ইয়াসা ‘স্রোতে প্রবেশকারী’ হওয়ার পরই বুদ্ধ লক্ষ করলেন আরেক প্রবীন বণিক এগিয়ে আসছেন ওঁদের দিকে। তিনি বুঝে গেলেন, নিশ্চয়ই ইয়াসার বাবা হবেন। তখন অধিকতর দক্ষতায় প্রাপ্ত বিবেচিত ইদ্ধি বা আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বলে ইয়াসাকে অদৃশ্য করে দিলেন তিনি। দারুণ বিচলিত ছিলেন ইয়াসার বাবা। তাঁর গোটা বাড়ি ইয়াসার খোঁজে ব্যস্ত, কিন্তু তিনি সোনার চপ্পলের ছাপ অনুসরণ করেছেন, যা তাঁকে সরাসরি বুদ্ধের কাছে নিয়ে এসেছে। আবার বণিককে বসালেন বুদ্ধ। আভাসে জানালেন অচিরেই ইয়াসাকে দেখতে পাবেন তিনি। ছেলের মতো একইভাবে নির্দেশনা দিলেন বাবাকে। নিমেষে মুগ্ধ হয়ে গেলেন বণিক: ‘প্রভু, এ অনন্য! সত্যি অনন্য!’ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। ‘ধৰ্ম্ম এমন স্পষ্ট করা হয়েছে যেন আপনি অন্ধকারে লণ্ঠন ধরে রেখে ভুল হয়ে যাওয়া একটা কিছু শুদ্ধ করে দিচ্ছেন।’ এরপর প্রথমবারের মতো তিনি বুদ্ধ, ধম্ম ও ভিক্ষুদের সংঘের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা প্রকাশকারী ঘোষণা ত্রি-আশ্রয় নামে নামে পরিচিত হয়ে ওঠা আচার পালন করলেন।[৩২] প্রথম সাধারণ অনুসারীদের প্রথম ব্যক্তিতে পরিণত হলেন তিনি, যিনি সংসারী থেকেও বৌদ্ধদের পদ্ধতির এক পরিবর্তিত ধরণ অনুসরণ করেছেন।
বাবার চোখের আড়ালে বুদ্ধে কথা শোনার সময় সম্পূর্ণ আলোকপ্রাপ্ত হলেন ইয়াসা, প্রবেশ করলেন নিব্বানায়। এই পর্যায়ে বুদ্ধ তাঁকে তাঁর বাবার সামনে প্রকাশ করলেন। ইয়াসাকে কেবল তাঁর মায়ের জন্যে হলেও বাড়ি ফিরে যেতে অনুনয় করলেন বণিক। অবশ্য বুদ্ধ ধীরে ধীরে তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন, ইয়াসা একজন আরাহাস্তে পরিণত হয়েছেন। তাঁর পক্ষে এখন গৃহস্থের জীবন যাপন অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এখন আর গৃহস্থের প্রজনন ও অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালনে সক্ষম করে তোলার মতো বাসনা ও আকাঙ্ক্ষায় আক্রান্ত নন তিনি। ধ্যানের জন্যে এখন তাঁর দীর্ঘ নীরবতা ও নিরিবিলি পরিবেশ প্রয়োজন হবে, সংসারী জীবনে যা সম্ভব হবে না। ফিরে যেতে পারবেন না তিনি। বুঝতে পারলেন ইয়াসার বাবা। কিন্তু বুদ্ধকে সেদিন তাঁর বাড়িতে আহার গ্রহণের আবেদন জানালেন। ইয়াসা হবেন তাঁর পরিচারক সন্ন্যাসী। খাবারের সময় ইয়াসার মা ও প্রাক্তন স্ত্রীকে দীক্ষা দিলেন বুদ্ধ। তারাও বুদ্ধের প্রথম মহিলা সাধারণ অনুসারীতে পরিণত হয়।
কিন্তু এ খবর পরিবারের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ল। বারানসির নেতৃস্থানীয় চার বণিক পরিবারের সদস্য ইয়াসার পার বন্ধু তাঁর গেরুয়া বসন পরার খবরে এতটাই বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলেন যে দীক্ষা নিতে বুদ্ধের কাছে হাজির হলেন তারা। আশপাশের পল্লী এলাকা হতে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় পরিবারের ইয়াসার পঞ্চাশ জন বন্ধুও তাই করলেন। অভিজাত ও বনেদী গোত্রের এইসব তরুণ অচিরেই আলোকপ্রাপ্ত হলেন। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই, টেক্সটসমূহ আমাদের বলছে, খোদ বুদ্ধসহ পৃথিবীতে আরাহান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল একষট্টি জনে।
উল্লেখযোগ্য গোত্রে পরিণত হচ্ছিল সংঘ। কিন্তু নতুন আরাহান্তদের সদ্যপ্রাপ্ত মুক্তি নিয়ে বিলাসিতা করতে দেওয়া চলবে না। তাদের বৃত্তি জগৎ হতে স্বার্থপর পশ্চাদপসরণ নয়, অন্যদের বেদনা হতে মুক্তি অর্জনে সাহায্য করার জন্যে বাজার এলাকায় প্রত্যাবর্তন করতে হয়েছিল তাঁদের। এখন ধম্মের নির্দেশ মোতাবেক অন্যদের জন্যে বাঁচাবেন তারা। ‘এবার যাও,’ ষাটজন ভিক্ষুকে বললেন বুদ্ধ।
জগতের জন্যে সহানুভূতি দেখিয়ে দেবতা আর মানুষের সুবিধা, কল্যাণ ও সুখের জন্যে ভ্রমণ করো। দুজন একই পথে যেয়ো না। ধম্ম শিক্ষা দাও, ভিক্ষুগণ, পবিত্র জীবন নিয়ে ধ্যান কর। অন্তরে সামান্য আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ধৰ্ম্ম না শোনায় কষ্ট ভোগ করছে কিছু সত্তা। তারা এটা বুঝতে পারবে।[৩৩]
বুদ্ধ মতবাদ সুবিধাপ্রাপ্ত অভিজাত গোষ্ঠীর মতবাদ ছিল না। ‘সাধারণ মানুষের ‘অনেকের’ (বহুজনা) ধর্ম ছিল। বাস্তব ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উচ্চবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে আবেদন রাখলেও তাত্ত্বিকভাবে সবার জন্যে খোলা ছিল এটা এবং ধর্ম-বর্ণ যাই হোক না কেন কারও জন্যে এর দরজা রুদ্ধ ছিল না। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কেউ একজন এমন এক ধর্মীয় কর্মসূচির স্বপ্ন দেখেছেন যা একক কোনও দলের মাঝে সীমিত ছিল না, বরং সমগ্র মানব জাতির জন্যেই চিন্তা করা হয়েছে। উপনিষদের সাধুদের প্রচারিত মতবাদের মতো এটা কোনও নিগূঢ় পথ ছিল না, বাজার এলাকায়, নব প্রতিষ্ঠিত শহরে, বাণিজ্য পথ বরাবর সবার জন্যে উন্মুক্ত ছিল। মানুষ যখনই ধৰ্ম্মের কথা শুনেছে, গাঙ্গেয় অঞ্চলে বিবেচনা করার মতো একটি শক্তিতে পরিণত হওয়া সংঘে এসে ভিড় করেছে তারা। নতুন ব্যবস্থায় সদস্যরা ‘শাক্য গুরুর নির্দেশপ্রাপ্ত অনুসারী’ নামে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু নিজেদের তারা স্রেফ ভিক্ষুদের সংঘ (ভিক্ষু-সংঘ) হিসাবে আখ্যায়িত করতেন।[৩৪] যোগদানকারী লোকেরা এতদিন সুপ্ত থাকা মানবতার সমগ্র এলাকায় ‘জাগ্রত’ হয়েছে বলে আবিষ্কার করেছে। এক নতুন সামাজিক ও ধর্মীয় বাস্তবতা অস্তিত্ব লাভ করেছিল।
তথ্যসূত্র
১. বিনয়া: মহাভাগ্য, ১: ৬।
২. প্রাগুক্ত।
৩. প্রাগুক্ত।
৪. মাজহিমা নিকয়া, ২২।
৫. সামুত্তা নিকয়া ৫৩: ৩১।