- বইয়ের নামঃ স্রষ্টার জন্য লড়াই : মৌলবাদের ইতিহাস
- লেখকের নামঃ ক্যারেন আর্মস্ট্রং
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, ইতিহাস, প্রবন্ধ,
স্রষ্টার জন্য লড়াই : মৌলবাদের ইতিহাস
০. অনুবাদকের কথা / ভূমিকা
স্রষ্টার জন্যে লড়াই : মৌলবাদের ইতিহাস – ক্যারেন আর্মস্ট্রং
অনুবাদ: শওকত হোসেন
প্ৰথম প্ৰকাশ – একুশে বইমেলা ২০১১
অনুবাদকের কথা
বর্তমান বিশ্বে ধর্মীয় মৌলবাদ প্রসঙ্গটি ব্যাপক আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ৯/১১ পরবর্তী পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মকে নির্বিচারে মৌলবাদ অ্যাখ্যা দিয়ে খোদ ধর্মের বিরুদ্ধে সকল শক্তি প্রয়োগের একটি প্রবণতা গোটা বিশ্বজুড়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোর তিনটিতেই মৌলবাদের প্রবল উপস্থিতি থাকলেও এবং খৃস্ট ও ইহুদি ধর্মের মৌলবাদের ভয়ঙ্কর চেহারা সত্ত্বেও বিশ্ব-মিডিয়ার একপেশে প্রচারণার ফলে বর্তমানে কেবল ইসলাম ধর্মই মৌলবাদ ও ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থা এমন যেন ইসলাম ছাড়া আর কোনও ধর্মের অস্তিত্ব নেই; যে কোনও ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্যে ইসলামী সন্ত্রাসবাদই দায়ী। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে যেন ধার্মিকতা, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদের আর কোনও পার্থক্য নেই।
কিন্তু আসল ব্যাপার যে তা নয়, মৌলবাদ যে ধর্মের সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অভিব্যক্তি, আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ার প্রতি ধার্মিকদের বিশেষ সাড়া হিসাবে যার জন্ম, বর্তমান বিশ্বের ধর্ম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ স্বনামখ্যাত ব্রিটিশ গবেষক-লেখক ক্যারেন আর্মস্ট্রং সেটাই তুলে ধরেছেন বর্তমান গ্রন্থে। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, মৌলবাদ কোনওভাবেই নতুন ঘটনা নয় বা কেবল ইসলামই মৌলবাদের আসরে আক্রান্ত নয়। বিগত প্রায় কয়েকশো বছর ধরে, আধুনিকায়নের সূচনাকাল হতে, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের আবির্ভাবে অস্তিত্ব বিনাশের আশঙ্কায় ধর্মের টিকে থাকার সংগ্রাম থেকেই জন্ম হয়েছিল মৌলবাদের। পৃথিবীর সকল দেশের, সকল ধর্মের মানুষই, অন্তত কিছু সংখ্যক মানুষ, ধর্মের অখণ্ডতা রক্ষার নামে আধুনিকতার সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হয়েছে। আবার যুগে যুগে রাষ্ট্রও উপর হতে আধুনিকতা চাপিয়ে দিতে গিয়ে প্রতিপক্ষ নির্ধারণ করছে ধর্মকে, মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে পশ্চাদপদতার সমার্থক বিচার করে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য, ব্যতিক্রম নেই কোথাও। মৌলবাদ যেন আধুনিক মানুষেরই অপরিহার্য সঙ্গী। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে একে নির্মূল করার প্রয়াস বিজ্ঞান সম্মত নয় বলেই মনে হয়। মৌলবাদকে প্রতিহত বা নির্মূল করা নয়, প্রয়োজন একে সংশোধন করা। এর জন্যে মৌলবাদের চেহারা, তার আদিরূপ বা ইতিহাসটুকু জানা জরুরি। ইতিহাসের দীর্ঘ সময় জুড়ে মৌলবাদের উৎপত্তি হতে শুরু করে পর্যায়ক্রমে এর বিকাশ জানতে পারলে ধর্মের এই অসুস্থ অভিব্যক্তির বিরুদ্ধে সংশোধন প্রয়াস সহজতর হবে বলে মনে হয়। বাংলাদেশের পাঠকদের মৌলবাদের ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বিশ্বের মৌলবাদ সম্পর্কে আগ্রহী পাঠকদের কৌতূহল মেটাতে ক্যারেন আর্মস্ট্রংয়ের সুবিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থ ব্যাটল ফর গড: আ হিস্ট্রি অভ ফান্ডামেন্টালিজম-এর বাংলা অনুবাদ স্রষ্টার জন্যে লড়াই: মৌলবাদের ইতিহাস পাঠকদের হাতে তুলে দিতে পেরে আমি আনন্দিত।
উল্লেখ্য, মূলগ্রন্থে বহু দার্শনিক, ধর্মীয় ও কারিগরি পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। পাঠকদের সুবিধার জন্যে আমি যথাসম্ভব বাংলা পরিভাষা ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। ধর্মগ্রন্থের, বিশেষ করে পবিত্র কোরানের আয়াতের নির্ভুল অনুবাদের খাতিরে মুহম্মদ হাবীবুর রহমানের কোরান শরীফ: সরল বঙ্গানুবাদ-এর সাহায্য নিয়েছি।
মূলগ্রন্থে ব্যবহৃত না হলেও পয়গম্বর মুহাম্মদ-এর নামের শেষ (স) চিহ্ন ব্যবহার করেছি। পাঠকদের কাছে পয়গম্বর ও নবীগণের নামের শেষে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে যথাযথ বাণী ব্যবহারের অনুরোধ থাকল।
পাঠকদের একটি বিশ্বস্ত মূলানুগ ও সাবলীল অনুবাদ উপহার দেওয়ার চেষ্টা ছিল আমার। জানি না কতটুকু সফল হয়েছি। পাঠক সামান্য উপকৃত হলেও নিজের শ্রম স্বার্থক জানব। যে কোনও রকম ভুল-ত্রুটি আমাদের গোচরে আনলে পরবর্তী সংস্করণে তা সংশোধনের প্রয়াস নেওয়া হবে।
বইটি আরও আগে বের হওয়ার কথা ছিল। দেরি হবার কারণ প্রসঙ্গে পাঠকদের জ্ঞাতার্থে এখানে কিছু কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। এই বইটিসহ আমার অনূদিত আরও কিছু বই বের হওয়ার কথা ছিল আজিজ সুপার মার্কেটের সন্দেশ নামক প্রকাশনা সংস্থা থেকে। পাণ্ডুলিপিও জমা দিয়েছিলাম। এমনি এক সময় সহসা সুপ্রিয় অনুবাদক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট অনুবাদক জনাব জি.এইচ. হাবীরের কাছে জানতে পারি সন্দেশে’ স্বত্বাধিকারী লুৎফর রহমান চৌধুরীর অপকর্মের ফিরিস্তি। জনাব লুৎফর রহমান অনুবাদকদের প্রতারিত করে বিভিন্ন বিদেশী সংস্থা থেকে অনূদিত গ্রন্থের বিপরীতে অনুবাদকদের নামে বরাদ্দ ও প্রেরিত প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। এ খবর জানতে পেরে আমি নরওয়ের নরলা, কানাডিয়ান কাউন্সিল ফর ট্রান্সলেশন, ডাচ ফাউন্ডেশন ফর ট্রান্সলেশন, ইত্যাদি বিভিন্ন সংস্থার সাথে যোগাযোগ করে জনাব লুৎফর রহমানের অপকর্মের জ্বলন্ত প্রমাণ যোগাড় করি। তাতে জানা যায় এই তথাকথিত সাহিত্যসেবী আসলে একজন নিম্নশ্রেণীর তস্কর ছাড়া আর কিছুই নন। তিনি বিভিন্ন বিদেশী প্রকাশনা সংস্থা ও লেখকদের এজেন্টদের সাথে নামী-অনামী লেখকদের বাংলাদেশের পাঠকদের সাথে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার নামে খুবই সামান্য অর্থের বিনিময়ে লাইসেন্স (স্বত্ব নয়) হাতিয়ে নেন। তারপর অনুবাদকদের সাথে নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট বইটি অনুবাদ করানোর জন্যে নামকাওয়াস্তে চুক্তি সম্পাদন করেন। কিন্তু সেই চুক্তির কথা গোপন করে তিনি উল্লেখিত বিদেশী সাহিত্য সংস্থাগুলোর কাছে অনুবাদকের সত্যিমিথ্যার মিশেল জীবনবৃত্তান্ত ও জাল স্বাক্ষরসহ সম্পূর্ণ ভিন্ন মিথ্যা চুক্তিপত্রের অনুলিপি জমা দিয়ে অনূদিত গ্রন্থের বিনিময়ে অনুবাদকের নামে বরাদ্দ অর্থের জন্যে আবেদন করেন এবং অনুবাদককে কিছুই না জানিয়ে সেই অর্থ বেমালুম তছরুপ করেন। এভাবে এপর্যন্ত তিনি বহু লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই ঘৃণ্য কাজ করে আসছেন। তাঁর এমনি প্রতারণার ফাঁদ থেকে বাংলাদেশের কোনও অনুবাদক রেহাই পাননি। নদে উপন্যাসের অনুবাদক আনিস পারভেজ, সোফির জগৎ ও শত বর্ষের নিঃসঙ্গতার নন্দিত অনুবাদক জি.এইচ. হাবীব, একটি অপহরণ সংবাদ ও বাগদাদে একশ দিন- এর অনুবাদক সিলেট মেট্রপলিটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সুরেশ রঞ্জন বসাক, লাইফ অভ পাই ও টিন রঙা শাড়ীর অনুবাদক শীব্রত বর্মণ, তাশ রহস্য-এর অনুবাদক দ্বিজেন্দ্রনাথ বর্মণ, ক্যালি গ্যাংয়ের আসল ইতিহাসের অনুবাদক সালেহা চৌধুরীসহ কেউই বাদ যাননি। অথচ প্রকাশ্যে নিজেকে তিনি সাহিত্যসেবী হিসাবে পরিচয় দিয়ে থাকেন, ভান করেন সাহিত্যের সেবা করতে গিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া, ভারতীয় পূর্বপ্রকাশিত বিভিন্ন অনুবাদও তিনি তাঁর নিকটাত্মীয়দের নামে প্রকাশ করে বর্ণিত সংস্থাগুলো থেকে অনুদানের অর্থ আদায় করে নিয়েছেন। সম্পূর্ণ বিষয়টি অনুবাদকদের মাঝে জানাজানি হওয়ার পরও এবং প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও (বর্ণিত সংস্থাসমূহের ওয়েব সাইটে অনুসন্ধান করলেই এই অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ মিলবে) তিনি বিষয়টি অস্বীকার করে গেছেন। অনেক চেষ্টা করেও আমি ও অন্য অনুবাদকগণ প্রাপ্য অনুদানের টাকা তো বটেই অন্যান্য অনূদিত গ্রন্থের বিনিময়ে চুক্তিমাফিক প্রতিশ্রুত অর্থও পাইনি। তিনি চুক্তিভঙ্গ ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন বলে পূর্বপ্রকাশিত অনূদিত গ্রন্থ প্রত্যাহারের কথা লিখিতভাবে জানানো সত্ত্বেও তিনি সেগুলোর বিপনন অব্যাহত রেখেছেন এবং দাখিল করা পাণ্ডুলিপি ফেরত চাইলেও ফেরত দেননি; যে কারণে অত্যন্ত পরিশ্রম সপেক্ষ হলেও এ বইটি দ্বিতীয়বার অনুবাদ করতে হয়েছে। আমার আরও কয়েকটি অনূদিত গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি এখনও অন্যায়ভাবে আটকে রেখেছেন, বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও তাতে কান দেননি। বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখা এবং প্রতারণা থেকে দেশের অনুবাদকদের বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসবেন এটাই কাম্য। আমি আন্তরিকভাবে আশাবাদী যে, সংশ্লিষ্ট সংস্থা যথা-ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাংলাদেশের সাহিত্য জগৎকে লুৎফর রহমান চৌধুরীর মতো নিম্নশ্রেণীর তস্করের কবল থেকে উদ্ধার করে নিবেদিতপ্রাণ লেখক ও অনুবাদকদের প্রতারণার হাত থেকে রক্ষায় এগিয়ে আসবেন। পাঠক, লেখক ও অনুবাদকগণকে এই প্ৰকাশককে সামাজিকভাবে বর্জন করার আহ্বান জানাই। পাঠকদের একটি অন্যায় সম্পর্কে অবহিত করার জন্যেই এখানে এত কথা বলতে হলো। কারও ধৈর্যচ্যুতি ঘটার কারণ হলে আমি সেজন্যে ক্ষমাপ্রার্থী। প্রসঙ্গত, এই বক্তব্যের জন্যে রোদেলার প্রকাশক দায়বদ্ধ নন।