অ্যাক্সিয়াল যুগের নগর ও সাম্রাজ্যে সাধারণ জনগণ প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি ও বিস্তৃত দিগন্তের অধিকারী হয়ে উঠছিল, ফলে স্থানীয় কাল্টসমূহকে সীমিত ও সংকীর্ণ মনে হতে শুরু করেছিল। ঈশ্বরকে কিছু সংখ্যক দেবতার মাঝে সীমিত ভাববার বদলে মানুষ ক্রমবর্ধমানহারে একজন মাত্র বিশ্বজনীন দুর্ভেয় সত্তা ও পবিত্রতার উৎসের উপাসনা শুরু করেছিল। তাদের হাতে প্রচুর অবসর ছিল বলে আরও সমৃদ্ধ অন্তস্থঃ জীবন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়ে উঠেছিল; সেই অনুযায়ী তারা এমন এক আধ্যাত্মিকার আকাঙ্ক্ষা করতে শুরু করে যা কেবল বাইরের উপাদানের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল থাকবে না। সবচেয়ে সংবেদনশীলরা কৃষিভিত্তিক সমাজে প্রতীয়মান হওয়া সামাজিক অবিচারের কারণে অস্বস্তিতে ভুগছিল; সাধারণ কৃষকদের উপর নির্ভরশীল ছিল সেটা যারা উঁচু সংস্কৃতি থেকে কোনওভাবেই কোনও রকম সুবিধা পেত না। পরিণামে পয়গম্বর ও সংস্কারকদের আবির্ভাব ঘটে, এঁরা আধ্যাত্মিক জীবনে সহানুভূতির গুণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে জোর দিতে শুরু করেন: প্রতিটি মানুষের মাঝে পবিত্রতা প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা ও সমাজের অধিকতর নাজুক সদস্যদের বাস্তবভিত্তিক সেবা প্রদানের সদিচ্ছা প্রকৃত ধার্মিকতার পরীক্ষায় পরিণত হয়। এইভাবে অ্যাক্সিয়াল যুগে মানবজাতিকে পথনির্দেশনা দিয়ে চলা মহান কনফেশনাল ধর্মবিশ্বাসসমূহ সভ্য সমাজে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ভারতে বুদ্ধধর্মমত ও হিন্দুধর্ম, দূরপ্রাচ্যে কনফুসিয় মতবাদ ও তাওবাদ। এগুলোর প্রধান পার্থক্য সত্ত্বেও অ্যাক্সিয়াল যুগের এইসব ধর্মের ভেতর অনেক সাধারণ মিল ছিল: একক সর্বজনীন দুয়ে ধারণার বিকাশ ঘটাতে এগুলো সবই প্রাচীন ঐতিহ্যের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে, এক ধরনের অন্তস্থঃ আধ্যাত্মিকতার চর্চা করেছে এবং বাস্তবভিত্তিক সহানুভূতির প্রতি জোর দিয়েছে।
আজকের দিনে, যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, আমরা একই ধরনের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। আধুনিক কালের ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে এর শেকড় প্রোথিত, যখন পশ্চিম ইউরোপের মানুষ ভিন্ন ধরনের সমাজের বিবর্তন ঘটাতে শুরু করেছিল। কৃষি উদ্বৃত্তের উপর নির্ভরশীল নয়, এই সমাজ সম্পদকে সীমাহীনভাবে পুনরুৎপাদনে সক্ষম করে তোলা প্রযুক্তির নির্ভর ছিল। সত্যের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভিন্ন জ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী ধর্মীয় পরিবর্তনের ফলে এর আগের চারশত বছরের বিপুল সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লবের সাথে অর্থনৈতিক পরিবর্তনসমূহ অগ্রসর হয়েছে। এবং আরও একবার ধর্মীয় পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছিল। সারা বিশ্বে জনগণ জানতে পারছিল যে তাদের নাটকীয়ভাবে বদলে যাওয়া পরিবেশে বিশ্বাসের প্রাচীন ধরন আর কাজ করছে না। মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় আলোকন ও সান্ত্বনার যোগান দিতে পারছে না এগুলো। ফলে নারী- পুরুষ অ্যাক্সিয়াল যুগের সংস্কারক ও পয়গম্বরদের মতো ধার্মিক হয়ে ওঠার, অতীতের দর্শনের উপর ভিত্তি করে এমনভাবে নিজেদের গড়ে তোলার প্রয়াস পাচ্ছে যা মানবজাতিকে নিজেদের জন্যে নির্মিত এক নতুন বিশ্বে নিয়ে যাবে। এইসব আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার অন্যতম-আপাত তাকে যতই পরস্পরবিরোধী মনে হোক ন কেন—মৌলবাদ।
আমরা ধারণা করে নিতে চাই যে, অতীতের মানুষ (মোটামুটিভাবে) আমাদের মতোই ছিল; কিন্তু আসলে তাদের আধ্যাত্মিক জীবন অনেক ভিন্ন ছিল। বিশেষ করে ভাবনা, কথোপকথন ও জ্ঞান অর্জনের দ্বিমুখী ধারা গড়ে তুলেছিল তারা, পণ্ডিতরা যার নাম দিয়েছেন মিথোস ও লোগাস। দুটোই ছিল আবশ্যক: সত্যি অর্জনের ক্ষেত্রে উভয়কেই সম্পূরক মনে করা হত, দুটোরই তাদের ক্ষমতার বিশেষ অঞ্চল ছিল। মিথকে মৌল বিষয় মনে করা হত; আমাদের অস্তিত্বের ক্ষেত্রে সময়হীন ও ধ্রুব মনে করা বিষয়সমূহের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল তা। জীবনের উৎস, সংস্কৃতির ভিত্তি ও মানব মনের গভীরতর স্তরে দৃষ্টি দিত তা। বাস্তব বিষয়আশয়ের সাথে মিথের কোনও সম্পর্ক ছিল না, ছিল অর্থের সাথে। আমাদের জীবনের এক ধরনের তাৎপর্য খুঁজে না পেলে, আমরা মরণশীল নারী-পুরুষ অনায়াসে হতাশায় ডুবে মরি। সমাজের মিথোস মানুষকে এক প্রেক্ষিতের যোগান দেয় যা তাদের দৈনন্দিন জীবনের একটা অর্থ তুলে ধরে। এটা চিরন্তন ও সর্বজনীনের প্রতি তাদের মনোযোগ চালিত করে। আমরা যাকে অবচেতন মন বলব, এটা তাতেও প্রোথিত ছিল। আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা হবে বলে মনে করা হয়নি এমন সব বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী ছিল মনস্তত্ত্বের প্রাচীন ধরন। মানুষ পাতালে অবতরণ করে গোলকধাঁধায় সংগ্রামরত বা দানবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত বীরদের কাহিনী বর্ণনার সময় অবচেতন বলয়ের অস্পষ্ট এলাকাসমূহকে আলোয় তুলে নিয়ে আসত, একেবারেই যোক্তিক মনের অনুসন্ধানে যা বোধগম্য ছিল না; তবে আমাদের অভিজ্ঞতা ও আচরণের উপর যার গভীর প্রভাব ছিল। আমাদের আধুনিক সমাজে মিথের মৃত্যুর ফলে আমাদের অন্তস্থঃ জগতের মোকাবিলা করতে সাইকোঅ্যানালিসিসের বিজ্ঞানের উদ্ভাবন করতে হয়েছে।
যৌক্তিক প্রমাণ দিয়ে মিথকে তুলে ধরা সম্ভব নয়; এর আন্তর্দৃষ্টিসমূহ অধিকতর স্বজ্ঞাপ্রসূত: শিল্পকলা, সঙ্গীত, কবিতা বা ভাস্কর্যের মতো। কেবল কাল্ট, আচার ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ধারণ করা হলেই মিথ বাস্তবে পরিণত হয়, উপাসকদের উপর নান্দনিকতার ভিত্তিতে কাজ করে, তাদের ভেতর পবিত্র তাৎপর্যের বোধ জাগিয়ে তোলে ও অস্তিত্বের গভীরতর প্রবাহ উপলব্ধিতে সক্ষম করে তোলে। মিথ ও কাল্ট পরস্পরের সাথে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে কোনটার আবির্ভাব আগে ঘটেছে সেটা পণ্ডিতি বিতর্কের বিষয় হতে পারে: পৌরাণিক বিবরণ নাকি এর সাথে সংশ্লিষ্ট আচার।o মিথ আবার অতীন্দ্রিয়বাদের সাথেও সম্পর্কিত ছিল: স্বজ্ঞাপ্রসূত অন্তর্দৃষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সকল সংস্কৃতিতে বিকশিত মনোসংযোগ ও একাগ্রতার ধাপবিশিষ্ট অনুশীলনের মাধ্যমে মনের গভীরে অবতরণ। কাল্ট বা মরমী চর্চা ছাড়া ধর্মের মিথসমূহ বিমূর্ত রয়ে যায় ও অবিশ্বাস্য ঠেকে, ঠিক যেমন আমাদের বেশিরভাগের কাছেই সঙ্গীতের সুর অস্পষ্ট রয়ে যায় ও এর সৌন্দর্য উপলব্ধির জন্যে বিভিন্ন যান্ত্রিক অনুষঙ্গ দিয়ে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে।