আমাদের আলোচনায় আমরা চীনকে খুব বেশি প্রাধান্য দেইনি কারণ চীনারা তাদের উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতিতে দেবতাদের সম্পর্কে কোনো গল্প বয়ান করে না। ঐশ্বরিক যুদ্ধের কোনো গল্প সেখানে নেই, নেই মৃতাপন্ন দেবতা বা পবিত্র বন্ধন বা বিয়ে; কোনো স্বীকৃত দেবতামণ্ডলী নেই, নেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির গল্প বা মানুষের সাথে তুলনীয় দেবতার দল। তাদের শহরগুলোর কোনো পৃষ্ঠপোষক দেবতা থাকত না বা কোনো প্রকার শহুরে প্রার্থনার প্রথা। তার মানে এই না যে চৈনিক সমাজের কোনো পৌরাণিক ভিত্তি নেই। পূর্বপুরুষরা আরাধনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা এমন একটা পৃথিবীর দিকে ইশারা করে যা মানুষের পৃথিবীর চাইতে অনেক পুরাতন। মৃত আত্মীয়স্বজনের আচারঅনুষ্ঠান চাইনিজদের সামাজিক শৃঙ্খলার আদর্শায়িত প্রতিরূপ সরবরাহ করত যা পরিবার হিসাবে কল্পনা করা হয় এবং শিষ্টতার নীতি দ্বারা পরিচালিত হতো। নদী, তারা, বাতাস, আর শস্যাদি সবার মাঝেই আত্মা রয়েছে যা আকাশ দেবতা, ডি (পরবর্তীকালে তিয়েন। ‘স্বর্গ’ বলা হয়) এর অধীনে একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে। অন্যান্য আকাশ দেবতাদের ন্যায় চৈনিক আকাশ দেবতা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়নি। শান্ রাজবংশের সময়ে সে আরও জোরালো হয়ে উঠে (খ্রি: পূ: ১৭৬৬-খ্রি: পূ: ১১২২)। রাজার বৈধতা নির্ণয় করতে গিয়ে বলা হতো যে কেবল রাজা একাই ডি / তিয়েন এর সাথে যোগাযোগ করতে পারে এবং বারোমেসে দর্শনের নীতি অনুসারে সে ঈশ্বরের পার্থিব প্রতিরূপ- ১৯১১ সালের বিপ্লবের আগ পর্যন্ত চীনা সংস্কৃতিতে এই পুরাণ টিকে ছিল। পার্থিব প্রশাসন স্বর্গীয় ব্যবস্থার অনুরূপ; রাজাকে তার মন্ত্রীরা সাহায্য করে ঠিক যেমন তিয়েনকে ব্রহ্মাণ্ড পরিচালনায় অনুষঙ্গের দেবতারা সাহায্য করে থাকে।
চাইনিজরা বোধহয় অন্যান্য সংস্কৃতির চেয়ে আগে অ্যাক্সিয়াল মূল্যবোধের দিকে হাতড়ে হাতড়ে পথ চিনে এগিয়ে গিয়েছে। খ্রি: পূ: ১১২৬ সালে উই নদীর অববাহিকার লোকেরা বর্তমানে চীনের সেনসি প্রদেশ, শান বংশকে উৎখাত করে জোউ বংশের অভিষেক ঘটায়। জোউ দাবী করে যে শান বংশের শেষ রাজা দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল এবং মানুষের দুর্দশার কথা বিবেচনা করে তিয়েন তার ম্যাণ্ডেট জোউকে দিয়েছে– এ পুরাণে তিয়েন নীতিবাদী চরিত্রে অভিষিক্ত। ব্যাপক উৎসব আর শ্রুতিমধুর বাদ্যের সহযোগে স্বর্গের এই আদেশ জোউ উদ্যাপিত করে। এই বিধানকে সামাজিক সম্প্রীতির আগমনী হিসাবে দেখা হয় যা কিনা নিজেই ঐশ্বরিক। সব অংশগ্রহণকারীকে জীবিত বা মৃত, এসব অনুষ্ঠান মেনে চলতে হবে। সব অস্তিত্ব– সত্তা, পূর্বপুরুষ, এবং মানুষ– তাদের বিশেষ স্থান রয়েছে, সবাইকে নিজ নিজ পছন্দ অপছন্দকে এবং আচার অনুষ্ঠানের প্রতি ব্যক্তিগত প্রবণতা দমন করতে হবে যা বিশ্বের আদর্শ বিন্যাসকে মানুষের ত্রুটিযুক্ত পৃথিবীতে একটা বাস্তবতার রূপ দিয়েছে। আচার অনুষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ এতে অংশগ্রহণকারীরা নয়; ব্যক্তি মানুষ অনুভব করে পবিত্র জগতের সাথে তারা লীন হয়ে পড়ছে যা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আর তাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি।
কনফুসিয়াসের সময় নাগাদ অবশ্য, জোউ রাজত্ব ভঙ্গুর হয়ে এসেছিল এবং পুরাতন প্রথা ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল। আচার অনুষ্ঠানের প্রতি অনীহাই এর কারণ বলে প্রচার করেন কনফুসিয়াস এবং আচরণের (লি) বিধিবদ্ধ নিয়ম গ্রহণ করেন যা মানুষকে শিখাবে তাদের একে অন্যের প্রতি আচরণ কি ধরনের হওয়া উচিত। এখন মানুষ ভব্যতা জলাঞ্জলি দিয়ে স্বার্থপরের মতো কেবল নিজের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করছে। কিছু কিছু পুরান পুরাণে উল্লেখ ছিল যে ব্যাক্তিগত আত্মোৎসর্গের উপরে সৃষ্টিশীলতা নির্ভরশীল কিন্তু যুগান্তকারী পর্বের ঋষিরা নৈতিক বোধের এই অন্তজ্ঞানকে সুনির্দিষ্ট করে তোলেন। প্রত্যেককে প্রাত্যহিক জীবনে এই আত্মাহুতির অনুশীলন করতে হবে যারা নিজের মানবতাকে নিখুঁত করার ইচ্ছা রাখে।[৭২] কনফুসিয়াস পুরাতন চৈনিক মূল্যবোধের সাথে এই যুগান্তকারী করুণানিধির সংমিশ্রণ ঘটান। তিনি রেন (সহৃদয়তা) এর আদর্শ প্রচার করেন যা দাবী করে মানুষ ‘অপর মানুষ’কে ভালোবাসবে।[৭৩] সোনালী আইনের তিনিই প্রথম প্রচারক : ‘তুমি যেমন নিজের ক্ষতি করবে না তেমনি অপরের ক্ষতি করতে যেও না’।[৭৪] আত্মনিরীক্ষা আর মনের অভিব্যক্তি অ্যাক্সিয়াল সত্তা দাবী করে নিজের গোপন লুকানো মানসিকতার ইচ্ছাকৃত বিশ্লেষণের জন্য। নিজের চাহিদা প্রথমে বিশ্লেষণ না করে অন্যের সাথে ন্যায্য আচরণ কেউ করতে পারবে না; অপরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন হলো শু (নিজেকে পছন্দ করা)র একটা প্রক্রিয়া।[৭৫]
কিন্তু কনফুসিয়াস বুঝতে পেরেছিলেন কেবল যৌক্তিক অভিব্যক্তি বা সদিচ্ছা দ্বারা এটা সম্ভব না। সঙ্গীত আর আচারঅনুষ্ঠানের মিলিত রসায়নের মাধ্যমে স্বার্থপরতার চরম বিলুপ্তি অর্জন করা সম্ভব যা অন্যসব মহান কলার ন্যায় মানুষকে এমন একটা পর্যায়ে উন্নীত করে যা অনুভূতির চাইতে গভীর।[৭৬] অবশ্য কেবল আচারঅনুষ্ঠানে যোগ দেয়াটাই যথেষ্ট না : এর পেছনের উদ্দেশ্যটা বোঝা জরুরী যা অপরের প্রতি ‘আনত’ (রাঙ) অভিব্যক্তি হৃদয়ে প্রোথিত করবে অহংকার ঈর্ষা এবং ক্ষোভকে অতিক্রম করতে সহায়তা করে।[৭৭] অন্যান্য সদস্যদের প্রতি মাথা নত করে, কৃত্যানুষ্ঠানের দাবী মেনে নিয়ে এবং যখন প্রয়োজন তখন অন্যকে নেতৃত্বের সুযোগ দান করে ভক্তের দল- এসবই হবে মহিমাময় সঙ্গীতের সঙ্গতে- তাদের প্রতিবেশী অন্য মানুষের সাথে কি ধরনের আচরণ ও সম্পর্ক সাধারণ পরিস্থিতিতে বজায় রাখতে হবে সেটার শিক্ষা নেয়। অতীতের আদর্শ ব্যবস্থার দিকে কনফুসিয়াস ফিরে তাকান। দেবতাদের সম্পর্কে কোনো গল্প চীনাদের ভিতরে প্রচলিত নেই কিন্তু বীরদের শ্রদ্ধা প্রদর্শনের, যারা বস্তুতপক্ষে পৌরাণিক চরিত্র কিন্তু তাদের ঐতিহাসিক বলে মনে করা হতো, প্রথা চীনাদের মাঝে বিদ্যমান ছিল। সুদূর অতীতকালের পাঁচ ঋষি রাজার মাঝ থেকে দুজন ছিল কনফুসিয়াসের বিশেষ বীর চরিত্র। প্রথম জনের নাম ইয়াও যে চীনাদের সঙ্গীত আর আচার অনুষ্ঠানের যথাযথ ব্যবহারই কেবল শেখাননি সেই সাথে রাঙের গুণাবলী তাদের সামনে প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু তিনি নিজের পাঁচ ছেলের কাউকেই যোগ্য না মনে করায় সৎ চাষী শানকে নিজের উত্তরাধিকারী হিসাবে পছন্দ করেন। শানও অসাধারণ নিঃস্বার্থতার পরিচয় দেয়, তার আপন ভাইয়েরা আর বাবা তাকে হত্যার চেষ্টা করলেও তাদের প্রতি তার ভালোবাসা অক্ষুণ্ণ থাকে এবং তাদের প্রাপ্য সম্মান থেকে তাদের বঞ্চিত করে না।