অর্থনৈতিকভাবে বাংলার লুণ্ঠন রাজনৈতিক প্রাধান্য ডেকে আনে। ১৭৯৮ এবং ১৮১৮-এর মধ্যবর্তী সময়ে চুক্তি বা সামরিক বিজয়ের মাধ্যমে সিন্ধু উপত্যকা বাদে সমগ্র ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, ১৮৪৩ এবং ১৮৪৯ এর মধ্যবর্তী সময়ে পদানত হয় তা। ইতিমধ্যে ফ্রেঞ্চরা নিজস্ব সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রয়াস পেয়েছিল। ১৭৯৮তে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ব্রিটিশদের ভারতের সঙ্গে নৌযোগাযোগ ব্যাহত করার জন্য সুয়েযে একটা ঘাঁটি স্থাপনের আশায় মিশর দখল করে নেন। সঙ্গে করে পণ্ডিতদের একটা দল, আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্যসমৃদ্ধ একটা লাইব্রেরি, একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার, আরবী হরফসহ একখানা মুদ্রণযন্ত্র নিয়ে এসেছিলেন তিনি। শুরু থেকেই অগ্রসর ইউরোপীয় সংস্কৃতি এক অনন্যসাধারণ দক্ষ সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হওয়াটা ছিল মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদের চোখে আঘাত বিশেষ। মিশর ও সিরিয়ায় নেপোলিয়নের অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। রাশিয়ার সহায়তায় উত্তর দিক থেকে ব্রিটিশভারতে হামলা করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন তিনি। এতে ইরান কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পরবর্তী শতাব্দীতে ব্রিটিশরা দেশের দক্ষিণে একটা ঘাঁটি স্থাপন করে, অন্যদিকে রাশিয়া উত্তরের নিয়ন্ত্রণ লাভের প্রয়াস পায়। কেউই ইরানকে পুরোপুরি কলোনি প্রটেক্টরেট বানাতে চায়নি (বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তেল আবিষ্কার হওয়ার আগে পর্যন্ত), কিন্তু দুটো শক্তিই নয়া কাজার রাজবংশের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করেছিল, যাতে শাহগণ অন্তত যেকোনও একজনের সমর্থন ছাড়া আক্রমণ হানার সাহস না পান। বাংলার মত ব্রিটেন এবং রাশিয়া উভয়েই নিজেদের স্বার্থ হাসিল হবে এমন প্রযুক্তিরই বিকাশ ঘটিয়েছিল আর ইরানি জনগণের উপকারে আসতে পারে এমন ধরনের উদ্ভাবন, যেমন রেলওয়ে, রুদ্ধ করে রেখেছিল তাদের নিজস্ব কৌশলগত অবস্থান হুমকির মুখে পড়ে যাবার আশঙ্কায়।
ইউরোপীয় শক্তিগুলো একের পর এক ইসলামী দেশকে উপনিবেশে পরিণত করে। ১৮৩০-এ আলজেরিয়া দখল করে ফ্রান্স। এবং এর নয় বছর পর অ্যাডেন দখল করে ব্রিটেন। ১৮৮১ তে অধিকৃত হয় টিউনিসিয়া, ১৮৮২তে মিশর, ১৮৮৯তে সুদান এবং ১৯১২তে লিবিয়া ও মরোক্কো। ১৯১৫তে স্বাক্ষরিত সাইকস- পিকো (Sykes-Picot) চুক্তি অনুযায়ী মুমূর্ষু অটোমান সাম্রাজ্যের অঞ্চলগুলো (প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পক্ষাবলম্বন করেছিল এরা) বিজয়ের প্রত্যাশায় ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। যুদ্ধের পর ব্রিটেন ও ফ্রান্স যথারীতি সিরিয়া, লেবানন, প্যালেস্টাইন, ইরাক ও ট্রান্সজর্ডানে প্রটেক্টরেট এবং ম্যান্ডেট স্থাপন করে। ব্যাপারটাকে ভয়াবহ বিদ্বেষমূলক হিসাবে দেখা হয়েছিল, কেননা ইউরোপীয় শক্তিগুলো অটোমান সাম্রাজ্যের আরব প্রদেশগুলোকে স্বাধীনতা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। অটোমান মূলভূমিতে মুস্তাফা কেমাল ( Mustafa Kemal ), যিনি আতাতুর্ক (১৮৮১-১৯৩৮) নামে খ্যাত, ইউরোপীয়দের প্রতিরোধে সক্ষম হন এবং স্বাধীন টার্কি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন। বলকান এলাকা, রাশিয়া এবং মধ্য এশিয়ার মুসলিমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনাধীনে চলে আসে। এসব দেশের কোনও কোনওটিকে পরে স্বাধীনতা দেয়া হলেও পাশ্চাত্য প্রায়শই অর্থনীতি, তেল বা সুয়েয খালের মত সম্পদের নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রেখেছিল। ইউরোপীয় দখলদারি প্রায়ই তিক্তবিরোধের উত্তরাধিকার রেখে গেছে। ১৯৪৭-এ ব্রিটিশ যখন ভারত থেকে প্রত্যাহৃত হয়, ভারতীয় উপমহাদেশ হিন্দু ভারত ও মুসলিম পাকিস্তানের মাঝে ভাগ হয়ে যায়, যারা আজও মারাত্মক বৈরী মনোভাবাপন্ন রয়ে গেছে, পরস্পরের রাজধানীর দিকে পারমানবিক অস্ত্র তাক করে রেখেছে। ১৯৪৮-এ প্যালেস্টাইনের আরবরা যায়নিস্টদের কাছে তাদের আবাসভূমি হারিয়ে বসে। যায়নিস্টরা জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা করে। প্যালেস্টাইন হাতছাড়া হওয়ার ঘটনা ইউরোপীয় শক্তিগুলোর হাতে মুসলিম বিশ্বের অপমানিত হবার জ্বলজ্যান্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়, ইউরোপীয় শক্তিগুলো যেন লাখ লাখ প্যালেস্টাইনির আশ্রয়হীন অবস্থা আর স্থায়ী নির্বাসনে এতটুকু বিবেকের তাড়না বোধ করছে না।
কিন্তু তা সত্ত্বেও গোড়ার দিকে মুসলিমদের কেউ কেউ পাশ্চাত্যের প্রতি বেশ দুর্বল ছিল। ইরানি বুদ্ধিজীবী মুলকুম খান (১৮৩৩-১৯০৮) এবং আকা খান কিরমানি (১৮৫৩-৯৬) ইরানিদের প্রতি পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ এবং আধুনিক সেক্যুলার রীতিনীতি বেছে নিয়ে শরিয়াহ্ বাদ দেয়ার আহবান জানিয়েছিলেন এবং একেই প্রগতির পথে অগ্রসর হবার একমাত্র পথ বলে বিবেচনা করেছেন। এই গোষ্ঠীর সেক্যুলারিস্টরা ১৯০৬-এর সাংবিধানিক বিপ্লবে (Constitutional Revolution) অধিকতর উদারপন্থী উলেমাদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং কাজারদের একটি আধুনিক সংবিধান প্রণয়ন, রাজার ক্ষমতা সীমিতকরণ এবং ইরানিদের সংসদে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। নাজাফের অধিকাংশ মুজতাহিদ সংবিধান সমর্থন করেন। শেখ মুহাম্মদ হুসেইন নাইনি তাঁর অ্যাডমোনিশন টু দ্য নেশন (Admonition to the Nation, ১৯০৯)-এ অত্যন্ত চমৎকারভাবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন, যেখানে যুক্তি দেখান হয় যে এভাবে স্বেচ্ছাচারিতা সীমিত করা স্পষ্টতই শিয়াদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে এবং পাশ্চাত্য ধাঁচের সাংবিধানিক সরকার গোপন ইমামের প্রত্যাবর্তনের জন্য সবচেয়ে অনুকূল পরিবেশ। মিশরীয় লেখক রিফাহ্ আল-তাতাওয়ি(১৮০১-৭৩) ইউরোপীয় আলোকনপর্বের (Enlightenment) ধারণায় অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন, যাদের দর্শন তাঁকে ফালসাফার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল। প্যারিসে সবকিছু যেভাবে সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে সেটা পছন্দ করেছেন তিনি। ফরাসি সংস্কৃতির যৌক্তিক নির্ভুলতা দেখে মোহিত হয়েছেন, মুগ্ধ হয়েছেন সাধারণ মানুষের শিক্ষার হার দেখে, এবং উদ্ভাবনের প্রতি অদম্য আকর্ষণে আলোড়িত হয়েছেন। মিশরকে এই সাহসী নতুন জগতে প্রবেশে সাহায্য করার আশা করেছিলেন তিনি। ভারতে সাইয়ীদ আহমেদ খান (১৮১৭-৯৮) ইসলামকে আধুনিক পশ্চিমা উদারনৈতিকতাবাদের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রয়াস পেয়েছিলেন, তিনি দাবী করেছেন যে, আধুনিক বিজ্ঞান কর্তৃক আবিষ্কৃত প্রাকৃতিক আইনসমূহের সঙ্গে কুরান সম্পূর্ণই মানানসই। আলীগড়ে একটা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি, যেখানে মুসলিমরা প্রচলিত ইসলামী বিষয়াদির পাশাপাশি বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত। তিনি চেয়েছিলেন মুসলিমরা যেন নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয় অক্ষুণ্ণ রেখে ব্রিটিশদের হুবহু অনুকৃতি না হয়ে একটা আধুনিক সমাজে বসবাস করতে পারে।