- বইয়ের নামঃ আ হিস্ট্রি অফ গড / স্রষ্ট্রার ইতিবৃত্ত
- লেখকের নামঃ ক্যারেন আর্মস্ট্রং
- প্রকাশনাঃ রোদেলা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, প্রবন্ধ, ধর্মীয় বই
আ হিস্ট্রি অফ গড / স্রষ্ট্রার ইতিবৃত্ত
০. অনুবাদকের কথা / সূচনা
আ হিস্ট্রি অফ গড – ক্যারেন আর্মস্ট্রং / স্রষ্টার ইতিবৃত্ত – শওকত হোসেন
ইহুদি, ক্রিশ্চান ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের স্রষ্টা সন্ধানের ৪,০০০ বছরের ইতিহাস
প্রথম প্রকাশ : একুশে বইমেলা ২০১০
.
অনুবাদকের কথা
ক্যারেন আর্মস্ট্র-এর আ হিস্ট্রি অভ গড বইটির বিষয়বস্তু যেমন গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল তেমনি এর আলোচনার শাখা প্রশাখাও ছড়িয়েছে নানা দিকে: ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, সংস্কার, মনস্তত্ত্ব, ইত্যাদি। লেখক সুগভীর গবেষণা লব্ধ জ্ঞান হতে তুলে এনেছেন দৃষ্টি উন্মোচক নানা তথ্য। আবিষ্কৃত তথ্য সাজিয়ে তিনি একেশ্বরবাদী ধর্মে স্রষ্টার স্বরূপ সন্ধান করেছেন। আমি আশা করি বইটি বৃহত্তর পাঠক সমাজ, যারা স্রষ্টা ও সৃষ্টি নিয়ে ভাবেন তাদের ব্যাপক উপকারে আসবে। লেখক তার বক্তব্য সুস্পষ্ট করার স্বার্থে কোরান ও বাইবেল হাতে প্রচুর উদ্ধৃতি দিয়েছেন। কোরানের আয়াতসমূহের অনুবাদ ইসলামি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত পবিত্র কুরআনুল করীম হতে নেওয়া; পবিত্র বাইবেলের সংশ্লিষ্ট পঙক্তির অনুবাদ বাংলাদেশ বাইবেল সোসায়েটি কর্তৃক প্রকাশিত পবিত্র বাইবেল, পুরাতন ও নতুন নিয়ম থেকে উদ্ধৃত। কোরান ও বাইবেলের অনুবাদের ক্ষেত্রে যেখানে আয়াত সংখ্যা মেলেনি সেখানে প্রথম বন্ধনীর মাঝে বাংলা অনুবাদের আয়াত সংখ্যা আলাদাভাবে তুলে দিয়েছি।
গ্রন্থটির কেন্দ্রীয় বিষয় যেহেতু স্রষ্টা, গোটা বইতে তাই সামঞ্জস্য রাখার স্বার্থে গড এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসাবে ঈশ্বর শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
মূলগ্রন্থে না থাকলেও মহানবী মুহাম্মদ-এর নামের পর (স) ব্যবহার করা হয়েছে; এরপরও পাঠকদের কাছে অনুরোধ, অন্যান্য পয়গম্বর ও তাঁদের সহচরদের নামের শেষে যথাযথভাবে তাঁরা যেন (আ), (রা), ইত্যাদি পাঠ করেন।
যে কোনও অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটির জন্যে পরম করুণাময়ের ক্ষমা প্রার্থনা করি। আশা করি গ্রন্থটি বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সবার উপকারে আসবে এবং সেটা হলেই আমি আমার পরিশ্রম স্বার্থক হয়েছে বলে মনে করব।
শওকত হোসেন
মালিবাগ, ঢাকা।
e-mail: [email protected]
.
সূচনা
ছোটবেলায় বেশ কিছু ধর্মীয় বিষয়ে জোরাল বিশ্বাস ছিল আমার, কিন্তু ঈশ্বরে তেমন একটা আস্থাশীল ছিলাম না। নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে বিশ্বাসের সঙ্গে সেগুলোর ওপর নির্ভর করার আস্থাশীলতার পার্থক্য আছে। আমি অন্তরে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতাম, এ ছাড়া ইউক্যারিস্টে ঈশ্বরের প্রকৃত উপস্থিতি, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের নিরাময় প্রদানের ক্ষমতা, শাস্তিভোগের আশঙ্কা ও প্রায়শ্চিত্তের (Purgatory) বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতায়ও বিশ্বাস ছিল। অবশ্য এ কথা বলতে পারব না যে পরম সত্তা সম্পর্কিত এইসব ধর্মীয় মতামতে বিশ্বাসের ফলে পৃথিবীতে জীবন চমৎকার বা সুবিধাজনক বলে আমার মনে আস্থা জন্মেছিল। আমার ছোটবেলার রোমান ক্যাথলিসিজম বরং ভীতিকর এক বিশ্বাস ছিল। পোর্ট্রেট অভ দ্য আর্টিস্ট অ্যাজ আ ইয়ং ম্যান-এ জেমস জয়েস অত্যন্ত সঠিকভাবে বিষয়টি তুলে ধরেছেন। নরকের অগ্নিকুণ্ডের বিবরণ শুনেছি আমি। আসলে নরক যেন আমার কাছে ঈশ্বরের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তব মনে হয়েছে, কারণ তা ছিল এমন কিছু কল্পনায় আমি যাকে বুঝতে পারতাম। অন্যদিকে ঈশ্বর যেন অস্পষ্ট ধোঁয়াটে কোনও সত্তা ছিলেন, বর্ণনায় নয় বুদ্ধিবৃত্তিক বিমূর্ততায় তার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আমার বয়স যখন আট বছর, ‘ঈশ্বর কি?’ প্রশ্নের নিচ্ছিদ্র জবাব মুখস্থ করতে হয়েছিল আমাকে: ‘ঈশ্বর হচ্ছেন পরম আত্মা, যার কোনও অংশীদার নেই এবং যিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ।’ এটা মোটেই বিস্ময়কর নয় যে, এ জবাব আমার কাছে খুব একটা অর্থপূর্ণ মনে হয়নি। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এ জবাব এখনও আমাকে শীতল করে দেয়। একে সবসময়ই এককভাবে বিরস, অতিরঞ্জিত এবং উদ্ধত সংজ্ঞা মনে হয়েছে। অবশ্য এই বইটি লেখা শুরু করার পর থেকে জবাবটিকে সঠিক নয় বলেও বিশ্বাস করতে শুরু করেছি।
বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমি বুঝতে পারি যে, ধর্মে আতঙ্কের চেয়েও বেশি কিছুর অস্তিত্ব রয়েছে। আমি সাধুসন্ত, ভাববাদী কবিদের জীবনী, টি.এস. এলিয়ট ও অতিন্দ্রীয়বাদীদের মোটামুটি সরল রচনা পাঠ করেছি। শাস্ত্রের সৌন্দর্যে আলোড়িত হতে শুরু করেছিলাম বটে, যদিও ঈশ্বর দূরেই রয়ে গেছেন। আমার মনে হয়েছিল তার কাছে পৌঁছানো সম্ভব এবং তাঁর দর্শন সমগ্র সৃষ্ট বাস্তবতাকে হুঁপিয়ে যাবে। সে জন্যেই আমি ধর্মীয় সংগঠনে যোগ দিই, তরুণ শিক্ষানবীশ নান হিসাবে ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে ভ্রারও অনেক কিছু জানতে পারি। অ্যাপোলোজেটিক্স, ঐশী গ্রন্থ, ধর্ম তত্ত্ব ও গির্জার ইতিহাসে নিজেকে নিয়োজিত করি। মঠের জীবনাচারের ইতিহাস খুঁড়ে বেড়াই ও আমার নিজস্ব বৃত্তির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করি, যা আমাদের সম্পূর্ণ কণ্ঠস্থ করতে হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয়, এগুলোর কোনওটাতেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভূত হয়নি। সব গুরুত্ব যেন গৌণ বিষয়ের ওপর আরোপ করা হয়েছে, ধর্মের বিভিন্ন প্রান্তিক বিষয়াদি মনোযোগ পেয়েছে বেশি। আমি প্রার্থনায় মনোনিবেশ করেছি, ঈশ্বরের মুখোমুখি হতে মনের ওপর জোর খাঁটিয়েছি, কিন্তু তিনি আমার নিয়মনীতি ভঙ্গের দর্শক হিসাবে কঠোর প্রভুই রয়ে গেছেন কিংবা বিস্ময়করভাবে অনুপস্থিত থেকেছেন। আমি যতই সাধু সন্ন্যাসীদের পরমানন্দ (rapture) সম্পর্কে জানতে পেরেছি ততই ব্যর্থতার অনুভূতি জেগেছে আমার মনে। বিষাদের সঙ্গে আবিষ্কার করেছি, আমায় সামান্য ধর্মীয় অভিজ্ঞতা কোনওভাবে আমার আপন অনুভূতি ও কল্পনার ওপর চাপ প্রয়োগের ফলে আমারই নিজস্ব মস্তিষ্কসঞ্জাত। কখনও কখনও ভক্তির অনুভূতিটুকু ছিল গ্রেগোরিয়ান চ্যান্ট বা শাস্ত্রের সৌন্দর্য্যের প্রতি সহজাত সাড়া, কিন্ত আমার সত্তার অতীত কোনও সূত্র থেকে আমার মাঝে কোনও কিছু আসলে ঘটেনি। পয়গম্বর বা অতিন্দ্রীয়বাদীদের বর্ণনার ঈশ্বরের দেখা কখনও পাইনি আমি। জেসাস ক্রাইস্টকে, যার কথা ঈশ্বরের চেয়ে বেশি আলোচনা করে থাকি আমরা, একেবারেই ঐতিহাসিক চরিত্র মনে হয়েছে, প্রাচীন ইতিহাসে যিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। আমার মনে চার্চের কোনও কোনও মতবাদের ব্যাপারেও গভীর সন্দেহ জাগতে শুরু করে। মানুষ জেসাস যে ঈশ্বরের অবতার এটা নিশ্চিত করে বলতে পারে কে, আর এমন একটা বিশ্বাসের অর্থই বা কী? নিউ টেস্টামেন্ট কি আসলেই ব্যাপক ও দারুণভাবে পরস্পরবিরোধী ট্রেনিটি মতবাদ শিক্ষা দিয়েছে, নাকি ধর্মের অপরাপর বিভিন্ন বিষয়ের মতো এটাও জেরুজালেমে ক্রাইটের মৃত্যুর শত শত বছর পর ধর্মতাত্ত্বিকদের কল্পনাপ্রসূত বিষয়।
এরপর দুঃখের সঙ্গে ধর্মীয় জীবন ত্যাগ করি আমি; ব্যর্থতা ও অপূর্ণতার ভার হতে মুক্ত হবার পর ঈশ্বরে আমার বিশ্বাসও নীরবে বিদায় নিয়েছে বলে মনে হয়েছে। আমার জীবনে কখনও জোরাল প্রভাব রাখতে পারেননি তিনি, যদিও তাকে দিয়ে সেটা করানোর যথাসাধ্য প্রয়াস ছিল আমার। এখন তাঁর ব্যাপারে আর নিজেকে অপরাধী বা উদ্বিগ্ন মনে না হওয়ায়, এতই দূরে সরে গেলেন যে অস্তিত্ব নেইই বলা চলে। অবশ্য ধর্মীয় ব্যাপারে আমার আগ্রহ বা কৌতূহল অব্যাহত রয়ে গেছে। ক্রিশ্চানিটির গোড়ার দিকের ইতিহাস ও ধর্মীয় অভিজ্ঞতার প্রকৃতির ওপর বেশ কয়েকটা টেলিভিশন অনুষ্ঠান করেছি আমি। ধর্মীয় ইতিহাস সম্পর্কে যতই জেনেছি ততই আমার পুরোনো কিছু সন্দেহ যৌক্তিক প্রতীয়মান হতে শুরু করেছে। ছোটবেলায় বিনা প্রশ্নে যেসব মতবাদ মেনে নিয়েছিলাম সেগুলো আসলেই দীর্ঘ সময় জুড়ে মানুষেরই গড়ে তোলা। বিজ্ঞান যেন স্রষ্টা ঈশ্বরকে বাতিল করে দিয়েছে; বাইবেলিয় পণ্ডিতগণ প্রমাণ করেছেন জেসাস কখনও নিজেকে স্বর্গীয় সত্তা দাবি করেননি। একজন এপিলেপটিক হিসাবে মামার কিছু কিছু দৃষ্টিবিভ্রমের অভিজ্ঞতা ছিল সেগুলো স্রেফ স্নায়ুবিক দুর্বলতার ফল বলে জানতাম আমি: তবে কি সাধু-সন্ন্যাসীদের দিব্যদৃষ্টি ও পরমানন্দের অনুভূতিও কেবল তাদের মানসিক আলোড়নের প্রকাশ? ঈশ্বর যেন ক্রমবর্ধমান হারে স্থানচ্যুত হয়ে গেছেন বলে মনে হয়েছে, মানবজাতি যাকে অতিক্রম করে এসেছে।
নান হিসাবে আমার দীর্ঘ কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও ঈশ্বর সম্পর্কে নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে অস্বাভাবিক মনে করি না। ঈশ্বর সম্পর্কে আমার ধারণাগুলো গড়ে উঠেছিল ছোটবেলায়, অন্যান্য বিষয়ে আমার ক্রমবর্ধমান জ্ঞানের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি। আমি ফাদার ক্রিসমাসের ছোটবেলার সহজ ধারণাকে পরিমার্জনা করেছি, মানুষের দ্বিধা সংশয় সম্পর্কে আরও পরিপূর্ণ উপলব্ধি অর্জন করতে পেরেছি। কিন্ডারগার্টেনে যেটা সম্ভব ছিল না। তা সত্ত্বেও ঈশ্বর সম্পর্কে আমার পুরোনো ভ্রান্ত ধারণা পরিবর্তিত বা বিকশিত হতে পারেনি। আমার মতো বিচিত্র ধর্মীয় পটভূমি নেই যাদের তারাও হয়তো আবিষ্কার করবেন যে, ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের ধারণা ছোটবেলায় গড়ে ওঠা। সেদিনগুলোর পরে আমরা ছোটবেলার সবকিছু ফেলে এসেছি ও আমাদের শিশু বয়সের স্রষ্টাকেও বাদ দিয়েছি।
কিন্তু তারপর ধর্মের ইতিহাস নিয়ে আমার গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে, মানুষ আসলে আধ্যাত্মিক প্রাণী। প্রকৃতপক্ষেই হোমো সেপিয়েরা আসলে হোমো রিলিজিয়াস বলে তর্ক করার যথেষ্ট অবকাশও রয়েছে। নারী ও পুরুষ মোটামুটিভাবে মানুষ হয়ে ওঠার পর পরই দেব-দেবীর উপাসনা শুরু করেছিল; শিল্পকলার মতোই একই সময়ে তারা ধর্মকে সৃষ্টি করেছে। এটা যে কেবল ক্ষমতাশালী শক্তিকে প্রসন্ন করার জন্য ছিল তা নয়; এইসব আদি বিশ্বাস এই সুন্দর অথচ ভীতি জাগানো জগৎ নিয়ে মানুষের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। শরীর যে দুঃখ কষ্টের তা সত্ত্বেও জীবনের একটা অর্থ অনুসন্ধানে শিল্পের মতো ধর্মও একটি প্রয়াস। অন্য যে কোনও মানবীয় কর্মকাণ্ডের মতো ধর্মকেও অপব্যবহার করা যায়, আর আমরা যেন সেটাই সব সময় করে এসেছি। কুচক্রী রাজরাজরা ও পুরোহিতগণ আদিম সেকুলার স্বভাবের ওপর এটা চাপিয়ে দেননি, বরং এটা মানুষেরই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের বর্তমান সেকুলারিজম একেবারেই নতুন এক নিরীক্ষা, মানব ইতিহাসে যার নজীর নেই। এর পরিণতি দেখার জন্যে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। এ কথা সত্য যে, আমাদের পশ্চিমা উদার মানবতাবাদ শিল্পকলা বা কবিতার উপলব্ধির মতো আপনাআপনি আমাদের কাছে আসেনি, এর পরিচর্যা করতে হয়েছে। খোদ মানবতাবাদ ঈশ্বরবিহীন ধর্ম-সকল ধর্ম যে স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস রাখে তা অবশ্য নয়। আমাদের নৈতিক সেকুলার আদর্শের মনকে পরিচালিত করার নিজস্ব নিয়ম-কানুন রয়েছে যা মানুষকে মানব জীবনের পরম অর্থ সন্ধানে সাহায্য করে। এক সময় যা প্রথাগত ধর্মগুলোর কাজ ছিল।
তিনটি পরস্পর সম্পর্কিত একেশ্বরবাদী ধর্ম ইহুদিবাদ, খৃস্টধর্ম ও ইসলামে ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণা এবং অভিজ্ঞতার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা শুরু করার সময় আমি ভেবেছিলাম ঈশ্বরকে কেবল মানুষের প্রয়োজন ও ইচ্ছার সাধারণ এক প্রকাশ হিসাবে আবিষ্কার করব। আমার ধারণা ছিল যে তিনি সমাজ বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে এর আতঙ্ক ও আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেছেন। আমার অনুমান একেবারে অমূলক প্রতীয়মান হয়নি, তবে আমার কিছু কিছু আবিষ্কারে দারুণ বিস্মিত হয়েছি। আমার মনে হয়েছে তিরিশ বছর আগে যখন ধর্মীয় জীবন শুরু করতে যাচ্ছিলাম তখন এসব জানতে পারলে তিনটি একেশ্বরবাদী বিশ্বাসের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মুখে মহাশূন্য থেকে ঈশ্বরের অবতরণের অপেক্ষায় না থেকে নিজের জন্যে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে একটা ধারণা সৃষ্টি করে নেওয়া উচিত–একথা শোনার তীব্র উদ্বেগ থেকে রক্ষা পেতাম। অন্যান্য রাবাই, যাজক ও সুফীগণ আমাকে ঈশ্বরকে কোনও অর্থে ‘মহাশূন্যের বাস্তবতা’ মনে করার জন্যে তিরস্কার করতেন। আমাকে যৌক্তিক চিন্তার সাধারণ প্রক্রিয়ায় আবিষ্কৃত হওয়ার মতো বাস্তব বিষয় হিসাবে তার অভিজ্ঞতা লাভের প্রত্যাশা না করতে সতর্ক করে দিতেন তাঁরা। আমাকে বলতেন, এক গুরুত্বপূর্ণ অর্থে ঈশ্বর সৃজনশীল কল্পনার সৃষ্টি, আমার কাছে অনুপ্রেরণাদায়ী মনে হওয়া কবিতা ও সঙ্গীতের মতো। অত্যন্ত সম্মানিত কিছু একেশ্বরবাদী হয়তো শান্ত ও দৃঢ় কণ্ঠে আমাকে বলতেন, প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই-এবং তারপরেও ‘তিনি’ এই বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা।
এই বইটি সময় ও পরিবর্তনের অতীত স্বয়ং ঈশ্বরের বর্ণনাতীত বাস্তবতার ইতিহাস হবে না, বরং আব্রাহামের কাল থেকে আজকের দিন পর্যন্ত নারী ও পুরুষ যেভাবে তাঁকে কল্পনা করেছে, এটা তারই ইতিহাস। ঈশ্বর সম্পর্কে মানুষের ধারণার একটি ইতিহাস আছে, কিন্তু কালের বিবর্তনের বিভিন্ন পর্যায়ে একে ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর কাছে তা বরাবরই পরিবর্তিত অর্থ বহন করেছে। কোনও এক প্রজন্মে এক দল মানুষের সৃষ্ট ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণা অন্য এক দল মানুষের কাছে অর্থহীন হয়ে দাঁড়াতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, ‘আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি’ কথাটার বাস্তব কোনও অর্থ নেই, কিন্তু যখন কোনও নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মুখে বিশেষ প্রেক্ষাপটে উচ্চারিত হয় তখনই অন্য যে কোনও বাক্য বা কথার মতো ঐ প্রেক্ষাপটে তা অর্থ প্রকাশ করে থাকে। ফলে ‘ঈশ্বর’ শব্দের মাঝে কোনও একক অন্তর্নিহিত অপরিবর্তনীয় ধারণা নেই, বরং শব্দটি ব্যাপক অর্থ বহন করে যেগুলো আবার পরস্পর বিরোধী এবং এমনকি একটা অপরটিকে বাতিলও করে। ঈশ্বরের ধারণায় এই পরিবর্তনশীলতা না থাকলে অন্যতম মহান মানবীয় ধারণা হবার জন্যে তা টিকে থাকত না। যখনই ঈশ্বর সম্পর্কিত একটি ধারণা অর্থ হারিয়েছে বা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, নীরবে সেটাকে বর্জন করে এক নতুন ধারণাকে সেখানে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। একজন মৌলবাদী একথা প্রত্যাখ্যান করবে, কেননা মৌলবাদ ইতিহাস। বিরোধী: এটা বিশ্বাস করে যে আব্রাহাম, মোজেস ও পরবর্তীকালের পয়গম্বরগণ আজকের দিনের মানুষের মতোই তাদের ঈশ্বরের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। কিন্তু আমাদের তিনটি ধর্মের দিকে তাকালে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে ঈশ্বরের কোনও বস্তুনিষ্ঠ ধারণা নেই, প্রত্যেক প্রজন্মকেই তার জন্যে কার্যকর ঈশ্বরের ইমেজ নির্মাণ করে নিতে হয়। নাস্তিক্যবাদের ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য। ‘আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’ কথাটা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত অর্থ প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন সময়ে ‘নাস্তিক’ হিসাবে আখ্যায়িত ব্যক্তিরা এলাকার বিশেষ একটি ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছে। আজকের নাস্তিকদের প্রত্যাখ্যাত ঈশ্বরই কি প্যাট্রিয়ার্কদের ঈশ্বর, পয়গম্বরদের ঈশ্বর, দার্শনিকদের ঈশ্বর, অতিন্দ্রীয়বাদীদের ঈশ্বর কিংবা অষ্টাদশ শতকের ডেইস্টদের ঈশ্বর? এইসব উপাস্যই ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমগণ কর্তৃক তাদের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বাইবেল এবং কোরানের ঈশ্বর হিসাবে উপাসিত হয়েছেন। আমরা দেখব, তারা একে অপরজন থেকে একেবারে আলাদা। নাস্তিক্যবাদ প্রায়শঃ পরিবর্তনশীল একটা অবস্থা ছিল: এভাবে ইহুদি, ক্রিস্টান ও মুসলিমরা তাদের সমসাময়িক পৌত্তলিক প্রতিপক্ষ কর্তৃক নাস্তিক আখ্যায়িত হয়েছে, কেননা তারা অলৌকিকত্ব ও পরম সত্তা সম্পর্ক এক বিপ্লবাত্মক ধারণা অবলম্বন করেছিল। আধুনিক নাস্তিক্যবাদ কি একইভাবে আমাদের সময়ের সমস্যাদির প্রেক্ষিতে অপর্যাপ্ত ঈশ্বরের প্রতি আনাস্থা?
অন্য জগতের কথা বললেও ধর্ম দারুণভাবে বাস্তবসম্মত। আমরা দেখব যে, ঈশ্বর সম্পর্কিত কোনও বিশেষ ধারণা যৌক্তিক বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণে মাথাযথ হওয়ার চেয়ে বরং এর কার্যকারিতাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এর কার্যকারিতা বাইত হলেই তা বদলে যাবে-কখনও কখনও যা তীব্রভাবে ভিন্নতর। আমাদের পূর্ববর্তী একেশ্বরবাদীরা এতে এতটুকু বিচলিত হয়নি, কেননা তারা স্পষ্ট করেই জানত যে, ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের ধারণা স্থির বা অপরিবর্তনীয় নয়, বরং সাময়িক। এগুলো ছিল পুরোপুরি মানুষের সৃষ্টি-অন্য কিছু হতে পারে না-বরং এগুলো যে বর্ণনাতীত সত্তাকে প্রতীকায়িত করে। তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কেউ কেউ এই অত্যাবশ্যকীয় পার্থক্যের ওপর। গুরুত্ব আরোপ করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত উদ্ধত পন্থার উদ্ভব ঘটিয়েছে। মধ্যযুগীয় জনৈক সাধু এতদূর পর্যন্ত বলেছেন যে, ভুলক্রমে এই পরম সত্তা ঈশ্বর বাইবেলে উল্লেখিতই হননি। সমগ্র ইতিহাস জুড়ে নারী-পুরুষ জাগতিক। বিশ্বের অতীত আত্মার একটা মাত্রা যেন প্রত্যক্ষ করেছে। প্রকৃতপক্ষে, এটা। মানব মনের এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য যে, তারা বোধের অতীত এই রকম একটা ধারণাকে ধারণ করতে পারে। আমরা একে যেভাবেই ব্যাখা করতে চাই না কেন মানুষের দুয়ের এই অভিজ্ঞতা জীবনেরই বাস্তবতা রয়ে গেছে। সবাই একে অলৌকিক বলে মেনে নেবে তা নয়। আমরা যেমন দেখব, বৌদ্ধরা তাদের দর্শন ও অন্তর্দৃষ্টি অতিপ্রাকৃত উৎস হতে গৃহীত বলে স্বীকার করে না; তারা একে মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক হিসাবে দেখে। অবশ্য প্রধান সকল ধর্ম স্বীকার করবে যে, এই দুর্জ্ঞেয়কে স্বাভাবিক ধারণাগত ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। একেশ্বরবাদীরা এই দুয়েকে ‘ঈশ্বর’ আখ্যা দিয়েছে, কিন্তু এর চারপাশে জরুরী কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, ইহুদিদের বেলায় ঈশ্বরের পবিত্র নাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ, মুসলিমরা অলৌকিককে দর্শনীয় প্রতিমায় উপস্থাপিত করতে পারবে না। এই বিধান মনে করিয়ে দেয়, যে সত্তাকে আমরা ‘ঈশ্বর’ আখ্যায়িত করি তা সকল মানবীয় অভিব্যক্তির অতীত।
এটা প্রচলিত ধারার ইতিহাস হবে না, যেহেতু ঈশ্বরের ধারণা কোনও বিশেষ কালে সৃষ্টি হয়ে একরৈখিকভাবে চূড়ান্ত রূপ লাভ করেনি। বৈজ্ঞানিক ধারণা ওভাবে অগ্রসর হয়, কিন্তু শিল্পকলা বা ধর্মের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে না। প্রেমের কবিতায় যেমন অল্প সংখ্যক থিম রয়েছে ঠিক সেরকমই মানুষ ঈশ্বর সম্পর্কে বারবার একই কথার পুনরাবৃত্তি করে এসেছে। প্রকৃতপক্ষে, আমরা ঈশ্বর সম্পর্কে ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিম বিশ্বাসে বিস্ময়কর মিল লক্ষ করব। যদিও ইহুদি ও মুসলিমরা ক্রিশ্চানদের ট্রিনিটি ও ইনকারনেশনের ধারণাকে প্রায় ব্লাসফেমাস বিবেচনা করে, কিন্তু এইসব বিতর্কিত ধর্মতত্ত্বের নিজস্ব ধরনও সৃষ্টি করেছে তারা। এইসব সর্বজনীন ধারণার প্রত্যেকটি একটি অপরটির চেয়ে সামান্য ভিন্নতার অধিকারী, যা ঈশ্বরের অভিব্যক্তি প্রকাশের ক্ষেত্রে মানুষের সৃজনশীলতা ও মেধার পরিচয় প্রকাশ করে।
বিষয়বস্তু যেহেতু ব্যাপক, আমি তাই ইচ্ছাকৃতভাবেই ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমদের উপাস্য একক ঈশ্বরে নিজেকে সীমিত রেখেছি, যদিও ক্ষেত্র বিশেষে পৌত্তলিক, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধারণাসমূহও আলোচনা করেছি যাতে পরম সত্তা সম্পর্কিত একেশ্বরবা যুক্তিসমূহ আরও স্পষ্ট করা যায়। বিভিন্ন ধর্মে একেবারে স্বাধীনভাবে গড়ে ওঠা ঈশ্বরের ধারণা আশ্চর্যরকমভাবে সমরূপ বলে মনে হয়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের উপসংহার যাই হোক না কেন, এই ধারণার ইতিবৃত্ত আমাদেরকে অবশাই মানুষের মনোজগত এবং আমাদের আকাক্সক্ষার প্রকৃতি সম্পর্কে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দেবে। অধিকাংশ পাশ্চাত্য সমাজের সেকুলার ধারা সত্ত্বেও ঈশ্বরের ধারণা আজও লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে চলেছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, শতকরা নিরানব্বই ভাগ আমেরিকান জানিয়েছে তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে: প্রশ্ন হচ্ছে অসংখ্য ঈশ্বরের মাঝে কোনজনের প্রভুত্ব স্বীকার করে তারা?
ধর্মতত্ত্ব প্রায়শঃই বিমূর্ত ও একঘেয়ে মনে হয়, কিন্তু ঈশ্বরের ইতিহাস আবেগময় এবং প্রবলভাবে টানে। পরম বা চরম সত্তার অন্যান্য ধারণার বিপরীতে মূলত যন্ত্রণাদায়ক সংগ্রাম ও চাপের মধ্য দিয়ে একে লালন করা হয়েছে। ইসরায়েলের পয়গম্বরগণ শরীরের অন্ধিসন্ধি মুচড়ে দেওয়া দৈহিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে তাঁদের ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছেন যা তাঁদের ক্রোধ ও আনন্দে পরিপূর্ণ করে দিয়েছে। যে সত্তাকে তারা ঈশ্বর হিসাবে আখ্যায়িত করে একেশ্বরবাদীরা এক চরম অবস্থায় তার অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকে। আমরা পর্বতচূড়া, অন্ধকার, নিঃসঙ্গতা, সিফিকশন ও ত্রাসের কথা পাঠ করব। ঈশ্বর সংক্রান্ত পাশ্চাত্য অভিজ্ঞতা যেন বিশেষভাবে পীড়াদায়ক। এই সহজাত যাতনার কারণ কী? অন্য একেশ্বরবাদীরা আলো ও আকৃতির পরিবর্তনের কথা বলেছে। যে সত্তার অভিজ্ঞতা তারা লাভ করে তার বিবরণ দিতে গিয়ে অর্থডক্স ধর্মতত্ত্বের সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া সাহসিকতাপূর্ণ কল্পনার আশ্রয় নেয়। সাম্প্রতিককালে মিথলজি নিয়ে নতুন করে আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। এক ধর্মীয় সত্যের অধিকতর অভিব্যক্তির এক ব্যাপক আকাক্ষার প্রকাশ হিসাবে দেখা যেতে পারে। প্রয়াত আমেরিকান পণ্ডিত জোসেফ ক্যাম্পবেলের রচনাবলী আজকাল দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মানুষের চিরকালীন মিথলজি নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনি, প্রথাগত সমাজে এখনও প্রচলিত কিংবদন্তীসমূহের সঙ্গে সেগুলোর যোগসূত্র আবিষ্কার করেছেন। প্রায়শঃ ধারণা করা হয় যে, তিনটি ঈশ্বর-ধর্ম বুঝি মিথলজি ও কাব্যিক প্রতীকধর্মীতা মুক্ত। কিন্তু একেশ্বরবাদীরা আদিতে তাদের পৌত্তলিক প্রতিবেশীদের মিথ প্রত্যাখ্যান করলেও পরবর্তীকালে সেগুলো আবার তাদের অজান্তেই তাদের মাঝে ফিরে এসেছে। যেমন, অতিন্দ্রীয়বাদীরা ঈশ্বরকে নারী রূপে প্রত্যক্ষ করেছে। অন্যরা শ্রদ্ধার সঙ্গে ঈশ্বরের লিঙ্গ সম্পর্কে আলোচনা করেছে এবং স্বর্গীয় সত্রায় নারীসুলভ উপাদান যোগ করেছে।
এটা আমাকে এক কঠিন পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। কারণ এই ঈশ্বরের শুরু হয়েছিল পুরুষ দেবতা হিসাবে, একেশ্বরবাদীরা সাধারণত তাকে ‘পুরুষবাচক সে’ হিসাবে উল্লেখ করে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নারীবাদীরা বোধগম্যভাবেই এর প্রতি আপত্তি উত্থাপন করেছে। আমি যেহেতু ঈশ্বরকে ‘পুরুষবাচক সে’ হিসাবে বিবেচনাকারী মানুষের চিন্তা, ভাবনা ও দর্শন নিয়ে আলোচনা করব, তাই যদিও এটা বলাই যথোপযুক্ত শব্দ হতো, তবু আমি প্রথাগত পুরুষবাচক সর্বনামই ব্যবহার করব। এটা উল্লেখ করা বোধ হয় সমীচিন হবে যে, বিশেষ করে ইংরেজিতে ঈশ্বরের আলোচনায় পুরুষবাচক সম্বোধন ব্যবহার কষ্টকর। অবশ্য হি, আরবী ও ফরাসি ভাষায় ব্যাকরণগত লিঙ্গ ধর্মীয় আলোচনায় লিঙ্গিয় পাল্টা যুক্তি ও ডায়ালেকটিক এর সুযোগ সৃষ্টি করে যা এক ধরনের ভারসাম্য যোগায়, ইংরেজিতে যার অভাব রয়েছে। এভাবে আরবী আল্লাই (ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ট নাম) ব্যাকরণগতভাবে পুরুষবাচক, কিন্তু ঈশ্বরের অলৌকিক এবং দুৰ্জ্জেয় সত্তাবোধক শব্দটি—’আল-ধাত’–নারীবাচক।
ঈশ্বর সম্পর্কিত সকল আলোচনা অসম্ভব সমস্যায় আবর্তিত। কিন্তু একেশ্বরবাদীরা ভাষার ব্যাপারে অত্যন্ত ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করার পাশাপাশি একই সময়ে দুর্জ্ঞেয় সত্তার প্রকাশে ভাষার ক্ষমতাহীনতাও মেনে নেয়। ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমদের ঈশ্বর এমন একজন যিনি-এক অর্থে-কথা বলেন। তিনটি ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রেই তাঁর বাণী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঈশ্বরের বাণী আমাদের সংস্কৃতির ইতিহাস নির্মাণ করেছে। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে বর্তমানে ‘ঈশ্বর’ শব্দটি আমাদের জন্যে কোনও অর্থ বহন করে কিনা।
টীকা: আমি যেহেতু ইহুদি, মুসলিম ও ক্রিশ্চানদের দৃষ্টিকোণ থেকে ঈশ্বরের ইতিহাস পর্যালোচনা করছি, সেহেতু পশ্চিমে সাধারণভাবে ব্যবহৃত ‘খৃস্টপূর্ব’ এবং ‘খৃস্টাব্দ’ শব্দবন্ধ দুটি যথার্থ নয়। সেজন্যে আমি বিকল্প-বিসিই (Before the Common Era) এবং সিই (Common Era)-এর আশ্রয় নিয়েছি।
০১. উদ্ভব…
আদিতে মানবজাতি এমন একজন ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছিল যিনি বস্তুনিচয়ের সৃষ্টির মূল কারণ এবং আকাশ ও পৃথিবীর শাসনকর্তা। কোনও প্রতিমা দিয়ে তাঁর উপস্থাপন ঘটেনি বা উপাসনা করার জন্যে তাঁর কোনও মন্দির কিংবা পুরোহিতও ছিল না। মানুষের সংস্কারের প্রেক্ষিতে তিনি ছিলেন অনেক উঁচু স্থানের অধিকারী। আস্তে আস্তে তার জাতির চেতনা থেকে হারিয়ে যান তিনি। তিনি এতটাই দূরবর্তী হয়ে পড়েছিলেন যে, লোকে আর তাঁকে আকাক্ষা করতে চাইল না। পরিণামে, বলা হয়ে থাকে, অদৃশ্য হয়ে যান তিনি।
এটা অন্তত একটা মতবাদ, ১৯১২ সালে প্রকাশিত দ্য অরিজিন অভ দ্য আইডিয়া অভ গড গ্রন্থের মাধ্যমে ফাদার উইলহেম স্মিডট একে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। স্মিডট মত প্রকাশ করেছেন যে, বহু সংখ্যক দেব-দেবীর উপাসনা শুরু করার আগে নারী-পুরুষ এক আদিম একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিল। মূলত তারা একজন পরম উপাস্যের (Supreme Deity) অস্তিত্ব স্বীকার করত, যিনি জগৎ সৃষ্টি করেছেন এবং সুদূরে অবস্থান করে মানুষের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকেন। এরকম পরম ঈশ্বরে (High God) (অনেক সময় স্কাই গড’ আখ্যায়িত করা হয়, যেহেতু তিনি স্বর্গের সঙ্গে সম্পর্কিত) বিশ্বাস এখনও আফ্রিকার বহু আদি গোত্রের ধর্মীয় জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য রয়ে গেছে। তারা প্রার্থনার মাধ্যমে ঈশ্বরের নৈকট্য অন্বেষণ করে; বিশ্বাস করে যে তিনি তাদের ওপর নজর রাখছেন এবং পাপের শাস্তি দেবেন। কিন্তু বিস্ময়করভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনে তিনি অনুপস্থিত: তাঁর কোনও বিশেষ কাল্ট নেই এবং কোনও প্রতিমার মাধ্যমেও উপস্থাপিত হননি। গোত্রের সদস্যরা বলে থাকে যে, তিনি প্রকাশের অতীত, মানুষের এই জগৎ দিয়ে তাঁকে কলঙ্কিত করা যায় না। কেউ কেউ বলে থাকে তিনি ‘চলে গেছেন।’ নৃতাত্ত্বিকগণ মত প্রকাশ করেছেন যে, এই ঈশ্বর দূরবর্তী ও মহিমান্বিত হয়ে ওঠায় কার্যতঃ তিনি নিম্নতর আত্মা ও অধিকতর বোধগম্য দেবতা দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছেন। স্মিডটের মতবাদও একই কথা বলছে। প্রাচীনকালে পরম ঈশ্বর পৌত্তলিকদের দেবনিচয়ের অধিকতর আকর্ষণীয় দেবতা দিয়ে। প্রতিস্থাপিত হয়েছেন। সুতরাং, আদিতে ঈশ্বর একজনই ছিলেন। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে জীবনের রহস্য ও যন্ত্রণা ব্যাখ্যা করার জন্যে মানব সৃষ্ট প্রাচীন ধারণাসমূহের মধ্যে একেশ্বরবাদ ছিল অন্যতম। এখানে এমন একজন। আরাধ্য বা উপাস্য কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন তারও একটা আভাস মেলে ।
এ ধারণার সত্য-মিথ্যা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে বহু তত্ত্ব রয়েছে। তবে মনে হয় দেবতার সৃষ্টি এমন একটা ব্যাপার মানবজাতি যা সব সময় করে এসেছে। যখন কোনও একটা ধর্মীয় আদর্শ তাদের জন্যে অকার্যকর হয়ে পড়ে, স্রেফ তার স্থানে অন্য এক ধারণা বসিয়ে দেওয়া হয়। এসব ধারণা স্কাই গডের মতো কোনওরকম হট্টগোল ছাড়াই হারিয়ে যায়। আমাদের বর্তমান কালেও অনেকে বলবেন ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমদের উপাস্য ঈশ্বরও স্কাই গডের মতো দূরবর্তী হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ প্রকৃতই এমনও দাবি করেছেন যে, তিনি পরলোকগমন করেছেন। বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের মানুষের জীবন যাপনের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান হারে তার অপসারণ ঘটছে। তাঁরা আমাদের চেতনায় ঈশ্বর আকৃতির গহ্বরের কথা বলেন, যেখানে তার অবস্থান ছিল; কারণ কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও আমাদের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি এবং মানুষের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মতবাদসমূহের তিনি অন্যতম। আমরা কী হারাতে বসেছি বোঝার জন্যে-মানে, যদি সত্যি তিনি অপসৃয়মান হয়ে থাকেন-আমাদের দেখতে হবে এই ঈশ্বরের উপাসনা শুরু করার সময় মানুষ কী করছিল। কী তার অর্থ ছিল এবং কীভাবে তার উৎপত্তি ঘটেছিল। এ জন্যে আমাদের ফিরে যেতে হবে মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন কালে, যেখানে ১৪,০০০ বছর আগে আমাদের ঈশ্বরের ধারণা ধীরে ধীরে আবির্ভূত হয়েছিল।
আজকের দিনে ধর্মকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হওয়ার অন্যতম কারণ আমাদের অনেকেই এখন আর অদৃশ্য বিষয়াদি দিয়ে পরিবেষ্টিত থাকার অনুভূতি লালন করি না। আমাদের বিজ্ঞান ভিত্তিক সংস্কৃতি আমাদেরকে চোখের সামনের ভৌত ও বস্তুজগতের দিকে মনোযোগ দিতে শেখায়। জগৎ দেখার এই পদ্ধতি ব্যাপক ফল অর্জন করেছে। অবশ্য এর একটা পরিণাম হচ্ছে আমরা আমাদের ‘আধ্যাত্মিক’ বা ‘পবিত্র’ অনুভূতি হেঁটে ফেলেছি যা অধিকতর প্রথাগত সমাজে মানুষের জীবনের প্রত্যেকটা স্তরে প্রভাব বিস্তার করে থাকে, এক কালে যা মানুষের জগতকে বোঝার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল। সাউথ-সীর দ্বীপমালার অধিবাসীরা এই রহস্যময় শক্তিকে মানা (mana) আখ্যায়িত করে, অন্যরা একে এক ধরনের উপস্থিতি বা সত্তা হিসাবে অনুভব করে-কখনও কখনও এটা তেজস্ক্রিয়তা বা বিদ্যুৎ প্রবাহের মতো এক ধরনের নৈর্ব্যক্তিক ক্ষমতা হিসাবে অনুভূত হয়। গোত্রীয় প্রধান, গাছপালা, পাথর ও জীব জানোয়ারে এর আবাস বলে বিশ্বাস করা হতো। লাতিনরা পবিত্র মনে নুমিনা আত্মার অনুভূতি লাভ করে। আরবরা মনে করত গোটা পরিবেশ জিন-এ পরিপূর্ণ। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ এই বাস্তবতার সংস্পর্শে আসতে চেয়েছে, এগুলোকে কাজে লাগাতে চেয়েছে, কিন্তু আবার একে স্রেফ শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছে তারা। অদৃশ্য শক্তিসমূহকে যখন তারা ব্যক্তি সত্তায় পরিণত করে তাদের বাতাস, সূর্য, সাগর ও তারার সঙ্গে সম্পর্কিত কিন্তু মানবীয় চরিত্রের অধিকারী দেবতা বিবেচনা করতে শুরু করে, তখন তারা অদৃশ্যের সঙ্গে নিজেদের ও চারপাশের জগতের একাত্মতার সাধনাই প্রকাশ করেছিল।
ধর্মের ইতিহাসবিদ জার্মান রুডলফ অটো ১৯১৭ সালে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ দ্য আইডিয়া অভ দ্য হোলি প্রকাশ করেন। তাঁর বিশ্বাস নুমিনাসের এই অনুভূতিই ধর্মের মৌল বিষয়। এটা পৃথিবীর উৎপত্তি বা নৈতিক আচরণের একটা ভিত্তি খোঁজার ইচ্ছার অগ্রবর্তী। বিভিন্নভাবে মানুষ মুমিনাস শক্তি অনুভব করেছে-কখনও এটা বুনো ঘোর লাগা উত্তেজনা সৃষ্টি করে, কখনও এনে দিয়েছে গভীর প্রশান্তি; কখনও কখনও মানুষ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সহজাত রহস্যময় শক্তির উপস্থিতিতে ভয়, বিস্ময় ও তুচ্ছতার অনুভূতি লাভ করেছে। মানুষ যখন তার মিথসমূহ সৃষ্টি ও দেবতাদের উপাসনা শুরু করে তখন প্রাকৃতিক ঘটনাপ্রবাহের নিখুঁত ব্যাখ্যা আকাঙ্ক্ষা করেনি। রূপায়িত কাহিনী, গুহাচিত্র ও খোদাইচিত্রগুলো ছিল তাদের বিস্ময় ও ভাবনা প্রকাশের প্রয়াসের পাশাপাশি এই ভিন্নতর রহস্যময় শক্তিকে নিজেদের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত করার প্রয়াস। প্রকৃতপক্ষেই বর্তমানকালের কবি, শিল্পী ও সঙ্গীত শিল্পীরাও একই রকম আকাক্ষায় তাড়িত হন। উদাহরণ স্বরূপ, প্যালিওলিথিক যুগে কৃষি কাজের বিকাশ ঘটার সময় মাদার গডেসের উপর বিশ্বাস এই অনুভূতির প্রকাশ করেছে যে, মানুষের জীবনকে বদলে দেওয়া উর্বরতার পবিত্র মূল্য রয়েছে। শিল্পীরা তাঁকে নগ্ন অন্তঃসত্ত্বা নারী হিসাবে এঁকেছেন। সমগ্র ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতে নৃতাত্ত্বিকগণ এর আবিষ্কার করেছেন। বহু শত বছর মহান মাতা (Great Mother) কল্পনাযোগ্যভাবেই গুরুত্বপূর্ণ রয়ে গেছেন। প্রাচীন স্কাই গডের মতো পরবর্তীকালে দেবীদের মধ্যে হারিয়ে যান তিনি, অপরাপর উপাস্যের পাশে স্থান করে নেন। অত্যন্ত শক্তিশালী দেবী ছিলেন তিনি, স্কাই গডের চেয়ে শক্তিশালী তো বটেই–যিনি অস্পষ্ট সত্তা রয়ে গিয়েছিলেন। প্রাচীন সুমেরিয়ায় ইনানা, বাবিলনে ইশতার এবং কানানে আনাত নামে ডাকা হতো তাঁকে; মিশরে আইসিস আর গ্রিসে আফ্রোদাইত। এইসব সংস্কৃতিতে মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনে তার ভূমিকা বর্ণনা করার জন্যে আশ্চর্যজনকভাবে একই ধরনের গল্প-গাথা সৃষ্টি হয়েছিল । এইসব মিথ আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করার কোনও পরিকল্পনা ছিল না, বরং অন্য যে কোনওভাবে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে জটিল ও দূরবর্তী এক সত্তাকে বর্ণনার রূপকাশ্রিত প্রয়াস ছিল এগুলো । এই নাটকীয় ও স্মৃতি জাগানিয়া। দেব-দেবীর গল্পগুলো মানুষকে তার চারপাশের অদৃশ্য অথচ ক্ষমতাবান শক্তিসমূহকে অনুভব করার ক্ষমতাকে সংগঠিত করায় সাহায্য করেছে।
প্রকৃতপক্ষেই এমন মনে হয় যে, কেবল এই ঐশ্বরিক জীবনে অংশ নেওয়ার মাধ্যমেই তারা সত্যিকার অর্থে মানুষ হয়ে উঠতে পারে বলে প্রাচীনকালের মানুষের বিশ্বাস ছিল। পার্থিব জীবন আবশ্যকীয়ভাবে ভঙ্গুর এবং মৃত্যু দ্বারা আবৃত, কিন্তু নারী-পুরুষ দেবতার কর্মকাণ্ড অনুকরণ করলে তারা। তাদের উন্নত ক্ষমতা ও কার্যকারিতার অংশীদার হতে পারবে। এইভাবে, বলা হয়ে থাকে যে, দেবতারাই মানুষকে তাদের শহর ও মন্দির নির্মাণের কায়দা শিখিয়ে দিয়েছেন–যেগুলো স্বর্গে তাঁদের নিজস্ব আবাসের অনুকরণ মাত্র। দেবতাদের পবিত্র জগৎ-মিথসমূহে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে-কেবল মানুষের অনুসরণীয় আদর্শ নয়, বরং এটা মানুষের অস্তিত্বের প্রটোটাইপ। এটাই আদি নকশা বা আর্কিওটাইপ যার ভিত্তিতে মর্তে আমাদের জীবন গড়ে তোলা হয়েছে। এভাবে পৃথিবীর প্রত্যেকটা জিনিস স্বর্গের কোনও কিছুর অনুরূপ বলে বিশ্বাস করা হতো, অধিকাংশ প্রাচীন সংস্কৃতির আচরিক ও সামাজিক সংগঠন এবং আমাদের কালের অধিকতর প্রথাগত সমাজকে প্রভাবিত করে আসছে এই ধারণা।[১] উদাহরণ স্বরূপ, প্রাচীন ইরানে ইহ জগতের (গেতিক) প্রত্যেক ব্যক্তি বা বস্তুর আবার আর্কিওটাইপাল পবিত্র জগতে (মেনক) একটা করে প্রতিরূপ রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হতো। আধুনিক দুনিয়ায় আমাদের পক্ষে এমন একটা ধারণা মেনে নেওয়া কঠিন, কারণ আমরা স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতাকে মহান মানবীয় মূল্যবোধ হিসাবে দেখে থাকি। তবু বিখ্যাত উক্তি Post coitum omne animal tristis est এখনও একটি সাধারণ অনুভূতির প্রকাশ করে: এক আন্তরিক ও প্রবলভাবে প্রত্যাশিত মুহূর্তের পর আমরা প্রায়শঃই অনুভব করি আর কিছু বুঝি আমাদের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে, ধরতে পারিনি। কোনও দেবতার অনুকরণ এখনও গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় বোধ রয়ে গেছে: সাবাথের দিন বিশ্রাম গ্রহণ কিংবা মনডি বৃহস্পতিবারে কারও পা ধোয়া-খোদ কর্মকাণ্ডসমূহ অর্থহীন-এখনও তাৎপর্যপূর্ণ ও পবিত্র, কারণ মানুষ বিশ্বাস করে একদিন ঈশ্বর একাজগুলো করেছিলেন।
একই ধরনের আধ্যাত্মিকতা মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন সভ্যতার বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল। বর্তমান ইরাকের অন্তর্গত তাইগ্রিস-ইউফ্রেতিস উপত্যকায় প্রায় ৪,০০০ বিসিই কালে সুমেরিয় নামে পরিচিত এক জাতি বাস করত, যারা ওইকুমিনের (সভ্যজগত) অন্যতম আদি মহান সংস্কৃতির গোড়াপত্তন করেছিল। তাদের উর, ইরেচ ও কিশ নগরীসমূহে সুমেনিররা নিজস্ব কুনিফর্ম লিপি আবিষ্কার করে, যিগুরাত আখ্যায়িত অনন্য সাধারণ মন্দির-টাওয়ার নির্মাণ করে, গড়ে তোলে অসাধারণ আইন, সাহিত্য ও মিথলজি। অল্প দিনের ব্যবধানেই এখানে হামলা চালিয়েছিল সেমেটিক আক্কাদিয়রা, সুমেরদের ভাষা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিল তারা। আরও পরে, ২,০০০ বিসিইর দিকে অ্যামোরাইটরা সুমেরিয় আক্কাদিয় সভ্যতা দখল করে নেয় ও বাবিলনকে তাদের রাজধানীতে পরিণত করে। অবশেষে আনুমানিক ৫০০ বছর পরে, অসিরিয়রা নিকটবর্তী আশুরে বসতি স্থাপন করে ও শেষপর্যন্ত বিসিই অষ্টম শতকে বাবিলন দখল করে নেয়। বাবিলনের এই ঐতিহ্য কানানের ধর্ম ও মিথলজিকেও প্রভাবিত করে, যা পরে প্রাচীন ইসরায়েলিদের প্রতিশ্রুত ভূমিতে পরিণত হয়। প্রাচীন বিশ্বের অন্যান্য জাতির মতো বাবিলনবাসীরাও তাদের সাংস্কৃতিক অর্জনকে দেবতাদের অবদান হিসাবে আখ্যায়িত করেছে, তারা তাদের পৌরাণিক পূর্বসূরিদের কাছে নিজেদের জীবনধারা উম্মোচিত করেছিলেন। এভাবে বাবিলনকেই স্বর্গের একটা প্রতিরূপ হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে, এর মন্দির স্বর্গীয় কোনও প্রাসাদের প্রতিরূপ। স্বর্গীয় জগতের সঙ্গে এই সম্পর্ক বা যোগাযোগ বার্ষিক ভিত্তিতে মহান নববর্ষের উৎসবে পালন ও চিরকালীন রূপ পেত। বিসিই সপ্তম শতকে এটা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাবিলনে নিসান–আমাদের এপ্রিল মাসে পালিত এই উৎসবে ভাবগম্ভীর পরিবেশে রাজার মাথায় পরবর্তী এক বছরের জন্যে শাসনভার তুলে দিয়ে মুকুট পরানো হতো। কিন্ত এই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অধিকতর স্থায়ী ও কার্যকর দেবতাদের শাসন মেনে নিতে পারলেই টেকা সম্ভব ছিল, যারা জগৎ সৃষ্টির সময় আদি বিশৃঙ্খলার ভেতর শৃঙ্খলা এনেছিলেন। উৎসবের এগারটি পবিত্র দিন এভাবে আচরিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাধারণ অপবিত্র কালের অংশ। গ্রহণকারীদের দেবতাদের পবিত্র ও অনন্তকালে নিক্ষেপ করত। পুরোনো, মুমূর্ষ বছরকে বাতিল করার জন্যে ছাগল বলী দেওয়া হতো; জনসম্মুখে রাজার অপমান ও তার জায়গায় উৎসবের রাজার সিংহাসন আরোহণ আদি বিশৃঙ্খর পুনরাবৃত্তি ঘটাত; ধ্বংসের শক্তির বিরুদ্ধে দেবতাদের লড়াইয়ের অনুকরণে নকল যুদ্ধের আয়োজন করা হতো।
এইসব প্রতীকী কর্মকাণ্ডের পবিত্র মূল্য ছিল; বাবিলনবাসীকে এগুলো পবিত্র শক্তি বা মানায় বিলীন হতে সক্ষম করে তুলত যার ওপর তাদের মহান সভ্যতা নির্ভরশীল ছিল। যেকোনও সময়ে বিশৃঙ্খলা ও বিভাজনের শক্তির শিকার পরিণত হওয়া সংস্কৃতিকে ভঙ্গুর অর্জন মনে করা হতো। উৎসবের চতুর্থ দিন অপরাহ্নে পুরোহিত ও কয়ারিস্টরা বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে দেবতাদের বিজয় তুলে ধরা মহাকাব্য এনুমা এলিশ আবৃত্তি করার জন্যে সার বেঁধে পবিত্র মন্দিরে। প্রবেশ করত। এ কাহিনী পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশের সত্য ভিত্তিক বিবরণী নয়, বরং এক গূঢ় রহস্য তুলে ধরার ও এর পবিত্র শক্তি উৎসারণের কোনও এক সুচিন্তিত প্রতীকী প্রয়াস। সৃষ্টির আক্ষরিক বর্ণনা দান ছিল অসম্ভব, কেননা । কল্পনাতীত ওই ঘটনাবলীর সময় কেউ উপস্থিত ছিল নাঃ মিথ ও প্রতীকসমূহই তাই এসব বর্ণনার উপযুক্ত উপায় বা মাধ্যম। এনুমা এলিশের প্রতি সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিপাত বহু শতাব্দী পরে আমাদের নিজস্ব স্রষ্টা ঈশ্বরের জন্মদানকারী আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে খানিকটা আভাস দেয়। যদিও সৃষ্টি সংক্রান্ত বাইবেলিয় ও কোরানের বিবরণ শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ আলাদা রূপ ধারণ করে, কিন্তু এই অদ্ভুত মিথগুলো কখনও সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়নি; বরং আরও পরে ঈশ্বরের ইতিহাসে একেশ্বরবাদী রূপকের আড়ালে আবার ফিরে এসেছে।
স্বয়ং দেবতাদের সৃষ্টির প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু হয়েছে কাহিনীর; এই থিম ইহুদি ও মুসলিয় অতিন্দ্রীয়বাদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে দেখব আমরা। আদিতে, এনুমা এলিশ বলছে, দেবতারা জোড়ায় জোড়ায় এক আকৃতিহীন জলীয় বিস্তার থেকে আবির্ভূত হন-খোদ এই জিনিসটি আবার স্বর্গীয়। বাবিলিনিয় মিথে-পরবর্তীকালে যেমন বাইবেলেও-শূন্য থেকে কোনও কিছু সৃষ্টি হয়নি; এই ধারণা প্রাচীন জগতে ছিল অপরিচিত। দেবতা বা মানুষের অস্তিত্বের আগে অনন্তকাল থেকে এই পবিত্র কাঁচামালের অস্তিত্ব ছিল। বাবিলনবাসীরা এই আদিম স্বর্গীয় বস্তু সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে একে মেসোপটেমিয়ার জলাভূমির মতো পতিত অঞ্চল ধরে নিয়েছিল, যেখানে বন্যা বারবার মানুষের ভঙ্গুর সৃষ্টিকে মুছে দেওয়ার হুমকি দিয়ে চলত। সুতরাং এনুমা এলিশ-এ সৃষ্টি-পূর্ব বিশৃঙ্খলা বা পিণ্ড কোনও ভয়ঙ্কর ফেনিয়ে ওঠা বস্তু নয়, বরং এক কাদাময় বিশৃঙ্খলা যেখানে সবকিছু সীমা, সংজ্ঞা এবং পরিচয়বিহীন:
মিষ্টি ও তেতো
যখন এক সঙ্গে মিশে গেল, রঞ্জিত হয়নি কোনও তৃণ, স্রোতে
কাদাময় হয়ে ওঠেনি জল;
দেবতাগণ ছিলেন নামহীন, স্বভাবহীন, ভবিষ্যতহীন। [২]
এরপর আদি পতিত ভূমি থেকে উত্থিত হলেন তিনজন দেবতা: আপসু (নদীর মিঠা পানির অনুরূপ), তাঁর স্ত্রী তিয়ামাত (লোনা সমুদ্র) ও মাম্মু, বিশৃঙ্খল জরায়ু। তারপরও সত্যি বলতে এই দেবতারা ছিলেন আদি ও নিম্ন শ্রেণীর মডেল যাদের উন্নতির প্রয়োজন ছিল। ‘আপসু’ ও ‘তিয়ামাত’ নামগুলো ‘গহ্বর’ (abyss) ‘শূন্যতা’ (Void) কিংবা ‘অতলান্ত সাগর’ (bottomless gulf) হিসাবে অনুবাদ করা যেতে পারে। এগুলো আদিম আকৃতিহীনতার আকারহীন জড়তার কথা বলে যেগুলো তখনও স্বতন্ত্র পরিচয় লাভ করে উঠতে পারেনি।
পরবর্তী পর্যায়ে উৎসারণ (emanation) নামে পরিচিত এক প্রক্রিয়ায় ওদের মধ্য হতে অন্যান্য দেবতার আবির্ভাব ঘটেছে যা আমাদের ঈশ্বরের ইতিহাসের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। একে অপর হতে জোড়ায় জোড়ায় আবির্ভূত হয়েছেন নতুন দেবতা। স্বর্গীয় বিবর্তন ক্রিয়াশীল থাকায় পূর্ববর্তী দেবতার চেয়ে নতুন দেবতারা অর্জন করেছিলেন উন্নততর পরিচয়। গোড়াতে এসেছেন লাহমু এবং লাহাম; এদের নামে অর্থ ‘পঙ্ক’ (silt): (জল আর মাটি এখনও এক সঙ্গে মেশানো)। এরপর এলেন আনশের ও কিশার, (আকাশের দিগন্ত ও সাগরের প্রতিরূপ)। তারপর অনু (আকাশমণ্ডলী) ও ইয়া এলেন; যেন শেষ হলো গোটা প্রক্রিয়া। স্বর্গীয় জগতের আকাশ, নদী ও মাটি ছিল প্রত্যেকটা অপরের চেয়ে আলাদা ও সুস্পষ্ট। কিন্তু সৃষ্টির সূচনা ঘটেছিল কেবল: কেবল যন্ত্রণাদায়ক ও অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়েই বিশৃঙ্খলা ও বিচ্ছিন্নতার শক্তিকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল। তরুণ ও গতিশীল দেবতারা তাদের পিতামাতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন, কিন্তু আপসু ও মামুকে পরাজিত করতে পারলেও তিয়ামাতের বিরুদ্ধে টিকতে পারলেন না ইয়া । তিয়ামাত তাঁর পক্ষে যুদ্ধ করার জন্যে বিপুল সংখ্যক কদাকার দানব সৃষ্টি করলেন। সৌভাগ্যক্রমে চমৎকার একটা ছেলে ছিল ইয়া’র: মারদুক, সান গড, স্বর্গীয় ধারায় সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ সৃষ্টি। দেবতাদের মহাসংসদের এক সভায় মারদুক এই শর্তে তিয়ামাতের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর প্রস্তাব দিলেন যে, বিনিময়ে তাঁকে শাসন ক্ষমতা দিতে হবে। কিন্তু এরপরেও অনেক কষ্টেসৃষ্টে দীর্ঘস্থায়ী এক বিপজ্জনক লড়াইতে তিয়ামাতকে হত্যা করতে সক্ষম হলেন তিনি। এই মিথে সৃজনশীলতা হচ্ছে এক ধরনের সংগ্রাম, সীমাহীন বৈরিতার বিরুদ্ধে যাকে অর্জন করতে হয়েছে।
অবশ্য, শেষ পর্যন্ত তিয়ামাতের বিশাল শবদেহের ওপর দাঁড়িয়ে মারদুক এক নতুন বিশ্ব সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিয়েই আকাশের খিলান ও মানুষের পৃথিবী সৃষ্টির জন্যে তিয়ামাতের দেহ টুকরো করেন। এরপর সৃষ্টি করলেন বিধান যা সমস্ত কিছু যথাস্থানে রাখবে। শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। কিন্তু বিজয় তখনও সংহত হয়নি। বছরের পর বছর বিশেষ শাস্ত্রীয় আচারের মাধ্যমে একে বারবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ কারণেই দেবতাগণ নতুন পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল বাবিলনে মিলিত হলেন, এখানে এক মন্দির নির্মাণ করা হলো যাতে স্বর্গীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা যায়। ফলাফল, মারদুকের সম্মানে নির্মিত বিশাল যিগুরাত-’পার্থিব মন্দির অসীম স্বর্গের প্রতীক। কাজ শেষ হওয়ার পর একেবারে শীর্ষে আসন গ্রহণ করলেন মারদুক আর অন্য দেবতাগণ সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন: এটা দেবতার প্রিয় শহর, বাবিলন নগরী, আপনার প্রিয় দেশ!’ এরপর আচার পালন করলেন তাঁরা, যেখান থেকে গোটা বিশ্বজগৎ এর নিয়ম কানুন পায়, অদৃশ্য গোপন জগৎ সহজ হয়ে যায় এবং দেবতাগণ বিশ্বজগতে যার যার নির্দিষ্ট স্থান লাভ করেন। এসব আইন ও আচার অনুষ্ঠান পালন প্রত্যেকের জন্যে বাধ্যতামূলক; এমনকি সৃষ্টিকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে দেবতাদেরও এগুলো মানতে হবে । এই মিথ বাবিলনবাসীরা যেভাবে দেখেছে সেভাবে সভ্যতার অন্তর্নিহিত অর্থ প্রকাশ করে। এরা ভালো করেই জানত যে তাদের পূর্বসুরিরাই যিগুরাত নির্মাণ করেছিল, কিন্তু এনুমা এলিশের গল্পটি তাদের এই বিশ্বাসকেই ফুটিয়ে তোলে যে, তাদের সৃজনশীল প্রয়াস কেবল স্বর্গীয় ক্ষমতায় অংশী হতে পারলেই টিকে থাকবে। নববর্ষে তাদের পালিত শাস্ত্রীয় আচার মানুষের সৃষ্টির আগেই নির্ধারণ করা হয়েছে: বস্তুনিচয়ের খোদ প্রকৃতির মাঝেই লেখা আছে এসব, এমনকি দেবতারাও যা মানতে বাধ্য। এই মিথ তাদের এই বিশ্বাসও ফুটিয়ে তোলে যে, বাবিলন এক পবিত্র ভূমি, বিশ্বজগতের কেন্দ্রস্থল ও দেবতাদের আবাসসকল প্রাচীন ধর্মেই এই ধারণাটি দারুণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একটি পবিত্র নগরীর ধারণা–নারী-পুরুষ যেখানে সকল বস্তু ও ফলের উৎস পবিত্র ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার বোধ অনুভব করে–আমাদের নিজস্ব ঈশ্বরের তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
সবশেষে যেন চকিত চিন্তা থেকেই মানুষ সৃষ্টি করলেন মারদুক। তিনি কিংশুকে (কিংগু ছিলেন তিয়ামাতের জড়বুদ্ধি সহচর, আপসুর পরাজয়ের পর যাকে সৃষ্টি করেছিলেন) আটক ও হত্যা করে স্বর্গীয় রক্ত ও মাটি মিশিয়ে সৃষ্টি করলেন প্রথম মানব। সবিস্ময় ও সশ্রদ্ধায় তা প্রত্যক্ষ করলেন দেবতারা। মানুষের সৃষ্টিরই এই পৌরাণিক বিবরণে কিছুটা রসিকতার ছোঁয়া আছে; মানুষ সৃষ্টির সেরা নয়, বরং সবচেয়ে নির্বোধ ও অকর্মা দেবতা থেকে উদ্ভূত। তবে এ কাহিনী আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও তুলে ধরে-প্রথম মানুষকে এক দেবতার দেহাবশেষ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছিল: সীমিত পরিসরে হলেও সে স্বর্গীয় প্রকৃতির অংশীদার। মানুষ ও দেবতাদের মাঝে সাগরসম দূরত্ব নেই। স্বাভাবিক পৃথিবী, নারী-পুরুষ ও স্বয়ং দেবতাগণ, সবাই একই প্রকৃতির অংশীদার; তারা একই স্বর্গীয় বস্তু হতে সৃষ্ট। পৌত্তলিক দর্শন ছিল হলিস্টিক: দেবতাগণ সম্পূর্ণ রূপতাত্ত্বিক স্তরে মানবজাতির সঙ্গে সম্পর্করহিত নন: ঐশ্বরিকতা মানুষ থেকে আবশ্যিকভাবে বিচ্ছিন্ন নয়। সুতরাং, দেবতাদের বিশেষ আবির্ভাব বা স্বর্গ থেকে স্বর্গীয় আইন অবতীর্ণ হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। দেবতা ও মানবজাতিকে একই সংকট মোকাবিলা করতে হয়, পার্থক্য একটাই সেটা হচ্ছে, দেবতা অনেক শক্তিমান ও অমর। এই হলিস্টিক দর্শন কেবল মধ্যপ্রাচ্যেই সীমিত ছিল না, বরং প্রাচীন বিশ্বে একটি সাধারণ বিষয় ছিল। বিসিই ষষ্ঠ শতকে পিন্ডার তাঁর অলিম্পিক গেমসের গানে এই বিশ্বাসের গ্রিক রূপটি তুলে ধরেছেন:
মানুষ ও দেবতার জাতি একই;
একই মায়ের কাছ থেকে আমরা নিশ্বাস নিই।
কিন্তু সর্ববিষয়ে ক্ষমতার পার্থক্য আমাদের বিচ্ছিন্ন রাখে।
কারণ একটি কিছুই নয়;
কিন্তু তামাটে আকাশ চিরস্থায়ী তৎপরতার মতো স্থির
তবু মনের কিংবা দেহের বিশালত্ব দিয়ে
আমরা অমরদের মতো হতে পারি। [৪]
নিজস্ব সাফল্য অর্জনে ব্যায়ামরত ক্রীড়াবিদদের তাদের নিজস্ব রূপে না দেখে, পিন্ডার তাদের দেবতাদের দেখানো উদাহরণের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন, যাঁরা ছিলেন সকল মানবীয় অর্জনের আদর্শ। ধরা-ছোঁয়ার অতীত এমন কেউ হিসাবে মানুষ দাসের মতো দেবতাদের অনুকরণ করছে না বরং নিজেদের সুপ্ত স্বর্গীয় প্রকৃতি জাগিয়ে তোলার প্রয়াস পাচ্ছে।
মারদুক ও তিয়ামাতের মিথ কানানবাসীদের প্রভাবিত করেছিল বলে মনে হয়: তারাও ঝড় ও উর্বরতার দেবতা বাআল-হাবাদ (Baal-Habad)-এর প্রায় একই রকম কাহিনী বর্ণনা করেছে। বাইবেলে প্রায়ই একেবারে প্রশংসাহীন সুরে এই দেবতার উল্লেখ আছে। সাগর ও নদীর দেবতা ইয়াম-নাহারের সঙ্গে বাআলের যুদ্ধের কাহিনী বিসিই চতুর্থ দশকে প্রস্তরলিপিতে পাওয়া গেছে। কানানের পরম প্রভু এলের (El) সঙ্গে বাস করতেন বাআল ও ইয়াম দুজনই। এলের সভায় ইয়াম তাঁর হাতে বাআলকে তুলে দেওয়ার দাবি জানালেন। দুটি মন্ত্রপুতঃ অস্ত্রের সাহায্যে ইয়ামকে পরাস্ত করলেন বাআল, তাকে যখন হত্যা করতে উদ্যত হয়েছেন, এমন সময় আশেরাহ (এলের স্ত্রী ও দেবকুলের মাতা) আবেদন জানালেন যে, একজন বন্দিকে হত্যা করা অসম্মানজনক। বাআল লজ্জিত হয়ে ইয়ামকে ছেড়ে দিলেন, যিনি পৃথিবীকে বানের জলে ভাসিয়ে দেওয়ার ক্রমাগত হুমকি দিয়ে সাগর ও নদীর বৈরী দিকের প্রতিনিধিত্ব করেন, অন্যদিকে ঝড়ের দেবতা বাআল পৃথিবীকে করে তোলেন উর্বর। মিথের আরেকটি ভাষ্যে বাআল সাতমাথাঅলা ড্রাগন লোকান, হিব্রুতে লেভিয়াথান নামে আখ্যায়িত, কে হত্যা করেন। প্রায় সকল সংস্কৃতিতেই ড্রাগন হচ্ছে সুপ্ত, অসংগঠিত ও বৈশিষ্ট্যহীনতার প্রতীক। এইভাবে বাআল এক প্রকৃত সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে আদি আকারহীনতায় প্রত্যাবর্তন রোধ করেছেন ও উপহার হিসাবে তার সম্মানে দেবতাদের নির্মিত এক অপরূপ প্রাসাদ লাভ করেছেন। সুতরাং, একেবারে আদিম ধর্মে সৃজনশীলতাকে স্বর্গীয় হিসাবে দেখা হয়েছে: এখনও আমরা বাস্তবপক্ষে নতুন রূপদানকারী ও বিশ্বজগতের নতুন অর্থ প্রকাশক সৃজনশীল ‘অনুপ্রেরণা”-কে প্রকাশ করতে ধর্মীয় ভাষা ব্যবহার করে থাকি।
কিন্তু বিপরীত দিকে যাত্রা করেন বাআল: মৃত্যু বরণ করেন তিনি, তাঁকে অবতরণ করতে হয় মৃত্যু ও দেবতা মত-এর জগতে। পুত্রের পরিণতি জানতে পেরে পরম ঈশ্বর এ সিংহাসন ছেড়ে নেমে আসেন, গায়ে চাপান মোটা পোশাক, গালে বাড়তি জিনিস খুঁজে দেন, কিন্তু পুত্রকে উদ্ধার করতে পারেন না। বাআলের প্রেমিকা ও বোন আনা স্বর্গরাজ্য ছেড়ে নেমে এসে তার যমজ আত্মার সন্ধ্যানে বের হন, ‘গরু যেভাবে বাছুর বা ভেড়া যেভাবে তার বাচ্চাকে চায় সেভাবে তাঁকে কামনা করলেন তিনি। মৃতদেহের খোঁজ পাবার পর তাঁর সম্মানে অন্তেষ্টিভভাজের আয়োজন করলেন, তারপর মত-কে বন্দি করে তরবারির আঘাতে টুকরো টুকরো করে ভুট্টার মতো পিষে পুঁতে দিলেন জমিনে। অন্যান্য মহান দেবীগণ ইনানা, ইশতার ও আইসিস সম্পর্কেও একই রকম কাহিনী বর্ণিত হয়েছে–যারা নিহত দেবতার সন্ধান করেছেন ও পৃথিবীর মাটিতে নতুন জীবন ফিরিয়ে এনেছেন। যা হোক, আনাতের বিজয়কে অবশ্যই আচরিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বছরের পর বছর স্থায়ী রূপ দিতে হবে । পরে–আমরা জানি না কীভাবে, কারণ আমাদের সূত্র পূর্ণাঙ্গ নয়–বাআলকে পুনরুজ্জীবিত করে আনাতকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বিপরীত লিঙ্গের একীভুতকরণের ভেতর দিয়ে প্রতীকায়িত পরিপূর্ণতা ও সাম্যের এই মহিমান্বিতকরণ প্রাচীন কানানে আচরিক যৌনতার মাধ্যমে পালিত হতো। এইভাবে দেবতাদের অনুকরণের মাধ্যমে নারী-পুরুষ বন্ধ্যাত্যের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের অংশীদার হতো আর সাগরের সৃজনশীলতা ও উর্বরতা নিশ্চিত করত। একজন দেবতার মৃত্যু, দেবীর অনুসন্ধান ও স্বর্গীয় পরিমণ্ডলে বিজয়ীরূপে প্রত্যাবর্তন বহু সংস্কৃতিতেই চিরকালীন ধর্মীয় থিম ছিল এবং ইহুদি, ক্রিশান ও মুসলিমদের উপাস্য এক ঈশ্বরের একেবারে ভিন্ন ধর্মেও তা পুনরাবৃত্ত হবে।
বাইবেলে আব্রাহামের ওপর এই ধর্ম প্রযুক্ত হয়েছে। আনুমানিক বিসিই বিংশ ও উনবিংশ শতকের মাঝামঝি কোনও এক সময় উর ত্যাগ করে শেষ পর্যন্ত কানানে বসতি গড়েছিলেন আব্রাহাম। আমাদের কাছে আব্রাহামের সমসাময়িক কোনও দলিলপত্র নেই, তবে পণ্ডিতরা মনে করেন তিনি হয়তো যাযাবর গোত্রপ্রধানদের কেউ ছিলেন যিনি বিসিই তৃতীয় সহস্রাব্দের শেষ দিকে স্বজাতিকে নিয়ে মেসোপটেমিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্যে আগমনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই যাযাবররা, মেসোপটেমিয়া ও মিশরিয় সূত্রসমূহে যাদের আবিরু, আপিরু বা হাব্বির নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে, পশ্চিমা সেমিটিক ভাষায় কথা বলত, হিব্রু এমনি একটি ভাষা। এরা মৌসুমী চক্রের ধারা অনুযায়ী দল বেঁধে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাড়ি জমানো যাযাবর বেদুঈনদের মতো ছিল না; এদের কোনও বিশেষ গোত্রে ফেলা বেশ কঠিন; ফলে এরা প্রায়শঃই রক্ষণশীল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ত। মরুবাসীদের তুলনায় এদের সাংস্কৃতিক মর্যাদা ছিল উন্নততর। কেউ কেউ মার্সেনারি হিসাবে কাজ করত, অন্যরা সরকারি কাজে যোগ দিয়েছিল, বাকিরা বণিক, দাস বা কামারে পরিণত হয়। বুক অভ জেনেসিসে বর্ণিত আব্রাহামের কাহিনীতে তাঁকে সদোমের রাজার পক্ষে মার্সেনারি হিসাবে কর্মরত দেখানো হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তার স্ত্রী সারাহ মারা গেলে বর্তমান পশ্চিম তীরবর্তী হেবরনে জমি ক্রয় করেন আব্রাহাম।
জেনেসিসে বর্ণিত আব্রাহাম ও তাঁর নিকটতম বংশধরদের কাহিনী আধুনিককালের ইসরায়েল-এর কানানে তিনটি প্রধান হিব্রু বসতি ধারার ইঙ্গিতবহ হয়ে থাকতে পারে। একটি ধারা আব্রাহাম ও হেবরনের সঙ্গে সম্পর্কিত আনুমানিক বিসিই ১৮৫০ সংঘটিত হয়েছে। অভিবাসনের দ্বিতীয় ধারাটি আব্রাহামের পৌত্র জ্যাকবের সঙ্গে সম্পর্কিত যার নাম পরে ইসরায়েল রাখা হয়, (ঈশ্বর যেন তার শক্তির প্রকাশ ঘটান’); বর্তমান পশ্চিম তীরের আরব শহর নাবলুস, তখনকার শেচেমে বসতি করেছিলেন তিনি। বাইবেল আমাদের জানাচ্ছে, ইসরায়েলের বারটি গোত্রের পূর্বপুরুষে পরিণত জ্যাকবের পুত্র কানানের এক ভয়াবহ খরার সময় মিশরে অভিবাসী হয়েছিলেন। আনুমানিক বিসিই ১২০০ সালে ঘটেছিল হিব্রু বসতির তৃতীয় পর্যায়, এই সময় আব্রাহামের বংশধর বলে দাবিদার গোত্রগুলো মিশর থেকে কানানে এসে পৌঁছেছিল। তারা বলেছিল মিশরিয়রা তাদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করেছিল, কিন্তু তাদের নেতা মোজেসের উপাস্য ইয়াহ্ওয়েহ্ তাদের মুক্তি দিয়েছেন। জোরপূর্বক কানানে প্রবেশাধিকার আদায় করার পর তারা স্থানীয় হিব্রুদের সঙ্গে মৈত্রী গড়ে তুলে ইসরায়েলি জাতি হিসাবে পরিচিতি লাভ করে । বাইবেল এটা স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, আমাদের পরিচিত প্রাচীন ইসরায়েলিরা মোজেসের ঈশ্বর ইয়াহ্ওয়েহ্র প্রতি আনুগত্যের সুবাদে ঐক্যবদ্ধ বিভিন্ন জাতিগত দলের একটা কনফেডারেশন ছিল। অবশ্য বাইবেলিয় বিবরণ বহু শত বছর পর, আনুমানিক বিসিই অষ্টম শতকে লিপিবদ্ধ হয়েছে, যদিও তা নিশ্চিতভাবে অতীতের কল্পকাহিনীর সূত্রই অনুসরণ করেছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে জার্মানির বাইবেল পণ্ডিতগণ একটা জটিল পদ্ধতি গড়ে তোলেন যার মাধ্যমে বাইবেলের প্রথম পাঁচটি পুস্তক জেনেসিস, এক্সোডাস, লেভিটিকাস, নাম্বারস ও ডিউটেরোনমি-এর চারটি আলাদা উৎস শনাক্ত করা গেছে। পরবর্তীকালে এগুলোকে বিসিই পঞ্চম শতকে পেন্টাটিউক নামে পরিচিত একটি চূড়ান্ত খণ্ডে একীভূত করা হয়। সমালোচনার এই ধারা তীব্র বিরোধের মুখে পড়লেও এখন পর্যন্ত কেউ এমন কোনও সূত্র আবিষ্কার করতে পারেননি যা দিয়ে সৃজন এবং প্লাবনের মতো বাইবেলের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সম্পূর্ণ ভিন্ন বিবরণ কিংবা মাঝে মাঝে বাইবেলে পরস্পর বিরোধিতা পরিলক্ষিত হয় কেন তার কারণ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। বাইবেলের দুজন আদি লেখক, জেনেসিস ও এক্সোডাসে যাদের রচনা পাওয়া যায়, সম্ভবত অষ্টম শতকে লিখেছিলেন, যদিও কেউ কেউ আরও আগের কথা বলেন। একজন ‘J’ নামে পরিচিত ছিলেন, কারণ তিনি তাঁর ঈশ্বরকে ‘ইয়াহ্ওয়েহ্’ ডাকেন, অপরজন ‘E’ যেহেতু অধিকতর আনুষ্ঠানিক স্বর্গীয় উপাধি ‘ইলোহিম’ ব্যবহার পছন্দ করতেন। অষ্টম শতক নাগাদ ইসরায়েলিরা কানানকে দুটো পৃথক রাজ্যে বিভক্ত করেছিল। দক্ষিণের জুদাহ্ রাজ্যে রচনায় ব্যস্ত ছিলেন ‘J’. এদিকে ‘E’এসেছিলেন উত্তরের ইসরায়েল রাজ্য থেকে (মানচিত্র দেখুন, পৃ: ১৪)। পেন্টাটুয়েকের অন্য দুটি উৎস-ডিউটেরোনমিস্ট (D) এবং প্রিস্টলি (P)-র বর্ণিত ইসরায়েলের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কিত বিবরণ আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে। আলোচনা করব।
আমরা দেখব যে, বহু ক্ষেত্রে এবং E উভয়ই মধ্যপ্রাচ্য তাদের প্রতিবেশীদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতেন, কিন্তু তাদের বিবরণ দেখায়, বিসিই অষ্টম শতক নাগাদ ইসরায়েলিরা তাদের নিজস্ব একটা দর্শন গড়ে তুলতে যাচ্ছিল। উদাহরণস্বরূপ: তারা বিশ্বজগতের সৃষ্টির এক বিবরণের মাধ্যমে ঈশ্বরের ইতিহাসের বর্ণনা শুরু করেছেন, এনুমা এলিশের বিচারে যা নেহাৎ দায়সারা গোছের:
ইয়াহ্ওয়েহ্ ঈশ্বর যখন আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেন, সেই সময় পৃথিবীতে কোনও বুনো ঝোঁপ জন্ম নেয়নি, গজিয়ে ওঠেনি কোনও বুনো গাছও, ইয়াহ্ওয়েহ্ ঈশ্বর তখনও বৃষ্টি বর্ষণ করাননি বা জমি কর্ষণের জন্য তখনও আবির্ভাব ঘটেনি মানুষের। যাহোক, জমিন থেকে বন্যার জল ক্রমশঃ বেড়ে উঠে ভরিয়ে দিচ্ছিল গোটা ভূমি। ইয়াহ্ওয়েহ্ ঈশ্বর মাটির মানুষকে (আদম) মাটি (আদামাহ) হতে তৈরি করলেন। তারপর তার নাকে ফুঁ দিয়ে প্রাণ সঞ্চার করলেন তিনি এবং এইভাবে মানুষ জীবীত প্রাণে পরিণত হল।[৬]
এটা ছিল একেবারে ভিন্ন পথে যাত্রা। মেসোপটেমিয়া ও কানানের সমসাময়িক পৌত্তলিকদের মতো বিশ্ব সৃষ্টি ও প্রাগৈতিহাসিক কালের ওপর গুরুত্ব আরোপের বদলে সাধারণ ঐতিহাসিক কালের ব্যাপারেই যেন বেশি আগ্রহী। বিসিই ষষ্ঠ শতকের আগে ইসরায়েলে সৃষ্টি বিষয়ে প্রকৃত আগ্রহ দেখা যায়নি, সেই সময় আমরা যাকে ‘P’ আখ্যায়িত করি, এই রচয়িতা, বর্তমান জেনেসিসের প্রথম অধ্যায়ের তাঁর রাজকীয় বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। ইয়াহ্ওয়েহ্ই যে আকাশ ও পৃথিবীর একক স্রষ্টা, এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন তিনি। অবশ্য মানুষ ও স্বর্গীয় সত্তার মধ্যকার সুনির্দিষ্ট পার্থক্য সম্পর্কে ‘J–এর ধারণা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। স্রষ্টা বা দেবতার মতো একই উপাদানে গঠিত হওয়ার বদলে মানুষ (আদম), পান হতে বোঝা যায়, পৃথিবী (আদামাহ)রই অংশ।
পৌত্তলিক পড়শীদের বিপরীতে জাগতিক ইতিহাসকে দেবতাদের আদিম, পবিত্র সময়ের তুলনায় তুচ্ছ, নাজুক ও গুরুত্বহীন বলে নাকচ করে দেননি তিনি। পৌরাণিক সময়কাল অতিক্রম না করা পর্যন্ত অত্যন্ত দ্রুত অগ্রসর হয়েছেন তিনি, যেখানে প্লাবন ও টাওয়ার অভ বাবেলের মতো গল্পগুলো অন্তর্ভুক্ত; তারপর ইসরায়েলের জাতির ইতিহাস বর্ণনায় হাত দিয়েছেন। দ্বাদশ অধ্যায়ে আব্রাম, পরে যার নাম আব্রাহাম হিসাবে (বহুজনের পিতা) পুণর্নামকরণ হয়েছে, যখন ইয়াহ্ওয়েহ্র কাছ থেকে নির্দেশিত হলেন যে, বর্তমান পূর্ব তুরস্কের হারানে তাঁর পরিবার ত্যাগ করে ভূমধ্যসাগর নিকটবর্তী কানানে অধিবাসী হওয়ার, তখন এর শুরু। আমাদেরকে জানান হয়েছে যে, তাঁর পৌত্তলিক পিতা তোবেহ্ উর থেকে আগেই সপরিবারে পশ্চিমে যাত্রা করেছিলেন। ইয়াহ্ওয়েহ্ এবার আব্রাহামকে বলছেন, তার বিশেষ নিয়তি নির্ধারিত রয়েছে: তিনি এমন এক শক্তিশালী জাতির পিতায় পরিণত হবেন একদিন যাদের মোট সংখ্যা আকাশের তারার সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে এবং একদিন তাঁর উত্তরসুরিরা কানানের অধিকার লাভ করবে আপন ভূমির মতো করেই। ‘J’ বর্ণিত আব্রাহামের আহ্বান শোনার কাহিনী এই ঈশ্বরের আগামী ইতিহাসের ধারা স্থির করে দিচ্ছে। প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যে আচার অনুষ্ঠান ও মিথে স্বর্গীয় মানার (mana) অভিজ্ঞতা অনুভূত হতো। মারদুক, আআল ও আরাত নিজেদের তাদের উপাসকদের সাধারণ, তুচ্ছ জীবনের সঙ্গে জড়াবেন বলে ভাবা হয়নিঃ পবিত্র সময়ে তাঁদের কর্মকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু ইসরায়েলের ঈশ্বর বাস্তব জগতের চলতি ঘটনাপ্রবাহে আপন ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। বর্তমানেই এক আজ্ঞা হিসাবে অনুভূত হয়েছেন তিনি। নিজ সম্পর্কে তাঁর প্রথম প্রত্যাদেশ ছিল একটি নির্দেশ: আব্রাহামকে আপন জাতিকে ত্যাগ করে কানান। দেশে পাড়ি জমাতে হবে।
কিন্তু ইয়াহ্ওয়েহ্ কে? আব্রাহাম কি মোজেসের মতো একই ঈশ্বরের উপাসনা করেছেন, নাকি তাকে ভিন্ন কোনও নামে চিনতেন তিনি? বর্তমান কালে বিষয়টি আমাদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, কিন্তু বাইবেলে যেন এ বিষয়টি অদ্ভুতভাবে অস্পষ্টতায় আবদ্ধ এবং এ প্রশ্নের স্ববিরোধী জবাব দেয়। ‘‘ বলছেন যে, আদমের পৌত্রের কাল থেকেই মানুষ ইয়াহ্ওয়েহ্র উপাসনা করে আসছে, কিন্তু ষষ্ঠ শতকে ‘P’ যেন বোঝাতে চাইছেন জ্বলন্ত ঝোপে (Buruing Bush) তিনি মোজেসের কাছে আবির্ভূত হওয়ার আগ পর্যন্ত ইসরায়েলিরা ইয়াহ্ওয়েহ্র কথা জানতই না। ‘P’ ইয়াহ্ওয়েহ্কে দিয়ে ব্যাখ্যা করাচ্ছেন, তিনি প্রকৃতই আব্রাহামের ঈশ্বর, যেন এটি একটি বিতর্কিত ধারণা: মোজেসকে তিনি বলছেন, আব্রাহাম তাঁকে ‘এল শাদ্দাই’ বলে ডাকতেন এবং স্বর্গীয় নাম ইয়াহ্ওয়েহ্ ছিল তাঁর অজ্ঞাত।’ অসামঞ্জস্যতাটুকু যেন বাইবেলের রচয়িতা বা সম্পাদকদের খুব একটা বিচলিত করেনি। আগাগোড়া তাঁর ঈশ্বরকে ‘ইয়াহ্ওয়েহ্’ নামে অভিহিত করেছেন। তাঁর রচনাকালে ইয়েহ্ওয়েই ছিলেন ইসরায়েলের ঈশ্বর, এখানে আর কিছু দেখার ছিল না। ইসরায়েলি ধর্ম ছিল বাস্তবভিত্তিক, আমাদের বিচলিত করে তোলার মতো অনুমান নির্ভর। বর্ণনার ব্যাপারে তেমন উৎসাহী ছিল না। কিন্তু তারপরেও আমাদের এটা ধরে নেওয়া উচিত হবে না যে আব্রাহাম বা মোজেস বর্তমানের আমাদের মতো করে তাঁদের ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতেন। বাইবেলের কাহিনী ও পরবর্তীকালের ইসরায়েলি ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের পরিচয় এত নিগুঢ় যে আমরা পরবর্তী সময়ের ইহুদি ধর্ম সংক্রান্ত জ্ঞান এইসব প্রাচীন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের ওপর আরোপ করতে প্ররোচিত হই। এভাবে আমরা ধরে নিই, ইসরাইয়েলের তিন পূর্ব পুরুষ আব্রাহাম, তার পুত্র ইসাক ও পৌত্র জ্যাকব একেশ্বরবাদী ছিলেন, তাঁরা একজন মাত্র ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। ব্যাপারটা এমন ছিল বলে মনে হয় না। প্রকৃতপক্ষে, এটা বলা বোধ হয় অধিকতর সঠিক হবে যে, এইসব আদি হিব্রু পৌত্তলিক কানানে তাঁদের প্রতিবেশীদের নানান ধর্মীয় ধ্যানধারণার অংশীদার ছিলেন। নিশ্চয়ই তারা মারদুক, বাআল ও আনাতের মতো দেব দেবীর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে থাকবেন। হয়তো তারা একই দেবতার উপাসনা করেননিঃ এমন হতে পারে যে আব্রাহামের ঈশ্বর, ইসাকের ‘আতঙ্ক’ কিংবা বা ‘কিনসম্যান’ ও জ্যাকবের ‘মাইটি ওয়ান’ তিন জন ভিন্ন দেবতা ছিলেন। [৮]
আরও অগ্রসর হতে পারি আমরা। এটা হওয়া খুবই সম্ভব যে আব্রাহামের ঈশ্বর ছিলেন কানানের পরম ঈশ্বর এল। এই দেবতা স্বয়ং আব্রাহামের কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছেন এল শাদ্দাই (পর্বতের এল) হিসাবে যা ছিল এল-এর প্রচলিত উপাধির একটি।[৯] অন্যত্র তাঁকে এল এলিয়ন (The Most High god) বা এল অভ বেথেল বলা হয়েছে। কানানের পরম ঈশ্বরের নাম ইসরায়েল বা। ইশমা-এল এর মতো হিব্রু নামে সংরক্ষিত আছে। তারা এমনভাবে তাঁকে প্রত্যক্ষ করেছিল যা মধ্যপ্রাচ্যের পৌত্তলিকদের অপরিচিত ছিল না। আমরা দেখব, বহু শতাব্দী পরে ইসরায়েলিরা ইয়াহ্ওয়েহ্স্র মানা বা ‘পবিত্রতা’-কে ভীতিকর অভিজ্ঞতা হিসাবে আবিষ্কার করেছে। উদাহরণ স্বরূপ, সিনাই পর্বতচূড়ায় এক বিস্ময় ও ভয় জাগানো আগ্নেয়গিরির অগ্নৎপাতের মাঝে মোজেসের সামনে দেখা দেন তিনি, ইসরায়েলিদের তাঁর সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে হয়েছে। সে তুলনায় আব্রাহামের দেবতা এল অনেক নমনীয় উপাস্য। আব্রাহামের সামনে বন্ধু হিসাবে আবির্ভূত হন তিনি, কখনও কখনও এমনকি মানুষের রূপও গ্রহণ করতেন। এপিফ্যানি নামে পরিচিত এক ধরনের অনুপ্রেরণা প্রাচীন পৌত্তলিক সমাজে সর্বজনবিদিত ছিল। যদিও সাধারণভাবে দেবতারা মরণশীল নারী-পুরুষের জীবন-ধারায় সরাসরি ভূমিকা রাখবেন বলে আশা করা হতো না, তবুও পৌরাণিক কালে বিশেষ সৌভাগ্যবান ব্যক্তিরা দেবতাদের প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। ইলিয়াদ একরম এপিফ্যানিতে পরিপূর্ণ। গ্রিক ও ট্রোজান উভয়ের কাছেই স্বপ্নের মাধ্যমে দেব-দেবীরা। এসেছেন, এই সময় মানবীয় ও স্বর্গীয় জগতের সীমানা প্রাচীর উন্মোচিত হয় বলে বিশ্বাস করা হতো। ইলিয়াদের একেবারে শেষ পর্যায়ে এক আকর্ষণীয়। তরুণ প্রিয়ামকে পথ দেখিয়ে গ্রিক জাহাজ বহরের কাছে নিয়ে যান যিনি শেষ পর্যন্ত নিজেকে হারমিস বলে পরিচয় দিয়েছেন। গ্রিকরা যখন তাদের বীরদের স্বর্ণযুগের কথা ভাবে, তারা অনুভব করে যে সেই বীরগণ দেবতাদের অনেক কাছাকাছি ছিলেন, দেবতারা আবার যা হোক মানব সন্তানদের মতো। একই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। এপিফ্যানির এইসব গল্প হলিস্টিক পৌত্তলিক দর্শন প্রকাশ করেছে: স্বর্গ যখন অত্যাবশ্যকীয়ভাবে প্রকৃতি বা মানুষের চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিল না তখন কোনওরকম ঝামেলা ছাড়াই তার অভিজ্ঞতা লাভ সম্ভব ছিল। জগৎ দেবতায় পরিপূর্ণ ছিল; যে কোনও সময়। অপ্রত্যাশিতভাবে কোনও এক কোণে কিংবা হেঁটে বেড়ানো কোনও পথিকের মাঝে তাদের দেখা মিলে যেতে পারে। মনে হয় সাধারণ মানুষ হয়তো বিশ্বাস। করত যে, এই ধরনের সাক্ষাৎ তাদের জীবনেও সম্ভব পর। এ থেকে অ্যাক্টস অভ দ্য অ্যাপসলস এর অদ্ভুত কাহিনীর ব্যাখ্যা মিলতে পারে। বিসিই প্রথম শতাব্দীর শেষ দিকে বর্তমানে তুরস্ক নামে পরিচিত দেশের লিস্ট্রাবাসী অ্যাপসল পল ও তাঁর শিষ্য বার্নাবাসকে জিউস ও হারমিস বলে ভুল। করেছিল।[১১]
মোটামুটি একইভাবে ইসরায়েলিরা যখন তাদের স্বর্ণযুগের কথা ভাবে, তারা আব্রাহাম, ইসাক ও জ্যাকবকে তাদের ঈশ্বরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ শর্তাধীনে জীবন যাপন করতে দেখে। কোনও শেখ বা চীফটেইনের মতোই এল তাঁদের বন্ধুত্বপূর্ণ উপদেশ দেন: ভ্রমণের সময় পথ দেখান, জানিয়ে দেন কাকে বিয়ে করতে হবে, স্বপ্নে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেন। মাঝে মাঝে তাঁকে মনুষ্য আকৃতিতে দেখতে পান তারা। এই ধারণাটি পরবর্তীকালে ইসরায়েলিদের জন্যে অভিশাপে পরিণত হবে। জেনেসিসের অষ্টাদশ অধ্যায়ে ‘J’ আমাদের বলছেন, হেবরনের নিকটবর্তী মামরির ওক গাছের পাশে আব্রাহামের সামনে আবির্ভূত হলেন ঈশ্বর। দিনের উত্তপ্ততম সময়ে চোখ তুলে তাকিয়ে তিনজন আগন্তুককে নিজ তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসতে দেখেছিলেন আব্রাহাম। মধ্যপ্রাচ্যের স্বাভাবিক আতিথেয়তাবোধ থেকে তিনি ওঁদের বসে বিশ্রাম নেওয়ার ওপর জোর দেন তারপর দ্রুত খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কথোপকথনের ভেতর দিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এই লোকগুলোর মাঝে একজন তার দেবতা ছাড়া আর কেউ নন, ‘ যাকে সবসময় ইয়াহ্ওয়েহ্’ বলছেন। বাকি দুজন ফেরেশতা বা অ্যাঞ্জেল বলে জানা গেল। এই রহস্য উদঘাটনে কেউই খুব একটা বিস্মিত হয়েছিল বলে মনে হয় না। বিসিই অষ্টম শতাব্দীতে ‘J’ যখন বাইবেল রচনা করছেন, তখন কোনও ইসরায়েলি এভাবে ঈশ্বরকে দেখার প্রত্যাশা করত নাঃ অধিকাংশই এমন ধারণাকে ভীতিকর মনে করত। J’-এর সমসাময়িক ‘E’ ঈশ্বরের সঙ্গে ধর্মপিতাদের অন্তরঙ্গতার গল্পগুলোকে বেমানান মনে করেছেন: আব্রাহাম বা জ্যাকবের কাহিনী বর্ণনার সময় ‘E’ ঘটনাবলীকে বহুকাল আগের বোঝাতে পছন্দ করেছেন এবং প্রাচীন কিংবদন্তীকে মনুষ্য রচনা তুল্য দাবি করার ব্যাপারে সীমা মেনে চলেছেন। এভাবে তিনি বলেছেন, ঈশ্বর একজন ফেরেশতার মাধ্যমে আব্রাহামের সঙ্গে কথা বলেছেন। ‘ অবশ্য এ ধরনের খুঁতখুঁতে মনোভাব পোষণ করেননি, নিজের বর্ণনায় এইসব আদিম এপিফ্যানির পুরোনো স্বাদ বজায় রেখেছেন।
জ্যাকবও বেশ কিছু এপিফ্যানির অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। একবার নিকটজনের মাঝ থেকে একজন স্ত্রী পছন্দ করার জন্যে হারানে প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। যাত্রার প্রথম পর্যায়ে, জর্দান উপত্যকার কাছে লুয (Luz)-এর একটা পাথরকে বালিশের মতো ব্যবহার করে ঘুমিয়ে পড়েন। সেরাতে স্বপ্নে একটা মই দেখতে পান তিনি যেটা স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝে যোগাযোগ স্থাপন করেছে: দেবতা ও মানুষের জগতের মাঝখানে ওঠানামা করছে ফেরেশতারা। মারদুকের যিগুরাতের কথা মনে না করে পারি না আমরা: স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝে ঝুলন্ত যিগুরাতের চূড়ায় একজন মানুষ তার দেবতাদের সঙ্গে মিলিত হতে পারত। মইয়ের শেষ ধাপে জ্যাকব এল-কে দেখেছেন বলে স্বপ্নে দেখলেন, এল তাঁকে আশীর্বাদ করলেন এবং আব্রাহামকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি করলেন: জ্যাকবের বংশধররা এক শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হয়ে কানান দেশের মালিক হবে। তিনি আরও একটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যা জ্যাকবের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব রেখেছিল বলে আমরা। দেখব। পৌত্তলিক ধর্ম প্রায়শঃই এলাকা বা অঞ্চলভিত্তিক হতো: একটা নির্দিষ্ট এলাকায় কেবল বিশেষ দেবতার এখতিয়ার থাকে, বাইরে কোথাও গেলে সেখানকার স্থানীয় দেবদেবীর উপাসনা করাই বুদ্ধিমানের পরিচায়ক। কিন্তু জ্যাকবকে এল প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে জ্যাকব কানান ত্যাগ করে যখন অচেনা দেশে যাবেন তখনও তিনি তাকে রক্ষা করবেন: ‘আমি তোমার সঙ্গে আছি তুমি যেখানেই যাবে, আমি তোমাকে নিরাপদে রাখব। প্রথম দিকের এপিফ্যানির এই কাহিনী দেখায়, কানানের পরম ঈশ্বর অধিকতর বিশ্বজনীন তাৎপর্যের অধিকারী হয়ে উঠতে শুরু করেছিলেন।
ঘুম থেকে উঠে জ্যাকব উপলব্ধি করলেন যে, তিনি বোকার মতো এমন। এক পবিত্র জায়গায় রাত্রি যাপন করেছেন, যেখানে দেবতাদের সঙ্গে মানুষের কথোপকথন হওয়া সম্ভব: ‘সত্যিই ইয়াহ্ওয়েহ্ এখানে আছেন, অথচ আমি তা জানতেই পারিনি। তাকে দিয়ে বলাচ্ছেন ‘J’। পৌত্তলিকরা স্বর্গীয় শক্তির মুখোমুখি হলে যেভাবে অনুপ্রাণিত হতো ঠিক সেরকম বিস্ময় বোধ করলেন। জ্যাকব: ‘এ জায়গাটা কী ভীতিকর। এটা ঈশ্বরের ঘর (বেথ প্রথা) ছাড়া তাঁর কিছু নয়; এটাই স্বর্গের দরজা।”[১৩] সহজাতভাবেই তিনি তার সময় ও সংস্কৃতির। ধর্মীয় ভাষায় নিজের মনোভাব প্রকাশ করেছেন: দেবতাদের আবাস খোদ বাবিলনকে ‘দেবদাদের তোরণ’ (Beb-ili) নামে ডাকা হতো। দেশের পৌত্তলিক রীতি অনুযায়ী জায়গাটাকে আলাদা করার সিদ্ধান্ত নিলেন জ্যাকব। বালিশ হিসাবে ব্যবহৃত পাথরটাকে উল্টে তেল মেখে পবিত্র করে নিলেন। এখন থেকে এ জায়গাকে আর লুয ডাকা যাবে না, ডাকতে হবে বেথ এল-এল-এর ঘর। কানানের উর্বরতার ধর্ম বিশ্বাসে খাড়া পাথর সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল, যা বিসিই অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত বেথ-এল-এ বিকাশ লাভ করতে দেখব আমরা। যদিও পরবর্তীকালের ইসরায়েলিরা এ ধরনের ধর্ম বিশ্বাসের তীব্র সমালোচনা করেছে, কিন্তু বেথ-এলে’র পৌত্তলিক স্যাঙ্কচুয়ারি জ্যাকব ও তার ঈশ্বরের আদি কিংবদন্তীর সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল।
বেথ-এল ত্যাগ করার আগে জ্যাকব ওখানে প্রত্যক্ষ করা ঈশ্বরকে আপন ইলোহিম হিসাবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এটা একটা কৌশলগত উপাধি, এ দিয়ে নারী-পুরুষের জন্যে দেবতার পক্ষে করা সম্ভব সবকিছুই বোঝানো হয়। জ্যাকব স্থির করেছিলেন, এল (কিংবা ইয়াহ্ওয়েহ্, ‘J’ যেমন আখ্যায়িত করছেন) যদি সত্যিই হারানে তাঁর হেফাযত করতে পারেন, তাহলে তিনি বিশেষভাবে কার্যকর। একটা বোঝাপড়ায় পৌঁছলেন তিনিঃ এলের বিশেষ নিরাপত্তার বিনিময়ে জ্যাকব তাকে ইলোহিম হিসাবে মেনে নেবেন, তাঁকেই একমাত্র দেবতা বলে গণ্য করা যায়। ইসরায়েলিদের ঈশ্বরের বিশ্বাস ছিল খুবই বাস্তবভিত্তিক। আব্রাহাম ও জ্যাকব দুজনই এলের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছেন, কারণ এল তাদের উপকারে এসেছেন: ধ্যানে বসে তার অস্তিত্বের। প্রমাণ রাখেননি তাঁরা, এল কোনও দার্শনিক বিমূর্ত কল্পনা ছিলেন না। প্রাচীন বিশ্বে মানা ছিল স্বয়ং-প্রকাশিত জীবনের বাস্তবতা, এটা কার্যকরভাবে প্রদান করতে পারলেই দেবতা আপন উপযোগিতার প্রমাণ রাখতে পারতেন। ঈশ্বরের ইতিহাসে এই বাস্তববাদিতা বরাবরই এক উপাদান হয়ে থাকবে। উপকারে আসে বলেই কোনও জাতি ঐশী সম্পর্কে একটা বিশেষ ধরনের ধারণা বা বিশ্বাস মেনে নেয়, সেটা বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক দিক থেকে নিখুঁত বলে নয়।
বহু বছর পর স্ত্রী ও পরিবারসহ হারান থেকে প্রত্যাবর্তন করেন জ্যাকব । কানানের ভূমিতে প্রবেশ করার সময় আবার এক অদ্ভুত এপিফ্যানির অভিজ্ঞতা লাভ করেন তিনি। পশ্চিম তীরে জাব্বক-এর ফেরিঘাটে এক আগন্তুকের দেখা পান যার সঙ্গে সারা রাত হাতাহাতি মারপিট চলে তার । ভোর হওয়ার সময় অধিকাংশ অলৌকিক সত্তার মতো প্রতিপক্ষ জানালেন যে, তাঁকে এবার বিদায় দিতে হবে, কিন্তু জ্যাকব তাঁকে আকড়ে থাকলেন: পরিচয় প্রকাশ না করা। পর্যন্ত তাঁকে যেতে দেবেন না। প্রাচীন বিশ্বে ব্যক্তি বিশেষের নাম জানা থাকলে তার ওপর বিশেষ ক্ষমতা লাভ করা যেত; কিন্তু আগন্তুক যেন এই তথ্যটুকু দেওয়ার ব্যাপারে অনীহা দেখাচ্ছিলেন। অদ্ভুত মারপিট অব্যাহত থাকলে জ্যাকব সচেতন হয়ে উঠলেন যে, তার প্রতিপক্ষ স্বয়ং এল ছাড়া অন্য কেউ নন:
তখন যাকব বিনয় করিয়া কহিলেন, ‘বিনয় করি, আপনার নাম কি? বলুন।’ তিনি বলিলেন, ‘কি জন্যে আমার নাম জিজ্ঞাসা কর?’ পরে তথায় যাকবকে আশীর্বাদ করিলেন। তখন যাকব সেই স্থানের নাম পানুয়েল (এল-র মুখ) রাখিলেন। ‘কারণ আমি এলকে সম্মুখা-সম্মুখি হইয়া দেখিলাম, তিনি বলিলেন, ‘তথাপি আমার প্রাণ বাঁচিল।’[১৪]
এই এপিফ্যানির চেতনা পরবর্তীকালের ইহুদি একেশ্বরবাদের চেতনার চেয়ে বরং ইলিয়াদের চেতনার অনেক কাছাকাছি, ঈশ্বরের সঙ্গে এমন আন্তরিক সংযোগ পরবর্তীকালে ব্লাসফেমাস চিন্তা মনে করা হতো।
যদিও এইসব আদি কাহিনী ধর্মপিতাদের তাদের দেবতার সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি মোটামুটি সে সময়কার পৌত্তলিকদের মতো করেই দেখায়, তবু এগুলো এক নতুন ধরনের ধর্মীয় অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। গোটা বাইবেলে আব্রাহামকে বিশ্বাসী মানুষ অভিহিত করা হয়েছে। আজকাল বিশ্বাসকে আমরা ধর্মমতের প্রতি বুদ্ধিবৃত্তিক সম্মতিদান হিসাবে সংজ্ঞায়িত করতে চাই, কিন্তু, আমরা যেমন দেখেছি, বাইবেলের রচয়িতাগণ ঈশ্বরে বিশ্বাসকে বিমূর্ত বা আধ্যাত্মিক বিশ্বাস হিসাবে দেখেননি। তাঁরা আব্রাহামের বিশ্বাসের প্রশংসা করার সময় তার অর্থডক্সির (ঈশ্বর সম্পর্কে একটা সঠিক ধর্মীয় মতামত ধারণ বা গ্রহণ) গুনকীর্তন করেননি বরং আমরা যেভাবে কোনও ব্যক্তি বা আদর্শে বিশ্বাস করার কথা বলি সেভাবে তাঁর আস্থার কথা বলেছেন। বাইবেলে আব্রাহাম বিশ্বাসী পুরুষ, কারণ তিনি মনে করেন, ঈশ্বর তাঁকে দেওয়া চমৎকার সব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন, সেগুলোকে অসম্ভব মনে হলেও। স্ত্রী সারাহ যেখানে বন্ধ্যা সেখানে আব্রাহাম কেমন করে এক মহান জাতির পিতা হবেন? প্রকৃতপক্ষেই, সারাহ মা হতে পারবেন, এই ধারণাটা এতটাই হাস্যকর ছিল যে তিনি মেনোপজ পর্ব অতিক্রম করে গিয়েছিলেন-প্রতিশ্রুতি শোনামাত্র আব্রাহাম ও সারাহ অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিলেন। সকল প্রতিকূল অবস্থা ছাপিয়ে যখন অবশেষে তাদের পুত্রের জন্ম হলো, তাঁরা তাঁর নাম রাখলেন ইসাক, এ নামের অর্থ ‘হাসি’ বোঝাতে পারে। কিন্তু রসিকতা তিক্ততার রূপ নিল যখন ঈশ্বর এক ভয়ঙ্কর দাবি করে বসলেন: আব্রাহামকে অবশ্যই তার একমাত্র পুত্রকে তার উদ্দেশে উৎসর্গ করতে হবে।
পৌত্তলিক সমাজে মানুষ উৎসর্গ করা ছিল সাধারণ ব্যাপার। নিষ্ঠুর হলেও এর মাঝে যুক্তি ও নীতি ছিল । প্রথম সন্তানকে প্রায়শঃই দেবতার বংশধর বলে বিশ্বাস করা হতো, মাকে যিনি droit de seigneur নামক কর্মের মাধ্যমে অন্তঃসত্ত্বা করেছেন। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে দেবতার শক্তি কমে গিয়েছে; সুতরাং, সেটা পূরণ ও প্রাপ্ত সকল মানার সঞ্চালন নিশ্চিত করার জন্যে প্রথম সন্তানকে তার স্বর্গীয় অভিভাবকের কাছে ফিরিয়ে দিতে হতো। অবশ্য ইসাকের ব্যাপারটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইসাক ছিলেন ঈশ্বরের উপহার, কিন্তু তাঁর স্বাভাবিক সন্তান নন। উৎসর্গ করার কোনও কারণই ছিল না, প্রয়োজন ছিল না স্বর্গীয় শক্তি পুরণের। প্রকৃতপক্ষে, উৎসর্গের ফলে আব্রাহামের গোটা জীবন অর্থহীন হয়ে পড়ত, তিনি এক মহান জাতির পিতা হবেন-এমন প্রতিশ্রুতির ওপর ছিল যার ভিত্তি। এই দেবতা ইতিমধ্যেই প্রাচীন বিশ্বের অপরাপর উপাস্য থেকে আলাদাভাবে ধরা দিতে শুরু করেছিলেন। তিনি মানবীয় দুঃখ-দুদর্শার অংশীদার ছিলেন না, নারী ও পুরুষের কাছ থেকে তাঁর শক্তি সঞ্চয় করার প্রয়োজন পড়েনি। তিনি ছিলেন ভিন্ন এবং যাচ্ছেতাই দাবি তুলতে পারেন। আব্রাহাম তাঁর উপাস্যে আস্থা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি আর ইসাক মোরিয়াহ পর্বতের উদ্দেশে তিন দিনের যাত্রায় নামলেন। মোরিয়াহ পর্বতই পরবর্তীকালে জেরুজালেমস্থ টেম্পলের নির্মাণস্থানে পরিণত হয়। ঐশী নির্দেশের কথা কিছুই জানতেন না ইসাক, নিজের সর্বনাশের কাঠ পর্যন্ত বহন করতে হচ্ছিল তাঁকে। একেবারে শেষ মুহূর্তে আব্রাহাম হাতে ছুরি নেওয়ার পরেই কেবল ঈশ্বর নিবৃত্ত হলেন; আব্রাহামকে জানালেন এটা স্রেফ একটা পরীক্ষা ছিল। আব্রাহাম এক মহান জাতির পিতা হবার যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন, যে জাতির লোকসংখ্যা আকাশের তারা বা সৈকতের বালিকণার সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে।
কিন্তু আধুনিক মানুষের কাছে এটা এক ভয়ঙ্কর কাহিনী: এখানে ঈশ্বর স্বেচ্ছাচারী ও খেয়ালি ধর্ষকামী হিসাবে উপস্থাপিত হয়েছেন। এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, আজকের বহু লোক যারা ছোটবেলায় এ কাহিনী শুনেছে তারা এমন একজন উপাস্যকে বর্জন করে। মিশর থেকে এক্সোডাসের মিথ, ঈশ্বর যখন মোজেস ও ইসরায়েলের সন্তানদের মুক্তির দিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেটাও আধুনিক অনুভূতির প্রতি সমান আক্রমণাত্মক। এ কাহিনী ভালো করেই জানা। ইসরায়েলিদের ছাড়তে অনিচ্ছুক ছিলেন ফারাও, তাই তার ওপর বল প্রয়োগ করার জন্যে ঈশ্বর মিশরের জনগণের উপর দশটি প্লেগ পাঠান। নীল নদ রক্তে পরিণত হয়; গোটা প্রান্তর ব্যাঙ আর পঙ্গপালে সয়লাব হয়ে গেল; নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে ডুবে গেল সারা দেশ। সবার শেষে ভয়ঙ্করতম প্লেগটি পাঠালেন ঈশ্বর: মিশরিয়দের প্রথম সন্তানকে হত্যা করার জন্যে পাঠানো হলো মৃত্যুর ফেরেশতাকে, কিন্তু নিষ্কৃতি দেওয়া হয় হিব্রু দাসদের সন্তানদের। এটা বিস্ময়কর নয় যে, ফারাও ইসরায়েলিদের ছেড়ে দিতে রাজি হলেও পরে আবার সসৈন্য ধাওয়া করলেন তাদের। সী অভ রীডস-এ তাদের নাগাল পেলেন তিনি, কিন্তু ঈশ্বর সাগর দ্বিখণ্ডিত করে ইসরায়েলিদের অপর পারে যেতে সাহায্য করে রক্ষা করলেন। মিশরিয়রা যখন তাদের পিছু ধাওয়া করতে গেল, তিনি আবার সাগরকে মিলিয়ে দিয়ে ফারাও ও তাঁর বাহিনীকে নিমজ্জিত করে ফেললেন ।
এটা নিষ্ঠুর, পক্ষপাতমূলক ও ঘাতক দেবতা: একজন যুদ্ধ দেবতা যিনি ইয়াহ্ওয়েহ্ স্যাবোথ বা সৈন্যদলের ঈশ্বর নামে পরিচিত হয়ে উঠবেন। তিনি প্রবলভাবে পক্ষপাতমূলক, পছন্দের ব্যক্তি ছাড়া আর কারও প্রতি মায়াদয়াহীন এবং একজন গোত্রীয় উপাস্য মাত্র। ইয়াহ্ওয়েহ্ এমন ভয়ঙ্কর দেবতা থেকে গেলে, তত তাড়াতাড়ি তার বিলোপ ঘটত তত সবার মঙ্গল হতো। বাইবেলে যেভাবে আমাদের কাছে এসেছে, এক্সোডাসের চূড়ান্ত মিথকে ঘটনাপ্রবাহের আক্ষরিক বিবরণ বোঝানো হয়নি। অবশ্য প্রাচীন মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের জন্যে একটা পরিষ্কার বাণী হয়ে থাকতে পারে, যারা দেবতাদের সাগর দ্বিখণ্ডিত করার ক্ষমতায় অভ্যস্থ ছিল। কিন্তু মারদুক ও বাআলের বিপরীতে ইয়েহওয়েহ্ ঐতিহাসিক পৃথিবীতে এক সত্যিকার সাগর দ্বিখণ্ডিত করেছেন বলে বলা হয়েছে। এখানে বাস্তববাদিতার সামান্যই ছোঁয়া আছে। ইসরায়েলিরা এক্সোডাসের কাহিনী পুনঃবর্ণনা করার সময় আজ আমরা যেমন ঐতিহাসিক নির্ভুলতায় আগ্রহী তেমন আগ্রহী ছিল না বরং আদি বা মূল ঘটনার তাৎপর্যটুকু বের করার প্রয়াস পেয়েছে, সেটা যাই থাকুক না কেন। কোনও কোনও আধুনিক পণ্ডিত মত প্রকাশ করেছেন যে, এক্সোডাস-কাহিনীটি কানানে মিশর ও এর মিত্রপক্ষের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে সংঘটিত এক সফল কৃষক বিদ্রোহের কিংবদন্তীর রূপ। সে সময়ে এমন একটা ঘটনা নজীরবিহীন ব্যাপার হওয়ার কথা, ফলে প্রত্যেকের মনে গভীর রেখাপাত করাই স্বাভাবিক। ক্ষমতাধর ও শক্তিমানের বিরুদ্ধে নির্যাতিতের ক্ষমতা লাভের এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা হয়ে থাকত সেটা।
আমরা দেখব, ইয়াহ্ওয়েহ্ এস্লোডাসের নিষ্ঠুর নির্দয় দেবতা রয়ে যাননি, যদিও মিথটি তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রতিটির ক্ষেত্রেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ছিল। এটা বিস্ময়কর মনে হতে পারে, ইসরায়েলিরা তাঁকে দুয়ে ও আবেগময় এক প্রতাঁকের আড়ালে শনাক্তকরণের অতীত একটা রূপ দিয়েছে। তারপরও এক্সোডাসের রক্তাক্ত কাহিনী স্বর্গ ও প্রতিহিংসাপূর্ণ ধর্মতত্ত্বের বিপজ্জনক ধারণা জাগানো অব্যাহত রাখবে। আমরা দেখব, বিসিই সপ্তম শতাব্দীতে ডিউটেরোনমিস্ট লেখক (D) নির্বাচনের ভীতিকর ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যা করার জন্যে এই প্রাচীন মিথ ব্যবহার করছেন, যা বিভিন্ন সময়ে তিনটি ধর্মবিশ্বাসের ইতিহাসে নিয়তি নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে। মানবীয় যে কোনও ধারণার মতো ঈশ্বরের ধারণাকেও নিজ স্বার্থে ব্যবহার ও অপব্যবহার করা যায়। মনোনীত জাতি ও স্বর্গীয় নির্বাচনের মিথ প্রায়শঃ ডিউটেরোনমিস্ট আমল থেকে আমাদের সময়েও দুঃখজনকভাবে প্রকট হয়ে আছে যা ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিম মৌলবাদের সময় পর্যন্ত সংকীর্ণ গোত্রীয় ধর্মতত্ত্বের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু ডিউটেরোনমিস্ট এক্সোডাস মিথের একটা ভাষ্য সংরক্ষণ করেছেন যা একেশ্বরবাদের ইতিহাসে সমানভাবে এবং আরও ইতিবাচকভাবে কার্যকর, যেখানে বলা হচ্ছে ঈশ্বর নির্যাতিত ও অক্ষমদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ডিউটেরোনমি-২৬-এ আমরা যা পাচ্ছি সেটা হয়তো ‘J’ এবং ‘E’-র লিখিত বিবরণের আগে লিখিত এক্সোডাসের ব্যাখ্যা হতে পারে। ফসলের প্রথম ফল ইয়াহ্ওয়েহ্র পুরোহিতদের হাতে তুলে দিয়ে নিচের ঘোষণাটি উচ্চারণ করার নির্দেশ দেওয়া হলো ইসরায়েলিদের:
এক নষ্টকল্প আরামিয় আমার পিতৃপুরুষ ছিলেন; তিনি অল্প সংখ্যায় মিশরে নামিয়া গিয়া প্রবাস করিলেন; এবং সে স্থানে মহৎ, পরাক্রান্ত ও বহু প্রজাতি হইয়া উঠিলেন। পরে মিশরিয়রা আমাদের প্রতি দৌরাত্ম। করিল, আমাদিগকে দুঃখ দিল ও কঠিন দাসত্ব করাইল; তাহাতে আমরা আপন পিতৃপুরুষদের ঈশ্বর ইয়াহ্ওয়েহ্র কাছে ক্রন্দন করিলাম আর ইয়াহ্ওয়েহ্ আমাদের রব শুনিয়া আমাদের কষ্ট, শ্রম ও উপদ্রবের প্রতি দৃষ্টি করিলেন। ইয়াহ্ওয়েহ্ বলবান হস্ত, বিস্তারিত বাহু ও মহা ভয় করত এবং নানা চিহ্ন ও অদ্ভুত লক্ষণ দ্বারা মিশর হইতে আমাদিগকে বাহির করিয়া আনিলেন। আর তিনি আমাদিগকে এই দেশ, মধু প্রবাহী দেশ দিয়াছেন এখন, ইয়াহ্ওয়েহ্, দেখ, তুমি আমাদের যে ভূমি দিয়াছ তাহার ফলের অগ্রিমাংশ আমি আনিয়াছি।[১৬]
ইতিহাসের প্রথম সফল কৃষক বিদ্রোহের সম্ভাব্য অনুপ্রেরণাদায়ী ঈশ্বর একজন অভ্যুত্থানের ঈশ্বর। তিনটি ধর্ম বিশ্বাসের প্রত্যেকটিতে তিনি সামাজিক ন্যায়বিচারের এক আদর্শের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, যদিও এটা বলতেই হবে যে ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমরা প্রায়ই এই আদর্শ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে এবং ঈশ্বরকে স্থিতাবস্থার ঈশ্বরে পরিণত করেছে।
ইসরায়েলিরা ইয়াহ্ওয়েহ্কে ‘আমাদের পূর্ব পুরুষের ঈশ্বর’ বলে ডেকেছে, তবু মনে হয় যে, তিনি হয়তো ধর্মপিতাদের উপাস্য কানানের পরম ঈশ্বর এলের চেয়ে ভিন্ন কোনও উপাস্য। হয়তো ইসরায়েলের ঈশ্বর হওয়ার আগে অদ্য কোনও জাতির ঈশ্বর ছিলেন তিনি। মোজেসের কাছে প্রথম দিকের আবির্ভাবের ঘটনাগুলোয় ইয়াহ্ওয়েহ্ বারবার ও দীর্ঘসময় ধরে নিজেকে আব্রাহামের ঈশ্বর বোঝানোর প্রয়াস পেয়েছেন, যদিও মূলত তাঁকে এল শাদ্দাই ডাকা হয়েছে। এই জোর দাবি মোজেসের ঈশ্বরের পরিচয় সংক্রান্ত একটা অত্যন্ত প্রাচীন বিতর্কের প্রতিধ্বনি হয়ে থাকতে পারে। এমন মত প্রকাশ করা হয়েছে যে, ইয়াহ্ওয়েহ্হু আদতে ছিলেন যোদ্ধা দেবতা, আগ্নেয়গিরির দেবতা, মিদিয়ান বা বর্তমান জর্দানে যাঁর উপাসনা করা হতো। ইসরায়েলিরা কোথায় ইয়াহ্ওয়েহ্কে আবিষ্কার করেছিল আমরা সেটা কখনও জানতে পারব না, যদি আদৌ তিনি একেবারে আনকোরা উপাস্য হয়ে থাকেন। আবার, বর্তমানে আমাদের জন্যে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা হতে পারে, তবে বাইবেলের লেখকদের জন্যে এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। পৌত্তলিক প্রাচীনকালে দেবতারা প্রায়ই একে অন্যের সঙ্গে মিশে যেতেন, কিংবা এক এলাকার দেবতাকে অন্য জাতির একই ধরনের দেবতা হিসাবে গ্রহণ করা হতো । আমরা এটুকুই নিশ্চিত হতে পারি যে, তাঁর উৎস যাই হোক না কেন, এক্সোডাসের ঘটনাবলী ইয়াহ্ওয়েহ্কে ইসরায়েলিদের সুনির্দিষ্ট ঈশ্বরে পরিণত করেছিল এবং মোজেস ইসরায়েলিদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, ইনিই। আব্রাহাম, ইসাক ও জ্যাকবের প্রিয় ঈশ্বর এল ।
তথাকথিত ‘মিদিয়নিয় তত্ত্ব’-অর্থাৎ ইয়াহ্ওয়েহ্ মূলত মিদিয়ান জাতির দেবতা ছিলেন-বর্তমানে সাধারণভাবে নাকচ করে দেওয়া হয়, কিন্তু মিদিয়ানেই মোজেস প্রথম ইয়াহ্ওয়েহ্র আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন। এটা স্মরণ করা হবে যে, ইসরায়েলি দাসের ওপর নির্যাতনকারী জনৈক মিশরিয়কে হত্যা করার পর মিশর থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন মোজেস। মিদিয়ানে আশ্রয় নেন তিনি, বিয়ে করেন এবং শ্বশুরের ভেড়ার যত্ন নেওয়ার সময়ই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখেন: আগুনে একটা ঝোঁপ পুড়ছে কিন্তু ছাই হচ্ছে না। ভালো করে দেখার জন্যে তিনি আরও কাছাকাছি গেলে ইয়াহ্ওয়েহ্ মোজেসকে নাম ধরে ডাক দিয়েছিলেন, চেঁচিয়ে উঠেছেন মোজেস: ‘আমি হাজির! (হিনেনি, পূর্ণ মনোযোগ ও আনুগত্যের দাবিদার ঈশ্বরের মুখোমুখি হওয়ার পর ইসরায়েলের সকল পয়গম্বর এই জবাবই দিয়েছেন):
তখন তিনি ঈশ্বর কহিলেন, ‘এ স্থানের নিকটবর্তী হইও না, তোমার পদ হইতে জুতা খুলিয়া ফেল; কেননা যে স্থানে তুমি দাঁড়াইয়া আছ উহা পবিত্র ভূমি।’ তিনি আরও কহিলেন ‘আমি তোমার পিতার ঈশ্বর, আব্রাহামের ঈশ্বর, যাকেবের ঈশ্বর,’ তখন মোজেস আপন মুখ আচ্ছাদন করিলেন কেননা তিনি ঈশ্বরের প্রতি দৃষ্টি সরাইতে ভীত হইয়াছিলেন।
ইয়াহ্ওয়েহ্ প্রকৃতই আব্রাহামের ঈশ্বর, এই নিশ্চয়তা সত্ত্বেও ইয়াহ্ওয়েহ্ একেবারে ভিন্ন ধরনের উপাস্য, আব্রাহামের সঙ্গে বন্ধুর মতো খাবার গ্রহণকারী ঈশ্বরের চেয়ে আলাদা। ইনি আতঙ্ক জাগান ও দূরত্ব বজায় রাখার ওপর জোর দেন। মোজেস যখন তার নাম-পরিচয় জানতে চাইলেন, ইয়াহ্ওয়েহ্ পান ব্যবহার করে জবাব দিলেন, যেটা, আমরা দেখব, বহু শত বছর ধরে একেশ্বরবাদীরা চর্চা করবে। সরাসরি নিজের নাম প্রকাশ করার বদলে তিনি জবাব দিলেন, “আমি যা আমি তাই।’ (Ehyeh asher ehyeh-I am who I Am)।” কী ছিল এর মানে? পরবর্তীকালের দার্শনিকগণ স্থির করেছেন যে, তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ সত্তা, নিশ্চয়ই তা বোঝাননি। এই পর্যায়ে হিব্রু ভাষার এমন কোনও আধিবিদ্যিক মাত্রা ছিল না, আরও ২,০০০ বছর পরে অর্জিত হয়েছিল তা। ঈশ্বর যেন আরও স্পষ্ট কিছু বোঝাতে চেয়েছিলেন। Ehyeh asher ehyeh ইচ্ছাকৃত অস্পষ্টতা প্রকাশের জন্যে ব্যবহৃত হিব্রু বাকধারা। বাইবেল যখন ‘ওরা সেখানে গিয়েছিল সেখানেই গেছে,’ ধরনের বাকধারা ব্যবহার করে তখন এটা বোঝায়: ‘ওরা কোথায় গেছে তার কোনও ধারণাই নেই আমার। সুতরাং, মোজেস যখন ঈশ্বরের পরিচয় জানতে চান কার্যতঃ তার জবাব ছিল: “আমার পরিচয় জানতে হবে না!’ বা ‘নিজের চরকায় তেল দাও!’ ঈশ্বরের প্রকৃতি সম্পর্কে কোনওরকম আলোচনা চলবে না আর পৌত্তলিকরা যেমনটি করে থাকে, দেবতাদের নাম উচ্চারণের সময় অবশ্যই তাঁকে ব্যবহার করা যাবে না। ইয়াহুগুয়েহ্ হলেন শর্তহীন একক। আমি তাই যা আমার হওয়ার কথা। যেমন ইচ্ছা রূপ নেবেন তিনি এবং কোনও রকম নিশ্চয়তা দেবেন না। সোজাসুজি তাঁর জাতির ইতিহাসের ধারা অংশগ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। এক্সোভাসের মিথ চূড়ান্ত বলে প্রমাণিত হবে: এমনকি সর্বাধিক প্রতিকূল পরিবেশেও এটা ভবিষ্যতের জন্যে আশা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।
ক্ষমতায়নের এই নতুন বোধের বিনিময়ে মূল্য দিতে হয়েছিল। মানবীয় উপলব্ধির বিচারে স্কাই গডকে অনেক বেশি দূরবর্তী মনে হয়েছিল। মারদুক, বাআল এবং মাতৃদেবী (Mother Goddesses)রা মানবজাতির অনেক কাছাকাছি ছিলেন, কিন্তু ইয়াহ্ওয়েহ্ আবার মানুষ ও স্বর্গের মাঝে বিরাট দূরত্ব ফিরিয়ে এনেছিলেন। সিনাই পর্বতের কাহিনীতে এ বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠেছে। পর্বতের কাছে পৌঁছার পর জনতাকে পোশাক পবিত্র করে দূরে অবস্থান করার নির্দেশ দেওয়া হয়। মোজেস ইসরায়েলিদের সতর্ক করতে বাধ্য হয়েছেন: ‘পাহাড়ের কাছাকাছি যাবে না বা ওটার পাদদেশ স্পর্শ করবে না। যে পাহাড়ের গায়ে হাত দেবে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। জনতা পাহাড় থেকে দূরে অবস্থান করেছে আর ইয়াহ্ওয়েহ্ আগুন ও মেঘের মাঝে অবতীর্ণ হয়েছেন:
পরে তৃতীয় দিন প্রভাত হইলে মেঘগর্জন ও বিদ্যুৎ এবং পৰ্ব্বতের উপরে নিবিড় মেঘ হইল আর অতিশয় উচ্চরবে তূরীধ্বনি হইতে লাগিল; তাহাতে শিবিরস্থ সমস্ত লোক কাঁপিতে লাগিল। পরে মোজেস ঈশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিবার জন্যে লোকদিগকে শিবির হইতে বাহির করিলেন। আর তাহারা পৰ্ব্বতের তলে দণ্ডায়মান হইল। তখন সমস্ত সিনাই পৰ্ব্বত ধূমময় ছিল; কেননা ইয়াহ্ওয়েহ্ অগ্নিসহ তাহার উপরে নামিয়া আসিলেন আর ভাটীর ধূমের ন্যায় তাহা হইতে ধূম উঠিতে লাগিল এবং সমস্ত পর্বত অতিশয় কাঁপিতে লাগিল।[২০]
মোজেস একাকী পাহাড়চূড়ায় উঠলেন এবং ল (Law) উৎকীর্ণ পাথরখণ্ডসমূহ গ্রহণ করলেন। পৌত্তলিক দর্শনের অনুরূপ প্রকৃতি হতে আহরণের বদলে শৃঙ্খলা, সাম্য ও ন্যায়বিচারের মূল নীতিমালাসমূহ অর্থাৎ আইন এবার মহাকাশ হতে অবতীর্ণ করা হলো। ইতিহাসের ঈশ্বর জাগতিক বিশ্বের অধিকতর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেন, তাঁর লীলাক্ষেত্র কিন্তু আবার এ থেকে গভীরভাবে আলাদা থাকার প্রবণতাও রয়েছে।
বিসিই পঞ্চম শতাব্দীতে সম্পাদিত এক্সোডাসের চূড়ান্ত টেক্সট-এ সিনাই পর্বতে ঈশ্বর মোজেসের সঙ্গে একটা চুক্তিতে (covennant) উপনীত হওয়ার কথা বলা হয়েছে (এ ঘটনাটি ১২০০ সাল নাগাদ সংঘটিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। এ বিষয়ে পণ্ডিতদের মাঝে বিতর্ক আছে: কোনও কোনও সমালোচক বিশ্বাস করেন যে, বিসিই সপ্তম শতাব্দীর আগে এই চুক্তি ইসরায়ের্লে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু সময় যাই হোক, চুক্তির ধারণা আমাদের জানায় যে, ইসরায়েলিরা তখন একেশ্বরবাদী হয়ে ওঠেনি, কেননা এটা কেবল বহু ঈশ্বরের পটভূমিতেই খাপ খায়। ইসরায়েলিরা এটা বিশ্বাস করত না যে সিনাইয়ের ঈশ্বর ইয়াহ্ওয়েহ্ই একমাত্র ঈশ্বর, তবে তারা অঙ্গীকার করেছিল, অন্য সব দেবতাকে অগ্রাহ্য করে তারা কেবল ইয়াহ্ওয়েহ্রই উপাসনা করবে। গোটা পেন্টাটিউকে একটা একেশ্বরবাদী ঘোষণা বা বাক্য খুঁজে বের করাও খুব কঠিন। এমনকি সিনাই পর্বতে হস্তান্ত। রিত টেন কমান্ডমেন্টসও অন্য দেবতাদের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছে: ‘আমার সামনে তোমাদের জন্যে আর কোনও অচেনা দেবতা থাকবে না।’[২১] মাত্র একজন উপাস্যের উপাসনা করার ধারণাটি বলতে গেলে এক নজীরবিহীন পদক্ষেপ ছিল। মিশরিয় ফারাও আখেনাতেন মিশরের অন্যান্য প্রচলিত দেবতাকে অগ্রাহ্য করে সূর্য দেবতার উপাসনার প্রয়াস পেয়েছিলেন, কিন্তু তার উত্তরাধিকারীরা অবিলম্বে সেই নীতিমালা পরিবর্তন করে ফেলেন। মানার সম্ভাব্য উৎসকে অগ্রাহ্য করা সোজাসুজি বোকামি মনে হয়েছে ইসরায়েলিদের। পরবর্তীকালের ইতিহাস আমাদের দেখায়, অন্য দেবতার কাল্ট অগ্রাহ্য করতে দারুণ অনিচ্ছুক ছিল তারা। যুদ্ধে আপন দক্ষতার প্রমাণ রেখেছিলেন ইয়াহ্ওয়েহ্, কিন্তু উর্বরতার দেবতা ছিলেন না তিনি। কানানে বসতি করার পর ইসরায়েলিরা সহজাত প্রবৃত্তির বশেই আবার কানের ভূস্বামী বাআলের কাল্টের আশ্রয় নিয়েছে, যিনি স্মরণাতীত কাল থেকে শস্য উৎপাদন করে আসছিলেন। পয়গম্বরগণ ইসরায়েলিদের চুক্তির শর্ত মেনে চলার অনুরোধ জানিয়েছেন, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী প্রচলিত পদ্ধতিতে বাআল, আশেরাহ, ও আনাতের উপাসনা অব্যাহত রেখেছে। প্রকৃতপক্ষে বাইবেল আমাদের জানাচ্ছে যে, মোজেস সিনাই পর্বতে থাকার সময় বাকি। সবাই কানানের পুরোনো পৌত্তলিক ধর্মে ফিরে গিয়েছিল। তারা প্রচলিত প্রতিমা সোনালি আঁড় তৈরি করে তার সামনে প্রাচীন আচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। সিনাই পর্বত চূড়ার আতঙ্ক জাগানো দিব্যপ্রকাশের বিপরীতে এই ঘটনার উপস্থাপন সম্ভবত পেন্টটিউকের সর্বশেষ সম্পাদকমণ্ডলীর ইসরায়েলের বিভাজনের তিক্ততার রূপ তুলে ধরার একটি প্রয়াস। মোজেসের মতো পয়গম্বরগণ ইয়াহ্ওয়েহ্র উচ্চ ধর্ম প্রচার করেছেন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ দেবতা, প্রকৃতি ও মানুষের মাঝে একতার হলিস্টিক দর্শন মোতাবেক প্রাচীন আচার পালন করতে চেয়েছে।
তারপরও এক্সোডাসের পর ইসরায়েলিরা ইয়াহ্ওয়েহ্কে তাদের একমাত্র ঈশ্বর হিসাবে মানার অঙ্গীকার করেছিল। পরবর্তী বছরগুলোয় পয়গম্বরগণ এই চুক্তির কথা তাদের মনে করিয়ে দেবেন। কেবল ইয়াহ্ওয়েহ্কে এলোহিম হিসাবে উপাসনা করার অঙ্গীকার ছিল তাদের। বিনিময়ে ইয়াহ্ওয়েহ্র প্রতিশ্রুতি ছিল তারা তার বিশেষ জাতিতে পরিণত হবে এবং তার অসাধারণ কার্যকর প্রতিরক্ষা ভোগ করবে। ইয়াহ্ওয়েহ্ তাদের এই বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, চুক্তি ভঙ্গ করলে তিনি তাদের নিষ্ঠুরভাবে ধ্বংস করে দেবেন। কিন্তু তারপরেও ইসরায়েলিরা এই চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল। জশুয়া পুস্তকে আমরা সম্ভবত ইসরায়েল ও তার ঈশ্বরের এই চুক্তির আদি বিবরণ পাই। চুক্তিটি ছিল এক আনুষ্ঠানিক সমঝোতা স্মারক, দুটি পক্ষকে একসঙ্গে আবদ্ধ করার জন্যে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে প্রায়শঃই এর ব্যবহার হতো। একটা নির্দিষ্ট ধরণ অনুসরণ করেছে এটা। চুক্তির টেক্সট শুরু হতো অধিকতর শক্তিশালী রাজার পরিচয় দিয়ে, তারপর বর্তমান কাল পর্যন্ত উভয়পক্ষের সম্পর্কের ইতিহাস বর্ণনা করা হতো। সবশেষে চুক্তির অমর্যাদা হলে শাস্তির প্রকৃতিসহ অপরাপর শর্তাবলী উল্লেখ করা হতো। গোটা চুক্তির অত্যাবশ্যকীয় বিষয়টি ছিল শর্তহীন আনুগত্যের দাবি। চতুর্দশ শতাব্দীতে হিট্টিট রাজা দ্বিতীয় মুরসিলিস এবং তার সামন্ত দুপ্পি তাশেকের মাঝে স্বাক্ষরিত চুক্তি বা কভেন্যান্টে রাজা দাবি তুলেছিলেন: “আর কারও কাছে আশ্রয় চাইবে না। তোমার পিতা মিশরে উপঢৌকন পাঠিয়েছে, তুমি তা করবে না…আমার বন্ধুর সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব হবে, আমার শত্রুর শত্রু হবে তুমি।’ বাইবেল আমাদের বলছে ইসরায়েলিরা কানানে পৌঁছে আপনজনদের সঙ্গে মিলিত হলে আব্রাহামের সকল বংশধর ইয়াহ্ওয়েহ্র সঙ্গে এক চুক্তিতে উপনীত হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মাজেসের উত্তরাধিকারী জোশুয়া, ইয়াহ্ওয়েহ্র প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। চুক্তিটি প্রচলিত প্যাটার্ন অনুসরণ করেছে। ইয়াহ্ওয়েহ্র পরিচয় দেওয়া হয়েছে, আব্রাহাম, ইসাক ও জ্যাকরের সঙ্গে তার কর্মকাণ্ডের উল্লেখ করা হয়েছে; এরপর এক্সোডাসের ঘটনাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। সবশেষে জোশুয়া চুক্তির শর্তাবলী উল্লেখ করে সমবেত ইসরায়েলি জাতির আনুষ্ঠানিক সম্মতি দাবি করেছেন:
অতএব এখন তোমরা ইয়াহ্ওয়েহ্কে ভয় কর, সরলতায় ও সত্যে তাহার সেবা কর, আর তোমাদের পিতৃপুরুষেরা (ফরাৎ) নদীর ওপারে ও মিশরে যে দেবতাগণের সেবা করিত তাহাদিগকে দূর করিয়া দেও; এবং ইয়াহ্ওয়েহ্র সেবা কর। যদি ইয়াহ্ওয়েহ্র সেবা করা তোমাদের মন্তু বোধহয়, তবে যাহার সেবা করিবে তাহাকে অদ্য মনোনীত কর; নদীর ওপারস্থ তোমাদের পিতৃপুরুষের সেবিত দেবগণ হয় হউক, কিম্বা যাহাদের দেশে তোমরা বাস করিতেছ সেই ইমোরিয়দের দেবগণ হয় হউক।[২২]
ইয়াহ্ওয়েহ্ ও কানানের প্রচলিত দেবতাদের মধ্য থেকে যে কোনও এক পক্ষকে বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল জনগণের। দ্বিধা করেনি ওরা। ইয়াহ্ওয়েহ্র মতো আর কোনও দেবতা ছিলেন না; আর কোনও উপাস্যকে তাঁর উপাসকের পক্ষে এমন কার্যকর দেখা যায়নি। ওদের জীবন ধারায় তার শক্তিশালী হস্তক্ষেপ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে যে, ইয়াহ্ওয়েহ্ই তাদের এলোহিম হওয়ার যোগ্যতা রাখেন: অন্য দেবতাদের বাদ দিয়ে তারা কেবল ইয়াহ্ওয়েহ্রই সেবা করবে। জোশুয়া তাদের সতর্ক করে দিয়েছেন: ইয়াহ্ওয়েহ্ দারুণ ঈর্ষাপরাণ । তারা চুক্তির শর্তাবলী উপেক্ষা করলে তিনি তাদের ধ্বংস করে দেবেন। জনতা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রইল: একমাত্র ইয়াহ্ওয়েহ্কেই তারা ইলোহিম হিসাবে বেছে নিয়েছে। তবে এখন আপনাদের মধ্যস্থিত বিজাতীয় দেবগণকে দূর করিয়া দেও, ও আপন আপন হৃদয় ইসরায়েলের ঈশ্বর ইয়াহ্ওয়েহ্র দিকে রাখ।[২৩]
বাইবেল দেখাচ্ছে, জনগণ চুক্তির প্রতি বিশ্বস্ত ছিল না। যুদ্ধের সময়, যখন ইয়াহ্ওয়েহ্র সমারিক নিরাপত্তা প্রয়োজন হতো তখন চুক্তির কথা মনে করত তারা, কিন্তু শান্তির সময় অতীতের কায়দায় বাআল, আনাত ও আশেরাহর উপাসনায় মগ্ন হতো। যদিও ইয়াহ্ওয়েহ্র কাল্ট ঐতিহাসিক প্রবণতার দিক থেকে মৌলিকভাবে আলাদা ছিল, কিন্তু প্রায়ই প্রাচীন পৌত্তলিকতার ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করেছে। বাদশাহ সলোমন যখন তার পিতা ডেভিড কর্তৃক জেরুসাইটদের কাছ থেকে অধিকৃত নগরী জেরুজালেমে ইয়াহ্ওয়েহ্ সম্মানে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, সেটা কানানের দেবতাদের মন্দিরসমূহের অনুরূপ ছিল । তিনটি বর্গাকৃতি জায়গার সমাহার ছিল তা, যা চৌকো আকৃতির একটা কক্ষে শেষ হয়েছে। এই কক্ষই ‘পবিত্রতম মন্দির’ নামে পরিচিত, যেখানে ইসরায়েলিদের এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ানোর সময় বহনযোগ্য বেদী আর্ক অভ দ্য কভেন্যান্ট রাখা ছিল। মন্দিরের ভেতরে ছিল এক বিরাটাকৃতি ব্রোঞ্জ বেসিন যা কানানের মিথের আদিম সাগর ইয়াম-এর স্মারক: চল্লিশ ফুট দীর্ঘ মুক্ত একজোড়া পিলার, আশেরাহর উর্বরতার কাল্টের ইঙ্গিতবাহী। বেথ-এল, শিলোহ হেবরন, বেথলহেম ও ডান-এ কানবাসীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রাচীন মন্দিরগুলোয় ইয়াহ্ওয়েহ্র উপাসনা অব্যাহত রেখেছিল ইসরায়েলিরা, এসব জায়গায় প্রায়ই পৌত্তলিক আচার অনুষ্ঠান করা হতো। মন্দিরটি অচিরেই আলাদা মর্যাদার অধিকারী হয়ে উঠেছিল, যদিও, আমরা দেখব, ওখানে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য আনঅর্থডক্স কর্মকাণ্ডও ঘটতে দেখা গেছে। ইসরায়েলিরা মন্দিরটিকে স্বর্গে ইয়াহ্ওয়েহ্র দরবারের অনুকৃতি হিসাবে দেখতে শুরু করেছিল। প্রায়শ্চিত্ত দিবসে ছাগল উৎসর্গ করার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শরৎকালে তাদের নিজস্ব নববর্ষ উৎসব ছিল; এর পাঁচদিন পরে কৃষি বর্ষের শুরুতে উদযাপিত হতো ট্যাবারন্যাকলস ভোজ-এর নবান্ন উৎসব। মত প্রকাশ করা হয়েছে যে, ট্যারন্যাকলস ভোজের সময় মন্দিরে ইয়াহ্ওয়েহ্র অভিষেকের সম্মানে উচ্চারিত কিছু শ্লোক (Psalms) মারদুকের অভিষেকের মতো আদি বিশৃঙ্খলা দমন করার ঘটনার স্মৃতিচারণ।২৯ বাদশাহ সলোমন স্বয়ং বিশিষ্ট সিনক্রিটিস্ট ছিলেন: অনেক পৌত্তলিক স্ত্রী ছিল তাঁর যাঁরা নিজস্ব দেবতার উপাসনা করতেন, বাদশা সলোমনের সঙ্গে তাঁর পৌত্তলিক পড়শীদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।
ইয়াহ্ওয়েহ্র কাল্টের জনপ্রিয় পৌত্তলিকতার আড়ালে হারিয়ে যাওয়ার বিপদ বরাবরই ছিল। নবম শতাব্দীর শেষার্ধে এটা বিশেষভাবে প্রকট হয়ে ওঠে। ৮৬৯ সালে রাজা আহাব উত্তরের ইসরায়েল রাজ্যের শাসনভার লাভ করেন। তাঁর স্ত্রী বর্তমান লেবাননের তায়ার ও সিদনের রাজকন্যা আন্তরিক পৌত্তলিক ছিলেন। গোটা দেশকে বাআল ও আশেরাহর ধর্মের অধীনে আনতে আগ্রহী ছিলেন তিনি। বাআলের পুরোহিতদের আমদানি করেন তিনি, উত্তরাঞ্চলীয়দের মাঝে দ্রুত অনুসারী যোগাড় করে ফেলেন তাঁরা, এরা রাজা ডেভিডের দ্বারা বিজিত হয়েছিল ও সুপ্ত ইয়াহ্ওয়েহ্ গোষ্ঠী। আহাব ইয়াহ্ওয়েহ্র প্রতি বিশ্বস্ত থাকলেও জেজেবেলের ধর্মান্তকরণের প্রয়াসে বাদ সাধেননি। অবশ্য তার শাসনাকালের শেষ দিকে যখন গোটা দেশ এক তীব্র খরায় আক্রান্ত হলো, তখন এলি-যাহ (ইয়াহ্ওয়েহ্ আমাদের ঈশ্বর’) নামের একজন পয়গম্বর পশমি চাদর ও চামড়ার লংক্লথ পরে দেশময় ইয়াহ্ওয়েহ্ প্রতি অবিশ্বস্ততার জন্যে সবাইকে অভিশাপ দিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। কারমেল পাহাড়ে ইয়াহ্ওয়েহ্ ও বাআলের মধ্যে এক প্রতিযোগিতা প্রত্যক্ষ করার জন্য রাজা আহাব আর প্রজাদের আহ্বান জানালেন তিনি। সেখানে বাআলের ৪৫০ জন পয়গম্বরের উপস্থিতিতে জনতার উদ্দেশে জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন: আর কতদিন ওরা উপাস্যের মাঝে দোদুল্যমানতায় ভুগবে? এরপর দুটো ষাঁড় আনতে বললেন তিনি, একটা নিজের জন্যে, অপরটি বাআলের পয়গম্বরদের জন্যে; দুটো ভিন্ন বেদীতে স্থাপন করতে হবে ওগুলো । যার যার ঈশ্বরকে ডাকবেন তারা এবং দেখবেন কোন দেবতা দুর্যোগ গ্রাস করার জন্যে অগ্নি প্রেরণ করেন। রাজি! চেঁচিয়ে জানান দিল জনতা। বাতালের পয়গম্বরগণ সারা সকাল তাঁকে আহ্বান জানিয়ে গেলেন; বেদী ঘিরে বিশেষ নাচে অংশ নিলেন, চেঁচামেচি করে ছুরি ও বর্শা দিয়ে নিজেদের ক্ষতবিক্ষত করলেন। কিন্তু ‘কোনও কণ্ঠস্বর শোনা গেল গেল না, মিলল না জবাব।’ এলি যাহ তিরস্কার করলেন: ‘আরও জোরে চেঁচাও!’ চেঁচিয়ে বললেন তিনি, কেননা তিনি একজন দেবতা: অন্য কাজ করছেন বা ব্যস্ত আছেন; কিংবা হয়তো কোথাও যাত্রা করেছেন; হয়তো ঘুমিয়ে আছেন, এবার জেগে উঠবেন।’ কিছুই ঘটল না: ‘কোনও কণ্ঠস্বর শোনা গেল না, জবাব নেই, তাদের প্রতি কোনও ভ্রূক্ষেপই করা হলো না।
এবার এলিযাহর পালা। ইয়াহ্ওয়েহ্র বেদীর চারপাশে ভিড় জমাল জনতা। বেদীর চারপাশে নালা খনন করে সেখানে পানি ঢেলে আগুন জ্বালানো আরও কঠিন করে তুললেন এলিযাহ্। এরপর ইয়াহ্ওয়েহ্কে আহ্বান জানালেন তিনি। এবং অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে স্বর্গ থেকে আগুন নেমে এসে বেদী আর ষাঁড়কে গ্রাস করে নিল, শুষে নিল নালার সব পানি। মুখ থুবড়ে পড়ল জনতা। ‘ইয়াহ্ওয়েহ্ই ঈশ্বর, জোর গলায় বলল তারা, ইয়াহ্ওয়েহ্ই ঈশ্বর।’ এলিযাহ্ মহানুভব বিজয়ী ছিলেন নাবাআলের পয়গম্বরদের আটক কর?’ নির্দেশ দিলেন তিনি। কাউকে ছাড়া যাবে নাঃ নিকটবর্তী এক উপত্যকায় নিয়ে ওদের হত্যা করলেন তিনি।[২৫] পৌত্তলিক মতবাদ সাধারণত অপর জাতির ওপর আরোপিত হতে চায় না। জেজেবেল ছিলেন কৌতূহলোদ্দীপক ব্যতিক্রম যেহেতু দেবালয়ে অন্যান্য দেবতার পাশে আরেকজন দেবতার খুব সহজেই স্থান মিলত। এইসব প্রাচীন পৌরাণিক ঘটনাবলী দেখায় যে, শুরু থেকেই ইয়াহ্ওয়েহ্র ধর্মমত ভয়ঙ্কর নির্যাতন ও অন্যান্য ধর্ম বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। পরবর্তী অধ্যায়ে এই বিষয়টি আরও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করব আমরা। গণহত্যার পর এলিযাহু কারমেল পাহাড়ের চূড়ায় উঠে দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা খুঁজে প্রার্থনায় বসলেন, ক্ষাণিক পর পর দিগন্ত জরিপ করার জন্যে দাস পাঠাতে লাগলেন। অবশেষে ক্ষুদ্র এক মেঘখণ্ডের খবর নিয়ে এল। সে-মানুষের হাতের সমান হবে ওটার আকার-সাগর থেকে উঠে আসছে। এলিযাহ্ তখন দাসকে পাঠালেন আহাবকে খবর দেওয়ার জন্যে যেন বৃষ্টি পথরোধ করার আগেই তিনি দ্রুত বাড়ি ফিরে যান। বলতে গেলে কথা বলার মুহূর্তেই ঝড়ো মেঘে আকাশ অন্ধকার করে মুষলধারায় বৃষ্টি ঝরতে শুরু করল। প্রবল উচ্ছ্বাসে এলিযাহ্ তাঁর আলখেল্লা গুটিয়ে আহাবের রথের পাশাপাশি ছুটতে শুরু করলেন। বৃষ্টি প্রেরণের মাধ্যমে ইয়াহ্ওয়েহ্ ঝড় দেবতা বাআলের ভূমিকা দখল করে নিয়েছেন; প্রমাণ করেছেন, যুদ্ধের মতো উর্বরতাদানেও সমান পারঙ্গম তিনি।
পয়গম্বরদের হত্যা করার প্রতিক্রিয়া ঘটার আশঙ্কায় পালিয়ে সিনাই পেনিনসুলায় চলে যান এলিযাহ্; ঈশ্বর যেখানে মোজেসকে দর্শন দিয়েছিলেন সেই পাহাড়ে আশ্রয় নেন। সেখানে এক নতুন থিওফ্যানির অভিজ্ঞতা লাভ করেন তিনি যা নতুন ইয়াহ্ওয়েহ্বাদী আধ্যাত্মিকতা প্রকাশ করেছে। স্বর্গীয় প্রতাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পাহাড় প্রাচীরের এক ফোকরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয় তাঁকে:
স্বয়ং ইয়াহ্ওয়েহ্ সেই স্থান দিয়া গমন করিলেন; এবং ইয়াহ্ওয়েহ্র অগ্রগামী প্রবল প্রচণ্ড বায়ু পর্বতমালা বিদীর্ণ করিল, শৈল সকল ভাঙ্গিয়া ফেলিল, কিন্তু সেই বায়ুতে ইয়াহ্ওয়েহ্ ছিলেন না। বায়ুর পরে ভূমিকম্প হইল, কিন্তু সেই ভূমিকম্পে ইয়াহ্ওয়েহ্ ছিলেন না। ভূমিকম্পের পরে অগ্নি হইল, কিন্তু সে অগ্নিতে ইয়াহ্ওয়েহ্ ছিলেন না। অগ্নির পরে ঈষৎ শব্দকারী ক্ষুদ্র একক স্বর হইল, তাহা শুনিবামাত্র এলিযাহ্ শাল দিয়া মুখ ঢাকিলেন।[২৬]
পৌত্তলিক উপাস্যদের বিপরীতে প্রকৃতির কোনও শক্তি নন ইয়াহ্ওয়েহ্, বরং একেবারে আলাদা জগতের। সরব নীরবতার বৈপরীত্যের মাঝে প্রায় দুর্বোধ্য মৃদু হাওয়ার গুঞ্জনে তার উপস্থিতি উপলব্ধি করা গেছে।
এলিযাহ্র কাহিনীতে ইহুদি ঐশীগ্রন্থের অতীত কালের সর্বশেষ পৌরাণিক বিবরণ রয়েছে। গোটা ওইকুমিনের সময় পরিবর্তনের হাওয়া ছিল পরিবেশে। বিসিই ৮০০-২০০ পর্যন্ত সময়কালকে অ্যাক্সিয়াল যুগ বলা হয়েছে। সভ্য জগতের সকল প্রধান অঞ্চলে মানুষ নতুন নতুন আদর্শ বা মতবাদ তৈরি করেছে যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ ও গঠনমূলক রয়ে গেছে। নতুন ধর্মীয় ব্যবস্থাগুলো পরিবর্তিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। আমাদের উপলব্ধির সম্পূর্ণ অতীত কোনও কারণে সকল প্রধান সভ্যতা বাণিজ্যিক যোগাযোগ না থাকা সত্ত্বেও সমান্তরালভাবে গড়ে উঠেছিল (যেমন চীন ও ইউরোপিয় অঞ্চলের কথা বলা যায়)। এক নতুন সমৃদ্ধির ফলে একটি বণিক শ্ৰেণী গড়ে উঠেছিল । রাজা, পুরোহিত, মন্দির এবং রাজপ্রাসাদ থেকে বাজারে ক্ষমতার স্থানান্তর ঘটছিল। নতুন অর্জিত সম্পদ বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আলোকনের দিকে নিয়ে যাবার পাশাপাশি ব্যক্তির বিবেক বোধকেও জাগিয়ে তুলেছে। নগরীসমূহে পরিবর্তনের ধারা ত্বরান্বিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অসাম্য ও শোষণের বিষয়টি স্পষ্টতর হয়ে ওঠে, জনগণ বুঝতে শুরু করে যে তাদের আচরণ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিয়তি প্রভাবিত করতে পারে। এইসব সমস্যা ও উদ্বেগের সমাধানের লক্ষ্যে প্রত্যেক অঞ্চল স্পষ্টতঃ পৃথক মতবাদ গড়ে তোলে: চীনে তাওবাদ ও কুনফুসিয়বাদ, ভারতে হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধমতবাদ এবং ইউরোপে দার্শনিক যুক্তিবাদ; মধ্যপ্রাচ্য একক কোনও সমাধান খুঁজে বের করেনি, তবে ইরান ও ইসরায়েলে যথাক্রমে থরোস্টোপ ও হিব্রু পয়গম্বরগণ যথাক্রমে একেশ্বরবাদের ভিন্ন রূপের জন্ম দিয়েছিলেন। ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হতে পারে, সেসময়ের অন্যান্য মহান ধর্মীয় দর্শনের মতো ‘ঈশ্বরে’র ধারণাও আক্রমণাত্মক বা আগ্রাসী পুঁজিবাদের চেতনার মাঝে বাজার অর্থনীতিতে বিকাশ লাভ করেছিল।
পরবর্তী অধ্যায়ে ইয়াহ্ওয়েহ্র পরিবর্তিত ধর্ম নিরীক্ষায় যাবার আগে আমি এমনি দুটো নতুন বিকাশের দিকে সংক্ষেপে নজর বোলানোর প্রস্তাব রাখছি। ভারতে ধর্মীয় বোধ সমরূপ ধারায় গড়ে উঠেছিল, কিন্তু এর আলাদা প্রবণতা ঈশ্বরের ইসরায়েলি ধারণার বিচিত্র বৈশিষ্ট্য ও সমস্যাদিকে আলোকিত করবে। প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের যুক্তিবাদও (Rationalism) গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমরা তাদের ধারণা গ্রহণ করেছে এবং সেগুলোকে নিজস্ব ধর্মীয় অভিজ্ঞতায় সংযোজনের প্রয়াস পেয়েছে, যদিও গ্রিক ঈশ্বর তাদের ঈশ্বরের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিলেন।
বিসিই সপ্তদশ শতাব্দীতে বর্তমান ইরান থেকে আর্যরা ইন্দাস উপত্যকায় হামলা চালিয়ে স্থানীয় জনগণকে পরাভূত করে। তারা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ধারণা চাপিয়ে দেয়, যেগুলো আমরা বেদ নামে পরিচিত গীতি কবিতার সংকলনে প্রকাশিত হতে দেখি। এখানে আমরা বহুসংখ্যক দেবতার উল্লেখ দেখতে পাই, যারা মধ্যপ্রাচ্যের দেবদেবীদের মতো মোটামুটি একই মূল্যবোধ প্রকাশ করেন এবং শক্তি, প্রাণ ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে প্রকৃতির শক্তির একাত্মতা তুলে ধরেন। কিন্তু তারপরও এমন ইঙ্গিত ছিল যাতে মানুষ বুঝতে শুরু করেছিল যে, অসংখ্য দেবতা হয়তো সবাইকে ছাপিয়ে যাওয়া একজন মাত্র স্বর্গীয় সত্তার প্রকাশ হতে পারেন। বাবিলনবাসীদের মতো আর্যরাও সজাগ ছিল যে তাদের মিথগুলো বাস্তব ঘটনার বিবরণ নয়, বরং এমন এক রহস্যের প্রকাশ যার যথাযথ ব্যাখ্যা দান এমনকি দেবতাদের পক্ষেও সম্ভব নয়। আদি বিশৃঙ্খলা থেকে দেবতা ও পৃথিবী সৃষ্টির প্রক্রিয়ার কল্পনা করতে গিয়ে তারা উপসংহারে পৌঁছায় যে কারও পক্ষে-এমনকি দেবতার পক্ষেও-অস্তিত্বের রহস্য উপলব্ধি করা সম্ভব নয়:
আহলে কে বলতে পারবে কখন এর উৎপত্তি ঘটেছে,
কখন এই উৎসারণ সংঘটিত হয়েছে,
ঈশ্বর কি একে বিন্যস্ত করেছেন, নাকি করেন নাই,–
কেবল এর স্বর্গীয় প্রতিপালকই জানেন।
কিংবা হয়তো তিনিও জানেন না![২৭]
বেদের ধর্ম জীবনের উৎস ব্যাখ্যা করার দিকে যায়নি বা দার্শনিক প্রশ্নাবলীর বিশেষ ধরনের উত্তর দেয়নি। তার বদলে মানুষকে অস্তিত্বের বিস্ময় ও আতঙ্কের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করার লক্ষ্যে একে গড়ে তোলা হয়েছে। উত্তরের চেয়ে বেশি প্রশ্নের উত্থাপন করেছে এবং মানুষকে সশ্রদ্ধ বিস্ময়ে ধরে রাখার জন্যে গড়া হয়েছে।
বিসিই অষ্টম শতাব্দী নাগাদ যখন ‘J’ ও ‘E’ তাদের বিবরণ লিপিবদ্ধ করছেন, সেই সময় ভারতীয় উপমহাদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মানে ছিল, বৈদিক ধর্ম প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে। আর্য আগ্রাসনের পর বহু শত বছর চাপা পড়ে থাকা স্থানীয় জনগণের ধারণা ফের জেগে ওঠে ও এক নতুন ধর্মীয় আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে। কর্মে নতুন আগ্রহ, অর্থাৎ কারও নিয়তি তার কর্ম দিয়ে নির্ধারিত হয়, এই ধারণা মানুষকে নিজের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের জন্যে দেবতাদের দায়ী করায় অনাগ্রহী করে তোলে। ক্রমবর্ধমান হারে দেবতাদের একজন একক দুৰ্জ্জেয় সত্তার (Reality) প্রতীক হিসাবে দেখা হচ্ছিল। বৈদিক ধর্ম উৎসর্গের আচার অনুষ্ঠানে ভরে উঠেছিল, কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় অনুশীলন যোগ (মনোযোগ একীভূত করার বিশেষ চর্চার মাধ্যমে মনের শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ) বোঝায় যে, বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব ধর্মের ওপর মানুষ অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছিল। উৎসর্গ ও শাস্ত্রীয় আচার যথেষ্ট বিবেচিত হয়নিঃ এই আচার অনুষ্ঠানের অন্তর্গত অর্থ আবিষ্কার করতে চেয়েছে তারা। আমরা স্মরণ করব যে, ইসরায়েলের পয়গম্বরগণও একই রকম অসন্তোষ বোধ করেছিলেন। ভারতে দেবতাদের আর উপাসকদের দেহাতীত কোনও সত্তা হিসাবে দেখা হচ্ছিল না, বরং নারী-পুরুষ সত্যের অভ্যন্তরীণ উপলব্ধির সন্ধান করেছে।
ভারতে দেবতাগণ আর খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। এখন থেকে ধর্মীয় গুরুগণ তাঁদের হাড়িয়ে যাবেন, যাদের দেবতাদের চেয়েও মঙ্গন বিবেচনা করা হবে। এটা ছিল মানুষের মূল্যের এক উল্লেখযোগ্য ঘোষণা ও নিজ হাতে নিয়তিকে নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা: উপমহাদেশের মহান ধর্মীয় দর্শনে পরিণত হবে এটা। হিন্দু ও বৌদ্ধ মতবাদের নতুন ধর্মগুলো দেবতাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করেনি বা মানুষকে তাদের উপসনা করতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। তাদের দৃষ্টিতে এ ধরনের অস্বীকৃতি ও নিষেধাজ্ঞা ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াতো। পরিবর্তে হিন্দু ও বৌদ্ধরা দেবতাদের ছাড়িয়ে যেতে, অতিক্রম করতে নতুন পথের সন্ধান করেছে। অষ্টম শতাব্দীতে সাধুগণ আরণ্যক এবং উপনিষদ নামের প্রবন্ধে এইসব বিষয় আলোচনা শুরু করেন যা সম্মিলিতভাবে বেদান্ত নামে পরিচিত: সর্বশেষ বেদ। আরও অসংখ্য উপবিষদ প্রকাশ পেল, বিসিই পঞ্চম শতাব্দীর শেষ নাগাদ এগুলোর সংখ্যা দাঁড়ায় ২০০টিতে। আমরা যাকে হিন্দু ধর্ম বলি সেটাকে সরলীকরণ করা অসম্ভব, কারণ এই ধর্মমত পদ্ধতি এড়িয়ে চলে .ও কোনও একটি ব্যাখ্যা পর্যাপ্ত বলে মানে না। তবে উপনিষদ দেবত্বের একটা পরিষ্কার ধারণা গড়ে তোলে যা দেবতাকে অতিক্রম করে যায় কিন্তু সর্ববস্তুতে নিবিড়ভাবে উপস্থিত থাকতে দেখা যায় ।
বৈদিক ধর্মে উৎসর্গের আনুষ্ঠানিকতায় মানুষ পবিত্র শক্তি অনুভব করেছে। এই পবিত্র শক্তিকে তারা ব্রাহ্মণ (Brahman) বলত। পুরোহিত গোত্রও ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত) এই ক্ষমতার অধিকারী বলে বিশ্বাস ছিল। আনুষ্ঠানিক উৎসর্গকে সমগ্র বিশ্বের ক্ষুদ্র রূপ হিসাবে দেখা হতো বলে ব্রাহ্মণগণ আস্তে আস্তে সমস্ত কিছুর আধার এক শক্তিতে পরিণত হন। সমগ্র বিশ্বকে ব্রাহ্মণের। রহস্যময় সত্তা থেকে সৃষ্ট এক স্বর্গীয় লীলা হিসাবে দেখা হয়েছে, যিনি সকল অস্তিত্বের অন্তর্গত অর্থ। উপনিষদ মানুষকে সবকিছুতে ব্রাহ্মণের অনুভূতি লালনের উৎসাহ যুগিয়েছে। এটা আক্ষরিক অর্থে দিব্যপ্রকাশের একটা প্রক্রিয়া: সকল সত্তার গুপ্তভূমির প্রকাশ ছিল এটা, সব ঘটনাই ব্রাহ্মণের প্রকাশে পরিণত হলো: বিভিন্ন ঘটনার পেছনে ঐক্যের ধারণার মাঝেই প্রকৃত দর্শন নিহিত। কোনও কোনও উপনিষদ ব্রাহ্মণকে ব্যক্তি-শক্তি হিসাবে দেখেছে, কিন্তু অন্যগুলো একেবারেই নৈর্ব্যক্তিক মনে করেছে। ব্রাহ্মণকে তুমি বলে সম্বোধন। করা যায় না; কারণ এটা নিরপেক্ষ; নারী বা পুরুষ অর্থে সে-ও বলা যাবে না, আবার সার্বভৌম উপাস্যের ইচ্ছা হিসাবেও অনুভব করা যাবে না। ব্রাহ্মণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেন না। নারী ও পুরুষের সঙ্গে দেখা করতে পারেন না; এইরকম সকল মানবীয় কর্মকাণ্ডের উর্ধ্বে ব্যক্তিগতভাবে এটা আমাদের প্রতি সড়িও দেন নাঃ পাপ একে ‘আক্রান্ত করতে পারে না, একে আমাদের ভালোবাসতে’ বা ‘ক্ষিপ্ত হতে বলা যায় না। বিশ্ব সৃষ্টি করার জন্যে একে ধন্যবাদ বা প্রশংসা করাও একেবারে বেমানান।
এই স্বর্গীয় শক্তিটি আমাদের আবৃত করে না রাখলে, পালন না করলে এবং অনুপ্রেরণা না যোগালে একেবারে দূরবর্তী হয়ে যেতেন। যোগের কৌশলসমূহ মানুষকে এক অন্তর্গত জগতের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছিল । আমরা দেখব, অঙ্গভঙ্গি, শ্বাসপ্রশ্বাস, খাদ্যগ্রহণ ও মানসিক একাত্মতার এইসব অনুশীলন অন্যান্য সংস্কৃতিতেও স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করেছিল যা ভিন্নভাবে ব্যাখ্যায়িত অথচ মানুষের জন্যে স্বাভাবিক আলোকপ্রাপ্তি ও আলোকিত হওয়ার এক বোধ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। উপনিষদের দাবি অনুযায়ী সত্তার নতুন মাত্রার অভিজ্ঞতাই বাকি বিশ্বকে টিকিয়ে রাখা পবিত্র শক্তি। প্রত্যেক ব্যক্তির মাঝে বিরাজিত চিরন্তন নীতিকে বলা হয় আত্মা। পুরোনো হলিস্টিক পৌত্তলিক দর্শনের একটা নতুন রূপ বা ভাষ্য এটা। আমাদের অন্তর ও বাইরের অত্যাবশ্যকীয়ভাবে স্বর্গীয় একক জীবানর (One Life) নতুন আবিষ্কার চান্দোগা উপনিষদ লবণের উদাহরণ টেনে। এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছে। শ্ৰেতাকেতু নামের এক তরুণ বার বছর একটানা বেদ পড়ে মুখস্থ করে ফেলেছে। তার বাবা উদ্দালক তাকে এমন একটা প্রশ্ন করলেন যার জবাব দিতে পারল না সে। তখন তার একেবারে। অজানা মৌলিক সত্য সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার কাজে হাত দিলেন উদ্দালক। ছেলেকে তিনি পানিতে এক টুকরো লবণ ফেলে পরদিন সকালে তাকে পরিণাম জানাতে বললেন। বাবা যখন তাকে লবণ দেখাতে বললেন, শ্ৰেকেতু তা খুঁজে পেল না, কারণ তা পুরোপুরি গলে গিয়েছিল। উদ্দালক এবার তাকে প্রশ্ন শুরু করলেন:
‘এপ্রান্তে একটু চুমুক দেবে? কেমন স্বাদ?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘লবণ।’
‘মাঝখানে চুমুক দাও। কেমন স্বাদ?’
‘লবণ।’
‘ওই প্রান্তে চুমুক দাও। কেমন স্বাদ?’
‘লবণ।’
এটা ফেলে দিয়ে আমার কাছে এসো। নির্দেশ পালন করল সে; [কিন্তু] তাতে লবণ যেমন ছিল তা থেকে বদলাল না।
[তার বাবা] তাকে বললেন: ‘আমার প্রিয় পুত্র, এটা সত্যি যে তুমি এখানে সত্তা উপলব্ধি করতে পারছ না, কিন্তু এটাও ঠিক যে এটা এখানেই আছে। এই প্রথম সত্তা–সমস্ত বিশ্বজগৎ এর সত্তা হিসাবে রয়েছে। এটাই বাস্তব: এটাও সত্তা: তুমি যা, শ্রেতাকেতু!’
এভাবে যদিও আমরা দেখতে পাই না, ব্রাহ্মণ সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছেন এবং আত্মার মতো আমাদের প্রত্যেকের মাঝে অনন্তকাল ধরে অবস্থান করছেন।[২৮]
আত্মা ঈশ্বরকে প্রতিমা, সূদূরর্তী ‘বাহ্যিক’ সত্তায় আমাদের ভয় আর আকাক্ষার প্রতিফলন হওয়া থেকে বিরত রাখে । হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী ঈশ্বরকে আমাদের পরিচিত পৃথিবীতে আরোপিত সত্তা হিসাবে দেখা হয় না। আবার এটা জগতের সঙ্গে একাকারও নয়। যুক্তি দিয়ে এর অর্থ বোঝার কোনও উপায় নেই আমাদের। কেবল এক অভিজ্ঞতার (anubhaba) মাধ্যমে এর ‘প্রকাশ’ ঘটে–আমাদের কাছে যা শব্দ বা ধারণা দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। ব্রাহ্মণকে ‘শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যায় না, যাকে ঘিরেই শব্দসমূহ উচ্চারিত হয়…মন দিয়ে যাকে ভাবা যায় না, বরং মন তাঁকে দিয়েই ভাবে।’[২৯] এরকম পরিব্যাপ্ত ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব নয়, এর সম্পর্কে চিন্তা করাও অসম্ভব, কেবল একে চিন্তার একটা বিষয়ে পরিণত করা হবে মাত্র। এটি সত্তার অতীতে যাওয়ার আদি আনন্দ বোধের মাঝে অনুভবযাৈগ্য এক বাস্তবতা: ঈশ্বর।
যারা জানে যে এটা ভাবনার অতীত তাদের ভাবনাতেই আসেন, তাদের ভাবনায় আসেন না যারা মনে করে ভেবে এর নাগাল পাওয়া যাবে।
জ্ঞানীর জ্ঞানের অতীত এটা, সাধারণের চেনা।
অনন্ত জীবনের দ্বারোদঘাটনের সচেতনতার আনন্দে চেনা যায় একে।[৩০]
দেবতাদের মতো, যুক্তি অস্বীকার করা হয়নি, বরং অতিক্রম করে যাওয়া। হয়েছে। ব্রাহ্মণ বা আত্মার অনুভূতি সঙ্গীত বা কবিতার মতো যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না, এ ধরনের শিল্প সৃষ্টি ও তা উপলব্ধি করার জন্যে বুদ্ধির প্রয়োজন; কিন্তু এটা এমন এক অভিজ্ঞতা বা বোধের যোগান দেয়, যা পুরোপুরি যৌক্তিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক সীমানা অতিক্রম করে যায়। ঈশ্বরের। ইতিহাসেও এটাও একটা অপরিবর্তনীয় থিম হয়ে থাকবে।
যোগির (Yogi) মাঝে ব্যক্তিক দুয়ের আদর্শ বিজড়িত থাকে যে আলোকপ্রাপ্তির জন্যে পরিবার ও সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সত্তার ভিন্ন। বলয়ে নিজেকে স্থাপন করে। বিসিই ৫৩৮ সাল নাগাদ সিদ্ধার্থ গৌতম নামের এক তরুণও তাঁর সুন্দরী স্ত্রী, পুত্র, বানারসের আনুমানিক ১০০ মাইল উত্তরে কপিলাবস্তুর বিলাসবহুল বাড়ি ছেড়ে ভিক্ষু সাধুতে পরিণত হয়েছিলেন। দুর্দশার দৃশ্য দেখে পীড়িত বোধ করেছিলেন তিনি, চারপাশের সবকিছুতে প্রত্যক্ষ করা অস্তিত্বের যন্ত্রণা উপশম করার রহস্য উদ্ধার করতে চেয়েছেন তিনি। ছয় বছর ধরে অসংখ্য হিন্দু গুরুর পায়ের কাছে বসেছেন, নানান ভয়ঙ্কর প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করেছেন, কিন্তু কোনও সমাধানই পাননি। সন্ন্যাসীদের মতবাদ তার মনপুতঃ হয়নি, আবার তার কৃচ্ছতা সাধনও তাকে আরও হতাশ করে তুলেছিল। অবশেষে এইসব পদ্ধতি বাদ দিয়ে নিজেকে যখন ধ্যান নিমগ্ন করলেন, একরাতে আলোকপ্রাপ্ত হলেন তিনি। গোটা সৃষ্টি আনন্দে উদ্বেলিত হলো, দুলে উঠল পৃথিবী, স্বর্গ থেকে পুষ্প বর্ষিত হলো, সুবাসিত হাওয়া বইল এবং বিভিন্ন। স্বর্গে দেবতারা আনন্দে মেতে উঠলেন। এবং আবারও, পৌত্তলিক দর্শনের মতো, দেবতা, প্রকৃতি ও মানুষ সহানুভূতিতে এক সূত্রে বাঁধা পড়ল। কষ্ট থেকে মুক্তি আর নির্বাণ লাভের যন্ত্রণার অবসানের এক নতুন আশা জেগে উঠেছিল। গৌতম পরিণত হলেন বুদ্ধে অর্থাৎ আলোকপ্রাপ্ত জনে। গোড়াতে দূরাত্মা মারা প্রলোভন দেখিয়ে তাকে যথাস্থানে অবস্থান করে অর্জিত আনন্দ উপভোগে প্রলুব্ধ করতে চাইল: এ বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে কোনও লাভ হবে না, কারণ কেউ তাঁর কথা বিশ্বাস করবে না। প্রচলিত দেবনিচয়ের দুজন দেবতা, মহাব্রহ্মা এবং সাকর দেবতাদের প্রভু-বুদ্ধের কাছে এসে পৃথিবীতে তাঁর নতুন পদ্ধতির ব্যাখ্যা করার আবেদন জানালেন। রাজি হলেন বুদ্ধ; পরবর্তী পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে তার বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে গোটা ভারত চষে বেড়ালেন: এই যন্ত্রণাময় জগতে একটা মাত্র বিষয়ই স্থির ও স্থায়ী। সেটা হলো ধম্ম, সঠিক জীবন যাপনের মূল কথা, একমাত্র যা আমাদের দুঃখকষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পারে।
এর সঙ্গে ঈশ্বরের কোনও সম্পর্ক নেই। দেবতাগণ সংস্কৃতির অংশ ছিলেন বলেই পরোক্ষে তাদের অস্তিত্ব মেনে নিয়েছিলেন বুদ্ধ, কিন্তু মানবজাতির তেমন প্রয়োজনে তাঁরা আসেন বলে বিশ্বাস করেননি। তারাও রোগ-শোকে আক্রান্ত হন: আলোকপ্রাপ্তিতে তাকে তারা সাহায্য করেননি; অন্য সব প্রাণীর মতো তারাও পুনর্জন্মের চক্রের অংশ, শেষ পর্যন্ত তারাও মিলিয়ে যাবেন। তারপরেও তাঁর জীবনের জটিল মুহূর্তগুলোয়-তার বাণী প্রচারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ের মতো তাঁর মনে হয়েছিল দেবতারা বুঝি তাকে প্রভাবিত করছেন, সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। সুতরাং বুদ্ধ দেবতাদের অস্বীকার। করেননি, তবে তিনি বিশ্বাস করতেন চূড়ান্ত নির্বাণ লাভ দেবতাদের চেয়েও উঁচু মর্যাদার। বৌদ্ধরা যখন ধ্যানের মাধ্যমে চরম আনন্দ বা দুয়ের অভিজ্ঞতা লাভ করে, তখন তারা আধ্যাত্মিক বা অতিপ্রাকৃত সত্তার সঙ্গে যোগাযোগের ফলে তা ঘটেছে মনে করে না। এসব অবস্থা বা পর্যায়ে মানুষের জন্যে স্বাভাবিক, সঠিক পথে জীবন যাপনকারী ও যোগের কৌশল আয়ত্তে আনা যে কারও পক্ষে এ অভিজ্ঞতা অর্জন সম্ভব। সুতরাং, কোনও দেবতার ওপর ভরসা করে অনুসারীদের নিজেদের রক্ষা করার তাগিদ দিয়েছেন বুদ্ধ।
আলোকপ্রাপ্তির পর বানারসে প্রথম অনুসারীর দেখা পাওয়ার পর আপন পদ্ধতির ব্যাখ্যা করলেন বুদ্ধ-এক অত্যাবশ্যকীয় সত্যের ওপর ভিত্তি করে যা গড়ে উঠেছে: সকল অস্তিত্বই দুঃখ (dhukka)। এটা পুরোপুরি যন্ত্রণাময়, সমগ্র জীবন খুবই জটিল। অর্থহীন প্রবাহে বিভিন্ন বস্তু আসে যায়। কোনও কিছুরই চিরন্তন তাৎপর্য নেই। কোথাও কিছু একটা ভুল আছে, এই বোধ নিয়ে ধর্মের শুরু। প্রাচীন পৌত্তলিকতার যুগে এই বোধ স্বর্গীয় জগৎ আমাদের চেনা জগতের সমরূপ আদর্শ জগতের কিংবদন্তীর দিকে টেনে নিয়ে গেছে, যা মানবজাতিকে শক্তি যোগাতে সক্ষম। বুদ্ধ শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, সকল প্রাণীর প্রতি দয়া প্রদর্শন, ভদ্র, দয়াময় ও সঠিক আচরণ দেখিয়ে ও কথা বলে এবং মনকে আচ্ছন্ন করতে পারে এমন মাদক বা সমজাতীয় পদার্থ গ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত রেখে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব। বুদ্ধ স্বয়ং নিজেকে এই পদ্ধতির আবিষ্কারক দাবি করেননি। একে খুঁজে পাওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন তিনিঃ ‘আমি এক প্রাচীন পথ, প্রাচীন সড়ক দেখেছি। বহুযুগ আগে বুদ্ধদের পথে চলাচলের পথ।’[৩১] পৌত্তলিকতার বিধি-বিধানের মতো অস্তিত্বের অত্যাবশ্যকীয় কাঠামোর সঙ্গে এটা সম্পর্কিত, জীবনের সহজাত অবস্থার সঙ্গে জড়িত। যৌক্তিক প্রমাণ দিয়ে দেখানো যায় বলে এর বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা ছিল তা নয়, বরং কেউ নির্ধারিত পথে জীবন পরিচালনা করতে উদ্যোগী হলে সে এর কার্যকারিতা বুঝতে পারবে বলেই এটা সেই বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। দার্শনিক বা ঐতিহাসিক প্রকাশের চেয়ে কার্যকারিতাই বরং সব সময় যে কোনও ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল: গত শত বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন অংশে বৌদ্ধরা এই ধরনের জীবনযাত্রা এক দুৰ্জ্জেয় বোধ জাগায় বলে জেনে এসেছে।
কর্ম মানুষকে অসংখ্য যন্ত্রণাময় জীবনের পুনর্জন্মের চক্রে বন্দি করেছে। কিন্তু নিজেদের অহমবোধকে সংস্কার করতে পারলেই তারা নিয়তিকে বদলাতে পারবে। পুনর্জন্মের প্রক্রিয়াকে জ্বলন্ত শিখার সঙ্গে তুলনা করেছেন বুদ্ধ, যার সাহায্য আরেকটি শিখা জ্বালানো হয়; শিখাঁটি না নেভা পর্যন্ত চলতে থাকে এভাবে। কেউ ভুল প্রবণতা নিয়ে জ্বলন্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে স্রেফ আরেকটা বাতি জ্বালবে সে। কিন্তু শিখাঁটি নির্বাপিত হয়ে গেলে, যন্ত্রণাচক্রের অবসান ঘটবে, নির্বাণ প্রাপ্তি ঘটবে। নির্বাণে’র আক্ষরিক অর্থ ‘শীতল হওয়া বা বিদায় নেওয়া। অবশ্য এটা স্রেফ একটা নেতিবাচক পর্যায় নয়, বরং বৌদ্ধদের জীবনে তা এমন এক ভূমিকা পালন করে যা ঈশ্বরের ভূমিকার অনুরূপ। এডওয়ার্ড কনযে তার বুদ্ধিজম: ইটস এসেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এ যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, বৌদ্ধরা প্রায়শঃই নির্বাণ বা পরম সত্তাকে ব্যাখ্যা করার জন্যে আস্তিকের মতো একই ইমেজারি ব্যবহার করে থাকে:
আমাদেরকে বলা হয়েছে যে, নির্বাণ চিরস্থায়ী, স্থিতিশীল, অপচনশীল, অনড়, জরাহীন, মৃত্যুহীন, অজাত এবং অসৃষ্ট; এটা শক্তি, আনন্দ এবং সুখ, নিরাপদ আশ্রয়, আশ্রম ও আক্রমণের অতীত এক স্থান; এটাই প্রকৃত ও পরম সত্তা: এটাই মঙ্গল, চরম লক্ষ্য এবং আমাদের জীবনের এক এবং একমাত্র পরিণতি, চিরন্তন, গুপ্ত ও দুর্বোধ্য শান্তি। [৩২]
কোনও কোনও বৌদ্ধ এই রকম তুলনায় আপত্তি তুলতে পারে, কেননা তারা মনে করে ঈশ্বরের ধারণা তাদের পরম সত্তার ধারণা প্রকাশের ক্ষেত্রে খুবই সীমিত। এর পেছনে প্রধান কারণ হলো অস্তিকগণ ঈশ্বর’ শব্দটি সীমিত অর্থে এমন এক সত্তাকে বোঝাতে ব্যবহার করে যিনি আমাদের চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন নন। উপনিষদের সন্ন্যাসীদের মতো বুদ্ধ নির্বাণের ব্যাপারটিকে অন্য যে কোনও মানবীয় বৈশিষ্ট্যের মতো করে সংজ্ঞায়িত বা আলোচনা করা যাবে না। বলে জোর দিয়েছেন।
নির্বাণ লাভ ক্রিশ্চানরা যেমনটি প্রায়শঃই বুঝে থাকে সেরকম ‘স্বর্গে গমন’-এর মতো ব্যাপার নয়। বুদ্ধ বরাবরই নির্বাণ বা অন্য পরম বিষয়াদি সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকার গেছেন, কেননা সেটা ‘অসঙ্গত’ বা ‘অনুচিত’ ছিল। আমাদের পক্ষে নির্বাণের সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ আমাদের ভাষা ও ধারণা অনুভূতি এবং বেদনার জগতের সঙ্গে বাঁধা। অভিজ্ঞতাই একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রমাণ। তার অনুসারীরা নির্বাণের অস্তিত্ব জানতে পারবে, কারণ সুন্দর জীবন যাপনের চর্চা তাদের সেটা প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম করে তুলবে।
এই যে সন্ন্যাসী, অজাত, অসৃষ্ট, অগঠিত, অমিশ্র। যদি, সন্ন্যাসীরা অজাত, অদৃষ্টে, অগঠিত, অমিশ্র না হয় তাহলে, জাত, সাধারণ, গঠিত এবং মিশ্র থেকে মুক্তি সম্ভব হবে না। কিন্তু অদৃষ্টে অজাত, অগঠিত ও অমিশ্র আছে, সুতরাং জাত, সাধারণ, গঠিত ও মিশ্র থেকে আছে মুক্তি। [৩৩]
তাঁর সাধুদের নির্বাণের প্রকৃতি নিয়ে আঁচ অনুমান করা ঠিক হবে না। বুদ্ধ যেটা করতে পারেন সেটা হচ্ছে একটা ভেলার ব্যবস্থা করে দেওয়া যার সাহায্যে তারা ‘অপর পারে’ যেতে পারবে। তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো যে নির্বাণপ্রাপ্ত একজন বুদ্ধ কি মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকেন, প্রশ্নটিকে ‘বেঠিক’ বলে নাকচ করে দিয়েছিলেন তিনি। এ যেন অগ্নিশিখা নিভে যাওয়ার পর সেটা। কোন দিকে গেছে জানতে চাওয়ার মতো। নির্বাণে বুদ্ধ আছেন বলা যেমন ভুল হবে তেমনি তিনি নেই বলাটাও সমান ভুল: ‘আছে’ শব্দটার সঙ্গে আমাদের বোধগম্য কোনও অবস্থার সম্পর্ক নেই। আমরা দেখব, শত শত বছরের পরিক্রমায় ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কিত প্রশ্নেরও। একই রকম জবাব দিয়ে এসেছে। বুদ্ধ দেখাতে চেয়েছিলেন যে, বোধ ও যুক্তির অতীত কোনও সত্তাকে বোঝাতে ভাষা যথাযথভাবে সমৃদ্ধ নয়। তিনি কিন্তু যুক্তিকে অস্বীকার করেননি, বরং স্পষ্ট ও সঠিক চিন্তা এবং ভাষার। ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি অবশ্য বলেছেন যে, কোনও ব্যক্তির ধর্মজ্ঞান বা বিশ্বাস, সে যেসব আচার অনুষ্ঠানে অংশ নেয়, সেগুলোর মতোই গুরুত্বহীন। এগুলো কৌতূহলোদ্দীপক হতে পারে, কিন্তু চরম তাৎপর্যমণ্ডিত কোনও বিষয় নয়। একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে উন্নত বা সুন্দর। জীবন, যদি সে সত্যকে প্রকাশে ব্যর্থ হয়।
অন্যদিকে গ্রিকরা প্রবলভাবে যুক্তি ও কারণ সম্পর্কে আগ্রহী ছিল। প্লেটো (Ca ৪২৮– Ca ৩৪৮ বিসিই) জ্ঞানতত্ত্ব ও প্রজ্ঞার প্রকৃতি সংক্রান্ত সমস্যাদি নিয়ে যারপরনাই ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর প্রথম দিকের অধিকাংশ রচনাই সক্রেটিসের যুক্তির পক্ষে যুক্তি হিসাবে রচিত হয়েছিল। সক্রেটিস মানুষকে তার চিন্তা উস্কে দেওয়া প্রশ্নের সাহায্যে তাদের ধারণা ব্যাখ্যা করতে বাধ্য করতেন। ৩৯৯ সালে তরুণ সমাজকে পথভ্রষ্ট করা ও অপবিত্রতার অপরাধে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ভারতীয় জনগণের পদ্ধতির প্রায় সমরূপ ছিল তা। তিনি ধর্মের প্রাচীন অনুষ্ঠান ও মিথের ব্যাপারে অসন্তুষ্ট বোধ করেছেন, এগুলোকে তাঁর চোখে অর্থহীন, অনুপযুক্ত ঠেকেছে। ষষ্ঠ শতকের দার্শনিক পিথাগোরাস দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন প্লেটো, যিনি হয়তো আবার পার্সিয়া ও মিশরের মাধ্যমে ভারত থেকে আগত ধারণায় প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারেন। তার বিশ্বাস ছিল, কোনও আত্মা দেহে আশ্রয় নেওয়া পতিত ও দূষিত দেবতা, অনেকটা কবরের শবের মতো এবং চিরস্থায়ী পুনর্জন্মের চক্রে অভিশপ্ত । আমাদের সত্তার সঙ্গে বেমানান এক পৃথিবীতে নিজেকে আগন্তুক মনে হবার সাধারণ মানবীয় অনুভূতিকে ভাষা দিয়েছেন তিনি। পিথাগোরাসের শিক্ষা ছিল আচরিক পরিশুদ্ধতা অর্জনের ভেতর দিয়ে আত্মাকে মুক্তি দেওয়া যেতে পারে যা একে সুশৃঙ্খল মহাবিশ্বের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সক্ষম করে তুলবে। প্লেটো স্বর্গের অস্তিত্ব, বোধগম্য জগতের অতীত অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা, আত্মা পতিত স্বর্গীয় সত্তার চেনা জগতের বাইরে একটা দেহে আটকা পড়েছে, যেটা মনের ক্ষমতার যৌক্তিকরণের মাধ্যমে আবার স্বর্গীয় অবস্থান ফিরে পেতে সক্ষম বলে বিশ্বাস করতেন। বিখ্যাত গুহার মিথে পৃথিবীতে মানুষের জীবনের অন্ধকার ও অস্পষ্টতার বিবরণ দিয়েছেন প্লেটো: সে কেবল গোটা প্রাচীরে ঠিকরে যাওয়া অনন্ত বাস্তবতার ছায়া প্রত্যক্ষ করে। কিন্তু আস্তে আস্তে তাকে বের করে আনা সম্ভব, স্বর্গীয় আলোয় নিজের মনকে খাপ খাইয়ে আলোকপ্রাপ্তি ও মুক্তি লাভ করতে পারে সে।
পরবর্তী জীবনে প্লেটো হয়তো অনন্ত আকৃতি বা ধারণা থেকে সরে এসে থাকতে পারেন, কিন্তু বহু আস্তিকের কাছে তাদের ঈশ্বরের ধারণা ব্যাখ্যার প্রয়াসে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এসব ধারণা ছিল স্থিতিশীল, স্থায়ী বাস্তবতা, মনের শক্তির যৌক্তিকীকরণের ভেতর দিয়ে যেগুলো উপলব্ধি করা সম্ভব। আমরা আমাদের ইন্দ্রিয় দিয়ে যেসব অস্থির, ত্রুটিপূর্ণ ঘটনাবলীর মোকাবিলা করে থাকি সেগুলোর চেয়ে অনেক বেশি পূর্ণাঙ্গ, স্থায়ী ও ফলপ্রসূ বাস্তবতা। এই জগতের বস্তুসমূহ প্রতিধ্বনি মাত্র, স্বর্গীয় জগতের অনন্ত আকারে ‘অংশগ্রহণ করে’ বা ‘অনুসরণ করে’। ভালোবাসা, ন্যায়বিচার ও সৌন্দর্য, ইত্যাদির মতো আমাদের সাধারণ ধারণার সমরূপ ধারণা রয়েছে। কিন্তু সকল আকৃতির মাঝে সেরা হচ্ছে ভালোর ধারণা। প্লেটো আদি আদর্শজগতের প্রাচীন মিথকে দার্শনিক রূপে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর চিরন্তন ধারণাসমূহকে পৌরাণিক শ্মীয় জগতের যৌক্তিক ভাষ্য হিসাবে দেখা যেতে পারে, জাগতিক বিষয়াদি যার তুচ্ছ ছায়ামাত্র। তিনি ঈশ্বরের প্রকৃতি আলোচনা করেননি, বরং আকৃতির স্বর্গীয় জগতে নিজেকে সীমিত রেখেছেন, যদিও কখনও কখনও মনে হয় যে, আদর্শ সৌন্দর্য বা ভালো প্রকৃতিই এক পরম সত্তার কথা বোঝাচ্ছে। প্লেটোর স্থির বিশ্বাস ছিল যে, স্বর্গীয় জগৎ স্থির, পরিবর্তনহীন। চলিষ্ণুতা ও পরিবর্তনকে গ্রিকরা নিম্নস্তরের বাস্তবতা হিসেবে দেখেছে: সত্য পরিচয়ধারী যে কোনও কিছু বরাবর একইরকম থাকে, স্থায়িত্ব ও অপরিবর্তনীয়তাই এর বৈশিষ্ট্য। সুতরাং সবচেয়ে নিখুঁত গতি হচ্ছে বৃত্ত, কারণ এটা চিরস্থায়ীভাবে ঘুরছে ও মূলবিন্দুতে ফিরে আসছে: ঘূর্ণায়মান মহাজাগতিক বলয়গুলো তাদের সাধ্যানুযায়ী স্বর্গীয় জগতকে অনুকরণ করে যাচ্ছে। স্বর্গের এই চরম স্থায়ী ইমেজ ইহুদি, ক্রিস্টান ও মুসলিমদের ওপর সীমাহীন প্রভাব বিস্তার করবে, যদিও এর সঙ্গে প্রত্যাদেশের ঈশ্বরের তেমন একটা মিল ছিল না; যিনি সব সময় ক্রিয়াশীল, সৃষ্টিশীল এবং বাইবেল অনুযায়ী, মানবজাতি সৃষ্টির পর অনুতপ্ত হয়ে গোটা মানবজাতিকে বন্যার পানিতে ধ্বংস করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে মত পর্যন্ত পরিবর্তন করেন।
প্লেটোর একটা অতিন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে একেশ্বরবাদীদের কাছে যা খুবই জুৎসই মনে হয়। প্লেটোর স্বর্গীয় আকৃতিসমূহ মহাশূন্যের বাস্তবতা বা সত্তা নয়, বরং নিজের মাঝেই এর দেখা পাওয়া সম্ভব। সিম্পোজিয়াম নামের নাটকীয় সংলাপে প্লেটো দেখিয়েছেন চমৎকার শরীরের ভালোবাসা কীভাবে পরিশুদ্ধ ও আদর্শ সৌন্দর্যের ভাববাদী চিন্তায় রূপান্তরিত করা যায়। সক্রেটিসের শিক্ষক দায়োতিমার মুখে তিনি ব্যাখ্যা করিয়েছেন যে, এই সৌন্দর্য অনন্য, চিরকালীন এবং পরম, আমরা এ বিশ্বে যা কিছু দেখতে পাই তার কোনওটার মতোই নয়
চিরন্তন সমস্ত কিছুর আগে আদি এই সৌন্দর্য; এটা কখনও রূপ পরিগ্রহ করে না বা শেষ হয়ে যায় না, বাড়ে না বা কমেও যায় না; তারপর, আংশিক সুন্দর বা আংশিক কুৎসিত এর কোনও পর্যায় নয়, কখনও সুন্দর, কখনও অসুন্দর নয়, একের প্রেক্ষিতে সুন্দর আর অন্যের বিপরীতে অসুন্দর নয়, এক স্থানে সুন্দর আর অন্যত্র অসুন্দর নয়, দর্শকদের মত অনুযায়ী পরিবর্তনশীল নয়, আবার এই সৌন্দর্য মুখমণ্ডল। বা হাতের সৌন্দর্য বা দেহাতীত কোনও কিছুর সৌন্দর্য চিন্তার মতো নয়, কিংবা চিন্তা বা বিজ্ঞানের সৌন্দর্যের মতো নয়, কিংবা এমন কোনও সৌন্দর্য নয় যা অন্যত্র বিরাজমান সেটা জীবিত কোনও প্রাণী হোক, আকাশ কিংবা মাটি হোক, কিংবা যাই হোক না কেন, একে সে দেখবে পরম, এককভাবে অবস্থানরত, অনন্য, চিরন্তন হিসাবে। [৩৪]
সংক্ষেপে সুন্দরের মতো ধারণার সঙ্গে আস্তিকরা যাকে ‘ঈশ্বর’ বলবে তার অনেক মিল রয়েছে। কিন্তু এর দুয়েতা সত্ত্বেও ধারণাসমূহ মানুষের মনেই পাওয়া যাওয়ার কথা। আমরা আধুনিক মানুষ চিন্তাকে কাজ হিসাবে দেখি যেন আমরা কিছু করছি। প্লেটো একে দেখেছেন এমন কিছু যা আমাদের মনে ঘটে: চিন্তার বিষয়বস্তু যে ব্যক্তি চিন্তা করছে তার মনে বা বুদ্ধিতে ক্রিয়াশীল বাস্তবতা। সক্রেটিসের মতো তিনি চিন্তাকে স্মরণের একটি প্রক্রিয়া হিসাবে দেখেছেন, আমরা সব সময় যা জানতাম কিন্তু ভুলে গেছি এমন কিছু স্মরণ করার আকাঙ্ক্ষা। মানুষ যেহেতু পতিত স্বর্গীয় সত্তা, স্বর্গীয় জগতের আকৃতিসমূহ তাদের মাঝেই বিরাজ করে এবং যুক্তির মাধ্যমে সেগুলো ‘স্পর্শ’ করা সম্ভব, যেটা কেবল যৌক্তিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ নয় বরং আমাদের অভ্যন্তরস্থ অন্তঃসত্তাকে ছোঁয়ার প্রয়াস। ঐতিহাসিক একেশ্বরবাদের তিনটি ধর্মের প্রত্যেকটির অতিন্দ্রীয়বাদী সাধকদের এই ধারণা প্রবলভাবে প্রভাবিত করবে।
প্লেটো বিশ্বাস করতেন মহাবিশ্ব অত্যাবশ্যকীয়ভাবে যৌক্তিক। এটা বাস্তবতার আরেকটি মিথ বা কাল্পনিক ধারণা। অ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ বিসিই) আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছেন। তিনিই প্রথমবারের মতো সকল বিজ্ঞানের ভিত্তি যৌক্তিক ব্যাখ্যাকরণের (Logical Reasoning) গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এই পদ্ধতির মাধ্যমে মহাবিশ্বকে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে। মেটাফিজিক্স নামে পরিচিত (নামটি তার সম্পাদকের দেওয়া, যিনি এইসব গবেষণামূলক প্রবন্ধকে ‘ফিজিক্সের পরে’: মেটা টা ফিজিক্স-এ স্থান দিয়েছিলেন), চৌদ্দটি নিবন্ধে সত্যের তত্ত্বগত উপলব্ধির প্রয়াসের পাশাপাশি তত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ও প্রথাগত জীববিদ্যারও গবেষণা করেছিলেন তিনি। তা সত্ত্বেও তিনি গভীর বুদ্ধিবৃত্তিক বিনয়ের অধিকারী ছিলেন, জোর দিয়ে বলেছেন কারও পক্ষেই সত্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়, তবে আমাদের প্রত্যেকে সম্মিলিত উপলব্ধির ক্ষেত্রে যার যার ক্ষুদ্র ভূমিকা রাখতে পারে। প্লেটোর রচনাবলী সম্পর্কিত তার মূল্যায়ন নিয়ে উল্লেখযোগ্য বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সামগ্রিকভাবে তিনি যেন আকৃতি সম্পর্কে প্লেটোর দুয়ের ধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী ছিলেন, এগুলোর আদি স্বাধীন সত্তা থাকার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছেন। অ্যারিস্টটল মত প্রকাশ করেছেন যে, কেবল আমাদের পরিচিত নিরেট বস্তগত জগতে যতক্ষণ আছে ততক্ষণই আকৃতির অস্তিত্ব রয়েছে।
ইহজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈজ্ঞানিক সত্যের প্রতি দুর্বলতা সত্ত্বেও প্রকৃতি সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি ছিল অ্যারিস্টটলের; ধর্ম ও মিথের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তিনি। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, বিভিন্ন রহস্যবাদী ধর্মে নবীশে পরিণত হওয়া ব্যক্তিদের কোনও বাস্তব জ্ঞান অর্জন করার প্রয়োজন হয়নি, বরং বিশেষ অবস্থায় স্থাপনের মাধ্যমে বিশেষ আবেগ অনুভব করতে হয়েছে।[৩৫] এভাবেই তার সুবিখ্যাত সাহিত্য তত্ত্ব ট্র্যাজিডি আতঙ্ক ও করুণা বোধের পরিশুদ্ধতাকে (Katharsis) সৃষ্টি করে যা পূনর্জনের অভিজ্ঞতার মতো। মূলত ধর্মীয় উৎসবের অংশ হিসাবে গড়ে ওঠা গ্রিক ট্র্যাজিডিসমূহ অত্যাবশ্যকীয়ভাবে ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের সত্যনিষ্ঠ বিবরণ ছিল না বরং তা ছিল আরও নিগূঢ় সত্য আবিষ্কারের প্রয়াস। প্রকৃতপক্ষে কাব্য ও মিথের চেয়ে ইতিহাস অনেক বেশি গুরুত্বহীন, তুচ্ছ: ‘একটা যা ঘটে গেছে তার বিবরণ দেয়, অপরটি বলে কী ঘটতে পারত। সে কারণে কাব্য ইতিহাসের চেয়ে ঢের বেশি দার্শনিক ও সিরিয়াস প্রাকৃতির; কারণ কাব্য বিশ্বজনীনতার কথা বলে, ইতিহাস বলে নির্দিষ্ট বিষয়ের কথা।’[৩৬] ঐতিহাসিক চরিত্র হিসাবে অ্যাচিলিস, ইদিপাস না থাকতে পারে কিন্তু আমরা হোমার ও সফোক্লিস-এর যেসব চরিত্রের সংস্পর্শে আসি সেগুলোর সঙ্গে তাদের জীবনের ঘটনাবলী অপ্রাসঙ্গিক যা মানব অবস্থা সম্পর্কে ভিন্নতর অথচ আরও গভীর সত্য প্রকাশ করে। ট্যাজিডির ক্যাথারসিস সম্পর্কিত অ্যারিস্টটলের বিবরণ এমন এক সত্যের দার্শনিক উপস্থাপন হোমো রিলিজিয়াসরা যা সবসময় সহজাত প্রবৃত্তি দিয়েই অনুধাবন করেছে: ঘটনাপ্রবাহের প্রতীকী, পৌরাণিক বা আচরিক উপস্থাপন নৈমিত্তিক জীবনে সহনীয় নয়, কিন্তু এগুলোকে আরও বিশুদ্ধ, আরও আনন্দময় রূপে পরিবর্তন করতে সক্ষম।
পরবর্তীকালের একেশ্বরবাদীর উপর, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের ক্রিশ্চানদের ওপর অ্যারিস্টটলের ঈশ্বর সংক্রান্ত ধারণা ব্যাপক প্রভাবে রেখেছে। ফিজিক্স-এ তিনি বাস্তবতার প্রকৃতি ও বিশ্বজগতের সারবস্তু পরীক্ষা করেছেন। তার লব্ধ জ্ঞান সৃষ্টি সংক্রান্ত প্রাচীন উৎসারণবাদী দার্শনিক ভাষ্য; অস্তিত্বের বিভিন্ন ধারাক্রম অনুযায়ী পর্যায় রয়েছে (hierarchy of existences), যার প্রত্যেকটি তার নিচের পর্যায়কে আকৃতি দান করে ও সেটার আকার ধারণ করে; কিন্তু প্রাচীন মিথের বিপরীতে অ্যারিস্টটলের তত্ত্ব অনুযায়ী এই উৎসারণ তাদের উৎস থেকে যত দূরে যায় ততই দুর্বল হয়ে পড়ে। একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছেন অটল চালক (Unmoved Mover), অ্যারিস্টটল যাকে ঈশ্বর বলে শনাক্ত করেছেন। এই ঈশ্বর নিখুঁত সত্তা এবং সেকারণে চিরন্তন, অনড় ও আধ্যাত্মিক। ঈশ্বর খাঁটি চিন্তা আবার একই সময়ে ভাবুক ও ভাবনা, নিজেকে জ্ঞানের সর্বোচ্চ লক্ষ্য উপলব্ধি করার এক অনন্ত মুহূর্তে ন্যস্ত রয়েছেন। বস্তু যেহেতু অসম্পূর্ণ ও মরণশীল, সুতরাং ঈশ্বরের কিংবা সত্তার উচ্চতর শ্রেণীতে কোনও বস্তুগত উপাদান নেই। অটল চালক সকল গতি ও বিশ্বজগতের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করেন, কেননা প্রত্যেক গতির পেছনে কারণ থাকতে বাধ্য যা কোনও একক উৎস পর্যন্ত অনুসরণ করা সম্ভব। আকর্ষণের এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি বিশ্বকে চালু করেন, কেননা সকল সত্তাই খোদ পরম সত্তার দিকে ধাবমান।
এক অগ্রাধিকার স্থানে মানুষের অবস্থান: তার মানব আত্মার বুদ্ধির মতো স্বর্গীয় আশীর্বাদ রয়েছে, যা তাকে ঈশ্বরের নিকটবর্তী করে তোলার সঙ্গে সঙ্গে স্বর্গীয় প্রকৃতির অংশীদার করেছে। যুক্তি প্রয়োগের এই দেবসম ক্ষমতা তাকে জীব-জানোয়ার ও গাছপালার উপরে স্থাপন করেছে। অবশ্য দেহ ও আত্মারূপে মানুষ সমগ্র মহাবিশ্বের এক ক্ষুদ্ররূপ, নিজের মাঝে মৌলিক বস্তুগুলোর পাশাপাশি যুক্তির স্বর্গীয় গুণও ধারণ করে। আপন বুদ্ধিমত্তাকে পরিশুদ্ধ করে অমর ও স্বর্গীয় হয়ে ওঠাই তার দায়িত্ব। প্রজ্ঞা (Sophia) মানবীয় গুণাবলীর ভেতর শ্রেষ্ঠ দার্শনিক সত্যের ধ্যানের (Theoria) মাধ্যমে এর প্রকাশ ঘটে, যা প্লেটোর মতানুযায়ী, স্বয়ং ঈশ্বরের কর্মকাণ্ডের অনুকরণের ভেতর দিয়ে আমাদের স্বর্গীয় করে তোলে। কেবল যুক্তি দিয়েই থিয়োরিয়া অর্জন করা সম্ভব নয়, বরং এর জন্যে প্রয়োজন শৃঙ্খলিত বোধের ভেতর দিয়ে আপন সত্তাকে অতিক্রম করে যাওয়া। অবশ্য খুব স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তি এ ধরনের প্রজ্ঞার অধিকারী হতে পারে, এবং অধিকাংশই কেবল দৈনন্দিন জীবনে দূরদৃষ্টি ও বুদ্ধিমত্তার অনুশীলন বা চর্চা ফ্রনেসিস (Phronesis) পর্যন্ত পৌঁছতে পারে।
তাঁর ব্যবস্থায় অটল চালক (Unmoved Mover)-এর গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান সত্ত্বেও অ্যারিস্টটলের ঈশ্বরের ধর্মীয় প্রাসঙ্গিকতা ছিল সামান্যই। তিনি বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেননি, কেননা তাতে করে অসঙ্গত পরিবর্তন ও পার্থিব কর্মকাণ্ডের প্রয়োজন হতো। যদিও সমস্ত কিছু তার দিকে ধাবমান, কিন্তু এই ঈশ্বর বিশ্বজগতের অস্তিত্ব সম্পর্কে একেবারেই নিস্পৃহ, নিরাসক্ত, কারণ তার পক্ষে নিম্নস্তরের কোনও কিছু সম্পর্কে ভাবনা সম্ভব নয়। তিনি অবশ্যই এ জগতকে পরিচালনা করেন না বা পথ দেখান না, আমাদের জীবনেও কোনও রকম প্রভাব রাখেন না, সে যেমনই হোক। ঈশ্বর তার অস্তিত্বের প্রয়োজনের তাগিদে তাঁর কাছ থেকে উৎসারিত মহাবিশ্বের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন কিনা সেটাই এক বিরাট প্রশ্ন। এমন একজন ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রশ্নটি প্রান্তিক হতে বাধ্য। অ্যারিস্টটল নিজেই হয়তো শেষ জীবনে তার তত্ত্ব ত্যাগ করতেন। অ্যাক্সিয়েল যুগের মানুষ হিসাবে তিনি ও প্লেটো উভয়ই ব্যক্তি বিশেষের বিবেক, সুন্দর জীবন ও সমাজে ন্যায় বিচারের বিষয়ে মাথা ঘামিয়েছেন। তবু তাদের চিন্তা ভাবনা ছিল এলিটিস্ট। প্লেটোর আকৃতি সংক্রান্ত নিখুঁত জগৎ বা অ্যারিস্টটলের দূরবর্তী ঈশ্বর সাধারণ মরণশীলদের জীবনে খুব একটা প্রভাব রাখার অধিকারী ছিলেন না, এ সত্যটি পরবর্তীকালে তাঁদের ইহুদি ও মুসলিম ভক্তরা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে।
সুতরাং অ্যাক্সিয়াল যুগের নয়া মতবাদগুলোয় একটা সাধারণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল যে, মানুষের জীবনে অত্যাবশ্যকীয় এক দুয়ে উপাদান রয়েছে। আমাদের আলোচনায় বিভিন্ন পণ্ডিতগণ এই দুয়েকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠার বেলায় নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে একে গুরুত্বপূর্ণ বলে মেনে নিয়েছেন সকলেই। তাঁরা প্রাচীন মিথলজিগুলোকে পুরোপুরি বাতিল করে দেননি, বরং নতুন করে ব্যাখ্যা করেছেন; মানুষকে সেগুলো ছাড়িয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। একই সময় এইসব অতি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদসমূহ যখন গড়ে উঠছিল, ইসরায়েলের পয়গম্বরগণ তখন পরিবর্তিত অবস্থার চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য গড়ে তুলছিলেন যার পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত ইয়াহ্ওয়েহ্ একমাত্র ঈশ্বরে পরিণত হন। কিন্তু এই ক্ষেপাটে ইয়াহ্ওয়েহ্ কীভাবে অন্যান্য উচ্চমার্গীয় দর্শনের সঙ্গে মানিয়ে উঠবেন?
০২. এক ঈশ্বর
বিসিই ৭৪২ সালে জুদাইন রাজ পরিবারের একজন সদস্য দিব্যদৃষ্টিতে জেরুজালেমে বাদশাহ সলোমন কর্তৃক নির্মিত মন্দিরে অবস্থানরত ইয়াহ্ওয়েহ্কে দেখতে পান। ইসরায়েলের জনগণের এক উদ্বেগময় সময় ছিল সেটা। সে বছর জুদাহ্র রাজা উযিয়াহ্ মারা যান এবং তার ছেলে আহায় সিংহাসনে আরোহন করেন। প্রজাদের ইয়াহ্ওয়েহ্র পাশাপাশি পৌত্তলিক দেবতাদেরও উপাসনা করার জন্যে উৎসাহিত করেন তিনি। উত্তরাঞ্চলীয় ইসরায়েল রাজ্যে তখন প্রবল অরাজক-প্রায় অবস্থা চলছে: রাজা দ্বিতীয় জেরোবম-এর মৃত্যুর পর ৭৪৬ থেকে ৭৩২ সময় কালে পাঁচ পাঁচজন রাজা সিংহাসনে আরোহন করেছিলেন, এদিকে আসিরিয়ার রাজা তৃতীয় তিগলেদ পিলসার বুভুক্ষের মতো তাদের ভূখণ্ডের দিকে তাকিয়েছিলেন, ওই অঞ্চলটিকে নিজের ক্রমপ্রসারমান সাম্রাজ্যের অঙ্গীভূত করতে উদগ্রীব ছিলেন তিনি। ৭২২ সালে তার উত্তরাধিকারী রাজা দ্বিতীয় সারগন উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য দখল করে অধিবাসীদের বিতাড়িত করেন: ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় দশটি গোত্র একীভূত হতে বাধ্য হয় এবং ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায়। ওদিকে ক্ষুদ্র জুদাহ রাজ্যটি আপন অস্তিত্ব নিয়ে ছিল শঙ্কিত। রাজা উযিয়াহর মৃত্যুর অল্প দিন পরে মন্দিরে প্রার্থনা করার সময় ইসায়াহ্ সম্ভবত প্রবল বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন; এবং একই সময় সম্ভবত অস্বস্তির সঙ্গে বিলাসবহুল মন্দিরে আনুষ্ঠানিকতার অসামঞ্জস্যতা সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। ইসায়াহ্ হয়তো শাসক শ্রেণীর সদস্য ছিলেন, কিন্তু তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল জনমুখী ও গণতান্ত্রিক, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুর্দশা নিয়ে দারুণভাবে চিন্তিত ছিলেন তিনি। পবিত্র মন্দিরের সামনের স্যাঙ্কচুয়্যারি যখন সুগন্ধি ধুপের ধোঁয়ায় ভরে উঠত ও উৎসর্গের প্রাণীর রক্তের উৎকট গন্ধে ভরে যেত তিনি হয়তো তখন ইসরায়েলের ধর্ম অখণ্ডতা ও অন্তর্নিহিত অর্থ হারিয়ে ফেলেছে ভেবে শঙ্কিত বোধ করছিলেন।
সহসা তিনি যেন দেখতে পেলেন, স্বর্গীয় প্রাসাদের প্রতিরূপ মন্দিরের ঠিক ছাদ বরাবর স্বর্গীয় সিংহাসনে বসে আছেন ইয়াহ্ওয়েহ্। ইয়াহ্ওয়েহ্র আলখেল্লাহ স্যাঙ্কচুয়ারি পরিপূর্ণ করে ফেলেছে, দুজন সেরাফ তার সেবা করছিল, ইয়াহ্ওয়েহ্ মুখের দিকে যেন না তাকাতে হয় তাই ডানা দিয়ে মুখ আড়াল করে রেখেছে তারা। সমবেত কণ্ঠে পরস্পরের উদ্দেশে চেঁচাচ্ছে তারা: ‘পবিত্র! পবিত্র! ইয়াহ্ওয়েহ্ স্যাবোথ পবিত্র। তার প্রতাপ গোটা পৃথিবীকে পূর্ণ করেছে।’[১] ওদের কণ্ঠস্বরে গোটা মন্দির যেন ভিত্তিমূলসহ কাঁপছে বলে মনে হতে লাগল, ধোঁয়ায় ভরে গেল পুরো জায়গা, নিশ্চিদ্র মেঘের মতো ঢেকে ফেলল ইয়াহ্ওয়েহ্কে, সিনাই পর্বতে যেমন মেঘ আর ধোঁয়া মোজেসের কাছ থেকে আড়াল করেছিল তাঁকে। বর্তমানে আমরা ‘পবিত্র’ শব্দটি ব্যবহার করার সময় সাধারণভাবে নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের কথা বুঝিয়ে থাকি। কিন্তু হিব্রু কাদ্দোশ এর সঙ্গে নৈতিকতার কোনও সম্পর্ক নেই, এটা ‘ভিন্নতা’ (otherness), চরম ভিন্নতা বোঝায়। সিনাই পর্বতে ইয়াহ্ওয়েহ্র আবির্ভাব মানুষ ও স্বর্গীয় জগতের মাঝে আকস্মিক সৃষ্ট বিশাল দূরত্ব তুলে ধরেছিল। এযাত্রা সেরাফরা চিৎকার করে বলেছিল: ইয়াহ্ওয়েহ্ আলাদা আলাদা! আলাদা!’ সময়ে সময়ে নারী-পুরুষকে বিস্ময় ও আতঙ্কে ভরিয়ে তোলা ঐশ্বরিক অনুভূতির (numinous) অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন ইসায়াহ্। রুডল্ফ অটো তার ক্লাসিক গ্রন্থ দ্য আইডিয়া অভ হোলিতে দুয়ে সত্তার আতঙ্কময় উপলব্ধিকে মিস্টেরিয়াম টেরিবল এত ফ্যাসিনান্স বলে বর্ণনা করেছেন: এটা ভয়ঙ্কর, কেননা এমন গভীর ধাক্কার মতো আমাদের কাছে আসে যার ফলে আমরা স্বাভাবিক অবস্থার সান্ত্বনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি; এবং ফ্যাসিন্যান্স, কারণ বিপরীতে এটা এক ধরনের অদম্য আকর্ষণের সৃষ্টি করে। এই সর্বগ্রাসী অভিজ্ঞতার কোনও যুক্তি নেই, যার সঙ্গে অটো সঙ্গীত বা যৌনতার তুলনা করেছেন: এর সৃষ্ট আবেগ ভাষা বা ধারণা দিয়ে পুরোপুরিভাবে প্রকাশ করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে ‘সম্পূর্ণ’ ভিন্ন-এর অনুভূতির ‘অস্তিত্ব’ আছে, এটাও বলা যাবে না, কারণ আমাদের স্বাভাবিক বাস্তবতার জগতে এর কোনও স্থান নেই।[২] অ্যাক্সিয়াল যুগের নতুন ইয়াহ্ওয়েহ্ তখনও যোদ্ধাদের দেবতা স্যাবোথ ছিলেন, কিন্তু স্রেফ একজন যুদ্ধ দেবতা ছিলেন না; আবার কোনও গোত্রীয় উপাস্যও ছিলেন না তিনি, যিনি চরমভাবে ইসরায়েলের পক্ষে তার প্রতাপ ও প্রতিশ্রুত ভূমির সীমানায় আবদ্ধ ছিলেন না, বরং গোটা পৃথিবীকে পূর্ণ করে তুলেছিলেন।
ইসায়াহ্ স্থৈর্য ও আনন্দবাহী আলোকনের অভিজ্ঞতা অর্জনকারী বুদ্ধ ছিলেন না। তিনি মানুষের নিখুঁত শিক্ষকে পরিণত হতে পারেননি। উল্টে মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়ে উঠেছেন, সশব্দে বলে উঠেছেন:
তখন আমি কহিলাম, হায় আমি নষ্ট হইলাম,
কেননা আমি অশুচি-ওষ্ঠাধর মানুষ,
এবং অশুচি-ওষ্ঠাধর জাতির মধ্যে বাস করিতেছি;
আর আমার চক্ষু রাজাকে ইয়াহ্ওয়েহ্ স্যাবোথকে দেখিতে পাইয়াছে।[৩]
ইয়াহ্ওয়েহ্র ছাপিয়ে যাওয়া পবিত্রতায় আক্রান্ত ইসায়াহ কেবল নিজের অসম্পূর্ণতা ও আচরিক অপবিত্রতা সম্পর্কেই সচেতন ছিলেন। বুদ্ধ বা কোনও যোগীর বিপরীতে কিছু সংখ্যক আধ্যাত্মিক অনুশীলনের ভেতর দিয়ে নিজেকে এরকম অভিজ্ঞতার জন্যে প্রস্তুত করেননি তিনি। আচমকা তার কাছে হাজির হয়েছে এটা, এর প্রলয়ঙ্করী প্রভাবে সম্পূর্ণ দিশাহারা হয়ে গেছেন তিনি। জ্বলন্ত কয়লায় টুকরো হাতে এক সেরাফ তাঁর কাছে উড়ে এসে মুখ পবিত্র করে দিল যাতে তিনি তার মুখে ঈশ্বরের বাণী উচ্চারণ করতে পারেন। পয়গম্বরদের অনেকেই ঈশ্বরের পক্ষে কথা বলতে অনিচ্ছুক ছিলেন বা সক্ষম ছিলেন না। ঈশ্বর সকল পয়গম্বরদের আদি সংস্করণ মোজেসকে জ্বলন্ত ঝোঁপ থেকে ডেকে ইসরায়েলের সন্তানের কাছে তার বার্তাবাহক হওয়ার নির্দেশ দিলে মোজেস এই বলে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন যে, তিনি ‘জড় মুখ ও জড় বিত্তের। এই অপরাগতার জন্যে ছাড় দিয়েছেন ঈশ্বর, তাঁর ভাই আরনকে মোজেসের পক্ষে কথা বলার অনুমতি দিয়েছেন। পয়গম্বরদের জীবন-কাহিনীর এই সাধারণ মোটিফটি ঈশ্বরের ভাষায় কথা বলার সমস্যাকেই প্রতীকায়িত করে। পয়গম্বরগণ স্বর্গীয় বার্তা ঘোষণায় আগ্রহী ছিলেন না; প্রবল চাপ ও কষ্টের মিশন গ্রহণে অনিচ্ছুক ছিলেন তারা। ইসরায়েলের ঈশ্বরের এক দুৰ্জ্জেয় শক্তিতে রূপান্তর শান্ত, অচঞ্চল প্রক্রিয়া ছিল না, বরং কষ্ট ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তা অর্জন করতে হয়েছে।
হিন্দুরা কখনও তাদের ব্রহ্মাকে মহান রাজা বলে আখ্যায়িত করেনি, কারণ তাদের ঈশ্বরকে এরকম মানবীয় পরিভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। ইসায়াহ্র দিব্যদর্শনের কাহিনীটিকে আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা না করার জন্য আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে: এটা বর্ণনাতীতকে বর্ণনার একটা প্রয়াস মাত্র। ইসায়াহ্ নিজের অজান্তেই মানুষের কাছে আপন অভিজ্ঞতার খানিকটা ধারণা দিতে তাঁর দেশের জনগণের পৌরাণিক ঐতিহ্য ফিরে নিয়েছেন। শ্লোকসমূহে (Psalms) প্রায়শঃই ইয়াহ্ওয়েহ্কে সিংহাসনে আসীন রাজা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, ঠিক তাদের প্রতিবেশীদের দেবতা বাআল, মারদুক ও দাগনের মতো, প্রায় একই ধরনের মন্দিরে রাজা হিসাবে যাদের অধিষ্ঠান ছিল। অবশ্য পৌরাণিক ইমেজারির আড়ালে ইসরায়েলে পরম সত্তা সম্পর্কিত এক সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের ধারণা উঠে আসছিল। এই ঈশ্বরের অভিজ্ঞতা হচ্ছে ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ। ভীতিকর ভিন্নতা সত্ত্বেও ইয়াহ্ওয়েহ্ ইসায়াহ্র সঙ্গে কথা বলতে পারেন, ইসায়াহ্ও জবাব দেন। কিন্তু উপনিষদের সাধুদের কাছে এটা অবিশ্বাস্য ঠেকত, কেননা ব্রাহ্মণ আত্মার সঙ্গে কথোপকথন বা সাক্ষাতের ধারণা অসঙ্গতভাবে মানবীয়।
ইয়াহ্ওয়েহ্ জিজ্ঞেস করলেন: ‘আমি কাকে পাঠাব? কে আমাদের বার্তাবাহক হবে?’ অতীতের মোজেসের মতো ইসায়াহ্ ঝটপট জবাব দিলেন: ‘আমি উপস্থিত (হিনেনি), আমাকে পাঠান!’ এই দর্শনের মূল কথা পয়গম্বরকে আলোকিত করা নয় বরং তাকে একটা নির্দিষ্ট কাজের দায়িত্ব দেওয়া। প্রাথমিকভাবে পয়গম্বর তিনি যিনি ঈশ্বরের সান্নিধ্যে যান, কিন্তু দুয়ের এই অভিজ্ঞতা-বোধ বৌদ্ধমতবাদের মতো জ্ঞান দান করে না বরং দায়িত্ব সৃষ্টি করে । পয়গম্বর অতিন্দ্রীয় আলোকনের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হবেন না বরং আনুগত্যের স্বাক্ষর রাখবেন। এটা প্রত্যাশা করাই স্বাভাবিক যে, বার্তা কখনও সহজ নয়। প্রচলিত সেমিটিক প্যারাডক্সের মাধ্যমে ইয়াহ্ওয়েহ্কে ইসায়াহকে বলেছেন যে মানুষ একে গ্রহণ করবে নাঃ তারা ঈশ্বরের বাণীকে প্রত্যাখ্যান করলে তিনি যেন হতাশ না হন: তুমি যাও, ওই জাতিকে বল, তোমরা শুনিতে থাকিও, কিন্তু বুঝিও না; এবং দেখিতে থাকিও, কিন্তু জানিও না।[৬] সাত শত বছর পর মানুষকে একই রকম কঠিন বার্তা প্রত্যাখ্যান করতে দেখে জেসাসও এই কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করেন। খাঁটি সত্যকে মানব জাতি ধারণ করতে পারে না। ইসায়াহর আমলের ইসরায়েলিরা সংঘাত ও বিলুপ্তির উপান্তে অবস্থান করছিল। ইয়াহ্ওয়েহ্ তাদের কোনও সুসংবাদ দেননিঃ তাদের শহরগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে, গ্রামগুলো বিধ্বস্ত হবে, জনশূন্য হয়ে পড়বে ঘরবাড়ি। ৭২২ সালে উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যের ধ্বংস ও দশটি গোত্রের বিতাড়ন প্রত্যক্ষ করার জন্য বেঁচে ছিলেন ইসায়াহ্। ৭০১ সালে সেন্নাচেরি এক বিশাল আসিরিয় সেনাবাহিনী নিয়ে জুদাহয় হামলা চালান, এখানকার ছিচল্লিশটি নগরী ও দুর্গ অবরোধ করেন; শূলে চড়িয়ে হত্যা করেন প্রতিরোধকারী কর্মকর্তাদের, দেশছাড়া করেন : ২০০০ মানুষকে এবং জেরুজালেমে ইহুদি রাজাকে ‘খাঁচায় বন্দি পাখির মতো’[৮] আটক করেন। এসব আসন্ন বিপর্যয় সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক করার পুরস্কারহীন দায়িত্ব পেয়েছিলেন ইসায়াহ্:
যদ্যপি তাহার দশমাংশও থাকে,
তথাপি তাহাকে পুনর্বার গ্রাস করা যাইবে;
কিন্তু যেমন এলা ও অলোনে বৃক্ষ ছিন্ন হইলেও তাহার গুঁড়ি থাকে,
তেমনি এই জাতির গুঁড়িস্বরূপ এক পবিত্র বংশ থাকিবে।[৯]
একজন বিচক্ষণ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের পক্ষে এসব দুর্যোগের পূর্বাভাস পাওয়া অসম্ভব ছিল না। ইসায়াহর বাণীর অসাধারণ মৌলিকত্ব হচ্ছে তার পরিস্থিতির বিশ্লেষণ। মোজেসের প্রাচীন পক্ষপাতদুষ্ট ঈশ্বর আসিরিয়াকে শত্রুর ভূমিকায় নিয়ে আসতেন; ইসায়াহর ঈশ্বর আসিরিয়াহকে নিজ উপায় হিসাবে দেখেছেন: দ্বিতীয় সারগন ও সেন্নাচেরিব ইসরায়েলিদের দেশান্তরী করে দেশকে ধ্বংস করেননি। ইয়াহ্ওয়েহ্ই জনগণকে বিতাড়ন করেছেন।[১০]
অ্যাক্সিয়াল যুগের পয়গম্বরদের বাণীর এটাই ছিল এক সুর। কেবল মিথ ও লিটার্জিতে নয়, ইসরায়েলের ঈশ্বর নিরেট বর্তমান ঘটনাপ্রবাহে নিজেকে প্রকাশের মাধ্যমে মূলত পৌত্তলিক উপাস্য হতে নিজের অনন্যতা প্রকাশ করেছিলেন। এবার নতুন পয়গম্বরগণ জোর দিয়ে বলতে শুরু করলেন যে, রাজনৈতিক দুর্যোগ ও বিজয় উভয়ই ঈশ্বরকে প্রকাশ করে যিনি ইতিহাসের প্রভু ও নিয়ন্তা হয়ে উঠছেন। সকল জাতি তার ভাণ্ডারে ছিল। আসিরিয়াহ দুর্যোগ কবলিত হবে, কারণ এর শাসকগণ উপলব্ধি করতে পারেনি যে তারা আসলে আরও বিশাল এক সত্তার হাতের পুতুল মাত্র।[১১] যেহেতু ইয়াহ্ওয়েহ্ আসিরিয়ার ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করেছেন, সেহেতু ভবিষ্যৎ নিয়ে ক্ষীণ একটা আশা ছিল। কিন্তু কোনও ইসরায়েলি এ কথা শুনতে চাইত না যে তার স্বজাতিই অদূরদর্শী রাজনীতি ও শোষণমূলক আচরণের মধ্য দিয়ে মাথার উপর রাজনৈতিক ধ্বংস ডেকে এনেছে। এ কথা শুনে কেউ খুশি হতো না যে, ইয়াহ্ওয়েহ্ই ৭২২ এবং ৭০১ সালে আসিরিয়া যুদ্ধের রূপকার ছিলেন, ঠিক যেভাবে তিনি জোশুয়া, গিদিয়ান ও রাজা ডেভিডের সেনাদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যে জাতির তার মনোনীত জাতি হওয়ার কথা সে জাতিকে নিয়ে কী ছেলেখেলা খেলছিলেন তিনি? ইসায়াহু কর্তৃক ইয়াহ্ওহেয়ের বর্ণনায় স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা পূরণের কিছু ছিল না। মানুষকে কষ্ট হতে মুক্তি দানের বদলে ইয়াহ্ওয়েহ্ যেন অনাকাক্ষিত বাস্তবতার মোকাবিলা করতে বলছিলেন। মানুষকে পৌরাণিক কালে নিক্ষেপকারী প্রাচীন কাল্টিক রীতিনীতির আশ্রয় নেওয়ার বদলে ইসায়াহ্র মতো পয়গম্বরগণ দেশবাসীকে ইতিহাসের প্রকৃত ঘটনাপ্রবাহের মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিলেন এবং সেগুলোকে ঈশ্বরের সঙ্গে ভীতিকর সংলাপ হিসাবে মেনে নিতে বলেছিলেন।
মোজেসের ঈশ্বর যেখানে বিজয়ের আনন্দে উল্লাসিত ছিলেন, ইসায়াহর ঈশ্বর সেখানে বিষাদময়। ভবিষ্যদ্বাণী, আমরা যেভাবে পাই, শুরু হয়েছে এক শোকবার্তা দিয়ে যেটা চুক্তির মানুষের জন্য দারুণভাবে হতাশাব্যাঞ্জক: ষাঁড় ও গাধা যার যার মনিবকে চেনে, কিন্তু ইসরায়েল জানে না, আমার প্রজাগণ বিবেচনা করে না।[১২] মন্দিরে পশুর উৎসর্গ নিয়ে ইয়াহ্ওয়েহ্ দারুণ বিক্ষুব্ধ, বাছুরের চর্বি দেখে তিনি অসুস্থ বোধ করেন, ছাগলের রক্ত ও পোড়া পশুর ঝরে পড়া রক্ত বিবমিষা জাগায়। ওদের উৎসব, নববর্ষের অনুষ্ঠান ও তীর্থযাত্রা বরদাশত করতে পারেননি তিনি।[১৩] ইসায়াহর শ্রোতারা এতে হতচকিত হয়ে থাকতে পারে: মধ্যপ্রাচ্যে এইসব কাল্টিক আনুষ্ঠানিকতা ছিল ধর্মের মূল রূপ । পৌত্তলিক দেবতাগণ তাঁদের হ্রাসমান শক্তির নবায়নের জন্যে আনুষ্ঠানিকতার। ওপর নির্ভরশীল ছিলেন; মন্দিরের জাকজমকের ওপর তাদের মর্যাদার অংশ নির্ভর করত। এখন ইয়াহ্ওয়েহ্ বলছেন তার কাছে এসব কর্মকাণ্ড একেবারে অর্থহীন। ওইকুমিনের অন্যান্য সাধু ও দার্শনিকের মতো ইসায়াহ্ উপলব্ধি করেছিলেন যে বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা যথেষ্ট নয়। ইসরায়েলিদের অবশ্যই তাদের ধর্মের অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করতে হবে। ইয়াহ্ওয়েহ্ উৎসর্গ নয় বরং সমবেদনা চেয়েছেন:
যদ্যপি অনেক প্রার্থনা কর,
তথাপি শুনিব না;
তোমাদের হস্ত রক্তে পরিপূর্ণ।
তোমরা আপনাদিগকে ধৌত কর, বিশুদ্ধ কর,
আমার নয়নগোচর হইতে তোমাদের ক্রিয়ার দুষ্টতা দূর কর;
কদাচরণ ত্যাগ কর,
সদাচরণ শিক্ষা কর,
ন্যায় বিচারের অনুশীলন কর,
উপদ্রবী লোককে শাসন কর,
পিতৃহীন লোকের বিচার নিষ্পত্তি কর,
বিধবার পক্ষ সমর্থন কর। [১৪]
স্বয়ং পয়গম্বরগণই সমবেদনার প্রবল দায়িত্ববোধ আবিষ্কার করেছিলেন যা পরবর্তীকালে অ্যাক্সিয়াল যুগে বিকশিত সকল প্রধান ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্যে পরিণত হবে। এ সময়কালে ওইকুমিনে বিকাশমান নতুন মতবাদসমূহ এই মর্মে জোর দিয়েছে যে, সত্যের পরীক্ষা হচ্ছে দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ধর্মীয় অভিজ্ঞতাকে সাফল্যের সঙ্গে সমন্বিত করা। মন্দিরের আনুষ্ঠানিকতা ও মিথের অপার্থিব জগতে আবদ্ধ হয়ে থাকা যথেষ্ট ছিল না। আলোকপ্রাপ্তির পর পুরুষ বা নারীকে অবশ্যই বাজার এলাকায় ফিরে গিয়ে সকল জীবিত প্রাণীর প্রতি দরদ প্রদর্শনের অনুশীলন করতে হবে।
সিনাইয়ের আমল থেকেই পয়গম্বরদের সামাজিক মতবাদ ইয়াহ্ওয়েহ্র কাল্টে অন্তর্লীন ছিল: এক্সোডাসের কাহিনীতে ঈশ্বর যে নির্যাতিতের পক্ষেই ছিলেন তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। পার্থক্য হচ্ছে এবার ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধেই নির্যাতনের অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। ইসায়াহ্র পয়গম্বরত্ব প্রাপ্তির সময় আরও দুজন পয়গম্বর অরাজক উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যে একই ধরনের বাণীর শিক্ষা দিচ্ছিলেন। প্রথমজনের নাম আমোস যিনি ইসায়াহ্র মতো অভিজাত শ্রেণীর লোক ছিলেন না, বরং রাখাল হিসাবে দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যে বাস করতেন। আনুমানিক ৭৫২ সালে আমোসও আকস্মিকভাবে আদিষ্ট হয়ে উত্তরের ইসরায়েল রাজ্যে ধেয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। ঝড়ের বেগে বেথ এলের প্রাচীন মন্দিরে প্রবেশ করে প্রলয়ের ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা পণ্ড করে দিয়েছিলেন তিনি। বেথ-এলের যাজক আমাযিয়াহ তাড়ানোর প্রয়াস পেয়েছিলেন তাঁকে। অর্বাচীন রাখালকে ভর্ৎসনা করার সময় আমরা তার কণ্ঠে প্রশাসনের কর্তৃত্বের সুর শুনতে পাই। তিনি যেন তাঁকে ভবিষ্যদ্বক্তাদের কোনও সদস্য ধরে নিয়েছিলেন, যারা দলে দলে ঘুরে ভবিষ্যদ্বাণী করে পেট চালায়। ‘হে দর্শক, যিহুদা দেশে পলায়ন কর।’ বিকৃত কণ্ঠে বলেন তিনি। সেই স্থানে রুটি ভোজন কর আর সেই স্থানে ভাববাণী বল। বেথল-এলে আমরা কিন্তু বৈথেলে আর ভাববাণী বলিও না, কেননা এ রাজার পূণ্যধাম ও রাজপুরী। একটুও দমলেন না আমোস, ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে তীব্র ভর্ৎসনার সুরে জবাব দিলেন, তিনি দলীয় পয়গম্বর নন, বরং ইয়াহ্ওয়েহ্র কাছ থেকে সরাসরি ক্ষমতাপ্রাপ্ত: ‘আমি কোনও পয়গম্বর নই, আমি পয়গম্বরদের ভ্রাতুসঙ্ঘের সদস্যও নই। আমি গোপালক ও ডুমুরফল সংগ্রাহক ছিলাম, কিন্তু ইয়াহ্ওয়েহ্ আমাকে ভেড়ার পাল দেখাশোনা থেকে সরিয়ে এনেছেন, এবং ইয়াহ্ওয়েহ্ বলেছেন: ‘যাও, আমার ইসরায়েল জাতিকে ভবিষ্যৎ জানিয়ে দাও।’[১৫] তবে কি বেথ-এলের জনগণ ইয়াহ্ওয়েহ্র বাণী শুনতে রাজি নয়? খুব ভালো, আবার এক দফা বক্তব্য রাখলেন তিনি: ওদের স্ত্রীরা রাস্তায় বেরিয়ে আসতে বাধ্য হবে, সন্তানদের হত্যা করা হবে এবং ইসরায়েল থেকে বহু দূরে নির্বাসিত অবস্থায় মৃত্যু ঘটবে ওদের।
নিঃসঙ্গতা ছিল পয়গম্বরের মূল বৈশিষ্ট্য। আমোসের মতো ব্যক্তিরা ছিলেন একাকী; অতীতের ছন্দ ও কর্তব্যের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছিল তাঁর। এটা তার বেছে নেওয়া কিছু ছিল না, তার ওপর আরোপিত হয়েছে। মনে হয় যেন চেতনার স্বাভাবিক প্যাটার্ন থেকে সহসা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছিল তাঁকে, ফলে স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ আর বজায় রাখতে পারছিলেন না। চান বা না চান জোর করে তাকে পয়গম্বর হতে বাধ্য করা হয়েছে। আমোস যেমন বলেছেন:
সিংহ গর্জন করিল, কে না ভয় করিবে?
প্রভু ইয়াহ্ওয়েহ্ কথা কহিলেন, কে না ভাববাণী বলিবে?[১৬]
বুদ্ধের মতো নির্বাণের সত্তাহীন বিলুপ্তিতে হারিয়ে যাননি আমোস; পরিবর্তে ইয়াহ্ওয়েহ্ তার অহমের স্থান দখল করে তাকে ভিন্ন জগতে টেনে নিয়েছেন। পয়গম্বরদের মাঝে আমোসই প্রথম সামাজিক ন্যায়বিচার ও সহানুভূতির গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। বুদ্ধের মতো তিনিও মানুষের দুঃখকষ্ট সম্পর্কে তীব্রভাবে সচেতন ছিলেন। আমোসের ভবিষ্যদ্বাণীর মাঝে নির্যাতিতের পক্ষে কথা বলছিলেন ইয়াহ্ওয়েহ্, দরিদ্রদের, ভাষাহীনদের অক্ষমতাকে ভাষা দিয়েছেন। আমরা যেভাবে পাই, তার ভবিষ্যদ্বাণীর একেবারে প্রথম লাইনেই ইয়াহ্ওয়েহ্ জেরুজালেমে তার মন্দির থেকে জুদাহ্ ও ইসরায়েলসহ নিকট প্রাচ্যের সবগুলো দেশের দুঃখকষ্টের কথা ভেবে তীব্র রোষে গর্জন করছেন। ইসরায়েলের জনগণ গোয়িম (goyim) অর্থাৎ জেন্টাইল (বা অ-ইহুদিদের মতোই খারাপ: তারা হয়তো দরিদ্রের ওপর নিষ্ঠুরতা ও তাদের নির্যাতনকে অগ্রাহ্য করতে পারে, কিন্তু ইয়াহ্ওয়েহ্ তা পারেন না। প্রতিটি প্রতারণা, শোষণ ও বঞ্চনার দারুণ নজীর লক্ষ করছেন তিনিঃ ইয়াহ্ওয়েহ্ যাকবের মহিমাস্থলের নাম লইয়া শপথ করিয়াছেন: ‘নিশ্চয়ই ইহাদের কোনও ক্রিয়া আমি কখনও ভুলিয়া যাইব না।’[১৭] প্রভুর শেষ বিচারের আকাক্ষা করার মতো কী হঠকারী তারা, যেদিন ইয়াহ্ওয়েহ্ ইসরায়েলকে আনন্দিত করবেন আর অপমানিত করবেন গোয়িমদের? ওদের জন্যে একটা বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে: ‘ইয়াহ্ওয়েহ্র দিন তোমাদের কি করিবে? তাহা অন্ধকার, আলোক নহে।’[১৮] ওরা কী নিজেদের ঈশ্বরের মনোনীত জাতি ভেবেছে? আসলে চুক্তির (Covenant) প্রকৃতি উপলব্ধি করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে তারা, যার অর্থ দায়িত্ব, সুবিধা নয়: ‘হে ইসরায়েল-সন্তানগণ, তোমরা এই বাক্য শুন, যাহা তোমাদের বিরুদ্ধে ইয়াহ্ওয়েহ্ বলিয়াছেন। চিৎকার করে বলেছেন আমোস, ‘আমি মিশর দেশ হইতে যাহাকে বাহির করিয়া আনিয়াছি সেই সমস্ত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে [বলিয়াছি] :
‘আমি পৃথিবীস্থ সমস্ত গোষ্ঠীর মধ্যে তোমাদেরই পরিচয় লইয়াছি এইজন্য তোমাদের সমস্ত অপরাধ ধরিয়া তোমাদিগকে প্রতিফল দিব।’[১৯]
চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েলের সকল মানুষ ঈশ্বরের নির্বাচিত এবং সে কারণে ভালো আচরণ পাবার দাবিদার। ঈশ্বর কেবল ইসরায়েলকে মহত্ব দান করার জন্যেই ইতিহাসে হস্তক্ষেপ করেন না, বরং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই তার উদ্দেশ্য। ইতিহাসে এটাই তাঁর স্বার্থ, প্রয়োজনে তিনি আপনভূমিতে ন্যায়বিচার স্থাপন করার জন্যে আসিরিয় সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করবেন।
এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, অধিকাংশ ইসরায়েলি ইয়াহ্ওয়েহ্র সঙ্গে সংলাপে লিপ্ত হতে পয়গম্বরের আহ্বানে সাড়া দিতে রাজি হয়নি। জেরুজালেম মন্দির বা কানানের প্রাচীন উর্বরতার দেবীদের স্বল্প চাহিদাসম্পন্ন ধর্ম পছন্দ ছিল তাদের। এভাবেই চলে আসছে: সংখ্যালঘুরা সহমর্মিতার ধর্ম অনুসরণ করে; অধিকাংশ ধার্মিক ব্যক্তিই সিনাগগ, চার্চ, মন্দির আর মসজিদে জাঁকজমকপূর্ণ উপাসনা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। প্রাচীন কানানিয় ধর্মগুলো তখনও ইসরায়েলে বিকশিত হচ্ছিল। দশম শতকে রাজা প্রথম জেরোম ডান ও বেথ এলের স্যাঙ্কচুয়ারিতে দুটো কাল্টিক সঁড় স্থাপন করেছিলেন। দুই শত বছর পরও ইসরায়েলিরা সেখানে উর্বরতা বৃদ্ধির আচার ও পবিত্র যৌনতায় অংশ নিয়েছে, আমোসের সমসাময়িক পয়গম্বর হোসেয়ার ভবিষ্যদ্বাণীতে যেমনটি আমরা দেখতে পাই। ইসরায়েলিদের কেউ কেউ অন্যান্য দেবতার মতো ইয়াহ্ওয়েহ্রও স্ত্রী আছে ভেবেছিল মনে হয়: প্রত্নতাত্ত্বিকগণ সম্প্রতি ‘ইয়াহ্ওয়েহ্ ও তার আশেরাহর উদ্দেশে নিবেদিত’ খোদাইলিপি আবিষ্কার করেছেন। বাআলের মতো দেবতাদের উপাসনা করে ইসরায়েল চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করছে দেখে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন হোসেয়া। সকল নতুন পয়গম্বরের মতো তিনিও ধর্মের অন্তর্নিহিত অর্থ নিয়ে ভাবিত ছিলেন। যেমন ইয়াহ্ওয়েহ্কে দিয়ে তিনি বলিয়েছেন: আমি দয়াই (hesed) চাই, বলিদান নয়; এবং হত্যাযজ্ঞ অপেক্ষা ঈশ্বর বিষয়ক জ্ঞান [daath Elohim].[২১]। ধর্মতত্তীয় জ্ঞানের কথা বোঝাননি তিনিঃ daath শব্দটি এসেছে হিব্রু ক্রিয়াপদ yada: জানা থেকে, যার যৌন দ্যোতনা রয়েছে। এভাবে ‘J’ বলেছেন আদম তার স্ত্রী ইভকে জানতেন।[২২] প্রাচীন কানানিয় ধর্মে বাআল মাটিকে বিয়ে করেছিলেন, মানুষ আচরিক যৌনমিলনের মাধ্যমে এর উদযাপন করত; কিন্তু হোসেয়া জোর দিয়ে বললেন যে, চুক্তির পর থেকে ইয়াহ্ওয়েহ্ বাআলের স্থান। গ্রহণ করেছেন এবং ইসরায়েলের জনগণের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। ওদের বুঝতে হবে যে বাআল নন, ইয়াহ্ওয়েহ্ই মাটিতে প্রাণের সঞ্চার করবেন।[২৩] তখনও একজন প্রেমিকের মতো ইসরায়েলকে তোয়াজ করছিলেন তিনি, তাকে কুসংস্কার বাআলের কাছ থেকে ফিরিয়ে আনতে প্রলুব্ধ। করতে বদ্ধপরিকর:
আর সেই দিন আমি লোকদের নিমিত্তে মাঠের পশু, আকাশের পক্ষী ও ভূমির সরীসৃপ সকলের সহিত নিয়ম করিব; এবং ধনুক খড়গ ও রণসজ্জা ভাঙিয়া দেশের মধ্য হইতে উচ্ছিন্ন করিব ও তাহাদিগকে নিশ্চিন্তে শয়ন করাই। আর আমি চিরকালের জন্যে তোমাকে বাগদান করিব; হাঁ, ধার্মিকতায়, ন্যায় বিচারে, দয়াতে ও বহুবিধ অনুকম্পায় তোমাকে বাগদান করিব।[২৪]
আমোস যেখানে সামাজিক দুরাচারকে আঘাত করেছেন, হোসেয়া সেখানে ইসরায়েলি ধর্মের অন্তর্মুখীতার অভাবের প্রতি ওপর জোর দিয়েছেন: ঈশ্বরের জ্ঞান-কে (hesed)-এর সঙ্গে সম্পর্কিত করা হয়েছে, যা ইয়াহ্ওয়েহ্র সঙ্গে অন্তরের সংযোগ ও উপলব্ধি বোঝায়, যাকে বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতার উর্ধ্বে উঠতেই হবে।
পয়গম্বরগণ কীভাবে ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের ভাবমূর্তি গড়ে তুলছিলেন হোসেয়া তার এক চমকপ্রদ আভাস দিয়েছেন। তার পয়গম্বরত্বের একেবারে সূচনায় ইয়াহ্ওয়েহ্ যেন কঠিন নির্দেশ জারি করেছিলেন। হোসেয়াকে তিনি একজন পতিতাকে (esheth zeauntm) বিয়ে করতে বলেছিলেন, কেননা ‘গোটা দেশ ইয়াহ্ওয়েহ্র অনুগমন হইতে নিবৃত্ত হওয়ায় ভয়ানক ব্যাভিচার করিতেছে।’[২৫] অবশ্য এটা মনে হয় যে, ঈশ্বর হোসেয়াকে পতিতার আক্ষরিক অর্থ:a wife of prostitution]-এর খোঁজে রাস্তায় ঘুরতে বলেননি। eseth telumim এমন কোনও নারী যে বাছবিচারহীন চলাফেরা করে বা উর্বরতার ধর্ম বিশ্বাসের পবিত্র পতিতা। উর্বরতার আচার অনুষ্ঠানের সঙ্গে হোসেয়ার পূর্ব পরিচয় ছিল বলে এটা মনে হয় যে তার স্ত্রী গোমার বাআলের ধর্মের পবিত্র কর্মচারীতে পরিণত হয়েছিলেন। সুতরাং, তাঁর বিয়েটা ছিল বিশ্বাসহীন ইসরায়েলের সঙ্গে ইয়াহ্ওয়েহ্র সম্পর্কের একটা প্রতীক। হোসেয়া ও গোমারের তিন সন্তান ছিল যাদের ভয়ঙ্কর প্রতীকী নাম দেওয়া হয়েছিল। বড় ছেলের নাম ছিল বিখ্যাত রণক্ষেত্রের নামানুসারে জেরিল, মেয়ের নাম ছিল লো-রুবামাহ যার অর্থ যাকে ভালোবাসা হয়নি এবং ছোট ছেলের নাম ছিল লো-আম্মি আমার জাতি নয়]। এর জন্মের পর ইয়াহ্ওয়েহ্ ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি রদ করে দেন: ‘কেননা তোমরা আমার প্রজা নহ, আমিও তোমাদের ঈশ্বর নহি।’[২৬] আমরা দেখব, পয়গম্বরগণ প্রায়শঃই স্বজাতির বিপজ্জনক অবস্থা বোঝাতে দীর্ঘ প্রহসনের আশ্রয় নিতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন, কিন্তু এটা মনে হয় যে, হোসেয়ার বিয়ের বিষয়টি আগে থেকেই পরিকল্পিত ছিল না। টেক্সট থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, গোমার তাদের সন্তান জন্ম নেওয়ার আগ পর্যন্ত eseth Reuumim-এ পরিণত হননি। কেবল পরবর্তী সময়ে হোসেয়ার মনে হয়েছে যে, তাঁর বিয়ে ঈশ্বরের ইচ্ছায় হয়েছে। স্ত্রী বিয়োগ এক মারাত্মক অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর, হোসেয়াকে যা ইসরায়েলিরা ইয়াহ্ওয়েহ্কে ত্যাগ করে বাআলের মতো উপাস্যদের সঙ্গে ব্যাভিচারে লিপ্ত হওয়ায় ইয়াহ্ওয়েহ্র অনুভূতির স্পষ্ট ধারণা দিয়েছিল। প্রথমে গোমারকে ত্যাগ করতে চেয়েছেন হোসেয়া, তাঁকে নিয়ে মাথা ঘামাতে চাননি আর: প্রকৃতপক্ষে ‘আইন’ অনুযায়ী অবিশ্বস্ত স্ত্রীকে তালাক দেওয়া পুরুষের দায়িত্ব। কিন্তু গোমারকে ভালোবাসতেন হোসেয়া, ফলে শেষ পর্যন্ত তার খোঁজে বের হন এবং নতুন মালিকের কাছ থেকে তাঁকে ফিরিয়ে আনেন। গোমারকে ফিরে পাবার আপন ইচ্ছার মাঝে ইয়াহ্ওয়েহ্র ইসরায়েলকে আরেকটা সুযোগ দিতে রাজি থাকার আভাস পেয়েছেন তিনি।
পয়গম্বরগণ যখন তাদের মানবিক অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার জন্যে ইয়াহ্ওয়েহ্কে দায়ি করছেন তখন আসলে তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থে নিজেদের ভাবমূর্তি অনুযায়ী একজন ঈশ্বরকে গড়ে তুলছিলেন। রাজপরিবারের সদস্য ইসায়াহ্ ইয়াহ্ওয়েহ্কে রাজা হিসেবে দেখেছেন; আমোস দরিদ্রের প্রতি তাঁর নিজের সহানুভূতি ইয়াহ্ওয়েহ্র ওপর আরোপ করেছেন, হোসেয়া ইয়াহ্ওয়েহ্কে দেখেছেন স্ত্রী পরিত্যাগকারী স্বামী হিসাবে, যিনি স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত রয়ে গেছেন। সকল ধর্মকে কোনও না কোনও মনুষ্যরূপ নিয়ে শুরু হতে হবে। মানবজাতি থেকে বহু দূরের কোনও উপাস্য, যেমন অ্যারিস্টটলের অটল চালক (Unmoved Mover) আধ্যাত্মিক আকাক্ষা জাগিয়ে তুলতে অক্ষম। এই অভিক্ষেপ যতক্ষণ নিজের মাঝে শেষ না হচ্ছে ততক্ষণ এটা কার্যকর ও উপকারী হতে পারে। এটা বলা প্রয়োজন যে, মানবীয় ভাষায় ঈশ্বরের এই কাল্পনিক উপস্থাপন এক সামাজিক দায়িত্বের অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছে, হিন্দু ধর্মে যা অনুপস্থিত। ঈশ্বর ধর্মের প্রত্যেকটাই আমোস ও ইসায়াহর সাম্যতা ও সমাজতান্ত্রিক নীতিমালা গ্রহণ করেছে। ইহুদিরাই প্রথমবারের মতো প্রাচীন বিশ্বে এক কল্যাণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল যা তাদের পৌত্তলিক প্রতিবেশীদের শ্রদ্ধা কুড়িয়েছে।
অন্যসব পয়গম্বরের মতো হোসেয়া বহুঈশ্বরবাদীতার আতঙ্কে ভুগেছেন। তিনি উত্তরাঞ্চলীয় গোত্রগুলো নিজেদের বানানো দেবতার উপাসনা করে নিজেদের স্বর্গীয় প্রতিশোধ বয়ে আনবে ভেবে শঙ্কিত ছিলেন।
আর এখন তাহারা উত্তরোত্তর আরও পাপ করিতেছে,
তাহারা আপনাদের নিমিত্তে আপনাদের রৌপ্য দ্বারা ছাঁচে ঢালা প্রতিমা
ও আপনাদের নিজ বুদ্ধিমতো পুত্তলি নিৰ্মাণ করিয়াছে;
সেই সমস্তই শিল্পকারদের কর্ম মাত্র; তাহাদের বিষয়ে উহারা বলে,
যেসকল লোক যজ্ঞ করে তাহারা গোব্যসদিগকে চুম্বন করুক।[২৭]
এটা অবশ্যই কানানিয় ধর্মের অত্যন্ত অবিবেচনাপ্রসূত ও অবমূল্যায়িত বর্ণনা। কানান ও বাবিলনের মানুষ কখনও ভাবেনি যে, তাদের দেবতাদের প্রতিমাসমূহও স্বর্গীয়, ওরা কখনও কোনও মূর্তির উপাসনা করতে মাথা নোয়ায়নি। প্রতিমাগুলো ছিল স্বর্গ বা আলৌকিকের প্রতীক। উপাসকদের মনোযোগকে আরও ঊর্ধ্বে আকৃষ্ট করার জন্যে তাদের কল্পনাতীত আদি ঘটনাবলীর মিথের মতো এসব নির্মাণ করা হয়েছিল। এসালিগার মন্দিরে মারদুকের মূর্তি বা কানে আশেরাহর শিলাস্তম্ভকে কখনও দেবতাদের সঙ্গে একীভূত করা হয়নি, বরং এগুলো মানুষকে মানবজীবনে অতিপ্রাকৃত উপাদানের দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ করতে সাহায্য করেছে। কিন্তু তারপরেও পয়গম্বরগণ অত্যন্ত অনাকর্ষণীয় অসন্তোষের সঙ্গে পৌত্তলিক প্রতিবেশীদের উপাস্য বা দেবতাদের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করেছেন। ওদের দৃষ্টিতে ঘরে তৈরি এইসব দেবতা সোনা ও রূপা ছাড়া আর কিছুই নয়; মাত্র কয়েক ঘণ্টায় একজন কারিগর এগুলো তৈরি করেছে; ওদের চোখ আছে কিন্তু ওরা দেখতে পায় না, কান দিয়ে শোনে না, ওরা হাঁটতে পারে না; উপাসকদেরই এদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যেতে হয়; ওরা বুদ্ধিহীন, জড় পদার্থ, মানবেতর বস্তু; তরমুজ খেতের কাগভাড়ুয়ার চেয়ে উন্নত কিছু নয়। ইসরায়েলের ইলোহিম ইয়াহ্ওয়েহ্র তুলনা ওরা এলিহিম (elihim), কিছু না। যেসব গোয়িম ওদের উপাসনা করে তারা নির্বোধ; ইয়াহ্ওয়েহ্ ওদের ঘৃণা করেন।[২৮]
বর্তমান কালে একেশ্বরবাদের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হওয়া দুর্ভাগ্যজনক অসহিষ্ণুতার সঙ্গে আমরা এত পরিচিত হয়ে উঠেছি যে আমরা হয়তো অন্য দেবতাদের প্রতি এই বৈরিতা যে নতুন ধর্মীয় প্রবণতা ছিল সেটা অনুধাবণ করতে পারব না। পৌত্তলিকতাবাদ আবশ্যকীয়ভাবে সহিষ্ণু ধর্মবিশ্বাস ছিল: নতুন দেবতার আবির্ভাবে পুরোনো কাল্টগুলো হুমকির সম্মুখীন না হলে প্রচলিত দেবনিচয়ের পাশে অনায়াসে আরেকজন দেবতার স্থান হতো। এমনকি অ্যাক্সিয়াল যুগের নতুন মতবাদসমূহ যেখানে দেবতাদের প্রতি প্রাচীন শ্রদ্ধার স্থান দখল করছিল তখনও প্রাচীন দেবতাদের প্রতি এমন তীব্র বিতৃষ্ণা দেখা যায়নি। হিন্দু ও বৌদ্ধমতবাদে আমরা দেখেছি, মানুষকে দেবতার ওপর সক্ষোভে চড়াও হওয়ার পরিবর্তে তাদের অতিক্রম করে যাওয়ার উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। অথচ ইসরায়েলের পয়গম্বরগণ ইয়াহ্ওয়েহ্র প্রতিপক্ষ হিসাবে দেখা দেবতাদের প্রতি এরকম শান্ত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারেননি। ইহুদি ধর্মগ্রন্থে ‘বহুঈশ্বরবাদীতা’র নতুন পাপ, মিথ্যা দেবতার উপাসনা বিবমিষার অনুভূতির সৃষ্টি করে। এটা এমন এক প্রতিক্রিয়া যা সম্ভবত চার্চের কোনও পোপ ও ফাদার যৌনতা সম্পর্কে যেমনটি বোধ করেন সেরকম। সুতরাং এটা যৌক্তিক বিবেচনাসূত্র কোনও প্রতিক্রিয়া নয় বরং গভীর উদ্বেগ ও অবদমনের পরিচায়ক। পয়গম্বরগণ কী তাঁদের নিজস্ব ধর্মীয় আচরণের কোনও সুপ্ত উদ্বেগ লালন করছিলেন? এমন কি হতে পারে, যে তারা অস্বস্তির সঙ্গে সচেতন ছিলেন যে ইয়াহ্ওয়েহ্ সম্পর্কিত তাঁদের ধারণাও পৌত্তলিকদের বহুঈশ্বরবাদীতার সমরূপ, কারণ তাঁরাও নিজস্ব ভাবমূর্তি অনুযায়ী একজন দেবতার সৃষ্টি করছিলেন?
যৌনতার প্রতি ক্রিশ্চানদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তুলনা অন্য দিক দিয়েও আলোক নিক্ষেপকারী। এই পর্যায়ে অধিকাংশ ইসরায়েলি অবচেতনভাবে পৌত্তলিক উপাস্যদের অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিল। এটা সত্যি যে, ইয়াহ্ওয়েহ্ ক্রমশঃ নির্দিষ্ট কিছু বলয়ে কানানিয়দের ইলোহিমের ভূমিকা গ্রহণ করছিলেন: যেমন হোসেয়া যুক্তি দেখাতে চাইছিলেন যে, ইয়াহ্ওয়েহ্ বাআলের চেয়ে ভালো উর্বরতার দেবতা। কিন্তু অপরিবর্তনীয় পুরুষ দেবতা ইয়াহ্ওয়েহ্র পক্ষে আশেরাহ, ইশতার বা আনাতের ভূমিকা দখল নিশ্চয়ই কঠিন ছিল, ইসরায়েলিদের মাঝে যাঁদের বহু অনুসারী তখনও ছিল-বিশেষ করে নারীদের মাঝে। যদিও একেশ্বরবাদীরা জোর দিয়ে বলবে, তাদের ঈশ্বর লিঙ্গের ঊর্ধ্বে; তবু তিনি আবশ্যকীয়ভাবে পুরুষ রয়ে যাবেন; যদিও আমরা লক্ষ করব, কেউ কেউ এই অসাম্য দূর করার প্রয়াস পাচ্ছে। এটা অংশতঃ তাঁর গোত্রীয় যুদ্ধ দেবতা হিসাবে আবির্ভাবের কারণে। কিন্তু দেবীদের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম বা যুদ্ধ অ্যাক্সিয়াল যুগের অধিকতর কম ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন দেখায়, এই সময় ক্রমশঃ মেয়েরা সামাজিক মর্যাদা হারাতে শুরু করেছিল। এটা মনে হয় যে, অধিকতর আদিম সমাজে নারীদের পুরুষদের চেয়ে অধিক মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকে। প্রথাগত ধর্মে মহান দেবীদের সম্মান নারীদের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতিফলন। অবশ্য নারীর উত্থান বোঝায় যে সামরিক ও শারীরিক শক্তির পুরুষালি বৈশিষ্ট্য নারীসুলভ বৈশিষ্ট্যকে পিছু হটিয়ে দিয়েছিল। এরপর থেকে ওইকুমিনে নারীদের প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়, সভ্যতায় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয় তারা। যেমন, গ্রিসে তাদের অবস্থান ছিল বিশেষভাবে খারাপ-পশ্চিমের লোকেরা প্রাচ্যের পুরুষতান্ত্রিক আচরণের সমালোচনা করার সময় এ সত্যটা তাদের মনে রাখা উচিত। এথেন্সের নারীদের জন্যে গণতান্ত্রিক আদর্শ সম্প্রসারিত হয়নি, তাদের পৃথক স্থানে রাখা হতো, নিম্নস্তরের প্রাণী হিসাবে ঘৃণা করা হতো। ইসরায়েলি সমাজও আরও পুরুষতান্ত্রিক হয়ে উঠছিল। অতীতকালে নারীরা ছিল শক্তিমতী, নিজেদের তারা তাদের স্বামীদের সমকক্ষ ভাবত। ডেবোরাহর মতো কেউ কেউ যুদ্ধে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বও দিয়েছে। এরকম বীরাঙ্গনাদের ইসরায়েলিরা জুথি ও এশতার হিসাবে শ্রদ্ধা করে যাবে, কিন্তু ইয়াহ্ওয়েহ্ সাফল্যের সঙ্গে কানান ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেবদেবীদের হারিয়ে দিয়ে একমাত্র ঈশ্বরে পরিণত হওয়ার পর তাঁর ধর্ম প্রায় পুরোপুরিভাবে পুরুষরা পরিচর্যা করবে। দেবীদের কাল্টগুলো বাদ পড়ে যাবে আর এটাই হবে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের একটা লক্ষণ, যা ছিল নতুন সভ্য জগতের বৈশিষ্ট্য।
আমরা দেখব, ইয়াহ্ওয়েহ্র বিজয় ছিল কষ্টার্জিত। এখানে চাপ, সহিংসতা ও সংঘাতের প্রয়োজন হয়েছে; এ থেকে বোঝা যায় একজন ঈশ্বরের ধর্ম ইসরায়েলিদের কাছে উপমহাদেশের জনগণের কাছে যেভাবে হিন্দু বা বৌদ্ধ ধর্ম এসেছিল তেমন সহজে আসতে পারছিল না। ইয়াহ্ওয়েহ্ যেন শান্তি পূর্ণ স্বাভাবিক উপায়ে প্রাচীন উপাস্যদের অতিক্রম করতে পারছিলেন না। তাঁকে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়েছিল । এভাবে ৮২ নম্বর শ্লোকে আমরা দেখি স্বর্গীয় সভার (Devine Assembly) নেতৃত্ব অর্জনের জন্যে তিনি একটা নাটক করছেন, যেটা বাবিলনিয় এবং কানানিয় উভয় মিথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে:
দেবতার মাঝে রায় ঘোষণা করার জন্যে
এলের সভায় আপন অবস্থান গ্রহণ করলেন ইয়াহ্ওয়েহ্।[২৯]
‘বিচার নিয়ে আর প্রহসন নয়
দুষ্টদের পালন আর নয়!
দুর্বল ও এতিমদের ন্যায়বিচার পেতে দাও,
দুস্থ ও পীড়িতদের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত আচরণ কর,
দুর্বল ও দরিদ্রকে বাঁচাও,
দুষ্টের কবল হতে ওদের রক্ষা কর!’
মুখ ও নির্বোধ, ওরা অন্ধের মতো চলে,
মানব সমাজের মূল ভিত্তি হানি করে।
আমি একবার বলেছিলাম, “তোমরাও দেবতা,
তোমরা সবাই এল এলিয়নের সন্তান’;
কিন্তু তারপরেও, মানুষের মতোই মারা যাবে তোমরা;
মানুষের মতো, দেবতাগণ, তোমাদের পতন ঘটবে।
স্মরণাতীত কাল থেকে এলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়ে আসা সভায় মোকাবিলা করার জন্যে উঠে দাঁড়িয়ে অন্যান্য দেবতার বিরুদ্ধে কালের সামাজিক চ্যালেঞ্জ মেটাতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ তুলেছেন ইয়াহ্ওয়েহ্। পয়গম্বরদের আধুনিক সমর্মিতার নীতি তুলে ধরেছেন তিনি, কিন্তু তার স্বর্গীয় সহকর্মীগণ বছরের পর বছর ন্যায়বিচার ও সাম্যের পক্ষে কথা বলার জন্যে কিছুই করেননি। প্রাচীনকালে ইয়াহ্ওয়েহ্ ওঁদের ইলেহিম হিসাবে মেনে নিতে তৈরি ছিলেন, এল এলিয়নের (‘সর্ব শ্রেষ্ঠ ঈশ্বর’, God Most high)[৩০] সন্ত নিগণ, কিন্তু দেবতারা প্রমাণ করেছেন তাঁরা অচল। মরণশীল মানুষের মতো ফুরিয়ে যাবেন তাঁরা। শ্লোক রচয়িতা ইয়াহ্ওয়েহ্কে সহযোগী দেবতাদের মৃত্যুর অভিশাপ দিতেই দেখাননি, বরং একই সঙ্গে তিনি এল’র প্রচলিত অবস্থানও কেড়ে নিয়েছেন, ইসরায়েলে তখনও যার সমর্থক ছিল বলে মনে হয়।
বাইবেলে ক্ষতিকর প্রচারণা সত্ত্বেও বহু-ঈশ্বরবাদীতার মাঝে খারাপ কিছু নেই আসলে এটা তখনই আপত্তিকর বা আনাড়ি হয়ে দাঁড়ায় যখন অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে নির্মিত ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিকে অতিপ্রাকৃত সত্তার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়। আমরা দেখব, ঈশ্বরের ইতিহাসের পরবর্তী পর্যায়ে ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমদের কেউ কেউ পরম সত্তার এই আদি ইমেজের ওপর কাজ করেছে ও এমন এক ধারণার উপনীত হয়েছে যা কিনা হিন্দু বা বৌদ্ধ দর্শনের কাছাকাছি। অন্যরা অবশ্য কখনওই এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করে উঠতে পারেনি, তবে ধরে নিয়েছে যে, ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের ধারণা পরম রহস্যের অনুরূপ। বহুঈশ্বরবাদী ধার্মিকতার বিপদ বিসিই ৬২২ সালে জুদাহ্র বাদশাহ জোসিয়াহর শাসন আমলে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। পূর্বসুরি রাজা মানাসেহ (৬৮৭-৪২) এবং রাজা আমন (৬৪২-৪০)-এর সমন্বয়ের নীতিমালা বদল করার জন্যে ব্যার্থ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। উল্লিখিত দুই রাজা জনগণকে ইয়াহ্ওয়েহ্র পাশাপাশি কানানের অন্য দেবতাদের উপাসনা করতে উৎসাহিত করেছিলেন। মানাসেহ প্রকৃতপক্ষে মন্দিরে আশেরাহ্র এক প্রতিমাও স্থাপন করেন, এখানে উর্বরতার কান্ট দ্রুত বিকশিত হচ্ছিল। অধিকাংশ ইসরায়েলি যেহেতু আশেরাহ্র ভক্ত ছিল এবং কেউ কেউ তাকে ইয়াহ্ওয়েহ্র স্ত্রী হিসাবে কল্পনা করত, তাই কেবল গোঁড়া ইয়াহ্ওয়েহ্বাদীরাই একে ব্লাসফেমাস মনে করতে পারত। কিন্তু ইয়াহ্ওয়েহ্র কাল্টকে উৎসাহিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জোসিয়াহ মন্দিরের ব্যাপক সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেন। শ্রমিকরা যখন প্রত্যেকটা জিনিস ওলট পালট করছিল, প্রধান যাজক হিলকিয়েহ একটা প্রাচীন পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করে বসেন, যেটা কিনা ইসরায়েলের সন্তানদের উদ্দেশে দেওয়া মোজেসের শেষ সারমনের বিবরণ। জোসিয়াহর সচিব শাপানকে ওটা দেন তিনি; রাজার উপস্থিতিতে উচ্চ স্বরে তা পাঠ করেন। এটা শোনার পর তরুণ রাজা আতঙ্কে তার পোশাক ছিঁড়ে ফেলেন: ইয়াহ্ওয়েহ্ তাঁর পূর্বপুরুষদের প্রতি এমন ক্ষুব্ধ হওয়ায় বিস্ময়ের কিছু নেই। তারা মোজেসকে দেওয়া তাঁর কঠিন নির্দেশ পালন করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিলেন।[৩১]
এটা প্রায় নিশ্চিত যে, হিলকিয়াহ্র আবিষ্কৃত ‘বুক অভ দ্য ল’ই বর্তমানে আমাদের কাছে ডিউটেরোনমি নামে পরিচিত গ্রন্থের মূল অংশ ছিল। সংস্কারক দল কর্তৃক এটার সময়োচিত আবিষ্কার নিয়ে নানান মতবাদ রয়েছে। কেউ কেউ এমনও মত প্রকাশ করেছেন যে, পয়গম্বর হুলদার সহায়তায় হিলকিয়াহ ও শাপানই গোপনে এটা লিখেছিলেন। জোসিয়াহ্ অবিলম্বে হুলদাহর সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন। আমরা কখনওই নিশ্চিতভাবে জানতে পারব না, তবে গ্রন্থটি নিশ্চিতভাবে ইসরায়েলে এক নতুন পরিবর্তনের আভাস প্রদান করে যা সপ্তম শতকের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছে। মোজেসকে তাঁর শেষ সারমনে চুক্তির প্রতি নতুন কেন্দ্রিকতা আরোপ করতে ও ইসরায়েলের বিশেষ মনোনয়নের ধারণা দিতে দেখানো হয়েছে। ইয়াহ্ওয়েহ্ সকল জাতির মধ্য থেকে নিজ জাতিকে আলাদা করে নিয়েছেন, সেটা তাদের কোনও গুণের কারণে নয় বরং তাদের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসার কারণে। বিনিময়ে তিনি পুর্ণ আনুগত্য ও অন্য সব দেবতার তীব্র প্রত্যাখ্যান দাবি করেছেন। ডিউটেরোনমির মূলে অন্তর্ভুক্ত ঘোষণাটি পরে ইহুদিদের বিশ্বাস প্রকাশের মন্ত্রে পরিণত হবে:
হে ইস্রায়েল শোন (shema)! ইয়াহ্ওয়েহ্ আমাদের ইলোহিম। একমাত্র ইয়াহ্ওয়েহ্ (ebad) আর তুমি তোমার সমস্ত হৃদয় ও তোমার সমস্ত প্রাণ দিয়া আপন ঈশ্বর ইয়াহ্ওয়েহ্কে প্রেম করিবে আর এই যে সকল কথা ও তোমার সমস্ত শক্তি আমি অদ্য তোমাকে আজ্ঞা করি; তাহা তোমার হৃদয়ে থাকুক।[৩২]
ঈশ্বরের নির্বাচন ইসরায়েলকে গোয়িমদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে। লেখক মোজেসকে দিয়ে বলাচ্ছেন, ওরা প্রতিশ্রুত ভূমিতে পৌঁছানোর পর, স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক থাকবে না। তারা তাহাদের সহিত কোনও নিয়ম করিবে না, বা তাহাদের প্রতি দয়া করিবে না। মিশ্র বিবাহ বা সামাজিক মেলামেশা চলবে না। সর্বোপরি, তাদেরকে কানানিয় ধর্ম উচ্ছেদ করতে হবে। তাহাদের যজ্ঞবেদী সকল উৎপাটন করিবে, তাহাদের স্তম্ভ সকল ভঙ্গিয়া ফেলিবে, তাহাদের আশেরাহ্ মূর্তি সকল ছেদন করিবে এবং তাহাদের খোদিত প্রতিমাসকল অগ্নিতে পোড়াইয়া দিবে। ইসরায়েলিদের নির্দেশ দিয়েছেন মোজেস, ‘কেননা তুমি আপন ঈশ্বর ইয়াহ্ওয়েহ্র পবিত্র প্রজা; ভূতলে যত জাতি আছে সেসকলের মধ্যে আপনার নিজস্ব প্রজা করিবার জন্যে তোমার উপর ঈশ্বর ইয়াহ্ওয়েহ্ তোমাকেই মনোনীত করিয়াছেন।’[৩৯]
আজকের দিনে ইহুদিরা শেমা (Shema) আবৃত্তি করার মাধ্যমে একেশ্বরবাদী ব্যাখ্যা দেয়। আমাদের ঈশ্বর ইয়াহ্ওয়েহ্ এক এবং অদ্বিতীয়। ডিউটেরোনমিস্টরা তখনও এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে পারেননি। ইয়াহ্ওয়েহ্ এবাদ (ebad) মানে ইয়াহ্ওয়েহ্ একক বোঝায়নি, বরং ইয়াহ্ওয়েহ্ই একমাত্র উপাস্য যাকে উপাসনা করার অনুমোদন আছে। অন্য দেবতারা তখনও হুমকি স্বরূপ ছিলেন: ওদের কাল্ট আকর্ষণীয় ছিল ও ঈর্ষাপরায়ণ ঈশ্বর ইয়াহ্ওয়েহ্র কাছে থেকে প্রলুব্ধ করে ইসরায়েলিদের টেনে নিতে পারতেন। তারা ইয়াহ্ওয়েহ্র আইনকানুন মেনে চললে তিনি তাদের আশীর্বাদ করবেন, সমৃদ্ধি দান করবেন, কিন্তু তাকে পরিত্যাগ করলে পরিণাম হবে ধ্বংসাত্মক:
‘এবং তুমি যে দেশ অধিকার করিতে যাইতেছ তথা হইতে তোমরা উনুলিত হইবে। আর ইয়াহ্ওয়েহ্ তোমাকে পৃথিবীর এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সমস্ত জাতির মধ্যে ছিন্নভিন্ন করিবেন; সেই স্থানে তুমি আপনার ও আপন পিতৃপুরুষদের অজ্ঞাত অন্য দেবগণের ধর্ম ও প্রস্তরের সেবা করিবে…আর তোমার জীবন তোমার দৃষ্টিতে সংশয়ে দোলায়মান হইবে…তুমি হৃদয়ে যে শঙ্কা করিবে ও চক্ষুতে যে ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখিবে, ত্যুক্ত প্রাতঃকালে বলিবে, “হায় হায় কখন সন্ধ্যা হইবে?” এবং সন্ধ্যাকালে বলিবে “হায় হায় কখন প্রাতঃকাল হইবে”।[৩৫]
সপ্তম শতাব্দীর শেষ দিকে রাজা জোসিয়াহ এবং তাঁর প্রজারা এই কথাগুলো শোনার সময়ে এক নতুন রাজনৈতিক হুমকির মুখোমুখি হতে যাচ্ছিলেন। আসিরিয়দের ঠেকাতে সক্ষম হওয়ায় উত্তরাঞ্চলীয় দশটি গোত্রের পরিণতি এড়াতে পেরেছিল ওরা। ওই দশ গোত্র মোজেসের বর্ণিত শাস্তি ভোগ করেছিল। কিন্তু বিসিই ৬০৬ সালে বাবিলনের রাজা নেবুপোলাসার আসিরিয়দের ধ্বংস করে নিজস্ব সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজ শুরু করেছিলেন।
এমনি চরম নিরাপত্তাহীন পরিবেশে ডিউটেরোনমিস্টদের নীতিমালা ব্যাপক প্রভাব রাখে। ইয়াহ্ওয়েহ্র নির্দেশ মানা দূরে থাক, ইসরায়েলের শেষ দুজন রাজা সেধে বিপদ ডেকে এনেছেন। অবিলম্বে সংস্কারে হাত দিয়েছিলেন জোসিয়াহ, অদম্য উৎসাহে কাজ শুরু করেন তিনি। সমস্ত ইমেজ, মূর্তি ও উর্বরতার প্রতীক মন্দিরের বাইরে এনে পোড়ানো হয়। জোসিয়াহ্ আশেরাহর বিরাট মূর্তি নামিয়ে সেখানে আশেরাহ্র পোশাক তৈরি করা মন্দির পতিতাদের থাকার ঘরগুলো ধ্বংস করে দেন। পৌত্তলিকতাবাদের আশ্রয় দেশের বিভিন্ন প্রাচীন উপাসনাগৃহও ধ্বংস করা হয়। এরপর থেকে পুরোহিতরা কেবল পবিত্ৰকৃত জেরুজালেম মন্দিরে ইয়াহ্ওয়েহ্র উদ্দেশে প্রাণী উৎসর্গ করতে পারতেন। প্রায় ৩০০ বছর পরে জোসিয়াহ্র সংস্কার কর্ম লিপিবদ্ধকারী ভাষ্যকারগণ এই অস্বীকৃতি ও দমনের ধার্মিকতার এক চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন।
[জোসিয়াহর] সাক্ষাতে লোকেরা বাআল দেবগণের যজ্ঞবেদী ভাঙিয়া ফেলিল এবং তিনি তদুপরি স্থাপিত সূৰ্য্য প্রতিমা ছেদন করিলেন আর আশেরা-মূর্তি ক্ষোদিত প্রতিমা ও ছাঁচে ঢালা প্রতিমা সকল ভাঙিয়া ধূলিস্যাৎ করিয়া যাহারা তাহাদের উদ্দেশে যজ্ঞ করিয়াছিল তাহাদের। কবরের উপর সেই ধূলা ছড়াইয়া দিলেন। আর তাহাদের যজ্ঞবেদীর উপরে যাজকদের অস্থি পোড়াইলেন এবং যিহুদা ও যিরূসালেমকে শুচি করিলেন। আর মনঃশির ইফ্রায়িম ও শিমিয়নের নগরে নগরে এবং নপ্তালি পৰ্য্যন্ত সর্বত্র কাঁথড়ার মধ্যে এইরূপ করিলেন।[৩৬]
অন্যান্য উপাস্যদের উর্ধ্বে ওঠার বুদ্ধের বিশ্বাসের পরেও সেগুলোকে নিঃশব্দে মেনে নেওয়ার ধারেকাছেও নেই আমরা। এই পাইকারী ধ্বংস সুপ্ত উদ্বেগ ও অভিযোগ থেকে উদ্ভূত ঘৃণা থেকে সৃষ্টি হয়েছিল।
সংস্কারকরা ইসরায়েলের ইতিহাস নতুন করে লিখেছিলেন। নতুন মতবাদ অনুযায়ী জোশুয়া, জাজেস, স্যামুয়েল এবং রাজাবলীর ঐতিহাসিক গ্রন্থ পরিমার্জনা করা হয়েছে এবং পরবর্তীকালে পেন্টটিউকের সম্পাদকগণ নতুন নতুন অনুচ্ছেদ যোগ করেছেন যা এক্সোডাস মিথের ডিউটেরোনমিস্ট ব্যাখ্যাকে অধিকতর পুরোনো ‘J’ ও ‘E’-এর বর্ণনার রূপ দিয়েছে। ইয়াহ্ওয়েহ্ এখন কানানের ধ্বংসের পবিত্র যুদ্ধের রূপকার। ইসরায়েলিদের বলা হয়েছে স্থানীয় কানানবাসীরা অবশ্যই তাদের দেশে থাকতে পারবে না,[৩৭] জোশুয়া যেন অশুভ সম্পূর্ণতার সঙ্গে এই নীতির বাস্তবায়নে বাধ্য হয়েছিলেন।
আর সেই সময় জোশুয়া আসিয়া পর্বতময় প্রদেশ হইতে–হিব্রোন, দবির ও আনাব হইতে, যিহুদার সমস্ত পর্বতময় প্রদেশ হইতে আর ইসরায়েলের সমস্ত পৰ্বতময় প্রদেশ হইতে আনাকীয়দিগকে উচ্ছেদ করিলেন; জোশুয়া তাহাদের নগরগুলোর সহিত তাহাদিগকে নিঃশেষে বিনষ্ট করিলেন। ইসরায়েল সন্তানগণের দেশে অনাকীয়দের কেহ অবশিষ্ট থাকিল না; কেবল দেলাতে গাতে ও আসদোদে কতকগুলি অবশিষ্ট থাকিল। [৩৮]
প্রকৃতপক্ষে সন্দেহাতীতভাবেই জোশুয়া ও জাজেস কর্তৃক কানান বিজয় সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না, যদিও নিশ্চিতভাবেই প্রচুর রক্তপাত হয়েছিল । কিন্তু এবার রক্তপাতের ঘটনাকে একটা ধর্মীয় যুক্তির ভিত্তি দেওয়া হলো। নির্বাচনের এই ধরনের ধর্মতত্ত্বের বিপদ এই যে, ধর্মতত্ত্ব একজন ইসায়াহর অতিপ্রাকৃত দৃষ্টিভঙ্গির সমপর্যায়ের নয়। একেশ্বরবাদের গোটা ইতিহাসকে ক্ষতবিক্ষতকারী পবিত্র যুদ্ধগুলোতে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ঈশ্বরকে আমাদের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে একটা প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করে নিজের ঘাটতিসমূহ উপলব্ধি করার বদলে এঁকে আমাদের অহমসৃষ্ট ঘৃণা বাড়িয়ে তোলা বা বৈধ করা ও একে চরম পর্যায়ে তোলার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে করে ঈশ্বরের আচরণ একেবারে আমাদের অনুরূপ হয়ে পড়ে, যেন তিনি আরেকজন মানুষ মাত্র। এমন একজন ঈশ্বর আমোস বা ইসায়াহ্র ঈশ্বরের চেয়ে আরও বেশি জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয়ই হওয়ার কথা, যিনি নির্দয় আত্মসমালোচনা দাবি করেন।
নিজেদের মনোনীত জাতি দাবি করার জন্যে ইহুদিদের প্রায়ই সমালোচনা করা হয়, কিন্তু তাদের সমালোচকগণ প্রায়শঃই বাইবেলিয়কালে বহুঈশ্বরবাদীতার বিরুদ্ধে পরিচালিত যুক্তিতর্ককে উস্কে দেওয়া অস্বীকৃতির সমরূপ অপরাধে দায়ী। তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রত্যেকটি যার যার ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে মনোনয়নের অনুরূপ ধর্মতত্ত্ব গড়ে তুলেছে, কখনও কখনও যা এমনকি বুক অভ জোশুয়ায় কল্পিত ধ্বংসলীলার চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে এনেছে। পাশ্চাত্যের ক্রিশ্চানরা অদ্ভুতভাবে নিজেদের ঈশ্বরের নির্বাচিত ভেবে আত্মপ্রসাদে ভোগে। একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে ক্রিশ্চানরা নিজেদের নব্য নির্বাচিত জাতি দাবি করে ইহুদি ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ক্রুসেডসমূহকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল–ইহুদিদের হারানো মর্যাদার অধিকারী হয়েছে তারা। নির্বাচনের কালভিনিস্ট ধর্মতত্ত্ব আমেরিকানদের ঈশ্বরের আপন জাতি বলে ভাবতে বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। জোশুয়ার জুদাহ্ রাজ্যের মতো এমন একটা বিশ্বাসের তখনই ব্যাপক সাড়া পাওয়ার কথা যখন রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার ফলে জাতি আপন অবলুপ্তির আতঙ্কে তাড়িত। সম্ভবত এ কারণেই বর্তমানে ইহুদি, ক্রিশ্বান ও মুসলিমদের মাঝে প্রকট বিভিন্ন ধরনের মৌলবাদে এ ব্যাপারটা নতুন করে প্রাণ খুঁজে পেয়েছে। ইয়াহ্ওয়েহ্র মতো একজন ব্যক্তি-ঈশ্বরকে এভাবে ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্ন সত্তাকে বাঁচানোর কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে; ব্রাহ্মণের মতো নৈব্যক্তিক উপাস্যের বেলায় যা সম্ভব নয়। আমাদের মনে রাখা দরকার, বিসিই ৫৮৭ সালে নেবুচাদনেযারের জেরুজালেম ধ্বংসের ঘটনা ও বাবিলনের ইহুদিদের বিতাড়নের পেছনে ক্রিয়াশীল ডিউটেরোনিজমে সকল ইসরায়েলি জড়িত ছিল না। নেবুচাদনেযারের অভিষেকের বছর ৬০৪ সালে পয়গম্বর জেরেমিয়াহ্ ইসায়াহ্র প্রতিমা-বিরোধী মতবাদের পুনর্জন্ম দেন যা মনোনীত জাতির বিজয়বাদী মতবাদ উল্টে দিয়েছিল: ঈশ্বর ইসরায়েলকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে বাবিলনকে ব্যবহার করছেন এবার ‘ইসরায়েলের পালা নিষিদ্ধ হবার’। সত্তর বছরের জন্যে নির্বাসনে যেতে হবে তাদের। এই ভবিষ্যদ্বাণী শোনার পর যাজকের হাত থেকে লিপি কেড়ে নিয়ে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে আগুনে নিক্ষেপ করেন রাজা জোহায়াকিম। প্রাণভয়ে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন জেরেমিয়াহ্।
জেরেমিয়ার জীবন দেখায়, ঈশ্বরের এই অধিকতর চ্যালেঞ্জিং ইমেজ গড়ে তোলার পেছনে কী বিশাল কষ্ট ও প্রয়াসের প্রয়োজন হয়েছিল। পয়গম্বর হতে চাননি তিনি, ভালোবাসার জাতিকে নিন্দা করতে গিয়ে গভীরভাবে বেদনার্ত হয়ে পড়েছিলেন।[৪০] জন্মগতভাবে ঝামেলাবাজ ব্যক্তি ছিলেন না তিনি, তার হৃদয় ছিল অত্যন্ত কোমল। যখন তার কাছে আহ্বান আসে, প্রতিবাদে কেঁদে উঠেছিলন তিনি: ‘হায়, হায়, হে প্রভু ইয়াহ্ওয়েহ্, দেখ, আমি কথা কহিতে জানি না, কেননা আমি বালক!’ আর ইয়াহ্ওয়েহ্ তখন ‘হস্ত প্রসারিত করিয়া’ তার ঠোঁট স্পশ করলেন এবং আপন বাণী তাঁর মুখে স্থাপন করলেন। যে বাণী তাঁকে উচচারণ করতে হয়েছিল সেটা ছিল দ্ব্যর্থবোধক ও স্ববিরোধী: ‘দেখ, উৎপাটন, ভঙ্গ, বিনাশ ও নিপাত করিবার নিমিত্ত, পত্তন ও রোপন করিবার নিমিত্ত…তোমাকে নিযুক্ত করিলাম।’[৪১] সমম্বয়ের অতীত চরম অবস্থার মাঝে যন্ত্রণাদায়ক টানাপোড়েন দাবি করেছে এটা। জেরেমিয়াহ্র ঈশ্বরের অনুভূতি ছিল যন্ত্রণাময়, যার ফলে হাত-পায়ে খিচুনি সৃষ্টি হয়েছে, ভেঙে গেছে হৃদয়, মাতালের মতো টলতে হয়েছে তাঁকে।[৪২] mysterium terrible et fascinans-এর অভিজ্ঞতা যুগপৎ ধর্ষণ ও চরিত্র খোয়ানোর মতো:
হে ইয়াহ্ওয়েহ্, তুমি আমাকে প্ররোচনা করিলে। আমি প্ররোচিত হইলাম;
তুমি আমা হইতে বলবান, তুমি প্রবল হইয়াছ।
আমি সমস্ত দিন উপহাসের পাত্র হইয়াছি-সকলেই আমাকে ঠাট্টা করে ।
যদি বলি তাহার বিষয় আর উল্লেখ করিব না, তাহার নামে আর কিছু কহিব না,
তবে আমার হৃদয়ে যেন দাহকারী অগ্নি অস্থিমধ্যে রুদ্ধ হয়;
তাহা সহ্য করিতে করিতে আমি ক্লান্ত হইয়া পড়ি,
আর তিষ্ঠিতে পারি না। [৪৩]
দুটি সম্পূর্ণ ভিন্নদিকে জেরেমিয়াহকে টানছিলেন ঈশ্বর: একদিকে তিনি গভীর আকর্ষণ বোধ করেছেন ইয়াহ্ওয়েহ্র প্রতি যেখানে প্রলোভনের মিষ্টি আত্মসমর্পণের সকল ছোঁয়া রয়েছে, কিন্তু অন্যদিকে আপন ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভেসে যাওয়া এক শক্তির টানে বিধ্বস্ত বোধ করেছেন।
আমোসের আমল হতেই পয়গম্বর একজন নিঃসঙ্গ একাকী মানুষ। এই সময়ে ওইকুমিনের অন্যান্য অঞ্চলের বিরপীতে মধ্যপ্রাচ্য ব্যাপকভাবে ঐক্যবদ্ধ ধর্মীয় আদর্শ গ্রহণ করেনি।[৪৪] পয়গম্বরদের ঈশ্বর ইসরায়েলিদের পৌরাণিক সচেতনতার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে মুলস্রোতের বাইরে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে এগোনোর ওপর জোর দিচ্ছিলেন। জেরেমিয়ার যন্ত্রণার মাঝে আমরা দেখতে পাই কি বিরাট টানাপোড়েন ও স্থানচ্যুতি জড়িত ছিল এতে। ইসরায়েল ছিল। পৌত্তলিক এলাকা ঘেরা ইয়াহ্ওয়েহ্ম্বাদের একটা ছোট অনক্লেভ; ইয়াহ্ওয়েহ্ নিজেও বহু ইসরায়েলি দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। এমনকি ডিউটেরোনমিস্টরা, যাঁদের ঈশ্বর অনেক কম ভীতিকর, ইয়াহ্ওয়েহ্র সঙ্গে সাক্ষাৎকে উৎপীড়ক সংঘাত হিসাবে দেখেছেন। তিনি মোজেসকে ইসরায়েলিদের কাছে ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য করেছেন, যারা ইয়াহ্ওয়েহ্র সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতের সম্ভাবনায় শঙ্কিত ছিল, ঈশ্বর প্রত্যেক প্রজন্মে একজন করে পয়গম্বর পাঠাবেন ঐশী প্রচারের ভার বহন করার জন্যে।
কিন্তু তখনও সর্বব্যাপী স্বর্গীয় শক্তি আত্মার সঙ্গে তুলনীয় কোনও কিছুর আবির্ভাব ঘটেনি ইয়াহ্ওয়েহ্র কাল্টে । বহিস্থঃ দুয়ে সত্তা হিসেবে ইয়াহ্ওয়েহ্কে দেখা হয়েছে। যাকে দূরবর্তী মনে না হওয়ার জন্যে কোনওভাবে মানব-সম করার প্রয়োজন ছিল। রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটছিল: বাবিলনিয়রা জুদাহয় আগ্রাসন চালিয়ে রাজা ও ইসরায়েলিদের প্রথম দলটিকে দেশান্তরে পাঠিয়ে দিয়েছিল; শেষ পর্যন্ত জেরুজালেমও আক্রান্ত হয়। পরিস্থিতির অবনতি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে জেরেমিয়াহ মানবীয় আবেগসমূহ ইয়াহ্ওয়েহ্র প্রতি আরোপ করা অব্যাহত রাখেন: গৃহহীন বলে দুঃখকষ্ট আর নিঃসঙ্গতার জন্যে ঈশ্বরকে বিলাপ করিয়েছেন তিনি, ইয়াহ্ওয়েহ্ তাঁর জাতির মতোই হতবুদ্ধি, অপমানিত ও পরিত্যক্ত বোধ করেছেন; তাদের মতোই যেন চিন্তিত, বিচ্ছিন্ন এবং বিবশ। জেরেমিয়াহ্ তার বুকে ফুঁসে ওঠা যে ক্রোধ অনুভব করেছেন সেটা তাঁর ক্রোধ নয় বরং ইয়াহ্ওয়েহ্র ক্রোধ।[৪৫] পয়গম্বরগণ যখনই মানুষের কথা ভেবেছেন তখনই আপনাআপনি ঈশ্বরের কথাও ভেবেছেন-জগতে যার উপস্থিতি যেন তাঁর জাতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রকৃতপক্ষেই, পৃথিবীতে কার্যকর হতে চাইলে ঈশ্বরকে মানুষের ওপর নির্ভর করতে হয়-এ ধারণাটি ঈশ্বর সম্পর্কে ইহুদি ধারণায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এমনও ইঙ্গিত রয়েছে যে, মানুষ তার আপন আবেগ ও অভিজ্ঞতার মাঝে ঈশ্বরের ভূমিকা উপলব্ধি করতে সক্ষম, অর্থাৎ ইয়াহ্ওয়েহ্ মানবীয় অবস্থারই একটা অংশ।
শত্রু যতক্ষণ সদর দরজায় অবস্থান করেছে, জেরেমিয়াহ্ ততক্ষণ ঈশ্বরের নামে তাঁর জাতিকে বকাবাদ্যি করেছেন (যদিও ঈশ্বর সকাশে তিনি তাদের পক্ষেই কথা বলেছেন)। ৫৮৭ সালে বাবিলনিয়দের হাতে জেরুজালেমের পতন হওয়ার পর, ইয়াহ্ওয়েহ্র কাছ থেকে আগত ভবিষ্যদ্বাণী আরও স্বস্তি দায়ক হয়ে উঠল: তিনি তাঁর জাতিকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এখন যেহেতু তাদের শিক্ষা হয়ে গেছে, ওদের দেশে ফিরিয়ে আনবেন। বাবিলনের কর্তৃপক্ষ জেরেমিয়াকে জুদাহ্য় থেকে যাবার অনুমতি দিয়েছিলেন, ভবিষ্যতের প্রতি আস্থা প্রকাশের পক্ষে তিনি কিছু ভূসম্পত্তি কিনেছিলেন: ‘কেননা ইয়াহ্ওয়েহ্ স্যারেথ এই কথা কহেন: বাটীর, ক্ষেত্রের ও দ্রাক্ষাক্ষেত্রের ক্রয় বিক্রয় এই দেশে আবার চলিবে।’[৪৬] এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, কেউ কেউ বিপর্যয়ের জন্যে ইয়াহ্ওয়েহ্কে দোষারোপ করেছে। মিশর ভ্রমণকালে জেরেমিয়াহ্ ডেল্টা অঞ্চলে পলায়নকারী ইহুদিদের একটা দলের দেখা পান যারা ইয়াহ্ওয়েহ্ বিশ্বাসী ছিল না। ওই দলের মহিলারা দাবি করল যে, যতদিন তারা স্বর্গের রানি ইশতারের সম্মানে প্রচলিত আচার-অনুষ্ঠান পালন করেছে। ততদিন সব কিছু চমৎকার চলছিল; কিন্তু জেরেমিয়াদের মতো লোকদের প্ররোচনায় সেসব বাদ দেওয়ার পরই বিপর্যয়, পরাজয় ও শাস্তি নেমে এসেছে। কিন্তু ট্র্যাজিডি যেন জেরেমিয়ার নিজস্ব অন্তদৃষ্টিকে আরও গভীর করে তুলেছিল।[৪৭] জেরুজালেমের পতন ও মন্দির ধ্বংসের পর তিনি উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলেন যে, ধর্মের এসব বাহ্যিক আবরণ স্রেফ এক অভ্যন্তরীণ মানসিক অবস্থার প্রতীক। ভবিষ্যতে ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তিটি হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন: ‘আমি তাহাদের অন্তরে আমার ব্যবস্থা দিব, ও তাহাদের হৃদয়ে তাহা লিখিব।’[৪৮]
যাদের নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল তাদের ৭২২ সালের উত্তরাঞ্চলীয় দশটি গোত্রের মতো একীভূত হতে বাধ্য করা হয়নি। দুটো গোষ্ঠী হিসাবে বাস। করেছে তারা একটা পোত্র বাবিলনে ও অপরটি নিষ্ঠুর এবং উরের অদূরবর্তী ইউফ্রেতিসের শাখা নদী শেরারের অন্য পারে এক এলাকায় যার নাম তারা। রেখেছিল তেল আবিব (বসন্তকালীন পাহাড়)। ৫৯৭ সালে নির্বাসিত ইহুদিদের প্রথম দলে একজন পুরোহিত ছিলেন, তাঁর নাম ইযেকিয়েল। টানা প্রায় পাঁচ বছর নিজ গৃহে অবস্থান করেন তিনি, এ সময় কারও সঙ্গে কথা বলেননি। এরপর অস্তিত্ব বিদীর্ণকারী ইয়াহ্ওয়েহ্ দর্শনের অভিজ্ঞতা হয় তার যার ফলে আক্ষরিক অর্থেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। তাঁর প্রথম দিব্যদর্শনের ঘটনাটির একটু বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা জরুরি, কারণ বহু শতাব্দী পরে-সপ্তম অধ্যায়ের আমরা যেমন দেখব-ইহুদি অতিন্দ্রীয়বাদীদের কাছে এটা অত্যন্ত গুরুত্ববহ। হয়ে উঠবে। ইযেকিয়েল আলোর ভেতর দিয়ে বস্ত্র নিক্ষিপ্ত আলোর একটি মেঘ দেখেছিলেন। উত্তর দিক থেকে তীব্র হওয়া বইছিল। এই ঝড়ো অস্পষ্টতার মাঝে তিনি যেন দেখতে পেলেন-ইমেজারির সাময়িক প্রকৃতির ওপর জোর দেওয়ার ব্যাপারে যত্নবান ছিলেন তিনি-চারটি শক্তিশালী পশু টেনে নিয়ে যাচ্ছে একটা বিশাল রথ। এগুলো বাবিলনের রাজপ্রাসাদের তোরণে খোদাই করা কারিবু (Karibu)-র মতো প্রায়, কিন্তু ইযেকিয়েল কল্পনার চোখে এগুলোকে দেখা অসম্ভব করে তুলেছেন: প্রত্যেকটার মানুষ, সিংহ, বঁড় ও ঈগলের চেহারা বিশিষ্ট চারটি করে মাথা, প্রত্যেকটি চাকা একটি অন্যটির উল্টোদিকে ঘুরছে। ইমেজারি কেবল দর্শনের যে অচেনা প্রভাব তিনি বর্ণনা করার চেষ্টা করছিলেন, তার গুরুত্বই তুলে ধরেছে। পশুগুলোর ডানা ঝাঁপটানোর শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছিল। পানির স্রোতের মতো শোনাচ্ছিল ওটার শব্দ, শাদ্দাইয়ের কণ্ঠস্বরের মতো, ঝড়ের মতো কণ্ঠস্বর, শিবিরের শব্দের মতো। রথের ওপর সিংহাসনের মতো একটা কিছু ছিল যেখানে পুরুষ মতো কেউ একজন ছিল, পিতলের মতো চকচক করছিল ওটা, বাহু থেকে অগ্নি বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। ওটাকে আবার ইয়াহ্ওয়েহ্র প্রতাপের (কভোদ) মতো মনে হয়েছে।[৪৯] নিমেষে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন ইযেকিয়েল এবং একটা কণ্ঠস্বরকে তার উদ্দেশে কথা বলতে শুনেছেন।
কণ্ঠস্বরটি ইযেকিয়েলকে ‘মানব সন্তান’ বলে সম্বোধন করেন, ঠিক যেন। মানুষ ও স্বর্গীয় জগতের মধ্যে বর্তমান দূরত্বের ওপর জোর দেওয়ার জন্যই। কিন্তু ইযেকিয়েলের ইয়াহ্ওয়েহ্ দর্শন আবার নির্দিষ্ট কাজের বাস্তব পরিকল্পনার জন্ম দেবে। ইসরায়েলের বিদ্রোহী সন্তানদের কাছে ঈশ্বরের বাণী পৌঁছে দিতে হবে ইযেকিয়েলকে। ঐশ্বরিক বার্তার অমানবীয় রূপটি এক ভয়ঙ্কর ইমেজ দিয়ে বোঝানো হয়েছে: বিলাপ ও গোঙানিতে আবৃত একটা পুঁথি ধরা হাত পয়গম্বরের দিকে এগিয়ে আসে। ঈশ্বরের বাণী হজম করে আপন সত্তার অংশে পরিণত করার জন্যে। যথারীতি Mysterium terrible এর মতোই fascinans : পুঁথির স্বাদ মধুর মতো মনে হলো। শেষ পর্যন্ত ইযেকিয়েল বললেন, ‘আর আত্মা আমাকে তুলিয়া লইয়া গেলে আমি মনস্তাপে দুঃখিত হইয়া গমন করিলাম আর ইয়াহ্ওয়েহ্র হস্ত আমার উপর বলবৎ ছিল।’[৫০] তিনি তেল আবিবে পৌঁছে গোটা সপ্তাহ স্তব্ধ থাকিয়া বসিয়া থাকলেন।
ইযেকিয়েলের অদ্ভুত অভিজ্ঞতা দেখায় যে, স্বর্গীয় জগৎ মানব জাতির কাছে কতখানি অচেনা ও দূরবর্তী হয়ে উঠেছিল। তিনি স্বয়ং এই দূরত্বের প্রতাঁকে পরিণত হয়েছিলেন। ইয়াহ্ওয়েহ্ বারবার বিভিন্ন অদ্ভুত কর্মকাণ্ড সম্পাদনের নির্দেশ দিয়েছেন তাঁকে, যেগুলো স্বাভাবিক সত্তা থেকে ইযেকিয়েলকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। ওসব আচরণ এই সংকটকালে ইসরায়েলের দুর্ভোগ তুলে ধরার জন্যেও প্রণয়ন করা হয়েছিল এবং এক গভীরতরে স্তরে দেখিয়েছে যে, খোদ ইসরায়েল পৌত্তলিক জগতে অনাহুত হয়ে উঠছে। এই কারণে স্ত্রীর মৃত্যুর পর ইযেকিয়েলের ওপর শোক প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরেপিত হয়েছে: একপাশে কাত হয়ে ৩৯০ দিন এবং অন্য পাশ ফিরে ৪০ দিন শুয়ে থাকতে হয়েছিল তাকে। একবার অবশ্য কোনও বাসযোগ্য নগর ছাড়া তল্পিতল্পাসই শরণার্থীর মতো তেল আবিবের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেও হয়েছিল তাকে। ইয়াহ্ওয়েহ্ এমন উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় ভরে দিয়েছিলেন তাকে যে কম্পন আর অস্থিরভাবে ঘুরে বেড়ানো থেকে বিরত থাকতে পারেননি তিনি। অন্য এক ঘটনায় পশুর বিষ্ঠা খেতেও বাধ্য করা হয়েছে তাকে, জেরুজালেম অবরোধকালে স্বদেশবাসীর অদৃষ্ট দুর্ভিক্ষের আগাম নিদর্শন ছিল সেটা। ইযেকিয়েল ইয়াহ্ওয়েহ্র কাল্টের প্রকট ধারাবাহিকতাহীনের (radical discontinuti)-এর প্রতাঁকে পরিণত হয়েছিলেন: কোনও কিছুই নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়ার উপায় ছিল না, স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল।
অন্যদিকে পৌত্তলিক দর্শন দেবতা ও সাধারণ জগতের মাঝে অনুভূত ধারাবাহিকতা উপভোগ করে যাচ্ছিল। প্রাচীন ধর্মে সান্ত্বনাদায়ক কিছুই পাননি ইযেকিয়েল, যেটাকে স্বভাবক্রমে তিনি আবর্জনা’ আখ্যায়িত করতেন। এক দিব্যদর্শনের সময় জেরুজালেমের মন্দির দেখানো হয় তাকে। আতঙ্কের সঙ্গে তিনি দেখাতে পান, বিনাশের দোরগোড়ায় পৌঁছেও জুদাহ্র জনগণ ইয়াহ্ওয়েহ্র মন্দিরে স্থাপিত পৌত্তলিক দেবতাদের উপাসনা করছে। খোদ মন্দির এক দুঃস্বপ্নময় জায়গায় পরিণত হয়েছে: এর কক্ষগুলোর দেয়াল কিলবিলে সাপ আর বিশ্রী সব জানোয়ারের ছবিতে ঢাকা; অশ্লীল আলোয় পুরোহিতরা ‘অশ্লীল আচরণে লিপ্ত, ঠিক যেন ব্ল্যাকরুমে যৌন ক্রিয়ায় জড়িয়ে আছে। হে মনুষ্যসন্তান, ইস্রায়েল জলের প্রাচীন-বর্গ অন্ধকারে, প্রত্যেকে আপন আপন ঠাকুর ঘরে কি কি কাৰ্য্য করে তাহা কি তুমি দেখিলে?[৫১] আরেকটা ঘরে দেবতা তামমুযের (Tammuz) দুর্ভোগের জন্যে বসে বসে কাঁদছিল মহিলারা; অন্যরা স্যাঙ্কচুয়্যারির দিকে পেছন ফিরে সূর্যের উপাসনা করছিল। সবশেষে পয়গম্বর তার প্রথম দিব্যদর্শনে দেখা ইয়াহ্ওয়েহ্র প্রতাপ চলে যাওয়া রথ দেখতে পান। কিন্তু তখনও পুরোপুরি দূরবর্তী উপাস্যে পরিণত হননি ইয়াহ্ওয়েহ্। জেরুজালেম ধ্বংসের পূর্ববর্তী শেষ দিনগুলোতে ইযেকিয়েল ইসরায়েল জাতির মনোযোগ আকর্ষণ ও তাঁকে মেনে নিতে বাধ্য করার ব্যর্থ প্রয়াসে ইয়াহ্ওয়েহ্ও চিৎকার করার কথা বলে গেছেন। আসন্ন বিপর্যয়ের জন্যে খোদ ইসরায়েলই দায়ী। ইয়াহ্ওয়েহ্কে বারবার দূরবর্তী মনে হলেও তিনি ইযেকিয়েলের মতো ইসরায়েলিদের বুঝতে উৎসাহ যুগিয়েছেন। যে, ঐতিহাসিক অমোঘ আঘাত দৈবচয়িত ও খেয়ালি নয় বরং এর নিগূঢ় যুক্তি ও সুষ্ঠুতা রয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির নিষ্ঠুর জগতে প্রকট একটা অর্থ খুঁজে পাবার প্রয়াস পাচ্ছিলেন তিনি।
বাবিলনের নদনদীর তীরে বসে নির্বাসিতদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই অনুভব করেছিল যে, প্রতিশ্রুত ভূমির বাইরে তারা ধর্ম পালন করতে পারবে না। পৌত্তলিক দেবতারা সবসময় আঞ্চলিক প্রকৃতির ছিলেন, ফলে কারও কারও কাছে ভিন্ন দেশে ইয়াহ্ওয়েহ্র গান গাওয়া অসম্ভব মনে হয়েছে: বাবিলনের শিশুদের পাথরের ওপর আছড়ে ফেলে মগজ বের করে ফেলার চিন্তা অনেকেই উপভোগ করেছে।[৫২] নতুন একজন পয়গম্বর অবশ্য শান্তির বাণী প্রচার করেছিলেন। তাঁর সম্পর্কে কিছুই জানি না আমরা, এটা হয়তো তাৎপর্যবহ, কেননা তার ভবিষ্যদ্বাণী ও শ্লোকে পূর্বসূরিদের মতো ব্যক্তিগত সংগ্রামের কোনও চিহ্ন দেখা যায় না। পরবর্তীকালে তাঁর রচনা ইসায়াহর ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে এক হয়ে যাওয়ায় সাধারণভাবে তাঁকে দ্বিতীয় ইসায়াহ্ আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। নির্বাসিত অবস্থায় ইহুদিদের কেউ কেউ বাবিলনের দেবতাদের উপাসনায় ফিরে গিয়েছিল, কিন্তু অন্যরা এক নতুন ধর্মীয় সচেতনতার দিকে ধাবিত হয়েছে। ইয়াহ্ওয়েহ্র মন্দির ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছিল, বেথ-এল ও হেবরনের প্রাচীন কাল্টিক উপাসনালয়গুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বাবিলনে তাদের পক্ষে স্বদেশী আচার-অনুষ্ঠান বা শাস্ত্রাচার পালন সম্ভব ছিল না। ওদের একমাত্র সম্বল ছিল ইয়াহ্ওয়েহ্। দ্বিতীয় ইসায়াহ্ একে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে ইয়াহ্ওয়েহ্কেই একমাত্র ঈশ্বর ঘোষণা দেন। তাঁর পুনর্লিখিত ইসরায়েলিদের ইতিহাসে এক্সোডাসের মিথ এমন ইমেজারির আবরণ পায় যা আমাদের আদিম সাগরে তিয়ামাতের বিরুদ্ধে মারদুকের বিজয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়:
আর ইয়াহ্ওয়েহ্ মিশ্ৰীয় সমুদ্রের খাড়ি নিঃশেষে বিনষ্ট করিবেন।
ফরাৎ নদীর উপরে নিজ উত্তপ্ত বায়ু সহকারে হস্ত দোলাইবেন,
তাহাকে প্রচার করিয়া সপ্ত প্রণালী করিবেন,
ও লোকদিগকে পাদুকাঁচরণে পার করিবেন।
আর মিসর দেশ হইতে ইস্রায়েলের বাহির হইয়া আসিবার সময়ে যেমন
তাহার নিমিত্ত পথ হইয়াছিল তেমনি তাহার প্রজাদের
অবশিষ্টাংশের অনূর হইতে অবশিষ্ট লোকদের নিমিত্ত এক রাজপথ
হইবে ।[৫৩]
প্রথম ইসায়াহ্ ইতিহাসকে স্বর্গীয় সতর্কবাণীতে পরিণত করেছিলেন। তাঁর সান্ত্বনা পুস্তকে (Book of Cousolation) বিপর্যয়ের পর দ্বিতীয় ইসায়াহ ইতিহাসকে ভবিষ্যতের নতুন আশা সঞ্চারে ব্যবহার করেছেন। ইয়াহ্ওয়েহ্ অতীতে ইসরায়েলকে একবার উদ্ধার করে থাকলে আবারও তা করতে পারবেন। তিনি স্বয়ং ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর উদগাতা, তার চোখে সকল গোয়িম কোনও পাত্রের এক ফোঁটা পানির চেয়ে বেশি কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে তিনিই একমাত্র ঈশ্বর যার গুরুত্ব আছে। বাবিলনের প্রাচীন উপাস্যদের একটা ঠেলাগাড়িতে তুলে সূর্যাস্তের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে কল্পনা করেছেন দ্বিতীয় ইসায়াহ্।[৫৪] তাদের দিন ফুরিয়ে গেছে: ‘আমি কি ইয়াহ্ওয়েহ্ নই? বারবার জিজ্ঞাসা রেখেছেন তিনি, আমার পাশে আর কোনও দেবতা নেই।[৫৫]
আমি ব্যতীত অন্য ঈশ্বর নাই;
আমি ধৰ্ম্মশীল ও ত্রাণকারী ইয়াহ্ওয়েহ্।
আমি ব্যতীত অন্য নাই।[৫৬]
গোয়িমদের দেবনিচয়কে অস্বীকার যেতে দেরি করেননি দ্বিতীয় ইসায়াহ্, বিপর্যয়ের পর যাদের অবশ্য বিজয়ী রূপে দেখা হয়ে থাকতে পারে। নির্বিকার চিত্তে তিনি ধরে নিয়েছেন, ইয়াহ্ওয়েহ্ই-মারদুক বা বাআল নন–সমস্ত মহান ঘটনাবলী ঘটিয়েছেন যা বিশ্বকে অস্তিত্ব দান করেছেন। সম্ভবত বাবিলনের সৃষ্টি সংক্রান্ত মিথগুলোর সঙ্গে নতুন যোগাযোগ ঘটার কারণেই ইসরায়েলিরা প্রথমবারের মতো সৃষ্টির ক্ষেত্রে ইয়াহ্ওয়েহ্র ভূমিকার ব্যাপারে ব্যাপকভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। তারা অবশ্যই বিশ্বজগতের ভৌত বা বাস্তব উৎপত্তি বা। সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অর্জনের প্রয়াস পায়নি বরং বর্তমান কঠিন বিশ্ব পরিস্থিতিতে সান্ত্বনা পেতে চেয়েছে। ইয়াহ্ওয়েহ্ আদিকালের দানবসদৃশ্য বিশৃঙ্খলাকে দমন করে থাকলে তার পক্ষে নির্বাসিত ইসরায়েলিদের উদ্ধার করা কোনও ব্যাপারই নয়। এক্সোডাস মিথ ও সময়ের সূচনালগ্নে জলীয় বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে বিজয়ের পৌত্তলিক গল্প গাথার মাঝে মিল লক্ষ করে স্বর্গীয় ক্ষমতা বা শক্তির এক নতুন আবির্ভাবের আশায় আস্থার সঙ্গে বুক বাঁধার আহ্বান জানিয়েছেন দ্বিতীয় ইসয়াহ। উদাহরণ স্বরূপ, এখানে তিনি কানানের সৃষ্টি সংক্রান্ত মিথ, দানব লোতনের বিরুদ্ধে বাআলের বিজয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এই সাগর-দানবকে রাহাব: কুমীর (tannin) ও অতলগহ্বর (tebom) বলেও ডাকা হতো:
ওঠো, জাগিয়া ওঠো! শক্তিতে আবৃত করো,
ইয়াহ্ওয়েহ্র হাত,
জাগিয়া ওঠো, অতীত কালের ন্যায়,
সেই বহু প্রজন্ম অতীতের সময়ের ন্যায়।
তুমি কি রাহাবকে খণ্ড-বিখণ্ড করো নাই;
আর ড্রাগনকে (tannin) বিদ্ধ করো নাই?
তুমি কি সাগরকে শুস্ক করো নাই,
বিশাল গহ্বরের (tehom) পানিকে
সাগতলকে পথে রূপান্তরিত করার জন্যে
যাতে উদ্ধারপ্রাপ্তরা অতিক্রম করিতে পারে? [৫৭]
ইসরায়েলের ধর্মীয় কল্পনায় অবশেষে ইয়াহ্ওয়েহ্ তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিদের গ্রাস করে ফেললেন: নির্বাসিত অবস্থায় পৌত্তলিকতাবাদের প্রলোভন আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছিল ও জুদাইজমের ধর্ম জন্ম নিয়েছিল। সে সময় ইয়াহ্ওয়েহ্র কাল্ট সঙ্গত কারণেই বিলুপ্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল ঠিক তখন চরম হতাশাব্যাঞ্জক পরিস্থিতিতে তিনি মানুষের আশাবাদী হয়ে ওঠার উপায়ে পরিণত হয়েছিলেন।
সুতরাং, ইয়াহ্ওয়েহ্ পরিণত হয়েছিলেন এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরে। দার্শনিক দিক দিয়ে তাঁর দাবির যৌক্তিকতা বিচারের কোনও প্রয়াস ছিল না। বরাবরের মতো নতুন মতাদর্শ যৌক্তিকভাবে তুলে ধরা সম্ভব বলে নয় বরং তা হতাশা রোধ ও আশা সঞ্চারে কার্যকর বলেই সফল হয়েছিল। ইহুদিরা স্থানচ্যুত ও বিতাড়িত অবস্থায় থাকায় ইয়াহ্ওয়েহ্র বিচ্ছিন্নতাবাদী কাল্টকে আর দূরবর্তী, অস্বস্তিকর ভাবতে পারেনি। এটা বরং প্রবলভাবে ওদের অবস্থা তুলে ধরেছে।
কিন্তু দ্বিতীয় ইসায়াহ্র ঈশ্বরের ইমেজে আরামপ্রদ কিছুই ছিল না। তিনি মানব মনের ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছেন
কারণ ইয়াহ্ওয়েহ্ কহেন, আমার সংকল্প সকল ও
তোমাদের সংকল্প সকল এক নয়,
এবং তোমাদের পথ সকল ও আমার পথ সকল এক নয়।
কারণ ভূতল হইতে আকাশ মণ্ডল যত উচ্চ,
তোমাদের পথ হইতে আমার পথও
তোমাদের সংকল্প হইতে আমার সংকল্প তত উচ্চ।[৫৮]
ঈশ্বরের রূপ ভাষা ও ধারণার আওতার অতীত। মানুষ যা আশা করে। ইয়াহ্ওয়েহ্ সবসময় সেটা করেনও না। অত্যন্ত দুঃসাহসী এক অনুচ্ছেদে, আজকের দিনে যেটাকে বেশ কটু মনে হয়, পয়গম্বর আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, এমন এক সময় আসবে যখন মিশর ও আসিরিয়াও ইসরায়েলের পাশে ইয়াহ্ওয়েহ্র জাতিতে রূপান্তরিত হবে। ইয়াহ্ওয়েহ্ বলবেন: ‘আমার প্রজা মিসর আমার হস্তকৃত অশূর ও অধিকার ইস্রায়েল আশীর্ব্বাদ যুক্ত হউক।”[৫৯] দুয়ে সত্তার প্রতাঁকে পরিণত হয়েছিলেন তিনি যার ফলে নির্বাচনের সংকীর্ণ ব্যাখ্যা তুচ্ছ ও অপর্যাপ্ত মনে হয়েছে।
বিসিই ৫৩৯ সালে পারসিয়ার রাজা সাইরাস বাবিলনিয় সাম্রাজ্য অধিকার করার পর পয়গম্বরদের বিরুদ্ধে বুঝি বদলা নেওয়া হয়েছে মনে হয়েছে। সাইরাস তার নতুন প্রজারে ওপর পারসিয় দেবতাদের চাপিয়ে দেননি, তবে বিজয়ীর বেশে বাবিলনে প্রবেশ করার পর মারদুকের মন্দিরে উপাসনা করেছেন। বাবিলনিয়দের কাছে পরাস্ত জাতির দেবতাদের প্রতিমাও তাদের আদি গৃহে পুনঃস্থাপন করেন তিনি। বিশ্ব বিশালাকৃতির আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যের অধীনে অভ্যস্থ হয়ে যাওয়ায় দেশান্তরীকরণের পুরোনো পদ্ধতি প্রয়োগ প্রয়োজন মনে করেননি। প্রজারা তাদের নিজস্ব এলাকায় নিজস্ব দেবতাদের উপাসনা করলে শাসন করার বিষয়টি অনেক সহজ হয়ে যায়। গোটা সাম্রাজ্য জুড়ে প্রাচীন মন্দিরসমূহের পুনঃস্থাপন উৎসাহিত করেছেন তিনি, বারবার দাবি করেছেন, তাদের দেবতাই তাঁর ওপর এই দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। তিনি ছিলেন পৌত্তলিক ধর্মের কোনও কোনও রূপের অন্তর্দৃষ্টির সহনশীলতা ও উদারতার উদাহরণ। ৫৩৮ সালে ইহুদিদের জুদাহয় ফিরে তাদের মন্দির পুনর্নির্মাণের অনুমতি দিয়ে এক আদেশ জারি করেন সাইরাস। কিন্তু ওদের অধিকাংশই ফিরে না যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর থেকে কেবল সংখ্যালঘু একটা দল প্রতিশ্রুত ভূমিতে বাস করবে। বাইবেল আমাদের বলছে, ৪২,৩৬০ জন ইহুদি বাবিলন ও তেল আবিব ত্যাগ করে স্বদেশের পথ ধরেছিল, যেখানে তারা তাদের হতবুদ্ধি স্বজাতিদের ওপর নতুন জুদাইজম চাপিয়ে দিয়েছিল।
আমরা নির্বাসনের পর রচিত এবং পেন্টাটিউকের অংশে পরিণত প্রিস্টলি ট্র্যাডিশনের রচনায় এর সঙ্গে কী জড়িত ছিল তা দেখতে পাই। এটা আমাদের ‘J’ এবং ‘E’ বর্ণিত ঘটনাবলীর নিজস্ব ব্যাখ্যা যোগায় এবং নাম্বারস ও লেভিটিকাস শীর্ষক দুটো নতুন পুস্তক যোগ করেছে। আমাদের প্রত্যাশা মতোই ইয়াহ্ওয়েহ্ সম্পর্কে অত্যন্ত উন্নত ও অতিরঞ্জিত ধারণা ছিল ‘P’-র। যেমন, তিনি বিশ্বাস করতেন না যে ‘J’ যেভাবে বলেছেন সেভাবে কারও পক্ষেই সত্যি সত্যি ঈশ্বরকে দেখা সম্ভব। ইযেকিয়েলের বহু ধারণার মতো তাঁর বিশ্বাস ছিল ঈশ্বর সম্পর্কে মানুষের ধারণা এবং প্রকৃত সত্তার মাঝে একটা পার্থক্য রয়েছে। ‘P’-এর সিনাই পর্বতে মোজেসের কাহিনীতে মোজেস ইয়াহ্ওয়েহ্হ্ দর্শন লাভের জন্যে আবেদন জানাচ্ছেন, ইয়াহ্ওয়েহ্ জবাবে বলছেন: ‘তুমি আমার মুখ দেখিতে পাইবে না, কেননা মনুষ্য আমাকে দেখিলে বাঁচিতে পারে না।’[৬০] তার বদলে স্বর্গীয় প্রতাপ থেকে রক্ষা পাবার জন্যে পাহাড় প্রাচীরের একটা ফোকরে আশ্রয় নিতে হবে মোজেসকে যেখান থেকে তিনি ইয়াহ্ওয়েহ্ বিদায় নেওয়ার সময় এক ঝলকের জন্যে অনেকটা পেছন থেকে দেখতে পাবেন। ‘P’-এমন একটা ধারণা যোগান দিয়েছেন যেটা ঈশ্বরের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। নারী-পুরুষ কেবল স্বর্গীয় সত্তার একটা আভা দেখতে পাবে, যাকে তিনি বলছেন ‘ইয়াহ্ওয়েহ্র প্রতাপ (kavod), ‘তাঁর সত্তার একটা প্রকাশ, যাকে স্বয়ং ঈশ্বরের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যাবে না।[৬১] মোজেস যখন পাহাড় থেকে নেমে এলেন, তার চেহারায়ও এই প্রতাপ বিচ্ছুরিত হচ্ছিল, এমন ঔজ্জ্বল্য নিয়ে ঝলমল করছিল যে, ইসরায়েলিরা তার দিকে তাকাতে পারছিল না।[৬২]
ইয়াহ্ওয়েহ্র ‘প্রতাপ’ পৃথিবীতে তাঁর উপস্থিতির একটি প্রতীক, সুতরাং এটা নারী-পুরুষের সৃষ্ট ঈশ্বর সংক্রান্ত ইমেজ ও স্বয়ং ঈশ্বরের পবিত্রতার পার্থক্য বুঝিয়ে দেয়। এভাবে এটা ইসরায়েলি ধর্মের পৌত্তলিক বৈশিষ্ট্যের এক পাল্টা ভারসাম্য ছিল। এক্সোডাসের প্রাচীন কাহিনীগুলো পর্যালোচনা করতে গিয়ে ‘P’ এটা ভাবেননি যে ঘুরে বেড়ানোর দিনগুলোয় স্বয়ং ইয়াহ্ওয়েহ্ ইসরায়েলিদের সঙ্গে ছিলেন সেটা হতো একটা অসম্ভব পার্থিব ব্যাপার। বরং তার বদলে তিনি ইয়াহ্ওয়েহ্ যেখানে মোজেসের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন সেই তাঁবু ইয়াহ্ওয়েহ্র ‘প্রতাপে’ ভরে ওঠা দেখিয়েছেন। একইভাবে মন্দিরে অবস্থানকারীও কেবল ইয়াহ্ওয়েহ্র প্রতাপই হতে পারে।[৬৩]
পেন্টাটিউকে ‘P’-র সবচেয়ে বিখ্যাত অবদান অবশ্যই জেনেসিসের প্রথম অধ্যায়ে সৃষ্টি সংক্রান্ত বিবরণ, যা এনুমা এলিশের অনুসরণ। আদিম গহ্ববের (tehom, tiamat-এর অপভ্রংশ) পানি দিয়ে শুরু করেছেন ‘P’, যেখান থেকে স্বর্গ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন ইয়াহ্ওয়েহ্। তবে দেবতাদের যুদ্ধের কোনও উল্লেখ নেই, উল্লেখ নেই ইয়াম, লোতান বা রাহাবের বিরুদ্ধে লড়াইয়েরও। ইয়াহ্ওয়েহ্ একাই সবকিছুর অস্তিত্ব দান করার দাবিদার। বস্তু ক্রম-উৎসারিত হয়নি, বরং ইয়াহ্ওয়েহ্ স্রেফ অনায়াস ইচ্ছা দিয়েই শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছেন। স্বভাবতই পৃথিবীকে ইয়াহ্ওয়েহ্ উপাদান বিশিষ্ট স্বর্গীয় ভাবতে যাননি ‘P’। প্রকৃতপক্ষে ‘P’-র ধর্মতত্ত্বে ‘পৃথকীকরণ’ (Separation) খুবই গুরুত্বপূর্ণ: রাত্রি হতে দিন, পানি হতে জমিন এবং অন্ধকার হতে আলোকে পৃথক করার ভেতর দিয়ে ঈশ্বর মহাবিশ্বকে এক সুশৃঙ্খল রূপ দিয়েছেন। প্রত্যেক পর্যায়ে ইয়াহ্ওয়েহ্ সৃষ্টিকে আশীর্বাদ ও পবিত্র করেছেন এবং ভালো’ আখ্যা দিয়েছেন। বাবিলনিয়দের কাহিনীর বিপরীতে মানব সৃষ্টি হচ্ছে সৃষ্টির ক্লাইমেক্স, হাস্যকর পশ্চাদচিন্তা নয়। নারী এবং পুরুষ স্বর্গীয় প্রকৃতির অংশীদার না হতে পারে, কিন্তু ঈশ্বরের অনুরূপ আকৃতিতে সৃষ্টি করা হয়েছে তাদের তাদের অবশ্যই তার সৃজনশীল কর্মধারাকে এগিয়ে নিতে হবে। এনুমা এলিশে যেমন রয়েছে, ছয়দিনব্যাপী সৃষ্টি কর্মের পর সপ্তম দিনে সাবাথের মতো বিশ্রামের কথা রয়েছে: বাবিলনিয় বর্ণনায় এই দিনে মহাসভা ‘নিয়তি নির্ধারণ ও মারদুককে স্বর্গীয় উপাধি দান করার জন্যে মিলিত হয়েছিল। ‘P’-র বর্ণনায় প্রথম দিনে বিরাজিত আদিম বিশৃঙ্খলার প্রতীকী বিপরীত অবস্থান পেয়েছে সাবাথ। শিক্ষামূলক সুর ও পুনরাবৃত্তি বোঝায়, ‘P’-র সৃষ্টি-কাহিনী এনুমা এলিশের মতো আচরিক আবৃত্তির উদ্দেশে রচিত হয়েছিল; ইয়াহ্ওয়েহ্র কাজের প্রশংসা এবং ইসরায়েলের স্রষ্টা ও শাসক হিসাবে তাকে অভিষিক্ত করার জন্য।
স্বভাবতই ‘P’-র ইহুদিবাদে নতুন মন্দির ছিল কেন্দ্রীয় বিষয়। নিকট প্রাচ্যে মন্দিরকে প্রায়শঃই মহাবিশ্বের অনুকৃতি হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে। মন্দির নির্মাণ ছিল এমন এক কর্মকাণ্ড যা মানুষকে খোদ দেবতাদের সৃজনশীলতায় যোগ দিতে সক্ষম করে তোলে। নির্বাসনকালে বহু ইসরায়েলি চুক্তির আর্ক-এর পুরোনো কাহিনীসমূহে সান্ত্বনা খুঁজে পেত; আর্ক একটা বহনযোগ্য মন্দির যেখানে ঈশ্বর তার জাতির সঙ্গে তাঁবু খাঁটিয়েছেন’ (Shaken), তাদের গৃহহীন অবস্থার অংশীদার হয়েছেন। স্যাঙ্কচুয়্যারি নির্মাণ, বিরান এলাকায় ভল্ট অভ মিটিং বর্ণনা করার সময় প্রাচীন পুরাণের আশ্রয় নিয়েছেন ‘P’। এর স্থাপত্য নকশা নতুন নয় বরং স্বর্গীয় মডেলেরই অনুকরণ: সিনাই পর্বতে মোজেসকে ইয়াহ্ওয়েহ্ অত্যন্ত দীর্ঘ ও বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়েছিলেন: ‘তাহারা আমার নিমিত্তে এক ধৰ্মধাম নির্মাণ করুক, তাহাতে আমি তাহাদের মধ্যে বাস করিব। আবাসের ও তাহার সকল দ্রব্যের বা আদর্শ আমি তোমাকে দেখাই, তদনুসারে তোমরা সকলই করিবে।[৬৫] স্যাঙ্কচুয়্যারি নির্মাণের দীর্ঘ বিবরণী আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করার কথা বলা হয়নি; এটা কেউ কল্পনা করেনি যে প্রাচীন ইসরায়েলিরা সত্যি সত্যি স্বর্ণ, রৌপ্য, পিত্তল; এবং নীল, বেগুনি ও লাল, এবং শাদা মসিনা সূত্র ও ছাগলোম ও রজীকৃত মেষচৰ্ম্ম ও শিটী কাষ্ঠ ইত্যাদি দিয়ে এমন একটা বিশাল উপাসনাগৃহ নির্মাণ করেছিল।[৬৬] এই দীর্ঘ প্রক্ষেপন আসলে ‘P-র সৃষ্টি-কাহিনীর স্মারক। নির্মাণের প্রত্যেক পর্যায়ে মোজেস সকল কাজ দেখেছেন এবং সৃষ্টির দিনের ইয়াহ্ওয়েহ্র মতো মানুষকে আশীর্বাদ করেছেন। বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিনে স্যাঙ্কচুয়্যারি নির্মিত হয়েছিল; উপাসনালয়ের স্থপতি বেয়ালেল ঈশ্বরের চেতনা (ruachelohim) দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন যা বিশ্বসৃষ্টি নিয়ে গভীর চিন্তাধারা ছিল, এবং উভয় বিবরণীই সাবাথ বিশ্রামের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছে।[৬৭] মন্দির নির্মাণ আদি সাম্যেরও একটা প্রতীক যা মানবজাতি পৃথিবী ধ্বংস করার আগে বিরাজমান ছিল।
ডিউটেরোনমিতে দাসসহ প্রত্যেককে একদিন বিশ্রাম দান ও ইসরায়েলিদের এক্সোডাসের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য সাবাথের পরিকল্পনা করা হয়েছিল।[৬৮] সাবাথকে এক নতুন তাৎপর্য দান করেছেন ‘P’। ঈশ্বরকে অনুসরণ করার ও বিশ্ব সৃষ্টির স্মরণের উপলক্ষ্যে পরিণত হয়েছে এটা। সাবাথ বিশ্রাম গ্রহণের সময় ইহুদিরা এমন এক কর্মকাণ্ডে অংশ নিত যা আদিতে ঈশ্বর একাই পালন করেছিলেন: স্বর্গীয় জীবন যাপনের একটা প্রতীকী প্রয়াস এটা ছিল। প্রাচীন পৌত্তলিকতাবাদে মানবীয় প্রতিটি আচরণ দেবতাদের কর্মকাণ্ডের অনুকরণ ছিল, কিন্তু ইয়াহ্ওয়েহ্র কাল্ট স্বর্গীয় ও মানব জগতের মাঝখানে এক বিশাল দূরত্ব তুলে ধরেছিল। এবার মমাজেসের ভোরাহ্ অনুকরণের মাধ্যমে ইহুদিরা ইয়াহ্ওয়েহ্র আরও কাছাকাছি যাবার প্রেরণা পেল। ডিউটেরোনমিতে বেশ কিছু অবশ্য পালনীয় আইনের উল্লেখ করা হয়েছে, টেন কমান্ডমেন্টস যার অন্তর্ভুক্ত ছিল। নির্বাসন ও এর অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে পেন্টাটিউকে একে বিস্তৃত করে ৬১৩টি নির্দেশ (mitzvot) সম্বলিত জটিল বিধিবিধানে পরিণত করা হয়। সূক্ষ্ম এই নির্দেশনাগুলো বহিরাগত কারও চোখে অপ্রাসঙ্গিক ঠেকে; নিউ টেস্টামেন্টের যুক্তিতর্কে তা খুব নেতিবাচক ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। ক্রিশ্চানরা যেমনটি ভাবতে চায়, ইহুদিরা সেরকম অসহনীয় ভার মনে করেনি এগুলোকে, বরং তারা একে ঈশ্বরের সকাশে বেঁচে থাকার প্রতীকী উপায় হিসাবে দেখেছে। ডিউটেরোনমিতে আহার সংক্রান্ত বিধিবিধান ইসরায়েলের বিশেষ মর্যাদার নিদর্শন ছিল।[৬৯] এগুলোকে ঈশ্বরের পবিত্র ভিন্নতার আচরিক প্রয়াস হিসাবেও দেখেছে তারা, মানুষ ও স্বর্গের মধ্যকার বেদনাদায়ক বিচ্ছিন্নতাকে যা দূর করে দিয়েছে। ইসরায়েলিরা যখন মধুঁকে মাংস হতে, অপরিচ্ছন্ন থেকে পরিচ্ছন্নকে ও গোটা সপ্তাহ থেকে সাবাথকে আলাদা করে তখন তারা ঈশ্বরের সৃজনশীল কর্মকাণ্ড অনুকরণের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ হতে পারে।
‘J’ এবং ‘E’ ও ডিউটেরোনমিস্ট বর্ণনার পাশাপাশি পেন্টাটুয়েকে প্রিস্টলি বিবরণের রচনাবলী স্থান পেয়েছে। যে কোনও প্রধান ধর্ম যে কতগুলো স্বাধীন দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার সমন্বয়ে গঠিত, এটা আমাদের তা মনে করিয়ে দেয়। কোনও কোনও ইহুদি বরাবরই ডিউটেরোনমিয় ঈশ্বরের দিকে ঝুঁকে থাকে, যিনি ইসরায়েলকে প্রচণ্ডভাবে গোয়িমদের থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্যে বেছে নিয়েছিলেন; কেউ কেউ একে মেসিয়ানিক মিথ পর্যন্ত প্রসারিত করেছে যখন সময়ের শেষ পর্যায়ে ‘ইয়াহ্ওয়েহ্র দিবসের প্রত্যাশা করা হয়েছে, যেদিন তিনি ইসরায়েলকে মহিমান্বিত করবেন ও অন্যান্য জাতিকে অপদস্থ করবেন। এসব পৌরাণিক বিবরণী ঈশ্বরকে খুব দূরবর্তী সত্তা হিসাবে দেখতে চেয়েছে। একটা বিষয়ে নীরব সম্মতি রয়েছে যে, নির্বাসনের পর পয়গম্বরদের যুগ শেষ হয়ে গেছে। ঈশ্বরের সঙ্গে আর সরাসরি যোগাযোগ হবে না; ইনোখ ও দনিয়েলের মতো সুদূর অতীতের মহান ব্যক্তিত্বের ওপর আরোপিত প্রতীকী দর্শনের মাধ্যমেই কেবল তা অর্জিত হয়।
দূর অতীতের এই বীরদের একজন, দুঃখ-দুর্দশা সহ্য করার ক্ষেত্রে বাবিলনে ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হিসাবে শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন জব। নির্বাসনের পরে রক্ষাপ্রাপ্তদের একজন এই প্রাচীন কিংবদন্তী উল্লেখ করে ঈশ্বরের প্রকৃতি ও মানুষের দুঃখদুর্দশা লাঘবে তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। প্রাচীন কাহিনীতে ঈশ্বর কর্তৃক পরীক্ষিত হয়েছেন জব, তিনি ধৈর্যের সঙ্গে অপরিসীম দুঃখকষ্ট সহ্য করেছেন বলে ঈশ্বর অতীতের ঐশ্বর্য ফিরিয়ে দিয়ে তাঁকে পুরস্কৃত করেছিলেন। জবের কাহিনীর নতুন ভাষ্যে রচয়িতা প্রাচীন কিংবদন্তীকে দুভাগ করে ঈশ্বরের আচরণের বিরুদ্ধে জবকে ক্ষুব্ধ দেখিয়েছেন। তিনজন সান্ত্বনাদাতাকে নিয়ে স্বর্গীয় বিধি-বিধানের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপনের সাহস দেখিয়েছেন জব, লিপ্ত হয়েছেন প্রবল বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কে। ইহুদিদের ধর্মীয় ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ধর্মীয় কল্পনা আরও গভীর বিমূর্ত প্রকৃতির অনুধাবনের দিকে বাঁক নিয়েছিল। পয়গম্বরগণ দাবি। করেছিলেন যে, পাপের ফল হিসাবেই ইসরায়েলকে দুর্দশাগ্রস্ত করেছেন ঈশ্বর; জবের রচয়িতা দেখাচ্ছেন, ইসরায়েলিদের কেউ কেউ প্রচলিত জবাবে আর সন্তুষ্ট ছিল না। জব এই দৃষ্টিভঙ্গিকে আক্রমণ করেছেন এবং এর বুদ্ধিবৃত্তিক অপূর্ণতা প্রকাশ করে দিচ্ছেন, কিন্তু ঈশ্বর সহসা তার হিংস্র ভাবনায় বাদ সাধছেন। এক দিব্যদর্শনে জবকে দেখা দিয়ে আপন সৃষ্ট জগতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনিঃ জবের মতো এক সামান্য সৃষ্টি দুয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে তর্কে যাবার সাহস করেন কীভাবে? জব হার মানেন, কিন্তু একজন আধুনিক পাঠক, যিনি দুঃখ বেদনার আরও সামঞ্জস্যপূর্ণ ও দার্শনিক সমাধানের সন্ধানে আছেন, এ সমাধানে সন্তুষ্ট হতে পারবেন না। অবশ্য জবের রচয়িতা প্রশ্ন ভোলার অধিকার অস্বীকার করছেন না, কিন্তু বোঝাতে চাইছেন স্রেফ বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এসব চিন্তাতীত বিষয়ের নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। বুদ্ধিবৃত্তিক আঁচ-অনুমানকে অবশ্যই প্রত্যক্ষ প্রত্যাদেশের পথ খুলে দিতে হবে, পয়গম্বররা। যেমন পেয়েছিলেন।
ইহুদিরা তখনও পর্যন্ত দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার শুরু করেনি, তবে চতুর্থ শতাব্দীতে তারা গ্রিক ন্যাশনালিজমের প্রভাবের আওতায় এসেছিল। বিসিই ৩৩২ সালে মেসিদোনিয়ার আলেকজান্দার পারসিয়ার তৃতীয় দারিয়াসকে পরাজিত করেন এবং এশিয়া ও আফ্রিকায় উপনিবেশ গড়ে তুলতে শুরু করে গ্রিকরা। তারা তায়ার, সিদন, গাযা, ফিলাদেলফিয়া (আম্মান ও ত্রিপোলি) এবং এমনকি শেচেম-এ নগররাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। প্যালেস্তাইন ও ডায়াসপোরার ইহুদিরা হেলেনিক সংস্কৃতি দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল, অনেকের কাছে তা ছিল অস্বস্তিকর, অন্যরা গ্রিক থিয়েটার, দর্শন, ক্রীড়া ও কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়েছিল। তারা গ্রিক ভাষা শিখেছে, জিমন্যাসিয়ামে শরীর চর্চা করেছে এবং গ্রিক নাম গ্রহণ করেছে। কেউ কেউ মার্সেনারি হিসাবে গ্রিক সেনাবাহিনীতেও কাজ করেছে। নিজেদের ঐশীগ্রন্থ গ্রিক ভাষায় অনুবাদ করেছে তারা, ফলে সেপচুয়াজিন্ট নামে পরিচিত ভাষ্যটির সৃষ্টি; এভাবে গ্রিকদের কেউ কেউ ইসরায়েলের ঈশ্বর সম্পর্কে জানতে পারে এবং ইয়াহ্ওয়েহ্ (বা ইয়াও, যেভাবে সম্বোধন করত তারা)-কে যিউস ও দায়োনিসাসের পাশাপাশি উপাসনা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কেউ কেউ সিনাগগ বা বিকল্প স্থানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। ডায়াসপোরার ইহুদিরা মন্দিরে উপাসনার বদলে বিকল্প এই স্থান গড়ে তোলে। এখানে তারা তাদের ঐশীগ্রন্থ পাঠ করত, প্রার্থনায় মগ্ন হতো ও সারমন শুনত। প্রাচীন ধর্মীয় বিশ্বের অন্য আর কিছুর সঙ্গে সিনাগগের মিল ছিল না। এখানে কোনও রকম আচার-অনুষ্ঠান পালন বা উৎসর্গের উপস্থিতি ছিল না বলে নিশ্চয়ই এগুলোকে দর্শনের স্কুলের মতো মনে হতো; সুপরিচিত কোনও ইহুদি পুরোহিতের আগমনের সংবাদ পেলে অধিক সংখ্যায় সিনাগগে হাজির হতো তারা, যেমন আপন দার্শনিকদের বক্তব্য শোনার জন্যে লাইন দিয়ে দাঁড়াত। কোনও কোনও গ্রিক এমনকি তোরাহ্র নির্দিষ্ট অংশ অনুসরণ করত ও ইহুদিদের সঙ্গে সমন্বয়বাদী সেক্টে যোগ দিয়েছিল। বিসিই চতুর্থ শতাব্দীতে ইহুদি ও গ্রিকদের ইয়াহ্ওয়েহ্কে জনৈক গ্রিক দেবতার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলার বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটেছে।
অবশ্য অধিকাংশ ইহুদি দূরত্ব বজায় রাখে। মধ্যপ্রাচ্যের হেলেনিস্টিক নগরসমূহে ইহুদি ও গ্রিকদের মাঝে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছিল। প্রাচীন বিশ্বে ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয় ছিল না। নগরীসমূহে দেবতারা দারুণ গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। মনে করা হতো যে তাঁদের কাল্টের প্রতি অবহেলা করা হলে তাঁরা পৃষ্ঠপোষকতা তুলে নেবেন। যেসব ইহুদি এইসব দেবতার অস্তিত্ব অস্বীকার করত তাদের নাস্তিক ও সমাজের শত্রু আখ্যা দেওয়া হয়। বিসিই দ্বিতীয় শতাব্দী নাগাদ এই বৈরিতা আরও গম্ভীর হয়ে ওঠে: প্যালেস্তাইনে যখন সেলুসিদ গভর্নর অ্যান্তিওকাস এপিফেন্স জেরুজালেমকে হেলেনাইজ করে মন্দিরে যিউসের কাল্ট চালু করার প্রয়াস পেয়েছিলেন তখন এমনকি একটা বিদ্রোহেরও সৃষ্টি হয়েছিল। ইহুদিরা নিজস্ব সাহিত্য গড়ে তুলতে শুরু করেছিল যেখানে যুক্তি দেখানো হয় যে, প্রজ্ঞা গ্রিক চাতুর্য নয় বরং ইয়াহ্ওয়েহ্ ভীতি। মধ্যপ্রাচ্যে প্রজ্ঞা-সাহিত্য ছিল এক সুপ্রতিষ্ঠিত ধারা, দার্শনিক বিচার বিবেচনা নিয়ে নয় বরং বেঁচে থাকার সর্বোত্তম উপায় অনুসন্ধানের মাধ্যমে জীবনের অর্থ খুঁজে পাবার প্রয়াস পেয়েছে এটা: প্রায়শঃ অনেক বাস্তবভিত্তিক হতে দেখা গেছে এটাকে। বিসিই তৃতীয় শতাব্দীতে বুক অভ প্রোভার্বস-এর রচয়িতা আরেকটু অগ্রসর হয়ে মত প্রকাশ করেছেন যে, প্রজ্ঞা হচ্ছে বিশ্ব সৃষ্টির সময় ঈশ্বরের মহাপরিকল্পনা অর্থাৎ এটাই ছিল তার প্রথম সৃষ্টি। চতুর্থ অধ্যায়ে আমরা যেমন দেখব, এই বিশ্বাসটি আদি ক্রিস্টানদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। প্রজ্ঞাকে ব্যক্তিক রূপ দিয়েছেন রচয়িতা যেন একে আলাদা সত্তা মনে হয়:
ইয়াহ্ওয়েহ্ নিজ পথের আরম্ভে আমাকে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন,
তাহার কর্ম সকলের পূর্বে, পূৰ্বাবধি।
আমি স্থাপিত হইয়াছি অনাদি কালাবধি,
আদি অবধি, পৃথিবীর উদ্ভবের পূৰ্বাবধি।
তৎকালে আমি তাহার কাছে কাৰ্য্যকরী ছিলাম;
আমি দিন দিন আনন্দময় * ছিলাম,
তাহার সম্মুখে নিত্য আহ্লাদ করিতাম;
আমি তাহার তুমণ্ডলে আহ্লাদ করিতাম,
মনুষ্য সন্তানগণে আমার আনন্দ হইত।[৭০]
[* (বা) ইয়াহ্য়ে আপন পথের আদিস্বরূপ আমাকে গঠন করিয়াছিলেন।
* (বা) তাঁহারা আনন্দজনক।]
অবশ্য প্রজ্ঞা স্বর্গীয় সত্তা ও ঈশ্বর কর্তৃক সৃষ্ট বলে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা প্রিস্টলি রচয়িতাদের বর্ণিত ঈশ্বরের প্রতাপে’র মতো, যা মানব জাতি সৃষ্টি ও মানুষের জীবনে অনুভব করতে পারে ঈশ্বরের সেই পরিকল্পনার কথা বোঝায়: রচয়িতা প্রজ্ঞাকে (হোখমাহ) পথে পথে ঘুরে মানুষকে ইয়াহ্ওয়েহ্কে ভয় করার আহ্বান জানাচ্ছেন বলে দেখিয়েছেন। বিসিই দ্বিতীয় শতাব্দীতে জেরুজালেমের একজন ধর্মভীরু ইহুদি জেসাস বেন সিরা প্রজ্ঞার একই রকম চিত্র এঁকেছিলেন। তিনি দেখিয়েছেন, স্বর্গীয় সভায় দাঁড়িয়ে প্রজ্ঞা নিজ গুণ গাইছেন: তার আগমন ঘটেছে স্বর্গীয় বাণী হিসাবে পরম প্রভুর (Most High) মুখ হতে যা দিয়ে ঈশ্বর বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন; সৃষ্টির সর্বত্র তার উপস্থিতি রয়েছে কিন্তু ইসরায়েলের জনগণের মাঝে আপন আবাস বেছে নিয়েছেন তিনি।[৭১]
ইয়াহ্ওয়েহ্র প্রতাপে’র মতো প্রজ্ঞার চরিত্রটি পৃথিবীতে ঈশ্বরের কর্মকাণ্ডের একটা প্রতীক। ইহুদিরা ইয়াহ্ওয়েহ্র এমন এক উঁচু ধারণার বিকাশ ঘটাচ্ছিল যে মানব জীবনে তার সরাসরি হস্তক্ষেপের কল্পনা করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। ‘P’-এর মতো তারা ঈশ্বরকে আমাদের জ্ঞান ও স্বর্গীয় সত্তার অভিজ্ঞতার মাঝে পার্থক্য টানার পক্ষপাতি ছিল। আমরা যখন মানুষের খোঁজে ঈশ্বরকে ছেড়ে প্রজ্ঞার গোটা বিশ্ব ঘুরে বেড়ানোর কথা পড়ি তখন খুব সহজেই ইশতার, আনা ও আইসিসের মতো পৌত্তলিক দেবীদের কথা মনে পড়ে যায় যাঁরা নিষ্কৃতির দায়িত্ব নিয়ে স্বর্গীয় জগৎ হতে অবতরণ করেছিলেন। বিসিই ৫০ সালের দিকে প্রজ্ঞা-সাহিত্য আলেকজান্দ্রিয়ায় ধর্মীয় যুক্তির রূপ লাভ করেছিল। আলেকজান্দ্রিয়ার এক ইহুদি দ্য উইজডম অভ সলোমন-এ ইহুদিদের চারপাশের আগ্রাসী হেলেনিক সংস্কৃতিকে প্রতিহত করে আপন ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এখানে ইহুদিদের গুরুত্বপূর্ণ বসতি ছিল-গ্রিক দর্শন নয় বরং ইয়াহ্ওয়েহ্ ভীতিই প্রকৃত প্রজ্ঞা গড়ে তুলেছে। গ্রিক ভাষায় লিখেছেন তিনি; প্রজ্ঞাকে (সোফিয়া) ব্যক্তিরূপ দিয়েছেন ও যুক্তি উত্থাপন করেছেন যে একে ইহুদি ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়:
[সোফিয়া] ঈশ্বরের ক্ষমতার প্রশ্বাস,
সর্বশক্তিমানের প্রতাপের নিখাদ উৎসারণ;
সুতরাং অপবিত্র কোনও কিছুই তাহার মাঝে প্রবেশাধিকার পাইবে না।
তিনি অনন্ত আলোকের প্রতিফলন,
ঈশ্বরের সক্রিয় ক্ষমতার ঝলমলে শশী,
তাহার মহত্বের ভাবমূর্তি। [৭২]
এই অনুচ্ছেদটি জেসাসের মর্যাদা সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে ক্রিশ্চানদের কাছেও দারুণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ইহুদি রচয়িতা অবশ্য সোফিয়াকে কেবল দুয়ে ঈশ্বরের এক বৈশিষ্ট্য হিসাবে দেখেছেন, যিনি নিজেকে মানবীয় উপলব্ধির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন। তিনি হচ্ছেন ঈশ্বর-যেভাবে-আপনাকে মানুষের-কাছে-প্রকাশ করেছেন, ঈশ্বর সম্পর্কিত মানবীয় উপলব্ধি, ঈশ্বরের প্রকৃত সত্তার চেয়ে রহস্যজনকভাবে আলাদা; যিনি সব সময় আমাদের উপলব্ধিকে এড়িয়ে যাবেন।
দ্য উইজডম অভ সলোমন-এর রচয়িতা গ্রিক চিন্তা-ভাবনা ও ইহুদি ধর্মের মধ্যকার টানাপোড়েন ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। আমরা দেখেছি, অ্যারিস্টটলের সৃষ্ট জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নির্বিকার ঈশ্বর ও বাইবেলের মানবীয় ব্যাপারে তীব্রভাবে জড়িত ঈশ্বরের মাঝে এক জটিল এবং সম্ভবত সমন্বয়ের অতীত পার্থক্য রয়েছে। গ্রিক ঈশ্বরকে মানুষের যুক্তির মাধ্যমে আবিষ্কার করা সম্ভব ছিল, কিন্তু বাইবেলের ঈশ্বর কেবল প্রত্যাদেশের মাধ্যমেই নিজেকে প্রকাশ করেন। এক অতল গহ্বর ইয়াহ্ওয়েহ্কে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল, কিন্তু গ্রিকরা বিশ্বাস করত যে, যুক্তির ক্ষমতা মানুষকে ঈশ্বরের নিকটবর্তী করে; সুতরাং আপন প্রচেষ্টা দিয়েই তারা তার কাছে পৌঁছুতে পারবে। তা সত্ত্বেও যখনই একেশ্বরবাদীরা গ্রিক দর্শনের প্রেমে পড়েছে অনিবার্যভবে তারা তাদের ঈশ্বরকে নিজেদের ঈশ্বরের সঙ্গে মেলানোর প্রয়াস পেয়েছে। এটা আমাদের কাহিনীর একটা প্রধান থিম হয়ে দাঁড়াবে। প্রথম যাঁরা এই প্রয়াস পেয়েছিলেন তাঁদের প্রথম জন হচ্ছেন প্রখ্যাত ইহুদি দার্শনিক ফিলো অভ আলেকজান্দ্রিয়া (৩০ বিসিই-৪৫ সিই)। ফিলো ছিলেন প্লেটোনিস্ট; আপন মেধা ও জ্ঞানে যুক্তিবাদী দার্শনিক হিসাবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। চমৎকার গ্রিক ভাষায় লিখতেন তিনি। সম্ভবত হিব্রু ভাষায় কথা বলতেন না, তবু ধর্মপ্রাণ ইহুদি ও মিতভোতের অনুসারী ছিলেন। নিজ ঈশ্বর ও গ্রিক ঈশ্বরের মাঝে বেমানান কিছু দেখেননি তিনি। তবে অবশ্যই একথা বলা প্রয়োজন যে, ফিলোর ঈশ্বরকে ইয়াহ্ওয়েহ্ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মনে হয়। যেমন, ফিলো যেন বাইবেলের ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোর ব্যাপারে বিব্রত ছিলেন, এগুলোকে তিনি বিস্তারিত রূপক বর্ণনায় পরিণত করার প্রয়াস। পেয়েছিলেন। স্মরণযোগ্য, অ্যারিস্টটল ইতিহাসকে অদার্শনিকসুলভ বিবেচনা করেছিলেন। তাঁর ঈশ্বরের কোনও মানবীয় গুণ নেই: যেমন, তিনি ক্রুদ্ধ’ হয়েছেন বলাটা খুবই ভুল হবে। আমরা ঈশ্বর সম্পর্কে যেটুকু জানতে পারি সেটা হলো তার অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা মাত্র। তবু ধার্মিক ইহুদি হিসাবে ফিলো বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর পয়গম্বরদের সামনে নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন। কীভাবে এটা সম্ভব হয়েছিল?
সম্পূর্ণ উপলব্ধির অতীত ঈশ্বরের মূল সত্তা (আউসিয়া) এবং পৃথিবীতে তার কর্মকাণ্ডকে ফিলো তার ক্ষমতা (dynameis) বা শক্তি’ (energeia) বলেছেন, এ দুটোর মাঝে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য টেনে এ সমস্যার সমাধান করেছিলেন তিনি। মূলত এটা ‘P’ এবং প্রজ্ঞা-রচয়িতাদের সমাধানের অনুরূপ। ছিল। ঈশ্বর স্বয়ং কেমন কোনওদিনই আমরা তা জানতে পারব না। ফিলো তাঁকে দিয়ে মোজেসকে বুলিয়েছেন: আমাকে বুঝতে পারাটা মানুষের প্রকৃতি, এমনকি গোটা আকাশ এবং মহাবিশ্বের সাধের অতীত। আমাদের সীমিত উপলব্ধিতে নিজেকে অভিযোজিত করার জন্যে ঈশ্বর তার ক্ষমতার মাধ্যমে যোগাযোগ করেন যার সঙ্গে প্লেটোর স্বর্গীয় আকারের মিল আছে বলে মনে হয় (যদিও ফিলো সব সময় এ ব্যাপারে স্থির নন)। এগুলো মানুষের বোধগম্য উচস্তরের বাস্তবতা। এগুলো ঈশ্বরের কাছ থেকে উৎসারিত বলে মনে করেছেন ফিলো, যেমন প্লেটো ও অ্যারিস্টটল আদি কারণ হতে মহাবিশ্বকে উৎসারিত হতে দেখেছিলেন। এসব ক্ষমতার দুটি বিশেষভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফিলো এদের নাম দিয়েছেন রাজকীয় ক্ষমতা (Kingly Power), যা মহাবিশ্বের শৃঙ্খলার মাঝে ঈশ্বরের প্রকাশ ঘটায়; এবং সৃজনী ক্ষমতা, যার মাধ্যমে ঈশ্বর মানুষের ওপর বর্ষিত আশীর্বাদের মাঝে নিজেকে প্রকাশ করেন। এসব ক্ষমতার কোনওটাকে স্বর্গীয় সত্তার আউসিয়ার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা চলবে না-যেটা দুর্ভেদ্য রহস্যের আড়ালে ঢাকা থাকে। এগুলো কেবল আমাদের বোধের অতীত এক সত্তার কিঞ্চিৎ আভাস পেতে সাহায্য করে। মাঝে মাঝে ফিলো ঈশ্বরের অপরিহার্য সত্তাকে (আউসিয়া) রাজকীয় ও সৃজনী ক্ষমতায় পরিবেষ্টিত থাকার কথা বলেছেন, অনেকটা ট্রিনিটর মতো। উদাহরণ স্বরূপ, তিনি মামরিতে দুজন দেবদূতসহ ইয়াহ্ওয়েহ্র অ্যাব্রাহামের কাছে হাজির হওয়ার কাহিনীর ব্যাখ্যা করার সময় যুক্তি দেখান: ঈশ্বরের আউসিয়ার রূপক উপস্থাপন দুই উচ্চতম ক্ষমতাসহ তিনি স্বয়ং।[৭৪]
‘J’ হয়তো এ ধারণায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়তেন। প্রকৃতপক্ষেই, ইহুদিরা ঈশ্বর সম্পর্কে ফিলোর ধারণাকে অনেকটা অসত্য হিসাবে দেখেছে। ক্রিশ্চানরা। অবশ্য তাকে দারুণ রকম উপকারী হিসাবে দেখবে এবং আমরা দেখব, গ্রিকরা ঈশ্বরের দুয়ে ‘সত্তা’ (essence) এবং যে শক্তি’ (energies) তাঁকে আমাদের কাছে প্রকাশ করে, এ দুটোর পার্থক্য লুফে নিয়েছিল। তারা তাঁর স্বর্গীয় লোগোসের তত্ত্বেও প্রভাবিত হবে। প্রজ্ঞা-রচয়িতদের মতো ফিলো কল্পনা করেছেন যে ঈশ্বর সৃষ্টির একটা মহাপরিকল্পনা (লোগোস) প্রণয়ন করেছিলেন; যার সঙ্গে প্লেটোর আকৃতির জগতের মিল রয়েছে। এইসব আকৃতি এরপর ভৌত বিশ্বে স্থাপন করা হয়। ফিলো কিন্তু সবসময় অটল ছিলেন না। কখনও তিনি বলেছেন, লোপোস অন্যতম একটা শক্তি, অন্য সময় মনে হয়েছে তিনি একে শক্তির চেয়েও বড় কিছু মানুষের পক্ষে অর্জনযোগ্য ঈশ্বর সম্পর্কিত সর্বোচ্চ ধারণা মনে করছেন। অবশ্য, আমরা যখন লোগোসের কথা ভাবি তখন ঈশ্বর সম্পর্কে কোনও ইতিবাচক জ্ঞান পাই নাঃ আমাদেরকে বাস্তব যুক্তির নাগালের বাইরে এক অনুভবভিত্তিক উপলব্ধির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় যা ‘চিন্তার উপায়ের চেয়ে উন্নত কিছু চিন্তা করা যেতে পারে এমন যেকোনো কিছুর চেয়ে মূল্যবান।’[৭৫] এটা প্লেটোর ধ্যান (থিয়োরিয়া-র মতো কিছু, একই ধরনের একটা ব্যাপার। ফিলো জোর দিয়ে বলেছেন, আমরা কখনওই ঈশ্বরের প্রকৃত সত্তার কাছাকাছি যেতে পারব নাঃ ঈশ্বর মানব মনকে যে পরমানন্দ স্বীকৃতিতে ছাপিয়ে যান তার মাঝেই সর্বোচ্চ সত্য অনুধাবন করতে পারি আমরা।
যেমন শোনাচ্ছে, ততটা নিরস নয় ব্যাপারটা: অজানার উদ্দেশে এক আবেগময় আনন্দ যাত্রার বিবরণ দিয়েছেন ফিলো, যা তাঁকে মুক্তি ও সৃজনশীল ক্ষমতা এনে দিয়েছে। প্লেটোর মতো আত্মাকে তিনি ভৌত জগতে নির্বাসিত অবস্থায় থাকার মতো দেখেছেন। একে অবশ্যই আবেগ, অনুভূতি এমনকি ভাষা ত্যাগ করে, এর প্রকৃত আবাস ঈশ্বরের দিকে এগোতে হবে, কারণ এসব আমাদের অপূর্ণ পৃথিবীর সঙ্গে বেঁধে রাখে। শেষ পর্যন্ত এটা এমন এক আনন্দের পর্যায়ে উন্নীত হবে যা একে অহমের আতঙ্কময় সীমাবদ্ধতা থেকে এক বৃহত্তর পূর্ণ সত্তায় তুলে নেবে। আমরা দেখেছি, ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণা প্রায়শঃই কল্পনা-নির্ভর অনুশীলন ছিল। পয়গম্বরগণ নিজ নিজ অভিজ্ঞতা নিয়ে ভেবেছেন, মনে করেছেন একে ঈশ্বর নামে আখ্যায়িত সত্তার প্রতি আরোপ করা যেতে পারে। ফিলো দেখাচ্ছেন: ধর্মীয় ভাবনা অনেকাংশে সৃজনশীলতার অন্যান্য রূপের মতোই। কখনও কখনও, বলেছেন তিনি, নিজের গ্রন্থসমূহ নিয়ে বিষণ্ণ মনে সংগ্রাম করে কোনও পথ খুঁজে পাননি, আবার কখনও মনে হয়েছে তার ওপর স্বর্গীয় প্রভাব ক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছে:
আমি…সহসা পরিপূর্ণ হয়ে উঠলাম, ধারণাগুলো তুষারপাতের মতো নেমে আসছে, যার ফলে স্বর্গীয় প্রভাবে আমি করিব্যান্টিক (Corybrantic) উন্মাদনায় ভরে উঠলাম এবং স্থান-কাল-পাত্র, বর্তমান, নিজেকে কী বলা হয়েছে, কী লেখা হয়েছে, সবকিছু সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ হয়ে গেলাম। কেননা আমি অভিব্যক্তি, ধারণা, জীবনের এক আনন্দ, বস্তুর স্পষ্ট স্বচ্ছতা অতিক্রম করে যাওয়া তীক্ষ্ণ দর্শন, যা সবচেয়ে স্পষ্ট উপস্থাপনের ফলে চোখের সামনে উপস্থিত হতে পারে, তা অর্জন করলাম।[৭৬]
অচিরেই গ্রিক জগতের সঙ্গে এমন একটা সমন্বয় অর্জন দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। ফিলোর মৃত্যুর বছর আলেকজান্দ্রিয়ার ইহুদি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হত্যালীলা পরিচালিত হয় এবং ইহুদিদের বিদ্রোহের ব্যাপক আশঙ্কার সৃষ্টি হয়। বিসিই প্রথম শতকে রোমানরা যখন উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল তখন তারা নিজেরাই গ্রিক সংস্কৃতির কাছে পরাস্ত হয়ে পুর্বসূরিদের উপাস্যদের গ্রিক দেবনিচয়ের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে এবং অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে গ্রিক দর্শনকে আপন করে নেয়। তারা অবশ্য ইহুদিদের প্রতি গ্রিকদের বৈরিতার উত্তরাধিকার লাভ করেনি। প্রকৃতপক্ষে, গ্রিকদের চেয়ে ইহুদিদেরই বেশি পছন্দ করত তারা, গ্রিক নগরসমূহে ওদের প্রয়োজনীয় মিত্র হিসাবে বিবেচনা করত যেখানে রোমের প্রতি বৈরিতার ক্ষীণ অস্তিত্ব ছিল । ইহুদিদের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল: ওদের ধর্ষ সুপ্রাচীন ঐতিহ্য হিসাবে পরিচিত ছিল, একে সম্মান জানানো হয়েছে। ইহুদি ও রোমানদের ভেতর সম্পর্ক এমনকি প্যালেস্তাইনেও চমৎকার ছিল, যেখানে বিদেশী শাসন সহজে মেনে নেওয়া হতো না। বিসিই প্রথম শতাব্দী নাগাদ রোমান সাম্রাজ্যে ইহুদিবাদ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। গোটা সাম্রাজ্যের এক দশমাংশ ছিল ইহুদি: ফিলোর আলেকজান্দ্রিয়ায় জনসংখ্যার চল্লিশ শতাংশ ছিল ইহুদি। রোমান সাম্রাজ্যের জনগণ এক নতুন ধর্মীয় সমাধানের অনুসন্ধানে ছিল: একেশ্বরবাদী ধ্যান-ধারণাসমূহ প্রচারণা পাচ্ছিল, স্থানীয় দেবতাদের আরও বৃহৎ, সর্বব্যাপী এক ঐশ্বরিক সত্তার প্রকাশ হিসাবে দেখা হচ্ছিল। রোমানরা ইহুদিবাদের উন্নত নৈতিক চরিত্রে আকৃষ্ট হয়েছে। বোধগম্য কারণে যারা হত্যা করা ও গোটা তোরাহ্ অনুসরণ করার বেলায় অনিচ্ছুক ছিল তারা প্রায়শঃই ‘গডফিয়ারার’ (Godfearer) নামে পরিচিত সিনাগগের সম্মান সূচক সদস্যপদ গ্রহণ করত, ওদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান ছিল। এমনকি এমনও মত প্রকাশ করা হয়েছে যে ফ্ল্যাভিয় সম্রাটদের একজন সম্ভবত ইহুদিবাদে দীক্ষিত হয়েছিলেন, যেমন কতস্তাইন পরে ক্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করবেন। অবশ্য, প্যালেস্তাইনে রাজনৈতিক উগ্রপন্থীদের একটা দল তীব্রভাবে রোমান শাসনের বিরোধিতা করে। সিই ৬৬ সালে তারা রোমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং অবিশ্বাস্যভাবে রোমান সেনাবাহিনীকে চার বছর ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। বিদ্রোহ ডায়াসপোরার ইহুদিদের মাঝে ছড়িয়ে যাবার আশঙ্কা করে কর্তৃপক্ষ, ফলে নিষ্ঠুরভাবে তা দমন করে। সিই ৭০ সালে নতুন সম্রাট ভেসপাসিয়ান-এর সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত জেরুজালেম অধিকার করে, মন্দির পুড়িয়ে ধূলিসাৎ করে নগরীটিকে রোমান নগরে রূপান্তরিত করে এর নাম রাখে আইলিয়া কাপিলানা। আরও একবার দেশান্তরী হতে বাধ্য হয় ইহুদিরা।
নয়া ইহুদিবাদের মূল প্রেরণা মন্দির ধ্বংস বিরাট দুঃখের কারণ ছিল; কিন্তু পরবর্তী ঘটনার প্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে মনে হয় ডায়াসপোরার হেলেনাইজড ইহুদিদের তুলনায় প্রায়শঃ অনেক বেশি রক্ষণশীল প্যালেস্তাইনের ইহুদিরা, সম্ভবত আগে থেকেই এই বিপর্যয়ের জন্যে তৈরি ছিল। পবিত্র ভূমিতে অসংখ্য গোত্র মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল যারা বিভিন্নভাবে জেরুজালেম মন্দির থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিল । এসিন ও কুমরান গোষ্ঠীর বিশ্বাস ছিল যে মন্দির অর্থলিলু ও দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়েছে; আলাদা কমিউনিটিতে বাস শুরু করেছিল তারা, মৃত সাগর তীরবর্তী মঠ ধরনের কমিউনিটির মতো একটা নতুন মন্দির গড়ে তুলছে বলে বিশ্বাস ছিল তাদের, যা হাতে নির্মিত নয়। ওদের মন্দির হবে আত্মার; প্রাচীন রীতি অনুযায়ী পশু উৎসর্গ করার বদলে নিজেদের পরিশুদ্ধ করত তারা এবং দীক্ষাগ্রহণমূলক অনুষ্ঠান ও দলীয় ভোজের মাধ্যমে পাপের ক্ষমা প্রার্থনা করত। পাথরের মন্দিরে নয়, ঈশ্বরের আবাস হবে প্রেমময় ভ্রাতৃসংঘে।
প্যালেস্তাইনের সকল ইহুদির মাঝে ফারিজিরা ছিল সবচেয়ে প্রগতিশীল। এরা এসিনদের সমাধানকে বাড়াবাড়িরকম অভিজাত শ্রেণীর মনে করেছিল। নিউ টেস্টামেন্টে ফারিজিদের কপটাচারী ও চরম ভণ্ড হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এর জন্যে দায়ী প্রথম শতকের ধর্মীয় যুক্তিতর্কের বিকৃতি। ফারিজিরা অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ইহুদি ছিল। তারা বিশ্বাস করত গোটা ইসরায়েল পুরোহিতদের এক পবিত্র জাতি হিসাবে অ্যাখ্যায়িত। মন্দিরের মতো তুচ্ছ ঘরেও ঈশ্বর অবস্থান করতে পারেন। এরই প্রেক্ষিতে তারা রাজকীয় বা স্বীকৃত পুরোহিত গোত্রের মতো জীবন যাপন করত এবং নিজস্ব বাড়িতে পবিত্রতা অর্জনের সেইসব বিধিবিধান পালন করত সেগুলো কেবল মন্দিরের জন্যে প্রযোজ্য ছিল। আচরিক অবস্থায় খাদ্যগ্রহণের ওপর জোর দিত তারা, কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল যে প্রত্যেক ইহুদির খাবার টেবিল আসলে মন্দিরে ঈশ্বরের বেদীর মতো। দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়ে ঈশ্বরের উপস্থিতির একটা অনুভূতি গড়ে তুলেছিল ওরা। পুরোহিত শ্রেণী ও জাঁকাল আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই ইহুদিরা। এখন ঈশ্বরের কাছে সরাসরি প্রার্থনা জানাতে পারে। প্রতিবেশীদের প্রতি সদয় আচরণ দিয়ে পাপের প্রায়শ্চিত করতে পারে; তোরাহ অনুযায়ী দান হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিতভাহ (mitzvah): দুজন বা তিনজন ইহুদি সম্মিলিতভাবে যখন তোরাহ্ পাঠ করে, ঈশ্বর তখন তাদের মাঝে উপস্থিত থাকেন। শতাব্দীর গোড়ার দিকের বছরগুলোয় দুটো আলাদা মতবাদ জন্ম নিয়েছিল। একটির নেতৃত্বে ছিলেন শাম্মাই দ্য এল্ডার, এটা ছিল বেশি উগ্র। অন্যটির নেতৃত্বে ছিলেন মহান ব্যাবাই হিল্লেল দ্য এল্ডার। ফারিজিদের ইতিহাসে এই মতবাদই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে। একটা গল্প চালু আছে যে, একদিন জনৈক পৌত্তলিক এসে হিল্লেলকে জানায় তিনি এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় প্রভু গোটা তোরাহ্ আবৃত্তি করতে পারলে সে ইহুদিবাদে দীক্ষা নেবে। হিল্লেল জবাব দিয়েছেন: “নিজে যেটা করতে পারবে না সেটা অন্যকে করতে বলো না। এটা গোটা তোরাহ; যাও এবং শিখে নাও।”[৭৭]
দুর্যোগের বছর ৭০ সাল নাগাদ প্যালেস্তাইনি ইহুদিবাদে ফারিজিরা সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও গুরুত্বপূর্ণ গোত্রে পরিণত হয়; ইতিমধ্যেই ওরা দেখিয়ে দিয়েছিল যে, ঈশ্বরের উপাসনা করার জন্যে মন্দিরের প্রয়োজন নেই ওদের, এই বিখ্যাত গল্পটি যেমন দেখায়:
একবার ব্যাবাই ইয়োহান্নান বেন যাক্কাই জেরুজালেম থেকে আসছিলেন, র্যাবাই জোশুয়া তাকে অনুসরণ করেন এবং মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পান।
“আমাদের দুর্দশা!’ বললেন ব্যাবাই জোশুয়া, এই যে, যেখানে ইসরায়েলিদের অসাম্যতার প্রায়শ্চিত হতো, সেটি ধ্বংস হয়ে গেছে।’
‘বস আমার,’ বললেন ব্যাবাই ইয়োহান্নান, ‘দুঃখ করো না। এটার মতোই কার্যকর প্রায়শ্চিত্তের স্থান আমাদের কাছে। এবং সেটা কী? এটা হচ্ছে প্রেমময় দয়ার প্রকাশ, যেমন কথায় আছে: “কারণ আমি ক্ষমা চাই, উৎসর্গ নয়”।[৭৮]
কথিত আছে, জেরুজালেম অধিকারের পর র্যাবাই ইয়োহান্নানকে একটা কফিনে করে জ্বলন্ত নগরী থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ইহুদি বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিলেন তিনি, রাষ্ট্র ছাড়াই ইহুদিরা ভালো থাকবে বলে ধারণা ছিল তাঁর। রোমানরা ইয়োহান্নানকে জেরুজালেমের পশ্চিমে জবনেহতে স্ব-শাসিত একটা ফারিজিয় সমাজ প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছিল। প্যালেস্তাইন ও বাবিলোনিয়ায়ও একই ধরনের সমাজ প্রতিষ্ঠা করা হয় যারা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখত। এই সমাজগুলো তান্নাইম নামে পরিচিত পণ্ডিতদের জন্ম দিয়েছিল, যাদের মধ্যে খোদ র্যাবাই ইয়োহান্নান স্বয়ং, র্যাবাই আকিভা দ্য মিস্টিক এবং র্যাবাই ইশমায়েল অন্তর্ভুক্ত ছিলেন: এঁরা মিশনাহ সংকলিত করেন: কথ্য আইনের লিখিত রূপ, মোজেসের আইনকে যা হালনাগাদ করেছে। এরপর অ্যামোরাইম নামে পরিচিত নতুন আরেক শ্রেণীর পণ্ডিত মিশনার ব্যাখ্যা দান শুরু করেন এবং সম্মিলিতভাবে তালমুদ নাম পরিচিত প্রবন্ধগুচ্ছ রচনা করেন। আসলে দুটো তালমুদ সংকলিত হয়েছিল; চতুর্থ শতাব্দীর শেষ নাগাদ সমাপ্ত জেরুজালেম তালমুদ এবং অধিকতর প্রভাবশালী হিসাবে বিবেচিত বাবিলোনিয় তালমুদ-এর সংকলন পঞ্চম শতকের শেষের দিকে শেষ হয়। প্রত্যেক প্রজন্মের পণ্ডিতগণ তালমুদ এবং এর ওপর প্রদত্ত পূর্বসুরিদের ব্যাখ্যার ওপর নিজস্ব মতামত দান শুরু করায় এই প্রক্রিয়াটি অব্যাহত রয়ে যায়। বহিরাগতরা যেমনটি ভাবতে চান, এই প্রথাসিদ্ধ ধ্যান উপলব্ধি নিরস বিষয় ছিল না। এটা ছিল ঈশ্বরের বাণী নিয়েই অনন্ত ধ্যান, নতুন পবিত্র মন্দির; পূর্ববর্তী ব্যাখ্যার প্রত্যেকটা এক নতুন মন্দিরের দেয়াল ও দরবারের প্রতীক, আপন জাতির মাঝে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে স্থাপন করছে।
ইয়াহ্ওয়েহ্ বরাবরই এক দুৰ্জ্জেয় উপাস্য ছিলেন, যিনি মহাশূন্য থেকে অদৃশ্য থেকে মানবজাতিকে পরিচালনা করছেন। র্যাবাইগণ তাঁকে মানুষের মাঝে ও জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ে গভীরভাবে উপস্থিত করে তোলেন। মন্দির হাতছাড়া ও ফের নির্বাসিত হওয়ার যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতার পর নিজেদের মাঝে একজন ঈশ্বরের উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল ইহুদিদের। র্যাবাইগণ ঈশ্বর সংক্রান্ত কোনও আনুষ্ঠানিক মতবাদ গড়ে তোলেননি। পরিবর্তে প্রায় দৃশ্যমান। সত্তার মতো তাঁকে অনুভব করেছেন। ওঁদের আধ্যাত্মিকতাকে ‘স্বাভাবিক অতিন্দ্রীয়বাদ’[৭৯] হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তালমুদের একেবারে শুরুর দিকের অনুচ্ছেদগুলোয় ঈশ্বরকে রহস্যময় বাস্তব সত্তা হিসাবে অনুভব করা হয়েছে। র্যাবাইগণ পবিত্র আত্মা (Holy Spirit)-র কথা বলেছেন যিনি সৃষ্টি এবং স্যাঙ্কচুয়্যারির নির্মাণ নিয়ে ভাবিত ছিলেন; প্রবল হাওয়া বা প্রচণ্ড অগ্নিশিখায় নিজ উপস্থিতি অনুভব করিয়েছিলেন। অন্যরা ঘণ্টাধ্বনি বা তীক্ষ্ণ করাঘাতের শব্দের মতো শুনতে পেয়েছেন একে। উদাহরণস্বরূপ, র্যাবাই ইয়োহান্নান একদিন ইযেকিয়েলের রথ দর্শনের প্রসঙ্গে আলোচনা করছিলেন, এমন সময় আকাশ থেকে আগুন নেমে এল এবং কাছেই দেবদূতদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল: এক অদৃশ্য কণ্ঠস্বর জানিয়ে দিল যে, ঈশ্বরের কাছ থেকে এক বিশেষ মিশন পেয়েছেন তিনি। [৮০]
তাঁদের সত্তার অনুভূতি এত প্রবল ছিল যে প্রচলিত যে কোনও বাস্তব মতবাদ বেমানান মনে হতো। র্যাবাইগণ বারবার মত প্রকাশ করেছেন যে সিনাই পর্বতের পাদদেশে অপেক্ষমান প্রত্যেক ইসরায়েলি ভিন্ন ভিন্নভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করেছিল। ব্যাপারটি ছিল এরকম, ঈশ্বর ‘প্রত্যেকের উপলব্ধির মাত্রা অনুযায়ী’[৮১] ওদের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন। একজন র্যাবাই যেমন বলেছেন: ‘ঈশ্বর গুরুভার হয়ে মানুষের কাছে আসেন বরং তাকে গ্রহণ করার মানুষটির ক্ষমতার সঙ্গে মানানসইভাবেই উপস্থিত হন।[৮২] র্যাবাইদের এই গুরত্বপূর্ণ দর্শনের মানে হচ্ছে ঈশ্বরকে কোনও সূত্র দিয়ে বর্ণনা করা সম্ভব নয় বা সবার কাছে তিনি একরকম নন। তিনি অত্যাবশ্যকীয়ভাবে মানসিক উপলব্ধি। প্রত্যেক ব্যক্তি যার যার নিজস্ব বিশেষ মেজাজ-মর্জির চাহিদার সমাধান হিসাবে ভিন্ন ভিন্নভাবে ঈশ্বরের সত্তার অভিজ্ঞতা লাভ করবে। র্যাবাই জোর দিয়ে বলছেন, প্রত্যেক ব্যক্তি পয়গম্বর ভিন্ন ভিন্নভাবে ঈশ্বরকে অনুভব করেছেন, কারণ তাঁর ব্যক্তিত্ব ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর ধারণাকে প্রভাবিত করেছে। আমরা দেখব, অন্য একেশ্বরবাদীরাও পুরোপুরি অনুরূপ ধারণা গড়ে তুলবে। এখন পর্যন্ত ইহুদিদের ঈশ্বর সম্পর্কিত ধর্মতাত্ত্বিক ধারণাসমূহ ব্যক্তিগত ব্যাপার, প্রশাসন এগুলো চাপিয়ে দেয় না।
যে কোনও প্রথাবদ্ধ মতবাদ ঈশ্বরের আবশ্যকীয় রহস্যময়তাকে সীমিত করে দেবে। র্যাবাই যুক্তি দেখিয়েছেন, ঈশ্বর সম্পূর্ণ বোধের অতীত। এমনকি মোজেসও ঈশ্বরের রহস্য ভেদ করতে পারেননিঃ দীর্ঘ গবেষণার পর রাজা ডেভিড স্বীকার গেছেন যে, তাঁকে বোঝার চেষ্টা বৃথা, কারণ তিনি মানুষের বুদ্ধির নাগালের বাইরে।[৮৩] ইহুদিরা এমনকি ঈশ্বরের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করার অনুমতি পায়নি, এটা তাঁকে প্রকাশ করার যে কোনও প্রয়াস যে অপর্যাপ্ত হতে বাধ্য তারই স্মারক: YHWH এভাবে ঈশ্বরের নাম লেখা হয়েছিল, কিন্তু ধর্মগ্রন্থ পাঠের সময় নামটি উচ্চারণ করা হয় না। প্রকৃতিতে ঈশ্বরের কর্মকাণ্ডের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে পারি আমরা; কিন্তু র্যাবাই হুনা যেমন বলেছেন, এটা কেবল গোটা সত্তা সম্পর্কে আমাদের খুবই সামান্য ধারণা দেয়: ‘বজ্র, ঘূর্ণিঝড়, তুফান, বিশ্বজগতের নিয়ম শৃঙ্খলার অর্থ এবং নিজ প্রকৃতি মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়; তাহলে কী করে সে সকল রাজার রাজার কার্যকলাপ বোঝার দাবি করে? ঈশ্বরের ধারণার মোদ্দা কথা হচ্ছে রহস্যময়তা এবং জীবনের বিস্ময় সম্পর্কে অনুভূতি উৎসাহিত করা নিখুঁত সমাধানের সন্ধান নয়। র্যাবাইগণ এমনকি প্রার্থনার সময় ঘনঘন ঈশ্বরের প্রশংসা করার ব্যাপারে ইহুদিদের সতর্ক করে দিয়েছেন, কারণ তাদের ভাষা ত্রুটিপূর্ণ হতে বাধ্য। [৮৫]
এই দুৰ্জেয় এবং দুর্বোধ্য সত্তা কীভাবে বিশ্ব জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছিলেন? র্যাবাইগণ একটি প্যারাডক্সের মাধ্যমে এই সংক্রান্ত মত প্রকাশ করেছেন: ‘ঈশ্বর হচ্ছেন পৃথিবীর স্থান, কিন্তু পৃথিবী ঈশ্বরের স্থান নয়।’[৮৬] ঈশ্বর পৃথিবীকে ঘিরে আছেন, আবৃত্ত করে রেখেছেন, কিন্তু সাধারণ সৃষ্টির মতো তিনি এখানে বাস করেন নাই। আরেকটি প্রিয় ইমেজে তারা বলছেন। যে, আত্মা যেমন দেহকে ভরিয়ে রাখে ঈশ্বর তেমনি পৃথিবীকে ভরে রেখেছেন: আত্মা দেহে থেকেও দেহাতীত। আবার, তারা এও বলেছেন যে, ঈশ্বর ঘোড়ার পিঠে একজন সওয়ারির মতো: যখন তিনি ঘোড়ার দিকে থাকেন, আরোহীকে ঘোড়ার ওপর নির্ভর করতে হয়, কিন্তু তিনি পশুটির চেয়ে উন্নত এবং লাগাম থাকে তাঁর হাতে। এগুলো ইমেজ মাত্র এবং অনিবার্যভাবে অপূর্ণাঙ্গ; এগুলো ছিল এক বিশাল, সংজ্ঞাতীত কিছুর কল্পনাভিত্তিক বর্ণনা, যার মাঝে আমরা বেঁচে থাকি, চলাফেরা করি এবং আমাদের সত্তাকে পাই। তারা পৃথিবীতে ঈশ্বরের অস্তিত্বের কথা বলবার সময় বাইবেল-লেখকদের মতো বৃহত্তর প্রবেশাতীত স্বর্গীয় রহস্যের সঙ্গে তিনি তাঁর যেসব চিহ্ন দেখার অনুমতি দিয়ে থাকেন তার মাঝে সযত্নে পার্থক্য টানার প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁরা YHWH এবং পবিত্র আত্মার ‘প্রতাপ’ (কাভোদ) ইমেজ পছন্দ করেছেন, এগুলো আমাদের অনুভূতির ঈশ্বরের সঙ্গে যে স্বর্গীয় সত্তার প্রকৃত রূপ মেলে না তারই স্মারক।
তাদের অন্যতম প্রিয় ঈশ্বর সমার্থক শব্দ ছিল হিব্রু শাকান হতে গৃহীত শেকিনাহ, যার অর্থ কারও তাঁবুতে বাস করা বা আবৃত্ত করা; যেহেতু এখন আর মন্দিরের অস্তিত্ব নেই, যেই ঈশ্বর ইসরায়েলিদের পথে পথে ঘুরে বেড়ানোর সময় সঙ্গী হয়েছিলেন তাঁর ইমেজ ঈশ্বরের নৈকট্যের কথা তুলে ধরেছে। কেউ কেউ বলেছেন যে, পৃথিবীতে তাঁর জাতির সঙ্গে বাসকারী শেকিনাহ এখনও টেম্পল মাউন্টে বাস করছেন, যদিও মন্দির ধ্বংস হয়ে গেছে। অন্য র্যাবাইদের যুক্তি ছিল, মন্দির ধ্বংস হওয়ায় শেকিনাহ জেরুজালেম থেকে মুক্ত হয়ে বাকি বিশ্বে বাস করার সুযোগ পেয়েছেন। স্বর্গীয় প্রতাপ’ বা পবিত্র আত্মার মতো শেকিনাহকে আলাদা স্বর্গীয় সত্তা হিসাবে চিন্তা করা হয়নি বরং পৃথিবীতে ঈশ্বরের উপস্থিতি মনে করা হয়েছে। র্যাবাইগণ স্বজাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করেছেন এবং লক্ষ করেছেন যে এটা সবসময় ওদের সঙ্গে ছিল:
এসো এবং দেখ ইসরায়েলিরা ঈশ্বরের কত প্রিয়, কারণ ওরা যেখানেই গেছে শেকিনাহ্ ওদের অনুসরণ করেছে, যেমন বলা হয়েছে, ‘ওরা যখন মিশরে ছিল আমি কি তখন ওদের পূর্বপুরুষদের ঘরে নিজেকে সহজে প্রকাশ করেছিলাম? খাবিলনে শেকিনাহ্ ওদের সঙ্গে ছিল, যেমন বলা হয়েছে, তোমাদের স্বার্থে আমাকে বাবিলনে পাঠানো হয়েছিল।’ এবং ভবিষ্যতে যখন ইসরায়েল নিষ্কৃতি লাভ করবে, শেকিনাহ ওদের সঙ্গে থাকবে, যেমন বলা হয়েছে, ‘তোমাদের প্রভু তোমাদের ঈশ্বর তোমাদের বন্দিত্ব ঘোচাবেন।’ অর্থাৎ ঈশ্বর বন্দিত্বের সাথে ফিরে আসবেন। [৮৮]
ইসরায়েল এবং ঈশ্বরের সম্পর্ক এতো নিবিড় ছিল যে অতীতে যখন তিনি ইসরায়েলকে উদ্ধার করেছেন, ইসরায়েলিরা ঈশ্বরকে বলেছে: ‘আপনি আপনাকেই মুক্তি দিয়েছেন।’[৮৯] নিজস্ব ইহুদি ঢঙে র্যাবাইগণ এই ধারণা গড়ে তুলছিলেন যে, ঈশ্বরের অনুভূতি সত্তার (Self) সঙ্গে জড়িত, হিন্দুরা যাকে আত্মা বলেছে। নির্বাসিতরা যেখানেই যাক না সেখানেই ঈশ্বরের অস্তিত্বের অনুভূতি বা ধারণা গড়ে তুলতে শোকিনাহর ইমেজ সাহায্য করেছিল। র্যাবাইগণ ডায়াসপোরার এক সিনাগগ থেকে অন্যটিতে শেকিনাহর ঘুরে বেড়ানোর কথা বলেছেন, অন্যরা বলেছেন এটা সিনাগগের দরজায় দাঁড়িয়ে ইহুদিদের হাউস অভ স্টাডিজের দিকে প্রতি পদক্ষেপে অগ্রসর হওয়াকে আশীর্বাদ জানায়; ইহুদিরা সিনাগগে সম্মিলিতভাবে শেমা আবৃত্তি করার সময়ও শেকিনাহ দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে।[৯০] পূর্বকালের ক্রিশ্চানদের মতো ইসরায়েলিরা তাদের র্যাবাইদের দ্বারা নিজেদেরকে ‘এক দেহ এবং এক আত্মা’[৯১] বিশিষ্ট একটি সমাজ হিসেবে দেখতে উৎসাহিত হয়েছে। এই সমাজই নতুন মন্দির, অন্তস্থ ঈশ্বরের আবাস: এজন্যেই যখন তারা সিনাগগে ‘ভক্তি সহকারে নিখুঁত সমস্বরে শেমা আবৃত্তি করে এক সুরে এক মনে আর এক কণ্ঠে’ তখন ঈশ্বর তাদের মাঝে উপস্থিত থাকেন। কিন্তু সমাজের যে কোনওরকম অসামঞ্জস্য তিনি ঘৃণা করেন এবং স্বর্গে ফিরে যান, দেবদূতরা যেখানে ‘এক স্বরে এবং এক সূরে’ স্বর্গীয় প্রশংসার গান[৯২] গাইতে থাকে। ঈশ্বর এবং ইসরায়েলের উচ্চ সম্মিলন তখনই সম্ভব হবে যখন ইসরায়েলিদের সঙ্গে ইসরায়েলিদের নিম্ন সম্মিলন সম্পন্ন হবে: র্যাবাইগণ ক্রমাগত তাদের বলে গেছেন, ইহুদিদের কোনও দল যখন একসঙ্গে তোরাহ্ পাঠ করে, শেকিনাহ্ তাদের মাঝে বসে থাকে। [৯৩]
নির্বাসিত অবস্থায় ইহুদিরা চারপাশের বিশ্বের কঠোরতা অনুভব করেছে; এই ধরনের উপস্থিতির বোধ তাদের সদাশয় ঈশ্বর দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকার অনুভূতি লাভে সাহায্য করেছে। তারা যখন তাদের ফিলেক্টরিগুলো (Plyaetoris: tfillin) হাত ও মাথায় জড়াত, আচরিক ঝালড় পরত এবং শেমার বাণী লেখা nezuzah দরজায় ঝোলাত ডিউটেরোনমি অনুযায়ী ঐসব অস্পষ্ট ও অদ্ভুত আচরণের ব্যাখ্যার প্রয়াস না পেতে বলা হয়েছে তাদের, তা এর মূল্য সীমীত করে দেবে; বরং তাদের উচিত হবে এসব mitzvot-এর অনুসরণ যেন ঈশ্বরের পরিব্যাপী ভালোবাসা সম্পর্কে সজাগ করে তুলতে পারে সে অবকাশ দেওয়া; ‘ইসরায়েল প্রিয়ভাজন! mitzvot দিয়ে বাইবেল তাঁকে ঘিরে রেখেছে: মাথা আর বাহুতে tfillin, দরজায় একটা mizuzah, পোশাকে titzit,[৯৪] এগুলো যেন কোনও রাজার তার রানিকে আরও সুন্দর করে তোলার জন্যে উপহার দেওয়া রত্নের মতো। ব্যাপারটা সহজ ছিল না। তালমুদ দেখায় যে, কেউ কেউ চিন্তা করেছিল এমন অন্ধকার পৃথিবীতে ঈশ্বর খুব একটা আসেন-যান কিনা।[৯৫] যারা জেরুজালেম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল কেবল তাদের মাঝেই নয়, বরং বরাবর ডায়াসপোরায় বাসকারী ইহুদিদের মাঝেও র্যাবাইদের আধ্যাত্মিকতা ইহুদিদের একটা মান স্থাপন করেছিল। সেটা একটা নিখুঁত তত্ত্বীয় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল বলে নয়: আইন-এর বহু অনুশীলনের যৌক্তিক কোনও অর্থ নেই, র্যাবাইদের ধর্ম গৃহীত হয়েছিল এর কার্যকারিতার জন্যে। র্যাবাইদের দর্শন তাদের স্বজাতির হতাশায় কবলিত হওয়া ঠেকিয়েছিল।
অবশ্য এ ধরনের আধ্যাত্মিকতা ছিল কেবল পুরুষের জন্যে-কেননা প্রয়োজন না থাকায়, নারীদের র্যাবাই হওয়া, তোরাহ্ পাঠ বা সিনাগগে যাবার অনুমতি ছিল না। সেসময়ের অধিকাংশ মতাদর্শের মতো ঈশ্বরের ধর্ম পুরুষতান্ত্রিক রূপ নিচ্ছিল। নারীদের দায়িত্ব ছিল বাড়িতে আচরিক পবিত্রতা বজায় রাখা। ইহুদিরা বহু আগেই বিভিন্ন উপকরণ আলাদা করার মাধ্যমে সৃষ্টিকে পবিত্র করেছিল। এই চেতনার আলোকে নারীদের পুরুষ সমাজ থেকে একটা ভিন্ন স্তরে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ঠিক যেমন রান্নাঘরে দুধ আর মাংস আলাদা তাকে রাখতে হয়। বাস্তব ক্ষেত্রে এর অর্থ ছিল ওদের নিম্নস্তরে ঠেলে দেওয়া। যদিও র্যাবাইরা শিক্ষা দিয়েছিলেন যে নারীরা ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট, কিন্তু পুরুষদের সকালের প্রার্থনায় তাদের অ-ইহুদি (জেন্টাইল) দাস বা নারী হিসাবে সৃষ্টি না করার জন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানানোর আদেশ দেওয়া হয়েছিল। তবু বিয়েকে পবিত্র দায়িত্ব এবং পারিবারিক জীবনকে পবিত্র বিবেচনা করা হতো। র্যাবাইগণ বিধিবিধানে এর পবিত্রতার প্রতি জোর দিয়েছেন যাকে প্রায়শঃই ভুল বোঝা হয়েছে। ঋতুস্রাবের সময় যৌন মিলনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণ এই নয় নারীকে নোংরা বা অস্পৃশ্য হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। পুরুষরা যেন স্ত্রী-সঙ্গকে নিশ্চিত ভেবে না বসে সেজন্যেই এই অবকাশের সৃষ্টি করা হয়েছিল: ‘কারণ একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে অনেক বেশি জেনে ফেলতে পারে এবং তাতে বিতৃষ্ণা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে, তোরাহ্ বলছে (ঋতুস্রাবের পর। সাতদিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রীকে নিদ্দাহ (যৌন সঙ্গমের অতীত] হতে হবে যাতে করে পরে সে পুরুষের কাছে বিয়ের দিনের মতো প্রিয় হয়ে। উঠতে পারে।’[৯৬] উৎসবের দিনে সিনাগগে যাবার আগে একজন পুরুষের জন্যে আচরিক স্নান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে সে সাধারণ অর্থে অপরিচ্ছন্ন বা নোংরা বলে নয়, বরং সে যেন পবিত্র প্রার্থনার জন্যে নিজেকে আরও বেশি পবিত্র করে তুলতে পারে সে জন্যে। এবং একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ঋতুস্রাবের পর আসন্ন পবিত্রতা অর্থাৎ স্বামীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করে নেওয়ার লক্ষ্যে নারীকে আচরিক-স্নানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এভাবে যৌনতা যে পবিত্র হতে পারে, এ ধারণা ক্রিশ্চানদের কাছে বিসদৃশ্য শোনাবে, খৃস্টধর্মে যৌনতা ও ঈশ্বরকে অনেক সময় পরস্পর বিরোধী হিসাবে দেখা হবে। এ কথা সত্যি যে, পরবর্তীকালের ইহুদিরা র্যাবাইদের এসব বিধিনিষেধের নেতিবাচক ব্যাখ্যা করেছে, কিন্তু র্যাবাইগণ নিরানন্দ, সন্ন্যাসমূলক জীবনবিরোধী আধ্যাত্মিকতার প্রচার করেননি।
বরং, উল্টো তারা জোর দিয়েছেন যে ভালো ও আনন্দে থাকা ইহুদিদের কর্তব্য। বারবার তারা বাইবেলিয় চরিত্র জ্যাকব, ডেভিড বা এশতারের অসুস্থ বা অসুখী অবস্থায় পবিত্র আত্মার তাদের ত্যাগ করা বা পরিত্যাগ করার কথা উল্লেখ করেছেন। অনেক সময় আত্মা তাঁদের ছেড়ে যাচ্ছে মনে হলে তাঁরা শ্লোক আবৃতি করে দেখিয়েছেন: ‘হে আমার ঈশ্বর, হে আমার ঈশ্বর, আমাকে কেন তুমি ত্যাগ করলে?’ ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় জেসাস যখন এই প্রশ্নটি উচ্চারণ করেছিলেন, সে সম্পর্কে কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন ওঠে এখানে। র্যাবাইগণ শিক্ষা দিয়েছেন যে, নারী-পুরুষ কষ্ট পাক এটা চাননি ঈশ্বর। দেহ যেহেতু ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে গঠিত, সুতরাং একে সম্মান দিতে হবে, যত্ন নিতে হবে: এমনকি মদ পান বা যৌনতার মতো আনন্দ ত্যাগ করাটাও পাপ হতে পারে, কারণ মানুষের উপভোগের জন্যেই ঈশ্বর এগুলো দান করেছেন। দুঃখ কষ্টে আর সন্ন্যাসে ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে না। তারা মানুষকে পবিত্র আত্মা ‘অধিকার করার প্রকৃত পথে চলার তাগিদ দেওয়ার সময় আসলে এক অর্থে নিজেদের জন্যে ঈশ্বরের নিজস্ব ইমেজ গড়ে নেওয়ার কথাই বুঝিয়েছেন। তারা শিক্ষা দিয়েছেন যে, ঈশ্বরের কাজের শুরু ও মানুষের কাজের শেষ কোথায় বলা মোটেই সহজ নয়। পয়গম্বরগণ সব সময় তাঁদের। নিজস্ব অন্তদৃষ্টি ঈশ্বরের ওপর আরোপ করে পৃথিবীতে তাঁকে দৃশ্যমান করে ভুলেছেন। এখন র্যাবাইরা এমন একটা কাজে নিজেদের নিয়োজিত করলেন যেটা একাধারে মানবীয় ও স্বর্গীয়। যখন তারা কোনও নতুন বিধান জারি করেছেন, সেটাকে একই সঙ্গে ঈশ্বর প্রদত্ত ও তাদের নিজস্ব আরোপিত বলেও দেখা হয়েছে। তোরাহ্র সংখ্যা বাড়িয়ে তাঁরা পৃথিবীতে তাঁর উপস্থিতির বিস্তার ঘটাচ্ছিলেন এবং একে আরও কার্যকর করে তুলছিলেন। নিজেরাই তোরাহর অবতার হিসাবে শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হয়েছেন তারা; ‘ল’-এর ক্ষেত্রে দক্ষতার কারণে অন্য যে কারও চেয়ে তারা অনেক বেশি মাত্রায় ‘ঈশ্বরের মতো’[৯৮] ছিলেন ।
সর্বব্যাপী ও অন্তস্থ ঈশ্বরের এই বোধ ইহুদিদের মানুষকে পবিত্র হিসাবে দেখতে সাহায্য করেছে। র্যাবাই আকিভার শিক্ষা (reduce), ‘প্রতিবেশীকে নিজের মতো করেই ভালোবাসতে হবে’ই ছিল ‘তোরাহর মহান নীতি।’[৯৯] ঈশ্বর, যিনি তাঁর অনুরূপে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, মানুষের বিরুদ্ধে আক্রমণ সেই ঈশ্বরেরই প্রত্যাখ্যান স্বরূপ। এটা নাস্তিক্যের সমান, ঈশ্বরকে অগ্রাহ্য করার ব্লাসফেমাস প্রয়াস। এ কারণেই হত্যা সর্বোচ্চ পাপ, ঐশীগ্রন্থ আমাদের শেখায়, যে মানুষের রক্ত ঝরায় সে যেন স্বর্গীয় প্রতিরূপকেই বিনষ্ট করে।’[১০০] আরেকজন মানুষের সেবা করার কাজটি হচ্ছে imitatio de: এতে ঈশ্বরের বদান্যতা আর দয়ার পুনসৃষ্টি ঘটে। যেহেতু সকলকেই ঈশ্বরের প্রতিরূপে গড়ে তোলা হয়েছে, সেহেতু সবাই সমান: এমনকি সর্বোচ্চ পুরোহিত যদি কাউকে আহত করেন তো তাকেও প্রহার করা যাবে, কেননা আঘাত করে তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করার অনুরূপ অপরাধ করেছেন।[১০১] ঈশ্বর আদম (adam) নামে একজন মানুষকে সৃষ্টি করেছিলেন আমাদের এই শিক্ষা দেওয়ার জন্যে যে, যদি কেউ একজন মানুষকেও ধ্বংস করে তাকে এমন শাস্তি দেওয়া হবে যেন সে গোটা বিশ্ব ধ্বংস করেছে।[১০২] এটা স্রেফ চড়া আবেগ ছিল না, বরং আইনের মূল নীতি: এর অর্থ ছিল, উদাহরণ স্বরূপ, যুদ্ধ বিদ্রোহের সময় কোনও একদলের স্বার্থে একজন ব্যক্তিকেও হত্যা করা যাবে না। কাউকে অপমানিত করা, হোক না সে গোয় (Goy) বা দাস, অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ, কেননা এটা হত্যার সমান, ঈশ্বরের ভাবমূর্তিকে অস্বীকার করার অপবিত্র অপরাধ ।[১০৩] মুক্তি বা স্বাধীনতার অধিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: র্যাবাইদের গোটা সাহিত্য তন্নতন্ন করে খুঁজেও কাউকে বন্দি করার কোনও রকম উল্লেখ খুঁজে পাওয়া কঠিন, কারণ একমাত্র ঈশ্বরই কারও স্বাধীনতা খর্ব করার অধিকারী। কারও সম্পর্কে বাজে গুজব রটানো ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করার সামিল।[১০৪] ঈশ্বরকে বড় ভাইয়ের মতো কিছু যেন না ভাবে ইহুদিরা, মহাশূন্য হতে যিনি তাদের প্রতিটি নড়াচড়ার উপর নজর রাখছেন; বরং তাদের প্রত্যেক মানুষের মাঝে ঈশ্বর উপস্থিতির একটা বোধ জাগিয়ে তুলতে হবে যাতে অন্যদের সঙ্গে আমাদের আচার আচরণ পবিত্র সাক্ষাতে পরিণত হয়।
প্রকৃতির দাবি অনুযায়ী বাস করতে পশু জগতের কোনও সমস্যা হয় না, কিন্তু নারী-পুরুষের জন্যে যেন পুরোপুরি মানুষ হয়ে ওঠা কঠিন। ইসরায়েলের ঈশ্বর মাঝে মাঝে যেন একেবারে অপবিত্র ও অমানুষিক নিষ্ঠুরতাকে উৎসাহিত করেছিলেন বলে মনে হয়। কিন্তু শত শত বছরের পরিক্রমায় ইয়াহ্ওয়েহ্ এমন এক ধারণার রূপ নিয়েছিলেন যা মানুষকে স্বজাতির প্রতি দরদ ও শ্রদ্ধা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে, যা ছিল অ্যাক্সিয়াল যুগের সকল ধর্মের বৈশিষ্ট্য বা নির্দেশক। র্যাবাইদের মতবাদ ঈশ্বরের ধর্মসমূহের দ্বিতীয়টির অনেক কাছাকাছি, ঠিক একই ঐতিহ্য বা ধারায় প্রোথিত ছিল যার শেকড় ।
০৩. জেন্টাইলদের প্রতি আলো
ফিলো যখন আলেকজান্দ্রিয়ায় তাঁর প্লেটোনাইজড় ইহুদিবাদ প্রচার করছেন এবং হিল্লেল ও শাম্মাই জেরুজালেমে যুক্তির জাল বিস্তার করে চলেছেন; সেই একই সময়ে একজন ক্যারিশম্যাটিক ফেইথ হীলার উত্তর প্যালেস্তাইনে কাজ শুরু করেছিলেন। জেসাস সম্পর্কে খুব কমই জানি আমরা। তাঁর জীবনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বিবরণী হচ্ছে সেইন্ট মার্কের গস্পেল, যা জেসাসের মৃত্যুর প্রায় চল্লিশ বছর পর আনুমানিক ৭০ সালে রচিত হয়েছিল। ততদিনে জেসাস তাঁর অনুসারীদের জন্যে যে তাৎপর্য অর্জন করেছিলেন সেগুলোর ঐতিহাসিক বাস্ত বতা পৌরাণিক উপাদানের ভারে চাপা পড়ে গিয়েছিল। সেইন্ট মার্ক এই তাৎপর্যকেই মূলত বিশ্বস্ত, সরলরৈখিক উপস্থাপনের বদলে তুলে ধরেছেন। প্রাথমিক ক্রিশ্চানরা তাকে এক নতুন মোজেস, নয়া জোশুয়া, নতুন ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে দেখেছে। বুদ্ধের মতো জেসাসও যেন তাঁর সমসাময়িক অনেকের গভীর আকাঙ্ক্ষা ধারণ করেছেন এবং যে-স্বপ্ন ইহুদিদের শত শত বছর তাড়া করে ফিরেছিল তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন। জীবদ্দশায় প্যালেস্তাইনের ইহুদিরা তাঁকে মেসায়াহ বলে বিশ্বাস করেছিল: তিনি জেরুজালেমে প্রবেশ করেছিলেন এবং ডেভিডের পুত্র বলে তার গুণ গাওয়া হয়েছিল; কিন্তু এর মাত্র কয়েকদিন পরেই রোমানদের কষ্টদায়ক কুসিফিক্সশন নামক শাস্তি প্রয়োগ করে তাকে হত্যা করা হয় । কিন্তু সাধারণ অপরাধীর মতো মৃত্যুবরণকারী একজন মেসায়াহর কেলেঙ্কারী সত্ত্বেও অনুসারীরা বিশ্বাস করতে চায়নি যে তাঁকে বিশ্বাস করা ভুল হয়েছে। গুজব ছিল যে, তিনি মৃত অবস্থা থেকে আবার উত্থিত হয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেছে, কুসিফিক্সশনের তিন দিন পর নাকি তাঁর কবর ফাঁকা দেখা গেছে; অন্যরা তাকে স্বপ্নে দেখেছে; এবং একবার ৫০০ মানুষ যুগপৎ দেখতে পেয়েছিল তাঁকে। অনুসারীদের বিশ্বাস ছিল যে অচিরেই তিনি ঈশ্বরের মেসিয়ানিক রাজ্য উদ্বোধন করার জন্যে আবার ফিরে আসবেন। যেহেতু এধরনের বিশ্বাস ধর্ম বিরোধী কিছু ছিল না, ওদের গোত্রটিকে হিল্লেলের পৌত্র এবং অন্যতম মহান তেন্নাইম র্যাবাই গ্যামালিয়ের মতো ব্যক্তিও প্রকৃত ইহুদি হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। তাঁর অনুসারীরা খাঁটি ইহুদিদের মতো প্রতিদিন মন্দিরে উপাসনা করত। শেষ পর্যন্ত অবশ্য জেসাসের জীবন, মৃত্যু ও পুনরুত্থানে অনুপ্রাণিত নব্য ইসরায়েল এক অ-ইহুদি (জেন্টাইল) ধর্ম বিশ্বাসে পরিণত হবে, যা ঈশ্বর সম্পর্কে এর নিজস্ব সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে তুলবে।
আনুমানিক সিই ৩০ সালে জেসাসের মৃত্যুর সময় ইহুদিরা আন্তরিকভাবে গোড়া একেশ্বরবাদী ছিল, সুতরাং মেসায়াহ স্বর্গীয় সত্তা হবেন এমনটা কেউ আশা করেনিঃ তিনি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত হলেও একজন সাধারণ মানুষই হবেন । কোনও কোনও র্যাবাই মত প্রকাশ করেছেন যে, অনন্তকাল থেকেই ঈশ্বর তাঁর নাম ও পরিচয় জানতেন। সুতরাং, এদিক দিয়ে ভাবলে একথা বলা যেতে পারে যে, সময়ের সূচনার আগে থেকেই প্রোভাবর্স এবং এক্লেসিয়াস্টিকাসের স্বর্গীয় প্রজ্ঞার সত্তার মতো একই প্রতীকী রূপে ঈশ্বরের সঙ্গে ছিলেন মেসায়াহ্। ইহুদিরা মনোনীত সত্তা মেসায়াহকে জেরুজালেমে প্রথমবারের মতো স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকারী রাজা ও আধ্যাত্মিক নেতা রাজা ডেভিডের বংশধরকে প্রত্যাশা করেছিল। শ্লোক (Psalms) সমূহ কখনও কখনও ডেভিড বা মেসায়াহকে ঈশ্বরের পুত্র’ অ্যাখ্যা দিয়েছে, কিন্তু সেটা ছিল ইয়াহ্ওয়েহ্র সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা বোঝানোর একটা স্বাভাবিক কায়দা। বাবিলন থেকে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে গোয়িমদের ঘৃণিত উপাস্যদের মতো ইয়াহ্ওয়েহ্রও একজন পুত্র আছে, এটা কল্পনাও করেনি কেউ।
আদি রচনা হিসাবে সবচেয়ে বিশ্বস্ত বিবেচিত মার্কের গস্পেল জেসাসকে সম্পূর্ণ সাধারণ স্বাভাবিক মানুষ হিসাবে উপস্থাপন করেছে, যার পরিবার আছে, আছে ভাই ও বোন। কোনও দেবদূত তার জন্মের ঘোষণা দেয়নি বা তাঁর দোলনাকে ঘিরে গান করেনি। শিশু বা কৈশোরে কোনওভাবেই তাঁকে আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বলে মনে হয়নি। যখন তিনি শিক্ষা দান শুরু করেন, নাযারেথের শহরবাসীরা একজন সামান্য ছুতোরের ছেলের এমন প্রতিভাবান হয়ে ওঠায় বিস্মিত হয়েছিল । জেসাসের কর্মজীবন দিয়ে বর্ণনা শুরু করেছেন মার্ক। মনে হয়, তিনি সম্ভবত মূলত ভবঘুরে সন্ন্যাসী জন দ্য ব্যাপটিস্ট-এর অনুসারী ছিলেন, যিনি সম্ভবত একজন এসিন: জেরুজালেমকে মারাত্মকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত বিবেচনা করেছেন জন এবং এর বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় প্রচারণা চালিয়েছেন। জনগণকে অনুশোচনা করে জর্দান নদীতে স্নান করে পবিত্র হওয়ার এসিন আচার আপন করে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। লুক জেসাস এবং জন প্রকৃতই সম্পর্কিত ছিলেন বলে মত প্রকাশ করেছেন। জনের কাছে দীক্ষা নেওয়ার জন্যে নাযারেথ থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে জুদাহয় এসেছিলেন জেসাস। মার্ক যেমন আমাদের বলছেন: “আর তৎক্ষণাৎ জলের মধ্য হইতে উঠিবার সময়ে দেখিলেন, আর স্বর্গ হইতে এই বাণী হইল, “তুমিই আমার প্রিয় পুত্র, তোমাতেই আমি প্রীত”।[১] জেসাসকে নিমেষে মেসায়াহ বলে শনাক্ত করেছেন জন দ্য ব্যাপটিস্ট। জেসাস সম্পর্কে এরপর আমরা যা শুনতে পাই তা হলো, তিনি গ্যালিলির সমস্ত গ্রাম আর শহরে ‘ঈশ্বরের রাজ্য সন্নিকট হইল’[২] ঘোষণাসহ শিক্ষা দান শুরু করেছিলেন।
জেসাসের মিশনের প্রকৃত রূপ সম্পর্কে নানান ধারণা রয়েছে। তাঁর বাণীর খুব অল্প অংশই গস্পেলসমূহে নথিভুক্ত করা হয়েছিল বলে মনে হয় এবং পরবর্তীকালের পরিমার্জনায় এসব বাণীর অনেকাংশই তার মৃত্যুর পর সেইন্ট পল প্রতিষ্ঠিত চার্চসমূহে বিকৃত বা পরিবর্তিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও, এমন কিছু সূত্র রয়ে গেছে যেগুলো তার কর্মধারার আবশ্যকীয় ইহুদি প্রকৃতির প্রতি ইঙ্গিত দেয়। ফেইথ হীলারবা গ্যালিলির পরিচিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে: জেসাসের মতোই ভিক্ষুকের জীবন যাপন করত তারা, ধর্মপ্রচার করত, অসুস্থদের সারাত এবং দুরাত্মা তাড়াত। আবার জেসাসের মতোই এইসব গ্যালিলিয় পবিত্র ব্যক্তির বিপুল সংখ্যক নারী শিষ্য থাকতে দেখা যেত। অন্যরা যুক্তি দেখিয়ে থাকেন যে, জেসাস সম্ভবত হিল্লেল-এর মতো একই ভাবধারার ফারিজি ছিলেন, ঠিক পলের মতো, যিনি খৃস্টধর্মে দীক্ষা নেওয়ার আগে নিজেকে ফারিজি দাবি করেছিলে। তিনি র্যাবাই গামালিয়েলের শিষ্য ছিলেন বলে বর্ণিত আছে।[৩] নিঃসন্দেহে জেসাসের শিক্ষা ফারিজিদের প্রধান মতামতের অনুসারী ছিল, কারণ তিনিও বিশ্বাস করতেন যে দান ও প্রেমই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ mitzvot; ফারিজিদের মতো তোরাহুর অনুসারী ছিলেন তিনি এবং বলা হয়ে থাকে যে সমসাময়িকদের তুলনায় অনেক কঠোর অনুসরণের শিক্ষা দিতেন।[৪] হিল্লেলের সোনালি বিধির (Golden Rule) একটি ভাষ্যের শিক্ষা দিয়েছিলেন তিনি, তার যুক্তি ছিল গোটা আইনকে ‘সর্ববিষয়ে তোমরা যাহা যাহা ইচ্ছা কর যে, লোকে তোমাদের প্রতি করে, তোমরাও তাহাদের প্রতি তাহা করিও এই একটা মাত্র সাধারণ বাক্য প্রকাশ সম্ভব।’[৫] সেইন্ট ম্যাথুর গস্পেলে জেসাস ‘স্ক্রাইব ও ফারিজিদের’ বিরুদ্ধে তীব্র ও অশ্লীল মন্তব্য উচ্চারণ করেছেন, তাদেরকে ভয়ানক কপটাচারী হিসাবে তুলে ধরেছেন।[৬] এটা প্রকৃত তথ্যের বা ঘটনার বিকৃত বিবৃতি এবং জেসাসের মিশনের মূল বৈশিষ্ট্য দানের মারাত্মক লজ্জন তো বটেই সেই সঙ্গে ফারিজিদের বিরুদ্ধে তিক্ত বিষোদগারও প্রায় নিশ্চিতভাবেই অসত্যও। উদাহরণ স্বরূপ, লুক তাঁর গস্পেল এবং অ্যাক্টস অভ দ্য অ্যাপসলস উভয়েই ফারিজিদের প্রতি বেশ সুবিচার করেছেন এবং ফারিজিরা যদি সত্যি জেসাসকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া চরম শত্রু হতো তাহলে পল তার ফারিজি পটভূমি নিয়ে বাগাড়ম্বর। করতে যেতেন না। ম্যাথুর গস্পেলের অ্যান্টি-সেমিটিক সুর ৮০র দশকে ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের মধ্যকার টানাপোড়েন তুলে ধরে। গস্পেল প্রায়ই দেখায় জেসাস ফারিজিদের সঙ্গে তর্ক করছেন, কিন্তু আলোচনা হয় আন্তরিকতাপূর্ণ কিংবা শাম্মাইয়ের অধিকতর কঠোর মতবাদের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে।
জেসাসের মৃত্যুর পর অনুসারীরা তিনি স্বর্গীয় সত্তা ছিলেন বলে সিদ্ধান্ত নেয়। ব্যাপারটি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ঘটেনি, আমরা যেমনটি দেখব, জেসাস মানবরূপে ঈশ্বর ছিলেন, এই মতবাদ চতুর্থ শতাব্দীর আগে চুড়ান্ত হয়নি। ক্রিশ্চানদের অবতারবাদে বিশ্বাস ধীরে ধীরে, জটিল এক প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে। জেসাস নিঃসন্দেহে কখনও নিজেকে ঈশ্বর দাবি করেননি। দীক্ষা গ্রহণের সময় স্বর্গীয় কণ্ঠস্বর তাঁকে ‘ঈশ্বর পুত্র’ বলে আহ্বান করেছিল, কিন্তু এটা হয়তো প্রিয় মেসায়াহ হিসাবে তার স্বীকৃতি ছিল। আকাশ থেকে ধ্বনিত এধরনের ঘোষণায় তেমন অস্বাভাবিক কিছু ছিল না প্রায়শঃই, র্যাবাইগণ প্রায়শঃই তাদের ভাষায় বাত কোল- আক্ষরিক অর্থে, “কণ্ঠস্বরের কন্যা”-এর অনুভূতি লাভ করতেন, যা ছিল সরাসরি পয়গম্বর সুলভ প্রত্যাদেশ প্রাপ্তির বিকল্প একধরনের অনুপ্রেরণা।[৭] পবিত্র আত্মা যখন র্যাবাই ইয়োহান্নান বেন যাক্কাই ও তার অনুসারীদের ওপর আগুনের রূপ নিয়ে অবতীর্ণ হয়ে তাঁর মিশনের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, সেই সময় এরকম বাত কোল শুনতে পেয়েছিলেন তিনি। জেসাস স্বয়ং নিজেকে ‘দ্য সান অভ ম্যান’ হিসাবে পরিচয়। দিতেন। এই উপাধি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে, কিন্তু এটা মনে হয় যে মূল আরামাইক বাকধারা বার নাশা মানবীয় অবস্থার দুর্বলতা এবং মরণশীলতার উপরই জোর দিয়েছে। যদি তাই হয়, তাহলে জেসাস নিজেকে ক্রমে একদিন কষ্ট সয়ে মারা যাবেন এমন একজন অসহায় মানব সন্তান হওয়ার ব্যাপারে জোর দিয়ে বরং অপ্রত্যাশিত কাজই করে থাকবেন।
অবশ্য গস্পেলসমূহ আমাদের বলে যে, ঈশ্বর জেসাসকে নির্দিষ্ট কিছু স্বর্গীয় ‘ক্ষমতা’ (dunamis) দিয়েছিলেন যে কারণে তিনি কিছুটা মরণশীল থাকলেও রোগ মুক্ত করা ও পাপ মোচনের মতো ঈশ্বর-সম কাজ করার সমর্থ হয়েছিলেন। সুতরাং লোকে যখন জেসাসকে কর্মরত দেখেছে, তখন তারা ঈশ্বর কেমন তার জীবন্ত, চলমান মূর্তির দেখাই পেয়েছে। একবার তাঁর তিন শিষ্য স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্টভাবে তাঁকে দেখার দাবি করেছেন । এ কাহিনীটি তিনটি সিপনোটিক গস্পেলেই রক্ষিত আছে। পরবর্তীকালের ক্রিশ্চানদের কাছে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এখানে বলা হয়েছে, পিটার, জেমস এবং জন নামের তিনজন অনুসারীসহ এক উঁচু পাহাড়ে উঠেছিলেন জেসাস-ওটাকে সাধারণভাবে গ্যালিলির তাবর পাহাড় বলে মনে করা হয়। সেখানে অনুসারীদের সামনে ‘দেহের পরিবর্তন’ ঘটান তিনিঃ তাঁহার মুখ সূর্যের ন্যায় দেদীপ্যমান এবং তাহার বস্ত্র দীপ্তির ন্যায় শুভ্র হইল।[৮] আইন ও পয়গম্বরদের প্রতিভূ হিসাবে মোজেস ও এলিযা সহসা তাঁর পাশে হাজির হলেন এবং তিনজনে কথোপকথনে লিপ্ত হলেন। পিটার পুরোপুরি হতবিহ্বল হয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, কি বলছেন বুঝতে পারেননি, এই দিব্যদর্শনকে স্মরণীয় করে রাখতে ওদের তিনখানা কুটির নির্মাণ করতে হবে। সিনাই পর্বতে মোজেসের ওপর নেমে আসা সেই উজ্জ্বল মেঘের মতো মেঘ পাহাড়চূড়া ঢেকে ফেলে এবং একটা বাত কোল ঘোষণা দেয়: ইনিই আমার প্রিয় পুন্ত্র, ইহাতেই আমি প্রীত, ইহার কথা শুন।[৯] বহু শতাব্দী পরে গ্রিক ক্রিশ্চানরা এই দিব্যদর্শনের অর্থ নিয়ে ভাবতে গিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে ঈশ্বরের ক্ষমতাই জেসাসের পরিবর্তিত দেহায়বয়বের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তারা আরও উল্লেখ করেছে যে জেসাস কখনও এইসব স্বর্গীয় ক্ষমতা বা দিনামেইজ কেবল নিজের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকার দাবি করেননি। জেসাস বারবার অনুসারীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তারা বিশ্বাস রাখলে অবশ্যই এসব ‘ক্ষমতা’ ভোগ করতে পারবে। বিশ্বাস দিয়ে অবশ্যই সঠিক ধর্মতত্ত্ব গ্রহণ করার কথা বোঝননি তিনি, বরং ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ এবং উন্মুক্ত হওয়ার এক অন্তর্গত প্রবণতার চর্চার কথা বুঝিয়েছেন। অনুসারীরা মনে কোনও রকম সন্দেহ পুষে না রেখে ঈশ্বরের কাছে উন্মুক্ত হতে পারলে তার মতো তারাও সব কিছু করতে পারবে । র্যাবাইদের মতো জেসাস একথা বিশ্বাস করতেন না যে আত্মা (Spitit) কেবল সুবিধাপ্রাপ্ত অভিজাতদের জন্যে, বরং সদিচ্ছাধারী সকল মানুষের কোনও কোনও অনুচ্ছেদে সেই র্যাবাইদের কারও কারও মতে এমনও মত প্রকাশিত হয়েছে যে, এমনকি গোয়িমরাও ‘আত্মাকে গ্রহণ করতে পারে বলে বিশ্বাস করতেন জেসাস। তাঁর অনুসারী ‘বিশ্বাস’ থাকলে তারা এমনকি আরও বড় কেরামতি দেখাতে পারবে। কেবল তারা যে পাপ মোচন ঘটাতে আর দূরাত্মা তাড়াতে পারবে তাই নয়, গোটা একটা পাহাড়কে সাগরে ছুঁড়ে ফেলতে পর্যন্ত সক্ষম হবে।[১০] তারা আবিষ্কার করবে যে তাদের নাজুক মরণশীল জীবনই মেসিয়ানিক রাজ্যে ক্রিয়াশীল ঈশ্বরের ‘ক্ষমতা’য় অলৌকিক রূপ ধারণ করেছে।
জেসাসের মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারীরা এই বিশ্বাস ত্যাগ করতে পারেনি যে তিনি কোনও না কোনওভাবে ঈশ্বরের একটা ইমেজের ধারক ছিলেন। প্রায় সূচনা থেকেই তারা জেসাসকে উদ্দেশ্য করে প্রার্থনা শুরু করেছিল। সেইন্ট পলের বিশ্বাস ছিল, ঈশ্বরের ক্ষমতাকে গোমিয়দের কাছে গ্রহণ উপযোগি করে তোলা উচিত, তিনি তাই বর্তমান তুরস্ক, ম্যাসিদোনিয়া-এর গ্রিসে গস্পেল প্রচার করেছিলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল কোনও অ-ইহুদি মোজেসের আইনের পুরোপুরি অনুসরণ না করেও নব্য ইসরায়েলের সদস্য হতে পারে। এতে অনুসারীদের মূল দলটি ক্ষুব্ধ হয়, আলাদা ইহুদি গোত্র হিসাবে পরিচিত হতে চেয়েছিল ওরা। এক আবেগময় বিরোধের পর পলের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটায় তারা। অবশ্য পলের ধর্মান্তরিতদের অধিকাংশই ছিল ডায়াসপোরার ইহুদি বা ‘গডফিয়ারার’, ফলে নব্য ইসরায়েল গভীরভাবে ইহুদিবাদী রয়ে গিয়েছিলে। পল কখনওই জেসাসকে ‘ঈশ্বর’ সম্বোধন করেননি। তিনি ইহুদি অর্থে তাঁকে ‘সান অভ গড়’ বলে ডেকেছেন; জেসাস স্বয়ং ঈশ্বরের অবতার ছিলেন, একথা তিনি বিলকুল বিশ্বাস করতেন নাঃ স্রেফ ঈশ্বরের ক্ষমতা’ আর ‘আত্মা ছিল তার আয়ত্তে যা পৃথিবীতে ঈশ্বরের কর্মকাণ্ডের প্রকাশ ঘটায় এবং স্বর্গীয় সত্তার সঙ্গে যাকে একাকার করা যায় না। এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে, জেন্টাইল জগতে নব্য-ক্রিশ্চানরা এই সূক্ষ্ম পার্থক্যের বোধ বজায় রাখত না; ফলে শেষ পর্যন্ত একজন মানুষ যে দুর্বল ও মরণশীল মানবজীবনের ওপর জোর দিয়েছেন তাঁকে স্বর্গীয় বলে বিশ্বাস করা হয়েছে। জেসাসের দেহে ঈশ্বরের অবতারের ধারণা বা মতবাদ বরাবরই ইহুদিদের বিক্ষুব্ধ করেছে, এবং পরবর্তী সময়ে মুসলিমরাও ব্লাসফেমাস বলে আবিষ্কার করবে। সুনির্দিষ্ট বিপদ সম্বলিত কঠিন মতবাদ এটা। ক্রিশ্চানরা প্রায়শঃই আনাড়িভাবে একে ব্যাখ্যা করে থাকে। তারপরেও ধর্মের ইতিহাসে এ ধরনের অবতারবাদী ভক্তি মোটামুটি একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য: আমরা দেখব, এমনকি ইহুদি ও মুসলিমরাও আশ্চর্যরকম সাদৃশ্যপূর্ণ নিজস্ব ধর্মতত্ত্বের জন্ম দিয়েছে।
প্রায় একই সময়ে ভারতে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনার মাধ্যমে জেসাসের চমকপ্রদ স্বর্গীয়করণের পেছনে ক্রিয়াশীল ধর্মীয় প্রেরণা বুঝতে পারি আমরা। বৌদ্ধ এবং হিন্দু উভয় ধর্মে স্বয়ং বুদ্ধ এবং মানবরূপে আবির্ভূত হিন্দু দেবতার মতো উন্নত সত্তার প্রতি প্রবল ভক্তি প্রকাশের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল । ভক্তি নামে পরিচিত এ ধরনের ব্যক্তিগত আনুগত্য, মানবায়িত ধর্মের জন্যে মানুষের চিরন্তন আকাক্ষার প্রকাশ বলে মনে হয়। এটা একেবারে নতুন ধরনের বিচ্যুতি হলেও উভয় ধর্মবিশ্বাসে অত্যাবশ্যকীয় শর্তাবলী বাদ না দিয়েই ধর্মের সঙ্গে যোগ করা হয়েছিল।
আনুমানিক বিসিই দুই শতাব্দীর শেষ নাগাদ বুদ্ধের মৃত্যুর পর মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তার একটা স্মৃতিচিহ্নের আকাঙ্ক্ষা করেছিল, কিন্তু তারা এও ভেবেছে যে কোনও মূর্তি নির্মাণ সঙ্গত হবে না, কেননা নির্বাণ লাভের পর স্বাভাবিক অর্থে তাঁর আর কোনও অস্তিত্ব নেই। কিন্তু তারপরেও বুদ্ধের প্রতি ব্যক্তিগত অনুরাগ ও তার আলোকপ্রাপ্ত মানব রূপ নিয়ে ধ্যান করার প্রয়োজন এমন প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, শেষ অবধি বিসিই প্রথম শতাব্দীতে উত্তর-পশ্চিম ভারতের গান্ধারা ও যমুনা নদী তীরবর্তী মথুরায় প্রথমবারের মতো তার মূর্তির আবির্ভাব ঘটে। এই প্রতিমাগুলো থেকে পাওয়া ক্ষমতা ও প্রেরণা বৌদ্ধ আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, যদিও গৌতমের দেওয়া শিক্ষা অন্তরের শৃঙ্খলা ও সত্তার বাইরের কারও প্রতি ভক্তি প্রকাশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। সব ধর্মই পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়। তা না হলে সেগুলো অচল হয়ে পড়বে। অধিকাংশ বৌদ্ধের কাছে ভক্তি অপরিসীম মূল্যবান বলে মনে হয়েছে । এটা বিলুপ্তির আশঙ্কায় থাকা বেশ কিছু আবশ্যকীয় সত্য তাদের মনে করিয়ে দেয়। স্মরণ করা যেতে পারে, বুদ্ধ প্রথম আলোকপ্রাপ্ত হওয়ার পর ব্যাপারটি গোপন রাখতে প্রলুব্ধ হয়েছিলেন, কিন্তু যন্ত্রণাকাতর মানুষের প্রতি দরদ থেকে পরবর্তী চল্লিশ বছর পথ প্রদর্শনে বাধ্য হয়েছেন। তারপরেও বিসিই প্রথম শতাব্দী নাগাদ বৌদ্ধ মঙ্ক বা ভিক্ষুরা আপন নির্বাণ লাভের প্রয়াসে মঠে মঠে বন্দি হয়ে যাওয়ায় এই বিষয়টি বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছিলেন যেন। ভিক্ষু পেশা অত্যন্ত কঠিন ছিল বলে অনেকেই একে সাধ্যের অতীত মনে করেছে। সিই প্রথম শতাব্দীতে এক নতুন ধরনের বৌদ্ধ বীরের আবির্ভাব ঘটে: বোধিসত্তা, যিনি বুদ্ধের উদাহরণ অনুসরণ করেন এবং মানুষের জন্যে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে আপন নির্বাণ বিসর্জন দেন। দুর্গত মানুষকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে তিনি পুনর্জন্মের কষ্ট ভোগে প্রস্তুত। বিসিই প্রথম শতাব্দীর শেষ দিকে সংকলিত প্রজ্ঞা-পারমিতা সূত্ৰসমূহ (Sermons on the Perfection of Wisdom)-এ যেমন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে বোধিসত্তারা:
আপন নির্বাণ লাভের আকাঙ্ক্ষা করেন না। বরং বিপরীতে, তাঁরা সত্তার অত্যন্ত যন্ত্রণাময় পৃথিবী জরিপ করেছেন, কিন্তু তারপরেও উচ্চমার্গের আলোক প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা করেন, জন্ম ও মৃত্যুর পালায় কম্পিত ওরা নন। পৃথিবীর প্রতি করুণাবশত পৃথিবীর উপকার সাধনের ব্রত নিয়েছেন ওরা, পৃথিবীকে শান্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে। ওরা স্থির করেছেন: ‘আমরা পৃথিবীর জন্যে আশ্রয়ে পরিণত হব, পৃথিবীর বিশ্রামের স্থল, পৃথিবীর পরম স্বস্তি, পৃথিবীর শান্তির দ্বীপ, পৃথিবীর আলোকমালা, পৃথিবীর উদ্ধারপ্রাপ্তির উপায়ের পথ প্রদর্শক।’[১১]
এছাড়াও, বোধিসত্ত্ব অপরিসীম মেধার অধিকারী হয়েছিলেন, যা আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে দুর্বলকে সাহায্য করতে সক্ষম। বোধিসত্তার কাছে প্রার্থনাকারী বৌদ্ধ জগতের এক স্বর্গে পুনর্জন্ম গ্রহণ করতে পারবে, যেখানকার পরিবেশ আলোকপ্রাপ্তি অনেক সহজ করে দেবে ।
টেক্সট জোর দিয়েছে যে এসব ধারণা আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করার নয়। এগুলো মামুলি যুক্তি বা পৃথিবীর ঘটনাপ্রবাহের সাথে সম্পর্কহীন, বরং স্রেফ ধরাছোঁয়ার অতীত এক সত্যের প্রতীক মাত্র। সিই দ্বিতীয় শতাব্দীর গোড়ার দিকে দার্শনিক নাগার্জুন দ্বন্দ্বমূলক শূন্য (void) মতবাদের প্রবর্তক, সাধারণ ধারাণাগত ভাষার অপূর্ণাঙ্গতা প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে বিপরীত ও দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির ব্যবহার করেছিলেন তিনি। তার জোরাল বক্তব্য ছিল পরম সত্য কেবল সাধনা বা ধ্যানের মাধ্যমে মানসিক শৃঙ্খলার ভেতর দিয়েই অর্জন করা। সম্ভব। এমনকি বুদ্ধের শিক্ষাও ছিল প্রথাগত, মানবসৃষ্ট ধারণা যা তিনি যে সত্য বোঝানোর প্রয়াস পেয়েছিলেন তার প্রতি সুবিচার করেনি। এই দর্শন গ্রহণকারী বৌদ্ধরা এমন ধারণা গড়ে তুলেছিল যে, আমরা যা কিছুর অভিজ্ঞতা লাভ করি তা আসলে মায়া। পশ্চিমে আমরা এদের হয়তো আদর্শবাদী বলব । সকল বস্তুর মূল সত্তা, পরম বা অ্যাবসোলিউট আসলে শূন্য, কিছু না, স্বাভাবিক জ্ঞানে যার কোনও অস্তিত্ব নেই। এই শূন্যতাকে নির্বাণের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলাটা স্বাভাবিক। যেহেতু গৌতমের মতো একজন বুদ্ধ নির্বাণ লাভ করেছেন, এর মানে অলৌকিক কোনও উপায়ে তিনি স্বয়ং নির্বাণে পরিণত হয়েছেন, পরমের সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছেন। সুতরাং নির্বাণাকাক্ষী প্রত্যেকেই বুদ্ধদের সঙ্গে একীভূত হওয়ারও প্রত্যাশী।
বুদ্ধ এবং বোধিসত্তাদের প্রতি এই ভক্তির সঙ্গে জেসাসের প্রতি ক্রিশ্চানদের ভক্তির মিল আছে। এটা ধর্মকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে, যেমন পল ইহুদিদের গোয়িমদের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন। একই সময়ে হিন্দুদের মাঝেও একই ধরনের ভক্তির একটা জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, যার কেন্দ্রে ছিলেন অন্যতম বৈদিক দেবতা শিব এবং বিষ্ণু। তারপরও সাধারণ মানুষের ভক্তি উপনিষদের দার্শনিক মিতাচারের চেয়ে শক্তিশালী প্রমাণিত হয়েছিল। কার্যত, হিন্দুরা এক ত্রিত্ববাদ জন্ম দিয়েছিল: ব্রক্ষ্মা, শিব এবং বিষ্ণু ছিলেন এক একক অলৌকিক সত্তার তিন প্রতীক বা বৈশিষ্ট্য।
অনেক সময় শিবরূপে ঈশ্বরের রহস্য সম্পর্কে চিন্তাভাবনা অনেক সহজ হয়ে থাকে: তিনি একাধারে ভালো-মন্দ, উর্বরতা-সংযমের দেবতা, যিনি স্রষ্টা এবং ধ্বংসকারী। জনপ্রিয় কিংবদন্তী অনুযায়ী শিব একজন মহান যোগিও ছিলেন, আবার ভক্তবৃন্দকে তিনি ধ্যানের মাধ্যমে ঈশ্বর সম্পর্কে ব্যক্তিগত ধারণার উর্ধ্বে ওঠারও অনুপ্রেরণা যোগান। বিষ্ণু মূলত আরও দয়াময় ও কর্মতৎপর। তিনি বিভিন্ন অবতাররূপে মানুষের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতে পছন্দ করেন। তাঁর অন্যতম বিখ্যাত রূপ হচ্ছে কৃষ্ণ চরিত্রটি, যিনি অভিজাত পরিবারে জন্ম নিলেও বেড়ে উঠেছিলেন রাখাল হিসাবে। জনপ্রিয় কিংবদন্তীগুলোয় রাখালীনিদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের গল্প অত্যন্ত প্রিয়, এসব গল্প ঈশ্বরকে আত্মার প্রেমিক হিসাবে উপস্থাপন করেছে। তারপরেও ভগবদ গীতায় বিষ্ণু যখন কৃষ্ণরূপে রাজপুত্র অর্জুনের সামনে উপস্থিত হন সে এক, ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা:
হে ঈশ্বর, তোমার দেহে আমি দেবতাদের দেখি,
আর বহু প্রাণের অস্তিত্ব:
মহাবিশ্বের স্রষ্টা ব্রহ্মা,
বসে আছেন পদ্ম সিংহাসনে,
দেবতা সকল আর স্বর্গীয় সরিসৃপ।[১২]
যেভাবেই হোক, কৃষ্ণের দেহে সব কিছুই আছে তার কোনও আদি বা অন্ত নেই, মহাশূন্য পূর্ণ করে আছেন তিনি এবং সব সম্ভাব্য উপাস্যদের ধারণ করছেন: ‘সংক্ষুব্ধ ঝড়-দেবতা, সূর্য দেবতাগণ, উজ্জ্বল দেবতাগণ এবং ‘আচারের দেবতাগণ।’[১৩] তিনি মানুষের ক্লান্তিহীন চেতনা’, মানুষের মূল সত্তা।[১৪] সমস্ত কিছু কৃষ্ণের দিকে ধাবিত হয়: সমস্ত নদীসমূহ যেমন সাগরের দিকে ধেয়ে যায় বা আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে মথ। এই ভয়ানক দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে সম্পূর্ণ দিশাহারা অর্জুনের কম্পিত হওয়া আর কিছুই করার থাকে না।
ভক্তির বিকাশ পরম সত্তার সঙ্গে মানুষের যেকোনও ধরনের ব্যক্তিগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার গভীর চাহিদার জবাব দেয়। ব্রাক্ষ্মণকে পুরোপুরি দুয়ে হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার পর তার একেবারে দূরবর্তী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে প্রাচীন ‘স্কাই গডে’র মতো মানুষের চেতনা থেকে পুরোপুরি মুছে যেতে পারেন তিনি। বুদ্ধ ধর্মে বোধিসত্তা মতবাদ এবং বিষ্ণুর অবতারসমূহ যেন ধর্মীয় বিকাশের আরেকটি পর্যায় নির্দেশ করে, যখন মানুষ পরম সত্তা মানুষের চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের হতে পারে না বলে জোর দিয়েছে। এইসব প্রতীকী মতবাদ এবং মিথ একটামাত্র এপিফ্যানি দিয়ে পরম সত্তাকে প্রকাশ করার ব্যাপারটি অস্বীকার করে: বোধিসত্তা এবং বুদ্ধের কোনও সীমা পরিসীমা নেই; আর অসংখ্য অবতার রয়েছে বিষ্ণুর। এসব মিথ মানুষের জন্যে আদর্শও প্রকাশ করে: মানবজাতিকে আলোকপ্রাপ্ত বা দেবতৃপ্রাপ্ত হিসাবে দেখায় এগুলো, যা মানুষের উদ্দীষ্ট।
সিই প্রথম শতাব্দী নাগাদ ইহুদিদেরও একই ধরনের স্বর্গীয় পরিব্যাপীতার তৃষ্ণা দেখা দিয়েছিল। জেসাসের ব্যক্তিসত্তা এই চাহিদা মিটিয়েছিল বলে মনে হয়। আমাদের জানা ক্রিস্টান ধর্মটির স্রষ্টা গোড়ার দিকের ক্রিশ্চান লেখক সেইন্ট পল বিশ্বাস করতেন, জেসাস জগতে ঈশ্বরের মূল প্রত্যাদেশ হিসাবে তোরাহুকে প্রতিস্থাপিত করেছেন।[১৫] তিনি একথা দিয়ে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন, জানা সহজ নয়। পলের পত্রাবলী এক সুসমন্বিত ধর্মতত্ত্বের বিবরণ চেয়ে বরং কিছু সুনির্দিষ্ট প্রশ্নমালার উত্তর। জেসাসকে তিনি অবশ্যই মেসায়াহ্ বলে বিশ্বাস করতেন: ‘ক্রাইস্ট’ শব্দটি হিব্রু মসিয়াক শব্দটির অনুবাদ, যার অর্থ মনোনীত জন। পল ব্যক্তি জেসাস সম্পর্কে এমনভাবে কথা বলেছেন যেন তিনি সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি কিছু ছিলেন, যদিও ইহুদি হিসাবে পল জেসাস ঈশ্বরের অবতার ছিলেন বলে বিশ্বাস করতেন না। জেসাস সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বারবার যিশু খৃস্টে (In christ) শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন: ক্রিশ্চানদের বাস ‘যিশু খৃস্টে’, তাঁর মৃত্যুতে তারা ব্যাপ্টাইজ হয়েছে, চার্চ কোনওভাবে তাঁর দেহ গঠন করেছে।[১৬] পল যুক্তি দিয়ে এই সত্যের পক্ষে কথা বলেননি। বহু ইহুদির মতো তিনি গ্রিক যুক্তিবাদের প্রতি বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন, যাকে তিনি স্রেফ ‘বোকামি’[১৭] বলে বর্ণনা করেছেন। এক আধ্যাত্মিক ও অতিন্দ্রীয় অভিজ্ঞতার ফলে তিনি জেসাসকে এক ধরনের পরিবেশ হিসাবে বর্ণনা করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সেখানে আমরা বাস করি, চলাফেরা করি এবং আমাদের সত্তার সন্ধান পাই।[১৮] পলের ধর্মীয় বোধের উৎসে পরিণত হয়েছিলেন জেসাস: সেই কারণেই জেসাস সম্পর্কে এমনভাবে কথা বলেছিলেন তিনি তাঁর সমসাময়িকরা যেমন করে ঈশ্বরের আলোচনা করে থাকবেন।
দায়িত্বপ্রাপ্ত ধর্ম সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পল বলেছেন যে, ‘আমাদের পাপের’[১৯] জন্যে জেসাস কষ্ট ভোগ করেছেন এবং প্রাণ দিয়েছেন। এতে বোঝা যায় একেবারে গোড়ার দিকে জেসাসের অনুসারীরা তাঁর মৃত্যুর কেলেঙ্কারীতে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে এবং ঘটনাটি কোনওভাবে আমাদের স্বার্থেই ঘটেছে বলে ব্যাখ্যা করে। নবম অধ্যায়ে আমরা দেখব, সপ্তদশ শতাব্দীতে অন্য ইহুদিরাও আরও এক মেসায়াহর কলঙ্কজনক পরিসমাপ্তির প্রেক্ষিতে একই রকম ব্যাখ্যা খুঁজে পাবে। গোড়ার দিকের ক্রিশ্চানরা মনে করেছে যে কোনও রহস্যময় উপায়ে জেসাস বেঁচে আছেন এবং তার ক্ষমতা এখন তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের মাঝে স্থান পেয়েছে। পলের পত্রাবলী থেকে আমরা জানি যে, গোড়ার দিকের ক্রিশ্চানরা সব ধরনের অস্বাভাবিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল যা হয়তো এক নতুন ধরনের মানবতার ইঙ্গিতবাহী হয়ে থাকবে কেউ কেউ ফেইথ-হীলার-এ পরিণত হয়েছিল, কেউ আবার স্বর্গীয় ভাষায় কথা বলত, অন্যরা ঈশ্বর থেকে প্রাপ্ত বলে বিশ্বাস করা বাণীর প্রচার করত। চার্চের প্রার্থনাগুলো কোলাহলপূর্ণ জাকাল ব্যাপার ছিল, মোটেই বর্তমান কালের প্যারিশ-চার্চের সান্ধ্য উপাসনা সঙ্গীতের মতো রুচিশীল নয়। জেসাসের মৃত্যু কোনওভাবে উপকারে এসেছিল বলেই মনে হয়: এটা এক নতুন ধরনের জীবন এবং এক নতুন সৃষ্টি’ সহজ করে তুলেছিল যা পলের পত্রাবলীর স্থায়ী সুর।[২০]
কুসিফিক্সশন আদমের কোনও ‘আদি পাপের প্রায়শ্চিত্ত হওয়ার ব্যাপারে অবশ্য বিস্তারিত কোনও মতবাদ ছিল নাঃ আমরা দেখব, চতুর্থ শতাব্দীর আগে এই মতবাদ জন্ম নেয়নি এবং এটা শুধু পশ্চিমেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পল এবং অন্য নিউ টেস্টামেন্ট রচয়িতাগণ কখনওই তাদের নিষ্কৃতি লাভের (Salvation) স্পষ্ট, পরিষ্কার ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়াস পাননি। তবু ক্রাইস্টের আত্মউৎসর্গ-সূচক মৃত্যু একই সময়ে ভারতে বিকাশ পাওয়া বোধিসত্তার আদর্শের অনুরূপ। বোধিসত্তার মতো ক্রাইস্ট কার্যত মানুষ ও পরম সত্তার মধ্যস্থতাকারীতে পরিণত হয়েছিলেন, পার্থক্য হচ্ছে, জেসাসই একমাত্র মধ্যস্থতাকারী এবং তার দেওয়া মুক্তি বোধিসত্তাদের মতো ভবিষ্যতের অনাদায়ী অনুপ্রেরণা নয়, বরং তর্কাতীত ব্যাপার। পল জোর দিয়ে বলেছেন জেসাসের ত্যাগ ছিল অনন্য। তিনি যদিও বিশ্বাস করতেন যে অন্যের স্বার্থে তাঁর নিজস্ব ভোগান্তি ছিল মঙ্গলকর, কিন্তু তাঁর স্পষ্ট বিশ্বাস ছিল জেসাসের দুর্ভোগ এবং মৃত্যু সম্পূর্ণ ভিন্ন পর্যায়ের।[২১] এখানে সুপ্ত বিপদ রয়েছে। অসংখ্য বুদ্ধ এবং ছলনাময় ও বৈপরীত্যে পূর্ণ সকল অবতার বিশ্বাসীকে মনে করিয়ে দেয় যে, পরমসত্তাকে কোনও একটা আকারে পরিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা বা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। খৃস্টধর্মের একক অবতারবাদ বোঝাতে চায় যে, ঈশ্বরের অন্তহীন সত্তা মাত্র একজন মানুষের মাঝে প্রকাশ পেয়েছিল যা তাঁকে একধরনের অপরিপকু পৌত্তলিকতার দিকে ঠেলে দিতে থাকে।
জেসাস জোর দিয়ে বলে গেছেন যে, ঈশ্বরের ‘ক্ষমতা’ কেবল তার একার জন্যে নয়। জেসাস এক নতুন ধরনের মানুষের প্রথম উদাহরণ, এই যুক্তি দেখিয়ে পল এই দর্শনকে আরও বিকশিত করেছেন। প্রাচীন ইসরায়েল যা কিছু অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে তিনি কেবল সেগুলো অর্জনই করেননি, বরং এক নতুন আদমে পরিণত হয়েছেন, এক নতুন মানবতা যেখানে গোয়িমসহ সব মানুষ যেভাবেই হোক যোগ দিতে বাধ্য।[২২] আবার, এটার সঙ্গে বৌদ্ধদের বিশ্বাস, যেহেতু সকল বুদ্ধ পরমসত্তার সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছেন, সেহেতু, এক বুদ্ধসমাজে (Buddhahood) যোগ দেওয়াই মানুষের আদর্শ হতে ভিন্ন নয়।
ফিলিপিন্থ চার্চের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে কিছু জরুরি প্রসঙ্গ উত্থাপনকারী গোড়ার দিকের ক্রিশ্চান-হাইম বলে বিবেচিত গানের উদ্ধৃতি দিয়েছেন তিনি। নবদীক্ষিতদের তিনি বলেছেন, তাদের অবশ্যই জেসাসের মতো আত্মত্যাগের প্রবণতা থাকতে হবে,
ঈশ্বরের স্বরূপ বিশিষ্ট থাকিতে তিনি ঈশ্বরের
সমান থাকা ধরিয়া লইবার বিষয় জ্ঞান করিলেন না,
কিন্তু আপনাকে শূন্য করিলেন,
দাসের রূপ ধারণ করিলেন,
মনুষ্যদের সাহায্যে জন্মিলেন;
এবং আকারে প্রকারে মনুষ্যবৎ প্রত্যক্ষ হইয়া
আপনাকে অবনত করিলেন;
মৃত্যু পর্যন্ত, এমনকি, ক্রুশীয় মৃত্যু পর্যন্ত আজ্ঞাবহ হইলেন।
এই কারণ ঈশ্বর তাহাকে অতিশয় উচ্চ-পদান্বিতও করিলেন,
এবং তাহাকে সেই নাম দান করিলেন,
যাহা সমুদয় নাম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ;
যেন যীশুর নামে স্বর্গ, মর্ত্য পাতালনিবাসীদের
‘সমুদয় জানু পতিত হয়, এবং সমুদয় জিহ্বা যেন স্বীকার করে’
যে যীশু খৃস্টের প্রভু (Kyrios),
এই রূপে পিতা ঈশ্বর যেন মহিমান্বিত হন।[২৩]
এই প্রার্থনা সঙ্গীতে যেন ক্রিশ্চানদের এমন একটা বিশ্বাস প্রতিফলিত হচ্ছে যে ‘আত্মশূন্য’ (Kenosis) করার ভেতর দিয়ে মানুষ হওয়ার আগে জেসাস ‘ঈশ্বরের সঙ্গে অবস্থান করছিলেন, এবং মানবরূপে বোধিসত্তার মতো মানবীয় অবস্থার দুর্ভোগের অংশীদার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অনন্ত কাল ধরে YHWH-এর পাশে দ্বিতীয় স্বর্গীয় সত্তা হিসাবে খৃস্টের অস্তিত্বের ধারণা গ্রহণ করা পলের মতো ইহুদির পক্ষে সম্ভব ছিল না। প্রার্থনা সঙ্গীত দেখাচ্ছে মহিমান্বিত হওয়ার পরেও জেসাস ঈশ্বরের চেয়ে ভিন্ন এবং নিম্নস্তরে রয়ে গেছেন। ঈশ্বর তাকে উন্নীত করে কাইরিয়স উপাধি দিচ্ছেন। জেসাস নিজে এই উপাধি গ্রহণ করতে পারেন না, উপাধিটি দেওয়া হয়েছে কেবল পিতা ঈশ্বরের মহিমায়।
প্রায় চল্লিশ বছর পর সেইন্ট জনের গস্পেলের রচয়িতা (রচনাকাল Ca ১০০) একই ধরনের মত প্রকাশ করেন। সূচনায় তিনি সৃষ্টির নিমিত্ত বাণী ‘শুরু হতেই ঈশ্বরের সঙ্গে’ ছিল বলে বর্ণনা করেছেন: ‘সকলেই তাঁহার দ্বারা হইয়াছিল, যাহা হইয়াছে, তাহার কিছুই তারা ব্যতিরেকে হয় নাই।’[২৪] লেখক ফিলোর মতো একই অর্থ বোঝাতে লোগোস শব্দটি ব্যবহার করছিলেন নাঃ তাঁকে হেলেনাইজড ইহুদিবাদের চেয়ে বরং প্যালেস্তাইনি ইহুদিবাদের সঙ্গে বেশি সম্পর্কিত বলে মনে হয়। এই সময়ে লিপিবদ্ধ তারগামস (Targums) নামে পরিচিত হিব্রু ঐশীগ্রন্থের আরামিক অনুবাদে মেমরা (বাণী) শব্দটি পৃথিবীতে ঈশ্বরের কর্মকাণ্ড বর্ণনা করার জন্যে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রতাপ, ‘পবিত্র আত্মা’ ও ‘শেকিনাহ্’র মতো অন্যান্য কারিগরি পরিভাষার মতোই ছিল এর অর্থ যা পৃথিবীতে ঈশ্বরের উপস্থিতি এবং স্বয়ং ঈশ্বরের দুর্বোধ্য সত্তার পার্থক্যের উপর জোর দেয়। স্বর্গীয় প্রজ্ঞার মতো, বাণী’ ঈশ্বরের সৃষ্টির আদি পরিকল্পনাকে প্রতীকায়িত করে। পল এবং জন জেসাসের পূর্বজীবন থাকার কথা বলার সময় আসলে এটা বোঝাতে চাননি যে তিনি পরবর্তীকালে ত্রিত্ববাদী ধারণা অনুযায়ী দ্বিতীয় স্বর্গীয় ব্যক্তি ছিলেন। তাঁরা বুঝিয়েছেন, জেসাস মানবীয় এবং ব্যক্তিক অস্তিত্বের উর্ধ্বে উঠেছিলেন। যেহেতু তাঁর প্রদর্শিত ‘ক্ষমতা’ ও ‘প্রজ্ঞা’ ঈশ্বর থেকে গৃহীত কর্মকাণ্ড, তাই কোনওভাবে ‘যাত্রা হইতে তিনি ছিলেন’[২৫] বলে তা প্রকাশ করেছিলেন।
কঠোর ইহুদি পটভূমিতে এইসব ধারণা বোধগম্য ছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ের গ্রিক পটভূমির ক্রিশ্চানরা এগুলোকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করবে। সিই ১০০ সালের দিকে রচিত অ্যাক্টস অভ দ্য অ্যাপসলস-এ আমরা দেখতে পাই, প্রথম দিকের ক্রিশ্চানদের তখনও ঈশ্বরের ইহুদি ধারণাই ছিল। পেন্টেস্টের ভোজে যখন সিনাই পর্বতে তোরাহ্ অবতীর্ণ হওয়ার বার্ষিকী উদযাপনের উদ্দেশ্যে ডায়াসপোরা থেকে শত শত ইহুদি জেরুজালেমে সমবেত হয়েছিল, তখন জেসাসের সঙ্গীদের ওপর পবিত্র আত্মা অবতরণ করেছিলেন। ‘হঠাৎ আকাশ হইতে প্রচণ্ড বায়ুর বেগের শব্দবৎ একটা শব্দ আসিল…এমন অনেক অগ্নিবৎ জিহ্বা তাহাদের দৃষ্টিগোচর হইল।’[২৬] এই প্রথম ইহুদি ক্রিশ্চানদের সামনে তাদের সমসাময়িক তেন্নাইমদের মতো পবিত্র আত্মা নিজেকে প্রকাশ করেছিলেন। অবিলম্বে অনুসারীরা দ্রুত বেরিয়ে গিয়ে ‘পার্থীয়, মাদীয় ও এলমীয় লোক এবং মিসমপতামিয়া, যিহুদিয়া ও কাপ্পাদকিয়া, পন্ত ও আশিয়া, ফরুগিয়া ও পাফুলিয়া, মিসর এবং লুবিয়া দেশস্থ, কুবীনির নিকটবর্তী এই অঞ্চল নিবাসী এবং প্রবাসকারী রোমীয়’[২৭] থেকে আগত ইহুদি ও গডফিয়ারারদের মাঝে প্রচারণা শুরু করে দিয়েছিলেন। সবিস্ময়ে তারা আবিষ্কার করে যে, অনুসারীরা তাদের নিজস্ব ভাষাতেই প্রচার করছে। পিটার জমায়েতের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতে উঠে দাঁড়ানোর পর এই ঘটনাকে ইহুদিদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বলে তুলে ধরেন তিনি। পয়গম্বরগণ ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, এমন একদিন আসবে যখন ঈশ্বর মানবজাতির ওপর তার আত্মা অবতরণ করাবেন যার ফলে এমনকি নারী ও দাসরাও দিব্যদর্শন পাবে, স্বপ্ন দেখবে।[২৮] সেইদিন মেসিয়ানিক রাজ্যের উদ্বোধন ঘটবে এবং ঈশ্বর তার জাতির সঙ্গে পৃথিবীতে বসবাস করবেন। নাযারেথের জেসাসই যে ঈশ্বর, এ দাবি করেননি পিটার। তিনি ছিলেন অদ্ভুত লক্ষণ ও চিহ্নসমূহ দ্বারা তোমাদের নিকটে ঈশ্বর কর্তৃক প্রমাণিত মনুষ্য: তাহারই দ্বারা ঈশ্বর তোমাদের মধ্যে ঐসকল কাৰ্য্য করিয়াছেন, যেমন তোমরা নিজেই জান। তার নিষ্ঠুর মৃত্যুর পর ঈশ্বর আবার তাঁকে জীবন দান করেছেন এবং ঈশ্বরের দক্ষিণ হস্ত দ্বারা উচ্চীকৃত হওয়াতে তাঁকে এক বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। পয়গম্বর এবং শ্লোক রচয়িতাগণ সবাই এই ঘটনার আগেই পূর্বাভাস দিয়েছিলেন; এইভাবে ইস্রায়েলের সমস্ত কুল নিশ্চয়ই জানুক যে, জেসাসই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সেই মেসায়াহ।[২৯] এই বক্তৃতাটিকে গোড়ার দিকের ক্রিশ্চানদের বার্তা (Kerygma) বলে মনে হয়।
চতুর্থ শতাব্দীর শেষ নাগাদ অ্যাক্টস-এর রচয়িতার উল্লিখিত স্থানগুলোতেই খৃস্টধর্ম শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল; ডায়াসপোরার ইহুদি সিনাগগগুলোতে এর শেকড় ছড়িয়ে পড়ে যা বিপুলসংখ্যক গড়ফিয়ারার বা ধর্মান্তরিতদের আকৃষ্ট করে। পলের পরিমার্জিত বা সংস্কৃত ইহুদিবাদ যেন তাদের বহু দোদুল্যমানতার সমাধান দিয়েছিল। তারাও বিভিন্ন ভাষায় কথা বলেছে বলে ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বর এবং একটা সুসঙ্গত অবস্থানের অভাব ছিল। ডায়াসপোরার বহু ইহুদি পশুর রক্তে সিক্ত জেরুজালেম-মন্দিরকে আদিম ও বর্বর প্রতিষ্ঠান ভাবতে শুরু করেছিল। জনৈক হেলেনিস্টিক ইহুদি স্তিফেন এর গল্পের ভেতর দিয়ে অ্যাক্টস অভ দ্য অ্যাপসলস এই দৃষ্টিভঙ্গিটি ধরে রেখেছে। এই ব্যক্তি জেসাসের গোত্রে দীক্ষা নিয়েছিল এবং ব্লাসফেমির অভিযোগে তাকে ইহুদিদের শাসক সভা স্যানহেদ্রিন পাথর ছুঁড়ে হত্যা করেছিল। স্তিফেন তার আবেগময় শেষ বক্তব্যে মন্দির ঈশ্বরের প্রকৃতির বিরুদ্ধে এক অসম্মান বলে দাবি করেছিল, তথাপি তিনি পরাৎপর (Most High), তিনি হস্তনিৰ্মিত গৃহে বাস করেন না।[৩০] মন্দির ধ্বংসের পর ডায়াসপোরার ইহুদিদের কেউ কেউ র্যাবাইদের হাতে বিকশিত তলমুদিয় ইহুদিদের গ্রহণ করেছিল। অন্যারা তাদের খৃস্টধর্মের মাঝে তোরাহ্র অবস্থান এবং ইহুদিবাদের বিশ্বজনীনতা সংক্রান্ত জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজে পেয়েছিল। এটা অবশ্যই গডফিয়ারারদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয় ছিল, যারা ৬১৩টি মিতযভোত-এর ভার ছাড়াই নব্য ইসরায়েলের পূর্ণ সদস্য হতে পেরেছিল।
প্রথম শতাব্দীতে ক্রিশ্চানরা ইহুদিদের মতোই সম্পর্কিত ভাবনা ও প্রার্থনা অব্যাহত রেখেছিল। তারা র্যাবাইদের মতো যুক্তি দেখিয়েছে। তাদের গির্জাগুলো সিনাগগের মতোই ছিল। আশির দশকে ক্রিশ্চানরা তোরাহ্ অনুসরণে অস্বীকৃতি জানালে সিনাগগ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বহিষ্কার করা হয় তাদের, সেসময় ইহুদিদের সঙ্গে তাদের প্রবল বিরোধ দেখা দিয়েছিল। আমরা দেখেছি যে প্রথম শতাব্দীর গোড়ার দিকের দশকগুলোয় ইহুদিবাদ বহুজনকে ধর্মান্তরিত হতে আকৃষ্ট করেছিল, কিন্তু ৭০-এর পরে ইহুদিরা রোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লে ওদের অবস্থানের অবনতি ঘটে। খৃস্টধর্মে গডফিয়ারাবদের পক্ষ ত্যাগ ধর্মান্তরিতদের ব্যাপারে ইহুদিদের সন্দিহান করে তোলে, তারা আর ধর্মান্তরকরণে আগ্রহ বোধ করেনি। পৌত্তলিকরা আগে যেখানে ইহুদিবাদের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিল, এবার তারা খৃস্টধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ল, কিন্তু এরা ছিল প্রধানত দাস ও নিম্নশ্রেণীর সদস্য। দ্বিতীয় শতাব্দীর একেবারে শেষ দিকেই কেবল উচ্চ শিক্ষিত পৌত্তলিকরা ক্রিশ্চান ধর্ম গ্রহণ করে এবং এক সন্দিহান পৌত্তলিক সমাজের কাছে ধর্মের ব্যাখ্যা তুলে ধরতে সক্ষম হয়ে ওঠে।
রোমান সাম্রাজ্যে খৃস্টধর্মকে ইহুদিবাদেরই একটা শাখা হিসাবে দেখা হয়েছিল, কিন্তু ক্রিশ্চানরা যখন স্পষ্ট জানিয়ে দিল যে তারা আর সিনাগগের সদস্য নয়, তখন তাদের মূল ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুতির মহাপাপ সংঘঠনকারী ধর্মান্ধদের একটা রিলিজিও’ হিসাবে তীব্র অসন্তোষের সঙ্গে দেখা হলো। রোমানদের রীতিনীতি কঠোরভাবে রক্ষণশীল ছিল: পরিবার প্রধান এবং আদি রীতিনীতিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখা হতো। প্রগতি’কে প্রায়ই ভবিষ্যতের দিকে নিঃশঙ্ক যাত্রা না ভেবে স্বর্ণযুগে প্রত্যাবর্তন হিসাবে দেখা হতো। অতীতের সঙ্গে ইচ্ছাকৃত সম্পর্ক চ্যুতিকে আমাদের সমাজের মতো সুপ্ত সৃজনশীল হিসাবে দেখা হতো না, আমাদের সামাজে যা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। নতুন আবিষ্কারকে বিপজ্জনক ও রাষ্ট্রদ্রোহ হিসাবে দেখা হয়েছে। রোমানরা । ঐতিহ্যের বিধিনিষেধ ছিন্নকারী গণ-আন্দোলনের ব্যাপারে প্রবলভাবে সন্দেহপ্রবণ ছিল। নাগরিকরা যাতে ধর্মীয় হাতুড়ে’দের হাতে না পড়ে সেজন্যে সতর্কতা অবলম্বন করত। অবশ্য তখন সাম্রাজ্য জুড়ে এক ধরনের অস্থিরতা ও উদ্বেগের আবহ বিরাজ করছিল। এক বিশাল সাম্রাজ্যে বসবাসের অভিজ্ঞতা প্রাচীন ঈশ্বর বা দেবতাদের যেন তুচ্ছ ও অপর্যাপ্ত করে তুলেছিল। লোকে ভিনদেশী ও অস্বস্তিকর সংস্কৃতির ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠেছিল। এক নতুন আধ্যাত্মিক সমাধানের সন্ধান করেছিল তারা। প্রাচ্যের কাল্টের আমদানি ঘটেছিল ইউরোপে: রাষ্ট্রের অভিভাবক রোমের প্রথাগত দেবতাদের পাশাপাশি আইসিস ও সিমিলে-এর মতো দেবতাদের উপাসনা চলছিল। সিই প্রথম শতাব্দীতে নতুন রহস্য-ধর্মগুলো নবীশদের নিষ্কৃতি ও পরজগতের জ্ঞান দেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল। কিন্তু এ সবটাই ধর্মীয় উৎসাহের কোনও প্রাচীন বিধানের প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়ায়নি। প্রাচ্যের দেবতারা প্রবল পরিবর্তন বা পরিচিত আচার-নিষ্ঠা ত্যাগের দাবি ওঠাননি বরং তাঁরা ছিলেন নবাগত সন্ন্যাসীর মতো, এক বৃহত্তর জগতের প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি ও বোধ জাগিয়ে তুলেছেন। আপনি যত ইচ্ছা ততগুলো রহস্য কাল্টে যোগ দিতে পারতেন কিন্তু শর্ত একটাই সেখানে প্রাচীন দেবতাদের অসম্মান করতে পারবেন না এবং মোটামুটিভাবে পরিমিতি বোধ বজায় রাখতে হবে, তাহলেই কোনও প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থায় রহস্য-ধর্মগুলোকে মেনে নেওয়া হতো এবং তা অঙ্গীভূত হয়ে যেত।
ধর্ম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বা জীবনের অর্থের সন্ধান দেবে, এটা কেউ আশা করেনি। সে ধরনের আলোকনের জন্যে দর্শনের দারস্থ হতো মানুষ। প্রাচীন কালের রোমান সাম্রাজ্যে মানুষ দেবতাদের পূজা বা উপাসনা করত বিপদে সাহায্য কামনা, রাষ্ট্রের জন্যে স্বর্গীয় আশীর্বাদ প্রার্থনা এবং অতীতের সঙ্গে ধারাবাহিকতার নিরাময়মূলক অনুভূতির জন্যে। ধর্ম ছিল ধারণার চেয়ে বরং কাল্ট ও আচারের ব্যাপর; এর ভিত্তি ছিল আবেগ, আদর্শ বা সচেতনভাবে গৃহীত তত্ত্ব নয়। বর্তমানকালেও এটা একেবারে অপরিচিত বিষয় নয়: আমাদের সমাজে অনেকেই আছে যারা ধর্মীয় প্রার্থনা সভায় যোগ দিলেও ধর্মতত্ত্বে আগ্রহী নয়, তারা অতি অদ্ভুত কিছু চায় না, পরিবর্তনের ধারণাকেও অপছন্দ করে। এরা মনে করে প্রতিষ্ঠিত বা প্রচলিত আচার-বিধিগুলো তাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত করে এবং একধরনের নিরাপত্তা বোধের যোগান দেয়। সারমন থেকে এরা অসাধারণ ধারণা বেরিয়ে আসার আশা করে না, শাস্ত্রারের পরিবর্তনে অস্বস্তি বোধ করে। মোটামুটি একইভাবে প্রাচীন যুগের শেষ ভাগে বহু পৌত্তলিকই পূর্বপুরুষদের মতো আদি দেবতাদের উপাসনা করতে ভালোবাসত। প্রাচীন আচার-আচরণ তাদের আত্মপরিচয়ের অনুভূতি যোগাত, স্থানীয় ঐতিহ্যের কথা মনে করিয়ে দিত এবং সবকিছু বরাবরের মতো চলার নিশ্চয়তা বলে মনে হতো। সভ্যতা যেন নাজুক অর্জন ছিল, একে অস্তিত্বের নিরাপত্তা বিধানকারী পৃষ্ঠপোষক দেবতাদের নির্বিচারের উপেক্ষা করে। হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া ঠিক হবে না। পূর্বপুরুষদের ধর্ম বিশ্বাস ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে কোনও কাল্ট প্রতিষ্ঠিত হতে দেখতে প্রচ্ছন্নভাবে শঙ্কিতই বোধ করত তারা। সুতরাং, খৃস্টধর্মের উভয় জগতেরই মন্দটুকু ছিল। ইহুদিবাদের মতো শ্রদ্ধাযযাগ্য প্রাচীনত্ব ছিল না এর, আবার আকর্ষণীয় পৌত্তলিকতাবাদের আচার-মালারও-যা সবার দৃষ্টিগ্রাহ্য ও উপভোগ্য ছিল-অভাব ছিল। এটা একটা প্রচ্ছন্ন হুমকিও ছিল, কেননা ক্রিশ্চানরা মাত্র একজন ঈশ্বরের কথা বলেছে, অন্য দেবতাদের আখ্যায়িত করছিল ভ্রান্তি হিসাবে। রোমান জীবনীকার গাইয়ুস সুতোনিয়াস (৭০-১৬০) খৃস্টধর্মকে অযৌক্তিক এবং উৎকেন্দ্রিক আন্দোলন মনে করেছেন, এটা একটি সুপারস্টিশিও নোভা এত্ প্রাভা-’নতুন’ বলেই এটি ‘খারাপ’। [৩১]
ধর্ম নয়, জ্ঞান ও আলোকনের জন্যে শিক্ষিত পৌত্তলিকরা দর্শমের দ্বারস্থ হতো। তাদের সাধু-সন্যাসি এবং জ্ঞানীরা হলেন প্রাচীনকালের প্লেটো, পিথাগোরাস এবং এপিকতেতাসের মতো দার্শনিকগণ। তাদের এমনকি ঈশ্বরের পুত্র হিসাবে দেখত তারা: উদাহরণ স্বরূপ, প্লেটোকে দেবতা অ্যাপোলো-পুত্র মনে করা হয়েছে। দার্শনিকগণ ধর্মের প্রতি শীতল শ্রদ্ধা বজায় রেখেছেন, তবে একে নিজেদের কর্মকাণ্ড হতে আবশ্যকীয়ভাবে আলাদা হিসাবেই দেখতেন। শ্বেত-প্রাসাদে অবস্থানকারী কেতাবী পণ্ডিত ছিলেন না ওঁরা তাঁদের একটা দায়িত্ব বা মিশন ছিল, তারা নিজস্ব মতবাদের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করে সমসাময়িকদের আত্মার মুক্তি ঘটাতে ব্যাকুল ছিলেন। সক্রেটিস এবং প্লেটো দুজনই তাদের দর্শনের ব্যাপারে ধার্মিক ছিলেন, তারা বৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিক গবেষণার ফলে বিশ্বজগতের মহিমা অবলোকন করার এক দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়েছেন বলে আবিষ্কার করেছিলেন। সিই প্রথম শতাব্দী নাগাদ তাই বুদ্ধিমান ও চিন্তাশীল ব্যক্তিরা জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে, অনুপ্রাণিত করার মতো আদর্শের খোঁজে ও নৈতিক প্রেরণার জন্যে তাদের শরণাপন্ন হয়। খৃস্টধর্মকে বর্বরোচিত বিশ্বাস বলে মনে হয়েছে। ক্রিশ্চান ঈশ্বরকে এক ভয়ঙ্কর আদিম উপাস্যের মতো মনে হয়েছে যিনি মানুষের জীবনে অযৌক্তিকভাবে বারবার হস্তক্ষেপে করে চলেন: তার সঙ্গে অ্যারিস্টটলদের মতো দার্শনিকদের সুদূরবর্তী পরিবর্তন রহিত ঈশ্বরের কোনওই মিল নেই। প্লেটো বা আলেকজান্দার দা গ্রেটের মতো মাপের মানুষকে ঈশ্বরের পুত্র ভাবা এক কথা, কিন্তু রোমান সাম্রাজ্যের কোনও এক অচেনা-অজানা কোণে অসম্মানজনক মৃত্যু বরণকারী এক সামান্য ইহুদিকে ঈশ্বর-পুত্র কল্পনা করা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
প্রাচীন যুগের শেষভাগে প্লেটোর মতবাদ সবচেয়ে জনপ্রিয় দর্শন ছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর নব্য প্লেটোনিস্টরা নৈতিকতা ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ প্লেটোর প্রতি নয়, বরং অতিন্দ্রীয়বাদী প্লেটোর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। তার শিক্ষা দার্শনিককে তাঁর প্রকৃত সত্তাকে দেহের বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে আপন সত্তাকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করতে এবং স্বর্গীয় জগতে আরোহণে সক্ষম। করতে ইহুদিদের উপকারে আসত। এক চমৎকার ব্যবস্থা ছিল এটা, ধারাবাহিকতা ও সমরূপতার ইমেজ হিসেবেই সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যবহার করেছে। সকল সত্তার ধারায় একেবারে চূড়ায় অবস্থানকারী সময়ের পরিবর্তনের আঁচড়ের বাইরে আপন চিন্তায় মগ্ন দ্য ওয়ান। প্রকৃত সত্তার পরিণতি হিসাবে দ্য ওয়ান হতেই সবকিছু অস্তিত্ব পেয়েছে: অনন্ত আকৃতিসমূহ দ্য ওয়ান হতে উৎসারিত হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে নিজস্ব বলয়ে সূর্য, নক্ষত্ররাজি এবং চাঁদকে সক্রিয় করেছে; সবশেষে দেবতাগণ যাদের এখন দ্য ওয়ানের দেবসভার মন্ত্রণা দাতা হিসাবে দেখা হচ্ছে, মানুষের পার্থিব জগতে স্বর্গীয় প্রভাব প্রেরণ করেছেন। প্লেটোনিস্টদের কোনও বর্বর উপাস্যের প্রয়োজন হয়নি যিনি অকস্মাৎ বিশ্ব সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বা মানুষের একটা ছোট দলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের জন্যে প্রতিষ্ঠিত স্তরকে অগ্রাহ্য করেছেন। কোনও ক্রুশবিদ্ধ মেসায়াহর মাধ্যমে ভীতিদায়ক মুক্তির প্রয়োজন ছিল না তার। সর্বপ্রাণে জীবনদানকারী ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে একজন দার্শনিক তার নিজস্ব যৌক্তিক শৃঙ্খলিত উপায়েই স্বর্গীয় জগতে আরোহণ করতে পারেন।
ক্রিশ্চানরা কীভাবে পৌত্তলিক সমাজে তাদের ধর্মবিশ্বাসের ব্যাখ্যা দিয়েছিল? একে দুটো আসনের মধ্যবর্তী একটা অবস্থা বলে ঠেকেছে, রোমান অর্থে ধর্মও মনে হয়নি, আবার দর্শনও নয়। তার ওপর, ক্রিশ্চানরা তাদের ‘বিশ্বাসের তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে থাকবে এবং সম্ভবত নিজেদের আলাদা বিশেষ ধরনের চিন্তাধারা গড়ে তোলার ব্যাপারে সচেতন ছিল না; এদিক দিয়ে পৌত্তলিক পড়শীদের সঙ্গে মিল ছিল তাদের। তাদের ধর্মের কোনও সুসমন্বিত ধর্মতত্ত্ব ছিল না, কিন্তু একে অঙ্গীকারের সযত্ন। বিকাশ হিসাবে অনেক সঠিকভাবে বর্ণনা করা যেত। তারা তাদের ‘ক্রীড’ আবৃত্তি করার সময় কতগুলো নির্দিষ্ট প্রস্তাবনায় সম্মতি প্রকাশ করত না। উদাহরণ স্বরূপ, ক্রীড়ার শব্দটি মনে হয় কোর দেয়ার (Cor Dare) থেকে এসেছে: যার অর্থ হৃদয় দেওয়া। যখন তারা ক্রীড়ো (Credo) শব্দটি উচ্চারণ করত (কিংবা গ্রিক ভাষার পিস্তেনো), তখন মননশীলতার চেয়ে বরং আবেগের প্রকাশ ঘটত। এভাবে সিলিসিয়ার বিশপ অভ মপসুয়েস্তিয়া থিয়োদর (৩৯২ থেকে ৪২৮) ধর্মান্তরিতদের কাছে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন:
যখন তুমি ঈশ্বরের সকাশে ‘আমি নিজেকে আবদ্ধ করলাম (Pisteuo) কথাটা উচ্চারণ করো, তোমরা বোঝাও তাকে তোমরা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকবে, কখনও তার সঙ্গে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করবে না, তোমরা তার সঙ্গে থাকবে এবং জীবন কাঠামোকে অন্য যেকোনও কিছুর চেয়ে উচ্চতর মনে। করবে এবং এমনভাবে তোমাদের আচার-আচরণকে গড়ে তুলবে যাতে তা তাঁর নির্দেশাবলীর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়।[৩২]
পরবর্তীকালের ক্রিশ্চানদের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে আরও তত্ত্বীয় বিবরণ দেওয়ার প্রয়োজন দেখা দেবে এবং তারা ধর্মের ইতিহাসে বিরল ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্কের আবেগের জন্ম দেবে। উদাহরণ স্বরূপ, আমরা দেখেছি, ইহুদিবাদে কোনও সুনির্দিষ্ট অর্থডক্সি ছিল না, বরং ঈশ্বর সম্পর্কিত সকল ধারণা আবিশ্যিকভাবে ব্যক্তিগত বিষয় ছিল। গোড়ার দিকে ক্রিশ্চানরা এই প্রবণতার অংশীদার ছিল।
অবশ্য দ্বিতীয় শতাব্দীতে খৃস্টধর্ম গ্রহণকারী কিছু সংখ্যক পৌত্তলিক তাদের ধর্মটি ঐতিহ্যের ধ্বংসাত্মক কোনও লঙ্ঘন নয় বোঝাতে অবিশ্বাসী পড়শীদের নিকটবর্তী হওয়ার প্রয়াস পায়; এসব অ্যাপোলোজিস্টের অন্যতম প্রধান ছিলেন জাস্টিন অভ সিসেরা (১০০-১৬৫)। ইনি ধর্মের জন্যে শাহাদাৎ বরণ করেছিলেন। অর্থের সন্ধানে তাঁর অস্থিরতার মাঝে আমরা সেসময়ের আধাত্মিক উৎকণ্ঠার ধারণা পাই। জাস্টিন তেমন গভীর বা মেধাবী চিন্তাবিদ ছিলেন না। খৃস্টধর্মে দীক্ষা নেওয়ার আগে তিনি স্টয়িকদের অনুগামী ভবঘুরে দার্শনিক ও পিথাগোরিয়ান ছিলেন, কিন্তু তাদের পদ্ধতির মূল কথা বুঝতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হন তিনি। দর্শনের প্রয়োজনীয় মেজাজ মেধার অভাব ছিল তার, কিন্তু কাল্টের উপাসনা ও আচার-আচরণের অতীত কিছু যেন প্রয়োজন ছিল। খৃস্টধর্মে তিনি তার সমাধান খুঁজে পান। তাঁর দুই ‘অ্যাপোলজিয়ায় (১৫০ এবং ১৫৫) তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ক্রিশ্চানরা স্রেফ প্লেটোকে অনুসরণ করছে, যিনি ঈশ্বর মাত্র একজন বলে উল্লেখ করে গেছেন। গ্রিক দার্শনিকগণ এবং ইহুদি পয়গম্বরদের সকলেই ক্রাইস্টের আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন-একটা যুক্তি যা তাঁর আমলের পৌত্তলিকদের প্রভাবিত করে থাকবে, কেননা ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতি নতুন আগ্রহ জন্ম নিয়েছিল তখন। তিনি আরও যুক্তি দেখিয়েছেন যে, জেসাস ছিলেন লোগোস বা স্বর্গীয় কারণের মানবরূপ, স্টয়িকরা যাঁকে কসমসের শৃঙ্খলার মাঝে দেখতে পেয়েছে গোটা ইতিহাস জুড়ে লোগোস বিশ্বে ক্রিয়াশীল ছিলেন, গ্রিক এবং হিব্রুদের সমানভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি অবশ্য এই উন্নত ধরনের ধারণাটির কোনও ব্যাখ্যা দেননিঃ একজন মানব সন্তান কী করে লোগোসের অবতার হতে পারেন, লোগোসই কি বাইবেলের প্রতীক বাণী বা প্রজ্ঞা? একক ঈশ্বরের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী ছিল?
অন্য ক্রিশ্চানরা আঁচ-অনুমানের প্রতি ভালোবাসা থেকে নয় বরং গভীর উদ্বেগকে প্রশমিত করার স্বার্থে আরও উগ্র ধর্মতত্ত্ব গড়ে তুলছিল। বিশেষ করে নসটিকোয়রা (জ্ঞানীগণ) স্বর্গীয় জগতের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে দর্শন ছেড়ে মিথলজির শরণাপন্ন হয়েছিল। তাদের মিথসমূহ ঈশ্বর এবং স্বর্গ সম্পর্কে অজ্ঞতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, যাকে দুর্ভোগ ও গ্লানির উৎস হিসাবে অনুভব করেছিল তারা। ১৩০ থেকে ২৬০ সাল সময় কালে আলেকজান্দ্রিয়ায় শিক্ষা দান করেছিলেন বাসিলিদেস ও তার সমসাময়িক ভ্যালেন্তিনাসরোমে শিক্ষা দানের জন্যে মিশর ত্যাগ করেছিলেন তিনি-এরা দুজনই প্রচুর অনুসারী পেয়েছেন এবং দেখিয়েছেন যে, খৃস্টধর্ম গ্রহণকারী অনেকের মাঝেই দিশাহারা, উনুল এবং প্রবলভাবে স্থানচ্যুতির অনুভূতি ক্রিয়াশীল ছিল।
অতি দুর্বোধ্য এক সত্তার কথা বলতে শুরু করেছিল নস্টিকোয়রা, তারা এর নাম দিয়েছিল গডহেড-যেহেতু এটাই আমরা যে নিম্নতর সত্তাকে “ঈশ্বর’ বলি তাঁর উৎস। এর সম্পর্কে আমাদের বলার মতো কিছুই নাই, কেননা আমাদের মনের সীমিত সাধ্যের বাইরে এর অবস্থান। ভ্যালেন্তিনাস গডহেডের। ব্যাখ্যা দিচ্ছেন এভাবে:
নিখুঁত এবং পূর্বাহ্নেই বিদ্যমান…অদৃশ্য ও নামহীন শূন্যতায় বাসরত: এটাই সূচনার শুরু এবং পূর্বপুরুষ এবং গভীরতা। এটা আধেয় এবং অদৃশ্য, চিরন্তন এবং অজাত, অনন্তকাল থেকে এটা শান্ত এবং গভীর নিঃসঙ্গ। এর সঙ্গে ছিল ভাবনা, যাকে মহিমা আর নৈঃশব্দ্যও বলা হয়। [৩৩]
মানুষ সবসময় এই পরম বা অ্যাবসোলিউট সম্পর্কে বহু জল্পনা-কল্পনা করেছে, কিন্তু তাদের কোনও ব্যাখ্যাই পর্যাপ্ত ছিল না। গডহেডকে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব, যা ‘ভালো’ও না আবার মন্দ’ও না; এমনকি একে ‘অস্তিত্ববান’ও বলা যাবে না। বাসিলিদেস শিক্ষা দিয়েছেন যে, একেবারে আদিতে কেবল ঈশ্বর নন, কেবল গডহেডই ছিলেন, সঠিক করে বলতে গেলে যা আসলে কিছুই না, কারণ আমাদের বোধগম্য অর্থে এর কোনও অস্তিত্ব ছিল না। [৩৪]
কিন্তু এই ‘কিছু না’ নিজেকে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করলেন, তিনি আর গভীর এবং নৈঃশব্দ্যে একাকী অবস্থান করে সন্তোষ বোধ করছিলেন না। তখন এর অতলান্ত গভীরতায় এক অন্তস্থ আন্দোলন ঘটে যার ফলে প্রাচীন পৌত্তলিক মিথলজিতে বর্ণিত উৎসারণগুলোর মতো ধারাবাহিক উৎসারণের সৃষ্টি হয়। এইসব উৎসারণের প্রথমটি ছিলেন ‘ঈশ্বর’, যাকে আমরা চিনি এবং যার কাছে আমরা প্রার্থনা করি। কিন্তু এমনকি ঈশ্বরও আমাদের অগম্য ছিলেন এবং আরও বিশদ হওয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। ফলস্বরূপ ঈশ্বর হতে জোড়ায় জোড়ায় আরও উৎসারণ ঘটতে থাকল, যার প্রত্যেকটি তার স্বর্গীয় গুণাবলীর প্রকাশ করেছে। ঈশ্বর লিঙ্গভেদের উর্ধ্বে, এনুমা এলিশের মতো, কিন্তু উৎসারিত প্রত্যেক জোড়ার একটি পুরুষ এবং অপরটি নারী-অধিকতর প্রথাগত একেশ্বরবাদের পৌরুষ বাচক পরিচয় দূর করার একটা প্রয়াস ছিল এটা। উৎসারিত প্রত্যেকটি জোড়া দুর্বলতর ও ক্ষীণকায় হয়ে ওঠে, কেননা এগুলো স্বর্গীয় উৎস হতে ক্রমশঃ দূরে সরে যাচ্ছিল। অবশেষে যখন এরকম ৩০টি উৎসারণ (বা ঈয়ন: যুগ) আবির্ভূত হওয়ার পর প্রক্রিয়াটির থেমে যায় এবং স্বর্গীয় জগৎ প্লেয়োমা (Pleroma) গঠিত হয়। নসটিকরা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য এক সৃষ্টিতত্ত্বের প্রস্তাবনা রাখছিল না, কেননা সবাই বিশ্বাস করত যে সৃষ্টি এধরনের যুগ, অপদেবতা ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় পরিপূর্ণ। সেইন্ট পল সিংহাসন, প্রাচীর (Dominations), সার্বভৌমত্ব ও ক্ষমতার কথা উল্লেখ করেছিলেন, অন্যদিকে দার্শনিকরা বিশ্বাস করতেন যে, এইসব অদৃশ্য শক্তি ছিল প্রাচীন দেবতা, এগুলোকে তারা মানুষ এবং দ্য ওয়ান-এর মাঝে মধ্যস্থতাকারীতে পরিবর্তন করেছেন।
একটা বিপর্যয়-এক আদিম পতনের ঘটনা ঘটে গিয়েছিল নসটিকরা যাকে নানাভাবে বর্ণনা করেছে। কেউ বলেছে সোফিয়া প্রেজ্ঞতা অগম্য গডহেড সম্পর্কে এক নিষিদ্ধ জ্ঞামের আকাভক্ষা করায় আশীর্বাদ বঞ্চিত হয়। তার মাত্রাছাড়া অনুমানের কারণে প্লেরোমা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পতিত হয় সে এবং তারই কষ্ট ও দুর্দশা বস্তুজগৎ গঠন করে। নির্বাসিত অবস্থায় দিশাহারা সোফিয়া স্বর্গীয় উৎসে ফিরে যাবার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সৃষ্টিজগতে ঘুরে বেড়িয়েছে। প্রাচ্য ও পৌত্তলিকদের ধারণার মিশেল এই বিশ্বাস নসটিকদের গভীর অনুভূতি প্রকাশ করে যে, আমাদের বিশ্ব কোনওভাবে স্বর্গের বিকৃতি; অজ্ঞতা এবং স্থানচ্যুতি থেকে যার সৃষ্টি। অন্য নসটিকরা শিক্ষা দিয়েছে যে ঈশ্বর’ বস্তুজগৎ সৃষ্টি করেননি, কেননা মৌল বস্তুর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক ছিল না। এটা কোনও এক ঈয়নের কাজ, যাকে তারা দোমিনেশন্স (Dominations) বা স্রষ্টা আখ্যায়িত করেছে। ঈশ্বরের প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে প্লেরোমার কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার আকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠেন ইনি। পরিণতিতে তাঁর পতন ঘটে এবং বিদ্রোহের প্রকাশ হিসাবে বিশ্ব সৃষ্টি করেন। ভ্যালেন্তিনাস যেমন ব্যাখ্যা করেছেন তিনি, জ্ঞানবিহীন থেকেই স্বর্গমণ্ডলী তৈরি করেছেন; মানুষের জ্ঞান ছাড়াই মানুষকে ছাড়াই আকার দিয়েছেন; পৃথিবীকে না বুঝেই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন।[৩৫] কিন্তু অন্য এক ঈয়ন লোগোস উদ্ধার করতে এগিয়ে এসেছিলেন এবং নারী ও পুরুষকে আবার ঈশ্বরের কাছে প্রত্যাবর্তনের পথ বাতলে দিতে জেসাসের দৈহিক রূপ ধরে পৃথিবীতে নেমেছেন। শেষ পর্যন্ত এধরনের খৃস্টধর্ম দমিত হবে, কিন্তু আমরা দেখব, বহু শতাব্দী পরে ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমরা আবার এ ধরনের মিথের দ্বারস্থ হচ্ছে, কারণ এটা অর্থডক্স ধর্মতত্ত্বের চেয়ে অনেক নির্ভুলভাবে তাদের ঈশ্বর সংক্রান্ত ধর্মীয় বোধ বা অনুভূতি প্রকাশ। করেছে।
এসব মিথ কখনওই সৃষ্টি ও মুক্তিলাভের আক্ষরিক বিবরণ হিসাবে বোঝানো হয়নি, স্রেফ অন্তর্গত সত্যের এক প্রতীকী প্রকাশ ছিল এগুলো। ‘ঈশ্বর’ এবং ‘প্লেরোমা’ ‘মহাশূন্যের কোনও বাহ্যিক বাস্তবতা নন বরং অন্তরে এর অস্তিত্ব অনুসন্ধান করতে হয়:
ঈশ্বর, সৃষ্টি এবং একই ধরনের অন্যান্য বিষয়ের অনুসন্ধান ত্যাগ কর।
নিজেকে দিয়েই শুরু করে তার সন্ধান। জেনে নাও তোমার অন্তরে কে সবকিছু তার বিষয় করে নিচ্ছে, আর বলছে, “আমার ঈশ্বর, আমার মন, আমার চিন্তা, আমার আত্মা, আমার দেহ। দুঃখ, আনন্দ, প্রেম আর ঘৃণার উৎস কোথায় জান। শেখ কীভাবে ইচ্ছা ছাড়াই কেউ দেখে, ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ভালোবাসে গভীরভাবে। এসব অনুসন্ধান কর, নিজের মাঝেই তাঁকে পাবে। [৩৬]
প্লেরোমা আত্মার একটা মানচিত্র তুলে ধরেছে। কোথায় খুঁজতে হবে তা। নসটিকের জানা থাকলে এমনকি এই অন্ধকার জগতেও স্বর্গীয় আলো অনুভব। করা সম্ভব: সোফিয়া কিংবা দেমিয়ার্জের (Demiurge) আদি পতনের সময় স্বর্গীয় আলোকচ্ছটাও প্লেরোমা থেকে ছিটকে বেরিয়ে বস্তুর মাঝে আটকা পড়ে গিয়েছে। নসটিক তার আপন আত্মার মাঝে স্বর্গীয় ছটার সন্ধান পেতে পারে, নিজের মাঝে অবস্থানরত স্বর্গীয় উপাদান সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে পারে, যা তাকে গন্তব্য দেখিয়ে দেবে।
নসটিকরা দেখিয়েছে যে, খৃস্টধর্মে নবদীক্ষিতদের অনেকেই ইহুদিবাদ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ঈশ্বর সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণায় সন্তুষ্ট ছিল না। তারা একজন দয়াময় উপাস্যের সৃষ্টি ‘ভালো’ হিসাবে পায়নি। একই ধরনের দ্বৈতবাদ এবং স্থানচ্যুতি মারসিয়নের (১০০-১৬৫) মতবাদকে বৈশিষ্ট্য দিয়েছিল। রোমে প্রতিদ্বন্দ্বী গির্জা প্রতিষ্ঠা করে প্রচুর অনুসারী পেয়েছিলেন মারসিয়ন। জেসাস বলেছিলেন, একটি ভালো গাছ ভালো ফলের জন্ম দেয়:[৩৭] পৃথিবী যেখানে মন্দ আর বেদনায় স্পষ্টভাবে পরিপূর্ণ সেখানে একজন ভালো ঈশ্বরের সৃষ্টি হয় কী করে? ইহুদি ধর্মগ্রন্থও মারসিয়নকে আতঙ্কিত করেছিল, যেখানে ন্যায়বিচারের উন্মাদনায় গোটা একটা জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্নকারী রুক্ষ কঠোর ঈশ্বরের বর্ণনা রয়েছে। তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে যুদ্ধের জন্যে উদগ্রীব’ ইহুদি-ঈশ্বরই ‘তার কর্মকাণ্ডে অস্থির এবং স্ববিরোধী’[৩৮] পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু জেসাস দেখিয়েছেন যে, আরেকজন ঈশ্বর ছিলেন ইহুদি ধর্মগ্রন্থে যার কথা কখনও উল্লেখ করা হয়নি। দ্বিতীয় এই ঈশ্বর ‘প্রসন্ন, কোমল আর স্রেফ ভালো এবং অনন্যসাধারণ।’[৩৯] তিনি পৃথিবীর বিচারক সম’ স্রষ্টার চেয়ে সম্পূর্ণই ভিন্ন। এই পৃথিবী যেহেতু তাঁর সৃষ্টি নয়, সুতরাং আমাদের উচিত তাঁকে ত্যাগ করা, কেননা এটা সেই দয়াময় উপাস্য সম্পর্কে আমাদের কিছুই জানাতে পারে না; আমাদের ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট প্রত্যাখ্যান করা উচিৎ, কেবল জেসাসের চেতনা বহনকারী নিউ টেস্টামেন্টের পুস্তকগুলোর দিকেই মনোযোগ দেওয়া উচিত। মারসিয়নের শিক্ষার জনপ্রিয়তা দেখায় তিনি এক সাধারণ উদ্বেগের জবাব যুগিয়েছিলেন। এক সময় এমনও মনে হয়েছিল যে তিনি বুঝি ভিন্ন চার্চের প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন। ক্রিশ্চানদের অভিজ্ঞতার এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় হাত দিয়েছিলেন তিনি; প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ক্রিশ্চানরা বস্তুজগতের সঙ্গে মানিয়ে নিতে অসুবিধা বোধ করেছে, এবং এখনও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক আছে যারা জানে না হিব্রু ঈশ্বর-এর কী অর্থ করা যায়।
উত্তর আফ্রিকার ধর্মতাত্ত্বিক তাতুলিয়ান (১৬০-২২০) অবশ্য দেখিয়েছিলেন যে মারসিয়নের ‘ভালো’ ঈশ্বরের সঙ্গে বাইবেলের ঈশ্বরের চেয়ে বরং গ্রিক দর্শনের ঈশ্বরের মিল বেশি। এই অটল উপাস্য যার সঙ্গে ক্রটিযুক্ত এই জগতের কোনও সম্পর্ক নেই, জেসাস ক্রাইস্টের ইহুদি ঈশ্বরের চেয়ে বর্ণিত অটল চালকের (Unmoved Mover)-এর অনেক কাছাকাছি। প্রকৃতপক্ষে, গ্রিকো-রোমান বিশ্বের অনেকেই বাইবেলিয় ঈশ্বরকে ভ্রান্তিময়, হিংস্র উপাস্য হিসাবে দেখেছে, যার উপাসনা প্রাপ্তির যোগ্যতা নেই। ১৭৮ সালের দিকে পৌত্তলিক দার্শনিক সেলসাস ক্রিশ্চানদের বিরুদ্ধে ঈশ্বর সম্পর্কে সংকীর্ণ আঞ্চলিক ধারণা পোষণ করার অভিযোগ এনেছিলেন। ক্রিশ্চানদের নিজস্ব বিশেষ প্রত্যাদেশের দাবি করার ব্যাপারটা তাঁকে হতবাক করেছিল: ঈশ্বর সকল মানুষের কাছেই সুলভ অথচ ক্রিশ্চানরা ছোট ছোট দলে জড়ো হয়ে ঘোষণা দেয়: ঈশ্বর এমনকি কেবল আমাদের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার জন্যে গোটা জগৎ, স্বর্গের সঞ্চালন পরিত্যাগ করেছেন, অগ্রাহ্য করেছেন বিশাল পৃথিবীকে।[৪০] রোমান কতৃপক্ষের হাতে নির্যাতিত হওয়ার সময় ক্রিশ্চানদের ধারণা রোমানদের বিশ্বাসের প্রতি ব্যাপক আক্রমণসূচক ছিল বলে তাদের বিরুদ্ধে নাস্তিক্যবাদের অভিযোগ আনা হয়েছিল। প্রচলিত দেবতাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ক্রিস্টানরা রাষ্ট্রের বিপদ ডেকে আনবে এবং নাজুক শৃঙ্খলাকে বিনষ্ট করবে ভেবে মানুষ শঙ্কিত হয়েছিল। খৃস্টধর্মকে সভ্যতার সাফল্যকে অগ্রাহ্যকারী এক বর্বর বিশ্বাস মনে হয়েছিল।
দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষ নাগাদ অবশ্য সত্যিকার অর্থে সংস্কৃত কিছু পৌত্তলিক খৃস্টধর্মে দীক্ষা নিতে শুরু করে। তারা গ্রিকো-রোমান আদর্শের সঙ্গে বাইবেলের সেমেটিক ঈশ্বরকে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়। এদের মাঝে প্রথম ছিলেন ক্লিমেন্ট অভ আলেকজান্দ্রিয়া (১৫০-২১৫), তিনি হয়তো ধর্মান্তরের আগে এথেন্সে দর্শন পাঠ করেছিলেন। ইয়াহ্ওয়েহ্ ও গ্রিক দার্শনিকদের ঈশ্বর যে একই, এব্যাপারে ক্লিমেন্টের মনে কোনও রকম সন্দেহ বা সংশয় ছিল নাঃ প্লেটোকে তিনি অ্যাটিক মোজেস বলেছেন। তবু জেসাস ও সেইন্ট পল উভয়েই হয়তো তার ধর্মতত্ত্বে অবাক মানতেন। প্লেটো ও অ্যারিস্টটলের ঈশ্বরের মতো ক্লিমেন্টের ঈশ্বর তার অ্যাপাথিয়া দিয়ে বৈশিষ্ট্যায়িত হয়েছেন: তিনি সম্পূর্ণ আবেগ কষ্টভোগ বা পরিবর্তনে অক্ষম। স্বয়ং ঈশ্বরের স্থিরতা ও নিস্পৃহতার অনুকরণ করার মাধ্যমে ক্রিশ্চানরা স্বর্গীয় জীবনে অংশ নিতে পারে। ক্লিমেন্ট জীবন যাপনের একটা নিয়ম প্রণয়ন করেছিলেন আশ্চর্যজনকভাবে যা র্যাবাইদের প্রণীত আচরণবিধির অনুরূপ, পার্থক্য একটাই স্টয়িক আদর্শের সঙ্গে এর মিল ছিল অনেক বেশি। একজন ক্রিশ্চানকে। জীবনের সব পর্যায়ে ঈশ্বরের অচঞ্চলতার অনুকরণ করতে হবে: তাকে অবশ্যই ঠিক হয়ে বসতে হবে, শান্তভাবে কথা বলতে হবে, শরীর কাঁপানো অট্টহাসি থেকে বিরত থাকতে হবে, এমনকি টেকুরও তুলতে হবে ধীরে। শান্ত থাকার এই অধ্যাবসায়ী চর্চার ভেতর দিয়ে ক্রিশ্চানরা অন্তর্গত বিপুল শান্তি সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠবে, যা আসলে তাদের মাঝে খোদিত ঈশ্বরেরই ইমেজ। ঈশ্বর। ও মানুষের মাঝে কোনও দূরত্ব নেই। ক্রিশ্চানরা একবার স্বর্গীয় জগতের উপযোগি হয়ে উঠলে তারা দেখবে এক স্বর্গীয় সঙ্গী আমাদের সঙ্গে একই ঘরে বাস করছে, টেবিলে বসছে, আমাদের জীবনের সকল নৈতিক প্রয়াসে অংশ নিচ্ছে। [৪১]
তারপরেও ক্লিমেন্ট বিশ্বাস করতেন জেসাসই ঈশ্বর ছিলেন। জীবিত ঈশ্বর, যিনি কষ্ট সয়েছেন এবং উপাসিত হচ্ছেন।[৪২] তিনিই ‘তাদের পা ধুইয়ে তোয়ালে দিয়ে মুছে দিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন বিশ্বজগতের প্রভু ও নিরহঙ্কার ঈশ্বর’[৪৩] ক্রিশ্চানরা ক্রাইস্টের অনুকরণ করলে তারাও স্বর্গীয়, অপাপবিদ্ধ ও যন্ত্রণাবোধহীন উপাস্যে পরিণত হবে। প্রকৃতই ক্রাইস্ট স্বর্গীয় লোগোস ছিলেন যিনি মানব রূপ গ্রহণ করেছেন যাতে তোমরা একজন মানুষের কাছ থেকে ঈশ্বরে পরিণত হওয়ার উপায় শিখতে পার।[৪৪] পশ্চিমে বিশপ অভ লিয়ন্স ইরেনিয়াস (১৩০-২০০) একই ধরনের মতবাদ শিক্ষা দিয়েছিলেন। জেসাস ছিলেন স্বর্গীয় কারণ লোগোসের অবতার। তিনি মানব রূপ নেওয়ার পর মানুষের উন্নতির প্রত্যেকটা স্তরকে পবিত্র করেছেন এবং ক্রিশ্চানদের জন্যে আদর্শে পরিণত হয়েছেন। একজন অভিনেতা যেভাবে তার অভিনীত চরিত্রটির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় বলে বিশ্বাস করা হয়, তাদেরও ঠিক সেভাবে তার অনুকরণ করতে হবে; তাহলেই তাদের মানবীয় সম্ভাবনা পূর্ণতা পাবে।[৪৫] ক্লিমেন্ট এবং ইবেনিয়াস তাদের নিজস্ব সময় ও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যসমূহের সঙ্গে ইহুদি ঈশ্বরকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছিলেন। যদিও পয়গম্বরদের ঈশ্বরের-যার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তার করুণরস (Pathos) এবং আক্রম্যতা (Vulnerability)-সঙ্গে তেমন মিল ছিল না, তবু ক্লিমেন্টের অ্যাপ্যাথিয়া মতবাদ ঈশ্বর সম্পর্কে ক্রিশ্চানদের ধারণার মৌল বিষয়ে পরিণত হবে। গ্রিক বিশ্বে আবেগ ও পরিবর্তনের চক্র হতে ঊর্ধ্বে উঠে অতিমানবীয় স্থৈর্যের আকাক্ষা করেছে মানুষ। অন্তর্গত বৈপরীত্য সত্ত্বেও এই আদর্শ টিকে গেছে।
ক্লিমেন্টের ধর্মতত্ত্ব জটিল প্রশ্নের জবাব দেয়নি। একজন সাধারণ মানুষ কী করে লগোস বা স্বর্গীয় কারণ হয়ে থাকতে পারে? জেসাস স্বর্গীয় ছিলেন বলে ঠিক কী বোঝানো হয়েছে? লগোস ও ‘ঈশ্বর পুত্র’ কী একই আর হেলেনিক বিশ্বের এই ইহুদি উপাধি কী অর্থ প্রকাশ করেছে? একজন যন্ত্রণাবোধহীন ঈশ্বর কী করে জেসাসের মাঝে কষ্ট ভোগ করতে পারেন? ক্রিশ্চানরা কীভাবে বিশ্বাস করে যে তিনি স্বর্গীয় সত্তা ছিলেন, আবার একই সময়ে জোর দিয়ে বলে যে ঈশ্বর মাত্র একজন? তৃতীয় শতাব্দীতে ক্রিশ্চানরা এসব প্রশ্নের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠতে শুরু করে। শতাব্দীর প্রথম বছরগুলোয় রোমে সাবেলিয়াস নামে প্রায় অখ্যাত এক ব্যক্তি মত প্রকাশ করেন যে, বাইবেলিয় পরিভাষার ‘পিতা, ‘পুত্র’ এবং ‘আত্মাকে’ নাটকের চরিত্র রূপায়নের জন্যে অভিনেতাদের মুখোশ (পারসোনা)-এর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। অভিনেতারা নাটকীয় চরিত্র গ্রহণ ও তাদের কণ্ঠস্বর দর্শকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে মুখোশের। আশ্রয় নেয়। সুতরাং একক ঈশ্বর এভাবেই জগতের ব্যাপারে বিভিন্ন পারসোনা গ্রহণ করেছিলেন। সাবেলিয়াস কিছু অনুসারী আকৃষ্ট করেছিলেন বটে কিন্তু অধিকাংশ ক্রিশ্চান তার তত্ত্বে বিষণ্ণ সাড়া বোধ করেছে: এখানে বোঝানো হয়েছে যন্ত্রণাবোধের অতীত ঈশ্বর পুত্রের ভূমিকা পালনের সময় কোনও ভাবে কষ্ট সয়েছেন। এ ধারণা একেবারে অগ্রহণযোগ্য বলে আবিষ্কার করেছে তারা। কিন্তু তারপরেও (২৬০ থেকে ২৭২) পল অভ সামোসাতা বিশপ অভ অ্যান্টিওক পর্যন্ত যখন বললেন যে জেসাস একজন সামান্য মানুষ ছিলেন যার মাঝে মন্দিরে থাকার মতো ঈশ্বরের বাণী এবং প্রজ্ঞার বাস ছিল-~-একেও একই রকম আন-অর্থডক্স বিবেচনা করা হলো। ২৬৪তে অ্যান্টিকের এক সিনদে পলের ধর্মতত্ত্বের নিন্দা করা হয়েছিল, যদিও রানি জেনোরিয়া অভ পালমিরার সমর্থন নিয়ে তিনি তাঁর পদ টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হন। জেসাস স্বর্গীয় ছিলেন, ক্রিশ্চানদের এই বিশ্বাসকে একই রকম জোরাল ঈশ্বর মাত্র একজন বিশ্বাসের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা বেশ কঠিন হয়ে উঠছিল।
২০২ সালে বিশপ অভ জেরুজালেমের সেবায় একজন যাজক হতে ক্লিমেন্ট আলেকজান্দ্রিয়া ত্যাগ করে কাতেসেতিকাল শিক্ষালয়ে গেলে তাঁরই এক মেধাবী ছাত্র তরুণ অরিগেন তাঁর স্থলাভিসিক্ত হন। তখন তাঁর বয়স ছিল আনুমানিক বিশ বছর। তরুণ অরিগেন প্রবলভাবে বিশ্বাস করতেন যে শাহাদাৎ বরণই স্বর্গে যাবার উপায়। চার বছর আগে তাঁর বাবা লেনিদেস (Leonedes) অ্যারিনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন, অরিগেন তাঁর সঙ্গে মিলিত হতে চেয়েছিলেন। অবশ্য পোশাক লুকিয়ে রেখে তাকে বাঁচিয়েছিলেন তাঁর মা। ক্রিশ্চান জীবনের অর্থ জগতের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, এই বিশ্বাস নিয়ে শুরু করেছিলেন অরিগেন; কিন্তু পরে এই অবস্থান বদল করে ক্রিশ্চান প্লেটোনিজমের একটা রূপ খাড়া করেন তিনি। মাঝে এক অনতিক্রম্য দূরত্ব দেখার বদলে কেবল শাহাদাৎ বরণের মতো চরম স্থানচ্যুতি দিয়ে মানুষ ও ঈশ্বরকে সম্পর্কিত করা সম্ভব। অরিগেন এমন এক ধর্মতত্ত্বের অবতারণা করেন যেখানে বিশ্বজগতের সঙ্গে ঈশ্বরের ধারাবাহিকতার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। তার আধ্যাত্মিকতা ছিল আলো, আশাবাদ ও আনন্দের। একজন ক্রিশ্চান পর্যায়ক্রমে সত্তার বা অস্তিত্বের ধাপ বেয়ে তার স্বাভাবিক উপাদান ও গন্তব্য ঈশ্বরের নিকটবর্তী হতে পারে।
প্লেটোনিস্ট হিসাবে ঈশ্বর ও আত্মার মাঝে সম্পর্কের ব্যাপারে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন অরিগেন: স্বর্গ সম্পর্কে জ্ঞান মানুষের স্বাভাবিক। বিশেষ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে একে আবার সজাগ ও জাগিয়ে তোলা যায়। সেমেটিক ঐশীগ্রন্থের সঙ্গে নিজ প্লেটোনিক দর্শনের সমন্বয়ের জন্যে বাইবেল পাঠের এক প্রতীকী পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন অরিগেন। এভাবে মেরির গর্ভে ক্রাইস্টের ভার্জিন বার্থকে প্রাথমিকভাবে আক্ষরিক অর্থে নেওয়া যাবে না, বরং আত্মায় স্বর্গীয় প্রজ্ঞার জন্ম হিসাবে দেখতে হবে। নসটিকদের কিছু ধারণাও গ্রহণ করেছিলেন তিনি। মূলত আধ্যাত্মিক জগতের সকল সত্তা স্বর্গীয় বাণী ও প্রজ্ঞায় লোগোস নিজেকে প্রকাশকারী অতিপ্রাকৃত ঈশ্বরেরই ধ্যান করেছিল। কিন্তু এই নিখুঁত ধ্যানে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে স্বর্গীয় জগৎ থেকে দেহে পতিত হয়, দেহ তাদের পতন থামিয়ে দেয়। অবশ্য সব আশা তিরোহিত হয়ে যায়নি। মৃত্যুর পরেও অব্যাহত থাকবে এমন এক দীর্ঘ অবিরাম যাত্রায় আত্মা আবার ঈশ্বরের কাছে যেতে পারবে। এটা ক্রমশঃ দেহের শৃঙ্খল ছাড়িয়ে লিঙ্গভেদের ঊর্ধ্বে উঠে খাঁটি আত্মায় পরিণত হবে। ধ্যান (থিয়োরিয়া)-এর মাধ্যমে আত্মা ঈশ্বরের জ্ঞানে (নসিস) সমৃদ্ধ হবে, যা একে পরিবর্তন করে চলবে যতক্ষণ না, প্লেটো স্বয়ং যেমন শিক্ষা দিয়েছেন, নিজেই স্বর্গীয় রূপ নেয়। ঈশ্বর গভীর রহস্যময়, আমাদের মানবীয় ভাষা বা ধারণা কোনওটাই তাকে যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু আত্মা যেহেতু ঈশ্বরের স্বর্গীয় প্রকৃতির অংশীদার; সুতরাং, ঈশ্বরকে বোঝার ক্ষমতা রয়েছে তার। লোগোসের ধ্যানমগ্ন হওয়া আমাদের স্বভাবজাত, কেননা সকল আধ্যাত্মিক সত্তা (লোগিকোই) আদিতে পরস্পরের সমান ছিল। যখন তাদের পতন ঘটে, কেবল জেসাস ক্রাইস্টের মনই স্বর্গীয় জগতে রয়ে গিয়ে পরম সন্তোষের সঙ্গে ঈশ্বরের বাণী নিয়ে ধ্যান করছিলেন এবং আমাদের নিজস্ব আত্মা ছিল তাঁরই আত্মার সমান। মানুষ জেসাসের ঐশ্বরিকতায় বিশ্বাস একটা স্তর বা পর্যায় মাত্র যা আমাদের যাত্রা পথে সাহায্য করবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা ঈশ্বরকে সামনা সামনি দেখার পর তা দুয়ে হয়ে উঠবে।
নবম শতাব্দীতে অরিগেনের কোনও কোনও ধারণাকে ধর্মদ্রোহী বলে নিন্দা জানাবে চার্চ। অরিগেন বা ক্লিমেন্ট কেউই বিশ্বাস করেননি যে, ঈশ্বর শূন্য হতে জগৎ সৃষ্টি করেছেন যা পরে অর্থডক্স ক্রিশ্চান মতবাদে পরিণত হয়। জেসাসের অলৌকিতা ও মানুষের মুক্তি সম্পর্কিত অরিগেনের ধারণা স্পষ্টই পরবর্তীকালের ক্রিশ্চান শিক্ষার সঙ্গে যায় নাঃ ক্রাইস্টের মৃত্যুর ফলে আমরা। ‘রক্ষা পেয়েছি বলে বিশ্বাস করতেন না তিনি, বরং তার বিশ্বাস ছিল আমরা আমাদের নিজস্ব শক্তিতেই ঈশ্বরের দিকে উত্থিত হব। আসল কথা হচ্ছে অরিগেন ও ক্লিমেন্ট তাদের ক্রিশ্চান-প্লেটোনিজম শিক্ষা দেওয়ার সময় কোনও আনুষ্ঠানিক মতবাদ ছিল না। ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন কিনা কিংবা মানুষ কীভাবে স্বর্গীয় হতে পারে নিশ্চিত করে জানত না কেউ। চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর অস্থির ঘটনাপ্রবাহ এক যন্ত্রণাদায়ক সংগ্রামের পরেই কেবল অর্থডক্স বিশ্বাসের সংজ্ঞার পথে নিয়ে যাবে।
অরিগেন সম্ভবত তার স্ব-নপুংসীকরণের জন্যে বিখ্যাত হয়ে আছেন। গস্পেলে জেসাস বলেছেন, কেউ কেউ স্বর্গীয় রাজ্যের স্বার্থে নিজেদের পুরুষত্ব বিনষ্ট করেছে। একথা অক্ষরে অক্ষরে বিশ্বাস করেছেন অরিগেন । প্রাচীন কালের শেষ পাদে পুরুষত্ব বিনষ্টকরণ বেশ চালু একটা ব্যাপার ছিল; অরিগেন অবশ্য নিজের ওপর ছুরি চালিয়ে বসেননি, কিংবা তাঁর এ সিদ্ধান্তটি সেইন্ট জেরোমি (৪৪২-৪২০)-দের মতো কোনও কোনও পশ্চিমা ধর্মতাত্ত্বিকের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হওয়া যৌনতার প্রতি কোনও বিকারগ্রসূত ঘৃণা থেকেও সৃষ্টি হয়নি। বৃটিশ পণ্ডিত পিটার ব্রাউন মত প্রকাশ করেছেন, এটা হয়তো তাঁর মানবীয় অবস্থার অনিশ্চয়তার মতবাদ তুলে ধরার প্রয়াস ছিল, যাকে আত্মা কর্তৃক অচিরেই ছাপিয়ে যাবার কথা। দৃশ্যত, ঈশ্বর যেহেতু নারী বা পুরুষ কোনওটাই নন, তাই স্বর্গীয়করণের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় লিঙ্গের মতো অসংখ্য উপাদান পেছনে ফেলে যেতে হবে। যে কালে লম্বা দাড়ি (প্রজ্ঞা বা জ্ঞানের প্রতীক) দার্শনিকদের বৈশিষ্ট্য ছিল সে যুগে অরিগেনের মসৃণ গাল এবং উচ্চ কণ্ঠস্বর হয়তো বা চমকপ্রদ একটা দৃশ্য ছিল।
আলেকজান্দ্রিয়ায় অরিগেনের পুরোনো শিক্ষক অমোনিয়াম সাক্কাসের কাছে শিক্ষা নিয়েছিলেন প্রটিনাস (২০৫-২৭০) এবং পরে ভারতে আসার সুযোগ পাওয়ার আশায় রোমান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ভারতে পড়াশোনা করতে উদগীব ছিলেন তিনি। দুর্ভাগ্যক্রমে এই অভিযানের দুঃখজনক। পরিসমাপ্তি ঘটে, অ্যান্টিওকে পালিয়ে যান প্লটিনাস। পরবর্তী সময়ে রোমে এক উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন দার্শনিক মতবাদের প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। নিজের ব্যাপারে তেমন প্রচারমুখী ছিলেন না তিনি, এমনকি জন্মদিনও পালন করতেন না, তাই তাঁর সম্পর্কে আমাদের জানার পরিধি খুব সামান্য। সেলসাসের মতো প্লটিনাসও খৃস্টধর্মকে সম্পূর্ণ আপত্তিকর বিশ্বাস বিবেচনা করেছিলেন, কিন্তু তারপরেও ঈশ্বরের তিনটি ধর্মের অসংখ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। সুতরাং ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর দর্শনের একটু বিস্তৃত আলোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। প্লটিনাসকে একটা জলাধার হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে: তিনি গ্রিক ধ্যান ধারণার ৮০০ বছরের মূল ধারা আত্মস্থ করে তাকে এমন এক রূপে প্রকাশ করেছেন যা আমাদের শতাব্দীর টি. এস. এলিয়ট এবং হেনরি বার্গসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরও প্রভাবিত করে গেছে। প্লেটোর ধারণার ওপর ভিত্তি করে প্লটিনাস সত্তাকে উপলব্ধি করার একটা পদ্ধতি গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু, মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খোঁজায় আগ্রহী ছিলেন না। তিনি বা জীবনের ভৌত উৎসও ব্যাখ্যা করারও প্রয়াস পাননি। একটা বস্তুনিষ্ঠ ব্যাখ্যার জন্যে মহাশূন্যের দিকে তাকানোর বদলে প্লটিনাস অনুসারীদের নিজেদের মাঝে আশ্রয় নিতে বলেছেন এবং মননের গভীরে অনুসন্ধান চালানোর তাগিদ দিয়েছেন।
মানুষ একটা ব্যাপারে সচেতন যে তাদের বর্তমান অবস্থায় কোথাও গড়মিল আছে; নিজেকে নিয়ে বা অপরের বেলায় বেকায়দা অবস্থানে আছে বলে মনে হয় তাদের, অন্তস্থ প্রকৃতির সঙ্গে যোগাযোগহীন এবং দিশাহারা। দ্বন্দ্ব ও সারল্যের ঘাটতি যেন আমাদের অস্তিত্বের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। তা সত্ত্বেও আমরা ক্রমাগত বহুমাত্রিক ঘটনাবলীকে একসূত্রে গাথতে চাইছি এবং সুশৃঙ্খল সমগ্রে পরিণত করতে চাইছি। আমরা যখন কোনও ব্যক্তির দিকে চোখ ফেরাই একটা পা, একটা হাত, তারপর আরেকটা হাত, মাথা, এভাবে দেখি না, বরং আপনাআপনি এসব উপাদানকে একজন পরিপূর্ণ মানুষের মাঝে সংগঠিত করি। একতার জন্যে এই আকাক্ষা আমাদের মানসিক কাজের ধারায় মৌলিক বিষয়। আমাদের অবশ্যই, পুঁটিনাসের বিশ্বাস অনুযায়ী, বস্তুনিচয়ের মূলসুরের প্রতিফলন ঘটাতে হবে। বাস্তবতার অন্তর্নিহিত সূত্র আবিষ্কারের জন্যে আত্মাকে অবশ্যই প্লেটোর পরামর্শ অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে হবে, পরিশুদ্ধতার একটা পর্যায় অতিক্রম করতে হবে এবং ধ্যানে (থিয়োরিয়া) মগ্ন হতে হবে, বিশ্বজগৎ ছাড়িয়ে, অনুভবের জগৎ পার হয়ে এমনকি বুদ্ধি বা মননের সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে উঠে বস্তুর বা সত্তার অন্তস্থল দেখার জন্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। তবে এটা আমাদের বস্তুর কোনও সত্তা অভিমুখে উত্তরণ নয় বরং মনের গহীন গভীরে ডুব দেওয়া। একে বলা যায় অভ্যন্তরে আরোহন।
পরম সত্তা এক আদিম একক, প্লটিনাস যাকে দ্য ওয়ান বলেছেন। প্রতিটি বস্তু অস্তিত্বের জন্যে এই সক্ষম সত্তার কাছে ঋণী। দ্য ওয়ান যেহেতু নিজেই সরল, এর সম্পর্কে বলার কিছু নেই: এর এসেন্স বা মূলসুর হতে সুস্পষ্ট পার্থক্য সম্পন্ন এমন কিছু নেই যে সাধারণ বর্ণনা সম্ভবপর করে তুলবে। স্রেফ এটা ছিল। স্বভাবতই দ্য ওয়ান নামহীন। আমরা ‘দ্য ওয়ান’ সম্পর্কে ইতিবাচক চিন্তা করতে চাইলে, ব্যাখ্যা দিয়েছেন পুটিনাস, সেক্ষেত্রে ‘নীরবতাতেই অনেক বেশি সত্যের সন্ধান মিলব ।’[৪৬] এর অস্তিত্ব আছে, তাও বলতে পারব না আমরা, কেননা স্বত্তা স্বয়ং হওয়ায়, কোনও বস্তু নয়, বরং সকল বস্তু থেকে ভিন্ন।’[৪৭] প্রকৃতপক্ষেই, ব্যাখ্যা করেছেন প্রটিনাস, এটা ‘সবকিছু, আবার কিছুই না, অস্তিত্বমান কোনও বস্তু হতে পারে না এটা, তারপরও এটাই সব।’[৪৮] আমরা দেখব, এই ধারণাটি ঈশ্বরের ইতিহাসে একটা স্থির সুরে পরিণত হবে।
কিন্তু যেহেতু ঈশ্বর সম্পর্কে আমরা কিছুটা ধারণা লাভ করতে পারি, তাই এই নীরবতা পূর্ণাঙ্গ সত্য হতে পারে না বলে যুক্তি দেখিয়েছেন প্রটিনাস। দ্য ওয়ান তার দুর্ভেদ্য অস্পষ্টতার চাদরে আড়াল হয়ে থাকলে এটা সম্ভব হতো না। দ্য ওয়ান নিশ্চয়ই নিজেকে ছাড়িয়ে আমাদের মতো অপূর্ণ সত্তার কাছে নিজেকে বোধগম্য করে তুলতে আপন সারল্যের ঊর্ধ্বে উঠেছেন। এই স্বর্গীয় ঊর্ধ্বরোহণকে ‘পরম আনন্দ’ হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। এরকম বলার কারণ, এটা খুঁতহীন মহত্বের দিক দিয়ে ‘আপনাকে ছাড়িয়ে যাওয়া’: ‘কোনও চাওয়া নেই, কোনও কিছুর ওপর অধিকার নেই, কোনও অভাব নেই, দ্য ওয়ান নিখুঁত এবং রূপকার্থে, তিনি ছাপিয়ে গেছেন আর এর প্রাচুর্যই নতুনের সৃষ্টি করেছে।’[৪৯] এসবের মাঝে ব্যক্তিগত কিছুই ছিল না; প্লটিনাস দ্য ওয়ানকে ব্যক্তিত্বসহ সকল মানবীয় প্রকৃতির উর্ধ্বে চিন্তা করেছেন। চরম সরল এই ‘উৎস’ থেকে অস্তিত্বশীল সকল কিছুর ব্যাখ্যার করার জন্যে তিনি উৎসারণের প্রাচীন মিথের শরণাপন্ন হয়েছেন-এই প্রক্রিয়াকে বর্ণনা করার লক্ষ্যে কিছু উপমার ব্যবহার করেছেন: এ যেন সূর্যের আলো বা আগুন থেকে বিকিরিত তাপের মতো, আপনি যত উত্তাপের কেন্দ্রের দিকে যাবেন ততই উত্তপ্ততর হয়ে ওঠে। প্রটিনাসের খুব প্রিয় একটা উপমা ছিল বৃত্তের কেন্দ্রের সঙ্গে দ্য ওয়ানের তুলনা, যাতে ভবিষ্যতের সকল সম্ভাব্য বৃত্তের সম্ভাবনা রয়েছে। জলাশয়ের পানিতে পাথর ফেললে সৃষ্টি হওয়া তরঙ্গের সঙ্গে মিল আছে এর। এনুমা এলিশের মতো মিথে উল্লিখিত উৎসারণের বিপরীতে-যেখানে দেবতাদের মতো জোড়া থেকে উদ্ভূত অপর জোড়া অধিকতর নিখুঁত এবং কার্যকর হয়ে ওঠে-পুঁটিনাসের প্রকল্পের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি ছিল একেবারে উল্টো। নসটিকদের মিথের মতো কোনও বস্তু এর উৎস দ্য ওয়ান থেকে যত দূরে সরে আসবে, সেটা ততই দুর্বল হয়ে পড়বে।
দ্য ওয়ান থেকে বিকিরিত প্রথম দুটি উৎসারণকে স্বর্গীয় হিসাবে দেখেছেন প্লটিনাস, কেননা এগুলো ঈশ্বরকে জানতে ও ঈশ্বরের জীবনধারায় আমাদেরকে অংশগ্রহণে সক্ষম করে তোলে। দ্য ওয়ানের সঙ্গে মিলে এগুলো এক স্বর্গীয় এয়ী গড়ে তুলেছে যা ট্রিনিটির চুড়ান্ত ক্রিশ্চান সমাধানের মোটামুটিভাবে বেশ কাছাকাছি। প্রটিনাসের প্রকল্পের প্রথম উৎসারণ, মন প্লেটোর ধারণা জগতের অনুরূপ। দ্য ওয়ানের সারল্যকে বোধগম্য করেছে এটা; কিন্তু জ্ঞান এখানে সহজাত ও প্রত্যক্ষ । এটা গবেষণা ও যুক্তি প্রয়োগের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কষ্টকর উপায়ে অর্জিত নয়, বরং আমাদের অনুভূতি যেমন কোনও বস্তু সামগ্রীকে বুঝে নেয়, সেভাবে আত্মস্থ হয়েছে। আত্ম উৎসারিত হয় মন থেকে ঠিক যেমন মনের উৎসারণ দ্য ওয়ান থেকে । এটা পূর্ণাঙ্গতার চেয়ে খানিকটা দূরবর্তী, এই পর্যায়ে জ্ঞান কেবল অসংলগ্নভাবে সংগ্রহ করা যাবে, ফলে তাতে পরম সারল্য ও সামঞ্জস্যতার ঘাটতি হয় । আত্মা আমাদের চেনা বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই: বাকি সমস্ত ভৌত ও আধ্যাত্মিক অস্তিত্বের উৎসারণ ঘটে আত্মা থেকে যা। আমাদের জগতকে এর যেটুকু ঐক্য ও সামঞ্জস্যতা আছে তার যোগান দেয় । এখানে আবার একটা বিষয় জোরের সঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে প্লটিনাস দ্য ওয়ান, মন ও আত্মার ত্রয়ীকে ‘মহাশূন্যে ঈশ্বর হিসাবে কল্পনা করেননি। স্বর্গ সকল অস্তিত্বের সম্মিলন। ঈশ্বর সর্বেসর্বা এবং নিম্নস্তরের সত্তা ততক্ষণই টিকে থাকে যতক্ষণ তারা দ্য ওয়ানের পরম সত্তায় অংশ নেয়।[৫০]
দ্য ওয়ানের দিকে প্রত্যাবর্তনের এক সমরূপ চলিষ্ণুতায় বহির্মুখী উৎসারণ রহিত হয়। আমাদের মনের কার্যধারা হতে আমরা যেমন জানি যে দ্বন্দ্ব ও বহুমাত্রিকতা থেকে অসন্তোষের কারণে সকল সত্তাই ঐক্যের আকাক্ষা করে আবার দ্য ওয়ানের কাছে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু এটা বাহ্যিক সত্তার দিকে আরোহণ নয়, বরং মনের গভীরে অভ্যন্তরীণ অবতরণ। আত্মাকে অবশ্যই হৃত সারল্য ফিরে পেতে হবে, ফিরে যেতে হবে তার প্রকৃত সত্তায়। যেহেতু সকল আত্মাই একই সত্তা দ্বারা সজীব হয়েছে, সুতরাং মানুষকে একজন শিল্পীকে ঘিরে থাকা কোরাসের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। বিশেষ কোনও ব্যক্তির সুরভঙ্গে অসাম্য ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে, কিন্তু সবাই পরিচালকের দিকে মনোনিবেশ করলে গোটা সমাজ লাভবান হবে, কেননা, ‘ওরা তখন যেভাবে গান গাওয়া উচিত সেভাবেই গাইবে এবং প্রকৃতই তার সঙ্গে থাকবে।’[৫১]
দ্য ওয়ান কঠোরভাবে নৈর্ব্যক্তিক; এর কোনও লিঙ্গ পরিচয় নেই এবং আমাদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। একইভাবে ব্যাকরণগতভাবে মন পুরুষবাচক এবং আত্মা (Psyche) নারীবাচক শব্দ, এখানে লিঙ্গের ভারসাম্য ও সমতা সম্পর্কিত পৌত্তলিকদের প্রাচীন দর্শন রক্ষা করার ক্ষেত্রে প্রটিনাসের আগ্রহ প্রকাশিত হয়ে থাকতে পারে। বাইবেলিয় ঈশ্বরের বিপরীতে, এটা আমাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বাড়ির পথ দেখাতে আসে না, আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে না, কিংবা ভালোবাসে না, কিংবা নিজেকে আমাদের সামনে প্রকাশ করে না। নিজ সম্পর্কে ছাড়া অন্য কিছুর জ্ঞান নেই এর।[৫২] তারপরেও মানব আত্মা কখনও কখনও দ্য ওয়ানের উপলব্ধিতে আনন্দে উদ্বেলিত হয়। প্রটিনাসের দর্শন যৌক্তিক প্রক্রিয়া নয় বরং এক আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান ছিল:
এখানে আমাদের, আমাদের দিক থেকে, সবকিছু একপাশে সরিয়ে রেখে কেবল এর দিকে মনোনিবেশ করে আমাদের সকল বন্ধন ছেড়ে তাতেই পরিণত হতে হবে, এখান থেকে পলায়নের জন্যে অবশ্যই আমাদের তাড়াহুড়ো করতে হবে, আমাদের সকল সত্তা দিয়ে ঈশ্বরকে আলিঙ্গন করার জন্যে আমাদের পার্থিব বন্ধন নিয়ে অধৈর্য হতে হবে, যেন আমাদের কোনও অংশই ঈশ্বরের থেকে সরে না থাকে। সেখানে হয়তো আমরা ঈশ্বরকে দেখতে পাব এবং বিধি যেমন প্রকাশ করেছে যেভাবে আমাদের দেখব: বুদ্ধির আলোয় পরিপূর্ণ বা স্বয়ং আলোয়, খাঁটি, প্রফুল্ল, বায়বীয়, জাত-প্রকৃত অর্থে, সত্তা–প্রকৃত নামে দেবতা হিসাবে। [৫৩]
এই ঈশ্বর কোনও অজ্ঞাত বস্তু নন, বরং আমাদের সর্বোত্তম সত্তা, ‘জানার বা উপলব্ধির মাধ্যমে আসে না, যা কিনা বুদ্ধিমান সত্তা আবিষ্কার করে (মন বা nons-এ) বরং এটা উপস্থিতি (Parousia), যা সকল জ্ঞানকে অতিক্রম করে।[৫৪]
প্লেটোনিয় ধারণার প্রভাব বলয়ে খৃস্টধর্ম ভিন্ন অবস্থান তৈরি করে নিচ্ছিল। পরবর্তী সময়ে ক্রিশ্চান চিন্তাবিদরা যখনই নিজস্ব ধর্মীয় অনুভূতি ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পেয়েছেন, স্বভাবতই তারা প্রটিনাস ও তাঁর পৌত্তলিক অনুসারীদের নিওপ্লেটোনিক দর্শনের আশ্রয় নিয়েছেন। এক নৈর্ব্যক্তিক, মানবীয় বৈশিষ্ট্যের অতীত, মানুষের জন্যে স্বাভাবিক আলোকপ্রাপ্তির এই ধারণা ভারতের হিন্দু-বুদ্ধ মতাদর্শের অনেক বেশি কাছাকাছি, যেখানে পড়াশোনায় গভীরভাবে আগ্রহী ছিলেন প্রটিনাস । সুতরাং বাহ্যিক পার্থক্য সত্ত্বেও পরম সত্তা সম্পর্কিত দর্শনের ক্ষেত্রে একেশ্বরবাদী ও অন্যান্য ধারণার গভীর সাদৃশ্য ছিল । লোকে পরম সত্তা সম্পর্কে ধ্যান করার সময় একই ধরনের ধারণা বা উপলব্ধি বোধ করে। কোনও এক সত্তার উপস্থিতিতে আনন্দ ও আতঙ্কের বোধ-যাকে নির্বাণ, দ্য ওয়ান, ব্রহ্মা বা ঈশ্বর বলা হয়-মনের একটা বিশেষ অবস্থা এবং প্রত্যক্ষ উপলব্ধি যা খুবই স্বাভাবিক, মানুষের অন্তহীন আকাক্ষার বিষয়।
ক্রিশ্চানদের কেউ কেউ গ্রিক বিশ্বের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল । অন্যরা এনিয়ে মাথা ঘামাতে চায়নি। ১৭০ সাল নাগাদ এক প্রবল নির্যাতনকালে মন্তানুস নামে এক নতুন পয়গম্বর আধুনিক তুরস্কের ফ্রাইগিয়ায় আবির্ভূত হয়ে নিজেকে স্বর্গীয় অবতার দাবি করেন: ‘আমিই প্রভু সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, মানুষের মাঝে যিনি অবতরণ করেছেন, চেঁচিয়ে বলতেন তিনি। আমি পিতা, পুত্র ও প্যারাক্লিট।’[৫৫] তাঁর সহচর প্রিসিলা ও ম্যাক্সিমিলাও একই রকম দাবি করেছিলেন। মস্তানিজম প্রবল প্রলয়বাদী বিশ্বাস ছিল যা ঈশ্বরের এক ভীতিজনক চিত্র এঁকেছিল। এর অনুসারীরা শুধু যে ইহজাগতিক জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য ছিল তা নয় বরং তাদের এও বলা হয়েছে যে ঈশ্বরের নৈকট্য লাভের একমাত্র পথ হচ্ছে শাহাদাৎ বরণ । বিশ্বাসের স্বার্থে তাদের যন্ত্রণাময় মৃত্যু ক্রাইস্টের আগমন তরান্বিত করবে: শহীদরা অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঈশ্বরের সৈনিক। ভয়ঙ্কর এই বিশ্বাস ক্রিশ্চানদের চেতনায় এক সুপ্ত চরমপন্থাকে উস্কে দিয়েছিল: ফাইগিয়া, সিরিয়া ও গলে দাবানলের মতো মস্তানিজমের বিস্তার ঘটে। উত্তর আফ্রিকায় যেখানকার জনগণ মানুষের বলী। দাবি করে, এমন দেবতায় অভ্যস্থ ছিল বলে সেখানে তা বিশেষভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। ভূমিষ্ঠ প্রথম শিশুর উৎসর্গ দাবিকারী তাদের বাআলের কাল্ট মাত্র দ্বিতীয় শতাব্দীতে সম্রাট কর্তৃক রদ হয়েছিল। অচিরেই এই বিদ্রোহী। বিশ্বাসটি (ক্রিড) লাতিন চার্চের নেতৃস্থানীয় ধর্মতাত্ত্বিক তারতুলিয়ানের মতো ব্যক্তিকে আকৃষ্ট করেছিল। প্রাচ্যে ক্লিমেন্ট ও অরিগেন এক প্রশান্ত, প্রফুল্ল অবস্থায় ঈশ্বরে প্রত্যাবর্তনের শিক্ষা দিয়েছিলেন, কিন্তু পশ্চিমের চার্চ ঈশ্বর মুক্তির শর্ত হিসাবে ভয়ঙ্কর মৃত্যু দাবি করে বসলেন। এই পর্যায়ে পশ্চিমে ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকায় খৃস্টধর্মকে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হচ্ছিল আর একেবারে গোড়া থেকে চরমপন্থা ও জরবদস্তির একটা প্রবণতা কাজ করছিল।
কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রাচ্যে খৃস্টধর্ম দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল। ২৩৫ সাল নাগাদ রোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মে পরিণত হয়েছিল তা। ক্রিশ্চানরা এ সময় একটি মাত্র বিশ্বাসের এমন এক মহান চার্চের কথা বলত যেখানে। চরমপন্থা বা বাড়াবাড়ির স্থান নেই। এই অর্থডক্স ধর্মতাত্ত্বিকরা নসটিক, মারসিয়নাইট, মন্তানিস্টদের নৈরাশ্যবাদী দর্শন বাতি ঘোষণা করে মধ্যপন্থা বেছে নেন। ধর্মবিশ্বাসে রহস্যময় কাল্ট ও কঠিন সন্ন্যাসব্রতের জটিলতা পরিহার গ্রিকো-রোমান বিশ্বের বোধগম্য পথে ধর্ম বিশ্বাস গড়ে তুলতে সক্ষম উচ্চ বুদ্ধিমত্তার লোকজনের কাছে আবেদন রাখতে শুরু করেছিল এটা। নতুন। এই ধর্ম নারীদেরও আগ্রহী করে তোলে: এর ঐশীগ্রন্থগুলো শিখিয়েছে যে স্রষ্টা। নারী বা পুরুষ নন এবং জোর দিয়ে বলে ক্রাইস্ট যেভাবে চার্চের আকাঙ্ক্ষা করেন ঠিক তেমনিভাবে পুরুষরা তাদের স্ত্রীদের প্রত্যাশায় থাকে। ইহুদিবাদ। এককালে যেমন অত্যন্ত আকর্ষণীয় ধর্ম হয়ে উঠেছিল, ঠিক তেমনি সব সুবিধার অধিকারী হয়ে উঠেছিল খৃস্টধর্ম, তদুপরি খত্না ও ভিনদেশী ‘আইনে’র সমস্যা ছিল না এর। চার্চগুলোর প্রতিষ্ঠিত জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থা ও পরস্পরের প্রতি ক্রিশ্চানদের দরদী ব্যবহারে পৌত্তলিকরা বিশেষ করে আকৃষ্ট হয়েছিল। নির্যাতন থেকে রক্ষা আর ভেতরের অসন্তোষ থেকে বাঁচার দীর্ঘ সংগ্রামকালে। চার্চ এমন এক দক্ষ সংগঠন গড়ে তুলেছিল যা প্রায় একটা সাম্রাজ্যের অনুরূপ: এটা বহুগোত্রীয় ক্যাথলিক, আন্তর্জাতিক, সর্বজনীন এবং দক্ষ আমলাদের হাতে পরিচালিত হচ্ছিল।
এতে করে চার্চ স্থিতিশীলতা বজায় রাখার একটা শক্তিতে পরিণত হয়েছিল যা সম্রাট কন্সতান্তাইনের পছন্দ হয়েছিল। ৩১২ সালের মিলভিয়ান যুদ্ধের পর খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তিনি এবং এর পরের বছর খৃস্টধর্মকে বৈধতা দেন। এর ফলে ক্রিশ্চানদের সম্পত্তির মালিকানা পাওয়ার অধিকার জন্মে, স্বাধীনভাবে উপাসনা করার সুযোগ পায় তারা এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়ে ওঠে। যদিও আরও দুশো বছর ধরে পৌত্তলিকতার বিকাশ ঘটেছিল কিন্তু খৃস্টধর্মই সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ধর্মে পরিণত হয়। বস্তুগত অগ্রগতির স্বার্থে চার্চে যাতায়াতকারীরা ধর্মান্তরিত হতে শুরু করে। সহিষ্ণুতার আবেদন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত নির্যাতিত গোষ্ঠী এই চার্চ অচিরেই নিজস্ব আইন ও বিধি বিধানের প্রতি আনুগত্য দাবি করে বসবে। খৃস্টধর্মের বিজয়ের কারণগুলো অস্পষ্ট; রোমান সম্রাটের সমর্থন ছাড়া এটা কিছুতেই সাফল্য অর্জন করতে পারত না, যদিও অনিবার্যভাবে তা নিজস্ব সমস্যার জন্ম দিয়েছিল। পুরোপুরি প্রতিকূলতার ধর্ম বলে সমৃদ্ধির কালে কখনওই এটা তুঙ্গ অবস্থায় থাকতে পারেনি। যেসব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান জরুরি হয়ে পড়েছিল, তার অন্যতম ছিল ঈশ্বরের মতবাদ: কন্সতান্তাইন চার্চে শান্তি স্থাপন করার পরপরই ভেতর থেকে এক নতুন বিপদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল যা খৃস্টধর্মকে তিক্ত বিরোধে লিপ্ত দুটো শিবিরে ভাগ করে দেয়।
০৪. ট্রিনিটি : ক্রিশ্চান ঈশ্বর
মোটামুটিভাবে ৩২০ সাল নাগাদ এক প্রবল ধর্মতত্ত্বীয় আবেগ মিশর, সিরিয়া এবং এশিয়া মাইনরের দেশসমূহে জোরাল হয়ে উঠেছিল। নাবিক ও পর্যটকরা জনপ্রিয় লোকসঙ্গীতের বিভিন্ন ভাষ্য গাইতে শুরু করেছিল যেখানে দাবি করা হয়েছে যে পিতা অগম্য এবং অদ্বিতীয় প্রকৃত ঈশ্বর, কিন্তু পুত্র চিরন্তনও নন এবং নন অজাতও; যেহেতু তিনি পিতার কাছ থেকে প্রাণ ও অস্তিত্ব লাভ করেছেন। স্নানাগারের একজন পরিচারকের ‘পুত্র এসেছিলেন শূন্যতা থেকে জোরের সাথে একথা বলে স্নানার্থীদের হয়রানি করার কথা শুনতে পাই, জনৈক মানিচেঞ্জার, বিনিময় হার জানতে চাওয়া হলে জবাব দেওয়ার আগে সৃষ্ট জগৎ ও অসৃষ্ট ঈশ্বরের পার্থক্য নিয়ে দীর্ঘ বক্তব্য রাখে; আরেকজন রুটিপ্রস্তুতকারী ক্রেতাকে জানায় যে, পিতা তার পুত্রের চেয়ে শ্রেয়তর । আজকের দিনে লোকে যেভাবে ফুটবল নিয়ে আলাপ করে ঠিক সেই একই রকম উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে এইসব বিমূর্ত প্রশ্ন সম্পর্কে আলোচনায় মত্ত হয়ে উঠেছিল লোকে। আলেকজান্দ্রিয়ার আরিয়াস নামের ক্যারিশম্যাটিক, সুদর্শন প্রেসবিটার এই বিতর্ককে আরও উস্কে দিয়েছিলেন। আকর্ষণীয় কোমল কণ্ঠের অধিকারী ছিলে আরিয়াস, চেহারায় দারুণ নির্বিকার ছাপ। বিশপ আলেকজান্দারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন তিনি, বিশপ উপেক্ষাও করতে পারেননি আবার জবাব দেওয়াও হয়ে উঠেছিল তাঁর জন্যে কঠিন: পিতা ঈশ্বরের মতো একইভাবে জেসাস ক্রাইস্ট ঈশ্বর ছিলেন কীভাবে? আরিয়াস ক্রাইস্টের ঐশ্বরিকতা অস্বীকার করছিলেন না; প্রকৃতপক্ষে জেসাসকে তিনি শক্তিশালী ঈশ্বর’ এবং পূর্ণ ঈশ্বর বলেছিলেন, কিন্তু তাঁর যুক্তি ছিল জেসাসকে প্রকৃতিগতভাবে স্বর্গীয় ভাবাটা ব্লাসফেমাস হবে: জেসাস স্পষ্ট করে বলেছেন যে, পিতা তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আলেকজান্দার এবং তাঁর তরুণ সহকারী আথানাসিয়াস অচিরেই বুঝতে পারলেন যে ব্যাপারটা আর সামান্য ধর্মতাত্বিক শোভনতায় সীমিত নেই। ঈশ্বরের প্রকৃতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলছিলেন আরিয়াস। এদিকে দক্ষ প্রচারবিদ আরিয়াস আপন ধারণায় সুর দিলেন এবং অচিরেই বিশপদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও এসব বিশপদের মতোই প্রবল উৎসাহে বিতর্কে লিপ্ত হলো।
বিতর্ক এতই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল যে সম্রাট কন্সতাইন বিষয়টি সুরাহা করার উদ্দেশ্যে হস্তক্ষেপ করেন এবং আধুনিক তুরস্কের নাইসিয়াতে এক সিন আহ্বান করেন। বর্তমানে আরিয়াসের নাম ধর্মোদ্রোহের প্রতিশব্দ, কিন্তু বিরোধ সৃষ্টি হওয়ার সময় কোনও আনুষ্ঠানিক অর্থডক্স অবস্থান ছিল না তার এবং কেন বা কীভাবে আরিয়াসের ভুল হয়েছে নিশ্চিত করে জানার উপায় ছিল না। তার দাবিতে নতুন কিছু ছিল নাঃ উভয় পক্ষের কাছে অতি সম্মানিত অরিগেনও একই ধরণের মতবাদ শিক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু অরিগেনের আমলের চেয়ে আলেকজান্দ্রিয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশে অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল, মানুষ প্লেটোর ঈশ্বরকে বাইবেলের ঈশ্বরের সঙ্গে সাফল্যের সঙ্গে সমন্বিত করা সম্ভব বলে বিশ্বাস করতে পারছিল না। উদাহরণস্বরূপ, আরিয়াস, আলেকজান্দার এবং আথানাসিয়াস এমন একটা মতবাদে বিশ্বাস রাখতে শুরু করেছিলেন যা যেকোনও প্লেটোবাদীকে চমকে দিত; তাঁরা ঐশীগ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে মনে করেছেন, ঈশ্বর শূন্য হতে বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন। আসলে, জেনেসিস এই দাবি করেনি। প্রিস্টলি লেখকগণ বোঝানোর প্রয়াস পেয়েছিলেন যে, ঈশ্বর আদিম বিশৃঙ্খলা থেকে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। ঈশ্বর একেবারে শূন্য হতে গোটা বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন, এই ধারণাটি ছিল একেবারে নতুন। গ্রিক মননে এটা ছিল একেবারে আনকোরা, ক্লিমেন্ট ও অরিগেনের মতো ধর্মবিদরা যারা প্লেটোর উৎসারণ প্রকল্প বিশ্বাস করে গেছেন, তারা কখনও এমন কথা বলেননি। কিন্তু চতুর্থ শতাব্দী নাগাদ ক্রিশ্চানরা জগৎ উৎপত্তিগতভাবে নাজুক, অপূর্ণ এবং এক বিশাল গহ্বর দ্বারা ঈশ্বর হতে বিচ্ছিন্ন থাকার নসটিকদের ধারণা গ্রহণ করতে শুরু করেছিল। শূন্য হতে সৃষ্টির এই নতুন মতবাদ মহাবিশ্ব সৃষ্টিকে। অপরিহার্যভাবে ভঙ্গুর আর অস্তিত্বের জন্যে পুরোপুরি ঈশ্বরের ওপর নির্ভরশীলতার উপর জোর দেয়। গ্রিক চিন্তাধারার মতো ঈশ্বর ও মানুষ আর । নিকটবর্তী থাকল না। এক বিরাট শূন্যতা থেকে ঈশ্বর প্রতিটি সত্তাকে সৃষ্টি করেছেন, যেকোনও মুহূর্তে তিনি তাঁর হেফাযতের হাত তুলে নিতে পারেন। ঈশ্বরের নিকট হতে সত্তার চিরন্তন উৎসারণের বিশাল ধারা আর রইল না; পৃথিবীতে স্বর্গীয় মানা প্রেরণকারী আধ্যাত্মিক সত্তাসমূহের মধ্যবর্তী একটা জগৎও অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলল। আপন প্রচেষ্টায় সত্তার ধারা বেয়ে আর ঈশ্বরের কাছে পৌঁছার উপায় থাকল না। নারী ও পুরুষের একমাত্র ঈশ্বর যিনি মূলত শূন্য হতে তাদের সৃষ্টি করেছেন এবং প্রাণশক্তি বজায় রেখেছেন, কেবল তার পক্ষেই চিরকালীন মুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব।
ক্রিশ্চানরা জানত জেসাস ক্রাইস্ট নিজের মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মাধ্যমে তাদের রক্ষা করেছেন; তারা বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে এবং একদিন ঈশ্বরের অস্তিত্বের মুখোমুখি হতে পারবে, যিনি স্বয়ং সত্তা এবং প্রাণ। কোনওভাবে ক্রাইস্ট ঈশ্বর ও মানবজাতিকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা দূরত্বটুকু অতিক্রম করে যেতে সক্ষম করে তুলেছেন তাদের। প্রশ্ন হলো, কাজটা কীভাবে করেছেন তিনি? মহাবিভক্তির কোন পাশে ছিলেন তিনি? প্লেরোমা, মধ্যস্থতাকারী ও ঈয়নের পূর্ণতার আর কোনও স্থান ছিল না। হয় ক্রাইস্ট, বাণী স্বর্গীয় রাজ্যের অধিবাসী ছিলেন (যেটা এখন কেবল ঈশ্বরের নিজস্ব অঞ্চল) না হয় নাজুক সৃষ্ট ব্যবস্থার অংশ ছিলেন তিনি। আরিয়াস ও আথানাসিয়াস মহাগহ্বরের বিপরীত দিকে স্থাপন করেছিলেন তাঁকে: আথানাসিয়াস রেখেছেন স্বর্গীয় অঞ্চলে এবং সৃষ্ট জগতে রেখেছেন আরিয়াস।
অদ্বিতীয় ঈশ্বর ও তার সকল সৃষ্টির মাঝে আবশ্যকীয় পার্থক্যের ওপর জোর দিতে চেয়েছিলেন আরিয়াস। বিশপ আলেকজান্দারের উদ্দেশে তিনি যেমন লিখেছিলেন, ঈশ্বর একমাত্র অজন্ম, একমাত্র চিরকালীন, একমাত্র তারই কোনও আদি নেই, তিনিই একমাত্র সত্য, একমাত্র তিনিই অমরত্বের অধিকারী, একমাত্র সর্বজ্ঞানী, সর্বোত্তম, একমাত্র স্রষ্টা। ঐশীগ্রন্থ ভালো করেই রপ্ত ছিল আরিয়াসের। ক্রাইস্ট-বাণী কেবল আমাদের মতোই সৃষ্ট জীব, এ দাবির সপক্ষে অসংখ্য দলিল উপস্থাপন করেছেন তিনি। প্রোভার্বসে দেওয়া স্বর্গীয় প্রজ্ঞার বর্ণনা ছিল তাঁর মূল অনুচ্ছেদ, যেখানে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, আদিতে ঈশ্বর প্রজ্ঞা সৃষ্টি করেছিলেন। এই টেক্সট-এ আরও বলা হয়েছে যে প্রজ্ঞা ছিল সৃষ্টির এজেন্ট। সেইন্ট জনের গস্পেলের উপক্রমণিকায় এ ধারনাটির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। আদিতে বাণী ছিল ঈশ্বরের সঙ্গে:
সকলেই তাঁহার দ্বারা হইয়াছিল, যাহা হইয়াছে,
তাহার কিছুই তাহা ব্যতিরেকে হয় নাই।
অন্যান্য সৃষ্ট জীবকে অস্তিত্ব দানের জন্যে ঈশ্বরের ব্যবহৃত সরঞ্জাম ছিল লোগোস । সুতরাং, এটা অন্য সকল বস্তু বা সত্তা থেকে একেবারেই ভিন্ন ও ব্যতিক্রমী উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। কিন্তু যেহেতু ঈশ্বর একে সৃষ্টি করেছেন, সুতরাং লোগোস আবশ্যিকভাবে স্বয়ং ঈশ্বরের চেয়ে আলাদা এবং ভিন্ন।
সেইন্ট জন পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে জেসাসই লোগোস ছিলেন, তিনি এও বলেছেন লোগোসই ছিলেন ঈশ্বর। তবু প্রকৃতিগতভাবে তিনি ঈশ্বর ছিলেন না, জোর দিয়ে বলেছেন আরিয়াস, বরং ঈশ্বর কর্তৃক স্বর্গীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি। আমাদের বাকি সবার চেয়ে তিনি আলাদা, কারণ ঈশ্বর আগে থেকেই জানতেন যে লোগোস মানুষ হওয়ার পর নিখুঁতভাবে তাকে মানবেন এবং, বলা যায়, জেসাসের প্রতি আগাম ঐশ্বরিকতা আরোপ করেছিলেন। কিন্তু জেসাসের অলৌকিকত্ব সহজাত ছিল না। এটা ছিল স্রেফ উপহার বা পুরস্কার। এই দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনেও বহু বিবরণ উপস্থাপনে সফল হয়েছিলেন আরিয়াস। জেসাস ঈশ্বরকে ‘পিতা’ সম্বোধন করেছিলেন, এই ব্যাপারটাই একটা পার্থক্য থাকার কথা প্রকাশ করে; পিতৃত্বের প্রকৃতির কারণেই পূর্বঅস্তিত্ব ও পুত্রের উপর সুনির্দিষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব বোঝায়। বাইবেলের উল্লিখিত ক্রাইস্টের অসম্মান ও দুর্বলতা সম্পর্কিত অনুচ্ছেদগুলোর প্রতিও জোর দিয়েছেন আরিয়াস। যেমনটি তার প্রতিপক্ষ দাবি করেছে, জেসাসকে অসম্মানিত করার কোনও উদ্দেশ্য আরিয়াসের ছিল না। ক্রাইস্টের গুণাবলী এবং আমৃত্যু আনুগত্য সম্পর্কে উঁচু ধারণা পোেষণ করতেন তিনি, যা আমাদের মুক্তি নিশ্চিত করেছে। আরিয়াসের ঈশ্বর গ্রিক দার্শনিকদের ঈশ্বরের কাছাকাছি ছিলেন, দূরবর্তী ও বিশ্বজগতের ঊর্ধ্বে; তিনিও মুক্তির গ্রিক ধারণার অনুসারী ছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ, স্টয়িকরা সব সময় শিক্ষা দিয়েছে যে গুণবান মানুষের পক্ষে সবসময়ই স্বর্গীয় মর্যাদা লাভ সম্ভব। প্লেটোনিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও এটা আবশ্যিক ছিল। আরিয়াস আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন যে ক্রিশ্চানরা নিস্কৃতি পেয়েছে ও স্বর্গীয় মর্যাদা লাভ করেছে, তারা ঈশ্বরের প্রকৃতির অংশীদার। এটা সম্ভব হয়েছে কেবল জেসাস আমাদের জন্যে পথ তৈরি করে গেছেন বলে। তিনি নিখুঁত মানব জীবন যাপন করে গেছেন; আমৃত্যু এমনকি ক্রুশবিদ্ধ হওয়া পর্যন্ত ঈশ্বরের আনুগত্য করেছেন। সেইন্ট পল যেমন বলেছেন, আমৃত্যু আনুগত্য প্রদর্শনের সুবাদেই ঈশ্বর তাঁকে বিশেষ মর্যাদার আসনে উন্নীত করেছেন এবং স্বর্গীয় প্রভু (Kyrios) উপাধি দান করেছেন।’ জেসাস মানুষ না হলে আমাদের কোনও আশাই থাকত না। প্রকৃতিগতভাবে ঈশ্বর হলে তার জীবনে অসাধারণত্ব বলে কিছুই থাকত না, অনুকরণ করার মতো কিছু থাকত না আমাদের। ক্রাইস্টের পুত্রানুগত্যের আদর্শ নিয়ে ধ্যান করার মাধ্যমে ক্রিশ্চানরাও স্বর্গীয় হয়ে উঠতে পারবে। নিখুঁত সৃষ্টি ক্রাইস্টকে অনুকরণের ভেতর দিয়ে তারাও ‘অপরিবর্তনীয় ও অপনোদনযোগ্য ঈশ্বরের নিখুঁত সৃষ্টিতে পরিণত হতে পারবে।
কিন্তু মানুষের ঈশ্বরকে ধারণ করার ক্ষমতা সম্পর্কে আথানাসিয়াসের ধারণা এতটা আশাবাদী ছিল না। মানুষকে জন্মগতভাবে নাজুক হিসাবে দেখেছেন তিনিঃ শূন্য হতে এসেছি আমরা এবং পাপের ফলে আবার শূন্যতায় নিক্ষিপ্ত হয়েছি। সুতরাং ঈশ্বর যখন তাঁর সৃষ্টি নিয়ে ভাবেন তিনি,
দেখেন সকল সৃষ্ট প্রকৃতিকে এর নিজস্ব ধারায় ছেড়ে দেওয়া হলে তা বিপদাপন্ন এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়বে। এটা রোধ এবং বিশ্বজগতকে অস্তিত্ব হীনতায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার হাত থেকে রক্ষার্থে তিনি আপন চিরন্তন লোগোস হতে সকল জিনিস সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টিকে অস্তিত্ব দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন।
ঈশ্বরের লোগোসের মাধ্যমে তাঁর নিকটবর্তী হয়েই কেবল মানুষ বিলুপ্তি বিনাশ এড়াতে পারে, কারণ একমাত্র ঈশ্বরই হচ্ছেন নিখুঁত সত্তা। লোগোস স্বয়ং দুর্বল সৃষ্টি হলে তার পক্ষে মানবজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হতো না। আমাদেরকে জীবনদানের জন্যে লোগোসকে দেহ দান করা হয়েছিল। তিনি মৃত্যু ও পাপের নশ্বর পৃথিবীতে নেমে এসেছিলেন আমাদেরকে ঈশ্বরের নির্লিপ্ততা ও অমরত্বের ভাগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু লোগোস স্বয়ং নাজুক সৃষ্টি হলে এটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত, যিনি নিজেই আবার শূন্যতায় হারিয়ে যেতে পারতেন। বিশ্বের যিনি স্রষ্টা একমাত্র তার পক্ষেই একে রক্ষা করা সম্ভব এবং তার মানে, দেহধারী লোগোসরূপী ক্রাইস্ট অবশ্যই পিতার মতো একই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। আথানাসিয়াস যেমন বলেছেন, আমরা যাতে স্বর্গীয় হয়ে উঠতে পারি সেজন্যেই বাণী মানুষের রূপ নিয়েছিলেন।
২০শে মে, ৩২৫ তারিখে বিশপগণ যখন সংকট দূর করার লক্ষ্যে নাইনিয়াতে সমবেত হয়েছিলেন, খুব অল্প সংখ্যকই ক্রাইস্ট সম্পর্কে আথানাসিয়াসের দৃষ্টিভঙ্গির অংশীদার ছিলেন। বেশির ভাগই আথানাসিয়াস এবং আরিয়াসের মতামতের মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তা সত্ত্বেও আথানাসিয়াস আগত প্রতিনিধিদের ওপর নিজস্ব ধর্মতত্ত্ব চাপিয়ে দিতে সক্ষম হন এবং সম্রাটের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কেবল আরিয়াস ও তার দুজন সাহসী সহচর তার ক্রীডে সাক্ষাদানে অস্বীকৃতি জানান। ফলে প্রথমবারের মতো শূন্য হতে সৃষ্টি মতবাদ সরকারী মতবাদে পরিণত হয়, যেখানে ক্রাইস্ট নগণ্য সৃষ্টি বা ঈয়ন নন বলে জোর দেওয়া হয়েছে। স্রষ্টা ও উদ্ধারকারী ছিলেন একই সত্তা।
আমরা একমাত্র ঈশ্বর,
পিতা সর্বশক্তিমানের উপর বিশ্বাস রাখি,
যিনি দৃশ্য অদৃশ্য সকল বস্তুর স্রষ্টা,
এবং বিশ্বাস করি একজন প্রভু ঈশ্বর, পুত্র জেসাস ক্রাইস্টে,
ঈশ্বরের একমাত্র সন্তান,
অর্থাৎ পিতার সত্তা (ousia) থেকে সৃষ্ট,
ঈশ্বর হতে ঈশ্বর,
আলো হতে আলো,
প্রকৃত ঈশ্বর হতে প্রকৃত ঈশ্বর,
জাত, পিতার সঙ্গে
একই বস্তু দ্বারা (homousion) সৃষ্ট নয়,
যার মাধ্যমে সকল বস্তু সৃষ্টি হয়েছে,
যেসব জিনিস স্বর্গে আছে আর
যেসব জিনিস আছে মর্ত্যে,
যিনি আমাদের জন্যে ও আমাদের
মুক্তির জন্যে মানুষের রূপ নিয়েছেন,
কষ্ট সয়েছেন,
তৃতীয় দিবসে আবার পুনরুত্থিত হয়েছেন,
আরোহণ করেছেন স্বর্গে
এবং নেমে আসবেন
জীবিত ও মৃতদের বিচারের জন্যে।
এবং আমরা বিশ্বাস করি পবিত্র আত্মায় ।
কন্সতন্তাইন ধর্মতত্ত্বীয় বিষয়াদি না বুঝলেও এই ঐকমত্যের প্রদর্শনে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু আসলে নাইসিয়ায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। সম্মেলন শেষ হওয়ার পর বিশপগণ আগের মতোই আবার যার যার শিক্ষাদানে ফিরে গিয়েছিলেন। পরবর্তী আরও ষাট বছর আরিয়ান সংকট অব্যাহত ছিল। আরিয়াস ও তার অনুসারীগণ পাল্টা লড়াই করে রাজকীয় অনুগ্রহ লাভে সফল হন। কমপক্ষে পাঁচবার নির্বাসিত হয়েছিলেন আথানাসিয়াস। নিজের ক্রীড টিকিয়ে রাখা খুব কষ্টকর হয়ে পড়েছিল তাঁর পক্ষে। বিশেষ করে homoonsion শব্দটি (আক্ষরিক অর্থে, একই উপাদানে তৈরি) দারুণ বিতর্কিত ছিল, কারণ এটা ঐশীগ্রন্থ বিরোধী এবং এতে বস্তুগত সংযোগ রয়েছে। এভাবে দুটো তামার মুদ্রাকে homousion বলা যেতে পারে, কেননা দুটোই একই বস্তু থেকে তৈরি ।
আবার, আথানাসিয়াসের ক্রীড বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব হীন। এখানে জেসাসকে স্বর্গীয় বলা হলেও ব্যাখ্যা করা হয়নি লোগোস দ্বিতীয় ঈশ্বর না হয়েও কীভাবে তিনি পিতার মতো একই উপাদানের হতে পারেন । ৩৩৯ সালে আথানাসিয়াসের বিশ্বস্ত বন্ধু ও সহকর্মী বিশপ অভ আনসিরা মার্সেলাস, যিনি এমনকি নির্বাসনে একবার তার সঙ্গীও হয়েছিলেন-যুক্তি দেখিয়েছেন যে লোগোস চিরন্তন স্বর্গীয় সত্তা হতে পারেন না। তিনি ঈশ্বরের মাঝে প্রচ্ছন্ন গুন; এ হিসাবে, নাইসিন ফরমুলাকে ত্রি-ঈশ্বরবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত করা যেতে পারত: তিন ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসের কথা রয়েছে এখানে: পিতা, পুত্র এবং আত্মা। বিতর্কিত homiousion শব্দের পরিবর্তে মার্সেলাস আপোস রফার জন্যে homiousion অর্থাৎ একরকম’ বা ‘একই স্বভাবের’ শব্দটি প্রস্তাব করেন। এই বিতর্কের জটিল ধারা প্রায়শঃ পরিহাসের সৃষ্টি করেছে; উল্লেখযোগ্যভাবে গিবন মনে করেছেন, তুচ্ছ বিষয়ে ক্রিস্টান ঐক্য হুমকির মুখে পড়াটা অসম্ভব একটা ব্যাপার। অবশ্য ধারণাগত দিক থেকে সংজ্ঞায়িত করা অসুবিধাজনক হওয়া সত্ত্বেও ক্রাইস্টের অলৌকিত্বের আবশ্যকতার প্রতি ক্রিশ্চানদের আঁকড়ে থাকার ব্যাপারটা বেশ চমকপ্রদ। মার্সেলাসের মতো বহু ক্রিশ্চান ঈশ্বরের একত্বের প্রতি হুমকিতে অস্বস্তিতে ভুগছিল। মার্সেলাস বোধ হয় বিশ্বাস করেছিলেন যে লোগোস কেবল একটা অতিক্রমশীল পর্যায় ছিল: সৃষ্টির সময় ঈশ্বর হতে আবির্ভূত হয়েছিল এটা, জেসাসের মাঝে স্থান করে নিয়েছে ও নিষ্কৃতি সমাপ্ত হওয়ার পর আবার স্বর্গীয় রূপে হারিয়ে যাবে, যাতে কেবল ঈশ্বরই সর্বেসর্বা রয়ে যাবেন।
শেষ পর্যন্ত আথানাসিয়াস মার্সেলাস ও তার অনুসারীদের বোঝাতে সমর্থ হন যে, তাদের পরস্পরের সঙ্গে যোগ দেওয়া উচিত, কারণ আরিয়ানদের চেয়ে তাঁদের মতের মিল অনেক বেশি। যারা বলেন যে, লোগোস পিতার মতো একই প্রকৃতির ছিল এবং যারা বিশ্বাস করেন যে তিনি প্রকৃতিগত দিক থেকে ঈশ্বরের মতো, তারা আসলে ভ্রাতৃপ্রতীম’, আমরা যা বলি, তারাও সেকথাই বোঝান, আমরা কেবল পরিভাষা নিয়ে বিতর্ক করছি। আরিয়াসের বিরোধিতায় অগ্রাধিকার দিতে হবে, যিনি ঘোষণা করেছেন যে পুত্র ঈশ্বর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও মৌলিকভাবে ভিন্ন প্রকৃতির। বহিরাগত কারও চোখে এসব ধর্মতত্ত্বীয় যুক্তিতর্ককে অনিবার্যভাবে সময়ের অপচয় মনে হবে: কারও পক্ষেই কোনও কিছু স্পষ্টভাবে প্রমাণ করার উপায় ছিল না, ও বিরোধ কেবলই ভাঙনেরই কারণ হয়েছে। অবশ্য অংশগ্রহণকারীদের জন্যে এটা কোনও শুষ্ক বিতর্ক ছিল না, বরং ক্রিশ্চান উপলব্ধির প্রকৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটা ব্যাপার ছিল। আরিয়াস, আথানাসিয়াস এবং মার্সেলাস, এঁদের প্রত্যেকেই উপলব্ধি করেছেন যে জেসাসের সঙ্গে একটা নতুন কিছু পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিল । তাঁরা ধারণাগত প্রতাঁকের সাহায্যে এই উপলব্ধিকে নিজেদের এবং অন্যদের কাছে ব্যাখ্যা করার জন্যে প্রকাশ-উপযোগি করে তোলার প্রয়াসে লিপ্ত ছিলেন। ভাষা কেবল প্রতীকায়িত হতে পারে, কারণ যে সত্তাসমূহের দিকে তারা নির্দেশ করেছেন তা ছিল অনির্বচনীয়। অবশ্য দুর্ভাগ্যক্রমে খৃস্টধর্মে এক গোঁড়া অসহিষ্ণুতার অনুপ্রবেশ ঘটছিল, শেষ পর্যন্ত যা সঠিক’ বা অর্থডক্স প্রতীক মেনে নেওয়াকে গুরুত্বপূর্ণ ও বাধ্যতামূলক করে তুলবে। খৃস্টধর্মের নজীরবিহীন মতবাদ বিষয়ক এই বিকার অনায়াসে মানবীয় প্রতীক ও স্বর্গীয় সত্তার ভেতর ভুল বোঝাবুঝি বা দ্বিধার জন্ম দিতে পারত। খৃস্টধর্ম আগাগোড়াই একটি স্ববিরোধী ধর্মবিশ্বাস (Paradoxical faith): প্রথম দিকের ক্রিশ্চানদের জোরাল ধর্মীয় অনুভূতি একজন ক্রুশবিদ্ধ মেসায়াহর বেলেঙ্কারীর আদর্শগত আপত্তি বা মতবিরোধ অতিক্রম করেছিল। এবার নাইসিয়াতে একেশ্বরবাদের সঙ্গে স্পষ্ট সামঞ্জস্যহীনতা সত্ত্বেও চার্চ ইনকারনেশন বা অবতারবাদের বৈপরীত্যকে গ্রহণ করে নিয়েছিল।
বিখ্যাত মরুচারী সাধক আথানাসিয়াস তাঁর জীবনীগ্রন্থ লাইফ অভ অ্যান্টনি তে দেখানোর প্রয়াস পেয়েছিলেন যে, তাঁর নতুন মতবাদ কীভাবে খৃস্টীয় আধ্যাত্মিকতাকে প্রভাবিত করেছে। মনাস্টিসিজম-এর প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত অ্যান্টনি মিশরিয় মরুভূমিতে কঠোর কৃচ্ছতার জীবন যাপন করতেন। তা সত্ত্বেও অজ্ঞাত পরিচয় লেখক কর্তৃক সংকলিত প্রাচীন মরু-সাধক বা মঙ্কদের নীতিকথার গ্রন্থ দ্য সেয়িংস অভ দ্য ফাদারস-এ তিনি অত্যন্ত মানবিক এবং সহজে বিচলিত ব্যক্তি হিসাবে অঙ্কিত হয়েছেন যিনি একঘেয়েমিতে ক্লান্ত, মানুষের সমস্যাদি নিয়ে বিচলিত ও উদ্বিগ্ন এবং সংজ্ঞা ও সরাসরি উপদেশ বা পরামর্শ দেন। কিন্তু জীবনীগ্রন্থে আথ্যানাসিয়াস একেবারে ভিন্ন আলোয় নিজেকে উপস্থাপন করেন। উদাহরণ স্বরূপ, তিনি আরিয়ান মতবাদের প্রবল বিরোধীতে রূপান্তরিত হয়েছেন: ইতিমধ্যেই তিনি আসন্ন দেবত্বের আস্বাদ গ্রহণ করেছেন, কেননা এক চমকপ্রদ মাত্রায় তিনি স্বর্গীয় অ্যাপাথিয়ার অংশীদার। উদাহরণ স্বরূপ, তিনি বিশ বছর অশুভ আত্মার সঙ্গে যুদ্ধ চালানোর পর যখন সমাধি থেকে উঠে আসেন, আথানাসিয়াস বলছেন, যে অ্যান্টনির দেহে বয়সের কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি। প্রকৃত ক্রিশ্চান ছিলেন তিনি, যার অচঞ্চল এবং নিস্পৃহ বৈশিষ্ট্য তাঁকে আর সবার চেয়ে ভিন্নতা দান করেছে: তার আত্মা ছিল অবিচল, তাই তাঁর বাহ্যিক অভিব্যক্তিও ছিল শান্ত।১৩ নিখুঁতভাবে ক্রাইস্টকে অনুকরণ করেছিলেন তিনিঃ ঠিক লোেগোস যেভাবে দেহ ধারণা করে পাপী পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং অশুভের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, অ্যান্টনিও একইভাবে শয়তানের আস্তানায় অবতরণ করেছিলেন । আথানাসিয়াস কখনও ধ্যানের কথা বলেননি, যা কিনা ক্লিমেন্ট বা অরিগেনের মতো ক্রিশ্চান প্লেটোনিস্টদের মতবাদ অনুযায়ী দেবতৃপ্রাপ্তি ও মুক্তির উপায় ছিল। তুচ্ছ মরণশীল মানুষের পক্ষে এভাবে তাদের নিজস্ব স্বাভাবিক শক্তির বলে ঈশ্বরের সান্নিধ্যে পৌঁছানো সম্ভব বলে বিবেচিত হচ্ছিল না আর। তার বদলে ক্রিশ্চানদের অবশ্যই দেহধারী বাণীর পাপাচারপূর্ণ বস্তুজগতে অবতীর্ণ হওয়াকে অনুকরণ করতে হবে।
কিন্তু তখনও দ্বিধান্বিত ছিল ক্রিশ্চানরা: ঈশ্বর যদি একজনই হয়ে থাকেন, তাহলে লোগোস কীভাবে স্বর্গীয় হতে পারেন? অবশেষে পূর্ব তুরস্কের কাপাদোসিয়ার তিনজন অসাধারণ ধর্মবিদ এমন একটা সমাধানের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এলেন যা ইস্টার্ন অর্থডক্স চার্চকে সন্তুষ্ট করে। এঁরা হলেন বিশপ অভ সিসারিয়া বাসিল (৩২৯-৭৯), তাঁর ছোট ভাই বিশপ অভ নাইসা গ্রেগরি (৩৩৫-৯৫) এবং বন্ধু গ্রেগরি অভ নাথিযান্যাস (৩২৯-৯১)। কাপাদোসিয়ানস হিসাবে আখ্যায়িত এই ব্যক্তিগণ গভীরভাবে আধ্যাত্মিক পুরুষ ছিলেন । অনুমান ও দর্শনে এখন আনন্দ লাভ করলেও তাদের বিশ্বাস ছিল ধর্মীয় অভিজ্ঞতাই ঈশ্বর সম্পর্কিত সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি। গ্রিক দর্শনে প্রশিক্ষিত এঁরা তিনজনেই সত্যের বাস্তব বিষয়াদি এবং এর অধিকতর দুর্বোধ্য দিকগুলোর পার্থক্যের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। আদি গ্রিক যুক্তিবাদীরা এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন: প্লেটো দর্শনের (যা যুক্তি দ্বারা উপস্থাপিত বলে প্রমাণযোগ্য ছিল) সঙ্গে পৌরাণিকভাবে প্রাপ্ত একই মাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক উপস্থাপনের ধরাছোঁয়ার বাইরের শিক্ষার পার্থক্য টেনেছেন। আমরা দেখেছি অ্যারিস্টটলও মানুষ শেখার (Mathein) জন্যে রহস্য ধর্মে আশ্রয় গ্রহণ করে না, বরং একটা কিছুর অভিজ্ঞতা (Pathein) লাভ করতে চায় বলে একই রকম পার্থক্য রেখা টেনেছিলেন। বাসিলও ডগমা ও কেরিগমা-র পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে ক্রিশ্চান অর্থে একই দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। ধর্মের ক্ষেত্রে উভয় ধরণের ক্রিশ্চান শিক্ষাই আবশ্যক। কেরিগমা হচ্ছে ঐশীগ্রন্থ নির্ভর চার্চের গণশিক্ষা; কিন্তু ডগমা বাইবেলিয় সত্যের গভীরতর অর্থ প্রকাশ করে যা কেবল ধর্মীয় অভিজ্ঞতা ও প্রতীকী রূপেই উপলব্ধি করা সম্ভব। গস্পেল সমূহের সরাসরি বাণীর আড়ালে বা পাশাপাশি পয়গম্বরদের কাছ থেকে ‘রহস্যময়ভাবে’ এক গোপন ও নিগূঢ় ঐহিত্য বিবরণ হস্তান্তরিত হয়েছে: এটা ‘ব্যক্তিগত এবং গোপন শিক্ষা ছিল’,
যা আমাদের পুণ্যাত্মা পূর্বপুরুষেরা নীরবে সংরক্ষণ করেছেন, যা উৎকণ্ঠা আর কৌতূহল রোধ করেছে…এই নীরবতার সাহায্যে রহস্যের পবিত্র রূপ সংরক্ষণ করার উদ্দেশ্যে। অদীক্ষিতজনদের এই শিক্ষা বহন করার অনুমোদন নেই: লিখিতরূপে এদের অর্থ প্রকাশ করা যাবে না।
.
শাস্ত্রীয় প্রতীক ও জেসাসের শিক্ষার সাবলীলতার আড়ালে ছিল অধিকতর গোপন এক ডগমা, যা ধর্মবিশ্বাসের আরও উন্নত উপলব্ধি তুলে ধরে।
নিগূঢ় এবং প্রকাশিত সত্যের মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্য ঈশ্বরের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে। কেবল গ্রিক ক্রিশ্চানদের মাঝেই এটা সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং ইহুদি ও মুসলিমরাও নিগূঢ় ঐতিহ্য গড়ে তুলবে। গোপন মতবাদের ধারণার পেছনে মানুষের মত বন্ধ করার উদ্দেশ্য কাজ করেনি। ফ্রিম্যাসনরির কোনও আদি ধরনের কথা বলেননি বাসিল। তিনি কেবল এই। সত্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন যে সকল ধর্মীয় সত্য স্পষ্ট এবং যৌক্তিকভাবে প্রকাশ উপযোগি নয়। কোনও কোনও ধর্মীয় দর্শনের অভ্যন্তরীণ অনুরণন রয়েছে যা কেবল কেউ তার একান্ত নিজস্ব সময়ে প্লেটোর সংজ্ঞানুযায়ী থিয়োরিয়া বা ধ্যানের মাধ্যমেই উপলব্ধি করতে পারে। যেহেতু সকল ধর্ম স্বাভাবিক ধারণা এবং বৈশিষ্ট্যের অতীত এক অনিবৰ্চনীয় সত্তার প্রতি নিবেদিত, সেহেতু বক্তব্য সীমাবদ্ধ এবং বিভ্রান্তিকর। আত্মার চোখ দিয়ে এসব সত্যকে না দেখলে যেসব লোক এখনও খুব অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেনি তারা ভ্রান্ত ধারণা পেয়ে বসতে পারে। সুতরাং, আক্ষরিক অর্থের পাশাপাশি ঐশীগ্রন্থসমূহের অ্যাধ্যাত্মিক তাৎপর্যও রয়েছে যা সবসময় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বুদ্ধও উল্লেখ করেছেন যে কিছু কিছু প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা ‘অসংগত’ বা বেমানান, যেহেতু এগুলো ভাষার আয়ত্তের অতীত বাস্তবতার কথা বলে। ধ্যানের এক অন্তর্মুখী কৌশলের আশ্রয় নিয়েই কেবল আপনি তা আবিষ্কার করতে পারবেন: এক অর্থে আপনাকেই তা তৈরি করে নিতে হবে। ভাষায় এগুলোর বর্ণনা দেওয়ার প্রয়াস বিতোফেনের শেষ কোয়ারটেট এর কোনও একটার মৌখিক বর্ণনা দেওয়ার মতোই অদ্ভুত হয়ে উঠতে পারে। বাসিল যেমন বলেছেন, এসব দুর্বোধ্য ধর্মীয় বাস্তবতা কেবল শাস্ত্রের প্রতীকী ভঙ্গি বা আরও ভালো, নীরবতার সাহায্যে বোঝানো যেতে পারে।
পশ্চিমের খৃস্টধর্ম আরও বাগাড়ম্বরপূর্ণ ধর্মে পরিণত হবে এবং অনিবার্যভাবে কেরিগমার ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠবে; এটাই হয়ে দাঁড়াবে ঈশ্বরের ক্ষেত্রে এর প্রধান সমস্যা। অবশ্য গ্রিক অর্থডক্স চার্চে উন্নত সকল ধর্মতত্ত্ব নীরব বা অ্যাপফ্যাটিক হবে। গ্রেগরি অভ নাইসা যেমন বলেছেন, ঈশ্বর সম্পর্কিত প্রতিটি ধারণাই সদস্যপূর্ণ, এক মিথ্যা সমরূপতা, প্রতিমা: এটা স্বয়ং ঈশ্বরকে প্রকাশ করতে পারে না। ক্রিশ্চানদের অবশ্যই আব্রাহামের মতো হতে হবে, যিনি গ্রেগরির উপস্থাপিত জীবনীতে ঈশ্বর সম্পর্কে সকল ধারণা বাদ দিয়ে এমন এক বিশ্বাস গ্রহণ করেছিলেন যা, যে কোনও ধারণার চেয়ে অবিমিশ্র এবং খাঁটি ছিল। গ্রেগরি তার লাইফ অভ মোজেস-এ জোর দিয়ে বলেছেন, আমরা যার প্রত্যাশা করি তার প্রকৃত দর্শন এবং জ্ঞান দেখার সঙ্গে জড়িত নয় বরং এমন এক সচেতনতার সঙ্গে সম্পর্কিত যার ফলে আমাদের লক্ষ্য সকল জ্ঞানকে ছাপিয়ে যায় এবং দুর্বোধ্যতার অন্ধকার দিয়ে সবদিক থেকে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন। আমরা বুদ্ধি দিয়ে ঈশ্বরকে দেখতে পারি না, কিন্তু সিনাই পর্বতে নেমে আসা মেঘের আড়ালে নিজেদের ঢাকতে পারলেই কেবল আমরা তাঁর উপস্থিতি অনুভব করতে পারব। ঈশ্বরের সত্তা {ousia) এবং বিশ্বে তার কর্মধারা (energaiai)-র মাঝে ফিলো যে পার্থক্য টেনেছিলেন, বাসিল তারই শরণাপন্ন হয়েছেন: ‘আমরা কেবল তার কাজ (energeial) দিয়েই ঈশ্বরকে জানতে পারি, কিন্তু আমরা তার সত্তার দিকে অগ্রসর হই না। এটাই ইস্টার্ন চার্চের ভবিষ্যতের সকল মূল কথায় পরিণত হবে।
কাপাদোসিয়রা পবিত্র আত্মার ধারণা গড়ে তুলতেও বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। তাঁদের ধারণা ছিল যে নাইসিয়ায় দায়সারাভাবে এদিকটাতে নজর দেওয়া হয়েছিল: আর আমরা বিশ্বাস করি পবিত্র আত্মায়’ কথাগুলো যেন শেষ বিবেচনায় আথানাসিয়াসের বিশ্বাসে যোগ করা হয়েছিল। পবিত্র আত্মার ব্যাপারে দ্বিধান্বিত ছিল মানুষ। এটা কি কেবল ঈশ্বরের একটি প্রতীক বা সমার্থক শব্দ নাকি আরও বেশি কিছু? কেউ কেউ একে (আত্মা) এক ধরনের কাজ ভেবেছিল,’ বলেছেন গ্রেগরি অভ নাযিয়ানস, কেউ ভেবেছে সৃষ্ট প্রাণী, কেউ ভেবেছে ঈশ্বর, কেউ বুঝে উঠতে পারেনি তাকে কি ডাকা যায়।২০ সেইন্ট পল নবায়ন, সৃষ্টি এবং পবিত্রকরণ সম্পর্কে পবিত্র আত্মার উল্লেখ করেছিলেন, কিন্তু এসব কাজ কেবল ঈশ্বর দ্বারাই সম্পাদন সম্ভব। সুতরাং বোঝা যায়, পবিত্র আত্মা, আমাদের মাঝে যার উপস্থিতিকে আমাদের মুক্তি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, নিশ্চয়ই স্বর্গীয়, সামান্য সৃষ্টি নন। কাপাদোসিয়রা একটা ফর্মুলা প্রয়োগ করেছিলেন যা আরিয়াসের সঙ্গে বিরোধের সময় ব্যবহার করেছেন আথানাসিয়াস: ঈশ্বরের একক সত্তা (ousia) রয়েছে যা আমাদের বোধের অতীত রয়ে গেছে-কিন্তু তিনটি অভিব্যক্তি তাঁকে জ্ঞাত করেছে।
ঈশ্বরকে তাঁর অজ্ঞেয় ousia দিয়ে চিন্তা শুরু করার বদলে কাপাদোসিয়রা মানবজাতির তার hypostases-এর অভিজ্ঞতা দিয়ে কাজ শুরু করেন। যেহেতু ঈশ্বরের ousia অপরিমেয়, আমরা কেবল পিতা, পুত্র ও আত্মারূপে আমাদের মাঝে প্রকাশের মাধ্যমেই তাকে জানতে পারি। অবশ্য এর মানে এই ছিল না যে কাপাদোসিয়রা, কোনও কোনও পশ্চিমা ধর্মবিদ যেমন মনে করেন, তিনটি স্বর্গীয় সত্তায় বিশ্বাসী ছিলেন। গ্রিক ভাষার সঙ্গে যারা পরিচিত নয় তাদের কাছে hypostasis শব্দটি ছিল বিভ্রান্তিকর, কারণ এর বহু অর্থ ছিল: সেইন্ট জেরোমির মতো কোনও কোনও লাতিন পণ্ডিত বিশ্বাস করতেন যে hvpostasis শব্দটি অর্থ ousia-র মতো এবং তারা ভেবেছিলেন গ্রিকরা তিনটি ঐশী সত্তায় বিশ্বাস করে। কিন্তু কাঁপোদোসিয়রা জোর দিয়ে বলেছেন pusia এবং hypostasis এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে, যা মনে রাখা অত্যাবশ্যক। এভাবে কোনও বস্তুর ousia হচ্ছে যা ওই বস্তুকে বিশেষ রূপ দিয়েছে; এটা কোনও বস্তুর ভেতরে আছে এমনভাবে প্রয়োগ করা হয়। অন্যদিকে hypostasis শব্দটি ব্যবহার করা হয় বাইরে থেকে একটি বস্তুকে প্রকাশ করার জন্যে। অনেক সময় কাঁপোদোসিয়গণ hypostasis শব্দের পরিবর্তে Prosopon শব্দটি ব্যবহারেও আগ্রহী ছিলেন। Proposon-এর আদি অর্থ ছিল ‘শক্তি’ (Force), কিন্তু বেশ কিছু গৌণ অর্থও যোগ হয়েছে: ফলে একে কোনও ব্যক্তির মনের অবস্থার বাহ্যিক প্রকাশ, চেহারার অভিব্যক্তি বোঝাতে ব্যবহার করা যেতে পারে; একে তার সচেতনভাবে গৃহীত কোনও ভূমিকা বা অভিনয়ের জন্যে বেছে নেওয়া কোনও চরিত্র বোঝাতেও ব্যবহার করা হয়ে। পরিণামে hypostasis-এর মতো Proposon-এর মানে কারও অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যের বাহ্যিক প্রকাশ কিংবা দর্শকের চোখে উপস্থাপিত ব্যক্তিক সত্তা। সুতরাং কাপপাদোসিয়রা যখন বলেন যে, ঈশ্বর তিন hypostases-এ একজন ousia, তাঁরা বুঝিয়েছেন যে ঈশ্বর স্বয়ং একজন: স্বর্গীয় আত্ম-সচেতনতা মাত্র একটিই। কিন্তু যখন তিনি তাঁর কোনও কিছু সৃষ্ট জীবকে দেখান, তখন তিনি foa Prosopoi!
এভাবে hypostases পিতা, পুত্র এবং আত্মাকে স্বয়ং ঈশ্বরের সঙ্গে মেলানো যাবে না, কারণ গ্রেগরি অভ নাইসা যেমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, স্বর্গীয় সত্তা (Ousia) ভাষাতীত এবং নামকরণের অতীত’, ‘পিতা, ‘পুত্র’ ও ‘আত্মা’ হচ্ছে আমাদের ব্যবহৃত পরিভাষা’ মাত্র যা দিয়ে আমরা তার energeiai-এর কথা বলি, যার মাধ্যমে তিনি নিজেকে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এসব শব্দের প্রতীকী মূল্য রয়েছে, কেননা এগুলো অনির্বচনীয় বাস্তবতাকে আমাদের বোধগম্য ইমেজে তর্জমা করে। মানুষ ঈশ্বরকে দুয়ে (অগম্য আলোয় ঢাকা পিতা), সৃজনশীল (লোগোস) এবং সর্বব্যাপী (পবিত্র আত্মা) হিসাবে অনুভব করেছে। কিন্তু এই তিনটি hypostases স্বয়ং স্বর্গীয় প্রকৃতির আংশিক ও অসম্পূর্ণ আভাস মাত্র, যা এধরনের ইমেজারি ও ধারণাকরণের বহু দূরে অবস্থান করে। সুতরাং, ট্রিনিটি (ত্রিত্ব)কে আক্ষরিকভাবে সত্যি হিসাবে দেখা চলবে না, বরং একে ঈশ্বরের গোপন জীবনের প্রকৃত সত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত উদাহরণ হিসাবে নিতে হবে।
গ্রেগরি অভ নাইসা তাঁর পত্র টু আলাবিয়াস: দ্যাট দেয়ার আর নট থ্রি গডস্-এ তিনটি স্বর্গীয় ব্যক্তি বা hypostases-এর অবিভাজ্যতা বা সহাবস্থান সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ মতবাদের রূপরেখা এঁকেছিলেন। ঈশ্বর নিজেকে তিনটি অংশে বিভক্ত করেছিলেন, এটা যেন কেউ না ভাবে, এটা ভয়ঙ্কর এবং সত্যি বলতে ব্লাসফেমাস ধারণা। ঈশ্বর যখন নিজেকে পৃথিবীতে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করেন, তখন এই তিনটি রূপেই পরিপূর্ণ ও সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করেন। ট্রিনিটি এভাবে আমাদের সৃষ্টির প্রতি ঈশ্বর হতে প্রতিটি কাজের প্যাটার্নের একটা আভাস দেয়: ঐশীগ্রন্থ যেমন দেখায়, এর উৎস ছিল পিতার কাছে, পুত্রের মাধ্যমে অগ্রসর হয়েছে এবং আত্মার পরিব্যাপীতার মাধ্যমে পৃথিবীতে কার্যকর হয়েছে। কিন্তু স্বর্গীয় প্রকৃতি কাজের প্রতিটি পর্যায়ে সমানভাবে উপস্থিত। আমরা আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনটি hypostases-এর পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বুঝতে পারি: পুত্রের প্রকাশ না হলে আমরা কখনও পিতা সম্পর্কে জানতে পারতাম না, পুত্রকেও আমরা চিনতে পারতাম না অন্তর্গত আত্মা ছাড়া, যিনি তাঁকে আমাদের কাছে পরিচিত করেছেন। আত্মা পিতার স্বর্গীয় বাণীর সহচর, ঠিক নিঃশ্বাস (গ্রিক, নিউমা, লাতিন, স্পিরিতাস)। যেমন মানুষের কথার সঙ্গে থাকে। ঐশীরাজ্যে তিন ব্যক্তি পাশাপাশি অবস্থান করেন না। একই ব্যক্তির মনে বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞানের উপস্থিতির সঙ্গে আমরা তাদের তুলনা করতে পারি: দর্শন হয়তো ওষুব বিজ্ঞান হতে আলাদা হতে পারে, কিন্তু এটা চেতনার একটা আলাদা স্তরে থাকে না। বিভিন্ন বিজ্ঞান পরস্পরকে ছাপিয়ে যায়, গোটা মনকে পূর্ণ করে, কিন্তু আবার আলাদা থেকে যায়।[২৩]
কিন্তু শেষমেষ ট্রিনিটি অতিন্দ্রীয় বা অ্যাধ্যাত্মিক অনুভূতি হিসাবেই কেবল অর্থ বহন করে: একে যাপন করতে হবে, চিন্তা করা যাবে না, কারণ ঈশ্বর মানবীয় ধারণার অতীতে অবস্থান করেন। এটা যৌক্তিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক বিবরণ নয় বরং যুক্তিকে তালগোল পাকিয়ে দেওয়া এক কাল্পনিক উদাহরণ। গ্রেগরি অভ নাযিয়ানস একের মাঝে তিনজনের ধ্যান এক গভীর ও সীমাহীন। আবেগের প্রকাশ ঘটায় যা চিন্তা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক স্পষ্টতাকে ঘোলা করে দেওয়ার কথা বলে এই বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছেন।
আমি যখনই একজনের কথা ভাবি, সঙ্গে সঙ্গে তিনজনের মহিমায় আলোকিত হয়ে উঠি; আমি তিনজনকে আলাদা করে নেওয়ামাত্র আবার ফিরে যাই একজনে। যখন কোনও একজনের কথা ভাবি, আমি পরিপূর্ণভাবে তার কথা ভাবি; আমার চোখ পরিপূর্ণ, আমার ভাবনার বৃহৎ অংশ আমাকে ছেড়ে যায়। [২৪]
গ্রিক ও রাশিয়ান অর্থডক্স ক্রিশ্চানরা ট্রিনিটির ধ্যানকে অনুপ্রেরণাদায়ী ধর্মীয় অভিজ্ঞতা হিসাবে আবিষ্কার করে গেছে। অবশ্য বহু পশ্চিমা ক্রিশ্চানের কাছে ট্রিনিটি স্রেফ হতবুদ্ধিকর । এর কারণ হতে পারে, ওরা হয়তো কাপাদোসিয়দের অ্যাখ্যায়িত Kerygmatic গুণাবলী বিবেচনা করেছে, অথচ গ্রিকদের বেলায় এটা ছিল ডগম্যাটিক সত্য যা কেবল অন্তর দিয়ে এবং ধর্মীয় অভিজ্ঞতার
ফলাফল হিসাবে আয়ত্ত করা যায়। অবশ্য যৌক্তিকভাবে এর কোনও অর্থই হয় না। প্রথমদিকে এক সারমনে গ্রেগির অভ নাযিয়ানস ব্যাখ্যা করেছিলেন যে ট্রিনিটির ডগমার দুর্বোধ্যতাই আমাদের ঈশ্বরের পরম রহস্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়; আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে তাঁকে বোঝার আশা করা ঠিক নয়। এটা আমাদের ঈশ্বর সম্পর্কে সহজ সাধারণ বক্তব্য রাখা থেকে বিরত রাখে, যিনি নিজেকে প্রকাশ করার সময় এক অলৌকিক উপায়েই কেবল নিজের প্রকৃতি দেখাতে পারেন। ট্রিনিটি কীভাবে কাজ করে সেটা বুঝতে পারার পথ খুঁজে পাবার সাধ্য আছে বলে ভাবতেও আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন বাসিল, সোজা কথায়: উদাহরণ স্বরূপ, গডহেডের তিনটি hypostases কীভাবে এক এবং একই সঙ্গে সমরূপ ও আলাদা এই ধাঁধার জবাব খোঁজার প্রয়াস পাওয়া অনুচিত। এটা ভাষা, ধারণা ও বিশ্লেষণের মানবীয় ক্ষমতার অতীত।[২৬]
এভাবে ট্রিনিটিকে অবশ্যই আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করা যাবে না; এটা বিমূর্ত কোনও ‘তত্ত্ব নয়, বরং থিয়োবিয়া বা ধ্যানের ফল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে পশ্চিমের ক্রিশ্চানরা যখন এই ডগমার কারণে বিব্রত বোধ করে পরিত্যাগ করার প্রয়াস পেয়েছিল, তখন তারা ঈশ্বরকে যুক্তির যুগের (Age of Reason) সঙ্গে যৌক্তিক ও বোধগম্য করতে চেয়েছিল। এটা, যেমন আমরা দেখব, আমাদের ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর তথাকথিত ঈশ্বরের প্রয়াণের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া অন্যতম উপাদান। কাপাদোসিয়রা যেসব কারণে এই কল্পনা-নির্ভর উদাহরণের অবতারণা করেছিলেন তার অন্যতম ছিল ঈশ্বর যেন আরিয়াসদের মতো ধর্মদ্রোহীদের বোধের গ্রিক দর্শনের যৌক্তিক ঈশ্বরের পরিণত না হতে পারেন। আরিয়াসের ধর্মতত্ত্ব একটু বেশি স্পষ্ট ও যৌক্তিক ছিল। ট্রিনিটি ক্রিশ্চানদের মনে করিয়ে দিয়েছে যে সত্তাকে আমরা ‘ঈশ্বর’ বলি মানব বুদ্ধিতে তার নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। নাইসিয়ায় প্রকাশিত অবতারবাদ গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু তাতে সরল বহুঈশ্বরবাদীতার সূত্রপাত হতে পারত। মানুষ স্বয়ং ঈশ্বরকে অতি বেশি মানবীয় ভাবতে শুরু করে বসতে পারে: “তিনি ঠিক আমাদের মতো ভাবছেন, কাজ করছেন, পরিকল্পনা করছেন, এমন ভাবনাও শুরু হতে পারত। এরপর ঈশ্বরের ওপর সব ধরণের পূর্বধারণাপ্রসূত মতামত চাপিয়ে দিয়ে সেগুলোকে পরম রূপ দেওয়াটা খুব দূরের ব্যাপার নয়। এই প্রবণতা সংশোধনের প্রয়াস ট্রিনিটি। একে ঈশ্বর সম্পর্কিত সত্য বিবরণ হিসাবে না দেখে বরং কোনও কবিতা বা ধর্মতত্ত্বীয় নাচ হিসাবে দেখা যেতে পারে, তুচ্ছ মরণশীল মানুষ, ঈশ্বর সম্পর্কে যা বিশ্বাস করে আর গ্রহণ করেছে তার মাঝামাঝি কিছু এবং এক নীরব উপলব্ধি যে এমন যেকোনও বক্তব্য বা কেরিগমা কেবল সাময়িক হতে পারে।
“থিয়োরি’ শব্দের ব্যবহারের ক্ষেত্রে গ্রিক ও পশ্চিমাদের পার্থক্য নির্দেশমূলক। প্রাচ্যের খৃস্টধর্মে থিয়োবিয়া সবসময় চিন্তা বোঝায়। পশ্চিমে তা যৌক্তিকভাবে প্রদর্শিত যুক্তিভিত্তিক প্রকল্প বুঝিয়ে থাকে। ঈশ্বর সম্পর্কে কোনও ‘থিয়োরি’ গড়ে তোলা বোঝায় যে তাঁকে চিন্তার মানবীয় ব্যবস্থা বা পদ্ধতিতে ধারণ করা যেতে পারে। নাইসিয়ায় মাত্র তিনজন লাতিন ধর্মবিদ ছিলেন। অধিকাংশ পশ্চিমা ক্রিশ্চান আলোচনার এই মাত্রায় যোগ্য ছিলেন না, তারা কোনও কোনও গ্রিক পরিভাষা বুঝতে না পারায় ট্রিনিটি মতবাদের বেলায় অসুখী বোধ করেছেন। সম্ভবত এটা ভিন্ন বাগধারায় সম্পূর্ণ অনুবাদযোগ্য ছিল না। প্রত্যেক সংস্কৃতিকে ঈশ্বর সম্পর্কে নিজস্ব ধারণা সৃষ্টি করতে হয় । ট্রিনিটির গ্রিক ব্যাখ্যা পশ্চিমাদের কাছে অচেনা মনে হয়ে থাকলে তাদের নিজস্ব ভাষ্য নিয়ে এগিয়ে আসার প্রয়োজন ছিল।
যে লাতিন ধর্মতাত্ত্বিক লাতিন চার্চের জন্যে ট্রিনিটিকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন তাঁর নাম অগাস্তিন। গভীর প্লেটোবাদী ছিলেন তিনি, ছিলেন প্রটিনাসের অনুগত, ফলে পশ্চিমের অনেক সহকর্মীর চেয়ে এই মতবাদের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা ছিল তাঁর। তাঁর ব্যাখ্যানুযায়ী, ভুল বোঝাবুঝির ব্যাপারটা প্রায়শঃই পরিভাষাগত কারণে হয়েছে:
অনির্বচনীয় বিষয়াদি প্রকাশের ক্ষেত্রে যেসব আমরা কোনওভাবে হয়তো প্রকাশ করতে পারি আমাদের অবস্থান থেকে তা কোনও ভাবেই পূর্ণভাবে কিছু প্রকাশ করে না, আমাদের গ্রিক বন্ধুগণ একজন সত্তা এবং তিনটি বস্তুর কথা বলেছেন, কিন্তু লাতিনরা বলেছেন একজন সত্তা বা বস্তু এবং তিন ব্যক্তিত্বের কথা।[২৭]
গ্রিকরা যেখানে ঈশ্বরের একক অপ্রকাশিত সত্তা বিশ্লেষণে অস্বীকৃতি জানিয়ে তাঁর তিনটি hypotases-কে বিবেচনা করে ঈশ্বরের দিকে অগ্রসর হয়েছিল, যেখানে স্বয়ং অগাস্তিন এবং তার পরবর্তী সময়ের পশ্চিমা ক্রিশ্চানরা স্বর্গীয় একত্ব দিয়ে শুরু করে তারপর এর তিনটি প্রকাশ আলোচনায় অগ্রসর হয়েছেন। অগাস্তিনকে অন্যতম ফাদার অভ দ্য চার্চ হিসাবে গ্রিকরা শ্রদ্ধা করেছে, কিন্তু তাঁর ত্রিত্ববাদী ধর্মতত্ত্বের ব্যাপারে তারা সন্দিহান ছিল, এতে করে ঈশ্বরকে তাদের কাছে বড় বেশি যৌক্তিক ও মানবরূপী মনে হয়েছে। গ্রিকদের মতো অগাস্তিনের মতবাদ বিমূর্ত (metaphysical) ছিল না, বরং তা ছিল মনস্তাত্ত্বিক ও বড় বেশি ব্যক্তিক।
অগাস্তিনকে পশ্চিমা চেতনার জনক বলা যেতে পারে। সেইন্ট পল ছাড়া আর কোনও ধর্মবিদ পশ্চিমে তাঁর মতো প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। প্রাচীনকালের শেষ পর্যায়ের অন্য যেকোনও চিন্তাবিদের চেয়ে তাকে অনেক অন্তরঙ্গভাবে চিনি আমরা, বিশেষ করে তাঁর রচিত ঈশ্বর আবিষ্কারের অসাধারণ এবং আবেগময় বিবরণ কনফেশনস-এর জন্য। জীবনের গোড়া থেকেই একটা ঈশ্বরবাদী ধর্মের সন্ধানে ছিলেন অগাস্তিন। ঈশ্বরকে তিনি মানবজাতির পক্ষে অত্যাবশ্যক হিসাবে দেখেছেন: আমাদের তিনি তার জন্যে সৃষ্টি করেছেন, কনফেশনস-এর শুরুতে ঈশ্বরকে বলেছেন তিনি, এবং তোমার মাঝে স্থান না পাওয়া পর্যন্ত অস্থির থাকবে আমাদের হৃদয়।২৮ কারথেজে বক্তৃতা শিক্ষা দেওয়ার সময় তিনি নসটিকবাদের মেসোপটেমিয় রূপ ম্যানিশেইজম-এর দীক্ষা নেন। কিন্তু এর সৃষ্টিতত্ত্ব তাঁকে সন্তুষ্ট করতে না পারায় পরে তা ত্যাগ করেন। অবতারের ধারণাকে তার কাছে আক্রমণাত্মক মনে হয়েছিল, ঈশ্বরের ধারণার অসম্মান; কিন্তু তিনি ইতালিতে থাকার সময় বিশপ অভ মিলান আব্রস তাকে বোঝাতে সক্ষম হন যে খৃস্টধর্ম প্লেটো ও প্লাটিনাসের সঙ্গে বেমানান নয়। কিন্তু তারপরেও অগাস্তিন চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিয়ে দীক্ষা গ্রহণে অনীহ ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন খৃস্টধর্মের ক্ষেত্রে কুমারব্রত গ্রহণ বাধ্যতামূলক এবং এমন সিদ্ধান্ত নেওয়াকে ঘৃণার চোখে দেখেছেন: “প্রভু, আমাকে পবিত্রতা দাও, প্রার্থনা করতেন তিনি, কিন্তু এখনই নয়।২৯।
তাঁর চূড়ান্ত পরিবর্তনের ব্যাপারটা ছিল Surm und Drang, অতীত জীবনের সঙ্গে সহিংস সম্পর্কচ্ছেদের পর কষ্টকর পুনর্জন-যা পাশ্চাত্যের ধর্মীয় অভিজ্ঞতার বৈশিষ্ট্য হয়ে আছে। একদিন মিলানে তিনি তার বন্ধু অলিপিয়াসের সঙ্গে বাগানে বসে থাকার সময় সংগ্রাম চরম পর্যায়ে উন্নীত হয়ে এক গুপ্ত গভীরতা থেকে গভীর আত্ম-মূল্যায়ন আমার সকল কষ্টকে তুলে এনে ‘আমার হৃদয়ের সামনে হাজির করল’ (শ্লোক ১৮: ১৫)। এতে এক প্রবল ঝড় ও প্রবল অশ্রু বর্ষণ সৃষ্টি হলো। গোঙানির সঙ্গে সব অশ্রু ঝরাতে আমি অলিপিয়াসের পাশ থেকে উঠে পড়লাম (কান্নার জন্যে নিঃসঙ্গতা অনেক বেশি জরুরি মনে হয়েছে) …কোনওমতে একটা ডুমুর গাছের নিচে লুটিয়ে পড়লাম, অশ্রুকে আর বাধা দিরাম না। আমার দুচোখে নদী বইতে শুরু করল, তোমার পছন্দের উৎসর্গ (শ্লোক ৫০: ১৯) এবং যদিও এই ভাষায় নয়, কিন্তু এই অর্থে-আমি বারবার তোমাকে বলেছি, আর কতদিন, হে প্রভু, আর কতদিন এমন তীব্র রাগান্বিত থাকবে?’ (শ্লোক ৬: ৪)
পশ্চিমে ঈশ্বর আমাদের কাছে খুব সহজে ধরা দেননি। অগাস্তিনের বিশ্বাস পরিবর্তনকে মনস্তাত্বিক অ্যাবরিঅ্যাকশন মনে হয়, যার পর নবদীক্ষিতের মাঝে সব আবেগ হারিয়ে ঈশ্বরের বাহুতে ক্লান্ত হয়ে লুটিয়ে পরার অনুভূতি জাগে। মাটিতে লুটিয়ে কান্নার সময় অগাস্তিন অকস্মাৎ কাছের এক বাড়ি থেকে শিশুকণ্ঠে ‘তোলে, লেগে: হাতে নাও, পড়, হাতে নাও, পড়! বাক্যটির পুনরাবৃত্তি শুনতে পান। একে প্রত্যাদেশ ধরে নিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ান অগাস্তিন এবং বিস্মিত অবস্থায় দ্রুত অসুস্থ আলিপিয়াসের কাছে ছুটে গিয়ে তাঁর নিউ টেস্টামেন্টখানা তুলে নেন । রোমানদের উদ্দেশে রাখা সেইন্ট পলের বক্তব্যের পাতা মেলে ধরেন তিনিঃ দাঙ্গা এবং মদ্যপানের অনুষ্ঠানে নয়, যৌনতা ও নোংরামিতে নয়, যুদ্ধ-বিদ্রোহে নয়, বরং প্রভু জেসাস ক্রাইস্টকে গ্রহণ কর এবং দেহ আর এর লালসার জন্যে কোনও ব্যবস্থা রেখো না।’ এক দীর্ঘ সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ঘটল: ‘আমার আর বেশি পড়ার প্রয়োজন বা ইচ্ছা হলো না, স্মৃতিচারণ করেছেন অগাস্তিন, এই বাক্যটির শেষ শব্দটি শেষ হওয়ামাত্রই যেন সকল উৎকণ্ঠা থেকে মুক্তির এক আলো আমার সারা হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়ল। সন্দেহের সকল ছায়া মিলিয়ে গেল।
অবশ্য ঈশ্বর আনন্দেরও উৎস হতে পারেন: কিন্তু এই ধর্মান্তরকরণের অল্পদিন পরেই অগাস্তিন মা মনিকার সঙ্গে তিবার নদীর তীরে অসতিয়ায় এক পরম আনন্দের অনুভূতি লাভ করেন। সপ্তম অধ্যায়ে এ বিষয়টি আরও বিস্তারিত আলোচনা করব আমরা। প্লেটোবাদী হিসাবে অগাস্তিন জানতেন ঈশ্বরকে অন্তরেই পাওয়া যায়। কনফেশনস-এর দশম পর্বে তিনি তাঁর ভাষায়, মেমোরিয়া বা স্মৃতির বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এটা মনে রাখার চেয়ে অনেক জটিল একটি প্রক্রিয়া, মনস্তাত্ত্বিকগণ যাকে বলছেন অবচেতন, তার অনেক কাছাকাছি। অগাস্তিনের কাছে স্মৃতি একসঙ্গে গোটা মন-চেতন ও অবচেতন-এর পরিচায়ক। এর জটিলতা ও বৈচিত্র্য তাঁকে বিস্ময়াভিভূত করেছিল। এটা ছিল এক ভীতি-জাগানো রহস্য, ইমেজ, আমাদের অতীত আর অসংখ্য প্রান্তর, খাদ ও গুহার অস্তিত্বে ভরা এক অপরিমেয় জগৎ। এই গিজগিজে অন্তর জগতেই ঈশ্বরের সন্ধানে অবতরণ করেছিলেন অগাস্তিন, যিনি আপাত স্ববিরোধীভাবে তার অন্তর-বাইরে দুভাবেই ছিলেন। বাহ্যিক জগতের ঈশ্বরের ভেতর এবং বাইরে দুজায়গাতেই ছিলেন। কেবল বাহ্যিক জগতে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ খোঁজা অর্থহীন। মনের প্রকৃত জগতেই কেবল তার । সন্ধান মিলতে পারে:
আমি তোমাকে ভালোবেসেছি, সৌন্দর্য যুগপৎ কত পুরোনো আবার একেবারে নতুন, আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। আর দেখ, তুমি ছিলে অন্তরে, আমি ছিলাম বাইরের জগতে আর সেখানে খুঁজেছি তোমাকে, আর আমার অসুন্দর অবস্থায় তোমার সৃষ্ট সুন্দর সব জিনিসের মাঝে ঝাঁপ দিয়েছি। আমার সঙ্গে ছিলে তুমি, কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে ছিলাম না । সুন্দর সব জিনিস আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল, অথচ তোমার মাঝে তাদের অস্তিত্ব না থাকলে তাদের কোনও অস্তিত্বই থাকত না।[৩৩]
সুতরাং ঈশ্বর কোনও বস্তুগত সত্তা বা বাস্তবতা নন, বরং আত্মার জটিল গহ্বরের আধ্যাত্মিক সত্তা। অগাস্তিন কেবল প্লেটো আর প্লাটিনাসের সঙ্গে নয়, বরং নিরীশ্বরবাদী ধর্মের বৌদ্ধ, হিন্দু এবং শামানদের অভিজ্ঞতারও অংশী হয়েছেন। তারপরেও তাঁর উপাস্য কোনও নৈর্ব্যক্তিক ঈশ্বর ছিলেন না, বরং জুদো-ক্রিস্টান ঐতিহ্যের প্রবলভাবে ব্যক্তিক ঈশ্বর । ঈশ্বর মানুষের দুর্বলতার মাঝে স্থান করে নিয়েছেন এবং তার সন্ধানে গেছেন:
আমার বধির অবস্থাকে ছিন্ন করে সজোরে আহ্বান আর চিৎকার করলে তুমি। তুমি ছিলে তীব্র উজ্জ্বল, আমার অন্ধত্বকে দূর করে দিয়েছ। সুবাসিত ছিলে তুমি, আমি শ্বাস গ্রহণ করেছি আর এখন তোমার পেছনে ছুটছি। আমি তোমার স্বাদ গ্রহণ করেছি, অনুভব করেছি আর তোমার জন্যে আমার ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটেনি। আমাকে তুমি স্পর্শ করেছ আর আমি তোমার শান্তির খোঁজ পেতে অগ্নিতে আক্রান্ত হয়েছি।[৩৪]
গ্রিক ধর্মবিদরা সাধারণত তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা ধর্মতত্ত্বীয় রচনায় উল্লেখ করেননি, কিন্তু অগাস্তিনের ধর্মতত্ত্ব তার একান্ত ব্যক্তিগত কাহিনী থেকে জন্ম নিয়েছে।
মনের প্রতি অগাস্তিনের দুর্বলতা তাঁকে পঞ্চম শতকের প্রথম দিকে লিখিত ত্রিত্ববাদের নিজস্ব মনস্তাত্ত্বিক প্রবন্ধগুচ্ছ দে ত্রিনিতে (De Trinitate) গড়ে তুলতে প্ররোচিত করেছে। ঈশ্বর যেহেতু নিজ প্রতিমূর্তিতে আমাদের সৃষ্টি করেছেন, সেহেতু আমাদের মনের গভীরে এক ট্রিনিটির অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে পারা উচিত। গ্রিকরা আদিভৌতিক রহস্যময়তা ও বাহ্যিক পার্থক্য উপভোগ করত। অগাস্তিন সেদিকে না গিয়ে আমাদের অধিকাংশের প্রত্যক্ষ করা সত্যের মূহুর্ত দিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন। আমরা যখন ‘ঈশ্বরই আলো’ বা ‘ঈশ্বরই সত্য জাতীয় কথা শুনি, তখন আমাদের আধ্যাত্মিক আগ্রহ বেড়ে ওঠা টের পাই এবং মনে করি যে ঈশ্বর আমাদের জীবনের একটা মূল্য ও অর্থ দিতে পারেন। কিন্তু ওই মুহূর্তের আলোকনের পর আমরা আবার আমাদের স্বাভাবিক মানসিক অবস্থায় ফিরে আসি, যেখানে আমরা পরিচিত এবং পার্থিব বস্তুতে’[৩৫] মোহান্ধ হয়ে থাকি। আমরা যত চেষ্টাই করি না কেন, আমাদের পক্ষে আর সেই অব্যক্ত আকাঙ্ক্ষার মুহূর্তটির নাগাল পাওয়া সম্ভব হয় না। চিন্তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া আমাদের কাজে আসবে নাঃ পরিবর্তে আমাদের তিনি সত্য ধরনের বাক্য দিয়ে ‘মন কী বোঝে’ সেটা বুঝতে হবে। কিন্তু যাকে চিনি না সেই সত্তাকে কি ভালোবাসা সম্ভব? অগাস্তিন দেখাতে চেয়েছেন, যেহেতু আমাদের প্রত্যেকের মনে প্লেটোর ইমেজের মতো ঈশ্বরের প্রতিবিম্ব স্বরূপ এক ট্রিনিটির অস্তিত্ব আছে, তাই আমরা আমাদের আদি রূপের-আদি নকশা–যার ভিত্তিতে আমাদের আকার দেওয়া হয়েছে-আকাক্ষা করি।
মন নিজেকে ভালোবেসেছে, এ দিয়ে যদি শুরু করি, আমরা ট্রিনিটির দেখা পাই না, দেখা মেলে দ্বিত্বের: ভালোবাসা ও মন। কিন্তু মন নিজের সম্পর্কে সজাগ না থাকলে আমরা যাকে আত্মসচেতনতা বলি সেটা সহ-নিজেকে ভালোবাসতে পারবে না। দেকার্তের আভাসে অগাস্তিন যুক্তি দেখিয়েছেন যে, আমাদের নিজেদের সম্পর্কে জ্ঞান অন্য সমস্ত নিশ্চয়তার মূল ভিত্তি। এমনকি সন্দেহের অনুভূতিও আমাদের আত্মসচেতন করে তোলে।
সুতরাং, আত্মার মাঝে তিনটি গুণের বাস: স্মৃতি, উপলব্ধি ও ইচ্ছা; যেগুলো যথাক্রমে জ্ঞান, আত্ম-জ্ঞান ও ভালোবাসার সঙ্গে সম্পর্কিত। স্বর্গীয় তিন ব্যক্তির মতো এই মানসিক কর্মকাণ্ডগুলো আবশ্যিকভাবে এক, কারণ এগুলো তিনটি আলাদা মন গঠন করে না, বরং প্রত্যেকে গোটা মনুকে পরিপূর্ণ করে রাখে ও বাকি দুটোকে আবৃত করে: ‘আমার মনে আছে যে, স্মৃতি, উপলব্ধি আর ইচ্ছা আছে আমার, আমি বুঝি যে আমি বুঝি, আমার ইচ্ছা আছে। ও আমি মনে করতে পারি। আমি আমার নিজস্ব ইচ্ছা, উপলব্ধি ও স্মৃতিশক্তিকে পরিচালিত করতে পারি।৩৮ কাপাদোসিয়দের বর্ণিত স্বর্গীয় ট্রিনিটির মতো তিনটি উপাদানের সবগুলোই, সুতরাং, একটি জীবন, একটি মন ও একটি সত্তা তৈরি করে।৩৯
তবে আমাদের মনের কর্মধারা বোঝাটা কেবল প্রথম পদক্ষেপ: আমরা আমাদের মনে যে ট্রিনিটির মুখোমুখি হই, সেটা স্বয়ং ঈশ্বর নন, বরং আমাদের স্রষ্টা ঈশ্বরের একটা চিহ্ন। আথানাসিয়াস ও গ্রেগরি অভ নাইসা উভয়ই মানুষের আত্মায় ঈশ্বরের পরিবর্তনকারী উপস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে আয়নায় প্রতিফলনের তুলনা টেনেছিলেন। একে সঠিকভাবে বোঝার জন্যে আমাদের অবশ্যই স্মরণ করতে হবে যে গ্রিকরা আয়নায় সৃষ্ট প্রতিবিম্বকে বাস্তব বলে বিশ্বাস করত, দর্শকের চোখ থেকে বিচ্ছুরিত আলো বস্তু হতে আসা আলোর সঙ্গে মিলে কাঁচের গায়ে আকৃতির সৃষ্টি করে। অগাস্তিনের বিশ্বাস ছিল, মনের ট্রিনিটিও একটা প্রতিফলন যাতে ঈশ্বরের উপস্থিতি রয়েছে, যা তার দিকে গমন করে। কিন্তু কীভাবে আমরা আয়নায় গভীরভাবে সৃষ্ট প্রতিফলিত ইমেজ পেরিয়ে স্বয়ং ঈশ্বরের কাছে যেতে পারি? কেবল মানবীয় প্রয়াসে ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যকার বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব নয়। কেবল ঈশ্বর বাণীর রূপ ধরে আমাদের সঙ্গে মিলিত হতে এসেছিলেন বলেই আমরা আমাদের মাঝে ঈশ্বরের প্রতিরূপ পুনঃস্থাপিত করতে পারি, পাপের দরুণ যা ক্ষতিগ্রস্ত বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। নিজেদের আমরা স্বর্গীয় কর্মকাণ্ডের কাছে মেলে ধরি যা আমাদের তিন রকম শৃঙ্খলার সাহায্য বদলে দেবে, অগাস্তিন যাকে বলছেন বিশ্বাসের ট্রিনিটি: রেতিনিও (আমাদের মনে অবতারের সত্য ধারন), কনতেমপ্লাতিও (সেগুলোর কথা ভাবা) ও দাইলেকতি (সেগুলোর মাঝে আনন্দ লাভ করা)। এভাবে ক্রমশঃ আমাদের মনে ঈশ্বরের উপস্থিতির ধারাবাহিক বোধ জাগানোর ভেতর দিয়ে ট্রিনিটি প্রকাশিত হবে। এই জ্ঞান স্রেফ বুদ্ধিগত তথ্যের সংগ্রহ নয়, বরং এক সৃজনশীল অনুশীলন যা আমাদের সত্তার গভীরতর প্রদেশে এক স্বর্গীয় মাত্রার প্রকাশ ঘটিয়ে আমাদেরকে বদলে দেবে ।
পশ্চিমা বিশ্বে সেটা ছিল অন্ধকার, ভয়ানক সময়। বিভিন্ন বর্বর গোত্র ইউরোপে অনুপ্রবেশ করে রোমান সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছিল; পশ্চিমে সভ্যতার পতন অনিবার্যভাবে সেখানে ক্রিশ্চান আধ্যাত্মিকতার ওপর প্রভাব ফেলেছিল। অগাস্তিনের মহান শিক্ষক আমব্রস এমন এক ধর্মবিশ্বাসের প্রকাশ করেছিলেন যেটা ছিল অত্যাবশ্যকীয়ভাবে আত্মরক্ষামূলক: ইস্ত্ৰেগ্ৰেতাস বা সামগ্রিকতা ছিল এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ। চার্চকে এর মতবাদের অখণ্ডতা রক্ষা করতে হচ্ছিল এবং ভার্জিন মেরির নিষ্পাপ দেহের মতো বর্বরদের মিথ্যা মতবাদ হতে একে মুক্ত রাখতেই হবে (যাদের অনেকেই আরিয়ানিজমে দীক্ষা নিয়েছিল)। অগাস্তিনের পরবর্তী কালের রচনায় এক গভীর দুঃখবোধও রয়েছে। রোমের পতন তাঁর আদি পাপ-এর মতবাদকে প্রভাবিত করেছিল, পরবর্তীকালে যা পশ্চিমা বিশ্বদৃষ্টির রূপ পাবে। অগাস্তিন বিশ্বাস করতেন যে, স্রেফ আদমের পাপের কারণে ঈশ্বর মানুষকে অনন্ত নরক যন্ত্রণায় নিক্ষেপ করেছেন। এই সহজাত অপরাধ যৌন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাঁর সকল বংশধরদের মাঝে সংক্রমিত হয়েছে, যৌনক্রিয়া আবার, অগাস্তিন যাকে বলেছেন, ‘উদগ্র-লালসায় দুষিত। উদগ্র-লালসা হচ্ছে ঈশ্বরের পরিবর্তে তুচ্ছ প্রাণীর মাঝে আনন্দ সন্ধান; যৌনক্রিয়ার সময় যখন আমাদের যুক্তিবোধ কামনা ও আবেগে পুরোপুরি ভেসে যায়, যখন ঈশ্বর পুরোপুরি বিস্মৃত হন ও প্রাণীকূল নির্লজ্জভাবে পরস্পরকে নিয়ে আনন্দে মগ্ন হয়, তখন প্রবলভাবে এটা অনুভূত হয়। শিহরণের ডামাডোল ও বেসামাল কামনায় যুক্তির এই প্রতীক বা ইমেজের পতন ঘটে। অবৈধ কামনা অস্বস্তি করভাবে বর্বরদের হাতে পশ্চিমে আইন-শৃঙ্খলার যুক্তির উৎস রোমের পতনের মতো। অগাস্তিনের কঠোর মতবাদ এ দুইকে মিলিয়ে এক নিষ্করুণ ঈশ্বরের ভয়ঙ্কর চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন:
পাপের ফলে (স্বর্গ হতে) বহিষ্কৃত আদম তার উত্তরসুরিকেও মৃত্যু ও নরকবাসের সাজায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দিয়েছেন, যে উত্তরসূরিকে তিনি স্বয়ং পাপের দ্বারা একেবারে শেকড়ে বিনষ্ট করেছেন; সুতরাং (উদগ্র যৌন লালসার মাধ্যমে, যার দ্বারা অবাধ্যতার কারণে তার ওপর এক জুৎসই শাস্তি আরোপ করা হয়েছিল। তাঁর এবং তাঁর সঙ্গীনি হতে-যিনি তাঁর পাপের কারণ এবং শাস্তিভভাগোর সঙ্গীনি হতে-নতুন যে বংশধরই আসুক না কেন আদি পাপের ভার বহন করতে হবে তাঁকে যুগ যুগ ধরে, যার দ্বারা চূড়ান্ত ভাবে বিদ্রোহী দেবদূতদের সঙ্গে সীমাহীন শাস্তির মুখোমুখি না হওয়া পর্যন্ত …এটা নিজেই অসংখ্য ভ্রান্তি ও দুঃখের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে থাকবে, সুতরাং, ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে, মানুষের হতভাগ্য পিণ্ডটি নিথর পড়েছিল, গড়াগড়ি যাচ্ছিল অশুভের মাঝে; এক ভ্রান্তি থেকে আরেক ভ্রান্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল; যোগ দিয়েছে পাপাচারী একদল দেবদূতের সঙ্গে, সবচেয়ে জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতার সবচেয়ে ন্যায়সঙ্গত মাশুল গুনছে।
ইহুদি বা গ্রিক অর্থডক্স ক্রিশ্চানদের কেউই আদমের পতনকে এমন ভয়ানক দৃষ্টিতে দেখেনি; পরবর্তীকালে মুসলিমরাও আদি পাপের এমন কঠোর ধর্মতত্ত্ব গ্রহণ করেনি। পশ্চিমে অনন্য এই মতবাদ অতীতে তারতুলিয়ানের বর্ণিত ঈশ্বরের চেহারা আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে।
অগাস্তিন আমাদের এক কঠিন ঐতিহ্যের উত্তরসূরি করে গেছেন। যে ধর্মটি নারী ও পুরুষকে আপন মানব সত্তাকে বংশপরম্পরায় ত্রুটিপূর্ণ হিসাবে দেখার শিক্ষা দেয়, সেটা তাদেরকে আপন থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। সাধারণভাবে যৌনতাকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখা ও বিশেষ করে নারীদের অসম্মানে এই বিচ্ছিন্নতা অনেক বেশি স্পষ্ট। যদিও আদিতে খৃস্টধর্ম নারীদের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ছিল, কিন্তু অগাস্তিনের সময়েই এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক প্রবণতায় আক্রান্ত হয়েছিল এটা। নারীদের প্রতি জেরোমির বিদ্বেষপূর্ণ চিঠিপত্রগুলোকে কখনও কখনও বিকৃতির পরিচায়ক বলে মনে হয়। তাতুলিয়ান নারীদের অশুভ প্রলোভন ও মানব জাতির জন্যে চিরকালীন বিপদ বলে অভিযুক্ত করেছিলেন:
তোমরা কী জান না যে, তোমরা প্রত্যেকেই একেকজন ইভ? বর্তমান যুগে তোমাদের লিঙ্গের ওপরই ঈশ্বরের সাজা বহাল আছে: অপরাধকে প্রয়োজনের তাগিদে থাকতে হবে। তোমরা শয়তানের দরজা; তোমরা সেই নিষিদ্ধ বৃক্ষের উন্মোচক; তোমরা স্বর্গীয় আইনের প্রথম লঙ্ঘনকারী; তোমরাই সেই শয়তান যাকে আক্রমণ করার সাহস পায়নি, তাকে প্রলুব্ধ করেছ। তোমরা ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি মানুষকে হেলাফেলায় ধ্বংস করেছ। তোমাদের সীমালঙ্ঘনের কারণে এমনকি ঈশ্বরের পুত্রকেও মরতে হয়েছিল ৪৪
সায় দিয়েছেন অগাস্তিন; ‘মা হোক বা স্ত্রী হোক, কী এসে যায়, এক বন্ধুকে লিখেছিলেন তিনি, তারপরও এরা প্রলুব্ধকারীই, প্রত্যেক নারীর ভেতর যার অস্তিত্বের ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।৪৫ আসলে ঈশ্বর যে নারী সৃষ্টি করেছেন, এটা নিয়েই বিভ্রান্তিতে পড়ে গিয়েছিলেন অগাস্তিন, যদি আদমের একজন ভালো সঙ্গী ও কথা বলার মানুষের প্রয়োজন থেকেই থাকে, সেক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী সৃষ্টি না করে বন্ধু হিসাবে দুজন পুরুষের ব্যবস্থা করলেই অনেক ভালো হতো। সন্তান ধারণই নারীর একমাত্র কাজ, যার ফলে যৌন রোগের মতো আদি পাপ পরবর্তী প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে। যে ধর্মটি মানবজাতির অর্ধাংশকে বাঁকা চোখে দেখে আর অনিচ্ছাকৃত যেকোনও মন, হৃদয় ও দেহের নড়াচড়াকে মনে করে মারাত্মক উগ্র যৌন লালসা, সে ধর্মটি কেবল নারী ও পুরুষকে তাদের অবস্থানচ্যুতই করতে পারে। পশ্চিমা খৃস্টধর্ম কখনওই এই বিকৃত পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের বিন্যাসের প্রতিটি পর্যায়ে ভারসাম্যহীন প্রতিক্রিয়ায় এটা এখনও চোখে পড়ে। পুবের নারীরা যখন এই সময়ে ওইকুমিনের নারীদের বহনকারী হীনম্মন্যতার ভার বহন করছিল, তখন পশ্চিমে তাদের বোনেরা বহন করেছিল ঘৃণা ও পাপময় যৌনতার বাড়তি ছাপ; যে ঘৃণা আর আতঙ্ক তাদের সমাজ বিচ্ছিন্ন করার কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।
ঈশ্বরের ধারণা যেখানে দেহে পরিণত হয়েছে ও আমাদের মানবীয় পরিচয়ের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে ক্রিশ্চানদের দেহের প্রতি আরও মর্যাদাশীল হওয়া উচিত ছিল, উল্টো ব্যাপারটি ঘটা অদ্ভুত এক পরিহাস বটে। এই জটিল বিশ্বাস নিয়ে আরও বিতর্ক হয়েছিল। চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে আপোলিনারিয়াস নেস্টোরিয়াস ও ইউতিচেস-এর মতো ‘ধর্মদ্রোহীগণ’ কঠিন সব প্রশ্নের উত্থাপন করেছেন। সৃষ্টের ঐশ্বরিকতা কীভাবে তার মানবরূপের সঙ্গে খাপ খেয়েছে? মেরি নিশ্চয়ই ঈশ্বরের মাতা নন, বরং মানুষ জেসাসের মাতা? ঈশ্বর অসহায় ক্রন্দনরত শিশু হন কীভাবে? বরং এটাই বলা কি বেশি সঙ্গত নয় যে তিনি মন্দিরের মতো খৃস্টের বিশেষ অন্তরঙ্গ ছিলেন? স্পষ্ট সামঞ্জস্যহীনতা সত্ত্বেও অর্থডক্সরা তাদের মতবাদ আঁকড়ে ছিল । বিশপ অভ আলেকজান্দ্রিয়া সিরিল আথানাসিয়াসের বিশ্বাস পুনরাবৃত্তি করেন: ঈশ্বর প্রকৃতই আমাদের পঙ্কিল জগতে এত গভীরভাবে নেমে এসেছিলেন যে তাঁকে এমনকি মৃত্যু ও অসহায়ত্বের স্বাদ গ্রহণ করতে হয়েছে। ঈশ্বর সম্পূর্ণ যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে, কষ্টভোগ বা পরিবর্তনে অক্ষম, এরকম দৃঢ় একটা বিশ্বাসের সঙ্গে এই বিশ্বাস মেলানো কঠিন মনে হয়েছে। প্রধানত স্বর্গীয় আপাথিয়া দিয়ে বৈশিষ্ট্যায়িত গ্রিকদের দূরবর্তী ঈশ্বরকে জেসাস ক্রাইস্টের মাঝে দেহধারণকারী ঈশ্বর হতে একেবারেই আলাদা মনে হয়েছে। অর্থডক্সরা ভেবেছে কষ্ট ভোগকারী অসহায় ঈশ্বরের ধারণাকে প্রবল আক্রমণাত্মক হিসাবে আবিষ্কারকারী ‘ধর্মদ্রোহীরা এর রহস্য ও বিস্ময়ের ঐশীরূপ বিনষ্ট করতে চেয়েছেন। অবতারবাদের বৈপরীত্যকে হেলেনিক ঈশ্বরের প্রতিষেধক মনে হয়-যিনি আমাদের আত্মতুষ্টি দূর করার জন্যে কিছুই করেননি এবং যিনি পুরোপুরি যৌক্তিক ছিলেন।
৫২৯ সালে সম্রাট জাস্তিনিয়ান অ্যাথেন্সে বুদ্ধিবৃত্তিক পৌত্তলিকতাবাদের শেষ ঘাঁটি দর্শনের প্রাচীন বিদ্যাপীঠ বন্ধ করে দেন: এর শেষ পণ্ডিত ছিলেন প্রটিনাসের বিশেষ অনুরাগী শিষ্য প্রক্লাস (৪১২-৪৮৫)। পৌত্তলিক দর্শন আড়ালে চলে যায় এবং নতুন খৃস্টধর্মের কাছে পরাস্ত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। যাহোক, চার বছর পর চারখানা অতিন্দ্রীয়বাদী প্রবন্ধ রচনা প্রকাশিত হয় যেগুলোর রচয়িতা সেইন্ট পলের প্রথম আথেনিয় দীক্ষাপ্রাপ্ত ডেনিস দ্য আরোপাগাইত হিসাবে কথিত। আসলে এগুলো লিখেছিলেন পরিচয় গোপন করে যাওয়া জনৈক ষষ্ঠ শতকীয় গ্রিক ক্রিশ্চান। কিন্তু ছদ্মনামের একটা প্রতীকী ক্ষমতা ছিল, যা মূল লেখকের পরিচয়ের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ: ছদ্ম ডেনিস নিওপ্লেটোনিজমের দর্শনকে ব্যাপ্টাইজ করতে সক্ষম এবং গ্রিকদের ঈশ্বরের সঙ্গে বাইবেলের সেমেটিক ঈশ্বরকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন।
ডেনিস কাপাদোসিয় পাদরিদেরও উত্তরাধিকারী ছিলেন। বাসিলের মতো তিনিও কেরিগমা ও ডগমার পার্থক্যকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন। এক চিঠিতে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, দুটো ধর্মতত্ত্বীয় ধারা রয়েছে এবং দুটোই অ্যাপসলদের কাছ থেকে প্রাপ্ত। কেরিগমা সম্বলিত গস্পেলসমূহ স্পষ্ট ও সহজবোধ্য এবং ডগমা সম্পর্কিত গস্পেলগুলো অস্পষ্ট ও অতিন্দ্রীয়। অবশ্য দুটোই পরস্পর হতে স্বাধীন, কিন্তু খৃস্টধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একটা প্রতীকী ও শিষ্যত্বের কথা বলে, আর অপরটি ‘দার্শনিক ও প্রমাণের ক্ষমতা রাখে’-এবং সব কিছুর মাঝে অনির্বচনীয় বিজড়িত। কেরিগমা এর স্পষ্ট প্রকাশিত সত্য দিয়ে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যোগায়, কিন্তু ডগমার নীরব বা গুপ্ত ধারা এক রহস্য যা দীক্ষার দাবি করে: ‘এটা দীক্ষার মাধ্যমে আত্মাকে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত ও কার্যকর করে যা কিছু শিক্ষা দেয় না। অ্যারিস্টটলের মতোই একই ভাষায় জোর দিয়ে একথা বলেছেন ডেনিস। এক রকম ধর্মীয় সত্য আছে যা কখনও ভাষা, যুক্তি বা যুক্তিভিত্তিক আলোচনা দিয়ে স্পষ্টভাবে বোঝানো সম্ভব নয়। এর প্রকাশ ঘটে প্রতাঁকের সাহায্যে, সাহিত্যের ভাষা বা ভঙ্গির মাধ্যমে, কিংবা মতবাদ দ্বারা, যেগুলো পবিত্র আড়াল, যা অনির্বচনীয় অর্থকে দৃষ্টির আড়ালে রেখেছে কিন্তু যা আবার চরম রহস্যময় ঈশ্বরকে মানুষের প্রকৃতির সীমাবদ্ধতার সঙ্গে অভিযোজিত করে ও ধারণাগতভাবে না হলেও অন্তত কাল্পনিকভাবে বোধগম্য রূপে বাস্তবতাকে (Reality) প্রকাশ করে।
গুপ্ত বা নিগূঢ় অর্থ কেবল সুবিধাপ্রাপ্ত অভিজাতদের জন্যে নয় বরং সকল ক্রিশ্চানের জন্যে। ডেনিস কেবল সাধু সন্ন্যাসীদের উপযুক্ত কষ্টকর কোনও শৃঙ্খলার পক্ষে কথা বলেননি। সকল বিশ্বাসীর অনুসৃত শাস্ত্রাচার ঈশ্বরকে লাভ করার প্রধান উপায় । তার ধর্মতত্ত্বে এরই প্রাধান্য ছিল। এক শক্ত পর্দার আড়ালে এসব সত্য লুকায়িত থাকার উদ্দেশ্য নারী-পুরুষকে শুভ ইচ্ছা হতে বঞ্চিত করা নয়, বরং সকল ক্রিশ্চানকে অনুমান ও ধারণার বোধ থেকে ঊর্ধ্বে তুলে স্বয়ং ঈশ্বরের অব্যক্ত সত্তার কাছে পৌঁছে দেওয়া। যে বিষয় কাপাদোসিয়দের সকল ধর্মতত্ত্ব অ্যাপোফ্যাটিক হওয়া উচিত, এই দাবি করতে অনুপ্রাণিত করেছিল সেটাই ডেনিসের জন্যে অপ্রকাশযোগ্য ঈশ্বরের কাছে যাবার এক শক্তিশালী পদ্ধতিতে পরিণত হয়েছিল।
প্রকৃতপক্ষে, ডেনিস ‘ঈশ্বর’ শব্দটি ব্যবহার করারই পক্ষপাতি ছিলেন–এর কারণ সম্ভবত শব্দটি অপর্যাপ্ত ও মানুষ-সদৃশ্য একটা সুর পেয়ে গিয়েছিল। তিনি প্রক্লাসের থিউলজি কথাটি পছন্দ করতেন প্রধানত যা শাস্ত্রীয় ছিল: পৌত্তলিক জগতে থিউলজি ছিল উৎসর্গ ও স্বর্গীয়করণের মাধ্যমে স্বর্গীয় মানা আহরণের উপায় । ঈশ্বর-আলোচনায় ডেনিস এর প্রয়োগ করেছেন, যা সঠিকভাবে উপলব্ধি করা গেলে প্রকাশিত প্রতাঁকে বিজড়িত স্বর্গীয় energeiai ও উন্মুক্ত করতে পারে। তিনি কাপাদোসিয়দের সঙ্গে একমত হয়েছিলেন যে ঈশ্বরের জন্যে সকল ধারণা ও ভাষাই অপর্যাপ্ত এবং একে অবশ্যই আমাদের জ্ঞানের অতীত এক সত্তার সঠিক বিবরণ হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না। এমনকি খোদ ‘ঈশ্বর’ শব্দটিও ত্রুটিপূর্ণ, কেননা ঈশ্বর ‘ঈশ্বরের ঊর্ধ্বে,’ ‘সত্তার অতীত এক রহস্য। ক্রিশ্চানদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে ঈশ্বর, নিম্নস্তরের সত্তাসমূহের সর্বোচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিত আরেকটি সত্তা নন। মানুষ বা অন্যান্য জিনিস ঈশ্বরের বিপরীতে এক আলাদা সত্তা বা বিকল্প সত্তা হিসাবে দাঁড়ায় না, যা জানার কোনও বিষয় হতে পারে। অস্তিত্ব আছে এমন জিনিসগুলোর একটি নন ঈশ্বর; তিনি আমাদের অভিজ্ঞতাজাত যেকোনও কিছুর চেয়ে আলাদা। আসলে ঈশ্বরকে বরং কিছু না’ ডাকাই অধিক সঠিক: এমনকি তিনি আমাদের ট্রিনিটি কোনওটাই নন। তিনি যেমন সকল সত্তার ঊর্ধ্বে তেমনি সকল নামেরও ঊর্ধ্বে। তারপরেও আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে একীভূত হওয়ার একটা পদ্ধতি হিসাবে আমাদের অক্ষমতাকে তার কথা বলার জন্যে ব্যবহার করতে পারি, যা আমাদের প্রকৃতির ‘দেবাত্বোরোপণ’ (theosis) ছাড়া আর কিছু নয়। ঈশ্বর ‘পিতা,’ ‘পুত্র’ ও ‘আত্মার মতো তার কোনও কোনও নাম ঐশীগ্রন্থে আমাদের সামনে প্রকাশ করেছেন, কিন্তু এগুলোর উদ্দেশ্য তাঁর সম্পর্কে তথ্য জানানো নয়, বরং নারী ও পুরুষকে তাঁর দিকে আকৃষ্ট করে তাদের তার স্বর্গীয় প্রকৃতির অংশ গ্রহণে সক্ষম করে তোলা।
দ্য ডিভাইন নেমস্ শিরোনামের প্রবন্ধের প্রত্যেক অধ্যায়ে ঈশ্বর প্রকাশিত একটি কেরিগমা সম্পর্কিত সত্য দিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন ডেনিস: তাঁর মহত্ব (goodness), প্রজ্ঞা, পিতৃত্ব, ইত্যাদি। এরপর তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে যদিও ঈশ্বর এসব উপাধি দিয়ে তাঁর একটা কিছুর প্রকাশ ঘটিয়েছেন, কিন্তু তিনি যা প্রকাশ করেছেন সেটা স্বয়ং তিনি নন। আমরা সত্যিই ঈশ্বরকে বুঝতে চাইলে আমাদেরকে অবশ্যই এসব গুণাবলী ও নাম অস্বীকার করতে এগিয়ে যেতে হবে। এভাবে আমাদের অবশ্যই বলতে হবে তিনি ঈশ্বর আবার ‘ঈশ্বর-নন, ‘ভালো’ বলেই আবার যোগ করতে হবে তিনি ‘ভালো-নন বিপরীত এই ধাক্কা, জানা ও অজানা উভয়কেই ধারণকারী একটি প্রক্রিয়া আমাদের পার্থিব ধারণাসমূহের উর্ধ্বে তুলে নেবে, আমরা স্বয়ং আপ্রকাশঅযোগ্য সত্তার কাছে পৌঁছে যাব। এভাবে আমরা একথা বলে শুরু করব যে:
তাঁর সম্পর্কে উপলব্ধি, যুক্তি, জ্ঞান, স্পর্শ, ধারণা, কল্পনা, নাম ও আরও বহু জিনিস রয়েছে। কিন্তু তাঁকে বোঝা যায় না, তাঁর সম্পর্কে কিছু বলা যায় না, তাঁকে নামও দেওয়া যায় না। তিনি বস্তুসমূহের একটি নন।
সুতরাং ঐশীগ্রন্থ পাঠ ঈশ্বর সম্পর্কে সত্য অবগত হবার কোনও প্রক্রিয়া নয় বরং কেরিগমাকে ডগমায় রূপান্তরিত এক বৈপরীত্যপূর্ণ অনুশীলন হওয়া উচিত। এই পদ্ধতি একটি থিউরজি, স্বর্গীয় ক্ষমতা ধারণ যা আমাদের স্বয়ং ঈশ্বরের কাছে আরোহণে সক্ষম করে তোলে এবং, পুঁটিনাস সব সময় যেমন শিক্ষা দিয়ে গেছেন, আমরা স্বর্গীয় হয়ে উঠি । এটা আমাদের চিন্তা বন্ধ করার একটি পদ্ধতি। আমাদেরকে ঈশ্বর সম্পর্কিত সকল ধারণা ত্যাগ করে যেতে হবে। আমরা আমাদের মনের ক্রিয়া থামাতে বলি। এমনকি ঈশ্বরের গুণাবলীর অস্বীকৃতিও পেছনে ফেলে যেতে হবে। তাহলে এবং কেবল তাহলেই আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে পরমানন্দাদায়ক ঐক্য অর্জন করতে পারব।
পরমানন্দের কথা বলতে গিয়ে মনের বিচিত্র অবস্থা কিংবা অস্পষ্ট যোগ অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জিত সচেতনতার বিকল্প ধরনের কথা বোঝাননি ডেনিস। এটা প্রার্থনা ও থিয়োরিয়ার বিপরীতধর্মী পদ্ধতিতে প্রত্যেক ক্রিশ্চানের আয়ত্ত করার মতো একটা ব্যাপার। এটা আমাদের কথা বন্ধ করবে এবং আমাদের নীরব স্থানে পৌঁছে দেবে। আমরা যখন বুদ্ধির অতীত সেই অন্ধকারে ঝাঁপ দেব, আমরা কেবল ভাষার অভাব দ্বারাই আক্রান্ত হব না, বরং আবিষ্কার করব যে আমরা বাকহারা ও জ্ঞানহীন হয়ে পড়েছি।৫৫ গ্রেগরি অভ নাইসার মতো তিনিও মোজেসের সিনাই পর্বতে আরোহণের কাহিনীকে উপদেশমূলক হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। মোজেস পাহাড়ে ওঠার পর স্বয়ং ঈশ্বরকে দেখতে পাননি, কেবল ঈশ্বর যেখানে ছিলেন সেখানেই উপস্থিত হয়েছিলেন। এক ঘন মেঘের অস্পষ্টতায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিলেন তিনি, কিছুই দেখতে পাননিঃ এভাবে আমরা যেসব দেখতে বা বুঝতে পারি সেগুলো প্রতীকমাত্র (ডেনিস Paradigm শব্দটি ব্যবহার করেছেন) যা সকল চিন্তার অতীত এক সত্তার উপস্থিতি প্রকাশ করে। মোজেস অজ্ঞতার অন্ধকারে পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং এর ফলে এমন কিছুর সঙ্গে মিলিত হতে পেরেছেন যা সকল উপলব্ধিকে ছাড়িয়ে যায়: আমরাও একই রকম আনন্দ লাভ করতে পারব যা। আমাদেরকে আমাদের সত্তার বাইরে নিয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে এক করে দেবে।
ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে মিলিত হতে পর্বতশীর্ষে নেমে আসেন বলেই কেবল এটা সম্ভব। এখানেই নিওপ্লেটোনিজম থেকে সরে এসেছেন ডেনিস। নিওপ্লেটোনিজমে ঈশ্বরকে স্থির ও দূরবর্তী মনে করা হয়েছে, যিনি মানবীয় প্রয়াসে কোনও সাড়া দেন না। গ্রিক দার্শনিকগণের ঈশ্বর যেসব অতিন্দ্রীয়বাদী হঠাৎ করে তাঁর সঙ্গে আনন্দময় মিলনে সক্ষম হতো তাদের ব্যাপারে অসচেতন ছিলেন, অথচ বাইবেলের ঈশ্বর মানুষের কাছে আসেন। ঈশ্বরও এক ‘পরমানন্দ লাভ করেন যা তাঁকে নিজেকে ছাড়িয়ে সৃষ্ট সত্তার নাজুক জগতে নিয়ে আসে:
এবং আমাদেরকে সাহস করে অবশ্যই নিশ্চিত করে বলতে হবে (কেননা এটাই সত্যি) যে, বিশ্বজগতের স্রষ্টা স্বয়ং বিশ্বের প্রতি তাঁর চমৎকার ও সুন্দর আকাঙ্ক্ষা হতে…তার সদয় কার্যক্রমের মাধ্যমে আপনার মাঝে হতে বেরিয়ে আসেন সত্তা আছে এমন সব জিনিসের দিকে…এবং এভাবে সকল কিছুর ঊর্ধ্বে তাঁর অলৌকিক আসন থেকে নেমে আসেন এক আনন্দময় ক্ষমতার মাধ্যমে সকল সত্তার অন্তরে বাস করার জন্যে, এক আনন্দময় ক্ষমতায় যা সকল সত্তার উর্ধ্বে এবং যার মাধ্যমে তিনি আবার নিজের মাঝেই রয়ে যান।
.
এক স্বয়ংক্রিয়া প্রক্রিয়ার বদলে উৎসারণ ভালোবাসা প্রকাশের এক আবেগময় ও স্বতঃস্ফূর্ততায় পরিণত হয়েছিল। ডেনিসের অস্বীকৃতি ও স্ববিরোধিতার কৌশলটি আমরা করি এমন কিছু নয়, এটা এমন কিছু যা আমাদের মাঝে ঘটে।
প্রটিনাসের বেলায় ‘পরমানন্দের ব্যাপারটি ছিল খুবই আকস্মিক ব্যাপার জীবনে মাত্র দু-তিনবার এ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন তিনি। ডেনিস পরমানন্দকে প্রত্যেক ক্রিশ্চানের সার্বক্ষণিক অবস্থা হিসাবে দেখেছেন। এটাই ঐশীগ্রন্থ বা শাস্ত্রের গুপ্ত বা নিগুঢ় বাণী, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভঙ্গিমায় যার প্রকাশ। এভাবে পুরোহিত যখন প্রার্থনা সভার শুরুতে বেদী ছেড়ে প্রত্যাবর্তনের আগে জমায়েতের ভেতর দিয়ে পানি ছিটিয়ে সাঙ্কচুয়্যারির দিকে এগোন, সেটা কেবল পরিশুদ্ধকরণের একটা আচার থাকে না-যদিও তা একটা আচারও বটে-স্বর্গীয় আনন্দের অনুকরণ করে এটা, যার মাধ্যমে ঈশ্বর তাঁর নির্জনতা ত্যাগ করে সৃষ্ট জীবনের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেন। ডেনিসের ধর্মতত্ত্বকে বোঝার সবেচেয়ে সেরা উপায় সম্ভবত এই যে, ঈশ্বর সম্পর্কে আমরা যতটা নিশ্চয়তা দিতে পারি এবং আমাদের বলার সত্যের সবটুকুই যে প্রতীকী এটা উপলব্ধি করার মাঝে আধ্যাত্মিক নাচ হিসাবে একে বিবেচনা করা। ইহুদিবাদের মতো ডেনিসের ঈশ্বরের দুটো বৈশিষ্ট্য রয়েছে: একটা আমাদের দিকে ফেরানো এবং জগতে নিজেকে প্রকাশ করে; অপরটি ঈশ্বরের দূরবর্তী দিক, যা সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য থেকে যায়। তিনি তাঁর চিরকালীন রহস্যের মাঝে নিজের মধ্যেই রয়ে যান, আবার একই সময় সৃষ্টিতে সম্পূর্ণ মিশে থাকেন। জগতের অতিরিক্ত আরেকটি সত্তা নন তিনি। গ্রিক ধর্মতত্ত্বে ডেনিসের পদ্ধতিটি আদর্শে পরিণত হয়। অবশ্য পশ্চিমের ধর্মবিদরা আলোচনা ও ব্যাখ্যা অব্যাহত রাখবেন। কেউ কেউ কল্পনা করেছে যে যখন তারা ‘ঈশ্বর’ শব্দটি উচ্চারণ করে তখন স্বর্গীয় সত্তাটি মনের ধারণার সঙ্গে মিলে যায়। কেউ কেউ আবার তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ঈশ্বরের প্রয়োগ করবে-বলবে ঈশ্বর এটা চেয়েছেন, ওটা নিষেধ করেছেন এবং সেটা পরিকল্পনা করেছেন-এক অর্থে যা বিপজ্জনক রকম পৌত্তলিকতাবাদী । কিন্তু গ্রিক অর্থডক্সের ঈশ্বর রহস্যময়ই রয়ে যাবেন ও ট্রিনিটি প্রাচ্যের ক্রিশ্চানদের কাছে তাদের মতবাদ সমূহের বৈশিষ্ট্যেও কথা মনে করিয়ে যাবে । শেষ পর্যন্ত গ্রিকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, প্রকৃত ধর্মতত্ত্বকে অবশ্যই ডেনিসের দুটো যোগ্যতা পূরণ করতে হবে: একে একাধারে নীরব এবং স্ববিরোধী (Paradoxical) হতে হবে।
গ্রিক ও লাতিনরাও সৃষ্টের ঐশ্বরিকতা সম্পর্কিত তাৎপর্যপূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছিল। অবতারবাদের গ্রিক ধারণাটিকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন বাইন্তাইন ধর্মতত্ত্বের জনক হিসাবে পরিচিত ম্যাক্সিমাস দ্য কনফেসর (৫৮০-৬৬২)। এর সঙ্গে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে বরং বৌদ্ধ আদর্শের অনেক বেশি মিল। ম্যাক্সিমাস বিশ্বাস করতেন যে কেবল ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হলেই মানুষ পূর্ণতা পেতে পারে, ঠিক যেমন বৌদ্ধদের বিশ্বাস ছিল, আলোকপ্রাপ্তিই মানুষের আসল গন্তব্য। এভাবে ঈশ্বর ঐচ্ছিক, মানুষের অবস্থার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া বাহ্যিক অচেনা সত্তা বা বিষয় নন। নারী-পুরুষের অলৌকিকের যোগ্যতা রয়েছে, তা অর্জিত হলেই সে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠবে। আদমের পাপের মোচন ঘটাতে লোগোস মানবমূর্তি ধরেননি; প্রকৃতপক্ষে আদম পাপ না করলেও অবতারের ব্যাপারটা ঘটত। লোগোসের অনুরূপে নারী-পুরুষের সৃষ্টি করা হয়েছিল, একমাত্র এই মিলটি নিখুঁত হলেই তারা পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জন করতে পারবে। তার পাহাড়ে জেসাসের মহিমান্বিত মানবরূপ আমাদের কাঙ্খিত মানবীয় অবস্থা দেখিয়েছে। বাণীকে দেহ দান করা হয়েছে যাতে করে গোটা মানবজাতি মানবরূপী ঈশ্বরের কৃপায় ঈশ্বরে পরিণত হতে পারে সম্পূর্ণ দেহ এবং আত্মায়, প্রকৃতি ও পূর্ণ ঈশ্বরে পরিণত হওয়ার মাধ্যমে, আত্মা এবং দেহে এবং কৃপায়।[৫৭] আলোকন ও বুদ্ধত্বের ক্ষেত্রে যেমন অতিপ্রাকৃত সত্তার হস্ত ক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত হয়নি, বরং মানুষের জন্যে স্বাভাবিক ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলার কথা বলা হয়েছে, এখানেও দেবতায় পরিণত খৃস্ট আমাদের দেখিয়েছেন। যে ঈশ্বরের কৃপায় আমরা কোন স্তরে উঠতে পারি। ক্রিশ্চানরা বরং সেভাবেই মানব-ঈশ্বর জেসাসকে শ্রদ্ধা জানাতে পারে যেভাবে বৌদ্ধরা আলোকপ্রাপ্ত গৌতমের মূর্তিকে শ্রদ্ধা দেখায়: তিনিই (বুদ্ধ) ছিলেন মহিমান্বিত এবং সম্পূর্ণ মানুষের প্রথম উদাহরণ।
অবতারবাদের গ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি খৃস্টধর্মকে যেখানে প্রাচ্যের ঐতিহ্যের অনেক কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল, জেসাস সম্পর্কে পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে একেবারে ভিন্ন পথ গ্রহণ করে। ধ্রুপদী ধর্মতত্ত্বের উদাতা বিশপ অভ ক্যান্টারবারি, আনসেল (১০৩৩-১১০৯) তাঁর হোয়াই গড় বিকেইম ম্যান প্রবন্ধে এই মতবাদ প্রকাশ করেন। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, পাপ এত বড় মাত্রার অবমাননা ছিল যে মানবজাতিকে নিয়ে গৃহীত পরিকল্পনা বাতিল না করার জন্যে পাপ মোচন ছিল অত্যাবশ্যক। আমাদের পক্ষে প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে বাণীকে দেহ দান করা হয়েছিল। ঈশ্বরের বিচারের দাবি ছিল এমন একজনকে দায় শোধ করতে হবে যিনি একাধারে ঈশ্বর ও মানুষ: অপরাধের মাত্রা বুঝিয়ে দিয়েছিল যে কেবল ঈশ্বরের পুত্রই আমাদের মুক্তি নিশ্চিত করতে পারবেন, কিন্তু অপরাধী যেহেতু মানুষ ছিল, তাই মুক্তিদাতাকেও মানবজাতির সদস্য হতে হবে। এটা এক গোছানো, আইনসম্মত প্রকল্প যেখানে ঈশ্বরকে চিন্তাশীল, যাচাইকারী ও বিশ্লেষণকারী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যেন তিনি একজন মানুষ। এটা নিষ্ঠুর ঈশ্বরের পাশ্চাত্য ভাবমূর্তি আরও জোরাল করেছিল, যিনি একধরনের মানব-উৎসর্গের মতো করে নিবেদিত আপন পুত্রের ভয়ঙ্কর মৃত্যুতেই সন্তুষ্ট হতে পারেন।
পাশ্চাত্য জগতে প্রায়শঃই ট্রিনিটির মতবাদকে ভুল বোঝা হয়েছে। মানুষ তিনটি আলাদা স্বর্গীয় চরিত্র কল্পনা করতে চায়, কিংবা গোটা মতবাদটিকে অগ্রাহ্য করে ঈশ্বরকে পিতার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে ও জেসাসকে বানায় স্বর্গীয় বন্ধু-ঠিক সমপর্যায়ের নয়। মুসলিম এবং ইহুদিরাও এ মতবাদকে বিভ্রান্তিকর, এমনকি ব্লাসফেমাস মনে করেছে। কিন্তু তারপরেও আমরা দেখব ইহুদিবাদ ও ইসলামের অতিন্দ্রীয়বাদীরা আশ্চর্যজনকভাবে একই ধরনের ঐশ্বরিক ধারণা সৃষ্টি করেছে। উদাহরণ স্বরূপ, কেনোসিসের ধারণা অর্থাৎ ঈশ্বরের নিজেকে উজার করে দেওয়ার আনন্দের ধারণাটি কাব্বালাহ এবং সুফীবাদ উভয় ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ট্রিনিটিতে ফাদার তিনি যা তার সবটুকুই উজার করে পুত্রকে দিয়ে দেন-এমনকি ভিন্ন জগতে নিজেকে প্রকাশ করার সম্ভাবনাটুকুও। একবার বাণী উচ্চারিত হয়ে যাবার পর, বলা হয়েছে, পিতা নীরব রয়ে যান। তার সম্পর্কে আমাদের আর বলার কিছু থাকে না, যেহেতু আমরা ঈশ্বর হিসাবে কেবল লোগোস বা পুত্রকেই চিনি। সুতরাং পিতার কোনও পরিচয় নেই, স্বাভাবিক অর্থে ‘আমি’বিহীন, এবং ব্যক্তি সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে ঘোলাটে করে দেয়। ‘পরম সত্তা’র একেবারে সূচনায় ‘কিছু না’ যে কেবল ডেনিস লক্ষ করেছেন তা নয়, প্লটিনাস, ফিলো এবং এমনকি বুদ্ধও দেখেছেন। পিতাকে যেহেতু খৃস্টধর্মের ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের শেষ হিসাবে দেখা হয়, সুতরাং কোনও ক্রিশ্চানের যাত্রা স্থানহীন, ঠিকানাহীন এবং সত্তাহীনের দিকে অগ্রসর হওয়ায় পরিণত হয়। ব্যক্তিক ঈশ্বর বা ব্যক্তিতে পরিণত পরম বা চরম সত্তার ধারণা মানুষের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে: হিন্দু ও বুদ্ধদের ভক্তির ব্যক্তি পর্যায়ের আনুগত্যের অনুমোদন দিতে হয়েছিল। কিন্তু ট্রিনিটির উদাহরণ বা প্রতীক বোঝাতে চায় যে, ব্যক্তিত্বকে অবশ্যই অতিক্রম করে যেতে হবে এবং ঈশ্বরকে মানুষের বর্ধিত রূপ ভাবা ও তাকে আমাদের মতো আচরণ বা চলাফেরা করছেন বলে কল্পনা করাটা যথেষ্ট নয়।
অবতারবাদের মতবাদকে বহুঈশ্বরবাদিতা রোধ করার আরেকটি পদক্ষেপ হিসাবেও দেখা যেতে পারে। একবার ‘ঈশ্বর’কে ‘মহাশূন্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন সত্তা হিসাবে দেখা হলে অতি সহজেই তাঁর সামান্য মূর্তি বা প্রতাঁকে পরিণত হওয়ার সম্বাবনা থাকে, যা মানুষকে আপন বৈশিষ্ট্যর বাইরে এনে আপন সংস্কার ও আকাক্ষার উপাসনায় সক্ষম করে তোলে। অপরাপর ধর্মীয় ঐতিহ্যগুলো ব্রাক্ষ্মণ-আত্মার উদাহরণের মতো পরম সত্তা মানবীয় রূপের সঙ্গে কোনওভাবে মিশে আছেন, এমন ধারণায় জোর দিয়ে এটা ঠেকানোর প্রয়াস পেয়েছে । আরিয়াস-এবং পরে নেস্টোরিয়াস এবং ইউতিচেস-প্রত্যেকে জেসাসকে মানুষ বা ঐশী সত্তার যেকোনও একটি বানাতে চেয়েছিলেন এবং তাদের বাধা দেওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল মানুষ ও ঐশীরূপকে আলাদা করে রাখার প্রবণতা। একথা ঠিক যে, তাদের সমাধান অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত ছিল, কিন্তু ডগমাকে–কেরিগমার বিপরীত-কবিতা বা সঙ্গীতের মতো পুরোপুরি প্রকাশযোগ্যতার মাঝে আটকে রাখা উচিত হবে না। অবতার মতবাদ-আথানাসিয়াস এবং ম্যাক্সিমাস কোনওভাবে যা প্রকাশ করেছেন ঈশ্বর’ এবং মানুষ যে অবিচ্ছেদ্য হতে বাধ্য সেই বিশ্বজনীয় দর্শন প্রকাশেরই এক প্রয়াস। পশ্চিমে, যেখানে অবতারবাদের ধারণার বিকাশ এভাবে হয়নি, সেখানে ঈশ্বরের একটি বাহ্যিক সত্তা ও আমাদের পরিচিত জগতের এক বিকল্প সত্তা রয়ে যাবার প্রবণতা রয়ে গেছে। পরিণামে এই ‘ঈশ্বর’কে-প্রক্ষিপ্ত করা খুব সহজ ছিল, যা সাম্প্রতিককালে অবনমিত হয়ে গেছে।
তা সত্ত্বেও জেসাসকে একমাত্র অবতার বানানোর মাধ্যমে, আমরা দেখেছি, ক্রিশ্চানরা ধর্মীয় সত্যের এক আলাদা মতবাদ গ্রহণ করেছে: জেসাস ছিলেন মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের প্রথম ও শেষ বাণী, যার ফলে ভবিষ্যতের প্রত্যাদেশ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। ফলে, ইহুদিদের মতো তারাও সপ্তম শতাব্দীতে আরবে এক পয়গম্বর আবির্ভূত হয়ে ঈশ্বরের কাছ থেকে সরাসরি প্রত্যাদেশ লাভ ও আপন জাতির জন্যে এক নতুন ঐশীগ্রন্থ আনার দাবি করলে ক্ষুব্ধ হয়েছিল। তবু শেষ পর্যন্ত একেশ্বরবাদের নতুন রূপ ‘ইসলাম’ নামে পরিচিত হয়ে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে। এই ধর্মটির বহু উৎসাহী নবদীক্ষিত এখানকার (যেখানে হেলেনিজম ছিল বিদেশী মতবাদ) গ্রিক ত্রিত্ববাদ হতে স্বস্তির সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, সেখানে এমন এক বাগধারায় ঈশ্বরের রহস্যকে প্রকাশ করে যা তাদের অচেনা ছিল, স্বর্গীয় সত্তার অধিকতর সেমেটিক ধারণাকেই বেছে নেয় তারা ।
০৫. একত্ব: ইসলামের ঈশ্বর
৬১০ সালের দিকে হিজাজের সমৃদ্ধ শহর মক্কায় এক আরব বণিক, যিনি কোনওদিন বাইবেল পড়েননি এবং সম্ভবত ইসায়াহ্, জেরেমিয়াহ্ বা ইযেকিয়েলের নামও শোনেননি, এমন এক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন যা আশ্চর্যজনকভাবে তাঁদের অভিজ্ঞতার অনুরূপ। মক্কার কুরাইশ গোত্রের সদস্য মুহাম্মদ ইবন আব্দাল্লাহ প্রত্যেক রমযান মাসে আধ্যাত্মিক ধ্যানে মগ্ন হবার উদ্দেশ্যে সপরিবারে হিরা পর্বতে যেতেন। পেনিনসুলার আরবদের মাঝে এটা একটা সাধারণ ব্যাপার ছিল। আরবদের পরম ঈশ্বরের উদ্দেশে প্রার্থনা ও পবিত্র মাসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা দরিদ্রদের মাঝে খাবার আর অর্থ দান করে সময় কাটাতেন তিনি। সম্ভবত উদ্বেগাকুল ভাবনাতেও প্রচুর সময় ব্যয় করতেন তিনি। মুহাম্মদের (স) পরবর্তী জীবনচরিত হতে আমরা জানি যে, মক্কার সাম্প্রতিক অতিচমকপ্রদ সাফল্য সত্ত্বেও সেখানকার এক উদ্বেগজনক অস্থিরতার ব্যাপারে দারুণ সজাগ ছিলেন তিনি। মাত্র দুই প্রজন্ম আগে আরবের মরুপ্রান্তরের অন্যান্য বেদুঈন গোত্রের মতো যাযাবরের কঠিন জীবন যাপন করে এসেছে কুরাইশরা: প্রতিদিন টিকে থাকার জন্যে প্রয়োজন হয়েছে কঠিন সগ্রামের। অবশ্য ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষদিকের বছরগুলোয় ব্যবসা বাণিজ্যে দারুণ সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয় তারা এবং মক্কাকে আরবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত করে। ওরা এত ধনী হয়ে ওঠে যা তাদের স্বপ্নের অতীত ছিল। কিন্তু তাদের আমূল বদলে যাওয়া জীবনধারার অর্থ ছিল তীব্র ও নিষ্ঠুর এক পুঁজিবাদের কাছে প্রাচীন গোত্রীয় মূল্যবোধগুলোর পরাস্ত হয়ে যাওয়া। মানুষ কেমন যেন দিশাহারা ও উন্মুল বোধে আক্রান্ত ছিল। মুহাম্মদ (স) জানতেন যে এক বিপজ্জনক পথে এগোচ্ছে কুরাইশরা; নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করার জন্যে একটা মতাদর্শ খুঁজে পাবার প্রয়োজন ছিল।
এসময় যেকোনও রাজনৈতিক সমাধানই ধর্মীয় ধরনের হতো। মুহাম্মদ (স) জানতেন, কুরাইশরা অর্থ-কেন্দ্রিক এক নতুন ধর্ম গড়ে তুলছিল। এটা খুব একটা বিস্ময়কর ছিল না, কারণ নিশ্চয়ই তাদের মনে এই ধারণা জন্মেছিল যে সম্পদই যাযাবর জীবনের বিপদ থেকে তাদের রক্ষা করেছে, আরবের মরুপ্রান্তরের সাধারণ বৈশিষ্ট্য অপুষ্টি ও গোত্রীয় সহিংসতা থেকে দূরে সরিয়ে এনেছে, যেখানে প্রত্যেক বেদুঈন গোত্র প্রতিদিন বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কার মোকাবিলা করত। এখন পর্যাপ্ত খাবার হয়েছে তাদের, মক্কাকে বাণিজ্য ও বিপুল বিনিয়োগের আন্তর্জাতিক কেন্দ্রে রূপান্তরিত করছিল তারা। নিজেদেরই আপন ভাগ্য নিয়ন্তা বলে ভেবেছে; কেউ কেউ এমনকি এমনও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, সম্পদ তাদের এক ধরনের অমরত্ব দান। করবে। কিন্তু মুহাম্মদের (স) বিশ্বাস ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণতার (ইসতাকা) এই কাল্ট গোত্রের বিলুপ্তি ডেকে আনবে। প্রাচীন যাযাবর আমলে সর্বাগ্রের বিবেচনা ছিল গোত্র, ব্যক্তি সব সময় দ্বিতীয় সারিতে ছিল: গোত্রের প্রতিটি সদস্য জানত অস্তিত্বের জন্যে তারা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। ফলে দলের দরিদ্র ও দুর্বল সদস্যের প্রতি লক্ষ রাখাকে দায়িত্ব হিসাবে দেখতে হতো তাদের। কিন্তু এখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বোধ সাম্প্রদায়িক আদর্শের জায়গা দখল করে নিয়েছে, প্রতিযোগিতা পরিণত হয়েছে রেয়াজে। লোকেরা নিজস্ব সম্পদ গড়ে তুলছে, দুর্বল কুরাইশদের প্রতি ক্ষেপও করছে না। প্রত্যেকটা ক্ল্যান বা গোত্রের ক্ষুদ্রতর পারিবারিক গ্রুপ মক্কার সম্পদের ভাগ পাওয়ার লক্ষ্যে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়ছিল এবং অপেক্ষাকৃত অসফল ক্ল্যানগুলোর কোনও কোনওটা [মুহাম্মদের (স) নিজস্ব হাশিম ক্ল্যানের মতো নিজের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন মনে করেছে। মুহাম্মদ (স) বিশ্বাস করছিলেন যে কুরাইশরা তাদের জীবনযাত্রার কেন্দ্রে আরেকটা দুয়ে মূল্য যোগ করতে না শিখলে, অহংকার ও প্রলোভন হতে মুক্ত না হলে তাঁর গোত্র নৈতিক দিক দিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে; পারস্পরিক সংঘাতে ধ্বংস হয়ে যাবে রাজনৈতিকভাবেও।
আরবের বাকি অংশের অবস্থাও ছিল হতাশাব্যাঞ্জক। বহু শতাব্দী ধরে হিজাজ এবং নাজদ অঞ্চলের বেদুঈন গোত্রগুলো জীবনের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর স্বার্থে পরস্পরের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। বেঁচে থাকার জন্যে অত্যাবশ্যক সাম্প্রদায়িক চেতনা গড়ে তুলতে সাহায্য করতে আরবরা মুরুব্ৰাহ্ নামে এক আদর্শ গড়ে তুলেছিল যা ধর্মের বহু কাজ সম্পন্ন করত। প্রচলিত ধারণায় আরবদের ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় ছিল না। বিভিন্ন পৌত্তলিক দেবতারা ছিলেন, আরবরা তাঁদের মন্দিরে উপাসনা করত, কিন্তু তারা এমন কোনও মিথলজি গড়ে তোলেনি যা এসব দেবতার ও পবিত্র স্থানের। সঙ্গে জীবনের চেতনার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে। পরকালের জীবন সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না তাদের, তবে তারা বিশ্বাস করত যে দহর-যাকে সময় বা নিয়তি হিসাবে অনুবাদ করা যায়–সর্বোচ্চ-মৃত্যু হার যেখানে অস্বাভাবিক রকম বেশি ছিল, সেখানে এমন একটা প্রবণতা সম্ভবত অত্যাবশ্যকই ছিল। পশ্চিমের পণ্ডিতগণ প্রায়শঃই মরুবাহকে ‘পৌরষ’ হিসাবে অনুবাদ করে থাকেন, কিন্তু এর তাৎপর্যের পরিধি ছিল আরও ব্যাপক: এটা দিয়ে যুদ্ধে সাহস বোঝাত, দুখ-কষ্ট সহ্য করার ধৈর্য বোঝাত আর বোঝাত গোত্রের প্রতি চরম আনুগত্য। মুরুবাহর গুণাবলী একজন অরবকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অগ্রাহ্য করে মুহূর্তের নোটিসে তার সায়ীদ বা গোত্রপ্রধানের নির্দেশ পালনের দাবি করে ও তাকে গোত্রের বিরুদ্ধে সংঘটিত যেকোনও অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়ার বীরের দায়িত্ব গ্রহণে নিবেদিত প্রাণ থাকতে হতো, গোত্রের দুর্বল সদস্যদের রক্ষা করতে হতো। গোত্রের অস্তিত্ব নিশ্চিত করার জন্যে সায়ীদ সম্পদ ও অন্যান্য জিনিস সমভাবে বণ্টন করতেন ও ঘাতক গোত্রের একজন সদস্যকে হত্যা করার মাধ্যমে আপন জাতির যেকোনও সদস্যের হত্যার বদলা নিতেন । এখানেই আমরা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে সাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ দেখতে পাই: স্বয়ং ঘাতককে শাস্তি দেওয়ার কোনও দায়িত্ব ছিল না, কারণ প্রাক-ইসলামি যুগের সমাজে একজন ব্যক্তি কোনও রকম চিহ্ন না রেখেই উধাও হয়ে যেতে পারত। তার বদলে শক্ৰগোত্রের যেকোনও একজন সদস্যই এধরনের উদ্দেশ্য অর্জনের ক্ষেত্রে আরেকজনের সমান ছিল। কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বহীন এক অঞ্চলে, যেখানে প্রত্যেক গোত্রীয় গ্রুপ আলাদা আইনের প্রতীক ছিল এবং যেখানে আধুনিক পুলিসের মতো কোনও শক্তির অস্তিত্ব ছিল না, সেখানে মোটামুটিভাবে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার একমাত্র উপায়ই ছিল প্রতিশোধ বা রক্ত বিবাদ। কোনও গোত্র প্রধান প্রতিশোধ গ্রহণে ব্যর্থ হলে এর সদস্যরা মর্যাদা হারাত এবং অন্যরা শাস্তির ভয় না করেই এর সদস্যদের অনায়াসে হত্যা করতে উৎসাহী হয়ে উঠত। এভাবে প্রতিশোধ ছিল ন্যায়-বিচারের রূঢ় ও তৈরি একটা ধরণ, যার মূল অর্থ ছিল কোনও গোত্রই যেন খুব সহজে অন্যটির ওপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে না পারে। এতে বিভিন্ন গোত্র সহিংসতার এক বিরামহীন চক্রে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও থাকত, যেখানে লোকজন একটা প্রতিশোধ আক্রমণের সমানুপাতিক হয়নি মনে করলে আরও খুনখারাবির জন্ম হতে পারত।
সন্দেহাতীতভাবে নিষ্ঠুর হলেও মুরুবাহর অনেকগুলো জোরাল দিকও ছিল। এটা সমতাবোধের গভীর ও জোরাল বোধ উৎসাহিত করেছে এবং বস্তুসামগ্রীর প্রতি নির্লিপ্ততার জন্ম দিয়েছে, যা, আবার বলতে হয়, সম্ভবত জীবন ধারনের জন্যে প্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় রসদপত্রের ঘাটতি আছে এমন এক অঞ্চলে জরুরি ছিল: দান ও বদান্যতার কাল্টও গুরুত্বপূর্ণ গুণ ছিল; এগুলো আগামী দিনের চিন্তা না করার শিক্ষা দিয়েছিল আরবদের। আমরা দেখব, এসব গুণ ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। বহু শত বছর আরবদের উপকারে এসেছে মুরুবাহ, কিন্তু ষষ্ঠ শতাব্দী নাগাদ এটা আর আধুনিকতার শর্তাবলী পুরণ করতে পারছিল না। প্রাক-ইসলামি যুগের শেষ পর্যায়ে, মুসলিমরা যে সময়কালকে জাহিলিয়া-অজ্ঞতার কাল-বলে অভিহিত করে থাকে, এক ব্যাপক অসন্তোষ আর আধ্যাত্মিক অস্থিরতা বিরাজ করছিল বলে মনে হয়। আরবরা চারপাশ থেকে দুই পরাক্রমশালী সাম্রাজ্য স্যাসানিয় পারসিয়া এবং বাইযান্তিয়াম দিয়ে পরিবেষ্টিত ছিল। বসতি অঞ্চলসমূহ থেকে আধুনিক ধ্যানধারণার অনুপ্রবেশ ঘটছিল আরবে; সিরিয়া বা ইরাক ভ্রমণ শেষে প্রত্যাবর্তনকারী বণিকগণ সত্যতার বিস্ময়কর কাহিনী সাথে করে নিয়ে আসছিল।
তা সত্ত্বেও আরবরা যেন চিরস্থায়ী বর্বরতার অভিশাপে অভিশপ্ত মনে হয়েছে। গোত্রগুলো অবিরাম হানাহানিতে লিপ্ত ছিল, যার ফলে নামমাত্র সম্পদ একত্রিত করে ঐক্যবদ্ধ আরব জাতিতে পরিণত হওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল; যদিও এরকম একটা অস্তিত্ব গড়ে ওঠার ব্যাপারে আবছাভাবে সজাগ ছিল তারা। নিজের হাতে নিয়তি তুলে নিয়ে নিজস্ব সভ্যতা গড়ে তুলতে পারছিল না তারা। সে জায়গায় পরাশক্তিগুলোর অব্যাহত শোষণের শিকার হয়ে চলছিল: প্রকৃতপক্ষে দক্ষিণ আরবের অধিকতর উর্বর ও অনন্য এলাকা এখনকার ইয়েমেন-মৌসুমী বৃষ্টির আর্শিবাদ ছিল এখানে-পার্সিয়ার এক সামান্য প্রদেশে পরিণত হয়েছিল। একই সময়ে এ অঞ্চলে অনুপ্রবেশকারী ধারণাসমূহ পুরোনো সাম্প্রদায়িক নীতিকে দুর্বল করে তোলা ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদের সংবাদ নিয়ে আসছিল। উদাহরণ স্বরূপ, পরকালের জীবন সম্পর্কিত ক্রিশ্চান মতবাদ প্রতিটি ব্যক্তির অনন্ত নিয়তিকে পবিত্র মূল্য দিয়েছিল: ব্যক্তিকে দলের অধীনে স্থাপনকারী এবং গোত্রের অস্তিত্বের ওপরই নারী-পুরুষের অমরত্ব পুরোপুরি নির্ভরশীল বলে দাবিদার গোত্রীয় আদর্শের সঙ্গে এটা কীভাবে খাপ খেতে পারে?
মুহাম্মদ (স) অসাধারণ মেধার অধিকারী মানুষ ছিলেন। ৬৩২ সালে যখন তিনি পরলোকগমন করেন, তখন আরবের প্রায় সকল গোত্রকে এক নতুন ঐক্যবদ্ধ সমাজ বা উম্মাহ অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। আরবদের নিজস্ব ঐতিহ্যের সঙ্গে চমৎকার মানানসই আধ্যাত্মিকতা এনে দিয়েছেন তিনি, যা এমন এক শক্তির উদ্বোধন ঘটিয়েছে যে মাত্র একশো বছরের ব্যবধানে হিমালয় পর্বতমালা থেকে পিরেনীজ অবধি বিস্তৃত নিজস্ব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে তারা। প্রতিষ্ঠা করেছে এক অসাধারণ সভ্যতার। কিন্তু মুহাম্মদ (স) ৬১০ সালের রমযান মাসে যখন হিরা পর্বতের চূড়ায় ছোট্ট গুহায় প্রার্থনায় নিমগ্ন হন, এরকম এক অসাধারণ সাফল্যের কথা চিন্তাও করেননি তিনি। বহু আরবের মতো মুহাম্মদও (স) বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে, প্রাচীন আরবীয় দেবনিচয়ের পরমেশ্বর আল্লাহই-যার অর্থ স্রেফ ‘ঈশ্বর’-ইহুদি ও ক্রিশ্চানদের উপাস্য ঈশ্বর। এও বিশ্বাস ছিল যে কেবল এই ঈশ্বরের একজন পয়গম্বরের পক্ষেই আপন জাতির সমস্যা সমাধান সম্ভব, কিন্তু তিনি নিজেই যে সেই পয়গম্বর হতে যাচ্ছেন এটা কখনওই বিশ্বাস হয়নি তার। আরবরা আসলেই দুঃখের সঙ্গে অনুভব করত যে আল্লাহ কখনও তাদের প্রতি কোনও পয়গম্বর প্রেরণ করেননি বা কোনও ঐশীগ্রন্থ অবতীর্ণ করেননি, যদিও স্মরণাতীতকাল থেকে তারই মন্দির রয়েছে ওদের মাঝে। সপ্তম শতাব্দী নাগাদ অধিকাংশ আরব বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে মক্কার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সুপ্রাচীনকালের চৌকো আকৃতির বিশাল উপাসনাগৃহ কাবাহ্ মূলত আল্লাহর উদ্দেশ্যেই নিবেদিত, যদিও এখন তা নাবাতিয় দেবী হুবালের অধিষ্ঠান। মক্কাবাসীরা আরবের সবচেয়ে পবিত্র স্থান কাবা গৃহ নিয়ে দারুণ গর্ব বোধ। করত। প্রতি বছর গোটা পেনিনসুলার আরবরা মক্কায় হজ্জ বা তীর্থযাত্রায় সমবেত হয়ে কয়েকদিন ধরে প্রচলিত আনুষ্ঠানিকতা পালন করত। কাবাহর চারপাশের পবিত্র এলাকা স্যাঙ্কচুয়্যারিতে সব রকমের সহিংসতা ছিল নিষিদ্ধ। যাতে মক্কায় আরবরা পুরোনো গোত্রীয় বর্বরতা সাময়িকভাবে স্থগিত জানা থাকায় শান্তিপূর্ণভাবে পরস্পরের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারে। কুরাইশরা জানত, স্যাঙ্কচুয়্যারি ছাড়া তাদের পক্ষে বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন সম্ভব ছিল না। তারা এও জানত যে কাবাহ্ গৃহের অভিভাবকত্ব এবং এর প্রাচীন পবিত্রতা রক্ষার সাফল্যের ওপর অন্যান্য গোত্রের মাঝে তাদের সম্মান বহুলাংশে নির্ভরশীল। কিন্তু যদিও আল্লাহ কুরাইশদের বিশেষ কৃপা করার জন্যে আলাদা করে নিয়েছেন, কিন্তু তিনি আব্রাহাম, মোজেস বা জেসাসের মতো একজন বার্তাবাহক কখনও পাঠাননি, আরবদের নিজস্ব ভাষার কোনও ঐশীগ্রন্থও ছিল না।
সুতরাং আধ্যাত্মিক দিক থেকে হীনম্মন্যতার এক ব্যাপক বোধ কাজ করছিল। আরবরা যেসব ইহুদি ও ক্রিশ্চানের সংস্পর্শে আসত তারা ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রত্যাদেশ না পাওয়ায় তাদের বর্বর জাতি বলে ক্ষেপাত। আরবরা তাদের চেয়ে বেশি জ্ঞানের অধিকারী এসব লোকদের প্রতি একধরনের মিশ্র অসন্তোষ আর শ্রদ্ধা বোধ করত। ইহুদিবাদ ও খৃস্টধর্ম এ অঞ্চলে খুব বেশি সাফল্য অর্জন করতে পারেনি যদিও, আরবরা ধর্মের এই অগ্রসর রূপকে নিজেদের প্রচলিত পৌত্তলিকতাবাদের চেয়ে উচ্চতর বলে স্বীকার করত। মক্কার উত্তরে ইয়াসরিব (পরবর্তীকালে মদিনা] ও ফাদাক নামের বসতিতে অজ্ঞাত উৎসের কিছু ইহুদি গোত্রের বাস ছিল; এবং পার্সিয়ান ও বাইযান্তাইন সাম্রাজ্যের মধ্যবর্তী সীমান্ত এলাকার উত্তরাঞ্চলীয় গোত্রগুলোর কিছু কিছু গোত্র মনোফিসাইট বা নেস্টোরিয়ান খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বেদুঈনরা মারাত্মক রকম স্বাধীনচেতা ছিল, তারা ইয়েমেনি ভাইদের মতো পরাশক্তির শাসনাধীনে না যাবার ব্যাপারে ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ; তারা এটাও বুঝতে পেরেছিল যে পারসিয় ও বাইয়ান্তাইন উভয় এলাকাই সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বার্থে ইহুদিবাদ ও খৃস্টধর্মকে ব্যবহার করছে। সম্ভবত তারা সহজাত প্রবৃত্তির বশে এও বুঝেছিল যে নিজস্ব ঐতিহ্য ক্ষয়ে যাওয়ায় সাংস্কৃতিকভাবে যথেষ্ট স্থানচ্যুতির স্বীকার হয়েছে তারা; আর যাহোক বিদেশী ভাষা ও ঐতিহ্যের আশ্রয়ে বিদেশী কোনও মতাদর্শ অন্তত চায়নি তারা।
আরবদের কেউ কেউ যেন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সংস্রবহীন অধিকতর নিরপেক্ষ একশ্বেরবাদের একটা ধরন আবিষ্কারের প্রয়াসে নিয়েজিত ছিল। পঞ্চম শতাব্দীতে প্যালেস্তাইনি ক্রিশ্চান ইতিহাসবিদ সোযোমেনোস আমাদের জানাচ্ছেন, সিরিয়াবাসী আরবদের কেউ কেউ তাদের ভাষায় আব্রাহামের সত্য ধর্ম পুনরাবিষ্কার করেছিল। ঈশ্বর তোরাহ্ বা গস্পেল প্রেরণের আগেই এসেছিলেন আব্রাহাম, সুতরাং তিনি ইহুদি বা ক্রিশ্চান কোনওটাই ছিলেন না। মুহাম্মদ (স) তাঁর নিজস্ব পয়গম্বরত্বের আহ্বান পাওয়ার অল্পদিন আগে, তার প্রথম জীবনীকার মুহাম্মদ ইবন ইসহাক (মৃ. ৭৬৭) আমাদের জানাচ্ছেন যে, মক্কার চারজন কুরাইশ আব্রাহামের সত্য ধর্ম হানিফায়ার সন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কোনও কোনও পশ্চিমা পণ্ডিত এই ক্ষুদ্র হানিফায়াহ্ দলটিকে জাহিলিয়াহ্র সময়ের আধ্যাত্মিক অস্থিরতার প্রতীক ধর্মীয় কাহিনী বলে যুক্তি দেখিয়েছেন, কিন্তু এর কিছু ঐতিহাসিক বাস্তবতা থাকতে বাধ্য। চারজন হানিফের মধ্যে তিনজন প্রথম দিকের মুসলিমদের সুপরিচিত ছিলেন: উবায়দাল্লাহ ইবন জাহশ ছিলেন মুহাম্মদ (স)-এর চাচাত ভাই, ওয়ারাকা ইবন নওফল, যিনি পরে খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেন, ছিলেন মুহাম্মদের (স) প্রথমদিকের আধ্যাত্মিক পরামর্শক এবং যায়েদ ইবন আমর ছিলেন মুহাম্মদের (স) অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহচর এবং ইসলামি সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবন আল খাত্তাবের চাচা। একটা গল্প প্রচলিত আছে: আব্রাহামের ধর্মের সন্ধানে মক্কা ত্যাগ করে সিরিয়া ও ইরাকের পথে রওনা দেওয়ার আগে যায়েদ একদিন কাবাহগৃহের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে উপাসনাগৃহকে ঘিরে প্রাচীন কায়দায় প্রদক্ষিণরত কুরাইশদের উদ্দেশে বলছিলেন: “হে কুরাইশগণ, যার হাতে যায়েদের আত্মা তার দোহাই, আমি ছাড়া তোমাদের আর কেউই আব্রাহামের ধর্ম অনুসরণ করছ না।’ এরপর দুঃখের সঙ্গে আবার যোগ করেছেন, “হে খোদা, যদি জানতাম কীভাবে উপাসনা আপনার পছন্দ আমি সেভাব