বের হয়ে এসেছেন। সাফাভিয় ব্যবস্থা ছিল প্রান্তিক, জনপ্রিয়তামুখী বিপ্লবী দল, শিয়া বিশেষ নিগূঢ় ধারা থেকে অনেক ভিন্ন।৩৯ শিয়া রষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইসমাইলের কোনও রকম দ্বিধা ছিল না, জাফর আস-সাদিকের আমল থেকেই শিয়ারা যেমন করে আসছিল, সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠের সাথে একটা সভ্য মোদাস ভিভেন্দি’র খোঁজ করার বদলে ধর্মান্ধভাবে সুন্নি বিরোধী ছিলেন তিনি। অটোমান ও সাফাভিয় সাম্রাজ্যে এক নতুন উপদলীয় অসহিষ্ণুতা দেখা দিয়েছিল; একই সময়ে ইউরোপে প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকদের ভেতর দেখা দেওয়া বিবাদের চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন ছিল না সেটা। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অটোমানরা তাদের এলাকায় শিয়াদের প্রান্তিকায়িত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। ইসমাইল যখন ইরানে আবির্ভূত হন, তিনিও সমানভাবে সেখানকার সুন্নাহকে নিশ্চিহ্ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠেন।

অবশ্য সাফাভিয়দের এটা আবিষ্কার করতে বেশি সময় লাগেনি যে, বিরোধী অবস্থানে থাকার সময় মেসিয়ানিক ‘চরমপন্থী’ আদর্শ কাজে এলেও এখন ক্ষমতায় আসার পর সেটা জুৎসই ঠেকছে না। প্রাচীন গুলুউ ধর্মতত্ত্ব মুছে ফেলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শাহ প্রথম আব্বাস (১৫৮৮-১৬২০) আমলাতন্ত্র থেকে চরমপন্থীদের বরখাস্ত করেন। দ্বাদশবাদী অর্থডক্সি প্রচারের জন্যে আরব থেকে শিয়া উলেমাদের আমদানি করেন তিনি। নতুন রাজধানী ইস্পাহান ও হিল্লায় তাঁদের জন্যে মাদ্রাসা নির্মাণ করেন, তাঁদের পক্ষে সম্পত্তি অর্পণ করেন (ওয়াকফ) ও উদার হাতে তাঁদের উপহার দেন। গোড়ার দিকে এই পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন ছিল, কারণ নতুন অভিবাসী হিসাবে উলেমারা শাহর উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু অনিবার্যভাবে শিয়া মতবাদের প্রকৃতি পাল্টে দিয়েছিলেন। শিয়ারা সব সময়ই সংখ্যালঘু দল ছিল। তাদের নিজস্ব মাদ্রাসা ছিল না, সব সময়ই একে অন্যের বাড়িতে পড়াশোনা করেছেন, বিতর্ক করেছেন। এখন শিয়ারা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছিল। ইস্পাহান শিয়া মতবাদের সরকারী বিদ্যাপীঠে পরিণত হয়।৪১ শিয়ারা সব সময়ই এর আগে সরকার থেকে দূরে অবস্থান করেছে, কিন্তু এখন উলেমাগণ ইরানের শিক্ষা ও আইনি ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ এবং আরও নির্দিষ্টভাবে সরকারের ধর্মীয় দায়িত্বও হাতে তুলে নিয়েছিলেন। প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র ছিল ইরানিদের সমন্বয়ে গঠিত, তখনও সুন্নাহর প্রতি অনুগত ছিল তারা, সুতরাং, তাদের আরও বেশি সেক্যুলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইরানি সরকারে সেক্যুলার ও ধর্মীয় বলয়ে একটা চলমান বিভাজন দেখা দিয়েছিল।৪২

উলেমগণ অবশ্য সাফাভিয় রাষ্ট্র সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন। তখনও তাঁরা সরকারী পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিলেন, নিজেদের প্রজা হিসাবে দেখতেই পছন্দ করতেন। সুতরাং, তাদের অবস্থান ছিল অটোমান উলেমাদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন, কিন্তু সহজাতভাবে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী। শাহদের উদারতা ও পৃষ্ঠপোষকতা উলেমাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন করে দিয়েছিল। অটোমান ও তাদের উত্তরাধিকারীরা যেখানে সব সময়ই ভর্তুকী প্রত্যাহার বা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার হুমকি দিয়ে উলেমাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারত, সেখানে শিয়া উলেমাদের এভাবে ভয় দেখানোর উপায় ছিল না। ইরানি জনগণের মাঝে শিয়া মতবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে তাঁরা এই বাস্তবতা থেকে লাভবান হচ্ছিলেন যে শাহগণ নন, বরং তাঁরাই গোপন ইমামের একমাত্র প্রকৃত মুখপাত্র। অবশ্য গোড়ার দিকের সাফাভিয়রা উলেমাদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম ছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইরানের জনগণ পুরোপুরি শিয়া মতবাদে দীক্ষিত হওয়ার আগে যাজকগোষ্ঠী সম্পূর্ণ নিজেদের মতো হয়ে উঠতে পারেনি।

কিন্তু ক্ষমতা দুর্নীতিগ্রস্ত করে। উলেমাগণ সাফাভিয় সাম্রাজ্যে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার সাথে সাথে অনেক বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ ও এমনকি গোঁড়া হয়ে উঠতে লাগলেন। শিয়া মতবাদের কিছু অধিকতর আকর্ষণীয় গুণাবলী চাপা পড়ে যায়। এই নতুন কঠোর পন্থা মূর্ত করে তোলেন সর্বকালের অন্যতম ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী উলেমা মুহাম্মদ বাকির মজলিসি (মৃ. ১৭০০)। শত শত বছর ধরে শিয়ারা ঐশীগ্রন্থের এক ধরনের উদ্ভাবনী প্রকৃতির কৌশল অনুসরণ করে এসেছে। কিন্তু অতীন্দ্রিয় ও দার্শনিক আঁচঅনুমানের প্রবল বিরোধী ছিলেন মজলিসি। দুটোই ছিল প্রাচীন নিগূঢ়বাদী শিয়া মতবাদের মূলধারা। তিনি ইরানে অবশিষ্ট সুফিদের উপর নিরলসভাবে নির্যাতনের সূচনা করেন ও ফালসাফাহ নামে পরিচিত দার্শনিক যুক্তিবাদ ও ইস্ফাহানে অতীন্দ্রিয় দর্শন দমন করার প্রয়াস পান। এভাবে অতীন্দ্রিয়বাদ ও দর্শনের প্রতি এক গভীর অবিশ্বাসের সূচনা করেছিলেন তিনি এখনও যা বর্তমান ইরানে টিকে আছে। কোরানের নিগূঢ় পাঠে মগ্ন হওয়ার বদলে শিয়া পণ্ডিতদের ইসলামি জুরিসপ্রুডেন্স ফিকহর প্রতি মনোনিবেশে উৎসাহিত করা হয়েছে।

হুসেইনের সম্মানে আয়োজিত আচরিক মিছিলের অর্থও পাল্টে দিয়েছিলেন মজলিসি।” আরও বিস্তৃত হয়ে উঠেছিল এসব: এখন সবুজ কাপড়ে ঢাকা উটের পিঠে ইমামের পরিবারের প্রতিনিধি হিসাবে ক্রন্দনরত নারী ও শিশুরা বসে থাকে, সৈনিকরা আকাশের দিকে ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে, গভর্নর, গণ্যমান্য লোকজন ও মানুষের জটলা ইমাম ও তাঁর শাহাদৎ বরণকারী সহচরদের প্রতীক কফিন অনুসরণ করে, এরা ছুরি দিয়ে নিজেদের আঘাত হেনে আহত করে।৫ কারবালা কাহিনীর দারুণ আবেগঘন বর্ণনা-রাওদা-খানি (‘রাওদাতের আবৃত্তি’) নামে পরিচিত বিশেষ অনুষ্ঠানে ইরাকি শিয়া ওয়াইজ কাশিফট (মৃ. ১৫০৪) রচিত রাওদাহ আশ-শাহাদা রাওদা-খানি জমায়েতে আবৃত্তি করা হত, জনতা জোরে চিৎকার করে বিলাপ করত, কাঁদত। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জীবন দিয়ে লড়াই করার জনগণের ইচ্ছা তুলে ধরায় এইসব আচারের সবসময়ই এক ধরনের বিপ্লবী সম্ভাবনা ছিল। এখন অবশ্য, জনগণকে হুসেইনকে একটা নজীর হিসাবে দেখার জন্যে উৎসাহিত করার পরিবর্তে মজলিসি ও তাঁর যাজকগোষ্ঠী শিক্ষা দিতে লাগলেন যেন তাঁকে একজন পৃষ্ঠপোষক হিসাবে বিবেচনা করা হয় যিনি তাঁর মৃত্যুর জন্যে শোক প্রকাশ করার মাধ্যমে ভক্তি দেখাতে পারলে তাদের বেহেশতে গমন নিশ্চিত করতে পারবেন। এবার স্থিতাবস্থার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে আচার অনুষ্ঠানগুলো জনগণকে শক্তিমানের পক্ষে আনুকূল্য দেখিয়ে কেবল নিজেদের স্বার্থের প্রতি খেয়াল রাখার শিক্ষা দিয়েছে। ৬ এটা ছিল পুরোনো শিয়া আদর্শের নপুংসকীকরণ ও অবমূল্যায়ন; এটা রক্ষণশীল রীতিনীতিকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। জনগণকে অস্তিত্বের মৌল বিধিবিধান ও ছন্দের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করার বদলে কাল্টকে কেবল বিপুল জনগোষ্ঠীকে সামাল দিয়ে রাখার কাজে লাগানো হয়েছে। এটা এমন এক পরিবর্তন ছিল যা সম্পূর্ণ ভিন্ন উপায়ে দেখায় যে, বিধ্বংসী রাজনৈতিক ক্ষমতা ধর্মের কী ক্ষতি করতে পারে।

মজলিসির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল ইস্ফাহানে মির দামাদ (মৃ. ১৬৩১) ও শিষ্য মোল্লাহ সম্রা (মৃ. ১৬৪০) হাতে বিকশিত অতীন্দ্রিয় দর্শন। সদ্রা এমন একজন চিন্তাবিদ ছিলেন ভবিষ্যৎ ইরানি প্রজন্মের উপর যার গভীর প্রভাব সৃষ্টি হবে।৪৭ মির দামাদ ও মোল্লাহ সদ্রা উলেমাদের কারও কারও নতুন অনমনীয় মনোভাবের দারুণ বিরোধী ছিলেন। একে তাঁরা শিয়া মতবাদ, এমনকি প্রকৃতপক্ষে সকল ধর্মের সামগ্রিক বিকৃতি বলে বিবেচনা করেছেন। প্রাচীন কালে শিয়ারা ঐশীগ্রন্থের গোপন অর্থ সন্ধানের সময় নীরবে মেনে নিয়েছিল যে স্বর্গীয় সত্যি সীমানাহীন, নতুন নতুন ধারণা সব সময়ই সম্ভব; কোরানের কোনও একক ব্যাখ্যা যথেষ্ট হতে পারে না। মির দামাদ ও মোল্লা সদ্রার চোখে সত্যিকারের জ্ঞান কোনওদিনই বুদ্ধিবৃত্তিক সমরূপতার ব্যাপার ছিল না। কোনও সাধু বা ধর্মীয় কর্তৃপক্ষই, তিনি যত মহান বা বিশিষ্টই হোন না কেন, সত্যির উপর একচেটিয়া অধিকার দাবি করতে পারেন না।

তাঁরা স্পষ্টভাবে রক্ষণশীল বিশ্বাস প্রকাশ করেছেন যে মিথোলজি ও যুক্তি উভয়ই মানব জীবনের পক্ষে আবশ্যক, একটি দিয়ে সম্পূরক না হলে অপরটি হারিয়ে যায়। মির দামাদ ছিলেন স্বভাব বিজ্ঞানী এবং ধর্মতাত্ত্বিকও। মোল্লা সদ্রা উলেমাদের পৌরাণিক স্বজ্ঞার দর্শনকে খাট করার জন্যে ও যৌক্তিক চিন্তার গুরুত্বকে বিসর্জন দিতে সুফিদের সমালোচনা করেছেন। প্রকৃত দার্শনিককে অ্যারিস্টটলের মতো যুক্তিবাদী হতে হবে, কিন্তু তারপরই তাঁকে নিজেকে অতিক্রম করে সত্যের এক নিগূঢ় কল্পনা নির্ভর উপলব্ধিতে পৌঁছুতে হবে। উভয় চিন্তকই অবচেতনের ভূমিকার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন, একে তাঁরা এমন এক পর্যায় হিসাবে বর্ণনা করেছেন যা ইন্দ্রিয়জ ধারণা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিমূর্ততায় অস্তিত্ববান। অতীতে সুফি দার্শনিকগণ এই মনস্তাত্ত্বিক অঞ্চলকে আলম আল-মিথাল বা খাঁটি ইমেজের জগৎ হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন। দিব্যদৃষ্টির বলয় এটা, আমরা যাকে অবচেতন বলব সেখান থেকে আগত, স্বপ্ন ও সম্মোহনী ইমেজারিতে যা মনের চেতন স্তরে উঠে আসে, কিন্তু অতীন্দ্রিয়দের কোনও কোনও অনুশীলন ও স্বজ্ঞামূলক চর্চার মাধ্যমেও যার নাগাল পাওয়া সম্ভব। মির দামাদ ও মোল্লা সদ্রা দুজনই জোর দিয়ে বলেছেন যে, যৌক্তিক বিশ্লেষণে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেলেও এইসব দিব্য দর্শন কেবল ধারণাগত কল্পনা নয়, বরং এসবের সুনির্দিষ্ট বাস্তবতা রয়েছে। এগুলোকে ‘কাল্পনিক’ বলে অবাস্তব হিসাবে বাতিল করার বদলে-একজন আধুনিক যুক্তিবাদী যেমনটা করতে পারে-আমাদের উচিত হবে আমাদের অস্তিত্বের এই পার্থক্যের দিকে নজর দেওয়া। সচেতন নির্মাণের পক্ষে এর অবস্থান অনেক গভীরে, কিন্তু আমাদের আচরণ ও ধারণার উপর এর গভীর প্রভাব রয়েছে। আমাদের স্বপ্ন বাস্তব, এগুলো আমাদের একটা কিছু বলে; স্বপ্নে আমরা কাল্পনিক কিছুর অভিজ্ঞতা লাভ করি। মিথোলজি ছিল অবচেতনের অভিজ্ঞতাকে ইমেজারিতে সংগঠিত করার প্রয়াস, নারী-পুরুষকে যা এইসব মৌলিক অঞ্চলকে তাদের নিজস্ব সত্তার সাথে সম্পর্কিত করতে সফল করে তুলত। বর্তমানে লোকে অবচেতন মনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে একই ধরনের ধারণা পেতে সাইকোঅ্যানালিস্টের শরণাপন্ন হয়ে থাকে। দামাদ ও মোল্লা সদ্রা জোরের সাথে বলেছেন যে, কেবল যৌক্তিকভাবে, প্রকাশ্যে ও আইনসম্মভাবে ধারণা করা কিছুই একমাত্র সত্যি নয়। এর একটা অন্তস্থঃ মাত্রা রয়েছে যা আমাদের স্বাভাবিক চেতন মনের কর্মকাণ্ড দিয়ে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।

এটা অনিবার্যভাবে কোনও কোনও উলেমাকে কট্টরপন্থী শিয়াদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে দিয়েছিল। মোল্লা সদ্রাকে ইস্ফাহান থেকে বিতাড়িত করে তারা। দশ বছর কুমের কাছে এক ছোট গ্রামে বাস করতে বাধ্য হন তিনি। এই নির্জনবাসের সময় বুঝতে পারেন যে, অতীন্দ্রিয় দর্শনের প্রতি ভক্তি সত্ত্বেও ধর্মের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এখনও বড় বেশি বৃদ্ধিবৃত্তিক রয়ে গেছে। জুরিসপ্রুডেন্স (ফিকহ) বা বাহ্যিক ধর্মতত্ত্বের পাঠ কেবল ধর্ম সম্পর্কে আমাদের তথ্য যোগাতে পারে, এটা ধর্মীয় অনুসন্ধানের মূল লক্ষ্য আলোকন বা ব্যক্তিগত পরিবর্তন এনে দিতে পারে না। কেবল মনোসংযোগের অতীন্দ্রিয় অনুশীলন গুরুত্বের সাথে চর্চা শুরু ও আপন সত্তার মাঝে গভীরভাবে আলম আল-মিথালে অবতরণের পরই তাঁর হৃদয়ে ‘আগুন জ্বলে উঠেছিল’ এবং ‘স্বর্গীয় জগতের আলোক আমার সামনে জ্বলে ওঠে…আমি আগে বুঝতে পারিনি এমন সব রহস্য উদ্ধার করতে সক্ষম হয়ে উঠি,’ তাঁর মহৎ সৃষ্টি আল-আসফার আল-আরবা’হ-তে (দ্য ফোর জার্নিজ অভ সোউল) পরে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।

সদ্রার অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা মানুষের পক্ষে এই জগতেই পূর্ণাঙ্গতা লাভ করা সম্ভব বলে নিশ্চিত করেছিল তাঁকে। কিন্তু রক্ষণশীল চেতনার প্রতি বিশ্বস্ত হওয়ায় তিনি যে সম্পূর্ণতার কথা কল্পনা করেছিলেন সেটা নতুন ও উচ্চতর এক পর্যায়ে উত্তরণ নয় বরং আব্রাহাম ও অন্যান্য পয়গম্বরের আদি খাঁটি দর্শনে প্রত্যাবর্তন ছিল। সকল অস্তিত্বের উৎস আল্লাহয়ও প্রত্যাবর্তন ছিল এটা। কিন্তু তাঁর মানে এই ছিল না যে অতীন্দ্রিয়বাদী এই জগৎকে ত্যাগ করেছেন। দ্য ফোর জার্নিজ অভ দ্য সোউল-এ এক ক্যারিশম্যাটিক রাজনৈতিক নেতার অতীন্দ্রিয় অভিযাত্রার বর্ণনা করেছেন তিনি। প্রথমে তাঁকে অবশ্যই মানুষের কাছ থেকে আল্লাহ’র উদ্দেশে যাত্রা করতে হবে। এরপর স্বর্গীয় বলয়ে ভ্রমণ করবেন তিনি যতক্ষণ না আল্লাহ’র বিভিন্ন গুণাবলী নিয়ে ধ্যান করে সেগুলোর অবিচ্ছেদ্য ঐক্যের ব্যাপারে সহজাত চেতনায় পৌঁছেন। এভাবে আল্লাহ’র মুখাবয়বের দিকে চোখ রেখে তিনি বদলে যান ও একশ্বরবাদের আসল অর্থ সম্পর্কে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও ইমামদের অনুভূত বোধের অনুরূপ এক অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেন। তৃতীয় যাত্রায় নেতা আবার মানব জাতির কাছে ফিরে এসে আবিষ্কার করেন যে, এখন তিনি জগৎকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে দেখছেন। তাঁর চতুর্থ ও চূড়ান্ত অন্বেষণ হচ্ছে এই জগতে আল্লাহ’র বাণী প্রচার করা, স্বৰ্গীয় আইন প্রতিষ্ঠার নতুন পথ বের করা ও আল্লাহ’র ইচ্ছা অনুযায়ী সমাজকে নতুন করে নির্মাণ করা।৫° এটা এমন এক দর্শন যা সমাজের পূর্ণতাকে যুগপৎ আধ্যাত্মিক উন্নতির সাথে সম্পর্কিত করে। অতীন্দ্রিয় ও ধর্মীয় গুরুত্ব ছাড়া এই মর্ত্য জগতে ন্যায়বিচার ও সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না। ইহজগতে সমাজকে পরিবর্তিত করতে অত্যাবশ্যক যৌক্তিক প্রয়াস একে অর্থ প্রদানকারী পৌরাণিক ও অতীন্দ্রিয় পরিপ্রেক্ষিত হতে অবিচ্ছেদ্য আবিষ্কার করে দ্বাদশবাদী শিয়ামতবাদে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া রাজনীতি ও আধ্যাত্মিকতার সংশ্লেষ ঘটিয়েছে মোল্লা সদ্রার দর্শন। মোল্লাহ সদ্রা এভাবে শিয়া নেতৃত্বের এক নতুন আদর্শের প্রস্তাব রেখেছিলেন আমাদের কালেও ইরানের রাজনীতিতে যার গভীর প্রভাব অব্যাহত থাকবে।

মোল্লা সদ্রার দর্শনের অতীন্দ্রিয় রাজনৈতিক নেতার ঐশী অন্তর্দৃষ্টি থাকতে পারে, কিন্তু তার মানে এই ছিল না যে তিনি শক্তি দিয়ে নিজের মত ও ধর্মীয় অনুশীলন অন্যের উপর চাপিয়ে দেবেন। তেমন কিছু করলে সদ্রার দৃষ্টিতে তিনি ধর্মের সত্যির মুল সত্তাকে অস্বীকার করেছেন। উলেমাদের ক্রমবর্ধমান শক্তির প্রবল বিরোধিতা করেছেন সদ্রা। সপ্তম শতাব্দীতে ইরানে ক্রমশ শেকড় ছড়াতে থাকা এক নতুন ধারণার কারণে বিশেষভাবে অস্বস্তিতে ভুগছিলেন তিনি। কিছু কিছু উলেমা এই সময় বিশ্বাস করেছিলেন যে, উলেমারাই গোপন ইমামদের একমাত্র আনুষ্ঠানিক মুখপাত্র হওয়ায় বেশির ভাগ মুসলিমই নিজে থেকে বিশ্বাসের মৌল বিষয়সমূহ (উসুল) ব্যাখ্যা করতে অক্ষম, সাধারণ জনগণকে তাই এমন একজন মুজতাহিদ নির্বাচন করতে হবে যিনি ইজতিহাদের (‘স্বাধীন যুক্তিপ্রয়োগ’) চর্চা করার ক্ষমতা রাখেন বলে প্রতীয়মান এবং তাঁর আইনি শিক্ষার উপর ভিত্তি করেই নিজেদের আচরণকে গড়ে তোলা উচিত। উসুলিদের-এই মতবাদের অনুসারীদের এই নামেই ডাকা হত—এইসব দাবি শুনে ভীত হয়ে উঠেছিলেন সদ্রা। ১ তাঁর দৃষ্টিতে এমন দাসত্বমূলক অনুকরণের (তাকলিদ) উপর নির্ভরকারী যেকোনও ধর্ম সহজাতভাবে ‘দূষিত’৷৫২ সকল শিয়াই পয়গম্বর ও ইমামদের ট্র্যাডিশন (আকবার) বোঝার ক্ষমতা রাখে এবং প্রার্থনা ও আচারআচরণের ভেতর দিয়ে প্রাপ্ত আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি ও যুক্তির উপর ভিত্তি করে নিজেরাই সমাধান বের করার উপযুক্ত।

সপ্তদশ শতাব্দী গড়িয়ে যাবার সাথে সাথে উসুলি ও তাদের বিরোধীদের সংঘাত আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সাফাভিয় শক্তির তখন পতন শুরু হয়েছে, সমাজ ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। সাধারণ জনগণ শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের একমাত্র উপযুক্ত শক্তি উলেমাদের মুখাপেক্ষী হয়ে ছিল, কিন্তু আপন ক্ষমতার প্রকৃতি নিয়ে নিজেদের ভেতরই বিরোধে লিপ্ত ছিলেন তাঁরা। এই পর্যায়ে অধিকাংশ ইরানি উসুলিদের বিরোধিতা করেছে, অতীতের ঐতিহ্যের উপর নির্ভরকারী তথাকথিত আকবারিদের অনুসরণ করেছে। আকবারিরা ইজতিহাদের প্রয়োগের নিন্দা জানিয়ে কোরান ও সুন্নাহর সংকীর্ণ আক্ষরিক অর্থের পৃষ্ঠপোষকতা করত। তারা জোর দিয়ে বলেছে যে, সকল আইনি সিদ্ধান্তকে অবশ্যই কোরান, পয়গম্বর বা ইমামদের সুস্পষ্ট বিবৃতি ভিত্তিক হতে হবে। এমন কোনও ঘটনা যদি ঘটে যার বেলায় কোনও স্পষ্ট বিধি নেই, মুসলিম জুরিস্ট অবশ্যই নিজের বিচার বিবেচনার উপর নির্ভর না করে বরং বিষয়টি সেক্যুলার আদালতে পাঠাবেন।৫৩ উসুলিরা অধিকতর নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করতে চেয়েছিল। ইসলামি ট্র্যাডিশনের অনুসৃত নীতিমালার ভিত্তিতে জুরিস্টগণ নিজস্ব যুক্তির ক্ষমতা প্রয়োগ করে বৈধ সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারতেন। তাঁরা ভেবেছিলেন যে আকবারিরা এমনভাবে অতীতে জড়িয়ে পড়বে যে ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স আর নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে না। গোপন ইমামের অনুপস্থিতিতে, যুক্তি দেখিয়েছে তারা, কোনও জুরিস্টই শেষকথা বলতে পারবেন না, আর কোনও পূর্ব নজীরই বাধ্যতামূলক হবে না। প্রকৃতপক্ষেই, তাঁরা এতদূর পর্যন্ত বলেছেন যে, অতীতের সম্মানিত কর্তৃত্বকে অনুসরণ করার বদলে বিশ্বাসীদের সব সময়ই কোনও একজন জীবিত মুজতাহিদের বিধান মেনে চলা উচিত। উভয় পক্ষই সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার একটা সময়ে রক্ষণশীল চেতনায় স্থির থাকার প্রয়াস পাচ্ছিল এবং উভয়ই প্রধানত স্বর্গীয় বাণী নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। আকবারি বা উসুলিদের কেউই বুদ্ধিবৃত্তিক সমরূপতার উপর জোর দেয়নি; এটা ছিল স্রেফ আচরণ বা ধর্মীয় অনুশীলনের ক্ষেত্রে বিশ্বাসীকে কার কাছে নতি স্বীকার করতে হবে, ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক অর্থের কাছে নাকি কোনও মুজতাহিদের কাছে সেই প্রশ্ন। তবু দুই পক্ষই একটা কিছু হারিয়েছিল। আকবারিরা আইনে মূৰ্ত আদিম স্বর্গীয় আজ্ঞাকে অতীতের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের সাথে গুলিয়ে ফেলেছে, পরিণত হয়েছে অক্ষরবাদীতে; আবিশ্যিকভাবে প্রাচীন শিয়া মতবাদের প্রতীকী ধর্মের সাথে তাদের সম্পর্ক হারিয়ে গিয়েছিল। তাদের চোখে বিশ্বাস পরিণত হয়েছিল বাহ্যিক কিছু নির্দেশনার ধারায়। মানুষের যুক্তির উপর অনেক বেশি আস্থা ছিল উসুলিদের, তাদের ধর্মের মিথোসে এখনও তা প্রোথিত আছে। কিন্তু বিশ্বাসীকে তাদের রায় মেনে নিতে হবে বলে জোর দিয়ে তারা মোল্লা সদ্রার ব্যক্তির পবিত্র স্বাধীনতায় বিশ্বাস খুইয়েছিল।

সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে রাষ্ট্রের দুর্বলতা পুষিয়ে দিতে পারবে এমন একটা আইনি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছিল, নেমে আসছিল অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা এবং পরবর্তীকালের শাহদের অযোগ্যতা রাষ্ট্রকে নাজুক করে তুলেছিল। ১৭২২ সালে আফগান গোত্রগুলো ইস্ফাহানে হামলা চালায়, নেহাত অসম্মানের সাথে আত্মসমর্পণ করে শহরটি। এক গোলযোগের যুগে প্রবেশ করে ইরান। কিছুদিনের জন্যে এমনও মনে হয়েছিল যে, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে এর অস্তিত্বও বুঝি থাকবে না। উত্তর দিক থেকে আগ্রাসন চালায় রাশানরা, পশ্চিম থেকে অটোমানরা। সুলতান হুসেইন শাহর তৃতীয় ছেলে দ্বিতীয় তাহমাস্প অবশ্য ইস্ফাহানের অবরোধ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। ইরানি আফসার গোত্রের সর্দার নাদির খানের সহায়তায় আগ্রাসীদের বিতাড়নে সফল হন তিনি। ১৭৩৬ সালে নাদির খান তাহমাস্পকে উৎখাত করে নিজেকেই সম্রাট ঘোষণা করেন। ১৭৪৮ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার আগে পর্যন্ত নিষ্ঠুর কিন্তু প্রায়শঃই দক্ষতার সাথে দেশটি শাসন করেছেন তিনি। তুর্কমান কাজার গোত্রের আকা মুহাম্মদ খান নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নেওয়ার আগ পর্যন্ত এক অন্ধকার অরাজক অন্তবর্তীকালীন সময় উপস্থিত হয়েছিল। ১৭৯৪ সালে শাসন সংহত করতে সক্ষম হন তিনি।৪ বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত ক্ষমতায় অবস্থান করে নতুন কাজার রাজবংশ।

এই বিষণ্ন বছরগুলোয় আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় পরিবর্তন ঘটে। নাদির খান ইরানে আবার সুন্নাহ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ব্যর্থ হন, ফলে নেতৃস্থানীয় উলেমারা ইস্ফাহান ছেড়ে ইরাকে অটোমান সাম্রাজ্যের মাজার শহর নাজাফ ও কারবালায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। একে প্রথমে বিপর্যয় মনে হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা উলেমাদের পক্ষে উপহার প্রমাণিত হয়েছে। কারবালা ও নাজাফে আরও বড় ধরনের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারী হয়ে ওঠেন তাঁরা। তাঁরা রাজনৈতিক শাহদের নাগালের বাইরে ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন ছিলেন। ক্রমে দরবারকে চ্যালেঞ্জ করার মতো অনন্য অবস্থানে পৌঁছে বিকল্প প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন। এই সময়ের দ্বিতীয় প্রধান পরিবর্তন ছিল বিশিষ্ট পণ্ডিত ওয়াহিদ বিহবেহানি (১৭০৫-৯২)-এর কিছুটা সহিংস পদ্ধতিতে অর্জিত উসুলিদের বিজয়। ইজতিহাদের ভূমিকা অনেক স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন তিনি, জুরিস্টদের পক্ষে এর প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিলেন। উসুলি অবস্থান মেনে নিতে অস্বীকারকারী যেকোনও শিয়াকে বিধর্মী হিসাবে নিষিদ্ধ করা হত, বিরোধিতাকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছে। কারবালা ও নাজাফে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘাতে কিছু সংখ্যক আকবারি প্রাণ হারায়। ইস্ফাহানের অতীন্দ্রিয় দর্শনও বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। সুফিবাদকে এমন বর্বরভাবে দমন করা হয়েছিল যে, বিহবেহানির ছেলে আলি সুফি-ঘাতক নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু, আমরা যেমন দেখেছি, ধর্মীয় বিষয়ে জোরজবরদস্তি সাধারণত উল্টো ফল দেয়, অতীন্দ্রিয়বাদ আত্মগোপনে চলে যায় এবং স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে সংঘর্ষ চালিয়ে যাওয়া ভিন্নমতাবলম্বী ও বুদ্ধিজীবীদের ধ্যানধারণাকে আকার দিতে থাকে। বিহবেহানির বিজয় ইরানি উলেমাদের পক্ষে রাজনৈতিক বিজয় ছিল। অরাজকতার উত্তাল সময়ে উসুলি অবস্থান জনপ্রিয় ছিল, কেননা এটা কিছু পরিমাণ শৃঙ্খলা নিয়ে আসার ক্যারিশম্যাটিক কর্তৃত্বের যোগান দিয়েছিল তাদের। মুজতাহিদগণ রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসতে সক্ষম ছিলেন, জনগণের মাঝে কখনওই ক্ষমতা হারাননি। কিন্তু ইমামদের আচরণ ও আদর্শ থেকে দূরবর্তী হওয়ায় স্বৈরাচারী উপায়ে অর্জিত বিহবেহানির বিজয় এক ধরনের ধর্মীয় পরাজয় ছিল।৫৬

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ অটোমান ও ইরানি সাম্রাজ্য উভয়ই বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল। কৃষি নির্ভর সভ্যতার সম্পদ ফুরিয়ে যাওয়ার অনিবার্য নিয়তি বরণ করে নিচ্ছিল এরা। অ্যাক্সিয়াল যুগের সময় থেকেই রক্ষণশীল চেতনা নারী-পুরুষকে গভীর স্তরে এই ধরনের সভ্যতার সীমাবদ্ধতা মেনে নিতে সাহায্য করে এসেছে। এর মানে এই ছিল না যে, রক্ষণশীল সমাজগুলো স্থবির ও অদৃষ্টবাদী ছিল। এই আধ্যাত্মিকতা ইসলামি বিশ্বে ব্যাপক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সাফল্য বয়ে এনেছিল। কিন্তু এই রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও শৈল্পিক প্রয়াস এক ধরনের পৌরাণিক পরিপ্রেক্ষিতে সম্পাদিত হয়েছিল, যা ইউরোপে বিকাশ লাভ করতে থাকা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ম্যল্যবোধের কাছে অচেনা হয়ে দাঁড়াবে। আধুনিক ইউরোপের বহু আদর্শ মুসলিমদের পক্ষে অনুকূল হবে। আমরা দেখেছি, তাদের ধর্মবিশ্বাস এমন প্রবণতার বিকাশ ঘটাতে উৎসাহিত করেছিল যা আধুনিক পাশ্চাত্যের পৃষ্ঠপোষকতা লাভকারী প্রবণতার অনুরূপ: সামাজিক ন্যায় বিচার, সাম্যবাদ, ব্যক্তির স্বাধীনতা, মানবীয় ভিত্তিক আধ্যাত্মিকতা, সেক্যুলার রাজনীতি, ব্যক্তিমুখী বিশ্বাস ও যৌক্তিক ধারণার চর্চা। কিন্তু নব্য ইউরোপের অন্যান্য বৈশিষ্টগুলো রক্ষণশীল রেওয়াজে গড়ে ওঠা মানুষের পক্ষে গ্রহণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে মুসলিমরা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ইউরোপিয়দের পেছনে পড়ে গিয়েছিল, এই সময় ইসলামি সাম্রাজ্যগুলো ও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, সেগুলো ইউরোপিয় রাষ্ট্রগুলোর কাছে নাজুক হয়ে দাঁড়ায়; এসব রাষ্ট্র বিশ্ব আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে প্রয়াস চালানোর প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে ভারতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে ব্রিটিশরা; এক নতুন সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল ফ্রান্স। ১৯শে মে, ১৭৯৮, নেপোলিয়ন বোনাপার্তে প্রাচ্যে ব্রিটিশ শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার লক্ষ্যে তুলন থেকে ৩৮,০০০ লোক ও ৪০০ জাহাজ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করল ফরাসী নৌবহর। ১লা জুলাই আলেকজান্দ্রিয়ার সৈকতে ৪,৩০০ সেনা অবতরণ করালেন নেপোলিয়ন, পরদিন ভোরের অল্প পরেই দখল করে নিলেন গোটা শহর।৫৭ এভাবে মিশরে একটা ঘাঁটি পেয়ে যান তিনি। সাথে করে পণ্ডিত, আধুনিক ইউরোপিয় সাহিত্যের একটা লাইব্রেরি, একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার ও আরবী হরফঅলা একটা ছাপাখানা নিয়ে এসেছিলেন নেপোলিয়ন। পশ্চিমের নতুন বৈজ্ঞানিক, সেক্যুলারিস্ট সংস্কৃতি আক্রমণ হানল মুসলিম বিশ্বে, কোনও কিছুই আর আগের মতো থাকবে না।

০৩. ক্রিশ্চান: সাহসী নতুন জগৎ (১৪৯২–১৮৭০)

ইহুদিরা যখন স্পেন থেকে তাদের বহিষ্কারের বেদনাদায়ক পরিণতি নিয়ে সংগ্রাম করছে এবং মুসলিমরা তিনটি মহান সাম্রাজ্য গড়ে তুলছিল সেই একই সময়ে পশ্চিমের ক্রিশ্চানরা এমন এক পথে পা রাখতে যাচ্ছিল যা তাদের প্রাচীন বিশ্বের পবিত্রতা ও নিশ্চয়তা থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে। এটা ছিল এক উজেনাময় কাল, আবার অস্বস্তিকরও বটে। চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে ক্রিশ্চান জগতের এক তৃতীয়াংশ অধিবাসীর প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল প্লেগের মহা মড়ক এবং ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের ভেতরকার শত বর্ষের যুদ্ধ ও ইতালিয় গৃহযুদ্ধের মতো অব্যাহত সংগ্রামে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল ইউরোপের দেশগুলো। ইউরোপিয়রা ১৪৫৩ সালে অটোমানদের হাতে ক্রিশ্চান বাইযান্তিয়ামের অধিকার, আভিগনন ক্যাপ্টিভিটির পাপাল কেলেঙ্কারী ও মহাবিবাদ প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল—এই সময় অন্তত তিনজন পন্টিফ একই সময়ে নিজেদের সেইন্ট পিটারের উত্তরাধিকারী দাবি করে বসেছিলেন-অনেককেই যা প্রাতিষ্ঠানিক চার্চের উপর বিশ্বাস হারাতে প্ররোচিত করেছিল। সাধারণ মানুষ অস্পষ্টভাবে নিজেদের আর নিরাপদ ভাবতে পারছিল না, এখন আর আগের মতো করে ধার্মিক হতে পারছে না বলে আবিষ্কার করেছিল তারা। কিন্তু তারপরেও এটা আবার মুক্তি ও ক্ষমতায়নেরও একটা কাল ছিল। ইবারিয় অভিযাত্রীরা এক নতুন জগৎ আবিষ্কার করেছিল: জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা স্বর্গ উন্মুক্ত করছিলেন এবং এক নতুন কারিগরি দক্ষতা পরিবেশের উপর ইউরোপিয়দের হাতে বৃহত্তর নিয়ন্ত্রণ তুলে দিচ্ছিল এর আগে যা কেউই অর্জন করতে পারেনি। রক্ষণশীল চেতনা যেখানে নারী-পুরুষকে সতর্কতার সাথে নির্ধারিত সীমানার ভেতর অবস্থান করার শিক্ষা দিয়েছিল, পাশ্চাত্য ক্রিশ্চান জগতের নতুন সংস্কৃতি সেখানে দেখিয়ে দিয়েছিল, পরিচিত জগতের বাইরে পা রাখা সম্ভব, সেটা কেবল বেঁচে থাকার জন্যে নয়, বরং সমৃদ্ধি অর্জনের জন্যেও। শেষ পর্যন্ত প্রাচীন পৌরাণিক ধর্মকে অসম্ভব করে তুলবে তারা এবং পাশ্চাত্য আধুনিকতাকে আসলে উৎসগতভাবে ধর্মবিশ্বাসের প্রতি বৈরী ছিল মনে হবে।

কিন্তু তাসত্ত্বেও পাশ্চাত্য সমাজের পরিবর্তনের এই প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যাপারটা এমন ছিল না। ক্রান্তিকালের অভিযাত্রী, বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদদের অনেকেই বিশ্বাস করেছিলেন যে ধর্মকে সম্পূর্ণ উৎখাত করার বদলে তাঁরা আসলে ধার্মিক হওয়ার নতুন নতুন পথ আবিষ্কার করছেন। এই অধ্যায়ে আমরা তাঁদের কিছু সমাধান পর্যালোচনা করে সেগুলোর গভীরতর তাৎপর্য বিবেচনা করব। তবে স্পষ্ট করে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে আধুনিক চেতনার যাঁরা মুখপাত্রে পরিণত হয়েছিলেন তাঁরা নিজেরা এটা সৃষ্টি করেননি। ষোড়শ শতাব্দী নাগাদ ইউরোপে এবং পরে এর আমেরিকান উপনিবেশসমূহে একটি জটিল প্রক্রিয়া কার্যকর ছিল যা সাধারণ মানুষের চিন্তাভাবনা ও জগৎকে দেখার দৃষ্টিকে বদলে দিচ্ছিল। প্রায়শঃই পরিবর্তন ধীরে ধীরে ও অলক্ষে ঘটেছে। অসংখ্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঠিক সেই মুহূর্তে চূড়ান্ত পরিবর্তনকারী মনে হয়নি এমন আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের ঘটনা ঘটছিল, কিন্তু সেগুলোর সম্মিলিত প্রভাব হয়ে দাঁড়াবে চূড়ান্ত। এসব আবিষ্কারই একটা বাস্তবভিত্তিক, বৈজ্ঞানিক চেতনায় বৈশিষ্ট্যায়িত ছিল, যা ক্রমশঃ রক্ষণশীল পৌরাণিক রীতিনীতি অচল করে দিয়েছে এবং বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষকে ঈশ্বর, ধর্ম, রাষ্ট্র, ব্যক্তি ও সমাজ সম্পর্কে নতুন নতুন ধ্যান-ধারণা গ্রহণে প্ররোচিত করেছে। ইউরোপ ও আমেরিকান উপনিবেশসমূহকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এইসব পরিবর্তনকে স্থান করে দিতে হয়েছে। সুদূরপ্রসারী অন্য যেকোনও সামাজিক পরিবর্তনের কালের মতো সহিংস সময় ছিল এটা। চলছিল বিধ্বংসী যুদ্ধ এবং বিপ্লব, সহিংস উচ্ছেদ, প্রত্যন্ত এলাকায় বিরাজনীতিকরণ ও জঘন্য ধর্মীয় সংঘাত। তিন বছরের পরিক্রমায় ইউারোপিয় ও আমেরিকানদের তাদের সমাজ আধুনিকায়িত করতে নিষ্ঠুর পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হয়েছে। রক্তপাত, নির্যাতন, ইনকুইজিশন, বিতাড়ন, দাসত্বে বন্দি এবং নিষ্ঠুরতার ঘটনা ঘটেছে। যেসব দেশ বর্তমানে আধুনিকায়নের বেদনাদায়ক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, উন্নয়নশীল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেই একই রক্তাক্ত উত্তেজনা প্রত্যক্ষ করছি আমরা।

কৃষির যৌক্তিকীকরণ ছিল এই প্রক্রিয়ার একটা ছোট্ট অংশ মাত্র, কিন্তু বর্ধিত ফসল ও স্বাস্থ্যবান গবাদিপশুর দল প্রত্যেকের জীবনের উপর প্রভাব ফেলেছে। অন্য আরও বিশেষায়িত উন্নয়নও ছিল। সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি বানাতে শুরু করেছিল মানুষ: কম্পাস, টেলিস্কোপ, ম্যাগনিফাইং লেন্স, ইত্যাদি এক নতুন জগৎকে তুলে ধরেছে এবং আরও উন্নত ম্যাপ, চার্ট ও নৌপরিচালনার কৌশল তৈরির কাজে লাগানো হয়েছে। সপ্তদশ শতাব্দীর ওলন্দাজ মাইক্রোস্কোপিস্ট আন্তনি ভ্যান লিভেনহোক প্রথমবারের মতো ব্যাক্টেরিয়া, স্পারমাতোযা এবং অন্যান্য অণুজীব প্রত্যক্ষ করেন; তাঁর পর্যবেক্ষণ একদিন প্রজনন ও বিকৃতির প্রক্রিয়ার উপর নতুন আলো ফেলবে। কেবল রোগ দুরীকরণেই এর বাস্তবভিত্তিক প্রভাব পড়বে না, বরং জীবন-মৃত্যুর মৌলিক এলাকাগুলোকেও পৌরাণিক উপাদান হতে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। ওষুধ বিজ্ঞান সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে শুরু করেছিল; উনবিংশ শতাব্দীর বেশ অনেকটা সময় পর্যন্ত অন্ধের মতো থেরাপি প্রয়োগ অব্যাহত থাকলেও সপ্তদশ শতাব্দীতে পয়ঃনিষ্কাষণের ব্যাপারে সচেতনতা বেড়ে উঠছিল এবং প্রথমবারের মতো বেশ কিছু রোগ শানাক্ত করা হয়েছিল। ভূ-বিজ্ঞানের বিকাশ সূচিত হয়েছিল, ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরির মতো বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে আলোচনা এইসব ঘটনা সংক্রান্ত পৌরাণিক বিবেচনাকে পিছনের কাতারে ঠেলে দেবে। যান্ত্রিক সরঞ্জামের উন্নতি ঘটে। ঘড়ি ও হাতঘড়ি আরও বেশি মাত্রায় নির্ভরযোগ্য হয়ে ওঠে। এই উন্নয়ন সময়ের সেক্যুলারাইজেশনের দিকে নিয়ে যাবে। গাণিতিক ও পরিসংখ্যানিক কৌশলের প্রয়োগ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন ধারণা যোগাচ্ছিল: ১৬৫০ ও ১৬৬০ এর দশকে ‘সম্ভাব্য’ শব্দটির অর্থ বদলে যেতে শুরু করে। এটা আর রক্ষণশীল কালের মতো ‘কর্তৃপক্ষের সমর্থনপুষ্ট’ বোঝানোর বদলে ‘সব আলামতের ভিত্তিতে সম্ভাব্য’ হয়ে দাঁড়াল। ভবিষ্যত সম্পর্কে এই স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি ও আস্থা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ও আমলাতান্ত্রিক যৌক্তিকীকরণের এক নতুন যাত্রায় প্ররোচিত করবে। ব্রিটিশ পরিসংখ্যানবিদ উইলিয়াম পেরি এবং জন গ্রান্ট বিশেষ করে জীবায়ুর ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইউরোপের লোকজন জীবন বীমা গ্রহণ করতে শুরু করেছিল।’ এসবই উৎসগতভাবে রক্ষণশীল চেতনার পরিপন্থী।

এসব উন্নয়নের কোনওটিকেই আলাদাভাবে চূড়ান্ত মনে হয়নি, কিন্তু সামগ্রিকভাবে এসবের প্রভাব ছিল আমূল পরিবর্তন সুলভ। ১৬০০ সাল নাগাদ ইউরোপে এমন ব্যাপক মাত্রায় উদ্ভাবন ঘটছিল যে প্রগতিকে অপরিবর্তনীয় মনে হয়েছে। কোনও একটি ক্ষেত্রে আবিষ্কার প্রায়শঃই অন্য ক্ষেত্রে আবিষ্কার উস্কে দিত। প্রগতি অপ্রতিরোধ্য গতিবেগ অর্জন করেছিল। জগতকে অপরিবর্তনীয় ও মৌলিক বিধির অধীন ভাবার বদলে ইউরোপিয়রা আবিষ্কার করছিল যে প্রকৃতিকে বিস্ময়করভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে তারা। পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে, এমনভাবে তাদের বস্তুগত প্রয়োজন মেটাচ্ছে যেমনটা আগে কখনও পারেনি। কিন্তু জনগণ জীবনের যৌক্তিকীরণের সাথে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার সাথে সাথে লোগোস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল ও মিথোস হয়ে গেল তুচ্ছ। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আগের চেয়ে অনেক বেশি নিশ্চিত হয়ে উঠেছিল মানুষ। ভীতিকর পরিণাম ছাড়াই পরিবর্তনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারছিল তারা। উদাহরণ স্বরূপ, অব্যাহত উদ্ভাবনের উপর ভিত্তি করে এবং বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবার দৃঢ় আশাবাদ নিয়ে পদ্ধতিগতভাবে পুনর্বিনিয়োগে প্রস্তুত ছিল ধনীকশ্রেণী। পুঁজিবাদী অর্থনীতি পাশ্চাত্যকে অনির্দিষ্টভাবে এর সম্পদ প্রতিস্থাপিত করতে সক্ষম করে তুলেছে, ফলে কৃষি ভিত্তিক প্রাচীন সমাজগুলোর সীমাবদ্ধতা হতে মুক্ত হয়ে গেছে। সমাজের এই যৌক্তিকীকরণ ও প্রযুক্তিকরণ শিল্প বিপ্লবের জন্ম দিয়েছে যখন, সেই সময় নাগাদ পশ্চিমারা অব্যাহত প্রগতি সম্পর্কে এতটাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল যে অনুপ্রেরণার জন্যে তারা অতীতের দিকে তাকানোর বদলে জীবনকে বরং ভবিষ্যতের আরও বৃহত্তর সাফল্যের দিকে ভীতিহীন অগ্রযাত্রা হিসাবে দেখেছে।

এই প্রক্রিয়ায় সামাজিক পরিবর্তন জড়িত ছিল। এজন্যে বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তিকে বেশ নিচু স্তরে আধুনিকায়নের প্রক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করতে হয়েছে। সাধারণ লোক প্রিন্টার, মেশিনিস্ট ও ফ্যাক্টরির শ্রমিকে পরিণত হয়েছিল, তাদেরও কিছু মাত্রায় দক্ষতার আধুনিক মানদণ্ড অর্জন করতে হয়েছিল। অধিক সংখ্যক লোকের কিছু পরিমাণ শিক্ষার প্রয়োজন ছিল। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক সাক্ষরতা অর্জন করে, আর এটা ঘটার পর তারা অনিবার্যভাবেই সমাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বৃহত্তর ভূমিকা দাবি করতে থাকে। আরও অধিকতর গণতান্ত্রিক ধারার সরকার আবশ্যক হয়ে উঠবে। কোনও জাতি তার সকল জনশক্তিকে আধুনিকায়িত করে এর উৎপাদনশীলতা বাড়াতে চাইলে তাকে ইহুদিদের মতো এ যাবৎ বিচ্ছিন্ন ও প্রান্তিকায়িত গোষ্ঠীসমুহকে মূলধারার সংস্কৃতিতে নিয়ে আসতে হবে। নব্য শিক্ষিত শ্রমিক শ্রেণী আর কখনওই প্রাচীন ক্ষমতা পরম্পরার কাছে নতি স্বীকার করবে না। পাশ্চাত্য সেক্যুলার সংস্কৃতিতে পবিত্র মূল্যবোধে পরিণত হওয়া গণতন্ত্র, সহিষ্ণুতা ও সর্বজনীন মানবাধিকারের আদর্শসমূহ জটিল আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল। এসব স্রেফ রাষ্ট্রনায়ক ও রাজনীতিবিদদের স্বপ্নের চমৎকার আদর্শ ছিল না, বরং অন্তত অংশত হলেও আধুনিক রাষ্ট্রের প্রয়োজনের তাগিদে সৃষ্টি হয়েছিল। প্রাথমিক আধুনিক ইউরোপে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তন ছিল আন্তসম্পর্কযুক্ত প্রক্রিয়ারই অংশ, প্রতিটি উপাদান অন্যটির উপর নির্ভরশীল ছিল। কোনও আধুনিক সমাজকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে গণতন্ত্রই সবচেয়ে দক্ষ ও ফলপ্রসু উপায় বলে প্রতীয়মান হয়েছিল, যেসব পূর্ব ইউরোপিয় দেশ গণতান্ত্রিক রীতিনীতি গ্রহণ না করে বাইরের গোষ্ঠীসমূহকে মূলধারায় আনতে অধিকতর নির্মম কৌশল বেছে নিয়েছিল প্রগতির মিছিলে তাদের অনেক পেছনে পড়ে যাওয়া থেকেই এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়।

সুতরাং, এটা ছিল একটা মুগ্ধকারী কাল, আবার কষ্টকর রাজনৈতিক পরিবর্তনের কালও ছিল তা, লোকে ধার্মিকতার সাথে একে আত্মস্থ করার প্রয়াস পেয়েছিল। এমনি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্পষ্টভাবে কাজ করছিল না বলে ধর্মবিশ্বাসের প্রাচীন মধ্যযুগীয় ধরনগুলো আর স্বস্তি যোগাতে পারছিল না। ষোড়শ শতাব্দীর ক্যাথলিক সংস্কারের মতো ধর্মকে আরও দক্ষ ও সংহত করে তোলারও প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু প্রাথমিক আধুনিক কালের সংস্কার দেখিয়েছে যে, ষোড়শ শতাব্দীতে আধুনিকায়নের প্রক্রিয়া বেশ ভালোভাবে ক্রিয়াশীল থাকলেও ইউরোপিয়রা তখনও রক্ষনশীল চেতনা ধারণ করছিল। আমাদের বিবেচিত মহান মুসলিম সংস্কারকদের মতো প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারকগণও অতীতে ফিরে যাবার মাধ্যমেই পরিবর্তনের কালে নতুন সমাধান খোঁজার প্রয়াস পাচ্ছিলেন। মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫৩৬), জন কালভিন (১৫০৯-৬৪) ও হালদ্রিচ যিইংউলি (১৪৮৪- ১৫৩১), এঁরা প্রত্যেকেই ক্রিশ্চান ট্র্যাডিশনের ঝর্নাধারা আদ ফন্তাসের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়েছেন। ইবন তাঈমিয়াহ কোরান ও সুন্নাহর খাঁটি ইসলামে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে যেখানে মধ্যযুগীয় ধর্মতত্ত্ব ও ফিকহ প্রত্যাখ্যান করেছেন, মার্টিন লুথার সেখানে একইভাবে মধ্যযুগীয় স্কলাস্টিক ধর্মতাত্ত্বিকদের আক্রমণ করে বাইবেল ও ফাদারস অভ চার্চের খাঁটি ক্রিশ্চান ধর্মে ফিরে যেতে চেয়েছেন। সুতরাং, রক্ষণশীল মুসলিম সংস্কারকদের মতো প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারকগণ ছিলেন একাধারে বিপ্লবী ও প্রতিক্রিয়াশীল। তখনও তাঁরা আসন্ন নতুন বিশ্বের অধীনে ছিলেন না, বরং বেশ ভালোভাবেই প্রাচীন কালে প্রোথিত ছিলেন।

কিন্তু তাসত্ত্বেও নিজ কালেরই মানুষ ছিলেন তাঁরা, এটা ছিল পরিবর্তনের সময়। গোটা এই গ্রন্থ জুড়ে আমরা দেখব, আধুনিকায়নের প্রক্রিয়া নিদারুণ উদ্বেগের সৃষ্টি করতে পারে। জগৎ বদলে যাবার সাথে সাথে মানুষ নিজেদের দিশাহারা ও পরাস্ত আবিষ্কার করে। ইন মিদিয়াস রেস-এ বসবাস করে সমাজ কোন দিকে এগোচ্ছে বুঝে উঠতে পারে না তারা, বরং সামঞ্জস্যহীনভাবে পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা লাভ করে। পরিবর্তনের ব্যাপক চাপে তাদের জীবনকে কাঠামো ও তাৎপর্য প্রদানকারী প্রাচীন মিথোলজি ভেঙে চুরমার হয়ে যাবার সাথে সাথে তারা আত্মপরিচয় হারানো ও বিবষকারী হতাশার অভিজ্ঞতা লাভ করে। আমরা যেমন দেখব, সবচেয়ে সাধারণ আবেগসমূহ হচ্ছে অসহায়ত্ব, নিশ্চিহ্নতার আতঙ্ক চরম পরিস্থিতিতে যা সহিংসতায় বিস্ফোরিত হতে পারে। লুথারের মাঝে আমরা এর খানিকটা দেখতে পাই। জীবনের গোড়ার দিকে যন্ত্রণাকর হতাশার শিকারে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। মধ্যযুগীয় কোনও ধর্মীয় আচারঅনুষ্ঠান ও অনুশীলনই তাঁকে মৃত্যুভয়ে সন্ত্রন্ত করে তোলা, তাঁর ভাষায়, ত্রিস্তিশিয়া (‘বিষাদ’)-কে স্পর্শ করতে পারছিল না, মৃত্যুকে তিনি সামগ্রিক নিশ্চিহ্নকরণ মনে করতেন। যখনই তাঁর উপর এই কালো ত্রাস নেমে আসত, তিনি আর ৯০ নম্বর শ্লোক পাঠ করতে পারতেন না, যেখানে মানব জীবনের বিস্তৃতির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে ও মানুষকে ঈশ্বরের ক্রোধ ও ক্ষোভ দ্বারা সাজাপ্রাপ্ত হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। গোটা জীবন মৃত্যুকে ঈশ্বরের ক্রোধের প্রকাশ হিসাবে দেখে এসেছেন লুথার। তাঁর বিশ্বাসে প্রতিপন্ন করার ধর্মতত্ত্বে মানবজাতিকে নিজ নিষ্কৃতি লাভে সম্পূর্ণ অক্ষম ও ঈশ্বরের দয়ার উপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল বলে বর্ণনা করেছেন। কেবল নিজেদের অক্ষমতা উপলব্ধি করেই তারা রক্ষা পেতে পারে। বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি পেতে পৃথিবীতেই যতবেশি ভালো কাজ করা সম্ভব সেটা করতে ভয়ঙ্কর এক কর্মযজ্ঞে মেতে উঠেছিলেন লুথার, কিন্তু ঘৃণায়ওo আচ্ছন্ন ছিলেন তিনি। তাঁর ঘৃণা পোপ, তুর্কি, ইহুদি, নারী ও বিদ্রোহী কৃষকদের উপরও চালিত হয়েছে-ধর্মতাত্ত্বিক সকল প্রতিপক্ষের কথা না বললেও চলে-লুথারের ক্রোধ আমাদের কালের অন্য সংস্কারকদের অনুরূপ হয়ে দাঁড়াবে, যাঁরা এক নতুন বিশ্বের বেদনার সাথে সংগ্রাম করেছেন এবং যাঁরা এমন এক ধর্ম বিকশিত করেছেন যেখানে ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা প্রায়শঃই অন্য মানুষের প্রতি ঘৃণা দিয়ে ভারসাম্য লাভ করে।

যিউইংলি ও কালভিনও তাঁদের মাঝে নবজন্ম লাভ করার বোধ জাগানো এক নতুন ধর্মীয় দর্শনের দেখা পাওয়ার আগে চরম অক্ষমতার অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা দুজনই নিশ্চিত ছিলেন যে নিজেদের নিস্তার লাভের জন্যে তাঁদের করার মতো কিছুই নেই, মানবীয় অস্তিত্বের দুঃখকষ্টের সামনে তাঁরা সম্পূর্ণ অসহায়। দুজনই ঈশ্বরের পরম সার্বভৌমত্বের উপর জোর দিয়েছেন, আধুনিক মৌলবাদীরা পরবর্তী সময়ে প্রায়ই যেমন করবে। লুথারের মতো যিউইংলি ও কালভিনকে নিজেদের ধর্মীয় জগৎ পুনর্নির্মাণ করতে হয়েছে। এমনকি অলক্ষে কিন্তু অপরিবর্তনীয়ভাবে ব্যাপক পরিবর্তনের অধীন হয়ে পড়া বিশ্বের পরিস্থিতির সাথে ধর্মকে মানানসই করে তোলার জন্যে অনেক সময় চরম ব্যবস্থার আশ্রয়ও নিতে হয়েছে তাঁদের।

সেই সময়ের মানুষ হিসাবে সংস্কারকগণ ঘটে যাওয়া পরিবর্তনসমূহকে তুলে ধরেছেন। রোমান ক্যাথলিক চার্চ ত্যাগ করে তাঁরা এই পর্যায় থেকে পাশ্চাত্য ইতিহাসকে তুলে ধরা অন্যতম প্রাথমিক স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আমরা যেমন দেখব, নতুন রীতি স্বায়ত্তশাসন ও পূর্ণাঙ্গ মুক্তির দাবি করেছে এবং এই বদলে যাওয়া পৃথিবীতে প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারকগণও ক্রিশ্চানদের পক্ষে একই দাবি করেছেন, যাদের অবশ্যই চার্চের শাস্তিমূলক নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই পছন্দ মোতাবেক বাইবেল পাঠ ও ব্যাখ্যা করার স্বাধীনতা থাকতে হবে। (অবশ্য তাঁদের শিক্ষার বিরোধিতাকারীর বেলায় তিন জনই অনমনীয় হয়ে উঠতে পারতেন: লুথার বিশ্বাস করতেন যে ‘ধর্মদ্রোহমূলক’ বই পুড়িয়ে ফেলা উচিত, আর কালভিন ও যিউইংলি ভিন্নমতাবলম্বীদের হত্যা করতে প্রস্তুত ছিলেন)। তিনজনই দেখিয়েছেন যে, এই যুক্তির কালে ধর্মের প্রাচীন প্রতীকী উপলব্ধি ভেঙে পড়তে যাচ্ছিল। রক্ষণশীল আধ্যাত্মিকতায় কোনও প্রতীক ঈশ্বরের বাস্তবতায় অংশ গ্রহণ করত, নারী-পুরুষ পার্থিব বস্তুতে পবিত্রকে অনুভব করত; প্রতীক ও পবিত্র এভাবে ছিল অবিচ্ছেদ্য। মধ্যযুগে ক্রিশ্চানরা সাধুদের রেলিক্সে স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা লাভ করেছে ইউক্যারিস্টিক রুটি ও মদকে অতীন্দ্রিয়ভাবে ক্রাইস্টের সাথে অবিচ্ছেদ্য মনে করেছে। কিন্তু এখন সংস্কারগণ ঘোষণা দিয়েছেন যে, রেলিক্সগুলো আসলে প্রতিমা, ইউক্যারিস্ট ‘স্রেফ’ প্রতীক, ধর্মসভা একে অতীন্দ্রিয়ভাবে উপস্থিত করা ক্যালভারির উৎসর্গের স্মারক নয়, বরং একটা সাধারণ স্মৃতিচিহ্নমাত্র। তাঁরা এমনভাবে ধর্মের মিথ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছিলেন যেন সেগুলো লোগোই; মানুষ যেমন দ্রুততার সাথে সংস্কারকদের অনুসরণ করেছে তাতে বোঝা যায় ইউরোপের ক্রিশ্চানদের অনেকেই অতীন্দ্রিয় সংবেদনশীলতা খোয়াতে শুরু করেছিল।

ধীরে ধীরে সেক্যুলারাইজ হতে শুরু করেছিল ইউরোপের জীবন। প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কারকগণ ধর্মীয় প্রয়াসের প্রাবল্য সত্ত্বেও সেক্যুলারাইজ হতে চলছিলেন। সংস্কারকগণ রক্ষণশীলের মতোই প্রাথমিক উৎস অর্থাৎ বাইবেলে ফিরে যাবার দাবি করলেও আধুনিক কায়দায় ঐশীগ্রন্থ পাঠ করছিলেন তাঁরা। সংস্কৃত ক্রিশ্চানদের স্রেফ নিজের বাইবেলের উপর ভরসা করে একাকী ঈশ্বরের সামনে দাঁড়াতে হয়েছে, কিন্তু মুদ্রণের উদ্ভাবনের ফলে প্রত্যেকের পক্ষে একটা বাইবেল যোগাড় সহজ হয়ে ওঠা ও তাদের বাইবেল পাঠে সক্ষম করে তোলা সেই সময়ের বিকাশ লাভ করা সাহিত্যের আগে এটা সম্ভব ছিল না। ক্রমবর্ধমান হারে তথ্যের অনুসন্ধানে ঐশীগ্রন্থসমূহ আক্ষরিকভাবে পাঠ করা হচ্ছিল, ঠিক যেভাবে আধুনিকায়িত প্রটেস্ট্যান্টরা অন্যান্য টেক্সট পাঠ শিখছিল। নীরব, একাকী পাঠ ক্রিশ্চানকে ব্যাখ্যার ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতি ও ধর্মীয় বিশেষজ্ঞদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করবে। ব্যক্তিগত বিশ্বাসের উপর গুরুত্বারোপ সত্যকে আধুনিক পাশ্চাত্য মানসিকতার বৈশিষ্ট্য অধিকতর ভাবগত করে তুলতে সাহায্য করবে। কিন্তু বিশ্বাসের গুরুত্বের প্রতি জোর দিলেও লুথার ভীষণভাবে যুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি যেন বুঝতে পেরেছিলেন যুক্তি আসন্ন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্বাসের প্রতি বৈরী হয়ে উঠতে পারে। তাঁর রচনায়-যদিও কালভিনের রচনায় নয়-আমরা দেখতে পাই, যুক্তি ও মিথলোজির প্রাচীন সম্পূরকতার দৃষ্টিভঙ্গি ক্ষয়ে যাচ্ছিল। স্বভাবজাত ঝগড়াটে কায়দায় লুথার সঘৃণায় অ্যারিস্টটল সম্পর্কে কথা বলেছেন, ইরাসমাসের বিরুদ্ধে নিন্দা ঝেড়েছেন, যাকে তিনি যুক্তির মূর্ত রূপ মনে করতেন, তিনি নিশ্চিত ছিলেন যুক্তি কেবল নাস্তিক্যবাদের দিকেই ঠেলে দিতে পারে। যুক্তিকে ধর্মীয় বলয় থেকে সম্পূর্ণ উৎখাত করতে গিয়ে লুথারই ছিলেন একে সেকুলারাইজকারী অন্যতম প্রথম ইউরোপিয়।

লুথারের চোখে ঈশ্বর যেহেতু চরম রহস্যময় ও গোপন, সুতরাং জগৎ ঐশী অস্তিত্ব হতে শূন্য। লুথারের দিউস অ্যাবসকন্দিতাসকে মানবীয় প্রতিষ্ঠান বা ভৌত বাস্তবতায় আবিষ্কার করা যাবে না। মধ্যযুগীয় ক্রিশ্চানরা চার্চে পবিত্রের অনুভূতি লাভ করেছিল, লুথার যাকে এখন অ্যান্টিক্রাইস্ট ঘোষণা করেছেন। এখন কি স্কলাস্টিক ধর্মতত্ত্ববিদদের (লুথারের তীব্র ক্রোধের লক্ষ্যও বটে) মতো করে মহাবিশ্বের অলৌকিক শৃঙ্খলা লক্ষ করে ঈশ্বরের জ্ঞান লাভ করা যাবে?’ লুথারের রচনায় ঈশ্বর এখন ধর্মীয় তাৎপর্যহীন হয়ে ওঠা ভৌত জগৎ থেকে সরে যেতে শুরু করেছিলেন। লুথার রাজনীতিকেও সেক্যুলারাইজ করেছেন। জাগতিক বাস্তবতা যেহেতু আধ্যাত্মিক বাস্তবতার সম্পূর্ণ বিরোধী, চার্চ ও রাষ্ট্রকে অবশ্যই স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে, প্রত্যেককে অন্যের সঠিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রকে সম্মান করতে হবে। লুথারের আন্তরিক ধর্মীয় দর্শন তাঁকে চার্চ ও রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতার পক্ষে কথা বক্তব্য দানকারী অন্যতম প্রথম ইউরোপিয়তে পরিণত করেছিল। কিন্তু তবু ধার্মিক হওয়ার এক নতুন উপায় হিসাবেই রাজনীতির সেক্যুলাইজেশন শুরু হয়েছিল।

লুথারের ধর্ম ও রাজনীতির পৃথকীকরণের বিষয়টি এসেছিল রোমান ক্যাথলিক চার্চের নিপীড়নমূলক পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর চরম বিতৃষ্ণা থেকে, নিজস্ব বিধি ও অর্থডক্সি চাপিয়ে দেওয়ার জন্যে চার্চ রাষ্ট্রকে ব্যবহার করছিল। ঈশ্বর বিহীন পৃথিবী সংক্রান্ত লুথারের দৃষ্টিভঙ্গির অংশীদার ছিলেন না কালভিন। যিউইংলির মতো তিনি বিশ্বাস করতেন, মঠে আশ্রয় নেওয়ার বদলে ক্রিশ্চানদের উচিত হবে রাজনীতি ও সামাজিক জীবনে অংশ নিয়ে তাদের ধর্মবিশ্বাসকে প্রকাশ করা। কালভিন উদীয়মান পুঁজিবাদী শ্রমনীতিকে শ্রমকে পবিত্র আহ্বান আখ্যা দিয়ে ব্যাপ্টাইজ করেছিলেন, মধ্যযুগীয় ভাবনার মতো একে পাপের স্বর্গীয় শাস্তি হিসাবে দেখেননি। কালভিন স্বাভাবিক জগতের প্রতি লুথারের বিতৃষ্ণারও অংশীদার ছিলেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বরকে তাঁর সৃষ্টির মাঝে প্রত্যক্ষ করা সম্ভব; জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগোল ও প্রাণীবিদ্যা পাঠ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। প্রাথমিক আধুনিক কালের কালভিনবাদীরা প্রায়শঃই ভালো বিজ্ঞানী ছিলেন। কালভিন বিজ্ঞান ও ঐশীগ্রন্থের ভেতর কোনও বিরোধিতা লক্ষ করেনি। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাইবেল ভূগোল বা বিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে কোনও আক্ষরিক জ্ঞান প্রচার করছে না, বরং সীমাবদ্ধ মানুষের বোধগম্য ভাষায় অনির্বচনীয়কে প্রকাশ করার চেষ্টা করছে। বাইবেলিয় ভাষা হচ্ছে বালবাতিভ (‘বালসুলভকথা’), অন্য কোনওভাবে প্রকাশ করার পক্ষে যারপরনাই জটিল সত্যের পরিকল্পিত সরলীকরণ।

প্রাক আধুনিক কালের মহান বিজ্ঞানীরা কালভিনের আস্থার অংশীদার ছিলেন। নিজেদের গবেষণা ও আলোচনাকে তাঁরা পৌরাণিক, ধর্মীয় কাঠামোতে দেখেছেন। পোলিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) বিশ্বাস করতেন তাঁর বিজ্ঞান ‘মানুষের চেয়েও বেশি ঐশ্বরিক।১০ কিন্তু তাসত্ত্বেও তাঁর হেলিওসেন্ট্রিক বিশ্বের মতবাদ প্রাচীন পৌরাণিক ধারণার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড আঘাত ছিল। তাঁর বিস্ময়কর প্রকল্প এতটাই চরম ছিল যে, তাঁর নিজ সময়ে খুব অল্প সংখ্যক লোকই তা হজম করতে পেরেছে। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, মহাবিশ্বের কেন্দ্ৰে অবস্থানের বদলে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ আসলে সূর্যের চারপাশে প্রচণ্ড গতিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা যখন আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবি যে স্বর্গীয় বস্তুসমূহ চলছে, সেটা স্রেফ উল্টোদিকে পৃথিবীর ঘোরার প্রক্ষেপণ। কোপার্নিকাসের তত্ত্ব অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছিল, কিন্তু জার্মান পদার্থবিদ ইয়োহানেস কেপলার (১৫৭১-১৬৩০) এর সমর্থনে গাণিতিক প্রমাণ যোগাতে সক্ষম হন, অন্যদিকে পিসিয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী গালিলিও গালিলি (১৫৬৪-১৬৪২) টেলিস্কোপের সাহয্যে গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করে কোপার্নিকাসের প্রকল্প হাতে কলমে পরীক্ষা করেছিলেন। তিনি নিজেই এই যন্ত্রটির উন্নতি সাধন করেন। ১৬১২ সালে গালিলিও যখন তাঁর আবিষ্কারের কথা প্রকাশ করলেন, বিশাল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। ইউরোপের সমস্ত লোক নিজেরা টেলিস্কোপ বানিয়ে স্বর্গ পর্যবেক্ষণ শুরু করেছিল।

ইনকুইজিশন গালিলিওকে স্তব্ধ করে দেয়। মত প্রত্যাহারে বাধ্য করে তাঁকে। কিন্তু তাঁর কিছুটা রগচটা স্বভাবও সাজা প্রাপ্তিতে কিছু অবদান রাখে। প্রাথমিক আধুনিক কালে মানুষ সহজাতভাবে বিজ্ঞানকে প্রত্যাখ্যান করেনি। কোপার্নিকাস যখন ভাটিকানে প্রথমবারের মতো তাঁর প্রকল্প পেশ করেন, পোপ একে অনুমোদন দিয়েছিলেন। এই তত্ত্বে কালভিনের কোনও সমস্যা হয়নি। বিজ্ঞানীগণ তাঁদের অনুসন্ধানকে আবিশ্যিকভাবে ধর্মীয় বিবেচনা করেছেন। এযাবত কোনও মানুষেরই জানার সুযোগ হয়নি, এমন সব রহস্য উন্মোচন করে চলার সময় কেপলার নিজেকে ‘স্বর্গীয় উন্মাদনায়’ আচ্ছন্ন মনে করেছেন, গালিলিও নিশ্চিত ছিলেন যে তাঁর গবেষণা ঐশী অনুপ্রেরণাজাত।” তখনও তাঁরা নিজেদের বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদকে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির সাথে মানানসই দেখতে পাচ্ছিলেন, মিথোস যেমন ছিল লোগোস-এর সম্পূরক।

তারপরেও বিপ্লবের সূচনা ঘটিয়েছিলেন কোপার্নিকাস। মানুষ আর কখনওই আর আগের মতো তাদের দেখতে বা তাদের ধারণাকে বিশ্বাস করতে পারবে না। এতদিন পর্যন্ত লোকে নিজেদের ইন্দ্রিয়জ প্রমাণের উপর নির্ভর করতে সক্ষম ভাবত। বিশ্বের বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের দিকে তাকিয়ে অদৃশ্যকে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছে তারা, তবে এইসব বাহ্যিক চেহারা একটি বাস্তবতার অংশ বলে নিশ্চিত ছিল। জীবনের মৌলিক বিধান সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করার জন্যে বিকশিত মিথসমূহ তাদের অভিজ্ঞতার সত্যের সাথে মানানসই ছিল। ইলিউসিসের গ্রিক উপাসকরা পারসেফোনের কাহিনীকে তাদের পালন উপযোগি ফসলের মৌসুমের সাথে মেলাতে পেরেছিল; কাবাহকে ঘিরে প্রতীকীভাবে দৌড়ে বেড়ানো আরবরা পৃথিবীকে ঘিরে গ্রহ-নক্ষত্রের গতিপথের সাথে নিজেদের এক রেখায় নিয়ে আসতে পারত এবং এভাবে অস্তিত্বের মৌল নীতিমালার সাথে ছন্দবদ্ধ থাকার কথা ভাবত। কিন্তু কোপার্নিকাসের পর সন্দেহের বীজ রোপিত হয়েছিল। প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল যে, পৃথিবী, যাকে স্থির মনে হয়েছিল, আসলে প্রবল বেগে চলছে; গ্রহগুলোকে ঘুরছে মনে হওয়ার কারণ লোকে সেগুলোর প্রতি তাদের নিজস্ব দৃষ্টি প্রক্ষেপিত করছিল: যাকে বাস্তবভিত্তিক ধরে নেওয়া হয়েছিল তা আসলে সম্পূর্ণই ভাবগত ছিল। যুক্তি আর মিথ আর এক তলে রইল না; প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানীর আবিষ্কৃত নিবিড় লোগোস যেন সাধারণ মানুষের ধারণাকে অবমূল্যায়িত করতে শুরু করেছিল এবং ক্রবর্ধমান হারে তাদের শিক্ষিত বিশেষজ্ঞদের উপর নির্ভরশীল করে তুলছিল। মিথ যেখানে মানুষের কর্মকাণ্ড জীবনের অত্যাবশ্যক অর্থের সাথে আবদ্ধ হিসাবে দেখিয়েছে, নতুন বিজ্ঞান হঠাৎ করেই নারী-পুরুষকে মহাবিশ্বের এক প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছিল। তারা আর বস্তুনিচয়ের কেন্দ্রে ছিল না, বরং মহাবিশ্বের এক বৈশিষ্ট্যহীন গ্রহে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের, যা আর তাদের প্রয়োজনকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছিল না। এক বিষণ্ণ দৃশ্য ছিল এটা, যার সম্ভবত নতুন সৃষ্টিবিজ্ঞানকে পুরোনটির মতো অর্থপূর্ণ করে তোলার জন্যে একটা মিথের প্রয়োজন ছিল কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান মিথলজিকে অপদস্থ করতে শুরু করেছিল। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭) পরীক্ষণ ও রহস্য উদ্ধারের বিকাশমান বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রবল ব্যবহারের

ব্যবহারের সাহায্যে পূর্বসুরিদের আবিষ্কারসমূহের সংশ্লেষ ঘটিয়েছিলেন। অভিকর্ষের ধারণাকে গোটা সৃষ্টিকে একসাথে ধরে রাখা এবং স্বর্গীয় বস্তুগুলোকে পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরতকারী বিশ্বজনীন শক্তি ধরে নিয়েছিলেন নিউটন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, এই ব্যবস্থা ঈশ্বর, অর্থাৎ মহান ‘মেকানিকের’ অস্তিত্বের প্রমাণ রাখে, যেহেতু মহাবিশ্বের জটিল পরিকল্পনা দুর্ঘটনাক্রমে আবির্ভূত হয়নি।১২ প্রাক আধুনিক বিজ্ঞানীদের মতো নিউটন মানুষের কাছে তাঁর ধারণামতে জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন ও নিশ্চিত ধারণা পৌছে দিয়েছিলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে তাঁর ‘ব্যবস্থা’ বস্তুগত বাস্তবতার সাথে সম্পূর্ণ মিলে গেছে এবং মানবীয় জ্ঞানকে আগের চেয়ে বহুদূর নিয়ে গেছে। কিন্তু লোগোসের জগতে সম্পূর্ণ মগ্ন নিউটনের পক্ষে মানুষকে এক ধরনের সত্যির পথ দেখানোর মতো অন্য আরও কোনও স্বজ্ঞা প্রসূত ধারণার অস্তিত্বে বিশ্বাস করা কঠিন করে তুলেছিল। তাঁর চোখে মিথলজি ও রহস্য ছিল চিন্তার আদিম ও বর্বর কায়দা। ‘এটা ধর্মের ক্ষেত্রে মানবজাতির উত্তপ্ত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন অংশ,’ বিরিক্তর সাথে লিখেছেন তিনি। ‘সব সময়ই রহস্য প্রিয় হওয়ায় যেটা তারা সবচেয়ে কম বোঝে তাকেই বেশি পছন্দ করে। ১৩

ক্রিশ্চান ধর্মবিশ্বাস থেকে পৌরাণিক মতবাদসমূহকে উৎখাত করার প্রশ্নে এক রকম বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন নিউটন। তিনি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, ট্রিনিটি ও ইনকারনেশনের অযৌক্তিক মতবাদ ষড়যন্ত্র, জালিয়াতি ও প্রতারণার ফলমাত্র। তাঁর মহান গ্রন্থ ফিলোসোফিয়া নেচারালিস প্রিন্সিপিয়া (১৬৮৭) রচনার সময় ফিলোসফিকাল অরিজিন অভ জেন্টাইল ফিলোসফি নামে এক বিচিত্র নিবন্ধ লিখতে শুরু করেছিলেন নিউটন, যেখানে যুক্তি দেখানো হয়েছে যে, নোয়াহ এক কুসংস্কারমুক্ত ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে কোনও প্রত্যাদিষ্ট ঐশীগ্রন্থ, রহস্য ছিল না, বরং কেবল একজন উপাস্য ছিলেন যাঁকে প্রাকৃতিক বিশ্বের যৌক্তিক ধ্যানের সাহায্যে জানা সম্ভব ছিল। পরের প্রজন্মসমূহ এই খাঁটি ধর্মকে কলুষিত করেছে। চতুর্থ শতাব্দীতে বিবেকহীন ধর্মবেত্তাদের হাতে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ট্রিনিটি ও ইনকারনেশনের মতবাদ যোগ হয়েছে এতে। প্রকৃতপক্ষেই, বুক অভ রেভেলেশন ট্রিনিটি মতবাদের উদ্ভবের ভবিষ্যদ্বাণী করেছে—‘তোমাদের পাশ্চাত্যের এই অদ্ভুত ধর্ম,’ ‘তিনটি সমান ঈশ্বরের কাল্ট’–ধ্বংসের অশ্লীলতা।” কিন্তু তারপরেও ধার্মিক লোক ছিলেন নিউটন এবং তখনও একটি যৌক্তিক আদিম ধর্মের অনুসন্ধানে একটা মাত্রা পর্যন্ত রক্ষণশীল চেতানায় বন্দি ছিলেন। কিন্তু আগের প্রজন্মের মতো নিজের ধর্ম বিশ্বাস প্রকাশ করতে পারছিলেন না তিনি। চতুর্থ শতাব্দীর গ্রিক অর্থডক্স ধর্মবিদগণ যে পরবর্তীকালের ইহুদি কাব্বালিস্টরা যেভাবে মিথোস তৈরি করেছিল ঠিক সেভাবে ট্রিনিটি মতবাদ সৃষ্টি করেছিলেন, এটা বুঝতে অক্ষম ছিলেন তিনি। গ্রেগরি অভ নিসা যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মার তিনটি হিপোস্তাসে কোনও বস্তুগত সত্য নয়, বরং স্রেফ স্বর্গীয় প্রকৃতি (অউসা) মানবীয় মনের সীমাবদ্ধতার সাথে যেভাবে খাপ খাইয়ে নেন তাকে বর্ণনা করার জন্যে ‘আমাদের ব্যবহৃত পরিভাষা’ মাত্র।১৫ প্রার্থনা, ধ্যান ও লিটার্জির কাল্টিক পরিপ্রেক্ষিতের বাইরে এটা কোনও অর্থ প্রকাশ করে না। কিন্তু নিউটন কেবল ট্রিনিটিকে যৌক্তিক পরিভাষায় দেখেছেন, মিথের ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারণা ছিল না, তাই এই মতবাদকে বাদ দিতে বদ্ধ পরিকর ছিলেন তিনি। আজকের দিনে বহু ক্রিশ্চানের ট্রিনিটির ধর্মতত্ত্ব নিয়ে সমস্যার মুখে পড়ার বিষয়টি দেখায় যে, যুক্তির দিক দিয়ে তারা নিউটনের পক্ষপাতিত্বের অংশীদার। নিউটনের অবস্থান সম্পূর্ণ বোধগম্য। তিনি ছিলেন পশ্চিমের অন্যতম প্রথম সারির ব্যক্তি যিনি বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের পদ্ধতি ও অনুশীলন সম্পূর্ণ আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। তাঁর সাফল্য ছিল আকাশ-ছোঁয়া আর এর ফল ছিল যেকোনও ধর্মীয় অভিজ্ঞতার মতোই আচ্ছন্নকারী। তিনি গবেষণার সময় বলতে অভ্যস্ত ছিলেন যে, ‘হে ঈশ্বর, আমার ধারণা আপনিই আপনার কথা ভাবেন!’১৬ আক্ষরিকভাবেই স্বজ্ঞাপ্রসূত অতীন্দ্রিয় সচেতনতার পক্ষে কোনও সময় ছিল না, যেটা হয়তো তাঁর প্রগতিকে ব্যাহত করতে পারত। পাশ্চাত্য পরীক্ষানিরীক্ষার চোখ ধাঁধানো ও প্রবল সাফল্যের কারণে মানুষের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুক্তি ও মিথ পরস্পরের বেমানান হয়ে উঠছিল।

সপ্তদশ শতাব্দী নাগাদ প্রগতি এতটাই নিশ্চত হয়ে ওঠে যে, বহু ইউরোপিয়ই তখন সম্পূর্ণ ভবিষ্যৎমুখী হয়ে উঠেছিল। অতীতকে সম্পূর্ণ নাকচ করে নতুন করে শুরু করার জন্যে প্রস্তুত থাকার বিষয়টি আবিষ্কার করছিল তারা। আগ্রসর হওয়ার গতিবেগ ছিল রক্ষণশীল চেতনার ভিত্তিভূমি পৌরাণিক পশ্চাদপসরণের ঠিক বিপরীত। নতুন বিজ্ঞানকে ভবিষ্যৎমুখী হতে হয়েছে: এভাবেই তা কাজ করে। কোপার্নিকাসের তত্ত্ব কার্যকরভাবে প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার পর টলেমিয় সৃষ্টি ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন আর সম্ভব ছিল না। পরে নিউটনের নিজস্ব ব্যবস্থা না হলেও তাঁর নিজের পদ্ধতি বাদ পড়ে যাবে। ইউরোপিয়রা সত্যি সম্পর্কে এক নতুন ধারণা গড়ে তুলছিল। নতুন নতুন আবিষ্কার সব সময়ই পুরোনো সত্যিকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে বলে সত্য কখনওই পরম হতে পারে না; একে অবশ্যই বাস্তবে, বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রমাণ করার প্রয়োজন ছিল এবং বাস্তব জীবনে এর কার্যকারিতা দিয়ে পরিমাপ করতে হত। প্রাথমিক কালের বিজ্ঞানের সাফল্য একে এমন কর্তৃত্ব দান করেছিল যা পৌরাণিক সত্যের চেয়ে অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করেছিল, যা এই যোগ্যতার কোনওটাই পূরণ করতে পারেনি।

ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের কাউন্সিলর ফ্রান্সেস বেকন (১৫৬১-১৬২৬) রচিত দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অভ লার্নিং-এ এটা ইতিম্যধ্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। বেকন জোরের সাথে বলেছেন সত্যি, এমনকি ধর্মের পবিত্রতম মতবাদকেও অভিজ্ঞতামূলক বিজ্ঞানের কঠোর সমালোচনামূলক পদ্ধতির অধীনে নিয়ে আসতে হবে। প্রমাণিত তথ্যে ও আমাদের ইন্দ্রিয়জ প্রমাণের বিরোধিতা করলে তাকে অবশ্যই ছুঁড়ে ফেলতে হবে। মানবজাতির জন্যে এক সুমহান ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার পথে অতীতের কোনও মহান দর্শনকেই বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেওয়া যাবে না। বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার মানবজাতির সব রকম ভোগান্তির অবসান ঘটাবে বলে বিশ্বাস করতেন বেকন, তিনি মনে করতেন এভাবে এই মাটির পৃথিবীতেই পয়গম্বরদের ভবিষ্যদ্বাণীর সেই রাজ্যের উদ্বোধন ঘটবে। বেকনের রচনায় আমরা নতুন যুগের উত্তেজনার দেখা পাই। তিনি এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, বিজ্ঞান ও বাইবেলের ভেতর কোনও বিরোধই লক্ষ করেননি। গালিলিও নিন্দিত হওয়ার অনেক বছর আগেই বিজ্ঞানের কর্মীদের পক্ষে সম্পূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার দাবি তুলেছিলেন তিনি, যাদের কর্মকাণ্ড সাধারণ মনমানসিকতার যাজককুলের কারণে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার মতো তুচ্ছ ব্যাপার নয়। দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অভ লার্নিং মিথ থেকে মুক্তির সন্ধান ও কেবল বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদই মানবজাতিকে সত্যের পথে নিয়ে যাবার শক্তির কথা ঘোষণাকারী স্বাধীনতার ঘোষণার মতো ছিল।

এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল এটা, আজকের আধুনিক পশ্চিমে আমরা বিজ্ঞানকে যেভাবে জানি তার সূচনাকে তুলে ধরে। এর আগে পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক ব্যাখ্যাকে সব সময়ই এইসব আবিষ্কারের ব্যাখ্যা তুলে ধরা এক ধরনের সামগ্রিক মিথলজির সীমানায় পরিচালনা করা হত। চলমান মিথ সব সময়ই এইসব আবিষ্কারের নিয়ন্ত্রণ করত, তাদের প্রয়োগের উপর বাধা আরোপ করত, রক্ষণশীল সমাজের সীমাবদ্ধতার দাবি ছিল এমনই। কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দী নাগাদ ইউরোপিয় বিজ্ঞানীরা প্রাচীন বাধা থেকে নিজেদের মুক্ত করে নিতে শুরু করেছিলেন। কৃষিভিত্তিক সমাজকে পেছনে টেনে ধরা বিভিন্ন উপাদান ধীরে ধীরে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হওয়ায় তাদের আর এসবের কোনও প্রয়োজন ছিল না। বেকন জোরের দিয়ে বলেছিলেন, বিজ্ঞানই একমাত্র সত্যি। একথা স্বীকার্য, বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর ধারণা আমাদের চেয়ে বেশ ভিন্ন ছিল। বেকনের চোখে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ছিল প্রধানত তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহের একটা ব্যাপার, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অনুমান ও প্রকল্পের গুরুত্ব হিসাবে নেননি তিনি। তবে সত্যি সম্পর্কে বেকনের সংজ্ঞা বিশেষ করে ইংরেজিভাষী দেশগুলাতে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, কেবল আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয় থেকে পাওয়া তথ্যের উপরই আমরা নিরাপদভাবে নির্ভর করতে পারি, বাকি সব স্রেফ কল্পনা। বাস্তব ক্ষেত্রে প্রমাণ করা সম্ভব নয় বলে দর্শন, মেটাফিজিক্স, ধর্মতত্ত্ব, শিল্পকলা, কল্পনা, অতীন্দ্রিয়বাদ এবং মিথলজিকে কুসংস্কার হিসাবে বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল।

জীবনের এই সম্পূর্ণ যৌক্তিক ধারায় বিশ্বাস করেও আবার ধার্মিক হতে চেয়েছে যারা, ঈশ্বর ও আধ্যাত্মিকতা নিয়ে চিন্তা করার নতুন পথ খুঁজে পেতে হয়েছে তাদের। আমরা ফরাসি বৈজ্ঞানিক রেনে দেকার্তের (১৫৯৬-১৬৫০) দর্শনে পৌরাণিক দৃষ্টিভঙ্গির মৃত্যু প্রত্যক্ষ করি। তিনি কেবল লোগোই, যুক্তির ভাষায় কথা বলতে পারতেন। নিঃসঙ্গতার দর্শন ছিল তাঁর। দেকার্তের চোখে মহাবিশ্ব প্রাণহীন একটা যন্ত্র, ভৌত জগৎ অনড় ও মৃত। স্বর্গ সম্পর্কে কোনও সংবাদ দেওয়ার ক্ষমতা এর নেই। মহাবিশ্বে একমাত্র মানুষের মনই জীবিত বস্তু, কেবল নিজের উপর নির্ভর করেই তা নিশ্চয়তা খুঁজে পেতে পারে। এমনকি আমাদের নিজস্ব সন্দেহ ও ভাবনার বাইরে আর কোনও কিছুর অস্তিত্ব আছে কিনা সে ব্যাপারে ও আমরা নিশ্চিত হতে পারি না। নিবেদিত প্রাণ ক্যাথলিক ছিলেন দেকার্তে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে নিজেকে সন্তুষ্ট করতে চেয়েছিলেন তিনি; কিন্তু মিথ ও কাল্টের আদিম কাল্পনিক অতীতে ফিরে যেতে অস্বীকার গেছেন। পয়গম্বর ও পবিত্র টেক্সটের দর্শনের উপরও নির্ভর করতে পারেননি তিনি। নতুন যুগের মানুষ হিসাবে চলমান ধারণা মেনে নিতে পারেননি, বৈজ্ঞানিককে অবশ্যই তাঁর মনকে তেবুলা রাসা-য় পরিণত করতে হবে। গণিত বা অনস্বীকার্যভাবে ঠিক ‘যা হয়ে গেছে তাকে আর বদলানো যাবে না’ ধরনের স্বতঃসিদ্ধ প্রস্তাব থেকে যা পাওয়া যেতে পারে সেটাই একমাত্র সত্যি। যেহেতু পেছনে যাবার পথ রুদ্ধ, দেকার্তে কেবল একটু একটু করে সমনেই যেতে পেরেছেন।

একদিন সন্ধ্যায় কাঠের চুলোর পাশে বসে থাকার সময় কোগিতো, এরগো সাম আপ্তবাক্যটি তৈরি করেন দেকার্তে। একে স্বপ্রকাশিত বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। আমরা কেবল আমাদের মনের সন্দেহের অভিজ্ঞতার বিষয়েই নিশ্চিত হতে পারি। কিন্তু এটা মানুষের মনের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে এবং ‘সীমাবদ্ধতার’ এই চিন্তা কোনও অর্থ প্রকাশ করবে না যদি আমাদের ‘সম্পূর্ণতা’ সম্পর্কে কোনও পূর্বধারণা না থাকে। অস্তিত্বহীন সম্পূর্ণতা তত্ত্বগতভাবে স্ববিরোধী হয়ে দাঁড়াবে। এরগো-চূড়ান্ত সম্পূর্ণতা-ঈশ্বর—অবশ্যই বাস্তব হতে বাধ্য।’ এই তথাকথিত প্রমাণে কোনও আধুনিক অবিশ্বাসীর সন্তুষ্ট হওয়ার কথা নয়। এখানে এই জাতীয় প্রসঙ্গের ক্ষেত্রে খাঁটি যুক্তির অক্ষমতাও দেখা যায়। জগতে আমাদের কার্যকর কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে যৌক্তিক চিন্তাভাবনা অপরিহার্য। দেকার্তের মতো কোনও বাস্তবভিত্তিক লক্ষ্যে পরিচালিত হলে বা আমরা জাগতিক বিশ্ব থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে যতদূর সম্ভব বস্তুনিষ্ঠভাবে কোনও কিছু বিবেচনা করতে চাইলে সবচেয়ে ভালোভাবে প্রয়োগ সম্ভব। কিন্তু আমরা যখন জানতে চাই এই জগৎ কেন টিকে আছে (আদৌ থাকলে!) বা জীবনের কোনও অর্থ আছে কিনা, যুক্তি খুব বেশি অগ্রসর হতে পারে না, আর আমাদের চিন্তার বিষয়টিও আমাদের কাছে অদ্ভুত হয়ে উঠতে পারে। শীতল বিশ্বে চুলোর পাশে আপন অনিশ্চয়তায় বন্দি দেকার্তে এমন একটি ‘প্রমাণ’ উচ্চারণ করেছেন যা কিনা আধুনিক মানুষের আধ্যাত্মিক টানাপোড়েন তুলে ধরা মানসিক ধাঁধার চেয়ে সামান্য বেশি কিছু।

এভাবে বিজ্ঞান ও বাধাহীন যুক্তিবাদ একসাথে সামনে অগ্রসর হওয়ার এমন একটা সময়ে মানুষের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মিথলজিহীন বাস করতে বাধ্য হওয়া বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের কাছে জীবন হয়ে পড়ছিল অর্থহীন। ব্রিটিশ দার্শনিক টমাস হবস (১৫৮৮-১৬৭৯) বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বর একজন ছিলেন, কিন্তু সকল বাস্তবসঙ্গত কারণেই ঈশ্বর নাও থাকতে পারেন। লুথারের মতো হবস ভৌত বিশ্বকে ঈশ্বরহীন মনে করেছেন। হবস বিশ্বাস করতেন, মানব ইতিহাসের উষা লগ্নে ঈশ্বর নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন, আবার একেবারে অন্তিমে তাই করবেন। কিন্তু সেই সময় পর্যন্ত আমাদের তাঁকে ছাড়াই এগিয়ে যেতে হবে, যেমন বলা হয়েছে, অপেক্ষা করতে হবে, অন্ধকারে।” প্রচণ্ডভাবে ধার্মিক মানুষ ফরাসি দার্শনিক ব্লেইজ পাসকার্ল (১৬২৩-৬২)-এর চোখে আধুনিক বিজ্ঞানের হাতে উন্মুক্ত অসীম বিশ্বজগতের শূন্যতা ও ‘চিরন্তন নীরবতা’ নিখাঁদ ভীতির জাগরণ ঘটিয়েছে:

যখন মানুষের অন্ধ ও করুণ অবস্থা দেখি, যখন গোটা মহাবিশ্বকে মৃতের মতো ও মানুষকে আলোহীন দেখি, যেন তাকে মহাবিশ্বের এক কাণে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে, যেন কে তাকে ওখানে নিয়ে গেছে তার জানা নেই, তাকে কী করতে হবে, মৃত্যুর পর কী পরিণতি হবে, কোনও কিছুই জানার মতো ক্ষমতা তার নেই, ঘুমের ভেতর কোনও ভয়াল নির্জন দ্বীপে নিয়ে যাওয়া কারও মতো সত্রাসে আলোড়িত হই আমি, পালানোর কোনও উপায় ছাড়াই জেগে উঠে দিশাহারা অবস্থা হয় যার। তখনই এমন করুণ অবস্থাও মানুষকে হতাশায় ঠেলে দেয় না দেখে বিস্মিত হই।১৯

এক বিশাল বাস্তব উপায়ে আধুনিক বিশ্বে যুক্তি ও লোগোস নারী-পুরুষের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাচ্ছিল, কিন্তু মানবীয় প্রকৃতির কারণেই এপর্যন্ত মিথোসের এখতিয়ারে থাকা উদ্ভূত বিভিন্ন চূড়ান্ত প্রশ্নের মোকাবিলা করার যোগ্যতা মানুষের ছিল না। এর ফলে পাসকাল বর্ণিত হতাশা ও বিচ্ছিন্নতা আধুনিক অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

তবে সবার জন্যে নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর দার্শনিক আলোকনের অন্যতম পথিকৃৎ জন লক (১৬৩২-১৭২৪)-এর পাসকালের মতো অস্তিত্বমূলক কোনও উদ্বেগ ছিল না। জীবন ও মানুষের যুক্তির উপর তাঁর বিশ্বাস ছিল প্রশান্ত ও আস্থাময়। ঈশ্বরের অস্তিত্বের ব্যাপারে কোনও সন্দেহ ছিল না তাঁর মনে, যদিও তিনি বুঝতেন আমাদের ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতার বাইরে অবস্থানকারী একজন উপাস্যের বাস্তবতা প্রমাণ করা বেকনের অভিজ্ঞতাজাত পরীক্ষায় উতরে যায় না। সম্পূর্ণ যুক্তির উপর নির্ভরশীল লকের ধর্ম কোনও কোনও মারানোর উদ্ভাবিত ডেইজম-এর অনুরূপ ছিল। তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন, স্বাভাবিক প্রকৃতি একজন স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ তুলে ধরে এবং যুক্তিকে ঠিক মতো মুক্তভাবে প্রকাশিত হতে দেওয়া হলে সবাই নিজ থেকেই সত্যি আবিষ্কার করতে পারবে। মিথ্যা ও কুসংস্করাচ্ছন্ন বিভিন্ন ধারণা এই পৃথিবীতে অনুপ্রবেশ করার একমাত্র কারণ পুরোহিতরা তাঁদের অর্থডক্সি মানুষের উপর জোর করে চাপিয়ে দিতে ইনকুইজিশনের মতো নিষ্ঠুর ও স্বেচ্ছাচারী বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করেছেন। সুতরাং, সত্যিকারের প্রকৃত ধর্মের খাতিরে রাষ্ট্রকে অবশ্যই সকল ধরনের বিশ্বাসকে সহ্য করতে হবে এবং স্রেফ বাস্তব প্রশাসন ও সরকার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। চার্চ ও রাষ্ট্রকে অবশ্যই আলাদা থাকতে হবে। একজনের কাজে আরেকজন হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এটা ছিল যুক্তির কাল। মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, বিশ্বাস করেছিলেন লক, নারী-পুরুষ স্বাধীন হয়ে উঠবে এবং সত্য উপলব্ধি করতে পারবে।২০

এমনি উদার দৃষ্টিভঙ্গি আলোকনের সুর স্থির করে দিয়েছিল, আধুনিক, সেক্যুলার, সহিষ্ণু রাষ্ট্রের অনুপ্রেরণাদানকারী আদর্শে পরিণত হয়েছিল। ফরাসি ও জার্মান আলোকন দার্শনিকরাও ডেইজমের যৌক্তিক ধর্মে অবদান রেখেছেন, প্রাচীন পৌরাণিক প্রত্যাদিষ্ট ধর্মগুলোকে সেকেলে বিবেচনা করেছেন তাঁরা। যুক্তিই যেহেতু সত্যির একমাত্র কষ্টিপাথর, ‘প্রত্যাদেশে’র কাল্পনিক ধারণার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত পুরোনো ধর্মগুলো এইসব প্রাকৃতিক ধর্মের আনাড়ী ভাষ্য বলে সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। বিশ্বাসের যৌক্তিক হওয়া উচিত, যুক্তি দেখিয়েছেন ব্রিটিশ ধর্মবেত্তা ম্যাথ্যু টিন্ডাল (১৬৫৫-১৭৩৩) ও রোমান ক্যাথলিক থেকে ডেইস্টে পরিণত আইরিশ জন টোল্যান্ড (১৬৭০-১৭২২)। আমাদের স্বাভাবিক যুক্তিই পবিত্র সত্যে পৌছানোর একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপায়, ক্রিশ্চান ধর্মকে অবশ্যই রহস্যময়, অতিপ্রাকৃত ও অলৌকিক থেকে মুক্ত করতে হবে। প্রত্যাদেশের কোনও প্রয়েজন নেই, কারণ যে কোনও সাধারণ মুনষের পক্ষেই স্বাধীন যুক্তিজ্ঞানের বদৌলতে সত্যে উপনীত হওয়া খুবই সম্ভব।২১ নিউটন যেমন তুলে ধরেছেন, ভৌত মহাবিশ্বের পরিকল্পনা নিয়ে বাইবেলেই একজন স্রষ্টা ও প্রথম কারণের অস্তিত্বের পক্ষে পর্যাপ্ত প্রমাণ মেলে। মহাদেশে জার্মান ইতিহাসবিদ হারমান স্যামুয়েল রেইমারাস (১৬৯৪- ১৭৬৮) যুক্তি দেখিয়েছেন যে, জেসাস কখনওই নিজেকে ঐশী সত্তা বলে দাবি করেননি। তাঁর লক্ষ্য সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ছিল। একটি ‘অসাধারণ, সরল, মহান ও বাস্তব ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা’ জেসাসকে স্রেফ একজন মহান নেতা হিসাবে শ্রদ্ধা করা উচিত। ২২

মিথোসের প্রাচীন সত্যসমূহকে এখন এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছিল যেন সেগুলো লোগোই, এটা ছিল সম্পূর্ণ নতুন পরিবর্তন, শেষ পর্যন্ত হতাশ করতে বাধ্য।

কারণ ঠিক যে সময়ে এই ধর্মবেত্তা, দার্শনিক ও ইতিহাসবিদগণ যুক্তির প্রাধান্য দাবি করছিলেন, ঠিক তখন জার্মান যুক্তিবাদী ইম্যানুয়েল কান্ট (১৭২৩-১৮০৪) গোটা আলোকনের প্রকল্পকেই খাট করে দেন। কান্ট একদিকে প্রাথমিক আধুনিকতার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মানুষকে অবশ্যই শিক্ষক, চার্চ ও কর্তৃপক্ষের উপর নির্ভরশীলতা ছুঁড়ে ফেলে নিজে থেকেই সত্যি সন্ধান করতে হবে। ‘আলোকন হচ্ছে মুনষের নিজে থেকে সৃষ্টি করা অভিভাবকত্ব থেকে মুক্তি, ‘ লিখেছেন তিনি। ‘অভিভাবকত্ব হচ্ছে অন্যের কাছ থেকে নির্দেশনা না পেয়ে নিজের মতো করে নিজের বোধকে কাজে লাগানোর অক্ষমতা। ২৩ কিন্তু আবার অন্যদিকে ক্রিটিক অভ পিউর রিজন (১৭৮১)-এ কান্ট যুক্তি দেখিয়েছেন যে, আমরা প্রকৃতিতে যে শৃঙ্খলা আবিষ্কার করি বলে ভাবি তার সাথে বাইরের কোনও বাস্তবতার সম্পর্ক থাকার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া অসম্ভব। এই শৃঙ্খলা’ আমাদের নিজস্ব মনের সৃষ্টি মাত্র, এমনকি নিউটনের তথাকথিত বৈজ্ঞানিক নিয়মকানুনও সম্ভবত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চেয়ে বরং মানুষের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কেই বেশি তথ্য যোগায়। মন বিভিন্ন ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতার সাহায্যে তার বাইরের কেনও তথ্য সংগ্রহ করার সময় এর ভেতর থেকে একটা অর্থ বের করতে একে তার নিজস্ব অন্তস্থঃ কাঠামো অনুযায়ী শনাক্ত করতে হয়। নিজের জন্যে একটি টেকসই যৌক্তিক দর্শন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মনের ক্ষমতার উপর দরুণ আস্থাশীল ছিলেন কান্ট। কিন্তু বাস্তবে মানুষের পক্ষে তার মনস্তত্ত্ব থেকে পালানো অসম্ভব দেখিয়ে তিনি এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, পরম সত্য বলে কিছু নেই। আমাদের সব ধারণাই আবিশ্যিকভাবে বস্তুনিষ্ঠ ও ব্যাখ্যামূলক। দেকার্তে যেখানে মানুষের মনকে এক মৃত পৃথিবীতে নিঃসঙ্গ নাগরিক হিসাবে দেখেছেন, কান্ট জগৎ ও মানুষের ভেতরের সম্পর্ক সম্পূর্ণ ছিন্ন করে দিয়ে তাকে আমাদের নিজেদের মাথার ভেতর বন্দি করেছেন।২৪ মানুষকে অভিভাবকত্ব থেকে মুক্ত করার পাশাপাশি এক বন্দিশালায় আটক করেছেন। প্রায়শঃই আধুনিকতা এভাবে এক হাতে কিছু দিয়ে আরেক হাতে কেড়ে নিয়েছে। যুক্তি আলোক ও মুক্তিদায়ী ছিল, কিন্তু তা নারী-পুরুষকে যে জগৎ তারা কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখছিল সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছিল।

পরম সত্যি বলে কিছুই যদি না থাকবে তাহলে ঈশ্বরের কী হবে? অন্যান্য ডেইস্টদের বিপরীতে কান্ট বিশ্বাস করতেন যে, উপাস্য ইন্দ্রিয়র নাগালের বাইরে অবস্থান করেন বলে মানুষের মনের অগম্য ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা অসম্ভব।২৫ পরমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যুক্তির আসলে একাকী কিছুই করার থাকে না। একমাত্র যে সান্ত্বনা কান্ট যোগাতে পেরেছিলেন সেটা হলো, একই যুক্তিতে ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতা প্রমাণ করা অসম্ভব। কান্ট স্বয়ং ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন, নিজের ধারণাসমূহকে ধর্মের প্রতি বৈরী মনে করেননি; তিনি ভেবেছিলেন, এসব ধারণা ধর্মবিশ্বাসকে যুক্তির উপর নেহাত অযথার্থ নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত করবে। ক্রিটিক অভ প্র্যাক্টিকাল রিজন-এর শেষে তিনি লিখেছেন, প্রত্যেক মানুষের অন্তরে নৈতিক বিধান খোদাই করার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন তিনি, স্বর্গের বিশালতার মতো যা তাঁকে বিস্ময় আর ভয়ে পরিপূর্ণ রাখে। কিন্তু ডেইস্ট ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে একমাত্র যে যৌক্তিক ভিত্তি তুলে ধরতে পেরেছিলেন তিনি সেটা খুবই সন্দেহজনক যুক্তি যে, এমন একজন উপাস্য ছাড়া ও পরকালের সম্ভাবনা না থাকলে আমাদের নৈতিক আচরণ করার কোনও কারণ দেখতে পান না তিনি। একেও প্রমাণ হিসাবে অসন্তোষজনকই বলতে হবে।২৬ কান্টের ঈশ্বর ছিলেন মানবীয় অবস্থায় জুড়ে দেওয়া পশ্চাদভাবনামাত্র। অন্তস্থঃ বিশ্বাস ছাড়া একজন যুক্তিবাদী কেন বিশ্বাস করতে যাবে তার কোনও প্রকৃত কারণ নেই। ডেইস্ট ও যুক্তিবাদী মানুষ হিসাবে অতীত কালের নারী-পুরুষ যুক্তির উপর নির্ভরশীলতা ছাড়াই কেবল প্রচলিত প্রতীক বা রেওয়াজের মাধ্যমে এক ধরনের পবিত্রের অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে পারত- সেসবে কান্টের কোনও অবকাশ ছিল না। স্বর্গীয় আইনের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন কান্ট, তাঁর চোখে এটা ছিল মানুষের স্বায়ত্তশাসনের বর্বোরোচিত অস্বীকৃতি, তিনি অতীন্দ্রিয়বাদ, প্রার্থনা বা আচার অনুষ্ঠানের ভেতর যুক্তি খুঁজে পাননি।২৭ কাল্টের অস্তিত্ব ছাড়া ধর্ম ও স্বর্গের ধারণা ক্ষীণ, শুষ্ক ও সমর্থনের অযোগ্য।

কিন্তু তারপরেও পশ্চিমে, বৈপরীত্যমূলকভাবে সত্যের একমাত্র মাপকাঠি হিসাবে যুক্তির আবির্ভাব ধর্মীয় অযৌক্তিতার বিস্ফোরণের সাথে মিলে গিয়েছিল। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে বহু প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক দেশ ও আমেরিকান কলোনিগুলোতে সংক্ষিপ্ত সময়ে জন্যে আবির্ভূত ব্যাপক উইচ ক্রেজ দেখিয়ে দিয়েছিল যে, বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের কাল্টও সব সময় অন্ধকার শক্তিকে দূরে ঠেলে রাখতে পারে না। অতীন্দ্রিয়বাদ ও মিথলজি নারী-পুরুষকে অবচেতন বিশ্বের মোকাবিলা করতে শিখিয়েছিল। এটা দুর্ঘটনামূলক নাও হতে পারে যে, এমন একটা সময় ধর্মীয় বিশ্বাস এই ধরনের আধ্যাত্মিকতা বিসর্জন দিতে শুরু করলে অবচেতন উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠেছিল। উইচ ক্রেজকে গোটা ক্রিশ্চান বিশ্বে নারী, পুরুষ ও ইনকুইজিটরদের সম্মিলিত ফ্যান্টাসি হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। লোকে বিশ্বাস করে বসেছিল যে, দানোর সাথে তাদের যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে ও কোনও শয়তানি আচার আর বিকৃত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রাতের অন্ধকারে তাদের উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ধরে নেওয়া হয়েছিল, ডাইনীরা ধর্মসভার বিকৃতিতে ঈশ্বরের বদলে শয়তানের উপাসনা করছে-প্রচলিত ধর্মের প্রতি ব্যাপকবিস্তারি অবচেতন বিদ্রোহ ফুটিয়ে তোলা পরিবর্তন হতে পারে। ঈশ্বরকে এত দূরবর্তী, অচেনা আর চাহিদা সম্পন্ন মনে হচ্ছিল যে, কারও কারও কাছে দানবীয় হয়ে উঠছিলেন তিনি; অবচেতেন ভীতি ও আকাঙ্ক্ষাসমুহ মানুষের দানবীয় রূপে ফুটিয়ে তোলা শয়তানের কাল্পনিক মূর্তিতে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে।২৮ খোদ ক্রেজের অবসান হওয়ার আগ পর্যন্ত উইচক্র্যাফটের দায়ে দণ্ডিত হাজার হাজার নারী-পুরুষকে হয় ফাঁসি দেওয়া হয়েছে নয়তো শূলে চড়িয়ে মারা হয়েছে। মনের এইসব গভীর স্তরসমূহকে বিবেচনায় না নেওয়া নতুন বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ এই বিকারগ্রস্ত বিস্ফোরণকে সামাল দিতে ছিল অক্ষম। এক বিশাল ভীতিকর ও ধ্বংসাত্মক যুক্তিহীনতাও আধুনিক অভিজ্ঞতার অংশ ছিল।

অতলান্তিকের উভয় পাড়ের মানুষের জন্যেই ভীতিকর সময় ছিল এটা। সংস্কার ছিল ইউরোপকে ভয়ঙ্করভাবে বৈরী শিবিরে বিভক্ত করে দেওয়া ভীতিকর বিচ্ছেদ। ইংল্যান্ডে প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকরা পরস্পরের উপর নির্যাতন চালিয়েছে: ফ্রান্সে প্রটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের ঘটনা (১৫৬২-৬৩) এবং ১৫৭২ সালে দেশব্যাপী প্রটেস্ট্যান্টদের গণহারে হত্যা ঘটেছে। তিরিশ বছর মেয়াদী যুদ্ধ (১৬১৮-৪৮) একের পর এক দেশকে টেনে এনে ইউরাপকে ধ্বংস করে দিয়েছে, শক্তিশালী ধর্মীয় মাত্রায় পরিচালিত ক্ষমতার সংঘাত ইউরোপের ঐকবদ্ধ হওয়ার যে কোনও আশা তিরোহিত করে দিয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতাও ছিল। ১৬৪২ সালে গৃহযুদ্ধে জর্জরিত হয়ে ওঠে ইংল্যান্ড, এরই পরিণতিতে রাজা প্রথম চার্লস নিহত হন (১৬৪৯) এবং পিউরিটান সাংসদ অলিভার ক্রমওয়েলের অধীনে একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৬৬০ সালে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে সংসদ কর্তৃক এর ক্ষমতা খর্ব করা হয়। পশ্চিমে আরও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের রক্তাক্ত ও বেদনাদায়ক আবির্ভাব ঘটছিল। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব আরও অনেক বেশি বিপর্যয়কর ছিল, এর অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে নেপোলিয়নের অধীনে শৃঙ্খলার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে ত্রাস ও সামরিক স্বৈরাচারের একটা রাজত্ব চলেছে। আধুনিক বিশ্বে ফরাসি বিপ্লবের উত্তরাধিকার দ্বিমুখী: স্বধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের আলোকন আদর্শের বিকাশ ঘটানোর পাশাপাশি আবার সমানভাবে প্রভাবশালী রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভয়াবহ স্মৃতিও রেখে গেছে। আমেরিকান উপনিবেশগুলোতেও সাত বছর মেয়াদী যুদ্ধ (১৭৩৬-৬৩)-যেখানে ফ্রান্স ও ব্রিটেন তাদের সাম্রাজ্যবাদী অধিকার নিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল-আমেরিকার পূর্ব উপকূলে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে, ভীতিকর ধ্বংসলীলার সৃষ্টি হয়েছে তাতে। এটা সরাসরি স্বাধীনতা যুদ্ধের পথে নিয়ে গেছে (১৭৭৫-৮৩) যার ফলে আধুনিক বিশ্বে সর্ব প্রথম সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পশ্চিমে আরও ন্যায়বিচারভিত্তিক ও সহিষ্ণু সামাজিক ব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটছিল, কিন্তু সেটা অর্জন সম্ভব হয়েছিল প্রায় দুই শতাব্দীব্যাপী সহিংসতার পর।

এই টালমাতাল সময়ে মানুষ ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল এবং কেউ কেউ এমনি নতুন পরিস্থিতিতে বিশ্বাসের প্রাচীন ধরন আর কাজ করছে না বলে আবিষ্কার করেছিল। পরবর্তীকালে ইহুদি ধর্মের শ্যাব্বেতিয় আন্দোলনের মতো নৈতিকতা বিরোধী আন্দোলন অতীতের সাথে বন্ধন ছিন্ন করে সামঞ্জস্যহীনভাবে নতুন কিছু লাভ করার প্রয়াস পেয়েছিল। সপ্তম শতাব্দীর ইংল্যান্ডে গৃহযুদ্ধের পর জ্যাকব বথিউমলি ও লরেন্স ক্লার্কসন (১৬৩০) এক ধরনের প্রাথমিক নাস্তিক্যবাদের প্রচার চালান। একজন বিচ্ছিন্ন, দূরবর্তী উপাস্য বহুঈশ্বরবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়, দ্য লাইট অ্যান্ড ডার্ক সাইড অভ গড (১৬৫০)-এ যুক্তি দেখিয়েছেন ক্লার্কসন; জেসাস ছাড়াও অন্য ব্যক্তির মাঝে মানবরূপ গ্রহণ করেছিলেন ঈশ্বর; সবকিছুতেই, এমনকি পাপেও স্বর্গীয় সত্তার অস্তিত্ব রয়েছে। দ্য সিঙ্গল আই-তে ক্লার্কসনের চোখে পাপ মানবীয় কল্পনামাত্র, আর অশুভ ঈশ্বরের একটি প্রকাশ। রেডিক্যাল ব্যাপ্টিস্ট অ্যাবিয়েযার কোপে (১৬১৯-৭২) প্রকাশ্যে যৌনতার টাবু ভঙ্গ করবেন ও জনসমক্ষে খিস্তিখেউর করবেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘মহান সমতাবিধানকারী’ ক্রাইস্ট ফিরে এসে বর্তমানের পচা ভণ্ডামীপূর্ণ ব্যবস্থাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করবেন। ২৯ নিউ ইংল্যান্ডের আমেরিকান কলোনিগুলোতেও নৈতিকতা বিরোধী মতবাদ চলছিল। ১৬৩৫ সালে ম্যাসাচুসেটসে পৌঁছানো জনপ্রিয় পিউরিটান যাজক জন কটন (১৫৮৫-১৬২৩) জোর দিয়ে বলেছেন, ভালো কাজের কোনও অর্থ নেই, সৎ জীবন যাপন অর্থহীন; এইসব মানব সৃষ্ট নিয়মনীতি ছাড়াই ঈশ্বর আমাদের উদ্ধার করার ক্ষমতা রাখেন। তাঁর শিষ্য অ্যানি হাচিনসন (১৫৯০-১৬৪৩) দাবি করেছিলেন, ঈশ্বরের কাছ থেকে ব্যক্তিগত প্রত্যাদেশ লাভ করেছেন তিনি, তাই বাইবেল পাঠ বা ভালো কাজ করার কোনও প্রয়োজন বোধ করেন না। এই বিদ্রোহীরা সম্ভবত জীবন মৌলিকভাবে বদলে যেতে থাকা নুতন বিশ্বব্যবস্থায় প্রাচীন বিধিনিষেধ আর কাজ না করার সেই অপরিণত ভাবনাই প্রকাশ করার প্রয়াস পাচ্ছিলেন। অবিরাম উদ্ভাবনের একটা কালে কেউ কেউ ধর্মীয় ও নৈতিক স্বাধীনতার জন্যে পা বাড়িয়ে আবার উদ্ভাবন থেকেও নিস্তার চাইবে, এটাই স্বাভাবিক।

অন্যরা নতুন যুগের আদর্শসমূহকে ধর্মীয় ভঙ্গিতে প্রকাশের প্রয়াস পেয়েছে। সোসায়েটি অভ ফ্রেন্ডস-এর প্রতিষ্ঠাতা জর্জ ফক্স (১৬২৪-৯১) এমন এক আলোকনের প্রচার করেছেন যা পরবর্তীকালের কান্টের মতবাদ থেকে খুব বেশি ভিন্ন ছিল না। তাঁর কোয়াকারদের নিজের অন্তস্তলেই আলোর সন্ধান করতে হবে। ফক্স তাদের ‘অন্যের কাছে নির্দেশনা নেওয়ার বদলে নিজের মতো করে উপলব্ধি অর্জন করতে’৩১ শিখিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ধর্মকে এই বিজ্ঞানের যুগে অবশ্যই ‘পরীক্ষামূলক’ হতে হবে; কোনও কর্তৃত্ববাদী প্রতিষ্ঠান নয়, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় সত্যায়িত হতে হবে।৩২ সোসায়েটি অভ ফ্রেন্ডস এক নতুন গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রচারণা চালিয়েছে: সব মানব সন্তানই সমান। কোয়াকারদের আর কারও সামনে মাথার টুপি খোলার প্রয়োজন নেই। অশিক্ষিত নারী-পুরুষকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী যাজকদের সমীহ করার প্রয়োজন নেই, বরং তাদের অবশ্যই নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে হবে। একইভাবে জন ওয়েসলি (১৭০৩- ৯১) আধ্যাত্মিকতায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও ব্যবস্থার প্রয়োগ ঘটাতে চেয়েছিলেন। তাঁর ‘মেথডিস্ট’ অনুসারীরা প্রার্থনার কঠোর নিয়ম মেনে চলত: বাইবেল পাঠ, উপবাস পালন ও দান। কান্টের মতো ওয়েসলি যুক্তি থেকে ধর্মবিশ্বাসের মুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ধর্ম মস্তিষ্কের কোনও মতবাদ নয়, বরং হৃদয়ের বিশ্বাস। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রিশ্চান ধর্মের যৌক্তিক ও ঐতিহাসিক প্রমাণসমূহ ‘আবদ্ধ ও বন্দি’ হয়ে পড়াটা এমনকি এক ধরনের আশীর্বাদও হতে পারে। এটা নারী-পুরুষকে মুক্ত করবে, তাদের ‘নিজেদের দিকে চোখ ফেরাতে বাধ্য করবে ও হৃদয়ের মাঝে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলন্ত আলোকে দেখতে বাধ্য করবে।’৩

ক্রিশ্চানরা বিভক্ত হতে শুরু করেছিল: কেউ কেউ ফিলোসফসদের অনুসরণ করে ধর্মবিশ্বাসকে রহস্যমুক্ত ও যৌক্তিক করার প্রয়াস পাচ্ছিল, অন্যরা যুক্তিকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে দিয়েছিল। এটা ছিল উদ্বেগজনক একটা ব্যাপার, বিশেষ করে আমেরিকান কলোনিগুলোতে বেশি দৃশ্যমান ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৌলবাদের বিকাশ এই বিভাজনের অন্যতম প্রতিক্রিয়া হয়ে উঠবে। প্রথম দিকের বছরগুলোতে পিউরিটান নিউ ইংল্যান্ড ছাড়া অধিকাংশ কলোনি ধর্মের প্রতি নিস্পৃহ ছিল; মনে হয়েছিল যেন সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ কলোনিগুলো বুঝি সম্পূর্ণ সেকুলারাইজড হয়ে উঠবে। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আবার প্রটেস্ট্যান্টদের আধিপত্য পুনরুজ্জীবিত হয়, পুরোনো পৃথিবীর তুলনায় নুতন বিশ্বে ক্রিশ্চানদের জীবনধারা অনেক বেশি আনুষ্ঠানিক হয়ে ওঠে। মূলত যাজকীয় কর্তৃত্ব প্রত্যাখ্যান করে যার যার নিজস্ব নেতৃত্ব অনুসরণের উপর জোরদানকারী কোয়াকার, ব্যাপ্টিস্ট ও প্রেসবিটারিয়ানদের মতো উপদলগুলো ফিলাদেলফিয়া অ্যাসেম্বলি স্থাপন করেছিল। এই অ্যাসেম্বলি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখত, যাজক সম্প্রদায়কে নির্দেশনা দিত ও যেকোনও রকম ধর্মদ্রোহীতাকে দমন করত। এই নির্যাতনমূলক অথচ আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার ফলে তিনটি গোষ্ঠীই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে ও এদের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বাড়তে থাকে। একই সময়ে মেরিল্যান্ডে চার্চ অভ ইংল্যান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়, জাঁকাল দর্শন চার্চ নিউ ইয়র্ক সিটি, বস্টন ও চার্লসটনের দিগন্ত রেখাকে আমূল বদলে দেয়।৩৫

কিন্তু একদিকে যখন বৃহত্তর নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা আরোপের লক্ষ্যে প্রয়াস চলছিল, তখন এই যৌক্তিক বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে তৃণমূল পর্যায়ে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়ারও সৃষ্টি হয়েছিল। রক্ষণশীল ধর্ম সব সময়ই মিথলজি ও যুক্তিকে পরিপূরক হিসাবে দেখেছে, একটি ছাড়া অন্যটি হীন হয়ে পড়বে। ধর্মীয় ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই ছিল, যেখানে যুক্তিকে প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করার সুযোগ করে দেওয়া হত। কিন্তু কোনও কোনও নতুন প্রটেস্ট্যান্ট আন্দোলনে (এই পরিবর্তনকে মার্টিন লুথারের সময় পর্যন্ত টেনে নেওয়া যেতে পারে) যুক্তিকে সাইড লাইনে ঠেলে দেওয়ার বা এমনকি পুরোপুরি বাতিল করার প্রবণতা অস্বস্তিকর যুক্তিহীনতার দিকে টেনে নিয়ে গেছে। কোয়াকারদের এ নামে অভিহিত করার কারণ ছিল গোড়ার দিকে প্রায়শঃই তারা তাদের ধর্মীয় পরিবর্তন প্রকাশ করার জন্যে কাঁপত, হুঙ্কার ছাড়ত আর চিৎকার করত—জনৈক পর্যবেক্ষক লক্ষ করেছেন-ফলে কুকুর ডেকে উঠত, গরুছাগল পাগলের মতো ছোটাছুটি করত আর শুয়োরের পাল আতঙ্কে চেঁচামেচি জুড়ে দিত। রেডিক্যাল কালিভিনিস্ট পিউরিটানদেরও-চার্চ অভ ইংল্যান্ডের ‘সম্পত্তি’ বলে তাদের ধরণার সবকিছুর বিরোধিতা করে যাদের শুরু হয়েছিল—একই ধরনের চরম, কোলাহলময় আধ্যাত্মিকতা ছিল। তাদের ‘নতুন জন্মে’র খিঁচুনী প্রায়শঃই আচ্ছন্ন ধরনের ছিল, আনন্দের সাথে ঈশ্বরের বাহুতে ডুব দিয়ে সফল হওয়ার আগে অনেকেই অপরাধরোধ, ভীতি ও অবশ করা সন্দেহের যন্ত্রণা বোধ করেছে। ধর্মান্তরকরণ বিপুল শক্তিতে আদি আধুনিককালে নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম করে তুলেছিল তাদের। তারা ভালো পুঁজিবাদী ও প্রায়শঃই ভালো বিজ্ঞানী ছিলেন। কিন্তু অনেক সময় মহত্বের প্রভাব ফুরিয়ে যেত, পিউরিটানরা তখন এক ধরনের পুনঃপতনে আক্রান্ত হত, অবিরাম বিষণ্ণতার চক্রে পড়ে যেত তারা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনকি তারা আত্মহত্যাও করেছে। ৩৭

এইদিক থেকে রক্ষণশীল ধর্ম উন্মাদনাগ্রস্ত ছিল না। মানুষকে আস্থার সাথে সম্পর্কিত করে তোলার জন্যেই এর আচারানুষ্ঠান ও কাল্টের পরিকল্পনা করা হত। বাকানালিয় কাল্ট ও উন্মত্ত পরমানন্দের ঘটনা নিশ্চিতভাবেই ঘটেছে বটে, কিন্তু তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠের চেয়ে বরং অল্প কিছু লোক প্রভাবিত হয়েছে। অতীন্দ্রিয়বাদ ব্যাপক জনসাধারণের জন্যে ছিল না। সর্বোচ্চ অবস্থায় এটা এক থেকে অন্যকে শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি: এখানে শিক্ষাব্রতীতে সযত্নে তত্ত্বাবধান করা হয় যাতে সে কোনও মানসিক অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় না পড়ে। অবচেতনে অবতরণের ব্যাপারটি এক ধরনের নৈপূণ্য; ব্যাপক দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা ও শৃঙ্খলা দাবি করে। দক্ষ নির্দেশক পাওয়া না গেলে ফল নিন্দনীয় হয়ে উঠতে পারে। প্রায়শঃই পর্যাপ্ত আধ্যাত্মিক নির্দেশনার অভাবে কারণে ঘটে যাওয়া মধ্যযুগীয় ক্রিশ্চান সাধুদের উন্মত্ত ও পাগলামিসুলভ আচরণ মনের বিকল্প অবস্থার চর্চার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলাহীনতার বিপদই তুলে ধরেছে। এই ধরনের অপচয় রোধ করার জন্যেই তেরেসা অভ আভিলা ও জন অভ দ্য ক্রসের সংস্কার পরিকল্পিত ছিল। অতীন্দ্রিয় যাত্রা গণহারে হাতে নেওয়া হলে শাব্বেতিয়দের নিশ্চিহ্নবাদ বা কিছু সংখ্যক পিউরিটানের মানসিক ভারসাম্যহীনতার মতো সমবেত হিস্টিরিয়ায় পর্যবসিত হতে পারে।

আবেগীয় বাড়াবাড়ি অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকার ধর্মীয় জীবনের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল। প্রথম মহাজাগরণে এই বিষয়টি বিশেষভাবে স্পষ্ট ছিল। ১৭৩৪ সালে কানেক্টিকাটের নর্থদাম্পটনে বিস্ফোরিত হয়েছিল এই আন্দোলন; বিজ্ঞ কালভিনিস্ট যাজক জোনাথান এডওয়ার্ডস (১৭০৩-৫৮) এর বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন। মহাজাগরণের আগে, ব্যাখ্যা করেছেন এডওয়ার্ডস, নর্দাম্পটনের লোকেরা তেমন ধার্মিক ছিল না, কিন্তু ১৭৩৪ সালে সহসা দুই তরুণ মারা যায়। এর ধাক্কা, (এডওয়ার্ডসের নিজস্ব আবেগ প্রবণ প্রচারণার সমর্থনে) গোটা শহর উন্মত্ত ধার্মিকতায় পতিত হয়, মহামারীর মতো ম্যাসাচুসেটস ও লঙ আইল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ে তা। লোকজন কাজ ফেলে সারাদিন বাইবেল পড়ে সময় কাটাতে শুরু করে। ছয় মাসের মধ্যেই শহরের তিনশো লোক বেদনাদায়ক ‘পুনর্জন্মের দীক্ষা লাভ করে। পরম আনন্দ ও ভীষণ বিষণ্নতার মাঝে ওঠানামা করছিল তারা; অনেক সময় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ত আর ‘তারা ঈশ্বরের ক্ষমা লাভের অযোগ্য ভাবতে তৈরি হয়ে যাওয়ার মতো অপরাধবোধের অনুভূতিতে ডুবে যেত।’ অন্যান্য সময়ে তারা ‘হাসিতে ফেটে পড়ত, একই সময়ে আবার স্রোতের মতো চোখে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত, মাঝেমাঝে প্রচণ্ড বিলাপে ফেটে পড়ত।৩৮ এই পুনর্জাগরণ মিলিয়ে যেতে শুরু করেছিল, এমন সময় এক ইংরেজ মেথডিস্ট যাজক জর্জ হুইটফিল্ড (১৭১৪- ৭০) বিভিন্ন উপনিবেশে সফর করে দ্বিতীয় দফা জোয়ার সৃষ্টি করেন। তাঁর সারমনের সময় লোকে অচেতন হয়ে যেত, কাঁদত, চিৎকার ছাড়ত; যারা রক্ষা পেয়েছে মনে করত তাদের চিৎকারে কেঁপে উঠত চার্চের অন্দর মহল আর নিজেদের নিশ্চিত সাজাপ্রাপ্ত ধরে নেওয়া দুর্ভাগাদের গোঙানি শোনা যেত। কেবল সাধারণ ও অশিক্ষিতরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। হার্ভার্ড ও ইয়েলে আনন্দমুখর সংবর্ধনা লাভ করেন হুইটফিল্ড। ১৭৪০ সালে একটি গণমিছিলের মাধ্যমে তাঁর সফরের সমাপ্তি টানেন তিনি, সেখানে বস্টন কমনের ৩০,০০০ লোকের সামনে সারমন দিয়েছিলেন।

এডওয়ার্ডস তাঁর বিবরণে এই ধরনের আবেগপ্রবণতার বিপদ তুলে ধরেছেন। নর্দাম্পটনে পুনর্জাগরণে ভাটা পড়লে একজন এতটাই বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল যে পরমানন্দমূলক আনন্দের হারিয়ে যাওয়ার মানে হতে পারে কেবল তার অবশ্যাম্ভবী নরক বাস, এটা নিশ্চিত হয়ে আত্মহত্যা করে বসে সে। অপরাপর শহরেও ‘অসংখ্য মানুষ…জোরালভাবে এটা বুঝিয়েছে বলে মনে হয়েছে, ওদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে, যেন কেউ একজন তাদের উদ্দেশে বলছে, “তোমার গলা কেটে ফেল, এটাই সেরা সুযোগ। এখন!” দুজন লোক ‘অদ্ভুত উৎসাহভরা বিভ্রমে পাগল হয়ে গেছে। এডওয়ার্ডস জোরের সাথে বলেছেন যে অধিকাংশ লোক জাগরণের আগে অপেক্ষাকৃত শান্ত ও চুপচাপ ছিল, কিন্তু তাঁর অ্যাপোলোজিয়া ধর্মকে কেবল হৃদয়ের একটা ব্যাপার কল্পনা করা কতখানি বিপজ্জনক হতে পারে সেটাই দেখিয়ে দেয়। ধর্মকে একবার অযৌক্তিক ধরে নিয়ে সেরা রক্ষণশীল আধ্যাত্মিকতার অন্তস্থঃ বাধাসমূহকে বাতিল করে দেওয়া হলে লোকে সব ধরনের বিভ্রমে পতিত হতে পারে। কাল্টের বিভিন্ন আচার আচরণ এমনভাবে পরিকল্পিত যাতে লোকে কোনও আঘাতের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে স্বাস্থ্যবান হয়ে অপর প্রান্ত দিয়ে বের হয়ে আসতে পারে। লুরিয় কাব্বালাহয় এই বিষয়টি খুবই স্পষ্ট, এখানে অতীন্দ্রিয়বাদীকে বিষাদ ও পরিত্যাগ দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়, কিন্তু আনন্দের সাথে অভিযাত্রা শেষ করানো হয়। একইভাবে হুসেইনের সম্মানে আয়োজিত প্রচলিত শিয়া মিছিল মানুষকে তাদের হতাশা ও ক্রোধ প্রকাশ করার একটা পথ তৈরি করে দেয়, তবে একটা আচরিক রূপে: অনুষ্ঠান শেষে তারা উন্মত্তের মতো ছোটাছুটি শুরু করে না, ধনী ও ক্ষমতাশালীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয় না। কিন্তু নর্দাম্পটনে লোকজনকে অগ্রসর হওয়ার পথে সাহায্য করতে কোনও পরিকল্পিত কাল্ট ছিল না। সবকিছু ছিল স্বতঃস্ফুর্ত ও বিশৃঙ্খল। লোকজনকে তাদের সম্পূর্ণ আবেগের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে এবং এমনকি তাতে জড়িত হতেও দেওয়া হয়েছে। মুষ্টিমেয় কিছু লোকের পক্ষে তা মারাত্মক প্রমাণিত হয়েছে।

তাসত্ত্বেও এডওয়ার্ডস নিশ্চিত ছিলেন যে, জাগরণ ঈশ্বরেরই কাজ ছিল। আমেরিকায় এক নতুন ভোরের সূচনা দেখিয়েছে তা, বিশ্বের বাকি অংশে ছড়িয়ে পড়বে এটা। প্রত্যেক পুনর্জাগরণের মাধ্যমে, এডওয়ার্ডস নিশ্চিত ছিলেন, ক্রিশ্চানরা পৃথিবীর বুকে ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবে, সমাজে সত্য ও স্বয়ং ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের প্রতিফলন ঘটাবে। জাগরণে রাজনৈতিকভাবে রেডিক্যাল কিছু ছিল না। এডওয়ার্ডস ও হুইটফিল্ড শ্রোতাদের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে, গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে প্রচারণা বা সম্পদের সুষম বণ্টনের দাবি তোলার তাগিদ দিতে যাননি; তবে এই অভিজ্ঞতা আমেরিকান বিপ্লবের পথ তৈরিতে সাহায্য করেছে। পরমান্দময় অভিজ্ঞতা বিপ্লবী নেতাদের ডেইস্ট আলোকন আদর্শের সাথে নিজেদের সম্পর্কিত করতে পারবে না এমন বহু আমেরিকানকে এক ধরনের স্বাধীনতার আনন্দময় স্মৃতির অনুভূতি যুগিয়েছে। ‘মুক্তি’ শব্দটি দীক্ষা ও স্বাভাবিক জীবনের ব্যথা ও বেদনা থেকে মুক্তির আনন্দ বোঝাতে ব্যাপক ব্যবহৃত হয়েছে। হুইটফিল্ড ও এডওয়ার্ডস, উভয়ই যাঁর যাঁর সমাবেশকে যারা পুনর্জন্ম লাভ করেনি এবং উন্মত্ততাকে যুক্তিবাদী নিরাসক্ততার সাথে দেখেছে সেই অভিজাত গোষ্ঠীর চেয়ে তাদের পরমানন্দময় বিশ্বাসকে উঁচু মানের ভাবতে উৎসাহিত করেছেন। পুনর্জাগরণের নিন্দাকারী যাজকদের ঔদ্ধত্যের কথা যাদের মনে ছিল তাদের অনেকেই বহু আমেরিকান কালভিনিস্টের ক্রিশ্চান অভিজ্ঞতায় পরিণত হওয়া প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষের প্রতি দারুণ অবিশ্বাস গড়ে তুলেছিল। জাগরণ আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম গণআন্দোলন ছিল। সাধারণ লোকজনকে দুনিয়াবিদারী ঘটনাপ্রবাহে অংশ গ্রহণের হঠকারী অভিজ্ঞতার সুযোগ করে দিয়েছিল যা ইতিহাসের ধারা পাল্টে দেবে বলে বিশ্বাস করেছিল তারা।

কিন্তু জাগরণ উপনিবিশের কালভিনিস্ট গোষ্ঠীগুলোকেও সরাসরি দ্বিধা বিভক্ত করে দিয়েছিল। বস্টন যাজক জনাথান মেহিউ (১৭২০-৬০) ও চার্লস চন্সি (১৭০৫-৮৭)-এর মতো ওল্ড লাইটস নামে পরিচিত হয়ে ওঠা ব্যক্তিগণ বিশ্বাস করতেন ক্রিশ্চান ধর্মকে যৌক্তিক, আলোকিত ধর্মবিশ্বাস হতে হবে পুনর্জাগরণবাদীদের উন্মত্ততায় ভীত হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা, তাদের বুদ্ধিবৃত্তি বিরোধী পক্ষপাতিত্বের প্রতি সন্দিহান ছিলেন।৪২ ‘ওল্ড লাইটস’দের সমাজের অধিকতর সমৃদ্ধ অংশ থেকে আসার প্রবণতা ছিল, অন্যদিকে নিচু শ্রেণীর লোকজন দলত্যাগী নিউ লাইট চার্চের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। ১৭৪০-এর দশকে দুই শোরও বেশি সমাবেশ বর্তমান গোষ্ঠী ত্যাগ করে নিজস্ব চার্চ প্রতিষ্ঠা করেছিল।৪৩ ১৭৪১ সালে প্রেসবিটারিয়ান নিউ লাইট প্রেসবিটারিয়ান সিনদ থেকে বের হয়ে গিয়ে যাজকদের প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রিন্সটনের নিউ জার্সিতে নাসান হলে নিজস্ব কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিল। পরে ভাঙন জোড়া লাগলেও মধ্যবর্তী সময়ে নিউ লাইটস একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় লাভ করে নিয়েছিল যা উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মৌলবাদী আন্দোলনের আবির্ভাবের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

মহাজাগরণ সবাইকে টলিয়ে দিয়েছিল। এর পর থেকে এমনকি ওল্ড লাইটস ও চলমান ঘটনাপ্রবাহে প্রলয়বাদী তাৎপর্য আরোপ করতে তৈরি ছিল। ১৭৫৫ সালের নভেম্বরে যুগপৎভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটলে জোনাথান মেহিউ বিশ্বাস করেছিলেন যে, ‘মহান বিপ্লব আসন্ন,’; ‘বিশ্বের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অবস্থায় লক্ষযোগ্য পরিবর্তনের’৪৪ অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। সহজাত প্রবৃত্তির বশেই মেহিউ সাত বছর মেয়াদী যুদ্ধের সময় প্রটেস্ট্যান্ট ব্রিটেন ও ক্যাথলিক ফ্রান্সের আমেরিকায় উপনিবেশের অধিকার নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী সংঘাতকে পারলৌকিক দৃষ্টিতে দেখেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেছেন, এর ফলে অ্যান্টিক্রাইস্ট শেষ যুগের মহাভণ্ড পোপের ক্ষমতা হ্রাসের ভেতর দিয়ে ক্রাইস্টের দ্বিতীয় আগমন ত্বরান্বিত হবে।৫ সাত বছর মেয়াদী যুদ্ধে নিউ লাইটস অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে মহাজাগতিক লড়াইয়ে আমেরিকাকে সামনের কাতারে লড়াই করতে দেখেছে। মোটামুটি এই সময়ে পোপ দিবস (নভেম্বর ৫) ছুটির দিনে পরিণত হয়, তখন উচ্ছৃঙ্খল জনতা পান্টিফের অফিস পুড়িয়ে দিয়েছিল।৪৬ ভীতিকর ও সহিংস সময় ছিল এটা। আমেরিকানরা তখনও জীবনকে অর্থ যোগাতে ও তাদের উপর নেমে আসা ট্র্যাজিডির ব্যাখ্যা করতে প্রাচীন মিথলজির শরণাপন্ন হচ্ছিল। তবে যেন আসন্ন পরিবর্তনেরও আলামত টের পাচ্ছিল তারা। সেকারণে ফ্রান্স ও রোমান ক্যাথলিক চার্চকে ন্যায়নিষ্ঠ আমেরিকান রীতিনীতির প্রতি শয়তানি ও ভীষণভাবে বৈরী বিবেচনা করে ঘৃণার ধর্ম গড়ে তুলেছিল।৪৭ এইসব প্রলয়বাদী ফ্যান্টাসির বিকাশ ঘটানোর সময় তারা যেন বুঝতে শুরু করেছিল যে, যতক্ষণ না সম্পত্তির বিনাশ সাধন করা হচ্ছে ততক্ষণ আসলে কোনও নিষ্কৃতি, চূড়ান্ত নাজাত বা স্বাধীনতা ও মিলেনিয়াল শান্তি আসছে না। নতুন এই বিশ্বকে অস্তিত্ব দিতে হলে রক্তাক্ত শুদ্ধিকরণের প্রয়োজন হবে। আমরা দেখব যে, উদীয়মান আধুনিকতার প্রতি সাড়া হিসাবে প্রায়শঃই ক্রোধের ধর্মতত্ত্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। আমেরিকানরা বুঝতে পেরেছিল, পরিবর্তন অত্যাসন্ন, কিন্তু তখনও প্রাচীন বিশ্বে বাস করছিল তারা। সাত বছর মেয়াদী যুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব ব্রিটিশ সরকারকে আমেরিকান উপনিবেশগুলোর উপর নতুন করভার চাপাতে বাধ্য করে। বিপ্লবাত্মক সঙ্কট উস্কে দেয় তা যা ১৭৭৫ সালে আমেরিকান স্বাধীনতা যুদ্ধে পর্যবসিত হয়। প্রলম্বিত এই যুদ্ধের সময় আমেরিকানরা আধুনিক রীতির ক্ষেত্রে কেন্দ্রিয় উপাদান অতীতের সাথে চরম বিচ্ছেদের সেই বেদনাদায়ক প্রক্রিয়ার সূচনা ঘটিয়েছিল, তাদের ঘৃণার ধর্ম এই বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে।

বিপ্লবের নেতৃবৃন্দ-যেমন, জর্জ ওয়াশিংটন, জন ও স্যামুয়েল অ্যাডামস, টমাস জেফারসন এবং বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন-বিপ্লবকে সেক্যুলার ঘটনা হিসাবে প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁরা ছিলেন যুক্তিবাদী, আলোকনের পুরুষ, জন লক, স্কটিশ কমনসেন্স দর্শন বা রেডিক্যাল উইং আদর্শের মতো আধুনিক আদর্শে অনুপ্রাণিত। ডেইস্ট হওয়ায় প্রত্যাদেশ ও ক্রাইস্টের ঐশ্বরিকতার ব্যাপারে অধিকতর অর্থডক্স ক্রিশ্চানদের চেয়ে দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে আলাদা। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংযমী, বিচক্ষণ লড়াই পরিচালনা করছিলেন তাঁরা, ধীরে অনীহার সাথে বিপ্লবের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। নিজেদের অবশ্যই অ্যান্টিক্রাইস্টের বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে মহাজাগতিক সংঘাতে লিপ্ত ভাবেননি। ব্রিটেনের সাথে বিচ্ছিন্নতা অনিবার্য হয়ে উঠলে, তাঁদের লক্ষ্য বাস্তব ভিত্তিক ও আঞ্চলিক উদ্দেশ্যে সীমিত ছিল: ‘সম্মিলিত উপনিবেশগুলো অধিকার বলে মুক্ত ও স্বাধীন রাষ্ট্র হবে।’ জন অ্যাডামস ও ফ্রাংকলিনের সাথে জেফারসন কর্তৃক খসড়া করা স্বাধীনতার ঘোষণা ৪ঠা জুলাই ১৭৭৬ তারিখে কলোনিয়াল কংগ্রেসে গৃহীত হয়, এটা ছিল লক-প্রচারিত স্ব- প্রকাশিত মানব অধিকারের আদর্শভিত্তিক একটি আলোকন দলিল। এইসব অধিকারকে ‘জীবন, মুক্তি ও সুখের সন্ধান’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এই ঘোষণা প্রকৃতির ডেইস্ট ঈশ্বরের নামে স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসন ও সাম্যের আধুনিক আদর্শের প্রতি আবেদন রেখেছে। অবশ্য রাজনৈতিকভাবে রেডিক্যাল ছিল না এই ঘোষণা। এখানে সমাজের সম্পদের পুনর্বণ্টনের বা মিলেনিয়াল ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কোনও ইউটোপিয় কথাবার্তার স্থান ছিল না। এটা ছিল সুদূর প্রসারী স্থিতিশীল কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা বাস্তব, যৌক্তিক লোগোস।

কিন্তু আমেরিকান প্রজাতন্ত্রের ফাউন্ডিং ফাদারগণ ছিলেন অভিজাত গোষ্ঠীর অংশ, তাঁদের ধারণা মামুলি ধরনের ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠ আমেরিকানরা কালভিনিস্ট ছিল, তারা এই যৌক্তিক রীতির সাথে তাল মিলিয়ে উঠতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষেই, তাদের অনেকেই ডেইজমকে শয়তানি আদর্শ মনে করেছে। ৮ প্রাথমিকভাবে অধিকাংশ উপনিবেশবাসী ঠিক তাদের নেতাদের মতোই ব্রিটেনের সাথে সম্পর্কচ্যুতিতে অনীহ ছিল। সবাই বিপ্লবী সংগ্রামে যোগ দেয়নি। প্রায় ৩০,০০০ এর মতো ব্রিটিশের পক্ষে যুদ্ধ করেছে এবং যুদ্ধের পর ৮০,০০০ থেকে ১০০,০০০-এর মতো নতুন রাষ্ট্র ছেড়ে কানাডা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা ব্রিটেনে চলে গেছে।৪৯ স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যারা, তারা একদিকে যেমন প্রাচীন মিথ ও ক্রিশ্চান ধর্মের মিলেনিয়াল স্বপ্নে প্রণোদিত হয়েছিল তেমনি ফাউন্ডারদের সেক্যুলারিস্ট আদর্শেও অনুপ্রাণিত ছিল। আসলে ধর্মকে রাজনৈতিক ডিসকোর্স থেকে আলাদা করা ছিল কঠিন। সেক্যুলারিস্ট ও ধর্মীয় আদর্শ সৃজনশীলভাবে মিশে গিয়ে আমেরিকার জন্যে নানামুখী আশার ধারক উপনিবেশবাসীদের ইংল্যান্ডের সাম্রাজ্যবাদী মহাশক্তি বিরোধী শক্তিতে যোগ দিতে সক্ষম করে তুলেছে। আমরা ইরানের ইসলামি বিপ্লবে (১৯৭৮-৭৯) একই ধরনের ধর্মীয় ও সেক্যুলারিস্ট মৈত্রী গড়ে উঠতে দেখব, এটাও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল।

বিপ্লবী সংগামের প্রথম দশকে সাধারণ লোক অতীতের সাথে রেডিক্যাল বিচ্ছেদ ঘটানো ঘৃণা করছিল। ব্রিটেনের সাথে সম্পর্কচ্যুতি অচিন্তনীয় মনে হয়েছে। অনেকেই আশা করেছিল যে ব্রিটিশ সরকার তাদের নীতির পরিবর্তন ঘটাবে। কেউই উত্তেজনার সাথে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ছিল না বা এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার স্বপ্ন দেখছিল না। বেশির ভাগ আমেরিকান তখনও সহজাতভাবে প্রাচীন প্রাক আধুনিক কায়দায় সংকটের প্রতি সাড়া দিচ্ছিল: নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে এক আদর্শ অতীতের শরণাপন্ন হচ্ছিল তারা। বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ ও যাঁরা আরও সেক্যুলার রেডিক্যাল হুইগ আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা ১০৬৬ সালে আগ্রাসী নরমানদের বিরুদ্ধে সাক্সনদের সংগ্রাম বা ইংরেজদের গৃহযুদ্ধকালীন পিউরিটান পার্লামেন্টারিয়ানদের সাম্প্রতিক সংগ্রাম থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করেছিলেন। কালভিনিস্টরা নিউ ইংল্যান্ডে পুরোনো ইংল্যান্ডে স্বৈরাচারী অ্যাংলিকান প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পিউরিটান সংগ্রামের কথা স্মরণ করে তাদের সোনালি অতীতের শরণাপন্ন হয়েছে; আমেরিকার বুনো এলাকায় একটি ধর্মনিষ্ঠ সমাজ গড়ে তোলার ভেতর দিয়ে নতুন বিশ্বে নির্যাতন থেকে মুক্তি ও স্বাধীনতার সন্ধান করেছিল তারা। এই সময়ের (১৭৬৩-৭৩) সারমন ও বিপ্লবী বক্তৃতা-বিবৃতি অতীতের নাজুক সাফল্যকে ধরে রাখার উপর গুরুত্ব দিয়েছে। রেডিক্যাল পরিবর্তনের চিন্তা অবনতি ও ধ্বংসের ভীতি জাগিয়ে তুলেছে। পুরোনো রক্ষণশীল চেতনা অনুযায়ী উপনিবেশবাসীরা ঐতিহ্য রক্ষা করতে চেয়েছিল। অতীতকে খুবই সহজ সরল হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে, ভবিষ্যৎকে উৎসগতভাবে ভীতিকর। বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ ঘোষণা করেছিলেন যে, ট্র্যাডিশন থেকে প্রবলভাবে বিচ্ছিন্ন হলে অনিবার্যভাবে আবির্ভূত বিপর্যয়কে ঠেকানোর জন্যেই তাঁদের কর্মপরিকল্পনার নকশা করা হয়েছে। বাইবেলের প্রলয়বাদী ভাষা ব্যবহার করে ভীতির সাথে ব্রিটিশ নীতিমালার সম্ভাব্য পরিণতির কথা বলেছেন তাঁরা।°

তবে এর পরিবর্তন ঘটেছিল। ব্রিটিশরা নাছোড়বান্দার মতো সাম্রাজ্যবাদী নীতিমালা আঁকড়ে থাকলে উনিবেশবাসীরা তাদের নৌকা পুড়িয়ে দিয়েছিল। বস্টন টি পার্টি (১৭৭৩) ও লুক্সমবার্গ এবং কনকর্ডের যুদ্ধের (১৭৭১) পর আর পেছনে যাবার উপায় ছিল না। স্বাধীনতার ঘোষণা প্রাচীন ব্যবস্থার সাথে সম্পর্ক চ্যুতি ঘটিয়ে এক নজীরবিহীন ভবিষ্যতের পথে যাত্রা শুরুর সাহসী প্রতিজ্ঞা প্রকাশ করেছে। এই দিক থেকে ঘোষণাটি ছিল আধুনিকায়নের দলিল, রাজনৈতিক পরিভাষায় ইউরোপে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা ও প্রতিমাবিরোধিতাকে প্রকাশ করেছে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ উপনিবেশবাসী জন লকের চেয়ে বরং ক্রিশ্চান ভবিষ্যদ্বাণীর বিভিন্ন মিথে বেশি অনুপ্রাণিত ছিল। পরিচিত, তাদের গভীরতর বিশ্বাসের সাথে অনুরণিত এবং এই কঠিন যাত্রাকে সফল করে তোলা মনস্তাত্ত্বিক শক্তি খুঁজে পেতে সক্ষম করে তোলা পৌরাণিক মোড়কে আধুনিক রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের দিকে চালিত হওয়ার প্রয়োজন ছিল তাদের। আমরা যেমন প্রায়শঃই আবিষ্কার করব, ধর্ম প্রায়শঃই আধুনিকতার বেদনাদায়ক অভিযাত্রায় প্রয়োজনীয় উপকরণ যোগান দেয়।

এভাবে মুলধারার চার্চের বহু যাজক (এমনকি অ্যাংলিকানরাও স্যাম অ্যাডামসের মতো জনপ্রিয় নেতাদের বিপ্লবী বাগাড়ম্বরকে ক্রিশ্চান রূপ দিয়েছেন। তাঁরা সরকারে সদগুণ ও দায়িত্বের গুরুত্বের কথা বলার সময় ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের দুনীতির বিরুদ্ধে অ্যাডামসের জ্বালাময়ী প্রত্যাখ্যান অর্থপূর্ণ হয়ে উঠত। ১ মহাজাগরণের আগেই নিউ লাইটস কালভিনিস্টদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি সতর্ক এবং পরিবর্তন সাধনের ক্ষেত্রে নিজেদের ক্ষমতায় আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। বিপ্লবী নেতারা ‘স্বাধীনতা’র কথা বলার সময় এমন পরিভাষা ব্যবহার করতেন যেটা আগেই ধর্মীয় অর্থে সম্পৃক্ত ছিল: এটা মহত্ম, গস্পেলের স্বাধীনতা ও ঈশ্বর পুত্রের সমাবেশ ধারণ করত। এটা ঈশ্বরের রাজ্যের মতো, যেখানে সকল নিপীড়নের অবসান ঘটবে, এবং মনোনীত জাতির মিথ, যারা বিশ্বের পবির্তনের বেলায় ঈশ্বরের অস্ত্রে পরিণত হবে, এমনি সব ধারণার সাথে সম্পর্কিত ছিল।৫২ ইয়েল ইউনির্ভার্সিটর প্রেসিডেন্ট টিমোথি ডিউইট (১৭৫২-১৮১৭) সোৎসাহে ‘ইম্যানুয়েল ল্যান্ডে’র আগমন ঘোষণাকারী বিপ্লব ও আমেরিকার ‘সেই নতুন, সেই বিচিত্র রাজ্যের প্রধান ঘাঁটি হওয়ার’ কথা বলতেন যা ‘পরম ঈশ্বরের সাধুদের প্রদান করা হবে।’৫৩ ১৭৭৫ সালে কানেক্টিকাটের যাজক ইবেনেযার বল্ডউইন জোর দিয়ে বলেছিলেন, যুদ্ধের বিপর্যয়ই কেবল ঈশ্বরের নতুন বিশ্বের পরিকল্পনাকে তরান্বিত করতে পারে। জেসাস আমেরিকায় মহান রাজ্যের গোড়াপত্তন করবেন: স্বাধীনতা, ধর্ম ও শিক্ষাকে ইউরোপ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, আটলন্টিক পাড়ি দিয়ে সেসব পশ্চিমে যাত্রা করেছে। বর্তমান সঙ্কট বর্তমান দুনীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার শেষ দিনের জন্যে পথ তৈরি করে দিচ্ছে। ফিলাদেলফিয়ার প্রোভোস্ট উইলিয়াম স্মিথের চোখে উপনিবেশবাসীরা ছিল ‘মুক্তি, শিল্পকলা ও স্বর্গীয় জ্ঞানের’৫৪ ঈশ্বর মনোনীত স্থান।

কিন্তু চার্চের লোকেরা রাজনীতিকে সেক্যুলারাইজ করে থাকলেও সেক্যুলার নেতৃবৃন্দ ক্রিশ্চান ইউটোপিয়বাদের ভাষা ব্যবহার করেছেন। জন অ্যাডামস আমেরিকার বসতিকে গোটা মানবজাতির আলোকনের জন্যে ঈশ্বরের পরিকল্পনা মনে করেছেন।৫৫ টমাস পেইন নিশ্চিত ছিলেন যে, ‘পৃথিবীর নতুন করে শুরু করার মতো ক্ষমতা আমাদের আছে। সেই নোয়াহর আমল থেকে এই পর্যন্ত এমন পরিস্থিতি আর সৃষ্টি হয়নি। নতুন বিশ্বের জন্মলগ্ন এলো বলে।৫৬ কেবল নেতৃবৃন্দের প্রয়োগবাদ সাধারণ লোকজনকে অজানা ভবিষ্যতের পথে যাত্রা ও মাতৃভূমির সাথে সম্পর্কচ্ছেদে সাহায্য করতে পারেনি। ক্রিশ্চান পরকালতত্ত্বের উৎসাহ, ইমেজারি ও মিথলজি বিপ্লবী সংগ্রামে অর্থ যুগিয়েছে ও সেক্যুলারিস্ট ও কালভিনিস্টদের ট্র্যাডিশনের সাথে চূড়ান্ত স্থানচ্যুতকারী বিচ্ছেদ ঘটাতে সমানভাবে সাহায্য করেছে।

সাত বছর মেয়াদী যুদ্ধের সময় বিস্ফোরিত ঘৃণাও একই কাজ করেছে। মোটামুটি একই ভাষায় ইরানিরা ইসলামি বিপ্লবের সময় আমেরিকাকে যেভাবে ‘মহাশয়তান’ আখ্যায়িত করেছে বিপ্লবী সংকটকালে ঠিক সেভাবেই ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শয়তানের সাথে হাত মেলানোর অভিযোগ তোলা হয়েছিল। কুখ্যাত স্ট্যাম্প অ্যাক্ট পাশ হওয়ার পর দেশাত্মবোধক কবিতা ও গানে এর প্রবক্তা লর্ডস বুট, গ্রেনভিল ও নর্থকে আমেরিকানদের শয়তানের চিরন্তন রাজ্যে প্রলুব্ধ করার ষড়যন্ত্রকারী শয়তানের চ্যালা হিসাবে তুলে ধরেছিল। স্ট্যাম্পকে ‘পশুর চিহ্ন’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, বুক অভ রেভেলেশন অনুযায়ী যা শেষ দিবসে সাজাপ্রাপ্তদের উপর খোদাই করা হবে। রাজনৈতিক মিছিলে শয়তানের ছবির পাশে ব্রিটিশ মন্ত্রীদের কুশপুত্তলিকা বহন করা হয় আর গোটা উপনিবেশ জুড়ে ‘স্বাধীনতা বৃক্ষে’ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ১৭৭৪ সালে রাজা তৃতীয় জর্জ সাত বছর মেয়াদী যুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডের অধিকৃত কানাডিয় এলাকার ফরাসি ক্যাথলিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দান করলে তাঁকে অ্যন্টিক্রাইস্টের সাথে সম্পর্কিত করা হয়। এবার তাঁর ছবিও পাপাল অ্যান্টিক্রাইস্ট ও শয়তানের সাথে স্বাধীনতা বৃক্ষে শোভা পেতে থাকে।৫৮ এমনকি অধিকতর শিক্ষিত উপনিবেশবাসীরা এই গোপন মহাজাগতিক ষড়যন্ত্রের ভীতিতে আক্রান্ত হয়েছিল। হার্ভার্ড ও ইয়েলের প্রেসিডেন্টদ্বয় বিশ্বাস করতেন যে, উপনিবেশগুলো শয়তানি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছে; ‘স্বেচ্ছাচারী শক্তির পছন্দনীয় ধর্ম’ পাপাসির আসন্ন পরাজয়ের অপেক্ষা করেছেন তাঁরা। পাপাল অ্যান্টিক্রাইস্টকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ঈশ্বরের বিধানকৃত পরিকল্পনার অংশে পরিণত হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ, নিশ্চিতভাবেই যা আমেরিকায় ঈশ্বরের মিলেনিয়াল রাজ্যের আবির্ভাব ঘোষণা করবে। ব্যাপক বিস্তৃত এই ভ্রমাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি ও সাধারণ রাজনৈতিক বিরোধকে শুভ ও অশুভ শক্তির মহাজাগতিক সংঘাত হিসাবে দেখার প্রবণতা দুর্ভাগ্যক্রমে মানুষ নুতন বিশ্বে পা রাখতে গিয়ে বিপ্লবী সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করার সময় প্রায়শঃই ঘটে। এই শয়তানি মিথলজি উপনিবেশবাসীদের প্রাচীন বিশ্ব থেকে নিশ্চিতভাবে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিতে সাহায্য করেছে, যার প্রতি তখন ও তাদের একটা জোরাল দুর্বলতার অবশেষ রয়ে গিয়েছিল। ইংল্যান্ডকে দানবায়িতকরণ, একে প্রতিপক্ষমূলক ‘অপর’, আমেরিকার বিপরীত মেরুতে পরিণত করে উপনিবেশবাসীদের নিজেদের জন্যে একটা স্পষ্ট পরিচয় গড়ে তুলতে সক্ষম করে তুলেছে এবং যে নতুন ব্যবস্থাকে বাস্তব রূপ দিতে তারা যুদ্ধ করছিল তাকে ভাষা দিতে সাহায্য করেছে।

এভাবে ধর্ম প্রথম আধুনিক সেক্যুলার প্রজাতন্ত্রের পত্তনে মুল ভুমিকা পালন করেছে। বিপ্লবের পর অবশ্য, সদ্য স্বাধীন রাজ্যসমূহ তাদের সংবিধান প্রণয়ন করার সময় ঈশ্বরের নাম সেখানে নেহাতই দায়সারাভাবে উল্লেখ করা হয়। ১৭৮৬ সালে টমাস জেফারসন ভার্জিনিয়ার অ্যাংলিকান চার্চ ভেঙে দেন; তাঁর বিলে ঘোষণা করা হয় যে, ধর্মের ব্যাপারে নিপীড়ন ‘পাপপূর্ণ ও স্বেচ্ছাচারমূলক,’ জনগণকে তাদের নিজস্ব মতামত ধারণ করতে দিলে সত্য বিজয়ী হবে এবং ধর্ম ও রাজনীতির ভেতর একটা ‘বিচ্ছিন্নতার দেয়াল থাকবে’। এই বিলে ভার্জিনিয়ার ব্যাপ্টিস্ট, মেথডিস্ট ও প্রেসবিটারিয়ান চার্চ সমর্থন দেয়, রাষ্ট্রে চার্চ অভ ইংল্যান্ডের সুবিধাজনক অবস্থানে অসন্তুষ্ট ছিল এরা। পরে অন্যান্য রাজ্য ভার্জিনিয়াকে অনুসরণ করে তাদের নিজস্ব চার্চগুলো ভেঙে দেয়, ১৮৩৩ সালে ম্যাসাচুসেটস সবার শেষে এ কাজটি করে। ১৭৮৭ সালে ফিলাদেলফিয়া সম্মেলনে ফেডারেল সংবিধান গৃহীত হলে সেখানে ঈশ্বরের কোনও উল্লেখই ছিল না; সংবিধানের প্রথম সংশোধনী বিল অভ রাইটস (১৭৮৯) আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে: ‘কংগ্রেস ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কোনও আইন প্রণয়ন করবে না বা এর স্বাধীন চর্চায় বাধাও দেবে না। এর পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মবিশ্বাস একটি ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাকৃত বিষয়ে পরিণত হবে। বিপ্লবী পদক্ষেপ ছিল এটা, যুক্তির কালের অন্যতম সাফল্য হিসাবে তা প্রশংসিত হয়েছে। এর পেছনের ভাবনাচিন্তা অবশ্যই আলোকনের সহিষ্ণু দর্শনে অনুপ্রাণিত ছিল, কিন্তু ফাউন্ডিং ফাদারগণ আবার অধিকতর বাস্তব বিবেচনায়ও আলোড়িত হয়েছেন। তাঁরা জানতেন, রাজ্যসমূহের ঐক্য ধরে রাখতে ফেডারেল সংবিধান খুবই জরুরি, তবে তাঁরা এও বুঝতে পেরেছিলেন যে, সরকার কোনও একটি বিশেষ প্রটেস্ট্যান্ট গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করে তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রধর্মে পরিণত করলে সংবিধান অনুমোদন পাবে না। উদাহরণ স্বরূপ, কংগ্রেশনাল ম্যাসাচুসেটস কোনওদিনই অ্যাংলিকান চার্চ প্রতিষ্ঠাকারী সংবিধানে সম্মতি দেবে না। এটাও সংবিধানের ধারা-৬; উপধারা-৩- এর মাধ্যমে ফেডারেল সরকারের অফিসে নিয়োগের ক্ষেত্রে ধ