- বইয়ের নামঃ পুরাণ : সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
- লেখকের নামঃ ক্যারেন আর্মস্ট্রং
- প্রকাশনাঃ রোদেলা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, ইতিহাস
পুরাণ : সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১. পুরাণ কাকে বলবো?
মানব সম্প্রদায় বরাবরই মিথ (পুরাণ) নির্মাতা। প্রত্নতত্ত্ববিদের দল নিয়ানডারথাল কবর খুঁড়ে পেয়েছেন অস্ত্র, যন্ত্রপাতি আর উৎসর্গীকৃত পশুর হাড়, যা তাদের নিজেদের জগতের মতোই ভবিষ্যৎ জগতের প্রতি এক ধরনের বিশ্বাসের কথা বলে। নিয়ানডারথাল মানুষেরা হয়তো তাদের মৃত পূর্ব পুরুষেরা এখন উপভোগ করছে এমন জীবনের কথা গল্পের ছলে একে অন্যকে বলত। মৃত্যুকে নিশ্চিতরূপেই তারা এমনভাবে অভিব্যক্ত করত যা তাদের সমসাময়িক অন্যান্য প্রাণীরা সেরকমভাবে দেখত না। জীবজন্তু একে অন্যকে মারা যেতে দেখে, আমরা যতদূর জানতে পারি, ব্যাপারটা নিয়ে তারা খুব একটা ভাবিত হয় না। কিন্তু নিয়ানডারথাল কবরগুলো থেকে আমরা একটা বিষয় বুঝতে পারি যে এসব প্রাচীন মানুষ যখন তাদের নশ্বরতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে তখন তারা এক ধরনের পাল্টা আখ্যান তৈরি করে যা তাদের এই নশ্বরতার সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। নিয়ানডারথাল লোকেরা যারা তাদের সঙ্গীদের এহেন যত্নের সাথে সমাধিস্থ করেছে বোঝাই যায় দৃশ্যমান বস্তুগত জগৎই যে একমাত্র বাস্তবতা না সেটা তারা কল্পনা করতে সক্ষম হয়েছিল। বহু প্রাচীন কাল থেকেই, সেজন্য এটা প্রতীয়মান হয় যে মানুষ তাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার অতীত, কল্পনা করার শক্তির কারণে স্বতন্ত্র।
আমরা কার্য-কারণ সন্ধানী প্রাণী। কুকুর, আমরা যতদূর জানতে পারি, তাদের সারমেয় জন্ম নিয়ে যন্ত্রণা অনুভব করে না, বিশ্বের অন্য প্রান্তের কুকুরের দুর্দশা নিয়ে কোনো প্রকার দুশ্চিন্তায় ভোগে না বা নিজেদের জীবন কোনো ভিন্ন প্রেক্ষাপট থেকে দেখার চেষ্টা করে না। কিন্তু মানুষ খুব সহজেই হতাশায় আক্রান্ত হয় এবং সভ্যতার শুরু থেকে আমরা গল্প তৈরি করেছি, আমাদের জীবনকে একটা বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে স্থাপিত করে যা একটা মূলগত ছক উন্মোচিত করে এবং হতাশাজনক আর বিশৃঙ্খলতার প্রমাণের বিপরীতে, জীবনের মানে আর মূল্য সম্পর্কে আমাদের মাঝে একটা বোধের জন্ম দেয়।
মানুষের মনের আরেকটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো আমাদের যুক্তিগতভাবে ব্যাখ্যার অতীত ধারণা এবং অভিজ্ঞতা অনুভব করার ক্ষমতা। আমাদের কল্পনা শক্তি, এমন একটা ক্ষমতা যা তাৎক্ষণিকভাবে বর্তমান/উপস্থিত না এমন কিছু ভাবতে আমাদের সাহায্য করে এবং আমরা প্রথম যখন সেটা কল্পনা করি তা তখন বাস্তবিক অস্তিত্বহীন। এই কল্পনাশক্তিই মিথ/পুরাণ এবং ধর্মের সৃষ্টিকারী। আজকাল পৌরাণিক চিন্তা খ্যাতিহীনতার গর্ভে পতিত হয়েছে; আমরা প্রায়শই একে অযৌক্তিক এবং আত্ম-প্রশ্রয়ী অভিধা দিয়ে বাতিল করে দেই। কিন্তু কল্পনাশক্তিই আবার বিজ্ঞানীদের নতুন জ্ঞান আহরণে সাহায্য করে এবং তাদের এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সহায়তা করে যা আমাদের দক্ষতা পক্ষান্তরে বহুগুণ বৃদ্ধি করে। বিজ্ঞানীদের কল্পনাশক্তির বরাভয়ে আমরা মহাশূন্যে ভ্রমণ করে চাঁদের বুকে হাঁটতে সক্ষম হয়েছি, যা একটা সময়ে কেবল পৌরাণিক আখ্যানের অংশ ছিল। বিজ্ঞান এবং পুরাণ উভয়েই মানুষের সম্ভাবনার সীমা বৃদ্ধি করেছে। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির ন্যায় আমরা পরবর্তীকালে দেখব যে পুরাণও, এই পৃথিবীকে বাদ দিয়ে চিন্তা করেনি বরং এখানেই আরও সক্রিয় আরও প্রাণবন্তভাবে বাঁচতে আমাদের সহায়তা করেছে।
নিয়ানডারথাল সমাধিক্ষেত্র পুরাণের পাঁচটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আমাদের অবহিত করে। প্রথমত, বিলুপ্তির ভয় এবং মৃত্যুর অভিজ্ঞতার ভিতরেই প্রায় সবসময়েই এর মূল নিহিত থাকে। দ্বিতীয়ত, পশুর অস্থি সাক্ষ্য দেয় যে সমাধিস্থ করবার সময় পশু উৎসর্গ করা হয়েছিল। পুরাণতত্ত্বকে সাধারণত প্রথাগত অনুষ্ঠান থেকে আলাদা করা যায় না। অনেক মিথ মূলত গণপ্রার্থনা অনুষ্ঠান, যা ছাড়া তাদের প্রাণবন্ত করে তোলা সম্ভব না এবং ইহজাগতিক প্রেক্ষাপটে তাদের অর্থ অনুধাবন করা অসম্ভব। তৃতীয়ত, নিয়ানডারথাল পুরাণ সমাধি ছাড়া অন্যভাবে মানব জীবনের স্বল্পতার, তার সীমিত আয়ুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সব শক্তিশালী পুরাণই মানবিক অনুভূতির চরম মাত্রা নিয়ে; আমাদের অভিজ্ঞতার সীমা অতিক্রম করতে তারা আমাদের বাধ্য করে। একটা সময় আসে যখন আমাদের সবাইকে একভাবে না একভাবে এমন একটা স্থানে যেতে হবে যা আমরা আগে কখনও দেখিনি এবং এমন কাজ করতে হবে যা আমরা আগে কখনও করিনি। অজ্ঞাতকে নিয়েই পুরাণ; এটা এমন একটা বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় প্রাথমিকভাবে যা বর্ণনা করবার মতো শব্দ আমাদের সঞ্চয়ে ছিল না। পুরাণ তাই চূড়ান্ত নীরবতার গভীরে উঁকি দেবার একটা প্রয়াস। চতুর্থত, পুরাণ কেবল তার খাতিরে কোনো গল্প বলা না। সে আমাদের শেখায় আমাদের আচরণ কি ধরনের হওয়া উচিত। নিয়ানডারথাল সমাধিতে, কিছু কিছু মৃতদেহ ভ্রূণের অবস্থানে সমাধিস্থ দেখা যায় যেন পূনর্জন্মের প্রতীক্ষায় রয়েছে : পরবর্তী পদক্ষেপ মৃত ব্যক্তিকে নিজে উদ্যোগী হয়ে নিতে হবে। সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারলে, পুরাণতত্ত্ব, এই পৃথিবীতে বা পরবর্তী কোনো জগতে, সঠিক কাজের জন্য উপযুক্ত আত্মিক বা মানসিক মনোভাব আমাদের মাঝে আরোপ করে।