- বইয়ের নামঃ বুদ্ধ
- লেখকের নামঃ ক্যারেন আর্মস্ট্রং
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, ইতিহাস, ধর্মীয় বই
বুদ্ধ
০. সূচনা
কোনও কোনও বৌদ্ধ বলতে পারে সিদ্ধার্থ গৌতমের জীবনী রচনা খুবই অবুদ্ধসুলভ ব্যাপার। তাদের চোখে কোনও কর্তৃপক্ষেরই শ্রদ্ধা পাবার যোগ্যতা নেই। বুদ্ধদের অবশ্যই স্বপ্রণোদিত হতে হবে। নির্ভর করতে হবে নিজেদের ওপর, কোনও ক্যারিশম্যাটিক নেতার ওপর নয়। যেমন বৌদ্ধ মতবাদের লিন-চি ধারার প্রতিষ্ঠাতা নবম শতকের এক পণ্ডিত তাঁর শিষ্যদের এমনকি এমন নির্দেশও দিয়েছেন, ‘যদি বুদ্ধের দেখা পাও, বুদ্ধকে হত্যা করো!’ কর্তৃত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হতে স্বাধীন থাকার গুরুত্ব বোঝাতেই এই উক্তি। গৌতম হয়তো এই বাক্যটির সহিংসতা অনুমোদন করতেন না। কিন্তু সারাজীবন তিনিও ব্যক্তির কাল্টের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন। অন্তহীনভাবে নিজেকে শিষ্যদের মনোযোগ হতে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। তাই জীবন ও ব্যক্তিত্ব নয়, বরং তাঁর শিক্ষাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বিশ্বাস করতেন অস্তিত্বের গভীরতম কাঠামোয় খোদাই করা সত্যকে জাগিয়ে তুলেছেন তিনি। সেটা হচ্ছে ধম্ম: শব্দটার ব্যাপক দ্যোতনা রয়েছে, তবে প্রাথমিকভাবে দেবতা, মানুষ ও পশুপাখির জীবনের একটা মৌলিক বিধি তুলে ধরে। এই সত্য আবিষ্কারের মাধ্যমে আলোকিত জনে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। এক গভীর অন্তর্গত পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছেন। জীবনের জ্বালা-যন্ত্রণার মাঝে শান্তি ও মুক্তি লাভ করেছেন। এইভাবে গৌতম পরিণত হয়েছেন বুদ্ধে–আলোকিত বা জাগ্রতজনে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে তাঁর যেকোনও শিষ্য একইভাবে আলোকিত হতে পারবে। কিন্তু লোকে মানুষ গৌতমকে পূজা শুরু করলে নিজেদের কর্তব্য হতে বিচ্যুত করে বসবে। তখন বিশ্বাস আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়ে মূল্যহীন নির্ভরশীলতার কারণ হয়ে দাঁড়াবে যা কোনও আধ্যাত্মিক অগ্রগতিকেই বাধাগ্রস্ত করবে।
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থসমূহ এই চেতনার প্রতি বিশ্বস্ত। গৌতমের জীবন ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে যেন সামান্যই আমাদের কাছে তুলে ধরে। সুতরাং আধুনিক মানদণ্ড অনুযায়ী বুদ্ধের জীবনী রচনা খুবই কঠিন, কারণ ঐতিহাসিকভাবে সঠিক বিবেচনা করা যাবে এমন খুব সামান্য তথ্যই আছে আমাদের হাতে। ২৬৯ থেকে ২৩২ বিসিই পর্যন্ত উত্তর ভারতীয় সাহরিয় রাজ্য শাসনকারী রাজা অশোকের লিপি থেকে বৌদ্ধ ধর্ম নামে কোনও ধর্মের অস্তিত্বের বিষয়টি প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়। কিন্তু বুদ্ধের আনুমানিক দুইশো বছর পরের মানুষ ছিলেন তিনি। নির্ভরযোগ্য তথ্যের এই অপ্রতুলতার কারণে ঊনবিংশ শতাব্দীর কোনও কোনও পশ্চিমা পণ্ডিত ঐতিহাসিক চরিত্র হিসাবে গৌতমের অস্তিত্বের ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাঁদের দাবি ছিল তিনি স্রেফ সেই সময়ের শাক্য দর্শনের ব্যক্তিরূপ বা সৌর কাল্টের কোনও প্রতীক ছিলেন। কিন্তু আধুনিক পণ্ডিতরা এই সন্দিহান অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। তাঁরা যুক্তি দেখান, বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থসমূহে খুব সামান্য জনপ্রিয়ভাবে পরিচিত ‘গস্পেল সত্যি’ থাকলেও আমরা মোটামুটি নিশ্চিত থাকতে পারি যে সিদ্ধার্থ গৌতমের অস্তিত্ব প্রকৃতই ছিল। শিষ্যরা যতখানি সম্ভব তাঁর জীবন ও শিক্ষার কথা সংরক্ষণ করেছে।
বুদ্ধ সম্পর্কে জানবার প্রয়াস চালাতে গেলে আমাদের বিশাল আকৃতির বুদ্ধ ধর্মগ্রন্থসমূহের ওপর নির্ভর করতে হয়। বিভিন্ন টেক্সটের বিষয়বস্তু জটিল ও এর বিভিন্ন অংশের মর্যাদা বিতর্কিত। তবে এটা মোটামুটিভাবে স্বীকৃত যে, অজ্ঞাত উৎসের উত্তর ভারতীয় পালি ভাষায় লিখিত টেক্সটাই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। যার সঙ্গে মঘধ ভাষার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে হয়। স্বয়ং গৌতম হয়তো এ ভাষায় কথা বলে থাকবেন। থেরাভেদা পদ্ধতির অনুসারী শ্রী লঙ্কা, বার্মা ও থাইল্যান্ডের বুদ্ধরা এইসব গ্রন্থ সংরক্ষণ করেছে। কিন্তু রাজা অশোকের আগে ভারতবর্ষে লেখালেখির খুব একটা চল ছিল না। পালি-বিধান মুখে মুখে সংরক্ষিত হয়েছে এবং সম্ভবত বিসিই প্রথম শতাব্দীর আগে লিপিবদ্ধ হয়নি। কেমন করে এইসব ধর্মগ্রন্থ রচিত হয়েছিল?
মনে হয় ৪৮৬ সালে (প্রচলিত পাশ্চাত্য সময় অনুযায়ী) বুদ্ধের মৃত্যুর অল্প পরেই তাঁর জীবন ও শিক্ষার কাহিনীগুলো সংরক্ষণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। বুদ্ধ সন্ন্যাসীরা তখন যাযাবর জীবন কাটাতেন। তাঁরা গাঙ্গেয় অববাহিকার শহর-বন্দরে ঘুরে ঘুরে জনগণকে দুঃখ-দুদর্শা থেকে আলোকন ও মুক্তির বার্তা শেখাতেন। অবশ্য বর্ষার সময়ে পথ থেকে সরে যেতে বাধ্য হতেন তাঁরা, নিজেদের বিভিন্ন বসতিতে জমায়েত হতেন তখন। বর্ষাকালীন এই অবকাশের সময়ে সন্ন্যাসীরা তাঁদের মতবাদ ও অনুশীলন নিয়ে আলোচনা করতেন। বুদ্ধের পরলোকগমনের অব্যবহিত পরেই, পালি টেক্সট আমাদের জানাচ্ছে, সন্ন্যাসীরা বিভিন্ন প্রচলিত মতবাদ ও অনুশীলনের মূল্যায়নের লক্ষ্যে একটা উপায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সম্মেলন আয়োজন করেন। মনে হয় আনুমানিক পঞ্চাশ বছর পর উত্তর ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কোনও কোনও সন্ন্যাসী তাঁদের মহান গুরুর কথা মনে রেখেছেন; অন্যরা আরও আনুষ্ঠানিক কায়দায় তাঁদের সাবুদ সংগ্রহ করেন। তখনও এসব লিখতে পারেননি তাঁরা। কিন্তু যোগ অনুশীলন তাঁদের অনেককেই বিস্ময়কর চমৎকার স্মৃতিশক্তি যুগিয়েছিল। তো তাঁরা বুদ্ধের বয়ান ও যার যার গোষ্ঠীর বিধি-বিধানের বিস্তারিত মুখস্থ করার উপায় বের করেছিলেন। যেমনটা স্বয়ং বুদ্ধ হয়তো করে থাকবেন। তাঁরা শিক্ষার একটা অংশকে কবিতায় পরিণত করেছিলেন, হয়তো আবৃত্তি করে থাকবেন (লিখিত টেক্সটে আজও বর্তমান); তাঁরা সূত্রবদ্ধ ও পুনরাবৃত্তিমূল কায়দাও আবিষ্কার করেছিলেন যাতে সন্ন্যাসীরা এইসব বয়ান অন্তর দিয়ে শিক্ষা করতে পারেন। তাঁরা হিতোপদেশ ও বিধিনিষেধকে আলাদা কিন্তু অংশত একইরকম উপাদানের সমগ্রে ভাগ করেছেন এবং বিশেষ সন্ন্যাসীদের এইসব সংকলন মুখস্থ করে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।