আল-আফগানির রাজনৈতিক প্রচারণাসমূহ, যেগুলো ছিল প্রায়শই উদ্ভট কিংবা একেবারেই অনৈতিক, এমনি হতাশায় পরিপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, ১৮৯৬-তে তাঁর একজন শিষ্য ইরানের শাহকে হত্যা করে। কিন্তু তাঁর বন্ধু এবং সহকর্মী মিশরীয় পণ্ডিত মুহাম্মদ আবদু (১৮৪৯-১৯০৫) ছিলেন অধিকতর গভীর এবং পরিমিতি বোধ সম্পন্ন চিন্তাবিদ। তাঁর বিশ্বাস ছিল, বিপ্লব নয়, বরং শিক্ষাই প্রকৃত সমাধান। মিশরে ব্রিটিশ দখলদারিত্বে চরম আঘাত পেয়েছিলেন আবদু, কিন্তু ইউরোপকে তিনি ভালোবাসতেন, ইউরোপীয়দের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন, পশ্চিমা বিজ্ঞান ও দর্শনে প্রচুর লেখাপড়া ছিল তাঁর। আধুনিক পশ্চিমের রাজনৈতিক, আইনসংক্রান্ত এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তিনি, কিন্তু এটা মনে করেননি যে সেগুলোকে মিশরের মত গভীরভাবে ধর্মভিত্তিক দেশে পাইকারি হারে রোপণ করা সম্ভব– মিশরে আধুনিকীকরণের হার ছিল তীব্র এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে পরিকল্পিতভাবেই এর বাইরে রাখা হয়েছিল। আধুনিক আইনগত এবং সাংবিধানিক উদ্ভাবন সমূহকে প্রচলিত ইসলামী ধ্যান ধারণার সঙ্গে এমনভাবে সংশ্লিষ্ট করা আবশ্যক যেন লোকে বুঝতে পারে। যে সমাজের মানুষ আইন বুঝতে পারে না কার্যত: সেটা আইনবিহীন দেশে পরিণত হয়। উদাহরণস্বরূপ, শুরাহ্ (পরামর্শ)র ইসলামী নীতি মুসলিমদের গণতন্ত্রের অর্থ বুঝতে সাহায্য করতে পারে। শিক্ষারও সংস্কার প্রয়োজন। মাদ্রাসার ছাত্রদের আধুনিক বিজ্ঞান পাঠ করতে হবে যাতে করে তারা ইসলামী প্রেক্ষিতে মুসলিমদের আধুনিক বিশ্বে প্রবেশে সাহায্য করতে পারে, যা তাদের কাছে অর্থবহ হয়ে উঠবে। কিন্তু শরিয়াহকে হালনাগাদ করে তুলতে হবে; এবং আবদু এবং তাঁর বয়কনিষ্ঠ সমসাময়িক সাংবাদিক রশিদ রিদা (১৮৬৫- ১৯৩৫) জানতেন এটা এক দীর্ঘ এবং জটিল প্রক্রিয়া। রিদা আরব বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিতদের ক্রমবর্ধমান সেক্যুলারিজমে শঙ্কিত বোধ করেছিলেন। এঁরা মাঝে মাঝে ইসলামই জনগণকে পেছন দিকে টানছে মনে করে ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতেন। রিদা মনে করেছেন, এতে কেবল উম্মাহ্ আরও দুর্বল হয়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের সহজ শিকারে পরিণত হবে। রিদাই হচ্ছেন অন্যতম প্রধান মুসলিম যিনি সম্পূর্ণ আধুনিক অথচ সংস্কৃত শরিয়াভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি এমন একটা কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যেখানে ছাত্ররা ফিক্হ শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইন, সমাজবিজ্ঞান, বিশ্ব ইতিহাস, ধর্মের বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনা এবং আধুনিক বিজ্ঞান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে উঠতে পারবে। এর ফলে প্রকৃত আধুনিক প্রেক্ষিতে ইসলামী জুরিসপ্রুডেন্স উন্নতি লাভ করবে যা পূর্ব ও পশ্চিমের ঐতিহ্যকে একসূত্রে গাঁথবে আর কৃষিভিত্তিক আইন- শরিয়াহকে পশ্চিমে বিকশিত নতুন ধরনের সমাজের সঙ্গে মানানসই করে তুলবে।
সংস্কারকগণ ক্রমাগত অনুভব করছিলেন যে ইসলামের বিরুদ্ধে ইউরোপীয়দের সমালোচনার উত্তর দেয়া প্রয়োজন। রাজনৈতিক বিষয়ের মত ধর্মক্ষেত্রেও পাশ্চাত্য মুসলিমদের এজেন্ডা স্থির করে দিচ্ছিল। ভারতে কবি-দার্শনিক মুহাম্মদ ইকবাল (১৮৭৬-১৩৩৮) জোর দিয়ে বললেন যে ইসলাম যেকোনও পশ্চিমা ব্যবস্থার মতই যুক্তিভিত্তিক। প্রকৃতপক্ষে, এটা প্রচলিত অন্যসব কনফেশনাল ধর্মবিশ্বাসের মাঝে সবচেয়ে যৌক্তিক এবং প্রাগ্রসর। এর কঠোর একেশ্বরবাদীতা মানব জাতিকে কিংবদন্তী হতে মুক্তি দিয়েছে আর কুরান মুসলিমদের তাগিদ দিয়েছে গভীরভাবে প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করার জন্যে, পর্যবেক্ষণের ফল নিয়ে চিন্তা করতে বলেছে আর কর্মকাণ্ডকে অব্যাহত পরীক্ষার বিষয়ে পরিণত করতে বলেছে। এভাবে আধুনিকতার জন্মদানকারী পরীক্ষা-নিরীক্ষার চেতনা আসলে ইসলাম থেকেই উদ্ভূত। এটা ছিল ইতিহাসের আংশিক এবং অযথার্থ ব্যাখ্যা, তবে এসময়ে খিষ্টধর্মকে উন্নত ধর্ম এবং ইউরোপকে প্রগতির চিরন্তন ধ্বজাধারী বলে মনে করার পাশ্চাত্য প্রবণতার চেয়ে খুব বেশী পক্ষপাতপূর্ণ নয় মোটেই। ইসলামের যৌক্তিক চেতনার প্রতি ইকবালের গুরুত্ব আরোপ তাঁকে সুফিবাদের নিন্দাবাদের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। নতুন ধারাকে তিনি অতীন্দ্রিয়বাদ থেকে ভিন্ন হিসাবে উপস্থাপিত করেছেন যা মুসলিম বিশ্বে ক্রমাগত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, আধুনিক যুক্তিবাদকেই যেহেতু সামনে এগোনোর একমাত্র উপায় বলে মনে হয়েছে। পশ্চিমা ধ্যান ধারণায় গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন ইকবাল, লন্ডনে পিএইচ.ডি. করেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর বিশ্বাস ছিল যে পাশ্চাত্য ধারাবাহিকতা জলাঞ্জলি দিয়ে অগ্রগতিকে বেগবান করেছে; এর সেক্যুলার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তিত্বের ধারণাকে ঈশ্বর হতে বিচ্ছিন্ন করে একে বহুঈশ্বরবাদী এবং আশঙ্কাজনকভাবে অশুভ করে তুলেছে। পরিণামে পাশ্চাত্য শেষ পর্যন্ত আপন ধ্বংসকেই ডেকে আনবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এটা উপলব্ধি করা কঠিন কিছু নয়, যাকে ইউরোপের সম্মিলিত আত্মহত্যা হিসাবে দেখা যেতে পারে। সুতরাং মুসলিমদের জগৎসংসার থেকে বিচ্ছিন্ন ধ্যানে মগ্ন হয়ে নয় বরং শরিয়া আদর্শসমূহকে বাস্তবায়িত করতে পারবে এমন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে জীবনে ঐশ্বরিক মাত্রা লক্ষ্য করার এক গুরুত্বপূর্ণ মিশন রয়েছে।