- বইয়ের নামঃ আ হিস্ট্রি অফ গড / স্রষ্ট্রার ইতিবৃত্ত
- লেখকের নামঃ ক্যারেন আর্মস্ট্রং
- প্রকাশনাঃ রোদেলা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, প্রবন্ধ, ধর্মীয় বই
আ হিস্ট্রি অফ গড / স্রষ্ট্রার ইতিবৃত্ত
০. অনুবাদকের কথা / সূচনা
আ হিস্ট্রি অফ গড – ক্যারেন আর্মস্ট্রং / স্রষ্টার ইতিবৃত্ত – শওকত হোসেন
ইহুদি, ক্রিশ্চান ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের স্রষ্টা সন্ধানের ৪,০০০ বছরের ইতিহাস
প্রথম প্রকাশ : একুশে বইমেলা ২০১০
.
অনুবাদকের কথা
ক্যারেন আর্মস্ট্র-এর আ হিস্ট্রি অভ গড বইটির বিষয়বস্তু যেমন গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল তেমনি এর আলোচনার শাখা প্রশাখাও ছড়িয়েছে নানা দিকে: ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, সংস্কার, মনস্তত্ত্ব, ইত্যাদি। লেখক সুগভীর গবেষণা লব্ধ জ্ঞান হতে তুলে এনেছেন দৃষ্টি উন্মোচক নানা তথ্য। আবিষ্কৃত তথ্য সাজিয়ে তিনি একেশ্বরবাদী ধর্মে স্রষ্টার স্বরূপ সন্ধান করেছেন। আমি আশা করি বইটি বৃহত্তর পাঠক সমাজ, যারা স্রষ্টা ও সৃষ্টি নিয়ে ভাবেন তাদের ব্যাপক উপকারে আসবে। লেখক তার বক্তব্য সুস্পষ্ট করার স্বার্থে কোরান ও বাইবেল হাতে প্রচুর উদ্ধৃতি দিয়েছেন। কোরানের আয়াতসমূহের অনুবাদ ইসলামি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত পবিত্র কুরআনুল করীম হতে নেওয়া; পবিত্র বাইবেলের সংশ্লিষ্ট পঙক্তির অনুবাদ বাংলাদেশ বাইবেল সোসায়েটি কর্তৃক প্রকাশিত পবিত্র বাইবেল, পুরাতন ও নতুন নিয়ম থেকে উদ্ধৃত। কোরান ও বাইবেলের অনুবাদের ক্ষেত্রে যেখানে আয়াত সংখ্যা মেলেনি সেখানে প্রথম বন্ধনীর মাঝে বাংলা অনুবাদের আয়াত সংখ্যা আলাদাভাবে তুলে দিয়েছি।
গ্রন্থটির কেন্দ্রীয় বিষয় যেহেতু স্রষ্টা, গোটা বইতে তাই সামঞ্জস্য রাখার স্বার্থে গড এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসাবে ঈশ্বর শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
মূলগ্রন্থে না থাকলেও মহানবী মুহাম্মদ-এর নামের পর (স) ব্যবহার করা হয়েছে; এরপরও পাঠকদের কাছে অনুরোধ, অন্যান্য পয়গম্বর ও তাঁদের সহচরদের নামের শেষে যথাযথভাবে তাঁরা যেন (আ), (রা), ইত্যাদি পাঠ করেন।
যে কোনও অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটির জন্যে পরম করুণাময়ের ক্ষমা প্রার্থনা করি। আশা করি গ্রন্থটি বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সবার উপকারে আসবে এবং সেটা হলেই আমি আমার পরিশ্রম স্বার্থক হয়েছে বলে মনে করব।
শওকত হোসেন
মালিবাগ, ঢাকা।
e-mail: saokot_nccbd@yahoo.com
.
সূচনা
ছোটবেলায় বেশ কিছু ধর্মীয় বিষয়ে জোরাল বিশ্বাস ছিল আমার, কিন্তু ঈশ্বরে তেমন একটা আস্থাশীল ছিলাম না। নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে বিশ্বাসের সঙ্গে সেগুলোর ওপর নির্ভর করার আস্থাশীলতার পার্থক্য আছে। আমি অন্তরে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতাম, এ ছাড়া ইউক্যারিস্টে ঈশ্বরের প্রকৃত উপস্থিতি, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের নিরাময় প্রদানের ক্ষমতা, শাস্তিভোগের আশঙ্কা ও প্রায়শ্চিত্তের (Purgatory) বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতায়ও বিশ্বাস ছিল। অবশ্য এ কথা বলতে পারব না যে পরম সত্তা সম্পর্কিত এইসব ধর্মীয় মতামতে বিশ্বাসের ফলে পৃথিবীতে জীবন চমৎকার বা সুবিধাজনক বলে আমার মনে আস্থা জন্মেছিল। আমার ছোটবেলার রোমান ক্যাথলিসিজম বরং ভীতিকর এক বিশ্বাস ছিল। পোর্ট্রেট অভ দ্য আর্টিস্ট অ্যাজ আ ইয়ং ম্যান-এ জেমস জয়েস অত্যন্ত সঠিকভাবে বিষয়টি তুলে ধরেছেন। নরকের অগ্নিকুণ্ডের বিবরণ শুনেছি আমি। আসলে নরক যেন আমার কাছে ঈশ্বরের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তব মনে হয়েছে, কারণ তা ছিল এমন কিছু কল্পনায় আমি যাকে বুঝতে পারতাম। অন্যদিকে ঈশ্বর যেন অস্পষ্ট ধোঁয়াটে কোনও সত্তা ছিলেন, বর্ণনায় নয় বুদ্ধিবৃত্তিক বিমূর্ততায় তার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আমার বয়স যখন আট বছর, ‘ঈশ্বর কি?’ প্রশ্নের নিচ্ছিদ্র জবাব মুখস্থ করতে হয়েছিল আমাকে: ‘ঈশ্বর হচ্ছেন পরম আত্মা, যার কোনও অংশীদার নেই এবং যিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ।’ এটা মোটেই বিস্ময়কর নয় যে, এ জবাব আমার কাছে খুব একটা অর্থপূর্ণ মনে হয়নি। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এ জবাব এখনও আমাকে শীতল করে দেয়। একে সবসময়ই এককভাবে বিরস, অতিরঞ্জিত এবং উদ্ধত সংজ্ঞা মনে হয়েছে। অবশ্য এই বইটি লেখা শুরু করার পর থেকে জবাবটিকে সঠিক নয় বলেও বিশ্বাস করতে শুরু করেছি।
বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝতে পারি যে, ধর্মে আতঙ্কের চেয়েও বেশি কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে। আমি সাধুসন্ত, ভাববাদী কবিদের জীবনী, টি.এস. এলিয়ট ও অতিন্দ্রীয়বাদীদের মোটামুটি সরল রচনা পাঠ করেছি। শাস্ত্রের সৌন্দর্যে আলোড়িত হতে শুরু করেছিলাম বটে, যদিও ঈশ্বর দূরেই রয়ে গেছেন। আমার মনে হয়েছিল তার কাছে পৌঁছানো সম্ভব এবং তাঁর দর্শন সমগ্র সৃষ্ট বাস্তবতাকে হুঁপিয়ে যাবে। সে জন্যেই আমি ধর্মীয় সংগঠনে যোগ দিই, তরুণ শিক্ষানবীশ নান হিসাবে ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে ভ্রারও অনেক কিছু জানতে পারি। অ্যাপোলোজেটিক্স, ঐশী গ্রন্থ, ধর্ম তত্ত্ব ও গির্জার ইতিহাসে নিজেকে নিয়োজিত করি। মঠের জীবনাচারের ইতিহাস খুঁড়ে বেড়াই ও আমার নিজস্ব বৃত্তির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করি, যা আমাদের সম্পূর্ণ কণ্ঠস্থ করতে হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয়, এগুলোর কোনওটাতেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভূত হয়নি। সব গুরুত্ব যেন গৌণ বিষয়ের ওপর আরোপ করা হয়েছে, ধর্মের বিভিন্ন প্রান্তিক বিষয়াদি মনোযোগ পেয়েছে বেশি। আমি প্রার্থনায় মনোনিবেশ করেছি, ঈশ্বরের মুখোমুখি হতে মনের ওপর জোর খাঁটিয়েছি, কিন্তু তিনি আমার নিয়মনীতি ভঙ্গের দর্শক হিসাবে কঠোর প্রভুই রয়ে গেছেন কিংবা বিস্ময়করভাবে অনুপস্থিত থেকেছেন। আমি যতই সাধু সন্ন্যাসীদের পরমানন্দ (rapture) সম্পর্কে জানতে পেরেছি ততই ব্যর্থতার অনুভূতি জেগেছে আমার মনে। বিষাদের সঙ্গে আবিষ্কার করেছি, আমায় সামান্য ধর্মীয় অভিজ্ঞতা কোনওভাবে আমার আপন অনুভূতি ও কল্পনার ওপর চাপ প্রয়োগের ফলে আমারই নিজস্ব মস্তিষ্কসঞ্জাত। কখনও কখনও ভক্তির অনুভূতিটুকু ছিল গ্রেগোরিয়ান চ্যান্ট বা শাস্ত্রের সৌন্দর্য্যের প্রতি সহজাত সাড়া, কিন্ত আমার সত্তার অতীত কোনও সূত্র থেকে আমার মাঝে কোনও কিছু আসলে ঘটেনি। পয়গম্বর বা অতিন্দ্রীয়বাদীদের বর্ণনার ঈশ্বরের দেখা কখনও পাইনি আমি। জেসাস ক্রাইস্টকে, যার কথা ঈশ্বরের চেয়ে বেশি আলোচনা করে থাকি আমরা, একেবারেই ঐতিহাসিক চরিত্র মনে হয়েছে, প্রাচীন ইতিহাসে যিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। আমার মনে চার্চের কোনও কোনও মতবাদের ব্যাপারেও গভীর সন্দেহ জাগতে শুরু করে। মানুষ জেসাস যে ঈশ্বরের অবতার এটা নিশ্চিত করে বলতে পারে কে, আর এমন একটা বিশ্বাসের অর্থই বা কী? নিউ টেস্টামেন্ট কি আসলেই ব্যাপক ও দারুণভাবে পরস্পরবিরোধী ট্রেনিটি মতবাদ শিক্ষা দিয়েছে, নাকি ধর্মের অপরাপর বিভিন্ন বিষয়ের মতো এটাও জেরুজালেমে ক্রাইটের মৃত্যুর শত শত বছর পর ধর্মতাত্ত্বিকদের কল্পনাপ্রসূত বিষয়।