- বইয়ের নামঃ ইসলাম : সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
- লেখকের নামঃ ক্যারেন আর্মস্ট্রং
- প্রকাশনাঃ রোদেলা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, প্রবন্ধ, ধর্মীয় বই, ইতিহাস
ইসলাম : সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১. সূচনা
পয়গম্বর (৫৭০-৬৩২)
খ্রিস্টিয় ৬১০ সালের রমযান মাসে আরবের একজন বণিক এমন এক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন যা বিশ্বের ইতিহাস বদলে দিয়েছে। প্রতি বছর এসময়ে মুহাম্মদ ইবন আবদাল্লাহ্ সাধারণত আরবীয় হিজাযের মক্কার ঠিক বাইরে হিরা পর্বতের একটি গুহায় ধ্যানে বসতেন। সেখানে প্রার্থনা করতে তিনি, উপবাস পালন করতেন এবং দরিদ্র জনসাধারণকে সাহায্য দিতেন। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর বিশ্বাস অনুযায়ী আরবীয় সমাজের এক সঙ্কট নিয়ে উদ্বেগে ভুগছিলেন তিনি। সাম্প্রতিক কয়েক দশকে তাঁর গোত্র কুরাইশ আশপাশের দেশসমূহের সঙ্গে বাণিজ্য পরিচালনার মাধ্যমে ধনী হয়ে উঠেছিল। মক্কা এক সমৃদ্ধ বাণিজ্য নগরীতে রূপান্তরিত হয়েছিল বটে, কিন্তু অর্থ- বিত্তের জন্যে আগ্রাসী প্রতিযোগিতার কারণে বেশ কিছু গোত্রীয় মূল্যবোধ হারিয়ে গিয়েছিল। যাযাবর জীবন যাত্রার রেওয়াজ অনুযায়ী গোত্রের অসহায়-দুর্বল সদস্যদের প্রতি নজর দেয়ার পরিবর্তে কুরাইশরা এখন গোত্রের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র গ্রুপিং বা ক্ল্যানের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে অর্থ উপার্জনে আরও বেশী মনোযোগী হয়ে পড়েছে। মক্কা এবং গোটা পেনিনসূলা জুড়ে আধ্যাত্মিক অস্থিরতাও বিরাজ করছিল। আরবদের জানা ছিল যে বাইযানটাইন ও পারসিয়ান সাম্রাজ্যগুলোয় অনুশীলিত জুডাইজম ও ক্রিশ্চানিটি তাদের নিজস্ব পৌত্তলিক ঐতিহ্যের তুলনায় ঢের বেশী উন্নততর। কেউ কেউ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে তাদের দেব-নিচয়ের পরম ঈশ্বর (High God) আল-লাহ্ (যাঁর নামের অর্থ স্রেফ “ঈশ্বর”)-ই ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের উপাস্য দেবতা, কিন্তু তিনি আরবদের কাছে তাদের নিজস্ব ভাষায় কোনও পয়গম্বর এবং ঐশীগ্রন্থ প্রেরণ করেননি। প্রকৃতপক্ষেই, যেসব ইহুদি ও ক্রিশ্চানের সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হত তারা আরবরা ঐশী পরিকল্পনা থেকে বাদ পড়ে গেছে বলে বিদ্রূপ করত। সমগ্র আরব বিশ্বে গোত্রগুলো হিংসা ও প্রতিহিংসার এক ভয়ঙ্কর চক্রে পড়ে ঘুরপাক খেয়ে মরছিল। আরবের বহু চিন্তাশীল ব্যক্তির মাঝে ধারণা জন্মেছিল যে আরবরা বিস্তৃত জাতি, সভ্য জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং স্বয়ং ঈশ্বর কর্তৃক উপেক্ষিত। কিন্তু ১৭ রমযানের রাতে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, যখন মুহাম্মদ(স:) ঘুম থেকে জেগে উঠে নিজেকে এক ভয়ঙ্কর সত্তার আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় আবিষ্কার করেন: এই সত্তা তাঁকে প্রবলভাবে আলিঙ্গন করে যতক্ষণ না তিনি তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসা আরবের এক নতুন ঐশীগ্রন্থের প্রথম বাণীসমূহ উচ্চারিত হতে শুনলেন।
প্রথম দু’বছর আপন অভিজ্ঞতার ব্যাপারে নীরবতা বজায় রাখেন মুহাম্মদ(স:)। নতুন নতুন প্রত্যাদেশ পেয়েছেন তিনি, কিন্তু সেগুলো কেবল স্ত্রী খাদিজা এবং খাদিজার চাচাত ভাই ক্রিশ্চান ওয়ারাকা ইবন নওফলের কাছে প্রকাশ করেছেন। দু’জনই একথা মেনে নিয়েছিলেন যে প্রত্যাদেশগুলো ঈশ্বরের কাছ থেকেই আগত, কিন্তু কেবল ৬১২-তেই মুহাম্মদ (স:) নিজেকে প্রচারণা চালানোর মত যথেষ্ট শক্তিশালী বোধ করেন এবং আস্তে আস্তে অনুসারী লাভ করেন: তাঁর তরুণ চাচাত ভাই আলী ইবন আবি তালিব, বন্ধু আবু বকর এবং তরুণ ব্যবসায়ী উসমান ইবন আফফান, যিনি ক্ষমতাশালী উমাঈয়াহ্ পরিবারের সদস্য ছিলেন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী সদস্যসহ নব ধর্মদীক্ষিতদের অধিকাংশই ছিল অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ক্ল্যানের সদস্য; অন্যরা মক্কার নতুন বৈষম্য নিয়ে অসুখী ছিল, আরব চেতনার সঙ্গে যাকে মানানসই মনে হয়নি তাদের কাছে। মুহাম্মদের(স:) বাণী ছিল সাধারণ। আবরদের তিনি ঈশ্বর সম্পর্কে নতুন কোনও মতবাদ (doctrine) শিক্ষা দেননিঃ সংখ্যাগরিষ্ঠ কুরাইশ ইতিমধ্যে বিশ্বাস করছিল যে আল্লাহ্ বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন এবং শেষ বিচারের দিনে মানব জাতির বিচার করবেন, যেমনটি ইহুদি ও ক্রিশ্চানরা বিশ্বাস করত। একটি নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন বলে ভাবনেনি মুহাম্মদ(সঃ), বরং তিনি কেবল আরবদের কাছে একমাত্র ঈশ্বরের প্রাচীন বিশ্বাসই আবার ফিরিয়ে আনছেন, যাদের এতদিন কোনও পয়গম্বর ছিল না। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, ব্যক্তিগত সম্পদ গড়ে তোলা ঠিক নয় বরং সম্পদ বণ্টন করাই মঙ্গল আর এমন একটি সমাজ গড়ে তোলা উচিত যেখানে অসহায় ও দুর্বলেরা সম্মানের সঙ্গে বিবেচিত হবে। কুরাইশরা যদি তাদের পথ ঠিক না করে তাহলে তাদের সমাজ ধসে পড়বে (যেমন অতীতে অন্যান্য অন্যায় আচরণ ভিত্তিক সমাজ ধ্বংস হয়ে গেছে), কেননা তারা অস্তিত্বের মৌলনীতিমালা লঙ্ঘন করছে।
এটাই কুরান (আবৃত্তি) নামে অ্যাখ্যায়িত নতুন ঐশী গ্রন্থের মূল শিক্ষা, কুরান নাম হওয়ার কারণ স্বয়ং মুহাম্মদ(স:) সহ অধিকাংশ বিশ্বাসী নিরক্ষর ছিলেন বলে এর অধ্যায় (সুরা) সমূহের প্রকাশ্য আবৃত্তি শুনে শিক্ষা গ্রহণ করতেন। মুহাম্মদের(স:) কাছে কুরান পঙক্তির পর পঙক্তি, সুরার পর সুরা এইভাবে পরবর্তী একুশ বছর ধরে, কখনও কোনও সঙ্কটের সমাধান হিসাবে আবার কখনও বিশ্বাসীদের ছোট গোষ্ঠীর মাঝে উদ্ভূত কোনও জিজ্ঞাসার জবাব স্বরূপ অবতীর্ণ হয়েছে। প্রত্যাদেশ সমূহ মুহাম্মদের (স:) জন্য কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতা ছিল, যিনি বলেছেন: “আমি কখনও এমন কোনও প্রত্যাদেশ লাভ করিনি যখন আমার আত্মাকে ছিনিয়ে নেয়ার মত অনুভূতি জাগেনি।”[১] প্রথম দিকে প্রভাব এমন ভয়ঙ্কর ছিল যে তাঁর গোটা শরীর থরথর করে কাঁপত; এমনকি প্রবল ঠাণ্ডার দিনেও ঘামতেন দরদর করে, প্রবল ভার অনুভব করতেন তিনি অথবা অদ্ভুত শব্দ বা কণ্ঠস্বর শুনতে পেতেন। একেবারে সেক্যুলার পরিভাষায় আমরা বলতে পারি মুহাম্মদ (স: ) তাঁর সমসাময়িকদের তুলনায় অনেক গভীর স্তরে তাঁর জাতির সামনে বিরাজিত সমস্যাবলী উপলব্ধি করেছেন, এবং ঘটনাপ্রবাহ “শ্রবণ করার” সময় অন্তরের অন্তস্ত লে গভীর ও কষ্টকরভাবে ডুব দিতে বাধ্য হয়েছেন যাতে কেবল রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্যই নয়, সঙ্গে সঙ্গে আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে আলোকময় সমাধান লাভ করা যায়। তিনি এক নতুন সাহিত্য ধরন এবং আরবীয় গদ্য ও পদ্য সাহিত্যের একটি মাস্টারপিসও নির্মাণ করছিলেন। প্রথম দিকের বিশ্বাসীদের অনেকেই কুরানের অসাধারণ সৌন্দর্যের কারণেই ধর্মান্তরিত হয়েছিল, যা তাদের গভীর আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে অনুরণিত হয়েছে, মহৎ শিল্পকর্মের আকারে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক পূর্ব ধারণাকে ভেদ করে গেছে এবং তাদের সমগ্র জীবনধারাকে বদলে দেয়ার জন্য যুক্তির চেয়ে গভীর কোনও স্তরে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এসব ধর্মান্তরকরণের ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে নাটকীয়টি হচ্ছে উমর ইবন আল-খাত্তাবের ইসলাম গ্রহণ, যিনি প্রাচীন পৌত্তলিকতাবাদের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন, প্রবলভাবে মুহাম্মদের(স:) বাণীর বিরোধিতা করতেন, নতুন গোত্রটিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কিন্তু আরবীয় কাব্য-সাহিত্যের একজন বিশেষজ্ঞও ছিলেন তিনি, এবং প্রথম বারের মত কুরানের বাণী শোনামাত্র এর অসাধারণ অলঙ্কারময় ভাষায় মুগ্ধ হয়ে যান। যেমন তিনি বলেছেন, ভাষা এর বাণী সম্পর্কে তাঁর সব সংস্কার ভেদ করে গেছে: “যখন আমি কুরান শুনলাম, আমার হৃদয় কোমল হয়ে গেল, আমি কাঁদলাম আর ইসলাম আমার মাঝে প্রবেশ করল।”[২]