আলতামিরা আর লাসাউক্স-এর ভূগর্ভস্থ গুহাসমূহ অসাধারণ প্যালিওলিথিক আধ্যাত্মিকতার একটা ঝলক আজও আমাদের জন্য ধারণ করে রেখেছে।[২০] হরিণ, বাইসন আর লোমঅলা ঘোড়া, পশুর ছদ্মবেশ নেয়া শামানের দল আর বর্শা হাতে শিকারীদের ভক্তি উদ্রেককারী চিত্রগুলো নিখুঁত চমৎকারিত্বপূর্ণ যত্ন আর দক্ষতায় আন্তর্ভৌম সুড়ঙ্গে অঙ্কিত হয়েছে যেখানে পৌঁছানো খুবই কষ্টসাধ্য। ভূগর্ভস্থ এসব স্থানই সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম মন্দির আর গির্জা, এসব গুহার মানে জানতে অজস্র পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা হয়েছে; চিত্রগুলোয় সম্ভবত স্থানীয় লোককাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যা আমরা কখনও জানতে পারবো না। কিন্তু তারা নিশ্চিতভাবে মানুষ আর ঈশ্বরদৃশ্য, আদিরূপ প্রাণীর মাঝে পরম সম্মিলনের একটা দৃশ্যকল্প যা গুহার দেয়াল আর ছাদকে অলংকৃত করেছে। তীর্থযাত্রীকে স্যাঁতসেঁতে এবং বিপজ্জনক সেইসব গুহায় হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হবে তবেই তারা কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছাতে পারবে। অন্ধকারের গর্ভে মুখ লুকিয়ে থাকা চিত্রিত পশুর দল তবেই দৃষ্টিপটে ধরা দেবে। আমরা এখানেও সেই একই জটিল রূপ এবং ধারণার প্রতিফলন দেখি যা আমাদের শামানের অভিযানের খবর জানিয়েছিল। শামানিক পর্বের মতোই, গুহাতেও বাদ্যবাজনা, নাচ, গান অনুষ্ঠিত হয়েছে, অন্য পৃথিবীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরুই হয় পৃথিবীর গর্ভে অবতরণের মাধ্যমে; এবং সেখানে মায়াবী পরিবেশে জীবজন্তুর সাথে তাদের যোগাযোগ হয়, পতিত, নিরানন্দ জগৎ থেকে যা আলাদা।
নবাগতদের জন্য অভিজ্ঞতাটা হয়তো একটু বেশিই জোরালো বিশেষভাবে আগে কখনও যে গুহায় প্রবেশ করেনি এবং মনে হয় যে এই গুহাগুলো গোষ্ঠীর যুবকদের শিকারীতে রূপান্তরিত করতে দীক্ষাদানের স্থান হিসাবে ব্যবহৃত হত। প্রাচীনকালে দীক্ষাদানের অনুষ্ঠানই ছিল ধর্মের মূল বিষয় এবং আজকের প্রথাবদ্ধ সমাজেও এর গুরুত্ব যথেষ্ট রয়েছে।[২১] আজও আদিবাসী সমাজে, সদ্যযুবকদের তাদের মায়ের কাছ থেকে জোর করে বিচ্ছিন্ন করে বাধ্য করা হয় সহিষ্ণুতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে যাতে তারা মানুষে গোত্রান্তরিত হতে পারে। শামানদের যাত্রার মতো, এটাও মৃত্যু আর পুনর্জন্মের প্রক্রিয়া : বালককে তার শৈশব হত্যা করে প্রাপ্তবয়স্কের দায়িত্বপূৰ্ণ পৃথিবীতে প্রবেশ করতে হবে। উপনয়নের স্মারকসমূহ মাটিতে পুঁতে ফেলা হয় বা সমাধি দেয়া হয়; তাদের বলা হয় এখন একটা দানব তাদের গ্রাস করবে বা একটা আত্মা তাদের হত্যা করবে। তীব্র শারীরিক যন্ত্রণা আর অন্ধকারে তাদের রাখা হয়, এসময় সাধারণত তাদের লিঙ্গাগ্রের ত্বকচ্ছেদ বা গায়ে উল্কি আঁকা হয়। অভিজ্ঞতাটা এতটাই তীব্র আর স্মরণীয় যে একবারের দীক্ষায় সবকিছু চিরতরে বদলে যায়। মনোবিদরা আমাদের বলেন যে এ ধরনের একাকিত্ব আর বঞ্চনা ব্যক্তিত্বের ভিতরে যে কেবল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তাই না ব্যক্তির মাঝে সুপ্ত সৃষ্টিশীলতাও জাগ্রত হতে পারে। সহিষ্ণুতার পরীক্ষার শেষ পর্যায়ে কিশোরকে জানানো হয় যে মৃত্যু মানে একটা নতুন সূচনা। পুরুষের দেহ আর সত্তা নিয়ে সে তার লোকদের মাঝে ফিরে আসে। মৃত্যুর সমূহ সম্ভাবনার সম্মুখীন হয়ে এবং অস্তিত্বের নতুন মাত্রায় আরোহণের এটা কেবলমাত্র একটা প্রক্রিয়া এটা জানার পরে, শিকারী বা যোদ্ধায় পরিণত হয়ে সে তার গোষ্ঠীর লোকদের রক্ষার জন্য তখন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত হয়ে উঠবে।
দীক্ষাদান পর্বের কোনো একটা সময়ে নবদীক্ষিত প্রথমবারের মতো নিজের গোত্রের সবচেয়ে পবিত্র পুরাণ শ্রবণ করে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। পুরাণ কোনো গল্প না যেকোনো লোকায়ত বা অকিঞ্চিৎকর পরিবেশে তা উচ্চারিত হবে। এর সাথে যেহেতু পবিত্র জ্ঞানের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে তাই সবসময়ে কৃত্যানুষ্ঠানের আবহে এটাকে পুনরায় স্মরণ করা হয়, যা তাকে সাধারণ লৌকিক অভিজ্ঞতা থেকে আলাদা মাত্রা দেয় এবং আত্মিক আর মানসিক রূপান্তরের পবিত্র প্রেক্ষাপটেই যা কেবল অনুধাবন করা সম্ভব।[২২] পুরাণ হলো সেই উপদেশ যা আমাদের চরম মাত্রায় প্রয়োজন। একটা পুরাণ আমাদের চিরতরে বদলে দেবে এটার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। কৃত্যানুষ্ঠানের সাথে মিলিত হয়ে যা গল্প আর শ্রোতার মধ্যবর্তী অন্তরায় দূর করে এবং নিজের করে নিতে যা তাকে সাহায্য করে, পৌরাণিক আখ্যানসমূহ এমনভাবে বিন্যাস করা হয় যা আমাদের পরিচিত জগতের নিরাপদ নিশ্চয়তা থেকে অজ্ঞাত জগতে ঠেলে দেবে। রূপান্তরের কৃত্যানুষ্ঠান সমূহ পালন না করে পুরাণ পাঠ অনেকটা বাজনা ছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার মতো অসম্পূর্ণ। মৃত্যু এবং নবজন্ম, পুনরুত্থানের প্রক্রিয়ার একটা অংশ হিসাবে না দেখলে, পুরাণের কোনো মানে খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। লাসাউক্সের মন্দিরের কৃত্যানুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা থেকে, এবং শিকার এবং শামানদের অভিজ্ঞতা থেকে, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যে নায়কদের জন্যেই পুরাণের সৃষ্টি হয়েছে। শিকারী, শামান আর নবদীক্ষিতের দল সবাইকে পরিচিত পরিবেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ভীতিকর অভিজ্ঞতা আত্মস্থ করতে হয়েছে। নিজের যূথবদ্ধ সমাজকে সমৃদ্ধ করার অঙ্গীকার নিয়ে ফিরে আসবার আগে তাদের নৃশংস মৃত্যুর সম্ভাবনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বীরোচিত অভিযান সম্পর্কে সব সংস্কৃতিতেই প্রায় একই ধরনের পুরাণ রয়েছে। নায়ক তার নিজের জীবনে বা সমাজে কোনো একটা উপাদানের ঘাটতি অনুভব করেন। পুরাতন যে মূল্যবোধ বংশপরম্পরায় তাঁর লোকদের আত্মিক উন্নতি সাধন করেছে সেসব তাঁর কাছে আবেদন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। তাই সে ঘর ছাড়ে এবং বিপদসঙ্কুল অভিজ্ঞতা সহ্য করে। সে দানবদের সাথে লড়াই করে। দূরতিক্রম্য পাহাড় টপকে যায়, নিকষ অন্ধকার জঙ্গল অতিক্রম করে এবং এই প্রক্রিয়ার মাঝে তার পুরাতন সত্তার বিলুপ্তি ঘটে এবং নতুন অন্তজ্ঞান বা দক্ষতা অর্জন করে সে তার জনগোষ্ঠীর কাছে ফিরে আসে। মানবতার জন্য প্রমিথিউস দেবতাদের কাছ থেকে আগুন চুরি করে এনেছিলো, এবং সে কারণে বহু শতাব্দী যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে; এনিয়াস বাধ্য হয়েছিল তার পুরাতন জীবন ত্যাগ করতে, প্রজ্বলিত অগ্নিকাণ্ডে মাতৃভূমির ঝলসে যাওয়া দেখতে এবং নতুন শহর রোম খুঁজে পাবার আগে তাকে নিম্নতলে অবতরণ করতে হয়েছিল। নায়কের পুরাণ এতটাই গভীরভাবে প্রোথিত যে ঐতিহাসিক চরিত্রদের জীবনকথা যেমন, বুদ্ধ, মুহাম্মদ (সা:), বা যীশু খ্রিস্ট, যেভাবেই বলা হোক না কেন এই আদি ছকের সাথে মিলে যাবেই আর এই কাহিনী প্রথম সৃষ্টি হয়েছিল সম্ভবত প্যালিওলিথিক যুগে।